বারমুডা লিলি

বারমুডা লিলি

কুণাল বোস হেসেই বাঁচে না। শিবু কাকার দপ্তরে বসেও হেসেছিল। তাই দেখে শিবু কাকা ধমকেই উঠেছিল। বলেছিল, আমি কি তোকে তোয়াজ তোষামোদ করে চলার পাত্র, যে মিথ্যে তোকে বাড়াতে যাব? না কি আমার কাগজটা আঁস্তাকুড় একটা যে। ছাই-ভস্ম যা পাব তাই নিয়ে ছাপার জন্য হাঁ করে থাকব? এত কাল কাগজ চালাচ্ছি, এত লেখা লিখছি কলমের আঁচড় টানা দেখলে কার মধ্যে কি আছে বুঝতে পারি না–আঁচ করতে পারি না? যে লেখা দেখে তোর বাবা অমন আগুন হয়েছে, তোকে কেটে দুখানা করতে পারলে শান্তি হয় বলেছে, আর তারপর মাথার বিকৃতি কি না দেখার জন্য অত চুপিচুপি ডায়েরিটা আমার কাছে চালান করেছে–সেই সব ছাইভস্ম লেখার মধ্যেও একটা সম্ভাবনা দেখেই তোকে আমার কাছে পাঠাতে বলেছিলাম নইলে আমার সময় কি কুল গাছ যে তোদের মতো অকাল কুণ্ড এসে ঝাঁকালেও ঝরঝর করে পড়বে? বাঁদর কোথাকারের।

নিচের কুচকুচে কালো ঠোঁটটা ছাতলা পড়া দাঁতে ঘষে কুণাল সবিনয়ে আপত্তি জানিয়েছে, ওই জীবটার অসম্মান কেন করছেন শিবু কাকা–বরং বাঁদরের কোথাকার বলুন।

শিবুকাকা আবার রেগে উঠতে গিয়ে হেসে ফেলেছিল। (কি বললি? বাঁদরের থেকে ইতর বাঁদরেতর) হাঃ হাঃ হাঃ–ওই জন্যই তো বলছিলাম আদা। জল খেয়ে লেগে যদি যাস তোর হবে। হলে দুটো পয়সারও মুখ দেখতে পাবি বাপ-দাদার হোটেলে খাচ্ছিস বলে দিন-রাত অত লাথি গুতোও খেতে হবে না। তা বলে ছাই ভস্ম যা হোক লিখে আনলেই তো আর আমি ছাপব না–সে রকম কিছু থাকলে তবে কথা। সেটা এমনি হয় না, বাঁদরামি ছেড়ে, মানে বাঁদরেতরামি ছেড়ে অনেক কাঠ-খড় পোড়ালে তবে হয়। কালো লম্বাটে বাঁধানো ডায়েরি বইটা শিবুকাকা তার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে। যা এখন, অনেক সময় ঢেলেছি তোর জন্যে, আর না।

ওটা হাতে করে কুণাল শিবুকাকার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। ঝোলানো গোঁফ আর থুতনির নিচের অল্প দাড়ির গোছায় মুখের হাসি ছড়িয়ে পড়ছে। তারপরেই গর্তের প্রায় গোল চোখ দুটো সচকিত। শিবুকাকার ঘরের পার্টিশনের এ ধারে একজন সাব এডিটর আর দুজন প্রফরিডার মাথা গুঁজে কাজ করছে। তাদের থেকে একটু দূরের চেয়ারে বেশ সুশ্রী একটি মেয়ে বসে আছে। বয়সে কুণালের থেকে বছর দুই তিন বড়ই হতে পারে…বছর পঁচিশ ছাব্বিশের কম নয়। কপাল ফাঁকা, সিঁথিতে সরু একটু নিদূরের দাগ ঝিলিক দিচ্ছে। কুণাল শিবুকাকার পার্টিশন দরজার ওপার থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়ে আসতেই চোখাচোখি। ও ঘরে ছিল বলেই মেয়েটিকে এদিকের এরা বসিয়ে রেখেছে মনে হয়। কুণালের লুব্ধ দুচোখ কয়েক নিমেষের মধ্যে নারীদেহ। ছিঁড়ে খুঁড়ে আবার মুখের ওপর এসে স্থির হল। এই চাউনি পড়ে নিতে বা বুঝে নিতে কোনো মেয়েরই ভুল হয় না বা সময় লাগে না। তখন কত রকম দেখতে হয়। সুন্দর মুখে বিরক্তির আঁচড় পড়ে। ধারালো হয়, ঘোরালো হয়, চোখে আগুনও ছোটে। কুণালের তখন আরও মজা লাগে। মনে হয় ও যেন চোখ থেকেই দুটো হাত বার করে দিয়ে কোনো মোহিনী তনু জাপটে ধরেছে, আর রণ-রঙ্গিনী তাই থেকে বেঁকেচুরে গুমরে দুমড়ে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করছে।

সামনের রমণীমুখ ভালো করে তেতে ওঠার আগেই কুণাল বোস লম্বা পা ফেলে তার দুহাতের মধ্যে এসে দাঁড়ালো। নিজের চেষ্টায় গড়া চেহারার ছাঁদ ছিরি যেমনই হোক, গলার স্বর যে এই মূর্তির সঙ্গে বেখাপ্পা রকমের মিষ্টি আর নরম তা-ও জানে। নিঃসংকোচে পিছনের দরজাটা আঙুল দেখিয়ে বললে, উনি এখন একা আছেন, আপনি যেতে পারেন।

বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় মেয়েটি নড়ে চড়ে ওঠার আগেই কুণাল বোস ঘরের বাইরে। সিঁড়ি পর্যন্ত গিয়ে আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ালো। এখান থেকেও সামনের দরজা দিয়ে সোজা শিবু কাকার পার্টিশন ঘেরা পর্যন্ত চোখ চলে। মেয়েটি ললিত ছন্দে ওই ঘরের দরজা পর্যন্ত পৌঁছেছে। মেয়েদের সামনে থেকে দেখতে বেশি ভালো লাগে কি পিছন থেকে কুণাল বোস ঠিক হদিস পায় না। অনেক সময় খেয়াল করে দেখেছে, যে মেয়েদের সামনে থেকে ভালো লাগে পিছন থেকে তাদের বেশির ভাগই যেন আরো ভালো লাগে। কিন্তু সামনে থেকে দেখতে যাদের হত-কুচ্ছিত লাগে তাদেরও এক একজনকে পিছন থেকে দেখতে অদ্ভুত ভালো। এমন একটা অভিজ্ঞতার কথা হাতের এই ডায়েরিটাতেই লেখা আছে।…আজ এক শ্যামাঙ্গী দীর্ঘাঙ্গীকে দেখলাম বিশ গজ আগে আগে হাঁটছে। দেখার সঙ্গে সঙ্গে সেই সুঠাম রমণীঅঙ্গ ঘিরে আমার গর্তে ঢোকা আদেখলে চোখ দুটো বনবন করে চক্কর খেতে লাগল। পা চালিয়ে ফারাক যত কমিয়ে আনছি, ভিতরের পশুটা ততো থাবা খুলছে। চলার ঠমকে সর্বাঙ্গের জোয়ার ঢেউ খেলে খেলে রেখায় রেখায় তটে তটে পা বেয়ে নেমে আসছে। গা ঘেঁষে তিন পা এগিয়ে গেলাম, ঘুরে তাকালাম। কি কুচ্ছিত কি কুচ্ছিত। কেউ যেন আমার গালে কষে একখানা থাপ্পড় বসিয়ে সব কিছুর ছন্দপতন ঘটিয়ে দিল। তারপর আবার আমি পিছনে। সে সামনে।…দেখে দেখে আমার মনে হচ্ছিল দ্বাপরের মানুষগুলো অনেক অকপট ছিল। যুধিষ্ঠিরকে পর্যন্ত দ্রৌপদীকে কয়েক জায়গায় অয়ি নিতম্বিনী বলে সম্বোধন করতে দেখা গেছে। কিন্তু এ-কালের দ্রৌপদীরা ওই বচন শুনলে সোজা একখানা চড় বসিয়ে দেবে

লেখার সময় সেই বাস্তব অনুভূতিটা এমনি প্রত্যক্ষ সত্য হয়ে উঠেছিল, যে হাতের ডায়েরি না খুলেও মুখস্তর মতো বলে যেতে পারে। দ্বিধান্বিতচরণ মেয়েটিকে শিবুকাকার দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে যেতে দেখা গেল। মনে হয় কোনো লেখা-টেখার তদবির তদারকে আসা। শিবুকাকা ঘরে একা। তার দুর্ভাগ্য কি সৌভাগ্য কে জানে। বোধহয় দুইই। শিবুকাকার বয়স ষাট, সেইজন্য সুবিধে। সুবিধে ক্যাশ করার। বয়েস কিন্তু গতর যখন নেই দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি?

সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায়। দোকানের ঘড়িতে বিকেল প্রায় চারটে। এক দেড় ঘণ্টা সময় খামোখা নষ্ট। একেবারে নষ্টই বা বলে কি করে। হাতের এই গাবদা ডায়েরিটা তো উদ্ধার হল। এটা এ বছরের নয়। তিন বছর আগের। কোনো মেয়ে গুরুকে প্রেজেন্ট করেছিল। গুরু বলতে প্রদীপ ব্যাণ্ডো। ডায়েরিটাতে কালোর চেকনাই ঠিকরে পড়ছিল। তার ওপর জ্বলজ্বল করছিল বড় বড় হরফের সোনালি ছাপ। ভিতরে সিল্কের ফিতে। ডায়েরি রসিকদের পছন্দ হবার কথা। কিন্তু কুণাল তখন পর্যন্ত একটুও ডায়েরি রসিক নয়। ওই কলেজে পড়া মেয়েই বা অমন ডায়েরি কোথায় পাবে! বাপ কাকা দাদা কারো কাছ থেকে হাতড়েছে। তারপর যে মুখ করে গুরুকে ওটা প্রেজেন্ট করেছিল, কুণালের মনে হয়েছিল মেয়েটা তার সর্বস্ব ওই হাতে দিয়ে দিলে, ছটার শোয়ে সিনেমা দেখার প্রোগ্রাম পাকা করে মেয়েটা চলে যেতেই গুরু তাচ্ছিল্য ভরে ডায়েরিটা টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছিল, সুন্দর মুখে বিরক্তির হিজিবিজি দাগ ফেলে বলেছিল, ভাল্লাগে না এ-দেশের মেয়েগুলো সব ভীতুর হদ্দ। অন্ধকারে বসে গা। টেপাটেপি করতে দেবে, সিনেমার পর ভালো রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলে আর আলাদা ক্যাবিনে নিয়ে ঢোকাতে পারলে বড় জোর একটু জাপটে ধরতে দেবে আর দুটো চুমু খেতে দেবে–তার বেশি এগোতে যাও অমনি হৃৎকম্প। আর নিউইয়র্কের মেয়েগুলো? শালা বারো বছর বয়সে ছেলেগুলোকে কাঁচপোকার মত হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায়–নিজেরা যেমন লোটে তেমনি লুঠতেও দেয়।

গুরুর মুখে নিউইয়র্কের গল্প শুনে শুনে কুণালের দুকান হেজে পচে যাবার কথা। কিন্তু উল্টে যেন মজা নদীতে রসের বান ডাকে। আগে তো শুনেই ওর কান গরম হত, সমস্ত শরীর গরম হত। শুনে শুনে গুরুর নিউইয়র্ক কুণালের কাছেও স্বর্গ। উত্তেজনার এমন জায়গা পৃথিবীতে আর কোথাও আছে নাকি? সেখানে উত্তেজনারই অন্য নাম জীবন। সেই জীবনের স্বাদ ভালো করে পাবার আগেই গুরুকে চলে আসতে হয়েছে এই খেদ তার যাবার নয়। গুরুর বাপ ছিল সেখানকার ডাক্তার। সেখানে এক একজন ডাক্তার–মানে কি? আইনের জাল-ছেঁড়া ডাকাত। দুবেলা দুপকেট বোঝাই করে ডলার আনত। সে কি রাজার হালে থাকা। তিন তিনটে গাডি ছিল ওদের। একটা বাবার, একটা মায়ের, আর একটা ওদের তিন ভাইয়ের। বাবার গাড়ি বাবা, মায়ের গাড়ি মা চালাতো। আর ওদের তিন ভাইয়ের গাড়ি সফার চালাতো। সেখানে একজন সফারের মাইনে কি তোর ধারণা আছে? এখানকার মাসের দশ হাজারিরাও সেই মাইনের ড্রাইভার রুখতে হলে ফতুর হয়ে যাবে।

ওর সেই ডাক্তার বাবার আর ভোদা মায়ের কি মতি হল–বাড়ি ঘর বেচে দিয়ে কয়েক আঁক-বোঝাই টাকা নিয়ে দেশে চলে এলো। ঢের সুখ করা গেছে এখন। ছেলেদের জন্যেই নাকি তাদের চাটি-রাটি তুলে চলে আসা। রাগে মুখ লাল করে গুরু বলত, অনেক সুখ তোমরা করলে, আমাদের কি হল? ছেলে মেয়ের সুখের এমন বারোটা যে বাজায় তারা বাবা-মা না শত্রু! এখানে তারা এসে বিরাট বাড়ি হাঁকিয়ে, দাসদাসী বাবুর্চি খানসামা রেখে দিব্যি পায়ের ওপর পা তুলে দিন কাটাচ্ছে। বাবার প্র্যাকটিসও এখানে নামেই, বিকেলে দুঘণ্টার জন্য চেম্বারে যায়–সন্ধ্যায় মায়ের সঙ্গে হুইস্কি গেলে। আমাদের জন্য আসা, আমরাই বা কি দিগগজ হলাম। আমাকে তো অন্তত বি, এ-টাও পাশ করাতে পারলে না। ভাই দুটো যা-হোক মেজে-ঘষে গ্র্যাজুয়েট হয়েছে।

গুরু মানে প্রদীপ ব্যাণ্ডোর বয়স এখন সাতাশ। কুণালের থেকে চার বছরের বড়। নিউইয়র্ক ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছিল তেরো বছর বয়েসে। কুণালের পনের বছর বয়েস থেকে সে এই গুরুর চেলা। এদিক থেকে গুরু উদার বলতে হবে। সে বয়েস দেখে না, বশ্যতা দেখে। হুকুম তামিল করার কেরামতি দেখে। সেই পনের বছর বয়েস থেকে এ এলাকার এমন কি পাড়ার কত মেয়ের কাছে গুরুর চিঠি চালান করেছে, জবাব নিয়ে এসেছে-সন্ধ্যার পর লেকে দূরে দাঁড়িয়ে তাদের পাহারা দিয়েছে, ঠিক আছে? আদর করে কুণাল মাঝে মাঝে শালা গুরু তুমি বলে কথা ঝাড়ে তাতেও গুরু হাসে। আনন্দে পিঠ চাপড়ায়। গুরুর নিজস্ব একটা ছোট্ট গাড়ি ছিল আরো ছবছর আগে পর্যন্ত। গুরুই চালাতো। তার পাশে কোনো না কোনো চটকদার মেয়ে থাকতই। আর পিছনে থাকত কুণাল। শুধু কি বাঙালী মেয়ে? বড় বড় রেস্তেরাঁ বা তার পাশের রাস্তা থেকে অবাঙালী মেয়ে গাড়িতে তোলার ব্যাপারেও গুরু কি কম ওস্তাদ ছিল! চোখাচোখি হলেই বুঝতে পারত কে উঠবে আর কে উঠবে না।

ওই রকম মেয়ের পাল্লায় পড়ে আর নেশার রসদ জোগানোর তাগিদে গাড়িটা জলের দরে বেচে দিয়েছিল। গুরুর নেশা তো আর মদ বা বিড়ি সিগারেট নয়। সে তখন থেকেই হাসিস আর মারিজুয়ানার খদ্দের। বাবা আবার একটা গাড়ি কিনে দেবে ধরেই নিয়েছিল। কিন্তু আজও দিল না। গুরু এ জন্যে যে ভাষায় নিজের বাবা-মাকে গালাগালি করে শুনে কুণাল মুগ্ধ।

গুরুর সব থেকে বড় পাসপোর্ট তার চেহারা। এখনো। কোনো ছেলে যদি মাখনের দলা হয় অনেক ডাঁশা মেয়ে তাকে পাত্তা দেয় না। কিন্তু সেই মাখনের দলা যদি স্মার্ট হয়, একসঙ্গে চোখ আর ঠোঁটে হাসতে জানে, তার কথার থেকে কাজের হাত যদি বেশি এগোয়–তাহলে কিস্তি মাত। গুরুর এই সাতাশ বছর বয়সে এমন কিস্তি মাত কম দেখল না কুণাল বোস। ভালো ঘরের কলেজে পড়া একে একে দুদুটো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেখল আর ডিভোর্স দেখল। কোর্টে এ পর্যন্ত তিন তিনটে মেয়ে ফুসলে নিয়ে পালানোর কেস দেখল, কি সেনসেশন, কি উত্তেজনা কুণালেরই তখন। যে উত্তেজনার নাম জীবন, গুরু হাতে-নাতে ওকে তাই দেখিয়েছে। পাড়ার কোনো। মেয়ে এখন- গুরুর দিকে তাকালে পর্যন্ত বাপ-মা মেয়েকে শাসন করে। কিন্তু তবু গুরুকে ঠেকায় কে? তার লীলা কি শুধু এই পাড়াটুকুর মধ্যে?

গুরুর মধ্যে অভিজ্ঞতার বীজ বোনা হয়েছে কি আজকে? বীজ বোনা হয়েছে। সেই তের বছর বয়সে–নিউ ইয়র্কে। একটু ভালো করে বোঝার আগে বাবা মা যে তাকে কি আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেছে, মনে হলে তাদের খুন করতে সাধ যায়। ছেলের। এই কলকাতা শহরে কত লোক অসময়ে পটাপট মরছে–আর তার বাবা মা যেন একটা বেঁচে থাকার খুঁটি ধরে বসে আছে। সম্ভব হলে, নিউইয়র্ক ছেড়ে চলে আসার জন্যেই বাবা মাকে সে চরম শাস্তি দিত। আর, সেখানকার মেয়েগুলো কি মেয়ে? জলজ্যান্ত আপেল এক একখানা। ফাঁক পেলে পনের ষোল সতের বছরের সেই মেয়েগুলো ওকে বুকে জাপটে তুলে নিয়ে পালানোর জায়গা খুঁজত। চুমু খেয়ে খেয়ে গালে ঠোঁটে জ্বালা ধরিয়ে দিত–ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে গিয়ে। ওকে বুকের ওপরে চেপে ধরে শুয়ে থাকত-আরো কত কাণ্ডমাণ্ড করত শুনলে তোর নোলা দিয়ে জল গড়াবে।

জল যেটুকু শুনতো তাতেই গড়াতে কুণালের।

 হ্যাঁ….এই ডায়েরিটার কথা। তিন বছর আগে টেবিলের ওপর গুরু ওটা ছুঁড়ে দিতেই বুকের ভিতরটা চড়চড় করে উঠেছিল কুণালের। ওর ততক্ষণে কেমন যেন বদ্ধ ধারণা, দেবার আগে ওই কালো ডায়েরির চকচকে বোর্ডে অন্তত গণ্ডা আষ্টেক চুমু খেয়েছে মেয়েটা। সেই তাপ ওতে এখনো লেগে আছে। তখুনি বলে বসেছিল, গুরু এই ডায়েরিটা আমাকে দেবে?

-ওটা দিয়ে তুই কি করবি?

কি বললে গুরু খুশি হবে আর উদার হবে কুণালের ততদিনে ভালোই জানা। জবাব দিয়েছিল, মাঝে মাঝে বুকের ওপর রাখব আর চুমু খাব। আমি আর এর থেকে বেশি কি পাব বলো।

শুনে গুরু হেসে সারা। হাসি আর থামতেই চায় না। শেষে বলেছে, আমার শিষ্য হয়ে তোর এ-রকম আনপ্র্যাকটিক্যাল সেলফ-স্যাটিসফ্যাকশন–আঁ? আরে কল্পনার ভোগ তো কবিদের জন্য আর স্পাইনলেস ছেলেদের জন্য! আমার শিষ্য হবে মোস্ট রেকলেস প্র্যাকটিক্যাল–সাধ গেলে হাতে হাতে আদায়। এই যে ডায়েরি দিয়ে গেল এর ওপরে আমি বিরক্ত কেন? সাধ আছে, সাহস নেই। আরে বাপু রেখে। ঢেকে সব দিক বজায় রেখে কতটুকু পাবে–ভিতরে বান যখন ডেকেছে সব দিক তছনছ করে দিয়ে ছোটো না, তবে তো থ্রিল–তবে তো একসাইটমেন্ট তবে তো লাইফ। ডায়েরিটা তারপর ওর দিকে ঠেলে দিয়েছিল, যা নিয়ে যা, দুধের সাধ ঘোলে মেটা।

তার পরেই মাথায় একটা উদার প্ল্যান এসে গেছল। তোকেও ছিটেফোঁটা প্র্যাকটিক্যাল আনন্দ দেবার ব্যবস্থা করছি। তোর জন্যে একটা টিকিট কেটে রাখব .আর মেয়েটাকে যা বলার বলে রাখব। ছটায় শো, তুই ঠিক সময়ে মেট্রোয় থাকিস।

তিন বছর আগে এই ডায়েরি হাতে করে বাতাস সাঁতরে নিজের ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করে ছিল। ব্যাণ্ডোদা যতই মুখ বাঁকাক আর ছেলেমানুষ ভাবুক ওকে, এটুকুতেই যে এত থ্রিল এত উত্তেজনা এ কি ভেবেছিল! বয়েস তো সবে তখন। কুড়ি। বি, এ ফেল করে আর পড়া ছেড়ে সবে গুরুর যোগ্য শিষ্য হয়েছে। তার আগে যেটুকু উত্তেজনার দিন গেছে তার বেশির ভাগ কাল্পনিক। গুরুর চেলাগরি করে। আর তার ভোগ কল্পনা করে যেটুকু আনন্দ। কিন্তু এই ডায়েরিটা বা ডায়েরিতে মেয়েটার স্পর্শ তো আর কল্পনা নয়। ফেরার আগে ওই মেয়ে যে ডায়েরির মলাটে গণ্ডাকতক চুমু খেয়ে নিয়েছে তা-ও কল্পনা বলে স্বীকার করতে রাজি নয় কুণাল। ঘরে এসে ওই ডায়েরির মলাটে গাদা গাদা চুমু খেয়ে বার বার ওটা বুকে চেপে ধরে বেশ একটু নতুন থ্রিল আর উত্তেজনা উপভোগ করেছে। কিন্তু সিনেমা হলে আরো থ্রিল ওর জন্যে অপেক্ষা করছে সেটা ভাবতে গিয়েই শিরায় শিরায় রক্ত গরম। ওর জন্যেও ব্যাণ্ডোদা টিকিট তো কেটে রাখবে, কিন্তু মেয়েটাকে আবার কি বলে রাখবে? মেয়ের পাশে বসে ছবি যে দেখেনি এমন নয়। আর তখন খুব সংগোপনে আর অন্যমনস্কর মতো এক একবার হাত ঠেকিয়েছে, হাঁটুতে হাঁটু লাগিয়েছে–তক্ষুণি আবার অপ্রস্তুত ভদ্রলোকের মতো গুটিয়ে বসেছে। একবার তো চিত্তির। বার কয়েক ও রকম করার পর হাফটাইমের আলো জ্বলতে দেখে মায়ের বয়সী একজন।

বিকেলে আধঘণ্টা আগেই মেট্রোর সামনে অপেক্ষা করছিল, আর সব থেকে শস্তার সব চেয়ে কড়া সিগারেট টেনে সময় পার করছিল। ঠিক সময় ধরেই ব্যাণ্ডেদা আর সেই মেয়ে হাত ধরাধরি করে হাজির। ও সামনে আসতে ব্যাণ্ডোদা (কুণাল অনেক সময় গুরু ছেড়ে ব্যাণ্ডোদা বলে কারণ এই ডাকের মধ্যে একটা নতুনের চমক আছে। –অন্তত তখন ছিল) পরিচয় করিয়ে দিল। বলল, এই আমার সেই কচি-কাঁচা লাজুক শিষ্য কুণাল বোস–তুমি আসছ তাই লাজুক তো আসতেই চায় না! সঙ্গে সঙ্গে এক চোখ একটু ছোট করে মেয়েটাকে গুরু একটু ইশারাও করল। ভব্যতার খাতিরে সেই মেয়ে কুণালের দিকে ফিরে একটু মাথা নাড়ল, আর ঠোঁটের কোণে হাসল, আর চোখের কোণে ভালো করে দেখে নিল। গুরুর কি কারসাজি ঠাওর করতে না পারার ফলে কুণাল মুখে একটু লাজুক-লাজুক ভাব টানাই বুদ্ধিমানের কাজ ভাবল।

কিন্তু বুকের ভিতরটা সত্যিই তখন একটা বাস্তব থ্রিলের তৃষ্ণায় ধকধক করছিল। এই মেয়ের উঁচু বুক আর টসটসে ঠোঁট দুটো শুকনো ডায়রি নয়–তার থেকে দের ঢের নরম-গরম বাস্তব।

একেবারে সারির শেষের তিনটে সীটে তারা তিনজন। প্রথমে গুরু মাঝে মেয়েটা শেষে কুণাল। কুণালের পরে সেই রো-তে আর সিট নেই। আলো নিভল। ছবি শুরু হল। মেয়ে পুরুষের মাখামাখি লপটা-লপটির হিন্দী ছবি। শুরু থেকে ঢলাঢলি। কিন্তু ছবি দেখবে কি, খানিক বাদেই কুণালের সর্বাঙ্গে কাটা। মেয়েটার হাঁটু আর হাঁটুর ওপরের খানিকটা কুণালের একদিকের সঙ্গে ক্রমে সেঁটে যেতে লাগল। আর কাঁধের ওপরের দিকটা ওর কাঁধের সঙ্গে একটা চাপাচাপির খেলা শুরু করে দিল। মাঝে মাঝে অন্ধকারেই আবার ঘুরে তাকায়। কুণালের গালে গরম নিঃশ্বাসের ছেকা লাগে।

হাফটাইমের আলো জ্বলতেই মেয়ে আবার শান্তশিষ্ট। মাঝে ভব্যরকমের ফারাক। এক একবার গুরুর কানে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলছে কিছু আর কুঁই কুঁই করে হাসছে। গুরুর তাকানো দেখে মনে হয় মজাটা ওকে অর্থাৎ কুণালকে নিয়েই। রোগাপটকা কুণালের ভিতরে যে তখন মদমত্ত দামাল হাতি দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে। সে যদি ওই মেয়ে জানত।

আবার ছবি শুরু হতে একই কাণ্ড শুরু হল। কুণালের শরীরের কণায় কণায় এবারে ডবল সাড়া দেবার ইচ্ছে। কিন্তু ও বুঝে নিয়েছে তাহলে মজা মাটি-ওকে লাজুক ছেলের ভূমিকা নিতে হবে। খানিক এ-রকম চলার পর মেয়েটার একটা আলতো হাত ওর হাতের ওপর এসে পড়ল। পড়ার পর পড়েই থাকল। তারপর উঠল যখন। কুণালের হাতখানা সুদ্ধ নিয়ে উঠল। ওর হাতটা গরম হাতে ধরে চেয়ারের হাতলের তলা দিয়ে টেনে নিজের কোলের ওপর ফেলল। তারপরে ওই হাত কোলের ওপর রেখে আর গরম হাতের আঙুলে আঙুলে খেলা চলল।

ছবি শেষ হবার পর বাইরে বেরিয়ে ঠোঁটের কোণে তেমনি হেসে আর চোখের কোণে তেমনি করে চেয়ে মেয়েটা জিজ্ঞাসা করেছিল, ছবি কেমন লাগল কুণাল বাবু?

নিরীহ লাজুক মুখ করে কুণাল জবাব দিয়েছে, ছবি আর দেখতে দিলেন কই।

চারুমুখির দুচোখ কপালে। আমি আবার কি করলাম।

গুরু হেসে উঠেছিল। বলেছিল, সম্পর্কটা যখন বউদি হতে চলেছে মওকা পেয়ে তুমিও একটু বাড়লে খুব অন্যায় হত না হাঁদা কোথাকারের।

ওকে বিদায় দিয়ে তারা পার্ক স্ট্রীটের দিকে চলে গেছল। আর কুণাল সর্বাঙ্গে জ্বলুনি নিয়ে ঘরে ফিরেছে। পরে গুরুর মুখে শুনেছে, মেয়েটাকে বলে রেখেছিল, শিষ্য–তার দারুণ লাজুক আর দারুণ ভালো ছেলে, সিনেমা হলে বসে ওর যদি ঘাম ছুটিয়ে দিতে না পারো তাহলে মজাই মাটি।

হেসে হেসে গুরু জিজ্ঞেস করেছিল, তা তোর ওটুকু বাস্তব অভিজ্ঞতা কেমন। লাগল বল।

কুণাল গলা শুকিয়ে জবাব দিয়েছে, তুমি শালা এক নম্বরের শত্রু গুরু বুকের মধ্যে এখন সাহারা জ্বলছে–ফের পেলে ওই ভাবী বউদিকে আমি না খুন করে বসে। থাকি।

ওই ভাবী বউদিটিই ছমাস বাদে গুরুর বিরুদ্ধে কোর্টে কেস ঠুকে দিয়েছিল। গুরু নাকি তাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার সঙ্গে মেলামেশা করত। শেষে। একদিন তার সর্বনাশ করে সরে পড়েছে। মেডিক্যাল চেকআপে পর্যন্ত সর্বনাশ প্রমাণ হয়েছিল। কিন্তু সর্বনাশটা শেষ পর্যন্ত কার মারফৎ হয়েছে সেটা প্রমাণ হয়নি। কারণ জেরায় জেরায় সাবালিকা মেয়ের অনেক গলদ বেরিয়ে পড়েছে।

যাক, এই সুন্দর ডায়েরিটার পাতা একটা দুটো করে ভরাটি হতে শুরু করেছে। আরো সাত আট মাস পর থেকে। হঠাৎই খেয়ালের বশে ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল। তারপর শুরুর তারিফ পেয়ে উৎসাহ বেড়েছিল। ব্যাপার আর কিছু না, ভিতরে কোনো বাসনা যখন দুর্বার হয়ে ওঠে, কোনো ঘটনায় স্নায়ুগুলো যখন উথাল পাথাল করতে থাকে–তখন ডায়েরির পাতায় সে-সব লেখা। লিখে ফেলে তার ওপরে কিছু মন্তব্য করা।

 যেমন প্রথমেই লিখেছিল, এই ডায়েরি যার কাছ থেকে পাওয়া সেই ভাবী বউদির। মতো একটি মেয়েকে সমস্ত নিষেধের গণ্ডী থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারলে কুণাল বোস কি করে? ওই ভাবী বউদির মতো স্বভাব চরিত্রের মেয়ে নয়, শুধু তার মতো অমন টসটসে দেখতে–কিন্তু তার ভেতরখানা তখন পর্যন্ত কোন সভ্যভব্য সুপুরুষকে নিয়ে কল্পনার জাল বুনছে। অবাধ্যতার জন্য তার ওপর প্রথমে কি ভাবে নির্মম আঘাত করে তাকে বোবা বানিয়ে দিত আগে তাই লিখেছে। কিন্তু বোবা বাধ্য মেয়ে কোন ছেলে চায়? সেই আক্রোশে তাকে কতভাবে নরকের তলায় টেনে নিয়ে চলেছে তার হুবহু বর্ণনা। কিন্তু মেয়েটা যখন শেষে আর বোঝে না, তাকেই যখন নরকের দোসরে। মেনে নিয়েছে, আত্মহুতি সম্পূর্ণ ভাবছে, তখন আবার কুণাল বোস নতুন চমক সৃষ্টিতে মেতে উঠেছে। যে সুন্দরের স্বপ্ন দেখত মেয়েটা, যে স্বপ্নের জাল বুনত, নরক ছেড়ে তাকে নিয়ে সেই দিকে এগিয়েছে। সেই সুন্দরের দরজা তারই বুকের তলায়–একটু একটু করে এবারে সেই দরজা খুলে দিয়েছে। তার সেই স্বপ্নের জালে এসে নিজেই ধরা দিয়েছে। মেয়েটা হতভম্ব হয়ে দেখছে, যার একদিক এমন কুৎসিত নরক, তারই আর একদিক কি অনির্বচনীয় সুন্দর! লেখার শেষে মন্তব্য, আমি কুৎসিত আমিই, সুন্দর আমার একটাকে যে নেবে সে আধখানা নেবে। আমার শালা একটাতে ক্লান্তি ধরে যায় বলে আমি ভোগে কখনো সুন্দর কখনো কুৎসিত।

ভাবী বউদির মতো সুন্দর চেহারার মেয়ের ওপর কুণাল বোসের পুরুষের নির্মম অত্যাচার আর তাকে নিয়ে নরকে তলিয়ে যাবার প্রত্যক্ষ বর্ণনা পর্যন্ত গুরুর দারুণ ভালো লেগেছিল। বারবার বাহবা দিয়েছিল। কিন্তু তাকে নিয়ে আবার সুন্দরের অভিসারে যাত্রা-পর্ব শুনে নাক সিটকেছিল।-ও আবার কি, ক্লাইম্যাক্স থেকে অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স–কেটে দে কেটে দেযত সব সিলি ডে-ড্রিমিং!

খবরের কাগজ খুললেই রোজ কটা করে ধর্ষণের খবর। কুণাল বোস সে-সব। খুঁটিয়ে পড়ে। যে খবর যত নির্মম তার প্রতি ততো আগ্রহ। তার ভিতরে ততো উত্তেজনা। চোখের সামনে সমস্ত ব্যাপারটা কল্পনা করে ভারী আনন্দ পায়। ডায়েরিতে অকপটে সে-সব স্বীকার-উক্তি আছে। সঙ্গে মন্তব্যও–শালার খবরের কাগজগুলো ঘটা করে প্রথম পাতায় এসব খবরগুলো ছাপে কেন? পড়ে সুড়সুড়ি লাগে বলেই তো। আরো মন্তব্য, মেয়ের মতো মেয়ে হলে এ ব্যাপারটা অপছন্দ করার কথা নয়–আসলে ভয় আর লোকলজ্জা। শালার কুকুর বেড়াল গোরু ছাগলও এ-ব্যাপারে মানুষের থেকে ঢের বেশি অকপট আর সৎ।

এটা পড়েও প্রদীপ ব্যাণ্ডো খুব পিঠ চাপড়েছিল।

…রোমাঞ্চকর ডাকাতির খবর পড়তেও তেমনি ভালো লাগে কুণাল বোসের। ঘটনা যতো বড় দরের হয় উত্তেজনাও ততো বাড়ে। এ-সবেরও স্বাদ তাকে পেতে শিখিয়েছে তার গুরু প্রদীপ ব্যাণ্ডো। পয়সা খরচ করে সেক্স আর ক্রাইমের গায়ে কাটা দেওয়া বই কিনে আগে নিজে পড়ে, পরে ওকে পড়ায়। বলে, এই তো লাইফ, থ্রিল আর একসাইটমেন্ট যেখানে নেই সে আবার লাইফ। এই সেক্স আর এই ক্রাইমের ব্যাপার কলকাতায়ও এখন কম ঘটছে না। ডায়েরিতে নিজের ভাবনা লেখা শুরু করার পরে মস্ত একটা ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয়েছিল। কালো অ্যামবাসাডারে চেপে ছজন লোক এসেছিল। সতের মিনিটের আগেই সতের লক্ষ টাকা হাতিয়ে সরে পড়েছিল তারা। এই অপারেশন সারতে গিয়ে মাত্র দুজন লোক খুন হয়েছিল আর জন পাঁচেক জখম। ডাকাতদের কেউ ধরা পড়েনি।

ঘটনাটা কুণাল বোসের কাছে এত সেনশেসনাল মনে হয়েছিল যে তিনবার করে আদ্যোপান্ত খুঁটিয়ে পড়েছে খবরটা। যত ভেবেছে ততো উত্তেজনা বেড়েছে। শেষে ডায়েরি নিয়ে বসেছে।

–মনে মনে আমিও একটা ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে উঠলাম। সঙ্গে সেই ছজনই লোক। আমি তাদের লিডার। সমস্ত প্ল্যান আমার। অপারেশন ফরমূলা আমার। প্রথমে ভেবেছিলাম পাঁচজনকে খুন করলে আর বারো চোদ্দ জনকে জখম করলেই কাজ হাসিল হবে। তাদের রক্তাক্ত মৃতদেহগুলো আমি আগেই চোখের সামনে দেখলাম। দেখলাম এই দেখাটা মন্দ উত্তেজনার ব্যাপার নয়। কিন্তু শেষে আর ওই প্ল্যান ভালো লাগল না। কারণ লোক মারা আর জখম করার উত্তেজনাটা পুরনো ব্যাপার। তার থেকে ঢের বেশি উত্তেজনার ব্যাপার কারো গায়ে একটা আঁচড় না বসিয়ে কাজ সারাটা। কাগজে এমন ডাকাতি নিয়ে দারুণ হৈ-চৈ হবে–পড়তে পড়তে সকলের বুকের তলায়। একটা ঠাণ্ডা স্রোত বইবে। হ্যাঁ, সেই প্ল্যানেই অপারেশন পাকা করলাম। এক-একজনের রিভলভারের মুখে তিনজন করে লোক পুতুল হয়ে থাকল। স্ট্রং রুমের চাবি আমার হাতে। চোদ্দ মিনিট লাগল টাকার বস্তা পিছনের গাড়ির ক্যারিয়ারে ঢোকাতে। পালাবার সময় ছটা রিভলবার থেকে মাত্র আঠারটা ফাঁকা আওয়াজের দরকার হয়েছিল।

-কিন্তু কত টাকার ডাকাতি সেটা ঠিক করতেই সময় লেগেছে একটু। প্রথমে ওই সতের লক্ষ টাকার অঙ্কটাই মাথায় ছিল। কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখলাম সতের লক্ষ টাকা আর কত টাকা? ভোগের শেষ দেখতে হলে এ টাকায় আর কদিন চলবে! ডাকাতি তো আমি মাত্র একটাই করেছি বা করলাম। টাকার অঙ্কটা বাড়াতে বাড়াতে সতের লাখ থেকে সত্তর লাখে তুললাম। কিন্তু ওতেও ভোগের শেষ হয় না। ডাকাতি করে সে টাকা তো আর আমি ব্যাঙ্কে রাখতে যাচ্ছি না যে সুদের টাকায় পায়ের ওপর পা তুলে জীবন কাটিয়ে দেব? শেষে সতের কোটিতে এসে থামলাম। কোনো ব্যাঙ্কে সতের কোটি টাকা নগদ থাকে কিনা আমি জানি না। কিন্তু আমার ডাকাতি আমারই। থাকতে হবে। আমি কাগজ কলম নিয়ে হিসেব করে দেখেছি। মাসে দুলক্ষ করে খরচ করলে (দুলক্ষ কাকে বলে তা-ও আমি জানি না, কিন্তু আমার মনে হল ওতে ভোগের সমস্ত রাস্তা খুলে দেওয়া যেতে পারে।) এক কোটিতে পঞ্চাশ মাস যাব। তাহলে সতের কোটিতে আটশ পঞ্চাশ মাস অর্থাৎ সতের বছর দশ মাস চলবে। এখন আমার বয়েস একুশ (তখন একুশই ছিল), তাহলে তখন বয়েস দাঁড়াবে একানব্বই বছর দশ মাস। তার বেশি ভাবার আর কোনো মানে হয় না। ও…আপনারা ভাবছেন আমার কাঁচা হিসেব-সঙ্গী ছয় জনের ভাগ কী হবে? আসল থ্রিল তো সেইখানে। আমার অপারেশনে লোক মারা নেই, মানে ব্যাঙ্কের নিরীহ লোকগুলোকে মারা নেই। তা বলে শত্রু মারব না এমন হলপ কে করেছে? ডাকাতির রাতে খেয়ে দেয়ে ফুর্তি করে ঘুমিয়ে আমার সঙ্গীরা কি আর দিনের মুখ দেখেছে? কাজটা কত সহজ। মদ খেয়ে সকলের তখন টইটম্বুর অবস্থা। সেই অবস্থায় আমি নিজের হাতে প্রত্যেকের ড্রিংক সাজিয়ে হাঁক দিলাম, লাস্ট ড্রিংক ফর দি বেড়। হ্যাঁ, ডাকাতির পর কুচকুচে কালো অ্যাম্বাসাডারের বদলে ধপধপে সাদা অ্যামবাসাডার চেপে আমরা দেড়শ মাইল দুরের এক হোটেলে উঠেছিলাম। একসঙ্গে নয়। আলাদা আলাদা। একে একে। কেউ কাউকে চিনি না। একেবারে শেষে সাদা অ্যামবাসাডার হাঁকিয়ে এসেছি একলা আমি। তখন রাত। অন্য ছজন যে যার ঘরে। আমার গাড়ির পিছনের ক্যারিয়ারে সতের কোটি টাকা কে আর জানছে। (ক্যারিয়ারে সতের কোটি টাকা আবার ধরে তো?) যাক সঙ্গীরাও জানে না, আমি শুধু রাতটুকুর জন্যেই আগাম টাকা দিয়ে ঘর বুক করেছি–ভোর রাতে উঠে গাড়ি নিয়ে চলে যাবার কথাও বুকিং ক্লার্ককে বলে রেখেছি। যাক, মনের আনন্দে আমার ঘরের রাতের আসর শেষে আমার অর্থাৎ লিডারের হাত থেকে সঙ্গীরা লাস্ট ড্রিংক ফর দি বেড় নিল। প্রত্যেকের গেলাসে (নিজের বাদে) সেই লাস্ট ড্রিংকে আমি কখন কি মিশিয়েছি সজাগ সচেতন থাকলেও তারা টের পেত না। তখন তো নেশায় বুদ। কি মিশিয়েছি সেটা অবশ্য আমি নিজেও এই লেখার সময় পর্যন্ত জানি না। এমন কিছু যা মদের গেলাস শেষ হবার পরেও ওরা যে যার। ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়া পর্যন্ত কোনো কাজ করবে না। তারপরই ওই ড্রিংক লাস্ট ড্রিংকই হবে। আর উঠবে না। আর এই না ওঠাটা যখন জানাজানি হবে তখন আমি কোথায় আর আমাকে সন্দেহই বা করে কে?

-তারপর আমার ভাগের পালা শুরু। যত রকমের ভোগ এই পৃথিবীতে আছে। সব আমার হাতের মুঠোয়। সদয় ভোগ, নির্দয় ভোগ, হিংস্র ভোগ, অহিংস ভোগ, সচেতন ভোগ, অচেতন ভোগ। আমি এই পৃথিবীর একমাত্র ভোগরাজ।

শেষে মন্তব্য, শালা ভোগের কিছু জানো না বলেই এক কথায় নিজেকে ভোগরাজ বানিয়ে শেষ করলে। অমন ভোগে হাবুডুবু খেতেই যদি পারো–তখন মনের ঘরে মাসে দুলাখের বদলে দুশ টাকা খরচের জীবন ঢের বেশি স্বাদের মনে হবে হয়তো কিন্তু সেটা ওই ভোগের আগে নয়।

এই শেষের মন্তব্যটা শুধু গুরুর পছন্দ হয়নি। নইলে বাকিটা বেশ লেগেছিল। যাক ডায়েরির আগাগোড়া কুণাল বোসের ভিতরের মনটা এখনি ছড়ানো ছিটানো। শিবুকাকা তার লেখা একটুও ভালো বলেনি, কিন্তু মন্তব্যগুলোর মধ্যে আর সব জিনিস খুঁটিয়ে দেখার মধ্যে কিছু সম্ভাবনা দেখেছে। তবে একটা লেখার প্রশংসাই করেছে। গুরুর মতে যেটা কোনো লেখাই নয়।

লেখাটার নাম ওড অন্ এ বারমুডা লিলি।

পরীক্ষায় ফেল করুক আর যাই করুক চেঁচিয়ে পাঠ্য বইয়ের ইংরেজি বাংলা কবিতা পড়ত, ইংরেজিতে নম্বর পেত একশর মধ্যে বড় জোর তিরিশ। কিন্তু কীটসএর ওড়-অন এ গ্রীসিয়ান আরন তা বলে কম বার চেঁচিয়ে পড়েনি। কুণাল বোসের কল্পনায় এর বিষয়বস্তুও অনেকটা এক রকম। তবে কুণাল বোসের ভাব আলাদা।

..বারমুডা লিলি হল একটা ফুলের নাম। যা কুণাল কখনো চর্ম-চোখে দেখেনি। ঘরের রঙিন ক্যালেণ্ডারে দেখেছে। ক্যালেণ্ডারে লম্বা তকতকে একটা সবুজ ভঁটার ওপরে ফুটে আছে বারমুডা লিলি। তার লম্বা লম্বা সাদা মসৃণ অদ্ভূত নরম ছটি পাপড়ি। ভিতরে রঙ-বেরঙের ছটি কেশর। বিলিতি ক্যালেণ্ডারের আর্ট পেপারে ছাপা ভারী সুন্দর একটা জীবন্ত ফুল দেখলে মনে হবে ওটা শুচিতার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু ওই সবুজ ডাটা বেয়ে উঠছে রঙিন একটা বীভৎস পোকা। পোকার লুব্ধ দুটো চোখ ভঁটার মাথার ওই ফুলটার দিকে। ওই পর্যন্ত উঠে ফুলটা কুরে কুরে খেতে পারলে তার জন্ম সার্থক, জীবন। সার্থক। ক্যালেণ্ডারের ওই ছবিটার দিকে তাকালেই অদ্ভুত একটা শিহরণ হত কুণালের। ছবিটার দিকে চেয়ে থাকত আর কল্পনায় দেখত ওই রঙিন বীভৎস পোকাটা স্থির অব্যর্থ। গতিতে ওই ফুলটার কাছে পৌঁছাচ্ছে কিন্তু ফুল জানেও না কি শোচনীয় তার পরিণতি। কল্পনাটা যত ঘন হত ততো যেন গায়ে কাঁটা দিতে কুণালের, একটা অস্বাভাবিক রোমাঞ্চ অনুভব করত। সেটা দুঃখের কি বীভৎস আনন্দের ঠিক করে উঠতে পারত না। যদিও জানা কথাই ছবির ওই লোভী পোকা কোনদিনই ফুল পর্যন্ত পৌঁছুতে পারবে না।

ওই ছবিটা দেখে দেখে মাথায় হঠাৎ একদিন একটা অদ্ভুত খেয়াল চাপল কুণালের। ডায়েরির পাতার মাপের এক টুকরো আর্ট পেপার কেটে নিয়ে ওই ক্যালেণ্ডার আর কাগজ, তার এক আর্টিস্ট বন্ধুর কাছে দিয়ে এলো। ক্যালেণ্ডারের ওই রঙিন ছবি আর্ট পেপারে হুবহু তুলে দিতে হবে। ক্যালেণ্ডারের ওই রং ফুল পোকা সব একরকম হওয়া চাই। ঠিক ঠিক হলে একটা ছোট বোতল তাকে প্রেজেন্ট করবে। বোতলের লোভে না হোক তাগিদের চোটে আর্টিস্ট বন্ধু তাই করে দিল। রং ফুল পোকা এক রকমই হয়েছে। সেই আঁকা আর্ট পেপারটা এনে কুণাল ডায়েরির বাঁ দিকের পাতায় সাঁটল। তারপর ডান দিকে ওড় অন এ বারমুডা লিলি লিখল।

বারমুডা লিলি, আসলে তুমি এক অনন্তযৌবনা অক্ষতসুন্দর নিষ্পাপ মেয়ে। তুমি নিশ্চিন্তে রূপের ডালি ছড়িয়ে বসে আছ। জানোও না কে তোমাকে গুটিগুটি খেতে আসছে–শেষ করতে আসছে। ও এসে পৌঁছুলে তুমি কি করবে–কেমন। চমকাবে? আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে। ভয়ের ছায়া তো আগে চলে। কিন্তু সুন্দরী, তোমার মনে কি ভয়ের ছায়াও পড়ে না? এ যৌবন ছড়িয়ে অমন নিশ্চিন্তে আনন্দে বসে আছ কি করে?…নাকি তুমি জানো, ওই নির্মম যম কোনদিন তোমার কাছে। পৌঁছুতে পারবে না–ওর লুব্ধ চোখ আর জ্বলন্ত ক্ষুধা নিয়ে ও যেমন আছে চিরকাল সেই রকমই থেকে যাবে?…তাই ঠিক বোধহয়। বাসনার চূড়ান্ত স্বপ্নের নাগাল আমরা কে কবে পেয়েছি? যার পরে আর কিছু নেই এমন ভোগবতীর কাছে কে কবে পৌঁছুতে পেরেছি? হয়তো তার হদিশ পেয়েছি, ওই ভীষণ রঙিন পোকাটার মতো লুব্ধ চোখে তাকে দেখেছি, লোভে হাত চেটেছি, গুটিগুটি সেদিকে এগোতে চেয়েছি। কিন্তু ওই বাসনার ডালি মরীচিৎকার মতো যেমন দূরে তেমনি দূরে। অনন্তযৌবনা বাসনার বারমুডা লিলি লোভের ডগার শেষ মাথায় চিরকালই ওমনি অক্ষতসুন্দর।

..আর ডায়েরির শেষ লেখাটার পরের মন্তব্য পড়ে শিবুকাকা একটু ঘুরিয়ে প্রশংসা করেছিল। বলেছিল, ঠিকই তো বুঝেছিস দেখি, তোকে গাধার মতো গোরু কে বলে? জেনে শুনে উল্লুক হয়ে বসে থাকলে কে তোকে ঠেলে তুলবে? শিবুকাকা নাকি প্রাচীন ইতিহাস আর সংস্কৃতির স্কলার ছিল। নিজের কাগজে নিজে লেখেও ওই ছাইভস্ম নিয়েই। কিন্তু তার জিভ যখন নড়ে তখন মনে হয় সে প্রাণিবিদ্যাবিশারদ ছিল। যাক, ওই শেষে কুণাল বোস লিখেছিল তার পরের মন্তব্য পড়লে গুরু নিশ্চয় তেড়ে মারতে আসত।

–আমরা জীবন খুঁজছি। জীবনের অর্থ খুঁজছি। গুরু খুঁজছে। সঙ্গে আমিও। ভোগের তলকূল দেখতে না পেলে জীবনের কি অর্থ? ল, এথিকস, ডিসেন্সি–এসব। অসার কথার লাগাম ছিঁড়তে যদি না পারো তো ভেড়া হয়ে থাকো। ও-সব আবেগ। টাবেগের আমরা ধার ধারি না। আমাদের জীবন মানে সেনসুয়াল প্লেজার। এক ভোগ ছাই করো, অন্য ভোগের পিছনে ছোটো। থ্রিল আর উত্তেজনা জীবনের সার কথা। সেটাই জীবন। তাই মেয়েমানুষের পিছনে ছুটি, তাকে ভালবাসার ফাঁদে ফেলি, নাচি (গুরুর খরচে হোটেলের এক মেয়েমানুষের কাধ ধরে দাঁড়কাকের মতো সত্যি আমি খাসা নেচেছিলাম–উঃ, সে কি থ্রিল!) মদ খাই, ম্যারিজুয়ানা টানি। এই থ্রিল আর উত্তেজনার লোভেই শুধু একবার আমি বাবার পকেট থেকে তার মানিব্যাগটাই হাপিস করে দিয়েছিলাম। এমনি থ্রিল আর উত্তেজনার মধ্য দিয়েই আমরা জীবন খুঁজে চলেছি।

মন্তব্য : জীবন খুঁজছ না এই করে তুমি শালা জীবন থেকে পালাচ্ছ সেটা তলিয়ে ভাবার সাহস নেই কেন?

..কুণাল বোসের এই সম্পদখানা অর্থাৎ এই ডায়েরিটা হারিয়ে গেছল। আর সেই কারণে চোখে একটু আধটু সর্ষেফুলও দেখছিল! হারানো ঠিক নয়, চুরি গেছল জানা কথাই। ওর ঘরে বাড়ির কেউই ঢোকে না। রুচি হয় না বলে ঢোকে না। রুচি যাতে না হয় কুণাল নিজেই সেভাবে ঘরখানা রাখত। ডায়েরিটা থাকত তার। সুটকেসে। গোড়ায় গোড়ায় ওই ডায়েরিটা লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার জন্যই চাবি দিত। কিন্তু পরে আর চাবি দেওয়া দরকার মনে করত না। কে আসছে তার ঘরে আর কে-বা দেখছে।…কুণাল খুব ভালো করেই জানে ডায়েরি সরানোটা কার কাজ। বড় বউদি ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। বড় বউদি কুণালের থেকে নবছরের বড়। কুণাল তার আওতার মধ্যে ছিল যখন, একটু শাসন-টাসনও করত। সে অবশ্য আট দশ বছর আগে। এখন কাছেও ঘেঁসে না। দূর থেকে সন্দিগ্ধ চোখে দেখে। কুণাল নিজের কানে শুনেছে, দাদাকে একদিন বলছিল, ও যে-রকম মরা মাছের মতো চোখ করে তাকায় ওর কাছে যেতেই ভয় করে। ওর হাড়ে মাংসে শয়তানি। ঢুকেছে বলে দিলাম।

কুণাল বোস রাগ করেনি। বরং মনে মনে হেসেছে। ওর কাছে যা জীবন থ্রিল, এদের বিচারে তা শয়তানি হতেও পারে। যাক, তার কয়েক দিনের মধ্যে সুটকেশ খুলে দেখে ডায়রিটা নেই। নেই তো নেই-ই। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। শেষে বুঝল, কেউ সরালে আর খুঁজে লাভ নেই। সরিয়েছে যে তার আর ভুল কোথায়। বাড়ির লোকের মুখের দিকে চেয়েই বুঝেছে সক্কলের সব চিন্তার বাইরে বিষম কিছু ঘটে গেছে। বাবা। শেষ পর্যন্ত কি করে কুণাল সেই অপেক্ষায় ছিল। যতই ক্ষেপে যাক না কেন, মারধোর করতে সাহস করবে না। আর দাদারা তো নিরীহ গোছের ভীতু মানুষ। ভাইয়ের পয়সা-অলা গুরুর খবর তারা রাখে, কিন্তু তলায় তলায় কোন গ্যাঙ-ট্যাঙের সঙ্গে মেশে কে জানে। বাড়ির এই অনিশ্চিত অবস্থাটাও মন্দ উপভোগ্য মনে হত না শেষের দিকে। এতেও যেন একটু থ্রিল আছে।

অবশ্য গুরু ব্যাণ্ডেদাকে ব্যাপারখানা বলে রেখেছিল। বাড়িতে ঠাই এর পর আর হবে কি হবে না ঠিক নেই। গুরু ঠোঁট উল্টে নিশ্চিন্ত করছে ওকে। বলেছে, আমাদের, ডিকশনারিতে আবার ভাবনা বলে কোনো কথা আছে নাকি। তাড়িয়ে দেয় চলে আসবি।

শেষে দেখা গেল ভেবে-চিন্তে বাবা এই কাণ্ড করেছে। ডায়েরিটা শিবুকাকার হাতে তুলে দিয়েছে। বাবা আর শিবুকাকা ক্লাসফ্রেণ্ড ছিল, সেই সুবাদে কাকা! একেবারে উল্টো মানুষ দুজনে। বাবা এমনিতে ঠাণ্ডা ভীতু স্বভাবের হঠাৎ হঠাৎ ক্ষেপে গেলে বাড়ি মাথায় করে তোলে। তারপর আবার বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় চুপসে যায়। নানা রকম ভাবনাচিন্তা মাথায় ঢোকে। কুণালের বেলায়ও তাই হয়েছে কোনো সন্দেহ নেই। আর শিবুকাকা হাসি-খুশি মেজাজী মানুষ, খেতে ভালবাসে, গালমন্দ করে জিভের। ঝাল ঝাড়তে ভালবাসে। তার সবেতে উৎসাহ, সবেতে কৌতূহল। এমন না হলে কুণালের এই ডায়েরি পড়েও কিছু সুসম্ভাবনার কথা তার মনে আসে।

ডায়েরি হাতে কুণাল একটা বাসে উঠে পড়ল। এমন খবরটা গুরুকে না দিলেই নয়। ডায়েরি ফিরে পাওয়ার থেকেও শিউলি মাসিক-পত্রের মালিক আর সম্পাদক শিবু আচার্যি ওর মধ্যে এক ভাবীকালের লেখককে আবিষ্কার করেছে এটাই আরো মজার খবর। তাছাড়া, আর এক তৃষ্ণা ভিতর থেকে সুড়সুড় করে ওপরের দিকে উঠে জিভটাকে বার বার শুকিয়ে দিচ্ছে। সেটা সিগারেটের তৃষ্ণা নয়। শিবুকাকার দপ্তর থেকে বেরিয়ে সিগারেট তো পর পর দুটো খেল। এটা তার থেকেও ঢের কড়া তৃষ্ণা। মারিজুয়ানার তৃষ্ণা। গুরু হয়তো তাই টেনে তার নিচের ঘরের ফরাসে চিৎপাত হয়ে আছে।

…বিকেল ছটায় প্রায় নিয়মিত একবার করে ঘণ্টা দুই আড়াইয়ের জন্য পার্ক স্ট্রীটে হানা দিতে হয়। আজ আর হয়তো সেটা হয়ে উঠবে না। বাড়ির লোক বেকার ভাবে কুণালকে। কিন্তু নিজের খরচ, নিজের ছোটখাট নেশার খরচ (বড় নেশার খরচ তো গুরু গৌরী সেনের কাছ থেকেই আসে), এমন কি নিজের জামা কাপড়ের খরচের জন্যও কারো কাছে তাকে হাত পাততে হয় না। এই রোজগারের ব্যবস্থাও গুরুর কল্যাণেই হয়েছিল অবশ্য। এখন নিজের চেষ্টায় পসার বেড়েছে। তাদেরও মতো জীবন। খুঁজছে অথচ ভিতরে ভীতুর ডিম এমন লোকের কি অভাব আছে? এই লোকেরা তার খদ্দের। তাদের মধ্যে বাঙালী আছে, অবাঙালী আছে।…বছর খানেক আগে গুরুর সঙ্গে একবার বম্বে আর গোয়ায় বেড়াতে গেছল। সেখান থেকে গুরু গাদা গাদা ব্ল পিকচার আর ব্লু-ফিল্ম কিনেছিল। ততদিনে সে-সব দেখে-দেখে গুরুর তো বটেই, কুণালেরও চোখ পচে গেছল–রক্তমাংসের জ্যান্ত মেয়েগুলোর মধ্যেই এখন আর আগের মত থ্রিল খুঁজে পায় না–এ-তো ছবি আর ফিলম! কিন্তু তবু গুরু কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে এত ছবি আর ফিলম কিনছে কেন মাথায় ঢোকেনি। পরে গুরুই বলেছে, কেন? কলকাতায় এগুলোর দারুণ ডিম্যাণ্ড–যে দুটো দোকান থেকে গুরু পর্ণোগ্রাফির বই কেনে বা পয়সা দিয়ে বাড়ি এনে পড়ে, আসার আগে সেই দুটো দোকান থেকেই বলে দিয়েছে ভালো মাল পেলে ভালো দামে কিনবে। হ্যাঁ, গুরুর পর্ণোগ্রাফি পড়ার ঝোঁক এখনো আছে। বলে, মানুষের ভোগের নিত্য নতুন যত রকমের বৈচিত্র্য আছে, কোনো কোনো লেখায় তা মেলে। এতে দস্তুরমতো মাথা-খাটানোর স্কোপ আছে। স্টিল ছবি বা ফিল্ম-এর থেকে বইয়ের মতো বই হলে ঢের বেশি ইন্টারেস্টিং।

গুরু বলল, এগুলো কেমন মোটা লাভে ঝেড়ে দিই দেখিস–তোকেও লাভের কিছু ভাগ দেব। আর ওই দুটো দোকানের মালিকের সঙ্গেও তোর আলাপ করিয়ে দেব। খদ্দের আনার চৌকস লোক তো তাদের সব সময়ই দরকার হয়। কুণাল বোস এখন এই দালালির কাজে পাকা হয়ে গেছে। কাঁচপোকার মতো খদ্দের ধরে নিয়ে আসে। আবার নিজেও ঘুরে ঘুরে বেশি লাজুক খদ্দেরের কাছে সাপ্তাহিক ভাড়ায় ছবি আর পর্ণোগ্রাফির বই পৌঁছে দেয়। এই খদ্দেররাই আবার কদিন গেলে পরদায় মুভি ব্লু ফিল্ম দেখার আশায় ওকে তেল দেয়।

অকাতরে এর জন্যে তারা মোটা টাকা খরচ করে। কুণালের ঝোঁপ বুঝে কোপ, অর্থাৎ খদ্দেরের পকেটের ওজন বুঝে মাশুল আদায়। এই করে দালালির রোজগার বাড়ছেই। অথচ এক বছর আগেও কি জানত ওই দুটো দোকানেরই গোপনে মুভি ব্লু ফিল্ম দেখানোর এমন পরিপাটি ব্যবস্থা আছে?

যা ভেবেছিল তা নয়। গুরু চিৎপাত হয়েই তার এক্সক্লসিভ নিজের ঘরের ফরাসে শুয়ে আছে। তার পাশে দুটো পোস্টকার্ড সাইজের ফটো পড়ে আছে, হাতেও একটা খুব মনোযোগ দিয়ে সেই ফটো দেখছে গুরু!

কুণাল শব্দ না করে পাশে বসল। আলতো হাতে ওই বাকি ফটো দুটো তুলে নিল। দুটো ফটোই একটা মেয়ের। ফুটফুটে সুন্দর কচি মুখ। বড় জোর বছর সতেরো আঠারো হবে বয়েস। ডাগর চোখ। চোখের পাতা ফেললে বোধহয় নাকের ডগা অনেকটা ছাড়িয়ে যাবে। মোটাও নয়, রোগাও নয়। সব থেকে চোখে পড়ার মতো মেয়েটার মুখের কমনীয়তা। কেউ যেন ছাঁচে গড়ে কমনীয়তার রস উপুড় করে ঢেলেছে।

হাতের ছবিটা সামনে রেখে গুরু আড়চোখে কুণালকে দেখছে আর টিপটিপ হাসছে। চোখাচোখি হতে বলল, দেখে ফেললি তো! তোকে অবাক করে দেব বলে একমাস ধরে চেপে বসে আছি।

–কি ব্যাপার গুরু, এ আবার কোথাকার হরী পরী? কিন্তু এ তো একেবারে কচি!

তেমনি হেসে গুরু জবাব দিল, বাগবাজারের। হাতের ফটোটা এগিয়ে দিল। দেখে ফেলেছিস যখন এটাও দ্যাখ।

অর্থাৎ এটা কচি বলার জবাব। একটু আড় হয়ে মেয়েটা বাঁ-হাত মাথার পিছনে তুলে খোঁপা ঠিক করছে–সেই সময়ের ছবি। ফলে পিছনের খানিকটা আর বুকের। এক দিকের সুডৌল মাধুরী যেন উপছে পড়েছে। চোখ ফেরানো যায় না।

শুরু হৃষ্টমুখে জানান দিল, এ ছবিতে কোন কায়দায় কি তুলেছি ও মেয়ে নিজেও..। জানে না।…তা কি রকম মনে হচ্ছে?

দারুণ।

চোখে দেখলে রাতে তোর ঘুম হবে কিনা সন্দেহ। দেখবি?

 বাগবাজারে গিয়ে?

ইদানীং তো আমি প্রায় রোজই যাচ্ছি। এই ফটোটা আমার থাকবে, আজ ওই ফটো দুটো দিয়ে আসতে যাব। চল…।

কুণাল বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত থাকে পার্ক স্ট্রীটে। সে-সময় গুরুর কোন্ লীলা চলছে জানবে কি করে। লোভ হচ্ছে বটে, আবার নেশার লোভ নিয়ে এসেছিল তা ও বাতিল করতে মন চায় না। বলল, একটু বড় গাঁজার ইচ্ছে ছিল যে গুরু…।

বড় গাঁজা অর্থাৎ মারিজুয়ানা। গুরু আমল দিল না। বলল, ও-সব এসে হবে, আগে বড় গাঁজার রাণী দেখবি চল।

গুরু তৈরী হয়ে রাস্তায় বেরুলো। ট্যাক্সি নিল! হুকুম করল, বাগবাজার।

ডায়েরি ফেরত পাওয়া বা কুণালের লেখক হবার সম্ভাবনার মজার খবরটা আর দেওয়াই হল না। ওর হাতের সেই কালো ডায়েরিটা গুরুর চোখে পড়েও পড়ল না। ট্যাক্সি ছুটেছে আর এদিকের রসের ব্যাপারখানা কি থেকে কি গড়াচ্ছে ব্যাণ্ডোদা মনের আনন্দে সেই ফিরিস্তি শোনাচ্ছে শিষ্যকে।…ওই ফটোর মেয়ের মা গুরুর মায়ের ছেলেবেলার খুব বন্ধু ছিল। একদিন দুজনের দুজনকে না দেখলে চলত না এমন নাকি। হঠাৎ এর মধ্যে একদিন কার মুখে শুনেছে সেই ছেলেবেলার বন্ধু আজ চৌদ্দ বছর ধরেই কলকাতায়। আমেরিকায় নয়। সে দিন-আনা দিন-খাওয়া গরীবের বউ আমেরিকা ফেরত এত বড়লোক বান্ধবীর কাছে আসবে কি আসবে না সেই দ্বিধা ছিল। শেষে ইচ্ছেটাই বড় হয়েছে। ফোন গাইডে ঠিকানা দেখে ছোট মেয়েকে সঙ্গে করে এক-সন্ধ্যায় চলেই। এসেছে। নিচে তখন গুরু ছিল। তার সঙ্গেই মা-মেয়ের প্রথম দেখা। সে-যে কি দেখা গুরুই জানে। এত বড় বাড়িতে পা ফেলে দুজনেই তারা বেশ জড়সড়। চন্দনা। মানে ফটোর মেয়ে সেদিন একখানা ঘন নীল শাড়ী পরে এসেছিল। গুরুর মনে হচ্ছিল, নীলের মধ্যে আকাশের চাঁদখানা মুখ বাড়িয়ে আছে।

কাকে চাই শুনে সঙ্গে করে দোতলায় নিয়ে চলল। বাবা মা তখন মুখোমুখি বসে মদ গিলছে জেনেও। ছেলেবেলার বান্ধবী শুনে আর নিরাভরণা মহিলার একেবারে সাদামাটা বেশবাস দেখেই তার মগজে একটা আশা উঁকি ঝুঁকি দিয়ে গেছে। বান্ধবীকে স্বামীর সঙ্গে মদের বোতল আর মদের গেলাস নিয়ে বসা দেখেই তো মহিলার হয়ে গেল। ওদিকে বাবা-মাও অবাক। গুরুই ভিতরে ডাকল, আসুন মাসিমা ভিতরে আসুন। মা-কে বলল, তোমার ছেলেবেলার বন্ধুকে চিনতে পারছ না?

নাম বলার পরেও ব্যাণ্ডোদার মায়ের চিনতে সময় লাগল একটু। বাবা সাহেবী কায়দায় নিজে উঠে ওদের বসতে আপ্যায়ন করল। তারপর অন্য ঘরে চলে গেল।ওরা জড়সড় হয়ে বসল। ব্যাণ্ডেদা বাইরে থেকে লক্ষ্য করল, চেনার পরেও মা তেমন আগ্রহ দেখালো না। ভদ্রতার খাতিরে জিজ্ঞেস করল, ড্রিংক চলে কিনা। মহিলা এমন মাথা নাড়ল। যে বাইরে থেকে ব্যাণ্ডোদা হেসেই ফেলল। সে যেন উঠে ওই ঘর ছেড়ে ছুটে বেরুতে পারলে বাঁচে। দুচার কথায় মা তার ঘরের খবর নিল। মহিলা বাগবাজারে থাকে।চন্দনারা চার বোন। চন্দনা ছোট। বড় তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী পোস্ট অফিসের চাকরি থেকে এ বছরেই রিটায়ার করেছে, এখন ডায়বেটিসে প্রায় শয্যাশায়ী। মায়ের জেরার মতো প্রশ্নে দুই এক কথায় এইসব জবাব এসেছে। একটু বাদেই মহিলা বলল, উনি গেলাস রেখে চলে গেলেন, আমি অসময়ে এসেছি, আজ উঠি। ব্যাণ্ডোদার মা আপত্তি করল না, মাথা নাড়ল। ওরা উঠতে বলল, তোর এই ছোট মেয়েটা তো বেশ সুন্দর হয়েছে, বিয়ের চেষ্টা করছিস নাকি? মহিলা মিনমিন করে জবাব দিল, সে-রকম কিছু না, সবে এবার হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিল…এখনো ফল বেরোয়নি…বয়েস মাত্র সতের।

তারা নামার আগেই ব্যাণ্ডোদা সরে গেছল। তার বাবাকে বলেছে, তোমার গাড়িটা নিয়ে ঘণ্টাখানেকের জন্য বেরুচ্ছি। রাতে তার বাবা কলেও বেরোয় না গাড়ির ও দরকার হয় না।  

মা মেয়ে খানিকটা এগোবার পর পিছন থেকে গাড়ি থামিয়ে ব্যাণ্ডোদা তাদের ধরেছে। নেমে এসে পিছনের দরজা খুলে দিয়ে মহিলাকে বলেছে, উঠুন মাসিমা –পৌঁছে দিচ্ছি।

মা মেয়ে দুজনেই খুব হকচকিয়ে গেছে। মহিলা বলেছে, আমরা তো বাগবাজারে থাকি

ব্যাণ্ডোদা বলেছে, গাড়িতে বাগবাজার আর কতক্ষণের পথ। আর বলেছে, পুরনো বান্ধবীর সঙ্গে বাগবাজার থেকে এসে আপনি কেমন দেখা করলেন আমি দেখেছি, আর বুঝেছি, এমন জানলে আপনি আসতেন না। তাই আমিই যেটুকু পারি প্রায়শ্চিত্ত করি–উঠুন উঠুন পিছনে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে।

মহিলা তাড়া খেয়ে উঠে বাঁচল। মেয়েটা আদব-কায়দা জানে না বলে সেও মায়ের পিছনে উঠল। গাড়ি হাঁকিয়ে সামনে চোখ রেখেই ব্যাণ্ডোদা আলাপ জুড়ে দিল। আর। ফাঁকে ফাঁকে রিয়ার গ্লাসে মেয়েটাকে দেখতে লাগল। সংকোচ কাটিয়ে মহিলা বলল, তুমি এভাবে গাড়িতে আমাদের পৌঁছে দিতে চললে, তোমার মা হয়তো অসন্তুষ্ট হবেন।

ব্যাণ্ডোদা বেশ গলা ছেড়ে হাসল (ওটা সরলতার লক্ষণ জানে), জবাব দিল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন মাসিমা, আমাদের কারো ব্যাপারে কারো ইন্টারফিয়ার করা রীতি নয়–একদিক থেকে আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। তা আমার মায়ের সঙ্গে এককালে খুব ভাব ছিল বুঝি আপনার?

-খুব। এই জন্যেই তো…

কিছু বলতে গিয়ে থমকালো। আবারও হা-হা হেসে ব্যাণ্ডোদা বলল, আপনাকে কিছু লজ্জা পেতে হবে না, আমি একনজরেই সব বুঝে নিয়েছি। মা অনেক বদলেছে, অনেক বড়লোক হয়েছে। তবে আমার শুধু অনুরোধ বাবা মাকে দেখে আপনি তাদের ছেলেকে বিচার করবেন না। মায়ের আচরণে আজ আমি কোথায় আঘাত পেয়েছি। জানলে আমার জন্য আপনার কষ্ট হত।

মহিলা বলেছে, সে-কি কথা বাবা, আমি এরই মধ্যে বুঝেছি তুমি সোনার ছেলে।

বাড়িতে পৌঁছে দিতে গিয়ে ব্যাণ্ডো দেখেছে, নিতান্তই দীন দশা তাদের। ভদ্রলোক.. হয়তো বড় তিন মেয়ে পার করতেই ফতুর হয়েছে। মেয়েগুলোর চেহারা খাসা বলে। তবু পার হয়েছে। ভদ্রলোক সত্যিই প্রায় অথর্ব। একবার: ডায়বেটিক স্ট্রোক পর্যন্ত। হয়ে গেছে। তাকে দেখার কর্তব্যেই ব্যাণ্ডোদা এরপর: ঘন ঘন এসেছে। তাদের চোখে সে তখন আর সোনার ছেলে নয়, হীরের টুকরো ছেলে। হ্যাঁ, মহিলা ততদিনে তারও খোঁজ খবর সব নিয়েছে বইকি। অবশ্য ব্যাণ্ডোদার কাছ থেকেই। গেলেই একরাশ ফল মিষ্টি নিয়ে যায়। মহিলা কিছু বলতে গেলে অভিমান করে, আমাকে ছেলে ভাবলে কিছু বলবেন না, আমার মা আছে, কিন্তু আপনাকে দেখার আগে আমি মা পাইনি।

পাঁচ দিন আগে ব্যাণ্ডোদা তিন হাজার টাকা জোর করে মহিলার হাতে গুঁজে দিয়েছে–মেসোমশাইয়ের সব থেকে ভালো চিকিৎসা হওয়াই চাই। মহিলা তিন হাজার টাকা একসঙ্গে দেখেছে বলে মনে হয়নি ব্যাণ্ডোদার। তার যে দেবার অধিকার আছে তার দুদিন আগে মহিলাকে সে সেটা স্পষ্টই বুঝিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, আমাকে যদি খুব অপছন্দ না হয়, তাহলে যেদিন বলবেন সেদিন আমি গাড়ি নিয়ে এসে আপনাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে যাব…অবশ্য আমার ব্যাপারে আমার ডিসিশনই ফাইন্যাল, তবু একটা ফরম্যালিটির ব্যাপার আছে তো। আমি মাকে বলেই রেখেছি, ওঁদের আপত্তি না হলে চন্দনাকে বউ করে ঘরে তোলার জন্য রেডি থেকো।

মহিলা তো আকাশের চাঁদ হাতে পাবেই। মা রাগ করেছে কিনা জিজ্ঞেস করতে ব্যাণ্ডোদা আবার সেই হা-হা হাসি হেসেছিল বলেছিল, এবারে গিয়েই দেখতে পাবেন। তাছাড়া জানেন তো কারো ব্যাপারে ইন্টারফিয়ার করা আমাদের রীতি নয়।

যাক, ব্যাণ্ডোদার অভিমান দেখেই মহিলা সেই তিন হাজার টাকা হাত পেতে নিয়েছে। তারপর এইসব ছবি-টবি তুলতে দিতে আর বাধা কোথায়। ব্যাণ্ডোদার আফসোস, ওই দুটো খুপরি ঘর, চন্দনাকে সেভাবে একলা পাচ্ছে না–তবে পাবার চান্স এবারে একটু হয়েছে। ব্যাণ্ডোদা বলল, মেয়েটা এখনো এমন চেয়ে থাকে না, যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না কি হতে যাচ্ছে। তখন ইচ্ছে করে, ওকে বুকের মধ্যে নিয়ে একেবারে পিষে ফেলি, আর টসটসে চোখ দুটো দাঁতে করে ছিঁড়ে আনি।

ওরা পৌঁছুলো। কুণাল দেখল মেয়েটাকে। ছবি অত সুন্দর, কিন্তু এর বুঝি তুলনা নেই। দেখামাত্র সদ্যফোঁটা যুঁই ফুলের মতো মনে হল কুণালের। আড়চোখে কুণালকেও দেখল। ঠোঁটের ফাঁকে হাসির দাগ পড়ল একটু। ছাগলদাড়ি দেখে হাসি পাচ্ছিল। বোধহয়। যে-লোকের বন্ধু, কুণালেরও আদর যত্ন কম হবে কেন? যতক্ষণ ছিল ওরা, চন্দনার মায়ের অস্থির অস্থির ভাব। এরই মধ্যে ফাঁক বুঝে ব্যাণ্ডোদা বার দুই চোখে চোখে কথা কইতে চেষ্টা করল চন্দনার সঙ্গে। কিন্তু চন্দনার আয়ত গভীর কালো চোখে আর দুটো ঠোঁটের ফাঁকে একটু হাসির আভাস খেলা করে গেল শুধু। আর খেয়াল না করে ব্যাণ্ডোদা একটু কাছাকাছি হতে চেষ্টা করলেই তেমনি খেয়াল না করেই যেন ওই মেয়ে একটু তফাতে সরে যায়। দুবার হয়েছে এমন। আ-হা-হা, কুণালের চোখে পলক পড়ে না–কি যে দেখাচ্ছিল না মেয়েটার মুখখানা তখন–যেন একখানা কালো মেঘের সঙ্গে চাঁদের লুকোচুরি খেলা। উপমা ঠিক হল না। চাঁদ হাসে। এই মেয়ের মুখে শুধু একটু হাসির আভা ছড়ায়।

ওঠার সময় চন্দনার মা ব্যাণ্ডেদাকে জিজ্ঞেস করল, কাল আসছ তো বাবা? কুণালকেও নিয়ে এসো।

ব্যাণ্ডোদা বলল, কাল হয়ে উঠবে না…দেখি। আপনাকে আমাদের বাড়ি কবে নিয়ে যাচ্ছি বলুন?

–যেতে তো হবেই, শীগগিরই যাব…তবে আমার কেমন ভয় করে বাবা।

জবাবে কুণাল ব্যাণ্ডোদার হা-হা হাসির একটা নমুনা দেখল।

আবার ট্যাক্সি। ব্যাণ্ডোদা বলল, কি রকম বুঝলি?

কুণাল ঝুঁকে পায়ের ধুলো নিতে গেল।তোমার জবাব নেই গুরু, পায়ের ধুলো দাও। দারুণ-দারুণ–আমার বুকে চিতার আগুন জ্বলছে।

গুরু খুশি।

-তোমার মাকে সত্যি বলে রেখেছ?

-না বলার কি আছে! বলতে তো হবেই। তা কেমন লাগল বল!

–বললাম তো জবাব নেই। বয়েস সতেরো হলেও খুব বাড়ন্ত গড়ন।

–বয়েস সতেরো নয়, আঠারো। আমার সাতাশ শুনে ওর মা-ই স্বীকার করেছে। আঠারো না হলে সব-দিকে অমন ডবকা হয়?

–তুমি কাল আসছ না বললে, ফের কবে আসছ?

–পরশু। মুচকি হাসল।তবে পরশু তোকে আনা যাচ্ছে না।

–কেন?

চন্দনার বাবাকে নিয়ে ওর মা পনের দিনে একদিন পোলিক্লিনিকে দেখাতে যায়…পরশু শনিবার, যাবে আমি কদিন আগেই শুনেছিলাম। ঘণ্টা কয়েকের মামলা। পুরনো ঝিটা অবশ্য বাড়ি আগলে বসে থাকে, তবু এই মওকায় তাকে এদিক ওদিক সরিয়ে চন্দনাকে দুই একবার বুকে চেপে তো ধরতে পারব আর কষে দুচার করে চুমুও খেতে পারব–এবারে কোন শালা ঠেকায়।–তা তোর ভিতরটা খুব চড়চড় করছে?

–খাঁ-খাঁ করছে।

–সত্যি বলছিস?

–এই দেখানোর আগে আমার চোখ দুটো তুমি অন্ধ করে দিলে না কেন গুরু।

প্রদীপ ব্যাণ্ডো হাসতে লাগল। খানিক বাদে হঠাৎ বলল, যা এত যখন..ছমাস। এক বছর বাদে সুবিধে বুঝে তোকেই দিয়ে দেব।

কুণাল আঁতকে উঠল।–দিয়ে দেবে!

-না তো কি! কোন একটা মেয়েকে নিয়ে আমি জীবন কাটাবো ভাবিস নাকি? ঐ আগের অন্য বউ দুটোর মতো হবে না–সাপের মতো ফেস-ফোঁস করবে না…ঠিক চিট করা যাবে। তোকে নিয়ে আমার একটা দায়িত্ব আছে?

রাত নটা নাগাদ কুণাল বাড়ি ফিরে দেখে শিবুকাকা বসে আছে। সামনে বাবা আর দাদারাও আছে। ওকে দেখেই শিবুকাকা বলল, তোর কথাই এদের বলছিলাম এতক্ষণ। তোর সাবজেক্ট ঠিক করে ফেলেছি

বাবা আর দাদাদের মুখ দেখে মনে হল তারা আশার কথাই শুনছিল কিছু। বাবা বলে উঠল, আগে কাকার পায়ের ধুলো নে হারামজাদা পায়ের ধুলো নে।

কুণাল পিতৃ আদেশ পালন করল।

শিবুকাকা বলল, ওই বাঁদরেতরদের নিয়েই তোর ফীচার স্টার্ট করব। মানে তরুণের মন নাম দিয়ে তুই মাসে একটা করে ফীচার লিখবি। এক এক পর্যায়ের এক-একটা তরুণ:বেছে নিবি–তার মনের কথা সুখ দুঃখের কথা শুনবি তারপর। লিখবি। শেষে তোর মন্তব্য জুড়ে দিবি। মন্তব্য ওই রকম সরস হওয়া চাই–বুঝলি কোন রকম?

কুণাল সুবোধ ছেলের মতো মাথা নাড়ল, বুঝেছে।

প্রত্যেকটা লেখার জন্য পঁচিশ টাকা আর ঘোরাঘুরির জন্য পাঁচ টাকা করে পাবি। সেরকম উতরোলে বই ছাপার ব্যবস্থাও আমি করে দেব। বাবাকে বলল, তুমি কিছু ভেব না ভায়া, ওর ভার আমি নিলাম–আজ পর্যন্ত অনেক গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করেছি।

বাবা কৃতজ্ঞতায় গদগদ।

.

আরো রাত্রি।

ঘুম থেকে ধড়মড় করে একেবারে বিছানায় উঠে বসল কুণাল। বেডসুইচ টিপে আলো জ্বালল। ঘেমে গেছে। এ কি অদ্ভুত স্বপ্ন রে বাবা! ঘুরে ঘরের কোণের সুটকেসটার দিকে তাকালো। না, থাক–স্বপ্ন ছাড়া আর কি। কিন্তু বুকের ভিতরটা ধপধপ করছে। এখনো। হাত বাড়িয়ে ড্রয়ারটা খুলল। ছোট হুইস্কির বোতলটা খুলে কাঁচাই গলায় ঢেলে দিল। দুই একবার গা ঝাঁকানি দিয়ে টেবিলের গেলাস থেকে অল্প একটু জল খেল। বোতলটা ড্রয়ারে রেখে আলো নিভিয়ে আবার শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুম আর আসে না। যতবার চোখ লেগে আসে, গুরুর মুখ আর চন্দনার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে।…চন্দনাকে বুকে চেপে গুরু চুমু খেতে যাচ্ছে। কাল বাদে পরশু দুপুরে যা ঘটবে।

বার কয়েক এ-রকম হতে আবার বেডসুইচ টিপে উঠে বসল। নিজের উদ্দেশে গাল পাড়ল, শালা পেট জ্বালিয়ে দিয়ে তোর জেগে খোয়াব দেখা বার করছি। ড্রয়ার খুলল। হুইস্কির বোতলটা এবারে গলায় ঢেলে শেষই করে দিল।

.

পরের দিন।

দুপুর তিনটেয় একটা রিকশ চেপে কুণাল বোস বাড়ি ফিরল। এই দুপুরে ঘরের বাইরে কেউ নেই, নইলে ওকে দেখলে হাঁ হয়ে যেত। ট্রাউজারের ওপর ওর গায়ে শুধু একটা সৃতির গেঞ্জি। জামাটা এক হাতে গোল করে দলা পাকানো।

রিকশা ভাড়া দিয়ে নিঃশব্দে নিজের ঘরে চলে এলো। দলা পাকানো জামাটা চৌকির কোণে ছুঁড়ে ফেলে দিল। সুটকেস খুলে কালো ডায়েরিটা বার করল। ড্রয়ার হাতড়ে একটা পুরনো ব্লেড নিয়ে বসল। ওড় অন বারমুডা লিলির পাতাটা খুলল। তকতকে সবুজ ডাটার ওপর বসা রঙিন বীভৎস পোকাটার মাথাটুকু শুধু ব্লেড দিয়ে কেটে দিল। তারপর নতুন পাতায় চলে এলো। কলম বার করল। শিবু কাকার কাগজের জন্য তরুণের মনএর প্রথম বা শেষ ফীচার এক্ষুণি লিখে ফেলবে। বারমুডা লিলির লেখাটা পছন্দ হয়েছিল যখন, এ লেখাটা নিশ্চয় আরো ঢের বেশি পছন্দ হবে।

-আমি এক্ষুণি গুরুর বাড়ি থেকে ফিরলাম। বেলা বারোটা থেকে পৌনে তিনটে পর্যন্ত তার ওখানে তার সঙ্গেই ছিলাম। গুরু পরের দিনের অপেক্ষায় মশগুল। আর আমি? না, জীবনে এত থ্রিল আর এমন উত্তেজনার স্বাদ আমি পাইনি। গ্র্যাণ্ড–যাকে বলে সুপার গ্র্যাণ্ড। অথচ নেশা কেবল একলা গুরুই করছিল। আমি যোগান দিয়ে চলেছিলাম। গুরুর তখন আমার দিকে মন দেবার চোখ কোথায়। ভাবে মশগুল। তার থেকে ঢের বেশি নেশায় মশগুল। আমার নেশা যোগানদারির ব্যাপারটা তো আর খেয়াল করে দেখেনি। কেবল টেনেই চলেছে।…তারপরে একসময় মাথা আর তুলতে পারছে না। চোখ আর খুলতে পারছে না। আমার থ্রিল আর উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। গ্র্যাণ্ড গ্র্যাণ্ড গ্র্যাণ্ড!

সময় হয়েছে মনে হতে গুরুর ড্রয়ার খুললাম। খাপ থেকে তার সোনালি বাঁটের বিলিতি ক্ষুরটা বার করলাম। গুরু বরাবর নিজের এই ক্ষুরে কামাতে ভালবাসে। গুরুর পাশে বসলাম। বাঁ হাতে তার বালিশটা ঘাড়ের একটু তলার দিকে নিয়ে এলাম। তারপর সেই হাতেই থুতনিটা একটু ওপরের দিকে ঠেলে বললাম, গুরু মুখখানা একটু ওপরের দিকে তোলো তো

চোখ খুলতে না পেরে গুরু খুব অস্পষ্ট গলায় জড়িয়ে জড়িয়ে বলতে চেষ্টা করল, কি করবি…

-তোলোই না, যা করব তুমি টেরও পাবে না। থুতনি আরো ঠেলে তোলার কাজটা আমিই করলাম। তারপর চেপে ধরে চোখের পলকে যা করার করে ফেললাম। ফিনকি দিয়ে এক ঝলক রক্ত আমার চোখে মুখে দাড়িতে আর জামায় লাগল। কিন্তু নিশ্চিন্ত না হওয়া পর্যন্ত আমি থামি কি করে? কসেকেই বা লাগল। গুরু বার কয়েক মাত্র হাত-পা ছুঁড়ল। আধ-কাটা খাসীকে আমি এর থেকে ঢের বেশি পা ছুঁড়ে দাপাতে দেখেছি। নেশার জন্য অত পারে নি কি, কি জন্য আমি জানি না। আমার দুহাতে লালে লাল। ফরাস রক্তে ভেসে যাচ্ছে। গুরুর রক্ত যে এমন বিষম লাল আর এত গরম কে জানত। ছুটে বাথরুমে এলাম। ভালো করে মুখ হাত ধুলাম। জামাটা খুলে পুঁটলি করলাম। আমার হাতে সময় খুব নেই জানি। পুলিশ ধাওয়া করার। আগে বাড়ি গিয়ে শিবু কাকার তরুণের মন লিখে ফেলতে হবে।

রিকশা চেপে বাড়ি চলে এলাম। লিখতে বসলাম।…যা বলছিলাম, ওই বীভৎস রঙিন পোকাটা বারমুডা লিলির কাছে পৌঁছে যাবে এ কেমন করে হয়? কি করে হয়? অথচ পরশু মাঝরাতে আমি সেই স্বপ্নই দেখে উঠলাম। দেখলাম সেই সবুজ ডাটা বেয়ে বেয়ে ওটা সত্যি উঠছে। উঠছেই। যত উঠছে ততো ওটার দুচোখ আরো লোলুপ বীভৎস হয়ে উঠছে। প্রায় ডগা পর্যন্ত উঠতে একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে আমার ঘুম ভেঙে গেল। তারপর সকালে গুরুর ওখানে যাওয়া পর্যন্ত জেগে জেগেই। কতবার যে ওই স্বপ্নের দৃশ্যটা দেখলাম ঠিক নেই। বাঁকা চোরা আট দশটা লিকলিকে পা বার করে ওটা উঠেই চলেছে।

কিন্তু তা কি কখনো হয়? হতে পারে? এখন আমি নিশ্চিন্ত। ওই লোলুপ বীভৎস রঙিন পোকাটা কোনো দিন আর বারমুডা লিলির নাগাল পাবে না।

কোনদিন না! কখনো না!