স্বর্ণ-শহরে টারজান (টারজান এ্যাণ্ড দি সিটি অফ গোল্ড)

স্বর্ণশহরে টারজান (টারজান এ্যাণ্ড দি সিটি অফ গোল্ড)

বর্ষাকাল শেষ হতে চলেছে; সময়টা সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি; কিন্তু নদীতে এখনও অনেক জল, সাম্প্রতিক বর্ষণের ফলে মাটি বেশ নরম।

এরই মধ্যে সুদূর কাফা পর্বতশ্রেণীর বাসিন্দা একটি ছোট দস্যুদল ঘোড়ায় চেপে চলেছে নিঃসঙ্গ পথিক দলবদ্ধ যাত্রী ও গ্রামবাসীদের লুট করার ধান্ধায়।

তাদের থেকে কিছুটা দূরে একটা শিকারী শিকারকে তাড়া করে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে শিকারীটি মোটেই শিকারী প্রাণীর মত দেখতে নয়, অথচ সে তো শিকারী প্রাণীই বটে; কারণ একমাত্র শিকার ধরেই সে তার পেট ভরায়; আবার একজন বিশিষ্ট ব্রিটিশ লর্ডের যে ছবি আমাদের চোখে। ভাসে সে তার মতও নয়, অথচ সে তো একজন ব্রিটিশ লর্ডই বটে-সে হল বানরদলের টারজান।

দুদিন যাবৎ বৃষ্টি পড়ছে; ফলে টারজান ক্ষুধার্ত। একটা হরিণ-শিশু ঝোপ ঝাড় ও লম্বা নলবনের আড়ালে দাঁড়িয়ে জল খাচ্ছে। আর টারজান হেঁটে এমনভাবে এগিয়ে চলেছে যাতে হরিণটাকে আক্রমণ করতে পারে। সে বুঝতেই পারেনি যে একদল অশ্বারোহী তার পিছনে উঁচু জায়গায় ঘোড়া থামিয়ে। নিঃশব্দে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

সাদা পোশাক পরা দস্যুরা নিচে নামতে লাগল; তাদের হাতে বর্শা ও লম্বা নলের গাদা বন্দুক। তারাও অবাক হয়ে গেছে। এ ধরনের কোন সাদা মানুষকে তারা আগে কখনও দেখে নি।

হরিণটা মাঝে মাঝে মাথা তুলছে। হঠাৎ তার দৃষ্টি মুহূর্তের জন্য নর-বানরটির উপর পড়তেই সে এক পাক ঘুরে ছুট দিল। সঙ্গে সঙ্গে টারজানও পিছন ফিরে তাকাল; দেখল, আধ ডজন অশ্বারোহী ধীরে ধীরে তার দিকেই এগিয়ে আসছে; সে বুঝতে পারল এরা কারা, আর এদের উদ্দেশ্যই বা কি। এরা সব দস্যু, লুণ্ঠন ও হত্যাই এদের একমাত্র কাজ-শত্রু হিসেবে এরা নুমা-র চাইতেও নির্মম।

দস্যুরা যখন বুঝল টারজান তাদের দেখতে পেয়েছে তখন তারা হাতের অস্ত্র ঘোরাতে ঘোরাতে চীৎকার করে জোর কদমে সবেগে তার দিকে ছুটে গেল।

কিন্তু টারজান না মুখ ফেরাল, না ছুট দিল। সে ভাল করেই জানত যে ছুটে পালিয়ে অশ্বারোহীদের হাত থেকে পার পাওয়া যাবে না। তাই বলে সে যে খুব ভয় পেয়েছে তাও নয়।

দীর্ঘ সুসামঞ্জস দেহ, মাংসপেশী হারকিউলিসের মত নয়, অনেকটা এপোলোর মত; পরনে একটিমাত্র সিংহের চামড়া; পিঠের উপর ঝুলন্ত তীরভর্তি তূণীর ও একটা ছোট হাল্কা বর্শা; কোমরে ঝুলছে বাবার শিকারী ছুরিটা; তার বাঁ হাতে রয়েছে ধনুক, আর আঙুলের মাঝখানে চারটি বাড়তি তীর।

যে মুহূর্তে সে বুঝতে পারল যে পিছন থেকে এগিয়ে আসা অশ্বারোহীদের হাতে তার বিপদের সম্ভাবনা আছে, সঙ্গে সঙ্গেই সে লাফ দিয়ে উঠে ধনুকে টংকার দিল। দস্যুরা আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সচেতন হবার আগেই টারজান ধনুকটাকে বাঁকিয়ে তীর ছুঁড়ল।

প্রথম তীরটি সোজা এসে বিঁধল সামনের সদ্যুটার বুকে; দুই হাত উপরে তুলে সে ঘোড়ার পিঠ থেকে নিচে পড়ে গেল। ততক্ষণে বিদ্যুৎগতিতে ছুটে এল আরও চারটি তীর; কোনটিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হল না। মাটিতে ছিটকে পড়ল আরও এক দস্যু; তিনজন আহত হল।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই চার অশ্বারোহী এসে তাকে ঘিরে ফেলল। আহত তিনজন নিজেদের শরীর থেকে পালকওয়ালা তীর টেনে তুলতেই ব্যস্ত, কিন্তু চতুর্থ অনাহত দস্যুটি বর্শা উঁচিয়ে সশব্দে টারজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

টারজানও ধনুকের ছিলাটাকে গলা থেকে খুলে নিয়ে সেটা দিয়ে প্রাণপণ শক্তিতে আঘাত করল শত্রুর বর্শার হাতলে; তারপর লোকটির হাত চেপে ধরে এক লাফে তারই ঘোড়ার পিঠে চেপে বসল।

মুহূর্তকাল পরেই টারজান ঘোড়ার পিঠে চেপে নদী পেরিয়ে ওপারের শক্ত মাটিতে পা দিল। এবার সে নিরাপদ। ওপারের ক্রুব্ধ দস্যুদের লক্ষ্য করে একটা তীর ছুঁড়ল। তীরটা গিয়ে বিধল আহত দস্যুটার উরুতে।

বনের মধ্যে ঢুকবার পরেই মাথার উপরকার একটা গাছের ডাল ঝুলে পড়ে টারজান ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিল। সে খুব রেগে গেছে; দস্যুরা এসে পড়ায় তার মুখের খাবার হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখন আবার নতুন করে তাকে খাবার খুঁজতে হবে। তাই সে অন্য জীবের খোঁজ করতে করতে অচিরেই তা। পেয়ে গেল এবং ভোজন পর্ব সমাধা করল।

এবার বেশ হৃষ্ট চিত্তে টারজান নদীর দিকেই ফিরে চলল। নদীটা পার হয়ে দস্যুদের পথটাই ধরল। তাদের সঙ্গে একটা চূড়ান্ত বোঝাপড়া করতেই হবে।

টারজান যখন বনের প্রান্তে পৌঁছে গেল একটা সিংহ তখন তার দক্ষিণে সামান্য দূরে এগিয়ে চলেছে। তাই টারজান গাছে চড়ে ডাল থেকে ডালে চলে নিঃশব্দে দস্যুদের শিবিরের দিকে এগিয়ে চলল।

টারজান শিবিরের ঠিক মাথার উপরকার একটা গাছে পৌঁছে গেল। নিচে জনাবিশেক লোক এবং তাদের ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র দেখতে পেল। বন্য জন্তুর হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য ডালপালা ও ঝোপঝাড় দিয়ে একটা বেড়ামতন তৈরি করা হয়েছে।

এবার চকিতে চোখ বুলিয়েই টারজান নিচেকার সব কিছু ভাল করে দেখে নিল; কিন্তু তার সাগ্রহ দৃষ্টি স্থির নিবদ্ধ হল একটি জিনিসের উপর; অগ্নিকুণ্ডের কিছু দূরেই একটি সাদা মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে। পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে মনে হচ্ছে এতকাল যত সাদা মানুষ সে দেখেছে তাদের চাইতে এই বন্দী সাদা মানুষটি স্বতন্ত্র। গোড়ালি, কব্জি, গলা ও মাথার অলংকার ছাড়া তার সারা দেহের একমাত্র আচ্ছাদন হাতির দাঁতের গোলাকার চাকতি পর পর সাজিতে তৈরি একরকম গ্রীবা ও বক্ষস্ত্রাণ। এ ছাড়া তার দুই বাহু ও দুই পা সম্পূর্ণ উলফঙ্গ।

শিবিরের উপর নজর রাখতে গিয়ে টারজনের হঠাৎ মনে হল, এই দস্যুরা যেমন তার মুখের গ্রাস হরিণটাকে হাতছাড়া করে দিয়েছে, তেমনি সেও ওদের কাছ থেকে একটা কিছু হরণ করবে। একথা ভাবতে গিয়েই তার মনে হর, আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ওই সাদা মানুষটাকে চুরি করতে পারলেই তো ব্যাটাদের বোকা বানানো যায়।

গাছের ছায়ার আড়ালে নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগল টারজান। কতক্ষণে দস্যুরা গভীর ঘুমে ঢুলে পড়বে, কতক্ষণে তাদের শিকারকে নিয়ে সে পালাতে পারবে-তারই অপেক্ষা। এক সময় নুমা’র তীব্র গন্ধ তার নাকে এল। অবশ্য সে ভালভাবেই জানে, ঘোড়ার গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে নুমা’ শিবিরের কাছে এলেও যতক্ষণ আগুনটা ভালভাবে জ্বলতে থাকবে ততক্ষণ সে কিছুতেই শিবিরে ঢুকবে না।

শেষ পর্যন্ত এক সময় সকলেই ঘুমিয়ে পড়ল। শাস্ত্রীও ঘুমে ঢুলছে। ছায়ার মত নিঃশব্দে টারজান গাছ থেকে নেমে এল।

ক্রমেই সে শাস্ত্রীটি আরও কাছে এগিয়ে চলল। এবার ঠিক তার পিছনে। একটা কঠিন হাত দ্রুত বেরিয়ে এল, ইস্পাত-কঠিন কয়েকটা আঙুল চেপে বসল শাস্ত্রীর বাদামী গলায়, আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা ছুরি আমূল বিদ্ধ হল তার বাঁ কাঁধ থেকে হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত।

অসাড় দেহ থেকে টারজান ছুরিটা তুলে নিল; তারপর এগিয়ে চলল বন্দীর দিকে। সে খোলা জায়গাতেই শুয়ে আছে। নিভন্ত আগুনের অস্পষ্ট আলোয় দেখতে পেল বন্দীর চোখ দুটি ফোলা; সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সে টারজনের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের উপর আঙুল তুলে টারজান তাকে চুপ করে থাকতে বলল। হাঁটু ভেঙে তার পাশে বসে হাত-পায়ের শক্ত চামড়ার দড়ি কেটে দিল; টারজান তাকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিল।

মুহূর্তকাল পরেই সে ইসারায় বন্দীকে বলল তাকে অনুসরণ করতে। কিন্তু দস্যুরাও স্থির সংকল্প-তাদের কিছুতেই পালাতে দেবে না। বন্দুকের কুঁদো ও বর্শা বাগিয়ে তারাও রুখে দাঁড়াল। অরণ্যের রাজ ও তার সঙ্গী বুঝল, অবস্থা বড়ই সঙ্গীন।

একজন দস্যু এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল যেখান থেকে সঙ্গীদের কোন বিপদ না ঘটিয়েই গুলি ছোঁড়া যায়। গাদা বন্দুকটা কাঁধের উপর তুলে সে টারজনের দিকে নিশানা স্থির করল।

টারজানকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়বার জন্য লোকটা সবে বন্দুকটা কাঁধের উপর তুলেছে এমন সময় অপর এক দস্যু সহসা আর্তনাদ করে উঠল, আর সে আর্তনাদকে ছাপিয়ে শোনা গেল সিংহ নুমার গর্জন; এক লাফে সে এসে হাজির হল শিবিরের মাঝখানে।

যে দস্যুটি টারজানকে গুলি করতে উদ্যত হয়েছিল সে একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে সিংহটাকে দেখেই ভয়ে চীৎকার করে উঠল। উত্তেজনাবশে রাইফেলটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সিংহের থাবা থেকে পালাতে গিয়ে ছিটকে পড়ল টারজনের হাতের মধ্যে।

টারজানও পলায়নমান দস্যুটাকে দুই হাতে মাথার উপর তুলে নুমার মুখের সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিল। নুমাও সঙ্গে সঙ্গে বিরাট হা করে হতভাগ্য লোকটির মাথা ও গলা ঢুকিয়ে দিল মুখের ভিতরে। এদিকে টারজানও সঙ্গীটিকে অনুসরণ করার ইঙ্গিত করে এক ছুটে সিংহটাকে পাশ কাটিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়ল গাছের সেই দো-ডালায় যেখান থেকে নুমা লাফিয়ে নেমে এসেছিল। শ্বেতকায় বন্দীটিও সঙ্গে সঙ্গে তার পিছু নিল। সিংহের আকস্মিক আবির্ভাবে হতচকিত দস্যুরা সঠিক বুঝে ওঠার আগেই সাদা মানুষ দুটি রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

দিনের পর দিন দুটি মানুষ বিরাট এক পর্বতমালার গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করতে লাগল। দীর্ঘদিন ধরে এক সঙ্গে চলাফেরার সুযোগে সে সঙ্গীর ভাষাটি আয়ত্ত করতে সচেষ্ট হল।

টারজান প্রথমেই জেনে নিল যে তার সঙ্গীটির নাম ভালতোর, আর ভালতোর গোড়া থেকেই টারজনের অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করতে লাগল। সঙ্গীটি নিরস্ত্র হওয়ায় টারজান তার জন্য একটা বর্শা ও তীর-ধনুক তৈরি করে দিল। তারপর থেকেই ভালতোর জঙ্গলের রাজাকে শেখাতে শুরু করল তার ভাষায় কথা বলতে, আর টারজান শেখাতে লাগল ধনুর্বিদ্যা।

এইভাবে অনেক সপ্তাহ কেটে গেল, কিন্তু ভাল্‌তোরে দেশটা তখনও যে দূরে সেই দূরেই রয়ে গেল। পাহাড়ে শিকারের অভাব নেই, তাই খাদ্যের কোন সমস্যা নেই।

কিন্তু ভালতোরের অত ধৈর্য নেই; অবশেষে একদা দিন শেষে পথরোধকারী একটা সুউচ্চ পাহাড় প্রাচীরের সামনে পৌঁছে সে অসংকোচে বলল, আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। এখন আমরা কি করব?

যে শিবিরে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল সেখান থেকে তোমার দেশটা কোন্ দিকে বলতে পার? টারজান শুধাল।

ভালতোর জবাব দিল, সেখান থেকে থেনার সোজা পূর্ব দিকে; সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।

টারজান আশ্বাস দিয়ে বলল, পূর্ব দিকে আমি ঠিকই যেতে পারব, কিন্তু ঠিক আমাদের পথের উপর না পড়লে তো তোমার দেশটাকে আমি চিনে নিতে পারব না।

ভালতোর বলল, আমরা যদি সে দেশের পঞ্চাশ বা একশ’ মাইলের মধ্যে পৌঁছতে পারি তাহলে কোন উঁচু জায়গা থেকে জারাটরকে আমরা দেখতে পাবই। সেখান থেকে থেনারের পথ আমি চিনতে পারব, কারণ এথনি শহরটা জারাটর থেকে প্রায় খাড়া পশ্চিমে।

জারাটর ও এথনিটা কি? টারজান জানতে চাইল।

জারাটর একটা বিরাট পর্বত-শিখর; তার কেন্দ্রস্থল অগ্নি ও গলিত পাথরে পরিপূর্ণ। সেটা ওথার উপত্যকার উত্তর প্রান্তে অবস্থিত; স্বর্ণশহর কাথুনির লোকরাই সেটার মালিক। আমি নিজে গজদন্তের শহর এথনির অধিবাসী। ওনার উপত্যকার অন্তর্গত কাথুনির অধিবাসী আমাদের চিরশত্রু।

টারজান বলল, তাহলে কাল আমরা থেনার উপত্যকার এথনি শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করব।

নতুন দিনের শুরু হল মেঘমেদুর ভয়ঙ্কর পরিবেশে। বর্ষাকাল পার হয়ে গেছে, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে যে, পাহাড় শ্রেণীর ভিতর দিয়ে টারজান ও ভালুতোর হারানো থেনার উপত্যকার পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে তারই সুউচ্চ শিখরের মাথায় বিলম্বিত ঝড় যেন পুঞ্জীভূত হচ্ছে। রোদের উত্তাপে ও রাতের ঠাণ্ডা কাটেনি। ডালপালার বিছানা ছেড়ে উঠে মানুষ দু’টি শীতে কাঁপছে।

পড়ন্ত বিকেলে একটা গভীর খাদ বেয়ে উঠে উঁচু উপত্যকার উপর এসে তারা দাঁড়াল। হঠাৎ ভাতের সানন্দে চীৎকার করে উঠল, পেয়েছি পেয়েছি! ঐ তো জারাটর!

টারজান সেদিকে তাকিয়ে দেখল দূরে একটা চওড়া-মাথা পর্বত-শিখর মেঘ-ভাঙা রাঙা আলোয় ঝলমল করছে। বলল, তাহলে ওটাই জারাটর! আর থেনার ওর ঠিক পূর্ব দিকে?

ভালতোর জবাব দিল, হ্যাঁ; তার অর্থ এই উপত্যকার নিচে ঠিক আমাদের সামনেই ওন্থার। ওথারের প্রায় দক্ষিণ সীমান্তে আমরা পৌঁছ গেছি। ঐ তো স্বর্ণ-শহর ক্লাথুনি। খুবই সমৃদ্ধ শহর, কিন্তু আদিবাসীরা আমার জাতির শত্রু।

টারজান আর একবার কাথুনি শহরের উপর চোখ বুলিয়ে প্রশ্ন করল, ওটাকে তোমরা স্বর্ণশহর বল কেন?

ভালতোর বলল, সোনালী গম্বুজ আর সোনার সেতুটা দেখতে পাচ্ছ না? ওগুলো নিরেট সোনা দিয়ে মোড়া। কোন কোন গম্বুজের সোনা এক ইঞ্চি পুরু, আর সেতুটা নিরেট সোনার ইট দিয়ে তৈরি।

টারজান প্রশ্ন করল, এত সোনা ওরা পায় কোথায়?

শহর থেকে সোজা দক্ষিণের পাহাড়ে সোনার খনি আছে, ভালতোর জবাব দিল।

আর তোমার দেশ থেনার কোথায়?

ওনথারের পূর্ব দিকের পাহাড়ের ঠিক ওপারে। শহরের প্রায় পাঁচ মাইল উপরে যেখানে নদী ও রাস্তাটা বনের মধ্যে ঢুকে গেছে দেখতে পাচ্ছ?

এথনি থেকে আমরা কতদূরে আছি? টারজান শুধাল

 প্রায় পঁচিশ মাইল, ভালতোর জবাব দিল।

 টারজান বলল, তাহলে তো আমরা এখনই রওনা দিতে পারি।

ভালতোর বলে উঠল, অবশ্যই পার; কিন্তু দিনের আলোয় ওনথার পার হবার চেষ্টা করাটা নিরাপদ হবে না। কাথুনির ফটকে শান্ত্রীরা নিশ্চয় আমাদের দেখতে পেলে আমাদের খুন করবে, নয় তো বন্দী করবে। রাতেও ও পথে সিংহের ভয় আছে। কিন্তু দিনের বেলায় অবস্থা আরও শোচনীয়।

কোন্ সিংহ? টারজান জানতে চাইল।

ভালতোর বলল, কাথুনির মানুষরা সিংহ পালে; গোটা উপত্যকায় অনেক সিংহ ঘুরে বেড়ায়। নিচে নদীর এপারে যে বিস্তীর্ণ উপত্যকা দেখতে পাচ্ছো ওটার নাম ‘সিংহ-ক্ষেত্র। ও জায়গাটা সন্ধ্যার পরে পার হওয়াই নিরাপদ।

তোমার তেমন ইচ্ছা, কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে টারজান বলল। এখনই যাত্রা করা অথবা রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করা আমার কাছে দুই-ই সমান।

এক সময় অদৃশ্য সূর্য পশ্চিম দিগন্তে আরো ঢলে পড়ল; ঘন কালো মেঘ উত্তরের পর্বত শিখরকে ঢেকে ফেলল। ভালতোর বলল, এবার আমরা যাত্রা করতে পারি।

একটা গিরিপথ ধরে দু’জনে নিচে নামতে লাগল। দু’পাশের খাড়া পাহাড় কাথুনি শহরের দৃষ্টি থেকে তাদের আড়াল করে রাখল। ঝড়ের সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। সঙ্গে বজ্রের গর্জন। আকস্মাৎ বিদ্যুতের একটা প্রচণ্ড ঝিলিক কয়েক সেকেন্ডের জন্য গোটা উপত্যকাটিকে ঝলসে দিল; প্রচণ্ড এক জলধারার ধাক্কায় দু’জনেই মাটিতে পড়ে গেল।

কোনরকমে আবার যখন উঠে দাঁড়াল তখন তারা দাঁড়িয়ে আছে প্রচণ্ড জলস্রোতের মধ্যে। কিন্তু ঝড়ের দেবতার সব জারিজুরির বুঝি সেখানেই ইতি ঘটল। বৃষ্টি থেমে গেল। ভালতোর আবার পথ দেখিয়ে এগিয়ে চলল।

থেনারের রাস্তাটা যেখানে নদীকে অতিক্রম করেছে সেই জায়গাটা স্বর্ণ সেতু অর্থাৎ কাথুনি শহরের ফটক থেকে সাত মাইল দূরে। তিন ঘণ্টায় সেই পথটা পার হয়ে দু’জনে এসে দাঁড়াল নদীতীরে।

ভালতোর ইতস্তত করে বলল, সাধারণত জল থাকে ফুটখানেক গভীর। এখন তিন ফুট গভীর।

টারজান বলল, অচিরেই জল গভীরতর হবে। পাহাড় ও উপত্যকার উপর থেকে ঝড়ের সব জল এখনও এসে পৌঁছয়নি। আজ রাতেই যদি নদী পার হতে হয় তো এখনই পার হতে হবে।

ভালতোর বলল, ঠিক আছে। আমাকে অনুসরণ কর; আমি খালটাকে চিনি।

জলে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদের মুখে আবার মেঘে ঢেকে গেল। খালটা ভাতোরের পরিচিত, তাই সে বেশ দ্রুতগতিতেই সেটা পার হতে লাগল। ফলে টারজান ক্রমেই তার থেকে পিছিয়ে পড়তে। লাগল। তবু প্রাণপণ শক্তিতে সে খালটা পার হতে লাগল।

জলের স্রোত প্রবল; টারজনের মাংসপেশীও প্রবল শক্তিধর। তিন ফুট গভীর জল ক্রমে ফুলে ফেঁপে টারজনের কোমর পর্যন্ত উঠল। হঠাৎ পথ ভুল করে সে একটা গর্তে পা দিল। সঙ্গে সেঙ্গ প্রচণ্ড স্রোত। তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।

ওদিকে ভালতোর নিরাপদে অপর তীরে পৌঁছে টারজনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেও সে যখন এল না তখন ভালতোর তার নাম ধরে অনেক ডাকল, কিন্তু কোন সাড়া মিলল না।

সারাটা রাত সে অপেক্ষা করে রইল। ভোরের আলো ফুটল। তবু বন্ধুর দেখা নেই। অবশেষে তার দৃঢ় ধারণা হল, উন্মত্ত বন্যার টান টারজানকে মৃত্যুর মুখে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ক্ষুব্ধ হৃদয়ে নদীর তীর ছেড়ে সে আবার যাত্রা শুরু করল থেনার উপত্যকার দিকে।

উচ্ছ্বসিত নদীর ক্রুদ্ধ জলধারার সঙ্গে প্রাণ রক্ষার যুদ্ধে সতত ব্যস্ত টারজান সময়জ্ঞান একেবারেই হারিয়ে ফেলল। মৃত্যুর বিরুদ্ধে এ সংগ্রামের যেন শুরু নেই, শেষ নেই।

একটু একটু করে সে নিজের দেহটাকে টেনে তুলল নদীর তীরে। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল; সিংহের মত শরীরটাকে একবার ঝেড়ে নিল; ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে একটা অস্পষ্ট আলোর রেখা যেন চোখে পড়ল। টারজান সতর্ক পায়ে এগিয়ে চলল।

নদী থেকে কয়েক পা এগোতেই সামনে একটা প্রাচীর। প্রাচীরের কাছাকাছি হতেই আলোটা আর চোখে পড়ল না। কয়েক পা পিছিয়ে এক দৌড়ে প্রাচীরের কাছে গিয়ে দিল লাফ। বাড়ানো আঙুল দিয়ে প্রাচীরের মাথাটা ধরে ঝুলে পড়ল। ধীরে ধীরে উপরে উঠে ঘোড়ার মত প্রাচীরের দুই পাশে পা ঝুলিয়ে বসে প্রাচীরের অপর পারে তাকাল।

 আলোর দিকে অর্ধেক পথ পৌঁছনো মাত্রই অবসিত প্রায় ঝড়ের শেষ বিদ্যুৎটি ঝলসে উঠল। টারজনের সামনে দেখা দিল একটা নিচু বাড়ি, একটা আলোকিত জানালা, একটা ঢাকা-দেয়া দরজা ও তার আশ্রয়ে দণ্ডায়মান একটি মানুষ। সেই ক্ষণিক আলোয় টারজানও সেই মানুষটির দৃষ্টিকে এড়াতে পারল না।

সঙ্গে সঙ্গে ঘণ্টার কর্কশ শব্দে রাতের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়ল। দরজাটা সপাটে খুলে গেল, বাইরে বেরিয়ে এল মশালধারী অনেক মানুষ। পশুর স্বাভাবিক সতর্কতা বশেই টারজান উল্টোদিকে। ছুট দিল; টারজান বুঝতে পারল, পালাবার চেষ্টা বৃথা। দুই হাত বুকের উপর ভাঁজ করে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তিন দিক থেকে লোকজন এসে তাকে ঘিরে ধরল। সে এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে নিশ্চয় এটা স্বর্ণ-শহর।

টারজান বন্দী হল স্বর্ণ-শহরের রক্ষীদের হাতে। রক্ষীরা চত্তর পেরিয়ে একটা বাড়িতে টারজানকে নিয়ে গেল। মশালের আলোয় যে ঘরে তাকে ঢুকিয়ে দিল সেখানে আরও একটি লোককে সে দেখতে পেল।

ঘর অন্ধকার। টারজান সঙ্গীকে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে।

তবু সময় নষ্ট না করে টারজান তখনই ঘরটি পরীক্ষা করতে শুরু করল। প্রথমেই গেল দরজার কাছে। সেখান থেকে দেয়াল বরাবর ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। সে জানে, ঘরের অপর লোকটি দূর কোণে একটা বেঞ্চিতে বসে আছে।

অন্ধকারে কে যেন বলে উঠল, কি করছ?

 ঘরটা পরীক্ষা করছি-টারজান বলল।

লোকটি বলল, আমার নাম ফোবেগ। তোমার?

 টারজান।

 তুমি কি কাথুনির লোক, না এথনির?

কোনটাই না; আমি এসেছি সুদূর দক্ষিণের একটা দেশ থেকে।

এই কাথুনিতে এলে কেমন করে?

পথ হারিয়ে এসে পড়েছি, পুরো সত্য কথাটা টারজান বলতে চাইল না; শুধু বলল, বন্যার তোড়ে ভাসতে ভাসতে তোমাদের শহরে এসে পড়েছি। এখানে ওরা আমাকে বন্দী করেছে; ওদের অভিযোগ, আমি ওদের রানীকে হত্যা করতে এসেছি।

অর্থাৎ ওদের ধারণা তুমি নেমোনকে হত্যা করতে এসেছ! কি জান, যে কোন অবস্থাতেই নেমোনকে খুশি করতে ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে।

নেমোন কি তোমাদের রানী?

ফোবেগ আবেগের সঙ্গে বলে উঠল, ঈশ্বরের কেশরের নামে বলছি, সে রানী তো বটেই, তার চাইতেও অনেক কিছু বেশি! ওন্থার বা থেনারে আগে কখনও এমন রানী হয় নি, আর ভবিষ্যতেও কখনও হবে না।

রানী কি সুন্দরী? টারজান প্রশ্ন করল।

হ্যাঁ, আমাদের রানী পৃথিবীর সেরা সুন্দরী। কিন্তু এবার ফোবেগ গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, কিন্তু সে একটি শয়তানী। আমি যে এত বছর ধরে তার সেবা করছি আমিও তার কাছে করুণা ভিক্ষা করতে চাই না।

টারজান শুধাল, কোন্ অপরাধে তুমি এখানে এসেছ?

ফোবেগ বিষণ্ণ গলায় বলল, ভুলক্রমে আমি ঈশ্বরের লেজে পা দিয়েছিলাম।

লোকটির কথা শুনেই টারজনের খটকা লেগেছিল, কিন্তু এই শেষের কথা শুনে সে হতভম্ব হয়ে গেল।

টারজান লোকটির ভাষা বুঝতে পারলেও তার কথার তাৎপর্য কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না। রানীর খুশির সঙ্গে ন্যায়বিচারের কি সম্পর্ক থাকতে পারে?

সে যখন এই সব চিন্তা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল, ঠিক সেই সময় বহুদূর দক্ষিণে আর একটি বন্য প্রাণী ঝড়ের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছে। তারপর দিনের আলো ফুটলে সে বাইরের রোদে বেরিয়ে এল। বন্য প্রাণীটি আর কেউ নয়-আমাদের পূর্ব পরিচিত কালো কেশরওয়ালা সেই সিংহটি। নতুন-ওঠা রোদে হলদে সবুজ চোখ দুটো মিটমিট করতে করতে প্রাতঃরাশের খোঁজে নিচে নেমে গেল। আবার ঠিক সেই সময়ই দুটি সৈনিকের সঙ্গে একজন কালো ক্রীতদাস জঙ্গলে রাজার জন্য প্রাতরাশ নিয়ে কাথুনির কারা-কক্ষে প্রবেশ করল।

বিনা প্রতিবাদে কাথুনির কারা কক্ষে ঢুকবার সময় টারজান ভেবেছিল যে পরদিন সকালেই তাকে জিজ্ঞবাদ করে ছেড়ে দেয়া হবে। কিন্তু পরদিন সকালে ওরা তাকে বাইরে নিয়ে যায় নি; তারপর দিনও নয়, এবং তার পরের দিনও নয়। সেও মুক্তির আশায় আশায় অপেক্ষা করেই আছে।

তারপর একদিন চারজন সৈনিক এসে দরজাটা সপাটে খুলে ফেলল। তাদের একজন হাঁক দিল, আমাদের সঙ্গে চলে এস-দু’জনই।

ফোবেগ বিষণ্ণ মনে, আর টারজান নুমার মত আরণ্য মর্যাদার সঙ্গে তাদের পিছু পিছু চলতে লাগল। চত্ত্বর পেরিয়ে একটা দরজার ভিতর দিয়ে দীর্ঘ বারান্দার শেষে একটা বড় ঘরে সকলে ঢুকল। সেখানে হস্তিদন্ত ও স্বর্ণখচিত পোশাকে সজ্জিত সাতজন অফিসার একটা টেবিলের উপরে বসে ছিল। তাদের মধ্যে দু’জনকে টারজান চিনতে পারল-প্রবীণ টমোস ও তরুণ গেমনন।

ফোবেগ ফিসফিস করে বলল, এরা সকলেই সম্ভ্রান্ত লোক। টেবিলের ঠিক মাঝখানে বসেছে বুড়ো চমোস, রানীর মন্ত্রী; তার ডাইনে বসেছে এরোট; সে আমার মত সাধারণ সৈনিকই ছিল, কিন্তু নেমোনের নজর পড়ায় সে এখন রানীর প্রিয় পাত্র। তার বাঁ দিকে বসে আছে যুবক গেমনন। তার অধীনে যে সব সৈনিক কাজ করে তারা সকলেই বলে তার মত লোক হয় না।

তার কথা শেষ হতেই ঘরের একদিকের দরজা খুলে হাতির দাঁত ও সোনার ঝলমলে পোশাক পরিহিত একটি লোক উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করলঃ রানী। বলেই আবার সরে গেল।

সবগুলো চোখ পড়ল দরজার দিকে; সম্ভ্রান্ত লোকগুলো উঠে দাঁড়াল; তারপর দরজার দিকে মুখ করে নতজানু হল। শুধু বানর-রাজ টারজান নতজানু হল না।

জনৈক রক্ষী গর্জন করে উঠল, নিচু হ শেয়াল! পরমুহূর্তেই মৃত্যু-কঠিন নিস্তব্ধতার মধ্যে প্রবেশ করল। রানী। অলসভাবে একবার চারদিকে তাকাল। তার চোখ পড়ল টারজনের উপর। ভুরু দুটি ঈষৎ কুঁচকে গেল।

দীর্ঘ পল্লবে ঢাকা কালো চোখ তুলে রানী টারজনের দিকে তাকাল। দেখল তার ব্রোঞ্জ রঙের চামড়া, আর মাংসপেশী সমৃদ্ধ দেহ। শুধাল, তুমি নতজানু হলে না কেন?

টারজান নির্ভয়ে জবাব দিল, ওরা বলেছে তুমি আমাকে মেরে ফেলবে; তাহলে তোমার সামনে আমি নতজানু হব কেন? তুমি তো আমার রানী নও?

টমোস চীৎকার করে উঠল, থাম! মূর্খ ক্রীতদাস, অসভ্য বর্বর, তুমি কি জান না যে রানী নেমোনের সঙ্গে কথা বলছ?

আন্ডার অফিসারের দিকে মুখ ফিরিয়ে টমোস হুকুম করল, ওদের এখান থেকে নিয়ে যাও; মৃত্যুর ব্যবস্থা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত সেলেই আটকে রাখবে।

নেমোন বলল, দাঁড়াও। এই লোকটি সম্পর্কে আমি আরও কিছু জানতে চাই। টারজনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আদর-ভরা সরল গলায় বলল, তাহলে তুমি আমাকে মেরে ফেলতেই এসেছিলে?

টারজান জবাব দিল, আমি স্ত্রীলোককে মারি না। তোমাকে মারতে আমি এখানে আসি নি।

 তাহলে কেন তুমি ওন্থারে এসেছিলে?

টমোসের দিকে মাথাটা নেড়ে টারজান জবাব দিল, ওই লালমুখ বুড়োকে তো সে কথা দু’বার বলেছি। ওকেই জিজ্ঞাসা কর; যারা আমাকে মেরে ফেলাই স্থির করেছে তাদের কাছে আমি আর কৈফিয়ৎ দিতে পারি না।

টারজনের কথায় নেমোনের মুখ রাগে লাল হয়ে উঠেছিল, কিন্তু সে সংযম হারাল না। ঠাণ্ডা গলায়। শুধাল, অপর লোকটি কে?

এবার জবাব দিল এরোট, ও একজন মন্দির রক্ষী, নাম ফোবেগ। ও দেবতা টুসকে অপবিত্র করেছে।

নেমোন বলল, সিংহ-ক্ষেত্রে ওদের দুজনের লড়াই দেখতে আমাদের বেশ মজাই লাগবে। দেবতা টুস-এর দেয়া দেহ ছাড়া অপর কোন অস্ত্র ছাড়াই ওদের যুদ্ধ করতে হবে। যে জিতবে সে মুক্তি পাবে।

সিংহ-ক্ষেত্র নামে পরিচিত একটা সমতল ভূমিতে বহু দর্শক এসে জমা হয়েছে। রক্ষীরা দুই যোদ্ধাকে সেই দিকে নিয়ে চলল।

সমতল ভূমির মাঝখানে বিশ বা ত্রিশ ফুট মাটি খুঁড়ে নিচে একটা ডিম্বাকৃতি মন্ত্র-ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। সেই মাটি গর্তের চারদিকে ফেলে ক্রমশ উঁচু করা হয়েছে।

খিলানের নিচে দিয়ে মলুক্ষেত্রের দিকে নামবার সময় টারজান দেখল, প্রায় অর্ধেক আসন এর মধ্যেই ভর্তি হয়ে গেছে। নিশ্চয় এটা একটা মহাফুর্তির দিন। সে ফোবেগের কাছে ব্যাপারটা জানতে চাইল। ফোবেগ বলল, বর্ষাকাল শেষ হলে প্রতি বছরই একটা অনুষ্ঠান হয়; এটা তারই অংশ।

 ইতোমধ্যে শহরের দিক থেকে ঢাক ও শিঙার শব্দ ভেসে এল। বাজনা ক্রমেই এগিয়ে আসছে। কাছে এলে ঢালু জায়গা বেয়ে বাজনাদাররা মল্লাক্ষেত্রের একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াল।

বাজনার পরেই মার্চ করে এল একদল সৈনিক; প্রত্যেকের বর্শার মাথায় উড়ছে রঙিন পতাকা। দৃশ্য মনোরম, কিন্তু এর পরে যা, এল তার তুলনায় কিছুই নয়।

সৈনিকদের কয়েক গজ পিছনেই এল চার সিংহে টানা সোনার রথ; তার উপরে লোম ও বিচিত্র রঙের কাপড়ে সাজানো আসনে অর্ধশায়িত ভঙ্গিতে বসে আছে রানী নেমোন। ষোলটি কালো ক্রীতদাস ধরে আছে সিংহের রাশ; রথের দুই পাশে মার্চ করে চলেছে সোনা ও হাতির দাঁতের ঝকঝকে পোশাক পরা দু’জন করে সম্ভ্রান্ত লোক; দীর্ঘদেহী একটি কালো মানুষ একটা বড় লাল ছাতা ধরে আছে রানীর মাথায়।

শোভাযাত্রা মলু-ক্ষেত্রে পৌঁছবার পরে নেমোন রথ থেকে নেমে সমবেত সকলের জয়ধ্বনির মধ্যে তার নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে বসল।

বেজে উঠল শিঙা। সৈনিকরা টারজান ও ফোবেগকে সঙ্গে নিয়ে মন্ত্র-ক্ষেত্রের চারদিকে ঘুরতে লাগল। রানীর আসনের সামনে দিয়ে যাবার সময় নেমোন আধ-বোজা চোখে নবাগত লোকটিকে ও মোটা কাথুনীয়কে ভাল করে লক্ষ্য করল।

ক্যাপ্টেন ঘোষণা করল, শিঙা বাজলেই তোমরা লড়াই শুরু করতে পার। দেবতা টুস্ তোমাদের সহায় হোন।

শিঙা বেজে উঠল। সারা রঙ্গালয় উৎকণ্ঠায় নিশ্চুপ। দু’জন এগিয়ে গেল ‘দু’জনের দিকে। ফোবেগ গর্বোদ্ধত, আত্মপ্রত্যয়ে দৃঢ়। টারজনের গতি সিংহের মত সহজ, সাবলীল।

ফোবেগ টারজনের একেবারে কাছে এগিয়ে গেল। টারজান গলাটা বাড়িয়ে দিল। ফোবেগ সেটা চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে টারজান দুই হাতের মুঠো এক করে হঠাৎ সেটাকে তুলে সজোরে আঘাত করল ফোবেগের থুতনিতে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঠেলে দিল। ফোবেগের ভারী দেহটা সবেগে ছিটকে গেল ডজন। খানেক পা দূরে; সে ধপাস করে বসে পড়ল।

হতভম্ব জনতার মুখ থেকে একটা সবিস্ময় আর্তনাদ বেরিয়ে এল। যারা টারজনের উপর বাজি ধরেছিল তারা সোল্লাসে চীৎকার করে উঠল। ( ফোবেগ কোনরকমে উঠে দাঁড়াল। তীব্র ক্রোধে মুখখানা লাল। গর্জে উঠে সে আবার টারজানকে আক্রমণ করল, আর রেহাই নেই। এবার তোকে শেষ করব।

মৃত্যু! মৃত্যু! ফোবেগের সমর্থকরা চেঁচাতে লাগল। মৃত্যু! মৃত্যু! আমরা চাই মৃত্যু!

লঘু পদক্ষেপে একপাশে সরে গিয়ে টারজান তার বাড়ানো হাত দুটি চেপে ধরে দুই দিকে সরিয়ে দিল; তারপরেই একটা ব্রোঞ্জকঠিন হাত ফোবেগের গলাটা চেপে ধরল; পরমুহূর্তেই হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে টারজান প্রতিপক্ষকে মাথার উপর দিয়ে ছুঁড়ে দিল। ফোবেগ সবেগে মল্ল ক্ষেত্রের উপর ছিটকে পড়ল।

নোমোন বাজির আসনে ঝুঁকে বসল; তার চোখ দুটো জ্বলছে; বুকটা উঠছে নামছে। অন্য অনেকের মতই এরোটের বুকটা যেন চেপে বসেছে।

টারজান আবারও ফোবেগের দেহটা মাথার উপর তুলে নিল। অসহায় ফ্লোবেগ বৃথাই হাত-পা ছুঁড়তে লাগল। টারজান মলু-ক্ষেত্রের এক প্রান্তে রানীর আসনের কাছে পৌঁছে ভারী দেহটাকে জনতার মধ্যে ছুঁড়ে দিল।

বলল, তোমাদের শক্তিমানকে ফিরিয়ে নাও। টারজনের ওকে কোন দরকার নেই।

কী আশ্চর্য, হায়েনার মত চীৎকার করতে করতে জনতা সেই দেহটাকে আবার মলু-ক্ষেত্রের মধ্যেই ছুঁড়ে দিয়ে বলে উঠল, ওকে মেরে ফেল! মেরে ফেল!

আসন থেকে ঝুঁকে নেমোনও চেঁচিয়ে বলল, ওকে মেরে ফেল! মেরে ফেল!

বিরক্তিতে কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে টারজান ফিরে চলল।

টারজান জবাব দিল, আমি ওকে মারব না।

নেমোন উত্তেজনায় লাল হয়ে আসনে উঠে দাঁড়াল। টারজান মুখ তুলতেই বলল, টারজান! কেন তুমি ওকে মারবে না?

 টারজান পাল্টা প্রশ্ন করল, কেন মারব? ও তো আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আমি হত্যা করি কেবল আত্মরক্ষা বা খাদ্যের জন্য; কিন্তু আমি তো মানুষের মাংস খাই না, কাজেই ওকে মেরে ফেলব কেন?

এরোটের মুখে আতংকের ছায়া। রানীর দিকে তাকিয়ে বলল, এই উদ্ধত বর্বরটাকে শেষ করে দেবার হুকুম কি দেব?

 নেমোন মাথা নাড়ল। তার মুখে অজ্ঞাত রহস্যের আবরণ, কিন্তু দুই চোখে এক বিচিত্র অগ্নি জ্বালা। বলল, দু’জনকেই আমরা জীবন ফিরিয়ে দিলাম। ফোবেগকে মুক্ত করে দাও। আর অপরজনকে প্রাসাদে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।

খেলার সমাপ্তি ঘোষণা করে রানী উঠে পড়ল।

সিংহ-ক্ষেত্রের অনেক মাইল দক্ষিণে ওথার উপত্যকার একটি সিংহ তখন অরণ্যের মধ্যে অস্থিরভাবে পায়চারি করে চলেছে। মনে হচ্ছে সে যেন কাকে খুঁজছে। এবার সে মাথা তুলে এমনভাবে গর্জন করে উঠল। যে মাটি কাঁপতে লাগল। আর বানর ‘মানু’ তার ভাই-বোনদের নিয়ে গাছের ফাঁক দিয়ে পালিয়ে গেল। অনেক দূরে একটা হাতি ডেকে উঠল। তারপরেই জঙ্গলের বুকে নেমে এল নিস্তব্ধতা।

একজন আন্ডার অফিসারের নেতৃত্বে একদল সাধারণ সৈনিক টারজানকে সঙ্গে করে স্টেডিয়ামে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সেখান থেকে সে শহরে ফিরল সম্ভ্রান্ত লোকদের সঙ্গী হয়ে। নেমোনের হাভভাবে তারা। বুঝতে পেরেছিল যে এই নবাগতই হয় তো রানীর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠবে; তাই অনেক সম্ভ্রান্ত লোকই তার সঙ্গে মাখামাখি শুরু করে দিল। মলু-ক্ষেত্র থেকেই যারা টারজনের সঙ্গ নিল, নানা ভাবে তারা তার। প্রণস্তিন্ত গাইতে লাগল। গেন তাদের অন্যতম।

শহরে পৌঁছে গেমনন টারজানকে তার নিজের বাসায় নিয়ে তুলল। তার বাসা বলতে একটা শোবার ঘর ও স্নানের ঘর; অন্যসব ব্যবস্থা অপর একজন অফিসারের সঙ্গে ভাগাভাগি করে চালাতে হয়। দেওয়ালে রয়েছে অস্ত্রশস্ত্র, বর্ম-চর্ম, নানা পশুর মাথা, আর চামড়ার উপর আঁকা ছবি। কিন্তু ঘরের মধ্যে লেখার সরঞ্জাম কিছুই চোখে পড়ল না। গেমননকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে টারজান জানতে পারল, লেখার মত কোন শব্দ কোন লিখিত ভাষায় সে শেখে নি।

 স্নান সেরে বেরিয়ে এসেই দেখল আহার প্রস্তুত। টারজান সঙ্গে সঙ্গে খেতে বসে গেল। গেমনন কাছে বসে কথা বলতে লাগল।

হঠাৎ টারজান প্রশ্ন করল, তোমার সিংহ আছে?

নিশ্চয়। আমি একজন সিংহ পরুষ; সিংহ রাখতেই হবে। রানীর প্রয়োজনে যুদ্ধ করতে প্রত্যেক সিংহ-পুরুষকে সিংহ রাখতেই হবে। আমার পাঁচটা সিংহ আছে।

সূর্য অস্ত গেলে ঘরে ঢুকল একটি ক্রীতদাস; হাতে জ্বলন্ত প্রদীপ; সিলিং থেকে ঝোলানো শিকলে প্রদীপটাকে ঝুলিয়ে দিল।

গেমনন দাঁড়িয়ে বলল, সন্ধ্যে ভোজের সময় হয়েছে।

আমি খেয়েছি, টারজান বলল।

 তবু চল; সেখানে অনেকের সঙ্গে আলাপ হবে।

টারজান উঠল। গেমননের পিছু পিছু ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

রাজপ্রাসাদ। দু’জন একসঙ্গে সেখানে ঢুকলেও বসবার ঘর থেকেই গেমনন বিদায় নিল। রানীর ঘরে ঢুকল টারজান একা।

দ্রুত চোখ বুলিয়ে টারজান ঘরটা দেখে নিল। ঘরটা বড় নয়, কিন্তু চমৎকারভাবে সাজানো। নিরেট সোনার স্তম্ভের উপর ছাদটা দাঁড়িয়ে আছে। দেওয়ালে হাতির দাঁতের টালি বসানো; রঙিন পাথরে মোজাইক করা মেঝেতে নানা রঙের কম্বল ও জীব-জন্তুর চামড়া ছড়ানো; তার মধ্যে একটি মানুষের মাথাশুদ্ধ ট্যান-করা চামড়াও রয়েছে।

ঘরের এক প্রান্তে একটা বড় সিংহ দুটো স্তম্ভের মাঝখানে শিকল দিয়ে বাঁধা রয়েছে। সিংহটা প্রকাণ্ড; টারজান ঘরে ঢোকরা মুহূর্ত থেকেই সিংহটা হিংস্র চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এরোট ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা বন্ধ করতে না করতেই সিংহটা ভয়ংকর গর্জন করে টারজনের দিকে লাফ দিল। কিন্তু সিংহটা শিকলে বাঁধা; মেঝেতে পড়ে গজরাতে লাগল।

নেমোন বলল, বেলথার তোমাকে পছন্দ করছে না।

ওর মধ্যে তো কাথুনির সব লোকের মনোভাবই প্রতিফলিত হচ্ছে, টারজান জবার দিল।

সেটাই সত্যি নয়, রানী আপত্তি জানাল।

 নয়?

আমি তোমাকে পছন্দ করি। নেমোনের কণ্ঠস্বর নিচু ও আদর মাখানো।

এবার আমার প্রশ্নের জবাব দাও। নিজের দেশে তুমি কি একজন সিংহ-পুরুষ?

সেখানে আমি একজন সম্ভ্রান্ত লোক; তবে সেটা নিজের গুণে নয়, বংশগত অধিকারে।

নেমোন উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠল, আঃ! আমিও তাই ভেবেছিলাম; তুমি একটি সিংহ-পুরুষ!

 তাতে কি হল? টারজান প্রশ্ন করল।

নেমোন হাতটা বাড়িয়ে টারজনের হাতের উপর রাখল; নরম ও গরম হাতখানা একটু কেঁপে উঠল। নেমোন বলল, আমি তোমাকে মুক্তি দেব, কিন্তু এক শর্তে।

সেটা কি?

তুমি এখানেই থাকবে; ওথারকে-আমাকে ছেড়ে যাবে না। রানীর কণ্ঠস্বর আগ্রহে ভাঙা।

টারজান চুপ। এ কথা সে দিতে পারে না বলেই কথা বলল না।

নেমোন ফিসফিস্ করে বলল, আমি তোমাকে কাথুনির সম্ভ্রান্ত নাগরিক করে দেব। সোনার শিরস্ত্রাণ, হাতির দাঁতের বক্ষস্ত্রাণ বানিয়ে দেব। তোমাকে সিংহ দেব পঞ্চাশটা, একশ’টা-যত চাও। তুমি হবে আমার দরবারের ধনীশ্রেষ্ঠ এবং সর্বাধিক ক্ষমতার অধিকারী।

আর ঠিক তখনই দূর প্রান্তের একটা দরজা খুলে ঘরে ঢুকল এক নিগ্রো রমণী। এক সময়ে সে খুবই লম্বা ছিল। এখন বয়সের ভারে ন্যুজ দেহ, মাথায় যৎসামান্য সাদা চুল। শুকনো ঠোঁট দুটি বেঁকে গিয়ে দাঁত-বিহীন মাড়ি বেরিয়ে পড়েছে। দ্বারপথে লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ছে যেন পক্ষাঘাতে পঙ্গু একটি বিকৃতদর্শন ডাইনি।

বাধা পেয়ে নেমোন শরীরটাকে সোজা করে চারদিকে তাকাল।

বুড়ি ডাইনি মেঝেতে লাঠিটা ঠুকতে লাগল, আর অদ্ভুত ভয়ংকর একটা পুতুলের মত মাথাটা অবিরাম নাড়তে লাগল। ঠোঁট দুটি তখনও বেঁকে আছে। ক্যাক-ক্যাক করে বলল, আয়! আয়! আয়!

নেমোন লাফ দিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চীৎকার করে বলল, ম’দুজে! আমি তোমাকে মেরে ফেলব; টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলব! চলে যাও এখান থেকে।

বুড়ি কিন্তু তবু লাঠি ঠঠকিয়ে বলতে লাগল, আয়! আয়! আয়!

ধীরে ধীরে নেমোন তার দিকে এগিয়ে গেল। যে কোন অদৃশ্য শক্তির দুর্বার টানে সে ঘরটা পার হয়ে গেল; বুড়ি সরে দাঁড়াল; আর রানী দরজা পার হয়ে অন্ধকার বারান্দায় মিশে গেল। একবার টারজনের দিকে তাকিয়ে বুড়িও দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।

নেমোনের সঙ্গে সঙ্গে টারজানও উঠে দাঁড়িয়েছিল। মুহূর্তমাত্র ইতস্তত করে রানী ও বুড়িকে অনুসরণ করে সেও ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শিকল-বাঁধা সিংহটা বজ্রের মত হুংকার দিয়ে লাফিয়ে উঠল।

পরদিন সকালে বাসায় ঢুকেই গেমনন দেখল, বসার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে টারজান প্রাসাদ চত্বরের দিকে তাকিয়ে আছে।

বলল, সকালেই তোমাকে দেখতে পেয়ে খুশি হয়েছি।

 নিশ্চয় বিস্মিতও হয়েছ? জঙ্গলের রাজা বলল।

গেমনন জবাব দিল, তোমাকে আর কোনদিন না দেখতে পেলেও বিস্মিত হতাম না। তারপর রানী কি বলল? আর এবোট, সে নিশ্চয় তোমাকে সেখানে দেখে খুশি হয় নি?

টারজান হাসল, তা হয় কি? তবে রানী তো তাকে সঙ্গে সঙ্গে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল।

আর সারা সময়টা তুমি তার সঙ্গে একা ছিলে? গেমনের কণ্ঠে অবিশ্বাসের সুর।

টারজান তার কথাকে সংশোধন করে দিয়ে বলল, না। বেলথার ও আমি ছিলাম।

 হ্যাঁ, বেলথারের থাকারই কথা। আচ্ছা! তাহলে ম’দুজেকেও দেখেছ? সে নিশ্চয় জামাই-আদর করে নি।

টারজান বলল, না। আসলে সে আমার দিকে তাকায়ই নি। শুধু নেমোনকে বেরিয়ে যেতে বলল। আর নেমোনও বেরিয়ে গেল। কালো বুড়িটার হুকুম সে সহজেই মেনে নিল।

গেমনন বলতে লাগল, মদুজে সম্পর্কে অনেক কথা এখানে চালু আছে। তার মধ্যে একটা হল, নেমোনের ঠাকুর্দার আমল থেকেই ম’দুজে রাজবাড়িতে ‘ক্রীতদাসী হয়ে আছে; তকালীন রাজার ছেলে নেমোনের বাবার চাইতে কয়েক বছরের বড়। প্রবীণরা আজও বলে যে নিগ্রো হলেও তরুণী ম’দুজে দেখতে সুশ্রী ছিল, আর কানা-ঘুষায় এও শোনা যায় যে নেনোম তারই মেয়ে।

নেমোনের জন্মের প্রায় এক বছর আগে তার বাবার রাজত্বের দশম বছরে গর্ভাবস্থায় রহস্যজনক পরিস্থিতিতে রানী মারা যায়। মৃত্যুর ঠিক আগে একটি শিশুপুত্র জন্মলাভ করে। তার নাম আলেকস্টার; সে আজও বেঁচে আছে।

তাহলে সে রাজা হল না কেন? টারজান জানতে চাইল।

রাজ-দরবারে ষড়যন্ত্র ও নরহত্যার সে এক দীর্ঘ রহস্যে-ঢাকা কাহিনী; তার কতটা সত্য আর কতটা অনুমান কে জানে। জীবিত লোকদের মধ্যে মাত্র দু’জন সেটা জানে। হয় তো নেমোনও জানে।

রানীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই ম’দুজের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে লাগল। ম’দুজের অনুগ্রহ পেয়ে টমোসের প্রভাব-প্রতিপত্তিও বাড়তে লাগল। বছরখানেক পরে রাজার মৃত্যু হল। তাকে বিষ খাইয়ে মারা হয়েছে এই অভিযোগে সম্ভ্রান্ত লোকরাও বিদ্রোহ করে বসল; কিন্তু মদুজের প্ররোচনায় টমোস সব দোষ আর একটি ক্রীতদাসীর ঘাড়ে চালিয়ে দিয়ে বিদ্রোহীদের শান্ত করল; সেই ক্রীতদাসীর প্রাণদণ্ড দেয়া হল।

শিশু রাজপুত্রের রিজেন্ট হিসেবে টমোস দশ বছর রাজত্ব চালাল। আর আলোকস্টারকে পাগল সাব্যস্ত করে মন্দিরের মধ্যে বন্দী করে রেখে বারো বছর বয়সে নেমোনকে কাথুনির রানীর পদে অভিষিক্ত করা হল।

ওদিকে এরোট হচ্ছে ম’দুজে ও টমোসের সৃষ্টি, আর তার ফলে এমন একটা গোলমেলে ব্যাপারের সৃষ্টি হয়েছে যেটা যেমন মজাদার তেমনই শোচনীয়। টমোস চায় নেমোনকে বিয়ে করতে, অথচ ম’দুজের তাতে মত নেই। তাই ম’দুজে চায় নেমোন এরোটকে বিয়ে করুক, কিন্তু যেহেতু এরোট সিংহ-পুরুষ নয়, এবং যেহেতু রানীর বিয়ে সর্বোচ্চ সম্প্রদায়ে হাওয়াটাই চিরাচরিত প্রথা, তাই নেমোন রানী হিসেবে সে প্রথা ভাঙতে নারাজ।

ম’দুজে চায় এরোটের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে, কারণ এরোট তার হাতের পুতুল।

একটা কথা স্থির জেনো, ম’দুজে তোমার শত্রু। মনে রেখো, এই কুৎসিত বুড়ির ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে দাঁড়িয়েছে তারই ভাগ্যে জুটেছে নির্মম মৃত্যু। কাজেই ম’দুজে, টমোস ও এবোট সম্পর্কে সাবধান; আর বন্ধু হিসেবে তোমাকে চুপি চুপি বলি, নেমান সম্পর্কেও সাবধান।

তারপর দুই বন্ধু বের হল শহর দেখতে। বড় বড় গাছের ছায়ায় ঢাকা প্রশস্ত পথ। দুই পাশে ম্লান্ত নাগরিকদের সাদা ও সোনালী বাড়ি। এক জায়গায় দেখা গেল ক্রীতদাস কেনা-বেচা চলছে। দোকানে দোকানে নানা রকম পসরাও সাজানো রয়েছে।

বাজারের যেখানে যায় যেখানেই টারজান সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে; দেখামাত্রই সকলে তাকে চিনতে পারে; সে তো সকলের চোখেই স্টেডিয়ামের নায়ক।

জঙ্গলের রাজা এক সময় বলল, এখান থেকে বেরিয়ে যাই চল; এত ভিড় আমার ভাল লাগে না।

বেশ তো, প্রাসাদে ফিরে চল; সেখানে রানীর সিংহগুলো দেখা যাবে।

টারজান বলল, সেই ভাল; ভিড় দেখার চাইতে সিংহ দেখা অনেক ভাল।

একটি বড় সিংহ দক্ষিণ দিক থেকে নিঃশব্দে কাফা-সীমান্ত পার হয়ে গেল। সে সিংহটি এমন নিশ্চিতভাবে পথ চলছে যে তার মনে সন্দেহের লেশমাত্র আছে বলে মনে হয় না।

সে কেন চলেছে? এই বিঘ্নসংকুল দীর্ঘ পথে কিসের প্রেরণায় সে চলেছে? চলেছেই বা কোথায়? কি বা কাকে সে খুঁজছে? একমাত্র সে-পশুরাজ সিংহ নুমাই তা জানে।

সে রাতে গেমনন ও টারজান তাদের বাসাতেই রাতের খাওয়া শেষ করল। ভালতোর জানাল, সে ঘুমতে যাচ্ছে, সকালের আগে যেন ঘুম ভাঙানো না হয়।

ভোর হতেই টারজান ও ভালতোর ঘুম থেকে উঠে পড়ল, কারণ একটু সকাল-সকাল ভালতোরকে এথনি-যাত্রা করতে হবে। পাশের ঘরে তাদের প্রাতরাশ তৈরি হচ্ছে।

গজদন্তের গুল্ফ-বন্ধনীর সঙ্গে স্যান্ডেলের ফিতে বাঁধতে বাঁধতে ভালতোর বলল, আবার আমাদের দেখা হল, আবারও এল বিদায়ের পালা। আহা বন্ধু, তুমি যদি আমার সঙ্গী হতে তো কী ভালই হত।

টারজান তাকে বুঝিয়ে বলল, দেখ, গেমননের হেফাজতে থাকাকালে আমি যদি কাথুনি ছেড়ে চলে। যাই তাহলে গেমননের জীবন বিপন্ন হবে; তাই আমি এখন যেতে পারছি না। কিন্তু তুমি নিশ্চিত জেন, এথনিতে তোমার সঙ্গে আমি দেখা করবই।

ভালতোর বলতে লাগল, বন্যার ফলে আমরা যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম তখন আশাই করতে পারি। নি যে আর কোন দিন জীবিত অবস্থায় তোমাকে দেখতে পাব। সিংহের মুখে দাঁড়িয়ে তোমাকে চিনতে পেরেও নিজের চোখকে পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারি নি। টারজান, চার-চারবার তুমি আমার জীবন রক্ষা করেছ; আমার পিতৃগৃহে সাদর অভ্যর্থনা তোমার জন্য সর্বদাই অপেক্ষা করে থাকবে।

টারজান ও ভালতোরের খাওয়া শেষ হতেই একজন এসে খবর দিল, ভাতোরের পথ-প্রদর্শক যাত্রার জন্য তৈরি; এক মুহূর্ত পরে সংক্ষেপে বিদায় পর্ব শেষ করে ভালতোরও স্বদেশের পথে যাত্রা করল।

সেদিন সন্ধ্যায় টারজান সবে গেমনন ও তার বাবা ও মায়ের সঙ্গে রাতের খাবার খেতে বসেছে এমন সময় একটি ক্রীতদাস এসে জানাল, ডোরিয়ার বাবা টুডোস-এর বাড়ি থেকে একজন বার্তাবহ এসেছে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিয়ে।

তাকে এখানে পাঠিয়ে দাও, গেমনন বলল।

একটু পরেই ঘরে ঢুকল একটি দীর্ঘকায় নিগ্রো।

 গেমনন সাদরে বলল, আরে গেম্বা! কি খবর এনেছ বল?

ক্রীতদাস বলল, খবরটি গুরুতর এবং গোপনীয়।

এদের সামনেই সব কথা বলতে পার গেম্বা।

আমার মালিক টুডোস-এর কন্যা ডোরিয়া আমাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে, এরোট আজ কৌশল করে তার পিতৃগৃহে ঢুকে তার সঙ্গে কথা বলেছে। কি কথা বলেছে সেটা কিছু নয়, কিন্তু সে যে ডোরিয়াকে দেখেছে সেটাই গুরুতর।

গেমননের বাবা বলে উঠল, ব্যাটা শেয়াল!

গেমননের মুখে ছায়া পড়ল। আর কোন কথা আছে?

না মালিক; এই সব, গেম্বা জবাব দিল।

গেমনন পকেটের থলি থেকে একটা স্বর্ণমুদ্রা বের করে গেম্বাকে দিল। তোমার মনিব-কন্যার কাছে ফিরে গিয়ে বল, কাল তাদের বাড়িতে গিয়ে আমি তার বাবার সঙ্গে কথা বলব।

ক্রীতদাস চলে গেলে গেমনন অহায়ভাবে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি করতে পারি? টুড়োসই বা কি করবে? কে-ই বা কি করতে পারে? আমরা অসহায়।

টারজান বলল, হয়তো আমি কিছু করতে পারি। বর্তমানে আমি তোমাদের রানীর বিশ্বাসভাজনদের একজন; রানীর সঙ্গে আমি কথা বলল; দরকার হলে তোমাদের পক্ষে ওকালতি করব।

গেমননের চোখে নতুন আশার আলো দেখা দিল। তা যদি কর! রানী তোমার কথা শুনবে। আমার বিশ্বাস, একমাত্র তুমিই ডোরিয়াকে বাঁচাতে পার। কিন্তু মনে রেখ, কোনক্রমেই রানী যেন তাকে দেখতে না পায়; তাহলে আর রক্ষা নেই- রানী হয় তাকে বিকলাঙ্গ করে দেবে, নয় তো মেরে ফেলবে।

পরদিন সকালে রাজপ্রাসাদ থেকেই দূত এসে জানাল, রানীর হুকুম দুপুরে টারজানকে তার সঙ্গে দেখা করতে হবে; সেই সঙ্গে গেমননের প্রতি তার নির্দেশ, সে যেন শক্তিশালী রক্ষী নিয়ে টারজনের অনুগমন করে, কারণ রানীর আশংকা টারজনের শত্রুরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

গেমননের বাবা বলল, নেমোনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবার মত সাহস যাদের আছে তারা নিশ্চয় খুব শক্তিমান শত্রু।

গেমনন বলল, গোটা কাথুনিতে সে সাহস শুধু একজনই রাখে।

বৃদ্ধ মাথা নাড়ল। বলল, বুড়ি শয়তানী! আহা! টু যদি তাকে ধ্বংস করে ফেলত! একটি ক্রীতদাসী বুড়ি শাসন করবে কাথুনি রাজ্য-সেটা বড়ই লজ্জার কথা!

কথা বলল টারজান, নেমোনকে দেখে আমারু কিন্তু মনে হয়েছে যে সেও ঐ বুড়ির মৃত্যু চায়।

গেমননের বাবা বলল, ঠিক কথা, কিন্তু সে কাজ করার সাহস তার নেই। ঐ বুড়ি ডাইনি আর টমোস মিলে রানীর মাথার উপর এমন একটা ভয়ের খড়গ ঝুলিয়ে রেখেছ যে তাদের কাউকে ধ্বংস করার সাহস তার হবে না। তবু আমি স্থির জানি সে ওদের দুজনকেই ঘৃণা করে, আর সে যাকে ঘৃণা করে তাকে কদাপি বেঁচে থাকতে দেয় না।

গেমনন বলল, শোনা যায় যে তারা দুজনই রানীর জন্মের গোপন কথাটি জানে, আর সে কথা জনসমক্ষে প্রচার হলে রানীর সর্বনাশ অনিবার্য। কিন্তু সে কথা এখান থাক; তুমি নেমোনের সঙ্গে কথা বলার আগে আমি টুডোস-এর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি না।

টারজান ও গেমননের শহরে ফিরতে দুপুর হয়ে গেল; তখনি টারজানকে নিয়ে নেমোনের কাছে যেতে হবে। একদল রক্ষী-সৈনিক নিয়ে তারা প্রাসাদে পৌঁছামাত্রই রানীর কাছ থেকে শুধুমাত্র টারজনের ডাক পড়ল।

কোথায় ছিলে? রানী প্রশ্ন করল।

 টারজান বিস্মিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।

 কাল রাতে কোথায় ছিলে?

গেমননের বাড়িতে, টারজান জবাব দিল!

ডোরিয়ার সঙ্গে কাটিয়েছ? নেমোনের গলায় অভিযোগ।

 টারজান বলল, না সে আগের রাতে। টুডোস-এর বাড়িতে গিয়েছিলে কেন? এবার রানীর গলায় কোন অভিযোগ নেই।

কি জান, পাছে আমি পালিয়ে যাই বা আমার কোন বিপদ ঘটে এই আশংকায় গেমনন আমাকে একলা ছেড়ে দিতে সাহস পায় না; তাই সে যেখানেই যায় আমাকে সঙ্গে নিয়ে যায়।

এবার রানী শান্ত গলায় বলল, আমাকে বলা হয়েছিল যে তুমি ডোরিয়াকে ভালবাস, কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করি নি। সে কি খুব সুন্দরী?

টারজান হেসে বলল, হয় তো গেমনন তাই মনে করে।

 রানী তবু জানতে চাইল, তুমি কি মনে কর?

 কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে টারজান বলল, তা দেখতে মন্দ নয়।

 নেমোনের মত সুন্দরী কি?

 কোথায় সূর্য, আর কোথায় দূরতম নক্ষত্র!

এ জবাবে নেমোন খুশি হল। টারজনের আরও কাছে গিয়ে মোহিনী কটাক্ষে বলল, তুমি কি আমাকে সুন্দরী ভাব?

তুমি খুব সুন্দরী। টারজান সত্য কথাই বলল।

টারজনের গা ঘেঁষে বসে মসৃণ, গরম হাতে তার গলাটা জড়িয়ে ধরে নেমোন ফিসফিসিয়ে বলল, আমাকে ভালবাস টারজান?

ঘরের দূর কোণে শিকলের ঝন্‌ঝন্‌ শব্দ হল; হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বেলথার ভয়ংকরভাবে গর্জে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে নেমোন টারজনের কাছ থেকে সরে গেল; তার শরীরের ভিতরে একটা শিহরণ বয়ে গেল;

মুখে দেখা দিল কিছুটা আতংক, কিছুটা ক্রোধ।

ঈষৎ কেঁপে উঠে বিরক্ত গলায় রানী বলল, বেথারের মনে ঈর্ষা জেগেছ। এই পশুটার জীবনের সঙ্গে আমার জীবনের কোথায় যেন একটা আশ্চর্য, বন্ধন আছে। সেটা যে কি আমি জানি না। যদি জানতে পারতাম! তার চোখে ফুটে উঠল উন্মাদের ঝিলিক। এক এক সময় মনে হয় টু হয় তো ওকেই আমার স্বামী করে পাঠিয়েছে; কখনও মনে হয় অন্যরূপে ও যেন আমারই প্রকাশ। তবে একটা কথা জানি; যেদিন বেলথার মরবে, সেদিন আমারও মৃত্যু হবে।

বিষণ্ণ চোখ তুলে সে টারজনের দিকে তাকাল; বলল, বন্ধু আমার, চল, দু’জনে মিলে মন্দিরে যাই; টু হয়তো নেমোনের অন্তরের সব প্রশ্নের জবাব দেবে।

সিলিং থেকে ঝোলানো ব্রোঞ্জের একটা থালায় আঘাত করতেই তার শব্দ সারা ঘরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। একটা দরজা খুলে জনৈক সম্ভ্রান্ত নাগরিক দ্বারপথেই আভূমি নত হল।

রানী হুকুম দিল, রক্ষীদের খবর দাও। আমরা মন্দিরে যাব টুকে দর্শন করতে।

শোভাযাত্রা এগিয়ে চলেছে মন্দিরের দিকে বর্শাগ্রে পতাকা উড়িয়ে মার্চ করে চলেছে সৈনিক দল, ঝলমলে পরিচ্ছদে শোভিত হয়ে চলেছে নাগরিকগণ, সিংহবাহিত সোনার রথে চলেছে রাণী। রথের এক পাশে হাঁটছে টমোস, অন্য পাশে এরোটের জায়গায় হেঁটে চলেছে টারজান।

মন্দিরের কাছে পৌঁছে সে দেখতে পেল, শিকলে বাঁধা একটি ক্রীতদাসী মেয়েকে নিয়ে একদল পুরোহিত এগিয়ে আসছে। মেয়েটিকে নেমোনের রথের কাছে এনে পুরোহিতরা দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু মন্ত্রতন্ত্র উচ্চারণ করার পরে মেয়েটিকে রথের পিছনে বেঁধে দিল। আবার শোভাযাত্রা শুরু হল। পুরোহিতরা মেয়েটির পিছন পিছন হাঁটতে লাগল।

মন্দিরের সামনে এসে নেমোন রথ থেকে নেমে প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে সুসজ্জিত দ্বারপথে উঠে গেল। তার পিছনে পুরোহিতরা; সেই সঙ্গে ভীত, বিস্ফারিত নেত্র, ক্রন্দনরতা মেয়েটিও উঠল। তারপর উঠে এল পরিষদবর্গ। রক্ষী সৈনিকদল বাইরেই অপেক্ষা করতে লাগল।

মন্দিরটি তিন-তলা; মাঝখানে একটা সুউচ্চ গম্বুজ। গম্বুজের ভিতরটা সোনায় মোড়া; স্তম্ভগুলো ও সোনার; দেওয়ালে বিচিত্রবর্ণের কারুকার্য। প্রধান ফটকের ঠিক বিপরীত দিকে উঁচু বেদীর উপর একটা বড় খাঁচা, আর খাঁচার দুই পাশে দুটো নিরেট সোনার সিংহ-মূর্তি দণ্ডায়মান। বেদীর সামনে পাথরের রেলিং দিয়ে ঘেরা একটা সিংহাসন এবং খাঁচার মুখোমুখি একসারি পাথরের বেঞ্চি।

নেমোন এগিয়ে এসে সিংহাসনে বসল; সম্ভ্রান্ত নাগরিকরা বসল বেঞ্চিতে। টারজনের দিকে কেউ নজরই দিল না; সে রয়ে গেল রেলিংয়ের বাইরে।

টারজান দেখল, পুরোহিতরা মেয়েটিকে নিয়ে বেদীতে উঠল আর তাদের পিছনে খাঁচার মধ্যে উঠে এল একটি বৃদ্ধ ও রুগ্ন সিংহ। প্রধান পুরোহিত সুরেলা গলায় অর্থহীন মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগল; অন্য পুরোহিতরা মাঝে মাঝে তার সঙ্গে গলা মেলাল। নেমোন সাগ্রহে সামনে ঝুঁকে বসল; তার দুই চোখ বৃদ্ধ সিংহের উপর স্থিরনিবদ্ধ।

সহসা মন্ত্র থেমে গেল। রানী উঠে দাঁড়াল। রুগ্ন ও বৃদ্ধ সিংহটার দিকে দুই হাত বাড়িয়ে বলতে লাগল, হে টু,! নেমিেন তোমাকে অভিবাদন জানাচ্ছে; তোমার জন্য সে নৈবেদ্যও এনেছে। নেমোনের সে নৈবেদ্য তুমি গ্রহণ কর, তাকে আশীর্বাদ কর। তার বন্ধুদের তুমি রক্ষা কর, আর ধ্বংস কর তার শত্রুদের। হে টুস, তাকে দাও সেই বস্তু যা তার অন্তরের প্রধান কামনা-তাকে ভালবাসা দাও, পৃথিবীর সেই একটি মাত্র মানুষের ভালবাসা তাকে দাও যাকে সে ভালবেসেছে। খাঁচার ফাঁক দিয়ে সিংহটা তার। দিকে তাকাল।

নেমোন অলস ভঙ্গীতে সোনার সিংহাসনে গিয়ে বসল। খাঁচার অপর পাশে দরজা দিয়ে পুরোহিতরা মেয়েটিকে বের করে নিয়ে গেল।

নিঃশব্দে কাঠ হয়ে সিংহাসনে বসে নেমোন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে খাঁচার ভিতরের সিংহটার দিকে। পুরোহিতরা এবং নাগরিকদের অনেকেই এক ঘেয়ে সুরে মন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছে। টারজান পরিষ্কার বুঝতে পারছে যে তারা সিংহের কাছেই প্রার্থনা করছে, কারণ সকলেরই দৃষ্টি সেই বৃদ্ধ পশুরাজের দিকে। কাথুনিতে প্রথম আসার পরে যে সব প্রশ্ন তাকে বিচলিত করেছিল সে সব কিছুর জবাব সে এতক্ষণে খুঁজে পেয়েছে। ফোবেগের বিচিত্র সব শপথ, তার দেবতার লেজে পা দেবার কথা-সবই সে। বুঝতে পারছে।

সহসা একটা উজ্জ্বল আলোর রেখা উপর থেকে খাঁচার মধ্যে নেমে এসে জানোয়ার-দেবতাটিকে সোনালী আলোয় ভাসিয়ে দিল। সিংহটা এতক্ষণ অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল; এবার সে থেমে উপরের দিকে তাকাল, তার দুটি চোয়াল ফাঁক হয়ে গেল, ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে লালা গড়াতে লাগল। সমবেত দর্শকবৃন্দ এক সুরে মন্ত্র উচ্চারণ করল। কি ঘটতে যাচ্ছে সেটা আংশিক আঁচ করে টারজান সামনের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু তার মনে যাই থাকুক, মুহূর্তের মধ্যে যে শোচনীয় ঘটনা ঘটে গেল তাকে রোধ করার চেষ্টায় সে তখন বড় বেশি দেরী করে ফেলেছে। সে দাঁড়ানোমাত্রই ক্রীতদাসী মেয়েটির দেহ উপর থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে অপেক্ষামান সিংহের থাবার মধ্যে বন্দী হল। নরমাংসাশীর ভয়ঙ্কর গর্জনের সঙ্গে মিশে গেল একটি মাত্র হৃদয়বিদারক আর্তনাদ। পরমুহূর্তেই সে আর্তনাদ বাতাসে মিলিয়ে গেল। মেয়েটি মারা গেল।

বিরক্তিতে ক্ষোভে টারজান মন্দির থেকে বেরিয়ে তাজা বাতাস ও সূর্যের আলোয় এসে দাঁড়াল, আর তখনই ফটক থেকে জনৈক সৈনিক অস্ফুট স্বরে তার নাম ধরে ডাকল। সেই দিকে তাকিয়ে সে ফোবেগকে দেখতে পেল।

ঠোঁট নড়ে-কি নড়ে না এমনি ভাবে নিচু গলায় ফোবেগ বলল, তোমার সঙ্গে কথা আছে! সূর্যাস্তের দু’ঘণ্টা পরে মন্দিরের পিছন দিকে এসো। এখন কোন জবাব দিও না; যদি আমার কথা শুনে থাক আর আসতে রাজী থাক তাহলে শুধু ডানদিকে মাথাটা নাড়াও।

টারজান সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়তেই রাজকীয় শোভাযাত্রা সারিবদ্ধভাবে মন্দির থেকে বের হতে লাগল; আর সে সুযোগ মত নেমোনের ঠিক পিছনে তার মধ্যে ঢুকে পড়ল। রানী তখন শান্ত, আত্মস্থ। প্রাসাদে পৌঁছে সে টারজানসহ সকলকেই ছুটি দিল।

ওদিকে পিতৃগৃহে গেমনন অস্থিরভাবে মেঝেতে পায়চারি করছে। একটা পাথরের বেঞ্চিতে টারজান অর্ধশায়িত অবস্থায় বসে আছে। বন্ধু যে খুবই চিন্তিত তা সে বুঝতে পারছে। তবু গেমননের মনকে বিষয়ান্তরে নিয়ে যাবার জন্য মন্দিরের আজকের ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলল, মন্দিরটা চমৎকার, কিন্তু আজ সেখানে যে নিষ্ঠুর অনুষ্ঠান হতে দেখলাম সেটা ওখানে মানায় না।

গেমনন বলল, টু-এর কাছে নৈবেদ্য দেয়া কিন্তু অন্যায় কাজ নয়; কিন্তু একটা সত্যিকারের অন্যায়কে লুকিয়ে রাখা হয়েছে ঐ মন্দিরে। মন্দিরই কোনখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে নেমোনের ভাই আলেক্সটারকে; সে সেখানে পচে মরছে, আর ব্যাভিচারী টমোস ও নিষ্ঠুর ম’দুজে কাথুনিকে শাসন করছে। উন্মাদিনী নেমোনের বকলমে।

অনেকেই এ ব্যবস্থার পরিবর্তন চায়, আলেক্সটারকে সিংহাসনে বসাতে চায় কিন্তু ভয়ংকর ত্রিমূর্তির ক্রোধ-বহ্নিকে তারা ভয় করে। তাই দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুই করা হচ্ছে না।

খেতে খেতেই টারজান ফোবেগের সঙ্গে দেখা করার মতলব আঁটতে লাগল। যেমন করেই হোক তাকে একাই যেতে হবে, আর যেতে হবে গেমননকে না জানিয়ে গোপনে।

খাবার পরেই ক্লান্তির অজুহাতে নিজের ঘরে চলে গেল টারজান। সামনেই বাগান। সেখানে বড় বড় গাছেরও অভাব নেই। একটু পরেই দেখা গেল জঙ্গলের রাজা ডাল থেকে ডালে ঝুলতে ঝুলতে টুস-এর স্বর্ণ মন্দিরের দিকে এগিয়ে চলেছে।

মন্দিরের পিছনকার একটা গাছে পৌঁছেই সে দেখতে পেল, দীর্ঘকায় ফোবেগ একটা গাছের ছায়ায় অপেক্ষা করছে। ঠিক তার সম্মুখে নিঃশব্দে গাছ থেকে নেমে সে ফোবেগকে অবাক করে দিল।

ফোবেগ বলল, তুমি এসে গেছ ভালই হয়েছে। অনেক কথা বলার আছে। ইতোমধ্যে আমি আরও অনেক কিছু জেনেছি।

টারজান বলল, আমি কান পেতে আছি।

ফোবেগ বলতে আরম্ভ করল, রানীর দাসীদের একজন আড়াল থেকে নেমেমান ও টমোসের কথা বার্তা শুনে ফেলেছে। টমোস অভিযোগ করেছে, তুমি, গেমনন ও টুভোস নাকি রানীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছ। টমোস আরও বলেছে যে ডোরিয়া খুব সুন্দরী, আর তুমি তার প্রেমে পড়েছ।

তাহলে এবার আমি ফিরে যাব গেমনের কাছে; তাকে সতর্ক করে দেব। হয় তো নেমোনকে নরম করতে বা বুদ্ধিতে হারিয়ে দিতে কোন পথে আমরা বের করতে পারব।

ও দুটোই সমান শক্ত; ফোবেগ মন্তব্য করল; তবু আপাতত জানাই বিদায় ও শুভ-কামনা।

সৈনিকটির মাথার উপরকার একটা ডাল ধরে ঝুলে পড়ে টারজান রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

বিস্ময়ে মাথা নাড়তে নাড়তে ফোবেগ মন্দিরে তার বাসার দিকে ফিরে গেল।

অনেক রাতে ফোবেগ এল টারজনের সঙ্গে দেখা করতে।

 টারজান জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার? তুমি কি দুঃসংবাদ এনেছ?

খুব খারাপ খবর, ফোবেগ জবাব দিল। গেমনন, টুডোস ও তাদের বেশ কিছু বন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। প্রাসাদের অন্ধকূপে আটক করা হয়েছে। ডোরিয়াকে ধরে নিয়ে মন্দিরে বন্দী করা হয়েছে। তোমাকেও বাইরে দেখতে পাব আশা করি নি। যাইহোক, যদি কাথুনি থেকে পালাতে পার তো এই মুহূর্তে পালাও। যে কোন মুহূর্তে রানীর মত পাল্টে যেতে পারে; সে এখন রেগে কাঁই হয়ে আছে।

টারজান বলল, ধন্যবাদ ফোবেগ। কিন্তু যাবার আগে বলে যাও ডোরিয়াকে কোথায় বন্দী করে রাখা হয়েছে।

আজ সন্ধ্যায় যে বাড়িটার দরজায় আমি দাঁড়িয়েছিলাম তার পিছন দিকে মন্দিরের তিন তলায়।

টারজান ফোবেগের সঙ্গে ফটক পর্যন্ত গিয়ে পথে নামল। কোথায় যাচ্ছ? ফোবেগ জানতে চাইল। রাজ প্রাসাদে।

ফোবেগ বাধা দিয়ে বলল, তুমিও পাগল হয়েছ দেখছি। কিন্তু ততক্ষণে টারজান পথে নেমে দ্রুত পদক্ষেপে প্রাসাদের দিকে এগিয়ে চলেছে।

বেশ রাত হয়েছে; কিন্তু প্রাসাদ-রক্ষীরা এতদিন টারজানকে ভালভাবেই চিনে নিয়েছে; তাই কেউ তাকে বাধা দিল না। দরজা খুলে গেলে টারজান অতি-পরিচিত গজদন্ত-কক্ষে পা বাড়াল।

ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে রানী। চুল এলোমেলো, মুখ ঈষৎ রক্তিম। বোঝা যাচ্ছে, ঘুম থেকে সদ্য উঠে এসেছে। ক্রীতদাসীকে দরজাটা বন্ধ করে ঘর থেকে চলে যেতে বলল। তারপর নরম কোচে বসে টারজানকে ইশারায় পাশে বসতে বলল। তুমি আসায় বড় খুশি হয়েছি। ঘুমতে পরছিলাম না; কেবলি তোমার কথা মনে হচ্ছিল। এবার বল তো তুমি কেন এসেছ? তুমিও কি আমার কথাই ভাবছিলে?

টারজান জবাব দিল, তোমার কথাই ভাবছিলাম, নেমোন তুমি আমাকে সাহায্য করবে?

রানী নরম গলায় বলল, শুধু তোমার চাওয়ার অপেক্ষা। তোমাকে অদেয় নেমোনের, কিছুই নেই।

দুই বাহু মেলে দিয়ে সে টারজনের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, টারজান! প্রায় চাপা কান্নার সুর তার গলায়। আর তখনই ঘরের দূর প্রান্তের সেই মারাত্মক দরজাটা খুলে গেল; পাথরের মেঝেতে ধাতুনির্মিত লাঠির খট খট শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে দু’জনই সোজা হয়ে বসে তাকাল ম’দুজের ক্রুব্ধ মুখের দিকে।

বিকৃতদর্শন বুড়ি কর্কশ কণ্ঠে চীৎকার করে বলল! বোকার ডিম কোথাকার! লোকটাকে বাইরে পাঠিয়ে দে! নইলে চোখের সামনেই তার মৃত্যু তোকে দেখতে হবে।

নেমোন লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। বুড়ি তখন তীব্র রোষে থর থর করে কাঁপছে। ঠাণ্ডা গলায় নেমোন বলল, তুমি অনেক দূর এগিয়েছ ম’দুজে। তোমার ঘরে চয়ে যাও; মনে রেখো যে আমিই রাণী।

বীভৎস বুড়ি ধারালো গলায় ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল, রানী! তোর সব পরিচয় ওকে বলে দেব।

নেমোন দ্রুত পায়ে বুড়ির দিকে এগিয়ে গেল। যাবার সময় নিচু টুলটার উপর ঝুঁকে পড়ে সেখান থেকে কি যেন তুলে নিল। সহসা বুড়ি আর্তনাদ করে কুঁকড়ে সরে গেল কিন্তু ঘর থেকে পালিয়ে যাবার আগেই নেমোন ঝাঁপিয়ে পড়ে তার চুলের মুঠি চেপে ধরল। হাতের লাঠি তুলে মদুজে রানীকে আঘাত করল। তাতে রানীর ক্রোধের আগুন যেন ঘৃতাহুতি পড়ল।

চীৎকার করে বলল, চিরকাল তুমি আমার জীবনটা নষ্ট করে এসেছ-তুমি আর পাপাত্মা টমোস। সব সুখ থেকে তোমরা আমাকে বঞ্চিত করেছ, আর তার জন্য এই নাও! মুখের কথা শেষ হতে না হতেই ছুরির সুতীক্ষ্ণ ফলাটাকে সে বসিয়ে দিল আর্তকণ্ঠ বুড়ির লাল বক্ষে; আরও নাও! এই নাও! এই নাও! প্রতি বারেই ছুরির ফলাটা গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করে রানী নেমোনের মুখের কথা আর বুকের ব্যথার বিষকে তীব্রতর করে তুলল।

ধীরে ধীরে মদুজের আর্তনাদ থেমে গেল; সে,মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।

নেমোন আবার টারজনের মুখোমুখি দাঁড়াল। বলল, হ্যাঁ, তুমি সাহায্যের কথা কি বলছিলে, সেটা আর একবার বল; নেমোন আজ মুক্ত হস্ত।

টারজান বলল, তোমার দরবারের একজন সম্ভ্রান্ত নাগরিক আমার প্রতি খুবই সদয় ব্যবহার করেছে। আজ সে বিপদগ্রস্ত; তুমি তাকে বাঁচাও। এটাই আমার প্রার্থনা।

নেমোনের ভুরু কুঞ্চিত হল। কে সে?

গেমনন। টুডোস, টুডোসের কন্যা ও কয়েকজন বন্ধুসহ সে গ্রেফতার হয়েছে। এটা আমার সর্বনাশ করার ষড়যন্ত্র মাত্র।

হঠাৎ তীব্র ক্রোধে জ্বলে উঠে রানী চীৎকার করে বলল, তোমার এত সাহস যে বিশ্বাসঘাতকদের হয়ে ওকালতি করতে এসেছ! কিন্তু এ সবের কারণ আমি জানি; তুমি ডোরিয়াকে ভালবাস।

তাকে আমি ভালবাসি না; তাকে ভালবাসে গেমনন। তুমি তাদের সুখী হতে দাও নেমোন।

নেমোন সরে গেল; কোচে বসে দুই হাতে মুখ ঢাকল; চাপা কান্নায় তার দুই কাঁধ কাঁপতে লাগল; তা দেখে টারজনের দয়া হল; তাকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে গেল। কিন্তু কিছু বলার অবকাশই পেল না; নেমোন হঠাৎ তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল; ভেজা চোখ দুটি চকচক্ করছে। চীৎকার করে বলে উঠল, ডোরিয়া মেয়েটা মরবে! কাল জারাটর তাকে গ্রহণ করবে!

কখন তার মৃত্যু ঘটবে? টারজান প্রশ্ন করল।

আজ রাতে চামড়ায় ভরে সেলাই করে কাল তাকে নিয়ে যাওয়া হবে জারাটরের কাছে। তুমিও আমাদের সঙ্গে যাবে, বুঝলে।

টারজান মাথা নাড়ল। আবার প্রশ্ন করল, আর আমার অন্য বন্ধুরা? তারা বেঁচে যাবে তো?

নেমোন উত্তর দিল, কাল রাতে তুমি আমার কাছে আসবে। তখন দেখব, নেমোনের প্রতি তুমি কি ব্যবহার কর; তখনই নেমোনও স্থির করবে, তোমার বন্ধুদের প্রতি কি রকম ব্যবহার সে করবে।

টুডোস-কন্যা ডোরিয়া হাত-পা বাঁধা অবস্থায় টুস-এর মন্দিরের তিনতলার একটা ঘরে চামড়ার স্কুপের উপর শুয়ে আছে।

এক সময় দরজা খুলে গেল। মশালের আলোয় ঘর আলোকিত হল। ঘরে ঢুকল এরোট। দরজা বন্ধ করে দিল। দেওয়ালের গর্তে মশালটা বসিয়ে রাখল।

বলল, আহা, ডোরিয়া! কোন্ দুর্ভাগ্য তোমাকে এখানে এনে হাজির করেছে?

ডোরিয়া বলল, এ প্রশ্নের জবাব তো মহামান্য এরোটই আমার চাইতে ভাল জানে।

হ্যাঁ, আমি জানি। আমিই তোমাকে এখানে আনিয়েছি; তোমার বাবাকে বন্দী করেছি; আর গেমননকেও সেখানে পাঠিয়েছি।

গেমনন বন্দী! মেয়েটি আর্তনাদ করে উঠল। ধীরে ধীরে নিজেকে সংযত করে শুধাল, আমাকে নিয়ে কি করবে?

এরোট জবাব দিল, নেমোনের হুকুমে তোমাকে জারাটরের কাছে সমর্পণ করা হবে। তরপর হেসে বলল, কালই তোমার মৃত্যু হবে।

উত্তেজনায় হাঁপাতে হাঁপাতে এরোট ডোরিয়ার পায়ের বেড়ি খুলে দিল। তাকে বলল, তুমি নেমোনের চাইতেও সুন্দরী।

জানালার দিক থেকে একটা অস্পষ্ট গর্জন ভেসে এল। ডোরিয়া সেদিকে তাকাতেই এরোটের মুখ ছাইয়ের মত সাদা হয়ে গেল। তার ভীরু বুক ভয়ে উথাল-পাথাল। এক লাফে সে দরজার দিকে ছুটে গেল।

যে শোভাযাত্রা মৃত্যুপথযাত্রী ডোরিয়াকে নিয়ে জারাটরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে, খুবই সকালেই সেটা যাত্রার জন্য প্রস্তুত হল। ওনৃথার উপত্যকার শেষ প্রান্তে অবস্থিত পর্বতমালায় জারাটরের অবস্থান; কাথুনি শহর থেকে ষোল মাইল দূরে। জারাটরের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আবার শহরে ফিরে আসতে বেশ রাত হয়ে যাবে। তাই শত শত মশালধারী ক্রীতদাস যাবে শোভাযাত্রার সঙ্গে।

নেমোন টারজানকে শুধাল, জারাটরকে কখনও দেখেছ?

না।

জারার একটি পবিত্র পর্বত; কাথুনির রাজা ও রানীদের শত্রুদের জন্য টুস্ সেটা সৃষ্টি করেছে; সারা পৃথিবীতে এরকম দ্বিতীয়টি নেই।

টারজান বলল, সেটা দেখলে আমার ভালই লাগবে।

দুপুরে জলপানের জন্য যাত্রার বিরতি হল। আধঘণ্টা পরেই আবার শুরু হল যাত্রা। অচিরেই তারা পর্বতমালার ভিতরে ঢুকে পাকানো পথে পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগল।

ক্রমে গন্ধকের ধোয়া এসে নাকে লাগল। একটু পরেই আগ্নেয়গিরিতে চড়ে পুরো দলটাই প্রকাণ্ড বড় এক গিরি-বিবরের প্রান্তে পৌঁছে গেল। অনেক নিচে গলিত পাথর টগবগ করে ফুটছে; আগুনের শিখা ছিটকে উঠছে; ছিটকে বের হচ্ছে বাম্প ও হলুদ ধূমের কুণ্ডলী। সে দৃশ্য যেমন আকর্ষক তেমনই ভয়াল, ভয়ংকর। কাথুনি সৃষ্টির আগে থেকেই সব ছোট ছোট শিখরের ঊর্ধ্বে একক মহত্ত্বে দাঁড়িয়ে আছে জারাটর। দুই হাত এক করে নত মস্তকে টারজান অপলক নয়নে তাকিয়ে রইল সেই বিক্ষুব্ধ নরকের দিকে।

দু’জন সন্ন্যাসী ডোরিয়ার চামড়ার ভিতরে সেলাই করা দেহটাকে রথ থেকে তুলে নিয়ে আগ্নেয়গিরির মুখ-বিবরের প্রান্তে রানীর পায়ের কাছে রাখল। তারপর ডজনখানেক পুরোহিত তাকে ঘিরে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগল।

নেমোন যাতে টুডোস ও গেমননের যন্ত্রণাকে পুরোপুরি উপভোগ করতে পারে সে জন্য তাদের দু’জনকেই ঘটনাস্থলের আরও কাছে নিয়ে আসা হল; কারণ এ অনুষ্ঠান তো শুধু মাত্র তাদের শাস্তি নয়, রানীর উপভোগের বিষয়ও বটে।

পুরোহিত দু’জন ডোরিয়ার দেহটাকে তুলে ফুটন্ত আগ্নেয়গিরির মুখে ছুঁড়ে ফেলতে উদ্যত হতেই সে চীৎকার করে বলে উঠল, থাম! বিশ্বাসঘাতক টুডোসের কন্যার অপরূপ রূপ-লাবণ্য আমরা দেখতে চাই; তার বাবা ও প্রেমিকও দুই চোখ ভরে তাকে দেখুক; আর তাদের দেখে সকলে বুঝুক যে নেমোনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার ফল কী ভয়ংকর। টারজান–৩০ক

একজন পুরোহিত ছুরি হাতে নিয়ে থলের সেলাইটা কেটে ফেলল; সিংহের বাদামী চামড়ার নিচে নিশ্চল দেহটার রূপরেখার উপর টুডোস ও গেমননের দৃষ্টি স্থিরনিবদ্ধ। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল তাদের কপালে; কঠিন হয়ে উঠল তাদের চোয়াল ও মুষ্টি।

পুরোহিতরা থলির চামড়াটাকে একদিক থেকে গুটিয়ে তুলে নিতেই মৃতদেহটা গড়িয়ে মাটিতে পড়ল সকলের চোখের সামনে। শোনা গেল একান্ত বিস্ময়ের একটা অব্যক্ত ধ্বনি। তীব্র রোষে চীৎকার করে উঠল নেমোন। দেহটা এরোটের মৃতদেহ।

এ সবের অর্থ কি? রানীর কণ্ঠস্বর তার কোষবদ্ধ ইস্পাতের মতই শীতল।

বিরক্ত মুখভঙ্গী করে নেমোন হুকুম দিল, এরোটের দেহটাকে জারাটরে মুখে ফেলে দেয়া হোক; আর অগ্নিগর্ভ মুখ-বিবর যখন দেহটাকে গিলে ফেলল তখন সে আবার হুকুম দিল, এই মুহূর্তে ফিরে চল কাথুনিতে।

সমবেত সকলকে সঙ্গে নিয়ে রানীর রথ পাহাড়ের পথে ঘুরে ঘুরে নামতে লাগল। রানী একেবারে নীরব। মাঝে মাঝে শুধু তাকিয়ে দেখছে রথের পাশের চলমান দানব-মূর্তিটাকে।

একঘেয়ে ক্লান্ত কাথুনি-প্রত্যাবর্তন এক সময় শেষ হল। স্বর্ণ-সেতু পার হয়ে সকলে শহরে ঢুকল। রানী হুকুম দিল, ডোরিয়াকে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হোক।

টুডোস ও গেমননকে পাঠান হলো কারাকক্ষে। টারজনের প্রতি হুকুম হল, প্রাসাদে গিয়ে রানীর সঙ্গে খানা খেতে হবে। টমোসকে বলা হল ডোরিয়াকে খুঁজে বের করতে; না পারলে তার কপাল মন্দ!

একটা ছোট খাবার ঘরে শুধুমাত্র টারজান ও রানী একত্রে আহার-পর্ব সমাধা করল। তারপর নেমোন তাকে নিয়ে গেল অতি-পরিচিত গজদন্ত কক্ষে।

রানী বলল, এরোট ও ম’দুজে বেঁচে নেই। টমোসকে কাজে পাঠিয়েছি। আজ রাতে কেউ আমাদের বিরক্ত করতে আসবে না।

টারজান স্থির দৃষ্টিতে তাকে দেখতে লাগল। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, এই মিষ্টি মোহিনী নারীই হয়ে ওঠে রানী নেমোনের মত এক নিষ্ঠুর অত্যাচারী।

তারপর গভীর আবেগে বলে উঠল, আমাকে ভালবাস টারজান! আমাকে ভালবাস! ভালবাস! ভালবাস!

একটু একটু করে মেঝেতে নেমে গিয়ে নেমোন নতজানু হল টারজনের পদপ্রান্তে। অস্ফুট স্বরে বলল, হে পরমেশ্বর টুস!

জঙ্গল-রাজ তার দিকে তাকাল। এক রানী তার পদপ্রান্তে। মুহূর্তে তার মোহ ভঙ্গ হল। অস্পষ্ট শব্দ করে টারজান উঠে দাঁড়াল। নেমোন গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে; নিঃশব্দে সেখানেই পড়ে রইল। টারজান দরজার দিকে এগিয়েও ফিরে এল। নেমোনকে তুলে কোচে শুইয়ে দিল। গর্জে উঠল শৃঙ্খলাবদ্ধ বেলথার; সে গর্জনে ঘরটা কেঁপে উঠল।

নেমোন চোখ মেলল। মুহূর্তের জন্য তাকাল ঝুঁকে পড়া টারজনের দিকে। তারপরেই তার চোখে জ্বলে উঠল উন্মাদ ক্রোধের অগ্নিশিখা। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় চীৎকার করে বলতে লাগল, আমার ভালবাসাকে তুমি প্রত্যাখ্যান করলে! আমাকে পায়ে ঠেললে! হায় টুস্! আর আমি মাথা নুইয়েছি তোমার পায়ে! এক লাফে ঘরের কোণে ঝোলানো ঘণ্টার কাছে গিয়ে কাঠি দিয়ে তিনবার তাতে আঘাত করল। কাংস্যধ্বনি ছড়িয়ে পড়ল সারা ঘরে। তার সঙ্গে মিলল কুদ্ধ সিংহের গর্জন।

টারজান দরজার দিকে বাড়াল। ঠিক তখনই দরজাটা সপাটে খুলে গেল। দুই সম্ভ্রান্ত নাগরিকসহ বিশজন সৈনিক ঘরে ঢুকল।

নেমোন হুকুম করল, একে ধর! রানীর অপর শত্রুদের সঙ্গে একেও কারাগারে নিক্ষেপ কর।

টারজান নিরস্ত্র। একমাত্র সঙ্গী তরবারিখানাও গজদন্ত-কক্ষে ঢুকবার সময় খুলে রেখে এসেছে দরজার কাছে। বিশটা বর্শা তার দিকে উদ্যত; সে হাল ছেড়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করল।

কারাগারে বসে টুডোস ও গেমনন বহুদূর থেকে সৈনিকদের পায়ের শব্দ শুনতে পেল। তাদের ঘরের সম্মুখে এসেই পায়ের শব্দ থেমে গেল। খোলা দরজা দিয়ে একজন ঘরে ঢুকল। সৈনিকদের হাতে মশাল ছিল না। তাই কেউ কাউকে চিনতে পারল না।

রক্ষী-সৈনিকরা চলে গেল নতুন বন্দী সানন্দে বলে উঠল, অভিবাদন জানাই টুডোস ও গেমনন!

 টারজান! গেমনন উচ্ছ্বসিত গলায় বলে উঠল।

তা ছাড়া আর কে হবে, টারজান বলল।

কেন তুমি এখানে এলে? টুডোস প্রশ্ন করল।

 তা জানি না।

কঠিন হেসে টুভোস বলল, নেমোনের এই নরকে আশার কোন স্থান নেই।

টারজান মাথা নেড়ে বলল, হয়তো নেই, কিন্তু আমি আশা ছাড়ব না। কাল রাতে মন্দিরের কারাকক্ষে ডোরিয়াও তো সব আশা ছেড়ে দিয়েছিল। তবু জারাটরের হাত থেকে সে তো পালাতে পেরেছে।

সে রহস্য আমার বুদ্ধির অতীত, গেমনন বলল।

টারজান ভরসা দিয়ে বলল, কিন্তু খুবই সরল। একটি বিশ্বস্ত বন্ধু এসে আমাকে জানিয়ে গেল যে ডোরিয়াকে বন্দী করে রাখা হয়েছে মন্দিরে। সঙ্গে সঙ্গে তার খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। ভাগ্যক্রমে কানিতে বড় বড় গাছপালার অভাব নেই; একটা তো মন্দিরের গায়েই দাঁড়িয়ে আছে; তার ডালপালা ছড়িয়ে আছে ডোরিয়ার কারা-কক্ষের জানালা পর্যন্ত। সেখানে পৌঁছে দেখলাম এরোট ডোরিয়াকে উত্তক্ত করছে। যে চামড়ার বস্তায় বেঁধে ডোরিয়াকে জারাটর যাত্রায় পাঠাবার কথা ছিল সেটাও হাতের কাছে পেয়ে গেলাম। এর চাইতে সরল ব্যাখ্যা আর কি হতে পারে? যে যাত্রা ছিল ডোরিয়ার কপালে সেটাই জুটে গেল এরোটের ভাগ্যে।

টুডোস আবেগাপ্লুত গলায় বলে উঠল, তুমি তাকে উদ্ধার করেছ! কোথায় সে?

টারজান সাবধানে বলল, কাছে সরে এস। দেওয়ালও শত্রুতা করতে পারে। শোন গেমনন, ডোরিয়া নিরাপদ আশ্রয়েই আছে। কোন ভয় নেই।

গেমনন বলল, ডোরিয়া নিরাপদ! এবার সুখে মরতে পারব।

টুডোস অন্ধকারে হাতটা বাড়িয়ে টারজনের কাঁধে রেখে বলল, আমার কৃতজ্ঞতা জানাবার কোন উপায় নেই, কারণ জানাবার মত কোন ভাষা নেই।

ভোর হল।

দুপুরের পরে একটি বন্দী এসে টারজানকে নিয়ে গেল। সঙ্গের অফিসারটি তিন বন্দীরই পরিচিত; লোকটি ভাল, সহানুভূতিশীল।

রক্ষীদের ঘরে নিয়ে গিয়ে টারজানকে শক্ত শিকল দিয়ে বাঁধা হল। একটা সোনার কলার পরানো হল গলায়; তার দু’দিকে দুটো শিকলে ধরা রইল দু’জন সৈনিকের হাতে।

এত বেশি সতর্কতা কেন? টারজান জানতে চাইল।

অফিসার বলল, এটাই রীতি। রানীর শিকারকে সব সময় এইভাবে নিয়ে যাওয়া হয় ওথার উপত্যকার সিংহ-ক্ষেত্রে।

আর একবার টারজানকে হটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল কাথুনির রানীর রথের কাছে। কিন্তু এবার সে হাঁটতে লাগল রথের পিছনে-দুই দীর্ঘদেহ সৈনিক ও জনবিশেক রক্ষী-পরিবেষ্টিত এক শৃঙ্খলাবদ্ধ। বন্দীরূপে। আর একবার স্বর্ণ-সেতু পার হয়ে ওথার উপত্যকার সিংহ-ক্ষেত্রে পৌঁছে গেল।

সঙ্গে এক বিরাট জনতা। যে মানুষ নেমোনের ভালবাসাকে পায়ে ঠেলেছে তার দুরবস্থা ও মৃত্যু দেখার জন্য রানী গোটা শহরকেই আমন্ত্রণ করে এনেছে।

নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে নেমোন রক্ষীদের হুকুম দিল, বন্দীকে তার কাছে আনা হোক। টারজান এসে দাঁড়াল। নেমোন বলল, তোমরা যেতে পার; বন্দীর সঙ্গে আমি একা কথা বলতে চাই।

রক্ষীরা কিছুটা দূরে যেতেই নেমোন টারজনের দিকে তাকাল; টারজান হাসছে। বন্ধুত্বপূর্ণ সহজ সুরে টারজান বলল, এমনি করেই তুমি আরও অনেককে মারবে, আরও বেশি অসুখী হবে। তারপর একদিন আসবে তোমার মরবার পালা।

নেমোন শিউরে উঠল। আমার মরবার পালা! হ্যাঁ, অতীতে সকলেই নিহত হয়েছে, কাথুনির সব রাজা, সব রানী। কিন্তু আমার পালা এখনও আসেনি। যতদিন বেলথার বেঁচে আছে ততদিন আমিও বেঁচে আছি। একটু চুপ করে থেকে আবার বলল, শিকারী সিংহটাকে এনে শিকারের গন্ধ শুকিয়ে দাও।

সমবেত সম্ভ্রান্ত নাগরিকবৃন্দ, সেনাদল ও জনতা দুই ভাগ হয়ে শিকারী সিংহ ও তাদের রক্ষীদের আসার পথ করে দিল। টারজান দেখতে পেল স্বর্ণ রজ্জুতে বাঁধা একটা প্রকাণ্ড সিংহ সেই পথে এগিয়ে আসছে, আর আটজন রক্ষী সে রজ্জ্বটা টান করে ধরে আছে।

অগ্নি-চক্ষু সেই শয়তান নেমোনের রথের দিকে এগিয়ে চলল; অনেক দূর থেকেই তার দুই কানের মাঝখানে একগুচ্ছ শ্বেত কেশর দেখেই টারজান তাকে চিনতে পারল। সিংহটি বেলথার!

একজন সম্ভ্রান্ত নাগরিক টারজনের কাছে এগিয়ে গেল। সে ফরডোস, গেমননের বাবা! চাপা নিচু স্বরে সে টারজানকে বলল, এতে অংশগ্রহণ করতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত, কিন্তু এটা করতে আমি বাধ্য। তারপর গলা চড়িয়ে বলল, রানীর নামে বলছি, সকলে চুপ কর। কাথুনির রানী নেমোনের বড় শিকারের নিয়মাবলি সম্পর্কে অবহিত হওঃ সৈনিকদের মধ্যস্থিত পথের মাঝখান দিয়ে শিকার চলবে উত্তর দিকে; সে একশ’ পা এগিয়ে যাবার পরে রক্ষীরা শিকারী সিংহ বেলথারকে ছেড়ে দেবে। সিংহ যখন শিকারকে ধরে খেতে শুরু করবে তখন রক্ষীরা আবার বেলথারকে বেঁধে ফেলবে।

টারজনের দিকে ঘুরে বলল, যতক্ষণ বেলথার তোমাকে ধরতে না পারবে ততক্ষণ তুমি সোজা উত্তর দিকে ছুটতে থাকবে।

টারজান প্রশ্ন করল, আমি যদি তাকে এড়িয়ে পালাতে পারি? তাহলে মুক্তি পাব?

ফরডোস সক্ষেদে বলল, সব প্রস্তুত ইয়োর ম্যাজেস্টি। শিকার কি শুরু হবে?

চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেমোন বলল, সিংহকে আর একবার শিকার শুঁকতে দাও; তারপরই শুরু হোক শিকার।

রক্ষীরা বেলথারকে নিয়ে গেল টারজনের কাছে।

কাথুনির পাশ দিয়ে যে নদীটা বয়ে চলেছে তারই একটা গহ্বরের মধ্যে ঘন ঝোপের ভিতরে আছে আর একটি সিংহ। বিশালদেহ সেই সিংহের গায়ের রং হলুদ, আর কেশর কালো। চোখ দুটি বুজে থাকলেও আসলে নুমা’ জেগেই আছে।

মাঠের মধ্যে টারজান তখন বর্শা-ঘেরা পথ ধরে ছুটছে। প্রতিটি পদক্ষেপ সে গুণছে, কারণ সে জানে, একশ’ পদক্ষেপ শেষ হতেই বেলথারকে ছেড়ে দেয়া হবে তার পিছনে। একটা ফন্দী সে এটেছে। পূর্ব দিকের নদী বরাবর রয়েছে একটা গভীর জঙ্গল। একবার সেখানে পৌঁছতে পারলেই সে নিরাপদ। একবার সেই সব গাছের ডাল ধরে ঝুলে পড়তে পারলে কোন সিংহ বা মানুষই অরণ্য-রাজকে ধরতে। পারবে না।

কিন্তু বেলথার তাকে ধরে ফেলার আগে সে কি জঙ্গলে পৌঁছতে পারবে? একশ’ পা আগে থেকে দৌড় শুরু করে যে কোন সাধারণ সিংহকে টারজান হয় তো দৌড়ে মেরে দিতে পারে; কিন্তু বেলথার তো। সাধারণ সিংহ নয়; কাথুনির সব শিকারী সিংহদের মধ্যে সে শ্রেষ্ঠ।

একশতম পদটি ফেলার সময় সে পরিপূর্ণ গতিতে একটা লাফ দিল। তার পিছনে শিকল ছাড়া সিংহের গর্জন; তার সঙ্গে মিশেছে জনতার হল্লা।

ছুটে আসছে বেলথার। তার পিছনে ছুটছে রানীর রথ; তারও পিছনে সম্ভ্রান্ত নাগরিক, সৈনিক ও সাধারণ মানুষের দল।

এই বুঝি বেলথার শিকারকে ধরে ফেলল।

পিছনে তাকিয়ে টারজানও বুঝল, তার শেষ ক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে। নদী এখনও দু’শ গজ দূরে, আর সিংহের দূরত্ব মাত্র পঞ্চাশ গজ।

টারজান ঘুরে দাঁড়াল। অপেক্ষা করতে লাগল। সে জানে এ পরিস্থিতিতে কি করতে হবে। আরও অনেকবার সে সিংহের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু আজ সে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। বুঝতে পারছে মৃত্যু অনিবার্য। তবু সে লড়াই করে মরবে।

শুরু হল সেই মৃত্যু-সংগ্রাম। গর্জন করে লাফিয়ে পড়ল বেলথার।

হঠাৎ ঘটল অঘটন। বেলথার প্রায় টারজনের উপর এসে পড়েছে এমন সময় একটি বাদামী দেহ বিদ্যুৎগতিতে তাকে পাশ কাটিয়ে ছুটে এল পিছন থেকে; দুই পিছনের পায়ে ভর দিয়ে বেলথার টারজনের মুখোমুখি দাঁড়াতেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল উদ্যত নখর ও থাবা সোনালী শরীর ও কালো কেশর ঢাকা একটি বিশাল সিংহ।

 নবাগত সিংহটি বেথারের চাইতে বিশালকায় এবং অধিকতর শক্তিশালি; শক্তি ও হিংস্রতার একেবারে তুঙ্গে অবস্থিত। একবার সুযোগ পেতেই তার বিরাট চোয়াল সজোরে বসে গেল নেমোনের শিকারী সিংহের গলায়। তার বড় বড় দাঁত কেশরের ফাঁক দিয়ে বসে গেল বেথারের চামড়া ও মাংস ছিন্নভিন্ন করে। তারপর বিড়াল যেভাবে ইঁদুরকে ঝাঁকায় সেইভাবে বেলগারের ঘাড় মটকে তার পা ধরে ঝাঁকাতে লাগল।

মৃতদেহটাকে সজোরে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বিজয়ী সিংহটি কাথুনিবাসীদের দিকে মুখ খিঁচিয়ে দাঁড়াল। তারপর ধীরে ধীরে ফিরে গেল টারজনের পাশে। টারজান সস্নেহে সোনালী সিংহ জাদ- বাজার কালো কেশরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

চারদিক নিস্তব্ধ। তারপরই শোনা গেল নারীকণ্ঠের এক বিচিত্র আর্তনাদ। নেমোনের আর্তনাদ। সোনার রথের সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে পরিপূর্ণ নিঃশব্দের মধ্যে সে গিয়ে দাঁড়াল মৃত বেলথার-এর পাশে। বিস্মিত, নিশ্চল জনতা হাঁ করে তাকে দেখতে লাগল।

নেমোনের চটি পরা পা দুটি স্পর্শ করল শিকারী.সিংহের রক্তাক্ত কেশর; একদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইল তার দিকে। হয়তো এক মিনিট নীরবে প্রার্থনা ও করল। তারপর সহসা মুখ তুলে চারদিকে তাকাল। দুই চোখে উন্মাদ ঝিলিক; মুখখানি একেবারে সাদা।

বেলথার মরে গেল। আর্তকণ্ঠে কথাগুলো বলে ক্ষিপ্রগতিতে নিজের ছুরিখানাকে কোষমুক্ত করে তার সুতীক্ষ্ণ অগ্রভাগকে বসিয়ে দিল নিজের বুকের গভীরে। নিঃশব্দে নতজানু হয়ে সে উল্টে পড়ে গেল। মৃত বেলুথারের দেহের পাশে।

ফরডোসের নেতৃত্বে সৈনিকদল, নাগরিকবৃন্দ এবং সাধারণ মানুষরা শহরে ফিরে গিয়ে নেমোনের কারাগার থেকে সব বন্দীদের মুক্ত করে দিল; আলেক্সটারকে রাজা রূপে ঘোষণা করল; তাদের মৃত রানী পড়ে রইল সিংহ-ক্ষেত্রের এক প্রান্তে মৃত বেত্থারের পাশে।

সে মানবিক কর্তব্যকে তারা অবহেলা করেছিল, অরণ্যরাজ তাই পালন করল; আফ্রিকার আকাশের নিচে চাঁদের নরম আলোর একটি নারীর সমাধির পাশে সে মাথা নিচু করে দাঁড়াল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *