1 of 3

০১।২ প্রথম কাণ্ড : দ্বিতীয় অনুবাক

দ্বিতীয় অনুবাক
প্রথম সূক্ত : যাতুননাশনম
[ঋষি : চাতন। দেবতা : অগ্নি ও ইন্দ্র। ছন্দ : অনুষ্টুপ, ত্রিষ্টুপ ]

প্রথম মন্ত্রঃ স্তুবানমগ্ন আ বহ যাতুধানং কিমীদীনং। ত্বং হি দেব বন্দিতো হন্তা দস্যোর্বভুবিথ। ১।

বঙ্গানুবাদ— হে জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব! আমাদের দেবার্চনাপরায়ণতা প্রদান করুন (আমাদের হৃদয়ে দেবভাব আনয়ন করুন); ইতস্ততঃ প্রচ্ছন্নভাবে বিচরণশীল শত্রুকে আপনি অপসারিত করুন। হে দ্যোতমান দেবতা! যেহেতু আপনি শত্রুর নাশকারী হন,–সেই হেতু আপনি সকলের বন্দনীয় হন ॥ ১৷৷

 মন্ত্ৰাৰ্থ আলোচনা— এই মন্ত্রের প্রতি পদের আলোচনা করলে মন্ত্রের নানা রকম অর্থ আমনন করা যেতে পারে। সায়ণের ভাষ্যেও নানারকম অর্থের আভাষ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রের স্তুবানং পদ উপলক্ষে তিনি তিনরকম অর্থ কল্পনা করেছেন।…অগ্নি পদও, তার ব্যাখ্যায়, নানা অর্থ নানা ভাব প্রাপ্ত হয়েছে। ব্যাপ্তি অর্থে তার নাম অগ্নি, অগ্রণী গুণহেতু তাঁর নাম অগ্নি, তাতে স্নেহভাব নেই বলে তার নাম অগ্নি ইত্যাদি। আমাদের কাছে অগ্নে অর্থে হে জ্ঞানস্বরূপ অগ্নি-ই সমীচীন মনে হয়েছে। যাতুধানং পদে সায়ণ রাক্ষসং প্রতিবাক্য গ্রহণ করেছেন। ভাব এই যে, যে রাক্ষসগণ যজ্ঞ নষ্ট করতো, ঐ পদে তাদের প্রতিই লক্ষ্য আছে। আবহ ক্রিয়াপদ উপলক্ষে এক অর্থে যজ্ঞক্ষেত্রে দেবগণকে আনয়ন-ভাব প্রকাশ পেয়েছে; অন্য অর্থে হিংসক রাক্ষসগণকে দণ্ড-প্রদানের জন্য আনয়ন করুন ভাব আনা হয়েছে। আমরা মনে করি, এখানে যাতুধানং বলতে মন্ত্রে অন্তরস্থিত শত্রুগণের প্রতিই লক্ষ্য আসে। তারা যেন বিস্তৃতি লাভ করতে পারে, তারা যেন দূরীভূত হয়, হৃদয় যেন দেবভাবে পরিপূর্ণ হয়ে আসে,-এটাই এ মন্ত্রের প্রার্থনার মর্মার্থ। ১৷৷

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ আজ্যস্য পরমেষ্ঠি জাতবেদস্তবশি। অগ্নে তৌলস্য প্রাশান যাতুনা বি লাপয় ॥ ২॥

বঙ্গানুবাদ –শ্ৰেষ্ঠস্থাননিবাসিন্ (শুদ্ধসত্ত্বভাবান্তবর্তি), জ্ঞানাধার, সকল প্রাণীশরীরে নিবাসি, হে অগ্নিদেব! আপনি আমাদের শ্রেষ্ঠ হবনীয়াংশ (বিশুদ্ধা ভক্তিকে) সৰ্থা গ্রহণ করুন, আর আমাদের শত্রুগণকে বিশেষরূপে বিনাশ করুন ॥ ২॥

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— এই মন্ত্রে পরমেষ্ঠি পদে স্বর্গ ইত্যাদি উৎকৃষ্ট স্থানের অধিবাসী অর্থ ভাষ্যকার নির্ধারণ করেছেন। এইভাবে তিনি আজ্যস্য পদে ঘৃতের ভাগ, জাতবেদঃ পদে যিনি বেদ জানেন, নূবাসিন অর্থে যিনি সকল দেহের মধ্যে অবস্থিত, তৌলস্য পদে সুক-সুবা ইত্যাদি অর্থ নিষ্পন্ন করেছেন। ইত্যাদি। কিন্তু একটু বিবেচনা করলে বোঝা যায়, এ ঋকের মধ্যে স্থূল-বস্তুর সাথে সম্বন্ধ আদৌ নেই। যিনি সকলের দেহের মধ্যে বিদ্যমান আছেন, যিনি জাবেদ অর্থাৎ সকল জ্ঞানের আধার-স্থান, স্থূল ঘৃতের দ্বারা তার কি উপাসনা করবে? আজ্যস্য পদের সাথে তৌলস্য পদের সম্বন্ধের বিষয় বিচার করলে সূক্ষ্মবিষয়ের সম্বন্ধই সংসূচিত হয়। আমরা তুলনার্থক তুল ধাতু থেকে তৌলস্য পদের ব্যুৎপত্তি স্বীকার করি। তাতে বোঝা যায়, যে হবনীয় তুলনায় শ্রেষ্ঠ বলে প্রতিপন্ন হয়, সেই হবনীয়ের প্রতিই লক্ষ্য রয়েছে।…..এখানে বলা হয়েছে-তুলনায় হৃদয়ের যে ভাব শ্রেষ্ঠ বলে প্রতীত হয়, হে দেব! আপনি আমার সেই ভাবটি মাত্র গ্রহণ করুন; হৃদয়ের আর যে আমার অন্যভাব আছে–অসৎ-ভাবসমূহ আছে–তাদের আপনি দূর করে দিন। ভাব এই যে, আমার বিশুদ্ধা ভক্তিটুকু আপনাতে ন্যস্ত থোক। যাতুধানদের বিনাশ করুন-এই বাক্যে বোঝা যায়, হৃদয়ের শত্রুদের হৃদয় হতে দূর করে দিন। ইত্যাদি। ২

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ বি লপন্তু যাতুনা অত্রিণো যে কিমীদিনঃ। অথেদমগ্নে নো হবিরিন্দ্রশ্চ প্রতি হতং। ৩৷৷

বঙ্গানুবাদ –হে জ্ঞানদেব! সেই সর্বভু, ভক্ষদ্রব্য অন্বেষণে ইতস্ততঃ বিচরণশীল, শত্রুগণ (রিপুগণ) আপনার দ্বারা বিনাশ-প্রাপ্ত হোক; শত্রুবিনাশের পর আমাদের হৃদয়স্থিত শ্রেষ্ঠ শুদ্ধসত্ত্বভাবকে লক্ষ্য করে, আপনি এবং আপনার ঐশ্বর্য-বিভূতি-সমূহ আমাদের প্রাপ্ত হোক। ৩।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –মনুষ্যখাদক রাক্ষসেরা যজ্ঞকারীদের ভক্ষণ করবার জন্য ইতস্ততঃ বিচরণ করতো। ভগবান্ অগ্নিদেব, তাদের সংহার করুন এবং তিনি ও ইন্দ্রদেব উভয়ে মিলিত হয়ে আমাদের প্রদত্ত হবিঃ গ্রহণ করুন-ভাষ্যানুসারে এটাই মন্ত্রের অর্থ হয়।–শব্দানুসারে মন্ত্রের অর্থ ঐরকমই বটে; কিন্তু ভাব অন্যরকম। মন্ত্রের মুখ্য অর্থ আধ্যাত্মিক-ভাবমূলক।কিমীদিনঃ অর্থাৎ ইতস্ততঃ সকলের হৃদয়ে, অলিণঃ অর্থাৎ সকল সৎ-বৃত্তি-ভক্ষণকারী যে যাতুধানাঃ অর্থাৎ শত্রুগণ বর্তমান রয়েছে, তাদের হনন না করলে, বিশুদ্ধ হবির (অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বভাবের) উন্মোয হয় না।…ভক্ত প্রার্থনা করছেন যে, ভগবান্ তার হৃদয়ের শত্রুগণকে একে একে নিঃশেষিত করুন। একে একে অসৎ-বৃত্তিগুলি তার হৃদয় হতে দূরীভূত করুন। তার হৃদয়ে সত্ত্বভাব জাগিয়ে তুলুন; আর সেই সত্ত্বভাবের মধ্যে সকল ঐশ্বর্য সহ আপনি বিরাজমান হোন। ৩।

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ অগ্নিঃ পূর্ব আ রভতাং প্রেন্দ্রো নুদতু বাহুমা। ব্রবীতু সর্বো যাতুমান্ অয়মষ্মীত্যেত্য। ৪

বঙ্গানুবাদ –জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেব, সর্বদেববর্গের অগ্রণী হয়ে, শত্ৰুসংহারে প্রবৃত্ত হোন; আর প্রচণ্ড বলশালী দেবরাজ ইন্দ্রদেব, শত্রুগণকে দূরীভূত করুন। দেবতার প্রভাবে বিধ্বস্ত হয়ে, শত্রুসেনানায়ক (দুর্বুদ্ধি ইত্যাদি) সকল শত্রুসেনা-সহ দেবতার সমীপে আগমন পূর্বক, আমি এই হই বলে (অর্থাৎ পরাজয় স্বীকার-পূর্বক) পলায়ন করুক। ৪

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –পদাবলি যে ভাবেই বিন্যস্ত থাকুক, এই মন্ত্রের তাৎপর্য সহজেই হৃদয়ে ধারণা করা যায়।-জ্ঞানই সর্ব-অপকর্ম-নিবারণে অগ্রণী-জ্ঞানই সকল পাপ দূরীকরণে প্রথম সহায়। জ্ঞানের উন্মেষ না হলে, কে শত্রু–কে মিত্র বুঝতে না পারলে, কিভাবে শত্রু দমিত ও মিত্র সংবর্ধিত হবে? তাই জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেবকে সকল দেবগণের অগ্রণী বলে অভিহিত করা হয়। জ্ঞানোদয়ের পরেই শক্তিসঞ্চয়। শক্তির রাজা-ইন্দ্রদেব। দৈবভাবের নায়ক তিনি; তাই তিনি দেবরাজ। জ্ঞানের উদয়েই দেবভাব প্রবল হয়। তখন, শত্রুসেনার নায়ক দুবুদ্ধিই বলো, আর মায়া-মোহই বলো, বিধ্বস্ত হতে থাকে।…তখন কোন্ রিপুর কোন্ কার্য, মানুষ তা বুঝতে পেরে একে একে এক এক শত্রুকে তাড়িয়ে দিতে পারে। আমরা মনে করি, প্রার্থনার ছলে, সেই নিগূঢ় তত্ত্বই এই মন্ত্রের মধ্যে বিধৃত রয়েছে। ৪

.

পঞ্চম মন্ত্রঃ পশ্যাম তে বীর্যং জাতবেদঃ প্র পো ক্ৰহি যাতুনা নৃচক্ষঃ। ত্বয়া সর্বে পরিতপ্তাঃ পুরস্তাৎ ত আ যন্তু প্রক্কবাণা উপেদং ॥৫॥

 বঙ্গানুবাদ— জ্ঞানের আধার হে দেব! আপনার শত্রুদমনের সামর্থ্য আমরা নিয়ত প্রত্যক্ষ করছি; হে সকল কর্মের দ্রষ্টা! আমাদের শত্রুগণকে দূরীভূত হবার জন্য আপনি আদেশ করুন; আপনার প্রভাবে সর্বৰ্থা পরিতপ্ত সেই শত্রুগণ, আপন আপন অপরাধ স্বীকার পূর্বক, এই সকর্মের সমীপে বা সৎ-জ্ঞানের সান্নিধ্যে বিনাশপ্রাপ্ত হোক ৫

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— এ মন্ত্রে পূর্ব-মন্ত্রের প্রার্থনাই দৃঢ়ীকৃত হচ্ছে। সাধনার পথে অগ্রসর হতে হতে সাধক দেখতে পান–জানতে পারেন–ভগবানের কি অপার মহিমা! তখনই তিনি বলতে পারেন,–হে ভগবন! আপনার বীর্য-সামর্থ্য এইবার আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। তারপর বলতে পারেন,–হে ভগবন্! আপনি যখন আমাদের সৎ-অসৎ সকল কর্মের দ্রষ্টা, আমাদের কোনও কর্মই যখন আপনার অ-দৃষ্ট নেই; তখন কাজেই বলতে হয়, শত্রুদের দূর করবার আজ্ঞা দিন। আপনার আজ্ঞা প্রচারিত না হলে, জ্ঞানবার্তা এক বিঘোষিত না হলে, তারা আপন অধিকার-স্থান পরিত্যাগ করতে বাধ্য হবে কেন? আপনার আদেশেই জ্ঞানের প্রভাব। জ্ঞানের প্রভাব বিস্তার হলেই শত্রুগণ পলায়ন করতে বাধ্য হবে।–মন্ত্রের শেষাংশ পূর্ববর্তী মন্ত্রেরই শেষাংশের দৃঢ় প্রতিধ্বনি। শত্রুগণ পরিতপ্ত হোক; আত্মদোষ খ্যাপন করুক; নিজেদের অপকর্মের ফুল নিজেরা উপভোগ করে নিজেরাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হোক। ইদং উপ এই যে দুটি পদ, এদের বিশেষ সার্থকতা দেখি।পাপ ভস্মীভূত হয়–কোথায়? পুণ্যের প্রভায়। দুস্কৃত বিনাশ-প্রাপ্ত হয়–কোথায়? সুকৃতের শাণিত খগাঘাতে। দুর্বুদ্ধি অপসারিত হয়–কোন্ সময়? সৎ-বুদ্ধি এসে যখন হৃদয় অধিকার করে। ঐ দুই পদ সেই তত্ত্ব ব্যক্ত করছে। এইভাবে বোঝা যায়, এই মন্ত্র সত্ত্বভাবের উদ্বোধক হয়ে ভক্তকে শত্রু-নাশের সন্ধান প্রদান করছে। ৫।

.

যষ্ঠ মন্ত্রঃ আ রভম্ব জাতবেদোহম্মাকার্থায় জজ্ঞিষে। দুতো নো অগ্নে ভূত্বা যাতুনা বি লাপয়। ৬।

বঙ্গানুবাদ –হে জ্ঞানাধার দেব! শত্ৰুসংহার-কার্যে ব্রতী হয়ে আমাদের ইষ্টসাধনের নিমিত্ত আপনি প্রাদুর্ভূত হয়ে থাকেন। হে জ্ঞানস্বরূপ দেব! আমাদের দূতস্বরূপ (সুহৃৎ) হয়ে, আপনি শত্রুদের বিনাশ করুন। ৬

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এই মন্ত্রে দুটি তত্ত্ব অনুধাবন করবার আছে। প্রথমতঃ, জ্ঞানের উদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই যে শত্রুইনন কার্য আরম্ভ হয়, মন্ত্রের প্রথমাংশে সেই তত্ত্ব পরিব্যক্ত। শত্রুদমনের সঙ্গে সঙ্গেই অগ্নিদেব জন্মগ্রহণ করেন। এরকম বাক্যের মর্মার্থই এই যে, জ্ঞানেনাদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই অজ্ঞানতা মোহান্ধকার দূরীভূত হয়। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশের শব্দগত অর্থ এই যে,–হে দেব! আমার পক্ষের দূত হয়ে গিয়ে তুমি শত্রুকে সংহার করে এসো। এখানকার অর্থে, এক পক্ষে এই ভাব প্রকাশ পায়; এখানে যেন বলা হচ্ছে,–আপনি দূতরূপে বিপক্ষের শিবিরে প্রবেশ করে গুপ্তভাবে শত্রুকে সংহার করে আসুন। যাঁরা অগ্নি প্রভৃতি দেবগণকে মনুষ্য-রপে কল্পনা করেন, তাদের মতে এই অর্থই সমীচীন বলে পরিগৃহীত হয়। কিন্তু পক্ষান্তরে এখানকার মর্ম অন্যরকম। এখানে বলা হচ্ছে যে, জ্ঞানের সাথে পরিচিত হওয়া মাত্রই অজ্ঞানতা বিনাশপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। হত্যাকার্য-সাধনের উদ্দেশে দূত শব্দ প্রয়োগের একটু বিশেষ সার্থকতা আছে। দূত নিরপেক্ষভাবে শত্রুর সন্নিহিত হয়ে তৎক্ষণাৎ বিনাযুদ্ধে শত্রুর বিনাশসাধনে সমর্থ হয়। সেইরকম, দ্বন্দ্ব উপস্থিত হওয়ার পূর্বেই জ্ঞানের দ্বারা অজ্ঞানতা প্রতিহত হয়ে থাকে। আলোক ও আঁধারের দৃষ্টান্তই এ ক্ষেত্রে সম্যকসমীচীন। আলোকের উপস্থিতি-মাত্রই অন্ধকার দূরে যায়। আলোক ও অন্ধকার কখনও একত্র যুগপৎ থাকতে পারে না ৷ ৬ ৷৷

.

 সপ্তম মন্ত্রঃ ত্বমগ্নে যাতুনা উপবা ইহাবহ। অথৈমিন্দ্রো বজ্রেনাপি শীর্ষাণি বৃশ্চতু। ৭

বঙ্গানুবাদ –জ্ঞানস্বরূপ হে অগ্নিদেব! আপনি আমার শত্রুগণকে (রিপুশত্রুগণকে) আবদ্ধ (সংযত) করে, এই যজ্ঞে আনয়ন করুন (এই কর্মে নিয়োগ করুন); আর, সেই দেবাধিপতি ইন্দ্র, তীক্ষ্ম বজ্রের দ্বারা তাদের মস্তক ছেদন করুন (পরে কর্ম-শক্তির দ্বারা তারা নাশ-প্রাপ্ত হোক) ৭

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –ভাষ্যানুসারে এই ঋকের মর্ম এই য়ে,–হে অগ্নি! আপনি রজু প্রভৃতির দ্বারা রাক্ষসদের হস্ত-পদ ইত্যাদি অবয়ব বন্ধন করে এই দেশে আনয়ন করুন; দেবতাদের অধিপতি ইন্দ্রদেব, সেই রাক্ষসদের মস্তক বজের দ্বারা ছেদন করুন। এই অনুসারে নানা উপ্যাখ্যানের ও প্রত্নতত্ত্বের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হতে পারে। রাক্ষসেরা ঋষিদের যজ্ঞ নষ্ট করতো; সেইজন্য ঋষিরা যেন অগ্নিকে বা রাজসেনাপতিকে বলছেন,–আপনি ঐ রাক্ষসদের বেঁধে আনুন; পরিশেষে রাজা তাদের মস্তক ছেদন করবেন! শত্রু নিপাত হলে, আমরা সুখস্বচ্ছন্দে যজ্ঞকার্যে সমর্থ হবো। প্রত্নতত্ত্বের পক্ষে এ মন্ত্রের অর্থ হয়, –অনার্যের বা দস্যুর উৎপীড়নে ভারতবর্ষে নবাগত আর্যগণ বড় বিপন্ন হয়ে পড়েন। তাঁরা তখন ঐ মর্মের বাক্যে অগ্নিকে সম্বোধন করে বলেছিলেন। আমরা কিন্তু মন্ত্রটিকে সাধারণ দৃষ্টিতে দর্শন করি। এখানে প্রথমে জ্ঞানের দ্বারা রিপুশত্রুদের দমন করাবার বিষয় বলা হয়েছে। রিপুদের দমিত সংযত করে কার্যে প্রবৃত্ত করাতে পারলে, ভগবান্ আপনিই তাদের বিনষ্ট করেন, তারা আপনা আপনিই তখন আত্ম-প্রবৃত্তি ত্যাগ করে সম্মার্গে সৎকর্মে প্রধাবিত হয়। একটি দৃষ্টান্তের দ্বারা বিষয়টি বোঝাবার চেষ্টা করা যাচ্ছে।–কাম (কামনা) একটা প্রবল রিপু। তার দ্বারা যে কত অপকর্ম সাধিত হতে পারে, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু ঐ কামকে যদি জ্ঞানের দ্বারা রজ্জবদ্ধ অর্থাৎ সংযত করে কর্মে নিয়োগ করতে পারি, তাতে অশেষ সুফল প্রাপ্ত হওয়া যায়। মনে করুন–কামনা যদি পরোপকারে বা পরসেবায় আসে, কামনা যদি বিপন্নের বিপদ-উদ্ধারে বিনিযুক্ত হয়, কামনা যদি ভগবানের প্রতি অচলা থাকে, তাতে কিরকম শ্রেয়ঃ সাধিত হতে পারে! তারই পরবর্তী অবস্থার বিষয় মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে বিস্তৃত রয়েছে। পূর্বোক্তরূপ কামনার বা কামনামূলক কর্মের। ফলে নিষ্কাম কর্মের সূচনা হয়। নিষ্কাম-কর্মই সে ক্ষেত্রে মুক্তির প্রকৃষ্ট সোপান হয়ে দাঁড়ায়। তুমি তোমার। রিপুগণকে সংযত করো এবং ক্রমশঃ সকার্যে বিনিযুক্ত করো। তোমার শ্রেয়েলাভ আপনিই সাধিত হবে। এটাই মন্ত্রের উপদেশের মর্মার্থ। ৭

.

দ্বিতীয় সূক্ত : যাতুধাননাশনম্

[ঋষি : চাতন দেবতা : বৃহস্পতি অগ্নীষোম ছন্দ : অনুষ্টুপ, ত্রিষ্টুপ]

প্রথম মন্ত্রঃ ইদং হবির্যাতুনা নদী ফেনমিবাবহৎ। য ইদং স্ত্রীপুমানকরিহ স স্তুবং জনঃ ॥ ১।

বঙ্গানুবাদ –আমাদের অনুষ্ঠিত এই পূজা (হবিঃ), তরঙ্গিণী যেমন আপন প্রবাহের দ্বারা ফেনপুঞ্জকে মহাসমুদ্রে বহন করে নিয়ে যায়, সেইরকম আমাদের রিপুশত্রুগণকে সম্যকারে ভগবৎ সমীপে নিয়ে যাক (অর্থাৎ ভগবকার্যে সকার্যে নিযুক্ত করুক); স্ত্রী বা পুরুষ, যে জন এই ই রকম হবনীয় (পূজা) করে (করতে পারে), সেই জনই প্রকৃত ভগবৎপূজাপরায়ণ হয়ে থাকে। ১।

মন্ত্ৰাৰ্থ আলোচনা –ভাষ্য-ভাবে বোঝা যায়, এই মন্ত্রে যেন অভিচার কর্মের বিষয় বিবৃত হয়েছে। প্রথমে বলা হচ্ছে,-হে আজ্য (মন্ত্রঃপূত ঘৃত)! এই রাক্ষস পিশাচ ইত্যাদিকে তুমি দূরীকৃত করো। তরঙ্গিণী যেমন ফেনাকে দেশ-দেশান্তরে নিয়ে যায়, এই শত্রুদেরও সেইরকম অন্যত্র নিয়ে যাও। তারপরে বলা হয়েছে–যে পুরুষ বা যে স্ত্রী এইরকম আভিচারিক হবিঃ শত্ৰুকৃত উপদ্রব-নিবারণের উদ্দেশে বিহিত করেন, অগ্নি ইত্যাদি দেবের কৃপায় তারা নিরুপদ্রবে তাদের সেবাপরায়ণ থাকেন। শত্রুনাশ-কামনায় আভিচারিক ক্রিয়ার অনুষ্ঠান করে যে সুফল লাভ করা যায়,-এক পক্ষে এটাই মন্ত্রের তাৎপর্য।–এখন, আমরা যে দিক দিয়ে যে অর্থের অধ্যাহার করলাম, তার মর্ম প্রকাশ করছি। মন্ত্রে আছে,নদীফেনমিব। এতে ফেনকে নদী যেমন দেশদেশান্তরে নিয়ে যায়–এই অর্থ প্রকাশ করে। আমরা কিন্তু দেশ দেশান্তর না বলে মহাসমুদ্রে নিয়ে যায়–এমন অর্থই সঙ্গত বলে মনে করলাম। তাতে উপমার উপযোগিতাই প্রতিপন্ন হয়। আমার হবিঃ বা পূজা, ভগবানের নিকট যেন আমার বিপুশত্রুগণকে পৌঁছিয়ে দেয়; কাম ইত্যাদি বিপু ভগবৎ-কর্মে নিযুক্ত হোক,–এটাই মন্ত্রের প্রথম অংশের মর্ম।…ফলতঃ, মনোবৃত্তিসমূহ, কাম ইত্যাদি রিপুগণ, সৎপথে পরিচালিত হোক। তারাই আমায় শ্রেয়ঃ লাভ করাবে,তাদের দ্বারাই আমার মুক্তিপথের সকল আশঙ্কা বিদূরিত হবে। এটাই মর্মার্থ। ১।

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ অয়ং স্তুবান আগমদিমং স্ম প্রতি হত। বৃহস্পতে বশে লবন্ধাগ্নীষোমা বি বিধ্যতং ॥ ২॥

বঙ্গানুবাদ –হে দেবগণ! এই শত্রুপীড়িত রিপুনির্যাতনগ্রস্ত জন আপনাদের পূজাপরায়ণ হয়ে অনুগ্রহ-প্রাপ্তির নিমিত্ত অগ্রসর হয়েছে; সেই অর্চনা-পরায়ণ জনকে আপনার বলে গ্রহণ করুন। হে দেবশ্রেষ্ঠ বৃহস্পতি! আপনার অর্চনাপরায়ণ জনের প্রতি উপদ্রবকারী শত্রুদের আপনার আয়ত্তাধীন করে অর্চনাকারীকে রক্ষা করুন। হে একাধারে কঠোর-কোমল-ভাবাপন্ন অগ্নি ও সোম নামক যুগ্ম দেবদ্বয়! আপনারা বিপরীত-মার্গগামী উপদ্রবকারী বৈরিগণকে বিতাড়িত করুন। ২।

মন্ত্রাৰ্থআলোচনা –এই মন্ত্রে তিন রকম প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে। সে প্রার্থনা তিন শ্রেণীর দেবতার নিকট তিন রকমে প্রকাশ পেয়েছে। প্রথম–সমস্ত দেবগণকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে–হে দেবগণ! আপনাদের অর্চনাকারী এই আমাদের মধ্যে আপনাদের সকল প্রকার বিভূতির সমাবেশ হোক।.. মর্ম এই যে,-সকল দেবভাবের আমরা যেন অধিকারী হই; দেবগণের অঙ্কে আমাদের যেন স্থান হয়। শত্ৰুনিপীড়িত নির্যাতনগ্রস্ত জনের এমন প্রার্থনাই সঙ্গত। দ্বিতীয় প্রার্থনা–বৃহস্পতি দেবতার নিকট। বৃহস্পতির পরিচয়ে ভাষ্যকারই বলেছেন–সকল দেবতার (বা দেবভাবের) রক্ষাকর্তাই এখানে বৃহস্পতি নামে অভিহিত হয়েছেন। তার নিকট প্রার্থনা জানানো হলো–হে সকল দেবের সংরক্ষক! আমার শত্রুদের আপনার আয়ত্তাধীন করে আপনি আমাকে রক্ষা করুন। এই স্থলে শত্রুদের একেবারে মেরে ফেলার প্রার্থনা জানানো হলো না। বলা হলো,-তাদের বশে রেখে আমাদের শ্রেয়ঃ সাধন করুন। এর তাৎপর্য এই যে, ইহ সংসারে কাম ইত্যাদি রিপুর একেবারে বিসর্জন–দূরের (উচ্চ স্তরের) বিষয়। প্রথমে, তারা যাতে ভগবৎপদাঙ্কানুসারী হয়, তারই চেষ্টা পেতে হবে। তারপর, তারা ক্রমশঃ লয়প্রাপ্ত হবে। প্রথম সূক্তের সপ্তম মন্ত্রে এ প্রসঙ্গের আভাষ আছে।উপসংহারে মন্ত্রের তৃতীয় প্রার্থনা–অগ্নীযোম দেবদ্বয়ের নিকট। ঐ যুগ্ম দুই দেবতায় দুই ভাবের দ্যোতনা করে। অগ্নি-জ্ঞানমূর্তি-তীব্ৰতেজঃসম্পন্ন–দীপ্তিমন্ত। সোম-স্নিগ্ধমূর্তি আবরক-স্নেহভাবের দ্যোতক। একপক্ষে জ্বালামালার ভাব; পক্ষান্তরে স্নিগ্ধতা-দানের ভাব। এ পক্ষে নিগূঢ় আলোচনায় বোঝা যায়, এখানে যেন বলা হচ্ছে-হে কঠোর-কোমল-ভাবাপন্ন দেবযুগল! আপনারা কঠোর-শাসনে আমার রিপুশত্রুদের সন্ত্রস্ত করুন। তারা দমিত বা বিমর্দিত হলে, স্নেহভাবের পোষণে যেন কার্য করে,–এটাই প্রার্থনার ভাব। দুর্দান্ত ও সদা অসৎকার্যে বিনিযুক্ত রিপুগণ অগ্নি-শক্তির দ্বারা স্থির থোক; সোম-শক্তির দ্বারা তারা সুপথে পরিচালিত হোক;- এখানকার এটাই তাৎপর্য।–কেউ কেউ এ মন্ত্রে আর্য-অনার্যের যুদ্ধের সংস্রব আনতে পারেন। সে দিকের অর্থে, দেবগণ কর্তৃক শত্রু থেকে আর্যদের রক্ষার কথা, সেনাপতি বৃহস্পতি কর্তৃক শত্রুদের আয়ত্তাধীন করা এবং অগ্নি ও সোম বা অগ্নীষোম কর্তৃক শত্রুদের বিতাড়ন,–প্রভৃতি অর্থই অধ্যাহৃত হয় ॥ ২॥

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ যাতুনস্য সোমপ জহি প্ৰজাং নয়স্ব চ। নি স্তুবানস্য পাতয় পরমবরং ॥ ৩॥

বঙ্গানুবাদ— হে সোমপ (শুদ্ধসত্ত্বভাবগ্রহণশীল দেব)! আপনি রিপুশত্রুদের (অথবা তৎসংক্রান্ত অসম্ভাব-পরম্পরাকে) নাশ করুন; আপনার অনুগত জনকে (আমাকে) অভিমত ফল দান করুন (আমার ইষ্ট সাধিত হোক); স্তবপরায়ণের (আমার) শ্রেষ্ঠ দর্শন লাভ হোক (আপনার অৰ্চনাকারীকে পরম পদার্থের দর্শনশক্তি প্রদান করুন); আর, নিকৃষ্ট শত্রুকে নিঃশেষে বিনাশ। করুন ॥ ৩ ৷৷

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— ভাষ্যানুসারে এ মন্ত্রের প্রথমাংশের অর্থ-হে সোমরসপানশীল অগ্নিদেব! আপনি রাক্ষসদের পুত্রপৌত্র ইত্যাদি নাশ করুন; অথবা আমাদের প্রতি উপদ্ৰবকারী রাক্ষসকে হনন করুন। আর আমাদের অভিমত ফল প্রদান করুন, আমাদের অনিষ্ট দূর করে আমাদের ইষ্ট-প্রাপ্তির ব্যবস্থা করুন। সেই অনুসারে দ্বিতীয় অংশের অর্থ–আর, ভীত হয়ে যে শত্রু আপনার স্তুতিপরায়ণ হয়েছে, সেই শত্রুর L উৎকৃষ্ট দক্ষিণ চক্ষুঃ এবং নিকৃষ্ট বাম চক্ষুঃ স্বস্থানচ্যুত অর্থাৎ উৎপাটিত করুন। শত্রু বিনষ্ট হোক। ইত্যাদি। –আমাদের অর্থ কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। আমরা যাতুধানদের প্রজা বলতে, রিপুগণ হতে উৎপন্ন অসৎ-ভাবসমূহ অর্থ গ্রহণ করলাম। রিপুগণ এবং তাদের সম্বন্ধীয় অসৎ-ভাব বা কুকাৰ্য-পরম্পরা নাশ প্রাপ্ত হোক–আমরা মনে করি, এটাই এক প্রার্থনা। দ্বিতীয় প্রার্থনা,–আপনার অনুগত আমায় ইষ্টদান করুন। মন্ত্রের দ্বিতীয় পংক্তির স্তুবানস্য পদে রাক্ষসদের মধ্যে যারা আপনার স্তুতিপরায়ণ হয়–এ অর্থ না ধরে, আমরা আপনার স্তবপর অর্চনাকারী অর্থ গ্রহণ করলাম। স্তুবানস্য অর্থাৎ স্তবকারীর দক্ষিণ ও বাম দুই চক্ষু উৎপাটন করে নাও-এ অর্থও আমরা সঙ্গত মনে করি না। মন্ত্রের দ্বিতীয় পংক্তিতে আমরা দুটি প্রার্থনা দেখি। প্রথম, অর্চনাকারীকে (আমাকে) পরমার্থ-দর্শনশক্তি দিন; দ্বিতীয়, নিকৃষ্ট যে শত্রু, তাকে বিনষ্ট করুন। অথবা আপনার কৃপায় সাধু পরিত্রাণ লাভ করুক; অসাধুর সংহার সাধিত হোক ৷ ৩৷৷

.

চতুর্থ মন্ত্র: যত্রৈমগ্নে জনিমানি বেথ গুহা সমত্রিণাং জাতবেদঃ। তাংস্তুং ব্ৰহ্মণা বাবৃধানো জহ্যেষাং শততহমগ্নে ॥ ৪

বঙ্গানুবাদ— জ্ঞানোৎপন্ন জ্ঞানস্বরূপ হে অগ্নিদেব! নিভৃত-হৃদয়কন্দরে আশ্রয়প্রাপ্ত শুদ্ধসত্ত্বভাবগ্রাসকারী এই রিপুশত্রুগণ যে স্থানে অবস্থিতি করে এবং যেভাবে উৎপন্ন (বৃদ্ধিপ্রাপ্ত) হয়, আপনি তা অবগত আছেন। হে অগ্নিদেব! মন্ত্রশক্তির প্রভাবে আপনি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে (আমাদের অর্চনায় প্রকাশমান হয়ে), আপনি সেই শত্রুদের সংহার করুন এবং সেই শক্রকৃত অশেষপ্রকার হিংসা নাশ করুন। ৪

মন্ত্ৰার্থআলোচনা ভাষ্যানুসারে এই মন্ত্রের মর্মার্থ এই যে,-নরভু রাক্ষসেরা যে নিভৃত গিরিগুহায় লুক্কায়িত থাকতো, অগ্নিদেব তা অবগত ছিলেন। তাই, তার নিকট প্রার্থনা করা হচ্ছে,–আপনি মন্ত্রের দ্বারা (আভিচারিক শক্তির দ্বারা) বর্ধিত-বল হয়ে, আপন স্থানে অধিষ্ঠিত সেই রাক্ষসগণকে নাশ করুন এবং তারা আমাদের প্রতি যে শতপ্রকার হিংসা করে, তা নিবৃত্ত করুন। এরকম ভাষ্যাভাষে আর্য-অনার্যের দ্বন্দ্বের বিষয় অথবা ঋষিদের যজ্ঞনাশকারী রাক্ষসদের দমনের প্রশ্নই মনে আসে। সে পক্ষে, অগ্নিকে সেনাপতি অথবা আভিচারিক ক্রিয়াপরায়ণ বলে মনে করা যায়। আমরা যে পথ অনুসরণ করে অর্থ নিষ্পন্ন করছি, তাতে আধ্যাত্মিক পক্ষে সুষ্ঠু-সঙ্গত ভাবই প্রাপ্ত হওয়া যায়। গুহা সতাং পদে পর্বতের গুহায় লুক্কায়িত থাকার ভাব গ্রহণ না করে, আমরা হৃদয়-রূপ গুপ্ত-গৃহের অভ্যন্তরে অবস্থিত অর্থই সঙ্গত বলে মনে করি। এই মন্ত্রের একটি পদ–অত্রিণাং। সায়ণ এখানে অত্রি ঋষির সম্বন্ধ-সূচনা করেননি। তিনি ঐ পদের নরভু অর্থ গ্রহণ করেছেন। আমরা তা না করে ঐ পদের শুদ্ধসত্ত্বভাবগ্রাসকারী অর্থেরই সমীচীনতা দেখি। রিপুশত্রুগণ হৃদয়ের নিভৃত গুহাতে উৎপন্ন ও পরিপুষ্ট হয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাবকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এমন কি, তাদের ধর্মই এই–তারা সৎ-ভাবনিচয়কে গ্রাস করবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করে থাকে। আমরা যখন তা জানতে সমর্থ হই, তখনই কাতরভাবে জ্ঞানস্বরূপ দেবতার শরণাপন্ন হয়ে থাকি। পরে, সাধনার প্রভাবে শুদ্ধসত্ত্বজ্ঞান অধিকৃত হলে–জ্ঞানাগ্নির জ্যোতিতে আমরা শত্রুর প্রকৃত অবস্থা ও শক্তি-সামর্থ্যের বিষয় দেখতে পাই ও জানতে পারি।তখন মন্ত্র-শক্তির প্রভাবে, ভগবৎ-অর্চনার ফলে, জ্ঞান প্রকাশ পায়; তাতে শত্রু নাশপ্রাপ্ত হয়, শত্ৰুকৃত শত-সহস্র প্রকার উপদ্রব বিদূরিত হয়ে থাকে। এই যে সরল সত্য দার্শনিক তত্ত্বমন্ত্রের মধ্যে সেটাই বিবৃত রয়েছে,-হে জ্ঞানাধার ভগবন্! আমাকে জ্ঞান দাও; আমি যেন শত্রুদের চিনতে পারি। আমায় শক্তি দাও; আমি যেন তাদের দূরীভূত করতে সমর্থ হই,–আমার নিকট তাদের প্রভাব যেন আদৌ কার্যকরী না হয়।–প্রার্থনা-পক্ষে মন্ত্রের নিগূঢ় মর্ম এটাই ॥৪॥

.

তৃতীয় সূক্ত : বিজয়ায় প্রার্থনা

[ঋষি : অথর্বা দেবতা : বসব, ইন্দ্র, পূষা, বরুণ, ইন্দ্র, অগ্নি ইত্যাদি ছন্দ : ত্রিষ্টুপ]

প্রথম মন্ত্রঃ অম্মি বসু বসবো ধারয়ন্ত্ৰিন্দ্ৰঃ পূষা। বরুণো মিত্রো অগ্নি। ইমমাদিত্যা উত বিশ্বে চ দেবা উত্তরস্মিন জ্যোতিষি ধারয়ন্তু ॥১॥

বঙ্গানুবাদ –নিবাসহেতুভূত দেবগণ, পরমেশ্বর্যশালী দেব, পোষণকারী দেবতা, অভীষ্টবর্ষী দেবতা এবং বিপদে উদ্ধারকারী দেব, প্রার্থনাকারী এই আমাতে (আমাকে) ধন (পরমার্থ) স্থাপন (প্রদান) করুন। অপিচ; অনন্তের অংশভূত অনন্তস্বরূপ আদিত্য-নামক দেবগণ এবং দ্যোতমান দেববিভূতিসকল, প্রার্থনাকারী এই আমাকে অতিশয় উৎকৃষ্ট জ্যোতিতে (পরব্রহ্মে) স্থাপিত করুন। (অর্থাৎ আমি যেন দেবানুগ্রহে পরব্রহ্ম লাভ করতে সমর্থ হই) ॥ ১।

মন্ত্রাৰ্থ আলোচনা –উপক্রমণিকায় দেখতে পাওয়া যায়,অস্মিন্ বসু ইত্যাদি মন্ত্রবিশিষ্ট সূক্ত, নানা কার্যে ব্যবহৃত হয়। এর দ্বারা সকলরকম সম্পত্তিকামেচ্ছু ব্যক্তি বাসিত কৃষ্ণলমণিদ্বয় (নীলা) ধারণ করবে এবং অন্নের মধ্যে পুরুষের আকৃতি লিখে সেই অন্ন ভোজন করবে। এস্থলে বাসিত শব্দের অর্থ– এয়োদশী ইত্যাদি তিথিত্রয়ে দধি ও মধু-পূর্ণ পাত্রে মণি (নীলা) প্রক্ষেপ করে রেখে তার পরদিবস অর্থাৎ চতুর্থ দিনে সেই মণিবন্ধন। শত্রু কর্তৃক রাজ্যচ্যুত রাজার পুনরায় স্বরাজ্যে প্রবেশের নিমিত্ত এই সূক্তমন্ত্রের দ্বারা অভিমন্ত্রিত অন্ন ভোজন আবশ্যক। আয়ুষ্কাম ব্যক্তি যুগ্মকৃঞ্চল-মণি স্থালীপাকে প্রক্ষেপ করে এই সূওমন্ত্রের দ্বারা সেই মণিবন্ধন ও স্থালীপাক-উদ্ভব অন্ন ভোজন করবেন। উপনয়ন-কর্মে মাণবকের। অনুমন্ত্রণ বিষয়েও এই সূক্ত বিনিযুক্ত হয়। ঐরাবতী নামক মহাশান্তিতে, বাৰ্হস্পতি নামক মহাশান্তিতে এবং পুষ্পভিষেক কর্মে এই সূক্তের বিনিয়োগ হয়ে থাকে।–সূক্তের এই প্রথম মন্ত্রটির ব্যাখ্যা-প্রসঙ্গে ভাষ্যকার সায়ণ বলেন, এই সর্বসম্পদ ইত্যাদিকামী ব্যক্তিতে, নিবাসহেতুভূত বসুগণ অভিলষিত ধন স্থাপন করুন। কেবল যে বসুগণই ধন স্থাপন করবেন, তা নয়; পরন্তু, পরমেশ্বর্যযুক্ত দেবগণের অধিপতি ইন্দ্রদেব, পোষণকারী পূষাদেব, সকল জগৎকে নিগৃহীত করবার নিমিত্ত পাশজালের দ্বারা ব্যাপ্তকারা রাত্রির অধিষ্ঠাতা বরুণদেব, সকলকে মরণ হতে ত্রাণ করেন বলে মিত্ৰনামক দিবসের-অধিষ্ঠাতা দেব এবং ইন্দ্র দেববৃন্দের অগ্রণী অগ্নিদেবও এই পুরুষে ধন স্থাপন করুন। অপিচ, অদীনা দেবমাতা, তার পুত্র-ধাতা অর্যমা ইত্যাদি আদিত্যগণ এবং অন্য সমস্ত দেবগণ, এই পুরুষকে উৎকৃষ্টতর তেজের মধ্যে স্থাপন করুন। ভায্যের প্রতি দৃষ্টি করলে এই সূক্তের এবং সূক্তের অন্তর্গত এই প্রথম মন্ত্রের এইরকম অর্থই অবগত হওয়া যায়। আমরা ইন্দ্র ইত্যাদি দেবনামের পূর্বাপর যেভাবে অর্থ-সঙ্গতি রক্ষা করে এসেছি, ভাষ্যকার এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা-প্রসঙ্গে সেই সমস্ত দেব-নামের অর্থ সেইরকমই গ্রহণ করেছেন।–সায়ণ-ভায্যে প্রায় সর্বত্রই দেবগণে ব্যক্তিত্ব আরোপিত দেখি। কোনও কোনও দেবতা-বিষয়ে, তাদের মাতা-পিতা পর্যন্ত তিনি কল্পনা করেছেন। পুরাণে রূপকের মধ্যে ঐ সকল বিষয় বিবৃত আছে। সেই সকল স্থলে ভাষ্যকারকে তারই অনুসরণকারী বলা যেতে পারে। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত ফল ফলেছে। বেদের কদর্থকারিগণ তা দর্শন করে দেবতায় ব্যক্তিত্ব আরোপ করে বেদ-বাক্যের নিত্যত্ব ইত্যাদিতে বিঘ্ন ঘটিয়েছেন। এক একটি মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত ভগবানের এক একটি বিভূতির বিকাশ, এ কথা আমরা পূর্বেই বলেছি। এখানে, ভাষ্যকার প্রত্যেক ভগবৎ-বিভূতির–এক একটি কার্যকারণ ইত্যাদি, শাস্ত্রান্তর হতে প্রমাণ উধৃত করে সপ্রমাণ করেছেন। মন্ত্রের প্রথমেই অস্মিন্ একটি পদ। অস্মিন্ বলতে অন্য একটি বিশেষ পদকে আকাঙ্ক্ষা করে। মন্ত্রে তার কোনও উল্লেখ নেই। ভাষ্যকার, সর্বসম্পদাদিফলকামে জনে পদ অধ্যাহার করেছেন। আমরা এ মন্ত্রটি, সাধকের নিজের প্রার্থনার বেদক বলে, ঐ পদে প্রার্থনাকারিণী ময়ি পদ উহ্য করেছি। তাতে প্রার্থনার ভাবে মন্ত্রের প্রথমাংশের অর্থ হয়–নিবাসহেতুভূত দেবগণ, পরমৈশ্বর্যশালী দেব, পোষণকারী দেবতা, অভীষ্টবর্ষী দেবতা এবং বিপদ-উদ্ধারকারী দেবতা, প্রার্থনাকারী আমাকে পরমার্থ ধন প্রদান করুন। এ অপেক্ষা দেবতার নিকট উচ্চ প্রার্থনা আর কি হতে পারে? অতঃপর মন্ত্রের শেষাংশে উক্ত প্রার্থনার সামঞ্জস্য রক্ষিত হলো। এই অংশে তিনি মুক্তি–ভগবৎসাযুজ্য প্রার্থনা করছেন। তাঁর প্রার্থনা–এখানে সমস্ত দেবভাবের নিকট। প্রথম অংশের মতো এখানে এক একটি দেবতার কাছে প্রার্থনা জ্ঞাপন করলেন না; তার প্রার্থনা–এখানে সমস্ত দেবভাবের নিকট। অর্থাৎ তার দেবতাতে ভেদজ্ঞান অপসৃত হয়েছে। তিনি জেনেছেন-সকল দেবতাই তো ভগবানের বিভূতি। তাই সকল দেবতার কাছে তার প্রার্থনা–হে দেবগণ! হে অনন্তাংশসস্তৃত অনন্তস্বরূপ আদিত্যগণ! প্রার্থনাকারী আমাকে পরব্রহ্মে মিশ্রিত করুন। আপনাদের অনুগ্রহে আমি যেন পরব্রহ্মে মিলিত হই। আমরা এই মন্ত্রে এমনই প্রার্থনা লক্ষ্য করছি। ১।

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ অস্য দেবাঃ প্রদিশি জ্যোতিরস্তু সূর্যো অগ্নিরুত বা হিরণ্যং। সপত্না অম্মদধরে ভবন্ত্তমং নাকমধি রোহয়েমং ॥ ২॥

 বঙ্গানুবাদ –হে সর্বদেবগণ (ভগবৎ-বিভূতিনিবহ)! আপনাদের অনুজ্ঞার প্রভাবে এই প্রার্থনাকারীর (আমার) হৃদয়ে দেবভাবের সঞ্চার (জ্ঞানের উন্মেষ) হোক; সর্বপ্রকাশক সূর্য, অঙ্গনাদিগুণবিশিষ্ট সর্বত্র পরিব্যাপ্ত অগ্নি এবং সুবর্ণ ইত্যাদি ঐশ্বর্য (স্নিগ্ধদ্যুতি), এই প্রার্থীকে (আমাকে) সুখ প্রদান করুন; শত্রুগণ এই অর্চনাকারীর (আমার) নিকট নিকৃষ্ট (উপক্ষীণ) হোক; এই প্রার্থনাকারীকে (আমাকে) শ্রেষ্ঠ-সুখ-স্থানে অধিরোহণ করিয়ে দিন। (সে অর্থাৎ আমি যেন, পরম সুখ প্রাপ্ত হই)। ২

মন্ত্ৰাৰ্থআলোচনা –এই মন্ত্রটি গ্রামাদি ফলের কামনায় ইন্দ্রদেব-সকলের উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত হয়েছিল, ভাষ্যাভাষে তা-ই প্রকাশ আছে। সেই অনুসারে এই মন্ত্রের সাথে পুরাবৃত্তের সম্বন্ধ আছে মনে করা যায়।–আমরা কিন্তু মন্ত্রটিকে নিত্যপ্রার্থনামূলক বলেই মনে করি। আমরা দেখছি, মন্ত্রে তিন রকম প্রার্থনা বিদ্যমান। প্রথম–প্রার্থী দেবভাবের যাচ্ঞা করছেন; বলছেন–হে দেববিভূতিনিবহ! আপনাদের জ্যোতিঃ আমার মধ্যে বিচ্ছুরিত হোক; আমি যেন দেবভাবের অধিকারী হতে পারি। জ্যোতিঃ–অর্থাৎ প্রকারান্তরে জ্ঞানোন্মেষেরই প্রার্থনা। মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে, সেই জ্যোতিঃ বা জ্ঞানোন্মেষ যে কিভাবে সংঘটিত হবে, প্রার্থীর আকাঙ্ক্ষা যে কত উচ্চ, তা-ই ব্যক্ত হচ্ছে। প্রার্থী বলছেন,–সূর্যের, অগ্নির এবং হিরণ্যের জ্যোতিঃ যেন আমাতে সমাবেশ হয়। এখানে, তিনটি শব্দে তিনরকম ভাব জ্ঞাপন করছে। সূর্যের জ্যোতিঃ আমাকে দাও,–এ রকম প্রার্থনার মর্ম এই যে,-আমি যেন আত্মজ্ঞানে পরমাত্মার স্বরূপ প্রাপ্ত হই; আমার জ্ঞানে যেন পারিপার্শ্বিক সকলেই জ্ঞানী হয়। সাধনার উচ্চস্তরে উপনীত সাধক এইভাবে নিজেও উদ্ধার পান, অপরকেও উদ্ধার করেন। অগ্নির জ্যোতিঃ চাওয়ার অর্থ হলো,-আমাতে বিস্তৃত হয়ে সে জ্ঞান–সে দেবভাবুনিবহ–সর্বত্র ওতঃপ্ৰোতঃ বিস্তৃত হোক। এই হেন উদার বিশ্বজনীন প্রেমের ভাবে অন্বিত প্রার্থনাতেও যেন তৃপ্তি হলো না। পুনরায় প্রার্থনা জানানো হলো–যেন অগ্নির জ্যোতিরূপে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকলের মধ্যে সে দেবভাব (সে জ্ঞান) বিস্তৃত হয়ে পড়ে। অবশেষে হিরণ্যং পদ। ঐ পদে প্রধানতঃ স্নিগ্ধতার ভাব মনে আসে। জ্যোতির-দীপ্তির ঔজ্জ্বল্যে, যেন নয়ন ঝলসিয়ে না যায়,–যেন হৃদয় প্রপীড়িত। না হয়। স্নিগ্ধতার সাথে-তৃপ্তির সাথে, দেবভাবের দীপ্তি যেন হৃদয়ে উদ্ভাসিত হয়। যেন সহনীয় মনোমদভাবে হৃদয় দেবত্বে আকৃষ্ট হতে পারে। এটাই এই প্রার্থনার মর্ম। হিরণ্যং বলতে, সুবর্ণ ইত্যাদির দ্যুতি বোঝালেও, প্রলোভনের ভাব আসে; সম্পদের ঐশ্বর্যের মত্ততা উপস্থিত হয়। যেন স্নিগ্ধতা দেখে প্রলুব্ধ হয়ে, দেবভাবের প্রতি আকৃষ্ট হয়, সে পক্ষে এটাই তাৎপর্য।-মন্ত্রের শেষাংশ-শত্রুদমনের এবং ঐহিক ও পারত্রিক পরম সুখলাভের প্রার্থনামূলক। হৃদয়ে দেবভাবের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমার রিপুকুল হীনবীর্য হোক, পরম সুখ মোক্ষধন আমার অধিগত হোক;–এটাই আকাঙ্ক্ষা। ২।

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ যেনোয় সমভরঃ পয়াংস্যুত্তমেন ব্ৰহ্মণা জাতবেদঃ। তেন ত্বমগ্ন ইহ বর্ধয়েমং সজাতানাং শ্রৈষ্ঠ্য আ ধেহ্যেনং। ৩।

 বঙ্গানুবাদ –জ্ঞানোৎপন্ন (সর্বজ্ঞ) জ্ঞানস্বরূপ হে অগ্নিদেব! যে প্রসিদ্ধ উৎকৃষ্টতম মন্ত্রশক্তির দ্বারা (জ্ঞানের দ্বারা–আহুত হয়ে) হবনীয় দ্রব্যাদি (সত্ত্বভাব ইত্যাদি) ভগবানকে প্রাপ্ত হয়, আপনি সেইরকম মন্ত্রের (জ্ঞানের) দ্বারা এই অর্চনাকারীকে ইহলোকে সমৃদ্ধিযুক্ত করুন, এবং এই প্রার্থীকে সমানজাতগণের (দেবগণের) মধ্যে শ্রেষ্ঠস্থানে প্রতিষ্ঠিত রাখুন। ৩ ৷৷

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— এখানে জাতবেদঃ পদের দ্বারা আমরা জ্ঞানোৎপন্ন (বেদ অর্থাৎ জ্ঞান, তা থেকে জাত অর্থাৎ উৎপন্ন) অর্থ নির্দেশ করলাম। জ্ঞান যে জ্ঞান হতেই উৎপন্ন হয়, অগ্নি যে অগ্নি হতেই সঞ্জাত হয়, তা আর বলার প্রয়োজন হয় না। জাতবেদঃ সেই জন্যই অগ্নিকে বুঝিয়ে থাকে। ব্ৰহ্মণা পদে মন্ত্রশওিপ্রভাবেন বা জ্ঞানেন অর্থ গৃহীত হয়েছে। ব্রহ্ম পদ-জ্ঞানবোধক। জ্ঞানই ব্রহ্মশ্রুতিতে আছে। তাতে ব্রহ্মণা পদের অর্থ হয়–মন্ত্রশক্তির দ্বারা বা জ্ঞানের দ্বারা। ভাব এই যে, জ্ঞানের বা মন্ত্রশক্তির সাহায্যে। পয়াংসি পদে ভাষ্যকার–ক্ষীরোজ্যাদিরূপিণী হবীংষি, লিখেছেন। আমরা তাঁরই অনুসরণে পয়স শব্দের অর্থ দ্রব্য গ্রহণ করলাম। এখানে দ্রব্যও হতে পারে; শুদ্ধ-সত্ত্বভাব বা ভক্তি অর্থও আসতে পারে। তাতে ভাব দাঁড়ায় এই যে,-মন্ত্রপূত বা জ্ঞানসহযুত যে পয়ঃ (শুদ্ধ-সত্ত্বভাব, ভক্তি ইত্যাদি ইবনীয়)। সুজাতানাং পদে ভাষ্যকার, ভাবে জ্ঞাতিগণের অর্থ এনেছেন। তাতে প্রার্থনা দাঁড়িয়েছে, আপনারা, এই উপাসককে তার জ্ঞাতিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠপদ প্রদান করুন। এ ভাবের এমন অর্থ, রাজার নিকট বা কোনও প্রধান ব্যক্তির নিকট প্রার্থনায় প্রকাশ পেতে পারে। কিন্তু ভগবানের দ্বারে দণ্ডায়মান সাধকের প্রার্থনায়, এমন উক্তি কখনও সঙ্গত নয়। সাধনাক্ষেত্রে জ্ঞাতির মধ্যে বড় হবার কামনা কে করে? আমরা সে। ভাব গ্রহণ করলাম না। সজাতানাং পদকে আমরা এখানে দেব-ভাবের দ্যোতক বলে মনে করি। এখানকার ভাব এই যে, অগ্নিদেবকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে,–আপনার সহজাতদের মধ্যে। অগ্নির (জ্ঞানের) সহজাত বলতে দেবভাবকেই বুঝিয়ে থাকে ৷ ৩৷৷

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ এষাং যজ্ঞমত বর্চো দদেহহং রায়ম্পোষমত চিত্তান্যগ্নে। সপত্না অম্মদধরে ভবন্ত্তমং নাকমধি রোহয়েমম্ ॥ ৪৷৷

বঙ্গানুবাদ –হে জনস্বরূপ অগ্নিদেব! বিঘ্ননাশ-ইষ্টপ্রাপ্তি-সম্বন্ধীয় সৎ-অনুষ্ঠানে, আপনার অনুগ্রহপ্রার্থী আমি, ব্রতী হয়েছি, আমার তেজের এবং ধনের (পরমার্থের) পুষ্টি এবং চিত্তের সৎ-ভাববিধান আপনি করুন; শত্রুগণ এই অর্চনাকারীর নিকট নিকৃষ্ট (উপক্ষীণ) হোক; এই প্রার্থনাকারীকে শ্রেষ্ঠ সুখস্থানে অধিরোহণ করিয়ে দিন (আপনার কৃপায় সে যেন পরম সুখ প্রাপ্ত হয়। ৪

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –মন্ত্রটিকে আমরা চার অংশে বিভক্ত করেছি। প্রথম অংশে (অগ্নে থেকে আ দদে অংশে) অর্চনাকারী নিজেকে সৎকর্ম সৎ-অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত করছেন। দ্বিতীয় অংশে (উত থেকে চিত্তানি মহ্যং বিধেহি অংশে) তাঁর প্রার্থনা–তেজের পুষ্টি; তিনি চাইছেন–চিত্তে সৎ-ভাবের সমাবেশ হোক। তার পরের প্রার্থনা–পূর্বের (দ্বিতীয় মন্ত্রের মতো) শত্রুদমন এবং শ্রেষ্ঠ সুখ প্রাপ্তির কামনা সেখানে প্রকাশ পেয়েছে। ৪।

.

চতুর্থ সূক্ত : পাশবিমোচনম

[ঋষি : অথর্বা দেবতা : অসুর, বরুণ ছন্দ : ত্রিষ্টুপ, অনুষ্টুপ]

প্রথম মন্ত্রঃ অয়ং দেবানামসুরো বি রাজতি বশা। হি সত্যা বরুণস্য রাজ্ঞঃ। ততম্পরি ব্ৰহ্মণা শাশদান উগ্রস্য মনন্যারুমিং নয়ামি ॥ ১।

বঙ্গানুবাদ দেবগণের মধ্যে পাপীর (অসতের) দণ্ডদাতা এই বরুণদেব, বিশেষভাবে প্রকাশমান আছেন; কেননা, সত্যভাব রাজা বরুণেরই বশে আছে। সেই কারণে, সর্বতোভাবে সত্যজ্ঞানের দ্বারা বলীয়ান হয়ে, আমি সেই কঠোরশাসক বরুণ-দেবের ক্রোধ হতে এই জীবনকে পরিত্রাণ করছি। ১

 মন্ত্রাৰ্থ আলোচনা –এই সূক্তের মন্ত্র-কয়েকটির যে প্রয়োগ-বিধি আছে, তাতে বোঝা যায়, জলোদর-রোগ-নিবৃত্তির পক্ষে এই মন্ত্র কয়েকটি অব্যর্থ ফল প্রদান করে। এই মন্ত্র উচ্চারণ-পূর্বক ঘটস্থিত জলকে গৃহতৃণদর্ভপিঞ্জলীর দ্বারা (শান্তিজল) রোগীর গাত্রে প্রক্ষেপ করতে হয়। তাতেই রোগমুক্ত হওয়া যায়।ভাষ্যে প্রকাশ, ইন্দ্র ইত্যাদি দেবগণের মধ্যে বরুণদেবই কঠোর শাসক (অসুর)। (এখানে অসুর পদ পাপীদের শাসনকর্তা–প্রকারান্তরে দেবতা অর্থেই প্রযুক্ত হয়েছে। ঋগ্বেদেও আমরা দেখেছি, অসুর শব্দে কোথাও দেবতা অর্থে এবং কোথাও বা যারা সুর নয় অর্থাৎ দৈত্য অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে)। তিনি সত্য ভাষণশীল এবং সত্যবস্তু থেকেই তার উৎপত্তি। অথবা, সত্য তার বশে আছে। বরুণ-বিষয়ক এই মন্ত্রের দ্বারা তার আরাধনা করলে, তিনি সন্তুষ্ট হন। তখন তার অনুগ্রহে শক্তি-সামর্থ্য পাওয়া যায়। আর, তার ফলে, পরম উগ্র সেই বরুণদেবের ক্রোধ থেকে মুক্তিলাভ হয়। জলোদরগ্রস্ত রোগী, জলোদর রোগ থেকে মুক্তি লাভ করে। আমি জলোদরগ্রস্ত রোগী, আমি রোগশান্তির জন্য, এই মন্ত্রে বরুণদেবের উপাসনা করছি।–ভাষ্যে মন্ত্রের এমন অর্থই প্রকাশমান আছে। আমরা যে দৃষ্টিতে দেখছি, তাতে বলি-মন্ত্রের অর্থে কেবল যে জলোদরগ্রস্ত রোগীর রোগ-শান্তির প্রার্থনা মাত্র প্রকাশ পেয়েছে, তা নয়। পরন্তু এ মন্ত্রে সংসার-তাপগ্রস্ত জন, শান্তিধামে উপনীত হবার প্রার্থনা করছে,–সাধারণতঃ এই ভাবই প্রকাশ পেয়েছে। …আমরা বলি ইমং পদ এই জীবনকে বোঝাচ্ছে, এবং উন্নয়ামি পদে উগমনের ভাব এসেছে। বরুণদেবের উপাসনায়, তার আদর্শে সত্যপর হয়ে, আমরা যেন আমাদের জীবনকে ঊর্ধ্বদেশে ভগবৎসকাশে নিয়ে যাই–প্রার্থনায় এই ভাবই প্রকাশ পেয়েছে। অসৎকে পাপীকে বরুণদেব দণ্ডদান করেন, বরুণের পাশে আবদ্ধ হয়ে পাপী নির্যাতনগ্রস্ত হয়। আমরা যেন সৎ হই, তাতে তার তৃপ্তি আসবে, আমরা শান্তিধামে উপনীত হবে। এটাই এ প্রার্থনার সাধারণ মর্মার্থ। জলোদররোগগ্রস্তের রোগশান্তির পক্ষেও এ মন্ত্রের প্রয়োগ বাঞ্ছনীয়; পরন্তু, ভবব্যাধি নাশের পক্ষেও এ মন্ত্রের উপযোগিতা উপলব্ধ হয়। ১।

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ নমস্তে রাজন্ বরুনাস্তু মন্যবে বিশ্বং হ্যগ্ৰ নিচিকেষি দ্রুগ্ধং। সহস্রমন্যান্ প্র সুবামি সাকং শতং জীবাতি। শরদস্তবায়ং ॥ ২॥

 বঙ্গানুবাদ— পাপীগণের দণ্ডদাতা হে দ্যোতমান বরুণদেব! (আমাদের পাপকর্মজনিত) আপনার ক্রোধ শান্তি হোক। হে কঠোর-শাসক দেব! সকল প্রাণিকৃত অপরাধ আপনি অবগত আছেন। তথাপি, হয় তো আপনার অপরিজ্ঞাত আছে–আমার এমন সকল সহস্র সহস্র অপরাধ সহ, আমি সর্বতোভাবে আপনার শরণাগত হচ্ছি। এই পাপনিপীড়িত জন, আপনার অনুগ্রহে (পাপক্ষালনের উদ্দেশে সৎ-কর্মের অনুষ্ঠানের নিমিত্ত) শত সংবৎসর জীবিত থাকুক–এই প্রার্থনা ॥ ২॥

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –ভাষ্যাভাষে বোঝা যায়, এ মন্ত্রটি যেন জলোদরগ্রস্ত রোগীর প্রতিনিধিস্বরূপ পুরোহিত উচ্চারণ করছেন। তিনি বলছেন,-হে দেব! আপনার ক্রোধকে নমস্কার। সকলের পাপের সমাচার আপনি অবগত আছেন। তা জানার কারণেই সকলের প্রতি আপনার অশেষ ক্রোধ সঞ্জাত হয়। যাই হোক, আপনার সেই ক্রোধের শান্তির জন্য সহস্র পাপকর্মপরায়ণ জনগণের পক্ষ হয়ে, তাদের প্রতিনিধিস্বরূপ আমি প্রার্থনা করছি যে, এই ব্যাধি-পীড়িত জনকে নীরোগ করুন এবং শতবর্ষ পরমায়ু দান করুন।–শান্তিস্বস্ত্যয়ন-কর্মে জলোদরগ্রস্ত রোগীর রোগ-উপশমের উদ্দেশে যখন এই মন্ত্র প্রযুক্ত হয়, তখন এই অর্থে এই ভাবেই এর প্রয়োগ সঙ্গত বলে মনে করতে পারি। কিন্তু আমরা মনে করি, এ মন্ত্রটি সাধারণ, ভবব্যাধিগ্রস্তের পক্ষেও প্রযুক্ত হতে পারে। আমরা মন্ত্রের প্রথম ও দ্বিতীয় অংশের অর্থ প্রায়ই ভাষ্যানুমত রেখেছি। তৃতীয় অংশে (তথাপি অন্যান্ থেকে জীবাতি অংশে) দুটি ভাব আমনন করে এনেছি। আমরা মনে করি এখানে অন্যান্ পদে প্রার্থীর মনে আত্মকৃত অপরের অপরিজ্ঞাতনানা পাপকর্মের বিষয় উদয় হয়েছে। তিনি যেন আত্মগ্লানিতে জরজর হয়ে বলছেন–হে দেব! সকল পাপ আপনার জানা আছে সত্য; কিন্তু আমি এত পাপ করেছি যে, তার অনেকগুলি হয় তো আপনার অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। আমার মনের অগোচরে তো পাপ নেই। তাই অতি সঙ্কোচে আমি আপনার শরণ গ্রহণ করছি। আপনার জ্ঞাত ও অজ্ঞাত আমার যত পাপ আছে, সেই সকল পাপ বিমোচনের আপনি উপায় বিধান করুন।–এইরকম অয়ং পদের পর পাপক্ষালনার্থং সৎকর্মানুষ্ঠানকরণায় বাক্যাংশও ঐ অর্থেরই সম্যক্ সঙ্গতি রক্ষার পক্ষে অধ্যাহার করতে হয়েছে। শত শরৎ অর্থাৎ শত বৎসর পরমায়ু দাও-এ প্রার্থনা সাধারণ নিম্নশ্রেণীর প্রার্থীর উপযোগী হতে পারে; কিন্তু উচ্চস্তরের সাধক কেবল বাঁচতে চান না। তারা সৎকর্মের অনুষ্ঠানে পাপক্ষয়কারী জীবনেরই প্রার্থী হন। সুতরাং আমরা মনে করি-হে ভগবন্! যাতে আমার পাপের ক্ষয় হয়, চরমে আমি পরম আনন্দলাভ করতে সমর্থ হই, দয়া করে তারই উপায় বিহিত করুন।-এটাই এ মন্ত্রের মর্মার্থ। ২

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ যদুবথামৃতং জিহুয়া বৃজিনং বহু। রাজ্ঞা সত্যধর্মণো মূঞ্চামি বরুণাদহং। ৩

বঙ্গানুবাদ— বাক্যের দ্বারা যে-কিছু অসত্য উক্ত হয়ে থাকে, তাতে অধিক পাপ সঞ্জাত হয়। সত্যধর্মপালনশীল, (দণ্ডদানের) বিধানকর্তা পাশবদ্ধকারী যেই বরুণদেব হতে, হে আমার জীবন! তোমাকে আমি (আমার কর্মের প্রভাবে) মুক্ত করছি। (ভাবার্থ,অনৃতই পাপের মূলীভূত। পাপ হতে অশেষ ক্লেশ উৎপন্ন হয়। সেই পাপ বিনাশের নিমিত্ত আমি সত্যরক্ষক ভগবানের অনুসরণ করছি)। ৩।

মন্ত্রাৰ্থআলোচনা— আমরা মনে করি, জলোদরগ্রস্ত রোগীর রোগ-নিরাময়ের জন্য প্রযুক্ত হলেও এই মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। সাধক এখানে সঙ্কল্প করছেন,–জীবন! তুমি পাপের পাশে আবদ্ধ হয়েছ; আমি তোমায় মুক্ত করছি–এই সঙ্কল্প করলাম। কিভাবে মুক্ত করব? বরুণদেবের আদর্শের অনুসরণ করে। তিনি সত্য-সংরক্ষক; তিনি সত্যের পালক। আমি যদি সত্যপর হতে পারি, তিনি অবশ্যই আমায় রক্ষা করবেন,অবশ্যই আমার পাপ মোচন হবে। আমি সত্যপর হবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সুতরাং আমার জীবনের বন্ধনমোচনেও আর সংশয়ের কারণ নেই। পাপের ভার লাঘব করবার পক্ষে, পাপের পাশ ছিন্ন করবার সম্বন্ধে, সত্যভাষণ-সত্যের অনুসরণ–একমাত্র উপায়। এই মন্ত্র সেই শিক্ষাই দিচ্ছেন। মন্ত্রের বক্তব্য যত রোগের মূল-অসত্যকথন; অসত্য পরিবর্জন করো, সত্যে একনিষ্ঠ হও, তোমার সকল সন্তাপ ও দূরীভূত হবে।–তবে ভায্যের ভাব–অবশ্যই একটু স্বতন্ত্র প্রকারের। ভাষ্যকার বলেন,-এ মন্ত্র জলোদরগ্রস্ত রোগীকে সম্বোধন করে প্রযুক্ত হয়। তাতে পুরোহিত যেন বলেন,-তুমি মিথ্যাকথনের ফলস্বরূপ জলোদর-রোগগ্রস্ত হয়েছ। আমি বরুণদেবের প্রসাদে মন্ত্র শক্তির দ্বারা তোমায় রোগমুক্ত করছি। মিথ্যাকথনের ফলে জলোদর রোগের সঞ্চার হয়। এই মন্ত্র উচ্চারণ করলে, শান্তিকর্মের ফলে, সেই রোগ নাশ পায়। এটাই এ মন্ত্রের ভাষ্যের ভাব। ৩।

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ মুঞ্চামি হৃা বৈশ্বানরাদণবান্মহতস্পরি। সজাতানুগ্ৰহা বদ ব্ৰহ্ম চাপ চিকীহি নঃ ॥ ৪

বঙ্গানুবাদ –হে আমার জীবন! তোমাকে অগ্নিদেবের কোপ হতে (জ্বলন-জ্বালা হতে) এবং জলাধিপতির ভীষণ কোপ হতে (জলসম্বন্ধি ভীষণ ব্যাধি হতে) আমার কর্মপ্রভাবের দ্বারা সর্বতোভাবে মুক্ত করছি (অথবা, হে আমার জীবন! বিশ্বহিতসাধক কর্মের দ্বারা তোমাকে সেই ভীষণ সংসার-সমুদ্র হতে সর্বতোভাবে উত্তীর্ণ করছি)। হে দুর্দমনীয় (বিচঞ্চল)! তুমি তোমার কর্মসম্বন্ধ হতে তোমার সহচর অসৎপ্রবৃত্তিদাতাগণকে সর্বতোভাবে অপসারণ করো; মন্ত্ররূপ স্তুতি সর্বতোভাবে উচ্চারণ করো এবং ব্রহ্মকে অবগত হও। (মন্ত্রটিতে পাপক্ষালনের জন্য উদ্বোধন প্রকাশ পাচ্ছে। পাপমোচনের, সঙ্কল্পও এতে পরিদৃষ্ট হয়। ব্ৰহ্মকে অনুধ্যান করে অসপ্রবৃত্তি বিনাশ করো এবং তার দ্বারা, সকল যন্ত্রণা বিদূরিত হোকমন্ত্রে এই ভাব প্রকাশিত হয়েছে)। ৪

মন্ত্ৰার্থআলোচনা— জলোদরগ্রস্ত রোগীর রোগমুক্তির জন্য এইটি চতুর্থ মন্ত্র। মিথ্যাকথনজনিত পাপে জলোদর রোগ উৎপন্ন হয়। মিথ্যাকে পরিত্যাগ করে, সত্যের অনুসারী হয়ে, এই মন্ত্রের ক্রিয়ার দ্বারা সুফল প্রাপ্ত হওয়া যায়। রক্তহীনতায় জলসঞ্চয়ে যে সকল রোগী নিত্য নিত্য কালের কবলে পতিত হচ্ছে, তারা বিধিপূর্বক এই সূক্তের মন্ত্র-কয়টি প্রয়োগ করে সাফল্য লাভ করুন।-ভাষ্যের মত এই যে, মন্ত্রের প্রথমাংশে জলোরগ্রস্ত রোগীকে এবং শেষাংশে বরুণদেবকে সম্বোধন করা হয়েছে। প্রথমাংশে রোগীকে সম্বোধনপূর্বক বলা হচ্ছে,-হে রোগগ্রস্ত! তোমাকে সেই বিশ্বনরহিতকারী ভীষণ সমুদ্র হতে অর্থাৎ জলাভিমানী দেবতার কোপ হতে (জলোদর রোগ হতে) মুক্ত করছি। দুশ্চিকিৎস্য যে জলরোগ, এই মন্ত্রের প্রভাবে, তা হলে তুমি মুক্তি পাও। এইরকম, মন্ত্রের শেষাংশে বরুণ দেবতাকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে,–হে উগ্র! আপনিও আপনার সহকারীগণকে এই পুরুষের বিষয়ে বলুন। তাঁরা আগত হয়ে আর যেন এই পুরুষকে পীড়ন না করেন, তা সর্বতোভাবে বলে দিন। আমাদের অন্নরূপ হবিঃ বা স্তুতির দ্বারা অপরাধ বিস্মৃত হোন এবং আমাদের জ্ঞাত হোন।–মন্ত্রের প্রয়োগ-সম্বন্ধে এবং মন্ত্রের রোগনাশিকা শক্তির বিষয়ে আমাদের কোনই মতান্তর নেই। আমাদের বক্তব্য, মন্ত্রের ভাব-বিষয়ে। আমরা মনে করি, মন্ত্রটি সর্বথা আত্ম-উদ্বোধন-মূলক। ভাষ্যকার বলেছেন,-মন্ত্রের প্রথমাংশে জরাগ্রস্তকে এবং শেষাংশে উগ্রমূর্তি বরুণদেবকে সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু আমরা বলি, মন্ত্রের দুটি অংশেই আপন জীবনের উদ্দেশে সম্বোধন আছে। জীবন (মন বলতেও পারা যায়) দুর্দমনীয় বিচঞ্চল যথেচ্ছকর্মকারী; তাই উগ্র পদ প্রযুক্ত দেখি। জীবনের সহচর–অসৎপ্রবৃত্তিনিচয়। তাই সজাতান পদের প্রয়োগ আছে। মন্ত্রের উপদেশ, তাদের দূরীকৃত করে, মন্ত্রের দ্বারা-উপাসনার দ্বারা-ব্রহ্মকে অবগত হও। সেই তোমার প্রকৃত কর্ম। সেই কর্মের প্রভাবেই তুমি পাপের কবল থেকে মুক্তি পেতে পারো। মিথ্যাচারিতার দরুণ রোগসঞ্চার হয়। সকল রোগের মধ্যে নিদারুণ জলরোগ–রক্তশূন্যতা। সেই রোগ দূর হয় কিসে? সে রোগের সে যন্ত্রণার উপশম হয় কিভাবে? মন্ত্রে সেই উপদেশ প্রদত্ত হয়েছে ॥ ৪

.

পঞ্চম সূক্ত : নারীসুখপ্রসূতি

 [ঋষি : অথর্বা। দেবতা : পূষা, অর্যমা, বেধাঃ, সূযা ইত্যাদি ছন্দ : পংক্তি, অনুষ্টুপ ইত্যাদি]

প্রথম মন্ত্রঃ বষ তে পূষন্নস্মিৎ সূত কৃণোতু বেধাঃ। সিতাং নার্যত প্রজাতা বি পর্বণি জিহতাং সূতবা উ ॥১॥

বঙ্গানুবাদ –হে প্রাণিসমূহের পোষণকারী (পূষা) দেবতা! আপনার প্রীতিসাধনের নিমিত্ত দেবগণের আহ্বাতা এই উপাসক, সেই প্রাণিসমূহের প্রেরক (অর্যমা দেবতা) এবং জগতের নির্মাতা বিধাতা (বেধাঃ দেবতা) যে দেবতা আছেন, তাঁদের প্রতি চিত্ত ন্যস্ত করে, ইহজগতের পুনর্জন্মের নিবৃত্তির বিষয়ে, কল্যাণপ্রদ বষট্র মন্ত্র উচ্চারণের দ্বারা, আপনার উদ্দেশে ভক্তিরূপ হবিঃ অর্পণ করছে। গর্ভিণী নারী যেমন সন্তানবতী হয়ে প্রসবজনিত ক্লেশ হতে বিমুক্ত হন, সেইরকম পুনর্জন্মের নিবৃত্তি-বিষয়ে মায়ামোহরূপ বন্ধনসমূহ হতে (আপনার কৃপায়) জগতের সকলে মুক্তিলাভ করুক। (মন্ত্রে দুরকম ভাব প্রকটিত। একরকম অর্থে ভগবৎ-অর্চনাপরায়ণ হয়ে ঋত্বিক গর্ভযন্ত্রণা-মোচনের প্রার্থনা করছেন; অন্য অর্থে, জন্মগতি রোধের নিমিত্ত সাধকের ব্যাকুলতা প্রকাশ পাচ্ছে)। ১

মন্ত্ৰাৰ্থ আলোচনা –এই মন্ত্র এবং এই সূক্তের অন্তর্গত এর পরবর্তী কয়েকটি মন্ত্র–সুপ্রসব কার্যে ব্যবহৃত হয়। গর্ভিণী গর্ভ যন্ত্রণায় দারুন কষ্ট পাচ্ছেন, সেই সময় যথাবিধি দেবপূজনের পর এই সূক্তের মন্ত্র কয়েকটি উচ্চারণ-পূর্বক শান্তিজল গ্রহণ করণীয়। গর্ভিণীর মস্তক হুতোষ্ণ শান্তিজলে সিক্ত করে মন্ত্রোচ্চারণ করলে, তৎক্ষণাৎ সুপ্রসব-সুখে সন্তানজনন কার্য সাধিত হয়ে থাকে। এ পক্ষে এই মন্ত্রসম্বন্ধে ভাষ্যকারের ব্যাখ্যা এইরকম; যথা,-হে সকল প্রাণিজাতের.পোষক দেব! দেবগণের আহ্বানকারী ঋত্বিক, প্রাণিসমূহের প্রেরক অর্যমা-নামক দেবতার (আদিত্যের) প্রতি একাত্ম হয়ে বষ মন্ত্রের দ্বারা হবিঃ অর্পণ করছে এবং সকল জগতের নির্মাতা বেধাঃ দেবতার সাথে ধ্যান-বিশেষের দ্বারা একাত্মভূত হয়ে বষট মন্ত্রে হবিঃ দান করছে। সেই হবিঃ গ্রহণপূর্বক তুমি তুষ্ট হও। তার পুণ্যফলে এই গর্ভিণী স্ত্রী, সন্তান-প্রসব করে, প্রসবজনিত ক্লেশ হতে বিমুক্ত হোক,–অক্লেশে সে প্রসব করুক। আর তার সুখপ্রসবের জন্য তার প্রসব-নিরোধক সন্ধিবন্ধনগুলি দূর হোক, অর্থাৎ বিশ্লথ হয়ে আসুক।–ভাষ্যের অর্থই প্রচলিত; এবং সে অর্থ যে অসঙ্গত, তা আমরা বলছি না। তবে, আমাদের মত এই যে, কেবল সুপ্রসবের জন্য কেন, এই মন্ত্র ভববন্ধন-মোচনের জন্যও প্রযুক্ত হতে পারে। কেবল নারীর সম্বন্ধেই বা কেন, নরনারী সকলের সম্বন্ধেই এ মন্ত্রের সার্থকতা লক্ষ্য করি। মন্ত্রের দু একটি পদের অর্থ-বিষয়ে একটু অনুধাবন করলেই, তাতে এক সৎ-ভাবপূর্ণ বিশ্বজনীন ভাব প্রাপ্ত হওয়া যায়। মূলের সুতৌ ও সুতবে পদের অর্থ হৃদয়ঙ্গম হলেই মন্ত্রের ভাব পরিস্ফুট হয়। ভাষ্যকার, সুতৌ পদের প্রতিবাক্য লিখেছেন –সুখপ্রসব কর্মাণি। আমরা প্রতিবাক্যে বলছি–জন্মকর্মবিষয়ে, পুনর্জন্মনিবৃত্তৌ। সুতবে পদে ভাষ্যকার লিখেছেন-সুখপ্রসবার্থং; আমরা বলি–পুনর্জন্মনিবৃত্তিবিষয়ে।–মূলের একটি বাক্যহোতা বষট্‌ কৃণোতু। একভাবে তার অর্থ দাঁড়িয়েছে-হোতা সুপ্রসবের জন্য বষট্র মন্ত্র উচ্চারণে হবিঃ অর্পণ করছেন; অন্যভাবে অর্থ দাঁড়াচ্ছে হোতা পুনর্জন্ম-নিবৃত্তি-বিষয়ে বষট মন্ত্র উচ্চারণে হবিঃ অর্পণ করছেন। এক ভাবে গর্ভিণী যাতে বিনাক্লেশে সন্তান প্রসব করে–এই প্রার্থনা। অন্যভাবে–আমার যেন জন্মগতি রোধ হয়। আর যেন আমায় গর্ভযন্ত্রণা ভোগ করতে না হয়।–-হোতা যখন অর্যমার ভাবে ভাবুক হতে পারেন, হোতা যখন ধাতার (বেধাঃ) ধ্যানে আত্ম-সম্মিলনে সমর্থ হন, কল্যাণপ্রদ বষট্র মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ভক্তিরূপ হবিঃ যখন প্রাণিসমূহের পোষণকারী দেবতার উদ্দেশে সমর্পিত হয়ে থাকে; তখনকার প্রার্থনায় সুপ্রসবের কামনা তুচ্ছাদপি তুচ্ছ কামনা; সে কামনায়, সে প্রার্থনায়, পরম ধনই–জন্মগতি রোধরূপ মোক্ষ ধনই–প্রাপ্ত হওয়া যায়–সে পক্ষে মন্ত্রের দ্বিতীয় অংশে একটি উপমার ভাব প্রকাশ পেয়েছে বলে আমরা মনে করি। এ সংসারে গর্ভ-যন্ত্রণাকে একটি বিষম যন্ত্রণা বলে চিহ্নিত করা হয়। গ্রন্থিবন্ধন (পবাণি) সে যন্ত্রণার প্রধান কারণ। সে বন্ধন বিশ্লথ হলে, প্রসব সুখদ হয়ে আসে। গর্ভ যেমন, ক্লেশের কারণ, জন্ম তেমনই দুঃখের কারণ। গর্ভের যেমন গ্রন্থিবন্ধন ক্লেশ-প্রদায়ক, পুনর্জন্মের নিবৃত্তির বিষয়ে সেইরকম মায়ামোহরূপ বন্ধন সকলই অশেষ ক্লেশের কারণ। জন্ম হলেই জরা-মৃত্যু এসে কষ্ট দেবে; এই জন্মই আমাকে পুনর্জন্ম গ্রহণের চক্রে নিষ্পেষিত করবার জন্য আবদ্ধ করবে। স্নেহের বন্ধন, মমতার বন্ধন, মায়ার বন্ধন, মোহের বন্ধন–আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে। আমি পরিত্রাণ পাবো কি করে? এখানকার তাই প্রার্থনা–হে প্রাণিসমূহের পোষণকারী পূষাদেবতা! আপনার তৃপ্তির জন্য হোতা আমি দেবভাবের আহ্বানকারী আমি, আপনার অর্চনা করছি। আপনাকে অর্চনা করবার সঙ্গে সঙ্গে, আমি আমার প্রেরক দেবতার শরণাপন্ন হয়েছি, আমি আমার নির্মাতা বা ধারক দেবতার শরণাপন্ন হয়েছি। অর্থাৎ, এখন তাদের জানাচ্ছি, তারা যেন আর আমাকে ইহসংসারে প্রেরণ না করেন, তারা যেন আর আমাকে নির্মাণ বা ধারণ না করেন। তাদের অনুধ্যান করার এটাই আমার লক্ষ্য। ইত্যাদি।-মন্ত্র সুপ্রসবের জন্যও প্রযুক্ত হোক; আবার নিজের গতি মুক্তির জন্যও প্রযুক্ত হোক। এটাই আমাদের আকাঙ্ক্ষা ॥ ১.

.

দ্বিতীয় মন্ত্রঃ চতম্রো দিবঃ প্রদিশতম্রো ভূম্যা উত। দেবা গর্ভং সমৈরয় তং ব্যর্ণবন্তু সূতবে ॥ ২॥

বঙ্গানুবাদ –দ্যুলোকের এবং ভূলোকের যে চারটি দিক্ এবং চারটি বিদিক্‌ আছে, সেই সকল দিকের দেবগণ (দেবভাবসমূহ), জন্মগ্রহণের মূল গর্ভকে (সংযত) করুন; পুনর্জন্মের নিবৃত্তির বিষয়ে সেই দেবগণ, গর্ভকে (জীবকে) বিমুক্ত করুন। (ভাবার্থ, বিভিন্ন দিকে অবস্থিত দেবগণ মুক্তিমার্গে সহায় হোন। তারা সকলে জন্মগতি রোধ করে দিন)। ২।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –ভাষ্যানুসারে এ মন্ত্রের প্রচলিত ভাব এই যে,দ্যুলোক-সম্বন্ধী চারটি (প্রাচী ও ইত্যাদি) প্রধান দিক আছে। এবং ভূলোকেরও ঐ রকম চারটি প্রধান দিক আছে। সেই সকল দিকের পর অধিপতি ইন্দ্র ইত্যাদি দেবগণ পূর্বে যে গর্ভ সঙ্গত করেছেন, অর্থাৎ যে গর্ভের উৎপত্তি তাদের দ্বারা সাধিত হয়েছে, অধুনা সেই দেবগণ প্রসবের নিমিত্ত সেই গর্ভাশয়ের জ্বণকে বহির্গত করে দিন, গর্ভ বিগতাচ্ছাদন হোক,-জরায়ুর বাধা অপসারিত হোক। সুপ্রসবের পক্ষে মন্ত্র এই অর্থেই প্রযুক্ত হয়ে থাকে।–এই অর্থ এক পক্ষে অসঙ্গত নয়। পক্ষান্তরে মন্ত্র থেকে মুক্তির কামনাও প্রকাশ পায়। তার মর্ম এই যে, সকল দিকের সকল দেবভাব এসে জন্মগ্রহণমূলকে সঙ্গত করুন; আর পুনর্জন্মনিবৃত্তি বিষয়ে বাধা অপসৃত হোক, হৃদয়ে দেবভাবসমূহ জাগরূক হলে, পুনর্জন্মগ্রহণের পথ ক্রমশঃ রুদ্ধ হতে থাকে; –জন্মগতিরোধের পক্ষে যে, সকল বাধা ছিল, সেগুলি সবই একে একে দূর হতে থাকে। এপক্ষে, এখানে সেই প্রার্থনাই প্রকাশ পেয়েছে। বলে আমরা মনে করি। ২৷৷

.

তৃতীয় মন্ত্রঃ সূষা ব্যুর্ণোতু বি যোনিং হাপয়ামসি। শ্ৰথয়া সূষণে ত্বমব ত্বং বিষ্কলে সৃজ ॥ ৩৷

 বঙ্গানুবাদ— জ্ঞানদাত্রী (সূষা) দেবতা অজ্ঞানাবরণ অপসারণ করুন; হে দেবতে! আপনি (আমার) উৎপত্তিমূলকে বিশেষ ভাবে মুক্ত করুন (প্রার্থনা–আমার কর্মের দ্বারা আমার উৎপত্তিমূল যেন আর দৃষ্ট না হয়); হে উদ্ধারকারিণি (মুক্তিপ্রদায়িনি) দেবতে! আপনি, আমার সন্ধিবন্ধনসমূহকে বিমুক্ত করুন (যেন আমার বন্ধন দিন দিন শ্লথ হয়ে আসে); হে কালরূপিণি দেবতে! আপনি, আমাকে আপনাতে লীন করুন। (আমি যেন আপনার সাথে মিলিত হই)। (মন্ত্রের এক অর্থ সুপ্রসবমূলক। অপর অর্থে পরিত্রাণ লাভের প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে) ॥ ৩

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –এ মন্ত্রটি সুপ্রসব-সংক্রান্ত তৃতীয় মন্ত্র। গর্ভিণীর প্রতি লক্ষ্য করে, মন্ত্রে সূ প্রভৃতি দেবতার নিকট সুপ্রসবের প্রার্থনা জ্ঞাপন করা হচ্ছে। এই লক্ষ্যে ভাষ্যে যে অর্থ হয়, তার মর্মসূষা দেবতা গর্ভের জরায়ুবন্ধন শ্লথ করুন, তার আবরণ বা বাধা দূর হোক। গর্ভিণীর সুপ্রসবের জন্য (গর্ভস্থ শিশু যাতে সুখে নির্গত হয়, সেই অভিপ্রায়ে) আমরা গর্ভ-নির্গম-মার্গকে বিস্তৃত করি। হে সূষণে দেবতে! সুখপ্রসব নিমিওক আমাদের এই কর্মের দ্বারা প্রীত হয়ে যোনিদ্বার বিশ্লথ করো,-গর্ভিণীর সন্ধিবন্ধন মোচন হোক। হে দেবি বিষ্কলে (কালস্বরূপিণি দেবতে)! আপনি গর্ভস্থ জীবকে অবাঙমুখি (অধোভাগে মুখ রেখে) প্রেরণ করুন।–কেবল গর্ভিণীর গর্ভযন্ত্রণা লাঘবের প্রতি বা সুপ্রসবের প্রতি লক্ষ্য রেখে মন্ত্র উচ্চারিত হলে, ঐ অর্থই গৃহীত হয়–হোক। তবে এই সকল মন্ত্রের মধ্যে আমরা অপর তত্ত্বের সন্ধান করি। আমরা মনে করি, এ সকল মন্ত্রের প্রয়োগ সকলের পক্ষে সমভাবে হতে পারে। গর্ভযন্ত্রণা কেবল যে গর্ভিণী নারীই ভোগ করছে, তা নয়। জীবমাত্রকেই সে রকম যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে।….আমরা মনে করি, সেই সকল যন্ত্রণা থেকে মুক্তির প্রার্থনাই এখানে প্রকাশ পেয়েছে।–প্রথম, দেবতাকে সূষা বলে অভিহিত করা হয়েছে। সূষণে বিষ্কলে রূপে তার সম্বোধন আছে। সূষা, সূষণে ও বিষ্কলে পদ তিনটির অর্থ-বিষয়ে ভাষ্যকার বিস্তর গবেষণা প্রকাশ করেছেন। আমরা সূষা পদে জ্ঞানদাত্রী অর্থ গ্রহণ করি। আবার সু-উষা এমন বিশ্লেষণেও এই ভাবই অধ্যাহৃত হয়। উষা জ্ঞান-প্রকাশিকা দেবতা। সুষণে সম্বোধন পদেও ঐ ভাবেরই প্রকাশ রয়েছে। জ্ঞানদাত্রী দেবীকে তাই উদ্ধারকারিণী বলা হয়েছে। সুপ্রসব পক্ষেও উদ্ধার করার : ভাব আসে; আবার মুক্তির পক্ষেও সেই ভাবই ব্যক্ত করে। বিষ্কলে পদের ধাতুগত অর্থে ব্যাপ্তি ও কাল একা বুঝিয়ে থাকে। তা থেকেই দেবতাকে কালস্বরূপিণী বলে প্রখ্যাত করেছি; ইত্যাদি।–মূলে আছে–ত্বং অব সৃজ। ভাষ্যকার বলেছেন-গর্ভং অবাঙমুখে প্রেরয়-গর্ভকে নীচুমুখ করে অবস্থিত করো। প্রত্নতত্ত্ব এখানে আর্যগণের এক বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সন্ধান পাবেন; অর্থাৎ প্রসবের সময় সন্তানের মুখ নিম্নভাগে অবস্থিত হলে সুপ্রসব হয়–এ বিষয় তাদের জানা ছিল, বলতে পারবেন। অব পদ রক্ষাৰ্থ অ ধাতু থেকে উৎপন্ন। সেই রক্ষার ভাব নিয়েই ভাষ্যকার অব সৃজ বাক্যের অর্থে মুখ নীচু দিকে হোক—এই ভাব গ্রহণ করেছেন; কিন্তু, এখানেও মুখ্য লক্ষ্য সেই রক্ষা। কেননা, তাহলেই সন্তান রক্ষাপ্রাপ্ত হবে, আমরা এখানে সেই রক্ষার অর্থ অন্যভাবে গ্রহণ করলাম। দেবতাকে কালস্বরূপিণী বলা হয়েছে। তার নিকট প্রার্থনা করা হচ্ছে,-অব সৃজ অর্থাৎ আমায় এমনভাবে সৃষ্টি করুন, যেন আমি রক্ষা প্রাপ্ত হই। আমার রক্ষা কি? কালস্বরূপ দেবতায় লীন হওয়াই-ভগবানে আশ্রয় পাওয়াই আমার রক্ষা। আমরা তাই অর্থ করেছি–হে কালস্বরূপিণী দেবতে! ত্বং মাং তয়ি লীনং কুরু। এই প্রার্থনাই রক্ষার প্রার্থনা। হে ভগবন্! আপনি আমাকে আপনাতে লীন করে নিন,–এটাই তো চরম প্রার্থনা ॥ ৩

.

চতুর্থ মন্ত্রঃ নৈব মাংসে ন পিবসি নৈব মজ্জহতং। অবেতু পৃশ্নি শেবলং শুনে জরাব্বত্তবেহব জরায়ু পদ্যতাং ॥৪॥

বঙ্গানুবাদ— হে পরিত্রাণপ্রার্থী! শরীরগত মাংসের প্রতি তুমি কখনও পিপাসিত (আকাক্ষিত) হয়ো না; মজ্জার সাথেও তুমি কখনও আবদ্ধ হয়ো না; (ভাব এই যে, অস্থি-মাংস-মেদ-মজ্জাযুত দেহের প্রতি যেন তোমার কামনা না থাকে)। জলের উপরিস্থিত শৈবালের ন্যায় এই সংসারের সম্বন্ধ মনে করে, হৃদয়ে জ্ঞানকিরণ ধারণ করো; (ভাব এই যে, নির্লিপ্তভাবে সংসারে বিচরণ করে, ভগবানের কর্ম করে যাও)। হে গতাগতিশীল! তোমার জন্ম-সম্বন্ধ (গতাগতি) নাশের জন্য তোমার জীবসম্বন্ধকে (জীবনকে) সেই রক্ষকসকাশে প্রেরণ করো (এ জীবন যাঁর তে এসেছে, তাতেই গিয়ে পুনর্মিলিত হোক–এমন ভাবে তাতে আত্মসমর্পণ করো)। (ভাবার্থ,-হে পরিত্রাণপ্রার্থী! পুনর্জন্ম-গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা পরিহার করো। ভগবানে আত্মসমর্পণ করো। মন্ত্রে এই রকমই আত্ম-উদ্বোধনের ভাব প্রকাশ পেয়েছে)। ৪।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –সমস্যাপূর্ণ মন্ত্রের সমস্যাপূর্ণ অর্থ আমনন করা হলো। এ মন্ত্রটি সুপ্রসব সংক্রান্ত চতুর্থ মন্ত্র। কিন্তু আমাদের অর্থে দাঁড়াচ্ছে,-মন্ত্রটি ভগবানে আত্মলীন হওয়ার পক্ষে আত্ম-উদ্বোধন মূলক।–ভাষ্যকারের অর্থের উপর আমাদের এই অর্থান্তরকল্পনার প্রয়াসের কারণ এই যে, এই জাতীয় মন্ত্রের এক সর্বজনীন অর্থ আছে–তা আমরা অবশ্যই মনে করি।-এই, যে চতুর্থ মন্ত্রটি, প্রচলিত ভাষ্যানুসারে এটি প্রসবিত্রীকে বা জরায়ুকে সম্বোধন পূর্বক উচ্চারিত হয়েছে-প্রতিপন্ন হয়। তাতে ভাব হয়–হে প্রসবিত্রি! উদরগত মাংসের দ্বারা তোমার স্থূলতা সাধিত হবে না। অথবা, হে জরায়ু! শরীরগত মাংস সম্বন্ধের দ্বারা তুমি সম্বন্ধ নও। তোমাদের সে সম্বন্ধ কেমন? না, জলে যেমন (শৈবাল) থাকে, সেইরকম। অতএব, শ্বেতবর্ণ যে জরায়ু, তুমি গর্ভ হতে সত্বর পতিত হও। মল যেমন পরিত্যাজ্য, জরায়ুর ও প্রসবিত্রীর সম্বন্ধও তেমনই। তাদের পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়া আবশ্যক। অতএব, হে জরায়ু! তুমি সত্বর পতিত হও।–এই মন্ত্রটির এই ভাবেই অর্থ এখন প্রচলিত। কিন্তু, আমরা মনে করি, পরিত্রাণকামী এখানে নিজে নিজেকে সম্বোধন করে মোক্ষপক্ষে অগ্রসর হবার জন্য নিজেকে নিজে প্রস্তুত করছেন। তিনি বলছেন, হে আমার জীবন! যদি তুমি পরিত্রাণ কামনা করো, মাংসের প্রতি মমতাবান্ হয়ো না, মজ্জার প্রতি আসক্তি পরিত্যাগ করো, দেহের অর্থাৎ জন্মের সম্বন্ধ যাতে পরিহার করতে পারো, সেই মতো চেষ্টান্বিত হও। বন্ধন-মোচনের চেষ্টা করো; আনন্দের অধিকারী হবে।–ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আমরা এ মন্ত্রটিকে চার অংশে বিভক্ত করেছি। প্রথম দুই অংশে (মাংসেন নৈব পিবসি এবং মজ্জসু আহতং নৈব অংশ দুটিতে) প্রায়ই ভাষ্যকারের অনুসরণ আছে। কেবল সম্বোধনপদ অধ্যাহারে ও পিবসি পদের অর্থ-বিষয়ে আমরা অন্যমত গ্রহণ করেছি। পানার্থক পা ধাতু হতে ঐ পিবসি পদের বুৎপত্তি স্বীকার করলে ঐরকম অর্থই সিদ্ধ হয়–কাসি, আকাঙ্ক্ষিত ভবসি। আমরা মন্ত্রের তৃতীয় ও চতুর্থ শব্দার্থ সামান্য পরিবর্তিত করেছি। কিন্তু ভাবে আকাশ-পাতাল পার্থক্য দাঁড়িয়েছে। শৈবলং পদের প্রতিবাক্যের সাথে আমরা কেবল ইতি মত্বা বাক্যাংশ অধ্যাহার করেছি। পৃশ্নি পদে শ্বেত। সুতরাং জরায়ুকে লক্ষ্য না করে ঐ পদে জ্ঞানকিরণকে লক্ষ্য করছে–বুঝছি। তাতে, মন্ত্রাংশের ভাব যা দাঁড়িয়েছে, বঙ্গানুবাদেই তা অভিব্যক্ত হয়েছে। পদ্মপস্থিত জলের মতো নির্লিপ্ত ভাবে সংসারে অবস্থান করে জ্ঞানের সেবাপরায়ণ হও–এটাই এখানকার তাৎপর্য বলে আমরা মনে করি। চতুর্থ অংশের শুনে পদের অর্থে ভাষ্যকার সমস্যা গণনা করেছেন। আমরা, ঐ পদকে গতার্থক শুন্ ধাতুর দ্বারা নিষ্পন্ন–শুন শব্দের সম্বোধনের রূপ বলে গ্রহণ করেছি। তাতে অর্থ আসে–গতাগতিশীল। যারা আত্মার উদ্ধারের জন্য চেষ্টা করতে না পেরে কর্মবন্ধকে কেবলই আবদ্ধ হয়ে সংসারে গতাগতি করে, ঐ পদে তাদেরই লক্ষ্য করছে। শুন শব্দে কুকুর ও নীচ প্রভৃতি অর্থ সেই কারণেই আসে। এখানে প্রার্থনাকারী নিজেকে নিজেই ঐ সম্বোধনে সম্বুদ্ধ করছেন। তাতে তাঁর আত্মগ্লানির ভাব প্রকাশ পাচ্ছে। মূলে জরায়ু পদ দুবার প্রযুক্ত দেখি। আমরা এক অর্থে জন্ম-সম্বন্ধং অন্য অর্থে জীবসম্বন্ধং প্রতিবাক্য গ্রহণ করেছি। তাতে প্রথমকে নাশের জন্য এবং শেষকে ভগবানের সাথে স্থাপন করবার জন্য ভাব প্রকাশ পেয়েছে। অব পদ্যতাং পদের,-আমরা মনে করি এটাই যথাযোগ্য প্রতিবাক্য-রক্ষকসকাশে বা ভগবৎ-সকাশে প্রেরয়তাং। জন্মসম্বন্ধ যাতে ছিন্ন হয় এবং ভগবানের সাথে সম্বন্ধ যাতে প্রতিষ্ঠিত হয়, তা-ই এখানকার লক্ষ্য। ইত্যাদি ৷৷ ৪৷৷..

.

পঞ্চম মন্ত্রঃ বি তে ভিনদ্মি মেহনং বি যোনিং বি গবীনিকে। বি মাতরং চ পুত্রং চ বি কুমারং জরায়ুণাব। জরায়ু পদ্যতাং ৫

বঙ্গানুবাদ –হে আমার জীবন! তোমার কর্মক্লেদরূপ উৎপত্তিমূল জন্মাধার-স্থানকে আমি বিচ্ছিন্ন করছি, তোমার উৎপত্তিসম্বন্ধযুত নাড়ীকেও আমি বিচ্ছিন্ন করছি; তোমার মাতৃস্নেহ-সম্বন্ধকে ও পুত্রস্নেহ-সম্বন্ধকে আমি বিচ্ছিন্ন করছি, এবং জরায়ুসম্বন্ধ বিশিষ্টের সাথে তোমার কৌমার অবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করছি। তোমার জরায়ুরূপ জন্মসম্বন্ধকে তুমি সেই রক্ষকসকাশে ১৮ প্রেরণ করো। (সংসার-বন্ধনের হেতুভূত সর্ববিধ সম্বন্ধ-স্নেহসম্বন্ধ, কাম-সম্বন্ধ প্রভৃতির বিচ্ছিন্ন করবার আকাঙ্ক্ষা মাত্র প্রকাশ পেয়েছে)। ৫।

মন্ত্ৰার্থআলোচনা –সুপ্রসব-পক্ষে এটি পঞ্চম মন্ত্র। তবে এ মন্ত্রটি পড়ে মনে হতে পারে, যেন কোনও যন্ত্র-ব্যবহারের দ্বারা সন্তান বাহির করা হচ্ছে। প্রত্নতত্বের পক্ষে এ মন্ত্রকে ধাত্রীবিজ্ঞানের পোষক মন্ত্র বলে মনে করা যেতে পারে। ভাষ্যের মতে, এই মন্ত্রের উচ্চারণের দ্বারা সুখপ্রসব সাধিত হয়।–সে অর্থ অসঙ্গত বলছি না। তবে, আমরা মনে করি, মন্ত্রের মধ্যে ক্লেদকর্মরূপ আত্ম-উৎপত্তির সম্বন্ধ ছিন্ন করবার সঙ্কল্প প্রকাশ পাচ্ছে। প্রকারান্তরে এক শ্রেণীর যোগসাধন বলেও মনে করা যেতে পারে। মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধন মূলক। মন্ত্রোচ্চারণকারী নিজেকে নিজে মুক্তির পথে অগ্রসর করছেন। কামসম্বন্ধই উৎপত্তির মূলীভূত। স্নেহ মায়া মমতা সবই তা হতে উৎপন্ন হয়। সাধক, এখানে প্রথম সেই সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করছেন। স্নেহ-মমতা ইত্যাদি বন্ধনের মূল। কাম-সঙ্গ তিনি প্রথমেই পরিত্যাগ করতে সঙ্কল্পবদ্ধ হলেন। তারপর মাতার স্নেহ, পুত্রের মমতা বা নির্ভরতা একে একে সমস্তই পরিহারের পক্ষে প্রতিজ্ঞা করলেন। পরিশেষে তার সঙ্কল্প হলো, জরায়ুর মধ্য দিয়ে সংসারে আর পরিভ্রমণ করবেন না। তাঁর জীব-সম্বন্ধকে তিনি ভগবৎ-পাদপদ্মে উৎসর্গ করলেন। ৫।

.

ষষ্ঠ মন্ত্রঃ যথা বাতো যথা মনো যথা পতন্তি পক্ষিণঃ। এবা ত্বং দশমাস্য সাকং জরায়ুণা পতাব জরায়ু পদ্যতাং ॥৬॥

 বঙ্গানুবাদ –হে গৰ্ভস্থশিশুবৎ সংসারজ্ঞানানভিজ্ঞ (হে দশাবস্থামধ্যগত)! জরায়ু সহ (জরায়ু যেমন বন্ধন মুক্ত হয়ে ভূপতিত হয় সেই রকম, অথবা জরায়ু অবস্থা হতেই) তুমি ভগবৎ সকাশে নিপতিত হও (তাতে আত্মসমর্পন করো); অবাধগতিহেতু যে প্রকারে বায়ু ত্বরিতগমনশীল, যে প্রকারে অপ্রতিবদ্ধ হয়ে মন শীঘ্রতর গতিবিশিষ্ট, পক্ষিগণ অপ্রতিহত-গতিনিবন্ধন যে প্রকারে আকাশমার্গে অবাধে উড্ডীয়মান হয়; তুমিও সেই প্রকারে তোমার জীব-সম্বন্ধকে (সকল বাধা হতে মুক্ত করে) রক্ষক সমীপে (ভগবৎ-সমীপে) প্রেরণ করো। (ভাবার্থ এই যে,–প্রতিবন্ধক-সমূহ অপসৃত হলে মানুষ সত্বরই ভগবানকে প্রাপ্ত হয়ে থাকে)। ৬

 মন্ত্রাৰ্থআলোচনা –এই মন্ত্র সুপ্রসব-সংক্রান্ত ষষ্ঠ বা শেষ মন্ত্র। দ্বিতীয় অনুবাকেও এটি শেষ। মন্ত্র।–ভাষ্যানুসারে এই মন্ত্রের অর্থ এই যে,–হে দশম-মাসীয় গর্ভস্থ শিশু! তুমি সত্বর গর্ভ হতে পতিত হও। বায়ু যেমন অবাধে গমন করে, মন যেমন যথেচ্ছ বিচরণ করতে সমর্থ হয়, পক্ষীসকল যেমন অবাধে আকাশে উড্ডীয়মান হয়ে থাকে; তুমিও সেইরূপ অবাধে গর্ভ হতে নির্গত হও। কোনরূপ বাধা যেন তোমাকে আটকিয়ে না রাখে।–আমাদের অর্থ অনুসারে মন্ত্রটিকে সংসার-বন্ধন মোচনের পক্ষে উদ্বোধনা-মূলক বলে মনে করা যেতে পারে। দশমাস্যা পদ ভাষ্যকারের মতে দশমাসকাল গর্ভে অবস্থিত শিশুর সম্বোধনে প্রযুক্ত হয়েছে। আমরা ঐ পদটিকে সংসার-জ্ঞানানভিজ্ঞ অর্থে প্রযুক্ত বলে মনে করেছি।

একটু দূর কল্পনায় ঐ পদে দশ-দশাপন্ন মনুষ্যমাত্রকেই বোঝাচ্ছে বলেও মনে করা যেতে পারে। যাই হোক, ঐ দশমাস্য সম্বোধনে বলা হয়েছে,তুমি জরায়ু সহ পতিত হও। আমরা বলি,–সে পক্ষে তার ভাব এই যে,-বন্ধনমুক্ত হলে প্রাণ যেমন সংসারে পতিত হয়, তুমি সেইভাবে ভগবৎ-পাদপদ্মে পতিত হও। সকল বন্ধন ছিন্ন করে তুমিও সেইরকম তাতে আত্মসমর্পণ করো।-পূর্ব মন্ত্রে সেই সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করার ভাবই ব্যক্ত হয়েছে। এ মন্ত্রে তা-ই দৃঢ়তার সাথে প্রখ্যাপিত হচ্ছে। এখানে যে তিনটি উপমার বিষয় আছে, সে তিনটিতেই অবাধ গতির ভাব প্রকাশ পাচ্ছে। বায়ু অবশ্যই দ্রুতগতিশীল; মনের ন্যায় দ্রুতগতি, সংসারে আর কার আছে? এই যে দ্রুত অবাধগতি, এই উপমার মধ্যেই বন্ধনমুক্তির ভাব প্রকট হয়ে রয়েছে। পক্ষিগণের গতির উপমায়ও সেই ভাবই ব্যক্ত করছে। বন্ধন-মুক্ত পক্ষিগণই আকাশে অবাধে বিচরণ করে। ঐ উপমা তিনটিতে লক্ষ্য করবার বিষয়-বন্ধনমুক্তি। এই সকল উপমাই যেন বলছে,-এখানে সংসারী মায়ামোহবদ্ধ জীবের প্রতি বন্ধনমোচনের উপদেশ আছে। এখানে মন্ত্র যেন তারস্বরে বলছে, রে ভ্রান্ত জীব! কেন তুমি নিত্য নিত্য অভিনব বন্ধনের ডোরে আবদ্ধ হচ্ছো? ভগবানের কর্মে আত্মনিয়োগ করো। তার শরণে আশ্রয় লও। বন্ধন হতে মুক্তিলাভ করবে। তাতেই পরমসুখ মোক্ষ তোমার অধিগত হয়ে আসবে। আমরা মনে করি এটাই এ মন্ত্রের শিক্ষা ৷ ৬ ৷৷

1 Comment
Collapse Comments
বিধান রায় । June 11, 2021 at 5:08 am

বাংলায় অর্থব বেদের অনুবাদ এবং ব‍্যাখ‍্যা করার জ
ন‍্য বাঙ্গালীরা বিশেষ উপকৃত হবেন। ধন‍্যবাদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *