টারজন ও জঙ্গলে খুন (টারজন এ্যাণ্ড দি জাঙ্গল মার্ডারস)

টারজন ও জঙ্গলে খুন (টারজন এ্যাণ্ড দি জাঙ্গল মার্ডারস)

লেফটেন্যান্ট সিসিল বার্টন ভূ-মধ্যসাগরের উপর দিয়ে দক্ষিণ দিকে আফ্রিকার উপকূলভাগের দিকে উড়ে চলেছিল। সে হঠাৎ পশ্চিমে ফিরে লন্ডনে চলে যেতে পারত। কিন্তু ইংরেজ সরকার থেকে নির্দেশ এসেছে তাকে আফ্রিকার কেপটাউনে যেতে হবে। যাবার পথে বঙ্গানিতে নেমে তার রাখা সেখানকার রেসিডেন্ট কমিশনারের হাতে নক্সাটা দিয়ে যেতে হবে।

বঙ্গানিতে একটা বিমানবন্দর ছিল। কিন্তু সেটা জরুরি অবস্থায় কাজ চালানোর জন্য ব্যবহৃত হত। সেখানে বিমানে তেল নেবার ব্যবস্থা আছে কি না তা না জানায় বার্টন ঠিক করল সে তিউনিসে নেমে ট্যাঙ্কে তেল ভরে নেবে।

সে যখন ট্যাঙ্কে তেল ভরছিল আর অফিসারদের সঙ্গে কথা বলছিল তখন তিউনিসের একজন অধিবাসী তাকে ইংরেজি ভাষায় বলল, ইতালীরা তোমাকে মারতে মারতে কেপটাউনে নিয়ে যাবে যদি বেশিক্ষণ এখানে থাক।

বার্টন বুঝল, ইতালীয় সরকার নিশ্চয় তার খোঁজ করছে এবং তাকে ধরার জন্য পিছু নিয়েছে।

তাই তেল ভরেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে বিমান ছেড়ে দিয়ে আকাশে উঠল বার্টন। বুঝল তিউনিসের স্থানীয় লোক তাকে সতর্ক করে দিয়ে ভালই করেছে। তার উপকার করেছে।

বারবার পিছন ফিরে আকাশপথে দেখতে লাগল বার্টন কোন অনুসরণকারী বিমান তার পিছু পিছু আসছে কি না। তিউনিসের বিমানবন্দরে তার মোট সময় গেছে আধঘণ্টা। তখন গোধূলিবেলা। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসতে তখনো কিছু দেরী আছে। তাই বার্টন ভাবল সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত যদি সে অনুসরণকারীদের দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকতে পারে তাহলে রাত্রির অন্ধকারে তাকে ধরতে পারবে না। তারা। সে যাচ্ছিল বঙ্গানি বিমানবন্দরের দিকে। কেপটাউনে যাবার আগে সেখানে থামবে সে।

সহসা পিছন ফিরতেই অস্তম্লান সূর্যের শেষ রশ্মিতে বার্টন এক সময় দেখল তার পিছনে অনেক দূরে একটা উড়ন্ত বিমানের রূপালি পাত চকচক করছে।

তার বিমানের আলো দেখে পিছনের বিমান সারারাত ধরে অনুসরণ করে আসতে লাগল। বিমানটা তার বিমানের থেকেও দ্রুতগামী। তাই তার খুব কাছে কাছে আসছে।

শত্রুদের আসল উদ্দেশ্যের কথা বুঝতে পারল বার্টন। শত্রুরা তাকে চায় না, চায় শুধু সেই নক্সাটা আর তার সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র। একবার সে কোন রকমে বঙ্গানিতে পৌঁছতে পারলেই আর তার কোন ভয়ই থাকবে না। তার নক্সা ও সরকারি কাগজপত্র সব নিরাপদে রেখে দিতে পারবে। তার যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে।

কিন্তু তা আর হলো না। সকাল হতেই বার্টন দেখল অনুসরণকারী বিমানটা তার একেবারে কাছে বাঁ দিকে এসে পড়েছে। তার একদিকের পাখাটা প্রায় ঠেকছিল তার বিমানের পাখায়।

বার্টন দেখল সেটা ইতালির বিমানবাহিনীর এক অনুসন্ধানকারী বিমান। ইতালীয় সামরিক বিভাগের একজন অফিসার সেটা চালাচ্ছে। এ ছাড়া সে বিমানে যে দু’জন যাত্রী ছিল তাদের চিনত না বার্টন। তবে তার মনে হলো তারাই হলো জুবানোভ আর ক্যাম্পবেল। তাদের কখনো চোখে দেখেনি এবং চিনত না। তবু তার মনে হলো তারা ছাড়া আর কেউ নয় এই দু’জন যাত্রী।

উড়ন্ত বিমান দুটোর পিছনে ছিল উন্মুক্ত প্রান্তর। অনুসরণকারী বিমানের চালক তাকে প্রায়ই থামতে বলেছিল। কিন্তু বার্টন থামবে না। সে দেখছিল আর মাত্র পঞ্চাশ মাইল পরেই বঙ্গানির বিমানবন্দর। সুতরাং সে ইশারায় জানাল সে থামবে না।

তখন পিছনের বিমান থেকে মেশিনগানের গুলি ছুটে এসে তার বিমানের পিছনে লাগল। বার্টনের হাতে তখন ছিল মাত্র একটা পিস্তল। সেই পিস্তল থেকে সে বিমানের কন্ট্রোলরুমের যাতে ক্ষতি হয় তার জন্য আরো তিন-চারবার গুলি করল সে।

পিছনের বিমানটা তখন তার দিকে পরিবর্তন করল। মনে হলো সেটা নামতে শুরু করেছে। বার্টন তখনো এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু যাবার আগ তার শত্রুরা চরম আঘাত হেনে গেল তাকে। মেশিনগান থেকে আবার গুলি করতে সে গুলির আঘাতে তার বিমানের পিছনের রাডার ও স্টেবিলাইজার ভেঙ্গে গেল। বিমানটা ঘুরতে লাগল। ঘুরতে ঘুরতে নিচে নামতে লাগল।

বার্টন তখন ইঞ্জিন থেকে বেরিয়ে এসে প্যারাসুটে করে মাটিতে নামল। নামার সময় দেখল অনুসরণকারী শত্রু বিমানটা দক্ষিণ দিকে নিচে নামতে নামতে বনের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

একই বনের মধ্যে দু’জায়গায় ভেঙ্গে পড়ে থাকা এই বিমান দুটিকে দেখে টারজান।

প্যারাসুট থেকে বাইরে এসে বার্টন দেখল, চারদিকে শুধু বন আর বন। কোথাও কোন জনবসতি বা জনপ্রাণী নেই। দেখল আফ্রিকার বিশাল গভীর জঙ্গলের মাঝখানে এসে পড়েছে সে। তার মনে হলো এখান থেকে পূর্ব দিকে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে পড়বে বাসেলি।

বার্টন দেখল তার বিমানটা এক ফুট দূরে পড়েছে। ইঞ্জিনে আগুন লাগেনি। ইঞ্জিনটা কেটে দিয়েছিল সে শুধু। বিমানে গিয়ে কিছু খাবার আর গুলি নিয়ে এসে তার ধারণামত পথ ধরে বঙ্গানির দিকে রওনা হয়ে পড়ল সে।

সে বুঝতে পারল তার অনুসরণকারীদের বিমানটাও এখান থেকে কিছু দূরে পড়েছে এবং তারা তার খোঁজে বেরিয়ে পড়বে নিশ্চয়। সে ভাবল বঙ্গানি। যদি এখান থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে হয় তাহলে আজ থেকে তৃতীয় দিনের মধ্যে সে পৌঁছবে সেখানে।

কিন্তু বার্টন জানত না যে এ অঞ্চলে সিংহ আছে এবং এখানকার আদিবাসীরা মোটেই বন্ধুভাবাপন্ন নয়। সে আরও জানত না বঙ্গানি এখান থেকে পঞ্চাশ মাইল নয়, তিনশো মাইল দূরে অবস্থিত।

সিসিল বার্টনের পথে বুইরো নামে এক নরখাদক আদিবাসীদের বস্তি ছিল। কিন্তু সে তাদের দেখা না পাওয়ায় সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় পার হয়ে গেল তাদের অঞ্চলটা। অথচ এই আফ্রিকার জঙ্গলের মধ্যে যার জন্ম সেই বাঁদরদলের রাজা টারজান ঘটনাক্রমে বুইরোদের আকস্মিক আক্রমণে আহত ও বন্দী হলো।

টারজান সেদিন প্রতিকূল বাতাসে বনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল তখন অনুকূল বাতাসের অভাবে কোন গন্ধ-সূত্র না পাওয়ায় সে মোটেই জানতে পারেনি প্রায় বিশজন বুইরো তার পথ ধরেই আসছে। তারা শিকার করতে করতে এসে পড়ে সেই দিকে।

তারা খুবই নিঃশব্দে তার দিকে এগিয়ে আসছিল বলে তাদের পদক্ষেপের কোন শব্দ শুনতে পায়নি টারজান।

এমন সময় তার বাঁ দিকে একটা আহত সিংহকে দেখতে পেল সে। সিংহটার গায়ের এক পাশ থেকে রক্ত পড়ছিল। সিংহটা হঠাৎ ঘুরে আক্রমণ করল টারজানকে। টারজান তার ডান কাঁধ থেকে ভারী বর্শাটা নামিয়ে তা দিয়ে সিংহটাকে মারতে উদ্যত হতেই পিছন থেকে বুইরোরা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর।

তাদের সর্দার পিঙ্গুর ছেলে চেমিঙ্গো চিনতে পেরেছিল টারজানকে। এই চারজনই একবার তাদের গাঁ থেকে তাদের এক বন্দীকে ছিনিয়ে নিয়ে এসে বোকা বানায় তাকে।

চেমিঙ্গো তাই সময় নষ্ট না করে তার বর্শা দিয়ে টারজনের পিঠে আঘাত করল। তবে আঘাতটা তত জোর হয়নি, তেমন আহত হলো না টারজান। টারজানও তার পিঠের তৃণ থেকে একটা তীর নামাল।

এদিকে সিংহটা তখন ঢাল হাতে একজন বুইয়েরা যোদ্ধার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ফেলে দিল। তখন অন্য যোদ্ধারা একযোগে আক্রমণ করে ঘায়েল করে ফেলল সিংহটাকে।

চেমিঙ্গো এবার খুশি হয়ে বন্দী টারজান আর সিংহের একটা মৃতদেহ নিয়ে বিজয়গর্বে তাদের গায়ে গিয়ে হাজির হলো।

তাদের গাঁয়ের যাদুকর ডাক্তার বন্দী অবস্থায় না রেখে তখনি মেরে ফেলতে বলল টারজানকে। কিন্তু গাঁয়ের অনেকে টারজানকে ছেড়ে দিতে বলল। কারণ তাকে বধ করলে তার মৃত আত্মা গায়ের অনেক ক্ষতি করবে।

তখন চেমিঙ্গোর বাবা সর্দার পিঙ্গু একটা আপোষ করল।

পিঙ্গু হুকুম দিল, বন্দীকে ভাল করে বেঁধে উপযুক্ত পাহারার মধ্যে রেখে দাও। তার ক্ষত স্থানের চিকিৎসা করো। এর মধ্যে যদি কোন অশুভ ঘটনা না ঘটে তাহলে অন্যান্য বন্দীদের মত তারও অবস্থা হবে। তখন ভোজন উৎসব চলবে।

টারজনের ক্ষত স্থান থেকে রক্ত ঝরা বন্ধ হয়ে গেল। সাধারণ মানুষ হলে সেই ক্ষততেই মৃত্যু হত। তার। কিন্তু টারজান সাধারণ মানুষ নয়। এরই মধ্যে সেরে উঠেছে সে। মুক্তির কথা ভাবতে শুরু করে দিয়েছে।

বুইরোরা তাকে শক্ত করে বেঁধে রেখেছিল। প্রতিদিন রাতে তারা বাঁধনটা শক্ত করে দিত। আবার টারজান তার পরে একটু একটু করে আলগা করে দিত সে বাঁধন যাতে তার হাতে পায়ের রক্ত চলাচলে কোন অসুবিধা না হয়।

টারজান বুঝতে পারে তারা ওকে খাইয়ে মোটা করতে চাইছে। তার শক্ত পেশীবহুল দেহটার মাংস খেতে ওদের ভাল লাগবে না। তাই তার দেহে চর্বির সঞ্চার করে ওর দেহটাকে নরম করতে চায়।

বন থেকে বাতাসে ভেসে আসা অনেক শব্দই শুনতে পায় সে। শীতা বা চিতা বাঘের ডাক, ভাঙ্গো বা হায়েনার অট্টহাসি, নুমা বা সিংহের গর্জন-অনেক কিছুই শুনতে পায় সে।

সহসা একটা শব্দ শুনে সজাগ হয়ে ওঠে সে। মাথাটা দোলাতে দোলাতে মন্ত্র উচ্চারণের মত মুখ থেকে একটা শব্দ বার করতে থাকে। প্রহারারত রক্ষী তাকে জিজ্ঞাসা করে, কি করছ?

টারজান বলে, আমি প্রার্থনা করছি।

রক্ষী পিঙ্গুর কাছে গিয়ে কথাটা জানালে সে বলে, ঠিক আছে। ওকে প্রার্থনা করতে দাও।

রক্ষী এসে দেখে সেইভাবে প্রার্থনা করতে করতে মাঝে মাঝে চীৎকার করে উঠছে টারজান।

টারজান বুঝতে পারে তার চীৎকারে কাজ হচ্ছে। কানে এক বাঞ্ছিত শব্দ আর নাকে এক আকাঙ্খিত গন্ধ পায় সে। বুইরোরা এসব কিছুই বুঝতে পারে না।

টারজান যখন এক একবার গলা ফাটিয়ে চীৎকার করে তখন বুইরোরা ভাবে তার গলায় খুব জোর আর সে তার দেবতাদের শোনাবার জন্য এত জোরে চীৎকার করছে।

এদিকে জঙ্গলের গভীরে তখন টারজনের হাতি-বন্ধু ট্যান্টর একদল হাতির সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সে ছিল দলপতি। সে হঠাৎ টারজনের ডাক শুনতে পায়। সে তখন চীৎকার করে তার দলের অন্য সব হাতিদের জড়ো করে এক জায়গায়। তারপর একযোগে টারজনের গলার শব্দ লক্ষ্য করে বুইরোদের বস্তির দিকে আসতে থাকে।

গাছপালা ভেঙ্গে গর্জন করতে করতে গায়ের দিকে আসতে থাকা হাতির দলের শব্দটাকে টারজানই। প্রথমে শুনতে পায়। হাসি ফুটে ওঠে টারজনের ঠোঁটে। তার প্রার্থনায় তাহলে কাজ হয়েছে।

টারজান এবার স্পষ্ট শুনতে পায় কাঠের গেট ভেঙ্গে গাঁয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে মত্ত হাতির দল। সে তখন জোরে চীৎকার করে ওঠে, ট্যান্টর ট্যান্টর, তোমরা আমার কাছে এস, এই যে আমি।

কিন্তু টারজনের ডাক শোনবার কোন প্রয়োজন ছিল না হাতিদের। তার গন্ধ তারা পেয়েছিল।

গোটা গাঁটাকে বিধ্বস্ত করে সব কুঁড়েগুলোকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়ে টারজনের ঘরের সামনে এসে উপস্থিত হল হাতিরা। তারপর ঘরের চালটাকে তুলে ফেলে টারজানকে শুড় দিয়ে পিঠে উঠিয়ে নিল তার বন্ধু ট্যান্টর।

হাতির পিঠে উঠেই টারজান অন্য হাতিদের কি করতে হবে না হবে নির্দেশ দিতে লাগল। গোটা গাটা একেবারে বিধ্বস্ত হলে এবং বুইবোরা হাতিদের অত্যাচারে গা ছেড়ে সাময়িকভাবে পালিয়ে গেলে টারজান হাতির দলকে বনে ফিরে যাবার নির্দেশ দিল। টারজনের হাত দুটো বাঁধা ছিল তখনো। হাতির পিঠে চেপে বনে ফিরে গেলে বাদরেরা খুলে দিল তার হাতের বাঁধন।

ট্যান্টরকে আদর করে হাতিদের কাছ থেকে বিদায় নেবার পর আবার গাছে উঠে যাত্রা শুরু করল টারজান। কিন্তু এবার আর বিদেশী বিমান যাত্রীদের খোঁজে নয়। সেই ইংরেজ বিমানযাত্রী হয়ত এতদিনে আর বেঁচে নেই। হয় সে বনের মধ্যে না খেয়ে মারা গেছে অথবা কোন হিংস্র জন্তুর পেটে গেছে।

যাই হোক, এখন বঙ্গানি যেতে হবে। সেখানকার রেসিডেন্ট কমিশনার তার বন্ধুবর টারজানকে ঢোল সহরৎ করে খবর পাঠিয়েছেন সে যেন অবিলম্বে দেখা করে তার সঙ্গে। বুইরোদের গায়ে বন্দী অবস্থায় থাকার সময়েই এই ঢোল সহরতের কথা শুনতে পায় সে।

আফ্রিকার গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিনের পর দিন ধরে পথ চলাকালে দু’দুবার সিংহের কবলে পড়েছিল বার্টন। কিন্তু দুটোরই কাছাকাছি একটা গাছ পেয়ে যাওয়ায় সেই গাছের উপর উঠে পড়ে প্রাণ বাঁচায় সে। একবার সারাদিন গাছে উঠে বসে থাকতে হয় সিংহের ভয়ে। তৃষ্ণায় একটু জল পর্যন্ত খেতে পায়নি। অবশেষে অধৈর্য হয়ে শিকারের আশা ছেড়ে চলে যায় সিংহটা। আর একদিন আর একটা সিংহের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। কিন্তু সিংহটার পেট ভর্তি ছিল বলে সে কোন মনোযোগ দেয়নি বার্টনের দিকে। বার্টন। অবশ্য ভাবত সিংহমাত্রই সব সময় নরখাদক। তারা জীবজন্তুকে দেখলেই বা হাতের কাছে পেলেই খেয়ে ফেলে।

কিন্তু খাদ্যের সমস্যাটা দিনে দিনে প্রকট হয়ে উঠল বার্টনের কাছে। খেতে না পেয়ে তার শরীর রোগা হয়ে যেতে লাগল দিনে দিনে। হাতের কাছে ফলমূল যা পেতে লাগল তাই খেতে লাগল।

কিন্তু দেহটা তার শীর্ণ হলেও মনে তখনো জোর ছিল। আশা ছিল বার্টনের।

একদিন সকালের দিকে পাহাড়ের ধারে বসেছিল সামনে উপত্যকাটার দিকে তাকিয়ে। সহসা দেখতে পেল উপত্যকাটার উপর থেকে একদল যাত্রীর একটা সফরী এগিয়ে আসছে তার দিকে।

বহুদিন পর আজ প্রথম মানুষের দেখা পেল আফ্রিকার জঙ্গলের মধ্যে। আনন্দে চীৎকার করে উঠল বার্টন। দেখল সফরীতে রয়েছে একদল শ্বেতাঙ্গ পুরুষ আর দু’জন শ্বেতাঙ্গ মহিলা। কুলিরা মালপত্র বয়ে নিয়ে আসছিল পিছনে। রোদের তাপ থেকে মাথা বাঁচানোর জন্য শ্বেতাঙ্গদের মাথায় ছিল শিরস্ত্রাণ। সামনেই একজন স্থানীয় পথ-প্রদর্শক ছিল।

সফরীর কাছে ছুটে গেল বার্টন। তার চোখে জল এসে গিয়েছিল, আনন্দে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। সে হাত বাড়িয়ে ডাকতে লাগল তাদের।

তার ডাকে থেমে গেল চলমান সফরীটা। কিন্তু বার্টন দেখল তার প্রতি পথিকদের কারো কোন উৎসাহ বা আগ্রহ নেই।

বার্টনের ছেঁড়া ময়লা পোশাক আর শীর্ণ চেহারা দেখে একটি মেয়ে বলে উঠল, কি ভয়ঙ্কর!

বার্টন মেয়েটিকে চিনত। সে বলল, তোমার আচরণে আমি দুঃখিত বারবারা। তুমি শুধু উপরের পোশাকটাকেই দেখলে, কিন্তু সে পোশাক যে মানুষটা পরে আছে তাকে দেখলে না।

মেয়েটি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, তুমি চেন আমাকে?

বার্টন বলল, ভালভাবেই চিনি। তুমি হচ্ছ বারবারা রামসগেট। লর্ড জন রামসগেট নামে ঐ ভদ্রলোক তোমার ভাই। অন্যদের আমি চিনি না।

পথিকদের একজন বলল, লোকটা বোধহয় আমাদের এই সফরীর কথা কারো কাছে শুনেছে। যাই হোক, তোমার কথা বল। তুমি কি তোমাদের সফরীর দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছ? তুমি কি ক্ষুধার্ত? তুমি কি আমাদের যাত্রীদলে যোগ দিতে চাও?

লর্ড জন বলল, থাম বাল্ট ওকে ওর কথা বলতে দাও।

বার্টন বলল, আজ যদি তোমাদের একজন কুলির সঙ্গে আমার দেখা হত, তাহলে সে আগে আমায় কিছু খাদ্য ও পানীয় দিত।

মেয়েটি লজ্জিত হয়ে বলল, আমি দুঃখিত। আমি খাবার ও জল আনতে বলেছি।

বার্টন বলল, তাড়াতাড়ি করতে হবে না। আমি আগে তোমাদের প্রশ্নের উত্তর দেব। আমি লন্ডন থেকে একটি বিমানে করে কেপটাউন যাচ্ছিলাম। পথে নামতে বাধ্য হই। তারপর থেকে আমি বঙ্গানির দিকে এগিয়ে চলেছি। এবার আমি আমার পরিচয় দিচ্ছি। আমার নাম লেফটেন্যান্ট সিসিল গাইলস বার্টন। আমি সরকারি বিমানবাহিনীতে কাজ করি।

লেডি বারবারা বলল, অসম্ভব! এ কখনই হতে পারে না।

 লর্ড জন বলল, আমরা বার্টনকে চিনি। তোমাকে তার মত দেখতে লাগছে না।

তার জন্য দায়ী আফ্রিকা। তোমরা কাছ থেকে খুঁটিয়ে দেখলে অবশ্যই চিনতে পারবে। প্রতি সপ্তার শেষে আমি তোমাদের রামসগেট প্রাসাদে অতিথি হিসেবে যেতাম।

লর্ড জন ভাল করে বার্টনকে দেখে চিনতে পেরে বলল, হা ভগবান! সত্যিই ত। ক্ষমা করো বন্ধু।

এই বলে করমর্দনের জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিল তার।

বার্টন কিন্তু সে হাত গ্রহণ করল না। বলল, এই হাত একজন দুর্দশাগ্রস্ত বিপন্ন পথিকের দিকে আগেই বাড়িয়ে দেয়া উচিত ছিল। সুতরাং এখন এ হাত আমি মর্দন করতে পারব না।

লর্ড জন তার বোনকে বলল, ঠিকই বলেছে। ভুলটা আমাদেরই।

আর আপত্তি করল না বার্টন। তারা পরস্পরের করমর্দন করল। বারবারা তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ডানকান ট্রেন্ট নামে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।

খাওয়ার পর সফরীর অন্য সব সদস্যদের সঙ্গে পরিচিত হলো বার্টন। সেই দলে মিঃ রোমানফ নামে এক রুশীয় পথিক ছিল। সে দাড়ি কামাতে কামাতে বার্টনকে জানাল বঙ্গানি সেখান থেকে এখনো দুশো মাইল দূরে।

বার্টন আরো জানতে পারল আসলে দুটো সফরী ছিল। একটা ছিলা রোমানফের আর একটা ছিল লর্ড জনদের। পরে যখন ওরা দেখল ওদের গন্তব্যস্থল এক অর্থাৎ ওরা সকলেই বঙ্গানি যাবে তখন এক করে ফেলল দুটো সফরী।

জন বলল, তফাৎ এই যে রোমানরা বন্দুক নিয়ে শিকার করে আর আমরা ক্যামেরা নিয়ে শিকার করি।

ট্রেন্ট বলল, সব বাজে। এর থেকে পশুশালায় গিয়ে জীবজন্তুদের ছবি তুলে আনলেই হলো।

বার্টন আরও জানল জিরাল্ড ছিল আগে রোমানফের পথ-প্রদর্শক। বার্টন জানতে পারল একে একে সে ছাড়া আরো দু’জন বিপন্ন পথিক এই সফরীতে যোগদান করে। তারা হলো স্মিথ আর পিটারসন। তাদের আদিবাসী সঙ্গীরা নাকি তাদের ত্যাগ করে চলে যায়।

বার্টন বলল, ওদের দেখে কিন্তু ভাল মানুষ মনে হচ্ছে না।

লর্ড জন বলল, ওরা নিজেদের কোন কাজই করতে চায় না। তাছাড়া গল্টের আচরণ বড়ই প্রভুত্বমূলক। সে কথায় কথায় সকলকে বিদ্রূপ করে। সবাই তাকে ঘৃণা করে। আমাদের এই সফরীটাকে মোটেই এক সুখী পরিবার বলা যায় না।

ডিনারের পর কফি আর সিগারেট দেয়া হলো সকলকে।

বার্টন বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল, আজ সকালেই আমি না খেয়ে শুকিয়ে মরে যাচ্ছিলাম। কার ভাগ্যে কি আছে তা কেউ জানে না।

বারবারা বলল, ভবিষ্যতে আমাদের কি আছে সেটা আগে হতে জানতে না পারাটাই বোধ হয় ভাল।

দিনের পর দিন কেটে যেতে লাগল। বার্টনের সঙ্গে জন রামসগেটের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যেতে লাগল। বিশেষ করে সে বারবারাকে ভালবেসে ফেলল। তার লক্ষণ দেখে ডানকান ট্রেন্ট ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল।

একদিন গোলমান বাধল সফরীর মধ্যে। বার্টন হঠাৎ সেখানে এসে পড়ায় সে গোদেনস্কিকে একটা ঘুষি মেরে ফেলে দিল। গোদেনস্কিও তার ছুরি বার করল। তখন বারবারা এসে পড়ায় গোদেনস্কি চলে গেল।

বারবারা বার্টনকে বলল, তোমার একজন শত্রু হলো।

 বার্টন বলল, আমার অনেক শত্রু আছে।

 এরপর ডানকান ট্রেন্ট এসে বার্টনকে স্পষ্ট বারবারার কাছ থেকে সরে যেতে বলল।

শান্তভাবে বার্টন বলল, আমার মনে হয় এ ব্যাপারটা বারবারার উপরেই ছেড়ে দেয়া ভাল। কে সরে যাবে না যাবে সেটা সেই ঠিক করবে।

এতে ট্রেন্ট প্রথমে আঘাত করে বার্টনকে। বার্টন তখন জোরে একটা ঘুষি মেরে ফেলে দেয় ট্রেন্টকে।

পরদিন সকালে লর্ড জন গোদেনষ্কিকে জানিয়ে দেয় বঙ্গানিতে পৌঁছে গেলেই কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেয়া হবে তাকে। সকলেই এড়িয়ে চলতে লাগল গোদেনস্কিকে। এমন কি স্মিথ ও পিটারসনও তাকে দেখতে পারত না। সারাদিন সে তাই একা একা মুখ ভারী করে পথ চলত ও তার কাজ করে যেত।

আগুনের মত গরম রোদের নিষ্ঠুর তাপে সকলেরই কষ্ট হচ্ছিল। মালবাহী কুলিদের কষ্ট হচ্ছিল সবচেয়ে বেশি। গল্ট সব সময় ছোটাছুটি করে কুলিদের দেখাশোনা আর বকাবকি করছিল।

এক সময় ধৈর্য হারিয়ে ফেলে গল্ট একটা কুলিকে মারতে মারতে মাটিতে ফেলে দিল। সে উঠে দাঁড়ালে আবার তাকে ফেলে দিল।

বার্টন তখন নিকটেই ছিল। সে গল্টের সামনে এসে বলল, খবরদার মারবে না বলে দিচ্ছি।

 গল্ট বার্টনকে বলল, তুমি নিজের চরকায় তেল দাওগে। এ সফরী আমি পরিচালনা করছি।

বার্টন বলল, কার সফরীকে পরিচালনা করছ তা আমি দেখতে চাই না। তুমি কোন লোককে মারবে না বা গালাগালি দেবে না।

গল্ট সঙ্গে সঙ্গে একটা ঘুষি চালিয়ে দিল। বার্টন সরে গিয়ে সেটা এড়িয়ে গেল। তারপর এক ঘুষিতে ফেলে দিল গল্টকে।

সফরীতে আসার পর এই হলো বার্টনের তিন নম্বর লড়াই।

 লর্ড জনকে বার্টন বলল, আমি দুঃখিত রামসগেট সকলের সঙ্গেই আমার ঝগড়া বাধছে।

 তাকে সমর্থন করে রামসগেট বলল, তুমি ঠিকই করেছ।

বারবারাও বলল, গল্টকে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে খুব ভাল করেছ তুমি। লোকটাকে সবাই খারাপ বলে।

বার্টন বলল, আর কারো সঙ্গে শত্রুতা করতে হবে না। আগামীকালই আমরা বঙ্গানিতে পৌঁছব।

এর পর পরস্পরকে শুভরাত্রি জানিয়ে সকলেই শুতে চলে গেল শিবিরের মধ্যে। শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল বার্টন, আজ সে সত্যিই সুখী। আগামীকালই তার বাবার সঙ্গে দেখা হবে। তাছাড়া বারবারাকে সে পেয়েছে প্রেমিকারূপে।

শান্তিপূর্ণ এক স্তব্ধতা বিরাজ করছিল নৈশ শিবিরের মধ্যে। জ্বলন্ত আগুনের পাশে বসেছিল তন্দ্রাচ্ছন্ন প্রহরী। দূরে এক সিংহের গর্জন শোনা গেল। জ্বলন্ত আগুনে বেশি করে কাঠ ফেলে দিল আস্কারি।

তখনো কিছুটা রাত ছিল। ভোর হয়নি ভাল করে। আগের প্রহরীর পর নতুন যে প্রহরী এসেছে সে একগাদা কাঠের পাশে পিঠ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

ঘুম ভাঙ্গতেই দৈত্যাকার নগ্ন এক শ্বেতাঙ্গকে আগুনের ধারে বসে থাকতে দেখে চমকে ওঠে সে। ভাল করে চোখ মেলে দেখে বুঝল এটা স্বপ্ন নয়, তার দেখার কোন ভুল হয়নি।

প্রহরী দৈত্যাকার লোকটিকে বলল, কে তুমি? কোথা থেকে এসেছ? তুমি যদি কোন দৈত্যদানব হও তাহলে আমি তোমাকে খাবার এনে দেব। কোন ক্ষতি করো না আমার।

আগন্তুক লোকটি বলল, আমার নাম টারজান। এটা কার সফরী?

 প্রহরী বলল, এ সফরী দু’জনের-বাওয়ানা রোমানক আর বাওয়ানা রামসগেটের।

 টারজান বলল, ওরা বঙ্গানি যাচ্ছে ত?

আমরা আগামীকালই বঙ্গানিতে পৌঁছব।

ওরা শিকার করে?

বাওয়ানা রোমানক শিকার করে। কিন্তু বাওয়ানা রামসগেট শুধু ছবি তোলে।

এরপর টারজান বলল, তোমাদের শিবিরের মধ্যে একজন মৃত লোক আছে।

এই বলে শ্বেতাঙ্গদের শিবিরটার দিকে হাত বাড়িয়ে দেখাল।

শিবিরের ভিতরে গিয়ে প্রহরী ডাকাডাকি করে সকলকে তুলল। বলল, কোথা থেকে দৈত্যের মত একটা নগ্নদেহ শ্বেতাঙ্গ এসে বলছে এই শিবিরের মধ্যে একটা মৃত লোক পড়ে আছে।

সকলেই টারজনের চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেল। ভয় পেয়ে গেল। অবশেষে রামসগেট তার কাছে গিয়ে কথা বলল তার সঙ্গে।

টারজান বলল, আমার নাম টারজান। সত্যিই এই শিবিরের মধ্যে একটা লোক মরে পড়ে আছে।

 রামসগেট বলল, কি করে বুঝলে তুমি?

 বাতাসে গন্ধ পেয়ে বুঝলাম। মানুষ মরে গেলেই এটকা বিশেষ গন্ধ বার হয় তার দেহ থেকে।

সকলেই হেসে উড়িয়ে দিল তার কথাটা। বলল, নোকটা পাগল।

কিন্তু রামসগেট গল্টকে ডেকে খোঁজাখুঁজি করতে বলল। বলল, সবাইকে ডেকে তোল। আজ খুব সকালেই যাত্রা শুরু করব।

এমন সময় একজন ভৃত্য ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল বার্টন তার ঘরে মরে পড়ে আছে।

সকলেই বলতে লাগল, ঐ উলফঙ্গ আধ-পাগলা লোকটাই খুন করেছে বার্টনকে। কিন্তু লর্ড জন রামসগেট বা বারবারা এ কথা মানতে পারল না। ওরা বলল, ওর তাতে স্বার্থ কি? তাছাড়া প্রহরী বলছে, মাত্র কিছুক্ষণ আগে আসে লোকটা। এসে ঠাণ্ডায় আগুন পোয়াতে থাকে।

টারজান শান্তভাবে বলল, আমি আসার আগেই লোকটি নিহত হয়।

বার্টনের মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখা গেল। তার পিঠে ছোরা মারা হয়েছে। ছোরাটা তার হৃৎপিণ্ডটাকে বিদ্ধ করেছে।

রামসগেট বলল, আগন্তুককে সন্দেহ করার কোন অর্থ হয় না। বারবারা বলল, বার্টনের শত্রু ছিল এই শিবিরে। গল্ট আর ট্রেন্টের সঙ্গে তার মারামারি হয় এবং ওরা তাকে খুন করবে বলে ভয় দেখায়।

অবশেষে ঠিক হলো বঙ্গানিতে গিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হবে ব্যাপারটাকে। পুলিশ প্রমাণ করবে কে খুন করেছে।

গল্ট আর ট্রেন্ট বলল, লোকটাকেও আমরা বেঁধে সঙ্গে করে নিয়ে যাব।

কিন্তু গল্ট টারজনের কাছে যেতেই তাকে সরিয়ে দিল টারজান। ট্রেন্ট তখন পিস্তল তুলে ধরে টারজানকে বলল, পালাবার চেষ্টা করলেই গুলি করব।

কিন্তু ভয়ে লক্ষ্য ঠিক করতে পারল না ট্রেন্ট। গুলিটা অন্য দিকে চলে গেল। টারজান তার পিস্তল ধরা হাতটা ধরে ফেলল। তারপর তাকে টানতে টানতে বনের দিকে নিয়ে গেল।

ট্রেন্ট চেঁচাতে লাগল, তোমরা কিছু করতে পারছ না? ও আমাকে বনে নিয়ে গিয়ে খুন করবে।

রামসগেট বলল, গুলি করলে ট্রেন্টের গায়ে লাগবে। আমরা কিছুই করতে পারছি না।

বনের মধ্যে নিরাপদে ঢুকেই ট্রেন্টকে ছেড়ে দিল টারজান। ট্রেন্ট ছুটে শিবিরে এসে বলল, আমার হাতের কব্জি ভেঙ্গে গেছে। সাংঘাতিক জোর লোকটার গায়ে। আমাকে ছেড়ে দিয়েই গাছের উপর উঠে বাঁদরের মত ডাল থেকে ডালে লাফ দিয়ে দিয়ে চলে গেল।

একটা স্ট্রেচারে বার্টনের মৃতদেহটাকে চাপিয়ে বয়ে নিয়ে যেতে লাগল কুলিরা।

 আবার যাত্রা শুরু হলো সফরী। আজ দেরী হয়ে গেল শিবির গোটাতে।

সেদিন বঙ্গানি পৌঁছতে পারল না ওরা। রাতে আবার এক জায়গায় শিবির স্থাপন করল ওরা। কিন্তু সেদিন মাঝরাতে পিটারসন খুন হলো। তারও পিঠে একটা ছোরা বসিয়ে দেয়া হয়।

স্মিথ বলল, সেই উলঙ্গ লোকটার কাজ। সে এসেছিল, আমি পালিয়ে যাবার সময় গুলি করেছি। অন্ধকারে দেখতে পাইনি গুলিটা লেগেছে কিনা। সে রাতে আর ঘুম হলো না কারো, ভয়ে আর উৎকণ্ঠায় স্তব্ধ হয়ে রইল সবাই।

বঙ্গানিতে মৃত সিসিল গাইলস বার্টনের বাবা কর্নেল জিরাল্ড গাইলস বার্টনের সরকারি বাংলোতে বসেছিল টারজান।

বার্টনের মৃত্যু সংবাদটা টারজানই দিল তার বাবাকে।

কর্নেল বার্টন বলল, কিন্তু কে কোন্ স্বার্থে আমার ছেলেকে খুন করল?

টারজান বলল, স্বার্থ নিশ্চয়ই আছে। তবে ওদের সফরীতে ট্রেন্ট নামে একটা লোক আছে। সে আর বার্টন একটি মেয়েকে ভালবাসত। সুতরাং অনেকের সন্দেহ ট্রেন্টও ওকে মারতে পারে।

বার্টন বললেন, সফরী বঙ্গানিতে এলে আমি ওদের সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করব। দোষীকে খুঁজে বার করতেই হবে।

টারজান বলল, খুনী যদি আফ্রিকাতে থাকে তাহলে আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবে না।

সফরী বঙ্গানিতে পৌঁছেই শিবির স্থাপন করল। তারপর রোমানক আর রামসগেট কর্নেল বার্টনের বাংলোতে এসে দেখা করল। তারা বার্টনের মৃত্যু সংবাদ দিলে কর্নেল বললেন, এ খবর আগেই জেনেছেন তিনি।

ওরা আশ্চর্য হয়ে বলল, তা কি করে সম্ভব?

এমন সময় টারজান এসে তাদের সামনে দাঁড়াল।

রামসগেট বলল, গত রাতে আমাদের শিবিরে পিটারসন নামে আর একজন লোক খুন হয়।

টারজানকে দেখেই রামসগেট বলল, ওই হচ্ছে খুনী। ওই বার্টনকে এবং আগের রাতে পিটারসনকে খুন করেছে। স্মিথ ওকে গত রাতে দেখেছে শিবিরে।

কর্নেল বার্টন বলল, এ কখনই হতে পারে না। টারজান কখনই আমার ছেলেকে খুন করতে পারে না। আর গত রাতে ও আমারই কাছে ছিল। সুতরাং পিটারসনকে খুন করেনি।

টারজানকে সঙ্গে নিয়ে কর্নেল বার্টন রামসগেটদের শিবিরে গেলেন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।

তিনি গিয়ে বললেন, এই শিবিরের কেউ কারো নামে কোন অভিযোগ করতে চায়?

বারবারা বলল, আমি ট্রেন্টর বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনছি।

টারজান কর্নেলের অনুমিত নিয়ে প্রশ্ন করতে লাগল। সে প্রথমে সকলের ছুরি পরীক্ষা করল। তারপর রামসগেটকে বলল, স্মিথ ও পিটারসনকে কতদিন থেকে চেন তোমরা?

রামসগেট বলল, মাত্র কয়েকসপ্তাহ আগে আমাদের সফরীতে যোগদান করে ওরা।

পিটারসন কিছুটা খুঁড়িয়ে চলত?

রামসগেট বলল, হ্যাঁ।

স্মিথ বলল, এ সব খুঁজে দরকার কি? লোকটার মাথায় ছিট আছে।

টারজান হঠাৎ স্মিথের পেটের কাছে দেখল তার শার্টটা উঁচু হয়ে আছে। সে হাত দিয়ে দেখল সেখানে বেশ কিছু কাগজপত্র আছে।

টারজান এবার সকলের সামনে জোর গলায় বলল, ট্রেন্ট বার্টনকে খুন করেনি, স্মিথই হচ্ছে খুনী। সে বার্টনকে খুন করেছে। সে পিটারসনকেও খুন করেছে।

কর্নেল বার্টন বললেন, কিন্তু কি কারণ থাকতে পারে এই খুনের?

টারজান স্মিথের জামার তলায় লুকোন কাগজগুলো টেনে বার করে বলল, এই দরকারী কাগজগুলোই হলো একমাত্র কারণ। আসলে ওদের স্মিথ আর পিটারসন নাম নয়। স্মিথের আসল নাম হলো যোশেফ ক্যাম্পবেল আর পিটারসনের নাম হলো জুবানেভ। বার্টনের কাছ থেকে এই কাগজগুলো ছিনিয়ে নেয়াই হলো ওদের একমাত্র লক্ষ্য। বার্টনের জীবিত অবস্থায় ওরা যদি চুরি করত কাগজগুলো তাহলে শিবিরের মধ্যে খোঁজ করলেই ধরা পড়ত ওরা। ক্যাম্পবেল তাই খুন করে ওকে। পরে ক্যাম্পবেল জুবানেভকেও খুন করে কারণ তাহলে এই কাগজগুলো ইতালি সরকারের কাছে বিক্রি করলে যা টাকা পাবে তাতে ভাগ দিতে হবে না কাউকে।

কর্নেল বার্টনের সঙ্গে যে পুলিশবাহিনী ছিল তারা ক্যাম্পবেল ওরফে স্মিথকে গ্রেপ্তার করল।

রামসগেট কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল টারজানকে, জুবানেভই যে মৃত পিটারসন এটা কি করে বুঝলে?

টারজান বলল, আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয় বড় প্রবল। কারণ আমি জঙ্গলে ছোট থেকে পশুদের কাছে মানুষ। পশুদের মতই আমার ঘ্রাণশক্তি প্রবল। সভ্য জগতের কেউ বুঝতে পারবে না একথা। ওদের ভাঙ্গা বিমান দুটো আমি দেখেছি। সেখানে একটা দস্তানা কুড়িয়ে পাই। সেই দস্তানাটা শুঁকে যে গন্ধ পাই পিটারসনের মৃতদেহটা এঁকেও সেই গন্ধ পেয়েছিলাম।

সবকথা শেষ করে সব রহস্যের সমাধান করে টারজান বলল, বিদায় বন্ধুগণ, আমি এবার আমার বাড়ি যাচ্ছি। মাঝে মাঝে আমার নিজের লোকদের দেখতে বাড়ি যাই বটে, কিন্তু জঙ্গলের ডাক না শুনে পারি না, তার টানে ধরা না দিয়ে পারি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *