নুড়ি

নুড়ি

ঘনাদার হাই তোলা একটা অনুষ্ঠান বিশেষ। গরাদের ফাক থেকে পুঁচকে দুপেয়ে জানোয়ারগুলোর বেআদবি দেখে দেখে সিংহ মশাই-এর যখন দিক ধরে যায়, তখন তার আলস্য-ভাঙা দেখবার সৌভাগ্য যদি কারুর হয়ে থাকে তা হলে সে ঘনাদার হাই তোলার কিঞ্চিৎ মর্ম বুঝতে পারবে। তেমনই বিরাট মুখব্যাদান, তেমনই দন্তরুচিকৌমুদির শোভা ও তেমনই তিন বৎসর তৈলবিহীন গোরুর গাড়ির চাকার আওয়াজের মতো সুদীর্ঘ একটানা একটি সুরলহরী। সিংহমশাই তবু ঘনাদার মতো তুড়ি দিতে পারে না।

ঘনাদার হাই তোলা দেখে আমরা সত্যি তাজ্জব হয়ে গেলাম। তাজ্জব হলাম তাঁর হাই তোলার দৃশ্যে নয়, তিনি যে হাই তুললেন কী করে শুধু এই কথা ভেবে।

রাম, শিবু ও আমি পরস্পরে হতাশ ভাবে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। হায়, হায়! সন্ধ্যার সমস্ত আয়োজনটাই মাটি!

সকাল থেকে অবিশ্রান্তভাবে বৃষ্টি পড়ছে। করপোরেশনের কর্তব্যপরায়ণতার দৌলতে সে বৃষ্টির জলের সাধ্য কি যে সহজে রাস্তা থেকে বেরোয়। ট্রাম বাস বন্ধ। কলকাতা প্রায় ভেনিস হয়ে উঠেছে বললেই হয়। এ হেন সন্ধ্যাটা মেসে বসে জমাবার জন্য সন্ধ্যা থেকে ঘনাদাকে উসকে দেবার কী চেষ্টাটাই না করা হয়েছে! কিন্তু এ বাদলায় ঘনাদাও যেন বাসি মুড়ির মতো মিইয়ে গেছেন।

যে-ঘনাদার কাছে তিল ফেলতে না ফেলতে তাল হয়ে ওঠে, জলের ছিটে পড়তে পড়তে যিনি প্রলয় প্লাবনে আমাদের ভাসিয়ে দেন, সেই ঘনাদাকে আজ সন্ধ্যা থেকে একটু তাতিয়ে তুলতে পর্যন্ত পারা গেল না।

অথচ কোনও অনুপানই বাদ পড়েনি।

ঘনাদাকে ধার দিতে দিতে শিশিরের সিগারেট কেস প্রায় খালি হয়ে এসেছে, শিবু ও রাম সেই যে নতুন মার্কিন সিগারেট লাইটারটা তাঁর হাতে দিয়েছে, তা প্রায় বাজেয়াপ্ত হবার শামিল জেনেও এখনও পর্যন্ত একবার ফেরত চায়নি। মেসের ম্যানেজার আমাদের শাসনে ভুলেও একবার ছমাসের বাকি পাওনার কথা তোলেনি এবং আমরা সবাই টমটম চালানো থেকে অ্যাটম বোমা পর্যন্ত হেন প্রসঙ্গ নেই যা ঘনাদার সামনে টোপ গিলতে তুলে ধরিনি।

কিন্তু আরামকেদারায় কমন রুমের একমাত্র আরাম-কেদারায় সেই যে ঘনাদা গা এলিয়ে দিয়েছেন, তারপর তাঁকে একটু সোজা করে বসাতেও পারিনি।

মাছ ধরার প্রসঙ্গ দিয়ে শিবু অনুষ্ঠান শুরু করেছে। রাম তাতে ফোড়ন দিয়ে বলেছে, বর্ষার দিনে মাছ নাকি টোপ খায় ভাল।

কিন্তু মাছে টোপ খাক বা না খাক, আমাদের টোপ বৃথাই নষ্ট হয়েছে। এমনকী কত বড় এক মহাশের একবার তার ছিপে উঠেছিল, গৌরাঙ্গ সগর্বে তা দুহাত ছড়িয়ে দেখিয়ে দেবার পরও ঘনাদার কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি।

মহাশের থেকে ঘনাদা একেবারে দক্ষিণ মেরুসাগরে মহাতিমি শিকারের কথা তুলবেন এই আশাই আমরা করেছিলাম, কিন্তু তার বদলে তিনি ক্লান্তভাবে শুধু একটু সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়েছেন।

মাছ থেকে আমরা পাহাড়ে ওঠার কথা তুলেছি। হাতের কাছে এমন একটা হিমালয় থাকা সত্ত্বেও বাঙালির ছেলেদের কেন যে পাহাড়ে চড়ার এতটুকু উৎসাহ ও যোগ্যতা নেই তা নিয়ে গৌরাঙ্গ দুঃখ প্রকাশ করেছে।

আমরা আড়চোখে চেয়ে দেখেছি ঘনাদা আরামকেদারার হাতলের ওপর একটা পা তুলে দিয়ে আর একটু আয়েশ করে শুয়েছেন।

পাহাড়ে চড়া থেকে বন্দুক ছোঁড়া ও তা থেকে আবার ঘোড়ায় চড়ায় আমরা ঘুরে গেছি।

ঘনাদা সিগারেটে সুখটান দিয়ে চোখ দুটি মুদ্রিত করেছেন। হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা ওয়েট-লিফটিং অর্থাৎ ওজন তোলার কথা পেড়েছি। বিজ্ঞানের নজির তুলে শিবু বলেছে—পোকামাকড়েরা যখন নিজেদের চেয়ে বহুগুণ ওজনের জিনিস তুলতে পারে, তখন মানুষেই বা পারবে না কেন?

প্রশ্নটা মাঠেই মারা গেছে। ঘনাদা হাই তুলেছেন এবং আমরা এবার আশা ছেড়ে দিয়েছি।

মরিয়া হয়েই রাম বোধ হয় শেষ চেষ্টা করেছে। কলাকৌশল সব জলাঞ্জলি দিয়ে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করেছে, আচ্ছা, ঘনাদা, আপনি কখনও ওয়েট লিফটিং করেননি?

ওয়েট-লিফটিং! ঘনাদা নেহাত আলস্যভরে বলেছেন, না, ওয়েট-লিফটিং করিনি। তবে একবার একটা পাথর তুলেছিলাম।

আমরা একেবারে উদগ্রীব হয়ে উঠে বসেছি। গৌরাঙ্গ সোৎসাহে জিজ্ঞাসা করেছে, পাথর তুলেছেন! কত বড় ঘনাদা?

আমাদের একেবারে দমিয়ে ধরাশায়ী করে ঘানাদা বলেছেন, কত বড় আর! এই এতটুকু নুড়ি ছটাকখানেক ওজন হবে।

আমাদের হতাশার দীর্ঘনিশ্বাস শেষ হবার আগে ঘনাদা অত্যন্ত তাচ্ছিল্যভরে আবার বলেছেন, মিকিউ দ্বীপটা তাতেই তো ফেটে চৌচির হয়ে গেল।

একটা দ্বীপ ফেটে চৌচির হয়ে গেল? শুধু একটা নুড়ি তোলার জন্য? নিজেদের অজান্তে আমরা প্রশ্ন করে ফেলেছি।

ঘনাদা যেন অবজ্ঞাভরে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেছেন, হ্যাঁ, তাইতেই ফেটে চৌচির হয়ে সমুদ্রে ড়ুবে গেল।

না, আর ঘনাদাকে উসকানি দেবার দরকার হয়নি।

তিনি নিজেই এবার শুরু করেছেন।

 

নিউ হেব্রাইডিজের নাম শুনেছিস কখনও?

আর শুনে থাকলেও আসলে কী বস্তু বোধ হয় জানিস না। নিউ হেব্রাইডিজ হল নিউজিল্যান্ডের ঠিক উত্তরে অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্ব কোণে কয়েকটি ছোট ছোট দ্বীপের জটলা।

পৃথিবীর মাইল পঞ্চাশ ওপর থেকে দেখলে মনে হবে যেন সমুদ্রের ওপর কটা পাথরকুচি ফাঁক ফাঁক করে সাজিয়ে ইংরেজি ওয়াই অক্ষরটা লেখা।

এই ওয়াই-এর তিনটে হাতা যেখানে এসে মিলেছে সেখানকার এফাটা দ্বীপটাই হল সমস্ত দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী।

এফাটায় দুটো বন্দর, ভিলা আর হাভানা। ভিলা বন্দরেই সরকারি আস্তানা।

চন্দন কাঠের ব্যবসার জন্য তখন নিউ হেব্রাইডিজের একেবারে দক্ষিণের আনিওয়া নামে একটি দ্বীপে থাকি। সেখান থেকে সরকারি লাইসেন্স নেবার জন্যে ভিলা বন্দরে ক-দিনের জন্যে এসেছি।

সরকারি দপ্তরখানা সব দেশেই সমান। আঠারো মাসে তাদের বছর। নিউ হেব্রাইডিজে আবার এ বিষয়ে গোদের ওপর বিষফোড়া আছে। একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব সেখানে দোসর। নিউ হেব্রাইডিজের রাজধানী এক, কিন্তু রাজত্ব দুজনের। ইংরেজ আর ফরাসি এক সঙ্গে মিলে সেখানে শাসন করে। সুতরাং সাত দিনের কাজ সাত সপ্তাহেও সারা হল না। ইংরেজি থেকে ফরাসি আর ফরাসি থেকে ইংরেজিতে তরজমা হতে হতে আমার লাইসেন্সের আর্জি, কোন লালফিতের জালে যে জড়িয়ে পড়েছে তার হদিসই তখন পাচ্ছি না। ঠিক এই সময়ে সঁসিয়ে পেত্রার সঙ্গে আমার হঠাৎ আলাপ হয়। আলাপ হল আশ্চর্য ভাবে। রাজধানী ও বন্দর হলে কী হয়, ভিলাতে ভাল একটা হোটেল নেই। মালানা নামে একটি দেশি লোকের টিনের চাল দেওয়া একটা মেটে দোতলার ওপরকার একখানা ঘর ভাড়া করে আছি। সেদিন সরকারি দপ্তরখানা থেকে যত অকর্মণ্য কর্মচারীদের সঙ্গে বচসা করে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরছি, এমন সময় ওপরে আমারই ঘরে তুমুল আন্দোলন হচ্ছে বলে মনে হল।

নড়বড়ে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে অত্যন্ত অবাক হয়ে ওপরে উঠে গেলাম। ঘরের দরজায় যাবার সময় আমি তালা দিয়ে গেছি নিজের হাতে। সে ঘরে গণ্ডগোল হয় কী করে?

সিড়ি দিয়ে উঠে মাঝখানের বারান্দাটুকু পার হবার আগেই মালানার সঙ্গে দেখা। আমার ঘর থেকে সে উত্তেজিতভাবে বেরিয়ে আসছে। আমায় দেখতে পেয়েই সে হাত-পা নেড়ে জানালে যে এখুনি আমাদের পুলিশে যাওয়া দরকার।

পুলিশে যাওয়া দরকার? কেন?

আর কেন? কোথাকার এক ফরাসি গুণ্ডা এসে আপনার ঘর দখল করেছে। আমি কত ঠেকাবার চেষ্টা করলাম, তা শুনলই না। জোর করে তালা ভেঙে ঘরে ঢুকল। এখনই আমি থানায় যাচ্ছি।

হেসে বললাম, তার আগে লোকটার চেহারা একবার দেখা দরকার নয় কি!

মালানা সভয়ে বলল, দেখবেন কী মশাই! সে একেবারে খুনে গুণ্ডা। কী করে বসবে ঠিক নেই।

হেসে বললাম, আমি কী করব যখন ঠিক আছে তখন ভাবনা কী?

মালানা কথাটা ঠিক বুঝতে না পেরে একটু হতভম্ব হয়ে ভয়ে ভয়ে আমার পিছু পিছু এল।

ঘরে ঢুকেই দেখি আমার জিনিসপত্র চারিদিকে ছত্রাকারে ছড়ানো! তারই মধ্যে আমার ডেক-চেয়ারটিতে গা এলিয়ে দিয়ে বিশাল চেহারার একটি লোক নিশ্চিন্ত আরামে পাইপ টানছে। পরনে একটা প্যান্ট ছাড়া তার কিছু নেই। গরমের দরুনই বোধ হয় গায়ের জামাজোড়া সব খুলে ফেলেছে। লোকটার গায়ের চামড়া সাদা এবং গোঁফ-দাড়ির ছাঁট দেখলে ফরাসি বলেই মনে হয়।

আমায় ঢুকতে দেখেই লোকটা ডেক-চেয়ারে উঠে বসে বাঘের মতো ফরাসি ভাষায় হুঙ্কার দিয়ে উঠল, কে রে, হতভাগা নিগার!

মালান তো সেই হুঙ্কার শুনেই তীরের মতো ছিটকে গিয়ে পড়ল বারান্দায়। তারপর আর তার চুলের টিকি দেখা গেল না।

মুচকে একটু হেসে আমি একেবারে পরিষ্কার বাংলায় বললাম, চিনতে পারছ না, সাহেব! আমি তোমার যম!

দুর্বোধ ভাষা শুনে আর আমায় হাসতে দেখে সাহেব একেবারে খেপে গেল। আমায় প্রায় কাঁচাই গিলে ফেলবে এমনই ভাবে দাঁত কড়মড় করে দাঁড়িয়ে উঠে এবার ইংরেজিতে বললে, বেরিয়ে যা শিগগির, কালা নেটিভ! নইলে তোর গায়ের সমস্ত চামড়া আমি খুলে নেব।

আগের মতোই হেসে বললাম, বল কী সাহেব, আমার যে শুনেই গা সুড়সুড় করছে, কিন্তু তার আগে তোমায় যে একটু গা তুলতে হবে, এটা আমারই ঘর কিনা।

আমার মুখে চোস্ত জার্মান শুনে সাহেব প্রথমটা একেবারে থ হয়ে গেল। যাই হোক, সাহেব একেবারে মুখখু নয়, জার্মান ভাষাটা অন্তত বোঝে জেনে আমার একটু কৌতূহলও তখন বেড়েছে।

প্রথমে হতভম্ব হলেও পরমুহূর্তেই আমার কথার বিষটুকুর জ্বালাতে সাহেব একেবারে ফেটে পড়ল, এ ঘর তোমার? প্রমাণ কী তার?

আবার একটু হেসে আমার জিনিসপত্রগুলো দেখিয়ে দিয়ে বললাম, প্রমাণ তো তুমিই ঘরময় ছড়িয়ে রেখেছ।

বটে! বলে সাহেব হঠাৎ আমার সুটকেসটা ধরে বাইরের বারান্দায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললে, যাও, তোমার প্রমাণ ঘরের বার হয়ে গেছে। আর সুবুদ্ধি যদি এখনও হয় তা হলে একটি লাথিতে তোমাকেও ওই প্রমাণের পিছু পিছু পাঠিয়ে দেব।

ঘরের মাঝখানেই সাহেবের প্রকাণ্ড কেবিন ট্রাঙ্কটা পড়েছিল। সেটা তুলে নিয়ে বললাম, সেটা একটু অভদ্রতা হয় নাকি? তার চেয়ে বরং তুমিই দেখো, সাহেব, আমি তোমার মোট বইবার সমস্যাটা মিটিয়ে দিচ্ছি।

ট্রাঙ্কটা ছুঁড়ে বারান্দা পার করে নীচে ফেলে দিলাম।

সাহেব এক লহমা হাঁ করে দাঁড়িয়ে থেকে একেবারে তোপের গোলার মত আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

জামাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে চেয়ে দেখি, জানালার কাছে সচাপ্টে যেমন ভাবে

পড়েছিল সাহেব সেইভাবেই শুয়ে আছে। নট নড়নচড়ন নট কিচ্ছু!

ঘরের কুঁজো থেকে তার মুখে জল ছিটিয়ে দিয়ে নিজেই এবার গিয়ে তুলে ধরলাম।

সাহেব হাঁফিয়ে উঠে বসে চোখ না খুলেই চেঁচিয়ে উঠল, আমি মরে গেছি, নির্ঘাত মরে গেছি।

তাকে একটা ঝাঁকানি দিয়ে বললাম, হ্যাঁ, মরে তুমি নরকে এসেছ। যমরাজ তোমায় অভ্যর্থনা করতে এসেছেন। চেয়ে দেখো!

সাহেব এবার চোখ খুলে তাকিয়ে বললে, অ্যাঁ-মরিনি তা হলে! কিন্তু আমার শিরদাঁড়া ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেছে!

বললাম, না, তাও হয়নি। উঠে দাঁড়াও দেখি।

সাহেব কিন্তু বসে বসে আমায় ভাল করে লক্ষ করে বললে, তুমি কি জাপানি?

তারপর নিজে নিজেই আবার বললে, উঁহুঃ, জাপানিদের চেহারা তো এরকম হয়!

হেসে বললাম, আমি জাপানি নয় বাঙালি। বাংলাদেশের নাম শুনেছ। কখনও?

বাংলাদেশ! সাহেবের চোখ দুটো বড় হয়ে উঠল, বাংলাদেশের নাম শুনিনি। আবার? তাগোরের সঙ্গে আমার কত আলাপ ছিল।

তাগোরের সঙ্গে! তাগোর আবার কে?

বাঃ—রাবীন্‌দ্রা নাত্‌ তাগোর!

বুঝলাম কবিগুরুর নাম ফরাসি উচ্চারণে এই রকম দাঁড়িয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, তার সঙ্গে তোমার আলাপ ছিল? কোথায় আলাপ হয়েছিল?

একটু যেন ভড়কে গিয়ে সে বললে, আলাপ মানে দেখাশোনা আর কি! পারিতে দেখাশোনা হয়েছিল।

বেশ একটু কড়াভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, কী সূত্রে?

সাহেব আরও আমতা আমতা করে বললে, মানে, তিনি যখন ওখানে ছিলেন তখন কাগজে তাঁর ফটো দেখেছিলাম।

ধমক দিয়ে এবার বললাম, দেখো সাহেব, আমার কাছে ওসব ধাপ্পা দিয়ে কোনও লাভ হবে না। তোমার পাততাড়ি গুটিয়ে এঘর থেকে সরে পড়তেই হবে। নাও ওঠো।

সাহেব এবার রীতিমতো কাঁদুনি গেয়ে উঠল, উঠব তো! কিন্তু যাব কোন চুলোয় শুনি? পোড়া শহরে কি একটা হোটেল আছে? সারাদিন ঘুরে একটা ঘরের বারান্দা পর্যন্ত ভাড়া পাইনি। আমি কি রাস্তায় গিয়ে শোব?

এবার হেসে ফেলে বললাম, আচ্ছা, আমার এখানে থাকতে পারো, কিন্তু বেচাল যেন আর না দেখি।

সাহেব নিজের গর্দানটায় একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বললে, না, আমার গর্দানটা বিমা করা নেই।

মালপত্র নীচে থেকে তুলে এনে তারপর আমরা বেশ জমিয়ে বসে আলাপ শুরু করলাম। মসিয়ে পেত্রা আমারই মতো ভবঘুরে লোক। ঝগড়া দিয়ে শুরু হওয়ায় এবং দুজনেই এক ধাতের লোক হওয়ায়, দোস্তি-টা আমাদের খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। আমি ইতিমধ্যে আমার চন্দন কাঠের ব্যবসার কথা বলেছি। মসিয়ে পেত্রা মাথা নেড়ে বলেছে, ওসব চন্দন কাঠ-টাট কোনও কাজের নয়, এ দ্বীপপুঞ্জের আসল মাল হল গন্ধক! দেখো না এক বছরের মধ্যে এই গন্ধকের ব্যবসায় কী রকম লাল হয়ে যাই।

উদারভাবে পেত্রা তারপর আমাকে তার ব্যবসার ভাগীদার করতে রাজি হয়েছে। তামি হেসে বলেছি, আগে তুমি গন্ধকের খনি খুঁজে বার করো, তারপর দেখা যাবে!

পেত্রা অত্যন্ত ক্ষুন্ন হয়ে বলেছে, ওঃ, তুমি আমায় অবিশ্বাস করছ—পাগল ভাবছ আমায়! আচ্ছা, দেখতে পাবে একদিন।

 

পেত্রার আস্ফালন যে একেবারে মিথ্যে নয়, একদিন সত্যিই তার প্রমাণ পেয়েছি। কিন্তু সে প্রায় বছর ছয়েক বাদে। এই ছ বছর তার কোনও খোঁজই রাখিনি বা পাইনি। এফাটা দ্বীপে মালানার বাড়িতে আমার ঘরে দুদিন থাকার পর হঠাৎ একদিন সকালবেলা কিছু না বলে কয়ে সে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছল। একটু অবাক হলেও তার সম্বন্ধে বিশেষ মাথা ঘামাইনি। এ রকম খামখেয়ালি লোক দুনিয়ায় এ পর্যন্ত অনেক দেখেছি। বিকেলে কী করবে সকালে তারা নিজেরাই জানে না।

ছ বছর বাদে আবার তার সঙ্গে সাক্ষাৎ! এবার খুব অদ্ভুত ভাবে।

আনিওয়া দ্বীপে ফিরে এসে চন্দন কাঠের পেছনে তখনও লেগে আছি। কিন্তু ব্যবসা অত্যন্ত মন্দা। ফিজি দ্বীপের চন্দন কাঠ উজাড় করবার পর বেহিসাবি সদাগরেরা এই দ্বীপে হানা দিয়ে অবাধে যথেচ্ছভাবে চন্দন গাছ কেটে একেবারে সাবাড় করে দিয়েছে বললেই হয়।

ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে আবার কোথাও পাড়ি দেব কিনা ভাবছি। এমন সময় অদ্ভুত। একটা ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। আনিওয়া দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে সমুদ্রের ধারের একটি ছোট গাঁয়ের সর্দারের বাড়িতে তখন আমি থাকি। কিছুদিন ধরেই গাঁয়ের লোকদের ভেতর একটা চাঞ্চল্য ও উত্তেজনা লক্ষ করছিলাম। সেদিন তার কারণটা জেনে অবাক হয়ে গেলাম।

আমাদের গাঁ থেকে মাইল দশেক দূরে সমুদ্রের ওপর আর একটি ছোট দ্বীপ দেখা যায়। দ্বীপ না বলে তাকে সমুদ্রের ভেতর থেকে ওঠা একটা পাহাড় বলাই উচিত। যেদিকে যাও, সমুদ্রের ওপর থেকে প্রায় খাড়া পাহাড়ের দেয়াল প্রায় দু হাজার ফুট উঠে গেছে।

এ দ্বীপটিকে এ অঞ্চলের লোকে অপদেবতার বাসা বলেই জানে। জনমনিষ্যি সেখানে থাকে না। শুধু ঝাঁকে ঝাঁকে সামুদ্রিক পাখি সন্ধ্যার পর সেই পাহাড়ের নীচের দিকের খাঁজে ও পাথুরে তাকে রাত্রিবাস করতে নামে। দুঃসাহসী দু-চার জন দেশি লোক তাদের ভারা-ঝোলানো কাটা মারান নৌকোয় দিনের বেলা সেখানে, সেই পাখিদের আবর্জনার সার হিসেবে অত্যন্ত দামি, গুয়ানো সংগ্রহ করতে যায়। কিন্তু মরে গেলেও সেখানে রাত কাটায় না। এমনকী দিনের বেলাতেও পাহাড়ের ওপর কী আছে তারা কোনও দিন সাহস করে চড়ে দেখেনি।

এই ভুতুড়ে পাহাড়ে কিছুদিন থেকে অপদেবতার উৎপাত নাকি আরও বেড়ে গেছে। গুয়ানো কুড়োতে গিয়ে এক দলের জন ছয়েক নাকি আশ্চর্য ভাবে মারা পড়েছে। ওপর থেকে প্রকাণ্ড একটা পাথর ঠিক তাদের লক্ষ করেই কে গড়িয়ে দিয়েছিল। আরেক দল পাহাড়ের ওপর বিকট এক মূর্তি দিনের বেলাতেই দেখতে পেয়েছে।

এসব ছাড়া রাত্রে আজকাল পাহাড়ের ওপর এই গাঁ থেকেই অদ্ভুত ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে দেখা যায়, মাঝে মাঝে রহস্যজনক শব্দও সেখান থেকে ভেসে আসে।

পাছে পাহাড়ের অপদেবতার কোপ এই গাঁ পর্যন্ত এসে পৌঁছায়, সেই ভয়েই গাঁয়ের লোক সারা। ভূতের ওঝারাও সময় বুঝে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করতে ব্যস্ত। অপদেবতাকে ঠাণ্ডা করবার কড়ার দিয়ে তারা ষােড়শোপচারে ভূত পুজোর আয়োজন করেছে।

সর্দারের কাছে ব্যাপারটা সব শুনে, আমি নিজেই পাহাড়ে দ্বীপে যাব ঠিক করলাম। সদারের নিষেধ-মানা, উপরোধ-অনুরোধ যদি বা কাটানো গেল, দ্বীপে আমায় নৌকোয় পৌছে দেয় এমন লোকই পেলাম না গাঁয়ে।

অবশেষে রেগে ছোট একটা ডিঙি নিয়ে নিজেই একদিনে বিকেলে দ্বীপের উদ্দেশে রওনা হলাম। সঙ্গে একটা ধারালো ছুরি। আর কুয়ো থেকে যা দিয়ে ড়ুবে-যাওয়া বালতি ঘড়া তোলে সে রকম কাঁটার গোছা বাঁধা একটা লম্বা মজবুত দড়ি। রাত কাটাবার মতো কিছু খাবার-দাবারও সর্দার সঙ্গে দিয়েছিল, যদিও রাত আমার সেখানে কাটবে কি না সে বিষয়ে তার ঘোরতর সন্দেহ।

আমার ডিঙি সমুদ্রে ঠেলে দেবার সময় সর্দার প্রায় কেঁদে ফেলে আর কি! এতদিন এক সঙ্গে থাকার দরুন আমার ওপর এই সরল অসভ্য মেলানেশিয়ের সত্যি একটা মায়া পড়েছিল। এমন সাধ করে বেঘোরে মরতে যাওয়ায় তাই সে সত্যিই ব্যথা পেয়েছে।

একলা ডিঙি বেয়ে ভূতুড়ে পাহাড়ের দিকে যেতে যেতে নিজেরও কাজটা একটু বেশিরকম গোঁয়ারতুমি বলে মনে হচ্ছিল। কোথায় কোন চুলোয় কী ভূতুড়ে কাণ্ড হচ্ছে, তাতে তোর মাথাব্যথা কেন বাপু! কিন্তু ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে যাওয়াই যার স্বভাব তার উপায় কী!

ভূতুড়ে দ্বীপের ধারে গিয়ে যখন পৌঁছোলাম তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। সামুদ্রিক পাখিদের অধিকাংশই পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ডানা গুটিয়ে তখন নিজেদের আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে। দু-চারটে দেরি করে ফেরা পাখির পাখার ঝটপটানি শুধু শোনা যাচ্ছে।

সুবিধেমতো এক জায়গায় পাহাড়ের ধারে নৌকো বেঁধে ছুরিটা আর দড়ি-বাঁধা কাঁটাটা নিয়ে তীরে উঠলাম। তীরে মানেও পাথর। সে পাথরের তীর গজ কুড়ি পরেই খাড়া পাহাড়ের দেয়ালে শেষ হয়েছে। ছুরিটা কোমরে গুঁজে দড়ি বাঁধা কাঁটাগুলো ওপরের দিকে ছুঁড়ে দিলাম। একবার ফসকাবার পর ওপরের একটা খাঁজে কাঁটা আটকে গেল। ঠিক মতো আটকেছে কিনা দড়ি নেড়ে একবার দেখে নিয়ে তা-ই বেয়ে সেই খাঁজের ভেতর পা দিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর আবার কাঁটা ছুঁড়ে ওপরের কোনও খাঁজে লাগাবার কসরত।

এমনই ভাবে প্রাণ হাতে করে পাহাড়ের মাথায় গিয়ে যখন উঠলাম তখন বেশ রাত হয়েছে। আমি পাহাড়ের পশ্চিম দিক দিয়ে উঠেছিলাম। সে দিকটা অন্ধকার হলেও ওপারে কৃষ্ণপক্ষের চতুর্থী না পঞ্চমীর চাঁদের আলো পড়ে চারিদিক বেশ ভালই দেখা যাচ্ছে।

সেই আলোয় সামনে যা দেখা গেল তাতে আমি সত্যি অবাক! পাহাড়ের ওপরে ছোট একটি হ্রদ। নীচে থেকে এ জলাশয়টির কথা কল্পনাও করা যায় না। কেউ করেওনি এপর্যন্ত। সমস্ত পাহাড়টা যেন পেয়ালার মতো এই হ্রদটিকে ওপরে তুলে ধরেছে।

নিঃসঙ্গ পাহাড়ের চূড়ায় চাঁদের আলোয় ঝলমলে হ্রদটিকে কী সুন্দর যে দেখাচ্ছিল, কী বলব!

দড়ি বেয়ে ওঠার পরিশ্রমে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। হ্রদের ধারে একটা পাথরের চাঁই-এর পাশে বসে মুখ চোখে জল দিতে যাচ্ছি, হঠাৎ নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই সমস্ত শরীর এক মুহূর্তের জন্য কেমন যেন হিম হয়ে গেল।

হ্রদের ঠিক ওপারে জলের ভেতর থেকে সত্যিই একটা বিকট মূর্তি ওপরে উঠে আসছে। মূর্তিটা মানুষের মতো সোজা হয়ে হাঁটছে-কিন্তু মানুষের সঙ্গে আর কোনও সাদৃশ্য তার নেই। কবন্ধের মতে, বর্তুলাকার বীভৎস একটা ধড় যেন দুটো থামের ওপর দাঁড় করানো—তার হাঁটার ভঙ্গিও এমন অমানুষিক যে আপনা থেকে সমস্ত শরীর শিউরে উঠে।

মূর্তিটা জল থেকে উঠে বিশ্রী টলমলে পায়ে দুলতে দুলতে ওপারের পাহাড়ের একটা অন্ধকার গহ্বরের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

না, এ রহস্যের মীমাংসা না করলে নয়। মন শক্ত করে যথাসম্ভব সাবধান হয়ে হ্রদের পাড় দিয়ে ওপারে দৌড়ে গেলাম।

সামনে সুড়ঙ্গের মতো সেই গহ্বর। এক মূহূর্ত ইতস্তত করে ছুরিটা কোমর থেকে খুলে নিয়ে তার ভেতর গিয়ে ঢুকলাম। সুড়ঙ্গটা বেশি দীর্ঘ নয়, একটা বাঁক ফিরতেই দূরে একটা আলোকিত জায়গা দেখা গেল। এই কি তা হলে হ্রদের জলের সেই বিকট জীবের আস্তানা? আলো জ্বালবার ক্ষমতাও কি তার আছে?

সন্তর্পণে পা টিপে টিপে সেখানে গিয়ে পৌঁছোলাম। সুড়ঙ্গটা এখানে একটা মাঝারি গোছের গুহায় শেষ হয়েছে।

গুহার ভেতরে পৌঁছে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। সেখানে কেউ নেই, কিন্তু ঘরের এক পাশে একটা কেরোসিনের বাতি জ্বলছে, দেওয়ালে পোশাক-আশাক টাঙানো।

এই ভুতুড়ে দ্বীপে এই দুর্গম পাহাড়ের চূড়ায় মানুষ এল কোথা থেকে! জলের তলা থেকে ওঠা সেই অমানুষিক জীবটিই বা গেল কোথায়!

অবাক হয়ে দেওয়ালের ধারের পোশাকগুলো লক্ষ করছি এমন সময় সমস্ত গুহা। কাঁপিয়ে সশব্দে একটা বন্দুকের গুলি আমার কানের পাশ দিয়ে দেয়ালে গিয়ে লাগল।

বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে আমার ছুরিও হাত থেকে ছুটে বেরিয়ে ওধারের দেওয়ালে বিধে গিয়ে কাঁপতে লাগল। যে বন্দুক ছুঁড়েছিল তার ডান হাতের জামার আস্তিন সেই ছুরিতে দেওয়ালের সঙ্গে আঁট হয়ে গেছে। হাত নাড়বার তার ক্ষমতা নেই।

লোকটার ওপর এবার ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে সবিস্ময়ে বললাম, এ কী, মসিয়ে পেত্রা!

মঁসিয়ে পেত্রা করুণভাবে একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ, আপাতত তোমার বন্দী!

 

অর্ধেক রাত তারপর আমাদের পরস্পরের খোঁজখবর নিতেই কেটে গেল। কী করে বন্দরের খোঁজে নানা জায়গা ঘুরে সঁসিয়ে পেত্রা শেষে এই দ্বীপে উঠেছে, সব কাহিনী শোনার পর জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু জলের তলার সেই কিম্ভুতকিমাকার জীবটি তা হলে কী?

পেত্রা একটু হেসে আমায় নিয়ে গুহার একদিকের একটি পাথরের দরজা সরিয়ে অন্য একটা ছোট গুহায় নিয়ে গেল। পাথরের দরজাটি এমন কায়দায় বসানো যে এমনিতে চোখে পড়ে না। আমারও চোখে পড়েনি।

ছোট গুহার ভেতরে ঢুকে সামনের দিকে আঙুল দেখিয়ে পেত্রা বললে, এই তোমার সেই বিকট জীব।

অবাক হয়ে দেখি সামনে দুটো ড়ুবুরির পোশাক দেওয়ালের ধারে সাজানো হয়েছে! পোশাক দুটি সাধারণ ড়ুবুরির পোশাক থেকে একটু অবশ্য ভিন্নভাবে তৈরি।

পেত্রা নিজেই সে কথা আমায় জানালে, পোশাকগুলো আমি নিজেই ফরমাশ দিয়ে গড়িয়ে এনেছি।

কিন্তু কেন? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।

কেন?—আচ্ছা দেখবে চলো, বলে পেত্রা আমায় নিয়ে আবার সেই হ্রদের ধারে গিয়ে বললে, জলে এখন একটু হাত দাও দেখি।

হাত দিয়ে সবিস্ময়ে বললাম, এ কী, এ তো রীতিমতো গরম! ঘণ্টা তিনেক আগেও তো ঠাণ্ডা দেখেছি!

পেত্রা থেমে বললে, এইটেই এ হ্রদের রহস্য এবং তারই কিনারা করবার জন্যে এই ড়ুবুরির পোশাক। এ হ্রদ থেকে থেকে হঠাৎ এত গরম হয়ে ওঠে যে ওপরে ঝঞার কুণ্ডলী উঠতে থাকে। এদেশে লোকরা তাই দেখে ভাবে এখানে অপদেবতা আছে।

জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি ড়ুবুরির পোশাকে এ হ্রদের জলে নেমে কী পেয়েছ?

কী পেয়েছি, কাল ঠাণ্ডা হবার পর নীচে নামলেই দেখতে পাবে।

পরের দিন জল ঠাণ্ডা হতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। ড়ুবুরির পোশাক পরে আমরা দুজনে তারপর হ্রদের নীচে নামলাম। পাহাড়ের ওপরে হলেও হ্রদটি খুব কম গভীর নয়। কিন্তু জল এমন পরিষ্কার যে দেখতে কিছু কষ্ট হয় না।

জলের তলায় পরস্পরের সঙ্গে কথা বলবার জন্যে আমরা একটা স্পিকিং টিউব অর্থাৎ কথা কইবার রবারের নলের ব্যবস্থা করে গিয়েছিলাম।

হ্রদের তলায় এক জায়গায় এসে পেত্রা বললে, নীচের দিকে চেয়ে কিছু দেখতে পাচ্ছ?

বললাম, দেখতে পাচ্ছি তো নীলচে একরকম পাথর।

নীলচে পাথর নয়, পৃথিবীর সব চেয়ে দামি রত্ন হিরে যার মধ্যে পাওয়া যায় এ সেই পাথর।

হিরে! উত্তেজিত ভাবে নীচের দিকে চেয়ে দেখতে দেখতে চমকে উঠলাম। নীলচে পাথরের গায়ে সত্যিই নানা জায়গায় আরেক জাতের পাথর এই জলের তলাতেও জ্বলজ্বল করছে।

হিরে! চারিধারে এত হিরে! এই হ্রদের মধ্যে তো সাতটা সাম্রাজ্যের ঐশ্বর্য তা হলে লুকোনো রয়েছে। মনের ওপর যেন রাশ রুখল না। ওরই ভেতর প্রকাণ্ড একটা জ্বলজ্বলে পাথর দেখতে পেয়ে সেটা নেবার জন্যে পাগল হয়ে উঠলাম। বাটালি গগাছের একটা যন্ত্র পেত্রা সঙ্গে এনেছিল। সেটা দিয়ে ঠুকে ঠুকে ধারের পাথর আলগা করে যখন সেটা তুললাম তখন অবাক হয়ে দেখি তার নীচে একটা নলের মতো গর্ত বেরিয়ে পড়েছে এবং তার ভেতর দিয়ে হুহু করে জল গলে যাচ্ছে।

এই সামান্য ব্যাপারে পেত্রা কিন্তু হঠাৎ যেন খেপে গেল। আমার আরও কয়েকটা হিরে সংগ্রহ করবার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সে একেবারে পাগলের মতো টানতে টানতে আমায় ওপরে নিয়ে গিয়ে তুলল। শুধু তাই নয়, ড়ুবুরির পোশাক ছেড়ে ফেলেই আমায় কোনও কথা বলবার অবসর না দিয়ে, টেনে নিয়ে গেল পাহাড়ের এক প্রান্তে। সেখান থেকে দড়ির একটি সিঁড়ি জলের ধার পর্যন্ত টাঙানো এবং জলের ধারে পাহাড়ে একটি খাঁজের আড়ালে একটি ছোট মোটরঞ্চ দেখলাম লুকোনো রয়েছে।

দড়ির সিঁড়ি দিয়ে মোটর-বোটে নেমে সেটি চালিয়ে মাইল দশেক দ্বীপটি থেকে দূরে যাবার আগে মুখে ফেনা উঠিয়েও পেত্রার কাছ থেকে একটা কথা বার করতে পারলাম না।

অবশেষে অত্যন্ত রেগে বললাম, আমার কথার জবাব যদি না দাও তা হলে তোমায় বোট থেকে আমি সমুদ্রে ফেলে দেব-বুঝেছো! বলো—এ রকম ভাবে হঠাৎ পাগলের মতো পালিয়ে আসার মানে কী?

মানে এখুনি বুঝতে পারবে। কানে আঙুল দিয়ে শক্ত হয়ে বোটের রেলিং ধরে বোসো দেখি।

তার পরের কথা আর শুনতে পেলাম না। আমি দ্বীপটির দিকেই মুখ ফিরিয়েছিলাম। হঠাৎ আকাশ ফাটানো শব্দে সেই বিরাট পাহাড়ের দ্বীপটি তুবড়ির খোলের মতো চৌচির হয়ে ফেটে গিয়ে সমুদ্রের জলে ড়ুবে গেল।

প্রলয়ের মতো যে ঝড় তারপর উঠল, আর যে সব প্রচণ্ড ঢেউ এসে দৈত্যের মতো কিছুক্ষণ আমাদের বোট নিয়ে লোফালুফি শুরু করলে, তাদের হাত থেকে বেঁচে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছতে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল।

এইবার পেত্রাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কী বলো তো পেত্রা!

ব্যাপার আর কী? তোমার এই হিরে তোলা!

ওই এক ছটাক একটা নুড়ি তোলাতেই এত বড় একটা দ্বীপ ফেটে চৌচির হয়ে গেল!

তা যাবে না! পেত্রা বুঝিয়ে দিল, দ্বীপটা আসলে একটা আগ্নেয়গিরি ছাড়া কিছু নয়। ওপরে যে হ্রদ দেখেছ সেটা এককালে ছিল আগুন বেরুবার মুখ, এখন কোনও রকমে বুজে গিয়ে বহুকালের বৃষ্টির জল জমে হ্রদ হয়ে উঠেছে। কিন্তু নীচেকার আগুন যে এখনও নিভে যায়নি, জল মাঝে মাঝে গরম হওয়াতেই তা বোঝা যায়।

হ্রদের তলাটি খুব পুরু তো নয়। তুমি নুড়ি তোলার সঙ্গে সঙ্গে কোনও গোপন ফুটো তাই সেখানে বেরিয়ে পড়ে। সেই ফুটো দিয়ে হ্রদের জল গভীর পাতালের প্রচণ্ড আগুনের ওপর গিয়ে পড়ে। সে জলের তার পর বাষ্প হয়ে উঠতে কতক্ষণ! ওপরে তো সরু একটা ফুটো। বেরুবার পথ না পেয়ে সেই বাষ্প তাই ক্রমশ প্রচণ্ড বেগ পেতে পেতে গোটা পাহাড়টাকে ফাটিয়ে বেরিয়ে গেছে। ঐ নুড়িটুকু তুলেই দ্বীপটাকে তুমি ভোবালে!

ঘনাদার গল্প শেষ হলে গৌরাঙ্গ সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলে, দ্বীপটার নাম কী ছিল ঘনাদা?

ঘনাদা বিরক্ত হয়ে বললেন, যা ড়ুবে গেছে তার নামে কী দরকার?

আর সেই ছটাক-খানেক হিরেটা? শিবু জিজ্ঞাসা করলে, সেটা নিশ্চয় হাতছাড়া করেননি।

ঘনাদা হঠাৎ কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। শিবুর কথাটা বোধ হয় তাঁর। কানে গেল না।