লুপ্ত সাম্রাজ্যে টারজান (টারজন অ্যাণ্ড দি লস্ট এম্পায়ার)

লুপ্ত সাম্রাজ্যে টারজান (টারজন অ্যাণ্ড দি লস্ট এম্পায়ার)

মনিবের খোলা বাদামী কাঁধের উপর নকিমা উত্তেজিতভাবে নাচতে শুরু করে দিল। অনবরত কিচির-মিচির করছে, আর একবার টারজনের মুখের দিকে একবার জঙ্গলের দিকে তাকাচ্ছে।

ওয়াজিরিদের ছোট সর্দার মুভিরো বলল, কে যেন আসছে বাওয়ানা; নকিমা শুনতে পেয়েছে।

টারজানও শুনেছে।

মুভিরো বলল, বড় বাওয়ানার কান তো হরিণের মতই।

 টারজান হেসে বলল, তা যদি না হত তাহলে আজ টারজানকে এখানে দেখতেই পেতে না।

কে আসছে? মুভিরো শুধাল।

 একদল মানুষ, টারজান জবাব দিল।

প্রথম দেখা গেল একটি দীর্ঘদেহ নিগ্রো সৈনিককে। ওয়াজিরিদের দেখেই সে থেমে গেল। একটু পরে একটি দাড়িওয়ালা সাদা মানুষ এসে তার পাশে দাঁড়াল। ভাল করে লক্ষ্য করে সাদা মানুষটি শান্তির চিহ্ন দেখিয়ে এগিয়ে গেল। জঙ্গলের ভিতর থেকে এক ডজন বা তারও বেশি সৈনিক তাকে অনুসরণ করল। তাদের বেশিরভাগই কুলি; সঙ্গে মাত্র তিন-চারটে রাইফেল।

টারজান এবং ওয়াজিরিরা এবার বুঝতে পারল যে দলটা ছোট ও নিরীহ। ভয়ের কোন কারণ নেই।

দাড়িওয়ালা লোকটি এগিয়ে আসতেই টারজান সোল্লাসে বলর, ডক্টর ভন হারবেন! প্রথমে তো তোমাকে চিনতেই পারিনি।

হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে ভান হারুবেন বলল, অরণ্যরাজ টারজান, ঈশ্বর আমার প্রতি সদয়। তোমার সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে পুরো দুদিন আগেই তোমার দেখা পেয়ে গেলাম।

টারজান বলল, তুমি কেন টারজনের দেশে এসেছ ডাক্তার? আশা করি আমার বন্ধুটির কোন বিপদ দেখা দেয়নি।

ভন হারবেন বলল, আমরা এসেছি তোমার সাহায্য পাবার আশায় আমার ছেলে এরিকের ব্যাপারে। তাকে তো তুমি কখনও দেখনি।

টারজান বলল, না। কিন্তু তোমরা খুব ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত। এইখানে তাঁবু ফেল। খেতে খেতেই তোমার সব কথা শোনা যাবে।

ভন হারবেনই শুরু করল। এরিক আমার একমাত্র ছেলে। চার বছর আগে ঊনিশ বছর বয়সে সম্মানের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম শেষ করে প্রথম ডিগ্রিও পেয়েছে। সেই থেকে ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা নিয়েই দিন কাটিয়েছে এবং প্রত্নতত্ত্ব ও অপ্রচলিত প্রাচীন ভাষায় বিশেষ জ্ঞান লাভ করেছে। কয়েক মাস আগে সে আমার কাছে এসেছিল; এসেই আমাদের জেলায় এবং কাছাকাছি অঞ্চলে ব্যবহৃত কয়েকটি উপজাতির বিভিন্ন বান্টু কথ্য ভাষার প্রতি সে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সেই বিষয়ে উপজাতিদের মধ্যে গবেষণা চালাতে গিয়ে ওয়াইরামওয়াজি পর্বতমালার লুপ্ত উপজাতির প্রাচীন উপকথার বিষয়ে সে জানতে পারে, আর সেই থেকেই তার মনে বিশ্বাস জন্মেছে যে এই উপকথার কোন বাস্তব ভিত্তি আছে, আর তা নিয়ে গবেষণা চালাতে পারলে হয়তো বাইবেলীয় যুগের লুপ্ত উপজাতিদের কোন বংশধরদের দেখাও মিলে যেতে পারে।

টারজান বলল, সে উপকথা আমি ভাল করেই জানি, আর তা নিয়ে অনুসন্ধান চালাবার ইচ্ছাও অনেকবার হয়েছে, কিন্তু সময় ও সুযোগের অভাবে তা আর ঘটে ওঠে নি।

ডাক্তার বলতে লাগল, এরিক যখন ওয়াইরামওয়াজিতে একটা অভিযানের প্রস্তাব করল তখন আমি বরং তাকে উৎসাহই দিয়েছি, কারণ এ ধরনের একটা অভিযান পরিচালনার পক্ষে সেই তো সবচাইতে উপযুক্ত লোক। সে বান্টুদের কথ্য ভাষা জানে, উপজাতিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছে। আর পর্বতারোহণের যথেষ্ট অভিজ্ঞতাও তার আছে।

কিন্তু যাত্রার পরে কিছুদিন যেতে না যেতেই আমি খবর পেয়েছি যে তার দলের কিছু লোক নিজ নিজ গ্রামে ফিরে এসেছে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু তারা আমাকে এড়িয়ে গেছে। কিন্তু যে সব কথা আমার কানে এসেছে তাতে পরিষ্কার বুঝতে পারছি যে আমার ছেলের সময় ভাল যাচ্ছে না; কিছু গোলমাল দেখা দিয়েছে। সুতরাং স্থির করলাম, একটা সাহায্যকারী দল নিয়ে তার কাছে যাব। কিন্তু সারা জেলা ঘুরে ওয়াইরামওয়াজির পর্বতে যাবার মত মাত্র এই ক’টি লোককে যোগাড় করতে পেরেছি, কারণ তাদের ধারণা যে ওয়াইরামওয়াজি লুপ্ত উপজাতিরা একদল রক্তচোষা প্রেত। তখনই বুঝলাম যে এরিকের দল ছেড়ে যারা চলে এসেছে তারাই জেলার সর্বত্র এই আতংক ছড়িয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে স্বভাবতই অরণ্যরাজ টারজনের কথাই আমার প্রথম মনে হয়েছে। …….এখন বুঝতে পারছ কেন আমি এখানে এসেছি।

তার কথা শেষ হতেই টারজান বলল, আমি তোমাকে সাহায্য করব ডাক্তার।

ভন হারবেন বলল, খুব ভাল কথা। আমি জানতাম তোমার সাহায্য পাব। যতদূর মনে হচ্ছে এখানে। তোমার লোকের সংখ্যা প্রায় কুড়ি, আর আমার সঙ্গে আছে চৌদ্দ। আমার লোকরা তল্পিবাহকের কাজ করতে পারবে, আর তোমার লোকরা তো আফ্রিকার সেরা যোদ্ধা বলে পরিচিত। তোমার নির্দেশে আমরা অচিরেই পথের হদিস পেয়ে যাব, আর ছোট হলেও যে দলটি আমাদের সঙ্গে যাবে তাদের নিয়ে এমন কোন দেশ নেই যেখানে আমরা যেতে পারব না।

টারজান মাথা নেড়ে বলল, না ডাক্তার, আমি একাই যাব। সেটাই আমার চিরকালের রীতি। একা হলে আমি অনেক দ্রুত যেতে পারব। তুমি তো জান জংলী লোকেরা আমাকে তাদের আপনজন বলে মনে করে। অন্য লোক দেখলেই তারা দূরে সরে যাবে, কিন্তু আমার কাছ থেকে দূরে যাবে না।

ভন হারবেন বলল, তুমি ভাল করেই বোঝ যে আমি তোমার সঙ্গেই যেতে চাই। তবে তুমি না বললে আমাকে তা মানতেই হবে।

তুমি তোমার মিশনে ফিরে যাও ডাক্তার, সেখানেই আমার চিঠির জন্য অপেক্ষা করে থেকো।

মুভিরোর দিকে ঘুরে বলল, মুভিরো, আমার সৈন্যদের নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও। প্রয়োজন হলে আমি ডাকলেই যাতে তাদের পাই সেইভাবে ওয়াজিরির প্রতিটি সৈনিককে সর্বদা প্রস্তুত রেখো।

টারজান তার ধনুক ও তীর-ভর্তি তূনীর পিঠে ঝুলিয়ে নিল; বাঁ কাঁধ ও ডান বগলের নিচে জড়িয়ে নিল ঘাসের দড়িটা; কোমরে ঝোলাল স্বর্গত পিতার শিকারী ছুরি। ছোট বর্শাটা হাতে নিয়ে মাথা সোজা করে দাঁড়াল।

এক মুহূর্ত সেইভাবে দাঁড়িয়ে ছোট নকিমাকে সঙ্গে নিয়ে একটি বিদায়-বাণীও উচ্চারণ না করে ধীর গম্ভীর পদক্ষেপে টারজান জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল।

ওয়াইরামওয়াজি পর্বতের গায়ে তাঁবুর ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে এরিক ভন হারবেন শিবিরের দিকে তাকাল।

প্রথম ঘুম ভাঙতেই চারদিকে অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা তার মনে একটা গোলমালের পূর্বাভাষ জাগিয়ে তুলেছিল। খাস খানসামা গাবুলাকে বার বার ডেকেও কোন সাড়া না পেয়ে সেটা আরও বেড়ে গেল।

তাড়াতাড়ি খোঁজ-খবর করতেই দেখা গেল লোকজনরা ভন হারবেনের সবকিছু নিয়ে সরে পড়েছে। সমস্ত খাবার-দাবার, রাইফেল ও গুলি তারা সঙ্গে নিয়ে গেছে। রেখে গেছে শুধু একটা লাজার পিস্তল ও এমুনিশন বেল্ট; এ দুটি বস্তু তাঁবুতে তার নিজের কাছেই ছিল।

ভন হারবেন পাহাড়ের উত্রাইয়ে বনের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।

একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে তার বেশি সময় লাগল না। তাঁবুতে ফিরে গিয়ে প্রয়োজনীয় কিছু টুকিটাকি জিনিস হ্যাঁভারস্যাকে ভরে নিল, এমুনিশন বেল্টটা বুকের উপর জড়িয়ে নিল, তারপর উপরের দিকে তাকিয়ে ওয়াইরামওয়াজি রহস্যের পথে যাত্রা করল।

সারাটা দিন সে পাহাড় বেয়ে উঠল। বিশ্রাম শুধু রাতে। সকালে উঠে আবার যাত্রা শুরু করল।

শেষ বাধা পেরিয়ে পর্বতশিখরে দাঁড়িয়ে ভন হারবেন উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল। সম্মুখে প্রসারিত একটা উঁচু-নিচু উপত্যকা। দূরে দেখা যাচ্ছে আর একটা পর্বতশ্রেণী-অস্পষ্ট ও ধূসর। দূরের পাহাড় ও তার মধ্যে কি আছে? আবিষ্কারের সম্ভাবনায় তার নাড়ীর গতি দ্রুততর হল।

অনেক নিচে ফিতের মত তিনটে স্রোতধারা হ্রদে এসে পড়েছে; আরও দূরে চোখে পড়ছে একটা ফিতে-সেটা সম্ভবত রাস্তা। খাদের পশ্চিম দিকটা ঘন জঙ্গলে ঢাকা। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখল, সেই বন ও হ্রদের মাঝখানে কি যেন নড়াচড়া করছে; হয়তো কোন তৃণভোজী পশুই হবে।

এ দৃশ্য দেখে ভন হারবেনের আবিষ্কারক মনটা উত্তেজনার একেবারে চরমে উঠে গেল। নিশ্চয় এখানেই আছে ওয়াইরামওয়াজি লুপ্ত উপজাতির গোপন রহস্য; যতদূর চোখে পড়ছে এই সব খাড়া পাথরের প্রাচীর বেয়ে নিচে নামা একেবারেই অসম্ভব।

সূর্য ডুবে গেল। এক সময় এ্যানিটের প্রাচীরে একটা সংকীর্ণ ফাটল তার চোখে পড়ল। পাহাড়ের মাথা থেকে নিচে নামবার মত একটা পথ তবু পাওয়া গেল; কিন্তু সে পথটা কতদূর নেমে গেছে ঘনায়মান অন্ধকারে তা বোঝা গেল না।

ক্ষুধায় ও ঠাণ্ডায় কাতর হয়ে রাতের অন্ধকারে সে সেখানেই বসে পড়ল; নিচের অন্ধকার শূন্যে তার চোখ। অন্ধকার আরও গাঢ় হতেই সে দেখল, অনেক নিচে একটা আলোর ফুলকি ঝিলিক দিয়ে উঠল; আরও একটা, আবারও একটা। প্রতিটি ঝিলিকের সঙ্গে বাড়ছে তার উত্তেজনা, কারণ আলো থাকা মানেই মানুষের উপস্থিতি। জলাভূমির মত হ্রদের অনেক জায়গাতেই আলোর ফুলকি জ্বলছে; আর যেখানে দ্বীপটা অবস্থিত সেখানে অনেক মানুষের চলাফেরা।

ওটা কি? নিচের আঁধার-ঢাকা গহ্বর থেকে যে শব্দটা উঠে আসছে সেটা শুনবার জন্য ভন হারবেন কান পাতল। অস্পষ্ট ক্ষীণ একটা শব্দ কানে এল; কিন্তু তার ভুল হয়নি-সে শব্দ মানুষের কণ্ঠস্বর।

অনেক দূরে উপত্যকার বুক থেকে ভেসে এল কোন জন্তুর আর্তনাদ; তারপরেই দূরে’বজ্রপাতের মত একটা গর্জন শোনা গেল। সেই শব্দ শুনতে শুনতে ভন হারবেন ক্লান্ত হয়ে সেখানেই শুয়ে পড়ল।

সকাল হলে কিছু গাছপালা জোগাড় করে আগুন জ্বেলে শরীর গরম করল। দিনের আলোয় পাহাড়ের গায়ের ফাটলটা ভাল করে পরীক্ষা করে দেখল। সেটা কয়েকশ’ ফুট পর্যন্ত নেমে অদৃশ্য হয়ে গেছে। তবু তার ধারণা হল, সেটা ওখানেই শেষ হয়ে যায় নি, আরও নিচে নেমে গেছে।

তবু নিরূপায় হয়েই তাকে নিচে নামতে হবে। আশা মরীচিকা! যদি একটা পথ মিলে যায়! ফাটলের উপর থেকে পা বাড়িয়ে নিচে নামতে যাবে এমন সময় পিছনে পায়ের শব্দ শুনে বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে গিয়ে সে হাতের লাজারটা বাগিয়ে ধরল।

মুখ ফেরাতেই এরিক ভন হারবেন দেখল রাইফেলধারী জনৈক নিগ্রো তার দিকেই এগিয়ে আসছে।

হাতের পিস্তল নামিয়ে সে চীৎকার করে ডাকল, গাবুলা! তুমি এখানে কি করছ?

সৈনিক বলল, বাওয়ানা, আমি তোমাকে একলা ফেলে চলে যেতে পারিনি; এই পাহাড়ের অধিবাসী প্রেতাত্মাদের হাতে তো তোমাকে মরতে দিতে পারি না।

ভন হারবেন সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল, তাই যদি হয় গাবুলা, তাহলে তারা তো তোমাকেও মেরে ফেলতে পারে।

গাবুলা বলল, জানি বাওয়ানা, আমিও মরব। আজ রাতে আমাদের দু’জনেরই মৃত্যু অনিবার্য।

তবু তুমি আমার পিছু পিছু এসেছ কেন?

তুমি আমাকে কত দয়া করেছ বাওয়ানা; তোমার বাবা আমাকে কত দয়া করেছে। ওদের কথা শুনে ভয় পেয়ে আমি ওদের সঙ্গে পালিয়েছিলাম, কিন্তু আমি ফিরে এসেছি।

ভন হারবেন বলল, কিন্তু গাবুলা, আমি ওই খাদের নিচে নামব। বিদায়। সে হাতটা বাড়িয়ে দিল। গাবুলা কিন্তু মনিবের বাড়ানো হাতটা না ধরেই বলল, আমিও তোমার সঙ্গে যাব।

জীবন্ত ওখানে নামতে পারলেও কোনদিন ফিরতে পারবে না জেনেও?

হ্যাঁ।

ভন হারবেন নতুন উৎসাহে ও শক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে আবার নিচে নামতে পা বাড়াল।

নানা রকম পরীক্ষা-নীরিক্ষার পরে অনেক কষ্ট স্বীকার করে প্রথমে ভন হারবেন ও পরে গাবুলা সেই গহ্বরের নিচে পৌঁছে গেল।

সামনেই একটা ছোট নদী সবুজ উপত্যকার বুক চিরে এঁকে বেঁকে এগিয়ে পড়েছে একটা বড় জলাভূমিতে, যতদূর মনে হয়। জলাভূমিটা মাইল দশেক বিস্তৃত।

জলজ ঘাস ও শেওলার নিচের কর্দমাক্ত মাটির উপর দিয়ে দু’জন সেই জল ভেঙ্গে এগিয়ে চলল। যেতে যেতে এক সময় পায়ের নিচে শক্ত মাটি পেয়ে ভন হারবেন বলে উঠল, আর ভয় নেই গাবুলা; মনে হচ্ছে এই পথ ধরেই আমরা হ্রদটাতে পৌঁছতে পারব।

এমন সময় পিছন থেকে একটা ছোট নৌকা দ্রুতবেগে ছুটে এসে সেখানে থেমে গেল। এক নৌকা ভর্তি সশস্ত্র সৈনিক তাদের দুজনকে ঘিরে ফেলল।

এরিক ভন হারবেন দীর্ঘকায়, উলফঙ্গপ্রায় সৈনিকদের মুখের দিকে তাকাল। প্রথমেই তার মনোযোগ পড়ল তাদের অস্ত্রশস্ত্রের দিকে।

আধুনিককালের অসভ্য মানুষদের হাতে যে রকম দেখা যায় তাদের বর্শাগুলো তার চাইতে অন্য রকম। আফ্রিকার অসভ্য লোকদের মত বর্শা তো আছেই, তাছাড়া আর একরকম ভারী বল্লম আছে যা দেখে যুবক পুরাতত্ত্ববিদটির মনে স্বভাবতই প্রাচীন রোমকদের হাতের তীক্ষ্ণমুখ শলাকার কথাই মনে পড়ল। সেই মিলটি আরও বেশি স্পষ্ট করে তুলল তাদের কাঁধের উপর থেকে ঝোলানো কোষবদ্ধ এক ধরনের ছোট, চওড়া দু-মুখো তরবারি। এগুলো যদি রোমের রাজকীয় বাহিনীর গ্লোডিয়াস হিসৃপেনাস না হয় তো ভন হারবেন এতকাল বৃথাই পড়াশুনা করেছে, গবেষণা করেছে।

বলল, গাবুলা, ওদের জিজ্ঞাসা করতো ওরা কি চায়।

 বান্টু ভাষায় গাবুলা শুধাল, তোমরা কারা, আর এখানে কি চাও?

ভন হারবেনও-বলল, আমরা বন্ধু হতে চাই। আমরা এসেছি তোমাদের দেশ দেখতে। তোমাদের সর্দারের কাছে আমাদের নিয়ে চল।

একটি ঢ্যাঙা নিগ্রো মাথা নেড়ে বলল, আমরা তোমাদের কথা বুঝতে পারছি না। তোমরা আমাদের বন্দী। তাই তোমাদের নিয়ে যাব আমাদের মনিবের কাছে। নৌকায় উঠে এস। বাধা দিলে বা গোলমাল করলে মেরে ফেলব।

ভন হারবেন ও গাবুলা ডোঙ্গায় পা দিল। একটা চওড়া খালের বুকে দুই পাশে দশ-পনেরো ফুট লম্বা প্যাপিরাস গাছের ভিতর দিয়ে ডোঙ্গা ভেসে চলল।

সর্দার জিজ্ঞাসা করল, তুমি কোথা থেকে এসেছ?

ভন হারবেন জবাব দিল, জার্মানিয়া থেকে।

সর্দার বলে উঠল, আরে! তারা তো বন্য ও অসভ্য বর্বর। তারা তো রোমের ভাষাই বলে না; তোমার মত খারাপ করেও বলে না।

কতদিন আগে জার্মান বর্বরদের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ ঘটেছিল?

 আমি তো কখনও সে দেশে যাইনি; তবে আমাদের ইতিহাসকাররা তাদের ভাল করেই চেনে।

তারা কতদিন আগে তাদের কথা লিখেছে?

 রোমক সনের ৮৩৯তম বর্ষে।

সে তো আঠারোশ’ সাইত্রিশ বছর আগেকার কথা। তারপরে সেখানে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে।– সর্দার বলল, তা কেমন করে হবে? এ দেশের তো কোন পরিবর্তন ঘটেনি।

ওয়াইরাম ওয়াজি পর্বতের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত গ্রামের বাগেগো লুকেডি লাউয়ের খোলায় দুধ নিয়ে ঘরে ঢুকল। একটি দৈত্যের মত সাদা মানুষ মেঝেতে বসে আছে। দুই হাত পিছু-মোড়া করে বাঁধা; পায়েও বেড়ি। লুকেডির হাত থেকে দুধটা খেতে খেতেই বাইরে একটা সোরগোল উঠল। নানা রকম হুকুমের শব্দ। ছেলেমেয়েদের চেঁচামেচি। বেজে উঠল–রণ-ডঙ্কা। শুরু হল অন্ত্রের ঝনঝনা। উচ্চ চীৎকার। লুকেডি দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েই সত্রাসে চীৎকার করে পিছিয়ে এসে কুঁকড়ে বসে পড়ল।

টারজান সবিস্ময়ে লুকেডির মুখের দিকে তাকিয়ে পরে নিচু দরজা দিয়ে বাইরে তাকাল।

 গ্রামের পথে উদ্যত বর্শা হাতে পুরুষ, আতংকিত নারী ও শিশুদের ভিড়।

প্রথমে টারজান ভাবল, অন্য কোন অসভ্য জাতি বুঝি গ্রামে আক্রমণ করেছে। কিন্তু একটু পরেই হৈ-চৈ থেমে গেল। বাগেগোরা ইতস্তত পালাতে লাগল। তাদের পিছনে ধাওয়া করছে কিছু সৈনিক। কিছুক্ষণ চুপচাপ। তার পরেই এস্ত পায়ের শব্দ, কিছু হুকুম, আর মাঝেসাঝে ভয়ার্ত আর্তনাদ।

তিনটি মূর্তি সবেগে কুটিরে ঢুকে পড়ল-শত্রু সেনারা কিছু পলাতককে খুঁজছে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে লুকেডি ঘরের এক কোণে লুকিয়ে পড়ল। টারজান বসে রইল। তাকে দেখতে পেয়ে দলপতি সবিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করল। একজন টারজানকে কিছু বলল। টারজান কিছুই বুঝতে পারল না, যদিও ভাষাটা যেন তার কাছে চেনা-চেনা মনে হল।

তাদের একজন লুকেডিকে দেখতে পেয়ে তাকে টানতে টানতে ঘরের মাঝখানে নিয়ে এল। তারপর আঙুল বাড়িয়ে দরজাটা দেখিয়ে টারজানকে আবার কিছু বলল। টারজান তার গলার শিকলটা দেখাল।

একটি সৈনিক কুটির থেকে বেরিয়ে গেল। একটু পরেই দুটো পাথর হাতে নিয়ে ফিরে এসে সে টারজানকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে পাথরটাকে সজোরে তালার উপর ঠুকতে লাগল। তালাটা ভেঙে গেল।

মুক্তি পাওয়ামাত্রই টারজান ও লুকেডিকে কুটিরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হল। গ্রামের মাঝখানে প্রায় পঞ্চাশটি পুরুষ, নারী ও শিশু। বাগেগো বন্দীকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে শ’খানেক হালকা বাদামী রঙের। সৈনিক। টারজান এবার এই সব নবাগতদের দিকে দৃষ্টি ফেরাল।

তাদের আলখাল্লা, বর্ম, শিরস্ত্রাণ পাদুকা-এসব কিছুই টারজান আগে কখনও দেখে নি; অথচ সবই তার কাছে কেমন যেন পরিচিত বলে মনে হচ্ছে। একটা বিচিত্র অনুভূতি জাগল তার মনে; সে যেন এই লোকগুলোকে আগেও দেখেছে, তাদের কথাবার্তা শুনেছে, এমন কি তাদের ভাষাও যেন বুঝতে পারছে। অথচ সে এও জানে যে, আগে কখনও সে তাদের দেখেনি। এমন সময় গ্রামের অপর দিক থেকে আর একটি মানুষ এগিয়ে এল–একটি সাদা মানুষ, সৈনিকদের মতই সাজপোশাক, তবে অনেক বেশি দামী ও ঝলমলে। হঠাৎ টারজান যেন সব রহস্যের চাবিকাঠিটি হাতে পেয়ে গেল যে লোকটি এগিয়ে আসছে। সে যেন উঠে এসেছে রোমের পালাজ্জো ডি কনজারভেটারিতে অবস্থিত জুলিয়াস সিজারের প্রতিমূর্তির বেদী থেকে। আসলে এই যুবকটির নাম মালিয়াস লেপাস।

প্রতিটি সৈনিকের হাতে একটা করে ছোট শিকল ও তার একদিকে একটা করে ধাতুর কলার ও তালা। সেগুলোর সাহায্যে তারা বন্দীদের গলায় গলায় শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলল। কিন্তু টারজানকে দলবন্দী করে এক শিকলে বাঁধা হল না; তার গলায় একটা লোহার কলার পরিয়ে শিকলের অপর প্রান্তটা। তুলে দেয়া হল একজন সৈনিকের হাতে।

পর্বতের সানুদেশ ধরে তারা উত্তর দিকে এগিয়ে চলল।

ঘটনাক্রমে টারজনের জায়গা হয়েছে বন্দী-সারির পিছনে আর লুকেডি রয়েছে সেই সারির একেবারে শেষে। হাঁটতে হাঁটতে টারজান শুধাল, এরা সব কারা লুকেডি?

টারজনের দিকে তাকিয়ে জনৈক বন্দী বলল, ওরা এসেছে ওদেরই একজনের হত্যাকে প্রতিরোধ করতে। ভালই হয়েছে যে এই লোকটিকে মেরে ফেলার আগেই ওরা এসে পড়েছে। নইলে সব্বাইকে মেরে ফেলত।

দু’ঘণ্টা চলবার পরে পথটা হঠাৎ ডানদিকে মোড় নিয়ে একটা সংকীর্ণ পাহাড়ি সুড়ঙ্গে ঢুকে গেল। চলতে চলতেই টারজান বুঝতে পারল যে তারা ক্রমেই পাহাড়ের ভিতরে ঢুকলেও উপরে ওঠার বদলে সুড়ঙ্গটা বরং নিচের দিকেই নেমে যাচ্ছে।

ধুলো ভর্তি পথ ধরে সকলে এগিয়ে চলল দক্ষিণ দিকে। অনেকগুলো গ্রাম পার হয়ে গম্বুজ ও বুরুজওয়ালা একটা অট্টালিকা-নগরী। রাজপথ ধরে চলতে চলতে দেখল রাস্তায় ও বাড়ির ফটকে অনেক বাদামী ও কালো মানুষের ভিড়। অনেকেরই পরনে কুর্তা ও আলখাল্লা, যদিও নিগ্রোরা প্রায় উলফঙ্গ।

 অধিকতর প্রশস্ত আর একটা রাজপথ ধরে কিছুটা এগোতেই একটা বৃত্তাকার বিরাট গ্র্যানিট পাথরের বাড়ি দেখা গেল। বড় বড় থামের উপরে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ ফুট উঁচু পর্যন্ত ধাপে ধাপে উঠে গেছে একটা বিরাট বাড়ি। একতলায় পর পর অনেকগুলো ঘর; কিন্তু পরের সবগুলো তলাই ফাঁকা। তার ভিতর দিয়েই টারজান দেখতে পেল, বৃত্তাকার বাড়িটার উপরে কোন ছাদ নেই; বুঝতে পারল একটা মলুক্ষেত্র রোমের কালো-সিয়ামের মত।

 সকলে ঘোরানো বাড়িটার পিছন দিকে পৌঁছে গেল। বাড়ির ভিতরে অসংখ্য গলি, বারান্দা ও ছোট। ছোট ঘর; যেমন সংকীর্ণ, তেমনই অন্ধকার। সবগুলো ঘরের লোহার দরজা খোলা। চার-পাঁচজনের এক  একটা দেলের গলা থেকে শিকল খুলে নিয়ে তাদের এক একটা অন্ধকার নরকের মধ্যে ঠেলে দেয়া হল।

 টারজান দেখল, লুকেডি ও অন্য দু’জন বাগেগোর সঙ্গে তাকে যে ঘরে ঠেলে দেয়া হয়েছে সেটা আগোগোড়া গ্যানিট পাথরে গড়া। ঘরের একটি মাত্র দরজায় লোহার গরাদে বসানো। দরজার উল্টো দিকের দয়ালের মাথায় একটিমাত্র গরাদ দেয়া জানালা দিয়ে সামান্যমাত্র আলো ও হাওয়া ঘরে ঢুকছে। তাদের মুখের উপরেই দরজা বন্ধ করে ভারী তালা লাগিয়ে দেয়া হল। সেই নির্জন ঘরে সকলে অপেক্ষা করতে লাগল অনাগত নিয়তির জন্য।

একটা ফটকের সামনে পাল্কি থামল। লেপাস ও এরিক পাল্কি থেকে নামল। বাগানে ঢুকল। একটা গাছের ছায়ায় বসে একজন মজবুত দেহ বয়স্ক লোক নিচু ডেস্কে কি যেন লিখছে। তার প্রাচীনকালের রোমক দোয়াত, খাগের কলম, পার্চমেন্ট কাগজ দেখে ভন হাবেনের দেহে শিহরণ খেলে গেল।

কেমন আছ খুড়ো! লেপাস চেঁচিয়ে বলল। বয়স্ক লোকটি তার দিকে মুখ ফেরাল। লেপাস্ আবার বলল, আজ তোমার জন্য একজন অতিথি এনেছি। এই হচ্ছে অনেক দূরের দেশ জার্মানিয়া হতে আগত বর্বর সর্দার এরিক ভন হারবেন। তারপর ভন হাবেনের দিকে ঘুরে বলল, আর এই আমার মাননীয় খুড়ো মশায় সেপ্টিমাস ফেবোনিয়াস।

সেপ্টিমাস সাদরে ভন হারবেনকে গ্রহণ করল। কুশল-প্রশ্নাদি বিনিময়ের পরে লেপাসকে সঙ্গে দিয়ে তাকে ভিতরে পাঠিয়ে দিল।

এক ঘণ্টা পরে পোশাকাদি বদলে ভন হারবেন আবার যখন একাকি বাগানে ফিরে গেল সেপ্টিমাস তখন সেখান থেকে চলে গেছে।

 ভন হারবেন একাই বাগানের ভিতরে ঘুরতে লাগল। ঘুরতে ঘুরতে একটা ঝোপের বাঁক ঘুরতেই একটি সুন্দরী তরুণীর একেবারে মুখোমুখি হল। তরুণীটি অস্ফুট গলায় বলল, তুমি কে?

ভন হারবেন জবাব দিল, আমি এখানে নবাগত। মালিয়াস লেপাস আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আমি তার খুড়ো সেপ্টিমাস ফেবোনিয়াসের অতিথি।

মেয়েটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, তা হতে পারে। অতিথি সঙ্কারের ব্যাপারে বাবার কুখ্যাতি আছে।

ভন হারবেন প্রশ্ন করল, তুমি কি ফেবোনিয়াসের মেয়ে।

মেয়েটি বলল, হ্যাঁ, আমি ফেবোনিয়া। কিন্তু তোমার পরিচয় এখনও দাও নি।

আমি এরিক ভন হারবেন; জার্মানিয়া থেকে এসেছি।’

মেয়েটি সোৎসাহে বলে উঠল, জার্মানিয়া! সিজার জার্মানিয়ার কথা লিখে গেছে বটে। সাঙ্গুইনরিয়াসও লিখেছে। সে দেশ তো অনেক দূরে।

ভন হারবেন বলল, সেদিনের পরে এত বেশি শতাব্দীকাল পার হয়ে গেছে যে তার তুলনায় তিন হাজার মাইলের দূরত্বটাকে খুব বেশি বলে মনে হচ্ছে না।

একটু চুপ করে থেকে ভন হারবেন ডাকল, ফেবোনিয়া!

 সপ্রশ্ন দৃষ্টি তুলে মেয়েটি বলল, বল।

তোমার নামটা বড় সুন্দর। এ রকম নাম আগে কখনো শুনি নি।

 নামটা তোমার পছন্দ?

খুব।

হঠাৎ মেয়েটি চমকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ভন হারবেনও পিছন দিকে ঘুরে গেল। একটি তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি সম্পর্কে তারা কেউই সজাগ ছিল না।

ভন হারবেন দেখল, একটি বেঁটে কৃষ্ণকায় যুবক তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ঝলমলে পোশাক। কোমর থেকে ঝুলছে একটা বেঁটে তরবারি।

যুবকটি বলল, তোমার এই বর্বর বন্ধুটি কে ফেবোনিয়া?

মেয়েটি উদ্ধত কণ্ঠে জবাব দিল, এ হচ্ছে এরিক ভন হারবেন; আমার বাবা সেপ্টিমাস। ফেবোনিয়াসের অতিথি। আর এ হচ্ছে ফুলবাস ফুপাস; বাবার প্রশ্রয় পেয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে।

ফুপাস ক্রুদ্ধ চোখ তুলে তাকাল। ঠিক সেই সময় মালিয়াস লেপাস এসে পড়ায় ব্যাপারটা বেশি দূর গড়াল না। তবে ভন হারবেন বুঝতে পারল যে এই যুবকটি ফেবোনিয়াকে ভালবাসে।

আরও একটু পরে সেপ্টিমাস ফেবোনিয়াস এসে তাদের দলে যোগ দিল। বলল, এবার সবাই মিলে স্নানে যাওয়া যাক।

লেপাস ভন হারবেনকে চুপি-চুপি বলল, খুড়ো এবার সাবইকে নিয়ে সিজারের স্নানাগারে যাবে।

একটু বেলা হলে সৈন্যরা এসে কারা-কক্ষের দরজা খুলে দিল। জনৈক ক্রীতদাসসহ একটি শ্বেতকায় যুবক অফিসার ও কয়েকজন সৈনিক ঘরে ঢুকল। অফিসারটি শহরের ভাষায় টারজানকে কিছু বললে সে মাথা নেড়ি বুঝিয়ে দিল যে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। তখন ক্রীতদাসটি বাগেগোদের ভাষায় কথা বললে টারজান তা বুঝতে পারল। তখন সেই ক্রীতদাসের মারফৎ অফিসার টারজনের সঙ্গে কথা বলতে লাগল।

অফিসার বলল, তুমি কে, আর একজন সাদা মানুষ হয়ে বাগেগোদের গ্রামে কি করছিলে?

বন্দী জবাবে জানাল, আমি অরণ্যরাজ টারজান। এই পাহাড়ে এসে হারিয়ে গেছে এমন আর একটি সাদা মানুষের খোঁজই আমি এসেছি পা ফসকে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে বাগেগোরা আমাকে বন্দী করে। তোমার সৈন্যরা বাগোগোদের গ্রামে হানা দিয়ে আমাকে ধরে এনেছে। সব কথা তো বললাম; আশা করি এবার তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে।

অফিসার বলল, তোমার কথার জবাব দিতে আমি আসি নি; এসেছি তার কাছে তোমাকে নিয়ে যেতে যে তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে।

অফিসারের নির্দেশে সৈনিকরা টারজানকে নিয়ে কারা-কক্ষের বাইরে চলে গেল।

শহরের রাজপথ ধরে মাইলখানেক যাবার পরে সকলে একটা খুব বড় বাড়িতে ঢুকল। চওড়া বারান্দা ঘুরে তারা ঢুকল একটা প্রশস্ত কক্ষে। সেই কক্ষের এক প্রান্তে উঁচু বেদীর উপর কারুকার্যখচিত প্রকাণ্ড আসনে বসে আছে একটি দশাসই মানুষ।

ঘরে আরও অনেক লোকের সমাবেশ; সকলেরই পরনে কম-বেশি ঝকঝকে পোশাক-পত্তর। ক্রীতদাস, হরকরা ও অফিসাররা অনবরত আসা-যাওয়া করছে। টারজানকে নিয়ে সকলে একটা স্তম্ভের পাশে অপেক্ষা করতে লাগল।

বাগেগো দোভাষীকে টারজান জিজ্ঞাসা করল, এটা কোন্ জায়গা? আর দূরের ঐ লোকটিই বা কে?

এটা হচ্ছে পাশ্চাত্য দেশের সম্রাটের দরবার-কক্ষ। আর ওই হচ্ছে সাবলেটাস ইম্পারেটার স্বয়ং।

সম্রাট সাবলেটাসের চেহারা দেখবার মত। সাদা সুতোর টিউনিকের উপর সোনার বর্ম আঁটা; সাদা স্যান্ডেলে সোনার বলস; আর কাঁধের উপর থেকে নেমে এসেছে সিজারদের লাল পৃষ্ঠ-বসন। ভুরুর উপর দিয়ে জড়ানো কারুকাপ্যখচিত সাদা ফিতেটা বহন করছে তার মর্যাদার অপর চিহ্ন।

 সকলে সিংহাসনের অদূরে থামতেই টারজান বাগেগো দোভাষীকে বলল, সাবলেটাসকে জিজ্ঞাসা কর, কেন আমাকে বন্দী করা হয়েছে; তাকে বল, আমি চাই অবিলম্বে আমাকে মুক্তি দেয়া হোক।

সাবলেটাস সক্রোধে বলে উঠল, সাবলেটাস ইম্পারেটরকে হুকুম করতে সাহস করে সে কে?

দোভাষীর কথা শুনে টারজান বলল, ওকে বলে দাও যে আমি অরণ্যরাজ টারজান; আর ওর মতই আমিও হুকুম করতে এবং হুকুম তামিল হতে দেখতেই অভ্যস্ত।

সে কথা শুনে সাবলেটাস গর্জন করে উঠল, এই উদ্ধত কুত্তাটাকে এখান থেকে নিয়ে যাও।

সঙ্গে সঙ্গে দুটি সৈনিক টারজানকে চেপে ধরল। একজন ধরল ডান হাত, অপরজন বা হাত। কিন্তু হঠাৎ টারজান এত জোরে দু’জনের মাথা ঠুকে দিল যে, তারা অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল, আর সে নিজে বিড়ালের মত অনায়াস ভঙ্গীতে এক লাফে সম্রাট সাবলেটাসের বেদীর সামনে পৌঁছে গেল।

শক্ত থাবায় সম্রাটের কাঁধ দুটো চেপে ধরে টারজান তাকে সিংহাসন থেকে তুলে নিয়ে বারকয়েক সজোরে ঘুরিয়ে ছেড়ে দিল। কয়েকজন বর্শাধারী সাব্‌লেটাসকে উদ্ধার করতে ছুটে আসা মাত্রই সম্রাটের গলার চামড়া ও বর্মের নিচটা ধরে টারজান তাকে এমনভাবে তুলে ধরল আত্মরক্ষার ঢালের মত করে যে, পাছে সম্রাটের গায়ে আঘাত লাগে সেই ভয়ে বর্শাধারীরা টারজানকে আক্রমণ করতেই সাহস পেল না।

বাগেগো দোভাষীকে উদ্দেশ্য করে টারজান তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, ওদের বলে দাও আমি রাস্তায় নেমে যাবার আগে কেউ যদি আমাকে বাধা দেয় তাহলে সম্রাটের গলাটা আমি ছিঁড়ে ফেলব।

কথাগুলো শুনে সাবলেটাস তার লোকজনদের হুকুম দিল তারা যেন টারজানকে আক্রমণ না করে বরং তাকে নির্বিবাদে প্রাসাদ ছেড়ে চলে যেতে দেয়। ক্রোধে, ত্রাসে ও ক্ষোভে সালেটাসের গলা তখন থর থর করে কাঁপছে।

অর্ধনগ্ন বর্বর লোকটি তাদের সম্রাটকে দুই হাতে তুলে ধরে ফটক পেরিয়ে গাছের সারি দিয়ে ঘেরা রাজপথে নেমে গেল। দোভাষী চলল তার আগে আগে।

প্রশস্ত রাজপথের মাঝখানে থেমে টারজান সাকূলেটাসকে মাটিতে নামিয়ে দিল।

সাবলেটাস অতি দ্রুত ফটকের দিকে এগিয়ে চলল, আর রক্ষীরা আবার এসে রাজপথে ভিড় করল। কিন্তু তাদের চোখের সামনেই টারজান কয়েক পা দৌড়ে গিয়ে এক লাফে বুড়ো ওক গাছের ডালে চড়ে টারজান ডাল-পাতার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সাবলেটাস ছুটতে ছুটতে বলতে লাগল, শিগগির! ওর পিছু নাও! ওই অসভ্য লোকটাকে যে নামিয়ে আনতে পারবে তাকে এক হাজার দিনার পুরস্কার দেব।

এগিকে গাছের ডালে-ডালে কিছুদূর গিয়ে টারজান একটা নিচু ছাদের উপর নেমে এক লাফে আর একটা গাছে চড়ে বসল। কোন লোকজন সেদিকে আসছে কি না দেখার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে টারজান মাটি থেকে মাত্র বিশ ফুট উপরে নেমে এল। এত নিঃশব্দে সে নেমে এল যে প্রাঙ্গণে দাঁড়ানো দুটি মানুষ কিছুই টের পেল না।

টারজান কিন্তু তাদের ভালোভাবেই চিনতে পারল। দুটি যুবক-যুবতী। যুবকটির কণ্ঠে ক্রোধের আভাষ। যুবতীটি সহসা চলে যাবার জন্য পা বাড়াল। যুবকটিও এক লাফে এসে তার হাত চেপে ধরল। যুবতীটি চীৎকার করে উঠল। যুবকটি এক হাতে তার মুখ চাপা দিয়ে আর এক হাতে তাকে জড়িয়ে ধরল। আর তখনই মাটিতে ধপাস্ করে একটা শব্দ হওয়ায় মুখ ফিরিয়ে একটি অর্ধনগ্ন দৈত্যকে দেখে বিস্ময়ে হাঁ করে রইল। দুটি ইস্পাত-ধূসর চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ তার ভয়ার্ত কালো চোখের উপর, দুটি ভারী হাত চেপে ধরল তার টিউনিক; তাকে আছড়ে ফেলে দিল একপাশে।

যুবতী বলল, ডিলেক্টা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। এ জন্য আমার বাবা তোমাকে পুরস্কৃত করবে।

বাইরে পায়ের শব্দ শোনা গেল। পরক্ষণেই একটি যুবক অফিসার এসে হাজির হল। টারজান তাকে চিনতে পারল। এ সেই ম্যাক্সিমাস প্রিক্লেরাস যে তাকে কলোসিয়াম থেকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে এসেছিল।

সব কথা শুনে প্রিক্লেরাস রেগে আগুন। বলল, থাম। ভাল চাও তো এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাও।

ফাস্টাসের মুখ লাল হয়ে উঠল। বলল, আমার বাবা সম্রাট সব কিছুই শুনতে পাবে। ডিলেক্টা, তুমিও ভুলে যেয়ো না যে সাবলেটাস ইম্পারেটর তোমার বাবার প্রতিও খুব প্রসন্ন নয়।

ডিলেক্টা চীৎকার করে বলল, আমার ক্রীতদাসকে হুকুম করার আগেই তুমি এখান থেকে বেরিয়ে যাও।

দুই কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফাস্টাস বাগান থেকে বেরিয়ে গেল।

অন্যদের সেখান থেকে সরিয়ে দিয়ে প্রিক্লেরাস পিংগুকে বলল, নবাগত লোকটিকে বল যে, আমি তাকে বন্দী করতে এলেও সে যদি আমার নির্দেশ মত কাজ করে তাহলে ডিলেক্টার অনুরোধে আমি তাকে সাহায্য করতেই চাই।

টারজান বলল, কি নির্দেশ? আমাকে কি করতে হবে?

প্রিক্লেরাস বলল, তুমি যে আমার বন্দী এইভাবে আমার সঙ্গে চল। আমি তোমাকে কলোসিয়ামের দিকেই নিয়ে যাব। আমার বাড়ির বিপরীত দিকে পৌঁছেই আমি এমন একটা ইঙ্গিত করব যাতে তুমি বুঝতে পারবে যে সেটা আমার বাড়ি। তার পরেই আমি এমন সুযোগ করে দেব যাতে তুমি গাছের উপর। দিয়ে পালিয়ে আমার বাড়িতে ঢুকে যেতে পার। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি সেখানেই অপেক্ষা করবে। ডিলেক্টা এখনই পিংগুকে আমার বাড়ি পাঠাবে তোমার সেখানে যাবার সংবাদটা জানাতে, যাতে প্রাণ দিয়েও তারা তোমাকে রক্ষা করে। বুঝতে পারলে?

বুঝেছি, টারজান বলল।

প্রিক্লেরাস বলল, পরে তোমাকে কাস্ট্রা স্যাঙ্গুইনারিয়াসের বাইরে পাহাড়ের ওপারে পাঠাবার একটা ব্যবস্থা আমরা করতে পারব বলেই আশা করি।

টারজানকে সঙ্গে নিয়ে সৈন্যসামন্তসহ ম্যাক্সিমাস প্রিক্লেরাস এগিয়ে চলল কলোসিয়ামের দিকে। কিছুদূর গিয়ে প্রিক্লেরাস পথের পাশে একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবল, আর তার পরেই এসে সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দিল। টারজান বুঝতে পারল, তরুণ অফিসারটি তার বাড়ির নিশানা তাকে বুঝিয়ে দিল।

গাছের ডালে ঝুলতে ঝুলতে টারজান প্রিক্লেরাসের বাড়িতে গিয়ে নামল। পিংগু সেখানে তার জন্যে অপেক্ষা করেই ছিল। আর তার পাশেই দাঁড়িয়েছিল মধ্যবয়সী একটি সম্ভ্রান্ত মহিলা।

মহিলা মপিংগুকে শুধাল, এই কি সেই লোক?

মপিংগু বলল, হ্যাঁ, সেই।

মহিলা বলল, ওকে বল যে আমি ম্যাক্সিমাস প্রিক্লেরাসের মা কেস্টিভিটাস; আমার ছেলের পক্ষ হয়ে তাকে এখানে অভ্যর্থনা করছি।

বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরেই ম্যাক্সিমাস প্রিক্লেরাস টারজনের ঘরে ঢুকল। সঙ্গে সকালবেলাকার সেই দোভাষী লোকটি।

লোকটি টারজানকে বলল, তোমার দোভাষী ও চাকর হিসেবে আমি এখানেই থাকব।

প্রিক্লেরাস জানাল, একমাত্র এই বাড়িটা ছাড়া সর্বত্র সম্রাটের লোকরা তন্ন তন্ন করে তোমার খোঁজ করেছে। কোথাও না পেয়ে সাবলেটাসের ধারণা হয়েছে যে তুমি পালিয়েছ। আমরা তোমাকে দিন কয়েক এখানে লুকিয়ে রাখব; তারপর রাতের অন্ধকারে শহরের বাইরে পাঠিয়ে দেব।

টারজান হেসে বলল, দিনে বা রাতে যে কোন সময়েই আমি ইচ্ছা করলেই এখান থেকে চলে যেতে পারি। কিন্তু যার খোঁজে আমি এসেছি সে যে এখানে নেই সেটা নিশ্চিত জানতে পারলে তবেই আমি যাব। কিন্তু সর্বপ্রথম তোমার এই করুণার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, যদিও এই করুণার কারণ আমি জানি না।

প্রিক্লেরাস বলল, কারণটা খুবই সরল। আজ সকালে যে যুবতীটিকে তুমি রক্ষা করেছ সে ডিয়ন। সৃপ্লেন্ডিডারের মেয়ে ডিলেক্টা তার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। আশা করি, আমার কৃতজ্ঞতার কারণটা এবার বুঝতে পেরেছ।

তা পেরেছি, টারজান বলল, ভাগ্যিস আমি ঠিক সময়ে সেখানে হাজির হয়েছিলাম।

এবার প্রিক্লেরাস বলল, এখানে তোমার জীবন যে কোন সময় বিপন্ন হতে পারে। তবু তুমি এখানে থাকতে চাইছ কেন?

টারজান বলতে লাগল, আমার এক বন্ধুর ছেলেকে খুঁজতে আমি এখানে এসেছি। অনেক সপ্তাহ আগে সেই যুবকটি আবিষ্কারের নেশায় এই ওয়াইরামওয়াজি পর্বতে এসে ঢুকেছে। বাইরে থেকেই তার লোকজন তাকে ফেলে পালিয়েছে। কিন্তু আমার দৃঢ় ধারণা যে কোন ভাবেই হোক সে এখানেই এসেছে। তাই যদি হয় তাহলে আজ হোক কাল হোক সে আমাদের এই শহরে আসবেই, আর নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝেছি যে এখানে এলে তোমাদের সম্রাট তার সঙ্গে বন্ধুর মত ব্যবহার করবে না। তাই আমি এখান থেকে যেতে চাই তাকে সাহায্য করব বলে।

প্রিক্লেরাস বলল, বেশ তো, তাই থাক। আমার বাড়িতে তুমি স্বাগত অতিথি।

 টারজান তিন সপ্তাহ কাটাল ম্যাক্সিমাস প্রিক্লেরাসের বাড়িতে।

ওদিকে ঠিক সেই সময় ভন হারবেন সুখে দিন কাটাচ্ছে প্রাচ্যের সম্রাটের দরবারে একজন সম্ভ্রান্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে। কিন্তু যতই সুখে ও মর্যাদায় দিন কাটুক, আসলে সে যে একজন বন্দীমাত্র এই চেতনা তাকে সর্বদাই বিমর্ষ করে তোলে; সেখান থেকে পালাবার উপায়ের কথা ভাবে। তবু সে সব কিছুই সে ভুলে যায় এখনই সেপ্টিমাস ফেবোনিয়াসের কন্যার কথা তার মনে পড়ে।

এইভাবেই দিন কাটে। আর অনেক দূরের অন্য এক জগতে একটি ভয়ার্ত ছোট বানর এক সুদূর অরণ্যের প্রান্তে লাফিয়ে বেড়ায় মনের দুঃখে।

মনিব-কন্যা ও প্রিক্লেরাসের পরিবারের লোকজন ছাড়া একমাত্র সেই যে এত বড় একটা গোপন খবর জানে সেটাই মাঝে মাঝে পিংগুর মনকে সুড়সুড়ি দেয়, আর সেও এখানে-সেখানে মুখ খুলে বসে। ডিয়ন সপ্লেন্ডিডাস পরিবারের সে বিশ্বস্ত ভৃত্য। তবু হাটে-বাজারে কখন যে সে কাকে কি বলেছে তাতেই ক্ষতি যা হবার তা হয়েছে। সেনানায়ক তাকে বন্দী করে প্রাসাদে নিয়ে গেল। সেখানে একজন অফিসারের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে সব গোপন খবর সে ফাঁস করে দিল। ফলে সম্রাটের আদেশে পরপর বন্দী হল মপিংগুর মনিব, প্রিক্লেরাস ও টারজান।

যে সৈনিকরা টারজানকে কারা-কক্ষের মধ্যে ঠেলে দিল তাদের হাতে মশালের আলোয় সে দেখতে পেল, আরও একটি সাদা মানুষ ও জনাকয়েক নিগ্রোকে দেয়ালের গায়ে শিকলে বেঁধে রাখা হয়েছে। নিগ্রোদের মধ্যে একজন লুকেডি। টারজানকেও শিকলে আটকে দেয়া হল সাদা মানুষটির ঠিক পাশেই।

সৈনিকরা চলে গেল। কারা-কক্ষ অন্ধকারে ভরে গেল।

পাশের সাদা লোকটি বলল, তুমিই কি সেই সাদা বর্বর যার সুখ্যাতি কারাগারের মধ্যেও এসে পৌঁছেছে।

আমি অরণ্যরাজ টারজান।

সাবলেটাসকে তুমিই দুই হাতে মাথার উপর তুলে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এসেছিলে! তাজ্জব ব্যাপার!

টারজান বলল, ওসব কথা থাক। তুমি কে, আর কোন্ অপরাধে সিজারের কারাগারে ঢুকেছ?

লোকটি বলল, কোন সিজারের কারাগারে আমি ঢুকি নি। যে জীবনটা এখন কাস্ট্রা স্যাঙ্গুইনারিয়াসের সিংহাসনে বসেছে সে কোন সিজারই নয়।

তাহলে সিজার কে? টারজান প্রশ্ন করল।

 একমাত্র প্রাচ্যের সম্রাটরাই সিজার নামের অধিকারী।

 টারজান বলল, তাহলে ধরেই নিচ্ছি যে তুমি কাস্ট্রা স্যাঙ্গুইনারিয়াসের লোক নও।

না। আমি কাস্ট্রা মেয়ারের মানুষ।

তাহলে তুমি এখানে বন্দী হলে কেমন করে?

লোকটি বলল, সে অনেক কথা। আমার খুড়ো প্রাচ্যের সম্রাট ভালিডাস অগাস্টাস বিশ্বাসঘাতকতা করে আমাকে সাবুলেটাসের হাতে তুলে দিয়েছে। আমার নাম ক্যাসিয়াস হাস্টা; ভলিডাসের আগে আমার বাবাই ছিল সম্রাট। ভালিডাসের ভয়, আমি হয়তো সিংহাসনের দিকে হাত বাড়াতে পারি। তাই একটা সামরিক মিশনে পাঠাবার নাম করে সে আমাকে সাবুলেটাসের হাতে তুলে দিয়েছে।

তোমাকে নিয়ে সাবলেটাস কি করবে? টারজান জানতে চাইল।

ঠিক তোমাকে নিয়ে যা করবে, ক্যাসিয়াস হাস্টা জবাব দিল। সাবলেটাসের বিজয় উপলক্ষ্যে প্রতি বছর যে উৎসব হয় সেখানে আমাদের হাজির করা হবে, আর মলু-ক্ষেত্রে তাদের আমাদের খোরাক জোগাতে আমরা খুনোখুনি করে মরব।

সেটা কখন হবে? টারজান জানতে চাইল।

 আর বেশি দেরী নেই। দেখছ না এখানে কত সাদা ও কালো মানুষকে আটক করে রেখেছে।

অন্ধকারে লুকেডিকে দেখা যাচ্ছে না, তবু তার দিকে ফিরে টারজান ডাকল, লুকেডি।

বল, লুকেডির গলা শোনা গেল।

তুমি ভাল আছ তো?

আমি তো মরতে বসেছি। ওরা আমাকে সিংহ দিয়ে খাওয়াবে, না হয় ক্রুসে পুড়িয়ে মারবে, অথবা যোদ্ধাদের সঙ্গে আমাকে লড়িয়ে দেবে। লুকেডির কাছে সবই সমান।

এই সব লোকই তোমাদের গাঁয়ের?

কে একজন বলে উঠল, গতকাল ওরা বলেছিল আমরা ওদের আপনজন, আর কালই সিজারের মজার জন্য ওরা আমাদের দিয়ে খুনোখুনি করাবে।

টারজান বলল, তোমরা নিশ্চয় সংখ্যায় খুব কম, তাই এই ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছ।

মোটেই না; সংখ্যায় আমরা শহরের লোকের দ্বিগুণ। আমরা সকলেই সাহসী যোদ্ধা।

তাহলে তোমরা বোকা।

আমরা চিরদিন বোকা থাকব না। অনেক লোকই সাবলেটাস ও কাস্ট্রা স্যাঙ্গুইনারিয়াসের সাদা মানুষদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে প্রস্তুত।

শহরের এবং বাইরের নিগ্রোরা সিজারকে ঘৃণা করে। কথাগুলো বলল মপিংগু। তাকেও টারজনের সঙ্গে বন্দী করে আনা হয়েছে।

লোকগুলোর কথাবার্তা টারজনের মনে নতুন চিন্তার খোরাক জোগাল। সে জানে, হাজার হাজার আফ্রিকান ক্রীতদাস শহরে আছে; আরও হাজার হাজার আছে বাইরের গ্রামে গ্রামে। তাদের ভিতর থেকে যদি কোন নেতা মাথা তুলে দাঁড়ায় তাহলে অচিরেই সিজারের অত্যাচারের অবসান ঘটানো যায়।

এই সময় আর একদল সৈন্য এসে কারাগারের বাইরে থামল। ফটক খুলে তাদের মশালের আলোয় টারজান দেখল, আরও একটি বৃন্দীকে তারা সঙ্গে করে এনেছে। লোকটিকে টানতে টানতে ভিতরে নিয়ে আসতেই টারজান তাকে চিনতে পারল। ম্যাক্সিমাস প্রিক্লেরাস তাকে চিনতে পেরেও কথা বলল না দেখে টারজানও চুপ করে গেল। প্রিক্লেরাসকে শিকল দিয়ে দেয়ালের সঙ্গে বেঁধে রেখে সৈন্যরা বেরিয়ে গেলে টারজান বলল, আমার সঙ্গে বন্ধুত্বের ফলেই তোমার আজ এই দশা হয়েছে।

প্রিক্লেরাস বলল, নিজেকে অকারণে দোষী করো না বন্ধু। ফাস্টাস বা সাবলেটাস অন্য যে কোন একটা ছুতো খুঁজে নিত। যবে থেকে ডিলেকটার উপর ফাস্টাসের নজর পড়েছে তবে থেকেই আমার কপাল পুড়েছে। ওরা আমাকে সরিয়ে দিতই। আমি শুধু ভাবছি, কে আমার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করল।

আমি। অন্ধকারেই একজন বলে উঠল।

 কে কথা বলল? প্রিক্লেরাস শুধাল।

টারজান বলল, মপিংগু। তোমার সঙ্গে দেখা করতে ডিয়ন সপ্লেন্ডিডাসের বাড়ি যাবার পথে আমার সঙ্গে তাকেও বন্দী করা হয়েছে।

আমার সঙ্গে দেখা করতে! প্রিক্লেরাস সবিস্ময়ে বলল।

আমিই মিথ্যা করে ও কথা বলেছি, পিংগু বলল। ওরা আমাকে বলতে বাধ্য করেছে।

ওরা কারা?

সিজারের অফিসার ও ছেলে। আমাকে সম্রাটের প্রাসাদের মধ্যে টেনে নিয়ে চিৎ করে ফেলে সাঁড়াশি দিয়ে আমার জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছিল, গরম শিক দিয়ে চোখ দুটো পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। বল কর্তা, তারপরে আমি আর কি করতে পারতাম।

প্রিক্লেরাস বলল, সব বুঝতে পেরেছি। তোমাকে আমি দোষ দিচ্ছি না মৃর্পিংগু।

কারাগারের ঠাণ্ডা ও শক্ত পাথরের মেঝেতে শুয়েও টারজান একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল। সে ঘুম ভাঙল অনেক বেলায় কারাধ্যক্ষের ডাকে। সকলকেই খেতে দেয়া হল মোটা রুটি ও জল।

খেতে খেতে টারজান অন্য বন্দীদের ভাল করে দেখতে লাগল। কাস্ট্রাম মেয়ারের এক সিজারের পুত্র ক্যাসিয়াস হাস্টা, কাস্ট্রা স্যাঙ্গুইনারিয়াসের এক সম্ভ্রান্ত নাগরিক সৈন্যাধ্যক্ষ ম্যাক্সিমাস প্রিক্লেরাস, আর সে নিজে, এই তিনজনই সাদা মানুষ। বাকি সকলেই কালো নিগ্রো।

দুদিন দু’রাত কেটে গেল। তৃতীয় দিনে আর একটি বন্দীকে সেখানে রেখে রক্ষী-সৈন্যরা চলে গেল।

ক্যাসিয়াস হাস্টা চাপা উত্তেজনায় ডেকে উঠল, সিসিলিয়াস মেটেলাস, তুমি!

হাস্টার কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে মুখ ফিরিয়ে অপর যুবক বলে উঠল, হাস্টা! টার্টারাসের গভীরতম গভীর থেকে উঠে এলেও ও কণ্ঠস্বর আমি চিনতে পারতাম।

কোন্ দুর্ভাগ্য তোমাকে এখানে এনে ফেলেছে? হাস্টা শুধাল।

যে ভাগ্য আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে আমাকে মিলিত করেছে সেটা দুর্ভাগ্য হতে পারে না।

কিন্তু এ ঘটনা ঘটল কেমন করে?

মেটেলাস বলতে লাগল, তুমি কাস্ট্রাম মেয়ার ছেড়ে আসার পরে সেখানে অনেক কিছুই ঘটেছে। সম্রাটের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়ে ফুলবাস ফুপাস তোমার সব বন্ধুদেরই সন্দেহ করেছে। তাদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। এমন কি ফুপাস যদি তার মেয়ে ফেবোনিয়ার প্রেমে না পড়ত তাহলে সেপ্টিমাস ফেবোনিয়াসকেও এতদিনে কারাগারে ঢুকতে হত। কিন্তু সবচাইতে বড় দুঃসংবাদ হল, ভালিডাস অগাস্টাস ফুস ফুপাসকে পোষ্যপুত্র নিয়েছে এবং তাকেই পরবর্তী ম্রাটরূপে ঘোষণা করেছে।

হাস্টা চেঁচিয়ে বলে উঠল, ফুপাস হবে সিজার! আর মিষ্টি মেয়ে ফেবোনিয়া? সে কি ফুপাসকে ভালবাসতে পারবে?

মেটেলাস বলল, সেখানেই তো গোলমালের মূল। সে ভালবাসে আর একজনকে।

 কে সে? মালিয়াস লেপাস নিশ্চয় নয়?

সে কাস্ট্রাম মেয়ারের মানুষ নয়। জার্মানিয়া থেকে আগত এক বর্বর সর্দার। সে নিজের নাম বলেছে এরিক ভন হারবেন।

টারজান বলে উঠল, এরিক ভন হারবেন। তাকে তো আমি চিনি। সে কোথায়? নিরাপদে আছে তো?

মেটেলাস বলল, মালিয়াস লেপাসের সঙ্গে সেও কাস্ট্রাম মেয়ারের কারাগারে বন্দী। মলু-ক্ষেত্রের খেলায় যদি সে বেঁচেও যায়, তাহলে তাকে সরিয়ে দেবার অন্য পথের অভাব ফুপাসের হবে না।

মল্ল-ক্ষেত্রের খেলা কবে হবে? টারজান প্রশ্ন করল।

অগাস্টের মাঝামাঝি তারিখে, হাস্টা জবাব দিল।

আমি শুনেছি সে খেলা এক সপ্তাহ ধরে চলে। কাস্ট্রাম মেয়ার যেতে ক’দিন লাগে। টারজান শুধাল।

মেটেলাস জবাব দিল, সেনাদলের লাগে আট ঘণ্টা। কিন্তু সে প্রশ্ন কেন? তুমি কি কাস্ট্রাম মেয়ার যাবার কথা ভাবছ নাকি?

টারজান কঠিন গলায় বলল, হ্যাঁ।

মেটেস হেসে বলল, আমাদেরও নিশ্চয় সঙ্গে নেবে?

 তোমাদের দু’জনকেই সঙ্গে নেব, টারজান বলল।

 দু’জনই হেসে উঠল।

ম্যাক্সিমাস প্রিক্লেরাস বলল, কাস্ট্রাম মেয়ারে গিয়ে ক্যাসিয়াস হাস্টা যদি আমার বন্ধু থাকে তাহলে আমিও আছি তোমাদের দলে।

হাস্টা বলল, কথা দিলাম ম্যাক্সিমাস প্রিক্লেরাস।

 হাতের শিকল বাজিয়ে মেটেলাস বলল, কবে আমরা যাত্রা করব?

টারজান বলল, যে মুহূর্তে আমার হাতের শিকল ভোলা হবে; মলু-ক্ষেত্রে নিয়ে যাবার আগে সে কাজটা নিশ্চয় করা হবে।

খেলার শেষ দিন এসে গেল। রক্তপিপাসু মানুষের দল কলোসিয়ামে সমবেত হয়েছে। সেলের বাসিন্দাদের শেষবারের মত নিয়ে যাওয়া হয়েছে মলু-ক্ষেত্রের বেড়ার ধারে। লড়াইতে তাদের ফল ভালই। হয়েছে, কারণ বারোটার মধ্যে মাত্র চারটে আংটা শূন্য হয়েছে।

দরজাটা সপাটে খুলে একজন ছোট অফিসার এসে বলল, তোমরা সকলেই এস। এবার শেষ খেলা।

তাদের প্রত্যেককে দেয়া হল একটা তরবারি, ছুরি, বল্লম, ঢাল ও শনের জাল। একে একে তাদের ঢোকানো হলো মলু-ক্ষেত্রের ভিতরে। সপ্তাহব্যাপী লড়াইয়ের পরেও বেঁচে আছে এমন শ’খানেক যোদ্ধা সেখানে হাজির ছিল।

তাদের দুই সমান দলে ভাগ করা হল। এক দলের কাঁধে বেঁধে দেয়া হল লাল ফিতে, অপর দলের কাঁধে সাদা ফিতে।

টারজান, হাস্টা, মেটেলাস, লুকেডি, মপিংগু ও ওগো সকলেই পড়ল লাল ফিতের দলে।

 টারজান, হাস্টাকে শুধাল, আমাদের কি করতে হবে?

লালের সঙ্গে সাদার যুদ্ধ চলবে যতক্ষণ না লাল অথবা সব সাদা মারা পড়ে।

দুই দল মলু-ক্ষেত্রের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রিফেক্ট লড়াইয়ের নিয়মকানুন শুনিয়ে দিল। ভেরী বেজে উঠল। দুই দলের সশস্ত্র মানুষ এগিয়ে চলল পরস্পরের দিকে। শুরু হল দুই দলের মুখোমুখি লড়াই।

অনেকক্ষণ ধরে লড়াই চলল। দংশনক্ষত শ্যেন বিহঙ্গ যুঝে ভুজঙ্গ সনে।’ এ এক আশ্চর্য লড়াই। বাঁচার লড়াই। নিয়ম নেই, নীতি নেই। হয় তোমার জীবন যাবে, নয়তো আমার।

রক্তাক্ত লড়াই শেষ হল। লালের দলে তখনও পনেরোজনই বেঁচে আছে।

তখন জনতা সমস্বরে চীৎকার করে বলতে লাগল, বিজয়ীর মালা লালদের গলায় পরিয়ে দেয়া হোক; কিন্তু তার পরিবর্তে একমাত্র টারজান ছাড়া বাকি সকলকেই মলু-ক্ষেত্রের বাইরে নিয়ে যাওয়া হল।

সকলে ভাবল, সাবলেটাস হয়তো তাকে বিশেষভাবে সম্মানিত করতে ইচ্ছুক। কিন্তু এ সব কী হচ্ছে?

ক্রীতদাসরা এসে মৃতদেহগুলোকে মলু-ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল; পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্রগুলো কুড়িয়ে নিল; নতুন করে বালি ছড়িয়ে দিল। টারজান যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সিজারের আসনের নিচে, একাকি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।

বুকের উপর দুই হাত ভাঁজ করে টারজান দাঁড়িয়েই আছে। কিসের জন্য এ প্রতীক্ষা তাও সে জানে না। জনতার ভিড়ের ভিতর থেকে ভেসে এল একটা অস্পষ্ট আর্তনাদ-ক্রমেই সে আর্তনাদ তীব্রতর হতে হতে প্রচণ্ড ক্রোধের চীৎকারে পরিণত হল, আর সে সব কিছুকে ছাড়িয়ে টারজনের কানে বাজতে লাগল। কয়েকটা শব্দ ও অত্যাচারী! ভীরু! বিশ্বাসঘাতক! সাবলেটাস নিপাত যাক!

প্রিফেক্টকে কাছে ডেকে সিজার ফিসফিস করে আবার তার সঙ্গে কি যেন পরামর্শ করল। বেজে উঠল ভেরী। প্রিফেক্ট উঠে দাঁড়াল। হাত তুলে বলতে লাগল, এই বর্বর লোকটির অসাধারণ ক্রীড়া-কৌশল সম্রাটের এতই ভাল লেগেছে যে তার প্রিয় প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য তাকে দিয়ে আর একটি নতুন। খেলার ব্যবস্থা-প্রিফেক্ট তার কথা শেষ করতে পারল না; বিস্ময়ে ও রাগে সমবেত দর্শকরা হৈ-হৈ করে উঠল। সিজারকে লক্ষ্য করে নানা রকম ধ্বনি দিতে লাগল। উদ্যত বল্লম হাতে সৈনিকরা তাদের ঠেকিয়ে রাখতে লাগল।

এমন সময় মলু-ক্ষেত্রের শেষ প্রান্তের ফটকটা সপাটে খুলে গেল।

মলু-ক্ষেত্রের শেষ প্রান্তের দিকে তাকিয়ে টারজান দেখল, ছ’টি গোরিলাকে ফটক দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। কয়েক মিনিট আগেই মল্ল-ক্ষেত্র থেকে উৎসারিত বিজয়-গর্জন তাদের কানে গেছে; তাই উত্তেজনায় ও হিংস্রতায় কাঁপতে কাঁপতে তারা খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসেছে। সামনেই দেখতে পেল একটি ঘৃণিত টারমাঙ্গানিকে। যারা তাদের বন্দী করেছে, বিরক্ত করেছে, আঘাত করেছে, এ তো তাদেরই একজন।

একটি গোরিলা গর্জে বলল, আমি গোয়াট। আমি খুন করি।

আর একটিও গর্জে উঠল, আমি জুঠো। আমি খুন করি।

 গো-ইয়াড ঘেঁকিয়ে বলল, টারমাঙ্গানিকে মার।

তারা হেলে-দুলে এগোতে লাগল।

ওদিকে জনতা শিস দিচ্ছে, আর্তনাদ করছে। সে সব ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে তাদের স্লোগন : সিজারের পতন হোক! সালেটাস মুর্দাবাদ!

গোরিলারা এগিয়ে চলল। সকলের সামনে জুঠো। সে বলল, আমি জুঠো। খুনে।

 টারজান বলল, বন্ধুকে খুন করার আগে ভাল করে তাকাও জুঠো। আমি অরণ্যরাজ টারজান।

জুঠো অবাক হয়ে থেমে গেল। অন্যরা তাকে ঘিরে দাঁড়াল।

 গো-ইয়াড বলল, আমি ওকে চিনি। আমি যখন যুবক ছিলাম তখন ও ছিল রাজা।

গাইয়াট বলল, সত্যি তো এর চামড়া সাদা।

টারজান বলল, হ্যাঁ, আমি সাদা-চামড়া। এখানে আমরা সকলেই বন্দী। এই সব টারমাঙ্গানিরা আমাদের শত্ৰু, তোমাদের শত্রু। ওরা চায় আমরা পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি, কিন্তু আমরা তা করব না।

জুঠো বলল, না, আমরা টারজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না।

সাবলেটাস পাশের অতিথিকে শুধাল, কি ব্যাপার? ওরা ওকে আক্রমণ করছে না কেন?

লোকটা ওদের মন্ত্রে বশ করেছে, অতিথি বলল।

উপস্থিত জনতা হা করে দেখছে। তারা দেখল, টারজান সিজারের আসনের দিকে এগিয়ে চলেছে; গোরিলারা হেলে-দুলে চলেছে তার পাশে পাশে।

সম্রাটের আসবেন নিচে পৌঁছে তারা দাঁড়িয়ে পড়ল। টারজান সাবুলেটাসের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার সব ফন্দি ব্যর্থ হয়েছে সিজার। এরা সবাই আমার আপনজন। আমার কোন ক্ষতি এরা করবে না। বরং আমার এক কথায় এরা গিয়ে তোমাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবে।

সে কাজ টারজান অনায়াসে করতে পারত, কিন্তু তার পরেই তো সৈনিকদের হাতে বল্লমের আঘাতে তারও ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে। তাছাড়া, নিজে পালিয়ে যাবার আগে ক্যাসিয়াস হাস্টা ও সিসিলিয়াস মেটেলাসকেও তো সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে; তাদের সাহায্য ছাড়া সে তো এরিক ভন হারবেনের খোঁজই করতে পারবে না।

তাই প্রিফেক্ট যখন আবার তাকেও গোরিলাদের কারাগারে ফিরিয়ে নিতে এল তখন সে কোনরকম বাধাই দিল না। মলু-ক্ষেত্রের ফটক বন্ধ হয়ে গেলে আবার একবার তার কানে এল জনতার সমবেত কণ্ঠস্বর ও সাবলেটাসের পতন হোক।

কারাগারে ঢুকেই টারজান দেখতে পেল ম্যাক্সিমাস প্রিক্লেরাসকে। এক বন্ধুর চেষ্টায় কারাগারের চাবিও তাদের হস্তগত হল। হাতের বেরি খুলে তারা সোজা হয়ে দাঁড়াল। অন্ধকার বারান্দা দিয়ে সেল থেকে সেলে ঢুকে সব বন্দীকে মুক্ত করে দিল। শুধু নিজেদের দলের লোকই নয়। আরও যে সব পেশাদার যোদ্ধাকে সিজার আটকে রেখেছিল তাদেরও মুক্তি দেয়া হল।

সকলেই একবাক্যে টারজনের নেতৃত্বকে মেনে নিল।

টারজান বলল, আমরা সকলে হয়তো জীবিত অবস্থায় বেরিয়ে যেতে পারব না, কিন্তু যারা পারবে তারা অবশ্যই সিজারের অবিচারের প্রতিশোধ নেবে।

জনৈক যোদ্ধা বলল, তুমি ন্যায় করেছ কি অন্যায় করেছ জানি না; আমরা বাঁচব কি মরব তাও বুঝি না; শুধু বুঝি লড়াই–যুদ্ধ।

টারজান বলল, যুদ্ধ তোমরা পাবে–প্রচুর যুদ্ধ।

তাহলে আমাদের পরিচালনা কর।

টারজান বলল, কিন্তু তার আগে আমার বাকি বন্ধুদের মুক্তি দিতে হবে।

প্রিক্লেরাস বলল, সব সেল আমরা খালি করে দিয়েছি; আর কেউ কোথাও নেই।

আছে বন্ধু আছে, টারজান বলল; এখনও বাকি আছে আমার গোরিলা বন্ধুরা।

কাস্ট্রাম মেয়ারে ভালিডাস অগাস্টাসের কারাগারে এরিক ভন হারবেন ও মালিয়াস লেপাস সুদিনের জন্য অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু সুদিন কি আসবে?

লেপাস বিষণ্ণ গলায় বলল, মৃত্যু ছাড়া আর কিই বা আমরা আশা করতে পারি। আমাদের বন্ধুরা, ক্ষমতাচ্যুত, কারাগারে বন্দী, না হয় নির্বাসিত।

আর সব দোষ আমার, ভন হারবেন বলল।

নিজেকে অকারণে দোষী করো না। ফেবোনিয়া তোমাকে ভালবেসেছে সেটা তো তোমার অপরাধ নয়। আসল অপরাধী কুচক্রী ফুপাস।

ভন হারবেন তবু বলতে লাগল। আমার ভালবাসাই ফেবোনিয়ার বিপদ ডেকে এনেছে, তার বন্ধুদের বিপন্ন করেছে। আর আমি এখানে পাথরের দেয়ালে শিকলে বন্দী হয়ে আছি। কিছুই করতে পারছি না।

লেপাস বলে উঠল, আহা, এ সময় ক্যাসিয়াস হাস্টা যদি এখানে থাকত! একটা মানুষের মত মানুষ। সিজার পোষ্যপুত্র নিয়েছে ফুপাসকে। এ পরিস্থিতিতে হাস্টার নেতৃত্ব পেলে গোটা শহর ভালিডাস অগাস্টাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত।

সেই সময়ে উপত্যকার অপর প্রান্তে কাস্ট্রা স্যাঙ্গুইনারিয়াস শহরে সাবুলেটাসের দরবার-কক্ষে নিয়ন্ত্রিত লোকেরা একে একে জড় হতে শুরু করেছে, কারণ সেই সন্ধ্যায়ই সিজার-পুত্র ফাস্টাসের বিয়ে হবে ডিয়ন সপ্লেন্ডিডাসের কন্যার সঙ্গে।

রাজপথে, এমন কি রাজপ্রাসাদের ফটকের ভিতরেও প্রচণ্ড ভিড় জমে গেছে। ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি, হৈ-হল্লার শেষ নেই। জনতার চোখে-মুখে প্রচণ্ড ক্রোধ। আর সে ক্রোধ প্রকাশের মন্ত্র-অত্যাচারীর পতন হোক! সাব্‌লেটাস মুর্দাবাদ! ফাস্টাস মুর্দাবাদ!।

ওদিকে প্রাসাদের উপরের ঘরে ক্রীতদাসী-পরিবৃত হয়ে বসে আছে বিয়ের কনে, মা তাকে নানাভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছে।

ডিলেক্টা বলছে, তা হবে না; কিছুতেই আমি ফাস্টাসের স্ত্রী হব না। ঘাঘরার নিচে দৃঢ়মুষ্টিতে সে ধরে আছে একটা সরু চুরির হাতল।

কলোসিয়ামের নিচেকার বারান্দায় টারজান তার সেনা-সমাবেশ নিয়ে ব্যস্ত। লুকেডি ও সহবন্দী জনৈক গ্রাম-প্রধানকে ডেকে বলল, তোমরা পোর্টা প্রিটোরিয়াতে চলে যাও। সেখানে এপ্পিয়াস। এপ্লোসাসকে বলবে, ম্যাক্সিমাস প্রিক্লেরাসের খাতিরে তোমাদের যেন শহর থেকে বেরিয়ে যেতে দেয়া হয়। তারপর গ্রামে গ্রামে গিয়ে যোদ্ধা সংগ্রহ করবে। তাদের বলবে, তারা যদি সিজারের উপর প্রতিশোধ নিতে চায়, যদি চায় স্বাধীন মুক্ত জীবন, তাহলে তাদের অবিলম্বে শহরে এসে এখানকার বিদ্রোহী নাগরিকদের সঙ্গে যোগ দিয়ে অত্যাচারিকে ধ্বংস করতে হবে। তাড়াতাড়ি চলে যাও; সময় বড়ই অল্প। সকলকে সঙ্গে নিয়ে পোর্টা প্রিটোরিয়ার পথে শহরে ঢুকে সোজা চলে যাবে। সিজারের প্রাসাদে।

***

দলে দলে লোক আসতে লাগল। বাইরের গ্রাম থেকে অর্ধ-নগ্ন যোদ্ধার দল, শহরের ক্রীতদাসের দল আর সমাজচ্যুত মানুষের দল যাদের মধ্যে আছে খুনী, চোর ও পেশাদার মল্লযোদ্ধা। সকলের আগে আগে চলেছে প্রিক্লেরাস, হাস্টা, মেটেলাস ও টারজান। টারজানকে ঘিয়ে চলেছে গাইয়াট, জুঠো, গো ইয়াড ও অন্য গোরিলারা।

প্রশস্ত রাজপথ ভায়া প্রিন্সিপ্যালিস বড় বড় সব গাছে ঢাকা থাকায় রাতের অন্ধকারে একটা সুড়ঙ্গের রূপ নিয়েছে। সেই পথে কয়েকজন মশালধারীর পিছন পিছন টারজান প্রাসাদের দিকে এগিয়ে চলল অনুগামীদের নিয়ে।

ফটকে শাস্ত্রী চেঁচিয়ে বলল, কে আসে?

 আমি অরণ্যরাজ টারজান।

সমবেত জনতা এক কণ্ঠে তার জয়ধ্বনি করে উঠল।

 কেন তোমরা এখানে এসেছ? কি চাও?

আমরা এসেছি ফাস্টাসের হাত থেকে ডিলেক্টাকে উদ্ধার করতে, আর কাস্ট্রা স্যাঙ্গুইনারিয়াসের সিংহাসন থেকে অত্যাচারিকে টেনে নামিয়ে নিতে।

হাজার কণ্ঠ এই ঘোষণাকে সমর্থন জানিয়ে বলল, অত্যাচারী মুর্দাবাদ! প্রাসাদ-রক্ষী মুর্দাবাদ! তাদের হত্যা কর- হত্যা কর!

জনতা দৃঢ়পদক্ষেপে প্রাসাদ-ফটকের দিকে এগিয়ে গেল।

সংবাদ-বাহক ছুটে গেল দরবার-কক্ষে সিজারের কাছে। ভাঙা গলায় বলল, জনতা বিদ্রোহ করেছে। সেনাদল, মল্লযোদ্ধা ও ক্রীতদাসরা তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। তারা ফটকের উপর ভিড় করছে। ফটক ভেঙ্গে পড়বে।

তখন সিজারের দরবার-কক্ষের সোপান শ্রেণীতে চলেছে ফাস্টাস ও ডিলেক্টার বিয়ের আয়োজন। মন্দিরের প্রধান পুরোহিত দাঁড়িয়ে আছে সমবেত দর্শকদের দিকে মুখ করে। একপাশে দাঁড়িয়ে আছে ফাস্টাস। ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল বিয়ের কনে। সঙ্গে প্রদীব হাতে কুমারী সখীর দল। ডিলেক্টার মুখখানি ম্লান, কিন্তু পদক্ষেপ ধীর অথচ দৃঢ়। তাকে দেখাচ্ছে সম্রাজ্ঞীর মত। কিন্তু কনের পোশাকের নিচে তার ডান হাতে যে ধরা আছে একখানি সুতীক্ষ ছুরিকা সেটা কেউ দেখতে পেল না।

সে সোপানে পা রাখল; কিন্তু ফাস্টাসের মত পুরোহিতের কাছে না থেমে সে সোজা উপরে উঠে গেল। সাবলেটাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, রোমের নাগরিক হিসেবে আমি আবেদন রাখছি সিজারের কাছে।

সিজার বলল, বেশ, বল তুমি কি অনুগ্রহ চাও?

আমি কোন অনুগ্রহ চাই না; আমি দাবী করছি আমার অধিকার। ফাস্টাসের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করার আগে ম্যাক্সিমাস প্রিক্লেরাসকে আমি এইখানে জীবিত ও মুক্ত দেখতে চাই। তুমি তো ভালই জান যে সেই শর্তেই আমি এ বিয়েতে রাজী হয়েছি।

সিজার সক্রোধে উঠে দাঁড়াল। বলল, তা হতে পারে না।

দরবার-কক্ষের এক পাশের অলিন্দ থেকে ভেসে এল একটি কণ্ঠস্বর, হ্যাঁ, নিশ্চয় হতে পারে, কারণ আমার ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে ম্যাক্সিমাস প্রিক্লেরাস।

সকলেরই দৃষ্টি পড়ল অলিন্দের দিকে। এক সঙ্গে অনেকে বলে উঠল, সেই বর্বর লোকটা! ম্যাক্সিমাস প্রিক্লেরাস!

অলিন্দ থেকে এক লাফে একটা উঁচু স্তম্ভকে আঁকড়ে ধরে টারজান দ্রুত নেমে গেল মেঝের উপর। তার পিছন পিছন নেমে এল ছ’টি লোমশ গোরিলা।

সিজার চীৎকার করে ডাকল, রক্ষী! রক্ষী!

টারজান ও ছ’টি গোরিলা ধেয়ে গেল সিংহাসনের দিকে। রক্ষীদের হাতে ঝলসে উঠল দশ-বারখানা তরবারি। মেয়েরা আর্তনাদ করে মূৰ্ছা গেল। ভয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় সিজার স্বর্ণ-সিংহাসনে এলিয়ে পড়ল। ফাস্টাস আর্তনাদ করে পালিয়ে গেল। এক লাফে টারজান হাজির হল ডিলেক্টার পাশে। গোরিলারা সিঁড়ি বেয়ে সিংহাসনের দিকে এগিয়ে আসছে দেখে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সিজার লুটিয়ে পড়ল তার মহত্ব ও শক্তির প্রতীক সিংহাসনেরই পিছনে।

ওদিকে ভায়া প্রিন্সিপ্যাসিস-এর উপর প্রচণ্ড ঢেউয়ের মত একের পর এক আছড়ে পড়ছে ক্রুদ্ধ জনতার দল। ফটক ভেঙ্গে তারা ভিতরে ঢুকে পড়েছে। তাদের পায়ের নিচে অনেক রক্ষী চাপা পড়ে মরল।

এমন সময় পোর্টা ডেকুকামার দিক থেকে অনেক দূরে শোনা গেল ভেরীর আওয়াজ। সকলে আনন্দে উল্লাস-ধ্বনী করে উঠল। নিশ্চয় গ্রাম থেকে যোদ্ধার দল এসে পড়েছে তাদের সাহায্য করতে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা তা নয়। বল্লম ও তারবারি উঁচিয়ে ধেয়ে এল সম্রাটের সৈন্যদল। ভীতত্রস্ত জনতা ছুটে পালাতে শুরু করল। আর দুর্ধর্ষ সেনাদল রক্তাক্ত তরবারি ও জ্বলন্ত মশাল হাতে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল।

দুই পক্ষের রণ-কোলাহলকে ছাপিয়ে বাগানের দূর প্রান্ত থেকে ভেসে এল এক বর্বর চীৎকার। সে চীৎকার উভয় পক্ষের সেনানীদেরই ক্ষণতরে স্তব্ধ করে দিল। টারজান সাগ্রহে মাথা তুলে তাকাল। বাতাসের গন্ধ শুঁকতে লাগল। পরিচয়, আশা, বিস্ময়, অবিশ্বাস- সব যেন এক সঙ্গে তার বুকের মধ্যে। উত্তাল হয়ে উঠল।

সে বর্বর চীৎকার বাড়তে বাড়তে ক্রমে সিজারের বাগানে ঢুকে পড়ল। সম্রাটের ভাড়াটে সৈনিকরা মুখ তুলে দেখল, একটি বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসছে একদল বীর যোদ্ধা। তাদের মাথার চামড়ার শিরস্ত্রাণে উড়ছে। পাখির পালক, তাদের কণ্ঠেই ধ্বনিত হচ্ছে এই ভয়ংকর রণ-গর্জন-ওয়াজিরিয়া এসে পড়েছে।

টারজান দেখল, সকলের সামনে রয়েছে মুভিরো; তার পাশে লুকেডি। কিন্তু সেই মুহূর্তে টারজনের বা সেখানে সমবেত অন্য কারও নজরে না পড়লেও সেই ওয়াজিরি বাহিনীর সঙ্গেই ছিল কাস্ট্রা স্যাঙ্গুইনারিয়াসের নানা গ্রাম থেকে আসা সেই সব যোদ্ধার দল যারা দীর্ঘকালব্যাপী অবিচারের প্রতিহিংসা নিতে গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে ছুটে এসেছে সিজারের রাজপ্রাসাদকে লক্ষ্য করে।

শেষ পর্যন্ত সম্রাটের সেনাদল অস্ত্র ত্যাগ করে টারজনের কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করল। মুভিরো ছুটে এসে টারজনের সামনে নতজানু হয়ে তার হাতে চুমু খেল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা ছোট বানর ঝুলন্ত ডাল থেকে লাফিয়ে নেমে এল টারজনের কাঁধে।

মুভিরো বলল, ওয়াজিরিদের প্রতি পূর্বপুরুষের অনেক কৃপা না থাকলে আমরা ঠিক সময়ে এসে পৌঁছেতে পারতাম না।

টারজান বলল, নকিমাকে না দেখা পর্যন্ত আমিও তো বুঝতে পারিনি আমার সন্ধান তোমরা কেমন করে পেলে।

মুভিরো বলল, হ্যাঁ, সবই নকিমার কৃতিত্ব। সেই তো ওয়াজিরিদের দেশে গিয়ে আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে। তাই তো আজ বড় বাওয়ানাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা দেশে ফিরে যেতে পারব।

টারজান মাথা নেড়ে বলল, না, আমি তো এখন যেতে পারব না। আমার বন্ধুর ছেলে এখনও এই উপত্যকায় আছে। তোমাদের সকলের সাহায্যে এবার আমি তাকে উদ্ধার করতে পারব।

এই সময় প্রিক্লেরাস এসে বলল, বন্ধু টারজান, গ্রাম থেকে যে সব লোক এসে রাজপ্রাসাদে ঢুকেছে তারা নির্বিচারে সকলকে খুন করছে, লুট চালাচ্ছে। তাদের তো বাধা দিতে হবে। এ সব থামাতে হবে।

টারজান বলল, নিশ্চয় থামাতে হবে। সৈন্য পাঠিয়ে সাবলেটাস ও ফাস্টাসকে এখানে নিয়ে এস।

কিন্তু যাদের পাঠানো হল তারা ফিরে এসে জানাল, সাবলেটাস মারা গেছে, ফাস্টাসও মারা গেছে। দরবার-কক্ষে ও অলিন্দ-পথে সেনেটর, রাজপুরুষ ও অফিসারদের মৃতদেহ স্থূপীকৃত হয়ে আছে।

বিষণ্ণ মুখে প্রিক্লেরাস শুধাল, কেউ কি বেঁচে নেই?

একজন বলল, আছে। কিছু লোক একটা ঘরে আত্মগোপন করেছিল। শুধু তারাই বেঁচে আছে। তাদের আমরা সব কথা জানিয়েছি। তারা এখনই এসে পড়বে।

অলিন্দ-পথে ঘরে এসে ঢুকল সদলে ডিয়ন সপ্লেন্ডিডাস। তাকে দেখেই ডিলেক্টা আনন্দে চীৎকার করে উঠে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল।

 স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে টারজান বলল, সিজারের মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু তোমাদেরই একজনকে তো সিজারের দায়িত্বভার বহন করতেই হবে।

একজন চীৎকার করে বলে উঠল, টারজান জিন্দাবাদ! নতুন সিজার জিন্দাবাদ। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের প্রতিটি স্যাঙ্গুইনারিয়াসের মুখে উচ্চারিত হল সেই ধ্বনি।

টারজান হেসে মাথা নেড়ে বলল, না আমি নই। এখানে এমন একজন আছে যার মাথায় আমি এই রাজমুকুট পরিয়ে দিতে চাই; তবে এক শর্তে।

কে সে? আর কি সেই শর্ত?

ডিয়ন সপ্লেন্ডিডাস, বাইরের গ্রাম থেকে যে সব মানুষ এসেছে তাদের চিরতরে মুক্তি দিতে হবে, তাদের পুত্র-কন্যাদের আর কখনও ক্রীতদাস করে রাখা হবে না। অথবা তাদের মল্লবীরদের কখনও জোর করে মলু-ক্ষেত্রে পাঠানো হবে না-এই শর্তে তুমি কি রাজমুকুট পরতে রাজী আছ?

ডিয়ন সপ্লেন্ডিডাস মাথা নুইয়ে সম্মতি জানাল; আর টারজান রাজমুকুট পরিয়ে নতুন সিজারকে অভিষিক্ত করল।

কাস্ট্রা স্যাঙ্গুইনারিয়াস থেকে ভায়া মেয়ার পথ ধরে পূর্ব দিকে এগিয়ে চলেছে পাঁচ হাজার মানুষ। টারজনের ঠিক পিছনে উড়ছে ওয়াজিরিদের মাথার সাদা পালক। ম্যাক্সিমাস প্রিক্লেরাসের নেতৃত্বে চলেছে। দীর্ঘদেহী ভাড়াটে সৈনিকের দল; আর সকলের পিছনে চলেছে দূর গ্রাম থেকে আগত যোদ্ধারা।

গরম ধুলোভর্তি রাস্তা ভায়া মেয়ার ধরে ওয়াজিরিরা পথ চলছে তাদের নিজস্ব রণ-সংগীত গাইতে গাইতে। ভারী শিরস্ত্রাণ বুকের উপর ঝুলিয়ে, লাঠির মাথায় বোঝাঁপত্তার ঝুলিয়ে কাঁধের উপর ফেলে মুখ খিস্তি করতে করতে চলেছে ভাড়াটে সৈনিকরা। আর দূর গ্রাম থেকে আশা যোদ্ধারা হাসি-ঠাট্টা করতে করতে চলেছে একদল বনভোজনকারীর মত।

কাস্ট্রাম মেয়ারের দুর্গের সম্মুখে সেনা সমাবেশ ও যুদ্ধের যন্ত্রপাতি সাজিয়ে বসাতে এত সময় কেটে গেল যে কাজ শেষ হবার পরে ক্যাসিয়াস হাস্টা বুঝতে পারল সেদিন আর দুর্গ আক্রমণ করা সম্ভব হবে না, কারণ ততক্ষণে অন্ধকার নেমে আসবে। তাই আর একটা মতলব মাথায় নিয়ে টারজান, মেটেলাস ও প্রিক্লেরাসকে সঙ্গে নিয়ে সে দুর্গের ফটকের দিকে এগোতে লাগল। তাদের সামনে চলল একদল মশালবাহী ও শান্তির পতাকা হাতে একদল সৈনিক।

 বিপক্ষের সৈন্যদের আগমনের সময় থেকেই দুর্গের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা ও কর্মচাঞ্চল্য দেখা দিয়েছিল। এখন শান্তির পতাকা হাতে একটি দলকে আসতে দেখে দুর্গাধিপতি একটি বুরুজ থেকে তাদের উদ্দেশ্য জানতে চাইল।

ক্যাসিয়াস হাস্টা বলল, শান্তির ব্যাপারে ভালিডাস অগাস্টাসের কাছে আমার দুটি মাত্র দাবী। এক, মালিয়াস লেপাস ও এরিক ভন হারবেনকে মুক্তি দিতে হবে; দুই, আমাকে কাস্ট্রাম মেয়ারে ফিরে যাবার অনুমতি দিতে হবে এবং আমার পদমর্যাদার অনুকূল সবরকম সুযোগ-সুবিধা আমাকে ভোগ করতে দিতে হবে।

কে তুমি?

 আমি ক্যাসিয়াস হাস্টা। আমাকে তো তোমার ভাল করেই চেনা উচিত।

দুর্গাধিপতি বলল, ঈশ্বর করুণাময়।

ক্যাসিয়াস জিন্দাবাদ! ফুলবাস ফুপাস মুর্দাবাদ! বহুকণ্ঠ একসঙ্গে গর্জে উঠল।

কয়েকজন ছুটে এসে দুর্গের ফটক খুলে দিল। দুর্গাধিপতি হাস্টার পুরনো বন্ধু। ছুটে বেরিয়ে এসে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল।

হাস্টা বলল, এ সবের অর্থ কি? কি হয়েছে?

ভালিডাস অগাস্টাসের মৃত্যু হয়েছে। আজই মল্ল-ক্ষেত্রে গুপ্তঘাতকের হাতে সে নিহত হয়েছে। ফুলবাস ফুপাস এখন বসেছে সিজারের আসনে। বড় ভাল সময়ে তুমি এসে পড়েছ। সারা কাস্ট্রাম মেয়ার তোমাকে স্বাগত জানাবে।

দুর্গ থেকে হ্রদের তীর পর্যন্ত এবং ভাসমান সেতু হয়ে দ্বীপ পর্যন্ত এগিয়ে চলল প্রাচ্যের নতুন সম্রাটের বাহিনী। খবরটা ছড়িয়ে পড়ল সারা শহরে। জনসাধারণ উল্লাসে ফেটে পড়ল; ক্যাসিয়াস হাস্টাকে জানাল স্বাগত সম্ভাষণ।

অফিসার বাইরে থেকেই চীৎকার করে বলল, তোমরা সকলেই বেরিয়ে রাজপথে চলে এস। প্রাচ্যের সম্রাট ক্যাসিয়াস হাস্টার এই সব বন্ধুদের গায়ে কেউ হাত তুলো না।

ফেবোনিয়া, ভন হারবেন, লেপাস ও গাবুলা একসঙ্গে পড়-বাড়িটার সিঁড়ি বেয়ে নেমে রাজপথে এসে দাঁড়াল।

মালিয়াস লেপিস বলল, ঐ তো ক্যাসিয়াস হাস্টা। কিন্তু বাকি ওরা সব কারা?

ফেবোনিয়া বলল, ওরা নিশ্চয় স্যাঙ্গুইনারিয়াসের মানুষ। কিন্তু দেখ, ওদের মধ্যে একজনের কেমন বর্বরদের মত পোশাক। আরও দেখ, তার পিছনে যে যোদ্ধারা আসছে তাদের মাথায় পাখির পালক উড়ছে।

মালিয়াস লেপিস বলল, এ রকম দৃশ্য আমি জীবনে কখনও দেখি নি।

ভন হারবেন বলল, আমিও না। তবু ওদের আমি চিনতে পেরেছি। কারণ ওদের খ্যাতি ও বিবরণ আমি হাজার বার পড়েছি।

ওরা কারা? ফেবোনিয়াস শুধাল।

 শ্বেতকায় দৈত্যটি হল অরণ্যরাজ টারজান, আর যোদ্ধারা হল তারই ওয়াজিরি সেনাদল।

পুরনো বন্ধুকে আলিঙ্গন করে হাস্টা বলল, ঈশ্বরের জয় হোক! কিন্তু জার্মানিয়ার যে বর্বর দলপতির খ্যাতি কাস্ট্রা স্যাঙ্গুইনারিয়াস পর্যন্ত পৌঁছে গেছে সে কোথায়?

লেপিস বলল, এই তো সে। নাম এরিক ভন হারবেন।

টারজান আরও কাছে এগিয়ে গেল। ইংরেজিতে বলল, তুমিই এরিক ভন হারবেন?

ভন হারবেনও ইংরেজিতে বলল, আর তুমি তো অরণ্যরাজ টারজান, আমি জানি।

টারজান হেসে বলল, তোমাকে দেখাচ্ছে মোল আনা একজন রোমকের মত।

ভন হারবেন মুচকি হেসে বলল, আমি কিন্তু ষোল আনা একজন বর্বর।

রোমকই হও, আর বর্বরই হও, তোমাকে যখন তোমার বাবার হাতে ফিরিয়ে দেব তখন সে খুব খুশি হবে।

ভন হারবেন শুধাল, অরণ্যরাজ, তুমি কি আমার খোঁজেই এখানে এসেছ?

 টারজান বলল, একেবারে ঠিক সময়েই এসে পড়েছি।

 কি কলে যে তোমাকে ধন্যবাদ জানাব? ভন হারবেন বলল।

আমাকে নয় বন্ধু, টারজান বলল, ধন্যবাদ জানাও ছোট্ট নকিমাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *