টারজান ও চ্যাম্পিয়ন (টারজান এ্যাণ্ড দি চ্যাম্পিয়ন)

টারজান ও চ্যাম্পিয়ন (টারজান এ্যাণ্ড দি চ্যাম্পিয়ন)

এক বিশাল প্রান্তরের এক প্রান্তে বনটা যেখানে থেমে গেছে সেখানে একটা মাল বোঝাই ভারী ট্রাক এগিয়ে যাচ্ছিল বনের দিকে।

ট্রাকটা যেদিকে যাচ্ছিল তার উল্টো দিকে প্রান্তরের উপর দূরে একজন পথিক দাঁড়িয়ে ছিল। ট্রাকটা দেখে অবাক হয়ে গেল পথিকটি।

হেলমেট মাথায় একজন শ্বেতাঙ্গ ট্রাকটা চালাচ্ছিল। তার পাশে বসে ছিল একজন নিগ্রো। ট্রাকের উপর যে সব মাল বোঝাই করা ছিল তার উপর আরো কয়েকজন নিগ্রো ছিল।

পথিকটি ধীর গতিতে ট্রাকটা যেদিক থেকে আসছিল সেই দিকে এগোতে লাগল। তার পরনে পোশাক বলতে ছিল মাত্র একটা কৌপীন। হাতে ছিল আদিম যুগের অস্ত্র-একটা তীর ধনুক, তৃণ আর একটা বর্শা। তাঁর কাঁধের উপর ছিল একটা ছোট বাঁদর। লোকটি জাতিতে শ্বেতাঙ্গ হলেও আফ্রিকায় দীর্ঘকাল থাকার জন্য রোদে পুড়ে পুড়ে গায়ের চামড়াটা তামাটে হয়ে যায়। বাঁদরটা একটা হাত দিয়ে লোকটির ঘাড়টা জড়িয়ে ধরে বসেছিল তার কাঁধের উপর। বাদরটার নাম কিমা।

ট্রাকের ড্রাইভার দূরে টারজানকে দেখতে পেয়ে আদিবাসী ভেবে পিস্তলটা খাপ থেকে বার করল। সে দেখল তার পাশে বসা যুবকটির হাতেও একটা রাইফেল রয়েছে।

ড্রাইভার তার পাশের কৃষ্ণকায় নিগ্রো যুবকটিকে বলল, লোকটা কে?

 যুবকটি উত্তর করল, একজন শ্বেতাঙ্গ মালিক।

টারজনের কাছে এসে ট্রাকটা থামাল শ্বেতাঙ্গ ড্রাইভার।

 টারজান ট্রাকটার পাশে দাঁড়িয়ে ড্রাইভারকে বলল, এখানে তোমরা কি করছ?

মেলটন তার সামনে একজন নগ্ন লোককে দেখে তার এই প্রশ্নটাকে একটা বেয়াদবি বলে মনে করল।

মেলটন বলল, দেখছ ত, একটা লরী চালাচ্ছি।

টারজান এবার তীক্ষ্ণ-কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। বলে টারজান তখন তার একটা হাত বাড়িয়ে মেলটনের হাতের কব্জিটা ধরে তাকে জোর করে নামাল ট্রাক থেকে। তারপর তার পিস্তলটা কেড়ে নিল।

ট্রাকের উপরে যে সব নিগ্রো বসেছিল তারা হতবুদ্ধি হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। তারা দেখল মেলটনকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে তার ঘাড় ধরে ঝাঁকুনি দিতে লাগল লোকটা।

মেলটনের গায়েও শক্তি ছিল। কিন্তু টারজনের সঙ্গে পেরে উঠল না সে। মেলটনের মনে হলো, কোন মানুষ নয়, সে যেন কোন বন্য জন্তুর কবলে পড়েছে।

টারজান এবার মেলটনকে ছেড়ে রাইফেল হাতে নিগ্রো যুবকটার দিকে তাকিয়ে বলল, রাইফেল ফেলে দাও।

যুবকটি ইতস্তত করছিল। মেলটন বলল, ফেলে দাও।

মেলটন এরপর টারজানকে বলল, আমার কাছে কি জানতে চাও তুমি?

 আমি জানতে চাই তোমরা এখানে কি করছ?

 আমি কয়েকজন আমেরিকান লোককে খুঁজতে যাচ্ছি।

তারা কোথায়?

মেলটন বলল, ঈশ্বর জানেন। আজ সকালে তারা একটা ছোট গাড়িতে করে বেরিয়ে যায়। আমাকে বলেছিল বনটার প্রান্তে এসে অপেক্ষা করতে। সেখানে তাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে দিনের শেষে। হয়ত তাদের কোন বিপদ ঘটেছে।

এখানে কি করতে এসেছিল তারা?

 শিকার করতে।

এটা ত নিষিদ্ধ এলাকা। এদিকে কেন তারা এল?

মুলারগান কোন কথা শুনবে না। সে নিজেকে সবজান্তা ভাবে। সে ভাবে সে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নামকরা হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন। এমন লোক জীবনে আমি দেখিনি কখনো। মুলারগানের ম্যানেজার লোকটা তত খারাপ নয়। কিন্তু লোকটা আধপাগলা, তার কথা শুনে হাসি পায়। সে শুধু নিউ ইয়র্কে ফিরে যেতে চায়। এখানে খুব ভয়ে ভয়ে আছে। ওরা দু’জনে নিউ ইয়র্কে চলে গেলে আমি বাঁচি।

টারজান বলল, আর কেউ তাদের সঙ্গে সেই?

না।

তাহলে তাদের আশা ছেড়ে দিতে পার। এটা সিংহের রাজ্য।

মেলটন বলল, তাহলেও আমার উপর যখন দায়িত্ব আছে তখন তাদের একবার খুঁজে দেখি, তুমি আবার বাধা দেবে না ত?

না। যাও, খুঁজে দেখ। তবে বলবে তারা যেন এ অঞ্চল ছেড়ে চলে যায়।

এই বলে টারজান বনের মধ্যে চলে গেল।

মেলটন চীৎকার করে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কে, পরিচয়টা দিলে না?

টারজান বলল, আমার নাম টারজান।

একটা সিংহের গর্জনে বিশাল প্রান্তরের নিস্তব্ধতাটা ভঙ্গ হলো। সিংহটা তখনো অবশ্য দূরে ছিল। কিন্তু গাড়িতে বসে থাকা মুলারগান ও তার ম্যানেজারের কানে আসতে লাগল গর্জনটা।

মুলারগান বলল, ওটা কিসের শব্দ?

 মার্কস বলল, একটা শুয়োর।

দিনের আলো থাকলে শুয়োরটাকে মারা যেত। এখন গোটাকতক শুয়োরের চপ হলে ভাল হত। এখন দেখছি ঐ ইংরেজটা ছাড়াই আমরা চালিয়ে নিতে পারব।

মুলারগান বলল, তা অবশ্য বটে।

হঠাৎ সামনে একটা আলো দেখতে পেয়ে মার্কস বলল, ঐ দেখ আলো। মনে হয় আমাদের ট্রাকটা।

দুটো গাড়ি একজায়গায় হলে সকলে গাড়ি থেকে নেমে হাত পা ছড়িয়ে বসল। তারা সকলেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।

মুলারগান ট্রাকের ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

মেলটন বলল, শিবির থেকে বেরিয়ে আমরা ত সোজা আসছি। আপনাদের হালকা গাড়ির মত এই ভারী ট্রাকটা এত খারাপ রাস্তায় তাড়াতাড়ি যেতে পারে না। যাই হোক, কোন শিকার পেলেন?

না। আমার মনে হয় এখানে শিকারের মত কোন জীবজন্তু নেই।

শিকার যথেষ্টই আছে। এখানকার কোন জায়গায় স্থায়ীভাবে শিবির স্থাপন করলে শিকার পাওয়া যাবে।

মার্কস বলল, আমরা আজ কিছু বুনো মোষ দেখেছিলাম। কিন্তু মোষগুলো পালিয়ে গেল।

মুলারগান বলল, আমি পায়ে হেঁটে কিছুদূর তাদের অনুসরণ করেছিলাম। কিন্তু তারা পালিয়ে যায়।

আপনার ভাগ্য ভাল যে পালিয়ে গেছে।

 তার মানে?

 আপনি যদি তাদের একটাকে গুলি করতেন তাহলে আপনি নিজেই মারা পড়তেন।

মুলারগান বলল, তুমি যা খুশি বলতে পার। কিন্তু আমি গবাদি জাতীয় কোন পশুর ভয়ে ভীত নই।

মেলটন নিগ্রোদের সাহায্যে সেখানেই শিবির গড়তে লাগল। মুলারগান ও মার্কসকে বলল, আজকের মত এখানেই রাত কাটানো যাক। কাল সকালে ত ফিরে যেতেই হবে।

মুলারগান চীৎকার করে বলল, ফিরে যাব মানে? এখানে আমি শিকার করতে এসেছি। শিকার করব।

মেলটন বলল, আজ পথে একটা লোকের সঙ্গে আমার দেখা হলো। সে বলল এটা নিষিদ্ধ অঞ্চল। আমাদের চলে যেতে হবে।

সে আমাদের চলে যেতে বলার কে? সে কে তা বলেছিল তোমায়?

 তার নাম টারজান।

তাকে বলেছিলে আমি কে?

হ্যাঁ, বলেছিলাম। কিন্তু সেটা সে গ্রাহ্য করেনি।

 সে কি ভাবে, আমাকে আফ্রিকা থেকে তাড়িয়ে দেবে সে।

মেলটন বলল, সে যখন বলেছে তখন চলে যাওয়া উচিত।

মার্কস হেসে বলল, আমি এখনি চলে যাবার জন্য প্রস্তুত। এই জ্বর-সর্দি নিয়ে আফ্রিকায় থাকা উচিৎ নয়।

মুলারগান বলল, আমি ভাল শিকার না পাওয়া পর্যন্ত যাব না।

নিগ্রোরা ট্রাক থেকে মালপত্র নামাতে লাগল। একজন রাতের রান্নার জন্য আগুন জ্বালাল। অনেকে হাসিঠাট্টা ও গান করতে লাগল। একজন নিগ্রো মাথায় করে ভারী একটা বোঝা ট্রাক থেকে নামিয়ে শিবিরে ঢুকতে গিয়ে মুলারগানের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। মুলারগান পড়ে যায়। সে উঠে একটা চড় মারে। নিগ্রোটাকে।

মেলটন এগিয়ে এসে মুলারগানকে বলল, আর তুমি কখনো ওদের গায়ে হাত দেবে না, আমি অনেক সহ্য করেছি এতদিন। আর কারো গায়ে হাত দেবে না।

মুলারগান তখন রেগে গিয়ে বলল, তাহলে তোমারও একটা চড় খাবার মন হয়েছে।

কিন্তু সে মেলটনকে চড় মারতে উদ্যত হতেই পিস্তল উঁচিয়ে ধরল মেলটন। বলল, বাঁচতে চাও ত দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাও।

মুলারগান মুখ ঘুরিয়ে চলে গিয়ে মার্কসকে বলল, ইংরেজরা রসিকতা বোঝে না।

ওদের সকলের রাতের খাওয়া হয়ে গেলে একটা সিংহের গর্জন শুনতে পেল ওরা। মনে হলো। সিংহটা ওদের শিবিরের খুব কাছেই আছে।

মুলারগান বলল, সেই শুয়োরটা।

মেলটন বলল, কোথায় শুয়োর?

শব্দ শুনতে পাচ্ছ না?

মুলারগান ট্রাকের পাশে গিয়ে স্পটলাইট ঘোরাতেই দেখল একটা বড় সিংহ দাঁড়িয়ে রয়েছে। সিংহের চোখে জোর আলো পড়তে সে আস্তে আস্তে চলে গেল।

আফ্রিকায় বাবাঙ্গো নামে এক ধরনের আদিবাসী আছে। তাদের দেহগুলো খুবই বলিষ্ঠ। মাথাগুলো কামানো। দাঁতগুলো খুব সাদা ঝকঝকে না হলেও তারা নরখাদক। অন্যান্য জীবজন্তুর থেকে মানুষের মাংস খেতে তাদের ভাল লাগে বলেই তারা মানুষ খায়। তারা জীবজন্তু শিকারের মতই খাবার জন্য মানুষ। শিকার করে। অন্য সব অঞ্চলের লোকেরা তাদের ভয় করে।

সম্প্রতি টারজনের কাছে একটা খবর যায়, বাবাঙ্গোরা দখলিভুক্ত এক অঞ্চলের অধিবাসীদের আক্রমণ করেছে। টারজান তাই বহুদূর থেকে বহু পথ হেঁটে এ বিষয়ে তদন্ত করতে এসেছে। তার পিছনে। সর্দার মুভিরোর অধীনে একদল ওয়াজিরি যোদ্ধা আসছে।

মেলটনের সঙ্গে টারজনের যেদিন দেখা হয় তার পরদিন সকালে টারজান সেই প্রান্তরের কাছাকাছি বনের ভিতর দিয়ে পথ হাঁটছিল সচকিতভাবে। পথের ঘাসের ভিতর বিষাক্ত পোকা, গাছের উপর ওৎ পেতে থাকা চিতা, কালো পিঁপড়ে প্রভৃতি সব কিছুর সামনে কড়া নজর রেখে চলেছিল সে।

সহসা একটা মোটর গাড়ির শব্দ শুনতে পেল টারজান। তারপরই দেখল একদল জেব্রা ছুটে পালাচ্ছে আর একটা চলন্ত মোটরগাড়ি থেকে একটা লোক একটা সাব-মেশিনগান থেকে গুলি করছে। গুলি করতে করতে চলে গেল গাড়িটা। সেই গুলিতে অনেকগুলো জেব্রা মারা গেল, অনেকগুলো আহত হলো। কিন্তু অকারণে নিরীহ জন্তুগুলোকে মেরে চলে গেল গাড়িটার আরোহীরা। গাড়িটাতে ছিল মাত্র দু’জন লোক।

গাড়িটা যেদিকে গেল সেইদিকেই এগিয়ে যেতে লাগল টারজান। সে ভাবল, ঘটনাক্রমে লোকদুটোর সঙ্গে দেখা তার হবেই। তখন দেখা যাবে।

এদিকে মুলারগান তার মোটরগাড়িটা আরো কিছুদূর নিয়ে গিয়ে একটা খাদের কাছে থামল। তারপর মাকর্সকে বলল, যদি এমনি করে একদল সিংহের দেখা পেতাম জো, তাহলে কেমন মজা হত?

মার্কস বলল, চমৎকার হয়েছে। তোমার লক্ষ্য ভাল। সব তাড়িয়ে দিয়েছ ঝাঁকের মধ্যে গুলি করে।

খাদের কাছে এসে বনুটা থেমে গেছে। ওরা বসে কথা বলছিল। মুলারগান বলল, আমাদের এখন থামলে চলবে না। এমন সব জিনিস শিকার করে নিয়ে গিয়ে তার নমুনা দেখাতে হবে যা দেখে তাক লেগে যাবে সাংবাদিকদের।

সহসা একটা হাতি দেখতে পেয়ে তার সাব-মেশিনগানটা তুলে নিল মুলারগান। সে গুলি করল। কিন্তু একটা নয়, পর পর অনেকগুলো হাতি এগিয়ে আসছে এই দিকে। গুলিটা কোন হাতির গায়ে লাগেনি।

হাতিদের চোখ ছোট বলে তারা ওদের গাড়িটার কাছে এসে চারদিকে তাকাতে লাগল। বিপদটা কোনদিকে তা দেখতে কিছুটা সময় লেগে গেল হাতিগুলোর। এই অবসরে আবার গুলি ভরে গুলি করল মুলারগান। একটা হাতি পড়ে গেল। অন্যগুলো পালিয়ে গেল। কিন্তু একটা পুরুষ হাতি পাগলা হয়ে ছুটে এল। মুলারগান আর মার্কস গাড়িটার উল্টো দিকে চলে গেল। হাতিটা উল্টে দিল গাড়িটাকে। চাকাগুলো উল্টে গেল উপর দিকে।

হাতিটা আগেই গুলি খেয়েছিল। এবার উল্টে পড়ে গেল।

 মুলারগান বলল, আমাদের হাতের পিস্তল ছাড়া আর সব অস্ত্র গাড়িটার মধ্যে চাপা পড়ে গেল।

এদিকে টারজান বন্দুকের গুলির আওয়াজের সঙ্গে হাতিদের আর্তনাদ শুনতে পায়। সে বুঝতে পারল যে দু’জন শ্বেতাঙ্গ জেব্রাদের ঝাঁকে গুলি করেছে তারাই হাতিদেরও মারছে।

এক প্রচণ্ড রাগে অভিভূত হয়ে সেই শব্দ ধরে এগিয়ে যেতে লাগল টারজান। খাদের কাছে গিয়ে সে থামতেই দেখতে পেল মুলারগান আর মার্কস।

কিমা মারপিটের আশংকায় টারজনের কাঁধ থেকে একটা গাছের উপর বসে দেখতে লাগল কি হয়।

 টারজান তাদের কাছে গেলে মুলারগান তাকে বলল, কি চাও তুমি?

 মরা হাতিটাকে দেখিয়ে টারজান বলল, তোমরা এটাকে মেরেছ?

 মেরেছি ত কি হয়েছে?

পিস্তলটা হাতে ধরে বলল মুলারগান।

 টারজানও তোমাদের মারবে।

মুলারগান তার পিস্তল থেকে গুলি করতে না করতেই পা দিয়ে লাথি মেরে তার হাত থেকে পিস্তলটা ফেলে দিল টারজান। মার্কস-এর হাত থেকেও পিস্তলটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

মুলারগান বলল, তুমি টারজান না?

এই বলে টারজনের মুখে একটা ঘুষি মারতে গেলে সরে গেল টারজান। তারপর মুরালগানের মাথার। পাশে এমন একটা চড় মারল যাতে সে পড়ে গেল মাটিতে।

মার্কস ভয়ে লাফাতে লাফাতে চীৎকার করে মুলারগানকে বলতে লাগল, উঠে পড়। ওকে মেরে ফেল।

মুলারগান আবার উঠে দাঁড়িয়ে টারজানকে ঘুষি মারতে লাগল। কিন্তু তাতে কিছুই হলো না তার। টারজান এবার মুলারগানকে ধরে উপরে উঠিয়ে মাটিতে জোরে ফেলে দিল। তারপর তার বুকের উপর বসে তার গলাটা দু’হাত দিয়ে টিপে ধরল।

মুলারগান অস্পষ্টভাবে মার্কসকে বলতে লাগল, আমাকে বাঁচাও। আমাকে মেরে ফেলছে।

এমন সময় কিমা চীৎকার করে উঠল অন্য কারণে। কিমা চীৎকার করে টারজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। কিন্তু টারজান তখন একমনে লড়াই করাতে শুনতে পায়নি তা সময়ে।

মার্কসও দেখতে পায়। কিন্তু তখন বড় দেরী হয়ে গেছে। খাদের ওপার থেকে প্রায় একশো জন। বাবাঙ্গো এসে কখন ওদের ঘিরে ফেলেছে তা বুঝতে পারেনি ওরা। বাবাঙ্গোরা ওদের জীবন্ত ধরে নিয়ে যেতে চাইল। তাই ওরা ওদের কোনরকম আঘাত না করেই বেঁধে ফেলল পিছন থেকে।

টারজান কিছুটা লড়াই করল প্রথমে। কিন্তু সংখ্যায় ওরা অনেক বেশি ছিল বলে পেরে উঠল না। সেও বন্দী হলো।

বন্দীদের পিছনে বর্শা দিয়ে খোঁচা দিতে দিতে বাবাঙ্গোরা তাদের গায়ে নিয়ে গেল তাদের। কিমা তখন হতাশ হয়ে বনের শেষে সেই প্রান্তরটার দিকে ছুটে গেল।

বনের মধ্য দিয়ে একটা পায়ে চলা পথের উপর দিয়ে তিনজন শ্বেতাঙ্গ বন্দীকে তাদের গায়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল বাবাঙ্গোরা।

মার্কস এক সময় ভয়ে ভয়ে মুলারগানকে জিজ্ঞাসা করল, ওরা আমাদের নিয়ে কি করবে?

মুলারগান বলল, ঐ লম্বা চওড়া টারজান নামের লোকটাকে জিজ্ঞাসা করো।

মার্কস বলল, লোকটা মানুষ নয়, পশু। ওর গর্জন শুনেছিলে? ও তোমাকে ফ্লাইওয়েটের মত তুলেছিল আর হেভিওয়েটের মত মাটিতে ফেলেছিল। খুব ভাগ্য ভাল যে বেঁচে গেছ।

অবশেষে একটা ছোট নদী যেখানে একটা বড় নদীতে গিয়ে পড়েছে সেখানে এলোমেলোভাবে গড়ে ওঠা একটা অস্থায়ী শিবিরে গিয়ে থামল বাবাঙ্গোরা।

শিবিরের সামনে গিয়ে ওরা দাঁড়াতেই অনেক নারী ও শিশু ছুটে এল চীৎকার করতে করতে। নারীরা থুথু ফেলতে লাগল বন্দীদের উপর আর ছেলেরা ছড়ি দিয়ে মারতে লাগল। তখন যোদ্ধারা তাদের সরিয়ে দিল।

এরপর বন্দীদের গলায় দড়ি দিয়ে নিয়ে গিয়ে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হলো।

মার্কস অতিশয় ক্লান্ত হয়ে পড়ায় মাটিতে শুয়ে পড়ল। মুলারগান ঠেস দিয়ে বসে রইল। টারজান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারদিকের পরিবেশ খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। সে এক মনে শুধু মুক্তির কথা চিন্তা করতে লাগল।

সহসা কি একটা আর্তনাদ শুনে মার্কস তার সঙ্গীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। বলল, ওটা কিসের শব্দ? শুনতে পাচ্ছ?

নদীর দিক থেকে একটা আর্তনাদ আসছিল। কিন্তু নদীর ধারে গাছপালা থাকার জন্য ওরা কিছু দেখতে পাচ্ছিল না।

টারজান বলল, ওটা খাওয়ার থেকে আরও খারাপ। ওরা খাবার মাংসগুলোকে নরম করছে। যারা আর্তনাদ করছে তারা হলো কিছু নরনারী আর শিশু। তিন-চারদিন আগে ওদের হাত পা ভেঙ্গে দিয়েছে। ওদের মাথাগুলোকে বাঁশের লাঠির সঙ্গে বেঁধে এমনভাবে নদীর জলে ঝুলিয়ে রেখেছে যাতে ওরা ডুবে। না যায় বা আত্মহত্যা করতে না পারে। ওরা যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে। এইভাবে তিন চারদিন ওদের মৃত্যুযন্ত্রণার মধ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রেখে তারপর ওদের কেটে সেই মাংস খাবে।

একথা শুনে মুলারগানের মুখ সাদা হয়ে গেল। ভয়ে একেবারে ভেঙ্গে পড়ল মার্কস।

টারজান বলল, তোমরা ভয় পেয়ে গেছ। কষ্টভোগ করতে চাও না। কিন্তু জেব্রা আর হাতিগুলো তোমাদের আঘাতে অনেক কষ্ট অনেক যন্ত্রণা ভোগ করেছে।

মুলারগান বলল, ওরা পশু। কিন্তু আমরা মানুষ।

টারজান বলল, তোমরাও একদিক দিয়ে জন্তু। আহত হলে জন্তুদের মতই তোমাদেরও কষ্ট হয়। বাবাঙ্গোরা তোমাদের খাবার জন্য তোমাদেরও কষ্ট দেবে-এতে আমি খুশি। তোমরা বাবাঙ্গোদের থেকেও খারাপ। হাতি ও জেব্রাগুলোকে মারার কোন কারণ ছিল না তোমাদের।

এরপর তিনজনই চুপ করে রইল। সবাই ভাবতে লাগল। মার্কস ভয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। মুলারগানও ভেঙ্গে পড়ল। সব সাহস হারিয়ে ফেলল।

মুলারগান অবশেষে বলল, আমি তোমার কথাটি ভাবছি। সত্যিই আমরা জীবহত্যা করে আনন্দ পাই। এ কথাটা কোনদিন ভেবে দেখিনি। এখন বুঝেছি এ সব কাজ না করলেই ভাল হত।

সে রাত্রিতে বন্দী তিনজনকে এক জায়গায় শুতে দেওয়া হলো। সে রাত্রিতে উৎসবে মেতে রইল বাবাঙ্গোরা। তাদের কথাবার্তা থেকে টারজান বুঝতে পারল পরদিন রাত্রিতে বন্দী শ্বেতাঙ্গাদের হাত পা ভেঙ্গে জলে ভাসিয়ে দেবে।

টারজান মুলারগানকে বলল, আমি তোমার হাতের বাঁধন খুলে দেব প্রথমে। তার পর তুমি আমার বাঁধন খুলে দেবে।

মুলারগান বলল, ঠিক আছে।

বন্দীদের কাছে কোন প্রহরী ছিল না। টারজান জানত ওদের উন্মত্ত নাচগান বন্ধ হলেই ওরা পাহারার ব্যবস্থা করবে। সে প্রথমে মুলারগানের বাঁধনটা খুলে দিল। মুলারগান তারপর টারজনের হাতের বাঁধন খুলে দিল। মার্কস-এর বাঁধন আরো সহজে ভোলা হয়ে গেল।

তিনজনই এইভাবে মুক্ত হলে টারজান চুপি চুপি তাদের বলল, আমার পিছু পিছু তোমরা বুকে হেঁটে এস। কোন গোলমাল করবে না।

মুলারগান পশুহত্যার ব্যাপারে তার দোষ স্বীকার করায় টারজান তাদের একটা সুযোগ দিতে চায় তাদের মুক্ত করে।

 টারজান বুকে হেঁটে বনের দিকে ফাঁকা জায়গায়টার দিকে এগিয়ে গেল। সে একা ওদের সামনে দিয়ে ছুটে পালাতে পারত বনে। কারণ ওর গতিবেগ অবিশ্বাস্যভাবে দ্রুত। ওরা ধরতে পারত না ওকে। কিন্তু সঙ্গে আরও দু’জন লোক আছে। তাদের নিয়ে কোনরকমে ওদের অলক্ষ্যে অগোচরে বনের মধ্যে চলে যাওয়াই হলো ওর একমাত্র লক্ষ্য।

ওরা এইভাবে প্রায় একশো ফুট যাওয়ার পর কয়েকবার হাঁটতে থাকে মার্কস। সেই শব্দে সচকিত হয়ে ওঠে বাবাঙ্গোরা।

টারজান তখন ওদের বলে, এবার উঠে পড়ে বনের দিকে ছুটতে থাক।

ওরা সবাই বনের দিকে ছুটতে থাকলে বাবাঙ্গোরাও ওদের ধরার জন্য ছুটতে থাকে। প্রথমে মার্কসকে ওরা সহজেই ধরে ফেলল। তারপর মুলারগানকে। টারজানকে ওরা ধরতে পারল না মুলারগানও হয়ত পালাতে পারত। কিন্তু সে মার্কসকে ফেলে রেখে উদারতার বশবর্তী হয়ে পালাতে চায়নি।

মুলারগানকে ওরা ধরে ফেললেও সহজে কিন্তু ধরা দিতে চায়নি সে। সে পর পর ঘুষি চালিয়ে কয়েকজনকে মাটিতে ফেলে দেয়। কিন্তু পিছন থেকে একজন বাবাঙ্গো এসে বর্শার লম্বা বাটটা দিয়ে তার মাথায় এমনভাবে মারল যে সে পড়ে গেল মাটিতে।

ফাঁকা জায়গাটার শেষ প্রান্ত থেকে বনটা শুরু হয়েছে। একটা গাছের উপরে উঠে টারজান দেখতে লাগল। মুলারগানের বীরত্ব ও সাহসের জন্য মনে মনে প্রশংসা না করে পারল না সে। একজনকে বাঁচাতে গিয়ে সে তার আত্মত্যাগ ভিত্তিক যে বীরত্বের পরিচয় দিল সে আজ সে বীরত্ব বনের পশুদের মধ্যে দেখাই যায় না।

কিমা আবার প্রান্তর পার হচ্ছে। কিন্তু এবার একা একা নয় বা টারজনের কাঁধে চড়ে নয়, এবার সে ওয়াজিরি সর্দার মুভিয়োর কাঁধে চড়ে সেই প্রান্তরটার উপর দিয়ে যাচ্ছিল। টারজনের মত মুভিরোর কাঁধের উপর থাকলেও কিমার সাহস দারুণ বেড়ে যায়। তার হৃদয়টা হয়ে ওঠে সিংহের মত।

মেলটন তার লরী নিয়ে মুলারগানদের দেখতে না পেয়ে বন থেকে ফিরে আসার পথে মুভিয়োর নেতৃত্বে ওয়াজিরিদলটাকে দেখতে পেল।

সে তার বাইনোকুলার দিয়ে ভাল করে দেখল দলটাকে। তারা আদিবাসী যোদ্ধা হলেও তাদের হাবভাব মোটামুটি বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হলো। তবু সে লরীর উপর বসে থাকা, নিগ্রোদের সব বাড়তি রাইফেলগুলোকে ঠিক করে রাখতে বলল।

কিন্তু একজন নিগ্রো বলল, ওরা কিছু করবে না। ওদের গুলি করবেন না। তাহলে আমাদের সকলকে মেরে ফেলবে। ওরা হলো বিরাট যোদ্ধা, ওদের বলে ওয়াজিরি। এই অঞ্চলের কোন একটা জায়গা বাবাঙ্গোর আক্রমণ করছে তাই ওরা বাবাঙ্গোদের তাড়িয়ে দিতে যাচ্ছে। তবে ওরা আমাদের কোন ক্ষতি করবে না।

মুভিরো ট্রাকের সামনে এসে হাত তুলে ট্রাক থামাল।

 মলটন গাড়ি থামাল। মুভিরো তাকে জিজ্ঞাসা করল, কোথা হতে আসছ?

মেলটন খাদের কাছে আসার পথে জেব্রাদের মৃতদেহ দেখে বুঝতে পারল মুলারগানরা কোন্ পথে গেছে। আরো এগিয়ে গিয়ে একটা খাদের ধারে মুলারগানের মোটরটা উল্টোন অবস্থায় দেখে।

মেলটন কাছে গিয়ে যা যা দেখেছিল এবং যাদের খোঁজে সে গিয়েছিল তা বলল সব।

মুভিরো বলল, তোমাদের বন্ধু দু’জন ছাড়া আর কোন শ্বেতাঙ্গকে দেখেছিলে?

গতকাল টারজান নামে এক শ্বেতাঙ্গকে দেখেছিলাম।

তোমাদের লোকের সঙ্গে তিনিও কি ধরা পড়েছেন?

মেলটন বলল, তা ত জানি না।

মুভিরো বলল, আমাদের সঙ্গে এসে বনের প্রান্তে শিবির স্থাপন করো। তোমার বন্ধুরা যদি বেঁচে থাকে তাহলে তাদের আমরা ফিরিয়ে আনবই।

যাই হোক, ওয়াজিরি যোদ্ধারা বেশ জোর কদমে চলতে লাগল। মেলটন তার ট্রাকটা ধীরে গতিতে চালিয়ে তাদের পিছু পিছু যেতে লাগল।

এদিকে বাবাঙ্গোরা সারারাত উৎসবে মেতে থাকার পর গভীরভাবে সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে। তারা দুপুরের আগে উঠবে না। তাদের একজন বন্দী পালিয়ে গেছে। তার উপর মুলারগানের আঘাতে তাদের কয়েকজনের চোয়াল আর নাক ভেঙ্গে গেছে।

বাবাঙ্গোদের সঙ্গে লড়াইয়ে মুলারগানের মাথাটা ব্যথা করছিল। মার্কস-এর সর্বাঙ্গ ব্যথা করছিল। সে বলল, নোংরা লোকগুলো আমাদের দেহের তিন চার জায়গার হাড়গোড় ভেঙ্গে জলে তিন চার দিন। ডুবিয়ে রাখবে। তারপর খাবে।

মুলারগান তাকে ধমক দিয়ে বলল, চুপ করো। আমি এসব কথা ভুলে যেতে চাইছি।

টারজান ওয়াজিরিদের সন্ধানে বন পার হয়ে সেই প্রান্তরের কাছে গেল। কিন্তু তাদের দেখা না পেয়ে আবার সে বনের মধ্য দিয়ে গাছে গাছে বাবাঙ্গোদের বস্তির সামনে এসে হাজির হলো। সে বুঝতে পারল সে একা কখনো তাদের কবল থেকে বন্দী দু’জনকে মুক্ত করতে পারবে না।

অন্য পথ দিয়ে সে শিবিরে পৌঁছল। সেই নদীটার ধারে এসে দেখল নদীর জলে ভিজিয়ে রাখা বন্দীরা তখনো তেমনিভাবে আছে। শিবিরের কাছে সে সিংহের গন্ধ পেল। গন্ধ শুঁকে সে বুঝল একটা সিংহ আর সিংহী ক্ষুধার্ত অবস্থায় শিকারের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

প্রায় এক ডজন বাবাঙ্গো যোদ্ধা মুলারগান আর মার্কস-এর কাছে এসে তাদের বাঁধন কেটে দিল। তারপর তাদের দেহদুটোকে জোরে নাড়া দিয়ে তাদের দাঁড় করিয়ে দিল।

এরপর তারা তাদের বস্তির মধ্যভাগে নিয়ে গেল। সেখানে একটা গাছের তলায় তাদের সর্দার আর যাদুকর ডাক্তার বসেছিল। যোদ্ধারা অর্ধবৃত্তাকারে তাদের সর্দারকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল। তাদের পিছনে ছিল নারী আর শিশুরা।

তখন রাত্রিকাল বলে শিবিরের ধারে আগুন জ্বলছিল।

বন্দী দু’জনকে মাটিতে চিৎ করে ফেলে দেয়া হলো। দু’জন যোদ্ধা তাদের প্রতিটি হাত পা ধরে ছিল।

অদূরে একটা গাছের উপরে ঘন পাতার আড়াল থেকে সবকিছু লক্ষ্য করছিল এক নগ্নপ্রায় শ্বেতাঙ্গ। বন্দীদের উদ্ধার করার একটা সুযোগ খুঁজছিল সে সুযোগ না পেলে সে কিছুই করতে পারবে না। সে ওদের বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন দিতে পারবে না।

এদিকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের কাছ থেকে দুটো সিংহ এক নিমেষহারা চোখে তাকিয়ে ছিল ঘটনাস্থলের দিকে। তাদের লেজদুটো নড়ছিল।

এমন সময় নদী থেকে একটা আর্তনাদের শব্দ পেয়ে সিংহীটা সেইদিকে চলে গেল। কিন্তু সিংহটা লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বাবাঙ্গোদের দিকে।

যাদুকর ডাক্তার বন্দী দু’জনের দিকে এগিয়ে এল। তার এক হাতে ছিল একটা জেব্রার লেজ। সে লেজের উপর পালক লাগানো ছিল। আর এক হাতে ছিল একটা লাঠি।

প্রার্থনার কথাগুলো স্মরণ করার চেষ্টা করল মুলারগান। তাদের দু’জনের উপর জেব্রার লেজটা বুলিয়ে তাদের দিকে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল। সে আর কি সব বিড় বিড় করে বলতে লাগল।

এরপর হঠাৎ এক সময় সে একটা লাফ দিয়ে মুলারগানের শায়িত দেহটার উপর তার লাঠিটা ঘোরাতে লাগল। দু’জন যোদ্ধা তাকে আলগা করে ধরে ছিল।

যোদ্ধাদের হাতগুলো এক ঝটকায় সরিয়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল মুলারগান। তারপর যাদুকর ডাক্তারের মুখের উপর এমন জোরে একটা ঘুষি মারল যার ফলে তার চোয়াল ভেঙ্গে গেল আর সে মাটিতে পড়ে গেল।

সমবেত যোদ্ধারা চীৎকার করে ঘিরে ধরল মুরালগানকে।

এদিকে সিংহীটা নদীর ধার থেকে তার ধারাল নখওয়ালা একটা থাবা বাড়িয়ে বাবাঙ্গোদের বলি একজন নারীর ভেসে থাকা মাথাটাকে ধরে ফেলল। মেয়েটি আর্তনাদ করে উঠতেই বাবাঙ্গোরা সেদিকে মনোযোগের সঙ্গে তাকাতেই সিংহটা তাদের আক্রমণ করল। তার ভয়ঙ্কর গর্জনে মাটি কাঁপতে লাগল।

বাবাঙ্গোরা তখন বন্দী দু’জন আর আহত যাদুকর ডাক্তারকে ফেলে রেখে পালিয়ে গেল যেদিকে পারল।

মুলারগান উঠে দাঁড়াবার আগে সিংহটা তার কাছে গিয়ে পড়ল। শায়িত লোকটির ভীত সন্ত্রস্ত চোখপানে তাকিয়ে রইল সিংহটা। মুলারগান তার নিঃশ্বাসের গন্ধ পাচ্ছিল। তার হলুদ চোয়াল আর দাঁত দেখতে পাচ্ছিল।

এমন সময় একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল মুলারগান। এ দৃশ্য সত্যিই অভূতপূর্ব।

দেখল টারজান গাছ থেকে নেমে লাফিয়ে পড়ল সিংহটার উপর।

দেখল টারজনের পাদুটো সিংহের ছোট ছোট পা দুটোকে জড়িয়ে ধরেছে। তার পেশীবহুল লৌহ কঠিন হাতদুটো সিংহের গলাটা জড়িয়ে ধরে আছে। টারজান তার দেহের সমস্ত ভার দিয়ে চেপে আছে সিংহটার পিঠে।

সিংহটা তার পিছনের পায়ের উপর ভর দিয়ে খাড়া টারজনের দেহটাকে ফেলে দিতে চাইছে আর ভয়ঙ্করভাবে গর্জন করছে। কিন্তু কিছুতেই মুক্ত করতে পারছে না নিজেকে।

মুলারগান দেখল সিংহটা এবার নিজে থেকে মাটিতে পড়ে টারজানকে ফেলে দেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাও পারছে না।

জীবনে বহু লড়াই, বহু কুন্তীর প্যাঁচ দেখেছে মুলারগান। কিন্তু সিংহ ও মানুষে এমন প্রাণপণে লড়াই জীবনে কখনো কোথাও দেখেনি বা তার কথা শোনেওনি।

সিংহদের শক্তির অনুপাতে সহ্যশক্তি নেই। তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল সিংহটা। সে এবার চারপায়ের উপর ভর দিয়ে কোনরকমে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল।

টারজান তখন একটা হাত সিংহটার ঘাড় থেকে ছাড়িয়ে খাপ থেকে তার শিকারের ছুরিটাকে বার করল। এই সুযোগে সিংহটা ঘুরে টারজনের হাতটাকে কামড়াতে গেল। কিন্তু টারজান তার ছুরিটা সিংহের ঘাড়ের উপর আমূল বসিয়ে দিল।

সিংহটা বিকট গর্জন করতে করতে যতবার শূন্যে লাফ দিতে লাগল ততবারই তার ঘাড়ে ও পাঁজরে ছুরিটা সজোরে আমূল বসিয়ে দিতে লাগল টারজান।

সিংহটা পড়ে গেল তার মৃতদেহের উপর একটা পা রেখে আকাশের পানে মুখ তুলে বিজীয় বাঁদর গোরিলাদের মত ভয়ঙ্করভাবে চীৎকার করে উঠল টারজান। তা শুনে মাটিতে বসে পড়ল মার্কস। মুলারগানের মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল। বাবাঙ্গোরা সিংহগর্জনের থেকে আরো ভয়ঙ্কর সেই অচেনা চীৎকার শুনে ছুটে আরো দূরে পালাতে লাগল।

টারজান বন্দী দু’জনকে মুক্ত করে সেই নৈশ অন্ধকার বনের মধ্য দিয়ে সেই প্রান্তরের কাছটায় নিয়ে এল।

পরদিন আপন আপন লোকদের সঙ্গে মিলন হলো সকলের। মুলারগান আর মার্কস মেলটনের সঙ্গে এক শিবিরে রইল। টারজান ওয়াজিরিদের সঙ্গে আলোচনা করতে লাগল। বাবাঙ্গোদের ঐ অঞ্চল হতে তাড়াবার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠতে লাগল তারা।

যাবার আগে টারজান মুলারগান ও মার্কসকে বলল, আফ্রিকা থেকে সোজা আমেরিকায় চলে যাবে। আর কখনো আসবে না।

মুলারগান বলল, কখনো না এ কথাটা কতদিন মনে রাখতে পারব তা জানি না।

মার্কস টারজানকে বলল, শোন মিস্টার, তুমি যদি আমার হয়ে একবার কুস্তি লড়ো তাহলে তোমাকে একশো স্বর্ণমুদ্রা দেব।

টারজান মুখ ঘুরিয়ে ওয়াজিরিদের সঙ্গে চলে গেল সেখান থেকে।

মার্কস মুলারগানকে বলল, দেখলে, লোকটা একশো স্বর্ণমুদ্রা প্রত্যাখ্যান করে চলে গেল। তবে তোমার পক্ষে ভালই হয়েছে। কারণ ও একবার লড়াইয়ে নামলে এক রাউন্ডেই তোমার চ্যাম্পিয়নপদ কেড়ে নিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *