আহুতি

আহুতি

সোমনাথ চাটুজ্যের কাছে আজও একে একে পাঁচ-ছ দফা লোক এলো। প্রত্যেকের কাঁধের ঝোলায় বিশ-পঁচিশখানা করে বই। বইগুলো তারা সোমনাথবাবুকে বুঝিয়ে দিয়ে বখশিশ নিয়ে চলে গেল! সোমনাথবাবুর থমথমে মুখ। বাড়ির চাকর সে বইগুলো তাঁর নির্দেশে ভিতরে নিয়ে গেল। ভিতরে মানে রান্নাঘরের সামনে ঢিবি করে রাখাল সেগুলো।

তিনদিন ধরে বাড়িতে লোকে বড় তাজ্জবকাণ্ড দেখছে কর্তার। বাড়ির লোক বলতে এখন ঠাকুর-চাকর, সোমনাথবাবুর গৃহিণী আর ছোট মেয়ে সুলেখা। আরো একটি জীব আছে, প্রভুর কাণ্ড দেখে সেও কম অবাক হবে না। সে কোন লোক নয়, সোমনাথবাবুর অ্যালসেসিয়ান উলফ। সব দেখেশুনে রগচটা এই জীবটিও হকচকিয়ে গেছে।

সব থেকে বেশি হতভম্ব সোমনাথবাবুর স্ত্রী শশীরানী। ডাক্তার ডাকার কথা কদিনই ভাবছেন। একটা ফোন করলেই ডাক্তার এসে পড়বে, কিন্তু শশীরানী ভরসা করে তাও ডাকতে পারছেন না। ডাক্তার এলে এই মানুষ আবার কোন মূর্তি ধরবে কে জানে!

সোমনাথবাবু হাসিখুশি মানুষ। কিন্তু কদিনের এই মুখ দেখলে কেউ বলবে না মানুষটা হাসতে জানে।

সোমনাথ চাটুজ্যে তেমনি গম্ভীরমুখে উঠলেন। চাকর যেখানে বইয়ের ঢিবি করেছে, পায়ে পায়ে সেখানে এলেন। বইগুলো দেখলেন একটু চেয়ে। ঝকঝকে বই, নতুনের গন্ধ লেগে আছে।

–কটা এলো?

চাকর তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলল, আজও একশ ত্রিশ

পুরনো চৌকস চাকর। তার হিসেবে বিশ্বাস করা যায়।

 বললেন, বোস, আরো খান-বিশ-পঁচিশ আসবে।

..প্রথম দিন আনা হয়েছিল পঁচাত্তরখানা। দ্বিতীয় দিনে একশ দশ। তৃতীয় দিনে একশ পঁচিশ। আজ আসবে কম করে একশ পঞ্চাশ। মনে মনে একটু হিসেব করে নিলেন সোমনাথবাবু। মোট দাঁড়াল চারশ পঞ্চাশ।…আরো দেড়শ কিনলে এ-যাত্রার কাজ শেষ।

ভিন্ন ভিন্ন বই নয়। একই বইয়ের কপি সব। উপন্যাস। নাম–অনুরাগ চক্র। এই বইয়ের ঢিবির সবগুলোই অনুরাগ চক্র। আজ চারদিন ধরে থাকে-থাকে খেপে খেপে কেবল অনুরাগ চক্রই আসছে সোমনাথবাবুর বাড়িতে। আরো দেড়শ এই বই-ই আসবে।

উপন্যাসখানার দাম আট টাকা। মোট ছশ বই যদি কিনতে পারেন সোমনাথবাবু, তাহলে দাম দাঁড়াল চার হাজার আটশ টাকা। বই যাদের দিয়ে কেনানো হচ্ছে তাদের মারফত কমিশন পাওয়া যাচ্ছে পঁচিশ পারসেন্ট। তার মানে বারোশ টাকা বাদ। তাহলে খরচা দাঁড়াল তিন হাজার ছশো। এ ছাড়া ওই লোকগুলোকে–যারা বই কিনে আনছে –তাদের বখশিশ দিতে হচ্ছে প্রত্যেককে দশটাকা করে।

যে দেড়শ বই আরো আসবে তার দাম বাদ বাকি সব টাকা সোমনাথবাবু দিয়েই দিয়েছেন।

এ বই অর্থাৎ অনুরাগ চক্রর লেখক সোমনাথ চাটুজ্যে নিজেই।

হ্যাঁ, এই চারদিন ধরে বিভিন্ন লোক মারফৎ নিজের বই-ই কিনে চলেছেন তিনি। কালকের মধ্যে নতুন চার-পাঁচজনকে দোকানে পাঠিয়ে আরো দেড়শ অন্তত কিনবেন।

বাইরে পরিচিত গলার হাঁক শোনা গেল। কার গলা চিনতে পারার সঙ্গে সঙ্গে মুখখানা বিব্রত এবং বিরক্ত। যাঁর পদার্পণ তিনি যে, আসবেনই জানা কথা। ওই ভদ্রলোকের হন্তদন্ত হয়ে আসার মত একটা অস্ত্র সোমনাথ চাটুজ্যেই নিক্ষেপ করেছেন। তবু বিব্রত, তবু বিরক্ত।

– বাইরের ঘরে চেনা-গলার হাঁক শুনে আড়াল থেকে মনে মনে আশান্বিত কেউ যদি হয়ে থাকেন, তিনি শশীরানী। অন্যদিন হলে খুশিমুখে তিনিই বেরিয়ে আসতেন। আজ পারলেন না। আজ সঙ্কোচ। কিন্তু তা সত্ত্বেও আশা, ঘরের মানুষের এই মতির কিছু হদিশ মিলতে পারে এবার।

গাড়ি হাঁকড়ে যিনি এসে হাজির হয়েছেন তার নাম বিজয় ঘোষ। বাংলা দেশের এক নামজাদা প্রকাশক। তার অনুগ্রহ সরস্বতীর দপ্তরে প্রবেশের ছাড়পত্রের সামিল। অনেক মাঝারি লেখককেও প্রচারের মাধ্যমে প্রথম সারিতে এনে হাজির করেছেন তিনি, এ-দেশের লেখককুল তার প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু সোমনাথ চাটুজ্যের সম্পর্কে আজ অন্তত ঠিক একথা খাটে না। তিনি মাঝারি নন। একেবারে সামনের সারির একজন। বিজয় ঘোষের সঙ্গে তার বহুদিনের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্ব এখন অপর লেখক এবং প্রকাশকের চোখ টাটানোর মতো ফলপ্রসূ-এই শুধু বলা যেতে পারে।

সোমনাথ চাটুজ্যে বাইরের ঘরে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে বিজয় ঘোষ গলায় কাপড়ের খুটটা জড়িয়ে নিয়ে দুহাত জোড় করল।–কী অপরাধ বলো!

মিনমিন করে সোমনাথবাবু জবাব দিলেন, অপরাধ আবার কি, বোসো…।

গম্ভীর মুখে আসন নিয়ে বিজয় ঘোষ পকেট থেকে একটা রেজেস্ট্রি খাম বার করলেন।–আমি কি বিশ্বাস করব, এটা তুমিই আমাকে পাঠিয়েছ?

সোমনাথবাবু তেমনি মিনমিন করেই জবাব দিয়েছিলেন, হ্যাঁ ভাই…পাঠাতে হল। বিজয় ঘোষের গোল মুখের ওপর দৃষ্টি স্থির হল একটু।

-তোমাকে কে কী বলেছে?

–কেউ কিছু বলেনি।

–আমার থেকে কেউ বেশি টাকার টোপ ফেলেছে?

–না।

-আমি বাইশশ ছেপে দুচার হাজার ছেপেছি, এ-রকম রিপোর্ট কেউ দিয়েছে। তোমাকে? 

– না।

সেদিন, যখন তুমি আমাকে টেলিফোন করেছিলে, আমি জানিয়েছিলাম দেড়মাসে দেড়হাজারের বেশি কপি বিক্রি হয়ে গেছে। হঠাৎ এই চারদিন ধরে বাকি কপিগুলো মুড়িমুড়কির মত বিক্রি হয়ে যাচ্ছে–আর দেড়শ বইও নেই। তবু আমি ঠিকমত তোমার বই বিক্রি করতে পারছি না–এ-কথা কেউ বলেছে?

-না, সে-সব কিছুই না।

 ঈষৎ অসহিষ্ণু অভিমানক্ষুব্ধ স্বরে বিজয় ঘোষ বলে উঠলেন, তাহলে আমার ওপর এই চিঠির বজ্রাঘাত কেন খুলে বলবে তো?…এই কদিনের বিক্রি দেখে রাতারাতি পরের এডিশন ছাপার জন্য আমি একসঙ্গে চারটে প্রেসের সঙ্গে ব্যবস্থা করে ফেলেছি-তার মধ্যে তোমার এই হুকুমজারি, এই বই আমি ছাপতে পারব না!

-ইয়ে, পরে সব তোমাকে বলবখন।

 –এখনো পরে বলবে! তোমার এই চিঠির হুকুমই পাকা তাহলে?

 –হুকুম আবার কী, বিশেষ দরকার হয়েছে…তাই।

 –কিসের দরকার? টাকার?

–না।

–তাহলে আমাকে ছাড়ার?

সোমনাথ চাটুজ্জে নীরব।

–তা আমাকে ছেড়ে এ বই কাকে দিচ্ছ এখন, কে নিচ্ছে?

 সোমনাথবাবু নিরুত্তর।

একটু চুপ করে থেকে বিজয় ঘোষ সখেদে বললেন, তুমি বই তুলে নিচ্ছ সে জন্যে দুঃখ নেই, কী হয়েছে বলছ না বলেই দুঃখ। তার মানে, এমন অপরাধ করেছি যার কোন ক্ষমা পর্যন্ত নেই, কি বলো?

ক্ষমার কথা শুনে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন সোমনাথ চাটুজ্যে।

কেন বার বার এসব কথা বলো, অপরাধ কারো যদি হয়ে থাকে এ দুনিয়ায়, আমারই হয়েছে, বুঝলে? বলতে বলতে আরো উত্তেজিত মুখে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। জানতে চাও এ বই কাকে দিচ্ছি? কে নিচ্ছে জানতে চাও? হঠাৎ এগিয়ে এসে হাত ধরে টানলেন, এসো, দেখবে এসো–

বিমূঢ় বিজয় ঘোষকে টেনে নিয়ে বারান্দা ছাড়িয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন তিনি।

শশীরানীর আড়াল ঘুচে যেতে তিনিও তটস্থ।

রান্নাঘরে চাকর সেই বড় উনুনটা ধরিয়েছে। সে-ই বইয়ের পাঁজা এক-একটা করে নিয়ে সজোরে টেনে ছিঁড়ে উনুনে দিচ্ছে। এক-একটা করে বই গনগনে উনুনে পুড়ছে আর সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে ছাই হয়ে যাচ্ছে।

বিষম হকচচিয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি চাকরকে বাধা দিতে যাচ্ছিলেন বিজয় ঘোষ, নিজেই বাধা পেলেন। সোমনাথবাবু হাত ধরে থামালেন তাকে। বিরস কণ্ঠে বিড়বিড় করে বললেন, আমার হুকুমেই একাজ করছে। বই কাকে দিচ্ছি, কে নিচ্ছে দেখলে? চারদিন ধরে তোমার এত বই বিক্রি হচ্ছে কেন বুঝতে পারলে?

বিজয় ঘোষের দুচোখ ঠিকরে পড়ার দাখিল। এমন কাণ্ড তিনি এতকালের ব্যবসায়ী জীবনে আর দেখেননি। এই ধ্বংসযজ্ঞ আর তিনি সহ্য করতে পারলেন না। তার ওপর বিষম ঘাবড়ে গেছেন তিনি। লেখকের মাথা হঠাৎ সাম্প্রতিক খারাপ হয়ে গেছে, তাতে আর একটুও সন্দেহ নেই। এখন বই পোড়াতে পোড়াতে যদি বইয়ের প্রকাশকের মাথাও এমনি করে উনুনে গোঁজার রোখ চাপে–তাহলে? মনে হওয়া মাত্র তখনকার মত ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রস্থান করলেন তিনি। এরপর একেবারে ডাক্তার টাক্তার নিয়ে তবে বাড়িতে ঢোকা যেতে পারে।

মাথা যে সাজ্জাতিক রকমের খারাপ হয়েছে, শশীরানীরও তাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই। সুখের সংসারে কেন এরকম বিপর্যয় ঘটে গেল, তা তিনি কিছুটা আঁচ করতে পারেন। কিন্তু অনেকটাই দুর্বোধ্য এখনো।

শশীরানী প্রথমে ভেবেছিলেন, ওই হতভাগা ছেলে আর বড় মেয়েটা মুখে এ ভাবে চুনকালি দিল বলেই মাথাটা খারাপ হয়ে গেল। মানী লোক, চারদিকে কত নামডাক–মাথা খারাপই হবার কথা। দুঃখে ঘেন্নায় আজ কদিন ধরে তার নিজেরই তো বুকের ভেতরটা হু-হু করে জ্বলছে!

কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এর জন্যে ছোটও কম দায়ী নয়। বাপে আর ওই ছোট মেয়েতে সেদিন কি কাণ্ডই ঘটে গেল! দেখেশুনে ভয়ে-ত্রাসে অস্থির তিনি। অথচ বলতে গেলে ওই ছোট মেয়েই বাপের একেবারে চোখের মণি। তার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বাপের এত আদর কেউ পায়নি। দুঃখের সংসারই তো ছিল এক-সময়। একটা মানুষ কলম চালিয়ে এতবড় বাড়ি করবে গাড়ি করবে, এত সম্মান প্রতিপত্তি হবে, একি স্বপ্নেও কখানো ভেবেছিলেন তিনি… ওই ছোট মেয়ে যেদিন কোলে এলো সেদিনই এক মস্ত সুখবর–কোন সিনেমা কোম্পানী স্বামীর একখানা গল্প কিনেছে, বেশ কয়েক হাজার টাকা ঘরে এসেছে।

সেই থেকে বাপের কাছে ছোট মেয়ের কদর। তারপর থেকে সত্যিই দিনে দিনে ভাগ্য ফিরেছে আর দেমাকী মেয়ের আদর বেড়েছে। অন্য ভাইবোন দুটো এ-জন্যে ওকে হিংসেই করে মনে মনে, শশীরানী বেশ বুঝতে পারেন।

আর ওই ছোট মেয়েও ছিল বাপ-অন্ত-প্রাণ। ওর বাপের সম্পর্কে কেউ কখনো একটু বিরূপ কিছু বলেছে কি, রক্তে নেই। লিখতে থাকলে সামনে ঘুরঘুর করেছে, কতক্ষণে বাবা লেখা ছেড়ে উঠবে আর ও তখন লেখা গোছগাছ করে রাখার নামে। ছাপার আগেই একদফা পড়ে নেবে। সেই মেয়ে কিনা এত লেখা-পড়া শিখে এম.এ পাস করে বাপের সঙ্গে এই ব্যবহার করল! সেই ব্যাপারের পর থেকেই বাড়িতে। এই পাগলের কাণ্ড চলেছে। মেয়ে দিনরাত দোতলার ঘরে বসে থাকলেও, নীচে কী ঘটছে কদিন ধরে সে কি জানে না? সব শোনার পরেও মেয়ে সেই আগের মত গুম হয়ে রইল তো রইলই। তার ওপর এই কদিনের মধ্যে একটা ডাক্তার পর্যন্ত ডাকল না। এখনো ওর রাগই বেশি! সবকটা স্বার্থপর, সবকটা অমানুষ।

সোমনাথ চাটুজ্যের এক ছেলে দুই মেয়ে। ছেলে সুদীপ, আর মেয়েরা শ্রীলেখা আর সুলেখা। সুদীপ টেনেটুনে বি.এ পাস করেছিল, তারপর সেই থেকে ভালো কিছু ব্যবসা করা যায় কিনা তাই নিয়ে মাথা ঘামিয়ে চলেছে। চাকরিতে ঘেন্না তার।

শ্রীলেখা দুবার বি.এ. ফেল করে স্পষ্টই ঘোষণা করেছে, পড়াটড়া আর তার দ্বারা হবে না। কিন্তু সে চৌকস মেয়ে নয়, এমন কথা কেউ বলবে না। সপ্তাহে গোটা তিনেক ইংরেজি বাংলা সিনেমা একটা-দুটো থিয়েটার দেখে, আর কালচারাল নাটক টাটক করে তার ফুরসত নেই বললেই চলে। ছোট মেয়ে সুলেখা হায়ার সেকেণ্ডারিতে বেশ ভালো রেজাল্ট করেছিল, বি.এ-তেও খুবই ভালো, আর এম. এ-তে তো কথাই নেই-বাংলায় ফার্স্ট ক্লাস একেবারে। কাগজে যখন ওর ছবি বেরিয়েছিল, তখনকার মেয়ে সে সে-কথাও লেখা ছিল। এখন রিসার্চ করছে, তার জন্যে টাকাও পাচ্ছে।

শ্রীলেখা পড়ে না, একটা বই নিয়ে শুলেই- তার ঘুম পায়– যেটুকু পড়া হয়েছে। সেটুকুই আবার নতুন করে পড়তে হয়, নইলে কিছুই মনে থাকে না–আর সেই করতে গিয়ে আবার ঘুম। এই কারণে দীর্ঘদিন পর্যন্ত সোমনাথবাবুর মনে একটা খেদ ছিল। সেটা গেছে ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে উঠতে। তারা সকলেই বাপের লেখার ভক্ত। বিশেষ করে ছোট মেয়ের তো কথাই নেই। লাইন মুখস্থ বলে দিতে পারে অনেক বইয়ের। ওর মাকে বলে, বাবার দর্শনতত্ত্বর কত কথা যে আমি পরীক্ষার খাতায় মেরে দিই, ঠিক নেই!

অনেক আধুনিক চটকদার মাসিক আর সাপ্তাহিকপত্র ব্যক্তিগত ইন্টারভিউ নিয়ে লেখক-সমাচার ছাপায়। সেরকম লোক এলে সোমনাথবাবু সুলেখাকে পাঠিয়ে দেন। বলেন, আমার সম্পর্কে আমার থেকেও ও-ই ভালো জানে। বাপের সম্পর্কে ছোট মেয়ের বিবৃতিই ফলাও করে ছাপা হয়।

এমনি একটা ব্যাপারে প্রায় বছরখানেক আগে এই মেয়ের কাছ থেকেই প্রথম আঘাত পান সোমনাথবাবু। সুলেখা সবে এম. এ পরীক্ষা দিয়েছে, তখন নচের ঘরে এমনি এক কাগজের সম্পাদকের কাছে সুলেখাকে পাঠিয়ে ঘণ্টাখানেক বাদে দেখেন, সম্পাদকের কাছে বাপের সম্পর্কে ফলাও করে বলছে শ্রীলেখা। সুলেখা সেখানে নেই। পরে বড় মেয়ের কাছে যা শুনলেন তিনি, প্রায় অবিশ্বাস্য। সম্পাদককে নাকি সুলেখা বলে দিয়েছে, বাবার ইদানীং কালের লেখা সে পড়ে না, অতএব কিছু বলতেও পারবে না। অবাক হয়ে সম্পাদক জিজ্ঞাসা করেছে, কেন? ও জবাব দিয়েছে, ভালো লাগে না। দিদির ভালো লাগে, তাকে ডেকে দিচ্ছি।

শুনে রাগের থেকে সোমনাথবাবু অবাকই হয়েছেন বেশি। এই মেয়েটা যে এত বোকা তিনি কল্পনা করেননি! সাহিত্যে নতুন বাস্তবের বাতাস নিয়ে আসছেন তিনি। সে-বাস্তব অনেক সময় নির্মম, কুৎসিত, নগ্ন। কিন্তু উপায় কি, যে কালের যা! কালের এই রসদ যোগানোর ফল তো সকলেই দেখছে। তার শেষের চার-চারটে বই বাজারে হৈ-হৈ করে বিক্রি হচ্ছে। বিশেষ গোঁড়ামি যাঁদের, তারা সমালোচনার ফুল ফোঁটাচ্ছে। বটে, কিন্তু সাহিত্যে বিপ্লব আনতে হলে সকলকে খুশি করা যায় না। মেজরিটি যে খুশি, বইয়ের বিক্রিই তার প্রমাণ।

তারপর শেষের এই বই–অনুরাগ চক্র। বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে একখানা বই নিয়ে এত হৈ-চৈ বাংলা দেশে বোধহয় আর কোনো বই নিয়ে হয়নি। গোড়ারাও অবশ্য সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের কাগজে তারা গালাগাল করেছে। তার উত্তরে সোমনাথবাবু নিজের খাতিরের কাগজে লিখেছেন, জীবনে সুন্দর আছে, কুৎসিত আছে, জীবনকে বাদ দিয়ে সাহিত্য হয় না। কুৎসিতকে অস্বীকার করা মানে জীবনকেই অস্বীকার করা।

এর জবাবে সেই গোঁড়াদের কাগজ ফলাও করে একজনের প্রশ্ন ছেপেছে। প্রশ্ন, সাহিত্যে-যাত্রা বলতে জীবনের কুৎসিত থেকে সুন্দরের দিকে যাত্রা বুঝব, না সুন্দর থেকে কুৎসিতের দিকে? জীবনের অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, না আলো থেকে অন্ধকারের দিকে?

এই প্রশ্ন ফলাও করে ছাপা হয়েছে, তার কারণ ওই প্রশ্ন করেছে সুলেখা চট্টোপাধ্যায়–তার ছোট মেয়ে।  

ছাপার অক্ষরে ওই নাম দেখে স্তব্ধ হয়ে ছিলেন সোমনাথ চাটুজ্যে। তারপর জুৎসই একটা জবাব লিখবেন ঠিক করেছিলেন।

কিন্তু সে-অবকাশ পেলেন না। তার আগেই বাড়িতে দ্বিতীয় বিভ্রাট আর এই দ্বিতীয় বিভ্রাটে মাথাই খারাপ হবার দাখিল সোমনাথবাবুর।

প্রথম বিভ্রাট গেছে মাসতিনেক আগে। তখনো অনুরাগ চক্র বেরোয়নি। বড় ছেলে সুদীপ পাড়াতে একটি বড়ঘরের কায়স্থ মেয়েকে নিয়ে ভেগে পড়ল। সেই সঙ্গে বাপের মাত্র হাজার পাঁচেক টাকা সঙ্গে নিয়েছে। লিখে রেখে গেছে তার বাবাকে, তিনি উদার; অসবর্ণ বিয়ে এখানেই হতে পারত, কিন্তু মেয়ের বাড়ির লোক ভয়ানক গোঁড়া বলেই আপাতত পালাতে হচ্ছে। স্ত্রীর কাছে ছেলেকে যথেচ্ছ গালাগাল করেই ক্ষান্ত হয়েছেন সোমনাথবাবু।

কিন্তু দ্বিতীয় বিভ্রাট তার চতুর্গুণ। বলা নেই, স্ত্রী হঠাৎ এক রাত্রে তাঁর লেখার ঘরে এসে হাউ-মাউ করে কেঁদে পড়লেন। তারপর ব্যাপার শুনে স্তম্ভিত তিনি।

বড় মেয়ে শ্রীলেখা অন্তঃস্বত্ত্বা। কিছুদিন ধরেই স্ত্রীর সন্দেহ হচ্ছিল। আজ যে করে হোক স্পষ্টই টের পেয়েছেন। আর বেগতিক দেখে শ্রীলেখাও স্বীকার করেছে। বলেছে, সেই ছেলে তাকে বিয়ে করবে, তাই আর দেরী না করে ব্যবস্থা। করা দরকার।

মাথার আগুন একরকম জল ঢেলেই নেবাতে হয়েছে সোমনাথবাবুকে। সেও এক কায়স্থের ছেলে। ছোটাছুটি করে আর হয়রানির একশেষ হয়ে দরকারী কাজ আগে সম্পন্ন করেছেন তিনি। সেই ছেলের সঙ্গে মেয়ের চুপিচুপি বিয়ে দিয়ে বিদায়। করেছেন তাকে। বাপ তার গলায় গামছা দিয়ে একাড়ি টাকা আদায় করেছে।

ধকল শেষ হতে মাত্র পাঁচ দিন আগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছিলেন তিনি। বিষণ্ণ স্ত্রীকে বলেছিলেন, ছেলে আর বড় মেয়েকে ত্যাগ করলেন তিনি, আর তাদের মুখ দেখবেন না, কোন সম্পর্ক রাখবেন না–তার বাড়ি ঘর টাকাকড়ি সব তার ছোট মেয়ে পাবে–আর কেউ এক কপর্দকও পাবে না।

পাশের ঘর থেকে ছোট মেয়ে সুলেখা সটান তার সামনে এসে হাজির।-কেন পাবে না তারা? কেন তাদের ত্যাগ করবে? তারা কী দোষ করেছে?

প্রশ্ন ছেড়ে মেয়ের এই মূর্তি দেখে সোমনাথবাবু হতভম্ব। শশীরানীও। তীক্ষ্ণ চাপা স্বরে সুলেখা আবার বলে উঠল, জীবনের এই রাস্তায় গড়িয়ে তোমার চোখে এমন কী অন্যায় কাজ করেছে তারা? তারা যা করেছে সে-রকম ঘটনা তোমার এক-একটা বইয়ে অনেকবার করে ঘটেছে–আর শেষের বইটাতে তো কথাই নেই! তোমার অবাধ্য তো কেবল আমি হয়েছি, তাড়াতে যদি হয় আমাকেই তোমার তাড়ানো উচিত।

সোমনাথবাবু নির্বাক। হঠাৎ শশীরানী বলে উঠলেন, তোর কী মাথাখারাপ হয়ে গেল, মুখের ওপর এ-সব কী বলছিস্ তুই?

-ঠিকই বলছি মা। বাবা না তাড়ালেও এ বাড়িতে আর থাকার ইচ্ছে নেই আমার–আমি অন্য জায়গা খুঁজছি। কার মেয়ে বলতে পর্যন্ত এক-এক জায়গায় লজ্জায় পড়তে হয় আমাকে। সে-কথা থাক, কিন্তু বাবা কী বলে রাগ করে–এসব কথাই বা বলে কেন?

যেমন এসেছিল, তেমনি এক ঝটকায় সুলেখা আবার নিজের ঘরে চলে গেল।

এ-ঘরে শশীরানী নির্বাক, বিমূঢ়। আর সোমনাথ চাটুজ্যে বিবর্ণ, চিত্রার্পিত।