1 of 3

০১।৬ প্রথম কাণ্ড : ষষ্ঠ অনুবাক

ষষ্ঠ অনুবাক
প্রথম সূক্ত : রাষ্ট্রাভিবর্ধনম সপত্নক্ষয়ণং চ
[ঋষি : বশিষ্ঠ। দেবতা : ব্ৰহ্মণস্পতি, অভীবর্তমণি। ছন্দ : অনুষ্টুপ]

প্রথম মন্ত্র: অভীবর্তেন মণিনা যেনো অভিবাবৃধে। তেনাস্মন্ ব্ৰহ্মণস্পতেইভি রাষ্ট্রায় বর্ধয় ॥ ১।

বঙ্গানুবাদ –চক্ৰসন্নিবিষ্ট অথবা জ্ঞানভক্তি-পরিচালিত, সমৃদ্ধিসাধন-হেতু প্রসিদ্ধ, ঐশ্বর্যোপেত অপ্রতিহত-গমনশীল রথের দ্বারা অথবা সৎকর্ম-রূপ যানের দ্বারা (অর্থাৎ, সঙ্কর্মের দ্বারা) ভগবান্ সর্বত্র প্রবৃদ্ধ হন (অর্থাৎ, সর্বত্র তার মহিমা প্রকটিত হয়); (উপমার ভাব এই যে, সুপরিচালিত রথ যেমন অপ্রতিহত গতির কারণে মানুষকে গন্তব্যস্থান প্রাপ্ত করায়, জ্ঞানভক্তি পরিচালিত সৎকর্মের দ্বারা মানুষ সেইরকম ভগবানকে প্রাপ্ত হয়; অপিচ, সেই সঙ্কর্মের প্রভাবেই ভগবানের মহিমা উপলব্ধি করতে পারে)। হে, প্রজ্ঞানাধার দেব! পূর্বোক্ত ঐশ্বর্যোপেত যানের সাহায্যে অথবা জ্ঞানভক্তিসমন্বিত সকর্মের দ্বারা আমাদের (মোক্ষপ্রাপ্তেচ্ছু জনকে) হৃদয়রাজ্যের ঔৎকর্ষ-সাধনের জন্য সত্ত্বভাব ইত্যাদির দ্বারা সমৃদ্ধিসম্পন্ন করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনা হে প্রজ্ঞানাধার ভগবন্! জ্ঞানভক্তি-পরিচালিত সৎকর্মের সাহায্যে যাতে হৃদয়ে সত্ত্বভাবের সঞ্চার করতে সমর্থ হই, অপিচ জ্ঞানভক্তি সৎ-ভাব ও সৎকর্মের দ্বারা যাতে আমরা ভগবানকে প্রাপ্ত হই। এবং তার মহিমা অবগত হতে পারি, আপনি তার বিধান করুন)। ১।

মন্ত্রাৰ্থ আলোচনা –এই নূতন অনুবাকে নূতন সূক্তের নূতন মন্ত্রে এক নূতন প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে। সূক্তানুক্রমণিকায় প্রকাশ,–শত্রুমর্দিত রাজ্যের অভিবৃদ্ধির জন্য, মাহেন্দ্ৰী নামক মহাশান্তির কার্যে রথনেমি মণিবন্ধনে এই সূক্ত বিনিযুক্ত হয়ে থাকে। কৌশিতকী ব্রাহ্মণে, মণিবন্ধন সংক্রান্ত যে উপদেশ আছে, তা এই,–সূত্রোক্ত লক্ষণ অনুসারে রথচক্রনেমিমণিকে সংপাতিত ও মন্ত্রপূত করে উদসৌ সূর্যঃ (কৌ. ১।২৯৪৬) ইত্যাদি মন্ত্রে শরীরের উত্তম, স্থানে বন্ধন করবে। সেই রথনেমিমণি কি সামগ্রী, সে বিষয়ে উক্ত হয়েছে; যথা–অয়স্কান্ত, লৌহ, সীসক, রজত ও তা পরিবেষ্টিত স্বর্ণ, কুশের উপরে স্থাপন করে অভিবৰ্তেন প্রভৃতি মন্ত্র-চারটিতে পরিশোধিত করতে হয়। পরে সূত্রের দ্বারা বন্ধন করে সেই মণি, শরীরের উত্তম স্থানে ধারণ করবার বিধি আছে। (কৌ. ২৭)।-মন্ত্রটি বড়ই জটিলতাপূর্ণ। মন্ত্রের অভিবৰ্তেন এবং মণিনা পদ দুটিই সে জটিলতার সৃষ্টি করেছে। ভাষ্যমতে মন্ত্রের যে অর্থ হয়, তা ও– এই-সমৃদ্ধিসাধক যে প্রসিদ্ধ অপ্রতিহতগমনশীল চক্রনেমিনির্মিত মণির দ্বারা ধৃত হয়ে দেবগণের অধিপতি ইন্দ্রদেব সর্বত্র প্রবৃদ্ধ অর্থাৎ পরমৈশ্বর্যোপেত ত্রিলোকপতি হয়েছিলেন; হে ব্ৰহ্মণস্পতি দেব; সেই পূর্বোক্ত মহিমোপেত মণির দ্বারা, আমাদের শত্রুপীড়িত রাজ্যের অভিবৃদ্ধির জন্য, করি (হস্তী) তুরগ (অশ্ব) ও ধন ইত্যাদির দ্বারা আমাদের সমৃদ্ধিসম্পন্ন করুন; অর্থাৎ, আপনার প্রসাদে সমৃদ্ধিশালী আমাদের রক্ষিত রাজ্য যাতে শত্রুভয়রহিত হয়ে বর্ধিত হয়, তা করুন। এখানে রাজ্যভ্রষ্ট রাজার বা জমিদারী হতে বঞ্চিত জমিদারের রাজ্য বা জমিদারী প্রাপ্তির প্রার্থনার বিষয় সূচিত হয়েছে, মনে করতে পারি। তা ছাড়া, ভাষ্যকারের ব্যাখ্যায় অন্য কোনও উচ্চভাব উপলব্ধ হয় বলে মনে করতে পারা যায় না; সূক্তানুক্রমণিকার প্রয়োগবিধি দৃষ্টেও তার বেশী কোনও ভাব উপলব্ধ হয় না। আমাদের ব্যাখ্যা মূলতঃ ভাষ্যকারের ব্যাখ্যারই অনুসারী হলেও, ভাবে অভিব্যক্তির বিষয়ে স্বতন্ত্র পথ পরিগ্রহ করেছে। আমাদের বঙ্গানুবাদেও তা অভিব্যক্ত হয়েছে। মন্ত্রের সমস্যামূলক কয়েকটি পদের বিশ্লেষণ করলেই আমাদের পরিগৃহীত ভাব হৃদয়ঙ্গম হবে। মন্ত্রের অন্তর্গত অভিবৰ্তেন ও মণিনা পদ দুটি বিশেষ সংশয়-মূলক। ভাষ্যকার ঐ দুই পদের মধ্যে মণিনা পদের কোনও অর্থ নির্দেশ করেননি। তবে তিনি অভিবৰ্তেন পদের যে অর্থ নির্দেশ করেছেন, তাতেই মণিনা পদের ভাব অনেকটা উপলব্ধি করতে পারা যায়। ভাষ্যকারের মতে অভিবৰ্তেন পদের অর্থ–অভিতো বৰ্ততে চক্র অনেনেতি অভিবর্তো নেমিঃ। সুতরাং অভিবর্তঃ পদে নেমি এবং তা হতে তৎসংলগ্ন চক্র অর্থ পাওয়া গেল। ঐ অভিবৰ্তেন পদ মণিনা পদের বিশেষণ-বাচক। তাতে অভিবর্তেন মণিনা পদের ভাষ্যকার এইরকম অর্থ নির্দেশ করেছেন,–চক্রনেমিনির্মিতো মণিঃ। যদ্বা অভিতঃ সর্বতঃ পররাষ্ট্ৰাদৌ অপ্রতিহত-গতির্বর্ততে অনেন ইতি অভিবর্তো মণিঃ তেন। চক্রনেমি নির্মিত যা, তা-ই মণি; অথবা পররাষ্ট্র ইত্যাদি সর্বত্র যার দ্বারা পুরুষের অপ্রতিহতগতি হয়, তা-ই অভিবর্তো মণিঃ। ভাষ্যকার যদ্বা অভিধায়ে যে অর্থ প্রকাশ করেছেন, তাতেই ঐ মণিনা পদে রথ বা যান অর্থ অধিকতর প্রস্ফুট হয়েছে। প্রথম অর্থে তিনি বললেন,–চক্রনেমিনির্মিতে মণিঃ; দ্বিতীয় অর্থে, যদ্বা অভিধায়ে, তা বিশদ করে বললেন,–অভিতঃ সর্বতঃ পররাষ্ট্ৰাদৌ অপ্রতিহতগতিবর্ততে অনেন পুরুষ ইতি অভিবর্তো মণিঃ; অর্থাৎ পররাষ্ট্র ইত্যাদি সর্বত্র এতদ্বারা পুরুষের অপ্রতিহতগতি হয় বলে একে অভিবর্ত মণি বলে। তবেই বোঝা গেল,-কোনও সংবাহনকে বা যানকে ঐ পদে নির্দেশ করছে। এখন, চক্রনেমি-নির্মিত অথচ সর্বত্র অপ্রতিহতগমনশীল যে মণি বা সংবাহন, সে মণি কি সামগ্রী? সে মণি, ভাষ্যকারের অর্থানুসারে রথ বা যান ভিন্ন অন্য আর কি হতে পারে? অভিধানে মণি (মণী) পদের নানা পর্যায় দৃষ্ট হয়। কিন্তু সেখানে ঐ পদে রথবোধক কোনও শব্দই দৃষ্ট হয় না। নিরুক্ত-গ্রন্থেও যান বা রথবোধক কোনও পর্যায় দেখি না। তবে কেন মণি পদে রথ বা যান অর্থ অধ্যাহার করা হয়? ভাষ্যকারই যে অর্থ প্রকাশ করেছেন, তাতে মণিঃ পদে রথ বা যান ভিন্ন অন্য কোনও অর্থই উপলব্ধি করতে পারা গেল না। তবে রথ বা যান শব্দের পরিবর্তে মণি পদের ব্যবহারের তাৎপর্য কি? তারও একটু বিশেষত্ব আছে। রত্নের মধ্যে যেমন মণি শ্রেষ্ঠপদবাচী, সেইরকম রথের মধ্যে যে রথ বা যান শ্রেষ্ঠ, তাকেই বলতে পারা যায়। লৌকিক হিসেবে ইন্দ্রদেবের সংবাহকারী যান যেমন শ্রেষ্ঠ, আধ্যাত্মিক হিসেবে সেইরকম ভগবানের নিকট নয়নসমর্থ যানই শ্রেষ্ঠ-পদবাচ্য। সে যানকে বা রথকে আমরা জ্ঞানভক্তিপরিচালিত সৎকর্ম নামে অভিহিত করতে পারি। সেই ভাব হতেই অভিবৰ্তেন মণিনা পদ দুটির আমরা জ্ঞানভক্তিপরিচালিতেন সৎকর্মরূপযানেন অর্থ অধ্যাহার করেছি। রথনেমি চক্রের দ্বারা সন্নিবিষ্ট থাকলে রথ যেমন আরোহীকে দ্রুতবেগে গন্তব্যস্থানে পোঁছাতে পারে, কর্ম-রূপ যান যদি জ্ঞান ও ভক্তিরূপ চক্রের দ্বারা পরিচালিত হয়, তাহলে ভগবৎ-প্রাপ্তি অতি সহজসাধ্য হয়ে আসে। গন্তব্যস্থানে পৌঁছাতে হলে রথনেমিতে যেমন চক্র দুটির সহায়তা বা সংযোজন আবশ্যক ভগবানকে পেতে হলে কর্মের সাথে তেমনি জ্ঞান ও ভক্তির সংমিশ্রণ একান্ত প্রয়োজন। তাই জ্ঞান ও ভক্তি কর্মরূপ যানের দুটি চক্ররূপে নির্দিষ্ট হয়েছে। জ্ঞানের দ্বারা চিত্ত নির্মল হয়; এ ভক্তিতে সে জ্ঞান দৃঢ়তা অবলম্বন করে। ভক্তিসংমিশ্ৰিত জ্ঞান বা জ্ঞান-পরিশুদ্ধ ভক্তি উভয়ই কর্মকে সৎপথে পরিচালিত করে। তখন ভগবানের মহিমা, ভগবানের ঐশ্বর্য, সর্বত্র প্রকটিত দেখতে পাওয়া যায়। সকর্মের প্রভাবে, জ্ঞান ও ভক্তির সংমিশ্রণে, ভগবান্ প্রবর্ধিত হয়ে থাকেন অর্থাৎ ভক্ত সাধকের বহুল সৃষ্টিতে ভগবানের মহিমা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। মানুষ স্বভাবতঃ মনোবৃত্তির বশীভূত। মনোবৃত্তির উৎকর্ষ অপকর্য অনুসারে, মানুষ সৎপথে বা অসৎপথে প্রধাবিত হয়। কিন্তু জ্ঞানের প্রভাবে যদি সে মনোবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত হয়, আর ভক্তির দ্বারা যদি তা সৎ-ভাবে সম্বন্ধযুত হয়, তাহলে, মানুষের চিত্তবৃত্তি সৎ-এর প্রতিই আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। তখনই সৎস্বরূপে সাযুজ্য-লান্ড তার সহজলভ্য হয়। তখনই সে তার মহিমার ও তার ঐশ্বর্যের বিষয় উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়। মন্ত্রের প্রথমাংশে যে বলা হয়েছে,-সমৃদ্ধিসাধক চনেমিনির্মিত মণির দ্বারা ধৃত হয়ে ইন্দ্রদেব সর্বত্র প্রবৃদ্ধ হয়েছিলেন; আমরা মনে করি, তার তাৎপর্য এই যে,–জ্ঞান ও ভক্তি সংমিশ্রিত সৎকর্মের দ্বারা ভগবানকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারলে, তাঁর মহিয়সী মহিমা আপনিই হৃদয়ে প্রকটিত হয়ে পড়ে। তখনই তার অনন্তত্বের, তার অসীমত্বের, ভঁর মহত্ত্বের, তার বিশ্বব্যাপকতার, তার সর্বত্র-বিদ্যমানতার, তার নানারকম গুণবিশেষণের বিষয়ে উপলব্ধি জন্মে। তখনই বুঝতে পারা যায়, কেন তিনি এক হয়েও বহু, আবার বহু হয়েও এক; তখনই বুঝতে পারা যায়, কেন তিনি নাম-রূপ বিবর্জিত, আবার কেন তিনি নাম-রূপ সমন্বিত। তখনই বুঝতে পারা যায়, কেন তিনি গুণময়, আবার কেন তিনি গুণাতীত। ফলতঃ, জ্ঞানভক্তিসংমিশ্রিত সকর্মই ভগবৎ-প্রাপ্তির একমাত্র উপায়। মন্ত্রের প্রথম অংশে এই ভাবই পরিব্যক্ত বলে মনে করি।–মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশের (পংক্তির) ভাব এই যে,-হে প্রজ্ঞানাধারদেব! আমাদের হৃদয়-রাজ্যের অভিবৃদ্ধির জন্য আমাদের সেই মণির দ্বারা সমৃদ্ধিসম্পন্ন করুন। এখানে মুমুক্ষু সাধক, জ্ঞানভক্তি-সংমিশ্ৰিত আপন সৎকর্মের দ্বারা হৃদয়ে সত্ত্বভাব ইত্যাদি সঞ্চারের প্রার্থনা জ্ঞাপন করছেন। শত্রুবিমর্দিত রাজ্য যেমন বিশৃঙ্খল ভাবে অবস্থিতি করে; অন্তঃশত্রুর–অজ্ঞানতার এবং তার সহচর অসৎপ্রবৃত্তি-সমূহের-পীড়নে হৃদয়-রাজ্যও সেইরকম অসারতা প্রাপ্ত হয়ে থাকে। রাজ্যে শান্তি স্থাপিত হলে, সে রাজ্য যেমন ক্রমশঃ সমৃদ্ধির দিকে অগ্রসর হয়; হৃদয়-রাজ্যের সম্বন্ধেও সেইরকম। অজ্ঞানতা ইত্যাদি শসমূহের বিদূরণে হৃদয় নির্মলতা প্রাপ্ত হয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাব ধারণ করলে, ক্রমশঃ সে হৃদয় উন্নত ও ভগবৎ-অভিমুখী হতে থাকে। সে পক্ষে দেবতার অনুগ্রহই প্রধান সহায়। সেইজন্য প্রজ্ঞানাধার ভগবানের নিকট জ্ঞান-ভিক্ষা করে প্রার্থনা জানানো হয়েছে; বলা হয়েছে,–হে দেব! আমাদের সৎকর্মে নিয়োজিত করুন; আর, সেই সঙ্কর্ম জ্ঞান ও ভক্তির দ্বারা পরিচালিত হোক। ইন্দ্রদেব যে দুই চক্রবিশিষ্ট মণির সাহায্যে অপ্রতিহতগতিতে অভীষ্ট-স্থানে গমন করেন; আমরা যেন সেইরকম জ্ঞানভক্তির দ্বারা পরিচালিত সৎকর্মের সহায়তায় আমাদের অভীষ্ট সেই ভগবানে উপনীত হতে সমর্থ হই। করি-তুরগ-ধন-রত্ন ইত্যাদি যেমন রাজ্যের ঐশ্বর্য-জ্ঞাপক, সেইরকম সেই জ্ঞানভক্তি-পরিচালিত সৎকর্ম-সঞ্জাত সত্ত্বভাবই হৃদয়ের সমৃদ্ধি- সূচক। সে ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধশালী হতে পারলে, শত্রুভয় আর থাকে না। তখন ভগবৎ-মহিমা আপনা-আপনিই প্রকট হয়ে পড়ে। সেই অবস্থাই সাধনার পরিণতি; সেই অবস্থাই সাধকের মুক্তির অবস্থা। ভগবৎ-ভক্ত সাধক, তারই জন্য প্রার্থনা করেন, তার জন্য তাঁর প্রাণ-মন! নিয়োজিত। আমাদের মনে হয়, মন্ত্র এই উচ্চ ভাব ধারণ করে আছেন। ১।

.

দ্বিতীয় মন্ত্র অভিবৃত্য সপত্নানভি যা নো অরাতয়ঃ। অভি পৃতন্যন্তং তিষ্ঠাভি যো নো দুরস্যতি ॥ ২॥

বঙ্গানুবাদ –হে আমার জ্ঞানভক্তি-বিমিশ্র কর্ম! তুমি আমাদের জন্মসহজাত অন্তঃশত্রুদের অভিভব করে বিনাশ করো; আমাদের কর্মের দ্বারা সঞ্জাত যে সকল বহিঃশত্রু আছে, তাদেরও প্রতিকুল হয়ে বিনাশ করো। আমাদের বশীকরণোম্মুখ হিংসা-প্রলোভন ইত্যাদি শত্রুদের পরাভব করো। যে বহিরন্তঃশত্রু আমাদের মায়ামোহ ইত্যাদির দ্বারা বশীভূত করতে প্রযত্নপর হয়, তাদেরও অভিভূত করে বিনাশ করো। (অন্তঃশত্ৰু-বহিঃশত্রু অথবা হিংসাপরায়ণ অপর যে শত্রু আছে, আমাদের কর্মের প্রভাব তাদের বিনাশ করুক। ভাবার্থ এই যে,আমাতে এইরকম কর্ম-সামর্থ্য উপজিত হোক, যার দ্বারা বহিরন্তঃশত্রু সকলকে বিনাশ করতে সমর্থ হই) ॥ ২॥

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— মন্ত্রটি সরল ও সহজবোধ্য। মন্ত্রের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ভাষ্যকারের সাথে আমাদের বিশেষ কোনও মতান্তর ঘটেনি। যেমন পূর্ব মন্ত্রে, তেমনই এই মন্ত্রেও শত্রুনাশের প্রার্থনা জ্ঞাপন করা হয়েছে। পূর্ববর্তী মন্ত্রের সাথে মিলিয়ে পাঠ করলে বোঝা যায়, মন্ত্রে মানুষের সাথে মানুষের দ্বন্দ্বের বিষয়ই প্রখ্যাপিত হয়েছে। ভাষ্যকারের ব্যাখ্যায় সেই ভাবই পরিস্ফুট দেখি। কিন্তু আমাদের মনে হয়, মন্ত্রটি আধ্যাত্মিক জগতের এক মহান আদর্শও প্রকটিত করছেন। মানুষ, মানুষের কতটুকু অনিষ্ট সাধন করতে পারে? আর সে অনিষ্ট কত কালই বা স্থায়ী হয়? কিন্তু মানুষ নিজের কর্মের দ্বারা যে অনিষ্ট সাধন করে থাকে, তা জন্মজন্মান্তরেও সংশোধিত হয় না। সেইজন্যই মন্ত্রে বলা হচ্ছে, আমার কর্মের প্রভাব এমন.হোক, যার দ্বারা আমার বহিঃশত্রু ও অন্তঃশত্রুকে আমি পরাভূত করতে পারি।-শাস্ত্রে কর্মে নানারকম স্তরপর্যায় নির্দিষ্ট আছে। যাকে আমরা সকর্ম বলে অনুভব করি, জ্ঞান-বুদ্ধির তারতম্য-হৈতু সে কর্ম সময় সময় বন্ধনের হেতুভূত মহা-অনিষ্টকর কর্মে পর্যবসিত হয়ে থাকে। কিন্তু জ্ঞান ও ভক্তি বিমিশ্র কর্মে সে সম্ভাবনা নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না। সেই জন্যই কর্মের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান ও ভক্তির সংমিশ্রণ প্রয়োজনীয় বলে শাস্ত্রে উল্লিখিত হয়েছে। দুরধিগম্য কর্মতত্ত্ব-সমালোচনার কোনও আবশ্যকতা এই স্থলে উপলব্ধ হয় না। তবে ভগবানের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত কর্মই যে গতিমুক্তির হেতুভূত, সে বিষয়ে কোনই সংশয় নেই। সৎকর্মের অনুষ্ঠান, সপ্রসঙ্গের আলোচনা, সাধুসঙ্গে বসবাস,–এটাই হলো শত্রুনাশের একমাত্র উপায়। কিবা লৌকিক পক্ষে, কিবা আধ্যাত্মিক পক্ষে, উভয়ই এ সকলের সার্থকতা উপলব্ধ হয়ে থাকে। সৎসঙ্গে সৎ-প্রসঙ্গের আলোচনায়, সাংসারিক আবিলতা প্রায়শঃই হৃদয়কে অভিভূত করতে পারে না; সাধুসঙ্গে সহবাসে সাংসারিক দুঃখতাপের অনেকটা শান্তি ঘটে। মন বাহ্য-প্রকৃতিতে আবিষ্ট হতে অল্পই অবসর পায়। এই ভাবে জ্ঞানের ও ভক্তির উদয়ে মানুষের কর্ম সৎপথেই প্রধাবিত হতে থাকে। কর্ম যখন সৎপথে ধাবিত হয়, মন যখন সৎ-এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে, তখন কি আর মানুষের হৃদয়ে কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপু প্রভুত্ব-বিস্তারে সমর্থ হয়? তখন সেই কর্মই ক্রমশঃ কর্মবন্ধন ছিন্ন করবার পক্ষে সহায়ক হতে থাকে। আমাদের মনে হয়,-মন্ত্রে এই তত্ত্বই নিহিত রয়েছে।-মন্ত্রের ভাব এই যে, আমরা যেন–সেইরকম কর্ম সম্পাদনে সমর্থ হই; আমাদের কর্ম যেন জ্ঞানভক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়। সেইরকম কর্ম করতে পারলেই, আমাদের কর্মবন্ধন ছিন্ন হবে। আমাদের মধ্যে সেই কর্মসামর্থ্য উপজিত হোক, যার দ্বারা আমরা সংসারের সকল বন্ধন হতে মুক্ত হতে পারব ॥ ২

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ অভি ত্বা দেবঃ সবিতাভি সোমো অবীবৃধৎ। অভি ত্বা বিশ্বা ভূন্যভীবর্তো যথাসসি ॥ ৩॥

বঙ্গানুবাদ –হে আমার জ্ঞানভক্তি-বিমিশ্র কর্ম! দীপ্তিদানাদিগুণযুক্ত দ্যোতমান, ভূতসমূহের প্রসবয়িতা অর্থাৎ সর্বভূতান্তরাত্মা শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ ভগবান্ তোমাকে সর্বতোভাবে সমৃদ্ধ করুন; অপিচ, হে আমার জ্ঞানভক্তিবিমিশ্র কর্ম! যে রকমে তুমি বর্তনসাধনভূত অর্থাৎ ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গল-হেতুভূত হও, সেই রকমে নিখিলচরাচরাত্মক ভূতজাতসমূহ তোমার উৎকর্ষ সাধন করুক। (প্রাণিসমূহ সকর্মপরায়ণ হোক, তা-ই তাদের গতিমুক্তির হেতুভূত। মন্ত্রে এই রকম ভাব দ্যোতিত হচ্ছে)। ৩

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রটিও সরল ভাব পরিজ্ঞাপক। মানুষ জ্ঞানলাভ করুক, তার হৃদয় ভক্তিরসে বিগলতি হোক, আর সেই জ্ঞান ও ভক্তির সংমিশ্রণে সক্কর্মের অনুষ্ঠান করুক; তা-ই তার গতিমুক্তির হেতুভূত–মন্ত্র এই শিক্ষা প্রদান করছেন। মন্ত্র বলছেন, মানুষ সৎকর্মপরায়ণ হোক, মানুষ ভগবানে প্রীতিযুক্ত হোক। তাহলেই তার সকল কর্মের অবসান হবে।–তকর্ম হরিতোষং যৎ–সেই কর্মই কর্ম, যাতে ভগবান, পরিতুষ্ট হন। ভগবান্ কর্মকে অভিবৃদ্ধ করুন–এর তাৎপর্য এই যে, যে কর্ম ভগবৎসংশ্রবযুক্ত, যে কর্ম ভগবানের পরিতৃপ্তি-বিধায়ক, সেই কর্ম করতে পারলেই তোমার কর্ম ঊর্ধ্বগতি লাভ করবে। সকর্ম যেমন ইহকালে মানুষের শ্রেয়ঃসাধক, পরকালেও তা তেমনি মানুষের গম্মুিক্তিদায়ক। সেইরকম কর্মানুষ্ঠানের প্রচেষ্টা মানুষের মধ্যে আসুক, মানুষ নিজে হতেই সেইরকম কর্মানুষ্ঠানে ব্যাপৃত থাকুক। আমরা মনে করি, মন্ত্র এই উপদেশ প্রদান করছেন। মণিধারণে মানুষ যেমন সর্বত্র বিজয়লাভে সমর্থ হয়, মণি যেমন সর্বত্র তার অবাধগতি প্রদান করে; জ্ঞানভক্তি-বিমিশ্র সৎকর্মও তেমনি মানুষকে সর্বলোকে সর্বকালে বিজয়শ্রী মণ্ডিত করে থাকে–মন্ত্রের অন্তর্গত অবিবৃধৎ প্রভৃতি অতীতকালের ক্রিয়াপদের প্রয়োগ দেখি। আমরা মনে করি, মন্ত্রের সাথে কোনও কালাকালের সম্বন্ধ নেই। ঐ ক্রিয়াপদে ভূতভবিষ্যৎ বর্তমান ত্রিকালের বিষয়ই প্রখ্যাপিত করছে। ভগবান আমার কর্ম সমৃদ্ধসম্পন্ন করুন–এই বাক্য যেমন বর্তমানে, তেমনি অতীতে, তেমনি ভবিষ্যতে–সর্বকালেই বলা চলতে পারে। মন্ত্র নিত্য-সত্য; তার সাথে কালাকালের কোনও সম্বন্ধ পরিকল্পনা করা সর্বথা সমীচীন নয়। তাতে বেদের নিত্যত্ব-বিষয়ে অন্তরায় ঘটে ॥ ৩॥

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ অভিবর্তো অভিভবঃ সপত্নক্ষয়ণণা মণিঃ। রাষ্ট্রায় মহ্যং বধ্যতাং সপত্নেভ্যঃ পরাভুবে ॥ ৪

বঙ্গানুবাদ –অভিবর্তনসাধনভূত অর্থাৎ ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গলহেতুভূত, কর্মসঞ্জাত শত্রুগণের অভিভবিতা, জন্মসহজাত অন্তঃশত্রুগণের বিনাশকারী জ্ঞানভক্তি-পরিচালিত সঙ্কর্ম, আমার অভিবৃদ্ধির নিমিত্ত, আন্তবাহ্য সকল শত্রুর নাশের জন্য এবং পরমাশ্রয়রূপ রাজ্যধনসম্পাদনের উদ্দেশ্যে, আমাকে বন্ধন করুক অর্থাৎ আমাকে প্রাপ্ত হোক। (সৎকর্মই সকল সুখের নিলয়। সৎকর্ম আমার চিরসহচর হোক। তার দ্বারাই আমি সকল দুষ্কৃতনাশে সমর্থ হবো, তার দ্বারাই আমার পরমাশ্রয় লাভ হবে। এই মন্ত্রে এইরকম ভাব দ্যোতিত হচ্ছে)। ৪

মন্ত্ৰাৰ্থআলোচনা –এই মন্ত্রের কয়েকটি পদের বিভক্তি ব্যত্যয় স্বীকার না করলে, মন্ত্রের অর্থ বোধগম্য হওয়া সুকঠিন। ভাষ্যকারও বিভক্তি-ব্যত্যয়েই অর্থ-নিষ্পন্ন করেছেন ও আমরাও তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিভক্তি ব্যত্যয়ে অর্থ নিষ্কাশনে বাধ্য হয়েছি। মন্ত্রে মণির গুণবর্ণন আছে;-মন্ত্রে মণিবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা প্রখ্যাপিত হয়েছে। কিন্তু ভাষ্যকার অপহৃত রাজ্য-ধন পুনরুদ্ধারের নিমিত্ত, স্বজাতি-জ্ঞাতি-বিরোধে মণিবন্ধনের যে প্রয়োজনীয়তার বিষয় উল্লেখ করেছেন, তা আমরা স্বীকার করি না, অথবা মণিঃ পদের ভাষ্যকার যে অর্থ পরিগ্রহণ করেছেন, তা-ও আমাদের অনুমোদিত নয়। মণিঃ পদে আমরা যে ভাব উপলব্ধি করি, এই সূক্তের প্রারম্ভেই, প্রথম মন্ত্রের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-ব্যপদেশেই তা পরিব্যক্ত হয়েছে; সুতরাং এই স্থলে তার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। লৌকিক-প্রয়োগে মারণ-অভিচার ইত্যাদি ব্যাপারে মন্ত্রে যে অর্থ সূচিত হয় হোক। কিন্তু মন্ত্রের লক্ষ্য যে মানুষকে এক অভিনব পথ প্রদর্শন করে, আমরা তা-ই প্রকটিত করছি। শত্রু যতই প্রবল হোক, সৎ-ভাবের, সৎ-ব্যবহারের, সৎ-কর্মের প্রভাবের নিকট তাকে মস্তক অবনত করতে হবেই হবে। মানুষ-শত্রু এমন কেউই থাকতে পারে না, যে এতে বশীভূত না হয়–যে বৈরভাব ভুলে না যায়। যেমন লৌকিক, পক্ষে তেমনই আধ্যাত্মিক পক্ষে–উভয়ই সৎ বা সত্য সমপ্রভাবসম্পন্ন। সৎকর্মে, সৎ-ভাবে, সৎ-চিন্তায়–তার বিপরীত ভাব আসতেই পারে না। কর্ম যদি জ্ঞান ও ভক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়, তাহলে কি আর অন্য কোনও শক্তি তার নিকট তিষ্ঠিতে পারে? কুপ্রবৃত্তি, কুচিন্তা, হিংসা-প্রলোভন ইত্যাদি, কাম-ক্রোধ–যতই শক্তিসম্পন্ন হোক, কেউই সে প্রভাবের নিকট তিষ্ঠিতে পারে না। অজ্ঞানতাই তো সে সকলের মূলীভূত। মূল যদি উচ্ছিন্ন হয়, কাণ্ড-শাখা-প্রশাখা কতক্ষণ তিষ্ঠিতে পারে? আর তার সাথে যদি একটু ভক্তির সংমিশ্রণ থাকে, তাহলে আর রক্ষা থাকে কি? জ্ঞান ও ভক্তি যে সৎ-ভাবজনক অসৎ-ভাবনাশক, শাস্ত্রে সর্বত্রই তার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। সেই জ্ঞান ও ভক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যে কর্ম, তা-ই গতিমুক্তির হেতুভূত,–পরমার্থরূপ পরমাশ্রয়ে সংবাহন-কর্তা। মন্ত্রে তাই ভক্ত সাধক কামনা জানাচ্ছেন,–জ্ঞানভক্তি-পরিচালিত কর্মই যেন আমার চিরসহচর হয়। তাহলে কি হবে? জ্ঞানের দ্বারা প্রকৃত কর্ম নির্বাচনে সমর্থ হবো; ভক্তিতে সেই কর্ম ভগবানে ন্যস্ত হবে। তাহলে, আমার কর্মই তখন যানস্বরূপ হয়ে আমাকে সেই সকল কর্মের মূলাধার ভগবানের নিকট নিয়ে যাবে। তখনই আমার কর্মের অবসান হবে; তখনই আমার কর্মের নিবৃত্তি ঘটবে; তখনই চিরশান্তিময়ের ক্রোড়ে, আশ্রয়-লাভ করে পরম শান্তি প্রাপ্ত হবে। আমাদের মতে, মন্ত্রে এই ভাবই দ্যোতিত হচ্ছে। যেমন অন্তরের শত্রু, তেমনি বাহিরের শত্রু, সৎ-ভাবের নিকট সকলেই পরাজিত ॥ ৪।

.

পঞ্চম মন্ত্রঃ উদসৌ সূর্যো অগাদুদিদং মামকং বচঃ। যথাহং শহহাহসানসপত্নঃ সপত্নহা ॥ ৫৷৷

বঙ্গানুবাদ –নভোমণ্ডলে পরিদৃশ্যমান সকলের প্রকাশক সূর্যদেব যেমন স্বপ্রকাশ হন, তেমনি আমার সম্বন্ধি সদা উচ্চাৰ্যমাণ ভগবৎ-মহিমাপ্রকাশক মন্ত্ররূপ বাক্যও প্রকাশরূপের দ্বারা নিত্য-সত্য হয়; (সূর্যের উদয়ে যেমন নিত্যপ্রত্যক্ষীভূত ধ্রুবসত্য, মন্ত্রশক্তিও তেমনি স্বতঃপ্রকটিত নিত্য-সত্য)। যে প্রকারে সাধনাপরায়ণ আমি শত্রুগণের হন্তা হতে পারি, আমার উচ্চারিত মন্ত্রশক্তি সেইরকম স্বপ্রকাশ অর্থাৎ শক্তিসম্পন্ন হোক; তার দ্বারা আমি বহিরাগত-শত্রুবিরহিত এবং সহাধিষ্ঠিত ১ শত্রুগণের বিনাশ সমর্থ হই। (ভাব এই যে, ভগবৎপ্রসাদে মন্ত্রশক্তি আমাদের শত্রুহননের অনুকূল হোক) ৫

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— এই মন্ত্রে শত্রুনাশের কামনা প্রকাশ পেয়েছে; অপিচ, মন্ত্রশক্তির মাহাত্মও প্রকটিত হয়েছে। মণি-বন্ধনে স্বরাজ্যে এবং পররাজ্যে অপ্রতিহত-প্রভাবে গমনাগমন করতে পারা যায়, অপিচ হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার হয়,-সূক্তের আরম্ভে এই যে মণির প্রভাবের বিষয় কথিত হয়েছে, এই সকল মন্ত্রে সেই বিষয় ক্রমে বিশ্লেষিত হচ্ছে। মণিধারণের জন্য তৎকালিক সূর্যোদয় এবং প্রযুজ্যমান বাক্য শত্রুনাশের সহায় হোক, বক্ষ্যমান মন্ত্র এই ভাব প্রকটন করছেন। ভাষ্যপাঠে এই বিষয় অবগত হতে পারি। সূর্যোদয় প্রতিদিনই প্রত্যক্ষীভূত হচ্ছে, বাক্যও আমরা প্রতিদিন প্রতিনিয়তই উচ্চারণ করছি। তথাপি মন্ত্রে সেই সেই বিষয় বিশেষভাবে বলবার প্রয়োজন কি? প্রয়োজনের বিষয় মন্ত্রেই স্পষ্টীকৃত হয়েছে। মণিধারক যাতে তার শত্রুনাশ করতে পারে, সূর্যোদয় এবং মন্ত্র-প্রয়োগ তার সহায়ক অনুকূল হোক; স্থূলতঃ শুভক্ষণে শুভমুহূর্তে মণিধারণ করা হয়, এটাই উদসৌ হতে বচঃ পর্যন্ত মন্ত্রাংশের প্রয়োজন–ভাষ্যে উক্ত হয়েছে। –মন্ত্রটি কিছুটা জটিলভাবাপন্ন। মন্ত্রে পদসমূহের যে অন্বয় ভাষ্যের মধ্যে পরিদৃষ্ট হয়, তাতে সহসা কোনও ভাব উপলব্ধ হয় না। মন্ত্রের প্রথম পংক্তির সাথে দ্বিতীয় পংক্তির সম্বন্ধ যে ভাবে রক্ষিত হয়েছে, সে পক্ষে আমাদের পদ্ধতি, ভাষ্য অপেক্ষা; কিছুটা স্বতন্ত্রতা অবলম্বন করেছে। দ্বিতীয় পংক্তির যথা পদের সাথে অন্বয়ে তথা এবং উদগাৎ প্রভৃতি পদ অধ্যাহার করতে হয়েছে। এই ব্যতীত ঐ যথা পদের ভাব গ্রহণ করা যায় না।উদসৌ সূর্যো অগাৎ–এই মন্ত্রাংশের অন্তর্গত উদগাৎ পদের ভাষ্যানুমোদিত অর্থ– উদিতবান পদ অতীতকালের ভাব জ্ঞাপন করে। কিন্তু সূর্যোদয় নিত্য-ধ্রুবসত্য। সুর্য যে পূর্বে উদিত হয়েছিলেন, এখন আর উদিত হন না,-এ ভাব গ্রহণ করা যায় না। সূর্যের উদয় ত্রিকালেই সত্য-ধ্রুব নিত্যপ্রত্যক্ষীভূত। মন্ত্রশক্তিও সেইরকম। যথানিয়মে উচ্চারিত মন্ত্র যে অলৌকিক প্রভাব-সম্পন্ন, সর্বত্রই তার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত প্রত্যক্ষ করি। এখনও অনেক স্থলে সে শক্তির প্রভাব প্রত্যক্ষীভূত হয়। ভূত-ভবিষ্যৎ বর্তমান ত্রিকালজ্ঞাপক যে ক্রিয়াপদ উদগাৎ, তা কেরলমাত্র অতীত-কালদ্যোতক বলে কিভাবে গ্রহণ করতে পারি? এ ভাব বেদ-মন্ত্রের সর্বত্রই প্রকটিত। তাই উদগাৎ পদের উদয়তি স্বপ্রকাশো ভবতি অর্থ আমরা পরিগ্রহ করেছি। মন্ত্রের প্রথমাংশে এই দুই নিত্য-সত্য-তত্ত্ব প্রকটিত–এই ভাব উপলব্ধি করেই, আমরা মন্ত্রের প্রথম অংশের অর্থ করেছি–সূর্যোদয় যেমন নিত্যপ্রত্যক্ষভৃত স্বতঃসিদ্ধ, মন্ত্রশক্তির প্রভাবও সেইরকম ধ্রুবসত্য। মন্ত্রের প্রথমাংশে এ সত্যতত্ত্ব প্রকটনের উদ্দেশ্য কি? দ্বিতীয় অংশে সেই বিষয় বিশ্লেষিত হয়েছে। মন্ত্রের শক্তি স্বতঃসিদ্ধ নিত্যসত্য বটে; কিন্তু আমার শত্রুনাশের পক্ষে সে শক্তির কার্যকারিতা নিত্যসত্য-রপে প্রকটিত হোক,–দ্বিতীয় অংশে সাধনা-সম্পন্ন জনের এটাই আকাঙ্ক্ষা। মন্ত্রের উচ্চারণে অন্তর পরিশুদ্ধ হোক, কর্ম সৎপথে পরিচালিত হোক, আন্তরবাহ্য শত্রুর বিনাশে মন্ত্রের অলৌকিক প্রভাব প্রকাশ পাক,–এটাই আকাঙ্ক্ষা ॥ ৫।

.

ষষ্ঠ মন্ত্রঃ সপত্নক্ষয়ণণা বৃষাভিরাষ্ট্ৰো বিষাসহিঃ। যথাহমেষাং বীরাণাং বিরাজানি জনস্য চ। ৬।

বঙ্গানুবাদ –হে আমার জ্ঞানভক্তি-পরিচালিত কর্ম! তুমি সহাধিষ্ঠিত বা জন্মসহজাত ও শত্রুগণের বিনাশক, অভীষ্টফলবৰ্ষক বা অভীষ্টপূরক, ইহলোকে ও পরলোকে অপ্রতিহত প্রভাববিশিষ্ট, এবং বিবিধ রকমে বিশেষভাবে শত্রুগণের অভিভবকারী হও। অতএব, তোমার প্রভাবে যে রকমে সৎকর্মপরায়ণ আমি আত্মসম্বন্ধি শত্রুসৈন্যের এবং স্বকীয় ও পরকীয় প্রাণিজাতের অর্থাৎ অন্তঃশত্রু ও বহিঃশত্রুগণের নিয়ামক বা অভিভবকারী হতে পারি, তার বিধান করো। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। সৎকর্মসাধনের দ্বারা যাতে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গল-সাধনে সমর্থ হই, তা করবো–এটাই সঙ্কল্প) ॥ ৬৷৷

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— মণিবন্ধনে মানুষ যে অলৌকিক প্রভাবে প্রভাবান্বিত হতে পারে, এই সূক্তের মন্ত্রগুলিতে সেই বিষয়ই প্রদর্শিত হয়েছে। মণিধারণে মানুষ শত্রুনাশে সমর্থ হয়, প্রজাদের অভিলষিত কর্মের অনুষ্ঠানে তাদের অভীষ্ট-পূরণে সমর্থ হয়, আপন রাজ্যে এবং পরকীয় রাজ্যে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে এবং বিদ্রোহপরায়ণ জনগণকে অবাধে বশীভূত করতে সমর্থ হয়। মণির প্রভাবে মানুষ এইরকম গুণবিশিষ্ট। হতে পারে। মণি ধারণকারী তাই বলছেন,-পূর্বোক্তরূপ গুণসমূহে বিভূষিত হয়ে যাতে শত্রুসেনাকে এবং স্বকীয় ও পরকীয় ব্যক্তিবর্গকে শাসন করতে পারি, হে মণি, আমি সেইরকম প্রয়াস পাবো। ভাষ্যমতে মন্ত্রের এইরকম অর্থ নিষ্পন্ন হয়েছে। ফলতঃ, কর্মশক্তির অলৌকিক কার্যকারিতার বিষয়ই সর্বত্র প্রখ্যাপিত হয়েছে। আমরাও সেই ভাবেই মন্ত্রের অর্থ নিষ্কাশনে প্রয়াস পেয়েছি। মন্ত্রের অর্থ নিষ্কাশনে ভাষ্যকারের সাথে আমাদের বিশেষ মতান্তর ঘটেনি। তবে আমরা যে আদর্শে অনুপ্রাণিত, সেই আদর্শের অনুসরণে আমাদের অর্থ ভিন্ন-পথ পরিগ্রহণ করেছে। আমাদের মনে হয়, মন্ত্রে মানুষের সাথে মানুষের দ্বন্দ্বের বিষয়। প্রকটিত হয়নি। এ মন্ত্র অন্তর-রাজ্যের আন্তর ও বহিঃশত্রুর সম্বন্ধে প্রযুক্ত হয়েছে। কর্মের প্রভাবে তাদেরই বিনাশের কামনা মন্ত্রে প্রকাশ পেয়েছে। এ-সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা আমরা পূর্বে বহুস্থলে করেছি।-মন্ত্রের অন্তর্গত অভিরাষ্ট্রঃ পদে আপন রাজ্যে ও পরকীয় রাজ্যে আধিপত্য বিস্তারের ভাব প্রকাশ পেয়েছে। সেই ভাব হতে আধ্যাত্মিক জগতের যে উচ্চ আদর্শ প্রকটিত হয়েছে, আমাদের বঙ্গানুবাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই তা উপলব্ধ হবে। সৎ-কর্মের প্রভাব ইহলোকে ও পরলোকে উভয়ত্রই প্রকটিত দেখতে পাওয়া যায়। সৎকর্মে যেমন ইহলোকে যশোসম্মান লাভ হয়, তেমনি পরলোকে পরমাগতি প্রাপ্ত হওয়া যায়। সৎকর্মের দ্বারা সেই পরাগতি লাভের কামনাই মন্ত্রে প্রকাশ পেয়েছে ॥ ৬৷৷

.

দ্বিতীয় সূক্ত: দীর্ঘায়ুঃপ্রাপ্তিঃ

[ঋষি : অথর্বা (আয়ুষ্কাম) দেবতা : বিশ্বে দেবা (বসব, আদিত্যগণ দেবগণ) ছন্দ : ত্রিষ্টুপ, জগতী ]

প্রথম মন্ত্রঃ বিশ্বে দেবা বসবো রক্ষতেমমুতাদিত্যা জাগৃত শূয়মশ্মি। মেমং সনাভিরুত বান্যনাভির্মেমং। প্রাপৎ পৌরুষেয়য়া বো যঃ ॥১॥

বঙ্গানুবাদ –হে দেবগণ বা দেবভাবসমূহ এবং হে সকলের নিবাসহেতুভূত দেবগণ বা। আশ্রয়প্রদ দেবভাবসমূহ! মুক্তিকাম এই প্রার্থনাকারীকে (শত্রুর আক্রমণ হতে রক্ষা করো। অপিচ, হে অনন্তের অঙ্গীভূত দেবগণ অথবা দেববিভূতি-সমূহ! তোমরাও এই মুক্তিকাম সাধকের অথবা তার অনুষ্ঠিত সকর্মের রক্ষার জন্য সদা জাগরুক থাকো অর্থাৎ সর্বদা অবহিত ভাবে অবস্থিতি করো। যাতে মুক্তিকামী সাধককে আপন জন্মসহজাত শত্রু অথবা বহিরাগত শত্ৰু অভিভূত করতে না পারে; অথবা, তার কর্মের দ্বারা সঞ্জাত শত্রু মুক্তিকাম সাধককে হিংসা করতে সমর্থ না হয়, সেই জন্য তোমরা অবহিতভাবে অবস্থিতি করো। (এই মন্ত্রে শত্রুনাশের কামনা বিদ্যমান। শ্রেয়োলাভে বহু বিঘ্ন ঘটে। সেই জন্য, সকল বাধা অপসারণের নিমিত্ত, মোক্ষেচ্ছজন সকল দেবতার বা দেবভাবের অনুকম্পা প্রার্থনা করছেন। প্রার্থনার ভাব এই যে, দেববিভূতিসমূহ আমাদের কর্মে অধিষ্ঠিত হয়ে আরব্ধকর্ম সুসিদ্ধ করুন এবং আমাদের মুক্তির বিধান করুন)। ১।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই দ্বিতীয় সুক্তের মন্ত্রগুলিতেও সেই একই ভাবে শত্রুনাশের প্রার্থনা বিজ্ঞাপিত হয়েছে। সূত্তানুক্রমণিকায় নানারকম কার্যে এই সূক্তের বিনিয়োগবিধি উক্ত হয়েছে। প্রথম-আয়ুষ্কাম ইষ্টিতে এই সূক্তের মন্ত্রসমূহ প্রযুক্ত হয়। স্থালীপাকে তিনটি ঘৃতপিণ্ড নিক্ষেপ করবার বিধি। তারপর সংপাতনের পরে মন্ত্রঃপূত করে সেই ঘৃত ও স্থালীপাক দ্রব্য ভক্ষণ করতে হয়। দ্বিতীয়–উপনয়ন-কার্যে এই সূক্তের মন্ত্রগুলির বিনিয়োগের বিষয় কৌশীতকী ব্রাহ্মণে কথিত হয়েছে। উপনয়ন-কালে মাণবকের নাভিদেশ সংস্তম্ভন করে সূক্তের মন্ত্রগুলি জপ করতে হয়। বাহুর দ্বারা গৃহীত প্রাঞ্চ অবস্থাপন-পূর্বক দক্ষিণ হস্তের দ্বারা নাভিদেশ সংস্তম্ভনান্তর অস্মিন বসু বসবো ধারয়ন্তু বিশ্বে দেবা বসবঃ প্রভৃতি মন্ত্র পাঠ করবার বিধি। তৃতীয়–আয়ুষ্কাম-ইষ্টির বৈশ্বদেবযাগে এই সূক্তের বিনিয়োগ আছে। অধায়োৎসর্জনকর্মে আজ্যহোমে এই সূক্তের মন্ত্রগুলি প্রযুক্ত হয়ে থাকে। চতুর্থ–আয়ুষ্যগণে এই সূক্তের পাঠ বিহিত আছে বলে  উপনয়ন-কালে আজহোমে এর বিনিয়োগ দৃষ্ট হয়। পঞ্চম-নক্ষত্রকল্পে বিহিত ঐরাবতাখ্য মহাশান্তিকর্মে, আয়ুষ্যগণের বিধান-হেতু সেই গণপ্রযুক্ত এই সূক্তের মন্ত্রগুলির বিনিয়োগের বিষয় উক্ত হয়েছে। ষষ্ঠ-বৈশ্যদেবাখ্য মহাশান্তি-কার্যেও এর প্রয়োগ পরিদৃষ্ট হয়। সপ্তম–আয়ুষ্য অভয় স্বস্ত্যয়ন প্রভৃতি পঞ্চগণে হোমকার্য সম্পন্ন করণের পর পরিশিষ্টোক্ত পুষ্পভিষেক-কার্যে এই সূক্তের গণপ্রযুক্ত বিনিয়োগ উল্লিখিত হয়েছে। অষ্টম–এই সূক্তের অন্তর্গত যে দেবা দিবি ইত্যাদি মন্ত্র দর্শপূর্ণমাস-ইষ্টির বষট্রকার অনুমন্ত্রণে বিনিযুক্ত হয়। লৌকিক ক্রিয়া-পদ্ধতিতে মন্ত্রের বিনিয়োগ সম্পর্কে বা অর্থ-বিষয়ে ভাষ্যকারের সাথে আমাদের বিশেষ কোনও মতান্তর ঘটেনি। মন্ত্রে এক অতি উচ্চ প্রার্থনার ভাব দ্যোতিত হয়েছে। সাধক ভগবৎ-আরাধনায় সমাবিষ্ট। তিনি সকল দেবতার বা দেবভাবের নিকট প্রার্থনা জানাচ্ছেন,–তার আর কার্যে যেন কোনও বিঘু উপস্থিত না হয়। দেবগণ সেই বিষয়ে সাধককে রক্ষা করুন। তিনরকম শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কা মন্ত্রের মধ্যে প্রকটিত। সেই তিনরকম শত্রু–সনাভিঃ, অন্যনাভিঃ ও পৌরুষেয়ঃ। সনাভিঃ পদের ভাষ্যানুমোদিত অর্থ–সমানো নাভিঃ গর্ভাশয়ো যস্যাসৌ সনাভিজ্ঞাতিঃ। অন্যনাভিঃ অর্থ–অসমানজন্মা অজ্ঞাতিরূপঃ। পৌরুষেয়ঃ অর্থ পুরুষকৃতঃ। এখানে জ্ঞাতি অজ্ঞাতি রূপ দুরকম শত্রুর এবং পুরুষ অর্থাৎ অপরের কৃত অনিষ্টের বিষয় বিবক্ষিত হয়েছে,–ভাষ্যের এটাই অভিমত।–এই সকল শত্রুর দ্বারা ইহসংসারে যে অশেষ অনিষ্ট সংসাধিত হয়ে থাকে, সে বিষয় আর বোঝাতে হবে না। এই সব বাহ্য শত্রুর নাশ-কামনায় এই মন্ত্র প্রযুক্ত হয়–এটাই ভাষ্য ইত্যাদির অভিমত। বহিঃশত্রুর বিনাশের পক্ষে যাই হোক, কিন্তু আধ্যাত্মিক হিসেবে ঐ সকল পদে যে এক অভিনব অর্থের সূচনা করে, সেই বিষয়ই আমাদের আলোচ্য। সনাভিঃ পদের ভাষ্যকার যে অর্থ গ্রহণ করেছেন, সেই অনুসারেই আমরা ঐ পদের অর্থ করি–জন্মসহজাতঃ। জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই যাদের উৎপত্তি, তারা সমানজন্ম। জ্ঞাতি প্রভৃতি, জন্মসহজাত অর্থাৎ জন্মমাত্রই জ্ঞাতির সাথে জ্ঞাতিত্ব-রূপ সমান সম্বন্ধের উদ্ভব হয়ে থাকে। জ্ঞাতি যেমন ও ও শত্রু, জন্মের সঙ্গে সঙ্গে যেমন জ্ঞাতিরূপ শত্রুর সাথে সম্বন্ধ উপস্থিত হয়; তেমনি জন্মমাত্র যে সকল পদ কুপ্রবৃত্তি-কুসংস্কার হৃদয়ে সঞ্জাত হয়, তারাও সেই জ্ঞাতি-শত্রু পদবাচ্য। অন্যনাভিঃ পদে জ্ঞাতি ভিন্ন অন্যান্য শত্রুকে বুঝিয়ে থাকে। জ্ঞাতি যেমন আপন গৃহে থেকে অনিষ্ট-সাধনে প্রয়াস পায়, অন্যনাভিঃ অর্থাৎ জ্ঞাতি ভিন্ন অন্যান্য যে শত্রু, তারা দূরে দূরে থেকে অনিষ্ট সাধন করে। এইরকম শত্রুকে আমরা বহিরাগত শত্রুর পর্যায়ে অভিহিত করি। এরা অন্তরে থাকে না; বহির্দেশ হতে এরা অনিষ্ট-সাধন করে। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য প্রভৃতি শত্রু অন্তরস্থ হয়েও বহির্দেশ হতে অনিষ্টসাধন করে। এ পক্ষে সেই বহিরাগত কার্যই লক্ষ্যস্থল। ক্রোধজনক, প্রলোভনজনক, মোহজনক সামগ্রী দর্শনে, হৃদয়ে ঐ সকল বৃত্তির স্ফুরণ হয়। সেই সেই সামগ্ৰী লাভে অন্তরায় উপস্থিত হলে, নানা অনর্থের সূত্রপাত ঘটে। পৌরুষেয়ঃ পদের অর্থ পুরুষকৃতঃ। পুরুষের কর্মের দ্বারা যে অনিষ্ট সঞ্জাত হয়, তাকেই পৌরুষেয়ঃ বলা যেতে পারে। এই ভাব হতে আমরা ঐ পৌরুষেয়ঃ পদের অর্থ অধ্যাহার করেছি–কর্মণা সঞ্জাতঃ। জন্মসহজাত অন্তঃশত্রু, হিংসাপ্রলোভন ইত্যাদি বহিরাগত শত্রু এবং কর্মের দ্বারা সঞ্জাত শত্রু–এই তিনরকম শত্রু যাতে সৎকর্মে বাধা উৎপন্ন করতে না পারে, মন্ত্রে দেবগণের বা দেবভাবসমূহের নিকট সেই প্রার্থনা জ্ঞাপন করা হয়েছে। ভাব এই যে,-হৃদয়ে যদি দেবভাব উপজিত হয়, তাহলে অন্তঃশত্রু বহিঃশত্ৰু কোনও শত্রুই আর অভিভূত করতে পারে না। তখন অনুষ্ঠিত কর্মও সৎপথে পরিচালিত হওয়ায় তার দ্বারাও কোনরকম অনিষ্টপাতের সম্ভাবনা থাকে না। সৎকার্যের বিঘ্ন বহুরকম। হৃদয় যদি নির্মল হয়, অন্তর যদি দেবভাবে মণ্ডিত হয়; তাহলে সৎকর্মের সকল অন্তরায়ই দূরে পলায়ন করে। বিশ্বে দেবা বসবো রক্ষতেমং মন্ত্রাংশ তাই বলছেন,–তোমরা নিখিল দেবভাবের অধিকারী হও; তাহলে দেবগণ তোমাদের সর্বদা সর্বত্র রক্ষা করবেন। আর, তাহলে প্রজ্ঞানরূপী ভগবান ভগবান্ তোমাদের হৃদয়ে সর্বদা জাগরিত থেকে তোমাদের সৎপথে পরিচালিত করবেন। তখন আর তোমাদের কোনও শত্রুই পরাভূত করতে সমর্থ হবে না। আমরা মনে করি, মন্ত্রের মধ্যে এই ভাবই নিহিত ॥১॥

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ যে বো দেবাঃ পিতরো যে চ পুত্রাঃ সচেতসসা মে শৃণুতেদমুক্ত। সর্বেভ্যো বঃ পরি দদাম্যেতং স্বস্ত্যেনং জরসে বহাথ ॥ ২॥

বঙ্গানুবাদ –হে দীপ্তিদানাদিগুণযুক্ত দেবভাবসমূহ! তোমাদের মধ্যে যারা পিতৃবৎ স্নেহকারুণ্যসম্পন্ন অর্থাৎ সত্ত্বসমন্বিত এবং পুত্রবৎ পবিত্রকারক ও পরিত্রাণসাধক, সেই তোমরা সকলে সমানমনস্ক অর্থাৎ অবহিত বা প্রত্যাতিশয়যুক্ত হয়ে বর্তমান এই স্তোত্র শ্রবণ করো অর্থাৎ গ্রহণ করো। হে দেবভাবসমূহ! তোমাদের সকলের উদ্দেশ্যে মোক্ষেছু এই ব্যক্তিকে অর্থাৎ আমাকে পরিরক্ষণের জন্য প্রদান করছি অর্থাৎ শরণ নিচ্ছি। তোমরা তোমাদের স্থিতাত্মা মোক্ষেচ্ছু এই আমাকে পরিত্রাণের নিমিত্ত আধ্যাত্মিক-দুঃখ ইত্যাদি নাশের দ্বারা, জরাপ্রাপ্তি অর্থাৎ মোক্ষপ্রাপ্তি পর্যন্ত সকলরকম মঙ্গল (কল্যাণ) বিধান করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক! মোক্ষমার্গ-অনুসারী ব্যক্তিকে দেবতারা সর্বদা রক্ষা করেন। দীপ্তিদানাদিগুণযুক্ত পবিত্রতাসাধক দেবভাবসমূহ আমার মোক্ষ বিধান ও করুন, এই প্রার্থনা)। ২।

মন্ত্রাৰ্থআলোচনা –সরল প্রার্থনামূলক এই মন্ত্রে এক উচ্চ ভাব প্রকটিত হচ্ছে। মন্ত্রের অন্তর্গত পিতরঃ ও পুত্ৰাঃ পদ দুটিতে সেই ভাব পরিস্ফুট হয়েছে। পিতার ন্যায় স্নেহকরুণা-পূর্ণ প্রতিপালক সত্ত্বভাব ইত্যাদি এস্থলে পিতরঃ পদের লক্ষীভূত বলে আমরা মনে করি। পুত্রাঃ পদ পবিত্রতাসাধক পরিত্রাণকারক অর্থ দ্যোতনা করে। পুত্র পিতামাতাকে পবিত্র করে-পুন্নামক নরক হতে পরিত্রাণ করে। এই ভাব হতে পুত্রাঃ পদের অর্থ অধ্যাহৃত হয়েছে-পবিত্রকারকাঃ, পরিত্রাণসাধকাঃ। তাতে মন্ত্রের প্রথমাংশের যে অর্থ হয়েছে আমাদের বঙ্গানুবাদে তা পরিদৃষ্ট হবে।-মন্ত্র সরল-ভাবদ্যোতক, ভাষ্যের ভাবও সহজবোধ্য; সুতরাং অধিক অলোচনা নিষ্প্রয়োজন। ভাষ্যকারের পন্থা (লৌকিক প্রয়োগানুসারে) একরকম, আমাদের পরিগৃহীত পন্থা (আধ্যাত্মিক ভাবে) অন্যরকম–প্রভেদ এইমাত্র ॥ ২॥

.

তৃতীয় মন্ত্র: যে দেবা দিবি ষ্ঠ যে পৃথিব্যাং যে অন্তরিক্ষ ওষধীষু পশুধেষু পশুস্বন্তঃ। তে কৃণুত জরসমায়ুরস্মৈ শতমন্যা পরি বৃণ মৃত্যু ॥ ২॥

বঙ্গানুবাদ –দীপ্তিদানাদিগুণযুক্ত হে দেববিভূতিসমূহ! তোমাদের মধ্যে যে সমুদায় দ্যুলোকে অবস্থিতি করে; অপিচ যারা পৃথিবীলোকে, অন্তরিক্ষলোকে বৃক্ষবনস্পতিসমূহে এবং গো-অশ্ব ইত্যাদি পশু সমূহের মধ্যে বর্তমান আছে; মোক্ষপ্রাপ্তিকাম ব্যক্তির–আমার-উপকারের নিমিত্ত, মোপ্রাপ্তির কাল পর্যন্ত, (সিদ্ধিলাভ পর্যন্ত), সেই সকল দেববিভূতি জীবন বিধান করুন; (যে পর্যন্ত অভীষ্টপূরণরূপ সিদ্ধিলাভ না হয়, সে পর্যন্ত সকল দেববিভূতি সকল বাধা দূর করে আমাকে রক্ষা করুন–এটাই ভাবার্থ)। হে দেববিভূতিসমূহ! আপনারা অপরিমিত বা অস্বাভাবিক মরণহেতুভূত জরা ইত্যাদিকে অর্থাৎ অপমৃত্যুকে বা অকালমৃত্যুকে পরিবর্জন অর্থাৎ নাশ করুন এবং শতবর্ষপরিমিত অর্থাৎ পূর্ণায়ুষ্কাল বা মোক্ষ বিধান করুন। (অভীষ্টলাভ বা মোক্ষপ্রাপ্তি পর্যন্ত শত্রুগণ যাতে বিঘ্ন উৎপাদন করতে না পারে, তা করুন। আপনাদের অনুগ্রহে যেন মোক্ষলাভে সমর্থ হই। অতএব হে দেবগণ! সাধনমার্গে আপনারা আমাকে রক্ষা করুন; যাতে আমার পদস্খলন না হয়, আপনারা তার বিহিত করুন।–মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। সর্বলোকে এবং সর্বভূতে যে সকল, দেবভাব আছে, তারা সকলে আমাকে প্রাপ্ত হোক অর্থাৎ রক্ষা করুক। ৩

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রটিতেও আয়ুবৃদ্ধির কামনা প্রকাশ পেয়েছে। পৃথিবীতে, অন্তরিক্ষে, স্বর্গলোকে এবং ভূতসমূহে–সুলতঃ সর্বভূতে সর্বলোকে যে যে সকল দেবভাব বিদ্যমান আছে, তারা সকলে আয়ুষ্কাম-ব্যক্তিকে পূর্ণায়ুষ্কাল পর্যন্ত রক্ষা করুন,ভাষ্যপাঠে মন্ত্রের এই ভাব অবগত হওয়া যায়। মন্ত্রের অর্থ নিষ্কাশনে ভাষ্যকারের সাথে দু এক স্থলে সামান্য যে মতান্তর ঘটেছে, আমাদের বঙ্গানুবাদে তা পরিদৃষ্ট হবে। দিবি, পৃথিব্যাং, অন্তরিক্ষে, ওষধীষু, পশুষু, অপসু প্রভৃতি পদের ভাষ্যকার যে অর্থ পরিগ্রহণ করেছেন, আমরাও ঐ সকল পদের সেই রকমই অর্থ গ্রহণ করেছি। তবে ভাষ্যে সেই সেই অধিষ্ঠাত্রী

দেবতাকে যে ভাবে সম্বোধন করা হয়েছে, আমাদের ভাব তা অপেক্ষা স্বতন্ত্র। যে দেবাঃ দিবি স্থ মন্ত্রাংশের ভাষ্যমতে অর্থ হয়–সূর্য ইত্যাদি যে সকল দেবতা দ্যুলোকে অবস্থিত। এইরকমে যে দেবাঃ পৃথিব্যাংস্থ মন্ত্রাংশের অর্থ–অগ্নি প্রভৃতি যে সকল দেবতা পৃথিবীলোকে অবস্থিত এবং যে দেবাঃ অন্তরিক্ষে স্থ মন্ত্রাংশের অর্থ-বায়ু প্রভৃতি যে সকল দেবতা অন্তরিক্ষলোকে অবস্থিত। স্থূলতঃ, প্রকাশ-প্রবর্ষণ-পচন ইত্যাদি উপকারের নিমিত্ত তিনলোকে যে সকল দেবতা বর্তমান, তারা সকলে আয়ুষ্কাম ব্যক্তিকে রক্ষা করুন, ভাষ্যে এই ভাব পরিব্যক্ত। আমরা দেবাঃ পদে দেবভাব, ভগবৎ-বিভূতি বা শুদ্ধসত্ত্ব অর্থ গ্রহণ করি। সর্বলোকে এবং বৃক্ষবনস্পতি, গো-অশ্ব ইতাদি পশু এবং উদক-সমূহেস্থূলতঃ সর্বভূতে যে সকল সৎ-ভাবের সমাবেশ আছে, সেই সকলে যে সকল ভগবৎ-বিভূতি-সমূহ বিরাজিত, মোক্ষেচ্ছু সাধক সেই সকল সৎ-ভাবের অধিকারী হবার কামনা করছেন। সাধন-পথের অন্তরায় বহুরকম। সৎ-ভাবের উদয়ে হৃদয় নির্মল হলে কোনও বিভীষিকাই তখন হৃদয়কে বশীভূত বা অভিভূত করতে পারে না। এখানে আমাদের মনে হয়, সেই সর্বলোকস্থায়ী সর্বভূতান্তৰ্গত দেবভাবসমূহ সেই সকল অন্তরায় বিদূরিত করে মোক্ষপ্রাপ্তি পর্যন্ত অর্থাৎ সাধনা পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত, সাধককে রক্ষা করবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। অন্যান মৃত্যুন পদ দুটির ভাষ্যমতে অর্থ হয়–অকালমৃত্যু বা অপমৃত্যু প্রভৃতি। মন্ত্রের শেষাংশে অকাল মৃত্যু বা অপমৃত্যু নিবারণ করে পূর্ণশতবর্ষ পরিমিত জীবিতকাল বিহিত করবার প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে। আমরা এস্থলে অন্যান্ মৃত্যুন পদ দুটিতে অকালমৃত্যু বা অপমৃত্যু অর্থ গ্রহণ করি না। আমাদের ভাব সেইরকমই বটে; কিন্তু অর্থ স্বতন্ত্র। সাধনায়, সিদ্ধিলাভের সময়, পূর্ণসিদ্ধি লাভ করবার পূর্বে, আন্তর-বাহ্য-শত্রুর আক্রমণে চিত্ত যদি বিক্ষোভিত হয়, মন যদি বিপথে গমন করে, তাহলে সেই অবস্থাকেই অকালমৃত্যু বা অপমৃত্যু বলা, চলতে পারে। আমাদের পরিগৃহীত ভাব এমন। তাতে অন্যান্ মৃত্যু পরিবৃণক্ত মন্ত্রাংশের অর্থ হয় যে, সাধনার স্তরে অগ্রসর হবার সময়, যে সকল বিঘ্ন এসে সাধনার ক্রমভঙ্গ করতে প্রয়াস পায়, হে দেবগণ! তোমরা সেই আন্তর ও বাহ্য উভয় রকম বাধাবিঘ্ন অপসারণ করো। আর সেই বাধা-বিঘ্ন অপসারণের কালে আমাদের শতবর্ষ পরিমিত জীবনকাল প্রদান করো; অর্থাৎ যে পর্যন্ত না আমার সাধনায় সিদ্ধি লাভ হয়– আমার অভীষ্ট পূরণ হয়–যে পর্যন্ত না আমি মোক্ষলাভে সমর্থ হই, সে পর্যন্ত, হে দেবগণ! আপনারা আমাকে রক্ষা করুন। আমরা মনে করি, মন্ত্রে এ ভাবই পরিস্ফুট। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যেখানে যে সৎ-ভাবের সমাবেশ আছে, মন্ত্রে প্রার্থনাকারী সাধক সেই সকলকেই আবাহন করছেন। তার আকাঙ্ক্ষা–কি স্বর্গে, কি মর্ত্যে, কি অন্তরিক্ষে, কি ভূতজাতসমূহে–যেখানে যে ভগবৎ-বিভূতিরূপ দেবভাব বা শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্চিত আছে, সে সকলই যেন আমি অধিকার করতে পারি। সাধনার অন্ত নেই। সাধনার পথে যতই অগ্রসর হবে, ততই দেবভাবসমূহ হৃদয় অধিকার করবে,ততই হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাব সঞ্জাত হবে,ততই ভগবানের অনুকম্পা-লাভে সমর্থ হবে। এইভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে, অর্চনাকারী সাধক তাই বলছেন,–স্বর্গে, অন্তরিক্ষে, পৃথিবীতে এবং ভূতজাতসমূহে, যেখানে ভগবানের যতগুলি বিভূতি-স্বরূপ সৎ-ভাব ও শুদ্ধসত্ত্ব বিদ্যমান আছে, সে সমস্তই আমার হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হয়ে আমার সাধনায় সিদ্ধি প্রদান করুক; আমি মোক্ষলাভে L. ভগবানের সাথে সম্মিলিত হই।–এই আকাঙ্ক্ষাই মন্ত্রে বিধৃত ॥৩॥

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ যেং প্রজা উত বানুযাজা হুতভাগা অহুতাশ্চ দেবাঃ। যেষাং বঃ পঞ্চ প্রদিশো বিভক্তাস্তান বো অম্মৈ সত্ৰসদঃ কৃপোমি। ৪

বঙ্গানুবাদ –যে দেবভাব প্রথমোৎপন্ন অর্থাৎ জন্মসহজাত, অপিচ যারা সৎকর্মের দ্বারা সঞ্জাত, যারা জ্ঞানের দ্বারা লব্ধ এবং যারা জ্ঞানকর্ম ব্যতিরেকে স্বতঃসঞ্জাত অর্থাৎ সাধুসঙ্গে সম্প্রসঙ্গে উপজিত হয়; অপিচ, যে সকল দেবভাব সকল দিকে পরিব্যাপ্ত হয়ে বিদ্যমান; হে দেবভাবসমূহ। সেই হেন আপনাদের মোক্ষেচ্ছু পুরুষের কল্যাণের জন্য অর্থাৎ আমার উপকারের নিমিত্ত, হৃদয়রূপ যজ্ঞগৃহে সম্যকপ্রকারে নিহিত (স্থাপিত) করছি। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক নিখিল দেবভাব আহরণ করে হৃদয়ে সংস্থাপনের জন্য মন্ত্রে সাধকের সঙ্কল্প বিদ্যমান) ৪

অথবা,

হে দেবগণ! আপনাদের মধ্যে যে দেবগণ প্রথম হবির্ভাগের গ্রাহক, অপিচ যাঁরা প্রথম-যাগের পরবর্তী হবির্ভাগের গ্রাহক, অপিচ যাঁরা হুতদ্রব্যের ভাগগ্রহণকারী এবং যারা হোম-আধানের বহির্ভাগে প্রক্ষিপ্ত হবির্ভক্ষক; আরও আপনাদের মধ্যে যে দেবগণ সকল দিক ভাগ করে অবস্থিত আছেন; পূর্বোক্ত সেই আপনাদের সকলকে, মিেক্ষকামী সাধকের অর্থাৎ আমার উপকারের নিমিত্ত, আমার হৃদয়রূপ যজ্ঞাগারে সম্যক্রমে নিহিত করি। (সকল দেবগণ হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হয়ে মোক্ষ বিধান করুন–এটাই ভাবার্থ)। ৪।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— মন্ত্রের মধ্যে যে দুটি যেষাং পদ আছে, ঐ দুটি যেষাং পদে এই মন্ত্রটি কিছুটা জটিলতা-প্রাপ্ত হয়েছে। ঐ দুই পদের সাথে অন্যান্য পদের অন্বয় সহজসাধ্য নয়। ভাষ্যকার টেনে-বুনে প্রথম ও দ্বিতীয় যেষাং পদ দুটির একটা অন্বয় স্থির করেছেন বটে; কিন্তু প্রথম স্থলে তাঁকে দেবানাং স্বভূতাঃ পা দুটি এবং দ্বিতীয় স্থলে যেষাং প্রসিদ্ধানাং পদ দুটি অধ্যাহার করতে হয়েছে। ঐ প্রথম যেষাং পদের সাথে বঃ পদের অন্বয় হয়েছে। কিন্তু ঐরকম অন্বয়ের–যেষাং প্রসিদ্ধানাং বঃ যুম্মাকং অর্থের ভাবগ্রহণ যে একান্ত কষ্টসাধ্য, সাধারণ দৃষ্টিতেই তা বোধগম্য হবে। মন্ত্রের মধ্যে দুটি পদ দৃষ্ট হবে। ভাষ্যকারের ব্যাখ্যায় প্রথমটি ষষ্ঠীর বহুবচনে যুম্মাকং রূপে এবং দ্বিতীয় বঃ পদ দ্বিতীয়ার বহুবচনে যুম্মা রূপে অর্থ করা হয়েছে। যেষাং এবং বঃ পদসমূহের বিভক্তি-ব্যত্যয় না করে অন্য পদের সাথে তাদের অন্বয় করা কঠিন। ভাষ্যকার পূর্বোক্ত রকমে আবশ্যকমতো পদ ইত্যাদি অধ্যাহার করেছেন বলেই মনে হয়। মন্ত্রের যেষাং পদ যে ভাবে ব্যবহৃত, পূর্ব-মন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে হলে, বিভক্তি-ব্যত্যয় স্বীকার করতেই হবে। এ ব্যতীত মন্ত্রের সুষ্ঠু সঙ্গত অর্থ নিষ্কাশন করা সম্ভবপর নয়। ভাষ্যকার বলেন–প্রয্যজা (ঋ.১০৫১ ৮) মন্ত্রে যে অগ্নির বিষয় উল্লিখিত হয়েছে, প্রজাঃ  পদে সেই অগ্নিকে বোঝাচ্ছে। যেষাং পদ সে হিসাবে পূজার্থ বহুবচনে ব্যবহৃত হয়েছে। যাই হোক, আমরা আমাদের ব্যাখ্যায় ঐ যেষাং পদের বিভক্তি-ব্যত্যয় করে যে দুরকম অন্বয় করেছি, এবং তাতে মন্ত্রে যে ভাব পরিব্যক্ত হয়েছে, তা আমাদের বঙ্গানুবাদে পরিদৃষ্ট হবে। ভাষ্যকারের মতে, আয়ুষ্কাম ব্যক্তির আয়ুবৃদ্ধির জন্য এই মন্ত্রে দেবগণের নিকট প্রার্থনা জানানো হয়েছে। সে বিষয়ে অবশ্য আমাদের সাথে ভাষ্যকারের বিশেষ মতান্তর নেই। তবে আমরা মনে করি,প্রজঃ অনুযাজঃ প্রভৃতি পদে যেমন যজ্ঞাংশভাগী সেই সেই দেবতাকে বোঝাচ্ছে, তেমনই ঐ পদসমূহে হৃদয়ের বৃত্তি-সমূহের প্রতিও লক্ষ্য আছে। প্রজঃ পদে যেমন যজ্ঞের অগ্রাংশগ্রহণকারী দেবতাকে বোঝায়, তেমনি ঐ পদে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ে যে সকল সৎ-বৃত্তির সঞ্চার প্রথমেই হয়ে থাকে, তাদেরও বুঝিয়ে থাকে। অনুযাজঃ পদেও তেমনি দুরকম ভাব পরিব্যক্ত হয়। অগ্নি যজ্ঞের ভাগ প্রথম গ্রহণ করেন; তারপর অপরাপর দেবগণ ক্রমপর্যায় অনুসারে যজ্ঞভাগ প্রাপ্ত হন। সেইরকম, জন্মের পর আমাদের কর্মের দ্বারা যে সকল সৎ-ভাব হৃদয়ে উপজাত হয়, অনুযাজঃ পদে আমরা মনে করি, সেই সকল সৎ-ভাবের প্রতিই লক্ষ্য আছে। হুতভাগাঃ এবং অহুতাদঃ পদ দুটিতেও ঐরকম দুপ্রকার ভাব পরিব্যক্ত হয় বলে আমরা মনে করি। হুতভাগাঃ পদের ভাষ্যমতে অর্থ হয়,–অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হবিঃ যে দেবগণ ভক্ষণ করেন, তাঁরাই হুতভাগাঃ অর্থাৎ অগ্নির দ্বারা যে হবিঃ সংশোধিত হয়, তা-ই সেই দেবগণ গ্রহণ করেন। সে হিসাবে জ্ঞানের প্রভাবে হৃদয়ে যে সৎ-ভাবের সঞ্চার হয়, তাকেই আমরা হুতভাগাঃ পদের লক্ষ্য বলে মনে করি। আর অহুতাদঃ পদের লক্ষ্য যে দেবগণ, তারা, হোমাগ্নির চতুর্দিকে ইতস্ততঃ প্রক্ষিপ্ত হবিভাগ গ্রহণ করে থাকেন। তা হতে আমাদের অর্থ হয়-জ্ঞান ও কর্ম ভিন্ন আপনা-আপনিই হৃদয়ে যে সৎ-ভাবের সঞ্চার হয় অর্থাৎ সাধুসঙ্গে সপ্রসঙ্গে অন্তরে যে সৎ-ভাবের সঞ্চার হয়ে থাকে, অহুতাদঃ পদের তা-ই লক্ষ্য বলে মনে হয়। সে হিসাবে, যেষাং হতে অহুতাশ্চ পর্যন্ত মন্ত্রাংশের অর্থ হয় এই যে,যে দেবভাব আমাদের জন্মসহজাত, যারা কর্মের দ্বারা সঞ্জাত, যারা জ্ঞানের দ্বারা লব্ধ এবং যারা জ্ঞান ও কর্মের সহায়তা ভিন্ন স্বতঃসঞ্জাত অর্থাৎ সাধুসঙ্গে সপ্রসঙ্গে উপজিত। আবার অন্য পক্ষে, প্রধান অপ্রধান সকল দেবতার ভাবও মনে আসতে পারে। ঋগ্বেদের নমো মহত্ত্যে নমঃ অর্ভকেভ্যঃ প্রভৃতি মন্ত্রে যেমন প্রধান অপ্রধান সকল দেবতার নিকটই প্রার্থনা জানানো হয়েছে; তেমনি এই মন্ত্রেও যেষাং প্রজাঃ প্রভৃতি মন্ত্রে প্রধান অপ্রধান সকল দেবতাকেই আহ্বান করা হয়েছে বলে মনে করি।পঞ্চ প্রদিশঃ পদের ভাষ্যের অর্থ–পূর্ব ইত্যাদি পাঁচ দিক। এই দিক-বিভাগ সম্বন্ধে নানা মতান্তর আছে। কারও মতে পাঁচ দিক, কারও মতে দশ দিক্‌ ইত্যাদি। লোকবিভাগেও যেমন মান্তর, দিক্-বিভাগেও তেমনি মতান্তর। যাই হোক, আমরা ঐ পঞ্চ প্রদিশঃ পদ দুটিতে সকল দিক অর্থাৎ এই বিশ্বচরাচরের সর্বত্র অর্থ পরিগ্রহণ করেছি। তাতে মন্ত্রের অর্থ হয়েছে, বিশ্বচরাচরের সর্বত্র যে সকল সৎ-ভাব বিদ্যমান আছে, সেই সবগুলিকে এনে আমার হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করি। দ্বিতীয় অন্বয়েও সেই একই ভাব পরিস্ফুট। বিশ্বচরাচরের সর্বত্র প্রধান অপ্রধান যে সকল দেবতা আছেন, তারা সকলে এসে আমার। হৃদয়রূপ যজ্ঞাগারে যথাযোগ্য স্থানে অধিষ্ঠিত হোন। দেবতার অধিষ্ঠানে আসুরিক প্রভাব-সমূহ বিদূরিত। হোক,–মন্ত্রে এই ভাব পরিব্যক্ত বলে মনে করি। ৪

.

তৃতীয় সূক্ত : পাশমোচনম

[ঋষি : ব্রহ্ম দেবতা : আশাপাল (বাস্তোষ্পতি) ছন্দ : অনুষ্টুপ, ত্রিষ্টুপ]

প্রথম মন্ত্রঃ আশানামাশাপালেভ্যশ্চতুর্ভো অমৃতেভ্যঃ। ইদং ভূতসাধ্যক্ষেভ্যো বিধেম হবিষা বয়ম্ ॥ ১।

বঙ্গানুবাদ –সকল অভীষ্টের পূরক এবং ধর্ম-অর্থ-কাম মোক্ষরূপ চতুবর্গ-ফলের দাতা, মরণরহিত নিত্যসত্যরূপ, স্থাবর-জঙ্গমাত্মক বিশ্বের অধিপতি দেবগণের পরিতৃপ্তির জন্য, আমার অনুষ্ঠিত এই কার্যে হৃদয়গত শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা পরিচর‍্যা করি অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বকে সমর্পণ করি। (মন্ত্রটি সঙ্কল্প-মূলক। ভগবানের পূজায় হৃদয়গত শুদ্ধসত্ত্বই প্রধান উপকরণ। তা-ই ভগবানের প্রীতিসাধক।

অতএব হৃদয়ে সঞ্চিত শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা ভগবানের পূজা করি–এটাই সঙ্কল্প) ১

 মন্ত্ৰার্থআলোচনা –নূতন সূক্তে নূতন প্রার্থনার সমাবেশ। সূক্তানুক্রমণিকায় এই সূক্তের নানারকম প্রয়োগ উল্লিখিত হয়েছে। নিত্য, নৈমিত্তিক এবং কাম্য ভেদে দ্বাবিংশ সবযজ্ঞ বিহিত হয়ে থাকে। সেই দ্বাবিংশতি সব্যজ্ঞ এই,–ব্রহ্মেদিন, স্বগৌর্দন, চতুঃশরাবসবৌদন, সবশতৌদন, দ্বয়াজৌদন, পঞ্চৌদন, ব্রহ্মাসৌদন, মৃত্যুসব-অনডুৎসবদ্বয়, কর্কি-পৃদ্বিয়, পৌনশীল, পবিত্র, অর্বরা, ঋষভ, বশা, শালা, বৃহস্পতি প্রভৃতি। এদের মধ্যে চতুঃশরাবৌদনসবে আশানা প্রভৃতি সূক্তের বিনিয়োগ আছে। সেই যুগে আশানা প্রভৃতি মন্ত্রের দ্বারা বিরুক্ত হবির অভিমৰ্শন, সম্পাতন এবং দাতৃবাচন ও দান করবার বিধি। কৌশিতকী-ব্রাহ্মণে এই প্রক্রিয়া-পদ্ধতির বিস্তৃত বিবরণ পরিদৃষ্ট হবে। এইভাবে ধূমকেতুরূপ অদ্ভুতদর্শনে দিক্‌-দেবতা বহুরূপ অজের অবদানসমূহ এবং সেই দেবতা-সম্বন্ধি চরু এই সূক্তের প্রতি মন্ত্রে হোমাগ্নিতে নিক্ষেপ করতে হয়। এই বিষয়ে অথ যত্রৈত প্রভৃতি মন্ত্রে প্রক্রম করে, অশোনামিতি দৈশস্য প্রভৃতি মন্ত্রে শেষ করবার বিধি। এই ভাবে গ্রাম-নগর-দেশ-প্রাকার ইত্যাদি অবদরণে আশ্রামস্বা ইত্যাদি মন্ত্রে এই সূক্তের দ্বারা পুরোডাশ ও পাষাণ প্রভৃতি নিখনন করবার বিধি আছে। এই সূক্তের প্রথম ইত্যাদি মন্ত্রে সর্বরোগ-ভৈষজ্যে আপ্লাবন, অবসেচন ও অপায়ন ইত্যাদি করতে হয়। এই সম্বন্ধে অপরাপর বিনিয়োগও আছে। অশ্বমেধ-যাগে উৎসৃষ্ট অশ্বকে আশানা প্রভৃতি মন্ত্রে ব্রহ্মাখ্য অধ্বর্য অনুমন্ত্রিত করবেন। অদ্ভুতমহাশান্তিকর্মে, এই সূক্তের প্রথম মন্ত্র দিক্-দেবতা-বিষয়ে প্রযুক্ত হয়ে থাকে; নক্ষত্রকল্পে এই বিষয় উক্ত হয়েছে। স্বস্তি মাত্র প্রভৃতি শেষ বা চতুর্থ মন্ত্রটির দ্বারা সর্বস্বস্ত্যয়নকাম ব্যক্তি রাত্রিতে উপস্থান করবে। সূক্তের অন্তর্গত মন্ত্র-সমূহের এইরকম প্রয়োগের বিষয় সূক্তানুক্রমণিকায় উল্লিখিত হয়েছে। এইরকম প্রয়োগবিধির অনুসরণেই ভাষ্যকার সূক্তের মন্ত্র-সমূহের অর্থ নিষ্কাশন করেছেন। মন্ত্রটি অবশ্য কিছুটা জটিলভাবাপন্ন। আশানাম্ আশাপালেভ্যশ্চতুর্ভো মন্ত্রাংশেই সেই জটিলতা অধিকতর ঘনীভূত হয়েছে। সূক্তানুক্রমণিকায় প্রকাশ,–মন্ত্রটি দিক্-দেবতাগণের উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত হয়ে থাকে। আশা পদ নিরুক্তে দিক্‌-বাচী বলে উল্লিখিত। আশানা ও আশাপালেভ্যঃ পদ দুটির আশা পদ সংশয়-মূলক। সেই সংশয় নিরসনের জন্য ভাষ্যকার বলেন,-আশানা ইতি..ইত্যাদি। অর্থাৎআশানাম পদটি ষষ্ঠ্যন্ত বলে ঐ পদে ঈশিতব্যের বহুত্ব প্রতিপাদিত হচ্ছে। পরন্তু দুটি আশা পদে পুনরুক্তিদোষ ঘটেনি। আশানা আশাপালেভ্যঃ পদ দুটিতে দিসমূহের অধিপতিত্ব বিবক্ষিত হয়েছে। ভাষ্যকার চতুর্ভঃ আশাপালেভ্যঃ পদ দুটির ঐ অর্থ গ্রহণ করেছেন। ইন্দ্র ইত্যাদি দেবগণ দশদিকপালরূপে উল্লিখিত ও সম্পূজিত হন। চতুর্ভঃ পদে পূর্ব ইত্যাদি চারটি দিককে বোঝায়। সেই হিসাবেই হয়তো ভাষ্যকার ইন্দ্র-যম ইত্যাদি দেবতার বিষয় চতুর্ভঃ পদের লক্ষ্যস্থানীয় বলে নির্দেশ করেছেন। যাই হোক, আমাদের অর্থ একটু স্বতন্ত্র পন্থা অবলম্বন করেছে। আশানা পদে দিক্-বোধক সর্বাং দিশাং প্রতিবাক্যে সকল দিকে বর্তমান অনন্ত ভূতসঙ্ঘকে বোঝাচ্ছে বলে মনে হয়। আশা পদ ব্যপ্তার্থক অশ ধাতু হতে নিস্পন্ন–অশ ব্যাপ্তেী। তাতে ঐ আশা পদে সর্বতোভাবে ব্যাপ্ত বোঝায়। ভগবান্ এই বিশ্বের সর্বত্র ব্যাপ্ত; আবার ভূত সমষ্টিতে এই বিশ্বের উৎপত্তি অথবা ভূতসঙ্ঘ এই বিশ্বের সর্বত্র অনুপরমাণুক্রমে অবস্থিত। সুতরাং আশানা পদের অর্থে ভাষ্যে যেমন দিমূহ প্রতিপন্ন হয়, তেমনি ঐ পদে দিমূহে অবস্থিত অনন্ত ভূতসঙ্ঘ এবং তাদের অধিপতি অনন্তস্বরূপ ভগবাকে বুঝিয়ে থাকে। আশানা পদের এই একরকম অর্থ হতে পারে। আবার আশা পদের প্রচলিত সাধারণ অর্থ-অভীষ্ট পদ গ্রহণ করলেও আশানা এবং আশাপালেভ্যঃ পদ দুটির সুষ্ঠু সঙ্গত অর্থ হয়। তাতে বহুবচনা আশানা পদের অর্থ হয়–সর্বাভীষ্টানাং। সেই সকল অভীষ্টের যাঁরা পূরণ করেন, আমরা মনে করি, আশানা এই ষষ্ঠী বিভক্তির বহুবচনান্ত পদে তারাই বিবক্ষিত হয়েছেন। সেই হিসাবেই ঐ আশানা পদের অর্থ হয়েছে-সর্বাভীষ্টানাং–পূরকেভ্যঃ ইতি ভাবঃ।–মানুষের কামনার অন্ত নেই। ধনং দেহি, রূপং দেহি, যশো দেহি, দ্বিষো জহি, ভার্যাং মনোরমাং দেহিতার কত কামনা, তার কত অভিলাষ। কিন্তু সকল অভীষ্টের সকল কামনার শ্রেষ্ঠ কামনা ধ ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষরূপ চতুর্বর্গধন লাভের কামনা। সেই চতুর্বর্গরূপ অভীষ্ট যারা পূরণ করেন, চতুর্ভঃ আশাপালেভ্যঃ পদ দুটিতে তাদের প্রতিই লক্ষ্য আছে। সে হিসাবে, আমাদের মতে, ঐ দুই পদের অর্থ হয়েছে-ধর্মার্থকামমোক্ষরূপেভ্যঃ চতুর্ভঃ ফলদাতৃভ্যঃ। সে কারা? ভূতেভ্যঃ অধ্যক্ষেভ্যঃ পদ দুটিতে তা স্পষ্টীকৃত হয়েছে বলে মনে করি। স্থাবরজঙ্গমাত্মক এই বিশ্বের অধিপতি যে ভগবানের বিভূতি বা ভগবৎ-ভাবসমূহ, তারাই মানুষের সকল অভীষ্ট পূরণ করে থাকেন। এখানে সেই ভগবৎ-বিভূতি সমূহের বা দেবভাবসমূহের শক্তিমত্তার বিষয়ই আশানা ও চতুর্ভঃ আশাপালেভ্যঃ পদসমূহে বিবক্ষিত হয়েছে বলে মনে করি। চতুর্ভঃ পদের ইন্দ্র-যম ইত্যাদি অর্থ আমরা পরিগ্রহণ করি না। বেদে ত্রি, চতুর, সপ্ত প্রভৃতি সংখ্যাবাচক পদ বহু অর্থেই প্রযুক্ত হয়েছে। আমরা এস্থলে ঐ চতুর্ভঃ পদের পূর্ব ইত্যাদি চারিদিক অর্থও পরিগ্রহণ না করে বিভক্তিব্যত্যয়ে বিবিধরূপেন অর্থ গ্রহণ করেছি। আশাপালেভ্যঃ পদে সকল দিকের অর্থাৎ এই বিশ্বচরাচরের যিনি পালক, যিনি সকল অভীষ্টের পূরক, যিনি চতুর্বর্গফলের দাতা, বিশ্বব্যাপক অনন্তস্বরূপ সেই ভগবাকেই লক্ষ্য করা হয়েছে, তা আমাদের বঙ্গানুবাদের মধ্যে পরিদৃষ্ট হবে। দুটি আশা পদ থাকায় আশানা এবং আশাপালেভ্যঃ পদ দুটির অন্বয় সুকঠিন হয়। সেইজন্য ভাষ্যকার দ্বিতীয় আশা পদের অর্থ যে একরকম পরিহারই করেছেন, তা তাঁর ভাষ্য-দৃষ্টেই উপলব্ধ হয়।–ভাষ্যকার মন্ত্রের ইদ পদের বিভক্তি-ব্যত্যয় স্বীকার করেছেন। আমরাও তাঁর পদাঙ্কানুসরণে বাধ্য হয়েছি। তা ছাড়া, ঐ পদের অম্বয় সুকঠিন। ভাষ্যকার ঐ পদের অর্থ করেছেন, ইদানীং চতুঃসরাসব যাগকালে। যাগ-পদে সৎকর্মানুষ্ঠান দ্যোতনা করে। সেই ভাব হতে আমরা ঐ ইদম পদের অর্থ করেছি, মদনুষ্ঠিতে অস্মিন্ সৎকর্মণি। সৎকর্মে ভগবানের অধিষ্ঠান হোক, হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা তার পুজা করি, মন্ত্র সাধকের এমন সঙ্কল্প ব্যক্ত করছেন। সৎস্বরূপ ভগবানের পূজায় হৃদয়ের সৎ-ভাবই প্রধান উপকরণ। আনন্দেই সেই সদানন্দময়ের পরিতুষ্টি। মন্ত্র তাই উপদেশ দিচ্ছেন–সম্ভব সত্ত্বভাবের দ্বারা ভগবাকে। পূজা করো। তাহলেই তোমার সকল অভীষ্ট সিদ্ধ হবে ॥ ১।.

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ য আশানামাশাপালাশ্চত্বার স্থান দেবাঃ। তে নো নিঋত্যাঃ পাশেভ্যো মুঞ্চতাংহসো অংহসঃ ॥ ২॥

বঙ্গানুবাদ –সকল অভীষ্টের পূরক এবং বিবিধরূপে পালনকারী অর্থাৎ ধর্মার্থকামমোক্ষরূপ চতুর্বর্গফলের দাতা যে প্রসিদ্ধ দ্যোতনশীল দেবভাব অর্থাৎ ভগবৎ-বিভূতিসমূহ বিদ্যমান আছে; সেই প্রসিদ্ধ দেবভাবসমূহ আমাদের রিপুগণের উৎপন্ন পাপবন্ধন হতে এবং অন্যান্য সর্বপ্রকার পাপবন্ধন হতে মুক্ত করুন অর্থাৎ উদ্ধার করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে,–আমাতে সৎ-ভাব চিরকাল অধিষ্ঠিত থাকুক এবং ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষরূপ চারিপ্রকার ফল প্রদান করুক) ॥ ২॥

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –মন্ত্রটিতে সরল প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে। মানুষের আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই, মানুষের কামনা অফুরন্ত। নিঃশ্রেয়স বা ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ লাভের আশাই সর্বপ্রধান এবং সর্বশ্রেষ্ঠ আশা। প্রার্থনাকারী এই মন্ত্রে সেই ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষরূপ চতুর্বর্গধনলাভের এবং পাপবন্ধন হতে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রার্থনা জানাচ্ছেন। পাপবন্ধন আর কি? এই সংসার-বন্ধনই তো পাপ-বন্ধন! যতদিন সংসারে গতাগতি থাকবে, ততদিন পাপের প্রলোভন হতে, রিপু-শত্রুর নানা উপদ্রব হতে পরিত্রাণ-লাভের আশা অতি বিরল। সেইজন্য, জন্মগতিরোধ করে আত্মায় আত্মসম্মিলনের জন্য–সেই ভবভয়হারী ভগবানের নিকট ভক্ত সাধক কাতরকণ্ঠে প্রার্থনা জানিয়ে বলছেন,-হে ভগবন্! এমন করুন, আমাকে এমন কর্ম-সামর্থ্য প্রদান করুন, যেন পাপ মাত্র আমায় স্পর্শ করতে না পারে; যেন আমি চতুর্বর্গ-ধনের অধিকারী হতে পারি। আমাদের মনে হয়, মন্ত্রে এই সরল প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে। ভাষ্যের ভাবের সাথে আমাদের ব্যাখ্যার বিশেষ কোনও পার্থক্য ঘটেনি। তবে অন্বয়-মুখে কোনও কোনও পদের বিভক্তি-ব্যত্যয় সংসাধিত হয়েছে। ভাষ্যকার দেবাঃ পদকে সম্বোধনপদ রূপে গ্রহণ করেছেন; আর যে এবং তে পদের সাথে যুয়ং পদ অধ্যাহৃত করে মন্ত্রের অর্থ নিষ্কাশন করেছেন।দেবাঃ পদকে সম্বোধন পদ ধরলে যে ও তে পদ দুটির সাথে যুয়ং পদের সংযোজনা না করলে মন্ত্রের অর্থ নিষ্কাশন করা একরকম অসম্ভব হয়ে পড়ে। দেবাঃ পদ প্রথমার বহুবচন। ঐ পদকে সম্বোধন পদরূপে পরিগ্রহণ করবার কোনই কারণ পরিলক্ষিত হয়। না। দেবাঃ পদকে কর্তৃপদরূপে গ্রহণ করলে যে ও তে পদ দুটির সাথে অতিরিক্ত একটি যুয়ং পদ অধ্যাহার করবার কোনই আবশ্যক, দেখি না। আমরা ঐ দেবাঃ পদকে কর্তৃপদ রূপেই গ্রহণ করেছি। স্থন ক্রিয়াপদ ললাটের বহুবচনে ব্যবহৃত। আমরা ঐ পদের অর্থে বিভক্তিব্যত্যয়ে লটের বহুবচনে বিদ্যন্তে পদ অধ্যাহার করেছি। এইভাবে আমাদের মতে মন্ত্রের যে অর্থ নিষ্পন্ন হয়েছে, আমাদের বঙ্গানুবাদে তা পরিদৃষ্ট হবে। মন্ত্রের অন্তর্গত পদসমূহের অর্থ সরল। আশানা এবং আশাপালাঃ পদ দুটির অর্থ পূর্বৰ্মন্ত্রের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য ॥ ২॥

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ অভ্রামস্থা হবিষা যজাম্যশ্লোণা ঘৃতেন জুহোমি। য আশানামাশাপালস্তুরীয়ো দেবঃ স নঃ সুভূতমেই বৎ ॥ ৩ ৷৷

বঙ্গানুবাদ –হে পরমেশ্বর্যশালী ভগবন্! ক্লান্তিরহিত অর্থাৎ একৈকশরণ্য হয়ে আমি তোমাকে শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা পূজা করি। হে মম কর্ম! পাপবিরহিত অর্থাৎ নির্মলচিত্ত হয়ে ক্ষরণশীল ভক্তিরসের অর্থাৎ অনন্যা ভক্তির দ্বারা তোমাকে সুসংস্কৃত অর্থাৎ ভগবানে নিয়োজিত করি। যিনি সকল অভীষ্টের পূরক, চতুর্বর্গফলের দাতা দ্যোতনাত্মক পরিত্রাতা, সেই ভগবান্ আমাদের অনুষ্ঠিত এই কর্মে চতুর্বর্গফলরূপ প্রভূত ধন আমাদের প্রাপ্ত বা প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার, ভাব এই যে,-হে ভগবন! আমাদের সৎ-ভাবের ও ভক্তির দ্বারা পরিতুষ্ট হয়ে আমাদের প্রতি সদা করুণাপরায়ণ হোন। আমাদের পূজা গ্রহণ করুন; আমাদের চতুর্বর্গফলরূপ মহৎ ধন প্রদান, করুন) ৩

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রটিও সরল প্রার্থনামূলক। প্রার্থনাকারী ভগবৎ-অর্চনাপরায়ণ সাধকের এখানে প্রথমে ভগবাকে শুদ্ধসত্ত্বরূপ হবির দ্বারা অর্চনা করবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেলো। তার পর যখন তিনি বুঝলেন, শুদ্ধসত্ত্বে ভক্তির স্ফুরণ আবশ্যক, তখনই তার প্রার্থনা প্রকাশ পেলো–শুদ্ধসত্ত্বকে ভক্তিরসের দ্বারা সুসংস্কৃত করে নিই। হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্ব আর ভক্তিমিশ্রিত কর্ম–যদি একযোগে আকর্ষণ করে, সাধ্য কি যে ভগবান্ স্থির থাকেন? সে আকর্ষণে তার আসন টলবে; তিনি ভক্তের হৃদয়ে এসে সমাসীন হবেন। হৃদয়ে যখন ভগবানের অধিষ্ঠান হবে, তখনই ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষরূপ চতুর্বর্গফল লাভ হবে, তখনই মুক্তির পথ সুগম হয়ে আসবে। আমরা মনে করি, স্থূলতঃ মন্ত্রে এই ভাবই পরিব্যক্ত।–এই মন্ত্রের অন্তর্গত অশ্লোণঃ এবং তুরীয়ঃ পদ লক্ষ্য করবার বিষয়। ঐ দুই পদের অর্থ সম্বন্ধে ভাষ্যকারের সাথে আমাদের বিশেষ মতান্তর ঘটেছে। ভাষ্যকার অশ্লোণঃ পদের যে অর্থ করেছেন, তা এই,-অশ্রোণঃ শ্রোণাখ্যব্যাধিবিশেষরহিতঃ সন্। কিন্তু ধাতু-অর্থের অনুসরণে ঐ পদের অর্থ হয়–হিংসা করা। শ ধাতু হতে (শৃ + ন–প্রং) ঐ পদের উৎপত্তি। তাহলে, অশ্রোণঃ পদে হিংসারহিতঃ অর্থ নিষ্পন্ন হয়। হিংসা পাপেরই নামান্তর বা রূপান্তর। ব্যাধিও পাপ হতেই উৎপন্ন হয়। এই সকল বিষয় বিবেচনা করে আমরা ঐ অশ্লোণঃ পদের পাপবিরহিতঃ সন, নির্মলচিত্তেন প্রভৃতি অর্থ অধ্যাহার করেছি। সূক্তানুক্রমনিকায় সর্বরোগভৈষজ্যে এই সূক্তের মন্ত্রসমূহের বিনিয়োগ আছে। তা হতেই বোধ হয় ভাষ্যকার পূর্বোক্তরূপ অর্থ নিষ্পন্ন করেছেন। এক্ষণে তুরীয়ঃ পদের অর্থের বিষয় আলোচনা করেই আমাদের বক্তব্যের উপসংহার করি। তুরীয়ঃ পদের প্রচলিত অর্থ সাধারণতঃ চতুর্থ ধরা হয়। ভাষ্যকারও এই ভাবই গ্রহণ করে পূর্বোদরিতেন্দ্রাদিদিপালাপেক্ষয়াঃ চতুর্থঃ প্রতিবাক্য গ্রহণ করেছেন। তুরীয়ঃ পদ নিপাতনে সিদ্ধ। ঐ পদে পরিত্রাতা, পরব্রহ্ম প্রভৃতি অর্থও কোষগ্রন্থে দেখতে পাওয়া যায়। তুরীয় পদের প্রয়োগ হিসাবে আমরা পরিত্রাতা অর্থই গ্রহণ করেছি। তুরীয় পদের এই অর্থই এখানে সুষ্ঠু সঙ্গত এবং এই অর্থই মন্ত্রের প্রকৃত তাৎপর্য প্রকাশ করছে। ॥ ৩৷৷

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ স্বস্তি মাত্র উত পিত্রে নো অস্তু স্বস্তি গোভ্যো জগতে পুরুষেভ্যঃ। বিশ্বং সুভুতং সুবিদং নো অস্ত্র জ্যোগের দৃশেম সূর্যম্ ॥ ৪

বঙ্গানুবাদ— হে ভগবন্! আপনার প্রসাদে আমাদের জননীর অথবা মাতৃবৎ স্নেহ কারুণ্যরূপিণী ভক্তির মঙ্গল হোক; (ভাব এই যে–ভগবৎ-প্রসাদে আমাদের মধ্যে অবিনাশী ভক্তি উপজাত হোক, অথবা আমাদের জন্মের সাথে মঙ্গল অবিথ থাকুক); অপিচ, আমাদের জনকে অথবা পিতৃবৎ রক্ষক শুদ্ধসত্ত্বে মঙ্গল হোক; (ভাব এই যে,-ভগবৎ-অনুকম্পায় আমাদের মধ্যে অবিনাশী শুদ্ধসত্ত্ব অবস্থিতি করুক। অথবা, আমাদের পালনের সাথে মঙ্গল অবিথ থাকুক)। হে ভগবন্! আপনার প্রসাদে আমাদের গো-অশ্ব ইত্যাদি পশুতে অথবা স্তোত্রেতে অথবা অভীষ্টদানে মনোবাঞ্ছাপূরক-জ্ঞানকিরণসমূহে মঙ্গল হোক; (ভাব এই যে, ভগবানের অনুগ্রহে আমাদের মধ্যে জ্ঞানরশ্মি অবিচ্ছিন্নভাবে উৎকর্ষসম্পন্ন হোক, অথবা আমাদের প্রার্থনার সাথে মঙ্গল অবিথ থাকুক)। হে ভগবন্! আপনার অনুগ্রহে আমাদের সম্বন্ধী অপরাপর পুরুষের অথবা পৌরুষসামর্থোপেত সঙ্কৰ্মনিবহের মঙ্গল হোক; (ভাব এই যে, ভগবৎ-অনুগ্রহে আমাদের সকৰ্ম-সাধনের সামর্থ্য অভিমতবৰ্ষক ও সাফল্যমণ্ডিত হোক)। পরন্তু হে ভগবন্! আপনার অনুকম্পায় সকল লোকের মঙ্গল, হোক; (ভাব এই যে-ভগবান্ জগতের কল্যাণবিধান করুন)। আমাদের সম্বন্ধীয় সৎ-ভাবের দ্বারা স্থাবরজঙ্গমাত্মক বিশ্বচরাচর অথবা বিশ্বের সকল প্রাণী শোভনধর্মোপেত চতুর্বর্গসমন্বিত এবং শোভনজ্ঞানযুক্ত অর্থাৎ পরমপ্রজ্ঞানসম্পন্ন, হোক; অথবা–হে ভগবন্! আপনার অনুগ্রহে সুসমৃদ্ধ সকল শোভনধন আমাদের হোক। অপিচ, হে ভগবন্! আপনার অনুগ্রহে যেন চিরকাল জ্যোতির্ময় জ্ঞানস্বরূপ আপনাকে (সর্বত্র) দর্শন করতে আমরা সমর্থ হই। ৪

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রের প্রার্থনা সরল, মন্ত্রের ভাব সহজবোধ্য। কিন্তু ভাষ্যের অর্থ একটু জটিলতাসম্পন্ন। সূক্তানুক্রমণিকায় এই মন্ত্রটি সর্বস্বস্ত্যয়নকামেষ্টিতে বিনিযুক্ত হওয়ার বিধি উল্লিখিত হয়েছে। সেই অনুসারে, ভাষ্যমতে যাজ্ঞিকের মাতার, পিতার, গো-ইত্যাদি পশুর, ভৃত্যের এবং পরিশেষে, জগতের সকলের মঙ্গল-কামনা করা হয়েছে। যাজ্ঞিকের সম্বন্ধীয় সকলই মঙ্গলময় হোক। যাজ্ঞিকগণ এবং তাদের সংসৃষ্ট সকলে শতবৎসর জীবিত থাকুন। স্থূলতঃ মন্ত্রে এই ভাব পরিব্যক্ত।–ঐরকম অর্থ যে অসঙ্গত, তা আমরা বলি না। তবে একটু বিচার করে দেখলে বোঝা যায়,ইহলৌকিক কল্যাণ-কামনার সাথে পারলৌকিক মঙ্গল-কামনাও এই মন্ত্রের অন্তর্নিহিত রয়েছে। ভক্তি, জ্ঞান, কর্ম ও যাবতীয় সৎ-ভাবের অবিনাশিত্ব-কামনা-মন্ত্রের প্রথমাংশের লক্ষ্যস্থল বলে মনে করি। মাত্রে পদে মাতৃস্বরূপিণী ভক্তিকে, পিত্রে পদে পিতৃবৎ পালক ও রক্ষক সেই গুণাবলিকে অর্থাৎ শুদ্ধসত্বভাবকে, পুরুষেভ্যঃ পদে পুরুষের অর্থাৎ ভৃত্য ইত্যাদির ন্যায় পুরুষসামর্থোপেত সৎকর্মনিবহকে, গোভিঃ পদে ইহলৌকিক মঙ্গলরূপ জ্ঞানকিরণনিবহকে এবং জগতে পদে সর্বলোকস্থায়ী শুদ্ধসত্ত্বভাবকে, অবিনাশিরূপে অন্তরে প্রতিষ্ঠিত করবার প্রার্থনা, মন্ত্রের মধ্যে প্রকটিত রয়েছে। এইরকম ভাবও এই মন্ত্রের অর্থে প্রাপ্ত হওয়া যায়। স্বস্তি পদ অবিনাশিনামের মধ্যে পঠিত হয়। সুতরাং স্বস্তি অস্তু পদ দুটির তাৎপর্যার্থে, শাশ্বত নিত্য জ্ঞান-ভক্তি ও সৎ-ভাব প্রভৃতি হৃদয়ে সংরক্ষণের ভাব প্রকাশ করছে। বিশ্বের হিতকর ঐ সকল সামগ্রী যেমন ইহকালে অভিমতবর্ষক, তেমনি পরকালে চতুর্বর্গফলসাধক। মোক্ষাভিলাষী ভক্ত সাধকের এই প্রার্থনাই সঙ্গত প্রার্থনা। আপন আদর্শে জগৎকে অনুপ্রাণিত করা, আপন দৃষ্টান্তে জগৎকে উন্নত করা–প্রকৃত সাধকেরই একমাত্র লক্ষ্যস্থল। এ ছাড়া, তার অন্য কোন প্রার্থনা থাকতে পারে না। উপাসনার প্রথম স্তরে পার্থিব বস্তুজাতের কল্যাণ-কামনায় প্রাণ উদ্বুদ্ধ হয় বটে; কিন্তু সাধনার উচ্চস্তরে আরোহণ করলে একমাত্র শুদ্ধসত্ত্বের প্রতিই প্রাণ আকৃষ্ট হয়। দুরকম স্তরের দুরকম ভাবই মন্ত্রার্থে হয়।-মন্ত্রের দ্বিতীয় চরণের বিশ্বং হতে অস্তু পর্যন্ত অংশের আমরা তাই দুরকম অর্থ পরিগ্রহণ করেছি। তার মধ্যে দ্বিতীয় প্রকারের অর্থ ভাষ্যানুসারী কমবেশী সঙ্কীর্ণতাব্যঞ্জক। বিশ্বের সকল সমৃদ্ধ ধন আমাদের হোক–দ্বিতীয় অন্বয়ে এই ভাব পরিব্যক্ত হয়েছে। প্রথম অন্বয়ে ঐ অংশের অর্থ হয়েছে, আমাদের সৎ-ভাবের প্রভাবে বিশ্বের সকলে চতুর্বর্গরূপ শোভনধনোপেত এবং শোভনজ্ঞান অর্থাৎ পরমপ্রজ্ঞানসম্পন্ন হোক। এর ভাব এই যে, আমাদের সৎ-ভাব সৎকর্ম এমন আদর্শস্থানীয় হোক,–যে আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্বের সকলে সৎ-ভাবসম্পন্ন, সৎ-জ্ঞানসম্পন্ন ও সৎকর্মপরায়ণ হয়; আর, তার দ্বারা তারা চতুর্বর্গ লাভে সমর্থ হতে পারে। আমরা মনে করি, প্রথম অন্বয়ের এই ভাবই অধিকতর সঙ্গত এবং এতেই মন্ত্রের ঐ অংশের সর্বজনীন ভাব প্রকাশ পায়।-মন্ত্রের অন্তর্গত জ্যোগেব দৃশেম সূর্য অংশের প্রার্থনা–অতি মহৎ। এই অংশে, আমরা মনে করি, শত সম্বৎসর জীবিত থাকার ভাব প্রকাশ করে না। আমাদের মতে, ঐ অংশের অর্থ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এখানে সূর্যং পদে জ্যোতির্ময় জ্ঞানময় ভগবানের প্রতি লক্ষ্য আসে। চিরকাল যেন তাকে দর্শন করতে সমর্থ হই–এইরকম বাক্যের অর্থ এই যে-জ্ঞানরূপ তিনি যেন হৃদয়ে সর্বদা প্রতিষ্ঠিত থাকেন। হে ভগবন্! আপনারই অনুগ্রহে আপনাকে যেন চিরকাল দেখতে সমর্থ হই;-আপনি যেন আমার অন্তরে– চিরজাগরুক থাকেন। ঐ মন্ত্রাংশের প্রার্থনা এইরকম বলেই আমরা মনে করি।যদিও ভাষ্যকারের সাথে নানা বিষয়ে আমাদের মতান্তর ঘটেছে, তথাপি লৌকিক হিসাবে ভাষ্যকারের অর্থ কখনও অসঙ্গত নয়। যে কার্যে মন্ত্রের যে বিনিয়োগ এবং সেই অনুসারে মন্ত্রের যে অর্থ হয়, সে বিষয়ে আমাদের বিরুদ্ধ মত পোষণ করবার কোনও কারণ নেই। তবে আমাদের পরিগৃহীত পস্থার অনুসরণে মন্ত্রের যে অর্থ নিষ্পন্ন হয়, বঙ্গানুবাদে আমরা তা-ই ব্যক্ত করেছি। ৪।

.

চতুর্থ সূক্ত : মহদব্রহ্ম

[ঋষি : ব্রহ্মা দেবতা : দ্যাবাপৃথিবী ছন্দ : অনুষ্টুপ ]

প্রথম মন্ত্রঃ ইদং জনাসসা বিদথ মহদ ব্ৰহ্ম বদিষ্যতি। ন তৎ পৃথিব্যাং নো দিবি যেন প্রাণন্তি বীরুধঃ ॥১॥

বঙ্গানুবাদ –হে প্রার্থনাকারিগণ অথবা অর্চনাপরায়ণ জনগণ অথবা হে আমার মনোবৃত্তিসমুহ! তোমরা এই সত্যকে বা ব্রহ্মকে জেনো। সত্য বা ব্রহ্মই সেই মহত্ত্বাদিগুণসম্পন্ন বিশ্বব্যাপক ব্রহ্মকে বিজ্ঞাপিত করেন অর্থাৎ জানিয়ে দেন। যে ব্রহ্মের অনুগ্রহে ওষধিসমূহ অর্থাৎ অমরত্ববিধায়ক অমৃত-অবিনাশিরূপে বিদ্যমান, সেই ব্ৰহ্ম আমাদের সম্বন্ধীয় অর্থাৎ পাপপূর্ণ এই পৃথিবীতে থাকেন এবং দ্যুলোকেও থাকেন না। (ভাব এই যে-ভগবানই ভগবানের স্বরূপ জানিয়ে দেন। তাতেই সুখ-আরোগ্য-সম্পদ ইত্যাদি বিদ্যমান। তিনিই অমৃতত্ববিধায়ক। কিন্তু পাপী তাঁর সাথে সম্বন্ধশূন্য) ১

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই সুক্তের মন্ত্রগুলির তিনরকম বিনিয়োগের বিষয় সূক্তানুক্রমণিকায় পরিদৃষ্ট হয়। প্রথম–বন্ধ্যা স্ত্রীর পুত্রজননকার্যে মন্ত্রসমূহের দ্বারা উদক অভিষেক প্রদান করতে হয়। শিংশুপা শাখায় উদকের দ্বারা বন্ধ্যা স্ত্রীর মস্তকে শান্তিজল প্রক্ষেপ করণীয়। দ্বিতীয়–এই সুক্তের দ্বারা পুষ্টিকাম এবং সম্পৎকাম ব্যক্তি দ্যাবাপৃথিবী যাগ বা উপাদান করবে। তৃতীয়–এই সূক্তের প্রথম মন্ত্র দর্শপূর্ণ মাসেষ্টিতে পত্নীর অঞ্জলিতে উদপাত্র নিনয়নে বিনিযুক্ত হয়। এইরকম প্রয়োগবিধির অনুসরণে ভাষ্যকার উদকাত্মক ব্রহ্মের সত্ত্বা প্রতিপাদিত করবার উদ্দেশ্যে মনুস্মৃতি হতে এবং তৈত্তিরীয়-সংহিতা হতে দুটি প্রমাণ উদ্ধৃত করেছেন, এবং তারই অনুসরণে ব্রহ্ম পদে ব্ৰহ্মণঃ প্রথম কার্যং অর্থ অধ্যাহার করেছেন। তিনি আরও অধ্যাহার করেছেন, মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিঃ পদ। ঐ অধ্যাহৃত পদ বদিষ্যতি ক্রিয়াপদের কর্তৃপদরূপে পরিগৃহীত। বস্তুতঃ ঐরকম কোনও পদ অধ্যাহার না করলে,বদিষ্যতি ক্রিয়াপদের অন্বয় হওয়া কঠিন। আবার ব্রহ্ম পদকে কর্মপদরূপে গ্রহণ করায়, তার বিভক্তি-ব্যত্যয় সংঘটিত হয়েছে। অর্থ হয়েছে-ব্ৰহ্মণঃ প্রথমকা। কিন্তু আমরা বলি, ঐ ব্ৰহ্ম শব্দে উদকাত্মক ব্রহ্ম বা ব্ৰহ্মণঃ প্রথমকার্য অর্থ ব্যক্ত করে না। ব্রহ্ম পদে–মন্ত্রকে এবং ভগবানকে বোঝায়। মন্ত্রই মন্ত্রশক্তির বিষয় বিজ্ঞাপিত করবেন, অথবু ভগবানই তার স্বরূপ বিজ্ঞাপিত করবেন। মহ ব্রহ্ম বদিষ্যতি মন্ত্রাংশে এই ভাব ব্যক্ত করছে বলে আমরা মনে করি। এ মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি ব্রহ্মের প্রথম কার্য তোমাদের বলবেন–এ অর্থে কি কোনও সৎ-ভাবের উপলব্ধি হয়? –বেদমন্ত্রের নিত্যত্ব ও অপৌরুষেয়ত্ব সংরক্ষিত হয়? মন্ত্রে যখন ঋষির কথা নেই, তখন ঋষির সম্বন্ধ টেনে এনে কেন নিত্যসত্য সনাতন বেদমন্ত্রের অর্থান্তর ঘটাবো? সুতরাং আমরা ভাষ্যকারের অর্থ এই বিষয়ে গ্রহণ করতে পারলাম না। পক্ষান্তরে, প্রথম অনুবাকের দ্বিতীয় মন্ত্রে যে ভাব উপলব্ধি করেছি, এখানেও আমরা সেই ভাবই পরিগ্রহণ করি। অন্তরস্থিত সৎ-ভাবই সকল বিষয় জানিয়ে দেয়–সেখানে তা দেখেছি। এখানেও আমরা দেখতে পাচ্ছি,ভগবানই বা ভগবৎ বিভূতিসমূহই ভগবানের স্বরূপ জানিয়ে থাকে। আবার মন্ত্রশক্তির মাহাত্ম্য অলৌকিক। শাস্ত্রসম্মতভাবে মন্ত্র উচ্চারিত হলে, মন্ত্রের এক অলৌকিক শক্তি প্রকাশ পায়; সে মন্ত্রে অঘটন সংঘটন হয়। সেই মন্ত্রশক্তির প্রভাবে ভগবানও বিচলিত হয়ে পড়েন। আবার মানুষ সৎ-বৃত্তির সাহায্যে-বিবেক-বুদ্ধির প্রেরণায়–ভগবানের স্বরূপ জানতে পারে। হৃদয়ে জ্ঞানের সঞ্চার হলে, অন্তরে সৎ-বৃত্তির উদয় হলে, অন্তর আপনিই বলে দেয়–ভগবান্ কেমন বা কোথায় কি ভাবে অবস্থিত আছেন। অন্তর ভক্তিযুত হলে, হৃদয় সৎ-ভাবে পরিপূর্ণ হলে, আপনা আপনিই মানুষ তা জানতে পারে। ভক্তের হৃদয়ই ভগবানের বাসস্থান, ভক্তির পূজাই তার প্রকৃত পূজা। তিনি অন্তরিক্ষেও থাকেন না, স্বর্গেও থাকেন না, মর্তেও থাকেন না। তিনি তো নিজেই বলেছেন,–নাহুং তিষ্ঠামি বৈকুণ্ঠে যোগিনাং হৃদয়ে ন চ। মদ্ভক্তাঃ যত্র তিষ্ঠন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদঃ। এ তত্ত্ব–এ নিগূঢ় রহস্য–একমাত্র ভক্তিসহযুত হৃদয়ই ব্যক্ত করতে পারে; একমাত্র ভগবৎ-অনুগ্রহেই তা জানতে পারা যায়। আর একমাত্র মন্ত্রশক্তি সে স্বরূপ ব্যক্ত করতে সমর্থ। মন্ত্রের প্রার্থনার ভাব এই যে,-ভগবৎ-অনুগ্রহে আমার অন্তরই যেন ভগবানের স্বরূপ জানিয়ে দেয়। সে তত্ত্ব অবগত হয়ে আমি যেন অমৃতত্ব লাভে সমর্থ হই এবং আমার যেন পরম মঙ্গল লাভ হয়। আমরা মনে করি, মন্ত্রের মধ্যে এই ভাবই নিহিত। মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। নিজের মনোবৃত্তি-সমূহকে সম্বোধনে ভগবানের স্বরূপ-তত্ত্ব মন্ত্রে পরিব্যক্ত হয়েছে। বীরুধঃ পদে ওষধির অর্থাৎ সুখারোগ্য-সম্পদের ভাব ব্যক্ত করে বলে মনে করি। যেন বীরুধঃ প্রাণন্তি–বলবার তাৎপর্য এই যে, ওষধিতে ব্যাধি নাশ হয়। নির্বাধি না হতে পারলে, ভগবৎ-আরাধনায় নানা অন্তরায় উপস্থিত হয়। পাপ-বৃত্তিই সকল ব্যাধির মূলীভূত। মন্ত্রের ঐ অংশের ভাবু এই যে, পাপস্পর্শে আমি যেন ব্যাধিগ্রস্ত না হই। অপিচ, সর্বব্যাধি-বিনিমুক্ত হয়ে আমি যেন ভগবৎ-আরাধনায় বিনিযুক্ত হতে পারি। অথবা সকল ব্যাধির প্রধান যে ভবব্যাধি, মন্ত্রাংশে সেই ভবব্যাধি-নাশের কামনা প্রকাশ পেয়েছে বলেও মনে করতে পারি। ফলতঃ ভাষ্যকার ঐ অংশের যে অর্থ নিষ্পন্ন করেছেন, তাতে মন্ত্রাংশের কোনই সার্থকতার বিষয় উপলব্ধ হয় না। ভগবান কি কেবল ওষধিকেই জীবিত রাখেন? বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকলই তো তারই রক্ষায় ও পালনে জীবিত থেকে আপন আপন কার্যে বিনিযুক্ত রয়েছে। সুতরাং একমাত্র বীরুধঃ বা ওষধিসমূহকে জীবিত রাখেন, এরকম উক্তির তাৎপর্য কি? পূর্বোক্তরূপ ভবব্যাধি-নিবারণের কামনাই এখানে ব্যক্ত বলে আমরা মনে করি। এ ব্যতীত, ঐ অংশে অন্য কোনও উচ্চভাব প্রকাশ করে বলে মনে হয় না। এইরকমে আমরা মন্ত্রে যে ভাব উপলব্ধি করি, আমাদের বঙ্গানুবাদে তা পরিব্যক্ত ॥ ১।

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ অন্তরিক্ষ আসাং স্থাম শ্রান্তসদামিব। আস্থানমস্য ভূতস্য বিদুষ্টদ বেধসো ন বা ॥ ২॥

বঙ্গানুবাদ –তপস্যার ও আত্ম-উৎকর্ষের দ্বারা পরমপদপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণের ন্যায় অথবা সাধুগণ যেমন তপস্যার দ্বারা ও আত্ম-উৎকর্ষের প্রভাবে শ্রেষ্ঠপদে অবস্থান করেন–সেইরকম, সর্বাভীষ্টপূরক ভগবানের যোগ্য আসন অন্তরিক্ষবৎ অনন্তপ্রসারিত ভক্তের হৃদয়ে নির্দিষ্ট আছে। (ভাব এই যে, ভক্তের হৃদয়ই ভগবানের উপযুক্ত আসন; অতএব, ভক্তির দ্বারা ভগবাকে পাবার জন্য প্রবুদ্ধ হচ্ছি–এটাই সঙ্কল্প)। ইহলোকে অথবা ইহজন্মে স্থাবরজঙ্গমাত্মক বিশ্বচরাচরের বা জগতের প্রাণস্বরূপ ও কারণভূত ভগবানের স্বরূপকে মেধাবী ক্রান্তদর্শিগণ অবগত আছেন; অন্যে তা জানেন না। ভাব এই যে,ভগবানের মাহাত্ম্য অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন সাধকদেরও দুয়ে; সুতরাং অজ্ঞান ব্যক্তির পক্ষে যে দুজ্ঞেয় হবে, তাতে আর আশ্চর্য কি? ভগবান্ স্বয়ং যদি আপন স্বরূপ বিজ্ঞাপিত না করেন, মানুষ কেমন করে তা জানতে সমর্থ হবে? অতএব, সেই জ্ঞান লাভ করতে হলে, ভগবানের অনুগ্রহ-লাভই সর্বথা বিধেয়। ২।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –মন্ত্রটি সরলভাবদ্যোতক। ভক্তের হৃদয়ই ভগবানের যোগ্য আসন, ভক্তির দ্বারাই ভগবাকে পাওয়া যায়। ভগবানের স্বরূপ দুৰ্জ্জেয়, ভগবৎ-ভক্ত সাধকও তাঁর স্বরূপের বিষয়ে সম্যক জ্ঞানলাভে সমর্থ হন না। তিনি যদি জানিয়ে দেন, তবেই তার স্বরূপ জানা যায়। এ ব্যতীত, সে তত্ত্ব দুরধিগম্য। সুতরাং ভগবানের স্বরূপ জানতে হলে, ভগবানের অনুগ্রহলাভে প্রযত্নপর হওয়া একান্ত কর্তব্য। মন্ত্র এই উপদেশ প্রদান করছেন বলে মনে হয়।–ভাষ্যমতে এই মন্ত্রে অপের স্থান নির্দিষ্ট হয়েছে। ওষধি-সমূহের জীবনহেতুভূত অ–পৃথিবীর ও স্বর্গের মধ্যস্থলে অন্তরিক্ষ-লোকে অবস্থিত; এবং অপের এই অবস্থিতির বিষয় মনু ইত্যাদি জ্ঞানিগণও অবগত নন। ভাষ্যকার মন্ত্রের এইরকম তাৎপর্য নির্দেশ করেছেন। কিন্তু আমাদের অর্থ তা হতে স্বতন্ত্র পথ পরিগ্রহ করেছে। আমাদের বঙ্গানুবাদে সেই বিষয় উপলব্ধ হবে। মন্ত্রের মধ্যে অ-বোধক কোনও পদ পরিদৃষ্ট হবে না। আর ভাষ্যানুমোদিত অর্থে মুন্ত্রের কোনও উচ্চভাব দ্যোতিত হয় বলেও মনে হয় না। আমরা মনে করি, মন্ত্রটি ভগবৎ-সম্বন্ধে প্রযুক্ত। সে পক্ষে মন্ত্রে যে ভাব পরিব্যক্ত, প্রথমেই তা প্রকাশিত হয়েছে। ২।

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ যদ রোদসী রেজমানে ভূমিশ্চ নিরক্ষত। আর্দং তদদ্য সর্বদা সমুদ্রস্যের স্রোত্যাঃ ॥ ৩৷৷

 বঙ্গানুবাদ –দ্যাবাপৃথিবী অথবা দ্যাবাপৃথিবীবৎ সর্বব্যাপী আধাররূপী জ্ঞানভক্তি হৃদয়ে প্ৰদ্দীপিত হলে, পৃথিবীবৎ সর্বধারণক্ষম হৃদয় নিশ্চয়ই ভগবানের করুণাধারা ধারণ করতে সমর্থ হয়। সমুদ্রগামী নদী যেমন অক্ষীণততায় হয়ে প্রবাহিত হয়, সেইরকম ভগবানের সেই করুণাধারা ইহলোকে ও পরলোকে সকলকালেই অক্ষীণ অর্থাৎ শেষরহিত হয়ে আছে। (ভাব এই যে, –ভগবানের করুণার অন্ত নেই। জ্ঞান ও ভক্তির দ্বারা সেই করুণা লাভ করতে পারা যায়। জ্ঞানভক্তি লাভের পরে মানুষ ভগবানের করুণা আপনা-আপনিই লাভ করে থাকেন) ॥ ৩॥

মন্ত্ৰাৰ্থআলোচনা –মন্ত্রটি বিশেষ জটিলতা-পূর্ণ। এই মন্ত্রের অর্থ নিষ্কাশনে বিশেষ আয়াস স্বীকার করতে হয়েছে। ভাষ্যের প্রচলিত অর্থে মন্ত্রের কোনও উচ্চভাব বোধগম্য হয় না। ভাষ্যকার মন্ত্রের যে অর্থ করেছেন, প্রথমে তার মর্ম দেখা যাক। ভাষ্যমতে, মন্ত্রটি বিশ্বসৃষ্টিবিয়য়ক। মন্ত্রের অর্থ,-হে দ্যাবাপৃথিবী! জল-উৎপাদনে ব্যাপৃত হয়ে পৃথিবী-লোকে ও দ্যুলোকে তোমরা প্রাক্-উদীরিত জলকে উৎপাদন করেছিলে। সেই উদক বর্তমানকালে ও সকলকালে, সমুদ্রগামী নদীর ন্যায়, আর্দ্রগুণযুক্ত ও শোষরহিত হয়ে বিদ্যমান আছে। ভাষ্যের অনুসারী যে সমস্ত অনুবাদ প্রচলিত আছে, তাতে উদকের সম্বন্ধ দৃষ্টিগোচর হয় না। অপিচ, সেই সমস্ত অনুবাদে মন্ত্রের যে অর্থ সূচিত হয়, ভাষ্যের অর্থ অপেক্ষা তা কিছুটা উচ্চবদ্যোতক।–যাই হোক, আমাদের অর্থ ভিন্নপথ পরিগ্রহণ করেছে। সে মতে,–জ্ঞান ও ভক্তিই ভগবানের করুণা-লাভের একমাত্র উপায়। হৃদয়ে যখন জ্ঞানের ও ভক্তির স্ফুরণ হয়, তখনই সে হৃদয়ে ভগবানের করুণার সঞ্চার হয়ে থাকে। ভগবানের করুণা অসীম অনন্ত। তার শেষ নেই–তার ক্ষীণতা নেই। সেই করুণা-স্রোত সর্বকালে সমভাবে প্রবাহিত। মন্ত্রে এই নিত্য-সত্য-তত্ত্ব প্রকটিত বলে মনে করি। জ্ঞানভক্তি লাভ হলে, ভগবানের করুণা আপনা-আপনিই বর্ষিত হয়ে থাকে। সমুদ্রগামী স্রোতের মতো অর্থাৎ নদী যেমন : অবাধগতিতে সমুদ্রের প্রতি প্রধাবমানা হয়, ভগবানের করুণাও তেমনি ভক্তের প্রতি আপনা-আপনিই বর্ষিত হয়ে থাকে। মন্ত্র প্রচ্ছন্নভাবে এই উপদেশ দিচ্ছেন বলে মনে হয় যে,-যদি ভগবানের করুণা লাভ করতে চাও, জ্ঞানের অধিকারী হও; ভক্তিরসের অমৃতের দ্বারা হৃদয়কে অভিসিঞ্চিত করো। তাহলে করুণারূপী ভগবানকে তুমি প্রাপ্ত হতে পারবে।–আমাদের মনে হয়, মন্ত্রে এই ভাবই দ্যোতিত হচ্ছে। ৩

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ বিশ্বমন্যামভীবারং তদন্যস্যামধিশ্রিতম। দিবে চ বিশ্ববেদসে পৃথিব্যৈ চাকরং নমঃ ॥৪॥

বঙ্গানুবাদ— সমগ্র জগৎ মায়ার দ্বারা আচ্ছন্ন আছে; অতএব, এই জগৎ মায়ায় অথবা তার আশ্রয়ভূত প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত আছে–বলা হয়; সেই জ্ঞান লাভের জন্য, আমি দুলোককে এবং বিশ্বের জ্ঞানভূত পৃথ্বীলোককে সর্বতোভাবে নমস্কার করছি। (ভাব এই যে, পৃথিবীর এবং স্বর্গের সম্বন্ধ বুঝে আমি যেন মায়ার বিভ্রম নাশ করবার জন্য সঙ্কল্পবদ্ধ হই–এটাই কামনা)। ৪

মন্ত্ৰাৰ্থআলোচনা –ভাষ্যানুসারে এই মন্ত্রটিতে অপের শ্রেষ্ঠত্ব-সূচনার জন্য দ্যাবাপৃথিবীকে প্রশংসা করা হয়েছে। সে পক্ষে ভাষ্যকার নানারকম অর্থ খ্যাপন করে গিয়েছেন। প্রথমে বিশ্বং পদটিকে তিনি কর্মে ষষ্ঠী হবে বলে নির্দেশ করেছেন। (বিশ্বম্ ৷৷ কর্মনি ষষ্ঠ্যাভাবচ্ছান্দশঃ। বিশ্বস্য অন্যাম্ ৷৷)। অন্যাং পদও, তাঁর মতে, অন্যা এইরকম প্রথমান্ত মূর্তি প্রাপ্ত হয়েছে। সেই অনুসারে মন্ত্রের প্রথম অংশের বিশ্বং অন্যাং অভীবারং (পাঠান্তরে–অভীবারঃ বা অভীবার) পদ তিনটির ভাব দাঁড়িয়েছে, বিশ্বের সকলকে দুলোক আবৃত করে আছে; অর্থাৎ, সকল জগৎ অন্য অর্থাৎ দ্যুলোক কর্তৃক আচ্ছন্ন আছে। ভাষ্যানুসারী আর একরকম অর্থ-কর্তৃভূত সকল জগৎ অন্যকে অর্থাৎ দ্যুলোককে উদ্দেশ করে সম্পূর্ণরূপে ভজনযুক্ত হয়েছিল;-বৃষ্টি-বিষয়ক প্রার্থনা জানিয়েছিল। এইরকম, মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশের,তৎ অন্যস্যাং অধিশ্রিতং বাক্যাংশের, ভাষ্যানুসারী অর্থ এই যে,-উক্ত বিশ্ব পৃথিবীকে আশ্রয় করে বিদ্যমান আছে। অতঃপর, মন্ত্রের দ্বিতীয় চরণের অর্থ নির্দেশ করা হয়েছে,-দ্যুলোককে এবং ধনভূত অথবা জ্ঞানভূত পৃথিবীকে হবিলক্ষণ অন্ন দান করি অথবা নমস্কার করি।–এখন, আমরা বলি, অন্যাং পদের লক্ষ্যস্থল- মায়া। কেন-না, মায়াতেই বিশ্বসংসার আচ্ছন্ন রয়েছে। এ পক্ষে, অভীবারং পদে, ভাষ্যকার যে আচ্ছন্নং পদ প্রতিবাক্য গ্রহণ করেছেন, তারই সার্থকতা দেখি। প্রথম চরণের প্রথমাংশে, বিশ্বং অন্যাং অভীরারং পদ তিনটিতে, উক্তরূপ ভাব পরিব্যক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, তারই দ্বিতীয় অংশে, এই জগৎ কাকে আশ্রয় করে অধিষ্ঠিত–তারই দ্যোতনা দেখতে পাই। এই যে অন্যস্যাং পদ, এর দ্বারা মায়ার আশ্রয়ভূত প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। দর্শনের প্রতিপাদ্য সৃষ্টিতত্ত্ব আলোচনা করলে, মায়াই বা কি এবং প্রকৃতিই বা কি–সেই বিষয়ে অভিজ্ঞতা লাভ হলে, এই তত্ত্ব অধিগত হতে পারে। তার দ্বারা বুঝতে পারা যায়,–কি দ্যুলোক অথবা কি ভূলোক–সকলই প্রকৃতির ক্রিয়া। প্রকৃতির সেই ক্রিয়ার বিষয়–মায়ার সেই বিভ্রম আনয়নের মোহজাল-বিস্তার–আমরা যেন ছেদন করতে পারি; এইরকম সঙ্কল্প–এই মন্ত্রের মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে। বলেই আমরা সিদ্ধান্ত করি।-মন্ত্রের দ্বিতীয় চরণে যে নমস্কার করার ভাব প্রকাশ পেয়েছে, তাতেই বোঝা যায়, সে নমস্কারের উদ্দেশ্য কি? দিবে দ্যুলোককে এবং পৃথিব্যৈ পৃথিবী-লোককে আমরা যখন যুগপৎ নমস্কার করতে পারি, তখন সেই দুয়ের মধ্যে যার প্রভাব বিদ্যমান রয়েছে, তারই প্রতি দৃষ্টি সঞ্চালিত হয় কি? মায়ার খেলা, প্রকৃতির ক্রিয়া–তার যা মূলীভূত, পৃথিবীর প্রতি এবং দ্যুলোকের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে করতে, ক্রমশঃ তার প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। রূপ দেখতে দেখতে, রূপ যাঁর–তার প্রতি লক্ষ্য পড়ে। এ পক্ষে, এই মন্ত্রের সঙ্কল্প এই যে,-আমরা যেন পৃথিবীর ও স্বর্গের সম্বন্ধ পরিজ্ঞাত হবার চেষ্টা করি। কেন-না তা পরিজ্ঞাত হতে পারলেই তত্ত্বজ্ঞান অধিগত হয়। সেই জ্ঞানই ভগবৎ-প্রাপ্তি–সেই জ্ঞানই মোক্ষ।–এই মন্ত্রের অন্তর্গত বিশ্ববেদসে পদে পৃথিবীর এক বিশিষ্ট পরিচয় প্রদত্ত হয়েছে। এই পৃথিবীর মনুষ্যই যে সকল জ্ঞানে জ্ঞানান্বিত হতে পারে, ঐ পদ তারই আভাস দিচ্ছে। এই পৃথিবীই, ইহলোকই সকল জ্ঞান লাভের কেন্দ্রস্থল। এখানে অবস্থিত থেকেই আমরা সকল জ্ঞানে জ্ঞানী হতে পারি। যে পৃথিবী সেই জ্ঞানের আলয়, এখানে সেই পৃথিবীকে নমস্কার করা হয়েছে। অজ্ঞান-আঁধারে যা আচ্ছন্ন, তার প্রতি এখানকার লক্ষ্য নয়। দ্যুলোক-স্বর্গ-সকল জ্ঞানের আধার। সেই স্বর্গকে, আর বিশ্ববেদস যে পৃথিবী সেই পৃথিবীকে, নমস্কার করা হয়েছে। নমস্কার বা পূজা বলতে অনুসরণ অর্থই প্রকাশ পায়। দেবতার পূজায়, দেবত্বের অনুসরণে, হৃদয়ে দেবভাবের সঙ্কল্প আসে। এই সকল বিষয় নানা স্থানে বুঝিয়ে আসা হয়েছে। সেই দৃষ্টিতেই দ্যুলোকের প্রতি এবং জ্ঞানভূত পৃথিবীর প্রতি নমস্কারে, সেই দুয়ের অন্তর্নিহিত গুণাবলির আদর্শ অনুধ্যানের ভাবই প্রাপ্ত হওয়া যায়। এইরকমে এই মন্ত্রে মায়া-মোহের বিভ্রম বিনাশ-পূর্বক তত্ত্বজ্ঞান-লাভের কামনাই প্রকাশমান দেখা যায়। আমাদের মতে, আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণে এই দর্শন আদৌ অসঙ্গত ও অসমীচীন নয়। ৪

.

পঞ্চম সূক্ত : আপঃ

[ঋষি : শন্তাতি দেবতা : (চন্দ্রমা), আপঃ ছন্দ : ত্রিষ্টুপ ]

প্রথম মন্ত্রঃ হিরণ্যবর্ণাঃ শুচয়ঃ পাবকাঃ যাসু জাতঃ সবিতা যাস্বগ্নিঃ। যা অগ্নিং গর্ভং দধিরে সুবর্ণাস্তা ন আপঃ শং স্যোনা ভবন্তু। ১।

বঙ্গানুবাদ –হিতরমণীয়-বর্ণবিশিষ্ট (অর্থাৎ গুণসমূহের দ্বারা চিত্তাকর্ষক), বিশুদ্ধ, শোধনকারী শক্তিসমূহ যা হতে (অর্থাৎ যে শুদ্ধসত্ত্ব হতে) সঞ্জাত হয় এবং যা হতে (অর্থাৎ যে শুদ্ধসত্ত্ব হতে) পবিত্রকারক সবিতা এবং জ্ঞানদেবতা উৎপন্ন হন; যে দেবগণ (অর্থাৎ যে শুদ্ধসত্ত্বভাবসমূহ) জ্ঞানদেবতাকে (জ্ঞানকে) আপন গর্ভে ধারণ করেন; আবিল্য-পরিশূন্য আকাঙ্ক্ষণীয় সেই প্রসিদ্ধ জনহিতসাধক শুদ্ধসত্ত্বরূপ দেবতা আমাদের প্রতি শান্তিপ্রদায়ক ও সুখসাধক হোন। (প্রার্থনার ভাব এই যে,–যার দ্বারা অন্তর পবিত্র হয়, যাতে জ্ঞান বৃদ্ধি পায়, যাতে সকল রকম সুখশান্তি অধিগত হতে পারে, সেই শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের হৃদয়ে জেগে উঠুক। ১

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই সূক্তের হিরণ্যবর্ণাঃ প্রভৃতি চারটি ঋক্, যেখানেই অপ-দেবতার বিনিয়োগ আছে, সেখানেই বিনিযুক্ত হয়ে থাকে। গোদানাখ্য সংস্কার-কর্মে, মধুপর্কে পাদোদক অভিমন্ত্রণে, অনুদক দেশে উদক-প্রাদুর্ভাব-লক্ষণের জন্য, উদকপূর্ণ কলশ ভঙ্গ হলে নব-কলশ-সংস্থাপনে এবং পুষ্পভিষেকে কলশ-অভিমন্ত্রণে এই সূক্তের প্রয়োগ বিহিত আছে।–ভাষ্যানুসারে সূক্তের অন্তর্গত প্রথম মন্ত্রের উদ্দিষ্ট দেবতা–অ৷ অপকে অর্থাৎ জলকে সম্বোধন করেই এই মন্ত্রের অর্থ ভাষ্যে অধ্যাহৃত হয়েছে। সেই অনুসারে হিরণ্যবর্ণাঃ পদ অপেরই (জলেরই) বর্ণ প্রকাশ করছে। হিরণ্যের বর্ণের ন্যায় যে জ্বলের বর্ণ, তা-ই এখানকার লক্ষ্যস্থল। শুচয়ঃ এবং পাবকাঃ পদ দুটিতে–জল যে স্নান-পান ইত্যাদির দ্বারা মানুষকে শুদ্ধ করে, তা-ই বোঝানো হয়েছে। সবিতা এবং অগ্নি যে জল হতে উৎপন্ন হন, তার প্রমাণ-স্বরূপ ভাষ্যে নির্দেশ করা হয়েছে,-সমুদ্র হতে সূর্যের উদয় প্রত্যক্ষীভূত হয়ে থাকে। মেঘের মধ্যে বিদ্যুৎরূপে এবং সমুদ্রের মধ্যে বাড়বানল-রূপে অগ্নির বিদ্যমানতা পরিলক্ষিত হয়। অতএব, যাসু অগ্নিঃ বাক্যের সার্থকতা। এই ভাবে, অগ্নি যে জলের গর্ভে আছে, তা প্রতিপন্ন হয়ে থাকে। উপসংহারে সেই জলকে আহ্বান-পূর্বক বলা হয়েছে,–জল আমাদের রোগনাশক এবং সুখকারক হোক। ভাষ্যের এটাই মর্ম।–আমাদের পরিগৃহীত অর্থে আমরা যথাপূর্ব অপ-শব্দে শুদ্ধসত্ত্বকে-হৃদয়ের সৎ-ভাব ইত্যাদিকে নির্দেশ করেছি। সায়ণের ভাষ্যেও সময়ে সময়ে পদার্থবিশেষের উল্লেখ-প্রসঙ্গে তাদের অধিষ্ঠাত্রী দেবতার পরিকল্পনা দেখা যায়। সে ভাব প্রকাশ না করলে, বস্তু-পক্ষে অর্থ পরিগ্রহণ করবার প্রয়াস পেলে, অনেক স্থলে সঙ্গত অর্থই সিদ্ধ হয় না। ফলতঃ, প্রায় প্রত্যেক মন্ত্রেই রূপকের অধ্যাস দেখা যায়। আমরা যেখানে যেখানেই অপ-শব্দের ব্যবহার দেখেছি, সেই সকল স্থলেই দেবভাবের (শুদ্ধসত্ত্বের) প্রতি লক্ষ্য রয়েছে–বুঝেছি। এখানেও সেই দৃষ্টিতেই সৎ-অর্থ প্রাপ্ত হওয়া যায়। বলা হয়েছে–হিরণ্যবর্ণাঃ। সত্ত্বভাবে দেবত্বে ঐ বিশেষণের উপযোগিতা সম্যক্ দৃষ্ট হয়। সত্ত্বভাব যে রমণীয়, তা যে লোকের আপনা-হতেই চিত্তাকর্ষক, পরন্তু তা যে লোকের হিতসাধক, তা আর বোঝাবার প্রয়োজন হয় না। যেমন হিরণ্যের প্রতি লোকের চিত্ত আকৃষ্ট হয়, দেবত্বের সত্ত্বভাবের প্রতিও মানুষের চিত্ত সেইরকম আকৃষ্ট হয়ে থাকে। এই সংসারে কে না দেবত্বের অধিকারী হতে অভিলাষ করেন? তাই বলা হয়েছে-হিরণ্যবর্ণা। দেবত্ব স্বয়ং নির্মল বিশুদ্ধিতাসম্পন্ন; এবং দেবত্বের সংস্পর্শে অপরেও বিশুদ্ধিতা লাভ করে। তাই বলা হয়েছে–শুচয়ঃ পাবকাঃ। সবিতা এবং অগ্নি যে সত্ত্বভাব হতে উৎপন্ন হন, তার তাৎপর্য এই যে,–পবিত্রতাসাধক জ্ঞান এবং জ্ঞানের উৎপাদক অবস্থা সত্ত্বভাব হতেই সঞ্জাত হয়ে থাকে। মানুষ যতই সৎকর্মপরায়ণ ও সত্ত্বভাবের অনুসারী হবে, ততই তার মধ্যে জ্ঞান বৃদ্ধি প্রাপ্ত হবে। কর্মে ও জ্ঞানে পারস্পরিক অবিচ্ছিন্ন সম্বন্ধ। যেখানেই সৎকর্মের অনুষ্ঠান, সেখানেই জ্ঞানের উদ্ধৃতি; আবার যেখানেই জ্ঞানের বিকাশ, সেখানেই সঙ্কর্মের অনুষ্ঠানে রতি মতি প্রবৃত্তি। এই দৃষ্টিতেই, অগ্নিকে, অর্থাৎ জ্ঞানাগ্নিকে সত্ত্বভাব যে নিজের মধ্যে ১ উৎপন্ন করেন–গর্ভে ধারণ করেন, তা বোধগম্য হয়। মন্ত্রের প্রার্থনা এই যে,-সুবর্ণাঃ তাঃ আপঃ নঃ শং রে স্যোনাঃ ভবন্তু। তার মর্ম– এই যে,–সুবর্ণবৎ রমণীয় আকাঙ্ক্ষণীয় সেই যে আপঃ অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বভাবসমূহ, তাঁরা আমাদের মধ্যে বিদ্যমান থেকে আমাদের শান্তি ও সুখ প্রদান করুন। আমরা সিদ্ধান্ত করি, মন্ত্রে এইরকম ভাবই প্রকাশিত হয়েছে। ১।

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ যাসাং রাজা বরুণো যাতি মধ্যে সত্যানৃতে। অবপশ্য জনানাম্‌। যা অগ্নিং গর্ভং দধিরে সুবর্ণাস্তা ন আপঃ শং স্যোনা ভবন্তু ॥ ২॥

বঙ্গানুবাদ –সেই দেবগণের (শুদ্ধসত্ত্বসমূহের) অভ্যন্তরে অবস্থিত থেকে মনুষ্যগণের সৎ ও অসৎ কর্মকে অবগত হয়ে, সেই অনুসারে, পাপীদের নিগ্রহকর্তা ও পুণ্যাত্মাগণের রক্ষক, অভীষ্টবর্ষণকারী বরুণদেব, মনুষ্যগণের নিকট গমন করেন বা তাদের প্রাপ্ত হন; (ভাব এই যে, মনুষ্যগণের সৎ-অসৎ কর্ম অনুসারে অভীষ্টবর্ষক দেবতা তাদের রক্ষক বা দণ্ডদাতা হন); যে দেবতাগণ (অর্থাৎ যে শুদ্ধসত্ত্বভাবসমূহ) জ্ঞানদেবতাকে (জ্ঞানকে) আপন গর্ভে ধারণ করেন; আবিল্যপরিশূন্য আকাক্ষণীয় সেই প্রসিদ্ধ জনহিতসাধক শুদ্ধসত্ত্ব-রূপ দেবতা আমাদের প্রতি শান্তিপ্রদায়ক ও সুখসাধক হোন। (ভাব এই যে,–যে শুদ্ধসত্ত্বের অভ্যন্তরে সৎ-অসৎ কর্মের ফলদাতা দেবতা বাস করেন, সেই শুদ্ধসত্ত্ব আমাদের শান্তিপ্রদ ও সুখসাধক হোক। ২৷

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রের দ্বিতীয় চরণটি পূর্ব মন্ত্রেরই অনুবর্তী। সুতরাং প্রার্থনা অভিন্নই রয়েছে। জ্ঞান যার অভ্যন্তরে বিদ্যমান রয়েছে, সেই সত্ত্বভাব আমাদের শান্তিপ্রদ ও সুখসাধক হোন; অর্থাৎ জ্ঞান-সহযুত সত্ত্বভাবের অধিকারী হয়ে আমরা যেন সুখ-শান্তি লাভ করতে পারি;-প্রার্থনার এটাই। তাৎপর্য। তবে এই মন্ত্রের প্রথম চরণটি কিছু বৈচিত্র্যসম্পন্ন। অপের অর্থাৎ জলের অধিপতি বা রাজা বরুণ। ভাষ্যে প্রকাশ,–তিনি পাপীর নিগ্রহকর্তা; তিনি জলের মধ্যে অর্থাৎ সমুদ্রের গর্ভে অরস্থিতি করেন। সেখানে অবস্থিতি করে, তিনি মনুষ্যগণের সত্যভাষণ ও মিথ্যাকথন লক্ষ্য করে থাকেন এবং সেই অনুসারে আপন হস্তে পাশ ধারণ করে আছেন। এক দৃষ্টিতে দেখতে গেলে এই উপাখ্যান যে ভ্রান্তিমূলক, আপনা-হতেই তা উপলব্ধি করা যায়। পূর্বৰ্মন্ত্রের ব্যাখ্যাতে ও ভাষ্যে সেই ভ্রমের পরিচয় পেয়েছি। সেখানে আছে–সূর্য সমুদ্র হতে উত্থিত হন। এখানে দেখছি, বরুণ-সম্বন্ধেও সেই ভাব প্রকাশমান। কিন্তু তা যে রূপক, তা বলাই বাহুল্য। যাই হোক, ভাষ্যের অর্থ হতেই ভাব প্রাপ্ত হওয়া যায় যে, বরুণ দেবতা রাজার ন্যায় বিদ্যমান থেকে সকর্মকারিগণকে পালন এবং অপকর্মকারিগণকে দণ্ডপ্রদান করেন। আমরা বরুণঃ পদে অভীষ্টবর্ষণকারী দেব অর্থ গ্রহণ করি। সে দেবতা সকলেরই সকল প্রকার কামনা পূরণ করে থাকেন। কিন্তু এখানে এই মন্ত্রে তার কর্ম বিশিষ্টভাবে নির্দেশ করা হয়েছে–বুঝতে পারি। মন্ত্রের অন্তর্গত জনানাং সত্যানৃতে অবপশ্যন্ বাক্যাংশে তার সেই কর্মের ভাব প্রকাশ পেয়েছে। তিনি সত্যও দেখেন এবং অসত্যও দেখেন; সৎকর্মের প্রতিও লক্ষ্য করেন এবং অসৎকর্মের প্রতিও লক্ষ্য করেন। সেই লক্ষ্য অনুসারেই মনুষ্যগণকে তিনি আশ্রয়দান বা দণ্ডপ্রদান করে থাকেন। কিন্তু সেই দেবতারও আবাস-স্থান অপের অর্থাৎ সত্ত্বভাবের মধ্যে। যেখানে সত্ত্বভাব আছে, সেইখানেই তিনি বিদ্যমান থেকে মানুষের সৎ-অসৎ কর্মের ফলদাতা হন। তাঁর আবাসস্থান-স্বরূপ যে সত্ত্বভাব, তা আমাদের মধ্যে সঞ্চিত থোক এবং তার দ্বারা আমরা যেন সুখের ও শান্তির অধিকারী হই। এটাই এই মন্ত্রের প্রার্থনার মর্মার্থ। ২।

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ যাসাং দেবা দিবি কৃন্তি ভক্ষং যা অন্তরিক্ষে বহুধা ভবন্তি। যা অগ্নিং গর্ভং দধিরে সুবর্ণাস্তা ন আপঃ শং স্যোনা ভবন্তু ॥৩৷৷

 বঙ্গানুবাদ –দীপ্তিদানাদিগুণবিশিষ্ট দেবভাবসমূহ (ইন্দ্র ইত্যাদি দেবগণ) যে অপের অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বের সারভূত অমৃতকে স্বর্গলোকে উপভোগ্য করেন এবং যে অপ অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বসমূহ অন্তরিক্ষে অর্থাৎ অন্যান্য সর্বলোকে নানা রকমে (বহুরূপে) বিদ্যমান আছে; এবং যে অপ অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বসমূহ জ্ঞানাগ্নিকে আপন অভ্যন্তরে ধারণ করে আছে; আকাঙ্ক্ষণীয় সেই লোকহিতসাধক সত্ত্বভাবসমূহ আমাদের শান্তিপ্রদায়ক ও সুখসাধক হোক। (ভাব এই যে,-স্বর্গলোক সত্ত্বভাবের নিলয়; অন্যলোকে সত্ত্বভাবসমূহ বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত আছে; জ্ঞানের আশ্রয়ভূত সেই সত্ত্বভাবসকল আমাদের সুখশান্তির প্রবর্ধক হোক–এই আকাঙ্ক্ষা) ॥ ৩॥

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রের দ্বিতীয় চরণ পূর্ববর্তী মন্ত্র দুটির দ্বিতীয় চরণের অনুরূপ। সুতরাং দ্বিতীয় চরণের অর্থ এখানেও অভিন্ন রয়েছে। মন্ত্রটির প্রথমাংশে শুদ্ধসত্ত্বের মহিমা ব্যাখ্যাত হয়েছে। হৃদয়ে দেবভাব সঞ্জাত হলেই শুদ্ধসত্ত্বরূপ অমৃত উপভোগের অধিকার জন্মায়। সত্ত্বভাব সর্বত্রই নানা প্রকারে বিদ্যমান আছে; কিন্তু তা উপভোগের জন্য হৃদয়কে প্রস্তুত করা চাই। কর্ম ও জ্ঞান সাধনার দ্বারা হৃদয়কে পবিত্র দেবভাবসম্পন্ন করা চাই। তবেই শুদ্ধসত্ত্বরূপ অমৃত উপভোগ করতে সামর্থ্য জন্মাবে। যাতে আমরা উপযুক্ত সাধনার দ্বারা সেই অধিকার লাভ করতে পারি, মন্ত্রে সেই প্রার্থনাই দেখতে পাওয়া যায়। অমৃত পানের অধিকার জন্মালে, তার ফলে, পরম সুখ ও শান্তিলাভ ঘটবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তাই সেই চরম ও পরম শান্তি লাভের জন্য মন্ত্রে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে।-যাঁরা সত্ত্বগুণসম্পন্ন, যাঁদের হৃদয় বিশুদ্ধ ও নির্মল, তারা তো আপনা-আপনিই অমৃত লাভ করবেন। কিন্তু অধম পতিত আমরা কি সেই অমৃত-পানে বঞ্চিত থাকব? বিশ্ব ব্যেপেই তো সেই সত্ত্বভাবের প্রকাশ আছে। তবে কেবল অধম আমরাই কি সেই সত্ত্বভাব হতে এবং তার আনুষঙ্গিক অমৃতত্ব হতে বঞ্চিত হবো? তা তো নয়! প্রাণ ভরে অমৃতময়কে ডাকার মতো ডাকতে পারলে তিনি নিজেই তো দয়াপরবশ হয়ে অধম পাপীকেও অমৃতের অধিকারী করে থাকেন? সেই ডাকার মতোই তাঁকে একবার ডেকে দেখি না! মন্ত্রে তাই প্রার্থনা হচ্ছে ভগবানের কৃপায় সেই অমৃতবারির ধারা আমাদের মস্তকে বর্ষিত হোক; আমরাও অমৃতত্ত্ব লাভ করি ॥ ৩৷৷

.

চতুর্থ মন্ত্র: শিবেন মা চক্ষুষা পস্যতাপঃ শিবয়া তোপ শত ত্বচং মে। ঘৃততঃ শুচয়ো যাঃ পাবকাস্তা ন আপঃ শং স্যোনা ভবন্তু ॥ ৪ ৷৷

বঙ্গানুবাদ –হে শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ দেবগণ! মঙ্গলরূপ জ্ঞান-দৃষ্টির সাথে অনুগ্রহাকাঙ্ক্ষী আমার হৃদয়ে উপজিত হোন অর্থাৎ যাতে আমার ইষ্ট লাভ হয়, তা বিহিত করুন। অপিচ, মঙ্গলপ্রদ অর্থাৎ ইষ্টপ্রাপক স্পর্শের দ্বারা আমার হৃদয়কে প্রাপ্ত হোন; (ভাব এই যে, আমার হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাব উপজিত হোক)। অমৃতপ্রাপক বিশুদ্ধ পবিত্রকারী যে শুদ্ধসত্ত্ব-রূপ দেবতা, সেই দেবতা আমাদের প্রতি শান্তিপ্রদায়ক এবং মঙ্গলবিধায়ক হোন; (ভাব এই যে, অমৃত-প্রাপক, শুদ্ধসত্ত্বভাব-সমূহ আমাদের পরাশান্তি প্রদান করুক) ৪

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। মন্ত্রের ভাব সরল ও সহজবোধ্য! হৃদয়ে সত্ত্বভাবের সঞ্চারের নিমিত্ত প্রার্থনাই এই মন্ত্রে পরিদৃষ্ট হয়। এই মন্ত্রের ভাব সূক্তান্তৰ্গত অন্যান্য মন্ত্রের ভাবের সাথে একসূত্রে গ্রথিত। অন্যান্য মন্ত্রে পরোক্ষ প্রার্থনা আছে। কিন্তু এই মন্ত্রে সত্ত্বভাবকে দেবতারূপে গ্রহণ করে তাঁর নিকট প্রত্যক্ষভাবে প্রার্থনা করা হচ্ছে। সেই প্রার্থনার মর্ম এই সূক্তের অন্যান্য মন্ত্রের প্রার্থনার অনুরূপ।–শুদ্ধসত্ত্ব পরম-মঙ্গলবিধায়ক। হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বের আবির্ভাব হলে মানুষ পরম মঙ্গলের পথে অগ্রসর হয়। সত্ত্বভাবের সাথে জ্ঞান অচ্ছেদ্য সম্বন্ধে আবব্ধ। তাই সত্ত্বভাবের সাথে জ্ঞান-উন্মেষের প্রার্থনা মন্ত্রের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। অমৃত-প্রাপক সত্ত্বভাব আমাদের হৃদয়ে উপজিত হোক, হৃদয় পরাজ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত হোক, এই জ্ঞানের আলোকে আমরা যেন পরম মঙ্গলের পথে অগ্রসর হতে পারি–এইরকম প্রার্থনার ভাবই মন্ত্রের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। পরমমঙ্গল পরাজ্ঞান যে শুদ্ধসত্ত্বের সাথে একসূত্রে গ্রথিত, তা-ই এই মন্ত্রের প্রথমাংশে প্রখ্যাত হয়েছে। দ্বিতীয় অংশের বিষয় পূর্ব মন্ত্রগুলিতে এবং বিশেষভাবে আমাদের এই বঙ্গানুবাদে ব্যক্ত হয়েছে। ৪

.

ষষ্ঠ সূক্ত : মধুবিদ্যা

[ঋষি : অথর্বা দেবতা : মধুবনস্পতি ছন্দ : অনুষ্টুপ ]

প্রথম মন্ত্রঃ ইয়ং বীরুন্মধুজাতা মধুনা ত্বা খনামসি। মধোরধি প্রজাতাসি সা ন মধুমতস্কৃধি ॥ ১।

বঙ্গানুবাদ –হে অমৃতবিধায়ক শুদ্ধসত্ত্বভাব! সাধকের হৃদয়ে বর্তমান, তুমি স্বভাবতঃ অমৃত সুর হতে উৎপন্ন; আমরা তোমাকে অমৃতত্বলাভের জন্য পরমার্থকামনায় যেন লাভ করতে পারি; তুমি অমৃত (অথবা অমৃতের স্বরূপ) হতে উৎপন্ন। সাধকের হৃদয়ে অথবা ভগবানে বর্তমান তুমি আমাদের অমৃতযুত (ইষ্টসিদ্ধিযুত) করো। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ হতে সত্ত্বধারা প্রবাহিত হয়; আমরা সত্ত্বভাবের প্রভাবে যেন তা লাভ করতে সমর্থ হই) ॥১।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— এই সূক্তের অন্তর্গত মন্ত্রগুলির তিনরকম বিনিয়োগের বিষয় ভাষ্যানুক্রমণিকায় পরিদৃষ্ট হয়। প্রথম–পরিযজ্জকর্ম-সমূহে সভায় প্রবেশের পূর্বে এই সূক্তটি পাঠ করে মধুক নামা বীরুধ ভক্ষণ করবে। দ্বিতীয়,–বিবাহ ইত্যাদি কর্মে এই মন্ত্রে অভিষিক্ত করে রক্তসূত্রের দ্বারা মধুকমণি হস্তাঙ্গুলিতে ধারণ করবে। তৃতীয় বিবাহ ইত্যাদি উপলক্ষে চাতুর্থিকা-কর্ম-সমূহে শয়নকালে মধুমণি পিষ্ট করে এই সূক্তের দ্বারা অভিমন্ত্রণের পর বরবধূ পরস্পর গমন করবে। অশ্বমেধ-যজ্ঞে ব্রহ্মেদ্যবদনেও এই সূক্তের বিনিয়োগ আছে। (অশ্বমেধে ব্রহ্মোদ্যবদনেহপি এতৎ সূক্তং)।অনুক্রমণিকার এই নির্দেশ গ্রহণ করে ভাষ্যকার বীরুৎ পদের অর্থ গ্রহণ করেছেন-মধুকনামা লতা; এবং তার জন্য মধু পদেরও নানারকম অর্থ নিষ্পন্ন হয়েছে। কিন্তু আমাদের ব্যাখ্যায় আমরা সে অর্থ গ্রহণ করিনি। আমরা পূর্বেই (১কা-৬অ-৪সূ-১ম) প্রদর্শন করেছি যে, বিরুৎ পদে অমরত্ববিধায়ক বস্তুর নির্দেশ করে। সেই অর্থে আমরা এখানে বিরুৎ (বীরুৎ) পদে অমৃতত্ববিধায়ক সত্ত্বভাবকেই লক্ষ্য করে, মধু পদে পূর্বাপরই অমৃত অথবা অমৃতস্বরূপ ভগবান্ অর্থ গ্রহণ করেছি। তার দ্বারা যে অর্থ পাওয়া যায়, তা আমাদের বঙ্গানুবাদে পরিদৃষ্ট হবে।–এই মন্ত্রে সত্ত্বভাবের মহিমা প্রখ্যাপিত হয়েছে। সেই সত্ত্বভাব লাভের প্রার্থনাই মন্ত্রে বিদ্যমান আছে। সত্ত্বভাবই অমৃতত্ত্বের বিধায়ক। সত্ত্বভাবের সাহায্যেই মানুষ ভগবানের সাথে নিজের সংযোগ উপলব্ধি করতে পারে। অমৃতস্বরূপ ভগবান্ হতে সত্ত্বভাব সমুদ্ভূত। ভগবৎ-অঙ্গীভূত সেই সত্ত্বভাবের সাহায্যে মানুষ অমৃতত্ত্ব-লাভে অধিকারী হয়। তাই সেই পরমধন-লাভের উপায়ভূত সত্ত্বভাব-প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা মন্ত্রের মধ্যে ফুটে উঠেছে।–সত্ত্বভাব সর্বত্র সর্বজীবের হৃদয়েই বর্তমান আছে। আধারের প্রকৃতি ও প্রকার ভেদে তার বিকাশের বিভিন্নতা হয় মাত্র। যা সর্বত্র আছে, তা আপন হৃদয়ে ধারণ করবার সামর্থ্য-লাভের জন্য প্রার্থনা ও সাধনার প্রয়োজন। ভগবান্ অমৃতস্বরূপ। তার হতেই অমৃতধারা জগতে প্রবাহিত হয়। সাধকের হৃদয় তার বিশেষ আধার মাত্র। মন্ত্রের প্রার্থনা,-নঃ মধুমতং কৃধি–অর্থাৎ আমাদের মধুযুক্ত করুন। আমরা যেন অমৃতত্ব লাভ করতে পারি, আমরা যেন অমৃত হই। ১।

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ জিহ্বায়া অগ্রে মধু মে জিহ্বামূলে মধুলক। মমেদহ ক্ৰতাবসো মম চিত্তমুপায়সি ॥ ২॥

 বঙ্গানুবাদ –আমার রসনায় অমৃত বর্তমান হোক, বাক্‌-যন্ত্রে অমৃত বিদ্যমান থাকুক; (ভাব এই যে, আমার সকলরকম প্রার্থনা সর্বদা অমৃতসম্বন্ধি হোক)। হে অমৃতসম্বন্ধি শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি আমার সবরকম কর্মে নিশ্চিতরূপে বর্তমান থাকো; অপিচ, তুমি আমার অন্তরকে প্রাপ্ত হও অর্থাৎ হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হও; (ভাব এই যে, আমার সবরকম কর্ম সদাকাল অমৃত-সম্বন্ধি এবং ইষ্টপ্রাপক হোক) ॥ ২

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রটির প্রচলিত ব্যাখ্যায় রূপকের আভাষ আছে। আমাদের চিত্ত মধুময় হোক, বাক্য মধুময় হোক, আমার বাক্য ও চিত্ত উভয়ই পরমার্থলাভে সদা বিনিযুক্ত থাকুক,–এটাই ব্যাখ্যার সারমর্ম। কিন্তু আমাদের ব্যাখ্যা একটু ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করেছে। আমাদের বাক্য কর্ম চিন্তা সমস্তই অমৃতলাভের জন্য প্রযুক্ত হোক, কায়েন-মনসা-বাচা আমরা অমৃতত্বলাভের জন্য প্রবুদ্ধ হই,আমার বাক্য ও চিত্ত উভয়ই পরমার্থ-লাভে বিনিযুক্ত হোক,–এটাই আমাদের ব্যাখ্যার সারমর্ম। নচেৎ, আমাদের জিহ্বাতে মধু থাকুক অথবা কর্মে মধু বর্তমান থাকুক–এই ব্যাখ্যার কোনও সার্থকতা দেখতে পাওয়া যায় না। আমরা যা বলবো, যা করবো, তা যেন আমাদের অমৃতের সন্ধান দেয়, আমাদের চিন্তা যেন আমাদের অমৃতত্ত্বের পথে নিয়ে যায়। আমাদের সর্বরকম প্রচেষ্টা আমাদের সেই পরম সুখ ও শান্তির পথে নিয়ে যাক, আমরা যেন আমাদের শক্তিকে সবরকমে জীবনের সেই পরম ও চরম উদ্দেশ্য-সাধনে নিযুক্ত করতে সমর্থ হই। ভাষ্যে মধুঁকতে সম্বোধন পদ পরিদৃষ্ট হয়। মন্ত্রের মধ্যে কিন্তু সেরকম কোনও পদের সমাবেশ নেই। জিহ্বাতে মধু ইত্যাদি রসের সমাবেশ থাকলে বাক্য সকলের নিকট মধুর ও সুশ্রাব্য হয়–ভাষ্যকার প্রথমাংশে এই ভাব অধ্যাহার করেছেন। আমরা বলি,-মন্ত্রাংশ আরও উচ্চভাবমূলক। জিহ্বার অগ্রভাগে ও মূলদেশে মধু বর্তমান থাকুক–এই বাক্যে আমরা অন্য ভাব উপলব্ধি করি। আমাদের বাক্য ও কার্য যেন মধুময় হয় অর্থাৎ আমরা কখনও ভুল করেও যেন ভগবানের গুণানুকীর্তন ভিন্ন অন্য কিছু না করি, আমাদের বাক্য সর্বদা যেন আমাদের অমৃতের আধার ভগবানের প্রতি প্রধাবিত করে,–উক্ত বাক্যে আমরা এমনই তাৎপর্য উপলব্ধি করি। ফলতঃ, কায়মনোবাক্যে হরিকথা ভিন্ন যেন অন্য কথা আমাদের রসনায় না আসে। বাক্য হরিময় হোক,–সর্বস্ব শ্রীহরিতে সমর্পণ করে হরিপাদপদ্মে লীন হয়ে যাই, মন্ত্রের প্রতি পদের প্রতি শব্দে এই ভাবেরই পরিস্ফুরণ লক্ষ্য করি। ২।

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ মধুমন্মে নিক্রমণং মধুমন্মে পরায়ণ। বাচা বদামি মধুমদ ভূয়াসং মধুসংদৃশঃ ॥ ৩৷৷

বঙ্গানুবাদ –আমার ইহজীবন (অথবা ভগবৎসন্নিকর্ষ-লাভের নিমিত্ত আমার অনুষ্ঠান-সমূহ) অমৃতময় (ভগবৎপ্রাপ্তিমূলক) হোক; আমার পরজীবন (ভগবৎসন্নিকর্ষলাভ) অমৃতময় (ভগবৎপ্রীতিসাধক) হোক; বাক্-ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যা বলবো, সেই সবই যেন অমৃতলাভ-বিষয়িণী হয় অর্থাৎ আমার বাক্য ভগবৎ-প্রীতিমূলক হোক; আমি যেন (সকলের প্রীতিভূত) অমৃতযুক্ত হই। (ভাব এই যে–আমি যেন কায়মনোবাক্যে সর্বতোভাবে অমৃতত্বলাভে সমর্থ হই ৷৩৷৷

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— এই মন্ত্রটিও পূর্ব মন্ত্রের ন্যায় অমৃতলাভ-বিষয়ক। এই মন্ত্রের ব্যাখ্যায় ভাষ্যকারের সাথে আমাদের অনৈক্য ঘটেছে। ভাষ্যকার মধুকলতাকে সম্বোধন করে মন্ত্রের ব্যাখ্যা আরম্ভ করেছেন। কিন্তু আমাদের মতে এখানে মধুকলতাকে টেনে আনবার কোনও প্রয়োজন নেই। মধু শব্দে আমরা সর্বত্রই অমৃত অর্থ গ্রহণ করেছি। এখানেও এই অর্থেরই সুসঙ্গতি দেখতে পাই। নিক্রমণং পদে ইহজীবনং এবং পরায়ণং পদে পরজীবনং অর্থ গ্রহণ করেছি। যা আমাদের নিকটে রয়েছে, যার মধ্যে আমরা রয়েছি, তা আমাদের এই বর্তমানজীবন ইহলোক। আবার এই পরিদৃশ্যমান জগৎ হতে বিদায় গ্রহণ ও করে যখন বহুদূরে–লোকান্তরে–গমন করবো, তখন যে জীবন আরম্ভ হবে, তা এই জগৎ হতে দূরে, তাই পরজীবন। তাই নিক্রমণং এবং পরায়ণং পদ দুটিতে যথাক্রমে ইহজীবন এবং পরজীবন অর্থ সুসঙ্গত বলে মনে হয়। নতুবা নিকট গমন এবং দূরগমন মধুময় হোক,–এই বাক্যের বিশেষ কোনও সার্থকতা দেখতে পাওয়া যায় না। তাই এই মন্ত্রের মধ্যে এই প্রার্থনাই দেখতে পাই–আমার জীবন–ইহকাল ও পরকাল–মধুময় হোক, আমার প্রত্যেক বাক্য অমৃতলাভের বিষয়ভূত প্রার্থনায় পর্যবসিত হোক। আমি যা বলবো, তা-ই যেন আমাকে অমৃতের পথে অগ্রসর করে দেবার উপযোগী হয়। আমি যেন অমৃতের অধিকারী হই। নিক্রমণং এবং পরায়ণং পদ দুটির আর যে সুসঙ্গত অর্থ, তার আভাষ বঙ্গানুবাদে প্রদত্ত হয়েছে। সে মতে নিক্রমণং পদের অর্থ হয়,-ভগবৎ-সন্নিকর্ষলাভায় মম অনুষ্ঠানং। ভাষ্যে ঐ পদের সন্নিহিতার্থে প্রবর্তনং এক অর্থ আছে। কার সন্নিহিতার্থে প্রবর্তন? আত্ম-উৎকর্ষসম্পন্ন ব্যক্তি ভগবানের সন্নিকটে গমনই শ্রেয়ঃ-সাধক বলে মনে করেন। অনুষ্ঠান-সমূহ আপনা-আপনিই ভগবৎপ্রাপ্তিমূলকভাবে যাতে অনুষ্ঠিত হয়, সেই প্রচেষ্টাই তাঁর দেখতে পাওয়া যায়। তার আকাঙ্ক্ষাও সেইরকমই হয়ে থাকে। আবার ভগবানের সন্নিকর্ষ লাভ করেও যাতে তাঁর পরিতৃপ্তি বিধান করতে পারেন, সে আকাঙ্ক্ষাও তাতে দেখতে পাওয়া যায়। পাছে, তার অনুষ্ঠান ভগবানের প্রতিমূলক না হয়, পাছে তিনি পুনরায় তার বিরাগভাজন হয়ে সংসার-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন, এই আশঙ্কা সর্বদা তার মনে জাগরুক থাকে। তাই ভগবৎসন্নিকর্য লাভেও যাতে ভগবানের প্রীতিসাধন করতে পারেন, তার প্রীতিকর কার্যের অনুষ্ঠানে সমর্থ হন,–সেই সঙ্কল্প মধুমন্মে পরায়ণং পদ দুটিতে প্রকাশ পেয়েছে। আমার কর্ম, আমার মন, আমার বাক্য ভগবানের প্রীতিসাধক হোক, মন্ত্রের এই ভাব প্রকাশ পেয়েছে। আমি যেন এমন কর্ম না করি, যাতে ভগবানের প্রীতি উপজিত না হয়; আমার মনে এমন চিন্তার উদয় না হয়, যার দ্বারা আমি ভগবান্ হতে দূরে সরে পড়ি; আমার রসনা হতে এমন বাক্য যেন নিঃসৃত না হয়, যার সাথে ভগবানের কোনও সম্বন্ধ না থাকে। ফলতঃ, কিবা কার্যে কিবা চিন্তায়, কিবা বাক্যে সর্ববিষয়ে ভগবানের প্রতি উৎপাদন করে তাতে আত্মলীন করবার আকাঙ্ক্ষাই এই মন্ত্রে প্রকাশ পেয়েছে। মানবজীবনের চরম উদ্দেশ্যও তা-ই। ভগবৎ-চরণে আত্মলীন হওয়া, অর্থাৎ অমৃতের সাগরে নিজেকে বিসর্জন দেওয়াই, মানুষের জীবনের পরম আকাঙ্ক্ষণীয় সর্বোত্তম পরিণতি। এই মন্ত্রে সেই পরিণতি লাভের জন্য প্রার্থনা পরিদৃষ্ট হয়। ৩।

.

 চতুর্থ মন্ত্র: মধোরস্মি মধুতরো মদুঘান্মধুমত্তরঃ। মামিৎ কিল ত্বং বনাঃ শাখাং মধুমতীমিব ॥৪॥–

বঙ্গানুবাদ— অমৃতলাভে (শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে) আমি যেন অমৃত (সৎ-ভাবসম্পন্ন) হই; অমৃতলাভে আমি যেন অমৃতযুক্ত (সৎ-ভাবসহযুত) হই; মধুযুক্ত বৃক্ষ যেমন মানুষের প্রীতি উৎপাদন করে; সেইরকম হে অমৃতস্বরূপ ভগবন্! সৎ-ভাব-কামনাকারী প্রার্থনাকারী আমাকে কলুষকলঙ্ক-পরিশূন্য সৎ-ভাবসম্পন্ন করে আপনাকে প্রাপ্ত করুন অর্থাৎ আমাকে উদ্ধার করুন। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। ভাবার্থ-অমৃত লাভ করে আমি যেন অমৃত হয়ে যাই) ৪

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই সূক্তের প্রায় সকল মন্ত্রেরই ভাবধারা একরকম। বিভিন্নরকম শব্দপ্রয়োগের সাহায্যে নানাভাবে এই ভাবের বিকাশ মন্ত্রগুলিতে দেখতে পাওয়া যায়। সেই ভাব–অমৃত-লাভের প্রার্থনা।

এই মন্ত্রের মধ্যে অতিশয়-অর্থে তরপ প্রত্যয়ের ব্যবহার সম্বন্ধে একটু আলোচনা করা প্রয়োজন। আমি মধু সুদ হতে মধুতর হবো–এ কথার অর্থ কি? জগতের সকল সামগ্রীর মধ্যেই অমৃতের বীজ নিহিত আছে। সাধনার ফলে; ভগবানের কৃপায় তা-ই বিকশিত হয়ে মানুষকে পূর্ণত্ব প্রদান করে–অমৃতময় করে। এই বীজ-অবস্থা হতে বিকশিত অবস্থায়–পূর্ণত্বের অবস্থায়–যাবার প্রার্থনাই এই মন্ত্রের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। ক্ষুদ্রত্ব হতে মহত্ত্বে যাবার, মৃত্যুর পথ হতে অমৃতে যাবার যে অমৃতবীজ মানুষের মধ্যে আছে, তাকে পূর্ণভাবে ফুটিয়ে তোলবার জন্য প্রার্থনাই এই মন্ত্রের মধ্যে প্রাপ্ত হই। ভাষ্যকার এই মন্ত্রেও মধুঁকতে সম্বোধন পদ অধ্যাহার করে যে ব্যাখ্যা করেছেন, তা আমরা গ্রহণ করতে পারিনি। সাধারণ মধুকলতার দ্বারা মানুষ কিভাবে মধুময় হতে পারে তা বোধগম্য হওয়া সুকঠিন। পরন্তু, নিত্যসত্য বেদমন্ত্রের সাথে অনিত্য লতার সম্বন্ধ টেনে এনে, বেদের নিত্যত্বেই বা বিঘ্ন ঘটাবার প্রয়োজন কি? আমরা মনে করি, বেদের মন্ত্রের সাথে পার্থিব কোনও সামগ্রীরই সম্বন্ধ বিদ্যমান নেই। অপিচ, নিত্যসত্য বেদের মধ্যে সেই সাধারণ অর্থ অপেক্ষা অনেক উচ্চ নিগূঢ় ভাব নিহিত আছে বলেই আমরা মনে করি। সেই ভাব–অমৃতলাভের প্রার্থনা–যা বেদের অন্যত্র মৃত্যুৰ্মো অমৃতং গময় প্রার্থনায় ধ্বনিত হয়ে উঠেছে। আমরা সেই ভাবধারারই অনুসরণ করবার প্রয়াস পেয়েছি। ৪

.

পঞ্চম মন্ত্রঃ পরি ত্বা পরিতনেক্ষুণাগামবিদ্বিষো। যথা মাং কামিন্যসো যথা মন্নাপগা অসঃ ॥৫॥

বঙ্গানুবাদ –হে ভগবন্! সর্বত্ৰব্যাপকমধুরত্বহেতু লোকে যেমন ইক্ষু কামনা করে, আমি সেইভাবে আপনাকে সম্যভাবে প্রাপ্ত হবার জন্য প্রার্থনা করি; কাময়মানা পতিপরায়ণা পত্নী যেমন আপন পতিকেই কামনা করে, আপনি আমার প্রতি সেইরকম অনুরাগসম্পন্ন হোন, অর্থাৎ আপনি যেন আমাদের পরিত্যাগ না করেন; অপিচ, হে ভগবন্! যাতে আমাকে পরিত্যাগ না করেন, সেইরকম বিহিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক; সর্বতোভাবে আমি যাতে ভগবৎপরায়ণ হতে পারি, হে ভগবন্! সেইরকম বিহিত করুন) ৷ ৫৷৷

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— এ মন্ত্রটি অত্যন্ত জটিলতাসম্পন্ন। ভাষ্যকার সম্বোধনে হে জায়ে পদ অধ্যাহার করে ব্যাখ্যা আরম্ভ করেছেন। (হে জায়ে ত্বা ত্বাং পরিত্যুনা পরিতেন সর্বতোব্যাপেন–ইত্যাদি)। কিন্তু জায়া পদ অধ্যাহার করলেও অর্থ খুব পরিষ্কার ও সুসঙ্গত হয়নি। বিশেষতঃ ভাষ্যকার যে অর্থের কল্পনা করেছেন, সেই অর্থে একটি লৌকিক বিষয়ের নির্দেশ করে মাত্র। তথাপি ব্যাখ্যাতে পরিততুনা ইক্ষুণা পদ দুটির বিশেষ সার্থকতা থাকেনি। এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা সম্বন্ধে আমাদের ধারণা স্বতন্ত্র। আমরা মনে করি, এই মন্ত্র বর্তমান সূক্তের অন্তর্গত অন্যান্য মন্ত্রের মতোই অমৃতস্বরূপ ভগবানকেই লক্ষ্য করে। সর্বতোভাবে অমৃতত্বলাভের জন্য প্রার্থনা এই মন্ত্রে আছে। পত্নী যেমন পতির সাথে মিলিত হন, তিনি যেমন তার প্রতি অনুরাগ-সম্পন্ন অপিচ তারা যেমন পরস্পর একাত্মতা লাভ করেন; সেইরকম অবিচ্ছিন্নভাবে অমৃতলাভের জন্য এই স্থলে প্রার্থনা করা হয়েছে। আমরা যেন অমৃত হতে পারি, আমাদের জীবন যেন অমৃতময় হয়, আমরা যেন কখনও অমৃত হতে বিচ্ছিন্ন না হই। আমরা যেন পরিপূর্ণ অমৃতের পথে অগ্রসর হয়ে জীবন = সার্থক করতে পারি। এইরকম প্রার্থনাই মন্ত্রের মধ্যে নিহিত আছে। ৫৷৷

.

সপ্তম সূক্ত : দীর্ঘায়ুঃপ্রাপ্তিঃ

[ঋষি : অথর্বা (আয়ুষ্কামঃ) দেবতা : হিরণ্যম, ইন্দ্রাগ্নী, বিশ্ব দেবগণ ছন্দ : জগতী, ত্রিষ্টুপ ]

প্রথম মন্ত্রঃ যদাবধু দাক্ষায়ণা হিরণ্যং শতানীকায় সুমনস্যমানাঃ। তৎ তে বর্ধমায়ুষে বসে বলায় দীর্ঘায়ুত্বায় শতশারদায় ॥১॥

বঙ্গানুবাদ –আত্মশক্তিশালী শোভনান্তঃকরণবিশিষ্ট সৎ-ভাবসম্পন্ন ব্যক্তিগণ রিপুজয়ের নিমিত্ত যে সকর্মসাধন-সামর্থ্য-রূপ শুদ্ধসত্ত্ব হৃদয়ে সঞ্চয় করেন; হে মোক্ষকামী আত্মা (আমি)! তোমার মঙ্গলকামনায় শুদ্ধসত্ত্বরূপ প্রসিদ্ধ সেই রত্ন, সাধনশক্তি লাভের জন্য, আত্মশক্তির উন্মেষণের নিমিত্ত, অনন্তশক্তি লাভের জন্য এবং অনন্তজীবন প্রাপ্তির নিমিত্ত আমি যেন ধারণ করতে সমর্থ হই। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। ভাব এই যে,-শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে আমি যেন সৎকর্ম সাধনের সামর্থ্য লাভ করতে পারি) ॥ ১

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই সূক্তের অন্তর্গত মন্ত্রগুলির নানারকম বিনিয়োগ দৃষ্ট হয়। ভাষ্যকার সেই বিনিয়োগের অনুসরণ করে মন্ত্রগুলির ব্যাখ্যা করেছেন। সূক্তানুক্রমণিকায় প্রকাশ,–সকল রকম সম্পঙ্কর্মে, আয়ুষ্কামনায়, উপনয়নে এবং অলঙ্কারধারণ প্রভৃতি কর্মে এই মন্ত্রগুলি প্রযুক্ত হয়ে থাকে। ভাষ্যকার সেই অনুসারেই হিরণ্যং প্রভৃতি পদের অর্থ করেছেন। মন্ত্রের লৌকিক প্রয়োগ যে ভাবেই নিষ্পন্ন হোক, সেই সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য নেই; তার বিরুদ্ধে মতও আমরা প্রকাশ করছি না। তবে তার অতিরিক্ত আধ্যাত্মিক প্রয়োগের বিষয়ে ঐ পদের অর্থ সম্বন্ধে আমরা সেই বিষয়ে ভাষ্যকারের সাথে একমত হতে পারিনি। আমাদের মতে হিরণ্যং পদে হিতরমণীয় রত্নকেই বোঝায় সত্য; কিন্তু সেই হিতরমণীয় রত্ন কি? যা শ্রেয়ঃ ও প্রেয় উভয়ই, যা মানুষকে পরমানন্দের পথে নিয়ে যায়, অথচ যা মানুষের প্রিয়, সেই বস্তু শুদ্ধসত্ত্ব বা সৎকর্ম-সাধন-সামর্থ্য। সৎকর্মের দ্বারাই মানুষ স্বয়ং নিজের এবং অন্যের প্রকৃত হিতসাধন করতে পারে। পরিণামে শুদ্ধসত্ত্ব–সকর্মই মানুষের প্রিয় বলে বিবেচিত হয়। তাই হিরণ্যং পদে আমরা শুদ্ধসত্ত্বকে বা সকর্ম-সাধন-সামর্থ্যকেই লক্ষ্য করেছি।–অনীক পদে সংগ্রাম, রিপুসংগ্রাম বোঝায়। তাই শতনীকায় পদে রিপুজয়ায় অর্থ গ্রহণ করেছি। শতানীকায় অর্থাৎ বহু শত্রু জয়ের নিমিত্ত। মানুষের শত্রুর অন্ত নেই। অন্তঃশত্রু বহিঃশত্রু-নানা শত্রুর আক্রমণে মানুষ অহরহ বিপর্যস্ত হয়ে আছে। সেই সকল শত্রুজয়ের আকাঙ্ক্ষাই ঐ পদে প্রকাশ পেয়েছে। সৎকর্মের দ্বারা শুদ্ধসত্ত্বের উন্মেষণে চিত্তবৃত্তি নির্মল হলে মানুষ রিপুজয়ে সমর্থ হয়। সৎকর্মের সাহায্যে মানুষ অনন্ত জীবন লাভ করতে পারে। কীর্ত্যিস্য সঃ জীবতি। সৎকর্মের সাধনেই মানুষ চিরজীবী হয়ে থাকে। সদ্ভাবের প্রভাবেই মানুষ সৎকর্মসাধনে সমর্থ হয়। সাধকগণ সেই সঙ্কর্মের দ্বারা নিজেদের জীবনকে উন্নত ও পবিত্র করেন। মন্ত্রের মধ্যে এই প্রার্থনাই আমরা দেখতে পাই।–শতশারদায় পদে ভাষ্যকার অর্থ করেছেন,–শতসংবৎসর জীবনায়। এই পদের দ্বারা মানুষের আয়ুর পরিমাণ নির্ধারিত হয়েছে বলে ভাষ্যকারের ধারণা। কিন্তু শত শব্দ যে বহুসংখ্যা ॥ বোঝাতে–অনন্ত পরিমাণ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, তা আমরা বহুবার লক্ষ্য করেছি। এখানেও শত শব্দ অনন্ত অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে বলে মনে করি। সকর্ম-সাধনের দ্বারা অনন্ত-জীবন লাভ হয়। তাই সেই অনন্ত-জীবন-লাভের সাধনভূত সৎকর্ম-সাধন-সামর্থ্য প্রাপ্তির কামনা মন্ত্রে ফুটে উঠেছে। প্রচলিত ব্যাখ্যানুসারে শতশারদায় পদে প্রাচীন ভারতের মানুষের আয়ু-সম্বন্ধে পণ্ডিতগণের এই অদ্ভুত ধারণার পরিচয় পাওয়া যায়। সেই অনুসারে মানুষের আয়ু শতবর্ষ নির্দিষ্ট হয়। ঋগ্বেদেরও বহু স্থলে এই তথ্যের পরিচয় পাওয়া যায়। পঞ্চাশ ষাট হাজার বর্ষজীবী মানুষের উপাখ্যান পরবর্তীকালের কল্পনা। অবশ্য, বর্ষ শব্দে বহু ক্ষেত্রে দিন বা মাসও কল্পিত হতো। কিন্তু এইস্থলের মতো প্রায় প্রতি স্থলেই শতবর্ষ, সহস্রবর্ষ ইত্যাদি পদের দ্বারা বহু বা অপরিমিত বর্ষই সূচিত হয় ও হতো ॥১॥

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ নৈনং রক্ষাংসি ন পিশাচাঃ সহন্তে দেবানামোজঃ। প্রথমজং হ্যেহত। যো বিভর্তি দাক্ষায়ণং হিরণ্যং স জীবেষ্ণু কৃণুতে দীর্ঘমায়ুঃ ॥ ২॥

বঙ্গানুবাদ –শুদ্ধসত্ত্বরূপ সৎকর্মসাধনসামর্থ্য সকলের আদিভূত। শুদ্ধসত্ত্বই দিব্যশক্তি প্রদান করে। শুদ্ধসত্ত্বকে রিপুগণ অভিভব করতে পারে না; (ভাব এই যে,–শুদ্ধসত্ত্বের বা সৎকর্মসাধনের দ্বারা রিপুজয় হয়); যে আত্মশক্তিসাধক শুদ্ধসত্ত্বরূপ সৎকর্মসাধন-সামর্থ্য প্রাপ্ত হন, তিনি প্রাণি-সমূহের মধ্যে অনন্ত জীবন লাভ করেন; (মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রকাশক। ভাবার্থ–শুদ্ধসত্ত্বই সকলের মূলীভূত। শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে মানুষ সকর্মের সাধন-সামর্থ্য এবং অনন্তজীবন-লাভে সমর্থ হয়) ॥ ২॥

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে সৎকর্ম-সাধনের দ্বারাই মানুষ মুক্তির পথে অগ্রসর হতে পারে। সৎ-ভাবের দ্বারা চিত্ত নির্মল হয়, মনোবৃত্তি ঊর্ধ্বগামী হয়ে থাকে। মুক্তিলাভের নানারকম উপায়ের মধ্যে হৃদয়ে সৎ-ভাবের সঞ্চয় এবং সৎকর্মের সাধনই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ সহজ উপায়। অন্তরের সৎ-বৃত্তিরাজি সৎকর্মের সাধনায় বিকশিত হয়ে থাকে। সৎকর্মের সাধনার দ্বারা হৃদয় মন উপযুক্তভাবে গঠিত হলে ভক্তি-জ্ঞানের সঞ্চার হয়। তাই সৎকর্মকে প্রথম সাধনোপায় বলা হয়েছে। অবশ্য সাধকভেদে প্রথমে জ্ঞান ও ভক্তিরও আবির্ভাব হতে পারে; কিন্তু তথাপি তার সঙ্গে কর্ম কোন-না-কোনও আকারে বর্তমান থাকে।–সৎকর্মের প্রভাবে শুদ্ধসত্ত্বের উন্মেষে রিপুগণ পরাজিত হয়। সুতরাং মানুষ অনায়াসেই তার চরম পরিণতির দিকে অগ্রসর হতে পারে। অনন্তজীবন-লাভের পথে মানুষের সর্বপ্রধান বিঘ্ন–রিপুশত্রুগণ। রিপুগণই মানুষকে তার গন্তব্য পথ হতে বিচ্যুত করে দেয়। কর্মের প্রভাবে রিপুগণ পরাজিত হলে ঊর্ধ্বগতি সহজ ও সুগম হয়;–পরিণামে মানুষ পূর্ণত্ব লাভ করে। তাই সৎ-ভাবসম্পন্ন সকর্ম-সাধক অনন্তজীবন লাভ করতে পারেন। ভাষ্যকার রক্ষাংসি পিশাচাঃ প্রভৃতি পদে রাক্ষস পিশাচ প্রভৃতি কল্পনা করেছেন এবং পিশাচ পদের জ্বর ইত্যাদি উপদ্রব অর্থ করেছেন। যাস্কের মত অনুসারে রক্ষ পদের অর্থ– যা হতে রক্ষা করতে হবে। আমরাও এই অর্থ সঙ্গত বলে মনে করি। কিন্তু রাক্ষস পিশাচ প্রভৃতি কোনরকম অদ্ভুত দেহধারী জীব আছে বলে মনে করি না। আমাদের অন্তরস্থায়ী রিপুগণ হতেই আমাদের নির্মল সত্তাকে রক্ষা করতে হবে। তারাই প্রকৃত রাক্ষস। পিশাচ শব্দেও আমরা এই ভাব গ্রহণ করি। আমাদের অন্তরস্থ রিপুরূপ রাক্ষস পিশাচ প্রভৃতি হতে আত্মরক্ষা করাই এখানকার উদ্দেশ্য। প্রচলিত ব্যাখ্যা হতে রাক্ষস পিশাচ প্রভৃতি অদ্ভুত জীবগণের আভাষ পাওয়া যায়; এবং এটাও অনুমান করা হয় যে, সেই সকল নরহিংসাকারী জীবগণ হতে রক্ষা পাবার জন্য প্রাচীনগণ নানারকম মন্ত্রপূত মাদুলী ও রত্ন প্রভৃতি। ধারণ করতেন। কিন্তু মন্ত্রের প্রয়োগ যা-ই হোক, মন্ত্রের লৌকিক প্রয়োগ যে ভাবেই নিষ্পন্ন হোক, সে বিষয়ে অমাদের কোনই বক্তব্য নেই। আমরা তার অতিরিক্ত অন্য যে উচ্চভাব মন্ত্রের মধ্যে দেখতে পাই, আমাদের বঙ্গানুবাদে তা-ই প্রকাশ করেছি। এই প্রসঙ্গে একটি বিষয় বিশদীকৃত করা আবশ্যক মনে করি। শুদ্ধসত্ত্ব ও সঙ্কর্ম–এই উভয়ের মধ্যে কোটি মূল, তা নিয়ে অনেক সময় বিতণ্ডার উদয় হয়। বীজ বা বৃক্ষ-কোটি কোটির মূল, তা যেমন নির্দেশ করা দুরূহ, সৎ-ভাব ও সৎকর্ম সম্বন্ধেও সেইরকম। সৎকর্ম ভিন্ন সৎ-ভাবের উদয় হয় না; আবার সৎ-ভাব উন্মোষিত না হলে, সৎ-অসৎ বিচারশক্তি জন্মে না। অনেকে কর্মের প্রাধান্য খ্যাপন করেন, অনেকে আবার সৎ-ভাবকেই মূলীভূত বলে নির্দেশ করেন। তবে উভয়ই যে পরস্পর অভিন্ন সম্বন্ধ-বিশিষ্ট, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমরা সেই দৃষ্টিতেই অর্থ নিষ্পন্ন করেছি। ২।

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ অপাং তেজো জ্যোতিরোজো বলং চ বনস্পতীনামুত বীর্যাণি। ইন্দ্র ইবেন্দ্ৰিয়াণ্যধি ধারয়ামো অস্মিন তদ। দক্ষমাণণা বিভরদ্ধিরণ্যম ৷ ৩৷৷

 বঙ্গানুবাদ –শুদ্ধসত্ত্বসম্বন্ধি তেজঃশক্তি, জ্ঞানালোক, বীর্য, শক্তি এবং আত্মশক্তি সম্পন্নগণের শক্তি-সামর্থ্য, আমি যেন প্রাপ্ত হই; অপিচ ইন্দ্রশক্তিতুল্য মহাশক্তি আমি যেন ধারণ করতে সমর্থ হই। প্রসিদ্ধ সেই শুদ্ধসত্ত্বরূপ সৎকর্মসাধনসামর্থ্য আমাতে উপজিত হোক। (ভাব এই যে,আমি যেন আত্মশক্তিসম্পন্ন হই এবং সৎকর্ম-সাধনের সামর্থ্য লাভ করতে পারি) ॥ ৩॥

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –মানুষের মধ্যেই অনন্ত উন্নতির বীজ নিহিত আছে। সাধনার দ্বারা ভগবৎ-কৃপায় সেই শক্তিকে জাগরিত করতে পারলে জীবই শিব হয়ে ওঠে। ভগবানের করুণা-ধারা সমভাবে প্রবাহিত হচ্ছে। যাঁরা নিজেদের মধ্যে সেই করুণাধারা ধারণ করবার উপযুক্ত শক্তির বিকাশ করতে পারেন, তাঁরাই তা লাভ করেন। তাদের হৃদয়ে আপনা-আপনি শুদ্ধসত্ত্বের বিকাশ হয়। আবার উপযুক্ত ধারণা-শক্তি না জন্মালে, ভগবানের কোনও দানই স্থায়ী হয় না; তাই আত্মশক্তি-লাভের জন্য এই প্রার্থনা। আত্মশক্তি লাভ করলে মানুষ সহজেই নিজের গন্তব্য-পথে চলতে পারে। প্রচলিত ব্যাখ্যার সাথে আমাদের ব্যাখ্যার মিল নেই। তবে এই মন্ত্রের লৌকিক বিনিয়োগের ব্যাপারে আমাদের স্বীকৃতি আছে ৷ ৩৷৷

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ সমানাং মাসামৃতুভিষ্টা বয়ং সংবৎসরস্য। পয়সা পিপর্মি। ইন্দ্রাগ্নী বিশ্বে দেবাস্তেইনু মনস্তামহৃণীয়মানাঃ ॥৪॥

 বঙ্গানুবাদ –হে আমার মন! বৎসরের দ্বারা, মাসপরিমাণ কালের দ্বারা এবং ঋতুসমূহের দ্বারা পরিগণিত নিত্যকাল তোমাকে শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা যেন আমি পূর্ণ করতে পারি; (ভাব এই যে, নিত্যকাল যেন আমি শুদ্ধসত্ত্বভাবে পূর্ণ হই); বলৈশ্বর্যাধিপতি জ্ঞানদেব প্রমুখ সকল দেবতা প্রসন্ন হয়ে তোমার মঙ্গল বিধান করুন; (ভাব এই যে, আমি যেন সকল দেবভাব লাভ করতে পারি) ॥ ৪।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –ভাষ্যকারের মতে এই মন্ত্রের অর্থ দাঁড়ায় এই,মাস ঋতু প্রভৃতির দ্বারা পরিগণিত সম্বৎসর আমি তোমাকে গোধন ধান্য ইত্যাদির দ্বারা পূর্ণ করবো; ইন্দ্রাগ্নি প্রভৃতি বিশ্বদেবগণ অক্রোধ হয়ে তোমাকে অঙ্গীকার করুন। আমাদের মতে, গোধন ধান্যের কোনও প্রসঙ্গ মন্ত্রে নেই। পয়সা পদে আমরা শুদ্ধসত্ত্ব অর্থ গ্রহণ করেছি। মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। হৃদয়কে শুদ্ধসত্ত্বে পূর্ণ করবার জন্য প্রচেষ্টা এই মন্ত্রের মধ্যে পরিদৃষ্ট হয়। সকল দেবগণের আশীর্বাদ প্রার্থনাও এই মন্ত্রের মধ্যে আছে। সকল দেবতা আমার প্রতি প্রসন্ন হোন, সকলের মঙ্গল আশীর্বাদ আমার মস্তকে বর্ষিত হোক। সকলের অনুকম্পায়। অমি যেন জীবনের চরম সার্থকতা লাভ করতে পারি। এই ভাবের প্রার্থনাই মন্ত্রে দেখতে পাওয়া যায়। দেবতার কৃপাতেই হৃদয়ে দেবভাবের, শুদ্ধসত্ত্বের বিকাশ সম্ভবপর হয়। তাই মন্ত্রে হৃদয়ে সত্ত্বভাবের উদ্বোধনের প্রার্থনাও করা হয়েছে। ৪।

[ ইতি প্রথমং কাণ্ডং সমাপ্তম্]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *