বামনের দেশে টারজান (টারজন এ্যান্ড দি অ্যাণ্ট মেন)

বামনের দেশে টারজান (টারজন এ্যান্ড দি অ্যাণ্ট মেন)

উগোগো নদীর তীরে নর-খাদক ওবেবের গ্রামের একটা অন্ধকার নোংরা ঘরে পাছার উপর ভর দিয়ে বসে এস্টেবান মিরান্ডা একটা আধসিদ্ধ মাছের বাকি অংশটা খুবলে খুবলে খাচ্ছিল। তার গলায় ঝুলছে কয়েক ফুট লম্বা মরচে-ধরা শিকলে আটকানো একটা ক্রীতদাস-কণ্ঠি।

গত এক বছর ধরে এস্টেবান মিরান্ডা এইভাবে কুকুরের মত শিকলে বাঁধা আছে। তার নিশ্চিত ধারণা যে সেই গোরিলাদের টারজান; দীর্ঘকাল যাবৎ সে নিজেকে টারজনের সঙ্গে একাত্ম করে ভেবেছে এবং একজন ভাল অভিনেতার মত অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে সেই ভূমিকায় অভিনয় তো করেছেই, উপরন্তু তার মতই জীবন যাপন করেছে-টারজানই হয়ে উঠেছে। ওবেবের কাছেও সে গোরিলাদের টারজান; কিন্তু গ্রামের ওঝা এখনও বলে যে আসলে সে হচ্ছে জল-পিশাচ, আর তাকে না রাগিয়ে বরং তার পূজা করাই উচিৎ। ওঝা গ্রামের মানুষদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে সে তাদের এই বন্দীটি টারজনের ছদ্মবেশে আসলে জল-পিশাচ; সুতরাং তার কোন ক্ষতি হলে গ্রামের সর্বনাশ হয়ে যাবে।

এস্টেবান মিরান্ডার সুখের বিষয়টি হল রুশ ক্রাস্কির হীরকের থলের চিন্তা। গোরিলা-মানুষটির কাছ থেকে থলেটা চুরি করার পরে স্পেনীয় লোকটি ক্রাস্কিকে খুন করে সেটা হস্তগত করে-আবার বোলগানির নিষ্ঠুর অত্যাচারের হাত থেকে হীরক প্রাসাদ উপত্যকায় গোমাঙ্গানিকে উদ্ধার করার পরে সেই। লোকটিই হীরক গম্বুজের নিচে অবস্থিত সুরক্ষিত কক্ষে থলেটি তুলে দেয় টারজনের হাতে।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা নোংরা খোয়াড়ের অস্পষ্ট আলোয় বসে এস্টেবান মিরান্ডা সেই উজ্জ্বল পাথরগুলো গোণে, আদর করে তাতে হাত বুলোয়। কারও পায়ের শব্দ শুনলেই রুপকথার ঐশ্বর্যকে লুকিয়ে ফেলে তার একমাত্র পরিধেয় শতচ্ছিন্ন কটি-বস্ত্রের মধ্যে।

একটি বছরের নির্জন বন্দী-জীবনের পরে এখন আবার তার সামনে দেখা দিয়েছে আনন্দের খোরাকঃ ওঝা খামিসের মেয়ে উহ্হা। একটি বছর ধরে এই রহস্যময় বন্দীটিকে সে দূর থেকে দেখেছে; ক্রমে তার ভয় ভেঙ্গেছে; একদিন বন্দী যখন কুঁড়ের বাইরে রোদে শুয়েছিল তখন মেয়েটি তার কাছে এগিয়ে এল।

তাকে দেখে এস্টেবান থেমে থেমে বলল, এক বছর হল আমি সর্দার ওবেবের গাঁয়ে এসেছিন, কিন্তু আগে কখনও ভাবতেও পারিনি যে তোমার মত একটি সুন্দরী এখানে থাকে। তোমার নাম কি?

উহহা খুশি হল। বলল, আমি উহ্হা। ওঝা খামিস আমার বাবা।

 এস্টেবান শুধাল, তুমি এতদিন আসনি কেন?

 ভয়ে!

কিসের ভয়?

মেয়েটি ইতস্তত করতে লাগল। এস্টেবান হেসে বলল, আমি জল-পিশাচ, তোমার ক্ষতি করব- এই ভয় তো?

হ্যাঁ।

শোন! এস্টেবান ফিসফিস্ করে বলল, কাউকে বলো না কিন্তু। জল-পিশাচ হলেও আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না।

তবু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে উহ্হা ছুটে বাড়ি ফিরে গেল।

দিনের শেষে খামিস বাড়ি ফিরলে এক সময় উহহা তাকে শুধাল, আচ্ছা বাবা, জল-পিশাচের ক্ষতি যারা করে সে তাদের কেমন করে শাস্তি দেয়?

খামিস বলল, নদীতে যত মাছ আছে, তারও তেমিন অসংখ্য উপায় আছে। নদী থেকে মাছ তাড়িয়ে দিতে পারে, জঙ্গল থেকে শিকার তাড়িয়ে দিতে পারে, ফসল নষ্ট করে দিতে পারে। তাহলেই তো আমরা না খেয়ে মরে যাব। রাতের বেলা আকাশ থেকে আগুন এনে ওবেবের সব মানুষকে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে পারে।

একটু চুপ করে থেকে উহহা আবার বলল, তার গলায় কন্ঠি বাঁধা থাকলে সে পালাবে কেমন করে? কে ওটা খুলে দেবে?

খামিস বলল, ওবেবে ছাড়া আর কেউ ওটা খুলতে পারবে না। তার থলির মধ্যে একটা পিতলের টুকরো থাকে; সেটা দিয়েই কণ্ঠিটা খোলা যায়। কিন্তু জল-পিশাচের কোন কিছুই দরকার হয় না। ইচ্ছা করলেই সে সাপ হয়ে কণ্ঠির ভিতর দিয়ে গলে যেতে পারে। আরে, তুমি চললে কোথায়?

ঘাড় ফিরিয়ে মেয়ে বলল, ওবেবের মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে।

ওবেবের মেয়ে তখন ভুট্টা পেষাই করছিল। ওঝার মেয়েকে দেখে মুখ তুলে হাসল। সতর্ক করে দিয়ে বলল, গোলমাল করো না উহ্হা, ভিতরে বাবা ঘুমচ্ছে।

নানান কথা বলতে বলতে এক সময় উহ্হা ছুটে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়াল। ওপাশের দেয়ালের গায়ে ওবেবে মাদুরে শুয়ে ঘুমচ্ছে। তার নাক ডাকছে। উহহা চুপিসারে এগিয়ে গেল। সর্দারের শরীরের নিচ থেকে তার থলির অর্ধেকটা বেরিয়ে আছে। কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে সে থলিটা তুলে নিল। মুখটা খুলে ভিতরে কি আছে দেখল। পিতলের চাবিটা চিনতে তার অসুবিধা হল না। চাবিটা বের করে নিয়ে থলিটা বন্ধ করে আবার বিছানায় রেখে দিল। তারপর সতর্ক দ্রুত পদক্ষেপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

সে রাতে ওবেবের ঘরে উনুনের আগুন ক্রমে ছাই হয়ে গেল; একে একে সকলেই ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ল। এস্টেবান মিরান্ডা তার খোয়াড়ের দরজায় এস্ত পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে কান পাতল।

সে হাঁক দিল, কে?

চুপ! আমি ওঝা খামিসের মেয়ে উহহা। তোমাকে মুক্তি দিতে এসেছি। এই দেখ! তোমার গলার কণ্ঠির চাবি আমার হাতে।

খুব ভাল করেছ। ওটা দাও।

আর একটু এগিয়ে চাবিটা তার হাতে দিয়েই উহহা পালিয়ে যাচ্ছিল; বন্দী তাকে বাধা দিয়ে বলল, দাঁড়াও! যখন মুক্তি দিয়েছ তখন আমাকে জঙ্গল পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে চল, আর কিছু অস্ত্রশস্ত্র এনে দাও। যে আমাকে মুক্তি দেবে, জল-দেবতার কৃপা লাভ করতে হলে এ কাজ তাকে করতেই হবে।

উহহা তীরবেগে অন্ধকার গ্রামের পথে অদৃশ্য হয়ে গেল। বার কয়েক ব্যর্থ চেষ্টার পরে মিরান্ডার গলায় মরচে-ধরা তালাটা খুলে গেল। এবার সে মুক্ত, স্বাধীন। পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই উহ্হা তীর ভর্তি এটা তূণীর, একটা ধনুক ও একটা ছুরি নিয়ে হাজির হল।

এস্টেবান বলল, এবার আমাকে ফটক পর্যন্ত নিয়ে চল।

জল-পিশাচের ভয়ে এবং জল-দেবতার কৃপা লাভের আশায় উহহা এ প্রস্তাবেও রাজী হল। বড় রাস্তাটা এড়িয়ে যতটা সম্ভব কুঁড়ে ঘরগুলোর ছায়ায় ছায়ায় সে এস্টেবানকে নিয়ে গ্রামের ফটকে পৌঁছে গেল।

উহহা ফটক বন্ধ করে গ্রামে ফিরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই এস্টেবান তার হাতটা ধরে বলল, এস, তোমার পুরস্কার নাও।

উহ্হা নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল। কিন্তু মিরান্ডা হাত দিয়ে তার মুখটা চেপে ধরে মেয়েটিকে তুলে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

লর্ড গ্রেস্টোকের আফ্রিকাস্থ বাংলোর বারান্দা থেকে নেমে তিনটি প্রাণী গোলাপ-বীথির ভিতর দিয়ে ফটকের দিকে হাঁটতে লাগল। দু’জন পুরুষ ও একজন স্ত্রীলোক; বয়স্ক লোকটির হাতে বৈমানিকের শিরস্ত্রাণ ও একজোড়া গগলস্। যুবকটির কথা মন দিয়ে শুনতে শুনতে সে নিঃশব্দে হাসছে।

যুবকটি বলল, মা এখান থাকলে তুমি এ কাজ করতে পারতে না; মা তোমাকে করতে দিত না।

টারজান বলল, তুমি ঠিক কথাই বলেছ। কিন্তু এবারটা তুমি আমাকে উড়তে দাও; আমি কথা দিচ্ছি, তোমার মা ফিরে না আসা পর্যন্ত আর আকাশে পাড়ি দেব না।

তরুণীটি বলল, ওর মতই আমারও তোমার জন্য ভয়ের অন্ত নেই বাবা। তুমি এত বেশি ঝুঁকি নাও যে মনে হয় তুমি বুঝি বা নিজেকে অমর বলে মনে কর। তোমার আরও সাবধান হওয়া উচিত।

যুবকটি স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে বলল, মিরিয়েম ঠিকই বলেছে; তোমার আরও সাবধান হওয়া উচিত বাবা।

দূরের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে একটা বাইপ্লেন। আর ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে দুটি ওয়াজিরি সৈনিক। শিরস্ত্রাণ ও গগলস পরে টারজান ককপিটে চড়ে বসল।

এক মুহূর্ত পরেই বাইপ্লেনটা আকাশে উড়ল।

ঘণ্টা দেড়েক ধরে টারজান সোজা উড়ে চলল। যে রকম সহজ নৈপুণ্যের সঙ্গে সে জাহাজটাকে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে তারই অনাস্বাদিতপূর্ব আনন্দে সে ভুলেই গেল কতক্ষণ ধরে উড়ছে, বা কতদূর পথ পার হয়েছে।

টারজান স্থির করল, জাহাজটাকে বাড়িমুখো ফেরাবার আগে এই রহস্যটকা দেশটাকে আরাও ভাল করে দেখতে মাটির আরও কাছাকাছি নামবে। করলও তাই। হঠাৎ তার খেয়াল হল, বিচিত্র এই নতুন দেশটাকে দেখতে সে এতই মশগুল হয়ে পড়েছিল যে কখন অজান্তে জাহাজটা বেশি নিচে নেমে গেছে। সঙ্গে সঙ্গেই জাহাজটা অনেক উঁচু একটা বড় গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে পাক খেয়ে সশব্দে ভেঙ্গে পড়ল। মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরেই সব নিশ্চুপ।

বনপথ ধরে এগিয়ে এল একটি অতিকায় প্রাণী; দেহ গঠন মানুষের মত, অথচ ঠিক মানুষ নয়। কড়াপড়া শক্ত হাতে একটা মুগুর নিয়ে একটা অতিকায় পশু বুঝি দুই পায়ে খাড়া হয়ে এগিয়ে এল। প্রাণীটির উচ্চতা ছ’ ফুটের মত।

আরও খানিকটা এগিয়ে এসে দেখতে পেল একটা লোক পথের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। সে গোরিলা-মানুষ টারজান। সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। মাথার উপরে তার বিধ্বস্ত বাইপ্লেনটা গাছের ডালে আটকে রয়েছে।

এই বিচিত্র লোকটিকে দেখে অবাক হল, কিন্তু ভয় পেল না। আঘাত করতে হাতের মুগুরটা তুলেও কেন কে জানে আঘাত করল না। তারপর গোরিলা-মানুষের দেহটাকে একঝটকায় কাঁধে তুলে নিয়ে যেদিকে যাচ্ছিল সেই দিকেই হাঁটতে লাগল।

টারজানকে কাঁধে নিয়ে একটা বিচিত্র পাথরের গুহায় সে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে তার ছেলেমেয়েরা টারজানকে ঘিরে দাঁড়াল। তাকে ভাল করে দেখল, উল্টে দিল, খোঁচা দিল চিমটি কাটল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না, টারজান যেমন ছিল তেমনি পড়ে রইল।

টারজনের ভাগ্য ভাল, উড়োজাহাজ থেকে পড়ার সময় নরম ডালপালার ভিতর দিয়ে পড়ায় মাথায় সামান্য আঘাত ছাড়া বড় রকমের কোন আঘাত পায়নি। ধীরে ধীরে তার জ্ঞান ফিরে এল। ক্রমে শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল।

উঠে বসল। ধীরে ধীরে গুহার বাইরে বেরিয়ে এল। সেখানে অনেকগুলো ছেলেমেয়ে কেউ রোদে, কেউ বা ছায়ায় বসে আছে। টারজান ভাবল, এরা কারা? এরা কি তার রক্ষী, না নিজেরাই বন্দী?

কালো চুলের মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে টারজান মাথাটা নাড়তে লাগল। তার মনে পড়ল, মাঝপথে হঠাৎ বিমানটা ভেঙ্গে পড়েছিল, একটা বড় গাছের ডালপাতার ভিতর দিয়ে সে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল; কিন্তু তাছাড়া আর কিছুই তার মনে পড়ছে না। আলালি ছেলেমেয়েদের দিকে চোখ রেখে নির্ভীক সিংহের মত সদম্ভে পা ফেলে বাইরের উঠোনে এসে দাঁড়াল।

সঙ্গে সঙ্গে ছেলেমেয়েগুলো এগিয়ে এসে তাকে ঘিরে ধরল। ছেলেগুলোকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে মেয়েগুলোই কাছে এগিয়ে এল। টারজান তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল; পর পর নানা উপজাতির ভাষায় কথা বলল, কিন্তু তারা কোনটাই বুঝতে পারল না। সকলেরই ক্রুদ্ধ দৃষ্টি তখন টারজনের উপর। তাকে দিয়ে পেটের ক্ষিধে মেটাতে তারা তখন কৃতসংকল্প।

কিন্তু তাদের বাধা দিল ষোল বছরের একটি ছেলে। নানা রকম অঙ্গভঙ্গী করে ও মাথা নেড়ে সে অন্য সকলকে বিরত করতে চেষ্টা করতে লাগল। ফল কিন্তু হল উল্টো। ক্ষিধের জ্বালায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে অন্য ছেলেমেয়েগুলো এই ছেলেটাকেই পাল্টা আক্রমণ করে বসল। দ্রুত সরে গিয়ে ছেলেটা কোমর থেকে কয়েকটা পালক-লাগানো পাথর তুলে নিয়ে তাদের দিকে ছুঁড়ে মারল। দুটি মেয়ে আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তৃতীয় পাথরটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে একটা ছেলের কপালে গিয়ে লাগতে সেও সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল। এবার ছেলেমেয়েরা সকলেই মারমার ভঙ্গীতে ছেলেটাকে তাড়া করে এল। একটা পাথর আবার তাদের লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিয়েই ছেলেটা টারজনের দিকে ছুটে গেল।

কিসের টানে কে জানে টারজান ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হাসল। ছেলেটা ভয়ঙ্কর দুই পাটি দাঁত মেলে ধরল; অবশ্য টারজনের বুঝতে অসুবিধা হল না যে ছেলেটা তার হাসিরই প্রতিদান দিল। টারজান। আবার ছেলেটার দিকে তাকাল; সে তখন ভয়ে কাঁপছে। অদূরেই পিছনের একটা প্রাচীর। একটানে আলালুস জাতির ছেলেটাকে কাঁধে তুলে নিয়ে টারজান সেইদিকে ছুটে গেল। এক লাফে প্রাচীরের উপর চড়ে বসে ছেলেটিকেও ও পাশের মাটিতে নামিয়ে দিয়ে নিজেও সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়ল।

পথ দেখিয়ে ছেলেটা ছুটছে আগে আগে; পিছনে ছুটছে টারজান। কিন্তু অচিরেই সে দ্রুততর গতিতে ছেলেটাকে ছাড়িয়ে আগে চলে গেল। পরমুহূর্তেই অনুসরণকারীদের বোকা বানিয়ে টারজান জঙ্গলে ঢুকেই। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। কিন্তু দূর থেকেও তার চোখ রইল আলালুস ছেলেটার দিকে। সে তখন নিচের পথ ধরে প্রাণপণে ছুটছে।

আলালুস যুবকটিকে সঙ্গে নিয়ে শুরু হল টারজনের দীর্ঘ পথযাত্রা।

এইভাবে টারজান ও আলালুস যখন দীর্ঘ অরণ্যপথ পার হয়ে চলল আর টারজান খুঁজতে লাগল একটা। পালাবার পথ, ঠিক তখনই ওঝা খামিসের মেয়ে ছোট্ট উহহাকে সঙ্গে নিয়ে সেই একই অরণ্যের অন্য। প্রান্তের পথ ধরে এগিয়ে চলেছে এস্টেবান, পশ্চিম উপকূলে যাবার একটা পথের সন্ধানে।

আলালুস যুবকটি টারজনের পিছনেই লেগে রইল। এতদিনে টারজানও যুবকটির ইঙ্গিত ভাষা কিছুটা শিখে নিয়েছে।

একদিন তেমনিভাবে একা শিকারে বেরিয়ে টারজান একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল। দেখতে পেল একটি বিরাটকায়া আলালুস নারীকে; তাকে ঘিরে ধরেছে একদল বেঁটে বামন- পশ্চিম উপকূলের বিশেষ ধরনের হরিণের পিঠে সওয়ার হয়ে তারা হাতের বর্শা ও তরবারি দিয়ে বার বার আঘাত করছে আলালুস নারীর বিরাট দুটি পায়ে; নারীটিও আক্রমণকারীদের লাথি মেরে ও হাতের মুগুর চালিয়ে ধীরে ধীরে জঙ্গলের দিকে পিছু হটে যাচ্ছে। নারীটির এক এক লাথিতে আক্রমণকারীদের ডজনখানেক সৈনিক। ধরাশায়ী হচ্ছে; ইতোমধ্যেই শ’খানেক যোদ্ধার প্রায় অর্ধেকই মারা পড়েছে।

টারজান জঙ্গলের আড়াল থেকে খোলা জায়গায় বেরিয়ে এল। তাকে দেখা মাত্রই দ্বিতীয় শত্রু মনে করে বামন সৈন্যরা হতাশায় চীৎকার করে রণে ভঙ্গ দিল। কিন্তু নারীটি মুখ ভেংচে মুগুর উঁচিয়ে তাকেই তেড়ে এল। তার বাঁ হাতের মুঠিতে ঝুলছে একটি বেঁটে মানুষ। সঙ্গে সঙ্গে টারজানও ধনুকে তীর জুড়ে হুংকার দিয়ে উঠল, চলে যাও, নাইলে তোমাকে খুন করে ফেলব। আর যাবার আগে হাতের ছোট মানুষটিকে ছেড়ে দিয়ে যাও।

নারীটি কিন্তু হিংস্র ভঙ্গীতে দাঁত বের করে আরও জোরে ছুটে এল। আর দেরী করা বিপজ্জনক। টারজান হাতের তীর ছুঁড়ে দিল। সে তীর আমূল বিদ্ধ হল নারীটির বুকে। সে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। কিন্তু তার আগেই টারজান এক লাফে এগিয়ে গিয়ে তার মুঠোর ভিতর থেকে বামন সৈন্যটিকে উদ্ধার করে আনল।

সমবেত বামনরা আনন্দে হৈ-হৈ করে এগিয়ে এল। নতজানু হয়ে সকলে টারজনের হাতে চুমো খেতে লাগল। টারজান বুঝতে পারল, এই লোকটি তাদের সকলের শ্রদ্ধার পাত্র; হয়তো তাদের সর্দার।

সকলের দিকে ভাল করে তাকিয়ে টারজান বুঝল, এদের মধ্যে যে সবচাইতে লম্বা তার উচ্চতা মাত্র আঠারো ইঞ্চি; রোদে পুড়ে তাদের সাদা চামড়া অনেকটা তামাটে রং ধরেছে।

মুক্তিপ্রাপ্ত যুবকটি এগিয়ে এসে টারজনের সামনে নতজানু হয়ে হাত বাড়াল; টারজানও মাথাটাকে ঈষৎ নামিয়ে হাত বাড়িয়ে অভিবাদন জানাল। সর্দার জানাল, তারা এবার ফিরে যাবে; অতএব টারজানও তাদের সঙ্গেই চলুক।

কৌতূহল বশতই টারজান তারেদ সঙ্গে যেতে সম্মত হল।

যাই হোক, দিনের আলো থাকতে থাকতেই এক সময় টারজান দেখতে পেল, অনেক দূরে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে গুম্বুজ আকারের অনেকগুলো পাহাড়ের চূড়া আর একদল সৈনিক হরিণের পিঠে সওয়ার হয়ে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে দ্রুত গতিতে।

আরও কাছে পৌঁছে টারজান দেখল, অসংখ্য বামন সেই পাহাড়-চূড়াগুলোতে চলাফেরা করছে; আর যেগুলোকে দূর থেকে পাহাড়ের চূড়া বলে মনে হয়েছিল আসলে সেগুলো ছোট ছোট পাথরের তৈরি। গম্বুজ- ওয়ালা বাড়ি; নিজেরাই সেগুলো তৈরি করেছে।

সকলের সঙ্গেই টারজনের একটা হৃদ্যতা গড়ে উঠল। বিশেষ করে তাদের রাজা অ্যাডনড্রোহাখিস তো তার উপর খুব খুশি, কারণ রাজার ছেলে কোমোডোফ্লোরেন্সলকে সেই বাঁচিয়েছে আলালুস নারীর কবল থেকে। অতএব পরম সুখেই তার দিন কাটতে লাগল।

কথা প্রসঙ্গে একদিন টারজান রাজকুমার কোমোডোফ্লোরেন্সলকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার স্ত্রী কোথায়?

সে জবাব দিল, আমার স্ত্রী নেই। পার্শ্ববর্তী শহর ভেল্টোপিসমেকাসের বিরুদ্ধে আমাদের একটা যুদ্ধের আয়োজন চলছে। সেখানকার রাজার একটি পরমা সুন্দরী কন্যা আছে; নাম জাজারা। রাজা অ্যাডেনড্রোহাখিসের ছেলের সেই হবে উপযুক্ত পাত্রী।

একদিন রাজা অ্যাডেনড্রোহাখিসের শহরের এক প্রান্তে একটা বড় গাছের নিচে ঘাসের বিছানায় শুয়ে। ছিল টারজান। হঠাৎ মাটির নিচ থেকে একটা অস্পষ্ট কাঁপন কানে আসায় তার ঘুম ভেঙ্গে গেল।

জেগে উঠে ভাল করে কান পাততেই সে বুঝতে পারল, শব্দটা মাটির নিচে থেকে আসছে না, আসছে মাটির উপর থেকেই, আর সেটাও খুব দূর থেকে নয়। শব্দটা অতি দ্রুত এগিয়ে আসছে। মুহূর্তমাত্র হতচকিতভাবে থেকেই হঠাৎ সে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। রাজা অ্যাডেনড্রোহাখিসের প্রাসাদ গম্বুজ মাত্র শ’খানেক গজ দূরে; টারজান সেই দিকে পা চালিয়ে দিল। দক্ষিণ ফটকের মুখে জনাকয়েক সৈনিকসহ একজন অফিসার এসে প্রশ্ন করল, ব্যাপার কি?

টারজান জবাব দিল, অনেক হরিণের আসার শব্দ সে শুনতে পেয়েছে।

অফিসার বলল, কোন্ দিক থেকে আসছে?

পশ্চিম দিকে আঙ্গুল বাড়িয়ে টারজান বলল, শব্দটা ঐদিক থেকেই আসছে বলে মনে হচ্ছে।

ভেল্টোপিসমেকাসের লোকেরা আসছে। চীৎকার করে কথাগুলো বলেই অফিসার সঙ্গীদের দিকে ঘুরে বলল, শীঘ্র যাও। ট্রোহানাডামেকাসের লোকদের জাগাও- আমি যাচ্ছি রাজপ্রাসাদ ও রাজাকে সতর্ক করে দিতে।

সকলেই যার যার পথে চলে গেল।

টারজান দেখতে পেল, অবিশ্বাস্যরকম অল্প সময়ের মধ্যেই হাজার হাজার সৈনিক দশটি গম্বুজের প্রতিটি থেকে জলস্রোতের মত বেরিয়ে আসছে। উত্তর ও দক্ষিণ ফটক দিয়ে বেরিয়ে আসছে হরিণারোহী সৈনিক আর পূর্ব ও পশ্চিম ফটক দিয়ে বেরিয়ে আসছে পদাতিক সৈন্যের দল।

সৈন্য পরিচালনার গুরু দায়িত্ব নিয়ে গম্বুজ-প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এসেছে যুবরাজ কোমোডোফ্লোরেন্সল। শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সে শহর থেকে দু’মাইল দূরে প্রথম ঘাঁটি বানিয়েছে সাত হাজার পাঁচ শ’ সৈন্যের। তার পিছনে আধ মাইল দূরে রেখেছে দু’হাজার সৈন্য; তাছাড়া অগ্রবর্তী সৈন্যদলে আছে দশ হাজার সৈনিক; গোটা শহরটাকে তারা ঘিরে রেখেছে।

টারজান রাজা অ্যাডেড্রোহাখিসের দিকে এগিয়ে গেল। রাজার গায়ের সোনালী পোশাক ঝলমল করছে।

তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে রাজা বলল, রক্ষী-দলপতি আমাকে বলেছে, ভেল্টোপিসমেকাস বাহিনীর আগমন বার্তা তুমিই সকলের আগে জানিয়েছ। তাই আর একবার ট্রোহামাডামেকাসের মানুষদের তুমি কৃতজ্ঞতাপাশে বেঁধেছ। কি করলে সে ঋণ শোধ হবে বল?

টারজান সবিনয়ে জানাল, আমার কাছে তোমাদের কোন ঋণ নেই। তোমাদের বন্ধুত্ব লাভ করলেই আমি খুশি হব। তুমি শুধু এই অনুমতি দাও, আমি যেন তোমার ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে পারি।

রাজা বলল, মৃত্যু-কীট যতদিন আমাকে গিলে না খাবে ততদিনই আমি তোমার বন্ধু থাকব। তোমার যেখানে খুশি যেতে পার। তুমি যে যুদ্ধের জায়গাটাই বেছে নিয়েছ তাতে আমি মোটেই বিস্মিত হয়নি।

যুবরাজ কোমোডোফ্লোরেন্সল তাকে সাদরে গ্রহণ করল। তার কাঁধে একটা পাতা ভরা ডাল দেখে যুবরাজ অবাক হয়ে তাকাল।

টারজান বলর, খবর কি?

যুবরাজ বলল, খবর পেয়েছি, ওদের দলে আছে বিশ থেকে ত্রিশ হাজার সৈন্য।

ঠিক তখনই পশ্চিম দিক থেকে একটা শব্দের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল।

 যুবরাজ হাঁক দিল ওরা এসে পড়েছে।

উঁচু নিচু প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে টারজান দেখল, ভেল্টোপিসমেকাস বাসীরা দলে দলে এগিয়ে আসছে।

কোমোডোফ্লোরেন্সলের হুকুমে শুরু হল প্রচণ্ড লড়াই। সেদিকে তাকিয়ে যুবরাজ বলল, সংখ্যায় ওরা অনেক বেশি। সেই সংখ্যার জোরেই ওরা আমাদের কিছু লোককে বন্দী করবে, আমরাও কিছু লোককে বন্দী করব।

বলতে বলতেই যুবরাজ সেখান থেকে সরে গেল। সে ছুটে গেল নিজের সৈন্যদের পাশে। সেখানে চলেছে দুই পক্ষের হাজার হাজার সৈন্যের মরণপণ সংগ্রাম।

এতক্ষণে ভেল্টোপিসমেকাসবাসীদের দৃষ্টি পড়ল টারজনের উপর। তারা দলে দলে ধেয়ে এল তাকে লক্ষ্য করে। টারজানও প্রথমে হাতের ডালটা দিয়ে তাদের ঝাটা-পেটা করতে লাগল। কিন্তু শত্রুপক্ষ যে সংখ্যাহীন। টারজনের আঁটার আঘাতে যতজন মারা যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে তারা দশগুণ এসে তার উপর। ঝাঁপিয়ে পড়ল।

হঠাৎ একটি বেঁটে সৈনিক এসে ছুঁ মারল টারজনের পেটে; সে আঘাতে তার মাথাটা ঘুরে গেল। মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে গেল সে।

নরখাদক ওবেবেদের ওঝা খামিসের মেয়ে উহহা জঙ্গলের মধ্যে একটা ভাঙা ঘরে ঘাসের উপর গুঁড়ি-সুড়ি মেরে শুয়ে আছে।

স্পেনীয় লোকটির দিকে তাকিয়ে ছোট্ট নিগ্রো মেয়েটির চোখ দুটি ঝিকমিকিয়ে উঠল, কারণ তার প্রতিহিংসা সাধনের উপায় রয়েছে ঐ লোকটিরই দখলে। আগুনের দিকে ঝুঁকে শুয়ে পড়ে লোকটি খুশি মনে তাকিয়ে আছে তার ছোট হরিণ চামড়ার থলেটার দিকে। ছোট্ট উহহা জানে, থলের ভিতরকার এই ঝকমকে ছোট্ট পাথরগুলোকে এস্টেবান মিরান্ডা কত ভালবাসে। সেগুলো যে হীরে তা সে জানে না, সেগুলোর মূল্যও বোঝে না। শুধু জানে যে এই পাথরগুলোকে লোকটা এত ভালবাসে যে সে মরবে তবু ওগুলো হাতছাড়া করবে না।

এক সময় স্পেনীয় লোকটির শ্বাস-প্রশ্বাস থেকেই বোঝা গেল সে ঘুমিয়ে পড়েছে। আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে উহহা ঘাসের নিচে হাত ঢুকিয়ে একটা বড় মুগুর টেনে বের করল। খুব সাবধানে ধীরে ধীরে উঠে ঘুমন্ত মিরান্ডার পাশে হাঁটু ভেঙ্গে বসল। মুগুরটাকে মাথার উপর তুলে সবেগে মাত্র একবার এস্টেবানের খুলিতে আঘাত হানল- একটি আঘাতই যথেষ্ট। কিন্তু উহহা চায় না যে সে মারা যাক; সে বেঁচে থেকে জানুক যে উহহা তার বড় আদরের থলেটা চুরি করেছে। মিরান্ডার কোমরে ঝোলানো ছুরিটা দিয়েই কটিবস্ত্রটা কেটে উহহা তার চামড়ার থলে ও হীরেগুলো হাতিয়ে নিল। তারপর দরজার কাটা গাছগুলো সরিয়ে রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

জ্ঞান ফিরে এলে টারজান দেখল, একটা বড় ঘরের মাটির মেঝেতে সে শুয়ে আছে। দুটো বড় আকারের মোমবাতি জ্বলছে ঘরে।

ঘরে পঞ্চাশ থেকে একশ’ জন অন্য লোক রয়েছে। সকলেরই উচ্চতা প্রায় তারই মত, কিন্তু তারা সকলেই সশস্ত্র ও সুসজ্জিত। টারজান ভুরু কুঁচকে অনেকক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে রইল।

ভাল করে জ্ঞান হতে আরও বুঝতে পারল যে তার সারা শরীরে ব্যথা, হাত দুটো ভারী ও অবশ। হাত নাড়তে চেষ্টা করল-পারল না, দুটো হাতই পিছমোড়া করে বাঁধা। তবে পায়ে কোন বাঁধন নেই। অনেক কষ্টে উঠে বসে চারদিকে তাকাল। ঘরভর্তি সৈনিক; দেখতে হুবহু ভেল্টোপিস্মেকাসবাসীদের মত। কিন্তু তাদের উচ্চতা স্বাভাবিক মানুষেরই মত। ঘরে অনেকগুলো টেবিল ও বেঞ্চি পাতা; লোকগুলো হয় তাতে বসে আছে, নয়তো মেঝেতে শুয়ে আছে। তাদের প্রায় সকলেই আহত, অনেকে গুরুতর আহত। কিছু লোক তাদের সেবা-শুশ্রূষা করছে।

টারজনের ক্ষতস্থানগুলো খুব তাড়াতাড়ি শুকিয়ে গেল। সাত দিনের দিন তাকে হাজির করা হল রাজা একোমোয়েলগোর প্রাসাদে।

ফটকের দরজা খুলে গেল। প্রকাণ্ড ঘর। উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত, নানা কারুকর্মে ঝলমল। উঁচু বেদীর উপর আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে বসে আছে রাজা।

রক্ষী-সর্দার তার সম্মুখে নতজানু হয়ে অভিবাদন জানিয়ে বললঃ হে একোমোয়েলহাগো, ভেল্টোপিসমেকাসের রাজা, সর্ব-মানবের শাসনকর্তা, তোমার হুকুম মতই জোয়ান্‌থ্রোহাগোর এই ক্রীতদাসকে এনেছি।

কয়েক মিনিট নিঃশব্দে তার দিকে তাকিয়ে থেকে রাজা বলল, তুমি কোন্ শহর থেকে এসেছ?

জবাব দিল রক্ষী-সর্দার, এ বেচারি কথা বলতে পারে না।

কোন শব্দ করতে পারে? রাজা শুধাল।

বন্দী হবার পর থেকে কোন শব্দই উচ্চারণ করেনি।

এই সময় ঘরের অন্য দিকের দরজাটা খুলে গেল। রাজকুমারী ঘরে ঢুকলে রাজা বলল, এস জানূজারা। দেখ কী বিচিত্র এক দৈত্যকে এখানে আনা হয়েছে।

রাজকুমারী মেঝে পেরিয়ে টারজনের সামনে এসে দাঁড়াল। টারজান বুঝল, এই মেয়েটির সঙ্গেই একদিন তার বন্ধু কোমোডোফ্লোরেন্সলের বিয়ে হবে। হঠাৎ সে লক্ষ্য করল, রাজকুমারীর সুন্দর ভুরু দুটি যেন বাঁকা হয়ে উঠল।

রাজকীয় গম্বুজ থেকে টারজানকে সোজা নিয়ে যাওয়া হল শহর থেকে সিকি মাইল দূরে অবস্থিত খনি অঞ্চলে। মাটির নিচে একটা আলোকিত ঘরে ঢুকে তাকে খনির ভারপ্রাপ্ত অফিসারের হাতে তুলে দিয়ে রাজার হুকুম জানিয়ে দেয়া হল।

টেবিলে রাখা একটা মস্ত বড় খাতা খুলে অফিসার বলল, তোমার নাম?

রক্ষী-সর্দার বলল, ও তো জাটাকোলোলদের মতই বোবা; সুতরাং ওর কোন নাম নেই।

অফিসার বলল, ঠিক আছে, ওকে আমরা দৈত্য বলে ডাকব। খাতায় লিখল-জুয়াল, মালিক জোয়ান্‌থ্রোহাগো, নিবাস ট্রোহানাডালমেকাস; তারপর একজন সৈনিককে ডেকে বলল, ওকে ছত্রিশ তলায় নিয়ে যাও; সেখানকার সর্দারকে বলে দিও ওকে যেন হাল্কা কাজ দেয়া হয়, আর ওর যেন কোনরকম ক্ষতি না হয়, কারণ সেটাই রাজার হুকুম-যাও! না, দাঁড়াও; এই নাও ওর সংখ্যা; এটা ওর কাঁধে সেটে দাও।

কালো অক্ষরে সংখ্যার ছাপ মারা একটা গোল কাপড়ের টুকরো নিয়ে সৈনিক সেটাকে পিতলের আংটা দিয়ে টারজনের সবুজ জামার কাঁধের সঙ্গে আটকে দিল।

টারজানকে হাল্কা কাজই দেয়া হল। সেই সুযোগে অবসর সময়ে সে চারদিকের সব কিছু দেখে বেড়াতে লাগল।

তাকে সবচাইতে বিস্মিত করেছে এই লোকগুলোর দেহের আকার। তারা কেউ বামন নয়, যে কোন ইউরোপীয় মানুষের মতই দেখতে।

একদিন ঘুরতে ঘুরতে একটি তরুণীর সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল। উনুনের আগুনে সে এক টুকরো মাংস ঝলসাচ্ছিল। চোখে চোখ পড়তেই সে ইশারায় টারজানকে কাছে ডাকল। কাছে গিয়ে দেখল মেয়েটি খুবই সুন্দরী।

তুমি দৈত্য? মেয়েটি শুধাল।

 আমি জুয়াল, টারজান জবাব দিল।

ওর কাছে তোমার কথা শুনেছি। আমি তোমার জন্যও খানা পাকাব, অবশ্য অন্য কারও সঙ্গে যদি সে ব্যবস্থা না করে থাক।

কারও সঙ্গে কোন ব্যবস্থাই আমি করিনি; কিন্তু তুমি কে, আর ওটাই বা কে?

মেয়েটি বলল, আমি টালাস্কার, কিন্তু আমি তো ওর শুধু সংখ্যাটাই জানি। তার সংখ্যা আট শ’র তিনগুণ যোগ উনিশ। তোমার সংখ্যা দেখছি আট শ’র তিনগুণ যোগ একুশ। তোমার কি কোন নাম আছে?

সবাই আমাকে জুয়ানথ্রল বলে ডাকে।

পিছন থেকে একটা হাত তার কাঁধ স্পর্শ করল; একটি পুরুষ-কণ্ঠ ডাকল তার নাম ধরে : টারজান!

মুখ ফেরাতেই পূর্ব-পরিচয়ের একটা খুশির ঝলকে টারজনের মুখ ঝম করে উঠল।

কোম-! সহর্ষে সে ডাকতেই যাচ্ছিল, কিন্তু লোকটির তর্জনী ততক্ষণে তার ঠোঁটের উপর উঠে এসেছে। লোকটি বলল, এখানে ও নাম নয়। এখানে আমি আওপোলটো।

কিন্তু তোমার এত বড় শরীর! তুমি তো এখন আমার মতই বড়। বামনরা সব হঠাৎ এত বড় হয়ে উঠল কেমন করে?

কোমোডোফ্লোরেন্সল হাসল। বলল, মানুষের অহংকারই তাকে বুঝতে দেয় না যে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো দিক থেকেও তো ঘটে থাকতে পারে।

টারজান বলল, কী বলতে চাও তুমি? তাহলে কি আমিই বেঁটে হয়ে গেছি?

কোমোডোফ্লোরেন্সল মাথা নাড়ল। একটা গোটা জাতির মানুষজন, তাদের জিনিসপত্র, অস্ত্রশস্ত্র, বাড়িঘর সব কিছু হঠাৎ আকারে বড় হয়ে গেছে- এটা ভাবার চাইতে তুমি নিজেই ছোট হয়ে গেছ সেটা ভাবাই সহজতর নয়?

 কিন্তু সে তো অসম্ভব! টারজান চীৎকার করে বলল।

যুবরাজ বলল, কয়েক চাঁদ আগে পর্যন্ত আমিও তাই বলতাম। এমন কি যখন গুজব রটে গেল যে ওরা তোমাকে বেঁটে করে দিয়েছে তখনও আমি তা বিশ্বাস করি নি। কিন্তু এখন তো নিজের চোখেই সব দেখতে পাচ্ছি।

কি করে এটা করল? টারজান জানতে চাইল।

কোমোডোফ্লোরেন্সাল বলতে লাগল, ভেল্টোপিসমেকাসে, হয়তো গোটা বামনদের দেশেই, জোয়ান্‌থ্রোহাগো হচ্ছে সবচাইতে পণ্ডিত লোক। তার অনেক অলৌকিক কীর্তির কথা আমরা শুনেছি। সে একজন শ্রেষ্ঠ ওয়ালমাক।

টারজান বলল, বামনদের দেশে এরকম কোন যাদুকরের কথা তো আগে কখনও শুনি নি। টারজনের ধারণা ‘ওয়ালমাক’ কথাটার অর্থ যাদুকর। অবশ্য অনেকটা তাই বটে। যে বিজ্ঞানী অলৌকিক কাণ্ড ঘটাতে পারে তাকেই বলা হয় ওয়ালমাক।

আওলোলটো বলতে লাগল, জোয়ানথ্রোহাগোই তোমাকে বন্দী করেছিল। তোমাকে ভেল্টোপিসমেকাসে নিয়ে আসার পরে নিজের যন্ত্রপাতির সাহায্যে সেই তোমাকে বেঁটে বানিয়ে দিয়েছে। ওদের আলোচনা থেকেই আমি এ সব জেনেছি; ওরা বলছে, এ কাজ করতে তার নাকি বেশি সময়ও লাগেনি।

কি ভেবে টারজান বলল, যে কাজ জোয়ানথ্রোহাগো করেছে সেটাকে পাল্টে দেবার ক্ষমতাও নিশ্চয় তার আছে।

সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। কোন জীবকে মূল আকারের চাইতে বড় করতে সে পারে না, যদিও অনেক জীবজন্তুকে সেই আজ পর্যন্ত ছোট করেছে।

টারজান সখেদে বলল, তাহলে তো দেশে ফিরে আমার শত্রুদের কাছে আমি খুবই অসহায় হয়ে পড়ব।

যুবরাজ ধীর গলায় বলল, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না বন্ধু।

 কেন?

কারণ তোমার নিজের দেশে ফিরে যাবার কোন সম্ভাবনা নেই। যদি বাবা কখনও ভেল্টোপিসমেকাসের লোকদের যুদ্ধে হারাতে পারে, তবেই আমাদের উদ্ধারের একটা উপায় হতে পারে।

টারজান বলল, তাহলে তুমি কি মনে কর যে বাকি জীবনটা আমাদের এই পাতালের গর্তেই কাটাতে হবে?

দুঃখের হাসি হেসে যুবরাজ বলল, কখনও যদি আমাদের মজুরের কাজ করতে বাইরের জগতে পাঠায়, তাহলে

দুই কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে টারজান বলল, বুঝেছি। দেখাই যাক।

অনেকগুলো ঘর ও বারান্দা পেরিয়ে টারজান ও কোমোডোফ্লোরেন্সলকে প্রাসাদের একই তলায়। একেবারে ভিতরের দিকে একটা ছোট ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে দিয়ে বাইরে থেকে খিল এঁটে দেয়া হল।

কোমোডোফ্লোরেন্সল ফিস ফিস করে বলল, এবার আমরা একা; সব কথা বলা যেতে পারে।

 টারজান শুধাল, আমরা কোথায় আছি?

যুবরাজ বলল, আমরা আছি এলুকোমোয়েলহাগোর গম্বুজের একেবারে সর্বোচ্চ তলায় একটা ভিতরের ঘরে। একেবারে নিচু তলা থেকে ছাদ পর্যন্ত খোলা জায়গাটা সোজা উঠে গেছে এ ঘরটা তার ঠিক পাশে বলেই বেঁচে থাকার জন্য আমাদের কোন মোমবাতির দরকার হচ্ছে না-খোলা জায়গাটা দিয়ে যথেষ্ট হাওয়া আমরা পাচ্ছি। এবার বল, ঘরের মধ্যে এতক্ষণ কি হল।

টারজান বলল, কি পদ্ধতিতে আমাকে বামন করা হয়েছে সেটা দেখলাম; আরও জানলাম, যে কোন সময়ে আমার আগেকার শরীর আবার ফিরে পেতে পারি-তিন থেকে ঊনচল্লিশ চাঁদের মধ্যে যে কোন দিন সেটা ঘটতে পারে।

যতদিন এই ছোট ঘরে আছ ততদিন সেটা না ঘটলেই ভাল।

 যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে এখান থেকে বের হতেই হবে।

যুবরাজ জানালার কাছে গিয়ে গরাদের মোটা শিকগুলো দেখিয়ে বলল, তুমি কি মনে কর যে এগুলো ভাঙতে পারবে?

টারজান বলল, এখনও তো পরীক্ষা করে দেখিনি, বলেই জানালার কাছে গিয়ে শিকগুলো পরীক্ষা করতে কিছুটা চাপ দিতেই বেঁকে গেল। এবার সবলে চাপ দিতেই দুটো শিক সম্পূর্ণ বেঁকে গিয়ে জানালা থেকে খুলে বেরিয়ে এল।

কোমোডোফ্লোরেন্সল অবাক হয়ে বলল, জোয়ানথ্রোহাগো তোমার আকার ছোট করেছে বটে, কিন্তু তোমার ক্ষমতাকে খাটো করতে পারেনি।

সবগুলো শিক খুলে ফেলে একটা ছোট শিককে সোজা করে নিয়ে যুবরাজের হাতে দিয়ে বলল, বেশ ভাল অস্ত্র হবে। পালাতে গিয়ে যুদ্ধ করতে হলে কাজে লাগবে। নিজের জন্যও একটা শিক সোজা করে নিল।

তারপর টারজান যুবরাজকে বলল, আজ রাতে, কাল, অথবা পরবর্তী চাঁদে-কে জানে? সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে।

টারজান শুধাল, এই তলা থেকে গোলাকার গম্বুজের পথে একেবারে ছাদ পর্যন্ত দূরত্ব কতটা হবে বল তো?

 তা বারো হুয়াল হবে।

 মিনুনিদের মাপকাঠি অনুসারে এক হুয়াল মোটামুটি তিন ইঞ্চির মত।

সবচাইতে লম্বা শিকটা নিয়ে যতদূর সম্ভব মেপে টারজান বলল, দূরত্বটা বড়ই বেশি।

কিসের?

 ছাদের।

তাতে তোমার কি? তুমি কি ভাবছ যে গম্বুজের ছাদে উঠে সেখান থেকে পালাবে?

টারজান দৃঢ়স্বরে বলল, নিশ্চয় অবশ্য যদি ছাদে উঠতে পারি।

কোমোডোফ্লোরেন্সল আরও জোরে হেসে উঠল। তুমি কি ভাবছ নিচে নামলেই পালাতে পারবে? শাস্ত্রীরা নেই? অন্য পাহারাদার নেই?

টারজান বলল, তাহলে তো দেখছি সুড়ঙ্গের ভিতর দিক দিয়ে নামাই নিরাপদ।

কোমোডোফ্লোরেন্সল চেঁচিয়ে বলল, এই সুড়ঙ্গ বেয়ে নামবে? তুমি কি পাগল! নামতে গেলেই তো একেবারে চারশ’ হুয়ান নিচে পড়ে যাবে।

থাম! টারজান থমকে উঠল।

অন্ধকার ঘরে কোমোডোফ্লোরেন্সল সঙ্গীর নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পেল; শুনতে পেল পাথরের গায়ে লোহার শিক ঘষার ও ঠোকার শব্দ।

কি করছ তুমি?

 থাম! টারজান বলল।

কোমোডোফ্লোরেন্সল অবাক বিস্ময়ে অপেক্ষা করে রইল। আবার কথা বলল টারজান, খনির যে ঘরে টালাস্কারকে আটকে রেখেছে সেটা খুঁজে বরে করতে পারবে?

কেন?

তার কাছে যেতে হবে। তাকে কথা দিয়েছি, সঙ্গে করে নিয়ে যাবে।

 তা বের করতে পারব।

আর কিছু সময় পরে টারজান বলল, এস। আমরা যাত্রার জন্য প্রস্তুত।

 কোন পথে পালাবে?

মাঝখানের সুড়ঙ্গ-পথে। যে উঁচলো শিকটা তোমাকে দিয়েছিলাম সেটা সঙ্গে আছে?

হ্যাঁ।

তাহলে জানালার ভিতর দিয়ে বেরিয়ে এস। মুখের কাছে যে শিকগুলো রেখেছি সেগুলো নিয়ে এস। বেশির ভাগটা আমিই বইব। চলে এস।

জানালার মুখে চারটে শিক পড়ে ছিল। প্রত্যেকটার মুখ বঁড়শির মত বাঁকানো। টারজান তাহলে অন্ধকারে এতক্ষণ এই কাজ করছিল। একটু এগোতেই সে টারজনের গায়ে ধাক্কা খেল।

টারজান বলল, এক মিনিট দাঁড়াও। জানালার গোবরাটে একটা গর্ত করছি। সেটা হয়ে গেলেই যাত্রা শুরু। একটু পরে আবার বলল, এবার শিকগুলো দাও।

আরও কয়েক মিনিট নিঃশব্দে কাজ করে টারজান মাথা তুলে বলল, আমি আগে নামছি। আমার শিস শুনলেই তুমি আমাকে অনুসরণ করবে।

কোথায়? যুবরাজ প্রশ্ন করল।

সুড়ঙ্গ-পথে সর্বপ্রথম যেখানে পা রাখার জায়গা পাব সেখানে। আশা করছি, আঠারো হুয়ালের মধ্যেই আর একটা তলা পেয়ে যাব। চারটে শিককে হুকে আটকে উপরের প্রান্তটাকে আটকে দিয়েছি গোবরাটের গর্তের সঙ্গে, আর একেবারে নিচের দিকটা ঝুলিয়ে দিয়েছি আঠারো হুয়াল নিচে।

টারজান ঈষৎ হেসে জানালা বেয়ে নিচে নেমে গেল; এক হাতে ছুঁচলো শিকের অন্ত্র, অন্য হাতে ঝুলছে গোবরাট থেকে।

একটার পর একটা শিক ধরে ঝুলতে ঝুলতে টারজান অন্ধকার সুড়ঙ্গ-পথে নামতে লাগল। এক সময় ঠিক নিচু তলায় জানালার গোবরাটটা পেয়েও গেল পায়ের নিচে। সেখানে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বারকয়েক নিঃশ্বাস টেনে খুব নিচু করে একটা শিস দিল। সঙ্গে সঙ্গে লোহার সিঁড়িটা নড়ে উঠল। কিছুক্ষণ পরে সেও টারজনের পাশে এসে দাঁড়াল। ফিফিস্ করে বলল, আরে! আমরা যে অসাধ্য সাধন করেছি! এবার মনে হচ্ছে, আমাদের পলায়নটা একেবারে অসম্ভব নাও হতে পারে।

টারজান বলল, ধীরে, বন্ধু, ধীরে; এখনও অনেক পথ বাকি। টালাস্কারের দেখা এখনও পাইনি। চলে এস।

হাতের শিক বাগিয়ে ধরে তারা পাশের ঘরটাতে ঢুকল। কোমোডোফ্লোরেন্সল চারদিকে তাকিয়ে বলল, আমদের ভাগ্য ভাল বন্ধু যে কোন রক্ষী নেই।

তার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই বিপরীত দিকের দরজাটা সপাটে খুলে দুটি সৈনিক ঘরে ঢুকল। চারদিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা এখানে কি করছ ক্রীতদাসরা?

শ-শ-শ! ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে টারজান বলল, দরজাটা বন্ধ করে দাও। কেউ শুনতে পাবে।

একটি সৈনিক বলল, কি শুনতে পাবে?

এক লাফে তাদের পেরিয়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল টারজান; লোহার শিকটা উদ্যত করে বলল, শুনতে পাবে যে তোমরা আমাদের বন্দী।

সঙ্গে সঙ্গে দুই বন্ধু একযোগে আক্রমণ করল দুই সৈনিককে। দু’জনের হাতের লোহার শিকের আঘাতে দুই সৈনিকেরই মৃত্যু হল।

টারজান বলল, প্রথম কর্তব্য এই দুই সৈনিকের সঙ্গে পোশাক বিনিময় করা। বলতে বলতেই গায়ের সবুজ জামাটা খুলে ফেলল।

তারপর একটা মৃতদেহকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে টারজান পাশের ঘরে গেল এবং জানাল দিয়ে। সেটাকে সুড়ঙ্গ-পথে নিচে ফেলে দিল। তার নির্দেশমত কোমোডোফ্লোরেন্সল অপর মৃতদেহটি নিয়ে অনুরূপভাবে নিচে ফেলে দিল।

টারজান বলল, মৃতদেহ দুটোকে ভাল করে পরীক্ষা না করলে সকলেই মনে করবে পালাবার চেষ্টা করে আমরা দুজনই মারা গেছি। বলতে বলতে যে হুক-করা শিকের মই বেয়ে তারা নেমেছে তারই দুটো খুলে নিয়ে টারজান সে দুটোকেও মৃতদেহের কাছে ছুঁড়ে ফেলে দিল। মুখে বলল, এর ফলে কথাটা আরও সহজেই সকলের মাথায় আসবে।

নতুন সাজে সেজে দু’জন বারান্দায় বেরিয়ে এল। একটার পর একটা তলা পার হয়ে নিচে নামতে লাগল। বারান্দায় বা সিঁড়িতে খুব অল্প লোকই চলাচল করছে। সৈনিকের পোশাক পরা লোক দুটির দিকে তারা কেউই বিশেষ মনোযোগ দিল না। যে যার কাজে চলে গেল।

নামতে নামতে একটা ফাঁকা জনহীন ঘর পেয়ে সেখানেই তারা রাতটা কাটিয়ে দিল। ঘুম ভেঙে উঠে আবার যখন হাঁটতে শুরু করল তখন সবগুলো বারান্দাতেই লোকের ভিড় বেড়ে গেছে।

একেবারে শেষ তলায় বারান্দায় পৌঁছতেই দেখতে পেল সুড়ঙ্গ-পথের নিচেকার চত্বরে অনেক মানুষের ভিড়। যারা ভিড়ের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে তারা ঘাড় উঁচু করে কি যেন দেখার চেষ্টা করছে। সকলেই নানা রকম প্রশ্ন করছে, কিন্তু কেউই কোন জবাব দিচ্ছে না।

একটু একটু করে টারজান আর কোমোডোফ্লোরেন্সলও ভিড়ের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। দুই কনুই দিয়ে ভিড় সরিয়ে একটি লোক বেরিয়ে আসতেই সকলে তার কাছে ব্যাপারটা জানতে চাইল। লোকটি তখন জানাল, পালিয়ে যাবার চেষ্টার ফলে দুটি ক্রীতদাস ওখানে মরে পড়ে আছে। বলল, গম্বুজ-প্রাসাদের একেবারে উপরের তলায় জোয়ান্থ্রাহাগোর ক্রীতদাসদের ঘরে তাদের আটক করে রাখা হয়েছিল। কোন। রকম জোড়াতালি দিয়ে একটা মই বানিয়ে সুড়ঙ্গ-পথে নিচে নামতে গিয়ে মইটা ভেঙ্গে নিচে পড়ে গেছে। দু’জনের শরীরই এমন ভাবে দুমড়ে ভেঙ্গে গেছে যে তাদের চেনাই শক্ত। এখন লাশ দুটোকে বাইরে নিয়ে জন্তুদের মুখে ফেলে দিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

আর দেরী না করে টারজান ও তার সঙ্গী ভিড়ের সঙ্গে মিশে ফটকের দিকে এগিয়ে গেল।

 বাইরের খোলা রোদে দাঁড়িয়ে কোমোডোফ্লোরেন্সল জানতে চাইল এবার কোন্ দিকে যাওয়া হবে?

 টারজান তাকে স্মরণ করিয়ে দিল, টালাস্কারের খোঁজে যেতে হবে; তাকে আমি কথা দিয়েছি।

দিনের পর দিন যায়। টারজান বাড়ি ফেরে না। তার ছেলে ক্রমেই শংকিত হয়ে উঠেছে। আশপাশের গ্রামে লোক পাঠিয়েছে। কোন খবর নেই।

শেষ পর্যন্ত একটা গুতি ও কিছু আদিম অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে বিশেষ দ্রুতগামী সাহসী ওয়াজিরিকে সঙ্গী করে কোরাক নিজেই বেরিয়ে পড়ল বাবার খোঁজে। অনেক দিন ধরে অনেক পরিশ্রম করে প্রতিটি জঙ্গলে ও বনভূমি তারা চষে ফেলল কিন্তু বাবার কোন খোঁজই পেল না।

তিনজন যাত্রী তিনদিন ধরে একটানা পূর্বের দিকে হাঁটল, চতুর্থ দিনে মোড় নিল দক্ষিণ দিকে। দূর দক্ষিণ দিগন্তে দেখা দিল একটা মহা অরণ্য। দক্ষিণ-পশ্চিমে আছে ট্রোহানাডামেকাস; এখনও দু’দিনের পথ।

দু’দিন পরে তারা ট্রোহানাডামেকাসের রাজপ্রাসাদের অদূরে পৌঁছ গেল। দূর থেকেই শাস্ত্রীরা তাদের দেখতে পেল; সঙ্গে সঙ্গে একদল সৈন্য ছুটে গেল তাদের খোঁজ-খবর নিতে। যুবরাজ ও টারজানকে দেখেই তারা উল্লাসে ফেটে পড়ল।

সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিয়ে যাওয়া হল এডেম্রোহাখিসের দরবার-কক্ষে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাজা আনন্দে কেঁদেই ফেলল। টারজানকেও সে ভোলে নি; যদিও প্রায় তাদের সমান উঁচু এই মানুষটিই যে সেই দৈত্যাকার টারজান একথা বুঝতে সকলেরই বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল।

যাই হোক, রাজা তাকেও সিংহাসনের কাছে ডেকে নিয়ে জারটল বা যুবরাজ পদে অভিষিক্ত করল, উপযুক্ত যান-বাহন ও অর্থ দিল, বাসস্থানের ব্যবস্থা করল, আর অনুরোধ জানাল, সে যেন তাদের মধ্যেই। স্থায়ীভাবে বসবাস করে।

তখন কোমোডোফ্লোরেন্সল টালাস্কারকে সিংহাসনের নিচে নিয়ে বলল, মহান এডেস্রোহাখিস, এবার আমার নিজের জন্য একটি বর চাইছি। জার্টালোস্টো হিসেবে অন্য শহর থেকে লুট করে আনা কোন রাজকন্যাকে বিয়ে করতে আমি প্রথাবদ্ধ; কিন্তু ক্রীতদাসী মেয়েটির মধ্যে আমি খুঁজে পেয়েছি আমার প্রেয়সীকে। তাই সিংহাসনের দাবী ছেড়ে দিয়ে তার বিনিময়ে এই মেয়েটিকে গ্রহণ করার অনুমতি আমাকে দেয়া হোক।

রাজা তখন সিংহাসনের সোপান বেয়ে নিচে নেমে এসে জাজারার হাত ধরে তাকে নিয়ে সিংহাসনের পাশে বসিয়ে দিল।

বলল, কেবলমাত্র প্রথামতেই তুমি কোন রাজকন্যাকে বিয়ে করতে বাধ্য; কিন্তু প্রথা তো বিধান নয়। ট্রোহানাডালমেকাসের একজন অধিবাসী যাকে ইচ্ছা তাকেই বিয়ে করতে পারে।

টালাস্কার বলল, সে যদি বিধান অনুসারে কোন রাজকন্যাকেই বিয়ে করতে বাধ্য হত তাহলেও সে আমাকে বিয়ে করতে পারত, কারণ আমি মান্ডালামেকাসের রাজা টালাখাগোর মেয়ে। ভেল্টোপিসমেকাসের লোকেরা আমার মাকে বন্দিনী করে নিয়ে এসেছিল আমার জন্মের মাত্র কয়েক চাঁদ–আগে। মা আমাকে বলে গিয়েছিল, কোন রাজপুত্র ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করার আগে আমি যেন আত্মহত্যা করি; কিন্তু কোমোডোফ্লোরেন্সল যদি কোন ক্রীদতাসের পুত্র হত তাহলে মায়ের সে নির্দেশ আমি লঙ্ঘন করতাম। ভেল্টোপিস্মেকাস ছেড়ে আসার রাত পর্যন্ত আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে সে রাজপুত্র; কিন্তু তখন তো আমার মন-প্রাণ সবই তাকে সঁপে দিয়েছি, যদিও সে কথা সে মোটেই জানত না।

সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে গেল, কিন্তু টারজনের দেহের কোন পরিবর্তন হল না। মিনুদিনদের মধ্যে বেশ সুখেই তার দিন কাটছিল; তবু দেশের জন্য তার মন কেঁদে উঠল; সে স্থির করল, এই চেহারা নিয়েই নিম্নসংকুল স্বদেশের পথে যাত্রা করবে।

বন্ধুরা তাকে বাধা দিল, কিন্তু টারজান কৃত-সংকল্প অকারণে আর বিলম্ব না করে সে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যাত্রা করল। এক হাজার হরিণ-আরোহী সৈন্যের এক কামাক সেনাদল মহা অরণ্য পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিল।

ছোট ছোট পশু, পাখি ও ডিম খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে গাছের ডালে শুয়ে সে রাত কাটাল। দ্বিতীয় রাতেই একটা বমির ভাব হওয়াতে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। একটা আসন্ন বিপদের আশংকা তাকে পেয়ে বসল। হঠাৎ তার মনে হল, হয়তো স্বাভাবিক দেহ ফিরে পাবার এটা পূর্ব লক্ষণ। অজ্ঞান হয়ে যাবার আগে যে রকম হয়ে থাকে সেই রকম তারও মাথার ভিতরটা ঝিমঝিম করতে লাগল। গাছের উপর থেকে নিচে নামবার মত জোরও যেন পাচ্ছে না। হাঁটু কাঁপছে। কোন রকমে নিচে নেমে একটা চড়াই বেয়ে উঠতে লাগল। হঠাৎ একটা তাজা বাতাসের ঝাঁপটা এসে নাকে লাগল। সে খাড়া হয়ে দাঁড়াল। সে বন পার হয়েছে। এবার সে মুক্ত!

পিছন থেকে একটা গর্জন কানে এল। তলোয়ার হাতে নিয়ে সে কাটা-বনের মধ্যে ঢুকে গেল। কত দূর গেল বা কোন্ দিকে গেল কিছুই বুঝতে পারল না। তখনও ঘন অন্ধকারে চারদিক ঢাকা। হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়েই সে জ্ঞান হারাল।

নর-খাদক ওবেবের গ্রাম থেকে ফিরবার পথে জনৈক ওয়াজিরি পথের পাশে একটা কংকাল দেখতে পেল। সেটা কোন বিশেষ ঘটনা নয়। আফ্রিকার জনপথে এ রকম অনেক কংকাল পড়ে থাকে। কিন্তু এ কংকালটা দেখে সে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কিন্তু ওবেবের গ্রামের অনেক অদ্ভুত কাহিনী শুনেই উসুলা তার প্রিয় মনিবের খোঁজে এ দেশে এসেছিল। ওবেবে কখনও টারজানকে দেখেনি বা তার কথাও শোনেনি। এ কথা সে বার বার উসুলাকে বলেছে; কিন্তু ওখানকার অন্য অনেকের মুখ থেকে সে শুনেছে যে এক বছর বা তারও বেশি সময় ওবেবে একটি সাদা মানুষকে বন্দী করে রেখে ছিল, আর কিছু দিন আগে সে পালিয়ে গেছে। প্রথমে উসুলা সেই সাদা লোকটিকেই টারজান বলে ধরে নিয়েছিল, কিন্তু সে লোকটি বন্দী হওয়ার সময়-কালটা বিবেচনা করে সে বুঝতে পেরেছে যে সে লোক টারজান হতে পারে না; তাই সে দেশে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু পথের পাশে একটি শিশুর কংকাল দেখেই তার মনে পড়ে গেল উহহার নিরুদ্দেশ হবার কথা। সে থমকে দাঁড়াল। ভাল করে লক্ষ্য করতে আরও একটা জিনিস সে দেখতে ফেল-পথ থেকে কয়েক ফুট দূরে আরও কয়েকটা কংকালের মধ্যে পড়ে আছে একটা ছোট চামড়ার থলে। উসুলা নিচু হয়ে সেটা তুলে নিয়ে ভিতরকার জিনিসগুলো হাতের উপরেই ঢেলে ফেলল। দেখেই বুঝতে পারল জিনিসগুলো তার মনিবের। অনেক চাঁদ আগে সাদা মানুষরা বড় বাওয়ানার এই সব হিরে চুরি করেছিল। এগুলো সে তার মনিব-পত্নীকে ফিরিয়ে দেবে।

তিনদিন পরে বৃহৎ কণ্টক বনের কাছকাছি পথ ধরে নিঃশব্দে চলতে চলতে হঠাৎ সে থেমে গেল; দৃঢ় মুষ্টিতে চেপে ধরল হাতের বর্শাটা। একটি ছোট খোলা জায়গায় প্রায় উলফঙ্গ একটি লোক মাটিতে পড়ে আছে। লোকটি জীবিত-নাড়াচড়া করছে। কিন্তু সে কি করছে। উসুলা নিঃশব্দে আরও কাছে এগিয়ে গেল। কি বীভৎস দৃশ্য! একটি মোষের পচা-গলা মৃতদেহের পাশে শুয়ে সাদা মানুষটি সাগ্রহে মোষের হাড় থেকে মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে।

লোকটি মাথাটা একটু তুলতেই তার মুখটা ভাল করে দেখতে পেয়ে উসুলা আতংকে চীৎকার করে উঠল। এ যে বড় বাওয়ানা।

ছুটে গিয়ে উসুলা তাকে হাঁটুর উপর তুলে নিল। কিন্তু লোকটি সমানে হাসতে লাগল, আর শিশুর মত বক্ বক্ করে চলল। পাশেই মোষটার শিং-এর সঙ্গে ঝুলছে বড় বাওয়ানার হীরে বসানো সোনার লকেটটা। উসুলা আবার সেটাকে বড় বাওয়ানার গলায় পড়িয়ে দিল। কাছাকাছি তার জন্য একটা ভাল কুটির বানিয়ে দিল; শিকার করে তার খাবার এনে দিল; গায়ের জোর ফিরে না আসা পর্যন্ত তার কাছেই। রয়ে গেল। গায়ের জোর ফিরে এলেও তার মনের জোর কিন্তু ফিরল না। সেই অবস্থাতেই উসুলা মনিবকে বাড়ি নিয়ে গেল।

তার সারা দেহে ও মাথায় অনেক আঘাত ও ক্ষত। যে মানুষটি একদিন ছিল অরণ্যরাজ টারজান আজ সেই ছোট্ট মানুষটিকে সারিয়ে তুলবার জন্য ইংল্যান্ড থেকে একজন বড় সার্জনকে আফ্রিকায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হল।

যে কুকুরের দল একদিন লর্ড গ্রেস্টোককে ভালবাসত আজ তারা এই জড়বুদ্ধি লোকটিকে দেখে দূরে সরে যায়। তাকে যখন হুইলচেয়ারে বসিয়ে সোনালী সিংহ জাদ্-বাল-জার খাঁচার কাছে নিয়ে যাওয়া হয় তখন সেটাও তাকে দেখে গর্জন করতে থাকে।

ছেলে কোরাক অসহায়ভাবে মেঝেতে পায়চারি করে। মা ইংল্যান্ড থেকে রওনা হয়েছে। এখানে পৌঁছে বাবার এই অবস্থা দেখে তার যে কি প্রতিক্রিয়া হবে সে কথা ভাবতেও সে ভয়ে শিউরে ওঠে।

জল-পিশাচটা যেদিন নর-খাদক ওবেবের গ্রাম থেকে তার মেয়ে উহ্হাকে চুরি করে পালিয়েছে সেই দিন থেকেই ওঝা খামিস তাকে নিরন্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে। অনেক দূর-দূর গ্রামেও গেছে; কিন্তু মেয়েকে বা তার অপহরকারীকে খুঁজে পায়নি।

তেমনি একটা ব্যর্থ অনুসন্ধানের পরে খামিস দেশে ফিরে চলেছে। সবে সকাল হয়েছে। শিবির তুলে নতুন করে যাত্রা শুরু করতেই ডান দিকে শ’খানের গজ দূরে একটা খোলা জায়গায় কিছু একটাকে পড়ে থাকতে দেখল। নিচু ঘাসের উপরে বেরিয়ে আছে মানুষের একটা হাঁটু। আরও কাছে এগিয়ে যেতেই বিস্ময়ের একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল তার ঠোঁট থেকে জল-পিশাচের দেহটা চিৎ হয়ে পড়ে আছে; একটা হাঁটু ভেঙে রয়েছে- সেটাই সে দেখতে পেয়েছে ঘাসের উপরে।

জল-পিশাচ কি মৃত, না ঘুমিয়ে আছে? হাতের বর্শাটাকে খামিস তার বুকে ছোঁয়াল। জল-পিশাচ জাগল না। ও তাহলে ঘুমিয়ে নেই! আবার মৃত বলেও মনে হচ্ছে না। খামিস হাঁটু ভেঙ্গে বসে তার বুকে কান রাখল। সে মরে নি!

এই পিশাচ তার মেয়েকে চুরি করেছে। খামিস ক্রোধে জ্বলে উঠল।

কোমরে জড়ানো শক্ত দড়িটা খুলে নিয়ে পিশাচের হাতে দুটোকে পিঠ-মোড়া করে বেঁধে অপেক্ষা করতে লাগল। ঘণ্টাখানেক পরে জ্ঞান ফিরে এলে জল-পিশাচ চোখ মেলে তাকাল।

ওঝা বলল, আমার মেয়ে উহ্হা কোথায়?

জল-পিশাচ হাতের বাঁধন খুলতে চেষ্টা করল, পারল না। খামিসের প্রশ্নের কোন জবাব দিল না। চুপচাপ শুয়ে রইল। কিছুক্ষণ পরে আবার চোখ মেলল।

হাতের বর্শা দিয়ে খোঁচা মেরে ওঝা হুকুম করল, উঠে দাঁড়াও!

জল-পিশাচ পাশ ফিরে হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠ দাঁড়াল। খামিস বর্শা উঁচিয়ে পথ দেখিয়ে দিল। সন্ধ্যা নাগাদ তারা পৌঁছে গেল ওবেবের গ্রামে।

যে কুঁড়ে ঘর থেকে জল-পিশাচ একদিন পালিয়েছিল খামিস তাকে সেই ঘরেই ঠেলে দিল। অনেক বর্শা ও প্রশ্নের খোঁচা খেয়েও জল-পিশাচ একটা কথাও বলল না। তাকে দেখতে এসে ওবেবেও অনেক প্রশ্ন করল; কিন্তু জল-পিশাচ শুধু হা করে তাকিয়ে রইল, কোন কথাই বলল না।

ওঝা উঠে এসে আবার প্রশ্ন করল। জবাব পেল না। প্রচণ্ড রাগে সে জল-পিশাচের মুখে একটা ঘুষি মারল। নিচু হয়ে একটা গরম শিক তুলে নিয়ে বলল, এবার আমার প্রশ্নের জবাব ঠিকই দেবে!

ওবেবে কর্কশ গলায় বলল, আগে ডান চোখটা!

ডাক্তার এল টারজনের বাংলোতে-লেডি গ্রেস্টোকই সঙ্গে করে নিয়ে এল। লন্ডনের খ্যতনামা সার্জন। সার্জন ও লেডি গ্রেস্টোক সঙ্গে সঙ্গে টারজনের ঘরে গেল। জোড়াতালি দিয়ে তৈরি হুইলচেয়ারে টারজান বসেছিল। অর্থহীন দৃষ্টিতে সে তাদের দিকে তাকালাম।

তুমি আমাকে চিনতে পারছ না জন? লেডি বলল।

 ছেলে এসে তাকে বাইরে নিয়ে গেল। মা তখন কাঁদছে।

ছেলে বলল, বাবা আমাদের কাউকেই চিনতে পারছে না মা। অস্ত্রোপচারের আগে তুমি আর বাবার সঙ্গে দেখা করো না। এ অবস্থায় ওকে দেখলে তোমার কেবল কষ্টই বাড়বে।

সার্জন তাকে পরীক্ষা করল। মাথার খুলিতে আঘাত লাগায় মস্তিষ্কের উপর একটা চাপ পড়েছে। অস্ত্রোপচারের ফলে সেই চাপটা চলে গেলে রোগীর মানসিক ভারসাম্য ও স্মৃতিশক্তি ফিরে আসতে পারে। কাজেই অস্ত্রোপচার করাই সঙ্গত।

পরের দিনই কয়েকজন নার্স ও দু’জন ডাক্তার এল নাইরোবি থেকে। সকালেই অস্ত্রোপচার করা হল।

 ঘণ্টাখানেক পরেই দরজা খুলে সার্জন তাদের ঘরে ঢুকল।

সার্জন বলল, এখনই আপনাদের কিছু বলতে পারছি না। শুধু এইটুকু বলতে পারি যে অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে। আমি নির্দেশ দিয়েছি, দশ দিন পর্যন্ত নার্স ছাড়া আর কেউ লর্ডের ঘরে ঢুকতে পারবে না। ওষুধ খাইয়ে তাকে আমি দশ দিনের জন্য আধা-অজ্ঞান অবস্থায় রেখে গেলাম। লেডি গ্রেস্টোক, ততদিন আমরা শুধু আশাই করতে পারি।

ওঝার বাঁ হাত জল-পিশাচের কাঁধে; তার ডান হাতে দগদগে লাল লোহার শিক।

ওবেবে আবার বলল, ডান চোখটা আগে।

সহসা বন্দীর পিঠ ও কাঁধের মাংসপেশীগুলো ফুলে ফুলে উঠতে লাগল। মুহূর্তের জন্য এত প্রচণ্ড শক্তিতে সে শরীরটা ঝাঁকি দিল যে তার হাতের বাঁধন পট পট করে ছিঁড়ে গেল; মুহূর্ত পরেই তার ইস্পাত-কঠিন আঙ্গুলগুলো ওঝার ডান কব্জির উপর চেপে বসল। জ্বলন্ত দৃষ্টি পড়ল তার চোখের উপর। ওঝার আঙ্গুলগুলো অসাড় হেয় এল; জ্বলন্ত শিকটা হাত থেকে পড়ে গেল।

ওবেবে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সকলেই যার যার বাড়ির দিকে ছুট দিল। তা। দেখে ওবেবেও পালিয়ে গেল।

তখন জল-পিশাচ দুই হাতে খামিসকে ধরে মাথার উপর তুলে সর্দার ওবেবের পিছনে ধাওয়া করল। ওবেবে তার আগেই নিজের ঘরে ঢুকে গেল। আর তাকে শেষ করে দিতে জল-পিশাচও এক লাফে ঘরের চালে উঠে চাল ভেঙ্গে নিচে নেমে গেল।

একটা দেহ তার উপর নেমে আসায় সর্দার ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু সেই মুহূর্তে আতংকের চাইতেও আত্মরক্ষার তাগিদটা ওবেবের কাছে বড় হয়ে উঠল। কোমর থেকে ছুরিটা টেনে নিয়ে বার বার। বসিয়ে দিল জল-পিশাচের দেহে। যখন বুঝতে পারল যে তার ইহলীলা সাঙ্গ হয়েছে তখন তাকে টানতে টানতে বাইরের চাঁদ ও আগুনের আলোয় নিয়ে এসে ওবেবে চীৎকার করে বলতে লাগল, ফিরে এস ভাই সব ফিরে এস; ভয়ের কিছুই নেই, কারণ আমি তোমাদের সর্দার ওবেবে নিজের হাতে জল-পিশাচটাকে। হত্যা করেছি।

বলতে বলতে পিছনের মৃতদেহটাকে ভাল করে দেখেই ওবেবে আঁতকে উঠে পথের ধূলোর উপরেই বসে পড়ল। যাকে সে টেনে এনেছে সেটা ওঝা খামিসের দেহ।

লোকজনরা এগিয়ে এসে সবই দেখল; কোন কথা বলল না; সকলেই ভয় পেয়েছে। কয়েকটি সৈনিককে সঙ্গে নিয়ে ওবেবে ঘরের ভিতরে ও বাইরে অনেক খুঁজল। লোকটি চলে গেছে। ফটক পর্যন্ত গেল। ফটক বন্ধ। কিন্তু ফটকের সামনের ধূলোয় খালি পায়ের ছাপ রয়েছে একটি সাদা মানুষের খালি পায়ের ছাপ।

ওবেবে ঘরে ফিরে এল। ভয়ার্ত লোকগুলো তার জন্যই অপেক্ষা করে আছে।

সে বলল, ওবেবের কথাই ঠিক। লোকটা জল-পিশাচ নয়- অরণ্যরাজ টারজান, কারণ একমাত্র সেই পারে খামিসকে অতটা উঁচুতে তুলে ধরে ঘরের চালের উপর ছুঁড়ে দিতে, আর একমাত্র সেই পারে। কোনরকম সাহায্য ছাড়া আমাদের ফটক ডিঙিয়ে যেতে।

এল সেই দশম দিনটি। অস্ত্রোপচারের ফলাফল জানতে বড় সার্জনটি এখনও গ্রেস্টোকের বাংলোতেই অপেক্ষা করছে।

সার্জন বলল, লর্ড গ্রেস্টোক এবার তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে উঠবেন। অনেক কথাই তাকে বলে দিতে হবে। জ্ঞান হবার পরেও তিনি নিজেকেই চিনতে পারেননি; কিন্তু এ রকম পরিস্থিতিতে সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

আশ্চর্য চোখে চারদিকে তাকিয়ে রোগী ঘরের মধ্যে কয়েক পা হাঁটল।

সার্জন বলল, ইনি আপনার স্ত্রী গ্রেস্টোক।

লেডি গ্রেস্টোক দুই হাত বাড়িয়ে স্বামীর দিকে এগিয়ে গেল। অশক্ত রোগীর মুখে ঈষৎ হাসি খেলে গেল; সেও দুই পা বাড়িয়ে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল। সহসা কে যেন তাদের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। ফ্লোরা হকেস।

সে বলে উঠল, হা ঈশ্বর, লেডি গ্রেস্টোক! এ আপনার স্বামী নয়। এতো মিরান্ডা, এস্টেবান মিরান্ডা! আপনি কি মনে করেন, লক্ষ লোকের মধ্যেও আমি ওকে চিনতে পারব না? এখানে আসার পর থেকে আমি তাকে একবারও দেখিনি। রোগীর ঘরেই তো যাইনি, কিন্তু সে এ ঘরে ঢোকামাত্রই আমার মনে। সন্দেহ জেগেছে। মুখের হাসি দেখেই আমি তাকে চিনতে পেরেছি।

বিহ্বল স্ত্রী চীৎকার করে বলল, ফ্লোরা! তুমি ঠিক চিনেছ? না! না! নিশ্চয় তোমার ভুল হয়েছে! স্বামীকে ফিরিয়ে দিয়ে আবার নিয়ে যাবার জন্য ঈশ্বর নিশ্চয় তাকে আমার কাছে এনে দেয়নি। জন! বল, সত্যি কে তুমি? তুমি নিশ্চয় আমাকে মিথ্যা বলবে না।

মুহূর্তের জন্য লোকটি চুপ করে রইল। যেন দুর্বলতাবশতই এদিক-ওদিক দুলতে লাগল। সার্জন এগিয়ে এসে তাকে ধরে ফেলল।

লোকটি বলল, আমি খুবই অসুস্থ। হয়তো আমি বদলে গেছি, কিন্তু আমিই লর্ড গ্রেস্টোক। কিন্তু এই নারীকে তো আমি স্মরণ করতে পারছি না। সে ফ্লোরা হকেসকে আঙুল দিয়ে দেখাল।

মিথ্যা কথা! মেয়েটি কেঁদে ফেলল।

হ্যাঁ, কথাটা মিথ্যা, একটি শান্ত কণ্ঠস্বর পিছন থেকে বলে উঠল। সকলে ঘুরে দাঁড়াল। বারান্দায় যাবার ফরাসী দরজায় দাঁড়িয়ে আছে একটি দৈত্যাকার শ্বেতকায় মূর্তি।

তার দিকে ছুটতে ছুটতে লেডি গ্রেস্টোক চীৎকার করে বলে উঠল, জন! কী করে এত বড় ভুল আমি করলাম? আমি

বাকি কথা আর বলা হল না; অরণ্যরাজ টারজান এক লাফে ঘরের ভিতরে ঢুকে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *