টারজান ও দলচ্যুতরা (টারজান এ্যাণ্ড দি কাস্টএ্যাওয়েজ)

টারজান ও দলচ্যুতরা (টারজান এ্যাণ্ড দি কাস্টএ্যাওয়েজ)

সেদিন সাইগন নামে একটা মালবাহী ছোট জাহাজ আমেরিকায় যাবার পথে জীবজন্তু বোঝাই এর জন্য অপেক্ষা করছিল মোম্বাসা বন্দরে। ডেকের ভিতর থেকে সিংহ, হাতি, হায়েনা প্রভৃতি বিভিন্ন জীবজন্তুর বিচিত্র ক্ষুব্ধ ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল।

জাহাজের রেলিংয়ের ধারে দু’জন লোক কথা বলছিল। তাদের মধ্যে একজন বলছিল, জাহাজ ছাড়ার জন্য আমরা প্রায় প্রস্তুত। প্রতিদিন আমার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। যদি তাকে ধরতে পার তাহলেও তাকে আনতে এক মাস লেগে যাবে।

আবদুল্লা আবু নেজিম বলল, শোন ক্রাউজ সাহেব, এ কাজ আমি পারবই। সে এখন নদালোদের দেশেই আছে। ফলে তাকে ধরা সহজ হবে। তার কথাটা একবার ভেবে দেখ সাহেব। একটা আসল বন্য লোক, ছোট থেকে বাঁদরদের কাছে মানুষ হয়েছে। সে কত সিংহ মেরেছে, বুনো হাতিরা তার খেলার সাথী। তুমি জাহাজে বোঝাই করে যত জীবজন্তু নাসারায় নিয়ে যাবে, তার একার দাম হবে সেই সব জীবজন্তুর থেকে বেশি। তার থেকে তুমি ধনী হয়ে উঠবে সাহেব।

পরদিন সকাল থেকে আবহাওয়াটা ভালই ছিল। অনুকূল বাতাসে সাইগন জাহাজটা ভারত মহাসাগরের উপর দিয়ে উত্তর-পূর্বদিকে এগিয়ে যেতে লাগল। ডেকের উপর জন্তু-জানোয়ারগুলো শান্ত ও নীরব হয়েই ছিল। মাদুর ঢাকা কাঠের বিরাট খাঁচাটা থেকে বন্য লোকটির কোন সাড়া শব্দ আসছিল না।

জেনেত্তে লাঁও নামে মহিলাটি ক্রাউজের সঙ্গে ডেকের উপর এসে হাজির হলো।

সাইগনের দু’নম্বর নেট উইলহেম স্মিৎস রেলিং-এর ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিল আধখোলা চোখে।?

মহিলাটি তাকে বলল, বন্য লোকটাকে দেখতে পারি?

স্মিৎস বলল, মনে হয় লোকটা এখনো বেঁচেই আছে। গতকাল জাহাজে তোলার সময় লোকটাকে প্রচুর মারা হয়েছে। আব্দুল্লা আমাকে যা বলল তাতে বোঝা গেল লোকটাকে পোষ মানানো কষ্টকর হবে। চল, লোকটাকে দেখে আসি।

এই বলে সে জাহাজের লস্কর নাবিককে ডেকে বলল। খাঁচা থেকে মাদুরটা সরাও।

আঁচার উপর থেকে যখন মাদুরটা সরাচ্ছিল তখন স্মিৎস এসে ক্রাউজকে জিজ্ঞাসা করল, খাঁচার ভিতরে কি আছে মিস্টার ক্রাউজ?

একটা বুনো লোক।

খাঁচার উপর থেকে মাদুরের ঢাকনাটা সরাতেই খাঁচার ভিতরে দৈত্যাকার একটা লোককে দেখা গেল। লোকটা তাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে লাগল।

মেয়েটি বলল, লোকটা ত শ্বেতাঙ্গ।

 ক্রাউজ বলল, হ্যাঁ তাই।

 তুমি পশুর মত একটা লোককে খাঁচায় ভরে রাখবে?

 লোকটা ইংরেজ।

 স্মিৎস কথাটা শুনে ঘৃণাভরে থুথু ফেলল খাঁচার ভিতরে।

জেনেত্তে রাগের সঙ্গে পা ঠুকে বলল, এমন কাজ কখনো করো না।

ক্রাউজ চড়া গলায় বলল, তোমার তাতে কি? আমি বলেছি না লোকটা একটা নোংরা ইংরেজ শুয়োর।

লোকটা একজন মানুষ এবং শ্বেতাঙ্গ।

লোকটা মানুষের একটা মূর্তিমাত্র। কোন একটা কথাও বলতে বা বুঝতে পারে না। একজন জার্মান তার উপর থুথু ফেলেছে এটা তার পক্ষে সম্মানের কথা।

তাহলেও স্মিৎসকে এ কাজ আর কখনো করতে দেব না।

ঘণ্টা বাজতেই তার কাজে চলে গেল স্মিৎস। তার পিছন পানে তাকিয়ে জেনেত্তে বলল, লোকটা একটা শুয়োর।

এই সময় হ্যান্স দ্য গ্ৰাত্তে নামে এক ওলন্দাজ নাবিক এসে দাঁড়াল তাদের কাছে। হ্যান্স কুড়ি-বাইশ বছরের এক সুদর্শন যুবক। ও হলো জাহাজের প্রথম মেট। স্মিৎস তাকে হিংসা করে।

জাহাজের ক্যাপ্টেন লার্সেল তখন প্রবল জ্বরে শয্যাগত হয়ে পড়েছিল তার কেবিনে। ক্রাউজ জাহাজটা ভাড়া করলেও ক্যাপ্টেন লার্সেল তার সঙ্গে কথা বলত না। নাবিকদের বেশিরভাগ ছিল লস্কর আর চীনা। তাদের মধ্যে প্রায়ই ছুরি মারামারি চলত। সে তুলনায় ডেকের ভিতরে বন্দী পশুগুলো ছিল বেশ শান্ত।

হ্যান্স খাঁচাটার দিকে তাকিয়েই বলে উঠল, লোকটা শ্বেতাঙ্গ! ওকে বনের পশুর মত এভাবে আটকে রাখতে পারবে না।

জেনেত্তের মত সেও প্রতিবাদ করল।

ক্রাউজ সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি তাই করব। আমি কি করি না করি সেটা তোমাদের কাউকে দেখতে হবে না।

কথাটা বলার সময় জেনেত্তের উপর কটাক্ষপাত করল ক্রাউজ।

হ্যান্স বলল, অন্তত ওর হাত দুটোর বাঁধন খুলে দিন। এইভাবে বেঁধে রাখাটা এক অনাবশ্যক নিষ্ঠুরতা।

ক্রাউজ বলল, আমি ওর হাতের বাঁধন খুলে দিতে পারি যদি কেউ একটা লোহার খাঁচা এনে দিতে পারে এখানে। এই অবস্থায় ওকে খাওয়ানো একটা কঠিন কাজ।

জেনেত্তে বলল, গতকাল থেকে কোন খাদ্য বা পানীয় পেটে পড়েনি ওর। ও যেই হোক, তুমি একটা অসহায় মানুষের উপর যে ব্যবহার করছ আমি একটা কুকুরের সঙ্গেও তা করব না।

এমন সময় পিছন থেকে আব্দুল্লা এসে বলল, লোকটা কুকুরের থেকেও হীন।

এই বলে খাঁচার কাছে গিয়ে থুথু ফেলল সে। সঙ্গে সঙ্গে তার গালের উপর জোরে একটা চড় বসিয়ে দিল জেনেত্তে। আব্দুল্লা রাগের মাথায় তার ছোরাটা বার করতে যেতেই হ্যান্স ছুটে এসে তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আব্দুল্লার হাতটা ধরে ফেলল।

ক্রাউজ বলল, এটা তোমার করা উচিত হয়নি জেনেত্তে।

আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছিল জেনেত্তের চোখ থেকে। আমি লোকটাকে এভাবে অপমান করতে কিছুতেই দেব না।

হ্যান্স বলল, আর আমি ওকে সাহায্য করব এ বিষয়ে। আপনি ওকে খাঁচায় ভরে রাখবেন কি না তা দেখতে যাব না। কিন্তু ওর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করছেন কি না সেটা অবশ্যই আমি দেখব।

ক্রাউজ জোর গলায় বলল, কি করতে চাও তোমরা?

হ্যান্স বলল, প্রথমে তোমাকে মেরে ফাটিয়ে দেব, তারপর যে বন্দরে আমাদের জাহাজ থামবে। সেখানকার কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেব তোমায়।

জেনেত্তে বলল, লোহার খাঁচা এসে গেছে। ওকে ওটার মধ্যে ঢুকিয়ে ওর হাতের বাঁধন খুলে দাও।

হ্যান্স কর্তৃপক্ষের হাতে তাকে তুলে দেবার কথা বলায় ভয় পেয়ে গেল ক্রাউজ। তাই সে তার সুরটা নরম করে বলল, ঠিক আছে, ওর সঙ্গে ভাল ব্যবহারই আমি করব। ওর পিছনে অনেক টাকা ঢেলেছি আমি। ওর সঙ্গে ভাল ব্যবহার না করাটা বোকামি হবে আমার পক্ষে।

একটা বড় লোহার খাঁচা কাঠের খাঁচাটার পাশে এনে রাখা হল। ক্রাউজ হাতে একটা রিভলবার নিয়ে খাঁচার ভিতরকার লোকটাকে বলল, এই খাঁচাটায় ঢুকে পড়। বোকা বোবা কোথাকার।

কিন্তু লোকটা ক্রাউজের দিকে একবার তাকালও না।

ক্রাউজ তার লোকদের বলল, একটা রড এনে ওকে খুঁচিয়ে দাও।

জেনেত্তে বলল, আমাকে দেখতে দাও।

এই বলে সে খাঁচার কাছে গিয়ে বলতেই ভিতরের লোকটা কাঠের খাঁচা থেকে গুঁড়ি মেরে লোহার খাঁচায় এসে ঢুকল। হ্যান্সের কাছ থেকে ছুরিটা নিয়ে সে লোকটার হাতের বাঁধনটা কেটে দিল।

মুখে কোন কথা না বললেও নীরবে মুখটা তুলে দৃষ্টির মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা জানাল জেনেত্তের প্রতি।

হ্যান্স জেতেত্তের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, লোকটির চেহারাটা এক সত্যিকারের পুরুষের মত।

জেনেত্তে বলল, আবার সুন্দরও বটে।

 এরপর ক্রাউজের দিকে তাকিয়ে সে বলল, কিছু খাদ্য আর পানীয় নিয়ে এস।

ক্রাউজ আব্দুল্লাকে বলল, ও কি খায় আব্দুল্লা?

আব্দুল্লা বলল, কুকুরটা দুদিন খায়নি। এখন ও হাতের কাছে যা পাবে তাই খাবে। জঙ্গলে থাকার। সময় ও পশু বধ করে কাঁচা মাংস খেত পশুর মত।

ক্রাউজ বলল, আমরা সেটা পরীক্ষা করে দেখব।

একজন নাকিব মাংস আর জল নিয়ে এলে জেনেত্তে তা নিয়ে বন্দীর হাতে দিল। বন্দী লোকটা মাংস নিয়ে খাঁচার এক কোণে গিয়ে দাঁত দিয়ে একটা বড় মাংস খণ্ড কামড়ে কামড়ে খেতে লাগল আর গর্জন। করতে লাগল।

আব্দুল্লা বলল, এল আদ্রিয়া জাতীয় সিংহেরা এইভাবে খায়।

 ক্রাউজ বলল, ও সিংহের মত গর্জন করে। আদিবাসীরা ওকে কি নামে ডাকে আব্দুল্লা?

আব্দুল্লা বলল, বাঁদরদলের টারজান বলে ডাকে ওকে।

ভারত মহাসাগর পার হয়ে সুমাত্রা দ্বীপে গিয়ে থামল সাইগন। সেখানে আরো কিছু পশু বোঝাই করল ক্রাউজ। সে নিল একটা গণ্ডার, তিনটে ওরাং ওটাং, দুটো বাঘ, একটা চিতাবাঘ আর একটা হাতি।

হ্যান্স তাকে কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেবে বলে ভয় দেখিয়েছিল বলে বাটাভিয়াতে নামল না ক্রাউজ। সুমাত্রা থেকে সে এগিয়ে যেতে লাগল সিঙ্গাপুরের দিকে। সাইগন যাবে দক্ষিণ চীন সমুদ্রে দিয়ে ম্যানিলায়।

ক্রাউজ খুশি হলো। এতক্ষণ পর্যন্ত তার পরিকল্পনা ভালভাবেই কাজ করেছে। সে যদি একবার নিউ ইয়র্কে জাহাজটা নিয়ে যেতে পারে তাহলে মোটা লাভ করবে। তবে সে এত খুশি হত না যদি সে জানত কি ব্যাপার চলছে। জাহাজের ক্যাপ্টেন লার্সেল তখনো তার কেবিনে শয্যাগত ছিল। হ্যান্স দ্য গ্রোত্তে একজন ভাল অফিসার হলেও সে নতুন। সাইগন জাহাজে কি গোপন ষড়যন্ত্র চলছিল সে বিষয়ে তারও কোন জ্ঞান ছিল না। রাত্রিবেলায় ডেকের উপর সামনের দিকে জাহাজের দ্বিতীয় মেট স্মিৎস আর জবু সিং ও অন্যান্য লস্কর বা নাবিকদের মধ্যে কি সব গোপন কথাবার্তা হত, ক্রাউজের মত সেও তার কিছুই জানত না।

একদিন লস্কর জবু সিংকে চাঁদ নামে এক লস্কর জিজ্ঞাসা করল, পশুগুলোর কি হবে?

জবু সিং বলল, স্মিৎস বলেছে পশুগুলোকে আমরা সমুদ্রে ফেলে দেব জাহাজ থেকে।

চাঁদ আপত্তির সুরে বলল, কিন্তু ওগুলোর অনেক দাম। আমরা পশুগুলোকে রেখে দিয়ে পরে বিক্রি করতে পারি।

অন্য একজন লস্কর বলল, আমরা ধরা পড়ে যাব এবং আমাদের ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হবে তার জন্য।

জবু সিং বলল, আমরা যখন সিঙ্গাপুরে ছিলাম তখন স্মিৎস জানতে পারে ইংলন্ড ও জার্মানির মধ্যে যুদ্ধ চলেছে। এটা এক ইংজের জাহাজ। স্মিৎস বলেছে একজন জার্মান হিসেবে ইংরেজ জাহাজ দখল করার অধিকার আছ তার। আমরা তাহলে পুরস্কার হিসেবে কিছু করে টাকা পাব। তবে তার মতে এক্ষেত্রে জন্তু জানোয়ারগুলোর কোন দাম হবে না, ওগুলো শুধু এক আবর্জনা মাত্র।

চাঁদ বলল, ইল্লিনি দ্বীপে একজন লোক আছে সে পশুগুলোকে কিনবে। সুতরাং স্মিৎসকে তাদের সমুদ্রে ফেলে দিতে দেব না।

নাবিকরা এইভাবে তাদের নিজেদের ভাষায় কথা বলত। তারা ভাবত জাহাজের চীনা নাবিকরা বুঝতে পারবে না তাদের কথা। কিন্তু তাদের এ ধারণা ভুল ছিলো। সাইগন জাহাজে লুম চিপ নামে এক চীনা নাবিক ছিল। সে চীন উপসাগরে ফেলুক্কা নামে একটা জাহাজে কাজ করেছে। তখন সে লস্করদের। ভাষা শেখে। সে লস্করদের বিশ্বাস করত না, বরং তাদের ঘৃণা করত: কারণ তারা একবার ফেলুক্কা। জাহাজটা দখল করে তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। তারা যা যা লুট করে তার ভাগ দেয়নি তাকে।

তবে নাবিকদের ষড়যন্ত্রের কথাগুলো শোনার সময় উদাসীনভাবে পাইপ খেয়ে যাচ্ছিল সে। তার মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছিল না সে তাদের সব কথা শুনেছে কি না।

এদিকে খাঁচার ভিতরে বন্দী লোকটা খাঁচার ভিতরে ইতস্তত পায়চারি করতে করতে মাথার উপর লোহার রড়টা ধরে প্রায়ই ঝুলত। খাঁচার কাছে কেউ এলে সে থেমে যেত।

জেনেত্তে লাও প্রায়ই তার খাঁচাটার কাছে এসে দেখত তার খাওয়া হয়েছে কি না। তারপর তাকে ফরাসী ভাষা শেখানোর চেষ্টা করত। কিন্তু বন্দী টারজনের তাতে বিশেষ কোন আগ্রহ ছিল না। সে মুখে কোন কথা কারো সঙ্গে না বললেও মনে মনে ঠিক সঙ্গতভাবেই চিন্তা করে যেত। তার একমাত্র চিন্তা ছিল সে কিভাবে উদ্ধার করবে নিজেকে এই অবস্থা হতে। তাকে নিয়ে ভবিষ্যতে এরা কি করবে তা সে সব বুঝতে পেরেছে। তবে সে যে এই খাঁচা থেকে যেমন করে তোক পালাবেই সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই তার।

খাঁচার লোহার রেলিংগুলোকে পরীক্ষা করে সে দেখে সেগুলোকে বাঁকিয়ে তার দেহটাকে খাঁচা থেকে বার করতে এমন কোন কষ্ট হবে না। কিন্তু জাহাজ থেকে সমুদ্রে সে ঝাঁপ দিলেই তাকে গুলি করা হবে। কারণ ওরা তাকে ভয় করে। গুলির কথা ভেবেই সে নীরবে বন্য পশুর মত ধৈর্য ধরে থাকে।

আব্দুল্লা বা স্মিৎস যখন ডেকের উপর আসে টারজান তখন তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে। কারণ তারা দুজনেই তার উপর থুথু ফেলে। তাকে ঘৃণা করার কারণ ছিল আব্দুল্লার। আব্দুল্লার দাস ব্যবসা আর হাতির দাঁতের কারবারের সে-ই অবসান ঘটায়। আর স্মিৎসের সে জাতীয় শত্রু।

আব্দুল্লা ক্রাউজ আর জেনেত্তেকে ঘৃণার চোখে দেখত আর হ্যান্স তাকে ঘৃণা করত। সে তাই স্মিৎসের পক্ষে চলে আসে। ক্রমে তারা অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠে পরস্পরের। আব্দুল্লা ক্রাউজের উপর প্রতিশোধ নেবার সুযোগ খুঁজছিল বলে সে স্মিৎসের দ্বারা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে ফেলে নিজেকে।

সেদিন বিকালবেলায় লুম চিপ হ্যান্সের কাছে এসে বিদ্রোহীদের ষড়যন্ত্রের কথা সব বলল। বলল, বিদ্রোহীরা আজ রাতেই জাহাজ দখল করবে। তারা লার্সেল, ক্রাউজ, আর তোমাকে খুন করবে। শুধু চীনাদের বাদ দেবে।

হ্যান্স চিন্তান্বিত হয়ে বলল, চীনা নাবিকরা? তারা কি করবে।

 তারা তোমাদের মারবে না। তারা ষড়যন্ত্রে যোগ দেয়নি।

তারা কি বিদ্রোহী নাবিকদের সঙ্গে লড়াই করবে?

 তাদের হাতে বন্দুক দাও। তাহলেই লড়াই করবে।

তারা বন্দুক পাবে না। রড় আর ছুরি দিয়ে লড়াই করতে বল। তোমাকে ধন্যবাদ লুম। তোমার কথা কখনো ভুলব না।

হ্যান্স সঙ্গে সঙ্গে লার্সেলের কেবিনে চলে গেল। কিন্তু দেখল লার্সেল জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে তারপর ক্রাউজের কেবিনে চলে গেল। সেখানে ক্রাউজ আর জেনেত্তের কাছে লুম চিপের কথাগুলো সব বলল।

ক্রাউজ বলল, এখন আমরা কি করব?

 হ্যান্স বলল, আমি এখনি স্মিৎসকে গ্রেফতার করব।

হঠাৎ কেবিনের দরজাটা খুলে গেল। দেখা গেল স্মিৎস একটা স্বয়ংক্রিয় রিভলবার হাতে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। তার পিছনে ছয়জন বিদ্রোহী।

স্মিৎস হ্যান্সকে বলল, তুমি আমাকে গ্রেফতার করবে না? চীনাটা যখন তোমার সঙ্গে কথা বলছিল তখন আমি তা দেখি। এ সে যা বলেছে তা আমি জানি।

এরপর সে লস্করদের বলল, ওদের সাবইকে বেঁধে ফেল।

বিদ্রোহী নাবিকরা কেবিনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ক্রাউজ কাপুরুষের মত বিনা প্রতিবাদে আত্মসমর্পণ করল। হ্যান্স জেনেত্তের সামনে গিয়ে লস্করদের বলল, খবরদার, মেয়েছেলের গায়ে হাত দেবে না। লস্কর বা বিদ্রোহী নাবিকরা জেনেত্তেকে বাঁধতে গেলে ঘুষি মেরে দু’জনকে ফেলে দিল হ্যান্স। জেনেত্তেও তার ভারী একজোড়া বায়নাকুলার দিয়ে মেরে ফেলে দিল দু’জনকে।

তবে লড়াই শেষ হলে দেখা গেল আঘাতে অচেতন হয়ে পড়েছে হ্যান্স। বাকি সবাইকে বেঁধে ফেলেছে বিদ্রোহীরা।

ক্রাউজ অবশেষে স্মিৎসকে বলল, এটা বিদ্রোহ স্মিৎস। মনে রেখো, আমাকে যদি ছেড়ে না দাও তাহলে এর জন্য ফাঁসিতে মরতে হবে তোমায়।

স্মিৎস বলল, এটা বিদ্রোহ নয়, আমি আমাদের রাষ্ট্রের নামে এই ইংরেজ জাহাজটিকে দখল করলাম।

ক্রাউজ বলল, আমিও জার্মান। আমি জাহাজটিকে ভাড়া করি। সুতরাং এটা জার্মান জাহাজ, ইংরেজ জাহাজ নয়।

স্মিৎস বলল, তা নয়, এটা ইংলন্ডেই রেজিস্ট্রি করা হয় এবং এই জাহাজ ইংরেজ পতাকা বহন করেই ভেসে চলেছে। তুমি যদি জামান হও তাহলে তুমি বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী। তোমাকে কি করতে হবে। তা আমরা জানি।

টারজান বুঝতে পারল জাহাজে রীতিমত একটা গণ্ডগোল হয়েছে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা কি তা জানতে পারেনি সে। জেনেত্তে নামে সেই মেয়েটিকে ও ছোকরা অফিসার হ্যান্সকে দু’দিন দেখেনি সে। দেখছে যে মেটটা তার উপর থুথু ফেলেছিল একদিন জাহাজটা এখন তারই দখলে।

চীনা নাবিকরা মুখ বুজে জাহাজ চালানোর কাজ করে যাচ্ছে। আব্দুল্লা তার ভয়ে খাঁচার কাছে আসে না।

এখন বিদ্রোহী নাবিকরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় জাহাজে। চীনা নাবিকরা সব কাজ করলেও অল্প কোন ত্রুটি অথবা বিনা দোষেই স্মিৎস তাদের লাথি মারে। একদিন এক চীনাকে বেত মেরে লঘু দোষে ভয়ঙ্কর শাস্তি দেয়া হয়।

স্মিৎস খাঁচার কাছে গিয়ে টারজানকে গালাগালি দেয় দাঁত খিঁচিয়ে। তার প্রতি স্মিসের এই ঘৃণার কোন সঙ্গত কারণ খুঁজে পায় না টারজান।

একদিন স্মিৎস একটা হারপুন নিয়ে এসে খাঁচার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে টারজানকে মারার জন্য সেটা খাঁচার ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়। টারজান সেটা ধরে সঙ্গে সঙ্গে এক হ্যাঁচকা টানে কেড়ে নেয় স্মিৎসের হাত থেকে। সেই থেকে সশস্ত্র টারজনের কাছে আসতে ভয় পায় স্মিৎস।

একদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা দেখল নিজের চোখে। নিচের কয়েকজন নাবিক একটা কাঠের আর একটা লোহার খাঁচা উঠিয়ে এনে তার খাঁচাটার পাশে রাখল। তারপর জেনেত্তে নামে সেই দয়ালু। মেয়েটাকে কাঠের খাঁচাতে আর ক্রাউজ ও হ্যান্সকে লোহার খাঁচাটাতে ভরে রাখা হলো।

হ্যান্স স্মিৎসকে প্রশ্ন করল, এ সবের অর্থ কি স্মিৎস?

স্মিৎস বলল, নিচের তলায় তালাবন্ধ থাকার জন্য অভিযোগ করছিলে তোমরা। তাই এখানে এনে রাখা হলো। অনেক আলো হাওয়া পাবে। এ জন্য আমাকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত তোমাদের।

এই বলে হাসতে লাগল স্মিৎস।

হ্যান্স বলল, আমাদের নিয়ে যা খুশি করো। কিন্তু একজন শ্বেতাঙ্গ মহিলাকে এভাবে লস্করদের চোখের সামনে রাখা উচিৎ কি?

স্মিৎস হ্যান্সের কথা উত্তরে বলল, জেনেত্তে চাইলে আমার কেবিনে এসে থাকতে পারে। লার্সেলকে অন্য জায়গায় রাখা হয়েছে।

জেনেত্তে এমন সময় পিছন থেকে বলে উঠল, তার থেকে জেনেত্তে থাকবে বন্য লোকটির সঙ্গে একই খাঁচায়।

স্মিৎস বলল, আমি তোমাদের সবাইকে বন্য পশুদের সঙ্গে বার্লিনে নিয়ে গিয়ে সবাইকে দেখাবার জন্য এক প্রদর্শনীর আয়োজন করব। তুমি যদি তোমার প্রিয় বন্য লোকটির সঙ্গে এক খাঁচাতে থাক তাহলে সে দৃশ্য দেখে লোকে আনন্দ পাবে। আব্দুল্লা বলেছে লোকটা নাকি নরখাদক। তোমাকে ওর কাছে রাখলে ও তোমাকেই খাবে। আমাকে খাবার দিতে হবে না।

হ্যান্স স্মিত্সকে দেখে আপন মনে হাসতে হাসতে বলল, লোকটা পাগল।

একটু পরেই পিস্তল হাতে লোকজন নিয়ে ফিরে এল স্মিৎস। প্রথমে জেনেত্তের খাঁচার দরজা খুলে দেয়া হলো, তারপর টারজনের খাঁচার দরজা খোলা হলো। শেষে স্মিৎস জেনেত্তেকে হুকুম করল, যাও, লোহার খাঁচার মধ্যে চলে যাও।

হ্যান্স চীৎকার করে বলতে লাগল, এ কাজ করো না স্মিৎস।

 ধমক দিয়ে হ্যান্সকে থামিয়ে দিয়ে স্মিৎস আবার বলল, যাও বলছি।

এরপর তার লোকদের বলল, রড় দিয়ে ওকে খুঁচিয়ে খাঁচায় ঢুকিয়ে দাও।

কিন্তু একজন জেনেত্তেকে লোহার রড় দিয়ে খোঁচাতে গেলে টারজান গর্জন করতে করতে এগিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে তিনটে পিস্তল তার দিকে ধরা হলো।

জেনেত্তে ভয় পেয়ে গেলেও সে ওদের পীড়নের ভয়ে ঢুকে পড়ল খাঁচার মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে খাঁচার দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

হ্যান্স, স্মিৎস, ক্রাউজ, নাবিকরা সবাই স্তব্ধ বিস্ময়ে দেখতে লাগল ব্যাপারটাকে।

খাঁচার ভিতরে ঢুকেই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কি হয় তা দেখতে লাগল জেনেত্তে। সে টারজনের মুখপানে তাকাল এবং টারজানও তার মুখপানে তাকাল। জেনেত্তে দেখল টারজনের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে একফালি। হাসিটা দেখে আশ্বস্ত হলো জেনেত্তে। তার মনে হলো টারজনের হাসিটা বন্ধুত্বপূর্ণ। তা দেখে সে নিজেও হাসল।

টারজান এবার স্মিৎসের দেয়া হারপুনটা তুলে নিয়ে জেনেত্তের হাতে দিল সেটা।

হ্যান্স প্রথমে ভাবল টারজান হয়ত খুন করতে যাচ্ছে জেনেত্তেকে। তাই সে চীৎকার করে উঠেছিল ভয়ে। স্মিত্সকে বলল, লোকটাকে গুলি করো স্মিৎস।

কিন্তু টারজান কিছুই করল না দেখে সকলেই আশ্বস্ত হলো।

জেনেত্তের প্রতি টারজনের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব দেখে হতাশ হয়ে পড়ল স্মিৎস। সে ভেবেছিল তাকে হয়ত ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে টারজান। তাই সে আব্দুল্লাকে বলল, লোকটা আসলে বন্য নয়, ওর বেশ টনটনে জ্ঞান আছে। আব্দুল্লা তুমি একটা মিথ্যাবাদী।

আবদুল্লা স্মিৎসকে বলল, তুমি যদি মনে করো লোকটা বন্য বর্বর নয়, তাহলে তুমি নিজে তার খাঁচায় গিয়ে ঢুকতে পার।

পরদিন সকালে লোহার খাঁচার দু’জন বন্দী হাসিখুশিতে মেতে উঠল। যে বন্য লোকটিকে আব্দুল্লা নরখাদক বলে অভিহিত করেছে, যে কাঁচা মাংস খাবার সময় সিংহের মত গর্জন করে, যে তিনজন আফ্রিকান যোদ্ধাকে হত্যা করেছে সেই লোকটির সঙ্গে খাঁচার ভিতরে একটি রাত্রি কাটানো সত্ত্বেও জেনেত্তে দেখল তার দেহ অক্ষত আছে। কোন ক্ষতি হয়নি তার।

তা দেখে জেনেত্তে সকালে উঠেই এত খুশি হলো যে আনন্দের আবেগে একটা জনপ্রিয় ফরাসী গান গাইতে লাগল।

এদিকে টারজান খুশি হলো মেয়েটি ফরাসী বুঝতে পারার জন্য।

ফরাসী ভাষায় টারজান জেনেত্তেকে বলল, সুপ্রভাত!

বহুদিন আগে একজন ফরাসী লেফটেনেন্টের কাছে ফরাসী ভাষা শেখার সময় কথাটা শেখে টারজান।

জেনেত্তে তাকে সুপ্রভাত জানিয়ে আশ্চর্য হয়ে টারজনের মুখপানে তাকাল। তারপর বলল, ওরা যে বলেছিল তুমি নাকি কথা বলতে পার না।

টারজান বলল, একটা দুর্ঘটনায় আমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম। এখন ঠিক হয়ে গেছি।

এতে আমি আনন্দিত।

 টারজান বলল, তুমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলে। আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই।

ওরা কত ভয়ঙ্কর কথা বলেছিল। তুমি হয়ত শুনেছ তাদের কথা।

আমি কোন কথা বলতে পারিনি। তাদের কথা বুঝতেও পারিনি। তারা কি কি বলেছিল?

 তারা বলেছিল তুমি বড় হিংস্র। তুমি নাকি মানুষ খাও।

টারজনের মুখে আবার হাসি ফুটে উঠল। বলল, তারা তাই তোমাকে আমার খাঁচায় ভরে দেয়। ভেবেছিল আমি তোমাকে খেয়ে ফেলব। কে তোমাকে খাঁচায় ভরেছিল?

স্মিৎস, যে বিদ্রোহী হয়ে উঠে জাহাজ দখল করে।

 টারজান বলল, ঐ লোকটাই আমার মুখের উপর থুথু ফেলেছিল।

টারজনের গলার মধ্যে সিংহের গর্জনের একটা আভাস পেল জেনেত্তে। আব্দুল্লা ঠিকই বলেছে। লোকটা সিংহের কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে এখন আর কোন ভয় পায় না সে।

স্মিৎস কেন তোমায় ঘৃণা করে?

জেনেত্তে বলল, আমি তা জানি না। সে এক দুঃখবাদী বাতিকগ্রস্ত লোক। সে বেচারা লুম চিপের কি অবস্থা করেছে তা তুমি দেখেছ। সে অন্যান্য চীনা নাবিকদের কথায় কথায় লাথি মারে ও আঘাত করে।

আমি আশা করি জাহাজে কি কি ঘটেছে তা তুমি আমায় বলবে। আমি তা বুঝতে পারিনি। ওরা আমাকে নিয়ে কি করতে চায় তা যদি জেনে থাক তাও বলবে।

ক্রাউজ ত তোমাকে তার অন্যান্য পশুদের সঙ্গে একজন লোক হিসেবে শহরের লোকদের দেখাবার জন্য আমেরিকায় নিয়ে যাচ্ছিল।

ক্রাউজই এখন প্রথম মেটের সঙ্গে একটা খাঁচায় বন্দী হয়ে আছে। তাই না?

হ্যাঁ।

এবার তুমি ওদের বিদ্রোহের কথাটা ভেঙ্গে বল। স্মিসের পরিকল্পনাটাই বা কি সে সম্বন্ধে যা জান বল।

জেনেত্তের সব কথা বলা শেষ হলে টারজান বুঝতে পারল সাইগন জাহাজে কি নাটক চলছে। সে বুঝল জেনেত্তে, খাঁচায় ভরা হ্যান্স দ্য গ্রোত্তে, ক্রাউজ আর চীনা নাবিকরা তাদের দিকে।

হ্যান্স ঘুম থেকে উঠেই জেনেত্তেকে ডেকে বলল, তুমি ভাল আছ ত? ও তোমার কোন ক্ষতি করেনি ত?

 জেনেত্তে তাকে আশ্বাস দিয়ে বলল, না, কোনভাবে কোন ক্ষতি করেনি।

হ্যান্স বলল, আমি আজ স্মিৎসের সঙ্গে কথা বলব। আমি ও ক্রাউজ যদি তাকে কথা দিই তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনব না তাহলে সে হয়তো তোমাকে খাঁচা থেকে মুক্ত করে দিতে পারে।

জেনেত্তে বলল, জাহাজের মধ্যে এইটাই আমার পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। স্মিৎস যতদিন জাহাজের কর্তা হয়ে থাকবে ততদিন আমি খাঁচা থেকে বেরোব না।

স্মিৎস এসে দেখল টারজান খাঁচার ভিতরে শুয়ে ঘুমোচ্ছে।

স্মিৎস জেনেত্তেকে বলল, তুমি এখনো বেঁচে আছ দেখছি। আমার মনে হয় বাঁদরটার সঙ্গে রাতটা ভালভাবেই কাটিয়েছ এবং ওকে কিছু খেলা শিখিয়েছ। আমি তাহলে তোমায় ওর প্রশিক্ষক হিসেবে প্রদর্শনীতে দেখাতে পারব।

এরপর স্মিৎস খাঁচাটার কাছে এসে টারজানকে ভাল করে দেখে বলল, ও কি ঘুমোচ্ছে না কি ওকে খুন করেছ তুমি?

সহসা টারজান তার একটা হাত খাঁচা থেকে বার করে স্মিৎসের হাঁটুটা ধরে ফেলল। টারজান তখন স্মিৎসের হাঁটুটা খাঁচার ভিতরে টেনে আনতে স্মিৎস পড়ে গেল। সে চীৎকার করে উঠতে টারজান আর একটা হাত দিয়ে তার পিস্তলটা টেনে নিল।

স্মিৎস চীৎকার করতে লাগল, বাঁচাও, বাঁচাও। আব্দুল্লা, জবু সিং, চাঁদ, বাঁচাও।

আবদুল্লা জবু সি, চাঁদ স্মিৎসের চীৎকার শুনে ছুটে এল। কিন্তু টারজান তাদের দিকে পিস্তলটা উঁচিয়ে ধরতে তারা থেমে গেল।

টারজান বলল, খাবার আর জল এনে দাও, তা না হলে তোমার হাঁটুটা ভেঙ্গে দেব।

ক্রাউজ আর হ্যান্স দ্য গ্রোত্তে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল।

 স্মিৎস খাবার আর জল আনার জন্য চীৎকার করতে লাগল। সহসা হ্যান্স টারজানকে লক্ষ্য করে বলে। উঠল, দেখ, তোমার পিছনে কি?

কিন্তু টারজান পিছনে ফিরে দেখার আগেই একটা পিস্তল গর্জে উঠল এবং টারজান পড়ে গেল। জবু সিং খাঁচার পিছন দিক দিয়ে চুপি চুপি গিয়ে গুলি করে তার পিস্তল থেকে।

স্মিৎস ছাড়া পেয়ে সরে গেল। জবু সিং টারজনের উপর আবার গুলি করতে গেলে জেনেত্তে টারজনের পিস্তলটা তুলে নিয়ে জবু সিংকে লক্ষ্য করে গুলি করল। গুলিটা তার ডান হাতে লাগল। তার পিস্তলটা হাত থেকে পড়ে যেতে জেনেত্তে খাঁচার ধার থেকে সেটা তুলে নিল।

জেনেত্তে এবার হাঁটু গেড়ে বসে টারজনের বুকের উপর কান পেতে তার হৃৎস্পন্দন শোনার চেষ্টা করতে লাগল।

স্মিৎস উঠে দাঁড়িয়ে এক নিষ্ফল আক্রোশে চেঁচামেচি করছিল। এমন সময় সে একটা জাহাজ দেখতে পেয়ে ভাল করে সেটা দেখার জন্য উপরে উঠে গেল। সাইগন জাহাজের উপর কোন পতাকা ছিল না তখন। দরকার মত যে কোন একটা জাতীয় পতাকা উড়িয়ে দেবে সে।

দেখা গেল দূরে দেখতে পাওয়া জাহাজটা এক ইংরেজ জাহাজ। সে সঙ্গে সঙ্গে সাইগনের উপর একটা ইংরেজ পতাকা উড়িয়ে দিল। তারপর বেতারে সেই জাহাজের কাছে খবর পাঠিয়ে একজন ডাক্তার পাঠাতে বলল।

সেই অচেনা জাহাজটা জানাল তাদের সঙ্গে একজন ডাক্তার আছে। স্মিৎস জানাল, সে এখনি একটা নৌকা পাঠাচ্ছে।

স্মিৎস তখন বেশ কিছু পিস্তল, রাইফেল, ছোরা, রড় প্রভৃতি অস্ত্র গোপনে একটা নৌকার উপরে তুলে নিয়ে সে নিজে কয়েকজন নাবিককে নিয়ে নৌকাটায় উঠে বসল।

জাহাজটার কাছে গিয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তারা জাহাজে উঠে পড়ল। এমন সময় দেখা গেল সাইগনে জার্মান পতাকা উড়ছে।

জাহাজটাতে ছিল পঁচিশ তিরিশজন লোক আর দু’জন মহিলা। স্মিৎসের জলদস্যুসুলভ কারবার দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল জাহাজের ক্যাপ্টেন। স্মিৎসকে বলল, এ সবের মানে কি?

স্মিৎস তার সাইগন জাহাজে উড়তে থাকা জার্মান পতাকাটা দেখিয়ে বলল, এর মানে হলো আমি জার্মান সরকারের পক্ষ থেকে তোমাদের গ্রেফতার করলাম। এ জাহাজ এখন আমাদের দখলে। তোমাদের ইঞ্জিনীয়ার এবং জাহাজ চালক জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যাবে। আমার প্রথম মেট জবু সিং দেখাশোনা করবে। সে কিছুটা আহত। তোমাদের ডাক্তার তার ক্ষতটা বেঁধে দেবে। বাকি তোমরা সবাই আমার সঙ্গে জাহাজে গিয়ে উঠবে। মনে রাখবে এখন তোমরা যুদ্ধবন্দী। সেই মত আচরণ করবে।

দখল-করা জাহাজের ক্যাপ্টেন স্মিৎসকে বলল, কিন্তু আমাদের জাহাজ ত যুদ্ধ জাহাজ নয়, কোন পণ্যবাহী জাহাজও নয়। এটাকে কি জন্য দখল করবেন?

লম্বা চেহারার একজন যুবক বলল, হ্যাঁ, এটা দখল করতে পারেন না।

স্মিৎস তাকে ধমক দিয়ে বলল, চুপ করো। তোমরা ইংরেজ। এইটাই জাহাজ দখল করার যথেষ্ট কারণ। এখন এস। তোমাদের ডাক্তার কই?

ডাক্তার যখন জবু সিং-এর ক্ষতটা বেঁধে দিচ্ছিল তখন স্মিৎস আর তার লোকজন জাহাজের ভিতরটা খোঁজাখুঁজি করে কতকগুলো পিস্তল আর শিকারের রাইফেল পেল। সেগুলো নিয়ে তার লোকজনকে কিছু নির্দেশ দিয়ে সে বন্দীদের নিয়ে তার জাহাজে চলে গেল।

জবু সিং-এর গুলিটা টারজনের মাথার একটুখানি চামড়া ছিঁড়ে দিয়ে চলে যায়।

সে তাই কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞান হয়ে থাকে। আঘাতটা জোর হয়নি। তাই সে কিছুক্ষণ পরেই উঠে বসল।

অন্য জাহাজ থেকে স্মিৎস কয়েকজন লোককে বন্দী করে নিয়ে এলে জেনেত্তে বলল, স্মিৎস জলদস্যু হয়ে গেছে। ঐ সব লোকগুলোকে নিয়েও কি করবে তা বুঝতে পারছি না। ওরা সংখ্যায় প্রায় পনেরজন হবে।

বন্দীদের মধ্যে থেকে আটজনকে স্মিৎস জাহাজ চালানোর কাজে পাঠিয়ে দিল। তারপর দুটো খাঁচা এনে বন্দীদের বলল, কে কার সঙ্গে কোন্ খাঁচায় থাকবে বেছে নাও।

একটি মেয়ে তার কাকা ও কাকিমাকে নিয়ে ছোট খাঁচাটায় ঢুকল। অন্য খাঁচাটায় ঢুকল দখল করা জাহাজের ক্যাপ্টেন বোল্টন, দ্বিতীয় মেট টিবেট, ডাক্তার ক্রোক আর এ্যালজারনন নামে এক যুবক।

যে খাঁচাটায় কর্নেল উইলিয়াম সিসিল লে, তার স্ত্রী পেনিলোপ লে আর ভাইঝি প্যাট্রিসিয়া ছিল সেই খাঁচাটা ছিল টারজানদের খাঁচাটার ঠিক পাশে। ৭৭

পেনিলোপ লে টারজানকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার ভাইঝিকে বলল, কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার! লোকটা প্রায় উলফঙ্গ।

প্যাট্রিসিয়া বলল, লোকটা কিন্তু দেখতে খুব সুন্দর কাকিমা।

 স্মিৎস এবার চীৎকার করে বলতে লাগল, এবার এই সব জন্তুদের খাবার দেয়া হবে।

কয়েকজন নাবিক ও লস্কর খাবার ও জল নিয়ে এল বন্দীদের জন্য।

খাবারগুলো ছিল পরিমাণে কম এবং বাজে। টারজানকে একখণ্ড কাঁচা মাংস দেয়া হলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই টারজনের গলা থেকে বেরিয়ে আসা সিংহের গর্জনের মত একটা শব্দ শুনতে পেয়ে পেনিলোপ বলে উঠল আশ্চর্য হয়ে, দেখ, দেখ, লোকটা কাঁচা মাংস খাচ্ছে আর সিংহের মত গর্জন করছে।

টারজান জেনেত্তের মুখপানে তাকিয়ে মৃদু হাসল।

টারজান প্রতিদিন লক্ষ্য করত রাতের একজন প্রহরী রোজ রাত চারটের সময় খাঁচার বন্দীদের পরিদর্শন করে যায়। সে তখন একাই আসে। তবে স্মিৎস তার নিরাপত্তার জন্য একটা পিস্তল দিয়েছিল তাকে।

রাত গম্ভীর হলে মুষলধারে বৃষ্টি নামল। ঝড়ের বেগ হয়ে উঠল প্রবল। ভয়ানকভাবে দুলতে লাগল সাইগন জাহাজটা।

টারজান তার খাঁচার মধ্যে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে এই দুর্যোগটা দেখছিল। সে দেখল তাদের পাশের খাঁচাটায় সেই ইংরেজ মেয়ে প্যাট্রিসিয়াও দাঁড়িয়ে আছে।

টারজান অপেক্ষা করছিল পরিদর্শনকারী সেই পাহারাদারটার জন্য। কিন্তু সে রাতে পাহারাদার এল না।

ইংরেজ মেয়েটিকে পায়চারি করতে দেখে টারজনের মনে হলো, সত্যিই কাজের। যে কোন অবস্থার সম্মুখীন হতে পারে সাহসের সঙ্গে। মুখ বুজে সব দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে পারে।

টারজান বুঝতে পারল মেয়েটি সুযোগ আসার অপেক্ষায় আছে। সুযোগ এলেই সাহস আর বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজ করে যাবে সে।

টারজান প্যাট্রিসিয়ার খামার কাছে এসে দেখল, মেয়েটির ঝড় বৃষ্টির বেগ ও জাহাজের দোলানিটাকে সহজভাবে মেনে নিচ্ছে।

টারজান মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি একজন ইংরেজ?

হ্যাঁ।

৪১৫

আমার নাম প্যাট্রিসিয়া লে বার্ডেল। আপনার নামটি জানতে পারি কি?

 আমার নাম টারজান।

আপনাকে কিভাবে খাঁচায় ভরা হলো তা বলবেন কি মিস্টার টারজান?

আব্দুল্লা আবু নেজিম আমার উপর প্রতিশোধ নেবার জন্যই আমাকে এই খাঁচায় এনে ভরে। সে আমাকে আফ্রিকার এক সর্দারের সহায়তায় ধরে। আব্দুল্লা আমাকে ক্রাউজ নামে একটা লোকের কাছে। বিক্রি করে। ক্রাউজ আমেরিকায় বিক্রি করার জন্য কিছু জন্তু জানোয়ার সংগ্রহ করে। আমার খাঁচার পাশে একটা খাঁচায় বন্দী আছে ক্রাউজ। স্মিৎস একদিন ক্রাউজের এই জাহাজের দ্বিতীয় মেট ছিল। সে ক্রাউজের জাহাজ দখল করার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ও তার জন্তু জানোয়ারগুলো সব তার দখলে আসে। ক্রাউজও এখন তার হাতে বন্দী।

তবে সমুদ্রের অবস্থা যদি আরো খারাপ হয় তাহলে সে আমাদের বেশিদিন আটকে রাখতে পারবে বলে মনে হয় না।

প্রচণ্ড ঝড়ে ও তুফানে জাহাজটা তখন দুলছিল ভীষণভাবে।

রাত্রি শেষ হলো অবশেষে। কিন্তু ঝড়ের বেগ কমল না। মাঝে মাঝে এক একটা ঢেউ এসে জাহাজের ডেকটাকে ভাসিয়ে দিচ্ছিল। যারা খাঁচার ভিতরে বন্দী ছিল তারা সবাই ভিজে গেল।

সেদিন বন্দীদের কেউ খাবার দিয়ে গেল না। ডেকের নিচে ক্ষুধার্ত পশুগুলো গর্জন করতে লাগল। দুর্যোগের তৃতীয় দিনের বিকালের দিকে দু’জন চীনা নাবিক বন্দীদের কিছু খাবার দিয়ে গেল। খাবার বলতে ছিল ঠাণ্ডা সঁতসেঁতে বিস্কুট।

এদিকে টারজান যার জন্য অপেক্ষা করছিল সে এসে গেল অবশেষে। অশোকা নামে এক লস্কর খাঁচাগুলো পরিদর্শন করতে এল।

অশোকা ডেকের উপর এলে জাহাজের আলোয় তাকে দেখতে পেল টারজান।

অশোকা যখন খাঁচাগুলোর সামনে দিয়ে চলে গেল টারজান তখন খাঁচার দুটো রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে। ছিল। জেনেত্তেও তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বুঝতে পারল কিছু একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটবে।

জেনেত্তে দেখল টারজান খাঁচার রেলিং দুটোর উপর তার গায়ের সব শক্তি প্রয়োগ করছে। খাঁচার রেলিং দুটো বেঁকে ফাঁক হয়ে গেল এক সময়।

টারজান বেরিয়ে পড়ল খাঁচা থেকে।

অশোকা যখন শেষ খাঁচাটার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন তার পিছন থেকে কে এসে তার গলাটা টিপে ধরল। তার বন্দুকটা ছিনিয়ে নিল সঙ্গে সঙ্গে।

তা দেখে জেনেত্তে খাঁচার সেই ফাঁক দিয়ে দু’হাতে দু’টো পিস্তল নিয়ে বেরিয়ে এল।

অশোকা চীৎকার করার চেষ্টা করলে টারজান তাকে বলল, চেঁচালে মেরে ফেলব।

টারজান পিছন ফিরে দেখল জেনেত্তে তার পিছু পিছু আসছে। সে তখন অশোকার কাছে থেকে খাঁচাগুলোর চাবির গোছাটা নিয়ে জেনেত্তের হাতে দিয়ে বলল, সব খাঁচার দরজাগুলো খুলে দাও।

টারজান নিচু গলায় বন্দীদের বলল, তোমরা আমার সঙ্গে চলে এস। শুধু কর্নেল আর মেয়েরা থাকবে।

তারপর অশোকাকে খাঁচার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে জেনেত্তেকে বলল, খাঁচাটায় চাবি দিয়ে দাও।

নাইয়াদ জাহাজ থেকে আসা লোকগুলোকে পিছন ফিরে দেখে চিনতে পারল টারজান। অশোকার থেকে উদ্ধার করা পিস্তলটা হ্যান্স দ্য গ্রোত্তেকে দিল টারজান। তারপর জেনেত্তেকে বলল, দখল করা নাইয়াদ জাহাজের দ্বিতীয় মেট টিবেটকে একটা পিস্তল দিতে বল।

টারজান টিবেটকে বলল, তুমি আমার সঙ্গে এস। হ্যান্স জাহাজ চালাবে।

এরপর সে অন্যান্য লোকদের বলল, তোমরা যে যা পার যা হোক একটা করে অস্ত্র তুলে নিয়ে আমার সঙ্গে এস। কারণ লড়াই হবেই।

ঝড়টা আবার নতুন করে শুরু হল। সাইগন জাহাজটা আবার দুলতে লাগল আগের মত। টারজান তার দলবল নিয়ে মই বেয়ে ব্রিজের উপরে উঠল। সেখানে লস্কর চাঁদ চাকা ধরে ছিল আর স্মিৎস পাহারা দিচ্ছিল।

টারজানকে দেখতে পাবার সঙ্গে সঙ্গে চীৎকার করে চাঁদকে সাবধান করে দিয়ে বন্দুকের ঘোড়াটা টিপে দিল। গুলিটা ছাদে গিয়ে লাগল। টারজান তার বন্দুকটা আর টিবেট চাঁদের বন্দুকটা ছিনিয়ে নিল।

এরপর স্মিৎস আর চাঁদকে টারজান একটা খালি খাঁচার কাছে এনে তার চাবি খুলে বন্দী স্মিৎস আর চাঁদকে তার মধ্যে ঢুকতে বলল।

এমন সময় ঝড়ের গর্জনকে ছাপিয়ে একটা গুলির শব্দ নিচের থেকে কানে এল টারজনের। সে তখন সেই শব্দ লক্ষ্য করে ছুটে গেল।

ঘটনাস্থলে গিয়ে টারজান দেখল কয়েকজন সশস্ত্র লস্কর আর তার লোকদের আক্রমণ করেছিল। কিন্তু কোন ক্ষতি করতে পারেনি।

টারজান দেখল তিন-চারজন লস্কর পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। টারজান দুটো পিস্তল হাতে তাদের পিছন দিকে গিয়ে বলল, পিস্তলগুলো ফেলে দাও। তা না হলে গুলি করব।

মুখ ঘুরিয়ে টারজনের দু’হাতে দুটো পিস্তল দেখে দু’জন লস্কর তাদের পিস্তল দুটো ফেলে দিল।

এরপর প্রতিপক্ষদের সকলকে নিরস্ত্র করা হল। যার কাছে যা কিছু ছিল সব কেড়ে নেয়া হলো। সাইগনের চীনা নাবিকরা ও নাইয়াদ জাহাজের নাবিকরা কোন বাধা না দিয়ে খুশি হয়ে চলে এল। টারজনের দলে। আধপাগলা স্মিৎসের অধীনে তারা আর কাজ করতে চাইছিল না।

জাহাজটাকে সম্পূর্ণরূপে দখল করার পর টারজান একটা সেলুনের মধ্যে সবাইকে ডাকল।

টারজান দখল করা নাইয়াদ জাহাজের ক্যাপ্টেন বোল্টনকে বলল, তুমি এই জাহাজের ক্যাপ্টেন হবে। হ্যান্স দ্য গ্রোত্তে হবে তোমর প্রথম মেট আর টিবেট হবে দ্বিতীয় মেট। হ্যান্স বলেছে এ জাহাজে দুটো কেবিন আছে। একটাতে থাকবে কর্নেল আর তার স্ত্রী আর অন্যটাতে থাকবে প্যাট্রিসিয়া আর জেনেত্তে।

টারজান এবার হ্যান্স দ্য গ্রোত্তের কাছে গিয়ে সব কথা বলে বলল, উবানোভিচের খবর কি?

 আমি তাকে ডেকে পাঠিয়েছি। এখনি এসে পড়বে।

গ্রোত্তে বলল, লোকটা কোন পক্ষেই নেই। ও লোকটা হাড়ে হাড়ে কমিউনিস্ট। এই যে এসে গেছে।

উবানোভিচকে দেখে রাগান্বিত আর সন্দিগ্ধ মনে হলো। সে রুষ্ট হয়ে বলল, তোমরা এখানে সব দাঁড়িয়ে কি করছ। স্মিৎস কোথায়?

সে আছে ক্রাউজের সঙ্গে একই খাঁচাতে। বিদ্রোহের সঙ্গে তোমার কোন যোগাযোগ ছিল কি না তা আমি জানি না। এখন তুমি যদি জাহাজে ইঞ্জিনীয়ার হিসেবে আগের মত কাজ করে যেতে চাও তাহলে কেউ কোন প্রশ্ন করবে না।

উবানোভিচ বলল, ঠিক আছে। তাই হবে।

 টারজান বলল, বোল্টন এখন এ জাহাজের ক্যাপ্টেন। তার কাছে বল যে তুমি ইঞ্জিনীয়ার।

এমন সময় তাদের পিছন থেকে একটা গুলির শব্দ এল। ডেকের সামনের কাঁচের জানালাটা ভেঙ্গে গেল সেই গুলিটা লাগায়। তারা মুখ ঘুরিয়ে দেখল আব্দুল্লা মই-এর সবচেয়ে উপরের ধাপে একটা ধূমায়িত পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

আব্দুল্লা আবার একটা গুলি করল। কিন্তু জাহাজটা প্রবলভাবে দুলছিল বলে লক্ষ্যভ্রষ্ট হল তার গুলি। সঙ্গে সঙ্গে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল টারজান। টাল সামলাতে না পেরে মই-এর উপর থেকে পিছন দিকের। ডেকে চিৎ হয়ে পড়ে গেল আব্দুল্লা। তার উপর টারজান পড়ে গেল।

ক্যাপ্টেন বোল্টন যে দু’জন লোককে টারজনের কাছে পাঠিয়েছিল তারা এই ঘটনা দেখতে ছুটে গেল। দেখল টারজনের গায়ে কোন আঘাত লাগেনি। সে সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ল। কিন্তু আব্দুল্লা অচেতন হয়ে পড়ে আছে।

জেনেত্তের কাছ থেকে খাঁচার চাবি আনতে পাঠিয়ে দিল টারজান। তারপর যে আঁচাতে ক্রাউজ আর স্মিৎস ছিল সেটা খুলতে বলে আব্দুল্লার অচেতন দেহটাকে টানতে টানতে এনে সেই খাঁচার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল।

ঝড়ের বেগ প্রচণ্ড হয়ে উঠল আবার। টারজান বুঝতে পারল নির্দিষ্ট পথ হতে অন্য দিকে সরে যাচ্ছে সাইগন। মাস্তুল ঝড়ে উড়ে গেছে।

তখন ভোর হয়ে আসছিল। বোল্টনের কথায় টারজান দূরে তাকিয়ে দেখল ঝড় আর স্রোতের আঘাতে মাস্তুলহারা সাইগন দুর্বার বেগে পাহাড়-ঘেরা এক দ্বীপের দিকে ভেসে চলেছে।

বোল্টন বলল, জাহাজটা জোরে গিয়ে ঐ সব পাহাড় প্রাচীরের গায়ে ধাক্কা লাগলে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। তার থেকে এখন থেকে নৌকা নামিয়ে সবাইকে পাঠিয়ে দেয়া হোক। ডান দিকে একটা ফাঁক আছে খাড়ির মত। সেখান থেকে কূলে ওঠা সহজ হবে।

বোল্টন নৌকা নামানোর হুকুম দিতেই কয়েকজন লস্কর একটা নৌকা নামিয়ে কূলের দিকে চলে গেল। হ্যান্স দ্য গ্রোত্তে বাধা দেবার সুযোগ পেল না। অন্যান্য লস্কররা নৌকা নামানোর চেষ্টা করতেই বোল্টন ও টিবেট পিস্তল উঁচিয়ে তাদের সামনে দাঁড়াতেই তারা থেমে গেল।

বোল্টন বলল, যে আমাদের কথা মানবে না তাকেই গুলি করবে। এখন আমরা দেখব ওরা কোথায় কিভাবে গিয়ে কূলে ওঠে।

সাইগন অসহায়ভাবে পাহাড় প্রাচীর দিয়ে ঘেরা দ্বীপটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। ওদিকে লস্করদের নৌকাটাও উত্তাল সমুদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এগোতে লাগল।

টারজান বলল, ঝড় আর সমুদ্রের তুফান দুটোই শান্ত হয়ে আসছে। দ্বীপের কাছে সমুদ্র অনেক শান্ত। সেখানে গেলে নৌকা নামালে কূলে ওঠা সহজ হবে।

বোল্টন বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে ক্যাপ্টেন হিসেবে আমি একা জাহাজে থাকব। আমাদের সকলের জীবন যেখানে বিপন্ন তখন চারটে নৌকা নামিয়ে যাত্রীদের যেতে বলব।

কিন্তু সকলেই লস্করদের নৌকাটার কি হয় তা দেখার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠল। কেউ নৌকায় করে। যাবার ঝুঁকি নিতে চাইল না।

ওরা দেখল লস্করুদের নৌকাটা খাড়ির কাছে যেতে পারল না। দ্বীপটার কাছে ঢেউএর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এক সময় উল্টে গেল। লস্কররা সাঁতার কাটতে কাটতে এগোতে লাগল।

বোল্টন বলল, এখানকার জল অগভীর।

ঝড় আর তুফানের বেগ কমে যাওয়ায় সাইগন ধীর গতিতে এগোচ্ছিল দ্বীপের দিকে। পাহাড়ে গিয়ে ধাক্কা লাগার আর দেরী নেই। তাই এবার নৌকা নামাবার হুকুম দেয়া হলো।

নাবিকরা যখন নৌকা নামানোর কাজে ব্যস্ত ছিল তখন ক্রাউজ চীৎকার করে উঠল খাঁচা থেকে, শোন গ্রোত্তে, তোমরা কি আমাদের ফেলে চলে যাবে? আমরা কি খাঁচার মধ্যে ইঁদুরের মত ডুবে মরব?

গ্রোত্তে টারজনের মুখপানে তাকাল। টারজান জেনেত্তের কাছ থেকে চাবি নিয়ে খাঁচার দরজা খুলে দিয়ে বলল, তোমাদের ছেড়ে দিলাম। এর বেশি কিছু করতে পারব না। তোমরা তোমাদের জীবন রক্ষা করবে। তোমাদের আচরণ যেন ভাল হয়। তোমাদের হত্যা করার যথেষ্ট কারণ ছিল। কিন্তু করব না।

খাঁচা খুলে দিতে ক্রাউজ, স্মিৎস আর আব্দুল্লা বেরিয়ে এল রাগে গর্জন করতে করতে।

বোল্টন চীৎকার করে উঠল, নৌকা ও ভেলা ঠিক করে রাখ। এবার জাহাজে ধাক্কা লাগবে।

জাহাজের যাত্রীরা সবাই এক গভীর ভয় আর উদ্বেগের সঙ্গে শেষ মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

পাহাড়ের উপর সাইগন জাহাজটা সরাসরি ধাক্কা লাগাল না। অবশেষে একটা বিশাল ঢেউ এসে জাহাজটাকে মারতে জাহাজটা আটকে গেল পাহাড়ে। আবার পাহাড়ের কাছে টেনে আনতে থাকে।

টারজান এবার বোল্টনকে বলল, আমি ওখানে গিয়ে দেখি জল কতটা। যারা সাঁতার জানে না আমি তাদের কোন নৌকা বা ভেলায় চাপিয়ে দিয়ে কূলে উঠতে সাহায্য করব।

রেলিং-এর উপর তুলে ঝাঁপ দিল টারজান। সকলে জাহাজের উপর রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করতে লাগল টারজানকে।

প্যাট্রিসিয়াও জলে ঝাঁপ দিয়ে টারজনের পাশে গিয়ে বলল, আমি সাঁতার জানি, আমি আপনাকে সাহায্য করব।

জেনেত্তেও ঝাঁপ দিল। কিন্তু সে সাঁতার জানত না। টারজান তাকে ধরে একটা নৌকার উপর চাপিয়ে দিল।

এরপর অনেকেই এগিয়ে এল টারজনের সাহায্যে। হ্যান্স, টিবেট, কোচ, চীনা নাবিকরা আর নাইয়াদ জাহাজের অনেকেই এগিয়ে এল। বাকি সবাই জাহাজ থেকে নেমে কূলে উঠে গেছে।

টারজান প্রথমে ওরাং ওটাংদের ছেড়ে দিল। টারজান তাদের সঙ্গে তাদের ভাষায় কি সব কথা বলল, তারা ভয়ে টারজানকে জড়িয়ে ধরল। টারজান তাদের নামিয়ে দিল।

তারপর বড় বড় জন্তুর খাঁচাগুলো খুলে দেয়া হলো। প্রথমে তিনটে পোষা ভারতীয় হাতিকে ছেড়ে দেয়া হল। মাহুত একটা হাতির পিঠে চেপে রইল। হাতিটা সাঁতার কেটে কূলে গিয়ে পৌঁছল তা দেখে বাকি হাতি দুটোও তাই করল, তা দেখে আফ্রিকার বুনো হাতিগুলোও তাই করল।

এরপর বাঘ আর সিংহদের খাঁচাগুলো খুলে দেয়া হলো। বিপদ বুঝে তারাও নির্বিবাদে জল কেটে কুলে গিয়ে উঠল।

সকলে দেখতে লাগল। জন্তুগুলো ছাড়া পেয়ে কূলে উঠে জঙ্গল দেখতে পেয়ে একে একে সেই জঙ্গলে চলে গেল।

বাকি রইল শুধু সাপগুলো। টারজান বলল, ওরা আমার চিরকালের শত্ৰু, ওরা মরে মরুক।

যাত্রীদের সকলকে কূলে নামিয়ে দিয়ে নাবিকরা খালি নৌকা আর ভেলাগুলো নিয়ে আবার জাহাজে ফিরে এল।

বোল্টন তাই আদেশ দিয়েছিল।

এরপর দুদিন ধরে জাহাজের মালপত্র সব নৌকায় করে কূলে নিয়ে যাওয়া হলো।

তৃতীয় দিন বিকালের দিকে যখন শিবির তৈরির সব কাজ হয়ে গেল তখন সকলের অলক্ষ্যে পাহাড়ের মাথা থেকে এক ডজন লোক বেলাভূমিতে বসে থাকা একদল অচেনা বিদেশী লোকদের দেখতে লাগল। এই প্রথম তারা তাদের দ্বীপে বিদেশী মানুষ দেখল।

পাহাড় থেকে যারা সাইগন জাহাজের বিপন্ন যাত্রীদের লক্ষ্য করছিল তারা ছিল সেই দ্বীপের আদিবাসী যোদ্ধা। তাদের কোমরে এক ধরনের লাল ছোট কাপড় জড়ানো ছিল, পায়ে ছিল চামড়ার চটি। মাথায় পালক, হাতে গয়না। তাদের সর্দার জালন দিনের বেশভূষা ছিল সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ।

তাদের হাতে ছিল তীর ধনুক। প্রত্যেকের পিঠে ছিল দুটো করে তৃণ। আর ছিল একটা বর্শা আর পাথর ছোঁড়ার গুলতি। এছাড়া ছিল একটা করে কাঠের তলোয়ার, বর্শা আর চামড়া দিয়ে মোড়া কাঠের ঢাল।

সেদিন দুপুরবেলায় জাহাজ থেকে আনা মানচিত্রটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল ক্যাপ্টেন বোল্টন। কিন্তু দেখল মানচিত্রে সমুদ্রের একশো মাইলের মধ্যে কোন দ্বীপের উল্লেখ নেই।

বোল্টন বলল, এমন হতে পারে যে এই দ্বীপটা এখনো পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে।

দলের সবাইকে ডেকে টারজান বলতে লাগল, এই শিবিরে স্মিৎস, ক্রাউজ, আব্দুল্লা আর উবানোভিচকে থাকতে দেব না। ক্যাপ্টেন বোল্টন বলেছে, এ দ্বীপে হয়ত আমাদের সারাজীবন কাটাতে হবে। ওরা থাকলে আবার গোলমাল বাধবে।

এরপর সে ক্রাউজ, আব্দুল্লা, স্মিৎস আর উবানোভিচকে বলল, তোমরা এখান থেকে উত্তর দিকে চলে যাও। এখান থেকে দশ মাইলের মধ্যে আসতে পারবে না তোমরা। এলে হত্যা করব আমি তোমাদের।

উবানোভিচ বলল, ঠিক আছে, আমরা যাব। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র ও খাবারের ভাগ নিয়ে যাব আমাদের সঙ্গে।

 টারজান বলল, তোমরা জীবন নিয়ে যেতে পারছ এটাই যথেষ্ট।

শিবির গড়ার কাজ হয়ে গেলে অস্ত্র তৈরির কাজে মন দিল টারজান।

একদিন খুব সকালে অন্যরা ঘুম থেকে না উঠতেই তার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শিকারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল টারজান। নদীটার গতিপথ ধরে এগিয়ে চলল সে। কিন্তু নিচে অনেক ঘন ঝোপঝাড় থাকায় গাছের ডালে ডালে এগিয়ে চলল সে।

কিছুদূর এইভাবে যাবার পর টারজান দেখল দুটো ওরাং ওটাং তার পিছু পিছু আসছে। তারা ওর ভাষা বুঝত এবং শিবিরেই ছিল। টারজান তাদের বলল, গোলমাল করো না। টারজান শিকার করবে।

তারা তাই গাছে চড়ে ডালে ডালে বনের গভীরে চলে গেল।

পাহাড়ের ঢালু জায়গায় টারজান দেখল কয়েকটা হাতি গাছের ডালপালা খাচ্ছে। একটা হাতির গায়ে হাত বুলোতে সে টারজানকে শুড় দিয়ে তার পিঠে চাপিয়ে নিল।

টারজান তখন নালা নালা’ বলে চীৎকার করতেই সে তাকে নামিয়ে দিল।

এরপর সে কিছুদূর গিয়ে হাতিটাকে ডাকতেই সে উত্তর দিল।

ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় ঘন জঙ্গল আর কাছে জল দেখে টারজান বুঝল এটা শিকারের একটা ভাল জায়গা।

সকাল হতেই নাকে শুয়োরের গন্ধ পেল টারজান। এর পরই সে পেল আরো দুটো গন্ধ-একটা সিংহের আর একটা মানুষের।

টারজান এবার গাছের উপর ডালে ডালে সেই গন্ধের সূত্র ধরে এগোতে লাগল।

এদিকে যে লোকটা একটা সিংহ ধরতে যাচ্ছিল সে হলো ঠাক চান। ঠাক চান সিংহ শিকার করতে আসেনি। জীবনে সে সিংহ দেখেনি কখনো। সে এসেছিল একটা শুয়োর শিকার করতে। কিন্তু শিকার করতে এসে হঠাৎ একটা সিংহকে দেখে ছুটে পালাতে থাকে সে।

চাক টুটুল জিউ নামে ঠাক চানের এক পূর্ব-পুরুষ জুকাতান থেকে এই দ্বীপে এসে চিচেন ইজ্জা নামে এক নগর স্থাপন করে। তার আগে সমুদ্রের মধ্যে এই দ্বীপটা দেখে সে তার নাম দেয় উজান বা উক্সনাল।

ঠাক চান শিকারে এসেছিল সেই চিচেন ইজ্জা নগর থেকে।

সিংহটাকে দেখে ভয়ে পালাতে থাকে ঠাক চান। ক্ষুধিত সিংহটার গতির সঙ্গে পেরে ওঠেনি সে। তাই একটা ফাঁকা জায়গা দেখে সেখানে হতাশ হয়ে বসে পড়ে। মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতে থাকে। সিংহটা তার কাছে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।

এমন সময় ঠাক চান দেখল দেবতার মত দেখতে গৌরবর্ণ এক নগ্ন মানুষ গাছ থেকে হঠাৎ সিংহটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

সিংহটা মাটিতে পড়ে যেতেই তার গলাটা একটা হাত দিয়ে ধরে আর একটা হাতে ধরা ছুরিটা সিংহটার পাঁজরে বসিয়ে দিতে লাগল বার বার। সিংহটা কিছুতেই পেরে উঠল না। অবশেষে বার বার ছুরির আঘাতে লুটিয়ে পড়ল সিংহটা।

সিংহটা মরে যেতেই লোকটা তার মৃতদেহের উপর একটা পা রেখে আকাশের দিকে মুখ তুলে এমন ভয়ঙ্করভাবে চীৎকার করে উঠল যা শুনে ভয় পেয়ে গেল ঠাক চান। লোকটা আসলে দেবতা না শয়তান তা বুঝতে পারল না। ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে উঠল তার মনটা।

টারজান বনদেবতা ভেবে ঠাক চান মধুর সম্ভাষণে কৃতজ্ঞতা জানাল তাকে। কিন্তু তার উত্তরে টারজান যা বলল তার কিছুই বুঝতে পারল না সে। ভাবল দেবতারা হয়ত এই ভাষাতেই কথা বলে।

এরপর বনদেবতা টারজানকে সঙ্গে করে সে চিচেন ইৎজা নগরের প্রান্তে এসে হাজির হলো। ঠাক চান হাত বাড়িয়ে নগরটাকে দেখিয়ে বলল, চিচেন ইৎজা।

নগরের বাইরে মাঠে অনেক নারী পুরুষ চাষের কাজ করছিল। নগরদ্বারে যোদ্ধারা পাহারা দিচ্ছিল।

টারজানকে দেখল এক বিরাট প্রাচীর দিয়ে গোটা নগরটা ঘেরা। নগরের মাঝখানে আছে পিরামিডের মত একটা উঁচু মন্দির। নগরের মধ্যে অনেক বড় বড় বাড়ি আছে। নগরের লোকগুলো ঠাক চানের মত বেঁটে খাটো আর বাদামী রঙের।

টারজনের নগ্ন দৈত্যাকার মূর্তির পানে তাকিয়ে সকলেই আশ্চর্য হয়ে গেল। ঠাক চান নগরদ্বারের প্রহরীদের কাছে গিয়ে বনদেবতা চে হিসেবে টারজনের পরিচয় দিল। বলল, একটা বিরাট আকারের হিংস্র জন্তুর কবল থেকে এই দেবতা বাঁচিয়েছে তাকে।

কিছুদিন আগে পাহাড় থেকে যে একদল আদিবাসী সাইগন জাহাজের বিপন্ন যাত্রীদের দেখতে পায়। সেই দলের সর্দার জালন দিনও নগরদ্বারের প্রহরীদের মধ্যে ছিল।

জালন দিন টাজনকে বলল, তুমি যদি বনদেবতা চে হও তাহলে তার প্রমাণ দাও। তাহলে আমাদের রাজা তোমাকে ভক্তি ও সম্মানের সঙ্গে বরণ করে নেবে।

ঠাক চান বলল, দেবতারা মানুষের ভাষা বুঝতে পারে, কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলে না।

ঠাক চানের কথায় আর টারজনের দেবতার মত চেহারাটা দেখে কিছুটা মুগ্ধ হলো জালন দিন। সে তাই তাদের সঙ্গে করে রাজপ্রাসাদ সংলগ্ন মন্দিরে নিয়ে গেল তাদের।

সেখানে অনেক যোদ্ধা, পুরোহিত ও সর্দার ছিল। জালন দিন একজন পুরোহিতকে ঠাক চানের সব কথা বুঝিয়ে বলল।

টারজান যোদ্ধাদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে ভাবল এই নগরে প্রবেশ করা বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি। তাকে তারা ফাঁদে ফেলতে পারে এবং তার থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে।

এরপর প্রধান পুরোহিত চান ইপ প্রথমে টারজনের চেহারা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। তাকে সম্মানের সঙ্গে সম্বোধন করল। কিন্তু সর্দার জালন দিন তাকে জানাল এই দেবতা কোন মর্ত মানবের সঙ্গে কথা বলেন না।

চান ইপ তাকে বলল, তুমি সমুদ্রের বেলাভূমিতে একদল বিদেশীকে দেখেছিলে। এ তাদেরই একজন নয় ত?

সর্দার জালন দিন বলল, তা হতে পারে হুজুর।

চান ইপ বলল, এ যদি দেবতা হয় তাহলে তারাও সবাই দেবতা। কিন্তু তুমি বলেছিলে এক ভগ্ন জাহাজ কূলের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল।

জালন দিন বলল, এ কথা সত্য।

প্রধান পুরোহিত বলল, তাহলে এরা সবাই মানুষ। কারণ দেবতা হলে তারা ঝড় তুফানকে জয় করতে পারত।

এ কথা খুব সত্য।

চান ইপ তখন বলল, তাহলে এই লোকটাকে দেবতার কাছে বলি দেয়া হবে। একে নিয়ে যাও এখান থেকে।

ঘটনার স্রোত এইভাবে প্রতিকূলে যাওয়ায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল ঠাক চান। তবু সে প্রতিবাদের সুরে বলল, এঁর কাজ আপনি দেখেননি হুজুর। আপনি দেখেননি একটা জন্তু আমাকে গ্রাস করতে এলে ইনি তার পিঠের উপর লাফ দিয়ে পড়ে তাকে মেরে ফেলেন। দেবতা ছাড়া কোন মানুষ সে কাজ করতে পারে না।

প্রধান পুরোহিত ঠাক চানকে বলল, এখান থেকে চলে যাও, তা না হলে তোমাকেও বলি দেয়া হবে অথবা কূয়োর জলে ডুবিয়ে মারা হবে।

ঠাক চান ভয়ে সেখান থেকে চলে গেল।

প্রধান পুরোহিতের কথা টারজান বুঝতে না পারলেও তার হাবভাব এবং ঠাক চানের চলে যাওয়া অর্থ সে বুঝতে পেরেছিল।

টারজান চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছিল, মন্দিরের বাইরে একটা বাগান আছে। তার ওপারে নগর প্রাচীরের ওধারে শুরু হয়েছে গভীর বন। টারজান দেখল সেখান থেকে নগরপ্রাচীর খুব একটা দূরে নয়।

টারজান এবার প্রধান পুরোহিতকে ফেলে দিয়ে যোদ্ধাদের হাতগুলো সরিয়ে দিয়ে মন্দিরের পাঁচিলে উঠে লাফ দিয়ে বাগানে পড়ল। তারপর বাগান থেকে একটা বড় বাড়ির ছাদে উঠে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নগরের রাজপথে পড়ল।

রাজপথে যে সব মানুষ ছিল তারা টারজনের নগ্নপ্রায় বাদামী রঙের চেহারাটা দেখে ভয়ে ও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।

রাজপথের প্রান্তে ছিল নগরদ্বার। সে দ্বারে কয়েকজন প্রহরী পাহারা দিচ্ছিল। নগরদ্বারের ওপারেই ছিল বন। নগরদ্বারটা কোনরকমে পার হয়ে গেলেই মুক্ত হয়ে যাবে টারজান। কিন্তু প্রহরীরা তাকে বাধা দিল।

টারজান তখন তাদের একজনকে ধরে তার দেহটা দিয়ে ঠেলে অন্যদের সরিয়ে পার হয়ে এগিয়ে যেতে থাকল। কিন্তু হঠাৎ পিছন থেকে একটা পাথর খণ্ড এসে সজোরে তার মাথার পিছন থেকে লাগতেই অচৈতন্য হয়ে মাটিতে পড়ে গেল টারজান।

চেতনা ফিরে পেয়ে টারজান দেখল সে একটা ঘরে একটা কাঠের খাঁচার মধ্যে বন্দী হয়ে আছে। ঘরের মধ্যে ছিল একটা মাত্র জানালা। সেই জানালা দিয়ে অল্প কিছু আলো আসছিল বাইরে থেকে।

টারজান দেখল তার খাঁচার রেলিংগুলো কাঠের এবং সে চেষ্টা করলেই খাঁচা থেকে মুক্ত করতে পারে নিজেকে। কিন্তু খাঁচা থেকে কি করে বেরোবে সেইটাই হলো সমস্যা।

খাঁচার দুটো কাঠের রেলিং খুলে খাঁচা থেকে বার হলো টারজান। একটি রেলিং হাতে লাঠির মত ধরে দরজার কাছে অপেক্ষা করতে লাগল।

সহসা দরজা খুলে একজন যোদ্ধা ঘরের মধ্যে ঢুকতেই টারজান তাকে এমনভাবে মেরে ফেলল যে। সে কোন শব্দই করতে পারল না। খোলা দরজা দিয়ে মুখ বার করে সে দেখল বাইরে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। কতকগুলো জয়ঢাক রয়েছে এক জায়গায়। তাদের কোন একটা উৎসব হচ্ছে।

এমন সময় টারজনের চোখে পড়ল সেই ঘরের দরজার বাইরে, একটা মেয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তাকে ঘিরে আছে চারজন পুরোহিত। একজন পুরোহিত একটা ছুরি ধরে আছে শায়িত মেয়েটির বুকের উপর। মেয়েটিকে তারা হয়ত বলি দেবে। তারই জন্য এ উৎসবের আয়োজন।

যে পুরোহিতের হাতে ছুরি ছিল সে তার ছুরিটা মেয়েটির বুকে বসিয়ে দেবার জন্য হাতটা তুলতেই তার হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিল টারজান।

তারপর সেই পুরোহিতটাকে দু’হাতে ধরে অন্য দু’জন পুরোহিতের উপর এমনভাবে ফেলে দিল যে তারা মন্দিরের মেঝের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। বাকি দু’জনকে সে তার হাতের লাঠি দিয়ে মেরে ধরাশায়ী করে দিল।

সমবেত জনতা টারজনের কাণ্ড দেখে ভয়ে ও বিস্ময়ে স্তব্ধ ও হতবাক হয়ে গেল। তারা তাকে কোনরকম বাধা দিতে পারল না।

টারজান তখন বন্দিনী মেয়েটিকে কাঁধের উপর তুলে নিয়ে যে পথে এসেছিল সেই পথে নগর প্রাচীরের দিকে এগিয়ে চলল।

ইৎজল চা নামে যে মেয়েটিকে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছিল সে নিজেকে মুক্ত করার কোন চেষ্টা করল না। সে ভাবল বনদেবতা চে তাকে উদ্ধার করে যখন বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তখন তাকে বাধা দিয়ে কোন লাভ হবে না।

নগর প্রাচীর পার হয়ে মাঠে গিয়ে পড়ল টারজান। মাঠের ওপারেই বন। অবাধে বনের ভিতরে চলে গেল টারজান।

ইৎজল চাকে নিয়ে বনের গভীরে ঢুকে বনদেবতা চে এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। সে একটা গাছে। উঠে তার মুখ দিয়ে জোর গলায় এক বিকট চীৎকার করল। সেই চীৎকার শুনে দুটো কিম্ভূকিমাকার জন্তু এসে বনদেবতা চে-র সঙ্গে মিলিত হলো। ইৎজল চা ভাবল ওই দুটো জন্তুও দেবতা; বনদেবতার সহচর। তাদের ভাষা ইৎজল চা কিছুই বুঝতে পারল না।

এবার টারজান চাকে বন থেকে এক পার্বত্য পথে নিয়ে নামিয়ে দিল। ইশারায় তাকে হাঁটতে বলল।

যেতে যেতে পথে এক জায়গায় টারজান ‘ট্যান্টর ট্যান্টর’ বলে ডাকতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে আফ্রিকার এক পুরুষ হাতি ডালপালা ভেঙ্গে ছুটে এল। তার বিরাট চেহারা দেখে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল ইৎজল চা।

চেতনা ফিরে পেয়ে চা দেখল তারা এক বিরাটাকার জন্তুর পিঠে চেপে আছে। বনদেবতা তার পিছনে বসে আছে তাকে ধরে। তার সঙ্গী দু’জন অপদেবতা জন্তুটার পাশে পাশে পথ চলছে।

এইভাবে মাত্র দু-এক ঘণ্টার মধ্যে জীবনে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা লাভ করল ইৎজল।

তখন বিকাল শেষ হয়ে আসছিল। প্যাট্রিসিয়া ও জেনেত্তে কয়েকজন লোকের সঙ্গে শিবিরের উঠোনে বসে টারজনের কথাটা তখন সকলেই আলোচনা করতে লাগল।

প্যাট্রিসিয়া বলল, ঐ দেখ।

সকলে দেখল বনের ভিতর থেকে এক বিরাট হাতি এগিয়ে আসছে তাদের শিবিরের দিকে। হাতির পিঠে ছিল টারজান। দুটো ওরা; ওটাং হাতিটার দু’পাশে হেঁটে আসছিল।

হাতিটা শিবিরের সামনে থামতেই টারজান মেয়েটিকে ধরে নামাল হাতির পিঠ থেকে।

ইৎজল চা ভাবল এরা সবাই দেবতা। তাই তার আর ভয় হলো না।

 শিবিরের সকলে বিস্ময়ে এমন অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে কেউ কোন কথা বলতে পারল না।

টারজান প্যাট্রিসিয়ার কাছে গিয়ে বলল, আমি আশা করি এই মেয়েটির তুমি দেখাশোনা করবে।

 প্যাট্রিসিয়া প্রতিবাদের সুরে প্রশ্ন করল, আমি?

হ্যাঁ তুমি।

 কর্নেল তখন টারজানকে বললেন, এ সবের মানে কি স্যার?

টারজান বলল, আমাদের দক্ষিণে এক নগর আছে। ওখানকার লোকেরা নরবলি দেয় ওদের দেবতার কাছে। এই মেয়েটিকে ওরা বলি দিতে যাচ্ছিল। হঠাৎ আমি সেখানে গিয়ে পড়ি। আমি তখন ওকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি।

প্যাট্রিসিয়া বলল, আমিই ওকে দেখব।

কোন বৈচিত্র দেখা গেল না। প্যাট্রিসিয়া ইৎজল চাকে ইংরেজি শেখাতে লাগল। টারজানও ইজ্জলের কাছ থেকে তাদের ভাষা শিখতে লাগল।

টারজান মাঝে মাঝে বনের মধ্যে শিকারে গিয়ে একটা করে বনশুয়োর শিকার করে আনত। সে ছাড়া অন্য কেউ শিকারে যেত না।

এদিকে চিচেন ইৎজা নগরের প্রধান পুরোহিত চান ইপ জিউ তখনো রেগে ছিল প্রচণ্ডভাবে। মন্দির থেকে বলি চুরি হয়ে গেছে। মন্দির অপবিত্র হয়ে গেছে। দেবতারা রেগে যাবেন।

রাজা চিৎ কং জিউ বলল, মনে হয় দেবতা চে-ই তোমার বলিকে নিয়ে গেছে।

প্রধান পুরোহিত বলল, না না বনদেবতা নয়, সেদিন জালন দিন সমুদ্রের ধারে যে সব বিদেশীদের দেখেছিল ও তাদেরই একজন। তুমি একশোজন যোদ্ধা পাঠিয়ে বিদেশীদের শিবির থেকে ইৎজল চাকে ধরে আনাও।

সেদিন সকালে টিবেট কয়েকজন নাবিককে নিয়ে সাইগন জাহাজ থেকে নৌকার জন্য কাঠ সংগ্রহ করতে যাচ্ছিল। তখন শিবিরের অন্য সকলে প্রাতরাশ খাবার জন্য এক জায়গায় জড়ো হয়েছিল।

কর্নেল বলল, প্যাট্রিসিয়া কোথায়?

জেনেত্তে বলল, আমি উঠে তাকে দেখতে পাইনি। তার আগেই সে কোথায় চলে গেছে।

ইৎজল চা বলল, প্যাট্রিসিয়া ও টারজান আলাদা আলাদা সময়ে বেরিয়ে গিয়ে জঙ্গলে মিলিত হয়।

কর্নেল বললেন, প্যাট্রিসিয়া যদি জঙ্গলে যায় তাহলে আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব টারজান যেন তার পাশে থাকে।

এদিকে প্যাট্রিসিয়া নদীটা ধরে উত্তর-পূর্ব দিকে এগোতে লাগল। ভাবল টারজানও গাছের ডালে ডালে সেই দিক দিয়েই দ্বীপটার অন্য প্রান্তে এগিয়ে চলেছে।

প্যাট্রিসিয়া দেখল তার পাহাড়ী পথটা ক্রমশ উঁচু হয়ে গেছে সামনে। সে ভাবল পাহাড়টায় উঠে দ্বীপটার কোথায় কি আছে ভাল করে দেখবে। উঠতে উঠতে এক জায়গায় গিয়ে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল প্যাট্রিসিয়া।

এমন সময় ক্রোচ বলল, সমুদ্রের বেলাভূমি দিয়ে যেন কারা আসছে?

বোল্টন বলল, এ যে দেখছি ক্রাউজ আর স্মিৎস আসছে। হা হা, তাদের সঙ্গে উবানোভিচ আর আব্দুল্লাও আছে।

তারা সকলেই তখন খাপ থেকে পিস্তল বার করে নীরবে অপেক্ষা করতে লাগল।

ক্রাউজ শিবিরে তাদের সামনে এসে বলল, আমাদের কোন আগ্নেয়াস্ত্র নেই। দু’জন লোককে আমরা আপনাদের এখানে পাঠিয়েছিলাম। তারা ফিরে যায়নি। আমাদের আরো দু’জন লোককে সিংহতে ধরে নিয়ে গেছে। আপনারা আমাদের এভাবে বিপদের মধ্যে ছেড়ে দেবেন না। দয়া করে আমাদের এই শিবিরে থাকতে দিন। আমরা আপনাদের আদেশ মেনে চলব।

কর্নেল বলল, টারজান ফিরে এলে গোলমাল ও অশান্তির সৃষ্টি হবে।

ক্রোচ বলল, আমার মনে হয় ওদের তাড়িয়ে দেয়া অমানুষিকতার কাজ হবে।

কর্নেল বললেন, অন্তত টারজান ফিরে না আসা পর্যন্ত তোমরা এখানে থাক ক্রাউজ।

ক্রাউজ বলল, ধন্যবাদ কর্নেল। আমরা সত্যিই ভাল ব্যবহার করব।

প্যাট্রিসিয়া কিছুক্ষণ সেখানে বসে থাকার পর আবার কিছুটা এগিয়ে চলল। সেখান থেকে সমুদ্র দেখা যাচ্ছিল। জায়গাটা বড় শান্ত আর সুন্দর। সে ভাবল শিবির থেকে মাঝে মাঝে বেড়াতে আসবে এখানে।

হঠাৎ ঝোপ থেকে একটা বাঘ বেরিয়ে পড়ল তার সামনে। তার লেজটা নাড়ছিল।

তার কাঁধ হতে রাইফেলটা নামিয়ে পর পর দু’বার গুলি করল প্যাট্রিসিয়া।

শিবিরে তখন জেনেত্তে বলছিল, আমার কিন্তু ভাল মনে হচ্ছে না। ওদের থাকতে দেয়া মোটেই উচিৎ হয়নি।

হ্যান্স দ্য গ্রোত্তে বলল, আমি ওদের দিকে নজর রাখব।

এমন সময় ওরা সকলে রাইফেলের দুটো গুলির শব্দ শুনতে পেলেন। কর্নেল বললেন প্যাট্রিসিয়া নিশ্চয় কোন বিপদে পড়েছে।

এই বলে তিনি ঘর থেকে তাঁর রাইফেলটা এনে যেদিক থেকে গুলির শব্দ এসেছিল সেই দিকে ছুটে গেলেন। তাঁর পিছু পিছু রাইফেল হাতে হ্যান্স, ক্রোচ আলজি ও বোল্টনও ছুটে বেরিয়ে গেল।

ওরা সবাই জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল স্মিৎস ক্রাউজের দিকে ঘুরে বলল, কি মজা। এবার দেখা যাক অস্ত্রশস্ত্র কি আছে। এটা আমাদের সুবর্ণ সুযোগ।

জেনেত্তে তার ঘরে ছুটে গিয়ে তার রাইফেলটা তুলে নিতেই স্মিৎস তাকে বাধা দিল।

ওরা চারজন তখন একে একে সব অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ বার করল। তারপর পিস্তল উঁচিয়ে ওদের লস্করদের বাধ্য করল ওদের সব মালপত্র বয়ে নিয়ে যেতে। ক্রাউজ বলল, আমাদের যা যা দরকার সব পেয়ে গেছি।

জেনেতে বাধা দিতে ক্রাউজ তাকে আঘাত করল।

জেনেত্তের সব বাধাদানকে অগ্রাহ্য করে তাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল ক্রাউজ।

জালন দিন আর তার একশোজন যোদ্ধা যখন সমুদ্রতীরবর্তী বিদেশীদের শিবিরের দিকে এগিয়ে আসছিল বনের মধ্যে দিয়ে তখন তারা দুটো রাইফেলের গুলির আওয়াজ পায়। কিন্তু বন্ধুদের গুলি সম্বন্ধে কোন ধারণাই ছিল না তাদের, জালন দিন ছিল সবার আগে।

হঠাৎ একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়াল দিন। দেখল তাদের সামনে কিছু দূরে বিরাট একটা জন্তু পড়ে রয়েছে। জন্তুটা মৃত আর তার উপর একটা পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অদ্ভুত একটা অস্ত্র হাতে এক আশ্চর্য পোশাক পরা এক নারীমূর্তি।

জালন বুদ্ধিমান। সে তাই সামনে না গিয়ে বনের আড়াল থেকে লুকিয়ে ঘিরে ফেলতে বলল সেই নারীকে।

তারপর একদিক থেকে জালন দিন তার তলোয়ারে একটা শব্দ করতে সেদিকে তাকাল প্যাট্রিসিয়া আর সঙ্গে সঙ্গে জালন দিনের দু’জন যোদ্ধা গিয়ে তার পিছন থেকে একটানে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল তার রাইফেলটা।

এরপর এক মুহূর্তে চারদিক থেকে একশোজন যোদ্ধা এসে ঘিরে ফেলল তাকে।

প্যাট্রিসিয়া তাদের দেখে তারা কারা তা বুঝতে পারল। সে শুধু টারজনের মুখ থেকে এই ধরনের লোকদের কথা শোনেনি। সে প্রাচীন মায়া সভ্যতা সম্বন্ধে অনেক বইও পড়েছে।

ইৎজল চার কাছ থেকে শেখা মায়াদের ভাষায় ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভাবে সে বলল, তোমরা আমাকে নিয়ে কি করবে?

জালন দিন বলল, সেটা আমাদের প্রধান পুরোহিত জিউ ঠিক করবে। এই বলে সে তার চারজন যোদ্ধাকে চিচেন ইৎজ নগরে বন্দিনীকে বয়ে নিয়ে যেতে লাগল।

প্যাট্রিসিয়াকে চারজন যোদ্ধা ধরে নিয়ে গেলে জালন দিন তার বাকি যোদ্ধাদের নিয়ে শিবির সাইগনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।

এদিকে কর্নেল লে ও তাঁর সঙ্গীরা যে পথে প্যাট্রিসিয়া নেমে এসেছিল পাহাড় থেকে সেই পথে দ্রুতবেগে এগিয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ তারা মাথায় পালকের পোশাক পরা একদল আদিবাসী যোদ্ধার সম্মুখীন হলো।

আদিবাসী যোদ্ধারা তাদের দেখতে পেয়েই পাথর ছুঁড়তে লাগল চীৎকার করতে করতে।

কর্নেল তাঁর সঙ্গীদের বললেন, এমনভাবে গুলি করো যাতে গুলিগুলো ওদের মাথার উপর দিয়ে চলে যায়।

কিন্তু জালন দিন যখন দেখল ওদের অস্ত্রগুলো শুধু শব্দ করছে, আঘাত করতে পারছে না তখন সে তার যোদ্ধাদের আক্রমণ চালিয়ে যেতে বলল।

কর্নেল তখন হুকুম দিলেন, ওদের হত্যা করার জন্য গুলি করো।

ওদের রাইফেলগুলো গর্জে উঠল। এক ঝাঁক গুলি ছুটে গেল। তাতে চারজন যোদ্ধা মারা গেল। জালন দিন তবু এগিয়ে যেতে থাকলেও তার যোদ্ধারা গুলির ভয়ে পালাতে লাগল। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন দিকে বনের মধ্য দিয়ে ছুটে পালাতে লাগল।

কর্নেলরা প্রথমে পথ হারিয়ে উল্টোদিকে যাচ্ছিল। তারপর কিছুটা ঘোরাঘুরি করার পর অবশেষে তারা সমুদ্রের বেলাভূমিতে তাদের শিবিরের কাছে এসে পড়ল।

তারা শিবিরের কাছে এলে টিবেট বিষণ্ণ মুখে এগিয়ে এসে একটা দুঃসংবাদ দিল।

টিবেট বলল, বড়ই দুঃসংবাদ স্যার। আমি এই মাত্র শিবির থেকে আসছি। স্মিৎস আর তার বন্দীরা আমাদের শিবির থেকে সব অস্ত্রশস্ত্র এবং বেশ কিছু রসদ নিয়ে পালিয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, ওরা জেনেত্তেকেও ধরে নিয়ে গেছে।

হ্যান্স দ্য গ্রোত্তে টিবেটকে বলল, কোন্ পথে তারা গেছে টিবেট?

সমুদ্রের তীর দিয়ে তাদের পুরনো শিবিরে বোধ হয়।

 হ্যান্স মর্মাহত ও ক্রুদ্ধ হয়ে সেই পথে যেতে লাগল।

 কর্নেল বললেন, কোথায় যাচ্ছ?

হ্যান্স বলল, আমি তাদের ধরব।

কিন্তু তাদের হাতে এখন অনেক অস্ত্রশস্ত্র। তুমি একা কিছু করতে পারবে না। এখন আমাদের হাতে বাড়তি লোক নেই। ওরা যে কোন সময় আমাদের শিবির আক্রমণ করতে পারে।

গ্রোত্তে অনমনীয়ভাবে বলল, আমি যাবই।

তখন টিবেট বলল, আমিও যাব।

নাইয়াদ জাহাজের দু’জন নাবিকও যেতে চাইল তাদের সঙ্গে। কর্নেল ওদের সাবধান করে দিলেন, খুব সাবধান। সামনের দিকে ওদের শিবিরে না গিয়ে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে লুকিয়ে ওদের শিবিরে যাবে।

ওরা চারজন তখনি সমুদ্রের ধার দিয়ে যাত্রা শুরু করল।

আদিবাসীদের সঙ্গে কর্নেলদের যখন যুদ্ধ হয় তখন রাইফেলের গুলির যে শব্দ হয় সেই শব্দ বনের মধ্যে শুনতে পেয়েছিল টারজান। সেই শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে আসতে থাকে সে। কিন্তু শব্দটা ঠিক কোন দিক থেকে আসছিল তা ধরতে না পেরে ভুল পথে গিয়ে পড়ে সে।

টারজান দেখল সে শিবির সাইগনের পরিবর্তে স্মিৎসদের শিবিরের কাছে এসে পড়েছে। সে অতি সাবধানে বনের ভিতর দিয়ে ওদের শিবিরের কাছে এসে পড়ল। দেখল স্মিৎসরা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও মালপত্র নিয়ে কোথা হতে ফিরল শিবিরে। সে আরও দেখল ক্রাউজ জেনেত্তেকে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। সে তখন বুঝল স্মিৎসদের সঙ্গেই তার শিবিরের লোকদের যুদ্ধ হয়েছে এবং স্মিৎসরাই জয়ী হয়েছে। তবে কি তাদের শিবিরের সব লোক নিহত হয়েছে?

প্যাট্রিসিয়া কোথায়? ইৎজল চারই বা কি হলো?

 এদিকে উভয় সংকটে পড়লেন কর্নেল। এখন তার হাতে মাত্র চারজন সশস্ত্র লোক। এই লোক দিয়ে শিবির রক্ষা করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় প্যাট্রিসিয়ার খোঁজ চিচেন ইজ্জা নগরেও যাওয়া সম্ভব নয়।

কর্নেল যখন এই সব ভাবছিলেন তখন প্যাট্রিসিয়াকে চারজন যোদ্ধা উক্সমাল দ্বীপের রাজা আর প্রধান পুরোহিতের সামনে হাজির করল।

যোদ্ধারা রাজাকে বলল, জালন দিন এই বিদেশী বন্দিনীকে পাঠিয়ে দিল। জালন দিন বাকি যোদ্ধাদের নিয়ে বিদেশীদের শিবিরের দিকে এগিয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছে। আমরা শব্দ শুনতে পেয়েছি।

রাজা বলল, জালন দিন ভালই কাজ করেছে।

প্রধান পুরোহিত জিউ বলল, এই নারীকেই বলি দেয়া হবে দেবতার কাছে।

 রাজা প্রধান পুরোহিতকে জিজ্ঞাসা করল, মেয়েটা কি কোন দেবী?

ওদের কথাবার্তা বুঝতে পেরে প্যাট্রিসিয়া বলল, আমি বনদেবতা চের জীবনসঙ্গিনী। তিনি যখন এর আগে এই নগরে এসেছিলেন তখন তোমরা তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করায় তিনি রেগে আছেন তোমাদের উপর। তোমরা যদি বুদ্ধিমান হও তাহলে আমাকে পাঠিয়ে দাও তার কাছে। যদি তা না করো তাহলে তিনি তোমাদের ধ্বংস করবেন।

রাজা মাথা চুলকাতে চুলকাতে জিউকে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা ত দেবতাদের চেন। বনদেবতা চে কি চিচেন ইৎজাতে এসেছিল? তোমরা কি সে দেবতাকে কাঠের খাঁচায় ভরে রেখেছিলে? আর সেই দেবতাই বলির মেয়েটাকে চুরি করে নিয়ে যায়?

প্রধান পুরোহিত জিউ বলল, না, সে ছিল একজন মানুষ।

তথাপি আমাদের তাড়াহুড়ো করে কোন কাজ করা উচিৎ হবে না। মেয়েটাকে এখন কুমারীদের মন্দিরে রেখে দাও কিছুকালের জন্য। ..

এই বলে রাজা দু’জন পুরোহিতকে ডেকে প্যাট্রিসিয়াকে কুমারীদের মন্দিরে নিয়ে যেতে বলল, সঙ্গে সঙ্গে আদেশ দিল, তার সঙ্গে যেন ভাল ব্যবহার করা হয়।

প্যাট্রিসিয়া কিছুটা খুশি হলো এই অবস্থায়। সে ভাবল তার কথাগুলো প্রধান পুরোহিত বিশ্বাস না করলেও কিছুটা রেখাপাত করেছে রাজার মনে। যাইহোক কিছুদিনের জন্য অন্তত অব্যাহতি। তাতে টারজান তাকে উদ্ধার করার কিছুটা সময় পাবে অন্তত।

টারজান বনের ভিতর থেকে স্মিৎসদের শিবিরটার অবস্থা দেখতে লাগল। সে ভাবল চারজন সশস্ত্র লোকের সামনে যাওয়া ঠিক হবে না। তার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো জেনেত্তেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া।

গাছপালার আড়ালে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। ওরা আরো কাছে এল এবং লস্কররা মালপত্র নামিয়ে রাখলে টারজান প্রস্তুত হলো তার তীর ধনুক নিয়ে।

সহসা টারজনের ধনুক থেকে একটা তীর ছুটে গিয়ে ক্রাউজের বুকে বিঁধল। তীরটা বুকে গাঁথা অবস্থাতেই সামনের দিকে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে ক্রাউজ যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে করতে মরে গেল।

অন্য সকলে ভয় পেয়ে গেল। উবানোভিচ বলল, কি হলো?

 স্মিৎস বলল, ক্রাউজ মৃত। কেউ তীর মেরেছে বন থেকে।

 আব্দুল্লা বলল, টারজান ছাড়া আর কে?

স্মিৎস বলল, কোথায় সে?

টারজান বলল, এই যে এখানে আমি। আমার আরো অনেক তীর আছে। জেনেত্তে, তুমি সোজা আবার বনের ভিতরে চলে এস। কেউ তোমাকে বাধা দিতে এলে তার অবস্থা ক্রাউজের মতই হবে।

জেনেত্তে তাড়াতাড়ি শিবির থেকে বনের ভিতরে চলে এল। তাকে বাধা দেবার জন্য কেউ হাত তুলল না।

স্মিৎস চীৎকার করতে লাগল, আমি তাকে দেখে নেব।

এই বলে সে রাইফেল তুলে টারজনের কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে গুলি করল।

 আবার একটা তীর গিয়ে স্মিসের বুকটাকে বিদ্ধ করল। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল বুকে হাত দিয়ে।

জেনেত্তে তার কাছে আসতেই গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ল টারজান। তাকে বলল, শিবিরের অবস্থা কি?

জেনেত্তে যা যা ঘটেছিল সব বলল। টারজান তখন বলল, ওরা তাহলে স্মিৎস আর তার সঙ্গীদের শিবিরে থাকতে দিয়েছিল। কর্নেলের নির্বুদ্ধিতায় আমি আশ্চর্য হয়ে গেছি। এই বলে জেনেত্তেকে কাঁধে তুলে নিয়ে গাছের উপরে উঠে গাছে গাছে ডাল ধরে ধরে শিবিরের দিকে এগিয়ে চলল টারজান।

এদিকে বনের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে হ্যান্স আর টিবেট যখন স্মিৎসদের শিবিরের কাছে পৌঁছল তখন সে দেখল শিবিরের সামনে দু’জন লোক মরে পড়ে আছে।

আব্দুল্লা হ্যান্স আর টিবেটকে দেখায় সঙ্গে সঙ্গে রাইফেল থেকে গুলি চালাল। কিন্তু কোন গুলিই লাগল না তাদের গায়ে।

হ্যান্স তখন হাঁটু গেড়ে বসে টিবেটকে বলল, তুমি উবানোভিচকে আর আমি আব্দুল্লাকে মারব।

এই বলে তারা গুলি চালাতেই উবানোভিচ ও আব্দুল্লা মাটিতে পড়ে গেল।

কিন্তু জেনেত্তেকে দেখা গেল না শিবিরে। হ্যান্স দেখল, ক্রাউজ, আব্দুল্লা আর উবানোভিচ মরে গেছে। কিন্তু স্মিৎস তখনো যন্ত্রণায় ছটফট করছে। হ্যান্স তাকে বলল, জেনেত্তে কোথায়?

স্মিৎস কোনরকমে বলল, বন্য লোকটা তাকে নিয়ে গেছে।

হ্যান্স বলল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, সে এখন নিরাপদ।

হ্যান্স আর টিবেটের সঙ্গে যে তিনজন নাবিক এসেছিল তারা সবাই মিলে অস্ত্রশস্ত্রগুলো নিল। বাকি সব মালপত্র স্মিৎসদের লস্করদের শিবির সাইগনে নিয়ে যেতে বলল।

এইভাবে তারা শিবির সাইগনের দিকে রওনা হলো।

এদিকে শিবিরের অবস্থা দেখে বিরক্ত হয়ে উঠল টারজান। সে বলল, শিবিরে ওদের ঢুকতে দেয়া উচিৎ হয়নি।

কর্নেল বললেন, দোষটা আমার। ওরা নিরস্ত্র, একটা নরখাদক সিংহ কাছেই ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তাই মানবতার খাতিরে আমি ওদের থাকতে দিই।

এমন সময় স্মিৎসদের শিবির থেকে গুলি বিনিময়ের আওয়াজ শোনা যেতে লাগল।

টারজান বলল, এখন প্যাট্রিসিয়াকে খুঁজে বার করতে হবে। তোমরা ঠিক জান আদিবাসীরা তাকে ধরে নিয়ে গেছে তাদের নগরে?

কর্নেল বললেন, আমি দুটো গুলির শব্দ পেয়ে ছুটে যাই সেইদিকে। কিন্তু একসোজন আদিবাসী যোদ্ধা ঘিরে ফেলে আমাদের। ওদের চারজন আমাদের গুলিতে মারা যেতে ওরা পালিয়ে যায়। তখন আমরা তাদের আর অনুসরণ করতে পারিনি। আমরা প্যাটকে দেখতে পাইনি বটে, তবে মনে হয়। আমাদের সঙ্গে ওদের দেখা হওয়ার আগেই ওকে ওদের একটা দল তাকে ধরে নিয়ে যায়।

এরপর টারজান ইৎজল চাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের নগরের লোকরা প্যাট্রিসিয়াকে কি করবে বলত?

ইৎজল বলল, দুতিন দিন পর অথবা মাসখানেক পরে ওকে বলি দেবে। ততদিন আমার মনে হয় ওকে পিরামিডের উপরে কুমারীদের মন্দিরে রাখবে। ভাল পাহারার ব্যবস্থা থাকবে।

আজ রাতেই যাব।

ইৎজল চা এবার তা দু’হাত দিয়ে টারজনের গলাটা জড়িয়ে ধরে অনুনয় বিনয়ের সুরে বলল, তুমি যেও না। মেয়েটাকে তুমি উদ্ধার করতে পারবে না। ওরা তোমায় মেরে ফেলবে। আমি তোমাকে। ভালবাসি। তুমি আমাকে বনে নিয়ে যাও। এখানে আমার কাউকে ভাল লাগে না।

টারজান বলল, ওরা ত সবাই তোমাকে দয়া করে।

ওদের দয়া আমি চাই না। আজ রাতে তুমি চিচেন ইৎজ্জায় যেও না।

 তার কাঁধে হাত বুলিয়ে টারজান বলল, আজ রাতেই আমি যাচ্ছি।

 ইৎজল চা তখন রেগে বলল, আসলে তুমি তাকে ভালবাস এটাই হলো তোমার যাওয়ার কারণ।

টারজান বলল, এ কথা আর কখনো যেন বল না।

 এই বলে সে অন্য সকলের কাছে চলে গেল।

ইৎজল চা প্রচণ্ড রাগে গজ গজ করতে করতে নিজের ঘরে চলে গেল। মাটিতে পড়ে সে নিষ্ফল আক্রোশে ছটফট করতে লাগল। তীব্র প্রতিহিংসা জাগল তার মনে।

এই সময় সে দরজার দিকে তাকাতেই দেখল হ্যান্সের দল ফিরে আসছে জয়ী হয়ে। শিবিরের সকলের দৃষ্টি তাদের উপরে পড়তেই তার ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে বনের ভিতর চলে গেল ইৎজল চা।

হ্যান্স দেখতে পেয়েই ছুটে গিয়ে তার গলাটা জড়িয়ে ধরল জেনেত্তে। বলল, আমি ভেবেছিলাম তুমি আর বেঁচে নেই।

হ্যান্স বলল, না না, আমি বেঁচে আছি। আর তোমাকে স্মিৎস বা তার দলকে ভয় করতে হবে না। ওরা সবাই এখন মৃত।

টারজান বলল, শুনে খুশি হলাম। ওরা অত্যন্ত পাজী লোক ছিল।

এদিকে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চিচেন ইৎজা নগরের দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল ইৎজল চা। তখন অন্ধকার হয়ে আসছিল বলে ভয় করছিল তার। কিন্তু একই সঙ্গে ঘৃণা, প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধ বাসনায় উন্মত্ত হয়ে সব ভয় ঝেড়ে ফেলে ছুটছিল সে।

প্রধান পুরোহিতের কাছে গিয়ে তার পায়ে পড়ে গেল ইৎজল চা। তাকে চিনতে পেরে প্রধান। পুরোহিত জিউ বলল, আবার কেন ফিরে এলি?

আমি এই কথা তোমাদের জানাতে এসেছি, যে লোকটা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল সে আজ রাতে শ্বেতাঙ্গ মেয়েটাকে উদ্ধার করতে আসবে।

প্রধান পুরোহিত জিউ বলল, এই কথা আমাদের জানানোর জন্য তোমাকে এক বিশেষ পুরস্কার দেয়া হবে। তোমার সম্মানের জন্যই বলি দেয়া হবে তোমাকে দেবতাদের উদ্দেশ্যে।

এরপর ইৎজল চাকে বন্দিনী হিসেবে বলির জন্য একটা খাঁচায় রাখা হলো।

টারজান সন্ধ্যার সময় চিচেন ইৎজা নগরের কাছাকাছি এসে ঠিক করল, নগরের সকলে ঘুমিয়ে না পড়লে সে নগরে ঢুকবে না।

বাতাসে গন্ধ শুঁকে টারজান বুঝল, তার বন্ধু হাতিটা নগরের আশে-পাশেই আছে। টারজান হাতিটাকে ডাকতেই সে তার কাছে এল। তারপর তাকে পিঠে চাপিয়ে নগরদ্বার পর্যন্ত পৌঁছে দিল।

নগরপ্রাচীরে উঠে প্রাচীর থেকে লাফ দিয়ে ওদিকের রাস্তার উপর পড়ল টারজান। রাস্তাগুলো তখন ছিল একেবারে ফাঁকা। টারজান অবাধে পিরামিডের মত দেখতে সেই মন্দিরটার তলায় এসে দাঁড়াল।

এদিকে কুমারীদের মন্দিরের দ্বারপথে বারোজন যোদ্ধা ছায়ায় গা-ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে ছিল। তারা জানত আজ রাতে টারজান আসবে।

কিন্তু টারজান কাউকে দেখতে না পেয়ে মন্দিরের ভিতরে পা দিতেই একটা বড় জাল এসে ঢেকে ফেলল তাকে। সে তখন অসহায়।

দু’জন পুরোহিত তখন ভেরী বাজাতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠল সমস্ত শহর। অসংখ্য মানুষ চারদিক থেকে আলো হাতে ছুটে আসতে লাগল।

 টারজানকে ধরে সিঁড়ি বেয়ে নিচেতে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। তারপর প্যাট্রিসিয়াকে আনানো হলো কুমারী মন্দির থেকে।

তারপর প্রধান পুরোহিত চান ইপ জিউ-এর নেতৃত্বে টারজান ও প্যাট্রিসিয়াকে নিয়ে এক বিরাট মিছিল বার হলো।

মিছিলটা সমস্ত নগর পরিক্রমা করে নগরসীমানার বাইরে একটা মৃত আগ্নেয়গিরির গহ্বরের পাশে থামল। সেই গহ্বরের তলায় অনেক জল ছিল।

ঢাক, ঢোল, ভেরী প্রভৃতি বাজনার সঙ্গে সঙ্গে পুরোহিত মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগল। তারপর এক সময় তারা টারজানকে ধরে ফেলে দিল সেই গহ্বরের মধ্যে।

প্যাট্রিসিয়া এই ঘটনাতে মর্মাহত হলেও ভেঙ্গে পড়ার মত মেয়ে সে নয়। টারজানকে গহ্বরের জলে ফেলে দেয়ার পর সে গহ্বরের উপর মুখ বাড়িয়ে বলল, টারজান, তুমি কোনরকমে জলে ভেসে থাক। আমি মায়া সভ্যতার লোকদের প্রথা জানি। যদি কোন অপরাধীকে এই পবিত্র কুয়োর জলে ভোরবেলায় ফেলে দিয়ে সে দুপুর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে তাহলে তাকে দেবতা হিসেবে দেখে ওরা।

টারজান হাসিমুখে হাত নাড়ল। প্যাট্রিসিয়ার ভাষা বুঝতে পারল না পুরোহিতরা।

অবশেষে সূর্য মধ্য আকাশে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অস্বস্তিবোধ করতে লাগল প্রধান পুরোহিত চান ইপ জিউ। দুপুর হলেও যদি লোকটা বেঁচে থাকে তাহলে এটাই প্রমাণিত হবে যে সে-ই-বনদেবতা চে। সেটা তার পক্ষে ক্ষতিকর হবে। তখন বনদেবতাই হয়ে উঠবে সর্বেসর্বা।

দুপুর গত হতেই জনতা এক প্রবল উল্লাসে ফেটে পড়ল। কারণ তারা নিজের চোখে দেখল বন্দী তখনো বেঁচে আছে পবিত্র কূয়োর জলে।

একটা দড়িতে ফাঁস লাগিয়ে সেটা ফেলে দেয়া হলো টারজনের কাছে। টারজান ফাসটা ছাড়াই দড়ি ধরে উঠে এল।

টারজান উঠেই রাজা ও প্রধান পুরোহিতের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল, আমিই বনদেবতা চে, আমি একজন মানুষের বেশ ধারণ করে মর্ত্যে নেমে এসেছিলাম কিভাবে তোমরা রাজ্য শাসন করছ তা দেখার জন্য। কিন্তু তোমাদের শাসনকার্যে সন্তুষ্ট নই আমি। এখন আমি যাচ্ছি। দিনকতক পর আবার এসে দেখব তোমরা কোন উন্নতি করতে পেরেছ কি না। এখন আমি এই মেয়েটিকে নিয়ে যাচ্ছি। ইৎজল চাকে ছেড়ে দাও। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত কাউকে যেন বলি দেয়া না হয়।

এই বলে টারজান প্যাট্রিসিয়ার হাত ধরে পাহাড় থেকে নামতে লাগল। তাদের পিছনে এক বিরাট জনতা গান গাইতে গাইতে আসতে লাগল। নগরদ্বারের কাছে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল টারজান।

টারজান এক অদ্ভুত চীৎকার করল। একটা হাতির নাম ধরে ডাকতে লাগল। তার ডাক শুনে একটা হাতিও চীৎকার করতে করতে ছুটে এল।

প্যাট্রিসিয়া ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু টারজান বলল, আমার বন্ধু। ভয়ের কিছু নেই।

এই বলে হাতিটার শুঁড়ের উপর হাত রাখল টারজান। তারপর সে তাদের একে একে পুঁড় দিয়ে তুলে নিতে বলল।

তারা হাতির পিঠে চাপলে হাতিটা ঘুরে যাত্রা শুরু করতেই ওরা দু’জনেই পিছন ফিরে দেখল চিচেন ইজার সব লোক নতজানু হয়ে প্রার্থনা করছে এবং তাদের মাথাগুলো মাটিতে ঠেকানো আছে।

এদিকে শিবির সাইগনে তখন সকলেই টারজনের আশা একরকম ছেড়েই দিয়েছে। তারা ভাবছিল টারজান আর প্যাট্রিসিয়াকে আর তারা দেখতে পাবে না কখনো।

কর্নেল বললেন, কেন তুমি লোকটার বিরুদ্ধে শুধু শুধু তিক্ত হয়ে উঠছ। সে ত আমাদের সঙ্গে মিত্রতা ছাড়া কখনো শত্রুতা করেনি।

এমন সময় জেনেত্তে বলল, টারজান এসে গেছে। সঙ্গে প্যাট্রিসিয়া।

 হাতির পিঠ থেকে নেমে ছুটে শিবিরে চলে এল প্যাট্রিসিয়া।

এমন সময় দূরে সমুদ্রের উপর একটা জাহাজ দেখা গেল।

ক্যাপ্টেন বোল্টন চোখে বাইনাকুলার দিয়ে দেখে বলল, আরে এটা ত নাইয়াদ জাহাজ, ভাসতে ভাসতে এই দিকেই আসছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *