গরমের ছুটি

ভলিউম ৫৪ – গরমের ছুটি – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৪

০১.

বিশাল এক জঙ্গলের মধ্যে বাড়িটা। জমিদার বাড়ি। কুমিল্লা থেকে এসে ময়নামতি ছাড়িয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার মহাসড়ক ধরে কয়েক মাইল এগোলে পথের বাঁ পাশে পড়বে বিশাল এক বটগাছ। সেটার কাছে নেমে একটা ইট বসানো সরু রাস্তা ধরে আরও কিছুদূর গেলে সেই জঙ্গল, হীরামতির বাগ, অর্থাৎ বাগিচা। গরমের এই ছুটিতে সেটাই আমাদের গন্তব্য। হ্যাঁ, আমি রবিন বলছি। আবার এসেছি বাংলাদেশে বেড়াতে, আমরা তিন বন্ধু-আমি, কিশোর পাশা, এবং মুসা আমান।

অন্যান্যবারের মত এবারেও কিশোরের মামা রিটায়ার্ড ডিআইজি আরিফ চৌধুরী সাহেবের ঢাকার বাসাতেই উঠেছিলাম আমরা। একটা দিন ওখানে কাটিয়ে পরদিনই রওনা হলাম কুমিল্লার উদ্দেশে। গন্তব্য হীরামতির বাগ। নামটা শুনলে কেমন লাগে, তাই না? মনে হয়, প্রচুর হীরা-মতি পাওয়া যায় বুঝি ওই জঙ্গলে। আসলে তা নয়, হীরা আর মতি নামে দুই ভাইবোন ছিল, জমিদারের সন্তান। বিশাল এক দীঘি কাটিয়েছিলেন জমিদার আইন উদ্দিন সরকার, সেই দীঘিতে ডুবে মারা গিয়েছিল ছেলেমেয়ে দুটি। তখন থেকেই সেই দীঘির নাম হয়ে গেল হীরামতির দীঘি। কালক্রমে দীঘির চারপাশের বাগান সংস্কারের অভাবে জঙ্গল হয়ে গেল, দীঘির নামেই নাম হয়ে গেল সেই জঙ্গলেরও।

এই কাহিনী শুনেছি আমরা কিশোরের চাচা রাশেদ পাশার মুখে। তিনিই আমাদের এখানে আসতে অনুরোধ করেছেন। জঙ্গলের মধ্যে যে পূরানো জমিদার বাড়ি আছে, তার মালিক এখন রেহান উদ্দিন সরকার, রাশেদ পাশার দূর সম্পর্কের ফুফা। আইন উদ্দিন সরকারের শেষ বংশধর। আমেরিকায় বসেই শুনেছেন রাশেদ পাশা, তার ফুফুর খুবই দুরবস্থা চলছে এখন। তাই আমাদেরকে এখানে এসে নিজের চোখে সব দেখে খোঁজখবর করে যেতে বলেছেন রাশেদ আংকেল। সম্ভব হলে তখন সাহায্য করবেন।

ঢাকা থেকে কুমিল্লার বাসে চড়েছি আমরা। ময়নামতিতে নেমে স্কুটার নিয়েছি।

বটগাছের গোড়ায় কয়েকটা ছোট ছোট দোকান-মুদি, চা-পান-বিড়ি, এ সবের। ওগুলোর কাছে এসে ড্রাইভারকে থামতে বলল কিশোর। এগিয়ে এল কয়েকজন নোক, কৌতূহলী হয়ে দেখতে লাগল আমাদের। জমিদার বাড়িটা কোনদিকে জিজ্ঞেস করতে সবাই হাত তুলে দেখিয়ে দিল ইট বিছানো রাস্তাটা।

সেই পথ ধরে এগোল আমাদের স্কুটার। অনেক পুরানো রাস্তা, জমিদারী আমলে সরকারদের কোনও একজন তৈরি করেছিলেন নিজের খরচে। এখন অনেক জায়গারই ইট নেই, ক্ষতের মত হয়ে আছে, জায়গায় জায়গায় গর্ত। মেরামত হয় না কত বছর কে জানে।

বেশ গরম পড়েছে। ঘেমে যাচ্ছি। পথের দুপাশে মাইলের পর মাইল কেবল খেত আর খেত। তরমুজ-বাঙ্গী ফলে আছে। এলোমেলো মাতাল হাওয়ায় ধুলোর। ঘূর্ণি উড়ছে। চাষীদের বাড়িঘর চোখে পড়ে কচি-কদাচিৎ। ওরা এই ভোলা মাঠে বাস করে না, থাকে দূরে, খেতের সীমানায় ওই যে ওই গ্রাম চোখে পড়ছে, সেখানে।

অবশেষে দেখতে পেলাম জঙ্গলটা। তিন পাশ ঘিরে খেত, একধারে নদী। কিছুদূর খোলা জায়গা ধরে এগিয়ে বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল পথটা। ঘন গাছপালার ভেতর দিয়ে কয়েকশো গজ এগোতে দেখতে পেলাম জমিদার বাড়ির চৌহদ্দি। জঙ্গলটা আগে জঙ্গল ছিল না, বাড়ির আশপাশে বিশাল সব বাগান ছিল, আস্তে আস্তে সেই বাগান জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। বিরাট সিংহদরজার প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই আর এখন, কেবল দু-পাশের দুটো স্তম্ভ বাদে। একটা স্তম্ভের গোড়ায় একপাশে এখনও থাবা উঁচিয়ে বসে আছে শ্বেতপাথরের এক মস্ত সিংহ।

খোয়াবিছানো লম্বা গাড়িপথ পার হয়ে বিশাল এক প্রাসাদের সামনের গাড়িবারান্দায় এসে দাঁড়াল স্কুটার। রোদে ঝকঝক করছে ছড়ানো উঠান। সেখানে দানা খুঁটছিল একঝাঁক পায়রা আর ঘুঘু। স্কুটারের শব্দে ডানা ঝাঁপটে উড়ে গেল একসঙ্গে। কয়েকটা পায়রা গিয়ে বসল বাড়ির কার্নিসে, বাকবাকুম জুড়ে দিল।

খাইছে! হাঁ করে তাকিয়ে আছে মুসা, কি সুন্দর জায়গা!

স্কুটার থেকে নেমে আমিও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সত্যিই অসাধারণ! জঙ্গলের মাঝে এমন একটা বাড়ি থাকতে পারে, না দেখলে ভাবাই যায় না। অনেক পুরানো বাড়ি। সংস্কারের অভাবে এখানে ওখানে বেরিয়ে পড়েছে লাল ইট, জানালার শাসিগুলো অপরিষ্কার, আনাচে কানাচে লতাগুল্ম আর শ্যাওলার রাজত্ব। পলকে একটা দিবাস্বপ্ন দেখে ফেললাম-এককালে আমাদেরই মত কত কিশোরের আনাগোনা ছিল এখানে, খেলে বেড়াত তারা, হই-চই করত, আজ একেবারে নীরব।

ওই যে, দাদী। বলে উঠল কিশোর।

উঁচু বারান্দার ওপরের বড় দরজাটা খুলে গেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন বৃদ্ধা। বয়েস ষাটের বেশি, কিন্তু এখনও মনে হয় চল্লিশের কোঠায়। অপরূপ সুন্দরী ছিলেন এককালে, বোঝা যায়। হবেনই, অত সুন্দরী না হলে কি আর জমিদার বাড়িতে বিয়ে হয়।

আমাদের আসার খবর চিঠিতে আগেই জানিয়েছেন রাশেদ আংকেল। সুতরাং আমাদের পরিচয় দিতে হলো না তাকে। হাসিমুখে সাবলীল ভঙ্গিতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে লাগলেন আমাদের দিকে। শুধু বললেন, এসেছিস। তোদের অপেক্ষাই করছি।

কোন রকম দ্বিধা নেই, জড়তা নেই, প্রথমেই আমাকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে আদর করলেন। আমি যে বিদেশী, অন্য ধর্মের মানুষ, বাঙালী মুসলিম পরিবারের মেয়ে হয়েও তার পরোয়াই করলেন না তিনি। মুহর্তে পছন্দ করে। ফেললাম তাকে, মনে হলো তিনি আমার নিজের দাদী। তারপর মুসাকে চুমু খেলেন তিনি, আমার পেছনেই ছিল সে। সবশেষে কিশোরকে, স্কুটারের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে উঠে আসতে দেরি করে ফেলেছিল সে।

আয়, ঘরে আয়, ডাকলেন দাদী। আমি জানি, তাঁর ডাকনাম হীরা, অবশ্যই রাশেদ আংকেলের কাছে জেনেছি। এই নামটার জন্যেই আইন উদ্দিন সরকারের বাবা কনেকে বেশি পছন্দ করেছেন, কারণ তাঁর ছেলের ডাকনামও তিনি রেখেছিলেন মতি। সুযোগ পাওয়ামাত্র মিলিয়ে দিলেন হীরামতিকে। হীরামতির বাগ নামটাকে সার্থক করার জন্যেই যেন।

উঠানের কোণ থেকে উঠে বার দুই ঘাউ! ঘাউ! করে হাঁক ছেড়ে এগিয়ে এল একটা নেড়ি কুকুর। নেড়ি হলেও স্বাস্থ্য বেশ ভাল, খাবারের অভাব হয় না।

ও আমাদের কালু, হেসে পরিচয় করিয়ে দিলেন দাদী। আদর করে একবার ডাকলেই হয়, ভাব হয়ে যাবে।

সবার আগে মুসার সঙ্গে ভাব করে নিল কুকুরটা। আমাদেরও অবজ্ঞা করল না।

দোতলায় আমাদের থাকার ঘর গুছিয়ে রেখেছেন দাদী। দেখিয়ে দিলেন। বললেন, হাতমুখ ধুয়ে আয়, আমি নাস্তা দিচ্ছি।

ঘরটা দেখার মত। দেয়াল, ছাত, কড়ি-বরগাগুলো মোটেও মসৃণ নয়, দমকা বাতাসে পুকুরের শান্ত পানিতে যেমন কুচি কুচি ঢেউ ওঠে অনেকটা তেমনি, তার ওপর বিচিত্র অলঙ্করণ। অনেক বড় বড় জানালা। বাইরে বাগান। প্রজাপতি, ফড়িঙ আর পাখির ভিড় সেখানে। আমার মনে হতে লাগল আমি বাস্তবে নেই, পরীর রাজ্যে এসে পড়েছি।

মুখহাত ধুয়ে, কাপড় পাল্টে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় নেমে এলাম মস্ত হলঘরে। বাবুর্চিখানা, চাকরদের ঘর, খাবার ঘর আর রান্নাঘরে ঢোকা যায় সে ঘর থেকে। রান্নাঘর থেকে আরেকটা ছোট ঘরে চলে যাওয়া যায় উল্টোদিকের একটা দরজা দিয়ে, পরে জেনেছি। ওই ঘরটা কোন কাজে লাগে না, তবে অনেকটা সিঁড়িঘর হিসেবেই ব্যবহার হয়। মেঝেতে একটা লোহার শিকের জালিকাটা ঢাকনা, তার নিচে কয়লার ঘর। এককালে রান্নাঘরের চুলায় কয়লা ব্যবহার হত, এখন গ্যাস আসায় বাতিল হয়ে গেছে ওসব চুলা। কয়লা জমিয়ে রাখারও আর প্রয়োজন হয় না। রান্নাঘর দিয়ে ছাড়াও ওই সিঁড়িঘরে ঢোকার আরও একটা পথ আছে, আমাদের শোবার ঘর থেকে। একটা আলমারি আছে দেয়াল ঘেঁষে, প্রথম দেখে তাই মনে হয়েছিল। পরে দেখে অবাক হয়েছি, ওটা আলমারি নয়, একটা গোপন দরজা, অন্য পাশে সরু একটা অন্ধকার সিঁড়ি নেমে গেছে। দেখে খুব রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। যাই হোক, সে-সব কথায় পরে আসছি।

হলঘরের দেয়ালে ঝোলানো বিরাট বিরাট ছবি, বেশির ভাগই হাতে আঁকা, ফ্রেমে বাঁধানো। সরকার পরিবারের পূর্বপুরুষদের ছবি। আধুনিক ছবি অর্থাৎ ফটোগ্রাফ আছে একটাই, হীরাদাদু আর মতিদাদার যুগল ছবি, দু-জনেই বিয়ের সাজে সজ্জিত, বর আর কনে। অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম ছবিটা। খুব সুন্দর।

খাবার ঘরে খেতে বসে কিশোর জানতে চাইল মতিদাদা কোথায়।

দাদী জানালেন, আক্কেল আলীকে নিয়ে শহরে গেছেন কাজে। জানা গেল, আক্কেল আলী এ বাড়ির একমাত্র কাজের লোক। টাকার অভাবে একজনের বেশি নোক রাখার ক্ষমতা নেই আর এখন রেহান উদ্দিনের। অথচ দাদুর যখন বিয়ে হয়, প্রথম আসেন এ বাড়িতে, তখনও অনেক চাকর-বাকর ছিল। আর তার আগে তো কথাই নেই, গিজগিজ করত নাকি মানুষে।

সন্ধ্যার মুখে শহর থেকে ফিরলেন দাদা। পুরানো, ঝরঝরে একটা মোটরগাড়িতে করে। আমরা তখন বাগানে। ছবির মানুষটারই মত আছেন এখনও, কেবল চুলগুলো সব সাদা হয়ে গেছে, এবং চোখের কোণে আর গলার নিচে ভাজ।

গাড়ি থেকে নেমেই আমাদের দেখলেন। ঋজু ভঙ্গিতে এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। এসে গেছ তাহলে। ভেরি গুড।

বিশাল থাবা দিয়ে চেপে ধরলেন আমার হাতটা। ঝাঁকিয়ে দিলেন আন্তরিক ভঙ্গিতে।

.

০২.

পরের দু-তিনটে দিন কালুকে নিয়ে দারুণ কাটল আমাদের। ফলগাছের অভাব নেই বাড়িটাতে। আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল তো আছেই, আরও নানা রকম ফলের ছড়াছড়ি। বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াই আমরা, ফল খেয়ে পেট ভরে থাকে, ভাত খাওয়ার আর জায়গা থাকে না। আমেরিকা থেকে এসে আমরা ভাত খাই শুনে নিশ্চয় অবাক লাগছে তোমাদের। কিন্তু সত্যি বলছি, এখানে এসে রুটির চেয়ে ভাতই বেশি প্রিয় হয়ে উঠেছে আমার। বোধহয় আবহাওয়াটা এমন যে এই খাবারই ভাল লাগে।

কালু ছাড়াও আরও একটা প্রাণী আছে এ বাড়িতে, অনেক বড় একটা কালো হুলো বেড়াল, টিক্কা খান। নামটা আক্কেল আলীর দেয়া। বেড়ালটার বড় বড় গোফ দেখলেই নাকি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নেতা জেনারেল টিক্কা খানের কথা মনে পড়ে যায় তার। বেড়ালটাকে পাখিরাও পছন্দ করে না, সে উঠানে নামলেই চমকে যায় পায়রা আর ঘুঘুর দল, নিমেষে ডানা ঝাঁপটে উড়ে পালায়।

আক্কেল আলী নিজেও একটা চরিত্র বটে। সেই ছেলেবেলায় সাত-আট বছর বয়েসে সে ঢুকেছে এ বাড়িতে, তারপর আর যায়নি। সবাই চলে গেছে একে একে, সে রয়ে গেছে। এখন চাকর-মালী থেকে শুরু করে মতিদাদার শোফারের কাজ, সব সে একা করে। হালকা-পাতলা খাটো শরীর, কুচকুচে কালো গায়ের রঙ, বসে যাওয়া চোয়াল দেখে বোঝার উপায় নেই তার আসল বয়েস কত।

মাত্র কয়েকটা দিনেই বাড়িটার প্রতি ভীষণ মায়া পড়ে গেছে আমার। মনে হতে থাকে, সহজেই সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি এখানে।

তিন দিনের দিন সকালে সামনের বাগানে আমগাছের ছায়ায় বসে আছি, এই সময় গাড়ির শব্দ কানে এল। গাড়িপথে ঢুকল একটা চকচকে গাড়ি। গাড়ি বারান্দায় থামিয়ে নেমে গিয়ে পেছনের দরজা খুলে দিল শোফার। নামলেন বেশ সভ্রান্ত পোশাক পরা একজন বয়স্ক ভদ্রলোক। বয়েস মতিদাদার সমানই প্রায় হবে। ছুটে গিয়ে হলঘরের দরজা খুলে দিল আক্কেল আলী। দুজনকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল।

আয়েসী ভঙ্গিতে গাছের গোড়ায় বসে ছুরি দিয়ে কেটে আম খেতে খেতে গল্প করতে লাগলাম আমরা। দারুণ টেস্ট, আমের মত এত স্বাদ পৃথিবীর আর কম ফলেরই আছে। গাড়ির শব্দে উড়ে গিয়েছিল, একটা দুটো করে আবার উঠানে নেমেছে আট-দশটা ঘুঘু আর পায়রা।

ঘণ্টাখানেক পর চলে গেল মেহমানরা। তাঁদের সঙ্গে গেলেন মতিদাদা। আরেকটু পরে দাদীকে দেখলাম পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে দীঘির শান বাধানো ঘাটে বসলেন। ওটাই হীরামতির দীঘি। পাথরে তৈরি সোফার মত আসনে বসে তাকিয়ে রইলেন পানির দিকে, সাদা শাপলাগুলো যেদিকে ফুটেছে সেদিকে মুখ। চুপচাপ বসে রইলেন তিনি।

আমের রসে হাত ভরে গেছে। ধোয়ার জন্যে চললাম দীঘির দিকে। ঘাটের কাছে এসেই থমকে দাঁড়ালাম। এ-কি! দাদী কাঁদছেন! গাল বেয়ে নেমেছে পানির ধারা। কি হয়েছে তার?

আমার সাড়া পেয়েই তাড়াতাড়ি শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে ফিরে তাকালেন। জোর করে হেসে বললেন, ও, রবিন! কি রে, খুব গরম?

না, হাত ধুতে এসেছি। দাদী, তুমি কাঁদছ কেন?

কই? চোখে কি যেন পড়ল…

 মিথ্যে কথা বোলো না। আমি তোমাকে স্পষ্ট কাঁদতে দেখলাম।

দ্বিধা করলেন একবার দাদী। তারপর হাত দিয়ে তার পাশের জায়গাটা চাপড়ে দিয়ে বললেন, আয়, বোস।

বসলাম তার পাশে।

একটু আগে লোকটা এল না, গাড়িতে করে, দেখেছিস নিশ্চয়?

 তিনি তোমাকে কিছু বলেছেন?

না, বলেনি, তবে কাদিয়েছে। ও এই বাড়ি কিনতে চায়। আমাকে আর তোর দাদাকে চিরকালের জন্যে চলে যেতে হবে এখান থেকে। ভাবলেই বুক ফেটে যায় আমার!

কেন দাদী, চলে যেতে হবে কেন? এতটাই অভাবে পড়ে গেছ তোমরা?

বসে খেলে রাজার ভাণ্ডারও ফুরায়, রবিন। জমিদারের ছেলে কাজকর্ম তো কিছু শেখেনি, টাকার দরকার হলেই জমি বেচেছে। এ বাড়ির আশেপাশে যত জমি আছে সব এককালে সরকারদের ছিল। শত শত একর। আজ আর এক বিযেও অবশিষ্ট নেই, শুধু এই বাড়িটা বাদে। দুর্ভাগ্যের সূচনা সেদিন থেকেই, যেদিন সরকারদের সৌভাগ্য হারিয়ে গেল!

সরকারদের সৌভাগ্য মানে! পেছন থেকে বলে উঠল কিলোর। আমাদেরকে একান্তে কথা বলতে দেখে কৌতূহলী হয়ে সে আর মুসাও চলে এসেছে।

আয়, বোস, দু-জনকে বসতে বললেন দাদী।

দীঘির পানিতে ডোবাডুবি করছে দুটো পানকৌড়ি। সেদিক তাকিয়ে আছে মুসা। শিকারীর দৃষ্টি। একটা বন্দুক হাতে পেলেই এখন গুলি করে বসত।

তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে দাদীকে জিজ্ঞেস করলাম, কোনও জিনিসের কথা বলছ?।

হ্যাঁ, অনেক দামী কিছু জিনিস, আমাদের আগ্রহ দেখে মুচকি হাসলেন দাদী। প্রায় দুশো বছর আগে, ইংরেজ আমলে এ বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা আইন উদ্দিন। সরকারকে ওগুলো উপহার দিয়েছিলেন আগরতলার এক মহারাজা।

কি কি জিনিস ছিল? আগ্রহে বকের মত গলা বাড়িয়ে দিয়েছে কিশোর।

মুক্তার হার, হীরার জড়োয়া সেট, চুণি-পান্না বসানো সোনার একটা পানপাত্র, আর আরও নানা রকম জিনিস।

কিন্তু হারাল কি করে ওগুলো?

দেশ বিভাগের সময় হিন্দু-মুসলমানে যখন দাঙ্গা লাগল, এই এলাকায় তখন হিন্দুদের আধিপত্য। সেই সময় হঠাৎ করে মারা গেলেন তোর মতিদাদার দাদা আমিন উদ্দিন সরকার। সেই থেকে গায়েব হয়েছে জিনিসগুলো।

কি করে মারা গেলেন?

সেটাও এক রহস্য। একদিন দীঘির ওই পাড়ের ঘাটলার কাছে তাকে মরে পড়ে থাকতে দেখা গেল। অভিশপ্ত এই দীঘি। কত মানুষকে যে নিল!

খুন করেনি তো?

কেউ কেউ সে রকম সন্দেহ করেছে। তাদের ধারণা ছিল, জিনিসগুলোর লোভে খুন করা হয়েছিল মানুষটাকে! যাই হোক, ওগুলো আর পাওয়া গেল না। তাকে খুন করে হয়তো জিনিসগুলো নিয়ে গিয়েছিল কেউ। কিংবা সেই লোকের হাতে পড়ার আগেই তিনি কোথাও লুকিয়ে ফেলেছিলেন ওগুলো। আর তা করে থাকলে এখন এ বাড়িরই কোনখানে আছে। কারণ দাঙ্গা শুরুর পর আর একটি দিনের জন্যেও বাড়ির সীমানার বাইরে যাননি আমিন উদ্দিন সরকার।

এ বাড়িতেই আছে বলছ? আনমনে বলল কিশোর, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা শুরু হয়ে গেছে তার। কি ভাবছে সে, পরিষ্কার বুঝতে পারছি আমি।

থাকতেও পারে। তবে আমার বিশ্বাস, নেই।

নেই মনে হওয়ার কারণ? জানতে চাইল কিশোর।

কারণ ওগুলোকে সরকারদের সৌভাগ্য নাম দিয়েছিলেন আইন উদ্দিন সরকার। যতদিন ছিল, রমরমা অবস্থা ছিল সরকারদের, যেই গেল, অমনি শুরু হলো পতন।

এ সব কুসংস্কার। জমিদারী বিলুপ্তির পর টাকা রোজগারের অন্য কোন উপায় করেনি বলেই আসলে ফকির হয়েছে ওরা।

একেবারে ভুল বলিসনি কথাটা। অকর্মা বলেই তো এখন শেষ সম্বল বাড়িটাও বিক্রি করতে হচ্ছে। দাদীর কণ্ঠে ক্ষোভ।

বাড়ি বিক্রি মানে? কিশোর শোনেনি খবরটা।

তাকে আর মুসাকে আবার সব খুলে বললেন দাদী। এখান থেকে চিরতরে চলে যাওয়ার কথা বলতে গিয়ে আবার গলা ধরে এল তার।

খানিকক্ষণ চুপ থেকে ঘনঘন কয়েকবার নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। তারপর মুখ তুলল, বাড়িটা বাঁচানোর এখন একটাই উপায়, একসঙ্গে অনেকগুলো টাকা পেয়ে যাওয়া।

মলিন হাসি হাসলেন দাদী। একটা কানাকড়িও নেই আর তোর দাদার কাছে। অনেক টাকা কোথায় পাবেন?

আছে, উপায় আছে। গুপ্তধনগুলো খুঁজে বের করতে পারলেই আর টাকার অভাব হবে না তোমাদের।

সে আশার গুড়ে বালি। অনেকেই খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছে, পায়নি। তার মানে নেই এখানে। আমিন উদ্দিন সরকারকে খুন করে কেউ নিয়ে গেছে ওগুলো। কে নিয়েছে, তা-ও জানি। তার এক মুন্সী ছিল। তিনি যেদিন মারা গেলেন, সেদিন থেকেই ওই লোকটাও নিখোঁজ হলো। আর তাকে দেখা যায়নি।

হুঁ! সহজে নিরাশ হতে জানে না কিশোর পাশা। তবু, একবার যখন গুপ্তধনের গন্ধ পেয়েছি, সহজে হাল ছাড়ছি না আমি। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, দাদী, এ বাড়িতে থাকলে আমরা ওগুলো খুঁজে বের করবই!

.

০৩.

সেইদিন থেকেই গুপ্তধন খোঁজায় লেগে গেলাম আমরা। কিন্তু কিশোর পাশাও বেকায়দায় পড়ে গেল। কোন সূত্রই নেই হাতে, কিসের সাহায্যে খুজবে? তেমন কোন সূত্রই দিতে পারলেন না দাদী। আক্কেল আলীকে জেরা করেও কিছু জানা গেল না। প্রায় পয়তিরিশ বছর ধরে আছে এ বাড়িতে, অনেক ইতিহাস জানে এখানকার, কিন্তু গুপ্তধন উদ্ধারের ব্যাপারে সে-ও কোন সাহায্য করতে পারল না।

পরদিন সকালে উঠে নাস্তা খেয়ে আবার বাড়ির মধ্যে ঘুরে বেড়াতে শুরু করল কিশোর। গোপন দরজা কিংবা গোপন কুঠুরি আছে কিনা খুঁজছে। দাদী বললেন, একটা গোপন সিঁড়িই আছে জানি, যেটার দরজা আলমারির মত, যেটা দিয়ে তোদের ঘরে চলে যাওয়া যায়। আর কিছু নেই।

আসলেও মনে হলো নেই। কারণ অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কিছু পেলাম না আমরা। নিরাশই হয়ে গেলাম। আমাদের অবস্থা দেখে শেষে দাদী বললেন, দেখ, বেড়াতে এসেছিস, বেড়িয়ে যা। ওসব গুপ্তধন খোঁজা বাদ দে। ওগুলো নেই এখানে। থাকলে অনেক আগেই পেয়ে যেত লোকে।

কিন্তু… তর্ক করতে গেল কিশোর।

তাকে থামিয়ে দিয়ে দাদী বললেন, ওসব কিন্তু-ফিন্তু বাদ দিয়ে বনের ভেতর থেকে ঘুরে আয়গে, যা। ভাল লাগবে। অনেক কিছু দেখার আছে। যা।

প্রায় জোর করেই আমাদেরকে ঘর থেকে ঠেলে বের করে দিলেন তিনি।

ভোর বেলা উঠেই শহরে চলে গেছেন দাদা, বোধহয় বাড়ি বিক্রির কাজেই। আমরা ঘুম থেকে উঠে দেখিনি তাঁকে। বাগানে দেখা হয়ে গেল আক্কেল আলীর সঙ্গে। গাছের গোড়ায় নিড়ানি দিচ্ছে। হেসে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছ?

জানালাম।

কোথায় গেলে কি দেখতে পাব, বলে দিল সে। একটা জায়গায় যেতে নিষেধ করল, বনের ভেতরে একটা মজা পুকুর। জায়গাটা নাকি ভাল না।

সঙ্গে সঙ্গে মুসা ধরল, কি ভাল না? ভূত আছে নাকি?

আবার হাসল আক্কেল আলী, তা জানি না। তবে বড় বড় সাপ আছে। এই তো, আর বছরই তো একটা বিরাট কেউটে মারলাম। জাম পাড়তে গিয়েছিলাম, দেখি গাছের গোড়া বেড় দিয়ে পড়ে আছে।

বেড় দিয়ে পড়ে থাকে! এত্তোবড়!

মুসার কথার জবাবে মাথা নাড়ল আক্কেল আলী। আরও একটা ব্যাপারে সাবধান করল আমাদের, জলার কাছে না যেতে। বেশ বড় একটা জলা আছে। তাতে নাকি পানির চেয়ে কাদা বেশি। পা পড়ে গেলে হড়াৎ করে একেবারে হাঁটু পর্যন্ত দেবে যায়।

পুকুরটা কোন দিকে আছে জেনে নিল কিশোর। সিংহ-দরজা দিয়ে বেরিয়ে সেদিকের পথই ধরল। আক্কেল আলী মানা করায় তার কৌতূহল বেড়ে গেছে।

আমাদের আগে আগে চলেছে কালু। অচেনা বনে-বাদাড়ে সঙ্গে কুকুর থাকলে অনেক সুবিধে।

বনে ঢুকে পড়লাম আমরা। ঘন হয়ে জন্মে আছে আম আর কাঁঠাল গাছ। বিরাট বিরাট কালোজামের গাছও আছে। মাঝে মাঝে বাঁশের ঝাড়। বনের মধ্যে এক ধরনের সবুজাভ আলো। গাছের মাথা দিয়ে যেন চুরি করে নেমে এসে মাটিতে পড়েছে রোদ, গোল গোল হয়ে পড়ে বনতলে সোনালি অলঙ্করণ করে দিয়েছে যেন।

প্রচুর শেয়ালের গর্ত দেখা গেল। আর আছে বেজি ও গোসাপ। প্রথম জানোয়ারটার দিকেই কালুর আগ্রহ বেশি দেখা গেল। গর্ত দেখলেই ছুটে যাচ্ছে সেদিকে, নাক নামিয়ে শুঁকছে। মাঝে মাঝে হাঁক ছাড়ছে ঘাউ ঘাউ করে, যেন বলতে চাইছে: বেরিয়ে আয় ব্যাটা শিয়ালের ছাও, হয়ে যাক একহাত! চুরি করে হাঁস-মুরগী খাওয়া তোমার আমি বের করব!

চলতে চলতে থমকে দাঁড়াল মুসা। তাকিয়ে আছে সামনের দিকে।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, কী?

হাত তুলে দেখাল মুসা, ওই যে।

 গাছের ফাঁক দিয়ে আমরাও দেখতে পেলাম পুকুরটা। কালচে-সবুজ পানি।

সুন্দর! বিড়বিড় করল কিশোর।

আমি বললাম, হ্যাঁ, খুব। শাপলা ফুটে আছে কেমন দেখছ? দারুণ!

লাল আর সাদা শাপলায় ছেয়ে আছে পুকুরটা।

তুলতে পারলে কাজ হত, বললাম। দাদীর জন্যে নিয়ে যেতে পারতাম।

হ্যাঁ, নামো, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল মুসা, আর অমনি টুক করে সিন্দুকে টেনে নিয়ে যাক!

সিন্দুক? বুঝতে পারলাম না, সেটা আবার কি?

ও, জানো না এখনও। বাংলাদেশের অনেক পুকুরেই সিন্দুক থাকে। পুরানো দীঘি, পুরানো বড় আন্ধা পুকুর-যেগুলোর চারপাশে জংলা হয়ে থাকে, পানি কালো, সেগুলোতে বাস করে এই ভূতুড়ে সিন্দুক। বড় বড় শেকল থাকে। যেই পানিতে নামবে, আস্তে করে এসে পায়ে পেঁচিয়ে ধরবে। তারপর একটানে একেবারে মাঝপুকুরে, পানির তলায়।

হেসে জিজ্ঞেস করলাম, নিয়ে গিয়ে কি করে?

হাত উল্টে মুসা বলল, আমি কি জানি? হয় গোলাম বানিয়ে রাখে, নয়তো ভূতুড়ে সিন্দুক বানিয়ে নিজেদের দলভারি করে। কিছু তো একটা করেই, নইলে নেয় কেন?

কিশোরের মতই আমারও ভূতপ্রেতে তেমন বিশ্বাস নেই, কিন্তু পুকুরটার দিকে তাকিয়ে মনে হলো সত্যিই থাকতে পারে ও রকম ভূতুড়ে কিছু, শাপলা পাতায় ঢাকা কালো পানি দেখলে কেমন গা ছমছম করে।

পুকুরের একটা পাড়ে ঝোঁপঝাড় একটু হালকা, বাকি তিন পাড়ে ঘন জঙ্গল হয়ে আছে। বেতবন নেমে এসেছে একেবারে পানির ওপর। বেত গাছের গোড়া বিছুটি আর লজ্জাবতী গাছে ছাওয়া। গাঢ় গোলাপী রঙের ফুল ফুটে আছে।

যে পাড় হালকা, সেই পাড়ে এসে উঁড়ালাম আমরা। লাফ দিয়ে সরে গেল একটা ব্যাঙ। ছড়ছড় করে পানির ওপর দিয়ে পিছলে চলে গেল অনেক দূর।

ব্যাঙটা যেখানে বসে ছিল সেখানে তাকাতেই একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম। একটা চৌকোণা পাথর। ফুটখানেক পানির নিচে আরও একটা। কাত হয়ে আছে। শ্যাওলায় ছাওয়া। পিচ্ছিল যে হয়ে আছে বোঝার জন্যে পা রাখার দরকার নেই, দেখেই বোঝা যায়। পা দিলেই আছাড় খেয়ে পড়তে হবে পানিতে।

আশ্চর্য! ভুরু কুঁচকে পানির নিচে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল কিশোর, এখানে সিঁড়ি বানাল কে?

সিঁড়ি নাকি? সিন্দুকের ভয় ভুলে এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে তাকাল মুসা।

তা ছাড়া আর কি?

তাই তো। পুকুরে তো সিঁড়ি বানায় মানুষ ঘাটলা তৈরি করলে। নেমে গোসল করার জন্যে।

কিংবা ঘাটলার সিঁড়িতে বসে আয়েশ করার জন্যে।

তাহলে কে সেই আয়েশী লোক?

 নিশ্চয় সরকারদের কেউ। দেখো, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কাছাকাছি ঘরবাড়ি আছে। বাগানবাড়ি থাকলেও অবাক হব না।

এদিক ওদিক তাকাতে শুরু করল কিশোর। ঘাটের কাছ থেকে গজ পঞ্চাশেক দূরে বিশাল এক বেতের ঝাড়। সেটার দিকে চোখ আটকে গেল তার। আনমনে হাত নেড়ে আমাদের বলল, চলো তো, দেখি!

বেত গাছের সাংঘাতিক কাটা। লম্বা লম্বা লতা হয়, তাতে আঁকশির মত কাটা, ছোঁয়া লাগলেই চামড়া ছড়ে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে যায়।

পড়ে থাকা একটা মরা ডাল খুঁজে আনল মুসা। সেটা দিয়ে কোনমতে বেত ফাঁক করে করে ভেতরে তাকাল। চোখে পড়ল একটা দেয়াল। আর কোন সন্দেহ নেই। সত্যিই একটা বাড়ি আছে এখানে।

ভেতরে কি আছে দেখতে হয়, কিশোর বলল।

এখানে গুপ্তধন আছে ভাবছ নাকি? জিজ্ঞেস করল। গরমের ছুটি

সম্ভাবনা কম। তাহলে পেয়ে যেত লোকে। তবু দেখতে চাই কি আছে।

ঢুকবে কি করে? জিজ্ঞেস করলাম। যা বেতের বেত, চোখের পলকে ছিলেছুলে দেবে।

বাড়ি গিয়ে দা এনে কাটতে হবে। চলো, আক্কেল আলীর কাছ থেকে নিয়ে আসি।

সব শুনে আক্কেল আলী বলল, তোমাদের না ওদিকে যেতে মানা করেছি, তা ও গেলে…

আরে দূর, হাত নেড়ে উড়িয়ে দিল কিশোর, গেলে কি হয়? এর চেয়ে অনেক গভীর আর বিপজ্জনক জঙ্গলে ঢুকেছি আমরা। দুটো দা দাও। ভেতরে ঢুকব।

সাপের কামড় খেয়ে মরার ইচ্ছে হয়েছে আরকি। চলো, আমিও যাব। একলা ছেড়ে দিলে মা বকবেন।

তোমার আর যাওয়ার দরকার নেই, মুসা বলল, আমরাই কাটতে পারব।

তাহলে মা-কে বলে যেতে হবে। নইলে আমিই বলে দেব। তোমাদের কিছু হলে শেষে মা আমাকে আস্ত রাখবেন না।

দাদীকে বলতে গেলে বাধা দিয়ে বসতে পারেন, এই ভয়ে আক্কেল আলীর কথার আর প্রতিবাদ করলাম না। তাকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হতে যাব, এই সময় বারান্দায় বেরোলেন দাদী। এসেছিস তোরা? এ-কি, এখনও গোসলই করিসনি। যা যা, জলদি যা। আমার রান্না হয়ে গেছে।

মুগডাল দিয়ে রুইমাছের মাথার মুড়িঘন্ট, রুইমাছ ভাজা, চালকুমড়া ভাজি আর ডাল দিয়ে গলা পর্যন্ত গিললাম। তারপর যখন ক্ষীরের মত ঘন দুধ আর শহর থেকে কিনে আনা ফজলি আম নিয়ে এলেন দাদী, করুণ চোখে ওগুলোর দিকে তাকাতে লাগলাম। কারণ আমার আর একটা দানা গেলারও সামর্থ্য নেই। তবে মুসা ছাড়ল না। ইয়া বড় বড় দুটো ফজলি আম আর বড় এক বাটি দুধ মেরে দিল অনায়াসে। কম করে হলেও এক হাজার বার আউড়াল-এর চেয়ে সুস্বাদু খাবার পৃথিবীর আর কোন দেশে নেই।

ভরপেট খেয়ে তক্ষুণি আর বেরোতে পারলাম না। আধঘণ্টা মত গড়াগড়ি দিয়ে নিলাম বিছানায়। তারপর উঠে আক্কেল আলীকে সঙ্গে করে দা নিয়ে রওনা হলাম মজা পুকুরের পাড়ে।

.

০৪.

আক্কেল আলীকে সঙ্গে এনে খুব ভাল করেছি। খানিক পরেই বুঝলাম, সে না এলে ওই বেত কেটে ভেতরে ঢোকার সাধ্য আমাদের হত না। সাংঘাতিক শক্ত গোড়। সারা গায়ে বড় বড় কাঁটা। বেতগাছ কাটতে হলে একটা বিশেষ কায়দায় কাঁটা বাঁচিয়ে কোপ দিতে হয়। সামান্য এদিক ওদিক হলেই কনুই থেকে হাতের নিচের অংশের চামড়া আর থাকবে না, ফালাফালা হয়ে যাবে কাঁটার আঘাতে। আক্কেল আলীর বক্তব্য, পাগল না হলে এই বেত কেটে ওই পোড়াবাড়িতে ঢোকার কথা ভাবে না কেউ। অর্থাৎ তার ধারণায়, আমরা তিনজনই পাগল।

বাড়িটা যে আছে ওখানে, জানা ছিল তার। বানিয়েছিলেন এখানকার প্রথম জমিদার, আইন উদ্দিন সরকার। এতটাই পোড়ো, ঢুকে দেখার কথা মনে হয়নি কখনও আক্কেল আলীর। পঁয়তিরিশ বছর আগে সে যখন এসেছিল, তখনও এমনই কাটা ছিল এখানটায়। তার মনে হয়েছিল-কি আর আছে এর মধ্যে দেখার মত, সাপ আর ইঁদুর-শজারু ছাড়া? শুধু ওসব দেখার জন্যে কাটার খোঁচা খেয়ে ঢোকার কষ্ট কে করে।

শেষ পর্যন্ত আক্কেল আলীর চেষ্টাতেই ঘরে ঢোকা সম্ভব হলো। দুই কামরার বাড়ি, বাগানবাড়ি নয়, তবে প্রচণ্ড গরমের সময়, কিংবা মন ভাল না লাগলে এসে একাকী কাটানোর জন্যে একটা চমৎকার জায়গা ছিল এটা একসময়। সামনে পুকুর, বন-জঙ্গল, গরমের দিনে চাঁদনী রাতে নিশ্চয় অপরূপ দৃশ্য হয়।

ভেতরে মাকড়সার জালের ছড়াছড়ি, পা বাড়ালেই হাতে, মুখে লাগে। সঙ্গে করে আনা ছোট একটা ডাল দিয়ে সামনের জালগুলো ছিঁড়ে সরিয়ে টর্চের আলো ফেলল কিশোর। জানালা আছে দুটো, কিন্তু বাইরে থেকে লতাপাতায় এমন করে জড়িয়ে আটকে রেখেছে, ঠেলে খোলা মুশকিল।

ভেতরের দিকের ঘরে দেয়ালের কাছে বহু পুরানো একটা বেঞ্চ রাখা, তাতে পুরু হয়ে ধুলো জমে আছে। টেবিলও আছে একটা, তাতেও ধুলো। আরেকটু কাছে এগোল কিশোর। আমরা রইলাম তার পেছনে।

দুটো গ্লাস দেখতে পেলাম টেবিলে।

কিশোর বলল, শেষবার যারা ঢুকেছিল এখানে, কথা বলেছিল বসে, তারা নিশ্চয় এই গ্লাসে করে কিছু খেয়েছিল। দু-জন লোক।

আক্কেল আলী বলল কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গেই, কি আর খাবে! মদ খেয়েছিল আরকি! এ বাড়িতে তো এক সময় রীতিই ছিল, পুরুষমানুষের মদ খেতে হবে।

একটা গ্লাস তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে কিশোর বলল, এ রকম গ্লাস রান্নাঘরের আলমারিতেও দেখেছি।

খাটো খাটো গ্লাস, খুব ভারি কাঁচে তৈরি, ইংল্যান্ডের একটা কোম্পানির নাম ছাপ দিয়ে লেখা রয়েছে তলায়।

অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ঘরগুলোতে আর কোন জিনিস পেলাম না। গুপ্তধনের কোন চিহ্ন না পেয়ে কিছুটা নিরাশই হলাম।

রাতে খাবার টেবিলে বসে পোড়ো বাড়িতে ঢোকার খবরটা জানালাম আমরা।

 গ্লাস দুটো পেয়ে খুশি হলো দাদী।

মতিদাদা বললেন, ঘরটা সুন্দর। তোমাদের বয়েসে চাঁদনী রাতে, বৃষ্টির দিনে, কতদিন গিয়ে একা একা বসে থেকেছি ওখানে। বন দেখতে খুব ভাল লাগত। বিশেষ করে পুকুরটা। শাপলায় ভরা, চাঁদের আলোয় রহস্যময় হয়ে উঠত। মুষলধারে বৃষ্টি যখন হত, তখন লাগত আবার আরেক রকম। শাপলাপাতায় বৃষ্টির নাচন দেখেছ? দুর্দান্ত!

চাঁদনী রাতে সিন্দুকেরা নিশ্চয় ছানাপোনা নিয়ে বেরোত! মুসা বলে উঠল। উঠে আসত পানি থেকে। ধাড়িটা থাকত আগে আগে, তার পেছনে মাদীটা, আর তাদের পেছনে ছানার দল। হেলেদুলে এগোচ্ছে বড় দুটো, আর পিচ্চিগুলো নাচানাচি করছে। ছবি তুলে রাখতে পারলে কোটিপতি হয়ে যাওয়া যেত!

ভুরু কুঁচকালেন দাদা। কারা বেরোত?

 মুসার ভূতুড়ে সিন্দুকের কথা বুঝিয়ে বলল কিশোর।

হা-হা করে হাসলেন দাদা। বললেন, তাহলে একদিন গিয়ে রাতে থেকেই দেখো, বেরোয় কিনা?

থাক থাক, তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন দাদী, ছেলেগুলোকে আর কুবুদ্ধি দিয়ো না। সাপখোপের আড্ডা, শেষে কামড় খেয়ে মরবে।

কিন্তু কুবুদ্ধিটা কিশোরের মাথায় ঠিকই ঢুকে গেল। ঘরে ফিরে এসে শলা পরামর্শ করতে লাগল আমাদের সঙ্গে, ঘরটা পরিষ্কার করে ওখানে রাত কাটালে মন্দ হয় না। আমরা না করলাম না। একবার যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে, সেটা করবেই, আর তাকে ফেরানো যাবে না। তা ছাড়া ভয় ভয় করলেও ওখানে থাকতে আমাদের যে একেবারেই ইচ্ছে করছিল না, তা নয়।

সুতরাং পরদিন থেকেই দাদীকে না জানিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম আমরা। ধুয়ে মুছে ঝকঝকে তকতকে করে ফেললাম বাড়িটাকে। আশপাশের জঙ্গল সাফ করলাম। জানালা খুলে দেয়া গেল। আরেকটা চমৎকার জিনিস বেরোল, একট। অ্যাকোয়ারিয়াম। মাটিতে বেশ বড় একটা ট্যাংক বানিয়ে, চারপাশ পাকা করে দেয়া হয়েছে। নালা কেটে পুকুর থেকে পানি ঢোকার ব্যবস্থা আছে। তাতে কিছু জলজ উদ্ভিদ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে এমন করে, যাতে মাছের আগ্রহ জন্মায়। ওই অ্যাকোয়ারিয়ামে এসে ঢোকে ওরা। বহু দিন পরিষ্কার করা হয় না বলে ময়লা হয়ে আছে এখন ট্যাংকটার পানি, গাদা গাদা পাতা পড়ে পচে আছে তলায়। ওই পানিতেই কয়েকটা পুঁটি আর একটা টাকি মাছকে ঘুরতে দেখলাম।

দু-দিন লাগল সব ঠিকঠাক করতে।

তৃতীয় দিনের দিন বিকেলে ওই বাড়িতে বসেই চা খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। খাবার আর চায়ের কেটলি গুছিয়ে নিয়ে রওনা হলাম।

ঘরের দাওয়ায় বসে বসে প্রকৃতি দেখতে লাগলাম আমরা।..

করুণ গলায় টেনে টেনে বিলাপ করছে ঘুঘু। মাঝে মাঝে অলস ভঙ্গিতে শিস দিচ্ছে দোয়েল। পুকুরের পানিতে শাপলার ফাঁকে ফাঁকে পোকা আর ছোট মাছ খুঁজে বেড়াচ্ছে দুটো জলমুরগী।

পশ্চিমে যতই ঢলতে লাগল সূর্য, বনতলে লম্বা হতে লাগল গাছের ছায়া।

 চা খাওয়া শেষ করলাম আমরা।

হঠাৎ মাথার ওপর কর্কশ গলায় ডেকে উঠল একটা পেঁচা। চমকে চোখ তুলে তাকালাম। চালার খাপে বাসা ওটার। দিন শেষ হয়ে রাত আসছে, জেগে উঠছে বনের নিশাচরেরা। খানিক আগেই উঁকি দিয়ে গেছে একজোড়া শেয়াল।

বাসাটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে উঠল কিশোর, ওটা কি?

উঠে দাঁড়াল সে।

আমি আর মুসাও তাকালাম।

কোথায়? জিজ্ঞেস করলাম।

 বাসাটার পাশে দেখো। বাক্সের কোণা মনে হচ্ছে না?

খাইছে! তাই তো!

মোটেও দেরি করল না মুসা। খাপের ফাঁকে খুঁজে রাখা ছোট কাঠের বাক্সটা বের করে আনল। প্রায় দুশো বছরের পুরানো বাক্স, সারা গায়ে পিতলের পাত বসিয়ে নকশা করা। নিশ্চয় কারও শখের জিনিস ছিল এটা। বেশ ভারি।

এর মধ্যে গুপ্তধন নেই তো? কানের কাছে নিয়ে বাক্সটা ঝাঁকি দিয়ে ভেতরে কি আছে বোঝার চেষ্টা করল মুসা।

না, বেশি ছোট, কিশোর জবাব দিল। ভাবছি, খাপের মধ্যে গেল কি করে? পাখিতে নিতে পারেনি। এটা তোলার সাধ্য হবে না কোন পাখিরই। তাহলে কেউ রেখেছে। মানুষ।

আছে কি এর মধ্যে? জিজ্ঞেস করলাম।

খুলেই দেখা যাক না, মুসার হাত থেকে বাক্সটা নিয়ে ডালা খোলার চেষ্টা করল কিশোর। কিন্তু ডালাটা যে কোন দিকে, কোটা ওপর আর কোটা নিচ, সেটাই বোঝা গেল না। বেশ কায়দা করে তৈরি বাক্সটা।

অন্ধকার হয়ে গেছে। আলোয় না দেখে বাক্সটা খোলা যাবে না বুঝতে পেরে সেই চেষ্টা আর করলাম না আমরা। ওটা নিয়ে বাড়ি ফিরে চললাম।

.

০৫.

গাড়ি-বারান্দায় সেই গাড়িটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম আবার বাড়ি কিনতে চায় যে লোকটা, তার। ঘনঘন আসা-যাওয়া করছে, কিনেই ছাড়বে। খুব তাড়াতাড়ি গুপ্তধনগুলো আমরা উদ্ধার করতে না পারলে বাঁচানো যাবে হীরাদাদীর এত সাধের এই জমিদার বাড়ি।

দাদা-দাদী নিশ্চয় লোকটার সঙ্গে হলঘরে আছে, ওখানে বসে বাক্স খোলা নিরাপদ নয়, তাই ডাইনিং রুমে চলে এলাম আমরা। টেবিলে বসেই বাক্সটা খোলায় মন দিল কিশোর। বাক্সের গায়ে হালকা একটা রেখা চোখে পড়ল। বোঝা গেল, ওটাই জোড়া, কিংবা ঢাকনার কিনারা। ঘর থেকে গিয়ে তার ব্যাগ থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা এনে দেয়ার অনুরোধ করল আমাকে।

 এনে দিলাম।

গ্লাস দিয়ে দেখে নিশ্চিত হলো সে, ঢাকনা কোনটা। সূক্ষ্ম ফাঁকটায় ছুরির মাথা ঢুকিয়ে চাড় দিতে লাগল। সামান্যতম নড়ল না ঢাকনাটা। আরও জোরে ছাড় দিতেই সামান্য ফাঁক হলো মনে হলো। জোরে জোরে চাড় দিতে লাগল তখন।

অবশেষে খুলে গেল ঢাকনা। মনে হলো, কোন ধরনের আঠা মাখিয়ে তারপর চেপে বসিয়ে দেয়া হয়েছিল ওটা, সে জন্যেই খুলতে অত কষ্ট হয়েছে।

ভেতরে কি আছে দেখার জন্যে আগ্রহে সামনে ঝুঁকে পড়লাম আমরা তিনজন।

হতাশ হতে হলো। কিছুই নেই! কিচ্ছু না! একটা সোনার মোহর কিংবা একটা সাধারণ আঙটিও নেই। গুপ্তধন তো দূরের কথা।

বাক্সটা টেবিলে রেখে দিয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করল কিশোর।

খালি বাক্স হাতে নিয়ে আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল কিছুক্ষণ মুসা। তারপর নিরাশ ভঙ্গিতে রেখে দিয়ে বলল, দূর, খামোকা সময় নষ্ট!

আমি হাতে তুলে নিলাম বাক্সটা। ব্যাপারটা আমার চোখেই পড়ল প্রথম। বাইরের দিকটা যত বড়, ভেতরের দিকটা তার চেয়ে অনেকটাই ছোট, বিশেষ করে নিচের দিক। অতটা তো হওয়ার কথা নয়! অত পুরু নয় কাঠ। তাহলে? কিশোরকে বললাম আমার সন্দেহের কথাটা।

থাবা দিয়ে আমার হাত থেকে বাক্সটা কেড়ে নিয়ে একবার তাকিয়েই বলে উঠল কিশোর, তাই তো! ফলস বটম আছে।

বাক্সের নিচে বসানো চোরা কুঠরিটা খোলার চেষ্টা করতে করতে ঘেমে গেল সে, কিন্তু লাভ হলো না। খুলতে পারল না। শেষে রেগে গিয়ে মারল এক আছাড়। ভেঙে ফেলতে চায়। আর তাতেই হয়ে গেল কাজ। প্রচণ্ড আঘাতে ছুটে গেল ভেতরের স্প্রিঙ, খুলে গেল কুঠুরির ঢাকনা।

হুমড়ি খেয়ে পড়লাম আমরা তিনজন। ভেতরে রয়েছে একটা পুরানো খাম।

ছোঁ মেরে তুলে নিল কিশোর। খামের ভেতর থেকে বেরোল একটা অনেক পুরানো চাবি, আর এক তা ভাজ করা কাগজ। চাবিটা নিশ্চয় সিন্দুক কিংবা আলমারির, ভাবলাম, আর কাগজটা শুপ্তধন কোথায় আছে তার নকশা। দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

চাবিটা পকেটে রেখে ভাঁজ করা কাগজটা মেলল কিশোর।

আরেকবার হতাশ হতে হলো আমাদেরকে। কোন নকশা-টকশা নেই, কলম দিয়ে আঁকা একজন মানুষের ছবি। বিশেষত্ব একটাই, কয়েক রঙে আঁকা হয়েছে ছবিটা, একই কলম ব্যবহার করে, ভিন্ন ভিন্ন রঙের কালি দিয়ে। নিখুঁত করে আঁকা। কার ছবি চিনতে পারলাম। হলঘরে দেখেছি। জমিদার আমিন উদ্দিন সরকারের।

মানে কি এর? বিড়বিড় করল কিশোর।

 ঘোড়ার ডিম! রেগে গেছে মুসা।

হতে পারে ওই ছবিটাই খুব দামী… বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। চোখের কোণ দিয়ে চোখে পড়ল একজন মানুষ। নিঃশব্দে কখন এসে দাঁড়িয়েছেন ঘরে, উত্তেজনায় খেয়াল করিনি।

মুখ তুলে তাকালাম। গভীর আগ্রহে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছেন সেই ভদ্রলোক, যিনি বাড়ি কিনতে চান। আমরা তাকাতেই জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় পেয়েছ এটা?

বাক্সের মধ্যে, জবাব দিয়ে দিল মুসা।

 বাক্সটা কোথায় পেলে?

 কিশোরের বার বার চোখ টেপা সত্ত্বেও খেয়াল করল না মুসা, বলে দিল, পোড়োবাড়িতে। মজা পুকুরের ধারে বেতবন আছে না, সেখানে।

একটু দেখতে পারি ছবিটা? হাত বাড়ালেন ভদ্রলোক।

এই সময় ঘরে ঢুকলেন মতিদাদা। জিজ্ঞেস করলেন, কিসের ছবি?…এ-কি, এ তো আমার দাদার! কোথায় পেলে?

জানানো হলো তাকে।

লক্ষ করলাম, ছবিটার দিকে তাকিয়ে চকচক করতে লাগল ভদ্রলোকের চোখ, যিনি বাড়ি কিনতে এসেছেন। ছবিটা রেখে ভোলা বাক্সটাও হাতে নিয়ে দেখলেন। তারপর টেবিলে রেখে ঘুরে তাকালেন দাদুর দিকে, বললেন, হ্যাঁ, বাকি ঘরগুলো দেখার আর দরকার নেই আজ। রাতের বেলা না দেখে অন্যদিন এসে দিনের বেলা দেখব।

কিন্তু আপনিই তো দেখার জন্যে চাপাচাপি করলেন! ভদ্রলোকের এই হঠাৎ মত পরিবর্তনে যেন কিছুটা অবাকই হয়েছেন দাদা।

তা বলেছি। এখন বুঝতে পারছি, ঠিকই বলেছেন, রাতের বেলা ভালমত দেখা যায় না সব।

বেরিয়ে গেলেন আবার দু-জনে।

রাতের বেলা খাবার টেবিলে ছবিটা নিয়ে আলোচনা হলো। দাদু বললেন, আমার দাদু কিছুটা পাগলাটে স্বভাবের ছিলেন। ধাঁধা আর রহস্যের প্রতি বেজায় ঝোঁক ছিল তাঁর। নিজে নিজে অনেক ধাঁধা তৈরি করেছেন। ছবিও ভাল আঁকতে পারতেন।

তোমার কি মনে হয়, জিজ্ঞেস করল কিশোর, এই ছবিটাও কোন ধরনের ধাঁধা? গুপ্তধন কোথায় আছে তার ইঙ্গিত?

তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন দাদা। তোর মাথায়ও দেখি উদ্ভট সব ভাবনা খেলে বেড়ায়। দাদার সঙ্গে মিলত ভাল। হাহ্ হাহ্!

তুমি গুরুত্ব দিচ্ছ না? তাহলে বাক্সটার মধ্যে অত যত্ন করে উঠিয়ে চালার খাপে ভরে রাখলেন কেন?

ওটাও আরেক পাগলামি।

কিন্তু মেনে নিতে পারল না কিশোর, তার মুখ দেখেই বোঝা গেল।

খাওয়ার পর ঘরে এসে চাবিটা দরজার চৌকাঠের নিচের একটা ফোকরে লুকিয়ে রাখল কিশোর। বলল, সাবধানের মার নেই।

ডাইনিং রুমে তখন যে কথাটা শেষ করতে পারিনি, সেই কথাটাই তুললাম আবার, ছবিটা দামী কোন ছবি নয় তো? হয়তো আমিন উদ্দিন সরকারের ছবির নিচে আঁকা আছে অনেক দামী কোন শিল্পীর ছবি। হতে পারে না?

পারে, মাথা ঝাঁকাল কিলোর।

আমার মনে হয়, মুসা বলল, ছবিটার নিচে কোন গোপন দরজা আছে। ফ্রেমটা কত বড় দেখেছ?

সেটাও সম্ভব। চলো, বরং দেখেই আসি।

শূন্য হলঘর। দাদা-দাদী শোবার ঘরে চলে গেছেন। আক্কেল আলী থাকে বাইরের একটা ঘরে, আগে মালী থাকত ওঘরে। সেটার দরজাও বন্ধ, তার মানে আক্কেল আলীও শুয়ে পড়েছে। বাড়ির বাইরে বাগানে পাহারা দিচ্ছে কালু। আমরা টর্চের আলো ফেলতেই এগিয়ে এল লেজ নাড়তে নাড়তে।

গুপ্তধন খোঁজার এটা চমৎকার সময়। আবার হলঘরে ফিরে এলাম আমরা। আমিন উদ্দিন সরকারের ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। আসল না নকল, নিচে আরও ছবি আঁকা আছে কিনা বোঝার উপায় নেই।

এ ভাবে দেখে কিছু বুঝব না, কিশোর বলল। বুঝতে হলে ল্যাবরেটরিতে পাঠাতে হবে।

নিচে পথ আছে কিনা দেখে ফেলি না কেন? মুসা বলল।

বেশ শক্ত করে দেয়ালে লাগানো আছে ভীষণ ভারি ফ্রেমটা। খুলে সরাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হলো।

সরিয়ে আবারও হতাশ হলাম। কোন ফঁক-ফোকর নেই। একেবারে নিরেট দেয়াল। দেয়ালে ঠুকে ঠুকে দেখলাম, একটা ইঞ্চি জায়গাও পেলাম না যেখান থেকে ফাপা আওয়াজ বেরোয়।

কি আর করব। ছবিটা আবার আগের জায়গায় বসিয়ে রাখলাম।

আগতত আর কিছু করার নেই এখানে। তদন্তের কাজ রাতের মত স্থগিত রেখে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ার প্রস্তাব দিল মুসা। সানন্দে রাজি হলাম আমি। তবে কিশোরের যাওয়ার ইচ্ছে নেই। সে জানাল, কিছু থাকলে এই ঘরটাতেই আছে। আমার মন বলছে!

থাকলে সেটা সকালেও বের করা যাবে, বললাম আমি। চলো, গিয়ে শুয়ে পড়ি। ঘুমিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করি আগে।

০৬.

উত্তেজনায় ভাল ঘুম হলো না সে রাতে। দুঃস্বপ্ন দেখলাম। পাহাড়ের গুহায় আলিবাবার রত্ন খুঁজে পেয়েছি যেন আমরা, কিন্তু বের করে আনার আগেই কেড়ে নিল চল্লিশ ডাকাত। আমাদের ধরে বেঁধে ফেলল। মুসাকে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল পাথরের বেদিতে। তার মুণ্ডু কাটবে। হাউমাউ করে চিৎকার করতে লাগল মুসা। আরেক ডাকাত এসে আমার কাধ চেপে ধরে ঝাঁকাতে লাগল।

ভেঙে গেল ঘুম। দেখি, ওঠার জন্যে আমার কাঁধ ঝাঁকাচ্ছে কিশোর।

নাস্তা সেরে দাদা চলে গেলেন শহরে, দাদী রান্নাঘরে। আমরা চলে এলাম হলঘরে। আগের রাতের অসমাপ্ত কাজটা শেষ করার জন্যে। কিশোরের ধারণা, রহস্যের সমাধান রয়েছে আমিন উদ্দিন সরকারের ছবিটাতে। গুপ্তধনের চাবিকাঠি ওটাই।

কিন্তু তাকিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ ব্যথা করে ফেললাম। অাভাবিক কিছুই বের করতে পারলাম না ছবিটার। নিরেট কাঠে তৈরি ফ্রেম, ফাপাও নয় যে তার ভেতর কোন নকশা জাতীয় কিছু ভরে রাখা যাবে।

কিন্তু কিশোর হাল ছাড়ল না। সামনে এগিয়ে, পিছিয়ে গিয়ে, মাথা এপাশে কাত করে, ওপাশে কাত করে দেখতে লাগল। সেই সঙ্গে চলল তার নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা।

আচমকা আনমনে বলে উঠল, ব্যাপারটা অদ্ভুত!

কি অদ্ভুত? জানতে চাইলাম আমি আর মুসা।

 আমিন উদ্দিন সরকারের বাবরি চুল।

 চুলে আবার কি করল? বুঝতে পারলাম না।

হয়তো কোন ফকির কিংবা পীরের মুরিদ ছিলেন, মন্তব্য করল মুসা। এ দেশে অনেককেই তো ও-রকম রাখতে দেখি, যেন মুরিদ হলে বাবরি না রাখলে চলে না।

পীরের অনুকরণ করে আরকি, কিশোর বলল। আমিন উদ্দিন সরকার কেন ও রকম চুল রেখেছিলেন, সেটা তার ব্যাপার, আমাদের মাথাব্যথা নেই। আমার প্রশ্ন হলো, বাক্সের ছবিটাতে খাটো করে ছাঁটা চুল এঁকেছেন কেন তিনি?

আঁকার সময় হয়তো তার ছোট চুল ছিল।

সেই কথাটাই ভাবছি। কি করে জানব? দীর্ঘ একটা মুহূর্ত আবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। দু-বার চিমটি কাটল নিচের ঠোঁটে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, রবিন, ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা নিয়ে আসবে? ছবিটাও নিয়ে এসো।

ঘর থেকে ওগুলো এনে দিলাম তাকে।

 দুটো ছবি মিলিয়ে মিলিয়ে দেখতে লাগল সে।

বাবরির ওপর ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা ধরে রাখল দীর্ঘক্ষণ। ধীরে ধীরে হাসি ফুটল তার মুখে। মাথা দুলিয়ে বলল, ই, বুঝেছি! এত্তো সহজ, অথচ…

কি বুঝেছ! প্রায় চিৎকার করে উঠলাম আমি আর মুসা।

কিন্তু কিশোর জবাব দেয়ার আগেই ঝটকা দিয়ে খুলে গেল সদর দরজা। ছুটে ঘরে ঢুকল আক্কেল আলী। ভীষণ উত্তেজিত। চিৎকার করে ডাকতে লাগল, মা, ও মা, জলদি বেরোন! সাংঘাতিক কাণ্ড হয়ে গেছে! মা-আ!

রান্নাঘর থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরোলেন দাদী। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে রে! অত চিৎকার করছিস কেন?

সর্বনাশ হয়ে গেছে, মা! সাহেব অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন। লোক এসে খবর দিল, এখুনি হাসপাতালে যেতে হবে আপনাকে!

কিসের গুপ্তধন খোঁজা, আর কিসের ছবি-রহস্যের সমাধান, দল বেঁধে হাসপাতালে ছুটলাম আমরা।

খুব ব্যথা পেয়েছেন মতিদাদা। সারা গায়ে ছোট-বড় ব্যান্ডেজ, বা পায়ে প্লাস্টার। হাড় ভেঙে গেছে। তবে হুঁশ আছে তার। আমাদের দেখে মলিন হাসি হাসলেন। প্রথমেই দাদীকে সাবধান করে দিলেন চিৎকার করে কান্নাকাটি না করতে।

তাঁর মুখেই জানলাম, রঙ সাইড থেকে একটা ট্রাক এসে গুঁতো মেরেছিল তার গাড়িকে। ভাগ্যিস তিনি আস্তে চালাচ্ছিলেন, তাই অনেকটা সামলে নিতে পেরেছেন। নয়তো মুখোমুখি সংঘর্ষেই ভর্তা হয়ে যেত গাড়িটা। রাস্তার পাশের খাদে উল্টে পড়াও বিচিত্র ছিল না। যা-ই ঘটুক না কেন, এ কাহিনী বলার জন্যে আর বেঁচে থাকতেন না তাহলে। ট্রাকের নম্বর রাখতে পারেননি তিনি। তবে একটা ব্যাপার তার মনে হয়েছে, ইচ্ছে করেই এসে তো লাগিয়েছে ট্রাকটা। যেন মারার জন্যেই রাস্তার মোড়ে ওত পেতে বসে ছিল।

ব্যাপারটা রহস্যময় মনে হলো আমার কাছে। প্রশ্ন জাগল, এই দুর্ঘটনার সঙ্গে গুপ্তধনের কোন সম্পর্ক নেই তো? কিন্তু আমরা যে গুপ্তধন খুঁজছি কে জানে? কারও তো জানার কথা নয়!

হাসপাতালের ভিজিটিং আওয়ার শেষ হলো। বাড়ি ফিরে যেতে হবে। দাদাকে দেখাশোনার জন্যে তাঁর কাছে রয়ে গেলেন দাদী। বার বার দুঃখ প্রকাশ করলেন, আমাদের খুব অসুবিধে হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা সে-কথা উড়িয়ে দিয়ে বললাম, কোন অসুবিধে হবে না। আক্কেল আলী থাকলেই যথেষ্ট। সে না থাকলেও অসুবিধে নেই, আমরাই রান্না করে খেতে পারব। বাড়িটা খালি হয়ে যাওয়ায় মনে মনে খুশি হলো বরং কিশোর–পরে বলেছে আমাকে আর মুসাকে, রহস্যটার সমাধান করতে সুবিধে হবে।

সকালে চমৎকার রোদ ছিল, কিন্তু হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এখন দেখি কেমন যেন মুখ গোমড়া করে রেখেছে আকাশ। গুমোট গরম, বাতাস স্তব্ধ। আকাশের ঈষাণ কোণে একটুকরো সুরমা রঙের মেঘ যেন গ্যাট হয়ে বসে আছে। ভাবেসাবে। মনে হলো, কোন কারণে যেন রেগে গেছে প্রকৃতি, ফেটে পড়ার অপেক্ষায় আছে। সন্দেহ হলো, কালবোশেখি আসছে না তো?

বাড়ি ফিরে উঠানে ঘুঘুর পালকে দানা খুঁটতে দেখলাম না। কবুতরগুলো গিয়ে বসেছে ছাতের কার্নিশে, বকবকম নেই, চুপ করে থাকার মধ্যেও যেন কি এক ধরনের অস্থিরতা। বিপদের আশঙ্কা করছে বোঝা গেল।

যাই হোক, খাওয়া-দাওয়া সেরে আর কোন কাজ না থাকায় কিশোরের উৎসাহে ছবি-রহস্য সমাধানের কাজে লেগে গেলাম আমরা। দাদার এখন অনেক টাকা দরকার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গুপ্তধনগুলো উদ্ধার করা গেলে ভাল।

যে কথাটা তখন বলতে গিয়ে বলতে পারেনি কিশোর, দাদার অ্যাক্সিডেন্টের কথায় থেমে যেতে হয়েছিল, সেটাই বলল, বাক্সে পাওয়া ছবির চুলের ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছ? খাটো করে আঁকা-ই হয়েছে দেয়ালে ঝোলানো ছবিটার বাবরি চোখে পড়ানোর জন্যে। আর এর মধ্যেই করে রাখা হয়েছে কারসাজি। ভাল করে দেখো আরেকবার, তোমরাও বুঝতে পারবে।

দেখলাম, যতভাবে সম্ভব। সেই আগের মতই অন্ধকারে রইলাম। মুসা বলল, দেখো, পারলে আগেই পেরে ফেলতাম; ঝুলিয়ে না রেখে বলেই ফেলো না ছাই!

কিশোর বলল, যত কারসাজি চুলের মধ্যে করে রাখা হয়েছে। দেখো, ভিন্ন ভিন্ন রঙে অতি খুদে খুদে অক্ষর আর নম্বর লেখা।

প্রায় ছোঁ মেরে কিশোরের হাত থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা কেড়ে নিলাম। সত্যিই তো! খুব সরু নিবের কলম দিয়ে এমন করে আঁকা হয়েছে ওগুলো, মিশে রয়েছে কোঁকড়া চুলের মধ্যে। জানা না থাকলে মনে হবে চুলের অলঙ্করণ করার জন্যে ওসব এঁকেছে আর্টিস্ট। ভাল বুদ্ধি করেছিলেন আমিন উদ্দিন সরকার।

নিশ্চয় কোন তথ্য দিয়েছেন! মুসা বলল। গুপ্তধনের খোঁজ!

তা দিয়েছেন, কিশোর বলল। তবে খুবই গোলমেলে জিনিস। সাঙ্কেতিক। সঙ্কেতের মানে বের করতে না পারলে বোঝা যাবে না কোথায় আছে।

তাহলে বসে আছো কেন? শুরু করে দাও না। আমরা যে পারব না, অন্তত আমি পারব না এ তো জানা কথাই।

আবার ম্যাগনিফাইং গ্লাস তুলে নিল কিশোর। দেখতে লাগল খুদে অক্ষর আর নম্বরগুলো।

দেখো, একটা নিয়ম মেনে চলা হয়েছে। চুলের দুটো করে ভাজের ফাঁকে, মাঝখানে একসারিতে রয়েছে অক্ষরগুলো। একেক সারির একেক রঙ। লালচে, ধূসর, বাদামী, ছাই রঙ…রঙের এই বিভিন্নতা কেন? একেকটা রঙ কি একেকটা বাক্য গঠন করেছে?

অক্ষরগুলো এত ছোট, ঠিকমত পড়া যায় না, বললাম।

ইচ্ছে করেই অত ছোট করেছে, নইলে তো যে কারোই চোখে পড়ে যেত। গ্লাস দিয়ে চেষ্টা করলে পড়া যাবে। এক কাজ করো, কাগজ কলম নিয়ে এসো।

নোটবুক আর পেন্সিল পকেটেই থাকে আমার। বের করে তৈরি হয়ে বসলাম।

বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ বাজ পড়ল প্রচণ্ড শব্দে। ভীষণ চমকে গেলাম। ছুটে দরজার বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি আর মুসা। তাজ্জব হয়ে দেখলাম আকাশের রূপ। সেই সুরমা রঙের মেঘের টুকরোটাই বিরাট-বিশাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে প্রায় আধখানা আকাশ জুড়ে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে তার ভেতর। আরও কিছু ছেঁড়া মেঘের টুকরো ছুটাছুটি করছে আকাশের ইতিউতি।

কালবোশেখি আসছে, পেছন থেকে বলে উঠল কিশোর।

মালীর ঘর থেকে বেরিয়ে এল আক্কেল আলী আর কালু। আক্কেল আলী বলল, ঘরে যান, ঝড়বৃষ্টি হবে।

আমি বললাম, আসুক। ঝড় দেখব আজ।

হাসল আক্কেল আলী। বলল, আম কুড়ানোর ইচ্ছে আছে নাকি?

 আছে! লাফিয়ে উঠল মুসা। অসুবিধে হবে?

কিছু হবে না, যদি আসল ঝড়টা আসার আগেই ঘরে ঢুকে যান। বেশি ঝড়ে ডাল ভেঙে পড়ে, গাছ উপড়ায়, মাথায় পড়লে মরবেন।

শাই শাই একটা আওয়াজ কানে আসছিল, বুঝতে পারছিলাম না কিসের, গাছের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই বুঝলাম বাতাসের শব্দ শুনছিলাম। অনেক জায়গায় অনেক রকমের ঝড় দেখেছি, কিন্তু এর যেন তুলনা হয় না। স্তব্ধ হয়ে থাকা গাছের ডালপাতা আচমকা ভীষণ দুলতে আরম্ভ করল। প্রচণ্ড আঘাতে শুকনো পাতা উড়তে লাগল। টুপটাপ খসে পড়তে লাগল পাকা আম।

লাফ দিয়ে বারান্দা থেকে নেমে গেলাম আমরা তিনজন। পাকা আম কুড়াতে শুরু করলাম। কিন্তু কটা কুড়াব! দু-হাতে দুটো তুলে নিতে না নিতেই আশপাশে আরও দশ-বিশটা করে পড়ে। আম কুড়াতে যে এত মজা জানতাম না। মহাআনন্দে আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিল কালু। আম তো তুলতে পারে না, চারপাশে নাচানাচি আর ঘেউ ঘেউ জুড়ে দিল। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে আক্কেল আলী।

কয়েক মিনিট পর ক্ষণিকের বিরতি দিয়ে আবার বইতে শুরু করল বাতাস। আগের চেয়ে দ্বিগুণ জোরে। সেই সঙ্গে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা পড়তে লাগল। এইবার শঙ্কা দেখা দিল আক্কেল আলীর চোখে। জরুরী গলায় বলল, জলদি ঘরে যান! তুফান এসে গেছে!

বারান্দায় গিয়ে উঠলাম। কিন্তু প্রবল বাতাস আর বৃষ্টির দাপটে সেখানেও টিকতে পারলাম না। ঘরে ঢুকে যেতে হলো। আমাদের সঙ্গে ঢুকল আক্কেল আলী আর কালু।

প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে বইল ভয়াবহ ঝড়। তারপর হঠাৎ যেমন এসেছিল তেমনি করেই থেমে গেল আবার। কমে গেল বাতাস, আস্তে আস্তে বৃষ্টি পড়াও থেমে গেল। বাইরে বেরিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। পশ্চিম আকাশে বিশাল এক মেঘের পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে পড়ন্ত সূর্য। আশ্চর্য তার রূপ আর রঙ! বিশ্বাসই হতে চায় না–এই কয়েক মিনিট আগেও কালিগোলা অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল এখানে পৃথিবী। মাটিতে পড়ে থাকা ঝরাপাতার স্তূপ, ভেঙে পড়া ডাল আর পানি জমা না থাকলে ঝড় হয়ে গেল যে সেটাই বোঝা যেত না।

অনেক আম পাওয়া গেল। খেতে খেতে গলা পর্যন্ত ভরে গেল আমাদের। দু হাত, মুখ রসে মাখামাখি। ফল যে কোনদিন এত মজা করে, এভাবে খাওয়া যায়, তা-ও জানতাম না। এত মায়া, এত মাধুর্য আছে যে এই দেশটাতে, এখানে কেউ না এলে, বাস না করলে অনুভব করা তো দূরের কথা, আন্দাজও করতে পারবে না।

সন্ধ্যা হলো। প্রচণ্ড ঝড়ের পর কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে প্রকৃতি। দূর থেকে আজান শোনা গেল। ধ্যানমগ্ন হয়ে গেছে বুঝি সবাই-ওই যে গোধূলির কালচে আকাশ, নিচের গাছপালায় ছাওয়া প্রকৃতি, পোকামাকড়, পশুপাখি, সব, সবাই যেন স্রষ্টার প্রার্থনায় মগ্ন। দেখতে দেখতে মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায় অকারণে।

আলো জ্বেলে দিল আক্কেল আলী। রাতের জন্যে রান্না করতে গিয়ে ঢুকল রান্নাঘরে। আমরা তিন বন্ধু আবার ফিরে এলাম হলঘরে, আমিন উদ্দিন সরকারের ছবির কাছে। সাঙ্কেতিক অক্ষরের সমাধান করতে বসলাম।

অক্ষর আর নম্বরগুলো সাজিয়ে ফেলতে লাগল কিশোর। সে বলতে লাগল, আমি লিখে নিলাম। প্রথমে লালচে রঙে লেখা অক্ষর, লাইনটা দাঁড়াল এ রকম:

নিজচে২ খোঁজজো৪ আধাজর৩ জালেজর১

তারপর বাদামী:

আজছে২ তাজাহার৩ ভেজতর৪ সিজন্দুক১

একেক রঙে লেখা অক্ষরের একেকটা লাইন, সব মিলিয়ে হলো চারটে:

নিজচে২ খোঁজজোঃ আধাজরত জালেজর১
আজছে২ তাজাহার ভেজতরঃ সিন্দুক
সাজত তিন২ পাঁজচে৩ মিজলিয়ে দেজখো৫
 রজতুরাজি৩ পেজয়ে যাজবেহ

অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম বোকার মত, কিছুই বুঝতে পারলাম না।

 মুসা তো বলেই ফেলল, খাইছে! এ কোন ভাষা!

কারও কথার জবাব দিল না কিশোর। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অক্ষরগুলোর দিকে। তারপর নীরবে আমার হাত থেকে পেন্সিলটা নিয়ে বলল, মনে হয় বুঝতে পারছি। এক, দুই, তিন করে নম্বর দেয়া আছে। নম্বর অনুসারে অক্ষরগুলোকে পর পর সাজিয়ে ফেলা যাক।

সাজিয়ে লেখার পর দাঁড়াল:

 জালেজর নিজচে আধাজর খোঁজজো
সিজন্দুক আজছে তাজাহার ভেজতর
 সাজত তিজন পাজচ মিজলিয়ে দেজখো
পেজয়ে যাজবে রজতুরাজি

মুসা বলল, এতেই বা কি হলো? সহজ কি হয়েছে?

হাসি ফুটল কিশোরের মুখে। মাথা নেড়ে বলল, হয়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এখনও বুঝতে পারছ না? একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ? প্রতিটি শব্দেই একটা করে বর্গীয় জ জুড়ে দেয়া হয়েছে, জটিল করে তোলার জন্যে। বাদ দিয়ে দাও…

বুঝে গেছি! প্রায় চিৎকার করে উঠলাম। পানির মত সহজ হয়ে গেছে এখন। তাড়াতাড়ি নোটবুকে লিখে ফেললাম:

জালের নিচে আধার খোজো
সিন্দুক আছে তাহার ভেতর
সাত তিন পাঁচ মিলিয়ে দেখো
পেয়ে যাবে রত্নরাজি

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। বলল, মেসেজ পেয়ে গেছি! কোথায় খুঁজতে হবে বলে দিয়েছে। কাল থেকেই শুরু করব খোঁজা!

.

০৭.

 সারাদিন অনেক পরিশ্রম গেছে। রাতের খাওয়া সেরে শোয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম।

মাঝরাতে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল আমার। কালুর ডাকে। নিচতলায় আক্কেল আলীর সঙ্গে ছিল সে। এখন বাইরে চলে গেছে। তার ঘেউ ঘেউ শুনে আক্কেল আলীর ঘুমও ভাঙল। ডাকতে ডাকতে বাইরে বেরোল সে।

মুসা আর কিশোরও জেগে গেল। সবাই বেরোলাম। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলাম আক্কেল আলীকে। সে বলল, মনে হয় চোর ঢুকেছিল!

জিজ্ঞেস করলাম, কিছু নিয়েছে?

বুঝতে পারছি না!

ঘরে ফিরে এসে দেখতে লাগল সে, কিছু নিয়েছে কিনা। দেখা গেল সব ঠিকঠাকই আছে। কিছু খোয়া যায়নি। সময়মত কালু জেগে যাওয়াতেই বোধহয় খালিহাতে পালিয়েছে।

তবে খালি হাতে যে যায়নি, যা নিতে এসেছিল, নিয়েই গেছে, সেটা জানতে পারলাম পরদিন সকালে। আমাদের ঘরে টেবিলের ওপর রেখেছিলাম পোড় বাড়িতে পাওয়া বাক্স আর তার ভেতরের কাগজটা। অনেক খুঁজেও আর পেলাম না সেটা। বুঝলাম, ওটা নিতেই এসেছিল চোর।

আরও নিশ্চিত হয়ে গেলাম, সঠিক পথেই এগোচ্ছি আমরা। গুপ্তধনগুলো এখনও খোয়া যায়নি, এ বাড়িতেই আছে। তবে দুঃখের বিষয়, আমরা ছাড়াও আরও কেউ জানে সে-খবর। ছবিটাও নিয়ে গেছে। আমাদের আগেই যদি গুপ্তধন কোথায় আছে, বের করে ফেলে?

কিশোর বলল, ফেললে ফেলুক। সিন্দুকের চাবি আমাদের কাছে। খুলবে কি করে?

তালা ভেঙে, জবাব দিল মুসা।

দেখা যাক কি করে। আমরাও তো আর বসে থাকব না। আমাদের অনেক সুবিধে। বাড়ির যেখানে-সেখানে যখন-তখন খোঁজাখুঁজি করতে পারব, সে পারবে না। তাকে আসতে হবে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে।

তা-ও বটে।

খাবার তৈরি করে, টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে হাসপাতালে রওনা হয়ে গেল আক্কেল আলী। আমরা বাড়িতেই রয়ে গেলাম। বলে দিলাম, বিকেলে ভিজিটিং আওয়ারে দাদাকে দেখতে যাব।

সকালের নাস্তা সেরেই আর দেরি করল না কিশোর, মেসেজটার মানে বের করতে বসে গেল। কয়েকবার করে পড়ল ছড়াটা। তারপর বলল, প্রথম লাইনটা থেকে শুরু করি-জালের নিচে আধার খোজো!

আধার মানে তো পাত্র, তাই না? মুসার প্রশ্ন।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর, হ্যাঁ।

কি বলতে চায়? কোন জালটালের নিচে লুকিয়ে রেখেছে সিন্দুকটা?

মনে হয় না, মাথা নাড়ল কিশোর। জাল এমন কোন জিনিস নয় যার নিচে দেখা যায় না। তা ছাড়া সুতার জাল আর কতদিন টেকে? ব্যবহার করলে তো যায়ই, পড়ে থাকলেও নষ্ট হয়ে যায়।

তাহলে?

সেটাই তো ভাবছি, আনমনে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর।

আমি বললাম, আচ্ছা, দেখতে ভুল করোনি তো? হয়তো জল লিখেছে, তুমি পড়েছ জাল…

তীক্ষ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে তুড়ি বাজাল কিশোর, ঠিক বলেছ! জলই হবে! তাহলে মিলে যায়! জলের নিচে আধার খোজো, তার ভেতরে সিন্দুক আছে। তার মানে কোন জলাশয় বা পানির নিচে লুকানো আছে একটা বড় পাত্র, তার মধ্যে রাখা হয়েছে সিন্দুকটা।

পুকুরের নিচে না তো? মুসা বলল, মজা পুকুরটা! আমি বাবা ওর মধ্যে নামতে পারব না। সাধারণ সিন্দুক থাকলেই ওতে ভূত হয়ে যাবে, আর রত্ন ভরা লোহার সিন্দুক হলে তো কথাই নেই, ভূতুড়ে সিন্দুকদের রাজা হবে!

ওই পুকুরে ডুব দিতে আমারও ভয় লাগবে, স্বীকার করল কিশোর। এক কাজ করতে পারি আমরা। আক্কেল আলী এলে, জেলে এনে মাছ ধরার ছুতোয় বেড়জাল নামিয়ে দিতে পারি। নিচে থাকলে জালে আটকাবেই সিন্দুকটা।

যদি দীঘিটাতে ফেলে দিয়ে থাকে? আমি প্রশ্ন তুললাম।

আমার তা মনে হয় না। এত বড় দীঘি থেকে যে সিন্দুক তোলা সহজ হবে না, এত নিচে নেমে কেউ খুঁজতে পারবে না, এটা জানা ছিল আমিন সরকারের। নিজেকে দিয়েই ভাবি, তার পরিস্থিতিতে আমি হলে কি করতাম? এমন কোথাও রাখতাম, যেখানে খোঁজার কথা সহজে মনে আসবে না কারও, কিন্তু জেনে গেলে বের করে আনতে আর অসুবিধে হবে না। দীঘির তলা থেকে তুলে আনা বেজায় কঠিন। একমাত্র উপায়, সমস্ত পানি সেঁচে ফেলা। তারপরেও কথা থাকে, কাদায় বেশিদিন জেগে থাকবে না ভারি সিন্দুক, দ্রুত তলিয়ে যাবে। তখন পানি সেঁচলেও আর পাওয়ার উপায় থাকবে না। দীঘির নিচে লুকানোটা মোটেও নিরাপদ না। এমন কোথাও রেখেছেন, যেখানে সহজে খুঁজে পাবে না কেউ, আবার নিরাপদে থাকবে দীর্ঘদিন।

পুকুরের বেলায়ও তো এ কথা খাটে?

তা খাটে। তবে ছোট পুকুর তো, পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তা ছাড়া তখন তাড়াহুড়োয় কোনমতে সিন্দুকটা লুকিয়ে ফেলার কথাই কেবল ভেবেছেন আমিন সরকার…

আচ্ছা, বাধা দিয়ে মুসা বলল, আরও সহজ জায়গার কথা ভাবছি না কেন আমরা?

কোথায়? জানতে চাইলাম আমি আর কিশোর।

 পোড়ো বাড়িটার পাশের মাছের অ্যাকোয়ারিয়াম! ওটাও তো জলাশয়…

তাই তো! লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর, আজকে আমার মাথাটার হলো কি? এটা ভাবলাম না কেন? জলদি চলো! শাবল, কোদাল নিয়ে যাব!

কালুকে সঙ্গে করে সেই পোড়োবাড়ির কাছে চলে এলাম আমরা। অগভীর নালার মুখটা মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিতেই পুকুরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। অ্যাকোয়ারিয়ামের সামান্য পানি সেঁচে ফেললাম আমরা। নিচে কাদা। কোদাল দিয়ে তুলে ফেলতে যথেষ্ট কষ্ট হলো। তারপরে মাটি খোঁড়া অবশ্য সহজ হয়ে গেল, ভেজা মাটি বেশ নরম। কোপ দিলেই উঠে চলে আসে।

কিন্তু ছয়…সাত…আট ফুট গর্ত করে ফেলার পরও কিছুই পাওয়া গেল না। শাবল কিংবা কোদালের ফলায় লেগে ঠং করে উঠল না লোহার সিন্দুক। আরও ফুট দুয়েক খুঁড়ে দেখল মুসা। গলগল করে পানি উঠে আসছে এখন গর্তের নিচে। ভরে যাচ্ছে।

বোঝা গেল, এখানে নেই সিন্দুকটা।

ক্লান্ত হয়ে বেতবন থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা। সারা গা কাদায় মাখামাখি। দীঘির পানিতে ধুয়ে ফেললাম। খিদে ততটা পায়নি, কারণ কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর আম খেয়েছি।

খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে বাড়িতে এসে ভাত খেয়ে নিলাম। সকালেই রান্না করে রেখে গেছে আক্কেল আলী। তারপর আবার বেরোলাম গুপ্তধন খুঁজতে।

পুকুর আর দীঘিটা বাদে যত রকম জলাশয়, অর্থাৎ পানির আধার আছে ও বাড়িতে, সমস্ত জায়গায় খুঁজলাম। পানির ট্যাংকের ওপর উঠে ঢাকনা তুলে ভেতরটা দেখল মুসা। বাগানের ট্যাপের নিচে মাটি খুঁড়ে দেখা হলো। এমনকি ঘরে বাইরে যতগুলো কল আছে, সবগুলোর আশপাশের, নিচের দেয়াল ঠুকে ঠুকে দেখলাম কোথাও ফাপা জায়গা আছে কিনা। টর্চের আলো ফেলে পুরানো। পাতকুয়াটার নিচেটা দেখলাম। পানি নেই এখন। শুকনো। সিন্দুক জাতীয় কিছু চোখে পড়ল না।

বেশ হতাশ হয়েই বিকেল বেলা হাসপাতালে রওনা হলাম তিনজনে। কালুকে রেখে গেলাম বাড়ি পাহারায়। টিক্কা খানও রইল, তবে তাকে দিয়ে কোন কাজ হবে না। চোর এলে ঠেকাতে পারবে না সে, ঠেকাতে যাবেও না। সে নিজেই একটা বড় চোর।

মতিদাদার অবস্থা আজকে বেশ খারাপ মনে হলো। দাদীর মখ শুকনো। কি ব্যাপার? ডাক্তার বললেন, না, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। জখমগুলো ফুলেছে, প্রচণ্ড ব্যথা, সেজন্যেই কষ্ট পাচ্ছেন দাদা। ব্যথা কমানোর ইনজেকশন দেয়া হয়েছে, সেই সঙ্গে ঘুমের ওষুধ, সেরে যাবে। অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়বেন দাদা।

দুঃখ করে দাদী বলতে লাগলেন, আমরাও বেড়াতে এলাম, আর এ রকম একটা অঘটন ঘটল। আটকে বসে থাকতে হচ্ছে তাকে, আমাদের জন্যে কিছুই করাতে পারছেন না।

তাঁকে নানা ভাবে সান্তনা দিলাম। কিশোর ইঙ্গিত দিল, খুব তাড়াতাড়িই গুপ্তধনগুলোও বের করে ফেলা যাবে। ও বাড়িতেই যে আছে ওগুলো, এখন এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত।

ভিজিটিং আওয়ার শেষ হলে বাড়ি ফিরলাম আমরা।

সিংহ দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ভেবেছিলাম, গেটের কাছে বসে থাকবে কাল, কিন্তু তাকে দেখলাম না। উঠানে এসে দেখি নিশ্চিন্ত মনে খাবার খুঁটছে একজোড়া ঘুঘু আর কয়েকটা কবুতর। কালু নেই। গেল কোথায়? হঠাৎ তার ঘেউ ঘেউ শোনা গেল মালীর ঘর থেকে, আমাদের সাড়া পেয়েই বোধহয় ডেকেছে।

গিয়ে দেখি বাইরে থেকে দরজায় শেকল তুলে দিয়ে ঘরে আটকে রাখা হয়েছে তাকে। অবাক কাণ্ড! কে করল এ কাজ?

গম্ভীর হয়ে কিশোর বলল, ওই চোরটা এসেছিল। কোন ভাবে কুত্তাটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে ঘরে আটকে রেখে গুপ্তধন খুঁজেছে! জলদি এসো, দেখি কি করল!

আর কোথাও কোন পরিবর্তন দেখলাম না, কেবল হলঘরে আমিন উদ্দিন সরকারের ছবিটা মেঝেতে নামানো। তারমানে আমাদেরই মত ওটার পেছনে গুপ্তপথ আছে কিনা দেখতে চেয়েছে চোর। বোধহয় আমাদের সাড়া পেয়েই আর তোলার সময় পায়নি, তাড়াহুড়ো করে পালিয়েছে।

আচ্ছা, আক্কেল আলী কিছু করছে না তো? মুসার প্রশ্ন। মাথা নাড়ল কিশোর, মনে হয় না। এ বাড়ির অনেক পুরানো চাকর সে…

পুরানো চাকরেরা যে অঘটন ঘটায় না, এমন তো কোন কথা নেই। হাসপাতাল থেকে আমাদের অনেক আগে বেরিয়ে এসেছে সে।

সে তো বাজারে যাবে বলে।

আমরা তো আর সঙ্গে যাইনি। দেখব কি করে? বাজারে যাওয়ার ছুতো করে হয়তো এখানে চলে এসেছিল।

চুপ হয়ে গেল কিশোর। হা-না কিছু আর বলল না।

আমরা আসার ঘণ্টাখানেক পর ফিরল আক্কেল আলী। হাসল আমাদের দিকে তাকিয়ে। বলল, আজ পাঙ্গাস মাছ রান্না হবে। অনেক বড় দেখে এনেছি। টমেটো দিয়ে মাছ, ফুলকপি ভাজি, ডাল। আম-কাঁঠাল-দুধ তো আছেই। চলবে?

মুহূর্তে চোরের খাতা থেকে তাকে খারিজ করে দিল মুসা। তাড়াতাড়ি বলল, চলবে মানে! জলদি যাও, ভাই, রান্নাটা সেরে ফেলো! এতটা খিদে পেয়েছে বুঝিনি

 আক্কেল আলী রান্নাঘরে চলে গেল। আমরা বেরিয়ে এসে বসলাম দীঘির ঘাটে। সূর্য তখন প্রায় ডুবে গেছে। পশ্চিম আকাশের বিশাল মেঘটা একটা লাল-কালো বিচিত্র পাহাড়ের মত লাগছে।

গুপ্তধনের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে লাগলাম আমরা।

কিন্তু কোন মানে বের করতে পারলাম না। মুসা বলল, দেখো, আমার মনে হয় ওই মজা পুকুরটাতেই খোঁজা দরকার। জেলে নামিয়ে দিয়ে দেখা উচিত।

দাদা থাকলে সুবিধে হত, কিশোর বলল। বেকায়দা হয়ে গেল। দেখি আক্কেল আলীকে জিজ্ঞেস করে, সে কোন ব্যবস্থা করতে পারে কিনা।

.

০৮.

খাবার টেবিলে বসে জিজ্ঞেস করা হলে আক্কেল আলীকে। কেন জাল ফেলতে চাই, জানতে চাইল সে। সব শুনে বলল, তা জেলের ব্যবস্থা করা যায়। নগদ টাকা দিতে হবে না। মাছ যা উঠবে তার অর্ধেক দিয়ে দিলেই হবে। কিন্তু ওই পুকুরটাতে ভাল জাতের মাছ কিছু নেই। শোল, গজার এসব ছাড়া।

ওসব মাছের ভাগ নিয়ে কোন জেলে জাল ফেলতে রাজি হবে না? কিশোর জানতে চাইল।

হয়তো হবে। শোল-গজারেরও মেলা দাম। মাছই পাওয়া যায় না আজকাল মোটে। ভোরবেলা বেরোব। পেয়ে যাব কাউকে না কাউকে।

রাতটা নিরাপদেই কাটল।

পরদিন সকালে জেলের ব্যবস্থা ঠিকই করে ফেলল আক্কেল আলী।

তিনবার করে বেড়া দেয়া হলো পুকুরটাতে। ভকভক করে নিচ থেকে কাদা উঠে ওপরের পানিও ঘোলা করে দিল, সর্বনাশ হয়ে গেল শাপলার। মাছ ধরা পড়ল প্রচুর–কই, শিং, মাগুর, টাকি, শোল এসব মাছ। জেলেরা অখুশি হলো না। অখুশি হলাম আমরা। সিন্দুক তো দূরের কথা, ছোটখাটো একটা বাক্সও পাওয়া গেল না।

মাছের ভাগ নিয়ে চলে গেল জেলেরা। ভাগে পাওয়া বাকি অর্ধেক মাছের বেশির ভাগই আবার পুকুরে ছেড়ে দিল আক্কেল আলী, কিছু জিইয়ে রাখল খাওয়ার জন্যে।

দাদা আর দাদীর জন্যে খাবার নিয়ে হাসপাতালে চলে গেল সে। আমরা আবার এসে বসলাম পুকুর পাড়ে।

কিশোর হাত বাড়াল আমার দিকে, দেখি, দাও তো তোমার নোটবইটা। মেসেজের মানে বুঝতে হয়তো ভুল করেছি আমরা। অন্য কিছু বোঝাতে চেয়েছে।

কয়েকবার করে ছড়াটা পড়ল সে।

আমি বললাম, আচ্ছা, তোমার দেখার ভুল না তো? লিখেছে এক অক্ষর, তুমি পড়েছ আরেকটা, এমন হতে পারে না?

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। তা তো পারেই! চলো, দেখি!

ভুল একটা সত্যিই হয়েছে, বেরোলো সেটা। প্রথম লাইনে জানের নিচে আধার খোজোর জায়গায় হবে জালের নিচে আঁধার খোজো। মাত্র একটা চন্দ্রবিন্দুর গোলমাল। কিন্তু ওই একটা চন্দ্রবিন্দুই যে এভাবে ভোগাবে আমাদের, তা কি আর জানতাম!

মুসা বলল, লাভটা কি হলো? আগের মতই গ্রীক ভাষা হয়ে আছে। জালের নিচে আঁধার কোথায়? জাল নিজেই তো একটা ফাঁকওয়ালা জিনিস…

লেখাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল কিশোর। বলল, বোধহয়, বুঝেছি! এসো!

সোজা আমাদের থাকার ঘরে চলে এল সে। চৌকাঠের নিচ থেকে বের করল লুকিয়ে রাখা চাবিটা। টর্চ নিয়ে এগোল আলমারির দরজার মত দরজাটার দিকে। কোন প্রশ্ন করলাম না। জানি, নিজে থেকে কিছু সে না বললে প্রশ্ন করে তার কাছে থেকে জবাব পাব না।

দরজা খুলে আমাদের নিয়ে চলে এল সিঁড়ির নিচে। জালের মত ঢাকনাটার কাছে এসে কিশোর বলল, দেখো, এইটাকে যদি জাল ধরে নিই, তাহলে এর নিচে কি আছে?

কয়লা, নিরীহ স্বরে জবাব দিল মুসা।

আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, অন্ধকার!

হ্যাঁ, অন্ধকার, মাথা ঝাঁকাল কিলোর, মানে, আঁধার। জালের নিচে আঁধার খুঁজতে বলা হয়েছে। চলো, সেটাই এখন খুঁজি।

একটানে ঢাকনাটা খুলে নিয়ে সবার আগে নেমে পড়ল মুসা। আমি আর কিশোর নামলাম তার পেছনে। দেয়াল ঠুকে ঠুকে পরীক্ষা করলাম আমরা। মেঝে পরীক্ষা করলাম–জায়গায় জায়গায় ছাল-চামড়া ওঠা, মেরামত করার কথাও আর মনে হয়নি কারও। এখানে নামেই না কেউ। প্রায়োজন পড়ে না। কোথাও কোন ফাপা শব্দ হলো না। ঘরে কোন জানালা দরজা নেই, আলো আসার পথ নেই, ঢোকার একমাত্র পথ ওই জালিকাটা ঢাকনাটা।

সিন্দুকটা আছে কোথায়? প্রশ্নটা আমাদের সবারই মনে।

এককোণে অযত্নে ফেলে রাখা হয়েছে কিছু কয়লা, ছোট একটা ভূপ। সেদিকে তাকিয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে লাগল কিশোর।

বাইরে কালুর ঘেউ ঘেউ শোনা গেল। সে যে উত্তেজিত হয়ে ডাকছে, গুপ্তধনের চিন্তা আমাদের মাথায় না থাকলে হয়তো বুঝতে পারতাম। কিন্তু এ-মুহূর্তে কোন গুরুত্বই দিলাম না ডাকটাকে।

কয়লার স্তূপের দিকে হাত তুলল কিশোর, ওর নিচে দেখতে হবে।

 মরচে পড়া একটা বেলচা পড়ে আছে। সেটা তুলে নিল মুসা।

কয়লা সরাতে দেরি হলো না। মেঝেতে দেখা গেল খানিকটা জায়গার প্লাস্টার নেই। ইট বেরিয়ে আছে। ওরকম ইট ঘরের অনেক জায়গাতেই বেরিয়ে আছে। আলাদা কিছু না। খুব একটা আশা করতে পারলাম না।

শাবল দিয়ে চাড় মেরে সেগুলো তোলার পরই কিন্তু বেরিয়ে পড়ল একটা খুদে আয়রন সেফ। চিত করে শোয়ানো। ডালা এবং হাতল ওপরের দিকে করা।

উত্তেজনায় প্রায় কাঁপছি আমি। মুসার অবস্থাও আমারই মত।

আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসল কিশোর। বলল, জালের নিচে আঁধার খোজো, সিন্দুক আছে তাহার ভেতর। এটুকু মিলে গেল। এবার পরের লাইন–সাত তিন পাঁচ মিলিয়ে দেখো। এটা সহজ, নিজেই যেন নিজেকে বোঝাচ্ছে সে, লক কম্বিনেশন। চাবির ফুটোয় চাবি ঢুকিয়ে মোচড় দিল। ঘুরল না। নব ধরে কম্বিনেশন মেলাতে শুরু করল-সাত…তিন…পাঁচ। কট করে একটা আওয়াজ হলো। আবার চাবিতে মোচড় দিতেই খুলে গেল তালা।

হাতল ধরে বাঁকা করে চাপ দিয়ে টেনে ডালা খুলল কিশোর।

হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম আমরা। টর্চের আলোয় যেন জ্বলতে লাগল সোনা আর পাথরে তৈরি মহামূল্যবান জিনিসগুলো।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে থাকার পর নীরবতা ভাঙল মুসা, খাইছে, কি জিনিসরে বাবা! দাম কত হবে?

খড়খড়ে গলায় জবাব এল ওপরের ঢাকনার কাছ থেকে, অনেক! কোটিখানেক টাকা হলেও অবাক হব না। অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে, খুঁজে বের করার জন্যে।

ঝট করে ফিরে তাকালাম আমরা। অপরিচিত একটা লোক। হাতে পিস্তল। ধীরপায়ে সরু সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে শুরু করল সে।

কয়লার ঘরের মেঝেতে এসে দাঁড়াল লোকটা।

 কে আপনি? কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে কিশোর, বুঝতে পারছি।

বললেই কি আর চিনবে? খড়খড়ে গলায় বলল লোকটা, আমার নাম রবিউল। কিন্তু অনেকেই আমাকে দেখতে পারে না, বলে রবিগুণ্ডা। তাতে অবশ্য আমি কিছু মনে করি না, আড়ালে বলে তো। সামনে বলার সাহস কারও নেই।

কি চান?

সেটা আবার বলে দিতে হবে নাকি? হাতে করে আনা একটা চটের ব্যাগ ছুঁড়ে দিয়ে বলল রবিগুণ্ডা, অনেক করেছ, ছোট্ট আরেকটা কাজ করো, জিনিসগুলো ভরে দাও, নিয়ে বিদেয় হই।

তারমানে আপনিই লেগেছিলেন পেছনে। ছবি চুরি করেছেন, খালি বাড়িতে এসে কালুকে মালীর ঘরে ভরে রেখে অনুসন্ধান চালিয়েছেন…

কালু কি কুত্তাটার নাম নাকি? ভীষণ পাজি। এখন ও তো ঢুকতেই দেবে না। শেষে মাথায় বাড়ি দিয়ে বেহুশ করে ফেলে রেখে আসতে হলো।

মতিদাদার গাড়িতেও আপনিই ধাক্কা লাগিয়েছিলেন নাকি?

 খিক খিক করে হাসল রবিগুণ্ডা। না, আমি না, আমার এক দোস্ত।

ও। একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল কিশোর। গালে হাত ডলল। তারপর বলল, তার মানে একা কাজ করছেন না আপনি। দলে আরও লোক আছে। আপনাদের বস কে?

হাসি হাসি ভাবটা দূর হয়ে গেল রবিগুণ্ডার মুখ থেকে। আচমকা খেঁকিয়ে উঠল, এত কথা জিজ্ঞেস করো কেন! যা বলছি, করো, জিনিসগুলো ব্যাগে ভরে দাও গুলি খেতে না চাইলে! জলদি!

আচ্ছা আচ্ছা, যাচ্ছি! তাড়াতাড়ি বলল কিশোর। গুলি করবেন না!

এক ধমকেই কাবু হয়ে গেল! এটা তো তার স্বভাব না। কোন চালাকি করছে না তো? পরস্পরের দিকে তাকালাম আমি আর মুসা।

আড়চোখে দেখলাম, সেটার কাছে গিয়ে আবার বসে পড়ল কিশোর। লোকটার দিকে পেছন করে। হাঁ হয়ে খুলে থাকা ডালার নিচে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বের করে আনল চাবিটা, আলগোছে ফেলে দিল বুক পকেটে, লোকটার অলক্ষে। তারপর এক ঝটকায় ডালাটা আবার লাগিয়ে দিয়ে কম্বিনেশনের নব ঘুরিয়ে সব নম্বর দিল এলোমেলো করে।

অ্যাই, কি করো, কি করো! বলে চিৎকার করে উঠল লোকটা।

 হাত ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়াল কিলোর। ডালাটা বন্ধ করে দিলাম।

খোলো, নইলে গুলি করব!।

পা বাড়াতে গেল মুসা। ঝট করে তার দিকে পিস্তল ঘুরিয়ে ধমক দিল রবিগুণ্ডা, খবরদার!

থেমে গেল মুসা।

কঠিন কঠে বলল লোকটা, এক থেকে তিন পর্যন্ত শুনব। এর মধ্যে না খুললে প্রথমে পায়ে গুলি করব, তারার… কি করবে পিস্তল নাচিয়ে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল সে।

শুনল, এক!

চুপ করে রইলাম আমরা। কিশোর কি করে দেখছি।

 কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে আবার বলল রবিগুণ্ডা, দুই!

কিশোর চুপ।

উসখুস করছে মুসা। আমারও অস্থির লাগছে।

ঠিক এই সময় একটা নড়াচড়া লক্ষ করলাম ওপরে। দেখলাম, ঢাকনার কাছে নীরবে এসে দাঁড়িয়েছে কাল। লোকটা তিন গোনার সঙ্গে সঙ্গে ঘাউ করে একটা হাঁক ছেড়ে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর।

.

০৯.

একসঙ্গে ঘটে গেল কয়েকটা ঘটনা। আমাকে ওপর দিকে তাকাতে দেখেই সন্দেহ হওয়ায় রবিগুণ্ডাও তাকিয়েছিল। সরে যাওয়ার চেষ্টা করল সে। তাতে লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো কালু, টুটি কামড়ে ধরতে পারল না। তবে একেবারে বিফল হলো না তার। আক্রমণ। ঝাড়া লেগে হাত থেকে পিস্তলটা উড়ে চলে গেল নোকটার।

এ রকম একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল মুসা। চোখের পলকে গিয়ে পড়ল লোকটার ওপর। জাপটে ধরে এক ল্যাঙ মেরে ফেলে দিল মেঝেতে। আমিও চুপ রইলাম না। তুলে নিলাম পিস্তলটা।

আবার গলায় কামড় বসাতে গেল কালু। মার খেয়ে হিংস্র হয়ে উঠেছে, প্রতিশোধ নিতে চাইছে লোকটার ওপর। গলার কলার টেনে তাকে আটকাল কিশোর।

পিস্তলটা আমাদের দখলে চলে আসায় আর কিছু করতে পারল না রবি। তা ছাড়া একা সে, আমাদের তিনজনের সঙ্গে পারবে না, তার ওপর রয়েছে  সাংঘাতিক খেপে যাওয়া একটা কুকুর। আর গোলমাল করল না সে।

তাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা। ছাড়া রাখতে সাহস পাচ্ছি না। তাই একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলার ব্যবস্থা করলাম। এরপর বসলাম আলোচনায়, কি করা যায়?

কিশোর বলল, থানা অনেক দূরে। অতটা পথ তাকে হটিয়ে নিয়ে যাওয়া নিরাপদ না। তা ছাড়া একটা লোককে পিছমোড়া করে বেঁধে পিতলের মুখে নিয়ে চললে ভিড় করে আসবে লোকে। কেন নিয়ে চলেছি, কি করেছে সে, জিজ্ঞেস করে করে জান অস্থির করে দেবে। বলতে হবে আমাদের। গুপ্তধনের খোঁজ পেয়েছি যে জানাজানি হয়ে যাওয়ার ভয় আছে। চোর-ডাকাতের তো অভাব নেই। আরও অনেকেই এসে লুট করার চেষ্টা করবে তখন।

তাহলে কি করব? বললাম, একে এখানে এভাবেই বেঁধে রেখে যাই। থানায় গিয়ে পুলিশকে খবর দিই, পুলিশই এসে ধরে নিয়ে যাক।

এটাই ভাল, মুসা বলল। রবিগুণ্ডার দিকে তাকাল সে। হেসে বলল, কি মিয়া, থাকতে পারবে না? কালুকে পাহারায় রেখে যাব। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এখানে পাখি দেখবে। সময়টা খারাপ কাটবে না।

থানায় এসে দাদায় পরিচয় জানিয়ে, আমরা তার কি হই বলে, চোর ধরার খবরটা দিলাম। গাড়ি নিয়ে রওনা হলেন একজন সাব ইন্সপেক্টর। তাঁর নাম ফারুক হোসেন।

কিন্তু সাংঘাতিক একটা চমক অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্যে। গাছের কাছে। এসে দেখলাম, রবিগুণ্ডা পালিয়েছে। কয়েক টুকরো কাটা দড়ি পড়ে আছে গোড়ায়। কালুকে ছেড়ে রেখে গিয়েছিলাম, তাকে এখন বেঁধে রাখা হয়েছে গাছের সঙ্গে। আমাদের দেখেই কেউ কেউ করে উঠল।

অপদার্থ কুকুর! মার খায়, ধরা পড়ে, এ একটা কুকুর হলো নাকি! গাধা! বিরক্ত হয়ে বলল মুসা। হত যদি জিনার রাফিয়ান, কিংবা আমাদের চিতা, টের পেত বাছাধন। পালাতে আর হত না। কিন্তু ছুটল কি করে লোকটা?

গম্ভীর হয়ে কিশোর বলল, গিটগুলো হয়তো শক্ত করে দাওনি। ভুল হয়ে গেছে। আমাদের একজনের থাকা উচিত ছিল এখানে।

আমরা যে মিথ্যে বলিনি, বিশ্বাস করলেন সাব-ইন্সপেক্টর। কাটা দড়িগুলো আছে। সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো পিস্তলটা। ওটা তার হাতে তুলে দিলাম আমরা। চোরটাকে ধরার সব রকম চেষ্টা করা হবে-এই আশ্বাস দিয়ে চলে গেলেন তিনি।

আপাতত আর কোন কাজ নেই। খাওয়া-দাওয়া সেরে হাসপাতালে রওনা হলাম আমরা। দাদার খোঁজও নেব, গুপ্তধন পাওয়ার সুখবরটাও তাঁকে জানাব।

বলো কি বিশ্বাসই করতে পারলেন না দাদা। সত্যি পেয়েছ! গোয়েন্দা বটে তোমরা! কিন্তু আর ও বাড়িতে ফিরে যাওয়া চলবে না তোমাদের। হোটেলে থাকবে। বলা যায় না, দলবল নিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে রবিগুণ্ডা। ক্ষতি করবে তোমাদের।

তা পারবে না, কিশোর বলল। সাবধান থাকব। ওর মত গুণ্ডাকে কেয়ার করি না আমরা। এর চেয়ে অনেক বড় বড় চোর-ডাকাতের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। আমাদের। ও কিছু করতে পারবে না। হোটেলে থাকলে গুপ্তধনগুলো পাহারা দেবে কে?

পুলিশকে বলোনি ওগুলোর কথা? অবাক হলেন দাদা।

না। বলেছি, পিস্তল দেখিয়ে ঘরে ডাকাতি করতে এসেছিল রবিশুণ্ডা। কালুর সাহায্যে আটকে ফেলেছি।

ইস, অ্যাক্সিডেন্ট করার আর সময় পেলাম না। এখন বাড়ি থাকা উচিত ছিল আমাদের।

অ্যাক্সিডেন্টটা ইচ্ছে করে ঘটানো হয়েছে, আপনাকে সরিয়ে দেয়ার জন্যে। রবিগুণ্ডা একা নয়, আরও লোক আছে। আমার বিশ্বাস, দলের নেতা অন্য কেউ। আড়ালে থেকে যে কলকাঠি নাড়ছে। ওরা ভেবেছিল, আপনি হাসপাতালে গেলে দাদীও বাড়ি থাকবে না। তাহলে আমাদেরকেও অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। এই সুযোগে গুপ্তধনগুলো বের করে নিয়ে যেতে পারবে ওরা। আমরা যে থেকেই যাব, বাগড়া দেব, এটা ভাবেনি।

সেই জন্যেই তো ভয়। রাগ করে এখন তোমাদের ওপর শোধ তোলার চেষ্টা করবে। অ্যাক্সিডেন্টে আমি মরেও যেতে পারতাম। কেয়ার করেনি ওরা। তারমানে তোমাদের খুন করতেও হাত কাপবে না ওদের। তাই বলছি…

বলাবলির কিছু নেই, দৃঢ়কণ্ঠে বলল কিশোর, আমরা ও বাড়িতেই ফিরে যাব। দেখাই যাক না, ওদের কতখানি দৌড়। গিয়েই জিনিসগুলো নিরাপদ কোথাও সরিয়ে ফেলব। আগের জায়গায় রাখা ঠিক হবে না।

কোথায় সরাবে?

দেখি গিয়ে। জায়গা একটা পেয়েই যাব। এতবড় বাড়িতে লুকানোর জায়গার অভাব হবে না।

আক্কেল আলীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম আমরা। দেখি, গাছেই বাধা রয়েছে। কালু। আমরা বেরোনোর সময় ওকে ছেড়ে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমাদের দেখে কুঁই কুঁই শুরু করল।

রাগ করে মুসা বলল, ঠিক হয়েছে! তোর মত একটা অপদার্থ গর্দভের ওরকম শাস্তিই হওয়া উচিত। গলায় দড়ি বেঁধে থাকতে কেমন লাগল?

গুপ্তধনগুলো দেখার জন্যে ভেতরে ভেতরে তড়পাচ্ছে আক্কেল আলী। বাড়ি এসে আর থাকতে পারল না। বলল, চলুন না, জিনিসগুলো দেখি।

তাকে নিয়ে কয়লা রাখার ঘরে ঢুকলাম আমরা। ঢুকেই চক্ষু স্থির। আয়রন সেফের ঢাকনা হাঁ হয়ে খুলে আছে। ভেতরে নেই জিনিসগুলো।

তাড়াতাড়ি গিয়ে হুমড়ি খেয়ে বসে পরীক্ষা করতে লাগল কিশোর। মুখ না তুলেই বলল, কোন ধরনের এক্সপ্লোসিভ দিয়ে তালা ভেঙে খোলা হয়েছে!

তারমানে অহেতুকই এত কষ্ট করলাম আমরা! তিক্তকণ্ঠে বলল মুসা। গেল জিনিসগুলো! আর পাওয়া যাবে না!

বাতাসে বারুদের কড়া গন্ধ। নাক উঁচু করে শুঁকতে শুঁকতে কিশোর বলল, বেশিক্ষণ হয়নি গেছে।

তাতে কি? ধরা তো আর যাবে না।

তবু এখুনি গিয়ে পুলিশকে জানানো দরকার।

থানায় গিয়ে সেই সাব ইন্সপেক্টরকে পাওয়া গেল-ফারুক হোসেন, তাঁর ডিউটি শেষ হয়নি। এইবার সব কথা, অর্থাৎ গুপ্তধনের কথাটাও খুলে বলতে হলো। মৃদু অনুযোগ করলেন তিনি, তখন জিনিসগুলোর কথা তাকে না জানানোয়। তাহলে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারতেন। ভুল যে হয়ে গেছে, স্বীকার করতেই হলো আমাদের।

ওয়্যারলেসে আশপাশের সমস্ত ফাঁড়িতে খবরটা জানিয়ে দিলেন তিনি। রেলস্টেশন, বাস স্টেশন আর যেদিকে যে-কটা মহাসড়ক বেরিয়ে গেছে, সবগুলোতে কড়া পাহারার ব্যবস্থা হলো। রবিগুণ্ডার চেহারার বর্ণনা দিয়ে দেয়া হলো। ওরকম চেহারার লোকের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে পুলিশ।

দু-জন কনস্টেবলকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে সরেজমিনে তদন্ত করে দেখে গরমের ছুটি গেলেন সাব ইন্সপেক্টর। বললেন, চোরটার কোন খবর পেলে আমাদের জানামো হবে।

আক্কেল আলী হাসপাতালে গিয়ে দাদাকে খবরটা জানানোর কথা বলল। কিশোর রাজি হলো না। অসুস্থ অবস্থায় তাকে সুখবর দেয়া যায়, কিন্তু দুঃসংবাদ জানানোটা উচিত নয়।

.

১০.

 এরপর কয়েক দিন কেটে গেল। আর কোন ঘটনা ঘটল না। জমিদার বাড়িতে আছি আমরা। খাইদাই, ঘুরে বেড়াই আর গুপ্তধনগুলো পেয়েও হাতছাড়া হয়ে গেল বলে দুঃখ করি। ওগুলো উদ্ধারের আর কোন ব্যবস্থা করতে পারিনি।

দাদার অবস্থা ভাল হয়ে আসছে। পায়ের হাড় জোড়া লাগতে আরও দেরি হবে। তবে সে-জন্যে হাসপাতালে আর থাকার প্রয়োজন পড়বে না। শুনলাম, শথ্রি তাকে ছেড়ে দেয়া হবে।

রবিগুণ্ডা ধরা পড়েনি। তার কোন হদিসই করতে পারেনি পুলিশ। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেন সে।

আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে ওকে, একদিন বলল কিশোর।

কি করে? মুসার প্রশ্ন। কোন সূত্র নেই আমাদের হাতে। কোথায় খুঁজব? পুলিশই যেখানে বিফল হয়েছে, আমরা কি করতে পারি?

তা জানি না। তবে কিছু একটা করা দরকার।

কোন ব্যাপারেই সহজে নিরাশ হওয়া কিশোরের ধাতে নেই।

যাই হোক, সুত্রটা হঠাৎ করেই পেয়ে গেলাম। কিংবা বলা যায় সূত্রের মালিককেই পাওয়া হয়ে গেল। সেদিন হাটের দিন। দুপুরের পর আক্কেল আলী কল, হাটে যাবে। আমরাও রওনা হলাম তার সঙ্গে।

বিরাট হাট বসেছে ময়নামতি বাজারের আশপাশ জুড়ে। ঘুরে ঘুরে সওদা করতে শুরু করল আক্কেল আলী! সব পাওয়া যাচ্ছে এখানে–মাছ, তরিতরকারি, ডিম, নানা রকম ফল। খুবই ভাল লাগত আমাদের, কিন্তু মজা অনেকখানি নষ্ট করে দিল আমাদের প্রতি মানুষের অস্বাভাবিক কৌতূহল। বিদেশী দেখলেই বোধহয় এ রকম করে ওরা। দল বেঁধে শুধু যে ছোট ছেলেরা পেছনে লাগল, তা নয়, অনেক বড় মানুষও আমাদের পিছে পিছে ঘুরতে লাগল। কোথায় যাই, কি করি, দেখে। শেষে ধমক দিয়ে ওদের সরাতে হলো আক্কেল আলীকে। তা-ও কি আর পুরোপুরি সরে। কয়েকটা ছেলে লেগেই রইল, এমন ভাবভঙ্গি ওদের, আমরা যেন চিড়িয়াখানার জীব, কিংবা ভিনগ্রহ থেকে নেমেছি।

এক জায়গায় গরম গরম জিলিপি ভাজা হচ্ছে দেখে লোভ সামলাতে পারল না মুসা, খেতে বসে গেল। আমি আর কিশোরও বসলাম। লোকের কৌতূহলী নজর আমাদের দিকে মুহূর্তের জন্যেও যেন সরাতে ইচ্ছে করছে না ওদের। আড়ষ্ট বোধ করতেন রকম ফুল মানুষের অস্থাটি করতে লাগলাম আমি। তবে মুসা ওসব কেয়ার করল না। কুড়মুড় করে খেয়েই চলল। দেখতে দেখতে সাবাড় করে দিল কেজিখানেক।

হঠাৎ এক চানাচুরওয়ালার ওপর চোখ পড়ল আমাদের। রঙিন বিচিত্র পোশক পরনে, মাথায় লম্বা চোখা টুপি, মুখে চোঙ। সেটাতে ফুঁ দিয়ে বো বো আওয়াজ করছে, অদ্ভুত ভঙ্গিতে কথা বলছে। যেন সার্কাসের সঙ। তার চোখও আমাদের ওপর। আমরা তাকাতেই দ্বিধা করল, চোখ নামিয়ে নিল, তারপর সরে চলে গেল আরেক দিকে।

লোকটাকে চেনা চেনা লাগল না? লোকটার পেছনটা দেখা যাচ্ছে, সেদিকে তাকিয়ে আছে কিশোর।

কিসের চেনা, জিলিপির আমেজে রয়েছে এখনও মুসা। পাশের দোকানে কদমা বিক্রি হচ্ছে। কদমার স্তূপের দিকে খেয়াল এখন তার। এখানে ওরকম সাজ সেজেই চানাচুর বিক্রি করে তো, পোশাকের জন্যে সবাইকেই এক রকম দেখা যায়।

 আমি সেটা মানতে পারলাম না। লোকটাকে পরিচিত মনে হয়েছে আমারও। নিচু গলায় বললাম, রবিগুণ্ডা নয় তো? ছদ্মবেশে আছে?

উঠে দাঁড়াল কিশোর। এগিয়ে গেল লোকটার দিকে। আমিও এগোলাম তার সঙ্গে।

চানাচুর কেনার ছুতোয় লোকটাকে ভালমত দেখলাম আমরা। চুল কেটে, গোঁফ কামিয়ে, মুখে রঙ মেখে অনেক পরিবর্তন করে ফেলেছে চেহারার, কিন্তু কিশোরের তীক্ষ্ণ চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না।

সরে এসে ফিসফিস করে আমাকে বলল সে, রবিগুণ্ডাই, কোন সন্দেহ নেই।

কি করব? পুলিশকে খবর দেব?

না, চোখ রাখতে হবে। বাজারের পর সে কোথায় যায় দেখব।

আক্কেল আলীকে লাগিয়ে রাখলাম তার পেছনে। আমরা লাগলে সন্দেহ করবে। সে ছদ্মবেশে থাকা সত্ত্বেও আমরা যখন তাকে চিনেছি, আমাদেরকেও নি চিনে ফেলেছে।

সন্ধ্যা হয়ে এল। বড় বড় কুপি বাতি জ্বেলে নিতে লাগল দোকানিরা, বাইরে যারা বসেছে। তবে আর বেশিক্ষণ চলল না হাট। ভেঙে গেল দ্রুত। বাজার থেকে বেরিয়ে একটা পায়েচলা মেঠোপথ ধরে রওনা হলো চানাচুরওলা। পিছু নিল আক্কেল আলী। তার সঙ্গে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে অনুসরণ করলাম আমরা তিনজন।

শুরুতে পিছু নেয়াটা খুব একটা কঠিন হলো না, কারণ হাটফেরতা প্রচুর লোক চলেছে, তাদের সঙ্গে মিশে গেলাম আমরা। আকাশে চাঁদ আছে বটে, তবে চারু পাঁচদিনের। আলো যা আছে তাতে রাস্তা দেখা যায়, কিন্তু কয়েক গজ দূর থেকেও মানুষ চেনা যায় না। চানাচুরওলাকে চেনা যাচ্ছে তার বিচিত্র পোশাকের জন্যে, বিশেষ করে মাথার চূড়াওয়ালা টুপিটাই তার অস্তিত্ব ফাঁস করে দিচ্ছে।

এক জায়গায় এসে দু-ভাগ হয়ে গেছে রাস্তাটা। মূল পথটা চলে গেছে গায়ের দিকে, লোকজন সব সে-দিকে চলে গেল। রবি চলল অন্য পথটা ধরে নদীর দিকে। ভাগ্যিস এখানে চষা খেত আর নেই, ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে এগিয়েছে পথ, নইলে আমাদেরকে দেখে ফেলত সে। মাথা নুইয়ে ঝোঁপঝাড়ে গা ঢেকে নিঃশব্দে এগোলাম আমরা।

বেশ কাছে থেকেই তাকে অনুসরণ করে চলেছে আক্কেল আলী। কাজটায় ভয় যেমন লাগছে তার, মজাও পাচ্ছে। চমৎকার রোমাঞ্চ বোধ করেছে তার অনুভূতির কথা পরে সব বলেছে আমাদের।

হঠাৎ কি যেন ভেবে পেছন ফিরে তাকাল চোরটা। ঝট করে একটা ঝোঁপের পাশে বসে পড়ল আক্কেল আলী। তাকে আর দেখল না রবিগুণ্ডা।

এ কোথায় চলেছে সে?-অবাক হয়ে ভাবল আক্কেল আলী। ভাব দেখে তো মনে হচ্ছে নদীর পাড়ের শোনের দিকে চলেছে। সর্বনাশ! লোকটার কি ভয়ডর বলে কিছু নেই? ওখানেই তো আছে ভয়ঙ্কর এক কালী মন্দির, পারতপক্ষে ওদিকে ঘেষে না লোকে। এমনকি গরু চরাতেও যায় না রাখালরা। নেহায়েত বাধ্য হলে কোন কারণে দিনের বেলায়ও লোকে ওটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দোয়া-দরূদ পড়ে বুকে ফুঁ দিতে দিতে যায়।

বিশাল এক নারকেল-সুপারির বাগানে ঢুকে গেছে পথটা। বাগানটার দুই পাশে বিরাট জঙ্গল। আম-কাঁঠাল-জাম ছাড়াও আরও নানা রকম গাছ আছে, মাঝে মাঝে বাশঝাড়। ভয়ানক জায়গা।

আক্কেল আলীকে অবাক করে দিয়ে একেবারে ওই কালী মন্দিরের সামনেই গিয়ে দাঁড়াল রবিগুণ্ডা। আরেক বার পেছনে তাকিয়ে দেখে নিশ্চিত হয়ে নিল কেউ পিছু নিয়েছে কিনা। কাউকে না দেখে ভাবল, নেয়নি। সেজন্যেই চোঙাটা নামিয়ে রেখে পকেট থেকে মোম আর দেশলাই বের করে ধরাল। আলো হাতে ঢুকে পড়ল মন্দিরের ভেতর।

পিছিয়ে এল আক্কেল আলী। ভয় পেয়েছে সে। দুই হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে আরেকটু হলেই পড়েছিল আমাদের গায়ের ওপর।

কি হলো? জানতে চাইল কিশোর।

কা-কা-কালী মন্দিরে ঢুকল লোকটা!

 তাতে কি?

বুঝতে পারছেন না? কাছেই শ্মশান, মড়া পোড়ানো হয়। আর ওই মন্দিরে কালীদেবীর পূজা হয়। বছরে একবার। বাকি সময়টায় খালিই পড়ে থাকে। লোকে বলে, ওই শশ্মশানের যত ভূতের আড্ডা ওই মন্দিরে।

খাইছে! আক্কেল আলীর চেয়ে বেশি ভয় পেয়ে গেল মুসা। আমি যাই!

ঘুরতে গেল সে। খপ করে তার হাত চেপে ধরল কিশোর। দাঁড়াও! রবিগুণ্ডাকে যখন ভূতে কিছু করে না, আমাদেরও করবে না। চলো, দেখি।

আগে আগে চলল কিশোর। তার পেছনে আমি। আমাদের পেছনে ভয়ে ভয়ে আসতে লাগল মুসা আর আক্কেল আলী।

মন্দিরের ভাঙা দরজা দিয়ে ভেতরের মোমের আলো দেখতে পেলাম। গাছপালার আড়ালে লুকিয়ে রইলাম আমরা।

ফিসফিস করে কিশোর বলল, এখানেই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে গুপ্তধনগুলো। বেরও করতে পারছে না পুলিশের ভয়ে, নিয়ে পালাতেও পারছে না। নিতে পারলে এতদিনে পালিয়ে যেত। পুলিশকে ফাঁকি দেয়ার জন্যেই চানাচুরওয়ালার ছদ্মবেশে থাকতে হচ্ছে।

কিন্তু এই ব্যাটা এখানে থাকে কি করে! সাংঘাতিক অবাক লাগছে মুসার, এই ভূতের আড্ডায়!

তার মানেই তো বোঝা যাচ্ছে ভূতফুত কিছু নেই এখানে। কেউ আসেও না, নিরাপদ ভেবেছে জায়গাটা।

কি করব এখন আমরা? জিজ্ঞেস করলাম। লোকটাকে ধরার চেষ্টা করব?

না। ভয়ানক লোক সে। আরও পিস্তল থাকতে পারে তার কাছে। গুলি খেতে যাওয়ার মানে হয় না। তার চেয়ে এক কাজ করা যাক, তুমি আর আমি এখানে থাকি, মুসা আর আক্কেল আলী গিয়ে পুলিশকে খবর দিক। এখানে থেকে চোরটার ওপর নজর রাখব আমরা। আর তাকে পালাতে দেয়া যাবে না।

১১.

মুসা আর আক্কেল আলী চলে গেল।

চুপ করে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। একে তো জঙ্গল, তার ওপর শ্মশান, ভূতে বিশ্বাস না থাকলেও গা ছমছম করতে লাগল আমার। পরিবেশটা খারাপ। সেটাকে আরও ঘোরাল করে ভোলার জন্যেই যেন পেঁচা ডেকে উঠছে কর্কশ স্বরে, শোনা যাচ্ছে শেয়ালের হুক্কাহুয়া। কি করছে প্রাণীগুলো? নদীর ধারে কাঁকড়া খুঁজছে, না মড়ার তালাশে আছে?

কিশোর বলল, শ্মশান ছাড়া থাকে না। এমন করে পুরো শরীরটাকে পুড়িয়ে ফেলা হয়, ছাই ছাড়া আর কিছুই থাকে না। কাঁকড়া খুঁজতেই গেছে শেয়ালগুলো।

এ সব আলোচনাও এখন ভয় ধরাচ্ছে মনে। সারা আসে না কেন? মনে হতে লাগল, অনন্তকাল ধরে অনুপস্থিত ওরা।

অথচ বেশি সময় কিন্তু লাগল না ওদের। রবিগুণ্ডার ব্যাপারে সতর্ক হয়েই আছে পুলিশ। খবর শুনে একটা মুহূর্তও আর দেরি করলেন না সাব ইন্সপেক্টর ফারুক হোসেন। দলবল নিয়ে হাজির হয়ে গেলেন। গাড়ির শব্দ শুনলে সাবধান হয়ে গিয়ে পালানোর চেষ্টা করতে পারে চোরটা, সেজন্যে খেতের কিনারে গাড়ি রেখে এতদূর হেঁটে এসেছেন।

সামান্যতম বাধা দিতে পারল না রবিগুণ্ডা, কল্পনাই করেনি তার পিছু নিয়ে এখানে এসে হাজির হয়েছি আমরা। ও বোধহয় ভেবেছিল, আমরা তাকে চিনতে পারিনি।

তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় কিশোর অনুরোধ করল ফারুক সাহেবকে, স্যার, নিয়ে গিয়ে তো নিশ্চয় কথা আদায়ের চেষ্টা করবেন। কি বলল না বলল আমাদের জানাবেন?

নিশ্চয় জানাব। পুলিশকে অনেক সাহায্য করেছ তোমরা। ধন্যবাদ। এক কাজ কোরো, কাল সকালে চলে এসো। আমার ডিউটি থাকবে তখন।

সুতরাং পরদিন সকালে উঠেই থানায় গিয়ে হাজির হলাম আমরা।

আমাদের বসতে দিলেন ফারুক সাহেব। চা-বিস্কুট আনালেন। কোন খবর আছে কিনা জানতে চাইল কিশোর।

মাথা নাড়লেন তিনি। মহাপাজী। স্বীকার কি আর করে। অনেক চেষ্টা করেছি। একটা কথাই স্বীকার করেছে, পিস্তলটা তার, ওটা দেখিয়ে তোমাদের হুমকি দিয়েছে–না করে পারেনি, তার কারণ পিস্তলে তার আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। কিন্তু গুপ্তধনের কথা কিছুই বলেনি সে। সেফের তালা ভেঙে সে নাকি নেয়নি।

মন্দিরের ভেতরটা ভালমত খুঁজে দেখা দরকার ছিল, কিশোর বলল।

হাসলেন সাব ইন্সপেক্টর। দেখিনি মনে করেছ? আজ ভোরে উঠেই দু-জন লোক পাঠিয়েছি। তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে সব। কিচ্ছু পায়নি।

হতাশ হলাম।

আমাদের মুখ দেখে সান্তনা দেয়ার জন্যে বললেন তিনি, ধরা যখন পড়েছে, স্বীকার ওকে করতেই হবে। সরকার সাহেবকে বোলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওগুলো বের করে তাকে ফেরত দেয়ার চেষ্টা করব।

হাসপাতালে দাদার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম আমরা। সব জানালাম তাকে, আর কিছু গোপন করলাম না। দাদা-দাদী দু-জনেই খুব বকলেন আমাদের, ওসব ভয়ঙ্কর চোর-ডাকাতের সঙ্গে লাগতে গিয়েছি বলে। শেষে দাদা বললেন, খবরদার, ওসবের মধ্যে আর যাবিনে। পুলিশ কিছু করতে পারে ভাল, না পারে নেই, টাকা লাগবে না আমার। তোদের যে কোন ক্ষতি হয়নি এতেই আমি খুশি।

কিন্তু আমরা খুশি হতে পারলাম না। এত কষ্ট করে জিনিসগুলো উদ্ধার করলাম আমরা, আর সেটা কেড়ে নিয়ে যাবে একটা চিকে চোর, কিছুতেই মেনে নিতে পারলাম না।

কিশোর তো আরও পারল না। বাড়ি ফিরেই তার প্রথম কথা হলো, দাদুরা আসবেন পরশুদিন। তার আগেই বের করতে হবে গুপ্তধনগুলো।

কি করে? জানতে চাইল মুসা।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওই কালী মন্দিরের কাছেই কোথাও আছে ওগুলো। ওখানে থেকেছে রবিগুণ্ডা, জিনিসগুলো দূরে কোথাও রাখবে না। চোখে চোখে রাখতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক।

সুতরাং সেদিন দুপুরের খাওয়ার পর আবার গেলাম আমরা শ্মশানে। দিনের বেলা অতটা ভয় লাগে না জায়গাটাকে। তবে মানুষজনের আনাগোনা মোটেও নেই। পাখির ছড়াছড়ি। এত ঘুঘু দেখা গেল, এয়ারগানটা কেন নিয়ে এল না, সে জন্যে আফসোসের সীমা রইল না মুসার।

মন্দিরের কাছে এসে আশপাশের বনের ওপর চোখ বোলাল মুসা। কোথায় থাকতে পারে, বলো তো?

আছে এখানেই কোথাও, জবাব দিল কিশোর। মন্দিরের ভেতরে নেই, তাহলে পেয়ে যেত পুলিশ। তারমানে বাইরে রেখেছে। মাটিতে পুঁতেও রাখতে পারে।

তাহলে বের করতে বুলডোজার লাগবে… আচমকা থেমে গেল মুসা। কান পাতল। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল, এই, মন্দিরের ভেতর লোক আছে! কথা শুনলাম!

মুসার কানের ওপর ভরসা আছে আমাদের। তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়লাম ঝোঁপের ভেতর।

চুপ করে বসে রইলাম পুরো একটা মিনিট। তারপর উঠে দাঁড়াল মুসা, তোমরা থাকো এখানে। আমি দেখে আসি।

পা টিপে টিপে মন্দিরের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। কান পেতে শুনল কয়েক মিনিট। ফিরে এসে বলল, দু-জন লোক। গুপ্তধন খুঁজতে এসেছে। রবিগুণ্ডার দলের। সে নাকি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ওদের সঙ্গে। শফিক সাহেব বলে একজন লোকের কথা বলছে, ওই লোক ওদের বস্। ভয়ানক খেপে গেছে নাকি সে। রবিউলকে ধরতে পারলে চামড়া ছাড়াত, পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে বলে রক্ষা।

আরও কয়েক মিনিট পর খালিহাতে বেরিয়ে এল লোকগুলো। খুব রেগেছে, চেহারা দেখেই আন্দাজ করা যায়। একজনের রোমশ শরীর, মুখটা শিম্পাঞ্জীর মত। আরেকজন রোগা-পটকা, খাটো। মুখে বসন্তের দাগ। পান-ধাওয়া কালো দাঁত। মুখটা ছুঁচোর মত।

অহেতুক এখানে সময় নষ্ট করছি, মাইনকা, গরিলা বলল। রইব্বা হারামজাদাটা যে এত্তবড় শয়তান জানতাম না!

জানাজানি রাদ দিয়ে আরও ঘেঁজ, ছুঁচো, অর্থাৎ মানিক বলল। খালিহাতে গেলে যত ঝাল আমাদের ওপর ঝাড়বে শফিক সাহেব।

আমরা কি করব, না পেলে?

রইব্বাটা আমাদেরও ফাঁসিয়ে দিয়ে গেল। খালিহাতে গেলে শফিক সাহেব ভাববে, আমরাও মিছে কথা বলছি। বেঈমানী করছি, ক্ষোভের সঙ্গে বলল মানিক।

মন্দিরের বাইরেও খুঁজতে শুরু করল ওরা। দেখছে, কোনখানে মাটি খোঁড়া হয়েছে কিনা। মন্দিরের দেয়ালের ফাঁকফোকরও বাদ দিল না। যেখানেই কোন জিনিস লুকানোর মত জায়গা দেখছে, তার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কিংবা উঁকি দিয়ে দেখছে। কথা বলছে। বেশির ভাগই রবিগুণ্ডাকে গালাগাল, আর নিজেদের ভাগ্যকে দোষারোপ। শিম্পাঞ্জীর মত লোকটার নামও জানতে পারলাম, বদু।

খুঁজতে খুঁজতে আমাদের কাছাকাছি চলে এল দু-জনে। ঠিক এই সময় মুসার পেল হাঁচি। কিছুতেই চেপে রাখতে পারল না, হ্যাঁচচো করে উঠল প্রচণ্ড জোরে।

.

১২.

 দৌড়ে এল দুই চোর।

ঝোঁপ থেকে প্রায় টেনে-হিঁচড়ে বের করল আমাদের। চিনে ফেলল। নিশ্চয় রবিগুণ্ডার কাছে আমাদের কথা শুনেছে। বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগল, কেন এখানে এসেছি।

রোমাঞ্চকর এক গল্প ফেঁদে বসল কিশোর, বদুটাকে প্রায় বিশ্বাসও করিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু মানিককে ফাঁকি দেয়া গেল না। সে বলল, ওসব ধানাই-পানাই করে লাভ নেই। তোমরাই গুপ্তধনগুলো খুঁজে বের করেছ, শুনেছি। একবার যখন পেরেছ, আবারও পারবে। আর সেগুলো খুঁজতেই এসেছ তোমরা। ভালই হলো। খোজো, বের করে দাও। ছেড়ে দেব।

কি আর করা? কিশোর বলল, মন্দিরের ভেতর থেকে শুরু করব।

ওখানে কি দেখবে? বদু বলল। পুলিশ দেখেছে। আমরাও দেখেছি। কিছুই নেই।

তবু দেখব। বলা যায় না, আপনাদের চোখ এড়িয়েও গিয়ে থাকতে পারে।

আমার মনে হলো, ফাঁকি দিতে চাইছে কিশোর। খামোকাই এখানে ওখানে খুঁজবে, কিছু না পেলে শেষে বিরক্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে লোকগুলো; তারপর গিয়ে আসল জায়গায় খুঁজব আমরা-এমন কিছু হয়তো ভাবছে সে।

কি যেন ভাবল মানিক। দ্বিধা করল একবার। তারপর বলল, বেশ, খোঁজা। এসো।

আমাদের সঙ্গে আবার মন্দিরে ঢুকল ওরাও।

ভেতরটা আবছা অন্ধকার। কেমন একটা ধোয়াটে গন্ধ। মাকড়সার জাল ঝুলছে যেখানে সেখানে। একধারে বেদীতে কালীমূর্তি। লাল জিভ বের করা, গলায় মাটির তৈরি নরমুণ্ডের মালা। একহাতে খাড়া। ভয়ানক চেহারা।

মুসা তো দেখে আঁতকেই উঠল।

গুপ্তধন লুকানোর মত জায়গা তেমন নেই। এককোণে পড়ে আছে চানাচুরওয়ালার পুরানো টিনের বাক্স আর চোঙটা। বাক্সটায় তেল চিটচিটে ময়লা একটা কাপড় বাধা, গলায় ঝোলানোর জন্যে। বাক্সের ওপরে ছড়ানো গোল বারান্দামত জায়গাটায় অনেকগুলো খুপরি, তাতে তেল-মশলার শিশি। খোপে খোপে ডাল ভাজা, বাদাম ভাজা, পেঁয়াজ-মরিচ, আর চানাচুর বানানোর অন্যান্য উপকরণ সাজিয়ে রাখা।

অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম আমরা সবাই মিলে। মূর্তির পেছন দিকটা ভাঙা, ভেতরের খড়গুলো টেনে টেনে বের করা হয়েছে।

কিশোর জানতে চাইল, কে বের করেছে এগুলো? আপনারা?

না, মাথা নাড়ল মানিক। আমার মনে হয়, প্রথমে এর মধ্যেই জিনিসগুলো লুকিয়েছিল রইব্বা, তারপর বের করে আবার অন্য কোথাও রেখেছে।

ভাঙা ফোকরটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। চিন্তিত মনে হলো তাকে। কোমরে ঝোলানো টর্চ খুলে নিয়ে মূর্তির ভেতরে আলো ফেলে ফাপা জায়গাটা দেখল। আরও কিছু খড় বাদে আর কিছুই নেই ভেতরে।

মন্দিরের ভেতরে পাওয়া গেল না জিনিসগুলো।

গজগজ করতে লাগল বদু বলেছি না নেই, শুধু শুধু সময় নষ্ট!

বিরক্ত হয়ে ধমক দিল মানিক, আহ, থাম তো তুই! ওদের কাজ ওদেরকে করতে দে!

বাইরে এসে আবার খোঁজা হলো। মন্দিরের চারপাশে বেশ অনেকখানি জায়গার মাটি পরীক্ষা করা হলো। কোথাও নতুন খোঁড়া কোন গর্ত পাওয়া গেল না। গাছের কোটরও বাদ দেয়া হলো না। কিন্তু কোথায় যে গুপ্তধনগুলো লুকিয়েছে রবিগুণ্ডা, তার কোন হসিদই পাওয়া গেল না।

নিতান্ত নিরাশ হয়েই আমাদের ছেড়ে দিল দুই চোর। শাসিয়ে দিল, ওদের পিছু নেয়ার চেষ্টা করলে ভাল হবে না।

হাঁটতে লাগল ওরা। একটাই রাস্তা। সুতরাং ওদের পিছু নেয়া ছাড়া উপায় থাকল না আমাদের। ওরাও জানে, কিছুদূর এগিয়ে দুটো রাস্তা দুদিকে চলে গেছে। তাই আমরা পিছে পিছে হাঁটায় কিছু বলল না।

কথা বলতে বলতে চলেছে বদ আর মানিক, আমাদের আগে আগে। দ্রুত হাঁটছে ওরা। ফিরেও তাকাল না আমাদের দিকে। নারকেল বাগানের বাইরে বেরিয়ে ওরা চলে গেল একপথে, আমরা আরেক পথে।

খেত পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠতে উঠতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। গাঁয়ের মসজিদ থেকে আজান শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ আমার হাত চেপে ধরল কিশোর। দাঁড়াও। বাড়ি যাব না আমরা!

তাহলে কোথায় যাবে? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

গুপ্তধনগুলো আনতে।

খাইছে! বলো কি? মুসাও আমার মতই অবাক হয়েছে। জানো নাকি কোথায় আছে ওগুলো? তাহলে বের করলে না যে?

বের করলেই তো নিয়ে যেত ওই দুই চোর।

কোথায় আছে? জানতে চাইলাম আমি।

 চলো, গেলেই দেখবে।

আকাশে চাঁদ আছে। পথ দেখে চলতে অসুবিধে হলো না। আবার এসে ঢুকলাম নারকেল বাগানে। সোজা মন্দিরের দিকে এগোল কিশোর। টর্চ আছে তার কাছে। কোমর থেকে খুলে নিয়ে জালল।

আমাদের নিয়ে আবার মন্দিরে ঢুকল সে। হেসে জিজ্ঞেস করল, বলো তো, কোথায় থাকতে পারে?

সাফ মানা করে দিল মুসা, জানি না। হাজার বছর একনাগাড়ে ভাবলেও আন্দাজ করতে পারব না!

বেশ, সূত্র দিচ্ছি, দেখো বুঝতে পারো কিনা। ধরো, অনেক দামী কিছু জিনিস আছে তোমার কাছে। ওগুলো সবচেয়ে বেশি নিরাপদ কোন জায়গায় থাকলে? এমন কোথাও, যেখানে রাখলে তোমার অজান্তে কেউ খুঁজে পাবে না, তোমাকে না জানিয়ে নিতে পারবে না কিছুতেই…

সঙ্গে সঙ্গে রাখলে, বললাম।

 ঠিক। তুড়ি বাজাল কিশোর। রবিগুণ্ডার পকেটে ছিল না জিনিসগুলো। তাহলে কোথায়…

প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, চানাচুরের বাক্স!

হেসে মাথা ঝাঁকাল কিশোর, হ্যাঁ। চলো, বের করে নিই।

বাক্সের ওপরের ডালাটা আলগা। সেটা সরাতেই দেখা গেল বাটা কানায়। কানায় ভরা ডালভাজা আর বাদামভাজায়। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিল কিশোর। বের। করে আনল পানপাত্রটা। বলল, আর দেখার দরকার আছে? সব আছে এর মধ্যে।

কিশোর, তুমি একটা জিনিয়াস! না বলে পারল না মুসা।

নাও, চানাচুরওয়ালা সাজো এখন, হেসে মুসাকে বলল কিশোর। বাক্সটা গলায় ঝোলাও। রাত হয়েছে অনেক, বাড়ি যেতে হবে।

কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য তখনও কাটেনি। মন্দিরের দরজায় বেরোতেই দেখলাম দুই পাশে দুই প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে দুই চোর।

আমাদের দেখেই খিকখিক করে হেসে বলে উঠল মানিক, কি বদু বলেছিলাম না, ছেলেগুলো বোকা নয়। ওরা ঠিক বুঝেছে কোথায় আছে মাল। আমাদের চেয়ে অনেক চালাক। তুই তো বিশ্বাসই করতে চাস না। ফিরে না এলে কি হত, ভাব।

রইব্বাটাও কম চালাক না, ঘোঁৎ-ঘোৎ করে বলল বদু। অমন একটা চানাচুরের বাক্সের মধ্যে রেখে দেবে, কে ভাবতে পেরেছিল! আমরা তো আমরা, পুলিশই ধোকা খেয়েছে…কিন্তু এ তিনটেকে এখন কি করি?

কি আর করব। আটকে রেখে যাব মন্দিরের মধ্যে। মালগুলো দরকার ছিল আমাদের, পেয়েছি, ব্যস। যাওয়ার আগে একটা ধন্যবাদও দিয়ে যাব ওদের। আমাদের অনেক ঝামেলা বাঁচিয়ে দিল বলে। আবার খিকখিক করে হাসল মানিক। পকেট থেকে বের করল বড় একটা ছুরি। ফলা ধরে টানতেই কিটকিট শব্দ করে খুলে গেল ওটা। ঝিক করে উঠল চাঁদের আলোয়।

হাত বাড়াল সে, দাও, এবার বাক্সটা দিয়ে দাও দেখি। গোলমাল করলে ভূড়ি ফাঁসিয়ে দেব।

এই গুপ্তধন নিয়ে অনেক ঝামেলা সহ্য করেছি আমরা। বার বার উদ্ধার করছি, শেষ মুহূর্তে কেউ না কেউ এসে ছিনিয়ে নিচ্ছে। আর হাতছাড়া করতে রাজি নই আমরা কেউই।

কিশোর চুপ।

মুসাও চুপ। বারটা দেয়ার কোন লক্ষণ দেখাল না।

দাও বলছি! ধমক দিয়ে বলল মানিক।

চুপ করে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বহু। আমরা কেউ গোলমাল করলেই হাত তুলবে, ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে।

কিশোরের দিকে একবার তাকিয়ে আস্তে করে গলা থেকে বাক্স ঝোলানোর কাপড়টা খুলে নিল মুসা। এক পা বাড়াল মানিকের দিকে, ওটা দেয়ার ভঙ্গিতে।

ছুরিটা বাঁ হাতে নিয়ে মানিকও হাত বাড়াল।

কাপড়টা দুই হাতে চেপে ধরে মানিকের মাথা সই করে আচমকা ঘুরিয়ে বাড়ি মারল মুসা। প্রচুর জিনিসপত্র বোঝাই থাকায় ভারি হয়ে আছে বাক্স। ডাল, বাদাম, তেল-মরিচ-পেঁয়াজ সব ঝরে পড়ল বৃষ্টির মত। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে ডালাটা খুলে উড়ে গিয়ে পড়ল কয়েক হাত দূরে।

মাথার একপাশে বাড়ি লেগেছে মানিকের। উহ করে মাথা চেপে ধরে বসে পড়ল সে। ছুরিটা ছেড়ে দিয়েছে হাত থেকে। কিশোরের টর্চের আলোয় পলকের জন্যে দেখলাম, মানিকের আঙুলের ফাঁকে রক্ত।

বাক্সের কাপড়টা হাত থেকে ছেড়ে দিল মুসা। মাটিতে পড়ে ঝনঝন করে উঠল বাক্স। তাকানও না সে। প্রায় ডাইভ দিয়ে পড়ে মাটি থেকে তুলে নিল মানিকের ছুরিটা।

নড়ে উঠল বদু। ঠেকানোর জন্যে এগিয়ে এল। ধরতে চাইল মুসাকে।

কিন্তু ততক্ষণে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে সে। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ছুরি চালাল বদুর হাত সই করে। এফেঁড় ওফোড় করে দিল তালু।

মাগোহ! বলে চিৎকার করে উঠল বদু।

বিমূঢ় হয়ে গেছে দু-জনেই। মুসা যে এই কাণ্ড করে বসবে কল্পনাই করতে পারেনি। ওরা ভেবেছিল, তিনজনেই আমরা ছেলেমানুষ, ছুরি দেখিয়ে ধমক দিলেই পেসাব করে দেব।

এত দ্রুত ঘটে গেল ঘটনাটা, আমি বা কিশোরও স্তব্ধ হয়ে রইলাম একটা মুহূর্ত।

হাত বাড়াচ্ছে মানিক, মুসাকে ধরার জন্যে নয়, বাক্সটার দিকে।

আর একটা সেকেন্ডও দেরি করলাম না আমি। নিচু হয়ে এক থাবায় কাপড়টা ধরে হ্যাঁচকা টানে বাক্সটা তুলে নিয়েই দৌড় দিলাম বনের দিকে।

ধরো! ধরো! বলে চিৎকার করে উঠল মানিক।

পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম আলো নিভিয়ে দিয়েছে কিশোর। মুসাকে সাহায্য করতে হাত লাগিয়েছে।

কোন দিকে তাকালাম না। সোজা দৌড় দিলাম অন্ধকার বনের মধ্যে দিয়ে। আশা করলাম, পেছনে পায়ের শব্দ শুনতে পাব–বদু কিংবা মানিক, কোন একজন আমাকে তাড়া করে আসবেই।

কিন্তু এল না ওরা। মুসা আর কিশোর আটকে রেখেছে নিশ্চয় ওদের।

একটা ঘন ঝোঁপের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। বাক্সটা দু-হাতে ধরে বসে বসে হাঁপাতে লাগলাম। কান খাড়া রেখেছি কেউ আসে কিনা শোনার জন্যে। প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছি, যা হয় হবে, গুপ্তধনগুলো আর চোরের হাতে পড়তে দেব না।

লড়াইয়ের শব্দ কানে আসছে। এখনও মুসা আর কিশোরকে পরাজিত করতে পারেনি দুই চোর। সহজে পারবে বলেও মনে হয় না।

আমি ঠিক করলাম, পারুক আর না পারুক, আমি এই ঝোঁপ থেকে বেরোচ্ছি না।

এই সময় হঠাৎ করেই কানে এল কুকুরের ডাক। এগিয়ে আসছে।

রাতের বেলা এই জঙ্গলের মধ্যে গায়ের নেড়িকুত্তাগুলোরও একলা আসার কথা নয়। তারমানে সঙ্গে লোক আছে। কে?

ধক করে উঠল বুক! আক্কেল আলী না তো! আসার সময় তাকে বলে এসেছিলাম, মন্দিরে যাচ্ছি আমরা। আমাদের দেরি দেখে হয়তো কালুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।

আমার অনুমান যে ঠিক, খানিক পরেই বুঝতে পারলাম।

বাবাগো, খেয়ে ফেলল গো! বলে চিৎকার করতে করতে ঝোঁপঝাড় ভেঙে ছুটে এল একজন লোক। পেছনে ঘেউ ঘেউ করে তাড়া করেছে একটা কুকুর।

আমার ঝোঁপের সামনে দিয়েই ছুটে গেল লোকটা। পায়ের কাছে লেগে রয়েছে কুকুরটা। দু-জনকেই চিনতে পারলাম–বদু আর কালু। অতবড় লোকটা যে কুকুরকে এ রকম ভয় পায়, না দেখলে বিশ্বাস হবে না। পড়িমরি করে নদীর দিকে চলে গেল সে। পেছনে কালু। হঠাৎ করেই যেন দুঃসাহসী হয়ে পড়েছে কাপুরুষ কুকুরটা।

হাসি পেল আমার। কিন্তু শব্দ শুনে ফেলার ভয়ে চেপে গেলাম।

আরেকটু পর আমার আর কালুর নাম ধরে ডাক শোনা গেল। মুসা ডাকছে আমাকে, আর আক্কেল আলী কালুকে।

ফিরে এল কুকুরটা। আমার ঝোঁপের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। নাক উঁচু করে কুঁই কুঁই করতে লাগল। তারপর ছোট্ট একটা হাঁক ছাড়ল, খেক!

বুঝলাম আমার অস্তিত্ব ফাঁস হয়ে গেছে। হেসে বললাম, দাঁড়া, বেরোচ্ছি।

কালুর পেছন পেছন চললাম। অন্ধকারে বনের মধ্যে পথ হারিয়েছি, বুঝতে পারলাম। কুকুরটার সাহায্য না পেলে এখন পথ চিনে মন্দিরের কাছে যাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়ত।

গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে টর্চের আলো দেখা গেল। আমাকেই খুঁজতে আসছে কিশোররা।

আমাকে দেখেই বলে উঠল কিশোর, এই যে, আছ ঠিকঠাক? জিনিসগুলো আছে?

আছে, জবাব দিলাম।

শুনলাম, আমি দৌড় দেয়ার পর মানিক আমার পিছু নিতে যাচ্ছিল, টর্চ দিয়ে তার মাথায় বাড়ি মারে কিশোর। দুই দুইবার বাড়ি খেয়ে কাহিল হয়ে পড়ে মানিক। বদুর সঙ্গে লড়তে থাকে মুসা। এই সময় আমাদের খুঁজতে খুঁজতে এসে হাজির হয় আক্কেল আলী। কুকুরকে সাংঘাতিক ভয় পায় বদু দেখেই মারে দৌড়। তাকে তাড়া করে কালু। তিনজনের সঙ্গে পারবে না বুঝে মানিকও আর দাঁড়ায়নি, পিঠটান দিয়েছে।

বাড়ি রওনা হলাম আমরা। সাবধান থাকলাম, যাতে রাস্তায় আর কোন আচমকা আক্রমণের শিকার না হতে হয়।

বড় রাস্তায় উঠে কিশোর বলল, জিনিসগুলো বাড়ি নিয়ে যাওয়া নিরাপদ নয়।

 জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় রাখবে?

থানায় চলো।

ওই অবস্থায় আমাদের দেখে অবাক হয়ে গেলেন ফাড়ির ডিউটি অফিসার। আমাদের পরিচয় দিয়ে সব কথা তাকে বললাম। জিজ্ঞেস করলাম, ফারুক সাহেব কোথায়। তিনি জানালেন, বাইরে একটা জরুরী তদন্তের কাজে গেছেন, চলে আসবেন শীঘ্রি।

আমরা বসলাম।

আধঘণ্টা পরেই চলে এলেন ফারুক হোসেন। আমাদের অত রাতে ওই অবস্থায় দেখে তিনিও অবাক। জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার?

সব শুনে তিনি বললেন, সাংঘাতিক কাণ্ড করে এসেছ। পুলিশ যা পারেনি সেটাই করে বসে আছ! তোমরা যে এতবড় গোয়েন্দা, কল্পনাই করতে পারিনি!

ডিউটি অফিসারও আমাদের অনেক প্রশংসা করলেন। দু-জন পুলিশ অফিসারের এই উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় লজ্জাই লাগতে লাগল আমার।

কিশোর বলল ফারুক সাহেবকে, স্যার, জিনিসগুলো বাড়ি নিয়ে যেতে ভরসা পাচ্ছি না। এত রাতে তো ব্যাংক খোলা পাব না, নিরাপদ আর কোন জায়গার কথাও জানা নেই। থানায় রেখে যেতে চাই।

একমুহূর্ত চিন্তা করে নিলেন সাব ইন্সপেক্টর। তারপর মাথা ঝাঁকালেন, বেশ, রেখে যাও। রিসিট দিয়ে দিচ্ছি। যখন ইচ্ছে নিয়ে যেয়ো।

.

১৩.

 রাতটা নিরাপদে কাটল। পরদিন সকালে আক্কেল আলীর সঙ্গে হাসপাতালে রওনা হলাম।

গিয়েই শুনলাম, দাদাকে রিলিজ করে দেয়া হবে সেদিনই।

আমাদের অ্যাডভেঞ্চারের কথা জানালাম দাদা-দাদীকে। আমরা ছুরি মারামারি করেছি, এ কথা শুনে দাদী তো বাকহারাই হয়ে গেলেন। দাদা দিলেন বকা। আমাদের ওভাবে মন্দিরে যেতে দিয়েছে বলে আক্কেল আলীকেও বকতে লাগলেন।

চুপ করে রইলাম। বকে বকুক, আমাদের কাজ তো সারা।

 দাদা-দাদীকে হাসপাতাল থেকে নিয়েই সেদিন বাড়ি ফিরলাম আমরা।

গুপ্তধনগুলো ফাঁড়িতেই রইল। কিশোরের ধারণা, এখনও বাড়িতে আনা নিরাপদ নয়। তবে চানাচুরের বাক্সটা নিয়ে এসেছে। অকারণে কিছু করে না সে। জিজ্ঞেস করলাম কেন এনেছে।

সে বলল, এটা এমন জায়গায় রেখে দেব যাতে বাড়িতে ঢুকলে সহজেই চোখে পড়ে। কেউ খুঁজতে এলে দেখে ফেলে। আমার বিশ্বাস, ওই দুই চোর আবার আসবে জিনিসগুলোর খোঁজে। ওদের বস্ ওদেরকে ছাড়বে না, পাঠাবেই।

মুসা জানতে চাইল, তাহলে এরপর আমাদের কাজ কি?

বাক্সের টোপটা রেখে দিলাম, কিশোর বলল, দেখা যাক ফাঁদে ধরা দেয় কিনা। দিলে বদু আর মানিককেও পাকড়াও করব। তারপর পুলিশে ধরে ভালমত ধোলাই দিলেই সুড়সুড় করে বলে দেবে বসের নাম। পালের গোদাটাকেও ধরতে পারবে তখন পুলিশ। এখন থেকে আমাদের কাজ হবে, নজর রাখা। বাড়ির কাছাকাছি অচেনা কাউকে দেখলেই চোখ রাখব।

একটা কথা কয়েক দিন ধরেই মনে হচ্ছে আমার, জিজ্ঞেস করার কথা ভুলে যাই, এখন করলাম, কিশোর, দাদার অ্যাক্সিডেন্টের পর ওই ভদ্রলোককে কিন্তু আর একবারও দেখিনি।

আমিও ভেবেছি কথাটা। চলো দাদাকে জিজ্ঞেস করে দেখি, হাসপাতালে দেখা করেছে কিনা।

দাদা জানালেন, একদিন দেখা করতে গেছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। বাড়ি কেনার ব্যাপারে আর তেমন আগ্রহ দেখায়নি। বরং বার বার গুপ্তধনের কথা জানতে চেয়েছে।

তার নাম কি জানতে চাইল কিশোর।

দাদা জানালেন, শফিকুর রহমান।

সন্দেহটা পাকাপোক্ত হলো আমাদের, ওই লোকই চোরেদের বস। কারণ, সেদিন মানিক আর বদু আলোচনা করার সময়ও শফিক সাহেব নামটা বলেছিল।

আম-জাম-লিচু-কাঁঠাল খাই আমরা, রাতে আর দুপুরে খাই দাদীর চমৎকার রান্না, সকালে নানা রকম পিঠা। বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াই, রাতে কখনও বসি দীঘির ঘাটে, অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করি, কখনও গিয়ে বসি মজা পুকুরের পাড়ের সেই ঘরটার বারান্দায়।

উড়ে যাচ্ছে যেন আমাদের দিনগুলো। কিন্তু যাদের জন্যে উৎসুক হয়ে থাকি রোজই বিকেলের পর থেকে, তাদের আর সাড়াশব্দ নেই। তিন দিন গিয়ে যখন চারদিন পড়ল, সন্দেহ হতে লাগল আমার, আর আসবে না।

তবে সেদিনই এল ওরা। কিংবা বলা যায় সেই রাতে। জানানটা দিল কাল। দীঘির ঘাটলায় বসে আছি আমরা তিনজন। দাদা-দাদী বেডরুমে চলে গেছেন। আক্কেল আলী গেছে তার ঘরে। গল্প করছি, এই সময় একটা আমগাছের নিচ থেকে চাপা গরগর করে উঠল কুকুরটা।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিলোর। চাপা কণ্ঠে বলল, এসে গেছে।

আগেই প্ল্যান করে রেখেছি আমরা, ওরা এলে কি করব। গাছপালার আড়ালে গা ঢেকে মুসা আর কিশোর এগিয়ে গেল কালুর দিকে। আমি গেলাম মালীর ঘরের দিকে, আক্কেল আলীকে ডাকতে।

ঘুমায়নি সে। আগে থেকেই জানা ছিল তারও, এ রকম জরুরী অবস্থা হতে পারে। একবার ডাকতেই দরজা খুলে উঁকি দিল, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, কি?

মনে হয় এসে গেছে। বেরোও।

নিঃশব্দে বেরিয়ে এল সে। পা টিপে টিপে আমরাও এগোলাম কিশোররা যেদিকে গেছে সেদিকে।

একটা আম গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে কিশোর আর মুসা। কালুর গলার কেন্ট ধরে রেখেছে মুসা, শান্ত থাকতে বলছে কুকুরটাকে। ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেছে কালু, চুপ করেই আছে। গাছের গায়ে গা মিশিয়ে দাঁড়ালাম আমরা।

চাঁদের আলোয় দুটো ছায়ামূর্তিকে বেরোতে দেখলাম গাছের ছায়া থেকে। চেহারা বোঝা না গেলেও আকৃতিতেই চিনলাম বদু আর মানিককে।

বাড়ির সদর দরজার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ প্রায় দশ মিনিট দাঁড়িয়ে রইল ওরা।

আমরাও চুপ। কালুকে নিয়েই ভয়, কখন চিৎকার করে ওঠে।

কেউ জেগে নেই বাড়ির ভেতর, বোধহয় এ-ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই অবশেষে বদুকে রেখে পা বাড়াল মানিক। সদর দরজার দিকে এগোল।

নড়ে উঠল মুসাও। আগেই আন্দাজ করে রেখেছে কিশোর, ওরা এলে কোনপথে কোথায় ঢুকবে। চানাচুরের বাক্সটা কয়লার ঘরে রেখে দিয়েছে সে। তার ধারণা, চোরগুলো ওই জায়গাটাতেই খুঁজবে আগে।

কালুর বেল্টটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গাছের আড়ালে আড়ালে দ্রুত এগোল মুসা, অদৃশ্য হয়ে গেল। বাড়ির পেছন দিকের একটা জানালা খোলা রেখে দিয়েছি আমরা এ রকম জরুরী মুহূর্তের কথা ভেবেই। সেদিক দিয়ে ঘরে ঢুকে যাবে সে।

সদর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল মানিক। পাকা চোর সে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভেতর থেকে বন্ধ করে রাখা দরজাটা খুলে ফেলল। ফিরে তাকাল একবার। লুকিয়ে থাকা বদর উদ্দেশে হাত নাড়ল, তারপর ঢুকে গেল ঘরের মধ্যে।

অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। মুসার কাজটা সহজ। জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকবে, রান্নাঘরে লুকিয়ে থাকবে মানিকের অপেক্ষায়। সে কয়লার ঘরে নেমে গেলেই ওপরের ঢাকনাটা নামিয়ে তালা লাগিয়ে দেবে।

অস্থির হয়ে উঠেছে কাল। আর চুপ থাকতে চাইছে না। রাফি কিংবা চিতার মত ট্রেনিং পাওয়া শিক্ষিত কুকুর নয় সে, অতি সাধারণ নেড়ি কুত্তা। এতক্ষণ যে কথা। শুনেছে এইই বেশি। হয়তো আরও শুনত, কিন্তু ভজকট করে দিল একটা শেয়াল। ঝোঁপের ভেতর থেকে মাথা বের করল হঠাৎ। আমরা না দেখলেও কালু দেখে ফেলল। আর যায় কোথায়। চুপ থাকার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে গলা ফাটিয়ে ঘেউ ঘেউ করে উঠল।

মশায় কামড়াচ্ছে। চুলকাতে গিয়ে সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম, ঢিল পড়ল কুকুরটার গলার কলারে, এক ঝটকায় আমার হাত থেকে সেটা ছাড়িয়ে নিয়ে শেয়ালকে তাড়া করার জন্যে লাফ মারল সে।

কিন্তু শেয়াল কি আর দাঁড়ায়। কুকুরের ডাক শুনেই পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল আবার ঝোঁপের মধ্যে।

বদু ভাবল, তাকে দেখেই খেপে গেছে কুকুরটা। বাবাগো, খেয়ে ফেলল গো! বলেই ঘুরে মারল দৌড়। কালুর নজর সরে গেল শেয়ালের দিক থেকে। বন্দুকেও দু চোখে দেখতে পারে না সে। শেয়ালের চেয়ে তাকে তাড়া করাটাই ভাল মনে করল বোধহয়, বদুর পায়ের গোছায় কামড়ে দেয়ার লোভেই যেন ঘেউ ঘেউ করতে করতে ছুটে গেল তার পেছনে।

ক্ষণিকের জন্যে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম আমরা। আমাদের প্ল্যান মত ঘটল না সব কিছু। সবার আগে সামলে নিল কিশোর। চিৎকার করে বলল, তুমি আর আক্কেল আলী বহুকে ধরো, আমি মুসার কাছে যাচ্ছি!

কালুর পেছনে দৌড় দিলাম আমি।

একটা শুকনো ডাল কুড়িয়ে নিয়ে আমার পেছন পেছন এল আক্কেল আলী।

দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঝোঁপঝাড় ভেঙে ছুটছে বদু। কিন্তু যত জোরেই ছুটুক, কুকুরের সঙ্গে পাল্লায় পারার কথা নয়। বুঝতে পারল, ধরা পড়ে যাবে সে। থামল না তবু। কিন্তু কপাল খারাপ তার। একটা শেকড়ে পা বেধে উড়ে গিয়ে পড়ল ধুড়স করে।

তার গায়ের ওপর উঠে পড়ল কালু। কামড়ানোর জন্যে জায়গা বাছাই করছে যেন।

বাবাগো, আমি শেষ! বলে চিৎকার করে এলোপাতাড়ি ঘুসি মারতে লাগল বদু। একটা লাগল কালুর নাকেমুখে। ওটাও আরেক ভীতু। ব্যথা লাগতেই কেউ করে লাফিয়ে নেমে গেল বদুর ওপর থেকে। ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে লাগল। আবার কামড়াতে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করছে।

সুযোগটা কাজে লাগাল বদু। আমরা তার কাছে পৌঁছার আগেই লাফিয়ে উঠে। আবার দিল দৌড়।

ঘেউ ঘেউ করে আবার তার পিছু নিল কালু।

কোন দিকে যাচ্ছে হুশ নেই দুর। সামনে যে জলাভূমি সে খেয়াল করল না। বরং আরেকটু এগিয়ে সামনে পানি চিকচিক করতে দেখে কুকুরের হাত থেকে বাঁচার জন্যে সোজা নেমে গেল সেটাতে। ছোপ ছোপ করে কাদা-পানি ভেঙে এগোতে লাগল।

কিন্তু কয়েক কদমের বেশি যেতে পারল না। হঠাৎ দেখলাম হাঁটু পর্যন্ত কাদায় ডুবে গেছে। পা যতই তোলার চেষ্টা করছে, আরও দেবে যাচ্ছে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল সে। মরে যাওয়ার ভয়ে বিকট চিৎকার করে উঠল।

জলাভূমির কিনারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগল কালু। আমরাও এসে দাঁড়ালাম। তাকে বাঁচানোর জন্যে আমাদেরকে অনুরোধ করতে লাগল বদু।

কয়েক মিনিট পর সেখানে এসে হাজির হলো মুসা আর কিশোর। বদুর দুরবস্থা দেখে হেসেই অস্থির মুসা। ওরা কি করেছে জিজ্ঞেস করলাম আমি। কিশোর জানাল, মানিককে নিয়ে গণ্ডগোল হয়নি। কয়লার ঘরে তালা দিয়ে রেখে এসেছে।

ডালটা নিয়ে কাদায় নেমে গেল মুসা। তার একটা হাত শক্ত করে ধরে রাখলাম আমি আর কিশোর। ডালটা বদুর দিকে বাড়িয়ে দিল মুসা। চেপে ধরতে বলল।

ধরল বদু।

মুসা বলল, এইবার আস্তে আস্তে উঠে এসো। তাড়াহুড়ো করলে কিন্তু ডাল ছেড়ে দেব।

সামান্যতম গোলমাল করল না বদু। যা নির্দেশ দেয়া হলো, নীরবে পালন করল।

তাকে তুলে আনলাম কাদা থেকে।

মুসার হাত থেকে ডালটা নিয়ে লাঠির মত বাগিয়ে ধরল আক্কেল আলী। বন্দুকে হুমকি দিল, তেড়িবেড়ি করলেই দেবে মাথায় বসিয়ে।

তবে আর কিছু করল না বদ। এক কালুর ভয়েই সে কাবু হয়ে আছে। বাকি চারজনের সঙ্গে মারপিটের ঝুঁকি নিতে চাইল না।

বদুকেও এনে কয়লার ঘরে ভরলাম আমরা।

চেঁচামেচিতে দাদা-দাদীও জেগে গেছেন। দাদী দেখতে এলেন কি হয়েছে।

সেই রাতেই আক্কেল আলীকে পুলিশের কাছে পাঠানো হলো, দুই চোরকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।

.

পরদিন সকালে নাস্তা খেতে বসেছি। দাদাও বসেছেন আমাদের সঙ্গে। দাদী গরম গরম ভাপা পিঠে এনে দিচ্ছেন রান্নাঘর থেকে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই উঠে পড়ল গুপ্তধন উদ্ধারের আলোচনা।

মুসা বলল, একটা কথা বুঝতে পারছি না, এতদিন বসে রইল কেন রবিউল। চানাচুরওলার ছদ্মবেশে সহজেই তো পালিয়ে যেতে পারত।

জবাব দিল কিশোর, আমার ধারণা, প্রথমে এই বুদ্ধি মাথায় আসেনি তার। কিংবা পালানোর সাহসই হয়নি। জিনিসগুলো নিয়ে গিয়ে মূর্তির মধ্যে ভরে রাখল। দুই শত্রু তখন তার। একদিকে পুলিশ, আরেক দিকে তার দলের লোক–তাদের সঙ্গেও বেঈমানী করেছে। ফলে লুকিয়ে থাকতে হলো তাকে মন্দিরের মধ্যে। কিন্তু নিরাপদ বোধ করল না ওখানে। যে কোন সময় ধরা পড়ে যেতে পারে। শেষে চানাচুরওলা সেজে বুঝতে চাইল, ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবে কিনা। বাজারে গেল সেটা বোঝার জন্যে। আরও একটা কারণে গিয়েছিল সে, পুলিশ আর তার দলের লোকের ব্যাপারে খোঁজখবর করার জন্যে…

কিন্তু বাদ সাধলে তোমরা, হেসে কথাটা শেষ করে দিলেন দাদা। একেবারে সময়মত গিয়ে হাজির হলে বাজারে। চিনে ফেললে তাকে। পালাতে যে পারবে না সে, প্রমাণ পেয়ে গেল হাতেনাতে।

হ্যাঁ, ব্যাটার কপালটাই খারাপ, হেসে মন্তব্য করল মুসা।

চুপচাপ খাওয়া চলল কিছুক্ষণ। একটা প্রশ্ন নিয়ে অনেক ভেবেছি আমি, জবাব খুঁজে পাচ্ছিলাম না-শফিকুর রহমান গুপ্তধনগুলোর লোভেই বাড়িটা কিনতে চায়নি তো? আর তাই যদি হয়ে থাকে, সে শিওর হলো কি ভাবে যে এই বাড়িতেই রয়েছে জিনিসগুলো, বের করে নিয়ে যেতে পারেনি আমিন উদ্দিন সরকারের মুন্সী?

প্রশ্নটা তুললাম।

দাদা বললেন, এর একটাই জবাব হতে পারে, কথাটা কোনভাবে মুন্সীদের কারও মুখেই জেনেছে শফিকুর রহমান। আমার কি সন্দেহ হচ্ছে জানো? এই শফিকুর রহমান মধু মুন্সীর ছেলে।

ছেলে! প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলাম আমরা তিনজন।

হ্যাঁ। তার একটা ছেলে ছিল বলে শুনেছি। বাবার কাছে নিশ্চয় গুপ্তধনের কথা শুনেছে সে। বিদেশে চলে গিয়েছিল বলে এতদিন আসতে পারেনি। দেশে ফিরেই বাড়িটা কিনতে এসেছে।

বিদেশে গিয়েছিল কি করে জানলেন? জিজ্ঞেস করলাম।

শফিকুর রহমান নাকি অনেক দিন দেশের বাইরে ছিল, আমাকে বলেছে। তোমাদের বয়েসে জাহাজে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিল, ফিরেছে এই কিছুদিন আগে। সে যে মধু মুন্সীর ছেলে, এটা আমার অনুমান। আগে কিছু সন্দেহ করিনি, এখন করছি।

খাওয়ার পর থানায় রওনা হলাম আমরা। ফারুক হোসেনকে পাওয়া গেল। তাকে বললাম শফিকুর রহমানের ব্যাপারটা। তিনি জানালেন, বদু মুখ খুলেছে। বলেছে, শফিক সাহেব নামে এক লোকই ওদের বস্, গুপ্তধনগুলো চুরি করার জন্যে টাকা দিয়েছিল ওদের।

আমাদের মুখ থেকে সব কথা শুনে আরও শিওর হলেন তিনি। শফিকুর রহমানের কাছে যাবেন বললেন।

তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে গুপ্তধনগুলো নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম আমরা।

মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলেন দাদা-দাদী।

গর্বের সঙ্গে দাদা বললেন দাদীকে, দেখেছ, কি জিনিস! পানপাত্রটা দেখো, কি সুন্দর কারুকাজ করা। আর পাথর কি! আজকাল এসব জিনিস কল্পনাই করা যায় না।

সুন্দর, স্বীকার করলেন দাদী, তবে কল্পনা করা যায় না কথাটা ঠিক না। টাকা খরচ করলে এখনও এমন বানানো যাবে।

দূর, কি যে বলো তুমি, সেই কারিগরই নেই। চমৎকার একটা হার তুলে নিয়ে দাদীকে দিয়ে বললেন দাদা, নাও, এটা তোমাকে দিয়ে দিলাম। পরো।

সলজ্জ হাসি হেসে দাদী বললেন, তোমার মাথায় দোষ পড়েছে! এই বুড়ো বয়েসে এ হার পরে আমি কি করব! বললেন বটে, কিন্তু হারটা নিয়ে পরে ফেললেন।

হাসলেন দাদা। বললেন, দারুণ মানিয়েছে। আমাদেরকে সাক্ষি মানলেন, কি বলিস, মানিয়েছে না?

সাংঘাতিক! আমার আগেই বলে উঠল মুসা।

কিশোর বলল, এক কাজ করব, দাঁড়াও, তোমার পা-টা ভাল হয়ে গেলে তোমাদের বিবাহ বার্ষিকী পালন করব আমরা…

কিন্তু তার তো অনেক দেরি আছে, দাদা বললেন।

তাতে কি? আমাদের খাতিরে আগামই নাহয় করে ফেললে। বাসর ঘর সাজিয়ে দেব তোমাদের।

কৃত্রিম মুখ ঝামটা দিয়ে একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন দাদী, এই সময় হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল আক্কেল আলী। ভীষণ উত্তেজিত। বলল, হুজুর, একটা সাংঘাতিক খবর আছে! নন্দী পাড়ার সাহেব মিয়া এসেছে। আমাদের যে জমিগুলো নদীতে ডুবে গিয়েছিল বহুকাল আগে, আবার নাকি ভাসছে। চর জেগেছে, হুজুর, চর জেগেছে!

খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন দাদা। তারপর বিড়বিড় করলেন, সরকারদের সৌভাগ্য! শুরু হয়ে গেল আবার! আক্কেল আলীর দিকে মুখ তুলে বললেন, জাগবেই, জাগতেই হবে। আবার আমাদের সব হবে! আসল জিনিসই ফিরে এশেছে যে! জিনিসগুলোর দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি।

আনন্দে দাদীর চোখে পানি এসে গেছে। প্রচণ্ড আগে সইতে না পেরে উঠে এসে আমার কপালে চুমু খেয়ে মাথাটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরলেন নীরবে।

একে একে মুসা আর কিশোরকেও চুমু খেলেন। তারপর বললেন, সরকার বাড়ির সৌভাগ্য ওই সোনার জিনিস নয়, আমার এই তিনটি রত্ন। ওরা ঘরে এসেছে। বলেই না ভাগ্য ফিরতে শুরু করেছে আমার, বুঝতে পারছি সোনাদানায় আবার ভরে উঠবে এই বাড়ি!

জমিদার-দাদার বাড়িতে এরপর মহাআনন্দে কাটতে লাগল আমাদের দিন।

নতুন কিছু আর বলার নেই।

ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা জানার জন্যে নিশ্চয় কৌতূহল হচ্ছে তোমাদের; শফিকুর রহমান মধু মুন্সীর ছেলে–দাদার এই অনুমানটা সত্যি কিনা প্রমাণ করা গেল না, কারণ ধরা গেল না তাকে। পুলিশ তার ঠিকানায় খোঁজ নিতে গিয়ে দেখে, ঘরের তালা বন্ধ। বাড়িওয়ালা জানাল, আগের রাতে নাকি তড়িঘড়ি করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে চলে গেছে লোকটা। বলে গেছে, আর আসবে না। দামী গাড়িটাও নাকি তার নিজের ছিল না, ভাড়া, রেন্ট-অ্যা-কার কোম্পানি থেকে নিয়েছিল।

তবে যাই হোক, শফিকুর রহমান ধরা পড়ুক আর না পড়ুক, বিপদ কেটে গেছে। দাদা-দাদীর মুখে হাসি ফুটাতে পেরে আমরা খুব খুশি। নিশ্চয়ই তোমরাও খুশি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *