টারজান ও সোনালী সিংহ (টারজন এ্যাণ্ড দি গোল্ডেন লায়ন)

টারজান ও সোনালী সিংহ (টারজন এ্যাণ্ড দি গোল্ডেন লায়ন)

বাংলো বাড়িতে ফেরার পথে টারজান, তার স্ত্রী জেন আর তার ছেলে কোরাক বনপথে দেখল একটা মরা সিংহীর পাশে তার একটা জীবন্ত বাচ্চা ঘুমিয়ে আছে।

হাত বাড়িয়ে প্রথমে বাচ্চাটাকে ধরতে যেতেই সে গর্জন করে মুখটা সরিয়ে নিল। তার হাতটা আঁচড়ে দিতে গেল।

জেন বলল, অনাথা বেচারী, কিন্তু কি সাহস!

কোরাক বলল, এখনো ওর চার-পাঁচ মাস মার দুধ দরকার। ওকে আর বাঁচানো যাবে না।

টারজান বলল, ওকে মরতে দেয়া হবে না।

জেন বলল, তুমি তাহলে ওকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে লালন-পালন করবে?

 টারজান বলল, হ্যাঁ, তাই করব।

এই বলে সে বাচ্চাটার ঘাড়ে ধরে তার গায়ে হাত বুলিয়ে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কি বলতেই বাচ্চাটা চুপ করে রইল শান্ত হয়ে। তাকে বুকে তুলে নিল।

জেন আশ্চর্য হয়ে বলল, কি করে সম্ভব হলো এটা?

টারজান বলল, সভ্য জগতের মানুষরা এসব বুঝতে পারে না। বনেই আমার জন্ম।

টারজান সিংহশাবকটাকে সঙ্গে নিয়ে দুধের খোঁজে একটা আদিবাসী গাঁয়ে গেল।

সর্দার বলল, তার অনেক ছাগল আছে। ছাগলের দুধ এনে দেবে।

এমন সময় টারজনের চোখে পড়ল একটা মাদী কুকুর শুয়ে আছে। তার সম্প্রতি বাচ্চা হয়েছিল। কিন্তু বাচ্চাগুলো মারা যাওয়ায় তার দুধের বাটগুলো দুধে ভর্তি। টারজান দেখল ঐ কুকুরটার দুধ সিংহের বাচ্চাটাকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে পারলে আর ভাবনা থাকবে না।

টারজান বলল, কুকুরটাকে আমি কিনে নিয়ে যাব।

সর্দার বলল, কিনতে হবে না মালিক। ওকে আপনি নিয়ে যান। দরকার হলে আরো কুকুর নিয়ে যান।

 সে রাতটা আদিবাসীদের গায়েই কাটাল টারজানরা।

পরদিন সকাল হলেই বাংলো বাড়ির দিকে রওনা হলো ওরা। বাংলোটা আর ওয়াজিরি বস্তিটা আর বেশি দূরের পথ নয়।

টারজান, জেন আর কোরাক বন পার হয়ে সেই ফাঁকা জায়গাটায় এসে দেখল তাদের বাংলো বাড়িটা ঠিকই চারপাশের গাছপালা আর ওয়াজিরিদের বস্তির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। টারজান ভেবেছিল জার্মানদের দ্বারা একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে বাড়িটা।

টারজানরা বাংলোটার কাছে যেতেই ওয়াজিরি সর্দার বুড়ো মুভিরো এগিয়ে এসে প্রথমে অভ্যর্থনা জানাল তাদের।

টারজানদের আসার খবর পেয়ে বিশ্বস্ত ওয়াজিরিরা ছুটে এসে তাদের ঘিরে আনন্দে নাচতে লাগল।

এদিকে দিন দিন বেড়ে উঠতে লাগল সিংহশাবক জাদ-বাল-জা। টারজান তাকে এরই মধ্যে অনেককিছু শিখিয়েছে। টারজনের কথামত তার সঙ্গে চলাফেরা করে, কোন জিনিস হারিয়ে গেলে গন্ধসূত্র ধরে খুঁজে বার করে আনতে পারে। কোন জিনিস বয়ে নিয়ে যেতে পারে।

সিংহের বাচ্চাটাকে খাওয়ানোর জুন্য এক অদ্ভুত পদ্ধতি অবলম্বন করে টারজুন। একটা মানুষের ডামি বা প্রতিমূর্তি করে তার গলায়-মাংস বেঁধে দিত খাবার সময়। ডামিটার গলায় মাংস বেঁধে দাঁড় করিয়ে দেয়া হত। তারপর টারজান তাকে মাংস খাবার হুকুম দিতেই সিংহ বাচ্চাটা লাফ দিয়ে ডামিটার গলা থেকে মাংস ছিনিয়ে নিত।

সেদিন বিকালে টারজান জেন আর কোরাককে সঙ্গে নিয়ে বাংলো থেকে কিছুদূরে জঙ্গলের মধ্যে এমন একটা জায়গায় গিয়ে উঠল যেখানে হরিণ পাওয়া যায়। তাদের সঙ্গে চারজন নিগ্রো শিকারীও ছিল। কোরাক একুশো পাউন্ড বাজী রেখেছিল। সিংহশাবকটা যদি কাছে মাংস থাকা সত্ত্বেও টারজনের কথা মত চলে তাহলে সে তার বাবাকে একশো পাউন্ড দেবে। জাদ-বাল-জা টারজনের ঘোড়ার পিছনে পিছনে। বনে আসতে লাগল।

ওরা চুপি চুপি, একটা ঝোপের ধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একদল হরিণ চড়ে বেড়াচ্ছিল। এদিক থেকে সিংহ জাদ-বাল-জাকে ছেড়ে দেয়া হল। জাদ-বাল-জাকে দেখে হরিণরা দল বেঁধে ছুটে পালাল। শুধু একটা হরিণ পালাতে পারল না। জাদ-বাল-জা তাকে ধরে ফেলল সে পালাবার আগেই।

কোরাক বলল, এবার ওর আসল পরীক্ষা।

টারজান বলল, ও শিকারকে আমার কাছে নিয়ে আসবে।

জাদ-বাল-জা প্রথমে মরা হরিণটাকে নিয়ে ইতস্তত করতে লাগল। একবার ক্ষোভে গর্জন করে উঠল। তারপর ঘাড়টা ধরে টারজনের সামনে টেনে আনল মৃত দেহটাকে। টারজান এবার জাদ-বাল জার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে প্রশংসা করে নিচু গলায় তার কানে কানে কি বলল।

জেন ও কোরাক বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল।

জাদ-বাল-জার বয়স মাত্র বছর দুই হলেও তখনই সাধারণ সিংহশাবকের থেকে আকারে অনেক বিরাট হয়ে উঠল সে। তার বুদ্ধিও সাধারণ সিংহের থেকে অনেক বেশি হয়ে উঠল। তাকে দেখে একই সঙ্গে গর্ব আর আনন্দ বোধ করত টারজান। সে তাকে নিজের হাতে সব কিছু শেখাতে থাকে।

এক বছর পর্যন্ত জাদ-বাল-জা টারজনের বাংলো বাড়িতে ছাড়া অবস্থায় সর্বত্র ঘুরে বেড়াত। টারজনের বিছানার নিচে এক জায়গায় শুত। কিন্তু তার বয়স এক বছর পূর্ণ হতেই একটা বড় খাঁচার ভিতর তাকে রাখার ব্যবস্থা করল টারজান। মাঝে মাঝে তাকে নিয়ে শিকার করতে যেত সে জঙ্গলে।

এমন সময় টারজান খবর পেল তার জমিদারীর পশ্চিম আর দক্ষিণ দিকে একদল লুণ্ঠনকারী অনেক আদিবাসী অধ্যুষিত গা আক্রমণ করে হাতির দাঁত লুণ্ঠন করে নিয়ে যাচ্ছে এবং আদিবাসীদের উপর পীড়ন চালাচ্ছে। শেখ আমুর বেন খাতুরের পর থেকে এই ধরনের ঘটনা আর ঘটেনি।

কথাটা শুনে টারজান রেগে গেলেও এক মাস কেটে গেল এবং এর মধ্যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনার কথা শোনেনি।

এদিকে জার্মান আক্রমণের ফলে টারজনের অনেক আর্থিক ক্ষতি হয়। বাংলো মেরামত আর ওয়াজিরি বস্তির উন্নয়নের জন্য অনেক টাকা খরচ হয়। অনেক ফসল ও মজুত শস্য নষ্ট হয়। তাই বাংলোতে ফিরে আসার পর থেকে অর্থাভাব দেখা দেয় টারজনের সংসারে।

একদিন রাত্রিতে টারজান জেনকে বলল, আমার মনে হচ্ছে আমাকে একবার ওপার নগরীতে যেতে হবে।

জেন বলল, আমার কিন্তু ভয় লাগছে। তুমি দু’বার গিয়ে কোনরকমে ফিরে এসেছ। তৃতীয়বার গেলে কোন বিপদ ঘটতে পারে। এমন কিছু অভাব হয়নি আমাদের। আমাদের এখনো যা আছে তাতে আমাদের খাওয়া পরার কোন অভাব হবে না।

টারজান বলল, এর আগের বারে ওয়ারপার আমার পিছু নিয়েছিল। তাছাড়া ভূমিকম্পের ফলে আটকে পড়ি আমি। এবার এ ধরনের কোন দুর্ঘটনার সম্ভাবনা নেই।

জেন বলল, তাহলে কোরাক বা জাদ-বাল-জাকে সঙ্গে নিয়ে যাও।

টারজান বলল, না, ওরা থাক। কোরাক বাংলোর নিরাপত্তা রক্ষা করবে। আমার অনুপস্থিতিতে বিপদ ঘটতে পারে। জাদ-বাল-জাকে সঙ্গে করে সে শিকার করে নিয়ে আসবে। তাছাড়া আমি বেশির ভাগ পথ দিনের বেলায় হাঁটব। কিন্তু সিংহটা রোদে গরমে মোটেই হাঁটতে পারবে না। আমার সঙ্গে যাবে পঞ্চাশজন ওয়াজিরি যোদ্ধার একটা দল।

কিছুদিনের মধ্যে বাংলো থেকে ওপার নগরীর পথে রওনা হয়ে পড়ল টারজান।

টারজনের বাংলো থেকে ওপার নগরী পঁচিশ দিনের পথ। টারজান একা হলে সে গাছে গাছে অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারত। কিন্তু ওয়াজিরি যোদ্ধারা বেশি দ্রুত পথ চলতে না পারায় দেরী হচ্ছিল টারজনের। প্রতিদিন রাত্রি হলেই পথের ধারে লতাপাতা ডালপালা দিয়ে একটা করে শিবির তৈরি করত।

একদিন টারজান শরাহত এক হরিণকে দেখে ছুটে গেল তার দিকে। মরা হরিণটার পাশে একটা পায়ের ছাপ দেখতে পেল টারজান। সেটা পরীক্ষা করে এঁকে দেখল ছাপটা কোন শ্বেতাঙ্গের পায়ের।

ওয়াজিরিরা তখন শিবিরে তার জন্য অপেক্ষা করছে ভেবে মরা হরিণটা কাঁধে করে শিবিরে ফিরে গেল টারজান। পরদিন সকালে আবার রওনা হলো ওরা ওপারের পথে। টারজান ওয়াজিরিদের এগিয়ে যেতে বলে অদৃশ্য শিকারীর পায়ের ছাপ অনুসরণ করে তার খোঁজ করতে লাগল।

পথে একদল বাঁদর-গোরিলার সঙ্গে দেখা হলো। তারা টারজানকে বলল, গতকাল তুমি আমাদের গোরিলা যুবক গোবুকে বধ করেছ। তুমি চলে যাও, তা না হলে আমরা তোমাকে হত্যা করব।

টারজান বলল, আমি তোমাদের গোবুকে হত্যা করিনি।

সে বুঝল যার পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছে সেই শ্বেতাঙ্গই হয়ত গোবুকে বধ করেছে। তাই ওরা ভুল করে শ্বেতাঙ্গ টারজানকে গোবুর হত্যাকারী ভাবছে।

ওপার নগরীর কথা আর তার মূল উদ্দেশ্যের কথা ভুলে গিয়ে সেই হত্যাকারী শ্বেতাঙ্গের খোঁজ করে যেতে লাগল। এইভাবে ওপারে নগরীর উপত্যকার একধারে পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে হাজির হলো টারজান। সেখানে গিয়ে কতকগুলো পায়ের ছাপ দেখতে পেল।

টারজান পরীক্ষা করে দেখল সে ছাপগুলো কতকগুলো কৃষ্ণকায় নিগ্রো আর কতকগুলো শ্বেতাঙ্গের। তাদের মধ্যে একজন নারীও আছে। দলটাকে ধরার জন্য এগিয়ে যেতে লাগল টারজান।

কিছুদূর গিয়ে একটা শিবির দেখতে পেল সে।

 টারজান বাংলো থেকে চলে গেলে কোরাকরা নির্বিঘ্নেই দিন কাটাচ্ছিল।

এইভাবে এক সপ্তাহ কেটে যাবার পর একদিন নাইরোবি থেকে এক পিওন একখানা টেলিগ্রাম নিয়ে এল। তাতে জানা গেল লন্ডনে জেনের বাবার দারুণ অসুখ; জেনকে সেখানে যেতে হবে। ঠিক হলো। জেন সেইদনই রওনা হবে লন্ডনের পথে। কোরাক তাকে নাইরোবিতে দিয়ে আসবে। সেখান থেকে সে লন্ডনগামী জাহাজে চাপবে।

কোরাক আর জেন দু’জনেই যখন বাড়িতে ছিল না তখন একদিন বাড়ির এক বিগ্রোভৃত্য জাদ-বাল জার খাঁচা পরিষ্কার করার সময় অসাবধাণতাবশত খাঁচার দরজাটা খোলা রেখেছিল। এই অবসরে জাদ বাল-জা বনে পালিয়ে যায়।

এদিকে সেই রাত্রিতে অচেনা বিদেশীদের খোঁজে এগিয়ে যেতে যেতে একটা অস্থায়ী শিবিরের সামনে এসে পড়ল টারজান। শিবিরের সামনে একটা গাছের উপর উঠে পাতার আড়াল থেকে শিবিরের লোকজনদের গতিবিধি লক্ষ্য করতে লাগল। দেখল শিবিরে মোট চারজন শ্বেতাঙ্গ পুরুষ আছে আর একটি ঘরে একজন মহিলা আছে বলে মনে হলো। শ্বেতাঙ্গ চারজনের মধ্যে দু’জন ইংরেজ, একজন জার্মান, একজন রুশদেশীয়।

টারজান দেখল শিবিরের কাছে একটা সিংহের গর্জন শুনে ব্লুবার নামে জার্মান লোকটা ভয়ে উলফটে পড়ে গেল।

এমন সময় টারজান গাছ থেকে নেমে শিবিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। শিবিরের সামনে যে আগুন জ্বলছিল তার আভায় টারজনের গোটা দৈত্যাকার চেহারাটা প্রকট হয়ে উঠল সকলের কাছে। একটা তাঁবুর ঘরের মধ্যে ফ্লোরা কার্লের সঙ্গে কথা বলছিল। সে ঘরের ভিতর থেকে টারজানকে দেখেই চিনতে পারল। দেখার সঙ্গে সঙ্গে ভয় পেয়ে গেল ফ্লোরা, কারণ সে টারজনের লন্ডনের বাড়িতে বেশ কিছুদিন কাজ করেছে এর আগে। তার কাছ থেকে ভাল ব্যবহারও পেয়েছে। টারজান আর জেনের মধ্যে ওপার নগরীর ধনরত্ন নিয়ে যে সব কথাবার্তা হত তা শুনেই উচ্চভিলাষ জাগে তার মনে। সে তখন একটা দলের। সঙ্গে ভিড়ে গিয়ে ওপার নগরীতে গিয়ে সেই ধনরত্ন লুণ্ঠন করে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করে।

ফ্লোরা গোপনে কার্লকে বলল, আমাদের পথে এখন একমাত্র বাধা হলো এই টারজান। ও যেন আমাদের আসল উদ্দেশ্যের কথা কখনই জানতে না পারে। আমিও ওকে দেখা দেব না। ওকে এখন হত্যা করাও যাবে না। কারণ ওর বিশ্বস্ত ওয়াজিরি আদিবাসীরা তাহলে আমাদের মেরে ফেলবে। তার থেকে এক কাপ কফির সঙ্গে কিছু বিষ মিশিয়ে ওকে অচেতন করে ফেলে রেখে আমাদের পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করো।

টারজান শিবিরের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের প্রশ্ন করল, কে তোমরা? আমার বিনা অনুমতিতে আমার বন রাজ্যে প্রবেশ করে কি করছ? আমি হচ্ছি এ বনের রাজা টারজান।

এস্তেবানের চেহারাটা অনেকটা টারজুনের মত দেখতে। সে তখন বাইরে কোথায় গিয়েছিল। তাই ওরা হঠাৎ টারজানকে দেখে ভাবল, এস্তেবান টারজান সেজে এসে ভয় দেখাচ্ছে তাদের। কিন্তু ফ্লোরার কথায় ভিতর থেকে কার্ল এসে সরাসরি টারজনের কথার উত্তরে বলল, আসুন আসুন, আমরা সত্যিই ভাগ্যবান যে আপনার দর্শন পেলাম এবং নিজে থেকে এসে দেখা দিলেন আপনি। আপনার নাম আমরা শুনেছি, কিন্তু দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আমরা পথ হারিয়ে কষ্ট পাচ্ছি এখানে। আপদি যদি পথটা আমাদের দেখিয়ে দেন ত ভাল হয়। এখন একটু দয়া করে বসুন, এক কাপ কফি খান।

এদিকে কফি তৈরি করার সময় টারজনের কফির কাপে ওষুধ ঢেলে দিল কার্ল, টারজনু তার কিছুই জানতে পারল না।

টারজান যখন শিবিরে কফি খাচ্ছিল, তখন ওপার নগরীর বাইরেকার পাঁচিলের সবচেয়ে উঁচু জায়গাটার উপর দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিল একটা লোক। লোকটা বেঁটে এবং বিকৃত ধরনের। তার মাথায় জটা আর মুখে দাড়ি ছিল। গায়ে ছিল বাঁদরদের মত লোম। তার চোখ দুটো ছিল ছোট ছোট, দাঁতগুলো বড় বড় আর পা দু’খানা বাঁকা বাঁকা।

মন্দিরের প্রধান পুরোহিত কাদিজ তখন মন্দিরের পাশে একটা পুরোনো গাছের তলায় বসেছিল। তার সঙ্গে ছিল বারোজন তার অধীনস্থ পুরোহিত।

পাহারাদার সোজা কাদিজের সামনে গিয়ে বলল, অচেনা একদল বিদেশী ওপার নগরীর দিকে উত্তর পশ্চিম দিক থেকে এগিয়ে আসছে।

তখন কাদিজ তার দলের পুরোহিতদের নিয়ে মন্দির সংলগ্ন বাগান থেকে নগর প্রাচীরের দিকে চলে গেল। পাঁচিলের উপর থেকে দেখল সত্যিই একদল লোক এগিয়ে আসছে। দলটা তখন অনেকটা এগিয়ে। এসেছে এবং তাদের স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।

একজন পুরোহিত প্রধান পুরোহিতকে বলল, সেই টার্মাঙ্গানী যে নিজেকে টারজান বলে পরিচয় দেয়। দলের বাকি সবাই কৃষ্ণকায় নিগ্রো।

কাদিজ বলল, তুমি ঠিক বলছ? টারজান আসছে?

অন্য একজন পুরোহিত বলল, হ্যাঁ, টারজানই বটে।

টারজানকে চিনতে পারার সঙ্গে সঙ্গে কাদিজ চীৎকার করে উঠল, ওকে ঢুকতে দিও না। ওকে ঢুকতে দিও না। যাও, এখনি একসোজন যোদ্ধা নিয়ে এস। ওদের সবাইকে মেরে ফেলব নগর প্রাচীরে ঢোকার আগেই।

একজন পুরোহিত বলল, কিন্তু কাদিজ, প্রধান পুরোহিত লা ত টারজানকে আসতে বলেছিল। কারণ টারজান তাকে হাতির কবল থেকে বাঁচিয়েছিল। ও তাই টারজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল।

কাদিজ তাকে ধমক দিয়ে বলল, চুপ করো। ওদের ওপারে ঢুকতে দেয়া হবে না। ওদের আমি হত্যা করব। যে আমার বিরুদ্ধে কোন কথা বলবে বা আমার উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দেবার কথা বলবে তাকে আমি। নিজের হাতে খুন করব।

এদিকে পাঁচিল পার হয়ে নগর সীমানার বাইরে টারজনের বা তার দলের কোন চিহ্ন দেখতে পেল না কাদিজ। তখন সকাল হয়ে গেছে। সে ক্রমাগত উপত্যকার উপর দিয়ে টারজনের সন্ধানে হেঁটে যেতে লাগল। এইভাবে অনেকটা দূর যাওয়ার পর ডালপালার এক পরিত্যক্ত শিবির দেখতে পেল কাদিজ।

শিবিরটা পরিত্যক্ত হলেও ভিতরটায় ঢুকে খোঁজ করতে লাগল কাদিজ। এক সময় তার এক যোদ্ধা টারজনের অচেতন দেহটাকে পড়ে থাকতে দেখে চীৎকার করে উঠল।

পুরোহিত ছুটে গিয়ে টারজনের বুকের উপর কান পেতে দেখে বলল, না মরেনি, বেঁচে আছে।

কাদিজ তখন বলল, ওর হাত পা বেঁধে ফেল। যে ব্যক্তি একদিন বেদী থেকে পালিয়ে এসে সূর্যদেবতার বেদীকে কলুষিত করেছে আজ তার উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য সূর্যদেবতাই তাকে তুলে দিয়েছেন আমাদের হাতে। ওকে টেনে রোদের আলোয় নিয়ে এস। সূর্যদেবতা চোখ মেলে তাকিয়ে ওকে দেখুন।

এই কথা বলে সে তার কোমর থেকে ছুরিটা খুলে সূর্যের দিকে মুখ তুলে টারজানকে বলি দেবার জন্য উদ্যত হলো।

পুরোহিতদের মধ্যে একজন কাদিজের এই কাজের প্রতিবাদ করে বলল, কাদিজ, তুমি বলি দেবার কে? এ কাজ হলো প্রধান পুরোহিত লা-এর। আমাদের রানী লা-ই একমাত্র সূর্যদেবতার কাছে কাউকে বলি দিতে পারে।

কাদিজ তাকে ধমক দিয়ে বলল, চুপ করো ডুথ। আমি হচ্ছি প্রধান পুরোহিত লা-এর স্বামী আমার কথাই হলো আইন। যদি বাঁচতে চাও ত আমার উপর কোন কথা বলবে না।

ডুথ রেগে গিয়ে বলল, তুমি যদি লা এবং সূর্যদেবতাকে রুষ্ট করে তোল তাহলে তোমাকেও অন্যদের মত শাস্তি পেতে হবে।

কাদিজ বলল, সূর্যদেবতা আমাকে বলেছে মন্দির অপবিত্র করার অপরাধে একে বলি দিতে হবে আমাকে।

এই বলে সে টারজনের পাশে নতজানু হয়ে বসে তার বুকটা লক্ষ্য করে ছুরিটা ধরল।

এমন সময় একটা বড় মেঘ এসে আকাশে মধ্যাহ্নের সূর্যটাকে ঢেকে দিল। কাঁদিজের মনে হঠাৎ সন্দেহ দেখা দিল। তবে কি সূর্যদেবতা তার এই কাজ সমর্থন করছেন না? তাই ভয় পেয়ে ছুরিটা। টারজনের বুকে বসাতে গিয়েও বসাল না। উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল! মেঘটা না কাটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগল। ভাবল আবার সূর্য দেখা দেবার সঙ্গে সঙ্গে সে বলির কাজটা সেরে ফেলবে।

কাদিজ যখন দেখল মেঘটা কেটে আসছে এবং মেঘের প্রান্ত থেকে সূর্য এখনি বেরিয়ে আসবে তখনি সে আবার বসে ছুরিটা উপরে তুলে ধরল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে নারীকণ্ঠে কে তার নাম ধরে ডাকল, কাদিজ।

মুখ ঘুরিয়ে কাদিজ দেখল, ওপারের প্রধান পুরোহিত লা তার পিছনে দাঁড়িয়ে তার পিছনে ডুথ আর বারো তেরোজন পুরোহিত তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

লা বলল, এর মানে কি কাদিজ?

কাদিজ বলল, সূর্যদেবতা এই নাস্তিক অধর্মাচারীর জীবন নিতে চাইছে।

লা ক্রুদ্ধভাবে বলল, মিথ্যা কথা। সূর্যদেবতার কিছু বলার থাকলে তা তাঁর প্রধান পুরোহিতের মাধ্যমেই বলবেন। মনে রাখবে অতীতে এই ধরনের ঔদ্ধত্যের জন্য অনেক প্রধান পুরোহিতকে মন্দিরের। বেদীতে বলি দেয়া হয়েছে।

কাদিজ এবার নীরবে খাপের মধ্যে ছুরিটা ঢুকিয়ে রেখে ডুথের দিকে একবার ক্রুদ্ধভাবে তাকিয়ে চলে গেল সেখান থেকে। সে বুঝল ডুথই ছুটে গিয়ে লাকে খবর দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে।

কিন্তু লা এবার মুস্কিলে পড়ল। সে তার পদাধিকারবলে কাদিজের হাত থেকে বাঁচাল টারজানকে কিন্তু অন্য সব পুরোহিতদের ইচ্ছা সে নিজের হাতে টারজানকে বলি দেয়। এর আগে সে টারজানকে বেদী থেকে দু-দু’বার ছেড়ে দিয়েছে।

অথচ টারজানকে সে কিছুতেই বলি দিতে পারবে না নিজের হাতে। এই টারজানই তাকে দু-দু’বার সাক্ষাৎ মৃত্যুর কবল থেকে উদ্ধার করে।

লা তার লোকদের হুকুম দিল, একটা পাল্কি এনে টারজানকে ওপারের মন্দিরে নিয়ে চল।

টারজনের যখন জ্ঞান ফিরল সে দেখল তখন রাত্রিকাল। একটা অন্ধকার ঘরে সে মেঝের উপর শুয়ে আছে। পরে সে হাত দিয়ে মেঝেটাকে পরীক্ষা করে ও গন্ধ শুঁকে বুঝল সে ওপারের মন্দিরের নিচের তলায় একটা ঘরে আছে।

এদিকে টারজান যে ঘরে ছিল সেই ঘরেরই উপরতলায় একটা ঘরে প্রধান পূজারিণী লা ছটফট করছিল তার বিছানায়। যে তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয়জন, যে তার একমাত্র ভালবাসার বস্তু তাকে নিজের হাতে কিভাবে বলি দেবে তা বুঝে উঠতে পারল না সে।

রাত্রি তখন গভীর। হঠাৎ একজন পূজারিণী এসে লাকে বলল, ডুথ আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।

ডুথকে ডেকে পাঠিয়ে তার কথা শুনতে চাইল না। ডুথ বলল, কাদিজ আপনার বিরুদ্ধে ওয়া নামে এক পূজারিণী ও কয়েকজন পুরোহিতের সঙ্গে চক্রান্ত করছে। ওরা চারদিকে চর পাঠিয়ে লক্ষ্য রাখছে আপনি টারজানকে মুক্তি দান করছেন কি না। আপনি কোনভাবে টারজানকে মুক্তি দিলেই ওরা আপনার জীবন নাশ করবে। তখন ওয়া প্রধান পূজারিণীর পদ পাবে এবং কাদিজের সঙ্গে তার বিয়ে হবে।

এদিকে একজন পুরোহিত কাদিজকে একটা পরামর্শ দিল। বলল, আমরা যাকে পাঠিয়েছিলাম লার কাছে তার কথা শোনেনি। এখন আমাদের একজন লোককে পাঠাও টারজনের কাছে। সে বলবে আমি লা’র কাছ থেকে আসছি। আমি তোমাকে তার নির্দেশমত ওপার নগরীর বাইরে দিয়ে আসব। সেখান থেকে তুমি তোমার গন্তব্যস্থলে চলে যাবে। তারপর টারজানকে নিয়ে লোকটা গুপ্ত পথে বেরিয়ে যেতে গেলেই আমাদের প্রহরীরা তাদের ধরে ফেলবে। তখন আমরা গোপনে হত্যা করব টারজানকে। তারপর লা’র বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলল লা-ই নিশ্চয় বন্দীকে ছেড়ে দিয়েছে এবং এটা সম্পূর্ণ অধর্মাচরণ। ফলে তাকেও বলি দেওয়া হবে।

কাদিজ বলল, তাহলে আগামী কাল সূর্য অস্ত যাবার আগেই ওরা প্রধান পূজারিণীর আসনে বসবে।

সে রাতে হঠাৎ কার স্পর্শে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল টারজনের। সে বুঝল কোন এক অদৃশ্য নারীর হাত তার দেহটাকে স্পর্শ করে তাকে ঘুম থেকে জাগাচ্ছে। সে জেগে উঠতেই নারীটি বলল, এখনি আমার সঙ্গে এস। তোমার জীবন বিপন্ন।

টারজান জিজ্ঞাসা করল, কে পাঠিয়েছে তোমায়?

 নারীকণ্ঠ উত্তর দিল, লা আমায় পাঠিয়েছে তোমাকে ওপার নগরীর বাইরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়ার জন্য।

আর কালবিলম্ব না করে সেই নারীর পিছু পিছু বেরিয়ে পড়ল টারজান। ওরা এগিয়ে চলল ওপার নগরীর পিছনের দিকের এক গোপন সুড়ঙ্গ পথ ধরে। সারারাত ওরা একটানা পথ চলার পর ভোরবেলায় নগরসীমানার শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছল।

এবার সেই নারীর দিকে তাকিয়ে টারজান আশ্চর্য হয়ে গেল। দেখল তার সামনে লা নিজে দাঁড়িয়ে আছে।

 টারজান বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলল, লা তুমি!

লা বলল, ওপারে ফিরে যাবার আর কোন পথ নেই আমার।

টারজান বলল, নগরসীমানা যেখানে শেষ হয়েছে তার পর থেকেই শুরু হয়েছে অন্তহীন এক বিরাট জঙ্গল। এ পথের কোথায় কি আছে তার ত কিছুই জান না তুমি। অথচ এ ছাড়া ত এখান থেকে বেরিয়ে যাবার অন্য পথ নেই আমাদের।

লা বলল, শুনেছি এই বনটাতে অনেক বড় বড় বাঁদর-গোরিলা আর সিংহ আছে। তুমি কি এই পথেই যাবে বলে মনে করছ?

টারজান বলল, মরতে ত একদিন হবেই। তবে বৃথা ভয় করে কি হবে বলতে পার। তার থেকে চল, এই বনের ভিতর দিয়েই এগিয়ে যাব আমরা। ‘

এই বলে লাকে কাঁধের উপর তুলে নিয়ে বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল টারজান। তারপর একটা গাছের উপর বাঁদরের মত উঠে পড়ে গাছে গাছেই এগিয়ে চলল। টারজনের গায়ের শক্তি দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল না।

গাছের উপর থেকে লা দেখল অদূরে বনের ধারে কতকগুলো কুঁড়ে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কুঁড়েগুলো অদ্ভুত ধরনের। কুঁড়েগুলো একই মাপের–অর্থাৎ সাত ফুট করে চওড়া আর ছয় ফুট করে উঁচু। কিন্তু কুঁড়েগুলো মাটির উপর ছিল না; এক একটা গাছের ডালের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় শূন্যে দোতলার মত ঝুলছিল মাটি থেকে ঠিক তিন ফুট উপরে। কুঁড়েগুলোর গায়ে কোন দরজা দেখা গেল না; তবে হাওয়া ও আলো ঢোকার জুন্য তিন-চার ইঞ্চির একটা করে ফাঁক ছিল।

সহসা সমস্ত বনভূমি কাঁপিয়ে গর্জন করতে করতে একটা গোরিলা এসে গাঁয়ের ফটকের সামনে দাঁড়াল।

বোলগানি বা গোরিলাটা গায়ের ভিতরে ঢুকেই একজন গ্রামবাসীকে বলল, তোমাদের মেয়ে ও শিশুরা কোথায়? ডাক তাদের নিয়ে এসো তাদের এখানে।

একজন গ্রামবাসী সাহস করে কোনরকমে ক্ষীণ প্রতিবাদের সুরে বলল, কিন্তু আমরা ত একপক্ষকালের মধ্যেই একজন নারীকে তোমার হাতে তুলে দিয়েছ। এখন অন্য গাঁয়ের পালা।

কিন্তু বোলগানি এ কৃথায় রেগে গিয়ে বলল, থাম, থাম। আমাদের সম্রাট নুমার নামে দাবি জানাচ্ছি। আমার হুকুম তামিল করো অথবা মরো।

আর কোন কথা না বাড়িয়ে গ্রামবাসীরা নারী ও শিশুদের ডাকতে লাগল। কিন্তু কুঁড়ে থেকে কেউ বার হলো না। অবশেষে গায়ের যোদ্ধারা গুপ্তস্থান থেকে মেয়েদের ধরে নিয়ে এল। মেয়েরা ভয়ে কাঁপতে লাগল।

একজন গ্রামবাসী বলল, হে মহান বোলগানি, তোমাদের সম্রাট নুমা যদি শুধু আমাদের গা থেকেই মেয়ে ধরে নিয়ে যায় তাহলে কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের গায়ে যোদ্ধাদের জন্য আর কোন মেয়ে থাকবে না। তার ফলে শিশুও উৎপন্ন হবে না।

গোরিলাটা বলল, তাতে কি হয়েছে। সারা জগতে অনেক গোমাঙ্গানী বা কৃষ্ণকায় লোক বেড়ে গেছে। তোমাদের কাজই ত হলো আমাদের সম্রাট নুমার সেবা করা।

এই কথা বলতে বলতে গোরিলাটা মেয়েগুলোর গায়ে আঙ্গুল দিয়ে টিপে টিপে কি দেখতে লাগল। অবশেষে সে একটি মেয়েকে বাছাই করল। মেয়েটার কোমরে একটা শিশু বাঁধা ছিল।

গোরিলাটা বলল, আজ এই মেয়েটা হলেই চলবে।

এই বলে সে মেয়েটার কোল থেকে ছেলেটাকে টান মেরে নিয়ে মাটির উপর ছুঁড়ে ফেলে দিল। যুবতী মেয়েটি তখন তার ছেলেটাকে মাটি থেকে কুড়োতে গেলে গোরিলাটা তার লম্বা দুটো হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল মেয়েটাকে। আর এমন সময় গাঁয়ের ধারে একটা গাছের উপর এক বাঁদর-গোরিলার মত কে ভয়ঙ্করভাবে গর্জন করে যুদ্ধে আহ্বান জানাল গোরিলাটাকে।

সঙ্গে সঙ্গে গোরিলাটা তার ভয়ঙ্কর মুখ তুলে তাকাল পিছন ফিরে। গ্রামবাসীরাও ভয় পেয়ে গেল। তারা দেখল এক দৈত্যাকার শ্বেতাঙ্গ গাছ থেকে নেমে এগিয়ে আসছে। সহসা সে চোখের নিমেষে তার হাতের বিরাট বর্শাটা সজোরে ছুঁড়ে গোরিলাটার বুকটাকে বিদ্ধ কল। গোরিলাটা তৎক্ষণাৎ পড়ে গিয়েই মারা গেল।

টারজানকে শত্রু ভেবে গ্রামবাসীরা তাদের বর্শা উঁচিয়ে ধরল। টারজান গোরিলাটার বুক থেকে বর্শটা তুলে নিয়ে বলল, আমি তোমাদের বন্ধু, বর্শা নামাও। কে এই গোরিলা যে তোমাদের গা থেকে এইভাবে নারী ও শিশুদের ধরে নিয়ে যায় অথচ তোমরা কোন ব্যবস্থা নিতে পার না তার বিরুদ্ধে?

গ্রামবাসীদের একজন বলল, ও একটা গোরিলা, নুমার প্রেরিত পুরুষ।

টারজান কৌতূহলী হয়ে বলল, কিন্তু নুমা কে?

গ্রামবাসীরা বলল, নুমা হচ্ছে সম্রাট যে বোলগানিদের সঙ্গে হীরের প্রাসাদে থাকে। সে হচ্ছে রাজার রাজা।

গোরিলাটা টারজনের বর্শার আঘাতে মরে গেলে সেই যুবতী মেয়েটি তার ছৈলেকে কুড়িয়ে নিয়ে দেখল ছেলেটা বেঁচে আছে, তার গায়ে শুধু একটা আঘাত লেগেছে। সে যখন দেখল টারজান তার কোন ক্ষতি করতে চাইছে না, তখন সে আশ্বস্ত হলো।

অবশেষে গ্রামবাসীরা বলল, আমরা তোমাকে বধ করব না, তোমার কোন ক্ষতি করব না। আমরা শুধু তোমাকে আমাদের সম্রাট নুমার কাছে নিয়ে যাব।

টারজান বলল, তাহলে তারা ত আমায় খুন করবে।

গ্রামবাসীরা বলল, তাহলে আমরা কিছু করতে পারব না।

টারজান বলল, কিন্তু তারা জানবে কি করে যে এই বোলগানিটা তোমাদের গাঁয়ে মরেছে? আমি যদি মৃতদেহটা নিয়ে গিয়ে দূর জঙ্গলে ফেলে দিই তাহলে তারা এটা দেখতে পাবে না।

গ্রামবাসীরা বলল, সেটা হতে পারে।

টারজান বলল, আমি বিদেশী। পথ হারিয়ে ফেলেছি। তোমরা আমাকে এই উপত্যকা থেকে বার হবার পথটা দেখিয়ে দেবে যাতে আমি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যেতে পারি। ও পথে কি আছে তা জান তোমরা?

গ্রামবাসীরা বলল, না, তা ত জানি না, শুধু জানি ঐ পথ দিয়ে বোলগানিরা আমাদের গাঁয়ে আসে।

টারজান বুঝতে পারল এর বেশি খবরাখবর তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। সে বলল, আমার একটা কথা শোন। আমার একজন সাথী আছে। আমি তাকে তোমাদের কাছে রেখে ঐ পথে গিয়ে কিছুটা দেখে আসব। আমি কোন্ পথে কোন্ দিকে যাব তা ঠিক করতে পারব তাহলে। আমি না আসা পর্যন্ত আমার সাথী তোমাদের এই গাঁয়েই থাকবে। দেখবে যেন কোন ক্ষতি না হয় তার।

গ্রামবাসীরা বলল, তোমার সাথী কোথায়?

টারজান বলল, তার জন্য একটা কুঁড়ে ঠিক করে দাও। তাকে আনছি।

এই বলে টারজান যে গাছের উপর লাকে রেখে এসেছিল সেই গাছে গিয়ে লাকে ডেকে নিয়ে এল।

লাকে কথাটা বুঝিয়ে বলল,টারজান।

তারপর টারজান গোরিলার মৃতদেহটা অবলীলাক্রমে কাঁধের উপর চাপিয়ে নিয়ে গায়ের ফটক পার হয়ে বনের মধ্যে চলে গেল। কিভাবে টারজান গোরিলার বিরাট ও এত বড় ভারী দেহটা কাঁধের উপর এমন অনায়াসে তুলে নিল তা দেখে অবাক হয়ে গেল গ্রামবাসীরা।

টারজান চলে গেলে লা গ্রামবাসীদের বলল, আমার থাকার জন্য একটা কুঁড়ে ঠিক করে দাও।

ওপারের উত্তর-পূর্ব দিকে বনের ধারে একটা শিরিরে তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে সবেমাত্র। সেখানে ছয়জন শ্বেতাঙ্গ আর একজন নিগ্রোভৃত্য তখন রাতের খাবার খাচ্ছিল। শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে একজন মেয়ে ছিল, তার নাম ফ্লোরা।

ফ্লোরা বলল, আমাদের দলের মধ্যে এ্যাডলফ ব্লুবার আর এস্তেবান অপদার্থ। ব্লুবার কুঁড়ে আর কৃপণ আর এস্তেবানের শুধু বড় বড় কথা আছে।

তাছাড়া ব্লুবার টাকার ভয়ে বেশি কুলি নিয়োগ করতে চায়নি। পঞ্চাশজন লোক আশি পাউন্ড ওজনের সোনার তালগুলো বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাকি কিছু কুলি শিবিরের জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর বাড়তি কুলি একটাও নেই। এরা সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

পরদিন সকালে ওরা একসঙ্গে শিকারে বার হলো। শিকার করতে গিয়ে এস্তেবান দল থেকে অনেকটা দূরে সরে পড়েছিল একা একা।

হঠাৎ পঞ্চাশজন ওয়াজিরির একটা দল এস্তেবানকে ঘিরে ধরল। তাদের সর্দার ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বলল, ও বাওয়ানা, ও বাওয়ানা, তুমিই ব্রাদরদলের টারজান। বনের রাজা। তোমাকে হারিয়ে আমরা কত খুঁজেছি তোমায়। আমরা ভাবলাম তুমি একাই ওপারে গেছ। আমরা তাই সমস্ত বিপদের ঝুঁকি নিয়ে ওপারে যাচ্ছিলাম।

এস্তেবান প্রথমে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিল পরমুহূর্তে। তার মাথায় একটা কুবুদ্ধি খেলে গেল। সে নিজের পরিচয় গোপন রেখে নিজেকে টারজান বলে স্বীকার করে নিল। তাকে দেখতে অনেকটা টারজনের মত। এ জন্য সে নিজেও টারজনের মত বেশভূষা ধারণ করত।

ওয়াজিরি সর্দারের নাম উসুলা। এস্তেবান জানত এখন তাদের শিবিরে দুই চারজন নিগ্রোভৃত্য ছাড়া আর কেউ নেই। এই অবসরে সোনাগুলো নিয়ে পালিয়ে আসতে হবে।

শিবিরের কাছে গিয়ে এস্তেবান ওয়াজিরিদের বলল, শিবিরটাকে ঘেরাও করে ফেল।

এরপর এস্তেবান শিবিরের সামনে একা গিয়ে নিগ্রোভৃত্যদের বলল, আমি হচ্ছি টারজান। তোমাদের শিবির আমার লোকেরা ঘিরে ফেলেছে। কোন শব্দ করবে না বা গুলি ছোঁড়ার চেষ্টা করবে না।

এস্তেবান এবার হাত দিয়ে উসুলাকে আসার জন্য ইশারা করল। উসুলা এসে শিবিরের নিগ্রোভৃত্যদের বলল, আমরা হচ্ছি ওয়াজিরি যোদ্ধা, টারজান হচ্ছে আমাদের মালিক। আমরা তোমাদের এই চুরি করা সোনাগুলো উদ্ধার করতে এসেছি। আমরা তোমাদের কিছু করব না যদি তোমরা শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের এই দেশ ছেড়ে চলে যাও।

এস্তেবান নিগ্রোভৃত্যদের বলল, তোমরা চলে যাও, তোমাদের মালিকদের বলবে, দয়া করে টারজান তোমাদের জীবন ভিক্ষা দিয়েছে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওয়াজিরিরা সব সোনার তালগুলো শিবির থেকে বয়ে নিয়ে গেল।

এদিকে শিকার শেষে ফ্লোরারা বিশিরের দিকে এগিয়ে এলেই যেসব নিগ্রোভৃত্যরা শিবিরে পাহারারত ছিল তারা ফ্লোরাকে বলল, টারজান এসেছিল তার ওয়াজিরি যোদ্ধাদের নিয়ে। তারা সব সোনা নিয়ে গেছে।

ব্লুবার বলল, আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেল।

দূর থেকে টারজান প্রাসাদের মত যে একটা বাড়ি দেখেছিল সেই বাড়িটা লক্ষ্য করে বনের ভিতর দিয়ে যেতে লাগল।

কাছে গিয়ে গাছের আড়াল থেকে টারজান দেখল বাড়িটা সত্যিই প্রাসাদের মত আর চারদিকে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বাড়ির সীমানার মধ্যে কতকগুলো গোরিলা ঘোরাফেরা করছে। কিছু নিগ্রো নগ্নদেহ ক্রীতদাসও কাজ করছে। টারজান এক সময় সবার অলক্ষ্যে বাড়ির ফটকের সামনে গোরিলার মৃতদেহটা নামিয়ে দিয়ে এল।

দীর্ঘ সময় গাছের উপর উপেক্ষা করেও টারজান যখন বাড়ির ভিতরে ঢোকার কোন সুযোগ বা অবকাশ পেল না তখন লা-কে যে গাঁয়ে রেখে এসেছিল সেই গাঁয়ে ফিরে গেল। কিন্তু গাঁয়ে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেল। দেখল গাঁয়ের মধ্যে একটা লোকও নেই। টারজান সারা গাঁটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াল। কিন্তু কোথায় একটা লোককেও দেখতে পেল না।

হঠাৎ দেখল একটা কুঁড়ের পাশে একরাশ কাঠের আড়ালে লুকিয়ে আছে একটা মেয়ে। টারজান তাকে অনেকবার ডাকলেও ভয়ে সে এল না। অবশেষে টারজান তার হাত ধরে টেনে তাকে বার করে নিয়ে এসে বলল, আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না, বল, গাঁয়ের লোকেরা আর আমার সাথী কোথায় গেল?

মধ্যবয়সী আদিবাসী মেয়েটি বলল, বোলগানিরা সেই মৃতদেহটা দেখতে পায়। তারা তখন দলবেঁধে এসে গাঁয়ের সব লোককে ধরে নিয়ে গেছে। তোমার সাথীকেও নিয়ে গেছে।

টারজান বলল, তোমার কি মনে হয় ওরা এই গাঁয়ের সবাইকে হত্যা করবে?

মেয়েটি বলল, হ্যাঁ। ওরা কাউকে ক্ষমা করে না। আমি লুকিয়েছিলাম বলে আমাকে দেখতে পায়নি।

টারজান আবার সেই বোলগানিদের বাড়িটার কাছে ফিরে গেল। সে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। সে দেখল প্রাসাদের একটা ঘণ্টা বাজতেই সমস্ত আদিবাসী ভৃত্যরা কাজ থামিয়ে উঠোনে এসে সারবন্দীভাবে দাঁড়াল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব গোরিলারা শোভাযাত্রা সহকারে সোনার শিকল গলায় একটা সিংহকে ধরে নিয়ে এল উঠোনে। সিংহটা যে পথে আসছিল সেই পথের দু’ধারে অনেকে জোড়হাত করে পঁড়িয়েছিল। সম্ভ্রমে মাথা নত করছিল সবাই। সিংহটা এসে নিগ্রোভৃত্যদের গাগুলো একবার এঁকে এঁকে চলে যেতে লাগল। নিগ্রোগুলো ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

রাত্রি হওয়ার পর এক সময় দেখল সকলেই শুতে চলে গেল। কোথাও কোন পাহারাদার নেই। রাত্রি গম্ভীর হলে টারজান তার কাছে যে দড়ি ছিল তার সাহায্যে গেটের উপর দিয়ে প্রাসাদের ভিতর দিকে গিয়ে পড়ল। গোটা প্রাসাদটাকে সে খুঁজে বেড়াল। কয়েকটা ঘর খোলা দেখল। সেখানে দু’একটা গোরিলা ঘুমোচ্ছে। কিন্তু লা-এর কোন খোঁজ পেল না।

সহসা টারজনের মনে হলো তার পিছনে একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে। পিছনে ফিরেই সে দেখল একজন নগ্ন শ্বেতাঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে।

টারজান সেই হীরের প্রাসাদে রাতের অন্ধকারে একজন নগ্ন শ্বেতাঙ্গকে দেখতে পেয়ে তার খাপ থেকে ছুরি বার করতে যাচ্ছিল। কিন্তু সে লোকটা ছিল নিরস্ত্র; তার উপর তার মুখের হাবভাব দেখে টারজান সামলে নিল নিজেকে। লোকটার মুখে সাদা দাড়ি ছিল। তার গায়ে কিছু সোনা ও হীরের গয়না ছাড়া গোটা গাটাই ছিল নগ্ন।

টারজান দেখল লোকটা ইংরেজি ভাষা জানে। তবু বাঁদর-গোরিলাদের ভাষায় টারজান তাকে প্রশ্ন করল, কে তুমি? কি চাও?

বৃদ্ধ বলল, আমি কিশোর বয়স থেকে এখানে আছি। আমি ইংল্যান্ড থেকে একটা জাহাজে করে স্ট্যানলির সঙ্গে পালিয়ে আসি। আমি আফ্রিকার জঙ্গলের গভীরে একটা শিবিরের কাছে থাকতাম। একদিন তার সঙ্গে শিকার করতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলি। ঘুরতে ঘুরতে একদল আদিবাস আমায় ধরে তাদের গায়ে নিয়ে যায়। সেখান থেকে পালিয়ে এসে আমি উপকূলে যাবার পথে এদিকে চলে আসি পথ না জানায়। তখন এই গোরিলারা আমায় ধরে আটকে রাখে এখানে। সেই থেকে আমি বন্দী আছি এখানে। দেশে ফিরে যাবার কথা আজও ভাবি আমি। কিন্তু কোন উপায় নেই।

টারজান বলল, এখান থেকে বেরিয়ে যাবার কোন পথ নেই?

বৃদ্ধ বলল, এখান থেকে বাইরের উপত্যকা পর্যন্ত একটা সুড়ঙ্গ পথ আছে। কিন্তু সেখানে আছে কড়া পাহারা।

টারজান বলল, এ রাজ্যে কত নিগ্রো আদিবাসী আর কত গোরিলা আছে?

 বৃদ্ধ বলল, এ রাজ্যে প্রায় পাঁচ হাজার আদিবাসী আর একহাজার থেকে এগারোশো গোরিলা আছে।

টারজান আশ্চর্য হয়ে বলল, কিন্তু সংখ্যা এত বেশি থাকা সত্ত্বেও আদিবাসীরা ওদের কবল থেকে মুক্ত করতে পারে না কেন নিজেদের?

বৃদ্ধ বলল, বোলগানিদের তুমি চেন না। ওরা ভীষণ বুদ্ধিমান। আদিবাসীদের অত বুদ্ধি নেই।

টারজান বলল, বড় মজার ব্যাপার। কিন্তু যে সুন্দরী মেয়েটিকে ওরা ধরে এনেছে সে এখানে কোথায় আছে?

বৃদ্ধ বলল, আমি বলে দিতে পারি কোথায় আছে সে, কিন্তু তাকে তুমি উদ্ধার করতে পারবে না।

 টারজান বলল, তবু তুমি দেখিয়ে দাও।

বৃদ্ধ তাকে এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে বলল, ঐ বাড়িটার কোন না কোন ঘরে তাকে রাখা হয়েছে। তাছাড়া তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পার। আমি যতটা পারি সাহায্য করব। কারণ আমি গোরিলাদের ঘৃণা করি।

টারজান চলে গেল সেখান থেকে। সে বড় বাড়িটার মধ্যে গিয়ে এক একটা ঘরে ঢুকে তাকে খুঁজতে লাগল। একটা ঘরে কৃষ্ণকায়; এক আদিবাসী নিগ্রোকে দেখতে পেল টারজান। লোকটার চেহারাটা দৈত্যের মত।

নিগ্রোভৃত্যটি টারজানকে বলল, কি চাও তুমি? তুমি কি সেই মহিলাকে খুঁজছ যাকে ধরে আনা হয়েছে?

টারজান বলল, হ্যাঁ। তুমি জান কোথায় সে আছে?

 নিগ্রোভৃত্য বলল, হ্যাঁ, আমি তোমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারি।

 টারজান বলল, তুমি কেন আমার এ উপকার করবে?

নিগ্রো বলল, ওরা আমাকে তোমাকে একটা ঘরে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে বলেছে। সে ঘরে তুমি ও আমি ঢুকলেই দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। আমরা দুজনেই বন্দী হয়ে থাকব চিরকাল। তুমি যদি সেখানে আমাকে হত্যা করো তাহলে, ওরা তা গ্রাহ্য করবে না।

টারজান বলল, তুমি যদি আমাকে ফাঁদে ফেলে বন্দী করো তাহলে তোমাকে হত্যা করব আমি। কিন্তু যদি তুমি সেই বন্দিনী মহিলার ঘরে আমাকে নিয়ে যাও তাহলে তোমাকে মুক্তি দেব।

নিগ্রো বলল, কিন্তু এখান থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয় মোটেই।

ওরা দু’জনে সেই বড় বাড়িটার একটা বড় হলঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজাটা বন্ধ ছিল। নিগ্রোভৃত্যটি বলল, এই ঘরে তোমার সাথী আছে।

নিগ্রোটি হাত দিয়ে চাপ দিতেই দরজাটা খুলে গেল। টারজান নিগ্রোটার হাতটা ধরে রইল যাতে সে পালিয়ে যেতে না পারে। সে দেখল একটা বিরাট হলঘরের একপ্রান্তে একটা উঁচু মঞ্চের উপর কালো কেশওয়ালা এক বিরাটকায় সিংহ বসে আছে। তার গলায় একটা সোনার শিকল লাগানো আছে এবং সেই শিকলটা দু’দিকে দু’জন করে বসে থাকা নিগ্রো ক্রীতদাস ধরে আছে। সিংহটার পিছনে একটা সোনার বড় সিংহাসনে তিনজন গোরিলা বসেছিল। তাদের গায়ে অনেক সোনার আর হীরের গয়না ছিল। সেই ঘরটার নিচে এক জায়গায় দাঁড়িয়েছিল লা। তার দুদিকে দু’জন নিগ্রো প্রহরী ছিল।

টারজান বুঝল, এই সিংহটাকে ওরা সম্রাট নুমা বলে। সম্রাট নুমার নামে গোরিলারা রাজ্য শাসন করে। মঞ্চটার নিচে দুদিকে পাতা দুটো বেঞ্চিতে পঞ্চাশজন গোরিলা বসেছিল। তারা ছিল এক একজন সামন্ত।

টারজান এক সময় ঘরটার বাইরে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে সেই নিগ্রোভৃত্যটিকে বলল, এই ঘরের মধ্যে যে সব নিগ্রো ক্রীতদাস রয়েছে তারা সবাই গোরিলাদের কবল থেকে চিরদিনের মত মুক্তি পেতে চায়। ত? ওদের সঙ্গে ওদের ভাষায় কথা বলে দেখ। বল, আমার সঙ্গে ওরা যদি গোরিলাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাহলে আমি ওদের মুক্তি দৈব।

নিগ্রোটি বলল, কিন্তু তোমাকে বিশ্বাস করবে না তারা।

টারজান বলল, ওদের বল, আমাকে সাহায্য না করলে ওদের মরতে হবে।

এমন সময় সিংহাসন থেকে একজন গোরিলা গম্ভীরভাবে বক্তৃতার ভঙ্গিতে বলতে লাগল, হে রাজা নুমার সামন্তগণ, নুমা বন্দিনীর সব কথা শুনেছেন। তার ইচ্ছা বন্দিনী মৃত্যুদণ্ড লাভ করুক। সম্রাট নিজে। এখন ক্ষুধার্ত। তাই নিজে বন্দিনীকে অর সামন্তদের ও ঊর্ধ্বতন রাজ পরিষদের তিনজন সদস্যের উপস্থিতিতে ভক্ষণ করবেন। আগামী দিন এই বন্দিনী মহিলার সাথীকে বিচারের জন্য সম্রাট নুমার সামনে। আনা হবে।

অবশেষে সে নুমার সামনে লাকে নিয়ে আসার জন্য হুকুম দিল।

এই সময় অশান্ত হয়ে উঠল নুমা। সে তার মুখ বার করে গর্জন করতে লাগল। নিগ্রো ক্রীতদাসরা যখন লাকে জোর করে নুমা বা সেই সিংহ সম্রাটের মুখের কাছে জোর করে ঠেলে দিতে উদ্যত হলো তখন টারজান তার হাতের বর্শাটা সিংহের বুকটা লক্ষ্য করে সজোরে ছুঁড়ে দিল।

বর্শাটা সিংহটার বুকটা বিদ্ধ করায় লুটিয়ে পড়ল সিংহটা।

এদিকে টারজনের বাড়ি থেকে ছাড়া পাওয়া পোষা সিংহ জাদ-বাল-জা তার প্রভুর খোঁজে বহু বনপথ পার হয়ে প্যালেস অফ ডায়মন্ড বা হীরের প্রাসাদ-সংলগ্ন এক উপত্যকায় এসে পড়ে। সে বাতাসে গন্ধ এঁকে এঁকে এই প্রাসাদে এসে পড়ে। কিন্তু তখনো সে টারজান যেখানে ছিল সেখানে আসতে পারেনি।

 সম্রাট নুমা টারজনের বর্শার আঘাতে লুটিয়ে পড়লে টারজনের সঙ্গী সেই নিগ্রাভৃত্যটি ঘরের সব নিগ্রো ক্রীতদাসদের বলতে লাগল, তোমরা যদি মুক্তি পেতে চাও তাহলে এই বিদেশীকে সাহায্য করো। বোলগানিদের সব হত্যা করো।

নিগ্রোরা তখন একযোগে সিংহাসনে বসে থাকা সেই তিনজন গোরিলাকে লক্ষ্য করে বর্শা ছুঁড়তে লাগল। টারজান এবার মঞ্চের উপর উঠে গিয়ে মরা সিংহের বুকটা থেকে তার গেঁথে যাওয়া বর্শাটা তুলে নিয়ে ঘরে অন্য সব গোরিলা ছিল তাদের প্রতি আক্রমণ চালাতে লাগল। প্রথমে সে সামনের দিকে যে পঞ্চাশজন সামন্ত গোরিলা ছিল তাদের সম্বোধন করে বলল, থাম তোমরা, আগে আমার কথা শোন। আমি হচ্ছি বাঁদরদলের টারজান। আমি তোমাদের সঙ্গে কোন ঝগড়া বিবাদ করতে চাই না। আমি শুধু তোমাদের দেশ থেকে বাইরে যাবার একটা পথ খুঁজে পেতে চাই। আমাকে শুধু এই মহিলার সঙ্গে শান্তিতে চলে যেতে দাও এখান থেকে।

টারজনের কথা শুনে গোরিলাগুলো গর্জন করতে করতে কি সব বলাবলি করছিল নিজেদের মধ্যে। এমন সময় তাদের মধ্যে সেই বৃদ্ধ শ্বেতাঙ্গ ইংরেজকে দেখে রাগ হয়ে গেল টারজনের। সে তাকে চীৎকার করে বলল, শয়তান বিশ্বাসঘাতক কোথাকার। তুই এখানে এসে এদের আমার কথা বলে দিয়েছিস তাই এরা একজন নিগ্রোভৃত্যকে আমাকে ফাঁদে ফেলার জন্য পাঠিয়েছিল।

বৃদ্ধ বলল, না, আমি এই বন্দিনী মহিলার কি হয় তা দেখার জন্যই এখানে এসেছিলাম, তোমাকে ধরাতে আসিনি।

টারজান বলল, ঠিক আছে, তুমি তাহলে এখন আমার দলে চলে এসো। তোমার আনুগত্যের পরিচয় দাও আমার প্রতি। সারাজীবন দাসত্ব করার থেকে মৃত্যু অনেক ভাল।

নিগ্রো ক্রীতদাসরা সংখ্যায় ছিল মোট সাতজন। তারা সবাই টারজনের দলে এসে বর্শা,খড় আর কুড়াল নিয়ে লড়াই করতে লাগল।

বৃদ্ধ শ্বেতাঙ্গকে নিয়ে ওরা ছিল সংখ্যায় মাত্র নয় জন; কিন্তু গোরিলাদের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ। প্রথম দিকে গোরিলারা হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেও তারা এতক্ষণে নিজেদের সামলে নিয়ে একযোগে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।

এমন সময় দরজার সামনে একটা সিংহের গর্জন শুনে চমকে উঠল সবাই। টারজান দেখল জাদ বাল-জা কোথা থেকে এসে ঘরে ঢুকেছে। সে সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে চীৎকার করে ডাকল, জাদ-বাল-জা, মার বোলগানিদের।

সে আঙ্গুল দিয়ে গোরিলাদের দেখিয়ে দিল। জাদ-বাল-জার আক্রমণে কয়েকজন গোরিলা মারা গেল। আর বাকি কয়েকজন পালিয়ে গেল ঘর থেকে। টারজান তখন জাদ-বাল-জাকে মঞ্চের উপর নিয়ে গিয়ে বসিয়ে নিগ্রোদের বলল, এই হচ্ছে আসল সম্রাট তোমাদের।

লা বলল, চল, আমরা এখনি পালিয়ে যাই।

বৃদ্ধ বলল, যে সব গোরিলারা চলে গেছে তারা আবার দলবল নিয়ে আসবে। ওরা সহজে ছেড়ে দেবে না। ঐ দেখ প্রাসাদসংলগ্ন বাগানে কত গোরিলা রয়েছে।

এই সময় এক বিরাট গোরিলাকে বারান্দা দিয়ে সেই হল ঘরটায় ঢুকতে দেখেই টারজান জাদ-বাল জাকে ছেড়ে দিল। জাদ-বাল-জা এক লাফে গিয়ে আবার কয়েকজন গোরিলার গলা কামড়ে কেটে দিল। ফলে আর কোন গোরিলা ঘরের মধ্য ঢুকার চেষ্টা করল না। যে সব গেরিলারা ঘরের মধ্যে ঢুকে লড়াই করতে এসেছিল তাদের মধ্যে থেকে পনেরজন গোরিলাকে বন্দী করে পাশের একটা ঘরে বন্দী করে রাখল। টারজান।

এমন সময় উপর থেকে জ্বলন্ত কি একটা জিনিস পড়তেই লা টারজানকে দেখাল সেটা। টারজান দেখল ঘরের উপর ছাদের নিচে ব্যার্লকনির মত যে সব জায়গা ছিল তাতে কোথা থেকে অনেক গোরিলা এসে বসে আছে আর তেলেভেজানো কাপড়ে আগুন লাগিয়ে নিচে ফেলছে।

ইতোমধ্যে টারজান তিনজন নিগ্রোকে তাদের গাঁয়ের বস্তিতে পাঠিয়ে দিয়েছে যাতে তারা গ্রামবাসীদের সংগঠিত কৃরে নিয়ে আসতে পারে।

গোরিলারা উপর থেকে ক্রমাগত তেলভেজানো জ্বলন্ত কাপড়ের টুকরো ফেলতে থাকায় সমস্ত হলঘরটা ধোঁয়ায় ভরে গেল। এতে লা বলল, আর থাকতে পারছি না, এখান থেকে পালিয়ে চল।

বৃদ্ধ শ্বেতাঙ্গ বলল, ধোঁয়াটা আর একটু গম্ভীর হলে আমরা এক গোপন পথ দিয়ে চলে যাব। তাহলে গোরিলারা আর আমাদের দেখতে পাবে না।

টারজান বলল, সে পথে কোথায় নিয়ে যাবে আমাদের?

 বৃদ্ধ বলল, এই প্রাসাদের বাইরে উপত্যকায়।

ক্রমে সত্যিই ধোয়াটা আরো ঘন হয়ে উঠল। বৃদ্ধ তখন মঞ্চের পিছন দিক দিয়ে একটা পথ দিয়ে ওদের নিয়ে যেতে লাগল। টারজান, লা, জাদ-বাল-জা আর সেই নিগ্রোভূত্যটি বৃদ্ধের পিছু পিছু যেতে লাগল। বৃদ্ধ সিঁড়ি দিয়ে নেমে একটা সুড়ঙ্গপথ ধরল কতকগুলো অন্ধকার বারান্দা পার হয়ে।

বৃদ্ধ তাদের একটি বড় ঘরে নিয়ে গিয়ে টারজানকে ঘরের তাকের দিকে দেখতে বলল। টারজান : দেখল ঘরের চারদিকে তাকের উপর অনেক চামড়ার প্যাকেটে মোড়া কি সব জিনিস ভরা আছে। বৃদ্ধ। একটা প্যাকেট টেনে নিয়ে সেটা খুলে টারজানকে দেখাল। ওরা দেখল প্যাক্রেটটা হীরেয় ভর্তি। বৃদ্ধ একটা বাতি জ্বালাল অন্ধকারে।

বৃদ্ধ বলল, এক একটা প্যাকেটে পাঁচ পাউন্ড করে হীরে আছে।

 এরপর সে টারজনের হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বলল, এটা নিয়ে যাও।

সেই ঘর থেকে বেরিয়ে ওরা আবার অন্ধকারে সুড়ঙ্গপথ ধরল। পথে এক জায়গায় আর আকটা রুদ্ধদ্বার ঘর পেল ওরা। দরজাটায় বৃদ্ধ চাপ দিতেই দরজাটা খুলে গেল। সেই ঘরের পিছনের দিকের দরজাটা খুলে ওরা প্রাসাদের বাইরে চলে গেল। ওরা প্রাসাদের পূর্বদিকের ফটকের বাইরে চলে এল। বৃদ্ধ বলল, চল আমরা জঙ্গলের দিকে চলে যাই।

টারজান বলল, দাঁড়াও, নিগ্রোরা আসুক। ওরা এখনি এসে পড়বে।

দরবার ঘরে গোরিলারা ধোয়া কমে গেলে যখন জানতে পারল বিদেশীরা পালিয়েছে তখন তারা প্রাসাদের সব গোরিলাদের জড়ো করে প্রাসাদের সব গেটগুলোতে খোঁজ করতে লাগল।

হঠাৎ টারজান বলল, ঐ দেখ, গোরিলারা দলবেঁধে আমাদের দিকে আসছে। না, তুমি পালাও ওপারের পথ। আমি পরে যাব। নিগ্রোরা আসুক।

লা বলল, তুমি আমার জন্য যা করেছ তা আমি কখনো ভুলব না। আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাধ না। অতে মরতে হয় মরব।

এমন সময় সেই নিগ্লোভৃত্যটি ওদের দেখাল, ঐ দেখ, ওরা এসে গেছে।

টারজান দেখল সত্যিই পিছনের বন থেকে হাজার হাজার নিগ্রো আদিবাসী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ডায়মন্ড প্রাসাদের দিকে আসছে। টারজান তাদের গোরিলাদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে লাগল। ওদের মেরে ফেল। ওরা তোমাদের যুগ যুগ ধরে ক্রীতদাস করে রেখে অত্যাচার করে এসেছে। আর তার প্রতিশোধ নাও।

আদিবাসীরা ক্ষেপে গিয়ে বোলগানিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। জাদ-বাল-জাও বোলগানিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অনেককে ঘায়েল করল। এইভাবে অনেকক্ষণ লড়াই করার পর বহু গোরিলা মারা গেল। কিছুসংখ্যক গোরিলা বন্দী হলো আর কিছু পালিয়ে গেল।

লড়াই শেষ হয়ে গেলে টারজান লা আর বৃদ্ধ শ্বেতাঙ্গকে নিয়ে প্রাসাদের উপরতলায় দরবার ঘরে চলে গেল। আদিবাসী নিগ্রোদের সর্ব সর্দারদের ডাকা হলো।

টারজান তাদের বলল, এখানে এমন একজন বিদেশী আছেন যিনি এখানে তোমাদের সঙ্গে দীর্ঘকাল বাস করে আসছেন। যিনি তোমাদের রীতি-নীতি ও আশা আকাঙ্ক্ষার কথা সব জানেন। এই শ্বেতাঙ্গই হবেন তোমাদের রাজা।

বৃদ্ধ শ্বেতাঙ্গ বলল, কিন্তু আমি এখান থেকে সভ্য জগতে চলে যেতে চাই।

টারজান বলল, কিন্তু আপনি এতদিন পর সভ্য সমাজে গিয়ে কি করবেন? এই অসহায় নিগ্রোরা আপনার সাহায্য চায়। এরা সরল প্রকৃতির এবং বড় অনুগত।

অবশেষে টারজনের কথায় রাজী হয়ে বৃদ্ধ শ্বেতাঙ্গ বলল, ঠিক বুলেছ তুমি। আমি আর যাব না কোথাও।

পরদিন সকালেই টারজান তিন হাজার নিগ্রো, যোদ্ধা একশো গোরিলা আর লাকে নিয়ে ওপারের পথে রওনা হলো।

টারজান নিজের হাতে কাদিজকে শাস্তি দেবার জন্য পাঁচিলের উপর উঠে গেল। কাদিজের যোদ্ধারা হেরে যেতে লাগল নিগ্রোয়োদ্ধা আর গোরিলাদের হাতে। কাদিজ সুড়ঙ্গপথ দিয়ে কয়েকজন যোদ্ধা আর পুরোহিতকে নিয়ে ছুটে পালাতে লাগল। টারজান একাই তাদের পিছু পিছু ছুটতে লাগল।

ছুটতে ছুটতে একসময় অন্ধকার সুগঙ্গ পথে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল টারজান।

কাদিজের পুরোহিতরা টারজনের হাত পা বেঁধে তাকে নিয়ে মন্দিরের উপরে গিয়ে বেদীর উপর তাকে শুইয়ে দিল।

কাদিজ বলল, আজ আমি তোমাকে নিজের হাতে বলি দেব। আর আমি অপেক্ষা করব না কারো জন্য।

কাদিজ তার বলির খাড়াটা টারজনের গলার উপর উঁচিয়ে ধরল, এমন সময় মন্দিরের পাচিলের উপর একটা সিংহের গর্জন শুনে চমকে উঠল কাদিজ। ভয়ে তার হাত থেকে খাড়াটা পুড়ে গেল।

টারজান চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল জাদ-বাল-জা তার সন্ধানে এখানে এসে পড়েছে।

টারজান চীৎকার করে ডাকল জাদ-বাল-জাকে। বলল, ওকে মেরে ফেল জাদ-বাল-জা।

সঙ্গে সঙ্গে জাদ-বাল-জা এক লাফে পাচিল থেকে নেমে কাদিজের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কাদিজের সারা দেহ কামড়ে ছিঁড়ে খুঁড়ে দিয়ে সেটাকে একতাল মাংসে পরিণত করে ফেলল।

 টারজান তেমনি হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে রইল বেদীর উপর। কাদিজের অনুগত পুরোহিতরা কে কোথায় পালিয়ে গেছে ভয়ে।

ঘণ্টাখানেক পর লা তার বিজয়ী যোদ্ধাদের নিয়ে টারজনের খোঁজ করতে করতে মন্দিরে এসে হাজির হলো। সে টারজানকে বেদীর উপর পড়ে থাকতে দেখে ছুটে গিয়ে তার হাত পায়ের বাঁধন কেটে তাকে মুক্ত করে দিল।

এরপর সর পুরোহিত আর পূজারিণীরা লাকে তাদের রানী আর প্রধান পূজারিণী হিসাবে অকুণ্ঠচিত্তে মেনে নিল।

পরদিন সকালেই টারজান জাদ-বাল-জাকে নিয়ে লা-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তার দেশের বাড়ির পথে রওনা হয়ে পড়ল।

ওয়াজিরিরা যখন লেডী গ্রেস্টোককে হারিয়ে ক্লান্ত ও অবসন্ন দেহমনে তাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছিল তখন টারজান তার সোনালী সিংহটা নিয়ে অন্য পথ দিয়ে তাদের দেখতে পেল।

ওয়াজিরি সর্দার উসুলা টারজনের পায়ে পড়ে সব কথা বলল। জেনকে কিভাবে হারিয়েছে সে কথা কাঁদতে কাঁদতে বলার পর শাস্তি চাইল তার মালিকের কাছ থেকে।

কিন্তু টারজান বলল, তোমরা এখন বাড়ি ফিরে যাও। তোমাদের কোন দোষ নেই। তোমরা বাড়ি গিয়ে কোরাককে বাড়িতেই থাকতে বলবে।

এই কথা বলে জাদ-বাল-জাকে সঙ্গে নিয়ে আবার জঙ্গলের গভীরে চলে গেল জেনের খোঁজে।

টারজান যে পথে জেনের খোঁজে যাচ্ছিল সেই পথেই ফ্লোরার দলের চারজন শ্বেতাঙ্গ অর্থাৎ ব্লুবার, কার্ল, পীবল, আর খ্রক ক্ষুধার্ত আর ক্লান্ত অবস্থায় আসছিল। তাদের পাগুলো ফুলে গিয়েছিল। ক্ষিদের জ্বালা আর সহ্য করতে পারছিল না তাঁরা।

হঠাৎ এক সময় পাশের ঝোপ থেকে একটা তীর এসে একজনের হাতে লাগল। ওরা অবাক হয়ে গেল, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। কিছুক্ষণ পর আবার একটা তীর এসে একজনের পায়ে লাগল। এবার ওরা ঝোপের মাঝে কয়েকজন আদিবাসীকে দেখতে পেয়ে গুলি করতে লাগল রাইফেল থেকে। আদিবাসীরা ভয়ে জঙ্গলে পালিয়ে গেল।

টারজান একটা গাছের উপর উঠে সব দেখে গর্জন করে উঠল, গুলি থামাও, আমি তোমাদের উদ্ধার করব।

ওরা গুরি থামালে গাছ থেকে নেমে এল টারজান। ওদের দেখে সে বলল, আমি চিনেছি তোমাদের। তোমরাই কফির সঙ্গে ওষুধ মিশিয়ে দিয়ে আমাকে অচেতন করে ফেলেছিলে। তবু এভাবে তোমাদের এখানে মরতে দিতে চাই না। তোমরা বিপন্ন, তোমাদের উপর কোন প্রতিশোধ নেব না আমি। তোমরা কোথায় যেতে চাও?

কার্ল বলল, আমরা উপকূলের দিকে যেতে চাই। সেখান থেকে দেশে ফিরে যাব।

টারজনের সঙ্গে একটা গাঁয়ে গেল তারা। টারজান ওদের জন্য খাবার এনে দিল। পরে সে বলল, তোমাদের দলে লুভিনি নামে এক নিগ্রোভৃত্য ছিল। আমার লোকেরা বলেছে সে আমার স্ত্রীকে হত্যা করেছে। আমি তাকে খুঁজছি।

কার্ল বলল, ওই লোকটাই আমাদের নিগ্রোভৃত্যদের ক্ষৈপিয়ে তোলে। সে আমাদের হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে। আমাদের দলের ফ্লোরা নামে মেয়েটিকেও পাচ্ছি না আমরা। সে লেডী গ্রেস্টোকের কাছেই ছিল, আরবদের সঙ্গে লুভিনিরা লড়াই করছিল।

রাত্রিতে গাঁয়ের সামনে একটা ফাঁকা জায়গায় শুয়ে পড়ল ওরা। টারজান ওদের কাছাকাছি এক জায়গায় শুয়ে পড়ল। বলল, তোমাদের কোন ভয় নেই, জাদ-বাল-জা আমার পাশেই থাকবে।

কাল শুয়ে পড়েছিল, কিন্তু তখনো ঘুমোয়নি। হঠাৎ সে দেখল টারজান যখন শুতে যাচ্ছিল তখন তার কোমর থেকে চামড়ার মোড়ক দেয়া একটা প্যাকেট মাটিতে পড়ে গেল। কিন্তু টারজান সেটা বুঝতে পারল না। সে শুয়ে পড়ল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।

এদিকে কার্ল লোভে পড়ে শুয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে প্যাকেটটা নিয়ে নিল। তারপর সেটা ধীরে ধীরে খুলে দেখল প্যাকেটটা অসংখ্য হীরের টুকরোয় ভর্তি। সারারাত জেগে থেকে ভোর হতেই কার্ল পালিয়ে গেল শিবির ছেড়ে।

পরদিন সকালে উপকূলের দিকে রওনা হবার সময় ব্লুবার দেখল কার্ল শিবির ছেড়ে কোথায় চলে গেছে। টারজান সকাল হতেই চলে গেছে জাদ-বাল-জাকে নিয়ে।

এদিকে কার্ল বনের মধ্যে একা পথ চলতে চলতে অবসন্ন হয়ে পড়তে লাগল। বুকফাটা তৃষ্ণায় জল পর্যন্ত পায়নি একটু। তার উপর কোথা থেকে এক ধরনের অসংখ্য পিঁপড়ের রাশ তার জামার ভিতরে ঢুকে পড়ে আর তার গাটাকে কুরে কুরে খেতে শুরু করে দিয়েছে।

এক সময় সে অতিষ্ঠ হয়ে জামা প্যান্ট সব ছিঁড়ে ফেলে দিল। শুধু রাইফেল আর সেই হীরের প্যাকেটটা ছাড়া কিছুই রইল না তার কাছে।

এইভাবে যেতে যেতে সামনে একটা শিবির দেখতে পেল সে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, এস্তেবানের গলার স্বর শুনতে পেল সে। শুধু এস্তেবানের নয়, তার সঙ্গে ফ্লোরার গলাও শুনতে পেল। শিবিরের সামনে এগিয়ে গিয়ে এস্তেবানের নাম ধরে ডাকতে লাগল।

কিন্তু এস্তেবান বেরিয়ে এসে তাকে দেখে চিনতেই পারল না যেন।

কার্ল বলল, এস্তেবান, তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি কার্ল। আমি উপকূলের দিকে যাচ্ছিলাম।

এস্তেবান কড়া গলায় বলল, এখানে কি চাই? তুমি ঐ পথে যাও।

এমন সময় ফ্লোরা বেরিয়ে এসে বলল, কার্ল তুমি! আমাকে বাঁচাও, এস্তেবান আমাকে জোর করে ধরে এনে আটকে রেখে দিয়েছে।

কার্ল একটু জল চাইলে এস্তেবান বলল, জল আছে নদীতে। সেখানে চলে যাও।

এবার আর থাকতে না পেরে তার রাইফেল থেকে একটা গুলি করল কার্ল এস্তেবানকে লক্ষ্য করে। কিন্তু গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। তখন এস্তেবান, কার্ল আবার গুলি করার আগেই তার হাতের বর্শাট কালের বুকের মধ্যে আমূল ঢুকিয়ে দিল। রক্তাক্ত দেহে লুটিয়ে পড়ল কার্ল।

এদিকে মৃত কার্লের কৌপীনের মধ্যে হীরের প্যাকেটটা পেয়ে আনন্দে লাফাতে লাগল এস্তেবান। সে আবেগের সঙ্গে বলতে লাগল, এখন আমি ধনী।

কার্লের মৃতদেহটা সেখানেই ফেলে রেখে তারা শিবির ছেড়ে রওনা হয়ে পড়ল তখনি।

এদিকে পীবলস, গ্রুক আর ব্লুবার যখন আদিবাসীদের দেখিয়ে দেয়া পথে উপকূলের দিকে এগিয়ে চ্ছিল তখন হঠাৎ টারজান তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। টারজনের চোখ মুখের অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেল তারা।

টারজান কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করল, আমার হীরের প্যাকেটটা কোথায়? তোমরা সেটা নিয়েছ। আমি চলে যাবার সময় খেয়াল ছিল না। পরে বুঝতে পারি ব্যাপারটা।

ওরা তিনজন বলল, আমরা ত নিইনি।

টারজান বলল, তোমাদের মধ্যে আর একজন কোথায়?

ওরা বলল, কার্লকে সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে ভোরবেলায় আমরা ওঠার আগেই পালিয়ে গেছে। এবার বুঝতে পারছি, সে-ই তাহলে সেটা নিয়ে পালিয়ে গেছে।

টারজান ওদের সবকিছু খুঁজে দেখল কিন্তু প্যাকেটটা কারো কাছে পাওয়া গেল না।

টারজান আবার জাদ-বাল-জাকে সঙ্গে নিয়ে মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল বনের মধ্যে।

এদিকে এস্তেবান ফ্লোরাকে বলল, আমি এখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করে মরব না। তোমাকে আর আমার কোন প্রয়োজন নেই।

এই বলে সে ফ্লোরাকে পথের উপর রৈখেই চলে গেল। ফ্লোরা পথের উপরেই মৃতপ্রায় অবস্থায় শুয়ে পড়ল।

সেই রাতে একটা নদীর ধারে ছোটখাটো একটা শিবির তৈরি করল। তারপর আগুন জ্বালাল এস্তেবানু।

টারজনের অভিনয় করতে করতে নিজেকে সব সময় টারজান বলে ভাবত সে।

আগুন জ্বেলে তার পাশে বসেছিল এস্তেবান। হঠাৎ তার মনে হলো তার সামনে নদীর বাঁধের উপর থেকে সাদা পোশাক পরা এক অনিন্দ্যসুন্দরী শ্বেতাঙ্গ নারীমূর্তি এগিয়ে আসছে তার দিকে।

এস্তেবান অবাক হয়ে গেল।

এদিকে বাতাসে কার্ল এর গন্ধ-সূত্র খুঁজে খুঁজে এগিয় চলেছিল টারজান। হঠাৎ সে দেখল পথের উপর এক শ্বেতাঙ্গ নারী জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে।

টারজানকে দেখে ফ্লোরা এস্তেবান ভেবে বলল, অবশেষে আমাকে বাঁচাতে এসেছে এস্তেবান?

টারজান আশ্চর্য হয়ে বলল, এস্তেবান? আমি এস্তেবান নই।

 এবার টারজানকে চিনতে পেরে ব্যস্ত হয়ে উঠল ফ্লোরা, লর্ড গ্রেস্টোক আপনি?

টারজান বলল, হ্যাঁ আমি। কিন্তু তুমি কে?

ফ্লোরা বলল, আমি ফ্লোরা হক। একদিন লেডী গ্রেস্টোকের কাছে কাজ করতাম।

টারজান বলল, হ্যাঁ, মনে আছে আমার। তুমি এখানে কি করে এলে?

 ফ্লোরা বলল, আমরা ওপার নগরী থেকে সোনা চুরি করতে এসেছিলাম।

টারজান বলল, আমি তার কিছুই জানি না। তবে কি তুমি সেই উরোপীয়দের সঙ্গে ছিলে যারা একদিন আমার কফিতে ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল?

ফ্লোরা বলল, হ্যাঁ, আমরা সোনা পেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি একদিন ওয়াজিরিদের সঙ্গে এসে আমাদের শিবির থেকে তা নিয়ে যান।

টারজান আশ্চর্য হয়ে বলল, আমি ত কখনো আসিনি। আমি ত বুঝতে পারছি না তোমার কথা।

ফ্লোরা টারজনের কথায় আশ্চর্য হয়ে গেল। সে জানত টারজান কখনো মিথ্যা কথা বলে না। সে বলল, আমার নিগ্রোভৃত্যরা বিদ্রোহী হয়ে উঠলে এস্তেবান আমাকে চুরি করে নিয়ে যায়। পরে কার্ল এক প্ল্যাকেট হীরে নিয়ে আমাদের কাছে এসে পড়ে। কিন্তু এস্তেবান তাকে খুন করে হীরের প্যাকেটটা নিয়ে নেয়।

টারজান বলল, তাহলে তুমি এস্তেবানের কাছেই ছিলে?

ফ্লোরা বলল, সে আমায় ত্যাগ করে চলে গেছে। আমি এখানে মরতে বসেছি।

টারজান বলল, এসো আমার সঙ্গে, তাকে খুঁজে বার করব।

ফ্লোরা বলল, আমি হাঁটতে পারব না।

 টারজান তখন ফ্লোরাকে কাঁধের উপর তুলে নিয়ে এগিয়ে চলল।

কিছুদূর গিয়েই একটা আলো দেখতে পেল টারজান। কারা কথা বলছে সেখানে।

একজন নারীর কণ্ঠস্বর শুনে চিনতে পেরেই টারজান ডাক দিল, জেন! জেন তুমি!

জেন অবাক হয়ে একবার টারজনের পানে তাকাবার পর এস্তেবানের পানে তাকাতে গিয়ে দেখল। তার আগেই সে পালিয়ে গেছে সেখান থেকে।

জেন হতবুদ্ধি হয়ে বলল, তুমি যদি টারজান হও তাহলে ও কে? এর মানে কি?

টারজান বলল, আমিই ত টারজান।

ফ্লোরা বলল, ইনিই হচ্ছেন লর্ড গ্রেস্টোক, আর ও হচ্ছে ভণ্ড প্রতারক।

টারজান এবার জেনের দিকে এগিয়ে এল। জেন বলল, তাকে দেখে আমার অন্তর বিশ্বাস করতে চায়নি, শুধু সে তোমার মত দেখতে।

টারজান বলল, যাক ওকে যেতে দাও। সে আমার হীরে চুরি করে নিলেও তোমাকে এখানে ফেলে আমি যেতে পারব না।

এরপর সে জাদ-বাল-জাকে ডেকে বলল, লোকটাকে ধরে আন।

 জেন বলল, ও ওকে খেয়ে ফেলবে।

টারজান বলল, না আমার কাছে ধরে নিয়ে আসবে।

কিছুক্ষণ পর টারজান জেনকে বলল, আচ্ছা জেন, উসুলা বলছিল তুমি মারা গেঁছ। তোমাকে লুভিনি যে ঘরে বন্দী করে রেখেছিল সে ঘরটা পুড়ে যায় এবং ছাই-এর গাদার মধ্যে একটা মৃতদেহ পাওয়া যায়। এবং ওরা সেটা তোমার মৃতদেহ ভাবে। সেখান থেকে এখানে অক্ষত দেহে এলে কি করে? আমি তোমার মৃত্যুর জন্য লুভিনিকে দায়ী করে তার উপর প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে সারা জঙ্গল খুঁজে বেড়াই।

জেন বলল, আর তাকে কোনদিন খুঁজে পাবে না তুমি। লুভিনি যখন আমাকে বশ করার জন্য ধস্তাধস্তি করছিল তখন সহসা তার ছুরিটা কোমর থেকে নিয়ে তার বুকে আমূল বসিয়ে দিই। লুভিনি মারা যায়। গোটা গাঁটা তখন জ্বলছে। আমি পালিয়ে যেতেই সেই ঘরেও আগুন লেগে যায়। আমি তখন একটা আরবের সাদা আলখাল্লা তুলে নিয়ে তাই পরে জঙ্গলে পালিয়ে আসি।

ফ্লোরা বলল, এস্তেবানই ওয়াজিরিদের ভুলিয়ে তাদের সাহায্যে আমাদের শিবির থেকে সোনার তালগুলো চুরি করে নিয়ে যায়।

টারজান বলল, লোকটা একটা পাকা শয়তান।

 এমন সময় জাদ-বাল-জা এস্তেবানের পরনে যে চিতাবাঘের ছালটা ছিল সেই ছালটা মুখে করে নিয়ে এল।

টারজান তখন জাদ-বাল-জাকে নিয়ে সেই জায়গায় গেল যেখান থেকে সে এস্তেবানের ছালটা তুলে এনেছিল। টারজান দেখল নদীর ধারে কিছুটা রক্তের দাগ রয়েছে।

সে ফিরে এসে জেনদের বলল, সিংহটা ওকে ধরেছিল। তাই রক্তের দাগ রয়েছে। পরে সে নিজেকে ছিনিয়ে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়। নদীতে ওকে নিশ্চয় কুমীরে খাবে।

ফ্লোরা বলল, এতকিছুর জন্য আমিই একমাত্র দায়ী। আমার কুটিল লোভলালসা তাদের এই আফ্রিকার জঙ্গলে টেনে আনে। আমি তাদের ওপারের ধর্নরত্নের কথা বলেছিলাম এবং এস্তেবানের মত এমন একজন লোককে বাছাই করেছিলাম যে দেখতে অবিকল লর্ড গ্রেস্টোকের মত।

টারজান বলল, এর জন্য তোমাকে অনেক কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। তুমি প্রচুর শাস্তি পেয়েছ।

ফ্লোরা টারজনের সামনে নতজানু হয়ে বলল, আপনার এত দয়ার জন্য কি বলে ধন্যবাদ দের আপনাকে? আমি কিন্তু আর কোথাও যাব না। আমি আপনাদের কাছে থেকে গিয়ে সারা জীবন ধরে আপনাদের সেবা করে যাব।

টারজান বলল, ঠিক আছে, তুমি আমাদের কাছেই থেকে যেতে পার ফ্লোরা।

ওরা তিনজন জাদ-বাল-জাকে সঙ্গে নিয়ে পরদিন সকালে রওনা হয়ে ক্রমাগত তিনদিন ধরে বাড়ির পথে এগিয়ে যেতে লাগল। তিনদিন পর এক জায়গায় টারজুন দেখতে পেল তার ওয়াজিরি যোদ্ধারা তাদের খোঁজেই এদিকে আসছে।

টারজান জেনকে বলল, ওদের বাড়ি যেতে বললাম আর ওরা আমাদের খোঁজ করতে আসছে।

কিছুক্ষণের মধ্যই ওয়াজিরি যোদ্ধারা ওদের সামনে এসে পড়ল। টারজান আর জেনকে এক সঙ্গে দেখতে পেয়ে আনন্দের আবেগে নাচতে লাগল ওরা। অনেক কথার পর টারজান উসুলাকে জিজ্ঞাসা করল, সেই সোনার তালগুলো কোথায় রেখেছ?

উসুলা বলল, সেগুলো তুমি যেখানে রাখতে বলেছিলে তোমার কথামত সেখানেই পুঁতে রেখেছি।

টারজান বলল, আমি নই, আমার মত দেখতে অন্য একটা লোক তোমাদের ঠকিয়েছিল।

উসুলা আশ্চর্য হয়ে বলল, ওঃ মালিক, তাহলে সে আপনি নন!

 জেন বলল, সোনা হীরে যাক, আমরা ফিরে এসেছি এবং বাড়িতে কোরাক আছে, এটাই যথেষ্ট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *