২১. চাষ আর বাস

চাষ আর বাস পল্লীর জীবনে দুইটা ভাগ। মাঠ আর ঘর—এই দুইটি ক্ষেত্রেই এখানে জীবনের সকল আয়োজন সকল সাধনা। আষাঢ় হইতে ভাদ্ৰ—এই তিন মাস পল্লীবাসীর দিন কাটে মাঠে-কৃষির লালন-পালনে। আশ্বিন হইতে পৌষ সেই ফসল কাটিয়া ঘরে তোলে—সঙ্গে সঙ্গে করে রবি ফসলের চাষ। এ সময়টাও পল্লীজীবনের বার আনা অতিবাহিত হয় মাঠে। মাঘ হইতে চৈত্র পর্যন্ত তাহার ঘরের জীবন। ফসল ঝাড়িয়া, দেনা-পাওনা মিটাইয়া সঞ্চয় করে, আগামী চাষের আয়োজন করে; ঘরের ভিতর-বাহির গুছাইয়া লয়। প্ৰয়োজন থাকিলে নূতন ঘর তৈয়ারি করে, পুরনো ঘর ছাওয়ায়, মেরামত করে; সার কাটিয়া জল দেয়, শণ পাকাইয়া দড়ি করে। গল্প-গান-মজলিস করে, চোখ বুজিয়া হরদম তামাক পোড়ায়, বর্ষার জন্য তামাক কাটিয়া গুড় মাখাইয়া হাঁড়ির মধ্যে পুরিয়া জলের ভিতর পুঁতিয়া পচাইতে দেয়। চাষীর পরিবারের যত বিবাহ সব এই সময়ে মাঘ ও ফারুনে। জের বড়জোর বৈশাখ পর্যন্ত যায়। হরিজনদের চৈত্র মাসেও বাধা নাই, পৌষ হইতে চৈত্রের মধ্যেই বিবাহ তাহারা শেষ করিয়া ফেলে।

অকালে চৈত্র মাসের মাঝামাঝি এই অকাল-কালবৈশাখীর ঝড়জলে সেই বাঁধাধরা। জীবনে একটা ধাক্কা দিয়া গেল। ভোরবেলায় শণের দড়ি পাকানো ছাড়িয়া সবাই মাঠে গিয়া। পড়িল। প্রবীণদের সকলের হাতেই হুঁকা। অল্পবয়সীদের কোঁচড়ে অথবা পকেটে বিড়ি-দেশলাই, কানে আধপোড়া বিড়ি। সকলে আপন আপন জমির চারিপাশের আইলে ঘুরিয়া। বেড়াইতেছে। উচু ডাঙা জমিতে দুই-চারি জন আজই লাঙলের চাষ দিতে আরম্ভ করিয়াছে। নিম্নভূমি—জোলা জমিগুলিতে এখনও জল জমিয়া আছে, দুই-চারি দিন গিয়া খানিকটা না শুকাইলে এসব জমিতে চাষ চলিবে না। ময়ূরাক্ষীর চরভূমিতে তরিতরকারির চারাগুলি মাতৃস্তন্যবঞ্চিত শীর্ণকায় শিশুর মত এতদিন কোনোমতে বাঁচিয়া ছিল। এইবার মহীরাবণের পুত্র অহিরাবণের মত দশ দিনে দশমূর্তি হইয়া উঠিবে। তিলের ফুল সবে ধরিতেছে, জলটায় তিলের খানিকটা উপকার হইবে। তবে অপকারও কিছু হইয়া গেল, যে ফুলগুলি সদ্য ফুটিয়াছিল, এই বর্ষণে তাহার মধু ধুইয়া যাওয়ায় তাহাতে আর ফল ধরিবে না। এইবার আখ লাগানো চলিবে। জলটায় উপকার হইয়াছে অনেক। তবে গ্রামে ঘরবাড়ির ক্ষতি হইয়াছে প্রচুর। তাহার আর কি করা যাবে?

গ্রামের মেয়েরা ঝড়ে বিপর্যস্ত বাড়িঘর পরিষ্কার করিতে ব্যস্ত। কোমরে কাপড় বাঁধিয়া খড়কুটা জড়ো করিতেছে,সমস্ত সারে ফেলিতে হইবে। ছেলের দল আমবাগানে ছুটিয়া সেই ভোরবেলায় কেঁচড় ভরিয়া আমের গুটি কুড়াইতেছে। হরিজনদের মেয়েরা ঝুড়ি কাখে পথেঘাটে-বাগানে—পাতা-খড়-কাঠি শুকনা ডাল-পাতা সংগ্রহ করিয়া প্ৰকাণ্ড বোঝা বধিয়া ঘরে আনিয়া ফেলিতেছে; জ্বালানি হইবে। তাহাদের নিজেদের ঘর-দুয়ার এখনও সাফ হয় নাই। পুরুষেরা যে যার কাজে গিয়াছে। কেহ চাষী-গৃহস্থবাড়ির বাধা কাজে, কেহ জংশনে কলের কাজে, কেহ ভিন-গাঁয়ে দিনমজুরিতে।

দুর্গা আপনার ঘরে বসিয়া ছিল। তাহার কাজ বাঁধাধরা। তাহার বাহিরে সে যায় না। সে এইসব পাতা-কুটা কুড়াইয়া কখনও জ্বালানি করে না। জ্বালানি সে কেনে। ভোরবেলায় একদফা দুধ দোহাইয়া সে নজরবন্দিবাবুকে দিয়া আসিয়াছে; পথে বিলু-দিদিকেও খানিকটা দিয়া, সেইখানেই চা খাইয়া, বাড়ি আসিয়া বসিয়াছে। আগে আগে কিছুদিন সে চা খাইত কামারবউয়ের বাড়িতে; কামার-বউ নজরবন্দিবাবুর চা করিত, নজরবন্দিকে চা দিয়া বাকিটা পদ্ম এবং দুর্গা খাইত। কিন্তু সেদিন পদ্মের সেই রূঢ় কথার পর আর সে কামার-বউয়ের বাড়ির ভিতর যায় না। বাহিরে বাহিরেই নজরবন্দিবাবুর দুধের যোগান দিয়া, দুই-চারটা কাজকর্ম করিয়া দিয়া চলিয়া আসে। নজরবন্দিও আজ কয়েক দিন তাহাকে কোনো কথা বলে নাই। সে বসিয়া বসিয়া ভাবিতেছিল, কাল হইতে সে আর নিজে দুধ দিতে যাইবে না; মাকে দিয়া পাঠাইয়া দিবে। যে মানুষ কথা কয় না, তাহাকে যাচিয়া কথা বলা তাহার অভ্যাস নাই।

দুর্গার মা উঠান সাফ করিতেছিল; বউটা ডাল-পালা-খড়কুটা কুড়াইতে গিয়াছে। পাতু আপনার ছেলেটাকে লইয়া বসিয়া আছে দাওয়ার উপর। লোকে বলে ছেলেটা নাকি দেখিতে অনেকটা হরেন ঘোষালের মত হইয়াছে, কিন্তু তবু পাতু ছেলেটাকে বড় ভালবাসে। বছরখানেকের মধ্যে পাতুর অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটিয়াছে। অবস্থা এবং প্রকৃতি দুয়েরই। পূর্বে পাতু বায়েন বেশ মাতব্বর লোক ছিল। আচারে-ব্যবহারে বেশ একটু ভারিক্কি চাল দেখাইয়া চলিত। তখন পাতুর চালচতি দেখিয়া লোকে হিংসা করিত। ভাগাড়ের চামড়া হইতে তাহাদের ছিল মোটা আয়। চামড়া বেচিত, কতক চামড়া নিজে পরিষ্কার করিয়া ঢোল, তবলা, বায়া, খোল প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র ছাইয়া দিত। পাতুর ছাওয়া খোল তবলার শব্দের মধ্যে কাসার আওয়াজের মিঠা রেশ বাজিত। এই ভাগাড় হইতেই আসিত তাহার আয়ের বার আনা। বাকি সিকি আয় ছিল চাকরান-জমির চাষ এবং এখানে-ওখানে ঢাকের বাজনা হইতে। ভাগাড়টা এখন হাতছাড়া। হইয়া গিয়াছে। জমিদার টাকা লইয়া বন্দোবস্ত করিয়াছে। বন্দোবস্ত লইয়াছে আলেপুরের রহমৎ শেখ এবং কঙ্কণার রমেন্দ্র চাটুজ্জে।

চাকরান-জমিও পাতুর গিয়াছে, সে-জমি এখন জমিদারের খাসখতিয়ানের অন্তর্ভুক্ত। জমিটা পাতু নিজেই ছাড়িয়া দিয়াছে। না দিয়াই বা উপায় কি ছিল? তিন বিঘা জমি লইয়া বার মাস পালপার্বণে ঢাক বাজাইয়া কি হইবে? যে দিন বাজাইতে হইবে সেই দিনটাই মাটি। তার চেয়ে সে বরং নগদ মজুরিতে এখানে ওখানে বাজনা বাজাইয়া আসে সে ভাল। বায়না থাকিলে পরিষ্কার কাপড়ের উপর চাদর বাঁধিয়া ঢাক কাঁধে লইয়া পাতু বাহির হয়, ফিরিয়া আসে দুইএকটি টাকা লই; উপরন্তু দুই-একটা পুরনো জামাকাপড়ও লাভ হয়। প্রায় বারটা মাসই সে এখন বেকার। জনমজুর খাঁটিতেও পরে না! বাদ্যকর-বায়েন বলিয়া তাহার একটি সম্ভ্রম আছে, সে জনমজুর খাঁটিবে কেমন করিয়া? বসিয়া বসিয়া সে ভাগাড় বন্দোবস্ত লওয়ার কথাটাই ভাবে। তাহার চেয়েও ভাল হয় যদি চামড়ার ব্যবসা করিতে পারে। তাহাদেরই স্বজাতি নীলু বায়েন এখন অবশ্য নীলু দাস-চামড়ার ব্যবসা করিয়া লক্ষপতি ধনী হইয়াছে। এখন সে কলিকাতায় থাকে, মস্ত বড় চামড়ার ব্যবসা। মস্ত বাড়ি করিয়াছে, বাড়িতে ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। সেসব দেখিবার জন্য এম-এ, বিল-এল পাস করা একজন সরকারি হাকিম সরকারি চাকরি ছাড়িয়া তাহার ম্যানেজারি করিতেছে। প্রকাণ্ড বসতবাড়ি, হাওয়া-গাড়ি, ঠাকুর-বাড়ি আছে। দেশে আপনার গ্রামে কঙ্কণার বাবুদের মত ইস্কুল ও হাসপাতাল করিয়া দিয়াছে। তাহার ছেলে নাকি লাটসাহেবের মেম্বার। পাতু চামড়া ব্যবসায় ও ভাগাড় বন্দোবস্ত লইবার কল্পনা করে, সঙ্গে সঙ্গে এমনি ঐশ্বর্যের স্বপ্ন দেখে!

বার মাস জীবন ধারণের ব্যবস্থা করে তাহার স্ত্রী এবং দুর্গা। যে পাতু একদা দুর্গাকে কঠিন ক্ৰোধে লাঞ্ছিত করিয়াছিল—ছিরু পালের প্রতি প্রীতির জন্য, সেই পাতু হরেন ঘোষালের সঙ্গে সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও ছেলেটাকে ভালবাসে দিনরাত আদর করে। মধ্যে মধ্যে ঘোষালের কাছে যায়, আবদার করিয়া বলে-আজ চার আনা পয়সা কিন্তু দিতে হবে, ঘোষালমশায়!

দুর্গা নৈশ অভিসারে যায় কঙ্কণায়, জংশনে। প্রতীক্ষমাণ ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করে—সঙ্গে কে ও? অন্ধকারের অস্পষ্ট মূর্তিটি সরিয়া যায়, দুর্গা বলেও আমার সঙ্গে এসেছে।

—কে?

–আমার দাদা।

অস্পষ্ট মূৰ্তি হেঁট হইয়া নীরবে নমস্কার করে।

দুর্গা বলে—একটা সিগারেট দেন, ও ততক্ষণে বসে বসে খাক।

বাবুদের বাগান-বাড়ির কোনো গাছতলায় অথবা বারান্দায় সিগারেটের আগুনের আভায় পাতুকে তখন চেনা যায়। আসিবার সময় সে একটা মজুরি পায়চার আনা হইতে আট আনা; দুর্গা আদায় করিয়া দেয়।

সেদিন পাতু মনস্থির করিয়া বারবার দুর্গাকে বলিল—সঁচিশ টাকা বৈ তো লয়! দে না দুৰ্গ, ভাগাড়টা জমা নিয়ে লি।

দুর্গা বলিল—সে হবে। আজ এখুনই দুটো গাছের তালপাতা কেটে আগা দিকি, ঘরটা তো ঢাকতে হবে।

এই তাহাদের চিরকালের ব্যবস্থা। উড়িলে কি পুড়িলে ঘরের জন্য ইহারা ভাবে না। পুড়িলে কাঠ-বাঁশের জন্য তবু ভাবনা আছে; উড়িলে সেটা ইহারা গ্রাহ্য করে না। মাঠে খাস-খামারের পুকুরের পাড়ের অথবা নদীর বাঁধের উপরের তালগাছ কাটিয়া আনিয়া ঘর ছাইয়া ফেলে। শুধু পুরুষদের ফিরিবার অপেক্ষা কাজ হইতে ফিরিয়া তাহারা গাছে উঠিয়া পাতা কাটিবে, মেয়েরা মাথায় তুলিয়া ঘরে আনিবে। দু-চারি জন মেয়েও গাছে চড়িয়া পাতা কাটে। দুর্গাও এককালে তালগাছে চড়িতে পারি, কিন্তু এখন আর গাছে চড়ে না। প্রয়োজনও নাই, তাহার কোঠাঘরের চালে বেশ পুরু খড়ের ছাউনি—মজবুত বাঁধানে বাধা। তাহার চালের খড় কিছু বিপর্যস্ত হইয়াছে, বিশৃঙ্খল হইয়াছে এই মাত্র, উড়িয়া যায় নাই। ওগুলাকে আবার সমান করিয়া বসাইতে অবশ্য গোটা দুয়েক মজুর লাগিবে। এ কাজ পাতুকে দিয়াই হইবে, তাহাকেই বরং দুই দিনের মজুরি দিবে।

দুর্গার কথার উত্তরে পাতু বলিল–হুঁ।

–হুঁ তো ওঠ!

—বউটো আসুক আগে।

–বউ এলে পাঠিয়ে দোব, বউকে মাকে; তুই এখন যা দিক। পাতা কেটে ফেল গা যা।

দুর্গার মা উঠান পরিষ্কার করিতে করিতে বলিলমা লারবে বাছা। তুমি খেতে দিচ্ছ—তোমার তিলশুনো খাটছি, উপায় নাই, আবার বেটার খাটুনি খাটতে আরব আমি। ক্যানে, কিসের লেগে? কখনও মা বলে দু গণ্ডা পয়সা দেয়, না একটুকরা ট্যানা দেয় যে ওর লেগে আমি খাটব?

পাতু হুঙ্কার দিয়া উঠিল—আমরা দিই না তোর কোন্ বাবা দেয় শুনি?

—শুনলি দুৰ্গ, বচন শুনলি খাল্‌ভরার?

দুর্গা বাধা দিয়া বলিল—থা বাপু তোরা। তোর গিয়েও কাজ নাই, চেঁচিয়েও কাজ নাই। বউ আসুক আমরা দুজনায় যাব। দাদা তু এগিয়ে চল।

 

কোমরে কাটারি গুঁজিয়া পাতু আসিয়া উঠিল নদীর ধারে। ময়ূরাক্ষীর বন্যারোধী বাঁধটা নদীর সঙ্গে সমান্তরাল হইয়া পূর্ব-পশ্চিমে চলিয়া গিয়াছে। বাঁধের গায়ে সারবন্দি অসংখ্য তালগাছ এবং শরগাছ। পাতু বাছিয়া বাছিয়া ঢলকো পাতা দেখিয়া একটা গাছে চড়িয়া বসিল।  ওই খানিক দূরে গাছের উপর আখনা অর্থাৎ রাখহরি বাউরি পাতা কাটিতেছে। তার ওধারের গাছটায়ও কে? পুরুষ নয়, মেয়ে! আখনার বউ পরী? এপাশে ওই গাছটায়ও ওটা কে? পাতু ঠাহর করিতে না পারিয়া ডাকিল—কে রে উখানে?

আমি গণা। অর্থাৎ গণপতি।

–আর কে বটে?

–আমার পাশে বাঁকা, হুই রয়েছে ছিদাম। হুই মতিলাল।

গাছে চড়িয়াই সবার আলাপ-আলোচনা চলিতেছিল। সহসা এদিকে আখনা চিৎকার করিয়া উঠিল হুই? হুস হুই ধা! উঃ! হুস ধা, উঃ! বাবা রে, মেরে ফেলাবে লাগটে! হিশ, ঠোঁটের ঢাড় কি রে বাবা!

আখনার জিহ্বার একটু জড়তা আছে, স্পষ্ট কথা বাহির হয় না।

আখনাকে দুইটা কাক আক্ৰমণ করিয়াছে। মাথার উপর কা-কা করিয়া উড়িতেছে আর ঠোঁট দিয়া ঠোকর মারিতেছে। গাছটায় কাকের বাসা আছে। ওপাশে পরী, স্বামীকে গাল পাড়িতেছে ড্যাকরা বাঁশবুকোকে দশবার যে মানা করলাম, কাগের বাসা আছে, উঠি না! কেমন হইছে–বলিতে বলিতে আখনার বিব্রত অবস্থা দেখিয়া সে খিলখিল করিয়া হাসিয়া সারা হইল।

দূরে দুম করিয়া একটা শব্দ উঠিল। সর্বনাশ! কে পড়িয়া গেল? ওঃ, ভাদ্র মাসের পাকা তালের মত পড়িয়াছে। ফাটিয়া গেল না তো? না, মরে নাই, নড়িতেছে। যাক উঠিয়া বসিয়াছে। বাপ রে! আচ্ছা শক্ত জা! নদীর ধারের ভিজা মাটি—তাই রক্ষা! কিন্তু লোকটা কে?

—কে বটিস রে?

লোকটা উঠিয়া পঁড়াইয়া জবাব দিল—সাপ!

–সাপ?

—খরিশ। যেমন ইদিকের পাতায় উঠতে যাব-অমনি শালা—ফেঁস করে ফণা নিয়ে উঠেছে উদিকের পাতায়। কি করব, লাফিয়ে পড়লাম।

ফড়িং বাউরি। ছোঁড়া খুব শক্ত। খুব বাঁচিয়াছে আজ। সাপটা পাখির ডিমের সন্ধানে খেঙো বাহিয়া গাছে উঠিয়াছে।

—ওরে বাবা! পাতুরও জ্বালা কম নয়, একটা পাতা কাটিতেই অসংখ্য পিঁপড়ে বাহির হইয়া তাহার সর্বাঙ্গে ঘঁকিয়া ধরিয়াছে। পাতু গামছাটা খুলিয়া গামছার আছাড়ে সেগুলিকে ঝাড়িয়া ফেলিতে আরম্ভ করিল। দূর শালা, দূর! ধ্যেৎ! ধ্যেৎ! ধ্যেৎ!

***

দুৰ্গা আয়না দেখিয়া নরুন দিয়া দাঁত চাঁচিতেছিল। পরিষ্কার-পরিষ্কার দুর্গার একটা বাতিক। তাহার দাঁতগুলি শাঁখের মত ঝকঝক করা চাই। মধ্যে মধ্যে দাঁতে একটু আধটু পানের ছোপ পড়ে, খুব ভাল করিয়া দাঁত মাজিলেও যায় না। তখন সে তরুন দিয়া সেই ছোপের দাগ চাচিয়া তুলিয়া ফেলে। বউ ফিরিলেই সে বউকে লইয়া পাতা বহিয়া আনিতে যাইবে। হাঙ্গামা অনেক মাথায় চুলে ময়লা লাগিবে, সর্বাঙ্গ ধুলায় ভরিয়া যাইবে, কাপড়খানা আর পরা চলিবে না। কিন্তু তবু উপায় কি? মায়ের পেটের ভাই।

মা বলিলবউ রোজগার করছে, কখুনো একটা পয়সা দেয় আমাকে শাশুড়ি বলে ছেদ্দা করে?

দুর্গা হাসিয়া বলিল-থাক মা, আর বলিস না; ওই পয়সা ছুঁতে হয়?

মা এবার ঝঙ্কার দিয়া উঠিল—ওললা সীতের বেটি সাবিত্তিরি আমার। তারপর সে আরম্ভ করিল তিন কালের কথা, তাহার নিজের মা-শাশুড়ির আমলের শ্রুতিকথা, নিজেদের কালের স্মৃতিকথা, বর্তমান যুগের প্রত্যক্ষ বধূ-কন্যার বিবরণ-কাহিনী। অবশেষে বলিলবউ হারামজাদী সাবিত্তির, তখন ফণা কত? কত বলেছিলাম, তা নাক ঘুরিয়ে তখন বলত ছি! এখন

তো সেই ছি তপ্তভাতে ঘি হইছে। সেই রোজগারে প্যাট চলছে, পরন চলছে।

পাড়ার ভিতর হইতে কে গালি দিতে দিতে আসিতেছিল। দুর্গা বলিলথাম মা, থাম, আর কেলেঙ্কারি করিস না। নোক আসছে।

চিৎকার করিয়া গালি দিতেছিল রাঙাদিদি।

হবে না, দুগ্রগতি হবে না, আরও হবে। এরপর বিনি ঝড়ে উড়ে যাবে, বিনি আগুনে পুড়ে যাবে। ধানের ভেতর চাল থাকবে না, শুধু আগরা হবে।

দুৰ্গা হাসিয়া প্রশ্ন করিলকি হল রাঙাদিদি?

রাঙাদিদি সেই সুরের ঝঙ্কার দিয়া উঠিল—ধৰ্ম্মকে সব পুড়িয়ে খেলে মা। পিরথিমিতে ধৰ্ম্ম বলে আর রইল না কিছু।

চিৎকার করিয়া দুর্গা বলিল—কি হল কি? কে কি করলে?

—ওই গাঁদা মিনসে গোবিন্দে। এতকাল দিয়ে এসে আজ বলছে–না।

–কি?

—কি? ক্যানে, তুই আবার বেলাত থেকে এলি নাকি? পাড়ার নোক জানে, গায়ের নোক জানে, তুই জানিস না? বলি তুই কেলা ঘুড়ি? একে তো চোখে দেখতে পাই না, তার ওপর মুখপোড়া সুয্যির রোদের ছটা দেখ ক্যানে? চিনতে পারছি, তুই কে?

—আমি–দুগ্‌গা গো!

—দুগ্‌গা? মরণ! আপন ঠেকারেই আছিস। পরের কথা মনে থাকে না-ক্যানে? গোবিন্দের বাবা আমার কাছে দু টাকা ধার নিয়েছিল—জানিস না? বুড়ো ফি মাসে দু আনা সুদ আমাকে দিয়ে আসত। তা ছাড়া যখন ডেকেছি, তখনই এসেছে। ঘরে গোঁজা দিয়েছে, বর্ষায় নালা ছাড়িয়ে দিয়েছে। সে মল, তারপর গোবিন্দ দশ-বার বছর মাসে মাসে সুদ দিয়েছে, ডাকলে। এসেছে। আজ ডাকতে এলাম, তা বলে কিনা—মোল্লান, অনেক দিয়েছি, আর সুদও দোব না, আসলও দোব না, বেগারও দোব না। আমি চললাম দেবুর কাছে! চার পো কলি, মা! এখন যদি সবাই এই বলে তো আমার কি দুগ্‌গতি হবে।

এমন খাতক বৃদ্ধার অনেকগুলি আছে, অন্তত দশ-বার জন, দুই কুড়ির উপর টাকা পড়িয়া আছে। পুরুষানুক্রমে তাহারা সুদ গনিয়া যাইতেছে, বৃদ্ধা মরিলে আর আসল লাগিবে না। তবে এমন মহাজন গ্রামে আরও কয়েকজন আছে। সকলেই প্ৰায় স্ত্রীলোক এবং তাহাদের ওয়ারিশ আছে। আসলে ইহাদের ঋণআইনের ধারাই এমনি।

বৃদ্ধা যাইতে যাইতে আবার পাঁড়াইল—বলি দুগ্‌গা শোন!

—কি বল?

–একজোড়া মাকুড়ি আছে, লিবি? সোনার মুকুড়ি!

–মাকুড়ি? কার মাকুড়ি? কার জিনিস বটে?

–আয় আমার সঙ্গে। খুব ভাল জিনিস। জিনিস একজনার বটে, কিন্তু সে লেবে না। তা। মাকুড়ি কি করব আমি? তু লিস তো দেখ।

–না দিদি, আজ হবে না। আজ এখন তালপাতা আনতে যাব।

–মরণ, তুই আবার তালপাতা নিয়ে কি করব?

–আমার নয়, দাদার লেগে।

–ওরে দাদা-সোহাগী আমার! দাদার লেগে ভেবে ভেবে তো মরে গেলি! বুড়ি আপন মনেই বকবক করিতে করিতে পথ ধরিল। কিছুদূর গিয়া একটা গর্তের কাদায় পড়িয়া বৃদ্ধা মেঘকে গাল দিল, ইউনিয়ন বোর্ডের ট্যাক্স আদায়কারীকে গাল দিল, কয়েকটা ছেলে কাদা লইয়া। খেলিতেছিল—তাহাদের চতুর্দশ পিতৃপুরুষকে গাল দিল। তারপর জগন ডাক্তারের ডাক্তারখানার সম্মুখে ওষুধের গন্ধে নাকে কাপড় দিয়া ওষুধকে গাল দিল, ডাক্তারকে গাল দিল, রোগকে গাল দিল, রোগীকে গাল দিল। টাকা মারা যাইবার আশঙ্কায় বৃদ্ধা আজ ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিয়াছে। দেবুর বাড়ির কাছে আসিয়া ডাকিল–দেবু পণ্ডিত!

কেহ সাড়া দিল না। বিরক্ত হইয়া বৃদ্ধা বাড়ি ঢুকিল বলি কানের মাথা খেয়েছিস নাকি তোরা! অ দেবু?

বিলু বাহির হইয়া আসিল—কে, রাঙাদিদি!

—আমার মতন কানের মাথা খেয়েছিল; চোখের মাথা খেয়েছি? শুনতে পায় না? দেখতে পাস না?

বিলু ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসিল, এ কথার কোনো উত্তর দিল না। বুঝিল রাঙাদিদি বেজায় চটিয়াছে।

—সেই ছোঁড়া কই? দেবা?

–বাড়িতে নেই, রাঙাদিদি।

–কি বলি চেঁচিয়ে বল। গাড়ি কোথা গেল আবার?

–গাড়িতে নয়। বাড়িতে নেই। চণ্ডীমণ্ডপে গেল।

–চণ্ডীমণ্ডপে?

–হ্যাঁ।

–আচ্ছা। সেখানে যাচ্ছি আমি। বিচার হয় কি না দেখি। ভালই হল, দেবুও আছে–ছিও আছে। কান ধরে নিয়ে আসুক হারামজাদাকে। এত বড় বড় হয়েছে! ধৰ্ম্ম নাই, বিচার।

নাই?

বুড়ি বকিতে বকিতে চলিল চণ্ডীমণ্ডপের দিকে।

 

চণ্ডীমণ্ডপে তখন জমজমাট মজলিস।

ভুপাল বান্দী লাঠি হাতে দাঁড়াইয়া আছে। ষষ্ঠীতলায় মাথায় হাত দিয়া বসিয়া আছে পাতু, রাখহরি, পরী, বাকা, ছিদাম, ফড়িং আরও জনকয়েক। পাশে পড়িয়া আছে কয়েক অ্যাঁটি তালপাতার বোঝা। ময়ূরাক্ষীর বন্যারোধী বধ জমিদারের সম্পত্তি; সেখানকার তালগাছও জমিদারের। সেই গাছ হইতে পাতা কাটার অপরাধে ভূপাল সকলকে ধরিয়া আনিয়াছে। শ্ৰীহরি গম্ভীর মুখে গড়গড়া টানিতেছে। দেবু একধারে চুপ করিয়া বসিয়া আছে, তাহাকে ডাকিয়া আনিয়াছে পাতুদের দল। হরেন ঘোষাল নিজেই আসিয়াছে; সে প্রজা-সমিতির সেক্রেটারি। চিৎকার করিতেছে সে-ই।

–ওরা চিরকাল পাতা কেটে আসছে, বাপ-পিতামহের আমল থেকে। ওদের স্বত্ব জন্মিয়ে গেছে।

ঘোষালের কথায় শ্রীহরি জবাবই দিল না। পাতুসে বহুদিন হইতেই শ্রীহরির সঙ্গে মনে মনে একটি বিরোধ পোষণ করিয়া আসিতেছে—সে একটু উষ্ণভাবেই বলিল-পাতা তো চিরকাল কেটে আসা যায়, মাশায়। এ তো আজ নতুন নয়!

চিরকাল অন্যায় করে আসছিলি বলে আজও অন্যায় করবি গায়ের জোরে? কাটিস, সেটা চুরি করে কাটিস।

দেবু এতক্ষণে বলিল—চুরি একে বলা চলে না শ্ৰীহরি! আগে জমিদার আপত্তি করত না, ওরা কাটত। এখন তুমি গোমস্তা হিসাবে আপত্তি করবেশ, আর কাটবে না। এরপর যদি না বলে কাটে, তখন চুরি বলতে পারবে।

ঘোষাল বলিলনো, নেভার। ও তুমি ভুল বলছ, দেবু। গাছের পাতা কাটবার স্বত্ব ওদের আছে। তিন পুরুষ ধরে কেটে আসছে। তিন বছর ঘাট সরলে, পারে কেউ সে ঘাট বন্ধ করতে না পথ বন্ধ করতে?

হাসিয়া শ্ৰীহরি বলিল গাছ ওটা, পুকুর নয় ঘোষাল, পথও নয়।

—ইয়েস, গাছ ইজ গাছ এন্ড পথ ইজ পথ; বাট ম্যান্ ইজ ম্যান্ আফটার অল্।

—কাল যদি জমিদার গাছগুলি বেচে দেয়, ঘোষাল, কি কেটে নেয়, তখন পাতার অধিকার থাকবে কোথা? বাজে বোকো না। শুধু খাস-খামারের গাছ নয়, মাল জমির ওপরের গাছ পর্যন্ত জমিদারের প্রজা ফল ভোগ করতে পারে, কিন্তু কাটতে পারে না।

দেবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল, তাহার বুকের মধ্যে মুহুর্তে জাগিয়া উঠিল একটা বিস্তৃত ক্ষোভ। তাহাদের খিড়কির ঘাটে একটা কাঠাল গাছ ছিল, কাঁঠাল অবশ্য পাকিত না, কিন্তু ইচড় হইত প্রচুর। তাহার আবছা মনে পড়ে, আসবাব তৈরি করিবার জন্য জমিদার ওই গাছটি কাটিয়াছিল। কিছু দাম নাকি দিয়াছিল, কিন্তু প্রথমে তাহার বাপ আপত্তি করায় ওই আইনবলে জোর করিয়া কাটিয়াছিল। কতদিন তাহার বাবা আক্ষেপ করিত—আঃ, ইচড় হল গাছপাঠা। আর স্বাদ কি ইঁচড়ের!

দেবু বলিলতা হলে তাই কর, শ্ৰীহরি, গাছগুলো সব কেটে নাও। প্রজারা ফল খাবে না।

শ্ৰীহরি হাসিল—তুমি মিছে রাগ করছ, দেবু খুড়ো। ওটা আমি, আইনের কথা, কথায় বললাম। জমিদার তা করবেন কেন? তবে প্রজা যদি রাজার সঙ্গে বিরোধ করে, তখন আইনমত চলতে রাজারই বা দোষ কি? বেআইনি বা অন্যায় তো হবে না।

–কিন্তু এ গরিব প্রজারা কি বিরোধ করলে শুনি? হঠাৎ এদের এরকম ধরে আনার মানে?

–ওদের জিজ্ঞেস কর। ওই প্রজা-সমিতির সেক্রেটারি বাবুকে জিজ্ঞেস কর।

তারপর হরিজনদের দিকে চাহিয়া শ্ৰীহরি বলিল—কি রে? চণ্ডীমণ্ডপ ছাওয়াতে পয়সা নিবি না তোরা?

কথাটা এতক্ষণে স্পষ্ট হইল। সকলে স্তব্ধ হইয়া গেল। কি; সকলেই অন্তরে অন্তরে একটা জ্বালা অনুভব করিল। সর্বাপেক্ষা সেটা বেশি অনুভব করিল দেবু। তালপাতার মূল্য এবং চণ্ডীমণ্ডপ ছাওয়ানোর মজুরির অসঙ্গতি তাহার হেতু নয়; তাহার হেতু সমগ্র ব্যাপারটার মধ্যে শ্ৰীহরির ভঙ্গি।

রাঙাদিদি খানিকক্ষণ আগে এখানে আসিয়া ব্যাপার দেখিয়া-শুনিয়া অবাক হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। কানে ভাল শুনিতে পায় না, কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া ব্যাপারটা সে বুঝিল। তারপর বলিল–হ্যাঁ ড্যাক্‌রা, তোরা চণ্ডীমণ্ডপ ছাওয়াবি না? আস্পদ্দা দেখ, মাগো কোথা যাব!

হরেন ঘোষাল সুযোগ পাইয়া রাঙাদিদিকে ধমক দিল—যা বুঝ না, তা নিয়ে কথা বোলো না রাঙাদিদি। চণ্ডীমণ্ডপ এখন কার? চণ্ডীমণ্ডপ থাকল না থাকল তা ওদের কি? ওদের তো ওদের গাঁয়ের লোকেরই বা কি অধিকার আছে? চণ্ডীমণ্ডপ জমিদারের। চণ্ডীমণ্ডপ নয়, এটা এখন জমিদারের কাছারি!

—তা রাজারও যা পেজারও তাই। রাজার হলেই পেজার। দেবু হাসিয়া বেশ জোর গলাতেই বলিল—সে তো ওই তালপাতাতেই দেখছ, রাঙাদিদি।

কে? দেবু? হ্যাঁ।

তা বটে ভাই। তা জঁ ডিহরি, তালপাতা বৈ তো লয়! তা যদি ওরা রাজার না লেবে তো পাবে কোথা?

শ্ৰীহরি অত্যন্ত রূঢ়ভাবে ধমক দিল—যাও, যাও, তুমি বাড়ি যাও। এসব কথায় তোমায় কথা বলতে কেউ ডাকে নাই। বাড়ি যাও।

রাঙাদিদি আর সাহস করিল না। গ্রামের কাহাকেও সে ভয় করে না, কিন্তু শ্ৰীহরিকে সে সম্প্রতি ভয় করিতে আরম্ভ করিয়াছে। বৃদ্ধা ঠুকটুক করিয়া চলিয়া গেল। যাইতে যাইতে ডাকিল-দেবু, বাড়ি আয়। ছেলেটা কাঁদছে তোর।

মিথ্যা বলিয়া সে দেবুকে ডাকিল। যে মানুষ দেবু! আবার কোথায় শ্রীহরির সঙ্গে কি হাঙ্গামা করিয়া বসিবে! আর ছেলেটা যত হাঙ্গামা করিতেছে তত সে যেন তাহাকে দিন দিন বেশি করিয়া ভালবাসিতেছে।

দেবু কিন্তু রাঙাদিদির ডাক শুনিল না। সে শ্ৰীহরিকে বলিল—ভাল শ্রীহরি, তুমি এখন কি করতে চাও শুনি?

–মানে?

—মানে, এদের যদি চুরি করেছে বলে চালান দিতে চাও, দাও। আর যদি তালপাতার দাম নিতে চাও, নাও। দশখানা তালপাতায় ডোমেরা একখানা তালপাতার চ্যাটাই দেয়। দাম তার

দু-পয়সা। সেই এক আনা কুড়ি হিসাবে দাম দেবে ওরা!

—তা হলে ঝগড়াই করতে চাস তোরা? কি রে? শ্ৰীহরি প্রশ্ন করিল হরিজনদের।

–আজ্ঞে?

দেবু বলিল–গুনে ফেল, কার কত তালপাতা আছে, গুনে ফেল।

সকলে তালপাতা গুনিতে আরম্ভ করিল।

মুহূর্তে শ্ৰীহরি ভীষণ হইয়া উঠিল। হিংস্র ক্রুদ্ধ গৰ্জনে সে এক হক মারিয়া উঠিল—বো! রাষ্য তালপাতা!

তাহার আকস্মিক দুর্দান্ত ক্ৰোধের এই সশব্দ প্রকাশের প্রচণ্ডতায় সকলে চমকিয়া উঠিল। হরিজনেরা তালপাতা ছাড়িয়া সরিয়া দাঁড়াইল, কেবল পাত তালপাতা ছাড়িয়াও সেইখানেই দাঁড়াইয়া রহিল। ভবেশ, হরিশ শ্রীহরির পাশেই বসিয়াছিল, তাহারা চমকিয়া উঠিল। হরেন। ঘোষাল প্ৰায় অ্যাঁতকাইয়া উঠিয়াছিল। সে কয়েক পা সরিয়া গিয়া বিস্তারিত চোখে শ্ৰীহরির দিকে চাহিয়া রহিল। দেবু চমকিয়া উঠিয়াছিল, কিন্তু পরমুহূর্তেই আত্মসংবরণ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। বাউরি ও বায়েনদের কাছে আগাইয়া আসিয়া সে দৃঢ়কণ্ঠে বলিল—থাক্ তালপাতা পড়ে, উঠে আয় তোরা ওখান থেকে। আমি বলছি, ওঠ!

সকলে একবার তাহার মুখের দিকে চাহিল—তাহার শীর্ণ মুখখানির সে এক অদ্ভুত তেজোদীপ্ত রূপ। সে দীপ্তির মধ্যে বোধ করি তাহারা অভয় খুঁজিয়া পাইল। তাহারা সঙ্গে সঙ্গে চণ্ডীমণ্ডপ হইতে বাহির হইবার জন্য পা বাড়াইল।

শ্ৰীহরি ডাকিল-ভূপাল! আটক কর বেটাদের।

দেবু তাহার দিকে চাহিয়া একটু মৃদু হাসিল, তারপর পাতুদের বলিল–যে যার এখান থেকে চলে যা। আমার গায়ে হাত না দিয়ে কেউ তোদের ছুঁতে পারবে না।

হরেন ঘোষাল দ্রুতপদে সকলের অগ্রগামী হইয়া পথ ধরিয়া বলিল–চলে আয়।

সকলের শেষে চণ্ডীমণ্ডপ হইতে নামিয়া আসিল দেবু।

শ্ৰীহরির পিঙ্গল চোখ দুইটি ক্রুর শনিগ্রহের মত হিংস হইয়া উঠিল।

ঠিক ওই মুহূর্তেই রাস্তার উপর হইতে কে উচ্চকণ্ঠে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গে বলিয়া উঠিল—হরি হরি বল ভাই, হরি হরি বল! বলিয়াই হো-হো করিয়া এক প্রচণ্ড উচ্চহাস্যে সব যেন ভাসাইয়া দিল।

সে অনিরুদ্ধ। অনিরুদ্ধ হাততালি দিয়া উচ্চহাসি হাসিয়া যেন নাচিতে লাগিল। শ্ৰীহরির এই অপমানে তাহার আনন্দের সীমা ছিল না।

শ্ৰীহরি কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া একটা ক্রুদ্ধ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। ভবেশ, হরিশ প্রভৃতি প্রবীণ মাতব্বর যাহারা তাহার অনুগত তাহারাও এ ব্যাপারে স্তম্ভিত হইয়া লে। কিছুক্ষণ পর ভবেশই প্রথম কথা বলিল—ঘোর কলি, বুঝলে হরিশখুড়ো!

শ্ৰীহরি এবার বলিল—আমাকে কিন্তু আর আপনারা দোষ দেবেন না।

হরিশ বলিল—দোষ আর কি করে দিই ভাই; স্বচক্ষে তো সব দেখলাম।

–ভূপাল! শ্ৰীহরি ভূপালকে ডাকিল।

–আজ্ঞে?

–তোমার দ্বারা কাজ চলবে না, বাবা।

–আজ্ঞে? ভূপাল মাথা চুলকাইতে আরম্ভ করিল।

ভবেশ বলিল—এতগুলো লোকের কাছে ভূপাল কি করত, বাবা ছিহরি! ও বেচারার দোষ

কি?

–আজ্ঞে তার ওপর আমি চৌকিদার, ফৌজদারি আমি কি করে করি? আপনি ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বর। আপনিই বলুন হুজুর।

শ্ৰীহরি বলিল—তুই একবার কঙ্কণায় যা। বাড়ুয্যেবাবুদের বুড়ো চাপরাসী নাদের শেখের কাছে যাবি। তাকে বলবি—তোমার ছেলে কালু শেখকে ঘোষ মশায়ের কাছে পাঠিয়ে দাও; ঘোষ মহাশয় রাখবেন।

—কালু শেখ? সভয়ে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল ভবেশ।

–হ্যাঁ, কালু শেখ।

নাদের শেখ এককালের বিখ্যাত লাঠিয়াল; কালু তাহার উপযুক্ত পুত্র। তরুণ জোয়ান, শক্তিশালী, দুর্দান্ত সাহসী। দাঙ্গা করিয়া সে একবার কিছুকাল জেল খাঁটিয়াছে; তারপর ডাকাতি অপরাধের সন্দেহে চালান গিয়াছিল, কিন্তু প্রমাণ অভাবে খালাস পাইয়াছে। কালু শেখ ভয়ঙ্কর জীব।

শ্ৰীহরি বলিল—অন্যায় আমি করব না, হরিশ-দাদা। কারু অনিষ্টও আমি করতে চাই না। কিন্তু আমার মাথায় যে পা দেবে, তাকে আমি শেষ করব—সে অন্যায়ই হোক আর অধৰ্মই

হোক।

আবার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল এই ছোটলোকের দলবর্ষায় আমি ধান দিই তবে খায়—আজ আমাকে অমান্য করে উঠে গেল! ওই দেবু ঘোষ, সেটেলমেন্টের সময় আমি ওর জমিজমা সমস্ত নির্ভুল করে লিখিয়েছি, দুবেলা খোঁজ করেছি ওর ছেলের, পরিবারের। জান, হরিশ-দাদাফের যাতে ওর ইস্কুলের কাজটি হয়—তার জন্যেও চেষ্টা করেছিলাম। প্রেসিডেন্টকেও বলেছি।

ভবেশ বলিল-কলিতে কারু ভাল করতে নাই, বাবা!

—কাল হয়েছে ওই নজরবন্দি ঘোড়া। ও-ই এইসব করছে। কামার-বউটাকে নিয়ে ঢলালি করছে। আর ওই শালা কর্মকার কথা বলিতে বলিতে শ্ৰীহরি নিষ্ঠুর হইয়া উঠিল। নেমকহারামের গ্রাম। এক এক সময় মনে হয়—এ গায়ের সর্বনাশ করে দিই!

হরিশ বলিল–তা বললে চলবে ক্যানে ভাই! ভগবান তোমাকে বড় করেছেন, ভাণ্ডার দিয়েছেন, তোমাকে করতে হবে বৈকি! এ কথা তোমাকে সাজে না।

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া শ্ৰীহরি সহজ স্বরেই বলিল হরিশ-দাদা, ষষ্ঠীকাকাকে বলুন এইবার কাজ আরম্ভ করে দিক। ইট তো তোমার পড়ে রয়েছে। ইস্কুলের মেঝে না হয় দশ দিন পরে হবে, জল পড়াক ভাল করে; নইলে ফেটে যাবে মেঝে। কিন্তু সাঁকোটা এখন না করালে কখন করবে? তার ওপর ওটা আমার কাজ নয়, আমি অবিশ্যি দশ টাকা দিয়েছি। কিন্তু সে ইউনিয়ন বোর্ডকে দিয়েছি সাঁকো করবার জন্য। ইউনিয়ন বোর্ডকে আমি বলব কি?

হরিশের ছেলে ষষ্ঠী শ্ৰীহরির পৃষ্ঠপোষকতায় আজকাল ঠিকাদারির কাজ করিতেছে। ইউনিয়ন বোর্ড হইতে শিবকালীপুরের রাস্তায় একটা সাঁকো হইবে, শ্ৰীহরি নিজে স্কুলের মেঝে বাঁধাইয়া দিবে। এসবেরই ঠিকাদার ষষ্ঠীচরণ।

হরিশ বলিল—তোমার কাজেই সে এখন ব্যস্ত, ভাই। খাতাপত্র নিয়ে সকালে বসে, ওঠে। সেই রাত্রে। তামাদির হিসেব, হিসেব তো কম নয়!

ষষ্ঠীচরণ শ্ৰীহরির গোমস্তাগিরির কাগজপত্র সারিয়া দেয়। চৈত্র মাসে বাকি-বকেয়ার হিসাব হইতেছে; যাহাদের চার বৎসরের বাকি, তাহাদের নামে নালিশ হইবে। শ্ৰীহরির নিজের ধানের টাকার হিসাব আছে, তাহার তামাদি তিন বৎসরে। সেসবের হিসাবও হইতেছে।

ভূপাল চলিয়া গিয়াছিল; বরাত খাঁটিবার উপযুক্ত অন্য কেহও ছিল না। নিরুপায়ে ভবেশ নিজেই তামাক সাজিতে বসিয়াছিল। ষষ্ঠীতলার ধারে কাঠের ধুনি জ্বলে,—সেখানে বসিয়া কল্কেতে আগুন তুলিতে তুলিতে ভবেশ কাহাকে ডাকিল—কে রে? ও ছেলে!

একটি ছেলে একগুচ্ছ লালফুল হাতে করিয়া যাইতেছিল, ডাকিতে সে দাঁড়াইল।

—কে রে? কি ফুল হাতে? অশোক নাকি?

ছেলেটি বৈরাগীদের নলিন, সে গিয়াছিল মহাগ্রামে পটুয়াদের বাড়ি। ঠাকুরদের বাগানে অশোক ফুল ফুটিয়াছিল, সেখান হইতে অশোক ফুলের একটি তোড়া বাঁধিয়া আনিয়াছে নজরবন্দিকে দিবে। আরও কতকগুলি কলি সে আনিয়াছে, পণ্ডিতের বাড়িতে প্রতিবেশীদের বাড়িতে বিলাইবে। দুই দিন পরেই অশোক-ষষ্ঠী। অশোকের কলি চাই। নলিন অভ্যাসমত কথা না বলিয়া ঘাড় নাড়িয়া জানাইল-হ্যাঁ, অশোকের কলি।

দিয়ে যা তো, বাবা। একটা ডাল দিয়ে যা তো।

নলিন অশোকের কয়েকটি ফুল নামাইয়া দিয়া চলিয়া গেল।

শ্ৰীহরি বলিল—আমার পুকুরপাড়ের বাগানেও অশোকের চারা লাগিয়েছি।

সে একটা পুকুর কাটাইয়াছে। তাহার পাড়ে শখ করিয়া নানাজাতীয় গাছ লাগাইয়াছে। সবই প্রায় ভাল ভাল কলমের চারা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *