1 of 3

০০. সম্পাদকের নিবেদন / ভূমিকা

অথর্ববেদসংহিতা
(একাধিক অথর্ববেদজ্ঞের ভাষ্যাদি অবলম্বনে)

সম্পাদকের নিবেদন

ঐশ্বরীয় জ্ঞান সমূহের ভাণ্ডার হলো ‘বেদ’। মানবসভ্যতার প্রারব্ধকাল থেকে সেই সর্বৈশ্বর্যবানদত্ত জ্ঞানরাশির দ্রষ্টা ঋষিবর্গ জীবনোপযোগী সকল জ্ঞান ঋক্, সাম, যজুঃ ও ছন্দ বেদে প্রকাশ করেছিলেন। ছন্দোবেদ, নামান্তরে অথর্ববেদ, আত্মজ্ঞানের জন্য প্রসিদ্ধ। এই কারণে এই চতুর্থ বেদটি আরও নানা নামে বিরাজিত; যথা,-‘ব্রহ্মবেদ’, ‘আত্মবেদ’, ‘অমৃতবেদ’ ইত্যাদি। পৌরাণিক মতে ব্রহ্মর উত্তর (মতান্তরে পূর্ব মুখ থেকে এই বেদটির উৎপত্তি।

বিষ্ণুপুরাণ মতে-অমিততেজস্বী মুনিবর সুমন্তু তার কবন্ধনামক শিষ্যকে অথর্ববেদ অধ্যয়ন করালেন। কবন্ধও অথর্ববেদকে দু’ভাগে ভাগ করে দেবদর্শ ও পথ্য নামে দু’জন শিষ্যকে অধ্যয়ন করান। মৌগ, ব্রহ্মবলি, শৌক্তায়নি ও পিপ্পলাদ–এঁরা দেবদর্শের শিষ্য। পথ্যের তিনজন শিষ্য– জাজলি, কুমুদাদি ও শৌনক। শৌনক আবার নিজের অধীত সংহিতা দু’ভাগ করে একটি শাখা বকে ও একটি শাখা সৈন্ধবায়নকে পাঠ করান। সৈন্ধব ও মুঞ্জকেশ আপন আপন সংহিতা দুই দুই ভাগে বিভক্ত করলেন। নক্ষত্রকল্প, বেদকল্প, সংহিতাকল্প, আঙ্গিরসকল্প ও শান্তিকল্প–এই পাঁচ ভাগ সংহিতাসকলের বিকল্পক এবং অথর্ববেদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। (বি.পু, ৩/৬/৯১৫)।

ঐতিহাসিক তথ্যের বিচারে দেখা যায়–অথর্ববেদটি নয়টি (পৈপ্পলাদ, তৌদ, মৌগ, শৌনক, জাজল, জলদ, ব্রহ্মবেদ, দেবদর্শ ও চারণবৈদ্য) শাখায় বিভক্ত হয়ে মানুষের অন্তর্নিহিত জ্ঞানরাশিসমূহকে প্রকাশের ও প্রয়োগের মাধ্যমে সাংসারিক জীবনে অভীষ্ট লাভের সহজ পন্থা, দেখিয়ে দিয়েছিল। অথর্ববেদের বিভিন্ন শাখার মধ্যে সামান্য সামান্য পাঠভেদ ও প্রয়োগভেদ থাকলেও দু’টি ছাড়া অন্যগুলি বর্তমানে লুপ্তপ্রায়। সাম্প্রতিক কালে পৈপ্পলাদ ও শৌনক শাখাদু’টি যথাক্রমে পূর্বভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের এবং পশ্চিম ভারতের গুজরাট-মহারাষ্ট্র প্রদেশের (প্রাচীন রাষ্ট্রকূটের) অংশবিশেষে বিরাজ করছে। এই দুই শাখার মধ্যেও অল্পস্বল্প পাঠভেদ ও প্রয়োগভেদ থাকলেও মূল বিষয়ে দু’টিরই লক্ষ্য এক।

অবিভক্ত বঙ্গে যখন বেদচর্চার প্রচলন ছিল, তখন অথর্ববেদের শৌনক শাখাই অবলম্বিত হতো। এখন সংস্কৃত ভাষায় আমাদের দীনতার কারণে দু’একটি প্রাচীন টোলে কিংবা পাঠাগারে। শৌনক-শাখার অথর্ববেদ পাওয়া যায়। মধ্যবর্তী কালে উড়িষ্যা রাজ্যে পৈপ্পলাদ-শাখার অথর্ববেদ খুবই ত্রুটিপূর্ণ অবস্থায় প্রচলিত থাকলেও, বর্তমানে ত্রুটিহীন সংকলন উদ্ধার করা হয়েছে। এর জন্য শ্রীক্ষেত্রবাসী পণ্ডিতবর কুঞ্জবিহারী উপাধ্যায়ের অসীম উদ্যম স্বয়ং প্রত্যক্ষ করেছি। আমরা আমাদের অনুবাদ কর্মের সুবিধার্থে পশ্চিম ভারতে প্রাপ্তব্য অথর্ববেদ-সংহিতার শৌনক-শাখাভুক্ত একাধিক হিন্দী-সংকলন তার মাধ্যমেই লাভ করতে পেরেছি। এরই ফলস্বরূপ আমাদের অথর্ববেদ-সংহিতাটি সম্পূর্ণাংশে অনূদিত হতে পেরেছে। বলা বাহুল্য, সায়ণাচার্যের ভাষ্যানুলম্বনে স্বর্গীয় দুর্গাদাস লাহিড়ী মহাশয়ের গ্রন্থেও এই অনুবাদ অসম্পূর্ণই ছিল। কারণ সায়ণাচার্য স্বয়ংই সম্পূর্ণ অথর্ববেদ-সংহিতার ভাষ্যরচনা থেকে বিরত থেকেছেন। আমাদের সৌভাগ্য, আমরা বাংলা ভাষায় এর সম্পূর্ণ বঙ্গানুবাদ সুধী পাঠক-পাঠিকার করকমলে অর্পণ করতে পেরেছি। অবশ্য ) অথর্ববেদের ব্রাহ্মণ-সূত্র-ভাষ্য-কল্প ইত্যাদি সকল মৌলিক গ্রন্থগুলি আগে থেকেই সুরক্ষিত আছে। গোপথ ব্রাহ্মণ হলো অথর্ববেদের ব্রাহ্মণ। উপনিষৎ–প্রশ্ন, মুণ্ডক ও মাণ্ডুক্য। পাঁচটি কল্পসংহিতা নক্ষত্ৰকল্প (নক্ষত্রপূজার বিধি), বেদকল্প (ব্রহ্ম ও ঋত্বিক সম্পর্কিত বিষয়), সংহিতাকল্প (মন্ত্রবিধি সম্পর্কিত বিষয়), আঙ্গিরসকল্প (অভিচার-ব্যবস্থা সম্পর্কীয় তথ্যাবলী) ও শান্তিকল্প (অশ্ব, হস্তী ইত্যাদি পশুপালন বিষয়ক নির্দেশ সমূহ)।

*

অথর্ববেদের উপযোগিতা এবং অপর তিনটি বেদের সাথে এর অভেদত্ব, অথর্ববেদের আলোচ্য এবং ভগবৎ-তত্ত্ব, অথর্ববেদের কাল ও ভেদের ভাষ্যকার এবং সায়ণ-ভায্যের পক্ষাপক্ষ ইত্যাদি সম্পর্কে স্বর্গীয় দুর্গাদাসের সুচিন্তিত ভূমিকা আমাদের এই গ্রন্থে অবিকল মুদ্রিত হওয়ায় পুনরায় সেগুলির স্বতন্ত্র আলোচনা ধৃষ্টতারই নামান্তর; কারণ স্বর্গীয় লাহিড়ী মহাশয় অপেক্ষা বেদ সম্পর্কে অধিকতর অভিজ্ঞ জনের সন্ধান এ পর্যন্ত আমরা পাইনি।

আমরা আমাদের এই সংস্করণটির সজ্জা সম্পর্কে পাঠকদের কিছু জানাতে চাই। আমরা মূল পুঁথির অনুসরণে কাণ্ড, অনুবাক ইত্যাদিক্রমে মন্ত্রগুলি সাজিয়েছি। কিন্তু মন্ত্রের লৌকিক প্রয়োগ যে ভাবেই নিষ্পন্ন হোক সে বিষয়ে আমাদের কোন বক্তব্যই রাখিনি। তবে প্রথম কাণ্ডের প্রতিটি মন্ত্রের সবরকম ব্যাখ্যা দিতেও আমরা পশ্চাৎপদ হইনি। দ্বিতীয় কাণ্ড থেকে বঙ্গানুবাদগুলি আক্ষরিক ভাবেই করা হয়েছে। অনুবাদের বিশেষ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। উদ্দেশ্য এই যে, লৌকিক ক্রিয়াকাণ্ডের ক্ষেত্রে সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণের পরিবর্তে এই অনূদিত মন্ত্রগুলি পাঠ করলেও সুফল। পাওয়া যেতে পারবে। তবে মনে রাখবেন, স্বার্থকেন্দ্রিক আভিচারিক ক্রিয়ার সাধন দক্ষজন ব্যতীত অপরের পক্ষে ক্ষতিকর।

*

সূক্তস্য বিনিয়োগঃ অংশে ভাষ্যানুক্রমণিকার প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ প্রসঙ্গগুলি সবিস্তারে উল্লেখ করেছি। কোন কোন ক্ষেত্রে সূত্রের কেবলমাত্র উল্লেখ নয়, সূত্রের সম্পূর্ণ পংক্তিরও উল্লেখ করেছি। কিন্তু টীকায় সাধারণের জ্ঞাতব্য সংক্ষিপ্ত নির্দেশটুকুই দেওয়া হয়েছে; কারণ আমরা মনে করি, এই মন্ত্রগুলির বিনিয়োগে অভিচার-কুশল সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতজনেরই সাহায্য নেওয়া উচিত; নচেৎ বিপত্তির কারণ সংঘটনের সম্ভাবনা থেকে যায়। তবে কোন্ মন্ত্রে কোন্ অভিচার কিংবা কোন্ ব্যাধির কি ভেযজ তা জানার জন্য ‘টীকা’ অংশ অবশ্যই সহায়ক হতে পারে। আমরা প্রতিটি সূক্তের যথাযথ ঋষি, দেবতা ও ছন্দের উল্লেখ রাখায় মন্ত্রের বিনিয়োগ সম্পূর্ণতা পাবে।

*

আমরা মন্ত্রের বঙ্গানুবাদের ক্ষেত্রে উচ্চারণকেন্দ্রিক চলতি অক্ষরবিন্যাস অনুসরণ করেছি। এর উদ্দেশ্য, এই মন্ত্রগুলি বাংলায় সাবলীলভাবে বোধগম্য ও উচ্চারিত হওয়া প্রয়োজন। তাতেও কাজ হবে। ভাষার কৃত্রিমতায় এই মন্ত্রগুলি যাতে বিকৃত হতে না পারে, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য সেটাই।

আমরা সূচীপত্রে প্রতিটি কাণ্ডের সূক্তগুলি (১) (২) ইত্যাদি পর্যায়ক্রমে শেষ সংখ্যাটি পর্যন্ত উল্লেখ করেছি। আবার ওরই মধ্যে অনুবাক অনুসারে সূক্তগুলিকে বিন্যাস করা হয়েছে। যেমন, ধরা যাক,–কোন একটি সূক্তের সন্ধান প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে ‘(২/১৭)’, অর্থাৎ ২য় কাণ্ডের ১৭শ সূক্ত কিংবা ‘(২/৩/৭)’, অর্থাৎ ২য় কাণ্ডের ৩য় অনুবাকের ৭ম সূক্ত। বস্তুতঃ, দু’ ধরনের উল্লেখ একই সূক্তের নির্দেশক। দেখুন, সূক্তটির নাম ‘বলপ্রাপ্তি। আবার ‘(২/৩/৭/৪)’, অর্থাৎ ২য় কাণ্ডের ৩য় অনুবাকের ৭ম সূক্তের ৪র্থ মন্ত্র। সূচীপত্রকে অনুসরণ করে ঐ সূক্তে (অর্থাৎ ‘ওজোহস্যোজো মে’ ইত্যাদি সূক্তে) পৌঁছে ৪র্থ মন্ত্র দেখুন–আয়ুরস্যায়ুর্মে দাঃ স্বাহা। অর্থাৎ ‘(কাণ্ড। সূক্ত)’, ‘(কাণ্ড। অনুবাক। সূক্ত)’, (কাণ্ড। অনুবাক। সূক্ত। মন্ত্র)–টীকা অংশে এইভাবেই কোন সূক্ত বা মন্ত্রাংশের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

*

আচার্য সায়ণকে অবলম্বন করে পণ্ডিতাগ্রগণ্য দুর্গাদাস মহাশয়ের নিজস্ব চিন্তাধারার মিশ্রণে বিগঠিত শৌনক-শাখাভুক্ত ‘অথর্ববেদ-সংহিতা’ আমরা পেয়েছি এবং প্রয়োজন মতো এর সাহায্য গ্রহণ করেছি, বিশেষতঃ প্রথম কাণ্ডটির আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা। কিন্তু কেবলমাত্র তাকেই অনুসরণ করে। যাঁরা বাংলায় ‘অথর্ববেদ-সংহিতা সম্পাদনা করেছেন, তাঁদের গ্রন্থে সঙ্গত কারণেই সম্পূর্ণ বঙ্গানুবাদ দেওয়া যায়নি। পূর্বে ‘আথর্ববেদ- পৈপ্পলাদসংহিতা’ অর্থাৎ পৈপ্পলাদ শাখান্তর্গত অথর্ববেদ-সংহিতা গ্রন্থের ত্রুটিহীন সংস্করণের উদ্ধারকর্তা উপাধ্যায় মহাশয়ের কথা বলা হয়েছে। তারই সৌজন্যে শ্রীরাম শর্মা আচার্য সম্পাদিত শৌনক-সম্প্রদায়ের “অথর্ববেদ’ গ্রন্থটি পেয়ে যথেষ্ট উপকৃত হয়েছি। হিন্দীতে আরও অনেকগুলি সংকন দেখেছি; কিন্তু উৎকর্ষের বিচারে সেগুলি এর ধারে-কাছে রাখার যোগ্য নয়।

*

সর্ববিদ্যাবিশারদ অথর্বাচার্যগণ মানবজীবনের পক্ষে আবশ্যক সবরকমের বিদ্যা ও জ্ঞান এই অথর্ববেদে ভরে দিয়েছেন। শ্রীরাম শর্মা আচার্য মহাশয়ের অনুসরণে সেই বিদ্যার সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নে প্রদত্ত হলো–

(১) স্থালী পাকঃ (অন্নসিদ্ধি)। (২) মেধাজনন (বুদ্ধিবৃদ্ধির উপায় সমূহ)। (৩) ব্রহ্মচর্যম্ (বীর্যরক্ষণ, ব্রহ্মচর্যব্রত ইত্যাদি)। (৪) গ্রাম-নগর-রাষ্ট্র বর্ধন (গ্রাম, নগর, দুর্গ, রাজ্য ইত্যাদি প্রাপ্তি এবং সেগুলির সংবর্ধন)। (৫) পুত্র-পশু-ধন-ধান্য-প্রজা-স্ত্রী, করী, তুরগরথান্দোলিকাদি সম্পৎসাধিকানি (পুত্র,পশু, ধন, ধান্য, প্রজা, স্ত্রী, হাতি, ঘোড়া, রথ, পালকি ইত্যাদির সিদ্ধির উপায়)। (৬) সাম্মনস্যম্ (জনতার মধ্যে ঐক্য, মিলন, প্রেম, সহযোগিতা ইত্যাদি স্থাপনার উপায়)। (৭) রাজ-কর্ম (রাজার কর্তব্য এবং আবশ্যক কর্ম)। (৮) শত্ৰু-ত্রাসন (শত্রুকে কষ্ট প্রদান এবং বিনষ্ট করণের উপায়)। (৯) সংগ্রাম-বিজয় (যুদ্ধে বিজয় সম্পাদন)। (১০) শস্ত্র নিবারণম্ (শত্রুর ব্যবহার-কৃত প্রহরণ এবং সেই অস্ত্রের দ্বারা আক্রমণ প্রতিহত বা নিবারণ করণ)। (১১) পরসেনা মোহনম্ (শত্রুসেনায় মোহ, ভ্রম উৎপন্ন করণ; তাদের মধ্যে উদ্বেগ ভাব উৎপন্ন করণ, তাদের গতি রোধ করণ, তাদের উৎপাটিত করণ ইত্যাদি সাধন)। (১২) স্বসেনোৎসাই পরিরক্ষণ (আপন সেনাগণের উৎসাহ বর্ধন এবং তাদের নির্ভয় করণ)। (১৩) সংগ্রামে জয়-পরাজয় পরীক্ষা (যুদ্ধে জয় হবে বা পরাজয়, প্রথমেই তা বিচার করে নেওয়া)। (১৪) সেনাপত্যাদি প্রধান পুরুষ জয় কর্মাণি (সেনাপতি, মন্ত্রী, অমাত্য ইত্যাদি প্রধান রাজ্যাধিকারীগণকে নিয়ন্ত্রণে রক্ষণ)। (১৫) পর সেনাসঞ্চারণম্ (শত্রুসেনার মধ্যে গুপ্ত রীতিতে সঞ্চার পূর্বক তাদের সকল ভেদ জ্ঞাত হওন এবং তাদের থেকে নিজের উপর আসন্ন অনিষ্টর প্রতিকারের ব্যবস্থা করণ)। (১৬) শত্রুৎসাদিতস্য রাজ্ঞঃ পুনঃ স্বরাষ্ট্র প্রবেশনম্ (শত্রু দ্বারা উৎসাদিত হওয়া আপন রাজাকে পুনরায় স্বরাষ্ট্রে স্থাপন করণের যোজনা)। (১৭) পাপক্ষয় কর্ম (পতনের কারণসমূহের দূরীকরণ এবং প্রায়শ্চিত্তকরণ)। (১৮) গোসমৃদ্ধিকৃষি পুষ্টিতরাণি (গো, বলদ ইত্যাদির সংবর্ধন এবং কৃষিকার্যের বিকাশ সাধিত করণ)। (১৯) গৃহম্মৎকরাণি (ঘরের শোভা ও বৈভব বৃদ্ধির কর্ম)। (২০) ভৈষজ্যানি (রোগ নিবারক ঔষধি সম্পর্কে জ্ঞান)। (২১) গর্ভাধান ইত্যাদি কর্ম (গর্ভাধান থেকে সমস্ত আবশ্যকীয় সংস্কার)। (২২) সভাজয় সাধনম্ (সভাতে, বিবাদে জয় প্রাপ্ত করণ এবং কলহ শান্তির উপায়)। (২৩) বৃষ্টি সাধন (যোগ্য সময়ে বৃষ্টি বর্ষণের উপায়)। (২৪) উত্থান কর্ম (শত্রুর উপর আক্রমণ করণ)। (২৫) বাণিজ্য লাভঃ (দেশ-বিদেশে ব্যবসায়ের বৃদ্ধি সাধন পূর্বক লাভ ওঠানো)। (২৬) ঋণ বিমোচন (দ্বিতীয় লোককে প্রদত্ত ঋণের আদায় সম্পর্কিত বিধিসমূহ এবং নিজেকে ঋণ থেকে মুক্তি সম্পর্কিত উপায়সমূহ)। (২৭) অভিচার নিবারণম্ (ব্যক্তিগত অথবা সামাজিক শত্রুগণের দ্বারা প্রযোজ্য নাশকারী বিধিসমূহ থেকে ত্রাণ প্রাপ্তির উপায়)। (২৮) অভিচারঃ (শত্রুনাশের উপায় করণ)। (২৯) স্বস্ত্যয়ন। (কুশলপূর্বক দেশ দেশান্তরে ভ্রমণ করণ)। (৩০) আয়ুষ্যম্ (দীর্ঘ আয়ু ও সুদৃশ স্বাস্থ্য প্রাপ্তির সাধন)। (৩১) যজ্ঞ-যাগ (কল্যাণকরী যজ্ঞ সমূহের ক্রিয়া)।

অর্থাৎ,

পরবর্তী কালে উদ্ভূত বিভিন্ন তন্ত্রশাস্ত্রসম্মত মারণ (বধের উদ্দেশে অভিচার বিশেষ), উচাটন (শত্রুর হৃদয়ে উৎকণ্ঠা বা ব্যাকুলতা সঞ্চারণ), বশীকরণ (শত্রুদের বা পতিকে বা পত্নীকে স্ববশে আনয়নের জন্য অভিচারক্রিয়া) এবং প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের উৎসের নাম অথর্ববেদ-সংহিতা। অত্যন্ত স্বার্থকেন্দ্রিক উদ্দেশ্য সাধনের সার্থক আকর এই বেদটিতে সমগ্র মানবজাতির মঙ্গলকর মন্ত্র ও ক্রিয়াও আছে প্রচুর। যেমন,-মেধাজনন (১কা.। ১ সূ.); সংগ্রামজয়ের কারণ বাণের উৎপত্তি, জ্বরাতিসার প্রভৃতি রোগের শান্তির জন্য ও পুষ্পভিষেক (১২); মূত্রপুরীষ নিরোধের প্রতিকার, D অপর ক্লেশপ্রদ ব্যাধির উপশম (১৩); রাক্ষস পিশাচগণের বিনাশ (১৭); সম্পত্তি কামনাকারীর সম্পত্তিলাভ, রাজ্যচ্যুত রাজার পুনরায় রাজ্যলাভ, আয়ুষ্কাম ব্যক্তির আয়ুলাভের নিমিত্ত ক্রিয়া ইত্যাদি (১৯); অশনিপাত নিবারণ (১১৩); স্ত্রী বা পুরুষের দুর্ভাগ্য নিবারণ (১১৪); স্ত্রীলোকের ব্যাধিজনিত রজোরক্তস্রাব বন্ধ করণ (১১৭), স্ত্রীলোকের দুশ্চিহ্ন ও দুর্লক্ষণ দূরীকরণ, (১১৮); সংগ্রামজয় (১১৯); হৃদ্রোগ ও কামিলা ইত্যাদি রোগের শান্তি (১২২); শ্বেতকুষ্ঠ ও পলিত কুষ্ঠের নাশ (১২৩); জ্বর ইত্যাদি রোগ নিবারণ (১২৫); রাজ্যের অভিবৃদ্ধি (১২৯); বিভিন্ন কার্যে ব্যবহার বন্ধ্যা নারীর পুত্র-জনন ইত্যাদি (১৩২); সম্পকর্মে, আয়ুষ্কামনায় ও উপনয়ন কর্মে ব্যবহৃত ক্রিয়া ও মন্ত্রাবলী (১৩৫); আভিচারিক কর্মজনিত বিঘ্নরাশির বিনাশন (২৪); শাপমোচন (২১৭); স্ত্রীবশীকরণ (২৩০); অবিবাহিত কন্যার পতিলাভের মন্ত্র (২৩৬); সপত্নী ও বিবাদজয় কর্মে মন্ত্র ও ওষধি (৩১৮); পুংসবনকর্ম (৩২৩); বশীকরণ মন্ত্র ইত্যাদি (৩।২৫); ব্যাঘ্র, চোর প্রভৃতির ভয় নিবৃত্তি (৪। ৩); পুরুষের বীর্যকরণ (৪। ৪); স্ত্রীর প্রতি অভিগমনকালে পার্শ্ববতী জনগণকে নিদ্রাভিভূত করণ (৪। ৫); অস্ত্রাঘাতে রক্তপাত বন্ধ করণ, অস্থিভঙ্গের নিরাময় (৪। ১২); সত্য ও মিথ্যার সমীক্ষা, ধূমকেতুর উৎপাতশান্তি (৪। ১৬); ব্রহ্মমুখের ওদন যজ্ঞে বিনিয়োগ (৪। ৩৪); ভূতগ্রই ইত্যাদির উচ্চাটন (৪। ৩৬); দুতজয় কর্মে অক্ষসমূহের অভিমন্ত্রণ (৪। ৩৮); তেজোলাভ, বিজয় প্রার্থনা, পুষ্টিকামনা ও সম্পত্তি বিভাজন (৫। ৩); রোগীর আবোগ্য বিজ্ঞান, স্ত্রীলোকের প্রসবদোষ ও সূতিকারোগের নিরাময় (৫। ৬); চক্ষুরোগের চিকিৎসা (৬। ১৬); স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের ক্রোধ অপনয়ন (৬ ৪২); দুঃস্বপ্ন দর্শনের দোষ নিবৃত্তি (৬। ৪৫); শত্ৰুপত্মীর বন্ধ্যাকরণ (৭। ৩৪); বিরাট-পুরুষ সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর (৮। ৯-১৫); অতিথির মাহাত্ম (৯। ৬-১০); শিরোরোগের চিকিৎসায় মন্ত্রের প্রয়োগ (৯। ১২); যম-যমী সংবাদ (১৮। ১-২); ইত্যাদি; এবং পরিশেষে বৈদিক ব্রহ্মবিদ্যার মার্মিক রীতিতে মন্ত্রের বিবেচনা, যা আত্মবিদ্যা নামে কথিত এবং সদা গুপ্তবিদ্যা নামে পরিচিত। এই অন্তিম মন্ত্রের দ্বারা ব্রহ্ম ও জীবের একতা সামান্য ক’টি কথার মাধ্যমে অতি নিপুণ ভাবে প্রকাশ করে দেওয়া হয়েছে। ঋগ্বেদ-সংহিতায় যেমন বলা হয়েছে (১ম মণ্ডল, ৯০ সূক্ত)–সৎকর্মপরায়ণ মনুষ্যের তৃপ্তিসাধনের জন্য জগতের সকল পদার্থ সর্বদাই প্রস্তুত থাকুক; তাদের জন্য বায়ুসকল মাধুর্যোপেত কর্মফল বর্ষণ করুক–অর্থাৎ পরমানন্দ প্রদান করুক; এবং নদী সমুদ্র ইত্যাদি সলিলরাশি মধুর রস ক্ষরণ করুক–পরমানন্দ প্রদান করুক। ফলপাকান্তা ওষধিগণের ন্যায় কর্মফলের অবসানকারক সৎকর্মপরায়ণ আমাদের সৎ-বৃত্তি-সমূহ পরমানন্দপ্রদ হোক। অতএব ওষধিসমূহ মধুময় হোক; রাত্রি ও উষা মধুর হোক, জনপদ মাধুর্যবিশিষ্ট হোক, আকাশ মধুযুক্ত হোক, বনস্পতি মধুর হোক, সূর্য মধুর হোক, ধেনুসকল মধুর হোক। রাত্রি (অথবা অজ্ঞানতার অন্ধকার) মাধুর্যফলপ্রদ (সৎকর্মকারক সুফলপ্রদ) হোক; এবং উযাকাল-উপলক্ষিত দিবস-সকল (অথবা জ্ঞানের উন্মেষ) মাধুর্যোপেত সুফলপ্রদ হোক; এবং আমাদের পালক-রক্ষক স্বর্গলোক মাধুর্যোপেত সুফলপ্রদ হয়ে উঠুক। ইত্যাদি। এইরকম ভাবেই অথর্ববেদের ঐ অন্তিম মন্ত্রে বলা হয়েছে–আমাদের ওষধিগুলি অর্থাৎ শস্যসমূহ ও বৃষ্টির জল মধুযুক্ত হোক; অন্তরিক্ষলোক ইত্যাদি মধুযুক্ত হোক, যজমান মধুযুক্ত হোক এবং আমরা যেন বিদ্বেষশূন্য হয়ে বিচরণ করতে সমর্থ হই।–ওঁ মধু, ওঁ মধু, ওঁ মধু ৷৷

১লা বৈশাখ, ১৪১৯ বঙ্গাব্দ।
হাওড়া
শ্রীদিলীপ মুখোপাধ্যায়

.

সম্পাদকের পরিচিতি

পুরা যথা মহাভাগো
ব্যাসঃ সত্যবতীসূতঃ।
বেদানাং প্রবিভাগেন।
শশ্বৎ কীর্তিং পূরাং গতঃ ॥১॥

অন্যেহপি কবয়ঃ সর্বে।
ব্যাসমার্গানুগামিনঃ।
যশোলেশমনুপ্রাপুঃ
প্রান্স্যন্তি চ তথাহপরে ॥ ২॥

অদ্যাপি সূনুরানৃণ্যং
শ্ৰীনিকুঞ্জবিহারিণঃ।
যঃ কশ্চন দিলীপাখ্যঃ
শ্রীমান্ সত্যবতীসুতঃ ॥ ৩৷৷

কুর্ব ব্যাসবিধানস্য।
তপ্রবন্ধনিবন্ধনাৎ।
সতামাশীর্ভিরুদ্দীপ্তঃ
শশ্বজ্জীবতু সম্মতঃ ।৪।

–ইতি বিদুষাং বিধেয়স্য
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়সংস্কৃতধ্যাপকস্য
শ্রীসুখময় মুখোপাধ্যায়স্য।

.

অথর্ববেদসংহিতা — ভূমিকা (স্বর্গীয় দুর্গাদাস লাহিড়ী কর্তৃক রচিত)

“যথৈকপাৎ পুরুষো যন্ অনুভয়চক্রো বা রথো বর্তমানে
ভ্রেষং নেতি এবমেবাস্য যজ্ঞো
ভ্রেষং নেতি।”–ইতি শ্রুতে।

*

অথর্ববেদের উপযোগিতা

সাধারণতঃ একটা ধারণা আছে,-ঋক, যজুঃ, সাম এই তিন বেদের তুলনায় অথর্ববেদের উপযোগিতা অতি অল্পই পরিলক্ষিত হয়। এক সময় আমাদেরও সেই ধারণা ছিল। বেদের ত্রয়ী নাম দৃষ্টে এবং ‘অথর্ব এই সংজ্ঞার প্রচলিত অর্থ দেখে, পূর্বোক্তরূপ ধারণাই বদ্ধমূল হয়। ত্রয়ী শব্দে ঋক্ সাম যজুঃ আর অথর্ব শব্দে যজ্ঞকর্মে অব্যবহার্য, সুতরাং অথর্ব,–এইরকম অর্থ প্রচলিত আছে। কেন যে এই রকম অর্থ প্রচলিত, তার মূল অনুসন্ধান করে পাওয়া সুকঠিন। অথর্ববেদাধ্যায়িগণের প্রতি ঈর্ষা-বশতঃ, অন্য বেদাধ্যায়িগণের কেউ, সম্ভবতঃ ‘অথর্ব’ শব্দের ঐরকম অর্থ পরিকল্পনা ও প্রচার করে যান; তারই ফলে এখন ঐ ভাব বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। প্রকৃতপক্ষে কিন্তু অথর্ববেদের উপযোগিতা সর্বত্রই পরিলক্ষিত হয়। উপরে যে শ্রুতিবাক্য উদ্ধৃত হয়েছে, এ বিষয়ে তা-ই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। শ্রুতি বলেছেন,’একপদ-বিশিষ্ট পুরুষ যেমন গমন-বিষয়ে অশক্ত, অথবা একটি মাত্র চক্রযুক্ত রথ যেমন গমনে অশক্ত, সেইরকম ব্রহ্মহীন (অথর্ব মন্ত্রহীন) যজ্ঞও নিষ্ফল বলে জানবে।

*

 চতুর্বেদের অভেদসম্বন্ধ

যজ্ঞের কর্ম চতুর্বিধ,–হোতৃ, উদ্গাতৃ, অধ্বর্য এবং ব্রহ্ম। ঋক ইত্যাদি বেদত্রয়ে প্রথমোক্ত তিন কর্ম সম্পাদিত হয়। চতুর্থ যে ব্রহ্মকর্ম, তা অথর্ববেদ-সাপেক্ষ। এমন কি, শ্রুতিতে আছে,যজ্ঞকর্ম দুভাগে বিভক্ত; তার এক ভাগ প্রথমোক্ত তিন বেদের দ্বারা নিষ্পন্ন হয় এবং শেষভাগ অথর্ববেদের উপর নির্ভর করে। এ বিষয়ে (সায়ণাচার্যকৃত) অনুক্রমণিকা অংশে বিশদ আলোচনা দৃষ্ট হবে। আমরা আভাষ-মাত্র প্রদান করলাম। বেদের যে নাম ত্রয়ী হয়েছিল, তার উদ্দেশ্য অন্যরকম। পদ্যাংশ, গদ্যাংশ, গান (ঋক, যজুঃ, সাম)–বেদের মধ্যে এই তিনই আছে বলে বেদের নাম–  ত্রয়ী হয়। নচেৎ, কেবলই যে পদ্য, কেবলই যে গদ্য, কেবলই যে গান নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বেদ গ্রথিত আছে, তা-ও বলতে পারি না। দৃষ্টান্ত স্থলে যজুর্বেদের উল্লেখ করছি। সাধারণতঃ ধারণা, যজুর্বেদ বুঝি সম্পূর্ণভাবে গদ্যাংশেই পূর্ণ। কিন্তু বাস্তব তা নয়। তার মধ্যে পদ্য আছে, গদ্য আছে; আবার সূক্ষ্ম-দৃষ্টিতে দেখলে, গানও আছে। সামবেদ বলতে কেবল গানই বোঝায় না। অধিকাংশ ঋকই সামগানের অন্তর্ভূক্ত হয়ে আছে। আবার মন্ত্র ইত্যাদির প্রয়োগ-কালে পদ্য ও গদ্য দুই-ই, কি ঋকে কি সামে, প্রযুক্ত দেখতে পাই। অথর্ববেদের মধ্যেও এইরকম গদ্য, পদ্য, গান (ঋক্, যজুঃ, সাম) তিনই আছে। অতএব এই ভাবেও চতুর্বেদের সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করা যায় না।

*

ঐহিক ও পারত্রিক তবে অথর্ববেদের একটি বিশেষত্ব লক্ষ্য করা যেতে পারে। ঋক, যজুঃ, সাম বেদত্রয় প্রধানতঃ পারত্রিকের পথ প্রদর্শন করেছেন। অথর্ববেদের মন্ত্রগুলি ঐহিক ও পারত্রিক দুই পথেরই শ্রেয়ঃসাধনের উপায় প্রদর্শন করছেন। যদি ঐহিক অশান্তিতে চিরদগ্ধীভূত হতে হলো; তাহলে পারত্রিকের কার্যে প্রবৃত্তি কতক্ষণ অবিচলিত থাকতে পারে? সে পক্ষে অথর্ববেদের উপযোগিতার বিষয় ইয়ত্তা হয় না। আয়ুর্বেদের প্রবর্তনা কালে ঋষিগণ খ্যাপন করেছিলেন,–দেহ-রক্ষা ভিন্ন শরীরকে আধি-ব্যাধি-শূন্য করতে না পারলে, দেবকার্য সম্পাদনে বিঘ্ন ঘটতে পারে; তাই আয়ুর্বেদের প্রবর্তনা। অথর্ববেদ–সেই আয়ুর্বেদের পিতৃস্থানীয়। অথর্ববেদের লক্ষ্য-কিসে দেহ সুস্থ ও মন প্রফুল্ল থাকে, কি ভাবে জ্ঞানলাভ হয়, কি রকমে অন্তঃশত্রুকে দমন করা যায়, কি পদ্ধতিতে ত্রিবিধ দুঃখের হস্ত হতে নিষ্কৃতি লাভ হয়। শাস্ত্র বলেন–অথর্ববেদের মন্ত্রসমূহ চাক্ষুষফলপ্রদ। অথর্ববেদের অঙ্গীভূত আয়ুর্বেদের বিষয় চিন্তা করলেই এটা বোধগম্য হতে পারে। দ্রব্যগুণ ও মন্ত্রগুণ উভয়ে একত্র কার্য করলে যে কি ফল প্রাপ্ত হওয়া যায়, অথর্ববেদে সেই তথ্য প্রকাশিত দেখি। মন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রের সাধনোপযোগী দ্রব্যের ব্যবহারে অথর্ববিদগণ এককালে অসাধ্য সাধন করে গেছেন। প্রয়োগবিধি অজ্ঞাত থাকায়, মন্ত্র-উচ্চারণ ইত্যাদি ও মন্ত্র-প্রয়োগের ক্রিয়া-পদ্ধতিতে আমরা অভিজ্ঞ না হওয়ায়, অধনা মন্ত্র-কথিত ফল প্রাপ্ত হই না; সতরাং অথর্ববেদকে অথর্ব করে রেখেছি। নচেৎ, অথর্ববেদে যে সকল মন্ত্র আছে, সেই সমুদায়ের প্রয়োজনীয়তার বিষয় অনুধাবন করলে, অথর্ববেদ যে সর্বাগ্রে পঠনীয়, তা আপনা-আপনিই উপলব্ধ হয়। অথর্ববেদের প্রথম মন্ত্র মেধাজননমূলক(১)। সেই মন্ত্র আবৃত্তি করলে বা সেই মন্ত্রের অনুসারী কার্য করলে, বিদ্যাধিষ্ঠাত্রী বাক্‌-দেবীর কৃপা প্রাপ্ত হওয়া যায়। এইরকম মেধাজনন থেকে আরম্ভ করে, সংসারে মানুষের যা কিছু আবশ্যক, সেই সকল বিষয়ই অথর্ববেদে বিহিত হয়েছে।

১। ব্রাহ্মণ-সর্বস্ব-প্রণেতা হলায়ুধের মতে প্রথম মন্ত্র শান্তি-কর্মমূলক। তার মতে অথর্ববেদের প্রথম মন্ত্র এই,- “শন্নো দেবীরভীষ্টয় আপোভবস্তু পীতয়ে। শংযোরভিশ্রবনঃ।” কিন্তু সায়ণাচার্যের ভাষ্যানুসারে মেধাজনন-মূলক ত্রিসপ্ততি সূক্তটি প্রথম সূক্ত; সেই অনুসারে হলায়ুধ কর্তৃক উধৃত মন্ত্রটি যষ্ঠ সূক্তের মন্ত্র। রোথ, ইটনী প্রভৃতি ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ যে এিসপ্তাদি প্রভৃতিকেই প্রথম মন্ত্র বলে নির্ধারণ করে গেছেন। বোম্বাই (মুম্বাই) গরমেন্ট যে অথর্ববেদ প্রকাশ করেছেন, তারও প্রথম মন্ত্র শন্নো দেবীঃ প্রভৃতি নয়। আমরাও সেই মতই অনুসরণ করলাম। কিন্তু আমাদের দেশে নিত্যকর্মের র অন্তর্গত ব্রহ্মযজ্ঞের মন্ত্রে শন্নো দেবী: প্রভৃতি মন্ত্রই অথর্ববেদের আদি-মন্ত্র বলে পঠিত হয়।

*

অথর্ববেদের আলোচ্য

অথর্ববেদে যে যে বিষয় সন্নিবিষ্ট আছে, (সায়ণাচার্যের) অনুক্রমণিকার মধ্যেই (শেষাংশে) তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। অথর্ববেদের মন্ত্রসমূহ শত্রুর বিনাশ-সাধনে প্রযুক্ত হতো; ঐ মন্ত্রের সাহায্যে মনুষ্যগণ সর্বসম্পত্তি লাভ করতেন; ঐ মন্ত্রের ফলে ঐকমত্য সাধিত হতো; ঐ মন্ত্রের ফলে রাজা সংগ্রামে জয়শ্রী লাভ করে আসতেন। শত্ৰুনিপাতে, পাপক্ষয়ে, শান্তি-পৌষ্টিক ইত্যাদি কর্মে, অথর্ব-মন্ত্র প্রত্যক্ষ ফল প্রদান করতো। জ্বর ইত্যাদি ব্যাধিতে কষ্ট পাচ্ছ; অথর্ববেদের মন্ত্রে সে জ্বরে শান্তি লাভ করবে। সর্পবৃশ্চিক-জঙ্গম ইত্যাদির বিষ-নিবারণে অথবৰ্মন্ত্র অমোঘ অস্ত্র ছিল। এই উদ্দেশে মন্ত্র-সাহায্যে যে সর্পবিষ নাশের প্রথা বহুদিন থেকে প্রচলিত ছিল এবং তার সুফল পরিলক্ষিত হতো, সে মন্ত্র অথর্ববেদেরই অনুস্মৃতি। সৌভাগ্যকরণের পক্ষে, পুত্র ইত্যাদি লাভের পক্ষে, সুপ্রসব ইত্যাদির বিষয়ে, অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি নিবারণের পক্ষে, বাণিজ্য ইত্যাদিতে শ্রীবৃদ্ধিলাভের বিষয়ে, অথর্ববেদের মন্ত্র অশেষ ফল প্রদান করতো। বাস্তুসংস্কার, গৃহপ্রবেশ, চূড়াকরণ, উপনয়ন, জাতকর্ম, বিবাহ প্রভৃতি সকলই অথর্ববেদের অনুসরণ। অথর্ববেদ পাঁচ কল্পে বিভক্ত। তার এক কল্পে শান্তি-পৌষ্টিক ইত্যাদি কর্ম, অন্য কল্পে জ্যোতিষ ইত্যাদি বিষয়ক কর্ম, অন্য এক কল্পে ব্ৰহ্মকর্ম; এবং কল্পান্তরে সস্মৃতি-বিধি ইত্যাদি পরিবর্ণিত আছে। এমনকি, মৃতকল্প ব্যক্তিকে নবজীবন প্রদান করা হতো,–এ সকল বিষয়ও অথর্ববেদের আলোচনায় দেখতে পাই। অধিকন্তু, ভগবৎ-সম্বন্ধে ভগবানের স্বরূপ-জ্ঞান লাভের পক্ষে এবং জন্মজরামরণের গতিপথ রোধ করবার পক্ষে অথর্ববেদের মন্ত্র ইত্যাদির সার্থকতা উপলব্ধ হয়।

*

অথর্ববেদে ভগবৎতত্ত্ব

এক দিকে অথর্ববেদে যেমন ঐহিক সুখ-সাধনের উপায়-পরম্পরা প্রদর্শিত হয়েছে, অন্য পক্ষে সেইরকম পারলৌকিকের পথও অথর্ববেদে উন্মুক্ত রয়েছে। দেবতা কি? দেবতার স্বরূপ কি? বিশ্বনাথ কি ভাবে বিশ্ব ব্যেপে বিরাজ করছেন? এ সকল গভীর তত্ত্ব, ঋক্‌-যজুঃ-সাম বেদত্রয় যে ভাবে ব্যক্ত করে গেছেন; অথর্ববেদেও সে তত্ত্ব সেই ভাবেই পরিব্যক্ত রয়েছে। পরন্তু, অন্যত্র যা গভীর গবেষণার বিষয়ীভূত হয়ে আছে, অথর্ববেদে তা সকলের সহজবোধ্য-ভাবে বিবৃত রয়েছে। যখন পৃথকভাবে বোঝবার চেষ্টা করা যায়, তখন বুঝতে পারি,-ভিন্ন ভিন্ন দেবতাতে ভগবানের ভিন্ন ভিন্ন বিভূতি বিকাশমান। আবার যখন সমষ্টিগতভাবে তাঁকে দেখতে সমর্থ হই, তখন দেখতে পাই, তিনি বহু হয়েও এক হয়ে আছেন; তিনি অনন্ত হয়েও সান্ত; তিনি মহৎ হয়েও অণু; তাতেই বিশ্ব ওতঃপ্রোতঃ বিদ্যমান রয়েছে।(২) অথর্ববেদে এই বিষয়টি কেমন ভাবে বোঝানো হয়েছে, একটি মাত্র দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করছি। সে দৃষ্টান্ত অথর্ববেদের চতুর্থ কাণ্ডের ষোড়শ সূক্তের অন্তর্গত মন্ত্র। সেখানে বরুণ-দেবতার পরিচয় প্রকাশমান। বরুণ-দেবকে সম্বোধন করে প্রার্থনাকারী বলছেন–সমগ্র বিশ্বের অধিপতি সেই বরুণদেব আমাদের অতি নিকটে থেকে আমাদের কার্যকলাপ সমস্তই দেখছেন। যদি কেউ দণ্ডায়মান হন, পরিভ্রমণ করেন, অথবা লুক্কায়িত থাকেন; যদি কেউ নিদ্রিত হন অথবা জাগরিত হন; যদি দুই জনে বসে গোপনে কোনও পরামর্শ করেন;-বরুণদেব সকলই জানতে পারেন; তিনি যেন তৃতীয় ব্যক্তি রূপে সেখানে উপস্থিত আছেন।(৩) এই পৃথিবী সেই বরুণদেবের; এই বিস্তৃত অনন্ত আকাশ সেই বরুণদেবেরই। বরুণদেবই অনন্ত আকাশ ও অনন্ত সমুদ্র ব্যেপে আছেন; আবার এই ক্ষুদ্র জলবিন্দুর মধ্যেও তিনি বিদ্যমান রয়েছেন। যদি কেউ অনন্ত-বিস্তৃত আকাশকে লঙ্ঘন করেও পলায়ন করতে সমর্থ হয়, তথাপি সে বরুণদেবের দৃষ্টির অন্তরালে যেতে পারবে না। ইত্যাদি।(৪) এ বর্ণনায় দেবতার স্বরূপ উপলব্ধ হতে পারে। দেবতা যে কি, আর কি ভাবে যে তিনি অবস্থিতি করছেন; এ বর্ণনায় তার আভাষ পাওয়া যায়।

২। ম্যাক্সমুলার পর্যন্ত অথর্ববেদের মত দেখে দেবতার সম্বন্ধে ঐরকম ধারণার বিষয় খ্যাপন করতে বাধ্য হয়েছেন। Fold 1696801…-They were all meant to express Beyond, the Invisible behind the Visible, the Infinite within the Finite, the Super-natural above the Natural, the Divine, omnipresent and omnipotent. Max Muller–Vedic Deities in India : What can it Teach us.

৩। Varuna, the great.Lord of these worlds, sees as if he were near. If a man stands or walks or hides, if he goes to lie down or to get up, what two people sitting together whisper to each other, King Varuna knows it, he is there as the third. 272656TC (Psalm, cxxxix, 1, 2) ভগবৎ-বিষয়ে পরমেশ্বরকে সম্বোধনে এইরকম উক্তি দৃষ্ট হয়; ০ Lord, thou hast searched me and known me. Thou knowest my down-sitting and my uprising, thou understandest my thought afar off.

৪। এই অংশের মার্থে ম্যাক্সমুলার লিখেছেন, He who would flee far beyond the sky even he would not be rid of Varuna, the King. এ বিষয়ে অনুরূপ উক্তি বাইবেলেও দৃষ্ট হয়; যথা, If I take the wings of the morning, and dwell in the uttermost parts of the sea; even there shall thy hand lead me, and thy right hand shall hold me.–(Psalm, cxxix 9)

*

অথর্ববেদের কাল

 চারটি বেদেরই রচনা-কাল বিষয়ে বহু দিন হতে গবেষণা চলে এসেছে। অথচ, কেউ যে এ পর্যন্ত কোনও বেদের রচনা-কাল নির্ণয় করতে সমর্থ হয়েছেন, তা মনে করতে পারি না। একজন পণ্ডিত ঊনবিংশ কাণ্ডের সপ্তম সূক্তে কয়েকটি নক্ষত্র-সমাবেশের চিহ্ন পেয়ে স্থির করেছেন, খৃষ্ট-জন্মের ১৫১৬ বৎসর পূর্বে অথর্ববেদ সঙ্কলিত হয়েছিল। বালগঙ্গাধর তিলক(৫) তাঁর প্রণীত আর্যগণের উত্তর-মেরুবাস সংক্রান্ত গ্রন্থে অথর্ববেদ সম্বন্ধে যে আলোচনা করেছেন, তাতে প্রতিপন্ন হয়,–আর্যগণের উত্তর-মেরু-বাস-কালে অথর্ববেদের অস্তিত্ব ছিল। তিনি অথর্ববেদ সংহিতার এবং তৈত্তিরীয়-সংহিতার ঊষা বিষয়ক কয়েকটি মন্ত্র থেকে দেখিয়েছেন,-আর্যগণের উত্তরমেরু-বাসের প্রসঙ্গই ঐ সকল মন্ত্রে নিবদ্ধ আছে। আর সেই অনুসারে খৃষ্ট-জন্মের অন্ন ৮০০০ বৎসর পূর্বে তৈত্তিরীয়-সংহিতার অথবা অথর্ববেদের বিদ্যমানতা প্রতিপন্ন হয়। রামায়ণে আছে,–পুত্রার্থে যজ্ঞের নিমিত্ত, অথর্ববেদের বিধান অনুসারে যজ্ঞ করা হয়েছিল।(৬) ব্রহ্মার আদেশ অনুসারে বেদব্যাস চারজন শিষ্যকে চারটি বেদ বিষয়ে শিক্ষা দান করেন; সেই সময়ে সুমন্তু অথর্ববেদ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। ত্রেতার শেষে, কলিযুগের প্রারম্ভে, বেদব্যাসের বিদ্যমানতার বিষয় অনুধাবন করলে, বর্তমান হতে পাঁচ হাজার বৎসরের পূর্বে অথর্ববেদের বিদ্যমানতা সপ্রমাণ হয়। ফলতঃ অত দূর অতীতের বিষয়, যে অতীতের কথা ধারণায় আসে না–তার বিষয়, বৎসর ইত্যাদির গণ্ডীতে নিবদ্ধ করবার চেষ্টা পাওয়াই বিড়ম্বনা মাত্র। এই সকল কারণেই বেদকে সনাতন নিত্য বলা হয়। বেদকে সনাতন নিত্য বলার আরও এক কারণ, তাতে সনাতন নিত্য বস্তুই প্রখ্যাত আছে। যা সত্য, তা চিরদিনই সত্য। ভাষা-পরিচ্ছদের পরিবর্তন সম্ভবপর হলেও সত্যের সত্যত্ব বিনষ্ট হয় না। সত্য চির-অবিনাশী। বেদে সেই সত্য আছে বলেই বেদ নিত্য ও অবিনাশী।

৫। তিলকের গ্রন্থে প্রকাশ,-পোষ্ট গ্লেসিয়াল (post-glacial period) কালের পূর্বে ইন্টার-গ্লেসিয়াল (inter gla cial) কাল ছিল। সেই সময়ে আর্যগণ উত্তর মেরুতে বাস করেছিলেন। ক্রল প্রভৃতি আমেরিকার পণ্ডিতগণের (Dr. Crolls Climate and Time এবং Climate and Cosmology) গবেষণায় প্রকাশ যে, পোষ্ট গ্লেসিয়াল বা তুষারপাতের পরবর্তী অবস্থার আরম্ভ ৮০০০০ বৎসর পূর্বে। ইন্টার গ্লেসিয়াল বা তুষারপাতের কাল তারও পূর্ববর্তী। ক্রল প্রভৃতির মতের অনুসরণে তা হলে ৮০ হাজার বৎসরের অনেক পূর্বে উত্তর মেরুতে আর্যগণের বাস ছিল বোঝা যায়। কিন্তু তিলক অতদূর অগ্রসর হননি। তিনি ঐ সকল মত পরিত্যাগ করে সিদ্ধান্ত করেছেন যে, We …may adopt, for all practical pur poses, the view of the last glacial epoch closed and the post-glacial period commenced at about 8,000 or at best, about 10,000 B.C. vide, Mr. B. G. Tilak, Artic Home in the Vedas. এর পূর্বে ইন্টার-গ্লেসিয়াল কাল মানতে হলে এবং তখন অথর্ববেদ ও তৈত্তিরীয়সংহিতার অস্তিত্ব স্বীকার করলে, তা যে কত পূর্বের, তা কল্পনার বিষয় মাত্র, গণনার অওর্ভূত হতে পারে না।

৬। রামায়ণ, বালকাণ্ড, ১৫শ অধ্যায়, ২য় শ্লোক। বিষ্ণু-পুরাণ, তৃতীয়াংশ, চতুর্থ অধ্যায়। বায়ুপুরাণ ও মার্কণ্ডেয়পুরাণ ১ প্রভৃতিতে অথর্ববেদের প্রাধান্য দ্রষ্টব্য।

*

বেদের ভাষ্যকার

মূল বেদ নিয়েই, তার পাঠ-পাঠান্তর নিয়েই, যখন বিতর্ক বিতণ্ডা আছে, তখন তার ব্যাখ্যা-বিবৃতির বিষয়ে যে মতের অমিল থাকবে, তা বিচিত্র নয়। ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যাকারগণ ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বেদের ভাষ্য ও টীকা করে গেছেন। পরবর্তী ভাষ্যকারগণের ভাষ্যের মধ্যে পূর্ববর্তী ভাষ্যকারগণের হয় তো নামমাত্র উল্লেখ আছে, হয় তো কোনও কোনও স্থলে দুই-চার পংক্তি উধৃতও হয়েছে। কিন্তু সম্পূর্ণভাবে পূর্বতন কোনও ভাষ্যই যথাযথ প্রাপ্ত হওয়া যায় না। সায়ণাচার্যের, ভাষ্য বলে অথর্ববেদের যে ভাষ্য এখন আমরা পাচ্ছি, তা-ও ঠিক সায়ণাচার্যের লিখিত কিনা, সে বিষয়ে নানা সংশয় আসে। প্রথম সংশয়ের কারণ–ঋগ্বেদের এবং সামবেদের ভাষ্যানুক্রমণিকায় তিনি নিজের যে পরিচয় প্রদান করেছেন, অথর্ববেদের ভাষ্যানুক্রমণিকায় তাঁর যে আত্মপরিচয় আছে, তা কিছু বিভিন্ন রকমের। ঋগ্বেদের অনুক্রমণিকায় উপেপাদ্ঘাত প্রকরণে লিখিত আছে, বুক্ক নরপতির আদেশে মাধবাচার্য বেদার্থ-প্রকাশে উদ্যত হন। অথর্ববেদের ভাষ্যানুক্রমণিকায় দেখছি,–বুক্ক নরপতির বংশধর রাজা শ্রীহরিহর, সায়ণাচার্যকে অথর্ববেদের অর্থ প্রকাশের জন্য আদেশ করেছিলেন। তাতে মাধবাচার্য এবং সায়ণাচার্য দুই জন ভাষ্যকারের নাম পাওয়া যাচ্ছে। আরও বোঝা যাচ্ছে, ঋগ্বেদের যে ভাষ্য সায়র্ণাচার্যের নামে প্রচারিত, তা সায়ণাচার্যের রচনা নয়–তা মাধবাচার্যের রচনা। সামবেদের অনুক্রমণিকায় কৃপালু মাধবাচার্যো বেদার্থং বক্তৃমুদ্যতঃ এমন সূচনা আছে। তাতে সামবেদের ভাষ্যেরও রচনাকারী বলে মাধবাচার্যই নির্ধারিত হন। অথচ, তিন বেদের ভাষ্যই সায়ণের ভাষ্য বলে চলে আসছে। কেউ কেউ বলেন,–সায়ণাচার্য ও মাধবাচার্য। দুই সহোদর ভ্রাতা ছিলেন। মাধবাচার্য জ্যেষ্ঠ এবং সায়ণাচার্য কনিষ্ঠ। বিজয়নগরের রাজা বুক নরপতির দরবারে মাধবাচার্য প্রধান অমাত্য-পদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। রাজা তাঁরই উপরে বেদার্থ-প্রকাশের ভার অর্পণ করেন। কনিষ্ঠ ভ্রাতা সায়ণাচার্যের সাহায্যে মাধবাচার্য সেই কার্য সম্পন্ন করেছিলেন। তার জন্য ভাষ্য–সায়ণমাধবীয় ভাষ্য বলে প্রচারিত আছে; কোথাও বা মাধবীয় ভাষ্য নামেও ভায্য অভিহিত হয়। ১৩৭৫ খৃষ্টাব্দে সায়ণ-মাধব দুই ভ্রাতা বিজয়নগরের রাজসংসারে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, এমন প্রমাণ পাওয়া যায়। এতে সায়ণ-মাধব ৫৫০ বৎসরের পূর্ববর্তী বলে প্রতিপন্ন হয়। যে সময়ে তারা বিদ্যমান ছিলেন, সেই কালে সেই প্রদেশে (বিজয়নগরে) যাগযজ্ঞ ইত্যাদির বিশেষ প্রচলন ছিল। তার পূর্ববর্তী প্রাভাকর-সম্প্রদায় তখন প্রতিষ্ঠান্বিত ছিলেন। সেই জন্য সায়ণ-মাধবীয় ভায্যে যাগযজ্ঞের উপযোগী করেই মন্ত্রগুলির ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সায়ন-মাধবের ভায্যে স্বরের ও উচ্চারণের প্রতি তাই বিশেষ লক্ষ্য দেখা যায়। সায়ণ-ভাষ্যে মর্মার্থের দিকে তেমন লক্ষ্য দেখতে পাই না। তার পর সকল ভাষ্য যে সায়ণের নিজের লিখিত, তা-ও মনে করা যায় না। অনেক স্থলে দুই তিন লেখকের রচনা বলে প্রতিপন্ন হয়। এ বিষয়ে জনৈক বেদজ্ঞ পণ্ডিতের মত উধৃত করছি; যথা, ভাষ্যের ভাই তার প্রমাণ; কোনও স্থলে বিশুদ্ধ সংস্কৃত, কোনও স্থলে বা হিন্দী সংস্কৃত। আর এক প্রবলতর প্রমাণ এই যে, যেমন আমরা প্রথম হতে সূক্তগুলির ভাষ্য পাঠ করি, প্রথমতঃ সকল শব্দ ও ধাতু প্রভৃতির ব্যুৎপত্তি সম্পূর্ণভাবে দেখতে পাই; এবং তারপরে ঐ সকল শব্দ ও ধাতুর ব্যুৎপত্তির স্থলে পূর্বে উক্ত হয়েছে এমন দেখি। ক্রমাগত কতকগুলি সূক্তে এমন লিখিত হলো। পরে কিন্তু কোনও অনুবাকের বা ঋষি-সূক্তের আরম্ভ হতে আমরা পূর্বোক্ত ব্যুৎপত্তি-সমুদায় দেখতে পাই এবং দু একটি সূক্তে ঐভাবে সমস্ত ব্যুৎপত্তি দিয়ে আবার পূর্বের ন্যায় পূর্বে উক্ত হয়েছে এমন উল্লেখ দেখি। এইরকম পাঁচ বা সাত বা দশ সূক্তের অন্তর আমরা নূতন নূতন রচনার প্রমাণ প্রাপ্ত হই। এই ভিন্ন এক সূক্তে কোনও শব্দের যে ব্যুৎপত্তি প্রদত্ত হয়েছে, আর এক সুক্তে সেই শব্দের সেই অর্থে বিভিন্ন রকম ব্যুৎপত্তি দেখতে পাই এবং হয় তো দ্বিতীয় ব্যুৎপত্তিটি সম্পূর্ণ ভ্রমপূর্ণ। আর আমরা দেখতে পাই যে, এক স্থলে একটি শব্দের প্রকৃত ব্যাকরণানুসারে ব্যুৎপত্তি লিখিত হয়েছে; কিন্তু আর এক স্থলে সেই শব্দের ব্যুৎপত্তি সাধনের নিমিত্ত কতই কষ্ট-কল্পনা করা হয়েছে; অথচ, প্রকৃত ব্যুৎপত্তি দেওয়া হয়নি। যদি একজন সমস্ত বেদের ভাষ্য লিখতেন, তবে এইরকম বিশৃঙ্খলা কখনই ঘটত না। অতএব, সায়ণাচার্যের ভাষ্য সর্বত্র প্রামাণ্য নয়।

*

সায়ণভাষ্যের পক্ষাপক্ষ

সায়ণভায্যের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে-উভয় পক্ষেই অনেক কথা বলতে পারা যায়। বেদের আলোচনা যেমন দেশ হতে লোপ পেতে বসেছিল, তাতে বিজয়নগরের রাজার উৎসাহ পেয়ে বেদের ভাষ্য যদি তারা রচনা করে না যেতেন, তাহলে আমাদের বেদের ব্যাখ্যা-বিষয়ে যে সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকতে হতো, তা বলাই বাহুল্য। কেননা,তার পূর্ববর্তী প্রায় সকল ভায্যই এখন লোপ। পেয়েছে। সায়ণ-মাধব বেদ-জ্ঞানরূপ সৌধের একটা ভিত্তি স্থাপন করে গিয়েছিলেন; এখন তার উপর যার যেমন ক্ষমতা, সেই অনুরূপ অট্টালিকা নির্মাণ করে যাচ্ছেন। সায়ণাচার্যের ভাষ্যে বিবৃত বেদমন্ত্রের ভাব-সম্বন্ধে মতবিরোধ যে আজ-কালই ঘটছে, তা নয়; আর, সে মতবিরোধ কেবল যে স্বদেশীয় পণ্ডিতগণের মধ্যেই সংঘটিত হয়েছে, তা নয়; বহুকাল থেকে বহু পণ্ডিতের মস্তিষ্ক সায়ণভায্যের উপযোগিতা ও অনুপযোগিতা সম্বন্ধে আলোড়িত হয়েছে, দেখতে পাই। এ বিষয়ে পাশ্চাত্য-দেশের দুজন প্রসিদ্ধ পণ্ডিতের দুরকম অভিমতের আভায় প্রকাশ করছি। তাতে বিষয়টি অনেকাংশে বোধগম্য হবে। সায়ণের পর যাঁরা বেদের ভাষ্য-সম্বন্ধে আলোচনা করেন, তাঁদের মধ্যে জর্মন-দেশীয়-পণ্ডিত রুডলফ রোথ বিশেষ প্রসিদ্ধিসম্পন্ন। সায়ণের ভাষ্যানুসরণে বেদাধ্যয়নে প্রবৃত্ত হয়ে, তার মস্তিষ্ক অন্য পথে প্রধাবিত হয়। তাঁর পূর্ববর্তী পাশ্চাত্য-দেশীয় ব্যাখ্যাকার হোরেস উইলসন বলেছিলেন,–সায়ণই বেদের ভাষা সম্পূর্ণভাবে অনুধাবন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কোনও ইউরোপীয়ের পক্ষে সে ভাব পরিগ্রহণ সম্ভবপর নয়। কিন্তু রোথ বললেন,–ভাষাতত্ত্বের আলোচনা করলে উইলসনের উক্তির সার্থকতা প্রতিপন্ন হয় না। সায়ণ ইত্যাদি যে সময়ে বিদ্যমান ছিলেন, তাঁরা সেই সময়ের উপযোগী করে ভাষ্য লিখেছেন। কিন্তু তাদের ভাষ্য-রচনার সহস্র সহস্র বৎসর পূর্বে কি ভাবে কি শব্দ প্রযুক্ত হয়েছিল, তা বুঝতে গেলে, ভাবার্থ অন্যরকম হয়ে আসে। সুতরাং সায়ণভাষ্যকে বেদ-ব্যাখ্যার পক্ষে একমাত্র প্রমাণস্বরূপ বলে গ্রহণ না করে, বেদরূপ জ্ঞান-মার্গে অগ্রসর হবার একটি সোপান মাত্র বলে মনে করা যেতে পারে।(৭)

সায়ণের ভাষ্য-সম্বন্ধে যিনি যতই বিরুদ্ধ-মত প্রকাশ করুন; কিন্তু ঐ ভাষ্য বিদ্যমান ছিল বলেই আজ আমরা বেদ আলোচনায় অনেক পরিমাণে সমর্থ হচ্ছি। সুতরাং শত ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও সায়ণ-ভাষ্য আমাদের যে পথ-প্রদর্শক হয়ে আছে, তা কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না।(৮) তবে সেই ভাষ্যের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে, যাতে সত্য তথ্য অবগত হতে পারা যায়, সেই পক্ষে চেষ্টা করতে হবে।

৭।রোথের কৃ৩ সংস্কৃত ভাষার অভিধান (Sanskrit Worterbuch by Rudolph Roth) গ্রন্থের উপক্রমণিকায় লিখিত আছে,— We consequently hold that the writings of Sayana and of other commentators must not be an authority to the exegete, but merely one of the means of which he has to avail himself in the accomplish ment of his task. The purely etymological proceeding, as it must be followed up by those who endeavour to guess the sense of a word, without having before them the ten or twenty other passages in which the same word recurs, cannot possibly lead to a correct result, রোথ সাহেবের শেষ উক্তিটি বিশেষ মূল্যবান। আমরা বেদের ব্যাখ্যায় একই শব্দের একই অর্থ সর্বত্র যে অব্যাহত আছে, তা-ই প্রতিপন্ন করবার পক্ষে চেষ্টা করে আসছি।

৮। ম্যাক্সমুলারেরও ঠিক এই মত। তিনি বলেন,-With all its faults and weaknesses, Shayans commen tary was a sine quanon for a scholar-like study of the Rikveda,–Max Muller, Vedic Hymns, Vol. I. রেভারেণ্ড কৃষ্ণমোহন ঋগ্বেদের প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়ের ইংরাজী ব্যাখ্যা করেন। তারও মত যে, In the interpre tation of the Vedas, the safest course is to follow our own indigenous commentators and scholiasts etc.

Preface to Rigveda Samhita.

*

উপসংহার

বেদ অভিনব–চির অভিনব। তার মর্মার্থও অভিনব–চির অভিনব। তার অভ্যন্তরে এক সত্য সনাতন ভাব বিদ্যমান আছে; আবার তার বাহিরে নানা অর্থ পরিকল্পিত হতে পারে। বিভিন্ন কর্মের ফলে জীব বিভিন্ন রকম জন্ম পরিগ্রহ করে। মনুষ্য-জন্মের মধ্যেও তার কর্মানুরূপ ফলের প্রাধান্য অনুভব করতে পারা যায়। বেদ সেই বিভিন্ন অবস্থার বিভিন্ন ভাব বক্ষে ধারণ করে আছে। তাই বিভিন্ন জনে বিভিন্ন ভাবে বেদকে দর্শন করে থাকেন। মনুষ্য-জীবনে যিনি যে স্তরে অবস্থিত, তিনি সেই স্তরের অনুরূপ অর্থই বেদ থেকে পরিগ্রহ করতে সমর্থ হন;–যদিও বেদের অভ্যন্তরে সত্য-সনাতন অর্থ বিদ্যমান আছে। আমরা বিশেষ লক্ষ্য করে দেখেছি, যিনি যে কর্মের কর্মী, তিনি তার সেই কর্মের পরিপোষক অর্থই বেদমন্ত্র থেকে প্রাপ্ত হবেন। সেই জন্যই নানা মুনির নানা মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্মকাণ্ডের দিকে এক মত, ভক্তিকাণ্ডের দিকে এক মত, জ্ঞানকাণ্ডের দিকে এক মত; আবার তিনের সংমিশ্রণে আর এক সত্য-সনাতন মত। ব্যাখ্যার সময় যাতে যে মত প্রবল হবে, তিনি সেই মতই বেদমন্ত্রে প্রবল দেখবেন। তবে সত্য-জ্ঞান লাভ করব–এই সঙ্কল্প করে যদি কেউ বেদ অধ্যয়নে প্রবৃত্ত হন, তিনি যে সত্য-তত্ত্ব প্রাপ্ত হবেন, তাতে কোনই সংশয় নেই। যিনি যে পথ দিয়ে যে অর্থের অনুসরণেই অগ্রসর হোন, যদি লক্ষ্য থাকে–সৎ-বস্তু-লাভ, নিশ্চয়ই তাঁর সেই বস্তু অধিগত হবে। বেদরূপ কল্পতরুর মূলে উপস্থিত হয়ে যিনি যে ফলের কামনা করবেন, ধর্ম-অর্থ কাম-মোক্ষ চতুর্বর্গফল–স্তরে স্তরে সজ্জিত আছে দেখতে পাবেন।

.

অথর্ববেদানুক্রমণিকা
(সায়ণাচাৰ্যকৃত সংস্কৃত রচনা থেকে অনুবাদ)

ভাষ্যসূচনা

বৃহস্পতি-প্রমুখ দেববৃন্দ, সর্বপ্রকার পুরুষার্থসিদ্ধির প্রারম্ভে যে দেবতাকে প্রণাম করে কৃতার্থ হন, সেই গজাননকে আমি প্রণাম করছি।

বেদনিবহ যাঁর নিশ্বাসস্বরূপ, যিনি বেদসমূহ থেকে নিখিল বিশ্ব নির্মাণ করেছিলেন, সেই বিদ্যাতীর্থ মহেশ্বরকে আমি বন্দনা করছি।

আমি, অবিদ্যারূপ সূর্যের কিরণে সন্তপ্ত হয়ে, বিদ্যার অরণ্যস্বরূপ দেবতাকে ভজনা করছি; কারণ, সূর্যকরসন্তপ্ত জনগণের অরণ্যই প্রীতির কারণ হয়ে থাকে।

তার (দেবতার) কটাক্ষকৃপায় তদ্রপধারী যে বুক্কনরপতি, সেই বুকনরপতি থেকে হরিহরনামক রাজা, ক্ষীরসমুদ্র থেকে চন্দ্রের ন্যায়, সমুদ্ভূত হয়েছিলেন। (ভূমিকা দ্রষ্টব্য)।

বিজিতশত্রু, বীরকুলচূড়ামণি, ধর্মপথপ্রদর্শক, ব্রাহ্মণপোষক শ্রীহরিহরনামক সেই রাজা আপন চরিত্রাবলীর দ্বারা কলিকালকে সত্যযুগে পরিণত করেছিলেন।

শোভনবুদ্ধিসম্পন্ন শ্রীমান হরিহরনামক নৃপতি, সমগ্র পৃথিবীকে সুপালনে রেখে, রামরাজার ন্যায় আসক্তিশূন্য হয়ে, বহুরকম ভোগ্যবস্তু উপভোগ করেছিলেন।

শত্রুবিজয়ী সেই হরিহরভূপতি, সমগ্র পৃথিবীর ভার বহন করে, জনসাধারণের তুষ্টিবিধান করতে করতে ষোড়শ প্রকার মহৎ দান করেছিলেন।

মূলীভূত সেই অথর্ব-নামক বেদ আলোচনা করে সেই অথর্ববেদের অর্থ প্রকাশের নিমিত্ত, তিনি সায়ণাচার্যকে আদেশ করেছিলেন।

কৃপাপ্রবণ সায়ণাচার্য, অতি সন্তর্পণে পূর্বমীমাংসা এবং উত্তরমীমাংসা ব্যাখ্যা করে বেদার্থ প্রকাশ করতে উদযুক্ত হয়েছিলেন।

পারলৌকিক ফলপ্রদ ঋক্‌ যজুঃ ও সাম এই বেদত্রয়কে ব্যাখ্যা করে তিনি ঐহিক ও পারত্রিক ফলপ্রদ চতুর্থ অথর্ববেদার্থ প্রকাশ করতে ইচ্ছা করেছিলেন।

*

অনুক্রমণিকার মর্মানুবাদ

এই অনুক্রমণিকায় পূর্বপক্ষ ও উত্তরপক্ষ রূপে বিতর্ক-মীমাংসা দ্বারা অথর্ববেদের প্রতিষ্ঠা পরিকীর্তিত হচ্ছে।

প্রথমতঃ পূর্বপক্ষ উত্থাপিত করে, অথর্ববেদের অস্তিত্ব নাই–এটি সপ্রমাণ করবার চেষ্টা হচ্ছে। যজ্ঞং ইত্যাদি; অর্থাৎ যজ্ঞ ব্যাখ্যা করব, সেই যজ্ঞ বেদত্রয় (ঋক্‌ যজুঃ সাম) থেকে বিহিত হয়। এতে ঋগ্বেদ, সামবেদ ও যজুর্বেদেরই ফলবত্ত্ব এবং কর্মশেষত্ব আছে–এমন অবধারিত হচ্ছে। আরও, উক্ত বেদত্রয়েরই উৎপত্তি-বিষয় শ্রুত হওয়া যায়। ত্রয়োবেদা ইত্যাদি; অর্থাৎ, তিনটি বেদই সমুদ্ভূত হয়েছিল; ঋগ্বেদ অগ্নি থেকে, যজুর্বেদ বায়ু থেকে এবং সামবেদ সূর্য থেকে। ঋচঃ সামানি জঞ্জিরে ইত্যাদি মন্ত্রেও জানা যায়, ঋক্ থেকে সাম, সাম থেকে যজুর্বেদ উৎপন্ন হয়েছিল। অতএব তিনটি বেদেরই উৎপত্তি-বিষয় অবগত হওয়া যাচ্ছে।

বেদ-ত্রয়ের সংখ্যা-নিয়মও এইরকম শ্রুত হওয়া যায়;–যথা, বেদৈঃ ইত্যাদি; অর্থাৎ, বেদত্রয় দ্বারা সূর্যদেব সর্বত্রগ। যমূষয়ঃ প্রভৃতিতেও জানা যায়,-ত্রয়ীবি ঋষিগণ ঋক, সাম, এবং যজুঃ সমূহকে জানেন। ধর্মাবশেষ শ্রবণেও বেদ তিনটি বলে অবগত হওয়া যায়। যথা, উচ্চৈঋচা, যদৈব যজ্ঞস্য ইত্যাদি। অর্থাৎ-যজ্ঞের সম্বন্ধী যা সাম এবং যজুর্মন্ত্র দ্বারা কৃত হয়, তা শিথিল; যা ঋকের দ্বারা কৃত হয়, তা দৃঢ়। অতএব, ঋগ্বেদ, সামবেদ ও যজুর্বেদ এই তিনটিই বেদ বলে, এদের বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা হয়েছে। অথর্ববেদ ত্রয়ী (ঋক সাম ও যজুঃ) থেকে ভিন্ন বলে, এর কর্মযোগত্ব নেই; এইজন্য এটি ব্যাখ্যারও অযোগ্য।

এইভাবে অথর্ববেদের অনুপযোগিতা বিষয়ে পূর্বপক্ষ খ্যাপন করে, উত্তর-পক্ষরূপে অথর্ববেদের অস্তিত্ব সপ্রমাণ হচ্ছে। ঋগ্বেদের দ্বারা হৌত্রকর্ম (হোতৃসম্বন্ধীয় কর্ম), যজুর্বেদের দ্বারা আধ্বর্যব কর্ম (অধ্বর্য-সম্বন্ধীয় কর্ম) এবং সামবেদের দ্বারা ঔত্রকর্ম (উগাতৃ-সম্বন্ধীয় কর্ম) নির্বাহিত হয়। এইভাবে উক্ত বেদত্রয় সর্বদা প্রয়োগের প্রতিপাদক (নিষ্পদক) বলে অভিহিত হয়েছে। কিন্তু ব্রহ্ম-কর্ম-নিপাদক –কোন্ বেদ? চতুর্থ-সংজ্ঞক এই অথর্ববেদই ব্রহ্মকর্ম-সাধন করে থাকে। অতএব, এই অথর্ববেদের ব্যাখ্যা করা উচিত; কারণ এর অভাবেও যজ্ঞের অঙ্গহানি হয়ে থাকে।

এতেও পূর্বপক্ষ দোষান্তর দেখাচ্ছেন,–তা বলো না; কারণ উক্ত ঋক, সাম ও যজুর্বেদ থেকেই যজ্ঞের অপেক্ষিত যে ব্ৰহ্মকর্ম, তা-ও সিদ্ধ হয়ে থাকে। ঐতরেয়-ব্রাহ্মণে প্রবঞ্চিত হয়েছে, যদ ঋচৈব ইত্যাদি। অর্থাৎ, ঋকের দ্বারা হোতৃকর্ম, যজুঃ দ্বারা অধ্বর্য কর্ম, সামের দ্বারা উদ্গাতৃ কর্ম; তার দ্বারাই ত্রয়ী বিদ্যা বিশেষভাবে আরব্ধ হয়। ত্রয়ী আরব্ধ হলে, কি জন্য ব্রহ্ম-কর্ম অপেক্ষিত হবে? অর্থাৎ ত্রয়ী থেকেই ব্ৰহ্মকর্ম সম্পাদিত হয়। এই বিষয়ে স্মৃতিতেও দৃষ্ট হয়, ঋগ্বেদ দ্বারা হোতৃকর্ম, সামবেদ দ্বারা উদ্গাতৃ কর্ম, যজুর্বেদ দ্বারা অধ্বর্যকর্ম এবং তিন বেদ দ্বারা ব্ৰহ্মকর্ম সমাহিত হয়ে থাকে। অতএব হোত্র ইত্যাদি ঋত্বিকের কর্ম ঐ তিন বেদ থেকেই সিদ্ধ হয় বলে চতুর্থ যে অথর্ববেদ, তার আকাঙ্ক্ষাই থাকছে না। সুতরাং কি নিমিত্ত তার ব্যাখ্যার বিষয় চিন্তা করব?

অতঃপর প্রতিপক্ষের উত্তরে কথিত হচ্ছে–হৌত্র, আধ্বর্যব ও ঔদ্গাত্র এই রকম সমাখ্যা (নাম) দ্বারা বেদত্রয়ে সর্বদা (উক্ত) হোত্র ইত্যাদি কর্মের সাধনসামর্থ্য অবগত হওয়া যায় বলে (তার অতিরিক্ত) ব্রহ্মকর্ম-নিষ্পদনে উক্ত বেদত্রয়ের তাৎপর্য (কর্তৃত্ব) সম্ভব হচ্ছে না। যেমন, অন্যপর (অধ্বর্যকর্মসাধক) যে যজুর্বেদ, তার হোতৃকর্তব্য কর্মে অথবা হোতৃকর্মনিষ্পদক ঋগ্বেদের অগ্নিহোত্রসাধনে তাৎপর্য (অধিকার) নেই। ত্রয়ী বেদে আপন আপন বিহিত যজ্ঞকর্মের বিধান আছে। কিন্তু সেই সেই যজ্ঞকর্মের অন্তর্গত যে ব্রহ্মকর্ম, তা অথর্ববেদ থেকেই সিদ্ধ হয়। এই অথর্ববেদ ব্যতীত তাৎপর্যের (ব্রহ্মকর্মসম্বন্ধীয় অনুষ্ঠান ইত্যাদির) অভাব এবং অঙ্গহানি হয়। সুতরাং পূর্বমত D আদরণীয় নয়। এই অথর্ববেদ ব্যতীত যজ্ঞাঙ্গ অসম্পূর্ণ হয়–এই অভিপ্রায়ে, আখলায়ন বলেছেন, তদ যে কেচন ইত্যাদি। অর্থাৎ–ছান্দোগ্য ইত্যাদি বিষয়ে হোত্র সম্বন্ধীয় যে কিছু উপদেশ পঠিত হয়েছে, হৌত্রের অসম্পূর্ণত্ব বিধায় সেগুলি করবে না। অতএব, বাক্য ও মনের দ্বারা ঈপ্সিত যে যজ্ঞশরীর, তার অর্ধেক বেদত্রয় দ্বারা নিম্পাদিত হয়। এবং অপরাধ অথর্ববেদ কর্তৃক সম্পাদিত হয়। গোপথ-ব্রাহ্মণে এ বিষয় এমন উক্ত আছে; যথা, প্রজাপতিঃ ইত্যদি; অর্থাৎ প্রজাপতি একটি যজ্ঞ বিস্তার করেছিলেন। তিনি ঋকের দ্বারা হৌত্রকর্ম, যজুর্বেদের দ্বারা আধ্বর্যকর্ম, সামবেদের দ্বারা ঔাত্র কর্ম এবং অথর্ববেদের দ্বারা ব্ৰহ্মকর্ম সম্পাদিত করেছিলেন। অথবা, ত্রয়ী বেদ দ্বারা যজ্ঞের এক পক্ষ সংস্কার করেছিলেন, আর ব্রহ্ম মনের দ্বারা অন্য পক্ষ সংস্কার করেছিলেন। ঐতরেয় ব্রাহ্মণেও শ্রুত হয়েছে, ত্রয়ী বেদ দ্বারা যজ্ঞের এক পক্ষ নিস্পাদিত হয়, এবং মনের দ্বারা অপর পক্ষ নিস্পাদিত হয়। যথা, অয়ং বৈ ইত্যাদি; অর্থাৎ–এই যে পবিত্র যজ্ঞ, বাক্য এবং মনঃ, এর দুটি বর্তনী (পথ)। কারণ, বাক্য এবং মনের দ্বারাই যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। এই বাক্যরূপ ত্রয়ী বিদ্যা দ্বারা যজ্ঞের এক পক্ষ সংস্কৃত হয়, এবং ব্রহ্মা মনের দ্বারা অন্য পক্ষ সংস্কৃত করেন। এই-ই অভিপ্রায় করে গোপথ-ব্রাহ্মণে পূর্বভাগে প্রশ্নপূর্বক অথর্ববিকেই ব্রহ্মা বলে অঙ্গীকার করা হয়েছে। যথা, প্রজাপতিঃ ইত্যাদি; অর্থাৎ-প্রজাপতি সোমযাগেচ্ছু হয়ে বেদগণকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কাকে হোতৃরূপে, কাকে অধ্বর্যরূপে, কাকে উগাতৃরূপে এবং কাকে ব্রহ্মরূপে বরণ করব? তার উত্তরে বেদগণ বলেছিলেন,-ঋগ্বেদবেত্তাকে হোতৃরূপে, যজুর্বেদজ্ঞকে অধ্বর্যরূপে, সামবেদবিৎকে উদ্গাতৃরূপে এবং অথর্ববেদাভিজ্ঞকে ব্রহ্মরূপে বরণ করুন। এইরকম করলে যজ্ঞ চতুষ্পৎ হয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে। এ ক্ষেত্রে বিরুদ্ধ পক্ষের আপত্তিও এইভাবে খণ্ডিত হয়েছে; অথচেদ, যথৈকপাৎ ইত্যাদি। অর্থাৎ, যদি ঐরকম ব্রহ্মাকে বরণ করা না হয়, তবে যজ্ঞ, হোত্র ইত্যাদির দক্ষিণদেশে শূন্য হয়। যেমন, একপদবিশিষ্ট পুরুষ গমনবিষয়ে অশক্ত, অথবা একটিমাত্র চক্ৰযুক্ত রথ গমনে অসমর্থ, সেইরকম ব্ৰহ্ম (অথবমন্ত্র)-হীন যজ্ঞও ফলপ্রদ হয় না।

অতঃপর পূর্বপক্ষের আখ্যাত শ্রুতিবাক্য-সকলের সামঞ্জস্য প্রদর্শিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে– উদাহৃত শ্রুতিবাক্যানুসারী শ্রেষ্ঠ অথববিদ ব্রাহ্মণের অভাব হলে, সেই সেই শাখাতে, যেমন ব্রহ্মকর্ম উক্ত হয়েছে, তার দ্বারাই যজ্ঞশরীর নিষ্পন্ন হয়, এই অভিপ্রায়েই স ত্রিভিবেদৈবিধীয়তে অর্থাৎ সেই যজ্ঞ তিনটি বেদ দ্বারাই বিহিত হয় এই স্মৃতি প্রবর্তিত হয়েছে।

ত্রয্যা বিদ্যমা ক্ৰয়াৎ; অর্থাৎ ত্রয়ী বিদ্যা দ্বারাই বলবে–এই শ্রুতিটিও প্রকৃত ব্যাহৃতিত্রয়কে (ভূঃ ভূবঃ ও স্বঃ কে) অপেক্ষা করছে বলে কোনরকম বিরোধ ঘটছে না; অর্থাৎ এখানে বেদকে লক্ষ্য করা হয়নি, ব্যাহৃতিকেই লক্ষ্য করা হয়েছে। অস্য মহততা ভূতস্য ইত্যাদিতে, অর্থাৎ এই যে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ, এটি এই মহান্ ভূতের নিশ্বাসস্বরূপ। এর দ্বারাও, বেদের চতুষ্টয়ত্ব স্বীকৃত হয়েছে। বাজসনেয় শ্রুতিবাক্য অনুসারে, বেদত্রয়ের উৎপত্তির বিষয় জ্ঞাত হওয়া যায় বটে; কিন্তু বেদৈরশূন্যস্ত্রিভিরেতি সূর্যঃ; অর্থাৎ–বেদত্রয়ের দ্বারা সূর্যদেব সর্বত্রগ, এই যে শ্রুতি বাক্যটি, এর লক্ষ্য অন্যরকম। ঋগুভি পূর্বাহ্নে অর্থাৎ ঋক্‌ দ্বারা পূর্বাহ্নে ইত্যাদি বাক্যে বেদত্রয়ের ত্রিকাল অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে; অর্থাৎ ঋক্‌ দ্বারা পূর্বাহে, যজুঃ দ্বারা মধ্যাহ্নে এবং সাম দ্বারা সায়াহ্নে সূর্যদেব সর্বত্র গমন করে থাকেন–এই ভাব প্রকাশ পেয়েছে। ফলতঃ বেদ চারটি, এটা সর্বত্রই শ্রুত হয়েছে। তাপনীয় উপনিষদে পঠিত হয়েছে; যথা,-ঋগ্যজুঃ সামার্থবাণশ্চত্বারো বেদাঃ। অর্থাৎ বেদ চারটি; ঋক্‌ যজুঃ সাম ও অথর্ব। মুণ্ডকোপনিষদে পঠিত হয়েছে D তত্রাপরা ইত্যাদি; অর্থাৎ, তার মধ্যে অপরা বিদ্যা–ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে যমৃষয় ইত্যাদিতে, অর্থাৎ ত্রয়ীবি ঋষিগণ যে ঋক্ সাম যজুঃকে জানেন এইরকম বাক্যে, বেদত্রয়ের তিনরকম মন্ত্রগত অভিপ্রায় সূচনা করছে। এ বিষয়ে মহর্ষি জৈমিনি তচ্চোদকেষু ইত্যাদি সূত্র দ্বারা তিন বেদের বিষয় বলে চতুর্থ বেদের (অথর্ববেদের) প্রতিষ্ঠা খ্যাপন করেছেন। কর্মবেদমন্ত্রানুসারী; যেখানে অর্থক্রমে পাদব্যবস্থা হয়, সেখানেই ঋক, গীতি বিষয়ে সাম, শব্দ বিষয়ে যজুঃ; কিন্তু এই অথর্ববেদে সেই সমুদয় বিষয়ই বিদ্যমান আছে। অতএব বেদ যে চারটি তাতে কোনই সংশয় নেই। উচ্চৈষ্টাদি ধর্মনিয়ম ক্রমে পূর্বপক্ষ বলছেন–অগ্নি থেকে ঋগ্বেদ, বায়ু থেকে যজুর্বেদ এবং আদিত্য থেকে সামবেদ উৎপন্ন হয়েছে। চতুর্থ অথর্ববেদের কথা তারা বলেননি। কিন্তু তাঁদের উক্তি বেদত্রয়কে অপেক্ষা করে উপক্রমস্বরূপ প্রযুক্ত হয়েছে, মনে করতে হবে। তাতে চতুর্বেদের অস্তিত্ব-সম্বন্ধে কোনরকম দোষ ঘটছে না।

যদি বলি, এই অথর্ববেদান্তৰ্গত মন্ত্রসমূহ, ঋগ্বেদ ইত্যাদি থেকে ভিন্ন নয়; কিন্তু তা থেকেও এর অন্যতম নাম যুক্তিযুক্ত হচ্ছে; তাতেও অথর্ববেদের অস্তিত্বে দোষ ঘটছে না। অথর্ব-নামক ব্রহ্মা এই বেদের দ্রষ্টা বলে, তারই নাম অনুসারে এই বেদের নামকরণ হয়েছে। সেই সম্বন্ধ একটি উপাখ্যান আছে; যথা,পূর্বকালে, স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা সৃষ্টির নিমিত্ত তপস্যা আরম্ভ করেছিলেন। সেই তপস্যাযুক্ত ব্রহ্মার রোমকূপ-সকল থেকে ঘর্মধারা উৎপন্ন হয়েছিল। সেই স্বেদজ বারির মধ্যে আপন ছায়া অবলোকন করে তার শুক্র ক্ষরিত হয়। জলমধ্যে সেই শুক্র ক্ষরিত হলে, জলের দুই রকম আকৃতি হয়েছিল। তার মধ্যে একত্রস্থিত সেই রেতঃ ভৃজ্যমান হয়ে ভৃগু নামক মহর্ষিতে পরিণত হয়েছিল। সেই ভৃগু, আপন উৎপাদক অন্তর্হিত সেই ব্রহ্মার দর্শন-নিমিত্ত ব্যাকুল হন। তখন অশরীরি বাক্যের দ্বারা জ্ঞাত হয়েছিলেন, অথার্বাগেনমেস্বেবাস্বন্বিচ্ছ। অর্থাৎ, যাঁকে দেখতে ইচ্ছা করছ, তাঁকে সম্যকরূপে এই জলের মধ্যে দেখতে চেষ্টা কর। দৈববাণী কর্তৃক ঐরকম অভিহিত হয়েছিলেন বলে, তার অথর্ব আখ্যা হয়েছিল। অনন্তর অবশিষ্ট রেতোযুক্ত জলসমূহ কর্তৃক আবৃত ব্রহ্মার মুখ থেকে বরুণ শব্দ উচ্চারিত হয়েছিল, এবং সমস্ত অঙ্গ থেকে রস ক্ষরিত হয়েছিল। সেই অঙ্গরস থেকে আঙ্গিরস নামক মহর্ষি উৎপন্ন হয়েছিলেন। অনন্তর সৃষ্টির নিমিত্ত ব্রহ্মা সেই অথবা ও অঙ্গিরাকে তপস্যা করতে বললেন। তাঁদের তপস্যা-প্রভাবে একচন্দ্বচ ইত্যাদি মন্ত্র-সমূহের দ্রষ্টা বিংশতি-সংখ্যক অথবা এবং অঙ্গিরা উৎপন্ন হয়েছিলেন। তপ্যমান, সেই ঋষিগণের নিকট ব্রহ্মা যে মন্ত্র-সমূহকে দেখেছিলেন, তা-ই অর্থবাঙ্গির নামক বেদ বলে অভিহিত হয়েছিল। একর্ড ইত্যাদি ঋষিগণ, বিংশতিসংখ্যক বলে, বেদও বিংশতিকাণ্ড-বিশিষ্ট। অতএব, সকলের সারভূত বলে এই অথর্ববেদই শ্রেষ্ঠ বেদ। এ বিষয়ে গোপথব্রাহ্মণে শ্রুত হওয়া যায়, শ্রেষ্ঠো হি বেদঃ ইত্যাদি। অর্থাৎ তপস্যার দ্বারা সমুৎপন্ন শ্রেষ্ঠ বেদই ব্রহ্মজ্ঞবর্গের হৃদয়-দেশে বিরাজিত হয়। উক্ত ব্রাহ্মণে আরও শ্রুত হওয়া যায়,–এতদবৈ ভূয়িং  ইত্যাদি। অর্থাৎ, যা ভৃগু-অঙ্গিরস নামে অভিহিত, তা-ই শ্রেষ্ঠ বেদ। যা.অঙ্গিরা নামে আখ্যাত, তা-ই রস এবং যা অথবা নামে কথিত, তা-ই ভেষজ (ঔষধ); যা ভেষজ, তা-ই অমৃত; যা অমৃত, তা-ই ব্রহ্ম (অথবাখ্য বেদ)। এইরকমে সকলের সারভূত, ব্ৰহ্মাত্মক, এবং ব্রহ্মার কর্ম নির্বাহ করে বলে এটি (এই অথর্ববেদ) ব্রহ্মবেদ নামে আখ্যাত হয়। আরও শ্রুতি আছে, চত্বারো বা ইমে ইত্যাদি। অর্থাৎ, এই বেদসমূহ সংখ্যাতে চারটি; ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং ব্রহ্মবেদ (গো.ব্রা.২১৬)। অতএব সকল বেদের সার হওয়ায় অর্থবেদের মন্ত্র সিদ্ধমন্ত্র বলে সমান্নাত হয়ে থাকে। যথা,–ন তিথিঃ ইত্যাদি। অর্থাৎ, তিথি, নক্ষত্র, গ্রহ ও D চন্দ্ৰশুদ্ধি ইত্যাদির কোনও আবশ্যকতা নেই, যদি অথর্ববেদের মন্ত্র-সংপ্রাপ্তি ঘটে; কারণ, তা হলেই সর্ববিষয়ে সিদ্ধিলাভ হয়ে থাকে (প.২৫)। আরও, স্কন্দপুরাণের কমলালয় খণ্ডে অথর্ববেদের মন্ত্ৰসমূহকে উপমারূপে উক্ত করে অভিমতফলের সিদ্ধিবিষয় কথিত হয়েছে; যস্তত্ৰাথৰ্ব্বণা ইত্যাদি। অর্থাৎ, যে ব্যক্তি অথর্ববেদের মন্ত্রসমূহকে শ্রদ্ধাপূর্বক জপ করে, সে ব্যক্তি নিশ্চয়ই সেই বেদমন্ত্রকথিত সম্যক্ ফলপ্রাপ্ত হয়ে থাকে।

ব্রহ্মা, এই অর্থববেদের অঙ্গ বলে, এই বেদ কল্পনার অব্যবহিত পরেই সর্পবেদ ইত্যদি উপবেদ। সৃষ্টি করেছিলেন। সেইরকমে ব্রাহ্মণে কথিত হয়েছে, সদিশোহন্বৈক্ষত ইত্যাদি উপক্রম করে পঞ্চবেদানি নিবসিমীত ইত্যাদি। অর্থাৎ, সেই ব্রহ্মা পাঁচটি বেদ নির্মাণ করেছিলেন। সেই বেদ পাঁচটির নাম যথাক্রমে সর্পবেদ, পিশাচবেদ, অসুরবেদ, ইতিহাসবেদ ও পুরাণবেদ (গো, ব্রা, ১!১০)। পারত্রিকফলপ্রদ, দর্শপূর্ণমাস ইত্যাদি অনুষ্ঠেয়, অয়নান্ত অনুষ্ঠেয়, ত্রয়ীবেদ-বিহিত যজ্ঞকর্মসমূহে অপেক্ষিত যে ব্রহ্মকর্ম, তা অন্যান্য বেদ থেকে লব্ধ হয় না; সেইজন্য এই অথর্ববেদকেই ব্ৰহ্মকর্ম-সাধক বলে স্থিরীকৃত করা হলো। অপিচ, ঐহিক ফলপ্রদ শান্তিক, পৌষ্টিক কর্ম ও রাজকর্ম-সমূহ এবং অপরিমিতফলপ্রদ তুলাপুরুষ ইত্যাদি মহাদানসমূহ, অথর্ববেদ থেকেই সমাহিত হয়ে থাকে। অথৰ্ববিদ ব্রাহ্মণের দ্বারাই পৌরোহিত্য কর্ম করাবে; কারণ, সেই পুরেহিতের কর্তব্য রাজাভিষেক ইত্যাদি কর্মসমূহ অথর্ববেদ থেকেই বিস্তারিতভাবে সুসম্পন্ন হয়ে থাকে। বিষ্ণুপুরাণে অভিহিত হয়েছে; যথা,-পৌরোহিত্যং শান্তিকপৌষ্টিকানি ইত্যাদি; অর্থাৎ, রাজাগণের পৌরোহিত্য কর্ম, শান্তিক ও পৌষ্টিক ইত্যাদি কর্ম এবং ব্রহ্মকর্ম অথর্ববেদের দ্বারাই করাবে। ভট্টাচার্যগণও বলেছেন,–শান্তিপুষ্ট্যভিচারার্থাঃ ইত্যাদি। অর্থাৎ, শান্তিক ও পৌষ্টিক কর্মসমুদায় একমাত্র ব্রহ্ম-ঋত্বিকেরই আশ্রয়ীভূত। অতএব, ত্রয়ীবেদ-বিহিত কর্মসমুদায়ের ব্রহ্মকর্মও অথর্ববেদের দ্বারা নিষ্পন্ন হয়। নীতিশাস্ত্রেও কথিত হয়েছে–য্যাঞ্চ দণ্ডনীত্যাঞ্চ ইত্যাদি; অর্থাৎ যিনি ত্রয়ীবেদে ও দণ্ডনীতিতে অভিজ্ঞ, তিনিই পুরোহিত। সেই পুরোহিত, অথর্ববেদ-বিহিত শান্তিক ও পৌষ্টিক কর্ম করবে। মৎস্যপুরাণে উক্ত হয়েছে,–অথবৰ্মন্ত্র ও ব্রাহ্মণকাণ্ডাভিজ্ঞই পুরোহিত পদবাচ্য। মার্কণ্ডেয়পুরাণে অভিহিত হয়েছে,–রাজা, অথবৰ্মন্ত্রের দ্বারা অভিষিক্ত হয়ে সসাগরা পৃথিবীর অধিপতি হন; অথর্বপরিশিষ্টে কথিত হয়েছে,–যস্য রাজ্ঞ ইত্যাদি; অর্থাৎ, যে রাজার জনপদের মধ্যে শান্তিপারগ অথর্ববেদবিৎ ব্রাহ্মণ বাস করেন, সেই রাষ্ট্র নিরুপদ্রবে বর্ধিত হয়। সেই নিমিত্ত রাজা, জিতেন্দ্রিয় অথর্ববেদবিৎকে বিশেষরূপে দান-সম্মান ইত্যাদি সৎকার পূর্বক নিত্য পূজা করবেন (প.৪৬)।

যদি বলো, এমনই হলো; অর্থাৎ পূর্বোক্ত মতই অব্যহিত রইলো; তা হলে, অবশ্যই তার ব্যাখ্যাও উপপন্ন হতো। কিন্তু সেই ব্যাখ্যা কোথায়? এর উত্তরে কথিত হচ্ছে– স্বাধ্যায়োহধ্যেতব্যঃ (তৈ. আ. ২১৫); অর্থাৎ, স্বাধ্যায় অধ্যয়ন করবে। এই বিধির দ্বারা সমগ্র বেদাশির অর্থজ্ঞানপূর্বক অধ্যয়ন বিধি বোধিত হচ্ছে। উক্ত স্থলে বিবিধ অবিরুদ্ধ ভাবনাই প্রতীত হচ্ছে। সেই ভাবনা দ্বিবিধ; শব্দভাবনা এবং অর্থভাবনা। সেই ভাবনা দুটির লক্ষণ আচার্যগণ এইভাবে নির্দেশ করেছেন; যথা, লিঙাদিযুক্ত বিধিবাক্যসমূহে দুটি ভাবনার প্রতীতি হয়; শব্দভাবনা ও অর্থভাবনা। তাতে আবার শব্দভাবনার অর্থভাবনা চিন্তনীয়। লিঙাদি করণের দ্বারা এবং অর্থবাদের দ্বারা সমুৎপন্ন যে স্তুতি, তার ইতিকর্তব্যতা। অর্থবাদের স্বর্গ ইত্যাদি চিন্তনীয়; ধাতুর অর্থকরণ এবং প্রযোজ্য ইত্যাদি ইতিকর্তব্য।

যদি বলো,–ধাতু-অর্থ থেকে অতিরিক্ত ভাবনা জ্ঞানের বিষয়ীভূত নয়; যদি বলো,–কি করে ভাবনার ধাতু-অর্থ-করণ হবে, কি করেই বা সেই ভাবনার বিভাগ হতে পারে? আরও যদি বলো, –ভাব্যবস্তুনিষ্ঠ যে ভাবকের ব্যাপার, তা-ই ভাবনা। কিন্তু তা-ও বলতে পারো না। কেননা, পছ যজ গ প্রভৃতি ধাতুর অর্থ–ক্রমান্বয়ে অধিশ্রয়ণ, সংকল্প ও চলন; তাতে এর অতিরিক্ত ভাবকব্যাপারের অভাব হচ্ছে। যদি বলো, প্রযত্নই (চেষ্টাই) ভাবকের ব্যাপার; কিন্তু তা-ও বলতে পারো না। কারণ, তাতে বৃক্ষ চলছে, কাষ্ঠসমূহ পাক করছে, নৌকা যাচ্ছে ইত্যাদি অচেতন কর্তার ব্যাপারে প্রযত্নের অভাব হচ্ছে। যদি বলো,-স্পন্দই ভাবকের ব্যাপারে; তা-ও বলতে পারো না অর্থাৎ তা যুক্তিযুক্ত হচ্ছে না। কারণ আপন কর্তৃত্বব্যাপারে যজন করছে, দান করছে, হোম করছে ইত্যাদির স্থলে, তার (স্পন্দের) অভাব হচ্ছে। তা হলে উভয়ানুগত (স্পন্দ ও প্রযত্ননুগত) ঔদাসীন্যরূপ প্রচ্যুতি-সাধারণই (অকর্ম ইত্যাদি) ভাবকের ব্যাপার (ভাবনার বিষয়) হোক; কিন্তু তা-ও হতে পারে না। কারণ, সেই পক্ষে অচেতন শব্দে স্পন্দ এবং প্রযত্নের অভাব বশতঃ সেই উভয়ের সাধারণরূপ ব্যাপারের (কর্মের) অভাব হচ্ছে। ধাতু-অর্থ থেকে অত্যন্তাতিরেকিণী ভাবনা নেই। এটি সত্য। ধাতু-অর্থ-সমূহেপাক, যাগ, প্রযত্ন, সঙ্কল্প, অধিশ্রয়ণ, বিক্রেদন, অভিধান ও চোদ্দন, এইরকম অর্থ মাত্র আসে; তা ধাতুর স্বাভাবিক (স্বভাবসিদ্ধ) ধাতুর অভিধেয় (ভাবনার বা ধারণার বিষয়), অক্রিয়াত্মক (কর্ম-সম্বন্ধশূন্য) এবং সিদ্ধ-স্বভাব (পরিচয়), ধাতুর এই এক রূপ। সকল ধাতু-অর্থের অনুগত করোতি প্রত্যয়ের দ্বারা জ্ঞেয়, ক্রিয়াত্মক, সাধ্যস্বভাব, অন্যের উৎপাদনের বিষয়ে অনুকূলাত্মক, আখ্যাত প্রত্যয়ের দ্বারা বেদ্য, ধাতুর এই আর এক রূপ। বিষয়টি আরও প্রস্ফুট-ভাবে কথিতু হচ্ছে; যথা,-যঃ স্পন্দতে, যো যজতে, যশ্চরতি, যো বিদধাতি ইত্যাদি স্থলে, সর্বত্রই করোতির অর্থ অনুভূত হয়; যেমন, স্পন্দতে অর্থাৎ স্পন্দনং করোতি, যজতে অর্থাৎ যাগ করোতি এইরকম সর্বত্রই করোতি-অর্থের অনুগতি হচ্ছে। এ-বিষয়ে আচার্যগণ বলেছেন; যথা,–সিদ্ধ কর্তৃক্রিয়া ইত্যাদি। অর্থাৎ, সিদ্ধস্বভাব কর্তৃক্রিয়াবাচী আখ্যাত প্রত্যয় হলে, সামানাধিকরণ্যের দ্বারা করোতির অর্থই অবগত হওয়া যায় (মী.মা. বি. ২১১)। পরস্পর-ভিন্ন বিবিধ ধাতু-অর্থ-সমূহে, উৎপাদনীয় বস্তুর অন্তরকর্মক–এই যে অপর রূপ, তা ভাবিতার প্রযোজকব্যাপারত্ব-বশতঃ ভাবনা বলে অভিহিত হয়। তা যজেত, দদ্যাৎ, জুহুয়াৎ এইরকম আখ্যাত প্রয়োগ-সমূহেই অবগত হওয়া যায়; পাকঃ, ত্যাগঃ, রাগঃ ইত্যাদি স্থলে অবগত হওয়া যায় না বলে অন্বয় এবং ব্যতিরেকের দ্বারা আখ্যাত প্রত্যয়ের অভিধেয় বলে স্বীকৃত হয়। যথা,-অভিধাভাবনাং ইত্যাদি; অর্থাৎ, লিঙাদি, অন্যা অভিধাবনা বলে অভিহিত হয় এবং সকল আখ্যাতবিষয়ে অন্যা অর্থাত্মভাবনা বলে অবগত হওয়া যায় (মী, মা. বি. ২১১)। যে ধাতু-অর্থ-সমূহ প্রযত্ন অথবা স্পন্দ কিম্বা প্রযত্ন ও স্পন্দ উভয়ই অঙ্গীকার করে, সেই ধাতু-অর্থ সমূহের সর্বত্র অনুগমের অভাব হয়। তাতে সকল ধাতু-অর্থের অনুগত অন্য অর্থের উৎপাদন-বিষয়ে অনুকূলরূপ ভাবনা অঙ্গীকার করা উচিত। এ বিষয়ে কথিত আছে– সিদ্ধসাধ্যস্বভাবাভ্যাং ইত্যাদি; অর্থাৎ, ধাতু-অর্থ সিদ্ধ-স্বভাব ও সাধ্যস্বভাবভেদে দুরকম; তার মধ্যে অন্যের উৎপাদনের বিষয়ে অনুকূলাত্মক যে ভাবনা, সাধ্যরূপিণী। অতএব, ধাতু অর্থতিরেকিণী ভাবনা সিদ্ধ হলো।

অধ্যয়ন বিধিতে তব্য প্রত্যয়ের দ্বারা অবগত যে ভাবনা, তার তিনটি অংশর বিষয় উল্লিখিত হয়। সেস্থলে ধাতু-অর্থ, করণত্বের সাথে অন্বিত হয়; কারণ, ভাব্যবস্তুর অপেক্ষাতে তার লাভ হয় না। স স্বর্গং স্যাৎ সর্বান্ প্রত্যাবশিষ্টত্বাৎ (জৈ, ৪।৩১৫)। এই জৈমিনি-সূত্রের বিশ্বজিৎ ন্যায়ের দ্বারা স্বৰ্গই ভাব্য বলে অম্বিত হচ্ছে; এটা পূর্বপক্ষ। যদি বলো, এ স্থলে কি করে স্বর্গের ভাব্যতা হয়; কারণ সমনন্তর পদলভ্য স্বাধ্যায়েরই ভাব্যতা হচ্ছে। এও বলতে পারো না। কেননা, উক্ত স্বাধ্যায়ের অপুরুষার্থত্ব হেতু ভাব্যত্বের অসদ্ভাব হচ্ছে। তাহলে, তার অর্থ-জ্ঞানই দৃষ্ট প্রয়োজনরূপ বলে ভাব্য হোক। তা-ও হতে পারে না। যেহেতু, বিধি ভিন্নও পদ এবং পদার্থের ব্যুৎপত্তিযুক্ত পুরুষগণের অধীত স্বাধ্যায়ের দ্বারা অর্থজ্ঞান উৎপন্ন হয়। তবে, যদি বলো, অধীত স্বাধ্যায়ের দ্বারা অর্থকে জানবে এমন অবঘাত ইত্যাদির ন্যায় নিয়মার্থই বিধি হোক। তা-ও বলতে পারো না। তাতে, আরম্ভ না করে অধীত যে স্বাধ্যায়-বিধি, তা যজ্ঞের জন্য নয় বলে নিয়মার্থের অনুপপত্তি হচ্ছে। অবঘাত ইত্যাদি-সমূহ, যজ্ঞকার্যেই বিহিত হয়ে থাকে। অবঘাত-নিষ্পন্ন তণ্ডুল কর্তৃক পুরোডাশ ইত্যাদি নিম্পাদিত হয়; সেই পুরোডাশ ইত্যাদির দ্বারা দর্শ-পূর্ণমাস ইত্যাদি যজ্ঞ সম্পাদিত হয়ে থাকে; পরন্তু তণ্ডুল ইত্যাদির দ্বারা নিম্পাদিত হয় না। তাহলে, প্রমাণান্তরের সাথে বিরোধ হয়ে পড়ে। যদি বলো, স্বাধ্যায় ও অর্থজ্ঞানের আবশ্যক নাই, যদৃচোহধীতে ইত্যাদি (তৈ. আ. ২১০) সূত্রানুসারে অধ্যয়ন করে পঠিত অর্থবাদোক্ত ঘৃতকুল্যা ইত্যাদিই ভাবা হবে; কিন্তু তা-ও হতে পারে না। তা-ও ব্রহ্মযজ্ঞ ও স্বাধ্যায়কে অধিকার করে পঠিত হয়েছে। অতএব, তার দ্বারা গ্রহণ অধ্যয়ন-ফলসমর্পকত্বের লাভ হয় না। তথাপি, যদি বলো, এর অতিদেশ হতে প্রাপ্তিবশতঃ ফলই ভাব্য, হবে; তা-ও নয়। কারণ, অর্থবাদ কখনও অতিদেশ হতে পারে না। সেই, হেতু, বিশ্বজিৎ ন্যায়ের দ্বারা অধ্যয়ন-বিধির স্বৰ্গই ভাব্য। এ সম্বন্ধে উক্ত হয়েছে; যথা,–বিধি-ভিন্ন দৃষ্টলাভ হতে: অর্থ কখনও সম্ভব হয় না; বিধির শক্তিবশতঃ বিশ্বজিৎ ইত্যাদির ন্যায় স্বর্গ কল্পনীয়।

এস্থলে কথিত হচ্ছে,–অর্থজ্ঞানের জন্যই অধ্যয়ন-বিধি বিহিত হয়। যদি বলো, পদ এবং পদার্থের জ্ঞান-বিশিষ্ট পুরুষগণের বিধি-ভিন্নও অর্থজ্ঞান হয়, অতএব বিধি অনর্থক, এটা উক্ত হয়েছে; তা-ও নয়। অধ্যয়ন দ্বারা সংস্কৃত যে স্বাধ্যায়, তার দ্বারাই অর্থ অবগত হবে, পুস্তক ইত্যাদি পাঠ দ্বারা নয়, এইরকম বিধির নিয়ম আছে। যদি বলো, উক্ত বিধি যজ্ঞের নিমিত্ত নয়; অতএব, এতে নিয়মের অনুপপত্তি হচ্ছে। কিন্তু তা-ও বলতে পারো না। কারণ প্রাঙমুখোইন্নং ভুঞ্জীত অর্থাৎ পূর্বমুখ হয়ে অন্নভোজন করবে-এই যে বিধি, এও যজ্ঞের নিমিত্ত নয়। কিন্তু এই স্থলেও নিয়ম দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। যদি বলো, ব্রীহি সমূহকে প্রেক্ষণ করছে ইত্যাদি বিধির ন্যায় উক্ত বিধি, সংস্কার-বিধানমাত্রেই পর্যবসিত হচ্ছে বলে স্বাধ্যায়ের অর্থজ্ঞানরূপ অর্থকে জানাচ্ছে না; কিন্তু। এ-ও বলতে পারো না। চরুং উপদধাতি চরু সংস্কারমূলক এই উপধান-বিধি তৈত্তিরীয় সংহিতায় উক্ত হয়েছে। সেই বিধি অনুসারে সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে যেমন চরুর স্থলনিষ্পত্তি বা চরুর প্রস্তুত। কার্য সম্পন্ন হয়; সেইরকম স্বাধ্যায় (বেদ) অধ্যয়ন করতে করতে, তার অর্থবোধ করিয়ে দেয়। যদি বলো, সংস্কারের বিনিয়োগ পর্যন্ত সংস্কার-বিধি হলেও, ফলবিষয়ে বিশেষ উল্লেখ নেই; সুতরাং, কেন ঐ সংস্কার-বিধিতে স্বর্গরূপ অর্থ বিধান করবে না? এ-ও বলতে পারো না; কারণ দৃষ্টপ্রয়োজনরূপ অর্থজ্ঞানের সম্ভব হলে, অদৃষ্ট অর্থের কল্পনা নিষ্প্রয়োজন হয়। এ বিষয়ে কথিত হয়েছে, লভ্যমান ফল দৃষ্ট হলে, অদৃষ্টফল-কল্পনার প্রয়োজন হয় না; বিধির নিয়মাৰ্থ আছে বলে, অনর্থক বিধি বিহিত হয় না। যে দ্বিজ, শিষ্যকে উপনীত করে কল্প এবং রহস্যের সাথে বেদাধ্যয়ন করান, তাঁকে আচার্য বলে (ম. স্মৃ.২১৪০)। প্রাভাকরগণ বলে থাকেন, উক্ত স্মৃতির দ্বারা অনুমিত বিধির সাথে, উপনীয়াধ্যাপনেন ইত্যাদি বিধির দ্বারা স্বাধ্যায়েহধ্যেতবঃ অধ্যয়ন-বিধি লক্রিয় ১) হয়। তার অধিকারপরত্বের জ্ঞানেচ্ছা হলে, প্রথম প্রতীত (স্মৃতি-অনুমিত) বিধির দ্বারা আচার্যের অধিকার আশঙ্কা করা যায়। অন্তরঙ্গহেতু অর্থজ্ঞানের অধিকারপরত্ব ঘটে।

কিন্তু আচার্যকরণরূপ বিধির অভাববশতঃ তা যুক্তিযুক্ত নয়। যদি বলো, এইরকম উক্ত আছে, –উপনীয় তু যঃ শিষ্যং–এই স্মৃতির দ্বারা উপনীত করে অধ্যাপন হেতু আচার্য বলে ভাবনা করবে, যদি বলো, এইরকম আচার্যকরণরূপ বিধি অনুমিত হয়; কিন্তু তা-ও হতে পারে না। এই রকম শ্রুতিবাক্য অন্যরূপ স্মৃতির দ্বারাও অনুমান করতে পারা যায় না; কারণ এই স্মৃতির মতে উপনীত করে যিনি অধ্যাপয়িতা, তিনিই আচার্য নামে অভিহিত হন। কিন্তু অধ্যাপন-বিষয়ে এ বিধি বিহিত নয়। সেই বিধান-বিষয়ে যিনি অধ্যাপয়িতা, তাঁকে আচার্য বলে,–এই অংশের সাথে একবাক্যতার বিরোধ হচ্ছে। যদি বলো, উক্ত বিধিতে উপনীত করে অধ্যাপন করাবে–এইরকম অধ্যাপনাকে বিহিত করে, পরে বিধিসিদ্ধ অর্থকে যস্তু এইভাবে বলে, তার (অধ্যাপকের) আচার্যত্ব প্রতিপন্ন করছে; কিন্তু তা-ও হতে পারে না। কারণ ঐ অর্থে বিধির প্রতীতি না হয়ে বাক্যের ভেদকল্পনাতে প্রমাণের অভাব ঘটছে। এ বিষয়ে উক্ত হয়েছে,–একবাক্যের স্থলে বাক্যভেদ যুক্তিযুক্ত নয়। আরও, যোহধ্যাপয়েৎ এই যৎ শব্দের যোগও বিধির শক্তিকে নষ্ট করছে। যদি বলো, তাহলে, যদাগ্নেয়োহষ্টাকপালঃ ইত্যাদি স্থলেও যৎ শব্দের যোগে বিধির শক্তি নষ্ট হোক; তা-ও বলতে পারো। কিন্তু সেই স্থলেও যৎ শব্দ বর্তমান থাকায় বিধিভঙ্গ-ভয়ে, উক্ত তৈত্তিরীয়-সংহিতায় অমাবস্যায়াং চ পৌর্ণমাসাঞ্চ এইরকম অর্থবাদ দ্বারা যা স্তুত হয়, তা-ই বিহিত হয়। এই ন্যায়ে পরিকল্পিত অন্যকেই বিধি বলে স্বীকার করা হয়েছে। সেই হেতু উপনীয়তু যঃ শিষ্যং ইত্যাদি স্মৃতিবাক্যের দ্বারা অনুমিতা যে শ্রুতি, তা আচার্য-করণ-বিধিতে প্রমাণ নয়। যদি বলো, অষ্টবর্ষবয়স্ক ব্রাহ্মণকে উপনীত করবে এবং তাকে অধ্যয়ন করাবে; এই স্থলে সম্মানন (পা, ১৩৩৬) এই সূত্রের দ্বারা আচার্যকরণবিষয়ে নী ধাতুর আত্মনেপদ বিধান আছে বলে উপনয়নে আচার্য-করণ-বিধিই অপেক্ষিত হচ্ছে। তা-ও যুক্তিসিদ্ধ নয়; কারণ, ব্রাহ্মণের যকর্মের (যজন, যাজন, অধ্যয়ন, অধ্যাপন, দান ও প্রতিগ্রহের) মধ্যে যাজন, অধ্যাপন ও প্রতিগ্রহ এই কর্ম তিনটি জীবিকারূপে নিরূপিত হয়েছে। (ম. স্মৃ. ১০৩৬)। স্মৃতিতে উক্ত এই বাক্যের দ্বারা দ্রব্যোপার্জনের নিমিত্ত প্রাপ্ত যে অধ্যাপনা, তা-ও বিধিযোগ্য হচ্ছে না। তথাপি যদি বলো, তাতে অলৌকিক আচার্যসাধন হচ্ছে বলে অপ্রাপ্ত যে অধ্যাপন, তা বিধিযোগ্য হোক। এ-ও বলতে পারো না। কারণ, আচার্য-কর্ম লোকসিদ্ধ বলে তার অলৌকিকত্ব প্রতিপন্ন হচ্ছে না।

 যদি বলো, তা-ই হলো; যদি বলো, উপনয়ীত এই আত্মনেপদ থেকে নিয়মের সাথে বর্তমান যে উপনয়ন, তার শেষিত্ব-প্রতীতিবশতঃ আচার্য-কর্ম অলৌকিক; তা-ও নয়। আচার্যকরণে বর্তমান যে নী ধাতু, কর্তার অভিপ্রায় ভিন্ন বিষয়ে তার আত্মনেপদের বিধান আছে। অতএব উপনয়ন ও আচার্যকরণ এদের পরস্পরের অঙ্গাঙ্গিভাব হচ্ছে না। তাহলে স্বরিততিঃ (পা. ১৩৭২) এই সূত্রের দ্বারা ধাতু ত্বি বশতঃ আত্মনেপদের সিদ্ধি হয় এবং সম্মাননাদি সূত্র অনর্থক হয়। যদি বলো, যা কর্তার ক্রিয়াফলাভিপ্রায়, তা কর্তার অভিলষিত নয়; কিন্তু সেই ফল কর্তৃগত; অতএব, উপনয়ন ক্রিয়ায় যে ফল, তা মাণবকনিষ্ঠ বলে কভিপ্রায় হচ্ছে না। অতএব, যদি বলো, আচার্যকরণ বিষয়ই নী ধাতুর আত্মনেপদ সিদ্ধ হচ্ছে; কিন্তু তা-ও বলতে পারো না। কেননা, বসন্তে ব্রাহ্মণোহগ্নিমাধীতে (তৈ.ব্রা, ১১২৬) এই তৈত্তিরীয় সংহিতোক্ত অগ্ন্যাধান বিধিটির আধান ফল যে অগ্নিসংস্কার, তা অগ্নিগত। এতে কর্তার অভিপ্রায় সিদ্ধ হচ্ছে না। অতএব স্বরিততিঃ  এই সূত্রের দ্বারা আত্মনেপদ হবে না; এইরকম, উপনয়ন ক্রিয়ার ফল যে সংস্কার, তা মাণবকের (অনুপনীত ব্রাহ্মণকুমারের) অভিলষিত বলে, কর্তার অভিপ্রেত হচ্ছে না। পরন্তু, উক্ত সংস্কার আচার্যের অভিলষিত; কারণ, আচার্যের অভিলষিত না হলে তার ক্রিয়াফলের উপপত্তি হয় না; ক্রিয়ার জন্য অপর কেউ কর্তার অভিলষিত ফল প্রাপ্ত হলো না। কিন্তু কর্তার অভিলষিত ক্রিয়ার জন্য ক্রিয়ার ফল তারই হয়ে থাকে। তা না হলে, ক্রিয়ার জন্য অন্য ব্যক্তিরও শ্রম ইত্যাদিও ফলপ্রদ। হতো। এতে স্বৰ্গকামো যজেত ইত্যাদির স্থলে ক্রিয়াফল কত্রভিপ্রায় হয় না এবং আত্মনেপদও হয়। না। যদি বলো, মাণবকের ঈপ্সিত সাধনের দ্বারাই উপনেতার উপনয়ন-ক্রিয়ার ফল অভিলষিত, এটি আপনাদের মত; কিন্তু তার দ্বারা ক্রিয়াফলের কভিপ্রায়ত্ব প্রতিপন্ন হয় না। সুতরাং এ-ও বলতে পারো না; কারণ, তাতে আচার্যকামনার সাধন হয় না বলে, মাণবকের অধিকারে ঈপ্সিতের উপপত্তি হচ্ছে না। অথবা, উপপত্তি হলে, মাণবকাধিকারের অভিলষিত বস্তুর প্রযোজক বলে, আচার্যকের যে অধিকার, তার প্রযোজকত্ব হয় না। সেই হেতু, আত্মনেপদ হতেই ক্রিয়াফলের, কর্তার অনভিপ্রায়ের, অবগতি হয়। তাতে মাণবকের সম্যক ঈপ্সিত বস্তুর সাধনের দ্বারাই উপনয়নের প্রতীতি হচ্ছে।

উপনীয়তু যঃ শিষ্যং বেদমধ্যাপয়েৎ এই বিধিতে উপনীয় এই ক্তা প্রত্যয়ের দ্বারা উপনয়নের আচার্য-কর্মের শেষত্ব বলে মনে করো না; কারণ, স্মৃতিতে যে ক্কা প্রত্যয় আছে, তা সমানকর্তৃকয়ঃ পূর্বকালে (পা.৩৪।২১) এই সূত্রের দ্বারা এককর্তকত্ব বলে উপনয়ন ও অধ্যাপনের সমানকর্তৃকত্বকেই অভিহিত করছে। যেহেতু, ঐ ক্কা প্রত্যয়, এককর্তাতেই প্রযুজ্য এবং সেই এককর্তৃত্বও পরস্পর অঙ্গাঙ্গি ভাব হতেই উপপন্ন হয়। এই হেতু উপনয়ন যে অধ্যাপনের অঙ্গ, তা বিলম্বে প্রতীয়মান হয়। বসন্তে ব্রাহ্মণমুপনয়ীত (আপ, ধ. ১।১।১।১৯) এই দ্বিতীয় শ্রুতি-বাক্যটি, প্রত্যক্ষ শ্রুতিরই অন্তর্গত। এই দ্বিতীয় শ্রুতি-বাক্যের দ্বারা উপনয়নের উপনয়শেষত্ব সহজেই প্রতীত হচ্ছে। শ্রুতিবাক্যে ও স্মৃতিবাক্যে পরস্পর বিরোধ ঘটলে, শ্রুতিবাক্যই বলবান হয়–এই হেতু, দ্বিতীয় শ্রুতি অনুসারে, উপনয়নের উপনেয়-শেষত্বই অঙ্গীকার করা কর্তব্য।

যদি বলো, উপনয়ন, উপনেয়ের শেষত্ব-সাধক; তথাপি উপনেয় আবার আচার্য-কর্মের শেয-সাধক বলে, তার দ্বারা উপনয়নেরও তদঙ্গত্ব হোক। এ-ও বলতে পারো না। কারণ, উপনেয়-সংস্কার, আচার্য-কর্মের সমাপ্তিকারক, এবং উপনেয়ের শেষসাধক। অতএব, প্রয়োজনের অভাব-বশতঃ অন্য পুরুষগত যে আচার্য-কর্ম, তা বহিরঙ্গ হচ্ছে; এবং একপুরুষগত যে অধ্যয়নকর্ম, তা অধ্যয়ন হচ্ছে। অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ এই উভয়ের মধ্যে অন্তরঙ্গ বলবৎ; এই ন্যায় হেতু তা অধ্যয়নের অঙ্গ বলেই স্বীকার করা উচিত। যদিও এককর্তৃবিহিত স্মার্ত ক্কা প্রত্যয়ের শক্তিতেই, অন্তরঙ্গ-বিধি বাধিত হয়, তাহলে আপনার পক্ষে অধ্যাপনবিধিপ্রযুক্ত অধ্যয়ন বিধির অধিকারপরত্ব কি? এই জিজ্ঞাসা উপস্থিত হলে, তার উত্তরে কথিত হচ্ছে,–অধীত্য স্নায়াৎ। এই বিধিতে যে স্মার্ত ক্কা প্রত্যয় আছে, তার দ্বারা যেমন অন্তরঙ্গ-বিধির বাধ হয়; সেইরকম, অন্তরঙ্গাধজ্ঞানপরত্বকে পরিত্যাগ করে আচার্যের অধিকার-পরত্বই বলবৎ হয়। সেই হেতু কর্তার অভিপ্রায় ভিন্ন বিহিত যে আত্মনেপদ, তার শক্তিতে অন্তরঙ্গ যুক্তির বাধ-হেতু উপনয়ন–অধ্যয়নাঙ্গ। এই হেতু আচার্য-কর্ম, নিয়মের সাথে উপনয়ন বিধির সমাপক হচ্ছে না; অতএব আচার্যকর্মের অলৌকিকত্ব সিদ্ধ হচ্ছে না। কারণ, তা সিদ্ধ হলে, অন্য হতে প্রাপ্ত যে অধ্যাপনকর্ম, তার আচাৰ্যকর্মশেষত্ব হেতু উক্ত বিধিরই আসদ্ধি হয়। D যদি বলো, তাহলে কি করে অধ্যাপয়ীত এই বিধি যুক্তিযুক্ত হয়? এর দ্বারা অন্নাদিকামী ব্যক্তিকে যাগ করাবে? এই বিধিরূপ উক্ত অধ্যাপয়ীত বিধি, প্রযোজক-ব্যাপারের অন্তরঙ্গ হলেও প্রযোজ্যা-ব্যাপারপর, এটা বলব। এতয়ান্নাদ্যকামং উক্ত বিধিতে কামনারূপ শ্রুতির শক্তি হেতু কামী ব্যক্তিরই বিধিতে অপেক্ষা হচ্ছে বলে ঐ বিধি প্রযোজ্যব্যাপারপর হোক। এখানে কিন্তু তার অভাব বশতঃ প্রযোজ্যব্যাপারপর হবে না। এ বলতে পারো না। কারণ, নিষাদ স্থপতিং যাজয়েৎ–এস্থলে কামশ্রুতির অভাব হলেও দ্রব্যোপার্জনের নিমিত্ত প্রাপ্ত যে যাজনকর্ম, তাকে পরিত্যাগ করে অপ্রাপ্ত যে প্রয়োজ্যব্যাপার, তা-ই বিধেয় হচ্ছে। এর দ্বারা গুরু শিষ্যকে উপনীত করে মহাব্যাহৃতি পূর্বক বেদ অধ্যয়ন করাবে এবং ঐ শিষ্যকে শৌচাচার শিক্ষা দেবে (যা.স্মৃ. ১।২।৭)–এই স্মৃতির বিধিটিও যে অধ্যাপনবিধির বিষয় নয়, তা অবগত হওয়া যাচ্ছে।

আরও, উপনীত করে যিনি শিষ্যকে বেদ শিক্ষাদান করেন, তিনি আচার্য নামে অভিহিত হন (যা. স্মৃ. ২।২।২৬) এই স্মৃতির বিধিও ক্রিয়াযোগ্য আচার্য শব্দকে স্পষ্টভাবে অভিহিত করছে। অতএব, অধ্যাপকের বিধিই নেই, এটা সিদ্ধ হলো। অধ্যাপন বিধির অভাববশতঃ আপন বিধিপ্রযুক্ততাই অধ্যয়নের বিধি। সেই বিধি, অধ্যয়নের দ্বারা সংস্কৃত যে স্বাধ্যায়, তার দ্বারাই অর্থকে জানবে এমন অর্থবিহিত করছে। অতএব সমগ্র বেদরাশির অর্থ-বিবক্ষাতে স্বতঃ-প্রামাণ্যবশতঃ তার অন্তর্গত এই অথর্ববেদের ব্যাখ্যা করা যুক্তিযুক্ত, এটা স্থিরীকৃত হলো। বেদের যে স্বতঃ-প্রামাণ্য আছে, তা আচার্যগণ চোদ্দনা (প্রেরণা) সূত্রে উপপন্ন করেছেন। বাদিগণ সেই বেদবিষয়ে বহু রকম বিবাদ করে থাকেন। সাংখ্যগণ বলেন–প্রামাণ্য ও অপ্রামাণ্য এই উভয়ই বেদ থেকে প্রতিপন্ন (স্বতঃসিদ্ধ) হয়। তার্কিকগণ বলেন,–উক্ত প্রামাণ্য ও অপ্রামাণ্য অন্য থেকে হয়। মীমাংসকগণ বলেন, প্রামাণ্য স্বতঃসিদ্ধ, অপ্রামাণ্য-অন্যসিদ্ধ। সৌগতগণ বলেন, অপ্রামাণ্য–স্বতঃসিদ্ধ, প্রামাণ্য-অন্যসিদ্ধ।

স্বতঃসিদ্ধ যে প্রামাণ্য অর্থাৎ যা স্বতঃ-সপ্রমাণ, কার্যের কারণ থেকে কার্যের সাথে তা উৎপন্ন হয়। এ বিষয়ে সাংখ্যগণ এই রকম প্রতিপন্ন করেছেন, অসৎ স্বতঃই অপ্রামাণ্য। এই হেতু সৎ এবং. অসৎ উভয়ই আপন আপন স্বরূপ বিশিষ্ট; অর্থাৎ, যা সৎ, তা সৎ; যা অসৎ তা অসৎ। এই বিষয়ে প্রমাণ এই যে, যা অসৎ, তার ক্রিয়া নেই, যথা শশকের শৃঙ্গ। কর্তার পূর্বে কার্য অসম্ভব (অসৎ); কর্তা ভিন্ন কার্য হতে পারে না। অতএব সই আদিভূত। সুতরাং কারণের পূর্বে কার্য-সম্বন্ধ সপ্রমাণ হয় না। পুর্ব সম্বন্ধের বিষয় যদি উত্থাপন করো, কিন্তু তা-ও উপপন্ন হয় না; কেননা, অসতের সম্বন্ধই প্রমাণিত হয় না। আদিতে সতেরই কার্য (বিদ্যমানতা) স্বীকার করতে হবে। আদিতে অসৎ স্বীকার করলে, এইটি এর কারণ অথবা এইটি এর কার্য–এমন অধ্যাহার করা যায় না। অসতের এবং অসম্বন্ধের কোনরকম পার্থক্য নেই। (যা অসৎ, তার সাথে কার্যকারণের কোনরকম সম্বন্ধ থাকতে পারে না)। এ বিষয়ে শাস্ত্রে কথিত আছে,–অসত্তান্নাস্তি ইত্যাদি; অর্থাৎ-অসত্ত-হেতু (অসৎ) সম্বন্ধের সংশ্রব থাকে না। কারক (কর্তা) সৎসঙ্গযুক্ত। অসম্বন্ধ (অসৎ) হতে বিষয়ের উৎপত্তি কল্পনা করতে গেলে, তা যুক্তিতে দাঁড়াতে পারে না। অপিচ, কারণ হতে কার্য অভিন্ন বলে আদিতে অসতের উপপত্তি হয় না। যেমন, তন্তু হতে পট ভিন্ন নয়; কেননা তাদের পরস্পরের কর্ম-সম্বন্ধ আছে। যে বস্তু যা হতে ভিন্ন, সেই বস্তু তার কার্য হতে পারে না; (পরস্পর ভিন্ন বস্তুর সম্বন্ধ সূচিত হয় না); যেমন, গো ও অশ্ব পরস্পর ভিন্ন (একের সাথে অন্যের সম্বন্ধ নেই)। অন্য পক্ষে আবার দেখুন; যেমন তন্তুর কার্যপট (তন্তুর সাথে পটের সম্বন্ধ আছে); কেন-না তন্তু হতে ১) পট ভিন্ন নয়। যে বস্তু যে ভাবে বিভিন্ন, তার সাথে সংযোগ ও বিয়োগ সেই ভাবেই হয়ে থাকে; যেমন, কুণ্ড ও বদর কিম্বা মেরু ও বিন্ধ্য। কিন্তু পটের, তন্তুর সাথে উক্ত ভাবের সম্বন্ধ নেই (কুণ্ড ও বদরে কিম্বা বিন্ধ্য ও মেরুতে যে সম্বন্ধ ভিন্নতা, এখানে তা নেই। অতএব তন্তু হতে পট ভিন্ন নয়। এইভাবে তন্তু ও পটের অভেদ সিদ্ধ হয়। ফলতঃ কার্যের পূর্বে সতের অস্তিত্বই সিদ্ধ হয়ে থাকে।

এ বিষয়ে আরও কথিত হতে পারে,–ক্রিয়মাণত্ব সত্ত্বসাধন নয়; (অর্থাৎ, কর্ম থেকে সৎ উৎপন্ন হয় না); অসৎ থেকে সতের উৎপত্তি-হেতু বিবৃত হলে, তাতে মাত্র সন্দেহই বর্ধিত করে; যেমন, সৎ থেকে ঘট ইত্যাদির ক্রিয়মানত্ব দৃষ্ট হয় না, তাতে কৃতকরণরূপ ব্যাপারের অনুপপত্তি ঘটে। এইভাবে আবার অসৎ থেকে ক্রিয়মাণত্বও উপপন্ন হতে পারে; যেহেতু, উৎপত্তির পূর্বে ঘট ইত্যাদি অসৎ ছিল; উৎপত্তি দর্শন-হেতু সামগ্রীর মধ্যে গণ্য হয়ে তা সতে পরিণত হলো (অতএব অসৎ থেকে সতের উৎপত্তি কেন-না হতে পারবে?)। এমনও কথিত আছে, কারণের সাথে অসম্বন্ধ যে কাৰ্য, তার উৎপত্তি হয়; তাতে এটাই এর কার্য। এই-ই এর কারণ এইরকম নিয়মের অনুপপত্তি ঘটছে। কিন্তু তা-ও যুক্তিযুক্ত নয়। কেননা, কোনও কারণ কোনও কার্যে সমর্থ হয়, এইরকম সামৰ্থ-বশতঃ নিয়মের সিদ্ধি হচ্ছে। শক্তিমান ভিন্ন শক্তি থাকতেই পারে না। কিন্তু এ প্রসঙ্গে এমন প্রশ্ন উঠতে পারে না। এই অগ্নি, অদ্বিষ্ঠের অদ্বিতীয়ত্বের এবং অতীন্দ্রিয়ের আশ্রয় বলে, তার গুরুত্ব আশ্রয় সিদ্ধ হয়। শক্তিমানের সাথে শক্তির অভিন্নতা নেই। শক্তিকে কার্যকারণ-ভাবের নিয়মিকাও বলা যেতে পারে না। শক্তিমানের আশ্রয়ভূতা শক্তি, প্রতিনিয়ত শক্তিমানেরই অনুকূল স্বভাববিশিষ্টা বলে কথিত হয়। অন্যথা, সৎকার্য-বাদ পক্ষেও প্রধান উপাদান-স্বীকার হেতু, সর্ব-জগতের সর্ব-বস্তুর সময়ের সর্বত্র সর্বদা সৎস্বরূপে বিদ্যামানতার জ্ঞানের–অভাব ঘটে। তাতে, এটাই এর কার্য, এটাই এর কারণ, এ নিয়ম থাকে না। যদি বলো, সর্বত্র সর্বদা কার্যের সত্তা-বিশেষেও সেই সেই ভাবপ্রকাশক সামর্থ্য-নিয়ম-হেতু, সেই সেই ভাবপ্রকাশক নিয়ম হয়; তাহলে, আমাদের পক্ষে সেই সেই বিষয় উৎপাদক কারণ-সামর্থ্যের নিয়ম উপস্থিত হয়; তাতে পূর্বোক্ত সকার্য উৎপত্তির নিয়ম অব্যাহত থাকে। পুনশ্চ, কার্যকারণের অভেদ-সাধক যে অনুমান, তা-ও তন্তু-পটের সম্বন্ধ-বিষয়ে প্রত্যক্ষ-জ্ঞানের অভাব-বশতঃই ঘটে থাকে। তাকে প্রত্যক্ষ বিরুদ্ধ কালের অতীত বলে বুঝতে হবে। আরও, কর্তার ব্যাপারের অর্থাৎ কর্মের প্রারম্ভে কারণ বিষয়ে কার্য সৎ হয়। তাহলে কারণেই কার্যের উপলব্ধি ঘটছে। এ পক্ষেও বিতর্ক আছে। অপর পক্ষে বলতে পারেন, কারণে কার্য উপলব্ধ হয় না। সেই হেতু অসৎই প্রতিপন্ন হয়। যদি বলো, প্রথমে সবই কার্য হয়েছিল, কিন্তু তার অভিব্যক্তির অভাববশতঃ তা উপলব্ধ হয় না; তা-ও বলতে পারো না। এই যে অভিব্যক্তির প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়, স্বরূপতঃ তা কি? অদিতে তা সৎ কি অসৎ ছিল? যদি সৎ বলো, তাহলে আদিতেই কেবল তন্তু-সমূহেই পট উপলব্ধ হতো। আর যদি অসৎ বলো, তাহলে সেই অসৎ থেকেই পরে তার উৎপত্তি স্বীকার করতে হয়। তাতে সকল অসৎ থেকে অসৎ কার্যের উৎপত্তি অঙ্গীকৃত হয় না কি? তা-ই অঙ্গীকৃত হয়। এ বিষয়ে অধিক আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। অতএব সতের কার্য অস্বীকার করলে, প্রামাণ্য ও অপ্রামাণ্য উভয়ই স্বতঃসিদ্ধ হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে সামান্য মাত্র প্রমাণই প্রমাণের মধ্যে গণ্য হয়। তা অপ্রামাণ্য; কারণ তাতে সৎ এবং অসৎ উভয়ই স্বতঃসিদ্ধ হয়। কিন্তু তা যুক্তিযুক্ত নয়।

আরও, কেউ কেউ অপ্রামাণ্যকে স্বতঃসিদ্ধ এবং প্রামাণ্যকে অন্যসিদ্ধ মনে করেন। তাঁদের মত এই যে, যদি প্রামাণ্যকে স্বতঃসিদ্ধ বলে স্বীকার করো; তাতে কোটি সংখ্যার নির্ধারণে (অর্থাৎ বিষয়-মাত্রেই) প্রমাণের ও অপ্রমাণের কোনরকম সন্দেহই আসতে পারে না। অপর পক্ষে (অপ্রামাণ্য স্বতঃসিদ্ধ বলে স্বীকার করলে) সর্বত্রই সন্দেহ বর্তমান থেকে যায়। যদি বলো, কারণের গুণজ্ঞান থেকে অথবা অর্থক্রিয়ার উপলব্ধি থেকে প্রামাণ্যর নিশ্চয় হোক; তা-ও বলতে পারো না। কারণ, অর্থসন্দেহ হতেও প্রবৃত্তির উপপত্তি ঘটে। প্রবৃত্তকর্মের অর্থক্রিয়া (উদ্দেশ্য) উপলব্ধ হলে, পূর্বপরিজ্ঞাত অর্থক্রিয়াকারিত্বের সত্যতা অবধারিত হয়। তাতে সেই বিষয়ের পূর্বজ্ঞানের সেই অর্থসম্বন্ধিত-হেতু পশ্চাৎ তা প্রামাণ্য বলে নিশ্চিত হয়ে থাকে ( পূর্বে যে বিষয়ের যে জ্ঞান সঞ্চিত থাকে, তার দ্বারা সেই সম্বন্ধীয় ব্যাপারের উৎপত্তি বিষয়ক প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায়)। এ বিষয়ে উক্ত আছে, তস্মিন্ সদপি ইত্যাদি;অর্থাৎ, বিদ্যমানতা সৎ হলেও তার নিশ্চয় করতে সমর্থ হওয়া যায় না; পরবর্তী ক্রিয়ার জ্ঞান থেকেই কেবল তা অনুভূত হয়ে থাকে। এ বিষয়েও আপত্তি হতে পারে; কেউ বা বলতে পারেন,–অর্থক্রিয়াজ্ঞানেরও আপন বিষয়ার্থ-ক্রিয়ার পরিনিশ্চয়ে পরের অপেক্ষা থাকছে; এবং তাতে অনবস্থা আসতে পারে (একের কার্যের কারণ নির্ণয়ের বিভ্রম অসম্ভব নয়; সুতরাং পরবর্তী কার্য দেখে পূর্ববর্তী কার্যের কারণ নির্ধারণ করা সমীচীন নয়)। ফলদর্শনেই কারণ উপলব্ধ হয়; ফলের নিমিত্তই কার্য বিহিত হয়; ফল, কার্যকে আনয়ন করে না। স্কুট (প্রকাশমান) বিষয়ের অবিকল্প (রূপান্তরের অভাব) হেতু অর্থ-ক্রিয়া-জ্ঞান আপনা-আপনিই প্রমাণিত হয়। (দ্রব্য দর্শন-মাত্রই তার কার্যকারণের ভাব আপনা-আপনিই উপলব্ধ হয়)। এইভাবে আপন বিষয়ের যে, যাথার্থ্যাবধারণ, তাকেই প্রমাণ বলে। প্রমাণ্যের দ্বারা যা অবগত হওয়া যায়, তা প্রবৃত্তিরই অঙ্গ। সুতরাং প্রবৃত্তির (কর্মারম্ভের) পরবর্তী কালের অর্থক্রিয়ানির্ণয় (কার্যাদৃষ্টে কারণের অনুভবত্ব) নিষ্ফল বলে স্বীকার করা যায় না। জ্ঞানান্তরে নিশ্চিত প্রবৃত্তির ভাব প্রাপ্ত হওয়া যায়। বিসম্ব ইত্যাদি জ্ঞানের প্রবর্তক যে প্রমাণ, তার প্রতিবন্ধ বিশেষরূপে কল্পিত হতে পারে না। তার জন্য প্রবৃত্তি-প্রবর্তনায় (কর্মারম্ভে) পরবর্তী কালের সম্বন্ধ সূচনার উপযোগিতা প্রতিপন্ন হয় (পরবর্তী কালের জ্ঞানের দ্বারা পূর্ববর্তী কার্যের কারণ অনুমিত হয়ে থাকে)। আদ্যজ্ঞানে প্রবৃত্তির কার্যে ফলের অপ্রতীতি হলেও পরবর্তী জ্ঞানাস্তরে অর্থক্রিয়ারূপ ফলের বিষয় অবগত হওয়া যায়। এতে বিসম্বাদ উত্থাপিত হলে, তা বৈলক্ষণ্য (অযৌক্তিক) রূপে প্রতিপন্ন হয়। এ বিষয়ে উক্ত আছে, বৃত্তাবভ্যাসব্যাং  ইত্যাদি; অর্থাৎ,আদিতে অপ্রাপ্ত যে কর্মফল, তার বিষয় জানা যায় না; (তাকেই যদি মুখ্য বলে কল্পনা করি) অতএব, প্রবৃত্তির কার্যে বৈলক্ষণ্য প্রতীত হয়; (না জানা বা অজ্ঞতা কার্যসাধকের পরিপন্থী হতে পারে না)। অতএব ঝটিতিনিঃশঙ্ক প্রবৃত্তিও (সহসা নিশ্চিতভাবে প্রবৃত্তির যে কাৰ্য), বিসম্বাদিগণ কর্তৃক প্রবর্তিত প্রমাণের প্রতিবন্ধক-রূপ বিশেষ নির্দেশের দ্বারা, অনুমান থেকেই আপনা-আপনি প্রমাণিত হয় না (প্রকৃতপক্ষে অনুমানেই তার প্রমাণ উপপন্ন হয়)।

এ বিষয়ে বলা যেতে পারে,–অর্থের যথার্থতা নিশ্চয়-হেতু (অর্থাৎ অর্থ যথার্থ বলে) আদি-উৎপত্তি প্রমাণস্বরূপ গৃহীত হোক। গুণজ্ঞান হতে অথবা (পরম্পরা-ক্রমে প্রাপ্ত) সংবাদ হতে সেই নিশ্চয়তা (অর্থের যথার্থরূপ নিশ্চয়তা) স্থিরীকৃত হয়। এ সিদ্ধান্ত মিথ্যা বলা যেতে পারে না। সত্যজ্ঞান প্রদানের শ্রেষ্ঠ কারণ বলেই প্রামাণ্য স্বীকৃত হয়। প্রমিতি শব্দের অর্থ–অনধিগতবিষয়ের মর্মাবধারণ। যদি বলো, ইন্দ্রিয় ইত্যাদিয়ই প্রামাণ্য, জ্ঞানের প্রামাণ্য নেই; কিন্তু তা-ও বলতে পারো না। কেননা, জ্ঞানেরই অবধারণরূপত্ব। অতএব, জ্ঞান ভিন্ন অন্যের অবধারণের সাধনশ্রেষ্ঠত্ব উপপন্ন হয় না। অবধারণ দুরকম; জ্ঞানরূপ ও প্রাকট্য (প্রকাশ) রূপ। যা অনধিগত ছিল, তা D গোচরীভূতকরণই জ্ঞানের প্রামাণ্য। অতএব, অনধিগত বিষয়ের যথার্থরূপ অবধারণই প্রমিতি (অর্থাৎ সত্যজ্ঞান)। প্রমিতিসাধক যে জ্ঞান, তা-ই প্রমাণ। জ্ঞানের ভাবই (জ্ঞানোৎপন্ন বিষয়ই) প্রামাণ্য বলে অভিহিত হয়। প্রকৃত শব্দার্থের সাথে যার সম্বন্ধ নেই, তা প্রামাণ্য নয়। প্রমিতি লক্ষণরূপ বাক্যগত যে অবধারণ, সেই উদ্বোধক শব্দের দ্বারা জ্ঞানের ও প্রাকট্যের কার্যকারণ-ভাব উপলব্ধ হয়। তাতে নৈকট্য ও দূরত্বসাধক প্রামাণ্যের একরূপ-জ্ঞানের নিমিত্ত উপাদান প্রাপ্ত হওয়া যায়। জ্ঞানের ও প্রাকট্যের দুরকম শক্তি। তারা প্রমাণ-গোচর ও অপ্রমাণ-গোচর; অতএব, প্রামাণ্য ও অপ্রামাণ্য। উক্ত শক্তি দুটি, যথাক্রমে তথাভূত এই অর্থ এইরকম তথাত্ব অবধারণ. এবং অতথাভূত এই অর্থ এইরকম অতথাত্ব, অবধারণ–দুরকম ভাব প্রকাশ করে থাকে। তার মধ্যে তথাভূতার্থ অবধারণ বাক্য, অর্থক্রিয়ার জ্ঞান ইত্যাদি লক্ষণকে অপেক্ষা করে না বলে, জ্ঞানস্বরূপ মাত্রের অধীন। তার দ্বারা অবধারিত প্রামাণ্য স্বতঃ নির্দিষ্ট প্রামাণ্যর মধ্যে গণ্য হয়। আর, অতথাভূতার্থ অবধারণ-বাক্য জ্ঞানের স্বরূপ মাত্রের অধীন হলেও কারণ-দোষ ইত্যাদির জ্ঞাপক লক্ষণকে অপেক্ষা করে থাকে। অতএব, তদবসিত অপ্রামাণ্য বিষয় অন্য হতে অবধারিত হয়। পরন্তু অতথাভূত অবধারণ। জ্ঞানস্বভাবের অধীন নয়। তাতে ভ্রম ও বাধার অসম্ভব-প্রসঙ্গ হয় না (অর্থাৎ তাতে ভ্রম ও বাধা অবশ্যম্ভাবী)। শুক্তিতে রজতকে অতথাভূত বলে গোচরীভূত করছে যে জ্ঞান, তার ভ্রমত্ব ও বাধসম্ভব নেই (অর্থাৎ শুক্তি ও রজতের পার্থক্যজ্ঞানই সত্য)। অতথাভূতত্ব, জ্ঞানস্বভাবের অধীন হলেও, কারণ-দোষের অবগম অথবা বাধকের প্রত্যয়-হেতু, পরতঃ বলেই নির্ধারিত হয়। সেই জন্য, অপ্রামাণ্য, স্বতঃসিদ্ধ না হয়ে পরতঃ অর্থাৎ অন্য হতে সিদ্ধ হলো।

এই মতের বিরোধী অন্যান্য পণ্ডিতগণ বর্ণনা করেন যে, অপ্রামাণ্যর মতো কারণগত গুণের জ্ঞানহেতু কিংবা তার সম্বাদহেতু প্রামাণ্যও পরতঃ অর্থাৎ অন্য হতেই জ্ঞাত হওয়া যায়। তারা বলেন,–কর্মের অনভ্যস্ত অবস্থাতে সংশয় (ভ্রম) থাকে বলে অপ্রমাণ্যের মতো প্রামাণ্য অন্য হতেই জানা যায়। কিন্তু এই সাধন যুক্তিসিদ্ধ নয়; কারণ আমাদের মতেও এই অর্থ তথাভূত এইরকম অবধারণ-বশতঃ, প্রামাণ্য পরতই বলে নিশ্চিত হয়ে থাকে। এইভাবে সিদ্ধের সাধন হচ্ছে। যদি বলো, জান-বিষয়ে উৎপত্তি অপেক্ষিত না হলেও অন্য অপেক্ষিত হচ্ছে। কারণ, প্রামাণ্য যদি জ্ঞানহেতুমাত্রেরই অধীন হয়, তাহলে আমাণ্যের জ্ঞান অপ্রমাণ হয়। যেহেতু প্রামাণ্য বিষয়ে কারণের অভাব আছে। তা বলতে পারো না। কারণ, এইরকম হলে ঘট ইত্যাদির ন্যায় জ্ঞানই হতে পারে না। যদি বলো, যে স্থলে দোষের অভাব, সেস্থলে প্রামাণ্য কারণ হয়, আর যে স্থলে দোষের বিদ্যমন, সে স্থলে প্রামাণ্য কারণ হয় না; অতএব, অতি প্রসঙ্গ হচ্ছে না। কিন্তু তা বলতে পারো না; তাহলে, প্রামাণ্যও অধিকরূপে দোষের অভাবকে গ্রহণ করে জ্ঞাত হচ্ছে; অতএব কিভাবে সেই প্রামাণ্য জ্ঞানহেতু মাত্রের জন্য হবে? যদি বলো, দোষের অভাব প্রমাণ্যের কারণ হলেও, গুণ, প্রমাণ্যের হেতু হচ্ছে না, অতএব বেদসমূহের প্রামাণ্য স্বতঃসিদ্ধ, এটা সিদ্ধ হচ্ছে; কিন্তু তাহলে, গুণ প্রামাণ্যের কারণ বলে বরং দোষের অভাব প্রমাণ্যের কারণ নয় বলে সেইভাবে গুণের অভাব হচ্ছে; অতএব, বেদসমূহের অপ্রামাণ্য বেদ হতেই স্থিরীকৃত হচ্ছে। আমরা কিন্তু গুণের এবং দোষের প্রামাণ্য ও অপ্রামাণ্যর উভয়েরই প্রতি অন্বয় ও ব্যতিরেক উপলব্ধি করছি। সেই জন্য প্রামাণ্য ও অপ্রামাণ্য উভয়ই পরতঃ অর্থাৎ অন্য হতে এটা সিদ্ধ হলো।

এস্থলে অভিহিত হচ্ছে, বাধক না থাকলে, কার্যের কারণ হতেই কার্যের সাথে কার্যশক্তির, উৎপত্তি অঙ্গীকার করা কর্তব্য। অন্যথা, অর্থাৎ উক্তরূপ অঙ্গীকার না করলে, বহ্নিগত যে দাহিকা-শক্তি, তারও কারণান্তর হতেই উৎপত্তি হয়। অপিচ, সেই অগ্নি, যে সময় উৎপন্ন হয়, সেই সময় তার দাহিকা-শক্তি থাকে না। অগ্নি কিন্তু আপন (ইন্ধন ইত্যাদি) আশ্রয়কে দগ্ধ করতে করতেই উৎপন্ন হয়। অতএব, প্রামাণ্য যে স্বতঃসিদ্ধ, এটাই নিশ্চিত হলো। দোষ সম্বন্ধে অন্বয় ও ব্যতিরেকে, অপ্রামাণ্য পশ্চাৎ বিহিত হয় বলে, জ্ঞানের বিষয়ে হেতু-মাত্রের কারণ হচ্ছে না।

যদি বলো, এটাই না হয় হলো, কিন্তু প্রামাণ্য যদি জ্ঞানের বিষয়ে হেতু-মাত্রের অধীন হয়, তাহলে, স্মৃতিরও প্রামাণ্য স্বীকার করতে হয়। তা নয়। প্রামাণ্য শব্দে তথাভূত যে অর্থ, সেই অর্থের অবধারণকারী শক্তিকে বুঝিয়ে থাকে। আর, সেই স্মৃতি, জ্ঞানের হেতুমাত্র যে শব্দ, তারই অধীন; অতএব, স্মৃতি প্রামাণ্য হতে পারে না। অন্যথাতে, অর্থাৎ যদি প্রামাণ্য বলে স্বীকার করো তাতে, নৈয়ায়িক-মতেও অপ্রামাণ্য, দোষের অধীন হয়। অতএব, তার অভাবে স্মৃতিতেও প্রামাণ্য সম্ভব হয়ে পড়ে। প্রমা, জ্ঞানের হেতু হতে অতিরিক্ত হেতুর অধীন। কিন্তু এর কার্যসম্বন্ধ হলে বিশেষত্ব হয়। অতএব, অপ্রমার ন্যায়, এমন যে অনুমান, তা অসাধক হচ্ছে। যা প্রমা, তা জ্ঞান বলে, গুণ এবং দোষের কারও অধীন নয়। অতএব অপ্রমাবৎ এমন অনুমানের দ্বারা বিশেষণ-হেতু ভিন্ন অন্য হেতু জাত, সত্বরই প্রবৃত্ত, প্রবল যে বিশেষ-বিষয়, তার দ্বারা এই বিষয় বাধিত হচ্ছে। সেই প্রমা, বিশেষণ-হেতু-জাত বলে বিলম্বে প্রবৃত্ত হয়; অতএব, তা দুর্বল। সেই জন্য উৎপত্তিস্থলেও প্রামাণ্য জ্ঞানহেতুমাত্রের অধীন বলে স্বতঃসিদ্ধ এবং অপ্রামাণ্য দোষমাত্রের অধীন বলে অন্যসিদ্ধ, এটা স্থিরীকৃত হলো। অতএব বেদসমূহ অপৌরুষেয় বলে শব্দগত যে সকল গুণদোষ আছে, তাতে বেদকে পৌরুষেয় বলে শঙ্কা করতে পারো না। সুতরাং প্রামাণ্য যে স্বতঃসিদ্ধ, তা নির্বিবাদ।  এস্থলে পূর্বপক্ষ হচ্ছে–এইভাবে বেদের অপৌরুষেয়ত্বের বিষয় যা স্থিরীকৃত হলো, তা অসিদ্ধ কারণ বাক্য বলে বেদবাক্য পৌরুষেয়। যা উক্তসাধন, তা উক্তসাধ্য (অর্থাৎ, যেখানে সাধ্য আছে, সেখানে সাধনও আছে);–যেমন, ভারত ইত্যাদি পুরাণের বাক্যসমূহ। অতএব, বেদবাক্যসমূহ উক্তসাধন বলে পৌরুষেয়। অন্য পুরুষের পূর্ব যে অভিমত, তা. পৌরুষেয়। ক্রমবান বর্ণসমূহ পদ এবং ক্রমবিশিষ্ট পদসমূহই বাক্য বলে কথিত হয়। নিত্য বর্ণ-সমূহে স্বতঃসিদ্ধই ক্রমের অসম্ভব হয়; অতএব উচ্চারণের ক্রমনিবন্ধনেই ক্রম হয়ে থাকে। উচ্চারণের ক্রমও পুরুষেরই যত্নসাধ্য; এজন্য বেদবাক্যসমূহও ক্রমবিশিষ্ট বলে পুরুষ কর্তৃকই যত্নপূর্বক নিম্পাদিত হয়েছে। এই কারণবশতঃ যাঁরা বেদবাক্যকে অপৌরুষেয় বলে প্রামাণ্যকে স্বতঃসিদ্ধ বলেন, তাঁদের মত যুক্তিযুক্ত হচ্ছে না। যদি বলো–পূর্বপক্ষবাদী যে পুরুষসাধ্য বলেছেন, তা কেমন? তা কি সাক্ষাৎস্বরূপ স্বতন্ত্র (এক) পুরুষনিম্পাদ্য অথবা পরম্পরাক্রমে পুরুষান্তর নিম্পাদ্য? যদি সাক্ষাৎস্বতন্ত্র পুরুষনিপাদ্য বলা হয়, তাহলে, ইদানীং উচ্চাৰ্যমাণ বাক্য-বিষয়ে তার বাধ ঘটছে। এবং দ্বিতীয় অর্থাৎ পরম্পরাক্রমে পুরুষনিম্পাদ্য হতেই পারে না। যদি বলো,–সাক্ষাৎস্বতন্ত্র পুরুষ কর্তৃক প্রণীত অস্মম ইত্যাদি বাক্যসমূহে ঐকান্তিকতা হচ্ছে না, অর্থাৎ উভয় নিম্পাদ্য অতএব অপৌরুষেয়। তা-ও বলতে পারো না; যেহেতু, সাক্ষাৎ ও পরম্পরার পরস্পর ব্যভিচার থাকলেও সাক্ষাৎ ও পরম্পরার মধ্যে এস্থলে একেরই বিবক্ষা হচ্ছে। এরও অন্যথাতে ভারত ইত্যাদি পুরাণের যে বাক্যসমূহ, মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ইত্যাদি কর্তৃক সাক্ষাত্রপে প্রণীত হয়েছে, তা পরম্পরাতে নয় এবং যা পরম্পরাতে প্রণীত, তা সাক্ষাত্মপে নয়। এই রকম সাক্ষাৎ ও পরম্পরা এই উভয়ানুগত পৌরুষেয়ত্বের অভাবহেতু অন্যতর অপৌরুষেয় বলে কথিত হচ্ছে। অতএব, যা বাক্য, তা সাক্ষাৎ হোক আর পরম্পরাক্রমে হোক, স্বতন্ত্র পুরুষ-সাধ্য। এই হেতু যা কথিত হচ্ছে, তার বাধ অথবা ব্যভিচার কিছুই হচ্ছে না বলে বেদ পৌরুষেয় এটা সিদ্ধ হলো।

 এস্থলে উত্তর পক্ষ, সমর্থিত করছেন,–উক্ত মত সমীচীন নয়। এমন হলে বাক্যসমূহে বৃদ্ধ ব্যবহারের দ্বারা অবগত পদের ও পদের অর্থসম্বন্ধের, এবং চক্ষু ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের জন্য সেই সেই পদের অর্থবিশেযের বিষয়ে, পরস্পর নিশ্চিতজ্ঞানে অনিত্যজ্ঞানযুক্ত যে শরীরী, তারই স্বতন্ত্রকর্তৃত্ব দৃষ্ট হয়। এই হেতু যা বাক্য, তা তাদৃশ কর্তৃত্ব দ্বারা ব্যাপ্ত হয়; এবং আপন ব্যাপক যে সেইরকম কর্তা, সেই পক্ষে আপন অভিমত সাধন করতে করতে অশরীরী কর্তাকে বাধিত করছে; কারণ, এটি বিশেষের বিরোধী। পরন্তু পরবর্তী বিধির উৎকর্ষসাধনে অন্তর্ভাব হয়নি। সকল স্থলেই বাক্যত্বধর্মের যা হেতু (কারণ), তা শরীরবিশিষ্ট কর্তা কর্তৃক ব্যাপ্তরূপে দৃষ্ট হয়।

যদি বলো, এস্থলেও তা হলে, অনিত্য জ্ঞান-ইচ্ছা ইত্যাদি-বিশিষ্ট শরীরধারীরই কর্তৃত্ব হোক; অপিচ, চিরবৃত্ত যে কর্তা, তা উপলব্ধির যোগ্য নয়। অতএব, যোগ্যের অনুপলব্ধির বাধ হচ্ছে না। এই প্রশ্নও চতুরচিত্ত (বুদ্ধিমান) ব্যক্তিগণের চিত্তকে চমৎকৃত করতে সমর্থ হচ্ছে না। কারণ, এতে অপ (ভ্রান্ত) সিদ্ধান্ত আপতিত হচ্ছে। আরও যদি বেদবাক্যসমূহের শরীরধারী কর্তা হয়, তাহলে, সেই কর্তা চিরকাল বিদ্যমান এমন উপলব্ধির অভাব হলেও, এটা অবশ্যই শ্রুত হতো। কিন্তু কেউ কখনও, বেদের যে শরীরী কর্তা আছে, তা স্মরণ পর্যন্ত করেননি। সেইজন্য, বেদের কর্তা নেই, এটা নিশ্চিত হলো।

প্রশ্নকর্তা বলতে পারেন,-যদি বলো, কোন একটি মাত্র ব্যক্তি বেদকর্তাকে স্মরণ করেননি– এটাই অপৌরুষেয়ত্বের হেতু; অথবা সকল ব্যক্তিই, স্মরণ করেননি এই হেতু। এস্থলে কিন্তু প্রথম প্রশ্ন করতে পারো না; কারণ, দেবদত্ত, যে ঘটকে স্মরণ করেননি, সেই ঘট বিষ্ণুমিত্রের গৃহে অবশ্যই থাকতে পারে। দ্বিতীয় প্রশ্নও করতে পারো না; কেননা, জৈমিনীয়গণ যে শাস্ত্র স্মরণ করেননি, তা কণাদ ইত্যাদি মুনিগণ অবশ্যই স্মরণ করতে পারেন। প্রশ্নকারীর এ প্রশ্ন যুক্তিসিদ্ধ নয়। যেহেতু বৃদ্ধব্যবহারের দ্বারা অবগত যে পদের এবং পদার্থের সম্বন্ধ তার অর্থ-বিষয়ে বিলক্ষণরূপে ক্ষণিক চক্ষু ইত্যাদির জন্য জ্ঞানবিশিষ্ট মাতাপিতার সম্বন্ধে প্রসূত যে পার্থিব-শরীর-বিশিষ্ট বেদকর্তা, তারই স্মরণ হয় না। স্মরণকারিগণ, যা স্মরণ করে থাকেন, এবং বেদবাক্যসমূহে যেমন পুরুষান্তরের উল্লেখ আছে, তা-ই বাক্যনামে অভিহিত; এবং উক্ত বাক্য আমাদের মতবিরোধী নয়। অপিচ, প্রশ্নকর্তা জৈমিনীয়গণের যে উদাহরণ প্রদান করেছেন; সেই পক্ষে বক্তব্য এই যে, জৈমিনীয়গণ, স্মরণ করবার যোগ্য শাস্ত্রকে স্মরণ করেননি; অতএব, যোগ্য যে স্মৃতি, তা হলো না, এটাই ঐ স্থলে বাধক। এই কারণ বশতঃ (স্বতন্ত্র পুরুষ, বেদের বাক্য বলে) উক্ত বাক্যত্বই অপৌরুষেয়ত্বে হেতু হলো। ঐ হেতু, বিরোধী হচ্ছে বলে, বেদের যে স্বতন্ত্র পুরুষপূর্বকত্ব, তা সাধনা করতে অসমর্থ; অতএব, তার বিশেষ বিরোধ সিদ্ধ হলো।

যদি বলো, তা না হয় হলো; কিন্তু ঐতরেয় ব্রাহ্মণোক্ত–অনন্তর তাঁর মুখসমূহ হতে বেদসমূহ বিনির্গত হলো; ঋগ্বেদ অগ্নি হতে, যজুর্বেদ বায়ু হতে এবং সামবেদ আদিত্য হতে উৎপন্ন হয়েছিল (ঐ, ব্রা, ৫৩২); এবং ঋগ্বেদোক্ত–সেই সর্বহুৎ যজ্ঞ হতে ঋমূহ, ঋক হতে সামসমূহ, সাম হতে ছন্দঃসমূহ এবং ছন্দঃসমূহ হতে যজুর্বেদ সঞ্জাত হয়েছিল (ঋ.১০৯০৯) ইত্যাদি বেদের কারণ-বাদ সমূহ, বেদের পৌরুষেয়ত্বে প্রমাণ! এটাও যুক্তিসঙ্গত নয়। কারণ, সেই বেদসমূহ, পরস্পর বিরুদ্ধার্থবিশিষ্ট এবং অন্য প্রমাণের দ্বারা প্রতিহত। অতএব, তৈত্তিরীয় সংহিতোক্ত প্রজাপতিঃ (তৈ, স. ২।১।১৪) ইত্যাদি শ্রুতির ন্যায়, অর্থবাদ থাকলেও D উপপত্তির আপন অর্থে তাৎপর্যের অভাব হচ্ছে; (অর্থাৎ, উক্ত শ্রুতিবাক্যে যেমন, প্রজাপতি স্বকীয় বপাকে উৎখিন্ন করেছিলেন, এমন অর্থবাদ আছে, কিন্তু প্রকৃত বিষয়ে তাৎপর্যের অভাব হচ্ছে, সেইরকম)। বেদের মধ্যে যে কাঠকাদি-সমাখ্যা (নাম) আছে, তাও প্রবচনের নিমিত্ত মাত্র। অতএব বেদ যে অপৌরুষেয়, তা সিদ্ধান্তিত হলো। বেদ অপৌরুষেয় বলে নিত্য। যে সকল শুষ্কতার্কিক বেদের নিত্যত্ব স্বীকার করেন না, তারাই বেদব্যিয়ে বিবাদ করে থাকেন এবং বেদান্তৰ্গত শব্দ-সমূহে নিত্যত্ব অনিত্যত্ব অনুমান করে থাকেন। তারা বলেন, কৃতকত্বহেতু শব্দ অনিত্য। কারণ যা কৃতক, তা অনিত্যরূপেই দৃষ্ট হয়ে থাকে। যেমন ঘট, তেমন এই কৃতক; সুতরাং এটা অনিত্য। কিন্তু এ মত সমীচীন নয়। এটা যেমন, ধর্মবিশিষ্ট পর্বত ইত্যাদি প্রত্যক্ষ হলে সেই বিষয় অনুমান সাপেক্ষ; সেইরকম তার্কিকগণ কর্তৃক অঙ্গীকৃত হওয়া উচিত। অতএব অনুমানের সামর্থ্যবশতঃই শব্দ যে নিত্য, তা সিদ্ধ হলো। অপিচ, অনুসমূহ পূর্ত বলে ঘটের ন্যায় অনিত্য–এই অনুমানে যেমন ধর্মীর গ্রাহক পক্ষে প্রমাণ্যের বাধরূপ দোষ হয়, সেইরকম শব্দ-কৃতকত্বের অনুমানেও দোষ হয়ে থাকে। সেইমতো যদি বলো, যে শব্দধর্মী, তা কিরকমে প্রত্যক্ষ হতে পারে; কারণ কৃতক (কৃত্রিম) অনিত্য বলে তা-ও নিত্যত্বশূন্য। যদি এইরকমই হয়, তাহলে বক্তব্য এই যে, শব্দ ধর্মদ্বয়ের অভাববিশিষ্ট অথবা সেই ধর্ময়ের ভাববিশিষ্ট। অন্যত্র প্রত্যক্ষীকৃত যে অর্থ, তাকে উক্ত ধর্ময়, অন্যত্র সাধনা করছে বলে উভয় স্থলেই বাধদোষ হয়ে পড়ে। যদি বলো, বাদীর বুদ্ধিবিশেষ হতেই ধর্মদ্বয় আপতিত হয়, বস্তুবিশেষ হতে নয়; কারণ, বস্তুতে উক্ত উভয়রকম ভাব যোগ্য হতে পারে না; তাহলে যেস্থলে বাদীর বিপ্ৰতিপত্তি (বিরোধ) হয়, সেই স্থলে উক্ত উভয় ধর্মই আপতিত হয়। এবং সেই শব্দকে পক্ষ বলে, অঙ্গীকার করলে, কি করে বাধরূপ দোষ ঘটতে পারে! এবং তা স্বীকার না করলে সকল অনুমানই নষ্ট হয়ে পড়ে। তাই হোক, কিন্তু অন্য শব্দে বৈষম্য আছে। শব্দ। ধর্মিত্বরূপে প্রতীত হয়ে প্রত্যক্ষ এবং ব্যাপ্তির সম্বন্ধে পক্ষ ও ধর্মভাবে আশ্রয়ভূত হয়। ঐ শব্দ উৎপত্তির পর স্থিতিশীল বটে কিম্বা স্থিতিশীল নয়। যদি উৎপত্তির পর শব্দের বিদ্যমানতা অস্বীকার করা হয়, আশ্রয়ের অসিদ্ধি ইত্যাদি দোষ ঘটে থাকে। আর যদি বিদ্যমানতা স্বীকার করা হয়, তাহলে অনেকক্ষণ স্থায়ী হয় বলে তার ক্ষণিকত্বভঙ্গরূপ দোষ হয়। অথচ, যদি বলা যায়, শব্দরূপ জাতিবিশিষ্ট শব্দই স্থিতিশীল হয়, সে স্থলে আয়ুষ্মন ব্যক্তি বিচার করুন। তাতে কি, জাতি স্থিতিশীল হয়; অথবা ব্যক্তি স্থিতিশীল হয়? যদি বলো, জাতি স্থিতিশীল হয়, তাতে ব্যধিকরণের অসিদ্ধি ইত্যাদি দোষ সংঘটিত হয়। আপনারাই বলেছেন, শব্দত্বরূপ জাতি পক্ষ হতে পারে না। অনিত্য যে ব্যক্তিবিশেষ, –তার অবস্থান স্বীকার করলেও পূর্বোক্ত দোষত্ব ঘটে থাকে। আর যদি বলো কোনও ব্যক্তি আছে, তা হলেও শব্দব্যক্তি সকলকে ধর্মী বলে স্বীকার করায় হেতু বাক্য ভাগ্যসিদ্ধ হয়। কারণ, ভবিষ্যৎ শব্দ, (অর্থাৎ যে শব্দ পরে হবে) এক্ষণে বর্তমান যে কৃতকত্বরূপ হেতু, তার আশ্রয় হতে পারে না। (এস্থলে পূর্বপক্ষ বাদীর আশঙ্কা তুলে তার খণ্ডন করছেন)। আর যদি বলো, কারণের যে ব্যাপার-বিষয়ত্ব তারই নাম কৃতকর্ম, সেই কৃতকত্বের অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ এই কালয়ের সাথে কোন বিশেষ সম্বন্ধ নেই; সুতরাং তা সকল শব্দতে বর্তমান আছে; তাহলে তার্কিকের পাণ্ডিত্য অদ্ভুত বটে! যে পাণ্ডিত্যে স্বয়ং উক্ত তার্কিক মাত্র কালত্রয় সম্বন্ধবিশিষ্ট শব্দ জ্ঞানযুক্ত (অর্থাৎ যার এমন বুদ্ধি যে,–শব্দ কালত্রয় সম্বন্ধবিশিষ্ট হয়ে) কালত্রয়ের অতীত পদার্থকে প্রত্যক্ষ করেছেন (অর্থাৎ তার এমন পদার্থ প্রত্যক্ষ করাই অদ্ভুত পাণ্ডিত্যের পরিচায়ক); সেই হেতু প্রত্যক্ষের অভাবে অনুমানও হতে পারলো না। সুতরাং এই অনুমান বিষয়ে পর্বত ইত্যাদির ন্যায় ১) স্থিতিশীল বর্তমান শব্দকে পক্ষরূপে স্বীকার করতে হবে। (যেমন পর্বতো বহ্নিমান ধূমাৎ এই স্থলে পর্বতরূপ পক্ষ স্থিতিশীল এবং বর্তমান, সেইরকম শব্দও স্থিতিশীল এবং বর্তমান)। ধর্মী যে শব্দ তার অনিত্যত্ব স্থির হলে (অর্থাৎ ধর্মী শব্দ অনিত্য হলে) অপর যে ভবিষ্যৎ ইত্যাদি শব্দ তাদেরও শব্দত্ব-হেতুক অনিত্যত্ব স্বীকার করতে হবে; এবং পৃথিবী, পর্বত প্রভৃতির কৃতকত্ব অনুমানের ন্যায়, শব্দের কৃতকত্ব অনুমানও নিরাকৃত হলো, এটা জানবে। শব্দগ্রহণকারী যে প্রমাণ, তা কৃতকত্বশূন্য শব্দকেই গ্রহণ করে থাকে। (অর্থাৎ যে প্রমাণ শব্দ প্রতিপাদন করে, তা কেবল পুরুষযত্নসাধ্য নয় এমন শব্দকেই বুঝিয়ে থাকে)। উক্ত প্রমাণ আর মহী মহীধরবৎ এই ধর্মি-গ্রাহক প্রমাণের বাধক যে তকথিত হেতু এই উভয়ের মধ্যে অন্যতরের (একের) অসিদ্ধি হয়েছে। অতএব শব্দ যে নিত্য তা স্থির হলো।

শাব্দিকগণ সেই শব্দকে স্ফোট বলে থাকেন। (এবং) সে বিষয়ে যে শ্রুতিপ্রমাণ দিয়েছেন, তা এই;–শব্দ ব্ৰহ্ম যদেকং যচ্চৈতন্যং [ চ ] সর্বভূতানাং। যৎ পরিণামস্ত্রিভুরনমখিলমিদং জয়তি সা বাণী। ইতি। এর অর্থ–শব্দই ব্রহ্মস্বরূপ। তা অদ্বিতীয় অর্থাৎ স্ফোট ভিন্ন অন্য কিছুই নয়; কারণ, অন্যের সম্ভব নেই। যেহেতু, বর্ণ অনেক। অতএব ধ্বনির সম্ভব হচ্ছে না; এবং পদ আর বাক্য উভয়ের পৃথকভাব নেই, এমন আশঙ্কাও হতে পারে না। কারণ, পদ আর বাক্য বর্ণসমষ্টির দ্বারাই রচিত হয়ে থাকে। লোকে বা বেদে ধ্বনি, বর্ণ, পদ ও বাক্য ভিন্ন অন্য শব্দ প্রসিদ্ধ নেই। লোকশাস্ত্রজ্ঞ এবং বেদজ্ঞ পণ্ডিতগণ শব্দ ব্রহ্ম এইরকম পাঠ করে থাকেন। পদবিৎ পণ্ডিতগণ শব্দ ব্রহ্ম এইরকম পাঠ করে থাকেন। পদবিৎ পণ্ডিতগণও এইরকম বলে থাকেন,–অক্ষর (বর্ণ) এক, পদ এক, এবং বাক্যও এক (অর্থাৎ, তিনটিই এক, পৃথক পৃথক নয়)। উৎপত্তি ও বিলয়শীল (অর্থাৎ, যার উৎপত্তি ও বিলয় হয়) এরং অনেক বর্ণসকলে একমাত্র বুদ্ধির যা বিষয়ীভূত, তাকে স্ফোট বলে। তা, মহত্ত্ব-হেতু ব্রহ্ম বলে অভিহিত হয়ে থাকে। এর দ্বারা অর্থ প্রকাশিত হয়, এই জন্য একে স্ফোট বলা হয়েছে।

পূর্বপক্ষবাদী বলছেন, যদি শব্দ অর্থের প্রকাশক হয়, তাহলে সেই সেই শব্দ বর্ণাত্মক। কারণ, বর্ণসকল জ্ঞাত হলে অর্থও জ্ঞাত হয়ে থাকে, এইরকম প্রসিদ্ধ আছে। উত্তর-বাদী তার প্রতিবাদে বলছেন,–তুমি (পূর্বপক্ষবাদী) যা বলছ, তা সঙ্গত নয়। বর্ণাত্মক শব্দই অর্থ বুঝিয়ে দেয়। এটা কি অর্থ? (অর্থাৎ, এমন অর্থ অসম্ভব)। (আচ্ছা! জিজ্ঞাসা করি) এক একটি বর্ণ অর্থ-বোধক? না– মিলিত অনেক বর্ণ অর্থবোধক? এক একটি বর্ণ অর্থবোধক এ-কথা বলতে পারো না। কারণ, আকার প্রভৃতি বর্ণের মধ্যে প্রত্যেক বর্ণের উচ্চারণ করলেও অর্থবোধ হয় না। এমন মনে করতে পারো না। অব্যয় সকলের তিরস্কার ইত্যাদি অর্থ-বোধকত্ব দৃষ্ট হয়ে থাকে। অর্থাৎ, যখন অব্যয় সকল (অ ই উ প্রভৃতি শব্দ) তিরস্কার ইত্যাদি অর্থ বুঝিয়ে থাকে, এটা দৃষ্ট হয়; তখন প্রত্যেক বর্ণ অর্থবোধক হতে পারে। যেহেতু অব্যয় সকল অব্যয়াদ আঙ্গুপঃ (পা, ২৪ [৮২) এই পাণিনি সূত্র অনুসারে বিভক্তির লোপ করলে পর, অর্থ বুঝিয়ে দেয়; কিন্তু প্রাতিপদিক অবস্থায় তা পারে না। অতএব, তিরস্কার, আশ্চর্য ও আদর অর্থ বোধক অ, ই আর উ এই সকল বর্ণ পদাতকত্ব-হেতুক অনেক বর্ণাত্মক হয়েছে। (সেই জন্য অর্থবোধক হচ্ছে)। বিভক্তি বা বর্ণের অদর্শন-মাত্রেই (লোপমাত্রেই) তার অবিদ্যমানত্ব (অর্থাৎ বিভক্তি বা বর্ণ যদি লুপ্ত হয়, তবে তার বিদ্যমানতা নেই) : বলতে পারো না। কারণ, তাহলে সম্বোধন আর প্রাতিপদিকের অর্থ, এই উভয়েরই একত্ব (অর্থাৎ অভেদ) প্রসঙ্গ হয়। তা শব্দশাস্ত্রজ্ঞগণের মত-বিরুদ্ধ। ফলতঃ, এখানে তাহলে অব্যয়পদ সকলই D অর্থবোধক, প্রত্যেক বর্ণ নয়। কথিত আছে যে, অব্যয়ানি চ পদ বিশেষ্য ইতি। অর্থাৎ, অব্যয়সকল পদ-বিশেষ মাত্র। এর দ্বারা উপসর্গ প্রভৃতি সকল অব্যয় ব্যাখ্যাত হয়েছে। সেজন্য (অর্থাৎ যেহেতু প্রত্যেক বর্ণ অর্থবোধক হলো না), (মিলিত) অনেক বর্ণই অর্থবোধক (অর্থাৎ অনেক বর্ণ হতে অর্থবোধ হয়ে থাকে), এই কথা বলা যেতে পারে। এই পক্ষও কক্ষস্বরূপ (অর্থাৎ গৃহের ন্যায় অবলম্বনীয় করা যেতে পারে না, (অর্থাৎ, এই মত অবলম্বনীয় নয়)। কারণ পদাত্মক নয়–এমন ক, চ, ট, ত ইত্যাদি যে বর্ণসকল, তাদের অর্থবোধকতা দেখা যায় না। অতএব, পদাত্মক এমন অনেক বর্ণই অর্থবোধক হয়ে থাকে, এইরকম সিদ্ধান্ত স্থির হলো। সুবন্ত বা তিঙন্তকে পদ বলে। ঐ পদ প্রাতিপদিক অর্থাৎ শব্দ, নাম, কৃৎ, তদ্ধিত, ধাতু এবং সমাস এই সকল প্রকৃতি হতে সম্পাদিত হয়। সেই সকল বর্ণ স্বরূপ। কারণ, সেই বর্ণ হতে পৃথক পদ নেই। যেহেতু, বর্ণ হতে অতিরিক্ত পদ দৃষ্ট হয় না।

আচ্ছা! যদি এমন বলা যায় যে, যেমন গোত্ব ব্যক্তিগত জাতি বিশেষ; সেইরকম পদ, বর্ণগত কোনও একটি ধর্ম-বিশেষ। তাহলে এই দোষ হয় যে, যেমন একটি গোব্যক্তি দেখলে পদজ্ঞান হতে পারে (এটা সম্ভব নয়, সুতরাং দোষ); উক্ত দোষ হেতু বর্ণ সকলের সমষ্টি-বিশেষের নাম পদ, এমন বলতে হবে। সেই পদকে অর্থবোধক বলে বর্ণনা করতে হয়, এবং উক্ত নিয়ম অনুসারে পদ-সমষ্টি-বিশেষই বাক্য, এ-ও প্রতিপাদিত হলো। যেহেতু, বর্ণ বিচারের ন্যায় অর্থাৎ যুক্তি-পদ বিচারে সঞ্চারিত হয়েছে। অতএব, পদবিচারের যুক্তি বাক্য-বিচারে সঞ্চারিত হবে, এমন অর্থ বোঝাচ্ছে।– আচ্ছা! এই রকমই হোক। আপনিও বর্ণই শব্দ এই কথা বলেছেন। যেহেতু, পদ কিংবা বাক্য-স্বরূপ বর্ণ সকলের অর্থ-বোধকত্ব বলায় ভাবের প্রকাশ হচ্ছে না। অভিপ্রায় এই যে, যদি বর্ণসকল নিত্য অথবা অনিত্য হয়, উভয়পক্ষেই তাদের সমুদায় সিদ্ধ হয় না। নিত্য-বর্ণসকলকে গুণ কিংবা সর্বত্র স্থিত দ্রব্যরূপে ধরলে, পঞ্চাশৎসংখ্যক সেই বর্ণসকলের মিলন করতে কে সমর্থ হয়? (অর্থাৎ কেউই পারে না)। এবং বর্ণসকলের কণ্ঠ্য ইত্যাদি স্থান বা প্রযত্নের (উচ্চারণ-চেষ্টার) বৈয় (ব্যর্থত্ব) প্রসঙ্গ নেই। কারণ, স্থান এবং প্রযত্নের দ্বারা নিত্য বর্ণসকলেই অভিব্যক্তি (প্রকাশ) হয়ে থাকে। অভিব্যক্তিরও সমুদায় মিলন করতে পারা যায় না। যেহেতু, বর্ণের অভিব্যক্তির নাম– জ্ঞান। ঐ জ্ঞানও ক্রমে ক্রমে উৎপন্ন হয়ে থাকে। এ স্থলে গৌতমসূত্রই যুক্তি। সূত্র এই যুগপজ্ঞানানুৎপত্তির্মনসো লিঙ্গং। (গৌ. ১।১।১৬)। সূত্ৰাৰ্থ এই,–এককালীন দুই বা তার অধিক জ্ঞানের অনুৎপত্তি, মনের একটি সামর্থ্য (অর্থাৎ, মনের এমন শক্তি নেই যে, একসময়ে দুই বা তার অধিক জ্ঞান জন্মাতে পারে), এবং ক্রমে ক্রমে জায়মান, সুতরাং ক্ষণস্থায়ী জ্ঞান সকলের একদেশে (স্থানে) বা এক সময়ে মিলন করতে পারা যায় না। মিলন ভিন্ন অন্য সমুদায়ও নেই। সেই হেতু বর্ণ নিত্য হলেও সমুদায়ের অভাব স্পষ্ট বোধ হচ্ছে। (যখন সমুদায়ের অভাব হলো, তখন) কি রকমে বর্ণসমুদয় পদ ও পদ-সমুদয় বাক্য, অর্থবোধক হতে পারে? কিন্তু শব্দ থেকেই অর্থজ্ঞান হয়ে থাকে। তাহলে এটাই স্থির হলো যে, শব্দত্ব অন্য পদার্থ (অর্থাৎ শব্দত্ব জাতি হতে স্বতন্ত্র)।

আচ্ছা! এমন শব্দত্ব কোথা থেকে আসছে? এর উত্তরে বলা যায় যে, অনিত্য বর্ণসকল হতে। তাতে পূর্ব-প্রদর্শিত অনুপপত্তি (বিরোধ) হতে পারে, এমন বলতে পারো না। কারণ, পূর্ব পূর্ব বর্ণের সাথে পরবর্তী বর্ণ-সকলের জ্ঞান হয়ে থাকে, এই কথা বলব। কিন্তু অর্থজ্ঞানও এইরকমই হোক, এমন বলবেন না। তাহলে তার (সেই অর্থের) শব্দত্ব থাকে না (অর্থাৎ তা যে শব্দের জন্য, এমন বোধ হয় না)। তা-ও অসঙ্গত (অর্থাৎ কারও অভিমত নয়)। তাহলে এই স্থির হলো যে, উক্ত বুদ্ধি হতে প্রতীয়মান শব্দতত্ত্ব, প্রতীয়মান অর্থবোধকতারূপে একমাত্র জ্ঞানের বিষয় হয়ে থাকে। এটা কথিত হয়েছে যে, যা অর্থ প্রকাশ করে, তা-ই স্ফোট নামে খ্যাত।

শব্দব্রহ্ম যে এক, অর্থাৎ একমাত্র বুদ্ধির বিষয় এবং স্থাবর-জঙ্গমরূপ শরীরিগণের চৈতন্যস্বরূপ, তা কথিত হয়েছে। শব্দব্ৰহ্মণো ব্যতিরিক্তং ন চৈতন্যমস্তি–এর অর্থ এমন শব্দব্রহ্ম ভিন্ন অপর চৈতন্য নেই। এখানে আশঙ্কা হচ্ছে যে,-নানারকম এই শব্দ আদি দৃশ্যমান সকল বস্তুই চৈতন্যের বিবর্তমাত্ৰ (অর্থাৎ চৈতন্য হতে পৃথক নয়)। তা-ই শব্দতত্ত্ব। যে অধিষ্ঠান আছে (অর্থাৎ প্রতিষ্ঠা স্থির আছে), তা অধিক্ষিপ্ত হয় না। এই হেতু, শ্রুতিতে যৎপরির্ণামাস্ত্রিভুবনমখিলমিদং এমন বলেছেন। এখানে পরিণাম শব্দের অর্থ–বিবর্ত কথিত হয়েছে। আচ্ছা, পরিণাম আর বিবর্তে ভেদ কি? ভেদ এই যে,-পূর্ব আকার ত্যাগ না করে মিথ্যা নানারকম আকার প্রকাশ করাকে বিবর্ত বলে। যেমন, শুক্তিকাতে (ঝিনুকে) রজতের (রৌপ্যের) জ্ঞান; এবং সর্পাকৃতি রঞ্জুতে সর্পজ্ঞান। আর পূর্বরূপ পরিত্যাগ হলে নানা রকম আকারের জ্ঞানকে পরিণাম বলে। যেমন, দুগ্ধ সম্বন্ধে দধি জ্ঞান। ত্রিভুবনং যৎপরিণামঃ এমন বললে যাবতীয় ভৌতিক (অর্থাৎ পঞ্চভূত-গঠিত) পদার্থসকল শব্দ-ব্রহ্মের পরিণাম-স্বরূপ হয়ে যায়। সুতরাং তার বারণ নিমিত্ত অখিলমিদম্ এই কথা বলেছেন। এটা জড়-সম্বন্ধীয় জ্ঞানের বিষয় অর্থাৎ চৈতন্য ব্যতিরিক্ত বস্তুমাত্রের জ্ঞানের বিষয় সেই স্ফোটরূপ বাক্য প্রশংসনীয় হচ্ছে।

তার দ্বারা এটাই নির্ধারিত হচ্ছে যে,-চেতন, সকল বিস্তার-বিবর্তের আশ্রয়। শব্দব্রহ্মস্বরূপ স্ফোট নামক শব্দেই শব্দের অভিধেয়তা থাকে (অর্থাৎ উক্ত স্ফোট শব্দই শব্দের অভিধেয়)। বর্ণ সকলে থাকে না (অর্থাৎ বর্ণ সকল শব্দের অভিধেয় নয়)। কারণ, তারা স্কোটের মধ্যে গণ্য হয়ে থাকে। অতএব স্ফোটই শব্দ।

এমন যাঁরা মনে করে থাকেন, তাদের উপর ভীষণ বিপদ এসেছে বুঝতে হবে। (কারণ, তাদের মতে) অপ্রসিদ্ধ শব্দের জ্ঞান, এবং প্রসিদ্ধ অর্থের পরিত্যাগ হচ্ছে। যেমন, বর্ণাত্মক শব্দসকল হতে স্ফোট শব্দের জ্ঞান হয়ে থাকে, সেই রকম অর্থও প্রতীত হতে পারে। তাতে দোষ কি? (অর্থাৎ কোনও দোষ নেই)। জ্ঞান ব্যবধান থাকায়, সেই অর্থের শব্দত্ব থাকে না, এমন আশঙ্কা নেই। কারণ স্ফোটও শব্দ মাত্র। শব্দ, জ্ঞানের কারণ (অর্থাৎ জনক)। যেহেতু, বাদিপণ সকলেই প্রত্যক্ষ ভিন্ন সমস্ত করণের জ্ঞান-করণত্ব স্বীকার করেছেন। তার পর স্ফোট-পক্ষে যা পূর্বপক্ষ পরিহার, তা-ই বর্ণপক্ষে সঙ্গত হবে,–এটাই ব্যক্ত করে বলছেন যে, পূর্ব পূর্ব বর্ণের সংস্কারযুক্ত যে উচ্চারিত পরবর্তী বর্ণ, তা জ্ঞানের বিষয়ীভূত হয়ে অর্থকে বোঝাবে। সুতরাং, বর্ণও অর্থের মধ্যবর্তী গড়ু (রোগ বিশেষ) স্বরূপ;স্ফোট স্বীকারে প্রয়োজন কি? (অর্থাৎ স্ফোট স্বীকার করবার প্রয়োজন নেই)।

উক্ত কারণ বশতঃ, এবং বেদ সমূহের অপৌরুষেয়ত্ব, নিত্যত্ব ও বিবক্ষিতার্থত্ব হেতু উক্ত বেদ-সমূহের অন্তর্গত ব্ৰহ্মবেদও বিবক্ষিতার্থ (অর্থাৎ যার বলবার বিষয়ীভূত হয়েছে, তা বিবক্ষিতার্থ)। সুতরাং এর যে ব্যাখ্যা করা উচিত, তা-ও সিদ্ধ হচ্ছে।

ব্রহ্মবেদ-সম্বন্ধীয় ব্যাখ্যার আবশ্যকতা স্থির হলো সত্য; কিন্তু সকল বেদের পরে এর ব্যাখ্যা হচ্ছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে বলবো যে, বেদ-সকলের ক্রমিক প্রকাশ-প্রতিপাদক শ্রুতিই এর কারণ। সেই শ্রুতি অথর্ববেদের পূর্ব-ব্রাহ্মণে প্রণব (ওঙ্কার) প্রশংসাকালে কথিত হয়েছে। শ্রুতি এই

ব্রহ্ম হ বৈ ব্রহ্মানং পুষ্করে সসৃজে। স খলু ব্রহ্মা সৃষ্টশ্চিন্তাং আপেদে। কেনাহং একেনাক্ষরেণ D সবাংশ্চ কামান্ সর্বাংশ্চ লোকান্ সর্বাংশ্চ দেবান্ সর্বাংশ্চ বেদান সর্বাংশ্চ যজ্ঞান সর্বাংশ্চ শব্দান সর্বাংশ্চ বৃষ্টীঃ সর্বাণি চ ভূতানি স্থাবরজঙ্গমান্যনুভবেয়ং ইতি। স ব্রহ্মচর্যং অচরৎ। স ওঁ ইত্যেদক্ষরং অপশ্যৎ ত্রিবর্ণঃ চতুর্মাত্রং সর্বব্যাপি ইত্যাদি (গো, ব্রা, ১১৬)।

তস্য প্রথময়া স্বরমাত্ৰয়া পৃথিবীং অগ্নিং ওষধিবনস্পতি ঋগ্বেদং ভূরিতি ব্যাহৃতিং গায়ত্ৰং ছন্দঃ ত্রিবৃতং স্তোমং প্রাচীং দিশং বসন্তং ঋতুং (গো, ব্রা. ১১৯) ইত্যাদি শ্রুতির দ্বারা প্রণবের প্রথম তিনটি মাত্রায় ঋক্ প্রভৃতি অর্থাৎ ঋক, যজুঃ, সাম এই তিন বেদ প্রতিপন্ন করে পরে আশ্নাত হয়েছে যে, তস্য মকার মাত্রয়া পঙ্কেমসম্ অথর্ববেদং নক্ষত্রাণ্যোত ইতি স্বম্ আত্মান আনুষ্ঠুভং ছন্দঃ একবিংশং স্তোমং (গো, ব্রা, ১২০)। অর্থাৎ, ব্রহ্মা সেই প্রণবের মকার অংশের দ্বারায় জল, চন্দ্র, অথর্ববেদ এবং নক্ষত্রগণকে সম্বন্ধ (দেখেছিলেন)। (এখানে অপশ্যৎ ক্রিয়াপদ উহ্য আছে) আর আত্মস্বরূপ নিজেকে, অনুষ্ঠুভছন্দ ও একবিংশতি স্তেমকে (দেখেছিলেন); এবং তৈত্তিরীয়ক উপনিষদের ব্রহ্মযজ্ঞ প্রকরণেও যঋচোহধীতে পয়সঃ কুল্যা অস্য পিতৃম স্বধা অভিবন্তি। যদযজুংষি ঘৃতস্য কুল্যাঃ। যৎ সামানি সোম এভ্যঃ পবতে। যদ্ অথর্বাঙ্গিরসো মধধাঃ কুল্যাঃ (তৈ.আ.২১০) এই শ্রুতি আছে। অতএব, উক্ত রীতি অনুসারে সকল শ্রুতি-বাক্যে অথর্ববেদ ঋগাদির পরে উৎপন্ন এরূপ স্থির হওয়ায়, বেদত্রয় ব্যাখ্যা অপেক্ষায় তার ব্যাখ্যার আনন্তর্য যুক্তিসিদ্ধ (অর্থাৎ তার ব্যাখ্যাও যে ঋক্‌ যজুঃ সাম এই বেদ তিনটির ব্যাখ্যার অনন্তর হয়েছে। তা স্থির হলো)।

ঐহিক ও পারত্রিক সকল পুরু্যার্থ (অর্থাৎ ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ) জানবার উপায় স্বরূপ সেই অর্থববেদের নটি ভেদ আছে! তা এই,পৈপ্পলাদ, স্তোদ, মৌদ, শৌনকীয়, জাজল, জলদ, ব্ৰহ্মবদ, দেবদর্শ ও চারণবৈদ্য। তার মধ্যে শৌনকীয় ইত্যাদি চারটি শাখায় গোপথ ব্রাহ্মণ অনুসারে পাঁচটি সূত্রের দ্বারা অনুবাক সূক্ত ঋক্ প্রভৃতির বিনিয়োগ কথিত হয়েছে। সেই পাঁচটি সূত্র এই;–কৌশিক, বৈতাল, নক্ষত্ৰকল্প, আঙ্গিরসকল্প ও শান্তিককল্প। এস্থলে কল্পসূত্রাধিকরণে উপবর্যাচার্য বলেছেন যে নক্ষত্রকল্লো বৈতানস্তৃতীয় সংহিতাবিধিঃ। তূর্য আঙ্গিরসঃ কল্প শান্তিকল্পস্তু পঞ্চমঃ। এই কারিকার অর্থ এই রকম, সূর-পঞ্চকের মধ্যে প্রথম নক্ষত্রকল্প, দ্বিতীয় বৈতান, তৃতীয় সংহিতা-বিধি, চতুর্থ আঙ্গিরসকল্প ও পঞ্চম শান্তিকল্প। উক্ত কারিকাতে শাস্তিক এবং পৌষ্টিক ইত্যাদি কর্মে সমস্ত সংহিতা-মন্ত্ৰসকলের বিনিয়োগ-বিধান-হেতু কৌশিক সূত্রই সংহিতাবিধি নামে অভিহিত হয়েছে। (ঐ কৌশিক সূত্র) সেই কালে (অর্থাৎ বিনিয়োগ কালে) অপর সূত্র চারটির উপজীব্য হেতু প্রধান। এই বহুসংখ্যক সূত্রের মধ্যে অথর্ববেদের প্রতিপাদ্য কর্মসকল ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত থাকায় দুর্বোধ (অর্থাৎ সহজে বোধগম্য হয় না)। এই হেতু, সুখবোধের জন্য সেই কর্মসকল এই গ্রন্থে সংগৃহীত হচ্ছে। তার মধ্যে কৌশিক সূত্রে এই সকল কর্ম ক্রমে প্রতিপাদিত হবে। প্রথমে স্থালীপাক বিধানের দ্বারা দর্শপৌর্ণমাসযাগবিধি উক্ত হয়েছে। তারপর যে মেধাজনক সকল কর্ম ব্রহ্মচারীর সম্পকারক (অর্থাৎ ব্রহ্মচর্য ইত্যাদি সম্পাদক) গ্রাম, নগর, দুর্গ, রাষ্ট্র প্রভৃতির লাভ তার নিমিত্তক, পুত্র, পশু, ধন, ধান্য, প্রজা, স্ত্রী, হস্তি, অশ্ব, রথ অর্থাৎ যান এবং আন্দোলিকা (অর্থাৎ পালকি, চতুর্দোলা প্রভৃতি) সর্বসম্পত্তির সাধক এবং জনগণের মতের অভিন্নতা সম্পাদক সম্মিনস্থ কর্মসকল কথিত হয়েছে। তারপর, রাজকর্ম বিবৃত হয়েছে। শহস্তীদের ত্রাসজনক, সংগ্রাম অর্থাৎ যুদ্ধে জয়সাধন, বাণ-নিবারণ, খঙ্গ প্রভৃতি সকল শস্ত্রের প্রতিষেধ, শত্রু-সেনাগণের মোহন (অর্থাৎ চেতনা হরণ), উদ্বিগ্নকরণ, স্তম্ভম এবং উচ্চাটন প্রভৃতি কর্ম এবং নিজ সেনাগণের সর্বতোভাবে উৎসাহ, রক্ষা ও অভয়দান নিমিত্তক কর্ম। যুদ্ধে জয় বা পরাজয় বিষয়ে পরীক্ষা, এবং D শত্রু-সৈন্যগণের গতাগতির স্থান-সকলে মন্ত্রযুক্ত পাশ অর্থাৎ জাল, রজ্ঞ, অসি ও কশা (চর্মরজ্ঞ) প্রভৃতির প্রক্ষেপ ইত্যাদি সেনাপতি প্রভৃতি প্রধান পুরুষগণের জয় নিমিত্তক কার্য, জয়াভিলাষী রাজার রথে আরোহণ, মন্ত্রপূত্র ভেরী পটহ প্রভৃতি সমগ্র বাদ্যের তাড়ন (অর্থাৎ শব্দের নিমিত্ত তাকে আঘাত করা), আর শত্ৰুকর্তৃক পরাজিত রাজার পুনর্বার আপন রাজ্যে প্রবেশ-নিমিত্তক কার্য, এবং রাজার রাজ্যে অভিষেক, এই সকলই রাজকর্ম। পাপক্ষয়-কারক কর্মসকল। নিঋতিকর্ম। চিত্র-কার্য প্রভৃতি। পৌষ্টিক (অর্থাৎ পুষ্টি-সাধন) কর্ম। গোসম্পত্তি কারক (অর্থাৎ যে কর্মানুষ্ঠানে গোসম্পত্তি লাভ হয়ে থাকে, সেই কাৰ্য)। ভূমি ইত্যাদি সম্পত্তিকর কার্য। দেহ, বল, পুষ্টি নিমিত্ত মণি রত্ন ইত্যাদি ধারণ কার্য। কৃষিকার্যের উৎকর্ষকর কর্ম। বৃষরূপ সমৃদ্ধিজনক কর্ম। গৃহসম্পত্তি সম্পাদক নবগৃহ-আরম্ভ ইত্যাদি কর্ম, বৃষোৎসর্গ ও আগ্রহায়ণী কর্ম (অর্থাৎ আগ্রহায়ণ নামক যাগ-কর্ম। জন্মান্তর-কৃত পাপের জন্য যে সকল নানারকম দুশ্চিকিৎস্য রোগ হয়ে থাকে, তার ঔষধ নিরূপণ। সেই ঔষধসকলের মধ্যে প্রথম সমস্ত ব্যাধির ঔযধ নিরূপিত হচ্ছে। জ্বর, অতিসার অথবা জ্বরাতিসার, বহুমূত্র প্রভৃতি রোগের ঔষধ এবং অস্ত্র শস্ত্র ইত্যাদির আঘাতের জন্য রক্তস্রাব নিবারণ; ভূত, প্রেত, পিশাচ, অপম্মার (অর্থাৎ মুচ্ছারোগ-বিশেষ), ব্রহ্মরাক্ষস অর্থাৎ ব্রহ্মদৈত্য এবং বালগ্রহ প্রভৃতির প্রতিষেধকরণ; বায়ু, পিত্ত ও কফের ঔষধ। হৃৎ-রোগ, কালা ও শ্বিনামক রোগনিবারণ। সার্বকালীন জ্বর, এক দিনান্তর দিনদ্বয়ান্তর প্রভৃতি জ্বর, বিষমজ্বর, রাজযক্ষ্মা ও জলোদর অর্থাৎ উদরী-রোগ নিবারণ। গো, অশ্ব, প্রভৃতি পশুগণের ক্রিমিদোষ-নাশক ঔষধ। কন্দ, মূল, সর্প ও বৃশ্চিকরূপ স্থাবর ও জঙ্গমের বিষা-নিবারণ এবং মস্তক, চক্ষু, নাসিকা, কর্ণ ও জিহ্বা বা গলদেশজাত রোগের ঔষধ। ব্রাহ্মণ প্রভৃতির আক্রোশ নিবারণ এবং গণ্ডমালা প্রভৃতি বিবিধ জটিল রোগের ঔষধসকল। পুত্র ইত্যাদি কামনায় স্ত্রীকর্মসকল। গর্ভাধান, গর্ভস্থের পুষ্টিকর পুংসবন প্রভৃতি সুখপ্রসব নিমিত্তক কার্য। সৌভাগ্য-সম্পাদন। রাজা ইত্যাদির ক্রোধ-শান্তি। অভীষ্টের সিদ্ধি বা অসিদ্ধি বিষয়ে নিশ্চিত জ্ঞান। দুর্দিন (অর্থাৎ যে দিন সর্বদা মেঘাচ্ছন্ন থাকে), বজ্রাঘাত, এবং অতিবৃষ্টির নিবারণ। সভায় বা বিবাদে (অর্থাৎ রাজ-বিচারে মোকদ্দমায়) জয়লাভ, এবং কলহের (অর্থাৎ গৃহ বিবাদের) শান্তি-স্থাপন। নিজের ইচ্ছামতো নদীস্রোতঃ করণ। বৃষ্টির নিমিত্তক কার্যকল। অর্থের (অর্থাৎ ধন-রত্ন ইত্যাদির) উত্থাপন-রূপ কার্য, ন্যূতক্রীড়ায় জয়লাভ নিমিত্তক কর্ম। গোবৎসের বিরোধ-নিবারণ এবং অশ্ব-শান্তি। বাণিজ্যে লাভ-নিমিত্তক কর্ম। স্ত্রীলোকের পাপলক্ষণ নিবারণ (অর্থাৎ দুষ্টলক্ষণ শান্তি)। বাস্তুসংস্কার বিধি। গৃহ-প্রবেশ-কালীন কার্য, এবং গৃহে কপোত, কাক প্রভৃতি দুষ্ট পক্ষী পতিত হলে তার শান্তি-বিধান। দুষ্ট লোকের নিকট হতে প্রতিগ্রহ, অযাজ্যয়াজন ইত্যাদির জন্য দোষের প্রতিবিধান। দুঃস্বপ্নের নিবারণ (অর্থাৎ দুষ্ট-স্বপ্ন দর্শনে তার শান্তি)। বালক পাপনক্ষত্রে জন্মালে তার শান্তি। ঋণ পরিশোধ। দুষ্ট পক্ষী শকুন ইত্যাদি দর্শনে শান্তি। অভিচার-কর্মসকল, এবং পরকৃত অভিচারের প্রতিষেধ। স্বস্ত্যয়ন-কার্য। জাতকর্ম, নামকরণ, চূড়াকরণ ও উপনয়ন প্রভৃতি আয়ুষ্য কর্মসকল (অর্থাৎ ঐসকল কর্ম আয়ুর মঙ্গল করে থাকে)। একাগ্নিসাধ্য কাম্য-যাগ সমুদায়। ব্রহ্মৌদন, স্বগোদন প্রভৃতি দ্বাবিংশতি সোমবাগ এবং রাক্ষসাদি-নিবারণ। আবসথ্যের (অর্থাৎ গৃহস্থ-সম্বন্ধীয় লৌকিক-অগ্নির) স্থাপন। বিবাহ-প্রকরণ। পৈতৃমেধিক কার্য অর্থাৎ পিতৃপ্রীতিকর কর্মর্সমূহ। পিণ্ড। পিতৃযজ্ঞ। মধুপর্ক ব্যবস্থা। ধূলি, রক্ত প্রভৃতি বর্ষণ; যক্ষ, রাক্ষস ইত্যাদি দর্শন এবং ভূমিকম্প, ধূমকেতু, চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ প্রভৃতি যে বহুরকম উৎপাত তার শান্তি। আজ্য তন্ত্রবিধি। অষ্টকাকর্ম। ইন্দ্রোৎসব। তার পরে অধ্যয়নবিধি। এই সকল শৌনকসূত্রে কথিত হয়েছে। বৈতান সূত্রে, দর্শপৌর্ণমাস ইত্যাদি অয়নান্ত যে ঋক, যজুঃ, সাম–এই রবেদ তিনটির বিহিত কর্মসমূহ, তাতে ব্রহ্মা, ব্রাহ্মনাচ্ছংসী, আগ্রী এবং পোতা এই ঋত্বিক চারটির কর্তব্য নির্দিষ্ট হচ্ছে। এইরকম কর্তব্য নিরূপণ বিষয়ে বিভাগ এইরকম যে, ব্রহ্মার কর্তব্য অনুজ্ঞা, অনুমন্ত্রণ ইত্যাদি। ব্রাহ্মনাচ্ছ্বংসীর-কর্তব্য শস্ত্র প্রভৃতি। আগ্নীর্ধের কর্তব্য– অন্বহার্য, শ্ৰপণ ও প্রস্থিতাজা প্রভৃতি। পোতার কর্তব্য,–প্রস্থিত যাজা ইত্যাদি। কর্তব্যের মধ্যে কার্যের ক্রম কথিত হচ্ছে। প্রথমে দর্শপূর্ণমাস। তার পর, অগ্ন্যাধান, অগ্নিহোত্র, আগ্রহায়নেষ্টি। শাকমেধ ও শূনাসীরিয় এই চাতুর্মাস্য যাগ চারটি, বৈশ্বদেব, বরুণ-প্রঘাস, পশুগ। অগ্নিষ্টোম, উথ্য, যোড়শী এবং অতিরাত্র ভেদে চতুঃসংখ্যক সোময়াগ। বাজপেয় যায়। অপ্তের্যাম। অগ্নিচয়ন। সৌভ্রামণী। মৈত্রাবরুণীনামক আমিক্ষাযাগ। গোপ্রচারণ। রাজসূয়যজ্ঞ। অশ্বমেধযজ্ঞ। পুরুষমেধ অর্থাৎ নরমেধ যজ্ঞ। সর্বমেধ যজ্ঞ। বৃহস্পতিসব, গোসব প্রভৃতি নামে একদিন নিষ্পদ্য সোমবাগ সমূহ, ঝুষ্টি ও দ্বিরাত্র র‍্যাগের প্রকৃতিভূত সমুদায় অহীন যাগ। রাত্রিসত্র যাগ সমূহ। সম্বৎসর-সাধ্য অয়ন যাগ, এবং দর্শপূর্ণমাস-নিম্পাদ্য অয়নগ সমুদায়।

অতঃপর নক্ষত্র কল্প সূত্রের বিষয় লিখিত হচ্ছে;–প্রথমে কৃত্তিকা ইত্যাদি নক্ষত্ৰসকলের পূজা এবং হোম প্রভৃতি। তার পরে অদ্ভুত মহাশান্তি। নৈঋত কর্ম। নিমিত্তসকলের বিভিন্নতা অনুসারে অমৃত ইত্যাদি অভয়ান্ত ত্রিংশৎ (৩০) মহাশান্তি প্রতিপাদিত হয়েছে। দিব্য ও আকাশসম্বন্ধী বা ভূমিসম্বন্ধী এই তিনরকম উৎপাতে যে মহাশান্তি, তার নাম অমৃত। গতায়ুগণের (অর্থাৎ যাদের আয়ু শেষপ্রায় হয়েছে, তাদের পুনরায়) জীবন লাভের জন্য যে, মহাশান্তি, তা বৈশ্বদেবী। অগ্নিভয় নিবৃত্তির জন্য ও সমস্ত অভীষ্ট প্রাপ্তির জন্য আগ্নেয়ী মহাশান্তি। নক্ষত্র অথবা গ্রহজনিত ভয়ে ব্যাকুল কিম্বা রোগগ্রস্ত এমন লোকগণের সেই নক্ষত্র বা গ্রহ দোষ ও রোগ শান্তির নিমিত্ত ভাবী মহাশান্তি। ব্রহ্মতেজঃ কামনাকারী ব্যক্তির অগ্নির দ্বারা বস্ত্র বা শয্যা দগ্ধ হলে ব্রাহ্মী মহাশান্তি। রাজলক্ষ্মী ও ব্রহ্মতেজকামী ব্যক্তির বাস্পত্যা মহাশান্তি। সন্ততি, পশু ও অন্নলাভের জন্য এবং প্রজাক্ষয় নিবারণের জন্য প্রাজাপত্যা মহাশান্তি। শুদ্ধিকামী ব্যক্তির সম্বন্ধে সাবিত্রী মহাশান্তি। ছন্দঃ (অর্থাৎ ছন্দজ্ঞান) এবং ব্রহ্মতেজ এই উভয়ভিলাষী ব্যক্তির গায়ত্রী মহাশান্তি। সম্পৎকামী, অভিচার কর্মকর্তা, অথবা অভিচর্যমান (অর্থাৎ যার উদ্দেশে অভিচার করা হচ্ছে, এমন ব্যক্তির সম্বন্ধে আঙ্গিরসী মহাশান্তি। বিজয়, বল কিম্বা পুষ্টি-কামনাযুক্ত এবং শত্রুবর্গের উদ্বেগ-প্রার্থী লোকের সম্বন্ধে (অর্থাৎ বিজয় ইত্যাদি কামনায়) ঐন্দ্রী মহাশান্তি। অদ্ভুতের জন্য যে সকল জাগতিক বিকার তার নিবৃত্তি এবং রাজ্যাভিলাষী মনুষ্যের সম্বন্ধে মাহেন্দ্রী মহাশান্তি। অর্থাভিলাষী এবং ধনক্ষয়-নিবারণকামী লোকের পক্ষে কৌবেরী মহাশান্তি। বিদ্যা, শক্তি, ধন ও আয়ুঃ প্রার্থীর আদিত্যা মহাশান্তি। অন্নাভিলাষীর বৈষ্ণবী মহাশান্তি। ভূতি অর্থাৎ ঐশ্বর্য কামনার এবং বাস্তু সংস্কার-কর্মে বাস্তোম্পত্যা মহাশান্তি। রোগার্ত এবং আপগ্রস্তের রৌদ্রী মহাশান্তি। বিজয়কামীর অপরাজিতা মহাশান্তি। যমভয় (মহামারী) উপস্থিত হলে যম্যা মহাশান্তি। জলভয় (প্লাবন) উপস্থিত হলে বারুণী মহাশান্তি। বাত্যাভয় (অর্থাৎ প্রবল ঝড়ের সম্ভাবনা) উপস্থিত হলে বায়ব্যা মহাশান্তি। কুলক্ষয়-নিবারণের জন্য সন্ততি  নামক মহাশান্তি। বস্ত্ৰনাশ নিবারণের নিমিত্ত কাষ্ট্রী মহাশান্তি। বালকের ব্যাধি নিবারণের জন্য কৌমারী মহাশান্তি। পাপগ্রস্তের মহাশান্তির নাম নৈঋতী। বলকামীর (অর্থাৎ সামর্থ্য কামনায়) মারুণী মহাশান্তি। অশ্ববর্গের বিনাশ নিবারণের নিমিত্ত গান্ধবী মহাশান্তি। হস্তিগণের বিনাশনিবৃত্তির জন্য পারাবতী মহাশান্তি। ভূমি কামনাযুক্ত ১) ব্যক্তির সন্বন্ধে পার্থবিী নামে মহাশান্তি। ভয়াতুরের মহাশান্তির নাম অভয়া। মহাশান্তি এই সকলের অধীন (অর্থাৎ মহাশান্তি এই পদ অমৃত ইত্যাদি অভয়ান্ত শান্তি-সমূহের প্রত্যেকের সাথে অম্বিত হচ্ছে)। অতঃপর আঙ্গিরসকল্প-নামক সূত্রের বিষয় লিখিত হচ্ছে;–প্রথমে অভিচার সম্বন্ধীয় কার্য কর্তা, (যিনি উক্ত অভিচার করেন), কারয়িতা (অর্থাৎ যিনি কার্য করতে নিযুক্ত করেন) এবং সদস্য (উক্ত কার্যের পরিদর্শক), তাদের আপন আপন আত্মরক্ষা এবং অভিচার-কর্মের উপযোগী দেশ (স্থান), কাল, গৃহ, কর্তা, কারয়িতা (প্রযোজক), দীক্ষা ইত্যাদি ধর্ম, সমিধ (হোমের কাষ্ঠ ইত্যাদি) ও আজ্য (হোমের বস্তু) প্রভৃতি দ্রব্য সমুদয়ের নিরূপণ প্রক্রিয়া ইত্যাদি। তার পরে আভিচারিক কার্যকলাপ এবং অন্য কর্তৃক অনুষ্ঠিত অভিচার-সকলের প্রতীকার ইত্যাদি অন্যন্য কার্য-সমূহ।

 অনন্তর শান্তিককল্পের বিষয় এইরকম লিখিত হচ্ছে,–প্রথমে বৈনায়ক গ্রহগ্রস্তের সমুদায় লক্ষণ। তার শান্তির নিমিত্ত দ্রব্য-সমুহের সংগ্রহ। অভিষেক (অর্থাৎ মন্ত্রপূর্বক স্নান), বৈনায়ক হোম (বিনায়কদেবের পূজা-ব্যবস্থা) এবং আদিত্য ইত্যাদি নবগ্রহের যজ্ঞ প্রভৃতি। এই সকল কল্পে রাজ্যাভিষেকের উপযোগী দ্রব্য, প্রকৃতি-প্রদত্ত দ্রব্যের গ্রহণ ও পুরোহিত-বরণ প্রভৃতি বিষয়, উক্ত হয়নি। পরিশিষ্টে সেই সব বিষয় উক্ত হয়েছে; সেই সমস্ত বিষয় কথিত হচ্ছে; যথা,–প্রথমে রাজার অভিষেক। প্রতিদিন প্রাতঃকালে রাজাকে সেই সেই মন্ত্রের দ্বারা অভিমন্ত্রিত (অর্থাৎ মন্ত্ৰ-পূত) বস্ত্র, গন্ধ (চন্দন ইত্যাদি গন্ধদ্রব্য), অলঙ্কার, সিংহাসন, ঘোটক, হস্তী, আন্দোলিকা (চতুর্দোলা), খঙ্গ, ধ্বজ (পতাকা), ছত্র এবং চামর প্রভৃতি প্রদান ইত্যাদি পুরোহিতের কর্ম-সমুদায় তাতে বিবৃত আছে। সুবর্ণ, ধেনু, তিল এবং ভূমি দান প্রভৃতি রাজার প্রতিদিনের কর্তব্যকর্ম দৃষ্ট হয়; আর তাতে বিবৃত আছে, পূজিত-পিষ্ঠ (অর্থাৎ পবিত্র পিটুলী) দ্বারা নির্মিত দীপযুক্ত রাত্রির প্রতিমূর্তির দ্বারা রাজার আরত্রিক এবং রক্ষাবিধান ইত্যাদি যাবতীয় পুরোহিতের রাত্রি-কর্ম; রাজার পুষ্পভিষেক; রাত্রিকালে রাজার আরত্রিকবিধান; প্রতিদিন প্রাতঃকালে ঘৃত-দর্শন; কপিলাগাভীদান; তিল ধেনু দান; রস ইত্যাদি ধেনুসমূহের নিরূপণ; কৃষ্ণাজিন দান; ভূমিদান; তুল্য-পুরুষ দান-বিধি; সূর্যমণ্ডলাকার পিষ্ঠক-দান; হিরণ্যগর্ভবিধি; হস্তীর সাথে রথ দান; কণকা প্রভৃতি দশবিধ মহাদান; অশ্বযুক্ত রথ দান; গোসহস্র বিধি; বৃযোৎসর্গ; কোটি হোম; লক্ষ হোম; অযুত হোম; ঘৃতকম্বল বিধি; তড়াগ (পুষ্করিণী) প্রতিষ্ঠা, পাশুপত ব্ৰত; ইত্যাদি। অন্যান্য যাবতীয় দান ও ব্রত ইত্যাদি কর্মসমুদয় পরিশিষ্টে কথিত হয়েছে।

পরিশিষ্টের সাথে সূত্রপঞ্চকের প্রতিপাদ্য যাবতীয় কর্মের এই অনুক্রম সামান্যভাবে কথিত হলো। কিন্তু যা বিশেষ, তা সেই সূক্তের বিনিয়োগের সময় কথিত হবে। উক্ত কর্মসকল নিত্য, নৈমিত্তিক ও কাম্য ভেদে তিন রকম। তার মধ্যে জাতকর্ম ইত্যাদি নিত্য। দুর্দিন ও বজ্র-নিবারণ, অশ্বশান্তি এবং অদ্ভুত কর্ম–এইগুলি নৈমিত্তিক। আর মেধাজনন, গ্রাম-সম্পদ ইত্যাদি কর্মসমূহ কাম্য। এই স্থলে নিত্য এবং নৈমিত্তিক কর্মসমুদয় অবশ্য অনুষ্ঠেয় (অনুষ্ঠানের যোগ্য)। কারণ, না করলে প্রত্যবায় হয়,–এমন স্মৃতি আছে। স্মৃতি এই,নিত্য নৈমিত্তিকে কুর্যাৎ প্রত্যয় জিঘাংসয়া। অর্থাৎ, প্রত্যবায়-নাশের ইচ্ছায় (অর্থাৎ প্রত্যবায় দোষ না হয়, এই হেতু) নিত্য এবং নৈমিত্তিক কর্ম করণীয়। (অতএব, করলে প্রত্যবায় হয় না এমন বলায়, না করলে প্রত্যবায় হবে, এমন বোধ হচ্ছে; সুতরাং উক্ত কর্মদ্বয় অবশ্য কর্তব্য, এটাই প্রতিপন্ন হলো)। কিন্তু কাম্য-কর্ম সম্বন্ধে প্রবৃত্তি ইচ্ছাধীন (অর্থাৎ ইচ্ছা হলে অনুষ্ঠান করবে, না হলে করবে না; এতে কোনও দোষ-ত্রুটি নেই)। গ্রামের বাহিরে, পূর্ব বা উত্তর দেশে, অথবা মহানদী ও তড়াগ ইত্যাদির উত্তর তীরে, এই কাম্য কর্মসমুদয়ের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে; যেহেতু, কৌশিকসূত্রে এমন কথিত আছে। কৌশিকসূত্র এই–পুরস্তাদুত্তরাোেেহরণ্যে কৰ্মৰ্ণাং প্রয়োগ উত্তরত উদকান্তে (কৌ. ১৭)। অর্থাৎ, পূর্ব বা উত্তর দেশে, বনের মধ্যে এবং জলাশয়ের উত্তরভাগে কাম্যকর্মের প্রয়োগ (অনুষ্ঠান) করবে। পুংসবন ইত্যাদি নিত্যকর্মের (অনুষ্ঠান) গৃহেতেই হবে, এই মতো রুদ্র ভাষ্যকারের মত। উক্ত কর্মের কাল পর্বদ্বয় (পূর্ণিমা ও অমাবস্যা এই দুই তিথি পর্ব নামে খ্যাত), কিংবা পুণ্য-নক্ষত্র-যুক্ত অপর যে কোনও তিথি, সেই সেই নিমিত্তের অনন্তর কালই অদ্ভুত কর্মসমূহের কাল (অর্থাৎ তাতে কোনও তিথি ইত্যাদির নিয়ম নেই)। তার প্রমাণ এই;-অমাবস্যা পৌৰ্ণমাসি পুণ্য নক্ষত্রযুক তিথিঃ। এত এব ত্রয়ঃ কালাঃ সর্বেষাং কর্মণাং স্মৃতাঃ অদ্ভূতানাং সদাকালং আরম্ভঃ সর্বকৰ্মৰ্ণাং ইতি। অর্থাৎ, অমাবস্যা, পৌর্ণমাসি (পূর্ণিমা) এবং শুভ-নক্ষত্রযুক্ত যে কোনও তিথি এই কালত্রয় মাত্র সকল নিত্য কর্ম সম্বন্ধে স্মৃত হয়ে থাকে। আর সমুদয় অদ্ভুত কর্মের আরম্ভ সকল কালেই হতে পারে। আভিচারিক কর্মের পক্ষে এইমাত্র বিশেষ যে, গ্রামের দক্ষিণদিকে কৃষ্ণপক্ষে এবং কৃত্তিকা নক্ষত্রে তাদের অনুষ্ঠান হবে। এই স্থলে কৌশিক সূত্র প্রমাণ; তা এই,–অভিচারিকে দক্ষিণতঃ। সম্ভারমাহৃত্য আঙ্গিরস ইত্যাদি (কৌ. ৬/১)। এর অর্থ এইরকম,–আভিচারিক কর্ম-সমুদয়ের বিষয়ে অনুষ্ঠান দক্ষিণদিকে এবং আঙ্গিরসকল্পোক্ত দ্রব্য-সকল আহরণ করে কার্য করবে। এই সূত্রে আঙ্গিরস পদের আঙ্গিরসকল্পোক্ত এইরকম অর্থ করতে হবে। এই আভিচারিক কর্ম-সকলের প্রাচ্য এবং উদীচ্য অঙ্গ সমূহ দর্শপূর্ণমাসের সদৃশ কর্তব্য। যেহেতু, সূত্রকার বলেছেন যে,–ইমৌ দর্শপূর্ণমাসৌ ব্যাখ্যাতৌ দর্শপূর্ণমাসাভ্যাং পাক্যজ্ঞাঃ ইতি। অর্থাৎ এই পূর্ণমাস ব্যাখ্যাত হলো। এ থেকেই পাকযজ্ঞ-সকল (সম্পন্ন হবে)। উক্ত সূত্রে পাকযজ্ঞ এই শব্দের দ্বারা সমস্ত অথর্ব বেদোক্ত কর্ম কথিত হচ্ছে। সেই কর্ম দুপ্রকার; আজ্যতন্ত্র এবং পাকতন্ত্র। যে কর্মে আজ্য (ঘৃত) প্রধান হবিঃ অর্থাৎ হবনীয় দ্রব্য, তা-ই আজ্যতন্ত্র কর্ম। আর যে কর্মে চরু, পুরাডাশ প্রভৃতি দ্রব্যই প্রধান, তা-ই পাকতন্ত্র কর্ম। উক্ত আজ্যতন্ত্রের বিষয়ে অনুষ্ঠানের ক্রম এইরূপ,–প্রথমে কর্তা কর্তৃক অব্যসশ্চ এই মন্ত্রের জপ, কুশচ্ছেদন, বেদি, উত্তর বেদি। অগ্নিপ্রণয়ণ। অগ্নির প্রতিষ্ঠাপন। ব্ৰতগ্রহণ। কুশ পবিত্র-নির্মাণ। পবিত্রের দ্বারা যজ্ঞীয় কাষ্ঠের প্রেক্ষণ এবং উক্ত কাষ্ঠসকলকে সমীপে স্থাপন। কুশপ্রেক্ষণ। ব্রহ্মার আসন। ব্রহ্মার স্থাপন। কুশান্তরণ এবং আস্তীর্ণ কুশের প্রেক্ষণ। আপন আসন (অর্থাৎ, কর্মকর্তার আসন)। জলপাত্র স্থাপন। আজ্যসংস্কার। বগ্রহণ। গ্রহের (গ্রহনামক পাত্রবিশেষের) গ্রহণ। যাবতীয় পূর্ব কর্তব্য হোম এবং আজ্য ভাগদ্বয়। সবিতা প্রসবানাম (৫/২৪)। প্রসব-কর্মের দেবতা সবিতা। এই কর্মে (অর্থাৎ প্রসবনিমিত্ত কর্মে) অভ্যাতান দ্বারা আজ্যহোম করবে এই রকম সূত্ৰকারের উক্তি হেতু অভ্যাতান কর্ম-সমুদয়। এই পর্যন্ত পূর্বতন্ত্র অর্থাৎ আজ্যতন্ত্রের প্রথম তন্ত্র। তারপর উপদেশানুযায়ী প্রধান হোম। এইভাবে উত্তরতন্ত্র কথিত হচ্ছে, –অভ্যাতান কর্মসকল। পার্বণহোম। সমৃদ্ধিহোম। সন্নতিহোম। স্বিষ্টকৃৎ হোম। সর্বপ্রায়শ্চিত্তসম্বন্ধী হোম। স্কন্নহোম। পুনমৈত্বিন্দ্ৰিয় এই মন্ত্রের দ্বারা হোেম। স্কন্নাস্মৃতি হোমদ্বয়। সমুদয়-সংস্থিতি হোম। চতুগৃহীত হোম। বহিহোম (অর্থাৎ,দর্ভজুটিকা হোম)। সংস্ৰাবহোম। সমস্ত বিষ্ণুক্রম। ব্রতবিসর্জন। দক্ষিণাদান এবং ব্রহ্মার উত্থাপন। পাকতন্ত্রে অভ্যাতান কর্ম নেই, এইমাত্র বিশেষ। অন্য সবই আজ্যতন্ত্রের সমান। এই বিষয়ে গোপথব্রাহ্মণ প্রমাণ। তন্ত্রের অদ্ভুত কর্ম-সমুদয় আজ্য-তন্ত্রের মধ্যে গণ্য হলেও তাতে পাকতন্ত্রের মতো অভ্যাতান কর্মের অভাব আছে। এই সম্বন্ধে কেশব বলেছেন যে,–অভ্যাতান কর্মসকল পাকতন্ত্রে এবং সমুদায় অদ্ভুত-কর্মে বিনিযুক্ত হয় না; কিন্তু অন্যান্য সমস্ত কর্মে সেই সমুদায় প্রযুক্ত হয়ে থাকে (কে. ১৪/১)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *