২৮. ঢাক বাজিতেছে

মাস দুয়েক পর। গ্রামের কলেরা থামিয়া গিয়াছে।

আষাঢ় মাসের প্রথম সপ্তাহ। সাত তারিখে অম্বুবাচী পড়িল। ধরিত্রী নাকি এই দিনটিতে। ঋতুমতী হইয়া থাকেন। আকাশ ঘন-ঘোর মেঘাচ্ছন্ন। বর্ষা প্রত্যাসন্ন বলিয়া মনে হইতেছে। মিগের বাতে এবার যেরূপ প্রচণ্ড গুমট গিয়াছে, তাহাতে এবার বর্ষা সত্বর নামিবে বলিয়া চাষী অনুমান করিয়াছিল। জ্যৈষ্ঠের শেষের দিকে মৃগশিরা নক্ষত্রে যেবার এমন গুমট হয়, সেবার বর্ষা প্রথম আষাঢ়েই নামিয়া থাকে। অম্বুবাচীতে বর্ষণ হইয়া যদি কাড়ান লাগে, তবে সে অতি সুলক্ষণ—ঋতুমতী ধরিত্রীর মৃত্তিকা জলে ভিজিয়া অপরূপ উর্বরা হইয়া ওঠে। অম্বুবাচীর তিন দিন। হল-কর্ষণ নিষিদ্ধ।

গ্রামে গ্রামে ঢোল বাজিতেছে, লড়াইয়ের ঢোল।

অম্বুবাচীতে চাষীদের মধ্যে কুস্তি প্রতিযোগিতা হইয়া থাকে। চলতি ভাষায় ইহাকে বলে আমুতির লড়াই; এখানকার মধ্যে কুসুমপুর ও আলেপুরেই সমারোহ সর্বাপেক্ষা বেশি। এই দুইখানি মুসলমানের গ্রাম। আমুতির লড়াই হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই সমারোহের বস্তু। চাষের পূর্বে চাষীরা বোধহয় শক্তি পরীক্ষা করে। এ অঞ্চলের মধ্যে ভরতপুরে হয় সর্বাপেক্ষা বড় লড়াইয়ের আখড়া। বিভিন্ন স্থান হইতে নামকরা শক্তিমান চাষীরা যাহারা এখানে কুস্তিগীর বলিয়া খ্যাত, তাহারা যোগ দেয়। ভরতপুরে যে বিজয়ী হয়, সে-ই এ অঞ্চলে শ্রেষ্ঠ বীর বলিয়া সম্মানিত হইয়া থাকে। তবে শক্তিচর্চায় শক্তি প্রতিযোগিতায় মুসলমানদের আগ্ৰহ অপেক্ষাকৃত বেশি।

যতীনের বাড়ির সম্মুখে একটা জায়গা খুঁড়িয়া উচ্চিংড়ে ও গোবরা আখড়া খুলিয়াছে। দুইটাতে সারাদিন যুধ্যমান হইয়া পড়িয়াই আছে।

আজ নিষ্ঠাবান চাষীর বাড়িতে অরন্ধন। ঋতুমতী ধরিত্রীর বুকে আগুন জ্বালিতে নাই। ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব এবং বিধবারা এই তিন দিনই অগ্নিসিদ্ধ বা অগ্নিদগ্ধ কোনো জিনিসই খাইবে না। দেবু আজ অরন্ধন-ব্ৰত প্ৰতিপালন করিতেছে। একা বসিয়া শান্ত উদাস দৃষ্টিতে চাহিয়া আছে। মেঘমেদুর আকাশের দিকে। বর্ষার সজল ঘন মেঘ পুঞ্জিত হইতেছে, আবর্তিত হইতেছে, ভাসিয়া চলিতেছে ওই দূর দিগন্তের অন্তরালে। আবার এ দিগন্ত হইতে উদয় হইয়াছে নূতন মেঘের পুঞ্জ। অচিরে বর্ষা নামিবে। অজস্র বর্ষণে পৃথিবী সুজলা হইয়া উঠিবে, শস্যসম্ভারে শ্যামলা হইয়া উঠিবে। মানুষের দুঃখ-কষ্ট ঘুচিবে।

সবুজ হইয়া উঠিবে মাঠ, জলে ভরিয়া উঠিবে ঘাট। ময়ূরাক্ষী বহিয়া গৈরিক জলস্রোত বহিয়া যাইবে। শূন্য মাঠ ফসলে ভরিয়া উঠিবে। নীল আকাশ মেঘে ভরিয়া গিয়াছে। মেঘ কাটিয়া গেলে সূর্য, রাত্রে চন্দ্র রায় ভরিয়া থাকিবে। তাহারই জীবন শুধু শূন্য হইয়া গিয়াছে। এ আর ভরিয়া উঠিবে না।

একা বসিয়া এমনি করিয়া কত কথাই ভাবে। অকস্মাৎ জীবনে যে প্রচণ্ড বিপর্যয় ঘটিয়া গেল—তাহার ফলে তাহার প্রকৃতিচরিত্রেও একটা পরিবর্তন ঘটিয়া গিয়াছে। প্রশান্ত, উদাসীন, একান্ত একাকী একটি মানুষ; গ্রামের সকলে তাহাকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে, কিন্তু তবু তাহারা তাহার পাশে বেশিক্ষণ বসিয়া থাকিতে পারে না। দেবুর নিশ্চেষ্ট নির্বাক উদাসীনতার মধ্যে তাহারা যেন হাঁপাইয়া ওঠে।

রাত্রে–গভীর রাত্রে দেবু গিয়া বসে যতীনের কাছে। ওই সময় তার সাথী মেলে। যতীন তাহাকে অনেকগুলি বই দিয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী দেবুর ছিল। যতীন তাহাকে দিয়াছে রবীন্দ্রনাথের কয়েকখানা বই, শরৎচন্দ্রের গ্রন্থাবলী, কয়েকজন আধুনিক লেখকের লেখা কয়েকখানা বইও তাহার মধ্যে আছে। নিঃসঙ্গ অবসরে উহারই মধ্যে তাহার সময় অনেকটা নিরুদ্বেগ প্রশান্তির মধ্যে কাটে। কখনও কখনও সে দাওয়ার উপর একা বসিয়া চাহিয়া থাকে। ঠিক দাওয়ার সম্মুখে রাস্তার উপরের শিউলিগাছটির দিকে। ওই শিউলিগাছটির সঙ্গে বিলুর সহস্ৰ স্মৃতি বিজড়িত। বিলু শিউলি ফুল বড় ভালবাসিত। কতদিন দেবুও বিলুর সঙ্গে শরৎকালের ভোরে উঠিয়া শিউলি ফুল কুড়াইয়াছে।

আজ আবার বৈকালে তাহাকে আলেপুর যাইতে হইবে। আলেপুরের শেখ চাষীরা তাহার নিকট আসিয়াছিল; তাহাকে তাহাদের কুস্তির প্রতিযোগিতায় পাঁচ জন বিচারকের মধ্যে এক জন হইতে হইবে। সে হাসিয়া বলিয়াছিল—আমাকে কেন ইছু-ভাই, আর কাউকে

ইছু বলিয়াছিল—উরে বাস রে! তাই কি হয়! আপনি যে বাত বুলবেন—সঁচখানা গাঁয়ের নোক সিটি মানবে।

দেবু সেই কথাই ভাবিতেছে। পাঁচখানা গ্রামের লোক তাহাকে মানিবে—একদিন এমনি আকাঙ্ক্ষাই তাহার অন্তরে ছিল। কিন্তু কোন মূল্যে সে ইহা পাইল।

যতীন যদি তাহার সঙ্গে আলেপুর যাইত, বড় ভাল হইত; এই রাজবন্দি তরুণটিকে তাহার বড় ভাল লাগে, সে তাহাকে অসীম শ্ৰদ্ধাও করে। যতীন মধ্যে মধ্যে বলে—আমাদের দেশের লোক শক্তির চর্চাটা একেবারে করে না। তাহাকে সে আমুতির লড়াই দেখাইত। সকলেই শক্তির চর্চা একদিন করিত, প্রথাটা এখনও বাঁচিয়া আছে—এই চণ্ডীমণ্ডপটার মত। চণ্ডীমণ্ডপটা এবার ছাওয়ানো হয় নাই, বর্ষায় এবার ওটা পড়িয়া যাইবে। গ্রামের লোক ছাওয়ায় নাই, শ্ৰীহরিও হাত দেয় নাই। শ্ৰীহরি ওটা ভাঙিতে চায়। এবার দুর্গাপূজার পর সর্বশুদ্ধা ত্ৰয়োদশীর দিন সে ওখানে দেউল তুলিবে, পাকা নাটমন্দির গড়িবে। চণ্ডীমণ্ডপ এখন সত্য সত্যই শ্ৰীহরির। শ্ৰীহরিই এখন এ গ্রামের জমিদার। শিবকালীপুরের জমিদারি সে-ই কিনিয়াছে। চণ্ডীমণ্ডপ তাহার নিজস্ব। ইহার মধ্যে অনাচ্ছাদিত চণ্ডীমণ্ডপের দেওয়ালগুলি বৈশাখের ঝড়ে, কাদায় ভরিয়া গিয়াছে। কত পুরাতন দিনের বসুধারার চিহ্নগুলির একটিও আর দেখা যায় না।

শ্ৰীহরিও এখন তাহাকে প্রায়ই ডাকে-এসো খুড়ড়া, আমার ওখানে পায়ের ধুলো দিয়ে। ব্যঙ্গ করিয়া বলে না, সত্যই সে অন্তরের সঙ্গে শ্ৰদ্ধা করিয়া বলে।

কিন্তু বলিলে কি হইবে? ওদিকে আবার যে শ্ৰীহরির সঙ্গে গ্রামের দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা ধীরে ধীরে বীজ হইতে অঙ্কুরের মত উদগত হইতেছে। সেটেলমেন্টের পাঁচ ধারার ক্যাম্প আসিতেছে। শস্যের মূল্যবৃদ্ধির দাবিতে শ্ৰীহরি খাজনা বৃদ্ধি দাবি করিবে। শ্ৰীহরি সেদিন তার কাছে কথাটা তুলিয়াছিল। দেবু বলিয়াছে—আশেপাশের গ্রামে কি হয় দেখ। সব গ্রামে কি হয় দেখ। সব গ্রামের লোক যদি জমিদারকে বৃদ্ধি দেয়—তুমিও পাবে।

গভর্নমেন্ট সার্ভে হওয়ার ফলে এ দেশে জমিদারদের একটা সর্বজনীন পর্বের মত খাজনা বৃদ্ধির একটা সাধারণ উপলক্ষ উপস্থিত হইয়াছে। প্রজারা চিন্তিত হইয়া উঠিয়াছে। গ্রামের মাতত্ত্বরেরা তার কাছে ইহারই মধ্যে গোপনে গোপনে আসিতেছে। সে বরাবর বলিয়াছে, মনেও করিয়াছে—এসব ব্যাপারে সে থাকিবে না। তবু লোকে শুনিতেছে না। কিন্তু খাজনা বৃদ্ধি ইহার উপর খাজনা বৃদ্ধি? সে শিহরিয়া ওঠে। গ্রামের দিকে চাহিয়া দেখে—জীৰ্ণ গ্রাম, মাত্র দুইখানা কাপড় দুই মুঠা ভাত মানুষের জুটিতেছে না, ইহার উপর খাজনা বৃদ্ধি হইলে প্রজারা মরিয়া যাইবে। চাষীর ছেলে জমিদার হইয়া শ্ৰীহরি এসব কথা প্রায় ভুলিয়াছে; কিন্তু খোকাকে বিলুকে হারাইয়া সে আজ প্রায় সন্ন্যাসী হইয়াও এ কথা কিছুতেই ভুলিতে পারিতেছে না। গত কয়েকদিন ধরিয়া যতীনের সঙ্গে তাঁহার এই আলোচনাই চলিতেছে।

কি করিবে? যদি প্রয়োজন হয়—তবে আবার সে উঠিয়া-পড়িয়া লাগিবে। মধ্যে মধ্যে মনে। হয় না, কাজ কি এসব পরের ঝঞাটে গিয়া? তাহার মনে পড়ে ন্যায়রত্নের গল্প। ধর্মজীবন যাপন করিবার ইচ্ছা হয়। কিন্তু কিছুতেই তাহা হইয়া ওঠে না। যতীন তাহাকে এ গল্পের অন্যরূপ অর্থ বুঝাইবার চেষ্ট করিয়াছে, তাহাতেও তাহার ভাল লাগে নাই। কিন্তু একান্তভাবে ধর্মকর্ম লইয়াও সে থাকিতে পারিল না—এটাই তাহার নিজের কাছে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার বলিয়া মনে হইতেছে। তাহার ভিতরে একজন কে যেন আছে যে তাহাকে এই পথে এই ভাবে লইয়া চলিতেছে। সে-ই হয়ত আসল দেবু ঘোষ।

জগন ও হরেন তো ইহারই মধ্যে ভাবী খাজনাবৃদ্ধিকে উপলক্ষ করিয়া যুদ্ধ ঘোষণার পায়তারা করিতেছে। হরেন পথে-ঘাটে পাড়ায়-পাড়ায় বেড়ায়, অকারণে অকস্মাৎ চিৎকার করিয়া ওঠেলাগাও ধর্মঘট। আমরা আছি।

বাংলার প্রজা-সমাজে ধর্মঘট একটি অতি পরিচিত কথা ও একটি অতি পুরাতন প্ৰথা। ধর্মঘট নামেই ইহার প্রাচীনত্বের পরিচয় বিদ্যমান। ধর্ম সাক্ষ্য করিয়া—ঘট পাতিয়া যে কোনো সর্বসাধারণের কর্মসাধনের জন্য পূর্ব হইতে শপথ গ্রহণ করা হইত। পরে উহা জমিদার ও প্রজারপুঁজিপতি ও শ্রমজীবীর মধ্যে দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ হইয়াছে।

ইহার মধ্যে তাহারা বিপুল উত্তেজনা অনুভব করে, সঞ্জাশক্তির প্রেরণায় অসম্ভবকে সম্ভব। করিয়া তুলিতে চায়, আত্মম্বার্থ অদ্ভুতভাবে হাস্যমুখে বলি দেয়। প্রতি গ্রামের ইতিহাস অনুসন্ধান করিলে দেখা যাইবে—দরিদ্র চাষীদের মধ্যে এক-আধজনের পূর্বপুরুষ সেকালের প্রজা-ধর্মঘটের মুখ্য ব্যক্তি হইয়া সর্বস্ব খোয়াইয়া ভাবী পুরুষকে দরিদ্র করিয়া গিয়াছে। কোনো কোনো গ্রামে পোড়ো ভিটা পড়িয়া আছে; যেখানে পূর্বে ছিল কোনো সমৃদ্ধিশালী চাষীর ঘর সে ঘর ওই ধর্মঘটের ফলে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হইয়াছে। ঘরের মানুষেরা উদরানের তাড়নায় গ্রাম ত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে, অথবা রোগ অনশন আসিয়া বংশটাকে শেষ করিয়াছে।

কিন্তু ধর্মঘট সচরাচর হয় না। ধর্মঘট করিবার মত সর্বজনীন উপলক্ষ সাধারণত বড় আসে না। আসিলেও অভাব হয় প্রেরণা দিবার লোকের। এবার এমনই একটি উপলক্ষ আসিয়াছে। এ অঞ্চলেও প্রতি গ্রামেই গভর্নমেন্ট সার্ভের পর শস্যের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে খাজনাবৃদ্ধির আয়োজন করিতেছে জমিদারেরা। প্রজারা খাজনাবৃদ্ধি দিতে চায় না। এটাকে তাহারা অন্যায় বলিয়া মনে করে। কোনো যুক্তিই তাহাদের মন মানিতে চায় না। তাহারা পুরুষানুক্ৰমে প্ৰাণপাত পরিশ্রম করিয়া জমিকে উর্বরা করিতেছে—সে জমির শস্য তাহাদের। অবুঝ মন কিছুতেই বুঝিতে চায় না। গ্রামে গ্রামে প্রজাদের জল্পনা-কল্পনা চলিতেছে। আশ্চর্য, তাহার প্রতিটি তরঙ্গ আসিয়া আঘাত করিতেছে দেবুকে!

আলেপুরের মুসলমান অধিবাসীরা তাহাকে আজ যে আমুতির লড়াই দেখিবার নিমন্ত্ৰণ করিয়াছে, সে-ও এই তরঙ্গ। লড়াইয়ের পর ওই কথাই আলোচিত হইবে।

মহাগ্রামের তরঙ্গও তাহার কাছে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। গ্রামের লোকেরা ন্যায়রত্ন মহাশয়ের সমীপস্থ হইয়াছিল। ঠাকুর মহাশয় তাহাদের পাঠাইয়া দিয়াছেন দেবুর কাছে। একটা চিঠিতে লিখিয়া দিয়াছেন—পণ্ডিত, আমার শাস্ত্রে ইহার বিধান নাই। ভাবিয়া দেখিলাম তুমি পার; বিবেচনা করিয়া বিধান দিয়ে।

ন্যায়রত্নকে সে মনে মনে প্ৰণাম করিয়াছে। তুমি আমার ঘাড়ে এই বোঝা চাপাইছে। ঠাকুর? বেশ, বোঝ ঘাড়ে লইব। মুখে তাহার বিচিত্ৰ হাসি ফুটিয়া উঠিয়াছে। সে তাই ভাবিতেছে—অন্যায় সংঘর্ষ সে বাঁধাইবে না। আগামী রথের দিন-ন্যায়রত্নের বাড়িতে গৃহদেবতার রথযাত্রাকে উপলক্ষ করিয়া যে মেলা বসিবে, সেই মেলায় সমবেত হইবে পাঁচসাতখানা গ্রামের লোক। প্রতি গ্রামের মাতব্বরেরা ন্যায়রত্নের আশীর্বাদ লইতে আসে। ন্যায়রত্ন। দেবুকে নিমন্ত্ৰণ করিয়াছেন। দেবু ঠিক করিয়াছে, সেইখানেই সকল গ্রামের মাতব্বরদের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া যাহা হয় স্থির করিবে।

—পোঁ-ভস-ভস-ভস।

রেলগাড়ি ছুটাইয়া আসিয়া হাজির হইল উদ্দিংড়ে। মুহূর্তের জন্য দাঁড়াইয়া সে বলিল–নজরবন্দিবাবু ডাকছে। তারপর মুখে বাঁশি বাজাইয়া দিয়া ছুটিল—পোঁ—ভস-ভস-ভস

দেবু উদ্দিংড়ের ভাব দেখিয়া হাসিতে লাগিল।

দেবু আসিতেই যতীন বলিল অনিরুদ্ধের কথা।

—দু মাস তো পেরিয়ে গেল দেবুবাবু। তার তো এতদিনে ফেরা উচিত ছিল। আমি হিসেব করে দেখেছি—দশ দিন আগে বেরিয়েছেন তিনি। হিসেবে তাই হয়, থানাতেও তাই বলে।

—তাই তো! অনি-ভাইয়ের তো এতদিনে ফেরা উচিত ছিল।

–আমি ভাবছি—জেলে আবার কোনো হাঙ্গামা করে নতুন করে মেয়াদ হল না তো?

বিচিত্র নয়। অনি-ভাইকে বিশ্বাস নাই। গায়ে প্রচণ্ড শক্তি, দুর্দান্ত ক্রোধী। অনিরুদ্ধ সব পারে। দেবু বলিল-কামার-বউ বোধহয় খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে?

যতীন হাসিলমা-মণি? দেবুবাবু, ও এক বিচিত্র মানুষ। দেখছেন না-বাউণ্ডুলে ছেলে দুটো আর কোথাও যায় না। বাড়ির আশপাশেই ঘুরছে দিনরাত। মা-মণি ওই ওদের নিয়েই দিনরাত ব্যস্ত। একদিন মাত্র অনিরুদ্ধের কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। ব্যস। আবার যেদিন মনে পড়বে জিজ্ঞাসা করবে।

দেবুর চোখে এই তুচ্ছ কারণে জল আসিল। খোকাকে কোলে করিয়া বিলুর হাসিভরা মুখ, ব্যস্তসমস্ত দিনের কথা তাহার মনে পড়িয়া গেল। যতীন বলিলবরং দুর্গা আমাকে দু-তিন দিন জিজ্ঞাসা করেছে।

চোখ মুছিয়া দেবু হাসিল, বলিল-দুর্গা আমার ওদিক দিয়ে অজকাল বড় যায় না। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম তো বললেগাঁয়ের লোককে তো জান জামাই! এখন আমি বেশি গেলে-এলেই–তোমাকে জড়িয়ে নানান কুকথা রটাবে।

সত্য কথা। দুৰ্গা দেবুর বাড়ি বড় একটা যায় না। কিন্তু তাহার মাকে পাঠায় দুধ দিতে, পাতুকে পাঠায় দুবেলা। রাত্রে পাতুই দেবুর বাড়িতে শুইয়া থাকে, সে-ও দুর্গার বন্দোবস্ত। তা ছাড়া সে-ও যেন কেমন হইয়া গিয়াছে। সে আর লীলাচঞ্চলা তরঙ্গময়ী নাই। আশ্চর্য রকমের শান্ত হইয়া গিয়াছে। বোধহয় দেবুর ছোঁয়া লাগিয়াছে তাহাকে। যতীনের কিশোর তরুণ রূপ তাহাকে আর বিচলিত করে না। সে মাঝে মাঝে দূর হইতে দেবুকে দেখেতাহারই মত উদাস দৃষ্টিতে পৃথিবীর দিকে নিরর্থক চাহিয়া থাকে।

যতীন কিছুক্ষণ পরে বলিল—শুনেছি শ্ৰীহরি ঘোষ সদরে দরখাস্ত করেছে গ্রামে প্রজাধর্মঘটের আয়োজন হচ্ছে, তার মূলে আমি আছি। আমাকে সরাবার চেষ্টা করছেন। সরতেও আমাকে হবে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এই স্নেহপাগলিনী মেয়েটির জন্য যে ভেবে আকুল হচ্ছি। এক ভরসা আপনি আছেন। কিন্তু সে-ও তো এক ঝঞাট। তা ছাড়া এ এক অদ্ভুত মেয়ে, দেবুবাবু; ওই দুটো ছেলেকে আবার জুটিয়েছে। খাবে কি, দিন চলবে কি করে? আমি গেলেই ঘর ভাড়া দশ টাকা তো বন্ধ হয়ে যাবে। আজকাল মা-মণি ধান ভানে, কঙ্কণায় ভদ্রলোকদের বাড়িতে গিয়ে মুড়ি ভাজে। কিন্তু ওতে কি ওই ছেলে দুটোসমেত সংসার চলবে?

কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া দেবু বলিল—জেল-অফিস ভিন্ন তো অনিরুদ্ধের সঠিক খবর পাওয়া যাবে না। আমি বরং একবার সদরে গিয়ে খোঁজ করে আসি।

সদরে গিয়া দেবু দুই দিন ফিরিল না।

যতীন আরও চিন্তিত হইয়া উঠিল। অপর কেহ এ সংবাদ জানে না। পদ্মও জানে না। তৃতীয় দিনের দিন দেবু ফিরিল। অনিরুদ্ধের সংবাদ পাওয়া যায় নাই। জেল হইতে সে বাহির হইয়াছে দশ দিন আগে। দেবু অনেক সন্ধান করিয়াছে, সেই জন্য দুই দিন দেরি হইয়াছে। জেল হইতে বাহির হইয়া একটা দিন সে শহরেই ছিল দ্বিতীয় দিন জংশন পর্যন্ত আসিয়াছিল। সেখানে হইতে নাকি একটি স্ত্রীলোককে লইয়া সে চলিয়া গিয়াছে। এই পর্যন্ত সংবাদ মিলিয়াছে যে কলে কাজ করিবার জন্য সে কলিকাতা বা বোম্বাই বা দিল্লি বা লাহোরে গিয়াছে। অন্তত সেই কথাই সে বলিয়া গিয়াছে—কলে কাজ করব তো এখানে কেন করব? বড় কলে কাজ করব। কলকাতা, বোম্বাই, দিল্লি, লাহোর যেখানে বেশি মাইনে পাব, যাব।

বাড়ির ভিতর শিকল নড়িয়া উঠিল।

যতীন ও দেবু উভয়েই চমকিয়া পরস্পরের মুখের দিকে চাহিল। আবার শিকল নড়িল। যতীন এবার উঠিয়া গিয়া নৃতশিরে অপরাধীর মত পদ্মের সম্মুখে দাঁড়াইল।

পদ্ম জিজ্ঞাসা করিল—সে জেল থেকে বেরিয়ে কি কোথাও চলে গেছে?

–হ্যাঁ।

–কলকাতা, বোম্বাই?

–হ্যাঁ।

পদ্ম আর কোনো প্রশ্ন করিল না। ফিরিয়া চুপ করিয়া দেওয়ালে ঠেস দিয়া বসিল। সে চলিয়া গিয়াছে। যাক। তার ধর্ম তার কাছে!

তাহার এ মূর্তি দেখিয়া যতীন আজ আর বিস্মিত হইল না। পদ্ম বিষণ্ণ মূর্তিতে বসিতেই গোবরা ও উচ্চিংড়ে আসিয়া চুপ করিয়া পাশে বসিল। যতীন অনেকটা আশ্বস্ত হইয়া দেবুর নিকট ফিরিয়া আসিল।

***

দিন চারেক পর। সেদিন রথের দিন।

গত রাত্রি হইতে নববর্ষার বর্ষণ শুরু হইয়াছে। আকাশভাঙা বর্ষণে চারিদিক জলে থইথই করিতেছে। কাড়ান লাগিয়াছে। প্ৰচণ্ড বৰ্ষণের মধ্যে মাথালি মাথায় দিয়া চাষীরা মাঠে কাজ আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। জমির আইলের কাটা মুখ বন্ধ করিতেছে, ইদুরের গর্ত বন্ধ করিতেছে, জল আটক করিতে হইবে। পায়ের নিচে মাটি মাখনের মত নরম, সেই মাটি হইতে সোঁদা গন্ধ বাহির হইতেছে। সাদা জলপরিপূর্ণ মাঠ চকচক করিতেছে মেঘলা দিনের আলোর প্রতিফলনে। মধ্যে মধ্যে বীজধানের জমিতে সবুজ সতেজ ধানের চারা চাপ বাঁধিয়া এক-একখানি সবুজ গালিচার আসনের মত জাগিয়া আছে। বাতাসে ধানের চারাগুলি দুলিতেছে—যেন অদৃশ্য লক্ষ্মীদেবী মেঘলোক হইতে নামিয়া কোমল চরণপাতে পৃথিবীর বুকে আসিয়া আসন গ্রহণ করিবেন বলিয়া চাষীরা আসনখানি পাতিয়া রাখিয়াছে।

সেই বৰ্ষণের মধ্যে যতীন বাসা ছাড়িয়া পথে নামিল। তাহার সঙ্গে দারোগাবাবু। দুই জন। চৌকিদারের মাথায় তাহার জিনিসপত্র। দেবু, জগন, হরেন—গ্রামের প্রায় যাবতীয় লোক সেই বৰ্ষণের মধ্যে দাঁড়াইয়া আছে।

যতীনের অনুমান সত্য হইয়াছে। তাহার এখান হইতে চলিয়া যাইবার আদেশ আসিয়াছে। সদর শহরে—একেবারে কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ দৃষ্টির সম্মুখে রাখার ব্যবস্থা হইয়াছে এবার। দুয়ার। ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে ম্লানমুখী পদ্ম; আজ তাহার মাথায় অবগুণ্ঠন নাই। দুই চোখ দিয়া তাহার জলের ধারা গড়াইতেছে। তাহার পাশে উচ্চিংড়ে ও গোবরা স্তব্ধ, বিষণ্ণ।

প্রথমটা যতীন শঙ্কিত হইয়াছিল, ভাবিয়াছিল-পদ্ম হয়ত একটা কাণ্ড বাঁধাইয়া বসিবে। মূৰ্ছাব্যাধিগ্রস্ত পদ্ম হয়ত মূৰ্ছিত হইয়া পড়িবে—এইটাই তাহার বড় আশঙ্কা হইয়াছিল। কিন্তু পদ্ম তাহাকে নিশ্চিন্ত করিয়া কেবল কাঁদিল। তাহার পাশে উচ্চিংড়ে-গোবরা বেশ শান্ত হইয়া বসিয়া ছিল। পদ্ম তাহাকে কোনো কথা বলিল না।

উচ্চিংড়ে জিজ্ঞাসা করিল—তুমি চলে যাবা বাবু?

–হ্যাঁ। মা-মণির কাছে খুব ভাল হয়ে থাকবি, উচ্চিংড়ে। কেমন? আমি চিঠি দিয়ে খোঁজ নেব তোদের।

ঘাড় নাড়িয়া স্বীকার করিয়া উচ্চিংড়ে বলিল—আর তুমি ফিরে আসবা না বাবু?

যতীন ঘাড় নাড়িয়া হাসিতে গিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল—তারপর পদ্মকে বলিলমামণি, যেদিন ছাড়া পাব, একদিন তো ছেড়ে দেবেই, তোমার কাছে আসব।

পদ্ম চুপ করিয়াই রহিল।

এতক্ষণে পদ্ম নীরব রোদনের মধ্যেও মৃদু হাসিয়া হাতটি উপরের দিকে বাড়াইয়া দিয়া আকাশের দিকে চাহিল।

যতীনের চোখে জল আসিল। আত্মসংবরণ করিয়া সে বলিল যখন যা হবে, পণ্ডিতকে বলবে তার পরামর্শ নেবে।

পদ্মের মুখ এবার উজ্জ্বল হইয়া উঠিলা, পণ্ডিত আছে। চোখ মুছিয়া এবার সে বলিল–সাবধানে থেকো তুমি।

নলিন, সেই চিত্রকর ছেলেটিও ভিড়ের মধ্যে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। সে নীরবে অগ্রসর হইয়া আসিয়া চুপ করিয়া একটি প্রণাম করিয়া, অভ্যাসমত নীরবেই চলিয়া গেল।

যতীন তাহার দিকে চাহিয়া হাসিল।

হরেন হাত ধরিয়া বলিল–গুডবাই ব্রাদার।

জগন বলিল রিলিজড হলে যেন খবর পাই।

সতীশ বাউরি আসিয়া প্ৰণাম করিয়া একখানি ভঁজ করা ময়লা কাগজ তাহার দিকে বাড়াইয়া একমুখ বোকার হাসি হাসিয়া বলিল-আমাদের গান। নিকে নিতে চেয়েছিলেন আপুনি। অনেকদিন নিকিয়ে রেখেছি, দেয়া হয় নাই।

যতীন কাগজখানি লইয়া সযত্নে পকেটে রাখিল।

আশ্চর্য! দুৰ্গা আসে নাই!

দারোগাবাবু বলিল—এইবার চলুন যতীনবাবু।

যতীন অগ্রসর হইল–চলুন।

দেবু তাহার পাশে পাশে চলিল। পিছনে জগন, হরেন, আরও অনেকে চলিল। পথে চণ্ডীমণ্ডপের ধারে শ্ৰীহরি ঘোষ দাঁড়াইয়া ছিল। মজুরেরা চণ্ডীমণ্ডপের খড়ের চাল খুলিয়া দিতেছে, বর্ষার জলে ওটা ভাঙিয়া পড়িবে। তারপর সে আরম্ভ করিবে–ঠাকুরবাড়ি। শ্ৰীহরি ঘোষও মৃদু। হাসিয়া তাহাকে ক্ষুদ্র একটি নমস্কার করিল।

গ্রাম পার হইয়া তাহারা মাঠে আসিয়া পড়িল। যতীন বলিল-ফিরুন এবার আপনারা।

সকলেই ফিরিল। কেবল দেবু বলিল—চলুন, আমি বঁধ পর্যন্ত যাব। ওখান থেকে মহাগ্রামে যাব ঠাকুর মশায়ের বাড়ি। তার ওখানে রথযাত্রা।

পথে নির্জন একটি মাঠের পুকুরপাড়ে গাছতলায় দাঁড়াইয়া ছিল দুর্গা। তাহাকে কেহ দেখিল না। কিন্তু সে তাহাদের দিকে চাহিয়া যেমন দাঁড়াইয়া ছিল—তেমনি দাঁড়াইয়া রহিল।

সকলেই চলিতেছিল নীরবে। একটি বিতায় সকলেই যেন কথা হারাইয়া ফেলিয়াছে। দারোগাবাবুটিও নীরব। এতগুলি মানুষের মিলিত বিষণ্ণতা তাহার মনকে তাহার অজ্ঞাতসারেই

স্পৰ্শ করিয়াছে।

যতীনের মনে পড়িতেছিল—অনেক কিছু কথা, ছোটখাটো স্মৃতি। সহসা মাঠের দিকে চাহিয়া তাহার ভাবান্তর উপস্থিত হইল। এই বিস্তীর্ণ মাঠ একদিন সবুজ ধানে ভরিয়া উঠিবে, ধীরে ধীরে হেমন্তে স্বৰ্ণবর্ণে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিবে। চাষীর ঘর ভরিবে রাশি রাশি সোনার ফসলে।

পরমুহুর্তেই মনে হইল-তারপর? সে ধান কোথায় যাইবে?

তাহার মনে পড়িল অনিরুদ্ধের সংসারের ছবি। আরও অনেকের ঘরের কথা। জীর্ণ ঘর, রিক্ত অঙ্গন, অভাবক্লিষ্ট মানুষের মুখ, মহামারী, ম্যালেরিয়া, ঋণভার; শীর্ণকায় অর্ধ-উলঙ্গ অজ্ঞ শিশুর দল। উচ্চিংড়ে ও গোবরা বাংলার ভাবী-পুরুষের নমুনা।

পরক্ষণেই মনে পড়িল-পদ্ম তাহাদের কপালে অশোক-ষষ্ঠীর ফোঁটা দিতেছে।

হঠাৎ তাহার পড়া স্ট্যাটিস্টিক্সের কথা তুচ্ছ মনে হইল। অর্ধসত্য—সে শুধু কঠিন বস্তুগত হিসাব। কিন্তু সংসারটা শুধু হিসাব নয়। কথাটা তাহাকে একদিন ন্যায়রত্ন বলিয়াছিলেন। তাহাকে মনে পড়িয়া গেল। সে অবনত মস্তকে বারবার তাঁহাকে প্রণাম জানাইয়া স্বীকার করিল—সংসার ও সংসারের কোনো কোনো মানুষ হিসাবের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। ন্যায়রত্ন হিসাবের ঊর্ধ্বেপরিমাপের অতিরিক্ত। আরও তাহার পাশের এই মানুষটি পণ্ডিত দেবু ঘোষ, অর্ধশিক্ষিত চাষীর ছেলে, হৃদয়ের প্রসারতায় তাহার নির্ধারিত মূল্যাঙ্ককে ছাড়াইয়া গিয়াছে। কতখানিকতদূর যতীন তাহা নির্ধারিত করিতে পারে নাই, কেমন করিয়া গেল—সেও অঙ্কশাস্ত্রের অতিরিক্ত এক রহস্য।

এই হিসাব-ভুলের ফেরেই তো সৃষ্টি বাঁচিয়া আছে। এক ধূমকেতুর সঙ্গে সংঘর্ষে পৃথিবীর একবার চুরমার হইয়া যাইবার কথা ছিল। বিরাট বিরাট হিসাব করিয়া ও অঙ্ক কষিয়াই সেটা অঙ্কফল হিসাবেই ঘোষিত হইয়াছিল। অঙ্ক ভুল হয় নাই, কিন্তু পৃথিবী কোন রহস্যময়ের ইঙ্গিতে ভুল করিয়া ধূমকেতুটার পাশ কাটাইয়া বাঁচিয়া গিয়াছে।

নহিলে সেই সমাজ-শৃঙ্খলার সবই তো ভাঙিয়া গিয়াছে। গ্রামের সনাতন ব্যবস্থা নাপিত, কামার, কুমোর, তাঁতিআজ স্বকর্মত্যাগী, স্বকর্মহীন। এক গ্রাম হইতে পঞ্চগ্রামের বন্ধন, পঞ্চগ্রাম হইতে সপ্তগ্রাম, নবগ্রাম, দশগ্রাম, বিংশতি গ্রাম, শগ্রাম, সহস্রগ্রামের বন্ধন-রঞ্জু গ্ৰন্থিতে গ্রন্থিতে এলাইয়া গিয়াছে।

মহাগ্রামের মহা বিশেষণ বিকৃত হইয়া মহুতে পরিণত হইয়াছে, শুধু শব্দার্থেই নয়–বাস্তব পরিণতিতেও তাহার মহা-মহিমত্ব বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। আঠার পাড়া গ্রাম আজ মাত্র অল্প কয়েক ঘর লোকের বসতিতে পরিণত। ন্যায়রত্ন জীৰ্ণ বৃদ্ধ একান্তে মহাপ্রয়াণের দিন গণনা করিয়া চলিয়াছেন।

নদীর ওপারে নূতন মহাগ্রাম রচনা করিতেছেনূতন কাল। নূতন কালের সে রচনার মধ্যে যে রূপ ফুটিয়া উঠিবেসে যতীন বইয়ের মধ্যে পড়িয়াছে—তার জন্মস্থান কলিকাতায় প্রত্যক্ষ দেখিয়াছে। সে মনে হইলে শিহরিয়া উঠিতে হয়, মনে হয় গোটা পৃথিবীর আলো নিভিয়া যাইবে, বায়ুপ্রবাহ স্তব্ধ হইবে, গোটা সৃষ্টিটা দুবৃত্ত-ধৰ্ষিতা নারীর মত অন্তঃসারশূন্য কাঙালিনীতে পরিণত হইবে। জীর্ণ অন্তর, বুকে হাহাকার, বাহিরে চাকচিক্য, মুখে কৃত্রিম হাসি। দুর্ভাগিনী সৃষ্টি! আঙ্কিক নিয়মে তার পরিণতিক্ষয়রোগীর মত তিলে তিলে মৃত্যু। তবু কিন্তু সে হতাশ নয় আজ। মানুষ সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে অঙ্কশাস্ত্রের অতিরিক্ত রহস্য। পৃথিবীর সমুদ্রতটের বালুকারাশির মধ্যে একটি বালুকণার মতই ব্ৰহ্মাণ্ড-ব্যাপ্তির অভ্যন্তরে এই পৃথিবী, তাহার মধ্যে যে জীবনরহস্য, সে রহস্য ব্ৰহ্মাণ্ডের গ্ৰহ-উপগ্রহের রহস্যের ব্যতিক্রম—এক কণা পরিমাণ জীবন, প্রকৃতির প্রতিকূলতা মৃত্যুর অমোঘ শক্তি-সমস্তকে অতিক্ৰম করিয়া শত ধারায়, সহস্র ধারায়, লক্ষ ধারায়, কোটি কোটি ধারায় কালে কালে তালে তালে উচ্ছ্বসিত হইয়া মহাপ্রবাহে পরিণত হইয়া বহিয়া চলিয়াছে। সে সকল বাধাকেই অতিক্ৰম করিবে। আনন্দময়ী প্রাণবতী সৃষ্টি, অফুরন্ত তাহার শক্তি—সে তাহার জীবন-বিকাশের সকল প্রতিকূল শক্তিকে ধ্বংস করিবে, তাহাতে তাহার সংশয় নাই আজ। ভারতের জীবনপ্রবাহ বাধাবিঘ্ন ঠেলিয়া আবার ছুটিবে।

ন্যায়রত্ন জীর্ণ। তাঁহার কাল অতীত হইতে চলিয়াছে। তিনি থাকিবেন না। কিন্তু তাহার স্মৃতি আদর্শ নূতন জন্মলাভ করিবে।

যতীন হাসিল। মনে পড়িল ন্যায়রত্নের পৌত্র বিশ্বনাথকে। সে আসিবে। দেবু ঘোষ। নবরূপে পল্লীর এই শৃঙ্খলাহীন যুগে, ভাঙাগড়ার আসরের মধ্যে শ্ৰীহরি পাল, কঙ্কণার বাবু, থানার জমাদার, দারোগার রক্তচক্ষুকে তুচ্ছ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে, মহামারীর আক্রমণকে সে রোধ করিয়াছে। দেবুর বুকে বুক রাখিয়া আলিঙ্গনের সময় সে স্পষ্ট অনুভব করিয়াছে, অভয়ের বাণী তাহার বুকের মধ্যে আলোড়িত হইতে। সকল বাধা দূর করিয়া জীবনের সার্থকতা লাভের অদম্য আগ্রহের বাণী।

উত্তেজনায় বিপ্লববাদী শরীরে থরথর করিয়া কম্পন বহিয়া গেল। এ চিন্তা তাহার বিপ্লববাদের চিন্তা। আনন্দে তাহার চোখে ফুটিয়া উঠিল অদ্ভুত এক দীপ্তি। তাহার আনন্দ, তাহার সান্ত্বনা এই যে, সে তাহার কর্তব্য করিয়াছে। বন্দিজীবনে এই পল্লীর মধ্যে দেবুর জাগরণে সে সাহায্য করিয়াছে। বন্দিত্ব তাহার নিজের জীবনে জাগরণের ভাবপ্লাবনের গতিরোধ করিতে পারে নাই। এমনি করিয়াই নূতন কালের ধর্ষণ-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হইবে মানুষ বাঁচিবে। ভয় নাই, ভয় নাই।

বাঁধের উপর দেবু দাঁড়াইয়া বলিল—যতীনবাবু, আসি তা হলে। নমস্কার।

যতীন বলিল—নমস্কার দেবুবাবু, বিদায়। দেবুর হাত দুইখানি নিজের হাতের মধ্যে গ্রহণ করিয়া দেবুর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল; হঠাৎ থামিয়া আবৃত্তি করিল—

উদয়ের পথে শুনি কার বাণী—ভয় নাই ওরে ভয় নাই।
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।।

তারপর সে নিতান্ত অকস্মাৎ মুখ ফিরাইয়া দ্রুতবেগে চলিতে আরম্ভ করিল। দেবু যতীনের গতিপথের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। চোখ দিয়া তাহার দরদরধারে জল পড়িতে আরম্ভ করিল। এই একান্ত একক জীবন বিলু, খোকা চলিয়া গিয়াছে, জগন, হরেন আসিয়া আর তেমন কলরব করে না। সমস্ত গ্রাম হইতে সে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িতেছে। আজ যতীনবাবুও চলিয়া গেল। কেমন করিয়া দিন কাটিবে তাহার? কাহাকে লইয়া বাঁচিয়া থাকিবে? সহসা মনে পড়িল ন্যায়রত্নের গল্প। কই, তাহার সে শালগ্রাম কই? সে ঊর্ধ্বলোকে আকাশের দিকে চাহিয়া আত্মহারার মত হাত বাড়াইল, সমস্ত অন্তর পরিপূর্ণ করিয়া অকপট-কাতর স্বরে ডাকিল ভগবান!

ময়ূরাক্ষীর গর্ভে নামিয়া যতীন আবার ফিরিয়া দাঁড়াইল। সুউচ্চ বাঁধের উপর দণ্ডায়মান উর্ধ্ববাহু দেবুকে দেখিয়া সে আনন্দে তৃপ্তিতে মোহগ্ৰস্তের মত নিশ্চল হইয়া দেবুর দিকে চাহিয়া রহিল।

দারোগা ডাকিল যতীনবাবু, আসুন!

যতীন মাটিতে হাত ঠেকাইয়া, সেই হাত কপালে ঠেকাইয়া প্ৰণাম করিল। তারপর বলিল–চলুন।

অকস্মাৎ দূরে কোথাও ঢাক বাজিয়া উঠিল।

সেই দূরাগত ঢাকের শব্দে সচেতন হইয়া দেবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। ঢাক বাজিতেছে। মহাগ্রামে ঢাকের শব্দ। ন্যায়রত্নের বাড়িতে রথযাত্রা। রথ কোথায় গিয়া থামিবে কে জানে?

বাঁধের পথ ধরিয়া সে দ্রুতপদে অগ্রসর হইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *