চিতা-মানুষের দেশে চারজন (টারজান এণ্ড দি লিওপার্ড মেন)

চিতা-মানুষের দেশে চারজন (টারজান এণ্ড দি লিওপার্ড মেন)

মেয়েটি অস্বস্তির সঙ্গে বিছানায় পাশ ফিরল। বাতাসের বেগে পেট-মোটা মাছিগুলো সশব্দে তাঁবুর চাদোয়ার উপর আছড়ে পড়ছে। খোটায় টান লেগে তাঁবুর দড়িগুলো কডুকডু শব্দ করছে। খোলা পর্দাগুলো বাতাসে উড়ছে। তবু ঘুমন্ত মানুষটি পুরো জাগল না। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। ভাপসা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে একঘেঁয়ে দীর্ঘ পদযাত্রায় সে ক্লান্ত। শুধু একদিন তো নয়, অনেক দূর অতীতে যেদিন সে রেলের পথ ছেড়ে এসেছে তারপর থেকেই চলেছে এই একটানা পথ চলা।

না জানি কি অনিবার্য প্রয়োজন তাকে এই পথে নিয়ে এসেছে! বিলাস ও স্বাচ্ছন্দ্যের পথ ছেড়ে কোন্ প্রয়োজনে সে এসেছে এই আদিম অরণ্যে; বিপদ, রোদ-বৃষ্টি ও ক্লান্তির এই অনভ্যস্ত জীবনে? কেন সে এসেছে?

এই প্রচণ্ড ঝড়ের রাতে একটিমাত্র আস্কারি প্রহরী ঘুম-ঘুম চোখে জেগে আছে। দুটি প্রাণী ছাড়া তাঁবুর অন্য সকলেই ঘুমিয়ে আছে। বিশাল বপু আদিবাসীটি চুপি চুপি এগিয়ে চলেছে ঘুমন্ত মেয়েটির তাঁবুর দিকে।

মেয়েটির ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিদ্যুতের আলোয় দেখতে পেল, একটা লোক তাঁবুতে ঢুকল। সর্দার গোলাটোর বিশাল দেহকে চিনতে তার ভুল হল না। কনুইতে ভর দিয়ে পাশ ফিরে প্রশ্ন করল, কিছু কি গোলমাল হয়েছে গোলাটো? কি চাও তুমি?

লোকটি চাপা গলায় জবাব দিল, তোমাকে চাই কালি বাওয়ানা।

তাহলে শেষ পর্যন্ত তাই ঘটল। দু’দিন যাবৎ এই ভয়ই সে করছিল। দলের অন্য সকলের মুখেই সে দেখেছে চাপা ঘৃণার প্রকাশ। সেই একই ঘৃণা ফুটে উঠেছে এই লোকটির চোখে।

খাটিয়ার পাশে রাখা খাপ থেকে রিভলবারটা বের করে মেয়েটি বলল, বেরিয়ে যাও; নইলে তোমাকে মেরে ফেলব।

লোকটি এক লাফে তার দিকে এগিয়ে এল। মেয়েটি গুলি ছুঁড়ল।

একটা প্রকাণ্ড গাছের নিচে আশ্রয় নিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে একটি মানুষ। তার এক বগলে শীতে কুঁকড়ে গায়ের সঙ্গে কি একটা যেন লেপটে রয়েছে। লোকটি মাঝে মাঝে তার সঙ্গে কথা বলছে; অন্য হাত দিয়ে আদর করছে। দেখে মনে হয় তার ছেলে বুঝি। কিন্তু তা নয়, একটা ছোট বানর। বাতাসের প্রতিটি ঝাঁপটা, বিদ্যুতের প্রতিটি ঝলকানি, আর বর্জ্যের প্রতিটি হুংকারের সঙ্গে সঙ্গে সে কেঁপে কেঁপে আরও কুঁকড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ঝড়ের দাপট চরমে উঠল। যে গাছের নিচে তারা আশ্রয় নিয়েছিল সেটা ভেঙে পড়ল। বিড়ালের মত লোকটা এক পাশে লাফিয়ে পড়ল। বানরটা ছিটকে পড়ল বেশ খানিকটা দূরে। কিন্তু একটা মোটা ডাল এসে লাগল লোকটার মাথায়; সে মাটিতে পড়ে গেল; ডালটা তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলল।

ঝড় থেমে গেল। বানরটা মনিবকে ডেকে ডেকে অনেক খুঁজল। অন্ধকারে ভাল দেখা যায় না। তারই মধ্যে এক সময় গাছের নিচে খুঁজে পেল মনিবকে, নিশ্চল ও নিষ্প্রাণ।

কিল্লু গ্রামের ছোট দলটির প্রাণ-পুরুষ ছিল নিয়ামওয়েগি। নিজের গ্রাম টুম্বাই থেকে সে সেখানে গিয়েছিল একটি কৃষ্ণা সুন্দরীর পানি গ্রহণ করতে। মনের ফুর্তিতে চলতে চলতে খেয়ালই ছিল না; হঠাৎ এক সময় নেমে এল নিরক্ষবৃত্তাঞ্চলের রাত।

সৈনিকটি নিঃশব্দ পদক্ষেপে টুম্বাইয়ের পরিচিত পথ ধরে চলতে লাগল। সঙ্গে বর্শা ও ঢাল; কোমরে ঝুলছে লম্বা ছুরি। তার গলার তাবিজটা অনেক শক্তি ধরে। মাঝে মাঝেই সেটাতে আঙুল ঝুলিয়ে সে। তার কূল-দেবতা মুজিমোর স্তব করছে।

অর্ধেক পথ পার হবার পরেই হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন তাকে আক্রমণ করল। তার ধারালো নখর বসে গেল তার কাঁধের মাংসের মধ্যে। যন্ত্রণায় ও আতংকে আর্তনাদ করে দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে আক্রমণকারীদের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল। কাঁধের উপর থেকে থাবাটা সরিয়ে ছুরিটা বের করতেই আবার বিদ্যুৎ ঝলকে উঠল, আর সেই আলোয় তার চোখে পড়ল চিতাবাঘের মুখোশে ঢাকা একটা মানুষের বীভৎস মুখ।

নিয়ামওয়েগি অন্ধকারেই আবোল-তাবোল ছুরি চালাতে লাগল; সেই লোকটি পুনরায় পিছন থেকে নখর বসিয়ে দিল তার বুকে ও পেটে; পিছন থেকে সে তাকে জড়িয়ে ধরেছে লোমশ হাত দিয়ে। আবার ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ। যে তাকে জড়িয়ে ধরেছে তাকে নিয়ামওয়েগি দেখতে পেল না, কিন্তু দেখতে পেল আরও তিনজনকে-একজন তার সামনের আর দু’জন দুই পাশে। এবার সে আশা ছেড়ে দিল; আক্রমণকারীদের সে চিনতে পেরেছে; চিতাবাঘের চামড়া ও মুখোশপরা এই লোকগুলো চিতা-মানুষদের গুপ্ত সংঘের সদস্য।

এইভাবে উটেনগান নিয়ামওয়েগির মৃত্যু হল।

ঊষার আলো পড়েছে গাছের মাথায়। নিচে টুম্বাই গ্রামের খড়ের ঘরে ঘুম ভাঙল গ্রাম-প্রধানের ছেলে ওরান্ডোর। খড়ের বিছানা ছেড়ে সে বাইরে এসে পথের উপর দাঁড়ালো। যে কূলদেবতার নামে তার নাম রাখা হয়েছে দুই হাত তুলে সেই মুজিমোর উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাল।

যে পথ ধরে ওরান্ডো একাকি শিকারে চলল দুই মাইল পর্যন্ত সেটা কিন্তু গ্রামে যাবারও পথ। পরিচিত পথ, কিন্তু আগের রাতের ঝড়ে পথের এত ক্ষতি হয়েছে যে অনেক জায়গায় সে পথে চলাই দুষ্কর। পথের উপর গাছপালা পড়ে থাকায় পথের পাশের ঝোপের ভিতর দিয়ে ঘুরে যাবার পথে একবার তার চোখে পড়ল, একটা ভূপাতিত গাছের ডালপাতার নিচে থেকে মানুষের একটা পা বেরিয়ে আছে।

ওরান্ডো থামল। একটু পিছিয়ে এল। মানুষটা যেখানে পড়ে আছে সেখানকার ডালপালাগুলো নড়ে উঠল। সেখান থেকে মাথা বের করল একটা ছোট্ট বানর।

ওরান্ডোকে দেখে ভয় পেয়ে বানরটা কিচির-মিচির করতে করতে ছুটে গিয়ে একটা বড় গাছের ডালে উঠে পড়ল। ওরান্ডো তার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে পায়ের দিকেই নজর দিল। সাবধানে অগ্রসর হয়ে ঝুঁকে পড়ে বাকি দেহটা দেখতে চেষ্টা করল।

দৈত্য বিশেষ একটি সাদা মানুষ: চিতাবাঘের চামড়ার কটি-বন্ধনী ছাড়া প্রায় নগ্নদেহ; গাছের একটা ভারী ডালের নিচে চাপা পড়ে আছে। দুটি ধূসর চোখের দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ; লোকটি মারা যায়নি।

একটা ছোট ডালের নিচে সে চাপা পড়ে আছে। ওরান্ডো ডালটাকে একটু তুলে ধরতেই লোকটি ধীরে ধীরে উটে দাঁড়াল। দু’জনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ছোট বানরটা গাছের ডালে নিরাপদ দূরত্বে বসে মুখ ভেংচে কিচির-মিচির করতে লাগল।

কাজটা ভাল হল কি মন্দ হল বুঝতে না পেরে ওরান্ডো বর্শাটা হাতে নিয়ে নবাগতকে ভাল করে দেখতে লাগল। নবাগতও গাছটার নিচে থেকে ধনুক ও বর্শা তুলে নিল। তার কাঁধে তীরভর্তি তূণীর। অন্য কাঁধে একটা লম্বা, পাকানো দড়ি। কোমরে খাপে ঢাকা ছুরি।

ওরান্ডো কিস্তু গ্রামের পথ ধরেই এগিয়ে চলল। পিছনে নিঃশব্দ পায়ে চলল নবাগত লোকটি। চলতে চলতে আর একটা বানরের গলা শুনে পিছনে ফিরে তাকিয়ে ওন্ডো দেখল, বানরটা বসে আছে লোকটার কাঁধে, আর দু’জনে অনবরত কথা বলে চলেছে বানরদের ভাষায়।

অবাক কাণ্ড! এ কেমন ধারার লোক যে ভয় কাকে বলে জানে না, যে বানরদের ভাষায় কথা বলতে পারে। প্রশ্নটা মনে আসতেই আর একটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন জাগল তার মনেঃ এই জীবটি মানুষ তো?

পথের একটা বাঁক ঘুরতেই একটা ভয়াবহ দৃশ্য দেখে ওরান্ডোর চিন্তায় বাধা পড়ল। তার চোখের সামনে পড়ে আছে একটি সৈনিকের বিকৃত মৃতদেহ। বন্ধু ও সহকর্মী নিয়ামওয়েগিকে চিনতে বিলম্ব হল না। কিন্তু কেমন করে তার মৃত্যু হল।

নবাগত লোকটি এসে তার পাশে দাঁড়াল। নিচু হয়ে মৃত্যুদেহটাকে ভাল করে পরীক্ষা করতে সেটাকে উল্টে দিতে চোখে পড়ল মুখময় ইস্পাত-নখরের নির্মম আঘাতের চিহ্নগুলো।

নিরুত্তাপ গলায় সে শুধু বলল, চিতা-মানুষের কাজ।

কিন্তু ওরান্ডো তখন থরথর করে কাঁপছে। বন্ধুর মৃতদেহটা দেখামাত্রই চিতা-মানুষদের কথা তার মনে হয়েছিল। এই নৃশংস গুপ্ত সমিতির ভীতি বাসা বেঁধে আছে তার মনের গভীরে। তাদের রহস্যময় নরহন্তারক ধর্মীয় অনুষ্ঠান আরও বেশি ভয়ংকর এই কারণে যে তাদের সংঘবহির্ভূত কোন মানুষ সে সব কখনও চোখে দেখে নি, বা দেখলে আর বেঁচে থাকে নি।

মৃতদেহটাকে সেই একইভাবে বিকৃত করা হয়েছে; নরমেধ যজ্ঞের জন্য দেহের কতকগুলো বিশেষ অঙ্গকে কেটে নিয়েছে। ওরান্ডো শিউরে উঠল; কিন্তু সে শিহরণ যত না ভয়ের, তার চাইতে বেশি ক্রোধের। নিয়ামওয়েগি তার বন্ধু। শৈশব থেকে দু’জন এক সঙ্গে বড় হয়েছে। এই পৈশাচিক আক্রমণ যারা হেনেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা সাধনের জন্য তার আত্মা চীৎকার করে উঠল। কিন্তু অনেকের বিরুদ্ধে সে একা কি করবে? নরম মাটিতে অনেক পায়ের ছাপ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে অনেকে মিলে তাকে হত্যা করেছে।

নবাগত লোকটি বর্শায় ভর রেখে নিঃশব্দে সৈনিকটিকে দেখছিল- দেখছিল তার মুখের শোক ও ক্রোধের প্রকাশ। বলল, তুমি একে চিনতে?

আমার বন্ধু।

নবাগত কোন কথা বলল না; দক্ষিণের পথে পা বাড়াল।

ওরান্ডো তাকে অনুসরণ করে বলল, কোথায় যাচ্ছ?

যারা তোমার বন্ধুকে মেরেছে তাদের শাস্তি দিতে।

ওরান্ডো প্রতিবাদ করে বলল, তারা সংখ্যায় অনেক; আমাদেরই মেরে ফেলবে।

নবাগত জবাব দিল, তারা চারজন। আমিই মারতে পারব।

তারা যে চারজন তা জানলে কেমন করে?

পায়ের কাছের পথটা দেখিয়ে নবাগত বলল, একজন বৃদ্ধ খুঁড়িয়ে হাঁটে; একজন ঢ্যাঙা ও সরু; অপর দু’জন যুবক সৈনিক। তারা হাঁটে হাল্কা পায়ে, যদিও একজনের শরীর বেশ ভারী।

তুমি তাদের দেখেছ?

তাদের পায়ের ছাপ দেখেছি; সেটাই যথেষ্ট।

কথাগুলো ওরান্ডোর মনে ধরল। লোকটা পথের হদিস বোঝে বটে। আর দ্বিধা নয়। যা থাকে কপালে, ওর সঙ্গেই সে যাবে।

বলল, অন্তত ওরা কোন গ্রামে ফিরে গেল সেটা তো জেনে আসতে পারব। আমার বাবা টুম্বাই গ্রামের সর্দার। সারা ওয়াটেঙ্গা দেশে সে হরকরা পাঠাবে; যুদ্ধের ঢাক বেজে উঠবে; উটেঙ্গা যোদ্ধারা দলে। দলে আসবে। তখন আমরা চিতা-মানুষদের গ্রাম আক্রমণ করে নিয়ামওয়েগির রক্তের প্রতিশোধ নেব।

দু’জনে পথ চলতে লাগল। এক সময় ওরান্ডোর মনে হল, তার সঙ্গীটি কোন সাধারণ মানুষ নয়; অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। বিদ্যুৎ-চমকের মত সহসা একটা নতুন চিন্তা তার মনে দেখা দিল : যে পরলোকগত পূর্বপুরুষের নামে তার নামকরণ হয়েছে তার আত্মাই বুঝি এসে দেখা দিয়েছে। এই নবাগতের রূপ ধরে-এই লোকটিই তার মুজিমো। তাছাড়া মুজিমোর কাঁধের উপরকার ছোট বানরটিও একটি আত্মা। হয়তো বা নিয়ামওয়েগির যেমন সারা জীবনের বন্ধু ছিল, তেমনি এরা দু’জনও খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

সে ডাকল, মুজিমো!

 নবাগত মুখ ফিরিয়ে চারদিকে তাকিয়ে বলল, তুমি মুজিমোকে ডাকলে কেন?

ওরান্ডো জবাব দিল, আমি তোমাকেই ডেকেছি মুজিমো।

মুজিমো বলে?

 হ্যাঁ।

তুমি কি চাও?

ওরান্ডো বুঝল, সে ভুল করে নি; এই তো তার মুজিমো।

তুমি আমাকে ডাকছিলে কেন?

কোন জবাব খুঁজে না পেয়ে ওরান্ডো শুধাল, আমরা কি চিতা-মানুষদের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি মুজিমোঃ

আমরা সেই দিকেই চলেছি। এক কাজ করা যাক। গাছের ডালে ডালে ঝুলতে ঝুলতে যাওয়া যাক। চলে এস।

বলেই একটা বড় গাছের ডাল ধরে সে ঝুলে পড়ল।

ওরান্ডো চেঁচিয়ে বলল, দাঁড়াও। আমি তো গাছে-গাছে চলতে পারব না।

 তাহলে হেঁটেই এস। আমি এগিয়ে গিয়ে চিতা-মানুষদের ধরে ফেলব।

ওরান্ডোকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বানরটাকে কাঁধে নিয়ে নবাগত লোকটি মুহূর্তের মধ্যে গাছপালার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। সবিস্ময়ে তার কথা ভাবতে ভাবতেই ওরান্ডো পায়ে হেঁটে এগোতে লাগল।

সে যদি আরও বেশি সতর্ক থাকত তাহলেই বুঝতে পারত যে চার জোড়া হিংস্র লোলুপ চোখে গাছ পালার আড়াল থেকে তার উপর নজর রেখে চলেছে। যেই সে ভোলা জায়গাটার মাঝখানে পৌঁছে গেল অমনি ভয়ঙ্কর চীৎকার করতে করতে বীভৎসভাবে সজ্জিত চারজন সৈনিক লাফিয়ে পড়ে তার দিকে ছুটে এল।

লোবোঙ্গোর ছেলে ওরান্ডো আগে কখনও চিতা-মানুষদের সংঘের ভয়ঙ্কর কোন সদস্যকে চোখে দেখে নি; তবু এই চারজনকে চিনতে তার কোন অসুবিধা হল না। তখন তারা চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলেছে।

মেয়েটি গুলি ছুঁড়তেই গোলাটো যন্ত্রণায় চীৎকার করে উঠল; ডান হাতের কনুইয়ের উপরটা বাঁ হাতে চেপে ধরে ছুটে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল। কালি বাওয়ানা উঠে পোশাক পরল, খাপে-ঢাকা পিস্তলসহ কার্তুজের বেল্টটা বেঁধে নিল।

লণ্ঠনটা জ্বেলে চেয়ারে বসল; রাইফেলটাকে পাশে রাখল। বাকি রাতটা জেগেই পাহারা দেবে। কিন্তু সে রাতে আর কিছুই ঘটল না। এক সময় সে তন্দ্রায় ঢলে পড়ল।

যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘণ্টাখানেক মত বেলা হয়েছে। ঝড় থেমে গেছে, কিন্তু তাঁবুর চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে তার চিহ্ন। তাবুর দরজার কাছে এগিয়ে মেয়েটি তার চাকরকে ডেকে স্নানের জল ও প্রাতরাশ দিতে বলল। দেখল, কুলিরা বাধা-ছাদা করছে। ব্যান্ডেজ-বাঁধা হাতটা গলার সঙ্গে ঝুলিয়ে গোলাটো ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কুলিরা মালপত্র বেঁধে যাত্রার আয়োজন করছে, অথচ সে তো যাত্রার হুকুম জারি করে নি।

 এগিয়ে গিয়ে গোলাটোর বদলে আর একটি লোককে জিজ্ঞাসা করল, এ সবের অর্থ কি?

 লোকটি জবাব দিল, আমরা ফিরে যাচ্ছি।

আমাকে একা রেখে তোমরা ফিরে যেতে পার না।

 লোকটি বলল, তুমিও আমাদের সঙ্গে আসতে পার। তবে তোমার ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে।

বেপরোয়া ভঙ্গীতে মেয়েটি বলল, এ কাজ তোমরা করতে পার না। আমি যেখানে যাব সেখানেই তোমরা আমার সঙ্গে যাবে- এই শর্তেই তোমরা রাজী হয়েছিলে। মালপত্র নামাও; আমি হুকুম না দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা কর।

 লোকটি তবু ইতস্তত করছে দেখে মেয়েটি রিভলবার বের করল। এবার গোলাটো হস্তক্ষেপ করল রাইফেলধারী অস্কারিদের দিকে এগিয়ে এসে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, থাম! তোমরা তাঁবুতে ফিরে যাও। আমরা নিজেদের দেশে ফিরে যাচ্ছি। গোলাটোর সঙ্গে যদি ভাল ব্যবহার করতে তাহলে এসব ঘটত না; কিন্তু তা তুমি কর নি; আর এটা তারই শাস্তি।

মেয়েটির চোখের সামনে সকলে সার বেঁধে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। ভগ্ন হৃদয়ে সে তাঁবুতে ফিরে গেল।

ওদিকে সংঘের প্রতীক চিতাবাঘের চামড়ায় সজ্জিত চারমূর্তি ওরান্ডোকে ঘিরে ধরতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল বন্ধুর বিকৃত মৃতদেহের ছবি। মনের পটে আঁকা পড়ল নিজেরে শোচনীয় পরিণতির ছবি। কিন্তু সে ঘাবড়াল না। সে সৈনিক; মরতে হয় মরবে, তবু নিয়ামওয়েগির মৃত্যুর প্রতিশোধ সে নেবে। প্রাণপণ শক্তিতে বর্শাটাকে চেপে ধরে আঘাত হানল। একজন শত্রু আর্তনাদ করে মাটিতে পড়ে গেল। বাকি তিনজন ধীর পায়ে এগোতে লাগল।

দ্রুত মুখ ফিরিয়ে এনে সে বাকি শত্রুদের মোকাবিলার জন্য রুখে দাঁড়াল। পিছন থেকে কানে এল একটা বর্বর হুংকার। তা শুনে তার মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল। ফিরে তাকাবার অবসর নেই। বীভৎস মূর্তিগুলো ইস্পাতের বাঁকা নখরগুলো থাবার মত মেলে ধরে এগিয়ে আসছে তাকে ধরতে।

পিছন থেকে একটা মূর্তি হুংকার দিয়ে লাফিয়ে উঠে ওরান্ডোকে পাশ কাটিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রথম চিতা-মানুষটার উপর। মূর্তিটি ওয়ান্ডোর মুজিমো। এও কি সম্ভব যে তার গলা থেকেই বেরিয়েছে সেই পাশবিক ভয়ংর হুংকার! যাইহোক, বেগতিক বুঝে চতুর্থ শত্রুটি মুখ ঘুরিয়ে জঙ্গলের দিকে ছুট দিল; শেষ সঙ্গীটিকে ছেড়ে দিয়ে গেল তার ভাগ্যের হাতে।

মুজিমো তখন দুটি যুবক চিতা-মানুষের বড়টির সঙ্গে লড়ছে। শক্ত মুঠোর দুটো থাবাওয়ালা হাতকে এক সঙ্গে চেপে ধরে আর এক হাতে মুজিমো চেপে ধরেছে তার গলা। একটু একটু করে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ক্রমে তার হাত-পা সহ গোটা শরীরটাই শিথিল হয়ে এলিয়ে পড়ল। মৃতদেহটাকে সে মাটিতে ফেলে দিল।

তার দিকে এগিয়ে গিয়ে ওরান্ডো ভয়ে ভয়ে বলল, মুজিমো, আজ তুমি আমার প্রাণ রক্ষা করেছ। এ প্রাণ তোমার।

মুজিমো বলল, এখন মনে পড়ছে, তুমিও আমার প্রাণ রক্ষা করেছ।

 হা মুজিমো, আজ সকালেই।

 আজই সকালে! হ্যাঁ, তাই। আমরা শিকারে যাচ্ছিলাম। আমি সত্যি ক্ষুধার্ত; শিকারে চল।

 ওরান্ডো বলল, যে পালিয়ে গেল তার পিছু নেব না? ওদের গ্রামটা চিনে আসতে হবে না?

 মুজিমো বলল, আগে মরা মানুষদের সঙ্গে কথা বলে দেখি, তারা কতটা কি বলতে পারে।

ভয় কম্পিত গলায় ওরান্ডো শুধাল, তুমি মরা মানুষের সঙ্গেও কথা বলতে পার?

মুজিমো বলল, শব্দ দিয়ে কথা না বললেও অনেক সময় তারা অনেক কিছু বলতে পারে। ওদের ধারালো দাঁত বলেছে ওরা নরমাংস খায়; ওদের কবচ আর থলের জিনিসপত্র বলেছে যে ওরা জেলে; কোন বড় নদীর ধারে বাস করে, আর কুমীর গিমলাকে ভীষণ ভয় করে। ওদের থলের বঁড়শি ও কবচই সে কথা আমাকে বলে দিয়েছে। ওদের অলংকার অস্ত্র এবং কপাল ও থুতনির কাটা দাগ থেকেই জানতে পেরেছি ওরা কি জাতি, আর কোন্ দেশে বাস করে। যে পালিয়ে গেছে তাকে অনুসরণ করার কোন দরকার নেই; তার বন্ধুরাই সব কথা বলে দিয়েছে। তাই আপাতত শিকারে চল। চিতা-মানুষদের গ্রামে পরে যাওয়া যাবে।

দু’টি সাদা মানুষ একটা তালি-মারা জীর্ণ তাঁবুর সামনে বসেছিল। কোন চেয়ার না থাকায় তারা মাটিতেই বসেছিল। তাদের জামাকাপড় আরও বেশি তালি-মারা, আরও বেশি জীর্ণ। পাঁচটি আদিবাসী কিছুদূরে চুল্লীর পাশে বসে আছে। অপর একটি আদিবাসী তাঁবুর কাছে ছোট উনুনে সাদা মানুষদের জন্য আহার্য তৈরি করছে।

আর পারা যায় না, বয়স্ক লোকটি বলল।

একুশ-বাইশ বছরের যুবকটি বলল, তাহলে ফিরে যাচ্ছ না কেন?

 বয়স্ক সঙ্গীটি কাঁধ ঝাঁকাল। কোথায় যাব? দেশে ফিরে গেলে একটা নোংরা বাউণ্ডুলে বনে যাব। শ্রদ্ধা করুক আর নাই করুক, তবু তো এখানে ক’টা চাকর রাখতে পেরেছি; নিজেকে একজন কেউ-কেটা বলে ভাবতে পারি। আর সেখানে গেলে তো অন্যের হুকুম-বরদার হতে হবে। কিন্তু তুমি-তুমি কেন যে এই পাণ্ডব-বর্জিত দেশে ছারপোকা ও জ্বরের জঙ্গে লড়াই করে চলেছ তা তো বুঝি না। তুমি যুবক। তোমার সামনে রয়েছে একটা পুরো জীবন একটা গোটা জগৎ।

যুবকটি বলে উঠল, থাক! এমন ভাবে কথা বলছ যেন তুমি একটা একশ’ বছরের বুড়ো। তোমার বয়স তো তিরিশও হয় নি। আমাদের দেখা হবার পরেই তোমার বয়সটা আমাকে বলেছিলে।

অপরজন বলল, আরে, তিরিশ হলেই তো বুড়ো। মানুষ হতে হলে তিরিশের অনেক আগেই শুরু করতে হয়। আরে, এমন অনেক লোককে আমি জানি যারা মাল-কড়ি কামিয়ে তিরিশ বছরেই অবসর নিয়ে বসেছে। আমার বাবার কথাই ধর না-হঠাৎ সে চুপ করে গেল। হাসতে হাসতে যুবকটি বলে উঠল, মনে হচ্ছে ফিরে গেলে আমরা যুগল নিষ্কর্মা বনে যাব।

বুড়ো টাইমার বলল, কিন্তু এভাবে কতদিন কাটবে? দেখেশুনে মনে হচ্ছে আফ্রিকার সব হাতি কোন অজ্ঞাত জগতে চলে গেছে।

কিড বলল, বুড়ো বোবোলো দিব্যি গেলে বলেছিল যে এখানেই হাতির দেখা পাব; এখন বুঝছি লোকটা মিথ্যাবাদী।

টাইমার বুড়ো বলল, সে সন্দেহ আমার মনেও জেগেছে। কিন্তু বলে সব চুপচাপ বসে থাকলে তো চলবে না। এইসব অনুগত লোকগুলো যদি অবিলম্বে কিছু হাতির দাঁত চোখে না দেখে তাহলে নির্ঘাৎ আমাদের মত, তারাও ভাল করেই জানে যে এখানে হাতির দাঁত নেই তো মাইনেও নেই।

তা তো বুঝলাম। কিন্তু আমরা করবটা কি? হাতি বানাব?

খুঁজে বের কর। দুরের পাহাড়ে হাতি আছে; কিন্তু তারা তো তোমার গুলি খাবার জন্য নাচতে নাচতে এই শিবিরে এসে হাজির হবে না। কাজেই দু’জন করে লোক আর দিন কয়েকের খাবার সঙ্গে নিয়ে আমাদেরই বের হতে হবে। তাতে যদি হাতির খোঁজ না মেলে তো আমার নামে একটা জেব্রা পুষো।

কিড বলল, আমি রাজী।

টাইমার বুড়ো বলল, বেশ, কালই যাত্রা করব।

অনেক নির্জন দিন। অনেক আতংকের রাত। সঙ্গী লোজনদের দ্বারা পরিত্যক্ত হবার পরে একমাত্র অন্তরের নির্ভিকতাই মেয়েটিকে পাগল হয়ে যাবার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। তারপর অনন্তকাল বুঝি পার হয়ে গেছে; প্রতিটি দিন যেন এক একটি যুগ।

আজ সে একটা শিকার করেছে। রাইফেল চালিয়ে মেরেছে একটা শুয়োর।

কাজ করতে করতেই একটা শব্দ শুনে চোখ তুলতেই দেখতে পেল চারটি লোক নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে তাকেই দেখছে। একজন সাদা, বাকি তিনজন আদিবাসী। একটা যেন আশার আলো দেখতে পেল। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। ওরা এগিয়ে এল। সাদা মানুষটি সকলের আগে। ভাল করে তাকাতেই আশার আলো যেন নিভে এল। কোন সাদা মানুষের এ রকম অভদ্র চেহারা সে আগে কখনও দেখে নি। নোংরা জামা-পাকড় শতছিন্ন ও তালিমারা; মুখময় দাড়ি; টুপিটার এতই ভগ্নদশা যে মাথায় পরা আছে বলেই সেটাকে টুপি বলে চেনা যাচ্ছে; মুখটাও রুক্ষ, কঠিন।

বলল, তুমি কে? এখানে কি করছ?

ও দুটোর কোনটা নিয়েই তোমার মাথা ঘামাবার দরকার নেই। মেয়েটি ঘুরে দাঁড়াল।

লোকটির মুখ আরও বিকৃত হল; কিছু কড়া কথা ঠোঁটের ডগায় এসেওছিল; কিন্তু নিজেকে সংযত করে সে মেয়েটিকেই দেখতে লাগল। মেয়েটি সুন্দরী। নোংরা পোশাক, মুখ ঘামে ভেজা, শরীরে রক্তের দাগ; তবু তাকে সুন্দরী দেখাচ্ছে। দুই বছর পরে বুড়ো টাইমার এই প্রথম একটি সাদা মেয়ে মানুষকে দেখল।

সে প্রশ্ন করল, নিশ্চয় তুমি একাকি এ দেশের এত ভিতরে ঢোক নি। দলের অন্য সকলে কোথায় গেল?

তারা আমাকে ফেলে চলে গেছে।  

আর তোমার সাদা সঙ্গীরা-তারা?

সে রকম সঙ্গী কেউ ছিল না। মেয়েটি ঘুরে দাঁড়াল।

এখন তুমি কি করবে? একা তো এখানে থাকতে পারবে না। তাছাড়া কুলির সাহায্য ছাড়া থাকবেই বা কেমন করে?

একাই তিন দিন কাটিয়েছি; আরও কাটাব যতদিন

যতদিন মানে?

জানি না।

লোকটি বলল, আমার কথা শোন। বল তো, এখানে থেকে তুমি কি করছ?

একটু আসার আলো যেন দেখতে পেল মেয়েটি। বলল, একজনের খোঁজ করছি। তুমি হয় তো তার কথা শুনেছ, হয় তো সে কোথায় আছে তাও জান। আগ্রহে মেয়েটির গলা কাঁপছে।

তার নাম কি? বুড়ো টাইমার জিজ্ঞাসা করল।

 জেরি জেরোম। মেয়েটি অনেক আশা নিয়ে চোখ তুলল।

লোকটি মাথা নাড়ল। তার কথা কখনও শুনি নি।

মেয়েটির চোখ থেকে আশার সামান্য আলোটুকুও নিভে গেল। দুই চোখ বুঝি বা তার অজ্ঞাতেই জলে ভরে উঠল। তা দেখে বুড়ো টাইমার বলল, খুব হয়েছে; এখন চল।

কোথায়?

 আমার সঙ্গে।

কেন?

এই জঙ্গলে একটা সাদা ইঁদুরকেও আমি রেখে যেতে পারতাম না; আর তুমি তো একটা সাদা মেয়ে।

মেয়েটি উদ্ধত ভঙ্গীতে বলল, তোমার সঙ্গে যদি না যাই তাহলে?

না যাই-টাই নয়, তোমাকে যেতেই হবে। মাথায় ঘিলু থাকলে সে জন্য তোমার কৃতজ্ঞ হবার কথা। কিন্তু তোমাদের কাছে তো ও সব কথা বলাই বৃথা। তুমিও তো অন্য সব মেয়েরই মত- স্বার্থপর, অবিবেচক, অকৃতজ্ঞ।

মেয়েদের সম্পর্কে তোমার ধারণা দেখছি খুব ভাল, কি বল?

 ঠিক ধরেছ।

 এবার নরম সুরে মেয়েটি শুধাল, আচ্ছা তোমার শিবিরে গেলে আমাকে নিয়ে কি করবে?

সঙ্গী-সাথী পেলেই যত তাড়াতাড়ি পারি আফ্রিকার বাইরে পাঠিয়ে দেব।

আফ্রিকা ছেড়ে আমি যাব না। একটা উদ্দেশ্য নিয়ে আমি এখানে এসেছি।

তোমার উদ্দেশ্য তো সেই জেরোম নামক ভদ্দর লোককে খুঁজে বের করা; কিন্তু তার ভালর জন্যই একটি পুরুষ মানুষ হিসেবে আমার কর্তব্য তুমি তাকে খুঁজে পাবার আগেই তোমাকে এ দেশ থেকে বের করে দেয়া।

লোকটা পাগল নাকি? মেয়েটি শুনেছে, পাগলের কথা মত চলতে হয়; নইলে তারা হিংস্র হয়ে ওঠে। তাই সে ভয়ে ভয়ে বলল, হয়তো তোমার কথাই ঠিক। আমি যাব তোমার সঙ্গে।

লোকটি বলল, খুব ভাল কথা। এই তো বেশ মীমাংসা হয়ে গেল। তাহলে বাকি কথাটাও খোলসা হয়ে যাক। এখানকার কাজ শেষ করে আগামীকাল অথবা পরশু আমি শিবিরে ফিরে যাব। তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে না। আমার একটি চাকর তোমার দেখাশুনা করবে-রান্না করবে, সব কাজ করে দেবে। কোন মেয়ের হেপা আমি পোহাতে পারব না। তুমি আমাকে ঘাটাবে না, আমিও তোমাকে ঘাটাব না। তোমার সঙ্গে কথাও বলব না।

সেটা আমারও কথা, মেয়েটি সায় দিল।

 লোকটি আবার বলল, আর একটা কথা। সর্দার বোবোলোর দেশে আমার শিবির। আমার যদি একটা কিছু হয় তাহলে একটা লোককে সঙ্গে নিয়ে সেখানে চলে যেয়ো। সেখানে আমার অংশীদার তোমার দেখাশুনা করবে। শুধু আমার নাম করো, তাহলেই হবে।

বুড়ো টাইমার ও তার সঙ্গীরা সে রাতের মত সেখানেই তাঁবু খাটাল। সন্ধ্যার পরে নিজের তাবু থেকেই মেয়েটি দেখল, লোকটি আগুনের পাশে বসে পাইপ টানছে। হঠাৎ তার মনে এমন একটা নিরাপত্তার ভাব জাগল যা আফ্রিকায় ঢোকার পর থেকে কখনও অনুভব করে নি। তার মন বলল, একেবারে একা থাকার চাইতে একটি সাদা পাগলা মানুষও ভাল। কিন্তু লোকটি কি সত্যিই পাগল?

কী আশ্চর্য, ওদিকে বুড়ো টাইমারও মেয়েটির কথাই ভাবছে। পাইপের ধোঁয়ার মধ্যে ভেসে উঠছে তারই মুখ এক অপরূপা সুন্দরীর মুখ।

নিজের মনেই সে বলে উঠল, মলো যা! কেন যে মরতে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?

পরদিন সকালে উঠেই সে তাঁবু ছেড়ে চলে গেল। সঙ্গে নিল দুটো চাকর। একটা পুরনো রাইফেল দিয়ে অপর চাকরটিকে রেখে গেল মেয়েটির রক্ষী হিসেবে। সে যাবার আগেই মেয়েটি ঘুম থেকে উঠে এসে দাঁড়াল; কিন্তু তার দিকে না তাকিয়েই সে চলে গেল।

মনের ক্ষোভ চেপে রাখতে না পেরে মেয়েটি হিসৃহিস্ করে বলে উঠল, অসভ্য কোথাকার।

বুড়ো টাইমারের সারাটা দিন কঠোর পরিশ্রমে কেটে গেল। অনেক খুঁজেও একটা হাতির চিহ্ন মাত্রও দেখতে পেল না। এমন এটা আদিবাসীর দেখা পর্যন্ত পেল না যে হাতির দলের চলাফেরার হদিসটাও অন্তত দিতে পারে। অগত্যা ক্লান্ত, অবসন্ন দেহে সে আবার শিবিরেই ফিরে চলল।

দূর থেকে যখন খোলা জায়গাটা দেখতে পেল সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। প্রথমেই চোখে পড়ল মেয়েটির তাঁবু। তাঁবুর বাইরে কি যেন পড়ে আছে দেখেই তার শরীর ভয়ে ঠাণ্ডা হয়ে এল। দ্রুত ছুটে গেল সেইদিকে। চাকর দুটিও ছুটল তার পিছনে। মেয়েটির রক্ষী হিসেবে যাকে রেখে গিয়েছিল তার ভয়ংকরভাবে বিকৃত মৃতদেহটা সেখানে পড়ে আছে। নিষ্ঠুর নখরাঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়েছে তার দেহ।

সঙ্গীর দেহের উপর ঝুঁকে পড়ে নিগ্রো দুটি নিজেদের ভাষায় কি যেন বলল; তারপর বুড়ো টাইমারের দিকে ফিরে বলল, চিতা-মানুষরা এসেছিল বাওয়ানা।

বুড়ো টাইমার ভয়ে ভয়ে তাঁবুর দিকে পা বাড়াল। মেয়েটি তাঁবুর মধ্যে নেই। প্রথমেই তার মনে হল, গলা ছেড়ে তাকে ডাকবে। কিন্তু কেমন করে ডাকবে? তার নামটাই ত জানা হয় নি। পর মুহূর্তেই মনে হল, তাকে ডাকা বৃথা। সে যদিও বেঁচেও থাকে তাহলেও এতক্ষণে সে অনেক দূর চলে গেছে-রক্তপিপাসু শয়তানরা তাকে ধরে নিয়ে গেছে। যেমন করে হোক তাকে উদ্ধার করতেই হবে প্রতিশোধ নিতে হবে।

ওরান্ডোর ডাকে উটেঙ্গা সৈনিকদের কাছ থেকে ভাল করে সাড়া পাওয়া গেল না। যুদ্ধের নামে সকলেই নাচে; কিন্তু চিতা-মানুষদের গুপ্ত সংঘের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথায় সকলেরই বুক কাঁপে। তাই দেখা গেল যুদ্ধ যাত্রার ডাক পড়লে শ’খানেক লোক এসে হাজির হল।

এদিকে আর এক বিপদ। মুজিমোকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে নিয়ামওয়েগির আত্মাও উধাও হয়েছে। বড়ই অশুভ লক্ষণ। কিস্তু গ্রামের লুপিঙ্গুও যুদ্ধের বিপক্ষে। সুযোগ বুঝে সে ওরান্ডোকে শুধাল, তোমার মুজিমো তো চলে গেল। এখন কে আমাদের চিতা-মানুষদের গ্রামের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে?

ওরান্ডো প্রবল আপত্তি জানিয়ে বলল, সে আমাকে ছেড়ে যাবে তা আমি বিশ্বাস করি না।

বুঝি বা তার কথা রাখতেই কাছের একটা গাছের ডাল থেকে নেমে এল একটা দৈত্যাকার মূর্তি। সে মুজিমো। এক কাঁধে একটা মরা হরিণ, অন্য কাঁধে নিয়ামওয়েগির আত্মা।

ওরান্ডো শুধাল, কোথায় ছিলে মুজিমো? ওরা বলছিল, সোবিটো তোমাকে মেরে ফেলেছে।

কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে মুজিমো বলল, শুধু মুখের কথায় মানুষ মরে না। সোবিটো তো কথার বস্তা।

একটি বুড়ো প্রশ্ন করল, তুমি কি সোবিটোকে মেরে ফেলেছ?

তাকে বাধা দিয়ে মুজিমো বলল, আমি শিকারে বেরিয়েছিলাম। তোমাদের খাদ্য ভাল নয়; আগুনে পুড়িয়ে তোমরা সব নষ্ট করে ফেল।

একটা গাছের নিচে বসে শিকারের শরীর থেকে খানিকটা মাংস কেটে নিয়ে সে খেতে শুরু করল। মাঝে মাঝে গলার মধ্যে গরু-গর্ শব্দ হচ্ছে। বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সৈনিকরা সভয়ে তাকে দেখতে লাগল।

খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল। শরীরের আড়মোড়া ভাঙল। তারপর বলল, মুজিমো প্রস্তুত। উটেঙ্গারা প্রস্তুত থাকলে এবার যাত্রা শুরু হোক।

তিন দিন ধরে চলল একটানা অভিযান। মুজিমো পথ-প্রদর্শক; ওরান্ডো নেতা। যত এগিয়ে যাচ্ছে, সৈনিকদের মনোবল ততই বাড়ছে। সকলেরই ঠাট্টা বিদ্রুপের ফলে লুপিঙ্গুও চুপচাপ পথ চলেছে।

চতুর্থ দিন সকালে মুজিমো জানাল, তারা চিতা-মানুষদের গ্রামের কাছাকাছি এসে পড়েছে। পরদিন সকালেই সে একা এগিয়ে গিয়ে সব কিছু ভাল করে দেখে আসবে।

প্রাতরাশের পরে আগুনকে ঘিরে বসে গল্প করতে করতে এক সময় সকলের খেয়াল হল লুপিঙ্গু সেখানে নেই। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া গেল না। তখন সকলেই ধরে নিল যে শত্রুর কাছাকাছি এসে সে ভয়ে পালিয়ে গেছে। সেই ফাঁকে মুজিমো ও নিয়ামওয়েগির আত্মা নিঃশব্দে গাছের ডালে ডালে ঝুলে চিতা-মানুষদের গ্রামের দিকে এগিয়ে চলল।

গলায় দড়ি বেঁধে মেয়েটাকে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। দড়ির অপর প্রান্ত ধরে আছে একটি বলিষ্ঠ আদিবাসী যুবক; তার আগে আগে পথ দেখিয়ে চলেছে একটি বুড়ো, তার পিছনে আছে আর একটি যুবক। তিনজনেরই শরীর চিতাবাঘের চামড়ায় ঢাকা; মাথায় বেশ ভাল করে বসানো চিতাবাঘের মাথা; ইস্পাতের বাঁকা নখ বসানো তাদের আঙুলের ডগায়; দাঁতগুলো ঘসে ঘসে ধারালো করা হয়েছে; আর সারা মুখ চিত্র-বিচিত্র করে আঁকা। তিনজনের মধ্যে বুড়োটাই সর্দার; দেখতেও ভয়ংকর। যুবক তার দুটি কথায় উঠছে-বসছে।

সকলের কুটিল, কঠোর দৃষ্টির সম্মুখ দিয়ে আদিবাসীরা মেয়েটিকে নিয়ে হাজির হল একটা বড় কুটিরের সামনে। বাড়ির সামনে বসে আছে একটি পেটমোটা বুড়ো নিগ্রো; তার সারা মুখে বলিরেখায় ভরা। চিতা-মানুষদের সর্দার গাটো মুঙ্গু। চোখ তুলে তাকাতেই সাদা মেয়েটিকে দেখে তার রক্ত-রাঙা চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে উঠল। বুড়ো লোকটিকে লক্ষ্য করে বলল, তুমি আমার জন্য উপহার এনেছ, লুলিমি?

বুড়ো জবাব দিল, উপহার এনেছি, তবে কেবলমাত্র গাটো মুঙ্গুর জন্য নয়।

তার মানে? সর্দার ভেংচে উঠল।

উপহার এনেছি গোটা জাতির জন্য-চিতা-দেবতার জন্য।

মেয়েটিকে মন্দিরে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা চলতে লাগল। এমন সময় একটি সৈনিক ঘর্মাক্ত দেহে রুদ্ধশ্বাসে এসে হাজির হল।

গাটো মুঙ্গু বলল, তুমি কি সংবাদ এনেছ?

উটেঙ্গাদের সর্দার লোবোঙ্গোর ছেলে ওরান্ডোর নেতৃত্বে একশ’ সৈনিক এখান থেকে কয়েক ঘণ্টার পথ দূরে হাজির হয়েছে। তারা আক্রমণ করবে তোমার গ্রাম। এখনই যদি কিছু সৈনিক পাঠিয়ে তাদের পথের পাশে লুকিয়ে রাখতে পার তাহলে অতর্কিকে আক্রমণ করে তার সব উটেঙ্গাকে মেরে ফেলতে পারবে।

কোথায় তাঁবু ফেলেছে তারা?

বার্তাবহ সে স্থানের বিস্তারিত বিবরণ দিল। গাটো মুঙ্গু একজন উপ-প্রধানকে হুকুম দিল, তিনশ’ সৈনিক নিয়ে সে আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্যে যাত্র করুক। তারপর বলল, আজ রাতে আমাদের মহাভোজ হবে, আর এই অতিথি সেখানে আমার পাশে বসে পানাহার করবে।

বার্তাবহ বলল, আমি তো থাকতে পারব না। এখনই আমাকে ফিরে যেতে হবে, নইলে সকলে আমাকে সন্দেহ করবে।

তুমি কে? গাটো মুঙ্গু প্রশ্ন করল।

 বার্তাবহ জবাব দিল, আমি ওয়াটেঙ্গা দেশের কিস্তু গ্রামের লুপিঙ্গু।

 রাত নামছে। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। বনের পথ ধরে ছিন্ন বসন একটি সাদা মানুষ এসে দাঁড়াল একটা ফসলের ক্ষেতের শেষ প্রান্তে। ক্ষেতের ওপারে একটা বেড়া দিয়ে ঘেরা গ্রামের দীর্ঘ ছায়া পড়েছে মাঠের উপরে। লোকটির সঙ্গে দুটি কালো মানুষ।

তাদের একজন বলল, আর যেয়ো না বাওয়ানা। ওটা চিতা-মানুষদের গ্রাম।

বুড়ো টাইমার বলল, ওটা গাটো মুঙ্গুর গ্রাম। আগেও আমি তার সঙ্গে ব্যবসা করেছি।

তখন তুমি এসেছিলে অনেক লোকজন ও বন্দুক নিয়ে। আর তখন গাটো মুঙ্গু ছিল ব্যবসাদার। আজ তুমি এসেছ মাত্র দুটি চাকর নিয়ে; আর আজ তুমি দেখবে বুড়ো গাটো মুঙ্গু চিতা-মানুষ হয়ে গেছে।

বাজে কথা! সাদা মানুষটি চেঁচিয়ে বলল। একজন সাদা মানুষের কোন ক্ষতি করার সাহস তার হবে না। তাছাড়া, সব কিছু দেখে মনে হচ্ছে যে মেয়েটিকে এখানেই আনা হয়েছে। আমি ঐ গ্রামে যাবই।

নিগ্রোরা মাথা নাড়ল। তুমি যেয়ো না বাওয়ানা। সাদা মেয়েটি তোমার স্ত্রী নয়, মা নয়, বোন নয়। তাহলে তার জন্য তুমি কেন জীবনটা দেবে।

বুড়ো টাইমারও মাথা নাড়ল। সে তোমরা বুঝবে না। সে নিজেই কি বুঝেছে। হাত নেড়ে বলল, তাহলে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করো।

বুড়ো টাইমার মাঠ পেরিয়ে ফটকের দিকে এগিয়ে চলল। নিগ্রো দুটির চোখ জলে ভরে এল।

বুড়ো টাইমারকে দেখে গাটো মুঙ্গু উদ্ধত ভঙ্গীতে বলল, এখানে কি করতে এসেছ?

বুড়ো টাইমার বুঝল, অবস্থা সুবিধার নয়। এখানে নরম কথায় কোন কাজ হবে না। সে সরাসরি বলল, আমি এসেছি সাদা মেয়েটিকে নিয়ে যেতে।

কোন্ সাদা মেয়ে?

মিথ্যা প্রশ্ন করে আমাকে ভোলাতে চেষ্টা করো না। মেয়েটি এখানেই আছে। তাকে আমার হাতে তুলে দাও।

গাটো মুঙ্গু হুংকার দিয়ে উঠল, এ গায়ে কোন সাদা মেয়ে নেই। আর আমি সর্দার গাটো মুঙ্গু, হুকুম করি, কারও হুকুম শুনি না।

হুকুম তোমাকে শুনতে হবে বদমাশ। অন্যথায় একদল সৈন্য নিয়ে এসে তোমার গ্রামটাকে আমি মানচিত্রের বুক থেকে মুছে ফেলব।

গাটো মুঙ্গু ঘৃণাভরে বলল, তোমাদের আমি চিনি। তোমরা তো মাত্র দু’জন, আর বাকি পাঁচজন তো এখানকার মানুষ। তোমরা তো গরিব। হাতির দাঁত চুরি করে বেড়াও। মুখেই শুধু বড় বড় কথা বল। গাটো মুঙ্গু তোমার কথায় ভয় পায় না। তুমি তো এখন আমার বন্দী। একে এখান থেকে নিয়ে যাও। দেখো যেন পালিয়ে না যায়।

 দু’জন সৈনিক এসে তাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। গোটা নোংরা ছোট ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে তার অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিল। হাত-পা শক্ত করে বেঁধে রেখে চলে গেল। একজন মাত্র শাস্ত্রী রইল দরজার পাশে। পাহারায়। কিন্তু লোকটির পাজামার পকেটে যে একটা ছোট ছুরি ছিল সেটা খেয়ালই করল না।

অন্ধকার কারাগারে বসে বুড়ো টাইমার মেয়েটির কথাই ভাবছিল। এদের কবল থেকে কেমন করে তাকে উদ্ধার করবে সেই চিন্তাই এখন তার কাছে বড় হয়ে উঠেছে। এমন সময় কে যেন ঘরে ঢুকল। অন্ধকারে তাকে চিনতে পারল না, কিন্তু কথা শুনেই বুঝতে পারল যে, লোকটি তার পূর্ব-পরিচিত সর্দার বোবোলো।

বোবোলো বলল, আমি হয়তো তোমাকে সাহায্য করতে পারি। এখান থেকে বাইরে যেতে চাও তো?

 নিশ্চয় চাই।

আমি তোমাকে সাহায্য করব। কিন্তু তার জন্য দাম চাই।

 কত?

 দশটা হাতির দাঁত।

বুড়ো টাইমার শিস দিয়ে উঠল। বলল, সেই সঙ্গে একটা স্টিম-ইয়াট আর একটা রোলস রয়েসও চাই তো?

কিছু না বুঝেই বোবোলা ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ।

অনেক কথা-কাটাকাটির পর স্থির হল, বুড়ো টাইমার তার আংটিটা দেবে। সেই আংটি নিয়ে বোবোলো যাবে তার সঙ্গী কিডের কাছে। সেটা দেখেই কিভ চিনতে পারবে এবং বোবোলোর দাবীমত তাকে দশটা দাঁত দিয়ে দেবে। আর বুড়ো টাইমারও ছাড়া পাবে।

বুড়ো টাইমারের পিছনে গিয়ে বোবোলো তার আঙ্গুল থেকে আংটিটা খুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মনে মনে বলল, আংটি আর হাতির দাঁত দুইই হাতিয়ে নেব। বুড়ো টাইমার এবার গভীর গাড়ায়।

ওদিকে গাটো মুঙ্গু অন্য সর্দারদের নিয়ে আলোচনায় বসেছে, নতুন বন্দীকে নিয়ে কি করা যায়। বোবোলো এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিল। নানা জনের নানা মত। সকলেরই গলা সপ্তমে চড়া।

হঠাৎ তাদের আলোচনায় বাধা পড়ল। যে গাছের নিচে বসে আলোচনা চলছিল তার ডালে একটা সরু সরু শব্দ উঠল, আর পরক্ষণেই একটা ভারী জিনিস কে যেন ছুঁড়ে দিল তাদের ঠিক মাঝখানে। সভয়ে তারা উপরে তাকাল; অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেল না। নিচে তাকিয়ে দেখল, তাদের পায়ের কাছে পড়ে আছে একটা মানুষের মৃতদেহ। তার হাত-পা বাঁধা, আর গলাটা এ-কান থেকে ও-কান পর্যন্ত কাটা।

গাটো মুঙ্গু ফিসফিস্ করে বলল, এ তো সেই উটোঙ্গা লুপিঙ্গু। এই তো আমাদের গোপনে খবর এনে দিয়েছিল।

একজন বলল, তারা বিশ্বাসঘাতককে শাস্তি দিয়েছে।

বোবোলো বলল, কিন্তু তাকে গাছের উপর তুলে আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিল কে?

সকলেই একে-অন্যের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। বোবোলোই আবার মুখ খুলল, ওরান্ডোর এক মুজিমোর কথা আমরা শুনেছি। সেই সাদা মানুষ নাকি টুম্বাইয়ের ওঝা সোবিটোর চাইতেও বেশি শক্তিশালী। হয় তো সেই লুপিঙ্গুকে এখানে ফেলে দিয়েছে। আমাদের সতর্ক করে দিয়েছে। কাজেই বন্দীকে অবিলম্বে প্রধান পুরোহিতের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। সে যা ভাল বোঝে তাই করবে। বন্দীকে যদি মেরেও ফেলে তো সে দোষ আমাদের উপর বর্তাবে।

একজন বলল, খুব বুদ্ধিমানের মত কথা বলেছ।

পাতার ফাঁক দিয়ে মুজিমো সবই দেখতে পাচ্ছিল। নিয়ামওয়েগির আত্মা ঘুমিয়ে পড়েছে তার কাঁধের উপরে। সে দেখল, সাদা বন্দীটিকে সকলে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে। তার পায়ের বাঁধন খুলে দেয়া হয়েছে। নদীর তীরে পৌঁছে ছোট ছোট ডোঙ্গার একটা বহর (প্রায় ত্রিশটা ডোঙ্গা) তারা জলে ভাসিয়ে দিল। প্রায় তিনশ’ সৈনিক তাতে চড়ে বসল। গায়ে-মুখে রং-করা অসভ্য লোকগুলোকে নিয়ে সবগুলো ডোঙ্গা ভাটির স্রোতে তরতর করে চলতে লাগল।

নিয়ামওয়েগির আত্মাকে কাঁধে নিয়ে মুজিমোও গাছ থেকে নেমে নদীর সমান্তরাল পথটা ধরে এগোতে লাগল।

ঘটনাক্রমে বুড়ো টাইমার ও বোবোলো এক ডোঙ্গাতেই উঠেছে।

মন্দিরের কাছে পৌঁছে সকলে ডোঙ্গা থেকে নামল। সকলে মিলে মিছিল করে ঢুকল মন্দিরের সেই বড় ঘরটায়। ঘরটা লোকজনে ভর্তি। সকলে যার যার নির্দিষ্ট আসনে বসল। বুড়ো টাইমারের সাগ্রহ চোখ দুটি বৃথাই সাদা মেয়েটির সন্ধানে চারদিকে ঘুরতে লাগল। সেখানে সে নেই।

ছোট বেদীটার উপর দাঁড়িয়ে আছে প্রধান পুরোহিত। তার নিচে ও চারদিকে অনেক ছোট পুরোহিতের ভিড়। পাশেই ভারী দণ্ডের সঙ্গে শিকল দিয়ে বাঁধা রয়েছে। একটা প্রকাণ্ড চিতাবাঘ; নিচের জনতার দিকে তাকিয়ে গরু-গ করছে। বুড়ো টাইমারের মনে হল, সেটা যেন এই সব কালো মানুষদের পাশবিক ধর্মের এক মূর্ত প্রতীক।

প্রধান পুরোহিত তাদের উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল, হে চিতা-দেবতা, তোমার সন্তানরা তাদের এক শত্রুকে বন্দী করেছে। তোমার মহামন্দিরে তাকে নিয়ে এসেছে। এখন তোমার কি ইচ্ছা?

মহূর্তের জন্য সব নিশ্চুপ। সকলেরই চোখে প্রধান পুরোহিত ও চিতাবাঘের উপর নিবদ্ধ। তারপরই ঘটল এক অলৌকিক ঘটনা। সাদা মানুষটির শরীর ঠাণ্ডা হয়ে এল; চুল উঠল খাড়া হয়ে। চিতাবাঘের মুখ থেকে বের হল মানুষের ভাষা। এ যে অবিশ্বাস্য; অথচ সে তো নিজের কানেই শুনল : চিতা-দেবতার সন্তানরা যাতে খেতে পারে তার জন্য তাকে মেরে ফেলা হোক। কিন্তু তার আগে মন্দিরের নতুন প্রধান সন্ন্যাসীকে এখানে আনা হোক; আমার ভাইয়ের নির্দেশে লুলিমি তাকে এনেছে বহু দূর দেশ থেকে; আমার সন্তানরা তাকে একবার দেখুক।

অন্য তিনশ’ জনের সঙ্গে বুড়ো টাইমারের দৃষ্টি পড়ল বেদীর পিছনকার খোলা দরজার উপরে। অস্পষ্ট একটি মূর্তি অন্ধকারের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে দ্বারপথে দাঁড়াল; মশালের আলো পড়ল তার উপর।

বিস্ময় ও আতংকের একটা চীৎকার স্তব্ধ হয়ে গেল সাদা মানুষটির কণ্ঠতালুতে। এ মূর্তি যে সেই মেয়ের যাকে সে খুঁজছে।

অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। বেদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ইমিগেগ অনবরত বিড় বিড় করে কি যেন বলতে লাগল; কখনও কোন ছোট সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসিনীকে উদ্দেশ্য করে, কখনও বা চিতা-দেবতার উদ্দেশ্যে। আর যখনই চিতা-দেবতা জবাব দেয় তখনই সমবেত সৈনিকরা ভয়ে আঁতকে ওঠে।

চিতার মুখে কথা শুনে আরও একজন বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছে। ঘরটার ছাদের একটা বরগা সামনের দেয়াল ভেদ করে বাইরে খানিকটা বেরিয়ে আছে। তার উপরে বসে একটা ফোকড়ের ভিতর দিয়ে সব কিছুই সে দেখতে পাচ্ছে।

সে লোকটি মুজিমো। তার পাশে নিয়ামওয়েগির আত্মা। এত চিতাবাঘ দেখে সে বেচারি ভয়ে কাঁপছে।

মুজিমো আবার নিচে তাকাল। ঐ সাদা পুরুষ ও সাদা মেয়েটির কি হবে তা সে অনুমান করতে পারছে। কিন্তু তা নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু হঠাৎ একটা কিছু দেখে তার আগ্রহ বেড়ে গেল। বীভৎস মুখোশগুলোর আড়ালে একটা পরিচিত মুখ যেন তার চোখে পড়ল। অনেকক্ষণ ধরেই তার উপর সে নজর রেখেছিল। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। মুজিমোর ঠোঁটে ঈষৎ হাসি দেখা দিল। চলে এস। বলে সঙ্গীকে ডেকে সে কোন রকমে ছাদে উঠে গেল। বিড়ালের মত পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী একটা গাছের ডালে লাফিয়ে পড়ল। বনের অন্ধকার দু’জনকেই ঢেকে দিল।

নিচের বড় ঘরে সন্ন্যাসিনীরা তখন বেদীর উপর অনেক উনুন জ্বেলে দিয়েছে, তার উপর মাটির পাত্রে নরমাংস রান্না হচ্ছে। ওদিকে সন্ন্যাসীরা ভাড়ে ভর্তি করে নিয়ে এসেছে ঘোল আর চোলাই। সেগুলো খেয়ে সকলেই নাচতে শুরু করেছে। চোলাই পেটে পড়ায় প্রধান সন্ন্যাসীও পাগলের মত নাচতে শুরু করে দিল।

বুড়ো টাইমারের দিকে এগিয়ে গিয়ে বোবোলো বলল, আমার সঙ্গে চলে এসো।

কোথায়?

 তোমাকে পালাতে সাহায্য করব।

 মেয়েটিকে সঙ্গে না নিয়ে আমি যাব না।

বেশ তো, সে ব্যবস্থাও করা হবে। কিন্তু তোতামাদের দুজনকে তো এক সঙ্গে নিয়ে যেতে পারব না। বুঝতে পারলেই ইমিগেগ আমাকে মেরে ফেলবে। আগে তুমি এস। মন্দিরের পিছনে একটা ঘরে তোমাকে লুকিয়ে রেখে আসি। তারপর মেয়েটিকে নিয়ে যাব।

বুড়ো টাইমারকে মন্দিরের পিছনের একটা ঘরে নিয়ে গেলে সে বলল, ফিরে যাবার আগে আমার হাতের বাঁধর কেটে দাও।

মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করে বোবোলো বলল বেশ তো তাই দিচ্ছি। এখান থেকে তুমি একা তো পালাতে পারবে না। মন্দির একটা দ্বীপের মাঝখানে অবস্থিত। চারদিকের নদী কুমীরে ভর্তি; নদীপথে ছাড়া এখান থেকে বের হবার আর কোন পথ নেই।

বুড়ো টাইমার অধৈর্য গলায় বলল, বুঝেছি। এখন যাও; শিগ্‌গির মেয়েটিকে নিয়ে এস।

বোবোলো চলে গেল।

মন্দিরে তখন হুলুস্থুল কাণ্ড চলেছে। হাড়ির মাংস বিলি করা হচ্ছে; পাত্রের পর পাত্র চোলাই উজাড় হয়ে যাচ্ছে; উপরের বেদীতে প্রধান সন্ন্যাসী আচ্ছন্নের মত পড়ে আছে। চিতা-দেবতা উপুর হয়ে একটা মানুষের হাড় চিবুচ্ছে। প্রধান সন্ন্যাসিনী দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালে হেলান দিয়ে।

বোবোলো তার কাঁধে হাত রাখল। মেয়েটি চমকে চোখ ফেরাল।

বোবোলো ইসারা করে চুপি চুপি বলল, চলে এস।

মেয়েটি একটু আগেই দেখেছে, এই মেয়েটি বুড়ো টাইমারকে এখান থেকে নিয়ে গেছে। সে বোবোলোকে অনুসরণ করল।

মেয়েটিকে বুড়ো টাইমারের ঘরে পৌঁছে দিয়ে বোবোলো বলল, তোমরা এখানে অপেক্ষা কর।

মন্দিরে ফিরে গিয়ে বোবোলো দেখল সেখানকার হৈ-হল্লা অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ কৃতকর্মের জন্য তার কেমন ভয় করতে লাগল। মনে জোর আনবার জন্য তার চোলাইয়ের একটা বড় পাত্র তুলে মুখে ঢেলে দিল। ফল ফলতে দেরী হল না। এক ঘণ্টা পরে দেখা গেল বোবোলো মেঝেতে পড়ে অকাতরে ঘুমুচ্ছে।

 গাটো মুঙ্গুরও একই অবস্থা। অগত্যা সে হুকুম জারি করল, খাদ্য-পানীয় যখন নেই, তখন ফিরে চল বাড়ি। সকলেই সম্মত হল। এমন কি বোবোলো পর্যন্ত। তারও মাথার মধ্যে সব কিছু গুলিয়ে গেছে। কি যেন তার করার ছিল, কিন্তু কিছু মনে করতে পারছে না। অগত্যা অন্য সর্দারদের সঙ্গে সেও তার দলবল নিয়ে ডোঙায় উঠে পড়ল।

কিছু সৈনিকের নেশা তখনো ভাঙে নি। মন্দিরের চত্বরে সকলেই ছড়িয়ে পড়ে আছে। কিছু ছোট সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীও আছে তাদের মধ্যে। তাদের জন্য একটা ডোঙ্গা সর্দাররা রেখে গেছে। বেদীর এক কোণে ইমিগেগ গভীর ঘুমে কুঁকড়ে পড়ে আছে। পেট ভরা থাকায় চিতা-দেবতাও ঘুমিয়ে পড়েছে।

কালি বাওয়ানা ও বুড়ো টাইমার বোবোলোর অপেক্ষায় বসে আছে মন্দিরের পিছনের অন্ধকার ঘরে। বাড়িটা ক্রমেই চুপচাপ হয়ে আসছে; সকলের ফিরে যাবার আয়োজনও কানে আসছে। নদী তীরের হৈ হল্লা শুনেও তারা বুঝতে পেরেছে যে আদিবাসীরা নদীতে ডোঙ্গা ভাসিয়েছে।

বুড়ো টাইমার বলল, বোবোলোর তো এতক্ষণে আসা উচিত।

 কালি বাওয়ানা বলল, সে হয় তো আমাদের ফেলেই চলে গেছে।

টাইমার বলল, তাহলে তুমিও চলে এস। সময় নষ্ট করো না। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে আবার বলল, হাতে হাত দাও। আমরা যেন কখনও বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ি।

অনেক কষ্টে মন্দির থেকে বেরিয়ে ছুটতে ছুটতে তারা নদীর তীরে পৌঁছে গেল। মনে ভয় ছিল, নদীতে ডোঙ্গা না পেলে সব পরিশ্রমই বৃথা হয়ে যাবে। কিন্তু না, উল্লাসে তাদের মন নেচে উঠল। তীরে কাদার মধ্যে একটা ডোঙ্গা দাঁড়িয়ে আছে।

বুড়ো টাইমার হাত ধরে কালি বাওয়ানাকে ডোঙ্গায় তুলে দিল; তারপর নিজেও উঠে বসল। নীরবে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে তারা বড় নদীর দিকে ভেসে চলল।

মধ্যরাতের ঘণ্টাখানে পরে মুজিমো ও নিয়ামওয়েগি আত্মর ঘুমন্ত উটেঙ্গাদের মাঝখানে এসে নামল। শাস্ত্রীদের ঘাঁটিগুলো পরিদর্শন করে ওরান্ডো সবেমাত্র ফিরছে। সে জেগেই ছিল। বলল, কি সংবাদ নিয়ে এলে মুজিমো? শত্রু পক্ষের খবর কি?

প্রধান সন্ন্যাসী ও চিতা-দেবতার সঙ্গে পরামর্শ করতে তারা অনেকেই মন্দিরে চলে গেছে। আমরাও সেখানে গেলাম। কিন্তু এত বেশি পরিমাণ দেশী চোলাই তারা গিলল যে কিছু জানতেই পারল না। তাই তো তোমাকে বলতে এলাম, তাদের গ্রাম এখন প্রায় ফাঁকা; নারী, শিশু ও সামান্য কিছু সৈনিকমাত্র আছে। সে গ্রাম আক্রমণ করার এই উপযুক্ত সময়।

ঠিক বলেছ। ঘুমন্ত সৈনিকদের জাগিয়ে তুলতে ওরান্ডো হাততালি দিল।

বনের আঁকাবাঁকা পথ ধরে ওরান্ডোর সৈন্যদলকে সে নিয়ে চলল গাটো মুঙ্গুর গ্রামের দিকে। কনের শেষে ফসলের মাঠে পৌঁছে তারা একটু থামল, তারপর নিঃশব্দে হামাগুড়ি দিয়ে নদীর দিকে গেল। এতক্ষণে মুজিমো বুঝতে পারল যে চিতা-মানুষেরা মন্দির থেকে ফেরে নি। মুজিমোর কথামত সৈন্যদের নদীর ধারে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রেখে ওরান্ডো প্রতিটি সৈনিককে নির্দেশ দিল, সংকেত পেলেই যেন তারা সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে। ডোঙ্গার শব্দ কানে আসছে–ছলাৎ ছলাৎ, ছলাৎ। উটেঙ্গারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান। একে একে বিশটা ডোঙ্গা এসে ভিড়ল সৈনিক ডোঙ্গা থেকে নেমে সারিবদ্ধভাবে গ্রামের দিকে এগিয়ে চলল। আর দেরী নয়। ওরান্ডো সংকেত করল। সঙ্গে সঙ্গে নববইটি উটেঙ্গা সৈনিকের কণ্ঠে ধ্বনিত হল রণহুংকার; তাদের বর্শা ও তীর বৃষ্টিধারার মত ঝরে পড়তে লাগল চিতা মানুষদের উপর।

চিতা-মানুষদের লম্বা সারি তচনচু হয়ে গেল। অতর্কিত আক্রমণের ফলে পলায়ন ছাড়া অন্য কোন চিন্তাই তাদের মাথায় এল না। নদীর তীরে যারা পড়েছিল তারা আবার ডোঙ্গা ভাসাবার চেষ্টা করল; যারা তখনও তীরে নামে নি তারা ডোঙ্গার মুখ ঘুরিয়ে দিল মন্দিরের দিকে। বাকিরা পালাতে লাগল গ্রামের দিকে। তাদের পিছু ধাওয়া করল উটেঙ্গা সৈনিকরা। গ্রামের ফটক বন্ধ; ভিতরের রক্ষীরা ফটক খুলতে সাহস করল না। তুমুল যুদ্ধ হল সেখানেই। নদীর তীরে যারা পড়েছিল উটেঙ্গা সৈনিকদের হাতে তারা একেবারে কচুকাটা হয়ে গেল। আর অনেকক্ষণ যুদ্ধের পরে ভিতরের রক্ষীরা যখন ফটক খুলে দিল বাইরে তখন তাদের দলের আর কেউ অবশিষ্ট নেই, হয় মরেছে, না হয় তো পালিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে উটেঙ্গা সৈন্যরা হৈ-হৈ করতে করতে ভিতরে ঢুকে গেল। তাদের হাতের জ্বলন্ত মশালের আগুনে গাটো মুঙ্গুর গ্রামের খড়ের ঘরগুলো দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল। জয় সম্পূর্ণ হল।

ওরান্ডো তখন সেই ঘর-পোড়া আলোয় খুঁজে খুঁজে নিজের ক্ষয়-ক্ষতির হিসেবে করতে লাগল। ওরান্ডো দেখল, হতাহত সৈনিকদের পাশে একদলা কাদার মত চিৎ হয়ে পড়ে আছে মুজিমো।

সে দৃশ্য দেখে সর্দারের ছেলে বিস্মিত হল, শোকাহত হল; তার অনুচররাও মর্মাহত। তাদের ধারণা ছিল, মুজিমো প্রেতলোকের জীব, কাজেই তার মৃত্যু নেই। কিন্তু সেও তো মানুষের মতই মরণশীল। এতদিন লোকটা তাদের ধোকা দিয়েছে।

ওরান্ডো বলল, মানুষই তোক আর প্রেতই হোক, আমার প্রতি সে বিশ্বস্ত ছিল; তোমরাই তো চোখে দেখলে, সে যুদ্ধ করেছে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে।

সকলেই সে কথা মেনে নিল।

ওদিকে শেষ ডোঙ্গাটাতে চেপে বুড়ো টাইমার প্রাণপণে বৈঠা চালিয়ে যাচ্ছে ছোট খালের জলে। কালি বাওয়ানা বসে আছে ডোঙ্গার মধ্যে। অসভ্য লোকদের পরানো মাথার ঢাকনা খুলে ফেলেছে; ছিঁড়ে ফেলেছে গলার দাঁতের হার।

মনের সুখে ডোঙ্গা বাইছে বুড়ো টাইমার। হঠাৎ বৈঠার ছপছপাৎ শব্দ তার কানে এল। টাইমারের বুকের ভিতরটা ধড়াস করে উঠল। তাড়াতাড়ি ডোঙ্গার মুখ দক্ষিণ তীরের দিকে ঘুরিয়ে দিল। সেখানে গাছপালার ছায়ার মধ্যে লুকিয়ে পড়ল।

ঠিক তখনই আর একটা ডোঙ্গা পিছনে এসে হাজির হল। বোবোলোর গলা চিনতে বুড়ো টাইমারে ভুল হবার কথা নয়। কয়েকজন সৈনিক লাফিয়ে তাদের ডোঙ্গায় চড়ে তার মাথায় আঘাত করল, টেনে হিঁচড়ে তাকে ফেলে দিল। আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল।

আবার বোবোলোর গলা। জলদি কর। ওরা আমাদের পিছু নিয়েছে। উটেঙ্গারা আসছে।

অনেকগুলো শক্ত হাত ডোঙ্গার বৈঠা চেপে ধরল। বিদ্যুৎ কেগে ডোঙ্গাটা ছুটে চলল মন্দিরের দিকে। সাদা মানুষটির মুখ শুকিয়ে গেল। মেয়েটাকে প্রায় উদ্ধার করে এনেছিল। এমন সুযোগ আর আসবে না।

মেয়েটিকে ডাকল। কোন সাড়া এল না।

বোবোলোর ডোঙ্গা যখন বুড়ো টাইমার ও মেয়েটির ডোঙ্গার কাছাকাছি চলছিল তখন সাদা চামড়া ও নীল চুল দেখে বোবোলো মেয়েটিকে চিনতে পেরে অন্ধকারেই সবল হাত বাড়িয়ে তাকে নিয়ে এসেছিল তার নিজের ডোঙ্গায়। বোবোলোর হুকুমেই ডোঙ্গাটা বিদ্যুৎগতিতে গ্রামের দিকে ছুটে গিয়েছিল।

ঘটনার আকস্মিকতায় মেয়েটি তখন একেবাইে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। একমাত্র যে মানুষটির উপর এতক্ষণ পর্যন্ত সে ভরসা করে ছিল এবার সেও হারিয়ে গেল।

হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বুড়ো টাইমার ফিরে চলল মন্দিরের দিকে। সকলে তাকে টানতে টানতে মন্দিরে নিয়ে গের। মাতাল সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীরা ইতস্তত পড়ে আছে মন্দিরের মেঝেতে। গণ্ডগোল কানে যেতে প্রধান সন্ন্যাসী ইমিগেগ ঘুম থেকে জেগে উঠল। দুই হাতে চোখ মুছতে মুছতে বলল, কি হয়েছে?

ততক্ষণে গাটো মুঙ্গু ঢুকেছে মন্দিরে। সেই জবাব দিল, অনেক কিছু ঘটেছে। তোমরা সকলে যখন মাতাল হয়ে পড়েছিল, এই সাদা মানুষটা তখন পালিয়েছিল। উটেঙ্গারা আমার সৈনিকদের হত্যা করেছে, আমার গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে।

প্রধান সন্ন্যাসী আবছা চোখে চারদিকে তাকাল।

গাটো মুঙ্গু বিনীত গলায় বলল, বন্দীকে তাহলে ভাল করে বেঁধে মন্দিরের পিছনেই রেখে আসি?

 ইমিগেগ বলল, তাই যাও। এমন করে বেঁধে যেন পালাতে না পারে।

মাটিতে শুয়েই শ্বেতকায় দানব চোখ মেলে তাকাল। দেখল, ওরান্ডো ও তার সৈনিকরা দাঁড়িয়ে আছে। কি যেন মনে পড়ায় হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

বানরদের ভাষায় বলল, নকিমা! নকিমা! কোথায় তুমি নকিমা? টারজান এখানে।

ছোট বানরটি এক লাফে গাছ থেকে নেমে ছুটে এসে সাদা মানুষটির কাঁধে চড়ে বসল; তার গলা জড়িয়ে ধরে মনিবের গালে গাল রেখে আনন্দে কিচির-মিচির করতে লাগল।

ওরান্ডো সঙ্গীদের বলল, দেখছ তো মুজিমো মরে নি।

সাদা মানুষটি ওরান্ডের দিকে ফিরে বলল, আমি মুজিমো নই; আমি অরণ্যরাজ টারজান। বানরটিকে ছুঁয়ে বলল, এও নিয়ামওয়েগির আত্মা নয়; এ হল নকিমা। এখন আমার সব কথা মনে পড়ছে। অনেকদিন থেকে মনে করার চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারি নি-যেমনি একটা গাছের নিচে চাপা পড়েছিলাম সেদিন থেকেই সব কিছু ভুলে ছিলাম।

সারাদিন বসে বসে অনেক কথাই টারজনের মনে পড়তে লাগলঃ কেন সে এ দেশে এসেছিল, কেমন করে একটা দুর্ঘটনার ফলে বাঞ্ছিত পথ ধরে সেই দেশেই সে এসে পড়েছে, আর যে দেশের মন্দিরের সন্ধানে সে একদা পথে নেমেছিল তার সন্ধানও সে পেয়ে গেছে। এ জন্যই সেই দুর্ঘটনার কাছে সে চিরকৃতজ্ঞ।

সন্ধ্যার পরে রাতের খাবার খেতে বসে হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল চিতা-দেবতার মন্দিরে দেখা সাদা মানুষ ও সাদা মেয়েটির কথা। ওরান্ডোকে তাদের কথা জিজ্ঞাসা করলে সেও কিছুই বলতে পারল না।

টারজান অনেকক্ষণ ধরে কি যেন ভাবল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে নকিমাকে ডাকল।

কোথায় চললে? ওরান্ডো শুধাল।

চিতা-দেবতার মন্দিরে, টারজান জবাব দিল।

হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বুড়ো টাইমার সারাদিন সেখানে পড়ে রইল। না খাবার, না পানীয়। মাঝে মাঝে মন্দির-কক্ষ থেকে ভেসে আসছে মন্ত্রের শব্দ, প্রধান সন্ন্যাসীর কর্কশ কণ্ঠস্বর আর চিতাবাঘের গর্জন।

মশাল হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল এক সন্ন্যাসী। শয়তানের মত দেখতে এক বুড়ো; মুখে রং মাখানোর ফলে আরও বীভৎস দেখাচ্ছে। লোকটি টুম্বাই গ্রামের ওঝা সোবিটো। উপুর হয়ে সে বুড়ো টাইমারের পায়ের বাঁধন খুলতে লাগল।

আমাকে নিয়ে তোমরা কি করবে? বুড়ো টাইমার প্রশ্ন করল।

ঠোঁট চাটতে চাটতে সোবিটো বলল, প্রথমে তোমার হাত পা ভেঙ্গে দেয়া হবে; তারপর জলাভূমির উপর থেকে তোমাকে এমনভাবে হেঁট মুণ্ডে ঝুলিয়ে রাখা হবে যাতে তোমার নাক-মুখ জলের নিচে গিয়ে দমবন্ধ হয়ে তোমার মৃত্যু না ঘটে। এইভাবে তোমাকে তিন দিন রাখা হবে, আর তাতেই তোমার মাংস হবে নরম, সুস্বাদু।

বুড়ো টাইমার শিউরে উঠল। তিন তিন! হা ভগবান, এও কপালে ছিল!

বুড়ো টাইমারকে একটা লাথি মেরে বলল, আমার সঙ্গে এস।

অন্ধকার বারান্দা পার হয়ে তারা সেই বড় ঘরটায় হাজির হল। বন্দীকে দেখামাত্রই দেড়শ’ কণ্ঠ একযোগে চীৎকার করে উঠল, চিতাবাঘ গর্জে উঠল, প্রধান সন্ন্যাসী উপরের বেদীতে নাচতে লাগল, বীভৎস-দর্শন সন্ন্যাসিনীরা তার স্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে এমনভাবে লাফিয়ে এল বুঝি সাদা মানুষটাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।

সোবিটো এক ধাক্কায় বন্দীকে নিচু বেদীর উপর ফেলে দিয়ে টানতে টানতে প্রধান সন্ন্যাসীর সামনে নিয়ে এসে বলল, বলি এনেছি!

চিতা-দেবতাকে উদ্দেশ্য করে ইমিগেগ বলল, বলি এসে গেছে! চিতা-সন্তানদের হে পরম পিতা, এবার বল তোমার কি আদেশ?

ইমিগেগের হাতের ধারালো লাঠির খোঁচা খেয়ে পশুটার দাঁত বের করা মুখ থেকেই বেরিয়ে এল আদেশ। ওর হাত-পা ভেঙে দেয়া হোক, আর তৃতীয় রাতে একটা ভোজের আয়োজন করা হোক!

আর বোবোলো ও সাদা সন্ন্যাসিনীর কি হবে? ইমিগেগ প্রশ্ন করল।

তাদের মন্দিরে নিয়ে আসতে সৈনিক পাঠাও। আরেকটা ভোজের জন্য তার হাত-পা ভেঙ্গে দাও। আর সাদা মেয়েটিকে পাবে প্রধান সন্ন্যাসী ইমিগেগ। তারপর সেও ভোজে লাগবে।

ইমিগেগ চেঁচিয়ে বলল, চিতা-দেবতার বাণী শোনা হল। তার হুকুম মতই কাজ হবে।

সঙ্গে সঙ্গে আটজন সন্ন্যাসী লাফিয়ে পড়ে বন্দীকে চেপে ধরল, তাকে বেদীর উপর ছুঁড়ে ফেলল, হাত-পা ছড়িয়ে তাকে চিৎ করে ধরে রাখল, আর চারজন সন্ন্যাসিনী ছুটে এল ভারী মুগুর হাতে নিয়ে।

মেঝেতে চিৎ করে ধরে রাখা বুড়ো টাইমারকে লক্ষ্য করে সন্ন্যাসিনীদের হাতের মুগুরগুলো একসঙ্গে উদ্যত হওয়া মাত্রই একটি ক্রদ্ধ কণ্ঠস্বর ঘরের মৃত্যুস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে খান খান করে দিল।

সঙ্গে সঙ্গে প্রায়-নগ্নদেহ সেই দৈত্যাকার সাদা মানুষটি বানরের মত স্বচ্ছন্দ গতিতে মন্দিরের একটা। থাম বেয়ে নিচে নেমে এল। এক লাফে নিচু বেদীটার উপর গিয়ে দাঁড়াল। ভয়ে ও বিস্ময়ে লোকগুলো যেন হতভম্ব হয়ে পড়ল। সোবিটোর মুখেও কথা নেই। পা কাঁপছে। সে ঘোর কাটিয়ে আর্তনাদ করতে করতে বেদীর উপর থেকে সে ছুটে নিচে গেল সৈনিকদের পাশে।

বুড়ো টাইমারও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বিচিত্র মানুষটি সোবিটোকে ধরবার চেষ্টা না করে তার কাছেই এগিয়ে এল। বলল, আমাকে অনুসরণ কর। মন্দিরের পিছন দিক দিয়ে আমি বেরিয়া যাব। পিছনের দরজা দিয়ে দু’জনই অদৃশ্য হয়ে গেল।

মুহূর্তের জন্য থেমে বলল, সাদা মেয়েটি কোথায়? তাকেও সঙ্গে নিতে হবে।

বুড়ো টাইমার জবাব দিল, সে এখানে নেই; একজন সর্দার তাকে চুরি করেছে; মনে হয়, ভাটির দিকে তাকে গ্রামে নিয়ে গেছে।

তাহলে এই দিকে এস। টারজান তীরের মত বাঁ দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

দু’জন ছুটে চলল নদীর দিকে। সেখানে পৌঁছে ডোঙ্গাটা দেখিয়ে বলল, চড়ে বস। এখানে একটা ডোঙ্গাই আছে। কেউ তোমার পিছু নিতে পারবে না।

তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে না?

না। ডোঙ্গাটাকে ঠেলে দিয়ে প্রশ্ন করল, যে সর্দার মেয়েটিকে চুরি করেছে তার নাম জান?

তার নাম বোবোলো। ডোঙ্গা জলে ভাসিয়ে বুড়ো টাইমার আরও বলল, তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে পারলাম না; ইংরেজি ভাষায় সে রকম কোন শব্দ নেই।

নীরব মূর্তিটি কোন কথা বলল না। স্রোতের টানে ডোঙ্গা ভেসে চলল। বুড়ো টাইমার বৈঠা তুলে নিল হাতে। সাধ্যমত গতি বাড়াতে হবে।

ওরান্ডোর সৈনিকরা তাঁবুতে বসে আগুন পোয়াচ্ছে। তাদের পেট ভরা, তাই তারা খুশি। কাল দেশে ফিরে যাবে। সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে বিজয়ীর সম্বর্ধনা।

এমন সময় একটি দৈত্যাকার মূর্তি যেন বাতাস থেকে নেম এল তাদের সামনে। সকলেই তাকে চিনল। অরণ্যরাজ টারজান। কাঁধে হাত-পা বাঁধা একটা লোক।

কয়েকজন বলে উঠল, অরণ্যরাজ টারজান!

কেউ বলল, মুজিমো!

ওরান্ডো বলল, কাকে নিয়ে এসেছ?

লোকটাকে মাটিতে ফেলে টারজান বলল, তোমাদের ওঝাকে ফিরিয়ে এনেছি। ফিরিয়ে এনেছি সোবিটোকেসে যে চিতা-দেবতার একজন সন্ন্যাসী।

মিথ্যা কথা! সোবিটো আর্তনাদ করে উঠল।

টারজান বলল, চিতা-মানুষদের মন্দিরে আমি ওকে পেয়েছি। ভাবলাম, তোমরা হয়তো তোমাদের ওঝাকে ফিরে পেতেই চাও যাতে খুব কড়া ওষুধ বানিয়ে চিতা-মানুষদের হাত থেকে সে তোমাদের রক্ষা করতে পারে।

একজন সৈনিক গর্জে উঠল, ওকে খুন কর!

সোবিটোকে খুন কর! খুন কর! চার-কুড়ি কণ্ঠ একসঙ্গে গর্জে উঠল।

টারজান বলল, তোমাদের যা ইচ্ছা হয় তাই কর। সে তো আমার ওঝা নয়। আমার অন্য কাজ আছে। আমি চলি। যদি আর দেখা না পাও তবু টারজানকে মনে রেখো; তার জন্যই সাদা মানুষদের প্রতি সদয় ব্যবহার করো, কারণ টারজান তোমাদের বন্ধু, আর তোমরা তার বন্ধু।

যেমন নিঃশব্দে সে এসেছিল তেমনি নিঃশব্দেই অদৃশ্য হয়ে গেল। তার সঙ্গে নকিমাও চলে গেল-চলে গেল নিয়ামওয়েগির আত্মা।

রাতের অন্ধকারে পথ চলতে চলতে এক সময় বুড়ো টাইমার একটা বড় গাছে চড়ে বসল। সেখান থেকেই পাতার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল- গ্রামের মাঝখানে অনেকগুলো লোক গোল হয়ে নাচছে। তারই একটু ফাঁক দিয়ে চোখ ফেলতেই যে দৃশ্য তার চোখে পড়ল তাতে ভয়ে তার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

হাত-পা বাঁধা একটি মেয়ে মাটিতে পড়ে আছে, আর একটি কুৎসিত মেয়েমানুষ ওয়ালালা তার উপর ঝুঁকে হাতের বড় ছুরিটা ঘোরাচ্ছে। বুড়ো টাইমারের আতংকিত দৃষ্টির সামনে মুহূর্তের মধ্যে অভিনীত হল একটা বীভৎস নির্বাক দৃশ্যঃ সেই কুৎসিত মেয়েমানুষটা সাদা মেয়েটির চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলল, আর তার হাতে উদ্যত ছুরিটা আগুনের আলোয় ঝলসে উঠল। একটি মাত্র ছুরি ছাড়া সম্পূর্ণ নিরস্ত্র হওয়া সত্ত্বেও বুড়ো টাইমার ছুটে গিয়ে আসন্ন নারী হত্যার সেই দৃশ্যের সামীল হয়ে পড়ল।

তার কণ্ঠে ধ্বনিত হল রণ-হুংকার; আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা তীর এসে বিঁধল ওয়ালালার বুকে। বুড়ো টাইমারের দৃষ্টি তখন হত্যাকারীর উপরেই নিবদ্ধ; তীরটা সে দেখতে পেল; কিন্তু সে তীর কে ছুঁড়েছে কোন বন্ধু না শত্রু, সেটা সেও যেমন বুঝতে পারল না তেমিন বামনরাও বুঝতে পারল না।

মুহূর্তের জন্য বামনরা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। বুড়ো টাইমার বুঝতে পারল যে তাদের এই নিষ্ক্রিয় অবস্থা বেশিক্ষণ থাকবে না। সঙ্গে সঙ্গে একটা চালাকি খেলে গেল তার মনে। ভোলা ফটকের দিকে মুখ ফিরিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল, গ্রাম ঘিরে ফেল! কাউকে পালাতে দিও না! তবে আমাকে না। মারলে কাউকে মেরো না! সে কথাগুলো বলল বোবোলোদের ভাষায়। কাজেই সকলেই তার কথা বুঝতে পারল। এবার তার দিকে ফিরে বলল, একপাশে সরে দাঁড়াও। সাদা মেয়েটিকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। কেউ তোমাদের কোন ক্ষতি করবে না।

কেউ কিছু বলার আগেই এক লাফে এগিয়ে গিয়ে সে মেয়েটিকে কোলে তুলে নিল। ততক্ষণে দলের সর্দারের আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেছে। তার সামনে মাত্র একটি লোক। গ্রামের বাইরে আরও লোক থাকতে পারে। কিন্তু তার সৈনিকরাও কি যুদ্ধ জানে না? লাফ দিয়ে সামনে এগিয়ে সে চীৎকার করে বলল, সাদা লোকটাকে মেরে ফেল!

আর একটা তীর এসে বিধল তার বুকে; সে মাটিতে পড়ে গেল। আর তিনটে তীর এসে পর পর তিনটে বামনকে খতম করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বাকি লোকগুলো সভয়ে চীৎকার করতে করতে নিজেদের ঘরে ঢুকে গেল।

মেয়েটিকে কাঁধে ফেলে বুড়ো টাইমার বিদ্যুঙ্গতিতে ফটক পার হয়ে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিসের যেন একটা মড় মড় শব্দ তার কানে এল, কিন্তু সেটা কিসের শব্দ তা বুঝতে পারল না, বুঝবার চেষ্টাও করল না।

বন্দিনী সাদা মেয়েটির খোঁজে বোবোলেদের গ্রামে পৌঁছে একটা দৃশ্য দেখে টারজান অবাক হয়ে গেল। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় একটি সাদা মেয়ে মাটিতে পড়ে আছে। আর তাকে ঘিরে রান্না-বান্না ও নাচ গানের মৌজ চলেছে।

এখন তার একমাত্র কাজ মেয়েটিকে উদ্ধার করা। মাটিতে নেমে বেড়া টপকে সে গ্রামের ভিতরে ঢুকল পিছন দিক দিয়ে; তারপর কাছেই একটা গাছে চড়ে লুকিয়ে সব দেখতে লাগল। আর ঠিক তখনই একটি কুৎসিত বুড়ি মেয়েটির চুলের মুঠি ধরে হাতের ছুরিটা তুলল তার গলায় বসিয়ে দিতে।

মুহূর্তমাত্র সময় নেই; টারজান সঙ্গে সঙ্গে ধনুকে তীর ছুঁড়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ফটকের দিকে দিয়ে হুংকার ছুটে এল একটি সাদা মানুষ। বুঝতে পারল, মেয়েটিকে উদ্ধার করতেই সে এসেছে। তারপরের ঘটনা তো সকলেরই জানা।

টারজান গাছ থেকে নামবার আগেই যে ডালে সে দাঁড়িয়ে ছিল সেটা সশব্দে ভেঙ্গে পড়ল। সেই সঙ্গে টারজানও মাটিতে ছিটকে পড়ল। তার জ্ঞান হারিয়ে গেল। আবার জ্ঞান ফিরে আসতে দেখল, তার শরীরের উপর চেপে বসে বামনরা তার হাত পাকে বেশ শক্ত করে বেঁধে ফেলেছে। টারজান একবার আড়মোড়া ভাঙতেই বামনরা চারদিকে ছিটকে পড়ে গেল, কিন্তু তার হাত-পায়ের বাঁধন ছিঁড়ল না। সে বুঝল, একদল নির্মম, নিষ্ঠুর মানুষের হাতে সে বন্দী হয়েছে।

আত্মরক্ষা ও ফটক রক্ষার যথেষ্ট আয়োজন করা সত্ত্বেও বামনরা ভীষণ ভয় পেয়েছে। তাদের সর্দার মরেছে; মুখের গ্রাস সাদা মেয়েটা উধাও হয়েছে; দৈত্যের মত একটা সাদা মানুষ আকাশ থেকে নেমে এসে তাদের হাতে বন্দী হয়েছে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এতগুলো ঘটনা ঘটে যাওয়ায় তারা বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়েছে।

এই সব ভাবতে ভাবতেই নিচের গ্রাম থেকে একটা অদ্ভুত হুংকার তাদের কানে এসে লাগল। ওটা কিসের শব্দ ভাল করে বুঝতে না পেরে আদিবাসীরাও ভয়ে আঁতকে উঠল। জঙ্গলের অন্ধকারে অনেক দূর থেকে ভেসে আসা এ ধরনের রহস্যময়, ভয় জাগানো ডাক তারা আগেও শুনেছে, কিন্তু আগে কখনও গ্রামের এত কাছ থেকে শোনে নি; এ যে প্রায় গ্রামের মধ্যে।

যে দুটি বামন বন্দী দৈত্যটির পাহারায় ছিল তারাই ছুটতে ছুটতে এসে জানাল, শব্দটা এসেছে তাদেরই ফাঁকা ঘরটার ভিতর থেকে। তাদের চোখ বিস্ফারিত, শ্বাসরুদ্ধ হবার উপক্রম। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, যাকে আমরা বন্দী করেছি সে মানুষ নয়, একটা দৈত্য। শোন নি তার হুংকার?

এদিকে বামনদের নতুন সর্দার নিয়ালওয়া দলবল নিয়ে টারজনের ঘরটাকে ঘিরে দাঁড়াল। সকলেরই হাতে বিষ মাখানো তীর ও বর্শা। নিয়ালওয়ার সংকেত পেলেই সেই সব ছোঁড়া হবে। টারজনের জীবন মুহূর্তকালের সুতোয় ঝুলছে। এমন সময় বেড়ার ওপাশ থেকে ভেসে এল অনেক ক্রুদ্ধ কণ্ঠের গর্জন। নিয়ালওয়ার মুখের হুকুম তার ঠোঁটে এসেই স্তব্ধ হয়ে গেল।

চীৎকার করে সে বলে উঠল, ও কি?

বেড়ার দিকে তাকিয়ে বামনরা সভয়ে দেখল, কালো কালো সব মূর্তি বেড়া ডিঙিয়ে ভিতরে ঢুকেছে। সকলেই এক সঙ্গে আর্তনাদ করে উঠল, দৈত্যরা আসছে।

আর একজন চেঁচিয়ে বলল, ওরা সব জঙ্গলের লোমশ মানুষের দল।

হাতের বর্শা ছুঁড়ে ফেলে বামনরা পালাতে লাগাল। একটা বাড়ির ছাদে উঠে নকিমা চেঁচাতে শুরু করে দিল, এই পথে জু-টো! গোমাঙ্গানির বাসায় এখানেই আছে অরণ্যরাজ টারজান।

একটা প্রকাণ্ড থঙ্খলে মূর্তি সেই বাড়িটার দিকে দুলে দুলে এগোতে লাগল। যেমন চওড়া তার কাঁধ, তেমিন লম্বা তার হাত। তার পিছু নিল আধ ডজন মস্ত বড় বড় গোরিলা।

টারজান ডাক দিয়ে বলল, এখানে! টারজান এখানে আছে জু-টো।

বড় গোরিলাটা নিচু হয়ে দরজা দিয়ে ভিতরে তাকাল। তার ভিতর দিয়ে তার প্রকাণ্ড শরীরটা ঢুকল না। দুই হাত দিয়ে দরজার চৌকাঠ ধরে গোটা বাড়িটাকেই মাটি থেকে তুলে নিজের পিঠের উপরে আছড়ে ভেঙে ফেলল।

টারজান হুকুম করল, আমাকে জঙ্গলে নিয়ে চল।

জু-টো তাকে কোলে করে বেড়ার কাছে নিয়ে গেল। রাগে গর গর করতে করতে অন্য গোরিলারাও তাকে অনুসরণ করল। মানুষের গন্ধ তাদের ভাল লাগছে না। তারা যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেল। মুহূর্তকাল পরেই তারা জঙ্গলের ঘন অন্ধকারে মিশে গেল।

বুড়ো টাইমার ও মেয়েটি নিঃশব্দে অনেকটা পথ হাঁটল। কারও মুখে কথা নেই। থমথমে ভাব। কালি বাওয়ানা হাঁটছে একটু পিছনে থেকে। বারবার সে লোকটিকে দেখছে। কি যেন গভীর চিন্তায় সে মগ্ন।

একটা খোলা জায়গায় পৌঁছে বুড়ো টাইমার থামল। পাশেই নদী। নদীর তীরে একটা বড় গাছ। বলল, এখানেই আমরা বিশ্রাম নেব।

মেয়েটি কিছুই বলল না।

গাছের ডালপালা ও পাতা দিয়ে একটা আস্তানা বানাতে শুরু করে দিল বুড়ো টাইমার। তা দেখে কালি বাওয়ানাও সে কাজে হাত লাগাল। কাজ হয়ে গেলে দুজনে মিলে শুকনো ডালপালা কুড়িয়ে এনে আগুন জ্বালাল কারও মুখে কথা নেই।

এক সময় জঙ্গলের দিকে চোখ পড়তেই মেয়েটি চীৎকার করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

 হা ঈশ্বর! দেখ! দেখ!

চীৎকার শুনেই লোকটিও চোখ তুলে তাকাল। পরক্ষণে সেও লাফিয়ে উঠে বলল, পালাও! ঈশ্বরের দোহাই কালি, পালাও! মেয়েটি কিন্তু পালাল না। ছোট লাঠিটা হাতে নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। একটা বড় মুগুর হাতে নিয়ে লোকটিও অপেক্ষা করতে লাগল।

অদ্ভুত ভঙ্গীতে দুলতে দুলতে তাদের দিকে এগিয়ে এল একটা প্রকাণ্ড গোরিলা। এতবড় গোরিলা বুড়ো টাইমার আগে কখনও দেখে নি। মেয়েটি তখনও দাঁড়িয়ে আছে দেখে মিনতিভরা গলায় বলল, কালি, দয়া করে পালাও। ঐ জন্তুটাকে আমি কিছুক্ষণ আটকে রাখতে হয়তো পারবো, কিন্তু ওকে থামাতে পারব না। তুমি কি বুঝতে পারছ না কালি যে ও তোমাকেই চাইছে? মেয়েটি তবু নড়ল না। গোরিলাটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। দোহাই তোমার! লোকটি আবার মিনতি জানাল।

মেয়েটি বলল, আমি যখন বিপদে পড়েছিলাম তখন তুমি তো পালিয়ে যাও নি।

লোকটি কি যেন বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই গোরিলাটা আক্রমণ করে বসল। বুড়ো টাইমার মুগুর দিয়ে তাকে আঘাত করল; মেয়েটিও আঘাত করতে লাগল। সব বৃথা! জন্তুটা বুড়ো টাইমারের হাত থেকে মুগুরটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর অন্য হাতে আঘাত করল কালি বাওয়ানাকে; মেয়েটির মাথা ঘুরতে লাগল। গোরিলাটা মুহূর্তের মধ্যে বুড়ো টাইমারকে একটা ভাঙ্গা পুতুলের মত তুলে নিয়ে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল।

আঘাতের জের কাটিয়ে টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটি বুঝল সে একেবারে একা; বুড়ো টাইমার ও জন্তুটা উধাও। চেঁচিয়ে ডাকল; কোন সাড়া নেই। ভাবল, তাকে খুঁজতে যাবে, কিন্তু তারা, কোন্ পথে গেছে তাই তো সে জানে না তাহলে? এই প্রথম কালি বাওয়ানার মনে একটা নতুন অনুভূতি জাগল। এই মানুষটি তো তারই মানুষ। সেই তো তাকে ডেকেছিল- আমার কালি।

অরণ্যরাজ টারজান ভাগ্যের হাতেই নিজেকে ছেড়ে দিয়েছে। হাত-পায়ের যে বন্ধন অচ্ছেদ্য তাকে ছিন্ন করার ব্যর্থ চেষ্টায় সে শক্তি ক্ষয় করে নি, আবার অকারণ অনুশোচনার গ্লানিও ভোগ করে নি। সে চুপচাপ শুয়ে থাকে। নকিমাও মনমরা হয়ে তার পাশেই বসে থাকে।

বেলা পড়ে আসছে। এমন সময় কার যেন পদধ্বনি টারজনের কানে এল। নকিমা বা বড় গোরিলা সে শব্দ শোনার আগেই সে শুনতে পেল; সঙ্গে সঙ্গে গরু-র গরু-র, শব্দ করে সে সকলকে সজাগ করে দিল। লোমশ জন্তুগুলো কান খাড়া করল। মেয়ে জন্তুগুলোও এসে হাজির হল।

একটা প্রকাণ্ড মূর্তি হেলে-দুলে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল। সে গা-ইয়াট। তার এক বগলে একটা মানুষ।

বুড়ো টাইমারকে নিয়ে গা-ইয়াট টারজনের সামনে মাটিতে নামিয়ে দিল। বলল, আমি গা-ইয়াট। এই নাও একটা টার্মাঙ্গানি। কোন গোমাঙ্গানির দেখা পেলাম না।

গোরিলারা ক্রমেই বুড়ো টাইমারের কাছাকাছি আসতে লাগল। গোরিলাদের এত বড় দল সে আগে কখনও দেখে নি; গোরিলা যে এত বড় হয় তাও সে জানত না। হয়তো এগুলো গোরিলাই নয়; এরা গোরিলার চাইতে অনেক বেশি মানুষের মত দেখতে। আদিবাসীরা এই সব লোমশ মানুষদের কথা বলে বটে, কিন্তু সে সব গল্প বিশ্বাস করত না। সে আরও দেখত, হাত-পা বাঁধা একটি অসহায় সাদা মানুষ গোরিলাদের মাঝখানে শুয়ে আছে। প্রথমে সে তাকে চিনতে পারে নি। ভাবল, সেও হয়তো এই সব বন মানুষদের হাতে বন্দী। বন-মানুষটা যে কালির বদলে তাকে ধরে এনেছে সে জন্য সে কৃতজ্ঞ। বেচারী কালি! না জানি তার কপালে কি ঘটেছে।

গোরিলারা বুড়ো টাইমারকে ঘিরে ধরেছে। তাদের উদ্দেশ্যও স্পষ্ট। সে বেশ বুঝল, তার শেষের দিন সমাগত। তার পরই-কী আশ্চর্য! পাশেই মানুষটি গর্জন করে উঠল; ঠোঁট উল্টে যাওয়ায় তার ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ল। বলল, সাবধান! এই টার্মাঙ্গানি টারজনের সম্পত্তি; কেউ তার কোন ক্ষতি করো না।

গা-ইয়াট ও জু-টো ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্য সব গোরিলাদের তাড়িয়ে দিল। বুড়ো টাইমার অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। টারজনের কথা সে বুঝতে পারে নি; সে যে গোরিলাদের সঙ্গে কথা বলতে পারে এটা তার বিশ্বাস হয় না; কিন্তু নিজের চোখকে সে অবিশ্বাস করবে কেমন করে?

গম্ভীর নিচু গলায় ইংরেজি ভাষায় কেন যেন বলে উঠল, এক বিপদ পার হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আর এক বিপদে পড়েছ।

বুড়ো টাইমার বক্তার দিকে ফিরে তাকাল। গলাটা যেন চেনা-চেনা লাগছে। এতক্ষণে চিনতে পেরেই সোল্লাসে বলে উঠল, তুমিই তো আমাকে মন্দিরের বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলে!

আর এখন আমিই পড়েছি বিপদে, টারজান বলল।

বুড়ো টাইমার বলল, বিপদ তো দু’জনেরই। ওরা আমাদের নিয়ে কি করবে বলে আমার ধারণা?

 কিছুই করবে না, টারজান বলল।

তাহলে আমাকে এখানে এনেছ কেন?

টারজান বলল, আমিই ওদের বলেছিলাম একটি মানুষকে ধরে আনতে। ঘটনাক্রমে তোমাকেই সে প্রথম দেখতে পেয়েছিল।

ওই জানোয়ারটাকে তুমি পাঠিয়েছিলে? তুমি যা বল তাই ওরা করে? তুমি কে? আর কেনই বা একটা মানুষকে আনতে ওকে পাঠিয়েছিলে?

আমি অরণ্যরাজ টারজান। আমার হাত-পায়ের এই তারের বাঁধনগুলো খুলতে পারে এরকম একজনকে আমার প্রয়োজন। এই সব গোরিলা বা নকিমাকে দিয়ে সে কাজটা হয় নি।

বুড়ো টাইমার বলে উঠল, তুমিই অরণ্যরাজ টারজান! আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আদিবাসীদের উপকথার এক নায়ক। বলতে বলতেই সে অতি সহজে টারজনের হাত-পায়ের তামার তারের বাঁধন খুলতে লাগল।

টারজান শুধাল, সেই সাদা মেয়েটির কি হল? তুমি তো তাকে নিয়ে বামনদের গাঁ থেকে বেরিয়ে গেলে, কিন্তু আমি পারলাম না, বেঁটা শয়তান আমাকে আটক করল!

তুমি সেখানে ছিলে! ওহো, এবার বুঝতে পেরেছি; তুমিই তীরগুলো ছুঁড়েছিলে।

 হ্যাঁ।

তারা তোমাকে ধরল কেমন করে, আর তুমি ছাড়াই বা পেলে কেমন করে? আমি ছিলাম একটা গাছের উপরে-ডালটা ভেঙে পড়ল। মুহূর্তের জন্য জ্ঞান হারিয়েছিলাম। সেই সুযোগে তারা আমাকে বেঁধে ফেলে।

ঠিক বটে। গ্রাম ছেড়ে আসার সময় একটা মড়মড় শব্দ শুনেছিলাম।

টারজান বলল, নিঃসন্দেহে বড় গোরিলাদের আমি ডেকেছিলাম, আর তারাই গিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে এসেছে। ভাল কথা, সাদা মেয়েটি কোথায়?

আমরা দুজন শিবিরের দিকেই যাচ্ছিলাম, এমন সময় গোরিলাটা আমাকে পাকড়াও করল, বুড়ো টাইমার বলল। সেখানে সে এখন একা রয়েছে। তার খুলে দেবার পরে আমি তার কাছে ফিরে যেতে পারব তো?

আমিও তোমার সঙ্গে যাব। জায়গাটা কোথায়? চিনতে পারবে তো?

বেশি দূর নয়, কয়েক মাইলের বেশি হবে না; তবু খুঁজে নাও পেতে পারি।

 আমি পারব, টারজান বলল।

কেমন করে? বুড়ো টাইমার শুধাল।

গা-ইয়াটের পায়ের ছাপ দেখে; সেটা এখনও স্পষ্টই আছে।

বুড়ো টাইমার তখন টারজনের কব্জির তার খুলে গোড়ালির তার খুলতে ব্যস্ত। এক মুহূর্ত পরেই টারজনের বন্ধন-মুক্তি ঘটল। এক লাফে সে উঠে দাঁড়াল।

চলে এস! গা-ইয়াট যেখানে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছিল সেই দিকটা দেখিয়ে টারজান জোর কদমে ছুটল।

বুড়ো টাইমার তার সঙ্গে সমান তালে ছুটতে পারল না; ক্ষুধায় ও ক্লান্তিতে সে দুর্বল হয়ে পড়েছে। বলল, তুমি এগিয়ে যাও। তোমার সঙ্গে সমান গতিতে আমি ছুটতে পারছি না। কিন্তু সময় নষ্ট করা চলবে না। মেয়েটি সেখানে একা রয়েছে।

টারজান আপত্তি জানিয়ে বলল, একা রেখে গেলে তুমি পথ হারিয়ে ফেলবে। দাঁড়াও ব্যবস্থা করছি। নকিমাকে ডাকতেই সে গাছ থেকে লাফ দিয়ে টারজনের কাঁধে এসে বসল। টারজান বলল, তুমি টার্মাঙ্গানির কাছে থাক। ওকে পথ দেখিয়ে আমার পিছু পিছু নিয়ে এস।

দু’জনকে আলাপ করতে দেখে বুড়ো টাইমার তো অবাক। মানুষ আর বানরে কথা বলছে, এ যে অবিশ্বাস্য অথচ যা সে চোখে দেখছে, কানে শুনছে তাতো মায়া নয়, খাঁটি সত্য ঘটনা।

অসহায় সংকটে পড়ে কালি বাওয়ানা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। লোকটি যখন বামনদের হাত থেকে উদ্ধার করে আনল তখন তবু তার মনে কিছুটা স্বস্তির ভাব এসেছিল; তার সঙ্গে তুলনায় এখন তার পরিস্থিতি আরও অসহ্য মনে হতে লাগল। পরন্তু, বিপদের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে ব্যক্তিগত দুঃখ।

বুড়ো টাইমার যে অস্থায়ী আস্তানাটা তার জন্য বানিয়েছিল সেদিকে তাকিয়ে মেয়েটির দুই গাল বেয়ে চোখের জল ঝরতে লাগল। তার হাতের তৈরি ধনুকটা তুলে তাতে ঠোঁট দুটি ছোঁয়াল। আর কোনদিন তার সঙ্গে দেখা হবে না। এ-কথা ভাবতেই অবরুদ্ধ কান্নায় তার গলা আটকে এল। অনেক-অনেক দিন সে কাঁদে নি। সাহসের সঙ্গে কত দুঃখ, দুর্দশা ও বিপদের মোকাবিলা করেছে; কিন্তু এখন আস্তানার ভিতরে ঢুকে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

সব কিছুই কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেছে। জেরির সন্ধান ব্যর্থ হয়েছে। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি মানুষ তার সঙ্গে জড়িয়ে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে গেছে। দুঃখে ও অনুশোচনায় এখন তারই মূল্য তাকে শুধতে হচ্ছে।

বেশ কিছু সময় সেখানে শুয়ে হা-হুঁতাশ করল। তারপর এক সময় বুঝল এতে কোন ফল হবে না। হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। এই শেষ আঘাতের পরেও থেমে যাওয়া চলবে না। এখনও সে বেঁচে আছে, অথচ জেরিকে খুঁজে পায় নি। তাকে এগিয়ে যেতে হবে। নদীতে পৌঁছতে হবে। যেমন করে হোক নদী পার হতে হবে। বুড়ো টাইমারের শিবির খুঁজে বের করতে হবে। তার অংশীদারটির সাহায্য নিতে হবে কিন্তু তার জন্য তো খাদ্য চাই; বলকারক মাংস চাই। এই দুর্বল দেহ নিয়ে সে তো চলতে পারবে না। যে ধনুক সে তৈরি করে রেখে গেছে সেটার সাহায্যেই তাকে মাংসের ব্যবস্থা করতে হবে। তীরগুলো নিতে সে বাইরে বেরিয়ে এল। এখনও শিকারের সময় পার হয়ে যায় নি।

ঘর থেকে বেরিয়েই সে চমকে উঠল। ওটা কি? মনে মনে এই ভয়ই সে করছিল। জঙ্গলের কাছে দাঁড়িয়ে একটা চিতাবাঘ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চিতার হলদে চোখ দুটি তার উপর পড়তেই তার পেটটা মাটিতে নেমে গেল, বিকৃত মুখে একটা ফ্যাচফ্যাচ শব্দ হতে লাগল। জন্তুটা গুঁড়ি-মেরে তার দিকেই এগিয়ে আসছে; লেজটা বেঁকে বেঁকে নড়ছে।

ক্রমেই কাছে আসছে-আরও কাছে। মেয়েটি ধনুকে তীর লাগল। এ চেষ্টা বৃথা তা সে জানে। একটা বিধ্বংসী কামানকে এত ছোট একটা গুলিতে বিদ্ধ করা যাবে না। তবু শেষ চেষ্টা করতেই হবে।

চিতাটা এগিয়ে আসছে। এখন শুধু লাফিয়ে পড়ার অপেক্ষা। এমন সময় মেয়েটি দেখল, চিতাটার ঠিক পিছনে একটি মনুষ্য-মূর্তি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল-একটি দৈত্যাকার সাদা মানুষ, শুধুমাত্র কটিবস্ত্র পরিহিত।

কোন রকম ইতস্তত না করে লোকটি ছুটে আসছে চিতাটাকে লক্ষ্য করে নরম ঘাসের উপর তার পায়ের কোন শব্দও হচ্ছে না। হঠাৎ মেয়েটি সভয়ে লক্ষ্য করল, লোকটি নিরস্ত্র।

চিতা শরীরটাকে মাটি থেকে একটুখানি তুলল। পিছনের পা দুটি শরীরের নিচে টেনে আনল। এবার একটা লাফ। বাস, তাহলেই মেয়েটির ভবলীলা সাঙ্গ। ঠিক তখনই লোকটি যেন বাতাসে ভেসে এসে জন্তুটার পিঠের উপর চেপে বসল।

তারপর যা ঘটল সে অবিশ্বাস্য ঘটনা। দাগ-দাগ চামড়া ও বাদামী চামড়া, হাত ও পা, নখর ও দাঁতের অতি দ্রুত ওলোট-পালোট ও জড়াজড়ি; আর সে সব কিছুকে চাপিয়ে শোনা যেতে লাগল দুটি রক্তপাগল জন্তুর বীভৎস চীৎকার।

জড়াজড়ি করতে করতে মানুষটি হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। পেছন থেকে চিতাটার গলা পেঁচিয়ে ধরে সেটাকেও টেনে তুলল। সেই মৃত্যু-মুষ্টি থেকে নিজেকে ছাড়াতে জন্তুটা আপ্রাণ চেষ্টা করছে; কিন্তু তার গলা দিয়ে এখন আর স্বর বেরুচ্ছে না। ধীরে ধীরে জন্তুটার দেহ শান্ত হয়ে এল। তখন চিতাটার গলাটা মুচড়ে ছিঁড়ে ফেলে লোকটি তার মৃতদেহটাকে মাটিতে ফেলে দিল। মুহূর্তের জন্য লোকটি তার উপর পা রেখে দাঁড়াল। গোরিলার বিজয় চীৎকারে সারা বনভূমি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।

কালি বাওয়ানা শিউরে উঠল। তার শরীরের ভিতরটা যেন ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। একবার ভাবল এই জংলী মানুষটার কাছ থেকে পালিয়ে যাবে। কিন্তু তখনই সে তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল; পালাবার সুযোগই হল না। ভাবল, তীর-ধনুক তো হাতেই আছে; কিন্ত তা দিয়ে কি এই মানুষটাকে ভয় দেখানো যাবে!

লোকটি কিন্তু সহজভাবেই বলল, ঠিক সময়েই এসে পড়েছি। তোমার বন্ধুটিও এখনই এসে পড়বে; একটু থেমে বলল, ধনুকটা নামিয়ে রাখ, আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না।

ধনুকটা পাশে রেখে মেয়েটি বলল, আমার বন্ধু! কে? তুমি কার কথা বলছ?

 নাম তো জানি না। তোমার কি অনেক বন্ধু আছে?

বন্ধু তো একজনই আছে। কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম সে মারা গেছে। একটা মস্ত গোরিলা তাকে তুলে নিয়ে গেছে।

টারজান আশ্বাস দিয়ে বলল, সে ভালই আছে। এখনই আসবে।

কালি বাওয়ানা মাটিতে বসে পড়ল। অস্ফুট স্বরে বলল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ!

বুকের উপর দুই হাত রেখে টারজান মেয়েটিকে দেখছে। কী সুন্দর দেখতে! এই নরম শরীরে এত কষ্ট সে সহ্য করেছে? অরণ্যরাজ সাহসের প্রশংসা করে; সে জানে, যে বিপদের ভিতর দিয়ে মেয়েটি এসেছে তাতে কতখানি সাহস থাকা দরকার।

কার যেন পায়ের শব্দ কানে এল। টারজান বুঝতে পারল। পরিশ্রমের ফলে লোকটা হাঁপাচ্ছে। মেয়েটিকে দেখেই ছুটে গিয়ে বলে উঠল, তুমি ভাল আছ? মরা চিতাটা তার পাশেই পড়ে আছে।

হ্যাঁ, মেয়েটি জবাব দিল।

দু’জনই কেমন যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কার মনে কি আছে তা কেউ জানে না। লোকটিকে নিরাপদ দেখে মেয়েটি তার মনের ভাবটা চেপেই রাখল। আবার ওদিকে বুড়ো টাইমারের কানে তখনও বাজছে কালি বাওয়ানার সেই কঠোর উক্তি, আমি তোমাকে ঘৃণা করি।

টারজান বলল, তাদের দু’জনকে সে বুড়ো টাইমারের শিবিরে পৌঁছে দিতে পারে, অথবা নদীর ভাটিতে প্রথম থানায় তাদের রেখে আসতে পারে। মেয়েটি কিন্তু জিদ ধরল, সে শিবিরেই ফিরে যাবে, তারপর সেখান থেকে নতুন করে যাত্রার আয়োজন করবে; তখন বুড়ো টাইমার তার সঙ্গে নদীর ভাটিতেও যেতে পারে, অথবা জেরি জেরোমের অনুসন্ধানে তার সঙ্গীও হতে পারে।

রাত হবার আগেই টারজান মাংস নিয়ে ফিরে এল। দু’জনে সেই মাংস রান্না করতে বসল, আর টারজান একটু দূরে বসে শক্ত সাদা হাত দিয়ে কাঁচা মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগল। তার কাঁধে বসে ছোট্ট নকিমা ঘুমে ঢুলতে লাগল।

পশ্চিম অরণ্যের ওপারে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। বোবোলোর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বড় নদীটার খরস্রোতে তার আলো পড়ে ঝিলমিল করছে। একটি পুরুষ ও একটি নারী সেই স্রোতধারার দিকে তাকিয়ে আছে। এই অন্ধকার গহন অরণ্য তার সভ্য জগতের মধ্যে এই নদীই একমাত্র যোগসূত্র; অনেক নগর, বন্দর পার হয়ে সে দীর্ঘ যাত্রায় চলেছে পশ্চিম দিকে সাগরের ডাকে।

লোকটি বলল, কালই আমরা যাত্রা করব। ছয় বা আট সপ্তাহের মধ্যেই তোমরা দু’জন বাড়ি পৌঁছে যাবে। বাড়ি’ এই একটি মাত্র ছোট শব্দের মধ্যে কত না ইচ্ছা পূরণের আনন্দ লুকিয়ে আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে লোকটি বলল, তোমাদের দুজনের জন্য আমার কত আনন্দ।

মেয়েটি আরও কাছে এসে তার মুখোমুখি দাঁড়াল। চোখে চোখ রেখে বলল, তুমিও তো আমাদের সঙ্গেই যাচ্ছ?

এ কথা কেন ভাবছ? লোকটি শুধাল।

যেহেতু আমি তোমাকে ভালবাসি, তাই তুমি যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *