রমা মিত্র এবং মালবী মিত্র

রমা মিত্র এবং মালবী মিত্র

…প্রশান্তকে তিনদিন বাদে আসতে বলেছিল মালবী মিত্র। বলেছিল তিনটে দিন সে ভয়ানক ব্যস্ত থাকবে, দু-দুটো ছবি শেষের মাথায়–সকালে রাত্রিতে দুদফা করে শুটিং, এর মধ্যে দুদণ্ড মাথা ঠাণ্ডা করে কিছু ভাবার সময় নেই। বলেছিল, দিনতিনেক পরে যেন সে আসে। তখন শুনবে। তখন ভাববে। তখন যা বলার বলবে। নিরুপায় ভূভঙ্গি করে হেসেই বলেছিল, এই দেখো না, এতকাল বাদে তোমাকে দেখে কী যে করব ভেবে পাচ্ছি না, অথচ দুটো ঘণ্টা তোমাকে বসিয়ে আদর-যত্ন করতে পারলাম না…কী যে জীবন আমাদের যদি জানতে!

প্রশান্ত জবাব না দিয়ে চুপচাপ মুখের দিকে চেয়েছিল। সেই পুরু দুটো কাঁচ, তার ওধারে সেই ডাগর দুটো চোখ, সেই রকমই একমাথা ঝাকড়া চুল। কে বলবে

এই মানুষ একটানা সাত বছর বিদেশের মাটি চষে, মস্ত মস্ত চাকরি করে কিছুদিন আগে দেশে ফিরেছে। মালবী এই মুখ আর এই চাউনি দেখে ভাবতে পারো বড় জোর সাত মাস দেখেনি মানুষটাকে।

চুপচাপ ওই রকম খানিক চেয়ে থেকে প্রশান্ত বলেছিল, আচ্ছা, তিন দিন পরেই আসব তাহলে। তক্ষুণি উঠে দাঁড়িয়েছিল।

হ্যাঁ, এসো, রাগ করলে না তো? ঠিক এসো কিন্তু

ট্রেনের রিজার্ভ কামরার পুরু গদীতে ঠেস দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে বসে আছে। মালবী। বাইরের গাঢ় অন্ধকারের পাতাল ছুঁড়ে ট্রেন ছুটেছে। ওটা আলোয় পৌঁছুবে। কিন্তু মালবী কোথায় ছুটেছে? সে অন্ধকার খুঁজছে। কোনো অস্তিত্বগ্রাসী অন্ধকারে বিলীন হয়ে যাবার তাড়না তার। কিন্তু এমন জায়গা আছে কি…।

সামনের বার্থে অঘোরে ঘুমচ্ছে সারদা। ঝি ঠিক নয়, তার থেকে বয়সে বছর বারো বড় সহচরী বলা যেতে পারে, যে তার ঘর সামলায়। মনিবানীকে হঠাৎ এ ভাবে পড়িমরি করে বেরিয়ে পড়তে দেখে সে ততো অবাক হয়নি যত অবাক হয়েছে। টানা দুটো দিনের থমথমে মুখ দেখে। এত হাসি-খুশি যেন কোথায় উবে গেল! তারপর আজই হঠাৎ হুকুম, বেরুতে হবে। কোথায় যেতে হবে, কতদিনের মধ্যে যেতে হবে না জেনেই তড়িঘড়ি সব গোছগাছ করে নিতে হয়েছে। তা সহৃদয়া মনিবের এই গোছের খেয়ালের ধকল তাকে অনেক সামলাতে হয়। তাই আর থমথমে মুখের কারণ নিয়ে সে বিশেষ মাথা না গামিয়ে তোফা আরামে নিদ্রা দিয়েছে।

একবার তাকে দেখে নিয়ে অবসন্নের মত আবার বাইরের দিকে ফিরল মালবী মিত্র।

…সাত বছর বাদে প্রশান্ত এসেছিল কোনো একদিনের এক সাধারণ মেয়ে রমা মিত্রের কাছে। কিন্তু তার সঙ্গে কথা বলেছে এক অসাধারণ মেয়ে মাধবী মিত্র। যার তুলনা নেই। যার দর্শন পেলে বহু রসিকজন ভাগ্য মানে। খ্যাতির বিড়ম্বনায় যে মালবী মিত্র সর্বসাধারণের নাগাল থেকে বিচ্ছিন্ন-মিনিট চল্লিশ সে মাধবী মিত্র কথা বলেছিল প্রশান্তর সঙ্গে। রমা মিত্র নয়…প্রশান্ত কি তা বুঝেছে? বুঝে গেছে? বোঝার কথা, কিন্তু মালবী সেই মুখের দিকে চেয়ে নিঃসংশয় হতে পারেনি। শুধু তাই নয়, কথা বার্তায়, বিস্ময় আর হাসি-খুশির ফাঁকে মালবী তাকে প্রকারান্তরে এও বোঝাতে চেষ্টা করেছে, সাত বছর বাদে লোকটা এসে যে-কথা বলছে তার মধ্যে অবিশ্বাস অনেকখানি জায়গা জুড়ে আছে। কিন্তু লোকটা এও বুঝেছে কিনা সন্দেহ…রমা মিত্র নয়, আপন। মহিমায় বিকশিত এক মালবী মিত্র তাকে বলেছে আপাতত দিন-তিনেক তার মরবার ফুরসত নেই, তিন দিন পরে যেন আসে। প্রশান্ত বলেছে তাই আসবে।

..এই রাতটা পোহালে তিনটে দিনের অবসান। কালই বিকেলের দিকে প্রশান্ত আবার আসবে। ঢোকবার সময় বাড়ির দরজা-জানলা বন্ধ দেখে একটু অবাক হবে। তারপর দরজায় তালা ঝুলছে দেখে হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে থাকবে।…

মালবীর ঠোঁটের ডগায় কৌতুকের মত রেখা পড়ল একটু। কিন্তু চোখ দুটো অস্বাভাবিক চকচক করছে। বিগত এই কটা বছর শিল্পের তাগিদে ঠোঁটে তার অজস্র কৌতুক ঝরেছে, আর চোখ তার অজস্রবার চকচকিয়ে উঠে দুগাল বেয়ে ধারা নামিয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে সে-সবের মিল নেই।

রমা নিত্ৰ এখনো ভস্মস্তূপে পরিণত হয়নি। আর সেই ভস্মস্তূপ থেকে তখন। কোনো মালবী মিত্রর আবির্ভাব ঘটেনি।

এম. এ. পড়া একটি অতি সাধারণ মেয়ে রমা মিত্র। মামুলি প্রেমে পড়েছিল একটি বনেদী ঘরের সাধারণ ছেলের সঙ্গেই যার নাম প্রশান্ত ঘোষ। কিন্তু রমা মিত্র প্রায় অসাধারণই ভাবত তাকে। ভাবতে ভালো লাগত।

রমা রূপসী কিছু নয় যে নিজের সম্পর্কে বাড়তি গর্ব পুষবে। গায়ের রং বলতে গেলে কালোই। স্বাস্থ্যটা ভালো এই যা। আর যাদের দরদ আছে তারা নাক মুখ চোখও ভালো দেখে। তবে ফটো ওর খুব সুন্দর ওঠে, সত্যিকারের চেহারা থেকে ঢের বেশি সুন্দর মনে হয়। ফটোতে তো আর গায়ের রঙ ধরা পড়ে না। বি.এ. পাস করার পরেই তার বাবা এক বড় ঘরে মেয়ে দেবার আশায় ওর একখানা ছবি পাঠিয়েছিল পাত্রপক্ষের কাছে। ছবি দেখেই পাত্রপক্ষ সাগ্রহে এগিয়ে এসেছিল মেয়ে দেখতে। কিন্তু রঙ দেখে ফিরে গেছে। মোটামুটি ফর্সা হলেও হয়ত আটকাতো না, কিন্তু রমাকে ঠিক মোটামুটি ফর্সাও কেউ বলবে না।

কিন্তু গর্ব করার কত রমার গুণও একটু ছিল। খুব সুন্দর থিয়েটার করত স্কুল আর কলেজে পড়তে। মেয়ে-কলেজের সেই থিয়েটার দেখে অনেক ছেলে অনেক রূপসী মেয়ের থেকেও তার দিকে বেশি ঝুঁকত। ওর বাবা কোন ফার্মের বাঁধা মাইনের কমার্সিয়াল আর্টিস্ট হলেও আর্টিস্ট তো বটেন। উদার প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি। মেয়ের এই সখে বাধা দেননি কখনো। এম.এ. পড়ার সময়ও কি এক ব্যাপারে পাড়ার মেয়েরা মিলে থিয়েটার করেছিল। রমা মিত্র তার নায়িকা এবং সর্বাধিনায়িকা। সেই যশের দুদুটো অ্যামেচার থিয়েটার দলের ভদ্রলোকেরা ওর বাবাকে পর্যন্ত ধরে পড়েছিল, মেয়েকে থিয়েটার করতে দিতে হবে। নিরুপায় ভালমানুষ বাবা মেয়ের কাছেই পাঠিয়ে ছিলেন তাদের। রমা তাদের তাড়িয়েছে।

যাক, ওটা জীবনের ক্ষেত্র নয়–অন্য সব ক্ষেত্রেই রমা মিত্র নিজেকে অতি সাধারণের উর্ধ্বে ভাবত না কখনো। আর তার এই মাধুর্যটুকুই কারো কারো চোখে পড়ত, মনেও বোধহয় ধরত। বিশেষ করে চোখে পড়েছিল আর মনে ধরেছিল প্রশান্তর।

এই প্রেমে পড়া এমন কি তার পরিণতিও অনেকটা ছকে বাঁধা মামুলি ব্যাপার। হাজারগণ্ডা ছেলে-মেয়ে হামেশাই এ-রকম প্রেমে পড়ে থাকে। মিলন অথবা বিচ্ছেদের পরিণামে সচরাচর সে-রকম কিছু বৈচিত্র্যও চোখে পড়ে না। কিন্তু যে ছেলেটা আর যে মেয়েটা সেই মামুলি প্রেমে পড়ে, তাদের চোখে এখন দুনিয়ার রঙ আলাদা।

রমা যখন বিয়ে পড়ে তখন পরিচয়। পরিচয়ের রাস্তাটাও চিরাচরিত এবং সাজানো। রমার সহপাঠিনী সুমিতার মাসতুতো দাদা প্রশান্ত। সেখানেই দেখা-সাক্ষাৎ এবং আলাপ। প্রশান্ত তখন এঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ে। অবকাশ কম। কিন্তু ছুটিছাটায় বাড়ি এলে প্রায়ই তাকে সুমিতার ওখানে দেখা যায়। একদিন সুমিতাই প্রশান্তর মাসির বাড়ি আসার টানের কারণটা রমার কাছে ফাঁস করে দিল। বলল, প্রশান্তদা কলকাতায় এলেই ঘন ঘন আমাদের বাড়ি আসে কেন জানিস? তোর জন্য। তোকে ভালো লাগে।

সেই প্রথম রমা দুচোখ বড় বড় করে শুনল একটা ছেলের তাকে ভালো লাগে, আর সেই জন্যে সে তার মাসির বাড়ি আসে। ভালো লাগার কারণটাই খুব বিচিত্র লাগল তার। মেয়ে কলেজের চিত্রাঙ্গদা নাটক দেখার পর থেকেই নাকি এই ভালো। লাগার সূত্রপাত। রমা যখন চিত্রাঙ্গদা করেছিল তখন ফার্স্ট ইয়ার ছাড়িয়ে সবে সেকেণ্ড ইয়ারে উঠেছে। তখন নাচতেও পারত ভালো। চিত্রাঙ্গদা করে দুই একটা মেডেল টেডেল পেয়েছিল বটে, কিন্তু কোন ছেলের মনে এই গোছের ছাপ ফেলতে পেরেছে। সেটা কল্পনাও করেনি।

এর পর থেকে বলা বাহুল্য সুমিতার প্রশান্তদাকে সে একটু বিশেষ দৃষ্টিতেই দেখতে লাগল। পড়াশুনায় রমা সাদামাটা ছাত্রী, কিন্তু সুমিতার প্রশান্তদা শুনল স্কলারশিপ পাওয়া ছেলে। এনজিনিয়ারিং-এও প্রতি বছর ফার্স্ট হচ্ছে। রমার মনে তাইতে সঙ্কোচ একটু। কিন্তু পুরু কঁচের ওধারে প্রশান্তর চোখ দুটো যখন ঘুরে ফিরে তার দিকেই আটকে থাকত আর ঠোঁটের ফাঁকে একটু দুষ্টু-দুষ্টু হাসি লেগে থাকত। রমার তখন ছেলেমানুষই লাগত তাকে।

রমা যেবার বি.এ. পাস করল, প্রশান্ত সেবার এনজিনিয়ারিং পাস করে বেরুল। পাস করার সঙ্গে সঙ্গে ভালো মাইনের চাকরি। একে কৃতী ছেলে, তায় মুরুব্বির জোর আছে। তার বড়দাও আধা-প্রবীণ এনজিনিয়ার–বম্বের এক নামজাদা ডিজাইন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন ফার্মে মস্ত চাকরি করে। তার সুপারিশে তাদের কলকাতার শাখায়। বহাল হয়ে গেল সে। প্রশান্ত খুঁতখুঁত করেও বাপের হুকুম অমান্য করতে পারল না। তার ভয়ানক ইচ্ছে ছিল বিলেতে গিয়ে আরো কিছু ডিগ্রি-টিগ্রি পকেটস্থ হবার পর কর্মজীবন শুরু করে। কিন্তু বাপের ইচ্ছেটাই তাদের পরিবারে সব! তার বাবা জবরদস্ত পুলিস-অফিসার ছিলেন। অনেককাল রিটায়ার করেছেন। কিন্তু পারিবারিক ক্ষেত্রে ভদ্রলোকের পুলিসী মেজাজ এখনো অক্ষুণ্ণ আছে। সেই বাপ হুকুম করল–দাদা যা ব্যবস্থা করেছে তাই করো, চাকরিতে ঢোকো।

ছেলে মুখ সেলাই করে চাকরিতে ঢুকেছে।

প্রেমে হাবুডুবু অবস্থা নয় তাদের তখনো। আলাপ বেশ ঘনীভূত হয়েছে এই পর্যন্ত। আর তার ফলে প্রশান্তকে ভালো লাগতে শুরু করেছে এই পর্যন্ত। কিন্তু সুমিতার মুখে তাদের বনেদী বাড়ির কর্তাটির দাপটের কথা যা শোনে তাতে রমার ভয়ই করে। তবু সেই ভদ্রলোক ছেলের বিলেত যাওয়া বন্ধ করল বলে মনে মনে খুশিই হল। নিজের মনেই বলেছে, বেশ হয়েছে, বিলেত গিয়ে ছেলে একেবারে লাটসাহেব বনে আসবে!

প্রেমে হাবুডুবু অবস্থাটা দাঁড়াল রমার এম-এ পড়ার দুটি বছরে। প্রায়ই আপিস পালিয়ে প্রশান্ত ছেলেমানুষের মতই য়ুনিভার্সিটির দোরগোড়ায় ওর ছুটির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। গোড়ায় গোড়ায় রমা লজ্জা পেত। ক্লাসসুদ্ধ ছেলে-মেয়ে জেনে ফেলেছে। কিন্তু শেষে এটা সহজ হয়ে গেল। গল্প করতে করতে দুজনে এসপ্লানেড পর্যন্ত হাঁটে। রেস্টুরেন্টে খায়। তারপর ট্রামে পাশাপাশি বসে সন্ধ্যের সময় বাড়ি ফেরে। প্রশান্তর বাড়িতে জানে ছেলের কাজের চাপ, রমার বাড়িতে জানে মেয়ের লাইব্রেরিতে পড়ার চাপ। য়ুনিভার্সিটি আর আপিস পালিয়ে দুজনে সিনেমাও দেখে মাঝে মাঝে।

রমা বলে, তোমার জন্যে আমি ঠিক ফেল করব, তখন লজ্জায় আর মুখ দেখাতে পারব না।

প্রশান্ত জবাব দেয়, হু, ভারী তো বাংলা পড়া তার আবার ফেল!

রাগ দেখাতে গিয়েও কী মনে পড়তে রমা হেসে ফেলে, কী বললে, ভারী তো বাংলা–বলতে লজ্জা করে না, বাংলায় একটা চিঠি লিখতে সাতটা বানান ভুল হয়, বই পড়ার সঙ্গে শাড়ি পরার বানানের তফাৎ জানে না!

সেদিন সিনেমা দেখার প্রোগ্রাম করে প্রশান্ত রমাকে চিঠি লিখেছিল, ওমুক-রঙা শাড়িখানা পরে যেন আসে। তাইতেই বানানের বিভ্রাট।

কিন্তু প্রেম-প্রীতির ব্যাপারটা জানাজানি হতে আর বেশি দেরি হল না। প্রশান্তর বাবা সঠিক হদিস পেলেন সুমিতাকে জেরা করে। কার মেয়ে কেমন মেয়ে জানার পর ছেলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ তিনি। ওদিকে প্রশান্তর এক দাদার বিয়ে তখনো বাকি, সে সাধারণ চাকরি করে। তার বিয়েটা দিয়ে ফেলে কৃতী এনজিনিয়ার ছেলের জন্য অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা আনার সঙ্কল্প। বড় বড় ঘর থেকে প্রস্তাব আসছেও। তার মধ্যে এ-রকম ছেলেমানুষি বরদাস্ত করার মত নরম মন নয় তার। তাই ছেলেকে ডেকে বেশ কড়া সুরেই হুমকি দিলেন, বাপু হে, তোমার ছোড়দার বিয়েটা হয়ে গেলে তোমার। বিয়ে আমিই দেব। ততদিন ঠাণ্ডা মাথায় কাজের উন্নতি যাতে হয় সেই চেষ্টা করো।

বাবার হুমকির খবরটা সেদিনই রমাকে দিল সে। এই গুণটা আছে। নিজের সমস্যাটা দুজনের সমস্যা ভাবে। তাই সব কথাই রমাকে বলে। শোনামাত্র দুচোখ কপালে–সর্বনাশ! তাহলে?

ঠোঁট উল্টে প্রশান্ত জবাব দিল, সর্বনাশ আবার কি, ও-সব পুলিশী দাপটে দেশের স্বাধীনতা ঠেকানো গেছে?

রমা বলল, দুটো এক হল! তাতেও তো কত লোকে জীবন দিয়েছে।

আমিও তো একজনকে আমার জীবন দিয়েছি।

কী ভালো যে লেগেছিল শুনতে রমাই জানে। সেদিন সন্ধ্যার আড়ালে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কোণের চত্বরে বসে দুজনে যত কাছাকাছি হয়েছিল এর আগে ততটা আর কখনো হয়নি। সেদিন রাতে ভালো ঘুমুতে পারেনি রমা। দুটো ঠোঁটের সেই ঘন আবেগের স্পর্শ সমস্ত রাত ধরে তার সর্বাঙ্গে আবেশ ছড়িয়েছে আর বিহ্বল করেছে।

এমন অদ্ভুত ছেলেমানুষি প্রস্তাবও করে মানুষটা যে রমা হেসে বাঁচে না। সেদিন। ওর বাবার হুমকির প্রসঙ্গেই রমা বলেছিল, কিন্তু আমার বাপু সত্যি কেমন ভয় করছে!

প্রশান্ত তক্ষুনি বলেছিল, আমারও করছে।

তাহলে?

তাহলে চলো পালাই দুজনে। কিন্তু বাবা যা লোক, ঠিক আবার ধরে আনবে।

তাহলে?

তাহলে আর এক কাজ করা যাক। চলো কোন সাধু-সন্ন্যাসীর কাছে যাই, মন্ত্রের জোরে তারা বাবার মন বদলে দিক।

রমা হেসে উঠেছিল। তারপর বলেছিল, বিয়েটা হয়ে গেলে মন আমিই বদলে দিতে পারি বোধহয়।

প্রশান্ত সাগ্রহে বলে উঠেছিল, তাহলে তাই করে ফেলি এসো। রেজিষ্ট্রি বিয়ে করে সোজা বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াই।

ও বাবা! রমা আঁতকেই উঠেছিল, তোমার বাবার সামনে?

এরকম উদ্ভট উদ্ভট অনেক প্রস্তাব করে সে। কখনো বলে বাড়ি গিয়ে মাকে শাসাবে, এ বিয়ে না দিলে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়বে। কখনো ভাবে মাকে শেখাবে, এ বিয়ের জন্য ইষ্টদেবার স্বপ্ন-টপ্ন দেখেছে সেই গোছের কিছু ভাঁওতা দিয়ে বাবাকে বশ করতে।…সেদিন তো এমন মোক্ষম প্ল্যান মাথায় গজালো তার যে আপিস ফেলে রমাদের বাড়িতে এসে হাজির। রমার য়ুনিভার্সিটি ছুটি সেদিন। চুপি চুপি তাকে বাইরে টেনে আনল। সাগ্রহে বলল, তোমার সাহসে কুলোলে এবার আর কেউ আটকাতে পারবে না–পারবে?

সত্যি তেমন কিছু আশা করেছিল রমা। কী করতে হবে?

দু তিনদিনের মধ্যেই দুজনে পালাব আমরা।

এ তো পুরনো প্রান!

আঃ! আগে শুনোই না, তার কয়েকদিনের মধ্যে কাগজে চিঠি পাঠাব আমরা মানে ওমুক মেয়ে আর ছেলে একসঙ্গে আত্মহত্যা করেছে, ব্যস!

রমার দুচোখ বিস্ফারিত। কী ব্যস, কাগজে খবর পাঠিয়ে আমরা আত্মহত্যা করব?

 দূর পাগল, আমরা বিয়ে করব–সকলে জানবে আমরা আত্মহত্যা করেছি!

আস্ত পাগল তুমি! আচ্ছা স্কলারশিপ পেলে কী করে? অত ভালো এনজিনিয়ারিং পাসই বা করলে কী করে?

কেন?

— উড়ো খবর কাগজে ছাপবে কেন?

দুজনে একসঙ্গে ছবি তুলে কাগজে পাঠিয়ে দেব বাইরে থেকে–এই দুজন আত্মহত্যা করেছে–অন্য লোক খবর পাঠিয়েছে।

আত্মহত্যা করলে আমাদের বডি যাবে কোথায়? পুলিস চুপ করে বসে থাকবে? আমাদের টেনে বার করবে না? তখন আত্মহত্যাই করতে হবে!

এমন প্ল্যানটাও বাতিল হয়ে যেতে প্রশান্ত বিমর্ষ। রমা না থাকলে সে যে এতদিন একটা কিছু চমকপ্রদ বিভ্রাট বাঁধিয়ে বসত তাতে সন্দেহ নেই।

রমা এম.এ. পাশ করার পর দুজনেই অনেকখানি বেপরোয়া হয়ে উঠল। ওদিকে প্রশান্তর ছোড়দার বিয়ে হয়ে গেছে। তার বাবা তখন কৃতী ছেলের বিয়ের তোড়জোড় করছেন। প্রশান্ত স্পষ্টই তার মাকে জানিয়ে দিয়েছে বিয়ে কোথায় করবে। তার ফলে বাপ আগুন, মাও অসন্তুষ্ট। বাড়িতে অশান্তি। বাবাও ঘোষণা করেছেন, অবাধ্য হলে ছেলের সঙ্গে কোন সম্পর্ক থাকবে না।

রমা এম.এ. পাস করার পর প্রশান্ত জিজ্ঞাসা করল, এবার?

 রমা জবাব দিল, এবারে চাকরি।

 কী চাকরি? কোথায় চাকরি?

 স্কুলে স্কুলে-মাস্টারি ছাড়া আমি কী আর পেতে পারি?

খবরদার!

বা রে, তাহলে কি করব? বাবা আর কতকাল টানবেন?

 খপ করে তাকে কাছে টেনে প্রশান্ত বলেছে, বাবা কেন, আমি টানব।

 রমা হেসে ফেলেও ভ্রূকুটি করেছে–বিয়ের আগেই?

প্রশান্ত ভেবে-চিন্তে বলেছে, না, চোখ-কান বুজে এবারে বিয়েটাই আগে করে ফেলা যাক। কী আর হবে, বাপ মেরে ফেলতে তো আর পারবে না, বড়জোর আলাদা করে দেবে।

কিন্তু রমার মনে সায় দেয় না। কারণ অভিশাপ দিয়ে ঘর বাঁধবো কেমন করে?

ছুটির দিনে বেশ সকাল সকাল এক এক দিকে বেরিয়ে পড়ে দুজনে। কখনো ব্যাণ্ডেল, কখনো কাঁচড়াপাড়া, কখনো বা গঙ্গার বুকে ডিঙি নৌকায়। আর সমস্যার সমাধান কেমন করে হবে তাই ভাবে দুজনে। বিশেষ করে নির্জন বন-বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে দুজনেরই। সেই নির্জনতার একটা ভাষা আছে। হাত ধরা ধরি করে শুকনো পাতা মাড়িয়ে মাড়িয়ে এগোয় দুজনে। গাছের ছায়ায় ঘন হয়ে বসে। দুপুরে পাখির অলস ডাক কান পেতে শোনে। সমস্যা-টমস্যা সব দুজনেরই ভুল হয়ে যায় তখন।

রমা একদিন ঝগড়া টেনে আনে।-তুমি আমাকে ভালোবাস না ছাই, আসলে চিত্রাঙ্গদা পছন্দ তোমার!

তুমি তো চিত্রাঙ্গদা।

 আমি রমা। তবে চিত্রাঙ্গদার মত কুৎসিত বটে

 চিত্রাঙ্গদা কুৎসিত?

না তো কি?

তাহলে তুমি একটি অন্ধ, ভেতর দেখতে জানো না।

কথাগুলো যেন কান পেতে আস্বাদন করার মত। রমার অনেকদিন মনে হয়েছে লোকটা এনজিনিয়ার বটে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে কবি। শুধু কবি নয়, একেবারে অবুঝ কবি।

সামনের গাছটার দিকে তাকিয়ে কাব্যই করল প্রশান্ত। বলল, আমি যদি গাছ। হতাম, আর তুমি ওই লতার মত আমার সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে, বেশ হত।

রমা তক্ষুনি তার কাঁধে গা ঠেকিয়ে আর একটা হাতে তার গলা বেষ্টন করে বলল, লতা হবার দরকার কী, এই তো জড়িয়ে থাকলাম।

সেদিন ওই ঠাণ্ডা মানুষটার রক্তে কেন যে অত দোল লাগল রমা জানে না। এরকম তো আগেও হয়েছে। আগেও কাছে টেনে নিয়েছে। দুই উষ্ণ ঠোঁটের আবেগ ওর অধরের বাধা বিচূর্ণ করেছে। কিন্তু এই দিনের তৃষ্ণার মূর্তিটাই অন্যরকম। ওর দেহটা যেন ক্রমে একটা আবিষ্কারের বস্তু হয়ে উঠতে লাগল। নিবিড় নিষ্পেষণে সর্বাঙ্গে কী রকম একটা যন্ত্রণার শিহরণ, রমা যেন কোথা থেকে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে!

হঠাৎ ওকে দুহাতে ঠেলে দিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল সে। বিস্রস্ত বসন ঠিক করতে করতে ধমকের সুরে বলে উঠল, এই!

একটা ভুত নামল যেন প্রশান্তর কাঁধ থেকে। আত্মস্থ, বিব্রত।–কি?

রাক্ষুসেপনা কোরো না, সময় ফুরিয়ে গেল নাকি!

.

কিন্তু শিগগীরিই একটা ধাক্কা খেয়ে দুজনেরই মনে হল সময় ফুরিয়ে গেল বুঝি। প্রশান্তর সঙ্গে তার বাবার মুখোমুখি একটা সংঘাত হয়ে গেল এক বড়লোকের বাড়ির মেয়ে দেখতে যাওয়া নিয়ে। খুব বিনীত আর খুব স্পষ্ট ভাবে প্রশান্ত এবার বাবাকেই জবাব দিয়েছে, তার দেখতে যাওয়া সম্ভব নয়, এবং কারোরই না যাওয়া ভাল।

প্রাথমিক ঝড়টা প্রশান্তর উপর দিয়ে গেল। তারপর ভেবেচিন্তে ভদ্রলোক রমার বাবাকে ডেকে পাঠালেন একদিন। রমার বাবা এলেন।

প্রশান্তর বাবা রূঢ়মুখে জানতে চাইলেন, মেয়ের বিয়েতে তিনি কী করতে পারবেন?

রমার বাপ জবাব দিলেন, আপনি চাইলে শুধু বিয়েই দিতে পারব, আর কিছু করার সঙ্গতি নেই।

তপ্ত বক্রস্বরে প্রশান্তর বাবা বললেন, সেটা কি বেশী আশা করা হচ্ছে না?

রমার বাবা জবাব দিলেন, এর মধ্যে আমার কোন হাত নেই।

আপনার মেয়েকে বোঝাবার হাত বা দায় আমার?

আপনার ছেলেকে বোঝাবার হাত বা দায় আপনার।

নিঃস্ব লোকের এই উক্তিতে প্রশান্তর বাবা অপমানিত বোধ করলেন। আর আসল অপমানিত মানুষটি নিঃশব্দে উঠে গেলেন।

সব শুনে রমা রাগে জ্বলতে লাগল। বাবা ওর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নিয়ে ও-বাড়ি থেকে ফেরেননি। তবু বাবার অপমান ওকে মর্মান্তিকভাবে বিধল। ঘরে মা নেই-ভাইবোনদের কাছে বাবা অনেকখানি।

ওদিকে এ ঘটনার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই প্রশান্তর বাবা তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। ছেলেকে কলকাতা থেকে আপাতত সরাতে না পারলে এ মোহ কাটবে না, তাই বোম্বেতে বড় ছেলের সঙ্গে এ নিয়ে চিঠিপত্রের আদানপ্রদান চলছিল। রমার বাবার সঙ্গে কথা হবার পনের দিনের মধ্যে হেড-অফিস অর্থাৎ বম্বেতে পত্রপাঠ। বদলির অর্ডার পেল প্রশান্ত। সেটা যে দাদারই চেষ্টার ফল, বুঝতে কারো বাকি থাকল না।

এ খবরও রমা শুনল প্রশান্তর মুখ থেকেই। শোনার পর গুম সে। একটু বাদে বিরস মুখে জিজ্ঞাসা করল, বম্বে যাচ্ছ?

তুমি কী বলো, চাকরি ছেড়ে দেব?

আবার একটু চুপ করে থেকে রমা বলল, না, যাও।

প্রশান্ত অসহিষ্ণু, উতলাও।

তুমি এভাবে কথা বলছ কেন? সব তো জানো, আমার কী দোষ? তাছাড়া এই করে বাবা বা দাদা বা দুনিয়ার কেউ আমাদের আটকাতে পারবে?

পারবে না?

পাগল! এক বছরে হোক, দু বছরে হোক, পাঁচ বছরে হোক–বিয়ে আমাদের হবেই। যতদিন না হয়, আমার প্রতীক্ষায় তুমি থাকবে, তোমার প্রতীক্ষায় আমি থাকব।

সত্যি?

 সত্যি।

 সত্যি?

সত্যি সত্যি সত্যি। মুখের দিকে চেয়ে থেকে প্রশান্ত বিষণ্ণ মুখে হাসল একটু, কিন্তু আমাকে এখনো তুমি বিশ্বাস করলে না!

বিশ্বাস করলাম না?

প্রশান্ত মাথা নাড়ল, না।

দরদে রমার ভিতরটা ভরে গেল। দুহাত বাড়িয়ে তার মাথাটা বুকে টেনে আনল। বলল, বিশ্বাস করেছি। তুমি আমার অপেক্ষায় থাকবে, আমিও তোমার প্রতীক্ষায় থাকব।

তিন দিনের মধ্যে প্রশান্ত বম্বে চলে গেল। আর তিন মাসের মধ্যে তার চিঠি পেল লণ্ডনগামী জাহাজ থেকে। সুযোগ পেয়ে চাকরি ছেড়ে সে সাগর পাড়ি দিচ্ছে! রমা যেন প্রতীক্ষায় থাকে।

এই সবই ঘটে গেল রমা এম. এ. পাশ করার ছমাসের মধ্যে।

আর আরো দুমাস বাদে রমার মাথায় বুঝি বাজ পড়ল একটা। খবরটা দিল সুমিতা। তার অনেকদিন বিয়ে হয়ে গেছে। হঠাৎ দেখা। কথায় কথায় বলল, বিলেত গিয়ে প্রশান্তদা মেম বিয়ে করেছে, শুনেছিস?

রমা চমকে উঠল। তারপর অবিশ্বাস করল। বিশ্বাস করবে কী করে–মাত্র তিন সপ্তাহ আগেও সে প্রশান্তর আবেগভরা চিঠি পেয়েছে। তার এত অবিশ্বাস দেখেই পরে সুমিতা মাসির বাড়ি গিয়ে একখানা ছবি আর মাকে লেখা প্রশান্তর নিজের হাতে লেখা চিঠি নিয়ে এলো। তাদের বাড়িতে নাকি হুলুস্থুল ব্যাপার চলেছে সেই থেকে।

অবিশ্বাসের আর কিছু নেই। এক তরুণী শ্বেতাঙ্গিনীর বাহু বেষ্টন করে প্রশান্ত দাঁড়িয়ে। দুখানি হাস্যোজ্জ্বল মুখ। চিঠিতে লিখেছে, তোমরা আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না জানি, পারো তো আমাদের আশীর্বাদ করো।

এরপর দিনকয়েক পর্যন্ত রমার মাথায় শুধু আগুন জ্বলেছে।

এদিকে রমার বাবাও কিছু ঝামেলার মধ্যে ছিলেন, বাড়ি ছাড়ার কেস চলছিল বাড়িঅলার সঙ্গে। প্রতিপক্ষ ডিক্রি পেয়েছে, তিনমাসের মধ্যে বাড়ি ছাড়ার হুকুম হয়েছে। তার মধ্যে মেয়ের এই আঘাত। একমাসের ছুটির দরখাস্ত করে ভদ্রলোক ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লেন। আর তারপর ফিরে এসে অন্যত্র উঠলেন।

ভিতরে ভিতরে যাতনার মত একটা তাগিদ অনুভব করত রমা। সাধারণ মেয়ের অসামান্য হয়ে ওঠার তাগিদ। ভিতরটা যেন একটা জ্বলন্ত অঙ্গার হয়ে উঠছে তার, আর এই তাগিদ বাড়ছে।

আগে স্কুল-মাস্টারির চেষ্টা করছিল, এখন সে চেষ্টা ছেড়ে দিল।

এই অবস্থার মধ্যে হঠাৎ এক নামজাদা চিত্রপরিচালকের নামে বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল একটা। নায়িকার ভূমিকার জন্যে একজন শিক্ষিতা অভিনেত্রী চাই। ফোটোসহ আবেদন করতে হবে।

মাথায় একটা ঝোঁকই চাপল রমার। নতুন করে নিজের ছবি তুলিয়ে আবেদন। পাঠিয়ে দিল।

অসামান্য হবার যোগ্যতা ছিল রমা মিত্রের। ডাক এসেছে। কথা বলে আর ছাত্রজীবনের অভিনয়ের মেডেল দেখে পরিচালক খুশি একটু। ট্রায়েল দিয়ে আরো খুশি। চমৎকার ফোটোজনিক মুখ, সুন্দর বয়েস, নাক মুখ চোখ ভালো–তার ওপর অভিনয়ে বুদ্ধিদৃপ্ত সহজ দক্ষতা আছে। আশাতীত পছন্দ হল তার।

.

রমা মিত্র মরে গেল। ছবিতে এক মালবী মিত্রের আবির্ভাব দেখল সকলে। প্রথম। ছবিতে এমন বিপুল বন্দনা কম নায়িকার ভাগ্যেই জুটেছে।

তারপর এই দুবছরে দিনে দিনে তার আবির্ভাব স্থায়ী হয়েছে, উজ্জ্বলতর হয়েছে। আজ মালবী মিত্র একটা নাম। সে অসামান্যা। তার নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসৎ নেই।

কটা ছবির কাজ একসঙ্গে শেষ হতে মালবী একটু হাঁপ ফেলেছিল। নতুন কোন কোন ছবি হাতে নেওয়া যেতে পারে ভাবছিল। ধরছে তো এসে কতজনই। বম্বে থেকে ডাক এসেছে, তাতেও সাড়া দেবে কিনা চিন্তা করতে হবে।

এমন দিনে প্রশান্ত ঘোষ এসে হাজির। সারদার হাতে চিরকুট দেখেও নির্বাক খানিক। সেই পুরনো জ্বালা আর অনুভূতিটা নতুন করে আবার মাথার দিকে উঠছে। প্রথমে ভাবল সারদাকে বলে দেয়, দেখা হবে না বলগে যা। কিন্তু তা বলল না। বলল, এখানে নিয়ে আয়।

নিয়ে এলো। সেই মুখ, সেই পুরু কাঁচের চশমা, ঠোঁটের ডগায় সেই কাঁচা হাসি। দেখামাত্র রাগে সর্বাঙ্গ চিনচিন করে উঠল ভেতরটা।

প্রশান্ত দুচোখ ভরে দেখল তাকে খানিক।-কেমন আছ রমা?

রমা আবার কে, আমি তো মালবী! মালবী মিত্র!

প্রশান্ত হেসে উঠল, কি ফ্যাসাদেই যে ফেলেছিল এই নাম নিয়ে–যাকে সকলে চেনে তাকে কেউ চেনে না! বাইরে থেকে ফিরে এই একটা মাস হন্যে হয়ে খুঁজেছি তোমাকে। শেষে সুমিতার কাছে শুনলাম তুমি এখন উজ্জ্বলতম তারকা মালবী মিত্র। ..বিলেত থেকেও তোমাকে কত যে চিঠি লিখেছি, জবাব না পেয়ে শেষে হাল ছেড়েছি।

…বাড়ি ছেড়েছিল তাই চিঠি পায়নি৷৷ পেলেও জবাব দিত না। চোখে চোখ রেখে মালবী চেয়ে আছে।একা ফিরেছ না মেম-বউকেও এনেছ?

প্রশান্ত অবাক।–মেমবউ!

ভিতরটা দাউ দাউ করে জ্বলছে এখন। এমন নির্লজ্জও মানুষ হয়! ঠাণ্ডা গলায় বলল, তোমাদের কাঁধে হাত রাখা যুগল ছবি আমি দেখেছি, আর তোমার মাকে লেখা তোমার সেই চিঠিও আমি পড়েছি।

প্রশান্তর দুচোখ বিস্ফারিত প্রথম। তারপরেই হা-হা হাসি।–সে-সব তুমিও কি বিশ্বাস করেছ নাকি? কি আশ্চর্য! আমার প্রত্যেকবারের প্ল্যান তুমি বাতিল করেছিলে–তাই বিলেতে গিয়েই বাবাকে জব্দ করার মোক্ষম প্ল্যান ফেঁদেছিলাম। বাবার ওপর আমার তখন দুনিয়ার সব থেকে বেশি রাগ–আর কাঁধে হাত রেখে ছবি তোলার মত অন্তরঙ্গতা ও-দেশে একটু চেষ্টা করলেই হয়।

মুহূর্তের মধ্যে এ কি হল মালবীর? মাথাটা এমন প্রচণ্ডভাবে ঝিমঝিম করে উঠল কেন? তার অস্তিত্ব সুদ্ধ এভাবে নড়েচড়ে উঠল কেন? প্রাণপণে এই কথাগুলো ভণ্ডামী ভাবতে চেষ্টা করল কেন? আর ঘরে এত আলো, অথচ সামনে রাজ্যের অন্ধকার ভিড় করে আসছে কেন?

প্রশান্তও বিস্মিত চোখে চেয়ে আছে তার দিকে।

প্রাণপণ চেষ্টায় মালবী সামলে নিল নিজেকে।–বিশ্বাস করতে বলছ?

কী আশ্চর্য, আমি বলছি তাও বিশ্বাস করবে না?

 মালবী দেখছে তাকে। অন্তস্তল পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে।–তারপর?

তারপর আবার কি, এবারে বিয়ে। বাবা তো আর নেই, আর মায়ের যা অবস্থা, তোমাকে ঘরে আনতে পারলে বাঁচেন।

বসার চেয়ারটা, মাটি, বাড়িঘর যেন দুলছে মালবীর চোখের সামনে। তবু হাসি মুখেই বলতে চেষ্টা করল, কিন্তু আমি যে অভিনেত্রী হয়েছি!

মাথা ঝাঁকিয়ে প্রশান্ত বলল, কথা যদি রেখে থাকো, মানে আমার জন্যে প্রতীক্ষা যদি করে থাকো, তাহলে আর কোন কিছুতে যায় আসে না।

চেয়ার মাটি ঘর দুয়ার আর একবার বিষম দুলে উঠেছে। তারপর মালবী হেসেছে। নিজের জরুরী অ্যাপয়েন্টমেন্ট মনে পড়েছে। কাজের চাপে আপাতত মরবার ফুরসৎ নেই বলেছে। বলেছে, মাথায় কোনো কথা ঢুকছেই না এখন। তিন দিন বাদে তাকে আসতে বলেছে। তখন কথা হবে।

কিছু একটা ব্যতিক্রম অনুভব করেই প্রশান্ত লক্ষ্য করেছে তাকে। তারপর তিনদিন বাদে আসবে জানিয়ে উঠে চলে গেছে।

তিনদিনের মধ্যে দুরাত এক মিনিটের জন্যেও মালবী ঘুমোয়নি। আজ তার পালাবার তাগিদ।

কারণ সে তার মন দিয়ে বুঝেছে, প্রশান্ত এক বর্ণও মিথ্যে বলেনি।

তার কারণ, মালবী তার জন্য প্রতীক্ষা করেনি।…অসামান্য হয়ে ওঠার দুর্বার তাগিদে তার যৌবন-বাস্তবে একাধিক পুরুষের অভ্যর্থনা ঘটে গেছে। মালবী এতটুকু পরোয়া করেনি।

অন্ধকার বিদীর্ণ করে ট্রেন ছুটেছে। আলোয় পৌঁছুবে। কিন্তু মালবী ছুটেছে তেমনি অন্ধকারে নিজেকে মিলিয়ে দেবার তাড়নায়।

রমা মিত্রর ভস্ম থেকে একদিন মালবী মিত্র উঠে এসেছিল। আজ মালবী মিত্র ভস্ম হয়ে গেলেও এ জীবনে আর রমা মিত্রের হদিশ মিলবে না।