১৭. দেবু ঘোষের বিরুদ্ধে অভিযোগ

দেবু ঘোষের বিরুদ্ধে অভিযোগ একটি নয়। সরকারি জরিপের কাজে বাধা দেওয়া ও সার্ভে ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী আমিনকে প্রহার করার অপরাধে সে অভিযুক্ত হইয়াছে। স্থানীয় সেটেলমেন্ট অফিসারের নির্দেশমত এখানকার থানার অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর একজন কনস্টেবল লইয়া আসিয়াছে। গ্রাম্য চৌকিদার ভূপালও তাহাদের সঙ্গে আছে। তাহারা চণ্ডীমণ্ডপে অপেক্ষা করিতেছিল। দেবু অনিরুদ্ধের বাড়ি হইতে আসিবামাত্র তাহাকে গ্রেপ্তার করিয়াছে। এখন হাতে হাতকড়ি দিয়া লইয়া যাওয়া হইবে। আজ রাত্রিতে থাকিবে হাজতে, কাল সকালে সেটেলমেন্ট অফিসারের নিকট হাজির করা হইবে। তিনি ইচ্ছা করিলে জা িনি দিবেন কিংবা বিচারাধীন আসামি হিসাবে তাহাকে সদর জেলে পাঠাইবেন। আবার ইচ্ছা করলে সঙ্গে সঙ্গে বিচারের দিন ধাৰ্য করিয়া নিজে বিচার করিবেন। দেবুকে লইয়া তাহারা চণ্ডীমণ্ডপেই বসিয়া আছে।

দেবুও চুপ করিয়া মাথা হেঁট করিয়া বসিয়া ছিল। মাথার ভিতরটাই কেমন যেন শূন্য হইয়া গিয়াছে; কিসে কি হইয়া গেল তাহা চিন্তা করিবার শক্তি পর্যন্ত নাই। শুধুই সে ভাবিতে পারিল যে, যাহা সে করিয়াছে-ভালই করিয়াছে; এখন যাহা হইবার হইয়া যাক!

 

দেখিতে দেখিতে গ্রামের প্রায় সকল লোকই জমিয়া গেল। শ্ৰীহরি ও দাশজী গোমস্তা, ছোট দারোগা সাহেবের পাশেই বসিয়া আছে। মধ্যে মধ্যে মৃদুস্বরে তিন জনে কথাও হইতেছে। হরিশ আসিয়াছে, ভবেশ আসিয়াছে, হরেন ঘোষাল, মুকুন্দ ঘোষ, কীৰ্তিবাস মণ্ডল, নটবর পাল ও গ্রামের দোকানি বৃন্দাবন, রামনারায়ণ ঘোষ, এমনকি এই শীতের সন্ধ্যায় বৃদ্ধ দ্বারকা চৌধুরীও আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। জগন ডাক্তার দেবুর পাশে বসিয়া আছে। প্ৰগল্‌ভ জগনও আজ স্তব্ধ, বিষণ্ণ—এমন আকস্মিক অভাবনীয় পরিণতিতে সে-ও হতভম্ব হইয়া গিয়াছে। একপাশে গ্রামের হরিজনেরা দাঁড়াইয়া আছে। সতীশ, পাতু সকলেই আসিয়াছে। দুর্গা বসিয়া আছে ষষ্ঠীতলার একপাশে একা, নীরবে, মাটির পুতুলের মত।

চিৎকার করিতেছে কেবল বুড়ি রাঙাদিদি। চণ্ডীমণ্ডপের ওপাশে গ্রামের প্রবীণারা পর্যন্ত আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। তাহাদের সম্মুখে দাঁড়াইয়া রাঙাদিদি বলিতেছিল—এ একেবারে হাতে করে মাথা কাটা! দারোগা! দারোগা হয়েছে তো সাপের পাঁচ পা দেখেছে। বলি হা গো দারোগা, চুরি না জোরি না ডাকাতি, কি করেছে বাছা যে, এই দিন সন্ধেবেলা রাত পোয়ালে লক্ষ্মী তুমি বাছার হাতে দড়ি দিতে এলে?

হরিশ বলিল-ওগো রাঙা পিসি, তুমি থাম।

–ক্যানে? থামব ক্যানে? দেখব একবার কত বড় ওই দারোগা মিনসে!

একবার ধমক দিয়া শ্ৰীহরি বলিল রাঙাদিদি, তুমি থাম। যা হয় আমরা করছি, তুমি একটু চুপ কর। তোমরা মেয়েলোক–

—মেয়েলোক? আমার সাড়ে তিন কুড়ি বয়স হল—আমি আবার মেয়েলোক কি রে? একশো বার বলব, হাজার বার বলব; আমাকে কি করবে? বাঁধবি তো বাঁধ ক্যানে, দেখি। পণ্ডিতের মতন লোককে দড়ি দিয়ে বাঁধছিল—আমাকেও বাঁধ। লে বাঁধ! আহা, পণ্ডিতের মতন মানুষ, দেবুর মত ছেলে! বুড়ি অকস্মাৎ কাঁদিয়া ফেলিল।

দেবু এবার নিজে উঠিয়া আসিয়া বলিল—একটু চুপ কর, রাঙাদিদি, আমি তোমার কাছে হাতজোড় করছি।

বৃদ্ধা সস্নেহে তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া বলিল-আমি তোকে আশীর্বাদ করছি ভাই, সায়েব তোকে দেখবামাত্তর ছেড়ে দেবে, চেয়ারে বসিয়ে বলবে পণ্ডিত লোক, তোমাকে কি জেহেল দিতে পারি বাপ!

দেবু হাসিল।

ওদিকে ব্যাপারটাকে চাপা দিয়া কৌশলে মুক্তিলাভ করাইবার কথাবার্তা হইতেছিল। শ্ৰীহরি ঘোষ তাহার অগ্রণী, সঙ্গে জমিদারের গোমস্তা দাশজী আছে। ছোট দারোগা শ্ৰীহরি ঘোষের বন্ধু। লোক, শ্ৰীহরি তাহাকেই ধরিয়াছে। প্রত্যক্ষভাবে না হইলেও পরোক্ষভাবে দেবু শ্রীহরির বিরোধীপক্ষ; অন্তরে অন্তরে দেবু তাহাকে ঘৃণা করে—তাহা শ্ৰীহরি জানে। কিন্তু গ্রামের প্রধান ব্যক্তি হিসাবে শ্রীহরি আজ দেবুর পক্ষ অবলম্বন না করিয়া পারে না। সে থাকিতে তাহার গ্রামবাসী বিশেষ করিয়া তাহার জ্ঞাতি একজনকে হাতে দড়ি দিয়া লইয়া গেলে লোকে কি বুলিবে? সে ছোট দারোগাকে খুশি করিয়া একটা উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা করিতেছে।

ছোট দারোগা বলিল—পেশকারের কাছে যাও, ধরে-পেড়ে হয়ে যাবে একরকম করে। যে আমিন-কানুনগোর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে—তাদেরই খুশি কর, বিনয় করে মাফ চেয়ে নিক দেবু ঘোষ, ব্যস—মিটে যাবে। এ তো আকছার হচ্ছে।

শ্ৰীহরি বলিলখুডোর যে আমার বেজায় মাথাগরম গো—আমি প্রথম দিন শুনেই বলে পাঠিয়েছিলাম, খুড়া, একবার কানুনগো বাবুর সঙ্গে দেখা করে ব্যাপারটা মিটিয়ে এসো। রাজকর্মচারী তুই-তুকারি করলে তো হল কি?

ভবেশ অমনি বলিয়া উঠিল—এাই, গায়ে তো আর ফোকা পড়ে নাই।

শ্ৰীহরি বলিল—যখন ঘটনা ঘটল, তখুনি তখুনি জানতে পারলে তো সে ঢেউ আমিই তখুনি মেরে দিতাম ব্যাপারটা মিটিয়ে দিতাম। আমি যে অনেক পরে শুনলাম।

ব্যাপারটা এইভাবে ঘটিয়া গিয়াছিল। এও সেই তুই-তুকারি লইয়া ঘটনা।

দেবু আপনার দাওয়ায় বসিয়া ছিল—তখন বেলা প্রায় বারটা। সাইকেলে চড়িয়া সম্মুখের পথ দিয়া যাইতেছিল একজন কানুনগো। বোধহয় বহুদূর হইতে আসিতেছিল শীতের দিনে এক গা ঘামিয়া ধুলায় ও ঘামে আচ্ছন্ন এবং ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল ভদ্রলোক; দেবুকে দেখিয়া সাইকেল হইতে নামিয়াই সম্ভাষণ করিল—এই! ওরে! এই শোন্!

এই সম্ভাষণ শুনিলেই দেবু ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া ওঠে; তাহার তিক্ত কটু অতীতের স্মৃতি জাগিয়া ওঠে। তবু লোকটির মাথায় টুপি, সাদা শার্ট, খাকি হাফপ্যান্ট ও সাইকেল দেখিয়া সরকারি কর্মচারী অনুমান করিয়া সে চুপ করিয়াই রহিল।

—এই ইডিয়েট, শুনতে পাচ্ছিস?

এবার দেবু ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া লোকটির দিকে চাহিল-ইচ্ছা ছিল কোনো উত্তর না দিয়াই সে উঠিয়া গিয়া বাড়ির ভিতরে ঢুকিবে, উত্তর দিবে না, ওই লোকটার কোনো কথাই শুনিবে না। কিন্তু উঠিতে-উঠিতেও একবার সে লোকটির দিকে না চাহিয়া পারিল না।

চোখাচোখি হইতেই কানুনগো বলিল—যা, এক গ্রাস জল আন দেখি। বেশ ঠাণ্ডা জল। পরিষ্কার গ্লাসে, বুঝলি?

দেবু বিপদে পড়িয়া গেল। তৃষ্ণার জলের জন্য এই আবেদন অভদ্র হইলেও সে না বলিতে পারি না। তবুও সে মুখে কোনো কথা বলিল না, ঘরের ভিতর হইতে একটা মোড়া আনিয়া দাওয়ায় রাখিল; পিচবোর্ডে তৈয়ারি একখানা পাখা আনিয়া দিল। ওইগুলির মারফতেই নীরব আমন্ত্রণ জানাইয়া সে বাড়ির ভিতর চলিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরই এক হাতে ঝকঝকে মাজা একখানি থালায় একটি বড় কদমা ও এক গ্লাস জল এবং অন্য হাতে একটি বড় ঘটির এক ঘটি জল ও পরিষ্কার একখানি গামছা আনিয়া হাজির করিল।

লোকটি হাত-মুখ ধুইল, গামছা আগাইয়া দিলে বা হাত দিয়া কানুনগো গামছাখানা সরাইয়া দিল। হাত-মুখ মুছিয়া ফেলিল সে আপনার রুমালে; তারপর কদমাটার খানিকটা ভাঙিয়া মুখে দিয়া বোধহয় চাখিয়া দেখিল। কদমাটা টাটকা কদমা, বেশ ভালই লাগিবার কথা। লাগিলও বোধহয় ভাল; কারণ গোটা কদমাটাই নিঃশেষ করিয়া জল খাইয়া কানুনগো পরিতৃপ্তির একটা নিশ্বাস ফেলিল–আঃ!

দেবু ইতিমধ্যে ভিতরে গিয়াছিল। পান বা মসলা আনিতে ভুল হইয়া গিয়াছিল। বিলুকে বলিল—সুপারি লবঙ্গ আর দুটো পান দাও দেখি! শিগগির।

পান সাজাই ছিল। এক টুকরা পরিষ্কার কলাপাতার উপর দুইটি পান ও সুপারি, লবঙ্গ সাজাইয়া সে স্বামীর হাতে তুলিয়া দিল।

ঠিক এই সময়েই বাহির হইতে ডাক আসিলওরে! এই ছোকরা!

দেবু আর সহ্য করিতে পারিল না। পানের পাতাটা সেইখানেই ফেলিয়া দিয়া বাহিরে আসিয়া সে বলিল কিরে, কি বলছিল?

এমন অতর্কিত রূঢ় প্রত্যুত্তরের জন্য কানুনগো প্রস্তুত ছিল না। বিস্ময়ে ক্রোধে প্রথমে সে কয়েক মুহূর্ত হতবাক হইয়া রহিল, তারপর বলিলহোয়াট! আমায় তুই-তুকারি করিস?

নিৰ্ভয়ে দেবু উত্তর দিল—সে তো তুই-ই আগে করলি।

—কি নাম তোর শুনি? তারপর দেখছি তোকে!

দেবু তাহার মুখের দিকে চাহিল, তারপর নির্ভয়ে বলিল-আমার নাম শ্রীদেবনাথ ঘোষ। তাহার দিকে আগাইয়া গিয়া বলিল—কি করবি কর!

কানুনগো বিনা বাক্যব্যয়ে চলিয়া গিয়াছিল।

ওদিকে জরিপ স্থগিত রাখিবার জন্য শ্ৰীহরিদের দরবারে বিশেষ ফল হয় নাই; ধান কাটিবার জন্য মাত্র আর সাত দিন সময় মঞ্জুর হইয়াছিল। কিন্তু পৌষের চৌদ্দ দিনের মধ্যে বিস্তীর্ণ মাঠের ধান কটা ও তোলা অসম্ভব ব্যাপার। অসম্ভব কোনোমতেই সম্ভব হয় নাই। হইয়াছে কেবল শ্ৰীহরির এবং আর জন দুই-তিনের-হরিশ দোকানি, বৃন্দাবন দত্ত এবং কৃপণ হেলারাম চাটুয্যের। তাহাদের পয়সা আছে, বহু নগদ মজুর নিযুক্ত করিয়া তাহারা কাজ শেষ করিয়াছে। বাকি লোকের পাকাধানের উপর দিয়াই জরিপ চলিতে আরম্ভ করিল। সরকার হইতে অবশ্য যথাসম্ভব সাবধানতা অবলম্বন করিয়া ধান বাঁচাইয়া আইলের উপর দিয়া কাজ করিতে নির্দেশ রহিল।

দেবু প্রথম দিন মাঠে গিয়া দেখিল—সার্ভে টেবিলের ধারে দাঁড়াইয়া আছে সেই কানুনগো লোকটি। কানুনগোও দেবুকে দেখিল। দুজনের চিত্তই তিক্ত হইয়া উঠিল। কানুনগো লোকটি ডিস্পেপটিক, অত্যন্ত রুক্ষ মেজাজের লোক, লোকজনের সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করা তাহার স্বভাব। দেবু সাবধানে তাহাকে এড়াইয়া চলিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই কয়েকটা ক্ষুদ্র ব্যাপার উপলক্ষ করিয়া কানুনগো তাহাকে ক্যাম্পে হাজির হইতে নোটিশ দিল।

তিক্তচিত্তে দেবু অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল। সে স্থির করিল–যাহা হয় হউক, সে কিছুতেই ওই কানুনগোর সম্মুখে হাজির হইয়া হাত জোড় করিয়া দাঁড়াইবে না।

কানুনগো সুযোগ পাইয়া এই অনুপস্থিতির কথা সেটেলমেন্ট-ডেপুটিকে রিপোর্ট করিল। ডেপুটি সাহেব নোটিশগুলি দেখিয়া একটু বিস্মিত হইলেন। এই তুচ্ছ কারণে নোটিশ করা হইয়াছে? তাহার ওপর তিনি এই কানুন্‌গোটির স্বভাবও জানিতেন। তবুও আইনানুযায়ী দেবুকে নোটিশ করিলেন। দেবু এ নোটিশও অমান্য করিল। তারপরই ওয়ারেন্ট হওয়ার নিয়ম। এদিকে ঠিক এই সময়েই এক চরম ব্যাপার ঘটিয়া গেল।

দেবুরই একটা জমি পরিমাপের সময় কানুনগোর সঙ্গে তাহার বচসা আরম্ভ হইল। দেবু জমির রসিদ আনে নাই। বচসার উপলক্ষ তাই। কথার উত্তর দিতে দিতেই দেবুর নজর পড়িল,তাহার জমির ঠিক মাঝখানে পাকা ধানের উপর জরিপের শিকল টানা হইতেছে। সে ভাবিল—এটাও কানুনগোর ইচ্ছাকৃত ব্যাপার। কিন্তু সত্য বলিতে কি এটা কানুনগোর ইচ্ছাকৃত ছিল না, দেবুর জমিটার আকারই এমন অসমান যে, মাঝখানে প্রস্থের একটা মাপ না লইয়া উপায় ছিল না। রাগের মাথায় ভুল বুঝিয়া দেবু চরম কাণ্ড করিয়া বসিল। জরিপের চেন টানিয়া তুলিয়া ফেলিয়া দিল। কানুনগো সঙ্গে সঙ্গে টেবিল শিকল লইয়া মাঠ হইতে উঠিয়া একেবারে ডেপুটির ক্যাম্পে হাজির হইয়া রিপোর্ট করিল।

ডেপুটিবাবু সত্যকারের ভদ্রলোক, তিনি বাংলার চাষীর নিরীহ প্রকৃতির কথা জানেন, তিনিও এই দেশেরই মানুষ; তিনি অবাক হইয়া গেলেন। কিন্তু কানুনগোর বন্ধু পেশকারটি ধুরন্ধর লোক, সে তাহাকে পরিষ্কার বুঝাইয়া দিল–লোকটা ওই জে. এল. ব্যানার্জীর শিষ্য।

ডেপুটি আর উপেক্ষা করিতে পারিলেন না।

তারপরই এই পরিণতি। একেবারে ওয়ারেন্ট অব অ্যারেস্ট।

শ্ৰীহরি সত্যই বলিয়াছে—সে কয়েকবারই অনুরোধ করিয়াছে খুড়ো, চল তুমি, আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি, কানুন্‌গোকে আমি নরম করে এনেছি, তুমি একবারটি গেলেই সব মিটে যাবে।

দেবু বলিয়াছে–না।

জগন বলিয়াছে—পণ্ডিত, তুমিও একটা দরখাস্ত কর, সমস্ত ব্যাপার জানিয়ে দাও সি. ও.-কে.; ডি. এল. আর.-কেও একটা দরখাস্ত কর।

দেবু বলিয়াছে–না, থাক।

বিলু শঙ্কিত, উদ্বিগ্ন মুখে প্রশ্ন করিয়াছো—হ্যাঁ গো, কি হবে?

দেবু হাসিয়াছে—যা হয় হবে।

যাহা হইবার হইয়া গেল।

* * * *

শ্ৰীহরি দেবুর কাছে আসিয়া বলিল—ছোট দারোগাকে রাজি করিয়েছি, খুড়ো। প্রথমে কানুনগোর ক্যাম্পে যাবে, সেখানে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিয়ে, কানুনগোর চিঠি নিয়ে যাবে সার্কেল ডেপুটির কাছে। কেস খারিজ হয়ে যাবে, আমরা বাড়ি চলে আসব।

দেবু বলিল–না।

—না কি গো?

–না, সে আমি যাব না, ছিরু।

–ফল কি হবে, ভাবছ তা!

–যা হয় হবে। দেবু এবারও হাসিল।

শ্ৰীহরি গভীর দুঃখের সঙ্গে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়াও বিরক্তি সংবরণ করিতে পারি না, বলিল—কাজটা কিন্তু ভাল করছ না, খুড়ো।

দাশজী বলিলতা হলে আমরা আর কি করব বল?

মজলিসসুদ্ধ লোকই সমস্বরে বলিল-আমরা আর কি করব বল?

কেবল মজলিসের সঙ্গে সায় দিল না তিন জন জগন ডাক্তার, অনিরুদ্ধ আর হরেন। ঘোষাল। হরেন ঘোষালের অভ্যাস সকলের আগে কথা বলা, কিন্তু সে আজ কিছু না বলিয়াই। দ্রুতপদে উঠিয়া চলিয়া গেল।

জগন বলিল-ভেবো না দেবু ভাই! কাল যদি কেস না করে হাজতী আসামি করে জেলে পাঠায়, তবে সদরে গিয়ে মোক্তার এনে মামলা লড়ব। আর যদি কালই বিচার করে জেল দেয়, তবে সদরে আপিল করব। জামিন সঙ্গে সঙ্গে হবে।

দেবু বলিল—শতখানেক টাকা আমার পোস্ট আপিসে আছে, বিলুর কাছে ফরম সই করে দিয়েছি। দরকারমত টাকা বার করে নিয়ো। মামলা করে কিছু হবে না জানি, কিন্তু জেরা করে।

আমি সব একবার ফাঁস করে দিতে চাই।

অনিরুদ্ধ অত্যন্ত কাতরস্বরে বলিল দেবু ভাই, তার চেয়ে মামলা মিটিয়ে ফেল।

হাসিয়া দেবু বলিল—তুমি একটু সাবধানে থেকো, অনি-ভাই। ডাক্তার, ওকে তুমি একটু দেখো।

ছোট দারোগা বলিল–সন্ধে হয়ে গেল। কি ঠিক হল আপনাদের?

দেবু উঠিয়া দাঁড়াইল—চলুন, আমি তৈরি।

ছোট দারোগা ডাকিল-ভূপাল! রামকিষণ।

–একটুকুন দাঁড়ান, দারোগাবাবু! কোথা হইতে আসিয়া হাতজোড় করিয়া দাঁড়াইল দুর্গা। দেবুকে বলিল-আর একবার বিলুদিদির সঙ্গে দেখা করে যাও পণ্ডিত।

দারোগা বলিল—যান, দেখা করে আসুন।

মুখরা দুর্গা আজ নীরব হইয়া দেবুর আগে আগে পথ চলিতেছিল।

দেবু বলিল-দুর্গা, তুই কিন্তু ওদের একটু দেখিস, একটু খোঁজখবর নিস্।

অগ্ৰগামিনী শুধু নীরবে ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল।

 

বিলু কাঁদতেছিল। দেবু চোখ মুছাইয়া দিল। তারপর শুধু কয়টা কাজের কথাই বলিল–পোস্ট আপিসের টাকাগুলো তুলে এনে নিজের কাছে রেখো, ডাক্তার যা চাইবে দিয়ো মামলার জন্যে। সাবধানে থেকো। ধান-পান হিসেব করে নিয়ে নিজেই তুমি হিসেব করে নিয়ো। তুমি তো হিসেব জান। মন-খারাপ কোরো না। খোকার ভার তোমার ওপর রইল—ঘরদোর সব। তুমি আমার ঘরের লক্ষ্মী, তুমি চঞ্চল হলে তো চলবে না; তোমায় থাকতে হবে অচলা হয়ে।

বিলু একটি কথাও বলিতে পারিল না।

দেবু হাসিয়া সবশেষে তাহাকে বুকে টানিয়া লইয়া প্রগাঢ় আবেগে একটি চুম্বন দিয়া ঘর থেকে বাহির হইয়া আসিল।

বাহিরে ছিল পদ্ম ও দুর্গা। দেবু বলিল—মিতেনী, তুমি রইলে, দুর্গা রইল; বিলুকে তোমরা একটু দেখো।

সে চণ্ডীমণ্ডপে আসিয়া বলিল—চলুন।

–ওয়েট! চণ্ডীমণ্ডপে নাটকীয়ভাবে প্রবেশ করিল হরেন ঘোষাল। তাহার হাতে একটি অতি সুন্দর গাঁদা ফুলের মালা। মালাখানি সে দেবুর গলায় পরাইয়া দিয়া উত্তেজিত আবেগে চিৎকার করিয়া উঠিল-জয়, দেবু ঘোষের জয়!

মুহূর্তে ব্যাপারটার চেহারা পাল্টাইয়া গেল।

দারোগা যাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিল। ফুলের মালা ও জয়ধ্বনিতে দেবুর পা হইতে মাথা পর্যন্ত একটা অদ্ভুত শিহরন বহিয়া গেল। বুকের মধ্যে যে ক্ষীণতম দুর্বলতার আবেগটুকু

স্পন্দিত হইতেছিল—সেটুকুও আর রহিল না, তাহার পরিবর্তে ভাটার নদীর বুকে জোয়ারের মত একটা বিপরীতমুখী উচ্ছ্বসিত আবেগ আসিয়া তাহাকে স্ফীত প্রশস্ত করিয়া তুলিল। সঙ্গে সঙ্গে সমবেত জনতা দারোগা কনস্টেবলের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন থাকিয়াও প্ৰতিধ্বনি তুলিল জয়, দেবু ঘোষের জয়। দৃঢ় দীর্ঘ পদক্ষেপে দেবু সম্মুখে অগ্রসর হইল।

* **

লক্ষ্মীপূজার আয়োজন করিতে বিলুর হাত উঠিতেছিল না। এক-অন্ন পঞ্চাশ-ব্যঞ্জনে লক্ষ্মীর পূজা। এই বেদনা বুকে লইয়া সে-আয়োজন কেমন করিয়া কি করিবে সে; কাহার জন্য লক্ষ্মী পাতিবে। পুরুষকে আশ্ৰয় করিয়াই নারীর বাস, নারায়ণের পাশে লক্ষ্মীর আসন। দেবুই যখন আজ এই আয়োজনের মধ্যস্থলে উপস্থিত নাই, তখন—! বারবার তাহার চোখ ফাটিয়া জল আসিতেছিল।

কিন্তু রাঙাদিদি আসিয়া বলিলভাবিস না ভাই, পণ্ডিত ভাই আজই ফিরে আসবে। আর আমার পানে তাকিয়ে দেখ, তিনকুলে কেউ নাই, তবু তো পুজো করছি। তোর কোলে সোনার চাদ, দেবু আমার ফিরে আসছে—তোর পূজা না করলে চলে? দে, আমি বরং তোর লক্ষ্মী পেতে দিয়ে যাই। ওই চারদিকে শাঁখ বাজছে-লক্ষ্মী পাতা হয়ে গেল সব।

রাঙাদিদি কত বাহার করিয়া নিপুণ হাতে সাজাইয়া লক্ষ্মী পাতিয়া দিয়াছে। লাল রেশমি কাপড়ে এমন করিয়া ধান ও কড়িগুলি ঢাকিয়া দিয়াছে যে মনে হয় যেন ছোট্ট একটি বন্ধু সিংহাসনের উপর বসিয়া আছে।

পদ্ম দুই-তিনবার আসিয়াছিল। দুর্গা তো সকাল হইতে বসিয়াই আছে, নড়ে নাই। শ্ৰীহরির মা-বউও আসিয়াছিল।

মা মৌখিক তত্ত্ব করিয়া গিয়াছে; বউটি আনিয়াছিল একছড়া মর্তমান কলা, একটা থোড়, একটা মোচা-শ্ৰীহরির নূতন কাটানো পুকুরের পাড়ের ফসল। আর কতকগুলি মটরশুটি, একটা। কপি, বাড়িতে লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে শ্রীহরি শহর হইতে আনাইয়াছে। বউটি বলিয়া গিয়াছে তুমি ভেবো না, শাশুড়ি! তোমার ভাসুর-পো সকালেই গিয়েছে হাকিমের সঙ্গে দেখা করতে। খুড়শ্বশুরকে সঙ্গে নিয়ে সে আজই ফিরে আসবে।

প্রায় প্রতি ঘরের মেয়েরা আসিয়া বিলুর তত্ত্ব লইয়া গিয়াছে। জগন ডাক্তারের স্ত্রী পাবার আসিয়াছে। হরিজনেরা জনে জনে আসিয়াছে। খেজুরগুড়ের মহলাদারটি খেজুরগুড় দিয়া গিয়াছে। সতীশ হইতে প্রত্যেকেই ছোট ছোট ঘটিতে কাঁচা দুধ আনিয়া দিয়া গিয়াছে। আর প্রয়োজন নাই বলিলে শোনে নাই, বোঝে নাই; উত্তরে বিষণ্ণ মুখে বলিয়াছে অপরাধ করলাম, মা?

দুর্গা বলিল-বিলু-দিদি, ক্ষীর করে রাখ।

বিলু বলিল—কি হবে বল দেখি? পচে যাবে তো।

—পচবে কেন? দেখ না, জামাই ঠিক ঘুরে আসছে।

কয়েকটি বাড়ির গুটিকয়েক কুমারী মেয়ে আসিয়া দাঁড়াইল। ঘড়া দাও, বউদিদি, জল এনে

বিলুর ইহারা সম্পর্কে নন। বিলু মিষ্ট-হাসি হাসিয়া বলিল জল আমি এনেছি ভাই।

বিলু বলিল—বস, জল খাও।

–না। আমরা কাজ করতে এসেছি।

ইহাদের এই অকপট আত্মীয়তা বিলুর বড় ভাল লাগিল। এত আপনার জন তাহার আছে! মানুষ এত ভাল!

চণ্ডীমণ্ডপে তিলকুটো ভোগের ঢাক বাজিলে তবে মেয়ে কয়টি গেল। চণ্ডীমণ্ডপে আজও তিলকুটো সন্দেশে বাবা-শিব ও মা-কালীর ভোগ হইবে। ওখানে ভোগ হইলে, তবে বাড়িতে লক্ষ্মীর ভোগ হইবে। বাউরি-ডাম-মুচিদের ছেলেরা চণ্ডীমণ্ডপে ভিড় জমাইয়া বসিয়া আছে। একটুকরা তিলকুটোর জন্য। ইহার পর আবার বাড়ি বাড়ি পিঠা সাধিতে যাইবে।

বয়স্কেরা অনেকেই দেবুর জন্য সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে গিয়াছিল। ফিরিল প্রায় একটার সময়। সকলেই গম্ভীর, চিন্তান্বিত। বিচার এখনও হয় নাই। তবে সবই বুঝা গিয়াছে। কিন্তু কি করিবে তাহারা? সকলের চেয়ে গম্ভীর শ্ৰীহরি। আমিন শ্ৰীহরিকে ডাকিয়া স্পষ্টই বলিয়াছে—দেবুর পক্ষ লইয়া যে সাক্ষী দিবে, তাহার সহিত বুঝাপড়া হইবে পরে। কারণ দেবু কিছুতেই ক্ষমা চাহিতে রাজি হয় নাই।

মুরব্বিরা পরামর্শ করিয়া ঠিক করিয়াছে—তাহার চেয়ে কোনো পক্ষেই সাক্ষ্য তাহারা দিবে না।

বাড়ি আসে নাই কেবল জনকয়েক,জগন ডাক্তার, অনিরুদ্ধ, হরেন ঘোষাল, দ্বারকা চৌধুরী, তারা নাপিত। তাহারা বাড়ি ফিরিল প্রায় সন্ধ্যার সময়—বিষণ্ণ মুখে, মন্থর পদে। দুর্গা পথে দাঁড়াইয়া ছিল, সে প্রশ্ন করিল—কি হল ডাক্তারবাবু, চৌধুরীমশায়?

জগন বলিল—সমস্ত দিন বসিয়ে রেখে, সন্ধেবেলায় দিন ফেলে সদরে চালান দিলে! বদমায়েশি আর কি!

–চালান দিলে?

–হ্যাঁ। কালই যাব আমি সদরে, জামিনে পণ্ডিতকে খালাস করে আন।

কথাটা মিথ্যা। দেবুর এক বৎসর তিন মাস পনের মাসের মেয়াদে জেল হইয়াছে। কাল জগন সদরে যাইবে আপিল করিবার জন্য। দেবু কিন্তু আপিল করিতে বারণ করিয়াছে। সাক্ষীর অবস্থা দেখিয়া সে আপিলের ফলও আন্দাজ করিয়া লইয়াছে।

জগন গালিগালাজ করিয়াছিল গ্রামের লোককে। দ্বারকা চৌধুরী পর্যন্ত আত্মসংবরণ করিতে পারে নাই। বৃদ্ধ দন্তহীন মুখে কম্পিত অধরে বলিয়াছিল-ভগবান এর বিচার করবেন।

দেবু হাসিয়া বলিয়াছে—আপনি সেদিন যে গল্পটা বললেন—সেটা ভুলে গেলেন চৌধুরীমশাই? মানুষের ভুল-চুক পদে পদে, আর একটা কথা চৌধুরীমশায়, এরা আমার পক্ষে সাক্ষি না দিক, বিপক্ষেও তো দেয় নাই!

অনিরুদ্ধ চিৎকার করিয়া উঠিয়াছিল—দিলে মাথায় বজ্রাঘাত হত না?

জেলের কথাটা তাহারা চাপিয়া গেল; দেবুর স্ত্রীর কথা বিবেচনা করিয়াই প্ৰকাশ করিল না।

দুর্গা আসিয়া বিলুকে সংবাদ দিয়া বুলিল—তোমার কাছে আমার মা শোবে, বিলু-দিদি।

বিলু বলিল—তুই থাক্‌ না দুগ্‌গা, বেশ দুজনে গল্প করব। আমি ঘরে শোব, তুই বারান্দার দোরটিতে শুবি।

দুর্গা বলিলনা, বিলু-দিদি!

–কেন দুর্গা?

–আমার ভাই, নিজের বিছানা নইলে ঘুম হয় না।

বিলু আর অনুরোধ করিল না। ব্যাপারটা সে বুঝিল; একটু কেবল হাসিল, কিন্তু রাগ করিল। না। মরিলেও নাকি মানুষের স্বভাব যায় না।

 

সমস্ত দিনটা কাটিল, কিন্তু সন্ধ্যা হইতে সময় আর কাটিতে চায় না। বিলু চুপ করিয়া বসিয়া ছিল। সে জেলে। সন্ধ্যায় গোটা গ্রামটায় শাঁখ বাজিয়া উঠিতে তাহার চমক ভাঙিল–ঘরে মা-লক্ষ্মী রহিয়াছেন, ধূপ-দীপ দিতে হইবে। মায়ের শীতল-ভোগের আয়োজন এখনও করা হয় নাই। দুর্গা যাইবার সময় বাড়ির রাখালটাকে ডাকিয়া গিয়াছিল, ঘোড়াটা প্রচুর পরিমাণে। পিঠা খাইয়া কাপড় মুড়ি দিয়া একপাশে অঘোরে ঘুমাইতেছিল। বেচারির পেটটা ফুলিয়া বুকের চেয়েও উঁচু হইয়া উঠিয়াছে হসফাস করিতেছে। ছোঁড়াটাও আশপাশের বাড়ির শাঁখের শব্দে উঠিয়া বসিল, বলিল—সঁজ লেগে গেইচে লাগছে! মনিব্যান, সঁজ জ্বাল গো, শাঁখ বাজাও, ধূপপিদিম দাও।

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বিলু উঠিল। ছোঁড়াটা বসিয়া বসিয়া আপন মনেই কথা বলিতেছিল সবই মনিবের অর্থাৎ দেবুর কথা।

—মনিব এতক্ষণ বসে বসে আমাদের কথাই ভাবছে, লয় মনিব্যা?

বিলু চোখ মুছিল।

–আচ্ছা, মনিব্যান্‌! জেহেলে কি লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রেখে দেয়? মনিব তা হলে কি করে শোবে?

আৰ্তস্বরে বিলু বলিল ওরে তুই আর বকিস্ না, থাম্।

ছোঁড়াটা অপ্রস্তুত হইয়া চুপ করিয়া গেল।

সন্ধ্যা-প্রদীপ, ধূপ, শীতল-ভোগ সাজাইয়া বিলু বলিল-আমার সঙ্গে আয় বাবা, খামারে গোয়ালে যাব-বলিতে বলিতেই মনে পড়িলঘুমন্ত শিশুর কথা; তাহার কাছে কে থাকিবে? অন্যদিন এই সময়টিতে থাকিত সে। বিলু একাই খামারে গোয়ালে, মরাইয়ের তলে জল দিয়া সন্ধ্যা দেখাইয়া আসিত। আজ সে নাই বলিয়া অকারণে তাহার ভয় করিতেছে, তাহার আকস্মিক সকরুণ অসহায় অবস্থা ক্ষণে ক্ষণে তাহাকে অভিভূত করিয়া ফেলিতেছে।

ছোঁড়াটা উঠিয়া বলিল—চল।

–কিন্তু খোকার কাছে থাকবে কে?

—আমি থাকছি। বলিয়া সে শুইয়া পড়িয়া বলিল—এত ভয় কিসের গো, মনিব্যান? যাও ক্যানে, কিরষেণ রইছে সব খামারে।

–কিষানরা রয়েছে?

–নাই? আমি যে হেথা রইছি, তারাই তো গরু ঢোকালে গোয়ালে। রেতে একজন থাকবে বাড়িতে শুয়ে। পালা করে রোজ একজন করে থাকবে। মনিব নাই, থাকবে না? আমিও থাকব মনিব্যান, একটি করে কাহিনী কিন্তুক বলতে হবে।

বিলু সন্ধ্যা দেখাইয়া ফিরিয়া আসিল—সঙ্গে সঙ্গে কৃষাণ দুই জন।

লক্ষ্মীর সিংহাসনের সম্মুখে ধূপ-দীপ, শীতল-ভোগ রাখিয়া প্ৰণাম করিয়া বিলু কামনা করিলওঁকে মানে মানে খালাস করে দাও, মা। ওঁর মঙ্গল কর। ঘরে আমার অচলা হয়ে বাস। কর।

ছোঁড়াটা বলিল–মনিব্যান, সেই ক্ষীরের পিঠে আর আছে নাকি?

বিলু মৃদু হাসিয়া বলিল আছে।

–তবে তাই গণ্ডা দুয়েক দাও, আর কিছু খাব না রেতে।

–হ্যাঁ বাবা, তোমরা? বিলু প্রশ্ন করিল কৃষাণ দুই জনকে।

–দেন অল্প করে চারডি।

দুপুরবেলায় এক-একজন ভীমের আহার করিয়াছে। ইহাদের খাওয়াইতে বিলুর এত ভাল লাগে! দেবু নিজে ইহাদের খাওয়াইত। বিলু যোগাইয়া দিত, পরিবেশন করিত সে নিজে।

আবার অ্যাঁউরি-বাউরি দিয়া সব বাঁধিতে হইবে। মুঠ-লক্ষ্মীর ধানের খড়ের দড়িতে সমস্ত সামগ্রীতে বন্ধন দিতে হইবে। আজিকার ধন থাক, কালিকার ধন আসুক, পুরানে-নূতনে সঞ্চয় বাড়ুক। লক্ষ্মীর প্রসাদে পুরাতন অন্নে নূতন বস্ত্রে জীবন কাটিয়া যাক নিশ্চিন্তে নিৰ্ভাবনায়। অচলা হইয়া থাক মা, অচল হইয়া থাক।

 

শেষরাত্রে আর এক পর্ব। পৌষ-আগলানো পর্ব-এই পৌষ সংক্রান্তির রাত্রির শেষ প্রহর। পৌষ মাস যখন বিদায় লইয়া অন্ধকারের আবরণে পশ্চিম দিগন্তের মুখে পা বাড়ায়, পূর্ব দিগন্তে আলোক আভাসের পশ্চাতে মকর রাশিস্থ সূর্যের রথের সঙ্গে উদয় হয় মাঘের প্রথম দিন তখন কৃষক-বনিতারা পৌষকে বন্দনা করিয়া সনির্বন্ধ অনুরোধ করে—পৌষ তুমি যাইও না। চিরদিন তুমি থাক।

চণ্ডীমণ্ডপের আটচালায় পৌষ-আগলানো হইয়া থাকে।

ভোররাত্রে ঘরে ঘরে লোক জাগিয়া উঠিয়াছে, গ্রামময় মানুষের সাড়া। শাখও বাজিতেছে।

বিলুও উঠিল। ছেলেটিও জাগিয়াছিল—তাহাকে কাপড় জড়াইয়া রাখাল-ছেলেটার কোলে দিয়া বিলু পূজার আয়োজন করিতে বসিল।

–ও ভাই, পণ্ডিত-বউ! সব হল তোমার? এস!

ডাকিতেছিল পদ্ম।

বিলু দুয়ার খুলিয়া দিল।এই হয়েছে। ধূপের আগুন হলেই হয়, চল যাই।

উনানের কাঠ জ্বলিতেছিল; পদ্ম দাঁড়াইয়া রহিল, ধূপদানিতে আগুন তুলিয়া লইয়া বিলু বলিল—চল।

রাখাল-ছেলেটা লইল হারিকেন। বাড়িতে কৃষাণেরা রহিল। দুর্গার মা শুইয়াই রহিল–সে ওঠে নাই। বাড়ি হইতে বাহির হইয়াই রাখালটা চমকিয়া উঠিল, জিজ্ঞাসা করিল—কে?

—কে রে? পদ্ম জিজ্ঞাসা করিল।

ছোঁড়াটা আলোটা তুলিয়া ধরিয়া বলিল–দুগ্‌গা দিদি বটে।

লণ্ঠনের আলোটা দুর্গার উপর পড়িল পরিপূর্ণভাবে, পরনে পাটভাঙা খয়ের রঙের তাঁতের শাড়ি, চুলের পারিপাট্যও চমৎকার, কপালে টিপ; কিন্তু সমস্তই বিশৃঙ্খল—বিপর্যস্ত। সে যেন হাঁপাইতেছিল—চোখের দৃষ্টি যেন উদভ্ৰান্ত।

আলোর দিকে পরিপূর্ণভাবে ফিরিয়া দাঁড়াইল। এতটুকু লজ্জা করিল না, সে বলিল—মিছে। কথা বিলু-দিদি, মিছে কথা। পণ্ডিত জামাইয়ের পনের মাসের মেয়াদ হয়ে গিয়েছে! বলিতে বলিতে সে ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।

বিলু হতবাক হইয়া পাথরের মত দাঁড়াইয়া রহিল।

দুর্গা গিয়াছিল নৈশ অভিসারে। কঙ্কণায় সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে। আমিন, পিয়ন, এমনকি কানুনগোদের মধ্যেও দুই-এক জন, স্থানীয় দুৰ্গা-শ্রেণীর নারীদের ওপর গোপনে অনুগ্রহ করিয়া থাকে। পেশকারটি আবার এ বিষয়ে সকলের সেরা, দুর্গার কাছে কয়েকদিনই সে অনুগ্রহের। আহ্বান পাঠাইয়াছিল, কিন্তু দুর্গা যায় নাই। আজ সে গিয়াছিল নিজে। বলিয়াছিল, পণ্ডিতকে কিন্তু হাকিমকে বলে-কয়ে ছাড়িয়ে দিতে হবে।

পেশকার বলিয়াছিল—আচ্ছা; কাল সকালে।

ভোরবেলায় আসিবার সময় দুর্গার ভুল ভাঙিয়া দিয়াছে—তাহার অনুগ্রহপ্রার্থী পেশকারের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ একজন পিয়ন।

দুর্গা আর পাঁড়াইল না, চলিয়া গেল। সে মনে মনে বাছিতেছিল—আপনার সগোত্ৰাদের মধ্যে একটি বাহ্যশ্রীময়ী অথচ ব্যাধিযুক্তা সখী।

 

ওদিকে তখন চণ্ডীমণ্ডপে মেয়েদের সমস্বরে ধ্বনি উঠিতেছিল—পৌষ-বন্দনার, পৌষবন্ধনের।

পৌষ—পৌষ–সোনার পৌষ।
এস পৌষ যেয়ো না—জন্ম জন্ম ছেড়ে না।
না যেয়ো ছাড়িয়ে পৌষ–না যেয়ো ছাড়িয়ে,
স্বামী-পুত্ৰ ভাত খাবে কটোরা ভরিয়ে।
পৌষ–পৌষ—সোনার পৌষ,
বড় ঘরের মেঝেয় বোস,
বড় ঘরের মেঝে ভরে–বাহান্ন হোস!
সোনার পৌষ।…

পদ্ম তাহার কধে হাত দিয়া ডাকিল—এস ভাই!

বিলু স্বপোথি তের মত বলিল–চল।

কি করিবে? উপায় কি? যাইবার সময় সে বলিয়া গিয়াছে—খোকার ভার তোমার ওপর রহিল, আরও রহিল ঘর-দুয়ার-মরাইগরু-বাছুর-ধান-জমি—সবের ভার। তুমি আমার ঘরের লক্ষ্মী, তুমি চঞ্চল হইলে চলিবে না। সর্ব-অবস্থায় অচলা হইয়া থাকিতে হইবে তোমাকে।

তাই থাকিবে সে, তাই থাকিবে। তাহার ঘরের সোনার পৌষ চলিয়া যাইতেছে, তাহাকে পূজা করিয়া বাঁধিতে হইবে। না যেয়ো ছাড়িয়ে পৌষনা যেয়ো ছাড়িয়ে! পনের মাস পরে তো সে ফিরিয়া আসিবে। তখন তাহাকে যে পঞ্চাশ ব্যঞ্জন দিয়া কটোরা ভরিয়া অন্ন সাজাইয়া দিতে হইবে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *