১. হোয়াটস দ্য ম্যাটার

অপরাজিত আনন্দ – কিশোর উপন্যাস – মতি নন্দী

০১.

হ্যাল…লো অ্যান্ডি রবার্টস, হোয়াটস দ্য ম্যাটার উইথ য়্যু! দাঁড়িয়ে কেন? যাও যাও বল করো।

বলতে বলতেই প্রৌঢ় কোচ নেটের দিকে তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, পিচের কাছে পা, বলের পিচের কাছে পা এনে ফরোয়ার্ড। মুখ উঠছে। কেন? নির্ভয়ে খেলো। ইয়েস অ্যান্ডি—।

নিচু হয়ে গড়িয়ে আসা বলটা তুলে নিয়ে কোচ ছেলেটির দিকে ছুড়ে দিলেন।

মাত্র দু ওভার করেই কোমরে হাত! ব্র্যাডম্যান টানা কুড়ি ওভার বল করিয়েছিল মিলারকে দিয়ে ফরটি এইট নটিংহাম টেস্টে। সেকেন্ড ইনিংসে টোটাল চুয়াল্লিশ ওভার বল করেছিল মিলার। আর তুমি…কী করে খেলবে এই স্ট্যামিনা নিয়ে? প্র্যাকটিস প্র্যাকটিস, যে ভুলগুলো দেখিয়ে দিলাম শুধরে নাও। যাও যাও।

কোচ এগিয়ে এলেন নেটের ধার ঘেঁষে ব্যাটসম্যানের দিকে।

কলকাতার পুব শহরতলির নেতাজি পার্কে প্রায় পঁচিশটি ছেলেকে নিয়ে সাতদিন হল চলছে এই ক্রিকেট কোচিং। ব্যবস্থা করেছে পার্কেরই নেতাজি ব্যায়ামগার সি এ বি-র সহযোগিতায়। ছেলেদের বয়স চোদ্দো থেকে কুড়ির মধ্যে। অধিকাংশই স্কুল ছাত্র। কোচ করছেন যিনি, একদা রঞ্জি ট্রফিতে ছটি ম্যাচ খেলেছেন। প্রচুর বই পড়ে তিনি খেলা শিখেছেন কিন্তু একবার ৩৯ ছাড়া কখনও দশের বেশি রান করেননি।

আন্দ, দাঁড়িয়ে থাকিনি, কোচ তোর দিকে তাকাচ্ছে।

পাশ দিয়ে যাবার সময় ফিসফিসিয়ে বলে গেল আর একটি ছেলে।

আনন্দ মুখ তুলতেই কোচের সঙ্গে চোখাচোখি হল। বল হাতে সে মন্থরগতিতে বোলিং মার্কের দিকে এগোল। সতেরো কদম দূরত্ব থেকে ছুটে এসে বল করে সে। দূরত্বটা এখন তার কাছে সতেরো মাইল মনে হচ্ছে। কাউকে সে বলতে পারছে না আজ সকাল থেকে গা গরম, হাতে পায়ে গাঁটে গাঁটে ব্যথা, একটু ছুটলেই হাঁফ ধরছে। বল করার পরই বুকে ব্যথা উঠছে। এসব কথা কাউকে বলাটা তার কাছে লজ্জার ব্যাপার। কিন্তু সে বুঝতে পারছে আর এখন বল করতে পারবে না। করলে বুকের যন্ত্রণাটা বাড়বে।

ডেলিভারিটা সে একটু আস্তেই করল। ইনসুইং গ্রিপে বলটা ধরেছিল। অফ স্ট্যাম্পের ইঞ্চি চারেক বাইরে জমিতে পড়ে ছিটকে এসে অফ স্টাম্পে লাগল। পা দুটো নাড়াতে পারেনি, শুধু কুঁজো হয়ে ব্যাটটা এগিয়ে ধরে ব্যাটসম্যান বোকার মতো হেসে চোখের দিকে তাকাল। কোচ হাসিমুখে মাথা নাড়ছে। আনন্দ ভাবেনি বলটা অতখানি ছিটকে ঢুকে যাবে। কী করে এটা হল? ভাবতে ভাবতে ঘাড় ফিরিয়ে শুয়ে পড়া অফ স্টাম্পের দিকে তাকিয়েই, বুকে হাত রাখল। আবার সেই শ্বাসকষ্ট।

সময় নেবার জন্য আনন্দ আরও মন্থর পায়ে বোলিং মার্কে ফিরে এল। তিনজন স্পিনার ও একজন পেসার বল করছে। তাদের বল হয়ে যাবার পরেও আনন্দ ইতস্তত করল। ইশারায় সে বল করে যেতে বলল তাদের। কোচ সেটা লক্ষ করে, এগিয়ে এল।

ব্যাপার কী?

কীরকম যেন হাঁপ ধরছে।

এই কটা বল করেই! দেখে তো তোমাকে দুর্বল মনে হয় না। …আইডিয়াল ফিগার ফর এ ফাস্ট বোলার, হাঁপ ধরলে তো চলবে না; রান-আপটা এখনও জার্কি রয়েছে, সুদ করতে হবে। তা ছাড়া ডেলিভারির সময় বাঁ কাঁধটা ব্যাটসম্যানের দিকে যেভাবে দেখিয়ে দিয়েছিলাম, বাঁ-পায়ের উপর ভর দিয়ে পাছা থেকে শরীরের উপর দিকটা হাত থেকে বল ছাড়ার আগের মুহূর্তে যেভাবে ঘুরবে..হচ্ছে না তো। নিখুঁত হতে হলে অনবরত বল করে করে তৈরি হয়ে উঠতে হবে। আস্তে বল করো, এখনই গ্রেগ চ্যাপেলকে বল করতে হচ্ছে না তো…আস্তে দৌড়ে এসো, আস্তে ডেলিভারি দাও। বয়স কত?

ষোলো।

ক্লাস?

টেন।

ফেল করেছিলে কখনও?

 না।

কোচ নেটের দিকে তাকিয়ে ঘড়ি দেখলেন। প্যাড পরে অপেক্ষমাণ শিবনাথকে আঙুল তুলে বললেন: ইউ সোবার্স, গো।তারপর চেঁচিয়ে—গাভাসকার লিভ দ্য নেট, ইওর টাইম ইজ আপ।

গোবিন্দপ্রসাদ বেরিয়ে এল নেট থেকে।

 আরও দুটো বল করল আনন্দ। প্রতিটি ডেলিভারির পর শ্বাস নিতে গিয়ে তার মনে হচ্ছে বুকের মধ্যে বাতাস ঢুকছে না। বুকটা খালি। হাঁটু, কনুই যন্ত্রণায় খুলে পড়বে যেন। কাল রাতে জ্বর হয়েছিল। আজও হয়তো হবে। সে ভাবল, আর বল করা উচিত নয়। চুপচাপ এক ফাঁকে কেটে পড়তে হবে নয়তো জোর করে বল করাবে। ব্যায়ামাগারের দেয়ালটা পাশেই, সেটা শেষ হয়েছে পলাশ গাছটার লাগোয়া। ওই পর্যন্ত গিয়ে ডানদিকে ঘুরলেই কেউ দেখতে পাবে না। পার্কের পিচের রাস্তাটা ধরে টেনিস ক্লাবে ঢুকে বসে থাকলে কেউ এখন আর খুঁজে পাবে না তাকে। টেনিস তার ভাল লাগে। একসময় তার ইচ্ছা করত কৃষ্ণন হবে কিংবা রোজওয়াল। কিন্তু ক্রিকেটের টান সে আরও বেশি অনুভব করে টেনিসের থেকে।

কোচ বলল, ফললা থ্রু না করেই অমন দাঁড়িয়ে যাচ্ছ কেন?

আনন্দ বলতে পারল না কষ্ট হচ্ছে, সেটা আপনাকে আমি দেখাতে চাই না।

ধুতি-পাঞ্জাবি পরা গেমস টিচার বিনয়বাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন কোচের পাশে। তাঁর দিকে তাকিয়ে কোচ বললেন, পুরো ঝাঁকটার মধ্যে এই একটিই ছেলে…হবে, এরই হবে। ক্লাস আছে, রীতিমতো পেস আছে। কুইকলি ত্রুটিগুলো শুধরেও নিচ্ছে।

বিনয়বাবু খুবই বিজ্ঞােচিত ভঙ্গিতে বললেন, ইন্ডিয়ার তো এখন পেস বোলার দরকার।

কোচ অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকালেন। যেন, বেঁচে থাকার জন্য বাতাসের দরকার এই রকম একটা আবিষ্কারের কথা তাঁকে শোনানো হল। এখন দরকার, মানে! বরাবরই দরকার। নিসার-অমর সিং জুড়ির পর খাঁটি ওপেনিং অ্যাটাক কোনওদিনই আমাদের ছিল না, খাঁটি ফাস্ট বোলার নিসারের পর আজও হয়নি। বোধহয় এবার হবে।

আনন্দ?

কোচ অস্ফুটে কী বলে মাথা হেলালেন।

দেখছেন, বল করেই বুক চেপে ধরছে।

বোধহয় মাসলে টান ধরেছে।..ওয়েল অ্যান্ডি, স্টপ নাই।

কোচ হাত তুলে আনন্দকে নিষেধ করলেন। রেস্ট নাও, মাসাজ করো আস্তে আস্তে।

আনন্দ হাঁপ ছেড়ে কৃতজ্ঞ এবং বাধ্য ভঙ্গিতে বোলারদের দল থেকে সরে দাঁড়াল।

পড়াশুনোয় মোটামুটি তবে ইম্যাজিনেটিভ রচনা লিখতে পারে। ওর দাদাও যেন। কোন এক ক্লাবে খেলে, শুনেছি।

কী নাম?

নাম টাম তেমন নেই।

অ।

বিনয়বাবু অটিকে গ্রাহ্য না করে বলে চললেন, গুড বনেদি ফ্যামিলি, সবাই শিক্ষিত। দুই দাদা, বড়টি কানাডায় আছে আট বছর, ডাক্তার। অন্যটি মার্কেন্টাইল ফার্মে জুনিয়ার অফিসার আর ক্রিকেটও খেলে। বাবা উকিল, ভাল প্র্যাকটিস। তিনজনের ছোট্ট ফ্যামিলি।

তিনজন কেন, মা?

নেই। ওর ছোটবেলাতেই মারা গেছেন।

পুওর বয়।

কোচ মুখ ফিরিয়ে আনন্দকে দেখতে চাইলেন। আনন্দ নেই। প্রায় একশো বিঘের বিরাট নেতাজি পার্কের উপর দিয়ে চোখ বোলালেন। এক প্রান্তে টেনিস ক্লাব। লোহার উঁচু জালে এবং পর্দায় ঘেরা দুটি হার্ড কোর্ট ও একটি গ্রাস কোর্ট, সঙ্গে তাঁবু। তার পাশে একটি পুকুর। চিলড্রেনস পার্ক। অন্যদিকে ফুটবল মাঠ। ক্রিকেট ম্যাচও এখানে হয়। তিন-চারটি টালির চালাঘর পার্কের গেটের পাশে। কোনওটি ক্লাবঘর, কোনওটি ব্যায়ামের আখড়া। গেটের সামনেই নেতাজির ব্রোঞ্জ মূর্তি।

কোচ খুঁজে পেলেন না আনন্দকে।

গেল কোথায় ছেলেটা? বাড়ি কি কাছাকাছি?

অন্তত দু কিলোমিটার। বিনয়বাবুও পার্কের প্রান্তগুলিতে চোখ পাঠাচ্ছেন। এখন সব স্কুলেই গ্রীষ্মের ছুটি। সময়টা দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। গুটি তিরিশ ছেলে এবং কয়েকটি ফুটবল মাঠে নেমে পড়েছে। পুকুরেও ঝাঁপাঝাঁপি শুরু হয়ে গেছে। আনন্দকে তিনিও দেখতে পেলেন না।

আনন্দ ফাস্ট বোলার হবার মতো মেটিরিয়াল। এই বয়সেই এত পেস, এত কন্ট্রোল, ভাবাই যায় না।

দারুণ ব্যাটও করে। এবারই ইডেনে সামার ক্রিকেট টুর্নামেন্টে চল্লিশ বলে। সেঞ্চুরি করেছে। ভীষণ পিটিয়ে খেলে।

কোচ ঘাড় নাড়লেন। অর্থাৎ খবরটা জানেন। এরপর চেঁচিয়ে উঠলেন, আহ সোবার্স, তুমিও গাভাসকারের মতো ভুল করছ… ফরোয়ার্ড খেলার বল বেছে নাও, সব বলেই কি খেলে? কোন বল ছাড়বে সেটা বিচার করা অনেক শক্ত ব্যাপার। তা ছাড়া শরীর আর ব্যাটের মধ্যে অত ফাঁক থাকছে কেন?

বিনয়বাবু সেই ফাঁকে একটি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁরে, আনন্দ কোথায় গেছে রে?

বোধহয় টেনিস দেখছে। কাল তো ফেরার সময় ওখানেই ঢুকে পড়েছিল। আমাদের সঙ্গে আর ফেরেনি।

.

 সুরকির দুটি হার্ডকোর্ট তার পাশে আর একটি ঘাসের। আটটি ছেলে ও দুটি মেয়ে। কেউ ফোরহ্যান্ডে কেউ ব্যাকহ্যান্ডে ক্রমান্বয়ে বল মেরে যাচ্ছে বেসলাইন থেকে। নাগাড়ে সার্ভিস করে চলেছে দুজন পাশের কোর্টে। বছর দশেকের দুটি ছেলে ঠোঁট কামড়ে নেটের এপার-ওপার করাচ্ছে বলটিকে অসম্ভব মনোেযোগে। সাইডলাইনের ধারে কোচ দাঁড়িয়ে।

আনন্দ ইতস্তত করে, তারপর কোর্টের একটু দূরে নীলপর্দা ঘেঁষে পাতা তিনটি বেঞ্চের একটিতে গিয়ে বসে। কেউ কিছু বলল না, তাকালও না। সে নিজের ক্রিকেট বুট ও সাদা ট্রাউজার্সটার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করল। তার মতো এরাও প্লেয়ার, সুতরাং, আনন্দ ভাবল, প্লেয়ার হিসাবে এরা আর এক প্লেয়ারকে নিশ্চয়ই বেরিয়ে যেতে বলবে না। খুব ছোট থেকেই সে নেতাজি পার্কে আসছে। তখন আসত মেজদার সঙ্গে। মেজদা ক্রিকেট খেলত মিলন পল্লিতে। আনন্দ ক্রিকেট ফেলে টেনিস কোর্টের পাশে গিয়ে দাঁড়াত। টেনিস কেন যে তাকে টানে সে জানে না, বুঝতেও পারে না। হয়তো একা একা খেলতে হয়, লড়তে হয়, একাই জিততে হয়। ক্রিকেটও তাই। ব্যাটসম্যানকে একাই ব্যাট করতে হয়, ফিল্ডারকে একাই ক্যাচ লুফতে হয়। বোলারকে শুধু অন্যের সাহায্য নিতে হয় কখনও কখনও। এটা তার কাছে। অপমানকর মনে হয়। তাই সে চেষ্টা করে প্রতি বলে বোল্ড আউট করতে। ভিড়ের থেকে নির্জনতা তার ভাল লাগে, অন্যের সাহায্য নেওয়ার থেকে নিজের চেষ্টায় কাজ করা, দল বেঁধে চিৎকার করে খেলার থেকে মুখবুজে নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাওয়ায় তার আনন্দ বেশি।

টেনিস কোর্টের ছোট্ট একটা জায়গার মধ্যে বাঘের মতো কখনও ওত পেতে থাকা, কখনও থাবা মারা, কখনও ঝাঁপিয়ে পড়া। একই সঙ্গে স্লিপ ফিল্ডিং, ব্যাটিং আর ফাস্ট বোলিং! আনন্দ একদৃষ্টে লক্ষ করে সার্ভিসে ব্যস্ত দুজনের দিকে। হুবহু ফাস্ট বোলিং। ছুটে এসে বাঁ কাঁধ ব্যাটসম্যানের দিকে হতে হতে জমি থেকে শরীরটাকে একটু উঠিয়ে নিয়ে ডান পায়ের ভরে একটু পিছনে হেলে…তারপরই সার্ভিস আর বোলিং একই ব্যাপার। বাঁ হাত থেকে উঁচুতে ছুড়ে দেওয়া বলটা নামছে, ডান হাতের র্যাকেট আর ছিলে হেঁড়া ধনুকের মতো শরীরটা একই সঙ্গে সামনের দিকে ছিটকে যাচ্ছে বাঁ পায়ে ভর রেখে।

চশমাপরা ছেলেটির সার্ভিসে জোর নেই। লক্ষ করতে করতে আনন্দর মনে হল, এই ভুলটা তারও হত এবং অনেকটা কমাতে পেরেছে গত চার-পাঁচ দিনে। বল ছাড়ার সময় তার শরীরের ওজন বলের সঙ্গে না দিয়ে, পিছনে হেলিয়ে রাখত। এই ছেলেটিও বলে র্যাকেটের ঘা দেবার সময় পিছনে শরীরটা হেলিয়ে রাখছে। খুবই সাধারণ ভুল। এই ভুলটার কথা, তার ইচ্ছা করতে লাগল, ছেলেটিকে জানিয়ে দিতে।

টেনিস কোচ, অন্য কোর্টে ফোরহ্যান্ডে ব্যস্ত ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। উচিত হবে না, আনন্দ নিজেকে ধমক দিল, নিশ্চয় কোচের নজরে পড়বে, শুধরেও দেবে। তবু অস্বস্তি হচ্ছে। চমৎকার স্বাস্থ্য, প্রায় তার সমানই লম্বা, অথচ কী মিনমিনে সার্ভিস।

আনন্দ বেঞ্চে বসে ডান দিকে তাকিয়ে ছিল। চোখে পড়েনি বাঁ দিকের কোর্ট থেকে একটা বল বেঞ্চের দিকে ছিটকে এল। একজন চেঁচিয়ে বলটা ছুড়ে দেবার জন্য বলতেই সে মুখ ফিরিয়ে দেখল তার পিছনে হাত পাঁচেক দূরে পর্দার নীচেই বলটা। শিথিল দেহটাকে বেঞ্চ থেকে তুলে দাঁড় করাবার আগেই আনন্দ দেখল, বেঞ্চের পিছন থেকে শিম্পাজির মতো দুলতে দুলতে ছুটে গেল বলের দিকে এবং বলটা কুড়িয়ে কোর্টে ছুড়ে দিল সেই ছেলেটি, যাকে সে তাদের পাড়ার রাস্তায় মাঝে মাঝে দেখে।

নিঃশব্দে কখন যে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল আনন্দ টের পায়নি। মাথা ভরা রুক্ষ চুল, জ্বলজ্বলে চোখ, গায়ে আধময়লা লাল কালো চিজ কটনের শার্ট। গায়ের চামড়া খসখসে, পালিশচটা কাঠের মতো বিবর্ণ। ওর কাঁধ থেকে দেহটি কোমর পর্যন্ত ঝোঁকানো থাকে সর্বদা, যেহেতু ডান-পা পোলিওয় শীর্ণ সেহেতু বাম উরুতে হাত রেখে বাঁ দিকে ওকে ঝুঁকে থাকতে হয়। পা টেনে দুলে দুলে হাঁটে। বাঁ পা-টি ডান পায়ের থেকে একটু পুষ্ট। দুটি পা-কে মনে হয়, একটি তল্লা বাঁশ আর একটি কঞ্চি যেন মাটি থেকে উঠে নীল হাফ প্যান্টের মধ্যে ঢুকে গেছে। পায়ে নীল রঙের ধুলোভরা কেডস। ঠোঁট চেপে, শুধু দুটো চোখের মধ্য দিয়ে হাসছে কোর্টের দিকে তাকিয়ে। বয়স হয়েছে, অন্তত আনন্দের থেকে চার-পাঁচ বছরের বড়ই হবে। চোখের কোণে, ঠোঁটের কোলে বয়স লুকিয়ে আছে।

মস্ত বড় কাজ করেছে। বিরক্ত অপ্রতিভ আনন্দ আবার বেঞ্চে বসল। বলটা আমারই ছুড়ে দেওয়ার কথা, ওস্তাদি দেখাল আর কী। যেন ও ছাড়া আর কেউ কাজটা পারত না।

আনন্দ আবার তাকাল ওর দিকে, ওর পায়ের দিকে। অদ্ভুত অমানবিক ভঙ্গিতে দাঁড়ানো এবং দৌড়নোর দৃশ্যটা তার মনে কয়েকবার ভেসে উঠল। যে দেখবে তারই করুণা হবে। এই করুণা নিয়ে ওকে আজীবন কাটাতে হবে। হয়তো ও দারুণ গাইয়ে হবে, পণ্ডিত হবে, কবি হবে বা দারুণ ছবি-আঁকিয়ে হবে, কিন্তু আজীবন ওকে দেখেই সম্রম বা ভালবাসার আগে লোকের মনে প্রথমেই জাগবে করুণা। কী বিশ্রী ব্যাপারটা, আনন্দ ভাবল, মানুষের শরীর নিয়ে কী জঘন্য আমাদের ধারণা। এটাই যেন জীবনের একমাত্র জিনিস। শরীরের আড়ালেই তো আসলে জিনিসটা—মন, বুদ্ধি। তবু চেহারাটাই লোকে আগে চায়। চোখ সবার আগে যা দেখে তাই দিয়ে প্রথমেই ধারণা তৈরি করে দেয়। মন দিয়ে কি প্রথমেই দেখা যায় না? এবার মায়া হল তার। খেলা করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। কোনও খেলাই নয়। বেচারা! ক্ষমতা নেই, অথচ দেখে মনে হচ্ছে, খেলার খুব ইচ্ছে। কী ভীষণ ওর কষ্ট হয়, যখন অন্যদের খেলতে দেখে! আর-একটা টেনিস বল কোর্ট থেকে বেরিয়ে এল সোজা তার দিকেই। আনন্দ একটু ঝুঁকে ফিল্ড করতে পারত, করল না। বলটা বেঞ্চের তলায় গিয়ে পর্দায় লাগল।

অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে অপেক্ষা করছে আনন্দ। ছুটে আসুক। বলটা কুড়িয়ে ছুড়ে দিক কোর্টে।

আসছে না। তাকাল সে। বাম উরুতে হাত রেখে কোমরটা বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে। চোখাচোখি হল। আনন্দর মনে হল ও যেন চোখ দিয়ে জিজ্ঞেস করছে: তুমি নিজে ছুড়ে দেবে? যদি না দাও, তাহলে আমি ছুড়ব। দেবে ছুড়তে?

আনন্দ মাথা হেলাল।

চোখ দুটি উজ্জ্বল করে তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে ও হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। আনন্দ লাফিয়ে উঠে ছুটে গিয়ে ওকে মাটি থেকে তুলল। কী হালকা, জিরজিরে শরীর। লজ্জা ঢাকতে আনন্দর মুঠো থেকে বাহু দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে, লাগেনি, আমার লাগেনি বলতে বলতে তাড়াতাড়ি বলটা কুড়োবার জন্য এগিয়ে গেল।

আন্দ, তুই এখানে! যা ভেবেছি। বাড়ি যাবি না কি?।

আনন্দ টেনিস ক্লাবের গেটের দিকে হাত তুলে বন্ধুদের অপেক্ষা করতে বলে, কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করল, তোমার কি খুব খেলতে ইচ্ছে করে?

ও প্রথমে না শোনার ভান করল। আনন্দ আবার জিজ্ঞাসা করতে চাপা ঝাঁঝ নিয়ে বলল, আমি খেলি।

মুখটা এত কঠিন করে ও কোর্টের দিকে তাকিয়ে থাকল যে, আনন্দ ভরসা পেল না জিজ্ঞাসা করতে, কী খেলা খেলো? অভিজ্ঞ পোড়-খাওয়া বয়স্ক লোকের মতো এখন ওর মুখটাকে দেখাচ্ছে। আনন্দর মনে হল, ও অনেক কিছু জানে বোঝে ভাবে।

.

নেতাজি পার্ক থেকে বাড়ি হেঁটে কুড়ি মিনিটের পথ। ফেরার পথে আনন্দ বন্ধুদের জানাল, টেনিস সার্ভিস এবং ফাস্ট বোলিং ব্যাপার দুটো একই জিনিস। শুধু তাই নয়, সেটা বোঝাবার জন্য হাতের কিটব্যাগটা নামিয়ে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। একটা ঢিল কুড়িয়ে খানিকটা ছুটে ডেলিভারি দিল।

এবার সার্ভিসটা দেখা।

আনন্দর মনে হচ্ছে, আবার শরীরটাকে ঝাঁকিয়ে ধকল দিলে আবার সে শ্বাসকষ্টে পড়বে। বন্ধুরা কৌতূহলে তাকিয়ে। আনন্দ ভাবল, একটা সার্ভিস তো। কতটুকুই বা কষ্ট হবে।

আনন্দ সার্ভিস করল কাল্পনিক র্যাকেট ও বল নিয়ে। বন্ধুরা গভীরভাবে লক্ষ করল। একজন বলল, তফাত আছে। একটা ছুটে এসে ডেলিভারি, অন্যটা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে।

তা হলেও, আনন্দ তর্ক শুরু করল। মূল ব্যাপারটা একই। বল ডেলিভারি আর সার্ভিসের একটা সময়ে শরীরের সবকিছু একই নিয়মে চলে।

মোটেই না। কোন সময়টায় এক হয়?

আনন্দ সেটা বোঝাবার জন্য পরপর বার তিনেক বল করার ও সার্ভিস করার মহড়া দিয়ে হাঁফাতে লাগল।

দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে একজন বলল, অনেকটা মিল অবশ্য আছে বটে।

আর একজন কিছুটা হালকা বিদ্রুপ নিয়ে বলল, বিজয় অমৃতরাজের সার্ভিস তো দারুণ, ওকেই তাহলে ফাস্ট বোলার করে নিলে কেমন হয়?

টেনিসে নাকি বলে স্পিন টিন করানো হয়, সত্যি নাকি রে আন্দ?… কী হয়েছে।

রে তোর, নেটেও দেখলুম হাঁপাচ্ছিস!

কিছু না, মাসলে কেমন একটা টান ধরছে বল করলেই। একটু আস্তে হাঁট।

আনন্দ বলতে পারল না, মাসলে টান ধরাটা বাজে কথা। শুধু জ্বর হয়েছে বললে ওরা ভাববে ছেলেটা ননীর পুতুল। বরং মাসল পুল শব্দটার মধ্যে যেন গায়ের জোরের ব্যাপারটা রয়েছে। কিন্তু ফাস্ট বোলারদের কি বুকের মাসল পুল করে? কাগজে তো লিলি বা রবার্টসের উরুর পেশিতে টান ধরার কথাই শুধু লেখে! ওদের কি এমন হাঁপ ধরার মতো ব্যাপার হয় না? ওদের ফুসফুস কি কখনও গোলমাল করে না? করলে, টানা দশ বারো ওভার বল করতে পারত না। তা হলে আমার ফুসফুসটাই কি বিগড়েছে?

মনে হওয়া মাত্র চুল থেকে একটা তরাস আনন্দর পায়ের আঙুল পর্যন্ত নেমে গেল। তা হলে বিপজ্জনক কিছু কি একটা আমার হবে? কিংবা হয়তো হয়েছে। সে ঘাবড়ে গিয়ে চারপাশে একবার তাকাল। প্রতিদিনের মতোই লোকেরা হাঁটছে, বাস মোটর রিকশা চলেছে, শব্দ হচ্ছে, অন্য দিনের থেকে কোনও পার্থক্য নেই। কিন্তু এখন তার চোখে পড়ল তিন তলার পাঁচিল থেকে একটি বাচ্চা মেয়ে প্রায় কোমর পর্যন্ত শরীরটা বার করে ঝুঁকে আছে, রাস্তার কল থেকে অযথা জল পড়ে যাচ্ছে, রেস্টুরেন্ট থেকে ওমলেট ভাজার গন্ধ নাকে এল, রেডিয়োতে কেউ আবৃত্তি করছে। কবিতা। হঠাৎ যেন তার চারপাশের পৃথিবী তাকে স্পর্শ করতে শুরু করল। আনন্দ আশ্বস্ত হয়ে নিজেকে বলল, নাহ্, কিছু হয়নি।

.

০২.

হাতির চারটে পা জড়ো করলে যতটা ঘের হয়, এমন মোটা এক একটা থাম। এইরকম চারটে থাম আনন্দদের বাড়ির ফটকে। তার পাশে দুটো পাম গাছ। বাড়ির মতো ওদেরও বয়স একশো বছরের উপর। আনন্দর বাবা অনাদিপ্রসাদ কথায় কথায় একদিন, তাঁর কাছে শিক্ষানবীশ সদ্য ওকালতি পাশ দেবব্রতকে বলছিলেন, কলকাতার এই দিকের ওয়ান-থার্ড জমি ছিল বাঁড়ুজ্যেদের। সিপাই-মিউটিনির আগের কথা। তখন রামমোহন, দেবেন ঠাকুরদের আমল। দত্তরা তখন কোথায় হে, সব জমিজমা ছিল আমাদের। এই শিবা দত্তর ঠাকুদ্দা এইটিন সেভেনটি সিক্সে, আমাদের কাছ থেকেই পাঁচ বিঘে জমি পেয়ে বসত করে। সে এক মজার ব্যাপার।

চোরবাগানের ঘোষেদের বেড়ালের সঙ্গে আমাদের বেড়ালের বিয়ে; আমার ঠাকুদ্দার মা বিয়ের দিন সকালে বায়না ধরল বরযাত্রী যাবে একশো বেড়াল। নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে তিনি শয্যা নিলেন। রইরই পড়ে গেল—বেড়াল চাই, একবেলার মধ্যে একশো বেড়াল। বীরা দত্তর তেজারতি কারবার, কী একটা কাজে এসেছিল। বলল, আমি জোগাড় করে দেব, তবে বেড়ালপিছু এককাঠা জমি। করে। দিল জোগাড়। সেই দত্তদের এখন অবস্থা দেখো। কপাল, কপাল। বীরা দত্তর ছেলে হীরা দত্ত কলকাতায় এগারোটা বাড়ির মালিক হয়। পরে এ বাড়িতে আর থাকত না। পালোয়ান ছিল। ক্ষ্যাপা মোষের শিং ধরে মাটিতে ফেলে দিতে আমিই দেখেছি ছোটবেলায়। এই যে সামনের ছোট মাঠটা, শিবা দত্তর কারখানার পিছনে হে, যেটায় লরি রাখে, ড্রাম ট্রাম পড়ে থাকে, ওটা তো এখানকার ছেলেদের খেলার জন্য দান করে গেছে হীরা দত্ত। পুরো জমিটা দশ কাঠার। বটতলা ইন্সটিটুট, লাইব্রেরি, একসারসাইজ ক্লাব সবই তো ওরই করে দেওয়া।

অনাদিপ্রসাদের গল্প বলা বন্ধ হয় আনন্দর দিকে চোখ পড়তে। জিরান্ডিয়াল আর সিম্পল ইনফিনিটিভের মধ্যে তফাতটা দেবব্রতর কাছে বুঝে নেবার জন্য গ্রামার হাতে আনন্দ দাঁড়িয়ে। এতক্ষণ সে অবাক হয়ে শুনছিল। সাধারণত সারাদিনে তার বাবা দু-চারটের বেশি কথা তার সঙ্গে বলেন না, মেজদা অরুণের সঙ্গেও নয়। সাংসারিক যাবতীয় কথা হয় হাবুর মা আর বিপিনের সঙ্গে। হাবুর মা ছাব্বিশ বছর এ বাড়ির রান্নাঘরের দায়িত্বে, চোখে কম দেখে; বিপিনকে একত্রিশ বছর আগে নিযুক্ত করেছিলেন আনন্দর ঠাকুর্দা। জুতো না পরে বাড়ির বাইরে যায় না। হুকুম দেবার তালিকায় এ বাড়িতে তার স্থান দ্বিতীয়।

আনন্দকে প্রায়শই পড়া বুঝে নিতে সাহায্যপ্রার্থী হতে হয় দেবব্রত অর্থাৎ দেবুদার। অনাদিপ্রসাদ প্রাইভেট টিউটর রাখার ঘোরতর বিরোধী। তাঁর ধারণা, ফাঁকিবাজ ছাত্রদের জন্যই বাড়িতে মাস্টার দরকার এবং তাই সেটা বাজে খরচ। আসলে অনাদিপ্রসাদ একটু কঞ্জুস, দেবব্রতকে দিয়ে পড়ানোর কাজটা করিয়ে নেবার জন্যই এই অজুহাত। দেবব্রত পাশের পাড়ার ছেলে, একটু ঘুমকাতুরে। আনন্দর বড়দা অমলের সঙ্গে স্কুলে এক ক্লাসে পড়ত। অমল যায় ডাক্তারিতে, দেবু ওকালতিতে। ছোট্টখাট্ট রোগা শরীর। চশমার দুটো কাচের পাওয়ার মাইনাস এইট এবং টেন। খুঁতখুঁতে এবং মানুষের সঙ্গে মিশতে অনিচ্ছুক। যেখানে সেখানে, যখন তখন ঘুমিয়ে পড়ে। ওকালতি খুব একটা তার ভাল লাগে না। ভাল লাগে ঘুমোতে, ডিটেকটিভ বই পড়তে। ভীষণ ভক্ত ডিটেকটিভ মেইগ্রের।

মেইগ্রের মতোই, দেবু সব ব্যাপার একটু তলিয়ে বুঝতে চায়। সত্যসন্ধানী হওয়া উচিত মানুষ মাত্রেরই, দেবু প্রায়ই বলে। যা কিছু ঘটছে বা ঘটবে তার পিছনে কারণ থাকবেই। সেটাই হল সত্য। সেটা খুঁজে বার না করলে শুধু আইন টাইন দিয়ে সমাধান হয় না। আনন্দ বলেছিল, তা হলে একটা সমস্যার সমাধান করে দিন দেখি—আপনি যেখানে সেখানে কেন ঘুমিয়ে পড়েন? দেবু থতমত হয়ে তারপর বলেছিল, ঠিক আছে, রিসার্চ করে তোকে জানিয়ে দোব। চার দিন পরই দেবু একটা কাগজে তার গবেষণার ফল লিখে এনে আনন্দকে পড়ে শোনায়—ভাতই হল মূল কারণ। তারপরই চিনি দিয়ে তৈরি খাদ্য, আলু প্রভৃতি যাবতীয় কার্বোহাইড্রেট। মানুষের অন্ত্রনালিতে এগুলো গেঁজে উঠে ইথেনল তৈরি করে। এই জিনিসটার কেমিক্যাল নাম ইথেইল অ্যালকহল। বেশি পরিমাণে ভাত, মিষ্টি ইত্যাদি খেলে অন্ত্রে বেশি পরিমাণ ইথেনল তৈরি হয় যার ফলে শরীর ভার লাগে, চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে। তারপর দেবু বলে, এই ভাত খাওয়ার জন্যই বাঙালিরা কুঁড়ে। বুঝলি আনন্দ, আমি আজ থেকে ভাত খাওয়া ছেড়ে দিলুম। দুবেলা রুটি খাব। আনন্দ খোঁজ নিয়ে জেনেছিল, তিন দিন পর্যন্ত সে ভাতের বদলে রুটি খেয়ে থেকেছিল। দেবুর আর এক অভ্যাস মাঝে মাঝে বলে ওঠা, আঃ, যদি লটারির একটা ফাস্ট প্রাইজ পেয়ে যাই!

মাস দুয়েক হল দেবু আর তাদের বাড়িতে আসে না। তার কারণটা এইরকম— কোর্টে সওয়াল করতে করতে অনাদিপ্রসাদ হাত বাড়ালেন দেবব্রতর দিকে। টেবলে লাল মলাটের বাঁধানো তিনখানা একই আকারের হৃষ্টপুষ্ট বই দেবব্রতর সামনে। হাত বাড়ালেই সে জানে পরের পর কোন বই অনাদিপ্রসাদের হাতে গছিয়ে দিতে হবে। দুরাত্রি জেগে তিনি বার করেছেন, ছত্রিশ বছর আগে মাদ্রাজ হাইকোর্টে ঠিক এইরকম মামলায় যে রায়টি দেওয়া হয়েছিল। বইয়ের সেই পাতায় ফ্ল্যাপ দেওয়া আছে। মামলায় সেই পুরনো রায়টা তাঁর পাশুপত অস্ত্র।

হাত বাড়িয়েও বইটা হাতে না আসায় অনাদিপ্রসাদ তাকালেন, এবং দেখলেন, দেবব্রতর চোখ বন্ধ, চিবুক নেমে এসেছে বুকের কাছে। চাপা গর্জন হল একটা। ধড়মড়িয়ে উঠে দেবব্রত চোখ খুলে দেখল প্রসারিত একটি হাত এবং তখনি টেবিল থেকে একটা লাল বই তুলে হাতে ধরিয়ে দিল।

নাটকীয় ভঙ্গিতে ফ্ল্যাপ দেওয়া পাতাটি খুলে পড়তে গিয়ে অনাদিপ্রসাদের ভ্র কুঞ্চিত হল। এটা পরের মামলার জন্য দরকার। তিনি আবার হাত বাড়ালেন। দেবব্রত ব্যস্ত হয়ে আর একটা লাল বই দিল। হ্যাঁ, এইটাই, কিন্তু হায়, বইয়ে যে ফ্ল্যাপের টিকিও দেখা যাচ্ছে না। কীভাবে এখনি বার করবেন রায়টা! অনাদিপ্রসাদ ফ্যালফ্যাল চোখে জজের দিকে আর জ্বলন্ত চোখে দেবব্রতর দিকে তাকান। মাথা চুলকে দেবব্রত বলল, ফ্ল্যাপ তো স্যার দেওয়াই ছিল! কোথাও পড়ে উড়ে গেছে বোধহয়, আমি খুঁজে দেখছি।

ফ্ল্যাপ খুঁজতে, কোর্ট রুম থেকে দেবব্রত দুমাস আগে সেই যে দ্রুতবেগে বেরিয়েছিল তারপর আজও প্রত্যাবর্তন ঘটেনি। আনন্দের বাড়ির ত্রিসীমানায় সে আর আসে না। কিছু বুঝে নেবার দরকার হলে আনন্দই যায় ওর বাড়িতে।

এখন নেতাজি পার্ক থেকে ফেরার পথে তার দেখা হল দেবব্রতর সঙ্গে। কালো কোট, সাদা টাউজার্স এবং হাতে একটা পেপারব্যাক ডিটেকটিভ বই। কোর্ট থেকে ফিরছে।

দারুণ মুশকিলে পড়ে গেছে রে মেইগ্রে।

দেবুদা বইটা মাথার উপর তুলে নাড়তে লাগল। খুনি ওকে অফিসে ফোন করেছে, চিঠিও লিখেছে।

মুশকিলটা কোথায়!

খুনিটা মানসিক রোগে ভুগছে। বুঝলি না, এসব ক্ষেত্রে হয়তো আত্মহত্যা করে ফেলতে পারে।

যদি করেই, তাতে ক্ষতিটা কী? ধরা পড়লে তো ফাঁসিই হবে!

আহহা, বুঝছিস না। যদি আত্মহত্যা করে বসে, তা হলে তো কেউই জানতে পারবে না যে খুনিটাই মরেছে। প্যারিসে অমন কত লোকই তো রোজ মরছে। সুতরাং ওকে হাতেনাতে ধরতেই হবে। পাবলিককে দেখাতে হবে খুনি ধরা পড়েছে, নয়তো তারা নিশ্চিন্ত হবে কী করে? এদিকে মেইগ্রেকে দুদিন মাত্র সময় দিয়েছে ম্যাজিস্ট্রেট।

কীসের সময়?

খুনিদের একটা সায়কোলজি আছে। দেবুদা এধার-ওধার তাকাল, চল, হাঁটতে হাঁটতে বলছি। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে খুন নিয়ে আলোচনা করাটা ঠিক নয়। ভাল উকিল হতে হলে ডিটেকটিভের বুদ্ধি রাখতে হয়। তোর বাবা তো এসব বোঝেন না। শিবা দত্তর উকিল হয়ে সারাজীবন শুধু ভাড়াটেদের সঙ্গেই মামলা করে গেল। ব্রেইন…মেইগ্রের মতো ব্রেইন চাই উকিল হতে হলে।

কী যেন সায়কোলজির কথা বলছিলেন?

সায়কোলজি এমন ব্যাপার যা বই আর থিওরি দিয়ে বোঝা যায় না। জ্ঞান হয় বটে, কিন্তু ভাল স্কুলমাস্টার কি ঔপন্যাসিক কি একজন ডিটেকটিভ যতটা ভালভাবে মানুষকে বোঝে তেমন ভাবে বুঝতে পারা চাই।

উকিলদেরও তো তা হলে…।

নিশ্চয়, নিশ্চয়। দেবু হঠাৎ চুপ করে গেল একজন পথিককে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে দেখে। একটু দ্রুত হেঁটে এগিয়ে গিয়ে বলল, তোর বাবার জুনিয়ার হয়ে থাকলে কোনও অভিজ্ঞতাই হবে না।

বাবা তো খুনের কেস করে না।

সেই জন্যই তো ছেড়েছি তোর বাবাকে।

কী যেন সায়কোলজি সম্পর্কে বলছিলেন?

খুনিদের মনস্তত্ত্ব! যেখানে খুন হবে সেখানে ওরা আসবেই। যাকে খুন করেছে। তার ফিউনারালে নিশ্চয় যাবে এটা ধরে নিয়ে মেইগ্রে এক ফটোগ্রাফারকে বলল। সেখানে উপস্থিত যাবতীয় লোকের এলোপাথাড়ি ছবি তুলে যাও। যদি একটা লোককে বেশির ভাগ ছবিতে পাওয়া যায় তা হলে তার পিছনে লোক লাগাবে। পাওয়া গেল একটা মুখ। কিন্তু অতবড় শহরে ওই মুখের লোকটাকে কী করে খুঁজে বার করা যায়!

কাগজে ছাপিয়ে দিক। কেউ না কেউ চিনে ফেলে পুলিশকে জানিয়ে দেবে।

তুই যে ম্যাজিস্ট্রেটের মতোই কথা বললি। সে তো মেইগ্রেকে দুদিন সময় দিয়েছে। খুনিকে হয় এর মধ্যে ধরে দাও, নয়তো ওই মুখটা কাগজে ছাপাতে পাঠাব। মেইগ্রে পড়েছে মুশকিলে। তার দৃঢ় ধারণা কাগজে নিজের ছবি দেখলেই খুনি নির্ঘাত আত্মহত্যা করে বসবে।

তা হলে? মেইগ্রে কী করল?

 জানব কী করে, ট্রামে যা ভিড়, বইটা খোলার একটু চান্স পর্যন্ত পেলুম না।

দেবুদার হাঁটার গতি হঠাৎ বেড়ে গেল। আনন্দকে ফেলে রেখেই সে হনহনিয়ে তার বাড়ির পথ ধরল বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে। মেইগ্রে কীভাবে মুশকিল থেকে বেরিয়ে এল সেটা তাড়াতাড়ি জানা যাবে, তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছে বইটা শেষ করতে পারলে।

বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে আনন্দ। বীরা দত্ত রোড শেষ হয়েছে যেখানে, তার পুবে দত্তদের রাধাগোবিন্দ মন্দির। পশ্চিমে বটতলা ইনস্টিটিউটের একতলা বাড়ি আর খেলার মাঠ। মাঠের তিনদিকে—আনন্দদের বাড়ি, শিবা দত্তর কারখানার। পিছন দিক এবং মহিম ব্যানার্জি লেন। কতকগুলো জীর্ণ একতলা কোঠাবাড়ি এবং টিনের চালার বাড়ি নিয়ে মহিম বাঁড়ুজ্যের গলিতে বটতলা নামে একটা পাড়া আছে। সন্ধে নামছে! আর মিনিট পনেরোর মধ্যেই রাস্তার আলো জ্বালতে হুক লাগানো লাঠি হাতে করপোরেশনের লোক সুইচ টিপে টিপে চলে যাবে বীরা দত্ত রোড দিয়ে। রাধাগোবিন্দ মন্দিরে কাঁসর-ঘণ্টা বেজে উঠবে। ইনস্টিটিউটের লাইব্রেরি খুলবে ডগুদা। কারখানা গেটের পাশে দয়ানিধির চায়ের দোকানের বেঞ্চে একটা-দুটো লোক হয়তো দেখা যাবে—ওভারটাইমের লোক।

মন্দিরের বাগান থেকে হাসনুহানার গন্ধটা আনন্দর ভাল লাগল। ভিতরে এল সে। ব্যাডমিন্টন কোর্টের আকারের শ্বেত পাথরের ঠাকুরদালান। শঙ্খের কাজ করা খিলেন ও থাম, টানা পাঁচ সারি কালো পাথরের সিঁড়ি, ঝাড়বাতি। হাতে কিটব্যাগ, পায়ে চটি, তাই সিঁড়ির থেকে তফাতে দাঁড়িয়ে আনন্দ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল বিগ্রহের দিকে। বুকের ব্যথাটা এখন বোধ হচ্ছে না। ফুলের মিষ্টি গন্ধ বুকভরে টানল। শ্বাসকষ্ট হল না। ঠাকুর দালানটার পুব দিক উন্মুক্ত। সকালের রোদে শ্বেত পাথর ঠিকরে ওঠে। বিকেলে জল দিয়ে ধোয়ার পর শীতল হয়ে যায়। আনন্দর ইচ্ছা হল খালি গায়ে শুয়ে পড়তে। চটি খুলে সে ঠাকুরদালানে উঠে এসে বসল। আর তখুনি মনে পড়ল মাকে।

 সন্ধ্যার শ্বেত পাথরের মতো ঠাণ্ডা ছিল মায়ের মেজাজ। প্রতি সন্ধ্যায় এসে আরতি না দেখলে ছটফট করত। ঠাকুরদালানে মা বসত চোখ বন্ধ করে, দুটি হাত কোলে রেখে, গলায় আঁচল, তার প্রান্তে চাবির থোকা। লালপাড় শাড়ির ঘোমটায় ঘেরা যেন। কুমোরের হাতে গড়া মুখ। আনন্দ একদৃষ্টে তখন মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকত। হঠাৎ চোখ খুলে মা তাকাত। তারপর মুচকি হেসে আবার চোখ বন্ধ করত। ফিসফিস করে আনন্দ এক দিন বলেছিল, চোখ বুজে থাক কেন?

চোখ বন্ধ করলে যে ভাল দেখা যায়।

কী দেখো?

আমার আনন্দকে।

চাপা বাষ্প বুক থেকে গলা পর্যন্ত উঠে আনন্দর দুটি চোখকে ভিজিয়ে দিল। ধীর পায়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে এল রাস্তায়। কয়েকটা লরি, রিকশা ছাড়া বীরা দত্ত রোড দিয়ে সন্ধ্যার পর কোনও যানবাহন যায় না। রাস্তাটা ফাঁকা। সামনে ইনস্টিটিউটের জীর্ণ পলেস্তরা খসা ঘরের জানলা দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে। ডগুদা এসে গেছে। খেলার মাঠে লরি দাঁড়িয়ে। তা থেকে লোহা নামাচ্ছে মজুররা। শিবা দত্তর কারখানায় তৈরি হয় সিলিং ফ্যান, সাইকেল, ওজন মেসিনের পার্টস এবং আরও কী সব যন্ত্রপাতি।

নিজেদের বাড়িটাকে প্রতিবারই দূর থেকে আনন্দের মনে হয় ছবিতে দেখা অতিকায় এক প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসোর। দোতলাটা অন্ধকার। মেজদা আসে দশটা-এগারোটায়। দালানের আলোটা জ্বললেও বাইরে থেকে বোঝা যায় না। সিং দরজা দিয়ে একচিলতে আলো বাইরে পড়েছে। বাবা এখন হয়তো চেম্বারে, বিপিনদা বলে সেরেস্তায় বসেছে। রাত্রে শোবার জন্য ছাড়া বাবাকে দোতলায় দেখা যায় না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই এবং কোর্ট থেকে ফিরেই একতলার ঘরে ঢুকে পড়ে।

ফটকের পর প্রায় দশ মিটার মাটির পথ। বাড়িটার তিনদিকে অনেকটা জমি। একমানুষ উঁচু পাঁচিলে সেটা ঘেরা। দেউড়ির দশ ফুট উঁচু সিং-দরজাটার ডান দিকে রেলিং দেওয়া অন্ধকার রক। আনন্দ পৌঁছল রকের প্রান্তে ছোট্ট একটা দরজায়। সেটা দিয়ে ঢুকেই বেলেপাথরের সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে দরজাটার পাশ দিয়ে। সিঁড়ির ঘুলঘুলি থেকে আনন্দ স্কেল দিয়ে মেপে দেখেছে দেয়ালটা ঠিক দু ফুট আট ইঞ্চি চওড়া।

সিঁড়িতেও আলো নেই। দোতলায় দালানের আলোটাই কাজ চালিয়ে দেয় যখন, তা হলে আর দরকার কী? অনাদিপ্রসাদের এই যুক্তিটার প্রতিবাদ করে মেজ ছেলে অরুণ বলেছিল, ইলেকট্রিক বিল আমিই দেব।

আমার মরার পর।

অরুণ আর কথা বলেনি। শুধু গজগজ করে আনন্দকে শুনিয়ে বলেছিল, মধ্যযুগীয়, ডিক্টেটরি, ফিউডাল মনোবৃত্তি। এই করেই সব সম্পত্তি গেছে। আমরা গরিব হয়েছি।

আনন্দ জানে, এই বিরাট প্রাচীন বাড়িটা তাদের বনেদিয়ানা জাহির করলেও, আসলে তারা মধ্যবিত্ত। বাবার ওকালতির রোজগারে সংসারটা মোটামুটি স্বচ্ছন্দে চলে যায়, এই পর্যন্তই। মেজদার এক টাকাও বাবা নেয় না। মেজদা স্কুটার কিনেছে।

সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় সে বুকে টান বোধ করল। দোতলায় পৌঁছে সে ভাবল, কী হল আমার! এটা কি ফুসফুসের অসুখ? তা হলে কি মার মতো মরে যাব! দেয়ালে সার দেওয়া অয়েল পেইনটিং। সবাই পূর্বপুরুষ। ছবিগুলোর ক্যানভাসের রঙ চটা; কালো হয়ে গেছে। কারুর মুখ কারুর হাত বোঝা যায় শুধু হলুদ রঙের জন্য। ছবির সোনালি ফ্রেমের খাঁজে খাঁজে ধুলো। নির্জন দালানের বিবর্ণ আলোয় মৃত মানুষগুলোকে দেখাচ্ছে যেন আর একবার মৃত্যুমুখীন। আনন্দর মনে হল, ওদের থেকেও সে এই মুহূর্তে বেশি নিঃসঙ্গ, বিপন্ন এবং ভীত। সারা বাড়িতে প্রাণের স্পন্দন। আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না।

মোটা মোটা দেয়াল, ছাদ ভেদ করে শব্দ যাতায়াত করে না এ বাড়িতে। স্যাঁতস্যাতে ঠাণ্ডা মেঝে, কোণে কোণে ভ্যাপসা গন্ধ। ছবির মানুষগুলোর কেউ খালি গায়ে মোটা পৈতে ঝুলিয়ে, কেউ জোব্বা গায়ে পাগড়ি পরে বছরের পর বছর গোমড়া মুখে, বসে বা দাঁড়িয়ে। আনন্দ করুণ চোখে ওদের সকলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে শোবার ঘরে এল।

দোতলায় শোবার ঘর দুটি। বাড়ির দুই-তৃতীয়াংশ, পিছন দিকের প্রায় সবটাই আনন্দর ঠাকুর্দা বিক্রি করে দিয়েছিলেন হীরা দত্তকে। সেই অংশটা এখন শিবা দত্তর কারখানার গুদাম। সামনের দিকটায় আনন্দরা থাকে। হলঘরের মতো লম্বা একটা ঘর, তার দুই প্রান্তে দেয়াল ঘেঁষে দুটি খাট। আনন্দ ও অরুণের। পাশের ঘরটা অপেক্ষাকৃত ছোট, অনাদিপ্রসাদ থাকেন। চার দেয়ালে চারটে দেয়াল-আলমারি এবং পাঁচ ফুট দীর্ঘ একটা আয়না ছাড়া ঘরের বাকি সবই আধুনিক।

আলো না জ্বেলে, আনন্দ শুয়ে থাকে খাটে। খিদে পাচ্ছে। অপেক্ষা করতে লাগল হাবুর মা-র জন্য। এই সময় সে দিয়ে যায় দুধ আর সেঁকা পাঁউরুটি। হয়তো জানে না আনন্দ ফিরেছে। স্নান করতে নীচে তো যেতেই হবে, তখন বরং খেয়ে নেবে।

ক্লান্ত আনন্দ কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙাল বিপিন। ঘরে আলো জ্বলছে। মেজদা বাইরের বারান্দায় ট্রানজিস্টারে বি বি সি-তে কান পেতে রিলে শুনছে।

ওঠো ওঠো, না খেয়ে শুয়ে কেন? দুবার ডাকতে এসে ঘুরে গেছি।

আনন্দ বিছানায় উঠে বসে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, বিপিনদা আমার বুকে কেমন একটা কষ্ট হয়। গাঁটে গাঁটে ব্যথা, শ্বাস নিতে পারি না ছোটাছুটি করলে।

হবে না? দিনরাত লাফানি ঝাঁপানি, চোট তো লাগবেই। মালিশ করে দোবখন। এখন খেতে চললো।

ঘরে ঢুকল অরুণ। বিব্রত থমথমে মুখ। ট্রানজিস্টারটা কানে চেপে ধরে খাটে বসল।

দুদিন বাকি, ম্যাচ বাঁচাতে পারবে?

 উত্তর পাবে এমন আশা আনন্দ করেনি তাই জবাব না পেয়েও সে আবার বলল, ছশো উনত্রিশ আর ভারতের তিনশো দুই, তার মানে দুশো সাতাশ রানে পিছিয়ে, ইনিংস ডিফিট না হয়।

অরুণ হাত তুলে ওকে চুপ করতে বলে আরও কুঁজো হয়ে চোখ মুখ কুঁচকে রেডিয়োটা কানে চেপে ধরল।

টু ফর নান ছিল, এখন কত?…গাভাসকর আছে তো?

আনন্দ উঠে এসে অরুণের গা ঘেঁষে বসল। ঘর্ঘর আজেবাজে শব্দের মধ্য দিয়ে একটা গলা উঠছে নামছে। সাহেবদের বলা ইংরেজি আনন্দ ঠিকমতো বুঝতে পারে না।

হানড্রেড ফরটি টু না টু হানড্রেড ফরটি টু ঠিক বুঝতে পারছি না। এত ডিসটার্বেন্স হয়।

আনন্দ কী একটা বলতে যাচ্ছিল, অরুণ হাত তুলে চুপ করতে বলে আবার বারান্দায় গেল। আনন্দ তোয়ালে নিয়ে ভাবল, স্নান করতে যাবে কি যাবে না। দেয়াল-ঘড়িতে রাত সাড়ে সাতটা। বারান্দায় অরুণ কুঁজো হয়ে, রেডিয়োর অ্যান্টেনাটা তার কান ঘেঁষে থরথরিয়ে কাঁপছে লাউডগার মতো।

স্নান করে, খেয়ে, উপরে এসে দেখল অরুণ খাটে দুহাতে চোখ ঢেকে শুয়ে আনন্দর পায়ের শব্দে তাকাল। আনন্দ স্কোর জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল, তার আগেই অরুণ বলে উঠল, শ্যেম, শ্যেম। ওনলি ফরটি টু—বিশ্বাস করতে পারা যাচ্ছে না, মাত্র বিয়াল্লিশ!

অল আউট বিয়াল্লিশে! আনন্দও বিশ্বাস করতে পারছে না।

মাত্র সতেরো ওভারে, পঁচাত্তর মিনিটে ইনিংস খতম! কী লজ্জা!

আনন্দর মনে হল, তার বুকের মধ্যে একটা ব্যস্ততা ভীষণ উত্তেজনায় ছটফট করছে। ধড়ফড় করছে একটা কিছু। ধীরে ধীরে সে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

একজনও পেস খেলতে পারে না। পারবে কী করে, খেলেছে কখনও? দেশে কি ফাস্ট বোলার আছে?

আনন্দ মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। মেজদাটা আপনমনেই গজগজ করে যাচ্ছে। চোখ বুজল সে। সারা গায়ে যেন বেদনা চারিয়ে পড়ছে। হাঁটু কনুই কজি টনটন করছে। কপালে হাত রাখল। বোধহয় জ্বর আসবে।

এত বছর ধরে শুধু কথা আর কথা। তৈরি করা উচিত, তৈরি করতে হবে, অথচ কাজের কাজ কিন্তু একদমই হল না। এতবড় একটা দেশে কেউ জোর বল করতে পারে না, জোর বলে ব্যাট করতে পারে না! কী এমন বোলার ইংল্যান্ডের! আর্নল্ড আর ওল্ড। এই সেদিনই তো ওদের খেলল এখানে আমাদের এই ব্যাটসম্যানরাই, সিরিজও জিতল আর চার-পাঁচ মাসের মধ্যেই এই অধঃপতন, বিয়াল্লিশ! ছি ছি ছি।

আনন্দর চোখ ভারী হয়ে জড়িয়ে আসছে। রেডিয়োর ঘরঘর শব্দ যেন সে শুনতে পাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষের চিৎকার আর উচ্ছাস একসঙ্গে জট পাকিয়ে যাওয়ার মতো শব্দটা। আনন্দর মনে হচ্ছে, তাকে ঘিরেই পাক দিচ্ছে বিরাট এই উচ্ছ্বাস। এখন আর সে শোবার ঘরের বিছানায় নয়, লর্ডসে। ইংল্যান্ড ব্যাট করছে। বল হাতে সে ছুটে যাচ্ছে প্যাভিলিয়নের দিক থেকে। চিৎকার উঠছে: ফরটি টু… ফরটি টু। রিভেজ, রিভেনজ। ছিটকে পড়ল অ্যামিসের অফ স্টাম্প প্রথম বলেই। পরের বলে এডরিচের মিডল স্টাম্প। দুটো বলই অফ স্টাম্পের বাইরে পড়ে ছিটকে ঢুকে এসেছে। ডেভিড লয়েড ইয়র্কড হল তৃতীয় বলে। হ্যাটট্রিক! ইন্ডিয়ার নতুন ফাস্ট বোলারটি ক্ষেপে উঠেছে, ইংল্যান্ডকে চুরমার করতে তাণ্ডব শুরু করেছে বল নিয়ে। এরপর গ্রীগ, ফ্লেচার, ডেনেস, নট—আসছে আর যাচ্ছে। ইংল্যান্ড অল আউট ফরটি…না, থার্টি ফাইভ? ওয়ার্লড টেস্ট রেকর্ড নিউজিল্যান্ডের টোয়েন্টি সিক্স। তা হলে ইংল্যান্ডের টোয়েন্টি ফাইভ, পঁচিশ। নতুন রেকর্ড..রেকর্ড। লর্ডসে আগুন ছোটাব, আমি, ইন্ডিয়ার আনন্দ। সব লজ্জা অপমানের প্রতিশোধ নেব। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় সে বিড়বিড় করল। অরুণ শুনতে পেল না।

মেজদা, আমি ফাস্টবোলার হব। কাল থেকে দারুণ প্র্যাকটিস করব। শুধু এই বুকের কষ্টটার জন্যই যা…

সকালে ঘুম ভাঙার পর আনন্দ সর্বাঙ্গে বেদনা এবং জ্বর জ্বর বোধ করল। বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে হল না তার। উপুড় হয়ে বালিশে মুখ চেপে সে শুয়ে রইল।

খবরের কাগজের প্রথম পাঠক বাবা। সেটি বিপিনদা দোতলায় নিয়ে আসে সাড়ে সাতটায়। মেজদা কাগজটা পড়বে বিছানায় শুয়েই। তারপর পাবে আনন্দ। কাগজ পড়ার ইচ্ছা তার হচ্ছে না। মাথার মধ্যে যেন অনবরত বাম্পার চলেছে। চিড়িক দিয়ে লাফিয়ে উঠছে যন্ত্রণা। গাঁটে গাঁটে ব্যথা।

মেজদা, দ্যাখো তো আমার জ্বর হয়েছে কি না।

অরুণ মুখ ফিরিয়ে তাকাল। ভ্রূ কুঁচকে বলল, গা গরম লাগছে? মাথা ভার ভার?

হ্যাঁ, গায়েও ব্যথা।

 ইনফ্লুয়েঞ্জা।

অরুণ ওকে একগ্লাস জল ও একটা সাদা ট্যাবলেট দিয়ে, কপালে আঙুল ছুঁইয়ে বলল, এখন খুব হচ্ছে। চান করবি না, ভাত খাবি না, দুপুরে ঘুম, দেখবি সেরে গেছে। আর একটা ট্যাবলেট রেখে দিচ্ছি, দরকার বুঝলে খাবি।

ট্যাবলেট খেয়ে আনন্দ দুটো বালিশ মাথায় রেখে চিত হয়ে চোখ বন্ধ করল এবং ক্রমশ তার মনে হতে লাগল জ্বর কমছে, ব্যথাও কমছে। মাঝে মাঝে চোখ খুলে দেখতে লাগল জুলপি বাঁচিয়ে দাড়ি কামানোয় ব্যস্ত মেজদাকে। গত তিন মাসে তিন রকম জুলপি রেখেছে। প্রথমে ছিল বাজারের মাংসওলাদের দা-এর মতো যা দিয়ে টেংরির হাড় টুকরো করে। তারপর রেখেছিল নেপালিদের কুকরির মতো। এখন রয়েছে ক্রিকেট ব্যাটের মতো।

মেজদা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবার আসছে?

হু।

অ্যান্ডি রবার্টস আসবে?

সেফটি রেজার গাল থেকে তুলে অরুণ আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দুই জুলপির মাপ পরীক্ষা করতে করতে বলল, আসবে না আবার! না এলে উইকেটগুলো নেবে কে?

আমায় একদিন খেলা দেখাবে, যেদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফিল্ড করবে?

 দেখাব!

আমি শুধু অ্যান্ডির বোলিং দেখব।

কেন? কালিচরণ, রো, লয়েড—এদের ব্যাটিং?

 আমি ফাস্ট বোলারের অ্যাকশন দেখব। কখনও দেখিনি। তুমি দেখেছ?

দেখেছি, ওয়েস হল।

 লিন্ডওয়ালকে?

নাহ। তোয়ালে-সাবান হাতে একতলার কলঘরে যাবার জন্য অরুণ দরজার কাছে পৌঁছে ঘুরে দাঁড়াল, তুই নাকি জোরে বল করিস শুনলুম! আমাদের ক্লাবের শুভেন্দু দেখেছে নেতাজি পার্কে তোকে বল করতে। বলল, খুব পেস আর উইকেট থেকেও অনেকটা ওঠে নাকি!

আনন্দর কান দুটো গরম হয়ে গেল। লজ্জিত স্বরে বলল, জোরে বল না হাতি। এখনও এন্তার শর্ট পিচ পড়ে। স্টাম্পের সাত হাত বাইরে দিয়ে যায়।

প্রথম প্রথম ওইরকমই হয়। প্রাকটিস আর ধৈর্য—ওরেব্বাবা, আটটা বেজে গেছে!

অরুণ চলে যাবার পর আনন্দর মুখ হালকা হাসিতে ছেয়ে গেল। কত জোরে বল করি মেজদাটা জানে না। প্যান্ট চাইলে, বুট চাইলে কিনে দিয়েছে, কিন্তু একদিনও আমার খেলা দেখেনি। এবারে সামার ক্রিকেটের সেঞ্চুরিটার পর কাগজে এ ব্যানার্জি নামটা দেখে জিজ্ঞেস করেছিল, তুই নাকি? হ্যাঁ বলতে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছিল। ওই রকম অবাক আবার করে দেব যেদিন কাগজে দেখবে ইন্ডিয়া টিমে ওয়াড়েকর, এঞ্জিনিয়ার, তারপরই আনন্দ বানার্জি…। ওর চিন্তাটা একটু থমকে গেল। আমি যখন টেস্ট খেলব ততদিনে ওয়াড়েকর এঞ্জিনিয়াররা তো রিটায়ার করে যাবে! অন্তত সাত-আট বছর তো লাগবেই টেস্টম্যাচ পর্যন্ত পৌঁছতে। হয়তো তিন বছরেই এসে যেতে পারি। কিংবা এমন যদি হয়, এই বছরেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের এগেনস্টে! নেতাজি পার্কের ধার দিয়ে যাচ্ছিল পঙ্কজ রায়। নেট প্র্যাকটিস হচ্ছে দেখে, ক্রিকেটার তো, তাই মুখ ফিরিয়ে দেখতে দেখতে একটুখানি দাঁড়াল। তখন আমি বল করছি। তারপর আর চোখ ফেরাতে পারল না। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে দেখে এগিয়ে এসে আমাকে হয়তো জিজ্ঞাসা করবে, তোমার নাম কী? কোন স্কুলে পড়ো? একটা কাগজে লিখে নেবে যাতে ভুলে না যায়। তারপর একদিন হঠাৎ টেলিগ্রাম আসবে স্কুলে জয়েন টেস্ট ট্রায়াল ক্যাম্প ইমিডিয়েটলি। মাদ্রাজ কি বোম্বাই কি বাঙ্গালোর, কোথাও হবে ক্যাম্পটা। একটা ভাল স্যুটকেশ দরকার, তাছাড়া নিজস্ব ব্যাট প্যাড, গ্লাভস, ভাল বুট, দু-তিনজোড়া শার্ট-প্যান্টও চাই। আনন্দ আপন মনে হাসল। মেজদার অনেক টাকা খসবে। তাতে ওর আপত্তি হবে না! মেজদাটা ক্রিকেট পাগল।

খেলার মাঠে লরির শব্দ এবং মজুরদের চিৎকার শুনে আনন্দ জানলা দিকে তাকাল। মাঠটা যেন কারখানারই মাল ভোলা নামানোর জায়গা। খেলার মাঝেই লরি ঢুকে পড়ে। তখন খেলা বন্ধ করে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় থাকে না। আধঘণ্টা পর্যন্ত ছেলেদের দাঁড়াতে হয়েছে। তিন বছর আগে ফুটবল খেলার মধ্যে লরি ঢুকে পড়ায় ওরা কারখানার হেড দারোয়ানকে বলেছিল, তাড়াতাড়ি মাল খালাস করে লরি সরিয়ে দিতে। লোকটা তাচ্ছিল্যভরে জবাবে বলে, এ জমি তো দত্তবাবুদের। তাদের লরি যতক্ষণ খুশি দাঁড়িয়ে থাকবে। একটি ছেলে বলেছিল, এ মাঠ তো ক্লাবের জমি। তাই শুনে দারোয়ান বলে, ক্লাব তো উঠে গেছে। এ-জমি এখন শিবা দত্তবাবুর। বেশি কথা বললে, খেলা বন্ধ করে দেব।

ছেলেরা বুঝতে পারছিল না, ব্যাপারটা নিয়ে কার কাছে নালিশ জানাবে। পাড়ার ছেলেরা চাঁদা তুলে বল কিনে নিজেরাই মাঠে নেমে পড়েছে। তাদের কোনও ক্লাবও নেই। তবে অন্য দলের সঙ্গে ম্যাচ খেলার সময় নাম নেয় বটতলা ইনস্টিটিউট। কিন্তু ইনস্টিটিউটের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই। না থাকার কারণ, ফুটো ছাদের জীর্ণ একতলা বাড়ি, টিমটিমে একটা লাইব্রেরি, মরচেধরা আধভাঙা কিছু ডাম্বেল, মুগুর ইত্যাদি ছাড়া এখন ইনস্টিটিউটের কোনও অস্তিত্ব নেই। লাইব্রেরির কয়েকজন মেম্বার ছাড়া আর কোনও লোকের যাতায়াত নেই। বছর বারো আগে আনন্দর বড়দা অমলের উদ্যোগে রবীন্দ্র-জন্মােৎসবই ছিল শেষ অনুষ্ঠান। একটা কমিটি আছে। বহু বছর তার নির্বাচন হয়নি। কমিটির প্রেসিডেন্ট শিবা দত্ত, সম্পাদক অনাদিপ্রসাদ।

কিছু ছেলে আনন্দকে বলেছিল, চল তোর বাবাকে গিয়ে বলি। কয়েকজন বলে, আগে প্রেসিডেন্টের কাছে যাওয়াই উচিত। কিছুক্ষণ বিতর্কের পর স্থির হয়, সবার আগে ডগুদার কাছে যাওয়াই ভাল। বাড়ি ছিল না ডগুদা। পরদিন সকালে ওরা ডগুদার সঙ্গে দেখা করে। আনন্দ যেতে পারেনি।

কী কথা হয়েছিল শিবা দত্তর সঙ্গে, ডগুদা তা আর বলেনি। তাদের শুধু বলেছিল, বিকেলে লরি ঢুকবে না, মাঠের মধ্যে মাল রাখাও হবে না কথা দিয়েছে শিবা দত্ত। মুশকিল কী জানিস! এ মাঠটার তো কোনও বাপ-মা নেই। যদি নিয়মিত সারাবছর জমজমাট করে খেলার ব্যবস্থা হয়, লোকজন খেলা দেখতে আসে, তা হলে কি আর লরি ঢুকতে সাহস পাবে? তোরা তো দু-চারদিন ফুটবল কিংবা ক্রিকেট পিটিয়ে বন্ধ করে দিবি, বাকি সময় তো পোড়া জমি হয়েই থাকে মাঠটা।

কথাটা ঠিক। এই ছোট্ট জমিতে ছোটবেলাটা কাটিয়ে ছেলেরা বড় মাঠে চলে যায় বড় হওয়া মাত্র। আনন্দ ফুটবল খেলে না আর। ভাল লাগে না। টেনিস বলে ক্রিকেট খেলার স্তরও পেরিয়ে গেছে। বটতলার মাঠ থেকে গতবছরই সে নেতাজি পার্কে চলে এসেছে। মাঠে এখন যারা খেলে তাদের অনেকেই আনন্দর অচেনা। মাঠটাতে ঘাস নেই। বর্ষায় লরির চাকা যে গর্তগুলো করে, সেগুলো রোদে শুকিয়ে স্থায়ী হয়ে রয়েই যায়। যত্ন করার কেউ নেই। ডগুদার কথাটাই ঠিক, এ-মাঠের বাপ-মা নেই। আসলে, মাঠটার মা নেই।

ঘুমটা ভাঙল দুপুরে। সকাল থেকে সে কিছু খায়নি। প্রচণ্ড খিদে পেটের মধ্যে দাউদাউ করছে। হাবুর মা ঘরের দরজার বাইরে ঠাণ্ডা মেঝেয় ঘুমোচ্ছ। ওকে জাগিয়ে কিছু খেতে দেবার কথা বললেই বিপদ। জ্বর হয়েছে শোনার পরই বার্লি এনে দেবার জন্য বিপিনদাকে বার দুয়েক বলেছে। আনন্দ ধরেই নিল, তার জন্য বার্লি তৈরি হয়ে আছে। পা টিপে টিপে হাবুর মার পাশ দিয়ে সে নীচে রান্নাঘরে এল। রাত্রের খাবার রান্না করাই থাকে। লাউ-চিংড়ি, ঘন মুগের ডাল, বেগুন ভাজা আর পেঁপের চাটনি ঢাকা দেওয়া রয়েছে। রাত্রে শুধু রুটি তৈরি হবে। প্রত্যেকটি থেকে কিছু কিছু নিয়ে খেয়ে আনন্দ ঝরঝরে বোধ করল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সে রওনা হয়ে গেল নেতাজি পার্কের উদ্দেশে কিটব্যাগ হাতে।

.

০৩.

অ্যান্ডি, দেরি হল যে, বুকের ব্যথাটা কেমন?

ঠিক হয়ে গেছে। নেটের পিছনে মাটিতে বসে বুট পরতে পরতে আনন্দ বলল। কোচ কাছে এসে ঝুকে দাঁড়ালেন।

নতুন বল রেখেছি তোমার জন্য। জোরে করবে না। আগে বলের সুইং কন্ট্রোলে রেখে লেংথ আর ডাইরেকশনে মাস্টারি আনা, তারপর পেসের কথা ভাবা যাবে। ফাস্ট বোলিং মানেই শুধু জোরে বল করা নয়। চকচকে বলের সঙ্গে আঙুলের ভাব জমাও।

কোচ পকেট থেকে একটি বল বার করলেন। পাকা আপেলের রঙ। দেখেই লোভীর মতো চিকচিক করল আনন্দর চোখ।

কাউকে দিইনি এতক্ষণ। তরুণ ব্যাট করবে, টেকনিক ভাল, মাথাটা ঠাণ্ডা। ওকে মন দিয়ে বল করবে। মার খেলেও মাথা গরম করবে না। জোরে বল দেবার চেষ্টা করবে না। সুইংয়ে বিট করাই হবে তোমার উদ্দেশ্য।

আনন্দর ভয় ছিল, বুকের মধ্যে ধড়ফড়ানিটা হয়তো শুরু হবে। ইনসুইং গ্রিপে চার পাঁচ কদম ছুটে এসে পুরনো বলে কয়েকটা বল করল। শ্বাসকষ্ট হল না।

ঠিক আছে, নতুন বল আনন্দর হাতে তুলে দিয়ে কোচ চেঁচিয়ে বললেন, ডেনেস, হয়ে গেছে সময়, এবার টার্নার যাবে।

দেবেশ একটু মনঃক্ষুন্ন হয়েই বেরিয়ে এল। এইমাত্র সে পরপর তিনটে স্কোয়ারকাটে নেট ঝাঁকিয়েছে। তরুণ নেটে ঢুকে বিজ্ঞের মতো লেগ স্টাম্পের সামনে ব্যাট খাড়া করে ওয়ান লেগ গার্ড চাইল একজন বোলারের কাছে।

নতুন বল নিয়ে আনন্দ এই যে প্রথম বল করছে, তা নয়। কিন্তু তিন আঙুলে ধরে, হাত থেকে ছাড়ার সময় কান-ঘেঁষা হাতটাকে অনেক উঁচু থেকে চাবুক মারার মতো নামিয়ে আনা, তালুটাকে লেগ সাইডের দিকে ফিরিয়ে রাখা—এভাবে কোনওদিন বল করতে সে বাধ্য হয়নি। ভয়ে ভয়ে আস্তে বল করতে লাগল। মাথার মধ্যে আছে শুধু একটা কথা-লেংথ এবং শুধুই লেংথ।

দুটো বল ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ খেলে ও গোটাচারেক ছেড়ে দেবার পর তরুণ একটা ফুলটসকে অফ ড্রাইভ করল চমৎকার স্টাইলে। কান দুটো গরম হয়ে উঠল আনন্দর। বিড়বিড় করল: মাথা ঠাণ্ডা, অ্যান্ডি, মাথা ঠাণ্ডা রাখো। শ্বাস নিতে সামান্য অসুবিধে হচ্ছে। কিন্তু গ্রাহ্যে আনল না। এবার বলে একটু জোর আনল।

পিছিয়ে ব্যাকফুটে তরুণ গ্লান্স করল লেগ স্টাম্প থেকে। কোচ তারিফ জানিয়ে মাথা নাড়তেই আনন্দর মনের মধ্যে ঈর্ষা চুলকে উঠল। নেটে আরও তিনজন বল করছে। তাদের বল না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বলটা নেটের মধ্যে পড়ে রয়েছে। সে নেটের দিকে এগিয়ে এসে দাঁড়াল।

কী লাভলি, আলতো করে ঘুরিয়ে দিল দেখলি। নিখুঁত টাইমিং!

 তরুণের লেটকাটও দেখার মতো। সূক্ষ্ম মারগুলো ওর হাতে দারুণ খোলে। অফ স্টাম্পের বাইরে একবার বল পাক, দেখবি কী চমৎকার কাট করবে।

এই আন্দ, দে তো একটা অফ স্টাম্পের বাইরে একটু শর্ট পিচ।

 ওরা তরুণের বন্ধু। আনন্দ ছেলে দুটির দিকে ক্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, কেন?

তরুণের লেটকাট দেখব।

 দেখার আরও জিনিস আছে ব্যাটিং ছাড়াও।

ব্যাটের ঠোক্কর দিয়ে মেরে তরুণ বলগুলোকে বার করে দিচ্ছে নেটের ভিতর থেকে। নিজের বলটি কুড়িয়ে আনন্দ বলল, ফাস্ট বোলিংও দেখার মতো একটা জিনিস।

যেমন তুই এখন করছিস। এর থেকে মেয়েরাও তো জোরে বল করে।

ঝাঁ করে রক্ত ছুটে এল আনন্দর মাথায়। বটে! চোয়াল চেপে সে বোলিং মার্কে ফিরে এল। কোচ যা বলে বলুক, একটা বল অন্তত সুইং টুইং সিকেয় তুলে জোরে, ভীষণ জোরে দেবে।

বলটা এত জোরে আসবে এবং গুডলেংথ থেকে আচমকা লাফিয়ে উঠবে, তরুণ কল্পনা করেনি। ফরোয়ার্ড খেলতে গিয়ে থমকে যায় আর ব্যাট তুলে মুখ আড়াল করার আগেই বলটা কপাল ঘষড়ে নেটের উপর দিয়ে বেরিয়ে গেল।

আনন্দ তা দেখেনি। ডেলিভারি দিয়েই তার চোখ থেকে সব দৃশ্য মুছে অন্ধকার হয়ে যায়। ফুসফুসে সেই মুহূর্তে যেন একটা ছুরি গেঁথে গেল। ফলো-থুর সঙ্গেই সে বুক চেপে বসে পড়ে। তার সারা বুকটা থেকে যেন দৈত্যাকার একটা মুঠো এখন কচলে কচলে বাতাস বার করছে। যখন সে মুখ তুলল, তখন নেট থেকে তরুণকে ওরা ধরে বার করে আনছে। সাদা জামায় টপটপ রক্ত পড়ছে।

চোখ বন্ধ করল আনন্দ। একী হল? রক্ত কেন তরুণের মুখে? খুন করলাম নাকি, তরুণ কি মরে যাবে? কেঁপে উঠল ওর বুক। অতি ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে সে বোবাচোখে তাকিয়ে রইল তরুণকে ঘিরে ধরা জটলার দিকে। ফাস্ট-এইড বক্স দেখা যাচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে।

খুব বেঁচে গেছে। যদি সোজা মুখে লাগত তা হলে—

কপাল ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে বলেই আর কিছু হল না। বলটা গুড লেংথ থেকে লাফিয়ে উঠেছিল। বড় বাজে পিচ।

এই পিচে এত জোরে বল করতে দেওয়া উচিত হয়নি কোচের।

কোচ তো ওকে আস্তেই বল করতে বলেছিল, আমি নিজে শুনেছি।

কিছু হয়নি, সামান্যই কেটেছে। কোচ উবু হয়ে পিচ দেখছিলেন, এবার এগিয়ে এসে আনন্দর কাঁধে হাত রাখলেন। ফিকে হাসল আনন্দ।

পিচটা ভাল করে রোল করা নেই। এই সব পার্কে শুধু জল দিয়ে যা হোক করে রোলার টেনে কি পিচ তৈরি হয়? কত তরিবত, মেহনত, সময় লাগে পিচ তৈরিতে।

বলটা আমি জোরে দিয়েছিলাম।

আস্তে বলও কি লাফায় না? কোচ প্রায় ধমকে উঠলেন। তুমি কি ভেবেছ তোমার জন্যই তরুণের লেগেছে? মোটেই না। বোলারের কাজ বল করা, ব্যাটসম্যানের কাজ বলটা খেলা। খেলতে পারেনি ও। বল থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়াও খেলার একটা অংশ। ওর লাগার জন্য দায়ী তারাই যারা পিচ তৈরি করেছে। বলটা না লাফিয়ে গড়িয়েও তো যেতে পারত! তখনও কি তুমি এতটা দুঃখ পেতে? লেগেছে তো লেগেছে, খেলতে গেলে অমন একটু-আধটু লাগেই—তুমি মনখারাপ করছ কেন?

যদি মারাত্মক কিছু হয়?

হতে পারে। সব খেলাতেই ভয় আছে, ঝুঁকি আছে। তাই বলে কি পৃথিবীতে খেলা বন্ধ হয়ে গেছে? তবে এই ইনজুরিটা কোচিংয়ের ক্ষতি করল। মনে ভয় ঢুকে গেলে কী ব্যাপার?

ছেলেটি ইতস্তত করে বলল, প্র্যাকটিস কি আর হবে?

নিশ্চয় হবে। চলো, সবাই মিলে রোলারটা টেনে আনি। পিচটা রোল করে আবার শুরু হবে।

কোচ যাবার জন্য এগিয়েও ফিরে এলেন। ফাস্টবোলারের একমাত্র দুঃখ, স্টাম্প ওড়াতে না পারলে। এই দুঃখ যে দেবে তাকেই মেরে হটিয়ে দেবে ক্রিজ থেকে।

রোলারটা থাকে পার্কের এককোণে। কয়েকজন সেটা আনতে গেল। আনন্দ কিছুটা ভয় এবং সংকোচ নিয়ে এগিয়ে এল কপালে ব্যান্ডেজ বাঁধা তরুণের কাছে। কিছু বলার আগেই তরুণ ওর দিকে কটমটে চোখে তাকিয়ে বলল, নেক্সট টাইম, তোর ওই বলকে টেনিস ক্লাবের কোর্টে হুক করে পাঠাব।

শোনামাত্র আনন্দর মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। ওর ভয় হচ্ছিল, তরুণ হয়তো ভাববে, তার কপাল ইচ্ছে করেই ফাটিয়েছে। হয়তো চিরকাল একটা রাগ বিদ্বেষ মনে পুষে রাখবে। কিন্তু এখন সে বুঝল ভয় করার কিছু নেই। হুক করতে না পারার অক্ষমতায় তরুণ নিজের উপর ক্ষেপে গেছে। মাথা কাত করে কথাটা মেনে নিয়ে সে হাত বাড়িয়ে দিল তরুণের দিকে। এতক্ষণ যে অস্বস্তিটা তাকে কুরে খাচ্ছিল সেটা বন্ধ হল।

আমার কোনও দোষ নেই।

ঠিক আছে।

তারপর আনন্দ ছুটে গেল রোলার টানায় হাত লাগাতে। তরুণ তার উপর রাগ করেনি, এটা জানার পর, মন থেকে ভার নেমে গেছে। সে সর্বশক্তি রোলারে প্রয়োগ করেই বুঝল ভুল করেছে। বুকে চাপ পড়ে এমন কাজ কিছুতেই নয়। সে হাত নামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

একটি ছেলে বলল, হল কী তোর? আজ অনেকবার দেখেছি বল করার পর হাঁপানি রুগির মতো নিশ্বাস নিচ্ছিলি।

কদিন ধরেই বল করলে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়!

 ডাক্তার দেখা।

ছেলেটি চলে যাবার পর, আনন্দ বিষগ্ন বোধ করল। ডাক্তার দেখানোই উচিত। হয়তো এমন কোনও গোলমাল যেজন্য আমার আর খেলা উচিত নয়। নিশ্চয় কোনও অসুখ হয়েছে। মেজদা ছাড়া আর কাউকে বলা যাবে না ডাক্তার দেখাবার কথাটা। আনন্দ বার বার ভাবল এবং বিষণ্ণ হতে লাগল। হয়তো আর সে খেলতে পারবে না। ডাক্তার নিশ্চয় তাকে খেলা ছেড়ে দিতে বলবে। শ্বাসকষ্ট যখন, নিশ্চয় তা হলে ফুসফুস কিংবা হার্টের ব্যাপার। খেলা তো এই দুটো জিনিসের উপর ভর করেই। ফাস্ট বোলিং গায়ের জোর আর দম ছাড়া সম্ভব নয়। তা হলে কি আমি আর খেলতে পারব না? কিংবা হয়তো সেরে যাব কিছুদিন চিকিৎসার পর। কিংবা ডাক্তার যদি বলে, খেলতে পারো কিন্তু ছোটাছুটির খেলা নয়। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কোন খেলা আছে যাতে ছুটোছুটি করতে না হয়। লুডো, ক্যারম, তাস। ননসেন্স, তার থেকে মরে যাওয়াও ভাল। হ্যাঁ, মরে যাওয়া অনেক ভাল এই বুকের যন্ত্রণার থেকে।

আনন্দ বিষণ্ণ চোখে চারধারে তাকাল। সবাই কিছু না কিছু করছে। মানুষ চলছে রাস্তায়, গাড়ি চলছে রাস্তায়, মাঠে ফুটবল খেলছে কটা ছেলে, ক্রিকেট বল লোফালুফি করছে নেটের পাশে তিনজন। আকাশে উড়ছে চিল। কেউ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। চলছে, উড়ছে, নড়ছে। কেউ লক্ষ করল না কিটব্যাগ হাতে তার চলে যাওয়াটা। সবাই ব্যস্ত রোলার টানায়।

টেনিস ক্লাবের পাশ দিয়ে যাবার সময় আনন্দ সামান্য ইতস্তত করল। প্র্যাকটিস চলছে তিনটে কোর্টেই। আজ যেন ছেলেমেয়েদের সংখ্যাটা বেশি। ঢুকে পড়ল এবং বেঞ্চে বসল এক মহিলার পাশে। আনন্দর মনে হল, ওঁর ছেলে বা মেয়ে ট্রেনিংয়ে রয়েছে।

গতকাল আনন্দ যাকে কোচ ভেবেছিল, সেই লোকটি হলুদ বুশশার্ট ও কালো ট্রাউজার্স পরে ক্লাবের অফিসঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। এবার কোর্টের কাছে এল। আনন্দর পাশের মহিলাটিকে দেখে হেসে বলল, ভালই করছে, খুব তাড়াতাড়ি পিক-আপ করছে ফাইনার পয়েন্টগুলো। ইনটেলিজেন্ট গার্ল।

বাড়িতে তো দিনরাত শুধু বিলি, ইভন, মার্গারেট, ক্রিস এইসব নামই জপছে। কী করি বলুন তো?

করুক না।

ওর বাবা টেবল টেনিসের ভক্ত। এককালে খেলতেন তো। তিনি আবার ওয়াই-এম-সি-এতেও বুলুকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। বাপের সঙ্গে কী সব চিনে-জাপানি বলাবলি হয়, আমার আবার মনে থাকে না। কী যে করি, বুলুকে যে কোন খেলাটা ধরাব ভেবে পাচ্ছি না।

লোকটি হেসে কোর্টের ওধারে চলে গেল। আনন্দ বেঞ্চে হেলান দিয়ে ভাবল, এর মেয়ে নিজেই জানে না কী খেলা ভালবাসে। বাবা-মা জোর করে প্লেয়ার বানাচ্ছে। হয়তো মেয়েটার ইচ্ছে নাচ শেখার। সে পা ছড়িয়ে অলসভাবে তাকিয়ে দেখতে লাগল প্র্যাকটিস। একবার সে এদিক-ওদিক কাকে যেন খুঁজলও। মুচকি হাসি ঠোঁটে এসে মিলিয়ে গেল।

র‍্যাকেটের মাথাটাকে মনে করবে তোমারই হাতের অংশ—হাতটা যেন লম্বা হয়ে গেছে। যখন এটা অনুভব করবে, র্যাকেট কন্ট্রোল অনেক সহজ হয়ে আসবে।

আনন্দ একটু ঝুঁকে একাগ্র হয়ে লোকটির কথা শুনতে শুনতে ঘাড় নাড়ল। ঠিক। শরীর আর খেলার জিনিসটা এক করে ফেলতে হবে। মেজদা মাঝে মাঝে ক্রিকেট ব্যাটটা জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। কিন্তু লিগের খেলায় ওর স্কোর বাষট্টির বেশি ওঠেনি। কীসের যেন অভাব আছে মেজদার মধ্যে। পঞ্চাশ পেরোলেই নার্ভাস হয়ে যায়। অথচ সবাই বলে ওর টেকনিক নাকি সাউন্ড। শুধুই টেকনিক নয় আরও কিছু দরকার হয়। নার্ভ, সাহস।

স্ট্রোক তিনরকমের, সার্ভিস, গ্রাউন্ড স্ট্রোক আর ভলি। সব স্ট্রোকেই তিনটি জিনিস রয়েছে, বল মারার জন্য র্যাকেটটা শরীরের একধারে টেনে আনা, তারপর র্যাকেটটা সামনে চালানো, সবশেষে বল মারার পর বলের পথ ধরে শরীরের ঝোঁকে র্যাকেটটার এগিয়ে যাওয়া।

ঠিক ক্রিকেটের মতো, ব্যাকলিফট, মারের পর ফলো থ্রু।

চমকে পিছনে তাকাল আনন্দ। কুটি করল। ছ্যাঁত করে উঠেছিল বুকটা, কখন যে চুপিসাড়ে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। একটা পায়ের উপর ভর দিয়েই হাঁটা, অন্তত ঘষড়ানির শব্দও তো হবে! আশ্চর্য, কী নিঃশব্দ ভূতের মতো।

আনন্দ অস্ফুটে বলল, সব খেলাতেই তাই।

 ক্রিকেট, হকি, টেবল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, সব খেলাতেই এক নিয়ম।

আনন্দর ইচ্ছা হল বলে, তুমি কি সব খেলা খেলে দেখেছ? একটা পা-এর তো ওই অবস্থা।

কিন্তু কিছু না বলে যথেষ্ট রকমের তাচ্ছিল্য দেখাতে জ্ব তুলে সে মুখটা ফিরিয়ে নিল। বাঁ ধারের কোর্টে ফোরহ্যান্ডে বল পেটাপেটি শুরু হয়েছে বেসলাইন থেকে।

আমি অবশ্য খেলিনি, তবে লক্ষ করেছি।

মনের কথা বুঝে নিতে পারে দেখছি! কান দুটো একটু গরম হয়ে উঠল আনন্দর। ও যা ভেবেছে আমি তা ভাবিনি, এটা এখনি বুঝিয়ে দিতে হবে।

এসব বোঝার জন্য খেলার দরকার হয় নাকি?

খেললে আরও ভাল বোঝা যায়। তবে মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করালেও বোঝা যায়।

ওরে বাব্বা, এ যে দেখছি মন টন নিয়ে খেলার কথা বলে।

 আনন্দ মুখ ফিরিয়ে পিটপিট চোখে তাকাল ওর দিকে। সোজা তাকিয়ে আছে বেঞ্চের পিঠটা দুহাতে আঁকড়ে। আনন্দ আজ ভাল করে লক্ষ করল ওকে। চাহনিতে কোনও ভাব নেই। চাপা গাল দুটোর মাঝখানে খাড়া নাক, ডগাটা পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকা। ঈষৎ বাদামি চুল, মনে হয় মাস ছয়েক ছাঁটেনি, বছর দুয়েক তেল দেয়নি, দিন দশেক চিরুনি। কনুই থেকে শিরাগুলো কবজি পর্যন্ত রুগ্ন হাত দুটোকে বেঁধে রেখেছে।

ওর চোখে বিব্রত ভাব ফুটে উঠছে। আনন্দর মনে হল, ওকে এভাবে লক্ষ করাটা যেন পছন্দ করছে না। তাই সে ওর পায়ের দিকে তাকাল ইচ্ছে করেই।

পোলিওয়।

মুখ ঘুরিয়ে আনন্দ এবার অন্যদিক থেকে আসা কথায় কান দিল।

ফোরহ্যান্ডটাকে মনে করবে যেন এক বালতি জল ছুড়ছ। বাঁ হাতে হাতল ধরে ডান হাতটা বালতির নীচে। বাঁ পা আর বাঁ কাঁধটা এগিয়ে দিয়ে পাশে ঘুরে দাঁড়িয়ে বালতিটা পিছনে নিয়ে তারপর হুশ করে ছুড়ে দেবে। বালতিটা এগিয়ে যাবে শরীর। থেকে। ঠিক সেইভাবেই ফোরহ্যান্ড মারবে। বালতির তলার হাতটাই তোমার র্যাকেট-ধরা হাত।

কখনও ড্রাইভ করেছ? আনন্দ পালটা প্রশ্ন করল।

বইয়ে ছবি দেখেছি।

কার ছবি?

আর্ট অব ক্রিকেটে, ব্র্যাডম্যানের।

আনন্দ ঘুরে বসল। মেজদা গত বছর তার বন্ধুর কাছ থেকে বইটা দুদিনের জন্য চেয়ে এনেছিল। যতক্ষণ বাড়িতে থাকত বইটায় ডুবে যেত। অফিসেও নিয়ে যেত। আনন্দ একবার শুধু পাতা ওলটাবার সুযোগ পায় মেজদা যখন সকালে কলঘরে গেছল, তার মুশকিল ইংরেজি অক্ষরগুলোকে নিয়ে, অধিকাংশেরই মানে সে জানে না।

এই ল্যাংড়া ছেলেটা কোথা থেকে বইটা পেল?

তোমার বই?

কোর্ট থেকে একটা বল ছিটকে উড়ে আসছে আনন্দর পাশের মহিলাটির দিকে। উউ বাবারে বলে তিনি দুহাতে মুখ ঢাকলেন। আনন্দ এক হাতে টেনিস বলটা লুফে নিল। ছুড়ে ফিরিয়ে দিতে গিয়ে থমকাল। পিছনে তাকিয়ে হাসল। বলটা ওর দিকে এগিয়ে দিল।

ও হাসল। আনন্দর হাত থেকে বলটা নিয়ে ছুড়ে দিল কোর্টে।

 না, এখানে বসাটা ঠিক নয়।

ব্যস্ত হয়ে মহিলাটি ক্লাবঘরের সামনে পাতা চেয়ারে গিয়ে বসলেন। ওরা দুজনে একসঙ্গে হাসল।

ওর মেয়ে এখানে ট্রেনিংয়ে আছে, আবার টেবল টেনিসও শিখছে।

জানি। ওই তো ফোরহ্যান্ড মারছে, চশমাপরা।

সবাইকে চেনো?

অনেকের নাম জানি?

 বইটা তোমার?

ও ইতস্তত করে বলল, না, ঠিক আমার নয়, ডগুদা আমায় দিয়েছে। লাইব্রেরিতে উইয়ে ধরেছিল, বলেছে ফেরত না দিলেও চলবে। কেউ তো পড়ে না।

আনন্দ অবাক হয়ে গেল। বাড়ির সামনেই লাইব্রেরিটা, অথচ সে জানত না। আক্ষেপে মন ছেয়ে গেল, কেন মেম্বার হয়নি। মেজদা বলেছিল, যারা ক্রিকেট শিখতে চায়, বইটা তাদের গীতার মতো পড়া উচিত। আর সেই গীতাটাকে উইয়ে কেটে দিল লাইব্রেরির তাকে! একবার যদি কেউ বলত, তা হলে মেম্বার হয়ে যেত। লাইব্রেরিতে গিয়ে কোনওদিন সে ইংরেজি বইয়ের ক্যাটালগটাও যদি দেখত। মেজদাটাও কখনও লাইব্রেরির মেম্বার হয়নি। ওখানে নাকি মান্ধাতার আমলের বই আর মাসিক পত্রিকা ছাড়া কিছু নেই। অথচ আর্ট অফ ক্রিকেট ছিল। এরকম হয়তো আরও অনেক বই পড়ে আছে।

জিজ্ঞাসা করার জন্য মুখ ফিরিয়ে আনন্দ ওকে দেখতে পেল না। আসার মতোই নিঃসাড়ে চলে গেছে। গলা লম্বা করে আনন্দ চারধারে খুঁজল। কয়েক পা গেলেই পর্দার আড়ালে চলে যাওয়া যায়। ওকে দেখা গেল না। উঠে খুঁজতে ইচ্ছে হল না তার। একা বসে তাকিয়ে রইল কোর্টের দিকে। এবং ক্রমশ ভারবোধ করতে লাগল সারা দেহে। সামান্য ঝিমুনি আসছে।

আনন্দ নিজের কপালে হাত রাখল, বোধহয় আবার জ্বর আসছে। অনেকটা হেঁটে বাড়ি, কিছু পয়সা থাকলে রিকশায় যেত। মেজদাকে আজই বলতে হবে। ও হয়তো বাবাকে বলবে। জ্বর টর হলে বাবা বিরক্ত হয়। জ্বরের জন্য ডাক্তার দেখানো, ওষুধ কেনাটা বাজে খরচ মনে করে। মেজদা যেন বাবাকে না বলে। কিন্তু ডাক্তার যদি বলে, খেলা বন্ধ করতে হবে! যদি বলে তোমার দারুণ একটা অসুখ করেছে, খেলা একদম বন্ধ! চিরকালের মতো বন্ধ!

ভয়ে কেঁপে উঠল আনন্দর বুক। সন্ধ্যা নামছে। পার্কের গাছগুলোয় একটানা কিচিরমিচির করে চলেছে পাখিগুলো, আনন্দ ভেবে পায় না কী জন্য রোজ সন্ধ্যায় গাছে ফিরেই সবাই কথা বলে। এত কী কথা ওদের! সে নিজে একদম কথা বলে না বাড়ি ফিরে। কার সঙ্গেই বা বলবে। তরুণের কপাল ফেটেছে তার বলে, একথাটা বাড়িতে কাকে জানাবে? মেজদা তো আসবে অনেক রাতে।

যদি মা থাকত।

আকাশের গাঢ় কমলা রঙের অংশটার উপর একসার কালো ফুটকি ভেসে উঠে সন্ধ্যার ধূসরতার মধ্যে প্রবেশ করতে দেখল আনন্দ। ওরা পাখি। কোনও বিল বা দীঘির দিকে চলেছে। কিংবা ওরা হয়তো সাইবেরিয়া থেকে আসা এখন আবার ফিরে যাচ্ছে। হাজারেরও বেশি মাইল উড়ে যাবে। কী জোর ওদের ডানায়, ওদের হার্টে! অবসাদে ক্লান্ত লাগছে তার। এইবার তার নিজেকে একা মনে হচ্ছে। শীতকালের ভোরে ঘন কুয়াশার আড়ালে দূরের রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া মানুষের মতো এখন সে একা আবছা এবং বিষণ্ণ। মিলারকে দিয়ে টানা কুড়ি ওভার বল করিয়েছিল ব্র্যাডমান। স্ট্যামিনা, স্ট্রেংথ..স্ট্যামিনা, স্ট্রেংথ…কোথায় স্ট্যামিনা? বুকের মধ্যে কলকবজা একটা বিগড়েছে।

কোর্ট থেকে ওরা চলে গেছে। আনন্দ একা বসে, উঠতে ইচ্ছে করছে না। নেট অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। তরুণ কি আজ আবার ব্যাট করেছে? পরপর দুদিন চোরের মতো সে পালিয়ে এল। কী লজ্জা, আনন্দ ব্যানার্জি কিনা দু ওভার বল করেই টায়ার্ড! হাসবে, ওরা হাসবে।

বেঞ্চ থেকে উঠে, মন্থর পায়ে আনন্দ বেরিয়ে এল। ঘুম পাচ্ছে তার। হাঁটুতে ব্যথা, কনুইয়ে, কবজিতে ব্যথা।

পালিয়ে যাচ্ছে আনন্দ!

আনন্দ মাথা নাড়ল। কিছু করার নেই, কিছুই করার নেই। বিয়াল্লিশ অল আউট। তার থেকেও লজ্জার এই ক্লান্তি। এই ব্যথা, হাঁপ ধরা। পরপর দুদিন পালিয়ে আসা। আমি জানি না আমি কী করব। জানি না, জানি না, জানি না।

রাতে আবার জ্বর এল। অরুণ তার কাছে এসে কপালে হাত রাখতেই চোখ খুলে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আনন্দ হাতটা চেপে ধরল।

মেজদা, আমি পালিয়ে এসেছি। আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, হাত পায়ে ব্যথা করে। আমায় ডাক্তার দেখাও। আমায় ভাল করে দাও। দু ওভারও বল করতে পারি না।

ক্রমশ স্তিমিত হয়ে এল আনন্দর কণ্ঠস্বর। দু চোখ বন্ধ করতে করতে ফিসফিসিয়ে বলল, তরুণ বলেছে হুক করে টেনিস ক্লাবে পাঠাবে। আমি ঠুকে দিয়েছিলাম বলটা, কিন্তু ওরা ভেবেছে পিচটা খারাপ তাই লাফিয়েছে। কেন আমার বল মারবে? আমি অপমান সহ্য করব না।..চ্যালেঞ্জ নোেব, মেরে সরাব…সোবার্স, চ্যাপেল, বয়কট, লয়েড সবাই সবাইকে…আমাকে শুধু ভাল করে দাও, ভাল করে দাও, ভাল করে দাও।

.

০৪.

ডাক্তারবাবু, ভাল হয়ে যাবে তো?

চশমাটা টেবিল থেকে তুলে চোখে লাগিয়ে ডাক্তার তাকালেন অরুণের উদ্বিগ্ন মুখের দিকে। টাক ঢাকতে পিছনের চুল দিয়ে সযত্ন প্রয়াস রয়েছে ডাক্তারবাবুর মাথায়। বেঁটেখাটো মানুষটি এরকম আকুল কণ্ঠস্বর প্রতিদিন বহুবারই শুনে থাকেন বাড়িতে চেম্বারে বা হাসপাতালে। ব্যস্ত না হয়ে তিনি আড়চোখে একবার বাইরের দরজার পর্দাটার দিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন। পর্দার ওপারে, রাস্তায় নেমে যাওয়া সিঁড়ির ধাপে একজোড়া পা। আনন্দ দাঁড়িয়ে। রাস্তায় রবারের বল খেলছে পাড়ার ছেলেরা তাই দেখছে।

খেলা যত না হচ্ছে তার থেকেও বেশি চিৎকার করছে ছেলেরা। আনন্দ চেষ্টা করছে ঘরের মধ্যে মেজদা আর ডাক্তারের কথাগুলো শুনতে, কিন্তু পারছে না।

ঘরের মধ্যে যাবে কি না ভাবল। বুক ঢিপঢিপ করছে। ডাক্তারবাবু কী বলবেন, কে জানে! যতক্ষণ পরীক্ষা করছিলেন বলের ফ্লাইট লক্ষ করার মতো সে সারাক্ষণ গম্ভীর নিরাসক্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে ছিল। কিছুই সে বুঝতে পারেনি, বা তিনি তাকে বুঝতে দেননি।

প্রশ্ন হয়েছিল: কদ্দিন থেকে এই রকম শ্বাসকষ্ট হচ্ছে?

 দিন পাঁচেক আগে নেটে বল করার সময়।

 তার আগে কখনও হয়নি?

 আনন্দ আড়চোখে অরুণের উৎকণ্ঠিত মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল, হত, খুব সামান্য।

কতদিন আগে থেকে? দুবছর? তিন বছর?

আনন্দ মনে করার চেষ্টা করল।

জ্বর হত? সর্দি কাশি? গাঁটে গাঁটে ব্যথা?

 ডাক্তারের কাছে মিথ্যা বলতে নেই, লুকোতে নেই। আনন্দ ঘাড় নাড়ল।

 কাউকে জানাওনি?

আনন্দ কয়েক সেকেন্ড অরুণের মুখ লক্ষ করে বলল, না, আপনা থেকেই সেরে যেত তাই কাউকে বলতাম না।

মাকেও বলনি?

গলা খাঁকারি দিয়ে অরুণ বলল, আমাদের মা নেই। আনন্দ যখন আট বছরের তখন মারা যান, নিউমোনিয়ায়। অত্যন্ত চাপা ছিলেন, কাউকে কিছু প্রথমে বলেননি। আনন্দও মায়ের মতো চাপা স্বভাবের হয়েছে।

এক ঝলক হাসি আনন্দর মুখের ওপর খেলে গেল। ডাক্তারের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল।

ক্রিকেট ছাড়া আর কিছু খেলো?

 ফুটবল খেলতাম, এখন আর খেলি না।

 কোন পজিশনে?

লেফট উইং।

 ছুটতে গেলেই শ্বাসকষ্ট হত, তাই ফুটবল ছেড়েছ।

প্রশ্ন নয়, কথাগুলো যেন ঘোষণার মতো। ডাক্তারবাবু যেন জানেনই কেন আনন্দ ফুটবল খেলা ছেড়েছে। মরিয়া হয়ে সে বলল, পরে ব্যাকে খেলতাম। গত বছরও খেলেছি।

এ বছর?

আমি ক্রিকেটটাই শুধু খেলতে চাই। চোট লাগলে বোলিংয়ে অসুবিধে হবে ভেবে ফুটবল বন্ধ করেছি। আনন্দ একটু বেশি জোর দিল ভেবেইর উপর।

ডাক্তারবাবুর মুচকি হাসিটায় বিব্রত হয়ে, আবার সে বলল, পঙ্কজ রায় তো ক্রিকেটের জন্যই ফুটবল খেলা ছেড়েছিলেন।

উত্তর না দিয়ে ডাক্তারবাবু আর একবার স্টেথস্কোপ দিয়ে আনন্দর শ্বাস-প্রশ্বাস পরীক্ষা করে অরুণকে বললেন, ব্যাপারটা যে এই প্রথম, তা নয়। বছর কয়েক আগেই রিউম্যাটিক ফিভার শুরু হয়েছে। তখন গ্রাহ্য করেনি। চিকিৎসা না করে চেপে যাওয়ায়, ডাক্তারি পরিভাষায় এটা রিউম্যাটিক মাইট্রাল ইনকমপিটেন্সে দাঁড়ায়। সাধারণ সর্দি-জ্বর ভেবে চিকিৎসা না হওয়া আর অবহেলা, দুটো মিলে মনে হচ্ছে এখন অ্যাডভান্সড স্টেজের দিকে এগিয়েছে। এক্স-রে করা দরকার, দেখতে হবে এট্রিয়েল ফাইব্রিলেশন হয়ে গেছে কি না।

খুব সিরিয়াস ধরনের কিছু কি? অরুণ কোনওরকমে প্রশ্নটি করল। তার চোখে অজানা ভয় এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

হার্টের ব্যাপার। সেটা চলার একটা ছন্দ আছে। ছন্দটা বদলে গেছে। সুতরাং সিরিয়াস তো বটেই।

আনন্দ দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করল, সারতে কতদিন লাগবে? আমাদের কোচিং এখনও দিনদশেক চলবে। তার আগেই

ডাক্তারবাবু গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ছেন দেখে আনন্দ থেমে গেল।

বন্ধ। একদম বন্ধ। কোনওরকম পরিশ্রম নয়, সিঁড়ি ভাঙা পর্যন্ত বন্ধ। খুব আস্তে হাঁটাচলা করলেও করতে পারো। উত্তেজনা আসতে পারে এমন কোনও ব্যাপারে যাবে না, চিন্তাও করবে না। নুন খুব কম খাবে। অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ যা লিখে দিচ্ছি তাই নিয়মিত খাবে, বৃষ্টিতে ভেজা একদম বারণ, মাটিতেও শোবে না।

খেলা একদম বারণ? আনন্দ বিশ্বাস করতে পারছে না।

 হ্যাঁ, বারণ, তারপর অরুণকে প্রশ্ন, বাথরুম কি দোতলায়?

না, একতলায়।

তা হলে ওকে একতলায় রাখার ব্যবস্থা করুন, যাতে সিঁড়ি ভাঙতে না হয়।

অরুণ মাথা নাড়ল, কয়েক মুহূর্ত ভেবে আনন্দকে চাপা গলায় বলল, তুই একটু ঘরের বাইরে যা, দু-একটা কথা ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞাসা করব।

বাইরে সিড়িতে দাঁড়িয়ে আনন্দ কান পেতে রেখেছিল ঘরে। দু-একটা টুকরো শুনতে পেয়েছে:

দেখাশোনার কেউ নেই.নিশ্চয়, ওকে গুরুত্বটা বুঝিয়ে দেব।

 এর থেকে সেরিব্রাল এমবলিজম হতে পারে..পারমানেন্ট প্যারালিসিস..সাবধান না হলে…জোর করে করতে হবে। সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখা…মা থাকলে ভাল হত।

রাস্তায় একটা গোল হল। চিৎকারের মধ্যেও আনন্দ বুকের ধকধক শব্দটা শুনতে পাচ্ছে। প্যারালিসিস মানে পক্ষাঘাত। শুধু বিছানায় শুয়ে থাকা। হবে, হতে পারে অর্থাৎ আমি সারাজীবন বিছানায় শুয়ে থাকব! কী অদ্ভুত।

চল, যাই এবার।

চমকে উঠল। চিন্তায় ডুবে ছিল, বুঝতে পারেনি অরুণ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ উৎফুল্ল স্বরে সে বলল, ওই ছেলেটা ড্রিবল করছিল দারুণ, দেখবে?

স্কুটারে স্টার্ট দিয়ে শুকনো গলায় অরুণ শুধু বলল, তাই নাকি।

গম্ভীরমুখে সে সারা পথ স্কুটার চালিয়ে এল। ট্রাফিকের লাল আলোয় একবার থামতে হয়। তখন অরুণ পিছনে মুখ ফিরিয়ে বলেছিল, একতলায় আমাদের একটা ঘর পড়ে আছে না? কী আছে ওটায়?

ভাঙা সোফা, ঝাড়বাতি আরও কীসব আছে। খুব আরশুলা ঘরটায়। প্রায়ই বিছে বেরোয়।

আনন্দ আঁচ করতে পারছে মেজদার মাথায় এখন কী চিন্তা। একতলার ঘরটায় তার থাকার ব্যবস্থার কথা ভাবছে। কিন্তু ওঘরে বাস করার কোনও ইচ্ছেই তার নেই। সে আর একবার যখন আরশুলা-বিছের কথা বলতে যাচ্ছে তখনই স্কুটারটা ছেড়ে দিল। মেজদার চোয়াল অযথা শক্ত হয়ে গেছে দেখে সে বুঝল কোনও অনুনয়েই কাজ হবে না।

আনন্দর থাকার জন্য সেইদিনই ঘর নির্দিষ্ট হল একতলায়।

.

বাড়ির পিছনদিকে ছোট্ট এই ঘরটা বহু বছর পড়ে ছিল। বাড়ির লোকে ভুলেই গেছল ঘরটার কথা। উত্তরের জানলা খুললেই ঝোপঝাড় ছোটখাটো জঙ্গল। তারপরে একটা জলা জমি। জানলা ঘেঁষে বাড়ির পাঁচিল শুরু হয়েছে। দত্তদের কারখানার টিনের শেড আর চিমনিটা দেখা যায়। জানলার নীচেই পায়েচলা পথের দাগটা সাপের খোলসের মতো পাঁচিল ঘেঁষে কারখানার পিছনের দরজার পৌঁছেছে। আনন্দদের বাড়ির অর্ধেকটায় যে গুদাম, তার সঙ্গে কারখানার যোগাযোেগ এই পথ দিয়েও হয়। তবে লরি আসে সামনের দরজায়।

মিস্ত্রি আনিয়ে সারিয়ে, চুণকাম করে আনন্দর খাট বিছানা বই থেকে শুরু করে ব্যবহারের যাবতীয় জিনিস নীচের ঘরে আনা হল। ছোট্ট ঘরটা তাতেই যেন ভরে গেল। উত্তরে ছাড়াও পুবে একটা জানলা। সেটা খুললে বাড়ির বাগান তারপর পাঁচিল। বাগান বলতে কাগজিলেবুর গাছ, নিম গাছ, পাকার পোড় ইট, জংধরা টিন, সিমেন্টের ভাঙা রক আর এক হাঁটু ঘাস।

ঘরের ভিতর দিকেও একটা জানলা। অনেক টানাটানি করে অরুণ সেটা খোলে। অনাদিপ্রসাদের চেম্বারের দরজার মুখোমুখি জানলাটা। অরুণ সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেয়।

দু-একদিন লাগবে ঘরের গন্ধটা কাটতে। তারপরই ঠিক হয়ে যাবে। একটা পাখা লাগবে, কাল পরশুই কিনে আনব। একটা ঘড়ি হলেও ভাল হয়। আলনাও দরকার।

আনন্দ খাটে বসে দেখছিল কথা বলতে বলতে অরুণের পায়চারি। একা একটা ঘরে এবার থেকে দিন-রাত কাটাতে হবে ভাবতেই তার গা ছমছম করে উঠছে। কৌতূহলও হচ্ছে। ব্যাপারটা কেমন লাগবে কে জানে। অনেক রাত পর্যন্ত গল্পের বই পড়া যাবে, আলো নিভিয়ে দিতে বলবে না কেউ। এই সুবিধেটা ছাড়া আর কী লাভ হচ্ছে!

মেজদা, আমার কী অসুখ করেছে?

কিছু না, সামান্যই, অরুণ হাসবার চেষ্টা করে বলল। অসুখ অনেক রকমের হয়, কোনওটায় সঙ্গে সঙ্গে অপারেশন করতে হয়, কোনওটায় দীর্ঘদিন ওষুধ আর খাওয়াদাওয়ার রেস্ট্রিকশনে থাকতে হয়, কোনওটায় শুধু ডিসিপ্লিনড হতে হয়। আন্দ, তোমায় ডিসিপ্লিনড হতে হবে।

বিপিন দোতলার কুঁজোটা এনে রাখল। হাবুর মা তার নিজের বিছানা বালিশ এনে খাটের নীচে গুছিয়ে রাখছিল, বিপিন ধমকে উঠল: ওসব এখানে কেন?

আন্দ কি রাতে একা শশাবে নাকি? ভয় করবে না?

তোর তো নাক ডাকে, ও ঘুমোবে কী করে?

একটা ধুন্দুমার ঝগড়াকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে অরুণ বলল, হাবুর মা রাতে এঘরে থাকুক। একজনের থাকা দরকার। আনন্দর চলাফেরা একদম বারণ। ঝগড়াঝাঁটি শুনলে উত্তেজনা হবে, তাতে ক্ষতি হতে পারে।

অরুণের কথা শেষ হতে ওরা আনন্দর দিকেই তাকিয়ে ছিল। সে দেখল দু জোড়া চোখে ভীষণ মমতা, স্নেহ আর উৎকণ্ঠা। দেখে সে হাসল।

অরুণ তার পাশে খাটে বসল। জানলা দিয়ে একদৃষ্টে বাইরে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা ভাবছে। আনন্দও চুপ করে মেঝের দিকে তাকিয়ে। সে কিছুই ভাবছে না। ঘরে আর কেউ নেই। জলার দিক থেকে ঘুঘুর ডাক ভেসে আসছে।

আন্দ, তুই যথেষ্ট বড় হয়েছিস, নিজের ভালমন্দ বোঝার মতো বয়স হয়েছে।

অরুণ জানলার বাইরে চোখ রেখেই কথা বলে যাচ্ছে। ভারী থমথমে গলার স্বর। কারুর মৃত্যু সংবাদ বা গুরুতর দুর্ঘটনার খবর বলার সময় রেডিয়োর খবরপড়ুয়ার স্বর যেরকম হয়। মেজদা ওদের সকলের থেকে ভাল খবর পড়ে দেবে।

তোর অসুখটা খুব সিরিয়াস ধরনের।

কী অসুখ?

তোকে দারুণভাবে নিয়ম মেনে চলতে হবে। চব্বিশ ঘণ্টাই শুয়ে থাকা দরকার। শুধু বাথরুমে যাওয়া ছাড়া। শুয়েই খাওয়াদাওয়া করতে পারলে ভাল হয়।

আমি তো চলাফেরা দিব্যিই করতে পারছি, তা হলে?

এ ঘর থেকে একদম বেরোবে না।

ডাক্তারবাবু তো বললেন আস্তে আস্তে চলাফেরা করা যায়, শুধু সিঁড়ি ভাঙাই বারণ।

নিয়মিত ট্যাবলেট খেতেই হবে।

আনন্দ চুপ করে রইল। অরুণের স্বর অধৈর্য বিরক্ত হয়ে উঠেছে। ভিতরে ভিতরে যেন আবেগের সঙ্গে সে যুদ্ধ করছে। চেপে নামিয়ে দিচ্ছে কিন্তু পারছে না। চোখ বড় হয়ে গেছে, মুখ লাল হচ্ছে। মেজদার ভিতরে একটা বেলুন ফুলে উঠছে। ফেটে যায় যদি!

ঠাণ্ডা লাগাবে না। সারাক্ষণ জামা পরে থাকতে হবে। এঘরে বোধহয় পাখা দেওয়াটা ঠিক হবে না। সর্দিকাশি কোনওরকমেই যেন হয়।

অরুণ উঠে গিয়ে জানলাগুলো বন্ধ করে আবার খুলে কয়েকবার পরীক্ষা করল।

বৃষ্টিতে ভেজা একদম বারণ। চটি আছে? আচ্ছা কিনে আনব। খালি পায়ে হাঁটবে না  কখনও। মেঝেয় ভুলেও শোবে না। বসবেও না।

 না না না, কী হয়েছে আমার যে এত বারণ? এই তো আমি হাঁটছি।

 আনন্দ পায়চারি শুরু করল।

এই তো লাফাচ্ছি।

আন্দ!

চাপা চিৎকার করে অরুণ হাত বাড়িয়ে আনন্দর হাত চেপে ধরল।

 ক্লাস টেন-এ যে পড়ছে, নিজের ভালমন্দ তার বোঝা উচিত।

কী আমার ভাল আর মন্দ? এইভাবে ঘরের মধ্যে সারাদিন নিয়ম মেনে, কী আমার ভাল হবে? আমি তো ঠিকই আছি। শুধু এই ব্যথাটা, এ তো সেরে যাবে। বল করার সময় বুকের মধ্যে যে ধড়ফড়ানি

কোনওদিন সারবে না।

বলেই ফ্যাকাশে হয়ে গেল অরুণের মুখ। আনন্দ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে।

কোনওদিনই না?

নিশ্চয়ই সারবে, ডাক্তারবাবু যা বলেছেন যদি সেইভাবে চলো। আন্দ..আন্দ তোর নিজের জীবন এখন তোর নিজেরই হাতে। সারাক্ষণ তোকে চোখে চোখে রাখবার কেউ নেই। নিজেকেই নিজে দেখবি।

যদি না দেখি?

অরুণ চুপ করে তাকিয়ে রইল ওর মুখের দিকে। বেলুনটা ফেটে চুপসে গেছে।

আমার প্যারালিসিস হবে। আজীবন বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে।

আনন্দ চেয়ারে বসল অরুণের মুখোমুখি। বিকেলের ফিকে সোনালি রোদ দূরে একটা নারকেল গাছের পাতার ভাঁজে ভাঁজে ধুলোর মতো জমে। পুবের জানলা দিয়ে অরুণ দেখছে আষাঢ়ের মেঘ। আকাশের একটা কোণ থেকে গুঁড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসছে পিঠে একরাশ বৃষ্টি নিয়ে। দুজনেই ক্রমশ ধূসর ঝাপসা হতে লাগল ঘরের মধ্যে নিঃশব্দে।

আন্দ, আন্দ।

 ফিসফিস করল অরুণ। হঠাৎ আনন্দর মনে পড়ল তার মাকে।

ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছিল। আমি ঘুমোচ্ছিলুম। হাবুর মা ঘুম ভাঙিয়ে বলল, চল মা তোকে দেখতে চাইছে।

আল তুই ফাস্টবোলার হতে চাস, তাই না?

বড়দা, বাবা, বিপিনদা, ডাক্তারবাবু, তুমি—সবাই তখন ঘরে ছিলে। হাবুর মা আমাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গেল মার কাছে। আমি চোখ মেলতে পারছিলাম না, এত ঘুম তখনও চোখে। মা অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হাসল, ডান হাতটা কাঁধের. ঠিক এইখানে রেখে আমায় টানল। আমি মার বুকে মাথা রাখলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মা শুধু বলল, আন্দ আন্দ, লক্ষ্মী হয়ে থাকিস। তারপর বৃষ্টির একটানা শব্দটা আমাকে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিল।

আন্দ, লর্ডস মেলবোের্ন ব্রিজটাউন ইডেনে আগুন ছোটাবি। ইন্ডিয়া রাবার আনবে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে।

বৃষ্টিতে আমি ভিজতুম। বৃষ্টি আমাকে মার কথা মনে পড়িয়ে দেয়। বৃষ্টি মায়ের মতো সারা গায়ে হাত বুলোয়। আমার জ্বর হত, তবু ভিজতুম। মেজদা, আর কি ভিজতে পারব না?

আন্দ, সারা দেশ গর্বে তোর দিকে তাকাবে। বলবে, হারা ম্যাচ, জেতা অসম্ভব, তবু জিতিয়ে দিল আনন্দ ব্যানার্জি। একা জিতিয়ে দিল। এমন ফাস্ট বোলিং পৃথিবীতে আগে হয়নি।

কিন্তু আমি জানি, আমি জানি।

আনন্দ ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে মুখ রাখল অরুণের কোলে।

কিচ্ছু জানিস না। কী জানিস…য়্যাঁ, কী জানিস এইটুকু ছেলে? সব অসুখই সারে। লক্ষ্মীছেলের মতো কথা শুনলে সব অসুখই সারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *