টারজান ফিরে এল (দি রিটার্ন অফ দি টারজান)

টারজান ফিরে এল (দি রিটার্ন অফ দি টারজান)

জাহাজে যেতে কাউন্টেস দ্য কুদ আবেগের সঙ্গে বলল, চমৎকার।

কাউন্টপত্নীর চোখে চোখ পড়তেই একজন যুবক উঠে ডেকের দিকে চলে গেল। কাউন্টপত্নী জাহাজের এক কর্মচারীকে বলল, এ ভদ্রলোক কে?

কর্মচারীটি বলল, ভদ্রলোকের নাম মঁসিয়ে টারজান, আফ্রিকা যাবার জন্য টিকিট কেটেছেন।

ডেকে দাঁড়িয়ে অতীতের সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতের ভাবনা করতে লাগল টারজান। যে বিশাল জঙ্গলে অজস্র সিংহ ও জন্তুদের মাঝে জন্মের পর থেকে তার জীবনের বাইশটি বছর কাটিয়েছে সে, সে জঙ্গলের মধ্যে আবার ফিরে যাবার আনন্দ ও উত্তেজনার আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে উঠল তার মন। অবশ্য সে আবার সেখানে ফিরে গেলে কেউ তাকে অভ্যর্থনা জানাবে না। একমাত্র ট্যান্টর বা একটা হাতি ছাড়া তার কোন বন্ধু নেই সেখানে।

এক সময় টারজান যখন ডেকের উপর দিয়ে যাচ্ছিল তখন দেখল এক জায়গায়, রোকোফ আর পলভিচ একজন অবগুণ্ঠিতা মহিলার সঙ্গে উত্তেজিতভাবে তর্ক-বিতর্ক করছে।

রোকোফের হাবেভাবে টারজান বুঝল সে মহিলাটিকে দৈহিক পীড়নের ভয় দেখাচ্ছে। সে তাই যেতে যেতে থেমে গেল। রোকোফ টারজানকে তখনো দেখতে পায়নি। সে মহিলাটির একটা হাত ধরতে না ধরতেই টারজান তার লোহার মত শক্ত একটা হাত দিয়ে রোকোফের ঘাড় ধরে তাকে সজোরে ঠেলে দিল। রোকোফ এবার টারজনের মুখপানে তাকিয়ে বলল, কি চাও তুমি? তুমি কি এতই নির্বোধ যে নিকোলাস রোকোফকে অপমান করছ?

টারজান কোন কথা না বলে রোকোফকে এমনভাবে আবার ঠেলে দিল যে সে ডেকের উপর পড়ে গেল।

 রোকোফ উঠে দাঁড়িয়ে রেগে বলল, শুয়োর কোথাকার। এর জন্য তোমায় মরতে হবে।

এই বলে সে পকেট থেকে রিভলবার বার করে টারজানকে লক্ষ্য করে গুলি করার জন্য উদ্যত হলো। মহিলাটি মিনতি করে বলল, ও কাজ করো না রোকোফ।

কিন্তু টারজান নির্ভয়ে এগিয়ে গেল রোকোফের দিকে। যেতে যেতে বলল, বোকার মত কাজ করো না।

রোকোফ গুলি করল। কিন্তু রিভলবারে গুলি ছিল না তখন। টারজান তখন তার হাত থেকে রিভলবারটা কেড়ে নিয়ে রেলিং পার করে সমুদ্রের জলে ফেলে দিল।

এবার দু’জনে মুখোমুখি দাঁড়াল। রোকোফ বলল, তুমি নিকোলাস রোকোফকে অপমান করলে, তার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলে। এবার তুমি রোকোফ কে তা বুঝতে পারবে।

টারজান বলল, তুমি যে একটা কাপুরুষ তা আমি বুঝেছি।

রোকোফ মেয়েটিকে আঘাত করছে কিনা জানবার জন্য পিছন ফিরতেই সে দেখল মেয়েটি চলে গেছে সেখান থেকে। টারজান তখন সেখানে আর না দাঁড়িয়ে ডেকের উপর বেড়াবার জন্য অন্যত্র চলে গেল।

সেদিন রাতে খাওয়া শেষ হতেই ডেকের উপর বেড়াতে বেড়াতে জাহাজের সেকেন্ড অফিসারের সঙ্গে কথা বলছিল টারজান। পরে অফিসার চলে গেলে সে একাই বেড়াতে লাগল। হঠাৎ সে রোকোফ আর পলভিচের গলার আওয়াজ পেল। ওরা তাকে দেখতে পায়নি। রোকোফ পলভিচকে অনুচ্চস্বরে বলছে যদি সে চীৎকার করে তাহলে তার গলাটা টিপে ধরে থাকবে চুপ না করা পর্যন্ত।

কথাটা টারজনের কানে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই এক দুঃসাহসিক অভিযানের আকাক্ষা প্রবল হয়ে উঠল। তার মধ্যে। সে আড়াল থেকে রোকোফের গতিবিধি লক্ষ্য করতে লাগল। টারজান দেখল ওরা ফাস্ট ক্লাস কেবিনের দিকে চলে গেল। ওরা দরজার সামনে দাঁড়াতেই টারজান একটা গলির মধ্যে গিয়ে আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল।

দরজায় ঘা দিতেই ভিতর থেকে এক নারীকণ্ঠ বলল, কে?

রোকোফ বলল, আমি ওলগা,-নিকোলাস। ভিতরে আসতে পারি?

নারীকণ্ঠ তখন আবার বলল, কেন আমাকে এভাবে পীড়ন করছ নিকোলাস?

রোকোফ বলল, দরজা খোল, কথা আছে।

এবার দরজাটা ভিতর থেকে খোলার শব্দ হলো। রোকোফ ঘরে না ঢুকেই মহিলাটিকে চুপি চুপি কি বলতেই মহিলাটি বলল, না, তুমি যতই ভয় দেখাও তোমার দাবি আমি মেনে নিতে পারব না।

রোকোফ বলল, ঠিক আছে আমি ঢুকব না। তবে তোমাকে খুব শিগগিরই হার মানতেই হবে।

এরপর মহিলাটি কিছু বলার আগেই রোকোফ পলভিচকে কি ইশারা করতে পলভিচ ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করা বন্ধ করে তালা দিয়ে দিল। রোকোফ দরজার উপর কান পেতে রইল ভিতরের কথাবার্তা শোনার জন্য।

নারীকণ্ঠ বলল, কাপুরুষ কোথাকার! তুমি বেরিয়ে যাও এখনি এবং আর কখনো আসবে না।

এক মুহূর্তে সব চুপ হয়ে গেল একেবারে। তারপর নারীকণ্ঠের এক আর্ত চীৎকার শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে আবার চুপ হয়ে গেল সে কণ্ঠ।

নারীকণ্ঠ চুপ হবার সঙ্গে সঙ্গে টারজান তার গুপ্ত স্থান থেকে বেরিয়ে এল। রোকোফ চমকে উঠে পালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু টারজান তার জামার কলারটা ধরে ফেলল। তারপর টারজান তার দানবিক শক্তির চাপ দিয়ে কেবিনের তালাবন্ধ দরজাটা ভেঙ্গে দিয়ে রোকোফকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকল।

এবার মহিলাটি মৃদু হেসে অভ্যর্থনা জানাল টারজানকে।

টারজান বলল, আমি এর আগেই ধূমপান ঘরে ওদের দেখেছি। এই ধরনের লোক ভাল কিছু সহ্য করতে পারে না।

মহিলাটি বলল, মঁসিয়ে টারজনের বীরত্ব ও শক্তির কথা আমার স্বামী সব বলেছেন। তিনি আপনার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতার ঋণে ঋণী।

টারজান বলল, আপনার স্বামী?

হুঁ, আমার স্বামী হলেন কাউন্টেস দ্য কুদ।

তারপর থেকে সেই মহিলার সঙ্গে আর দেখা হয়নি টারজনের।

প্যারিসে পৌঁছেই দার্ণতের কাছে চলে গেল টারজান। টারজান স্বেচ্ছায় তার পৈত্রিক ভূ-সম্পত্তি আর পদমর্যাদা ত্যাগ করার জন্য দার্ণৎ তাকে তিরস্কার করল।

দার্ণৎ বলল, তুমি নিশ্চয় পাগল হয়েছ বন্ধু। তুমি শুধু ধনসম্পত্তি ও পদমর্যাদা ত্যাগ করলে না, তোমার দেহের শিরায় শিরায় যে ইংল্যান্ডের এক সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত পরিবারের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে সেটা জগতের সামনে প্রমাণ করার সুযোগটাও হারালে। কিন্তু একথা তারা বিশেষ করে জেন পোর্টার বিশ্বাস করল কি করে যে তুমি এক মেয়ে-বাঁদরের সন্তান? তোমার বাবার ডায়েরীতে পাওয়া তথ্য, তোমার শিশু বয়সের আঙ্গুলের ছাপ প্রভৃতির প্রমাণ সত্ত্বেও তুমি যে সবকিছু ছেড়ে দিলে তা আমার কাছে অবিশ্বাস্য বোধ হচ্ছে।

টারজান বলল, টারজান নামই আমার সবচেয়ে ভাল লাগছে। তুমি যদি আমাকে একটা চাকরি দেখে দাও তাহলে আমাকে অন্তত নিঃস্ব থাকতে হবে না।

দার্ণৎ বলল, আমি তা বলছি না। আমি আমার যথাসর্বশ্বের অর্ধেক যদি তোমাকে দান করি তাহলেও তোমার ঋণের দশ ভাগের এক ভাগ শোধ হবে না। তুমি আমাকে মবঙ্গাদের কাছ থেকে যেভাবে উদ্ধার করেছ তা আমি কখনো ভুলতে পারব না। টাকা দিয়ে তোমার ঋণ শোধের স্পর্ধা আমার নেই। তবে তোমার টাকার দরকার বলে সে দরকার মেটাতে চাই।

টারজান বলল, ঠিক আছে, কিন্তু আমি একটা কিছু করতে চাই। তাই একটা কাজ চাই। আর আমার উত্তরাধিকারের কথা যদি বলতে চাও তাহলে বলি আমার থেকে ক্লেটন এ বিষয়ে বেশি যোগ্য। সে ভদ্র, শিক্ষিত, আমার মধ্যে পশুসুলভ ভাব ও বৃত্তি সুপ্ত হয়ে আছে এবং সভ্যতা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির কিছুই জানি না। তাছাড়া আজ যদি ক্লেটনের কাছ থেকে সব সম্পত্তি ও পদমর্যাদা কেড়ে নিই তাহলে যে মেয়েটিকে আমি ভালবাসি এবং যে ক্লেটনকে বিয়ে করতে চলেছে তার অবস্থা কি হবে ভেবে দেখেছ? আমার কাছে। বংশ গৌরব বা পদমর্যাদার কোন দাম নেই।

দার্ণৎ বলল, কিন্তু ভবিষ্যতে এমন একদিন আসবে যখন তুমি তোমার বংশ মর্যাদা ফিরে পেয়ে আনন্দ লাভ করবে। অধ্যাপক পোর্টার ও মিস্টার ফিলান্ডার-একমাত্র তারা দুজনেই সর্বসমক্ষে বলতে পারেন সেই কেবিনটার মধ্যে যে শিশুর কঙ্কালটা পাওয়া যায় তা কোন মানব শিশুর নয়, সেটা এক শিশু বাঁদর-গোরিলার কঙ্কাল। তাঁরা বৃদ্ধ, বেশি দিন বাঁচবেন না। আসল সত্য উদ্ঘাটিত হলে মিস পোর্টারের মনের পরিবর্তন হবে।

টারজান বলল, তুমি মিস পোর্টারকে জান না। ক্লেটনের কিছু একটা না হলে ওর মনের পরিবর্তন কিছুতেই ঘটবে না। আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলে এক পরিবারে ওর জন্ম। জীবনে নিষ্ঠা আর বিশ্বস্ততাকে ওরা বড় করে দেখে।

সেই থেকে দু’সপ্তা ধরে দার্ণতের কাছে প্যারিসেই রয়ে গেলে টারজান।

একদিন সন্ধ্যার পর থিয়েটার দেখার পর টারজনের হঠাৎ নজর পড়ল কোন এক অচেনা লোকের এক জোড়া সন্ধানী দৃষ্টি তাকে লক্ষ্য করছে তার অগোচরে।

সেরাতে থিয়েটার হল থেকে বেরিয়ে অন্ধকার রাস্তাটা দিয়ে কিছুটা হেঁটে যেতেই টারজান দেখল একটা লোক ছুটে রাস্তাটা পার হয়ে অন্য দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরেই রাস্তার ধারের একটা তিনতলা বাড়ির দোতলার একটা ঘর থেকে নারীকণ্ঠের আর্ত চীৎকার শুনতে পেল সে।

আর্ত নারীকণ্ঠের চীৎকার কানে যাওয়া মাত্র টারজান ঘরটা লক্ষ্য করে ছুটতে লাগল। ঘরে ঢুকেই সে দেখল একজন নারী তার গলায় একটা হাত দিয়ে একাধারে দেওয়াল ঘেসে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর কয়েকজন। পুরুষ ঘোরাফেরা করছে ঘরখানায়। টারজানকে দেখে পুরুষগুলো কেউ সরে গেল না। প্রায় তিরিশ বছর বয়সের সেই নারীটি টারজানকে বলল, আমাকে বাঁচান মঁসিয়ে, ওরা আমাকে খুন করতে এসেছে।

টারজান ঘরের স্বল্প আলোয় দেখল একটা লোক ঘর থেকে বেরিয়ে গেল এবং সে হলো রোকোফ। রোকোফ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই একটা লোক একটা বড় দা হাতে টারজনের মাথায় মারার জন্য। এগিয়ে এল। বাকি লোকগুলো এবার একযোগে আক্রমণ করল টারজানকে। টারজান প্রথমে যে লোকটা তার মাথার উপর দা তুলে ধরেছিল সেই লোকটার মুখের উপর একটা জোর ঘুষি মারতেই সঙ্গে সঙ্গে মেঝের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে গেল লোকটা। টারজান এবার অন্য লোকগুলোকে মারতে লাগল। তার কাছে এটা যেন একটা খেলার ব্যাপার।

মেয়েটাও ভয়ে চীৎকার করে উঠল, হা ভগবান!

লোকগুলোর মধ্যে অনেকেরই হাড় ভেঙ্গে গেল। তারা সবাই ঘর থেকে কোনরকমে নিজেদের মুক্ত করে পালিয়ে গেল। রোকোফ এতক্ষণ বাইবেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে ভেবেছিল টারজান ওদের হাতে মারা যাবে। কিন্তু সে যখন দেখল টারজান সকলকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে ঘর থেকে তখন সে পুলিশকে টেলিফোন করল। বলল, একটা দুবৃত্ত কোথা থেকে এসে মারপিট করছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ অফিসাররা এসে ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখল ঘরের একধারে একজন যুবতী একটা নোংরা বিছানার উপর হাতে মুখ ঢেকে শুয়ে আছে আর তিনজন আহত লোক মেঝের উপর শুয়ে

যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে। ঘরের মাঝখানে দৈত্যাকার এক ভদ্রলোক ধবধবে সাদা পোশাক পরে দাঁড়িয়ে হাসছে।

একজন পুলিশ অফিসার জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে এখানে?

টারজান যা যা হয়েছিল সব কথা বুঝিয়ে বলল। কিন্তু সব কথা বলার পর মেয়েটির দিকে সমর্থনের আশায় তাকাতেই মেয়েটি বলল, ও মিথ্যা কথা বলছে। আসলে আমি যখন একা এই ঘরে ছিলাম তখন ও অসদুদ্দেশ্যে এসে আমার শালীনতা নষ্ট করার চেষ্টা করে। আমি সাহায্যের জন্য চীৎকার করলে এইসব ভদ্রলোকরা ছুটে আসে। কিন্তু এই লোকটা তাদের প্রত্যেককে আহত করে শুধু তার হাত আর দাঁত দিয়ে। ও মানুষ নয়, একটা পশু।

কথাটা শুনে মনে দারুণ আঘাত পেল টারজান। এবার সে রোকোফের চক্রান্তের কথাটা বুঝতে পারল।

 পুলিশরা অবশ্যই মেয়েটি কি প্রকৃতির তা জানত। তার সঙ্গীদেরও চিনত। কিন্তু এক্ষেত্রে কে দোষী তা তারা ঠিক করতে না পেরে সকলকেই গ্রেফতার করতে চাইল।

টারজান বলল, আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। এই মহিলার চীৎকার শুনে ছুটে আসি আমি। এর আগে কখনো দেখিনি এই মহিলাকে।

পুলিশ অফিসার বলল, আপনার যা বলার আদালতে বলবেন। এখন আমাদের সঙ্গে চলুন, এই বলে টারজনের কাঁধের উপর হাত দিতেই টারজান ঘুষি মেরে ফেলে দিল তাকে। তার সাহায্যে অন্য পুলিশরা। ছুটে যেতে তাদেরও এক এক ঘুষিতে ঘায়েল করে দিল টারজান। এরপর একজন অফিসার রিভলবার থেকে গুলি করতে যেতেই টারজান ঘরের বাতিটা নিভিয়ে দিলে ঘরখানা অন্ধকার হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল।

এদিকে টারজান রাস্তার দিকে জানালাটা দিয়ে বেরিয়ে একটা লাফ দিয়ে টেলিগ্রাফের পোস্টটা ধরে তাই দিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল। পুলিশরা তার আগেই চলে গেছে।

ফরাসী উপনিবেশ আলজিরিয়ার অন্তর্গত সিদি বেল আব্বে নামক এক জায়গায় জনৈক আমেরিকান। শিকারীর ছদ্মবেশে টারজানকে পাঠানো হলো। সেখানে লেফটন্যান্ট জার্নয় নামে এক অফিসার ফরাসী সরকারের সৈন্যবিভাগের অধিকর্তারূপে কাজ করছিল। ছদ্মবেশে তার উপর নজর রাখার জন্য টারজনের উপর ভার পড়ল। জার্নয়ের কাজকর্ম কিছুদিন ধরে ভাল লাগছিল না ফরাসী সরকারের। সে কিছু রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কাজে লিপ্ত আছে এমন সন্দেহও করা হয়। তাই তার কাজকর্মের উপর কড়া নজর রাখতে হবে টারজানকে।

আফ্রিকার নাম শুনে আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিল টারজান। কিন্তু পরে দেখল এটা আফ্রিকার উত্তরাঞ্চল, এবং মধ্য আফ্রিকার বনাঞ্চল থেকে এর ভূ-প্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। ওখানে পৌঁছে প্রথম দিনটা সে এখানে সেখানে ঘুরে কাটাল। পরদিন বেল আব্বেতে গিয়ে সামরিক ও অসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে তার পরিচয়পত্র দাখিল করল। সেখানকার ফরাসী ও আরব দেশীয় লোকদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথাবার্তা বলত টারজান। তবে কোন ইংরেজ দেখতে পেলে তার সঙ্গে ফরাসী ভাষায় কথা বলত, পাছে সে যে একজন। ইংরেজ এটা ধরা পড়ে যায়।

অল্পদিনের মধ্যে সেখানকার ফরাসী অফিসারদের সঙ্গে মেলামেশা করে তাদের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠল টারজান। জার্নয়ের সঙ্গেও দেখা করল। জার্নয়ের বয়স চল্লিশ। মুখটা সব সময় ভার করে থাকে এবং কারো সঙ্গে মেলামেশা করে না।

ক্যাপ্টেন জিরার্দ নামে একজন অফিসারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল টারজনের। একদিন জিরা টারজানকে বলল, তাদের কিছুদিনের জন্য সাহারার কাছে বু সাদা নামে একটা জায়গায় যেতে হবে। তিনজন অফিসারসহ একদল সৈন্য সেখানে যাবে। শিকারের অছিলায় টারজানও জিরার্দের সঙ্গে যেতে। চাওয়ায় কারো কোন সন্দেহ হলো না বা কেউ তাকে বাধা দিল না।

যাবার সময় বুইরা নামে একটা জায়গায় টারজান দেখল ইউরোপীয় পোশাক পরা একটি লোক তাকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করছে। টারজান কিন্তু ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব দিল না।

পরদিন প্রাতরাশ সেরে হোটেল থেকে আবদুল নামে আরবদেশীয় এক বিশ্বস্ত যুবককে পথ-প্রদর্শক ও দোভাষী হিসেবে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল টারজান। এক সময় আবদুল টারজানকে বলল, ঐ দেখ মালিক, কালো আলখাল্লা আর সাদা পাগড়ী পরা একটা এদেশীয় লোক আমাদের অনেকক্ষণ ধরে পিছু নিয়েছে। লোকটার উদ্দেশ্য খারাপ, কারণ ওর মুখের নিচের দিকটা ঢাকা, শুধু চোখ দুটো বার করা আছে।

টারজান বলল, আমি ত আজই এখানে এসেছি, আগে কখনো এ দেশে আসিনি। সুতরাং এখানে আমার কোন শত্রু থাকতে পারে না। তবে যদি ডাকাত হয় তাহলে আমরা প্রস্তুত। যত পারে লুটপাট করুক।

হোটেলে আবদুলের মাধ্যমে কাদুর বেন সাদেন নামে আরবদেশীয় এক মুসলমানের সঙ্গে আলাপ হলো টারজনের। লোকটি ভদ্র এবং একজন অশ্ব বিক্রেতা হিসাবে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াত। টারজান শিকারী জেনে কাদুর তাকে তাদের দেশের অরণ্যে গিয়ে শিকার করার জন্য আমন্ত্রণ জানাল।

কাদুর চলে গেলে টারজান কিছু দূরে একটি হোটেলের সামনে এক নাচের আসর দেখে সেখানে গিয়ে বসল। সেখানে আউলেদ নাইন নামে এক সুন্দরী তরুণী নাচছিল। টারজানকে দেখেই মেয়েটি তার কাছে এসে তার ঘাড়ের উপর একটা সিল্কের রুমাল নাড়তে লাগল। টারজান তাকে একটা মুদ্রা দিল। মেয়েটি নাচতে নাচতে একবার একটু সরে গিয়ে দু’জন আরবের সঙ্গে ফিস ফিস করে কি কথা বলল। তারপর আবার টারজনের কাছে এল। এবারও সে তাকে একটা মুদ্রা দিল।

এবার মেয়েটি টারজনের কানের কাছে মুখটা নিয়ে গিয়ে চুপি চুপি ভাঙ্গা ভাঙ্গা ফরাসী ভাষায় বলল, তুমি এখনি চলে যাও এখান থেকে। বাইরে দু’জন লোক তোমার ক্ষতি করার জন্য অপেক্ষা করছে। তোমাকে ওদের হাতে ধরিয়ে দেব বলে প্রথমে কথা দিয়েছিলাম আমি। পরে দেখলাম তুমি দয়ালু এবং বড় দ্র। তাই বলছি, চলে যাও, ওরা দুষ্ট প্রকৃতির লোক।

টারজান বলল, ঠিক আছে, ধন্যবাদ।

কিন্তু সেখান থেকে চলে গেল না টারজান। আবদুলও তার পাশে বসে রইল। এমন সময় একজন। গোমরা মুখো আরব এসে তাদের ভাষায় গালাগালি করতে লাগল টারজানকে।

টারজান আবদুলকে বলল, ওকে বলে দাও, আমি ওর কোন ক্ষতি করিনি। ও যেন এখান থেকে চলে যায়।

আবদুল আরবি ভাষায় লোকটাকে তাই বললে সে টারজানকে কুকুর বলে গাল দিল। বলল, তার বাবা কুকুর আর তার মা হায়েনা। একথা শুনে উপস্থিত অন্যান্য আরবরা হাসতে লাগল।

যে লোকটা গালাগালি করছিল তার মুখে একটা জোর ঘুষি মেরে দিল টারজান ৷ সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত আরবরা ছুটে এল শ্বেতাঙ্গ টারজানকে মারার জন্য।

টারজান আর আব্দুলকে আক্রমণ করার জন্য একসঙ্গে অনেক লোক এসে তাদের সামনে ঝাঁক বেঁধে তেড়ে এল। হঠাৎ টারজান একটা আরব যুবককে ধরে তার হাত থেকে অস্ত্রটা কেড়ে নিয়ে তাকে ঢাল হিসেবে তুলে ধরে সামনে পথ করে দু’জনে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তারপর অন্ধকার উঠোনটার এক প্রান্তে গিয়ে তারা দাঁড়াতেই ওরা দেখল দু’জন আরব রিভলবার থেকে গুলি করতে করতে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হতেই টারজান তাদের উপর লাফিয়ে পড়ল। একটা লোকের একটা হাতের কব্জি ভেঙ্গে যেতে সে পড়ে গেল। আর একটা লোকের পেটে ছুরি মেরে আবদুল তার নাড়িভুঁড়ি বার করে দিল।

সহসা টারজনের পিছন থেকে আউলেদ নামে সেই নাচিয়ে মেয়েটি তাদের ডেকে ঘরের ভিতর দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলার ছাদের ঘরের উপর নিয়ে গেল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই একদল আরব সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসতে লাগল। কিন্তু একসঙ্গে অনেক লোক তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে পুরনো সিঁড়ি অত লোকের ভার সহ্য করতে না পেরে ভেঙ্গে গেল। অনেক লোক পড়ে গিয়ে আহত হল।

আউলেদ বলল, এখানে বেশিক্ষণ আমাদের থাকা চলবে না। এখনি ওরা এসে পড়বে। ওরা ছাড়বে না। আমাকেও পালাতে হবে। কারণ ওরা জেনে গেলে আমি তোমাদের এখানে নিয়ে এসেছি।

টারজান বলল, ভেবো না, তুমি যেখানে যেতে চাও, আমি পাঠিয়ে দেব নিরাপদে।

আউলেদ বলল, আসলে আমি বন্দী।

টারজান আশ্চর্য হয়ে বলল, বন্দী!

আউলেদ বলল, হ্যাঁ, এদেশের দক্ষিণাঞ্চলে আমাদের বাড়ি। আমাকে দুবৃত্তরা বাড়ি থেকে চুরি করে এনে এই হোটেলওয়ালার কাছে বিক্রি করে দেয়। সেই এই হোটেলে নাচিয়ের কাজ করতে দেয় আমাকে। আমার বাবার নাম কাদুর বেন সাদেন।

টারজান বলল, তিনি ত এই শহরেই আছেন। কিছুক্ষণ আগে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়।

টারজান এবার ছাদে উঠে গিয়ে পাশের বাড়ির একটা ছাদে চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর টারজান সেই বাড়ির জানালা ও পাইপ বেয়ে আউলেদকে কাঁধে নিয়ে রাস্তায় নেমে এল। আবদুলও তার মত নামল।

এরপর টারজান আউলেদ আর আবদুলকে নিয়ে কাদুর যে হোটেলে ছিল সেই হোটেলে তার খোঁজে গেল। গিয়ে দেখল কাদুর বাইরে গেছে। কিছু পরে আসবে। তারা অপেক্ষা করতে লাগল।

কিছুক্ষণের মধ্যে কাদুর এসে তার হারানো মেয়েকে দেখেই তাকে জড়িয়ে ধরল। চোখে আনন্দাশ্রু বইতে লাগল। বলল, আল্লা কত দয়ালু।

তার মেয়ের কাছে তার উদ্ধারকর্তা টারজনের সব কথা শুনে কাদুর বলল, কাদুর বেন সাদেনের যথাসর্বস্ব, এমন কি তার জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দেবে তোমার কাছে।

হোটেলে কিছুটা ঘুমিয়ে নিয়ে ওরা শেষ রাতের দিকে ঘোড়ায় করে বু সাদার পথে রওনা হলো। ভাবল সন্ধ্যার আগেই ওরা সেখানে গিয়ে পৌঁছবে। টারজান আর আবদুল ছাড়া শেখ কাপুরের সঙ্গে চারজন সশস্ত্র সহচর ছিল। ওদের কাছে মোট সাতটা বন্দুক ছিল।

পথটা বড় খারাপ। বন্ধুর পাথুরে মাটি। মাঝে মাঝে একটা করে ছোট পাহাড়। কোথাও কোন জনপদ বা লোকালয় নেই। চারদিকে দেখা গেল শুধু দিগন্ত জোড়া শূন্য প্রান্তর আর পাহাড়।

যেতে যেতে প্রায়ই পিছন ফিরে তাকাচ্ছিল আবদুল। তার ধারণা শত্রুরা পিছু নিতে পারে তাদের। বিকেলের দিকে দেখা গেল তার ধারণাই ঠিক। দেখা গেল তাদের পিছনে অনেক দূরে একদল অশ্বারোহী আসছে।

বিপদের গন্ধ পেয়ে অনেক করে বুঝিয়ে শেখ কাদুর আর আউলেদকে পাঠিয়ে দিল টারজান। আবদুল তার সঙ্গ কিছুতেই ছাড়ল না। বু সাদা আর বেশি দূরের পথ নয়। টারজান আবদুলকে নিয়ে পথের ধারে একটা বড় পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রইল।

আরব অশ্বারোহীরা কাছে আসতেই টারজান চীৎকার করে উঠল, থাম, না হলে গুলি করব।

প্রথমে অশ্বারোহীরা একটু থেমে নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে টারজানদের ঘিরে ফেলল। তারপর গুলি করতে লাগল তাদের লক্ষ্য করে। টারজানরা পাথরের আড়াল থেকে গুলি চালাতে থাকায় তাদের গায়ে একটা গুলিও লাগল না। কিন্তু টারজানদের গুলিতে ছয়জন মারা। গেল। এমন সময় বু সাদার দিকে একদল আরব অশ্বারোহী এসে আক্রমণকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকায় অবশিষ্ট চারজন অশ্বারোহী ভয়ে পালিয়ে গেল। আসলে কাদুর সাদেনই বু সাদা শহর। থেকে তাদের দলের লোকদের নিয়ে আসে টারজানদের সাহায্যের জন্য।

টারজানদের গায়ে কোন আঘাত লাগেনি দেখে কাদুর খুশি হলো। তারা এক সঙ্গে বু সাদার দিকে রওনা হলো। সেখানে দু’দিন থাকার পর কাদুর তার মেয়েকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে একদিন যাত্রা করল। টারজানকে তাদের সঙ্গে যাবার জন্য অনেক করে অনুরোধ করল। কিন্তু টারজান বলল, তার কাজ আছে। কাদুরের মত আরবদেরও খুব ভাল লেগে গেল টারজনের।

কাদুরকে বিদায় দিয়ে টারজান সাহারায় হোটেল দু’পেতিতে চলে এল সোজা। তার দলের লোকেরা তখন এই হোটেলেই ছিল। খাবার ঘরে ঢুকে টারজান দেখল জার্নয় একজন অপরিচিত আরবের সঙ্গে ফিস ফিস করে কথা বলছে। টারজান দেখল আরবটা তার সাদা আলখাল্লার মধ্যে একটা ভাঙ্গা হাত ঝোলানো অবস্থায় লুকিয়ে রেখেছে। সেখানে না দাঁড়িয়ে থেকে হোটেলের অন্য দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল টারজান।

সেইদিনই দার্ণতের একখানা চিঠি পেল টারজান; চিঠিতে লেখা ছিল, প্রিয়, তোমাকে আগের চিঠিখানা লেখার পর আমি একটি কাজে একবার লন্ডনে গিয়েছিলাম। সেখানে তিনদিন ছিলাম। প্রথম। দিনই হেনরিয়েটা স্ট্রীটে তোমার ফিলান্ডার নামে এক বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। তাঁর অনুরোধে তার সঙ্গে তাঁদের হোটেলে যাই। সেখানে গিয়ে আমি অধ্যাপক পোর্টার, জেন পোর্টার ও এসমারাল্ডাকে দেখতে পাই। পরে ক্লেটনও সেখানে এসে উপস্থিত হয়। ওদের বিয়ে হবেই এবং বিয়ের দিনটা যেকোন দিন ঘোষিত হবে।

আমি যখন ফিলান্ডারের সঙ্গে একা ছিলাম তখন ভদ্রলোক আমাকে কতকগুলো গোপন কথা বললেন। তিনি বললেন, মিস পোর্টার এর আগে তিনবার বিয়েটা স্থগিত রাখে। তাঁর মতে মিস পোর্টার আসলে ক্লেটনকে বিয়ে করতে মোটেই উৎসাহী নয়।

তাঁরা অবশ্য সকলেই তোমার কথা জিজ্ঞাসা করেন। তবে আমি তোমার কথামত তোমার জন্মের ব্যাপারে কোন কথা বলিনি। শুধু বর্তমানে তুমি কোথায় আছ বা কি করছ সেই কথাই বলেছি। মিস পোর্টারকে অবশ্য তোমার ব্যাপারে খুবই উৎসাহী দেখা গেল এবং তোমার সম্বন্ধে সে অনেক কথাই জিজ্ঞাসা করল। আমি তোমার জঙ্গলে ফিরে যাওয়ার বাসনার কথাও বললাম।

তোমার কথা আলোচিত হবার সময় দেখলাম ক্লেটন যেন ঘাবড়ে গেল। তবু তোমার প্রতি সে তার মমতার পরিচয় দেয় এবং তোমার ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ প্রকাশ করে।

গত পরশু আমি প্যারিসে ফিরে এসেছি। গতকাল কাউন্ট ও কাউন্টপত্নীর সঙ্গে দেখা করেছি। তারা। তোমার কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। আমি সুযোগ পেলেই তোমাকে আবার চিঠি দিচ্ছি। ইতি তোমার বন্ধু
পল দার্ণৎ।

 চিঠিটা শেষ করে টারজনের মনে এক সকরুণ আনন্দের অনুভূতি জাগল।

এরপর তিনটি সপ্তা ধরে বিশেষ কোন ঘটনা ঘটল না। জার্নয় তাকে আগের থেকে বেশি করে এড়িয়ে চলত। সেই রহস্যময় অচেনা আরবটাকে দু’দিন দেখতে পায়।

বু সাদার জঙ্গল এলাকায় শিকার করে বেড়াতে লাগল টারজান।

সেদিন জঙ্গলে একটা পাহাড়ের ধারে শিকার করেত গিয়ে অল্পের জন্য বেঁচে গেল টারজান। ঘোড়ায় চড়ে সে যখন একটা জায়গায় যাচ্ছিল তখন একটা গুলি হঠাৎ তার মাথার শিরস্ত্রানটাকে অল্প ছুঁয়ে চলে যায়।

সেই রাত্রিতে তার বন্ধু ক্যাপ্টেন জিরার্দ টারজানকে খাবার সময় বলল, বুঝেছি এখানে শিকার করে তোমার সুখ হচ্ছে না। আমি আর জার্নয় একশো জন সৈনিক নিয়ে দেলফা যাচ্ছি আগামীকাল। ওখানকার একটা জেলায় ব্যাপকভাবে শান্তিভঙ্গ হওয়ায় সরকার আমাদের সেখানে যাবার আদেশ দিয়েছে। তুমি সেখানে সিংহ শিকার করতে চাও ত যেতে পার আমাদের সঙ্গে।

সঙ্গে সঙ্গে সানন্দে রাজী হয়ে গেল টারজান। জার্নয় কাছেই ছিল। সে কিন্তু এতে মোটেই খুশি হতে পারল না।

পরদিন সকালে রওনা হবার সময় টারজান দেখল তাদের সেনাদলের সঙ্গে দু’জন আরব ওদের সঙ্গ নিল। টারজনের এক প্রশ্নের উত্তরে জিরার্দ বলল, আমাদের সঙ্গে ওদের কোন সম্পর্ক নেই। ওরা এমনি সঙ্গে যাবে আমাদের।

টারজান আরবদের প্রকৃতি জানত। তারা বিদেশীদের মোটেই পছন্দ করে না। তারা কখনো বিনা কারণে ফরাসী সৈন্যদের সঙ্গে যাচ্ছে না। তার মনে সন্দেহ জাগায় সে তাদের উপর কড়া নজর রাখতে লাগল। আরবগুলো সেনাদলের শেষে অনেকটা পিছনে পিছনে আসছিল। টারজনের মনে হলো ওরা ভাড়াটে হত্যাকারী। আলজিরিয়ার জঙ্গলে তাকে হত্যা করলে কারো মনে কোন সন্দেহ জাগবে না।

দেলফাতে শিবির স্থাপন করে দু’দিন কাটানোর পর ঠিক হলো ওরা দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে যাবে কারণ সেখানে লুণ্ঠনকারীরা পাহাড়ের পাদদেশের অধিবাসী উপজাতিদের ধনপ্রাণ হানি করছে। এই মর্মে খবর আসায় ক্যাপ্টেন জিরার্দ সেখানে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু যাবার সময় টারজান দেখল সেই দু’জন আরব তাদের সঙ্গে যাচ্ছে না। অথচ আধঘন্টা আগেও জার্নয় সেই সব আরবদের একজনের সঙ্গে কথা বলেছে।

সেখান থেকে আবার যাত্রা শুরু করে একটা শিবিরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করল। সেখানে ক্যাপ্টেন জিরার্দ তার সেনাদলকে দু’দলে বিভক্ত করে দু’দিকে যাবার আদেশ দিল। একটা দলের নেতৃত্ব করবে সে নিজে আর একটা দলের সঙ্গে থাকবে জার্নয়। টারজান কোন দলে যাবে তা জিজ্ঞাসা করলে জার্নয় বলল, মঁসিয়ে টারজান আমার সঙ্গে চলুন।

ওরা একটা উপত্যকায় এসে পড়ল। চারদিকে ছোট ছোট পাহাড়। জার্নয় টারজানকে বলল, এবার আমরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ব। আমরা ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি এখানেই থাক।

টারজান বলল, আমিও তোমার সঙ্গে যাব। দরকার হলে লড়াই করব।

জার্নয় বলল, তুমি আমার অধীন। আমার আদেশ মেনে চলতে হবে তোমাকে।

এই বলে সে তার দলবল নিয়ে চলে গেল। টারজান একা সেখানে রয়ে গেল। তখন বিকেল হয়ে গেছে। টারজান একটা গাছের গুঁড়িতে ঘোড়াটাকে বেঁধে রেখে নিজে দাঁড়িয়ে রইল। সে রাইফেলটা পরীক্ষা করে দেখল তাতে গুলি ভরা আছে। ক্রমে সন্ধ্যে হয়ে গেলেও জার্নয় ফিরে এল না দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ল টারজান।

ভাবতে ভাবতে অল্প সময়ের মধ্যেই গাছে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল টারজান। কিন্তু হঠাৎ ঘুমটা। ভেঙ্গে গেল টারজনের। টারজান দেখল ঘোড়াটা দড়ির বাঁধন ঘেঁড়ে জন্য ছটফট করছে এবং অদূরে একটা কালো সিংহ দাঁড়িয়ে রয়েছে। বহুদিন পর সামনাসামনি একটা সিংহ দেখে ভয়ের পরিবর্তে আনন্দের রোমাঞ্চ জাগল টারজনের মধ্যে। কিন্তু এখন কোন বর্শা বা বিষাক্ত তীর নেই তার হাতে। তাই রাইফেল নিয় তৈরি হলো সে।

একটা গুলি খেয়েই ভয়ঙ্করভাবে ঝাঁপ দিল সিংহটা। কিন্তু টারজানও এক আশ্চর্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সব বিপদকে কাটিয়ে পর পর তিন চারটে গুলি করল। অবশেষে সিংহটা মরে গেল। তখন মরা সিংহটার। গায়ের উপর পা দিয়ে চাঁদের দিকে মুখ তুলে এমন জোরে বাঁদর-গোরিলাদের মত গর্জন করে উঠল যে আধ মাইল দূরে. একদুল আরব তা শুনতে পেয়ে চমকে উঠল।

টারজান বুঝল জার্নয় আর আসবে না। এটা তার এক চক্রান্ত। তাই সে সেখান থেকে হাঁটতে লাগল। কারণ সিংহটা গুলি খেয়ে লাফ দেবার সময় ঘোড়াটা দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে যায়।

সহসা একদল মানুষের চাপা পদশব্দ শুনে চমকে উঠল টারজান। চাঁদের আলোয় সে দেখল সাদা আলখাল্লা পরা একদল আরব হাতে লম্বা লম্বা বন্দুক নিয়ে আসছে তার দিকে। টারজান ফরাসী ভাষায় জিজ্ঞাসা করল তারা কি চায়। সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকের একটা গুলি এসে তার কপালটা একটু ছিঁড়ে দিয়ে চলে গেল। মুখ থুবড়ে পড়ে গেল টারজান।

তখন তারা টারজানকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে একটা ঘোড়ার উপর চাপিয়ে দিল। তারপর সেখান থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে সকলে যাত্রা শুরু করল। এইভাবে ছ’ঘণ্টা মরুভূমির উপর দিয়ে দ্রুতবেগে যাবার পর পরদিন দুপুরে ওরা একটা আরবদের বস্তিতে গিয়ে উঠল। বস্তিটা ছোট, মাত্র কুড়িটা তাবু আছে। একটা আরব সর্দারের বাড়িতে গিয়ে বন্দী টারজানকে নিয়ে উঠল ওরা।

এমন সময় একজন বুড়ো শেখ এসে সবাইকে বলল, কেউ বন্দীর গায়ে হাত দেবে না। আলি বেন আমেদ বলেছে, ও একজন বীর; একটা সিংহ মেরে পাহাড়ের ধারে একা বসেছিল। বন্দী যেই হোক, একজন বীর পুরুষ এবং তাকে আমরা শ্রদ্ধা করব যতক্ষণ সে আমাদের এখানে থাকবে। ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি একটা তাঁবুর মধ্যে বন্দী টারজানকে রেখে তাকে কিছু খাবার দেওয়া হলো। দরজার কাছে। পাহারাদার বসিয়ে দেওয়া হলো। ওদের কথা শুনে টারজান বুঝল যেসব আরব ওকে ধরে এনেছে তারা তাকে একজন লোকের হাতে তুলে দেবে। সেই লোকটার দ্বারাই একাজে নিযুক্ত হয়েছে তারা।

গোধূলিবেলায় একদল আরব টারজনের তাবুর সামনে এসে দাঁড়াল। তাদের মধ্যে একজন টারজনের কাছে আসতেই টারজান তাকে চিনতে পারল। সে হচ্ছে নিকোলাস রোকোফ। রোকোফ বলল, কি মঁসিয়ে টারজান, ওঠ, আমাকে অভ্যর্থনা করো কুকুর কোথাকার!

এই বলে সে পর পর কয়েকটা লাথি মারল টারজানকে।

টারজান কোন কথা বলল না। তখন সেই বুড়ো শেখ সর্দার এগিয়ে এসে বলল, পরে যা করো করবে, আমার সামনে কোন বীর পুরুষকে মারতে বা অপমান করতে দেব না কাউকে। আমি তাহলে ওর বাঁধন খুলে দেব। তখন দেখব তুমি কেমন মার ওকে।

রোকোফ শেখকে চটাতে চাইল না। সে থেমে গেল। বলল, ঠিক আছে, পরে আমি ওকে খুন করব।

শেখ বলল, আমার বাড়ির সীমানার মধ্যে নয়। আগামীকাল সকালে তুমি একে নিয়ে মরুভূমিতে গিয়ে যা পার করবে। তবে যাই করো আমাদের গায়ের সীমানা পার হবার আগে নয়।

রোকোফ তাতেই রাজী হয়ে চলে গেল সেখান থেকে।

ক্রমে রাত বাড়তে লাগল। তাঁবুতে একা পড়ে রইল টারজান। হঠাৎ সিংহের ডাক শুনতে পেয়ে চমকে উঠল সে। বস্তিটার বাইরে কিছু দূরে একটা সিংহ গর্জন করছিল। ক্রমে সেই সিংহটা তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। টারজান ভাবতে লাগল সে ত আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাঁচবে। তাতে যদি সিংহের হাতে প্রাণ যায় ত যাবে।

তাঁবুর ভিতরটা ভীষণ অন্ধকার। সে অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। সহসা টারজান বুঝতে পারল তাঁবুটা সরিয়ে এক পাশ থেকে কে ঢুকছে। ওর মনে হলো রাতের অন্ধকারে নির্জনে তাকে হত্যা করতে আসছে রোকোফ। কিন্তু এক নারীকণ্ঠ তার নাম ধরে ডাকতেই টারজান বলল, হ্যাঁ আমি। কিন্তু তুমি কে?

নারীকণ্ঠ উত্তর করল, আমি সিদি এইসার আউলেদ নাইন।

সঙ্গে সঙ্গে টারজান দেখল আউলেদ তার ছুরি দিয়ে তার বাঁধনগুলো কেটে দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে গেল টারজান।

টারজান বলল, তুমি কেন এখানে এলে? কি করে জানলে আমি এখানে বন্দী হয়ে পড়ে আছি?

আউলেদ বলল, আমি কাদুর বেন সাদেনের মেয়ে। আমাকে যে একদিন উদ্ধার করেছে তার জন্য আমার জীবনকে বিপন্ন করব সে আর বেশি কথা কি?

টারজান বলল, কিন্তু কেমন করে তুমি জানলে যে আমি বন্দী হয়েছি?

আচমেত তয়েব নামে আমার এক জ্ঞাতি ভাই তার কোন বন্ধুর সঙ্গে এখানে দেখা করতে এসেছিল। তোমাকে এখানে যারা ধরে এনেছিল তাদেরই একজন তার বন্ধু। সে গিয়ে আমাদের বলে একজন ফরাসীকে অন্য একজন ফরাসীর হাতে তুলে দেবার জন্য তারা বন্দী করে আনে। তার বিবরণ থেকে বুঝতে পারি তুমিই সেই ফরাসী। তখন আমার বাবা বাড়িতে ছিল না। আমি দুটো ঘোড়া নিয়ে চলে আসি এখানে। কাল সকালে আমরা আমাদের বাড়ি গিয়ে পৌঁছব। তখন আমার বাবা এসে যাবে। তখন, দেখব ওরা কেমন করে কাদুরের বন্ধুকে ছিনিয়ে আনে তার কাছে থেকে।

এক জায়গায় এসে আউলেদ সভয়ে বলল, আমি ত ঠিক এইখানে ঘোড়া দুটোকে ছেড়ে রেখে যাই। কিন্তু এখানে নেই ত।

টারজান বলল, সিংহ দেখে ঘোড়া দুটো বোধ হয় ছুটে পালিয়ে গিয়েছে।

অগত্যা আবার হাঁটতে লাগল ওরা। এখানকার পথঘাট আউলেদের সব চেনা।

সহসা এক সময় একটা কালো সিংহ ওদের পথ রোধ করে সামনে এসে দাঁড়ালো। তার হলুদ চোখ দুটো জ্বলছিল। আউলেদ হতাশ হয়ে বলল, সব শেষ।

টারজান আউলেদের কাছ থেকে ছুরিটা নিয়ে তাকে বলল, তুমি চলে যাও। আমি দেখছি।

আউলেদ চলে গেল না। শুধু একটু সরে দাঁড়াল। সিংহটা এবার টারজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠল। সিংহের সঙ্গে কিভাবে লড়াই করতে হয় টারজান তা জানত। সে সিংহটার পিছন দিক দিয়ে এক আশ্চর্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তার পিঠের উপর উঠে পড়ে তার কেশরগুলো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তারপর তার হাতের ছুরিটা বারবার সিংহটার গলায় ও পাঁজরে আমূল বসিয়ে দিতে লাগল। অবশেষে সিংহটা নিষ্প্রাণ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তার মৃতদেহের উপর পা তুলে দিয়ে চাঁদের দিকে মুখ তুলে বাঁদর-গোরিলাদের ভঙ্গিতে এক বিকট গর্জন করে উঠল।

আউলেদ ভয় পেয়ে গেল। তার মনে হলো টারজান যেন পাগল হয়ে গেছে। আউলেদ বলল, কি ধরনের মানুষ তুমি। তুমি যেভাবে সিংহটাকে মারলে তা ভাবাই যায় না। এমন কথা কখনো শুনিনি আমি। কিন্তু ওভাবে চীৎকার করলে কেন তুমি?

টারজান বলল, যখন আমি কাউকে হত্যা করি তখন আমি যেন মানুষ থাকি না, আমি যেন পশু হয়ে যাই।

আবার তারা যাত্রা শুরু করল। পাহাড়ি পথ পার হয়ে মরুপথে গিয়ে পড়ল। কিছুদূর যাবার পর ওরা একটা ছোট নদীর ধারে এসে দেখলো ঘোড়া দুটো চরছে। সেই ঘোড়া দুটোতে দু’জন চেপে ওরা যখন কাদুর বেন সাদেনের বাড়িতে পৌঁছল তখন বেলা নটা বাজে। কাদুন তখন বাড়ি ফিরে তার মেয়েকে দেখতে না পেয়ে পঞ্চাশজন সশস্ত্র লোক নিয়ে মেয়ের খোঁজে বার হবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। এমন সময় মেয়েকে দেখতে পেয়ে তার মুখ থেকে সব কথা শুনে টারজনের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল কাদুরের। টারজান শুধু একটা ছুরি দিয়ে একটা সিংহকে বধ করেছে একথা শুনে আরবরা সবাই টারজানকে অপরিসীম শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে দেখতে লাগল।

এক সপ্তাহ কাদুরের বাড়িতে অতিথি হিসাবে রইল টারজান। তারপর সে বিদায় নেবার সময় কাদুর পঞ্চাশজন সশস্ত্র আরবকে সঙ্গে নিয়ে টারজনের সঙ্গে বু সাদা পর্যন্ত গেল। টারজান এখন ওখানে গিয়ে তার দলের সঙ্গে মিলিত হবে।

পরদিন সকালে টারজান একটা ঘোড়ায় চেপে বুইরা ও আলজিয়ার্সের পথে রওনা হলো। জার্নয় যে হোটেলে ছিল, তার সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখল হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে জার্নয়। টারজান হাত তুলে নমস্কার করতে জার্নয়ও যন্ত্রচালিতের মত প্রতিনমস্কার জানাল। তার মুখে স্পষ্ট ভয়ের চিহ্ন ফুটে ছিল।

সিদি এই সাথে টারজান পৌঁছতেই এক ফরাসী অফিসারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল টারজনের।

অফিসার তাকে জিজ্ঞাসা করল, আজ সকালেই বু সাদ। ত্যাগ করেছ? জার্নয়কে দেখেছিলে?

টারজান বলল, হা, কি ব্যাপার?

জার্নয় আজ সকাল আটটার সময় গুলি করে আত্মহত্যা করেছে।

দুদিন পর সেখান থেকে আলজিয়ার্স শহরে গিয়ে পৌঁছল টারজান। এখান থেকে সে সরকারের নির্দেশে একটা জাহাজে করে কেপটাউন শহরে যাবে। যাবার আগে সে কর্তব্য ভার গ্রহণ করার পর থেকে যা যা ঘটেছে তার একটা পূর্ণ বিবরণ লিখল।

টারজান জাহাজে ওঠার সময় দেখল দু’জন সৌখিন পোশাক পরা লোক তাকে লক্ষ্য করছে বিশেষভাবে। দু’জনেরই মুখ দাড়ি কামানো। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এক ছদ্মনাম গ্রহণ করেছিল টারজান। জাহাজে যাত্রাকালে তার নাম হবে কডওয়েল, লন্ডন।

সেদিন রাত্রিতে জাহাজে এক তরুণীর সঙ্গে আলাপ হলো। তরুণীটির সঙ্গে তার মা ছিল। তরুণীর নাম হেজেল স্ট্রং। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল টারজনের এই হেজেল স্ট্রংকে উদ্দেশ্য করেই জেন পোর্টার একখানি চিঠি লিখেছিল তার কেবিনে থাকাকালে। হেজেল জেনের বিশেষ অন্তরঙ্গ বন্ধু।

কয়েক মাস আগে টারজান যখন ইউসকনসিন স্টেশনে জেনদের কাছ থেকে বিদায় নেয় তার কিছু পরে টারজনের কাছে পাঠানো দার্ণতের টেলিগ্রামটা পায় ক্লেটন। টেলিগ্রামটায় লেখা ছিল, তোমার আঙ্গুলের ছাপ থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে তুমিই লর্ড গ্রেস্টোক।

এই কথাগুলো পড়েই মুহূর্তে টারজনের জন্ম রহস্যটা উদ্ঘাটিতে হয়ে পড়ে ক্লেটনের কাছে। বুঝতে পারল সে নিঃস্ব। তার কিছু নেই। যে বিরাট ভূ-সম্পত্তি ও লর্ড উপাধি সে ভোগ করছে আসলে তা সব টারজনের।

জেনরা ক্লেটনকে ডাকতেই প্লাটফরমে গাড়ি এসে গেল। ক্লেটন ওদের জিজ্ঞাসা করল, টারজান কোথায়?

জেন বলল, ও তার গাড়িতে করে চলে গেছে। ও এখান থেকে নিউ ইয়র্ক যাবে।

ক্লেটন তখন টেলিগ্রামটার কথা কাউকে বলল না।

বাল্টিমোরে পৌঁছে ক্লেটন তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেরে ফেলতে চাইল। বলল, আমি লন্ডনে ফিরে যাব। বিয়ের পর তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই।

জেন বলল, এত তাড়াতাড়ি সম্ভব নয়। এখনো এক মাস দেরী হবে।

বাবার সঙ্গে লন্ডনে আসার পরেও জেনের মতের পরিবর্তন হলো না। বিয়েটা সে কিছুতেই সেরে ফেলতে চাইল না। এমন সময় টেনিংটন নামে এক ভদ্রলোক অধ্যাপক পোর্টারের কাছে জলজাহাজে আফ্রিকা ভ্রমণের এক প্রস্তাব আনতেই রাজি হয়ে গেল জেন। জেন তখন একটা অজুহাত পেয়ে গেল। ক্লেটনকে বলল, আমাদের ফিরতে অন্তত এক বছর লাগবে। তার আগে বিয়েটা সম্ভব নয়। টেনিংটনের জাহাজটা প্রথমে ভূমধ্য সাগর হয়ে লোহিত সাগরে যাবে। সেখান থেকে ভারত মহাসাগর। আফ্রিকার পূর্ব উপকূল বরাবর যাবার পথে বড় বড় বন্দরগুলোতে থামবে।

একদিন জিব্রাল্টার প্রণালী থেকে দুটো জাহাজ ছাড়ল। দু’টোর গতিপথ একই দিকে। অপেক্ষাকৃত ছোট জাহাজটাতে বসে জেন তখন আফ্রিকার জঙ্গল আর জঙ্গলের সেই মানুষটার কথা ভাবছিল।

এদিকে বড় জাহাজটা যখন জেনদের ছোট জাহাজটাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল তখন তার ডেকে কডওয়েল নামধারী টারজান স্ট্রং-এর সঙ্গে কথা বলছিল।

কথা প্রসঙ্গে একসময় টারজান বলল, আমি আমেরিকা সত্যিই ভালবাসি। এই আমেরিকাতে আমার পরিচিত এমন দু’জন আছেন যাদের কথা আমি কখনো ভুলব না। তাঁরা হলেন জেন পোর্টার আর অধ্যাপক পোর্টার।

হেজেল আশ্চর্য হয়ে বলল, আপনি জেন পোর্টারকে চেনেন? সে ত আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে আমরা মানুষ হয়েছি বোনের মত। কিন্তু এখন আমি তাকে হারাতে বসেছি।

টারজান বলল, তার মানে ওঁর কি বিয়ে হয়ে গেছে?

হেজেল বলল, সবচেয়ে দুঃখের কথা কি জানেন ও যাকে ভালবাসে তাকে ও বিয়ে করছে না। ও শুধু কর্তব্যের খাতিরে বিয়ে করছে অন্য একজনকে। আমি তাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছি এটা খুব খারাপ। যার জন্য আমি তার বিয়েতে যাবও না।

টারজান বলল, আমি তার জন্য দুঃখিত।

হেজেল বলল, আমি দুঃখিত সেই মানুষটির জন্য যাকে ও ভালবাসে এবং যে ওকে ভালবাসে। আমি তাকে জীবনে কখনো দেখিনি, কিন্তু জেনের কাছে শুনেছি সে এক অদ্ভুত মানুষ। আফ্রিকার জঙ্গলে তার জন্ম হয় এবং ভয়ঙ্কর বাদর-গোরিলাদের দ্বারা নালিত-পালিত হয়। সে ওদের সকলকে কয়েকবার মৃত্যুর কবল থেকে উদ্ধার করে এবং আরো কত উপকার করে। সে জেনের প্রেমে পড়ে যায় এবং জেনও যে তাকে ভালবাসে একথা সে ক্লেটনকে বিয়ে করার কথা দেওয়ার আগে পর্যন্ত জানতে পারেনি।

হেজেলের মুখ থেকে জেনের কথা শুনতে ভাল লাগছিল টারজনের। কিন্তু যখন সে কথার মধ্যে তার নাম এসে পড়ল তখন অস্বস্তি বোধ করতে লাগল টারজান। তাই প্রসঙ্গটা পাল্টে দেবার চেষ্টা করতে লাগল সে।

একদিন টারজান দেখল মঁসিয়ে থুরান নামে জাহাজের এক যাত্রীর সঙ্গে কথা বলছে হেজেল। হেজেল তার সঙ্গে ঘুরানের পরিচল করিয়ে দিল। থুরানকে দেখে টারজনের মনে হলো সে যেন কোথায় তাকে দেখেছে এর আগে। অথচ ঠিক মনে করতে পারছে না। থুরান বসবার চেয়ারটাকে সরাতে গেলে টারজান লক্ষ্য করল তার বাঁ হাতটা ভাঙ্গা; আর রোকোফই দাড়ি কামিয়ে থুরানের নাম ধরে বেড়াচ্ছে।

কোন একটা অজুহাত দেখিয়ে রোকোফ সেখান থেকে চলে যেতে রোকোফের কাঁধে একটা হাত রেখে টারজান বলল, এখানে কি খেলা খেলছ রোকোফ?

রোকোফ বলল, আমি তোমার কথামতই ত ফ্রান্স ত্যাগ করেছি।

টারজান বলল, তা ত দেখছি। কিন্তু ছদ্মবেশ ধারণ করে এ জাহাজে নিশ্চয় বিনা মতলবে আসনি।

রোকোফ বলল, ছদ্মনাম তুমিও ত ধারণ করেছ। সুতরাং আমারও এতে অধিকার আছে।

এরপর ক’দিন রোকোফকে আর দেখতে পেল না টারজান। কিন্তু টারজান তাকে দেখতে না পেলেও চুপ করে বসে ছিল না রোকোফ। সে পলভিচের সঙ্গে সব সময় টারজনের উপর চরম প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভাবছিল।

সেদিন রাত্রিতে ডেকের উপর কোন লোক ছিল না। টারজান একা রেলিং ধরে আনমনে দাঁড়িয়েছিল। ডেকের উপরটা অন্ধকার দেখাচ্ছিল। টারজান আনমনে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকায় সে বুঝতে পারেনি দু’জন লোক পা টিপে টিপে চুপিসারে এগিয়ে আসছে তার দিকে।

রোকোফ আর পলভিচ দু’জনে অতর্কিতে টারজনের দুটো পা পিছন থেকে ধরে টারজান কিছু বুঝতে পারার আগেই তাকে জলে ফেলে দিল।

জাহাজের যাত্রীরা কেউ জানতে পারল না ব্যাপারটা। একমাত্র হেজেল স্ট্রং তার কেবিল থেকে জলের উপর একটা ভারী জিনিস পড়ার শব্দ শুনেত পেল। মনে হলো কে যেন জলে ঝাঁপ দিল। কিন্তু ব্যাপারটাকে তেমন কোন গুরুত্ব দিল না সে।

প্রতিদিন হেজেলের সঙ্গে প্রাতঃরাশ খেত টারজান। কিন্তু এই ঘটনার পরদিন সকালে প্রাতঃরাশের টেবিলে এল না টারজান।

এবার জাহাজের ক্যাপ্টেনকে ব্যাপারটা জানাল হেজেল। ক্যাপ্টেন সঙ্গে সঙ্গে কডওয়েল নামধারী একজনকে খোঁজ করার হুকুম দিল। কিন্তু কোথাও কডওয়েলকে পাওয়া গেল না। হেজেল শুধু বলল, গত রাতে সে জলে ঝাঁপ দেওয়ার মত একটা শব্দ শুনতে পেয়েছিল। এর বেশি কিছু জানে না।

দু’দিন দুশ্চিন্তায় কেবিন থেকে বার হলো না হেজেল। তার চোখে মুখে গভীর উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। চোখের কোণে কোণে কালি পড়েছিল। একদিন সে ডেকের উপর বার হতেই মঁসিয়ে থুরান নামধারী রোকোফ এসে তাকে বলল, আমিও ব্যাপারটা মন থেকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারছি না মিস স্ট্রং।

হেজেল ক্রমে জানতে পারল টেনিংটনের জাহাজে করে জেনরা আফ্রিকা ভ্রমণে বার হয়েছে। এক সপ্তা কেপটাউনে থাকার পর জাহাজটা আবার রওনা হয়ে পশ্চিম উপকূল হয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যাবে।

তখন দুই বান্ধবীতে ক’দিন ধরে খুব আনন্দে কাটাল।

অবশেষে ঠিক হলো হেজেলরাও একই জাহাজে জেনদের সঙ্গে ইংল্যান্ডে যাবে। ক্লেটন হেজেলদের তাদের বাড়িতে যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানাল।

কেপটাউন ছাড়ার দু’দিন পর জাহাজে একদিন হেজেলের কেবিনে জেন বসে কথা বলছিল হেজেলের সঙ্গে। হঠাৎ একটা ছবি জেনকে দেখাতে গিয়ে হেজেল বলল, ইনি হচ্ছেন জন কডওয়েল। ইনি বলেছিলেন ইনি তোমাকে চেনেন। জাহাজে আসার পথে আলাপ হয়। ভদ্রলোক একদিন সমুদ্রের জলে পড়ে মারা যান।

ছবিটা দেখেই টারজানকে চিনতে পারল জেন। কাতরভাবে বলতে লাগল, মারা গেছে ওকথা বলো না হেজেল। বল, তুমি ঠাট্টা করছ আমার সঙ্গে।

এই কথা বলে মুর্ছিত হয়ে মেঝের উপর পড়ে গেল জেন। হেজেলের চেষ্টায় কিছুক্ষণের মধ্যেই জেনের জ্ঞান ফিরে এলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তার মুখপানে তাকিয়ে রইল হেজেল। ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে না পেরে বোকার মত বলল, তুমি জন কডওয়েলকে এমন অন্তরঙ্গভাবে ভালবাসতে তা আমি জানতাম না জেন।

জেন বলল, ও জন কডওয়েল নয় হেজেল। ও ছবি হচ্ছে টারজনের। ও ছবি আমার মনের মধ্যে গাঁথা রয়ে গেছে।

হেজেল বলল, উনি বলতেন, আফ্রিকায় ওঁর জন্ম, ফ্রান্সে শিক্ষালাভ করেন।

 জেন বলল, হ্যাঁ, তাই।

হেজেল বলল, তাহলে উনি জন কডওয়েল ছদ্মনাম নিয়ে জাহাজে ভ্রমণ করছিলেন। প্যারিসে কেনা ওঁর মালপত্রে জে. সি. টি. এই তিনটি অক্ষর লেখা ছিল। টি-টি টারজনের আদি অক্ষর।

চারদিন তার কেবিনে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে রইল জেন। সে ঘর থেকে একবারও বার হত না। একমাত্র হেজেল আর এসমারান্ডা ছাড়া তার ঘরে কেউ ঢুকতে পেত না কেউ।

জেনের অসুখের পর একটার পর একটা করে বিপর্যয় দেখা দিতে লাগল জাহাজে। প্রথমে জাহাজের ইঞ্জিন খারাপ হয়ে গেল। ইঞ্জিনের মেরামত চলাকালে দুদিন জাহাজটা আপনা থেকে ভেসে বেড়াতে লাগল মাঝ সমুদ্রে। আর একদিন দু’জন নাবিক ঝগড়া ও মারামারি করতে লাগল। একজন অন্য জনকে ছুরি মারল। একজন আহত হলো আর একজনকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হলো। কোন এক রাত্রিতে একটা নাবিক সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দিয়ে ডুবে গেল। অনেক খুঁজেও তার মৃতদেহ পাওয়া গেল না।

তখন নাবিকরা বলাবলি করতে লাগল, জাহাজ ছাড়ার সময় ওরা কুলক্ষণ দেখতে পায়। কপালে আরো কষ্ট আছে ওদের।

সত্যিই সে কষ্টের জন্য বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না ওদের। একদিন বেলা একটার সময় জাহাজের গায়ে একটা ফাটল দেখা দিল। জাহাজটা হঠাৎ কাত হয়ে গেল অনেকখানি। এমন সময় একজন নাবিক তলা থেকে ছুটে এসে খবর দিল, জাহাজে জল ঢুকছে, আর কুড়ি মিনিটের বেশি ভেসে থাকতে পারবে না জাহাজটা।

জাহাজের মালিক টেনিংটন ও সব যাত্রীরা তখন ডেকের উপর জড়ো হয়েছে। টেনিংটন সবাইকে সাহস দিয়ে বলল, ভয়ের কিছু নেই। মহিলারা জিনিসপত্র নিয়ে সব তৈরি হয়ে নিন। যে চারখানা নৌকা আছে তা প্রস্তুত করো।

চারখানা নৌকা যাত্রী বোঝাই হয়ে সমুদ্রে নেমে পড়ল। ওদের চোখের সামনে জাহাজটা ধীরে ধীরে ডুবে গেল।

নৌকার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিল জেন। পরদিন সকাল হবার অনেক পরে কড়া রোদ উঠতে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল নৌকার উপর রয়েছে সে, ক্লেটন, মঁসিয়ে থুরান আর তিনজন নৌকার মাঝি। অন্য নৌকাগুলোর কোন চিহ্ন দেখতে পেল না কোথাও। চারিদিকে ধূ ধূ করছে শুধু আটলান্টিক মহাসাগরের অনন্ত জলরাশি।

সে রাতে জাহাজ থেকে জলে পড়ার পর টারজনের হুশ হলো। বুঝলো কত সহজে রোকোফের হাতে বোকা বনে গেছে সে। হাত দিয়ে জল কেটে সাঁতার কেটে যেতে লাগল সে। দেখল জাহাজের আলোটা ক্রমে দূরে মিলিয়ে গেল। একবারও সাহায্যের জন্য চীৎকার করল না। জীবনে কখনো সে সাহায্য চায়নি কারো কাছে।

সকালের আলো দিগন্ত ফুটে উঠতেই টারজান দেখল দূরে একটা ভাঙ্গা জাহাজের একরাশ কাঠ ভেসে যাচ্ছে। টারজান কোনরকমে তার উপর উঠে বসল যাতে সাঁতার না কেটেই বিনা আয়েশে বেশ কিছুক্ষণ যাওয়া যায়। সেই ভাঙ্গা কাঠগুলোর উপর চেপেই অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল টারজান।

ঘুম ভাঙ্গতেই দুটো জিনিস চোখে পড়ল তার। সে দেখল যে স্থূপাকৃত কাঠগুলো ভেসে চলেছিল পাশে তার মাঝখানে একটা লাইফবোট আছে। আর দূর দিগন্তে বনচাপে ঘেরা একটা উপকূল দেখা যাচ্ছে। তার খুব পিপাসা পেয়েছিল। সে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাশ দিয়ে লাইফবোটটাতে চেপে বসল। সমুদ্রের ঠাণ্ডা জলে সে কিছুটা শীতল হলো। পিপাসাটা কিছু নিবারিত হলো।

নৌকাটা পরীক্ষা করে দেখল সেটা ঠিকই আছে। সেটাতে চেপে কুলের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। বিকালবেলায় সে কূলের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছল। কুলের গাছপালাগুলো তার অনেক দিনের চেনা মনে। হলো। অনেকদিন পরে তার প্রিয় কেবিনটাকে দেখতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল টারজান।

সেখান থেকে অন্য এক জনবসতির সন্ধানে এগিয়ে চলল টারজান। পথে বাঁদর-গোলিরাদের মত পড়ে থাকা পচা কাঠের গায়ে গজিয়ে ওঠা কিছু ব্যাঙের ছাতা তুলে খেল সে। সে রাতটা গাছের উপর ঘুমিয়ে কাটাল টারজান। পরদিন দেখল বনটা পাতলা হয়ে অদূরে কয়েকটা পাহাড়ের দিকে উঠে গেছে। পাহাড়ের মাঝখানে উপত্যকা দেখা যাচ্ছে। সেখানে কত হরিণ আর জেব্রা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সহসা দূরাগত মানুষের গন্ধ পেল সে বাতাসে। টারজান একটা গাছের উপর ওৎ পেতে বসে রইল। দেখল একজন নিগ্রো যোদ্ধা বর্শা ও তীর ধুনক হাতে সেইদিকেই আসছে। তার গলায় ফাঁস লাগাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠল টারজান। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো, তাকে হত্যা না করেও তার অস্ত্রগুলো সে পেতে পারে।

এমন সময় একটা সিংহ সেই কৃষ্ণকায় লোকটাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলো। কিন্তু সিংহটা লোকটাকে লক্ষ্য করে পা তুলে ঝাঁপ দিতেই তার গলাটায় টারজনের ফেলে দেওয়া ফাসটা আটকে গেল। টারজান দড়ি ধরে সিংহটাকে তুলতে গিয়ে তার ভার সামলাতে না পেরে হঠাৎ পড়ে গেল গাছ থেকে। সিংহটা এবার এক নতুন শত্রু পেয়ে টারজনের উপর ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু নিগ্রোটা তখন তার হাতের বর্শাটা সজোরে ছুঁড়ে দিল সিংহটাকে লক্ষ্য করে। বর্শাটা সিংহের বাঁ দিকের ঘাড়টাকে বিদ্ধ। করল। সময় পেয়ে টারজান তার হাতের দড়িটা গাছের গুঁড়িতে শক্ত করে বেঁধে নিল। নিগ্রোটা এবার এক বিষাক্ত তীর মারল সিংহটার পাঁজরে। টারজান তার হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে সিংহটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বার বার সেটা বসিয়ে দিতে লাগল তার গায়ে। পরে সিংহটা মরে গেলে দু’জনে দু’জনের মুখপানে তাকাল। দু’জনেই দু’জনকে তাদের উদ্ধারকর্তা হিসাবে মেনে নিল। দু’জনেই দু’জনকে ধন্যবাদ দিল আপন আপন ভাষায়।

সিংহের সঙ্গে ওরা যখন লড়াই করছিল তখন সিংহের গর্জন শুনে গ্রামবাসীরা সেদিকে ছুটে আসতে থাকে। সিংহটা মরে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই তারা ভিড় করে দাঁড়াল টারজান আর সেই শিকারিটার চারদিকে তারা প্রথমে টারজানকে সেখানে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। কিন্তু নিগ্রোটা তার গ্রামবাসীদের সব কথা বুঝিয়ে বলার পর তারা মেয়ে পুরুষ সবাই মিলে টারজানকে প্রচুর খাতির করতে লাগল। তারা তাকে গায়ে নিয়ে গিয়ে অনেক উপহার দিল। টারজান অস্ত্র চাইলে তারা বর্শা তীর প্রভৃতি অনেক অস্ত্র দিল। সেই নিগ্রো শিকারিটি তার ছুরিটা টারজানকে উপহারস্বরূপ দিয়ে দিল।

সে রাতে টারজনের সম্মানে এক নাচগানের উৎসব করল গ্রামবাসীরা। নাচের সময় টারজান দেখল তারা নরখাদক নিগ্রো নয়। রাত্রিতে টারজান তাদের গায়ের ভিতরে একটা বড় কুঁড়েতে থাকতে বলল। কন্তু টারজান জঙ্গলে গিয়ে একটা গাছের উপর ঘুমিয়ে রাত কাটাল। পরদিন সকালে আবার সেই গাঁয়ে ফরে এল টারজান। তখন গাঁয়ের লোকেরা তাকে দেখে আনন্দে চীৎকার করতে লাগল। গায়ের শকারিদের সঙ্গে জঙ্গলে শিকার করতে গেল টারজান। শিকারে তার পারদর্শিতা দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল গাঁয়ের শিকারিরা। তার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেল।

টারজান তাদের কাছে সেই গাঁয়েই রয়ে গেল। ক্রমে সে তাদের ভাষায় কথা বলতে শিখল। গায়ের সর্দার বাসুলি টারজানকে বন্ধুভাবে তাদের জাতির পূর্ব ইতিহাস সব শোনাল। বাসুলি বলল, বহু বছর আগে তারা উত্তরাঞ্চলে বাস করত। তারা তখন সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল। তারা ছিল এক শক্তিশালী উপজাতি। কিন্তু ক্রীতদাস ব্যবসায়ীরা বন্দুক নিয়ে ক্রমাগত আক্রমণ ও পীড়ন চালিয়ে তাদের শক্তি ও গৌরবের অনেকখানি নষ্ট করে দেয়।

টারজান বাসুলিকে বলল, আক্রমণকারীরা এখানে আসেনি কখনো?

বাসুলি বলল, বছরখানেক আগে একবার একদল আরব এখানে আসে। কিন্তু আমরা লড়াই করে তাদের তাড়িয়ে দিই।

কথা বলার সময় টারজান লক্ষ্য করল বাসুলির বাঁ হাতে একটা সোনার তাগা রয়েছে। টারজান তাকে। জিজ্ঞাসা করল, এই হলুদ ধাতু কোথায় পাও তোমরা?

আগে সোনা বা কোন মূল্যবান ধাতু সম্বন্ধে কোন আগ্রহ বা কৌতূহল ছিল না টারজনের। সভ্য জগতে যাওয়ার পর সে বুঝেছে এই সোনার কত দাম, কত শক্তি।

বাসুলি দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, এখান থেকে এক পক্ষকালের পথ একটা জায়গায়।

 টারজান বলল, সেখানে কখনো গেছ তুমি?

বাসুলি বলল, আমি যাইনি। আমার যখন যুবক বয়স ছিল তখন আমাদের জাতির একদল লোক এখানে বসতি স্থাপন করার পর জনপদের সন্ধানে এক জায়গায় গিয়ে হাজির হয়। সেখানকার অধিবাসীরা। এই হলুদ ধাতুর গয়না পরত। সে গাঁয়ের লোকগুলো তোমাদের মত শ্বেতকায় বা আমাদের মত কৃষ্ণকায়। নয়। তারা অদ্ভুত রকমের। বাঁদর-গোরিলাদের মত বড় বড় লোম আছে তাদের গায়ে।

টারজান বলল, তোমাদের মধ্যে যারা তখন সেখানে গিয়েছিল তাদের কেউ আছে এখন?

বাসুলি বলল, আমাদের বৃদ্ধ সর্দার ওয়াজিরি তখন বয়সে যুবক ছিল। সে তখন চৌআম্বির সঙ্গে গিয়েছিল সেখানে।

এবার ওয়াজিরিকে সেই গাঁয়ের কথা জিজ্ঞাসা করল টারজান।

ওয়াজিরি বলল, সে অনেক দূরের পথ। তাছাড়া আমি এখন বৃদ্ধ। তবে যদি একান্তই যেতে চাও তোমাকে এই বর্ষাকালটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

পরের দিন একদল শিকারি এসে খবর দিল এক জায়গায় অনেকগুলো দাঁতওয়ালা হাতি চরে বেড়াচ্ছে বনের ভিতরে। এই সব হাতি শিকার করতে পারলে দাঁতগুলো পাওয়া যাবে।

পরদিন সকাল হতেই ওয়াজিরি ও বাসুলিসহ পঞ্চাশজন যোদ্ধা শিকারে বার হলো। তাদের মধ্যে। টারজানও ছিল।

দু’ঘণ্টা হাঁটার পর ওরা বনের সেই জায়গাটাতে পৌঁছল গতকাল যেখানে হাতির পাল দেখা। গিয়েছিল। ওরা এখানে সেখানে খোঁজ করে হাতির পাল দেখতে না পেলেও টারজান বাতাসে গন্ধ শুঁকে বলল, আর বেশি দূরে যেতে হবে না। কাছাকাছিই আছে হাতির পালটা।

ওরা তখন এগিয়ে গিয়ে দেখল দল থেকে আলাদা হয়ে দুটো দাঁতওয়ালা পুরুষ হতি গাছের পাতা খাচ্ছে। তখন তীর ধনুক আর বর্শা নিয়ে ওরা হাতি দুটোকে আক্রমণ করল। টারজান গাছের উপর থেকে। সব দেখতে লাগল। দরকার হলে ও নেমে সাহায্য করবে ওদের।

একটা হাতির গায়ে ও বুকে অস্ত্রগুলো লাগায় সে পড়ে মারা গেল। কিন্তু অন্য হাতিটার গায়ে তেমন অন্ত্র না লাগায় সে ক্ষেপে গিয়ে গঁড় উঁচিয়ে তেড়ে গেল ওদের দিকে। হাতিরা পাগল হয়ে গেলে বড় ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। তাই তার সামনে কেউ দাঁড়াতে পারল না ওরা। টারজান উপর থেকে দেখল আর একটু হলেই বাসুলিকে ধরে ফেলবে হাতিটা। তাই আর দেরি না করে বাসুলি আর হাতিটার মাঝখানে হঠাৎ গাছ থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল টারজান।

হাতিটা এবার তার শিকার হাতছাড়া হয়ে যাবার ফলে একবার থমকে দাঁড়িয়ে টারজানকেই আক্রমণ করল। কিন্তু তার আগেই টারজান একটু ঘুরে গিয়ে তার হাতের বর্শাটা হাতিটার বুকে বিঁধিয়ে দিল। বর্শার ফলকটা তার বুকে আমূল বসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল হাতিটা। তখন সব নিগ্রো শিকারিরা টারজনের চারদিকে ভিড় করে দাঁড়াল। টারজান হাতির মৃতদেহটার উপর দাঁড়িয়ে মুখ তুলে ভয়ঙ্কর শব্দে গর্জন করে উঠল।

এরপর আবার ওরা হাতি শিকার শুরু করতেই টারজান ওদের পিছনে দূরে বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পেয়ে ওদের বলল, বন্দুকের আওয়াজ। নিশ্চয় তোমাদের গাঁ কেউ আক্রমণ করেছে।

ওয়াজিরিরা তখন দলবল নিয়ে গায়ের দিকে ছুটতে লাগল।

পরদিন সকালে টারজান তার দলের যোদ্ধাদের নিয়ে তাদের গায়ের চারদিকে একটু দূরে দূরে থেকে গাছের আড়ালে লুকিয়ে আক্রমণকারীদের লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়তে লাগল।

টারজনের নির্দেশমত তার দলের যোদ্ধারা গাছের আড়াল থেকে তীর ছুঁড়তে থাকায় আরবরা ও তাদের নিগ্রো যোদ্ধাদের অনেকেই সেই তীরের আঘাতে ঘায়েল হতে লাগল। অথচ তারা তাদের শত্রুদের কাউকে দেখতে পেল না বা গুলি করতে পারল না।

আরবরা তখন গা ছেড়ে চলে যাবার কথা ভাবছিল। তারা গায়ের মধ্যে একটা কুঁড়ে ঘরের মধ্যে আশ্রয় নিল। এমন সময় টারজান একটা গাছ থেকে এমন জোরে ঘরটাকে লক্ষ্য করে একটা বর্শা ছুঁড়ল যে বর্শাটা খড়ের চাল ভেদ করে আরবদের একজনের মাথায় গিয়ে পড়ল। যন্ত্রণায় একটা আর্তনাদ নিজের কানে শুনল টারজান।

এদিকে টারজনের দলের লোকেরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। তাদের যখন একজনও আহত হলো না তখন শত্রুদের অনেকেই তাদের তীরের ঘায়ে ঘায়েল হলো।

টারজান তাদের বলল, এবার তোমরা সেই শিবিরে চলে যাও। আজ আর কিছু করতে হবে না। ওরা কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে আর ভয়ে ভয়ে থাকুক। টারজানও ওদের সঙ্গে শিবিরে গেল। মরা হাতিটার মাংস। খেয়ে দুপুর রাত পর্যন্ত ঘুমিয়ে একাই এক সময় বেরিয়ে পড়ল সে।

আরবরা যে ঘরে শুয়েছিল সেই ঘরটা লক্ষ্য করে টারজান আবার একটা গুলি ছুঁড়ল।

গুলির শব্দে আর চীৎকারে আরবরা ও তাদের ক্রীতদাসরা সব কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে রাস্তায় ছোটা ছুটি করতে লাগল। কিন্তু কোথাও কোন শত্রু দেখতে পেল না। টারজান যখন দেখল তার গাছের তলায় রাস্তায় অনেক নিগ্রো ক্রীতদাস ভিড় করে গেটের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে তখন সে গাছ থেকে একটা গুলি করল এবং তাতে একটা ক্রীতদাস মারা গেল।

 বাকি ক্রীতদাসরা তাদের মালিকদের বলল, তারা আর এখানে থাকবে না। আরবরা তখন তাদের বুঝিয়ে বলল, তোমরা কোনরকমে আজকের রাতটা কাটিয়ে দাও। কাল সকালেই আমরা চলে যাব এখান থেকে।

পরদিন সকালে টারজান তার দলের যোদ্ধাদের নিয়ে গায়ের কাছে বনটায় এসে দেখল আরবরা তাদের দলবল নিয়ে গা ছেড়ে চলে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

যাবার আগে গাঁয়ের সব কুঁড়েঘরগুলো পুড়িয়ে দিতে চাইল আরবরা। তাদের হুকুমে তাদের একজন। ক্রীতদাস একটা মশাল নিয়ে একটা ঘরে আগুন ধরাতে গেলে টারজান দূরে গাছের আড়াল থেকে আরবী ভাষায় চীৎকার করে বলল, ঘর পুড়িও না। তাহলে তোমাদের খুন করব।

একথা শুনে ক্রীতদাসটা মশাল ফেলে দিল। তখন আরবরা চারদিকে তাকিয়ে কে একথা বলল তাকে খুঁজে পেল না। কোন মানুষকে দেখতে পেল না। তখন একজন আরব নিজে একটা জ্বলন্ত মশাল তুলে নিয়ে একটা ঘরে আগুন ধরাতে গেল। এমন সময় টারজনের একটা বিষাক্ত তীর দূর থেকে এসে তার বুকটাকে বিদ্ধ করল। এতে আরবরা ভয় পেয়ে আর ঘড় পোড়াল না।

এরপর আরবদের নির্দেশে হাতির দাঁতের বোঝাগুলো ক্রীতদাসরা মাথার উপর একে একে তুলে নিতে গেলে টারজান আবার তাদের উদ্দেশ্যে বলল, হাতির দাঁতগুলো নিও না, মৃত লোকের হাতির দাঁতে কোন প্রয়োজন নেই।

পরদিন সকালে ক্রীতদাসরা বোঝা কাঁধে তুলতে অস্বীকার করলে আরবরা তাদের দু’জনকে গুলি করে মারল। তখন সুযোগ বুঝে টারজান গাছের আড়াল থেকে ক্রীতদাসদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগল, তোমরা হাতির দাঁতের বোঝা তুলো না। তাহলে তোমরা মারা পড়বে। তোমরা তার থেকে তোমাদের নিষ্ঠুর মালিকদের হত্যা করো। তোমাদের প্রত্যেকের হাতের বন্দুক আছে। আমরা তাহলে তোমাদের কোন ক্ষতি করব না। আমরা তাহলে আমাদের গায়ে তোমাদের নিয়ে গিয়ে খাইয়ে তোমাদের দেশে পাঠিয়ে দেব।

বিদ্রোহের আভাস পেয়ে আরবরা এক জায়গায় জড়ো হলো। তাদের সর্দার যাত্রা শুরু করার জন্য হুকুম দিল ক্রীতদাসদের। কিন্তু ক্রীতদাসরা বোঝা তুলে যাত্রা শুরু না করায় সে রাইফেল তুলে গুলি করতে গেল ওদের লক্ষ্য করে। এমন সময় একজন ক্রীতদাস তার রাইফেলটা অতর্কিতে কেড়ে নিয়ে আরবদের লক্ষ্য করে গুলি করতে লাগল। তখন সব ক্রীতদাসরা একযোগে আক্রমণ করল আরবদের। দেখতে দেখতে সব আরবরা একে একে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

টারজান এবার গাছের আড়াল থেকে বলল, এবার হাতির দাঁতের বোঝাগুলো তুলে নিয়ে আমাদের গাঁয়ে নিয়ে চল।

ক্রীতদাসরা বলল, গায়ে তোমরা আমাদের খুন করবে না তা কি করে জানব? তুমি কে কথা বলছ?

টারজান তখন আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বলল, এই দেখ আমি। তোমরা আমাদের কথা শুনলে আমরা তোমাদের কোন ক্ষতি করবো না। আরবরাই আমাদের শত্রু।

যেদিন ক্রীতদাসরা হাতির দাঁতের সব বোঝা নিয়ে গায়ে গিয়ে পৌঁছল সেদিন রাতেই গাঁয়ের লোকরা নাচগানসহ এক বিজয়োৎসব করল। তারা সর্বসম্মতিক্রমে টারজানকে তাদের সর্দার নির্বাচিত করল।

জেন যে নৌকাটাতে ছিল তাতে যাত্রীরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। সকালে জেনেরই প্রথমে ঘুম ভাঙ্গল। চোখ খুলে জেন দেখল আর নৌকা তিনটের কোন দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।

ক্রমে ক্লেটনেরও ঘুম ভাঙ্গল। সে জেনকে বলল, ইশ্বরকে ধন্যবাদ যে আমরা এক সঙ্গে আছি।

জেন তখন বলল, দেখ অন্য নৌকাগুলো কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

ক্লেটন তখন মাঝিদের জিজ্ঞাসা করতে একজন মাঝি বলল, হয়তো পিছিয়ে পড়েছে।

কিন্তু মাঝিরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে লেগে গেল। দু’জন নৌকা বাইতে বাইতে দাঁড় ছেড়ে বসে রইল। মাঝিরা ক্লেটনের কাছ থেকে খাবারের টিন আর জলের ফ্লাস্কগুলো চাইল। ক্লেটন তখন খাবারের টিনগুলো মাঝিদের হাতে দিয়ে দিল।

কিন্তু খাবারের টিনগুলো দেখা গেল তেলে ভর্তি। জলের ফ্লাস্কগুলো দেখা গেল গানপাউডারে ভর্তি। মাঝিরা এতে রেগে গেল।

ক্রমে অবস্থা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। মাঝিরা পেটের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে চামড়া খেতে লাগল। তাতে ওরা অসুস্থ হয়ে পড়ল। টমকিন নামে এক মাঝি মারা গেল। তার মৃতদেহটা নৌকার পাটাতনে পড়ে রইল সারাদিন। ক্ষিদে আর পিপাসায় ওরা প্রত্যেকেই কাতর হয়ে উঠল। ওদের গলা শুকিয়ে গেল। তার উপর সারাদিন ধরে কড়া রোদ ভোগ করে ওদের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে উঠল।

জেন মৃতদেহটাকে আর সহ্য করতে পারছিল না। সে ক্লেটনকে বলল, ওটাকে জলে ফেলে দাও।

ক্লেটন মৃতদেহটাকে একা সরাতে পারছিল না। তাছাড়া সে সেটাকে সরাতে গেলে উইলসন নামে এক মাঝি তাকে বাধা দিল। রোকোফ বা মঁসিয়ে থুরান ক্লেটনের সাহায্যে এগিয়ে গেলে উইলসন বলল, ও ত মারা গেছে, আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। ওকে সরিও না।

এ কথার অর্থ বুঝতে পারল ক্লেটন। অর্থাৎ পেটের জ্বালায় ওরা নরমাংস খেতে চায়। অবশেষে অন্য এক মাঝি স্পাইডার ক্লেটনদের সঙ্গে একমত হলে উইলসন আর আপত্তি করল নার। মৃতদেহটাকে ক্লেটন আর রোকোফ দুজনে মিলে নৌকা থেকে তুলে সমুদ্রের জলে ফেলে দিল।

রাত্রিতে ক্লেটনের চোখে যখন ঘুম জড়িয়ে ধরেছিল তখন সে এক সময় দেখল উইলসন কেমন। অদ্ভুতভাবে তার পানে তাকাচ্ছে। সে দৃষ্টির অর্থ বুঝতে দেরি হলো না তা। ভয়ে গা শিউরে উঠল আর। কতক্ষণ ঘুমে অচেতন হয়ে ছিল সে তা সে জানে না। কিন্তু একটা খসখস আওয়াজ শুনে তার ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। চাঁদের আলোয় সে চোখ মেলে দেখল উইলসন গুঁড়িমেরে তার দিকে এগিয়ে আসছে। ক্লেটন তার মুখটা সরিয়ে নিল। তার মুখ থেকে জিবটা বেরিয়ে পড়ে ঝুলছিল। তার চোখগুলো জ্বলছিল।

জেনও জেগে উঠেছিল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সে ভয়ে চীৎকার করে উঠল। তার চীৎকারে থুরান ও স্পইডারও জেগে উঠল। ততক্ষণে দুর্বল ক্লেটনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দাঁত দিয়ে তার গলাটাকে ছেঁড়ার চেষ্টা করছে উইলসন। অবশেষে তিনজনে মিলে উইলসনকে টেনে সরিয়ে নৌকার পাটাতনের উপর ফেলে দিল। উইলসন পাগলের মত হাসতে হাসতে নৌকা থেকে সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দিল।

পরদিন সকালে রোকোফ ওরফে থুরান ক্লেটনের কাছে তার একটা প্রস্তাব রাখল। বলল, আমাদের এখন ক’দিন এভাবে যেতে হবে তার ঠিক নেই। আরো চার পাঁচদিনের আগে কূল পাওয়া যাবে বলে। মনে হয় না। কিন্তু এভাবে চললে আমাদের সবাইকে মরতে হবে। তার থেকে আমাদের মধ্যে যেকোন একজনকে মরতে হবে যাতে আর সবাই দিনকতক বাঁচতে পারে। তাই আমি ভাগ্য পরীক্ষা করতে চাই।

এ কথার মানে বেশ বুঝতে পারল ক্লেটন। এ কথায় জেন বা ক্লেটন কেউই রাজী হলো না। তখন সুচতুর রোকোফ বলল, মিস পোর্টার এই লটারী বা ভাগ্য পরীক্ষা থেকে বাদ, কারণ তিনি মেয়ে মানুষ। বাকি তিনজনের মধ্যে বেশিরভাগ যা চাইবে তাই হবে। তখন মাঝি স্পাইডারও রোকোফের মতে সায় দিল। ক্লেটন নিরুপায়। রোকোফের কিছু তাস ছিল। সে তাসের খেলা জানত। একটা নম্বরের কথা জানিয়ে নিজে তোলার পর বাকি ছ’জনকে একে একে সাত তুলতে বলল রোকোফ। এই তাসের লটারীতে ক্লেটন হেরে গেল। রোকোফ হয়ত তাই চেয়েছিল।

জেন তখন অচেতন হয়ে পড়েছিল, তিনদিন সে কোন কথা বলেনি। ক্লেটন বলল, এখন বিকেল, সন্ধ্যা হোক। জেন যেন দেখতে না পায়।

রোকোফ তার পায়জামার পকেট থেকে একটা ছুরি বার করল। তার লোভাতুর চোখদুটো ক্লেটনের উপর সদা সর্বদা নিবদ্ধ ছিল। না খেয়ে খেয়ে সেও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সন্ধ্যে হতেই দুর্বলতায় ক্লেটনও শুয়ে পড়ল। সে একপাও নড়তে পারছিল না। তার কথা বলারও ক্ষমতা ছিল না।

রোকোফ ক্লেটনকে বলল, তুমি আমার কাছে এস।

ক্লেটন উঠে বসে যাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু পারল না। টলে পড়ল। টলতে টলতে অসার হয়ে শুয়ে পড়ল। রোকোফ বলল, তুমি তোমার দায় এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছ। আমার সঙ্গে ছলনা করছ।

ক্লেটন বলল, না ছলনা করছি না। তুমি এস, আমি প্রস্তুত।

রোকোফ ফিস ফিস করে বলল, হ্যাঁ, আমিই যাচ্ছি।

অবশেষে ক্লেটন বুঝতে পারল রোকোফ তার খুব কাছে এসে পড়েছে। সে রোকোফের ক্রুর হাসির শব্দ শুনতে পেল। কে যেন মুখটা তার চেপে ধরল। তার পরেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল সে।

ওয়াজিরিদের সর্দার হবার পর সোনার সন্ধানে এক অভিযানে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল টারজান। যারা তার সঙ্গে স্বেচ্ছায় যেতে চায় এমন শক্ত সমর্থ পঞ্চাশজন যোদ্ধাকে বেছে নিল সে। কত পাহাড়, প্রান্তর, বন, নদী পার হয়ে পঁচিশ দিন পর তারা এক পাহাড়ের ধারে এসে এক শিবির স্থাপন। করল। সেই পাহাড়টার উপর থেকে সেই আশ্চর্য নগরটাকে দেখার আশায় পরদিন সকালেই ওরা পাহাড়টার চূড়ায় ওঠার চেষ্টা করতে লাগল। অনেক চেষ্টার পর টারজান একা পাহাড়টার চূড়ার উপর। উঠে দাঁড়াল। সামনে দেখল এক বিরাট উপত্যকা প্রসারিত হয়ে আছে। সেই উপত্যকার শেষ প্রান্তে একটা উঁচু পাথরের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা এক বিরাট নগরী রয়েছে মনে হলো।

পাহাড় থেকে নেমে এসে টারজান তার দলের লোকদের নিয়ে সেই নগরীর দিকে এগিয়ে চলল।

 অবশেষে সেই নগরপ্রাচীরের বাইরে গিয়ে হাজির হলো ওরা। পঁচিলটা পঞ্চাশ ফুট উঁচু। তার উপর ওঠা বা সেটা পার হওয়া সত্যিই এক কঠিন ব্যাপার।

 সেই পাঁচিলটার বাইরেই রাতটা কাটাবার জন্য এক শিবির স্থাপন করল টারজান। শোবার সময় নগরীর ভিতর এক অদ্ভুত চীৎকার শুনে ভয় পেয়ে গেল ওয়াজিরিরা। চীৎকারটা মানুষের আর্তনাদের মত শোনালেও ঠিক বুঝতে পারল না তারা।

পাঁচিলটার এক জায়গায় একটু ফাঁক ছিল। সেই দিকে ঢুকে তারা দেখল ভিতরে সেই ধরনের আর একটা পাঁচিল রয়েছে। দুটো পাঁচিল পার হয়ে ভিতরে গিয়ে টারজান দেখল সামনে একটা ফাঁকা জায়গায় অনেক বড় বড় পাথর ও ভগ্ন সৌধমালার অনেক ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে রয়েছে। ফাঁকা মাঠটার ওদিকে মন্দিরের মত একটা বড় বাড়ি রয়েছে। ওদের মনে হলো আধো অন্ধকার সেই মন্দিরের মধ্যে ছায়া মূর্তির মত কারা ঘুরে বেড়াচ্ছে ইতস্তত।

টারজান তার লোকদের ডাক দিল, এস, ভিতরে কি আছে দেখা যাক।

কিন্তু তার দলের লোকেরা যেতে চাইছিল না তার সঙ্গে। তারা তখনি ফিরে যেতে চাইছিল নিজেদের দেশে। কিন্তু টারজান যখন নীরবে এগিয়ে গেল তখন তারা তার অনুসরণ না করে পারল না।

একটা বড় বাড়িতে ঢুকল টারজান। তার মনে হলো কারা যেন তাকে দেখছে। তখন কোন জীবন্ত মানুষ দেখতে পেল না। তবু তাদের মনে হতে লাগল অসংখ্য ছায়ামূর্তি যেন নিঃশব্দ পদক্ষেপে তাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওয়াজিরিরা টারজানকে এক সময় বলল, ফিরে চল মালিক, কোন লাভ নেই এতে। এই শহরটা অনেকদিন আগে ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু মৃত লোকদের প্রেতাত্মাগুলো ছেয়ে আছে গোটা শহরটাকে।

টারজান তার লোকদের বলল, বন্ধুগণ, তোমরা যদি চাও সূর্যালোকে বাইরের জগতে ফিরে যেতে পার, কিন্তু প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব খুঁটিয়ে দেখব আমি। দেখব কোথায় সোনা আছে।

এক সময় টারজনের দলের লোকেরা ইতস্তত করতে লাগল। তারা কি করবে কিছু ভেবে পেল না। এমন সময় গতকাল রাতে যে অদ্ভুত, চীৎকারটা শুনেছিল সেই চীৎকারটা তাদের কানের কাছে ধ্বনিত হয়ে উঠল তীক্ষ্ণভাবে। চীৎকারটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাসুলি সমেত দলের সবাই ছুটে পালিয়ে গেল। টারজান একা সেই শূন্য ঘরটায় দাঁড়িয়ে রইল।

টারজান একা তখন মন্দিরের আরো ভিতরে চলে গেল। একটা রুদ্ধদ্বার ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করল টারজান। কিন্তু দরজাটা ঠেলার সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই চীৎকারটা ধ্বনিত হয়ে উঠল। টারজান ভাবল এই ঘরটাই হয়তো সোনার ভাণ্ডার। তাই তাকে সতর্ক করে। দেওয়া হচ্ছে। হয়ত এবার অদৃশ্য শত্রুরা তার সামনে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার উপরে।

তবু টারজান তার দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজাটা ফাঁক করে ভিতরে ঢুকে পড়ল। ভিতরটা দারুণ অন্ধকার। ঘরের মধ্যে কোন জানালা নেই। টারজান ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল আপনা থেকে আর সঙ্গে সঙ্গে কতকগুলো হাত ধরে ফেলল টারজানকে।

যে হাতগুলো টারজানকে ধরেছিল প্রচুর লড়াই করে সেগুলোর থেকে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করেও তা পারল না টারজান। হাতগুলো সংখ্যায় ছিল অগণ্য এবং তারা টারজানকে বেঁধে ফেলল। কিন্তু সেগুলো। কাদের হাত, কারা তাকে বাধল তা বুঝতে পারল না টারজান।

টারজনের হাত পা শক্ত করে বেঁধে তারা তাকে তুলে ঘরগুলো পার করে একটা ফাঁকা উঠোনে নিয়ে গেল। সেখানে তাকে তারা চিৎ করে শুইয়ে রেখে দিল। টারজান দেখল জায়গাটা চারদিকে উঁচু পাঁচিল। দিয়ে ঘেরা। মাথার উপর নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে। টারজান দেখল তাকে যারা বেঁধে এনেছিল সেই লোকগুলোর গায়ের রং সাদা। তাদের মাথার জটা বুকের উপর পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে। পাগুলো ছোট এবং মোটা। হাতগুলো লম্বা লম্বা আর পেশীবহুল।

টারজান বাঁধনের দড়িগুলো পরীক্ষা করে দেখল। কিন্তু সে তার থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল না। তখন বেলা দুপুর।

কিছুক্ষণ পর টারজান দেখল কিছু লোক এসে পাঁচিলের ধারে গ্যালারিতে এসে বসে পড়ল। আর কুড়িজন লোক হাতে খাড়া নিয়ে এক ধর্মীয় গান গাইতে লাগল। এমন সময় হঠাৎ কোথা থেকে এক নারী খাঁড়া হাতে এসে সেই লোকগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে তাদের বাধা দিয়ে কি বলতে তারা থেমে গেল।

 সেই মেয়েটি এবার টারজনের সব বাঁধন কেটে দিল। তারপর তাকে উঠে দাঁড়াতে বলল ইশারায়। এরপর তার গলায় দড়ি বেঁধে তাকে সেখান থেকে মন্দিরের অভ্যন্তরে একটা বেদীর কাছে নিয়ে গেল। টারজান দেখল বেদীর চার পাশে মানুষের রক্তের দাগ রয়েছে এবং দেয়ালে অনেক মানুষের মাথার খুলি রয়েছে। সে বুঝতে পারল এই বেদীর সামনে তাকে বলি দেওয়া হবে।

এরপর বেদীর উল্টো দিকের একটি অন্ধকার পথ দিয়ে এক যুবতী পূজারিণী একা এসে হাজির হলো সেখানে। টারজান বুঝল সেই যুবতীই হলো প্রধান পুরোহিত। তার গায়ের সোনার গয়নাগুলো হীরক খচিত ছিল। তার মুখটা ছিল বেশি বুদ্ধিদীপ্ত।

টারজান বুঝতে পারল এই সুন্দরী যুবতী কিভাবে একটু পরে রক্তপিপাসু ঘাতকীতে পরিণত হবে। প্রধান পুরোহিত ছুরি হাতে তৈরি হতেই পূজারী ও পূজারিণীরা সারবন্দীভাবে কাপ হাতে দাঁড়াল। বন্দীর দেহে ছুরিকাঘাতের সঙ্গে সঙ্গেই তারা সবাই আপন আপন কাপে রক্ত নিয়ে পান করবে।

এমন সময় পূজারীদের মধ্যে একটা তর্কাতর্কি শুরু হলো। কে প্রথমে দাঁড়াবে কে পরে দাঁড়াবে এই নিয়ে বিবাদ বাঁধল। গোরিলার মত একটা বর্বর লোক একটা বেঁটে লোককে সরিয়ে তার জায়গায় দাঁড়াবার চেষ্টা করছিল। বেঁটে লোকটা তখন প্রধান পুরোহিতের কাছে নালিশ জানাতে প্রধান পুরোহিত লোকটাকে সবচেয়ে শেষে দাঁড়াবার হুকুম দিল।

এমন সময় সেই বিক্ষুব্ধ পূজারীটা কোন অনুশাসন না মেনে তার পাশের এক পূজারীকে একটা লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত করল। তখন জোর গোলমাল শুরু হলো এবং টারজান শুয়ে শুয়ে সেদিকে তাকাল।

ক্রমে জনশূন্য হয়ে উঠল সমস্ত জায়গাটা। শুধু বেদীতে শায়িত টারজান, প্রধান পুরোহিত আর সেই বিক্ষুব্ধ উন্মত্তপ্রায় পূজারীটা ছাড়া আর কেউ ছিল না সেখানে।

এমন সময় টারজান তার সমস্ত শক্তি দিয়ে তার হাতের বাঁধন খুলে ফেলল। কিন্তু তখন দেখল সেই বিক্ষুব্ধ পূজারীটা প্রধান পুরোহিতকে জোর করে ধরে টানতে টানতে কোথায় নিয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে নারীকণ্ঠের এক আর্তচিৎকার শুনে পালাবার কথা ভুলে সেই চীৎকারের শব্দ শুনে একটা ঘরে গিয়ে। হাজির হলো টারজান। সেই ঘরটায় গিয়ে টারজান দেখল প্রধান পুরোহিতকে সেই বর্বর লোকটা দু’হাতে তাকে গলা টিপে হত্যার চেষ্টা করছে। তার হলুদ বড় বড় দাঁতগুলো চকচক করছিল বাদর-গোরিলাদের মত।

টারজান এবার লোকটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার গলাটা দুহাত দিয়ে সজোরে ধরে তাকে শ্বাসরোধ করে তার প্রাণহীন দেহটা মেঝের উপর ফেলে দিয়ে তার উপর দাঁড়িয়ে এক বিজয়সূচক চীৎকার করল। এদিকে প্রধান পুরোহিত তাদের দুজনের ধস্তাধস্তি দেখে ভয়ে স্তব্ধ হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তার আক্রমণকারী বর্বর লোকটা মরে যেতে সে ঘর থকে বেরিয়ে যাচ্ছিল একটি দরজা দিয়ে। টারজান তার একটা হাত ধরে বাঁদর-গোরিলাদের ভাষায় বলল, থাম।

প্রধান পূজারিণী বলল, কে তুমি, আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলছ?

টারজান বলল, আমি হচ্ছি বাঁদর-দলের অধিপতি টারজান।

যুবতী বলল, কি চাও তুমি? কেন তুমি আমাকে রক্ষা করলে?

আমি নারী হত্যা চাইনি।

কিন্তু এখন কি চাও?

প্রধান যুবতী টারজানকে আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বলল, তুমি এক আশ্চর্য মানুষ। একটু আগে আমি তোমাকে বধ করতে গিয়েছিলাম নিজের হাতে আর এখন তুমিই আমাকে বাঁচালে সাক্ষাৎ মৃত্যুর কবল থেকে।

টারজান বলল, আমি তোমাকে কোন দোষ দিই না, কারণ তুমি যা করছিলে তা তোমাদের ধর্মীয় প্রথার বশবর্তী হয়েই করছিলে।

যুবতী তখন বলতে লাগল, আমার নাম লা, আমি এখানকার প্রধান পুরোহিত ও পূজারিণী। এই নগরীর নাম ওপারে। আজ হতে প্রায় দশ হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা খনি থেকে সোনা তুলে এখানে সভ্যতার পত্তন করে এবং এক বিরাট নগরী গড়ে তোলে।

টারজান বলল, কিন্তু আমার কি হলো? আমাকে পালাবার পথ দেখিয়ে দাও।

লা বলল, কিন্তু এখন সব পথ বন্ধ। এখন তোমাকে একটা ঘরে লুকিয়ে রাখব। সন্ধা হলে আমি এসে তোমায় গুপ্ত পথ দিয়ে বাইরে নিয়ে যাব। আমি ওদের বলব, আমি অচৈতন্য হয়ে যাবার পর বন্দী। পালিয়ে গেছে।

একটা অন্ধকার ঘরে টারজানকে লুকিয়ে রেখে লা চলে গেল।

সহসা জ্ঞান ফিরে পেয়ে ক্লেটন দেখল মুষলধার বৃষ্টি পড়েছে। বৃষ্টির জলে তার সর্বাঙ্গ ভিজে গেছে। সে হাঁ করে কিছু বৃষ্টির জল পান করে একটু সুস্থ হলো। চোখ মেলে দেখল থুরান তার উপর অচেতন হয়ে পড়ে আছে। তার পায়ের কাছে জেন হতচেতন অবস্থায় নিথর হয়ে পড়ে আছে। তার মনে হলো। জেন মারা গেছে।

ক্লেটন কোন রকমে একটু উঠে একটা চাদরের আঁচল জলে ভিজিয়ে জেনের ঠোঁটদুটো একটু ফাঁক করে তার মধ্যে একটু জল ঢেলে দিল। শুকনো গলাটা ভিজতেই চোখ মেলে তাকাল জেন।

জেন ভয়ে ভয়ে বলল, মঁসিয়ে থুরান কোথায়? সে তোমায় মারেনি?

ক্লেটন বলল, ঐ দেখ ঐখানে পড়ে আছে। না মরলে বৃষ্টির জল পেয়ে জ্ঞান ফিরে পাবে। দেখি ওকে বাঁচাতে পরি কি না।

কিন্তু জেন হাত বাড়িয়ে তাকে নিষেধ করল। বলল, না, ওকে বাঁচিও না। ও তোমাকে খুন করবে।

দ্বিধাগ্রস্ত মনে ভাবতে লাগল ক্লেটন। ভাবতে ভাবতে এক সময় সামনে চোখ ফেলতেই আনন্দে চীৎকার করে উঠল সে, জেন, ঐ দেখ কুল।

ক্রমে নৌকাটা বেলাভূমির কাছে এসে ভিড়ল। ক্লেটন আগে নেমে পড়ে নৌকার দড়িটা একটা গাছে বেঁধে দিল যাতে নৌকাটা স্রোতের টানে ভেসে যেতে না পারে। তারপর সে জঙ্গলে গিয়ে কিছু ফল নিয়ে এসে সবাই মিলে ভাগ করে খেল।

আধ ঘণ্টা ধরে চেষ্টা করার পর থুরানের চেতনা ফিরিয়ে আনে ক্লেটন। ফল খেয়ে সবাই একটু সুস্থ হলে তারপর সবাই নৌকা থেকে নেমে বেলাভূমি পার হয়ে সেই গাছটার তলায় শুয়ে একটু ঘুমিয়ে নিল।

দিনকতক পর একদিন থুরানের কাছে জেনকে রেখে নদীতে জল আনতে যেতে বাধ্য হয়েছিল ক্লেটন। থুরান তখন জেনকে একা পেয়ে অসম্মানসূচক কি একটা কথা বলতেই জেন বলল, আজ যদি টারজান থাকত তাহলে তোমাকে সমুচিত শিক্ষা দিত।

থুরান রেগে গিয়ে বলল, সেই শুয়োরটাকে তুমি চেন?

জেন হাসতে লাগল থুরানের কথা শুনে। বলল, যারা তোমাকে ও টারজানকে দেখেছে তারা তোমার কথা বিশ্বাস করবে না।

ওরা যখন এইভাবে কথা বলছিল তখন ওরা কেউ জানত না ওদের এই বাসা থেকে উপকূলভাগের মাত্র পাঁচ মাইলের মধ্যে টারজনের কেবিন আর তারই কিছুদূরে বাকি তিনটি হারানো নৌকার যাত্রীরা সবাই নিরাপদে উপকূলবর্তী জঙ্গলেই বাস করছে। তবে ডুবে যাওয়া জাহাজের মালিক টেনিংটনের নৌকায় সব অস্ত্র থাকায় শিকারের বস্তু আর নিরাপত্তার কোন অভাব ঘটেনি তাদের। তাছাড়া তাদের নৌকাগুলোও সোজা পথে অল্পদিনের মধ্যেই কূল পেয়ে যায়। ফলে ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালায় তাদের তেমন কষ্ট পেতে হয়নি।

একদিন কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে থুরান যখন মাচার উপর ঘাসের বিছানায় শুয়েছিল তখন ক্লেটন জঙ্গলে শিকার করতে গিয়েছিল। জেন মাচার নিচে দাঁড়িয়ে কি করছিল। হঠাৎ ক্লেটন ছুটে এসে বলল, জেন পালাও, মাচায় যাও।

জেন দেখল তার পিছনে একটা সিংহ। কিন্তু সে ছুটে পালাল না। নতজানু হয়ে বসে প্রার্থনা করতে লাগল। যখন দেখল সিংহটা ক্লেটনের উপর ঝাঁপ দেবার জন্য উদ্যোগ করছে তখন সে তাদের প্রাণের সব আশা ত্যাগ করল। যুরান তা দেখে ভয়ে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল। এমন সময় জেন দেখল বনের ভিতর থেকে অদৃশ্য কোন এক মানুষের হাত থেকে ছোঁড়া বর্শা এসে সিংহটার বুকটাকে এফোড় ওফোঁড় করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সিংহটা।

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে ওঠার পর প্রধান পূজারিণী লা টারজনের ঘরে ঢুকল। তার হাতে কোন আলো ছিল না। সে টারজনের জন্য কিছু খাবার এনেছিল। অন্ধকারের মাঝেই লাকে চিনতে পারল টারজান।

লা বলল, তারা ক্ষেপে উঠেছে তোমাকে না পেয়ে। তাই এরই মধ্যে পঞ্চাশজন লোক তোমার খোঁজ করতে বেরিয়ে গেছে। এই ঘরটা ছাড়া মন্দিরের সর্বত্র খুঁজে বেড়িয়েছে তোমায়।

টারজান বলল, কিন্তু এ ঘরে আসতে ভয় পায় কেন তারা?

লা বলল, কারণ এ ঘর মৃতদের ঘর। যেসব লোককে বলি দেয়া হয় তাদের আত্মারা মৃত্যুর পর এ ঘরে এসে উপাসনা করে। জীবিত কোন লোক এ ঘরে এলে মৃতরা তাদের ধরে। যে বেঁচে রয়েছে তাকে। বলি দেয় তারা। এইভাবে তারা তাদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়। এইজন্য এ ঘরে কেউ ঢোকে না।

টারজান বলল, কিন্তু তুমি ঢুকলে কি করে?

লা বলল, আমি প্রধান পূজারিণী-আমি মৃতদের হাত থেকে নিরাপদ, এখন এস।

লা টারজানকে নিয়ে বলির বেদীর তলদেশে যে একটা অন্ধকার ঘর ছিল তার মধ্যে নিয়ে গেল। তারপর অনেকগুলো অন্ধকার বারান্দা পার হয়ে আবার একটা ঘরে রুদ্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। লা একটা চাবি বার করে তালাটা খুলে সেই ঘরের মধ্যে ঢুকে বলল, আগামীকাল রাত পর্যন্ত তুমি এই ঘরের মধ্যেই থাকবে।

টারজান দেখল একই মাপের বড় পড় পাথর দিয়ে দেওয়ালগুলো তৈরি। সহসা হাত দিয়ে পরীক্ষা করতে করতে সে দেখল দরজার উল্টোদিকের দেওয়ালটা আলগা করে গাঁথা। একটু চেষ্টা করতেই পাথর খণ্ডগুলো একটা একটা করে খুলে যেতে লাগল। টারজনের দেহটা বার হবার একটা পথ হয়ে গেল।

ওপারে গিয়ে টারজান আবার পাথর খণ্ডগুলো যথাস্থানে বসিয়ে যেমন ছিল তেমনি করে দিল। টারজান দেখল মাথার উপরে ছাদের মাঝখানে এক জায়গায় গোলাকার একটা ফাঁক রয়েছে। সেই ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়া এক ঝলক চাঁদের আলোয় টারজান দেখল সেখানে একটা জলের কূয়ো রয়েছে। কুয়োটার। পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে তার মনে হলো এই পথটা নিশ্চয় বাইরে যাবার একটা গোপন পথ। এ পথে সে বাইরে যেতে শেষ পর্যন্ত না পারলেও অন্তত একবার পরীক্ষা করে দেখতে চাইল। এগিয়ে গিয়ে দেখল সামনের দেওয়ালে আগের দেওয়ালটার মত আলগা করে পাথর গাঁথা একটা পথ রয়েছে। ওপারে গিয়ে আগের মত পাথরগুলো ঠিক জায়গায় বসিয়ে দিল। এরপর একটা সুড়ঙ্গ পথ পেল সে। সে পথে কিছুদূর যাবার পর খিল আঁটা একটা কাঠের দরজা পেল সে। খিলটা জোর করে খোলার সময় একটা জোর আওয়াজ হলো। টারজান কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে দেখল এই শব্দের কোন প্রতিক্রিয়া হয় কি না।

এরপর একটা বড় ঘরে গিয়ে দেখল সারা ঘরখানা তাল তাল ধাতুতে ভর্তি। তালগুলো অদ্ভুত আকারের কিন্তু একই মাপের। সেগুলো ভারী, কিন্তু সোনার কি না তা অন্ধকারে বুঝতে পারল না। একটা তাল নিয়ে উল্টো দিকের আর একটা দরজা দিয়ে ঘর হতে বেরিয়ে গেল টারজান।

ঘর থেকে বেরিয়ে অনেকটা পথ যাবার পর উপরে ওঠার পাথরের সিঁড়ি পেল। তারপর সেখান থেকে দেখল একটা পড় পাথর রয়েছে। তার ওপারেই নগরপ্রান্তের সেই বিরাট উপত্যকা। এবার মাথার উপর মুক্ত আকাশ থেকে চাঁদের আলো ঝরে পড়ছিল। সে আলোয় টারজান দেখল তার হাতের ধাতুর তালটা সোনার।

আপন মনে ভাবল টারজান, এই সেই প্রাচীন ওপার নগরী, সেই ভয়ঙ্কর সোনার দেশ। বিভীষিকা আর মৃত্যুর দেশ। উপত্যকার ওপারে সেই খাড়াই পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে যে পাহাড় হয়ে তারা গতকাল সকালে এখানে আসে। পা চালিয়ে উপত্যকাটা পার হয়ে সেই পাহাড়ের মাথায় উঠতে রাত কেটে গেল।

পাহাড় থেকে নেমে ধীরপায়ে সাবধানে এগিয়ে গেল টারজান। কিছুদূর গিয়ে গাছপালা দিয়ে তৈরি একটা ঝুপড়ি বা শিবির দেখতে পেল। তারপর পিছন থেকে তার দলের লোকদের চিনতে পারল।

ওয়াজিরিরা চমকে উঠে টারজানকে দেখতে পেয়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠল। বলল, আমরা তোমার কথাই ভাবছিলাম মালিক। ভাবছিলাম এখুনি তোমাকে উদ্ধার করতে যাব ওখানে।

টারজান বলল, পঞ্চাশজন লোককে এদিকে দেখেছ? তারা আমায় খুঁজছে।

বাসুলি বলল, বাঁদর-গোরিলাদের মত দেখতে ছোট ছোট পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পঞ্চাশজন লোকের একটা দল এই পথেই গেল। আমরা ওদের দেখা দিইনি।

 দিনটা সেইখানে কাটিয়ে তার দলের সবাইকে নিয়ে রাত্রিতে আবার সেই গোপন পথটা দিয়ে সেই ঘরটায় গিয়ে পঞ্চাশজন লোকের প্রত্যেকের হাতে দুটো করে সোনার তাল তুলে দিল টারজান। তারপর তারা দেশের পথে রওনা হলো। প্রায় একমাস চলার পর ওরা ওদের দেশের সীমানায় এসে পৌঁছল। কিন্তু এবার উত্তর দিকে ওদের গায়ে না গিয়ে পশ্চিম দিকের উপকূলভাগে যাবার মনস্থ করল। ওদের। বলল, তোমরা সোনাগুলো বনের এক জায়গায় রেখে দিয়ে গায়ে ফিরে যাও।

ওরা জিজ্ঞাসা করল, তুমি?

টারজান বলল, আমি দিনকতক এখানে আমার বাসায় থাকব। পরে তোমাদের ওখানে যাব।

তার দলের লোকেরা চলে গেলে টারজান আগে যেখানে অধ্যাপক পোর্টারের সিন্দুকটা পুঁতে রেখেছিল মাটিতে এবং সেখানে কোদালটা পড়ে ছিল তখনো সেখানে একটা বড় খাল করে সব সোনার তালগুলো পুঁতে রাখল।

রাতটা সেখানে কাটিয়ে পরদিন সকালে কেবিনের পথে যাত্রা শুরু করলো টারজান। কিছুদূর যাওয়ার পর বাতাসে মানুষের গন্ধ পেল। একজন শ্বেতাঙ্গ মানুষ আর সেই সঙ্গে একটা সিংহেরও গন্ধ পেয়ে গেল। একটা গাছের উপর থেকে টারজান দেখল একটা মই লাগানো মাচার নিচে একজন শ্বেতাঙ্গ মহিলা নতজানু হয়ে প্রার্থনা করছে আর একজন ভেঁড়া ময়লা পোশাক পরা শ্বেতাঙ্গ পুরুষ হাতে মুখ ঢেকে বসে। আছে। তার থেকে মাত্র তিরিশ হাত দূরে একটা ক্ষুধিত সিংহ তার উপর ঝাঁপ দেবার উদ্যোগ করছে। টারজান দেখল ধনুকে তীর লাগিয়ে ছোঁড়ার সময় নেই। এক মুহূর্ত দেরী হলে লোকটাকে আর বাঁচানো যাবে না। তাই সে তার বর্শাটা দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে সিংহটাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিল। বর্শাটা সিংহটার পিঠের উপর দিয়ে ঢুকে পেট দিয়ে বেরিয়ে এল।

টারজান দেখল মেয়েটি জেন পোর্টার। সে যেন নিজের চোখকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সে দেখল যে লোকটি ধীরে ধীরে চোখ মেলে মরা সিংহটার পানে তাকাল সে হচ্ছে ক্লেটন। টারজান কি মনে করে ওদের দেখা না দিয়ে ওয়াজিরিদের গায়ের দিকে পা চালিয়ে যেতে লাগল।

এদিকে জেন ও ক্লেটন কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর জেন প্রথমে কথা বলল, কে এই বর্শাটা ছুঁড়ল?

ক্লেটন বলল, ঈশ্বর জানেন। তারপর জেনকে বলল, তুমি মাচায় চলে যাও। আমি তো তোমাকে রক্ষা করতে পারব না।

পরের দিন থুরানের অবস্থা আরো খারাপ হলো। ক্লেটন সিংহটার মৃতদেহ থেকে বর্শাটা তুলে নিয়ে জঙ্গলে শিকারের খোঁজে বেরিয়ে গেল। জেন মাচা থেকে নেমে গাছের নিচে ঘোরাফেরা করতে লাগল। সে জঙ্গলের দিকে পিছন ফিরে থাকায় দেখতে পায়নি বাঁদর-গোরিলাদের মত দেখতে কতকগুলো বর্বর জাতীয় লোক চুপিসারে ঝোপের ভিতর দিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। ঘাসের খসখস শব্দে মুখ তুলে তাকিয়ে ভয়ে চীৎকার করে উঠল। কিন্তু তার মুখ চেপে ধরে তাকে তুলে নিয়ে চলে গেল ওরা।

জেন চেতনা ফিরে পেয়েই দেখল সে এক গভীর জঙ্গলের মধ্যে রয়েছে। তখন রাত্রিকাল। কাছেই একটা বড় অগ্নিকুণ্ড জ্বলছিল। তাতে একটা পাত্রে মাংস সিদ্ধ হচ্ছিল। তার থেকে কিছু ঝোল তুলে জেনকে খেতে দিল ওরা। কিন্তু নাকে একটা দুর্গন্ধ আসতে ঘৃণায় চোখ বন্ধ করল জেন।

দিনের পর দিন ধরে বনপথের মধ্য দিয়ে জেনকে হটিয়ে নিয়ে যেতে লাগল ওরা।

অবশেষে একটা প্রাচীরঘেরা এক প্রাচীন নগরীতে গিয়ে ঢুকল। ওরা ঢুকতেই জেনকে দেখে নারী পুরুষ সবাই জেনকে ঘিরে দাঁড়াল। মেয়েগুলোকে দেখে জেনের একটু আশা হলো, কারণ তাদের মুখগুলোকে দেখে কম নিষ্ঠুর বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু মেয়েগুলো তাকে দেখে একটা সহানুভূতির কথাও বলল না। জেনকে মাটির তলায় একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হলো। তাকে দুটো পাত্রে কিছু জল ও খাবার দেয়া হলো। এই ঘরটাতেই এক সপ্তাহ রাখা হলো তাকে। রোজ একজন করে মেয়ে এসে তাকে খাবার আর জল দিয়ে যেত। এক সপ্তাহ এইভার যাবার পর গায়ে একটু বল পেল জেন। কিন্তু সে জানত না এরপর জ্বলন্ত দেবতা সূর্যের উদ্দেশ্যে বলি দেয়া হবে তাকে।

এদিকে বর্শা ছুঁড়ে সিংহটাকে মারার পর মনের দুঃখে ওয়াজিরিদের গায়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। টারজান। কিন্তু সে আর কোন মানুষের সমাজে ফিরে যাবে না। জঙ্গলের মাঝেই একা রয়ে যাবে সে।

একথা ভাবতে ভাবতে টারজান বনের মধ্যে আগে যেখানে তার দলের বাঁদরগুলো নাচগানের উৎসব করত সেইখানে থাকতে লাগল। একদিন সেখানে একদল বাঁদর-গোরিলা ঘুরতে ঘুরতে এসে হাজির হলো।

পুরনো দিনের কথা ভেবে বয়স্ক গোরিলারা টারজানকে তাদের দলের একজন হিসেবে মেনে নিল। ফলে টারজান সেই থেকেই বাঁদরদলেই রয়ে গেল। এক সঙ্গে শিকার করতে লাগল। শিকারে টারজনের দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তা দেখে অবাক হয়ে গেল তারা। তার বুদ্ধির জন্য তাকেই তারা রাজা নির্বাচিত করল।

একদিন একটা বাঁদর অন্য কোথায় চলে গিয়েছিল ঘুরতে। ফিরে এসে সে বলল, পঞ্চাশজন অদ্ভুত ধরনের লোক একটা মেয়েকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

টারজান আগ্রহসহকারে জিজ্ঞাসা করল, লোকগুলো বাঁদরের মত দেখতে আর তাদের চেহারাগুলো বেঁটে বেঁটে? তাদের পাগুলো বাঁকা বাঁকা?

বাঁদর-গোরিলাটা বলল, হ্যাঁ।

তারা কি সিংহ আর চিতাবাঘের চামড়া পরেছিল?

 হ্যাঁ, তাদের পরনে তাই ছিল।

তারা যে মেয়েটিকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল তার গায়ের চামড়াটা খুব সাদা?

 হ্যাঁ, তার মাথায় অনেক চুল ছিল। তাকে ওরা টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।

টারজান বলল, হা ভগবান! কোথায় দেখেছ?

গোরিলাটা দক্ষিণ দিকে হাত বাড়িয়ে দেখাল।

 একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে টারজান লাফ দিয়ে গাছে উঠে তীরবেগে দক্ষিণ দিকে চলে গেল।

ক্লেটন শিকার থেকে ফিরে এসে দেখল জেন মাচার উপর নেই।

জেনের কথা থুরানকে জিজ্ঞাসা করতে সে আশ্চর্য হয়ে বলল, আমি ত জানি না। কোন শব্দও শুনতে। পাইনি।

ক্লেটন একাই বনের মধ্যে জেনের খোঁজ করে বেড়াতে লাগল। তখন সন্ধ্যে হয়ে আসছিল। কোথাও জেনের কোন সন্ধান না পেয়ে তার নাম ধরে বারবার ডাকতে লাগল। কিন্তু কোন সাড়াশব্দ পেল না।

তার ডাক শুধু একটা সিংহের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সিংহ দেখে কাছাকাছি একটা গাছের উপর উঠে পড়ল সে। সিংহটা চলে গেলেও অন্ধকারে ভয়ে গাছ থেকে নামল না।

পরদিন সকালে গাছ থেকে নেমে এসে দু’জনের আহারের সন্ধানে বার হলো ক্লেটন। এদিকে থুরানের জ্বর ছেড়ে যাওয়ায় তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে লাগল সে। এমন সময় ক্লেটন হঠাৎ জ্বরে পড়ে গেল। দিনে দিনে তার জ্বর বাড়তে লাগল। কিন্তু থুরান এবার বাইরে বেরিয়ে তার জন্য আহার সংগ্রহ করতে পারলেও ক্লেটনকে সে কিছুই দিত না। প্রথম প্রথম ক্লেটন কোনরকমে নিজেই উঠে নদী থেকে একটা পাত্র ভরে খাবার জল নিয়ে আসত। একদিন সে আর উঠতে পারল না। সে থুরানের কাছে একটু। জল চাইল।

কিন্তু থুরান এক পাত্র জল নিজে ক্লেটনের সামনে পান করে বাকি জলটা ফেলে দিল। ক্লেটনকে দিল না। বলল, তুমি জেনের সামনে আমাকে অপমান করতে।

ক্লেটন ক্ষীণকণ্ঠে বলল, সে আর বেঁচে নেই। তার কথা আর বলো না।

পরদিন থুরান তাকে একা ফেলে রেখে ক্লেটনের বর্শটা নিয়ে জনপদের উত্তর দিকে রওনা হলো।

এদিকে টেনিংটন তার দলবল নিয়ে কেবিনটা থেকে মাইলকতক দূরে সমুদ্রের ধারেই একটা জায়গায় বস করছিল। তারা রোজ বলত হারানো নৌকাটা একদিন তাদের কাছে কুলে এসে ভিড়বে।

সকলেই জেন, ক্লেটন আর থুরানের জন্য খুবই ভাবতে লাগল। টেনিংটন একদিন মিস হেজেল স্ট্রংকে বলল, আপনি কি থুরানকে বিয়ে করবেন বলে কথা দিয়েছেন?

হেজেল বলল, ভদ্রলোককে আমি পছন্দ করতাম। বড় ভাল লাগত। কিন্তু বিয়ের কথা ভাবিনি।

একদিন যখন হেজেলের সঙ্গে কথা বলছিল তখন অদূরে একজন দাড়িওয়ালা ঘেঁড়া ময়লা পোশাক পরা একটা লোককে আসতে দেখে রিভলবার থেকে গুলি করতে যাচ্ছিল টেনিংটন। কিন্তু লোকটা কাছে আসতে দেখল সে উঁসিয়ে থুরান। থুরানকে অন্যান্য যাত্রীদের সম্বন্ধে সবাই প্রশ্ন করতে সে বলল, আমরা। পথ হারিয়ে নৌকাতে প্রচুর খাদ্যাভাব ও জলকষ্ট পাই। তিনজন নাবিক একে একে মারা যায়। তারপর কুলে উঠে একটা মাচা তৈরি করে বাস করছিলাম। আমি যখন একদিন জ্বরে বেহুশ হয়ে ভুল বকছিলাম। তখন এক বন্য জন্তু তুলে নিয়ে যায় জেনকে। ক্লেটন জ্বরে মারা যায়।

এদিকে জেন সেই অন্ধকার ঘরখানায় কতদিন বন্দী ছিল তা বলতে পারবে না সে। কারণ মাটির তলায় সেই অন্ধকার ঘরখানায় দিবারাত্রি সমান ছিল তার কাছে। দিনকতক পরে একদল মেয়ে এসে তাকে নিয়ে কি একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান করল। তারপর তাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে একটা ফাঁকা উঠোনে আনল। মন্দিরের বেদীর সামনে তাকে থামতে বলল। বেদীতে রক্তের দাগ দেখে ভয় পেল জেন।

এরপর জেনকে যখন বেদীর উপর শুইয়ে দেওয়া হলো এবং প্রধান পূজারিণী তার বুকের উপর একটা ছুরি ধরে রইল তখন জেনের ভয় আরো বেড়ে গেল। ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল সে।

এদিকে টারজান বনটা পার হয়ে ওপার নগরীর দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল। বনের ভিতরটা গাছে গাছে এসেছে। তারপর থেকেই ছুটতে শুরু করেছে। একে একে পাহাড় আর উপত্যকা পার হয়ে সে। সামনের দিকে না গিয়ে গুপ্ত পথ দিয়েই প্রবেশ করল ওপারে নগরীতে।

 টারজান দেখল মন্দিরের কোন ঘরে কোন পূজারী বা পূজারিণী নেই। সবাই নরবলি দেখতে গেছে। বেদীর সামনে উঠোনটায় গিয়ে টারজান যখন অকস্মাৎ এক উন্মত্ত সিংহের মত উপস্থিত হল তখন সকলেই ভয় পেয়ে গেল। প্রধান পুরোহিত লা-এর হাত থেকে ছুরিটা পড়ে গেল। এদিকে একজন পূজারীর হাত থেকে একটা খাড়া কেড়ে নিয়ে যাকে তাকে বধ করে যেতে লাগল টারজান। সকলেই ভয়ে পালাতে লাগল।

টারজান এবার লা-এর কাছে গিয়ে বলল, আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না। আমি এই নারীকে নিয়ে যাব। একে উদ্ধার করার জন্য এসেছি। যদি তুমি আমাকে বাধা ধাও তাহলে তোমাকেও হত্যা করব।

লা ভয়ে ভয়ে বলল, কে এই নারী?

টারজান বলল, এ আমার স্ত্রী।

এই বলে অচৈতন্য জেনকে কাঁধে তুলে নিয়ে যে গুপ্তপথ দিয়ে এসেছিল সেই পথ দিয়েই চলে গেল, টারজান।

প্রথমে ভয়ে সবাই পালালেও পরে আবার দল বেঁধে পূজারীরা ফিরে এল। তারা বলাবলি করতে লাগল মন্দিরের পিছনের দিকের যে পথ দিয়ে ওরা পালিয়েছে সে পথে ওরা পালাতে পারবে না। ওদের আবার এখানেই ফিরে আসতে হবে। কিন্তু অনেকক্ষণ কেটে গেলেও টারজান যখন ফিরে এল না তখন ওরা আবার পঞ্চাশজন লোককে টারজনের খোঁজে পাঠাল।

ওপার নগরীটাকে পিছনে ফেলে এক মাইলের উপর উপত্যকাটা দিয়ে এগিয়ে যাবার পর টারজান পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল একদল লোক তার পিছনে আসছে। টারজান দ্রুত চোখের নিমেষে উপত্যকাটা পার হয়ে পাহাড়টার মাথার উপরে অবলীলাক্রমে উঠে গেল। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল পাহাড়টার ওপারে।

পাহাড়টার উপরে ওরা উঠে টারজানকে আর দেখতে না পেয়ে ফিরে গেল তারা।

এদিকে টারজান যখন দেখল তাকে আর অনুসরণ করছে না ওরা তখন একটা নদীর ধারে গিয়ে জেনকে নামিয়ে তার চোখে মুখে জলের ছিটে দিল টারজান।

জেন এবার ধীরে ধীরে চোখ মেলে বলল, টারজান তুমি?

টারজান বলল, হ্যাঁ, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, ঠিক সময়েই আমি গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। তাই তোমায় বাঁচাতে পেরেছি।

জেন বলল, হেজেল আর মঁসিয়ে থুরান যে বলল, মাঝ সমুদ্রে তুমি পড়ে গিয়ে মারা গেছ।

টারজান বলল, মঁসিয়ে থুরানই আমাকে অতর্কিতে জলে ফেলে দিয়েছিল। পরে তোমাকে সব কথা। বলব।

জেন এবার পায়ের উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, এখনো আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, জাহাজ ডুবির পর থেকে ক’মাস ধরে এত কষ্ট পাবার পর আর এত সুখ ভোগ করব। আমার মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি।

জেন বলল, এখন কোথায় যাবে, কি করবে?

টারজান বলল, বল কোথায় যেতে চাও তুমি?

হঠাৎ ক্লেটনের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় টারজান বলল, তোমার স্বামী কোথায়? তার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।

জেন বলল, ক্লেটনকে স্পষ্ট তোমার প্রতি আমার ভালবাসার কথা জানিয়ে দিই। আমি তাকে বিয়ে করতে পারব না।

এবার টারজনের মুখপানে তাকিয়ে জেন বলল, টারজান, তুমিই নিশ্চয় সেদিন সেই বর্শাটা ছুঁড়ে আমাদের প্রাণ বাঁচাও।

লজ্জায় মুখটা নামাল টারজান।

জেন বলল, কেমন করে তুমি আমাকে ফেলে পালালে?

টারজান বলল, ঈর্ষাজনিত এক রাগে ফেটে পড়ে আমি তখন চলে এসেছিলাম।

তারপর টারজান কিভাবে সমুদ্র থেকে ওয়াজিরিদের সঙ্গে মেশে এবং বাঁদর-গোরিলাদের দলে যোগ দেয় সে সব কথা একে একে বলল। ফ্রান্সে সে কি করেছিল তাও সব খুলে বলল।

জেন বলল, আমি থুরানের কথা বিশ্বাস করিনি। ওঃ, লোকটা কি ভয়ঙ্কর!

একদিন টারজান গাছের উপর থেকে তাদের দিকে অগ্রসরমান একদল মানুষের গন্ধ পেল বাতাসে। লোকগুলো কাছে এলে টারজান দেখল তারা তারই দলের লোক আর তাদের সঙ্গে বাসুলি রয়েছে। তাদের দেখে তাদের সামনে জেনকে নিয়ে নেমে পড়ল। বাসুলিরা তাদের নেতা টারজানকে ফিরে পেয়ে আনন্দে নাচতে লাগল। জেনকে তার সঙ্গে দেখে তার কথা বাসুলি জিজ্ঞাসা করায় টারজান বলল, এর সঙ্গে আমার বিয়ে হবে।

তখন জেনকে ঘিরেও ওরা নাচতে লাগল। তারপর তার দলের ওয়াজিরিদের সঙ্গে নিয়ে টারজান। জেনরা যেখানে থাকত সেই মাচাটায় গিয়ে হাজির হল।

টারজন দেখল ক্লেটনের অবস্থা সত্যিই খুব খারাপ। তার দেহটা বিছানায় মিশে গেছে। চোখগুলো কোটরে ঢুকে গেছে। বাসুলিকে নদী থেকে জল আনতে বলল। ক্লেটনের অবস্থা দেখে জেনের চোখে জল এল। টারজান বলল, আমাদের আসতে বড় দেরী হয়ে গেছে। যাই হোক দেখি কি করতে পারি।

বাসুলি জল নিয়ে এলে সেই জল ক্লেটনের চোখে মুখে ও কপালে দিয়ে কিছুটা জল তার মুখের ভিতরে ঢেলে দিল। ক্লেটন এবার চোখ মেলে তাকিয়ে টারজানকে দেখতে পেয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হলো। টারজান বলল, আর ভয় নেই। আমরা তোমাকে আবার ভাল করে তুলব।

ক্লেটন বলল, আর আমি ভাল হব না। আমি মারা যাব। তবু তোমরা এসেছ ভালই হয়েছে।

 জেন জিজ্ঞাসা করল, থুরান কোথায়?

ক্লেটন বলল, শয়তানটা আমাকে একা ফেলে চলে গেছে। প্রবল জ্বরের ঘোরে তার কাছে আমি একটু পিপাসার জল চেয়েছিলাম। কিন্তু সে আমার সামনে নিজে জল খেয়ে বাকি জলটা ফেলে দেয়।

সহসা উত্তেজনার বশে কনুই-এর উপর ভর দিয়ে উঠে বসল একবার ক্লেটন। বলল, হ্যাঁ বাঁচব। তাকে মেরে তবে মরব।

টারজান বলল, তার জন্য তোমার ভাবতে হবে না। আমি তার সঙ্গে বোঝাপড়া করব।

ক্লেটন আবার বিছানায় ঢলে পড়ল।

সন্ধ্যার দিকে ক্লেটন জেনকে ডেকে বলল, আমি তোমাদের উপর অবিচার করেছি জেন। তোমার প্রতি আমার ভালবাসার খাতিরে আমার অন্যায় আশা করি ক্ষমা করবে তুমি। যে কথা অনেক আগে তোমায় বলা উচিৎ ছিল আমার সে কথা একটি বছর ধরে বলিনি তোমায়।

এই বলে সে তার কোটের পকেট থেকে একটুকরো কাগজ বার করে জেনের হাতে দিল। তার খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। জেন তার মাথাটা তার হাতের উপর তুলে নিল। কিন্তু মাথাটা ঢলে পড়ল, তার দেহটা শক্ত ও স্থির হয়ে গেল।

ক্লেটনের মৃতদেহটার দুপাশে দু’জনে নতজানু হয়ে কিছুক্ষণ প্রার্থনা করল। তারপর দুজনেই উঠে দাঁড়াল। টারজনের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছিল। চোখে জল নিয়েই জেন কাগজটা খুলে দেখল সেটা একটা টেলিগ্রাম। দার্ণ সেটা ফ্রান্স থেকে টারজানকে পাঠিয়েছিল। তাতে লেখা আছে, তোমার আঙ্গুলের ছাপগুলো এই কথাই প্রমাণ করে যে তুমিই লর্ড গ্রেস্টোক।- ইতি দার্ণ

কাগজটা টারজনের হাতে দিয়ে জেন বলল, কথাটা সে জানলেও তোমাকে বলেনি?

টারজান বলল, আমি একথা জানতাম জেন। ইউসকনসিনের স্টেশনেই আমি এই টেলিগ্রামটা পাই। আমি সেখানেই এটা ফেলে এসেছিলাম। পরে ক্লেটন এটা পায়।

জেন বলল, কিন্তু এটা জানার পর তুমি আমাদের বলেছিলে, এক বাঁদর-গোরিলা তোমার মা আর তুমি তোমার বাবা কে জান না।

টারজান বলল, বলেছিলাম কারণ তোমাকে ছাড়া পদমর্যাদা ও ভূ-সম্পত্তির কোন প্রয়োজন অনুভব করিনি আমি।

পরদিন সকালে তার কেবিনের পথে যাত্র শুরু করল টারজান। চারজন ওয়াজিরি ক্লেটনের মৃত দেহটাকে বয়ে নিয়ে যেতে লাগল। টারজনের ইচ্ছা কেবিনের ধারে তার পিতার সমাহিত কঙ্কালের পাশে ক্লেটনকে সমাহিত করা হবে।

টারজনের মানবতাবোধ ও মমতা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল জেন।

মাইল তিনেক পথ অতিক্রম করেই কেবিনের কাছাকাছি এসে পড়ল ওরা। সহসা টারজনের দলের লোকেরা একজন বুড়ো লোকের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল টারজনের। ইতোমধ্যে জেন বুড়ো লোকটিকে চিনতে পেরে ছুটে গেল তার দিকে। বাবা বলে চীৎকার করতে লাগল সে।

জেনের কণ্ঠস্বর শুনে তার পানে তাকালেন অধ্যাপক পোর্টার। হারানো মেয়েকে দীর্ঘদিন পরে ফিরে পেয়ে আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন তাকে।

তারপর টারজানকে সশরীরে দেখতে পেয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন তিনি। তিনি বুঝতে পারলেন না তার মাথা ঠিক আছে কি না। কারণ অনেক আগেই জেনের বনদেবতা টারজনের মৃত্যু সংবাদ শুনেছেন।

ক্লেটনের মৃত্যু সংবাদ শুনে সত্যিই দুঃখে অভিভূত হয়ে পড়লেন অধ্যাপক পোর্টার। তিনি বললেন, মঁসিয়ে থুরান অনেকদিন আগেই খবরটা দিয়েছিল আমাদের।

টারজান বলল, থুরান কোথায়?

অধ্যাপক বললেন, কেবিনে। সে-ই ত আমাদের কেবিনে নিয়ে যায়। সে তোমাদের দেখে খুব খুশি হবে।

 টারজান বলল, চরম বিস্মিতও হবে।

এবার ওরা কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল সবাই মিলে। কেবিনে তখন অনেক লোক আনাগোনা করছে। টারজান সেখানে গিয়েই প্রথমে দার্ণকে দেখে আশ্চর্য হয়ে বলল, পল, একি তুমি এখানে কি করছ?

দার্ণৎ বুঝিয়ে বলল, কিভাবে এই উপকূলভাগের পাশ দিয়ে যেতে যেতে কেবিনটা দেখে নেমে পড়ে। কেবিনটাকে দেখার বড় ইচ্ছা হয় তার।

জেন টারজানকে এক সময় বলল, মঁসিয়ে থুরান যাকে রোকোফ বলছ, মিস্টার টেনিংটনের সঙ্গে সে বেড়াতে গেছে, তোমাকে দেখে সে দারুণ বিস্মিত হবে।

টারজান দাঁতে দাঁত চেপে বলল, কিন্তু তার বিস্ময়টা বড়ই ক্ষণস্থায়ী হবে।

তার এই কণ্ঠস্বর শুনে ভয় পেয়ে গেল জেন। বলল, জঙ্গলের নিয়ম আর সভ্য জগতের নিয়মকানুন। এক নয় প্রিয়তম। ওকে তুমি নিজে না মেরে ক্যাপ্টেন দাফ্রেনের হাতে তুলে দাও। আইনে ওর যা শাস্তি হয় হবে। তুমি নিজের হাতে ওকে মারলে সবাই তোমাকে দোষ দেবে, গ্রেফতার করতে বলবে। আমি তোমাকে আর হারাতে পারব না।

জেনের কথাটা মেনে নিল টারজান। এমন সময় জঙ্গল থেকে টেনিংটন আর থুরান নামধারী রোকোফ বেড়াতে বেড়াতে ফিরছিল কেবিনের দিকে। টারজানকে প্রথম টেনিংটন দেখল। টারজনের চোখে চোখ পড়তেই রোকোফের মুখটা ভয়ে সাদা হয়ে গেল।

টেনিংটন কিছু বুঝতে পারার আগেই রোকোফ তার বন্দুকটা উঁচিয়ে ধরে টারজানকে লক্ষ্য করে একটা গুলি করল। তার হাতটা টলতে থাকায় গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে টারজনের মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। দ্বিতীয়বার গুলি করার জন্য রোকোফ প্রস্তুত হতেই টারজান এসে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার। বন্দুকটা ছিনিয়ে নিল।

গুলির আওয়াজ শুনে কেবিন থেকে সবাই বেরিয়ে এল। টারজান নীরবে ক্যাপ্টেন দাফ্রেনের হাতে, রোকোফকে সমর্পণ করল। রোকোফের সব কথা আগেই ক্যাপ্টেনকে বলে রেখেছিল।

জেন এবার জাহাজ মালিক লর্ড টেনিংটনের সঙ্গে টারজনের পরিচয় করিয়ে দিল। টারজানই লর্ড গ্রেস্টোক একথা শুনে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল লর্ড টেনিংটন। দার্ণৎ তাকে টারজনের পূর্বজীবনের সব। কথা বুঝিয়ে বলল।

বিকেলের দিকে কেবিনের পাশে টারজনের বাবা জন ক্লেটনের সমাধির কাছে ক্লেটনকে সমাহিত করা হলো।

তারপর টারজান ক্যাপ্টেন দাফ্রেনকে দিনকতক অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ করল। বলল, দূর বনের ভিতরে তার কিছু জিনিসপত্র আছে। সেগুলো সে ওয়াজিরিদের সাহায্যে নিয়ে আসবে।

এই বলে তখনি চলে গিয়ে পরদিন বিকালেই এসে পড়ল টারজান। ওয়াজিরিদের সাহায্যে সোনার তালগুলো সব মটির তলা থেকে নিয়ে এসে জাহাজে তুলে দিল। খাঁটি সোনার তালগুলো দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল। কিন্তু কোথা থেকে কি করে পেয়েছে তা কাউকে বলল না টারজান।

পরদিনই জাহাজ ছাড়ার কথা ছিল। দার্ণত্রা যে জাহাজে করে এসেছিল সেই সামরিক জাহাজে করেই ওরা সবাই আপাতত ফ্রান্সে যাবে।

কিন্তু তার আগে টারজান জেনকে এক সময় বলল, আমার বড় ইচ্ছা, কেবিনেই আমাদের বিয়েটা অনুষ্ঠিত হোক। এই কেবিনেই আমার জন্ম হয়, এখানেই আমার বাবা মা দুজনেই মারা যান। এখানেই আমার কৈশোর আর যৌবনের অনেকখানি কেটেছে। এটাই আমার বাড়ি।

জেন বলল, খুব ভাল হবে।

 একথা শুনে সকলেই একবাক্যে সমর্থন করল তাদের।

টারজনের সঙ্গে জেনের বিয়েটা হয়ে যাবার পর টেনিংটনের একান্ত ইচ্ছানুসারে হেজেলের সঙ্গে তার বিয়েটাও হয়ে গেল। অবশেষে প্রস্থান সময় উপস্থিত হলো। নব দম্পতিদের ও আর সকলকে নিয়ে জাহাজ ছেড়ে দিল। ওয়াজিরিরা কূলে দাঁড়িয়ে বর্শাধরা হাত নাড়িয়ে তাদের মালিক দম্পতিকে বিদায় দিল। টারজানও জেনকে পাশে নিয়ে জাহাজের ডেকের উপর দাঁড়িয়ে তার বিশ্বস্ত ওয়াজিরি বন্ধু ও সহচরদের হাত নেড়ে বিদায় জানাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *