রহস্য-সন্ধানী টারজান (টারজানস কোয়েস্ট)

রহস্যসন্ধানী টারজান (টারজানস কোয়েস্ট)

অরণ্য-রাজ টারজান জঙ্গলের একটা পুরনো গাছের দো-ডালার ফাঁকে তৈরি পাতার বিছানায় উঠে বসল। আয়েস করে হাত-পা ছড়াল।

ছোট্ট নকিমা হাত-পা নেড়ে জেগে উঠল। কিচির-মিচির করে টারজনের কাঁধে চড়ে বসে লোমশ হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরল।

এই বৃহৎ অরণ্যে নিজের এলাকা ছেড়ে টারজান গিয়েছিল বহুদূরের এক অঞ্চলে। সেখান থেকেই সে ফিরে চলেছে।

নানা রকম অদ্ভুত গুজব কানে আসায় সে বিষয়ে তদন্ত করতেই সে গিয়েছিল। অরণ্যের অনেক অনেক ভিতরে এমন সব পথবিহীন পরিত্যক্ত অঞ্চল আছে যেখানে মানুষের পদার্পণ কদাচিৎ ঘটেছে, আর যারাই সেখানে গেছে তাদের মধ্যেও অনেকেই জীবন্ত ফিরে আসেনি। এই রকম রহস্যময় বিচিত্র গুজব তার কানে এসেছে। ইদানীং তরুণী মেয়েদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ঘটনা ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেছে। চৌদ্দ থেকে বিশ বছেরের মেয়েগুলো হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। তাদের কোন খোঁজই মেলে না।

গাছ থেকে গাছে ঝুলতে ঝুলতে সে অনায়াসে এগিয়ে চলেছে। কখনও তার পাশে, কখনও বা মাথার উপরে, ছোট্ট নকিমা অনেক দূরে থেকেও মনিবকে অনুসরণ করে চলেছে।

এক সময় সে দেখল, তার মনিব থেমে পড়েছে; বাতাস শুঁকছে; কান পেতে আছে। ছোট্ট নকিমা নিঃশব্দে টারজনের কাঁধে লাফিয়ে পড়ল।

মানুষ, টারজান বলল।

 পিছন দিক থেকে এগিয়ে টারজান খুব দ্রুত তাদের ধরে ফেলল। বলল, ওরা ওয়াজিরি।

গাছের উপর থেকেই টারজান ওয়াজিরিদের ভাষায় বলল, মুভিরো, আমার ছেলেরা তাদের দেশ থেকে এতদূরে কেন এসেছে?

মুভিরো বলল, ওঃ, বাওয়ানা, তুমি এসেছ ভালই হয়েছে। আমার মেয়ে বুইরা নিখোঁজ হয়েছে। একলা নদীর দিকে যাচ্ছিল; তারপর তাকে আর দেখা যায়নি।

মনে হয় এর পিছনে শয়তান আছে, রহস্য আছে বাওয়ানা। কাভুরুদের কথা শুনেছি। হয় তো এসব তাদের কাজ, আমরা তাদের সন্ধানেই বেরিয়েছি।

টারজান বলল, তাদের দেশ তো অনেক দূরে। তারই কাছের একটা জায়গা থেকে আমি এইমাত্র ফিরছি। সেখানকার লোকগুলো সব ভীরু। কাভুরুদের কোথায় পাওয়া যাবে ভয়ে তারা সে কথা জানলেও আমাকে বলতে চাইল না।

টারজান বলল, চোরদের কোন হদিস পেয়েছ কি?

মুভিরো বলল, কোন হদিস নেই। তাই তো বুঝতে পারছি যে এ সব কাভুরুদের কাজ; তারা কোন হদিস রেখে যায় না।

টারজান বলল, আমরা প্রথমেই যাব বুকেনাদের গ্রামে। তাদের মেয়েরাই হারিয়েছে সবটাইতে বেশি। আমি দ্রুততর ছুটতে পারি; কাজেই আমি আগে যাচ্ছি। চার দফা যাত্রা, কোথাও আটকে পড়লে হয় তো তিন দফা যাত্রায়ই তোমরা সেখানে হাজির হতে পারবে।

মুভিরো বলল, এবার বড় বাওয়ানা যখন আমাদের সহায় তখন আর ভয় নেই, কারণ আমি জানি এবার বুইরাকে খুঁজে পাওয়া যাবে।

টারজান আকাশের দিকে মুখ তুলে বাতাস শুকল। বলল, একটা খারাপ ঝড় আসছে মুভিরো। সেই ঝড়ের মুখে তোমাদের চলতে হবে।

কিছুক্ষণের মধ্যে বাতাস ঝাঁপিয়ে পড়ল উষ্ণ গাছগুলোর মাথায়। মেঘের গর্জন তীব্রতর হতে লাগল। আঁধার নেমে এল বনের বুকে। চমকাতে লাগল বিদ্যুৎ। শুরু হলো নিদারুণ বর্ষণ।

আধ ঘণ্টা কেটে গেল। ঝড়ের বেগ কমল না। হঠাৎ টারজান উপরের দিকে কান খাড়া করল।

 একজন সভয়ে জিজ্ঞাসা করল, আকাশে শোঁ-শোঁ আর্তনাদ করে ছুটে চলেছে ওটা কি বাওয়ানা?

টারজান বলল, অনেকটা বিমানের মত শব্দ; কিন্তু এখানে বিমান কি করতে এল তা তো বুঝতে পারছি না।

প্রিন্স এলেক্সিস বিমান-চালকের কামরায় মাথাটা বাড়াল। তার বিবর্ণ মুখে আতংকের আভাষ। বিমানের পাখার গর্জনকে ছাপিয়ে সে চীৎকার করে বলল, কোন বিপদ ঘটবে কি ব্রাউন?

চালক খেঁকিয়ে উঠল, ঈশ্বরের দোহাই, চুপ করুন। প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর একটা করে বোকা বোকা প্রশ্ন শোনা ছাড়াও আমার অনেক কাজ আছে।

পাশের আসনে বসা লোকটি ভীত কণ্ঠে তাকে সতর্ক করে দিয়ে বলল,—শ। হিজ হাইনেসের সঙ্গে ওভাবে কথা বলো না হে। কথাগুলো খুবই অশ্রদ্ধার।

ঘোড়ার ডিম, ব্রাউন মুখ ঝাটা দিল।

প্রিন্স স্খলিত পায়ে কেবিনে নিজের আসনে ফিরে এল।

প্রিন্সেস বলল, সেফটি বেল্টটা বেঁধে নাও লক্ষ্মীটি। যে কোন মুহূর্তে আমরা ডিগবাজি খেতে পারি। সত্যি বলছি, এ রকম ভয়ঙ্কর অবস্থায় কখনও পড়েছ কি? এখন মনে হচ্ছে না এলেই ভাল ছিল।

আমারও তাই মনে হচ্ছে, এলেক্সিস গজরাতে লাগল। একবার যদি মাটিতে পা রাখতে পারি, তাহলে আমার প্রথম কাজ হবে এই নির্লজ্জ বেয়াদব লোকটিকে গুলি করে মারা।

একটা বিদ্যুতের ঝিলিকে কালো মেঘগুলো ঝলসে উঠল। উড়োজাহাজটা মাতালের মত কাৎ হয়ে হঠাৎ নিচের দিকে নামতে লাগল। চীৎকার করে উঠল আনে; প্রিন্সেস সবরভ মূৰ্ছা গেল।

প্রিন্সেস সবরভ চেয়ারে বসেই ধাক্কা খেল। তার স্মেলিং সল্ট মেঝেতে ছিটকে পড়ল। টুপিটা নেমে এল একটা চোখের উপর; চুল এলোমেলো হয়ে গেল।

জেন বলল, তুমি বরং প্রিন্সেসকে দেখ আনে।

কোন জবাব নেই। ভাল করে লক্ষ্য করে জেন বুঝতে পারল, আনেৎ মূৰ্ছা গেছে।

জেন মাথা নাড়ল। ডেকে বলল, টিবস তুমি এখানে এসে প্রিন্সেসকে দেখ। আমি ব্রাউনের পাশে গিয়ে বসছি।

জেন বলল, শেষের ধাক্কাটা তুমি খুব সামলে নিয়েছ ব্রাউন। তোমার হাত খুব ভাল।

টিবস্ বলল, ধন্যবাদ। সকলে আপনার মত হলে কাজটা অনেক সহজ হত।

জেন বলল, উড়োজাহাজে সত্যি কোন গোলমাল দেখা দিয়েছে নাকি ব্রাউন?

 টিবস্ জবাব দিল, হ্যাঁ। ঝড়ের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছি; কোথায় এসেছি, কোন্ দিকে যাচ্ছি-কিছুই বুঝতে পারছি না। জানেন তো মিস, আফ্রিকায় অনেক পাহাড় আছে-বেশ উঁচু পাহাড়, যে কোন মুহূর্তে আমরা পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেতে পারি।

এই বিপদ এড়াবার কোন পথ নেই? জেনের কণ্ঠস্বর শান্ত, কিন্তু চোখ দুটি ভয়গ্রস্ত। পেট্রল-গ্যাস কি সত্যি খুব নেমে গেছে ব্রাউন?

দেখুন, ব্রাউন ড্যাস-বোর্ডের কাটাটা দেখাল। বড় জোর আর ঘণ্টাখানেক চলবে। যেমন করে হোক, আধঘণ্টার মধ্যে কোথাও নামতেই হবে। শুধু ভয় হচ্ছে, একটা পাহাড়ের উপর না আছড়ে পড়ি।

কয়েকটি নিঃশব্দ মুহূর্ত কেটে গেল। হঠাৎ জেন হর্ষধ্বনি করে উঠল। দেখ ব্রাউন গাছা! আমরা অনেকটা নেমে এসেছি। আর কতটা গ্যাস আছে।

পনের-বিশ মিনিট চলার মত আছে।

নিচে তাকিয়ে হতাশ গলায় জেন বলল, কিন্তু নিচে যে শুধু বন আর বন; উড়োজাহাজ নিয়ে নামবার মত একটা জায়গাও নেই।

একটা কোন ফাঁক পেয়ে যাব। অন্তত পক্ষে গাছের উপরে তো নামতে পারব। তাতে আর যাই। হোক, সকলে মিলে মারা পড়ব না।

ডালপালা ভাঙার খটমট শব্দ আর কাপড় ঘেঁড়ার খসখস শব্দের মধ্যে উড়োজাহাজটা বৃষ্টি-ভেজা, আন্দোলিত বনের মাথায় খাড়া নেমে গেল। ঝড়ের শব্দ আর উড়োজাহাজের ধাক্কার শব্দকে ছাপিয়ে শোনা গেল কেবিন-বন্দী যাত্রীদের আর্তনাদ আর গালমন্দ।

শেষ পর্যন্ত তাও থামল। উড়োজাহাজটা স্থির হয়ে গেল।

তারপর কয়েকটি ভয়ঙ্কর মুহূর্ত ভয়ে শুধুই নিস্তব্ধতা।

ব্রাউন পিছনে কেবিনের দিকে তাকাল। সেফটি বেল্টে বাঁধা অবস্থায় চার যাত্রী চার ভঙ্গীতে ঝুলে আছে। ব্রাউন শুধাল, পিছনের সকলে ভাল তো? আনেৎ, তুমি কেমন আছ?

ফরাসী মেয়েটি আবার কেঁদে উঠল। হয় মনডিউ! আমি বোধ হয় মরেই গেছি।

প্রিন্সেস সবরভ আর্তকণ্ঠে বলল, ওঃ কী ভয়ঙ্কর! কেউ আমার জন্য কিছু করছে না কেন? কেউ আমাকে একটু সাহায্য করছে না কেন? আনেৎ! এলেক্সিস! তোমরা কোথায়? আমি যে মরতে চলেছি।

এলেক্সিস গর্জে উঠল, সেটাই তোমার প্রাপ্য। যত সব পাগলের কাণ্ড-কারখানা! আমরা যে মরে যাইনি সেটাই আশ্চর্য। একজন ফরাসী পাইলট থাকলে এ রকমটা ঘটত না।

জেন বাধা দিয়ে বলল, বাজে কথা বলবেন না। ব্রাউন চমৎকারভাবে উড়োজাহাজটাকে নামিয়েছে।

তারপর নিজের বেল্টটা খুলে জেন কেবিনে উঠে গেল।

ওদিকে টারজান ও তার ওয়াজিরি সঙ্গীরাও ঝড় থামার অপেক্ষায় রইল।

কিছুক্ষণের জন্য ঝড়ের সঙ্গে একটা উড়োজাহাজের মোটরের শব্দ টারজান শুনতে পেয়েছিল। সে বুঝতে পেরেছিল যে জাহাজটা ঘুরপাক খাচ্ছে; তারপর সে শব্দটা কমতে কমতে মহাশূন্যে মিলিয়ে গেল।

মুভিরো বলল, বাওয়ানা, ঝড়ের মাথায় চড়ে কি মানুষ এসেছিল?

টারজান জবাব দিল, হ্যাঁ, অন্তত একজন তো বটেই, তবে ঝড়ের মাথায় কি ভিতরে তা জানি না।

ক্রমে আকাশ পরিষ্কার হল। সূর্য দেখা দিল।

টারজান উঠে দাঁড়িয়ে সিংহের মত শরীরটা ঝাড়া দিল। বলল, এবার আমি উকেনা যাত্রা করব; সেখানে যদি আমাকে না পাও তো জানবে যে আমি কাভুরু ও বুইরার খোঁজে গেছি। তোমাদের সাহায্যের দরকার হলে নকিমাকে পাঠিয়ে দেব তোমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসতে।

আর কোন কথা না বলে টারজান একটা জলে ভেজা ডাল ধরে ঝুলে পড়ে পশ্চিম দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

তৃতীয় দিন সকালে সে হাজির হল বুকেনাদের সর্দার উদাতলার গ্রামে।

একটা বাচ্চা বানর কাঁধে তার দীর্ঘ শরীর দেখেই গ্রামের ফটকে তার চারপাশে অনেক লোকের জটলা শুরু হয়ে গেল। তাদের দিকে কোনরকম নজর না দিয়ে টারজান সোজা গিয়ে উঠল তাদের সর্দার উদালোর ঘরে।

তাকে দেখে উদালো মোটেই খুশি হল না; বলল, আমরা তো ভেবেছিলাম বড় বাওয়ানা চলেই গেছে, আর ফিরবে না; আবার ফেরা হল কেন?

উদাতলার সঙ্গে কথা বলতে।

উদালোর সঙ্গে তো আগেই কথা হয়ে গেছে। উদালো যা জানে সবই তো তাকে বলেছে।

 এবার উদালো তাকে আরও কিছু বলবে। কাভুরুদের দেশ কোথায় সে কথাও বলবে।

বুড়ো বিরক্ত হল। উদালো তা জানে না।

তারা এই সব কথা বলতে বলতেই গ্রামের বর্শাধারী সৈনিকরা এসে তাদের ঘিরে ধরল।

চারপাশে সমবেত সৈনিকদের দেখিয়ে টারজান বলল, এ সবের অর্থ কি উদালো? আমি তো শান্তিতেই এসেছি ভাই হিসেবে তোমার সঙ্গে কথা বলতে।

গলা খাকারি দিয়ে উদালো বলল, তুমি এখান থেকে চলে যাবার পরে এখানে অনেক রকম কথা হয়েছে। কাভুরুদের সম্পর্কে শোনা গল্পগুলো এখানকার লোকেরা ভোলে নি। শোনা যায়, তারাও নাকি তোমার মতই সাদা মানুষ, আর উলফঙ্গ হয়ে চলে। তোমার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। আমার লোকেরা অনেকেই মনে করে যে তুমিও একজন কাভুরু, গুপ্তচরের কাজ নিয়ে এখানে এসেছ সুযোগ মত চুরির জন্য মেয়েদের বেছে রাখতে।

ধীরে ধীরে সে উঠে দাঁড়াল। আমাদের আর কোন মেয়েকে তুমি চুরি করতে পারবে না। বলতে বলতে সে সজোরে হাততালি দিল, সঙ্গে সঙ্গে সৈনিকরা টারজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

টারজান চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। চারদিকে উদ্যত বর্শা; সে জানে, এই মুহূর্তে পালাতে চেষ্টা করলে এক ডজন বর্শা তাকে গেঁথে ফেলবে।

সঙ্গে সঙ্গে কালো মানুষগুলোর মধ্যে তর্ক বেঁধে গেল। একদল বলল, ওকে মেরে ফেল; আর একদল। বলল, ওকে বন্দী কর; আবার আর একদল বলল, কাভুরুদের খুশি করতে ওকে ছেড়ে দাও।

তর্কাতর্কির ফলে সামনের সারির বর্শাধারীরা কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। টারজান বুঝল, এই পালাবার সুযোগ। বিদ্যুৎ গতিতে সে পাশের সৈনিকটির উপর লাফিয়ে পড়ল; বর্মের মত তাকে সামনে ধরে সে মানব ব্যুহ ভেদ করে ছুটতে লাগল। এত দ্রুত সে এদিক-ওদিকে মোড় নিয়ে চলতে লাগল যে তাদের সঙ্গী কালো মানুষটার জীবনকে বিপন্ন না করে টারজানকে লক্ষ্য করে বর্শা ছোঁড়া একেবারেই অসম্ভব।

সমস্ত ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে কালো মানুষগুলো তাকে বাঁধা দেবার সময়টুকুও পেল না। টারজান প্রায় ফটকের কাছে পৌঁছে যাবে এমন সময় একটা কিছু এসে তার মাথায় সজোরে আঘাত করল।

জ্ঞান ফিরে এলে সে বুঝল, দুর্গন্ধ ভরা একটা ঘরের মধ্যে সে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে সব কথাই তার মনে পড়ে গেল।

রাতের অন্ধকারে একটি মূর্তি নিঃশব্দে হামাগুড়ি দিয়ে অন্ধকারে বেরিয়ে এল। ঘরের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সভয়ে চারদিকে তাকাল।

সব চুপ। ভৌতিক ছায়ার মত মূর্তিটি নিঃশব্দে গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে চলল।

একটু আগেই টারজনের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ঘরের দরজাটা যাতে দেখা যায় সেইভাবে টারজান পাশ ফিরল। সেখানে দেখা দিল একটি ছায়া-মূর্তি। কে যেন ঘরে ঢুকছে।

অন্ধকারে পথ হাতড়ে ছায়া-মূর্তি আরও কাছে এগিয়ে এল। হঠাৎ টারজান প্রশ্ন করল, কে তুমি?

স্-স্-শ! অত জোরে কথা বলো না। আমি ওঝা গুপিংগু।

 কি চাও?

তোমাকে মুক্তি দিতে এসেছি। তোমার দেশে ফিরে যাও কাভুরু; সেখানে গিয়ে তোমার লোকজনদের বলো যে গুপিংগু তোমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে। বিনিময়ে তারা যেন গুপিংগুর কোন ক্ষতি না করে, পর মেয়েদের হরণ না করে।

টারজান হাসল। অন্ধকারে সে হাসি দেখা গেল না। বলল, তুমি বুদ্ধিমান গুপিংগু; এবার আমার বাঁধন কেটে দাও।

আর একটা কথা, গুপিংগু বলল।

 কি?

উদালো বা আর কাউকে বলো না যে আমি তোমাকে মুক্তি করে দিয়েছি।

আমার কাছ থেকে তারা কিছুই জানতে পারবে না; আমাকে শুধু বলে দাও তোমার দেশের লোফরা কি কাভুরুদের দেশে যাবার পথ চেনে?

ওঝা বলল, আমি চিনি-কিন্তু কাউকে সেখানে নিয়ে যাব না বলে কথা দিয়েছি।

আচ্ছা বল তো, সে দেশের পথে কেমন করে যাওয়া যায়; তবে তো বুঝব সে পথ তুমি চেন কি না।

আমাদের গ্রামের উত্তর দিক থেকে আরও উত্তরে গেলে একটা পুরনো হাতি চলার পথ আছে। পথটা খুব ঘোরানো, তবে কাভুরুদের দেশের দিকেই চলে গেছে।

আমার বাঁধন কেটে দাও, টারজান বলল।

নিজের ছুরি বের করে গুপিংগু বন্দীর হাত-পায়ের শক্ত বাঁধন কেটে দিল। আমি ঘরে না পৌঁছা পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা কর, বলে সে নিঃশব্দে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে গেল।

টারজান উঠে দাঁড়িয়ে শরীরটাকে ঝাঁকি দিল। তারপর হাঁটুর উপর বসে হামাগুড়ি দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

সর্দারের কুটিরের কাছে এসে থামল। অস্ত্রশস্ত্রগুলোর জন্য খুব লোভ হচ্ছে। কুটিরের মধ্যে একটা অস্পষ্ট আলো দেখা যাচ্ছে। দরজার কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখল, সৈনিকটির অদূরেই ধুনির পাশে তার অস্ত্রশস্ত্রগুলো পড়ে আছে।

সতর্ক পদক্ষেপে ভিতরে ঢুকে সে ঘুমন্ত দেহটাকে পেরিয়ে গেল। প্রথমেই তুলে নিল তার মূল্যবান ছুরিটা; তারপর তীরপূর্ণ তুণীরটাকে ডান পিঠে ঝুলিয়ে বাঁ কাঁধে জড়িয়ে নিল দড়িটা। ছোট বর্শা ও ধনুটাকে এক হাতে নিয়ে আবার দরজার দিকে ঘুরল।

সারাটা দিন টারজান গুপিংগুর নির্দেশ মত হাতিদের পথ ধরে উত্তর দিকে এগিয়ে গেল। বিকেলের দিকে একটা জন্তুকে মেরে ভোজন-পর্ব সমাধা করে সেখানেই রাতটা কাটিয়ে দিল।

পরদিন নিঃশব্দে চলতে চলতে একটা দমকা হাওয়া তার নাকে পৌঁছে দিল একটা বিচিত্র গন্ধ। টারজান থেমে গেল। গন্ধটা একজন টার্মাঙ্গানির, অথচ এ গন্ধ তার কাছে সম্পূর্ণ নতুন। তার সঙ্গে এসে মিশেছে একটি পরিচিত গন্ধ-সিংহ নুমার গন্ধ। এই দুটি গন্ধ একত্র হওয়া মানেই বিপদের সংকেত।

টারজান মানুষটিকেই প্রথম দেখতে পেল। লোকটি শ্বেতকায়; কিন্তু যত সাদা মানুষ সে এতকাল দেখেছে এ লোকটি তাদের চাইতে কত আলাদা। তার পরনে একটি মাত্র কটিবাস; তার কব্জি ও গোড়ালি ব্রেসলেটে ভর্তি মানুষের দাঁতের সাত-নহরী হার ঝুলছে তার গলায়; হাড়ের বা হাতির দাঁতের সরু নল আড়াআড়ি ঢুকে আছে তার নাকের ডগায়; দুই কানে ঝুলছে ভারী ভারী আংটা। কপাল থেকে গলার পিছন পর্যন্ত প্রসারিত একগুচ্ছ চুল ছাড়া গোটা মাথাটা কামানো; আর সেই চুলের সঙ্গে বাঁধা পালকগুলো বীভৎসভাবে বিচিত্র মুখের উপর ঝুলছে।

একটি গাছে হেলান দিয়ে লোকটি বসে আছে। দেখলেই বোঝা যায় একটা সিংহের উপস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অচেতন।

তাহলে এই অপরিচিত লোকটি তো কাভুরু হতে পারে। কিন্তু এ বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা করার আগেই একটু দূরের একটা গর্জন টারজনের কানে এল।

সঙ্গে সঙ্গে শ্বেতকায় বর্বরটি উঠে দাঁড়াল। এক হাতে তুলে নিল ভারী বর্শা, অন্য হাতে একটা আদিম ছুরি।

ঝোপের ভিতর থেকে সিংহটা পূর্ণ বিক্রমে তেড়ে এল। গাছে উঠে আত্মরক্ষা করার সময়টুকু পর্যন্ত লোকটি পেল না। অতি দ্রুত তার হাতের বর্শা পিছনে সরে গিয়েই বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে গেল লক্ষ্যের দিকে। তার হস্তে নিক্ষিপ্তবর্শা লক্ষ্যচ্যুত হল। সঙ্গে সঙ্গে টারজান গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে পড়ল সিংহটাকে লক্ষ্য করে।

শুরু হল দুই জানোয়ারের যুদ্ধ। মানুষের গর্জন ও গর-গর শব্দ এক হয়ে মিশে যাচ্ছে সিংহের গর্জনের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত গর্জন থেমে গেল; মৃত্যু-যন্ত্রণায় শেষবারের মত নড়ে উঠেই পশুরাজের দেহটা মাটিতে এলিয়ে পড়ল।

টারজান লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। শত্রুর লাশের উপর একটা পা রেখে আকাশে মুখ তুলে বিজয়ী গোরিলার মত হুংকার দিতে লাগল।

সেই বীভৎস ভৌতিক হুংকার শুনে শ্বেতকায় বর্বরটি কুঁকড়ে পিছিয়ে গিয়ে নিজের ছুরির হাতলটাকে সজোরে চেপে ধরল।

হুংকারের শব্দ দূর থেকে দূরে মিলিয়ে গেল। বুকেনাদের ভাষায় বর্বরটি প্রশ্ন করল, কে তুমি?

 আমি অরণ্যরাজ টারজান। আর তুমি?

আমি ইয়েনি, কাভুরু।

টারজান খুশি হল। এবার সে হয়তো কাভুরুদের পরিচয় জানতে পারবে।

মাথা নেড়ে ইয়েনি বলল, তোমার মত লোক আমি আগে কখনও দেখিনি। তুমি কালো মানুষ নও, আবার কাভুরুও নও! তুমি কি?

আমি টারজান। কাভুরুদের গ্রামের খোঁজ করছি। তুমি তো আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পার। তোমাদের সর্দারের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই।

ইয়েনি মাথা নেড়ে বলল, মরবার ইচ্ছা না হলে কেউ কাভুরুদের গ্রামে যায় না। তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছ, তাই আমি তোমাকে সেখানে নিয়ে যাব না। বা তোমাকে মারবও না। তুমি তোমার পথে চলে যাও টারজান।

বিমানের দলটি মাটিতে নেমে নিজেদের কাজে লেগে গেল। ছোট ঝর্ণাটার ধারে জেন খানিকটা খোলা জায়গা খুঁজে পেল। একটা বেড়া ও কিছু থাকার মত ঘর বানাবো শুরু হয়ে গেল।

বিকেল নাগাদ একটা বড় ঘর তৈরির কাজ শেষ হল। তাতে কোন রকমে দুটো ঘরের ব্যবস্থা করা হল, একটা মেয়েদের জন্য, আর একটা ছেলেদের।

ওদিকে জেন তখন অন্য এক ধরনের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। কিটি অনেকক্ষণ ধরে বসে বসে কাজ দেখল। তারপর আর কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল, তুমি এসব কি করছ ভাই?

অস্ত্র তৈরি করছি- একটা ধনুক, তীর আর একটা বর্শা।

বাঃ, কী সুন্দর তোমার হাতের কাজ! এগুলো নিয়ে খেলা করে আমাদের সময় বেশ কেটে যাবে।

জেন মুখ তুলে বলল, আমি যা তৈরি করছি তা দিয়ে আমাদের খাবার সংস্থান হবে, আত্মরক্ষার ব্যবস্থা হবে।

একটা ধনুক ও ছ’টা তীর বানিয়ে নিয়ে জেন উঠে পড়ল। ঘর ও বেড়ার ব্যবস্থা দেখে বলল, বাঃ বেশ হয়েছে। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি ডান হাতের ব্যবস্থা করতে। ব্রাউন, তোমার ছুরিটা দাও।

পাশের ঝর্ণাটার উপর নজর রেখে জেন নিঃশব্দে গাছের ডালে ডালে এগিয়ে চলল। এই সব ঝর্ণাতে জল খেতে জীবজন্তুরা অবশ্যই আসবে।

একটা অস্পষ্ট গন্ধ নাকে আসায় সে খুশি হয়ে উঠল। সামনে শিকার এসেছে।

আরও সতর্কতার সঙ্গে সে এগোতে লাগল, যাতে গাছের একটা পাতাও না নড়ে। ঠিক সেই সময় ডালপালার ফাঁক দিয়ে হরিণটাকে দেখতেও পেয়ে গেল। বিদ্যুৎগতিতে ধনুকে তীর জুড়ে ছুঁড়ে মারল। তীরটা গম্ভীর হয়ে বিঁধল হরিণটার বাঁ কাঁধে। একটা লাফ দিয়েই সেটা মাটিতে পড়ে মরে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে জেন নিচে নেমে এসে মৃত শিকারের দিকে ছুটে গেল। পিছনে বেশ কাছেই ঝোপের ভিতরে কিসের যেন নড়াচড়ার শব্দ কানে এল। আচমকা একটা ক্রুদ্ধ গর্জনে বনভূমির স্তব্ধতা ভেঙে খাখা হয়ে গেল। বিশ পা পিছনে চিতাবাঘ শীতা লাফিয়ে পড়ল রাস্তার উপরে।

হরিণটাকে নামিয়ে রেখে জেন ধনুকে পূর্ণ জ্যা আরোপ করে তীর ছুঁড়ে দিল শীতার বুক লক্ষ্য করে। তীর বুকে বিঁধতেই যন্ত্রণায় ক্রোধে তীব্র আর্তনাদ করে শীতাও পাল্টা আক্রমণ করল।

আশ্রয় শিবিরে বসে সকলেই সে আর্তনাদ শুনল। তাদের মনে হল যেন মানুষের কণ্ঠস্বর।

আনেৎ বলল, মদিউ, ওটা যে নারী-কণ্ঠের আর্তনাদ!

 ব্রাউন শংকিত গলায় বলল, লেডি গ্রেস্টোক!

 ব্রাউন ছোট হাত-কুড়ালটা নিয়ে শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে চলল।

টিবস্ পকেট থেকে গুলিহীন পিস্তলটা বের করল। বলল, আমিও আপনাদের সঙ্গে যাব মিঃ ব্রাউন। মিলেডির কোন বিপদ ঘটতে আমরা দেব না।

যে দিক থেকে আর্তনাদটা এসেছিল ব্রাউন ও টিবস্ সেই দিকেই এগিয়ে চলল।

একটু এগিয়েই ব্রাউন জেনকে দেখতে পেল। একটা চিতাবাঘের মৃতদেহ থেকে তিনটের মধ্যে শেষ তীরটা টেনে বের করছে। একটু দূরেই পড়ে আছে একটা হরিণের ক্ষত-বিক্ষত দেহ।

জেন বলল, সবে এই হরিণটাকে মেরেছি, এমন সময় শীতা এসে সেটাকে নিয়ে পালাতে যাচ্ছিল।

যে আর্তনাদ শুনে আমরা এসেছি সেটা কর-আপনার, না ওর?

 শীতার। তেড়ে আসতেই ছুঁড়লাম তীর। সঙ্গে সঙ্গে চীৎকার!

কপালের ঘাম মুছে ব্রাউন বলল, কি জানেন মিস, আমার ইচ্ছা করছে আপনার সামনে টুপি খুলে দাঁড়াই।

তার চাইতে বরং হরিণটাকে শিবিরে নিয়ে চল। তাতে অনেক বেশি কাজ হবে।

খুব হৈ-চৈ করে হরিণের মাংস দিয়ে ভোজন-পর্ব শেষ হল। তখন টিবস্ বলল, যদি অভয় দেন মিলেডি তো একটা কথা শুধাই। এখান থেকে আবার সভ্য জগতে ফিরে যাব কেমন করে তা বলুন।

জেন বলল, এ নিয়ে আমিও অনেক রকম ভাবছি। কি জান, আমরা সকলেই যদি সুস্থ সবল থাকতাম তাহলে ঝর্ণাটার তীর বরাবর এগিয়ে হয়তো একটা বড় নদীতে পড়তাম এবং এক সময় হয় তো একটা আদিবাসী গ্রামও পেয়ে যেতাম। সেখানে খাওয়া জুটত, গাইড পাওয়া যেত। তারপর তাদের সাহায্যে একটা ইউরোপীয় উপনিবেশ খুঁজে পাওয়া খুব শক্ত হত না।

 চমৎকার ব্যবস্থা মিলেডি; চলুন, এখনই রওনা হই।

না; আগে একজন কি দু’জন বেরিয়ে গিয়ে ব্যবস্থা করবে; বাকিরা এই শিবিরেই থাকবে।

ব্রাউন শুধাল, কিন্তু কে যাবে? আমি আর টিস?

এই নিয়ে শুরু হল আর এক দফা তর্কাতর্কি, কথা কাটাকাটি। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল, জেন একাই যাবে সাহায্যের ব্যবস্থা করতে।

জঙ্গলের বুকে নেমে এল নিস্তব্ধ রাত।

এক সময় জেন উঠে পড়ল, আমি এবার শুতে চললাম। কাল সকালেই উঠতে হবে। শুভ রাত্রি।

জেন চলে গেলে হাতের ঘড়ি দেখে ব্রাউন বলল, নটা বাজে। টিবস্ তুমি মাঝ রাত পর্যন্ত পাহারা দিয়ে আমাকে ডেকে দিও, আমি তিনটে পর্যন্ত জাগব তারপর জাগবে আমাদের মহামান্য ডিউক সকাল পর্যন্ত।

সবরভ শিবিরের মুখেই বসেছিল। ব্রাউনকে দেখে বলল, তোমাদের সব কথা আমি শুনেছি। তিনটেয় আমাকে ডেকে দিও। তখন আমি পাহারায় থাকব। এখন শুতে চললাম।

মাঝ রাতে টিবস্ যখন তাকে জাগিয়ে দিল তখন মনে হল, সে একটুও ঘুমোয় নি।

কয়েক মিনিট পাহারা দেবার পরেই আনেৎ এসে তার পাশে বসল।

ব্রাউন বলল, আচ্ছ, এত ভোরে তুমি কি করতে এখানে এলে?

আনেৎ বলল, আধঘণ্টা আগে কিসে যেন আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল, আর ঘুম এল না। সেটা যে কি তা জানি না, কিন্তু আমি চমকে জেগে উঠলাম; শুধু মনে হল, কে যেন ঘরের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে। জানেন তো, দরজার পর্দাটা নামিয়ে দিলে ভিতরটা খুব অন্ধকার হয়ে যায়।

তাহলে নির্ঘাৎ তুমি স্বপ্ন দেখেছ গো মেয়ে, ব্রাউন বলল।

মেয়েটি বলল, হয় তো তাই হবে; কিন্তু একটা কোন অস্বাভাবিক শব্দেই আমার ঘুম ভেঙেছিল, কারণ আমার ঘুম খুব গাঢ়। তাছাড়া একটু পরেই আমি কারও গলাও শুনেছিলাম।

ব্রাউন বলল, তুমি বরং ঘরে গিয়ে আর একবার ঘুমোবার চেষ্টা কর গে।

সত্যি বলছি মিঃ ব্রাউন, এখানে আর ঘুম আসবে না। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে যে ঘরের মধ্যে একটা ভয়ংকর কিছু ঘটেছে; আমার খুব ভয় করছে। আপনার কাছে যদি একটু বসি তাতে আপনার কোন আপত্তি নেই তো মিঃ ব্রাউন?

আপত্তির কি আছে? এ দলে তুমি আর লেডি গ্রেস্টোকই তো একমাত্র মানুষ। আর সবই তো বাজে লোক।

একটু চুপ করে থেকে ব্রাউন বলল, কখনও যদি এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারি সে হঠাৎ থেমে গেল।

তাহলে কি? মেয়েটি প্রশ্ন করল।

ব্রাউন ইতস্তত করতে লাগল। ধুনিতে আর একটা কাঠ ফেলে দিয়ে বলল, ভাবছিলাম, এমনও তো হতে পারে যে তুমি আর আমি- মানে হতেও তো পারে

হ্যা; তারপর? মেয়েটি ঘন ঘন নিঃশ্বস ফেলতে লাগল।

 ধর, আমাকে যদি মিঃ ব্রাউন বলে আর ডাকতে না হয়।

তাহলে কি বলে ডাকব?

 বন্ধুরা আমাকে চি বলে ডাকে।

কী মজার নাম। এ রকম নাম আমি কখনও শুনিনি। এ নামের অর্থ কি?

 যে শহর থেকে আমি এসেছি এটা তারই সংক্ষেপ।

কোন শহর?

চিকাগো?

মেয়েটি হেসে উঠল, ওহো, আপনি তাহলে বানান করেন C-h-i-, S-h-i নয়। কি বলেন মিঃ ব্রাউন

 উঁহু। বল চি।

 বটে! আমার আসল নাম নীল।

খুব সুন্দর নাম।

আনেৎও সুন্দর। আনেৎ নামে তো আমি পাগল।

নামটা তোমার পছন্দ?

হ্যাঁ, আর মেয়েটিকেও-তাকে আমার খুব ভাল লাগে। ব্রাউন হাত বাড়িয়ে আনেকে কাছে টানল।

তিনটে বেজে যাবার অনেক পরে ব্রাউনের খেয়াল হল যে সবরভকে ডেকে দিতে হবে। প্রিন্স যখন আগুনের পাশে এসে বসল তখন তাকে কেমন যেন অস্বস্তিকর মনে হল।

ব্রাউন ও আনেৎ শিবিরের দিকে এগিয়ে গেল। আনেৎ কাঁপা গলায় বলল, ওখানে ফিরে যেতে মন চাইছে না।

ব্রাউন বলল, কোন ভয় নেই। আমি বরং একটা চোখ খোলা রেখেই ঘুমব। কিছু শুনতে পেলেই আমাকে ডেকো।

পাশের ঘরে একটা তীব্র আর্তনাদে ব্রাউনের যখন ঘুম ভেঙে গেল তখন দিনের আলো দেখা দিয়েছে।

টিবস বলল, ওটা কি? ব্রাউন ততক্ষণে মেয়েদের ঘরের দিকে ছুটছে। সে দেখল, সবরভ ধুনির পাশে দাঁড়িয়ে আছে; সকালের আলোয় তাকে কেমন যেন ছাই-ছাই দেখাচ্ছে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেয়েদের ঘরের দিকে।

দরজায়ই আনেতের সঙ্গে দেখা। সে চীৎকার করে বলল, ও নীল, কাল রাতে একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটে গেছে। কিটি সবরভ মারা গেছে; তার মাথার খুলিটা দু’ভাগ হয়ে গেছে।

জেন শুধাল, প্রিন্স কোথায়?

 তিনি তো পাহারায় ছিলেন। আমি যখন ভিতরে ঢুকি তখন তিনি আগুনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।

তাকে একটা খবর দিতে হবে, জেন বলল।

আমার তো মনে হয় তার কাছে এটা কোন খবর নয়, ব্রাউন বলল।

 জেন চোখ তুলল। সবিস্ময়ে বলল, না, তিনি এ কাজ করতে পারেন না।

তাহলে কে পারে? বিমান-চালকের প্রশ্ন।

 টিবস্ বলল, মিঃ লেডি যদি বলেন তো আমি হিজ হাইনেসকে খবর দিতে পারি।

তাই দাও টিবস্।

টিবসকে দেখে প্রিন্স বলল, ব্যাপার কি? আনেৎ হঠাৎ চীৎকার করল কেন?

হার হাইনেস-মানে তিনি-তিনি মারা গেছেন।

কি?-কে?- না, এ সম্ভব নয়। কাল রাতে যখন শুতে যায় তখনও সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল।

টিবস্ বলল, তাকে খুন করা হয়েছে ইয়োর হাইনেস। উঃ, কী ভয়ংকর!

খুন! বলে প্রিন্স সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। শিবির থেকে বেরিয়ে এল জেন ও ব্রাউন।

জেন বলল, কি ভয়ঙ্কর কাণ্ড এলেক্সিস। এ কাজ কে করেছে, কেন করেছে তা তো আমি ভেবেই পাচ্ছি না।

প্রিন্স শুধাল, কি দিয়ে তাকে খুন করা হয়েছে?

 জেনকে বিচলিত বোধ হল। বলল, তা–তা, নিশ্চয়ই একটি টাঙ্গি দিয়ে। সে টাঙ্গিটা কোথায় গেল?

সবরভ বলল, টাঙ্গিটা খুঁজে বার করুন, তাহলেই খুনিও ধরা পড়বে। তিনটে থেকে আমি এখানে পাহারায় আছি। এ কাজ যেই করে থাকুক টাঙ্গিটাকে লুকিয়ে ফেলেছে।

জেন বলল, ঠিক আছে তাহলে আপনারা পুরুষরা চলে যান মেয়েদের ঘরটা খুঁজতে; আমি আর আনেৎ খুঁজে দেখি পুরুষদের ঘর।

সবরভ বলল, ও ঘরে আমি যেতে পারব না।

খুঁজবার বিশেষ কিছু নেই। শুধু যে ঘাস-পাতা বিছিয়ে বিছানা তৈরি করা হয়েছে সেগুলো উল্টে পাল্টে দেখা।

জেন খুঁজল এলেক্সিসের বিছানা। এলেক্সিসের হাত পড়ল টিবসের বিছানায়। আর আনেৎ খুঁজতে লাগল ব্রাউনের বিছানা। ঘাসের তলায় শীতল ও শক্ত একটা কিছু আনেতের হাতে লাগল, আর আঙুলগুলো শক্ত হয়ে গেল। শিউরে উঠে সে হাত সরিয়ে নিল। মুহূর্তের জন্য কি যেন ভেবে উঠে দাঁড়াল। বলল, এখানে কিছু নেই।

সবরভ দ্রুত চোখ তুলে তার দিকে তাকাল। জেন বলল, এখানে কিছু নেই।

এলেক্সিস বলল, টিবসের বিছানাতেও কিছু পেলাম না। কিন্তু আনে, তুমি হয় তো ব্রাউনের বিছানাটা ভাল করে দেখ নি। আমি একবার দেখছি।

এক পা এগিয়ে আনেৎ বলল, কি হবে তাতে? ওখানে কিছু নেই; বৃথা সময় নষ্ট হবে।

তবু আমি একবার দেখব, এলেক্সিস বলল।

সবরভ নিচু হয়ে ঘাসের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিল। বেশি সময় লাগল না। বলে উঠল, এই তো পেয়েছি। তুমি যে কি খুঁজেছ আনেৎ তা তুমিই জান।

ঘাসের ভিতর থেকে টাঙ্গিটা বের করে প্রিন্স সকলের চোখের সামনে তুলে ধরল। টাঙ্গিটা রক্তমাখা।

 বলল, এবার সন্তুষ্ট হলেন তো জেন?

জেন বলল, ব্রাউনের বেলায় এটা আমি বিশ্বাস করতে পারি না।

দেখুন, এ কাজ কে করেছে তার যথেষ্ট প্রমাণ তো পেলেন। এবার বলুন, কি করবেন? লোকটাকে এখনই শেষ করে দেয়া উচিৎ।

ব্রাউন শক্ত গলায় বলল, কাকে শেষ করে দেয়া উচিৎ? সে আর টিবস্ তখন দরজায় দাঁড়িয়ে।

জেন বলল, টাঙ্গিটা তোমর বিছানার নিচে পাওয়া গেছে ব্রাউন। সেটা প্রিন্সের হাতেই তাছে। দেখতেই পাচ্ছ টাঙ্গিটা রক্তমাখা।

ওঃ, তাহলে তুমিই ওটাকে আমার বিছানার নিচে রেখে দিয়েছিলে, তই না ব্যাটা হতচ্ছাড়া বেঁটে বামন? আমাকে গাড়ায় ফেলার চেষ্টা?

সপ্রশ্ন চোখে ব্রাউন একে একে সকলের দিকেই তাকাল। তবে কি এরা বিশ্বাস করেছে যে আমি এ কাজ করেছি? সে বুঝতে পারছে, যত তুচ্ছই হোক প্রমাণটা তারই বিরুদ্ধে।

বলল, কিন্তু একথা মনেও এনো যে তোমরা আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাতে পারবে।

জঙ্গলের পথে চলতে চলতে এক জায়গায় টারজান ঘুমন্ত অবস্থায় ওঝা গুপিংগুর মেয়ে নৈকাকে দেখতে পেয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে হাজির হল বুকেনাদের গ্রামে।

নৈকা আনন্দে হাততালি দিতে লাগল। টারজান বলল, নৈকা, এবার তুমি নিরাপদ। নির্ভয়ে ফিরে যাও; সেখানে সকলকে বলল যে অরণ্যরাজ টারজান তাদের শত্রু নয়।

বলেই সে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু তার আগেই দুটি ছোট চোখের দৃষ্টিকে সে এড়াতে পারল না। নৈকা যখন আনন্দে চেঁচাতে চেঁচাতে গ্রামের ফটকের দিকে ছুটে গেল, তখনই ছোট্ট নকিমা ডালে-ডালে দোল খেতে খেতে এক সময় লাফিয়ে পড়ল তার মনিবের কাঁধে।

হঠাৎ টারজনের কানের কাছে কিচির-মিচির করতে করতে নকিমা তার কাঁধের উপর লাফাতে শুরু করল।

টারজান বলল, আমার কানের কাছে নকিমার এত দাপাদাপি কেন? কি হয়েছে?

নকিমা চেঁচিয়ে বলল, ওয়াজিরি! ওয়াজিরি!

টারজান চকিতে মুখ ফেরাল। ওয়াজিরি কি? তারা তো এখানে নেই।

নকিমা বলল, তারা ওখানে আছে। গোমাঙ্গানিদের গায়ে। তাদের হাত-পা দড়ি দিয়ে বেঁধেছে। যে ঘরে টারজানকে রেখেছিল তাদেরও সেখানেই রেখেছে। গোমাঙ্গানিরা তাদের মেরে খেয়ে ফেলবে।

টারজান চমকে উঠল। ফিফিস্ করে বলল, টারজান যাবে উদালোর গাঁয়ে।

দু’জন গ্রামের পিছন দিকে মাটিতে নামল। গ্রামবাসীরা সকলেই তখন ভিড় করেছে সর্দার উদালোর বাড়ির সামনের রাস্তায়। গ্রামের পিছনটা তাই অন্ধকার ও নির্জন।

এক লাফে বেড়া ডিঙিয়ে ছায়ার মত নিঃশব্দে দু’জন সর্দারের বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল।

সর্দারের কুটিরের পিছনে টারজান মাটিতে নামল।

যে ঘরে তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল দ্রুত সেখানে পৌঁছে ভিতরে ঢুকে পড়ল। নাকই তাকে বলে দিল ওয়াজিরিরা সেখানেই আছে। ফিফিসিয়ে বলল, চুপ। আমি টারজান। ওরা তোমাকে নিতে আসছে। আমি তোমাদের বাঁধন কেটে দিচ্ছি। ওরা আসামাত্রই ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের অস্ত্র কেড়ে নিতে হবে; মুখে কাপড় খুঁজে দিয়ে ওদের বেঁধে ফেলতে হবে, যাতে কুঁ শব্দটি না করতে পারে। তারপর টারজনের পিছন পিছন ওদের নিয়ে যাবে সর্দারের কুটিরের পিছনে।

কথা বলতে বলতেই সে নিজের কাজ শেষ করল। তিনটি বুকেনা সৈনিক যখন বন্দীদের নিয়ে যেতে ঘরে ঢুকল তখন ওয়াজিরিরা সকলেই মুক্ত; নিঃশব্দে তারা অপেক্ষা করে আছে।

স্বপ্নেও ভেবো না যে তোমরা আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে। ব্রাউনের কণ্ঠস্বরে একটা চ্যালেঞ্জের আভাষ।

জেন বলল, আমরা কাউকে ফাঁসিতে ঝোলাব না। আইনকে আমরা নিজেদের হাতে নিতে পারি না। যতদিন কোন উপযুক্ত আদালতে আমাদের দোষ বা নির্দোষিতা প্রমাণিত না হচ্ছে ততদিন আমরা সকলেই সমান সন্দেহভাজন।

টিবস্ বলল, আপনার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত মিলেডি।

বাধা দিল এলেক্সিস, কিন্তু আমি একমত নই। এই জনহীন পথে একজন খুনিকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলা মোটেই নিরাপদ নয়। তার বিরুদ্ধে সব সাক্ষীকে লোপাট করে দিতে সে অনায়াসে আমাদের সবাইকে খুন করতে পারে।

তাহলে আপনি কি করতে বলেন? জেন প্রশ্ন করল।

খুনিকে এখানে রেখে আমরা নিকটবর্তী থানায় গিয়ে সব ব্যাপারটা জানাই; তারপর তারা এসে অপরাধীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাক।

জেন মাথা নাড়ল। কিন্তু কে খুনি তা তো আমরা জানি না।

ব্রাউন বলল, আমি ওসবের মধ্যে নেই। এই সব বিদেশী বন্দরে বিচারের ঝুঁকি নিতে রাজী নই। নিঃসম্বল একজন মার্কিন একজন কোটিপতি প্রিন্সের বিরুদ্ধে যুঝবে কিসের জোরে? না মিস, ফাঁসির। দড়িতে গলা বাড়িয়ে দিতে আমি পারব না।

জেন সরাসরি প্রশ্ন করল, তাহলে তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে না ব্রাউন? সত্যি, তুমি বড় বোকা।

আমি বোকা হতে পারি মিস, কিন্তু কোন বিদেশী আদালতের ঝুঁকি আমি নেব না। একটা ইংরেজ আদালত হলে তবু কথা ছিল।

জেন বলল, আমাদের দলে লোক এত কম, আর আমাদের অস্ত্রপাতি এতই যৎসামান্য যে আমাদের একসঙ্গে চলাই উচিত।

বিমান-চালক বলল, আপনাদের বিপদের মুখে ফেলে আমি যাব না মিস; আনেৎ ও আপনি যতক্ষণ নিরাপদ না হচ্ছেন ততক্ষণ আমি আপনাদের সঙ্গেই থাকব।

আমি জানতাম তুমি থাকবে, কিন্তু এবার আমাদের আর একটা কর্তব্য পালন করতে হবে-বড়ই অপ্রীতিকর কর্তব্য। প্রিন্সেসকে সমাধিস্থ করতে হবে।

মৃতদেহকে কবরে শুইয়ে দেয়া হল। সকলে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। আনেৎ কেবলই কাঁদতে লাগল। দুঃখে বুক ফেটে গেলেও জেনের চোখে জল নেই। তার সামনে অনেক কর্তব্য; ব্যক্তিগত দুঃখে সময় কাটানো তার চলবে না।

সে বলল, সব তো হয়ে গেল, এবার শিবির ভেঙে দেয়া হোক; এখানে কেউ আর থাকতে চাইবে না।

আনেৎ রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অন্য সকলেই যার যার জিনিস পত্তর গুছিয়ে নিতে গেল।

ধুনির কয়লায় মাংস ঝলসাতে দগ্ধাবশেষ কয়লার মধ্যে একটা জিনিস তার নজরে পড়ল। ধুনির কিনারায় এক টুকরো পোড়া কাপড়–তাতে তিনটে বোতাম লাগানো। একটা লাঠি দিয়ে সে কাপড়টা উল্টে দিল। কাপড়ের যে দিকটা নিচে ছিল সে দিকটা পোড়ে নি-রং ও নক্সা ঠিক আছে।

কাপড়টা যেন পরিচিত মনে হল; চিন্তা করতে গিয়ে তার চোখ দুটো অর্ধেক বুজে এল।

ব্রাউন এসে হাজির হল। বলল, রান্নার বাকিটা আমি শেষ করছি, তুমি বরং ততক্ষণে তোমার জিনিসপত্তর গুছিয়ে নাওগে।

আনেৎ বলল, ঠিক আছে; তুমি বরং এটা একবার ভাল করে দেখো। হাতের লাঠি দিয়ে সে ধুনির পাশের কাপড়ের টুকরোটা দেখাল।

ব্রাউন টুকরোটা তুলে ভাল করে দেখল। তার পর প্রিন্স এলেক্সিস্ স্বরভের দিকে তাকিয়ে একটা শিস্ দিল। তাকে খুব খুশি দেখাচ্ছে।

সকলকে ডেকে বলল, আপনারা আসুন। সব তৈরি।

সকলে এসে আগুনের পাশে বসল। ধুনির পাশে গাছের পাতা পেতে ব্রাউন মাংসের টুকরোগুলো সাজিয়ে রেখেছে।

ব্রাউন বলল, সকলে আরও ঘন হয়ে বসুন।

এলেক্সিস্ মাংসের একটা টুকরোয় কামড় দিয়েই বলল, কী সাংঘাতিক! এর তো একটা দিক পুড়ে গেছে। আরেকটা দিক কাঁচাই আছে। এ রকম রান্না আমার পেটে সহ্য হবে না। আমি খাব না।

ব্রাউন বলল, তা খেতে হয় খান। কিন্তু গ্র্যান্ড ডিউককে আমি একটা প্রশ্ন করছি। দেখতেই পাচ্ছি তিনি কোটটা বদলেছেন। কাল রাতে খুব সুন্দর একটা কোট তিনি পরেছিলেন। ভাবসাব দেখ মনে হচ্ছে সেটা তিনি আর পরবেন না। তার কাছ থেকে আমি সেটা কিনে নিতে চাই।

এলেক্সিস্ দ্রুত চোখ তুলল, মুখটা ম্লান। বলল, পুরনো পোশাক আমি বিক্রি করি না। পরা শেষ হলে তোমাকে দান করে দেব।

ব্রাউন বলল, সে তো আপনার কৃপা। কোটটা একবার দেখতে পারি কি? গায়ে দিয়ে দেখতাম মাপে ঠিক হয় কি না।

এখন তো হবে না বাবা; অন্য সব জিনিসের সঙ্গে সেটাও প্যাক করা হয়ে গেছে।

সবটা? ব্রাউন প্রশ্ন করল।

 সবটা? কি বলছ? সবটা তো বটেই।

তাই বুঝি? কিন্তু একটা টুকরো প্যাক করতে যে ভুলে গেছেন মিস্টার। ব্রাউন তিন-বোতামওয়ালা অংশটা তুলে ধরল।

স্বরভের মুখটা ভূতের মত সাদা হয়ে গেল। দুই চোখ বড় বড় করে কাপড়ের টুকরোটাকে দেখতে লাগল।

বলল, এ যে দেখছি মার্কিনী তামাসার আর এক নমুনা। ও টুকরোটা আমার কোটের নয়।

ব্রাউন বলল, কাল রাতে যে কোটটা আপনি পরেছিলেন এটা হুবহু সেই রকম দেখতে। আনেতেরও তাই ধারণা। তবে টিবসের এটা চেনা উচিত; সে তো আপনার খানসামা। কি হে টিবস, এটা আগে। কখনও দেখেছ?

টিবস্ এগিয়ে এসে কাপড়ের টুকরোটা উল্টে পাল্টে দেখল; আঙ্গুল দিয়ে ছাইটা ঝেড়ে ফেলল।

শেষ কখন সেটা দেখেছ? ব্রাউন জোর গলায় প্রশ্ন করল।

 আমি-সত্যি-সভয়ে সে সুবরভের দিকে তাকাল।

প্রিন্স চীৎকার করে উঠল। তুমি মিথ্যেবাদী টিবস্। ও রকম কোট কোন কালে আমার ছিল না। কোন দিন চোখেও দেখি নি। বল, ওটা আমার নয়।

ব্রাউন বলল, টিবস্ কিছুই বলে নি। এটা যে আপনার কোটেরই টুকরো তাও বলে নি। কিন্তু এবার বলবে। কি বল টিবস্?

টিবস্ বলল, এটা সেইরকম দেখতে।

এলেক্সিসের মুখের উপর চোখ রেখে ব্রাউন বলল, মিসেসের মাথায় আঘাত করার সময় নিশ্চয় ফিকি দিয়ে রক্ত ছুটে কোটটাকে ভিজিয়ে দিয়েছিল।

এলেক্সিস্ আর্তকণ্ঠে বলল, খবরদার! ঈশ্বরের দোহাই, খবরদার। আমি বলছি, তার গায়ে আমি হাতও দেই নি।

ব্রাউন বলল, এ কথা জজকেই বলবেন। আনেৎ, তুমি এই সাক্ষীই দিও; জজ নিশ্চয় এটার কথাই জানতে চাইবেন।

ততক্ষণে এলেক্সিস্ আবার আত্মসংযম ফিরে পেয়েছে। তাড়াতাড়ি বলল, এটা আমার কোটই ছিল; আমার সামনের ভিতর থেকে কেউ চুরি করেছে।

জেন বলল, পুরো ব্যাপারটাই আদালতের হাতে ছেড়ে দেয়া হোক।

 ব্রাউন মাথা নেড়ে বলল, বরাবরের মত এবারও আপনার কথাই ঠিক মিস।

খুব ভাল কথা। সকলের খাওয়া শেষ হয়ে থাকলে এবার আমরা যাত্রা করব। আমাদের শিবিরের গায়ে আমি একটা চিরকুট লটকে রেখে এসেছি। তাতে এই দুর্ঘটনা, আমাদের গতিবিধি এবং দলের সকলের নাম লিখে দিয়েছি। যদি কখনও কোন শ্বেতকায় শিকারীর দল এই পথে আসে তাহলে তারা এ খবরটা বাইরে পৌঁছে দিতে পারবে। সকলে প্রস্তুত?

এলেক্সিস্ বলল, প্রস্তুত।

তিন বুকেনা সৈনিক হামাগুড়ি দিয়ে কুটিরে ঢুকতেই টারজান সর্বশেষ সৈনিকটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার কঠিন আঙুলগুলো সৈনিকটির গলায় ফাঁসের মত চেপে বসল। প্রায় একই সময়ে মুভিরো ও তার দলবল অপর দু’জন সৈনিককেও মাটিতে ফেলে দিল। মুহূর্তের মধ্যে মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে তিনজনেরই হাত-পা বেঁধে ফেলা হল।

সর্দারের কুটিরের সামনে রাস্তায় তখন মাতাল আদিবাসীদের জমায়েত চলছে। তাদের দৃষ্টিকে এড়িয়ে টারজান ও অন্য ওয়াজিরিরা মিলে তিন বুকেনা সৈনিককে কাঁধে করে নিয়ে গেল সেই কুটিরের এক কোণে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাছের কাছে। তাদের একজনকে কাঁধে নিয়েই টারজান গাছে উঠে গেল। ধীরে ধীরে তাদের তিনজনকেই সমবেত নিগ্রোদের ঠিক মাথার উপরকার একটা চওড়া ডালে আরও ঘন পাতার আড়ালে নিয়ে শুইয়ে দিল।

তারপর তাদের মধ্যে একজনের গোড়ালির বেড়ির সঙ্গে নিজের দড়িটা বেঁধে তার মুখ থেকে কাপড়ের টুকরোটা বের করে নিয়ে মাথাটা নিচের দিকে রেখে টারজান তাকে মাটির দিকে নামিয়ে দিল। লোকটির মাথা পাতার আড়াল ভেদ কের নিচের নিগ্রোদের দৃষ্টিগোচর হবার আগেই টারজান-এর গলা থেকে বেরিয়ে এল গোরিলার সতর্ক-ধ্বনি। সঙ্গে সঙ্গে নাচ-গান থেমে গেল; নিগ্রোরা সভয়ে ইতস্তত তাকাতে লাগল।

চারদিকে নিস্তব্ধ। মাথার উপরকার পাতার ফাঁকে দেখা দিল তাদেরই একজনের মুণ্ড; ধীরে ধীরে তার দেহটাও নেমে এল। এ ধরনের রহস্যময় অলৌকিক ঘটনা তাদের জীবনে এর আগে কখনও ঘটে নি।

উপর থেকে ভেসে এল একটা গভীর কণ্ঠস্বর। আমি অরণ্যরাজ টারজান। ফটক খুলে আমার ওয়াজিরি লোকদের নিরাপদে যেতে দাও, নইলে টারজনের হাতে তোমাদের অনেকে মারা পড়বে।

এতক্ষণে ঝুলন্ত নিগ্রোটির মুখে কথা ফুটল, ফটক খুলে দাও; ওদের যেতে দাও; নইলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।

নিগ্রোরা ইতস্তত করতে লাগল।

উদালো হুকুম দিল, ওয়াজিরিদের সব অস্ত্র এনে দাও; ফটক খুলে দাও; ওদের বেরিয়ে যেতে দাও।

টারজান বুকেনা সৈনিকটিকে টেনে তুলে তার সঙ্গীদের পাশেই শুইয়ে দিল।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক; তোমাদের কাউকে মারব না। এই কথা বলে মাটিতে নেমে টারজান ওয়াজিরিদের সঙ্গে যোগ দিল।

তারা নির্ভয়ে হেঁটে চলল। নিগ্রোরা সভয়ে তাদের জন্য পথ করে দিল।

 উদালো বলল, আমার সৈনিক তিনজন কোথায়?

টারজান উত্তরে জানাল, তোমাদের ঘরের উপরকার গাছের ডালে তাদের তিনজনকেই জীবিত অবস্থায় পাবে। সর্দারের আরও কাছে গিয়ে বলল, দেখ উদালো, কোন বিদেশী যখন তোমাদের গাঁয়ে আসে, তাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করো-বিশেষত টারজান ও ওয়াজিরিদের সঙ্গে। মুহূর্তের মধ্যেই তারা বেড়ার ওপারের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

ওঝা গুপিংগুর মেয়ে নৈকা হাততালি দিয়ে নাচতে নাচতে বলতে লাগল, এই তো সে! এই সাদা সৈনিকটিই তো আমাকে বাঁচিয়েছিল। সে যে দলবল নিয়ে চলে গেছে এতে আমি খুব খুশি হয়েছি।

পরদিন দুপুর। ওয়াজিরিরা শিবির ফেলেছে একটা নদীর ধারে। একটা গাছে হেলান দিয়ে টারজান কিছু তীর তৈরি করছে।

একসময় টারজান মাথাটা তুলে দক্ষিণ দিকে তাকাল। বলল, কে যেন আসছে।

অনেক দূরে লোকটিকে দেখা গেল। তার মাথায় ওয়াজিরিদের সাদা পালক উড়ছে; হাতে একটা লাঠি; তার একটা মাথা চিরে দু’ভাগ করে তার ফাঁকে একটা খাম বসানো হয়েছে।

লোকটি কাছে এসে খামটা টারজানকে দিল।

 খাম খুলে পড়তে পড়তে টারজনের মুখে মেঘ নেমে এল।

মুভিরো শুধাল, কোন খারাপ খবর কি বাওয়ানা?

টারজান বলল, মেমসাব একটা বিমানে লন্ডন থেকে নাইরোবী যাত্রা করেছে; আর ঠিক সেই বড় ঝড়টার আগে। তোমার মনে আছে মুভিরো, ঝড়ের ঠিক পরে একটা উড়োজাহাজ আমাদের মাথার উপরে পাক খাচ্ছিল? আমরা তখনই ভেবেছিলাম যে জাহাজটা খুব বিপদে পড়েছে। হয় তো সেই। জাহাজেই মেমসাব ছিল।

মুভিরো বলল, একটু পরেই জাহাজটা চলে গেল। হয় তো সেটা নাইরোবী চলে গেছে।

টারজান বলল, তা হতে পারে। তবে ঝড়টা ছিল খুবই খারাপ, আর পাইলটও পথ হারিয়ে ফেলেছিল। কোন বিপদে পড়েই সে একটা নামবার মত জায়গা খুঁজছিল; নইলে ওভাবে পাক খেয়ে ঘুরত না।

মুভিরো প্রশ্ন করল, তুমি কি এখনই নাইরোবী ফিরে যাবে বাওয়ানা?

 তাতে লাভ কি হবে? টারজান উত্তর দিল।

মুভিরো শুধাল, আমরা কি তাহলে আমার মেয়ে বুইরার খোঁজেই চলতে থাকব?

টারজান বলল, হ্যাঁ। সকলেই খুব ক্লান্ত।

চলতে চলতে বেলা পড়ে এল। টিস, এলেক্সিস ও আনেৎ খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তাই একটা সুবিধামত জায়গায় পৌঁছে জেন সকলকে থামতে বলল রাতের মত। একটা ধুনি জ্বালিয়ে সকলে পালা করে পাহারা দেয়ার ব্যবস্থা করল। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখা গেল কেউ পাহারায় নেই। আনেও চলে গেছে।

আনেৎ শিবিরে নেই। অভিযাত্রীরা সকলেই কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেল।

জেন বলল, তার কি হতে পারে? আমি জানি সে জঙ্গলে বেড়াতে যায় নি। জঙ্গলকে সে ভয় করে।

ব্রাউন ধীরে ধীরে স্বরভের দিকে এগিয়ে চলল। তার মনে খুন চেপেছে; চোখে তারই স্ফুলিঙ্গ-দীপ্ত। বলল, আপনিই জানেন সে কোথায়। বলুন, তাকে কি করেছেন?

দুই হাত তুলে পিছনে সরে গিয়ে সবরভ বলল, আমি কিছু জানি না। আমি তো ঘুমিয়ে ছিলাম।

ব্রাউন বলল, আপনি মিথ্যেবাদী।

সবরভ চেঁচিয়ে বলল, দূরে সরে যাও। জেন, ওকে আর এগোতে দিও না; ও আমাকে মেরে ফেলবে।

ব্রাউন হুংকার দিয়ে উঠল, ঠিক বলেছেন; আমি আপনাকে খুন করব।

সবরভ মুখ ঘুরিয়ে দৌড়াতে শুরু করল।

ব্রাউন এক লাফে তার পিছু নিল। ডজন খানেক পা ফেলেই ভয়ার্ত লোকটিকে ধরে ফেলল। তার কাঁধ চেপে ধরল। বেপরোয়া হয়ে সবরভও আঁচড়ে-কামড়ে, ঘুষি মেরে তাকে বাধা দিতে লাগল। কিন্তু মার্কিনীটি তাকে মাটিতে ফেলে তার গলা চেপে ধরল।

বলল, কোথায় সে? বলুন, কোথায় সে?

 সবরভ ঢোক গিলে বলল, আমি জানি না। ঈশ্বরের নামে বলছি, আমি জানি না।

তাহলে মরুন। ব্রাউনের শক্ত মুঠি আরও চেপে বসল।

 যে ঘটনাটা বলতে এত সময় লাগল সেটা কিন্তু ঘটে গেল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই।

জেনও চুপ করে নেই। যে মুহূর্তে সে বুঝতে পারল যে ব্রাউন সবরভকে খুন করতে চাইছে, তখনই বর্শাটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল। বর্শার তীক্ষ্ণ মুখটা ব্রাউনের বাঁদিকে পাঁজরের উপর বসিয়ে বলল, ওকে ছেড়ে দাও ব্রাউন, নইলে এই বর্শা আমি তোমার হৃৎপিণ্ডে ঢুকিয়ে দেব।

ধীরে ধীরে ব্রাউনের মুঠি আলগা হয়ে গেল। সবরভকে ছেড়ে সে উঠে দাঁড়াল। বলল, আপনি ঠিক কথাই বলেছেন মিস। আপনার বিচার সব সময়ই সঠিক। কিন্তু বেচারী আনেৎ-এই ইঁদুরটা সম্পর্কে কাল রাতে সে আমাকে যা বলেছিল তাতেই আমার মাথায় খুন চেপে গিয়েছিল।

সে কি বলেছিল? জেন শুধাল।

ওই লোকটা কাল রাতে আনেতের কাছ থেকে সেই পোড়া কাপড়ের টুকরোটা কেড়ে নিতে চেষ্টা করেছিল; তারপর তাকে ভয় দেখিয়ে বলেছিল যে এ কথা কাউকে বললে তাকে খুন করবে। কাল যে আনেৎ চীৎকার করেছিল সেটা ওকে দেখে। সে বেচারি ওকে ভীষণ ভয় করত মিস।

এলেক্সিসের পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভয়ে কাঁপছে। কোন রকমে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, না। আমি শুধু কাপড়টা চেয়েছিলাম। সেটা আমার কিনা তাই দেখতে, আর অপনি আমাকে বিপদে ফেলার জন্যই ও চেঁচিয়ে উঠল।

জেন বলল, দেখুন, এভাবে কিছুই বোঝা যাবে না। আপনারা সকলেই যে যেখানে আছেন থাকুন, আমি একবার চারদিকে ঘুরে পায়ের ছাপগুলো দেখে আসি। সকলে ঘোরাঘুরি শুরু করলে কোন ছাপ। থাকলেও তা চাপা পড়ে যাবে।

জেন মুহূর্তকাল দাঁড়াল। প্রথমে পায়ের ছাপের দিকে তাকিয়ে পরে মাথার উপরকার গাছের ডালের দিকে তাকাল। হঠাৎ লাফিয়ে উঠে একটা ডাল ধরে ঝুলে সেই গাছে চড়ে বসল।

ব্রাউন ছুটে এসে শুধাল, কিছু কি দেখতে পেলেন মিস?

জেন উত্তর দিল, একটা মানুষ তো হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না। আনেৎ পায়ে হেঁটে এই গাছের নিচ পর্যন্ত এসেছে; এখানেই তার পায়ের ছাপ শেষ হয়েছে; অথচ সে শিবিরেও ফিরে যায় নি। তাহলে একটিমাত্র স্থানেই সে যেতে পারে, আর সেটা হচ্ছে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি।

ব্রাউন বাধা দিয়ে বলল, কিন্তু সে তো আপনার মত লাফিয়ে ওখানেই উঠতে পারে নি; সেটা তার পক্ষে সম্ভবই নয়।

জেন বলল, সে লাফ দিয়ে ওঠে নি। তা করলে পায়ের ছাপ দেখেই বোঝা যেত। তাকে উপরে তুলে আনা হয়েছিল।

উপরে তুলে নিয়েছে! হায় ভগবান! কে তুলে নিয়েছে? ব্রাউনের গলা আবেগে কাঁপছে।

 নিঃশব্দে কিছু মুখে দিয়ে সকলে আবার সেই ব্যর্থ অভিযানে পা বাড়াল। কারও মুখে কথা নেই।

সেদিন রাতের জন্য আবার তারা নদীর ধারে যাত্রাবিরতি ঘটাল। সঙ্গে সঙ্গে সবরভ ও টিবস মাটির উপর ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দিল। জেন ও ব্রাউন শিকারে বের হল রাতের খাবারের সন্ধানে।

সন্ধ্যা নাগাদ জেন ও ব্রাউন ফিরে এল একটা ছোট হরিণ মেরে। টিবস্ সেটাকে কেটে-কুটে আগুনে ঝলসাতে শুরু করে দিল। অন্যরা চুপচাপ বসে অপেক্ষা করতে লাগল।

সকলেই অল্পস্বল্প পেটে দিয়ে আগুনের পাশে শুয়ে পড়ল। জেগে রইল কেবল টিবস্। স্থির হল, পুরুষরাই একের পর এক রাত জেগে পাহারা দেবে।

ভোর চারটের সময় পাহারার দ্বিতীয় পালা শেষ করে টিবস্ ডেকে দিল এলেক্সিসকে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে সবরভ ধুনিতে আরও কাঠ চাপিয়ে দিল। তারপর সেদিকে পিছন ফিরে রাতের অন্ধকারে চোখ রাখল।

ভয় পেয়ে জঙ্গলের দিকে মুখ ফিরিয়ে সে ঘুমন্ত সঙ্গীদের দিকে দৃষ্টি ফেরাল। ব্রাউনের পাশে রাখা হাত-কুড়ালটার দিকে নজর পড়ল। সেখান থেকে দৃষ্টি সরে গেল জেনের উপর। কি অপরূপ সুন্দরী।

হঠাৎ এলেক্সিসের মনে হল, এই লোকটা যদি মারা যেত তাহলে তার নিজের জীবন নিরাপদ হত-তার আর জেনের মাঝখানে দাঁড়াবার কেউ থাকত না।

উঠে পায়চারি করতে করতে সে বারে বারে ব্রাউন ও তার কুড়ালটার দিকে তাকাতে লাগল।

টিবসের কাছে গিয়ে কান পাতল। লোকটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। জেন ঘুমিয়ে পড়েছে। ব্রাউনও।

ব্রাউন যদি মারা যেত। হঠাৎ একটা সংকল্প স্বরভের মনের মধ্যে শানিত হয়ে উঠল। চুপি চুপি এগিয়ে গেল ঘুমন্ত ব্রাউনের দিকে। তারপর এক হাঁটুতে ভর দিয়ে বসল। খুব সাবধানে তার একটা হাত এগিয়ে গেল কুড়ালটার দিকে।

হঠাৎ টিবসের ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ মেলে তাকাতেই দেখল, উদ্যত কুড়াল হাতে সবরভ ব্রাউনের উপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। চীৎকার করে সে লাফিয়ে উঠল। মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করে সবরভ টিবসের দিকে চোখ ফেরাল। আর তাতেই ব্রাউনের জীবন রক্ষা পেল।

টিবসের চীৎকার শুনে জেনও লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ব্রাউন মনস্থির করার আগেই সবরভ কুড়ালটা তুলে নিয়ে জঙ্গলের দিকে দৌড় দিল।

ব্রাউন তার পিছু নিতেই জেন বাধা দিয়ে বলল, ওর পিছু নিও না। কি লাভ হবে? এমনিতেই তো ওর হাত থেকে রেহাই পেয়ে গেলাম; ও আর ফিরে আসার সাহস পাবে না। বরং তুমি ওর পিছু নিলে আমরা সংখ্যায় কমে যাব।

ব্রাউন ঘুরে দাঁড়াল। হয়তো আপনার কথাই ঠিক। কিন্তু মৃত্যুই ওর পাওনা ছিল।

এই জঙ্গলে একলা থাকলে সেটা ও এমনিতেই পাবে। জেন যেন ভবিষ্যদ্বাণী করল।

তিনজন আবার পূর্ব দিকে যাত্রা শুরু করল। ঠিক সেই সময় সামান্য দূরের একটা গাছের পাতার আড়াল থেকে একজোড়া চোখ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে; দুটি মিটমিটে শয়তানী চোখ দুটি পুরুষের উপর থাকলেও তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে জেনের উপর।

ব্রাউন চলেছে সকলের আগে। তার পিছনে টিবস্। তারপর চলেছে জেন। গাছের উপর থেকে নিঃশব্দে তাদের অনুসরণ করে চলেছে একটি ক্লান্তিহীন যাত্রী।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রাউন থামল। বলল, রাতের যাত্রাবিরতির পক্ষে এই জায়গাটাই বেশ ভাল মনে হচ্ছে।

ইংরেজটি টলতে টতে কোনরকমে মাটিতে এলিয়ে পড়ল। বলল, বড় ক্লান্ত!

ব্রাউন হেসে বলল, আমার অবস্থা কিন্তু অতটা শোচনীয় নয়। আরে তিনি কোথায়?

পিছনে তাকিয়ে টিবস্ বলল, তিনি তো আমার ঠিক পিছনেই আসছিলেন। এক সেকেন্ডের মধ্যেই এসে পড়বেন।

ব্রাউন যেন ভয় পেল। বলল, তার তো এতটা পিছিয়ে পড়ার কথা নয়। হাই, আপনি কোথায়! লেডি গ্রেস্টোক!

কোন সাড়া নেই। দু’জনেই সাগ্রহে পিছনের দিকে তাকাল। টিবস্ কোনরকমে উঠে দাঁড়াল। ব্রাউন আবার ডাকল। টিবস্ ব্রাউনের মুখের দিকে তাকাল। ভয়ে বিবর্ণ।

ব্রাউন পিছনের পথ ধরে দৌড়তে শুরু করল। টিবস্ টলতে টলতে দৌড়তে লাগল। ব্রাউন মাঝে মাঝে থামছে আর জেনের নাম ধরে ডাকছে। কিন্তু কোন সাড়া নেই। ক্রমে রাতের আঁধার তাদের ঘিরে ধরল।

আতংকের মধ্যে নকিমার রাতটা কাটল। নকিমা ডালে ডালে লাফিয়ে টারজান ও ওয়াজিরিদের খোঁজে এগিয়ে চলেছে। ছোট একটা লাঠি তার হাতে; লাঠির মাথায় উড়ছে কাগজের একটা টুকরো।

কিছুদূর যেতেই মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। তার বুকের ভিতরটা টিপ্ টিপ্ করে উঠল। শব্দ লক্ষ্য করে ছুটতে লাগল। সে জানে এ কণ্ঠস্বর টারজনের।

সত্যি তাই। গাছের উঁচু ডাল থেকে নেমে এল বন্ধুর কাঁধে। এক হাতে জড়িয়ে ধরল টারজনের গলা; অপর হাতের লাঠির ডগায় উড়ন্ত কাগজের টুকরোটা এসে গেল সোজা টারজনের চোখের সামনে। লেখাগুলোর উপর দৃষ্টি পড়তেই সে হাতের খেলা সে চিনতে পারল। এ যে অবিশ্বাস্য; ছোট্ট নকিমার হাতে জেনের হাতের লেখা চিঠি- এ কথা কল্পনা করাও যে ভয়ঙ্কর।

লাঠির মাথা থেকে টারজান চিঠিটা খুলে নিয়ে পড়তে লাগল।

 মুভিরো বলল, নকিমা কি কোন খারাপ খবর এনেছে বাওয়ানা?

লেডি গ্রেস্টোকের চিঠি। একদল বন্ধুসহ সে বিমানসহ নামতে বাধ্য হয়েছে। কোন এক স্থানে তারা হারিয়ে গেছে। সঙ্গে না আছে খাবার, না আছে অস্ত্রশস্ত্র।

নকিমার দিকে ফিরে টারজান আবার বলল, এ চিঠি তোমাকে কে দিল?

কেউ এটা নকিমাকে দেয় নি। একটা ঝুপড়ির মধ্যে নকিমা এটা পেয়েছে।

 টারজান বলল, সেটা কোথায়? মনে করতে চেষ্টা কর। আমাকে সেখানে নিয়ে চল।

অনেক-অনেক পথ ঘুরতে ঘুরতে দু’জন এগিয়ে চলল। সব পরিশ্রম এক সময় সার্থক হল-গাছ গাছালির ভিতর দিয়ে নকিমা তাকে সেই আস্তানায় নিয়ে গেল যেখানে পথহারা বিমানযাত্রীরা আশ্রয় নিয়েছিল।

এখানে টারজান এমন সব অভ্রান্ত প্রমাণ পেল যাতে পরিষ্কার বোঝা গেল যে সেই মন্দভাগ্য যাত্রীদলের মধ্যে জেনও ছিল; নতুন আশায় উজ্জীবিত হয়ে গাছের ডালে ডালে সেই অজ্ঞাত দেশের। উদ্দেশ্যে সে যাত্রা করল যা তার জীবন-সঙ্গিনীকে গ্রাস করেছে।

সেদিন অপরাহ্নে টিবস্ ও ব্রাউনকে অনুসরণ করে গাছের ডালে ডালে ঝুলতে ঝুলতে জেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। আর সেই ফাঁকে যে লোকটি জেনকে অনুসরণ করছিল, এবার জেনকে কাঁধে করে গাছ-পালার ভিতর দিয়ে পূর্ব দিকে এগিয়ে চলল।

ধীরে ধীরে স্বরাচ্ছন্ন ভাবটা কাটিয়ে জেন জেগে উঠল। বুঝতে পারল নিজের ভয়াবহ অবস্থার কথা।

জেন ইংরেজিতে শুধাল, তুমি কে?

লোকটি ঠোঁট বাঁকাল; বালু বুলিতে বলল, বুঝতে পারছি না।

জেন বান্টু বুলি জানে। সে তাই সোৎসাহে বলে উঠল, কিন্তু আমি তোমার কথা বুঝি। এবার বল তুমি কে, আর আমাকে কেনই বা এনেছ। আমি তোমাদের শত্রু নই; কিন্তু তুমি যদি আমাকে আটকে রাখ বা আমার ক্ষতি কর তাহলে আমার লোকরা এসে তোমাদের গ্রামকে ধ্বংস করে ফেলবে, তোমাদের অনেককে মেরে ফেলবে।

তোমার লোকরা আসবে না। কাভুরুদের গায়ে কেউ আসে না। কেউ এলেই তার জান চলে যায়।

আমাকে নিয়ে কি করবে?

কাবান্দাবান্দার কাছে নিয়ে যাব।

জেন কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। পরে বলল, আমাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে দাও না। তাতে তোমারও সুবিধা। গাছের ভিতর দিয়ে চলার অভ্যাস আমার আছে।

একটু ইতস্তত করে লোকটি জেনকে নামিয়ে দিয়ে বলল, পালাবার চেষ্টা করো না। চেষ্টা করলেই মরবে।

হাত-পাগুলো ভাল করে টান-টান করে জেন লোকটিকে ভাল করে দেখল। আদিম অসভ্য মানুষের মতই দেখতে।

শুধাল, তোমার নাম কি?

ওগলি, সে জবাব দিল।

তুমিই নিশ্চয় সর্দার?

 আমি সর্দার নই। মাত্র একজনই সর্দার। সে কাবান্দাবান্দা।

পরদিন দুপুর নাগাদ বনের পথ শেষ হয়ে গেল। সামনেই খোলা মাঠ। সম্মুখে একটা সুউচ্চ পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত। পাহাড়ের গায়ে অনেকটা জায়গা পাথরের বেড়া দিয়ে শক্ত করে ঘেরা। খোলা জায়গাটাতে বড় বড় পাথরের চাই ইতস্তত ছড়ানো। তার ভিতর দিয়ে বয়ে চলেছে অনেকগুলো ঝর্ণা।

ওগলি চেঁচিয়ে ডাকতেই পাথরের দেয়ালের গায়ে দুটো বড় ফটক সামান্য খুলে গিয়ে তাদের দু’জনকে ভিতরে ঢুকতে দিল। সংকীর্ণ রাস্তার দু’পাশে ছোট ছোট পাথরের বাড়ি।

চৌমাথায় পৌঁছে ওগলি জেনকে নিয়ে একটা গলি ধরে নিচু, বৃত্তাকার একটা বাড়িতে পৌঁছে গেল। বাড়িটার কোন জানালা নেই; আছে শুধু ছাদে উঠবার একটা কাঠের মই। তাহলে এটা নিশ্চয় একটা কিভা-মন্দিরের মৃত্যু-কুঠুরি।

ওগলি বিরক্ত গলায় জেনকে মই বেয়ে উঠতে বলল। ছাদে পোঁছে বাড়িটার এমন সব লক্ষণ জেনের চোখে পড়ল যাতে এটা একটা কিভা সে বিষয়ে কোন সন্দেহ রইল না-ছাদের উপর একটা ছোট চতুষ্কোণ মুখের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে আর একটা মইয়ের প্রথম ধাপ।

সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে ওগলি হুকুম করল, নিচে নেমে যাও। সেখানেই তুমি থাকবে। পালাবার চেষ্টা করো না। তাতে আরও খারাপ হবে।

জেন নিচের দিকে তাকাল। কিছুই চোখে পড়ল না-শুধুই একটা অন্ধকার গহ্বর।

 জলদি! ওগলি ধমক দিল।

মইয়ের প্রথম ধাপে পা রেখে জেন ধীরে ধীরে নামতে লাগল সেই রহস্যময় অন্ধকার মহাশূন্যতার মধ্যে। তার মনে তখন একটিমাত্র চিন্তা ও কাভুরুদের গ্রামে কোন নারীকে সে দেখে নি। এই যোদ্ধারা যে সব মেয়েকে হরণ করেছে তাদের কি হয়েছে? তারাও কি নেমে গেছে এই অন্ধকার অতল গহ্বরে?

ওয়াজিরিদের নিয়ে মুভিরো বনের শেষ প্রান্তে হাজির হল। তাদের সামনে পাহাড়ের সানুদেশে একটি খোলা প্রান্তর।

একজন ওয়াজিরি আঙুল বাড়িয়ে বলল, উঁচু পাহাড়ের কোলে একটা গ্রাম দেখতে পাচ্ছি।

ভুরুর উপর হাত রেখে মুভিরো মাথা নেড়ে বলল, ওটা নিশ্চয় কাভুরুদের গ্রাম। শেষ পর্যন্ত তাহলে খুঁজে পেলাম। বুইরাকে আমরা হয়তো পাব না, কিন্তু কাভুরুদের এমন শিক্ষা দিয়ে যাব যে আর কোনদিন ওয়াজিরি মেয়েদের গায়ে তারা হাত তুলবে না।

এগিয়ে চল, বলে মুভিরো সদলে কাভুরুদের গ্রামের দিকে অগ্রসর হল। হঠাৎ সে থামল। বলল, ওটা কি?

ওয়াজিরিরা কান পাতল। একটা অস্পষ্ট একটানা শব্দ ক্রমেই উচ্চ হতে উচ্চতর হতে লাগল। সৈনিকরা নিঃশব্দে আকাশের দিকে তাকাল।

একজন বলল, ঐ তো সেই জিনিস। একটা উড়ন্ত নৌকা। ওয়াজিরিদের দেশের উপর দিয়ে আগেও আমি একটাকে উড়ে যেত দেখেছি। সেই একই শব্দ।

একটু পরেই উড়োজাহাজটা দৃষ্টিগোচর হল। তিন-চার হাজার ফুট উপরে সেটা পাক খেতে লাগল। ক্রমে মাটি থেকে শ’ খানেক ফুট উপরে নেমে এল। কিন্তু তখনও পাক খেতে খেতে ঘুরতে লাগল। বিমান চালক নামবার মত একটা জায়গা খুঁজছে। দু’ঘণ্টা ধরে সেই ব্যর্থ চেষ্টাই করে চলেছে।

অতটা নিচে নেমে আসার দরুণ চালক ওয়াজিরিদের দেখতে পেল। মাথায় সাদা পালক গোঁজা লোকগুলো বন থেকে বেরিয়ে আসছে। ওদিকে আদিবাসীরা বেরিয়ে আসছে তাদের গ্রাম থেকে। চেহারায় ও পোশাকে দুই দলের মধ্যে বিস্ময়কর পার্থক্য। সে বিমানটাকে আরও নিচে নামিয়ে আনল।

কক-পিট থেকে তার সঙ্গী একটা চিরকুট লিখে তাকে দিল, ওরা কারা? আমার তো সাদা মানুষ বলে মনে হচ্ছে।

চালক লিখল, ওরা সাদা মানুষই বটে।

সমস্ত প্রান্তর জুড়ে ইতস্তত ছড়ানো বড় বড় পাথরের চাঁই ও ঝর্ণা থাকার জন্য নিরাপদে নামবার মত জায়গা পাওয়াই ভার। তারই মধ্যে দুটো মাত্র জায়গা অপেক্ষাকৃত ভাল- একটা গ্রামের ঠিক সামনে, আর অপরটি বনের কাছাকাছি। সেখানে ওয়াজিরিরা হাজির হয়েছে দেখে চালক স্থির করল গ্রামের কাছে সাদা মানুষদের পাশেই নামবে। কী মারাত্মক ভুল!

মুভিরো সদলে এগিয়ে চলেছে গ্রামের দিকে। তখন দেখতে পেল, দু’জন আরোহী কক-পিট থেকে নামছে, আর কাভুরু গ্রামের খোলা ফটক দিয়ে বেরিয়ে আসছে অসভ্য সাদা যোদ্ধার দল।

মুভিরো দেখেই বুঝতে পারল, ওরা শত্রুপক্ষ। সে বুঝতে পেরেছে যে ওরাই কাভুরু। বর্শা উঁচিয়ে চীৎকার করতে করতে ওরা ছুটে যাচ্ছে দুই বিমানযাত্রীকে লক্ষ্য করে। যতদূর মনে হয়, ওয়াজিরিদের উপস্থিতিটা ওরা তখনও টের পায়নি।

নিচু গলায় সঙ্গীদের কি সব বলে মুভিরো সদলবলে এগোতে লাগল। তারা মাত্র দশজন; কাভুরুরা। সংখ্যায় অনেক বেশি, প্রতি একজনে দশজন; তবু তারা সাহস হারায় নি।

বিমানযাত্রীরা যখন বুঝতে পারল, যে আদিবাসীরা তাদের আক্রমণ করতে আসছে, তখন তারাও বিমানের দিকে ফিরে চলল। একজন কাভুরুদের মাথার উপর দিয়ে একটা গুলি ছুঁড়ল; তাতেও কাভুরুরা থামল না দেখে আবার গুলি ছুঁড়ল; এবার একজন কাভুরু মাটিতে পড়ে গেল। তবু তারা এগোতেই লাগল।

এবার দুই বিমানযাত্রীই গুলি ছুঁড়তে লাগল কিন্তু কাভুরুরা থামল না। অচিরেই তারা দুজন শত্রুর বর্শার আওতার মধ্যে যাবে। একটা সাময়িক আশ্রয়ের আশায় দু’জনই পিছন ফিরে তাকাল; কিন্তু যা দেখল তাতে তারা প্রমাদ গুণল- একদল কালো সৈনিক সার বেঁধে নিঃশব্দে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।

কিন্তু ক্ষতি যা হবার তা ততক্ষণে হয়ে গেছে- ওয়াজিরিরা এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেবার আগেই কাভুরুরা তাদের আরও কাছে এসে পড়ল। দু’জনের পিস্তলের গুলিতে কাভুরুদের আরও কয়েকজন ধরাশায়ী হল। তবু এগোতে লাগল। এক সময় কাভুরু ও ওয়াজিরি দুই দলই তাদের কাছে এসে পড়ল।

কাভুরুদের হাতের বর্শা উড়তে লাগল। বুকে বর্শা বিধে নবাগতদের একজন পড়ে গেল। এবার বর্শা। ছুঁড়তে লাগল ওয়াজিরিরা। সাময়িকভাবে কাভুরুদের গতিরোধ করা গেল।

কিন্তু সে তো মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণেই আবার তারা বর্শা ছুঁড়তে লাগল। এবার দ্বিতীয় বিমানযাত্রীও পড়ে গেল। সেই সঙ্গে পড়ল তিনজন ওয়াজিরি তারপরেই কাভুরু ও ওয়াজিরিদের মধ্যে শুরু হয়ে গেল হাতাহাতি যুদ্ধ।

ওয়াজিরিরা এখন সংখ্যায় সাত। সাহসে ভর করে তারা যুদ্ধ করছে। কিন্তু সংখ্যার অনেক বেশি কাভুরুদের সঙ্গে তারা এঁটে উঠতে পারবে কেন? যুদ্ধ চালাতে চালাতেই মুভিরো ও তার অন্যতম সঙ্গী বালান্দো মৃত বিমানযাত্রীদের পিস্তল ও গুলি হাতিয়ে নিল। এবার মুখোমুখি যুদ্ধে পিস্তলের পাল্লাই ভারি হয়ে উঠল; কাভুরুরা হকচকিয়ে গেল; সেই সুযোগে মুভিরো ও তার দলের লোকেরা একটা আশ্রয় খুঁজে নেবার মত সময় পেয়ে গেল। এখন তারা দলে মাত্র চারজন-মুভিরো, বালান্দো ও আর দু’জন।

মুভিরো একটা উঁচু এ্যানিট পাথরের উপর উঠে গেল; তার একমাত্র সঙ্গী বালালো। মুভিরো গুলি চালিয়ে কাভুরুদের আটকাতে লাগল। আর সেই সুযোগে বালান্দো উঠে গেল একেবারে চূড়োয়। তারপর সে গুলি চালাতে লাগল, আর মুভিরো পাহাড় বেয়ে উঠে গেল তার পাশে।

ফলে কাভুরুরা রণে ভঙ্গ দিয়ে গ্রামের দিকে ফিরে গেল। গোধূলির আলোয় মুভিরো স্পষ্ট দেখতে পেল, তারা সকলেই সার বেঁধে গ্রামের ফটক দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল।

দুঃখিত মনে মুভিরো ও বালান্দো পাহাড়ের আশ্রয় থেকে নিচে নেমে এল। এবার রাতের মত একটা আশ্রয় দরকার।

গাছে উঠে চলতে চলতে হঠাৎ একটা গন্ধ এসে টারজনের নাকে লাগল। যে দিক থেকে গায়ের গন্ধ আসছিল টারজান সেই দিকেই দ্রুত এগোতে লাগল। নাকই তাকে বলে দিল এ গন্ধ দুটি সাদা পুরুষের। একটি নারীর দেহ-গন্ধের আশায় বৃথাই সে শ্বাস টানতে লাগল।

টারজান এবার গতি কমিয়ে দিল। এগোতে লাগল নিঃশব্দে। অবশেষে দেখতে পেল, দুটি মানুষ ক্লান্ত পদক্ষেপে তার নিচেকার পথ ধরেই চলেছে।

এক সময় দু’জনই বসে পড়ল। উপরে ঘাপটি মেরে বসে টারজান তাদের সব কথাই শুনতে পেল। কোন কথাই বাদ গেল না।

টিবস্ বলল, মিঃ এবুলমিস আনেৎকে তুলে নিয়ে চলে গেল, অথচ আনেৎ চীৎকার করল না, এটা তো হতে পারে না।

ব্রাউন বলল, আনেৎ হয় তো ভয়ে চীৎকার করে নি। লোকটাকে সে ভীষণ ভয় করত।

লেডি গ্রেস্টোক তো তাকে ভয় করত না। তাহলে সে কেন সাহায্যের জন্য কাউকে ডাকল না?

টিবস বলল, তোমার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। লেডি গ্রেস্টোক একটি অসাধারণ মহিলা। আমি তো এখনও আশা রাখি তাকে খুঁজে পাব।

কিন্তু আনেতের কি হল? সে কথা যদি কেউ বলতে পারত।

 টারজান তখন নিঃশব্দে গাছ থেকে নেমে তাদের দু’জনের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।

সে বলল, আমি বলতে পারি।

 তার গলা শুনে দু’জনই ঘুরন্ত চাকার মত ঘুরে দাঁড়াল। দু’জনই বিস্ময়ে বিমূঢ়।

একটু পরেই ব্রাউন বলল, কে তুমি? আর কোত্থেকেই বা এখানে উদয় হলে? আর কি বলতে পার তুমি?

বলতে পারি কিভাবে তোমাদের দুটি স্ত্রীলোক উধাও হয়ে গেছে।

কি বলছ তুমি? এ যে এক আজব দেশরে বাবা। এখানে যখন-তখন মানুষ উধাও হয়ে যায়। আর তুমি হওয়ার ভিতর থেকে লাফিয়ে নেমে এলে একটা জ্যান্ত ভূতের মত। তুমি কে? বন্ধু না

বন্ধু, টারজান জবাব দিল।

এরকম বিনা পোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন? ব্রাউন জানতে চাইল; তোমার কি জামা-কাপড় নেই, না কি বুদ্ধিশুদ্ধি নেই?

আমি বানররাজ টারজান।

আচ্ছা! তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ায় খুশি হলাম; আমি নেপোলিয়ান। কিন্তু এবার হড়হড় করে বলে ফেল তো আনেৎ সম্পর্কে কি জান-দুটি মহিলার কথাই বল। কে তাদের নিয়ে গেছে? সবরভ কি? অবশ্য তুমি তো সবরভকে চেনই না।

টারজান বলল, সবরভকে আমি চিনি। তোমাদের বিমান দুর্ঘটনার কথাও জানি। আমি জানি যে প্রিন্সেস সবরভ খুন হয়েছে। আর লেডি গ্রেস্টোক ও আনেতের কি হয়েছে সেটাও জানি বলেই মনে হয়।

ব্রাউন অবাক। বলল, এত কথা তুমি জানলে কেমন করে? এবার চটপট বল, মহিলা দুটির কি হয়েছে।

তারা কাভুরুদের হাতে ধরা পড়েছে। তোরা এখন কাভুরুদের দেশে।

 কাভুরু কারা? ব্রাউন প্রশ্ন করল।

অভস্য সাদা মানুষদের একটি উপজাতি। অদ্ভুতভাবে তারা মেয়েদের চুরি করে হয় তো কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তাদের বলি দেয়।

কোথায় থাকে তারা?

তা জানি না। তাদের গ্রামের খোঁজে এসেই তোমাদের বিমান-দুর্ঘটনার কথা জানতে পারি। আমার বিশ্বাস, শীঘ্রই সেটাকে খুঁজে পাব। কাভুরুদের এমন কতকগুলো গুপ্ত ব্যাপার আছে যাকে তারা লুকিয়ে রাখতে চায়; কাজেই তাদের গ্রামের ত্রিসীমায় কাউকে ঘেঁসতে দেয় না।

কিসের গুপ্ত ব্যাপার? ব্রাউন প্রশ্ন করল।

লোকের বিশ্বাস, তারা একরকম অমৃত আবিষ্কার করেছে যা খেলে বুড়ো মানুষ আবার যুবক হতে পারে।

ব্রাউন শিস দিয়ে উঠল। বটে! আমরাও তো সেই খোঁজেই এসেছি। অবিশ্বাসের সুরে টারজান বলল, তোমরা খুঁজছ কাভুরুদের?

ব্রাউন বলল, বৃদ্ধ মহিলাটি সেই অমৃতের খোঁজেই এসেছিল; আমিও তাই-হঠাৎ সে থেমে গেল। রাগে তার মুখ কালো হয়ে উঠল। চীৎকার করে ডাকল, সবরভ!

বাঁকটা ঘুরেই ব্রাউনকে দেখে প্রিন্স থমকে দাঁড়াল। আমেরিকানটি এগিয়ে গেল তার দিকে।

সবরভ টারজানকে লক্ষ্য করে বলল, ওকে থামাও।

এক লাফে এগিয়ে গিয়ে টারজান ব্রাউনের হাত চেপে ধরল। হুকুমের ভঙ্গীতে বলল, থাম!

নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে ব্রাউন বলল, আমাকে যেতে দাও মুখখু কোথাকার। নিজের চরকায় তেল দাও গে। একটা বিরাশী সিক্কার ঘুষি বাগিয়ে সে টারজনের চোয়াল লক্ষ্য করে হাত তুলল। চকিতে সরে গিয়ে সে ব্রাউনকে চেপে ধরে দুই হাতে শূন্যে তুলে ঝোপের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, নেপোলিয়ান হে, ওয়াটারলুর কথা বেমালুম ভুলে গেছ যে।

তার চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে ব্রাউন বলল, সেটা এক আছাড়েই বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমি এখনও বুঝতে পারছি না সেই উকুনটাকে মারতে তুমি বাধা দিচ্ছ কেন।

কারণ তোমাদের ঝগড়াটা এখন বড় কথা নয়, আসল কথা হচ্ছে লেডি গ্রেস্টোকের পাত্তা করা।

আর আনেতের, ব্রাউন যোগ করল।

ঠিক, টারজান বলতে লাগল। তোমাদের তিনজনকে সভ্য জগতে ফেরৎ পাঠানোও দরকার। তোমরা কেউ জঙ্গলের লোক নও। তবু বোকার মত জঙ্গলে এসে নিজেরাও বিপদে পড়েছ, আর অন্যদেরও বিপদ ঘটিয়েছ।

টিবস্ এতক্ষণে সাহস করে বলল, যদি অনুমতি কর তো বলি, আমিও তোমার সঙ্গে একমত।

এতক্ষণে টারজনের খেয়াল হল সবরভ সরে পড়েছে।

বারকয়েক তার নাম ধরে ডাকল, কিন্তু কোন সাড়া মিলল না।

ব্রাউন বলল, তার প্রতীক্ষায় আমরা কি এখানেই বসে থাকব?

টারজান জবাব দিল,। আমি যাচ্ছি কাভুরুদের গ্রামের খোঁজে। পূর্ব দিকে কোথাও আমার লোকজনেরা রয়েছে। তোমাদের নিয়ে তাদের কাছে যাব। চল।

মইটার শেষ ধাপে পৌঁছে একটা অস্পস্ট শব্দ জেনের কানে এল। কাছেই কে যেন নড়াচড়া করছে। সঙ্গে সঙ্গে সে ভাল করে কান পাতল। উপরের চতুষ্কোণ ফোকড় দিয়ে সামান্য আলো আসায় ঘরের অন্ধকার কিছুটা হাল্কা হয়েছে। একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর ইংরেজিতে বলল, ম্যাডাম তুমি! তারা তোমাকেও ধরেছে?

আনেৎ, তুমি এখানে? তাহলে প্রিন্স তোমাকে চুরি করে নি?

না ম্যাডাম। একটা ভয়ঙ্কর সাদা মানুষ মন্ত্র বলে আমাকে অসহায় করে এখানে তুলে এনেছে। সাহায্যের জন্য চীৎকার করতে পারি নি। কোন রকম বাধা পর্যন্ত দেই নি। স্বেচ্ছায় তার কাছে এলাম। আর সে আমাকে গাছের উপর তুলে নিয়ে চলে এল।

ওদেরই একজন আমাকে ওই একইভাবে এনেছে আনেৎ। ওরা যাদু জানে। ওরা কি তোমার কোন ক্ষতি করেছে আনে।

তা করে নি। তবে আমি খুব ভয় পেয়ে গেছি। না জানি আমাকে নিয়ে ওরা কি করবে।

 কি করবে বলে তোমার মনে হয়? জেন প্রশ্ন করল। কোন রকম আঁচ কিছু পেয়েছ।

না ম্যাডাম, কিছু বুঝতে পারছি না। তোমাকেও ওরা কিছু বলে নি?

যে লোকটি আমাকে ধরে এনেছে তার নাম ওগলি। সে শুধু বলেছে যে আমাকে কাবান্দাবান্দার কাছে নিয়ে যাবে। যতদূর জেনেছি সেই তাদের সর্দার। তারা বড় বাজে লোক।

ওইটুকু বললে সব বলা হয় না ম্যাডাম। তারা ভয়ংকর লোক। এ সময় মঁসিয়ে ব্রাউন যদি এখানে থাকত। হায়, তার সঙ্গে আর আমার দেখা হবে না। আমার মন বলছে, এখানেই আমার মরণ হবে।

বাজে কথা রাখ আনেৎ। ওসব কথা মুখেও এনো না। এখন আমাদের একমাত্র চিন্তা-কেমন করে এখান থেকে পালাব।

পালাব? তার কি কোন উপায় আছে ম্যাডাম?

জেন আশ্বাস দিয়ে বলল, আমি দেখেছি এই কুঠুরিতে ঢোকার মুখে কোন পাহারা নেই; রাতেও যদি কোন পাহারা না বসায় তাহলে সহজেই আমরা ছাদে উঠে যেতে পারব। তারপর সেখান থেকে কি ঘটবে কপালে তা ভবিতব্যই জানে; তবু একবার চেষ্টা করে তো দেখতে হবে।

আপনি যা বলবেন ম্যাডাম।

 তাহলে আজ রাতেই।

 স্-শ, ম্যাডাম! কে যেন আসছে।

মইয়ের মুখে একটা লোক দাঁড়াল। হুকুম করল, চলে এস! দু’জনই।

 জেন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হায়রে দুরাশা।

দু’জন ছাদে উঠে গেল। লোকটিকে চিনতে পেরে জন বলল, এবার কি হবে ওগলি? আমাদের মুক্তি দেবে কি?

চুপ কর, কাভুরুটি হুংকার দিল। তুমি বড় বেশি কথা বল। কাবান্দাবান্দা তোমাকে ডেকেছে। তার কাছে বেশি কথা বলো না।

ওগলি জেনের হাত ধরে টান দিল- একখানি নরম, মসৃণ রোদে-পোড়া হাত। হঠাৎ থেমে গিয়ে সে ঘুরে দাঁড়াল। জেনের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা নতুন অগ্নিশিখা জ্বলে উঠল তার চোখে। আগে তোমাকে ভাল করে দেখি নি, চাপা গলায় সে বলল। আগে তোমাকে ভাল করে দেখি নি। প্রায় অশ্রুত তার কণ্ঠস্বর।

বিদ্যুৎ-ঝলকের মত দাঁত বের করে জেন দেখাল। বলল, আমার দাঁতের দিকে তাকাও। অচিরেই এই দাঁতের মালা দুলবে তোমাল গলায়। তোমার হবে চারনরী হার।

ফ্যাসফেঁসে গলায় ওগলি বলল, তোমার দাঁত আমি চাই না গো মেয়ে। তুমি আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছ। যে নারীসঙ্গ আমি প্রতিজ্ঞা করে ত্যাগ করেছি, সেই নারীই আমাকে যাদু করেছে।

বিদ্যুতগতিতে জেন অনেক কিছু ভেবে নিল। ফিস্-ফিস্ করে বলল, ওগলি, ইচ্ছা করলেই তুমি আমাকে সাহায্য করতে পার। এ কথা কেউ কোন দিন জানবে না। রাত পর্যন্ত আমাদের সাহায্য করতে পার। এ কথা কেউ কোন দিন জানবে না। রাত পর্যন্ত আমাদের লুকিয়ে রাখ। কাবান্দাবান্দাকে বল যে আমাদের খুঁজে পাচ্ছে না, আমরা পালিয়েছি। তারপর অন্ধকার হলে আমাদের গ্রামের বাইরে রেখে এসো। কাল ফিরে এলেই তুমি আমাদের-অন্তত আমাকে বনের মধ্যে দেখতে পাবে।

ওগলি বারকয়েক মাথা নাড়ল। তারপর হঠাৎ না! বলে চীৎকার করেই ওগলি কঠিন মুঠিতে জেনের হাত ধরে তাকে টানতে টানতে এগিয়ে চলল। তোমাকে কাবান্দাবান্দার কাছে নিয়ে যাবই।

জেন শুধাল, তুমি আমাকে এত ভয় পাচ্ছ কেন? আমি তো একটি মেয়ে মানুষ মাত্র।

তাই তো তোমাকে আমার ভয়। দেখতে পাচ্ছ এখানে কোন মেয়ে মানুষ নেই। যে সব মেয়েদের কাবান্দাবান্দার জন্য আনা হয়েছে তারা ছাড়া আর কেউ নেই। আমি একজন পুরোহিত। আমরা সকলেই পুরোহিত। মেয়ে মানুষরা আমাদের অপবিত্র করে দেবে। যদি আমরা দুর্বল হয়ে তাদের ছলাকলায় ভুলে যাই, তাহলে মৃত্যুর পরে চিরকাল নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হবে; আবার কাবান্দাবান্দা যদি সে কথা। জানতে পারে তাহলে অচিরেই আমাদের মৃত্যু হবে তীব্র যন্ত্রণায়।

দুটি মেয়েকে নিয়ে ওগলি রাজপথ ধরে ছুটতে লাগল গ্রামের পিছন দিক লক্ষ্য করে।

জেন বলল, তুমি তো কাবান্দার বন্ধু। তাকে বলে এই মন্দিরে তোমার থাকার ব্যবস্থা কর।

 কেন? ওলির স্বরে সন্দেহের ছোঁয়া।

কারণ এখানে তুমিই আমার একমাত্র বন্ধু। তুমি কাছে না থাকলে আমার ভয় করবে।

একটা চাপা গর্জন করে ভুরু কুঁচকে ওগলি বলল, আবার তুমি আমাকে মজাতে চেষ্টা করছ?

তার কাঁধে হাত রেখে জেন ফিসফিসিয়ে বলল, কাবান্দাবান্দার অনুমতি চাইবে তো?

ওগলি মুখ ঘুরিয়ে নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল; কিন্তু জেনের ঠোঁটে খুশির হাসি ফুটল। সে বুঝতে পেরেছে যে তারই জয় হয়েছে।

জেনকে হাজির করা হল কাবান্দাবান্দা মন্দিরের প্রশস্ত কেন্দ্রীয় কক্ষে। কক্ষটি বড়। গাছের গুঁড়ির উপর বসানো নিচু ছাদ। কাঠের মেঝেতে পালিশ। প্রতিটি স্তম্ভের উপরে একটা করে দাঁতবিহীন মাথার খুলি সাজানো। চাঁদের মাঝখানে ঘরের একটি মাত্র খোলা জায়গা দিয়ে প্রচুর সূর্যের আলো এসে পড়েছে। চিতাবাঘের চামড়ায় মোড়া বেদীর উপর স্থাপিত প্রকাণ্ড সিংহাসনে উপবিষ্ট একটি মূর্তি।

সিংহাসনে উপবিষ্ট লোকটির দিকে প্রথম দৃষ্টিতে তাকিয়ে জেন বিস্ময়ে ঢোক গিলল। লোকটি সুদর্শন।

এই তো কাবান্দাবান্দা, অথচ তার কল্পনার মূর্তির চাইতে কত আলাদা। এই তো সত্যিকারের রাজা; শুধু রাজা নয়, একাধারে ত্রিশক্তি-কাভুরুদের রাজা, ওঝা ও ঈশ্বর। সিংহাসনের দুই পাশে দুটি চিতাবাঘ ছাড়া বেদীর উপরে সে একাই আসীন। তার নিচে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাভুরু সৈনিকরা; আর আছে মোটা-সোটা ক্রীতদাসরা।

সঙ্গিনী দুটিকে বেদীর কাছে এনে ওগলি নতজানু হল; কর্কশ গলায় তাদেরও নতজানু হতে হুকুম করল। আনেৎ ভয়ে ভয়ে হুকুম পালন করল, কিন্তু জেন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নির্ভীক চোখে সিংহাসনারূঢ় লোকটির দিকে তাকিয়ে রইল।

লোকটি যুবক; চওড়া কটি-বন্ধনী ও নানা অলংকার ছাড়া প্রায় নগ্নদেহ। মানুষের দাঁতের হার গলা থেকে নেমে বুক পর্যন্ত ঢেকে দিয়ে কটি-বস্ত্রের কাছে নেমে এসেছে। কব্জিতে, বাহুতে, গোড়ালিতে ধাতু, কাঠ ও হাতির দাঁতের নানা অলংকার। কিন্তু জেনের দৃষ্টি সে সবের দিকে নেই; সে স্থির দৃষ্টিতে দেখছে যুবকটির দেবোপম মুখ ও সুগঠিত দেহখানিকে।

এক দৃষ্টিতে জেনের দিকে তাকিয়ে থেকে লোকটি রাজকীয় ভঙ্গীতে আদেশ করল, নতজানু হও!

জেন জানতে চাইল, কেন? কেন আমি তোমার সামনে নতজানু হব?

আমি কাবান্দাবান্দা।

সেজন্য একটি ইংরেজ মহিলা তোমার সামনে নতজানু হবে কেন?

 যুবকটি বলল, তুমি নতজানু হবে না?

নিশ্চয় না।

দুটি ক্রীতদাস জেনের দিকে এগিয়ে গেল। কাবান্দাবান্দা হাতের ইশারায় তাদের সরে যেতে বলল। বিচিত্র ভঙ্গীতে তার ঠোঁট দুটো বেঁকে গেল। সেটা খুশিতে, না ক্রোধে তা বুঝতে পারল না জেন।

ওগলি ও জেনকে উঠে দাঁড়াতে বলে যুবক জেনের দিকে ফিরে বলল, তুমি কে? আর কাভুরুদের দেশে কেন এসেছ?

আমি জেন ক্লেটন, লেডি গ্রেস্টোক। উড়োজাহাজে লন্ডন থেকে নাইরোবি যাবার পথে আমরা মাঝখানে নামতে বাধ্য হই। সঙ্গীদের নিয়ে উপকূলে পৌঁছবার পথে তোমার সৈনিকরা এই মেয়েটিকে ও আমাকে অপহরণ করে। আমি চাই, তুমি আমাদের মুক্তি দিয়ে নিকটবর্তী কোন বন্ধু গ্রামে পৌঁছে দাও।

কাবান্দাবান্দার ঠোঁটে একটু বাঁকা হাসি খেলে গেল। বলল, তাহলে তোমরাও একটা দানব পক্ষির পিঠে চড়ে এসেছ। আরও দু’জন এসেছে কাল। দানব পক্ষিটার পাশেই তাদের মৃতদেহ পড়ে আছে। আমার লোকজন দানব পক্ষিটাকে ভয় করে। কিছুতেই তার কাছে যাবে না। বলতো, সেটা কি ওদের কোন ক্ষতি করবে?

ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ওদের এই কুসংস্কারকে কাজে লাগাবার জন্য জেন বলল, ওটা থেকে দূরে থাকাই ভাল। ও রকম দানব পক্ষি আরও অনেক আসবে। তারা যদি দেখে তোমরা আমার বা সঙ্গিনীদের কোন ক্ষতি করেছ, তোমার এই গ্রাম ও লোকজনদের তারা ধ্বংস করে ফেলবে। আমাদের নিরাপদে পাঠিয়ে দাও; আমরা তাদের বলে দেব, যেন তোমাদের কোন ক্ষতি না করে।

যুবক জবাব দিল, তোমরা যে এখানে আছ তারা তা জানতেই পারবে না। কাভুরুদের গ্রামে অথবা কাবান্দার মন্দিরে কি ঘটে কেউ জানতে পারে না।

তুমি আমাদের ছেড়ে দেবে না?

না। এ গ্রামের ফটক দিয়ে একবার যে ঢোকে সে আর বের হতে পারে না-আর তুমি তো পারবেই না। অনেক মেয়ে আমার কাছে এসেছে, কিন্তু তোমার মত কেউ আসে নি।

তোমার তো অনেক মেয়ে আছে। তাহলে আমাকে চাইছ কেন?

আধ-বোঝা চোখে জেনের দিকে তাকিয়ে সে বলল, আমি জানি না। ওগলি এদের নিয়ে যাও তিন সাপের ঘরে।

আনেৎ বলে উঠল, তিন-সাপের ঘর! সে ঘরে কি তিনটে সাপ থাকে?

যেতে যেতে জেন বলল, যে সব ঘর পার হয়ে যাবে তার দরজার উপরে চোখ রেখো। তাহলেই তোমার প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবে। একটা দরজার মাথায় আছে শুয়োরের মাথা। আর একটাতে আছে দুটো মানুষের খুলি। একটাতে আছে চিতার মাথা। এইভাবেই এরা ঘরের নামকরণ করে থাকে, ঠিক আমরা যেমন হোটেলের ঘরে সংখ্যা লিখে দেই।

মন্দিরের তিন তলায় উঠে ওগলি তাদের নিয়ে যে ঘরটায় ঢুকল, সত্যি তার দরজার উপরে তিনটে সাপের মাথা খোদাই করা।

ওগলি বলল, পালাবার চেষ্টা করো না, তাতে কোন লাভ হবে না।

জেন বলল, মোটেই সে চেষ্টা করছি না। তুমি সাহায্য না করলে আমাদের পক্ষে পালানো অসম্ভব। তুমিই আমাদের একমাত্র বন্ধু।

হঠাৎ লোকটি প্রশ্ন করল, কাবান্দাবান্দা কিভাবে তোমাকে দেখছিল সেটা কি তুমি লক্ষ্য করেছ?

না তো, জেন বলল।

আমি করেছি; আগে কখনও কোন বন্দীর দিকে ওভাবে তাকাতে তাকে আমি দেখি নি। কিন্তু সে যদি এ কাজ করতে চেষ্টা করে, তাহলে আমি বারান্দায় কিসের শব্দ শুনে ওগলি চুপ করে গেল। দরজা খুলে ঘরে ঢুকল একটি ক্রীতদাস। সে পাশে সরে দাঁড়াতেই প্রকাশ পেল কাবান্দাবান্দার মূর্তি।

সে ঘরে ঢুকতেই ওগলি নতজানু হল। আনেৎ তাকে অনুসরণ করল। কিন্তু জেন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

কাবান্দাবান্দা বলল, তোমরা উঠে দাঁড়াও। জেন নামক এই মেয়েটি ছাড়া বাকি সকলেই বারান্দায় বেরিয়ে যাও। আমি ওর সঙ্গে নির্জনে কথা বলতে চাই।

ওগলি সোজাসুজি কাবান্দাবান্দার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে; কাভুরুর পুরোহিতদের প্রধান পুরোহিত, আমি যাচ্ছি; কিন্তু আমি কাছাকাছিই থাকব।

মুহূর্তের জন্য কাবান্দাবান্দার মুখটা ক্রোধে লাল হয়ে উঠল, কিন্তু মুখে কিছু বলল না। সকলে বেরিয়ে গেলে একটা বেঞ্চি দেখিয়ে জেনকে বসতে বলে নিজে তার পাশে বসল। অনেকক্ষণ জেনের দিকে তাকিয়ে রইল। এক সময় বলল, তুমি খুব সুন্দর। তোমার চাইতে বেশি সুন্দর কাউকে আমি দেখি নি। বড়ই দুঃখের কথা; বড়ই দুঃখের কথা।

দুঃখের কথাটা কি? জেন জানতে চাইল।

প্রসঙ্গ চাপা দিতে যুবক বলে উঠল, কিছু মনে করো না। আমার চিন্তাটা একটু সরে হয়ে গেছে। সে আবার চুপ করল; কিসের চিন্তায় ডুবে গেল। পরে আবার বলতে লাগল, তোমাকে বলা যেতে পারে। তুমি বুদ্ধিমতী, তুমি বুঝতে পারবে-অবশ্য আমি যদি যথেষ্ট শক্তিমান হই। কিন্তু যখন তোমার দিকে তাকাই, ওই দুটি চোখের গভীরে যখন দৃষ্টি মেলে দিই, তখন আমি বড় দুর্বল হয়ে পড়ি। না, না! আমি কর্তব্য পালনে বিচলিত হবে না; জগৎ আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে, আমাকে কর্তব্য সাধন করতেই হবে।

তুমি কি বলছ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, জেন বলল।

পারবে-পারবে। অনেক কাল আগে মৃত্যুহীন যৌবনের গুপ্ত কথা আমি জানতে পারি। কতকগুলো বিশেষ ফুলের রেণু, কতকগুলো গাছের শিকড়, চিতাবাঘের শিরদাঁড়ার মজ্জা, আর প্রধানত নারীর-যুবতী নারীর গ্রন্থি ও রক্ত-এমনি সব বস্তুর মিশ্রণে তৈরি হয় সেই যৌবন-রসায়ন। বুঝতে পেরেছ?

হা। জেন শিউরে উঠল।

চমকে উঠো না; মনে রেখো, এইভাবেই তুমি হবে জীবন্ত ঈশ্বরের অংশ। তুমি বেঁচে থাকবে চিরকাল গৌরবে দীপ্ত হবে তুমি।

কিন্তু এসব কিছুই তো আমি জানতে পারব না; তাহলে তাতে আমার কি লাভ?

আমি জানব যে তুমি আমার একটি অংশ। আর সেইভাবেই আমি তোমাকে পাব। সে আরও ঝুঁকল। কিন্তু তুমি যেমন আছ তেমনি তোমাকে রাখতে চাই আমি। জেনের কপোলে লোকটির গরম নিঃশ্বাস পড়ছে। কেন নয়? আমি কি প্রায় ঈশ্বর নই? ঈশ্বর কি ইচ্ছামত কাজ করতে পারে না? কে তাকে বাধা। দেবে?

জেনকে চেপে ধরে সে তাকে কাছে টানল।

অসহায় মেয়েটি কি করবে! আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিবশেই লোকটির ঠোঁটকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে চীৎকার করে ডাকল–ওগলি।

সঙ্গে সঙ্গে ঘরের দরজা সপাটে খুলে গেল। কাবান্দাবান্দা জেনকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মেঝেটা পার হয়ে ওগলিও থামল। দু’জন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। মুহূর্তের জন্য কাবান্দাবান্দার মুখ ও গলা রাগে লাল হয়ে উঠল। তারপরেই মরার মত সাদা মুখে সে ওগলির পাশ দিয়ে ঘর থেকে চলে গেল। একটা কথাও বলল না।

সৈনিক অতি দ্রুত জেনের কাছে গিয়ে বলল, ও আমাদের দু’জনকেই খুন করবে। আমাদের পালাতেই হবে; তাহলেই তুমি আমার হবে। মন্দির চত্বর ও গ্রামের নিচ দিয়ে একটা গোপন সুড়ঙ্গ আমি চিনি। জড়ি-বুটির খোঁজে কাবান্দাবান্দা মাঝে মাঝে সেই পথ দিয়ে যায়। অনেক রাত হলে আমরা যাব।

রাগে লাল হয়ে কাবান্দাবান্দা যখন প্রাসাদের অলিন্দপথে হেঁটে যাচ্ছে তখন একজন বন্দীসহ ইদেনির সঙ্গে তার দেখা হল।

তোমার সঙ্গে ও কে?

ইদেনি নতজানু হয়ে বলল, এরও মাথায় দানো ঢুকেছে। তাই তোমার কাছে নিয়ে এসেছি।

প্রধান পুরোহিত হুংকার দিয়ে উঠল, এখান থেকে নিয়ে যাও। তালাবন্ধ করে রাখ। কাল সকালে নিয়ে এস।

সবরভকে নিয়ে তিন তলায় উঠে ইদেনি তাকে একটা অন্ধকার ঘরে ঠেলে দিল। এটা দুই-সাপের ঘর। পাশেই তিন-সাপের ঘর। বাইরে থেকে দরজায় খিল এঁটে ইদেনি চলে গেল।

পাশের ঘরে ওলি বলল, আমি যাচ্ছি। এখন আমাকে লুকিয়ে থাকতে হবে। পরে এসে তোমাকে নিয়ে যাব।

কিন্তু আনেৎ কোথায়?

পাশের ঘরে।

তাকেও সঙ্গে নেবে তো?

দেখি। তুমি কিন্তু পালাবার চেষ্টা করো না। গুপ্ত পথ ছাড়া অপর একমাত্র পথ চত্বরের ভিতর দিয়ে। সেখানে ঢুকলেই নিশ্চিত মৃত্যু। সাবধান!

বেরিয়ে যাবার আগে ওলি দরজাটা বন্ধ করে বাইরে থেকে খিল এঁটে দিয়ে গেল।

দুই-সাপের ঘরে অন্ধকারে সবরভ একা।

পাশের ঘরে অস্পষ্ট শব্দ শুনে হাতড়াতে হাতড়াতে একটা দরজা পেল। তালাবন্ধ। বৃথাই সেটা টানাটানি করল।

 পাশের ঘরে জেন সে শব্দ শুনে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ওগলি বলেছে, আনেৎ আছে পাশের ঘরে। তাহলে তো সেই শব্দ করছে।

জেন দেখতে পেল, তার দিকে দরজায় একটা ভারী হুড়কো লাগানো। খুব সাবধানে সে একটু একটু করে হুড়কোটা সরাতে লাগল। ওপার্শে আনেও তালা ধরে টানাটানি করছে। দু’জনের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। অস্পষ্ট আলোয় একটা মূর্তিকে ঘরে ঢুকতে দেখে জেন ফিসফিস্ করে ডাকল, আনেৎ!

কথা বলল একটা পুরুষ কণ্ঠ। সে মারা গেছে। ব্রাউন তাকে খুন করেছে। জেনকেও সেই মেরে ফেলেছে। তুমি কে?

এলেক্সিস! জেন চেঁচিয়ে বলল।

তুমি কে? সবরভ প্রশ্ন করল।

আমি জেন-লেডি গ্রেস্টোক। তুমি কি আমার গলা শুনে বুঝতে পারছ না?

 তা পারছি, কিন্তু তুমি তো মৃত। কিটি কি তোমার সঙ্গে আছে? হা ঈশ্বর!

উল্টো দিকের দরজা থেকে কে যেন ছুটে এল। শোনা গেল আনেতের গলা। ম্যাডাম! ম্যাডাম! এসব কি? কি হয়েছে?

 সবরভ সভয়ে বলে উঠল, ও কে? আমি জানি ও আনেৎ। তোমরা সবাই আমার উপর ভর করেছ।

জেন সান্ত্বনার সুরে বলল, শান্ত হও এলেক্সিস। কিটি এখানে নেই, আর আনেৎ ও আমি দু’জনই বেঁচে আছি। বলতে বলতে সে আনেতের ঘরের দরজার কাছে গিয়ে হুড়কোটা খুলে দিল।

সবরভ আর্তনাদ করে উঠল, ওকে ঢুকতে দিও না! তুমি ভূত হও আর যাই হও, ওকে ঘরে ঢুকতে দিলে আমি তোমাকে টুকরো-টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলব।

সঙ্গে সঙ্গে দুরজা ঠেলে আনেৎ ছুটে এল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বারান্দার দরজা খুরে ঘরে ঢুকল কালো ক্রীতদাস মেডেক।

সে বলল, কি হচ্ছে এখানে? এ লোকটাকে কে এখানে আসতে দিল?

আনেৎকে দেখে সবরভ ভয়ে কুঁকড়ে সরে গেল। তার পরেই মেডেককে দেখে আর্তকণ্ঠে বলে উঠল, কিটি! না, আমি যাব না। তুমি চলে যাও!

মেডেক এগিয়ে গেল। সবরভ ঘুরে ঘরের একমাত্র জানালাটার দিকে ছুটে গেল। একমুহূর্ত গোবরাটে দাঁড়িয়ে থেকে পিছনে তাকিয়ে মেডেকের অস্পষ্ট মূর্তিটাকে দেখতে পেয়ে আতংকে চীঙ্কার। করতে করতে বাইরের অন্ধকার চত্বরে লাফিয়ে পড়ল।

মেডেক ছুটে গিয়ে জানালা দিয়ে মুখ বাড়াল। নিচ থেকে ভেসে এল স্বরভের আর্তকণ্ঠ। তাকেও ছাপিয়ে ভেসে এল অনেকগুলো চিতাবাঘের গর্জন ও হুংকার। বেচারি সবরভ! সদ্য নিহত শিকারের মাংস নিয়ে চিতাদের মধ্যে হুলুস্থুল পড়ে গেল। তারপর সব শেষ। চুপ।

মেডেক জানালা থেকে ফিরে এসে বলল, এ পথে পালাবার চেষ্টা বৃথা। তারপর বাইরের বারান্দায় গিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল।

আনেৎ বলল, কি দুঃখের ব্যাপার ম্যাডাম।

 জেন বলল, সত্যি দুঃখের। তবে এ ভালই হল। প্রিন্স সবরভ পাগল হয়ে গিয়েছিল।

 বাইরে পায়ের শব্দ শুনে আনেৎ বলল, স্-স্-স্ ম্যাডাম! কে যেন আসছে।

 জেন কান পেতে বলল, ধপাস্ করে কে যেন পড়ে গেল। শুনতে পেয়েছ?

 হা। এ যে আর এক বিপদ।

দরজাটা সপাটে খুলে গেল; ঢুকল একটি মূর্তি। কণ্ঠস্বর শোনা গেল। কোথায় তুমি? ওগলির কণ্ঠস্বর।

আমি এখানে, জেন জবাব দিল।

তাড়াতাড়ি চলে এস। সময় নষ্ট করো না।

 চলে এস আনেৎ, জেন বলল।

অন্য মেয়েটিও এখানেই আছে? ওগলির প্রশ্ন।

জেন বলল, হ্যাঁ আমি গেলে ও-ও যাবে।

কাভুরু বলল, তাই হবে। কিন্তু জলদি।

ওগলিকে অনুসরণ করে মেয়ে দুটি বারান্দায় বেরিয়ে এল।

অনেক বারান্দা ও ঘর পার হয়ে তিনজন এগিয়ে চলল সতর্ক পা ফেলে। ক্রমে রাত বাড়তে লাগল। তিনজনেরই একমাত্র লক্ষ্য জঙ্গলে পৌঁছবার গুপ্ত সুড়ঙ্গের মুখ।

এক সময় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ওগলি বলল, আমরা পৌঁছে গেছি। এই ঘরেই গুপ্ত সুড়ঙ্গের মুখ। কোন রকম শব্দ করো না।

সাবধানে দরজা ঠেলে তিনজন ঘরে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারের ভিতর থেকে অনেকগুলো হাত বেরিয়ে এসে তাদের জাপটে ধরল। একটা ধস্তাধস্তির শব্দ জেন শুনতে পেল। শোনা গেল পলায়মান পদধ্বনি। তাকে টানতে টানতে বারান্দায় আনা হল। একজন নিয়ে এল একটা তৈল-প্রদীপ।

জেনের পাশে দাঁড়িয়ে আনেৎ ঠঠ করে কাঁপছে। তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচজন সৈনিক। ওগলি সেখানে নেই।

একজন সৈনিক বলল, কোথায় গেল ওগলি? নিশ্চয় সুড়ঙ্গ-পথে পালিয়েছে। ছুটে চল। তাকে ধরতেই হবে।

অপর সৈনিক বলল, এতক্ষণে সে অনেক দূরে চলে গেছে। আমরা ধরবার আগেই সে বনের মধ্যে পৌঁছে যাবে। রাতের অন্ধকারে সেখানে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সকাল হোক, তখন দেখা যাবে।

আর একজন বলল, সেই ভাল। আপাতত এই দুটিকে কাবান্দাবান্দার কাছে পৌঁছে দেয়া যাক।

চিতাবাঘের চামড়ায় ঢাকা বিছানায় বসে ছিল কাবান্দাবান্দা। বড় বড় চোখে জেনের দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা, এখান থেকে পালিয়ে যাবে? তা-ওগলি কোথায় গেল?

একজন সৈনিক জানাল, সে সুড়ঙ্গ-পথে পালিয়েছে।

বাঁকা হাসি হেসে কাবান্দাবান্দা বলল, ঠিক আছে। এটিকে নিয়ে আবার তিন-সাপের ঘরে আটকে রাখ। দেখ, যেন পালিয়ে না যায়। তারপর জেনকে দেখিয়ে বলল, এর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে; এই ষড়যন্ত্রে আর কারা লিপ্ত আছে তা আমাকে জানতে হবে। যাও।

আনেৎকে নিয়ে সকলে চলে গেল।

কাবান্দাবান্দা জেনকে একা পেয়ে বলল, বটে! ওগলির সঙ্গে পালাচ্ছিলে তার সঙ্গিনী হবার আশায়। তোমার জন্যই সে তার শপথ ভাঙতে যাচ্ছিল।

জেনের ঠোঁট ঘৃণায় বেঁকে গেল। বলল, ওগলি হয়তো তাই ভেবেছিল।

তুমিও তো তার সঙ্গী হয়েছিলে।

 হয়েছিলাম, তবে জঙ্গল পর্যন্ত; তারপর হয় পালাতাম, নয়তো তাকে খুন করতাম।

 প্রধান পুরোহিত বলল, কেন? তোমারও কোন শপথ আছে নাকি?

 আছে- আনুগত্যের শপথ।

সাগ্রহে ঝুঁকে পড়ে প্রধান পুরোহিত বলল, কিন্তু সে শপথ তো ভাঙতে পারতে-ভালবাসার জন্য; আর তা না হলে মুক্তিপণ হিসেবে।

জেন মাথা নাড়ল। কোন কিছুর জন্যই নয়।

আমি কিন্তু আমার শপথ ভাঙতে পারি। এক সময় ভাবতাম কোনক্রমেই এ শপথ ভাঙ্গা যায় না, কিন্তু, তোমাকে দেখার পর থেকে-কাবান্দাবান্দা থামল, তারপর হঠাৎ বলল, কাবান্দাবান্দা হয়েও আমি যদি আমার শপথ ভাঙাতে পারি, তাহলে তুমিও তো তোমার শপথ ভাঙতে পার। তার জন্য যে মূল্য তুমি পাবে তার জন্য যে কোন নারী তার আত্মাকেই বেচে দিতে রাজী হবে- সে মূল্য অনন্ত যৌবন, শাশ্বত সৌন্দর্য।

জেন এবারও মাথা নাড়ল। না সে প্রশ্নেই ওঠে না।

তুমি কাবান্দাবান্দাকে ফিরিয়ে দিচ্ছ? তার মুখের নিষ্ঠুরতা দুটি চোখেও ছড়িয়ে পড়ল। মনে রেখো, তোমাকে ধ্বংস করবার, অথবা কোন কিছু না দিয়েই তোমাকে অধিকার করবার ক্ষমতা আমার আছে। কিন্তু আমি উদার। কেন জান কি?

কল্পনাও করতে পারি না।

কারণ আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি তোমাকে চিরদিনের মত এখানে রাখব; তোমাকে করব প্রধান ভৈরবী; যুগ যুগ ধরে তোমাকে যৌবনবতী করে রাখব; রূপবতী করে রাখব। তুমি আর আমি চিরকাল বেঁচে থাকব। মানবজাতিকে নবযৌবন দানের ক্ষমতা আমার আছে; সেই ক্ষমতাবলে সারা জগৎকে রাখব পায়ের নিচে। আমরা হব ঈশ্বর-আমি দেব, আর তুমি দেবী।

কাবান্দাবান্দা দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেল। চিত্র-বিচিত্র দেয়াল, আলমারি খুলে একটা বড় বাক্স বের করল। বলল, এখানে এস; দেখ। বাক্সের ডালাটা খুলে জেনের সামনে মেলে ধরল। ভিতরে মটর দানার মত অনেকগুলো কালো রঙের বটিকা। জান একগুলো কি?

না।

এই সব বটিকা হাজার মানুষকে দেবে অনন্ত যৌবন ও রূপ। একটি মুখের কথায় এগুলো তোমার হবে। আকাশে ভরা চাঁদ ওঠার শুভক্ষণে এর একটি বটিকা খেলে তুমি পাবে সেই অমূল্য রত্ন যার জন্য জগতের প্রথম মানুষ থেকে শুরু করে গোটা মানবজাতি সাগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। জেনের হাত ধরে যুবক তাকে কাছে টানল।

ঘৃণায় চীৎকার করে জেন নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করল। যুবক তাকে আরও জোরে চেপে ধরল। জেন সজোরে তার মুখে আঘাত করল। বিস্মিত যুবকের মুঠি শিথিল হল। আর সেই সুযোগে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জেন পাশের ছোট ঘরে ছুটে গেল।

ক্রোধে গর্জন করতে করতে কাবান্দাবান্দা তার পিছু নিল। বারান্দায় যাবার দরজার কাছেই তাকে ধরে ফেলল। জেনের আপ্রাণ বাধা সত্ত্বেও চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে তাকে ভিতরের ঘরে নিয়ে। চলল।

কেমন করে কিভাবে কাভুরুদের গ্রামে ঢোকা যায় তা নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত আলোচনা করে টারজান ও ব্রাউন অনেকু রাতে বনের প্রান্তে একটা গাছে চড়ে শুয়ে পড়ল।

টারজান বলল, তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন। তুমি শুয়ে পড়। আমি তোমাকে ঠিক সময়ে জাগিয়ে দেব।

 টারজানও ঘুমোল। কিন্তু তার ঘুম খুব পাতলা। প্রয়োজন মতই ঘুম ভেঙে যায়। হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে গেল। একটা অস্বাভাকি শব্দ যেন তার চেতনায় আঘাত করল।

গাছের ভিতর দিয়ে সে দ্রুত এগিয়ে গেল। কান থেকে এবার নাকে এসে লাগল একটা গন্ধ। বুঝতে পারল, কাছেই একটি কাভুরু আছে। ভাল করে তাকাতেই দেখতে পেল, একটা লোক জঙ্গলের পথে হেঁটে চলেছে। মুহূর্তমাত্র অপেক্ষা করে টারজান তার উপর লাফিয়ে পড়ল; তাকে মাটিতে ফেলে দিল। লোকটির দেহ শক্তপোক্ত। নিজেকে ছাড়াতে যথাসাধ্য চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। জঙ্গলের রাজার হাতে সে তো মোমের পুতুলমাত্র।

লোকটির দুই হাত পিছমোড়া করে বেঁধে টারজান তাকে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। আধা অন্ধকারে টারজনের মুখের দিকে তাকিয়ে লোকটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আর যাই হোক, এ লোকটি কাভুরু নয়।

বলল, কে তুমি? তুমি তো কাভুরু নও; তাহরে নিশ্চয় আমাকে কাবান্দাবান্দার কাছে নিয়ে যাবে না।

 টারজান বলল, তুমি যদি আমার প্রশ্নের ঠিক জবাব দাও, তাহলে তোমাকে কাবান্দাবান্দার কাছে নেব না, বা তোমার কোন ক্ষতিও করব না। তুমি কে?

আমি ওগলি।

সদ্য গ্রাম থেকে এসেছ?

 হ্যাঁ।

গ্রামে ফিরে যেতে চাও?

না। কাবান্দাবান্দা আমাকে মেরে ফেলবে।

 কাবান্দাবান্দা কি এতই বড় যোদ্ধা যে তুমি তাকে ভয় কর?

তা ঠিক নয়, তবে সে খুব শক্তিধর কাভুরুদের প্রধান পুরোহিত।

একটু একটু করে টারজান ওলির কাছ থেকে সব কথা জেনে নিয়ে বলল, তাহলে মেয়ে দুটি এখনও জীবিত আছে?

হা; অন্তত কয়েক মিনিট আগে পর্যন্ত বেঁচে ছিল।

 তাদের কি এখনই কোন বিপদ ঘটতে পারে?

কাবান্দাবান্দা কি করবে তা কেউ বলতে পারে না। তবে আমার মনে হয় এখনই তাদের কোন বিপদ ঘটবে না, কারণ তাদের একজনকে সে সঙ্গিনীরূপে বেছে নেবে, হয়তো বা এতক্ষণ নিয়েছে।

গুপ্ত পথটা কোথায়? আমাকে সেখানে নিয়ে চল। দাঁড়াও; আগে আমার বন্ধুদের ডাকি।

টারজান সঙ্গীদের জাগিয়ে তুলল।

ওগলি বলল, আমি তোমাকে সুড়ঙ্গ-পথে নিয়ে যেতে পারি, কিন্তু সে পথে তোমরা বন্দিরে ঢুকতে পারবে না। গুপ্ত পথের হসিদ যারা জানে না তাদের কাছে সুড়ঙ্গের উভয় মুখই একদিকে খোলে-বনের দিকে; একমাত্র কাবান্দাবান্দাই ফেরার হদিস জানে। তাই সহজেই মন্দির থেকে বেরিয়ে আসা যায়, কিন্তু ফিরে যাওয়া অসম্ভব।

কয়েক মিনিট ধরে আরও অনেক প্রশ্ন করে ওগলির কাছ থেকে খবরাখবর জেনে নিয়ে টারজান সঙ্গীদের বলল, আনেৎ ও লেডি গ্রেস্টোক মন্দিরের মধ্যেই আছে। আমার বিশ্বাস লোকটি সত্য কথাই বলেছে। ওর কথায় যতদূর বুঝতে পারছি লেডি গ্রেস্টোকের সমূহ বিপদ; কাজেই সময় নষ্ট করা চলবে না। মুভিরোর দিকে ফিরে বলল, ব্রাউন ও আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত এই লোকটিকে আটকে রাখ। অন্ধকার নামবার আগেই যদি ফিরে না আসি তো বুঝবে যে আমাদের সব চেষ্টা বিফল হয়েছে। তখন বিমানযাত্রীদের কাছ থেকে যে সব অস্ত্র পেয়েছে সেগুলো আমাদের দিয়ে দাও। ব্রাউনের ধারণা জাহাজে আরও অস্ত্র আছে। চলে এস ব্রাউন।

দু’জন নিঃশব্দে এগিয়ে চলল খোলা প্রান্তেরের ভিতর দিয়ে। উড়োজাহাজের কাছে পৌঁছে ব্রাউন সোজা তাতে উঠে গেল। নেমে এসে এক বাক্সভর্তি কার্তুজ টারজনের হাতে দিয়ে বলল, তোমার তো পটেক নেই, এইটে দিয়ে কাজ চালাবে। আমি সবগুলি পকেটভর্তি করে এনেছি- প্রায় টনখানেক ওজন হয়েছে।

পেট্রোল কতটা আছে? টারজান শুধাল।

একটা টুপি ভর্তি হবে, ব্রাউন জবাব দিল।

ওতে হবে?

তা-মেশিন গরম হতে যদি বেশি সময় না লাগে। প্যারাসুট পেয়েছ?

একটা প্যারাসুট নিজে পরে টারজান আর একটা দিল ব্রাউনকে। তারপর দু’জনই ককপিটে উঠে গেল। মুখে কোন কথা বলল না। সব ব্যবস্থা রাতেই পাকা করা হয়েছিল।

অল্প চেষ্টাতেই প্রপেলার গর্জে উঠল। ব্রাউন হাসিমুখে বলল, যদি স্তবস্তুতি কিছু জানা থাকে তো সবগুলো আউড়ে যাও। যাত্রা শুরু হল।

বিমানটা স্বচ্ছন্দে উপরে উঠতে লাগল। বনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল মুভিরো, বালান্দো, টিবস্ ও ওগলি। আর দেখতে লাগল কাভুরু সৈনিকরা; বিমানের গর্জন শুনে ইতোমধ্যেই তারা পথে পথে জড়ো হয়েছে।

একজন সৈনিক ভয়ার্ত গলায় বলে উঠল, মরা মানুষ কি উড়তে পারে। তার ধারণা যে দুটি যাত্রী বিমানের পাশে মরে পড়ে ছিল তারাই ওটাকে চালাচ্ছে।

 সে কথা শোনামাত্রই সব কাভুরুদের মনে গেঁথে গেল। ভয়ে তারা শিউরে উঠল।

উড়োজাহাজটা যখন গ্রামের দিকে চলল তখন তারা আরও ভয় পেল।

একজন বলল, ওরা প্রতিশোধ নিতে এসেছে।

আর একজন বলল, আমরা যদি কুটিরেব মধ্যে ঢুকে যাই তাহলে ওরা আমাদের দেখতে পাবে না।

যে কথা সেই কাজ। দেখতে দেখতে পথঘাট ফাঁকা হয়ে গেল। প্রতিশোধ এড়াতে সকলেই ঘরে ঢুকে গেল।

জাহাজটা উপরে উঠতে লাগল–আরও উপরে।

এক সময় ব্রাউন চীৎকার করে বলল, প্রস্তুত হও।

টারজান নিরাপত্তা-বেল্টের হুকটা খুলে দিল।

হঠাৎ জাহাজটাকে ক্ষণিকের জন্য থামিয়ে দিয়ে ব্রাউন চীৎকার করে উঠল, লাফ দাও।

 নিচের পাখনাটা ধরে টারজান লাফ দিল। পরমুহূর্তে ব্রাউনও লাফিয়ে পড়ল।

কাবান্দাবান্দার সঙ্গে জেন এঁটে উঠতে পারল না। ব্যাঘীর মত বাধা দেয়া সত্ত্বেও সে জেনকে টানতে টানতে ভিতরের ঘরে নিয়ে গেল।

তাকে কোচের উপরে ঠেলে দিয়ে কাবান্দাবান্দা বলল, শয়তানী, তোমাকে মেরে ফেলাই উচিত, কিন্তু আমি তোমাকে মারব না। তোমাকে বাঁচিয়ে রাখব; পোষ মানাব- আর সে কাজ এখনই শুরু করব। বিকৃত মুখে সে জেনের দিকে এগিয়ে গেল।

ঠিক সেই সময় বাইরের দরজায় ঘা পড়তে লাগল। কে যেন ভয়ার্ত গলায় ডাকল, কাবান্দাবান্দা! কাবান্দাবান্দা! আমাদের বাঁচাও! আমাদের বাঁচাও।

প্রধান পুরোহিত সক্রোদে চীৎকার করে বলল, কার এত সাহস যে কাবান্দাবান্দাকে বিরক্ত করে। তোমরা চলে যাও!

চলে যাওয়ার বদলে তারা দরজাটাকে সপাটে খুলে ফেলল। তাদের দলে সৈনিক ও ক্রীতদাস দুইই আছে।

প্রধান পুরোহিত শুধাল, তোমরা কি চাও? কেন এখানে এসেছ?

মরা মানুষরা উড়ছে; তারা উড়ছে গ্রামের উপরে, মন্দিরের মাথার উপরে। তারা এসেছে প্রতিশোধ নিতে।

কাবান্দাবান্দা ধমক দিয়ে বলল, তোমরা মূর্খ, ভীরু। মরা মানুষ কখনও উড়তে পারে না।

একজন সৈনিক বলল, কিন্তু সত্যি তারা উড়ছে। যে দু’জনকে কাল আমরা মেরেছিলাম তারাই এখন উড়ছে গ্রাম ও মন্দিরের উপরে। তুমি বাইরে চল কাবান্দাবান্দা; মন্ত্রের বলে ওদের তাড়িয়ে দাও।

প্রধান পুরোহিত বলল, তাই যাব। ইদেনি, এই মেয়েটাকেও সঙ্গে নিয়ে চল। সুযোগ পেলেই ও পালাবে।

ওকে পালাতে দেব না। বলতে বলতে ইদেনি সজোরে জেনের কব্জি চেপে ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল প্রধান পুরোহিতের পিছনে-পিছনে সকলে গিয়ে হাজির হল মন্দির-চত্বরে।

উড়োজাহাজের মোটরের শব্দ শুনেই জেন আকাশে চোখ তুলল। একটা ছোট বিমান পাখ খেয়ে ঘুরছে। কাভুরুরা বিস্মিত চোখে, ভীত চোখে সেদিকেই তাকিয়ে আছে।

পরমুহূর্তেই জেন দেখল, বিমান থেকে একজন লাফ দিল। তার দেখাদেখি আরও একজন।

একজন সৈনিক চেঁচিয়ে উঠল, ওরা এসে পড়ল! কাবান্দাবান্দা, মরা মানুষের প্রতিহিংসার হাত থেকে আমাদের রক্ষা কর।

বাতাসে প্যারাসুট দুটো খুলে গেল। তা দেখে একটি ক্রীতদাস আর্তনাদ করে উঠল, এবার ওরা পাখনা মেলছে। শকুরেন মত আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

ওরা দু’জন যখন ধীরে ধীরে মাটিতে নামছে তখন একটা হাল্কা হাওয়া ওদের বয়ে নিয়ে চলল মন্দিরের দিকে। ওরা দেখল, সমবেত জনতা মন্দির-চতুরে ভিড় করে আছে। ওরা দেখল, বিমানটি তীব্র গতিতে নেমে যাচ্ছে। আরও দেখল হঠাৎ জনতা উধাও হয়ে মন্দিরে ঢুকে গেল, আর তখনই বিমানটি চত্বরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাতে আগুন ধরে গেল।

টারজান প্রথম মাটিতে পা দিল। তারপর নামল ব্রাউন। দু’জনই ছুটল মন্দিরের দিকে। বাঁধা দেবার কেউ নেই। রক্ষীরাও ভয়ে পালিয়েছে। কয়েকটা চিতাও ভয় পেয়ে ছুটে পালাল।

কিছুটা এগোতেই অনেক কণ্ঠের কল-গুঞ্জন কানে এল। সেই শব্দ লক্ষ্য করে টারজান বারান্দা ধরে এগিয়ে গেল।

সকলে সমবেত হয়েছে কাবান্দাবান্দার দরবার-কক্ষে। প্রধান পুরোহিত সিংহাসনে বসে কাঁপছে আতংকের প্রতিমূর্তি যেন।

অন্য সবাইকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে একটি সৈনিক সিংহাসনের দিকে এগিয়ে গেল। কাবান্দাবান্দার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, তোমার পাপেই আমাদের এই বিপদ। তুমি তোমার শপথ ভাঙতে চেয়েছ। এই মেয়েটা ওগলিকে যাদু করেছিল; তোমাকেও যাদু করেছে। এই মরা মানুষদের ওই লেলিয়ে দিয়েছে আমাদের বিরুদ্ধে। ওকে শেষ করে দাও। নিজের হাতে ওকে শেষ করে দাও; তবেই আমরা রক্ষা পাব।

শত কণ্ঠে ধ্বনি উঠল, ওকে সাবাড় কর! ওকে সাবাড় কর।

দু’জন সৈনিক জেনকে চেপে ধরে টানতে টানতে বেদীর কাছে নিয়ে গেল। কম্পিতদেহ কাবান্দাবান্দা চুলের মুঠি ধরে জেনকে বেদীর উপর তুলে নিল। কটিবন্ধ হতে তুলে নিল তার সুতীক্ষ ছুরি। মেয়েটির বুক লক্ষ্য করে ছুরি তুলতেই দ্বারপথে গর্জে উঠল একটা পিস্তল। কাভুরুদের প্রধান পুরোহিত কাবান্দাবান্দা বুক চেপে ধরে মর্মভেদী হাহাকার করে জেনের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল।

দরজার দিকে তাকিয়েই জেন বলল, টারজান! অরণ্যরাজন টারজান!

একশ’ জোড়া চোখ পড়ল তাদের উপর-টারজান ও ব্রাউন নির্ভয়ে ঘরে ঢুকল। একজন সৈনিকের হাতে বর্শা উদ্যত হতেই কথা বলল ব্রাউনের পিস্তল; সৈনিক ধরাশায়ী হল।

টারজান কথা বলল স্থানীয় ভাষায়। আমরা এসেছি আমাদের মেয়েদের ফিরিয়ে নিতে। বিনা বাধায় তাদের তুলে দাও আমাদের হাতে, অন্যথায় তোমরা মুরবে। মনে রেখো, আমরা অন্য লোকের মত নই। আমাদের রাগিও না।

কাভুরুরা চিত্রার্পিতের মত দাঁড়িয়ে রইল।

হঠাৎ আনেৎকে দেখতে পেয়ে ব্রাউন এক লাফে সেদিকে এগিয়ে গেল। সৈনিকরা দুই পাশে সরে গিয়ে তাকে পথ করে দিল। আবেগরুদ্ধ গলায় সে আনেকে জড়িয়ে ধরল। ‘

টারজান এক লাফে এগিয়ে জেনকে বলল, চলে এস। ওরা কোন কিছু ভাববার আগেই আমাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে। নিচের ভয়ে জড়সড় মেয়েদের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, মুভিরোর মেয়ে বুইরা কি এখানে আছে?

একটি তরুণী ছুটে বেরিয়ে এল। চীৎকার করে বলল, বড় বাওয়ানা! এবার তাহেল বেঁচে গেলাম।

 টারজান বলল, তাড়াতাড়ি চল। অন্য যে সব মেয়ে এখান থেকে পালাতে চায় তাদেরও সঙ্গে নাও।

পালাতে তো সকলেই চায়। পুরো দলটাই এসে টারজান ও ব্রাউনকে ঘিরে দাঁড়াল। মন্দিরের ফটকের কাছে যেতে না যেতেই তাদের পথ রোধ করে দাঁড়াল ধোয়ার ঘন কুণ্ডুলি; মাথার উপরে দেখতে পেল সশব্দ অগ্নিশিখা।

আনেৎ বলে উঠল, মন্দিরে আগুন লেগেছে।

ব্রাউন বলল, এটাও আমাদেরই কাজ। উড়োজাহাজের আগুনেই মন্দির জ্বলছে। আমরাও বুঝি আটকা পড়ে গেলাম। এখান থেকে বের হবার অন্য কোন পথ কি কারও জানা আছে?

জেন বলল, আছে। মন্দির থেকে বনের মধ্যে যাবার একটা গুপ্ত পথ আছে। আমি তার প্রবেশ পথটা জানি। এদিকে চল। মুখ ফিরিয়ে সে দরবারকক্ষের দিকে পা বাড়াল। অল্পক্ষণেই পৌঁছে গেল কাবান্দাবান্দার ঘরে। হঠাৎ একটা নতুন চিন্তা এল জেনের মাথায়। ব্রাউনের দিকে ফিরে বলল, আমরা সকলেই জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলাম, দু’জন জীবন দিয়েছে, চিরযৌবনের গুপ্ত রহস্য জানতে। সে জিসিন আছে এই ঘরে। চলে এস।

প্রধান পুরোহিতের অন্দরমহলে ঢুকে আলমারিটা দেখিয়ে জেন বলল, এর মধ্যে একটা রহস্য আছে; তাতেই আছে তোমাদের বাঞ্ছিত বস্তু। কিন্তু চাবিটা আছে কাবান্দাবান্দার কাছে।

ব্রাউন বলল, আমার কাছেও একটা চাবি আছে। পিস্তলের এক গুলিতে তালাটাকে ভেঙ্গে সে আলমারি খুলে ফেলল।

ব্রাউন ছোট বাক্সটাকে তুলে নিল। তারপর সকলে ছুটল সুড়ঙ্গ-পথের খোঁজে।

পাশের বারান্দা দিয়ে কিছুটা এগিয়ে সকলে ঢুকল একটা অন্ধকার ঘরে। সেটা পার হয়ে একটা দরজা খুলল। বাইরে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার।

জেন বলল, এই সুড়ঙ্গ শেষ হয়েছে বনের মধ্যে। এই পথে এগিয়ে চল।

***

তিন সপ্তাহ পরে। ছয়টি প্রাণীর একটি দল সমবেত হয়েছে কাভুরুদের গ্রাম থেকে অনেক দূরে টারজনের বাংলোর বসবার ঘরের জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের পাশে। সেখানে আছে অরণ্যরাজ ও তার স্ত্রী; হাতে হাত ধরে সিংহের চামড়ার আসনে বসে আছে ব্রাউন ও আনে; পিছনে একটা চেয়ারে জাঁকিয়ে বসে। আছে টিবস্; আর ছোট্ট নকিমা গম্ভীরভাবে বসেছে একজন ভাইকাউন্টের কাঁধে।

ব্রাউন প্রশ্ন করল, বটিকাগুলো নিয়ে কি করতে চাও?

জেন বলল, তোমার যেমন ইচ্ছা। ওগুলো পাবার জন্য তুমি তো জীবনের ঝুঁকিও নিয়েছিলে। ওগুলো তুমিই নাও।

ব্রাউন বলল, না জীবনের ঝুঁকি তো আমরা সকলেই নিয়েছিলাম; তাছাড়া আসলে তুমিই তো ওগুলো পেয়েছ। এ নিয়ে যত ভাবছি ততই নিজের ভুল বুঝতে পারছি। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা অনেকেই এত বেশিদিন বেঁচে থাকি যে তাতে জগতের কোন কল্যাণই হয় না। অনেকেরই আরও আগেই মরে যাওয়া উচিৎ।

কি করা হবে আমি বলছি। এগুলো আমরা ভাগাভাগি করে নেব। আমরা পাঁচজন হব চিরজীবী।

আর চিররূপসী, আনেৎ যোগ করল।

একটু কেশে টিবস্ বলল, যদি ক্ষমা করেন তো একটা কথা বলি মিস। এত বছর ধরে ট্রাউজার ইস্তিরি করতে হবে-সে কথা ভাবতেও ভাল লাগে না আর রূপ- ওরে বাবা! তাহলে তো চাকরিই জুটবে না। সুন্দর খানসামার কথা কে কবে শুনেছে?

ব্রাউন তবু বলল, তাহলেও আমরা ভাগ করেই নেব। তুমি খেয়ো না। কিন্তু সাবধান, কোন প্রিন্সের কাছে যেন এগুলো বিক্রি করো না। এই নাও, পাঁচটা সমান ভাগ করেছি।

জেন হেসে বলল, তোমরা কি নকিমার কথা ভুলেই গেছ?

ব্রাউন বলল, ঠিক কথা। ভাগ হবে ছয়টা। অনেক মানুষের চাইতে এ জগতে নকিমার দরকার অনেক বেশি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *