পোকা

পোকা

ঘনাদা সেদিন প্রায় জব্দ হয়ে গিয়েছিলেন।

প্রায় জব্দ এই জন্য যে সত্যিকারের জব্দ হবার পাত্র ঘনাদা নন। যত বেকায়দায় পড়ুন না কেন, নিজেকে সামলে নেবার অসামান্য প্রতিভা ঘনাদার আছে। তেলা-মাছের মত যে-কোনও বেয়াড়া অবস্থা থেকে তিনি পিছলে বেরিয়ে যেতে পারেন।

সেদিন কিন্তু অবস্থাটা তাঁর বড় বেশি কাহিল হয়ে উঠেছিল। মেসের সকলের হাসি-ঠাট্টার চোটে তাঁর এতদিনের খ্যাতি-প্রতিপত্তি প্রায় ভেসে যায় আর কি! মেসের তেতলার একটি ছোট চোর কুঠরি গোছের ঘরে ঘনাদা একা থাকে। এই ব্যবস্থাটা শুধু তাঁর নিজেরই মনঃপূত নয়, আমাদেরও অনুমোদিত। ঘনাদার মতো অসামান্য পুরুষের সংস্পর্শে দিনরাত থাকা একটু বিপজ্জনক বলেই আমাদের ধারণা।

ঘনাদার তেতলার সেই ঘরে সেদিন রাত বারোটা নাগাদ হঠাৎ একটা খণ্ডযুদ্ধ বেধেছে বলে আমাদের মনে হল। শনিবারের রাত। পরের দিন ছুটি, সুতরাং ভোরে উঠবার তাড়া নেই বলে আমরা সবাই যে যার দলে একটু বেশিক্ষণ পর্যন্ত তাস পাশা খেলে সবেমাত্র শুতে গেছি, এমন সময় টেবিল-চেয়ার ওলটানোর সঙ্গে ওপরকার ঘরে ঘনাদার অমানুষিক চিৎকারে বিছানা থেকে উঠে বসলাম।

ব্যাপার কী! তাস পাশা ইত্যাদি খেলা ঘনাদার দুচক্ষের বিষ। শনিবার রাত্রে তাই তিনি আমাদের ওপর বিরক্ত হয়ে অন্যান্যদিনের চেয়ে একটু সকাল সকালই শুতে চলে যান। তারপর ওপরের ঘরে আলবোলায় তাঁর আরাম করে তামাক খাওয়ার শব্দ কখন করাতে কাঠ-চেরার মতো মধুর নাক ডাকার আওয়াজে মিশে যায়, সমস্তই আমরা নীচে থেকে টের পাই।

আজ হঠাৎ সেই সুখনিদ্রায় কী এমন আকস্মিক ব্যাঘাত ঘটল। ঘনাদার চিৎকার শুনলে তো মনে হয়, ব্যাঘাতটা হিংস্র কোনও সাতদিনের উপোসি বাঘ বা পাগলা গারদ ভেঙে বেরিয়ে আসা ছুরি হাতে খুনে গুণ্ডা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু ঘনাদার মত ত্রিভুবনজয়ী বীরের কাছে এসব তো তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার বস্তু। তা হলে ব্যাপারটা কী হতে পারে?

এই রহস্যময় ব্যাপারের নায়ক ঘনাদাই পরমুহূর্তে হুড়মুড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন শুনতে পেলাম। তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কী, ঘনাদা!

আমরা সবাই এখনও জেগে আছি, ঘনাদা বোধহয় ভাবেননি। আমাদের সকলের উৎকণ্ঠিত প্রশ্নের সামনে প্রথমটা এক মুহূর্তের জন্য তিনি কেমন যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন! কিন্তু সে বোধহয় আমাদের মনের ভুল। পরের মুহূর্তেই আমাদের সকলকে একেবারে স্তম্ভিত করে দিয়ে তিনি চাপা গলায় বললেন, ব্যাপার? ব্যাপার যা ভেবেছিলাম তা-ই!

কথাগুলো যেমন দুর্বোধ, ঘনাদার গলার স্বর তার চেয়ে বেশি রহস্যময়। সে স্বরে এমন একটা বিভীষিকার আভাস যে মনে হল শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে হিম একটা জলের ধারা যেন হঠাৎ বয়ে গেল!

শিবুই প্রথম এ ধাক্কা কতকটা সামলে উঠে কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলে, ভূত-টুত নাকি ঘনাদা?

ভূত! ঘনাদার বিদ্রুপের স্বরে বোঝা গেল, সামান্য ভূত-টুতের কথা তুলে শিবু তাঁকে কতখানি অপমান করেছে।

সবাই মিলে একবার দেখে আসব! প্রস্তাব করলে গৌর।

ঘনাদার তাতে কিন্তু ঘোর আপত্তি দেখা গেল। তাঁর কথায় মনে হল আমাদের অতখানি বিপদের মুখে পাঠাতে তিনি রাজি নন। তিনি বরং রাতটা আমাদের কারুর ঘরে শুয়ে কাটিয়ে দিয়ে সকালে যা করবার করবেন। কিন্তু আমরা অত সহজে নিরস্ত হতে পারলাম না। ঘনাদার মতো লোককে যার জন্য মাঝরাত্রে পরিত্রাহি ডাক ছাড়তে হয়, সে ব্যাপার যে কী, সন্ধান করবার চেষ্টা না করে আমরা থাকি কী করে!

সবাই মিলে সন্তর্পণে সিঁড়ি দিয়ে ঘনাদার ঘরে গিয়ে উঠলাম। ঘনাদা তাড়াতাড়িতে আলোটাও জ্বালতে পারেননি। ঘর একেবারে অন্ধকার। আলো জ্বাললে কী দেখতে হবে কে জানে ভেবে সুইচটা টিপতেও যেন ভয় করছিল। শিশিরই প্রথম সুইচটা টিপে দিলে সাহস করে।

কিন্তু কোথায় কী! ওলটানো চেয়ার টেবিল ছাড়া ঘরে তো কোনও কিছু দেখবার মতো নেই!

যথাসাধ্য চেষ্টা করেও আটকাতে না পেরে ঘনাদা আমাদের পেছন পেছনই ঘরে এসে ঢুকেছিলেন। আমরা অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকাতেই পরম গম্ভীর মুখে তিনি বললেন, কী বলেছিলাম! তাঁর ভাবখানা এই যে ঘরে কিছু না থাকাই যেন একটা ভয়ংকর রহস্য।

আমরা কিছু বলবার আগেই হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটা অদ্ভুত শব্দ শোনা গেল। গোঁ করে একটা শব্দ মেঝে থেকে ওপরে উঠে ঠক করে একটা আওয়াজে শেষ হল। আচমকা এই শব্দে আঁতকে উঠে প্রথমটা প্রায় নিজেদের অজান্তে হুড়মুড় করে সিঁড়ির দিকে হটে গিয়েছিলাম, কিন্তু পর মুহূর্তেই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবার জোগাড়।

গৌরই ছিল সবার সামনে। গোড়ায় পিছু লাফ দিয়ে হটে এলেও সে তখন মেঝে থেকে সেই ভয়ংকর রহস্যের মূলাধার বস্তুটিকে তুলে ধরেছে।

বড় গোছের একটা নারকুলো পোকা!

একবার ঘনাদার আর একবার সেই পোকার দিকে চেয়ে মেসের সকলের হাসি আর থামতে চায় না। শিশির অনেক কষ্টে তারই মাঝে দম নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, শেষকালে এই একটা পোকা আপনাকে এমন ভয় পাইয়ে দিলে, ঘনাদা!

সঙ্গে সঙ্গে আবার হাসির ধুম পড়ে গেল। কিন্তু এত হাসি-ঠাট্টা ঘনাদাকে যেন স্পর্শই করল না। অবিচলিত ভাবে নিজের বিছানার ওপর এসে বসে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তিনি আমাদের সকলের দিকে একবার তাকালেন, তারপর গম্ভীর মুখে বললেন, একটা পোকা দেখে ভয় পেয়েছি, না?

পা দুটো গুটিয়ে আর একটু আরাম করে বসে তিনি হঠাৎ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, একটা পোকার পেছনে আট হাজার মাইল কখনও ছুটে বেড়িয়েছ? তিন হাজার টন মরা পোকা নিয়ে কী করবে কখনও ভাবতে হয়েছে? পকেটে একটা কাঁচের বন্ধ শিশি আর হাতে একটা কাগজ সম্বল করে আফ্রিকার গহনতম বনে-জঙ্গলে-জলায় কখনও একটা পোকার খোঁজে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে?

আমাদের হাসি তখন প্রায় শুকিয়ে গিয়েছে। তবু একবার জিজ্ঞাসা করলাম, কী সে পোকা, ঘনাদা! এই নারকুলো পোকা?

না, তার নাম—সিস্টোসার্কা গ্রিগেরিয়া!

থাক থাক, ঘনাদা! পোকা হলেও কৃষ্ণের জীব তো বটে। অমন যা-তা গালাগালি দেওয়াটা কি উচিত?

শিবুর বলার ধরনে হাসিটা আর একবার উথলে উঠতেই এক ধমকে সেটা থামিয়ে দিয়ে ঘনাদা বললেন, গালাগাল নয়, এ-ই হল তার বৈজ্ঞানিক নাম।

আমরা সিঁড়িটার দিকে পা বাড়াবার আগেই ঘনাদা শুরু করে দিলেন, ১৯৩১ সালের ২২ ডিসেম্বর। লাটভিয়ার রিগা শহরের সমস্ত পথঘাট বরফে ঢেকে গেছে। আগের রাত্রে এমন প্রচণ্ড তুষার ঝটিকা শহরের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে যে, মিউনিসিপ্যালিটির লোকজন এসে বরফ কেটে পরিষ্কার না করে দেওয়া পর্যন্ত অনেকে বাড়ির দরজাই খুলতে পারেনি। আমি যথারীতি প্রাতঃভ্রমণ সেরে আমার হোটেলে ফিরছি, এমন সময় খটাখট শব্দে এক ঘোড়ায় টানা ড্রোসকি আমার কাছেই এসে থামল। মোটা আসট্রাকান গায়ে মাথায় রুশ টুপি-পরা মিলিটারি চেহারার একটি লোক তা থেকে নেমে আমায় ভাল করে লক্ষ করে হাতে একটি চিঠি দিলে।

সে চিঠি পড়ে সত্যিই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, জেনারেল ভরনফ এখানে আছেন তা তো জানতাম না!

লোকটি সবিনয়ে বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ, তিনি আজ তিন বছর এখানেই আছেন। আপনার সঙ্গে এখুনি একবার দেখা করতে চান।

তা তো চিঠি পড়েই বুঝলাম, কিন্তু তিনি যার সঙ্গে দেখা করতে চান আমি যে সেই লোক, আপনি বুঝলেন কী করে?

আট্রাকান কোটটার গলাটা একটু তুলে দিয়ে লোকটি বললে, তা কি আর বুঝতে দেরি হয়! জেনারেল আপনার অনেক গল্পই আমার কাছে করেছেন, তা ছাড়া রিগা শহরের এই রক্ত-জমানো শীতে শুধু একটা সোয়েটার চাপিয়ে প্রাতঃভ্রমণে বেরুতে আর কেউ যে পারে না তা আমি ঠিক জানি।

শিবুর একটু বুঝি কাশি শোনা গেল। সেইসঙ্গে আমাদেরও। ঘনাদা গ্রাহ্য না করে বলে চললেন, গেলাম তারপর জেনারেল ভরনফের বাড়ি। রিগা উপসাগরের দক্ষিণ পাড়ে নোংরা পুরোনো শহরের এক ঘিঞ্জি পাড়ায় ভরনফের ভাঙা দুকামরা আস্তানা দেখে যত অবাক হলাম, তার চেয়ে বেশি হলাম স্বয়ং তাঁকে দেখে।

জেনারেল ভরনফের সঙ্গে আফ্রিকায় শিকারের সূত্রে আমার পরিচয়। একসঙ্গে নাইপার নদীতে আমরা ডিঙি বেয়ে দুশো পাঁচশো মাইল ঘুরে বেড়িয়েছি, কঙ্গোর গভীরতম জঙ্গলে গরিলার খোঁজে ফিরেছি প্রাণ হাতে নিয়ে, মাসাইদের সঙ্গে শুধু তীর-ধনুক দিয়ে শিকার করেছি। খাঁটি প্রুশিয়ান বলতে যা বোঝায়, চেহারায় চরিত্রে তিনি ঠিক তা-ই ছিলেন। শরীর ও মন দুই-ই একেবারে শক্ত ইস্পাতের তৈরি। শারীরিক কষ্ট কাকে বলে জানেন না, মানসিক দুর্বলতা কাকে বলে বুঝতে দেন না কখনও। প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মান সেনাপতি হিসেবে তিনি যথেষ্ট নাম করেছিলেন, রাজকীয় সম্মানও পেয়েছিলেন প্রচুর। সেই লোকের এই দুরবস্থা কী করে সম্ভব? আর্থিক অবস্থা তাঁর যত খারাপ হয়েছে, শরীর ভেঙে পড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। এ যেন আগের ভরনফের ছায়ামাত্র!

ভদ্রতা-বিরুদ্ধ হলেও কী করে এ দুর্দশা তাঁর হল তা না জিজ্ঞেস করে পারলাম । অদ্ভুতভাবে আমার দিকে চেয়ে ভরনফ বললেন, এ শহরে আপনি এসেছেন জেনে সে কথা বলতেই ডেকে পাঠিয়েছি। পৃথিবীর আর কেউ যে কথা জানে না তা-ই আজ আপনাকে বলব। আসুন।

আমায় ভেতরের ঘরে নিয়ে গিয়ে ভরনফ একটা দেরাজ খুলে একটা ফটো বার করলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এফটো কার জানে?

ফটোটা দেখেই চিনেছিলাম। অবাক হয়ে বললাম, এ ফটো তো ড. রথস্টাইনের। পনেরো বছর আগে সি-সি মাছি সম্বন্ধে গবেষণা করতে গিয়ে আফ্রিকায় মারা পড়েন।

ভরনফ ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, না, মারা সে পড়েনি, আজও বেঁচে আছে। নিজের মৃত্যু সে বিশেষ কোনও কারণে এইভাবে রটিয়েছিল।

কিন্তু আপনি সে কথা জানলেন কী করে?

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ভরনফ প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বললেন, সে আমার ভাই।

আপনার ভাই! ড. রইস্টাইন হলেন ইহুদি, আর আপনি খাস জার্মান। কী রকম ভাই?

সহোদর ভাই। এক বাপ-মায়েরই আমরা সন্তান! বলে ভরনফ অত্যন্ত বিষণ্ণভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার সঙ্গে যখন আমার আলাপ তখন আফ্রিকায় শিকারের ছুতোয় এই ভাইকেই আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম।

একটু চিন্তিতভাবে ভরনফের দিকে তাকালাম। দুঃখে অভাবে তাঁর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে নাকি? ভরনফ আমার সে দৃষ্টির অর্থ বুঝে স্লান হেসে বললেন, আপনি মনে করছেন, আমার বোধ হয় মাথা খারাপ হয়েছে! রথস্টাইন ইহুদি হয়ে কী করে আমার সহোদর ভাই হতে পারে আপনি ভেবে পাচ্ছেন না, নয়? গত মহাযুদ্ধে বীরত্বের জন্য জার্মানির শ্রেষ্ঠ সম্মান পেয়েও লাটভিয়ার এই শহরে একটা নোংরা পল্লীতে এই দারিদ্র্যের মধ্যে চোরের মতো কেন দিন কাটাচ্ছি ভাবলেই বুঝতে পারবেন।

আমায় চুপ করে থাকতে দেখে ভরনফ আবার বললেন, আমায় সবাই খাস জার্মান হিসেবে প্রুশিয়ানদের চেয়েও কড়া দাম্ভিক বলে জানত, এখনও অনেকে জানে। কিন্তু আসলে আমিও ইহুদি। তবে আমার ভাই ইহুদি জাতের গৌরব ছিল একদিন, আর আমি ছিলাম কুলাঙ্গার। জার্মানিতে—আর শুধু জার্মানিতে কেন— সমস্ত ইউরোপে ইহুদি-বিদ্বেষ কী রকম প্রবল, তা নিশ্চয় জানেন। গত দু হাজার বছর ধরে আমাদের ওপর যে অত্যাচার এরা করেছে, তার তুলনা হয় না। মাঝে মাঝে এ বিদ্বেষ কিছুদিনের জন্যে একটু চাপা থেকেছে মাত্র, তারপর আবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে আমাদের ধনে-প্রাণে ধ্বংস করেছে। ছেলেবেলা থেকেই এই ইহুদি-বিদ্বেষ আমাদের ক্ষিপ্ত করে তুলেছে—কিন্তু আমাদের দুভাইকে দুভাবে।

আমার ভাই জ্যাকব, রথস্টাইন আমাদের পদবি, চেষ্টা করেছে বৈজ্ঞানিক হিসেবে ইহুদি জাতের মুখোজ্জ্বল করতে, আর আমি পিতৃপরিচয় ভাঁড়িয়ে জার্মানদের সঙ্গেই মিশে যেতে চেয়েছি ইহুদি-বিদ্বেষ এড়াবার জন্যে। বিদ্যাবুদ্ধিতে জ্যাকবের চেয়ে আমি অনেক খাটো। বাপ-মা দুই-ই মারা যাবার পর বিশ বছর বয়সে আমি তাই একটা খনির চাকরি নিয়ে ব্রেজিলের জঙ্গলে চলে যাই। সেখান থেকে বছর পাঁচেক বাদে যখন জার্মানিতে ফিরে এলাম তখন আমি একেবারে খাঁটি প্রুশিয়ান, চেহারায় চলনে বলনে আমায় অন্য কিছু বলে চেনে কার সাধ্য।

ঘটনাচক্রেই প্রশিয়ান সাজবার এ সুযোগ আমার মিলে গেছল। বিশুদ্ধ প্রুশিয়ান বংশের একটি ছেলে আবিষ্কার-পর্যটনের নেশায় ব্রেজিলের জঙ্গলে এসে আমাদেরই খনির আস্তানায় মারা পড়ে। তার সঙ্গে আমার চেহারার মিলের কথা অনেকেই সে সময় বলেছিল। তারই সুযোেগ আমি নিলাম। মরবার সময়–তার সেবা করার দরুন—সে কয়েকটি কাগজপত্র ও জিনিস আমার হাতেই দেয় জার্মানিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। সেই কাগজপত্রের জোরে আমি অনেকটা নির্ভয়ে ভরন সেজে বসলাম। সামরিক বিভাগে ঢুকে উন্নতিও করলাম যথেষ্ট! কেউ কোনওদিন একটু সন্দেহও করতে পারল না।

এতদিনে ইচ্ছে করেই জ্যাকবের সঙ্গে আমি দেখা করিনি, যদিও তার সব খবরই রাখতাম। একদিন হঠাৎ বার্লিন থেকে মিউনিক যাবার পথে ট্রেনের একটি কামরায় তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমি তখন বড় মিলিটারি অফিসার। মিউনিকে যাচ্ছি একটা জরুরি তদন্তে, আর জ্যাকব সেখানে যাচ্ছে বৈজ্ঞানিকদের কী একটা সম্মেলনের সভাপতি হিসেবে।

আমি তাকে গোড়াতেই চিনলেও আমার মিলিটারি জাঁদরেল পোশাকে ও চালচলনে সে প্রথমটা কিছু বুঝতে পারেনি। সন্দিগ্ধভাবে দু-একবার তাকিয়েছিল মাত্র। পরিচয় দেবার আমার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু দিতে হল ঘটনাচক্রে। মাঝখানের একটা স্টেশনে গাড়ি থামতে আমার একজন তাঁবেদার কর্মচারী আমায় সেলাম দিতে এল আমার কামরায়। জ্যাকবকে দেখলেই ইহুদি বলে চেনা যায়। চেহারায় পোশাকে নিজের জাত লুকোবার কিছুমাত্র চেষ্টা তার নেই। আমার তাঁবেদার অফিসারটি যেমন গোঁড়া তেমনই অভদ্র। সে জ্যাকবের মুখের সামনেই আমায় বললে, এই ইহুদি জানোয়ারটা আপনার সঙ্গে এক গাড়িতে যাচ্ছে! দেব এ কামরা থেকে ঘাড় ধরে বার করে?

মরমে মরে গিয়েও বাইরে দাম্ভিকতার ভান করে বললাম, থাক, তার দরকার নেই, রাস্তায় কত বেড়ালকুকুরও থাকে!

একজন ইহুদিকে একটু জব্দ করবার সুবিধে না পেয়ে একটু অপ্রসন্ন হয়েই অফিসারটি শেষ পর্যন্ত কামরা থেকে নেমে গেল। গাড়িও দিল ছেড়ে। জানলার বাইরে মুখ বাড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ ফিরে দেখি, জ্যাকব একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে আছে। অত্যন্ত অস্বস্তির সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নিলাম, কিন্তু খানিক বাদেই তার দিকে না চেয়ে পারলাম না।

এখনও সে আমার দিকে চেয়ে আছে, কিন্তু তার মুখে একটু অনুকম্পার হাসি। কামরায় আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই—এই ভাগ্যি, নইলে একটা ইহুদির সামনে কড়া প্রুশিয়ান অফিসারের এরকম অস্বস্তি দেখে তারা সন্দিগ্ধই হয়ে উঠত।

হঠাৎ জ্যাকব বললে, ওইটুকুর জন্যই ধরা পড়ে গেলে, আইজ্যাক।

যতদূর সম্ভব মিলিটারি মেজাজের ভান করে বললাম, কী বলছ কী তুমি! কার সঙ্গে কথা কইছ জানো?

আর আস্ফালন করে লাভ কী আইজ্যাক? আমি তোমায় চিনতে পেরেছি। সত্যিকারের প্রশিয়ান অফিসার একটা ইহুদিকে কামরা থেকে নামিয়ে দেবার এ সুযোগ কক্ষনও ছাড়ত না!

সজল চোখে খানিক তার দিকে তাকিয়ে থেকে তার হাত দুটো ব্যাকুলভাবে ধরে ফেলে এবার বললাম, আমায় ক্ষমা করো, জ্যাকব! কী দুঃখে এ ছদ্মরূপ নিয়েছি তা জানো?

তা জানি। কিন্তু ইহুদি-বিদ্বেষের প্রতিশোধ কি এইভাবে নেওয়া যায়? ওই পোশাক তোমার চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছে না?

জ্যাকবের চেহারা একমুহূর্তে এমন বদলে গেল যে, সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম! তার চোখ দিয়ে যে আগুন ঠিকরে বেরুল, বুকের ভেতরকার কত বড় আগ্নেয়গিরি তা থেকে উঠে আসছে বুঝে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

একটু শান্ত হয়ে জ্যাকব বললে, যেমন করে পারো, লুকিয়ে-চুরিয়ে মিউনিকে আমার সঙ্গে দেখা কোরো। ইহুদি-বিদ্বেষের কী প্রতিশোধের আয়োজন হচ্ছে, তোমায় বুঝিয়ে দেব।

মিউনিকে সত্যিই তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম এবং যা শুনেছিলাম ও দেখেছিলাম তাতে বুঝেছিলাম, অতবড় বৈজ্ঞানিক হয়েও ইহুদি-বিদ্বেষের দরুন পদে পদে প্রত্যেক জায়গায় অপমানিত লাঞ্ছিত হয়ে জ্যাকব একেবারে উন্মাদ হয়ে গেছে। কিন্তু উন্মাদ হয়ে সে যে প্রতিশোধের পরিকল্পনা করছে, তার বৈজ্ঞানিক কূট কৌশল শুধু শয়তানের মাথাতেই জন্মানো সম্ভব। তার সঙ্গে কথা কইতে কইতে বুঝলাম, ইহুদি-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়বার একই প্রেরণা আমাদের দুজনের মধ্যে কী বিভিন্নভাবে কাজ করেছে! জাতের কুলাঙ্গার হয়েও আমি ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতাকে জয় করে মানুষকে ভালবাসতে শিখেছি, আর জাতির অপমানের শোধ নিতে গিয়ে জ্যাকব মানুষের শত্রুই হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার পরিকল্পনায় সমস্ত মানবজাতির কতখানি ক্ষতি হবে বুঝিয়ে তাকে নিরস্ত করবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু তীব্র বিদ্রুপের হাসি হেসে সে বলেছিল, নকল প্রুশিয়ান সাজতে সাজতে তুমি খানিকটা তা-ই হয়ে গেছ। আমার কথা তুমি বুঝবে না।

এর কিছুদিন পরে সে সি-সি মাছি সম্বন্ধে গবেষণা করবার নামে আফ্রিকায় চলে যায়। কিন্তু আমি জানতাম ওটা তার একটা ছুতোমাত্র।

ভরনফের কথা শেষ হলে আমি একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলাম, জ্যাকব রথস্টাইন যে সত্যি মারা যাননি, আপনি জানলেন কী করে?

জানলাম প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়ে।একটা কাগজের ফাইল দেরাজ থেকে বার করে ভরনফ বললেন, খবরের কাগজের এই কাটিংগুলো পড়ে দেখলে বুঝতে পারবেন, গত দশ বছরে এশিয়া-ইউরোপের নানা জায়গায় কী রকম অদ্ভুতভাবে ছোটখাটো দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। দেশভরা সোনার শস্য চক্ষের নিমেষে কীভাবে ছারখার হয়ে গেছে! এখনও পর্যন্ত জর্জিয়া, রুমানিয়া, মোরাভিয়া প্রভৃতি ছোটখাটো রাজ্যের ওপর দিয়েই এ বিপদ গেছে। বড় বড় দেশ এখনও রেহাই পেয়ে আছে। কিন্তু বেশিদিন আর নয়। তার আয়োজন সম্পূর্ণ হলেই সমস্ত ইউরোপ সে বিপদ ঠেকাতে পারবে কিনা সন্দেহ।

বললাম, কিন্তু এই ব্যাপারে আমাকে কেন ডেকেছেন বুঝতে পারছি না।

বুঝিয়ে দিচ্ছি, শুনুন। আমি নিজে বৃদ্ধ অথর্ব হয়ে পড়েছি। জার্মানির জঙ্গিমহলে এতদিন পরে কেমন করে জানি না আমার সত্যকার জাত সম্বন্ধে একটা সন্দেহের হাওয়া ওঠায় আমায় এখানে এসে প্রায় অজ্ঞাতবাস করতে হচ্ছে। যা আর পারি না, তা-ই আপনাকে করতে হবে। জ্যাকবকে খুঁজে বার করতে হবে। আমি জানি যদি কেউ পারে তো আপনিই পারবেন।

অবাক হয়ে বললাম, বলেন কী! পনেরো বছর যে লোকের কোনও পাত্তা নেই, তাকে আমি কোথায় খুঁজে বার করব? করবই বা কী করে?

একটা ছোট কাঁচের কৌটো খুলে ধরে ভরনফ বললেন, খুঁজে বার করবেন এর সাহায্যে। এই আপনার নিদর্শন!

এ কী! সত্যিই বিমূঢ় হয়ে বললাম, এ তো একটা মরা পোকা দেখছি!

হ্যাঁ, এই মরা পোকাই আপনাকে তার সন্ধান বলে দেবে। এ পোকা আফ্রিকার কোথায় যে জন্মায়, কোনও বৈজ্ঞানিক তা আজও জানে না। এ পোকা যেখানে পাবেন, জানবেন জ্যাকব সেখানেই তার চরম শয়তানি ষড়যন্ত্র পাকিয়ে তুলছে।

কিন্তু জ্যাকবের সন্ধান পেলেই বা করব কী?

আমার হাতে ছোট একটা বন্ধ কাঁচের শিশি আর একটা কাগজ দিয়ে ভরনফ বললেন, কী করবেন, এই কাগজে লেখা আছে। আজ দশ বছর পরে জ্যাকবের পৈশাচিক চক্রান্ত ব্যর্থ করবার এই অস্ত্র আমি অনেক কষ্টে আবিষ্কার করেছি।

ঘনাদা চুপ করলেন। গৌর জিজ্ঞাসা করলে, তারপর! জ্যাকবের খোঁজ আর পেলেন না বুঝি?

না, পেলাম বইকী! না পেলে কর্সিকাতে তিন হাজার টন মরা পোকা জমল কী করে?

শিবু অধৈর্যের সঙ্গে বললে, আহা, খুলেই বলুন না একটু!

ঘনাদা একটু বিজয়-গর্বের হাসি হেসে বললেন, সমস্ত আফ্রিকা ঘুরে বার-এল-আরব নদীর ধারে পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা মানুষ ডিঙ্কাদের দেশে তখন এসেছি। পকেটে সেই পোকার কৌটো তখনও আছে, কিন্তু মনে কোনও আশা নেই জ্যাকবকে খুঁজে পাবার। সাতফুট লম্বা আমার ডিঙ্কামাঝির সঙ্গে তার সালতির চেয়ে সরু লম্বা ডিঙিতে সেদিন জলার মধ্যে কুমির শিকারে গেছি। হঠাৎ তীরের ঝোপ থেকে একটা পোকা ঠিক আমার কোলের ওপরে এসে পড়ল। ছুঁড়ে ফেলে দিতে গিয়ে হঠাৎ চমকে গেলাম। কৌটোটা পকেট থেকে বার করে মরা পোকাটা তার পাশে ধরে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম একেবারে। সেই সিস্টোসার্কা গ্রিগেরিয়া।

তারপর জলা-জঙ্গল তোলপাড় করে জ্যাকবের আস্তানা খুঁজে বার করতে দেরি হল না। লোকটা তখন সত্যিই উন্মাদ হয়ে গেছে। তার সর্বনাশা পরিকল্পনার তোড়জোড় প্রায় শেষ।

পরিচয় দিয়ে আলাপ করবার পর আমার কাছে খোলাখুলি ভাবেই তিনি তখন সব কথা বললেন! দুদিন পরে ইউরোপের আকাশ কী করে অন্ধকার হয়ে যাবে সিস্টোসার্কা গ্রিগেরিয়ার ঝাঁকে বলতে বলতে তাঁর চোখ জ্বলে উঠল। গত পনেরো বছরের সাধনায় এমন অদ্ভুত পরিবর্তন তিনি তাদের জীবনধারায় নাকি করেছেন যে, কোথা থেকে ছাড়লে কতদূর পর্যন্ত গিয়ে তারা মাঠ-ঘাট শ্মশান করে দেবার জন্যে নামবে, তিনি তা বলে দিতে পারেন।

তাঁর প্রথম লক্ষ্য ইটালি। দুদিন পরেই ছ হাজার বর্গমাইল ব্যাপী এক ঝাঁক পোকা তিনি উড়িয়ে দেবেন ইটালিতে। তারপর একটা শ্যাওলার ছোপও কোথাও থাকবে না। ইটালির পর জার্মানি ও ইংল্যান্ডে কী ভাবে তিনি তাঁর অজেয় বাহিনী পাঠাবেন, সব নাকি তাঁর ছকবাঁধা আছে। আফ্রিকার এই অঞ্চলে সিস্টোসার্কা গ্রিগেরিয়ার জন্মস্থান খুঁজে বার করে তিনি এমনভাবে তাদের সংখ্যা বাড়িয়ে নিজের পরিকল্পনামাফিক তৈরি করেছেন যে, ইউরোপ দশ বছর সমস্ত অস্ত্র দিয়ে যুঝেও তাদের শেষ করতে পারবে না।

দুদিন বাদে সেই পতঙ্গের ঝাঁক সত্যিই উড়তে দেখলাম। সুডান থেকে লিবিয়া টিউনিসিয়ার আকাশ যেন রাতের মতো অন্ধকার হয়ে গেল। কিন্তু এ পতঙ্গের ঝাঁক। তবু ইটালি পর্যন্ত পৌঁছোল না। অর্ধেক মরল লিবিয়ার মরুতে, আর বাকি অর্ধেক কর্সিকার সমুদ্রের ওপর ঝরা-পাতার মতো মরে ঝরে পড়ল। সেই মরা পোকার ওজনই তিন হাজার টন।

কিন্তু তারা মরল কেন? জিজ্ঞাসা করলে শিশির। মরল ভরন যে বন্ধ শিশিটি দিয়েছিলেন তার দরুন। তার ভেতর এমন একটি রোগের জীবাণু ছিল যা সিস্টোসার্কা গ্রিগেরিয়ার যম। দুদিন আগে একটি পতঙ্গের মধ্যে সেই বিষ আমি ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম একটা ছুঁচ দিয়ে। সেই রোগ তারপর সংক্রামক হয়ে সমস্ত পতঙ্গ বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়!

ও, সিস্টোসার্কা গ্রিগেরিয়া তা হলে পঙ্গপাল! বললে শিবু। কিন্তু সে পঙ্গপাল তো শেষ হয়ে গেছে, তা হলে আজ আপনার একটা পোকায় অত ভয় কীসের?

অবজ্ঞার হাসি হেসে ঘনাদা বললেন, সিস্টোসার্কা গ্রিগেরিয়া শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু জ্যাকব রথস্টাইন তো হয়নি। পৃথিবীর কোন প্রান্তে বসে সে আবার কোন শয়তানি ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে কে জানে? হয়তো ওই পোকাটাই তার অগ্রদূত!