২৪. যতীনের মনের অবস্থা বিচিত্র

যতীনের মনের অবস্থা বিচিত্র। পল্লীগ্রামের কোন্ নিভৃত কোণে বাস করে ওই বৃদ্ধতার চারিপাশে এই ধ্বংসোনুখ পারিপার্শ্বিক অজ্ঞান-অশিক্ষা-দারিদ্র্য, হীনতায় জীৰ্ণ। কঠিন জীবন-সংগ্রাম এখানে নিপুণ সরীসৃপের সুকঠিন বেষ্টনীর মত শ্বাসরোধ করিয়া ক্রমশ চাপিয়া ধরিতেছে। ইহারই মধ্যে কেমন করিয়া প্রশান্ত অবিচলিতচিত্ত সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ স্বচ্ছ ঊর্ধ্বগ দৃষ্টি মেলিয়া পরমানন্দে বসিয়া আছেন! অসীম জ্ঞানভাণ্ডার লইয়া বসিয়া আছেন লবণাক্ত সমুদ্রতলে মুক্তাগর্ভ শুক্তির মত।

এই মুহূর্তে ইহা এক পরমাশ্চর্যের মত মনে হইল।

দণ্ডে দণ্ডে প্রহরের পর প্রহর অতিক্ৰম করিয়া রাত্রি ঘন গাঢ় হইয়া আসিতেছিল। দ্বিতীয় প্রহরের শেয়াল, পেঁচা ডাকিয়া গিয়াছে। কোনো একটা গাছে বসিয়া একটা পেঁচা এখনও মধ্যে মধ্যে ডাকিতেছে। এ ডাক অন্য রকমের ডাক প্রহর ঘোষণার ডাকের সহিত কোনো মিল নাই। প্রহরের ডাকের মধ্যে স্পষ্ট একটি ঘোষণার সুর আছে। গাছের কোটরের মধ্যে থাকিয়া অপরিণত কণ্ঠে চাপা শিসের শব্দের মত করিয়া অবিরাম একঘেয়ে ডাকিয়া চলিয়াছে উহাদের শাবকের দল। বনেজঙ্গলে, পথেঘাটে, ঘরে, চারিদিকে, আশপাশে অবিরাম ধ্বনি উঠিতেছে–অসংখ্য কোটি পতঙ্গের সাড়ার। অন্ধকার শূন্যপথে কালো ডানা সশব্দে আস্ফালন করিয়া উড়িয়া চলিয়াছে বাদুড়ের দল—একটার পর একটা, তারপর একসঙ্গে তিনটা, আবার একটা।

সেদিন বৃষ্টির পর আকাশ এখনও স্বচ্ছ, উজ্জ্বল, নীল, তারাগুলি পূর্ণদীপ্তিতে দীপ্যমান। চৈত্র মাসের বাতাস ঝিরঝির করিয়া বহিতেছে; সে বাতাসের সর্বাঙ্গ ভরিয়া ফুলের গন্ধের অদৃশ্য অরূপ সম্ভার। শেষ প্রহরে বাতাস হিমের আমেজে ক্রমশ ঘন হইতে ঘনতর হইয়া উঠিতেছে।

বৃদ্ধকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে ভুল হইয়া গিয়াছে। গল্পটি তাহার বড় ভাল লাগিয়াছে। ওই বৃদ্ধ এবং ওই গল্পের মধ্যে সে আজ পল্লীর জীবনমন্ত্রের আভাস পাইয়াছে। যুগ যুগ ধরিয়া ওই বৃদ্ধেরাই তাহাদের ওই গল্প শুনাইয়া আসিতেছে। গল্পটি সত্যই ভালভাল শুধু নয়–সত্য বলিয়াই তাহার মনে হইয়াছে। শুধু এক জায়গায় খটকা লাগিয়াছে। অলক্ষ্মীর আগমনে সৌভাগ্যলক্ষ্মীর অন্তৰ্ধান-কথাটি মৌলিক সত্য কথা। ভাগ্যলক্ষ্মীর অভাবে কর্মশক্তি পঙ্গু হয়, যশোলক্ষ্মী চলিয়া যান। লক্ষ্মীহীন হৃতকর্মশক্তি মানুষের কুলগৌরব ক্ষুণ্ণ করে। উচ্চিংড়ের মা চলিয়া গিয়াছে সেটেলমেন্ট ক্যাম্পের পিয়নের সঙ্গে। কিন্তু ধর্ম বলিতে বৃদ্ধ কি বুঝাইতেছেন, ওই প্রশ্নটা তাহাকে করা হয় নাই। অনেক চিন্তা করিয়াও সে এমন কোনো উত্তর খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিল না—যাহার সহিত পৃথিবীর নব-উপলব্ধ সত্যের একটি সমন্বয় হয়। সে ক্লান্ত হইয়া শূন্য-মস্তিষ্কে রাত্রির পল্লীর দিকে চাহিয়া রহিল।

প্রগাঢ় দুর্নিরীক্ষ্য অন্ধকারের মধ্যে পল্লীটা যেন হারাইয়া গিয়াছে। অনুমানে নির্দেশ করা যায়। সামনেই পথের ওপারে সেই ডোবাটা। সমস্ত রাত্রির মধ্যে সন্ধের সময় ঘাটটিতে একবার কেরোসিন ডিবি দেখা যায়, দুটি মেয়ে ডিবি হাতে বাসন ধুইয়া লইয়া যায়। ডিবির আলোয় তাহাদের মুখ বেশ স্পষ্ট দেখিতে পায় যতীন। ঘাট হইতে উঠিয়াই তাহারা বাড়িতে ঢুকিয়া কপাট দেয়। পল্লীটার অধিকাংশ ঘরেই সেই সন্ধ্যাতেই খিল পড়ে। শ্ৰীহরি ঘোষ এবং জগন ডাক্তার বা তাহার নিজের এখানে ছোটখাটো একটা করিয়া বিরোধী মজলিস এসবের পরেও জাগিয়া থাকে। কিন্তু সেই বা কতক্ষণ? দশটা বাজিতে না বাজিতে পল্লীটা নিস্তব্ধ হইয়া যায়।

যতীন একবার ভাল করিয়া গ্রামখানার দিকে চাহিয়া দেখিল। প্রগাঢ় অন্ধকারে সুষুপ্ত নিথর পল্লীটার ভঙ্গির মধ্যে নিতান্ত অসহায় শিশুর আত্মসমর্পণের ভঙ্গি যেন সুপরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে।

সহসা তাহার মনে পড়িয়া গেল—তাহার জন্মস্থান মহানগরী কলিকাতাকে। কলিকাতাকে সে বড় ভালবাসে। মহানগরী কলিকাতা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নগরীসমূহের অন্যতমা। দিনের আলো, রাত্রির অন্ধকারের প্রভাব সেখানে কতটুকু? দিনেও সেখানে আলো জ্বলে। রাত্রে পথের পাশে পাশে আলোয় আলোয় আলোময়। মানুষের তপস্যার দীপ্ত চক্ষুর সম্মুখে রাত্রির অন্ধকার মহানগরীর অবশ তনুর মত অসহায় দৃষ্টিতে চাহিয়া দাঁড়াইয়া থাকে। মোড়ে মোড়ে বিটের প্রহরী জাগ্ৰত-চক্ষে দাঁড়াইয়া ঘোষণা করেসে জাগিয়া আছে। গবেষণাগারে বৈজ্ঞানিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া আছে তাহার গবেষণার বস্তুর দিকে। গতিশীল দণ্ড স্পৰ্শ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে যন্ত্ৰী; যন্ত্র চলিতেছে-উৎপাদন চলিতেছে অবিরাম। জল আলোড়িত করিয়া জাহাজ চলিয়াছে, পোর্ট কমিশনারের লাইনের উপর ট্রেন চলিয়াছে; সাইডিঙে শান্টিং হইতেছে। পথে গর্জন করিয়া মোটর চলিয়াছে, মধ্যে মধ্যে রোমাঞ্চক আবেশ জাগাইয়া ধ্বনিত হইয়া উঠিতেছে অশ্বখুরধ্বনি। মহানগরী চলিয়াছেই—চলিয়াছেই দিনে রাতে, গতির তাহার বিরাম নাই। আসা-যাওয়ায়, ভাঙা-গড়ায়, হাসি-কান্নায় নিত্য তাহার নব নব রূপের অভিনব অভিব্যক্তি। তারও একটা অন্ধকার দিক আছে। কিন্তু সে থাক।

পল্লীর কিন্তু সেই একই রূপ। অদ্ভুত পল্লীগ্রাম। বিশেষ এদেশের পল্লীগ্রাম। সমাজ গঠনের আদিকাল হইতে ঠিক একই স্থানে অনন্ত-পরমায়ু পুরুষের মত বসিয়া আছে। ইন্ডিয়ান ইকনমিক্স-এর একটা কথা তাহার মনে পড়িয়া গেল। Sir Charles Matcalfe বলিয়া গিয়াছেন—

They seem to last where nothing else lasts…অদ্ভুত! Dynasty after dynasty tumbless down, revolution succeeds revolution! Hindu, Pathan, Mogul, Mahratta, Sikh, English are masters in turn, but the village community remains the same.

সে কি কোনোদিন নড়িবে না? বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে বিরাট পরিবর্তন শুরু হইয়াছে। সর্বত্র নববিধানের সাড়া উঠিয়াছে। এ দেশের পল্লীতে কি জীর্ণ স্থবির পুরাতনের পরিবর্তন হইবে না?

বিপ্লবী তরুণ, তাহার কল্পনার চোখে অনাগত কালের নূতনত্বের স্বপ্ন। সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। বৃদ্ধ বলিয়া গেলেন প্ৰকাণ্ড সৌধ বটবৃক্ষের শিকড়ের চাপে ফাটিয়া গিয়াছে।

সে সেই ভাঙনের মুখে আঘাত করিতে বদ্ধপরিকর। সেই ধর্মে সে যেখানে ক্ষুদ্রতম দ্বন্দ্ব দেখে, সেইখানেই সে দ্বন্দ্বকে উৎসাহিত করিয়া তোলে।

বাড়ির ভিতর হইতে দরজায় আঘাতের শব্দ হইল।

যতীন জিজ্ঞাসা করিল–মা-মণি?

–হ্যাঁ। পদ্ম তিরস্কার করিয়া বলিল—তুমি কি আজ শোবে না? অসুখবিসুখ একটা না করে ছাড়বে না দেখছি!

–যাচ্ছি। যতীন হাসিল।

—যাচ্ছি নয়, এখুনি শোবে এস। আমি বরং বাতাস করে ঘুম পাড়িয়ে দি। এস! এস বলছি।

—তুমি গিয়ে শোও। আমি এক্ষুনি শোব।

–না। তুমি এক্ষুনি এস। এস। মাথা খুঁড়ব বলে দিচ্ছি।

যতীন ঘরের ভিতর না গিয়া পারিল না। কিন্তু তাহাতেও নিষ্কৃতি নাই, পদ্ম বলিল–এদিকের দরজা খুলে দাও। বাতাস করি।

–দরকার নেই।

–না, দরকার আছে।

যতীন দরজা খুলিয়া দিল। পদ্ম যতীনের শিয়রে পাখা লইয়া বসিল। বলিল একজন বেরিয়েছে দুগ্‌গাকে সাপে কামড়েছে বলে—এখনও ফিরল না। তুমি–

—অনিরুদ্ধবাবু এখনও ফেরেন নাই!

–না। দাঁড়াও; দুগ্‌গা মরুক আগে, তারপর ফিরবে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে। দুনিয়ায় এত লোকে মরেওই হারামজাদী মরে না।

যতীন শিহরিয়া উঠিল। পদ্মের কণ্ঠস্বরে ভাষায় সে কি কঠিন আক্রোশ! দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সে চোখ বন্ধ করিল। কিছুক্ষণ পরই তাহার কানে একটা দূরাগত বিপুল শব্দ যেন জাগিয়া উঠিল। দ্রুততম গতিতে শব্দটা আগাইয়া আসিতেছে। ঘরেদুয়ারে একটা কম্পন জাগিয়া উঠিতেছে। সে উঠিয়া বসিয়া বলিল ভূমিকম্প!

হাসিয়া পদ্ম বলিল—কি ছেলে মা! যেন দেয়ালা করছে! ও ভূমিকম্প নয়, ডাকগাড়ি যাচ্ছে। শোও দেখি এখন।

—ডাকগাড়ি? মেল ট্রেন?

–হ্যাঁ, ঘুমোও।

সেই মুহূর্তেই তীব্র হুইসিলের শব্দ করিয়া ট্রেন উঠিল ময়ূরাক্ষীর পুলে, ঝুমঝম শব্দে চারিদিক পরিপূর্ণ হইয়া গেল। ঘর-দুয়ার থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। জংশন-স্টেশনে আলো জ্বলিতেছে। সেখানকার কলে রাত্রেও কাজ চলে। ময়ূরাক্ষীর ওপারেই জংশন। যতীন অকস্মাৎ যেন আশার আলোক দেখিতে পাইল। পল্লী কাঁপিতেছে।

কিছুক্ষণ পরে পাখা রাখিয়া পদ্ম সন্তৰ্পণে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

যাক, ঘুমাইয়াছে। উপরে মশারি ভাল করিয়া গুঁজিয়া দিয়া আসা হয় নাই, উচ্চিংড়েটাকে হয়ত মশায় ছিঁড়িয়া ফেলিল!

যতীনের ঘর হইতে বাহির হইয়া সে আশ্চর্য হইয়া গেল। উপর হইতে কখন নামিয়া আসিয়াছে। উচ্চিংড়ে। আপন মনেই এই তিন প্রহর রাত্রে উঠানে বসিয়া একা-একাই কড়ি খেলিতেছে।

 

শেষরাত্রে ঘুমাইয়া যতীনের ঘুম ভাঙিতে দেরি হইয়াছিল। তাহাকে তুলিল পদ্ম।-ওঠ ছেলে! ওঠ!

উঠিয়া বসিয়া যতীন বলিল—অনেক বেলা হয়ে গেছে, না?

–ওদিকে যে সর্বনাশ হয়ে গেল!

–সর্বনাশ হয়ে গেল?

–ছিরু পাল লেঠেল নিয়ে এসে গাছ কাটছে। সব ছুটে গেল, দাঙ্গা হবে হয়ত।

–কে ছুটে গেল, অনিরুদ্ধবাবু?

–সব–সব। পণ্ডিত, জগন ডাক্তার, ঘোষাল–বিস্তর লোক।

যতীন খুশি হইয়া উঠিল—বলিল—বেশ কড়া করে চা কর দেখি মা-মণি।

–তুমি কিন্তু নাচতে নাচতে যেয়ো না যেন।

–তবে আমায় ডাকলে কেন?

পদ্ম কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল—জানি না—

সত্যই সে খুঁজিয়া পাইল না কেন সে যতীনকে ডাকিল!

—মুখ-হাত ধোও। আমি চা করছি।

–উচ্চিংড়ে কই?

–সে বানের আগে কুটো—সে ছুটে গিয়েছে দেখতে।

গতকল্যকার অপমানের শোধ লইয়াছে শ্ৰীহরি। বাউরিবায়েনের কাছে মাথা হেঁট হইয়াছে। শুধু অপমান নয়—তাহার মতে, এটা গ্রামের শৃঙ্খলা ভাঙিবার একটা অপচেষ্টা। তাহার উপর দুর্গা তাহাদিগকে যেভাবে ঠকাইল সে সত্যটা ঘণ্টাদুয়েক পরেই মনে মনে বুঝিয়া ও জানিতে পারিয়া সে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিয়াছিল। এবং যাহারা ইহার সঙ্গে জড়াইয়া আছে তাহাদের শাস্তি দিবার ব্যবস্থা সে কাল সেই গভীর রাত্রেই করিয়া রাখিয়াছে।

কালু শেখ মারফত লাঠিয়ালের ব্যবস্থা করিয়া আজ সকালে সে জমিদারের গোমস্তা হিসাবে দেবু, জগন, হরেন ও অনিরুদ্ধের গাছ কাটিবার ব্যবস্থা করিয়াছে। গাছগুলি জমিদারের পতিত ভূমির উপর আছে। পূর্বকালে চাষী প্রজারা এমনই ভাবে গাছ লাগাইত, ভোগদখল করিত। জমিদার আপত্তি করিত না। প্রয়োজন হইলে, প্রজাকে দুইটা মিষ্ট কথা বলিয়া জমিদার ফলও পাড়িত, ডালও কাটিত। কিন্তু এমনভাবে সমূলে উচ্ছেদ কখনও করিত না। করিলে বহু পূর্বকালে—এক শশো বছর পূর্বে জমিদার-প্রজা দাঙ্গা বাধিত। পঞ্চাশ বৎসর পরে সে যুগ পাল্টাইয়াছিল। তখন প্রজা জমিদারের হাতে-পায়ে ধরিত, ঘরে বসিয়া গাছের মমতায় কাঁদিত। অকস্মাৎ আজ দেখা গেল, আবার তাহারা ছুটিয়া বাহির হইতেছে।

যতীন ব্যস্ত হইয়া উঠিতেছিল—সংবাদের জন্য। শেষ পর্যন্ত খুনখারাবি হইয়া গেলে যে একটা অত্যন্ত শোচনীয় ব্যাপার হইবে। উদ্বিগ্নভাবে সে ভাবিতেছিল—তাহার যাওয়া কি উচিত হইবে? তাহাকে এই ব্যাপারে কোনোমতে জড়াইতে পারিলে—সমগ্ৰ ঘটনারই রঙ পাল্টাইয়া যাইবে।

 

পদ্ম ইহারই মধ্যে তিনবার উঁকি মারিয়া দেখিয়া গিয়াছে—সে ঘরে আছে কি না।

যতীন শেষবারে বলিল-আমি যাই নি মা-মণি। আছি।

—তোমাকে বিশ্বাস নাই। সাংঘাতিক ছেলে তুমি।

যতীন হাসিল।

—হেসো না তুমি, হ্যাঁ। কথা বলিতে বলিতে পদ্ম পথের দিকে চাহিয়া বলিল–ওই। ওই লাও, নেললা আসছে। দাও পয়সা দাও।

সেই চিত্রকর ছেলেটি বৈরাগীদের নেললা আসিতেছে। পয়সার প্রয়োজন হইলেই নেলো আসে। অন্যথায় সে আসে না। নিঃশব্দে আসে—চুপ করিয়া বসিয়া থাকে, প্ৰশ্ন না থাকিলে প্রয়োজন ব্যক্ত করিতে পারে না; কিন্তু উঠিয়া যায় না, বসিয়াই থাকে। প্রশ্ন করিলে সংক্ষেপে বলে-পয়সা। দাবিও বেশি নয়, চার পয়সা হইতে চার আনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আজ কিন্তু নেলো একটু উত্তেজিত, মুখের গৌরবর্ণ রং রক্তাভ হইয়া উঠিয়াছে, চোখের তারা দুটি অস্থির; সে আসিয়া আজ বসিল না, দাঁড়াইয়া রহিল।

—কি নলিন? পয়সা চাই?

–পণ্ডিতের মাথা ফেটে গিয়েছে।

–কার? দেবুবাবুর?

–হ্যাঁ। আর কালীপুরের চৌধুরীমশায়ের।

–দ্বারকা চৌধুরীমশায়ের?

–হ্যাঁ। পণ্ডিতের আমগাছ কাটছিল, পণ্ডিত একেবারে কুড়ুলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

–তারপর?

—লেঠেলদের সঙ্গে পণ্ডিতের ঠেলাঠেলি লেগে গেল। চৌধুরীমশায় গেল ছাড়াতে। তা লেঠেলরা দুজনকেই ঠেলে ফেলে দিল।

—ফেলে দিলে?

–হ্যাঁ। গাছ কাটছিল, সেই কাটা শেকড়ে লেগে দুজনকারই মাথা ফেটে গেল।

–তারপর?

–খুব রক্ত পড়ছে। ধরাধরি করে ধরে নিয়ে আসছে।

–অন্য লোকেরা কি করছিল?

—সব দাঁড়িয়েছিল, কেউ এগোয় নাই। কর্মকার কেবল একজন লেঠেলকে এক লাঠি মেরে পালিয়েছে।

–জগন ডাক্তার কোথায়?

–সে জংশনে গিয়েছে—পুলিশের কাছে।

যতীন ঘরে ঢুকিয়া লিখিতে বসিল; টেলিগ্রাম। একখানা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে একখানা এসডিওর কাছে। আর একখানা চিঠি—এ জেলার জেলা-কংগ্রেস কমিটির কাছে। চিঠিখানা গোপনে পাঠাইতে হইবে।

টেলিগ্রাম করিতে ডাক্তারকে পাঠাইতে হইবে। কিন্তু এ পত্ৰখানা জগনের হাতে দেওয়া। হইবে না। দেবু ভাল থাকিলেই তাহাকে সদরে পাঠানো সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত হইত। সে একটু ভাবিয়া নেলোকে ডাকিয়া বলিল—একটা কাজ করতে পারবে?

নলিন ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল–হ্যাঁ।

–একখানা চিঠি জংশনের ডাকঘরে ফেলতে হবে। একটা চার পয়সার টিকিট কিনে বসিয়ে দেবে। কেমন?

নলিন আবার সেই ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল।

—কাউকে দেখিয়ো না যেন।

নলিনের আবার সেই নীরব স্বীকৃতি।

—এই চার পয়সার টিকিট কিনবে। আর এই চার পয়সার তুমি জল খাবে।

নলিন চিঠিখানি কোমরে রাখিয়া তাহার উপর সযত্নে ভঁজ করিয়া কাপড় বাঁধিয়া ফেলিল। আনি দুইটি বাঁধিল খুঁটে। তারপর ঘাড় হেঁট করিয়া যথাসাধ্য দ্রুতগতিতে চলিয়া গেল।

 

সমস্ত গ্রামখানা চঞ্চল হইয়া উঠিল।

জগন ডাক্তারের ডাক্তারখানায় দেবু ও চৌধুরীকে আনা হইয়াছিল। দেবু নিজে হটিয়াই আসিয়াছে। তাহার আঘাত তেমন বেশি নহে, তা ছাড়া তাহার জোয়ান বয়স-উত্তেজনাও যথেষ্ট হইয়াছিল; রক্তপাত বেশ খানিকটা হইলেও সে ভীত বা অবসন্ন হয় নাই। কিন্তু বৃদ্ধ চৌধুরী কাতর হইয়া পড়িয়াছে, আঘাতও তাহারই বেশি। প্রথমে চৌধুরী সংজ্ঞাহীন হইয়া পড়িয়াছিল; চেতনা হইলেও ধরাধরি করিয়া বহিয়া আনিতে হইয়াছে। চৌধুরী চোখ বুজিয়া শুইয়াই আছে। দেবু নীরবে বসিয়া আছে দেওয়ালে ঠেস দিয়া। ধুইয়া দেওয়ার পর রক্তাভ জলের ধারা কপাল বাহিয়া এখনও ঝরিতেছে। প্রায় সমস্ত গ্রামের লোকই জগনের ডাক্তারখানার সম্মুখে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়াছে।

টিঞ্চার আয়োডিন, তুলা, গরম জল, ব্যান্ডেজ লইয়া জগন ব্যস্ত। হরেন তাহাকে সাহায্য করিতেছে। মাঝে মাঝে হাঁকিতেছে—হট যাও। ভিড় ছাড়।  রাঙাদিদি একটা গাছতলায় বসিয়া কাঁদিতেছে। দুর্গা পাঁতে দাঁত টিপিয়া নিম্পলক নেত্রে দাঁড়াইয়া আছে। এমন সময় ডাক্তারখানায় যতীন আসিয়া উঠিল।

জগন বলিল গাছ সব আটকে দিয়েছি—পুলিশ এসে নোটিশ জারি করে গিয়েছে। কোনো পক্ষই গাছের কাছে যেতে পারবে না। আমি বারণ করে গেলাম, আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত কিছু কোরো না। কাটুক গাছ। ফিরে এসে দেখিদেবু এই কাণ্ড করে বসে আছে। অনিরুদ্ধ একজনের পিঠে এক লাঠি কষে পালিয়েছে।

ভিড়ের ভিতর হইতে অনিরুদ্ধ আগাইয়া আসিয়া বলিল—অনিরুদ্ধ ঠিক আছে। সে মেয়ে নয়—মরদ। অনিরুদ্ধের হাতে তাহার টাঙ্গি। সে বলিলটাঙ্গিটা তখন যে হাতের কাছে। পেলাম না! নইলে হয়েই যেত এক কাণ্ড!

যতীন বলিল—সেসব পরে যা হয় করবেন—এখন এঁদের তাড়াতাড়ি ব্যান্ডেজ করে। ফেলুন।

বৃদ্ধ দ্বারকা চৌধুরী এতক্ষণে চোখ মেলিয়া মৃদু হাস্যের সহিত হাত জোড় করিয়া বলিল–প্ৰণাম।

যতীন প্রতি-নমস্কার করিল—নমস্কার। কেমন বোধ করছেন?

–ভাল। মৃদু হাসিয়া বৃদ্ধ আবার বলিল—মনে করলাম মাঝে পড়ে মিটিয়ে দোব। দেবু গিয়ে কুড়ুলের সামনে দাঁড়াল। থাকতে পারলাম না চুপ করে।

সকলে চুপ করিয়া রহিল। এ কথার কোনো উত্তর দিবার ছিল না।

বৃদ্ধ বলিল পণ্ডিত নমস্য ব্যক্তি। শুধু পণ্ডিতই নয়, বীরপুরুষ। বয়স হলেও চশমা আমার এখনও লাগে না, দেবতা। কুড়ুলের সামনে পণ্ডিত যখন গিয়ে দাঁড়াল—তখনকার সে মূর্তি পণ্ডিত নিজেও বোধহয় কখনও আয়নায় দেখে নাই। বীরপুরুষ!

জগন বলিল—এগুলো হল গোঁয়ার্তুমি কি ফল হল? রাগ কোরো না, ভাই দেবু।

হাসিয়া বৃদ্ধ বলিল—সবার গাছই কেটেছে। গাছ এখনও দেবুরই দাঁড়িয়ে আছে, ডাক্তার।

জগন হরেন ঘোষালকে একটা প্রচণ্ড ধমক দিয়া উঠিল—কোন্ দিকে চেয়ে কাজ করছ ঘোষাল?

হরেন চমকিয়া উঠিল।

দেবু হাসিল। ডাক্তার বৃদ্ধের উপর চটিয়াছে। ঝালটা পড়িল হরেনের উপর।

***

পুলিশের একটা তদন্ত হইল।

শ্ৰীহরি কোনো কথাই অস্বীকার করিল না। শ্রীহরির পক্ষে কথাবার্তা যাহা বলিবার বলিল–দাশজী। দাশজী এখন জমিদারের সদর-কর্মচারী, এখানকার ভূতপূর্ব গোমস্তা। অভিজ্ঞ, সুচতুর, বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি। প্রজাস্বত্ব আইনে, ফৌজদারি আইনে সে সাধারণ উকিল-মোক্তার অপেক্ষাও বিজ্ঞ। শ্ৰীহরি সংবাদ পাইয়া তাহাকে আনিয়াছে। ব্যাপারটা এখন আর গ্রামের লোক এবং ব্যক্তিগতভাবে শ্রীহরির মধ্যে আবদ্ধ নয়। জমিদারের গোমস্তা হিসাবে সে ব্যাপারটা। করিয়াছে, সুতরাং দায়িত্ব জমিদারের উপরও পড়িয়াছে।

জমিদার বয়সে নবীন। এ-কালের বাংলাদেশের জমিদারের ছেলে। ইংরাজি লেখাপড়া জানে, জমিদারি খুব পছন্দ করে না। বারকয়েক ব্যবসা করিবার চেষ্টা করিয়া লোকসান দিয়া অগত্যা জমিদারিকেই অ্যাঁকড়াইয়া ধরিয়া বসিয়া আছে। জমিদারির মধ্যে আইন অনুযায়ী চলিবার প্রথা প্রবর্তনের চেষ্টা তাহার আছে, সেকালের জমিদারের মত জোরজবরদস্তির যারা সে মোটেই পছন্দ করে না। সেকালের জমিদারের মত ব্যক্তিত্বও তাহার নাই। কাজেই তার সাধু চেষ্টা। ফলবতীও হয় নাই। কলিকাতা যাইবার টাকার অভাব ঘটিলেই নায়েব-গোমস্তার মতে মত দিতে বাধ্য হয়। কলিকাতায় সিনেমা দেখে, থিয়েটার দেখে, একটু আধটু মদও খায়, রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে দর্শক হিসাবে যায়। ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার; লোকাল-বোর্ডে দাঁড়াইয়া এবার পরাজিত হইয়াছে। আগামী বারে কংগ্রেস-নমিনেশন পাইবার জন্য এখন হইতেই চেষ্টা করিতেছে। এবার অর্থাৎ উনিশ শো আটাশ সালে কলিকাতায় যে কংগ্রেস অধিবেশন হইবে—তাহার ডেলিগেট হইবার চেষ্টাও সে এখন হইতেই করিতেছে।

জমিদার কিন্তু এই সংবাদটা শুনিয়া পছন্দ করে নাই; বলিয়াছিল—এমন হুকুম যখন আমরা দিই নি, তখন আমাদের দায়িত্ব অস্বীকার করবেন। শ্রীহরি নিজে বুঝুক।

দাশজী হাসিয়া বলিয়াছিল শ্ৰীহরির মত গোমস্তা পাচ্ছেন কোথায়? সেটা ভাবুন! গ্রামের লোকের সঙ্গে তার ঝগড়া হয়েছে। সে গোমস্তা হিসেবে কাজটা অন্যায়ই করেছে। কিন্তু সেলোকটা আদায় হোক-না-হোক মহলের প্রাপ্য পাই-পয়সা চুকিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া, এই এক বছর হ্যান্ডনেটেও সে টাকা দিয়েছে-হাজার দুয়েক। তারপর সেটেলমেন্টের খরচা আদায়ের সময় আসছে। এক শিবকালীপুরেই আপনার লাগবে হাজার টাকার ওপর। তা ছাড়া অন্য মহলেরও মোটা টাকা আছে। এ সময় ওকে যদি ছাড়িয়ে দেন—তবে কি সেটা ভাল হবে?

জমিদারটি মিটিঙে দু-দশ কথা বলতে পারে, সমকক্ষ স্বজন-বন্ধুর মধ্যে বেশ স্পষ্টবক্তা বলিয়া খ্যাতি আছে; কিন্তু এই দাশজীটি যখন এমনই ধারায় চিবাইয়া চিবাইয়া কথা কয়, তখন জলমগ্ন ব্যক্তির মত হাঁপাইয়া উঠিয়া অসহায়ভাবে দুই হাত বাড়াই সে আত্মসমর্পণ করে।

দাশজী বলিল—আচ্ছা, এক কাজ করুন না কেন? শিবকালীপুর শ্ৰীহরিকে পত্তনি দিয়ে দেন না?

—পত্তনি?

–হ্যাঁ, ধরুন শ্রীহরি পাবে দু হাজারের উপর। তা ছাড়া আবার এই সেটেলমেন্টের খরচা লাগবে আর শ্রীহরিকে গোমস্তা রাখতে গেলে—এমনি বিরোধ হবেই। শ্ৰীহরি নেবেও গরজ করে।

—ও পত্তনি-টত্তনি নয়। যদি কিনে নিতে চায় তো দেখুন।

সম্পত্তি হস্তান্তরে জমিদারের আপত্তি নাই। সে নিজেই বলে—জমিদারি নয়, ও হল জমাদারি।

***

তদন্তে দাশজী সবিনয়ে সব স্বীকার করিল। আজ্ঞে হ্ৰা, গাছ কাটতে আমরা জমিদার তরফ থেকে হুকুম দিয়েছি। শ্ৰীহরি ঘোষ আমাদের গোমস্তা হিসেবেই গাছ কাটাতে লোক নিযুক্ত করেছিলেন। বৈশাখ মাসে গাছ আমরা হিন্দুরা কাটি না, কাজেই চৈত্র মাসে কাটবার ব্যবস্থা। এই সময়েই আমাদের সমস্ত বছরের কাঠ কেটে রাখা হয়।

জগন বলিল—কাটুন না। নিজের গাছ কাটুন, জমিদার কেন—

বাধা দিয়া দাশজী বলিল নিজের গাছই তো। ওসব গাছই তো জমিদারের।

—জমিদারের?

–আপনারাই বলুন জমিদারের কি না?

–না, আমাদের গাছ!

–আপনাদের? ভাল, কখনও আপনারা গাছের ডাল কেটেছেন?

–ডাল কাটি নি। কিন্তু আমরাই চিরকাল দখল করে আসছি।

–হ্যাঁ আপনারাই ফল ভোগ করেন। কিন্তু সে তো জমিদারের তালগাছের তাল কাটেন পাতা কাটেন আপনারা। শিমুলগাছের পাবড়া পাড়েন আপনারা। সরকারি পুকুরে লোকে পলুই চেপে মাছ ধরে। পুকুর পর্যন্ত গ্রামের লোকে একটা ভাগ করে রেখেছে; এ পুকুরের মাছ ধরবে রাম, শ্যাম, যদু ও পুকুরে ধরবে ঝালি, কানাই, হরি; অন্য পুকুরে ধরবে ভবেশ, দেবেশ, যোগেশ। এখন, এই তালগাছ—এই পুকুর এ সবেই কি আপনাদের মালিকানা?

দেবু এতক্ষণে বলিল-ভাল কথা, দাশমশায়। কিন্তু এসব গাছ যদি আপনাদের, তবে আপনারা এত লাঠিয়াল পাঠিয়েছিলেন কেন? জবরদখল দরকার হয় কোথায়? যেখানে দখল নাই সেইখানে—কিংবা যেখানে বে-দখলের সম্ভাবনা আছে সেইখানে। মানে সেখানেও দখল। সন্দেহজনক!

দাশ হাসিয়া বলিল না। না। লাঠিয়াল আমরা পাঠাই নি। আমরা পাঠিয়েছিলাম পাইক। লাঠি তাদের হাতে থাকে। ওদের দুছোটের শামিল ওটা। এখন ধরুন, যার যেমন বিয়ে, তার তেমন বাদি। আপনার আমার বাড়িতে বিয়ে হয়, একটা ঢোল বাজে একটা কাসি বাজে। তার সঙ্গে বড়জোর সানাই। জমিদার বাড়ির বিয়েতে বাজনা হয় হরেক রকমের। জমিদার তরফ থেকে গাছ কাটতে এসেছে-পাচ-সাতটা গাছ কাটবে, মজুর আছে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জনতার সঙ্গে আট-দশটা পাইক এসেছে—কি এমন বেশি এসেছে? আপনারা এমন বেআইনি দাঙ্গা করবেন জানলে—আমরা অন্তত পঞ্চাশ জন লাঠিয়াল পাঠাতাম। তার আগে অবশ্য শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা জানিয়ে খবর দিয়ে রাখতাম। তা ছাড়া আইন তো আপনি বেশ জানেন গো দেবুবাবু; গাছ কার বলুন না আপনি!

আজ এ তদন্তের ভার পাইয়াছিল এখানকার থানার দারোগাবাবু। দারোগাবাবু লোকটি ভাল। ক্ষমতার অপব্যবহার করে না, ব্যবহারও ভদ্র। দারোগা বলিল যাই বলুন দাশজী, কাজটি ভাল হয় নি। মানুষের মনে আঘাত দিতে নেই। যা আমাদের এতে করবার কিছু নাই। স্বত্বের মামলার বিষয়। আমরা নোটিশ দিয়েছি—মুখেও উভয় পক্ষকে বারণ করছি আদালতে মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত কেউ গাছের কাছ দিয়ে যাবেন না। গেলে ফৌজদারি হলে–আমরা তখন চালান দেব। পুলিশ বাদি হয়ে মামলা করবে।

তারপর উঠিবার সময় দারোগা আবার বলিল প্রজাস্বত্ব আইনের সংশোধন হচ্ছে, জানেন তো দাশজী?

–আজ্ঞে জানি বৈকি। দাশজী হাসিল। তারপর বলিল—হলে আমরা বাঁচি, দারোগাবাবু, আমরা বাঁচি।

দারোগাবাবুকে বিদায় করিয়া শ্ৰীহরি দাশজীকে লইয়া আপনার বৈঠকখানায় উঠিল। ইতিমধ্যে শ্ৰীহরি একটা নূতন বৈঠকখানা করিয়াছে। খড়ের ঘর হইলেও পাকা সিঁড়ি, পাকা বারান্দা, পাকা মেঝে।

দাশ তারিফ করিয়া বলিল–বা-বা-বা! এ যে পাকা আসর করে ফেললে, ঘোষ! কিন্তু আমাদের নীলকণ্ঠের গান জান তো? যদি করবে পাকা বাড়ি—আগে কর জমিদারি!

শ্ৰীহরি তক্তপোশের উপরের শতরঞ্জিটা ঝাড়িয়া দিয়া বুলিল—বসুন!

বসিয়া দাশজী বলিল–জমিদারি কিনবে ঘোষ?

–জমিদারি? শ্ৰীহরি চমকিয়া উঠিল। জমিদারির কল্পনা সে স্পষ্টভাবে কখনও করে নাই। সে প্রশ্ন করিল—কোন্ মৌজাঃ কাছে-পিটে বটে তো?

—খোদ শিবকালীপুর! কিনবে?

শ্ৰীহরি বিচিত্র সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে দাশজীর দিকে চাহিয়া রহিল। শিবকালীপুরের জমিদারি? গ্রামের প্রতিটি লোক তাহার প্রজা হইবে! ঘোষ হইবে সকলের মনিব, বাবুমহাশয়, হুজুর। চকিতে তাহার অধীর মন নানা কল্পনায় চঞ্চল হইয়া উঠিল। গ্রামে সে হাট বসাইবে। স্নানের মজা-দিঘিটা কাটাইয়া দিবে। চণ্ডীমণ্ডপে পাকা দেউল তুলিবে, আটচালা ভাঙিয়া নাটমন্দির গড়িবে। এল-পি পাঠশালার বদলে এম-ই স্কুল করিবে; নাম হইবে শ্ৰীহরি এম-ই স্কুল। ইউনিয়ন বোর্ড হইতে লোকাল বোর্ডে দাঁড়াইবে।

দাশজী বলিল কিনে ফেল ঘোষ। তোমার পয়সা আছে। জমিদারি হল অক্ষয় সম্পত্তি। তা ছাড়া–এই গাঁয়ের যারা তোমার শত্ৰু-একদিনে তোমার পায়ে গড়িয়ে পড়বে। সেটেলমেন্ট ফাইনাল পাবলিকেশনের আগেই কেনো। দরখাস্ত করে নাম সংশোধন করিয়ে নাও। ফাইনাল পাবলিকেশনের পর পাঁচধারার কোৰ্ট পাবে। টাকায় চার আনা বৃদ্ধি তো হবেই। আট আনার নজির হাইকোর্ট থেকে নিয়ে রেখেছি। শোন, আমি সুধিবা দরে করে দেব। হ্যাঁ, দরজাটা বন্ধ করে দাও দেখি।

শ্ৰীহরি দরজা বন্ধ করিয়া দিল।

দীর্ঘকাল পরামর্শ করিয়া হাসিতে হাসিতেই দুজনে বাহির হইল। দাশজী বলিল–ও নোটিশ তোমার বাজে, একদম বাজে নোটিশ দিয়েছে। তুমি যদি যাও—তার ফলে শান্তিভঙ্গ ঘটে। তবে হেনো হবে তেনো হবে, এই তো?

তারপর মুখের কাছে মুখ আনিয়া ভঙ্গি করিয়া নাড়িতে নাড়িতে বলিল—কিন্তু শান্তিভঙ্গ যদি না হয়, তা হলে? দাশজী ঠোঁট টিপিয়া হাসিতে আরম্ভ করিল।

শ্ৰীহরি বলিল—তবে আমি নিশ্চিন্দি হয়ে করতে পারি?

–নিশ্চয়, তবে সাবধান, কেউ যেন জানতে না পারে। কোনো হাঙ্গামা যেন না হয়।

–আর গাজনের কি করব?

–যা হয় কর।

–চণ্ডীমণ্ডপ তা হলে যেমন আছে তেমনি থাক।

–ওই কাজটি কোরো না ঘোষ। আমি বারণ করছি। চণ্ডীমণ্ডপের সেবাইত জমিদার বটে, কিন্তু অধিকার গাঁয়ের লোকের। পাকা নাটমন্দির, দেবমন্দির নিজের বাড়িতে কর। সম্পত্তি থাকতেও আছে—যেতেও আছে। যদি কোনোদিন সম্পত্তি চলেও যায় তখন আর কোনো অধিকার থাকবে না তোমার।

দাশজী শ্ৰীহরিকে চণ্ডীমণ্ডপের উপর টাকা খরচ করিতে নিষেধ করিতেছে। যে দিন-কাল পড়িয়াছে। সাধারণের জিনিসে নিজের টাকা খরচ করা মূৰ্খতা মাত্র।

***

পরদিন প্রাতঃকালেই গ্রামে আর একটা হইচই উঠিল।

দেবু ঘোষের আধ-কাটা আমগাছটা গতরাত্রেই কাটিয়া কেহ তুলিয়া লইয়াছে। কেহ আর কে? শ্ৰীহরি লইয়াছে। শান্তিভঙ্গ হয় নাই, সুতরাং আইনভঙ্গও সে করে নাই! সদ্যকাটা গাছটার শিকড়ের উপর আঙুল চারেক কাণ্ডটা কেবল জাগিয়া আছে। কাটা গাছটার অবশিষ্ট কোথাও বিশেষ পড়িয়া নাই। কেবল কতকগুলো ঝরা কাঁচা পাতা, কতকগুলো কাঁচা আম, আঙুলের মত সরু দুই-চারটা ডাল, শিকড়-কাটা কতক কুচা পড়িয়া আছে। জমিটার জলসিক্ত নরম মাটিতে গাড়ির চাকার দাগে, গরুর খুরের চিহ্নে, সাঙ্কেতিক ভাষায় লিখিত রহিয়াছে গত রাত্রের কাহিনী।

ঘোষাল আস্ফালন করিয়া বেড়াইতেছিল—রেগুলার থেট কেস হি ইজ এ থি! হি ইজ এ থি! হ্যান্ডকাফ দিয়ে চালান দেব।

দেবু বারণ করিল–না। ওসব বোলোনা, ঘোষাল!

জগন বলিল-দুপুরের ট্রেনেই চল মামলা রুজু করে আসি।

তাহাতেও দেবু বলিল–না।

ধীর পদক্ষেপে দেবু আসিয়া বসিল যতীনের কাছে।

যতীন বলিল—শুনলাম গাছটা রাতারাতি কেটে নিয়েছে।

জগন বলিল-মামলা করতে বলছি, দেবু রাজি হচ্ছে না।

দেবু একটু ম্লান হাসি হাসিল।

—কি হবে মামলা করে? গাছ আইন অনুসারে জমিদারের। মিছে টাকা খরচ করে কি লাভ?

–এরই মধ্যে যে অবসন্ন হয়ে পড়লেন দেবুবাবু?

–হ্যাঁ। অবসন্ন হয়েছি যতীনবাবু। আর পারছি না।

–দাঁড়ান, একটু চা করি।—উচ্চিংড়ে! উচ্চিংড়ে।

একা উচ্চিংড়ে নয়, সঙ্গে আরও একটা বাচ্চা আসিয়া হাজির হইল।

—চা করতে বল মা-মণিকে।

হরেন বলিল—এটা আবার কোথেকে এসে জুটল? একা রামে রক্ষা নাই সুগ্রীব দোসর!

হাসিয়া যতীন বলিল—উচ্চিংড়ের জংশনের বন্ধু। কাল পিছনে পিছনে এসেছিল গাছ কাটার হাঙ্গামা দেখতে। সেখানে বনের পাখি আর খাঁচার পাখিতে মিলন হয়েছে। উচ্চিংড়ে ওকে নিয়ে এসেছে।

—বেশ আছেন মশায়, নন্দী-ভৃঙ্গী নিয়ে। আপনার কাছেই এসে জোটে সব!

–আমার কাছে নয়। উচ্চিংড়ে ওকে নিয়ে এসেছে মা-মণির কাছে।

–মানে কামার-বউয়ের কাছে?

হাসিয়া যতীন বলিল–হ্যাঁ।

–অনিরুদ্ধ ওকে মেরে তাড়াবে।

—কাল সে বোঝাপড়া হয়ে গেছে। অনিরুদ্ধবাবু তাড়াতে চেয়েছিলেন। মামণি বলেছেন। ও গরু চরাবেখাবে থাকবে। অনিরুদ্ধবাবু গরু কিনেছেন কিনা। আর কামারশালায় হাপর টানবে।

উচ্চিংড়ে আসিয়া দাঁড়াইল–চা লাও গো বাবু।

ওদিকে ঢাক বাজিয়া উঠিল। উদ্দিংড়ে তাড়াতাড়িতে অর্ধেক চা উপচাইয়া ফেলিয়া, চায়ের বাটিগুলি নামাইয়া দিয়াই—দাওয়া হইতে এক লাফ দিয়া পড়িল; ড্যাং-ডাং-ডাং-ন্যাটাং ড্যাটাং-ডাং-ডাং-ড্যাং–ন্যাটাং ড্যাটাং! আয় রে গোবরা, শিব উঠছে দেখতে যাই।

গাজনের ঢাক বাজিতেছে। পূর্ণ এক বৎসর পরে গাজনের বুড়াশিব পুকুরের জল হইতে উঠিবেন। ভক্তেরা দোলায় করিয়া লইয়া আসিবে।

জগন বলিল–ভক্ত কে কে হল জান, ঘোষাল?

হরেন বলিল–ওলি ফাইব। একটা হাতের অঙ্গুলি প্রসারিত করিয়া সে দেখাইয়া দিল।

–চল, ব্যাপারটা দেখে আসি।

–চল।

জগন, হরেন চলিয়া গেল।

যতীন বলিল—দেবুবাবু!

–বলুন?

কি ভাবছেন?

–ভাবছি—দেবু হাসিল। তারপর বলিল দেখবেন?

–কি?

–আসুন আমার সঙ্গে।

 

অল্প খানিকটা আসিয়াই শ্ৰীহরির বাড়ি, বাড়ির পর খামার। পথ হইতেই খামারটা দেখা যায়। প্রকাও একটা জনতা সেখানে জমিয়া আছে। খামারের উঠানের মাঝখানে সোনার বর্ণ ধানের একটি স্তুপ। পাশেই তিনটি বাঁশের পোয়াতে বড় বড় ওজনের কাটা-পাল্লা টাঙানো হইয়াছে। একটা গাছের তলায় চেয়ার পাতিয়া বসিয়া আছে শ্ৰীহরি। জনকয়েক লোক দেবু ও যতীনকে দেখিয়া আড়ালে লুকাইয়া দাঁড়াইল। ওদিকে ওজনের পাল্লায় অবিরাম ধান ওজন চলিতেছে—দশ দশ–দশ রামে–ইগার ইগার। ইগার ইগার–ইগার রামে–বার বার।

দেবু বলিল—দেখলেন?

যতীন হাসিয়া বলিল, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে।

—কি ভাবছি আমি বুঝলেন? আমি একা পড়ে গিয়েছি!

কিছুক্ষণ পর যতীন বলিল—আপনি তা হলে বিবাদ মিটিয়ে ফেলুন দেবুবাবু। সত্যই বড় কষ্টে পড়বেন আপনি।

দেবু হাসিল, বলিলনা, ও ভাবনা আর ভাবিনে। ভাবছি—এতদিনের গাজন, আমাদের গ্রামে গাজনে কত ধুম ছিল, সমস্ত গ্রামের লোক প্রাণ দিয়ে খাটত। অন্য গাঁয়ের সঙ্গে আমাদের গাজনের ধুমের পাল্লা চলত। সেসব উঠে যাবে। নয়ত শ্ৰীহরির একলার হাতে গিয়ে পড়বে। দেবতাতে সুদ্ধ আমাদের অধিকার থাকবে না! ভগবানে আমাদের অধিকার থাকবে না। আমাদের ভগবান পর্যন্ত কেড়ে নেবে।

নেলো আসিয়া দাঁড়াইল।

যতীন বলিল—কি সংবাদ নলিন?

—আট আনা পয়সা। গাজনে এবার মেলা বসাবে ঘোষমশায়। পুতুল তৈরি করে বিক্রি করব। রং কিনব।

—মেলা বসাবে শ্রীহরি? দেবু উঠিয়া বসিল।

নলিনকে বিদায় করিয়া যতীন বলিলনলিনের হাতটি চমৎকার।

দেবু বলিল–ওর মাতামহ যে ছিল নামকরা কুমোর।

–কুমোর! নলিন তো বৈরাগী!

–হ্যাঁ। কাচের পুতুলের চল হল, শেষ বয়সে অভাবে পড়ে বুড়ো ভিক্ষে ধরে বোষ্টম হয়েছিল। তা ছাড়া বিধবা মেয়েটার বিয়ের জন্যও বোষ্টম হওয়া বটে। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া থাকিয়া দেবু আবার বলিল—শ্ৰীহরি এবার তা হলে ধুম করে গাজন করবে দেখছি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *