২২. অশোক-ষষ্ঠীর দিন

অশোক-ষষ্ঠীর দিন। এই ষষ্ঠী যাহারা করে, তাহাদের সংসারে নাকি কখনও শোক প্রবেশ করে। না। হারালে পায়, মলে জীয়োয়। অর্থাৎ কোনো কিছু হারাইয়াও হারায় না, হারাইলে ফিরিয়া পায়—মরিলেও মরে না, পুনরায় জীবিত হয়, অশোক-ষষ্ঠীর কল্যাণে। মেয়েরা সকাল হইতে উপবাস করিয়া আছে। ষষ্ঠীদেবীর পূজা করিয়া ব্ৰত-কথা শুনিবে, অশোক ফুলের আটটি কলি খাইবে। প্রসাদী দই-হলুদ মিশাইয়া–তাহারই ফোঁটা দিবে ছেলেদের কপালে। তারপর খাওয়া-নাওয়া; সে সামান্যই। অন্নগ্ৰহণ নিষেধ।

বার মাসে তের ষষ্ঠী। মাসে মাসে স্বৰ্গ হইতে আসে ষষ্ঠীদেবীর নৌকা, বার মাসে তের রূপে তিনি মর্ত্যলোকে আসেন পৃথিবীর সন্তানদের কল্যাণের জন্য। সিঁথিতে ডগমগ করে সিঁদুর, হাতে শাখা, সর্বাঙ্গে হলুদের প্রসাধন, ডাগর চোখে কাজল। পরের সাত পুতকে কোলে রাখেন, নিজের সাত পুত থাকে পিঠে। বৈশাখ মাসে চন্দন-ষষ্ঠী, জ্যৈষ্ঠে অরণ্য-ষষ্ঠী, আষাঢ়ে বাঁশ-ষষ্ঠী, শ্রাবণে লুণ্ঠন বা লোটন-ষষ্ঠী, ভাদ্রে চর্পটা বা চাপড়-ষষ্ঠী, আশ্বিনে দুর্গাষষ্ঠী, কার্তিকে কালী-ষষ্ঠী, অগ্রহায়ণে অখণ্ড-ষষ্ঠী-সংসারকে অখণ্ড পরিপূর্ণ করিয়া দিয়া যান, পৌষে মুলা-ষষ্ঠী, মাঘে শীতলা-ষষ্ঠী, ফাল্গুনে গোবিন্দ-ষষ্ঠী, চৈত্রে অশোক তরু যখন ফুলভারে ভরিয়া ওঠে, তখন শোক-দুঃখ মুছিতে আসেন মা অশোক-ষষ্ঠী। তারই কল্যাণ-স্পর্শে আনন্দে সুখে ওই ফুলভরা অশোক গাছের মতই সংসার হাসিয়া ওঠে। অশোকের পর আছে নীলষষ্ঠী। গাজন-সংক্রান্তির পূর্বদিন। তিথিতে ষষ্ঠী না হইলেও–ওই দিন হয় নীলষষ্ঠী।

পদ্ম সকালবেলা হইতে গৃহকর্ম সারিয়া ফেলিবার জন্য ব্যস্ত। কাজ সারিয়া স্নান করিবে, ষষ্ঠীর পূজা আছে, ব্ৰত-কথা শুনিতে যাইবে বিলুর বাড়ি। তারপর অশোকের কলি খাইতে হইবে। তাহার আবার মন্ত্র আছে। এহেন দিনে আবার অনিরুদ্ধ কাজের ঝাঁট বাড়াইয়া দিয়াছে। কামারশালা মেরামতে লাগিয়াছে। হাপর, নেয়াই, হাতুড়ি, সঁড়াশি ইত্যাদি লইয়া টানাটানি শুরু করিয়াছে। কামারশালার বহুকালের পুরনো ঝুল-কালি-কয়লা সাফ করা একদণ্ডের কাজ নয়। ইহার উপর কয়লার সঙ্গে মিশিয়া আছে লোহার টুকরা ছুতারের ব্রেদায় চাচিয়া তোলা কাঠের অ্যাঁশের মত পাতলা কোঁকড়ানো লোহাগুলি সাংঘাতিক জিনিস, বিধিলে বড়শির মত বিধিয়া যাইবে। ঝাঁটা দিয়া পরিষ্কার করিয়া আবার গোবর-মাটি প্ৰলেপে নিকাইতে হইবে।

পদ্মের সঙ্গে তারিণীর সেই ছেলেটাও কাজ করিতেছিল। ছেলেটিকে যতীন খাইতে দেয়। দুই-একটা কাজকর্ম অবশ্য ছেলেটা করে, কিন্তু অহরহই পদ্মের কাছে থাকে। অনিরুদ্ধ দুইএকটা ধমক দিলেও ছেলেটা আর বিশেষ কিছু বলে না। বিপদ হয় ঘোড়াটা বাহিরে গেলেই। বাহিরে গেলে আর সহজে ফেরে না। যতীন উহাকে দিয়া দেবুকে কোনো খবর পাঠাইলে দেবু আসে, কথাবার্তা কহিয়া চলিয়া যায়–কিন্তু ছেলেটার পাত্তা আর পাওয়া যায় না। অবশেষে একবেলা পার করিয়া খাইবার সময় ফেরে। কোনো কোনোদিন হরিজন-পাড়া, কি কোনো বনজঙ্গল খোঁজ করিয়া ধরিয়া আনিতে হয়। সে পদ্মই আনে।

অনিরুদ্ধ নূতন করিয়া কাজকর্ম আরম্ভ করিতে চায়।

কাবুলী চৌধুরীর কাছে টাকা সে পাইয়াছে। আড়াই শো টাকার জন্য চৌধুরী গোটা জোতটাই বন্ধক না লইয়া ছাড়ে নাই। অনিরুদ্ধ তাহাই দিয়াছে। তাহার মন খানিকটা খুঁতখুঁত করিয়াছিল; কিন্তু টাকা পাইয়া সে সব আফসোস ছাড়িয়া, মহা উৎসাহের সঙ্গে কাজ আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। বাকি খাজনার টাকাটা আদালতে দাখিল করিতে হইবে, আপোসে দিয়া বিশ্বাস নাই। আর আপোসেই বা সে দিবে কেন? পাচুন্দীর গরু-মহিষের হাট হইতে একজোড়া গরু কিনিবে। ইহার মধ্যে সে কৃষাণ বহাল করিয়া ফেলিয়াছে। দুর্গার ভাই পাতুকেই তাহার পছন্দ। তাহাকে সে কামারশালে চাকরও রাখিয়াছে। পাতুকে সে ভালবাসে। দুর্গার কাছে পাতু অনেক ওকালতি করিয়াছিল অনিরুদ্ধের জন্য।

সেদিন অনিরুদ্ধের সঙ্গে কামারশালায়ও পাতু কাজ করিতেছিল। মোটা মোটা লোহার জিনিসগুলি তাহারা দুজনে বহিয়া বাহির করিয়া আনিয়া রাখিতেছিল। কাজের ফাঁকে চাষের সম্বন্ধে কথাবার্তা চলিতেছিল। হইতেছিল গরুর কথা। কেমন গরু কেনা হইবে—তাই লইয়া আলোচনা।

পাতুর মতে দুর্গার নিকট হইতে বলদ-বাছুরটা কেনা হউক এবং হাট হইতে দেখিয়াশুনিয়া তাহার একটা জোড়া কিনিয়া আনিলে—বড় চমৎকার হাল হইবে!

অনিরুদ্ধ হাসিয়া বলিল-দুর্গার বাছুরটার দাম যে বেজায়!

পাইকেররা এক শো টাকা পর্যন্ত বলেছে। দুর্গা ধরে রয়েছে, আরও পঁচিশ টাকা। তা তোমাকে সস্তা করে দেবে। আমিসুদ্ধ যখন আছি।

হাসিয়া অনিরুদ্ধ বলিল—মোটে এক শো টাকা আমার পুঁজি। ও হবে না পাতু। ছোটখাটো গিঠগিঠ বাছুর কিব। জমিও বেশি নয়—বেশ চলে যাবে।

–কিন্তু দধি-মুখো গরু কিনো বাপু। দধি-মুখখা গরু ভারি ভালো লক্ষণ-মান।

–চল না, হাঁটে তো দুজনেই যাব।

পদ্ম বলিল তারিণীর ছেলেটাকো রে, আবার লোহার টুকরো কুড়োতে লাগলি? এই বুঝি তোর কাজ করা হচ্ছে?

ছোঁড়াটা উত্তর দিল না।

পাতু বলিল—এ্যাঁই এ্যাঁই, ই তো আচ্ছা ছেলে রে বাপু! এই ছেলে!

ছেলেটা দাঁত বাহির করিয়া পাতুকে একটা ভেঙচি কাটিয়া দিল।

—ও বাবা, ই যে ভেঙচি কাটে লাগছে! বলিহারির ছেলে রে বাবা।

অনিরুদ্ধ বলিল—ধরে আন। কান ধরে নিয়ে আয় তো পাতু!

পদ্ম হাঁ-হাঁ করিয়া উঠিল, ধোরো না, কামড়ে দেবে, কামড়ে দেবে।

ছোঁড়াটার ওই এক বদ অভ্যাস। কেহ ধরিলেই সঙ্গে সঙ্গে কামড় বসাইয়া দেয়। আর দাঁতগুলিতে যেন ক্ষুরের ধার। অতর্কিত কামড়ে আক্রমণকারীকে বিব্রত করিয়া মুহূর্তে সে আপনাকে মুক্ত করিয়া লইয়া পলাইয়া যায়। ওই তাহার রণকৌশল। আজ কিন্তু পাতু ধরিবার আগেই ছোঁড়াটা উঠিয়া ভো দৌড় দিল।

পদ্ম ব্যস্ত হইয়া উঠিল—উচ্চিঙ্গে, উচ্চিঙ্গে, ওরে অ উচ্চিঙ্গে! যাস না কোথাও যেন, শুছিস?

ছেলেটার ডাকনাম উচ্চিংড়ে; ভাল নাম মা-বাপে শখ করিয়া একটা রখিয়াছিল। কিন্তু সে তার বাপ-মা-ই জানত, ছেলেটা নিজেও জানে না। উচ্চিংড়ে কিন্তু পদ্মের ডাক কানেই তুলিল। না। তবে বাড়ির দিকেই গেল—এই ভরসা। পদ্মও বাড়ির দিকে চলিল।

অনিরুদ্ধ বলিলচলি কোথায়?

দেখি, কোথায় গেল!

–যাক গে, মরুক গে। তোর কি? আপনার কাজ কর তুই!

—ষাট! আজ ষষ্ঠীর দিন। তোমার মুখের আগল নাই? বড় বড় চোখে প্রদীপ্ত দৃষ্টিতে চাহিয়া পদ্ম অনিরুদ্ধকে নীরবে তিরস্কার করিয়া চলিয়া গেল।

দাঁতে দাঁত টিপিয়া অনিরুদ্ধও ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে পদ্মের দিকে চাহিয়া রহিল। পদ্ম কিন্তু ফিরিয়াও চাহিল না; বাড়ির মধ্যে চলিয়া গেল। অনিরুদ্ধ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কাজ করিতে আরম্ভ করিল। কথায় আছে—না বিয়াইয়া কানুর মা, এ দেখিতেছি তাই! অনিরুদ্ধেরই মরণ।

যাক, উচ্চিংড়ে অন্য কোথাও পালায় নাই। যতীনের মজলিসে গিয়া বসিয়াছে। যতীনের কথার সাড়া হইতেই দূর হইতে পদ্ম উচ্চিংড়ের অস্তিত্ব অনুমান করিল।

যতীন জিজ্ঞাসা করিতেছিলমা-মণি কোথায় রে?

–হুই কামারশালায়।

এই যে তাহারই খোঁজ হইতেছে। পদ্ম হাসিল।-কেন! মা-মণির খোঁজ কেন? ওই এক চাদ-চাওয়া ছেলে! এখন কি হুকুম হইবে কে জানে! সে ভিতরের দরজার শেকল নাড়িয়া সংকেত জানাইল-মা-মণি মরে নাই, বাঁচিয়া আছে। ওপাশে যতীনের ঘরের বাহিরের বারান্দায় ভরপুর মজলিস চলিতেছে। দেবু, জগন, হরেন, গিরিশ, গদাই অনেকে আসিয়া জমিয়াছে। শিকল নাড়ার শব্দ পাইয়া, হাসিয়া, যতীন বারান্দা হইতে ঘরে আসিয়া বাড়ির ভিতরের দিকের দরজায় দাঁড়াইল। কালি-ঝুলি-মাখা আপনার সর্বাঙ্গ এবং কালো ঘেঁড়া কাপড়খানার দিকে চাহিয়া পদ্ম ব্যস্ত হইয়া উঠিল, বলিলনা না, ভেতরে এসো না।

—আসব না?

–না, আমি ভূত সেজে দাঁড়িয়ে আছি।

–হাসিয়া যতীন বলিল–ভূত সেজে?

–হ্যাঁ, এই দেখ। দরজার ফাঁক দিয়া সে আপনার কালি-মাখা হাত দুখানা বাড়াইয়া দেখাইল। এসো না, জুজুবুড়ি! ভয় খাবে। সে একটি নূতন পুলকে অধীর হইয়া খিলখিল করিয়া হাসিতে আরম্ভ করিল।

যতীনও হাসিয়া বলিল—কিন্তু জুজুমা, এখুনি যে চায়ের জল চাই! হাতটা কিন্তু ধুয়ে ফেলো!

পদ্ম এবার গজগজ করিতে আরম্ভ করিল।–চা দিনের মধ্যে লোকে কতবার খায়। তাহার যেমন কপাল! অনিরুদ্ধ মাতাল যতীন চাতাল, ওই উচ্চিংড়েটা জুটিল তো সেটা হইল দাঁতাল।

যতীন ফিরিয়া গিয়া মজলিসে বসিল। চা তাহার মজলিসের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। হরেন। ইহারই মধ্যে বারদুয়েক তাগাদা দিয়াছে।

–চা কই মশাই? এ যে জমছে না!

মজলিসে আজ জগন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের বক্তৃতা দিতেছে। উপস্থিত আলোচনা চলিতেছে প্রজাস্বত্ব আইনের সংশোধন সম্ভাবনা সম্বন্ধে। বাংলা প্রদেশের আইনসভায় প্রজাস্বত্ব আইন লইয়া জোর আলোচনা চলিতেছে। কথাটা উঠিয়াছে শ্ৰীহরি পালের সেদিনের সেই শাসন-বাক্যের আলোচনা-প্রসঙ্গে। মাল জমি অর্থাৎ প্রজাস্বত্ববিশিষ্ট জমির উপর মূল্যবান বৃক্ষে প্রজার শুধু ফল ভোগের অধিকার ছাড়া আর কোনো স্বত্ব নাই। গাছ জমিদারের।

জগন বলিতেছে প্রজাস্বত্ব আইনের সংশোধনে সে স্বত্ব হবে প্ৰজার। জমিদারের বিষদাঁত এইবার ভঙিল। সেদিন কাগজে সব বেরিয়েছিল—কি রকম সংশোধন হবে! আমি কেটে যত্ন করে রেখে দিয়েছি। ও আইন পাস হবেই। ওঃ, স্বরাজ্য পার্টির কি সব বক্তৃতা! একেবারে আগুন ছুটিয়ে দিয়েছে।

গদাই জিজ্ঞাসা করিল—কি রকম কি সব হবে, ডাক্তার?

হরেন খবরের কাগজের কেবল হেডলাইনগুলি পড়ে আর পড়ে আইন-আদালতের কথা। বিস্তৃত বিবরণ পড়িবার মত ধৈর্য তাহার নাই। তবুও সে বলিল—অনেক। সে অনেক ব্যাপার। এই এত বড় একখানা বই হবে। বলিয়া দুই হাত দিয়া বইয়ের আকারটা দেখাইল। তারপর বলিল, বোকার মত মুখে মুখেই জিজ্ঞাসা করছি কি রকম হবে ডাক্তার।

জগনেরও সব মনে নাই—সব সে বুঝিতেও পারে নাই, তবুও সে কিছু কিছু বলিল।

প্রথমেই বলিল–গাছের উপর প্রজার স্বত্ব কায়েম হইবে।

হস্তান্তর আইনে জমিদারের উচ্ছেদ-ক্ষমতা উঠিয়া যাইবে।

খারিজ-ফিস্ নির্দিষ্ট হইবে, এবং সে ফিস্ প্রজা রেজিস্ট্রি আপিসে দাখিল করিবে।

মাল জমির উপরেও পাকা ঘর করিতে পারবে।

মোটকথা, জমি প্রজার।

গদাই বলিল–কোর্ফার নাকি স্বত্ব হবে? ঠিকে ভাগেরও নাকি–

জগন বলিল–হ্যাঁ হ্যাঁ। কোর্ফার স্বত্ব সাব্যস্ত হলে মানুষের আর থাকবে কি? নাকে তেল দিয়ে ঘুমো গিয়ে। ভাগে ঠিকের জমি সব তোর হয়ে যাবে।

দেবু আপন প্রকৃতি অনুযায়ী চুপ করিয়া বসিয়া ছিল। কয়েক দিন হইতেই তাহার মনে অশান্তির শেষ নাই। সে ভাবিতেছে, সেদিনের সেই পাতু প্রমুখ বাউরিবায়েনগুলির কথা। তাহার কথা শুনিয়া তাহারা শ্রীহরিকে অমান্য করিয়া উঠিয়া আসিয়াছে। অচিরে শ্ৰীহরির শাসনদণ্ড কোনো-না-কোনো একটা দিক হইতে আকস্মিকভাবে আঘাতে তাহাদের মাথার উপর আসিয়া পড়িবেই। তাহাদিগকে বচাইতে হইবে; এবং তাহাকেই বাঁচাইতে হইবে। পঁচাইতে সে ন্যায়ধর্ম অনুসারে বাধ্য। কিন্তু সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। বিলু, খোকা, সংসার, জমিজমা সম্বন্ধে তাহার চিন্তা করিবার অবসর নাই। মধ্যে মধ্যে এমনিভাবে ক্ষণিক দুশ্চিন্তার মত সাময়িকভাবে তাহাদিগকে মনে পড়িয়া যায়।

জগন বক্তৃতা দিয়াই চলিয়াছিল—দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন যদি আজ বেঁচে থাকতেন তা হলে আর দেখতে হত না।

ওই নামটিতে আসরের সমস্ত লোকগুলির শরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। দেশবন্ধুর নাম, তাহার পরিচয় সকলেই জানে, তাহার ছবিও তাহারা দেখিয়াছে।

দেবুর চোখের উপর ভাসিয়া উঠিল তাহার মূর্তি। দেশবন্ধুর শেষশয্যার একখানা ছবি বাঁধাইয়া ঘরে টাঙাইয়া রাখিয়াছে। মহাকবি রবীন্দ্রনাথ ছবির তলায় লিখিয়া দিয়াছেন—

এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্ৰাণ।
মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।।

 

যতীন বাড়ির ভিতর হইতে ডাকিল—উচ্চিংড়ে!

সে চায়ের খোঁজে বাড়ির ভিতরে গিয়াছিল।

মজলিসের মধ্যে বসিয়া উচ্চিংড়ের খেয়ালখুশিমত চাঞ্চল্য প্রকাশের সুবিধা হইতেছিল না। কিছুক্ষণ ধরিয়া পথের ওপাশে জঙ্গলের মধ্যে একটা গিরগিটির শিকার দেখিতেছিল; দেখিতে দেখিতে যেই একটু সুস্থির-শান্ত হইয়াছে, অমনি সেইখানেই শুইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। বেচারা!

হরেন তাহাকে ধমক দিয়া ডাকিল—এই ছেড়া, এই! দেবু বলিল-ডেকো না। ছেলেমানুষ, ঘুমিয়ে পড়েছে। বলিয়াই সে নিজেই ভিতরে উঠিয়া গিয়া যতীনকে বলিল—কি করতে হবে বলুন। যতীন বলিলচায়ের বাটিগুলো নিয়ে সকলকে দিয়ে দিন।

দেবুই সকলকে চ পরিবেশন করিয়া দিল। চা খাইতে খাইতে জগন আরম্ভ করিল—মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত মতিলাল নেহরু, জহরলাল নেহরু, যতীন্দ্রমোহন, সুভাষচন্দ্রের কথা।

চা খাইয়া সকলে চলিয়া গেল। সকলের শেষে গেল দেবু। যাইবার জন্য উঠিয়াছিল সর্বাগ্রে সে-ই। কিন্তু যতীন বলিল গোটাকয়েক কথা ছিল যে দেবুবাবু!

দেবু বসিল। সকলে চলিয়া গেলে যতীন বলিল—আর দেরি করবেন না, দেবুবাবু। সমিতির কাজটা নিয়ে ফেলুন।

সমিতি প্রজা-সমিতি। যতীন বলিতেছে, দেবুকে সমিতির ভার লইতে হইবে।

দেবু চুপ করিয়া রহিল।

আপনি না হলে হবে না, চলবে না। সকলেই আপনাকে চায়। হয়ত ডাক্তার মনে মনে একটু ক্ষুণ্ণ হবে। তা যোক সে ক্ষুণ্ণ, কিন্তু একটা জিনিস গড়ে উঠেছে—সেটাকে ভাঙতে দেওয়া উচিত হবে না।

দেবু বলিল-আচ্ছা, কাল বলব আপনাকে।

যতীন হাসিল, বলিলবলবার কিছু নাই। ভার আপনাকে নিতেই হবে।

দেবু চলিয়া গেল, যতীন স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।

বাংলার পল্লীর দুর্দশার কথা সে ছাত্রজীবনে অনেক পড়িয়াছে, অনেক শুনিয়াছে। অনেক সরকারি স্ট্যাটিস্টিক্স এবং নানা পত্রপত্রিকায় এর বর্ণনাও পড়িয়াছে, কিন্তু এমন বাস্তবরূপে সে কল্পনা করিতে পারে নাই। সবে এই তো চৈত্র মাস, কৃষিজাত শস্যসম্পদ এখনও সম্পূর্ণ শেষ হইয়া মাঠ হইতে ঘরে আসে নাই, ইহারই মধ্যে মানুষের ভাণ্ডার রিক্ত হইয়া গিয়াছে। ধান শ্ৰীহরির ঘরে গিয়াছে, জংশনের কলে গিয়াছে। গম, যব, কলাই, আলু–তাহাও লোকে বেচিয়াছে। তিল এখনও মাঠে, কিন্তু তাহার উপরেও পাইকার দান দিয়া গিয়াছে। ইহারই মধ্যে একদিন শ্রীহরির খামারে একটি জনতা জমিয়াছিল, শ্ৰীহরি ধান-ঋণ দিতে আরম্ভ করিয়াছে। এই গ্রামের মাঠে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের প্রায় সব জমিই নাকি মহাজনদের কাছে আবদ্ধ। মহাজনদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মহাজন শ্ৰীহরি।

পল্লীর প্রতিটি ঘর জীর্ণ, শ্ৰীহীন, মানুষগুলি দুর্বল। চারিপাশে কেবল জঙ্গল, খানায়-খন্দে পল্লীপথ দুৰ্গম। সেদিনের বৃষ্টিতে সমস্ত পথটাই কাদায় ভরিয়া উঠিয়াছে। স্নানের ও পানের জলের পুকুর দেখিয়া শিহরিয়া উঠিতে হয়। প্ৰকাণ্ড বড় দিঘি, কিন্তু জল আছে সামান্য খানিকটা স্থানে, গভীরতা মাত্র হাতখানেক কি হাতদেড়েক। সেদিন একটা লোককে সে পলুই চাপিয়া ও-দিঘিতে মাছ ধরিতে দেখিয়াছিল। পাকে-জলে ভাল করিয়া লোকটার কোমরও ডোবে নাই।

আশ্চর্য! ইহার মধ্যেই মানুষ বাঁচিয়া আছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন—এ বাঁচা প্রেতের বাঁচা। অথবা ক্ষয়রোগাক্রান্ত রোগীর দিন গণনা করিয়া বাঁচা। তিল তিল করিয়া ইহারা চলিয়াছে মৃত্যুর দিকে একান্ত নিশ্চেষ্টভাবে মৃত্যুর কাছে আত্মসমৰ্পণ করিয়াছে।

এখানে প্রজা-সমিতি কি বাঁচিবে? সঞ্চয়-সম্বলহীন চাৰী গৃহস্থের সম্মুখে চাষের সময় কঠিন গ্রীষ্ম, দুর্যোগ-ভরা বর্ষা। চোখের উপর শ্ৰীহরির খামারে রাশ রাশি ধান্যসম্পদ। সেখানে প্রজাসমিতি কি বাঁচিবেনা কাহাকেও বাঁচাইতে পারিবে? সমিতির প্রত্যক্ষ এবং প্রথম সংঘর্ষ হইবে যে শ্ৰীহরির সঙ্গে! হইবে কেন, আরম্ভ তো হইয়াই গিয়াছে।

সম্মুখের দাওয়ার উপর পড়িয়া ঘুমাইতেছে উচ্চিংড়ে।

ওই পল্লীর ভাবী পুরুষ। নিঃস্ব, রিক্ত, গৃহহীন, স্বজনহীন, আত্মসর্বস্ব। যে নীড়ের মমতায় মানুষ শ্রী অর্থাৎ লক্ষ্মীর তপস্যা করিয়া তাহাকে আয়ত্ত করিতে চায়—সে নীড় হার ভাঙিয়া। গিয়াছে।

অকস্মাৎ পদ্মের উচ্চকণ্ঠ তাহার কানে আসিয়া প্রবেশ করিল। পদ্ম তাহাকে শাসন করিতেছে। সেই শাসনবাক্যের ঝঙ্কারে তাহার চিন্তার একাগ্ৰতা ভাঙিয়া গেল। ষষ্ঠী-পুজোর থালা হাতে পদ্ম ঝঙ্কার দিতে দিতে আসিয়া সম্মুখে দাঁড়াইল; তাহার স্নান হইয়া গিয়াছে; পরনে পুরনো একখানি শুদ্ধ কাপড়। সে বলিল—কি ছেলে বাবা তুমি! পঞ্চাশবার শেকল নেড়ে ডাকছি, তা শুনতে পাও না? যাক, ভাগ্যি আমার, সাঙ্গপাঙ্গের দল সব গিয়াছে। নাও ফোঁটা নাও। উঠে দাঁড়াও।

যতীন হাসিয়া উঠিয়া পাঁড়াইল। শুচিস্মিতা পদ্ম কপালে তাহার দই-হলুদের ফোঁটা দিয়া বলিল—তোমার মা আজ দরজার বাজুতে তোমাকে ফোঁটা দেবে।

যতীনকে ফোঁটা দিয়া এবার সে ডাকিল—উচ্চিঙ্গে! অ উচ্চিঙ্গে! ওরে দেখ তো, ছেলের ঘুম দেখ তো অসময়ে! এই উচ্চিঙ্গে—!

ইতিমধ্যেই উচ্চিংড়ের বেশ এক দফা ঘুম হইয়াছিল, ক্ষুধার বেলাও হইয়াছিল, সুতরাং তিনবার ডাকিতেই সে উঠিয়া বসিল।

–ওঠ, উঠে দাঁড়া, ফোঁটা দি! ওঠ বাবা ওঠ।

উচ্চিংড়ে দাঁড়াইয়া প্রথমেই হাত পাতিল—পেসাদ! পেসাদ দাও!

পদ্ম হাসিয়া ফেলিল, পাঁড়া আগে ফোঁটা দি!

উচ্চিংড়ে খুব ভাল ছেলেটির মত কপাল পাতিয়া দাঁড়াইল, পদ্ম ফোঁটা পরাইয়া দিল।

যতীন বলিল, প্রণাম কর, উচ্চিংড়ে। প্রণাম করতে হয়। দাঁড়াও মা-মণি, আমিও একটা–।

–বাবা রে বাবা রে! আমাকে তুমি নরকে না পাঠিয়ে ছাড়বে না!

পদ্ম মুহূর্তে উচ্চিংড়েকে কোলে তুলিয়া লইয়া একপ্রকার ছুটিয়াই ভিতরে চলিয়া গেল।

***

চৈত্রের দ্বিপ্রহর। অলস বিশ্রামে যতীন দাওয়ার তক্তপোশখানির উপর শুইয়া ছিল। চারিদিক বেশ রৌদ্রদীপ্ত হইয়া উঠিয়াছে। উত্তপ্ত বাতাস এলোমেলো গতিতে বেশ জোরেই বহিতেছে। বড় বড় বট, অশ্বথ, শিরীষ গাছগুলি কচি পাতায় ভরা; উত্তাপে কচি পাতাগুলি ম্লান হইয়া পড়িয়াছে। সেদিনের বৃষ্টির পর মাঠে এখনও হাল চলিতেছে, চাষীরা এতক্ষণে হাল-গরু লইয়া বাড়ি ফিরিতেছে। সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজিয়া গিয়াছে, ঘর্মসিক্ত কালো চামড়া রৌদ্রের আভায় চকচক করিতেছে তৈলাক্ত লোহার পাতের মত; বাউরিবায়েনদের মেয়েরা গোবর, কাঠকুটা সংগ্রহ। করিয়া ফিরিতেছে। সম্মুখেই রাস্তার ওপাশেই একটা শিরীষ গাছের সর্বাঙ্গ ভরিয়া কি একটা লতা—লতাটির সর্বাঙ্গ ভরিয়া ফুল। চারিধারে মৌমাছি ও ভ্রমরের গুনগুনানিতে যেন এক মৃদুতম ঐকতান-সঙ্গীতের একটা সূক্ষ্ম জাল বিছাইয়া দিয়াছে। গোটাকয়েক বুলবুলি পাখি নাচিয়া নাচিয়া এ-ডাল ও-ডাল করিয়া ফিরিতেছে। দূরে কোথায় পাল্লা দিয়া ডাকিতেছে দুইটা কোকিল। চোখ গেল পাখিটার আজ সাড়া নাই। কোথায় গিয়া পড়িয়াছে—কে জানে! আকাশে উড়িতেছে কয়েকটা ছোট অ্যাঁকে—একদল বন-টিয়া; মাঠের তিল-ফসলে তাহাদের প্রত্যাশা। অসংখ্য বিচিত্র রঙিন প্রজাপতি ফড়িং ভাসিয়া ভাসিয়া ফিরিতেছে দেবলোকের বায়ুতাড়িত পুষ্পের মত।

গন্ধে, গানে, বর্ণচ্ছটায় পল্লীর এই এক অনিন্দ্য রূপ। কবির কাব্যের মতই এই গন্ধে গানে বর্ণচ্ছটায় যেন একটা মাদকতা আছে, কেমন একটা হাতছানির ইশারা আছে।

হঠাৎ উঠিয়া বসিয়া সেই ইশারার ডাকেই যেন মোহগ্ৰস্তের মত যতীন বাহির হইয়া পড়িল। কাছেই কোন গাছের মধ্যে ডাকিতেছে একটা পাখি। অতি সুন্দর ডাক। শুধু স্বরই সুন্দর নয়, ডাকের মধ্যে সঙ্গীতের একটা সমগ্ৰতা আছে। পাখিটি যেন কোন গানের গোটা একটা কলি গাহিতেছে। ওই পাখিটার খোঁজেই যতীন সন্তৰ্পণে জঙ্গলের ভিতর ঢুকিয়া পড়িল। খানিকটা ভিতরে গিয়া পাইল সে গাঢ় মদির গন্ধ। ধ্বনি এবং গন্ধের উৎসমূল আবিষ্কার করিবার জন্য সে অগ্রসর হইয়া চলিল। আশ্চর্য! পাখিটা এবং ফুলগুলি তাহার সঙ্গে কি লুকোচুরি খেলিতেছে! শব্দ। এবং গন্ধ অনুসরণ করিয়া যত সে আগাইয়া আসিতেছে তাহারাও যেন তত সরিয়া চলিতেছে। মনে হয় ঠিক ওই গাছটা। কিন্তু সেখানে আসিলেই পাখি চুপ করেফুল লুকাইয়া পড়ে। আবার আরও দূরে পাখি ডাকিয়া ওঠে। গন্ধ মনে হয় ক্ষীণ, উৎসস্থান মনে হয় আরও দূরে। মোহগ্ৰস্তের মত যতীন আবার চলিল।

–বাবু!

কে ডাকিল? নারীকণ্ঠ যেন!

যতীন পাশে দৃষ্টি ফিরাইয়া দেখিল—একটা গাছের শিকড়ের উপর বসিয়া রহিয়াছে দুর্গা। সে কি করিতেছে।

–দুর্গা?

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

আঁটসাঁট করিয়া গাছকোমর বাঁধিয়া কাপড় পরিয়া দুর্গা বসিয়া কি যেন কুড়াইতেছে।

—ওগুলো কি? কি কুড়োচ্ছ?

এক অঞ্জলি ভরিয়া দুর্গা বাড়াইয়া তাহার সামনে ধরিল। টোপা-টোপা স্ফটিকের মত সাদা এগুলি কি? এই তো সে মদির গন্ধ! ইহারই একছড়া মালা গাঁথিয়া দুর্গা গলায় পরিয়াছে। বিলাসিনী মেয়েটির দিকে যতীন অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল। গঠনভঙ্গিতে, চোখ-মুখের লাবণ্যে, রুক্ষ চুলে মেয়েটার সর্বাঙ্গভরা একটা অদ্ভুত রূপ নূতন করিয়া আজ তাহার চোখে পড়িল।

দুর্গা মৃদু হাসিয়া বলিল—মউ-ফুল।

—মউ-ফুল?

–মহুয়া ফুল, বাবু; আমরা বলি মউ-ফুল!

যতীন ফুলগুলি তুলিয়া নাকের কাছে ধরিল। সে এক উগ্র মদির গন্ধমাথার ভিতরটা যেন কেমন হইয়া যায়; সর্বাঙ্গ শিহরিয়া ওঠে।

–কুড়িয়ে রাখছি বাবু, গরুতে খাবে, দুধ বাড়বে। আবার দুর্গা হাসিল।

–আর কি করবে?

–আর সে—আপনাকে শুনতে হবে না!

–কেন, আপত্তি কি?

–আর আমরা মদ তৈরি করি।

–মদ?

–হ্যাঁ। পিছন ফিরিয়া দুর্গা হাসিতে লাগিল; তারপর বলিল–কাঁচাও খাই, ভারি মিষ্টি। যতীনও টপ করিয়া একটা মুখে ফেলিয়া দিল। সত্যই, চমৎকার মিষ্টি; কিন্তু সে মিষ্টতার মধ্যেও ওই মাদকতা। আবার একটা সে খাইল। আবার একটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাহার কানের ভিতরটা যেন গরম হইয়া উঠিল; নাকের ভিতর নিশ্বাস উগ্ৰ উত্তপ্ত! কিন্তু অপূর্ব এই মধু-রস।

দুর্গা সহসা চকিত হইয়া বলিলপাড়ার ভেতরে গোল উঠছে লাগছে।

–হ্যাঁ, তাই তো!

সে তাড়াতাড়ি ঝুড়িটা কাঁধে তুলিয়া লইয়া বলিল-আমি চললাম, বাবু। পাড়াতে কি হল দেখি গিয়ে।

যাইতে যাইতে সে ফিরিয়া দাঁড়াইল, হাসিয়া বলিল—মউ আর খাবেন না বাবু, মাদ্কে যাবেন।

—কি হবে?

–মাদ্‌কে! নেশা–নেশা! দুর্গা চলিয়া গেল।

নেশা! তাই তো, তাহার মাথার ভিতরটা যেন ঝিমঝিম করিতেছে। সর্বশরীরে একটা দাহ, দেহের উত্তাপও যেন বাড়িয়া গিয়াছে বলিয়া মনে হইতেছে।

–বাবু! বাবু!

আবার কে ডাকিতেছে?—কে?

জঙ্গলের ভিতর আসিয়া ঢুকিল উচ্চিংড়ে।

–গাঁয়ে খুব গোল লেগে যেয়েছে বাবু! কালু শ্যাখ বাউরি-মুচিদের গরু সব ধরে নিয়ে গ্যালা।

—গরু ধরে নিয়ে গেল। কালু শেখ কে? নিল কেন?

–কালু শ্যাখ–ছিরু ঘোষের প্যায়দা! দেখ না এসে–-তোমাকে সব ডাকছে!

যতীন দ্রুতপদে ফিরিল। উচ্চিংড়ে চড়িয়া বসিল মহুয়া গাছে। একেবারে মগডালে উঠিয়া পাকা ফুল পাড়িয়া খাইতে আরম্ভ করিল।

***

শ্ৰীহরি অপমানের কথা ভুলিয়া যায় নাই, অপমান ভুলিবার তাহার কথাও নয়। এ গ্রামের শাসন-শৃঙ্খলার জন্য লোকত ধর্মত সে-ই দায়ী। প্রতিটি মুহূর্তে সে দায়িত্ব শ্রীহরি অনুভব করে, উপলব্ধি করে—বিপদে-বিপর্যয়ে সে তাহাদের রক্ষা করিবে, আর শৃঙ্খলা ভাঙিলে সে তাহাদের। শাস্তি দিবে বিদ্রোহকে কঠিন হস্তে দমন করিবে। এ তাহার অধিকার। এ তাহার দায়িত্ব। যখন সে অত্যাচারী ছিল, তখন তাহার অধিকার ছিল না—এ কথা সে স্বীকার করে। কিন্তু আজ সে কোনো অন্যায় করে না—আজ সমস্ত গ্রামখানাতেই তাহার কর্তব্যপরায়ণতার, ধর্মপরায়ণতার পরিচয় শ্ৰীহরির মহিমায় উজ্জ্বল হইয়াছে। চণ্ডীমণ্ডপ, ষষ্ঠীতলা, কুয়া, স্কুলঘর-সর্বত্র তাহার নাম ঝলমল করিতেছে। রাস্তার ওই নালাটা আবহমানকাল হইতে একটা দুৰ্লজ্জ বিঘ্ন; সে নিজে হইতেই সে বিঘ্ন দূর করিবার আয়োজন করিতেছে। শিবকালীপুরের সকল ব্যবস্থাকে সেই পরম যত্নে সুষ্ঠু করিয়া তুলিয়াছে। সে সুব্যবস্থাকে অব্যবস্থায় পরিণত করিতে যে বিদ্রোহ, সে বিদ্ৰোহ দমন করা কেবল তাহার অধিকার নয়, কর্তব্য। তবে প্রথমেই সে কঠিন শাস্তি দিতে চায় না। চণ্ডীমণ্ডপ ছাওয়ানোর জন্য যাহারা মজুরি চায়, বলে—জমিদারের চণ্ডীমণ্ডপ—তাহারা বিনা মজুরিতে খাঁটিবে কেন, তাহাদের সে বুঝাইয়া দিতে চায়—বিনা বিনিময়ে জমিদারের কতখানি তাহারা ভোগ করে। মাত্র ওই কয়খানা তালপাতাই লয় না। জমিদারের খাস-পতিত ভূমি তাহাদের গরু-বাছুরের একমাত্র চারণভূমি। জমিদারের খাস-পতিত পুকুরের ঘাটে তাহারা নামে, স্নান করে, জল খায়; জমিদারের খাস-পতিত জমির উপর দিয়াই তাহাদের যাতায়াতের পথ। চণ্ডীমণ্ডপ সেই জমিদারের অধিকার বলিয়া বিনা পয়সায় ছাওয়াইবে না।

তাই সে নবনিযুক্ত কালু শেখ চাপরাসীকে হুকুম দিয়াছে—জমিদার-সরকারের বাধে কিংবা পতিত-জমিতে বাউরিবায়েনদের গরু অনধিকার প্রবেশ করিলেই গরুগুলিকে আগল করিয়া কঙ্কণার ইউনিয়ন বোর্ডের খোঁয়াড়ে দিয়া আসিবে। নবনিযুক্ত কালু মনিবকে কাজ দেখাইতে উদ্গ্রীব, তাহার ওপর এ কাজটা লাভের কাজ। খোয়াড়ওয়ালা এক্ষেত্রে গরুপিছু কিছু কিছু প্রকাশ্য চলিত ঘুষ দিয়া থাকে। সে আভূমি-নত এক সেলাম ঠুকিয়া তৎক্ষণাৎ মনিবের হুকুম প্রতিপালন করিতে চলিল। ভূপাল তাহাকে দেখাইয়া দিল—কোনগুলি শ্ৰীহরির অনুগত লোকের গরু। সেগুলি বাদ দিয়া, বাকি গরুগুলি সে ধরিয়া লইয়া গেল খোঁয়াড়ে।

শ্ৰীহরির গ্রাম-শাসনের এই দ্বিতীয় পর্যায়। ইহাতেও যদি লোকে না বোঝে, তবে আরও আছে। একেবারেই সে কঠিনতম দণ্ড দিবে না। অধর্ম সে করিবে না। লক্ষ্মী তাহাকে কৃপা করিয়াছেন, সে তাহার পূর্বজন্মের সুকৃতির ফল, সে উহার অপব্যবহার করিবে না। দানের তুল্য পুণ্য নাই—দয়ার তুল্য ধর্ম নাই—শাস্তিবিধানের সময়েও সেকথা সে বিস্মৃত হইবে না। তাহার ইচ্ছা ছিল, গরুগুলোকে আটক করিয়া তাহার বাড়িতেই রাখিবে, বাউরিবায়েনদের দল আসিয়া কান্নাকাটি করিলে তাহাদের অন্যায়টা বেশ করিয়া বুঝাইয়া দিবে। তাহা হইলে গরিবদের আর খোঁয়াড়ের মাসুলটা লাগিত না। মাসুল বড় কম নয়, গরুপিছু চারি আনা হিসাবে চল্লিশ-পঞ্চাশটা গরুতে দশ-বার টাকা লাগিবে। আবার সামান্য বিলম্ব হইলেই খোয়াড় ভেণ্ডার এক আনা হিসাবে। খোরাকি দাবি করিবে। অথচ খোরাকি এক কুটা খড়ও দেয় না—গরুগুলোকে অনাহারেই রাখে। খোরাকি হিসাবেও টাকা আড়াই-তিন লাগিবে। কিন্তু সে কি করিবে? আইন তাই। বেআইনি করিতে গেলেই দেবুজগন হয়ত তাহাকে বিপদাপন্ন করিবার জন্য মামলা বা দরখাস্ত করিয়া বসিবে।

চণ্ডীমণ্ডপে অর্ধশায়িত অবস্থায় গুড়গুড়ি টানিতে টানিতে সে অলস দৃষ্টিতে গ্রাম-হিতৈষীদের ব্যৰ্থ বিক্রম লক্ষ্য করিতেছিল। কিন্তু এত শীঘ্ৰ খবরটা আনিল কে?

খবরটা আনিয়াছিল তারাচরণ নাপিত। কালু শেখ গরুগুলাকে আটক করিলে রাখাল ছেলেরা মিনতি করিয়া কাঁদিয়া কালু শেখের পায়ে গড়াইয়া পড়িল।ওগো শ্যাখজী গো! তোমার পায়ে পড়ি মশাই, ছেড়ে দ্যান আজকের মতন ছেড়ে দান।

শেখের ক্রোধ হয় নাই, ক্রোধ হইবার হেতুও ছিল না, তবু ঘোড়াগুলোর ওই হাতে-পায়ে ধরা হইতে অব্যাহতি পাইবার জন্য কৃত্ৰিম ক্ৰোধে একটা ভয়ঙ্কর রকমের হক মারিয়া উঠিল–ভাগো হিঁয়াসে।

ঠিক সেই সময়ই ময়ূরাক্ষীর বন্যারোধী বাঁধের উপর দিয়া আসিতেছিল তারাচরণ ভাণ্ডারী। সে থমকাইয়া দাঁড়াইল। ছেলেগুলা শেখজীর হাঁকে ভয় পাইয়া খানিকটা পিছাইয়া গেলেও গরুগুলির সঙ্গ ছাড়িতে পারিতেছিল না। জনদুয়েক রাখাল উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে আরম্ভ করিয়া দিল,—ভাষাহীন হাউহাউ করিয়া কান্না।

কালু বলিল–ওরে উল্লুক, বেকুব, ছুঁচোরা সব, বাড়িতে বুল গা যা। হাউমাউ করে চিল্লাস না।

ছেলেগুলা সেকথা বুঝিল না, তাহারা ওই গরুগুলির মমতার আকর্ষণেই গরুর পালের পিছনে পিছনে চলিল। কান্নার বিরাম নাই।ওগো, কি করব গো? কি হবে গো?

শেখ আবার পিছনে তাড়া করিল—ভাগ্‌ বুলছি!

ছেলেগুলা খানিকটা পিছাইয়া আসিল; কিন্তু শেখ ফিরিবার সঙ্গে সঙ্গেই তাহারাও আবার ফিরিল।

তারাচরণ ব্যাপারটা বুঝিয়া লইল। কাল সে শ্ৰীহরির পায়ের নখের কোণ তুলিতে তুলিতে। ইহার খানিকটা আভাসও পাইয়াছিল। তারাচরণ দ্রুতপদে গ্রামে ফিরিয়া দেবুর খিড়কির দরজায় দাঁড়াইয়া তাহাকে সন্তৰ্পণে ডাকিয়া সংবাদটা দিয়া চলিয়া গেল। বলিল—শিগগির ব্যবস্থা কর ভাই, নইলে এক আনা করে ফাজিল লেগে যাবে। সে-ও আড়াই টাকা, তিন টাকা। ছটা বাজলে আজ আর গরু দেবেই না। কাল দু আনা করে বেশি লাগবে গরুতে।

খিড়কির দরজা দিয়াই সে বাহির হইয়া চলিয়া গেল। শ্ৰীহরি ঘোষ যে চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়া আছে, সে বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ। পণ্ডিতের বাড়ি হইতে বাহির হইতে দেখিলেই ঘোষ ঠিক তাহাকে সন্দেহ করিয়া বসিবে। জঙ্গলের আড়াল হইতে তারাচরণ এক ফাঁক দিয়া চণ্ডীমণ্ডপের দিকে চাহিয়া দেখিল, তাহার অনুমান অভ্রান্ত। এক ঝিলিক সকৌতুক হাসি তারাচরণের মুখে খেলিয়া গেল।

* * *

দেবু কিছুক্ষণ মাটির দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। আজ কয়েক দিন হইতেই যে আঘাত সে আশঙ্কা করিয়া আসিতেছিল সে আঘাতটা আজ আসিয়াছে। ইহার দায়িত্ব। সমস্তটাই তো প্রায় তাহার। এ কথা সে কোনো দিন মুহুর্তের জন্য আপনার কাছে অস্বীকার করে নাই। আঘাতটা আসিবার সঙ্গে সঙ্গে আপন মাথা পাতিয়া দিয়া নির্দোষ গরিবদের রক্ষা করিবার জন্য অহরহ সচেতন হইয়াই সে প্রতীক্ষা করিতেছে।

গরিবেরা পয়সাই বা পাইবে কোথা? তারাচরণ বলিয়া গেল, এক আনা হিসাবে বেশি লাগিবে-আড়াই টাকা, তিন টাকা বেশি লাগিবে। তাহা হইলে গরু অন্তত চল্লিশ-পঞ্চাশটি। মনে মনে সে হিসাব করিয়া দেখিল—দশ টাকা হইতে পনের টাকা দণ্ড লাগিবে। এ দণ্ড উহারা কোথা হইতে দিবে? জমি নাই, জেরাত নাই,সম্বলের মধ্যে ভাঙা বাড়ি আর ওই গরু-ছাগল। গাইগরুর দুধ বিক্রি করে, গোবর হইতে ঘুঁটে বিক্রি করে, গরু-বাছুর-ছাগল বিক্রি করে, ওই পশুগুলিই তাহাদের একমাত্র সম্পদ। ইছু শেখ এ সময়ে টাকা দিতে পারে, কিন্তু তাহার এক টাকার মূল্য হিসাবে অন্তত সে দুই টাকা আদায় করিয়া লইবে। তা ছাড়া উহাদের এই বিপদের জন্য দায়ী একমাত্র সে-ই। সে বেশ জানে, সেদিন ওই তালপাতা উপলক্ষ করিয়াই একটা মিটমাট হইয়া যাইত, উহারা শ্রীহরির বশ্যতা স্বীকার করিয়া লইয়া বাঁচিত। কিন্তু সেই তাহাদিগকে উঠিয়া আসিতে বলিয়াছিল। অন্যায়কে অস্বীকার করিতে সে-ই প্রেরণা দিয়াছিল। আজ নিজের বেলায় ন্যায়কে ধর্মকে মাথায় তুলিয়া না লইলে চলিবে কেন?

আরও কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করিয়া মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইল। ডাকিল—বিলু!

তারাচরণ ডাকিতেই বিলুও আসিয়া আড়ালে দাঁড়াইয়াছিল। সংবাদটা দিয়া তারাচরণ চলিয়া গেলেও বিলু দেবুর সম্মুখে না আসিয়া নীরবে সেই আড়ালেই দাঁড়াইয়া ছিল। সেও ওই গরিবদের কথাই ভাবিতেছিল; আহা, গরিব! উহাদের ওপর নাকি এই অত্যাচার করে! এই স্তব্ধ। দুপুরে বাউরিবায়েনপাড়ায় মেয়েদের সকরুণ কান্না শোনা যাইতেছে। শুনিয়া বিলুরও কান্না। পাইল, সে কাঁদিতেছিল। দেবুর ডাক শুনিয়া তাড়াতাড়ি চোখ মুছিয়া আসিয়া কাছে দাঁড়াইল।

দেবু বিলুর সর্বাঙ্গে অনুসন্ধান করিয়া দেখিল। কোথাও একটুকরা সোনা নাই। চাষীর ঘরে সোনার অলঙ্কারের বড় প্ৰচলন নাই। খুবজোর নাকে নাকছাবি, কানে ফুল, গলায় বিছাহার, হাতে শখাবাধা; বিলুর সেসব গিয়াছে।

বিলু বলিল–কি বলছ?

–কিছু নাই আর?

–কি?

–বাঁধা দিয়ে গোটাপনের টাকা পাওয়া যায়—এমন কিছু?

বিলু কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করিয়া বোধ করি তাহার সকল ভাণ্ডার মনে মনে অনুসন্ধান করিয়া দেখিল। তারপর সে ঘরের ভিতর গিয়া দুই গাছি ছোট বালা হাতে করিয়া ফিরিয়া আসিল।

দেবু দুই পা পিছাইয়া গেল—খোকার বালা?

–হ্যাঁ। এই বালা দুই গাছি দিয়াছিল বিলুর বাপ। দেবুর অনুপস্থিতিতে শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও বিলু এ-দুটিকে হস্তান্তর করতে পারে নাই।

বিলু বলিল–নাও।

—খোকার বালা নেব?

—হ্যাঁ নেবে। আবার যখন হবে তোমার, তুমি গড়িয়ে দেবে।

–যদি খালাস না হয়, আর গড়াতে না পারি!

–পরবে না খোকা।

দেবু আর দ্বিধা করিল না। বালা দুই গাছা লইয়া জামাটা গায়ে দিয়া দ্রুতদে বাহির হইয়া গেল।

 

গরুগুলিকে খালাস করিয়া ফিরিল সে সন্ধ্যার সময়। অর্ধেকদিন রৌদ্রে ঘুরিয়া জামাকাপড় ঘামে ভিজিয়া গিয়াছে। তাহার ওপর একপাল গরুর পায়ের ধুলায় সর্বাঙ্গ কাদায় আচ্ছন্ন। যতীনের দুয়ারে তখন বেশ একটা মজলিস বসিয়া গিয়াছে।

তাহাকে দেখিয়া সকলে প্ৰায় একসঙ্গে প্রশ্ন করিয়া উঠিল—কি হল দেবু?

—ছাড়ানো হয়েছে গরু।

দেবু তৃপ্তির হাসি হাসিল।

–কত লাগল?

সে কথার উত্তর না দিয়া দেবু বলিল—যতীনবাবু!

—বলুন?

–একটা কথা বলব আপনাকে।

–দাঁড়ান। আপনাকে বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আগে একটু চা করি আপনার জন্য।

–না। এখনই বাড়ি যাব আমি। কথাটা বলে যাই।

যতীন দেবুকে লইয়া ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল।

দেবু মৃদু অথচ দৃঢ় স্বরে বলিল–প্রজা-সমিতির ভার আমিই নেব।

—দাঁড়ান, চা খেয়ে তবে যেতে পাবেন।

সে বাড়ির ভিতরে গিয়া ডাকিল–মা-মণি! মা-মণি!

কেহ সাড়া দিল না।

পদ্ম বাড়িতে নাই, সে গিয়াছে উচ্চিংড়ের সন্ধানে। উচ্চিংড়ে এখনও ফেরে নাই, তাহাকে খুঁজিতে বাহির হইয়াছে।

যতীন নিজেই চায়ের জল চড়াইয়া দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *