টারজান ও সিংহমানব (টারজান এ্যাণ্ড দি লায়ন ম্যান)

টারজান ও সিংহমানব (টারজান এ্যাণ্ড দি লায়ন ম্যান)

স্টুডিওর অফিস ঘরে বসে প্রযোজনা সমিতির সহ-সভাপতি মিল্টন স্মিথ তার সহকারীদের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ব্যস্ত ছিল। ছয়জন সহকারীর কাছে তার নতুন ছবির পরিকল্পনা সম্বন্ধে তার বক্তব্য বোঝাচ্ছিল হাত নেড়ে।

একজন সেক্রেটারি এসে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে খবর দিল, ওরমান এসে গেছেন।

এরপর ঘরের দরজা ঠেলে সেক্রেটারি ওরমানকে নিয়ে এলে স্মিথ উঠে গিয়ে তার সঙ্গে করমর্দন করল। ঘরের সকলেই তাকে অভ্যর্থনা জানাল।

স্মিথ করমর্দন করে বলল, তোমাকে দেখে খুশি হলাম ওরমান। তুমি বোর্নিও থেকে আসার পর আর তোমার দেখা পাইনি। সেখানে তুমি একটা বড় কাজ করেছ। কিন্তু তার থেকে আরো বড় একটা কাজ তোমার জন্য রেখেছি। তুমি জঙ্গলের উপর তোলা কিছু ভাল ছবি দেখেছ আশা করি।

ওরমান বলল, হ্যাঁ, দেখেছি। এখন অনেকেই জঙ্গলের উপর ছবি তৈরি করছে।

স্মিথ বলল, এই সব জঙ্গলের উপর তোলা ছবি হলিউডের পঁচিশ মাইলের মধ্যেই কোন না কোন জায়গা থেকে তোলা হয়। তার মধ্যে শুধু আফ্রিকার ছবি আর গলার স্বর জুড়ে দেয়া হয়।

ওরমান বলল, কোথায় ছবি তোলা হবে? হলিউডের আশেপাশে।

স্মিথ বলল, না স্যার। আমরা একটা দলকে আফ্রিকার জঙ্গলের গভীরে পাঠাচ্ছি। সে জঙ্গলটার নাম ইতুরি জঙ্গল। তাছাড়া এ ছবি করে তুমি বিখ্যাত হয়ে যাবে।

ওরমান বলল, এই ছবিতে বিখ্যাত হব কি না জানি না। তবে আমি আফ্রিকা কখনো যাইনি। তাই সেখানে যেতে আমার ভাল লাগবে।

স্মিথ বলল, আমরা সব ব্যাপারটা আলোচনা করে দেখছি। আমরা তাই মেজর হোয়াইটকে বসিয়ে রেখেছি। মেজর হোয়াইট, ইনিই হলেন পরিচালক ওরমান। মেজর একজন নামকরা শিকারী এবং আফ্রিকার জঙ্গলের সবকিছু পড়া বইএর পাতার মত জানা আছে ওর। ও আমাদের দলের সঙ্গে টেকনিক্যাল এ্যাডভাইজার হিসেবে যাচ্ছে। এখন বিচিত্ৰকাহিনীটা সম্বন্ধে তোমাকে কিছু বলছি। আমাদের যে কাহিনীটা জো লিখেছে তার নায়ক হলো এমনই একজন মানুষ যার আফ্রিকার জঙ্গলে জন্ম হয় এবং সে সেখানেই লালিত পালিত হয়। সে একটা সিংহের দুধ খেয়েই মানুষ হয়। সে সিংহদের মাঝেই থাকত। বড় হয়ে সে সিংহদের রাজা হয়। তারপর একটি মেয়ের সংস্পর্শে এল সে। সে জীবনে মেয়ে কখনো দেখনি। মেয়েটি একদিন একটা পুকুরে স্নান করছিল। এমন সময় সেই সিংহমানুষ তার কাছে এল। কেমন লাগছে?

ওরমান বলর, ভালই ত মনে হচ্ছে। এখন কথা হচ্ছে সেই সিংহমানুষের ভূমিকায় কে অভিনয় করবে?

স্মিথ বলল, তার নাম স্ট্যানলি ওবরস্কি। আর ওবরস্কির নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করছে নাওমি ম্যাডিসন? গর্ডন মার্কাস ম্যাডিসনের বাবার ভূমিকায় অভিনয় করছে। ভূমিকাটা হলো এক শ্বেতাঙ্গ ব্যবসায়ীর। মেজর হোয়াইট যিনি এখানে এখন বসে রয়েছেন তিনি অভিনয় করছেন এক শ্বেতাঙ্গ শিকারীর ভূমিকায়।

ওরমান বলল, আমার ক্যামেরাম্যান কে হবে?

বিল ওয়েস্ট।

চমৎকার।

এছাড়া পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশজন ড্রাইভার থাকবে। জেনারেটার ট্রাক আর শব্দ যন্ত্রের ট্রাক ছাড়া থাকবে কুড়িটা ট্রাক। পাঁচটা প্রাইভেট কার যাবে যাত্রীদের নিয়ে।

স্মিথের কথা শেষ হতে ওরমান বলল, কিন্তু কবে আমরা আফ্রিকা রওনা হচ্ছি?

আজ হতে দশ দিনের মধ্যে।

শেখ আবেল বেনেম আর তার আরব অনুচরেরা দলের পিছন থেকে সব দেখছিল। তারা দেখছিল দু’শো জন নিগ্রোভূত্য কিভাবে নটন মালবোঝাই একটা ভারী ট্রাককে একটা ছোট্ট হাঁটুভোর কাদা জলে ভর্তি নদীর বুক থেকে টেনে তুলছিল। ওরমান সবকিছুর তদারক করছিল।

তার কিছুটা দূরে একটা যাত্রীগাড়ির ভিতরে দুটি মেয়ে বসেছিল আর সেই গাড়ির দরজা দিয়ে মুখ ঢুকিয়ে জেরল্ড বেন একটি মেয়েকে জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছ নাওমি?

খুব খারাপ।

আবার জ্বর হয়েছে?

জিঞ্জা ছেড়ে আসার পর থেকে আর জ্বর হয়নি।

তবে আমার মনে হচ্ছে আমি এখনি হলিউডে চলে যাই। কিন্তু মনে হচ্ছে আর সেখানে কোনদিন যেতে পারব না। এখানেই আমায় মরতে হবে।

না, না, ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিছুক্ষণ তারা নীরবে বসে মাছি তাড়াতে লাগল। আরবরা তাদের টাট্ট ঘোড়ার পিঠে চেপে সব কিছু দেখতে লাগল।

শেখ আবেল বেন তার পাশের একজন আরবকে বলল, দুটো মেয়ের মধ্যে কোন মেয়েটা হীরকদেশের রহস্য জানে তা জান?

আরবটা বলল, মেয়ে দুটো দেখতে একরকম।

 শেখ বলল, ওদের একজনের কাছে কাগজটা আছে এ বিষয়ে তুমি নিশ্চিত?

আরব বলল, হ্যাঁ, কাগজটা ছিল একজন বৃদ্ধ শ্বেতাঙ্গের কাছে। সেই বৃদ্ধই হলো মেয়েটার বাবা। যে শ্বেতাঙ্গ যুবকটা মুখ বাড়িয়ে কথা বলছে মেয়ে দুটোর সঙ্গে সে প্রথমে বৃদ্ধকে হত্যা করে কাগজটা হাত করার এক ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু পরে মেয়েটা সে ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে কাগজটা তার বাবার কাছ থেকে নিয়ে নেয়। বৃদ্ধ আর ঐ যুবকটা মনে ভাবছে কাগজটা হারিয়ে গেছে।

দু’শোজন নিগ্রোভৃত্য যখন ট্রাকগুলোর সঙ্গে বাঁধা মোটা মোটা দড়ি ধরে টানাটানি করছিল, টমাস ওরমান তখন একটা লম্বা চাবুক হাতে দাঁড়িয়েছিল তাদের কাছে। তার পোশাকগুলোয় কাদা লেগেছিল। তার সারা দেহে ঘাম ঝরছিল।

ওরমান তার দলবল নিয়ে হলিউড থেকে তিন মাস হলো এখানে এসেছে। কিন্তু যেখান থেকে ছবি তোলার শুরু হবে, সেই নির্দিষ্ট জায়গায় এখনো পৌঁছতে পারেনি। সবচেয়ে ভাবনার বিষয় হলো এই যে, এখানকার আদিবাসীরা তাদের পিছু নিয়েছে। তারা এখন প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠেছে তাদের পথে।

আবার মোটরবাহিনী এগিয়ে চলল। সামনের দিকে ছিল সশস্ত্র প্রহরী আর মালবাহকরা। সহকারী পরিচালক প্যাট ওগ্রেডির উপর ভার ছিল ট্রাকগুলোর। তার হাতে কোন চাবুক ছিল না। প্যাটের পাশে ছিল মেজর হোয়াইট। হোয়াইট এক সময় প্যাট ওগ্রেডিকে বলল, সবকিছুর ভার যদি তোমার উপর থাকত তাহলে খুব ভাল হত। মন মেজাজের দিক থেকে ওরমান মোটেই এ কাজের উপযুক্ত নয়।

সফরিটা আবার ধীর গতিতে এগিয়ে চলতে লাগল। ওরমান হোয়াইটকে পাশে নিয়ে সামনের দিকে রইল। নিগ্রোভৃত্যরা কুড়াল আর ছুরি দিয়ে পথ পরিষ্কার করতে করতে যাচ্ছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর ওরা একটা নদী পেল। ওরমান বলল, আজ এখানেই শিবির স্থাপন করব।

গাড়িগুলো সব দাঁড়িয়ে রইল। একটা গাড়ির নিচে বসে ওরমান এক বোতল স্কচ খাচ্ছিল। ম্যাডিসন তার একটা সিগারেট ধরাল। সে বনের চারদিকে তাকাচ্ছিল। দেখল নদীর ওপারেও ঘন বন। ম্যাডিসন এক সময় বলল, ফিরে চল টম তা না হলে আমরা সবাই মারা পড়ব।

ওরমান বলল, আমাকে আমার ছবি করার জন্য পাঠানো হয়েছে। যাই ঘটুক না কেন, আমাকে আমার কাজ করতেই হবে। যাও, তোমার সিংহমানুষকে তোমার মনের কথা জানাওগে।

এক সময় নিগ্রোদের সর্দার কামুড়ি ওরমানের সামনে এসে বলল, আমার লোকেরা আর তোমাদের সফরির সঙ্গে যাবে না।

ওরমান বলল, কিন্তু তোমরা সই করেছ চুক্তিপত্রে।

কামুড়ি বলল, কিন্তু আমার বানসুটোদের অঞ্চলে আসার জন্য সই করিনি। তোমরা যদি এখান থেকে ফিরে যাও তাহলে আমরা তোমাদের সঙ্গে থাকব।

ওরমান তার চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে চাবুক বার করল। বলল, আমি তোমাদের উচিৎ শিক্ষা দেব।

মেজর হোয়াইট ওরমানের কাঁধের উপর একটা হাত রেখে বলল, থাম। এতদিন আমি তোমার কোন কাজে হস্তক্ষেপ করিনি। কিন্তু এখন আমাদের সকলের জীবন বিপন্ন।

ওগ্রেডি বলল, তুমি নির্বোধের মত কাজ করছ টম। মেজর ঠিকই বলছে। কিছু মনে করো না মেজর। তুমিই এখন সবকিছুর ব্যবস্থা করো। কিভাবে আমরা এই ভয়ংকর জায়গাটা থেকে বেরিয়ে যেতে পারি তার জন্য চেষ্টা করো।

তার সহকারী ওগ্রেডি এখন তাকে আর সমর্থন করছে না দেখে চুপ করে গেল ওরমান। ওগ্রেডি মেজরকে জিজ্ঞাসা করল, এই বানসুটো অঞ্চল থেকে আমাদের বার হতে আর কদিন লাগবে।

হোয়াইট বলল, ট্রাকগুলোর জন্য পথ করে এগোতে আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে। তা না হলে দু’দিনের মধ্যেই এ অঞ্চলের বাইরে গিয়ে পড়তাম। তবে এখন আমাদের দু’সপ্তাহ লাগবে, তাও যদি ভাগ্য ভাল হয়।

কামুড়ির সঙ্গে কথা বলে ফিরে এসে হোয়াইট ওগ্রেডিকে বলল, ওরা বেশি টাকা পেলে আমাদের সঙ্গে যাবে। তবে ওদের আর চাবুক মারা চলবে ন।

সকাল হবার অনেক আগেই শিবিরের সবাই জেগে উঠল। সকালে উঠেই হোয়াইট জানতে পারল কামুড়ির অধীনস্থ পঁচিশজন নিগ্রোভৃত্য রাত্রিবেলায় শিবির ছেড়ে পালিয়ে গেছে। প্রহরীদের জিজ্ঞাসা করে জানল তারা কাল শিবির ছেড়ে কখন গেছে তা ওরা দেখতেই পায়নি।

প্রাতরাশের পর আবার রওনা হয়ে পড়ল ওদের সফরি। নদীটা পার হয়ে ওপারের বনভূমিতে গিয়ে পড়ল ওরা। নদীতে জল খুব কম ছিল আর তলায় পাথর থাকায় ট্রাকগুলো সহজেই পার হয়ে গেল। বানসুটোদের কোথাও চিহ্ন পাওয়া গেল না। আর কোন অশুভ ঘটনাও ঘটল না। ওদের চারপাশের বনভূমিতে কোথাও কোন জনপ্রাণী আছে বলে মনে হল না। ক্রমে দুপুর হয়ে গেল। দলের সবার মনে সাহস ফিরে এল।

সহসা অতর্কিতে এক ঝাঁক তীর ছুটে এল। দু’জন নিগ্রোভৃত্য মারা গেল সঙ্গে সঙ্গে। মেজর হোয়াইট ওরমানের পাশে এক সঙ্গে পথ হাঁটছিল। তার বুকেও একটা তীর এসে লাগলে সে তীরটা বুক থেকে জোর করে তুলে ওরমানের পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ল। শ্বেতাঙ্গ যাত্রীরা রাইফেল হাতে ছোটাছুটি করে বনটা তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল। সকলেই ট্রাক থেকে নেমে পড়ল।

পরদিন আবার যাত্রা শুরু করল ওরা। কামুড়ির লোকরাও রয়ে গেল। একটা ট্রাকের উপর মৃতদেহ চাপানো হলো। এরপর যেখানে শিবির স্থাপন করা হবে সেখানে কবর দেয়া হবে। বিক্ষুব্ধ নিগ্রোভৃত্যরা রাগের সঙ্গে রাস্তা পরিষ্কার করে যেতে লাগল। আরবরা যথারীতি দলের পিছনে রইল। আজ সকাল থেকেই ওরমানের হাতে চাবুক ছিল না। আজ সে ভালভাবে কথা বলছিল নিগ্রোভৃত্যদের সঙ্গে। তাদের মনে সাহস সঞ্চার করার চেষ্টা করছিল। সে বলল, আগামীকালই আমরা এ অঞ্চল থেকে বেরিয়ে যাব।

সারাদিন আর কোন ঘটনা ঘটল না। কিন্তু বিকালের দিকে আবার এক জায়গায় শিবির স্থাপন করার আগে কিন্তু আবার কয়েকটা তীর এসে বিদ্ধ করল তিনজনকে। তিনজন নিগ্রো মারা গেল। আর একটা তীর ওরমানের মাথার উপর দিয়ে যাবার সময় তার শিরস্ত্রাণটা ফেলে দিল। অল্পের জন্য বেঁচে গেল সে।

তখনো সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসেনি ওদের শিবিরে। সামান্য যে একটু আলো ছিল তাতে রোন্ডা তার ঘরে টেবিলে বসে কি লিখছিল একা একা। একটু দূর থেকে আতুই নামে আরবটা লক্ষ্য করছিল তাকে। হঠাৎ মার্কাস এসে রোন্ডার সামনে বসে তাকে বলল, কবিতা লিখছ নাকি?

রোন্ডা বলল, দৈনন্দিন ডায়েরী লেখার কাজটা সেরে রাখছি।

মার্কাস বলল, এ ডায়েরীর মধ্যে থাকবে বহু দুঃখজনক ঘটনার সকরুণ কাহিনী।

রোন্ডা বলল, ঘটনাক্রমে এই ম্যাপটা সেদিন আমার ব্যাগের মধ্যে পেয়ে যাই। সেদিন একটা দৃশ্যে আমার ছবি তোলার সময় এটা পাই।

ম্যাপটা খুলে রোন্ডা যখন মার্কাসকে দেখাচ্ছিল তখন আতুই আরো কাছে এসে কুটিল চোখে তা দেখল।

মার্কাস বলল, ওটা তোমার কাছেই রেখে দাও। ওরা চাইলে তবে দেবে। ওরা কি এই ম্যাপটা স্টুডিওতে তৈরি করে?

রোন্ডা বলল, না। জো একটা দোকান থেকে একটা পুরনো বই কিনে তার মধ্যে এটা পায়। এই মানচিত্রটাকে কেন্দ্র করেই ও কাহিনীর পটভূমি রচনা করেছে। ব্যাপারটা বেশ মজার নয়? লোকের মনে হবে এই ম্যাপটা দেখে হীরক দেশের উপত্যকায় যাওয়া সহজ হবে।

রোন্ডা ম্যাপটা এবার গুটিয়ে ভাঁজ করে তার ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল। আতুই সেটা লক্ষ্য করল।

মার্কাস বলল, অন্ধকার ঘন হয়ে উঠলেই কবর দেয়া হবে।

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে উঠলেই কবর দেয়ার কাজটা সারা হয়ে গেল। ম্যাডিসন বসে ভাবতে লাগল।

সে রাতে ওরমান একেবারেই ঘুমোতে পারল না। লণ্ঠনের আলোটা মিটমিট করে জ্বলছিল তার ঘরে। শেষ রাতের দিকে পাশের ঘর থেকে ওগ্রেডি তাকে লক্ষ্য করে বলল, ঘুমিয়ে পড় টম। তা না হলে তোমার মাথা গরম হয়ে যাবে।

ওরমান বলল, আমি ঘুমোতে পারছি না। আমি সারাক্ষণ হোয়াইটকে দেখতে পাচ্ছি। আমিই তাকে হত্যা করেছি। আমিই নিগ্রোদের হত্যা করেছি।

ওগ্রেডি বলল, এটা তোমার দোষ নয়। স্টুডিও কর্তৃপক্ষ তোমাকে যে কাজের ভার দিয়ে পাঠিয়েছে তুমি শুধু সেই কাজ জোরের সঙ্গে করে যাচ্ছ।

ওরমান তবু বলল, না, সব দোষ আমার। হোয়াইট বারবার আমায় নিষেধ করেছিল।

ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহটা জেগেছিল প্রথমে বিল ওয়েস্টের মনে। সে ছুটে নিগ্রোভৃত্যদের শিবিরে চলে গেল। কামুড়ীর খোঁজ করল। বিল দেখল শিবিরে একটা নিগ্রোভৃত্যও নেই।

বিল ওয়েস্টের ডাকাডাকিতে ওরমান আর ওগ্রেডি ছুটে এল। ওরমান বিলকে বলল, প্রাতরাশের কি হলো?

বিল বলল, প্রাতরাশ এবার থেকে নিজের হাতে তোমায় তৈরি করে নিতে হবে। শিবির ছেড়ে নিগ্রোভৃত্যরা সব পালিয়েছে। আগুনটা পর্যন্ত নিভিয়ে দিয়ে গেছে। শিবিরে কোন পাহারা নেই। মনে হয় আমাদের কিছু খাদ্যদ্রব্যও নিয়ে গেছে।

ওরমান বলল, কিন্তু কখন কোন্ দিকে পালাল? কোথায় যাবে তারা?

সবাই ওরমানের মুখপানে তাকাতে লাগল। তারা দেখল ওরমান প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই সামলে নিল নিজেকে। সকলে তখন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।

ওরমান নির্দেশ দিল, ট্রাকগুলো সব দেখ। ড্রাইভারদের সব বলল, মালপত্র সব ঠিক আছে কিনা। তারা দেখুক। বিন, তুমি এ কাজগুলো করো। প্যাট একজন প্রহরী বসিয়ে দাও শিবিরের সামনে। আরবরা এখনো আছে শিবিরে। প্যাট, তুমি বরং তাদের প্রহরীর কাজে লাগিয়ে দাও। তারপর সকলকে খাবার টেবিলে ডাক।

ওরমান শিবিরে একবার ঘুরে এসে খাবার টেবিলে এসে দেখল সবাই সেখানে বসে নিগ্রোদের শিবির ত্যাগের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছে নিজেদের মধ্যে।

ওরমান শান্তভাবে বলল, কি হয়েছে তোমরা সকলেই জান। এর জন্য কাউকে দোষারোপ করে লাভ নেই। আমাদের অবস্থা এখনো একেবারে হতাশাব্যাঞ্জক হয়নি। আমরা কোনরকমে বানসুটোদের এই এলাকা পার হতে পারলে আর কোন ভয় নেই। তখন আমরা কোন আদিবাসীদের গায়ে কিছু মালবাহক যোগাড় করব। এর মধ্যে তোমাদের সকলেই আপন আপন কাজ করে যেতে হবে। এবার হতে তোমাদের শিবির স্থাপন করতে হবে, শিবির গোটাতে হবে, মাল বোঝাই, মাল নামানো, রান্না, পথ পরিষ্কার করা, পাহারার কাজ সবই করতে হবে। এখন আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। কে রান্না করতে পারবে?

রোন্ডা বলল, সে রান্না করবে।

 ওরমান বলল, মোট তিনজন রাঁধুনির দরকার। আর কে কে রান্না করবে?

ওবরস্কি বলল, আমি সাহায্য করব রোন্ডাকে।

সবাই হেসে উড়িয়ে দিল কথাটাকে। অবশেষে ঠিক হলো রোন্ডা রান্নার কাজ করবে আর জিমি ও শর্টি তাকে সাহায্য করবে।

খাবার সময় নাওমি তার গাড়ির সীটে বসে রইল। খেতে গেল না। তাঁবু গুটিয়ে মাল বোঝাই করে সফরি রওনা হবার সময় রোন্ডা সব কাজ সেরে তার গাড়িতে গেল। সে কাগজে মোড়া গোটাকতক স্যাউউইচ নাওমিকে দিয়ে বলল, এগুলো তোমার জন্য এনেছি, তুমি খেয়ে নাও।

নাওমি ম্যাডিসন নীরবে তা খেয়ে নিল।

সফরির গতিটা খুব ধীর ছিল। শ্বেতাঙ্গরা পথ পরিষ্কারের কাজ ঠিকমত পারছিল না তারা একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল গরমে। কুড়াল দিয়ে গাছ কাটার কাজে অভ্যস্ত ছিল না তারা। পথের সামনে এখানে অনেক গাছ ছিল।

বিল ওয়েস্ট তার কপাল থেকে ঘাম ঝেড়ে বলল, পথ-প্রদর্শক না থাকায় আমরা বুঝতে পারছি না কোন্ পথে কোথায় যাচ্ছি।

যেতে যেতে ওরা বন পার হয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়ল। জায়গাটা মানুষ সমান লম্বা লম্বা ঘাসে ভর্তি, একটাও গাছ নেই।

ওরমান বলল, এখানে কোন গাছ না থাকায় শত্রুরা আমাদের বিরক্ত করবে না। জোরে গাড়ি চালাও। যাত্রীরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

কিন্তু ঘাসের উপর গাড়িগুলো কিছুটা এগিয়ে যেতেই ঘাসগুলোর ভিতর থেকে আবার এক ঝাঁক তীর উড়ে এল। এবার আর লুকিয়ে রইল না শত্রুরা। বানসুটো আদিবাসীরা যুদ্ধের ধ্বনি দিতে দিতে বর্শা হাতে সামনে ছুটে এল। রাইফেলগুলো গর্জে উঠল। শ্বেতাঙ্গ যাত্রীরা সকলেই গুলি চালাতে লাগল। রোন্ডাও রিভলবার হাতে বেরিয়ে পড়ল তার গাড়ি থেকে। আদিবাসীদের অনেকেই মারা গেল। তারা দু’মিনিটের মধ্যেই আবার ঘাসগুলোর মধ্যে পালিয়ে গেল। শ্বেতাঙ্গদের দশ-বারোজন মারা গেল।

নয়েস, বেন ও সাতজন আমেরিকান আর তিনজন আরব মারা গেল। তাদের মৃতদেহগুলো একটা ট্রাকের উপর চাপানো হলো।

ওগ্রেডি ওরমানকে বলল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে টম। শয়তানরা ঘাসগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিতে পারে।

ওরমান আবার যাত্রা শুরু করার হুকুম দিল। ওগ্রেডি বলল, কিন্তু ওবরস্কি কোথায়? তাকে ত দেখছি না।

মার্কাস বলল, আমি দেখছি আক্রমণের সময় ও গাড়ি থেকে নেমে ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। আক্ৰমণটা আমাদের বাঁদিকে শুরু হওয়ায় ও ডানদিকে চলে যায়।

 ওরমান নিজে ঘাসের মধ্যে ওবরস্কির খোঁজ করতে গেল। তার সঙ্গে আরো কয়েকজন খুঁজতে লাগল। কিন্তু অনেক খুঁজেও ওবরস্কিকে পাওয়া গেল না কোথাও। তার মৃতদেহও কেউ দেখতে পেল না।

যাই হোক, সফরি আবার এগিয়ে চলল। বিকালের দিকে এক জায়গায় শিবির স্থাপন করা হলো। রান্নার কাজ শেষ হলে সবাই বিষণ্ণ মুখে খাবার টেবিলে বসল।

স্ট্যানলি ওবরস্কির চেহারাটা অসাধারণভাবে বলিষ্ঠ হলেও মনে একটুও সাহস বা পৌরুষবোধ ছিল না। অথচ তাকে দেখে তা মনে হত না। কিন্তু আসলে তার মনটা ছিল দারুণ ভীরু প্রকৃতির। কিন্তু লজ্জায় সে তার ভীরুতা প্রকাশ করত না কখনো। আজও তাই বানসুটো অধিবাসীরা তাদের অকস্মাৎ আক্রমণ করলে সাহসের সঙ্গে দলের আর পাঁচজনের মত সম্মুখীন না হয়ে কোন লড়াই করে ঘাসের ভিতরে গিয়ে লুকিয়ে রইল।

একজন আদিবাসী তাকে দেখে প্রথমে ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু পরে সে তাদের দলের লোকদের ডাকে। সে একটা ছুরি বার করে। ওবরস্কির হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। সে তার দলের লোকদের কাছে। ছুটে পালাতেও পারল না।

ওবরস্কি তখন তার সামনের নিগ্রো আদিবাসীটিকে দু’হাত দিয়ে মাথার উপরে তুলে মাটিতে আছাড় মেরে ফেলে দিল। জীবনে আজ সে প্রথম লড়াই করল নিজের হাতে। তার দেহে এতখানি শক্তি ছিল, মনে এত সাহস ছিল তা নিজেই জানত না সে। আজ প্রথমে পরিচিত হলো তার নিজের শক্তি আর সাহসের সঙ্গে।

কয়েকজন বানসুটো আদিবাসী এসে ওবরস্কির হাত দুটো পিঠের দিকে ঘুরিয়ে বেঁধে দিল। তারপর লড়াই শেষে পালিয়ে যাবার সময় ওবরস্কিকেও হটিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। ক্রমাগত অনেকক্ষণ ধরে পথ। চলে আদিবাসীরা বিকালের দিকে একটা গায়ে গিয়ে পৌঁছল।

ওবরস্কিকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে গাঁয়ের সব লোক, নারী, শিশু সবাই ছুটে এল। তার গায়ে থুথু দিতে লাগল আর ময়লা ফেলতে লাগল। গায়ের সর্দার এসে দর্শকদের তাড়িয়ে দিল। অবশেষে এক অন্ধকার কুঁড়ে ঘরের সামনে তার মধ্যে ঢুকে পড়তে বলল। কিন্তু দরজাটা খুব ছোট বলে ঢুকতে পারছিল না ওবরস্কি।

আদিবাসী যোদ্ধারা তাকে কোনরকমে টেনে ঢোকাল। ঘরের ভিতরটা অন্ধকার হলেও ওবরস্কি দেখতে পেল কামুড়ি আর দু’জন নিগ্রো হাত পা বাঁধা অবস্থায় বসে আছে মেঝের উপর।

ওবরস্কি সিংহমানুষের অভিনয় করার জন্য এসেছিল বলে নিগ্রোভৃত্যরা তাকে সিম্বা বলত। ওবরস্কিকে দেখেই আশ্চর্য হয়ে কামুড়ি বলল, তোমাকে কি করে ধরল বাওয়ানা সিম্বা?

ওবরস্কি বলল, তুমি তাহলে পালিয়ে এসে ভাল কাজ করনি কামুড়ি।

কামুড়ি বলল, আমাদের দলের অনেকে পথে ওদের হাতে মারা যায়। কিছু লোককে বন্দী করে এনেছে। কিছু লোক পালিয়ে যায়।

ওবরস্কি বলল, ওরা আমাদের খুন করছে না কেন?

কামুড়ি বলল, কারণ ওরা আমাদের খাবে।

ওবরস্কি বলল, তুমি কি বলতে চাও ওরা মানুষখেকো?

কামুড়ি বলল, হ্যাঁ। তবে অন্য সব নরখাদক আদিবাসীদের মত নয়। ওরা সব সময় সব মানুষ খায় বা মানুষের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খায় না। ওরা কেবল যারা কোন না কোন দলের প্রধান বা সর্দার, যারা বীর সাহসী এবং বলবান ওরা শুধু তাদেরই হত্যা করে তাদের মাংস খায়। কারণ তাদের ধারণা তাহলে তারাও বীর, বলবান ও প্রধান হবে। আবার মৃতদেহের বাছাই করা শুধু কয়েকটা অঙ্গ খায় তারা। তারা। আমাদের হৃদপিণ্ড, হাতের তালু, পায়ের তলা, আর হাত-পায়ের পেশীগুলো খাবে।

সেদিন রাতের খাওয়া হয়ে গেলে ওরমান আর বিল ওয়েস্ট গিয়ে রোন্ডাকে বলল, তোমরা যাও, আমরা ডিশগুলো ধুয়ে নেব। জিমি আর শর্টি আমাদের সাহায্য করবে।

রাত্রি দুপুর হলে শ্বেতাঙ্গরা আরবদের ডেকে পাহারায় বসিয়ে দিয়ে শুতে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়ল তারা।

পরদিন সকালে রোদ ওঠার পর গর্ডন মার্কাস প্রথমে উঠল। উঠেই শিবিরটার চারদিকে তাকিয়ে তার কেমন মনে হতে লাগল। শিবিরটাকে ফাঁকা ফাঁকা মনে হলো তার। আগুনের কাঠ সব নিভে গেছে। ধোয়া হচ্ছে না তাতে। তার উপর কেউ পাহারায় নেই। এরপর সে দেখল আরবরা শিবির ছেড়ে পালিয়ে গেছে। মার্কাস তখন ছুটে গিয়ে ওরমান আর ওগ্রেডির তাঁবুতে গিয়ে তাদের জাগাল। ব্যস্তভাবে বলল, আরবরা পালিয়ে গেছে। তাদের ঘোড়া, মালপত্র কিছুই নেই।

ওরমান আর ওগ্রেডি মশারির ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। সব শুনে ওরমান বলল, মনে হচ্ছে। কয়েকঘণ্টা আগেই ওরা পালিয়েছে। যাই হোক, ওদের ছাড়াই আমাদের চলতে হবে। এখন প্রাতরাশের জন্য খাবার তৈরির জন্য মেয়েদের ডাক। জিমি আর শর্টিকেও ডেকে তোল।

মার্কাস মেয়েদের ঘরে চলে গেল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে ছুটতে ফিরে এল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মেয়েদের পাওয়া যাচ্ছে না। রোন্ডা, নাওমি কেউ নেই। তাদের ঘরটার সবকিছু তছনছ হয়ে আছে। আরবরা ওদের ধরে নিয়ে গেছে। ওদের চেঁচাবার সুযোগ দেয়নি। কিন্তু কেন তারা ওদের নিয়ে গেল।

ওগ্রেডি বলল, হয়তো মুক্তিপণ চায় মোটা রকমের অথবা ওদের বিক্রি করে দিতে চায় মোটা দামে।

ওরমান বলল, এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক জায়গায় মেয়ে বিক্রির বাজার আছে।

এরপর ওরমান কোথায় যাবার জন্য তার জামা-কাপড়, খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে তৈরি হতে লাগল। তা দেখে বিল ওয়েস্টও সেইভাবে যাবার জন্য তার জিনিসপত্র গোছাতে লাগল।

ওরমান তাকে বলল, কোথায় যাবে তুমি?

 ওয়েস্ট বলল, আমি যাব তোমার সঙ্গে।

ওগ্রেডি বলল, তোমরা যদি মেয়েদের খোঁজ করতে যাও তাহলে আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব।

অনেকেই যেতে চাইল। কিন্তু ওরমান বলল, না আমি একা যাব। দলবলের থেকে একজন লোক অনেক দ্রুত যেতে পারে। ওরা ঘোড়ায় গেলেও অনেক জায়গায় নামতে হবে ওদের। তার থেকে আমি হেঁটে তাড়াতাড়ি যাব। আমার অনুপস্থিতিতে সফরির ভার থাকবে ওগ্রেডির উপর।

ওগ্রেডি বলল, কিন্তু তুমি একা, ওদের ধরতে পারলেই বা কি করবে? কি করে একা লড়াই করবে?

ওরমান বলল, আমি ত লড়াই করব না। আরবরা ওদের বিক্রি করে যত টাকা পাবে আমি তাদের আরো বেশি টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনব।

এরপর ওরমান প্রাতরাশ খেতে খেতে বলল, ওম্বাম্বি জলপ্রপাতের কাছে তোমরা অপেক্ষা করবে আমার জন্য। সেখানে গেলে কিছু আদিবাসী ভৃত্য পাবে। দক্ষিণ দিকের পথ দিয়ে একজন লোককে জিঞ্জায় পাঠিয়ে আমাদের আমেরিকার স্টুডিওতে খবর পাঠিয়ে দেবে। যা যা ঘটেছে তা জানিয়ে দেবে। এবং এখন কি করা হবে তার নির্দেশ চাইবে।

ওরমান যাবার জন্য উদ্যত হতেই বিল ওয়েস্ট তার পিছু নিল। বলল, আমাকে যেতেই হবে। রোন্ডা কোথায় কেমন আছে তার কিছুই জানি না।

ওরমান বলল, বুঝেছি। আমি এ কথাটা ভাবিনি। তুমি আমার সঙ্গে যেতে পার।

ওরমান আর ওয়েস্ট শিবির থেকে বেরিয়ে যে পথে আরবরা ঘোড়ায় চড়ে পালিয়ে গেছে সেই পথ ধরে অদৃশ্য হয়ে গেল বনের মধ্যে।

রাত্রিশেষে নতুন দিনের আলোকে স্বাগত জানাল ওবরস্কি। কারণ এদিন মৃত্যু এসে তার বন্দীত্বের সব দুঃখ-কষ্টভভাগের অবসান ঘটাতে পারে। দড়ির শক্ত বাঁধনগুলোর জন্য তার হাতে পায়ে ব্যথা লাগছিল। তার উপর ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালা। ঘরের ছোট ছোট ইঁদুরগুলো গায়ে উঠে কামড়াচ্ছিল। সারা রাত ধরে গ্রামবাসীরা নাচগান করতে থাকায় তাদের সেই ভয়ঙ্কর নাচগানের শব্দে রাতে একটুও ঘুম হয়নি ওবরস্কির। কিন্তু ওবরস্কি দেখল কামুড়ি ও তার দু’জন লোক বেশ ঘুমোচ্ছে।

সে তাদের বলল, খাবার আর জলের জন্য তোমরা চীৎকার করো।

সারারাত নাচগান করে কাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে গ্রামবাসীরা প্রায় দুপুর পর্যন্ত ঘুমোল। তারপর মেয়েরা উঠে রান্নার কাজ করতে লাগল। কয়েকজন প্রহরী এসে বন্দীদের পায়ের বাঁধনগুলো খুলে দিয়ে তাদের সকলকে বানসুটো আদিবাসীদের সর্দার রঙ্গুলার ঘরের সামনে নিয়ে গেল। রঙ্গুলা কামুড়িকে তাদের ভাষায় কি বললে কামুড়ি ওবরস্কিকে বলল, সর্দার জিজ্ঞাসা করছে তোমরা ওদের দেশে কি করছিলে?

ওবরস্কি বলল, আমরা একটা কাজে চলে যাচ্ছিলাম। ওদের কোন ক্ষতি করিনি। আমরা বন্ধু তোমাকে ছেড়ে দিতে বল।

কামুড়ির মাধ্যমে সে কথা শুনে রঙ্গুলা বলল, সব শ্বেতাঙ্গদের মারা হবে। গতকাল তাকেও মারা হত, শুধু তোর চেহারাটা খুব বলিষ্ঠ বলে সঙ্গে সঙ্গে মারা হয়নি।

কামুড়ি রঙ্গুলাকে বলল, কিন্তু আমাদের কোন খাদ্য বা পানীয় দিয়ে এভাবে শুকিয়ে রাখলে তাতে কি লাভ হবে তাদের?

কামুড়ির কথার কোন জবাব না দিয়ে রঙ্গুলা তাদের যোদ্ধাদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা একটা লোককে ডেকে ওবরস্কির পাশে দাঁড়াতে বলল। দেখল ওবরস্কি তার থেকেও লম্বা এবং তার পেশীগুলো সত্যিই বেশ বলিষ্ঠ আর সুগঠিত।

কামুড়ি আর ওবরস্কিকে আবার সেই ঘরটার মধ্যে নিয়ে যাওয়া হলো। এবার আর তাদের পাগুলো বাঁধা হলো না। রঙ্গুলার নির্দেশে একটা আদিবাসী মেয়ে তাদের জল আর খাবার দিয়ে গেল।

এইভাবে এক সপ্তাহ কেটে গেল। তারপর একদিন রাত্রিবেলায় কামুড়ির একজন বন্দী লোককে তিন চারজন যোদ্ধা এসে তাকে সর্দারের ঘরের সামনে নিয়ে গেল। গ্রামবাসীরা ঢোলের তালে তালে উল্লাস করতে লাগল। সেই উল্লাসের মাঝে এক সময় এক তীক্ষ্ণ কণ্ঠের আর্ত চীৎকার শুনতে পেল ওবরস্কি।

কামুড়ি বলল, সব শেষ।

পরদিন রাতে আবার একজন বন্দীকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করল ওরা।

তৃতীয় দিন কামুড়ি বলল, আজ আমার পালা। আজ রাতে তোমাকে একা থাকতে হবে মালিক।

কিন্তু রাত্রি হতেই কামুড়ি আর ওবরস্কি দু’জনকেই নিয়ে যাওয়া হলো সর্দারের বাড়ির সামনে সেই বধ্যভূমিতে। ওবরস্কির সামনে কামুড়িকে নির্মম নিপীড়নের মাধ্যমে ধীরে ধীরে হত্যা করা হলো। কিন্তু সেদিন ওবরস্কিকে হত্যা করা হলো না। কামুড়িকে হত্যা করার পর ওবরস্কিকে আবার সেই ঘরে এনে রাখা হলো।

এদিকে টারজান দূর থেকে রঙ্গুলাদের গাঁ থেকে পর পর তিন রাত ঢাক-ঢোলের আওয়াজ, নাচ গানের শব্দ শুনতে পেয়েছে।

আজ রাতে আবার বানসুটোদের গাঁ থেকে দমদম নাচের বাজনার শব্দ শুনতে পেল। কি মনে হতে সেই গাঁয়ের দিকে গাছের ডালে ডালে এগোতে লাগল টারজান। জাদ-বাল-জা তখন তার সঙ্গে ছিল না।

গাঁয়ের কাছে গিয়ে টারজান দেখল গায়ের সর্দারের ঘরের সামনে নাচের আসর বসেছে। জ্বলন্ত আগুনের আলোয় দেখতে পেল তারই মত অনেকটা দেখতে বলিষ্ঠদেহী এক শ্বেতাঙ্গ যুবককে একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। একটু পরেই অর্থাৎ নাচ হয়ে গেলেই তার উপর অকথ্য পীড়ন চালিয়ে হত্যা করা হবে তাকে।

টারজান দেখল সর্দারের ঘরের আশেপাশে ও পিছনে অনেকগুলো গাছ রয়েছে। গায়ের পিছন দিক দিয়ে সে সর্দারের কুঁড়ের কাছে একটা গাছের উপরে উঠে গেল। সেখান থেকে ওদের নাচটা ভালভাবেই দেখতে পাচ্ছিল টারজান। মুখে রং মাখা যোদ্ধারা বাজনার তালে তালে নাচছিল আর মাঝে মাঝে লাফাচ্ছিল। সর্দার রঙ্গুলা এক পাশে দাঁড়িয়েছিল। বন্দী শ্বেতাঙ্গ যুবকটিকে দেখে কৌতূহল জাগল তার মনে। তার মত অনেকটা দেখতে। সে কে এবং কোথা থেকে এসেছে তা বুঝতে পারল না।

সর্দার রঙ্গুলা একটা টুলের উপর বসেছিল। সে হঠাৎ হুকুম দিল, বন্দীকে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেল এবার।

কিন্তু ওবরস্কিকে ধরে নিয়ে যাবার জন্য যোদ্ধারা তার কাছে এলেই ওবরস্কি একজনকে তুলে এনে অন্য যোদ্ধাদের উপর সজোরে ফেলে দিল। তাতে অনেকে পড়ে গেল। রঙ্গুলা চীৎকার করে বলতে লাগল, ওকে ধরে ফেল। বেঁধে ফেল।

কিন্তু সমানে একা অনেক লোকের সঙ্গে লড়াই করে যেতে লাগল ওরস্কি। নিগ্রোযোদ্ধারা সংখ্যায় বেশি থাকায় ক্রমে তারা ওবরস্কিকে ধরে ফেলল। কিন্তু তার হাত পা বাঁধতে গেলে সে আবার ঘুষিতে বেশ কয়েকজনকে ঘায়েল করল। তবু তারা ওবরস্কিকে মাটিতে ফেলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাছের উপর থেকে অতর্কিতে একটি দড়ির ফাস এসে সর্দার রঙ্গুলার গলায় আটকে গেল। তার হাত দুটোও বাধা পড়ে গেলে ফাঁসে। রঙ্গুলা ভয়ে ও বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে চীৎকার করে উঠল। তার পাশের লোকেরা কিছু বোঝার আগেই তার দেহটা আশ্চর্যজনকভাবে গাছের উপর উঠে গেল। অথচ গাছের উপর কোন লোক দেখতে পেল না তারা।

ওবরস্কি নিজেও কম আশ্চর্য হলো না।

হঠাৎ গাছের উপর থেকে এক অদৃশ্য লোকের গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল। রঙ্গুলাকে সে কণ্ঠস্বরে বলল, আমাকে দেখতে পাচ্ছ? দেখ আমি কে?

রঙ্গুলা ভয়ে ও যন্ত্রণায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, হ্যাঁ পাচ্ছি, ওয়ালাম্বে।

টারজান বলল, না, আমি ওয়ালাম্বে বা মৃত্যুর দেবতা নই। আমি তার থেকেও বড়। আমি হচ্ছি বাঁদরদলের টারজান। আমি যেকোন সময়ে মৃত্যু এনে দিতে পারি। যে কোন লোকের মৃত্যু ঘটাতে পারি।

রঙ্গুলা তেমনি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, কি চাও তুমি? কি করবে আমাকে নিয়ে?

টারজান বলল, আমি নিজেকে দুভাগে ভাগ করে আর একটি মানুষকে আমার মত করে তাকে পাঠিয়েছিলাম তোমাদের কাছে। তোমরা তার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করো তা দেখতে চেয়েছিলাম। আমি দেখলাম সে তোমার কোন ক্ষতি না করলেও তোমরা তাকে বিনা কারণে হত্যা করো, তার সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যবহার করো। এজন্য তোমাকে মরতে হবে।

রঙ্গুলা বলল, তুমি গাছের উপর এখানে রয়েছ, আবার গাছের তলাতেও রয়েছ। তুমি তাহলে দানব। তোমাকে খাদ্য, পানীয়, অস্ত্রশন্ত্র এবং মেয়ে দিয়ে সন্তুষ্ট করব। তুমি আমাকে মেরো না।

টারজান বলল, তোমার জীবনের একটা মূল্য ছাড়া আর আমি কিছুই চাই না।

রঙ্গুলা ভয়ে ভয়ে বলল, সেটা কি মালিক?

টারজান বলল, তোমাকে কথা দিতে হবে তুমি কোন শ্বেতাঙ্গের সঙ্গে লড়াই করবে না। তোমাদের দেশে কোন শ্বেতাঙ্গ এলে বরং তাকে সাধ্যমত সাহায্য করবে।

রঙ্গুলা বলল, কথা দিচ্ছি মালিক। আমি তাই করব।

টারজান বলল, তাহলে তোমাদের লোকদের বল ঐ বন্দীর বাঁধন খুলে তাকে যেন ছেড়ে দেয় তারা। তারপর গায়ের গেট খুলে দেয় যেন। আমরা চলে যাব।

রঙ্গুলা চীৎকার করে তার লোকদের সেইমত হুকুম দিল। টারজানও তখন তার গলা থেকে ফাসটা খুলে দিল।

ওবরস্কি এই সব ব্যাপার দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল একেবারে। গাছের উপর থেকে টারজান এবার ইংরেজিতে তাকে বলল, তুমি গাঁয়ের বাইরে বনের ধারে চলে যাও। ওরা তোমার কোন ক্ষতি করবে না। আমি যাচ্ছি এখনি।

ওবরস্কি টারজনের কথামত গাঁয়ের বাইরে বনের মধ্যে ঢুকতেই তার পিছনে গিয়ে হাজির হল টারজান। ওবরকি মুখ ঘুরিয়ে বলল, কে তুমি?

টারজান বলল, আমি বাঁধদলের রাজা টারজান।

ওবরস্কি আগেই টারজনের নাম শুনেছিল। সে ভেবেছিল টারজান কোন রক্ত মাংসের মানুষ নয়। সে শুধু আফ্রিকার রূপকথার এক কাল্পনিক চরিত্র।

বনের মধ্যে যেতে যেতে টারজান বলল, আমার পিছু পিছু এস।

ওবরস্কি বলল, তোমাকে আমার ধন্যবাদ জানানো হয়নি। তুমি এসে আমাকে উদ্ধার না করলে আজ আমার জীবন চলে যেত।

টারজান কিন্তু সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে নীরবে পথ চলতে লাগল।

অবশেষে তারা একটা ফাঁকা জায়গায় একটা নদীর ধারে এসে থামল। চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছিল ফাঁকা জায়গাটায়।

কিন্তু সে সৌন্দর্য ভাল করে উপভোগ করতে না করতেই দুটো সিংহ দেখে ভয় পেয়ে গেল ওরস্কি। তাদের মধ্যে একটা সিংহ আর একটা সিংহী ছিল। সিংহীটা ওদের দেখে গর্জন করতে লাগল।

টারজান ওবরস্কিকে বলল, কোন ভয় নেই, তুমি দাঁড়াও। সিংহীটাকে আমি চাই না, দেখি কি ব্যাপার।

ওবরস্কি সেইখানে ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল। সে দেখল টারজান সিংহটার দিকে এগিয়ে গেল। সে ভাবল টারজান পাগল।

কিন্তু ওরস্কি আশ্চর্য হয়ে দেখল টারজান এক দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলছে সিংহটার সঙ্গে। সে বলল, টার্মাঙ্গানী এসেছে, জাদ-বাল-জা তুমি তোমার সিংহীটিকে সাবধান করে দাও।

জাদ-বাল-জা নামে সিংহটা কাছে গিয়ে কি বলতেই সিংহীটি চলে গেল। জাদ-বাল-জাও তার সঙ্গে চলে গেল।

টারজান এবার ওবরস্কির ঘাড়ে একটা হাত রেখে বলল, জাদ-বাল-জা আর তোমার কোন ক্ষতি করবে না কখনো। সে এবার থেকে তোমার গন্ধ খুঁকে তোমাকে চিনতে পারবে।

টারজান এবার ঘাসের উপর সটান শুয়ে পড়ে বলল, এখানেই শুয়ে পড়। জাদ-বাল-জা পাহারা দেবে যাতে আমাদের কোন ক্ষতি না হয়। আচ্ছা তুমি এ অঞ্চলে কিভাবে এলে?

ওবরস্কি তখন আমেরিকা থেকে কখন কিভাবে কি কারণে আফ্রিকার জঙ্গলে এল তা সব বলল।

টারজান তা শুনে বলল, আমি যদি জানতাম তুমি ঐ সফরির লোক তাহলে আমি তোমাকে উদ্ধার করতাম না।

ওবরস্কি বলল, কেন?

টারজান বলল, তোমাদের দলনেতা লোকটা বড় খারাপ। ষে নিগ্রোভৃত্যদের প্রায়ই চাবুক মারত।

ওবরস্কি বলল, লোকটাকে আমি দেখতে পারতাম না। শুধু টাকার জন্য ছবিতে অভিনয় করতে আসি আমি। লোকটা পরিচালক হিসেবে খুব নামকরা। তবে বড় মদ খায় আর মদ খেয়েই চাবুক মারত লোকগুলোকে।

ঈয়াদ নামে এক আরব যুবক আতুইকে বলল, এই মেয়েটাকে ধরে এনে আমার মনে হয় ভুল করেছে শেখ। শ্বেতাঙ্গরা রাইফেল নিয়ে আমাদের ধরতে আসবে।

আতুই বলল, হীরের দেশের উপত্যকা আমরা কোনদিন খুঁজে না পেলেও আমরা শুধু হাতে দেশে ফিরে যাব না। মেয়ে দুটো বিক্রি করে দিলে মোটা দাম পাওয়া যাবে। এমন কি ওদের দলের শ্বেতাঙ্গরাও মুক্তিপণ হিসেবে অনেক টাকা দিয়ে ফিরিয়ে নিতে পারে ওদের। তাছাড়া ম্যাপটাতে ইংরেজি ভাষায় যেসব কথা লেখা আছে তা পড়ার জন্য মেয়ে দুটোর দরকার। আমি ইংরেজি বলতে পারি। কিন্তু পড়তে বা লিখতে পারি না।

সকাল থেকে সারাটা দিন ধরে অশ্বারোহী আরবরা ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছিল মেয়ে দুটোকে নিয়ে। নাওমি এক সময় রোন্ডাকে বলল, আর আমি হাঁটতে পারছি না। আমি মূৰ্ছিত হয়ে পড়ব।

সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়লে শেখ শিবির স্থাপন করল পথের ধারে এক জায়গায়।

সন্ধ্যার পর শেখ আতুইকে ম্যাপটা আনতে বলল। বলল, আমাকে বুঝিয়ে দাও কোথায় হীরকদেশের উপত্যকাটা আছে আর সেখানে যাবার পথটাই বা কোনদিকে।

আতুই আবার রোন্ডাকে ডাকল।

রোন্ডা ম্যাপটা দেখে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে বলল, কোথায় হীরকদেশঃ ও ত কল্পনা। আমাদের যে ছবি হবে তাতে ঐ ধরনের জায়গার একটা কল্পনা করা হয়েছে।

আতুই বলল, দেখ, বেদুইনদের তুমি ঠকাতে পারবে না। তুমি যদি আমাদের এটা দেখিয়ে না দাও তাহলে তোমার গলা কেটে দেব।

নাওমি ভয়ে শিউরে উঠে রোন্ডাকে বলল, তুমি ওদের বুঝিয়ে দাও। কেন এমন করছ?

রোন্ডা তখন ম্যাপটার উপর ঝুঁকে পড়ে শেখকে বোঝাতে লাগল। এক জায়গায় হাত দিয়ে বলল, এটা হলো উত্তর দিক। এটা হলো হীরক দেশের উপত্যকা। এখানে কতকগুলো তীর রয়েছে। এগুলো হচ্ছে পথ নির্দেশ। উপত্যকায় যাবার পথ। উপত্যকার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটা নদী রয়েছে। সেই নদীটা আবার আর একটা বড় নদীতে পড়েছে। এখানে এক নরখাদক উপজাতীদের বস্তি আছে।

শেখ একটা আঙুল দিয়ে বলল, এটা বোধ হয় ওস্বাম্বি জলপ্রপাত আর এটা হলো বানসুটোদের গাঁ। আগামীকাল আমরা এই নদীটা পেরিয়ে ফাঁকা প্রান্তরটায় গিয়ে পড়ব। তারপর একটা রুক্ষ্ম পাহাড় পাব।

আতুই বলল, কাল যদি ওখানে যেতে পারি তাহলে খুব তাড়াতাড়ি আমরা হীরকদেশের উপত্যকায় গিয়ে পড়ব।

শেখ আতুইকে কি বলতে রোন্ডা তাকে জিজ্ঞাসা করল শেখ কি বলল।

আতুই বলল, শেখ বলছে হীরকদেশে গিয়ে অনেক হীরে পেলে সে ধনী হবে। তখন সে তোমাদের দু’জনকেই রেখে দিতে পারবে। সে তখন আর বিক্রি করবে না তোমাদের।

আরবরা মেয়েদের শোবার জন্য একটা তাবুর ঘরে কম্বল বিছিয়ে দিল। রোন্ডার চোখে কিন্তু ঘুম এল না। সে এক সময় নাওমিকে বলল, ওরা যখন সত্যি সত্যিই হীরের দেখা বা খোঁজ পাবে না, তখন আমাদের উপর ক্ষেপে যাবে। আমাদের তখন যেখানে হোক বিক্রি করে দেবে। সুতরাং এখনি আমাদের পালিয়ে যেতে হবে এখান থেকে।

নাওমি বলল, সে কি, এই রাত্রিতে বনের ভিতর দিয়ে কি করে পালাবে? যাই হোক, তোমার মতলবটা কি?

রোন্ডা বলল, তুমি শুধু আমাকে অনুসরণ করে যাবে। কোন কথা বলবে না।

এই বলে সে উঠে দেখল আরবরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। একজন পাহারাদার শুধু আগুনের ধারে জেগে আছে। সেও তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে ঝিমোচ্ছে।

রোন্ডা চুপি চুপি উঠে গিয়ে একটা জ্বলন্ত কাঠ এমনভাবে সজোরে প্রহরীটার উপর খুঁজে ধরল যে, সে সঙ্গে সঙ্গে অচেতন হয়ে পড়ে গেল।

বনের মধ্যে অশ্বারোহীদের যাবার মত যে একটা পথ ছিল সেই পথ ধরে ওরমান আর বিল ওয়েস্ট এগিয়ে চলেছিল।

ওরমান এক সময় বলল, আমি ভেবেছিলাম একদিনের মধ্যেই আরবদের দেখা পেয়ে যাব এবং দেখা করেই শিবিরে ফিরে আসব। কিন্তু এগার দিন কেটে গেল। আর কোন আশাই নেই। এখন আমাকে ফিরে গিয়ে আমার দলের লোকদের বাড়ি পাঠাবার কথা ভাবতে হবে।

ওরা বুঝতে পারল বনে পথ হারিয়ে ফেলেছে। হঠাৎ ওয়েস্ট বলল, কিসের একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে কে যেন আসছে।

ওরমান বলল, ওটা একটা সিংহ হলে মুস্কিল হবে। কারণ এখানে পথটা সরু এবং দু’ধারে ঘন ঝোপ।

ওরমান আগে গুলি করল। গুলিটা সিংহটার মাথার খুলিতে লাগল। বিলের গুলি লাগল না। সিংহটা ক্ষেপে গিয়ে ওরমানকে আক্রমণ করল। ওয়েস্ট হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু ওরমানকে কোনভাবে আহত করার আগেই একটা গাছ থেকে টারজান সিংহটার উপর অতর্কিতে লাফিয়ে পড়ে তার কেশর ধরে বারবার ছুরি বসাতে লাগল তার গায়ে। সিংহটা মারা গেলে তার মৃতদেহের উপর দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে বিজয়সূচক এক চীৎকার করল। ওরমান আর ওয়েস্ট অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু তারা কোন ধন্যবাদ দেবার আগেই টারজান অদৃশ্য হয়ে গেল বনের মধ্যে।

প্রহরীটাকে মেরে রোন্ডা শিবিরের সব ঘোড়াগুলোকে ছেড়ে দিল। তাদের জন্য দুটো ঘোড়াকে বেছে নিয়ে নিজে একটাতে চেপে অন্যটাতে নাওমিকে চাপাল। অন্য ঘোড়াগুলোকে বনের মধ্যে তাড়িয়ে দিল। ঘোড়াগুলো ছাড়া পেয়ে এদিক সেদিক ছুটে পালাতে লাগল।

ফাঁকা জায়গাটা পার হয়ে বনপথ ধরল ওরা।

কিছুদূর যাবার পর তারা একটা নদীর সামনে এসে পড়ল। নদীটা কিভাবে পার হতে হবে তা বুঝতে পারল না।

রোন্ডা বলল, নদীটা পার হতে হবে। এখন ফিরে গেলে আরবদের কবলে পড়ব আমরা। আমার সঙ্গে সঙ্গে এস। নদীটা তেমন চওড়া বা গভীর নয়। ঘোড়াগুলোকে নামিয়ে দিলে ঠিক পার হয়ে যাব।

নদী পার হতেই সকাল হয়ে গেল। দূরে সামনে পাহাড় দেখা যাচ্ছিল। নদীটার এপারে ফাঁকা মাঠ। মাঝে মাঝে কিছু গাছপালা ছড়িয়েছিল।

নদী পার হয়ে ওরা আবার ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়েছিল। সহসা সামনে কতকগুলো গাছের ওধার থেকে একটা সিংহের গর্জন শোনা গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে সিংহটা ওদের সামনে এসে রোন্ডার ঘোড়াটাকে আক্রমণ করল আগে। রোন্ডা ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে মরার মত শুয়ে রইল স্থির হয়ে। সিংহটা। ঘোড়াটাকে মেরে তার উপর থাবা গেড়ে বসে রইল। এদিকে সিংহটা রোন্ডার ঘোড়াটাকে মারতে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে নাওমির ঘোড়াটা তীরবেগে পিছন দিকে ঘুরে পালিয়ে গেল। নদী পার হয়ে যে পথে। এসেছিল ওরা, সেই পথেই পালাতে লাগল ঘোড়াটা। নাওমি তার গতিকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারল না কোনভাবে। নাওমি একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল সিংহটা সেইভাবে বসে আছে ঘোড়ার মৃতদেহটার উপর আর তার অদূরে রোন্ডা তেমনি শুয়ে আছে নিস্পন্দ হয়ে।

এদিকে ওরমান আর বিল ওয়েস্ট পথ হারিয়ে গভীর জঙ্গলের মধ্যে অনেক ঘুরে বেড়াল। কিন্তু কোন পথ খুঁজে পেল না। ওরা হারানো মেয়ে দুটোর খোঁজে বেরিয়েছে দু’সপ্তাহ হয়ে গেল। কয়দিন কিছুই খাওয়া হয়নি। আজ আবার পথে সিংহ ওদের আক্রমণ করায় ভয় পেয়ে গেছে দু’জনেই।

ওরমান বলল, আমি ভূত বিশ্বাস করি না। ওবরস্কি ভূত নয়, ওবরস্কি নিজেই আমাদের উদ্ধার করে চলে গেছে। তবে তার মাথার ঠিক নেই। সে পাগল হয়ে গেছে বলে গায়ে তার জোর অনেক বেড়ে গেছে এবং সে আমাদের চিনতে পারেনি।

ওয়েস্ট বলল, ওবরস্কি যাই করুক সে শুধু আমাদের বাঁচায়নি, সে আমাদের আর একটা উপকার করে গেছে সিংহটাকে মেরে।

ওরমান বুঝল সিংহটার মাংস খাবার কথা বলছে ওয়েস্ট।

ওরা দুজনে বসে ছুরি দিয়ে সিংহটার মৃতদেহ কেটে পেট ভরে মাংস খেল এবং অনেকটা মাংস কেটে সঙ্গে নিয়ে নিল। মাংস খেয়ে কিছুটা গায়ে বল পেল ওরা।

সন্ধ্যার দিকে ওয়েস্ট হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে ওরমানকে কি দেখাল। ওরমান তা দেখে বলল, ও হচ্ছে ঈয়াদ নামে সেই আরবটা। কিন্তু ওর সঙ্গে ত দলের অন্য কেউ নেই। ও এক জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে একা বসে আছে তার পাশে।

ওরমান আর ওয়েস্ট রাইফেল হাতে এগিয়ে গেল। ওদের দেখে ঈয়াদও রাইফেল তুলে গুলি করতে গেল। কিন্তু তার আগেই ওরমান ওকে লক্ষ্য করে রাইফেল তুলে ধরেছে। সে ধমক দিয়ে বলল, বন্দুক নামাও।

ঈয়াদ বাধ্য হয়ে এবার বন্দুক নামাল।

ওরমান ওকে জিজ্ঞাসা করল, শেখ আবেল বেনেম কোথায়? আমাদের দল থেকে যে মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়েছিলে তারাই বা কোথায়?

ঈয়াদ শুধু নামগুলো ছাড়া ওদের কোন কথা বুঝতে পারল না। সে ইংরেজিতে কথা বলতে জানে না, আতুই জানত। সে হাবভাবে ও ইশারা করে বুঝিয়ে দিল, একটা মেয়েকে সিংহতে খেয়েছে। সে ছাড়া বাকি আরবদলের সবারই অবস্থা খুব খারাপ। তারা সবাই বিপদাপন্ন।

ওরা বুঝল ঈয়াদ নিশ্চয়ই কোন বিপদ থেকে বাঁচার জন্য দল ছেড়ে একাই পালিয়ে এসে পথ হারিয়ে ফেলেছে। না খেতে পেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে।

একটা নদীর ধারে সন্ধ্যার সময় শিবির স্থাপন করল ওরা। ওদের সঙ্গে যে মাংস ছিল তা রান্না করল ওরমান। ঈয়াদ ওদের সঙ্গেই রয়ে গেল। ওরমান বলল, আগামীকাল সকালে আমরা আমাদের সফরির। খোঁজে বার হব। ঈয়াদ আমাদের কাছে থাকবে পথ দেখাবার জন্য।

এদিকে ওদের শিবিরের কাছ থেকে ওদের অলক্ষ্যে অগোচরে টারজান কখন ওদের দেখে গেছে তা বুঝতে পারেনি ওরা। টারজান সেই রাতেই ওবরস্কির কাছে গিয়ে বলল, আমি তোমাদের দু’জন সঙ্গীকে দেখে এসেছি তাদের নাম ওরমান আর ওয়েস্ট। তাদের সঙ্গে একজন আরবও ছিল। আমাদের এখান থেকে উত্তর দিকে কয়েক মাইল দূরে।

ওবরস্কি বলল, মেয়েদের দেখনি?

টারজান বলল, না, কালই তোমায় ওরমানের কাছে নিয়ে যাব। সেখানে গেলেই জানতে পারবে সবকিছু।

সেদিন সিংহটার আক্রমণের পর চেতনা হারিয়ে ফেলেছিল রোন্ডা ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে। চেতনা ফিরে পেয়ে চোখ মেলে তাকাতেই সে দেখল একটা সিংহ তার মরা ঘোড়াটার উপর একটা পায়ের থাবা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে তখন ভয়ে আবার চোখ বন্ধ করল।

সিংহটা এবার তার কাছে এসে তার দেহটাকে শুঁকতে লাগল। রোন্ডা যতদূর পারল শ্বাসরুদ্ধভাবে মরার ভান করে রইল। সে জানত সাধারণত মরা মানুষকে কোনরকম পীড়ন করে না সিংহরা। দেখল কিছুক্ষণ পর ঘোড়ার মৃতদেহটা টানতে টানতে একটা ঝোপের আড়ালে নিয়ে গেল সিংহটা।

রোন্ডা শুয়ে শুয়ে লক্ষ্য করতে লাগল সিংহটাকে। সে দেখল কাছে একটা গাছ রয়েছে। গাছটায় কোনরকমে একবার উঠতে পারলেই আপাতত মুক্তি পাবে সিংহটার কবল থেকে। সিংহটা মাঝে মাঝে পিছন ফিরে তাকে দেখছিল।

সিংহটা যখন অন্যদিকে তাকিয়ে বসেছিল তখন রোন্ডা ছুটে গিয়ে গাছটার একটা ডাল ধরে ফেলল। ক্রমে সে গাছের উপরে উঠে গেল। সিংহটাও ততক্ষণে একটা লাফ দিয়ে তাকে ধরতে গিয়ে তার নাগাল টারজানক পেল না। গাছের উপর চারদিকে তাকাতে লাগল রোন্ডা। দেখল তার উত্তর-পূর্ব দিকে এক বিশাল প্রান্তর বিস্তৃত হয়ে আছে। প্রান্তরটার মাঝে মাঝে আছে কিছু কিছু গাছের জটলা। প্রান্তরটা ক্রমশ উঁচু হয়ে একটা পাহাড়ে গিয়ে মিলিয়ে গেছে। সহসা তার আতুই-এর একটা কথা মনে পড়ে গেল। ঐ পাহাড়ের নিচে উপত্যকাটার শেষ প্রান্তে একটা জলপ্রপাত আছে। তার নাম ওম্বাম্বি জলপ্রপাত। তার মনে হলো ঐ জলপ্রপাতের কাছে কোনরকমে গিয়ে পড়তে পারলেই সে তার সঙ্গীদের দেখা পাবে। ওরমান এখানেই যেতে বলেছিল। এক নতুন আশার আলো দেখতে পেল রোন্ডা।

প্রায় এক ঘণ্টা কেটে গেল। তারপর রোন্ডা দেখল সিংহটা ঝোপ থেকে বেরিয়ে যে নদীটা তারা পার হয়ে এসেছে সেই নদীর ধারে গিয়ে একটা ঝোপের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। রোন্ডা দেখল এই হচ্ছে সুযোগ। সে তাই গাছ থেকে নেমে উপত্যকার উপ দিয়ে হাঁটতে লাগল সামনের পাহাড়টাকে লক্ষ্য করে। একবার পিছন ফিরে দেখল সিংহটা আর আসছে না তার পিছনে। ক্ষুধা আর তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়েছিল সে।

ক্লান্তি ও দুর্বলতায় আর পথ চলতে পারছিল না রোন্ডা। এক সময় একটা পাথরের উপর বসে পড়ল। এমন সময় তার পিছনে কে ইংরেজিতে বলল, ও একা আছে। ওকে আমরা আমাদের দেবতার কাছে। নিয়ে যাব।

রোন্ডা মুখ ঘুরিয়ে দুটো গোরিলা মানুষের মত কথা বলছে।

একটা লোমশ হাতে রোন্ডাকে ধরে ফেলল, একটা গোরিলা তাকে বলল, এস আমাদের সঙ্গে। আমরা তোমাকে আমাদের দেবতার কাছে নিয়ে যাব।

রোন্ডা গোরিলা দু’টোর কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য ধস্তাধস্তি করতে লাগল। কিন্তু পারল না। একজন গোরিলা তাকে শক্ত করে ধরে পথ চলতে লাগল।

পথের মধ্যে দু’জন গোরিলা ঝগড়া শুরু করে দিল নিজেদের মধ্যে। যে গোরিলাটা রোন্ডাকে ধরেছিল সে বলল, সে তাকে তাদের দেবতার কাছে নিয়ে যাবে।

নাওমির ঘোড়াটা ঊর্ধ্বশ্বাসে আরবদের শিবিরের দিকে ছুটতে লাগল। নাওমি ঘোড়াটার লাগাম টেনে তার গতিটা অন্য দিকে ঘোরাবার অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু ঘোড়াটা তাকে সোজা আরবদের শিবিরে নিয়ে গেল। আতুই তাকে দেখতে পেয়ে আবার বন্দী করে ফেলল।

নাওমিকে দেখে খুশি হলো শেখ। সে বলল, অন্য মেয়েটি কোথায়?

 নাওমি বলল, সিংহ তাকে খেয়ে ফেলেছে।

শেখ বলল, ঠিক আছে। তুমি হলেই চলবে। আমাদের কাছে ম্যাপটা আছে। তুমিই আমাদের হীরকদেশের উপত্যকায় নিয়ে যাবে।

নাওমি বলল, আমি যদি তোমাদের সেখানে নিয়ে যাই তাহলে বল আমাকে মুক্তি দেবে? আমার সঙ্গীদের কাছে পাঠিয়ে দেবে?

শেখ আতুই-এর মাধ্যমে কথাটা শুনে বলল, ওকে বল তাই করব। কিন্তু আমরা হীরে পেয়ে গেলেও ওকে ছাড়ব না। এ কথাটা ওকে কিন্তু বলো না।

তখন বিকাল হয়ে গিয়েছিল। আরবরা নদীর ধারে গিয়ে সে রাতটার মত ওখানেই শিবির স্থাপন করল। পরদিন সকালেই ওরা আবার যাত্রা শুরু করল। নাওমি ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। নদীটার ধারে ধারে সরু পথটা ধরে ওরা এগোতে লাগল।

কিন্তু নদীটা বড় খরস্রোতা এখানে। তার উপর জলে অনেক কুমারী আছে। কোনখান থেকে নদীটা পার হওয়া সহজ হবে তা দেখতে গিয়ে দুটো দিন কেটে গেল ওদের। তারপর একটা জায়গা ওরা নির্বাচন করল। কিন্তু সেখান থেকেও নদী পার হতে গিয়ে সকাল থেকে প্রায় সারাদিন কেটে গেল। কিন্তু ওরা যখন নাওমিকে নিয়ে নদীর ওপারে গিয়ে পৌঁছল তখন দেখা গেল ওদের দু’জন লোক মারা গেছে এবং তাদের ঘোড়া দুটোকে কুমীরে ধরে নিয়ে গেছে।

নদীর ওপারে গিয়ে ওরা একটা চওড়া রাস্তা দেখতে পেল। সেই পথ ধরে ওরা যেতে লাগল। আতুই নাওমির পাশে পাশে ঘোড়ায় চেপে যাচ্ছিল। এক সময় আতুইকে দেখাল নাওমি, ঐ দেখ, লাল গ্রানাইট পাথরের একটা স্তম্ভ। ম্যাপে ওটা দেখানো আছে। ওর পূর্ব দিকেই আছে হিরকদেশের উপত্যকায় যাবার প্রবেশ পথ।

শেখের মুখে হাসি ফুটে উঠল কথাটা শুনে। নাওমি বলল, আমি আমার কথামত কাজ করেছি। তোমরা তোমাদের কথামত কাজ করো। আমাকে আমার সঙ্গীদের কাছে পাঠিয়ে দাও।

আতুই বলল, থাম, এখন নয়। এখনো আমরা উপত্যকায় পৌঁছায়নি।

পরদিন সকালেই টারজান তার কথামত ওরমান আর ওয়েস্টের সন্ধানে বার হতে চাইল। কিন্তু ওবরস্কি হঠাৎ জ্বলের পড়ে গেল। সে শুয়ে শুয়ে জ্বরের ঘোরে ভুল বকতে লাগল।

অবশেষে সে ওবরস্কিকে কাঁধে তুলে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে বেরিয়ে পড়ল। সারাদিন ধরে ক্রমাগত দক্ষিণ দিকে এগোতে লাগল।

দিনের শেষে একটা গায়ে গিয়ে পৌঁছল টারজান। ওবরস্কির তখনো জ্ঞান ফিরে আসেনি। টারজনের থাকার জন্য একটা কুঁড়ে ঘর দিয়েছিল গাঁয়ের সর্দার পুঙ্গু। সেই ঘরে ওবরস্কিকে শুইয়ে দিয়ে নিজে পেট ভরে খেয়ে নিল টারজান। তারপর একাই উত্তর দিকের একটা বনপথ ধরে হাঁটতে লাগল। তখন গোধূলি হয়ে গেছে।

এদিকে সেই গোরিলাদের পার্বত্য নগরীর আসাদ অন্তঃপুরে বন্দী অবস্থায় সাতদিন কাটাল রোন্ডা। রানীরা তাকে ভাল চোখে কেউ না দেখলেও কনিষ্ঠা রানী ক্যাথারিন পার তাকে ঘৃণা করত সবচেয়ে বেশি। কারণ রাজা রোন্ডাকে বিয়ে করলে তার আদর একেবারেই কমে যাবে রাজার কাছে।

ক্যাথারিন বলল, আমরা সব মিলিয়ে ছ’জন রানী। তাদের নাম হল ক্যাথারিন অফ আরাগন, এ্যনি বোলিন, জেন সেমুর, এ্যানি অফ ক্লীভস, ক্যাথারিন হাওয়ার্ডে ও ক্যাথারিন পার।

রোন্ডা বলল, আজ হতে চারশ’ বছর আগে ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরির রানীদের এই সব নাম ছিল।

ক্যাথারিন পার বলল, এটা হলো ইংল্যান্ড এবং আমাদের বিয়ের পর এই সব নাম দেয়া হয়েছে।

 রোন্ডা বলল, তোমাদের দেবতা কোথায় থাকে।

ক্যাথারিন পার বলল, ঐ প্রাসাদটায়। ওর ভিতরটায় কোনদিন ঢুকিনি। তাঁকে দেখিওনি কখনো। তবে শুনেছি তিনি নাকি খুবই বৃদ্ধ। দেবতার কাছে কেবলমাত্র রাজা আর তার সামন্তরা ছাড়া কেউ যেতে পারে না।

এমন সময় বাইরে তুমুল গোলমালের শব্দ শোনা গেল। জানালা দিয়ে ক্যাথারিন পার আর রোন্ডা উঁকি মেরে দেখল প্রাসাদের উঠোনে দু’দল গোরিলা লড়াই করছে ভয়ঙ্করভাবে।

ক্যাথারিন বলল, উলফসির দলের গোরিলারা উলফসিকে টাওয়ার থেকে মুক্ত করে এনেছে। রাজার দলের গোরিলাদের সঙ্গে উলফসির দল তাই লড়াই করছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই লড়াইটা অন্তঃপুরের বারান্দায় চলে এল। হঠাৎ ঘরের দরজা ঠেলে একদল পুরুষ গোরিলা ঘরে ঢুকল। তাদের নেতা ঘরে ঢুকেই বলল, সেই লোমহীন মেয়েটা কোথায়?

এই বলে সে রোন্ডার কাছে এসে তার হাতের কব্জিটা ধরে টানতে টানতে তাকে নিয়ে গেল। বলল, এস, দেবতা তোমায় ডেকে পাঠিয়েছে।

আরবরা সরু পথটা ধরে এগিয়ে যেতে থাকল। আতুই নাওমির পাশে পাশে তার ঘোড়াকে চালাতে লাগল। সে যে হীরকদেশে যাবে এবং সেখানে গিয়ে অনেক হীরে ও ধনরত্ন পাবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ। রইল না তা।

ক্রমে পথটা উঁচু হতে হতে একটা খাড়াই পাহাড়ের সামনে এসে পড়ল ওরা। আর ঘোড়া চালানো সম্ভব নয়। এবার পায়ে হেঁটে সাবধানে পাহাড়টা পার হয়ে ওধারের উপত্যকায় পৌঁছতে হবে।

ঈয়াদ সেইখানে ঘোড়ায় চেপে প্রতীক্ষায় রইল। শেখরা পা টিপে টিপে পাহাড়ে উঠতে লাগল। সহসা ঈয়াদ নিচে থেকে দেখতে পেল পাহাড়ের গা দিয়ে যে পথে শেখরা যাচ্ছিল সেই পথের ধারে ও উপরে ঘন বাঁশবন ছিল। সেই বাঁশবন থেকে মানুষের মত অনেকটা দেখতে কালো লোমওয়ালা একটা গোরিলা মুখ বাড়িয়ে উঁকি মেরে শেখদের দেখতে লাগল। এমনি করে পর পর কয়েকটা গোরিলা বাশবন থেকে বেরিয়ে এসে গর্জন করতে করতে আরবদের সামনে এসে দাঁড়াল। ঈয়াদ নিচে থেকে চীৎকার করে শেখকে সাবধান করার চেষ্টা করলেও তখন কোন উপায় ছিল না।

আরবরা পর পর গুলি করতে লাগল। তাতে দু-চারটে গোরিলা মারা গেল। জনকতক আহত হলো। কিন্তু বাকি সব গোরিলাগুলো আরবদের হাত থেকে সব বন্দুক কেড়ে নিয়ে সেগুলো ভেঙ্গে ফেলে দিল। তারপর তারা আরবদের ধরে তাদের ঘাড়ে কামড় দিতে লাগল আর তাদের হাতে কুড়াল আর লাঠি দিয়ে আঘাত করতে লাগল। বাকিংহাম নামে যে গোরিলাটা আগে রোন্ডাকে ধরেছিল সেই গোরিলাটা নাওমিকে তুলে নিয়ে পালাতে লাগল।

ঈয়াদ দেখল দু’জন গোরিলা তাকে ধরার জন্য পাহাড়ের উপর থেকে নেমে আসছে। সে তখন সেখানে আর না দাঁড়িয়ে ঘোড়াটাকে ঘুরিয়ে ছুটিয়ে দিল পিছন দিক দিয়ে।

গোরিলাদের হাতে ধরা পড়ে ভয়ে নাওমির রক্ত হিম হয়ে যেতে লাগল। আরবদের থেকে এরা আরো ভয়ঙ্কর।

এদিকে পুঙ্গুর গায়ে ওবরস্কিকে রেখে দিয়ে ওরমানদের খোঁজে জঙ্গলে ক্রমাগত গাছের ডালে ডালে এগিয়ে যেতে থাকল টারজান। রাতটা সে একটা গাছে কাটিয়ে সকালে আবার রওনা হলো। কিছুদূর যাওয়ার পর বাতাসে শ্বেতাঙ্গদের গন্ধ পেল।

পথে একটা হরিণ দেখতে পেয়ে সেটাকে শিকার করল টারজান। তার অল্প কিছু দূরেই ওরমান আর ওয়েস্ট সেই পথে আসছিল।

হঠাৎ ওরমান ওয়েস্টকে বলল, কিসের শব্দ শোনা যাচ্ছে?

ওয়েস্ট বলল, নিশ্চয় কোন জন্তু।

ওরমান বলল, ওবরস্কি আসছে।

ওয়েস্ট দেখল ওবরস্কির মত অবিকল দেখতে একটা লোক কাঁধের উপর একটা মরা হরিণ নিয়ে তাদের দিকে আসছে।

টারজান দেখল, ওরা দুজনেই তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

টারজান বলল, তোমরা নিশ্চয় খুবই ক্ষুধার্ত।

ওরমান বলল, ওবরস্কি তুমি?

টারজান বলল, তুমি কি ভেবেছিলে আমি ভূত?

টারজান তার নিজের পরিচয় না দিয়ে বলল, আমি তোমাদের দলের মেয়েদের খোঁজ করছি। তোমাদের দলের বাকি সবার খবর কি?

ওরমান বলল, তারা এখন কোথায় আছে কিছুই জানি না আমরাও মেয়ে দুটির খোঁজ করছি। আমরা এই আরবটিকে ধরেছি। এর কাছে জানতে পারি একটি মেয়ে সিংহের কবলে পড়ে মারা যায়। অন্যটির ও আরবদের কি অবস্থা হয়েছে তা ও জানে না।

টারজান তখন আরবী ভাষায় ঈয়াদকে প্রশ্ন করতে সে বলল, একটা মেয়ে সিংহের হাতে ধরা পড়ে। অন্যটিকে গোরিলাদের হাতে ধরা পড়তে দেখেছি আমি। গোরিলারা তাকে ধরে নিয়ে গেছে।

ঘটনাটা কোথায় ঘটেছে তার পূর্ণ বিবরণ জেনে নিল টারজান ঈয়াদের কাছ থেকে। তারপর সে ওরমানকে বলল, মনে হয় ও সত্য বলেছে। যাই হোক, আমি এখনি সেই উপত্যকায় গিয়ে দেখব।

এই বলে আবার গাছের উপর লাফ দিয়ে উঠে কোথায় চলে গেল টারজান।

ওরমান আর ওয়েস্ট সেইদিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ ধরে।

এদিকে বাকিংহাম নামে সেই গোরিলাটা নাওমিকে নিয়ে দক্ষিণ দিকের পাহাড়টা পার হয়ে উপত্যকাটার দক্ষিণ প্রান্তে গিয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণ যাওয়ার পর ওরা দেখল আর একটা গোরিলা ওদের তাড়া করে আসছে। বাকিংহাম নাওমিকে কাঁধে তুলে নিয়ে একটা বনে ঢুকে পড়ল।

বন থেকে ছুটে গিয়ে একটা পাহাড়ের গুহার সামনে এসে বাকিংহাম বলল, তুমি এখানে থাক। আমি সাফোককে মেরে তাড়িয়ে দিয়ে আসছি।

নাওমি সেই গুহাটায় একা রয়ে গেল। গুহার কাছে একটা ছোট ঝর্ণা ছিল। তার জল খেয়ে তৃষ্ণা মেটাল সে। এইভাবে দুটো দিন দুটো রাত কাটানোর পর তৃতীয় দিনে বাকিংহাম গুহাটায় ফিরে এসে বলল, তাড়াতাড়ি করে তুমি আমার পিঠে চাপ।

নাওমিকে পিঠে চাপিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল বাকিংহাম। অনেকক্ষণ ধরে এইভাবে যাবার পর পিছনে কার গর্জন শুনে থমকে দাঁড়াল। দেখল নগ্নদেহ এক শ্বেতাঙ্গ তার কাছে এসে পড়েছে।

নাওমি টারজানকে দেখে ওবরস্কি ভাবল। বলল, স্ট্যানলি, তুমি আমাকে বাঁচাও।

টারজান বাকিংহামকে বলল, তুমি চলে যাও বোলগানি। এ মেয়ে আমার, তোমাকে খুন করে ফেলবে।

বাকিংহাম ইংরেজিতে কথা বলায় আশ্চর্য হয়ে গেল টারজান। সে তাকে আক্রমণ করতে তার পিঠের উপর চড়ে তার ঘাড়টা ধরল। টারজনের সঙ্গে লড়াই করার জন্য নাওমিকে এক জায়গায় নামিয়ে। দিয়েছিল বাকিংহাম। সেখান থেকে ওদের লড়াই দেখতে লাগল।

হঠাৎ টারজান তার ছুরিটা বার করে বার বার বসিয়ে দিতে লাগল বাকিংহামের বুকে। অবশেষে বাকিংহাম নিষ্প্রাণ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে টারজান নাওমিকে নিয়ে চলে গেল সেখান থেকে।

নাওমি ক্ষুধায় ও দুর্বলতায় কথা বলতে পারছিল না। তাকে কাঁধের উপর তুলে পথ হাঁটছিল টারজান। নাওমি বলল, কোথায় যাবে এখন স্ট্যানলি?

টারজান বলল, জলপ্রপাতের কাছে ওরমান আর ওয়েস্ট অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

নাওমি বলল, তারা তাহলে এখনো বেঁচে আছে?

টারজান বলল, তারা তোমার খোঁজ করছিল। বোন্ডাকে বোধহয় সিংহতে খেয়েছে।

নাওমি হাত বাড়িয়ে গোরিলাদের নগরটাকে দেখিয়ে বলল, না, রোন্ডাকে গোরিলারা ধরে নিয়ে গিয়ে ঐ নগরের মধ্যে একটা পাথরের প্রাসাদে বন্দী করে রেখেছে। গোরিলাটা আমায় বলেছিল, সে ওদের দেবতার কাছে আছে।

পথে এবার সেই নদীটা পেল ওরা। টারজান এক জায়গায় নাওমিকে ধরে সাঁতার কেটে সহজেই নদী পার হলো। নাওমি আশ্চর্য হয়ে গেল।

জলপ্রপাতটার কাছে গিয়ে টারজান নাওমিকে দেখাল পাহাড়ের তলায় তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। টারজান বলল, ওরা হলো ওরমান, ওয়েস্ট আর ঈয়াদ নামে একটা আরব।

ওরমান ওদের দেখতে পেয়ে ছুটে এল। নাওমিকে জাড়িয়ে ধরলে তার চোখে জল এল।

টারজান বলল, আমাকে ওদের নগরটাকে দেখতে হবে। অনেককিছু জানতে হবে।

তখন অন্ধকার হয়ে আসছিল। সন্ধ্যার সেই ঘনায়মান অন্ধকারে ওদের বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়ল টারজান। সে খাড়াই পাহাড়টায় গা বেয়ে অবলীলাক্রমে উঠে যেতে লাগল।

ওয়েস্ট সেইদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলল, আমিও যাব।

সেই পাহাড় আর উপত্যকা পার হয়ে প্রাচীর ঘেরা একটা নগর দেখতে পেল টারজান। টারজান প্রাচীরটা পার হয়ে নগরমধ্যে পড়ল। ভিতরটা অন্ধকার। কোন গোরিলাকে কোথাও দেখতে পেল না। একটা বড় বাড়িতে আলো দেখতে পেল টারজান। সে অনুমান করল ঐটাই বোধহয় দেবতার প্রাসাদ, যার কথা নাওমি তাকে বলেছিল। প্রাসাদটা পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হয়েছে।

টারজান অন্ধকারে নগরটার একধার দিয়ে চলে যাওয়া পথটা ধরে প্রাসাদটার দিকে এগিয়ে চলল। প্রাসাদের একটা ঘরে মাত্র আলো জ্বলছিল। প্রাসাদের গেটে কোন পাহারা ছিল না।

প্রাসাদের ভিতর ঢুকে পর পর কয়েকখানা ঘর দেখতে পেল টারজান। কিন্তু হাত দিয়ে দেখল প্রতিটি ঘরের দরজায় তালা লাগানো আছে। একটা ঘরে তালা ছিল না। সেই ঘরে ঢুকে সে একটা সিঁড়ি পেল। সিঁড়িটা নিচে নেমে গেছে। সিঁড়িটা দিয়ে নিচে নেমে গিয়ে একটা সরু টানা বারান্দা পেল। তারপর একটা দরজা। দরজাটায় চাপ দিতেই সেটা খুলে গেল। কিন্তু টারজান খোলা দরজা দিয়ে একটা লম্বা ঘরে ঢুকে পড়তেই পিছন থেকে বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা। টারজান হাত দিয়ে দেখল সেটা আর খুলছে না। ঘরখানার মধ্যে একটা মশালের আলো জ্বলছিল। মশালটা ঘরের এককোণে ছিল। টারজান দেখল নাওমির মত দেখতে এক সুন্দরী যুবতী তার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে।

টারজান তার দিকে এগিয়ে যেতে মেয়েটি মুখ ঘুরিয়ে তাকে দেখে আশ্চর্য হয়ে বলল, স্ট্যানলি ওবরস্কি, তুমিও এখানে বন্দী হয়েছ?

হঠাৎ জোর গোলমালের শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠল রোন্ডা টেরী। জানালা দিয়ে দেখল, প্রাসাদের উঠোনে রাজা হেনরীর গোরিলাদের সঙ্গে দেবতার গোরিলাদের জোর লড়াই হচ্ছে। রাজার দল ক্রমশই হেরে যাচ্ছিল।

এমন সময় দরজা খুলে স্বয়ং রাজা হেনরি রোন্ডাকে ধরে নিয়ে যাবার জন্য ঘরে ঢুকল। রানীরা তখন ভয়ে রোন্ডার কাছ থেকে সরে গেল। হেনরি সোজা রোন্ডার কাছে এসে বলল, দেবতা তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছে। কিন্তু সে তোমাকে পাবে না। তুমি আমার।

এই বলে হেনরি রোন্ডাকে কাঁধের উপর তুলে নিয়ে প্রাসাদের সুড়ঙ্গপথ দিয়ে পালিয়ে যেতে লাগল। সুড়ঙ্গের শেষ প্রাণে একটা ঘর ছিল। সেখানে গিয়ে হেনরি বলল, এদিকে কেউ আসতে পারে না।

ঘরটা থেকে বেরিয়েই উপত্যকায় গিয়ে পড়ল হেনরি। একটা নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে বোন্ডাকে নামিয়ে দিল।

নদীর ধার দিয়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে নদীটা পার হলো হেনরি। সে রোন্ডার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিল তাকে।

হঠাৎ একটা সিংহের গর্জন শুনতে পেল গোরিলারাজা হেনরি। ঘন কুয়াশায় ছেয়েছিল সমস্ত উপত্যকাটা। কিছু দেখা যাচ্ছিল না।

এবার সিংহটা খুব কাছে এসে পড়াতে রোন্ডা ভালভাবে দেখতে পেল। তার মনে হলো সিংহটা খুব ক্ষুধার্ত। হঠাৎ হেনরি রোন্ডাকে তুলে নিয়ে সিংহটার মুখের সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিল। কিন্তু রোন্ডা মরার মত শক্ত হয়ে পড়ে রইল। সে জানত মরা মানুষকে সিংহ মারে না।

হেনরি একা ছুটে পালাচ্ছিল। কিন্তু তার জীবন্ত শিকার পালাচ্ছে দেখে সিংহটা লাফ দিয়ে তাকে ধরে ফেলল। দুজনেই গর্জন করতে লাগল। রোন্ডা একবার চোখ মেলে দেখল কিছু দূরে কতকগুলো গাছ রয়েছে। সে আরো দেখল সিংহ গোরিলারাজা হেনরিকে মেরে তার মুখটা চিবিয়ে খাচ্ছে। সে এখন তার শিকারের মাংস নিয়ে ব্যস্ত থাকবে ভেবে রোন্ডা উঠে ছুটে গিয়ে বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল।

বনের মধ্যে ঢুকে একটা নদী পেল রোন্ডা। সে ভাবল নদীটার পাড় দিয়ে ওম্বাম্বি জলপ্রপাতের কাছে যেতে পারলেই ওর সঙ্গীদের দেখা পাবে।

নিবিড় ক্লান্তিতে পা টেনে টেনে চলছিল রোন্ডা। হঠাৎ তার সামনে একটা গাছ থেকে আধা-মানুষ আধা-গোরিলার মত একটা ভয়ংকর জন্তুকে নেমে পড়তে দেখে চমকে উঠল সে। সে জন্তুর মুখটা মানুষের মত। কিন্তু দেহ আর কানটা বাঁদরের মত।

রোন্ডা ভাবল সে নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কেটে ওপারে পালিয়ে যাবে। কিন্তু ঝাঁপ দেবার আগেই গোরিলা মানুষটা ধরে ফেলল তাকে। সঙ্গে সঙ্গে আর একটা ঐ ধরনের গোরিলা মানুষ গাছ থেকে নেমে রোন্ডার অন্য হাতটা ধরে ফেলল। দুজন দুদিকে তার দুটো হাত ধরে টানতে লাগল। রোন্ডার মনে হতে লাগল তার হাত দুটো ছিঁড়ে যাবে।

এমন সময় এক নগ্ন শ্বেতাঙ্গ মানুষ কোথা থেকে এসে তার হাতের মোটা লাঠি দিয়ে গোরিলা দুটোকে মেরে তাড়িয়ে দিল। তারপর সে তার কাঁধের উপর রোন্ডাকে তুলে নিতেই প্রায় বিশটা গোরিলা এসে ঘিরে ফেলল তাদের। রোন্ডা দেখল যে মানুষটা তাকে ধরেছিল তার দেহ ও মুখচোখ সত্যিই সুন্দর ও সুগঠিত। তার মাথায় ছিল লম্বা লম্বা চুল। সিংহের কেশরের মত ঘাড়ের উপর ছড়িয়ে পড়েছিল চুলগুলো। গোরিলাগুলো শ্বেতাঙ্গ মানুষটার ভয়ে কেউ রোন্ডার কাছে আসতে পারছিল না।

ঠিক এই সময়ে কাছের একটা গাছ থেকে উলফঙ্গ এক শ্বেতাঙ্গ যুবতী নেমেই ছুটে এল তাদের দিকে।

মেয়েটি আসতেই সকলেই সম্ভ্রমের সঙ্গে পথ ছেড়ে দিল। কিন্তু সেই শ্বেতাঙ্গ লোকটা রোন্ডাকে কাঁধের উপর চাপিয়ে উধ্বশ্বাসে ছুটে পালাতে লাগল। সেই শ্বেতাঙ্গ মেয়েটিও ছুটতে লাগল লোকটার পিছু পিছু।

টারজান যখন দেখল রাজার গোরিলাদল একেবারে হেরে গেল এবং দেবতার গোরিলাদের সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে তখন সে গোরিলা দেবতার কাছে গিয়ে তার প্রতিশ্রুতির কথাটাকে স্মরণ করিয়ে দিল। দেবতা গোরিলা তখন পলাতক রাজা হেনরির খোঁজ করছিল। টারজান বলল, আগে সেই বন্দিনীকে খুঁজে বের করতে হবে।

গোরিলাদেবতা টারজানকে সঙ্গে করে জনকতক গোরিলাযোদ্ধা নিয়ে প্রাসাদের অন্তঃপুরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।

অন্তঃপুরে ঢোকার মুখে সিঁড়ির কাছে সাফোক আর হাওয়ার্ড পাহারা দিচ্ছিল। তারা দুজনেই রাজার দলের গোরিলা হলেও তারা যখন দেখল রাজার দল হেরে গেছে এবং রাজা পালিয়ে গেছে তখন তারা গোরিলাদেবতার বশ্যতা স্বীকার করল। গোরিলাদেবতাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে নতজানু হয়ে বলল, তারা দেবতারই সেবক এবং রাজাকে তারা তাড়িয়ে দিয়েছে প্রাসাদ থেকে।

গোরিলাদেবতা বলল, সেই বন্দিনী মেয়েটি কোথায়?

সাফোক বলল, অন্তঃপুরে ছিল। হেনরি তাকে নিয়ে পালিয়ে গেছে।

 কোন পথে পালিয়েছে?

আসুন, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।

এই বলে সে গোরিলাদেবতা আর টারজানকে নিয়ে সেই গুপ্ত সুড়ঙ্গপথটার শেষ প্রান্ত পৌঁছে গেল। তারপর বলল, এই দিকে হেনরি নগরের বাইরে কোথায় চলে গেছে।

টারজান আর না দাঁড়িয়ে তখনি নগরের বাইরে বেরিয়ে পড়ল রোন্ডার খোঁজে।

আরো এগিয়ে বনের মাঝে গিয়ে টারজান দেখল মাথায় ঝকরা চুলওয়ালা একজন নগ্ন শ্বেতাঙ্গ এক শ্বেতাঙ্গ নারীকে কাঁধের উপর নিয়ে ছুটছে আর এক শ্বেতাঙ্গ নারী সম্পূর্ণ উলফঙ্গ অবস্থায় তাকে তাড়া করে ছুটছে তার পিছনে।

বনটা পার হয়ে লোকটা একটা পাহাড়ে উঠতে লাগল। সে পিছন ফিরে টারজানকে দেখে বাঁদর গোরিলাদের ভাষায় বলল, ফিরে যাও। তা না হলে তোমাকে মেরে ফেলব।

এবার রোল্ডাকে চিনতে পেরে বলল, রোন্ডা!

লোকটা তখন টারজানকে মারার জন্য রোন্ডাকে পাহাড়ের গায়ে এক জায়গায় নামিয়ে রাখল। টারজান বলল, রোন্ডা, তুমি পাহাড়ের মাথায় উঠে যাও। আমি ওর সঙ্গে লড়াই করে ওকে আটকে রাখব।

সেই উলঙ্গ শ্বেতাঙ্গ যুবতী তখন শ্বেতাঙ্গ লোকটাকে বলল, মেয়েটা পালাচ্ছে, ওকে ধর।

লোকটা তখন টারজানকে ছেড়ে রোন্ডাকে ধরতে যেতেই টারজান তাকে গিয়ে ধরে ফেলল। লোকটার গায়ে প্রচুর শক্তি থাকলেও টারজান তার মুখে জোরে ঘুষি মেরে তাকে ফেলে দিয়ে তার বুকের উপর বসে আবার তার মাথায় আঘাত করল। কিন্তু তাকে হত্যা করল না। টারজান এবার উঠে দেখল সেই উলফঙ্গ মেয়েটা রোন্ডাকে ধরতে যাচ্ছে। সে তখন মেয়েটাকে ধরে পাহাড়ের মাথায় রোন্ডার কাছে উঠে গিয়ে তার দড়িটা দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলল তাকে। মেয়েটা অনেক ধস্তাধস্তি করেও পেরে উঠল টারজনের সঙ্গে।

টারজান দেখল সেই গোরিলাগুলো এবার পাহাড়ের নিচে থেকে উপরে উঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু ওরা যেখানে আছে সেখান থেকে পালাবার কোন পথ নেই। সে তখন চীৎকার করে গোরিলাদের বলল, তোমরা ফিরে যাও। তা না হলে তোমাদের দলের এই মেয়েটিকে হত্যা করব।

মেয়েটি তখন টারজনের মুখপানে তাকিয়ে হেসে বলল, ওরা থামবে না। তুমি আমাকে হত্যা করলেও ওরা তোমাকে ছাড়বে না। ধরতে পারলে ওরা আমাদের সকলকে খাবে। তুমি বরং পাথর ছুঁড়ে ওদের মার। তাহলে ওরা আর আসতে পারবে না।

টারজান দেখল মেয়েটি এখন শান্ত এবং কোনরকম বিরোধিতা করছে না তার। মেয়েটি টারজানকে বলল, এখন আমি তোমার। ওদের কাছে আর যাব না।

টারজান পাথর কুড়িয়ে গোরিলাদের মাথায় মারতে লাগল। তখনই সেই মেয়েটির বাঁধন খুলে দিতে সেও পাথর ছুঁড়তে লাগল। রোন্ডাও তাই করতে লাগল। মাথায় পাথর লাগায় গোরিলাদের কয়েকজন ঘায়েল হলো। তারা একটা গুহায় গিয়ে আশ্রয় নিল।

মেয়েটি বলল, আমরা এখানে দিন শেষ না হওয়া পর্যন্ত থাকব। অন্ধকার হয়ে গেলে ওরা আর বেরোবে না বা আমাদের তাড়া করবে না।

টারজান এক সময় মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি মানুষের মাংস খাও?

 মেয়েটি ইংরেজিতে বলল, আমি বা মালবিয়াত কেউই খাই না।

টারজান বলল, মালবিয়াত কে?

মেয়েটি বলল, আমার লোক। আগে আমি ওর কাছে ছিলাম। এখন তুমি তার সঙ্গে লড়াই করে আমাকে জয় করে নিয়ে নিয়েছ। এখন আমি তোমার। তবে ও মেয়েটা কে?

এই বলে রোন্ডাকে দাঁত বার করে আক্রমণ করতে গেল। টারজান তাকে ধরে ফেলল।

মেয়েটি বলল, যতদিন তোমার কাছে আমি থাকব ততদিন তুমি অন্য কোন মেয়েকে কাছে রাখতে পারবে না।

টারজান বলল, ও আমার নয়।

মেয়েটি বলল, ওর নাম কি? তোমারই বা নাম কি? আমার নাম বালজা।

টারজান বলল, ওর নাম রোন্ডা আর আমার নাম স্ট্যানলি বলতে পার। তুমি ইংরেজি শিখলে কোথা থেকে?

বালজা বলল, যখন আমি লন্ডনে ছিলাম। পরে লন্ডন থেকে আমাকে তাড়িয়ে দেয় ওরা।

টারজান বলল, কেন তাড়িয়ে দিয়েছে তোমায়?

বালজা বলল, কারণ আমি ওদের মত নই। ওরা আমায় অনেক আগেই তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার মা আমায় লুকিয়ে রেখেছিল। পরে আমার সন্ধান পায় ওরা। তখন আমি পালিয়ে আসি।

টারজান বলল, মালবিয়াতও তোমার মত?

বালজা বলল, ও ইংরেজি শিখতে পারেনি। তুমি ওর থেকে ভাল। তোমাকে আমার ভাল লাগে। তুমি কি মালবিয়াতকে মেরে ফেলেছ?

টারজান বলল, না মরেনি বোধ হয়। আহত হয়ে পড়ে আছে।

বালজা একটা পাথর কুড়িয়ে শায়িত মালবিয়াতের উপর ছুঁড়ে দিল। মালবিয়াত কোনরকমে হাতে পায়ে গুঁড়ি মেরে ওদের চোখের আড়ালে চলে গেল।

বালজা বলল, আমি ওর কাছে ফিরে গেলে ও আমাকে মারবে। তবে আমি সুন্দরী বলে আমাকে কিছু বলবে না। কিন্তু আমি ওর কাছে আর যাব না। আমি তোমার সঙ্গেই যাব।

ক্রমে পাহাড়গুলোর উপর সন্ধ্যার ছায়া নেমে আসতে ওরা পাহাড়টা থেকে নেমে একটা গুহার দিকে গেল। গুহাটায় গিয়ে টারজান দেখল সরু হলেও গুহার দুটো দিকে খাড়া হয়ে উপরে উঠে গেছে এবং উপরটা ফাঁকা। ভাবল এখানে থাকার থেকে উপরে উঠে যাওয়া ভাল।

টারজান ওদের বলল, আমি আগে উপরে উঠে যাই। পরে দড়িটা নামিয়ে একে একে উঠে যাবে তোমরা।

উপরে উঠে গেল ওরা। তখন রাত্রি হয়ে গেছে। সেখানে গিয়ে একটা জলনিকাশের নালা দেখতে পেল। হঠাৎ বোন্ডা দেখল সেই নালাটির কতকগুলো পাথর অন্ধকারে জ্বলছে। সে বেশ বুঝতে পারল ওগুলো হচ্ছে হীরে। হীরে ছাড়া অন্ধকারে কোন পাথর এমন করে আলো দিতে পারে না।

রোন্ডা বলল, পাথরগুলো কুড়িয়ে নিতে পারি?

 বালজা বলল, তুমি যতটা বয়ে নিয়ে যেতে পারবে, নিতে পার।

রোন্ডা বলল, এগুলো হীরে আর এই জন্যই এটাকে হীরকদেশের উপত্যকা। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা। ওদের নিয়ে ট্রাকে করে অনেক হীরে বোঝাই করে নিয়ে যেতে পারি।

টারজান বলল, না, জীবনে আর কখনো এই অভিশপ্ত হীরকদেশের নাম করবে না। এটাকে চিরকালের মত বিদায় জানাবে।

এরপর ওরা রাতের মধ্যে দক্ষিণ দিকে একটা পথ ধরল। গোরিলা-নগরী থেকে পালিয়ে আসা গোরিলাগুলো যে গুহায় থাকে সেগুলোকে দূর থেকে ওদের দেখিয়ে দিল বালজা। ওরা এখান থেকে দক্ষিণ দিকে গিয়ে সেই পাহাড়টায় গিয়ে পৌঁছবে, তার পাদদেশে আছে ওম্বাম্বি জলপ্রপাত যেখানে ওরমানদের অপেক্ষা করতে বলে এসেছে টারজান।

সারারাত ধরে পথ চলল ওরা। রোন্ডা অত্যধিক ক্লান্ত হয়ে পড়ায় টারজান তাকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। বালজা সমানে অক্লান্তভাবে পথ হাঁটতে লাগল। এইভাবে উঁচু নিচু অনেক পাহাড়ী পথ পার হয়ে ওরা ভোরবেলায় সেই পাহাড়টায় গিয়ে পৌঁছল।

কিছু পরে রোদ উঠতেই কুয়াশা কেটে গেল। ওরা সেই পাহাড়ের পাদদেশে এসে উপস্থিত হলো। টারজান বলল, এখান থেকে আমাদের শিবির আর বেশি দূরে নয়।

রোন্ডা বলল, এবার আমাকে নামিয়ে দাও স্ট্যানলি, এবার আমি হাঁটতে পারব। কিন্তু শিবিরে যাবার আগে বালজার জন্য একটা স্কার্ট যোগাড় করতে হবে।

টারজান বলল, ও সভ্য জাগতে গিয়ে বদলে যাবে একেবারে।

মাইলখানেক যাবার পর কতকগুলো তাঁবু দেখতে পেল ওরা। রোন্ডা চীৎকার করে উঠল, সফরি, আমাদের সফরি। প্যাটকে দেখতে পাচ্ছি।

ওরা শিবিরের কাছে এগিয়ে যেতেই শিবিরের একজন ওদের দেখতে পেয়ে চীৎকার করতে লাগল। তখন সবাই ছোটাছুটি শুরু করে দিল। সবাই রোন্ডাকে চুম্বন করল তাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে। নাওমি ম্যাডিসন টারজানকে চুম্বন করতেই বালজা তাকে মারতে গেল।

টারজান তার কোমর ধরে তাকে শান্ত করে বলল, ওরা সবাই তোমার বন্ধু। কাউকে মারতে নেই। ওদের সঙ্গে হলিউডে যাবে। সভ্য হবে।

বালজাকে দেখে সবাই আশ্চর্য হয়ে গেল। ওরমান ও ওগ্রেডি তার জন্য একটা নতুন ভূমিকা সৃষ্টি করল ছবিতে। ওরমান বলল, সে ছবির কাজ শুরু করবে। সে বলল, সে নিজেও কোন একটা ভূমিকায় অভিনয় করবে। ওগ্রেডি অভিনয় করবে মেজর হোয়াইটের শিকারীর ভূমিকায়।

শেষে ওরমান বলল, বালজার জন্য এমন একটা ভূমিকা তৈরি করেছি যে ভূমিকায় ও অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দেবে সবাইকে।

এরপর দু’সপ্তাহ ধরে ওরমান পরপর কয়েকটা দৃশ্যের ছবি তুলে ফেলল। টারজান এক সময় একটা দূর আদিবাসী গা থেকে একদল নিগ্রোভৃত্য নিয়ে এল শিবিরের কাজ ও মালপত্র বহন করার জন্য।

হঠাৎ একদিন একটা পিওন এসে একটা টেলিগ্রাম দিয়ে গেল ওরমানের হাতে। ওদের স্টুডিওর প্রযোজক খবর পাঠিয়েছে ওকে, দলের সকলকে ও ছবির যাবতীয় সাজসরঞ্জাম ও মালপত্র নিয়ে হলিউডে ফিরে যেতে হবে।

আর ছবি তোলা হবে না ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেল ওরমানের। কিন্তু বাকি সবাই খুশিতে লাফাতে লাগল। দীর্ঘদিন পর সাক্ষাৎ মৃত্যুর কবল থেকে আবার ফিরে যাবে ওরা হলিউডে।

টারজান ওরমানকে বলল, ও ওদের সঙ্গে বানসুটোদের গাঁ পর্যন্ত যাবে। সে ওদের বলল, বানসুটোদের গাঁয়ের সর্দারের সঙ্গে তার কথা হয়েছে সে আর ওদের কোন ক্ষতি করবে না।

বানসুটোদের গায়ের সীমানাটা ওদের পার করিয়ে দিয়ে টারজান ওদের বলল, আমি একজায়গায় যাচ্ছি। জিঞ্জায় গিয়ে তোমাদের সঙ্গ নেব।

সেখান থেকে পুঙ্গুদের গাঁয়ে ওবরস্কির খোঁজে চলে গেল টারজান। সে তখনো পর্যন্ত দলের কাউকে তার আসল পরিচয় দেয়নি। সবাই তাকে স্ট্যানলি ওবরস্কি বলেই জানে।

কিন্তু পুঙ্গুর সঙ্গে দেখা হতেই সে বলল, দুঃখের কথা বাওয়ানা, তোমার সেই লোকটি এক সপ্তাহ আগে মারা গেছে। আমরা তার মৃতদেহটা জিঞ্জায় শ্বেতাঙ্গদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি যাতে আমরা মেরেছি বলে কারো কোন সন্দেহ না হয়।

টারজনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। ও ভেবেছিল ওবরস্কিকে ওদের সামনে নিয়ে গিয়ে হাজির করিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়ার পর নিজের আসল পরিচয়টা দেবে। কিন্তু তা আর হলো না। আর ও ওদের কাছে ফিরে যাবে না কখনো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *