ধরিত্রীর গর্ভে টারজান (টারজান অ্যাঁট দি আর্থস কোর)

ধরিত্রীর গর্ভে টারজান (টারজান অ্যাঁট দি আর্থস কোর)

যে কোন স্কুলের ছেলেও জানে, পেলুসিডার পৃথিবীর ভিতরে আর একটা পৃথিবী; যে ফাঁকা গোলককে আমরা ধরিত্রী বলি তার আভ্যন্তরীণ তলেই এর অবস্থান।

ডেভিড ইনেস এবং এনার পেরি যখন নিধূম কয়লার নতুন স্তর আবিষ্কারের আশায় যন্ত্র-যানে চেপে একটা পরীক্ষামূলক অভিযাত্রায় বেরিয়েছিল তখনই ঘটনাক্রমে তারা এই পেলুসিডার আবিষ্কার করে। কিন্তু যন্ত্র-যানটা ভূ-গর্ভের দিকে চলতে শুরু করার পরে তার মুখটাকে যথাসময়ে ঘুরিয়ে দিতে না পারায় পাঁচ শ’ মাইল সোজা এগিয়ে তৃতীয় দিনে যন্ত্র-যানের মুখটা যখন ভিতরকার জগতের খোলসটাকে ভেঙ্গে বেরিয়ে গেল তখন এক ঝলক তাজা বাতাসে কেবিনটা ভরে গেল, যদিও অক্সিজেনের অভাবে পেরি ততক্ষণে অজ্ঞান হয়ে গেছে আর ডেভিডও দ্রুত জ্ঞান হারাতে বসেছে।

তারপর অনেক বছর কেটে গেল। দুই আবিষ্কারের জীবনে অনেক ঝড় বয়ে গেল। পেরি আর কোন দিনই ভূ-পৃষ্ঠে ফিরে আসেনি, আর ইনেস এসেছে মাত্র একবার। অবশ্য সেই একই যন্ত্র-যানে সে ফিরে গিয়েছিল পৃথিবী থেকে।

কিন্তু কিছুটা আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ বিগ্রহের ফলে, আর বেশ কিছুটা আদিম জীবজন্তু ও সরীসৃপের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে সভ্যতার পথে পেলুসিডার সাম্রাজ্যের অগ্রগতি খুব সামান্যই হয়েছে। তাছাড়া, এতদিন পরে ডেভিড ইনেস এবং এবৃনার পেরির অস্তিত্বের কোন হদিসই হয় তো আজ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

পৃথিবীর ঠিক কেন্দ্র থেকে ঝুলছে পেলুসিডারের সূর্য; সেখানকার সূর্য সব সময়ই শীর্ষস্থানে থাকে বলে পেলুসিডারে রাত বলে কিছু নেই, সেখানে বিরাজ করে অনন্ত শাশ্বত মধ্যাহ্ন।

কোন তারা না থাকায় এবং সূর্যের কোন আপাত গতি না থাকায় পেলুসিডারে কোন দিকনির্ণয় যন্ত্র নেই; দিকচক্ররেখা বলেও কিছু সেখানে নেই, কারণ যেখান থেকেই দেখা যাক সেখানকার ভূ-পৃষ্ঠ সব। সময়ই উপরের দিকেই উঠে যায়। আবার সে পৃথিবীতে সূর্য, তারা ও চন্দ্র না থাকায় আমাদের পৃথিবীর মত সময়ের হিসেবও সেখানে নেই। আর তার ফলে পেলুসিডার এমন এক সময়হীন পৃথিবী যেখানে ব্যস্ত মৌমাছি এবং সময়ই সম্পদ এই ধরনের কোন কথাই প্রচলিত নেই।

বহিঃপৃথিবীর মানুষ আমরা অতীতে পেলুসিডার থেকে প্রেরিত যে খবরটি ধরতে পেরেছিলাম তার মর্মার্থ হলঃ পেলুসিডারের প্রথম সম্রাট ডেভিড ইনেস তার প্রিয় জন্মভূমি লুরাজ এজ-এর অদূরবর্তী বৃহৎ উপত্যকায় অবস্থিত সারি নামক শহর থেকে মহাদেশ ও মহাসাগর পার হয়ে অনেক দূরের কোরসারদের দেশে এক অন্ধকার কারাগারে চরম দুঃখে দিন কাটাচ্ছে।

টারজান থেমে গেল। কান পাতল। বাতাস শুকল।

যে শব্দ টারজান শুনতে পেয়েছে সেটা এসেছে অনেক দূর থেকে। প্রথমে স্পষ্ট করে তার অর্থ বুঝতে না পারলেও সে এটা বুঝতে পেরেছে যে অনেক দূর থেকে একদল মানুষ আসছে।

কিছুদূর এগোতেই খালি পায়ের শব্দ আর আদিবাসীদের বোঝা বইবার গান তার কানে এল। তার পরেই তার নাকে এল কালো মানুষের গায়ের গন্ধ। আর সেই সঙ্গে এমন আর একটা আবছা গন্ধ নাকে এল যাতে টারজান বুঝতে পারল যে একটি সাদা মানুষ দলবল ও লটবহর নিয়ে শিকারে এসেছে।

মুখ ঘুরিয়ে টারজান নিঃশব্দে অতি দ্রুতগতিতে গাছপালার ভিতর দিয়ে এগিয়ে শিকারীদলের কিছুটা সামনে গিয়ে গাছ থেকে নেমে পথের উপর অপেক্ষা করতে লাগল।

একটা মোড় ঘুরেই শিকারীর দলটা তাকে দেখতে পেয়েই থেমে গিয়ে উত্তেজিতভাবে কথাবার্তা বলতে লাগল।

টারজান বলল, আমি টারজান। টারজনের দেশে তোমরা কি করতে এসেছ?

সঙ্গে সঙ্গে যে যুবকটি দলের একেবারে সামনে ছিল সে এগিয়ে এল। তার মুখে দেখা দিল হাসির রেখা। বলল, তুমিই লর্ড গ্রেস্টোক?

কালার পালিত পুত্র জবাব দিল, এখানে আমি অরণ্যরাজ টারজান।

তাহলে তো আমার ভাগ্য ভাল বলতে হবে, যুবকটি বলল, কারণ সুদূর দক্ষিণ কালিফোর্নিয়া থেকে আমি তোমার খোঁজেই এসেছি।

তুমি কে? টারজনের কাছে তোমার কিসের দরকার?

আমার নাম জ্যাসন গ্রিডলে। আর যে বিষয় নিয়ে কথা বলতে আমি তোমার কাছে এসেছি সে এক দীর্ঘ কাহিনী। আশা করি আমার সঙ্গে আমার পরবর্তী শিবিরে গিয়ে আমার এখানে আসার উদ্দেশ্যটা মন দিয়ে শুনবার মত সময় ও ধৈর্য তোমার হবে।

টারজান মাথা নাড়ল। এই জঙ্গলের রাজ্যে আমাদের সময়ের অভাব হয় না।

সেদিন সন্ধ্যায় জ্যাসন ও টারজান একত্রে বসে কফি খেতে খেতে টারজান বলল, এবার বল, দক্ষিণ কালিফোর্নিয়া থেকে এত পথ পেরিয়ে কেন তুমি আফ্রিকার একেবারে অভ্যন্তরে এসে ঢুকেছ?

গ্রিডলে হেসে বলল, কি জান, এখন সশরীরে এখানে হাজির হয়ে তোমার মুখোমুখি বসে হঠাৎ আমার কেমন যেন ভয় হচ্ছে যে আমার কথা শুনে তুমি না আমাকে পাগল ঠাউরে বস।

আমাকে সব ব্যাপারটা বুঝিয়ে বল।

পৃথিবীটা একটা ফাঁকা গোলক এবং তার ভিতরে আর একটা পৃথিবী আছে-এই মতটা তুমি কখনও শুনেছ কি?

এ মতটা তো বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে অনেক আগেই খণ্ডন করা হয়েছে, টারজান জবাবে জানাল।

মার্কিন ভদ্রলোক বলল, কিন্তু সম্প্রতি সেই আভ্যন্তরীণ জগৎ থেকে একটা সংবাদ সরাসরি আমার কাছে এসেছে।

তুমি আমাকে অবাক করে দিচ্ছ, টারজান বলল।

অবাক আমিও হয়েছিলাম, কিন্তু এ কথা সত্য যে পৃথিবীর অভ্যন্তরস্থ পেলুসিডার পৃথিবীর একূনের পেরির সঙ্গে আমার বেতার-সংযোগ ঘটেছিল, আর সংবাদের একটা অনুলিপি আমি সঙ্গে করেই এনেছি। সংবাদটি যে যথার্থ তার একটি প্রমাণপত্র আমি একজনের কাছ থেকে নিয়ে এসেছি যার নামের সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে। আমি যখন সংবাদটি পাই তখন সে লোক আমার পাশেই ছিল; এই সে সব কাগজপত্র।

আধ ঘণ্টা ধরে জ্যাসন গ্রিডলে পাণ্ডুলিপিটা খুলে তার বিশেষ বিশেষ সংখ্যাগুলো পড়ে শোনাল। পড়া শেষ করে বলল, এর থেকেই পেলুসিডারের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে, আর ডেভিড ইনেসের দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিই আমাকে বাধ্য করেছে এই প্রস্তাব নিয়ে তোমার কাছে আসতে যাতে আমরা এমন একটা অভিযান চালাই যার প্রথম উদ্দেশ্যই হবে কোর্সারদের কারাগার থেকে তার উদ্ধার সাধন।

টারজান বলল, আচ্ছা, যদি ধরেই নি যে একটি আভ্যন্তরীণ জগৎ আছে তাহলেই বা সে পৃথিবী আবিষ্কারের কি উপায়ের কথা তুমি ভেবেছ?

আমার মনে হয়, আধুনিক জেপেলিন ধরনের কোন বিশেষভাবে তৈরি বায়ু-যানেই আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী অভিযান চালানো যেতে পারে। হিলিয়াম গ্যাস ব্যবহারের ফলে সে বায়ু-যান নিরাপত্তার দিক থেকেও যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য হবে।

খুব সংগোপনে কাজ চলল ছ’মাস ধরে। ছ’মাস পরে ও-২২০ নামে পরিচিত বায়ু-যানটি আকাশে উড়বার জন্য প্রস্তুত হল। বড় সিগার-আকৃতির ও-২২০ যানটির বডি দৈর্ঘ্যে ৯৯৭ ফুট এবং তার পরিধি ১৫০ ফুট। গোটা যানটি ছ’টি বড় বড় বায়ু-নিরোধক ঘরে বিভক্ত। ইঞ্জিনগুলো ৬৫০০ অশ্ব শক্তিবিশিষ্ট; তার গতি ঘণ্টায় ১০৫ মাইল। এই হচ্ছে বায়ু-যানের বিবরণ।

জুন মাসের এক পরিষ্কার সকালে ভোর হবার আগেই ও-২২০ ধীরে ধীরে যাত্রা শুরু করল।

মূল অভিযানের জন্য ক্যাপ্টেন হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে জুপনারকে; তার পরিচালনায়ই বায়ু যানটি নির্মিত হয়েছে। আর আছে রাজকীয় বিমানবাহিনীর দুই প্রাক্তন অফিসার ভন হক্ট ও ডর্ফ এবং জাহাজ-চালক লেফটেন্যান্ট হাইন্স। এ ছাড়া আছে বারোজন ইঞ্জিনীয়ার, আটজন যন্ত্রকুশলী, একটি নিগ্রো পাঁচক ও দুটি ফিলিপিনো কেবিন-বয়।

অভিযানের দলপতি স্বয়ং টারজান। জ্যাসন গ্রিডলে তার সহকারী। তার যোদ্ধা হিসেবে আছে মুভিরো ও তার ন’জন ওয়াজিরি যোদ্ধা।

বায়ুানটি যখন স্বচ্ছন্দ গতিতে শহরের উপর উঠে গেল তখন জুপনার তার উৎসাহকে চেপে রাখতে পারল না। বলে উঠল, এমন সুন্দর যান আমি কখনও দেখিনি। হাত ছোঁয়ালেই এ সাড়া দেয়।

মোটামুটিভাবে ঘণ্টায় ৭৫ মাইল গতিতে চলে দ্বিতীয় দিন মাঝরাত নাগাদ ও-২২০ উত্তর মেরুতে পৌঁছে গেল। হাইন্স যখন ঘোষণা করল যে তার হিসেবমত তারা উত্তর মেরুর খাড়া উপরে পৌঁছে গেছে, তখন সকলের মধ্যেই উত্তেজনা দেখা দিল।

আরও পাঁচ ঘণ্টা দক্ষিণ দিকে উড়ে যাবার পরে হাইন্স চীৎকার করে উঠল, দেখ, দেখ। আমাদের ঠিক সামনেই জল দেখা যাচ্ছে।

হঠাৎ টেলিফোনটা বেজে উঠল। হাইন্স সিরিভারটা কানে লাগাল। খুব ভাল স্যার, বলে রিসিভারটা ঝুলিয়ে রেখে বলল, পর্যবেক্ষণ-কেবিন থেকে ভন হার্স্ট কথা বলল। নিচে একটা জন প্রাণীহীন প্রান্তর সে দেখতে পেয়েছে।

গ্রিডলে বলল, উত্তর কোসারের যে বিবরণ ইনেস দিয়েছে এটা তো তার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।

সকলেরই মনে বিশ্বাস হল, তাদের নিচের স্থলভাগটাই পেলুসিডার।

ও-২২০ ক্রমেই দক্ষিণ দিকে এগোতে লাগল। আর যে মুহূর্তে মধ্যরাতের সূর্য-বয়লটা দৃষ্টিপথের আড়ালে চলে গেল অমনি সম্মুখে দেখা দিল পেলুসিডারের সূর্য-দীপ্তি।

এই তো সেই পেলুসিডার যার স্বপ্ন দেখেছে জ্যাসন গ্রিডলে।

অরণ্য ছাড়িয়ে একটা ঢেউ-খেলানো প্রান্তর। মাঝে মাঝে কিছু গাছ-গাছালি। প্রান্তরের বুক চিরে অসংখ্য নদী গিয়ে মিশেছে বিপরীত দিকের একটা বড় নদীতে। দলে দলে চরে বেড়াচ্ছে নানা ধরনের পশু। কিন্তু কোথাও মানুষের দেখা নেই।

টারজান বলল, এ দেশ তো আমার কাছে স্বর্গ বলে মনে হচ্ছে। এখানে নামা যাক ক্যাপ্টেন।

জাহাজটা ধীরে ধীরে মাটিতে নেমে এল। একজন অফিসার ও দুটি লোককে পাহারায় রেখে অন্য সব যাত্রী পেলুসিডারের হাঁটু-সমান উঁচু সবুজ ঘাসের মধ্যে নেমে পড়ল।

চারদিকে তাকিয়ে টারজান বলল, এখন আমাদের সবচাইতে বেশি দরকার বিশ্রাম। পরিপূর্ণ বিশ্রামের জন্য আপাতত আমরা এখনেই থাকি, তারপর কোর্সার শহর খুঁজতে বের হওয়া যাবে।

এ প্রস্তাব সকলেই সমর্থন করল।

প্রতি চার ঘণ্টা অন্তর পাহারা বদলের ব্যবস্থা করা হল, আর অফিসার ও অন্য সকলেই ঘড়ির কাঁটা ধরে ঘুমোতে লাগল।

অরণ্যরাজ টারজনের ঘুমই প্রথম ভাঙল। সেই প্রথম জাহাজ থেকে বেরিয়ে পড়ল।

তখন পাহারায় ছিল লেঃ ডর্ফ। সে অবাক বিস্ময়ে দেখল, মাথাভর্তি কালো চুল জঙ্গলের রাজা খোলা প্রান্তর পার হয়ে বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ও-২২০-এর ছোট বার্থে শুয়ে অফিসার্স মেসের পাঁচক রবার্ট জোন্স হাই তুলল, শরীরটাকে টানটান করল; তারপর চোখ খুলে তাকিয়ে বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠে বসল। বলল, হায় ভগবান! মশাইরা সকলেই এখনও ঘুমে অচেতন!

মধ্যাহ্ন সূর্যের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাড়াতাড়ি পোশাক পরে নেমে গেল।

জ্যাসন গ্রিডলে কেবিন থেকে বেরিয়ে বলল, সুপ্রভাত!

 জুপনার ও ডর্ফ সুপ্রভাত বলে তাকে স্বাগত জানাল।

 জুপনার বলল, সুপ্রভাত বলব কি শুভ সন্ধ্যা বলব ঠিক বুঝতে পারছি না।

ডর্ফ বলল, বারো ঘণ্টা হল আমরা এখানে এসেছি, অথচ এর মধ্যে সময়ের কোন হেরফের ঘটল না। চার ঘণ্টা ধরে পাহারায় আছি, কিন্তু ঘড়ি সঙ্গে না থাকলে বুঝতেই পারতাম না সময়টা পনেরো মিনিটি না এক সপ্তাহ।

জুপনার বলল, গ্রেস্টোক কোথায়? সে তো খুব সকালেই ওঠে।

 গ্রিডলে বলল, আমিও তো রবকে সেই কথাই জিজ্ঞেস করছিলাম; সেও তাকে দেখেনি।

ডর্ফ বলল, আমি পাহারায় আসার পরেই সে বেরিয়ে গেছে। তারপর প্রায় ঘণ্টা তিনেক হয়ে গেল। বেশিও হতে পারে। দেখলাম, সে মাঠটা পেরিয়ে বনের মধ্যে ঢুকে গেল।

ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে গ্রিডলে ও ভন হস্টের নেতৃত্বে ওয়াজিরি যোদ্ধাদের দলটাকে পাঠানো হল টারজনের খোঁজে।

মুভিরোর উপর পথ চিনে এগিয়ে যাবার ভার দেয়া হল। গন্ধ শুঁকে শুঁকে মুভিরো ঠিকই এগিয়ে যেতে লাগল। বনের মধ্যে কিছুদূর গিয়ে একটা বড় গাছের নিচে সে থেমে গেল। বলল, এইখনে এসে বড় বাওয়ানা গাছে চড়েছে; কাজেই এর পর থেকে তার খোঁজ করা খুব শক্ত হবে।

তবু তারা এগিয়ে চলল।

ক্রমে অরণ্যের চেহারা বদলাতে লাগল। বড় বড় গাছগুলো এখন আর ততটা ঘনসন্নিবদ্ধ নয়। ঝোপ-ঝাড়ও ততটা ঘন নয়। ফলে পথ চলা কিছুটা সহজসাধ্য হয়েছে। ওয়াজিরি যোদ্ধাদের চলার গতি বাড়ল। মাইলের পর মাইল পার হয়ে গেল। মধ্যাহ্ন সূর্যের মায়ায় সময়ের হিসেব রাখতেও তারা বুঝি। ভুলে গেল।

ক্রমে চারদিক থেকে ভেসে আসতে লাগল বিচিত্র ধ্বনি–কখনও গরু-গর শব্দ, কখনও গর্জন, কখনও আর্তনাদ।

জ্যাসন গ্রিডলে অসহায়ভাবে সেই মধ্যাহ্ন সূর্যের দিকে তাকাল। সূর্যের হাসি বুঝি বা তাকেই ঠাট্টা করতে লাগল। অগত্যা যে কোন একটা পথ ধরেই সে এগোতে শুরু করল।

জ্যাসন গ্রিডলে জীবনে কখনও এত ব্যর্থ ও অসহায় বোধ করেনি। অন্তহীন পথ ধরে অনন্তকাল এই পথ চলা; অথচ তিলমাত্র ধারণা নেই সে ও-২২০-এর দিকে এগোচ্ছে না তার বিপরীত দিকে চলেছে। অথচ আর কিই বা সে করতে পারে।

ওদিকে সময় যত পার হচ্ছে ও-২২০-এর যাত্রীদের মন ততই আশংকায় ভরে উঠছে।

জুপনার বলল, প্রায় বাহাত্তর, ঘণ্টা হয়ে গেল তারা বাইরে গেছে। জীবনে কখনও আমি এত অসহায় বোধ করিনি। অথচ কি যে করব তাও বুঝতে পারছি না।

চোখে একটা শক্তিশালী দূরবীন লাগিয়ে হল হাইন্স চারদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। পেলুসিডারের বন্য প্রাণী দেখার ব্যাপারে এই তিনটি প্রাণীর এখন আর কোন আগ্রহ নেই। হঠাৎ সে বিস্ময়ে চীৎকার। করে উঠল।

কি হল? জুপনার বলল। কিছু দেখতে পেলে?

ডর্ফ বলল, দেখতে পেয়েছি। হয় গ্রিডলে, নয়তো ভন হস্ট। কিন্তু যেই হোক সে একা।

জুপনার আদেশের ভঙ্গীতে বলল, লেফটেন্যান্ট, দশজনকে সঙ্গে নিয়ে এখনি চলে যাও। সকলেই যেন সশস্ত্র হয়ে যায়। সময় নষ্ট করো না।

ডর্ফ ততক্ষণে নিচে নেমে গেছে। ও-২২০-এর মাথায় বসে দুই অফিসার তাদের দিকেই চোখ রাখল। দেখল, তারা পরস্পরের দিকেই এগিয়ে চলেছে। জমিটা ঢেউ খেলানো বলে কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। শ’খানেক গজ দূরে আসতেই লেফটেন্যান্ট চিনতে পারল যে লোকটি জ্যাসন গ্রিডলে।

দ্রুত ছুটে এসে পরস্পরের হাত চেপে ধরল। গ্রিডলে প্রথমেই হারানো লোকদের কথা জানতে চাইল।

ডর্ফ মাথা নেড়ে বলল, একমাত্র তুমিই ফিরে এসেছ।

 গ্রিডলের চোখ থেকে সব আগ্রহের আলো নিভে গেল। হঠাৎ সে যেন অনেক ক্লান্ত, অনেক বুড়ো হয়ে পড়ল।

সকলেই তার এই কয়েক ঘণ্টার অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাইলে গ্রিডলে বলল, সকলের আগে আমার চাই একটু স্নান। তারপর একপেট খাবার। তারপর হবে গল্প-গুজব।

আধ ঘণ্টা পরে স্নান করে, দাড়ি কামিয়ে নতুন পোশাক বদলে তাজা হয়ে খেতে খেতেই শুরু করল তার অভিযানের বিবরণ।

সব কথা শুনে জুপনার বলল, যে খোলা জায়গা থেকে তুমি ভন হর্স্ট ও ওয়াজিরিদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলে, আর একটা অনুসন্ধানকারী দল নিয়ে সেখানে যেতে পারবে কি?

গ্রিডলে উত্তর দিল, তা নিশ্চয় পারব। বরং এমনভাবে পথটা বুঝিয়ে দিতে পারব যে আমাকে কোন দরকারই হবে না। যদি আর একটা দল পাঠানোই স্থির হয়, তাহলেও আমি, সে দলের সঙ্গে যাচ্ছি না।

অফিসাররা সকলেই অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকাল।

দলের সঙ্গে যাচ্ছি না, তবে আমি যাচ্ছি একা স্কাউট-প্লেনটায় চেপে। আর আমার প্রস্তাব হচ্ছে, আমি যাত্রা করার অন্তত চব্বিশ ঘণ্টা পরে অনুসন্ধানকারী দলটাকে পাঠানো হোক, কারণ সেই সময়ের মধ্যেই আমি হয় হারানো বন্ধুদের অবস্থান জানতে পারব, না হয় একেবারেই বিফল হব।

প্লেনটাকে ভাল করে দেখে নিয়ে গ্রিডলে বাকি তিনজন অফিসারের সঙ্গে করমর্দন করল, জাহাজের সকলের কাছ থেকে বিদায় নিল, তারপর ভোলা কক-পিটে চড়ে বসল।

গ্রিডলে আকাশে উড়ল।

প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে জ্যাসন গ্রিডলে একটানা সোজা উড়ে চলল জঙ্গল, সমভূমি ও উঁচু-নিচু পাহাড়ি অঞ্চলের উপর দিয়ে।

এক সময় অনেক দূর আকাশে এমন একটা কিছু তার চোখে পড়ল যাতে চরম বিস্ময়ে তার নিঃশ্বাস আটকে এল।

ঠিক তার মাথার উপরে ঘুরছে একটা বিরাটকায় প্রাণী। তার দুই উড়ন্ত ডানার বিস্তার তার প্লেনের প্রায় দ্বিগুণ। বিরাট দুই চোয়ালে বড় বড় দাঁতগুলো ঝকঝক করছে। সহসা তার মনে হল, প্রাণীটি তাকেই আক্রমণ করতে উদ্যত।

গ্রিডলে তখন উড়ে চলেছে প্রায় তিন হাজার ফুট উঁচুতে। বিরাট টেরানোডনটি সোজা নামতে লাগল তার প্লেন লক্ষ্য করে। জ্যাসন ডাইভ দিয়ে সেটাকে এড়িয়ে যেতে চাইল। তার পরেই প্রচণ্ড সংঘর্ষ, বিরাট গর্জন, কাঠ ভাঙার ও ধাতুতে ঘষা লাগার শব্দ ও টেরানোডনটি সোজা এসে আছড়ে পড়ল প্লেনের প্রপেলারের ভিতরে।

তারপর যা ঘটল সেটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে আর পাঁচ সেকেন্ড দেরী করলে জ্যাসন গ্রিডলেকে আর সে দৃশ্য দেখতে হত না।

প্লেনটা সম্পূর্ণ উল্টে গেল, আর ঠিক সেই মুহূর্তে গ্রিডলেও লাফিয়ে পড়ল। প্যারাসুটের সুতোটা ধরে টান দিল। মাথায় কিসের যেন আঘাত লেগে সে জ্ঞান হারাল।

যে মুহূর্তে জ্যাসন গ্রিডলে তার প্যারাসুটের দড়িটা ধরে টেনেছিল ঠিক তখনই তার প্লেনের ভাঙা প্রপেলারের একটা অংশ এসে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করেছিল তার মাথায়। জ্ঞান ফিরে এলে সে দেখল সে একটা উপত্যকার মাথায় ঘন ঘাসের বিছানায় শুয়ে আছে। উঁচু পাহাড়ের ভিতর দিয়ে এঁকে-বেঁকে এসে একটা গিরি নালা সেখানেই সমতল ভূমিতে পড়েছে।

সঙ্গীদের খোঁজে এসে এই বিপদ ঘটায় গ্রিডলের খুব মন খারাপ হয়ে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে প্যারাসুটের বাঁধন খুলে ফেলল। তবু ভাল যে কপালের খানিকটা ছড়ে যাওয়া ছাড়া বিশেষ কোন ক্ষত হয়নি।

প্রথমেই তার মনে পড়ল জাহাজটার কথা। সে জানে, সেটা নিশ্চয়ই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, তবু তার আশা যে খোঁজ করলে তার ভিতর থেকে রাইফেল ও গুলিগুলো হয়তো পাওয়া যেতে পারে। এমন সময় একটা সম্মিলিত তর্জন-গর্জন কানে আসতেই সে ডান দিকে চোখ ফেরাল। কিছুটা দূরে একটা ছোট ঢিপির মাথায় দেখতে পেল, পেলুসিডারের চারটি হিংস্র নেকড়ে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। এই সব নেকড়েকে বহিঃপৃথিবীর প্রাণীবিজ্ঞানীরা বলে হায়েনোডন, আর এই ভিতর-পৃথিবীর লোকরা বলে জালোক। দেখেই জ্যাসন বুঝতে পারল যে নেকড়েগুলো তাকে দেখে চেঁচাচ্ছে না; তাদের দৃষ্টিকে অনুসরণ করে দেখতে পেল, একটি মেয়ে তাদের দিকেই ছুটে চলেছে, আর তাকে তাড়া করে চলেছে চারটে পুরুষ মানুষ। ভয়বিহ্বল মেয়েটি একবার নেকড়েদের দিকে, একবার লোক চারটির দিকে তাকাচ্ছে।

পালাবার আর একটি মাত্র পথই খোলা আছে। সেদিকে তাকাতেই জানার চোখ পড়ল জ্যাসন গ্রিডলের উপর। ইতস্তত করে সে থেমে গেল। তাকে উৎসাহ দিয়ে গ্রিডলে চীৎকার করে তার দিকেই ছুটে আসতে লাগল।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মুহূর্তমাত্র চুপ করে থেকে জানা মুখ ফিরিয়ে গ্রিডলের দিকেই ছুটে গেল। তার পিছু নিল চারটি জন্তু ও চারটি মানুষ।

৪৫ ক্যালিবারের কোল্ট রিভলবারটা খাপ থেকে বের করে নিয়ে গ্রিডলেও ছুটল মেয়েটির দিকে। বড় হায়েনোডনটা প্রায় কাছে এসে পড়েছে এমন সময় জানা পা হড়কে পড়ে গেল, আর জ্যাসনও তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে এত কাছে থেকে গুলি করল যে হায়েনোডনের দেহটা মেয়েটির পাশেই লুটিয়ে পড়ল।

গুলির শব্দ শুনে বাকি তিনটে জন্তু ও স্কুকের দল থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ফেলি দেশের এই স্কুকের দলই মেয়েটিকে তাড়া করেছিল। জালোকের মরা দেহটাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে জ্যাসন মেয়েটিকে তুলে ধরল। আর সেই সুযোগে অরণ্য-মানবীর সহজাত আত্মরক্ষার তাগিদে মেয়েটি খাপ থেকে টেনে বের করল তার পাথরের ছুরিটা। জ্যাসন গ্রিডলে জানতেও পারল না যে সেই মুহূর্তে মৃত্যু তার কত কাছে এসে গেছে। ছুরির ফলাটা বসিয়ে দেবার ঠিক পূর্বক্ষণে এই লোকটির চোখে মেয়েটি এমন কিছু দেখতে পেল, যাতে সে যেন স্পষ্ট বুঝতে পারল, এই মানুষটি তার বন্ধু, শত্রু নয়।

তার হাত থেকে ছুরিটা মাটিতে পড়ে গেল। তা দেখে নবাগতের মুখে দেখা দিল স্মিত হাসি। প্রত্যুত্তরে জোরামের লাল ফুলটির মুখেও হাসি দেখা দিল।

এদিকে দুটো হায়েনোডন তেড়ে গেল ঝুঁকদের আক্রমণ করতে, আর তৃতীয়টা তেড়ে এল জ্যাসন। ও জানাকে লক্ষ্য করে। জ্যাসনের রিভলবারের এক গুলিতে তৃতীয় হায়েনার জীবনান্ত হল। ওদিকে তখন লড়াই চলেছে মানুষে ও জন্তুতে। জ্যাসনের গুলিতে আর একটা হয়েনা লুটিয়ে পড়তেই ঝুঁকদের গদার আঘাতে লুটিয়ে পড়ল আরও একটা। জানার পাথরের বর্শায় মারা পড়ল চতুর্থটা।

হায়েনার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়ে এবার স্কুকের দলের দৃষ্টি পড়ল জ্যাসন ও জানার দিকে। জানা সভয়ে বলে উঠল, এবার ওরা আমাদের আক্রমণ করবে। তোমাকে মেরে ফেলে আমাকে নিয়ে যাবে। ওদের হাতে আমাকে ছেড়ে দিও না।

গদা ও গুলির যুদ্ধ বেশিক্ষণ চলল না। কোল্টের দুটি গুলিতে দু’জন ঘায়েল হতেই ভ্রুক ও তার সঙ্গী পালিয়ে প্রাণে বাঁচল।

চারটি হায়েনা ও দু’টো মানুষের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে জ্যাসন বলল, তোমাদের এই ছোট দেশটা বেশ সুন্দর; তবু এখানে মানুষ কি করে বেঁচে থাকে তা তো ভেবে পাই না।

জোরামের ফুলটি তার কথা বুঝল না, মুখে কিছু বললও না; শুধু সপ্রশংস দৃষ্টি মেলে জ্যাসনকে দেখতে লাগল। সে দৃষ্টিতে ফুটে উঠল মুগ্ধতা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা। এক কথায়, এবার সে আর পালাতে চেষ্টা করল না। জ্যাসন গ্রিডলেও বুঝি এবার পুরোপুরি পথ হারিয়ে ফেলল এই বিচিত্র জগতে।

একটা নিচু পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে টারজান নিচে একটা বিধ্বস্ত বিমানকে দেখতে পেল। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এসে খুঁজতে লাগল চালকের মৃতদেহ। যখন দেখল ভিতরে কোন দেহ নেই তখন সে যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল। একটু পরেই বিমানের পাশে বুট-পরা পায়ের ছাপ দেখেই চিনতে পারল সেগুলো জ্যাসন গ্রিডলের বুটের ছাপ। তাতেই বোঝা গেল তার কোনরকম গুরুতর আঘাত লাগে নি। কিন্তু গ্রিডলের পায়ের ছাপের সঙ্গেই যে মিশে আছে ছোট পায়ের স্যান্ডেলের ছাপ! এটা কি ব্যাপার! এই সঙ্গীটিকে গ্রিডলে জোটাল কোথা থেকে?

গ্রিডলে ও জানার পায়ের ছাপ ধরে কিছুদূর এগিয়েই একটা প্রকাণ্ড টেরানোডনের মৃতদেহ তারা দেখতে পেল।

আরও আধ মাইল চলার পরে দেখতে পেল, একটা ভোলা প্যারাসুট মাটির উপর পড়ে আছে আর তারই অনতিদূরে পড়ে আছে চারটি হায়েনোডন ও দুটি লোমশ মানুষের মৃতদেহ। ভাল করে পরীক্ষা করে টারজান বুঝল যে দুটি মানুষ এবং দুটি হায়েনোডন মারা পড়েছে বুলেটবিদ্ধ হয়ে। সর্বত্রই রয়েছে জ্যাসনের সঙ্গীর স্যান্ডেলের ছাপ।

প্রথম কথা বলল টারজান, লোক ছিল মোট চারজন এবং আমার বন্ধুর সঙ্গে কোন নারী অথবা যুবক।

এবার তার সঙ্গী স্থানীয় আদিবাসী টোয়ার মুখ খুলল, চারজন এসেছিল নিচু অঞ্চল ফেলি থেকে, আর অপরটি জোরামের মেয়ে।

কি করে জানলে? টারজান জানতে চাইল।

টোয়ার বলল, নিচু অঞ্চলের স্যান্ডেল আর পাহাড়ি অঞ্চলের স্যান্ডেল একরকম নয়। নিচু ঘাস বা শেওলা ঢাকা জলাভূমির উপর দিয়ে হাঁটতে হয় বলে নিচু অঞ্চলের হ্যাঁন্ডেলের সোল হয় পাতলা, আর পাহাড়ি অঞ্চলের স্যান্ডেলের সোল হয় মোটা।

আমরা কি জোরামের কাছে এসে পড়েছি? টারজনের প্রশ্ন।

 টোয়ার জবাব দিল, না, আমাদের সামনে সবচাইতে উঁচু পাহাড়টার ওপারে জোরাম।

প্রথম সাক্ষাতেই তুমি বলেছিলে যে তুমি জোরামের লোক।

হ্যাঁ, ওটাই আমাদের দেশ। তাহলে তো এই মেয়েটিকে তুমি নিশ্চয় চেন?

 সে আমার বোন, টোয়ার জবাব দিল।

টারজান অবাক চোখে তাকাল। বলল, কি করে বুঝলে?

ঘাসবিহীন নরম মাটির উপর পায়ের ছাপ এত স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে যে তার স্যান্ডেলের ছাপ চিনতে আমার কোন অসুবিধা হয়নি।

নিজের দেশ থেকে এতটা দূরে তোমার বোন কি করছিল? আর আমার বন্ধুর সঙ্গেই বা সে জুটল কেমন করে?

টোয়ার বলল, সেটা তো খুব পরিষ্কার। ফেলি থেকে আগত এই লোকগুলো তাকে বন্দী করতে চেয়েছিল। তোমার দেশের লোকটি এসে জালোকগুলো ও দুটো ফেলির লোককে মেরে ফেলে এবং বাকি দুটোকে তাড়িয়ে দেয়। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, আমার বোন তার হাত থেকে পালাতে পারেনি, তার হাতেই বন্দী হয়েছে।

টারজান হাসল। পায়ের ছাপ দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না যে সে পালাবার কোনরকম চেষ্টা করেছিল।

টোয়ার মাথা চুলকে বলতে লাগল, তা ঠিক।

টারজান বলল, আমার বন্ধু কদাপি তাকে জোর করে ধরে নিয়ে যায়নি। যদি তার সঙ্গে গিয়ে থাকে তো স্বেচ্ছায়ই গিয়েছে।

টোয়ার বলল, দেখাই যাক; সে যদি জোর করে জানাকে ধরে নিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে সে মরবে।

ঠিক সেই সময় একটি ভগ্নমনোরথ মানুষের দল টিপৃডার পর্বতশ্রেণীর শেষ প্রান্ত ঘুরে গাইওর কোর বা সুবৃহৎ গাইওর সমভূমিতে ঢুকেছে। দলের লোকসংখ্যা এগারো-দশটি কৃষ্ণকায় ও একজন শ্বেতকায়। মানুষের ইতিহাসে কেউ কোনদিন এই এগারোটি মানুষের মত সম্পূর্ণভাবে পথ হারিয়ে একান্ত অসহায় হয়ে পড়েনি।

মুভিরো ও তার যোদ্ধারা কুশলী অরণ্যচারী; কিন্তু পথ চিনবার এই অক্ষমতায় তারাও সম্পূর্ণ হতোদ্যম হয়ে পড়েছে।

ওদিকে ও-২২০-এর যাত্রীরা সঙ্গীদের প্রত্যাবর্তনের আশায় অপেক্ষা করে অধৈর্য হয়ে উঠল। শেষ পর্যন্ত জুপনার আর একটি দলের সঙ্গে ডকে পাঠাল তাদের খোঁজে। সত্তর ঘণ্টা পরে তারা ফিরে এসে জানাল যে কারও দেখা মেলেনি।

তখন জুপনার স্থির করল, এমন নিষ্ক্রিয়ভাবে আর এখানে অপেক্ষা করা চলে না; জীবিত বা মৃত যে কোন অবস্থায় সঙ্গীদের খুঁজে বের করতেই হবে।

অতএব আর বিলম্ব নয়। ও-২২০ আকাশে উড়ল। রবার্ট জোন্স তার তেল-চিটচিটে দিনপঞ্জীর পাতায় লিখল : দুপুরবেলা আমরা এখান থেকে যাত্রা করলাম।

জ্যাসন গ্রিডলে বলল, এই দিকে চল।

জানা বলল, না, এই দিকে। আঙুল বাড়িয়ে সে টিল্ডার পর্বতশ্রেণীর উঁচু শিখরগুলো দেখাল।

দু’জনের কেউ কারও ভাষা বোঝে না, তাই কিছু বোঝাতেও পারে না। হতাশ হয়ে গ্রিডলে বোকা বোকা চোখে জানার দিকে তাকিয়ে হাসল। সেই হাসিরই জয় হল। জোরামের ফুলটি জ্যাসনের প্রদর্শিত পথেই পা বাড়াল।

কিন্তু তাদের চলাই সার হল। ও-২২০-এর দেখা মিলল না। তখন জ্যাসন হতাশ ভঙ্গীতে জানার দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করল যে এখন থেকে জানা যে পথে যেতে বলবে সেই পথেই সে যাবে।

তারপর শুরু হল নতুন যাত্রা। চড়াই ভেঙ্গে দু’জন এগিয়ে চলল টিপডার পর্বতমালার সানুদেশ লক্ষ্য করে।

হঠাৎ এক সময় মেয়েটি শুধাল, আমার দিকে তুমি এত বেশি তাকাও কেন?

জ্যাসন গ্রিডলের মুখখানা লাল হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি সে চোখ ফিরিয়ে নিল। এই প্রথম সে বুঝতে পারল, সত্যি মেয়েটির দিকে সে বড় ঘন ঘন তাকাতে শুরু করেছে। কি যেন বলতে গিয়েও থেমে গেল।

কথা বলছ না কেন জ্যাসন? মেয়েটি শুধাল।

 কি কথা বলব?

 আমার দিকে তাকালে যে কথা ফুটে ওঠে তোমার চোখে।

অপার বিস্ময়ে গ্রিডলে তাকাল জানার দিকে। এও কি সম্ভব যে সে–দৃষ্টি ফুটে উঠেছে তার নিজের চোখে।

জ্যাসন তার প্রশ্নের কোন জবাব না দেয়ায় জোরামের লাল ফুলটি নিজের অন্তরের মধ্যে কি যেন খুঁজল। ধীরে ধীরে তার ঠোঁট থেকে মিলিয়ে গেল প্রত্যাশার হাসি।

ধীরে ধীরে সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মুখ ঘুরিয়ে ফিরে চলল সেই খাদটার দিকে যেখানে সে নেমে এসেছিল স্কুকদের তাড়া খেয়ে।

জ্যাসন চেঁচিয়ে ডাকল, জানা, রাগ করো না। কোথায় যাচ্ছ তুমি?

জানা থামল। উদ্ধত চিবুকটি আকাশে তুলে ম্লান হেসে পিছনে তাকিয়ে বলল, তোমার পথে তুমি চলে যাও জালোক; জানা চলল তার নিজের পথে। বলতে বলতেই যেন তার কথাকে প্রমাণ করতেই সে দ্রুতগতিতে খাদের পাড় থেকে নিচে নেমে গেল। জ্যাসন তাকে আর দেখতেই পেল না।

গহ্বরের মুখে ছুটে গিয়ে জ্যাসন গ্রিডলে নিচে তাকিয়ে দেখল, মাত্র কয়েক গজ নিচে খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে জানা ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছে। জ্যাসন রুদ্ধশ্বাস। এই মাথা ঝিম্‌-ঝিম্ করা খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে কোন প্রাণী যে নামতে পারে সেটা একেবারেই অবিশ্বাস্য। সে ভয়ে শিউরে উঠল।

জ্যাসন গ্রিডলে উঠে দাঁড়াল। রাইফেল ঝোলাবার চামড়ার ফিতেটাকে পিঠের উপর বাঁধল। দুটো বন্দুকের খাপকেও পিঠের উপর ঝুলিয়ে দিল। পায়ের বুট খুলে নিচের খাদের মধ্যে ফেলে দিল। তারপর উপুর হয়ে শুয়ে পা দুটো খাদের মধ্যে নামিয়ে দিল। হাত বা পা রাখার মত প্রতিটি জায়গা খুঁজে খুঁজে জ্যাসন গ্রিডলেও নামতে লাগল একটু একটু করে।

অনেক উপরে পাহাড় শ্রেণীর মাথায় দেখা দিল ঘন কালো মেঘ। পেলুসিডারে এই গ্রিডলের প্রথম মেঘ দেখা। সে বুঝল, বৃষ্টি আসন্ন; কিন্তু সে বৃষ্টি যে কত ভয়ংকর হতে পারে তা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি।

ঝড় উঠল। সঙ্গে সঙ্গে জানার মনে হল, এ ঝড় যে কতখানি বিপজ্জনক হতে পারে সে কথা তো নিচের লোকটি জানে না। কিন্তু সে তো ভাল করেই জানে এই প্রবল বর্ষণের ফলে অচিরেই খাদটা পরিণত হবে একটি উচ্ছ্বসিত তীব্রগতি জলস্রোতে। তার আগেই জ্যাসনকে খাদের দেয়ালের কোন একটা উঁচু জায়গায় এনে আশ্রয় দিতেই হবে।

এখানকার মেয়ে হলেও জানা আগে কখনও এত ভয়ংকর ঝড় দেখেনি। আকাশে বজ্র গর্জন করছে; বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বাতাস হাহাকার করছে; ধারা-বর্ষণে দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। তবু তারই মধ্যে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও করুণার ব্যর্থ প্রেরণায় সে অন্ধের মত নিচে নামছে। নিচে তাকিয়ে দেখল, খাদের জল উঠে এসে তাকে প্রায় দুই-ছুঁই করছে; এ অবস্থায় খাদের নিচে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না। লোকটি অনেক আগেই স্রোতের মুখে ভেসে গেছে।

জ্যাসন মারা গেছে! জোরামের লাল ফুলটি মুহূর্তের জন্য নিচে উচ্ছ্বসিত জলস্রোতের দিকে তাকাল। ইচ্ছা হল, ঝাঁপ দিয়ে নিচে পড়ে। তার আর বাঁচবার সাধ নেই। তবু কিসের যেন তাগিদে সে থেমে গেল। আবার সে উপরে উঠতে লাগল।

কালিফোর্নিয়ায় ও আরিজোনায় জ্যাসন গ্রিডলে অনেক ঝড় দেখেছে। খাদের জল তার হাঁটু পর্যন্ত ওঠার আগেই অনেক কষ্টে সে আরও খানিক উপরে একটা নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে গেল। সেখানেই। একটা ঝোলানো পাথরের চাইয়ের নিচে সাময়িক আশ্রয় পেয়ে গেল।

পাথরের খাঁজে একটা বাসায় অনেকগুলো ডিম দেখতে পেয়ে তাই খেয়ে আপাতত ক্ষুধার নিবৃত্তি করল। কাছেই একটা বেঁটে গাছ দেখতে পেয়ে পোশাক ছেড়ে সেগুলো শুকোতে দিয়ে তার নিচেই শুয়ে পড়ল।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল খেয়াল নেই; ঘুম ভাঙলে পোশাকের জন্য হাত বাড়াতেই এ কী! পোশাক তো নেই! চারদিকে তাকাল; কেউ কোথাও নেই। তার ঠিক পাশেই রিভলবার ও গুলির বেল্ট ছিল; সেগুলো যথাস্থানেই রয়েছে।

এক সময় দেখতে পেল, কিছুদূরে একটা গিরি-নালা থেকে ধোঁয়া উঠছে। চুপি চুপি সেখানে পৌঁছে জ্যাসন নিচে উঁকি দিল।

ঝর্ণার ধারে শুয়ে আছে একটি যোদ্ধা। পাশের আগুনে ঝলসানো হচ্ছে একটা মুরগি। যাতে যোদ্ধাটি কোন রকমে সন্দেহ না করে সে জন্য সে স্থির করল সোজাসুজি হেঁটে তার কাছে গিয়ে হাজির হবে। এমন সময় গিরি-নালার অপর দিকের পাহাড়ের মাথায় তার দৃষ্টি পড়ল। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এমন। একটি প্রাণী যা এর আগে বহিঃপৃথিবীর কেউ কোন দিন দেখেনি-চৰ্মাবৃত একটি বিরাট ডাইনোসর; দৈর্ঘ্যে ষাট-সত্তর ফুট, উচ্চতায় মাটি থেকে পুরো পঁচিশ ফুট। জন্তুটি হাঁটছে টিকটিকির মত চারটে পায়ে ভর রেখে। কিন্তু জ্যাসনকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ বিরাট লেজটাকে নিচে নামিয়ে সেটা সোজা ঝাঁপ দিল পাহাড়ের উপর থেকে।

বাতাসে হিস্-হিস্ শব্দ শুনে নিচের যোদ্ধাটি লাফ দিয়ে উঠে বর্শাটা বাগিয়ে ধরল; আর জ্যাসন গ্রিডলেও এক লাফে ঢালু পাহাড়টার উপর পৌঁছে দুটি বন্দুককেই খাপ থেকে খুলে যোদ্ধাটির দিকে ছুটে গেল।

পথ হারিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে টারজান। একটা পাহাড়ের মোড়ে বাক নিতেই একটি ছেলের সঙ্গে একেবারে মুখোমুখি হয়ে গেল। টারজানকে দেখেই ছেলেটি থমকে থেমে গেল। তার হাতে উদ্যত বর্শা ও খাপ-খোলা ছুরি।

অরণ্য-রাজ বলল, আমি টারজান, অরণ্যের রাজা। আমি এসেছি বন্ধুর মত, তোমাকে মারতে নয়।

 ছেলেটি বলল, আমি ওভান। কেন তুমি ক্লোভিতে এসেছ?

টারজান পথ হারিয়েছে। সে এসেছে পেলুসিডার থেকে অনেক দূরের এক অন্য জগৎ থেকে। বন্ধুদের হারিয়ে সে তাদেরই খোঁজ করছে। ক্লোভির লোকদের সঙ্গে সে বন্ধুত্ব করতে চায়।

ছেলেটি বলল, খুব ভাল কথা। তুমি আভান সর্দারের সঙ্গে কথা বলতে পার। সে আমার বাবা। তারা যদি তোমাকে মেরে ফেলতে চায় তাহলে আমি তোমাকে সাহায্য করব।

কথা বলতে বলতে দু’জন ক্লোভির দিকে চলতে লাগল।

ক্লোভির লোকজনদের মধ্যে মাত্র অল্প কয়েকজনই টারজানকে ভালবাবে গ্রহণ করল; তাদের মধ্যে আছে ওভানের মা মারাল, আর বোন রেলা।

একদিন মুখে মুখে জয়ধ্বনি শোনা গেল। কার্ব ফিরে এসেছে। জোরামের সর্বশ্রেষ্ঠা সুন্দরীকে নিয়ে ফিরে এসেছে ক্লোভির বিজয়ী যোদ্ধারা। কার্ব মহান! ক্লোভির যোদ্ধারা মহান!

বিশজন যোদ্ধা ফিরল কার্বের নেতৃত্বে। তাদের সঙ্গে একটি মাত্র মেয়ে। তার হাত পিঠমোড়া করে বাঁধা, গলায় একটা চামড়ার ফিতে; তার একটা দিক একজন যোদ্ধার হাতে ধরা।

আভান সর্দার সকলকে স্বাগত জানাল। উপহার স্বরূপ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে কার্বের সব কথা শুনল। তারপর বলল, এখনি পরিষদের একটা বৈঠক বসবে। সেখানেই স্থির হবে এই বন্দিনীকে কে পাবে। আরও একটা জরুরি ব্যাপার এদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।

এক সময় বন্দিনী মেয়েটিকে কাছে পেয়ে টারজান তাকে শুধাল, তুমি কি টোয়ারের বোন জানা?

মেয়েটি অবাক হয়ে তাকাল। তাকে ভাল করে দেখে নিয়ে বলে উঠল, ওহো তুমিই সেই নবাগতা?

 হ্যাঁ।

আমার দাদা টোয়ার সম্পর্কে তুমি কি জান?

আমরা একসঙ্গে শিকার করেছি। জোরামে ফিরে যাবার পথে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। তোমার ও তোমার এক সঙ্গীর পায়ের ছাপ দেখেই আমরা এগোচ্ছিলাম, এমন সময় ঝড় এসে সব মুছে দিল। আমিও তোমার সেই সঙ্গীর খোঁজেই বেরিয়েছি।

যে লোকটি আমার সঙ্গে ছিল তাকে তুমি চেন?

 সে আমার বন্ধু! সে কোথায়?

ঝড়ের সময় সে একটা গিরি-নালায় ছিল। নির্ঘাৎ ডুবে গেছে। তুমি তার দেশের মানুষ?

হ্যাঁ।

কি করে জানলে যে সে আমার সঙ্গে ছিল?

আমি চিনতে পেরেছি তার পায়ের ছাপ, আর টোয়ার চিনেছে তোমার পায়ের ছাপ।

মেয়েটি বলল, সে খুব বড় যোদ্ধা আর খুব সাহসী।

তুমি ঠিক জান সে মারা গেছে? টারজান প্রশ্ন করল।

নিশ্চিত জানি, জোরামের লাল ফুলটি বলল।

কিছুক্ষণ দু’জনই চুপ। তাদের মনে জ্যাসন গ্রিডলের চিন্তা। টারজনের খুব কাছে সরে এসে জানা ফিসফিস করে বলতে লাগল তুমি তার বন্ধু। কিন্তু এরা তোমাকে মেরে ফেলবে। কার্বকে আমি ভাল করেই চিনি। তার যা কথা সেই কাজ। আমরা দুজনই জ্যাসনের বন্ধু। যদি এখান থেকে পালাতে পারি আমি তোমাকে জোরামের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব।

ফিসফিস্ করে কি বলছ? পিছন থেকে একটা কর্কশ কণ্ঠস্বর ভেসে এল। মুখ ফিরিয়ে তারা দেখল, আভান সর্দার। স্ত্রী মারালকে ডেকে বলল, মেয়েটিকে গুহার মধ্যে নিয়ে যাও। ও কার সঙ্গিনী হবে পরিষদে সেটা স্থির না হওয়া পর্যন্ত ও সেখানেই থাকবে।

জানাকে নিয়ে মারাল চলে যাবার পরে টারজানও উঠে দাঁড়াল। চারদিকে তাকিয়ে দেখল, প্রায় শ’খানেক মানুষ এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে। আর পালাবার একমাত্র পথ গিরি-নালার মুখের কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে ডজনখানেক যোদ্ধা। একা হলে সে হয় তো ওদের ভিতর দিয়ে পথ করেই চলে যেতে পারত, কিন্তু একটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। সে গুহার মুখের দিকে এগিয়ে চলল। টোয়ারের বোন ও জ্যাসনের বন্ধুকে ফেলে সে নিজে পালাতে পারে না।

উড়ন্ত সরীসৃপটা দ্রুতগতিতে নেমে আসছে একক যোদ্ধাটিকে আক্রমণ করতে। তাকে লক্ষ্য করেই ঝাঁপ দিল জ্যাসন গ্রিডলে। সেই মুহূর্তে তার চোখে ভেসে উঠল একটি লুপ্ত সরীসৃপের ছবি-জুরাসিক পাহাড়ের স্টেগোসরাসের ছবি।

জ্যাসন দেখল, আসন্ন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও একক যোদ্ধাটির চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। তার এক হাতে ছোট বর্শা, অন্য হাতে পাথরের ছুরি। সে মরবে, কিন্তু বীরত্বের পরিচয় রেখে মরবে।

কিন্তু যোদ্ধাটি বর্শা ছুঁড়বার আগেই জন্তুটা তাদের সামনে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। নাকটা ঢুকে গেল মাটির মধ্যে। এক পাশে কাত হয়ে পড়ে মরে গেল।

মরে গেল! যোদ্ধাটি অবাক হয়ে বলল। কিসে মরল? আমি তো বর্শা হুঁড়িনি।

কোল্ট রিভলবার দুটো খাপে ভরতে ভরতে জ্যাসন বলল, এরাই মেরেছে।

তার দিকে তাকিয়ে সসম্ভ্রমে যোদ্ধাটি বলল, তুমি কে? জোরামদের দেশে কি করছ?

আমার নাম গ্রিডলে-জ্যাসন গ্রিডলে।

 জ্যাসন! হ্যাঁ, জ্যাসন গ্রিডলে, ঠিক বটে। এবার বল, তুমি কি টারজানকে চেন না?

টারজান! তুমি টারজানকে দেখেছ? সে বেঁচে আছে?

আমি তাকে দেখেছি। আমরা এক সঙ্গে শিকার করেছি, তোমাকে ও জানাকে খুঁজেছি; কিন্তু সে বেঁচে নেই, মারা গেছে।

কি করে মারা গেল?

একটা পাহাড়ের মাথায় চড়ে সেটা পার হচ্ছিলাম এমন সময় একটা টিপৃডার ছোঁ মেরে তাকে তুলে নিয়ে গেছে।

টারজান! এ আশংকা তার ছিল, কিন্তু এখন এমন অকাট্য প্রমাণ পাবার পরেও জ্যাসনের মনে হল এ অবিশ্বাস্য। সেই ইস্পাত-কঠিন মানুষটি মরতে পারে না।

জ্যাসনকে চুপ করে থাকতে দেখে যোদ্ধাটি বলল, তাকে তুমি খুব ভালবাসতে, তাই না?

হ্যাঁ, আমরা দুজন এক সঙ্গেই ছিলাম। এখন তো টারজান মারা গেছে, তাই আমি একাই জোরামের লাল ফুলটিকে খুঁজছি।

জ্যাসন বলল, আমিও তো তাকেই খুঁজছি। চল, দুজনে একসঙ্গেই খুঁজব। তোমার নাম কি?

লোকটি বলল, টোয়ার।

বন-জঙ্গল ও জলাভূমিতে ঘেরা অনেক পথ পার হয়ে দু’জন এগিয়ে চলল।

অরণ্য-রাজ নিঃশব্দে গুহার মধ্যে ঢুকে গেল। ভিতরকার স্বল্প আলোয় দৃষ্টি অভ্যস্ত হয়ে এলে সে বুঝতে পারল গুহাটা বেশ বড়। দেয়ালে গা ঘেঁষে খড়ের বিছানায় অনেক যোদ্ধা, কিছু নারী ও শিশু ঘুমিয়ে আছে। টারজান জোরামের মেয়েটির খোঁজে এগিয়ে চলল। সেই তাকে প্রথম চিনতে পেরে নীচু গলায় শিস্ দিয়ে জানিয়ে দিল।

এমন সময় মশাল হাতে একটি ছেলে গুহায় ঢুকল। টারজানকে দেখতে পেয়ে তার কাছে গেল। ছেলেটি ওভান।

সে বলল, পরিষদের সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। তারা তোমাকে মেরে ফেলবে।

টারজান উঠে দাঁড়াল। জানাকে বলল, এস। আর দেরী করা নয়। ওভানের দিকে ফিরে বলল, তুমি নিজেই বলেছ তুমি আমার বন্ধু। আশা করি তুমি চুপ করে থেকে আমাদের পালাবার সুযোগ করে দেবে।

ছেলেটি বলল, আমি তোমার বন্ধু বলেই এখানে এসেছি। বাইরে সশস্ত্র পাহারা। তাদের এড়িয়ে তোমরা পালাতে পারবে না।

কিন্তু এছাড়া আর কোন পথ নেই, টারজান বলল। একটা পথ আছে, আর সেই পথ দেখাতেই আমি এসেছি।

এস আমার সঙ্গে, বলে ছেলেটি গুহার শেষ প্রান্তের দিকে এগিয়ে চলল। তার পিছনে চলল টারজান। ও জানা।

একেবারে শেষপ্রান্তে গিয়ে ওভান থামল। মশালটা মাথার উপরে ধরল। সেই আলোয় দেখা গেল। একটা ছোট ঘরের শেষ প্রান্তে আছে একটা অন্ধকার ফাটল।

ছেলেটি বলল, ওই অন্ধকার গর্তের ভিতর থেকে একটা পথ চলে গেছে পাহাড়ের মাথায়। একমাত্র সর্দার ও তার জ্যেষ্ঠপুত্রই সে পথের খবর জানে। বাবা যদি জানতে পারে যে আমি তোমাদের এই পথটা দেখিয়ে দিয়েছি তাহলে আমাকেও মেরে ফেলবে। রাস্তাটা খুব খাড়া ও এবড়ো-থেবড়ো। তবু এটাই একমাত্র পথ। চলে যাও। আমার জীবন বাঁচিয়েছিলে বলেই তার প্রতিদান দিলাম।

কথা শেষ করেই সে মশালটাকে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিল। গাঢ় অন্ধকারে চারদিকে ঢেকে গেল। ছেলেটি আর কোন কথা বলল না। তার পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে গেল।

জানার হাত ধরে টানতে টানতে অনেক কষ্ট করে দু’জনে পাহাড়ের মাথায় উঠে গেল। তখন বলল, এবার? কোন্‌দিকে জোরাম?

আঙুল দিয়ে দেখিয়ে জানা বলল, ওই দিকে। কিন্তু ও পথে আমরা যাব না। কার্ব ও তার দলবল সবগুলো পাহাড়ি পথের উপরেই নজর রাখবে। কাজেই আমরা সোজা নেমে যাব নিচের সমতল অঞ্চলের দিকে।

নামতে নামতেই যতদূর চোখ যায় ততদূর পর্যন্ত বিস্তৃত একটা সমতলভূমি টারজনের চোখে পড়ল। শেষ পর্যন্ত একটা ঘোরানো গিরি-নালা ধরে চলতে চলতে তার একেবারে মুখে পৌঁছে সেই বিস্তীর্ণ সমতলভূমিতেই পৌঁছে গেল।

জোরামের লাল ফুলটিকে খুঁজে পাবার আশায় জ্যাসন গ্রিডলে পাহাড়ের চড়াই ভেঙ্গে ফেলির গ্রামের দিকে ছুটে চলেছে; বোনকে উদ্ধার করতে বা প্রতিশোধ নিতে বর্শা ও ছুরি হাতে তার পাশে চলেছে টোয়ার।

কোন রকম বিপদের আশংকা করে তারা পাহাড় বেয়ে নেমে গাছের নিচেকার ঘন ঝোপের ভিতরে ঢুকে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে একজন মানুষ লাফিয়ে পড়ে তাদের মাটিতে ফেলে দিল। মুহূর্তের মধ্যে দু’জনকে নিরস্ত্র করে পিঠমোড়া কের তাদের হাত বেঁধে ফেলল। তারপর ঝাঁকি দিয়ে দু’জনকে দাঁড় করিয়ে দিতেই আক্রমণকারীদের দিকে চোখ পড়ামাত্র জ্যাসন গ্রিডলের চোখ বিস্ময়ে একেবারে ছানাবড়া হয়ে গেল।

সে চেঁচিয়ে বলে উঠল, আরে কী আশ্চর্য! এখানে এসে গণ্ডার, ম্যামথ, ট্রাকোডন, টেরাডাকিটল ও ডাইনোসরের দেখা পাব তা জানতাম, কিন্তু পেলুসিডারের একেবারে গহন গভীরে ক্যাপ্টেন কিড, লাফিতে ও স্যার হেনরি মর্গানকে দেখতে পাব এ স্বপ্নেও ভাবিনি।

একজন বলল, ওটা কোন ভাষা? তুমিই বা কে? আর কোথা থেকে এসেছ?

ভাষাটা প্রাচীন মার্কিনী, আর আমি এসেছি ইউ, এস, এ থেকে। কিন্তু তোমরা কারা? আর কেনই বা আমাদের বন্দী করেছ?

একজন দাড়িওয়ালা লোক বলল, আমরা জানি তুমি কে বা কোন্ দেশ থেকে এসেছ। আমাদের বোকা বানাতে চেষ্টা করো না।

বেশ তো, তা যদি জানই তো আমাকে ছেড়ে দাও। কারণ তোমরা নিশ্চয় জান যে কারও সঙ্গে আমাদের কোন লড়াই নেই।

বক্তা বলল, তোমাদের দেশ সব সময়ই কোরসারদের সঙ্গে যুদ্ধরত। তুমি তো সারির লোক। তোমার অস্ত্রশস্ত্র দেখেই সেটা বুঝতে পেরেছি। তোমাকে দেখামাত্রই বুঝেছি, তুমি সুদূর সারি থেকে এসেছ। একজন সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বলল, এই তো স্বয়ং টানার। সে যখন কোরসারে বন্দী ছিল তখন তাকে দেখেছিলে কি?

না, তখন আমি জাহাজে ছিলাম। তবে এই যদি টানার হয় তাহলে আমরা অনেক পুরস্কার পাব।

 প্রথম বক্তা বলল, এবার জাহাজে ফিরে চল। আর সময় নষ্ট করে কোন লাভ নেই।

জাহাজের লিংবোট’টা তীরে একটা গাছের সঙ্গে বাঁধা ছিল। পাহারায় ছিল পাঁচজন কোরসার।

বন্দীদের নৌকার মধ্যে ঠেলে দিয়ে কোরসাররাও উঠে পড়ল। তীব্র স্রোতের টানে নৌকাটা তত করে ভেসে চলল।

পেরির কাছ থেকে বেতার মারফৎ জ্যাসন পেলুসিডারের টানারদের যে কাহিনী আগেই জানতে পেরেছিল তাতেই কোরসারদের চেহারা ও স্বভাব তার জানাই ছিল। তবু তারা কেউই সামনা সামনি দেখা রক্ত-মাংসের মানুষ ছিল না।

এইসব অসভ্য কোরসার, তাদের নৌকা, তাদের পোশাক ও প্রাচীনকালের আগ্নেয়াস্ত্র দেখেই জ্যাসন স্পষ্ট প্রমাণ পেল যে তারা সহিঃপৃথিবী থেকেই এখানে এসেছে। সে আরও বুঝল, এদের দেখেই ডেভিড ইনেসের মনে দৃঢ় ধারণা জন্মেছিল যে পেলুসিডার থেকে বহিঃপৃথিবীতে যাবার একটা পথ মেরু অঞ্চলের দিকে অবশ্যই আছে।

কাজেই এই অসভ্য লোকগুলোর হাতে পড়ার দুর্ভাগ্যের জন্য টোয়ার খুব হতাশ হলেও জ্যাসন কিন্তু দেখতে পেয়েছে সৌভাগ্যের হাতছানি। সে ধরেই নিয়েছে, এরা তাদের নিয়ে যাবে সেই কোরসার শহরে যেখানে ডেভিট ইনেসকে বন্দী করে রাখা হয়েছে; আর তা যদি হয় তাহলে তো পেলুসিডারের সম্রাটকে উদ্ধারের যে ব্রত নিয়ে তারা এই অভিযানে এসেছে তার প্রথম লক্ষ্যে তারা পৌঁছে যেতে পারবে।

নৌকা ভেসে চলেছে। জ্যাসন ও টোয়ারকে রাখা হয়েছে নৌকার মাঝখানে। তাদের হাত তখনও পিঠমোড়া করে বাঁধা। জ্যাসনের কাছেই যে কোরসারটি বসে আছে সঙ্গীরা তাকে ডাকছিল লাজো বলে। লোকটি প্রথম থেকেই জ্যাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।

প্রথম সুযোগেই সে লাজোর মনোযোগ আকর্ষণ করতে চেষ্টা করল। লাজো শুধাল, কি চাও?

তোমাদের সর্দার কে? জ্যাসন জানতে চাইল।

সর্দার কেউ নেই। সে আগেই মারা গেছে। তুমি কি চাও?

আমি চাই আমাদের হাতের বাঁধন খুলে ফেলা হোক। আমরা তো পালাতে পারব না। আমরা নিরস্ত্র, আর সংখ্যায় তোমরা অনেক। অথচ এইসব সরীসৃপদের আক্রমণে যদি নৌকাটা ভেঙ্গে যায় বা ডুবে যায়। তাহেল তো হাত-বাঁধা অবস্থায় আমরা একেবারেই অসহায় হয়ে পড়ব।

লাজো ছুরি বের করল। জ্যাসন ও টোয়ারের হাতের বাঁধন কেটে দিল।

আবার চলা শুরু হল। জ্যাসনের মনে হল, এই অজ্ঞাত যাত্রার বুঝি শেষ নেই। তারা অনেকবার খেল, অনেকবার ঘুমাল। সীমাহীন জলাভূমির বুক চিরে নৌকা চলেছে তো চলেইছে। দুই তীরের ঘন। সবুজ বন আর ডালে ডালে নানা রঙের ফুল দেখে দেখে চোখ পচে যাবার উপক্রম হল। তবু চলার শেষ হল না।

এতক্ষণ চুপচাপ বসে কাটালেও এবার জ্যাসন ও টোয়ারকেও কাজে লাগানো হল। তাদের হাতেও তুলে দেয়া হল বৈঠা। বারুদ-ভর্তি গাদা বন্দুক রয়েছে বৈঠাওয়ালাদের পাশে; নৌকার গলুই ও পিছন দিকে সশস্ত্র লোকগুলো চলেছে বাঁ দিকের তীরের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে।

বৈঠা চালাতে চালাতে তাদের দুজনকে খুবই ক্লান্ত হতে দেখে লাজো তাদের কিছুক্ষণের জন্য ছুটি দিল। এমন সময় হঠাৎ নৌকার গলুই থেকে ভয়ার্ত চীৎকার উঠলঃ তারা এসে পড়েছে।

নৌকার মধ্যে সাজ-সাজ রব পড়ে গেল। কোনরকমে ক্লান্ত দেহটাকে টেনে তুলে জ্যাসন তাকিয়ে দেখল বীভৎস সরীসৃপের পিঠে চেয়ে ধেয়ে আসছে মানুষের মতই একপাল জীব। হাতে লম্বা বল্লম। তাদের আঁশওয়ালা বাহনগুলো অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে জলের ভিতর দিয়ে ছুটে আসছে। আর কাছে এলে দেখল, মানুষের মত দেখতে হলেও তারা মানুষ নয়-এক শ্রেণীর বিবিত্র সরীসৃপ-মাথাটা গিরগিটের মত, তাতে সরু কান ও ছোট শিং।

সে চেঁচিয়ে বলল, হা ঈশ্বর! ওরা কারা?

টোয়ার কাঁপতে কাঁপতে বলল, ওরা হরিবের দল। ওদের হাতে পড়ার চাইতে মরা ভাল।

স্রোতের টানে ও বৈঠার বেগে ভারী নৌকাটা সোজা ছুটে চলেছে সেই ভয়ংকর বীভৎস জীবগুলোর দিকে। দূরত্ব ক্রমেই কমে আসছে। সামনের গলুই থেকে একটা বন্দুক গর্জে উঠল। হরিবরা নৌকার সামনে থেকে সরে গেল। কিন্তু পরমুহূর্তেই তারা নৌকার দুই পাশ বরাবর ছুটতে লাগল। গাদা বন্দুক থেকে সমানে বের হচ্ছে আগুন ও ধোঁয়া, ছুটছে তার ভিতরকার লোহা ও পাথরের টুকরো। কিন্তু হরিবদের ভ্রূক্ষেপ নেই। একটা পড়ছে তো দুটো এগিয়ে সে তার জায়গা নিচ্ছে।

নৌকার জীবিত আরোহীর সংখ্যা ক্রমে মুষ্টিমেয় হয়ে এল। হরিবরা তখন বাহনদের ছেড়ে প্রতিপক্ষের নৌকার উপর লাফিয়ে পড়তে লাগল। বাঁকা তলোয়ার ও গাদা বন্দুকের মৃত্যুলীলা সমানেই চলতে লাগল; কিন্তু বিপুল সংখ্যাধিক্যে বলীয়ান সর্প-নরের দল অবশিষ্ট কোরসারদের প্রায় ঢেকে ফেলল।

যুদ্ধ শেষ হল। তখন বেঁচে আছে মাত্র তিনজন কোরসার। লাজো তাদের মধ্যে একজন। হরিরা তাদের হাত বেঁধে তীরে নামালো। গুরুতর আহতদের ছুরির আঘাতে আঘাতে শেষ করল। জ্যাসন ও টোয়ারকে অক্ষত অবস্থায় দেখে তাদেরও হাত বেঁধে তীরে নামিয়ে কোরসারদের পাশেই রেখে দিল।

টোয়ার বলল, তুমি জান ওরা কারা? আগে কখনো ওদের দেখেছ?

লাজো বলল, হ্যাঁ, জানি, তবে এই প্রথম ওদের দেখা পেলাম। ওরা হরিবের দল–সর্প-নর বেলা আম ও গিয়র কোর্সের মধ্যবর্তী অঞ্চলে বাস করে।

ক্লান্ত দেহে, অবসন্ন মনে জ্যাসনও একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

উঠে দাঁড়াও। একজন হরিবের কর্কশ ডাকে জ্যাসনের ঘুম ভেঙে গেল। তোমার হাতের বেড়ি খুলে দিচ্ছি। পালাতে পারবে না। সে চেষ্টা করলেই মরবে। আমার সঙ্গে এস।

ওদিকে অন্য সব হরিবরা উঠে দাঁড়িয়ে শিসের মত একটা বিচিত্র শব্দ করে ডাকতে লাগল, আর সে ডাক শুনে জল থেকে উঠে ও জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে তাদের বাহনরা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ল।

সকলেই যার যার বাহনে চড়ে বসল। পাঁচ বন্দীকে বসিয়ে নিল পাঁচ আরোহীর সামনে। তারপর সেই বিচিত্র মিছিল এগিয়ে চলল সূর্যহীন অন্ধকার ঘন অরণ্যের পথে।

বন পার হয়ে তারা সূর্যের আলোয় পৌঁছে গেল। দূরে জ্যাসনের চোখে পড়ল একটা হ্রদের ঝিলমিল জল।

হ্রদের তীরে পৌঁছে একটি হরিব হঠাৎ টোয়ারের মুখ চেপে ধরে বুড়ো আঙ্গুল ও তর্জনীর চাপে নাকটা আটকে দিয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে হ্রদের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। একটু পরেই দু’জন ডুবে গেল।

একটু পরে আর এক হরিব এসে লাজোকে নিয়ে সেই একইভাবে হ্রদের জলে ডুব দিল। বাকি দুজন কোরসারেরও সেই একই দশা হতে দেরী হল না।

এবার তার পালা। হরিবের হাত থেকে ছাড়া পেতে জ্যাসন প্রাণপণ চেষ্টা করল। কিন্তু সেই চটচটে হাতের মুঠি আলগা হল না। তাকে নিয়ে সেও অতি দ্রুত জলের নিচে নেমে গেল। একটু পরেই আঠালো কাদার উপর দিয়ে তাকে টেনে নিয়ে চলল। একটু বাতাসের জন্য তার ফুসফুসটা যন্ত্রণায় চীৎকার করে। উঠল, সব ইন্দ্রিয় অবশ হয়ে এল, মুহূর্তের জন্য সব কিছু অন্ধকারে ঢেকে গেল। কিন্তু তার চাইতেও গাঢ়তর নরকের অন্ধকার গর্তের ভিতরে তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হল। তার পরেই তার মুখ ও নাকের উপর থেকে হাতটা সরিয়ে নেয়া হল। ধীরে ধীরে চেতনা ফিরে এলে সে বুঝল যে সে ডুবে যায় নি; কাদার উপর শুয়ে প্রশ্বাসের সঙ্গে টেনে নিচ্ছে বাতাস, জল নয়।

তার চারদিক ঘিরে নেমে এল পরিপূর্ণ অন্ধকার। একটা চটচটে শরীর তার শরীরের উপর দিয়ে সস করে চলে গেল; তারপর আর একটা–আরও একটা। জলের একটা ছলাৎছলাৎ, গড়গড় শব্দ, তারপর নীরবতা-কবরের নীরবতা।

বিস্তীর্ণ সমতল ভূমিতে পৌঁছবার পরে টারজান ও জানাও পড়ল হরিবদের কবলে। কিন্তু একদল সশস্ত্র প্রাণীর দ্বারা পরিবৃত হয়েও বিনা বাধায় অস্ত্র সমর্পণের ইচ্ছা অরণ্য-রাজের নেই। সে বলল, আমাদের নিয়ে তোমরা কি করতে চাও?

একটা হরিব বলল, তোমাদের নিয়ে যাব আমাদের গাঁয়ে; পেট ভরে খাওয়াব। হরিবদের কাছ থেকে কেউ পালাতে পারে না, সে চেষ্টা করো না।

টারজান তবু ইতস্তত করতে লাগল। জোরামের লাল ফুলটি তার আরও কাছে গিয়ে চুপি চুপি বলল, ওদের সঙ্গেই চল। তাহলে হয় তো পরে পালাবার কোন সুযোগ মিলতেও পারে।

মাথা নেড়ে টারজান হরিবের দিকে ফিরে বলল, আমরা প্রস্তুত।

অন্ধকার বনের পথ ধরে তারা এগিয়ে চলল।

জঙ্গলে ঢোকার পর থেকেই টারজান বুঝতে পেরেছে যে ইচ্ছা করলেই এখন সে পালাতে পারে। এক লাফে যে কোন একটা নিচু ডাল ধরতে পারলেই চোখের নিমেষে এক ডাল থেকে আর এক ডালে উঠে সে এমন ভাবে হাওয়া হয়ে যাবে যে কোন হরিবের সাধ্য নেই তাকে ধরতে পারে। কিন্তু সে তো জানাকে ফেলে যেতে পারে না। তাকে সব কথা বলার মত সুযোগও পাচ্ছে না। কাজেই সে সুযোগের জন্যই অপেক্ষা করতে লাগল।

এক সময় পাগলা হাওয়ায় এমন একটা গন্ধ তার নাকে এসে লাগল যা সে জীবনে আর কখনও পাবে বলে আশাও করতে পারেনি। এই পরিচিত গন্ধ যাদের গা থেকে আসছে তারা আছে সামনের দিকে। অতএব পালাবার সুযোগ এসেছে। কিন্তু দু’জন একই সঙ্গে পালানো সম্ভব নয়। মেয়েটিকে নিরাপদ করতে হলে আগে তাকে পালাতে হবে। তারপর

এক সময় মাথার উপরে একটা শক্ত ডাল দেখতে পেয়ে এক লাফে সেটাকে ধরে ফেলে টারজান বিদ্যুৎ গতিতে গাছের মগডালে ঘন পাতার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। এত দ্রুত ব্যাপারটা ঘটে গেল যে হরিবরা কেউ কিছু বুঝবার আগেই সে হাওয়া হয়ে গেল।

কিছুটা পিছন থেকে জানাও তাকে পালাতে দেখল। জোরামের লাল ফুলের মন থেকে আশার শেষ ক্ষীণ শিখাটাও নিভে গেল। টারজানকে সে দোষ দিল না, তবু সে মনে মনে জানল যে জ্যাসন তাকে এভাবে ছেড়ে যেতে পারত না।

বাতাসে ভেসে আসা গন্ধকে অনুসরণ করে টারজান অতি দ্রুত গাছপালার ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলল। বিশাল পেলুসিডারের অন্ধকার বনের মধ্যে এই গন্ধ তার নাকে আসবে সেটা যতই অবিশ্বাস্য হোক তবু এই গন্ধ যাদের কাছ থেকে আসছে তাদের অস্তিত্বকে সে কখনও সন্দেহ করেনি।

এক সময় সে নিচের স্তরে নামতে লাগল। গন্ধটাও ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে। নামতে নামতে যখন বনের এক কোণে মাটিতে তার পা পড়ল তখন দশটি দীর্ঘদেহী যোদ্ধার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে সে যেন। নেমে এল স্বর্গের দেবদূতের মত।

বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে মুহূর্তকাল তার দিকে তাকিয়ে থেকে তারা ছুটে গেল তার দিকে, তার সামনে নতজানু হয়ে তার হাত দুটিতে চুমো খেতে লাগল। তারা চীৎকার করে বলতে লাগল, ওঃ, বাওয়ানা, বাওয়ানা, সত্যি কি তুমি এলে! মুলুঙ্গু তার সন্তানদের প্রতি কৃপা করেছে; তাদের বড় বাওয়ানাকে জীবিত অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছে।

টারজান বলল, কিন্তু বাছারা, তোমাদের উপর আমি একটা কাজের ভার দিচ্ছি। সর্প-নররা পিছনেই আসছে; তাদের সঙ্গে আছে একটি বন্দিনী মেয়ে। তোমাদের সঙ্গে রাইফেল রয়েছে। আশা করি প্রচুর গুলিও আছে।

যতদূর সম্ভব বর্শা ও তীর ব্যবহার করে আমরা প্রচুর গুলি হাতে রেখেছি বাওয়ানা।

খুব ভাল করেছ। এবার সে সব দরকারে লাগবে। উড়োজাহাজটা থেকে আমরা কতটা দূরে আছি?

 তা তো জানি না, মুভিরো বলল।

জান না? টারজান বলল।

না বাওয়ানা, আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি।

 জাহাজ থেকে দূরে এসে তোমরা কি করছিলে? টারজান প্রশ্ন করল।

গ্রিডলে ও ভন হস্টের সঙ্গে আমরা তোমাকেই খুঁজতে বেরিয়েছিলাম বাওয়ানা।

তারা কোথায়? টারজান শুধাল।

অনেক দিন আগে আমরা গ্রিডলের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি; তারপর থেকে আর তাকে দেখিনি।

তারা আসছে। টারজান সকলকে সতর্ক করে দিল।

আমিও শুনতে পেয়েছি বাওয়ানা, মুভিরো বলল।

এবার দেখবে কিছু ভয়ঙ্কর মানুষ, টারজান বলল; তবে তাদের চেহারা দেখে ভয় পেয়ো না। তোমাদের বুলেটই তাদের সাবাড় করবে।

মুভিরো সদর্পে বলল, কোন ওয়াজিরিকে কখনও ভয় পেতে দেখেছ বাওয়ানা?

টারজান হাসল। বলল, একজনের রাইফেল আমাকে দাও, তারপর জঙ্গলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়। ঠিক কোন্ পথে তারা যাবে তা জানি না। যে কেউ তাকে দেখবে অমনি গুলি চালাবে মেরে ফেলতে। কিন্তু মনে রেখো, তাদের একজনের সামনে মেয়েটি আছে। খুব সাবধান, মেয়েটির যেন কোন ক্ষতি না হয়।

কথা শেষ হবার আগেই প্রথম হরিবটি দর্শন দিল। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল রাইফেল। অগ্রগামী হরিবটি ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল। গোরোবর ছুটিয়ে ধেয়ে এল বাকি হরিবরা। পরপর গর্জে উঠল টারজান ও অন্যদের হাতের আগ্নেয়াস্ত্র। পরাজয় কাকে বলে তা তারা জানত না; এবার জানল। প্রতিপক্ষের হাতের আগুন-খেকো অস্ত্রের বিরুদ্ধে এটে ওঠা যাবে না বুঝতে পেরে বাকি হরিবরা ইতস্তত ছুটতে লাগল।

এতক্ষণের মধ্যেও টারজান জানার দেখা পায়নি। ভাল করে দেখল, একটা দূরন্ত গতি গোরোবরের। পিঠে চড়ে বিদঙ্গতিতে সে ছুটে চলে যাচ্ছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা সওয়ারবিহীন গোয়োবর পিছন থেকে ধাক্কা মেরে তাকে মাটিতে ফেলে দিল। পুনরায় উঠে দাঁড়াবার আগেই জানা ও তার। অপহরণকারী দূরের গাছপালার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

অন্ধকার বনের পথে ছুটে চলেছে টারজান। দূর থেকে ছুটন্ত হরিবকে দেখতে পেয়েই টারজান একটা গাছে উঠে তাদের অনুসরণ করে চলল। ক্রম সে এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেল যেখানে তার ঠিক নিচের হরিবটা জানাকে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে।

কালবিলম্ব না করে একটা জীবন্ত বর্শার মত টারজান সোজা লাফিয়ে পড়ল হরিবের পিঠের উপর। সেই ধাক্কাতেই সেটা মাটিতে পড়ে গেল। পেশীবহুল হাতে তার গলাটা পেঁচিয়ে ধরে টারজান সেটাকে টেনে তুলে নিজেও সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর সেটাকে দুই হাতে মাথার উপর তুলে বার কয়েক ঘুরিয়ে সজোরে মাটিতে ছুঁড়ে দিল।

শেষ পর্যন্ত যখন বুঝতে পারল যে হরিবটা চিরদিনের মত স্তব্ধ হয়ে গেছে, তখন টারজান নিচু হয়ে তার পাথরের ছুরিটা নিয়ে নিল। মাটি থেকে তুলে নিল তার বল্লমটা। জানার দিকে ফিরে বলল, এস, এখানে আমাদের জন্য একটি মাত্র নিরাপদ স্থানই আছে। বলেই জানাকে কাঁধে তুলে নিয়ে সে এক লাফে গাছে চড়ে বসল।

মুভিরো ও তার দলকে যেখানে শেষ দেখেছিল সেই দিকেই তারা দ্রুত ফিরে চলল। এমন সময় শুনতে পেল অনেক পায়ের শব্দ তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।

মেয়েটিকে একটা মোটা ডালের আড়ালে লুকিয়ে রেখে টারজান নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগল।

মুহূর্তমাত্র অপেক্ষা করার পরেই নিচে দেখা দিল একটি প্রায় উলফঙ্গ মানুষ। কোমরে জড়ানো এক ফালি নোংরা ছাগলের চামড়া; তাও কাদায় মাখামাখি; সারা দেহেও কাদার প্রলেপ। এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে সে একাকি কি করছে বুঝতে না পেরে টারজান এক লাফে তার ঠিক সামনে মাটিতে নেমে এল।

তাকে দেখে লোকটিও থেমে গেল। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। চেঁচিয়ে বলল, টারজান! সত্যি কি তুমি! তুমি তাহলে মারা যাও নি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, সত্যি তুমি মারা যাও নি।

অরণ্য-রাজের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। সবিস্ময়ে বলল, গ্রিডলে! জ্যাসন গ্রিডলে! জানা যে বলল তুমি মারা গেছ!

জ্যাসন বলে উঠল, জানা! তুমি তাকে চেন? তাকে দেখেছ? কোথায় সে?

 সে আমার সঙ্গেই আছে, টারজান জবাব দিল। তারপর বলল, চল, ওয়াজিরিদের খুঁজে বের করতে হবে।

অদুরেই অনেক মানুষের কলকণ্ঠ ভেসে এল। রাইফেলধারী দশটি ওয়াজিরি যোদ্ধা টোয়ার ও তিন কোরসারকে ঘিরে ধরে নিয়ে আসছে।

এতক্ষণ উভয়পক্ষই পরস্পরকে শত্রু বলে ধরে নিয়েছিল। এবার টারজান, জ্যাসন ও জানার মধ্যস্থতায় তাদের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হল, বন্ধুত্ব গড়ে উঠল।

টারজানকে জীবিত দেখে টোয়ারের বিস্ময়ের সীমা রইল না। জানাকে সুস্থ দেহে নিরাপদে দেখতে পেয়ে আনন্দে ও স্বস্তিতে তার বুকটা ভরে গেল। জানা ছুটে এসে দাদাকে জড়িয়ে ধরল।

দীর্ঘ পরিশ্রম ও ক্লান্তির পরে সকলেই পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিল। পরস্পরকে শোনাল তাদের অভিযানের কাহিনী। টোয়ারের ইচ্ছা জানাকে নিয়ে জোরামে ফিরে যাবে। টারজান, জ্যাসন ও ওয়াজিরিদের একমাত্র বাসনা অভিযানের অন্য সঙ্গীদের খুঁজে বের করবে। লাজো ও তার সঙ্গীরা চাইল তাদের জাহাজে ফিরে যেতে।

অনেক আলোচনার পর স্থির হল, আপাতত সকলে মিলে কোরসারেই যাওয়া হবে। তদনুসারে অনেক খাবার-দাবার সঙ্গে নিয়ে একদিন সকলে লংবোট-টাতে চেপে বসল।

অনুকূল বাতাসে লুংবোটের আরোহীরা ভেসে চলেছে সূর্যালোকিত সমুদ্রের বুকে। আর সেই একই পথে আকাশে উড়ে চলেছে ও-২২০ অভিযানের হারানো সঙ্গীদের ব্যর্থ অনুসন্ধানে।

দেখতে দেখতে বাতাস ধেয়ে এল ঝড়ের বেগে, ঢেউ উত্তাল হয়ে উঠল। কাজেই তীরে যাবার চেষ্টা ছেড়ে তারা বাতাসের আগে আগেই চলতে বাধ্য হল। বৃষ্টি নেই, বিদ্যুৎ নেই, আকাশে মেঘ নেই- শুধু প্রচণ্ড ঝড়ের বেগে ধেয়ে আসছে বাতাস; উচ্ছ্বসিত সমুদ্র বুঝি তাদের গিলে খাবে।

কিন্তু ভাগ্যের যাদুবলে নৌকাটা রক্ষা পেল। বাতাস পড়ে গেল। সমুদ্র আবার শান্ত হল। এবার চারদিকে শুধু জল আর জল, তীরভূমির চিহ্নমাত্র চোখে পড়ছে না।

টারজান বলল, উপকূল-রেখা তো হারিয়ে গেল লাজো, এবার আমরা কোরসারের পথ খুঁজে পাব কেমন করে?

লাজা বলল, সেটা খুব সহজ হবে না।

হঠাৎ আঙুল তুলে জানা বলে উঠল, ওটা কি? সকলেরই দৃষ্টি সেই দিকে ঘুরে গেল।

লাজো বলল, একটা পাল। আমরা বেঁচে গেলাম।

 কিন্তু ধর জাহাজটা যদি শত্রুর হয়? জ্যাসন বলল।

লাজো বলল, না, তা নয়। কারণ কোরসার ভিন্ন অপর কারও জাহাজ এ সমুদ্রে চলাফেরা করে না।

জানা বলে উঠল, ওই আরেকটা পাল। অনেকগুলো পাল।

সকলে দূরের পালগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। ধীরে ধীরে সেগুলো এগিয়ে আসছে। শেষ পর্যন্ত বোঝা গেল যে একটা বেশ বড় নৌ-বহর তাদের অনুসরণ করছে।

লাজো বলল, ওরা তো কোরসার নয়। ওরকম জাহাজও আমি আগে কখনও দেখি নি।

শত্রু-জাহাজের পাটাতনের উপর একটি লোক উঠে এল। চীৎকার করে বলল, জাহাজ থামাও, নইলে তোমাদের উড়িয়ে দেব।

তুমি কে? জ্যাসন প্রশ্ন করল।

আমি আনোরক-এর জা, আর একটা পেলুসিডার-ম্রাট প্রথম ডেভিডার নৌ-বহর। তোমরা কারা?

আমরা বন্ধু, টারজান জবাব দিল।

কোরসারের সমুদ্রে পেলুসিডার-সম্রাটের কোন বন্ধু থাকতে পারে না।

এবনার পেরি যদি তোমার সঙ্গে থাকে তাহলে আমরা প্রমাণ করে দেব যে তুমি ভুল করছ, জ্যাসন বলল।

জা বলল, এবনার পেরি আমাদের সঙ্গে নেই; কিন্তু তার সম্পর্কে তুমি কি জান?

মার্কিনী সঙ্গীটিকে দেখিয়ে টারজান বলল, এর নাম জ্যাসন গ্রিডলে। হয় তো এবৃনার পেরির কাছে এর নাম শুনে থাকবে। একটা অভিযাত্রী দল নিয়ে বহির্জগৎ থেকে সে এখানে এসেছে কোরসারদের কারাগার থেকে ডেভিড ইনেসকে উদ্ধার করতে।

লংবোটে তিনজন কোরসারকে দেখে জার মনে কিছুটা সন্দেহ জাগলেও সব কথা বুঝিয়ে বলার পরে, বিশেষ করে ওয়াজিরিদের রাইফেলগুলো পরীক্ষা করে দেখার পরে সে এদের সব কথাই সত্য বলে মেনে নিল, সাদরে অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেল তাদের জাহাজে। সেখানে তখন নৌ-বহরের অনেকেই। হাজির হয়েছে। মুখে-মুখে খবর ছড়িয়ে পড়েছে যে অপরিচিত এই সব মানুষদের মধ্যে দু’জন তাদের বন্ধু; তারা এসেছে বহির্জগৎ থেকে ইনেসকে উদ্ধার করতে। তাই টারজান ও জ্যাসনকে স্বাগত জানাতে এসেছে অন্য সব জাহাজের ক্যাপ্টেনরা। তাদের মধ্যে আছে পেলুসিডার-সম্রাজ্ঞী সুন্দরী ডিয়ানের ভাই শক্তিমান ডেকর; তুরীয়দের সর্দার গুর্কের কোল্ক; আর সারির রাজা লোমশ ঘক-এর ছেলে টানার। তাদের কাছেই টারজান ও জ্যাসন জানল যে এই নৌ-বহরও চলেছে ডেভিডকে উদ্ধার করতে।

টানার প্রশ্ন করল, তোমরা কি করে আশা করতে পারলে যে মাত্র এক ডজন লোক নিয়ে ডেভিডকে উদ্ধার করতে পারবে?

টারজান বলল, আমাদের সব লোক এখানে নেই। আমরা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি, আর তাদের খুঁজে পাচ্ছি না। অবশ্য আমাদের দলে তোক খুব বেশি নয়। সম্রাটকে উদ্ধারের ব্যাপারে লোকবল অপেক্ষা অন্য বলের উপরেই আমরা নির্ভর করেছি।

ঠিক সেই মুহূর্তে জাহাজ থেকে হৈ-চৈর শব্দ ভেসে এল। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। সকলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখাচ্ছে। ইতোমধ্যেই কেউ কেউ কামানের নলকে সেই দিকে তুলে ধরেছে; সকলেই রাইফেলে গুলি ভরতে ব্যস্ত। টারজান ও জ্যাসন উপরে তাকাতেই দেখল তাদের মাথার উপরে ও-২২০।

বোঝা গেল, নৌ-বহরকে দেখতে পেয়ে উড়োজাহাজটা ঘুরে ঘুরে সেই দিকেই নেমে আসছে।

জ্যাসন বলে উঠল, ওটা আমাদের জাহাজ। ওরা আমাদের বন্ধু।

ক্রমে জাহাজ থেকে জাহাজে খবর ছড়িয়ে পড়ল। যে তাদের মাথার উপরে উড্ডীয়মান বস্তুটি কোন উড়ন্ত সরীসৃপ নয়, একটা উড়োজাহাজ, আর তাতে আছে এবৃনার পেরি ও তাদের প্রিয় সম্রাট প্রথম ডেভিডের বন্ধুর দল।

জ্যাসন গ্রিডলে জনৈক যোদ্ধার হাত থেকে বর্শাটা নিয়ে তার মাথায় লাজোর মাথার রুমালটা বেঁধে একটা পতাকা তৈরি করে সংকেত করলঃ ও-২২০ শোন! এটা পেলুসিডার-সম্রাট প্রথম ডেভিডের নৌ বহর; সেনাপতি আনোরক-এর জা; লর্ড গ্রেস্টোক, দশজন ওয়াজিরি ও জ্যাসন গ্রিডলে জাহাজেই আছে।

সঙ্গে সঙ্গে ও-২২০-এর পিছন দিকের বুরুজে গর্জে উঠল কামান-আন্তর্জাতিক অভিবাদন-রীতির প্রথম সূচনা।

উড়োজাহাজটা আরও নিচে নেমে এলে টারজান শুধাল, তোমাদের সঙ্গে সকলেই আছে তো?

 হ্যাঁ, জুনারের জবাব ভেসে এল।

 ভন হার্স্ট তোমাদের সঙ্গে আছে কি? জ্যাসনের প্রশ্ন।

না, জুনারের জবাব।

তাহলে একমাত্র সেই হারিয়ে গেল, জ্যাসন বিষণ্ণ গলায় বলল।

তোমরা কি একটা কিছু নামিয়ে দিয়ে আমাদের তুলে নিতে পার? টারজান প্রশ্ন করল।

জুপনার চেষ্টা করে জাহাজটাকে জা’র জাহাজের পাটাতনের পঞ্চাশ ফুটের মধ্যে নামিয়ে আনল। একটা ঝোলা নামিয়ে দিয়ে এক এক করে দলের সকলকেই ও-২২০-তে তুলে নিল; প্রথমে ওয়াজিরি, তারপর জানা ও টোয়ার, তারপর জ্যাসন ও টারজান; তিন কোরসারকে জা-র বন্দী রূপে রেখে দেয়া। হল।

নৌ-বহরটি ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল। ও-২২০-ও উড়ে চলল তার মাথার উপর দিয়ে। অনেকদিন পরে একত্র হয়ে অনেক কথা আলোচনা করল, অনেক স্মৃতি-কথা শোনাল।

দূরে দেখা দিল কোরসারের উপকূল-রেখা। তখন একটা ঝোলা নামিয়ে দিয়ে জাকে তুলে নেয়া হল ও-২২০-তে। সেখানে ডেভিডকে উদ্ধারের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হল। জা তার জাহাজে ফিরে এসে লাজো ও অপর দুই কোরসারকে ও-২২০-তে তুলে দিল।

জ্যাসন ও টারজান তিন বন্দীকে সঙ্গে নিয়ে প্রকাণ্ড উড়োজাহাজটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল। সব দেখে শুনে তারা তো একেবারে থ। কামান ও বোমা দেখিয়ে জ্যাসন বলল, এর একটা ছুঁড়লেই তোমাদের কিড-এর রাজপ্রাসাদটা হাজার ফুট আকাশের দিকে উড়ে যাবে। আর দেখতেই পাচ্ছ সে-রকম বোমা আমাদের হাতে অনেকগুলো আছে। আমরা ইচ্ছা করলেই গোটা কোরসার ও তার নৌ-বহরকে ধ্বংস করে ফেলতে পারি।

তারপরই ও-২২০ পূর্ণ গতিতে ছুটে চলল কোরসারের দিকে। শহরের মাথার উপর দিয়ে সেটাকে উড়তে দেখে কোরসারের রাজপথে ও গৃহ-প্রাঙ্গণে ভিড় জমে গেল। ভীত, বিস্মিত দৃষ্টিতে সকলেই তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে।

শহরের তিন হাজার ফুট উপরে জাহাজটা থামল। তিন কোরসার বন্দীকে টারজান ডেকে পাঠাল।

বলল, তোমরা জান, কোরসারকে ধ্বংস করার ক্ষমতা আমরা রাখি। পেলুসিডার-সম্রাটকে উদ্ধার করতে যে বিরাট নৌ-বহর আসছে তাও তোমরা দেখেছ। তার সঙ্গে আছে আমাদের এই উড়োজাহাজ। এখান থেকে আমরা শহর লক্ষ্য করে বোমা ছুঁড়ব। তোমাদের গুলি কখনও এতদূরে পৌঁছবে না। এ অবস্থায় তোমার কি মনে হয় না লাজো যে আমরা কোরসার অধিকার করতে পারব?

আমি তা জানি, লাজো জবাব দিল।

খুব ভাল কথা, টারজান বলল। একটা সংবাদ দিয়ে আমি তোমাকে কিডের কাছে পাঠাব। তাকে তুমি সত্য কথাই বলবে তো?।

বলব, লাজো জবাব দিল।

খুবই সহজ সংবাদ। তাকে বলবে, পেলুসিডারের সম্রাটকে মুক্ত করতেই আমরা এসেছি। কি ভাবে আমাদের সে দাবী আদায় করা হবে তাও তাকে বুঝিয়ে বলবে। তারপর বলবে, সে যদি সম্রাটকে জাহাজে করে নিয়ে গিয়ে আমোরক-এর জার হাতে অক্ষত অবস্থায় তুলে দেয়, তাহলে কোন গোলাগুলি না ছুঁড়ে আমরা সারিতে ফিরে যাব। বুঝেছ?

হ্যাঁ।

ঠিক আছে, বলে ডর্ফের দিকে ফিরে টারজান বলল, এবার ওকে নিয়ে যাবে কি?

লাজোর হাতে একটা প্যারাসুট দিয়ে জ্যাসন বলল, এটাকে ধর। এই রিংটাকে চেপে ধর। তারপর জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়েই সেটাকে ভাল করে একটা ঝাঁকি দিও, বাস্–তাহলেই তুমি স্বচ্ছন্দে মাটিতে নেমে যাবে একটা হাল্কা পালকের মত।

লাজো তবু বলল, আমি মরে যাব।

 জ্যাসন বলল, তুমি দেখছি ভয়ানক ভীরু। কিন্তু আমি বলছি, তোমার কোন ক্ষতি হবে না।

 লাজোকে কেবিনের দরজার কাছে নিয়ে ডর্ফ সেটাকে সপাটে খুলে দিল।

রিংটাকে ঝাঁকি দিতে ভুলো না, বলেই ডর্ফ সজোরে লাজোকে ঠেলে ফেলে দিল। পরমুহূর্তেই কেবিনের সকলেই দেখল, সাদা পাখনা মেলে প্যারাসুটটা বাতাসের বুকে ঝিল্‌মিল্ করছে। এবার টারজনের বাণী অবশ্যই কিডের কাছে পৌঁছবে।

একটু পরেই দেখা গেল, দলে দলে লোক চলেছে রাজপ্রাসাদ থেকে নদীর দিকে। একটা জাহাজ নোঙর তুলে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল সারি থেকে আগত নৌ-বহরের দিকে।

ও-২২০ আকাশ পথে তাকে অনুসরণ করে বলল, আর জার জাহাজটা এগিয়ে এল কিডের জাহাজের সঙ্গে মিলিত হতে। আর এই ভাবেই পেলুসিডারের সম্রাট ডেভিড ইনেস ফিরে গেল তার নিজের লোকজনের মধ্যে।

কোরসার জাহাজটা বন্দরে ফিরে গেল। উড়োজাহাজটা নেমে এল সারির নৌ-বহরের খুব কাছাকাছি। ডেভিড ও তার উদ্ধারকারীদের মধ্যে সম্ভাষণ-বিনিময় হল-অথচ তাদের কাউকে সে আগে কখনও দেখে নি।

দীর্ঘকাল বন্দী অবস্থায় কাটাবার ফলে অর্ধভুক্ত সম্রাট খুব শুকিয়ে গেছে; শরীরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবে তার দেহ মোটামুটি অক্ষতই আছে। নিজেদের দেশে ফিরে যাবার পথে সারির জাহাজগুলোতে আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল।

জ্যাসন বলল, আমি তোমাদের সঙ্গে ফিরছি না। আমাকে তোমরা জা-র জাহাজে নামিয়ে দাও।

কি বললে? টারজান চেঁচিয়ে বলে উঠল। তুমি এখানেই থেকে যাবে?

আমার কথামতই এই অভিযানের আয়োজন করা হয়েছিল। তাই অভিযানে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি মানুষের জীবন ও নিরাপত্তার পূর্ণ দায়িত্ব আমার। তাই লেঃ ভন হারে ভাগ্যকে অনিশ্চিতের হাতে ছেড়ে দিয়ে আমি কিছুতেই বহির্জগতে ফিরে যেতে পারি না।

টারজান বলল, কিন্তু তুমি কেমন করে ভন হার্স্টকে খুঁজে পাবে?

জ্যাসন উত্তর দিল, ডেভিড ইনেসকে বলল তার সন্ধানে একটা অভিযানের ব্যবস্থা করে দিতে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস পেলুসিডারের স্থানীয় লোকদের নিয়ে গড়া সেই অভিযাত্রীদল ভন হাস্টকে খুঁজে বের করতে পারবে।

টারজান বলল, তোমার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ এক মত। তুমি যদি এই নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে একান্তই ইচ্ছুক হয়ে থাক তাহলে এখনই তোমাকে জা-র জাহাজে নামিয়ে দেব।

রাইফেল, রিভলবার ও যথেষ্ট গুলি-গোলা নিয়ে জ্যাসন যাত্রার জন্য প্রস্তুত হল। অভিযানের সঙ্গীদের কাছ থেকে একে একে বিদায় নিল।

সকলের সঙ্গে করমর্দন শেষ করে বলল, বিদায় জানা।

মেয়েটি জবাব দিল না। দাদার দিকে ঘুরে দাঁড়াল।

বলর, বিদায় টোয়ার।

 বিদায়? কি বলছ তুমি জানা? টোয়ার শুধাল।

 যাকে ভালবেসেছি তার সঙ্গেই ফিরে যাচ্ছি আমি, জোরামের লাল ফুলটি স্মিত হেসে জবাব দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *