১২. অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে ইতুলক্ষ্মী পর্ব

অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে ইতুলক্ষ্মী পর্ব আসিয়া গেল।

অন্যান্য প্রদেশে-বাংলাদেশে বিশেষ অঞ্চলে কার্তিক-সংক্রান্তি হইতেই ইতু বা মিত্র-ব্ৰত আরম্ভ হয়, শেষ হয় অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে। রবিশস্যের কল্যাণ কামনা করিয়া সূর্য-দেবতার উপাসনা হইতেই নাকি ইহার উদ্ভব। দেবুদের দেশে কিন্তু সম মাস ধরিয়া সূর্য-দেবতার আরাধনার প্রচলন নাই। এদেশে রবিশস্যের চাষেরও বিশেষ প্রকার নাই, ধান-চাষ এখানকার প্রধান কৃষিকৰ্ম। ইতু-পর্বকে এখানে ইলক্ষ্মী বা ইতু-সংক্রান্তি পর্ব বলা হয়। হৈমন্তী-ধান মাড়াই ও ঝাড়াই করিবার শুভ প্রারম্ভের পর্ব এটি এবং রবিশস্যের আবাহনও বটে। চাষীদের আপন খামারে ইহার অনুষ্ঠান হয়। খামারের ঠিক মধ্যস্থলে শক্ত একটি বাঁশের খুঁটি পুতিয়া সেই খুঁটির তলায় আল্পনা দিয়া সেইখানে লক্ষ্মীর পূজা ভোগ হয়। ধান মাড়াইয়ের সময়ে ওই খুঁটিটির চারদিকেই ধানসুদ্ধ পোয়াল বিছাইয়া দেওয়া হইবে এবং গরু মহিষগুলি ওই খুঁটাতে আবদ্ধ থাকিয়া বৃত্তাকারে পোয়ালের উপর পাক দিয়া ফিরিবে। তাহাদের পায়ের খুরের মাড়াইয়ে খড় হইতে ধান ঝাড়াই হইয়া যাইবে।

এ পর্বের সঙ্গে চণ্ডীমণ্ডপের সম্বন্ধ বিশেষ নাই। তবে মেয়েরা প্রাতঃকালে স্নান করিয়া চণ্ডীমণ্ডপে প্রণাম না করিয়া লক্ষ্মী পাতিবে না। পূর্বকালে আরও খানিকটা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। দেবুর মনে আছে, পনের বৎসর পূর্বেও লক্ষ্মীপূজার শেষে সমস্ত গ্রামের মেয়েরা আসিয়া এইখানে সমবেত হইয়া সুপারি হাতে ব্ৰত-কথা শুনিতে বসিত। গ্রামের প্রবীণা কেহ ব্ৰতকথা। বলিতেন। অপর সকলে শুনিত। আজকাল সে রেওয়াজ উঠিয়া গিয়াছে। এখন দুই-তিন বাড়ির মেয়েরা কোনো এক বাড়িতে একত্রিত হইয়া ব্ৰত-কথা শুনিয়া লয়। দেবুর বাড়িতেও এই ব্ৰতকথার আসর বসে। আজ দেবু পাঠশালায় পড়াইতে পড়াইতে ওইসব কথাই ভাবিতেছিল। তাহার মনে সেদিন হইতে সমস্ত প্রেরণা ও শক্তি ক্ষুব্ধ ও আহত হইয়া অহরহ তাহাকে পীড়িত করিতেছে। যে কোনো সুযোগ পাইলেই তাহা অবলম্বন করিয়া আবার সে খাড়া হইয়া দাঁড়াইতে চায়। জগন ডাক্তারের সহিত যোগাযোগ আবার স্বাভাবিক নিয়মের বসে শিথিল হইয়া আসিয়াছে। জগন ডাক্তারের ঐ দরখাস্ত করার পন্থাটাকে সে অন্তরের সহিত গ্রহণ করিতে পারে না। দরখাস্তের কথায় তাহার হাসি আসে। অন্তর জ্বলিয়া ওঠে।

সে সাহিত্য পড়াইতেছিল—

অট্টালিকা নাহি মোর নাহি দাস-দাসী
ক্ষতি নাই, নহি আমি সে সুখ-প্রয়াসী।
আমি চাই ছোট ঘরে বড় মন লয়ে,
নিজের দুঃখের অন্ন খাই সুখী হয়ে!
পরের সঞ্চিত ধনে হয়ে ধনবান,
আমি কি থাকিতে পারি পশুর সমান?

সহসা তাহার নজরে পড়িল—একটি দীর্ঘাঙ্গী অবগুণ্ঠনবতী মেয়ে পথের ধার হইতেই চণ্ডীমণ্ডপের দেবতার উদ্দেশে প্রণাম করিল। চণ্ডীমণ্ডপে সে বোধহয় ইচ্ছা করিয়াই উঠিল না; কারণ তাহার পদক্ষেপে কোনো ব্যস্ততার লক্ষণ দেখা গেল না। দেবু তাহাকে চিনিল–অনিরুদ্ধের স্ত্রী। বুঝিল নবান্নের দিনের সেই ঘটনার জন্য অনিরুদ্ধের স্ত্রী চণ্ডীমণ্ডপের উপরে উঠিল না। মুহুর্তে দেবুর মন খারাপ হইয়া গেল। অনিরুদ্ধের স্ত্রী ওই যে নীরবে পথের উপর হইতে প্রণাম করিয়া চলিয়া গেল, তাহার প্রতিটি ভঙ্গি যেন রুদ্ধ-বেদনায় ব্যথিত বিষণ্ণ বলিয়া। তাহার মনে হইল। একা আসিয়া একা চলিয়া গেল, যেন বলিয়া গেল—একা আমিই কি দোষী? দেবু অনিরুদ্ধের স্ত্রীর গমনপথের দিকেই চাহিয়া রহিল, মেয়েটির ধীরপদক্ষেপ যেন ক্লান্ত। বলিয়া তাহার মনে হইল। সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস না ফেলিয়া পারিল না। কাজটা সত্যই অন্যায়। হইয়া গিয়াছে। এই মুহূর্তটিতে তাহার বিচারবুদ্ধির ত্রুটি স্বীকার না করিয়া পারিল না। অনিরুদ্ধের অন্যায়ের চেয়ে গ্রামের লোক যে অনিরুদ্ধের প্রতি অন্যায় করিয়াছে বেশি! ধান না দেওয়ার জন্যই অনিরুদ্ধ কাজ বন্ধ করিয়াছে। মজলিসে ছিরু আগে অপমান করিয়াছে, তবে অনিরুদ্ধ উঠিয়াছিল। অনিরুদ্ধের দুই বিঘা বাকুড়ির ধান কাটিয়া লওয়ার প্রতিকার যখন কেহ করিতে পারে নাই, তখন অনিরুদ্ধকে শাস্তি দিবার অধিকারই বা কাহার আছে? অকস্মাৎ সে বিস্ময়ে চকিত হইয়া উঠিল, মনের চিন্তাধারায় একটা ছেদ পড়িয়া গেল-একি! অনিরুদ্ধের স্ত্রী তাহার বাড়ির দিকে যাইতেছে কেন?–

পাঠশালার ছেলেগুলো পণ্ডিতের স্তব্ধতার অবকাশ পাইয়া উসখুস করিতে শুরু করিয়াছিল। একটি ছেলে বলিল-আজ ইতুলক্ষ্মী, মাস্টার মশায় আজ আমাদের হাপ-ইস্কুল হয়। নটা বেজে গিয়েছে ঘড়িতে।

দেবুর সম্মুখেই থাকে একটা টাইমপি। দেবু ঘড়িটার দিকে চাহিয়া আবার পড়াইতে শুরু করিল–

শৈশব না যেতে ক্ষেতে শিখিয়াছি কাজ,
সেই তো গৌরব মোর তাতে কিবা লাজ?

ধীরে ধীরে সমস্ত কবিতাটি শেষ করিয়া দেবু বলিল—কালকে এই পদ্যটির মানে লিখে আনবে সবাই। মানে বলতে কথার মানে নয়, কে কি বুঝেছ লিখে আনবে।

পাঠশালার ছুটি দিয়া সে আজ সঙ্গে সঙ্গেই আসিয়া বাড়ি ঢুকিল। বাড়ির উঠানে তখন তাহার স্ত্রীর সম্মুখে বসিয়া আছে পদ্ম, অদূরে বসিয়া আছে দুর্গা; তাহার স্ত্রী ইতুলক্ষ্মীর ব্ৰতকথা বলিতেছে। দেবুর স্ত্রী বড় ভাল উপকথা বলিতে পারে, এ পাড়ায় ব্রত-কথার আসর তাহার ঘরেই বসে। সে আসর শেষ হইয়া গিয়াছে। এ বোধহয় দ্বিতীয় দফা। দেবুর শিশু-পুত্রটিকে কোলে লইয়া পদ্ম বসিয়াছিল, দেবুকে দেখিয়া সে অবগুণ্ঠন টানিয়া দিল। দেবুর স্ত্রীও ঘোমটা অল্প একটু টানিয়া হাসিল। দুর্গা কাপড়চোপড় সামলাইয়া গুছাইয়া বেশ একটু বিন্যাস করিয়া বসিল। তাহারও মুখে ফুটিয়া উঠিল মৃদু হাসি। কিন্তু সেদিকে লক্ষ্য করিবার মত মনের অবস্থা দেবুর ছিল না। ব্ৰত-কথা তাহার স্ত্রী ভাল বলে—চমৎকার বলে, তাহাদের পাড়ার সকলেই প্রায় ব্ৰত-কথা শুনিতে তাহার বাড়িতে আসে। কিন্তু আজ কামার-বউয়ের তাহার বাড়িতে আসাটা যেমন অস্বাভাবিক তেমনি বিস্ময়কর।

নবান্নের দিন দেবু এই বধূটিকে কঠোরভাবে ভোগ ফিরাইয়া লইয়া যাইতে বলিয়াছিল। আজও কিছুক্ষণ আগেই পদ্ম পথ হইতে চণ্ডীমণ্ডপে দেবতার উদ্দেশে প্রণাম করিয়াছে, চণ্ডীমণ্ডপে ওঠে নাই, অথচ তাহারই বাড়িতে ব্ৰত-কথা শুনিতে আসিয়াছে—এ ব্যাপারটা সত্যই তাহার কাছে বিস্ময়কর মনে হইল। দেবু থমকিয়া দাঁড়াইল, পদ্মকে কোনো কথা বলিতে না পারিয়া প্রশ্ন করিল দুর্গাকে কি রে দুর্গা?

দুর্গার মুখে মৃদু হাসি বিকশিত হইয়া উঠিল, হাসিয়া সে বলিল—কথা শুনতে এসেছি দিদির কাছে। এমন কথা কেউ বলতে পারে না, বাপু। হাজার হোক পণ্ডিত-গিন্নি তো!

ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া দেবু বলিল—দিদি? কথাটা তাহাকে পীড়া দিয়াছিল।

–হ্যাঁ গো। দিদি! তোমার গিনি যে আমার বিলু দিদি, তুমি যে আমার জামাইবাবু! দেবুর সর্বাঙ্গ জ্বলিয়া গেল; কঠোর স্বরেই বলিল মানে? ও দিদি কি করে হল তোর?

চোখ দুইটা বড় বড় করিয়া বলিল—হেই মা! আমার মামার বাড়ি যে তোমার শ্বশুরদের গায়ে গো! আমার মামারা যে দিদিদের বাপের বাড়ির খেয়ে মানুষ-পুরনো চাকর! দিদি যে আমার মামাকে কাকা বলে; তা হলে আমার দিদি নয়?

ভাল না লাগিলেও প্রসঙ্গটা সম্পর্কে তাহাকে নীরব হইতে হইল। শুধু বলিল। তারপর স্ত্রীকে বলিল—উটি আমাদের কর্মকারের, মানে অনিরুদ্ধের স্ত্রী নয়?

দীর্ঘ অবগুণ্ঠন পদ্ম আরও একটু বাড়াইয়া দিল। দেবুর স্ত্রী চাপাগলায় বলিল–হ্যাঁ।

দুর্গা সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ করিল-কামার-বউয়ের কথা শোেনা হয় নাই। ওদের বাড়ি গেলাম তো দেখলাম—ম হয়ে বসে ভাবছে। উ পাড়ায় কথা হয় ওই পালের বাড়িতে ছিরু পালের বাড়িতে। ওদের বাড়ি যায় না কামার-বউ, তাতেই বললাম—এসো, আমার দিদির বাড়িতে এসো।

দেবু চুপ করিয়া রহিল।

দুর্গা বলিল—কামার-বউ ভয় করছিল, পণ্ডিতমশায় যদি কিছু বলে। সেদিন চণ্ডীমণ্ডপে তুমি নাকি বলেছিলে—

মধ্যপথেই বাধা দিয়া দেবু বলিল—অনিরুদ্ধ যে মহা অন্যায় করেছে।

অকুণ্ঠিত স্বরে অভিযোগ করিয়া দুর্গা বলিল—তোমার মত লোকের যুগ্য কথা হল না, পণ্ডিতমশায়। অন্যায় কি একা কর্মকারের? বল তুমি?

দেবু কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলা, তা বটে। বুঝতে আমার ভুল খানিকটা হয়েছিল।

সুযোগ পাইয়া বিনা দ্বিধায় সে ওই দুর্গার মারফতে কামার-বউয়ের কাছে কথাটা স্বীকার করিয়া ভারমুক্ত হইতে চাহিল।

দেবুর স্ত্রী চাপা গলাতেই ব্যস্ত হইয়া বলিল—কেঁদো না কামার-বউ, কেঁদো না! পদ্ম ঘোমটার আঁচল দিয়া বার বার চোখ মুছিতেছিল; সেটা সে লক্ষ্য করিয়াছিল।

দেবু ব্যস্ত হইয়া বলিলনা, তুমি কেঁদো না। অনিরুদ্ধ আমার ছেলেবেলার বন্ধু; একসঙ্গে পাঠশালায় পড়েছি। তাকে বোলো, আমি যাব আমি নিজেই যাব তার কাছে।

দুর্গা পদ্মকে লক্ষ্য করিয়া বলিয়া উঠিল—আমি তোমাকে বলেছিলাম তো কামার-বউ, ওই জগন ডাক্তারের মোড়লির পাল্লায় পড়ে জামাই আমাদের এ কাজ করেছে।

—না, না, মিছে পরকে দোষ দিনে দুর্গা। আমারই বুঝবার ভুল।

এমন আন্তরিকতা-মাখা কণ্ঠে অকপট স্বীকারোক্তি সে করিল যে দুৰ্গা পর্যন্ত স্তব্ধ হইয়া গেল।

দেবুই আবার বলিল–ওগো, অনিরুদ্ধের বউকে জল খাইয়ে তবে ছেড়ে দিও।

—আর আমি? দুর্গা ঝঙ্কার দিয়া উঠিল।-ওঃ, আমি বুঝি বাদ যাব? বেশ জামাইদাদা যা হোক।

স্বৈরিণী মেয়েটার কথা বলার ভঙ্গি, আত্মীয়তার সুর এমন মিষ্ট এবং মনকাড়া যে কিছুতেই রাগ করা যায় না তাহার উপর। তাহার কথায় দেবুর বউ হাসিল, পদ্ম হাসিল; দেবুও না হাসিয়া পারিল না। হাসিয়া দেবু বলিল—তোর জন্য ভাবনা তো আমার নয়, সে ভাবনা ভাববে তোর দিদি। আপনার জন থাকতে কি পরের আদর ভাল লাগে রে?

—লাগে গো লাগে। টাকার চেয়ে সুদ মিষ্টি; দিদির চেয়ে দিদির বর ইস্টি, আদর আরও মিষ্টি। আমার কপালে মেলে না।

দেবু হাসিয়াই বলিল—নে আর ফাজলামি করতে হবে না, এখন কথা শোন। বলিয়া সে যেন ভারমুক্ত হইয়া লঘুহৃদয়ে ঘরে ঢুকিল।

***

দরিদ্র ব্রাহ্মণের পিঠে খাবার সাধ হয়েছে।

দেবুর স্ত্রী ব্ৰত-কথা বলিতেছিল। ব্রাহ্মণ মনে মনে ভাবেন-চালের পিঠে, সরুচাকলি, মুগের পিঠে, নারকেল পুরের পিঠে, রাঙা আলুর পিঠে, ভাবেন আর তার জিভে জল আসে।

ঘরের ভিতর বসিয়া দেবু আপন মনেই হাসিল। জল তাহার জিভে আসিতেছে; বোধ করি ব্ৰত-কথার কথক ঠাকরুনমায় শ্রোতাদের জিহ্বা পর্যন্তও সজল হইয়া উঠিয়াছে।

কিন্তু সাধ হলেই তো হয় না, সাধ্যি থাকা চাই। দরিদ্র ব্রাহ্মণ, জমি নাই, জেরাত নাই, চাকরি-বাকরি নাই, ব্যবসা নাই, বাণিজ্য নাই, যজ্ঞি নাই, যজমান নাই-আজ খেতে কাল নাই আর কোথায় চাল কোথায় কলাই কোথায় গুড়, রাঙা আলুই বা আসে কোথা থেকে? আর ব্রাহ্মণ হয়েও চুরি করতে তো পারেন না! কি করেন?

দেবু ব্রাহ্মণের সততার তারিফ না করিয়া পারিল না।

কিন্তু ব্রাহ্মণের বুদ্ধি তো! তিনি এক ফন্দি বার করলেন। তখন অগ্রহায়ণ মাসের শেষ। মাঠ থেকে গেরস্তের গাড়ি গাড়ি ধান আসছে, কলাই আসছে, আলু আসছে, গাড়ির চাকায় পথের মাটি খুঁড়ো হয়ে এক হাঁটু করে ধুলো হয়েছে। ব্রাহ্মণ বুদ্ধি করে সন্ধ্যার পর বাড়ির সামনেই পথের ধুলোর ওপর আরও খানিকটা কেটে বেশ একটি গর্ত করলেন—তারপর ঢাললেন ঘড়া ঘড়া জল। পরের দিন যত গাড়ি আসে, সব পড়ে ওই গর্তের কাদায়। চাকা আটকে যায়। ব্রাহ্মণ সেই গাড়ি তুলতে সাহায্য করেন আর চাষীদের কাছে আদায় করেন—ধানের গাড়ির থেকে ধান, কলাইয়ের গাড়ি থেকে কলাই, গুড়ের নাগরি থেকে গুড়। এমনি করে ধান, কলাই, গুড়, আলু যোগাড় করে ঘরে তুললেন, তারপর ব্রাহ্মণীকে বললেন, নে বামনি, এবার পিঠে তৈরি কর।

দেবু এবার হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। ব্রাহ্মণের বুদ্ধিতে সে একেবারে মুগ্ধ হইয়া গিয়াছে। তাহার হাসিতে ব্ৰত-কথা বন্ধ হইয়া গেল। বাহির হইতে দুর্গা প্রশ্ন করিল—পণ্ডিতমশায়, হাসছ ক্যানে গো তুমি?

দেবু বাহির হইয়া আসিয়া বলিল,–বামুনের বুদ্ধির কথা শুনে। আচ্ছা বামুন!

দেবুর স্ত্রী মৃদু হাসিয়া ঘোমটা আরও একটু বাড়াইয়া দিল। বলিল—কথাটা শেষ করতে দাও, বাপু।

–আচ্ছা—আচ্ছা! বলিতে বলিতে দেবু বাহির হইয়া গেল।

***

পরিতুষ্ট লঘু মন লইয়া দেবু বাহিরে আসিয়া পথের ধারে বাহিরের ঘরের দাওয়ায় দাঁড়াইল। পল্লীগ্রামে জলখাবার বেলা হইয়াছে। মাঠ হইতে চাষীরা বাড়ি ফিরিতেছে। চাষীশ্রমিকেরা মাঠেই জল খায়, তাহাদের জলখাবার লইয়া মেয়েরা চলিয়াছে মাঠে; মাথায় তাহাদের গামছায় জলখাবারের পাত্র-কাকালে ঝুড়ি, হাতে জলের ঘটি। পুরুষদের জলখাবার খাওয়াইয়া, এই ধান কাটার সময় তাহারা ধানের শীষ সংগ্রহ করিবে, বনজঙ্গল হইতে শুকনা কাঠ ভাঙিয়া জ্বালানি সংগ্রহ করিবে।

দুই-চারিখানা ধান বোঝাই গাড়িও মাঠ হইতে ফিরিতেছে। অগ্রহায়ণের সংক্রান্তি ইহারই মধ্যে গ্রাম্য কাঁচা রাস্তা ময়দার মত ধুলায় ভরিয়া উঠিয়াছে; হেমন্তের শেষ দিন—রৌদ্রের রঙের মধ্যে যেন বৃদ্ধের পাংশু দেহবর্ণের মত শীতের পীতাভ আমেজ ফুটিয়া উঠিয়াছে। গাড়ির চাকায় উৎক্ষিপ্ত ধূলিকণায় সে রৌদ্রও ধূলি-ধূসর। চণ্ডীমণ্ডপের এক প্রান্তে ষষ্ঠীতলার বুড়া বকুলগাছটার গাঢ় সবুজ পাতাগুলার উপর ইহারই মধ্যে একটা ধুলার প্রলেপ পড়িয়া গিয়াছে। দেবু অন্যমনস্কভাবে আবার চণ্ডীমণ্ডপের উপর উঠিল। চণ্ডীমণ্ডপটারও সৰ্বাঙ্গ ধুলার আস্তরণ। ঘুরিয়া ফিরিয়া সে এইখানেই আসিয়া দাঁড়ায়। এই স্থানটির সঙ্গে তাহার একটা নিবিড় যোগাযোগ আছে যেন।

–হ্যাঁ হে নাতি, বলি, পাঠশালা ভাঙল তোমার? সাড়া-শদ কিছু নাই যেন লাগছে? এত সকালে?

জরাজীর্ণ কোনো নারীকন্ঠের সাড়া আসিল পথ হইতে।

—এস এস, রাঙাদিদি, এস। আজ ইতুলক্ষ্মী, হাফ-স্কুল! দেবু সাগ্রহে তাহাকে একটু অস্বাভাবিক উচ্চকণ্ঠে আহ্বান করিল।

এক বৃদ্ধা—এ গ্রামের রাঙাদিদি, প্রবীণের রাঙাপিসি। তেল মাখিয়া একগাছি কঁটা হাতে আসিয়া চণ্ডীমণ্ডপে উঠিল। বৃদ্ধা এই গ্রামেরই মেয়ে, সন্তানহীনা; শুধু সন্তানহীনাই নয়, সর্বস্বজনহীনা—আপনার জন তাহার আর কেহ নাই। চোখে এখন ভাল দেখিতে পায় না, কানেও খাটো হইয়াছে; কিন্তু দেহ এখনও বেশ সমর্থ আছে। এই সত্তরের উপর বয়সেও সে সোজা খাড়া মানুষ এবং রাঙাদিদি নামটিও নিরর্থক নয়; এখনও তাহার দেহবৰ্ণ গৌর এবং তাহাতে বেশ একটা চিকুণতা আছে। লোকে বলে—বুড়ি তেলহলুদে তাহার দেহটাকে পাকাইয়া তুলিয়াছে; দুই বেলায় পোয়াটাক তেল সে সর্বাঙ্গে মাখে, মধ্যে মধ্যে আবার হলুদও মাখে। সে বলে–তোরা সাবাং মাখিস—আমি হলুদ মাখব না? রোজ স্নানের পূর্বে বুড়ি চণ্ডীমণ্ডপে ঝাঁটা বুলাইয়া পরিষ্কার করিয়া যায়। এটি তাহার নিত্যকৰ্ম।

–ইতুলক্ষ্মীতে হাপ-স্কুল বুঝি? তা বেশ করেছিল। বুড়ি অবিলম্বে ঝাড় দিতে আরম্ভ করিয়া দিল। –কত গান শুনেছি এখানে ভাই নাতি-নীলকণ্ঠ, নটবর, যোগীন্দ্র; মতিরায়ও একবার এসেছিল। বড় যাত্রার দল। কেওন, পাঁচালী কত হত ভাই! তোরা আর কি দেখলি বল? সে রামও নাইসে অযুধ্যেও নাই। চণ্ডীমণ্ডপ নিকুবার জন্যে তখন মাইনে করা লোক ছিল, দিনরাত ভকতক ঝকঝক করত। সিঁদুর পড়লে তোলা যেত।

বুড়ি আপন মনেই বকিয়া যায়। জীবনের যত সমারোহের সুখস্মৃতিসে সমস্তই সে আহরণ করিয়াছে এই স্থানটি হইতে। এখানে আসিয়া তাহার সব কথা মনে পড়িয়া যায়। রোজ সে এই কথাগুলি বলে। কত বড় বড় মজলিস ভাই, গায়ের মাতব্বরেরা এসে বসত, বিচার হত; ভাল-মন্দতে পরামর্শ হত। তখন কিন্তুক মেয়েদের পা বাড়াবার যো থাকত না। ওরে বাস রে, মোড়লদের সে হাঁকাড়ি কি?

দেবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল—তুমি মলেই দিদি চণ্ডীমণ্ডপে আর ঝাঁট পড়বে না।

বুড়ির ঝাঁট মুহূর্তে থামিয়া গেল, উদাস কণ্ঠে বলিলমা কালী বুড়ো বাবা আপনার কাজের ব্যবস্থা করে নেবে রে ভাই।

আবার কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া বুড়ি বলিল—মরবার সময় যেন তোরা ধরাধরি করে এইখানে এনে বুড়িকে শুইয়ে দিস, ভাই!

দেবু বলিলতা দোব। তুমি কিন্তু তোমার কিছু পোঁতা টাকা আমাদের দিয়ে যেও চণ্ডীমণ্ডপটা মেরামত করা।

অন্য কেহ এ কথা বলিলে বুড়ি আর বাকি রাখিত না, তাহাকে গালিগালাজ দিতে আরম্ভ করিয়া পরিশেষে কাঁদিতে বসিত। কিন্তু দেবু যেন এ গ্রামের অন্য সকল হইতে পৃথক মানুষ। বুড়ি তাহাকে গালিগালাজ না দিয়া বুলিলা, নাতি, তুইও শেষে এই কথা বললি ভাই? গোবর কুড়িয়ে ঘুঁটে বেচে, দুধ বেচে, এক পেট খেয়ে টাকা জমানো যায়? তুই-ই বল ক্যানে!

বুড়ি এবার খসখস করিয়া যথাসাধ্য দ্রুতগতিতে ঝটা চালাইতে আরম্ভ করিল। টাকার কথাটা সে আর বাড়াইতে চায় না। টাকার কথা হইলেই বুড়ির ভয় হয় হয়ত কেহ কোনোদিন রাত্রে তাহাকে মারিয়া ফেলিয়া সর্বস্ব লইয়া পলাইবে। বুড়ির কিছু টাকা আছে সত্য, দুই-তিন জায়গায় মাটির নিচে পুঁতিয়া রাখিয়াছে। বেশি নয়, সর্বসমেত দশ কুড়ি পাঁচ টাকা।

***

মন্থরগতি উত্তেজনাহীন পল্লীজীবন। ইহারই মধ্যে রাস্তায় মানুষ চলাচল বিরল হইয়া আসিতেছে। মধ্যে মধ্যে কেবল দুই-একখানা গরুর গাড়িতে মাঠ হইতে ধান আসিতেছে। ক্যাঁচ-কোঁচ-ক্যোঁ—একঘেয়ে করুণ শব্দ উঠিতেছে। কর্মহীন দেবুও অলসভাবে চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়া ছিল। পৌষ মাস গেল মাঠের ধান ঘরে আসিলে, এ গাড়ি কয়খানাও আর যাওয়া-আসা করিবে না। সেবার বিশু-ভাই একটা কথা বলিয়াছিল—আমাদের গ্রামের সেই গরুর গাড়ি চড়ে জীবন যাত্ৰা আর বদলাল না। গ্রামগুলো গরুর গাড়ি চড়ে বলেই এমন পিছিয়ে আছে, জীবনটাই হয়ে গেছে টিমে তেতালা। অন্য দেশে চাষের কাজে এখন চলছে কলের লাঙল, মোটর ট্র্যাক্টর। তাদের গ্রাম চলে লরিতে-ট্রাকে।

দেবু অবশ্য বিশ্বনাথের কথা স্বীকার করে না। কিন্তু গরুর গাড়ি চড়িয়া এখানে যে জীবন চলিয়াছে সে কথা মিথ্যা নয়। ডিমা-ঢিলা চালে কোনোমতে গড়াইয়া গড়াইয়া চলিয়াছেওই চাকার ক্যাঁক্যোঁ শব্দের মত কাতরাইতে কাতরাইতে।

ভূপাল বাগদী চৌকিদার আসিয়া প্ৰণাম করিয়া দাঁড়াইল—পেনাম পণ্ডিতমশায়। ভূপালের পিছনে একটি অবগুণ্ঠনবতী মেয়ে, হাতে একটি হাঁড়ি।

দেবু অন্যমনস্কভাবেই হাসিয়া বলিল-ভূপাল?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। একবার নিকিয়ে-চুকিয়ে দিয়ে যাই চণ্ডীমণ্ডপটি। লে গোলে, সেই উ-পাশ থেকে আরম্ভ কর।

মেয়েটার হাতের হাড়িতে ছিল গোবর-মাটির গোলা, সে নিকাইতে আরম্ভ করিয়া দিল। ভূপাল—সরকারি চৌকিদার আবার জমিদারের লন্দীও বটে; আশ্বিন, পৌষ ও চৈত্র-এই তিন কিস্তির প্রারম্ভে তিনবার চণ্ডীমণ্ডপ তাহাকে গোলা দিয়া নিকাইতে হয়। লক্ষ্মীর পাঁচটা কর্তব্যের মধ্যে এটাও একটা।

দেবু এবার সচেতন হইয়া হাসিয়া বলিল—এ যে হরিঠাকুরের পুজো করা হচ্ছে ভূপাল। চক্রবর্তী ঠাকুরের পুজো করার মত কাণ্ড হচ্ছে ভূপাল। পাঁচখানা গাঁয়ে চক্রবর্তী ঠাকুর পুজো করে। একদিন এক গাঁয়ে গিয়ে একেবারে পাঁচ দিনের পুজো করে আসে। আবার পাঁচ দিন পরে যায়। পৌষ-কিস্তির যে এখনও অনেক দেরি হে!

পণ্ডিতের কথায় ভূপাল না হাসিয়া পারিল না, বলিল-আজ্ঞে আমাদের যুধিষ্ঠির থানাদারও (চৌকিদার) তাই করে; সন্ঝে-বেলায় বার হয়, রাত্রে তিনবার হক দেবার কথাও। একবারেই তিনবার হাঁক দিয়ে ঘরে এসে শোয়।

দেবু সশব্দে হাসিয়া উঠিল। ভূপাল বলিল আমি সেটা করি না—পণ্ডিতমশায়। গোমস্তামশায় এসে গিয়েছেন আজ।

–এসে গিয়েছেন? এত সকালে?

–আজ্ঞে হ্যাঁ, এবার সকাল-সকালই বটে। সেটেলমেন্টার এসেছে কিনা।

–সেটেলমেন্ট ক্যাম্প?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। ধুমধাম কত, তবুটাবু নিয়ে সে বিশ-পঁচিশখানা গাড়ি। শুনেছি খানাপুরী আরম্ভ হবে ৭ই পৌষ হতে। আজই সন্‌ঝেতে বোধহয় ঢোল-শোহরত হবে। খেয়েই আমাকে কঙ্কণা যেতে হবে।

সেটেলমেন্টের খানাপুরী? সমস্ত মাঠ জুড়িয়া পাকা ধান—সেই ধানের উপর শেকল টানিয়া-বুটজুতায় ধান মাড়াইয়া–খানাপুরী?

ভূপাল বলিল—ধান এবার মাঠেই ঝাড়াই হবে পণ্ডিতমশায়।

দেবু কুঞ্চিত করিয়া উঠিয়া পাঁড়াইল। এ যে অন্যায়! এ যে অবিচার!

Leave a Reply to Mustafa Mehmed Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *