1 of 3

০২।১ দ্বিতীয় কাণ্ড : প্রথম অনুবাক

অথর্ববেদসংহিতাদ্বিতীয় কাণ্ড
প্রথম অনুবাক
প্রথম সূক্ত : পরমং ধাম
[ঋষি : বেন দেবতা : ব্রহ্ম, আত্মা ছন্দ : ত্রিষ্টুপ, জগতী ]

মন্ত্রঃ বেনস্তৎ পশ্যৎ পরমং গুহা যদ যত্র বিশ্বং ভবত্যেকরূপ। ইদং পৃশ্নিরদুহজ্জায়মানাঃ স্ববিদো অভ্যন্ষত ব্রাঃ। ১। প্র তদ বোচে অমৃতস্য বিদ্বান্ গন্ধর্বো ধাম পরমং গুহা যৎ। ত্রীণি পদানি নিহিতা গুহাস্য যস্তানি বেদ স পিতৃপিসৎ ॥ ২॥ স নঃ পিতা জনিতা স উত বন্ধুধামানি বেদ ভুবনানি বিশ্বা। যো দেবানাং নামধ এক এব তং সংপ্রশ্নং ভূবনা যন্তি সর্বা ॥ ৩॥ পরি দ্যাবাপৃথিবী সদ্য আয়মুপাতিষ্ঠে প্রথমজামৃতস্য। বাচমিব বক্তরি ভুবনেষ্ঠা ধারেষ নন্বেষো অগ্নিঃ ॥ ৪ পরি বিশ্বা ভুবনান্যায়মৃতস্য তন্তুং বিততং দৃশে কম্। যত্র দেবা অমৃতমানশানাঃ সমানে যোনাবধ্যৈরয়ন্ত ॥ ৫

বঙ্গানুবাদ –সত্য জ্ঞান ইত্যাদি লক্ষণসম্পন্ন পরব্রহ্মে সম্পূর্ণ বিশ্ব লীন হয়ে আছে; এই হেন ব্রহ্মকে বেন (সূর্য) দেখেছিলেন। এই ভৌতিক জগতে অভিন্ন এবং সর্বশক্তিযুক্ত হওয়ায় তাঁকে (পরব্রহ্মকে) তিনি (বেন) সূর্যের রূপে এবং নামে প্রকট করেছিলেন। তবেই উৎপন্ন প্রজাগণ সেই সূর্যকে জ্ঞাত হয় এবং সম্মুখে দণ্ডায়মান হয়ে স্তব করে থাকে৷৷ ১।

রশ্মিবন্ত সূর্য হৃদয়-গুহায় স্থিত সেই ব্রহ্মকে আরাধকবৃন্দের নিকট বর্ণনা করুন। এই ব্রহ্মের তিন পাদ গুহায় স্থিত আছে, অর্থাৎ সাধারণ দৃষ্টি অথবা জ্ঞানের অন্তরালে অবস্থিত। সেই ব্রহ্মের জ্ঞান কেবল সত্য উপদেশের দ্বারাই লব্ধ হতে পারে৷৷ ২৷

সেই সূর্যাত্মক ব্ৰহ্ম (পরমাত্মা) আমাদের পোষক পিতা হন, তিনি আমাদের উৎপন্নকর্তা, তিনিই আমাদের ভ্রাতা ইত্যাদি। তিনিই আমাদের কর্মফলরূপ স্বর্গ ইত্যাদির জ্ঞাতা। সকল লোককে তিনি জ্ঞাতশীল। যে পরব্রহ্মকে বর্ণনা করা হয়েছে, তিনি ইন্দ্র, অগ্নি ইত্যাদি নামে লোকে প্রকট হয়ে থাকেন ৷৷ ৩৷

আমি আকাশ পৃথিবী এবং সম্পূর্ণ বিশ্বকে তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা প্রাপ্তি সম্পন্ন করেছি। সত্য ব্রহ্ম দ্বারা প্রথম উৎপন্ন সূত্ৰাত্মা যেমন সংসারকে ব্যাপ্ত করে স্থিত থাকে, সেইরকমেই আমি স্থিত হয়েছি। বক্তার মধ্যে স্থিত বাণীর প্রযুক্ত হওয়া মাত্রই যেমন সকল। জ্ঞান প্রকাশ পায় (জাত হয়), তেমনই তত্ত্বজ্ঞান প্রকট হতেই আমি সেই সব কিছুই প্রাপ্ত হয়ে গেছি। ৪।

ইন্দ্র ইত্যাদি দেবতা যে কারণভূত ব্রহ্মে লীন হয়ে যান এবং যে ব্রহ্মের বৃত্তিসমূহের দ্বারা সাক্ষাৎ হওয়ার পরমানন্দ ভোগ প্রাপ্ত হয়ে ইন্দ্রিয়সমূহ ব্রহ্মে মগ্ন হয়ে যায়, সেই ব্রহ্মের। দর্শনার্থ আমি জ্ঞান প্রাপ্ত হওয়ার পূর্বে বিভিন্ন লোকে অনেক বার ভ্রমণ সম্পন্ন করেছি। ৫।

সূক্তস্য বিনিয়োগঃ— দ্বিতীয়ে কাণ্ডে ষড় অনুবাকাঃ। তত্র প্রথমেনুবাকে পঞ্চ সূক্তানি। তত্র বেনস্তৎ ইতি প্রথমং সূক্ত। তস্য অভিমতফলসিদ্ধ্যসিদ্ধিবিজ্ঞানকর্মসু বিনিয়োগঃ। তানি চ। পঞ্চপর্বযুতবেণুদণ্ডং কাস্পীলবৃক্ষশাখাং যুগং বা অভিমন্ত্র অভিমতকার্যং সঞ্চিন্ত্য সমে দেশে ঊর্ধ্ব ধারয়েৎ। যদি দণ্ডায়শ্চিন্তিতদিশি নিপতেয়ুঃ তদা কার্যসিদ্ধিং জানীয়াৎ বিপর্যয়ে তু অসিদ্ধিং। তদ্বদেব ইয়ুং সন্ধায় অনেন সূক্তেন অভিমন্যু বিসৃজেৎ। নির্দিষ্টলক্ষ্যপতনেন অর্থসিদ্ধি। তথৈব দৰ্ভস্তম্বং অনেন অভিমন্ত্র কার্যং চিন্তয়িত্বা গণয়েৎ। সমসংখ্যায়াং অভিমত সিদ্ধিঃ। এবম্ ইং অভিমন্যু অগ্নৌ প্রক্ষিপেৎ। প্রদক্ষিণ জ্বলনেন ইষ্টসিদ্ধিঃ। তথৈব অক্ষান্ অনেন অভিমন্ত্র প্রক্ষিপেৎ। ইষ্টসংখ্যাপতনেন কার্যসিদ্ধিঃ ৷৷ এবং হস্তয়োরলিদ্বয়ং অনেন অভিমন্যু চিন্তয়েৎ। উদ্দিষ্টাঙ্গুলিস্পর্শনেন অভিলষিতসিদ্ধিঃ। তথৈব একবিংশতিসংখ্যাকাঃ শর্করা অভিমন্ত্র ততো গৃহীত্ব বিভজেৎ। যথোদ্দেশং সমবিষমভাবেন অর্থসিদ্ধিঃ ৷৷ তথা নষ্টদ্রব্যবিজ্ঞানার্থং উদকুম্ভং হলং অক্ষান বা নববস্ত্রেণ আবেষ্ট্য সম্পত্য অভিমন্ত্র অরজোবিত্তে কুমাঠে হরতং ইতি ক্ৰয়াৎ। তে চ যেন দিভাগেন হরেতাং ততো নষ্টং ইতি জানীয়াৎ৷৷ তথৈব বিবাহাৎ প্রাক্ কুমাৰ্যাঃ সৌভাগ্যাদিলক্ষণবিজ্ঞানকর্মন্যপি আকৃতিলোষ্টবল্মীকলোষ্টচতুস্পথলোষ্ট শ্মশানলোষ্টরূপাশ্চতস্রে মৃত্তিকা অনেনৈব সূক্তেন অভিমন্যু আসাং অন্যতমাং গৃহাণেতি কুমারীং ক্ৰয়াৎ। তত্র আকৃতিলোষ্টবল্মীকলোষ্টয়োঃ স্পর্শনে কল্যাণং ভবতি। আকৃতিলোষ্টঃ ক্ষেত্ৰমৃত্তিকেতি পূর্বং উক্তং। চতুষ্পলোষ্টস্পর্শনেন মরিষ্যতীতি জানীয়াৎ৷৷ তথা কুমাৰ্যা অঞ্জলৌ উদকং আপূর্য অভিমন্ত্র প্রক্ষিপেতি তাং ক্ৰয়াৎ। যদি প্রাচীং দিশং প্রতি নিনয়েৎ তথা কল্যাণং প্রতীয়াৎ। …অত্র স নঃ পিতা জনিতা ইত্যস্যা ঋচঃ অগ্নিচয়নে ষোড়শগৃহীতোত্তরাধাজ্যেন বৈশ্যকর্মণহোমে বিনিয়োগঃ… ইত্যাদি। (২কা, ১অ. ১সূ.)।

টীকা –দেবভাষায় বিরচিত উপরোক্ত সূক্তস্য বিনিয়োগঃ অংশে সায়ণাচার্যের বক্তব্য অনুসারে পরমং ধাম নামে প্রসিদ্ধ এই সূক্তের মন্ত্রগুলি নানারকম কর্মে, যথা,-অভিমত ফলসিদ্ধি বা অসিদ্ধি জানার জন্য বিনিয়োগ হয়ে থাকে। এর জন্য করণীয় সম্পর্কে তাঁর নির্দেশ এই যে, পাঁচটি পর্বযুক্ত একটি বংশদণ্ড (বেণুদণ্ড) কাম্পীলবৃক্ষ-শাখা বা যুগকে মন্ত্রপূত করে অভিমত কার্য বা উদ্দেশ্য স্মরণ (চিন্তা) পূর্বক সমতল স্থানে ঊধ্বদিকে ধারণ করণীয়। যদি দণ্ড ইত্যাদি চিন্তিত দিকে নিপতিত হয়, তবে কার্যসিদ্ধি, বিপর্যয়ে অসিদ্ধি, জানা যাবে। এই মন্ত্রের দ্বারা নষ্টদ্রব্য সম্পর্কে সম্যক সন্ধান জ্ঞাত হওয়া যায়। এই মন্ত্রের দ্বারা কুমারী কন্যার বিবাহের পর সৌভাগ্য ইত্যাদি সম্পর্কে ভবিতব্য জানা যায়।–এই প্রথম সূক্তের প্রথম মন্ত্রে বেন অর্থে আদিত্য বলা হয়েছে। গুহারূপে সর্বপ্রাণিহৃদয়ে সুতি-অন্তর প্রসিদ্ধ সত্যজ্ঞান ইত্যাদি পরম ব্রহ্মকে লক্ষ্য করা হয়েছে। এবং উক্তলক্ষণঃ সর্বজ্ঞ আদিত্যঃ শুভাশুভবিজ্ঞানং করোতু ইতি বিজ্ঞানকর্মণ সম্বন্ধঃ। (২কা, ১অ ১.সূ)।

.

 দ্বিতীয় সূক্ত : ভুবনপতিসূক্তম

 [ঋষি : মাতৃনামা দেবতা : গন্ধর্ব, অপ্সরা ছন্দ : ত্রিষ্টুপ, জগতী, গায়ত্রী, অনুষ্টুপ ]

মন্ত্রঃ দিব্যো গন্ধর্বো ভুবনস্য যতিরেক এব নমসস্যা বিস্ফীড্যঃ। তং ত্বা যৌমি ব্ৰহ্মণা দিব্য দেব নমস্তে অস্তু দিবি তে সধস্থম্ ॥১॥ দিবি স্পৃষ্টো যজতঃ সূৰ্য্যত্বগবয়াতা হরসো দৈব্যস্য। মৃডা গন্ধর্বো ভুবনস্য ষষ্পতিরেক এব নমস্যঃ সুশেবাঃ ॥ ২॥ অনবদ্যাভিঃ সমু জন্ম আভিরম্পরাস্কপি গন্ধর্ব আসীৎ। সমুদ্র আসাং সদনং ম আহুর্যতঃ সদ্য আ চ পরা চ যন্তি ॥ ৩॥.. অভিয়ে দিদুন্নক্ষত্রিয়ে যা বিশ্বাবসুং গন্ধর্ব সচর্ধ্বে। তাভ্যো বো দেবীম ইৎ কৃণোমি ॥ ৪৷ যাঃ ক্লাস্তমিষীচয়োহক্ষকামা মনোমুহঃ। তাভ্যো গন্ধর্বপত্নীভ্যোহরাভ্যোকরং নমঃ ॥ ৫

বঙ্গানুবাদ –দিব্য জল (বা রশ্মির) এবং শক্তিসমূহের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন সূর্য (গন্ধর্ব) বর্ষা ইত্যাদির দ্বারা পুষ্ট করার কারণে পৃথিবী ইত্যাদি লোকসমূহের স্বামী হন এবং তিনি প্রাণিসমূহকেও পুষ্টকরণশালী হয়ে থাকেন। তিনি প্রজাগণের নিমিত্ত স্তুত্য (পূজনীয়)। হে গন্ধর্ব সূর্য! আমি তোমাকে পরব্রহ্ম ভাবে (রূপে) মান্য (বা স্বীকার) করছি; এবং হবিঃ প্রদান পূর্বক নমস্কার করছি ৷ ১৷৷ যে গন্ধর্ব আকাশে স্থিত, সূর্যরূপ অপেক্ষাও তেজস্বী, লোকজগতের স্বামী, দেববর্গের ক্রোধ (বা আক্রোশ) দূরীকরণশালী এবং সুখদাতা, তিনি আমাদের সুখ প্রদান করুন। ২। সুন্দর রূপসম্পন্না রশ্মিরূপা অপ্সরাগণ অপেক্ষা সূর্যরূপ গন্ধর্ব সুসংগত হয়েছেন। এই অপ্সরাবৃন্দের স্থান সমুদ্রোপ নামক সূর্যই হন। বিদ্বানগণ বলে থাকেন, সূর্যোদয় কালে সূর্য হতেই রশ্মিসমূহ বহির্গত হয়, আবার অস্তকালে তাতেই লীন হয়ে যায়। ৩ ৷৷ হে নক্ষত্র রূপা রশ্মিসকল! তোমরা তোমাদের অপেক্ষা যে সম্পূর্ণ ঐশ্বর্যশালী চন্দ্রমার সাথে সংযুক্ত হয়ে থাকে, সেই হেন রূপসম্পন্ন তোমাদের আমি নমস্কারযুক্ত হবিঃ প্রদান করছি। ৪। উপদ্রবের দ্বারা মনুষ্যগণকে রোদন-করণশালিনী, মোহে নিমগ্নকারিণী, গ্লানির কারণস্বরূপা গন্ধর্বপত্নী অপ্সরাগণকে নমস্কার পূর্বক হবিঃ প্রদান করছি। ৫।

সূক্তস্য বিনিয়োগঃ –দিব্যো গন্ধর্বঃ ইত্যেৎ সূক্তং মাতৃনামগণে পঠিতং।…অস্য সূক্তস্য গন্ধর্বরাক্ষসারোভূতগ্রহাদিশান্তয়ে ঘৃতাক্তসবৌষধিহোমে চতুষ্পথে গ্রহগৃহীতশিরঃস্থিতমৃন্ময় কপালাগ্নিহোমাদৌ চ বিনিয়োগঃ… তথা ঘৃতমাংসমধুহিরণ্যপাংস্বাদিঘোরবর্ষণাত্তুতে মর্কটশ্বাপদাদি রূপয়ক্ষাত্তুতে গোমায়ুনামকমণ্ডুকবদনাদিষু অদ্ভুতেষু (চ) অনেন সূক্তেন আজং জুহুয়াৎ …তথা গ্রহযজ্ঞে প্রধানহোমানন্তরং শান্ত্যর্থং অনেন সূক্তেন আজং জুহুয়াৎ।…তথা প্রাঊদীরিতানাং– ত্রিংশচ্ছান্তীনাং তন্ত্রভূতায়াং মহাশূন্তৌ অনেন সূক্তেন আজং হুত্বা কুম্ভে সংপাতা আনয়েৎ। উক্তং হি নক্ষত্রকল্পে।…তথা অশ্বমেধে দিব্যো গন্ধর্বঃ ইত্যনয়া ঋচা ব্রহ্মা সংবৎসরান্তে যুজ্যমানং অক্ষং অনুমন্ত্ৰয়েত।… ইত্যাদি। (২কা, ১অ. ২)।

টীকা ভূবনপতিসূক্ত নামে প্রসিদ্ধ এই সূক্তের মন্ত্রগুলি মাতৃনামগণে পঠিত। গন্ধর্ব, রাক্ষস, অপ্সরা, ভূত, গ্রহ ইত্যাদির শান্তিকরণে বিনিযুক্ত হয়ে থাকে। উপরোক্ত সূক্তস্য বিনিয়োগঃ অংশে প্রয়োগবিধি দেওয়া হয়েছে। গ্রহজ্ঞে, মহাশান্তিকর্মে এর প্রয়োগ হয়। অশ্বমেধ যজ্ঞে এই ঋকাবলীর দ্বারা অনুমন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। (২কা, ১অ. ২সূ)।

.

তৃতীয় সূক্ত : আস্রাবস্য ভেষজম

[ঋষি : অঙ্গিরা দেবতা : ভৈষজ্য, আয়ু, ধন্বন্তরী ছন্দ : অনুষ্টুপ, বৃহতী ]

অদো যদবধাবত্যবৎকমধি পর্বতাৎ। তৎ তে কৃণোমি ভেষজং সুভেষজং যথাসসি। ১৷৷ আদা কুবিদঙ্গা শতং যা ভেষজানি তে। তেষামসি ত্বমুত্তমমনাস্রাবমরোগণম্ ॥ ২॥ নীচৈঃ খনন্ত্যসুরা অরুস্রাণমিদং মহৎ। তদাস্রাবস্য ভেষজং তদু রোগমনীনশৎ ॥ ৩ উপজীকা উত্তরন্তি সমুদ্ৰাদধি ভেষজ। তদাস্রাবস্য ভেষজং তদু রোগমশীশমৎ ॥৪৷ অরুস্রাণমিদং মহৎ পৃথিব্যা অধস্তৃত। তদাস্রাবস্য ভেষজং তদু রোগমনীনশৎ ॥ ৫৷৷ শং নো ভবন্তুপ ওষধয়ঃ শিবাঃ। ইন্দ্রস্য বজো অপ হন্তু রক্ষস আরাদ্বিসৃষ্টা ইষবঃ পতন্তু রক্ষসাম্ ॥ ৬৷৷

বঙ্গানুবাদ –যে মুঞ্জ ব্যাধি হরণশীল, শ্রেষ্ঠ পর্বত হতে উত্তরণশীল, তার অগ্রভাগ হতে ঔষধ প্রস্তুত করি। হে মুঞ্জ! তোমাকে পরম বীর্যযুক্ত ঔষধিরূপে প্রস্তুত করে ব্যাধি দূর করার নিমিত্ত প্রযুক্ত করছি। ১।

 হে ঔষধি! তুমি প্রযুক্ত হওয়া মাত্রই রোগকে বিনষ্ট করো; অতিসার ইত্যাদি রোগের বিনাশ সাধন করো। হে ঔষধি! তুমি আপন সজাতীয় ওষধি সমূহের মধ্যে উৎকৃষ্ট; তুমি অতিসার, অতিমূত্র এবং নাড়ীব্রণের নাশকরণে সম্পূর্ণভাবে সমর্থ ॥ ২॥

প্রাণনাশক অসুর এবং দেহপাত করণশীল ব্যাধিসমূহ এই ব্রণের মুখ (বা অগ্রভাগ) দিয়ে (দেহে) ব্যাপ্ত হচ্ছে। পরন্তু এই মুঞ্জ নামক ঔষধি স্রাবকে নিবর্তনশীল তথা অতিসার ইত্যাদি রোগকে নষ্টকরণশালী ৷৷ ৩৷৷

ভূমিগত জলরাশি হতে রোগনাশিনী ঔষধিরূপ মৃত্তিকা উপরে আগত হচ্ছে; এই বল্মীক-মৃত্তিকা (বা ক্ষেতের মৃত্তিকা) ব্রণকে পাক-করণশালী এবং অতিসার ইত্যাদি রোগসমূহকে সমূলে বিনাশ করে। থাকে ॥ ৫॥

ভেষজের নিমিত্ত প্রয়োগকৃত জল আমাদের রোগসমূহের প্রশমনকারী ও সুখদায়ক হয়। রোগ-উৎপাদক কারণসমূহকে ইন্দ্রের বজ্র বিনাশ করুক। রাক্ষসদের দ্বারা মনুষ্যগণের উপর। নিক্ষিপ্ত রোগরূপ আয়ুধ (বা বাণসকল) অন্যত্র (দূরে) গমন পূর্বক পতিত হোক৷ ৬ ৷৷

সূক্তস্য বিনিয়োগঃ –অদো যৎ ইতি সূক্তেন জ্বরাতিসারাতিমূত্রনাড়ীব্রণেষু তদুপশান্তয়ে মুঞ্জশিয়োনির্মিতরঙ্কুবন্ধনং ক্ষেত্রেমৃত্তিকায়া বা পায়নং সর্পিৰ্লেপনং চর্মদৃতিমুখেন অপানশিশ্ননাড়ীব্রণ মুখানাং কার্যং…ইত্যাদি৷৷(২কা, ১অ. ৩সূ)।

 টীকা –বলা হয়েছে, এই সূক্তে পর্বত শব্দের দ্বারা মুঞ্জবান নামক পর্বত বিবক্ষিত। সূক্তস্য বিনিয়োগঃ অংশে দেখা যাচ্ছে, এই সূক্তের মন্ত্রগুলি জ্বরাতিসার, অতিমূত্র, নাড়ীব্রণ ইত্যাদি রোগের না উপশান্তির নিমিত্ত প্রযুক্ত হয়। এই মন্ত্রের দ্বারা মুগ্ধশিরনির্মিত রঞ্জুর বন্ধন করণীয় বা ক্ষেত্ৰমৃত্তিকা ইত্যাদির প্রলেপ প্রদেয়। ইত্যাদি।(২কা, ১অ. ৩সূ.)।

.

চতুর্থ সূক্ত : দীর্ঘায়ুঃপ্রাপ্তিঃ

[ঋষি : অথর্বা দেবতা : (চন্দ্রমা), জঙ্গিড়মণি ছন্দ : পংক্তি, অনুষ্টুপ ]

দীর্ঘায়ুত্বায় বৃহতে রণায়ারিষ্যন্তো দক্ষমাণাঃ সদৈব। মণিং বিষ্কন্ধদূষণং জঙ্গিড়ং বিভৃমো বয়ম্ ॥১॥ জঙ্গিছড়া জম্ভা বিশরাদ বিন্ধা অভিশোচনাৎ। মণিঃ সহস্রবীর্যঃ পরিঃ পঃ পাতু বিশ্বতঃ॥ ২॥ অয়ং বিষ্কন্ধং সহতেইয়ং বাধতে অত্ৰিণঃ। অয়ং নো বিশ্বভেষজো জঙ্গিড়ঃ পাত্বংহসঃ ॥ ৩৷৷ দেবৈদত্তেন মণিনা জঙ্গিড়েন ময়োভুবা। বিষ্কন্ধং সর্বা রক্ষাংসি ব্যায়ামে সহামহে ॥ ৪৷ শণশ্চ মা জঙ্গিশ্চ বিষ্কন্ধাদভি রক্ষতাম্। অরণ্যান্য আভৃতঃ কৃষ্যা অন্যো রসেভ্যঃ ॥ ৫৷  কৃত্যাদূষিরয়ং মণিরথো অরাতিদূষিঃ। অথো সহস্বান্ জঙ্গিড়ঃ প্রণ আয়ুংষি তারিষৎ ॥ ৬৷৷

বঙ্গানুবাদ –আমরা দীর্ঘজীবী; তার নিমিত্ত হিংসাত্মক কর্মসমূহ হতে নিজেদের সদা রক্ষা করতে, রাক্ষসদের বেগকে অবরুদ্ধ করতে এবং শরীরকে সুখশালী করবার উদ্দেশে ব্যাধি দূরীকরণশালী জঙ্গিড় নামক বৃক্ষ নির্মিত মণি বন্ধন (ধারণ) করছি ॥১॥

 এই জঙ্গিড়মণি হিংসক কৃত্যা, রাক্ষসগণের চর্বণ (কামড়) হতে শরীরকে খণ্ড বিখণ্ডিত হওয়া হতে রক্ষা করতে সমর্থ। এটি সকল দিক হতে আমাদের সুরক্ষা করুক ॥২॥

এই মণি অপরের দ্বারা প্রেরিত উপদ্রবসমূহের মোকাবিলা করে থাকে এবং কৃত্যা ইত্যাদিকে নাশ করে থাকে। সমস্ত রোগকে শান্তকরণশালী ঔষধি রূপ এই মণি আমাদের পাপ হতে রক্ষা করুক ॥৩॥

অগ্নি ইত্যাদি দেবতাগণের দ্বারা প্রদত্ত সুখ-উৎপাদক জঙ্গিড়মণির সাহায্যে আমরা বিঘুরাশিকে, ভূত, প্রেত, পিশাচ এবং অসুরগণকে তাদের সঞ্চরণ স্থানেই নিবারণ করবো॥৪॥

 মণি-বন্ধক সূত্র-রূপ শণ এবং জঙ্গিড় আমাকে সকল দিক হতে রক্ষাকরণশালী হোক। এইগুলি হতে একটি শণ কৃষির রস (সার) হতে এবং জঙ্গিড় জঙ্গল, হতে আনীত হয়েছে। এই রকমে প্রাপ্ত এই দুটি আমাদের বিঘ্ন ইত্যাদি হতে রক্ষা করুক ॥৫॥

অন্যজনের দ্বারা অভিচার হতে উৎপন্ন পীড়াদায়িনী কৃত্যাকে এই মণি দূর করে থাকে। এটি বলবতী, শত্রুকে পরাভব-করণশালী। এই জঙ্গিড় মণি আমাদের আয়ুকে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত করুক ॥ ৬ ॥

সূক্তস্য বিনিয়োগঃ –দীর্ঘায়ুত্বায় ইতি সূক্তেন কৃত্যাদূষণার্থং আত্মরক্ষার্থং বিঘুশমনার্থং চ জঙ্গিড়াখ্যবৃক্ষবিশেষমণিং শণসূত্রপোতং কৃত্বা সংপাত্য অভিমন্যু বীয়াৎ।…দীর্ঘায়ুত্বায় চিরকাল জীবনায়…….জঙ্গিড়ঃ বৃক্ষবিশেষো বারাণস্যাং প্রসিদ্ধ। ইত্যাদি৷৷ (২কা, ১অ. ৪সূ)।

টীকা –দীর্ঘায়ু অর্থাৎ চিরকাল জীবন লাভের নিমিত্ত, কৃত্যা-দূষণার্থের জন্য, আত্মরক্ষার্থে ও বিঘ্নশমনার্থে জঙ্গিড় নামক বৃক্ষ বিশেষের দ্বারা নির্মিত মনি শণসূত্রে অভিমন্ত্রিত পূর্বক ধারণ কর্তব্য। এই জঙ্গিড় নামক বৃক্ষবিশেষ বারাণসীতে প্রসিদ্ধ এক বৃক্ষ। (২কা, ১অ. ৪সূ.)।.

.

পঞ্চম সূক্ত : ইন্দ্রস্য বীর্যাণি

 [ঋষি : ভৃগুরাথর্বণঃ দেবতা : ইন্দ্র ছন্দ : বৃহতী, ত্রিষ্টুপ]

 ইন্দ্র জুষস্ব প্র বহা যাহি শূর হরিভ্যাম্। পিবা সুতস্য মতেরিহ মখোশ্চকানশ্চারুমদায় ॥১৷৷ ইন্দ্র জঠরং নবব্যা ন পৃণস্ব মধধর্দিবোন। অস্য সুতস্য স্বর্ণোপ বা মদাঃ সুবাচো অগুঃ ॥২॥ ইন্দ্ৰস্তুরাষাশ্মিত্রো বৃত্ৰং যো জঘান যতীর্ন। বিভেদ বলং ভৃগুর্ন সসহে শত্রু মদে সোমস্য ॥৩॥ আ ত্বা বিশন্তু সুতাস ইন্দ্র পৃণস্ব কুক্ষী বিড়টি শক্র ধিয়েহ্যাঁ নঃ। শ্রুধী হবং গিররা মে জুষম্বেন্দ্ৰ স্বযুগভিমৎস্বেহ মহে রণায় ॥৪॥ ইন্দ্রস্য নু প্ৰা বোচং বীর্ষাণি যানি চকার প্রথমানি বর্জী। অহঃহিমম্বপস্ততর্দ প্র বক্ষণা অভিনৎ পর্বতানাম্ ॥৫॥ অহন্নহিং পর্বতে শিশিয়াণং ত্বষ্টাস্মৈ বজ্ৰং স্বয়ং ততক্ষ। বাশ্ৰা ইব ধেনবঃ স্যন্দমানা অঞ্জঃ সমুদ্রমব জথুরাপঃ ॥ ৬। বৃষায়মাণে অবৃণীত সোমং ত্ৰিককেপিবৎ সুতস্য। আ সায়কং মঘবাদত্ত বজ্ৰমহন্নেনং প্রথমজামহীনাম্ ॥৭৷

বঙ্গানুবাদ –হে ইন্দ্র! তুমি দিব্য ঐশ্বর্যের দ্বারা যুক্ত; আমাদের ঈঙ্গিত ফল প্রদান করো। আপন হর্ষশ্বের (হরি নামক অশ্বের) দ্বারা বাহিত হয়ে আমাদের যজ্ঞে আগমন করো এবং অভিযুত সোমরস পান করো। দশাপবিত্রে (ছাঁকনিতে) শুদ্ধীকৃত এই সোম তোমাকে তৃপ্ত করণশীল। ১।

হে ইন্দ্র! এই অমৃত তুল্য নবীন রসে যুক্ত সোমের দ্বারা আপন উদর পূর্ণ করো; পুনরপি সোমের আনন্দদায়ক রস তোমাকে স্তুতিকারক বাক্যের মতো স্বর্গের সমান হৰ্ষকারক হোক। ২৷৷

ইন্দ্র সকল জীবের মিত্র এবং শত্ৰুসকলকে বশ-করণশালী; তিনি বৃত্রাসুর এবং আবরক মেঘকে হনন করেছিলেন। অঙ্গিরাগণের যজ্ঞ-সাধন গো-সমূহকে হরণশীল বল নামক দৈত্যকেও ইন্দ্র হত্যা।  করেছিলেন। সোমপান পূর্বক হর্ষান্বিত হয়ে ইন্দ্র এই কার্য সাধন করেছিলেন৷৷ ৩।

 হে ইন্দ্র! এই অভিযুত সোমকে আপন কুক্ষিতে (উদরে বা গর্ভে) গ্রহণ করো (বা এই অভিযুতসোম তোমার উদরকে পূর্ণ করুক)। আমাদের আহ্বানের পর এই স্থানে আগত হও এবং আমাদের স্তুতিরূপ বাণী শ্রবণপূর্বক প্রসন্ন হও। হে ইন্দ্র! তুমি আপন মিত্র মরুত্বর্গ ইত্যাদি দেবতাগণের সাথে আমাদের কর্মফল প্রদান করতে সোমপান পূর্বক সন্তুষ্ট হও। ৪

ইন্দ্রের বীরত্বপূর্ণ কার্যসমূহের বর্ণনা করছি। তিনি বৃত্রাসুর এবং মেঘকে হত্যা করেছেন এবং অবরুদ্ধ জলকে নিঃসরিত করেছেন এবং পর্বতের উপর নদীসমূহের, নিমিত্ত মার্গ (পথ) নির্মাণ করেছেন। ৫।

ইন্দ্র বৃত্রাসুরকে হনন করেছিলেন, মেঘকে ছিন্নভিন্ন করেছিলেন এবং যখন বৃত্রাসুরের পিতা ত্বষ্টা ইন্দ্রের নিমিত্ত আপন বজ্রকে তীক্ষ্ণ করেছিলেন, তখন গাভীগণের ন্যায় নিম্নাভিমুখী নদীসমূহ সমুদ্রের পানে গমনশীল হয়েছিল। ৬

ইন্দ্র বৃষের ন্যায় সিঞ্চনশীল আচরণশালী। তিনি সোমরূপ অন্নকে প্রজাপতির নিকট হতে বরণ করেছিলেন এবং সোমযাগে অভিযুত সোমকে পান করেছিলেন। তারই শক্তিতে বলবান হয়ে বজ্ৰকে উত্তোলিত করেছিলেন এবং সেই হিংসক অসুরগণের মধ্যে প্রথম-উৎপন্ন বৃত্রাসুরকে নাশ করে দিয়েছিলেন। ৭৷৷

মন্ত্রস্য বিনিয়োগঃ –ইন্দ্র জুষস্ব ইতি সূক্তেন বলকামঃ ইন্দ্রং যজতে উপতিষ্ঠতে বা।… সোমাভিষবকালে অভিষবহোমেষু চ অস্য বিনিয়োগঃ। …তথা ঐন্দ্রীং বিজয়বলপুষ্টিপশুকামস্য পরচক্রাগমে চ ইতি (ন: ক. ১৭) বিহিতায়াং মহাশূন্তৌ এতৎ সূক্তং যোজয়েৎ।… ইত্যাদি। (২কা, ১অ. ৫সূ)।

টীকা— এই সূক্তের সাহায্যে বল কামনাপূর্বক ইন্দ্রের উদ্দেশে যজ্ঞ বা পূজা করণীয়। সোমের অভিষবকালে ও অভিষবহোমে এই মন্ত্রগুলির বিনিয়োগ বিহিত হয়েছে। তথা বিজয়লাভ, পুষ্টিপ্রাপ্তি ও পশুলাভের কামনা করে এই সূক্তমন্ত্রসমূহ পঠনীয়। মহাশান্তি হোমেও এগুলির বিনিয়োগ হয়ে থাকে। ভাষ্যে এই সূক্তের দ্বিতীয় মন্ত্রে যে আখ্যান অবলম্বন করে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, যে সন্ন্যাসীবৃন্দ বেদান্ত ইত্যাদি আলোচনা করেন না, তারা ইন্দ্রের দ্বারা হত হয়েছিলেন। সায়ণাচার্য পঞ্চম মন্ত্রে অহি শব্দের অর্থ করেছেন মেঘ বা বৃত্রাসুর, এবং বক্ষণা শব্দের অর্থ কুলপ্লাবনকারী নদী। পঞ্চম মন্ত্রে নু শব্দের অর্থ–ক্ষিপ্র! সপ্তম মন্ত্রে ত্রিকক শব্দের অর্থ সংবৎসর-সাধ্য সোমযাগ। (২কা, ১অ. ৫সূ.)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *