২. জানলার ধারে ভোরবেলায়

০৫.

জানলার ধারে ভোরবেলায় চেয়ারে বসে আনন্দ কৌতূহলে তাকিয়ে রইল মাঠের দিকে।

চেয়ারে বসলেই শুধু মাঠটার এক-তৃতীয়াংশ পুবদিকের জানলা দিয়ে দেখা যায়। বাকিটা ঢাকা পড়েছে কাগজিলেবু গাছটায়। বটতলা ইনস্টিটিউটের খানিকটা দেয়াল আর লাইব্রেরির একটা জানলাও আনন্দ দেখতে পায়। এখন জানলাটা বন্ধ অর্থাৎ ডগুদা এখনও আসেনি। সাতটায় লাইব্রেরি খোলার কথা।

এই নিয়ে চারদিন ওরা মাঠে আসছে। গুটি সাতেক বাচ্চা মেয়ে এবং আর একজন, যাকে প্রায়ই আনন্দ রাস্তায় দেখেছে। কাঁধে রঙিন ঝোলা, কালোপাড় সাদা শাড়ি, গায়ের রঙ কার্বন পেপারের ঝকঝকে দিকটার মতো, মুখটি লম্বাটে, সামনের দুটি দাঁতকে ঠোঁট কোনওমতেই আড়ালে রাখতে পারে না। শুধু হাঁটার জন্যই ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। এমন মেরুদণ্ড সিধে রেখে, চওড়া কবজির হাত দুটো না দুলিয়ে, মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে, গ্যারি সোবার্সের চলনে কোনও মেয়েকে আনন্দ হাঁটতে দেখেনি। সে আরও লক্ষ করেছে, প্রায় পুরুষদের মতো বাইসেপসের গড়ন, আঙুলগুলো মোটা। পায়ে সাদা কেডস। বয়স, আন্দাজ করা শক্ত। তার মনে হয়েছে, তিরিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে কোনও একটা জায়গায়। আনন্দ ওকে লটারির টিকিট বিক্রি করতে দেখেছে। থাকে বোধহয় বটতলার পিছনের কোনও গলিতে। তার বেশি সে ওর সম্পর্কে কিছু জানে না। মেয়েগুলির বেশির ভাগই বটতলা পাড়ার।

মাঠটাকে পাক দিয়ে ওরা দৌড়চ্ছে। কাগজিলেবু গাছটার পাশ দিয়ে সেকেন্ড দশেকের জন্য আনন্দ ওদের দেখতে পাচ্ছে। ধীরে, যেন লেফট-রাইট করতে করতে দৌড়চ্ছে। পা ফেলা শিখছে। একটি মেয়ের হচ্ছে না, আনন্দ এত দূর থেকেই সেটা বুঝতে পারছে।

মেয়েটি থেমে বাঁ দিকে তাকাল। লেবু গাছের আড়াল থেকে এগিয়ে এল—মনে মনে আনন্দ নামটা ঠিক করে ফেলে—লেডি সোবার্স। মেয়েটিকে কী বোঝাচ্ছে হাত নেড়ে, তারপর ঝুকে পা দুটো ধরে পর পর তোলা-নামা করিয়ে। এতদূর থেকে। আনন্দ শুনতে পাচ্ছে না। স্টেপিংটা দেখাবার জন্য লেডি সোবার্স নিজেই ছুটতে গিয়ে হাঁটুতে শাড়ি আটকে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল।

আনন্দ চোখ বুজল সঙ্গে সঙ্গে। প্রায় কুড়ি সেকেন্ড পর চোখ খুলল। মাঠের ওইখানটা ফাঁকা, কেউ নেই! এবার এল দুটি মেয়ে। ওদের পিছনে, লেডি সোবার্স। অ্যাথলিটরা যেমন খাটো প্যান্ট পরে তাই পরনে। রংটা আকাশি নীল। আনন্দ অবাক হয়ে গেল ওকে প্যান্ট পরা দেখে। এত বয়সী কেউ, অত খাটো প্যান্ট পরে এমন খোলা মাঠে! লোকজন যারা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে নিশ্চয় ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে বা দাঁড়িয়ে পড়ছে। আনন্দর কান দুটো গরম হয়ে উঠল। প্যান্টটা নিশ্চয় পরেই এসেছিল, ব্লাউজের মতো শার্টটাও। নিশ্চয় একসময় দৌড়টৌড় করত, ধরনধারণ দেখে তাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু এইরকম রক্ষণশীল এলাকায় প্রকাশ্যে এমন পোশাক পরতে পারে এত বয়সে—এ কে?

আনন্দ এরপর অনেকক্ষণ আর ওদের দেখতে পেল না। কিছু একটা করছে ওরা লেবু গাছটার ওধারে। দোতলার বারান্দায় গেলে দেখা যাবে, কিন্তু এঘর থেকে তার বেরোনো নিষেধ। শিকারি নেকড়ের মতো বিপিনদা ঘুরে বেড়ায় ঘরটার কাছাকাছি, দোতলায় মেজদা এখনও নিশ্চয় ঘুমোচ্ছে। নতুন টেবল-ঘড়িটায় সময় দেখল আনন্দ। ছটা বেজে পঞ্চাশ। সূর্য এখনও মন্দিরের আড়ালে, তবে কারখানার চালার ওপর রোদ পড়েছে।

ঘর থেকে সন্তর্পণে আনন্দ বেরোল। দোতলার বারান্দার তলায়, সিং-দরজার পাশের রকটা থেকে মাঠের অপরদিক দেখা যায়। মেয়েরা এখন কী করছে সেটা জানার জন্য কৌতূহলে সে মারা যাচ্ছে।

বিপিনদা বোধহয় দোতলায়। রান্নাঘর থেকে শব্দ আসছে, হাবুর মা এখন ব্যস্ত। প্রায় ছুটেই সে বাইরের রকে এল। একমাস পর এই প্রথম।

লেডি সোবার্স স্টার্ট নেওয়া দেখাচ্ছে। মাটিতে দুহাত, একটা হাঁটু ভেঙে মাটিতে ছুঁইয়ে রাখা। ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে বেড়ালের মতো শরীরটা কুঁকড়ে, তারপরই ছিটকে যাওয়া। এত দূর থেকে আনন্দ দেখতে পাচ্ছে স্টার্ট নেবার সেকেন্ড চারেক আগে ওর সারা শরীরটা শক্ত হয়ে যাচ্ছে। হাতির শুড়ের মতো কাঁধ থেকে নেমে আসা হাত দুটোর পেশিগুলো তীক্ষ্ণ হল, উরু থেকে পায়ের গোছ পর্যন্ত পাকানো রয়েছে ইস্পাতের স্প্রিং। মুখটা তুলে সামনে তাকিয়ে। গলার দুপাশে কান পর্যন্ত দড়ির মতো পাকিয়ে উঠেছে মাংস, চোয়াল শক্ত আর চোখদুটো ঝকঝক করছে সকালের রোদে। কালো পাথরে কয়েক মুহূর্তের জন্য খোদাই করা একটা অদ্ভুত কাঠিন্য যা বেগবান হবার প্রতীক্ষায়। বিপুল প্রাণশক্তি বেঁধে রাখা আছে লেডি সোবার্সের এই ভঙ্গিতে, ছাড়া পেলেই সকালের এই নরম রোদকে জ্বালিয়ে উৎখাত করে দেবে যেন। আনন্দর বুকের মধ্যে তিরতির করে উঠল ভয়।

কিন্তু ও কে? আনন্দ বিশ্বাস করতে পারছে না। কোমরে হাত রেখে। সরু কঞ্চির মতো ডান পা। শরীরটা ডানদিকে হেলে রয়েছে। মেয়েদের থেকে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগে লেডি সোবার্সের স্টার্ট শেখানো দেখছে। বীরা দত্ত রোড ধরে ডগুদা তখন হনহনিয়ে আসছে কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে।

ডগুদাকে দেখে ও বাঁ দিকে ঝুঁকে পা টানতে টানতে এগিয়ে গেল। লাইব্রেরির দরজায় তালা খুলে ডগুদা ভিতরে ঢুকল। বেরিয়ে এল হাতে একটা বেলের। আকারের লোহার গোলা নিয়ে, একে ওরা বলে শট! ইনস্টিটিউটের টিকে থাকা যে কটি লোহার সম্পত্তি এখনও রয়েছে এটি তারই অন্যতম।

শটটা দুহাতে ধরে, ও দুলে দুলে ফিরে এল। ধপ করে মাটিতে ফেলে, তালু ঝাড়ল। অবাক হয়ে আনন্দ ভাবল, লোহার বল কে ছুড়বে? ওই মেয়েরা না লেডি সোবার্স?

উত্তরটা একটু পরেই সে জেনে গেল। মেয়েরা একে একে বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে। সাতটার পর ওরা থাকে না। হয়তো পড়াশুনা করতে হয়। লেডি সোবার্স শট নিয়ে ছুড়তে শুরু করল। তিনটে ইট সাজিয়ে সার্কল করেছে। সার্কলের দিকে পিঠ ফিরিয়ে। ডান হাতে ধরা শট ডান গালে ঠেকিয়ে কুঁজো হয়ে। বাঁ পা জমি থেকে তোলা। স্ট্যাচুর মতো কয়েক সেকেন্ড নিথর, তারপরই ছিলেছেড়া ধনুকের মতো ছিটকে উঠল। ডান পায়ের ওপর ভর করে তিনটে ছোট্ট লাফে সার্কলের কাছে পৌঁছেই শরীরটা ঘুরিয়ে নিয়ে বাঁ পা মাটিতে ফেলল। ডেলিভারি দেবার ঠিক আগে যেন—তারপর সারা শরীরের মাসল টানটান। সব জোর গুটিয়ে এসে কাঁধে, সেখান থেকে ডান বাহু বেয়ে উঠে এল শট ধরা মুঠোয়। আ আ আহ চাপা একটা গোঙানির মতো আওয়াজ এতদূর থেকেও আনন্দ শুনতে পেল। তারপরই লোহার গোলাটা হাত থেকে উড়ে বেরিয়ে এল। মাটিতে পড়তেই ধপ শব্দ হল একটা।

ও প্রায় পনেরো হাত ছুটে গেল, দুলতে দুলতে। একটা ভাঙা ইটের ছুচলো টুকরো দিয়ে আঁচড় কাটল যেখানে গোলাটা পড়েছে। তারপর সেটা দুহাতে ধরে ফিরে এল লেডি সোবার্সের কাছে। আনন্দ হেসে ফেলল। সর্বত্র এই ওর কাজ, ফিরিয়ে দেওয়া। কিন্তু সারাজীবন কি ওর এইভাবেই চলবে! খাওয়া-পরার জন্য তো ওকে কাজকম্মো করতে হবে, চেষ্টা না করলে কি কাজ পাওয়া যায়? তা ছাড়া কে ওকে কাজ দেবে? খোঁড়া লোকেরাও চাকরি করে কিন্তু তারা লেখাপড়া জানে। ও তো স্কুলে পড়ে বলে মনে হয় না।

পিছনে গলা খাঁকরি হতেই আনন্দ চমকে কুঁকড়ে গেল। তাকিয়ে দেখল, বাবা।

এখানে?

 এই দেখছি, কেমন প্র্যাকটিস করছে শট পাট।

অনাদিপ্রসাদ এগিয়ে এসে মাঠের দিকে তাকালেন, ভ্রু কুঞ্চিত হল।

অসভ্যের মতো পোশাক, এসব কী! মেয়েছেলের এ কী বেশ!

 আনন্দ একপা একপা পিছাচ্ছে।

তুমি দেখছিলে?

এইমাত্র আমি এলাম।

হুম।

দরজার কাছে পৌঁছে গেছে। ডান দিকে ঘুরেই আনন্দ ছুটে ঘরে এল। অনাদিপ্রসাদের গলা শোনা গেল, বিপিনদাকে ধমকাচ্ছেন আনন্দর উপর নজর রাখায় অবহেলার জন্য।

সারাদিন কিছু করার নেই। মেজদার এনে দেওয়া গল্পের বই পড়া আর বিলিতি খেলার ম্যাগাজিন দেখা ছাড়া। ছবিগুলো দেখে দেখে চোখ পচে গেছে। ইংরেজি অক্ষরগুলোর অধিকাংশেরই মানে বুঝতে পারে না। আর বুঝতে না পারলে শুধু ছবি দেখে কী লাভ। বাড়ির কয়েকটি লোকের মুখ আর গলার শব্দ, এছাড়া আর কোনও মানুষের মুখ সে দেখতে পায় না। পুবের জানলা দিয়ে দূরে, কয়েক হাত বীরা দত্ত রোড আর মাঠে লরি দাঁড়ালে কয়েকটা লোক দেখা যায়। শুধু একদিন দুপুরে খুব কাছ থেকে একটা লোককে দেখেছিল।

উত্তরের জানলা দিয়ে সে দূরে তাকিয়ে শুয়েছিল। বহু দূর পর্যন্ত আকাশ দেখা যায়। ঘন ঝোপগুলোর ওপাশে জলা। মাঝে মাঝে ইলেকট্রিক ট্রেনের ভেঁপু বেজে উঠছে। আনন্দ কিছুই ভাবছিল না। শুধুই তাকিয়ে রয়েছিল। এমন সময় হঠাৎ জানলার গায়ের পথটা দিয়ে একটা লোক চলে গেল। পাঁচ-ছ সেকেন্ড পরে লোকটা, যার একমুখ দাড়ি আর একরাশ পাকাচুল, পিছিয়ে এসে অবাক হয়ে জানলা দিয়ে ভেতরে তাকাল। কারখানার কেউ, হয়তো গুদামে যাচ্ছে। আগে কখনও সে এই জানলাটা খোলা দেখেনি।

আনন্দ চমকে উঠেছিল। প্রায় তিন হাত দূরে এমন বিদঘুটে একটা মুখ আচমকা হাজির হলে ভয় তো করবেই। হাত বাড়িয়ে জানলার পাল্লাটা বন্ধ করে দিয়েছিল। বহুক্ষণ পরে পাল্লা খুলে এধার ওধার তাকায়। লোকটাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল। বহুদিন সে বাইরের মানুষ দেখেনি। তারপর সে একটু একটু করে বিষণ্ণ হয়ে পড়তে শুরু করে। খুব স্বাভাবিক, সাধারণ বিষণ্ণতা। দীর্ঘদিন মানুষ না দেখলে, বাইরে বেরোতে না পারলে, এরকম সকলেরই হয়। এই নিয়ে নালিশ করা যায় না। করবেই বা কার কাছে। প্রতিদিন সকালে আর রাতে মেজদা আসে। তাকে কিছু বলা যাবে না। এই নিয়ে। বেরোনোর কথায় একদমই কান দেবে না।

আনন্দ আপনমনে মাথা নাড়ল। মনটা ভার লাগছে। সকালে মেয়েদের ছোটা দেখে তার নিজেরও ইচ্ছা করেছিল, মাঠে গিয়ে ছুটতে। ওদের মতো স্টেপিং ফেলে দৌড়তে। হঠাৎ সে উঠে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করল। যেভাবে ওরা পা ফেলছিল সেই ভঙ্গিতে পা ফেলে ছোট্ট ঘরটায় আনন্দ পাক দিতে শুরু করল।

মাথাটা ঘুরছে, আনি-মানি-জানিনার পর যেভাবে ঘোরে। হাঁপ ধরছে। কারণ, যে-কোনও পরিশ্রমই একদম বারণ। আনন্দ দাঁড়িয়ে পড়ল। মুখটা রাগে গনগনে হয়ে উঠল। দ্বিগুণ জোরে সে হাঁটু তুলে তুলে ঘরের মধ্যে গোল হয়ে ছুটতে শুরু করল। আর বিড়বিড় করে বলতে থাকল:

বেশ করব। বেশ করব। বারণ বারণ বারণ। মানি না মানি না। এভাবে বেঁচে থাকার দরকার নেই, মানে হয় না।

বিছানার উপর দড়াম করে পড়ল সে। বালিশে মুখ ডুবিয়ে হাঁপাচ্ছে। হাঁপানিটা ধীরে ধীরে কান্নায় রূপান্তরিত হল। ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কিছুক্ষণ কেঁদে সে শূন্য চোখে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল। তখন সে একটা পাখির ডাক শুনতে পেল। প্রথমে ভেবেছিল বাঁশি। দ্বিতীয়বার সে মুখ তুলে উত্তরের জানলা দিয়ে তাকাল। ক্ল্যারিওনেটে প্রথম ফু দেওয়ার মতো করুণ একটানা। সেকেন্ড চারেক পরই স্বরটা ছটফটিয়ে লাফালাফি করল ছোট্ট বাছুরের মতো।

বার তিনেক ডাকার পর পাখিটার আর সাড়া নেই। কী পাখি? কোথায় ছিল এতদিন? ঝোপ-জঙ্গলের দিকে চোখ রাখল আনন্দ। অদ্ভুত ডাকটা তো। ময়না, কোকিল আর টিয়ে, কাক, চড়াই আর পায়রা ছাড়া কটা পাখির ডাকই বা শুনেছি। কটা গাছই বা চিনি। গ্রামের ছেলেরা অনেক বেশি জানে। এ পাখিটা আগেও হয়তো ডেকেছে, শুনিনি। কী মিষ্টি, অদ্ভুত কী যেন একটা রয়েছে শিসটায়।

আনন্দ বুঝতে পারছে না, কিন্তু শরীরে অনুভব করতে পারছে। হাতের রোমগুলো খাড়া হয়ে উঠেছে। তিরতির করে কাঁপুনি দিয়েছিল যেভাবে আজ সকালে তার বুকের মধ্যে হয়েছিল। নিঃসঙ্গ দিন ও রাতের মধ্যে ঢুকে পড়েছে অজানা এক সঙ্গী, এই শিসটা।

আবার শিস।

পুবের জানলায় সরে এসে আনন্দ নিম গাছের ডালে ডালে চোখ ফেলতে লাগল। কত বড়? চড়ুইয়ের মতো ছোট্ট? কাকাতুয়ার মতো বড়? শালিক পাখির মতো রঙ? কী নাম?

আনন্দ একবার উত্তরের, একবার পুবের জানলায় আসা-যাওয়া শুরু করল। আর ডাকছে না, হয়তো উড়ে গেছে। কিংবা ও সারাদিন তিন-চারবারের বেশি ডাকে না। কত পাখির কতরকমের স্বভাবই যে থাকে। কিংবা এখনি হয়তো কোনও বেড়াল কি চিল কি সাপ ওকে…!

হতাশ হয়ে আনন্দ বিছানায় শুয়ে বাইরে তাকাল। আকাশ ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। আকাশে মেঘ, উঁচু থেকে তোলা হিমালয় পর্বতমালার ছবির মতো। কী নিঃসঙ্গ, ধূধূ, বিরাট! বহুদিন আগে একটা রূপকথায় সে পড়েছিল, মানুষ মারা গেলে মেঘ হয়। সে বিশ্বাস করত এবং এখনও করে তার মা মেঘ হয়ে আকাশে কোথাও আছে। কিংবা হয়তো নেই। গনগনে রোদের তাপে সমুদ্র নদী খাল বিলের জল বাষ্প হয়ে মেঘ হয়। এসব প্রকৃতির তৈরি মেঘ। তার মা এভাবে মেঘ হবে না। কীভাবে হবে, কেমন দেখতে হবে তাই নিয়ে সে ভাবতে থাকল।

ঘুমিয়ে পড়েছিল আনন্দ। বন্ধ দরজায় ধাক্কার শব্দে ঘুম ভাঙল। হাবুর মা দুধ এনেছে। সে তাকাল লেবুগাছের পাশ দিয়ে মাঠের দিকে। ম্লান হয়ে এসেছে বিকেল। সন্ধ্যা নামছে। কয়েকটি মেয়ে মাঠের উপর দৌড়ে গেল। তারপর ও এল দুলতে দুলতে। ভাঙা ইটের টুকরো কুড়িয়ে একধারে ছুড়ে ফেলতে ফেলতে এগোচ্ছে। খালি পায়ে মেয়েদের পা কাটে, ব্যথা লাগে বলে তাই কাজে নেমে পড়েছে। সেই কুড়োনোরই কাজ। আনন্দ হাসতে গিয়েও হাসল না। ও যা কিছু করে সবই অন্যকে সাহায্য দিতে যেটা ওরই দরকার। লেডি সোবার্স বিকেলে আসে না। এধার ওধার ঘুরে এই সময়টায় হয়তো লটারির টিকিট বিক্রিতে ব্যস্ত থাকে। নিশ্চয় খুব গরিব। অনেকগুলো লোক আছে বাড়িতে, তাদের খাওয়াতে পরাতে হয়। ওর কাছ থেকে। একটা টিকিট কিনলে কেমন হয়?

সন্ধ্যায় হাবুর মা আফিংয়ের মৌতাতে কুঁদ হয়ে থাকে। বাবা চেম্বারে, মেজদা তো কোনওদিনই ফেরে না। বিপিনদা এইমাত্র কাচা জামা-প্যান্টের পুঁটলি নিয়ে বেরোল ধোপার কাছে ইস্ত্রি করিয়ে আনতে।

সন্তর্পণে ফটক থেকে বেরিয়েই আনন্দ প্রায় ছুটে অন্ধকার মাঠের মধ্য দিয়ে ইনস্টিটিউটের দিকে এগোল। ডগুদা লাইব্রেরি খুলেছে অনেকক্ষণ।

ডগুদা নিজেই একদিন বলেছিল, তার নাম ডগু কেন।

ডগ থেকে ডগু। ডগ মানে কুকুর। পতৌদির নাম টাইগার কেন জানিস? ছোটবেলায় ও বাঘাহামা দিত। তাই আদর করে টাইগার বলে ডাকা হত। আমিও ওই রকম হামা দিতুম, কিন্তু আমাকে বাবা আদর করে বলত ডগ। পতৌদির বাবা ছিল নবাব, আমার বাবা ছিল স্যাকরার দোকানের কারিগর। জীবনে হালুম হালুম করার চানস আর এল না, শুধু ঘেউ ঘেউই করে গেলুম। তাই সবাই বলে রগচটা ডগু।

ডগুদার বয়স বোঝা যায় না। চল্লিশ থেকে ষাটের মধ্যে যে কোনও একটা বয়স ধরে নেওয়া যেতে পারে। বিয়ে করেনি। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে কি না বোঝা যায় না কথাবার্তায়। মাথায় টাক, ছোটখাটো রোগাটে চেহারা। ভাইদের সংসারের এককোণে পড়ে আছে। বাড়ির বাইরের দিকের ঘরটায় থাকে। ময়দানে ঘেরা মাঠের গেট-কিপার। দৈনিক সাতটাকা মাইনে। বছরে পাঁচমাস মাত্র এই চাকরি। বাকি সাতমাস চলে টিউশনি করে। কয়েকটা বাচ্চা ছেলেকে পড়িয়ে মাসে আশি টাকা পায়। আর আছে আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের জন্য বেগারখাটা। তারই অন্যতম, এই অবৈতনিক লাইব্রেরিয়ানের কাজ।

পঁয়ত্রিশ বছরের এই লাইব্রেরিতে গত বছর দশেক বই কেনা হয়নি। তার আগে কেনা আর চেয়েচিন্তে আনা হাজার খানেক পুরনো বই নিয়েই ডগুদা চালিয়ে যাচ্ছে। মেম্বারদের চাঁদা থেকে মাসে গোটা পঁচিশ টাকা পাওয়া যায়। ইলেকট্রিক বিলের বাকি টাকা জমে গেলে ডগুদা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে সেক্রেটারি অনাদিপ্রসাদের কাছে। কিছুক্ষণ ধরে চড়াগলায় বলে যায়—পাড়াটা মরে গেল, এলাকাটা মরে গেল। কী ছিল আর কী হয়েছে। ছেলেরা বই পড়ে না, খেলাধূলো ব্যায়াম করে না। আপনারাও এসব দেখবেন না। নতুন বই কেনা দরকার, খেলার জিনিস টিনিস কিনে ছেলেদের সংগঠিত (ডগুদা ঘেরামাঠ কর্মচারী ইউনিয়নের সদস্য) করে একটা খেলার ক্লাব দরকার। প্রেসিডেন্ট তো মাঠটাকে নিজের কায়েমি স্বার্থে ব্যবহার করছে, তার তত উদ্দেশ্য মাঠটায় যাতে খেলাধুলো না হয়। বুঝি না ভেবেছেন? আমি ঠোঁটকাটা মানুষ, যা বুঝি তাই বলেছি। এসব আমি হতে দেব না, আপনি মেম্বারদের ডেকে সভা করুন, আমি বক্তব্য রাখব, আবেদন জানাব।

কোনওবারই সভা ডাকা হয়নি, সুতরাং আবেদনও জানান হয়নি। তবে লাইব্রেরির ইলেকট্রিক বাতি জ্বলা বন্ধ হয়নি। অনাদিপ্রসাদ বিল মিটিয়ে দেন।

ডগুদা মাথা নিচু করে ইস্যু করা বইয়ের নাম খাতায় লিখছে। অপেক্ষমাণ মেম্বারের হাতে বইটা দেবার সময় মুখ তুলেই দেখল আনন্দকে।

কী রে, তোর নাকি অসুখ? স্কুলে যাওয়া বন্ধ?

কে বলল?

 তোদের ক্লাসের শিবনাথ। হয়েছে কী?

বুকে একটা ব্যথা, রেস্ট নিলেই সেরে যাবে। ইতস্তত করে আনন্দ বলল, ডগুদা, খেলার বই কিছু আছে আর?

আর! মানে? ছিল নাকি কোনওকালে যে আর থাকবে?

আনন্দ চোখ বোলাল ডগুদার পিছনে পর পর দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বইয়ের র‍্যাকগুলোর দিকে। ছাদ থেকে শিকে ঝোলানো তক্তায় রয়েছে পুরনো বাঁধানো পত্রিকা। মেঝেয় পড়ে আছে উইয়ে খাওয়া কিছু বই। ওগুলো ওজনদরে বিক্রি হবে।

একটা বই তো ছিল, ব্র্যাডম্যানের আর্ট অফ ক্রিকেট। উইয়ে খেয়েছে বলে—

আনন্দ থেমে গেল। বই পালটাতে এসেছে বটতলার মাইতিদের বাড়ির চাকর।

 মা জিজ্ঞাসা করতে বলল, নেতাজিকে নিয়ে কী একটা বই বেরিয়েছে, সেটা দিতে।

এখনও কেনা হয়নি।

 তা হলে নিমাই

ইস্যু হয়ে গেছে।

তা হলে মোটা একটা বই দিন। একটা গপ্পো থাকবে।

ডগুদা মুখ পিছনে ফিরিয়ে কাকে যেন বলল, একটা মোেটা উপন্যাস দে তো রে। তিন নম্বর ব্যাকটা দ্যাখ।

ডগুদা এরপর আনন্দকে উদ্দেশ করে বলল, লাইব্রেরি বলবি এটাকে? ওই যে বাঁধানো লেখাটা, পড় তো।

আনন্দ এগিয়ে গেল দরজার পাশে ঝোলানো লেখাটা পড়তে। ধুলো আর বৃষ্টির জলে, বহুবছর আগে তুলি দিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে।

এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে…পড়তে পারছি না ডগুদা, জেবড়ে গেছে…

দেবতাত্মা হবে।

দেবতাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের..পড়তে পারছি না।

কাগজের হাহাকারে।

 বাঁধা পড়িয়া আছে।

 তারপরের প্যারা?

শঙ্খের মধ্যে যেমন সমুদ্রের শব্দ শুনা যায়, তেমনই এই লাইব্রেরির মধ্যে কি…ধুয়ে গেছে।

সমুদ্রের।

সমুদ্রের উত্থান-পতনের শব্দ শুনিতেছ?

এবার বল এখানে কী শুনতে, কী দেখতে পাচ্ছিস? সমুদ্রের শব্দ? দেবতা আর অমর আলোক?

কথাটা দেবতাত্মা নয়, মানবাত্মা।

চমকে আনন্দ ঘুরে দাঁড়াল। সামান্য বাদামি ঝাঁকড়া চুল, পাখির ঠোঁটের মতো নাকের ডগাটা বাঁকা। হাতে একটা বই। সেইরকম চুপিসাড়ে র্যাকগুলোর পিছন থেকে এসে দাঁড়িয়েছে ডগুদার পাশে।

কথাটা হচ্ছে—এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের…হাহাকারে নয় কারাগারে, বাঁধা পড়িয়া আছে। শঙ্খের মধ্যে যেমন সমুদ্রের শব্দ শুনা যায়, তেমনই এই লাইব্রেরির মধ্যে কি হৃদয়ের…সমুদ্রের নয়, উত্থান-পতনের শব্দ শুনিতেছ?

আনন্দ অবাক হয়ে তাকিয়ে শুনছিল ওর কণ্ঠস্বর। যেন সরোদ বাজাচ্ছে গলা দিয়ে। ক্ষীণ শ্রদ্ধা জমে উঠল তার মনে। ডগুদা বিব্রত মুখে খাতায় বইয়ের নাম লিখতে লিখতে বলল, সময় হয়ে গেছে, এবার কিন্তু বন্ধ করব।

দুলতে দুলতে ও বেরিয়ে গেল। হাতে একটা পাতলা বই। দরজার কাছে গিয়ে একবার ফিরে তাকিয়েছিল আনন্দর দিকে। চোখাচোখি হতেই হেসেছিল, আনন্দও।

ও কে ডগুদা?

অমল। ওকে আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট লাইব্রেরিয়ান করেছি। ভীষণ পড়ে। দেখলি তো কী রকম ভুলটা ধরিয়ে দিল।

অমল, পদবি কী?

গীতার ছেলে, মানে সততা ছেলে, ওর স্বামীর আগের পক্ষের। গীতা যখন বিধবা হয়ে ভাইদের কাছে এল তখন ওকেও সঙ্গে আনে। কেউ দেখার নেই, খাওয়াবার নেই। ওকে ফেলে আসতে পারেনি গীতা, বড় ভাল মেয়ে। ভাইরা অবশ্য মোটেই খুশি নয়। অমলকে, গীতাকেও ওরা উৎপাত বলে মনে করে। বেচারার পা-টা, ওইরকমই আজীবন থেকে যাবে।

গীতা কে?

 দেখিসনি? সকালে এই মাঠে মেয়েদের ট্রেনিং করায়, নিজেও করে।

লেডি সোবার্স।

কী বললি?

কিছু নয়। আপনাদের পাড়ায় থাকে?

পাশের বাড়িতে। অ্যাত্তোটুকু থেকে দেখছি গীতাকে। বিয়ের আগে দারুণ অ্যাথলিট ছিল। বেঙ্গল রিপ্রেজেন্ট করেছে ন্যাশনাল গেমসে। এশিয়ান গেমসের জন্য ট্রায়াল ক্যাম্পেও একবার গেছল। বিয়ে হল, তারপর বাঙালি-ঘরে যা হয়, বউয়ের অ্যাথলেটিকস চালিয়ে যাওয়াতে শ্বশুরবাড়ি রাজি হল না। স্বামী অ্যাকসিডেন্টে মারা যেতে বিধবা হয়ে বাপের বাড়ি এসেও বছরখানেক প্রায় কিছু করেনি। হঠাৎ মাঠে কানে এল, স্টেট ব্যাঙ্ক নাকি অ্যাথলিট রিক্রুট করবে। তাই ওকে বললুম, প্র্যাকটিস শুরু কর, চাকরি হয়ে যেতে পারে। টোটো করে লটারির টিকিট বেচে কদ্দিন চালাবি। চিরকাল তো ভাইয়েরা বসিয়ে রেখে খাওয়াবে না, আর অন্যের হাততোলা হয়ে থাকতে হলে দাসীবাঁদির মতো থাকতে হবে। তার থেকে বরং বয়স থাকতে থাকতে। যদি কাজটাজ জোগাড় করে নিতে পারে, লেখাপড়াও শেখেনি তেমন, স্কুল-ফাইনাল ফেল। দৌড়ের বয়স পেরিয়ে গেছে, আর হবে না, তবে গায়ের জোরের ব্যাপারগুলো তো হতে পারে। তা ছাড়া, পাড়ার বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলোকে নিয়ে যদি ওকে দিয়ে একটা ক্লাব হয়। ইচ্ছে আছে ভলি আর কবাডিও শুরু করব।

কথা বলতে বলতে টেবিল গুছিয়ে, জানলা বন্ধ করে ডগুদা আলোর সুইচের। দিকে হাত বাড়াল।

আনন্দ বেরিয়ে এসে বাড়ির দিকে হাঁটছে। ইতিমধ্যে কেউ তার খোঁজ করলে, তুমুল কাণ্ডের মুখে পড়তে হবে। একটু জোরেই সে পা চালাল।

আনন্দ শোনো।

ফটক ঘেঁষে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে। আনন্দ প্রথমে ভয় পেয়ে গেছল আচমকা ডাক শুনে।

কী বলল ডগুদা আমার সম্পর্কে?

 তোমার সম্পর্কে কোনও কথা তো হয়নি।

হয়েছে, আমি জানি। সবাই কৌতূহলী হয়। আমার পা, আমার হাঁটা দেখে হয়। তুমিও হয়েছ।

আনন্দ চুপ করে রইল। বাড়ির মধ্য থেকে হাঁকডাক আসছে না। বিপিনদা এখনও হয়তো ফেরেনি।

না, ওসবে আমার কৌতূহল নেই। তবে যতবারই দেখেছি, তুমি একটা না একটা কিছু দিচ্ছ—হয় বল ফিরিয়ে দিচ্ছ, মাঠ থেকে ইট তুলে ফেলে দিচ্ছ, বই এনে দিচ্ছ, কেন?

ভাল লাগে।

ব্যস, এই!

হ্যাঁ। আমার পক্ষে এর বেশি কিছু করা কি সম্ভব?

কেন, সেদিন যে বললে, খেলি! কী খেল, কোথায় খেল? এসো না আমার ঘরে, গল্প করব। একতলার একদম পিছন দিকে নিরিবিলি ঘরটা।

আনন্দ হাত ধরল অমলের। আস্তে হাতটা ছাড়িয়ে নিল ও।

আমি কারুর বাড়ি যাই না।

এলে কিন্তু ভাল লাগত। দিনরাত একা একটা ঘরে বন্দির মতো বাস করছি। হার্টের অসুখ, আমার হাঁটা পর্যন্ত বারণ। এখন লুকিয়ে বেরিয়েছি, জানতে পারলে ভীষণ বকুনি খেতে হবে।

কে বকবে, মা?

আনন্দ হেসে উঠল।

 মা নেই।

ওহ। আমারও নিজেরও মা নেই। তার জন্য আমার অবশ্য কোনও দুঃখ নেই। এই মা আমাকে ছোট থেকে নিজের ছেলের মতো ভালবেসেছে। আমার জন্য আজও কষ্ট করছে।

শুনলুম ডগুদার কাছে।

 তা হলে আমাকে নিয়ে কথা হয়েছে।

শুধু এইটুকুই।

আমার খুব অস্বস্তি হয় যখন কেউ আড়ালে আমার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করে। কেন যে হয় জানি না। লোকে আমাকে দেখে আড়ালে হাসে। একা থাকতেই ভালবাসি।

আর আমি সঙ্গ পাবার জন্য ছটফট করছি।

দুজনের ব্যাপারটা দুরকম। আমার চেহারা, এই খোঁড়া পা, আর তোমার হার্ট। তুমি বল করো, আর আমি কুড়োই।

আমার খেলা চিরতরে বারণ হয়ে গেছে। আমার যা অসুখ তা সেরে ওঠার নয়। কিন্তু তুমি তো খেল। কী খেলা বললে না তো।

উত্তর শোনার আগেই আনন্দ দেখল বীরা দত্ত রোড থেকে বিপিনদা মাঠের দিকে এগোচ্ছে। হাতে ইস্ত্রি করানো কাপড়ের পাঁজা।

আমি পালাই।

আনন্দ ছুটে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল।

.

গভীর রাতে একবার তার ঘুম ভেঙেছিল। তখন হঠাৎ আপনা থেকেই তার মনে হয়, পাখিটা এইবার হয়তো ডাকবে। সে অপেক্ষা করে। দোতলা থেকে ক্ষীণভাবে সেতারে আলাপের শব্দ আসছে। মেজদা টেপরেকর্ডার চালাচ্ছে। নিখিল ব্যানার্জির বেহাগ। বড়দা কানাডা থেকে পাঠিয়েছে রেকর্ডারটা। নিজের নিশ্বাস ছাড়া আনন্দ আর কিছু এখন শুনতে চায় না। হৃৎপিণ্ডটা ধকধক করে যাচ্ছে আর ক্রমশ একটা ভয় তাকে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। এই ধকধকানিটা বন্ধ হয়ে গেলেই সে মরে যাবে। ওটা বন্ধ হবার নোটিশ জারি হয়ে গেছে। কেউ না বললেও সে সকলের হাবভাব থেকে বুঝতে পারছে, গুরুতর কিছু একটা হয়েছে। এই শব্দটা সচল রাখার জন্য তাকে সাবধানে, কম নড়াচড়া করে বন্দি জীবন কাটাতে হচ্ছে। কী দারুণ, ভয়ঙ্কর আর মিষ্টি এই হার্টের শব্দ। প্রাণভরে এমন করে সে আগে কখনও শোনেনি। মেঝেয় শোয়া হাবুর মার নাকডাকার শব্দ শুনতে শুনতে তারপর কখন যেন সে আবার ঘুমিয়ে পড়ে।

সকালে জানলা থেকেই আনন্দ দেখল মেয়েদের দৌড় শেখা। ওদের সঙ্গে হাফপ্যান্ট পরে লেডি সোবার্সও দৌড়চ্ছে। শট ছোড়া দেখতে পেল না। সেজন্য বাইরের রকে যাওয়া দরকার।

অরুণ প্রতিদিনের মতো দেখতে এল আনন্দকে।

মেজদা, আর এভাবে থাকতে পারব না। আমি ভাল হয়ে গেছি।

কী করে বুঝলি?

কেন, এই তো দিব্যি চলাফেরা করছি, বুকে কোনও কষ্ট হচ্ছে না।

 দিব্যি আছিস বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। ঘোরাঘুরি করলে দিব্যি থাকতিস না। আচ্ছা, দিনে একবার ফটকের কাছে যাবার পারমিশান দিলাম।

আনন্দর সন্দেহ হল এত সহজে চট করে মেজদার উদার হয়ে যাওয়ায়। ডাক্তারবাবু নিশ্চয় আরও বেশি অনুমতি দিয়েছে, অনেক আগেই। মেজদা সাবধান হবার জন্য চেপে রেখেছিল, এখন টিপে টিপে ছাড়ছে।

ফটক নয়, লাইব্রেরি পর্যন্ত, আর একবার মন্দিরেও।

ওরে বাবা, মন্দির! রাস্তা পার হওয়া চলবে না। গাড়ি এসে পড়লেই তো ছুটবি। না, না, শুধু লাইব্রেরি পর্যন্ত।

দিনে দুবার, সকালে আর বিকেলে।

উহু, একবার।

তা হলে, ঘরে কিন্তু স্কিপিং শুরু করব।

আনন্দ মিছিমিছি ভয় দেখাচ্ছে না। এটা অরুণ বুঝতে পারল ওর চোখের দিকে তাকিয়ে। অনুমতি দিয়ে ঘর থেকে বেরোচ্ছে, আনন্দ ডাকল। তোমার টেপরেকর্ডারটা আমাকে দাও না, দেবে?

কী করবি? ট্রানজিস্টার তো রয়েছে।

ভাল লাগে না রেডিয়ো। আমি তোমার টেপগুলো চাই না, শুধু রেকর্ডার আর নতুন একটা ক্যাসেট। টেপ করব আমি।

নিজের গান?

গান কি জানি। যখন যা আমার মনে আসবে বলব, অন্যের কথা, হাবুর মা বিপিনদার ঝগড়া, ডগুদার গলা, গাছের পাতার শব্দ আর একটা পাখির ডাক। খুব মিষ্টি সুন্দর ডাক।

নষ্ট করবি না, ভাঙবি না?

আনন্দ জোরে মাথা নাড়ল।

আচ্ছা, কাল কি পরশু টেপ কিনে এনে দেব।

বিকেলে শিবা দত্তর কারখানার দুটি লরি মাঠের প্রায় মাঝখানে দাঁড়িয়ে মাল খালাস করছে। মাঠের উপর লোহার চাদর স্তৃপ করে রেখে একটা লরি চলে গেল। মেয়েরা দৌড়তে এসেছে। অপেক্ষা করে করে ওরা চলে যাচ্ছিল। আনন্দ রক থেকে লক্ষ করছিল, এবার এগিয়ে এল।

তোমরা চলে যাচ্ছ কেন, দাঁড়াও।

মেয়েরা দাঁড়িয়ে গেল। আনন্দ লরি সরিয়ে নেবার জন্য ড্রাইভারকে বলল। কর্ণপাত করল না লোকটি।

এটা কারখানার জমি নয়, খেলার মাঠ। এ-জমির মালিক বটতলা ইনস্টিটিউট।

হবে। ড্রাইভার নিরাসক্ত স্বরে বলল।

রেগে উঠল আনন্দ। প্রায় চিৎকার করে সে বলল, লরি হটাও।

লোকটি বিড়ি ধরাল। জবাব দিল না।

এটা খেলার জায়গা, লরি হটাও এখান থেকে।

 রাগে হাত কাঁপছে, সেই সঙ্গে আনন্দ অনুভব করল, বুকের মধ্যে অস্বস্তিকর একটা কিছু জমছে। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, উত্তেজনা আসতে পারে এমন কোনও ব্যাপারে যাবে না, চিন্তাও করবে না। উচিত হয়নি, এভাবে রেগে যাওয়ার মতো ব্যাপারে নাক গলানো ঠিক হয়নি। কিন্তু সরে আসি কী করে। মেয়েরা যে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আমাকে বলে কী হবে, ম্যানেজারবাবুকে বললাগে যাও।

লোকটা বিড়িতে টান দিয়ে কারখানার গেটে দয়ানিধির দোকানের দিকে চলে গেল। আনন্দ ভেবে পেল না এইবার তার কী করা উচিত। মেয়েরা কোনও কথা না বলে চলে যাচ্ছে। অসহায়ের মতো সে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ চিৎকার করে বলল, টায়ার ফাঁসিয়ে দোব। লরি কী করে চলে দেখব।

মাল খালাস করা মজুররা কৌতূহলভরে তার দিকে তাকাল। দপ দপ করে উঠল আনন্দর রগটা। কিছু করার নেই তার। লরিটাকে টান মেরে লোহাগুলোকে ছুড়ে ছুড়ে রাস্তায় ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। মেয়ে কটি জেনে গেল, সে একটা অপদার্থ, হামবাগ। ডগুদাকে বলতে হবে, শিবা দত্ত নাকি কথা দিয়েছিল বিকেলে লরি ঢুকবে না, মাঠেও মাল রাখা হবে না! কী হল সে কথার?

রাগে ফুসতে ফুসতে আনন্দ ফিরে এল। অনেকদিন পর আবার বুকে সেই ব্যাপারটা শুরু হয়েছে। নিজের ঘরে এসে সে শুয়ে পড়ল। আর তখনই জলার দিক থেকে ভেসে এল মিষ্টি শিস। তাড়াতাড়ি উঠে বসতে গিয়েই সে বুকের মধ্যে তীক্ষ্ণ একটা খোঁচা দেওয়া যন্ত্রণায় অসাড় হয়ে চাপা আর্তনাদ করল। পলকের জন্য তার মনে হল, এইবার সে মারা যাবে। টপটপ করে চোখ থেকে জল পড়তে শুরু করল তার। সে ভাবল, আমি আর কখনও সেরে উঠব না। এই ঘরটায় চিরজীবন একা পড়ে থাকব। ভগবান, কেন আমায় অন্য কোনও অসুখ দিলে না?

গভীর রাত্রে বৃষ্টি নামল। হাবুর মা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। হাত বাড়িয়ে উত্তরের জানলাটা বন্ধ করতে পারে আনন্দ। ঠাণ্ডা লেগে সর্দিকাশি হবে। ডাক্তারবাবুর বারণ, বলেছিলেন ব্রংকাইটিস যেন না হয়। তা হলে কিন্তু আর কখনও সারবে না।

জানলাটা বন্ধ করার জন্য আনন্দ হাত বাড়াল। তখনই তার মনে হল শিসটা যেন আবার ভেসে এল। বৃষ্টির ছাট মুখে লাগছে। গলা বুক ভিজে গেছে। একটা অস্ফুট স্বর তার বুকের মধ্যে বলছে, আন্দ, আন্দ, লক্ষ্মী হয়ে থাকিস।

হাতটা টেনে নিয়ে আনন্দ ফিসফিস করে অভিমানী গলায় বলল, থাকব না।

আমার আনন্দ খুব লক্ষ্মী, খুব ভাল ছেলে।

আমি ভাল ছেলে হতে চাই না। আমি বেরোতে চাই, খেলতে চাই, এই ঘর থেকে মুক্তি চাই।

না আনন্দ, মেজদা যা চায় তাই করিস। তোর ভালর জন্যই ও শক্ত হয়েছে।

 আমি একা থাকতে পারছি না। এভাবে একা থাকলে আমি মরে যাব। তুমি এসে থাকো না আমার সঙ্গে?

আমার আনন্দটা একদম পাগল, থাকব কী করে, আমি যে মরে গেছি। আমিও মরে তোমার কাছে যাব।

না আন্দ, না। তোর কথা শুনে আমার কষ্ট হচ্ছে। তোর দুঃখ দেখে আমার চোখে জল আসছে।

হাতের উপর বৃষ্টির ফোঁটা। আনন্দ চাটতে শুরু করল। মায়ের চোখের জল। মা মেঘ হয়েছে দুঃখটা যখন বাষ্পে রূপান্তরিত হল। আনন্দ বৃষ্টির ছাটের দিকে মাথাটা এগিয়ে আনল।

.

০৬.

সকালে চোখ খুলেই আনন্দ বুঝল তার গা-গরম, চোখ জ্বালা করছে, মাথা ভার। জ্বর আসবে নয়, এসে গেছে। বিছানা থেকে নামল। জানলা দিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। দৌড় শেষ করে মেয়েরা বোধহয় চলে গেছে। লেডি সোবার্স হয়তো এখনও প্র্যাকটিস করে চলেছে। হাবুর মার গলার স্বর আসছে। রান্নাঘর থেকে। মেজদার নিশ্চয় ঘুম ভাঙেনি। বাবা এতক্ষণে সেরেস্তায় বসে পড়েছে। আনন্দর মনে হল এখনি কাল বিকেলের কথাটা ডগুদাকে বলতে হবে।

ব্লাউজের মতো জামা আর হাফপ্যান্ট পরে কোমরে হাত দিয়ে গীতা হাঁফাচ্ছে। সকালের রোদে চিকচিক করছে ঘামে ভেজা শরীর। জমিতে আঁচড় কেটেই অমল চেঁচিয়ে উঠল।

এক বিঘৎ বেশি!

গীতা হাসল। চোখে অবিশ্বাস।

সত্যি বলছি, তুমি এসে দেখে যাও।

এগিয়ে এসে গীতা ঝুঁকে দেখল। অবিশ্বাস বদলে হল বিস্ময়।

তুমি তো আমায় বিশ্বাসই করো না।

কেন করব? কাল তুই তো কমিয়ে দাগ কেটেছিলি। এক বিঘৎ না আর-কিছু, ইঞ্চি চারেক হবে।

আমার বিঘতের মাপে বলেছি।

অমল হাসতে হাসতে কাছে এসে দাঁড়ানো আনন্দকে বলল, মায়ের আঙুলগুলো কত লম্বা দেখেছ?

গীতার হাতটা সে তুলে ধরল আনন্দর দিকে। ছাড়িয়ে নিয়ে গীতা লোহার শটটা কুড়িয়ে সার্কলে ফিরে গেল।

কাল বিকেলে তুমি চেঁচামেচি করেছিলে লরি দাঁড়ানোর জন্য?

মাথা নেড়ে আনন্দ তাকাল লাইব্রেরির দিকে। দরজা বন্ধ।

ডগুদা আজ সকালে শুনেই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেছে শিবা দত্তর বাড়িতে যাবার জন্য। আমাকে দেখতে বলে গেছে লাইব্রেরি। দারুণ রেগেছে।

একটি লোক বই হাতে আসছে। দেখেই অমল তার নিজস্ব ভঙ্গিতে ছুটল লাইব্রেরির দিকে।

লেডি সোবার্স শট গালে ঠেকিয়ে কুঁজো হয়ে তৈরি। আনন্দ পিছিয়ে এল। মাথাটা আরও ভার লাগছে। শরীরটা দুর্বল, কনুই আর হাঁটুতে ব্যথা। অন্তত একশো জ্বর।

আ আ আহ্….আঁক।

ধপ শব্দ করে লোহার গোলাটা ভিজে মাটিতে বসে গেল। আনন্দ আপনা থেকেই দু-তিন পা এগিয়ে থেমে পড়ল। হাতে করে গোলাটা ওর কাছে পৌঁছে দেবে কি না। ইতস্তত করে ভাবছে। ততক্ষণে গীতা এগিয়ে এল। ভ্রূ কুঁচকে মাটির দিকে ঝুঁকে ইটের টুকরোটা দিয়ে দাগ কেটে, গোলাটা তুলে নিয়ে ফিরে গেল। আনন্দকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনল না। আনন্দ কেমন যেন অপ্রতিভ বোধ করল।

আবার গোলাটা পড়ল। ইটে সাজানো সার্কলের কিনারে দেহের টলমলে ভারসাম্য সোজা করে রাখতে রাখতে গীতা তীক্ষ্ণচোখে তাকাল যেখানে গোলাটা পড়েছে। আনন্দ হাত তুলে ওকে অপেক্ষা করতে ইঙ্গিত করল।

এগিয়ে এসে গোলাটা তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দর মনে হল, এখান থেকে সার্কলটা মাত্র পনেরো-ষােলো হাত তত দূরত্ব! বোলার অ্যান্ডি কি হাতে করে পৌঁছে দিয়ে আসবে? একজন মেয়ে যদি ছুড়তে পারে এতটা তাহলে আমিই বা পারব না কেন, অমল কি সবাই? ভারী জিনিস তোলা বারণ, কিন্তু একবার তুললে এমন কী আর হবে! কিছু হয় কি না দেখাই যাক না।

ডান গালের কাছে গোলাটা ধরে আনন্দ ঠিক গীতার নকল করে কুঁজো হল। কনুইয়ে যন্ত্রণা, কবজি বেঁকে যাচ্ছে। গীতার মুখে হাসি খেলে গেল, তাই দেখে আনন্দর মুখেও হাসি ফুটল, শরীরে কী রকম একটা রোখ ঝাঁঝিয়ে উঠল। শরীরটা দোলাতে দোলাতে হাঁ করে নিশ্বাস নিয়ে ডান পায়ে ভর দিয়ে গীতার মতো ছোট ছোট দ্রুত লাফে গোলাটা ছোঁড়ার জন্য একধাপ লাফিয়েই হঠাৎ তার মনে হল সে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। চাপা চিৎকার করে সে পড়ে গেল মাটিতে। গোলাটা পড়ল তার ডান পায়ের পাতা ঘেঁষে।

যখন সংবিৎ ফিরল, আনন্দর মনে হল, সে যেন ঢেউয়ের উপর ভাসছে। চোখ খুলেই লজ্জায় চোখ বন্ধ করল। লেডি সোবার্স তাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে চলেছে বাড়ির দিকে। পাশে হাঁটছে অমল!

আমায় নামিয়ে দিন, এভাবে আমায় নিয়ে যাবেন না বাড়িতে।

আনন্দর করুণ ক্ষীণ স্বর অগ্রাহ্য করেই ওরা ফটকের কাছে পৌঁছল।

আর যাবেন না, নামিয়ে দিন এখানে।

ওকে নামিয়ে দিল গীতা। এইরকম পোশাকে অচেনা বাড়িতে যেতে তারও সঙ্কোচবোধ হচ্ছে।

পারবে হেঁটে যেতে? আর কখনও কিন্তু এমন কাণ্ড করবে না, অল্পের জন্য পা-টা বেঁচে গেছে। অমল, তুই ওকে ভিতরে পৌঁছে দিয়ে আয়। গা-টা বেশ গরম লাগছিল। বোধহয় জ্বর হয়েছে।

গীতা তালুটা আনন্দর কপালে রাখল। তাড়াতাড়ি আনন্দ ফটক পেরিয়ে বাড়ির দিকে এগোল। হাঁটু কাঁপছে, হাঁ করে নিশ্বাস নিচ্ছে। দাঁড়িয়ে পড়ল সে।

তুমি আমার কাঁধে হাত রেখে আস্তে আস্তে চলো। মা জানে না তোমার হার্টের অসুখ।

পিছন থেকে এগিয়ে এল অমল। আনন্দর ডান হাতটা ধরে নিজের কাঁধে রেখে বলল, চলো।

আনন্দ ভয় পেল। অবশেষে এক বিকলাঙ্গের উপর ভর করতে হচ্ছে! অসম্ভব একটা রাগে ঝাঁঝরা হতে হতে অমলের কাঁধে চাপ দিয়ে বলল, আমার মরে যাওয়া উচিত, যাবও।

কেন?

আনন্দ জবাব দিল না?

 রাগ করছ কেন? মানুষ মানুষের সাহায্য কি নেয় না বিপদে পড়লে? এতে লজ্জার কী আছে?

সে তুমি বুঝবে না।

অমল হাসল। হাসিটা স্লান দুঃখভরা। আনন্দ ইতস্তত করে বলল, তোমাকে সাহায্য নিয়ে চলতে হয়

নিশ্চয়। তাই তো আমি ভাল করে জানি মানুষের কাছে মানুষ কত দরকারি।

কিন্তু আমারও মানুষকে দরকার। একা একা হাঁপিয়ে গেছি।

ঠিক আছে, মাঝে মাঝে আসব।

বিপিনদার গলার শব্দ এগিয়ে আসছে। আনন্দ ভিতরে ঢুকে গেল।

.

আজ কেমন আছ?

আনন্দ বিছানার উপর গড়িয়ে জানলার ধারে সরে এসে মাথা হেলিয়ে হাসল, ভাল।

উত্তরের জানলার শিক ধরে অমল কনুই দুটো জানলার পাটায় রেখে ঝুঁকে দাঁড়াল।

কী করছিলে?

আনন্দ টেপরেকর্ডারটা দেখাল।

 ভীষণ মজার জিনিস। কাল বিকেলে ডগুদার মাঠের ঝগড়ার ঘর থেকে যা শুনতে পাচ্ছিলাম, টেপ করেছি।

আনন্দ প্লে লেখা বোতামটা টিপল। প্রথমে খরখর শব্দ হয়ে দূরে মোটরগাড়ি চলার, উঠোনে বাসনের, দোতলায় বিপিনদার গলার, ট্রেনের ভেঁপুর আওয়াজের মধ্য দিয়ে প্রকট হতে লাগল ডগুদার সঙ্গে কারখানার ম্যানেজারের ঝগড়া।

আমি বলছি সরাতে হবে…জানতেই পারবেন কে আমি।… আমি একজন পাবলিক, আমার বলার অধিকার আছে।

যান যান মশাই, পারেন তো কোর্টে গিয়ে প্রমাণ করুন যে এ-জমি ইনস্টিটিউটের।

কোর্ট ফোর্ট কী দেখাচ্ছেন, রীতিমতো লেখাপড়া করে দান করা জমি। সবাই জানে…

দলিল আছে?

 আলবাত আছে। সেক্রেটারি অনাদিবাবুর কাছে আছে।

 মালিককে গিয়ে ওসব কথা…

সে ব্যাটার দেখা পেলে তো…

মুখ সামলে…লরি রোজ দাঁড়াবে…অ্যাই দরোয়ান, ড্রাইভারকে বলবে এখানে…

তুলে দোব কারখানা, আগুন জ্বালিয়ে দোব। এটা খেলার মাঠ, শিবা দত্তর কারখানার জমি নয়। দরকার হলে কোর্টেই যাব। অ্যাজিটেশন করব, আন্দোলন হবে।

আনন্দ বোতাম টিপে বন্ধ করে দিল।

 ডগুদার ফেভারিট হবি আন্দোলন করা। দুজনেই হাসল।

 প্রত্যেক মানুষেরই একটা না একটা হবি থাকেই। দেবুদার হল ডিটেকটিভ মেইগ্রে। তোমার কোনও হবি আছে?

না।

অমল মুখ ফিরিয়ে রাখল অন্যমনস্কের মতো। আনন্দ মুখ নামিয়ে টেপরেকর্ডারে হাত বুলোতে লাগল।

মা আর প্র্যাকটিস করতে আসবে না। এখানকার অনেকেই পছন্দ করছে না ওর। হাফপ্যান্ট

আমার বাবা?

তাছাড়া কারখানার তিন-চারটে লোক রাস্তায় কাল টিপ্পনী কেটেছিল। বোধহয় ম্যানেজার কি মালিক পিছনে লাগতে বলে দিয়েছে। মা একজনকে চড় কষায়, আর একজনের কলার ধরে ঝাঁকিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়। ওরা শাসিয়েছে।

ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।

 হ্যাঁ। পারবে না কেন, মা-তো রোজ রাত্রে ঘরে ওয়েট-ট্রেনিং করে। ওজন তোলে, ওজন টানে, বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর।

ওজন?

লোহা। ইনস্টিটিউটে বারবেল, ডাম্বেল, পুলি পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছিল। ডগুদা সেগুলো দিয়েছে। দিনের বেলায় কাজকর্ম ফেলে একসারসাইজ করতে দেখলে বাড়িতে রাগারাগি করবে তাই রাতে করে।

অদ্ভুত তো!

কেন? এই কি পৃথিবীতে প্রথম নাকি! মা প্রথমে রাজি হয়নি, বলেছিল এই বয়সে এসব করে তার কিছু হবে না। আমি বলেছিলুম হবে, আগে তো দৌড়ঝাঁপ করতে, আবার তুমি শুরু করো। তারপর শুনিয়েছিলাম রোমানিয়ার লিয়া মানোলিউয়ের কথা। মেকসিকো ওলিম্পিকে মেয়েদের ডিসকাস-এ সোনা জিতেছিল।

তুমি অনেক পড়েছ, অনেক খবর রাখো।

সামান্য সামান্য। কাগজে যা বেরোয় তাই একটু আধটু জানি। তা মানোলিউয়ের কথাটা শোনো, খুব ইন্টারেস্টিং। ওকে ট্রেনিং ক্যাম্পে আসতেই বারণ করেছিল ওদের ফেডারেশন, বয়স হয়ে যাওয়ার জন্য। বলেছিল, তোমার দ্বারা আর কিছু হওয়া সম্ভব নয়, সুতরাং মিছিমিছি কেন আর ট্রেনিংয়ে আসা। এর ন মাস পরেই সে সোনা জেতে মেকসিকোয়। তখন বয়স কত জান? সাঁইত্রিশ! আমার মা-র বয়সও। তাই। মাকে তো আর ওলিম্পিকে সোনা জিততে হবে না, পেতে হবে একটা চাকরি। ঘরের মধ্যে রাতের পর রাত মানোলিউ ওজন তুলেছে, তিন ঘণ্টা করে। সবাইকে ভুল প্রতিপন্ন করবেই করবে। ইচ্ছা থাকলে মানুষ কী না পারে? স্বামী, সন্তান সব ঘুমোচ্ছে, আর সে একা ট্রেনিং করে গেছে, সঙ্গী শুধু রেডিয়োটা, আর বিড়বিড় করে কবিতা আবৃত্তি করেছে যাতে শরীরের কষ্ট ভুলে থাকতে পারে। দৃশ্যটা ভাবতে পারো আনন্দ? কী ভয়ঙ্কর কষ্ট স্বীকার করে সোনা পেয়েছে! কী তেজ, কী রোখ।

তুমি ভাবতে পারো এমন দৃশ্য?

একটুও ইতস্তত না করে অমল বলল, পারি। মানুষ যখন বার বার হেরে যায় তখন হাল ছেড়ে ভেঙে পড়ে। কিন্তু অনেকে পড়ে না। তারাই শেষ পর্যন্ত জেতে। মানোলিউ হেলসিঙ্কি থেকেই ওলিম্পিকে নামছে। সেখানে সিকসথ, মেলবোর্নে নাইনথ, রোমে ব্রোঞ্জ, টোকিয়োতে ব্রোঞ্জ। চারবার চেষ্টা করছে, সোনা পায়নি, তবু সে ভেঙে পড়েনি। যোলো বছর পর মেকসিকোয় যখন ফাইনালে ছুড়তে এল, তখন ডান হাতে চোট। ডাক্তার ইনজেকশান দিয়ে বলেছে, একবার ছোড়ার পরই কিন্তু হাতের জোর কমে যাবে। শুধু একবারই জোরে ছুড়তে পারবে।

অমলের চোখদুটো স্থিরভাবে তাকিয়ে রয়েছে। আনন্দ বিছানায় উঠে বসল। চোখদুটো তাকে যেন চুম্বকের মতো টেনে নিচ্ছে।

জিতল তো?

 নিশ্চয়, প্রথমবারেই যা ছুড়েছিল তাতেই। কিন্তু তখন তার মনের অবস্থাটা কল্পনা করতে পার?

আমি কখনও এরকম অবস্থায় পড়িনি।

 কল্পনা করো, একটা এইরকম অবস্থা তৈরি করো মনে মনে। ভাবো, তুমি জীবনের শেষ সুযোগের সামনে দাঁড়িয়েছ। সারা জীবন ধরে যে স্বপ্ন দেখেছ তা পূর্ণ হবে কি হবে না, সেটা তুমিই এই মুহূর্তে একমাত্র জানো। এইটাই শেষ, আর সুযোগ কখনও আসবে না তোমার কাছে। কল্পনা করো।

তুমি করতে পারো?

অমল মাথা হেলাল।

আমি ওলিম্পিকে একশো, দুশো, চারশো মিটারের সোনা জিতি।

 আনন্দ হেসে ফেলল।

দেবুদা যেমন দারুণ জটিল খুনের মামলার আসামিকে নির্দোষ প্রমাণ করে জেতার স্বপ্ন দেখে।

হ্যাঁ। সবাই স্বপ্ন দেখে, ঘুমিয়ে নয় জেগে। আমার মতো সব মানুষের ভিতরেই কোনও না কোনও অঙ্গ পোলিয়োয় পঙ্গু হয়ে আছে মনে হয়। তাই আস্ত গোটা হবার জন্য স্বপ্ন দ্যাখে।

যাঃ কী বাজে কথা বলছ।

আমার যা মনে হয় তাই বললুম। সব মানুষই জিততে চায় কিন্তু পারে না এই পোলিয়য়ার জন্য। তুমি নিখুঁত মানুষ দেখেছ?

আনন্দ একটু ভেবে মাথা নাড়ল।

নিখুঁত হওয়া আর জেতা একই ব্যাপার। আসলে সবাই নিখুঁত হতে চায়।

 তা হলে স্বপ্ন দেখে কী হবে?

ওইভাবেই ইচ্ছাটা পূরণ করে। স্বপ্নে তুমি যা খুশি হতে পারো। স্বপ্ন দেখে তারাই যাদের মন আছে, ইচ্ছে আছে। দুর্বল লোকে স্বপ্ন দেখতে পারে না, আমার অনেক ইচ্ছে আছে, জানি সেগুলো পূরণ হওয়া সম্ভব নয় তাই স্বপ্নে পূরণ করি, সেখানে আর একটা পৃথিবী আর এক অমল, সে সব জেতে—সব সব। ইচ্ছে করলে হারতেও পারি, এত ক্ষমতা আমার। নিজেকে বিরাট মনে হয় সেই পৃথিবীতে, তাই সারাক্ষণ সেখানেই থাকি।

 সারাক্ষণ স্বপ্ন দেখো!

চমৎকার সময় কাটে। একটা পাঁচ বছরের বাচ্চাকেও আমি দৌড়ে হারাতে পারব না। কিন্তু আমি সাড়ে ন সেকেন্ডে ওয়ার্লড রেকর্ড করে বোরজভকে হারিয়েছি মিউনিখে। বিকিলাকে হারিয়েছি ম্যারাথনে।

আকিবুয়াকে?

 চেষ্টা করিনি।

মার্ক স্পিজকে?

সাঁতার ভাল লাগে না।

কী ভাল লাগে তোমার?

অমল কাঁধে গাল ঘষল। ওর চোখে আর চুম্বক নেই। একপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কষ্টটা চোখে ধরা পড়ছে। আনন্দ ভাবল ওকে বলে ভিতরে এসে বিছানায় তুমি শশাও। কিন্তু ও আসবে না। প্রথমদিন ভিতরে আসতে বলেছিল, তখনও বলে ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ থাকলেই নাকি ওর মাথার মধ্যে কেমন করে। সব কিছু মনে হয় তার পায়ের মতো সরু দোমড়ানো এমন কী মানুষের মুখ চোখও ভাঙাচোরা বাঁকানো মনে হয়। তাই বাড়ির বাইরেই সারাক্ষণ কাটায়। আনন্দর কাছে এটা অদ্ভুত লেগেছিল। সে চেষ্টা করেও মানুষকে সরু যা দোমড়ানো চেহারা করতে পারে না। এজন্য মনের মধ্যে তা হলে দয়ানিধির দোকানের অদ্ভুত আয়নাটার মতো একটা আয়না দরকার যেখানে তাকালেই মুখটা লম্বা চ্যাপ্টা তোবড়ানো দেখাবে।

কাল রাতে আমি ডাক্তার হয়েছিলাম। বিরাট কেউ নয় খুব অখ্যাত সার্জন। কেউ সাহস পাচ্ছে না…একটা হার্টবদল করার অপারেশন, পি জি হাসপাতালে। আমি গিয়ে বললাম, আমি করে দেব। ওরা বিশ্বাসই করতে চাইছিল না। যাই হোক শেষকালে রাজি হল, কেননা…

কেননা, ছেলেটা এমনিই তো মারা যাবে।

ছেলেটা! কে বলল?

আমি জানি। তারপর?

 আটঘণ্টা ধরে করলাম।

 সাকসেসফুল?

 নিশ্চয়। এখন আবার সে নেটে প্র্যাকটিস শুরু করেছে। আমি দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, সে কাছে এসে বলল…

জানি। সে বলল অমল তোমার জন্য আমিও স্বপ্ন দেখব। তোমার পোলিও সেরে গেছে, তুমি ছুটছ, ভীষণ জোরে ছুটছ, সবাইকে হারিয়ে দিচ্ছ, ট্রফি জিতছ। তোমার জন্য ওলিম্পিকে ভারতের পতাকা উঠছে, জনগণমন সুর বাজছে।

নীলচে আকাশে যেন সোনালি রোদের আভা ছড়িয়ে পড়েছে। গভীর ঝকঝকে চাহনি আনন্দর মুখের উপর বোলাতে বোলাতে অমল ঠোঁট টিপে মাথা নাড়তে লাগল।

না না না, তার থেকে বরং তুমি এক কাজ করো, রোজওয়ালকে উইম্বলডন জেতাও। মানোলিউ তবু যোলো বছর পর জিতেছিল, কিন্তু রোজওয়াল সেই কবে একুশ বছর আগে প্রথম উইম্বলডনে খেলেছে কিন্তু এবারও হেরে গেল। ভাবলে কষ্ট হয় না? বছরের পর বছর চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু আর জিততে পারবে মনে হয় না, বয়স তো হয়েছে। চারবার ফাইনালে উঠে হেরেছে, বুড়ো হয়ে গেছে, আর কবে জিতবে বলতে পারো?

হালকা বিষগ্ন মেঘে অমলের চোখ ঢেকে গেল। আনন্দ ফিসফিস করে বলল, জিতবে। কোনর্সকেই হারাবে।

বলছ কী? সিক্স-ওয়ান, সিক্স-ওয়ান, সিক্স-ফোর, বিশ্রীভাবে কোনর্স এবার জিতেছে। ওকে হারানো রোজওয়ালের পক্ষে আর সম্ভব?

ইন্ডিয়ার আনন্দ ওকে হারাবে। তারপরই নিজেকে শুধরে বলল, আনন্দ মানে কিন্তু অমৃতরাজ নয়।

জানি। এ আনন্দ আমাদের।

 পিছনে শব্দ হতেই আনন্দ ফিরে তাকাল। বিপিনদা বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে।

দুপুরে তোমার ঘুমোবার কথা, আর তুমি গপ্পো করে যাচ্ছ? ডাক্তারবাবু কী বলে গেলেন সেদিন মনে নেই? কার সঙ্গে গপ্পো করছিলে?

আনন্দ জানলার দিকে তাকাল। অমল নেই।

কার সঙ্গে আবার গল্প করব। টেপ রেকর্ডার চালাচ্ছিলাম তো। শুনবে?

 আনন্দ বোতাম টিপল টেপ উলটোদিকে গোটাবার জন্য। থামিয়ে এবার প্লে বোতাম টিপল।

উকিলবাবু, আপনার কাছেই আছে হীরা দত্তর দানপত্রটা। আপনি সেক্রেটারি, আপনার উচিত নয় কি ইনস্টিটিউটের স্বার্থ দেখা?

আনন্দ তাকাল বিপিনদার দিকে। ডগুদার সঙ্গে অনাদিপ্রসাদের কথার টেপ। চেম্বার থেকে ডগুদার গলার শব্দ পেয়েই রেকর্ডার চালিয়ে দিয়ে ঘরের ভিতরের জানলাটার উপর রেখেছিল। বিপিনদা অবাক হয়ে শুনছে।

দানপত্র আমার কাছে আছে, কে বলল? তাছাড়া জমিটা দানই করে দিয়েছে, এটাই বা তোমার মাথায় এল কী করে? ওটায় খেলতে দিয়েছিল শিবার বাবা, দান করে দেয়নি।

বাজে কথা, আপনি ওর উকিল, ওর কাছ থেকে টাকা পান, তাই শিবা দত্তর হয়ে বলছেন।

ডগু, ভদ্রভাবে কথা বলো।

 আমরা সবাই জানি, এ জমির মালিক ইনস্টিটিউট। কারখানার সুবিধে হয় বলে জমিটা গাপ করতে চাইছে। আপনি তাকে সাহায্য করছেন।

তুমি বেরিয়ে যাও, নয়তো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেব, আর মাঠে যদি ওইরকম অসভ্যর মতো পোশাক পরা মেয়েছেলে দেখি, তোমাকে

কী আমাকে? মারবেন! কাটবেন?

 যাতে ভালমতো শিক্ষা পাও, সেই ব্যবস্থাই করব।

আনন্দ বন্ধ করে দিল রেকর্ডার।

 কারোর সঙ্গে গল্প করিনি, এবার বুঝলে?

সেইদিন রাতে ডগুবাবু যে ঝামেলা করে গেল, সেই সব কথা! কী আশ্চর্য, অদ্ভুত যন্তোর বার করেছে তো!

তোমার কথাবার্তাও এবার যন্তোরে ধরে রাখব যখন হাবুর মার সঙ্গে ঝগড়া করবে।

ভয় দেখাচ্ছ?

আনন্দ জবাব না দিয়ে পাশ ফিরে শুল। অমলের সঙ্গে কথা বলার সময় মাঝে মাঝে খেলাচ্ছলে বোতাম টিপে টিপে রেকর্ড করেছে। রেকর্ডার চালিয়ে তাদের দুজনের সেই কথাগুলো শুনতে শুনতে সে জানলার বাইরে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। একসময় তার কানে এল অমলের গলা।

ভাবো তুমি জীবনের শেষ সুযোগের সামনে দাঁড়িয়েছ। সারা জীবন ধরে যে স্বপ্ন দেখেছ—

আনন্দ বন্ধ করে দিল। মনে মনে বলল:

কোনওদিনই শেষ সুযোগের সামনে আমার দাঁড়ানো হবে না।… কিন্তু ইচ্ছা থাকলে মানুষ কী না পারে। সে এই পৃথিবীর মধ্যেই আর একটা পৃথিবী বানিয়ে সেখানে জিততে পারে হারতেও পারে।

.

০৭.

প্লে।

প্রায় পনেরো হাজার লোেক মুহুর্তে কথা বন্ধ করল। নিশ্বাস নেওয়া ও ছাড়া হচ্ছে চুপিচুপি। উইম্বলডন সেন্টার কোর্টে সেমিফাইনাল ম্যাচ—কোর্নসের সঙ্গে ব্যানার্জির।

আনন্দর সার্ভিস।

শান্ত চাহনিতে দেখে নিল, বেসলাইনের মাঝামাঝি কুঁজো হয়ে শিকারি চিতাবাঘের মতো জিমি। সার্ভিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ডাইনে বাঁয়ে দুলছে। বাঁ হাতে ধরা র্যাকেট তীক্ষ্ণ নখের মতো। এখনও কানে বাজছে জিমির কথাগুলো। ছোট্ট ড্রেসিংরুমে তারা দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আয়নায় চুল আঁচড়াচ্ছে। জিমি তার লম্বা চুলগুলো সমান ভাবে কান ঢেকে দুপাশ দিয়ে নামিয়ে দিতে দিতে মহম্মদ আলির ঢঙে বলেছিল: আই অ্যাম দ্য চ্যাম্পিয়ন—জাস্ট ট্রাই অ্যান্ড টেক মাই টাইটল অ্যাওয়ে।

ঘাসের ওপর বল ড্রপ দিল আনন্দ। সার্ভিসের আগে তিনবার বল ড্রপ দেওয়াটা তার অভ্যাস। জিমি সেমি ফাইনাল পর্যন্ত সেট হারায়নি এখনও। কোয়ার্টার ফাইনালে দেখেছে ট্যানারের ঘণ্টায় একশো চল্লিশ মাইলের সারভূকে জিমি কী অবহেলায় তাচ্ছিল্যে পালটা মার দিয়ে খুন করেছে। যত জোরে সারভূ আসে ততই যেন জিমির সুবিধে হয়।

আনন্দ আপন মনে হাসল। জিম্বাে, তোমার নাকি ছোটাছুটির স্পিড অকল্পনীয়, তোমার রিফ্লেক্স নাকি তুলনাহীন। দেখা যাক।

বলটা শূন্যে ছুড়ে র্যাকেটের ঘা দিল আনন্দ। সাইড লাইন আর সার্ভিস লাইনের কোনায় পড়ে কোর্নসের ব্যাকহ্যান্ডের নাগালের বাইরে দিয়ে বল বেরিয়ে গেল।

ফিফটিন-লাভ।

বাঁ দিকের কোর্টে সরে এল আনন্দ। ধীর মন্থর অলস তার হাঁটার ভঙ্গি। যেন ক্লাব টুর্নামেন্টে প্রথম রাউন্ড ম্যাচ খেলছে কোনও শিক্ষার্থীর সঙ্গে।

সার্ভ করল আনন্দ।

সেই একই জায়গায় বল পড়ল। মসৃণ অথচ তীব্রবেগে। জিমি ডান দিকে ঝাঁপিয়ে ব্যাক হ্যান্ডে কোনওরকমে র্যাকেট ছোঁয়াল। উঁচু হয়ে বলটা উঠল। হঠাৎ গুডলেংথ থেকে লাফিয়ে ওঠা বলে ব্যাট পাতলে সিলি মিড অনের মাথার ওপর যেরকম ক্যাচ ওঠে। সার্ভিস করেই আনন্দ ছুটে এসেছিল নেটের দিকে। জিমি বেস লাইনের ওপর অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে দেখছে বলটা নেটের ওপর আলতোভাবে নামছে। বাঁ হাত কোমরে রেখে অতি অবহেলায় আনন্দ ফাঁকা কোর্টের আর একপ্রান্তে ভলি মারল। খুব আস্তে টুং করে। ফিরে তাকালও না আর। যেন, এ তো জানা কথাই পয়েন্ট পাব! তারপর আবার সারভ করার জন্য আলস্যভরে বেস লাইনের দিকে যেতে যেতে বলবয়ের ছুড়ে দেওয়া বল থেকে একটা লুফে নিল।

মাইক্রোফোনে আম্পায়ারের গলা: থার্টি-লাভ।

আবার প্রচণ্ড সার্ভিস সেন্টার লাইনে খড়ির দাগ একটা জায়গায় হালকা ধোঁয়ার মতো উড়তে দেখা গেল। এস! দাগের ওপর বল পড়েছে। চারদিকের স্ট্যান্ডে গুঞ্জন উঠেই মিলিয়ে গেল। জিমি লাইনের দিকে তাকিয়ে দুহাত মুঠো করে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করল। সয়্যার করছে। গালাগাল দিচ্ছে। দিক। দিতেই হবে। জবাব দেবে কী করে এইরকম সার্ভিসের!

ফর্টি-লাভ।

কী যেন বলেছিল জিমি রিপোর্টারের কাছে?—আই অ্যাম গেটিং বেটার। আই নাউ হ্যাভ মোর শটস। দেয়ার ইজ নো প্রেশার অন মি। আত্মম্ভরিতা। ঠাণ্ডা মেজাজে, আনন্দ, ঠাণ্ডা মেজাজে খেলে যাও। পৃথিবীর একনম্বর তোমার সামনে। কাল রাত্রে যেমনই ছকে রেখেছ, ঠিক সেইভাবে বরফের মতো মাথা ঠাণ্ডা রেখে খেলে যাও। মন্থর করো খেলাটাকে। জিমিকে নেটে আসতে দিয়ো না, তা হলে তোমায় খুন করে ফেলবে। বেস লাইনে ঠেলে রাখো ওকে। তুমি যত মারবে, ততই ওর সুবিধা, যে ব্যাটসম্যানের হাতে স্ট্রোক আছে, ফাস্ট পিচ তাকে খুশি করে। কোনর্সের হাতে সবরকম মার আছে। মনে আছে উইম্বলডন-বিজয়ীদের নাম লেখা বিরাট বোর্ডটার ওপরে কিপলিংয়ের লাইনটা? যখন সবাই তোমার সম্পর্কে সন্দিহান তখন যদি নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে পারো…

বিশ্বাস রাখো, আনন্দ। তুমি পারবে। পারবে। পারতেই হবে, কেননা

সার্ভ করল আনন্দ।

বলটাকে ফোরহ্যান্ডে কোনর্স পেয়ে গেছে। আনন্দর ডানদিকে রিটার্নটা এল। সাইড লাইন বরাবর সে ফোরহ্যান্ডে মারল। কী অবিশ্বাস্য কোনর্সের ছোটা। নিমেষে বলের কাছে পৌঁছেছে। বিদ্যুৎগতি ক্রসকোর্ট শট এল আনন্দর ব্যাকহ্যান্ডে। বলটা সে কোনর্সের কোর্টের মাঝামাঝি মারল। এইবার দু-হাতে র্যাকেট ধরে ভয়ঙ্কর ব্যাকহ্যান্ড মারবে ও।

কোনর্স মারল, এবং আনন্দ ঠিক সেইখানেই, যেখানে বল এল। যেন ও আগে থেকে জানত। স্টপ-ভলি করল আনন্দ সামান্য ঝুঁকে। কোনর্স ছুটে এসে চেষ্টা করল পাসিং শট। আনন্দর লম্বা হাতে বাড়ানোে র্যাকেট বিদ্যুৎগতিতে বলটাকে মাঝপথে আটকে দিয়ে ফেরত পাঠাল কোনর্সের কোর্টে। নেটের কাছে দাঁড়ানো কোনর্স অসহায় ভাবে পিছনে তাকিয়ে ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো মাটিতে পা ঠুকল।

ফাস্ট গেম টু ব্যানার্জি।

এবার কোনর্সের সারভিস। বিনীত মৃদু ভঙ্গিতে আনন্দ অতিরিক্ত বলগুলো যেভাবে নেট থেকে ব্যাট দিয়ে মেরে বোলারের কাছে ফেরত দেয় সেই ভঙ্গিতে এক এক করে র্যাকেটে মেরে ধীরে ধীরে পাঠিয়ে দিল কোর্সের কোর্টে। কোনর্সের বন্ধু নাসতাসে হাত মুঠো করে ঝাঁকাচ্ছে। ন্যাস্টি উৎসাহ দিচ্ছে।

আনন্দ তাকাল আম্পায়ারের পিছনে স্ট্যান্ডের দিকে। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির ছোট্টখাট্ট একটা মানুষ, সঙ্গে স্ত্রী আর দুই ছেলে। বাইশ বছর আগে, আনন্দর জন্মেরও আগে প্রথম এখানে খেলেছে। আজও জিততে পারেনি। এবারের ফাইনালে কোনর্সের মুখোমুখি হলে কোনর্স ওকে খেয়ে ফেলবে। হয়তো কোনওদিনই আর জেতা হবে না।

চোখাচোখি হল। আনন্দ মাথা ঝুকিয়ে নমস্কার জানাল। রোজওয়াল মাথাটা সামান্য পাশে হেলাল। চোখে চাপা হাসি। অন্যদিক থেকে রোজওয়াল এবারেও ফাইনালে উঠেছে সেমি ফাইনালে নিউকোমবকে হারিয়ে। আনন্দর মনে হল, সে ওর ছেলের বয়সী।

কোনর্স সারভিস শুরু করতে যাচ্ছে

আগুন, আগুন, আগুন।

.

খাটের ওপর উঠে বসল আনন্দ। পুবের জানলা দিয়ে যতটা সম্ভব দেখার চেষ্টা করল। মাঠের ওপর দিয়ে কারখানার কয়েকটা লোক ছুটে গেল। হইচইয়ের আওয়াজে মনে হচ্ছে আগুন কারখানাতেই লেগেছে।

দেখার জন্য আনন্দ ফটকের কাছে আসতেই বিপিনদার ধমক খেল।

দেখতে হবে না। যাও, ঘরে যাও। সামান্য আগুন, নিভিয়ে ফেলেছে।

খেলার মধ্যে হঠাৎ বাধা পড়ায়, আনন্দ আর মেজাজ পাচ্ছে না। বিছানায় শুয়ে ঘড়ি দেখল। দুপুর দেড়টা। প্রথম সেটটা সে পর পর কোনর্সের তিনটে সার্ভিস ভেঙে নিয়ে নিল ৬–০ গেমে। আধমিনিটের মধ্যেই ব্যাপারটা চুকে গেল।

এবার দ্বিতীয় সেট।

.

সময় নষ্ট করে লাভ কী! এবারে ৬—১। তিনবার ডিউস হয়েছে। একটা গেম নিশ্চয়ই কোনর্স নেবে। অতবড় প্লেয়ার…৬-২ হতে পারে। দুটো গেম নিলে কী এসে যায় তার। লন্ডনে নিশ্চয়ই প্রচুর ইন্ডিয়ান আছে। বাঙালিও আছে। যারা লর্ডসে গিয়ে অপমানে খেপে, লজ্জায় মাথা নামিয়েছিল ৪২ রানের ইনিংস দেখে, তারা নিশ্চয় উইম্বলডনে এসেছে।

থার্ড সেট।

১–১; ২-২; ৩৩; ৪৪; ৪–৫। আনন্দ পিছিয়ে গেছে।

কোনর্সের সার্ভিস এবার। আগের গেমে প্রচণ্ড খেলে আনন্দর সার্ভিস ভেঙে সে এগিয়ে এসেছে ৫৪ হয়ে। আনন্দ চারদিকে তাকাল। মুখগুলো উত্তেজনায় টসটস করছে। ঠাসাঠাসি ভিড়ে লোক উপচে পড়ছে স্ট্যান্ড থেকে।

লড়ে যা বাঙালি।

একটা তীক্ষ্ণস্বর বাংলা শব্দগুলোকে সেন্টার কোর্টের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আনন্দ একবার তাকাল স্ট্যান্ডের দিকে।

কোনর্স সার্ভ করছে। বলটা জমিতে ছোবল দিয়ে বেরিয়ে গেল।

ফিফটিন লাভ।

মাথা ঠাণ্ডা রাখো, আনন্দ। জয় মুঠোয় আসতে এখনও অনেক পয়েন্ট বাকি। কোনর্স দারুণ লড়তে পারে। আলগা দিয়ো না।

বাঁ হাত কোমরে রেখে র্যাকেট ধরা ডান হাতটা ঝুলিয়ে আনন্দ, যেন ম্যাচ খেলছে না, খেলা দেখছে এমন উদাসীন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। ক্লাব-টুর্নামেন্টের মতো যেন ব্যাপারটা। কোনর্স দুই আঙুলে ভি দেখাল। ভিকট্রি? আনন্দর ঠোঁট তাচ্ছিল্যে মুচড়ে গেল।

সার্ভিস করেছে কোনর্স, প্রচণ্ড জোরালো। আনন্দ র্যাকেট ঠেকাতেই, থার্ডম্যানের দিকে ক্যাচ ওঠার মতো বল ছিটকে স্ট্যান্ডের দিকে চলে গেল।

কাম অন্ ব্যানার্জি।

 থার্টি-লাভ টু কোনর্স।

 বাঙালি জা-গ-ও।

আনন্দ হেসে ফেলল।

 হচ্ছে কী আনন্দ। স্টেডি স্টেডি।

প্লিজ রিফ্রেন ফ্রম এনি রিমার্কস।

নাসতাসে ডান হাতের ঘুষি বাঁ হাতের তালুতে মারছে। কোনর্স ভি দেখাল মুখ ভেঙচে। আনন্দ আড়চোখে লক্ষ করল, রোজওয়াল তার দিকে তাকিয়ে। কী বিষণ্ণ দুঃখী চাহনি। বুকটা মুচড়ে উঠল আনন্দর। ঘাবড়াচ্ছ কেন! তুমি নিশ্চিত থাকো, আমিই ফাইনালে যাব। সেখানে তুমি আমাকে হারাবে।

কোনর্সের সার্ভ। আনন্দ প্রচণ্ড ফোরহ্যান্ড মারল। নেট ঘেঁষে সাইড লাইন ছুঁয়ে বল বেরিয়ে গেল।

থার্টি-ফিফটিন।

কোনর্স সার্ভ করল। দুর্দান্ত ব্যাকহ্যান্ড রিটার্ন তার বাঁ দিকে।

থার্টি—অল।

এবারের সার্ভিসটাও দারুণ রিটার্ন করল আনন্দ। ডাউন দ্য লাইন বেরিয়ে গেল পনেরো হাজার লোককে চমকে দিয়ে। তারপর উচ্ছ্বাসের বিরাট একটা শব্দে সেন্টার কোর্ট কেঁপে উঠল। আনন্দ গেমটা জিতেছে। এখন ৫৫।

সেটটা জিতলেই ম্যাচটাও জেতা হয়ে যাবে। ক্লান্ত বোধ করল আনন্দ। এখনি জিতে কী লাভ! আকাশ জুড়ে গনগনে কারখানার ফার্নেসের মতো তাপ ছড়িয়ে। ফার্নেসের খোলা দরজাটার মতো সূর্য। গরমে ঘামে এক ধরনের আলস্য আনন্দের চোখে জড়িয়ে এল।

ফাইনালে রোজওয়ালের কাছে কি হেরে যাব? ইন্ডিয়াকে এত বড় সম্মান থেকে বঞ্চিত করব? কৃষ্ণণ দুবার সেমিফাইনালে উঠেছে। ব্যস, তারপর এই আনন্দ ব্যানার্জি। টেনিসের সব থেকে বড় সম্মান মুঠোয় পেয়েও ছেড়ে দেব? ভারতের ষাট কোটি লোেক কী দারুণ আশা নিয়ে অপেক্ষা করবে রেডিয়োয় কান পেতে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভিড়। পটকা-বোমা নিয়ে নেতাজি পার্কে আড্ডা দেওয়া ছেলেগুলো চেঁচাচ্ছে—আন্দো রে আন্দো, ওই যে ফাস্ট বল করত, নেটে একদিন মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল একটা ছেলের। শান্ত চুপচাপ থাকত। ও যে এমন টেনিস খেলে! হোক না বটতলার ছেলে, আমাদেরই পাড়ার। পটকা ফাটাবার জন্য ওরা অধীর হয়ে অপেক্ষা করবে। মেজদা তো অফিসই যাবে না। বাবা অবশ্য ঠিকই বেরোবে, চেম্বারেও বসবে। হাবুর মা বার বার হয়তো বিপিনদাকে জ্বালাবে—হ্যাঁ গা, আমাদের আন্দো সাহেবের সঙ্গে কীসের লড়াই করতে গেছে? ছেলেটা বড় দুবলা, পারবে তো? আর অমল কী করবে!

জানে, একমাত্র অমলই জানে কেন আমি ফাইনালে উঠতে চেয়েছিলাম। ফাইনালে কী রেজাল্ট হবে তাও জানে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর খেলতে খেলতে রোজওয়ালের মুখে ছাপ পড়ে গেছে চিন্তার, উদ্বেগের। চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে গেছে। মুখের চামড়া খসখসে মোটা আলগা হয়ে এসেছে। শরীর আর কুড়ি বছর বয়সের মতো ধকল নিতে পারে না। কী কষ্ট করে একটা লোককে সারা পৃথিবীর সেরাদের চ্যালেঞ্জ ঠেলে বাইশ বছর টিকে থাকতে হয়েছে। টেনিসের সব সম্মানই পেয়েছে শুধু সেরা সম্মানটি ছাড়া। একেই বলে বরাত! সেই বরাতকে কি হারানো যায় না?

একদিকে ষাট কোটি আর একদিকে মাত্র একজন। শ্রীকৃষ্ণ হলে কী করতেন? রোজওয়াল কি অর্জুন! যদি হেরে যাই তাহলে পরের বছর কিংবা তার পরের বছর জিততে পারি। কিন্তু রোজওয়াল আর পারবে না।

ষাট কোটি লোকের এত আশা, এত আকাঙ্ক্ষা চুরমার করে দেব, একজনের জন্য? অমল কি এই বিদঘুটে সমস্যাটার কথা ভেবেছে কখনও? একটা এত বড় দেশ, মানসম্মান কখনও পায়নি, শুধুই পিছনে, সকলের পিছনে। সারা পৃথিবী ভুলেই গেছে। এত বড় একটা দেশ স্পোর্টস জগতে আছে; দেশটার মানুষও ভুলে গেছে খেলাধুলায় তারা কিছু করতে পারে। হারের পর হার দেখতে দেখতে নুয়ে পড়েছে, বিশ্বাস করছে তারা অপদার্থ তাদের, দ্বারা ফাস্ট বোলিং হবে না, টেনিস চ্যাম্পিয়ন সম্ভব নয়। এই দেশটা চমকে জেগে উঠে শিরদাঁড়া সোজা করে তাকাবে যদি আনন্দ উইম্বলডন জেতে। ষাট কোটি মানুষ, ভাবা যায়! আর তার বদলে একজনের, মাত্র একজনের সাধ কিংবা বলা যায় শখ, মেটাবার জন্য এত মানুষকে ডুবিয়ে দেওয়া! কী করব এখন? দেশের জন্য না নিজের জন্য? বেচারা রোজওয়াল, কী সাধনা, মনের জোর—এসব কি ব্যর্থ হবে শেষ পর্যন্ত? দেশ বড় না একটা লোক বড়?

আনন্দ ছটফট করে বিছানার এধার থেকে ওধার গড়াগড়ি দিল।

কিছু একটা ইন্ডিয়াকে দোব। একটা, একবার, শেষ সুযোগের সামনে একবার…

ছটফট করতে করতে আনন্দ একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। ঘণ্টা দুয়েক গভীর ঘুমের পর আপনা থেকেই সে জেগে উঠল। উত্তরের জানলা দিয়ে আকাশে চোখ মেলে দেখল, ঘন মেঘে ছেয়ে রয়েছে। ঘুমোবার আগে ছিল গনগনে রোদ। বহু দূরে দমদমে নামার জন্য একটা জেট প্লেন নিচু হচ্ছে। তার হঠাৎ মনে পড়ল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট টিম এবার আসবে। ইংল্যান্ডে সদ্য থেঁতলে যাওয়া ভারতকে এবার ওরা মাড়িয়ে যাবে কারা কারা আসবে টিমে?

এখনও টিমের নাম অ্যানাউন্স করেনি। শুধু করেছে ক্যাপ্টেনের নাম, লয়েড। সোবার্স বলেছে, আমি রিটায়ার করিনি, তার মানে আসতেও পারে। কানহাইও। কালীচরণ, রো, ফ্রেডেরিকস, বয়েস, মারে, হোল্ডার, গিবস, এরা তো আসবেই। আর অ্যান্ডি রবার্টস। উফফ, কী টিম! এদের এগেনস্টে বোলিং!

চকচক করে উঠল আনন্দর চোখ। তছনছ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ভারতকে। মুহ্যমান লোকেরা রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে রিলে শুনছে আর হতাশায় মাথা নাড়ছে—এমন একটা দৃশ্য চোখের ওপর ভেসে উঠতেই টেপরেকর্ডারটা চালিয়ে, সেটা বুকের কাছে ধরে সে ফিসফিস বলতে লাগল: আকাশবাণী, এখন খবর পড়ছি ইভা নাগ। আজকের বিশেষ বিশেষ খবর হল, বোম্বাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে পঞ্চম ও শেষ টেস্ট খেলার জন্য ভারতীয় দলের নাম ঘোষিত হয়েছে। বাংলার ফাস্ট বোলার আনন্দ ব্যানার্জি চোদ্দোজনের মধ্যে স্থান পেয়েছেন।

সারা বিকেল সে এই কথাগুলো বাজিয়ে বাজিয়ে শুনল।

.

০৮.

ব্যানার্জি তুমি খেলছ!

এতক্ষণ কাঠ হয়ে বসে ছিল আনন্দ, ড্রেসিংরুমের কোণের চেয়ারটায়। পাশের ঘরে তখন সিলেকশন কমিটির মিটিং চলছিল। পাণ্ডুরং সালগাঁওকর না আনন্দ ব্যানার্জি, কে খেলবে? ঘরের আর এক কোণে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে পাণ্ডু একদৃষ্টে বাইরে তাকিয়ে। দুজনের মনে একই চিন্তা, কে বাদ যাবে। পতৌদির নিথর ডান চোখ কিছুক্ষণ গেঁথে রইল আনন্দর মুখে, তারপর পিঠে চাপড় দিয়েই তাকাল সালগাঁওকরের দিকে।

সরি পাণ্ডু।

সালগাঁওকরের মুখটা কিছুক্ষণের জন্য ফ্যাকাশে হয়ে রইল। বহুদিন ধরেই তার নাম আলোচিত হচ্ছে ভারতের সম্ভাব্য ওপেনিং বোলার হিসাবে। আজকের টাইমস অফ ইন্ডিয়ায়, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে, স্টেটসম্যানেও তাকে দলে নেবার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। সব কাগজই বলেছে, ব্যানার্জি বড্ড কাঁচা, এখনই বিশ্বের সেরা মারকুটে ব্যাটসম্যানদের সামনে ওকে ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না। যদি বেধড়ক মার খায় তা হলে কেরিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে। সকালে কাগজে এইসব পড়তে পড়তে আনন্দ নিশ্চিত হয়ে গেছল এগারোজনের মধ্যে তার জায়গা হবে না। তাই পতৌদির বাড়ানো হাতটা ধরতে ভুলে গিয়ে ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে রইল। সেই সময় সালগাঁওকরই এগিয়ে এসে তার বিরাট মুঠোয় আনন্দর ডান হাতটা ধরে বলল, আমি কিছু মনে করছি না। কেউ একজন তো বাদ যেতই। তোমার বদলে আমি হলাম। তুমি সাকসেসফুল হও এটাই চাই।

অনেকেই কনগ্রাচুলেট করে গেল। আনন্দ শুধু থ্যাংক ইউ বলা ছাড়া আর কোনও কথা মুখ দিয়ে বার করতে পারল না। অবশ্য বলার আছেই বা কী। সকলেই বয়সে বড়। ওরা পরস্পরকে ডাকে অদ্ভুত সব ডাকনামে—ভেঙ্কটরাঘবন ভেঙ্কি, বিশ্বনাথ ভিশ, সুনীল গাভাসকর সানি, একনাথ সোলর একি, প্রসন্ন প্রাস এইরকম আর কী। মেজদা বলে দিয়েছে, ওরা তোমার থেকে অনেক বড়। ছোট ছোটর মতোই থাকবে।

আর ঠিক আধঘণ্টা বাকি ফিফথ টেস্ট ম্যাচ শুরু হতে। আনন্দ ড্রেসিংরুম থেকে নেমে এল মাঠে। নতুন ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম। ইডেনের মতো অত বড় নয়। নেট-প্রাকটিস করছে দুটো টিমই। গিবস, বয়েস, সোবার্স বল করছে। কালীচরণ নেটের মধ্যে।

ইন্ডিয়ান নেটে ফারুক। একটা বল নিয়ে মিডিয়াম-পেসে আনন্দ বল করল কয়েকটা। ব্রিজেশ, মাঁকড় আর সোলকর অর্ধচন্দ্রাকারে দাঁড়িয়ে, ক্যাচিং প্র্যাকটিস করাচ্ছে প্রসন্ন। আনন্দ গিয়ে দাঁড়াল ব্রিজেশের পাশে। মালীরা এসেছে নেট তোলবার জন্য। পতৌদি আর লয়েড টস করতে নামছে। গেস্ট ব্লকে মেজদা বসে। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বোম্বাই এসেছে। কাল রাত্রে হোটেলে দেখা করে শুধু বলেছিল, আনন্দ, ঘাবড়াচ্ছিস?

ঘাবড়াব কেন, তবে বুকের মধ্যে—

মেজদা হাসিমুখে বলেছিল, সব অসুখই সারে। তুইও সেরে উঠবি।

পতৌদি টসে জিতেছে। কিন্তু ইন্ডিয়া ব্যাট করছে না। রবার্টস, সোবার্স, বয়েসের কথা ভেবে, তাজা পিচ ওদের হাতে তুলে না দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকেই ছেড়ে দিয়েছে আনন্দর বলের সামনে।

আনন্দর হাতে বল। জীবনের প্রথম টেস্টের প্রথম ওভার। ফ্রেডেরিকস গার্ড নিয়ে ক্রিজে আঁচড় কাটছে। পতৌদি ফিল্ড সাজাচ্ছে।

গালিকে ফোর্থ স্লিপ করে দেব?

আনন্দ বোকার মতো মাথা নাড়ল।

থার্ডম্যান রাখার দরকার আছে?

আনন্দ আবার মাথা নাড়ল।

পতৌদি আর কিছু জিজ্ঞাসা না করে ফিল্ড সাজাল। গাড়েওয়ার প্যাভিলিয়নের দিকে চব্বিশ স্টেপ নিয়ে বুটের স্পাইক দিয়ে ঘাসে আঁচড় কাটার পর আনন্দ মুখ তুলেই দেখল গ্যালারিতে দুটো টি ভি ক্যামেরা—এখন হয়তো তাকেই তাক করে আছে। আনন্দর বুক ঢিবঢিব করে উঠল। সে তাড়াতাড়ি ঘুরে গিয়ে ব্যাটসম্যানের দিকে তাকাল। তখন ফ্রেডেরিকস পিছনটা একবার দেখে নিয়ে স্টান্স নিল।

প্লে।

 আম্পায়ার রুবেন্স পাশে তুলে রাখা বাঁ হাতটা নামিয়ে ঝুঁকে পড়ল।

আনন্দ একবুক নিশ্বাস টেনে চোখ বন্ধ করল। তারপর ছুটতে শুরু করল বল হাতে। পঞ্চাশ হাজার লোকে ভরা স্টেডিয়াম শাসরুদ্ধ কৌতূহলের চাপে বোবা হয়ে গেল মুহূর্তে। এই সেই বোলার, যে একটাও ফাস্ট ক্লাস ম্যাচ না খেলেই টেস্ট খেলছে। সিলেক্টাররা ওর মধ্যে কী দেখে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে নামিয়েছে? অবশ্য প্রথম চারটি টেস্টেই হেভি ইনিংস ডিফিটের পর আর একটা ডিফিটে কিছু এসে যায় না। তা হলেও সালগাঁওকর ছিল, মহীন্দর অমরনাথ ছিল, ঘাউড়ি ছিল। তা নয়, কোথাকার এক বোলার, বেঙ্গলেও যাকে কেউ চেনে না, একে টেস্ট খেলাবার। কোনও মানে হয়?

ওরা উদগ্রীব হয়। কে এই ব্যানার্জি! কেমন বল করে, কত জোরে করে!

ব্যাটের ঠিক মাঝখানে বল মারার মিষ্টি একটা শব্দ। লেগ স্টাম্পে ফুলটস। ল্যাটা ফ্রেডেরিকস এক জায়গায় দাঁড়িয়েই অন-ড্রাইভ করেছে। স্কোয়ার-লেগ থেকে ব্রিজেশ প্যাটেল নিয়মরক্ষার জন্য কয়েক পা ছুটে থেমে গেল। একটা পুলিশ বাউন্ডারি থেকে বলটা ছুড়ে দিল।

প্রথম বলে চার। আনন্দর কান দুটো গরম হয়ে উঠল। রাতে একবার ভেবেছিল, প্রথম বলেই স্টাম্প ছিটকে দিয়ে মাঠে হইচই ফেলে দেবে। এঞ্জিনিয়ার ফাস্ট স্লিপ বিশ্বনাথকে কী যেন বলল। বিশ্বনাথ মাথা নাড়তে নাড়তে পাশের গাভাসকরের দিকে তাকিয়ে হাসল।

দ্বিতীয় বল। বলটা হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আনন্দর বুক হিম হয়ে গেল। ইন সুইংটা এত বড় হয়ে যাবে ভাবেনি। তাও শর্ট পিচ। মাঁকড় ভয়ে মাথা নিচু করল। স্কোয়ার কাটের শব্দটা চাবুকের মতো আনন্দর মুখে আছড়ে পড়ল। কভার থেকে পতৌদি হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেল পয়েন্ট বাউন্ডারির দিকে, মাঠের মধ্যে ছুড়ে দেওয়া বলটা আনতে। বলটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আনন্দর দিকে ছুড়ে দিল।

তৃতীয় বল।

হাঁটুটা কাঁপছে। কাঁধে যেন একশো কেজির চালের বস্তা চাপাননা। লেংথ আর ডিরেকশন এবার এ দুটো যেন ঠিক থাকে। স্রেফ সোজা বল। সুইং টুইংয়ে ওস্তাদি নয়। একটু শুধু ঠুকে দেওয়া।

সপাটে পুল। চার। এতটা শর্টপিচ হয়ে যাবে আনন্দ ভাবেনি।

 বলটা পতৌদি কাছে এসে হাতে দেবার সময় বলল, ঘাবড়ো মাৎ।

মাথা নিচু করে বোলিং মার্কে ফিরে এল আনন্দ। পিছন থেকে একটা চিৎকার এল—গুড বোলিং ফর লেডিজ ক্রিকেট।

দরদর ঘামছে আনন্দ। প্যান্টে হাত মুছল। একটা বাউনসার দিলে কেমন হয়? যদি ব্রিজেশের কাছে ক্যাচ ওঠে।

না হুক, না পুল ধরনের একটা শট। ফাঁকা মিড উইকেট দিয়ে বলটা বাউন্ডারিতে গেল। চার বলে যোলো রান। চারদিকে বেশ শোরগোল। আনন্দ কিছু শুনতে পাচ্ছে না। কিছু বুঝতে পাচ্ছে না। লজ্জায় অন্ধ হয়ে গেছে, কালা হয়ে গেছে। এখন কোনওরকমে মাঠ থেকে পালানো যায় যদি।

কিপ দ্য বল ওয়েল আউটসাইড দ্য লেগ স্টাম্প।

 পতৌদির গলাটা কেমন কঠিন। আনন্দ মাথা নাড়ল।

ফিফথ বল। রুবেন্স দুহাত মেলে ধরল। ওয়াইড বল।

সবাই বুঝে গেছে ব্যানার্জি নার্ভাস হয়ে পড়েছে। পালাবার একমাত্র উপায় ইনজিওর্ড হয়ে যাওয়া। পা মুচকে? টেরিফিক শট আটকাতে গিয়ে আঙুল ভেঙে? বল ধরতে ঝাঁপিয়ে কাঁধের হাড়ের ডিসলোকেশন?

পরেরটা হল নোবল, ফ্রেডেরিকস হাঁকড়েছে। আনন্দর মাথার উপর দিয়ে ছয় হতে হতেও হল না। বাউন্ডারির হাত খানেক ভিতরে পড়েছে।

আরও দুটো বল করতে হবে। ছ বলে একুশ রান হয়েছে। ফ্রেডেরিকসের কুড়ি, একটা ওয়াইড, এবার পালাতে হবে। মাসল পুল তো হতে পারে! ফাস্ট ওভারেই কি হওয়াটা উচিত হবে? লোকে ঠিক ধরে ফেলবেব্যাটা মার খেয়ে পালাচ্ছে।

এবার লেংথে সোজা বল, একটু স্লো। ফ্রেডেরিকস এবারও মারের বল পাবে ভেবেছিল। পা বাড়িয়ে ড্রাইভ করার জন্য ব্যাট তুলে যখন বুঝল বলটা মারলে উঠে যাবে তখন ব্যস্ত হয়ে ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ খেলতেই বলটা সামনে একটু উঠে গেল। আনন্দ হাত বাড়িয়ে ঝাঁপাল।

আর উঠছে না সে। ছুটে এল সবাই। বলটা মাটিতে পড়েছে, তার উপর পড়েছে ওর বুক। শরীরের চাপে বলটা পাঁজরে, ঠিক যেখানে হার্ট সঙ্গে সঙ্গে সেন্সলেস।

.

আনন্দ, আনন্দ।

চোখ বুজে আনন্দ হাঁপাচ্ছে। বুকের মধ্যে ধড়ফড়ানিটা কী রকম অদ্ভুত একটা ব্যথা তৈরি করেছে। একগোছা তীক্ষ ছুঁচ যেন পর পর বিধিয়ে যাচ্ছে। নিশ্বাস নিতে গেলে লাগছে।

আনন্দ?

চোখ খুলে তাকাল। জানলার বাইরে অমল।

শুনেছ, ডগুদাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।

কেন, কবে, কী করেছে?

কারখানায় সেদিন যে আগুন লেগেছিল, ওটা নাকি ডগুদার কাজ। পুলিশের কাছে ওরা নালিশ করেছিল তাই ওকে ধরে নিয়ে গেছে, কোর্টে কেসও উঠেছে।

এত ব্যাপার হয়ে গেল, আর আমি কিছুই জানি না! ডগুদা কোথায়?

 জেলে।

 জামিন দিয়ে ছাড়িয়ে আনা হয়নি?

 কে জামিন দাঁড়াবে? ওর ভাইয়েরা বলেছে, আমরা কিছু পারব টারব না। মা চেয়েছিল জামিন হতে, কিন্তু আমাদের তো টাকা বা বিষয়-সম্পত্তি কিছুই নেই।

ডগুদা আগুন লাগিয়েছে, হতেই পারে না। মিথ্যে কথা। কে দেখেছে?

দু-তিনজন ডগুদাকে নাকি কারখানার পিছনে যেদিকে আগুন লাগে, সেদিক থেকে আসতে দেখেছে। কালকেই মামলা উঠবে। এছাড়াও ডগুদা নিজেই তো একদিন চিৎকার করে বলেছিল আগুন লাগিয়ে দোব।

রাগের মাথায় ওরকম কথা সবাই বলে। তার মানে এই নয় যে, সত্যি সত্যিই আগুন দেবে। মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। আমি শিওর। এই মাঠটাই হচ্ছে সবকিছুর মূলে, শিবা দত্ত এটাকে গ্রাস করতে চায়। ডগুদাই হচ্ছে কাঁটা।

তোমার বাবা ওদের উকিল দাঁড়িয়েছে।

আনন্দর মুখ মুহূর্তের জন্য ফ্যাকাশে হল। চোখে ফুটল অসহায়তা।

আমি কী করতে পারি।

না না, এমনিই বললাম, আমি এখন চলি।

আনন্দ কিছু বলার আগেই জানলা থেকে অমল অদৃশ্য।

বিপিনদা ঘরে ঢুকল। তাকে ট্যাবলেট খাইয়ে চলে গেল।

আমি কী করতে পারি! আনন্দ ভাবতে শুরু করল ঘরে পায়চারি করতে করতে। ডগুদা পরের উপকার করার জন্য সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। একটা আদর্শ আছে, আদর্শবাদী লোক। তাই বিয়ে পর্যন্ত করেনি। সেকালে বিপ্লবীরাও নাকি এইরকম ছিলেন, দেবুদাই বলেছিলেন বিপ্লবীরা সংসারী হতেন না দেশের সেবা করার জন্য। ডগুদা সম্পর্কে বলেছিলেন, ইডিয়ট, লেখাপড়া করেনি, বুদ্ধিশুদ্ধি নেই, আছে শুধু গোঁয়ার্তুমি আর সারল্য। জীবনে এরাই পস্তায়। ডগুদা পরোপকার করতে গিয়ে এখন পস্তাচ্ছে। দেবুদা শুনে নিশ্চয় খুশি হবে। হঠাৎ আনন্দর মনে ভেসে উঠল একটি মুখ। পুরুলেন্সের চশমা, লম্বাটে চোয়াল, বিরাট একটা মাথা—দেবুদার মুখ। আশ্চর্য! আনন্দ মনে মনে বলল পায়চারি থামিয়ে, আশ্চর্য এতক্ষণ এটা কেন মনে আসেনি। দেবুদা তো উকিল, সেই তো ডগুদার জন্য মামলা লড়তে পারে। ছাড়িয়ে আনার জন্য প্যাঁচালো যুক্তি প্রমাণ দিয়ে বড় উকিল হবার এই তো সুযোগ দেবুদার সামনে। ফি নিশ্চয়ই চাইবে না, ব্রিফলেস উকিলকে সেধে মামলা দিলে বর্তে যাবে। মামলায় জিতলে বেকসুর ডগুদাকে খালাস করতে পারলে দেবুদার নাম হবে। তখন লাইন পড়ে যাবে ওর বাড়িতে। এটা ওর মাথায় ঢোকাতে যদি পারা যায়।

.

০৯.

তোর বাবা তো শুধু বোঝে আইন। আর, শুধু আইন মুখস্থ থাকলেই কি উকিল হওয়া যায়?

ডান হাতের তর্জনী দিয়ে দেবুদা কপালে তিনটে টোকা দিল।

নিশ্চয়, ব্রেনই তো আসল জিনিস। স্কুলমাস্টার কি ঔপন্যাসিক কি ডিটেকটিভের মতো উকিলেরও দরকার ব্রেন। মেইগ্রের ব্রেন আছে বলেই তো—

আনন্দ ইচ্ছে করেই শেষ করল না। তক্তপোশে আধশোওয়া দেবুদা মুচকি মুচকি হাসছে। মেজাজটা মনে হচ্ছে ভালই রয়েছে।

তা হলে ডগুদার কেসটা কী হবে?

আরে দূর, এসব ছোটখাটো ব্যাপারে আমাকে টানাটানি কেন।

ছোটখাটো! একটা লোক বিনা দোষে জেল খাটবে, ষড়যন্ত্রের শিকার হবে, আর একে ছোটখাটো বলছেন? ধরুন একটা লোককে মিছিমিছি খুনের সঙ্গে জড়িয়ে অকাট্য সব প্রমাণ রেখে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হল। ধরুন না মেইগ্রের সেই কেসটা যেটা একদিন বলেছিলেন আমাকে।

দেবুদা ভ্রূ কুঁচকে বলল, কোনটা?

 সেই যে গ্রামের খিটখিটে ঝগড়ুটে বুড়িটাকে একদিন তার ঘরে মরে পড়ে থাকতে দেখা গেল। এয়ার রাইফেলের গুলিতে মরেছে। সবাই সন্দেহ করল গ্রামের পাঠশালার মাস্টারকে। তার সঙ্গে বুড়ির প্রায়ই ঝগড়া হত। মাস্টার বাইরে থেকে এসেছে, গ্রামের লোকেরা তার শহুরে হাবভাব ভাল চোখে দেখত না, তাই তাকে ভীষণ অপছন্দ করত। গ্রামের পুলিশও মাস্টারকে সন্দেহ করছে। মাস্টারের ছেলের এয়ার রাইফেল আছে, অবশ্য অন্য বাড়িতেও আছে। তা ছাড়া মাস্টারের বাড়ি থেকে বুড়ির ঘরটা দেখা যায়। মাস্টার ভয়ে ছুটে এল প্যারিসে মেইগ্রের কাছে আকুল আবেদন নিয়ে আমাকে বাঁচান। মেইগ্রে তখন কী করল?

জানি।

বলতে পারত তো আমাকে আবার টানাটানি কেন? আমি শহরের পুলিশ, গ্রামের পুলিশের এলাকায় নাক গলাবার অধিকার নেই। কিন্তু গ্রামে গেল তো সে মাস্টারের সঙ্গে! লোকটার উপর কি শুধু মায়াই পড়ে গেছল? মানবিকতা বলে একটা ব্যাপারও তো আছে।

তুই তো বেশ গালভরা পাকাপাকা কথা শিখেছিস। উকিল হবি নাকি বাবার মতো!।

দেবুদা, আমার কিন্তু স্থির বিশ্বাস, ডগুদার কেসটা পেলে মেইগ্রে ঠিক নিয়ে নিত। বুদ্ধির ব্যাপার আছে যে!

উঠে বসল দেবুদা। চশমাটা পাঞ্জাবির খোঁটায় মুছে চোখে লাগিয়ে পিটপিট করে তাকাল।

কী বুদ্ধির ব্যাপার?

তা আমি কী করে জানব! একটা নিরপরাধ লোককে প্যাঁচে ফেলা হয়েছে, তাকে ছাড়িয়ে আনতে নিশ্চয় বুদ্ধি লাগবে। সাক্ষীদের জেরা করে, কি তাদের প্রমাণগুলো মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, কি ডগুদা তখন অন্য জায়গায় ছিল এইরকম কিছু প্রমাণ দিয়ে প্যাঁচটাকে খুলে ফেলতে হবে। মেইগ্রে হলে ঠিক পারত।

দেবুদা ডান তালু দাড়িতে ঘষতে ঘষতে আড়চোখে কয়েকবার আনন্দর মুখের দিকে তাকাল।

তবে মুশকিল কী জানেন দেবুদা, বাবার সঙ্গে আপনি পারবেন কি না তাই নিয়ে আমার বেশ—

আনন্দ টেবলে টাইমপিসটার দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। দেবুদার গাল ঘষা বন্ধ হয়ে গেছে।

কালকেই কেস আছে বললি। খরচ-টরচ দেবে কে?

মেইগ্রে তো নিজের খরচেই মাস্টারের সঙ্গে গ্রামে গিয়েছিল। নিজের খরচেই হোটেলে ছিল।

তাই বলে আমাকেও কি পকেট থেকে টাকা বার করতে হবে? একটা পয়সাও আমি খরচ করতে পারব না।

দমে গেল আনন্দ। দেবুদা রাজি হয়েও পিছিয়ে যাচ্ছে। বেচারা ডগুদা, বিনা দোষে জেল খাটবে। মিথ্যে মামলার ফাঁস থেকে ওকে বার করে আর কে আনতে পারে। শুকনো মুখে আনন্দ বলল, ডগুদা ওই মাঠটাকে পাড়ার ছেলেদের খেলার জন্য বুক। দিয়ে আগলে রাখে, শিবা দত্তর লোকের সঙ্গে ঝগড়া করে, মাঠটার দলিলে কী লেখা আছে ডগুদা তা জানে, ওর জন্যই মাঠটাকে ওরা গ্রাস করতে পারছে না। একটা ভাল লোক অযথা জেলে যাবে আর আমরা কিছু করব না?

করতে গেলে টাকা লাগে।

কোথায় পাব? ডগুদার বাড়ির কেউ একটা পয়সাও দিতে রাজি নয়।

 তাহলেই বোঝ কী রকম লোক। জেল খাটুক অভিজ্ঞতা হবে।

 আনন্দ যাবার আগে শুধু বলল, মেইগ্রে পড়ে আপনি কিছু বোঝেননি?

সন্ধ্যা উতরে রাত শুরু হয়ে গেছে। এতক্ষণ বাইরে থাকার অনুমতি তার নেই। দেবুদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আনন্দ জোরে হাঁটতে শুরু করল। পর পর কদিন রাতে বৃষ্টি হয়েছে। বাতাস জোলো। দেবুদা কাল তাহলে অ্যাপিয়ার হবে না। অন্ধকার খেলার মাঠটার মধ্য দিয়ে যাবার সময় একটা ইট পায়ে লাগতেই অভ্যাসবশত কুড়িয়ে নিল। সাইজটা ক্রিকেট বলের। নিশপিশ করে উঠল ওর ভিতরের রাগ আর দুঃখের মতোই কাঁধের পেশিগুলো। তিন আঙুলে ইটটাকে ধরে সে ছুটতে ছুটতে লাফিয়ে উঠে বল করার মতো ছুড়ল কারখানার দেয়ালে।

দেয়ালে ইট লাগার শব্দটা ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ডান হাতে সে বুক চেপে ধরল। মনে পড়ল তার বুকে চোট। এট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন নয়, ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ফ্রেডেরিকসের ক্যাচ ধরতে গিয়ে বলের উপর বুক দিয়ে পড়েছে। এখন সে বোম্বাইয়ে।

বুকে হেভি ব্যান্ডেজ। ডাক্তার বলেছে শুয়ে থাকতে। পুরো রেস্ট। কাল মাঠ থেকেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। এক্স-রে হয়েছে। পাঁজরার হাড়ে ক্র্যাক দেখা গেছে। কেবিনে রাখা হয়েছে।

ট্রানজিস্টারে কান পেতে আনন্দ শুয়ে। সেকেন্ড-ডে লাঞ্চে ওয়েস্ট ইন্ডিজ টু ফর ফোর হানড্রেড সেভেনটি। দু উইকেটে চারশো সত্তর। কালীচরণ ব্যাটিং দুশো চার, কানহাই ব্যাটিং হানড্রেড ফিফটি। ফ্রেডেরিকস সত্তর, আর একজন পনেরো, বাকিটা এক্সট্রা।

আউট!

লাঞ্চের পর প্রসন্নর প্রথম বলেই কালীচরণ শর্টলেগে সোলকারের হাতে!

কে আসছে? লরেন্স রো! রিলেওলারা কী যে বলে। আনন্দ কানের কাছে সেটটা ধরল ঠিক মেজদার মতো। (ওহ, কাল মেজদাও হাসপাতালে এসেছিল, আজ সকালেও। ইন্ডিয়া টিমেরও সবাই এসেছিল।)।

সোবার্স। আশ্চর্য, সোবার্সকে দেখে চিনতে পারে না? পতৌদি অ্যাটাকিং ফিল্ড সাজিয়েছে। নিউ ব্যাটসম্যান।

কানহাই-সোবার্স। তিন উইকেটে চারশো সত্তর। আর কতক্ষণ ব্যাট করবে? টি-এ ডিক্লেয়ার করা উচিত। সোবার্স পনেরো মিনিটে মারল প্রথম চার, বেদিকে। নেক্সট পনেরো মিনিটে তিরিশ। আশি মিনিটে একশো এক। কানহাই ততক্ষণে মাত্র বারো।

লয়েড ডিক্লেয়ার করল। লাঞ্চের পর একশো মিনিট ব্যাট করেই। সাড়ে পাঁচশো মিনিটে থ্রি ফর সিক্স হান্ড্রেড টোয়েন্টি। টি-এর আগে দশমিনিট ইন্ডিয়াকে ব্যাট করতে দিয়ে কী এমন লাভ হবে!

অন্ধকার মাঠের ওপর দিয়ে কয়েকটা লোক কথা বলতে বলতে চলেছে আনন্দদের বাড়ির দিকে। মাঠের উপর বিকেলে কয়েকটা ড্রাম নামিয়ে রেখে গেছে কারখানার লরি। আনন্দ এতক্ষণ তারই একটার উপর বসে। লোকেদের কথার শব্দে বোম্বাই টেস্টম্যাচ থেকে সে মুহুর্তে ফিরে এল বাস্তবে।

আনন্দ ওদের পিছু পিছু বাড়ির দিকে এগোল। মাথা ভার ভার লাগছে, গাঁটে গাঁটে যন্ত্রণা।

উকিলবাবু যা যা শিখিয়ে দেবে, মুখস্থ করে ফেলবি। ঠিক সেইভাবে বলবি।

কথা বলতে বলতে ফটক পেরিয়ে ওরা ঢুকছে। আনন্দ দেখল দুটি অল্পবয়সী ছেলে আর শিবা দত্তর ম্যানেজার।

বিপিনদা সিং-দরজার কাছে উৎকণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে; আনন্দকে দেখা মাত্র ফেটে পড়তে গিয়েও পড়ল না।

এ কী চোখমুখের অবস্থা হয়েছে। গা পুড়ে যাচ্ছে যে!

 বিপিনদা, আমাকে ঘরে নিয়ে চলো।

এইটুকু বলেই আনন্দ বিপিনদার বাহু আঁকড়ে হাঁপাতে লাগল।

কী যে এক অসুখ, চিকিচ্ছেও কিছু নেই। সন্ধে থেকে আমি খোঁজাখুঁজি করছি। মেজবাবু জানতে পারলে আমাকে আস্ত রাখবে না।

আনন্দ সারারাত জ্বরের ঘোরের মধ্যে কাটাল। এক একবার চমকে উঠে কান পেতেছে কিছু একটা শোনার জন্য। আবার আচ্ছন্ন হয়েছে। একবার তার মনে হল, কে যেন মাথায় হাত বুলোচ্ছে।

কে?

রোজওয়াল।

উইম্বলডন পেয়েছ?

এখনও তো কোনর্সের সঙ্গে তোমার সেমি ফাইনাল খেলা শেষ হয়নি।

 হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক। বাকি আছে বটে।

 তুমি সেরে উঠলে হবে?

 আনন্দ মাথা কাত করল।

.

সকালে অরুণ গম্ভীর হয়ে গেল ওকে দেখার পর।

ডাক্তারবাবু যা বারণ করেছিলেন, তুমি তা-ই কিন্তু করেছ। এই অসুখে সাবধানতাই কিন্তু একমাত্র চিকিৎসা, তোমায় তা বার বার বলা হয়েছিল।

আর কিছু সে বলেনি। দুপুরে আনন্দ ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে একবার ঘুরে এল।

ইন্ডিয়া অল আউট একশো পঁয়ত্রিশ তৃতীয় দিন লাঞ্চে। ফলোঅন। চারশো পঁচাশি রান পিছনে। খেলা এখনও আড়াই দিন বাকি। হার হার, আবার ইনিংস ডিফিট। উইকেটে লাইফ নেই, অ্যান্ডি একটাও উইকেট পায়নি। সোবার্স গুগলিতে দুটো, গিবস ছটা, দুটো রান আউট।

হাসপাতালের কেবিনে আনন্দর কানে রেডিয়ো। স্টেডিয়ামের হট্টগোলের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। যেন শ্মশানে খেলা হচ্ছে।

বিকেলে আনন্দর জ্বর কমে সন্ধ্যায় আবার বাড়ল, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কবজিতে, কনুইয়ে, হাঁটুতে, পায়ের গোছে কেউ যেন হাড়গুলো চিবোচ্ছে। যন্ত্রণায়। ঝনঝন করছে শরীর। কিন্তু বকুনির ভয়ে বলল না। সে যে খুব বেশি কাহিল নয়, এটা প্রমাণ করার জন্য বিপিনদা যা দিল, তা-ই খেয়ে ফেলল। বার বার উত্তরের জানলায়। তাকাল অমলের জন্য। ডগুদার মামলার খবর তাকে জানতেই হবে।

পরদিন দুপুরে অমল এল।

কী হল?

 মা গেছল কোর্টে। শিবা দত্তর হয়ে সাক্ষী দিল। চাওলা দয়ানিধি, মন্দিরে কাজ করে নেপেন নামে লোকটা, কারখানার লরি ড্রাইভার আর দুটো মজুর। সবাই বলল একই কথা। ডগুদা কারখানায় আগুন লাগাবে বলে শাসিয়েছিল, ওরা শুনেছে। আর আগুন লাগার কিছু আগে ওরা ডগুদাকে কারখানার কাছাকাছি দেখেছে।

ওরা সবাই শিবা দত্তর অনুগ্রহ নিয়ে চলে।

কিন্তু সে কথাটা তো জজকে বলে দেবার মতো কেউ নেই।

 ডগুদা বলতে পারে।

 মা বলল, ডগুদা নাকি সারাক্ষণ কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ইতস্তত করে অমল আরও কী যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল। আনন্দ তা লক্ষ করে খাট থেকে ঝুঁকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

তোমার বাবা আমার মাকে ডেকে নিয়ে বলেছে, ডগুদা যদি জমিটা নিয়ে চেঁচামেচি আর না করে তা হলে কেস তুলে নেবে আর কারখানায় একটা চাকরিও হবে। মাকে বলেছে ডগুদাকে বুঝিয়ে বলার জন্য।

আনন্দ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে অবশেষে হেসে উঠল।

পাগল, ডগুদা এতে রাজি হবে ভেবেছ? এভাবে ওকে কেনা যাবে না।

তোমার কি শরীর ভাল নেই আনন্দ? হাঁপিয়ে কথা বলছ কেন? চোখ মুখ ফুলো ফুলো!

আবার হাসল আনন্দ।

কোনর্সের সঙ্গে থার্ড সেটের খেলা চলছে ফাইভ গেম অল, ভীষণ টায়ার্ড এখন। রোজওয়াল ফাইনালে অপেক্ষা করছে আমার জন্য। এদিকে ইন্ডিয়া ফলোতন খেয়েছে।

তুমি বেশি কথা বোলো না।

শুনবে আমি প্রথম ওভারে কী কাণ্ড করেছি?

 না। তুমি শুয়ে পড়ো।

ফ্রেডেরিকস আমাকে পিটিয়ে ছাতু করে দিয়েছে। সারা স্টেডিয়াম শুধু ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করেছে আমাকে। আমি তখন লজ্জায় ভয়ে পালাবার ছুতো খুঁজছি। ওভারের শেষ বলে অসম্ভব একটা ক্যাচ ধরতে গিয়ে বলের ওপর বুক দিয়ে পড়েই দারুণ চোট। হাসপাতালে কেবিনে আছি এখন। বুঝলে অমল, এখন আমি সেই ভেতরের পৃথিবীতে।

আনন্দ চোখ বুজল। নিঃশব্দে জানলা থেকে অমল যে সরে গেল সেটা জানতে পারল না সে। আনন্দ দেখতে পাচ্ছে সে এখন হাসপাতালে। পা টিপে টিপে বেরোচ্ছে কেবিন থেকে। হাতে তোয়ালে মোড়া বুট-জোড়া। লম্বা বারান্দার শেষে সিঁড়ি একতলায় নেমে গেছে। জনমানব নেই কোথাও।

ইন্ডিয়া টি-এ চার উইকেটে পঁয়তাল্লিশ। রেডিয়োটা বন্ধ করেই সাদা জামা আর প্যান্টটা দ্রুত পরে নেয় আনন্দ। নার্স এখন ঘরে নেই। যে-কোনও মুহূর্তে এসে পড়বে। বুট পরে হাঁটলে শব্দ হবে। ওটা লুকিয়ে নিতে হবে। আনন্দ ব্যানার্জি খেলছে, অথচ ইন্ডিয়া হারবে, কী করে তা সম্ভব? বুকে চিড়িক করে উঠল একটা ব্যথা।

সে সিঁড়িতে পৌঁছে লাফিয়ে লাফিয়ে একতলায় এল। বুকের ব্যথাটা জোরে লাগছে। ব্যান্ডেজটা ভাগ্যিস দেখা যাচ্ছে না। বিশ্বনাথ কি ব্রিজেশের প্যাড, ব্যাট, গ্লাভস চেয়ে নিলেই হবে। আউট হয়ে গেছে ওরা।

ট্যাক্সি, অ্যাই ট্যাক্সি। স্টেডিয়াম চলো, হয়্যার দি টেস্ট ম্যাচ ইজ নাউ বিইং প্লেড। জলদি, কুইক।

ইন্ডিয়া সিক্স ফর ফিফটিওয়ান। তিনদিনেই খেলা শেষ হয়ে যাবে। পতৌদি ফিরে আসছে। ক্লিন বোল্ড বাই রবার্টস। ওর উইকেট এই একটাই। দারুণ স্লো পিচ। রবার্টসের মতো ফাস্ট বোলারও এর থেকে লাইফ পাচ্ছে না। অথচ ইন্ডিয়া কোল্যাপস করে যাচ্ছে। আর রইল কে? ব্যানার্জি তো ব্যাট করবে না। প্রসন্ন, বেদি, চন্দ্র। টি-এর পর ঝপাঝপ গেল আবিদ আর পতৌদি। গাভাসকর চব্বিশ নট আউট।

আর বড়জোর আধঘণ্টা। তারপরই ম্যাচ শেষ। তখন বাসে ওঠা, কি ট্যাক্সি পাওয়া শক্ত হবে। স্টেডিয়াম থেকে এখনই লোক বেরোতে শুরু করেছে।

পতৌদি মাথাটা বাঁ দিকে হেলিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে ফিরছে গ্লাভস খুলতে খুলতে। প্রসন্ন ব্যাট করতে নামবে। তাকে কী বলার জন্য মুখ তুলেই পতৌদি থমকে গেল। বাঁ চোখটা বিস্ময়ে প্রায় কপালে উঠল।

ব্যানার্জি।

 ব্যাড লাক, প্যাট।

ওর পাশ দিয়ে আনন্দ এগিয়ে গেল উইকেটের দিকে।

ইনজিওর্ড, তার উপর বোলার, তাই রবার্টস প্রথম বলটা অফ স্ট্যাম্পের অনেক বাইরে মিডিয়াম-পেসে দিল। সাড়ে চারশো রান হাতে নিয়ে এমন দয়া সবাই দেখাতে পারে।

শব্দ হল টকাস।

স্কোয়্যার কাট। গালিতে গিবস ভয়ে উবু হয়ে বসে পড়ল। বলটা দেখা গেল না বাউন্ডারিতে পৌঁছবার আগে পর্যন্ত।

সোবার্স হাসল হাততালি দিতে দিতে। কালীচরণও দিল। ওরা জানে, হারের মুখে ব্যাট করতে এসে এরকম দু-চারটে বেপরোয়া মার সবাই মারে।

নেক্সট বলটা সোজা। টক। বোলারের ওপর দিয়ে ছয়। ওভার শেষ। গাভাসকার এগিয়ে এল কথা বলতে।

ইউ জাস্ট স্টে দেয়ার সানি। ওনলি স্টে অ্যান্ড গিভ মি সাপোর্ট। ডোন্ট টেক শর্ট রানস বিকজ—

আনন্দ বুকে হাত দিয়ে, ইংরেজিতে কথাগুলো অনুবাদ করতে না পেরে শুধু বলল, পেন।

অবাক চোখে তাকাতে তাকাতে গাভাসকার ক্রিজে ফিরে গেল।

পনেরো মিনিটের মধ্যে লয়েডকে ফিল্ড ছড়িয়ে দিতে হল। রবার্টসের এক ওভারে কুড়ি রান। একটা সিঙ্গল নিতে পারত, নিল না। বুকে যন্ত্রণা। গিবসের এক ওভারে ছাব্বিশ, তিনটে ছয়ই স্ক্রিনের ওপর। সোবার্স এক ওভারে দিল যোলো। কভারে জলপোকার মতো ছোটাছুটি করছে বয়েস। গোয়েন্দাদের মতো থার্ডম্যানে লরেন্স রো পায়চারি করছে। নেমন্তন্ন বাড়িতে খাওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকা বরযাত্রীর মতো উশখুশ করছে কানহাই, স্লিপে।

বন্যার মতো রানের স্রোত চলেছে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে। ডুবে গেল কালীচরণের ইনিংস। সোবার্সের ইনিংস, কানহাইয়ের ইনিংস। বোম্বাইয়ের হাজার হাজার বাঙালি থাকে। নিশ্চয় তারা খেলা দেখতে এসেছে।

লড়ে যা বাঙালি।

আনন্দ স্ট্যান্ডের দিকে তাকিয়ে ব্যাট তুলল একবার।

বেঙ্গল টাইগার, কিল দেম।

 দিনের লাস্ট ওভারের লাস্ট বলে আনন্দ ঠিক একশোয় পৌঁছল বয়েসকে লেটকাট করে। সোবার্সের মতো ঠিক আশি মিনিট লাগল। লাগত না, দারুণ ফিল্ডিং আর সানির ঠুকঠাক সময় নষ্ট করা। দুবার ফ্ল্যাশ করেছিল অফ স্ট্যাম্পের বাইরে। আনন্দ স্টেডি সানি, স্টেডি বলার পর গাভাসকার আর করেনি।

ইন্ডিয়া সিক্স ফর হান্ড্রেড সিক্সটি। এখনও বাকি দুটো দিন। পুলিশ কর্ডন করে রেখেছে বাউন্ডারি তাই—নয়তো আনন্দ উচ্ছ্বাসের চাপে মারা যেত। হাজার হাজার লোক ঠেলাঠেলি করছে তাকে কিছু বলার জন্য। সব মিলিয়ে একটা বিরাট চিৎকার। লয়েড দাঁড়িয়ে গিয়ে ওকে আগে যেতে দিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমের সবাই হাততালি দিচ্ছে। আনন্দ চট করে গেস্ট ব্লকের দিকে তাকাল। মেজদার মুখ গম্ভীর।

বুকের ব্যথার জন্য কেউ জড়িয়ে ধরতে পারল না। সোলকার, বেদি, আবিদ গালে চুমু খেল। ডাক্তারবাবু রাগবে কি না বুঝতে পারছে না।

জানো, পুলিশে খবর দিয়েছে হাসপাতাল থেকে। না বলে তুমি চলে এসেছ।

 পুলিশে খবর দেওয়া কেন? হাসপাতালে কি কেউ রিলে শোনে না?

 জানো, মারাত্মক কিছু একটা হয়ে যেতে পারে তোমার। তোমার এখন নড়াচড়া পর্যন্ত বারণ।

ইন্ডিয়া হারছে আর আমি শুয়ে থাকব? ব্যানার্জিকে তা হলে চেনেন না। কালও আমি ব্যাট করব।

.

১০.

রাত্রে পাখিটা শিস দিচ্ছিল। বিছানায় উঠে টেবল থেকে টেপরেকর্ডারটা আনার মতো জোর আনন্দর ছিল না। একটু পরেই মেঘ ডেকে ওঠে। বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে। দোতলা থেকে অরুণ নেমে এসেছিল। জানলা বন্ধ করে, থার্মোমিটারে জ্বর দ্যাখে।

বাড়িতে তোর ঠিকমতো দেখাশোনা হচ্ছে না। ডাক্তারবাবু বলেছেন হাসপাতালে রাখতে।

কেন?

সেখানে কড়া পাহারায় থাকবি। সেইটাই তোর দরকার।

হাসপাতাল থেকেও তো পালিয়ে বেরোনো যায়। থার্টি টু ব্রিসবেনে এডি পেন্টার হাসপাতাল থেকে এসে ব্যাট করে ইংল্যান্ডকে ছ উইকেটে জিতিয়েছিল। তিরাশি রান করেছিল পেন্টার। গল্পটা তো তুমিই বলেছিল।

অরুণ চলে যাবার পর আনন্দ হেসেছিল। সারাদিনটা সে বিছানায় শুয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কাটিয়েছে। একবার তার মনে হয়েছিল, এইভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল। এই পৃথিবীতে এমন কী সুন্দর ভাল জিনিস আছে যেজন্য বেঁচে থাকা যায়? আবার তার মনে হয় সারা পৃথিবী সুন্দর আর ভাল জিনিসে ভরে আছে, এই বাড়ির বাইরে বেরোলেই সেই জিনিসগুলোর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। ভাবতে ভাবতে সে মনমরা হয়ে শুয়ে থাকে। বিকেলে ইচ্ছে হয়েছিল দোতলায় যেতে। এতদিনে একবারও ওঠেনি। জানলায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখল দুটো ঘুড়ির লড়ালড়ি। ঘুগনিওলার ডাক শুনে লোভ হয়েছিল, কিন্তু কাছে একটা পয়সা নেই।

সন্ধ্যায় আনন্দ বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে ধরা পড়ল বিপিনদার হাতে।

না, একদম বারণ।

 কোনও ওজর, কাকুতিমিনতি বিপিনদার কানে গেল না।

ফটকে সারাক্ষণ তালা দিয়ে রাখতে বলে গেছে মেজবাবু, তা জানো? বাবুর লোকজন সেরেস্তায় আসবে বলে এখন তালা খুলে ফটক পাহারা দিচ্ছি।

আধ ঘণ্টা পর আনন্দ নিঃসাড়ে বাগানের পুব পাঁচিলের ভাঙা নিচু দিকটা টপকাল। মাঠের মধ্য দিয়ে ছুটে বীরা দত্ত রোডে। সেখান থেকে জোরে হেঁটে দেবুদার বাড়িতে। তখন ওর সারা শরীর থরথর কাঁপছে। চিত হয়ে শুয়ে দেবুদা একটা পেপারব্যাক পড়ছিল। বইটা মুখ থেকে ধীরে ধীরে নামিয়ে কয়েক সেকেন্ড স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

কী হয়েছে তোর?

 কিছু না। হাঁপিয়ে গেছি।

 দেবুদা আবার বইটা মুখের উপর তুলে ধরল।

 তোর ডগুদা ছাড়া পেয়ে গেছে।

কী করে?

 শিবা দত্ত মামলা তুলে নিয়েছে।

সে কী! ডগুদা রাজি হল?

আনন্দর চোখের সামনে দেবুদা ঘোলাটে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিরাট একটা হাতুড়ি দিয়ে কেউ যেন তার মাথায় এইমাত্র মারল।

কেন রাজি হবে না? দেবুদা বলল।

শুনেছি ওরা বলেছিল জমির মালিকানার ব্যাপারটা যদি চেপে যায়, যদি ডগুদা আর চ্যাঁচামেচি করে ব্যাগড়া না দেয় তা হলে মামলা তুলে নেবে, একটা চাকরিও দেবে। ঠিকই করেছে ডগুদা।

আনন্দর মাথার মধ্যে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার দেখা শোনা বোঝা ধারণাগুলো। যা সত্যি, খাঁটি তার জন্য মানুষ সর্বস্ব ত্যাগ করবে কষ্ট স্বীকার করবে, এটাই সে এতদিন জেনে এসেছে।

আপনিও এই কথা বলছেন?

কেন বলব না? পাড়ার ছেলেরা খেলবে বলে জমি নিয়ে ঝগড়া করা, জেল খাটা, শেষ পর্যন্ত এতে কী লাভ? কই, পাড়ার কোনও লোক তো ওর পাশে এসে দাঁড়াল না? আনন্দ, একটা কথা সবার আগে নিজে বাঁচো তারপর অন্যকে বাঁচাও। ডগুদা তাই করল, বুদ্ধিমান লোক। চিরকাল লোকের উপকার করে বেড়িয়ে এখন বুঝতে পেরেছে এতে কোনও লাভ নেই। আগে নিজের উপকার তারপর অন্যের।

কথা না বলে আনন্দ শুধু দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলেছিল। দেবুদা বইটা আবার মুখের উপর তুলে ধরতেই সে নিঃশব্দে উঠে বেরিয়ে এল। ডগুদার বাড়িতে গিয়ে এখন একবার শুধু জিজ্ঞাসা করবে, কেন সে হার মেনে নিল।

বাড়ির সদর দরজার পাশে খুপরি একটা ঘরে ডগুদা থাকে। রাস্তার উপরেই ঘরের দরজা। বাড়ির ভিতরের সঙ্গে সম্পর্ক একদা ছিল একটা দরজা মারফত। এখন দরজাটা নেই তার জায়গায় দেয়াল উঠেছে। আনন্দ দূর থেকেই দেখল ডগুদার ঘরে হারিকেনের আলো জ্বলছে, দরজাটা আধ ভেজাননা।

ডগুদা তক্তপোশে পা ছড়িয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে। থুতনিটা মুঠোয় ধরা। গভীরভাবে একটা কিছু চিন্তা করছে। তার পায়ের দিকে বসে আছে গীতা মাথা নিচু করে। সেও কিছু একটা চিন্তা করছে। আনন্দ দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেই থতমত হল। লেডি সোবার্সকে এখানে দেখতে পাবে সে ভাবেনি। ওরা দুজনে চমকে উঠে তার দিকে তাকাল।

কী চাই? ডগুদা একটু রুক্ষস্বরেই বলল।

শুনলাম, আপনি নাকি চাকরি নিচ্ছেন শিবা দত্তর, এটা কি সত্যি!

ওরা দুজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। ডগুদা সিধে হয়ে বসে বলল, হ্যাঁ। তাতে তোর কী?

তা হলে মাঠটার কী হবে?

 ডগুদা চুপ করে রইল।

লাইব্রেরিটাও উঠে যাবে?

দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে রইল ডগুদা।

 মাঠে মেয়েদের ট্রেনিং বন্ধ হয়ে যাবে?

হ্যাঁ সব যাবে, সব বন্ধ হয়ে যাবে, তাতে আমার কী? আমি আর কোনও ঝামেলায় জড়াব না। এখান থেকে আমি চলে যাব। আমার বয়েস হচ্ছে, আর কটা দিনই বা বাঁচব।

ডগুদার গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে হঠাৎ থেমে গেল। আনন্দর মনে হল এই ঘরটা যেন মাটির নীচে, তার চারদিক চাপা। এখানে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। যেমনভাবে দেবুদার কাছ থেকে উঠে এসেছিল, সেইভাবেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এল। আধ অন্ধকার রাস্তা দিয়ে সে মাঠের কাছাকাছি আসতেই পিছন থেকে অমল ডাকল।

কী বলল ওরা?

ওরা?।

ডগুদা আর মা?

জানো অমল এখন আমার ইচ্ছে করছে প্রচুর আলো প্রচুর হাওয়ার মধ্যে ঘুরে বেড়াতে। চারিদিক এত দমবন্ধ করা লাগছে। ডগুদাকে খুব স্পিরিটেড, সৎ বলে জানতাম, কিন্তু শিবা দত্তর কাছে যে নিজেকে এত সহজে বিক্রি করে দেবে আমি ভাবিনি।

ওরা বিয়ে করবে তা হলে?

কী করবে? আনন্দ প্রায় চিৎকার করে উঠল।

ডগুদা আর তোমার লেডি সোবার্স। অন্য জায়গায় বাসা নিয়ে থাকবে, সেই কথাই ওরা আলোচনা করছিল।

তোমার মা…লেডি সোবার্স! কেন, কেন? থরথর কাঁপতে লাগল আনন্দ।

সকলের মতো ওরাও বাঁচতে চায় যে।

আমিও তো চাই। অমল অমল আমার কী হবে— আর্তনাদে চিরে গেল আনন্দর গলা।

তুমিও বাঁচবে, চিরকাল খেলা করে বাঁচবে।

 হঠাৎ যেন বিরাট ঘুষির মতো কথাটা আনন্দর বুকে লাগল। যন্ত্রণায় সে কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ার আগে হেসে উঠল সারামুখ উজ্জ্বল করে। ও তো জানত না, জমাট বেঁধে যাওয়া রক্তের একটা দানা সেই মুহূর্তে তার ব্রেনের দিকেই ছিটকে যাচ্ছে। ও তখন জানত না, সারা জীবনের জন্য ওর শরীরের বাঁ দিকটা অসাড় হয়ে যাবে। ও জানত না, ডাক্তারবাবু এই ভয়টাই অরুণকে বলেছিলেন।

দোতলার ঘরে নিজের খাটে শুয়ে আছে আনন্দ। বিপিনদা এইমাত্র তাকে পাশ ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। জানলা দিয়ে সে দেখতে পাচ্ছে আকাশটা গাঢ় নীল, সাদা টুকরো মেঘ ইতস্তত ছড়িয়ে অপেক্ষা করছে হাওয়ার। পেলেই ওরা ভেসে বেড়াতে শুরু করবে। আনন্দ অপেক্ষা করছে ওদের ভেসে বেড়ানো দেখার জন্য। বিছানায় শুয়ে জানলা দিয়ে সে আকাশ, মন্দিরের ধ্বজা আর একটা নারকেল গাছের হঠাৎ বাতাসে দোলা মাথা ছাড়া আর কিছু দেখতে পায় না। আর শুনতে পায় শব্দকর্কশ রুক্ষ ধপাধপ দুমদাম মাল ফেলা আর মাল তোলার শব্দ মাঠটা থেকে। মাঠে ছেলেমেয়েরা আর খেলে না। ডগুদা, লেডি সোবার্স আর অমল কোথায় যেন চলে গেছে এই অঞ্চল ছেড়ে।

দিন চারেক আগে সেই পাখির ডাকটা সে অনেকদিন পর শুনতে পেয়েছিল। গভীর রাতে শিসটা লণ্ঠনের মতো দুলতে দুলতে জানলার বাইরে দিয়ে চলে যায়। ভাগ্যিস টেপরেকর্ডারে ধরে রাখেনি? রাখলে, এমন করে অবাক হওয়ার মজাটা ফুরিয়ে যেত।

তন্দ্রা আসছে আনন্দর। চোখের পাতা জুড়ে আসছে ঘুমে। এমন সময় একটা স্বর ফিসফিস করল:

ব্যানার্জি আমি তোমার সঙ্গে ফাইনালে খেলার জন্য অপেক্ষা করছি।

কিন্তু আমি যে কোনর্সের সঙ্গে খেলাটা শেষ করতে পারছি না। ওকে হারাবার পরই তোমার কাছে আমায় তো হার মানতেই হবে, তখন যে আমার খেলাও ফুরিয়ে যাবে। আমি যে অনেকদিন খেলতে চাই।

ব্যানার্জি তুমি আমাকেও হারিয়ো।

 না না, তোমাকে আমি হারাতে পারব না।

 তুমি হেরে গেলে তোমার দেশের লোক দুঃখ পাবে।

 পাক পাক। আমার ইচ্ছেয় আমি হারব আমার ইচ্ছেয় আমি জিতব। আমি একটা দারুণ পৃথিবীতে চলে যাব যেখানে আমায় কেউ হারাতে পারবে না। কিন্তু মুশকিল কী জানো, জিতে ফেললেই সেই পৃথিবীটা থেকে আমায় বেরিয়ে আসতে হবে তাই কোনর্সের কাছে আমি জিতছি না। তুমি কি অধৈর্য হয়ে পড়ছ?

আমি ভয় পাচ্ছি ব্যানার্জি। কোনর্সের সঙ্গে খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে পড়বে, তখন তুমি যে ম্যাচ ছেড়ে দেবে।

না, মোটেই না। উইম্বলডন থেকে চলে যাবার পর ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে। ইন্ডিয়াকে ইনিংস ডিফিট থেকে বাঁচাবার জন্য আমি ব্যাট করব। এখন আমি একশো নট আউট, দুটো দিন ব্যাট করতে হবে। রেকগনাইজড ব্যাটসম্যান বলতে আছে শুধু গাভাসকার। আমি একটার পর একটা রেকর্ড ভাঙতে ভাঙতে যাব। পঞ্চাশ রানে ইন্ডিয়াকে এগিয়ে দিয়ে আউট হব। শেষদিন টি-এর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাট করতে নামবে আধঘণ্টায় ওই রানটা তুলে নিয়ে ম্যাচ জিততে। কিন্তু ফাস্ট বোলার ব্যানার্জি যে কী জিনিস এইবার ওরা তা দেখতে পাবে, কখনও দেখেনি এমন বোলিং করব।

সেই ম্যাচও তো শেষ হবে একদিন।

হোক। সারা পৃথিবী জুড়ে খেলা চলেছে রোজওয়াল, তুমি কি কাগজ পড়ো না? দ্যাখো না রোজ কত জায়গায় কত খেলা? অফুরন্ত অগুন্তি। আমি এই বিছানায় শুয়ে একটার পর একটা খেলা খেলে যাব। শেষ সুযোগ সব সময় আমার সামনে। থাকবে চিরকাল। সারা পৃথিবী গ্যালারিতে বসে অপেক্ষা করে থাকবে আমাদের ফাইনাল খেলাটার জন্য।

দোতলার ঘরে, দুপুরে, জানলা দিয়ে তাকিয়ে মেঘেদের ভেসে বেড়ানো দেখার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আনন্দর মুখের ওপর হালকা মেঘের মতো একটা হাসি ভেসে বেড়াতে লাগল। চোখদুটো জলে ভরে আসছে। তার উপরই ঝলমল করে উঠল নরম আভা নিয়ে বুকের মধ্য থেকে ফুটে ওঠা মিষ্টি রোদ। মনে মনে সে তখন বলল: এত খেলা, চারদিকে এত খেলা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *