পেঁচার ডাক

ভলিউম ৫১ – পেঁচার ডাক – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৭

০১.

রবিনকে খবরটা দিল দুধওয়ালা। কাল রাতে মিস্টার হুবারের বাড়িতে চোর ঢুকেছিল, শুনেছ খবরটা?

রবিনদের পাশের বাড়ির পরের বাড়িটা হপ্তা দুই আগে ভাড়া নিয়েছে কনি হুবার। একা থাকে।

কি কি নিয়েছে?

জানা যায়নি। মিস্টার হুবার বাড়ি নেই।

কে বলল আপনাকে? উত্তেজিত হয়ে উঠেছে রবিন। ওদের বাড়ির এত কাছে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল, আর সে কিছুই জানে না!

সকালে দুধ দিতে গিয়ে দেখি দরজা খোলা। একটা জানালা ভাঙা। মিস্টার হুবারের নাম ধরে ডাকাডাকি করলাম। বেরোলেন না। হলঘরের দরজা দিয়ে উঁকি দিলাম। ভেতরে জিনিসপত্র সব তছনছ হয়ে আছে। সন্দেহ হলো। ঘরে ঢুকে তক্ষুণি পুলিসকে ফোন করলাম।

ওহ! তারমানে ঝামেলা এসে দেখে চলে গেছে সব! ওদের আগেই ফারাম্পারকট এসে সূত্র খুঁজে নিয়ে চলে গেছে ভেবে হতাশ হয়ে পড়ল রবিন।

হ্যাঁ। নোটবুক বের করে কি কি সব টোকাটুকি করল। ভাবসাব দেখে মনে, হলো শার্লক হোমসের বাপ। আমাকে হুকুম দিল যাতে এ খবর কাউকে না বলি। ঝামেলাটা চিরকালই একটা হাঁদারাম। আমাকে ছাগল পেয়েছে আরকি। ওর কথায় আমি মুখ বন্ধ রাখি। আমার সব কাস্টোমারকে বলে দিয়েছি। যা পারে ও করুকগে এখন।

আপনি বাড়ির আশেপাশে কিছু দেখেছেন নাকি?

না। আশেপাশে ঘোরার সময়ই পাইনি। যখনই মনে হলো, বাড়িটাতে কিছু ঘটেছে, পুলিসকে ফোন করলাম। ভেতরে আমার মনে হয় কোন কিছুতে হাত দেয়া হয়নি। তোমরা তো গোয়েন্দাগিরি করো, নিশ্চয় বুঝতে পারছ আমি কিসের কথা বলছি।

মাথা ঝাঁকাল রবিন।

দুধওয়ালা চলে যাওয়ার পর আর দেরি করল না সে। সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল কিশোরকে খবরটা দেয়ার জন্যে।

কিশোরও আগ্রহী হয়ে উঠল। দুজনে মিলে রওনা হলো মুসাদের বাড়িতে। না না, তিনজনে মিলে। টিটুও চলল কিশোরের সাইকেলের ঝুড়িতে সওয়ার হয়ে। বাড়ি থেকে মুসা আর ফারিহাকে ডেকে নিয়ে চলে এল ওরা কনি হুবারের বাড়িতে।

হুবার ফেরেনি।

 কিশোর বলল, সূত্র খোজো সবাই। পায়ের ছাপ, পোড়া সিগারেটের গোড়া, ড্রেসার, জানালার কাছে হাতের ছাপ-এ সব। যে যা পাবে নোটবুকে লিখে রাখবে।

কিশোরকে ঘুরে আরেকদিকে রওনা হতে দেখে ফারিহা জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথায় যাচ্ছ?

জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরটা দেখব।

 জানালার পর্দা টানা। ভেতরে দেখা সম্ভব হলো না।

এক এক করে ছোট বাড়িটার জানালাগুলোয় উঁকি দিতে শুরু করল সে। কিন্তু একটা জানালা দিয়েও ভেতরে তাকানো গেল না।

সামনের দরজাটা বন্ধ। পেছনেরটাতেও তালা দেয়া।

পেছনের ভাঙা জানালাটার কাছে এসে দাঁড়াল সে। রান্নাঘরের জানালা। চোরই আসুক বা ডাকাত, এদিক দিয়েই ঢুকেছিল।

ভেতরে হাত ঢুকিয়ে পর্দাটা সরাল কিশোর। ঝড় বয়ে গেছে যেন ঘরের মধ্যে। ড্রেসার, টেবিলের প্রতিটি ড্রয়ার খুলে জিনিসপত্র মেঝেতে ছড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আলমারিগুলো খোলা। ওগুলোর জিনিসও সব মাটিতে।

কিছু একটা খোঁজা হয়েছে।

 কি জিনিস?

রান্নাঘর থেকে হঠাৎ একটা শব্দ শোনা গেল। বোঝা গেল না কিসের। কান পাতল সে। আবার শোনা গেল শব্দটা। ভাঙা জানালা দিয়ে ভেতরে তাকাল। দুটো জ্বলজ্বলে চোখ তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

মিআও! মিআও! ডাকল চোখের মালিক।

বেড়াল, কিশোর বলল। কি ভয় পেয়েছে দেখো। পেটে মনে হচ্ছে খিদে। খাবার দেয়ার কেউ নেই। বেচারা!।

বাড়ির কোণ ঘুরে এগিয়ে এল অন্যরা। হাতে নোটবুক।

কিশোর বলল, ঘরের মধ্যে একটা বেড়ালের বাচ্চাকে ফেলে দরজা আটকে দিয়ে গেছে। কি করা যায়?

বের করে নিয়ে এসো, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল ফারিহা।

কি করে? মুসার প্রশ্ন। সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ।

এই জানালাটা ভাঙা, দেখাল কিশোর। রুমাল জড়িয়ে নিলে ভাঙা কাঁচের ভেতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দেয়া যাবে। ছিটকানি খুলতে পারলে বের করে আনা যাবে বাচ্চাটাকে। এ ভাবেই জানালা খুলেছে চোর।

খোলো না তাহলে, রবিন বলল। ঝামেলা মনে হয় এখন আর আসবে না।

পকেট থেকে বড় একটা সাদা রুমাল বের করল কিশোর। আঙুলে শক্ত করে জড়াল। ভাঙা কাঁচের ফোকর দিয়ে ঢুকিয়ে দিল হাতটা। ছিটকানিটা খুঁজে পেয়ে বলল, পেয়েছি।

শার্সি খোলা এখন অতি সহজ। খুলে ফেলল ওটা।

চৌকাঠে উঠে বসল সে।

 সঙ্গে যাওয়ার জন্যে ঘেউ ঘেউ শুরু করল টিটু।

ধমক দিয়ে কিশোর বলল, এই, থামাও তো পাজিটাকে। ওর চিল্কারে কেউ কি হয়েছে দেখতে এলেই আর ঢুকতে পারব না।

তাড়াতাড়ি সবাই মিলে চেষ্টা চালিয়ে চুপ করাল টিটুকে।

কিশোর ঢুকে পড়ল ভেতরে। বেড়ালের বাচ্চাটা আলমারির একটা তাকে বসে আছে জড়সড় হয়ে। সে এগোতেই আরও ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই ভয়টা কেটে গেল যখন একবাটি দুধ এনে ওর সামনে রাখল কিশোর। ক্ষুধার্ত ভঙ্গিতে লপাত লপাত করে জিভ দিয়ে চেটে শেষ করে ফেলল দুধটা। তারপর পায়ের কাছে এসে মিউ মিউ করতে লাগল। কিন্তু যেই সে ধরতে গেল, ঘাবড়ে গেল আবার। এক দৌড়ে পালাল। ছুটে চলে গেল দরজা দিয়ে হলঘরে।

আই, পুষি, পুষি। আয়, আয়, ডাকল কিশোর।

 জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে মুসা জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?

পালিয়েছে।

তাড়াতাড়ি ধরো না। কেউ চলে এলে মুশকিল হবে।

খুঁজে বের করতে হবে তো আগে ওটাকে। তারপর না ধরা।

হলঘরে ঢুকল কিশোর। ওলটপালট হয়ে আছে জিনিসপত্র। কোট, জুতো, প্যান্ট, শার্ট এ সব জিনিস আলমারি আর একটা চেস্ট অভ ড্রয়ার থেকে বের করে ছড়িয়ে ফেলা হয়েছে মেঝেতে। বাচ্চাটাকে দেখতে পেল না। কোথায় যে গিয়ে লুকিয়েছে ওটা কে জানে। ঘর থেকে ঘরে ঘুরতে লাগল সে।

নিচে তিনটে ঘর। ওপরে তিনটে। সব কটার জিনিসপত্রের একই অবস্থা। ফায়ারপ্লেসের নিচে কালি পড়ে থাকতে দেখে বোঝা গেল যে-জিনিস খুঁজতে এসেছিল লোকটা, ওটার জন্যে চিমনির মধ্যেও ঢুকেছিল।

একটা বেডরূম থেকে বেরিয়ে আসতেই লাল জিনিসটা চোখে পড়ল ওর। তুলে নিল। দস্তানা। ছোটদের।

বিড়বিড় করল আনমনে, এখানে ছোট বাচ্চা এল কোত্থেকে? হুবার থাকে তো একা।

সন্দেহ হলো–কোনও শিশুকে কিডন্যাপ করে এনে এখানে লুকিয়ে রাখেনি তো হুবার, যার খোঁজে এসেছিল লোকটা?

আপনমনেই মাথা নাড়ল আবার। না, যত ছোট শিশুই হোক, তাকে ড্রয়ার কিংবা চিমনিতে খুজবে না লোকটা।

ছোটদের আর কোন পোশাক আছে কিনা খুঁজতে লাগল কিশোর। কিছুই নেই। যা আছে সব বড়দের, পুরুষ মানুষের।

দস্তানাটা পকেটে রেখে দিল সে। সূত্র। এক জোড়ার একটা। আরেকটা গেল কোথায়?

ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগল ওর কাছে। গতরাতে একটা শিশু ছিল এ বাড়িতে। মনে হয় তাড়াহুড়োয় কাপড় পরানো হয়েছে ওকে। একটা দস্তানা ভুলে পরানোই হয়নি। কিংবা ঠিকমত লাগেনি বলে খুলে পড়ে গেছে।

এই সময় কানে এল মুসার চাপা ডাক, কিশোর, জলদি বেরিয়ে এসো। ঝামেলা আসছে!

.

০২.

কিশোর নিচতলায় নামার আগেই কানে এল ফগ্যাম্পারকটের ধমক, ঝামেলা।

এই, তোমরা এখানে কি করছ? যাও, ভাগো!

তারপর শুরু হলো টিটুর চিৎকার, হই-চই। মুচকি হাসল কিশোর। নিশ্চয় এখন ফগের গোড়ালির পেছনে লেগেছে টিটু।

কোনদিক দিয়ে বেরোনো যায় ভাবল কিশোর।

বাড়ির পেছন দিকে চিৎকার শোনা যাচ্ছে ফগের, পুলিসের কাজে নাক গলাতে এসেছ তোমরা আইনের বিরোধিতা করছ। ভাল চাও তো যাও এখান থেকে। উফ, ঝামেলা!

কে বলল নাক গলাচ্ছি? প্রতিবাদ করল রবিন। পড়শীর বাড়িতে চোর ঢুকেছে শুনলাম, দেখতে এসেছি। এতে নাক গলানোর কি দেখলেন?

জবাব খুঁজে না পেয়ে খানিকক্ষণ আমতা আমতা করল ফগ। তারপর ধমকে উঠল, আবার কৈফিয়ত দেয়া হচ্ছে, না? জলদি সরাও ওই শয়তানটা কুত্তাটাকে! নইলে কিন্তু ভীষণ রেগে যাব বলে দিলাম!

নিশ্চয় গোড়ালি কামড়াতে চাইছে টিটু। ফগের চেহারা কি হয়েছে এখন কল্পনা করে হাসিতে পেট ফেটে যাবার অবস্থা হলো কিশোরের। অন্যদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দেখার সন্যে অস্থির হয়ে উঠল। আবার ভাবল, বেরোবে কোন পথে? ও যে ঘরে ঢুকেছে এটা দেখাতে চায় না ফগকে। তাহলে পেয়ে বসবে সে। নাক গলানোর ছুতোয় ওকে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে।

তোমাদের বড় বিচ্ছুটা কোথায়? আচমকা প্রশ্ন করল ফগ। এতক্ষণে খেয়াল করেছে কিশোর নেই ওখানে। নিজে নিজেই জবাব দিল, জ্বর নাকি? বাড়িতে পড়ে আছে? নিশ্চয় তাই। নইলে ওটারই তো আগে এসে এখানে হাজির হওয়ার কথা। সবার শেষে ধরুল ওকে, তাই না? ভাল হয়েছে। ওরকম শয়তানদের বিছানায় পড়ে থাকাই উচিত। আচ্ছা শিক্ষা হয় তাহলে। এখন যাও সবাই এখান থেকে। ভাগো। নইলে বাড়িতে গিয়ে নালিশ করব। ঝামেলা

বাড়িতে নালিশ করার হুমকিটা কাজে লাগল। মায়ের বকা খাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই মুসার। রবিনেরও না। মানে মানে সরে পড়ল তাই। কিশোরকে নিয়ে ভাবল না। ওর ব্যবস্থা ও করে নিতে পারবে। ফাঁকে ফাঁকি দিয়ে সহজেই বেরিয়ে আসতে পারবে ঘর থেকে।

কিন্তু অত সহজে পার পেল না কিশোর। সামনের দরজা খুলে বেরোতে যাবে, এই সময় তালা খোলার শব্দ শুনল। ফগ খুলছে। সরার সময় পেল না। পান্না খুলে গেল। সামনে কিশোরকে দেখে এমন ডলি করল ফগ মনে হলো মাথায় বাজ পড়েছে। হাঁ হয়ে গেল মুখ।

গুড মর্নিং, মিস্টার ফল, মসৃণ গলায় বলল কিশোর। আসুন, ঘরে আসুন।

আচমকা ফেটে পড়ল ফগ, ফগর‍্যাম্পারকট! তুমি এখানে কি করছ? ঝামেলা!

না, কোন ঝামেলা করছি না। বাইরে থেকে শুনলাম একটা বেড়ালছানা খিদেয় কাঁদছে। ওটাকে বাঁচানোর জন্যে ঢুকেছি।

অন্যের বাড়িতে লুকিয়ে ঢোকাটা বেআইনী। এর জন্যে আমি তোমাকে হাজতে ঢোকাতে পারি, জানো?

কিন্তু বেড়ালছানা…।

মিথ্যে বলে পার পাবে না! গর্জে উঠল ফগ। তোমাকে এবার বাগে পেয়েছি আমি, ছাড়ব না। বেড়াল-টেড়াল কিচ্ছু না। আসলে বাড়ি খালি পেয়ে চুরি করতে ঢুকেছিলে তুমি…

ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই মিআউ করে কিশোরের পায়ের কাছে এসে দাঁড়াল ছানাটা। প্রথম দর্শনেই অপছন্দ করল ফগকে। কটমট করে ওর দিকে তাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে হিসিয়ে উঠল।

হেসে বলল কিশোর, দেখলেন তো, মিথ্যে আমি বলিনি। বেড়ালটাই সাক্ষি।

বেড়ালটার দিকে মিটমিট করে তাকিয়ে রইল ফগ। ধমকে উঠল, যাও, এবারের মত ছেড়ে দিলাম। ভাগো ওটাকে নিয়ে। আমার জরুরী কাজ আছে এখানে। আর আসবে না, বলে দিচ্ছি।

বেড়ালের বাচ্চাটাকে নিয়ে সোজা মুসাদের বাড়ি রওনা হলো কিশোর। আশা করল, ওখানেই পাওয়া যাবে সবাইকে।

মুসাদের বাগানের ছাউনিতে অপেক্ষা করছে সবাই। কিশোরের সাড়া পেয়ে ছুটে বেরিয়ে এল টিটু। কোন কুকুরই বেড়াল দেখতে পারে না। টিটুও পারল না। তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দিল। ধমক দিয়ে ওকে চুপ করাল কিশোর। বাচ্চাটাকে তুলে দিল ফারিহার হাতে।

ছাউনির ভেতরে একটা বাক্সে ছানাটাকে বসিয়ে দিল ফারিহা, এমন জায়গায় যেখানে টিটু ওর নাগাল পাবে না।

ছাউনিতে ঢুকে একটা বাক্স টেনে সবার মুখোমুখি বসল কিশোর। জিজ্ঞেস করল, বাড়ির চারপাশ ঘুরে দেখেছ তো সবাই?

মুসা, ফারিহা, রবিন, তিনজনেই মাথা ঝাঁকাল।

সূত্র পেয়েছ?

একপাতা কাগজ বের করল রবিন। বলল, খুব বেশি কিছু না। এই যে, রিপোর্ট।

কাগজটা দেখল না কিশোর। মুখেই বলো। শুনি।

বাড়ির চারপাশ ঘুরে দেখেছি আমরা সবাই। কোনদিক দিয়ে চোর এসেছে, দেখেছি। সামনের গেট দিয়ে ঢোকেনি। বাগানের পেছনের দেয়াল টপকে এসেছে।

কি করে বুঝলে?

জুতোর ছাপ পেয়েছি। গম্ভীর হয়ে বসে গেছে মাটিতে। ওপর থেকে লাফিয়ে পড়লেই কেবল ওরকম দাগ পড়ার কথা।

হতে পারে। বলে যাও।

ওই একই জুতোর ছাপ এগিয়ে গেছে একটা ঝোঁপের ধার পর্যন্ত। ভেতরে লুকিয়ে বসেছিল। বুঝলাম, কারণ অনেকগুলো ছাপ দেখেছি ওখানে। ওখানে বসে নিশ্চয় বাড়ির দিকে চোখ রেখেছিল লোকটা।

ছাপের নকশা একে এনেছ?

নিশ্চয়ই, মুসা বলল। পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল। অনেক বড় পা লোকটার। এগারো নম্বর সাইজ। এই দেখো। নাইকি কোম্পানির জুতো। সোলের তলার নকশা আমার জুতোর মতই। একই জুতো। আমারটার সাইজ ওর। চেয়ে অনেক ছোট।

আর কি পেলে?

পকেট থেকে একটা সিগারেটের গোড়া বের করে দিল রবিন। এটা। মাটিতে পাতার নিচে পড়ে ছিল। সেজন্যেই ফগ দেখতে পায়নি।

ফগ ওখানে গিয়েছে কি করে জানলে?

অনেক জায়গায় ওর জুতোর ছাপ দেখেছি। সারা বাড়িতেই ঘুরেছে। ওর পা বিশাল। চোরটার চেয়েও বড়। দেখতে দেখতে মুখস্থ হয়ে গেছে। না চেনার কোন কারণ নেই। যাই হোক, আমার ধারণা, এ রকম সিগারেটের গোড়া আরও ছিল ওখানে। সে পেয়ে নিয়ে গেছে। এটা পাতার নিচে ছিল বলে দেখতে পায়নি।

তুমি পেলে কি করে?

আমি না। টিটু পেয়েছে। পাতার কাছে দাঁড়িয়ে গন্ধ শুঁকতে লাগল।

হাসল কিশোর। ও তো দেখি বড় গোয়েন্দা হয়ে গেছে।

 নিজের নাম শুনে কান খাড়া করে ফেলেছে টিটু।

ওর দিকে তাকিয়ে কিশোর বলল, ওস্তাদ হয়ে যাচ্ছিস তুই।

প্রশংসা বুঝতে পারল টিটু। লেজ নাড়তে লাগল।

 রবিনের দিকে ফিরল কিশোর, হ্যাঁ, আর কিছু?

ঝোঁপের ভেতর থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়েছে পায়ের ছাপ। ভাঙা জানালার নিচে গিয়ে থেমেছে। সুতরাং ওই জুতোর ছাপের মালিকই যে জানালা ভেঙে ঘরে ঢুকেছে, এটা অনুমান করতে অসুবিধে হয় না। একটা ইটের টুকরো পড়ে থাকতে দেখেছি জানালার নিচে। ওটা দিয়ে বাড়ি মেরেই কাঁচ ভেঙেছে সভবত।

ভাঙতে পারে, মাথা দোলাল কিশোর। এ ভাবে ভাঙলে শব্দ হবেই। কেউ শুনে থাকতে পারে। ঠিক আছে, খোঁজ নেয়া যাবে। বলো, আর কি পেয়েছ?

পায়ের ছাপ আরও আছে। তবে ওগুলো এমন সব জায়গায়, চোরের বলে মনে হলো না। সাইজেও মেলে না।

কোন্ কোন্ জায়গায়?

সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে ফুলের বেড় মাড়িয়ে পেছন দিকে চলে গেছে। আর ফিরে আসেনি। সামনের গেটের দিকেও যায়নি।

তারমানে কোন কারণে পেছন দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আর কেউ তো ও বাড়িতে থাকে না, সুতরাং এই ছাপগুলো কনি হুবারের হওয়ারই সম্ভাবনা।

ব্যস, এইই, কাগজটা ভাঁজ করে আবার পকেটে রেখে দিল রবিন।

.

০৩.

 নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করল কিশোর। এর অর্থ গভীর ভাবনা চলেছে তার মগজে। সূত্রগুলো নিয়ে ভাবছে।

এই সময় ওপরের বাক্সে নড়েচড়ে উঠল বেড়ালছানাটা। সেদিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ শুরু করল টিটু।

বিরক্ত হয়ে ধমক লাগাল কিশোর, আহ্, বড় বেশি বিরক্ত করিস! ও তোর কি করল যে ওকে.ধমকাচ্ছিস?

চুপ হয়ে গেল টিটু।

এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকাল কিশোর, যা বোঝা যাচ্ছে, ইবারের বাড়ি থেকে কেউ কোন জিনিস চুরি করে নিতে এসেছিল কাল রাতে।

কিন্তু নিজের বাড়ি থেকে হুবার ওভাবে পালাল কেন? মুসার প্রশ্ন।

তর্জনী তুলে নাড়ল কিশোর, তাড়াহুড়ো কোরো না। আসছি সেসব প্রশ্নে। হা, যা বলছিলাম। কাল রাতে একটা লোক হুবারের বাড়িতে ঢুকে ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে রইল। ও ভেবেছিল ওই সময় হুবার ঘুমিয়ে আছে। অসচেতন অবস্থায় পেয়ে যাবে ওকে। ঘুম থেকে ডেকে তুলে পিস্তল দেখিয়ে হুমকি দেবে। আদায় করে নেবে। যেটা নিতে এসেছে।

কিন্তু কোন কারণে হুবারকে চমকে দিতে পারেনি লোকটা। হতে পারে কাঁচ ভাঙার শব্দে জেগে গিয়েছিল হুবার। বিপদের গন্ধ পেয়েছিল। সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পাল্লাটা খোলা রেখেই অন্ধকারে পাগলের মত ছুটে পালিয়েছে…

কাল রাতে চাঁদ ছিল, মনে করিয়ে দিল ফারিহা। অন্ধকার ছিল না।

তা ঠিক, থ্যাংক ইউ। জ্যোৎস্নার মধ্যে পাগলের মত ছুটে পালিয়েছে। সঙ্গে করে নিয়ে গেছে লোকটা যে জিনিস নিতে এসেছিল সেটা। তারপর লোকটা ঘরে ঢুকে যখন দেখল পাখি পালিয়েছে, জিনিসটার জন্যে সারা ঘর তছনছ করে ফেলল।

জিনিসটা কি?

এখনও জানি না। তবে খুব বড় কিংবা ভারী কিছু নয়। তাহলে নিয়ে ছুটে পালাতে পারত না।

কি জিনিস অনুমানও করতে পারো না? জিজ্ঞেস করল ফারিহা। কিশোরের বুদ্ধির ওপর ওর বড় বেশি আস্থা। তার ধারণা, ঠিকই অনুমান করে ফেলতে পারবে কিশোর।

ঘরে ঢুকে একটা জিনিস পেয়েছি, পকেট থেকে লাল দস্তানাটা বের করল কিশোর।

জিনিসটার দিকে তাকিয়ে রইল সবাই। টিটু এগিয়ে এসে শুঁকতে লাগল।

ফারিহা বলে উঠল, এ তো পুতুলের দস্তানা! নাকি কোন বাচ্চার?

প্রথমে ভেবেছিলাম হুবার কোন শিশুকে কিডন্যাপ করে এনেছে। পরে বাদ দিয়েছি সম্ভাবনাটা। বাড়িতে এমন কিছু পেলাম না যাতে বোঝা যায় ওখানে কয়েকদিন একটা বাচ্চাকে রাখা হয়েছিল। শুধুই এই দস্তানাটা।

দস্তানাটা নেড়েচেড়ে দেখল রবিন। ঝকঝকে পরিষ্কার। বছর দুয়েকের কারও হাতে লাগবে বড়জোর। ফারিহা, তোমার বড় পুতুলটা কোথায়? ওই যে, পাঁচ বছরের জন্মদিনে পেয়েছিলে?

বাক্সে ভরে রেখে দিয়েছে, মুসা বলল। ও আর এখন পুতুল নিয়ে খেলে না।

আনব? উঠে দাঁড়াল ফারিহা।

নিয়ে এসো, কিশোর বলল। ফারিহা বেরিয়ে গেলে মুসা আর রবিনের দিকে ফিরল, চুরি করে ঢুকেছিল যে লোকটা তার পায়ের ছাপ একে এনেছ তোমরা। কিন্তু হুবারের ছাপ আনলে না কেন?

হাসল মুসা। গর্বিত ভঙ্গিতে বলল, এনেছি। তোমাকে দেখাতে ভুলে গিয়েছি। পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ভাঁজ খুলল। ছাপগুলো ছোট। কেমন চ্যাপ্টা আর অস্পষ্ট।

নীরবে ছবিটা দেখল কিশোর। বেডরূম স্লিপার পরেই পালিয়েছে হুবার। দেখো, গোড়ালি নেই। জুতো পরারই যখন সময় পায়নি, আমার ধারণা, কাপড় বদলানোরও সময় পায়নি। তারমানে অতিরিক্ত তাড়াহুড়া।

হ্যাঁ, ছাপ দেখে আমারও মনে হয়েছে স্লিপার, একমত হলো মুসা।

পুতুল নিয়ে ঢুকল ফারিহা। অনেক বড়।

ওটার হাতে দস্তানাটা পরানোর চেষ্টা করল কিশোর। আপনমনে বলল, যদি কোন শিশুরও হয়ে থাকে এটা, সে তোমার এই পুতুলটার চেয়ে বড় নয়, ফারিহা। বুঝতে পারছি না, এই দস্তানটা ফেলে গেল কিভাবে লোকটা? জিনিসটা আবার পকেটে রেখে দিল সে। থাকগে, পরে ভেবে দেখব।

কাজের মেয়েটাকে দিয়ে মুসা আর ফারিহাকে ডেকে পাঠালেন মুসার আম্মা। দুপুরের খাওয়ার সময় হয়েছে।

উঠে দাঁড়াল কিশোর। আমরাও বাড়ি যাই। রবিন, যাবে না?

মাথা ঝাঁকাল রবিন।

 মুসা জানতে চাইল, আমাদের মীটিং আবার কখন বসছে?

বিকেল সাড়ে তিনটায়। অবশ্য যদি তোমার আম্মা তোমাদেরকে জোর করে শুইয়ে না রাখেন। হয়তো বলতে পারেন–সবে জ্বর থেকে উঠলে, রেস্ট নাও।

তোমাকেও তো তোমার চাচী আটকে রাখতে পারেন?

 পারবে না। পালিয়ে আসব।

 তাহলে আমরাও পালিয়ে আসব, বুক ফুলিয়ে বলল ফারিহা।

ওপর থেকে মিউ করে জানান দিল বেড়ালের বাচ্চাটা, আমার কথা ভুলে গেলে নাকি?

খউ খউ করে উঠল টিটু, যেন বলতে চাইল, আরে না, সবাই ভুললেও আমি ভুলিনি!

রবিন জিজ্ঞেস করল, এটার কি হবে?

কিছুই হবে না। আমি ওকে পুষব, ফারিহা বলল।

যদি মা আবার বকাবকি শুরু না করে, বলল মুসা।

মুসার আম্মা যে জন্তু-জানোয়ার দেখতে পানেন না, এ কথা সবাই জানে। রবিন বলল, করলে আর কি করব। আমি বাড়ি নিয়ে যাব। একটা বাচ্চাকে না খাইয়ে রেখে মেরে তো আর ফেলা যায় না।

.

০৪.

 বিকেলে আবার মীটিং বসল মুসাদের ছাউনিতে। মুসার আম্মা কিংবা মেরিচাচী কেউই বাধা দেননি। ফলে বাধ্য হয়ে শুয়ে থাকা লাগেনি ওদের। বেঁচেছে।

আলোচনা শুরু করল কিশোর, লোকটা কিভাবে কাল হবারের বাড়িতে ঢুকেছিল, জানি আমরা। কিন্তু কি করে বেরিয়ে গিয়েছিল, জানি না। কেউ কিছু অনুমান করতে পারো?

পারি, জবাব দিল মুসা, সোজা সামনের দরজা খুলে বেরিয়ে চলে গেছে।

একটা জিনিস বোঝা যাচ্ছে, চাঁদনী রাতে প্রচুর ছোটাছুটি করেছে দুজন লোক। একজন বেরিয়েছে সামনে দিয়ে, আরেকজন পেছন দিয়ে দেয়াল টপকে। সামনের দরজা খোলা রেখে গেছে কোন একজন। বাতাসে খুলে আর বন্ধ হয়ে বাড়ি লেগে শব্দ হওয়ার যথেষ্ট সম্ভবনা আছে জেনেও সেই শব্দ কারও কানে যাওয়ার সভাবনাও বাদ দেয়া যায় না। এখন আমাদের খুঁজে বের করতে হবে, কার কানে গেছে সেই শব্দ।

কিভাবে? প্রশ্ন তুলল মুসা। জনে জনে গিয়ে তো আর জিজ্ঞেস করা যাবে না–এই মিয়া, তোমরা কি রাতের বেলা বিরাট পাওয়ালা এক লোক, আর নাইটগাউন পরা একজনকে লুকোচুরি খেলতে দেখেই? লোকে হাসবে না?

উপায় নেই, শান্তকণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। জিজ্ঞেস না করলে জানব কি করে তবে তুমি যে ভাবে কলছ ওভাবে করব না। জিজ্ঞেসও করব বেছে বেছে।

কি জিজ্ঞেস করবে?

বলব আমার এক আঙ্কেল পম আছে, রাতের বেলা ঘুমের মধ্যে হাঁটে। কাল রাতে বেরিয়ে গিয়েছিল। কোথায় গিয়েছিল, বলতে পারছে না। কেউ কি অচেনা কোন লোককে রাস্তায় হাঁটতে দেখেছ? কিংবা কোথাও যেতে দেখেছ তাকে?

তোমার আবার আসে পম এল কোত্থেকে?  

আছে। প্রয়োজনে শুধু পম নয়, আরেকজন আয়েস কমও এসে যাবে আমার। যার শখ, রাতের বেলা জোনাকি ধরা। কাল রাতে সেও বেরিয়েছিল জোনাকি ধরতে। তাকেও কেউ দেখেছে কিনা জিজ্ঞেস করব।

হাঁ হয়ে গেছে মুসা। তোমার এই আঙ্কেল পম আর বমের কথা তো কোনদিন আমাদের।

বলব কি? আমিও কি ছাই ওদের নাম শুনেছি নাকি? এইমাত্র বানিয়ে নিলাম। উদ্ভট কাণ্ডকারখানা করে তো দুজনেই। রাত দুপুরে যা খুশি করতে পারে। ওদের স্বভাবের কথা ব্যাখ্যা করে জিজ্ঞেস করলে লোকে আর হাসবে না।

হাসতে লাগল ফারিহা। নাম কি বানিয়েছ দুইধান, আহাহা! পম। বম। একজনকে নিশিতে পায়, আরেকজনের জোনাকি ধরার শখ। আসে কোধেকে তোমার মাথায় এ সব বুদ্ধি! হি-হি-হি-হি! হা-হা-হাহ!

মুসা আর রবিনও হাসছে।

মুসা বলল, তা তো বুঝলাম। কিন্তু জিজ্ঞেস করবে কাদের? সারা গায়েব সবাইকে করতে গেলে তো কয়েক মাস লেগে যাবে শুধু একটা প্রশ্নের জবাব। জানতেই।

সারা গাঁয়ের মানুষকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছে কে?

তাহলে?

নিশাচরদের জিজ্ঞেস করব।

এই তো শুরু হলো রহস্য করে কথা বলা!

আরি, সহজ করেই তো বললাম। নিশাচর মানুষদের চেনো না? চৌকিদার, চৌকিদার।

ওহ, জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। তাই বলো। ঠিক বলেছ। পড়লে ওদের চোখেই পড়তে পারে। রাতভর পাহারা দেয়। কিন্তু জিজ্ঞেস করলেই বলবে কেন?

বলবে, কারণ পম আর কম আমার চাচা।

তোমার চাচা। আমাদের তো নয়।

আমিই জিজ্ঞেস করব তাহলে। দিনের বেলা ওদের সাথে কথাই বলা যাবে না। সারারাত পাহারা দিয়ে দিনে ক্লান্ত হয়ে ঘুমায়। মেজাজ থাকে খারাপ। কথা জিজ্ঞেস করতে গেলে রেগে উঠতে পারে। তাই রাতেই দেখা করব। তখন তোমরা যেতে চাইলেও যেতে পারবে না। তোমাকে আর ফারিহাকে তো বেরোতে দেবেন না আন্টি, ভাল করেই জানি। জ্বর থেকে সরে উঠলে, ঠাণ্ডা লাগার ভয়েই বেরোতে দেবেন না। রবিনকেও বেরোতে দেবেন না ওর আম্মা। সে-ও জ্বর থেকে উঠেছে। বাকি রইলাম আমি আর টিটু। অতএব আমরাই বেরোব।

মেরিচাচী যদি বেরোতে না দেন?

চাচী আজ বাড়ি থাকবে না। রাতে একটা পার্টিতে চলে যাচ্ছে চাচা-চাচী দুজনেই। অতএব আমি ফ্রী।

 সত্যি, তোমার স্বাধীনতা দেখলে হিংসেই হয়! মুখ বিকৃত করে ফেলল মুসা, আমার মাটা যে কি! খালি পদে পদে বাগড়া!

রবিনের দিকে তাকাল কিশোর, রবিন, তোমাদের বাড়ি আর বারের বাড়ির মাঝখানের বাড়িটা কার?

কিটিদের।

বয়স?

আমাদেরই মত। কিছুটা বেশি হতে পারে।

করে কি?

স্কুলে পড়ে। পাখি দেখার শখ।

খাতির আছে তোমার সঙ্গে? নাহ, তেমন একটা নেই। দেখা হলে কেমন আছো, ভাল; বই নিয়ে দুচারটে কথা, এই পর্যন্ত। সে-ও বইয়ের পাগল। মাঝেমধ্যে আমার কাছে বই নিতে আসে। কেন?

যেহেতু হুবারের পাশের বাড়িতেই থাকে, তাকে গিয়েও জিজ্ঞেস করতে পারো গতরাতে কোন শব্দ শুনেছে কিনা, যেটা তার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়নি। একটা ছুতো করে চলে যেতে পারবে না?

মাথা কাত করল রবিন। আজই পারব। একটা পাখির বই হাতে করে নিয়ে যাব। লোভে চকচক করতে থাকবে ওর চোখ, আমি জানি। পড়ার জন্যে পাগল হয়ে যাবে। দেব, তবে তার আগে কথা আদায় করে নেব যতটা পারা যায়।

চুটুস করে চুটকি বাজাল কিশোর, ভাল বুদ্ধি! ঠিক আছে, তাই কোরো। জেনে এসে আমাকে ফোন করে জানিয়ো।

.

০৫.

 বাড়ি ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। তাড়াহুড়া করে একটা বই বের করে নিয়ে পাশের বাড়িতে রওনা হলো রবিন। পাওয়া গেল কিটিকে। সে নিজেই দরজা খুলে দিল। অবাক হলো রবিনকে দেখে। আরি, কি ব্যাপার, তুমি! আজ সূর্য পশ্চিম দিকে উঠল নাকি? এসো, এসো।

সূর্য ঠিক দিকেই উঠেছে, হাতের বইটা দেখাল রবিন। সেদিন বাবা কিনে এনে দিল এটা। ভাবলাম, তোমার তো পাখি খু। পছন্দ, হয়তো পড়তে ইনটারেসটেড হবে।

লোভী ছেলে রসগোল্লার দিকে যে দৃষ্টিতে তাকায় ঠিক সেই দৃষ্টি দেখা গেল কিটির চোখে। এসো, এসো, ঘরে এসো। আম্মা-আব্বা কেউ নেই বাড়িতে। চুটিয়ে গল্প করা যাবে। হাত বাড়াল, দেখি, বইটা?

ঘরে ঢুকেই বই খুলে বসল কিটি। ভঙ্গি দেখে মনে হলো চুটিয়ে গল্প করা বাদ দিয়ে এখন এই অবস্থায় যদি তাকে ফেলে যায় রবিন, তাহলেই খুশি হবে বেশি।

রবিন সেটা বুঝল। কিভাবে কথা শুরু করা যায় ভাবতে লাগল। সুযোগটা কিটিই তাকে করে দিল। বইয়ের একটা পাতা খুলে চিৎকার করে উঠল, আরে, পেঁচা? আর কি একখান ছবি দিয়েছে দেখো। দারুণ! র্দান্ত! ওই শোনো, পেঁচা ডাকছে। যেন বুঝতে পেরেছে আমি এখন ওর ছবি দেখছি। শুনতে পাচ্ছ?

কান পাতল রবিন। ডাকটা শুনতে পেল সে-ও! আজই প্রথম শুনলে? না কাল রাতেও শুনেছ?

রবিনের দিকে তাকাল কিটি। মাথা ঝাঁকাল। শুনেছি। জ্যোৎস্নায় ডানা ভাসিয়ে এসে বসল আমার জানালায়। মনে হলো যেন ওর সঙ্গে গিয়ে ইঁদুর ধরার দাওয়াত দিতে এসেছে আমাকে। কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে গেল। ওরা ডাকে খুব জোরে, কিন্তু ওড়ার সময় কোন শব্দ হয় না। ছায়ার মত ভেসে চলে যায়।

শব্দ করলে কি আর ইঁদুর বসে থাকত ধরা পড়ার জন্যে। ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ শুনলেই পালাত। আচ্ছা, যাই হোক, কটার সময় ডেকেছিল পেঁচাটা, মনে আছে?

অবাক হলো কিটি। কেন, তুমিও ওর ডাক শুনেছ নাকি? জবাবের অপেক্ষায় না থেকে চোখ আধবোজা করে ভাবতে লাগল, ডাকটা শুনেছি শুতে যাওয়ার ঠিক আগে। তখন বাজে দশটা। সাড়ে বারোটায় ঘুম ভেঙে গেল ওদের ডাকাডাকিতে। ওই সময়ই একটাকে দেখলাম জানালায় এসে বসতে। আস্তে করে বিছানা থেকে উঠে গেলাম ভালমত দেখার জন্যে।

তোমার বেডরূম কোনদিকে? আমাদের বাড়ির দিকে?

না, মিস্টার হুবারের। কাল রাতে চোর ঢুকেছিল ও বাড়িতে, জানো বোধহয়। কখন যে ঢুকল কে জানে। সাড়ে বারোটায় যখন জানালা দিয়ে তাকালাম, তখনও দেখি নিচতলায় আলো জ্বলছে। অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করেন মিস্টার হবার। মাঝে মাঝে জানালার পর্দা টানা থাকে না। ওই সময় দেখেছি টেবিলের সামনে বসে কি যেন করছেন। কাল রাতে রেডিও চালানো ছিল তার। শব্দ শুনেছি।

সাড়ে বারোটার পর আর কোন পেঁচা ডাকতে শোননি? সারারাতই তো শোনার কথা। চাঁদের আলো ছিল। নিশ্চয় ইঁদুর ধরেছে।

শুনেছি। পেঁচারা জ্যোৎস্না খুব ভালবাসে। অনেক রাতে আরেকবার ঘুম ভেঙে গেল আরেকটা শব্দে। কিসের শব্দ বুঝলাম না। আলো জ্বেলে ঘড়ি দেখলাম। সোয়া তিনটে বাজে। কয়েকটা বাদামী পেঁচা আর কয়েকটা ছোট পেঁচা ডাকাডাকি শুরু করল। ঝগড়া বাধিয়েছে মনে হলো।

ওই সময়ও কি হুবারের বাড়িতে আলো জ্বলতে দেখেছ?

দেখেছি। মজার ব্যাপার কি জানো, আলোটা দেখেছি রান্নাঘরে। ইলেকট্রিক আলো নয়। টর্চ কিংবা মোমবাতিটাতি হবে।

মনে মনে উত্তেজিত হয়ে উঠছে রবিন, কিন্তু সেটা বুঝতে দিল না কিটিকে। রান্নাঘরে আলো জ্বেলেছে নিয়ে সেই লোকটা, যে জানালা ভেঙে ঢুকেছে।

কিসের শব্দে ঘুম ভাঙল, বুঝতে পারনি? ভেবে দেখো তো, কাঁচ ভাঙার শব্দ কিনা?

তা হতে পারে, ভুরু কুঁচকে রবিনের দিকে তাকাল কিটি। চোর ঢোকার কথা ভাবছ নাকি তুমি? শোনো, কাঁচ ভাঙার শব্দই নি, আর যেটাই নি, আমার তাতে কোন আগ্রহ নেই। রান্নাঘরে কিসের আলো দেখেছি তা নিয়েও আমার মাথাব্যথা নেই। তা ছাড়া ঠিক ঠিক দেখেছি কিনা তাও বলতে পারব না। ঘুমের ঘোরে ভুলও দেখে থাকতে পারি।

অনেক কথা বলে ফেলেছে কেবল রবিনের কাছ থেকে টা পড়তে পাওয়ার কৃতজ্ঞতায়! আর নয়। বইয়ের পাতায় মুখ নামাল খাবার কিট।

আর কথা বলতে চায় না ও, বুঝল রবিন। উঠে দাঁড়াল। অনেক জেনেছে। এতটা জানতে পারবে আশা করেনি।

গুডবাই, কিটি।

গুড-বাই, বই থেকে মুখ না তুনেই জবাব দিল ফিটি। বইটা কবে ফেরত দেবে না দেবে কিছুই বলল না।

রবিনও কিছু জিজ্ঞেস করল না। দরজার দিকে হাঁটা দিল।

বাড়ি ফিরেই ফোন করল কিশোরকে। সব কথা জানাল।

বাহ্, অনেক কথা জেনে এসেছ তো, খুশি হলো কিশোর। বোঝা যাচ্ছে, জানালার কাঁচ ভেঙে রাত তিনটের পর লোকটা ঢুকেছিল হুবারের রান্নাঘরে, এবং তারপরে ছুটে পালিয়েছে হুবার। হয়তো সঙ্গে করে নিয়ে গেছে সেই জিনিসটা, যেটার জন্যে লোকটা এসেছিল।

আরও দুচারটা কথা বলে, রবিনকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রেখে দিল কিশোর। চৌকিদারদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে বেরোতে হবে তাকে।

০৬.

সকাল সকাল খেয়েদেয়ে তৈরি হয়ে নিল কিশোর। টিটুকে নেবে কিনা ভাবতে লাগল। প্রয়োজন মনে করল না। বরং রাতের বেলা ওকে সামলানোই ঝামেলা। ইঁদুর, ছুঁচো আর এ জাতীয় নিশাচর জীবের আনাগোনা হবে। সেটা কানে যাবে টিটুর। আর গেলেই হই-চই। তার চেয়ে রেখে যাওয়াটা ভাল মনে করল সে।

সে যে বেরোচ্ছে এটা বুঝতে দিল না টিটুকে। ঘরে আটকে রেখে বেরিয়ে চলে এল।

কোনদিকে যাবে?

পেছনের দেয়াল টপকে পালিয়েছে হুবার। সেদিকে নদী। অতএব প্রথমে নদীর দিকে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিল কিশোর। তবে তার আগে অনুমান করে নিতে হবে, ঠিক কোনদিকে গিয়েছে হুবার।

তাই চলে এল হুবারের বাড়ির পেছনে।

পুরো অন্ধকার হয়ে আছে বাড়িটা। পেছনের দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে রাস্তাটার দিকে তাকাল। ঘঁ, ঠিকই অনুমান করেছে। নদীর দিকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

হাঁটতে শুরু করল রাস্তা ধরে। এদিকে যে সব চৌকিদার পাহারা দেয় তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

আস্তে আস্তে হেঁটে চলল। চলে এল পথের শেষ মাথায়। এখানে রাস্তাটা ভাগ হয়ে দুটো পথ দুদিকে চলে গেছে। এদিক ওদিক তাকাল। কোনও চৌকিদার চোখে পড়ল না।

এখন কোনদিকে যাবে? ডানে, না বায়ে?

 ডানেরটাতে যাওয়াই ঠিক করল।

এবার ভাগ্য কিছুটা অসন্ন হলো। একসারি সাল গঠন জ্বলছে। তার মাঝে আবছামত দেখা যাচ্ছে চৌকিদারের কুঁড়ে। দরজায় একটা নড়াচড়া চোখে পড়ল। তারমানে কেউ আছে ওখানে।

কিশোর কাছাকাছি এগোতেই পায়ের শব্দ শুনে গলা বাড়িয়ে দিল লোকটা। জ্বলন্ত কয়লায় হাত সেঁকছে।

কাছে গিয়ে কিশোরও হাত দুটো ধরল কয়লার ওপর। উফ, একেবারে অবশ হয়ে গেছে। লোকটার দিকে তাকাল, কেমন আছেন?

কে হে তুমি? এত রাতে?

ঠেকা না থাকলে এই ঠাণ্ডার মধ্যে বেরোয় কোন পাগলে, প্রচণ্ড বিরক্তির ভান করে বলল কিশোর। নিজের পরিচয় দিল না। প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, কি আর বলব, কতগুলো উন্মাদ এসে জুটেছে বাড়িতে। এই যে আমার আঙ্কেল পমের কথাই ধরুন না। রাত দুপুরে ঘুমের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করার অভ্যেস। বলে নিশির ডাক। বাইরে বেরিয়ে কোথায় কোনদিকে চলে যায়, কোন ঠিকঠিকানা নেই। সকালে আর কিছু মনে করতে পারে না। বলুন তো কি কাণ্ড।

আজও বেরিয়েছে নাকি? জিজ্ঞেস করল চৌকিদার।

কাল রাতে বেরিয়েছিল। এদিকে এসেছিল নাকি, দেখেছেন? পাজামা পরা, পায়ে চটি। বিছানা থেকে নেমে বেরিয়েছে তো, ওগুলোই পরা ছিল। বড়জোর একটা কোট গায়ে দিয়ে থাকতে পারে। ঠাণ্ডা যে লাগে, এ ব্যাপারে পাগলেরও হুশ থাকে।

হেসে উঠল চৌকিদার। না, ওরকম কোন পাগলকে দেখিনি কাল। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে, যেন কেউ শুনে ফেলবে এই ভয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, শোনো, তোমাকে বলেই ফেলি-কাউকে বলে দিয়ো না আবার, ফগ শুনতে পেলে চাকরিটা যাবে-কাল রাতে আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তাই কিছু দেখিনি। এই ঠাণ্ডার মধ্যে কে যায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে, বলো। একটু চিন্তা করে নিয়ে বলল, তবে বুড়ো ক্যামার ঘুমায়নি। ও ঠিকমতই পাহারা দিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে নদীর দিকে চলে গিয়েছিল। ও নাকি পাজামা পরা এক লোককে দেখেছে। অত রাতে ওই পোশাকে নদীর ধারে লোকটাকে দেখে অবাক লেগেছে তার। সেজন্যেই বলেছে আমাকে। এখন বুঝলাম, পাগলটা কে। তোমার আঙ্কেল পম। পাগল বললাম বলে আবার কিছু মনে করলে না তো?

আরে না না। আমিই তো বললাম পাগল।

পাগল যখন জানোই, ঘরের মধ্যে রাতে তালা আটকে রাখো না কেন? নইলে কোনদিন রাতে নদীতে পড়ে ডুবে মরবে কে জানে।

এখন থেকে তাই করতে হবে। যাই, বুড়ো ক্যামারের সঙ্গেই কথা বলে আসি।

বুড়োকে কোথায় পাওয়া যাবে জেনে নিয়ে আবার রাস্তায় এসে উঠল কিশোর। কানে এল সাইকেলের বেলের পরিচিত শব্দ। রাস্তার মোড়ের লাইটপোস্টের আলোয় সাইকেল চালিয়ে আসতে দেখা গেল ফগর‍্যাম্পারকটকে।

চট করে একটা গাছের আড়ালে সরে গেল কিশোর। টিটুকে না এনে ভাল কাজ করেছে। ফগকে দেখলে আর ঠেকানো যেত না ওকে। চেঁচামেচি শুরু করে দিত। তাতে তদন্তের বারোটা বাজত।

কুঁড়ের কাছাকাছি গিয়ে সাইকেল থেকে নামল ফগ। এগিয়ে গেল চৌকিদারের সঙ্গে কথা বলার জন্যে।

গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল কিশোর।

আবার কতগুলো লাল আলো বুঝিয়ে দিল রাস্তার পাশে আরেকজন চৌকিদারের কুঁড়ে আছে। বুড়ো ক্যামারের আস্তানা। কাছেই নদী।

এই লোকও কিশোরকে চিনতে পারল না। নাম জিজ্ঞেস করল। বানিয়ে একটা নাম বলে দিল কিশোর। ওর ভয়, এখানেও এসে হাজির হতে পারে ফগ। বেরোনোর আর সময় পেল না ঝামেলাটা! ও যখন বেরিয়েছে একেবারে ঠিক তখনই! যাকগে, পুলিসের ডিউটি পুলিস করছে, সেটা তো আর ঠেকাতে পারবে না। বুড়ো ক্যামারকে তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করে জবাবগুলো জেনে নিয়ে এখন যত জলদি কেটে পড়া যায়।

আগের চৌকিদারের মত এত হাসিখুশি নয় বুড়ো ক্যামার। কথাও তেমন বলতে চায় না।

বুড়োকে আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করল কিশোর, আমার আঙ্কেল পমও রাতে ঘুমের ঘোরে হাঁটতে বেরিয়ে যেখানে আগুন দেখে সেখানেই হাত সেঁকতে বসে যায়।

কিশোরের আঙ্কেল পমের প্রতিও কোন আগ্রহ দেখাল না বুড়ো। নিশির ডাক কিংবা ঘুমের ঘোরে হাঁটা, কোনটাতেই ওর আকর্ষণ নেই।

কাল রাতে নিশ্চয় ওকে দেখেছেন আপনি, বলল কিশোর। পাজামা পরা। চটি পায়ে দিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। দেখুন দেখি কি কাও। এই শীতের মধ্যে ওই পোশাকে ঘর থেকে বেরোনো। পাগল আর কাকে বলে।

এতক্ষণে কিছুটা আগ্রহী মনে হলো বুড়োকে। মুখ খুলল, কাল রাতে দেখেছি আমি ওকে। পাজামা পরে দৌড়াচ্ছে। পাগলই মনে হয়েছিল আমার কাছে। এখন তো বুঝলাম ঠিকই অনুমান করেছি।

আমিও ঠিক অনুমানই করেছি–ভাবল কিশোর। নদীর দিকে দৌড়ে এসেছে। হুবার। পালাচ্ছিল। কিন্তু নদীতে কেন?

হাতে কিছু ছিল নাকি আমার আঙ্কেলের?

ছিল। জিনিসটা কি চিনতে পারিনি। নদীতে নেমেছিল মনে হলো। এই ঠাণ্ডার মধ্যে! আসলেই পাগল। তাহলে ওই লোক তোমার আঙ্কেল। প্রায়ই এ রকম বেরোয় নাকি?

বেরোয়। চাঁদনি রাতেই মাথা খারাপ হয় বেশি। এদিক দিয়ে আর ফিরতে দেখেননি নিশ্চয়?

না।

আবার প্রশ্ন করতে যাবে কিশোর, এই সময় কানে এল সাইকেলের বেলের শব্দ। এসে গেছে গগ। আর এখানে থাকা নিরাপদ নয়। বুড়োকে ধন্যবাদ দিয়ে উঠে এল তার কাছ থেকে। হঠাৎ ভাবনাটা এল মাথায়। ফগ কি বলে শোনা যাক না। দ্রুত আলোর কাছ থেকে সরে এসে ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল সে।

সাইকেল থেকে নামল ফল। কেমন আছো, ক্যামার?

 ভাল, মিস্টার ফগারকট। এত রাতে এখানে?

একটা কেস পেয়েছি, ক্যামার। সেটারই তদন্ত করছি। কাল রাতে সন্দেহজনক কাউকে এদিক দিয়ে যেতে দেবে নাকি?

দেখেছি। নিশিতে পাওয়া এক পাগলকে। শীতের মধ্যে পাজামা আর চটি পরে দৌড়াচ্ছিল।

ঝামেলা! কি বলছ! নিশিতে পাওয়া পাগল, এ কথা কে বলল তোমাকে?

একটা ছেলে। ওর আঙ্কেল পমের নাকি ঘুমের ঘোরে হাঁটার রোগ আছে।

ছেলেটা দেখতে কেমন?

আলোর কাছ থেকে সরে বসেছিল। ভালমত দেখিনি চেহারাটা। তবে মনে হলো চুলগুলো কোকড়া।

কোঁকড়া! প্রায় চিৎকার করে উঠল ফগ। তারমানে ওই বিচ্ছু ছেলেটাও তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। কঠোর কণ্ঠে বলল, শোনো, ক্যামার, শুনতে পাচ্ছো?

তা পাচ্ছি। আমি কানে খাটো হলে কি হবে, এতটা খাটো নই যে আপনার চিৎকার শুনতে পাব না।

ঝোঁপের মধ্যে বসে মুচকি হাসল কিশোর।

ঝামেলা! বেশি কথা বলো তুমি! ধমকে উঠল ফগ। যা বলি মন দিয়ে শোনো। কাল রাতের ওই পাগলটা আজও আবার এ পথে আসতে পারে। ওকে দেখলেই ধরে এনে আটকাবে। কথা আদায় করবে।

পাগল ধরতে গিয়ে শেষে মরব নাকি! মাথায় যদি বাড়ি মেরে বসে? আমি পারব না। আমার কাজ রাতে পাহারা দেয়া। দিচ্ছি, ব্যস। কাউকে আটক না করার জন্যে আমার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করতে পারবেন না।

হাসি চাপতে কষ্ট হলো কিশোরের।

ঝামেলা! ছেলেটা কোনদিকে গেছে?

 হাত তুলে দেখিয়ে দিল ক্যামার।

তারমানে বাড়ি যেতে হলে এ পথেই ফিরতে হবে কিশোর পাশাকে, বিড়বিড় করল ফগ। চিৎকার করে ক্যামারকে বলল, পাগল নাহয় নাই ধরলে। ছেলেটাকে তো ধরতে পারবে? এ পথ দিয়েই যাবে ও. তোমার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কাঁক করে কলার চেপে ধরে আটকাবে! তারপর যা করার আমি করব। আমি এই পথের মাথায়ই লুকিয়ে থাকল।

তাহলে আপনিই ধরছেন না কেন?

ঝামেলা! খালি তর্ক করে। আমি রছি না তার কারণ আমাকে দেখলেই ছোকরা দৌড়ে পালাবে। ধরার সুযোগ আর পাব না।

ধরে কি করবেন?

 সেটা আমার ব্যাপার, ধমকে উঠল ফগ!

চুপ করে ভাবতে লাগল ক্যামার। ফগকে চটিয়ে দিলে এই এলাকায় চাকরি করা কঠিন হয়ে পড়বে। অগত্যা রাজি হলো তার কথায়।

আবাঁর সাইকেলে চাপল ফগ। রাস্তা ধরে কিছুটা দূরে গিয়ে একটা বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল।

ঝোঁপের মধ্যে বসে সবই দেখতে পেল কিশোর। নীরবে খুব একচোট হেসে নিল। মনে মনে বলল, থাকো বসে ওখানে সারাত। বিচ্ছু ছেলেটাকে আর ধরতে হবে না।

টিটুকে সঙ্গে আনেনি বলে আরেকবার ধন্যবাদ দিল নিজের ভাগ্যকে। হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল ঝোঁপ থেকে। মাথা উঁচু করল না। নেমে পড়ল রাস্তার পাশের খাদে। ওটা পার হয়ে মাঠে উঠল। ঝোঁপঝাড় আর গাছপালার অভাব নেই। ওগুলোর আড়ালে আড়ালে এখন অনেক দূর চলে যেতে পারবে ফগ আর ক্যামারের চোখ এড়িয়ে। তারপর ঘুরে ফাঁকে পার হয়ে গিয়ে আরেক জায়গা দিয়ে রাস্তায় উঠে পড়লেই হলো। নিরাপদে চলে যেতে পারবে বাড়িতে।

.

০৭.

পরদিন সকালে নাস্তা করতে বসেছে কিশোর, এই সময় বাজল টেলিফোন। মিসেস বারজি এসে বলল, তোমার ফোন। রবিন করেছে।

একা সামলাতে পারেন না মেরিচাচী, তাই ঘরের কাজে সাহায্য করার জন্যে মিসেস বারজিকে রেখেছেন। মেরিচাচীরা যখন এখানে থাকেন না, রকি বীচে চলে যান, তখন গ্রীনহিলসের তাদের বাড়ি দেখাশোনার ভারও মহিলার ওপর।

এত সকালে ফোন! লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। নিশ্চয় নতুন কোন তথ্য কিংবা সূত্র পেয়েছে রবিন।

হালো?

কিশোর? ভেসে এল রবিনের উত্তেজিত গলা, হুবার ফিরে এসেছে। ফগ এখনও জানে না। তাই আগেভাগেই তোমাকে জানানো প্রয়োজন মনে করলাম।

তাই নাকি? খুব ভাল করেছ। কে বলল তোমাকে?

কিটি। সকালে বাগানে বেরিয়েছি। আমাকে দেখে এসে দেয়ালের ওপাশ থেকে কথা বলল। কাল রাতে নাকি পেঁচার ডাক শোনার জন্যে কান পেতে ছিল, এই সময় গেট খোলার আওয়াজ পায়।

কটার সময়?

রাত দুটো। চোর এসেছে ভেবে সঙ্গে সঙ্গে জানালায় গিয়ে দাঁড়ায়। দেখে চোর না, হবার। চাঁদের আলোয় চিনতে ভুল হয়নি ওর। বসার ঘরে ঢুকে আলো জ্বালে হুবার।

ওর পরনে কি ছিল?

ড্রেসিং-গাউনের মতই নাকি লেগেছে কিটির কাছে। হাতে কিছু ছিল না

তবে আগের রাতে বেরোনোর সময় একটা কিছু নিয়ে যে বেরিয়েছিল তে কোন সন্দেহ নেই। কাল রাতে চৌকিদার নিশ্চিত করেছে আমাকে এ ব্যাপারে।

তাহলে ওটা আর সঙ্গে আনেনি, রবিন বলল। কারণ হাতে যে কিছু ছিল না, এ ব্যাপারে কিটিও নিশ্চিত।

এক কাজ করো। মুসা আর ফারিহাকে ফোন করে তোমাদের বাড়িতে আসতে বলে দাও। আমি নাস্তা খেয়েই চলে আসছি। ঝামেলাও এ কেসের তদন্ত করছে। অনেকখানি এগিয়ে গেছে বলেই আমার ধারণা। আমরা যে পথে এগোচ্ছি, ঠিক সেই পথে সেও এগোচ্ছে…

কিশোর, তোর নাস্তা ঠাণ্ডা হয়ে গেল, ডাক দিলেন মেরিচাচী, জলদি আয়।

আসছি, মাউথপিসে হাতচাপা দিয়ে চিৎকার করে জবাব দিল সে। রাখি, রবিন। যা বললাম করো, রিসিভার নামিয়ে রাখতে গিয়ে মনে পড়ল কথাটা। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা, ফারিহাকে বোলো বেড়ালের বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়ে আসতে।

খাবারগুলো কোনমতে নাকেমুখে ওঁজে, সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল কিশোর। ঝুড়িতে বসিয়ে নিয়েছে টিটুকে। টপ স্পীডে রওনা হলো রবিনদের বাড়িতে।

পথে ফগকে দেখতে পেল। আরেক রাস্তা দিয়ে আসছে। তবে অনেক দূরে রয়েছে এখনও। কিশোরকে দেখে জোরে জোরে হাত নেড়ে থামতে ইঙ্গিত করল। নিশ্চয় আগের রাতের কথা জিজ্ঞেস করতে চায়।

থামল না কিশোর, যদিও আগের রাতে কতক্ষণ পর্যন্ত তার অপেক্ষায় বসে ছিল ফগ জানার খুব আগ্রহ। রবিনদের বাড়িতে না গিয়ে আরেকদিকে সাইকেল চালিয়ে দিল সে।

কিশোরকে ধরার জন্যে গতি বাড়িয়ে দিল ফগ। গায়ের জোরে প্যাডেল চাপতে লাগল।

কিশোরও বাড়িয়ে দিল গতি। মোড় ঘুরে এসে লাফ দিয়ে সাইকেল থেকে নেমে ঠেলে নিয়ে ঢুকে পড়ল একটা নির্জন বাড়ির বাগানে। বেড়ার পাশে লুকিয়ে বসল।

ফগও মোড়ের এ পাশে বেরিয়ে এল। লাল টকটকে হয়ে গেছে মুখ। হা করে হাঁপাচ্ছে। উড়ে চলে গেল যেন বেড়ার ওপাশের রাস্তা দিয়ে। কিশোর চুপ থাকতে বলল টিটুকে।

ফগ চলে গেলে বেরিয়ে এল কিশোর। সাইকেলে চেপে উল্টোদিকে রওনা হলো।

ঘামতে ঘামতে এসে রবিনদের বাড়িতে ঢুকল। ওর ঘরে ঢুকে দেখল মুসা, ফারিহা, রবিন সবাই ওর জন্যে অপেক্ষা করে বসে আছে। ফারিহার কোলে বেড়ালছানাটা। ওটাকে আদর করছে সে।

দেরি হওয়ার কারণ জানতে চাইল রবিন।

ঝামেলা পিছে লেগেছিল, জানাল কিশোর। হুবারের খবর কি?

ওকে দেখা যাচ্ছে না, রবিন বলল। নিশ্চয় বাড়িতে লুকিয়ে বসে আছে। বেড়াল আনতে বলেছিলে কেন? ওটা ফেরত দেয়ার ছুতোয় ওর সঙ্গে দেখা করার মতলব নাকি?

পারলে মন্দ হত না।

ও কি তোমাকে দেখলে খুশি হবে ভেবেছ?

না হলে না থোক। এ সুযোগ আমি হাতছাড়া করতে চাই না। ঝামেলার আগেই গিয়ে ওর সঙ্গে আমার কথা বলা দরকার।

ফারিহার হাত থেকে বেড়ালছানাটা নিল কিশোর। অমনি খউ বউ করে উঠল টিটু। ধমক দিল কিশোর, চুপ কর, হিংসুটে কোথাকার!

 বেরিয়ে এল সে। হুবারের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে দ্বিধা করতে লাগল। কোনদিক দিয়ে ঢুকবে? সামনে, না পেছন? একেবারেই নির্জন লাগছে বাড়িটা। কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। সে যে ফিরেছে এটা কি বুঝতে দিতে চাইছে না হুবার?

যা হোক কিছু একটা তাড়াতাড়ি করে ফেলা দরকার। এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। যে কোন সময় ফগ চলে আসতে পারে। পেছন দিয়ে যাওয়াই স্থির করল সে।

সামনের গেট দিয়ে ঢুকে সাবধানে পা টিপে টিপে ঘুরে বাড়ির পেছনে চলে এল। ভাঙা জানালাটার দিকে তাকাল। কাউকে চোখে পড়ল না। তারমানে লুকিয়ে থাকাই ঠিক করেছে হুবার। তাই যদি হয়ে থাকে সামনের গেটের বেল টিপলে দরজা খুলবে না। তাহলে কি করে ওকে বের করে আনবে?

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে আরম্ভ করল কিশোর। বনবন ঘুরতে লাগল যেন মগজের চাকাগুলো। বেড়ালছানাটার জন্যে উদ্বিগ্ন হবেই হুবার। জানালার ভাঙা ফোকরে মুখ রেখে বেড়ালের স্বর নকল করে ডেকে উঠল, মিআউ।

.

০৮.

 মিআউ! মিআউ! মিআউ।

ডেকেই চলল কিশোর। করুণ, ক্ষুধার্ত বেড়ালছানার ডাক। যে কারও হৃদয় ছুঁয়ে যাবে।

নিজের ডাক অন্যের মুখে শুনে প্রথমে কেমন অবাক হয়ে গেল ছানাটা। কিশোরের হাত থেকে ছুটে যাওয়ার জন্যে মোড়ামুড়ি শুরু করল। না পেরে সুর মিলিয়ে ডাকতে আরম্ভ করল মিআউ মিউ করে।

ফিসফিস করে ছানাটাকে উৎসাহ দিল কিশোর, গুড, চালিয়ে যা। আরও জোরে।

ওটাও চেঁচিয়েই চলল।

নিজে ডাকাডাকি বন্ধ করে কান পাতল কিশোর। ঘরের মধ্যে কোন শব্দ হয় কিনা শোনার চেষ্টা করল।

হ্যাঁ, শোনা যাচ্ছে। কেউ নড়ছে। হালকা পায়ের শব্দ। থেমে গেল। রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল একজন লোক, যেটা দিয়ে হলঘরে ঢোকা যায়।

এই লোকই নিশ্চয় হুবার–ভাবল কিশোর। ভাল করে তাকাল লোকটার দিকে। পরনে শার্ট-প্যান্ট। ড্রেসিং গাউন আশা করেছিল সে। এখনও কিশোর আর ছানাটাকে দেখতে পায়নি। রান্নাঘরের ভেতরে এদিক ওদিক চোখ বোলাচ্ছে। বুঝতে চাইছে কোনখান থেকে আসছে শব্দটা।

লোকটার বয়স খুব বেশি না। তরুণই বলা চলে। পাতলা মুখ। উজ্জল, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। চুল সুন্দর করে পেছন দিকে আঁচড়ানো। দেখে মনেই হয় না এই লোক রাত দুপুরে ভয়ে ঘর ছেড়ে পালাতে পারে।

মিআউ!

আবার কিশোরের হাত থেকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করল ছানাটা।

জানালার দিকে তাকাল নোকটা। কিশোরের কাধ আর মাথা চোখে পড়ল। বড় মানুষ ভেবে ঝট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে হলে ঢুকতে গিয়েও থেমে গেল। ফিরে তাকাল। ভাল করে দেখে বুঝল কিশোর বড় মানুষ নয়। ওর হাতে রয়েছে বেড়ালছানাটা।

ধীরে ধীরে এগিয়ে এল সে। ধরা পড়ে গিয়ে বিব্রত বোধ করছে যেন।

জানালার ফোকরের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কিশোর বলল, এটা আপনার বেড়াল? খিদেয় মিউ মিউ করছিল। বাড়ি নিয়ে গিয়ে খাইয়েছি।

হাত দিয়ে ডলে চুল সমান করল লোকটা। জবাব দিল, হ্যাঁ, আমার। দাঁড়াও, দরজাটা খুলে দিচ্ছি।

দরজার তালা আর ছিটকানি খুলল লোকটা। সাবধানে পাল্লা খুলে হাত বাড়াল, দাও।

কিশোর বুঝতে পারল, ছানাটা ওর হাতে দিলেই সঙ্গে সঙ্গে দরজা লাগিয়ে দেবে নোকটা। কথা বলার আর সুযোগ দেবে না। তাই ছানাটাকে আগের মতই ধরে রেখে বলল, আপনার ঘরে চোর ঢোকা নিয়ে গায়ে মহা উত্তেজনা। এখানে পুলিস এসেছিল, জানেন?

 অবাক মনে হলো হুবারকে। পুলিস! কেন? বাড়িতে যে লোক ছিল না জানল কি করে?

দ্রুত ভাবনা চলেছে কিশোরের মাথায়। দুধওয়ালা যে সারা গায়ে খবরটা রটিয়েছে, হবার তাহলে জানে না। ফগ এসে সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেছে এ কথাও জানে না। তার ধারণা, কেউ কিছু জানে না। এমনকি সে যে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল এ কথাও নয়।

কি হয়েছিল, বলছি সব, হুবারের পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল কিশোর।

বাধা দিল না হুবার। বরং কি ঘটেছিল শোনার জন্যে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। রান্নাঘরের দরজা লাগিয়ে দিল। কিশোরকে বসার ঘরে নিয়ে এল।

জিনিসপত্র সব এখন গোছগাছ করা। বাড়ি ফিরে আবার সব সাজিয়ে ফেলেছে হুবার।

বেড়ালটাকে ছেড়ে দিয়েছে কিশোর। মিউ মিউ করে ওদের পিছু নিল ওটা।

দুধ চাস নাকি? ছানাটাকে জিজ্ঞেস করল হবার। সরি, দিতে পারব না। দুধওয়ালা আসেনি আজ।

 পুলিস বোধহয় আসতে মানা করে দিয়েছে, একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল কিশোর। বলেছে আপনি বাড়ি নেই।

পুলিসের এত ঠেকা পড়ল কেন এসে খোঁজাখুজি করার? বিরক্ত হয়ে বলল হুবার। কেউ কি বাড়ি ফেলে দুচার দিনের জন্যে বাইরেও যেতে পারবে না?

পুলিস খবর পেয়েছে চোর ঢুকেছে আপনার বাড়িতে। জিনিসপত্র সব ওলটপালট হয়ে ছিল। হুবারের চোখের দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করল কিশোর, ওর কথা শুনে লোকটা চমকে যায় কিনা। জিজ্ঞেস করল, বাড়ি ঢুকে সব অগোছাল দেখতে পাননি?

দ্বিধা করতে লাগল হুবার। আর কিছু যেন বলতে চায় না। শেষে আমতা আমতা করে বলল, হ্যাঁ, তা পেয়েছি। কিন্তু পুলিশকে খবর দিল কে?

দুধওয়ালা। ছানাটাকে পায়ের কাছে ঘুরঘুর করতে দেখে কোলে তুলে নিয়ে আদর করল কিশোর। দুধ দিতে এসে দেখে সামনের দরজা খোলা। সন্দেহ হয় তার। ডাকাডাকি করে আপনাকে না পেয়ে ঘরে ঢুকে দেখে জিনিসপত্র সব তছনছ। তখন পুলিসকে খবর দেয় সে।

ও, তাই নাকি! আমি কিছুই জানতাম না।

বাড়ি থেকে কখন বেরিয়েছিলেন আপনি? আচমকা প্রশ্ন করল কিশোর। জবাবটা জানা আছে ওর। হুবার সত্যি বলে কিনা মিলিয়ে দেখতে চায়।

আবার দ্বিধা করতে লাগল হুবার। আগের রাতে। বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম। গতরাতে ফিরেছি। ফিরে দেখি জিনিসপত্র সব ছড়ানো। তবে কোন কিছু চুরি হয়নি। আমার অনুমতি ছাড়া এ ভাবে নাক গলানো উচিত হয়নি পুলিসের।

দরজা খোলা থাকাতেই এই বিপত্তিটা ঘটল আরকি। আপনি কি দরজা লাগিয়ে গিয়েছিলেন?

নিশ্চয়ই।

বিশ্বাস করল না কিশোর। রাতে কি চোর এসেছে সাড়া পাওয়ার পরে পালিয়েছিল নাকি, জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল। কিন্তু করল না। জানে, সত্যি জবাব পাবে না। এখন তো শার্ট-প্যান্ট পরা আছে। পায়ে জুতো। ড্রেসিং-গাউন আর স্লিপারটা কোথায় খুলে রেখেছে হুবার? ওপরতলায়? দেখতে পারলে হত।

জানালায় উঁকি দিল হেলমেট পরা একটা লাল টকটকে মুখ। ফার্যাম্পারকট।

চিৎকার করে উঠল হবার, কে? পুলিস। আবার এসেছে। এর একটা বিহিত না করলেই নয়!

ঠিক বলেছেন, স্যার, এর একটা বিহিত করা দরকার। ওদের জ্বালায় কোন মানুষ নিজের বাড়িতে শান্তিতে থাকতে পারবে না, তা কেন হবে?

রাস্তায় টহল দিতে বেরিয়ে এদিক দিয়েই যাচ্ছিল ফগ। হুবারের বাড়িটা চোখে পড়তে মনে হলো একবার উঁকি মেরে দেখে যায়। তাই দেখতে এসেছে।

হুবারের সঙ্গে কিশোরকে দেখে ওর গোল চোখ আরও গোল গোল হয়ে গেল। হা হয়ে গেল মুখ। আবার নাক গলাতে এসেছে ওই বিন্দু ছেলেটা! ওর আগেই এসে বসে আছে। চিৎকার করে হুবারকে বলল, দরজাটা খুলুন। আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।

জ্বলন্ত চোখে ফগের দিকে তাকাল হুবার। গটমট করে গিয়ে জানালার শার্সি খুলে দিল। কি কথা? এ ভাবে উঁকি মারছেন কেন? দেখছেন না একজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছি? কি দরকার আপনার?

ঝামেলা! বন্ধু! ওর মত একটা ছেলে আপনার বন্ধু?

অপমান করে কথা বলছেন কেন? দাঁড়ান, হেড অফিসে গিয়ে আমি রিপোর্ট করব আপনার নামে। আমি চোর-ডাকাত নই, বেআইনী কিছুই করিনি যে পুলিস বারবার আমার বাড়িতে আসবে।

ঝামেলা!…ইয়ে, ঝামেলা! কথা হারিয়ে ফেলল ফগ। কাশি দিল। ইয়ে…আপনার বাড়িতে চোরের উপদ্রব হয়েছিল…

হয়েছিল তো আপনার কি? আপনাকে কে উপদ্রব করতে বলেছে?

 অনেক কষ্টে হাসি চাপল কিশোর।

আপনার সামনের দরজা খোলা ছিল, কৈফিয়ত দেয়ার চেষ্টা করল ফগ। ভাবলাম…

কে ভাবতে বলেছে আপনাকে? ধমকে উঠল হুবার, যান, ভাঙন এখান থেকে!

আনন্দে ধেই ধেই করে নাচতে ইচ্ছে করল কিশোরের। হুবারকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করল। চিরকাল ওদেরকে যাও ভাগো বলে ধমকে এসেছে ফগ, এখন কেমন মজা? নিজের শুনতে কেমন লাগছে।

রেগে গেল ফগ। আহ..ইয়ে…ঝামেলা! আপনি কোনও প্রাণীকে বাড়িতে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ফেলে যেতে পারেন না। সেটা অমানবিক। বেআইনী।

 বেড়ালছানাটা ক্ষুধার্ত ছিল না! বলে ফগের মুখের ওপর শার্সিটা লাগিয়ে দিতে গেল হুবার।

চট করে রোমশ একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে ঠেকাল ফগ। ছানাটা নাহয় ছিল না। কিন্তু কুকুরটা? শুয়োরটা?

ভুরু কুঁচকে ফগের দিকে তাকিয়ে রইল হুবার। কি বলছেন আপনি, কনস্টেবল? কিসের কুকুর? কিসের শুয়োর? পাগল হয়ে গেলেন নাকি?

পাগল, না? ঝামেলা! শুধু কুকুর আর শুয়োরের ডাকই শোনা যায়নি, একটা শিশুর কান্নাও শোনা গেছে এ বাড়িতে। চিৎকার করে ওর মাকে ডাকছিল।

হুবারের চেহারা দেখে মনে হলো, ফগ যে পাগল হয়ে গেছে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই তার আর।

কিশোর ভাবল, এইই সুযোগ। ওরা দুজন কথা কাটাকাটি করতে থাক। সে গিয়ে ওপরতলাটা দেখে আসতে পারে। একটা মুহূর্ত দেরি করল না আর। বেড়ালছানাটাকে নিয়ে রওনা দিল সিঁড়ির দিকে। সঙ্গে নেয়ার কারণ–হুবার জিজ্ঞেস করলে ছুতো দেবে, তার কোল থেকে নেমে পালাচ্ছিল এটা, ধরার জন্যে সেও ছুটেছে পেছনে।

নিচতলায় ফগ আর হুবারের চিৎকার বেড়েছে। একটা কথা ভেবে কিশোরেরও অবাক লাগল, কুকুর, শুয়োর আর শিশুর কান্নার কথা কার কাছে শুনল ফগ? চুরি হওয়ার খবর শুনে ওরাও তো এসেছিল এ বাড়িতে। কই, বেড়ালছানাটা ছাড়া আর কোন জন্তু-জানোয়ার তো দেখেনি?

তবে কি কিটিকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিল ফগ? লোকটাকে দেখতে পারে না বলে বানিয়ে বানিয়ে উল্টোপাল্টা বলে দিয়েছে কিটি?

হ্যাঁ, তাই হবে। মুচকি হাসল কিশোর।

ওপরতলার যে ঘরটায় ঢুকল সে প্রথম, সেটাও গোছগাছ করা। গুছিয়ে ফেলেছে হবার। ওর স্লিপার আর ড্রেসিং-গাউনটা খোঁজায় মন দিল সে।

.

০৯.

ঘরের চারপাশে চোখ বোলাল কিশোর। একটা স্লিপারও চোখে পড়ল না। না না, আছে। একজোড়া লাল স্লিপার।

উল্টে দেখতে লাগল সে।

কাদা লাগা। প্রচুর কাদা। এগুলো পায়ে দিয়ে রাস্তায় হেঁটেছে হুবার, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

খাটের নিচ থেকে টেনে বের করল একটা লাল-সাদা পাজামা। ঠোঁট গোল করে শিস দিয়ে উঠল। পাজামার নিচের দিকটায় কাদামাখা। আপনমনে মাথা ঝকাল সে। এই কাদা কোথা থেকে এসেছে, ওর জানা।

নদীর কিনার থেকে।

এবার ড্রেসিং-গাউনটা দরকার। পাওয়া গেল ওটাও। একটা উঁচু আলমারির মধ্যে। ওটাও নোংরা। তবে তাতে কাদার বদলে খড়ের টুকরো লেগে আছে। ড্রেসিং-গাউনটা পরে কোথায় ঢুকেছিল হুবার?

আস্তে করে আলমারির দরজাটা লাগিয়ে দিল কিশোর।

মোটেও বন্ধুর বাড়িতে যায়নি হুবার, ভাবল সে। বন্ধু কি আর তাকে খড়ের গাদায় শুতে দিয়েছিল নাকি। আসলে খড় আছে এমন কোনখানে ঢুকে লুকিয়েছিল সে। গোলাঘরে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। রাতে রাস্তাঘাট সব নির্জন হলে ওখান থেকে বেরিয়ে চুপচাপ বাড়ি ফিরে এসেছে। চৌকিদার কি ফিরতে দেখেছে ওকে? তাহলে ভাববে আমার আঙ্কেল পম। হাহ হাহ!

নিচতলার গরম গরম কথাবার্তা থেমে গেল।

দড়াম করে একটা জানালা বন্ধ হওয়ার শব্দ হলো। মেঝেতে চার হাতপায়ে ভর দিয়ে উপুড় হয়ে ডাকতে আরম্ভ করল কিশোর, পুষি, পুষি, অ্যাই পুষি!

সিঁড়িতে একটা ডাক শোনা গেল, ওখানে কি করছ? জলদি নেমে এসো।

ঘর থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে বলল, সরি। বেড়ালছানাটা কোথায় জানি পালাল।

এই তো, নিচেই নেমে এসেছে, তপ্ত কণ্ঠে হুবার বলল। এবার তুমিও বেরোও। ছানাটাকে খাওয়ানোর জন্যে ধন্যবাদ। ওই নাকগলানো স্বভাবের পুলিসটাকে দেখে নেব আমি। ওর বিরুদ্ধে রিপোর্ট না করেছি তো আমার নাম হুবার নয়।

যাচ্ছি, স্যার, নিরীহ কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর।

রাগ কমছে না হুবারের। লোকটা একটা আস্ত পাগল। কোন এক কিটি নাকি তাকে বলেছে আমার বাড়িতে কুকুর, শুয়োর আর বাচ্চা শিশুর কান্না শুনেছে। কেউ কিছু বলল আর অমনি বিশ্বাস করে বসতে হবে?

পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করে সিগারেট ধরাল হবার।

পেট ফেটে হাসি আসছে কিশোরের। চারপাশে তাকাল। আর কিছু দেখার নেই এ বাড়িতে। নতুন কিছু আর বলারও নেই হুবারের। অতএব কেটে পড়া যায়।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে বলল, যাচ্ছি, স্যার। আপনি চলে এসেছেন, ছানাটার আর কোন অসুবিধে হবে না।

না, হবে না, কর্কশ কন্ঠে জবাব দিল হুবার। এখন যাও তো। আমাকে একটু শান্তিতে একা থাকতে দাও।

বেরিয়ে এল কিশোর। শিস দিতে দিতে এগোল গেটের দিকে। হুবারের বাড়িতে ঢুকে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। ফগের চেয়ে অনেক বেশি জানে এখন সে। ফগ ওবাড়িতে ঢুকতেও পারেনি, কাদামাখা স্লিপার আর পাজামাটাও দেখেনি।

গেটের বাইরে বেরোতেই পড়ল ফগের মুখোমুখি। অপেক্ষা করছিল সে। ঝামেলা!

কিসের ঝামেলা? যেন কিছুই বুঝতে পারছে না কিশোর।

লাল হয়ে গেল ফগের গাল। কটমট করে তাকাল কিশোরের দিকে। তাহলে তুমি ওই লোকটার বন্ধু। জবর খবর। তোমার মত পাজি ছেলে যে কোন বড় মানুষের বন্ধু হতে পারে, ভাবতেই অবাক লাগছে।

শুনে খুশি হলাম।

ঠাস করে চড় মারার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে রোধ করল ফগ। যতই চালাকি করো, বিচ্ছু, এবার আর পার পাবে না। তোমার নামেও রিপোর্ট লিখব আমি।

কেন, আমি আবার কি করলাম?

কি করেছ, থানায় গিয়ে রুলের শুতে খেলেই বুঝবে।

রিপোর্টটা কি লিখবেন সেটাই তো বুঝলাম না। কাল রাতে চৌকিদার কিছু বলেছে বুঝি আমার নামে? আমি তো বেআইনী কিছু করিনি। আমার আঙ্কেল পমকে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। সাবধান, তার সঙ্গে ঝামেলা করতে যাবেন না, মাথা খারাপ লোক..

ঝামেলা! আগে বাড়ল ফগ। কিশোরকে টেনে টেনে ছিঁড়তে পারলে এখন জালা কমত তার। জীবনে এত রাগা বোধহয় আর রাগেনি। বাধা না পেলে নিজেকে সামলাতে পারত না, হাত তুলে বসত। তারপর পড়ত আরও ঝামেলায়। টিটু ওকে বাঁচিয়ে দিল। বউ খউ করতে করতে ঘণ্টায় ষাট মাইল বেগে তেড়ে এল গোড়ালি কামড়ানোর জন্যে।

আর সবাই যেমন তেমন, টিটুকে পরোয়া না করে উপায় নেই। সোজা সাইকেলের দিকে দৌড় দিল ফগ। লাফ দিয়ে উঠে তাড়াহুড়ো করে প্যাডেল চাপতে গিয়ে একটা পা গেল ফসকে। ঋকি লাগল। আরেকটু হলে কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছিল সে।

পেছন পেছন খানিকদূর দৌড়ে গেল টিটু। তারপর ফিরে এল।

হাসতে হাসতে পেট চেপে ধরে রাস্তার ওপরই গড়াগড়ি খেতে লাগল কিশোর।

হুবারের বাড়িতে গিয়ে কি করল কিশোর, জানার জন্যে অস্থির হয়ে আছে সবাই। তাই হাসিটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।

হু, তোমার অনুমান দেখা যাচ্ছে সবই ঠিক, শোনার পর মাথা দুলিয়ে বলল ফারিহা। পাজামা আর স্লিপার পরেই পালিয়েছিল হুবার। কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থেকেছিল।

এবং সঙ্গে করে কোন জিনিস নিয়ে গিয়েছিল, যোগ করল কিশোর। কিন্তু ফিরে যখন এলকিটির কথা অনুযায়ী–তার হাতে তখন আর কোন কিছু ছিল না। তারমানে জিনিসটা কোথাও লুকিয়ে রেখে এসেছে।

নিশ্চয় কোন খড়ের গাদায়, রবিন বলল। গ্রীনহিলসে ওগুলোর অভাব নেই। অসংখ্য খড়ের গাদা আর গোলাঘর আছে। কোনটাতে রাখল?

জানি না। প্রয়োজন হলে খুঁজে বের করতে হবে, জবাব দিল কিশোর। হাতে সময় আমাদের কম। স্কুল খুলতে আর বেশি বাকি নেই। তার আগেই কাজ সারতে হবে।

কিন্তু কি করে কাজটা সারবে, অর্থাৎ প্রয়োজন দেখা দিলে জিনিসটা খুঁজে বের করবে, কারও মাথায় ঢুকল না। গ্রীনহিলসের সমস্ত খড়ের গাদা আর গোলাঘরে জিনিসটা খুঁজে বেড়ানো খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার চেয়ে কঠিন। তা ছাড়া ওরা জানেও না কি জিনিস হাতে করে নিয়ে গিয়েছিল হুবার।

যাই হোক, ওটা নিয়ে মাথা ঘামানোর আগে গত রাতে চৌকিদারদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কি করে এসেছে কিশোর, ফগকে কিভাবে হেনস্তা করেছে, কলার সুযোগ পেল এতক্ষণে।

শুরু হলো আরেকবার হাসাহাসি।

হাসতে হাসতে ফারিহা বলল, কিশোর, তুমি না, সত্যি কি বলব..হি-হি-হি। ওই ফগটাও হলো একটা আস্ত বোকা, তোমার পিছে লাগতে যায়। নিশ্চয় কাল সারারাত নদীর ধারে ঠাণ্ডার মধ্যে বসে থেকেছে তোমাকে ধরার জন্যে।

হয়তো, কিশোরও হাসছে। বুড়ো ক্যামারকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেই সব জানা যাবে।

চলো না গিয়ে জিজ্ঞেস করা যাক, প্রস্তাব দিল মুসা। হাতে তো কোন কাজ নেই আমাদের। সময় কাটবে।

রাজি হয়ে গেল সবাই।

.

১০.

 নদীর পাড়ে গিয়ে দেখল বুজে ক্যামারের কুঁড়ের দরজা বন্ধ। সারারাত জেগে থেকে এখন নিচয় ঘুমাচ্ছে সে। এই কথাটা কারও মনে হয়নি আগে। ডাকাডাকি করাটাও উচিত হবে না এখন।

নিরাশ হয়ে ফিরে যাবার কথা ভাবছে, এই সময় মুসা দেখল নদীর পাড়ে একটা ছাউনির ধারে নৌকার তলায় আলকাতরা লাগাচ্ছে তার এক পরিচিত মাঝি। নাম ওয়ালি উইলবার্ন। পাশে বসে আছে ওর টেরিয়ার কুকুরটা।

কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলল মুসা, দাড়াও, পাওয়া গেছে লোক। জিজ্ঞেস করে আসি।

সাইকেল রেখে মুসার পেছন পেছন চলল বাকি সবাই।

 লোকটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল মুসা।

 টিটুকে দেখে এগিয়ে এল টেরিয়ার কুকুরটা।

ব্রাশ ডলা থামিয়ে মুখ ফিরিয়ে ওর দিকে তাকান ওয়ালি। হেসে জিজ্ঞেস করল, কি, স্কুল শুরু হয়নি এখনও?

না। আর অল্প কদিন বাকি।

এ সময়ে নদীর পাড়ে কি মনে করে?

একজন লোকের খবর নিতে এসেছি।

কে?

ওর চাচা, কিশোরকে দেখাল মুসা, আঙ্কেল পম। রাতে ঘুমের মধ্যেই উঠে হাঁটতে বেরিয়ে যান। কোথায় যান, কি করেন, কোন ঠিকঠিকানা থাকে না। পরশুদিন রাতেও নাকি বেরিয়েছিলেন। কিশোরদের কাজের মেয়েটা জানালার বাইরে তাকিয়েছিল, সাহেবের হাতে একটা জিনিস ছিল দেখেছে। কি জিনিস, চিনতে পারেনি। পরদিন সেকথা আর মনে করতে পারলেন না আঙ্কেল পম। আমাদের পাঠিয়েছেন খোঁজ নিতে। বলেছেন, জিনিসটা খুঁজে বের করে দিতে পারলে পুরস্কার দেবেন।

আগ্রহী মনে হলে ওয়ালিকে। কোথায় খুঁজতে হবে বলেছেন কিছু?

ছোট্ট একটা সূত্র দিতে পেরেছেন। রাতে বেরিয়ে যেদিকে গিয়েছিলেন তিনি, সেদিকে নাকি শুধু পানি আর পানি দেখেছেন। পরদিন তার স্যাণ্ডেল আর কাপড়েও কাদা পাওয়া গেছে।

অবাক হয়ে মুসার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর আর রবিন। বুঝতে পারছে না, কোনদিকে এগোচ্ছে সে।

পানিতে ফেলে দেননি তো? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল ওয়ালি।

সেটাই তো জানতে এলাম। নদীর পাড়ে থাকেন। রাতে এদিকে কেউ এলে হয়তো চোখে পড়তে পারে।

মুসার উদ্দেশ্য এতক্ষণে বুঝতে পারল কিশোর। হুবার জিনিসটা এনে নদীর পাড়ে কোথাও লুকিয়েছে কিনা, কিংবা পানিতে ফেলে দিয়েছে কিনা, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন করে সেটা জানতে চাইছে। বাহু, মাথাটা তো ভালই খেলছে মুসার-মনে মনে প্রশংসা করল সে। যেহেতু নদীর দিকে এসেছিল হুর, তার স্লিপার আর পাজামায় কাদাও লেগে আছে, জিনিসটা নদীর পাড়েই কোথাও লুকিয়ে রেখে যাওয়াটা অসম্ভব নয়। কিংবা পানিতে ফেলে দিতে পারে।

আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইল কিশোর, ওয়ালি কি জবাব দেয় শোনার জন্যে।

মাথা নাড়ল ওয়ালি, না, রাতে কাউকে দেখিনি। তবে কাল রাতে চেঁচামেচি শুনে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। শুনি, বুড়ো ক্যামারকে ধমকাচ্ছে ফগর‍্যাম্পারকট। কোন একটা ছেলেকে নাকি ধরতে চেয়েছে, ধরতে পারেনি বলেই রাগ।

পরস্পরের দিকে তাকাল গোয়েন্দারা। সবার মুখেই হাসি।

আর কি শুনলেন? জানতে চাইল মুসা।

না, আর কিছু না। কিছুক্ষণ পর বুড়োকে কড়া নজর রাখার হুকুম দিয়ে চলে গেল ফগ। আজ সকালে এসে হাজির আমার কাছে। নৌকাটা রেডি করে দিতে বলেছে। ভাড়া নেবে।

কেন?

কি জানি? বলল, দরকার, রেডি করে রাখতে। বা হাতে কানের গোড়া চুলকাল ওয়ালি। আজ যেন আমার নৌকা আর বোটকের দাম বেড়ে গেছে হঠাৎ করে।

কান খাড়া করে ফেল কিশোর, মানে?

আরও একজন এসেছিল নৌকা আর বোট-হুক চাইতে।

কে? হুবার নাকি? পানিতে ডুবিয়ে রাখা বস্তায় ভরা জিনিস বা ওই রকম কিছু খুঁজে বের করার জন্যে অনেক সময় বোট-হুক ব্যবহার করে লোকে। ফগ আর হুবার দুজনেই হুকটা চায়, তারমানে দুজনেই পানিতে খুঁজতে বেরোবে মনে হচ্ছে। ফগকে যতটা মাথামোটা ভাবে ওরা, আসলে ততটা নয়। সেও অনুমান করে বসে আছে নদীর দিকেই এসেছিল হুবার, হাতের জিনিসটা পানিতে ফেলে গেছে। একটা ব্যাপার নিশ্চিত হওয়া গেল–হুবার যে খড়ের গাদায় গিয়ে শুয়ে ছিল, এ কথা এখনও জানে না ফগ।

এই দ্বিতীয় লোকটা কে? জানতে চাইল কিশোর।

চিনি না, জনমেও দেখিনি, জবাব দিল ওয়ালি। বিশালদেহী এক লোক। গায়ের রঙ বাদামী। গালে একটা কাটা দাগ। একটা চোখেও গোলমাল আছে। দশটা ডলার বাড়িয়ে দিয়ে আমার সবচেয়ে লম্বা হুকটা ভাড়া নিতে চাইল। বোঝে ঠেলা, একটা বোট-হুঁকের জন্যে দশ ডলার দিতে চায়। লোকটাকে পাগল মনে হয়েছে আমার। নিজেকে পরিচয় দিল বিজ্ঞানী বলে। পানির নিচে জন্মে থাকা উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করবে।

তাই, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা শুরু হয়ে গেছে কিশোরের। দ্বিতীয় লোকটা বার নয়। তাহলে কে? নিশ্চয় সেই লোকটা, যে বারো নম্বর জুতো পায়ে দেয়, চুরি করে সেদিন হুবারের বাড়িতে ঢুকেছিল যে।

ওয়ালিকে ধন্যবাদ দিয়ে সবাইকে নিয়ে ওখান থেকে সরে এল কিশোর।

টিটুর সঙ্গে আসতে চাইল টেরিয়ারটা। কয়েক মিনিটেই ভাল খাতির হয়ে গেছে। ডেকে ওকে ফিরিয়ে নিল ওয়ালি।

ওদের সাইকেলগুলোর কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর। ফিরে তাকাল বন্ধুদের দিকে, জলজ উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহের গল্পটা বিশ্বাস করেছ?

এক বিন্দুও না, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল রবিন। আমার মনে হয় সেই চোরটা। সেও সন্দেহ করেছে, হবার নদীর দিকে এসেছে, হাতের জিনিসটা পানিতে ফেলে দিয়েছে।

ফগেরও একই সন্দেহ।

আমি যাব না, বলে উঠল ফারিহা। ঝামেলা নদীতে নেমে কি করে না দেখে আমি যাব না এখান থেকে।

খানিক চিন্তা করে কিশোর বলল, এক কাজ করা যাক, তোমরা গিয়ে বসে থাকো ওয়ালির ছাউনিতে। ফগ এসে কি করে দেখবে। আমি থাকব না। আমাকে দেখলেই ভীষণ রেগে যাবে সে। কি করে বসে ঠিক নেই।

তুমি কোথায় যাবে? জানতে চাইল মুসা।

ওই দ্বিতীয় লোকটাকে খুঁজে বের করা যায় কিনা দেখি।

 কিভাবে?

জবাব না দিয়ে কিশোর বলল, এসো, সাইকেলগুলো লুকিয়ে ফেলা যাক। ফগ যাতে এসেই দেখে না ফেলে।

ঝোঁপের মধ্যে সাইকেলগুলো লুকিয়ে আবার ছাউনির কাছে ফিরে এল ওরা।

 মুখ তুলে তাকাল ওয়ালি, কি?

আমরা ঠিক করেছি, আজ নদীতে পিকনিক করব। আপনার ছোট নৌকাটা দরকার। ফগ কাজ সেরে চলে যাবার পরেই নাহয় নেব।

হেসে ফেলল ওয়ালি, বোট-হুক লাগবে না?

কিশোরও হাসল, না। জলজ উদ্ভিদে আমারও খুব আগ্রহ। তবে ওই বিজ্ঞানীর মত এত কষ্ট করার কোন ইচ্ছে নেই। বরং তাকে খুঁজে বের করে কয়েকটা প্রশ্ন করব উদ্ভিদের ব্যাপারে। কোনদিকে গেছে?

হাত তুলে নদীর কিনার ধরে এগিয়ে যাওয়া পায়েচলা পথটা দেখিয়ে দিল ওয়ালি।

তোমরা বসো, বন্ধুদের বলল কিশোর, আমি দেখে আসি। রওনা হয়ে গেল সে।

১১.

 হনহন করে হেঁটে চলেছে কিশোর। নজর সামনের দিকে।

নদীর একটা বাঁক ঘুরতেই দেখা পেয়ে গেল লোকটার। লম্বা একটা বোট-হুক দিয়ে পানিতে খোঁচাচ্ছে। পাশে রাখা একটা বেতের হাতলওয়ালা বড় ঝুড়ি। পানি থেকে নানা রকম উদ্ভিদ তুলে তাতে ভরছে।

একটা মুহূর্তের জন্যে সন্দেহ হলো কিশোরের, লোকটা সত্যি উদ্ভিদবিজ্ঞানী নয় তো? কিন্তু চেহারা দেখে পরক্ষণে বাতিল করে দিল ভাবনাটা। কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ওকে দেখে ফিরে তাকাল লোকটা।

নিরীহ ধরে কিশোর জিজ্ঞেস করল, কি তুলছেন?

জবাব দিল না লোকটা। কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

আপনার ঝুড়িতে নিশ্চয় অনেক শামুক জমা হয়েছে। বেছে নিতে পারি? আমি একটা হাঁস পালি…।

ধমকে উঠল লোকটা, খবরদার, ঝুড়িতে হাত দেববেনা। শামুকের এত দরকার হলে নিজেই ধরে নাওগে না।

আমার মনে হয় এদিকটাতে শামুক অনেক বেশি। এখন থেকেই পরি।

না! গর্জে উঠল লোকটা। এখানে না। আমার নানা নষ্ট করবে। অন্য কোথাও যাও। সারা নদীতেই শামুক ভর্তি।

দাঁড়িয়ে রইল কিশোর। নিশ্চিত হয়ে গেছে, এই লোক বিজ্ঞানী নয়।

গেলে না এখনও? হুক তুলল লোকটা। কথা না শুনলে যেন কিশোরের বুকেই বিধিয়ে দেবে। যাও, ভাগো এখান থেকে।

বাবারে! কি কাণ্ড! গ্রীনহিলসের সবাই আজকাল ফগের মুদ্রাদোষের শিকার হতে আরম্ভ করেছে নাকি? ফগ তো বলেই, হুরও বলে যাও, ভাগো! এই লোকটা বলে যাও, ভাগো!

আরেকবার যাও, ভাগো শোনার আগেই তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে এল কিশোর। গেল না মোটেও। একটা ঘন ঝোপে বসে চোখের সামনে থেকে দুটো ডাল সরিয়ে উঁকি দিয়ে রইল।

আবার পানিতে খোঁচাতে শুরু করল লোকটা। মাঝে মাঝেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। কিশোর কোনখান থেকে উঁকি মেরে আছে কিনা দেখছে বোধহয়।

পানিতে যে কোন্ জিনিস খুঁজছে, তাতে আর কোন সন্দেহ রইল না কিশোরের।

হুকে কি যেন বাধল লোকটার। টেনে তুলে আনল। একটা পুরানো জুতো। হক থেকে ওটা খুলে নিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে পানিতে ছুঁড়ে ফেলল আবার।

হুকে আটকে কয়েকটা জলজ উদ্ভিদ উঠে এল। ওগুলো খুলে নিয়ে ঝুড়িতে ভরল সে।

এটা ভান। কেউ যদি নজর রেখে থাকে তাহলে যাতে মনে করে এই লোক সত্যি জলজ উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করছে। বুঝতে অসুবিধে হলো না কিশোরের, আসলে খুজছে সে অন্য জিনিস।

পানি থেকে আবার একটা ফালতু জিনিস উঠে এল হুকে আটকে। আগের মতই বিরক্ত ভঙ্গিতে ওটা পানিতে ফেলে দিল লোকটা।

ফগ কি করছে জানার খুব কৌতূহল হলো কিশোরের। একের পর এক এ সব জিনিস উঠতে থাকলে ফগও বেজায় বিরক্ত হবে। কল্পনায় ওর মুখভঙ্গি দেখতে পেয়ে একা একাই নীরবে হাসতে লাগল সে।

মুসারা ওদিকে অপেক্ষা করছে ওয়ালির ছাউনিতে বসে।

ফগ এল। সাইকেল রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে জিজ্ঞেস করল, কি, হয়েছে?

এই যে, হয়ে গেছে, জবাব দিল ওয়ালি। দাঁড়ান, নামিয়ে দিচ্ছি।

ওরা যে লুকিয়ে আছে এটা যাতে টের না পায়, এ জন্যে টিটুর মুখ চেপে ধরে আছে ফারিহা। টেরিয়ারটা চুপচাপ বসে আছে মুসার পায়ের কাছে। ওটা শান্ত কুকুর। টিটুর মত এত চঞ্চল নয়।

কোনমতেই টিটুর মুখ বন্ধ রাখতে পারল না ফারিহা। ফগের গন্ধ পেয়েই খই খউ শুরু করল!

ওর কণ্ঠ ফগের পরিচিত। দরজায় এসে উঁকি দিল। ঝামেলা! এখানেও এসে বসে আছে। এই, তোমাদের পালের গোদাটা কই?

জানি না, সাফ জবাব দিয়ে দিল মুসা।

জলন্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, এখানে বসে থাকলে থাকো, কিছু বলব না। কিন্তু আবার যদি আমার কাজে নাক গলাতে এসেছ তো ভাল হবে। তোমাদের বিচ্ছু বন্ধুটাকেও সাবধান করে দিয়ো।

ফারিহার হাত থেকে ছুটে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো টিটু। গলা ছেড়ে হাঁক দেয়া বাদে ওর আর করার কিছু রইল না।

বেশি সময় নষ্ট করল না ফগ। নৌকায় চেপে বসল। হুক দিয়ে খুঁজতে শুরু করল পানিতে। আগের রাতে বুড়ো ক্যামারের কাছে জেনে নিয়েছে নদীর ঠিক কোন্‌খানটাতে নেমেছিল পাজামা পরা লোকটা।

নৌকায় করে ঘুরতে ঘুরতে একের পর এক বিরক্তিকর জিনিস তুলে আনতে লাগল পানির নিচ থেকে। সেগুলো ছুঁড়ে ফেলতে লাগল আর ঝামেলা। ঝামেলা! করতে থাকল। হঠাৎ চোখ পড়ল, তীরে দাঁড়িয়ে ওর কাজ দেখছে ছেলেমেয়েগুলো। গেল মেজাজ খারাপ হয়ে। মশার দল আবার এসেছে বিরক্ত করতে। মশা! হ্যাঁ, মশাই! তফাৎটা কেবল, মশা কামড়ানোর জন্যে গায়ে বসলে থাপ্পড় মেরে প্রতিশোধ নেয়া যায়। এগুলোকে যায় না। কবে ঠাণ্ডা করে দিত, কেবল ক্যাপ্টেন রবার্টসনের জন্যে পারে না।

রাগ কমানোর জন্যে পানিতে ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে হুক দিয়ে খোঁচাতে লাগল। উঠে আসতে লাগল নানা রকম জঘন্য জিনিস। মেজাজ আরও খারাপ করে দিল ওর।

তারপর এক সময় এমন একটা জিনিস উঠল, উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর মুখ। একটা লন্ড্রি ব্যাগ। ওখানে বসেই তাড়াতাড়ি ওটার মুখ খুলে ফেলল সে। যা বেরোল, তাতে আবার থমথমে হয়ে গেল মুখচোখ। অতি সাধারণ বাতিল কতগুলো কাপড়-চোপড়। কোন শিশুর হবে। অকাজের জিনিস, তাই কেউ ব্যাগে ভরে এনে পানিতে ফেলে দিয়ে গেছে। ব্যাগটা যাতে ডুবে থাকে, সেজন্যে তাতে ভারী পাথর ভরে দিয়েছে।

তীরে দাঁড়িয়ে আগ্রহের সঙ্গে তাকিয়ে আছে কিশোর গোয়েন্দারা।

আরও দুই জোড়া চোখ এখন আড়াল থেকে তাকিয়ে আছে ফগের দিকে। সেই গালকাটা লোকটা। খুঁজতে খুঁজতে নদীর বাঁক ঘুরে বেরিয়ে এসে ফগের দিকে চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়িয়েছে। একটা ঝোঁপের আড়ালে সরে গিয়ে দেখছে, ফগ কি পায়। তার বোধহয় সন্দেহ হয়েছে, সে যা খুঁজছে, ওই পুলিসের লোকটাও তাই খুজছে।

লোকটা বাকের আড়ালে চলে আসাতে আর দেখতে পাচ্ছিল না বলে ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে দেখা যায় এমন আরেকটা ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়েছে কিশোর। ফাঁকে সেও দেখতে পাচ্ছে।

অনেকক্ষণ ধরে খোঁজাখুঁজি করেও আজেবাজে জিনিস ছাড়া কিছুই পেল না ফগ। নিরাশ হয়ে নৌকা নিয়ে তীরের দিকে রওনা দিল সে।

গালকাটা লোকটাও কিছু না পেয়ে চলে গেল।

ওর পিছু নিয়ে লাভ নেই। ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে কিশোর এসে দাঁড়াল মুসাদের কাছে।

নৌকা থেকে নেমে কিশোরকে দেখে রাগ আর সামলাতে পারল না ফগ। চাকরির মায়া কিংবা ক্যাপ্টেনের ভয় আর করল না। সারারাত ওকে ঠাণ্ডার মধ্যে বসিয়ে রেখে শাস্তি দিয়েছে শয়তানটা। ওকে খানিকটা শিক্ষা না দিলেই আর নয়। নৌকায় ফেলে রাখা লন্ড্রি ব্যাগটা তুলে এনে খপ করে চেপে ধরল কিশোরের কলার। তারপর ঠাণ্ডা ভেজা পোশাকগুলো ঠেসে ভরে দিতে লাগল ওর শার্টের ভেতর। তার মতে, ঠাণ্ডার মধ্যে এরচেয়ে বড় শাস্তি আর হয় না।

বাধা দিতে এল ওয়ালি, এ কি করছেন, মিস্টার ফগর্যাম্পারট! একজন পুলিসম্যান হয়ে

চোপরাও! গর্জে উঠল ফগ।

চুপ হয়ে গেল ওয়ালি।

মুসা আর রবিন এসে টানাটানি করে সরিয়ে আনার চেষ্টা করল ফাঁকে। কিন্তু ফগের গায়ে যেন অসুর ভর করেছে। ব্যাগের সমস্ত জিনিস কিশোরের শার্টের ভেতরে ভরে দেয়ার আগে কোনমতে সরানো গেল না ওকে।

প্রতিশোধ নিতে পেরে রাগ অনেকটা কমল তার। কোনদিকে আর না তাকিয়ে সাইকেলে চেপে চলে গেল।

এক এক করে শার্টের ভেতর থেকে জিনিসগুলো বের করতে লাগল কিশোর। ওকে সাহায্য করল ফারিহা। বিড়বিড় করে বকতে লাগল ফগকে।

থাক, বোকো না, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। অনেক যন্ত্রণা দিয়েছি আমি ওকে। এটা করে খানিকটা মনের ঝাল যদি মেটে, মিটুক। আমাকে এমন করে কেউ ভোগালে আমিও শোধ নিতে ছাড়তাম না।

পানি থেকে তুলে আনা কাপড়গুলোর মধ্যে রয়েছে একটা নীল পাজামা, একটা লাল বেল্ট, একটা নীল টাই, লাল বোতাম বসানো একটা নীল ক্যাপ, একজোড়া মোজা, একজোড়া লাল জুতো, আর একটা লাল

থমকে গেল ফারিহা। জিনিসটা পরিচিত মনে হচ্ছে। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, কিশোর, দেখো দেখো!

দেখল কিশোর। ওরও চোখ বড় বড় হয়ে গেল।

একটা লাল দস্তানা!

ভালমত দেখার জন্যে ঘিরে এল মুসা আর রবিন। ওরাও চিনতে পারল। হবারের বাড়িতে যে দস্তানাটা পেয়েছিল কিশোর, অবিকল ওরকম আরেকটা। জোড়াটার দ্বিতীয়টা।

হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে গেল কিশোরের মুখ। ফগের ওপর রাগ না করে বরং আমাদের কৃতজ্ঞ হয়ে যাওয়া উচিত। আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে যে কতবড় সূত্র ফেলে চলে গেল, যখন জানতে পারবে, নিজের হাত নিজেই কামড়ে খেয়ে ফেলবে!

এই সময় খেয়াল হলো ওর, টিটু নেই আশেপাশে। উত্তেজনায় কারোরই মনে ছিল না ওর কথা।

মুসা বলল, সেজন্যেই তো বলি, এত নিরাপদে কাজটা সারতে পারল কি করে ঝামেলা! টিটুই নেই। আহা বেচারা, গোড়ালি কামড়ানোর এমন মস্তবড় একটা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো ও। আজ ও ঠিক কামড়ে দিতে পারত। বাধা দিত না তো কেউ…।

কিন্তু ও গেল কোথায়? উদ্বিগ্ন হলো ফারিহা।

এতক্ষণে যেন সংবিত ফিরে পেল ওয়ালি। সকালে ও আজ ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই নানা রকম কাণ্ড ঘটছে। অবাক হতে হচ্ছে বার বার। খানিক আগে ফগের রেগে যাওয়াটা তো রীতিমত বিমূঢ় করে দিয়েছে। ফারিহার প্রশ্নের জবাবে বলল, নিশ্চয় আমার টেরিয়ারটার সঙ্গে মাঠে চলে গেছে। মাঝেমধ্যেই খরগোশ ধরতে যায়। আজ সঙ্গী পেয়ে খুশির ঠেলায় বোধহয় শিকার শেখাতে নিয়ে গেছে তোমাদের কুকুরটাকেও। ভয় নেই, চলে আসবে।

.

১২.

দল বেঁধে কিশোরদের বাড়িতে ফিরে এল সবাই। কিশোরের ঘরে বসে কথা বলতে লাগল।

কিশোরের ধারণা, পুতুলের কাপড়গুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে রহস্যের চাবিকাঠি। অতএব সেগুলো ভালমত খুঁজে দেখা দরকার।

দুপুর হয়ে গেছে। মুসাদের বাড়ি থেকে ফোন করলেন মিসেস আমান। রবিনের মাও খোঁজ নিলেন। অসুস্থ ছেলেরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে সেই সকালে, এখনও ফেরার নাম নেই। দুজনেই অস্থির হয়ে উঠেছেন। মিসেস বারজি এসে প্রায় ধমকের সুরে জানিয়ে গেল সেকথা।

যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়াল ফারিহা। বিরক্ত হয়ে বলল, দূর, ফোন করার আর সময় পেল না। যখন আসল কাজটা শুরু করতে যাব তখনই…কিশোর, কথা দাও, আমরা না এলে দেখার কাজটা তুমি শুরু করবে না?

হাসল কিশোর, আচ্ছা, করব না। নিশ্চিন্তে চলে যাও। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে চলে এসো।

কিন্তু মুসারা বেরিয়ে যাওয়ার কয়েক মিনিট পরেই ঝমঝম করে নামল বৃষ্টি। কিছুক্ষণ পর কমল, তবে একেবারে বন্ধ হলো না। কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি, কখনও ঝমঝম করে, পড়তেই থাকল।

আর কোন কাজ না পেয়ে পুতুলের পোশাকগুলো ইলেকট্রিক হিটারে শুকাতে বসল কিশোর। পরীক্ষা করে দেখার জন্যে উতলা হয়ে উঠেছে মন! কিন্তু ফারিহাকে কথা দিয়েছে দেখবে না, তাই দেখল না।

 বিকেলের দিকে আকাশের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল। মুসা আর রবিনদের বাড়িতে ফোন করে জানল কিশোর, বেরোতে দিচ্ছেন না ওর মায়েরা। সবে জ্বর থেকে না উঠলে হয়তো এভাবে বাধা দিতেন না।

কি আর করবে? মনমরা হয়ে বসে রইল কিশোর।

পুতুলের কাপড়গুলো নিজের পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে রেখে খানিকক্ষণ টিভি দেখল। মন বসল না তাতে। বই পড়ার চেষ্টা করল! তাও মন বসাতে পারল না।

সন্ধ্যার পর চাচা-চাচী বেরিয়ে গেলেন। এক বন্ধুর বাড়িতে পার্টি আছে। ফিরতে অনেক রাত হবে।

সকাল সকাল খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ল কিশোর।

অনেক রাতে টিটুর চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল।

থামার জন্যে ওকে ধমকানো শুরু করল কিশোর।

 কিন্তু থামল না কুকুরটা। দরজার কাছে গিয়ে আরও জোরে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল।

সন্দেহ হলো কিশোরের। চোর এল না তো?

দরজার দিকে এগোল। পান্নাটা খুলতে না খুলতে একদৌড়ে বেরিয়ে গেল টিটু। নিচ থেকে কে? কে? বলে চিৎকার করে উঠল মিসেস বারজি।

কয়েক সেকেন্ড পর গেটের বাইরে রাস্তায় একটা গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট নিল। দ্রুত চলে গেল গাড়িটা। জানালা দিয়ে ওটার টেল লাইট দেখতে পেল কিশোর।

সারা বাড়ির আলো জ্বেলে দিল সে। রান্নাঘরের একটা জানালার কাঁচ ভাঙা। ওখান দিয়ে ছিটকানি খুলেই ঘরে ঢুকেছিল কেউ। হুবারের বাড়িতে চোর ঢোকার কথা মনে পড়ল কিশোরের। ঠিক একই ভাবে ওদের ঘরেও ঢুকেছিল লোকটা। কে? কেন?

হঠাৎ পেয়ে গেল জবাবটা। হুবারের বাড়িতে যে জিনিসের জন্যে ঢুকেছিল, ওদের বাড়িতেও সেই একই জিনিসের জন্যে এসেছিল লোকটা।

পুতুলের পোশাক!

নিশ্চয় সেই গালকাটা লোকটা। কিশোর তখন ভেবেছিল চলে গিয়েছে, আসলে যায়নি। নদীর পাড়ে কোথাও লুকিয়ে থেকে দেখেছে ফগ ওগুলো নিয়ে কি করে। সব দেখেছে। তারপর কিশোরের পিছু নিয়ে এসে ওদের বাড়িটা দেখে গেছে। এখন রাত দুপুরে এসে হানা দিয়েছে ওগুলোর জন্যে।

নিশ্চয় কোন মূল্যবান সূত্র লুকিয়ে আছে ওগুলোর মধ্যে। কোন সন্দেহ নেই আর।

অনেক রাতে বাড়ি ফিরলেন চাচা-চাচী।

চোর ঢাকার কথা জোর গলায় জানাল তাদের মিসেস বারজি। পুলিসে খবর দিতে বললেন মেরিচাচী।

রাজি হলেন না রাশেদ পাশা। পুলিস মানেই তো ফগর‍্যাম্পারকট। তাঁর মতে ওটা একটা হাঁদা। পারে কেবল ঝামেলা বাধাতে আর হই-হট্টগোল করতে। কাজের কাছ কিছুই পারে না। কিছু যখন নিতে পারেনি চোরে, অহেতুক রাত দুপুরে ফগকে খবর দিয়ে আর যন্ত্রণা বাড়ানোর দরকার নেই।

 পরদিন সকালে আকাশ ভাল হয়ে গেল। বৃষ্টি নেই। নাস্তা সেরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসে কিশোরদের বাড়িতে হাজির হলো ফারিহা, মুসা আর রবিন।

রাতে চোর আসার কথা ওদের জানাল কিশোর। কেন এসেছিল, কি তার উদ্দেশ্য সেটা নিয়েও সংক্ষিপ্ত আলোচনা হলো। কিশোরের সঙ্গে অন্য তিনশনও একমত হলো, গালকাটা লোকটাই এসেছিল, পুতুলের পোশাকের খোঁজে। অতএব আর দেরি না করে জলদি জলদি দেখে ফেলা দরকার কি এমন মূল্যবান জিনিস লুকিয়ে আছে ওগুলোর মধ্যে।

জিনিসগুলো নিয়ে কিশোরদের বাগানের ছাউনিতে ঢুকল সবাই।

টিটুকে পাহারা দিতে বলল কিশোর।

 এত কড়াকড়ি কেন? জানতে চাইল ফারিহা।

বলা যায় না, বেড়ার ফাঁকফোকরগুলো দেখতে দেখতে জবাব দিল কিশোর, কাল রাতের লোকটা এসে উঁকি দিয়ে শুনে ফেলতে পারে আমাদের কথা। আমরা কি পেলাম, দেখে ফেলতে পারে।

হেসে ফেলল ফারিহা, এত সতর্কতা! নিজেরদেরকে পাই মনে হচ্ছে আমার। একেবারে পাই হেডকোয়ার্টারের সাবধানতা।

কথা অনেক হয়েছে, অধৈর্য হয়ে উঠল মুসা, এবার আসল কাজটা সেরে ফেলা দরকার। পোশাকগুলোর ভেতরে কি আছে জানার জন্যে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে?

এই যে, শুরু করছি, বলে একটা জুতোর বাক্সের ডালা খুলল কিশোর। এর ভেতরে লুকিয়ে রেখেছে পুতুলের পোশাকগুলো। প্রথমে বের করল নীল রঙের পাজামাটা। বেশ সুন্দর। ওপর দিকে বোম লাগানো।

পকেট-টকেট কিছু নেই। ফারিহার দিকে তাকাল কিশোর, পুতুলের পোশাকের পকেট থাকে না, ফারিহা?

থাকে তো, হাত বাড়াল ফারিহা। দেখি? এটা ছেলে পুতুলের গায়ে মানাবে ভাল।

উল্টেপাল্টে ভাল করে দেখল সে। কিছু পাওয়া গেল না। রবিনের হাতে দিল। ও দেখে মুসাকে দেবে। প্রতিটি জিনিস সবাই মিলে দেখবে। তাতে কোন কিছু থেকে থাকলে চোখ এড়িয়ে যাওয়ার ভাবনা কম।

এরপর একটা লাল বেল্ট বের করল কিশোর। নিজে দেখে ফারিহার হাতে দিল। হাত থেকে হাতে ঘুরতে লাগল জিনিসটা। পাওয়া গেল না কিছু।

এরপর মোজালো দেখা হলো।

 পুতুলের নাম কিংবা কোন চিহ্ন দেয়া আছে কিনা দেখল ফারিহা। নেই।

মুসা বলল, পুতুলের কাপড়ে আবার নাম লেখা থাকে নাকি?  

থাকবে না কেন? ফারিহা বলল। অনেকেই নাম লিখে রাখে, কিংবা চিহ্ন দিয়ে রাখে, আলাদা করে বোঝার জন্যে। আমিই তো দিই।

মোজাতে পাওয়া গেল না কিছু। জুতোজোড়া বের করল কিশোর।

পুতুলের জন্যে বড়, বলল সে, কিন্তু বাচ্চা ছেলের জন্যে হোট। শক্ত করে বানানো, দেখো। পুতুলের জিনিস মনে হয় না। ফিতেগুলোও আসল। ইচ্ছে করলে বাঁধা যায়।

হয়তো কোন শিশুর জুতোই হবে, রবিন বলল। কোন বামন শিশু। স্বাভাবিক শিশুর চেয়ে পা ছোট তার।

তা নাহয় হলো, নিজের অজান্তে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। কিন্তু মাথায় ঢুকছে না এ জিনিসের এত গুরুত্ব হয়ে গেল কেন? কি এমন দামী জিনিস আছে এর মধ্যে যে চুরি করে নিয়ে যাওয়ার জন্যে দুটো বাড়িতে হানা দিল লোকটা?

দুটো ফিতেই খুলল ফারিহা। ভাল করে দেখল। খুব সুন্দর। আবার আগের মত জুতোতে বেঁধে রাখতে লাগল। একটার ফিতে বেধে জুতোটা পাশে রেখে আরেকটা বাধছে সে, এই সময় মাটিতে রাখা জুতোটা এসে ওকতে শুরু করল টিটু।

ওর দিকে তাকাল ফারিহা। হেসে জিজ্ঞেস করল, তোর নাক তো খুব কড়া। কার গন্ধ পাচ্ছিস?

বার দুই খুফ খুফ করল টিটু। তারপর মুখে নিয়ে একদৌড়ে চলে গেল ঘরের কোণে। জুতোটাকে ওখানে রেখে বসে পড়ল তার ওপর। যেন বোঝাতে চাইল, এটা এখন আমার।

তোর ওই খেলা বাদ দে তো! কদিন থেকেই শুরু করেছে। যা পায় নিয়ে গিয়ে দখল করে। কাল নিয়েছে আমার একটা রঙিন পেন্সিল। সকালে স্যান্ডেল। এখন জুতো, ধমক দিল কিশোর। আন ওটা। কাজ আছে।

আনল না টিটু। যেমন ছিল, বসে রইল।

হেসে বলল মুসা, কাল রাতে চোর তাড়িয়ে নিজেকে খুব বাহাদর ভাবছে আরকি। কাউকেই আর কেয়ার করে না। ব্যাটা শয়তানের হাড্ডি।

জুতোটা দেখা হয়ে যাওয়ার পরই নিয়েছে টিট, তাই আর ওটা নিয়ে মাথা ঘামাল না কিশোর বাক্স থেকে একটা কোর্ট বের করল। তাতে উঁচু কলারও আছে, বোতামও আছে।

ভালমত পরীক্ষা করে দেখল কিশোর। কোটের ভেতরে-বাইরে তো দেখলই, লাইনিংও বাদ দিল না। কিছুই লুকানো নেই। কোন কিছু ঠেকল না আঙুলে।

কিশোরের দেখা হয়ে গেলে অন্যেরাও দেখল কোটটা। ভাল কাপড়ে তৈরি পোশাকটা প্রায় নতুন। তেমন ব্যবহার করা হয়নি।

যতই দেখছি, ততই অবাক হচ্ছি, কিশোর বলল, কাকে পরানো হত এই পোশাক? চুরিই বা করা হলো কেন এগুলো?

চুরিটা কে করেছে? রবিনের প্রশ্ন। হুবার?

সে করে থাকলে ওগুলো নিয়ে গিয়ে আবার পানিতে ফেলে দেবে কেন? আমাকে খোঁচাচ্ছে আসলে একটা প্রশ্নই-সাধারণ এই জিনিসগুলো এত দামী হয়ে উঠল কেন? এর জবাব পাওয়া গেলেই সমাধান করে ফেলা যাবে এই রহস্যের।…এই যে, নাও, টাইটা দেখো। আর এই যে ক্যাপ।

ওর দিকে নজর দেয়া হচ্ছে না বলেই বোধহয় সেটা বোঝানোর জন্যে কাছে এসে দাঁড়াল টিটু। এর-ওর গা ঘেষাঘেষি করেও পাত্তা না পেয়ে খুকখুক শুরু করল।

বিরক্ত হয়ে কিশোর বলল, তোর সঙ্গে খেলার সময় এখন কারও নেই। যা তো এখান থেকে। তোকে বললাম পাহারা দিতে, আর তুই করছিস শয়তানী। যা, ভাগ।

মনমরা হয়ে গিয়ে আবার ঘরের কোণে বসে পড়ল টিটু।

ক্যাপটাও দেখা হয়ে গেলে ফারিহা বলল, এই তো শেষ, তাই না? পেলাম না তো কিছুই।

সেকথাই তো ভাবছি, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। এ ভাবে নিরাশ হব ভাবিনি। এক কাজ করা যেতে পারে।

তিন জোড়া চোখ ঘুরে গেল ওর দিকে। কি?

এগুলো নিয়ে হুয়ের কাছে চলে যাব। তাকে জিজ্ঞেস করব, কার জিনিস? এত দামী কেন?

জবাব দেবে? রবিনের প্রশ্ন।

 কি জানি!

তারচেয়ে বরং আরেকবার খুঁটিয়ে দেখা যাক; ফারিহা বলল। হয়তো প্রথমবারে আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে।

আরে, দূর! থাবা মারার ভঙ্গিতে হাত নাড়ল মুসা। এতগুলো চোখ, এমন করে দেখলাম, চোখ এড়িয়ে যায় কি করে?

তবে কিশোর তাচ্ছিল্য করল না ফারিহার কথাকে। মন্দ বলনি। যতক্ষণ সন্দেহ না যায়, সন্তুষ্ট না হওয়া যায়, বার বার দেখা উচিত। কখন যে কি জিনিস চোখ এড়িয়ে যাবে, বলা মুশকিল।

সুতরাং আবার প্রথম থেকে দেখা শুরু হলো।

এবং ফারিহার ধারণাই ঠিক। জিনিসটা পাওয়া গেল লাল কোটের উল্টে রাখা হাতার ভাঁজে। খুদে একটা সাদা রুমাল। সে-ই খুঁজে বের করল জিনিসটা। চিৎকার করে উঠল, দেখো দেখো, এমব্রয়ডারি করে ডেইজি ফুল আঁকা!

প্রায় ছোঁ মেরে তার হাত থেকে রুমালটা নিয়ে নিল কিশোর। ফুলের দিকে নজর নেই। ওর চোখ অন্যখানে। ফুলগুলোকে ঘিরে লেখা রয়েছে কতগুলো অক্ষর।

সবগুলো সাজালে একটা নাম হয়ে যায়।

ইউরিক্লেস! কপাল কুঁচকে ফেলেছে মুসা। এ রকম উদ্ভট নাম তো আর শুনিনি কখনও। এ তো মনে হচ্ছে গ্রীক!

আমারও মনে হচ্ছে গ্রীক, রবিন বলল। কিন্তু মিথলজিতে এ রকম কোন নাম আছে বলে তো মনে পড়ছে না।

আমি জানি ওটা কার নাম, উত্তেজিত হয়ে বলল কিশোর। দারুণ একখান সূত্র! ফারিহা, কাজের কাজই করেছ একটা!

.

১৩.

শোনো, গল্প বলার ঢঙে বলল কিশোর, বহুকাল আগে ইউরিক্লেস নামে এক লোক বাস করত গ্রীসে। সেকালে সবাই চিনত তাকে। বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল বিশেষ একটা গুণের জন্যে ভেনট্রিলোকুইজম জানত। অনেক ছাত্র তৈরি করে নিয়েছিল সে। ওরাও একেকজন দক্ষ ভেনট্রিলোকুইস্ট হয়ে ওঠে।

ও, এই ব্যাপার, মুসা বলল। আমি তো ভাবতাম ভেনট্রিলোকুইজম বিদ্যাটা বুঝি আধুনিক। তাহলে এই কারবার। প্রাচীন গ্রীকরা তো দেখি সব ব্যাপারেই ওস্তাদ ছিল।

বিদ্যাটা আধুনিক তো নয়ই, বরং বহু পুরানো। যতদূর জানা যায়, গ্রীকরাই এ বিদ্যার প্রচলন করেছিল। তারপর পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এটা। আফ্রিকার জুল থেকে শুরু করে মেরু অঞ্চলের এস্কিমোরা পর্যন্ত এ জিনিস প্র্যাকটিস করেছে। কিছুদিন আমিও আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। প্র্যাকটিস করেছি। কিন্তু করতে বড় কষ্ট। তা ছাড়া আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম বলে ছেড়ে দিয়েছি।

চোখ বড় বড় হয়ে গেল ফারিহার, তুমি ভেনট্রিলোকুইজম জানো!

অতি সামান্য, হাসল কিশোর। হঠাৎ ফুলে উঠল তার গাল। ঠোঁট দুটো গোল হয়ে গেল শিস দেয়ার ভঙ্গিতে। পরক্ষণে ঘরের কোণে একটা বেড়াল ডেকে উঠল। কান খাড়া হয়ে গেল টিটুর। সেদিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ শুরু করে দিল।

থাক, চেঁচাতে হবে না আর, বলল কিশোর। বেড়াল-টেড়াল কিছু নেই।

হাঁ হয়ে গেছে মুসা। তুমি করেছ ওই শব্দ!

 মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

বিশ্বাস করতে পারছে না রবিনও। সত্যি!

আবার মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

সন্দেহ প্রকাশ করল না কেবল ফারিহা। তার ধারণা, পৃথিবীতে এমন কোন কাজ নেই যেটা কিশোর পাশা করতে পারবে না।

যাই হোক, আবার আগের কথার খেই ধরল কিশোর, আমার প্রশ্ন, একটা আধুনিক পুতুলের রুমালে প্রাচীন গ্রীক ভেনট্রিলোকুইস্টের নাম লেখা কেন? আর এটা এত দামীই বা হয়ে উঠল কেন?

হাত নাড়ল মুসা, আমি বলতে পারব না। তুমিই বলো।

কোন রুমালে যখন কোন নাম লেখা হয়, সাধারণত সেটা হয় ওটার মালিকের নাম, এক এক করে সবার দিকে তাকাল কিশোর, তাই না?

মাথা ঝাঁকাল সবাই।

এখন দুটো ব্যাপার হতে পারে, কিশোর বলল, হয় রুমালটা পুতুলটারই নামে, নয়তো ওটার মালিকের–যে একজন ভেনট্রিলোকুইস্ট।

তাই তো! কিশোরের মতই ব্যাপারটা অনেকখানি আঁচ করে ফেলেছে রবিন। আগে ভাবলাম না কেন? পুতুলটা আসলে স্টেজে ব্যবহার করা হতো, থিয়েটার কিংবা পুতুলনাচ, এ ধরনের কোন শো-বিজনেসে, যে জন্যে এত বড় করে বানানো হয়েছে। পোশাক-আশাকগুলোও তাই এতটা নিখুঁত।

মাথা ঝাঁকিয়ে তার স্বভাবসিদ্ধ নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল কিশোর, প্রাচীন সেই ভেনট্রিলোকুইস্টের নামানুসারে রুমালের মালিকের স্টেজ নেম রাখা হয়েছিল ইউরিক্লেস। পুতুলটাকে নিয়ে খেলা দেখাত যে। দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে আসছে এখন সবকিছু।

কিন্তু আমার কাছে এখনও অমাবস্যার রাতের মতই অন্ধকার, মুসা বলল, পোশাকগুলো কাকে পরানো হত, তা নাহয় জানলাম; পুতুলের মালিকের নামও জানা গেল। কিন্তু তাতে আমাদের রহস্যের কিনারাটা কিভাবে হলো?

মিস্টার ইউরিক্লেসকে খুঁজে বের করতে পারলেই হয়ে যাবে, জবাব দিল কিশোর। হুবারকে গিয়ে জিজ্ঞেস করব পুতুলের এই পোশাকগুলো তার কাছে কেন, কেন এত দামী হয়ে উঠল এগুলো যে নেয়ার জন্যে তার বাড়িতে হানা দিল চোর, কেনই বা রাত দুপুরে ব্যাগে ভরে নিয়ে গিয়ে এগুলো নদীতে ফেলে দিয়ে আসা লাগল তার? এই জবাবগুলো পেয়ে গেলেই সমাধান করে ফেলতে পারব আমরা ইউরিক্লেস রহস্যের।

কিন্তু ওই ইউরিক্লেসকে খুঁজে বের করব কিভাবে আমরা? কোন সূত্র নেই আমাদের হাতে। সূত্র ছাড়া ওকে খুঁজে বের করা অসম্ভব। তা ছাড়া হাতেও আমাদের সময় নেই আর বেশি। তিন দিন পরেই স্কুল খুলে যাবে। না গিয়ে তো আর পারব না।

অত নিরাশ হচ্ছ কেন? দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল কিশোর, যুগ যুগ লাগবে না ইউরিকেসকে খুঁজে বের করতে। অল্প সময়েই হয়ে যাবে। শো-বিজনেস যারা করে, তাদের অফিস আছে। ওখানে ফোন করে খোঁজ নিলেই জানা যাবে ইউরিক্লেস নামের ভেনট্রলোকুইস্টকে কোথায় পাওয়া যাবে।

হুবারকেও জিজ্ঞেস করা যেতে পারে, রবিন বলল।

তা পারে। তবে জবাব সে নাও দিতে পারে। দিক আর না দিক, তার কাছে আমি যাবই। আজ বিকেলে দল বেঁধে সবাই গিয়ে হাজির হব তার বাড়িতে। আমি দেখতে চাই, পোশাকগুলো দেখলে তার মুখের অবস্থা কি হয়। চমকে যদি যায়, সামলে নেয়ার আগেই প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে নাস্তানাবুদ করে দেব। ভুল কোন জবাব দিলেই হয় কেবল, চেপে ধরৰ কাঁক করে।

পোশাকগুলো আবার জুতোর বাক্সে ভরে ফেলতে লাগল কিশোর।

ফারিহা বলল, রুমালটা খুব সুন্দর। এটা আমি আমার পকেটে রেখে দিই?

 তা দাও। না হারালেই হবে।

ঘড়ি দেখল রবিন। বিকেল হতে এখনও অনেক দেরি। সময়টা কিভাবে কাটানো যায়? কি করা যায়, বলো তো?

চলো, গিয়ে কোনখান থেকে চকলেট খেয়ে আসি, প্রস্তাব দিল মুসা।

মনে ধরল সবারই। সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

পথে ফগের সঙ্গে দেখা। কিশোরকে দেখে এগিয়ে এল। হাত তুলে থামার ইঙ্গিত করল ওদেরকে।

টিটকারির সুরে কিশোর বলল, আজ তো আপনার কাছে কোন ব্যাগট্যাগ নেই। কিছু ঢোকাবেন না আমার শার্টের মধ্যে?

গভীর ভাবটা একেবারেই নেই ফগের মধ্যে। কোমল গলায় বলল, ঝামেলা! কাল তুমি ব্যথা পাওনি তো, কিশোর?

অবাক হয়ে গেল ওরা। টিটুকে ঝুড়িতে আটকে রেখেছে কিশোর। সুতরাং সে কোন গোলমাল করতে পারল না। বলল, আজ পুবের সূর্য পশ্চিমে উঠল নাকি, মিস্টার ফগর‍্যাম্পারকট? এত ভাল ব্যবহার যে?

রাগে ঝিক করে উঠল ফগের চোখ। সেটা পলকের জন্যে। কঠিন কিছু বলতে গিয়েও সামলে নিল। জোর করে হাসি ফোঁটাল মুখে। ঢোক গিলল। তারপর বলল, ক্যাপ্টেন রবার্টসনের কাছে রিপোর্ট করেছিলাম। তাতে হুবারের বাড়ির কুকুর, ওয়োর আর বাচ্চা শিশুর ডাকের কথাও উল্লেখ করেছিলাম।

কৌতূহলী হয়ে উঠল কিশোর, তারপর?

অহেতুক কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল ফগ। এদিক ওদিক তাকিয়ে দ্বিধা করল। শেষে বলেই ফেলল, ক্যাপ্টেন একবর্ণও বিশ্বাস করেননি। তোমার কথা লিখেছিলাম রিপোর্টে। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়ে দিয়েছেন, তোমাকে সহকারী করে নিতে।

ও, এই ব্যাপার। এ জন্যেই এত ভাল ব্যবহার। মিটিমিটি হেসে জিজ্ঞেস করল কিশোর, সহকারী করার নির্দেশ দিয়েছেন, নাকি সহকারী হবার?

আবার জ্বলে উঠল ফগের চোখ। দাঁত কিড়মিড় করল। কিন্তু কঠোর কিছু বলার সাহস পেল না কিশোরকে। আরেকদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে শুধু বলল, ঝামেলা! উফ, ঝামেলা!

এতে আর ঝামেলার কি দেখলেন, কিশোর বলল। ক্যাপ্টেন যখন সাহায্য করতে বলেছেন আপনাকে, নিশ্চয় করব। আবার কথা হলে তাকে আমার সালাম জানাবেন। এখন আমরা চকলেট খেতে যাচ্ছি। পরে সময় করে কথা বলব।

ইচ্ছে করে কেউকেটা ভঙ্গি দেখিয়ে ফগের পিত্তি জ্বালিয়ে দিতে দিতে সাইকেলের প্যাডালে চাপ দিল কিশোর। যেদিকে যাচ্ছিল, দল বেঁধে সেদিকে রওনা হলো আবার। পেছনে তাকালে দেখতে পেত, চোখ গরম করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ফগ। আর শাপ-শাপান্ত করে ওর চোদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছে। এটা অবশ্য তাকালে দেখতে পেত না। কারণ এই বিশেষ কাজটা করছে ফগ মনে মনে।

.

১৪.

লাঞ্চের আরও ঘন্টাখানেক বাকি। চকলেট খাওয়ার পর তাই আবার কিশোরদের বাড়িতে ফিরে এল সবাই।

বাগানে ঢুকে ছাউনির দিকে তাকিয়েই থমকে গেল কিশোর।

কি হলো? পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল মুসা।

নীরবে হাত তুলে দেখাল কিশোর। তারপর দৌড় দিল ছাউনির দিকে। হাঁ হয়ে খুলে আছে দরজা। তালা লাগিয়ে গিয়েছিল সে। কজা ভেঙে খোলা হয়েছে। চাচা চাচী বাড়ি নেই। কোথাও গেছে হয়তো বেড়াতে। মিসেস বারজি গেছে বাজারে। এই সুযোগে কাজটা করেছে কেউ।

লোকটা কে, সেটা অনুমান করতে অসুবিধে হলো না কারোরই। নিশ্চয় সেই গালকাটা। ভেতরে ঢুকে দেখে সেটা আরও পরিষ্কার হলো। জিনিসপত্র সব তছনছ হয়ে আছে।

ওই ব্যাটা আবার এসেছিল পুতুলের কাপড়ের খোঁজে, মুসা বলল।

এবার নিশ্চয় নিয়েও গেছে, বলল রবিন।

কথাটা ঠিক। জুতোর বাক্সটা আছে বটে, কিন্তু ভেতরে পোশাকগুলো নেই। খালি করে সব নিয়ে গেছে। যে জিনিস হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল লোকটা, অবশেষে হাতে পেল সেগুলো।

ইস, কেন যে অন্য কোথাও রেখে যাওয়ার কথা মনে হলো না! কেঁদে ফেলবে যেন ফারিহা। ঘরে রেখে গেলেই হত। এখন কি নিয়ে হুবারের কাছে যাব আমরা?  

ঘরে রেখে গেলেও আজ নিয়েই যেত লোকটা, কিশোর বলল। গাধার মত বাড়ি খালি ফেলে চকলেট খেতে বেরিয়েছিলাম। দোষটা আমাদেরই। চমৎকার সুযোগ করে দিয়ে গেছি লোকটাকে। কি আর করা। যা গেছে গেছে। এখন অনুশোচনা করে আর লাভ নেই। এসো, ঘরটা গুছিয়ে ফেলি।

কিন্তু আমাদের তদন্তের কি হবে?

সে দেখা যাবে। উপায় একটা বেরিয়ে যাবেই।

জিনিসপত্রগুলো যেখানে যেটা ছিল, গুছিয়ে রাখতে আরম্ভ করল সবাই মিলে। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল ফারিহা, আরি, ভুলেই গিয়েছিলাম।

কাজ থামিয়ে দিয়েছে সবাই।

 কিশোর জিজ্ঞেস করল, কি?

রুমালটা! ওটা নিতে পারেনি। আমার পকেটে আছে।

ও, বিশেষ আগ্রহ দেখাল না কিশোর। ওটা দিয়ে আর কোন লাভ হবে না এখন আমাদের। রেখে দাও তোমার কাছেই।

পকেট থেকে রুমালটা বের করে ফেলেছিল ফারিহা, কিশোরের অনাগ্রহ দেখে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার রেখে দিল পকেটে।

আবার জিনিস গোছানোয় মন দিল ওরা। সবাই খুব মনমরা। তীরে এসে তরী ডোবার অবস্থা। সূত্রগুলো হাতে পেয়েও খোয়াতে হলো।

লাঞ্চের আগে যার যার বাড়ি চলে গেল মুসা, ফারিহা আর রবিন। টিটুকে নিয়ে কিশোর এসে ঘরে ঢুকল। মিসেস বারজি ফিরেছে। কিশোরকে দেখেই বলল, এক ভদ্রলোক তোমাকে ফোন করেছিলেন।

কে?

 ক্যাপ্টেন রবার্টসন।

ক্যাপ্টেন! কি বললেন?

বললেন তুমি বাড়ি এলেই যেন জানাই তিনি ফোন করেছিলেন। জরুরী কথা আছে।

সোজা টেলিফোনের দিকে দৌড় দিল কিশোর।

কে, কিশোর? ভেসে এল ক্যাপ্টেনের ভারী গলা। মেসেজটা তাহলে দিয়েছে তোমাকে। তা কেমন আছো?

ভাল, স্যার। কিজন্যে ফোন করেছিলেন?

ফগ একটা রিপোর্ট পাঠিয়েছে। উদ্ভট সব কথা লিখেছে। তোমার নামেও বিস্তর আজেবাজে কথা লিখেছে। আমি অবশ্য বিশ্বাস করিনি। কিন্তু মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটছে গ্রীনহিলসে। কি, বলো তো?  

ভেনট্রিলোকুইজম।

কি!

ভেনট্রিলোকুইজম, স্যার। বিদ্যেটার কথা নিশ্চয় জানা আছে আপনার।

 তা আছে। কিন্তু তোমার কথা তো কিছু বুঝতে পারছি না।

 ইউরিক্লেসের নাম শুনেছেন না, স্যার?সেই যে প্রাচীন গ্রীসে…

 কি হয়েছে ইউরিক্লেসের?

ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, স্যার।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরব থেকে ক্যাপ্টেন বললেন, কিশোর, কি আবল-তাবল বকছ! এত বছর পর তাকে খুঁজে পাবে কোথায়? তার কবরের হাড়ও এখন পাওয়া যাবে না।

ওকে নয়, স্যার, অন্য এক ইউরিপ্লেসকে খুঁজছি আমরা। এখনকার মানুষ।

অন্যপাশে হঠাৎ সতর্ক হয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন, তার কথা থেকেই বোঝা গেল। কিশোর, বেরিয়ো না কোথাও। আমি এখুনি আসছি। আর অপরিচিত কেউ এসে যদি ইউরিক্লেসের কথা জিজ্ঞেস করে, কিছু বলবে না।

.

১৫.

 ওপাশে লাইন কেটে গেল। বিমূঢ় হয়ে হাতের রিসিভারটার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। রীতিমত অবাক। ব্যাপার কি? ক্যাপ্টেন কি তাহলে রহস্যটার কথা কিছু জানেন? ইউরিক্লেসকে চেনেন? সাংঘাতিক কোন ব্যাপার আছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। নইলে হুট করে এ ভাবে আসার জন্যে অস্থির হয়ে যেতেন না।

নাক ডলল কিশোর। সেদিনই বিকেলে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে ছিল না তার। রহস্যটার কিনারা হয়নি এখনও। তবু ক্যাপ্টেন যখন নিজেই আসতে চাইছেন, কি আর করা।

তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে মুসা আর রবিনকে ফোন করল কিশোর। ক্যাপ্টেনের আসার খবরটা জানিয়ে ওদের আগেভাগেই চলে আসতে বলল।

কিন্তু ওদের আগেই ক্যাপ্টেন চলে এলেন তার সেই বিরাট কালো গাড়িতে চড়ে। সঙ্গে আরেকজন লম্বা লোক। সাদা পোশাক পরা হলেও বুঝতে অসুবিধে হলো না কিশোরের, এই লোক সাধারণ কেউ নন। হয় পুলিসের গোয়েন্দা বিভাগের হোমরা-চোমরা কেউ, নয়তো অন্য কোন ধরনের সিক্রেট সার্ভিসের; সিআইএর লোকও হতে পারে।

কিন্তু এই লোক ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কেন?

পরিচয় করিয়ে নিলেন ক্যাপ্টেন, ও কিশোর পাশা। হেসে বললেন, আমাদের লোকাল পুলিসকে খুব জ্বালাতন করে, তবে মাঝে মাঝে পুলিসকে বেশ সাহায্যও করে। অনেকগুলো জটিল কেসের সমাধান করা গেছে ও আর ওর বন্ধুদের কারণে।

রহস্যময় মানুষটার সঙ্গে হাত মেলাল কিশোর। একটা ব্যাপার লক্ষ কল, সঙ্গীর পরিচয় ছিলেন না ক্যাপ্টেন।

তাদেরকে বসার ঘ্রে এনে বসাল কিশোর।

চা-চাচী ফেরেনি। ভালই হয়েছে, নইলে পুলিস আসার জন্যে চাচীর কাছে একগাদা কৈফিয়ত দেয়া লাগত।

বসার পর সরাসরি কাজের কথায় এলেন ক্যাপ্টেন, হ্যাঁ, এখন বলো তো ইউরিক্লেসের ব্যাপারে কি কি জানো তুমি?

খুব বেশি কিছু না, স্যার, কিশোর বলল। এক কাজ করি, গোড়া থেকেই বলি। একটা রহস্যের তদন্ত করতে করতে ইউরিক্লেসের নামটা পেয়ে গেছি।

হ্যাঁ, বলো, প্রথম থেকেই বলো।

সবে শুরু করেছে কিশোর, এই সময় কয়েকটা সাইকেলের বেলের শব্দ শোনা গেল। বউ বউ করতে করতে দরজার দিকে ছুটে গেল টিটু।

ওই যে, মুসারা এসে পড়েছে। ক্যাপ্টেনের দিকে তাকাল কিশোর, ওরা এ ঘরে এলে কোন অসুবিধে আছে, স্যার? অন্যান্য বারের মত এবারও ওরা এ কেসে আমার সঙ্গে কাজ করছে।

না, কোন অসুবিধে নেই। আসতে বলো ওদের।

সাইকেল রেখে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল মুসা, ফারিহা, রবিন। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে অপরিচিত একজন লোক আছে দেখে থমকে দাঁড়াল।

হেসে হাত নেড়ে তিনজনকেই কাছে ডাকলেন ক্যাপ্টেন। উঠে হাত মেলালেন ওদের সঙ্গে।

দেখাদেখি ক্যাপ্টেনের সঙ্গীও উঠে দাঁড়ালেন। হাত বাড়িয়ে দিলেন।

হাত মেলানোর পালা শেষ হলে ফারিহা জিজ্ঞেস করল ক্যাপ্টেনকে, কাজে এসেছেন? নাকি আমাদের সঙ্গে দেখা করতে?

দুটোই। কিশোরের কাছে ফোন করেছিলাম। সে বলল, কি একটা গল্প নাকি আমাকে শোনাবে তোমরা।

সবাই বসল। ক্যাপ্টেনের যতটা সম্ভব কাছে বসল ফারিহা।

আবার গোড়া থেকে শুরু করল কিশোর। কিভাবে রবিনের কাছে হারের বাড়িতে চোর ঢোকার কথা বলেছিল দুধওয়ালা, কৌতূহলী হয়ে ওরা কিভাবে দেখতে গেল ওবাড়িতে, বেড়ালছানাটাকে বের করে আনল, সব বিস্তারিত বলতে লাগল।

স্বাভাবিকভাবেই ফগের কথা এসে পড়ল।

ক্যাপ্টেন বললেন, আমার আসার খবর বোধহয় ও পায়নি। কিশোর, ওকে একটা ফোন করে দেবে?

নিশ্চয়, স্যার।

 উঠে গিয়ে ফোন করে এল কিশোর। তারপর গল্পের বাকিটা বলতে লাগল।

পাঁচ মিনিটও গেল না, সাইকেল নিয়ে প্রায় উড়ে এসে পড়ল ফগ। হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল। কাপড়ে খাবারের ঝোল আর রুটির গুড়ো লেগে আছে। মোছারও সময় পায়নি। ফোন পেয়ে খাবার ফেলেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।

মাথা থেকে হেলমেট খুলে মেঝেতে রাখল সে।

ক্যাপ্টেন বললেন, বসো, ফগর‍্যাম্পারকট। কিশোর একটা গল্প শোনাচ্ছে আমাদের। তুমি এর অনেকখানিই জানো। কিন্তু রিপোর্টে তেমন কিছুই জানাওনি।

হাঁ হয়ে গেল ফগ। গোল চোখ আরও গোল। ভেবে পেল না কি কথা সে জানে অথচ ক্যাপ্টেনকে জানায়নি?

ফাঁকে দেখেই অস্থির হয়ে উঠেছে টিটু। আর থাকতে না পেরে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল ফগের গোড়ালির কাছে। ওর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে কড়া ধমক লাগাল কিশোর, অ্যাই, চুপ করে বোস্! জরুরী আলোচনা হচ্ছে।

কিশোরের দিকে তাকাল টিটু। মুখ দেখেই বুঝতে পারল, এখন দুষ্টুমি চলবে না। ফারিহার পায়ের কাছে গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল সে।

এগিয়ে চলল কিশোরের গল্প। রাতের বেলা চৌকিদারদের কাছে খোঁজ নিতে গিয়েছিল, তারপর ওকে ধরার জন্যে প্রায় সারারাত ঠাণ্ডার মধ্যে গাছের নিচে বসেছিল ফগ, এ কথায় আসার পর আর হাসি চাপতে পারল না মুসা। তার হাসি সংক্রমিত হলো ফারিহা আর রবিনের মধ্যে। জোর করে মুখ গভীর করে রাখল কিশোর। ক্যাপ্টেন আর তার সঙ্গীর মনে কি ঘটছে মুখ দেখে বোঝা গেল না। ঘাম দেখা দিয়েছে ফুগের কপালে।

পরদিন নদীতে নৌকা নিয়ে খুঁজতে গিয়ে কি পেয়েছিল ফগ, বলল কিশোর। ব্যাগের মধ্যে কি ছিল, তাও জানাল।

ফগের দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন, ফগর‍্যাম্পারকট, তোমার রিপোর্টে তো এ সব কথা বলনি? কি করেছ ওগুলো?

বেচারা ফগ। ভঙ্গি দেখে মনে হলো চোখ উল্টে দিয়ে পড়ে যাবে। ওর অবস্থা দেখে কিশোরের মায়াই হতে লাগল। তাড়াতাড়ি জবাব দিল, ওগুলো আমাকে দিয়ে দিয়েছিল। প্রতিটি জিনিস। অবাক হচ্ছেন, স্যার? আমিও হয়েছিলাম।

১৬.

কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, ক্যাপ্টেন বললেন, এত জরুরী সূত্রগুলো তোমাকে দিয়ে দিল কেন ও?

ঢোক গিলল ফগ। পাকা আপেলের মত টুকটুকে হয়ে যাচ্ছে গাল। ইস, হতভাগা বিচ্ছুটা! আবার ডোবাল ওকে! এই ছেলেটার কারণেই আবার অপদস্থ হতে চলেছে। জবাব খুঁজে পাচ্ছে না সে।

জবাব দিয়ে দিল ফারিহা, খুশি মনে কি আর দিয়েছে? ভেজা জিনিসগুলো পানি সহই ওর শার্টের ভেতর ঠেসে ভরে দিয়েছে।

আহ, ফারিহা, থামো তো! এমনিতেই যা অবস্থা হয়েছে ফগের, আরও বেকায়দায় ফেলতে চাইল না ওকে কিশোর। দোষটা আমারই ছিল।

আশ্চর্য! খুব বিরক্ত হলেন ক্যাপ্টেন। একজন পুলিস হয়ে তোমার এই আচরণ? শার্টের ভেতর ভেজা কাপড় ভরে শাস্তি দেয়াছি-ছি-ছি!

ঝামেলা! বিড়বিড় করল ফগ। না, স্যার…ইয়ে…আমি কি করে বুঝব কাপড়গুলো খুব জরুরী ছিল?…ওগুলো যে সূত্র, বুঝতেই পারিনি। আসলে ওই সকালে মাথাটা আমার এত গরম হয়ে ছিল…

আরে না না, বললাম তো, আবার বলল কিশোর, দোষটা আমারই ছিল। আপনার অত লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। ক্যাপ্টেনের দিকে তাকাল সে, আসলেই, স্যার, অতিরিক্ত বিরক্ত করে ফেলেছিলাম আমি মিস্টার ফগ্যাপারটকে। তারপর ফগকে বাঁচানোর জন্যে তাড়াতাড়ি আবার ওর কাহিনীতে ফিরে গেল। বলতে লাগল, কিভাবে কাপড়গুলো শুকিয়ে জুতোর বাক্সে ভরে রেখেছিল। রাতে চোর এসেছিল। কিন্তু কিছু নিতে পারেনি।

এ সব কথা ফগের কাছে নতুন। চোখ গোল গোল করে শুনতে লাগল সে।

সকালে মুসার আসার পর, কিশোর বলছে, পুতুলের পোশাকগুলো নিয়ে গিয়ে ছাউনিতে বসলাম ভালমত দেখার জন্যে। অনেকভাবে দেখেও প্রথমে কিছু পাইনি। শেষে ফারিহা কোটের হাতার ভেতর থেকে একটা খুদে রুমাল বের করল। তাতে ডেইজি ফুলের চারপাশ ঘিরে যে অক্ষরগুলো লেখা, সেগুলো এক করলে একটা নাম হয়ে যায়-ইউরিকেস। ফারিহার দিকে তাকাল সে, রুমালটা আছে সঙ্গে?

পকেট থেকে বের করে দিল ফারিহা।

চুপচাপ রুমালটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন ক্যাপ্টেন আর তার সঙ্গী। হাঁ হয়ে গেহে ফগ। ওর মাথায় কিছু ঢুকছে না।কিসের পুতুল? আর পুতুলের মধ্যে পাওয়া রুমালেরই বা কি অর্থ? রাতে বুড়ো ক্যামারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিল, হন্তদন্ত হয়ে নদীর দিকে ছুটে যেতে দেখেছে একটা লোককে। তার হাতে কোন জিনিস ছিল। বুড়োর মনে হয়েছে, জিনিসটা পানিতে ছুঁড়ে ফেলেছে লোকটা। যেহেতু হুবারের বাড়িতে চোর আসার রাতে ঘটেছে ঘটনাটা, ফগের সন্দেহ হয়েছিল, চোরাই মালটাল বা.ওই জাতীয় কোন কিছু পানিতে ফেলেছে চোর। লুকিয়ে রাখার জন্যে। এমন জায়গায়, যেখানে জলজ গাছগাছড়া আর শ্যাওলার মধ্যে আটকে থাকবে জিনিসটা। পরে এসে তুলে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু খুজতে গিয়ে যে পুতুলের পোশাকের ব্যাগ পেয়ে যাবে, আর অতি সাধারণ ওই জিনিসগুলো মূল্যবান সূত্র হয়ে যাবে, কল্পনাই করতে পারেনি। তাহলে কি আর বিচ্ছু ছেলেটাকে দেয়! উহ! রাগে এখন নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে ওর।

কিশোরের দিকে মুখ তুলে তাকালেন ক্যাপ্টেন, রুমালটা দেখে কি মনে হলো তোমার?

কিছুই না, জবাব দিল কিশোর। আমাকে অবাক করেছে নামটা।

কেন? প্রশ্ন করলেন তার সঙ্গী।

কারণ, স্বাভাবিক নাম নয় ওটা। ওই নামের কোন লোকের সঙ্গে আমার কোনদিন দেখা হয়নি। জানি, গ্রীসে গেলে ওই নামের অনেককেই পেয়ে যাব। নামটা আমাকে অবাক করেছিল কেন, বলি। এই নামের আরেক লোকের কথা আমি জানি, প্রাচীন গ্রীসে যার জন্ম, ভেনট্রিলোকুইজমের জনক বলা হয়। কি করে জানলাম নামটা, তাও বলি। একটা ভেনট্রিলোকুইজম শিক্ষার বইতে।

মৃদু স্বরে লম্বা ভদ্রলোক বললেন, বুদ্ধিমান ছেলে! কিশোরের দিকে তাকালেন, তাহলে তোমার মনে হয়েছিল ওগুলো আধুনিক কোন ভেনট্রিলোকুইস্টের পুতুলের পোশাক, যে ইউরিক্লেস নামে পরিচিত?

মাথা ঝাঁকাল কিশোর, হ্য। রুমালে নাম দেখে, ওই লোকটাকে খুঁজে বের করার কথা ভাবছিলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো এই রহস্যটা ভেদ করার মত কোন তথ্য পাওয়া যাবে।

আসনেই বুদ্ধিমান ছেলে,আনমনে বিড়বিড় করলেন আবার ভদ্রলোক। শুনে হয়তো খুশি হবে, তোমার অনুমান ঠিক। ইউরিকেল নামে সত্যিই একজন ভেনট্রিলোকুইস্ট আছে, আর ওই পোশাকগুলো তারই পুতুলের। হয়তো অবাক হবে শুনে এই পোশাকগুলো আমরাও খুঁজে বেড়াচ্ছি।

কেন? সত্যি অবাক হলো কিশোর। এত লোক সাধারণ একটা পুতুলের পোশাকের পেছনে লেগেছে কেন?

তুমি একটা গল্প শুনিয়েছ আমাদের, ভদ্রলোক বললেন, এবার আমি একটা গল্প শোনাই তোমাদের। তবে কথা দিতে হবে, আর কাউকে সেটা বলতে পারবে না। কোন প্রশ্ন করতে পারবে না। ইউরিক্লেসের নাম শুনে কেন অবাক হয়েছিলেন ক্যাপ্টেন রবার্টসন, জবাব পেয়ে যাবে গল্পটা শুনলে।

 সবগুলো চোখ স্থির হয়ে গেল তার মুখের ওপর, কেবল ক্যাপ্টেনের বাদে। তার চোখ সবার ওপর ঘুরছে।

কিশোর, তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, ক্যাপ্টেনের সঙ্গী বললেন, আশা করি বুঝে গেছ আমি পুলিস না হলেও ওরকমই একটা ডিপার্টমেন্টে কাজ করি।

নীরবে মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

আমাদের কাজ হলো, শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে যারা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাদের খুঁজে বের করা। অনেক লোক আছে ওরকম, বড় বড় জায়গায়, বড় বড় আসনে বসে আছে। অনেক তাদের ক্ষমতা, প্রভাব প্রতিপত্তি। তাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে খুব সাবধানে পা ফেলতে হয় আমাদে। প্রচুর খোঁজ-খবর, সাক্ষি-সাবুদ জোগাড় করে তবেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয়।

স্পাই! প্রায় ফিসফিস করে বলল ফারিহা।

 শুধু স্পাই নয়, আরও অনেক ধরনের খারাপ মানুষ আছে, তাদের দিকেও নজর রাখতে হয় আমাদের। মিস্টার ইউরিক্লেস আমাদের ইনফর্মার। ওইসব খারাপ মানুষদের খোঁজ-খবর দেয়। খুব ভাল ভেনট্রিলোকুইস্ট সে। পুতুল দিয়ে কথা বলানোর খেলা দেখায়। এ জন্যে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয় তাকে। খবর জোগাড়ের সুবিধে হয়। কনি হুবার ওর অ্যাসিসট্যান্ট।

ও, তাই! প্রায় চিৎকার করে উঠল ফারিহা।

আস্তে মাথা ঝাঁকালেন ক্যাপ্টেনের সঙ্গী। একদিন ইউরিক্লেসের এক বন্ধু এসে হাজির হলো আমার কাছে। জানাল, অপরাধীদের নামের একটা লিস্ট করেছে ইউরিক্লেস! কিন্তু শত্রুরা টের পেয়ে গিয়ে ওটা ছিনিয়ে নেয়ার জন্যে ওর পেছনে লেগেছে। লিস্টে এমন সব নাম আছে যাদের ধরার জন্যে আমরা অনেকদিন থেকে ওত পেতে আছি। দেশের ভেতরে শ্রমিক ধর্মঘট, কারখানায় ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ, আরও নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে এরা জড়িত বাঘা বাঘা সব মানুষ। সুতরাং লিস্টটা কতখানি দামী, বুঝতেই পারছ।

গভীর আগ্রহে শুনছে সবাই।

বলে চলেছেন ক্যাপ্টেনের সঙ্গী, তাকে সন্দেহ করে ফেলেছে অপরাধীরা, এটা টের পেয়ে গিয়ে লিস্টটা পুতুলের পোশাকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলল ইউরিক্লেস। আমরা কোন সাহায্য করার আগেই একরাতে কিডন্যাপ হয়ে গেল সে। তার আগে কোনভাবে সহকারী হুবারকে নিশ্চয় পুতুলটার কথা জানিয়ে যেতে পেরেছিল। ও কিডন্যাপ হওয়ার পর পরই ওর ঘর থেকে পুতুলটা বের করে নিয়ে যায় হুবার। ওটার মধ্যে মূল্যবান কিছু লুকানো আছে, বোধহয় জানানো হয়েছিল ওকে। কিন্তু কি জিনিস, সেটা বলা হয়নি। গ্রীনহিলসে এসে নতুন বাসা ভাড়া করে পুতুলটা সহ হুবার লুকিয়ে রইল যাতে শত্রুরা ওকে খুঁজে না পায়। কিন্তু বাঁচতে পারল না। অত্যাচার করে নিশ্চয় ইউরিক্লেসের মুখ থেকে আদায় করে নিয়েছিল কিডন্যাপাররা লিস্টটা কোথায় লুকানো আছে। হুবারকে খুঁজে বের করল ওরা। রাতের বেলা হানা দিল ওর বাড়িতে।

কে এসেছে বুঝতে পারল হুবার। টের পেয়ে আর দেরি করল না। পুতুলের গা থেকে তাড়াতাড়ি পোশাকগুলো খুলে নিয়ে একটা ব্যাগে ভরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। ওই তাড়াহুড়োর সময়ই লাল দস্তানাটা পড়ে গিয়েছিল, কিশোর যেটা খুঁজে পেয়েছে। তারপর ব্যাগটা নদীতে ফেলে দিয়ে এল হুবার। পুতুলটা লুকিয়েছে অন্য কোনখানে। হয়তো কোন খড়ের গাদায়। সেটা জরুরী নয়। কারণ লিস্টটা ওর মধ্যে নেই। ও এ সম্পর্কে কিছু জানে না, অস্বীকার করার জন্যেই সভবত এ কাজ করেছে। যাই হোক, ব্যাগটা পানিতে ফেলার কথা আজ নিয়ে জেনে গেছিল গালকাটা লোকটা। নদীতে খুঁজতে গিয়েছিল। কিন্তু ওর আগেই পেয়ে যায় ফগর‍্যাম্পারকট।

 এবারও চুপ থাকতে পারল না ফারিহা, আরেক কাজ করলেই পারত হুবার। লিস্টটা বের করে রেখে দিয়ে কাপড়গুলো ফেলে দিতে পারত।

কাছে রাখার সাহস পায়নি হয়তো।

 কিন্তু সে কি জানে না কাগজ পানিতে নষ্ট হয়ে যায়?

জানে। হয়তো এও জানে, কাগজটা এমনভাবেই রাখা আছে যাতে পানি লাগতে না পারে।

ক্যাপ্টেন বললেন, এখনই বোঝা যাবে সব। কিশোর, যাও তো, ওগুলো নিয়ে এসো।

চুপ করে রইল কিশোর। মুসা, রবিন আর ফারিহার মুখেও রা নেই।

ওদেরকে এ ভাবে চুপ হয়ে যেতে দেখে অবাক হলেন ক্যাপ্টেন। কি ব্যাপার?

ওগুলো আমার কাছে নেই, স্যার, মুখ কালো করে জবাব দিল কিশোর। ছাউনিতে রেখে বেরিয়েছিলাম, ফিরে এসে দেখি দরজা ভেঙে চুরি করে নিয়ে গেছে।

.

১৭.

 মৃদু শিস দিয়ে উঠলেন ক্যাপ্টেন। সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বললেন, যাহ্, গেল আবার হাতছাড়া হয়ে! গালকাটা লোকটাই নাকি?

তাই হবে, আর কে? চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন সঙ্গী। ওই লিস্ট আমাদের হাতে পড়লে ওর এবং আরও অনেকের সর্বনাশ হয়ে যাবে। নেয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিল তাই।

এবং শেষ পর্যন্ত নিয়ে ছাড়ল। কিশোরের দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন, সব নিয়ে গেছে?

হ্যাঁ। কেবল ছোট রুমালটা বাদে। ফারিহা ওটা পকেটে রেখে দিয়েছিল।

জিনিসগুলো কোথায় রেখেছিলে, চলো তো দেখি?

ঘর থেকে বেরিয়ে সবাই রওনা হলো ছাউনির দিকে। ফগও চলল। বিষণ্ণ হয়ে আছে খুব। যে রহস্যটা তার সমাধান করার কথা ছিল, করে ফেলেছিল প্রায়, নিজের বোকামির জন্যে সেটা হাত থেকে ফসকে গেল। এটা দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি।

ছাউনিতে ঢুকল সবাই। খালি জুতোর বাক্সটা দেখাল কিশোর। কিছু নেই ওর মধ্যে। আশেপাশে আরেকবার খুঁজে দেখল সবাই মিলে। কিছুই পাওয়া গেল না।

হঠাৎ মনে পড়ে গেল ফারিহার। চিৎকার করে উঠল, কিশোর, ভুলে গেছিলাম! টিটু একটা জুতো নিয়ে গিয়েছিল না?

উত্তেজিত হয়ে উঠল কিশোরও, আরে, তাই তো! ঘরের কোণের দিকে দৌড় দিল সে। বের করে আনল জুতোটা।

প্রায় ছোঁ মেরে ওর হাত থেকে ওটা নিয়ে নিলেন ক্যাপ্টেনের সঙ্গী। উল্টেপাল্টে দেখলেন। তারপর পকেট থেকে একটা ছোট ছুরি বের করে ধারাল ফলার মাথা দিয়ে খোঁচাতে শুরু করলেন জুতোর গোড়ালিতে।

খুব মজবুত করে বানানো। কেটে আলগা করতে সময় লাগল। ভেতরে একটা কুঠুরি তৈরি করা হয়েছে ইচ্ছে করে। তার মধ্যে ঠেসে ভরা হয়েছে একটা ভাঁজ করা কাগজ। মোম দিয়ে এমনভাবে বন্ধ করা হয়েছে কুঠুরির ফাঁকফোকর, পানি ঢুকতে পারেনি। বোঝা গেল জেনেশুনেই পানিতে ফেলেছিল হুবার।

চারপাশ থেকে ঘিরে আছে গোয়েন্দারা। সাবধানে ভাঁজ খুলে একনজর দেখেই পকেটে ভরে ফেললেন সেটা ক্যাপ্টেনের সঙ্গী। হাসিমুখে তাকালেন ক্যাপ্টেনের দিকে, হ্যাঁ, এটাই।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল গোয়েন্দারাও। ওদের মুখেও হাসি ফুটেছে। টিটুকে বার বার ধন্যবাদ দিতে লাগল। ওর শয়তানির যে এতটা সুফল মিলবে, কে বতে পেরেছিল।

কেবল ফগের মুখে হাসি নেই। সে আরও দমে গেছে।

ছাউনি থেকে দল বেঁধে আবার বেরিয়ে এল সবাই।

কিশোর জিজ্ঞেস করল ক্যাপ্টেনকে, এখন কি করবেন, স্যার?

প্রথমে হুবারের বাড়ি যাব। নিশ্চয় খুব আতঙ্কের মধ্যে কাটাচ্ছে বেচারা। এর ভয়টা দূর করব। তারপর খুঁজে বের করব গালকাটা লোকটাকে। আমার বিশ্বাস কাগজটা যেহেতু হাতে পায়নি, এখনও এই এলাকাতেই আছে সে। ধরতে তেমন অসুবিধে হবে না। ফগের দিকে তাকালেন তিনি, দায়িত্বটা তোমার ওপর দিয়ে সুবিধে হবে না। ভরসা করা যায় না। অফিসে গিয়েই লোক পাঠাচ্ছি। ওদেরকে সব রকমে সাহায্য করবে তুমি।

হঠাৎ সচকিত হয়ে খটাস করে স্যালুট কিল ফগ। ইয়েস, স্যার! নিশ্চয় স্যার! ঝামেলা!

হাঁটতে হাঁটতে কি মনে হতে কিশোরের দিকে ফিরে তাকালেন ক্যাপ্টেন, তুমি তো যেটা ধরো, সেটা শেষ করে ছাড়ো। ভেনট্রিলোকুইজমের বই পড়েছ বললে। শিখেছিলে নাকি?

হাসল কিশোর, খুব সামান্য। প্র্যাকটিস করতে গিয়ে তেমন ভাল লাগেনি বলে অল্প শিখে ছেড়ে দিয়েছি।

মুখটা নড়ে উঠল তার। গলাটা কেমন ফুলে উঠল। স্বর কিংবা কথা কিছুই বেরোল না।

ফগের ঠিক মাথার ওপরে একটা পেঁচা ডেকে উঠল কিররর-কিররর-কিররর। চমকে মুখ তুলে তাকাল সে। আহ, ঝামেলা! দিনকাল কি উল্টে গেল নাকি? এই দুপুরবেলা পেঁচা বেরোয়!

 পেঁচা কেন, মাথার ওপর কোন পাখিই দেখতে পেল না সে। আরও অবাক হয়ে গেল। এ কি ভূতুড়ে কাণ্ড! ডাক দিয়ে মুহূর্তে কোথায় উধাও হয়ে গেল পাখিটা?

কিন্তু ক্যাপ্টেন আর তার সঙ্গী ঠিকই বুঝে ফেলেছেন ব্যাপারটা।

ফগের দিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন বললেন, এখানেই তোমার সঙ্গে কিশোরের তফাৎ। ওর সামান্য চালাকিটাও ধরতে পারলে না। ঠিকই বোকা বানিয়ে ছাড়ল।

বড় বড় হয়ে গেল ফগের গোল চোখ। বোকাটা বনল কি করে ধরতে পারল না।

এখনও বুঝলেনা? আরে বোকা, ডাকটা কিশোরই দিয়েছে। ভেনট্রিলোকুইজম নিয়ে এত আলোচনা হলো, তাও মাথায় ঢুকল না? তোমার মাথার ওপর ও ছুঁড়ে দিয়েছে পেঁচার ডাক। এ জন্যেই তো পাখিটাকে দেখতে পাওনি। সবার সামনে বোকা বনে এতই হতাশ হয়ে গেল ফগ, তখনকার মত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, চাকরিটাই ছেড়ে দেবে। বিচ্ছু ছেলেটার কাছে পরাজিত হয়ে বার বার এ ভাবে লজ্জা পাওয়া থেকে তো বাঁচা যাবে। বিড়বিড় করে বলল, আহ, বড্ড ঝামেলা! তবে এতই আস্তে, কারও কানে গেল না কথাটা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *