৫. বিকেলবেলা চায়ের টেবিলে

বিকেলবেলা চায়ের টেবিলে শিবেন আবার দেখা পেল সুজিতের। সে জিজ্ঞেস করে জানল, সুনীতার পোর্ট্রেট স্কেচ-এর ব্যাপারটা কী। রঞ্জনের বিষয়েও সে মোটামুটি সুজিতকে জিজ্ঞেস করে জানল, কী কী কথাবার্তা তাদের মধ্যে হয়েছিল। এবং এ কথাও সে শিবেনকে জানাল যে, সে রঞ্জনকে ভালবেসে ফেলেছে।

শিবেন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তাই নাকি? শেষপর্যন্ত একটা গুণ্ডাকে ভালবাসা? কালাচাঁদের মতো ঘুষি খাবার ইচ্ছে হয়েছে বুঝি?

সুজিত আপন মনেই বলল, রঞ্জন ঠিক পশুর মতোই খেপে যায় যেন।

 শিবেন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সুজিত যেন এ সময়েই হঠাৎ বিষম খেয়ে বলে উঠল, ওহো, এ কথাটা তো সুনীতাকে বলা হল না।

–সুনীতাকে?নামটা উচ্চারণ করে শিবেনের প্রায় দমবন্ধ হয়ে এল। বলল, সুনীতার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে নাকি আবার? কবে গেছলেন ওর বাড়িতে, কখন?

সুজিত বলল, আমি তো ওর বাড়ি চিনি না। ও-ই এসেছিল এখানে।

এখানে? এখানে, মানে এ বাড়িতে?

–হ্যাঁ, আপনারা বেরিয়ে যাবার পরেই তো এসেছিল।

শিবেনের কিছুক্ষণ বাক্যস্ফুরণ হল না। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুজিতের দিকে তাকাল। যেন সে মিথ্যা বলছে কি না, সেটা যাচাই করতে চায়। জিজ্ঞেস করল, কার কাছে এসেছিল?

–আমার কাছেই এসেছিল, সেইরকমই বলল, দীপুর কাছে সেই স্কেচটা পেয়ে সে না এসে পারেনি।

সুজিতের মনে হল, শিবেনের চোখ দুটি ধকধক করে জ্বলছে। সুজিত সংকুচিত করুণ হেসে জিজ্ঞেস করল, আমার ওপর রাগ হচ্ছে, না?

শিবেন সহসা উঠে দাঁড়াল, তীব্র স্বরে জিজ্ঞেস করল, কেন, আপনার ওপর আমার রাগ হবে কেন?

সুজিত বলল, আপনার মুখ-চোখ দেখে যেন কী রকম লাগছে। আমি কি কোনও অন্যায় করেছি?

শিবেন স্তব্ধ, যেন ক্রুদ্ধ বিস্ময়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, আমি আপনাকে ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি শয়তান না মূর্খ ঠিক আন্দাজ করতে পারছি না।

 সুজিত বিষঃ হেসে চুপ করে রইল। শিবেন তবু সুজিতকে সহসা ছাড়তে পারল না। জিজ্ঞেস করল, আর কী বলল সুনীতা?

–অনেক কথা। বলল, ও নষ্ট, ভ্রষ্ট। ভাল কোনও কিছুকেই আর বিশ্বাস করতে পারে না। আর আটাশে মার্চ আমাকেও নিমন্ত্রণ করল।

–তাই নাকি?

–হ্যাঁ, ওইদিন নাকি পাঁজিতে পাকা দেখার তারিখ আছে, তাই ওই দিনই ও সব ঠিক বলবে।

পাকা দেখা? বলে শিবেন হো হো করে হেসে উঠল। আবার বলল, আপনাকেও যেতে বলল?

আবার হেসে উঠল, এবং সুজিতের পিঠ চাপড়ে সে বেরিয়ে গেল। তারপরেই এলেন ভুজঙ্গভূষণ। জানালেন, সুজিতের একশো টাকা সবই প্রায় ফুকে দিয়েছেন, এখন আর মাত্র দশ টাকা পড়ে আছে। সুজিত খুব অসহায়ভাবে জানাল, তার কাছে আর টাকা নেই। শুনে ভুজঙ্গভূষণ যেন ব্যথিত বিস্ময়ে জানালেন, সুজিতের কথা শুনে মদ খেতেই নাকি ওঁর লজ্জা করছে।

তারপর সকালবেলা প্রিয়নাথ ও বীরেন্দ্র সবাই কে কী বললেন, সব শুনতে চাইলেন। শোনার পরে একটা ভয়ংকর ইঙ্গিতমূলক কথা তিনি হাসতে হাসতে বললেন। বললেন, আসলে কী জান, ওই বজ্জাত শয়তান মেয়েটাকে শিবেনের সঙ্গে যদি ওরা বিয়ে দিতে পারে, তা হলে মেয়েটা ওদের দখলেইথাকে। মানে বুঝলে না, মধুর ভাণ্ডটা তোমার ঘরে রেখে, আমরা এসে খেয়ে যাব। সুজিতের কান দুটি যেন পুড়ে গেল এ কথায়। সুনীতা ওঁর কাছে কোনও মতেই ভাল হতে পারে না, এটা প্রায় কুসংস্কারের মতো, কিন্তু আর যা বললেন, সেটা একেবারে মিথ্যে ভেবে উড়িয়ে দিতে পারল না সে। কোথায় যেন এর মধ্যে একটা সত্যের ছোঁয়াচ আছে।

.

ইতিমধ্যে টেলিফোনে দোলার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে, দোলা তাকে ডেকে পাঠাল। পর পর দুদিন সুজিত রায়চৌধুরীদের বাড়িতে গেল। কিরণময়ী তাকে ভাল করে খাওয়ালেন, অনেক কথা শুনলেন। এমনকী, সুনীতার বিষয়েও সব কথা। দোলা প্রথমটা একেবারেই থমকে গিয়েছিল, যখন সে শুনল, সুনীতা এসেছিল তার কাছে। নানানভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে হেসে সে সুনীতার কথা সুজিতকে বলেছে। দু-একবার রাগ করে, কিছুক্ষণের জন্যে কথা বন্ধ করে দিয়েছে, কাছ থেকে উঠে চলে গিয়েছে। আবার ফিরে এসেছে, কথা বলেছে, খিলখিল করে হেসেছে। ক্ষণে ক্ষণে তার নানান পরিবর্তন। মাঝে মাঝে সুজিত বিব্রত হয়ে পড়ে, দোলাকে বুঝে উঠতে পারে না। দোলা তাকে বিস্মিতও করেছে, তার শিক্ষা এবং বিদ্যা দিয়ে। দোলা যে শুধু বুদ্ধিমতী নয়, বিদুষীও, সেটাও সে অনুভব করেছে। দোলা তাকে অনেক গল্প বলেছে নানান বিষয়ে। দেশ বিদেশ ইতিহাস সাহিত্য, অনেক বিষয়ে দোলার সম্যক জ্ঞান তাকে মুগ্ধ করেছে, একই সঙ্গে দোলার, এই সংসারের সকল মালিন্যের বাইরে সুখী পবিত্র জীবনটা তাকে আকর্ষণ করে। দোলার সবথেকে বড় গুণ, ও যে বিরাট ঐশ্বর্যের মধ্যে লালিত হচ্ছে, এ বিষয়ে যেন ওর কোনও ধারণা নেই, কোনও চেতনা নেই। অথচ বীরেন্দ্র রায়চৌধুরীর মেয়ের এটা থাকাই স্বাভাবিক ছিল। ওর শুধু অবাক লাগে, সুনীতা সম্পর্কে সুজিতের কৌতূহল, আবেগ, সুনীতাকে ভাল, দুঃখী, অসহায় বলে ভাবা। তখন যেন দোলারও মনে হয়, সুজিতের মস্তিষ্ক অপরিণত, সে নির্বোধ। অথচ সুজিতকে এই মনে করে শান্তি পায় না। সুজিতও তাকে ব্যাখ্যা করে ঠিক বোঝাতে পারে না।

দ্বিতীয় দিন বিদায় দেবার সময় দোলা নীচে নেমে এসে একটা আশ্চর্য কথা বলল। বলল, আপনি সত্যি সরল, শিশুর মতো। শিশুরা সুন্দর, কিন্তু একটা কথা জানেন তো, অনেক সময় অবুঝ শিশুরা বড় নিষ্ঠুর!

সুজিত হেসে উঠে বলল, ঠিক ঠিক, সত্যি বলেছ। শিশু মাত্রেই অবুঝ আর দায়িত্বহীন, ওরা তো– কিন্তু, কিন্তু

বলতে বলতে সে অবাক হয়ে দোলাকে জিজ্ঞেস করতে গেল, দোলা তাকে কেন এ কথা বলল। ততক্ষণে দোলা ওপরে চলে গিয়েছে, এবং একটা শব্দ পেল সে, ওপরের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। ইতিমধ্যে বীরেন্দ্রনারায়ণের কানে গিয়েছিল, শিবেনদের বাড়িতে সুনীতা এসেছিল সুজিতের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি ফোনে ডেকেছিলেন সুজিতকে, জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন, কেন এসেছিল, কী কথাবার্তা হয়েছে। তিনি শুধু অবাক হননি, মাথামুণ্ডু কিছুই নাকি বুঝতে পারছেন না। কলকাতায় এত লোক থাকতে সুনীতা তার মতো একটা বোকা, মানে যাকে বলে অপরিণত মস্তিষ্কের ছেলের সঙ্গে এত কথা বলতে যাচ্ছে কেন। সুজিত জানিয়েছে, সেটা সে সব ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছে না। বীরেন্দ্র বিস্মিত ও বিরক্ত হয়ে ফোন ছেড়ে দিয়েছেন।

এদিকে, দীপু সেই যে বাড়ির ভিতরে চলে গিয়েছিল, তারপর থেকে খুব সন্তর্পণে সুজিতকে এড়িয়ে চলেছে। সে কখন স্কুলে যাচ্ছে, বাড়ি আসছে, কিছুই টের পাওয়া যাচ্ছে না। দু-একবার যদি বা মুখোমুখি দেখা হয়ে গিয়েছে, দীপু কথা না বলেই পালাতে চেয়েছে। সুজিত দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করেছে, জবাব পেয়েছে কাটা কাটা বিচ্ছিন্ন। অথচ সুজিত লক্ষ করেছে, দীপু তাকে দূর থেকে লুকিয়ে দেখে। সে যখন হাঁটতে হাঁটতে মল্লিক বাজারের কবরস্থান আরও পেরিয়ে ল্যান্সডাউনের দিকে বেড়াতে যায়, তখন সে ছায়ার মতো অনুসরণ করে। তবু কাছে আসবে না। একটা বিষয় সুজিত আবিষ্কার করেছে, তার সুনীতাদির সম্পর্কে যারাই উৎসাহী, তারা সবাই মন্দ, সবাই ফেরেব্বাজ। শুধু তাই নয়, এই বয়ঃসন্ধিক্ষণের দীপুর মনে কোথায় একটা ঈর্ষাবোধও আছে ওর সুনীতাদির জন্যে। সুনীতার কাছে। প্রবেশাধিকার দিতে কাউকেই রাজি নয় সে। এই কথাটা ভাবতে সুজিতের ভাল লাগে। এই ঈর্ষার মধ্যে একটা সৌন্দর্য আছে।

আটাশে মার্চের এখনও দিন ছয়-সাতেক দেরি আছে। এই দিনটার কথা বারে বারে ঘুরে ফিরে সুজিতের মনে আসে। একটি যন্ত্রণাদগ্ধ অসহায় প্রাণকে সে প্রতি মুহূর্তে পীড়িত হতে দেখছে যেন, এবং তাকে নিজের বাহুডোরের মধ্যে নিয়ে একটু স্নেহ করতে ইচ্ছে করে। যেমন বাসা-ছাড়া একটি পক্ষীশাবককে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে ইচ্ছে করে। তারপর সে নিজের দিকে তাকিয়ে ভাবে, আমার ওপরে মানুষ কতটুকুই বা ভরসা করতে পারে।

এই সব ভাবনা সে যেদিন ভাবছিল, সেইদিনই প্রাক্-সন্ধ্যায়, উত্তরের খোলা জানালা দিয়ে উঠোনের ওপর মানুষের চলমান জীবনের নানান ছবি দেখছিল। সেই সময়, হঠাৎ তার গায়ে একটি কাগজের টুকরো এসে পড়ল। পিছন ফিরে সে কাউকে দেখতে পেল না। কোলের ওপর দেখল একটি চিরকুট। নিয়ে সে পড়তে লাগল। যদিও কোনও সম্বোধন ছিল না। তাতে লেখা ছিল, তুমি কে, তা বুঝতে পারছি না। তুমি কোথা থেকে এলে, তাও বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে যেন, সেদিন ট্রেনে, তোমার কামরায়, আমার নিয়তিই আমার হাত ধরে তুলে দিয়ে এসেছিল। আমি সব দেখেছি, সেই যে আমার অহংকার, তুমি তা ভেঙে দিলে। কিন্তু সবই হয়েছিল, সে কথা ঠিক, কেবল তুমি বাকি ছিলে। কিন্তু তুমি আমার ভেসে যাওয়া স্রোতের বুকে এমন এক বাধার সৃষ্টি করলে, এখন আমি তাতে যন্ত্রণা বোধ করছি। পৃথিবীর সহজতম, সরলতম মানুষ তুমি, এই কুটিল রাজ্যে কোন সাহসে এসে ঢুকলে, কোন সাহসে অকপট সত্যি কথা বলতে এসেছ জানি না। সম্ভবত এই সুনীতাকে পূর্ণ করতেই তোমার আবির্ভাব। কিন্তু তা বোধ হয় হবে না। পূর্ণতার যে ইঙ্গিত দেখেছি তোমার চোখে, সেই দেখাই বোধ হয় আমার জীবনের শেষ পাওনা। তুমি পালাও, তুমি পালাও। কিন্তু আটাশে মার্চের আগে নয়, আমার পাকা দেখার নিমন্ত্রণটা রেখে যেয়ো। তুমি কেন এসেছ এই যুগের এই শহরে! তোমরা যে কেউ কারুর যোগ্য নও। জীবনে আমার যা অনুভব করা বাকি ছিল, যে অনুভূতি না হলে, মরণেও শান্তি ছিল না, তাই দেখেছি, পুঞ্জীভূত তোমার চোখে। এই দেখার পরে, আমি ব্যাকুল হয়ে উঠছি, পাগল হয়ে উঠছি, সুখের কষ্টে মরে যাচ্ছি। মনে মনে তোমার কাছেই ছুটে যাচ্ছি। তুমি পালাও, নইলে আমার লোভ যে তোমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলবে। নীচে কোনও ইতি নেই। চিরকুটটি পড়েই সুজিত পিছনে ফিরল, দেখল দীপু তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুজিত জিজ্ঞেস করল, তুমি গেছলে বুঝি?

দীপু বলল, আমি তো রোজই যাই।

তাই নাকি? বলনি তো? তুমি এই চিরকুট পড়েছ?

 –পড়েছি। পরিষ্কার এবং সহজ জবাব দিল দীপু। আবার আপনি সত্যি চলে যাবেন?

–কোথায়?

–ওই যে সুনীতাদি আপনাকে পালাতে বলেছে?

–কেন পালাতে বলেছে, তুমি বুঝতে পেরেছ?

না, সুনীতাদির কথা আমি সব বুঝতে পারি না।

সুজিত একটু হেসে বলল, আমি চলে গেলে তুমি খুশি হও?

দীপু সহসা জবাব দিল না। একবার মুখ নামাল, আবার মুখ তুলে বলল, না।

-কেন? তুমি তো আর আমার কাছে আসতে চাও না, কথা বলতে চাও না।

দীপু বলল, প্রথমে ভেবেছিলাম, আপনিও দাদাদের মতো খারাপ লোক। এখন আর মনে হয় না। বলেই দীপু হঠাৎ কাছে এসে বলল, সুনীতাদি খালি আপনার কথা বলে কেন বলুন তো?

-তোমার হিংসে হয়?

–এখন আর হয় না।

–কেন?

–সুনীতাদি বলে, তুই, তোর সুজিতদা, তোরা সব এক।

 সুজিত দীপুকে কাছে টেনে নিল। বলল, তোমার সুনীতাদিকে বোলো, সুজিতদা পালাবার কথা ভাবে না।

.

এর দিন দুয়েক পরে সুজিত দোলাদের বাড়ি গিয়ে ওর একটা পোর্ট্রেট স্কেচ করে দিল। দোলা একবার কেবল জিজ্ঞেস করেছিল, না দেখে ওর মুখটা সুজিত আঁকতে পারল না কেন। সুজিত বলেছে, চেনা লোক, এবং কাছেই যখন আছে, তখন শুধু শুধু অদর্শনে একলা বসে কেন আঁকবে। মোটের ওপর দোলা খুব খুশি হয়েছে। তৃতীয় দিনে, শনিবারে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। শনিবারে সকালবেলা, শিবেন অফিসে বেরিয়ে যাবার পর পিয়ন এসে একটা ডাকের চিঠি দিল সুজিতকে। সোনালি রঙে লেখা একখানি কার্ড ছিল খামের মধ্যে। মোটামুটি যতটা পড়তে পারে, তাতে সুজিত বুঝল, আজ সন্ধ্যায় ক্যালকাটা ওয়েস্টার্ন ক্লাবে একটা পার্টি আছে, এবং সেখানে তার নিমন্ত্রণ। ব্যাপারটা মোটেই তার বোধগম্য হল না। নামটা পরিষ্কারই লেখা ছিল, মিঃ সুজিতনাথ মিত্র। খামের ওপরে, কেয়ার অফ শিবেন রায়। সে প্রথমে দীপুকে বলল। দীপুর ধারণা, বীরেন্দ্র রায়চৌধুরী এ সব করেছে, সুজিতকে সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে চায়। দীপু কার্ডটা পড়ে আরও ব্যাখ্যা করেছে, ডিনার ও ককটেল ব্যাপারটা কী। দীপু খুব গম্ভীরভাবে বুঝিয়েছে, ককটেল মানে মদ এক রকমের। সুজিত যেন না খায়।

বিকেলে শিবেনকে বেশ খুশি ও ব্যস্ত দেখা গেল। আগের থেকেই ঘোষিত ছিল, আজ বাইরে নিমন্ত্রণ। সে সান্ধ্যকালীন স্যুটে নিজেকে সাজিয়ে, বিকেলে যখন বাইরের ঘরে এল, সুজিত তখন তাকে নিমন্ত্রণের কার্ডটা দেখাল। শিবেন বিস্ময়ে হতবাক। প্রায় চেঁচিয়ে উঠল সে, ওয়েস্টার্ন ক্লাবে আপনার নিমন্ত্রণ? এর মানে কী?

–মানে তো আমিও জানি না। এটা ডাকে এসেছে।

শিবেন ঠোঁট কামড়ে, কুঁচকে বলল, আশ্চর্য! মিঃ রায়চৌধুরীর ব্যাপার কী? বলেই সে ফোন তুলে ডায়াল করল। কথা বলল, আমি শিবেন, কাকাবাবু। সুজিতেরও দেখছি ওয়েস্টার্ন-এ নিমন্ত্রণ। আপনি কিছু জানেন না? তবে? এ তো আশ্চর্য! আপনি কী বলেন? ও যাবে? ওর যদি ইচ্ছে হয়? আচ্ছা। হ্যাঁ, পোশাক তো ওর নেই, দেখি ও কী বলে। আজ্ঞে হ্যাঁ, গাড়ি এলেই আমি চলে যাব।

ফোনটা ছেড়ে দিয়ে সে আবার সুজিতের মুখোমুখি হল। বলল, আপনি যেতে চান পার্টিতে?

সুজিত ঘাড় কাত করে বলল, হ্যাঁ।

–কিন্তু কী পরে যাবেন? আপনার তো কিছুই নেই। আর আমার তো সবই আপনার বেমানান হবে। দেখবেন একবার ট্রাই করে?

সুজিত সম্মতি দিল। শিবেন তাকে তার একজোড়া স্যুট পরিয়ে দিল, দিয়ে হো হো করে হাসতে লাগল। বলল, খুলে ফেলুন, বিশ্রী দেখাচ্ছে।

সুজিত নিজেকে আয়নায় দেখে বলল, একটু বেশি ঢলঢলে লাগছে, আর তো কিছু খারাপ লাগছে না। ভালই তো দেখাচ্ছে আমাকে।

শিবেন হাসতে হাসতে বলল, আপনার অস্বস্তি হচ্ছে না তো? আপনি পারবেন যেতে এভাবে?

সুজিত বলল, তাতে কী হয়েছে। পোশাক তো লজ্জা নিবারণের জন্যে। দেখতে একটু অন্যরকম লাগছে, কিন্তু আমার কিছু খারাপ মনে হচ্ছে না।

শিবেন এক মুহূর্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে আবার হো হো করে হাসতে লাগল। বলল, সত্যি, আপনি–আপনি আপনাকে কিছু বলার নেই। চলুন দেখি, গাড়ি এসেছে নাকি।

বেরোবার সময় ভুজঙ্গভূষণ তাকে দেখে ঊনবিংশ শতাব্দীর পোশাকের বিষয় একটা বক্তৃতা দিয়ে দিল। দীপু চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে রইল। শিবেন কিন্তু বেশ খুশি।

.

জীবনে এই প্রথম পার্টিতে আসা। ক্লাবের গেটে দরোয়ান প্রথমেই তাকে বাধা দেবে কি না ভাবছিল। নিমন্ত্রিতদের হলে, সবাই হাঁ করে তাকিয়ে দেখতে লাগল। তাতে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলেও সে সকলের দিকেই তাকিয়ে, অমায়িক ভাবে হাসতে লাগল। মহিলারা তাকে দেখে কানাকানি করছিল। হাসাহাসি করছিল। সকলেই তার অচেনা। বীরেন্দ্রনারায়ণ এসে তাকে দেখেই রেগে বারুদ। কিন্তু কিছু করবার ছিল না। শিবেনকে বললেন, এ অবস্থায় একে না আনাই উচিত ছিল, তাতে ওর আসার যতই ইচ্ছে থাকুক। তবু তিনি কারুর কারুর সঙ্গে ওর আলাপ করিয়ে দিলেন। ওর বাবার নাম, অতীন্দ্রনাথ মিত্রের নামটা অনেকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। কুবের সিং, অরূপ দত্তদের সঙ্গে আলাপ হল, এবং আলাপ হওয়ামাত্রই সুজিত বলল, আপনাদের নাম শুনেছি। তারা অবাক হয়ে যখন জানতে চাইল, কোথায় শুনেছে, তখন সে বলল, সুনীতার বন্ধু তো আপনারা, সেই সূত্রেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুজিতের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তারা হাসিতে ফেটে পড়ল। তাকে নানান রকমের প্রশ্ন করে, সুজিতের জবাব ও তার ভাব-ভঙ্গি দেখে, একটা রীতিমতো হই-হুঁল্লোড় লাগিয়ে দিল। বেয়ারা ঘুরছিল ট্রেতে করে ককটেলের পাত্র নিয়ে। সুজিত দেখল, সবাই একটি একটি করে গ্লাস নিয়েছে। সে জানতে চাইল, এটা মদ কি না। তাই নিয়ে আবার হাসির ফোয়ারা ছুটল। এবং তাকে পান করবার জন্যে অনেকেই উৎসাহিত করতে লাগল। সে বলল, মদ সে কখনও খায়নি, এবং দীপু তাকে বারণ করেছে। আবার হাসির রোল পড়ল।

ঠিক এসময়েই, সমস্ত হলটা যেন স্তব্ধ হয়ে গেল, সবাই প্রবেশদরজার দিকে ফিরে তাকাল। সুজিত দেখল, সুনীতা ঢুকছে, তার সঙ্গে দু-একটি মেয়ে। অদ্ভুত তাদের সাজ-সজ্জা। বিচিত্র তাদের চুল বিন্যাসের ভঙ্গি। অধিকাংশ উপস্থিত মহিলাদের পোশাক-আশাক অদ্ভুত দেখতে হয়েছিল। তবে রূপের মধ্যে সুনীতাই যেন সুন্দরীশ্রেষ্ঠা। একজন স্কুল টাকমাথা লোক সুনীতাকে অভ্যর্থনা করল। কুবের সিং, অরূপ দত্ত আর শিবেন, সবাই সুনীতার কাছাকাছি চলে গেল। এতক্ষণ সুজিতকে নিয়ে যারা মজা করছিল, সুজিত তাদের কাউকেই আর তার পাশে দেখতে পেল না। এবং একটা আশ্চর্য ব্যাপার সে লক্ষ করল, মহিলারা কেউ গিয়ে সুনীতাকে অভ্যর্থনা করল না, অথচ অন্যান্য মহিলাদের, মহিলারা সকলেই অভ্যর্থনা করে, কাছে ডেকে কথাবার্তা বলেছিলেন। এখন অধিকাংশ মহিলারই ঠোঁট বেঁকে গেল, কপালে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠল, কেউ কেউ বিদ্রূপ করে জোরে হেসে উঠলেন। অনেক ভদ্রলোককেও দেখা গেল, তাঁরা সুনীতার ত্রিসীমানা থেকে সরে গেলেন। দু-একজন সুজিতের আশেপাশেই গুনগুন করে বলতে লাগল, সুনীতা নাগ নয়, নাগিনী। কেউ বলল, নাগরী। কেউ ভলাপচুয়াস। কথাটার মানে মোটামুটি জানা ছিল সুজিতের, স্বেচ্ছাচারিণী। আরও এমন সব আলোচনা করতে লাগল, সুজিতের শুনতে কষ্ট হচ্ছিল। সুনীতার জন্যে মনটা তার বিষণ্ণ হয়ে উঠল, করুণ হয়ে উঠল, এবং শেষপর্যন্ত পাশ থেকে একজন রুচিহীন ইঙ্গিত করায় সে হেসে বলল, না, আপনি যা বলছেন, ও তা নয়। ও প্রিয়নাথ দাশকে ব্ল্যাকমেল করছে না, প্রিয়নাথ দাশই বরং ওকে একদিক থেকে ব্ল্যাকমেল করেছে।

এ নিয়ে দু-একটা কথাকাটাকাটি হতেই, ব্যাপারটা হাসিতে পর্যবসিত হল। সুজিত সহসা চোখ তুলে দেখল, সুনীতা তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চোখাচোখি হতেই, সুনীতা কাছে এল, এবং সুজিতকে আপাদমস্তক দেখে বলে উঠল, একী, এ সব কী পরে এসেছ তুমি?

সুজিত বলল, শিবেনবাবুরটা পরে এসেছি।

সুনীতা হাসি সামলাতে পারল না। তার সঙ্গে বাকিরাও হেসে উঠল। শিবেন বলে উঠল সুনীতাকে, এ হাসির আনন্দটুকুর জন্যে ধন্যবাদ কিন্তু আমারই প্রাপ্য সুনীতা।

সুনীতা বলল, তাই নাকি? তার ঠোঁট বেঁকে উঠল। সে সুজিতকে বলল, তোমার যা পোশাক ছিল, তাই পরে এলে না কেন?

সুজিত বলল, সেগুলো সব ময়লা। কিন্তু আমার কিছু মনে হচ্ছে না।

আবার সবাই হেসে উঠল। সুনীতা হাসল না। সে সুজিতের চোখের দিকে তাকাল। তাদের দুজনের ঘনিষ্ঠ সম্বোধন ও কথাবার্তায় অনেকেই অবাক হয়েছিল। শিবেন যতই হাসুক, তার চোখে বিক্ষোভ ও ঈর্ষার রক্তাভা। কুবের সিং, অরূপ দত্ত এবং আরও অনেকেরই সেই অবস্থা। বিস্ময় এবং ঈর্ষা তাদের চোখে। কে একজন বলে উঠল, উদ্ধবটি কে? সুনীতা নাগের নিউ পিকআপ নাকি?

সুনীতার মুখ লাল হল, সাপিনীর মতো ফণা তুলে সে ঘাড় ফেরাল। আরও কয়েকজন তার সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে তাকাল। সুনীতা বলে উঠল, ঠিক তাই, ও আমার লাস্ট পিকআপ, কারণ ও জানোয়ার নয়, মানুষ।

একটা অস্বস্তিদায়ক স্তব্ধতা নেমে এল এই গুচ্ছটিকে ঘিরে। বীরেন্দ্র এসে কথাবার্তা বলে আবহাওয়াটা সহজ করে দিলেন, ইতিমধ্যে বেয়ারা কটেলের ট্রে নিয়ে সুনীতার সামনে এগিয়ে এল। সুনীতা চকিতে এক বার সুজিতের দিকে তাকাল। তারপর হাত নেড়ে দিল প্রত্যাখ্যান করে।…হঠাৎ এক সময়ে সুজিত আবিষ্কার করল, তার পাশেই রঞ্জনও রয়েছে। রঞ্জনের সেই ভাবলেশহীন কঠিন মুখ, কিন্তু তার দু চোখ ভরা বিস্ময়। এক হাতে মদের পাত্র। সুজিত খুশি হয়ে তার একটি হাত ধরে বলল, তুমি কখন এলে?

রঞ্জন বলল, অনেকক্ষণ।

বলেও সে সহসা চোখ নামাল না। এবং সুজিতের হাত ধরার মধ্যে তার কোনও আবেগ প্রকাশ পেল না। নিচু গম্ভীর স্বরে সে বলল, তোমার সঙ্গে সুনীতার এত ভাব, তা তো তুমি বলনি!

সুজিত হেসে বলল, হ্যাঁ, তারপরে ওর সঙ্গে দেখা হয়ে, আমার খুবই ভাব হয়ে গেছে।

 রঞ্জন বিস্মিত তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল সুজিতের দিকে। বলল, ভাব হয়ে গেছে?

সুজিত,অম্লান হেসে বলল, হ্যাঁ, আমরা বোধ হয় পরস্পরকে বুঝি।

কী বোঝ?

–ও একটি দুঃখী মেয়ে, একটু শান্তি আর ভালবাসার প্রয়োজন ওর।

 –আর তাই কি তুমি ওকে দিতে চাও?

–আমি ওকে তা দিতে পারব কি না বুঝি না, ও নিতে চায় কি না, তাও জানি না। আমি দেখলাম, ও খুব অসম্মানিতা। ওকে সবাই ঘৃণা করে। আমার কষ্ট হচ্ছে ওকে দেখে।

রঞ্জন বলল, কিন্তু ওকে আমি এ সব কিছু থেকেই সরিয়ে নিয়ে যাব।

দৃঢ়তার সঙ্গে এই কথা বলেই, হঠাৎ রঞ্জন ক্ষিপ্ত বাইসনের মতো অন্যদিকে মুখ ফেরাল, এবং শিবেনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, আমি শুনেছি তোমার কথা। তুমি আমাকে হুডলাম বলো আর ব্রুট বলো, সুনীতার ওপর থেকে তোমার হাত সরিয়ে নিতে হবে।

আবার একটা স্তব্ধতা নেমে এল, এবং সকলেই এইদিকে ফিরে তাকাল। সুজিত দেখল, সুনীতাও। বিস্ময়ে এবং অপমানে লাল হয়ে উঠেছে। শিবেন বলে উঠল, যুগটা সভ্য, আর এখানে কেউ ডুয়েল লড়তে আসেনি।

রঞ্জন বলে উঠল, ডুয়েল নিশ্চয়ই, অন্য কায়দায়, এই যা। কিন্তু তুমি যে তখন থেকে আমার সম্পর্কে যা তা বলে যাচ্ছ, আমি সবই শুনেছি।

শিবেন বলে উঠল, সেদিন তুমি অত্যন্ত জঘন্যভাবে আমাদের বাড়ি গেছলে, আমি সেই কথাই বলেছি।

–কিন্তু কেন গেছলাম, সে কথা বলিনি। এক লক্ষ টাকা পাবার জন্যেই তো তোমার যত লোভ, সেটা সবাইকে জানিয়ে দাও।

সুনীতা বসে ছিল, হঠাৎ উঠে দাঁড়াল! বলে উঠল, এ সবের মানে কী?

শিবেন ক্রুদ্ধ ঘৃণায় বলে উঠল, আমি টাকার লোভ করছি, তাতে তোমার কী?

–তাতে সুনীতার ক্ষতি, এবং আমারও ক্ষতি।

সুনীতা তাকিয়ে ছিল সুজিতের দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ সে হেসে উঠল। সে হাসি, মূৰ্হাগ্রস্তের মতো অস্বাভাবিক উন্মত্ত হাসি। সুজিতকে বলল, তুমি যেন কী বলছিলে সেদিন সব ভাল ভাল কথা? এখানে দেখ, কী রকম বেচা-কেনা হচ্ছে।

বীরেন্দ্র রঞ্জনকে লক্ষ্য করে বলে উঠলেন, ও যদি এক লক্ষ টাকা পায়, সেটা ক্ষতি কী? টাকার কি মূল্য কম?

রঞ্জন ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল, কিছুমাত্র না। একমাত্র প্রিয়নাথ দাশের টাকা বলেই ক্ষতি, কারণ এ বিয়েটাও একটা ব্যভিচার।

সুনীতা বলে উঠল, বাঃ বাঃ, কিন্তু আমি দেখতে চাই ডুয়েল ওরা দুজনেই লডুক।

সবাই থমকে গেল। রঞ্জন তাকাল তীক্ষ্ণ চোখে। শিবেন রাগের মধ্যেও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। রঞ্জন হঠাৎ হেসে উঠল, বলল, ডুয়েল লড়ব, কিন্তু টাকা দিয়ে। কত টাকা চাই তোমার শিবেন বলো? এক লক্ষের জায়গায় দেড় লাখ? দু লাখ? তিন লাখ?

শিবেনের মুখ ক্রমে সাদা হয়ে উঠতে লাগল। রঞ্জন বলল, আমি মিথ্যে কথা বলছি না। তুমি যাদের কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা নিয়ে এই বিয়ে করতে যাচ্ছ, আমি তোমাকে সেখানে তিন লাখ টাকা দেব। ভিক্ষে করে, লুঠ করে, যেখান থেকে পারি, ক্যাশ তিন লাখ টাকা। চেক নয়, দলিল নয়, করকরে নোট, তিন লক্ষ; রাজি? বলো, রাজি আছ?

সুনীতা বলে উঠল, ভিক্ষে করে আনবে তুমি, লুঠ করে আনবে তিন লাখ টাকা! আমি রাজি আছি, আটাশে মার্চে তুমি টাকা নিয়ে এসো আমার বাড়িতে। না আনতে পারলে আমি শিবেনকেই বিয়ে করব।

বীরেন্দ্র বলে উঠলেন, দ্যাটস্ রিয়্যাল স্পোর্টস।

চারদিক থেকেই হাততালি পড়ল। আর সুনীতার সেই ভয়ংকর হাসি হলের মধ্যে বাজছে। বাজনার শব্দ ছাপিয়ে তা শোনা যাচ্ছে। হাসতে হাসতে সুনীতা আবার চিৎকার করে উঠল, এই নিলামে যদি কেউ চার লাখ দিতে পারে তবে আমি তার। কে কিনবে আমাকে?…

কথা শেষ হবার আগেই সুজিতের দিকে তার চোখ পড়ল। সুনীতার হাসিটা সহসা যেন একটু থমকে গেল। আবার হেসে উঠতে যাচ্ছিল, সুজিতের অপলক চোখের দিকে তাকিয়ে, আবার থমকে গেল সে। সুজিত বলে উঠল, বাড়ি যাও সুনীতা।

সুনীতা সহসা মাথা নামাল, এবং ক্লান্তভাবে ওর সঙ্গের সেই দুটি মেয়ের একজনের কাঁধে হাত রাখল। তারপর আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আশেপাশের সবাই সুজিতের দিকে ফিরে তাকাল। শিবেন, রঞ্জনদের চোখে বিস্ময়ের অবধি নেই। সুজিত করুণভাবে হাসল সকলের দিকে তাকিয়ে। কে একজন বলে উঠল, কিছুই বোঝা গেল না। আর একজন বলল, ভভাজবাজি। বীরেন্দ্রনারায়ণ সুজিতকে একপাশে ডেকে বললেন, ব্যাপারটা কী বলো তো? ও তোমার কথা অমন করে শুনল কেন?

–ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল, আপনারা বুঝতে পারছিলেন না বোধ হয়, তাই ওকে আমি বাড়ি চলে যেতে বললাম।

–তুমি বললে, আর তাতেই চলে গেল?

–তাই তো দেখছি।

–কিন্তু কেন? তুমি–মানে–তোমার ব্যাপারটা কী?

 –আজ্ঞে, তা কী জানি।

বীরেন্দ্রনারায়ণ ভ্রুকুটি বিস্ময়ে উচ্চারণ করলেন, তুমি একটা, কী বলব, ইমপসিবল, ইম্পসিবল!

.

আটাশে মার্চ, বিকেল। সন্ধ্যা যতই আসন্ন হয়ে আসছে ততই সুজিতের বুকের ভিতরটা কী রকম করছে। এই কদিন সুনীতার কোনও খবর সে পায়নি। দীপু বার বার গিয়েছে, ফিরে এসে জানিয়েছে, সুনীতাদি বাড়ি নেই। দীপুর বিশ্বাস, সুনীতাদি বাড়িতেই আছে, দেখা করছে না, বোধ হয় খালি মদ খেয়ে পড়ে থাকছে। এই প্রথম সুজিতের মনে হচ্ছে, জীবনটা তার ঠিক পথে যাচ্ছে না। সম্ভবত সত্যি, সে ঠিক জায়গায় এসে পৌঁছয়নি। জীবন নিয়ে, স্নেহ ও প্রেমের অধিকার নিয়ে, এই আশ্চর্য বীভৎসতা সে চিন্তা করতে পারে না। ডক্টর ঘোষের কথা বারবার মনে হয়, মানুষ ঈশ্বর আর ভালবাসা, এই দুই বিষয়েই অত্যন্ত অনবহিত। সুনীতা আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে সৎ বলিষ্ঠ জীবনযাপনের চিন্তা করবার সাহসও লয় পেয়েছে। প্রিয়নাথের অপমানের শোধ তুলতে গিয়ে, নিজেকে সে এমন জায়গায় টেনে নিয়ে গেছে, সেই নরকের বাইরে আসার পথ সে আজ আর খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ বাইরে আসারই আকুতি ওর চোখে।

দীপুর সঙ্গে তার যাবার কথা সুনীতার বাড়িতে। ইতিমধ্যে দোলা তাকে টেলিফোন করেনি, বীরেন্দ্রনারায়ণও তাকে যাবার কথা বলেননি। উনি একদিন এসেছিলেন শিবেনের সঙ্গে। তাদের কথাবার্তা থেকে এইটুকু সংবাদ পেয়েছে, রঞ্জন তার অসুস্থ বাবার কাছে টাকা দাবি করেছিল, ওর বাবা দেননি শুধু নয়, বাড়িতে নাকি পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা পর্যন্ত করেছেন। যদিও রঞ্জন ওর বাবার একমাত্র ছেলে। ওর বাবার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। এখন রঞ্জন নাকি হুণ্ডি কাটার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যেই ওর নিজের গাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছে। কসবা না কোথায় একটা বাড়ি তার মাতামহের সম্পত্তি হিসেবে পেয়েছিল, সেটাও বিক্রি করে দিয়েছে। বাকি টাকার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কারণ এক লক্ষ টাকাও সংগ্রহ করতে পারেনি। এ সব কথা বীরেন্দ্র খুব উত্তেজিত উল্লাসেই বলেছেন। শিবেনের চোখ দুটিও জ্বলজ্বল করে উঠেছে।

ভুজঙ্গভূষণও সংবাদটা জানেন। তিনি এই নিয়ে সুজিতের সঙ্গে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলেছেন। সুজিতকে বলেছেন, জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ, লড়াইটা জমেছে ভাল। আচ্ছা ধরা যাক, বাঘ যদি রঞ্জন হয়, কুমিরটি তবে কে, তুমি বলতে পার?

সুজিত বলেছে, হ্যাঁ, শিবেনবাবু।

তুমি একটি উন্মুক।

আজ্ঞে?

–গর্দভ তুমি, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি। তবে শোনো, তোমাকে আমার জীবনের একটা অভিজ্ঞতা

সুজিত তাড়াতাড়ি বলেছে, কুমিরটা তবে কে, ওইটেই আগে বলুন।

–ও, তুমি ভাবছ, আমি মিথ্যে কথা বলতে যাচ্ছিলাম। যাক শোনো, এ ক্ষেত্রে কুমির হচ্ছে প্রিয়নাথ। প্রিয়নাথ টাকাটা কেন দিচ্ছে ওই মেয়েটাকে? না, যাতে সে জীবনে সেট করতে পারে। মেয়েদের সেট করা মানে কী? একটা বিয়ে, গুছিয়ে গাছিয়ে সংসার করা। এই তো? তা ছাড়া, প্রিয়নাথ বিশ্বম্ভর রায়ের মেয়েকে বিয়ে করবে, তাতে যেন মেয়েটা বাগড়া না দেয়, অথচ প্রিয়নাথেরা চায়, এমন একটা লোকের সঙ্গে মেয়েটার বিয়ে হোক, যাতে ও ওদের দখলে থাকে।

 সুজিত জিজ্ঞেস করেছে, আচ্ছা, এ দখলে রাখার মানেটা কী, বলতে পারেন?

-তুমি একটি বুন্ধু। বড়লোকেরা এই রকমই চায়, যা কিছু সুন্দর আর ভাল, তা তাদের দখলে থাক। ওই মেয়েটা রূপসী, যা শুনছি, সবদিকেই বেশ পোক্ত, এরকম একটা মেয়েকে নিজেদের দখলে রাখতে পারলে, বুঝতে পারছ না ব্যাপারটা? কিন্তু কী হবে তোমাকে বুঝিয়ে? টাকা তো নেই।

আজ্ঞে আছে, টাকা পাঁচেক আছে।

–তবে দিয়ে দাও তাড়াতাড়ি, খবরদার দীপু বা নয়নকে বোলো না যেন।

সুজিত ওর শেষ সম্বল যা ছিল, দিয়ে দিয়েছে। তারপরে ভেবেছে, ভুজঙ্গ ভুল বলেননি। হয়তো বাঘ কুমির ছাড়াও সিংহ-নেকড়েও অনেক আছে। তবু শেষপর্যন্ত এদের হিংস্র শিকার একমাত্র সুনীতা।

.

সন্ধ্যার একটু পরে দীপু সুনীতার বাড়ির কাছে পৌঁছে দিল সুজিতকে। রাস্তাটা ল্যান্সডাউন রোড।  সুজিতের একেবারে অচেনা নয়। শুধু বাড়িটাই সে চিনত না। সুজিত গিয়ে কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল একটি মেয়ে। এই মেয়েটিকে সে ওয়েস্টার্ন ক্লাবে সুনীতার সঙ্গে দেখেছিল। মেয়েটি তাকে দেখে, প্রথমে নাম জিজ্ঞেস করল, বাইরের ঘরে বসিয়ে ভিতরে গেল, তারপরে আবার ফিরে এসে ডেকে নিয়ে গেল। সুজিত ঢুকে দেখল বীরেন্দ্রনারায়ণ, প্রিয়নাথ, শিবেন এরা আগেই এসেছে। সুনীতা নিজে এগিয়ে এসে সুজিতকে ডাকল, এসো। আজ আমার পাকা দেখা।

সুনীতা প্রথম থেকেই হাসছিল। আবার হাসল। তার মুখ আরক্ত। সুজিত সুনীতার চোখের দিকে তাকাল। সুনীতা ভাল করে তাকাল না। বলল, এখানে বসো, এই সোফাটায়।

সুজিত ঘরের চারদিক ভাল করে দেখল। ঘরটি আধুনিক কায়দায় সাজানো। সুনীতা বলে উঠল, যা দেখছ এ সবই প্রিয়নাথবাবুর, আমার পিতৃবন্ধু, আমাকে মহারানির মতো রেখেছেন।

প্রিয়নাথ বললেন, কখনও তোমাকে কষ্টের মধ্যে রেখেছি, তা বোধ হয় বলতে পারবে না।

–মাথা খারাপ। এত আরামে ঐশ্বর্যে রেখেছেন যে, নিজের স্ত্রী-ছেলে-মেয়েদেরও কেউ রাখে না।

বলে সুনীতা খিলখিল করে হেসে উঠল। সুজিত বলে উঠল, সত্যি বেশ সুন্দর ঘর। এ সব জিনিসপত্রও খুব দামি, না?

শিবেন বলে উঠল, একটু একটু বোঝেন দেখছি।

সুজিত হাসল। বলল, মনে হয় দেখে।

বীরেন্দ্র বললেন, বাড়িটা তোমার চেনা ছিল বুঝি?

–আজ্ঞে না, বাড়িটা আমাকে দীপু দেখিয়ে দিল।

 সবাই সুজিতকে নিয়েই পড়ল। তাকে নিয়ে হাসাহাসির মধ্যে সুনীতার অংশগ্রহণে একটু বিভিন্নতা ছিল। সুনীতা তাই মাঝে মাঝে বলছিল, এত সহজে তুমি এমন করে কথা বলো কেমন করে? সুজিত বলছিল, কলকাতায় আসার সময় থেকে সমস্ত ব্যাপারটা তার কাছে অস্বাভাবিক অদ্ভুত হৃদয়হীন বলে মনে হচ্ছে।

শিবেন, প্রিয়নাথ ও বীরেন্দ্র বারে বারে ঘড়ি দেখছিলেন। তাদের সবাইকেই বেশ প্রসন্ন মনে হচ্ছিল। এক সময়ে নটা বাজলে বীরেন্দ্র বললেন, আর বোধ হয় অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই।

সুনীতা বলল, বিক্রিবাটা শেষ করা যাক। শেষ নিলামদার বোধ হয় আর এল না।…তার হাসির উচ্ছ্বাস ক্রমেই বাড়তে লাগল। বলল, পাকা দেখাটা তা হলে কী দিয়ে হবে?

বীরেন্দ্র বললেন, তোমাকে আশীর্বাদ করার জন্যে একটা নেকলেস এনেছি।

সুনীতা হেসে বলল, কত নেকলেস যে জমা হয়েছে। আমার কাঁধ আর গলাটা বোধ হয় দেখতে ভালই, তাই সবাই নেকলেস দেয়। কিন্তু টানাহ্যাঁচড়া করে কী হবে? শিবেনবাবুর সঙ্গে আমার আজ আংটি বদলটাও হয়ে যাক না।

শিবেন তাড়াতাড়ি বলল, সেই ভেবেই আমি একটা হিরের আংটি নিয়ে এসেছি, তোমার পছন্দ হবে কি না জানি না।

বলে সে পকেটে হাত দিতে গেল। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। সুনীতা বলে উঠল, বোধ হয় শেষ নিলামের শেষ ডাকওয়ালা এল। সুরুচি, দেখো কে এসেছেন। যদি রঞ্জনবাবু হন তো এখানে নিয়ে এসো।

সেই মেয়েটি এক বার দেখা দিয়েই আবার চলে গেল।

সুজিত বলে উঠল, এই মেয়েটি কে?

সুনীতা বলল, ঝি বলে ভুল কোরো না, আমার সখী, সঙ্গিনী।

হঠাৎ বাইরে গোলমাল শোনা গেল। সুরুচির গলা শোনা গেল, আপনি বসুন না, আমি খবর দিচ্ছি। ভু

জঙ্গভূষণের গলা পাওয়া গেল, তার দরকার নেই, আমি নিজেই যাচ্ছি।

বলতে বলতেই ভুজঙ্গ এসে ঘরে ঢুকলেন। সুনীতা বলে উঠল, আসুন, আসুন, আপনাকে নিমন্ত্রণ করতে সাহস করিনি, আসবেন কিনা আবার।

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, আমি নিমন্ত্রণ খেতে আসিনি। মজা দেখতে এসেছি। সত্যি বলতে কী, বাঘ কুমিরের লড়াইটা কেমন জমে, তাই দেখব। 

শিবেন ডেকে উঠল, বাবা!

–ডোন্ট কল্ মি বাবা। দেয়ার আর সো মেনি ফাদারস অফ ইউ।

 শিবেন লাফ দিয়ে উঠতে যাচ্ছিল। তাকে প্রিয়নাথ ধরল। সুনীতা খিলখিল করে হেসে বলল, আমার ভাবী শ্বশুরমশাই। শুনুন রায়মশায়, বাঘ আর কুমিরের কথা আপনি কী বলছিলেন?

ভুজঙ্গ প্রিয়নাথকে দেখিয়ে বললেন, কেন, এই তো কুমিরমশায় বসে আছেন। হারু মল্লিকের ব্যাটা সেই বাঘটি কোথায়? আসেনি এখনও?

বীরেন্দ্র বললেন, সে বোধ হয় ফেউ হয়ে ঘুরছে, আর বাঘ হতে পারল না রায়মশায়।

-ও, দেন অল চার্ম অব দি গেম ইজ লস্ট। হা হা হা! তা হলে কুমিরই জয়ী! তা হবে, হারু মল্লিকটা যা কিপটে, তিন লাখ টাকা ছেলেকে কিছুতেই দেবে না। একটা মেয়েছেলের জন্যে অত টাকা, ব্যাটা নিজে কোনওদিন তিন হাজার খরচ করেনি।

সুনীতা বলল, সেই মেয়েছেলে কিন্তু আপনার পুত্রবধূ হতে যাচ্ছে।

 ভুজঙ্গভূষণ হেসে বললেন, পুত্রবধূ! হা হা হা!

তিনি সুনীতার দিকে তাকালেন, এবং হঠাৎ হাসি বন্ধ করলেন। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলে উঠলেন, বেচারি!

বীরেন্দ্র বলে উঠলেন, আর দেরি করে বোধ হয় লাভ নেই।

ঠিক এই সময়েই আবার কলিং বেল বেজে উঠল। সুরুচি ছুটে গেল। একটু পরেই ঘরের দরজায় রঞ্জনকে দেখা গেল। তার হাতে একটা প্যাকেট, কাগজের প্যাকেট। তার সমস্ত মুখটা নিষ্ঠুর আর কঠিন দেখাচ্ছিল। দরজার কাছে, তার মুখের উধ্বভাগে চৌকাঠের ছায়া পড়েছিল, তাতে আরও ভয়ংকর দেখাচ্ছিল তাকে। তার ঘাড়ের পাশ দিয়ে কালাচাঁদের মুখটা একবার উঁকি দিল। দুজনেই মদ্যপান করে এসেছে, সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। কালাচাঁদ সুজিতকে চোখ টিপে বলল, আমরা এসে গেছি স্যার।

সকলেই স্তব্ধ। রঞ্জন কাগজের প্যাকেটটা সুনীতার দিকে বাড়িয়ে ধরল। সুনীতা এগিয়ে এসে সেটা নিল। রঞ্জন বলল, তিনশোটা নোট আছে, সবই হাজার টাকার।

সুনীতা বলে উঠল, তার মানে তিন লাখ!

রঞ্জনের গলার স্বরের মধ্যে যেন চাপা গর্জনের সুর। বলল, হ্যাঁ, জাল নয়, ছেঁড়া নয়, নতুন করকরে নোট। তোমার অতিথিদের দেখিয়ে দাও। বীরেন্দ্র বলে উঠলেন, থাক থাক, দেখাবার দরকার নেই।

বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। প্রিয়নাথ কী করবেন বুঝতে পারলেন না। বীরেন্দ্র যেন বিক্ষোভে প্রায় কাঁপছিলেন। প্রিয়নাথ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়েছিলেন সুনীতার দিকে। কেবল শিবেনের মুখটা যেন পুড়ে গিয়েছে। ভুজঙ্গভূষণ আসার সময়েই সে দাঁড়িয়েছিল। এখন তার হাত দুটি ঝুলে পড়া শিথিল অবস্থায়, ঘাড়টা খানিকটা উঁচু হয়ে উঠেছে। দৃষ্টি তার নীচের দিকে।

সুনীতা হাত তুলে টাকার প্যাকেট উর্ধ্বে ধরে বলল, তিন লাখ। প্রিয়নাথবাবু, আপনার এক লাখ আর আমার দরকার নেই। এখন আর আপনার টাকা নিয়ে কী করব? আপনি বোঝা নামাতে চাইছিলেন কিংবা অন্যদিকে আমাকে নতুন ঋণে বাঁধতে চাইছিলেন, তা জানি না, এখন আপনি মুক্ত।

রঞ্জন বলল, তা হলে সুনীতা–

সুনীতা বলে উঠল, আমি এখন তোমারই। তুমি এখনও দরজায় কেন, ভেতরে এসো। পাকা দেখা তো হয়ে গেল, মালা বদলটাই বাকি।

বলে ও খিলখিল করে হেসে উঠল। সেই দুরন্ত মূছাগ্রস্তের হাসি। পিছন থেকে রঞ্জনকে ঠেলে দিল কালাচাঁদ, বলল, চল না, চল না মাইরি, ভেতরে গিয়ে একটু সোফায় পা ছড়িয়ে বসি।

বলে সে ভিতরে ঢুকে সুনীতাকে হাত তুলে নমস্কার করল, বলল, নমস্কার।

 সুনীতা বলল, এসো এসো কালাচাঁদ।

আসব বইকী, আসব বইকী, অনেক দিন আরাম করে বসাই হয়নি।

ভুজঙ্গভূষণ বলে উঠলেন, শেষপর্যন্ত তা হলে বাঘেরই জিত! গুড়, ভেরি গুড়!

সুনীতা বলল, কিন্তু রায়মশায়, শিকারকে বাঘেই খাক আর কুমিরেই খাক, শিকারের তাতে মরার কষ্ট কিছু উনিশ-বিশ হয় কি?

ভুজঙ্গ বললেন, কিছুমাত্র না। কেউ ঠ্যাং কামড়ে ধরে আস্তে আস্তে পেটে পোরে। কেউ এক থাবাতেই গলার নলি ছিঁড়ে দেয়। ব্যাপার সেই একই।

সুনীতা খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে একটা সোফার গায়ে প্রায় এলিয়ে পড়ল। বলল, ঠিক বলেছেন, ঠিক বলেছেন রায়মশায়।

রঞ্জন বলে উঠল, তা হলে এত দিনে আমারই জিত হল। আশা করি, এর ওপরে আর চার লাখ টাকা দেবার কেউ নেই? তা হলে আমাকে আবার পাঁচ লাখের জোগাড়ে বেরুতে হবে।

বলে রঞ্জনও হাসল এবার, যার হাসি সুজিত যেন এই প্রথম দেখছে। সুজিতের চোখে-মুখে একটি উত্তেজনার ঝলক দেখা গেল। সে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সুনীতা, আমি তোমাকে দু-একটা কথা বলতে চাই।

সুনীতা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো উঠে দাঁড়াল, বলল, কী কথা?

সুজিত বলল, কলকাতায় আমি কখনও আসিনি, আমি এ শহরকেও চিনি না। কয়েক দিন মাত্র দেখেছি, আর তাতেই, জীবনের যা কিছু ভাবনা-চিন্তা, সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। এই সভ্য শহরে, মানুষদের যা জীবন দেখছি, এ সব আমি কিছুই জানতাম না। সকলেই এখানে এত অসুখী যে, পৃথিবীতে অসুখী মানুষ আর কোথাও আছে কি না আমি জানি না। আমি দেখেছি, এইসব মানুষদের সুখী হবার পথ এরা নিজেরাই নষ্ট করছে। যারা নিজেদের সম্মান করে না, তারা মেয়েদের কী করে সম্মান করবে? সুনীতা, আমি তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি, তাই আমি প্রস্তাব করছি, তোমার আপত্তি না থাকলে, আমি তোমাকে বিয়ে করব।

সুনীতা প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠল, তুমি?

বাকিরা সবাই ততক্ষণে হা হা করে হেসে উঠেছে। কালাচাঁদ গেয়ে উঠল, আগে জানতাম যদি, প্রেমের এতই জ্বালা গো…।

হাসেনি কেবল সুনীতা আর ভুজঙ্গভূষণ। ভুজঙ্গভূষণ বলে উঠলেন, সেটা কীভাবে?

সুজিত বলল, সেটা এইভাবেই যে, সুনীতার নিজের ইচ্ছেই সব, সুতরাং ওর যদি ইচ্ছে হয়, তা হলে ওকে আমি বিয়ে করতে চাই। আমি এখন সুস্থ, আমার

আবার একটা হাসির রোল পড়ল। বীরেন্দ্র বললেন, তুমি যে কী রকম সুস্থ, তা তো তোমার কথা থেকেই বুঝতে পারছি।

সুজিত বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ। সুস্থ না হলে আমি এই প্রস্তাব করতে পারতাম না।…সুনীতা, আমি বড়লোক নই, কিন্তু একটা কাজ আমি পাব কোথাও। আমি তোমাকে সম্মান করি, আমি তোমাকে ভালবাসি…

কালাচাঁদ হাততালি দিয়ে বলে উঠল, মাল ঠাসবুনুনি, ব্র্যাভো মাস্টার। শুধু ভালবাসা নয়, আবার সম্মান?

–হ্যাঁ কালাচাঁদ, ভালবাসার সঙ্গে শ্রদ্ধার একটা সম্পর্ক আছে, আর তার কথাই বলছি। সুনীতা যে দুঃখী আর অসহায়, এটা আমি প্রথম দিনই বুঝেছিলাম। ওর দরকার শান্তি আর ভালবাসার, যা ওর চারপাশে নেই, আমি তাই তোমাকে দেব সুনীতা। তুমি এদের এই পাশ ছিঁড়ে বেরিয়ে এসো। চলো, আমরা সাধারণ মানুষের মতো সংসার তৈরি করি গিয়ে।

ভুজঙ্গভূষণ বলে উঠলেন, আমি বলতে বাধ্য, এর চেয়ে ভাল আর কিছু হতে পারে না। এর থেকে অনেস্ট অ্যান্ড গ্রেট আর কিছুই নেই। ওহে মেয়ে, আমি তোমাকে বলছি, এটাই সব থেকে ন্যায়সঙ্গত, সুন্দর। তুমি ওর প্রস্তাব মেনে নাও।

সকলেই সুনীতার দিকে তাকাল। সুনীতা তাকিয়ে ছিল সুজিতের দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে সহসা সুনীতা প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বলে উঠল, না না, তা হতে পারে না সুজিত। এ তোমার সেই গল্পের মতোই সুন্দর, কিন্তু অবাস্তব। আমার জীবনে আর তা সম্ভব নয়।

সুজিত বলল, কেন সুনীতা?

সুনীতা বলল, তুমি জান আমার পরিচয়, প্রিয়নাথবাবুর সঙ্গে আমার দুর্নামের কথা?

–জানি, কিন্তু তার সত্যি-মিথ্যে নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই।

–আমি কলকাতায় কত লোকের সঙ্গে কতভাবে বেড়িয়েছি, আমার কোনও সামাজিক সম্মান নেই সুজিত। বরং লোকে জানবে, তুমি একটা খারাপ মেয়েকে নিয়ে ঘর করছ।

যত দিন আমি এই লোকদের বুঝতে পারিনি, তত দিন এই লোকদের বিষয় ভাববার ছিল। এখন আর এইসব লোকের কথায় আমার কিছু যায় আসে না সুনীতা।

সুনীতা চুপ করে রইল। সে যেন বিষম উত্তেজনায় কী চাপতে চাইছে, রুদ্ধশ্বাস আরক্ত হয়ে উঠছে। তারপর সে মুখ তুলে সকলের দিকে তাকাল। ভুজঙ্গ আবার বলে উঠলেন, এই ছোকরা অতি কঠিন কথা অতি সহজে বলছে। ও হচ্ছে একটা খাঁটি লোক। তোমরা যদি বিয়ে কর, তা হলে আমি তোমাদের আশীর্বাদ করব।

সুনীতা হঠাৎ যেন চিৎকার করে উঠল, না। না না না, সুজিত, তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে সম্ভব নয়। তা হলে তোমার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। আমি তোমাকে সুখী করতে পারব না, শুধু আমার এই নষ্ট জীবন দিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেব। না না না, তুমি আমার ছায়ার কাছ থেকে সরে যাও। তোমাকে আমি তাই আগেই চিঠি দিয়ে পালাতে বলেছিলাম। আজও বলছি, তুমি পালাও, তুমি পালাও সুজিত। আমার সব বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে। তুমি আর কিছুই পাবে না আমার কাছে। তুমি যা বিশ্বাস কর, আমি তা করি না। জীবনে শুধু একটি জিনিসের স্বাদ আমার বুঝতে বাকি ছিল, তা আমি তোমার চোখের দৃষ্টিতেই পেয়েছি। তুমি যাও।

সুজিত বলল, তুমি এক বার সাহস করো সুনীতা।

সুনীতার গলার স্বর প্রায় বন্ধ হয়ে এল। বলল, আমার সাহস নেই সুজিত। বইয়ে পড়েছিলাম, শব সাধনা করতে হলে শ্মশানই ঠিক জায়গা। বারো বছর আগে, আমার বাবার মৃত্যুর পর আমাকে শ্মশানেই উৎসর্গ করা হয়েছে। এই চব্বিশ বছর বয়সে আর সুখী ঘরের কোণের সংসারে ফিরে যাবার সাহস করি না। আমাকে ক্ষমা করো, সুজিত।

–সুনীতা, সুনীতা! বিষণ্ণ আবেগে ব্যথিত শোনাল সুজিতের গলা। ওরা দুজনে দুজনের দিকে তাকাল, এবং এক আশ্চর্য সম্মোহনে যেন কেউ চোখ ফেরাতে পারল না।

বীরেন্দ্র বললেন, আচ্ছা, এবার যাওয়া যাক।

প্রিয়নাথও বললেন, হ্যাঁ, চলুন।

সুনীতা বলে উঠল, দাঁড়ান। মিঃ রায়চৌধুরী, আপনার নেকলেস আমি নিতে পারলাম না। ওটা আপনি শিবেনের ভাবী স্ত্রীকেই দেবেন, এই অনুরোধ। আর একটা কথা

বলেই সে সুরুচিকে ডাকল। বলল, তোর তোলা উনুনটা জ্বলছে?

–হ্যাঁ।

সুরুচি একটি জ্বলন্ত তোলা উনুন নিয়ে এসে ঘরের মধ্যে বসিয়ে দিল। সুনীতা নোটের বান্ডিলটা ভাল করে টিপে দেখে বলল, বেশ ভাল করেই, কয়েক ভাঁজ কাগজে মোড়া আছে দেখছি। আগুন লাগতে সময় লাগবে। রঞ্জন, এ টাকা সব আমার তো?

রঞ্জন বলল, হ্যাঁ, তোমার।

সুনীতা বলল, এ টাকা শিবেনের প্রাপ্য, ও টাকা ভালবাসে।

কালাচাঁদ বলল, আমিও বাসি, মাইরি বলছি। বউ ছেলেমেয়ে একগাদা–সুনীতা সে কথায় কান না দিয়ে বলল, এ টাকা আমি উনুনে ফেলে দিচ্ছি, শিবেন তুলে নেবে।

বলেই সে তিন লাখ টাকার প্যাকেটটা উনুনে ফেলে দিল। সবাই চিৎকার করে উঠল। সুনীতা খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, নাও শিবেন, তুমি টাকার জন্যেই আমাকে চেয়েছিলে। নাও তাড়াতাড়ি।

কালাচাঁদ লাফ দিয়ে ধরতে গেল। রঞ্জন তাকে সজোরে আঘাত করল। কালাচাঁদ বলে উঠল, ওঃ, আমার চোখ পুড়ে যাচ্ছে মাইরি।

শিবেন থরথর করে কাঁপছে। ভুজঙ্গভূষণ সহসা চিৎকার করে বলে উঠলেন, টাকা! শিবেন, পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আমার জলে গেছে। আমার সতোর টাকা। তুই যদি মানুষ হোস, এ টাকায় হাত দিস না। শিবেন, খোকা, খোকা, তুই কাঁপছিস। আমি খুব গরিব, ধার করি, মদ খাই, কিন্তু নীচ নই, তুই এ টাকায় হাত দিস না।

ইতিমধ্যে বান্ডিলটা ধরে উঠেছে। সুনীতা হাসছে। শিবেন সহসা আগুনের মধ্যে হাত দিয়ে টাকা তুলতে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে তার জামার হাতায় আগুন ধরে গেল। ভুজঙ্গভূষণ চিৎকার করে উঠলেন, নীচ, নীচ!

প্রিয়নাথ ছুটে এসে জামার হাতার ও টাকার বান্ডিলের আগুন নিভাতে লাগলেন। সুনীতা হাসতে লাগল, রঞ্জনও হাসতে লাগল তার সঙ্গে। কালাচাঁদ চিৎকার করে বলল, ওঃ, কটা নোট যেন পুড়ে গেল।

শিবেন অজ্ঞান হয়ে পড়ল প্রিয়নাথের হাতের ওপরেই। সুজিত দেখল, সুনীতার হাস্যোজ্জ্বসিত শরীর কাঁপছে, কিন্তু চোখের কোণে জল পড়ছে।

.

সুজিত সারারাত্রি শিবেনদের বাড়িতে তার ঘরে চুপ করে বসেছিল। সে খালি ভাবছিল, রাত পোহালে আর এ বাড়িতে থাকা যাবে না। শিবেনকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। তার দুটো হাতই খানিকটা পুড়ে গেছে। সে হয়তো সকালেই ফিরবে। দীপুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল সুজিতের। তাকে সে মোটামুটি ঘটনা বলে দিয়েছে। ভুজঙ্গভূষণের খোঁজ কেউ জানে না। সারারাত্রি বাড়ি ফেরেননি। এ বাড়িতে আর থাকা যায় না।

পরদিন বেলা আটটার সময়েই বীরেন্দ্র ফোন করলেন সুজিতকে। জানালেন, গুঁড়িয়াঁটাঁড়ের হাসপাতাল থেকে একটা রেজেস্ট্রি চিঠি রি-ডাইরেক্ট হয়ে অলিভ রোডের ঠিকানায় সুজিতের নামে এসেছে। চিঠিটায় আর্জেন্ট ছাপ মারা আছে। সুজিত যেন দেরি না করে। পিয়ন আবার একটু বাদেই ঘুরে আসছে, সুজিত এখনি চলে আসুক।

সুজিত অলিভ রোডে গিয়ে পিয়নের কাছ থেকে চিঠিটা সংগ্রহ করল। নীচে বাইরের ঘরে, বীরেন্দ্রনারায়ণের সামনেই চিঠিটা খুলে ইংরেজি লেখা দেখে বীরেন্দ্রনারায়ণকে দেখতে দিল সে। বীরেন্দ্র চিঠিটা দেখতে দেখতে চিৎকার করে উঠলেন, কী সাংঘাতিক ব্যাপার! চিঠিটা দিচ্ছে তোমার বাবার ট্রাস্টি এবং সলিসিটর। উনি এখন খুবই অসুস্থ। প্রতাপ সিংহ গত বছর যে রকম তাদের নির্দেশ করেছিলেন, সে ভাবেই তিনি জানাচ্ছেন যে, এখন নিশ্চয়ই সুজিত সুস্থ, অতএব সে যেন তার সম্পত্তি ও অর্থের দায়িত্ব বুঝে নেয়। কলকাতার কয়েকটি বাড়ি এবং প্রায় বারো লক্ষ টাকা, ও সবই অতীন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর একমাত্র ছেলে সুজিতনাথ মিত্রকে দিয়ে গেছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

সুজিত অবাক হয়ে বলল, অনেকগুলো টাকা, না?

বীরেন্দ্রনারায়ণ প্রায় বিষম খেয়ে বললেন, এবং কলকাতায় কয়েকটা বাড়ি! মানে তোমার বাবা, কী আশ্চর্য, তোমার কপালটা তো আমি দেখছি একটা ইয়ে, কী বলব। কিন্তু সে কথা যাক, তোমার যা কিছু পুরনো কাগজপত্র সব নিয়ে এখুনি মুর্শিদাবাদ চলে যাও। উনি তোমাকে সবই বুঝিয়ে দেবেন, সেখানে একদম পাগলের মতো যা-তা কথাবার্তা বলো না যেন। ভদ্রলোক না আবার মারা যান। আমি টাইম-টেবল দেখে দিচ্ছি।

সুজিত বলল, আমি বলছিলাম, মানে আমার কাছে আর টাকা নেই, মুর্শিদাবাদ যেতে হলে কত লাগবে

–ইমপসিবল! আরে তোমাকে আমি টাকা দিচ্ছি। পাঁচশো, হাজার, যা লাগে, তুমি এখুনি চলে যাও। আর হ্যাঁ, দাঁড়াও, তোমার মাসিমা আর দোলার সঙ্গে এক বার দেখা করে যাও। চলো আমার সঙ্গে।

সুজিত সকলের সঙ্গেই দেখা করল। দোলা কোনও রকমে ভদ্রতাসূচক দু-একটি কথা বলে অন্য ঘরে চলে গেল। সুজিত চলে আসবার আগে, দোলার ঘরে একবার গেল। দেখল, দোলা চুপ করে বসে আছে। সুজিত বলল, আমি জানি তুমি আমার ওপর রাগ করেছ। কিন্তু আমি মিথ্যে কথা কখনও বলি না, আমার যা মনে হয়েছে, এ কদিন আমি তাই করেছি। দেখ দোলা, আমি চেয়েছি শান্তি এবং ভালবাসায় তৈরি একটা আশ্রয়। সুনীতাকে দেখে আমার এত কষ্ট হয় যে, ওকে আমি ভাল না বেসে পারি না। কিন্তু আশ্চর্য, আমি নির্বোধ বলেই বোধ হয় আমার মনে হয়, তোমার মতো একজন সুখী পবিত্র মেয়েকেও আমি ভালবাসি।

দোলা ঘাড় তুলে তাকাল। তার চোখে তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসা। সুজিত বলল, রাগ করছ আমার ওপর, না? রাগ কোরো না। হয়তো ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছি না। আমি আজ যাচ্ছি মুর্শিদাবাদে, তুমি সবই শুনেছ। ফিরে এসে তোমার সঙ্গে দেখা করব। যাচ্ছি এখন।

দোলা চোখ না ফিরিয়ে তাকিয়েই রইল। একটু পরে বলল, তোমার কথা আমি সত্যি বুঝতে পারি না। আপনি আপনি আমাকে কী মনে করেন, একটু বলতে পারেন?

–সে কথা তো প্রথম দিনই বলেছি। তোমাকে–তোমাকে আমি স্নেহ করি, ভালবাসি। তোমাকে আমি মনে করি, একটি নিষ্পাপ ফুলের মতো।

দোলা একটু থেমে বলল, মুর্শিদাবাদ থেকে এসে দেখা করবেন, সত্যি?

নিশ্চয়ই। কিন্তু আমার এখন সত্যি ভাবনা হয়েছে, এ সব টাকা-পয়সা বাড়ি-ঘর নিয়ে কী করব। আমি এ সবের কিছুই বুঝি না।

বীরেন্দ্রনারায়ণ ডাক দিলেন। গাড়ির সময় জানালেন। সুজিত বিদায় নিয়ে, চিঠিটা সঙ্গে করে চলে এল শিবেনদের বাড়িতে। টাকাও বীরেন্দ্রনারায়ণ দিয়ে দিয়েছিলেন। সুজিত দীপুকে এবং স্থবির সুনয়নীকে সব কথা বলল। সুনয়নী কাঁদলেন। কান্নার মধ্যে হাসির ঝিলিকও ছিল। দীপু নিজে চিঠিটা ভাল করে দেখল। সুজিত জানাল, তাকে দু-তিনদিন মুর্শিদাবাদে থাকতে হতে পারে।

সামান্য কিছু খেয়ে মুর্শিদাবাদ যাবার জন্যে বেরুবার মুহূর্তে, রঞ্জন এল। তার দিকে তাকিয়ে সুজিতের বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল। এক রাত্রের মধ্যেই তার চেহারা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। সুজিত কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই, রঞ্জন যেন চাপা গলায় গর্জে উঠল, সুনীতা কোথায়?

সুজিত অবাক হয়ে বলল, সুনীতা? তা তো জানি না! কেন, সে কি তার বাড়িতে নেই?

না। ভোরবেলা কোথায় বেরিয়ে গেছে, কোনও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। আজ বিয়ের নোটিস দিতে যাবার কথা ছিল রেজিস্ট্রি অফিসে। কাল সারারাত পাগলামি করেছে, বারে বারে তোমার নাম করেছে।

রঞ্জনের চোখ দুটি যেন হিংস্র হয়ে উঠল। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে সুজিতের বুকটা আবার কেঁপে উঠল। হয়তো রঞ্জন তাকেই হত্যা করতে চায়। সে বলল, কিন্তু আমি তো কিছুই জানি না সে কোথায়? এই তো বীরেন্দ্রবাবুর বাড়ি থেকে আসছি, এখন মুর্শিদাবাদ যাচ্ছি।

-মুর্শিদাবাদ কেন?

সুজিত সব বলল তাকে। রঞ্জন অবাক হয়ে সুজিতের দিকে তাকিয়ে রইল। সুজিত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল।

.

সুজিত সন্ধ্যাবেলা মুর্শিদাবাদ পৌঁছল। সলিসিটরের সঙ্গে দেখা হবার পর, প্রাথমিক কথাবার্তা, আলাপ-পরিচয় হল। সুজিতকে তিনি থাকতে বললেন। প্রকাণ্ড বাড়ি, কিন্তু লোকজন সামান্যই। জানা গেল, মহিলা কেউ নেই বাড়িতে। ঠাকুর-চাকরেরাই সব কিছু করে। সাজানো-গোছানো প্রকাণ্ড অতিথি-ভবনটাই সুজিতকে ছেড়ে দেওয়া হল।

রাত্রি সাড়ে দশটার সময় সুজিতের ঘরে ঢুকে একজন চাকর সংবাদ দিল, এইমাত্র কলকাতা থেকে যে গাড়ি এসেছে, তাতে একজন মহিলা এসেছেন, সুজিতবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চান। সুজিত তাকে নিয়ে আসতে বলল, এবং অবাক হল, কে আসতে পারে। তার ভাবনা শেষ হতে না হতেই দরজায় এসে দাঁড়াল সুনীতা। সুজিত যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। সে আধশোয়া থেকে উঠে দাঁড়াল। সুনীতার গায়ে দামি কাপড়চোপড় সবই আছে, কিন্তু সবই অবিন্যস্ত, বিস্রস্ত। মুখে ঈষৎ হাসি থাকলেও তার চোখে ব্যাকুল ভীতি ও চঞ্চলতা।

সুজিত বলল, তুমি?

সুনীতা ঘরে ঢুকে বলল, হ্যাঁ। পিছন ফিরে চাকরকে বলল, এই বাবুর খাওয়া হয়ে গেছে?

 চাকর জানাল, হ্যাঁ।

সুনীতা বলল, ঠিক আছে, তোমাকে আর কিছু করতে হবে না। আমি খেয়ে এসেছি। ইনি আমার স্বামী। তুমি যেতে পার এখন।

আজ্ঞে আচ্ছা মা-ঠাকরুন। চাকরটি চলে গেল। সুনীতা দরজাটা বন্ধ করে ফিরে দাঁড়াল। এ বাড়িতে ইলেকট্রিক নেই, একটি সেকালের পুরনো প্রকাণ্ড দেওয়াল বাতি জ্বলছিল। সেই আলোয়, ওরা দুজনেই দুজনের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। তারপর সুজিত পায়ে পায়ে কাছে এসে দাঁড়াল, বলল, সুনীতাই তো।

–চিনতে পারছ না?

–পারছি! কিন্তু কী করে এলে, কেমন করে জানলে এখানকার কথা?

দীপুর কাছ থেকে জেনেছি। জেনেই ছুটে চলে এসেছি।

 সুজিত আবার নির্বাক হয়ে গেল। সুনীতার মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে একটি হাত তুলে সুনীতার কপালে গালে ছোঁয়াল। সুনীতার চোখ ফেটে জল এসে পড়ল। সে সুজিতের বুকের মাঝখানে মুখ রেখে বলে উঠল, পারলাম না, পারলাম না গো তোমাকে ছেড়ে থাকতে। তোমাকে আর একবার দেখতে এলাম।

সুজিত দুই চোখ বুজল, স্নিগ্ধ মুখে, গভীর স্নেহে সে সুনীতার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। বলল, এসো, বসবে এসো সুনীতা। তোমার বুক এত ধুকধুক করছে কেন?

সুনীতা বলল, কে জানে, হয়তো রঞ্জনও আমার পিছু পিছু এসেছে। তুমি আমাকে আশ্রয় দাও, একটু লুকিয়ে রাখো তোমার কাছে।

খানিকক্ষণ ওরা কেউ কোনও কথা বলল না। তারপর সুজিত বলল, কাল রাত্রে কেন তুমি আমার কথায় রাজি হলে না?

সুনীতা বলল, আমি রাজি হলেও আর কিছুই আসত যেত না, সে কথা কি তুমি বুঝতে পারনি?

কিন্তু সুনীতা, তুমি কি সত্যি বিশ্বাস কর, তুমি আমি দুজনে ঘর বেঁধে থাকতে পারি না।

না, না, না গো। আমি যে সব বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি, তোমার এমন সরল সুন্দর জীবনটাকে আমার জন্যে আমি নষ্ট হতে দিতে পারব না।

তবে আজ কেন এমন করে ছুটে এলে?

–এলাম, কারণ সেই তোমাকে চিঠিতে লিখেছিলাম, তোমার কাছে এখুনি ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে, এ সেই ইচ্ছে। আমি যে তোমার চোখেই প্রথম দেখলাম, এই অভাগিনীকে তুমি ভালবেসেছ, নিজের পাথর হয়ে যাওয়া প্রাণের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তোমার প্রাণের রসে সেখানটাও ভরে উঠেছে। তাই তো বলেছিলাম, আমার নিয়তিই সেদিন রেলের সেই কামরায় আমাকে তুলে দিয়েছিল। জীবনের এই পাওনাটা যখন বুঝেছি, তখন তাকে একেবারে ছেড়ে দিয়ে থাকতে পারলাম না। হয়তো এই শেষ, এই শেষবারের জন্যে, জীবনের চরম স্বাদ পেতে এসেছি সুজিত।

–তারপর সুনীতা?

তারপর–তারপর আমাকে আবার ফিরে যেতে হবে সেখানেই। যেতে হবে না, রঞ্জন নিজেই খুঁজে বের করবে। সে আমাকে স্বর্গ-নরক-পাতাল, যেখান থেকে হোক, খুঁজে বের করবে।

সুজিত একটু অপেক্ষা করে বলল, সুনীতা, একটা কথা না বলে পারব না, তোমাকে রঞ্জন ভালবাসে। ওর ভালবাসায় কোনও খাদ নেই কিন্তু।

–কিন্তু অমানুষের, পশুর ভালবাসা। আমি যে ওকে কখনও ভালবাসিনি, আমি যে ওকে কখনও সে স্থান দিতে পারি না।

দুজনেই চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। তারপরে সুনীতার গলা শোনা গেল, চুপিচুপি, প্রায় কান্না মাখানো গলা, কেন তোমাকে দেখতে পেলাম। তোমাকে না দেখেও এ-জীবনটা তো অনায়াসে কেটে যেতে পারত।

–সে কথা আমারও সুনীতা! তুমি শুনেছ বোধ হয় আমি অনেক টাকা পেয়েছি, কলকাতায় কয়েকটা বাড়ি। আমি এ কদিন ধরে যে জীবনকে দেখলাম কলকাতায়, তারপরে আমার কথা শুনলে সবাই হাসবে। কিন্তু কী করব আমি এ সব নিয়ে?

সুনীতা একটু চুপ করে থেকে বলল, দোলাকে নিয়ে সুখে সংসার করো।

এ কথায় সুজিতের কোনও ভাবান্তর হল না। বলল, সুনীতা, দোলা খুব সুখী আর পবিত্র মেয়ে। ওকে আমি বলেছি, ওকে আমি ভালবাসি। কিন্তু সুনীতা, তফাতটা কোথায়, তা তোমাকে বোঝাতে পারছি না।

সুনীতা সুজিতের হাত ধরে বলল, বুঝতে পারছি।

সুজিত আবার বলল, তুমি যা বললে, হয়তো একদিন তাই হবে। কিন্তু সুনীতা, তুমি তো জান, এ চোখ চিরদিন কী দেখবার আশায় থাকবে, এ প্রাণের তার কোন সুরে বাজবে। হয়তো দোলা এ সবই বুঝবে, ও বুদ্ধিমতী মেয়ে, ভালবাসলে অনেক সময় ক্ষমাও করা যায়, ও হয়তো আমাকে ক্ষমাও করবে, তবু–তবু সুনীতা–

সুনীতার একটি হাত সুজিতের মুখে চাপা দিল। –এ সব শুনলে, আর তোমার কাছ থেকে পালাতে পারব না গো। হয়তো তোমার সামনেই নিজেকে শেষ করে দিতে হবে।

.

মুর্শিদাবাদে তিন দিন রইল সুজিত। সুনীতাও রইল। কাজকর্ম মিটতে মিটতে ওরা মুর্শিদাবাদের নানান জায়গায় বেড়াল। তারপর কলকাতায় ফেরার দিন সকালবেলাই সুনীতা সুজিতকে না বলে চলে গেল। কোথায় গেল, কিছুই জানতে পারল না। সে যখন স্টেশনে এসে গাড়িতে উঠল, তার পাশে এসে রঞ্জন বসল। জানতে চাইল সুনীতা তার কাছে এসেছিল কি না। সুজিত জানাল, হ্যাঁ, সে এসেছিল কিন্তু আজ সকালবেলাই চলে গেছে। কিন্তু কোথায় গেছে, সে কথা সুজিত জানে না। ওরা দুজনেই কলকাতায় ফিরল। রঞ্জন যে সুজিতকে বিশ্বাস করেনি, ওর চোখ দেখেই বোঝা গেল। শিয়ালদহ থেকে দুজনে আলাদা হয়ে গেল। সুজিত প্রথমে শিবেনের বাড়ি গেল। দীপু আর সুনয়নীর সঙ্গে দেখা হবার পর ভুজঙ্গভূষণের সঙ্গেও দেখা হল। তিনি ওকে সত্যি ভালবেসে ফেলেছিলেন। সুজিত ওঁকে কিছু টাকা দিল। বীরেন্দ্র তাকে প্রায় হাজারখানেক টাকা দিয়েছিলেন। পরে সুজিত বীরেন্দ্রের সঙ্গে দেখা করল। তাঁর অনুরোধে দুদিন ওখানেই কাটাল এবং ইতিমধ্যে, দলিলের বলে ব্যাঙ্কের টাকা ও সম্পত্তি সবই তার নামে পরিবর্তিত হয়ে গেল। বর্তমানে চারটে বাড়ি থেকে মাসিক আয় প্রায় দু হাজার টাকা। কিন্তু ভাড়াটেরা কেউই বাড়ির মালিককে একটি ফ্ল্যাটও ছেড়ে দিতে রাজি হল না। অগত্যা সুজিতকে আপাতত একটি হোটেলেই উঠতে হল।

কিন্তু একটা ব্যাপার সুজিত বারেবারেই লক্ষ করল, কে যেন তাকে সবসময়েই ছায়ার মতো অনুসরণ করছে। হোটেলে, রাস্তায় পথ চলতে, প্রায়ই দুটি চোখ সে দেখতে পায়, এবং একদিন শিবেনদের বাড়ি থেকে দীপু, সুনয়নী এবং ভুজঙ্গভূষণের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে আসতেই, পাঁচিলের অন্ধকার কোণে। সহসা দুটি বলিষ্ঠ হাত তার গলা টিপে ধরল। অন্ধকারের মধ্যেও রঞ্জনকে চিনতে তার ভুল হল না। মৃত্যু আসন্ন জেনে, সুজিত একবার কেঁপে উঠল, কিন্তু পরমুহূর্তেই তার গলা ছেড়ে দিয়ে রঞ্জনের মূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল। সুজিতের মনে হল, কী ঘটেছে সে জানে না। তার মস্তিষ্ক শূন্য। দেওয়ালে হেলান দিয়ে সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। ভুজঙ্গভূষণ গিয়ে তাকে আবিষ্কার করে বাড়ি নিয়ে এলেন। তারপরেও সে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল এবং আস্তে আস্তে যেন বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে ফিরে আসতে লাগল। আর সহসা কেঁপে উঠল, কারণ এ সবই তার সেই আগের বোধবুদ্ধিহীন অসুখের লক্ষণ।

পরদিন সুজিত একটা চিঠি পেল রঞ্জনের। সে লিখেছে, গতকাল আমার সঙ্গেই তোমার অন্ধকারে দেখা হয়েছিল, হঠাৎ আমার মনে হল আমি ভুল করছি। আমার হাত যাকে খুঁজছে, সে তুমি নয়, সুনীতা। তার সঙ্গে আমার দেখা হবেই, তখন শেষ বোঝাপড়া হবে। এর কয়েক দিন পরেই সুজিত দীপুর কাছে শুনতে পেল, রঞ্জনের সঙ্গে সুনীতার দেখা হয়েছে। শীঘ্রই নাকি তাদের বিয়ে হবে। রেজেস্ট্রি অফিসে গিয়ে তারা নোটিস করে এসেছে। শুনে সুজিত অনেকটা আশ্বস্ত হল। সেই রাত্রির ঘটনার পর তার শরীর যতটা খারাপ হয়েছিল, তার থেকে ভাল বোধ হতে লাগল।

একদিন বিকালে হঠাৎ সুনীতাকে নিয়ে রঞ্জন হোটেলে এল সুজিতের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু রঞ্জন ভাল করে কথা বলল না। সুনীতা কিন্তু খুব হাসল, অনেক বকবক করল, অনেকটা অর্থহীন প্রলাপের মতো। তারপর সুজিতকে বলে, হোটেল থেকে ভারমূথ আনিয়ে এক বোতল খেল। রঞ্জন শুধু বিদ্বিষ্ট ঈর্ষান্বিত নিষ্ঠুর চোখে সব দেখল। সুজিত রঞ্জনের সঙ্গে কথা বলবার চেষ্টা করল। রঞ্জন তেমন সাড়া দিল না। সে শুধু জানাল, সুনীতা আসতে চাইল বলেই তাকে আসতে হল। এবং একবার সুনীতা যখন। ঘরের জানালার কাছে গেল, তখন রঞ্জন ঠোঁট বাঁকিয়ে সুজিতকে বলল, তোমার চোখে ব্যথা ঝরে পড়ছে দেখছি। সুজিত বলল, হ্যাঁ, সুনীতার জন্যে আমার কষ্ট হচ্ছে। তারপরে সুনীতা লাইম জিন খেতে চাইল, রঞ্জনের অনুমতিক্রমে তাই দেওয়া হল। খাওয়ার পরে সুনীতা সোফাতে এলিয়ে পড়ল, ঘুমিয়ে পড়ল। তখন রঞ্জন জানাল, একদিন তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে সুজিত, আমি ওকে ভালবাসি কি না। আমি ওকে ভালবাসি। আমি ওকে যতখানি ভালবাসি, ঠিক ততখানিই ঘৃণা করি। এত ভাল কাউকে বাসিনি। এত ঘৃণাও কাউকে করিনি। আমি জানি না, ভালবাসার উলটো পিঠে ঘৃণা লেখা থাকে কিনা। বলেই সে সুনীতাকে টেনে তুলল, প্রায় ঘুমন্ত টেনে নিয়ে চলে গেল।

.

ইতিমধ্যে কালাচাঁদ এসে জুটেছে সুজিতের কাছে। রঞ্জন আর কাউকে তার কাছে রাখে না। রাখতে পারে না। কালাচাঁদ লোকটিকে অবশ্য সুজিতের খারাপ লাগে না। সমাজের নিচু এবং অন্ধকার দিকটাই তার বেশি দেখা আছে, এবং সেই জগৎটাই সে চেনে। কিন্তু অন্যান্য কাজও সে চেষ্টা করলে পারে। এখন সে সুজিতের অনেক কাজ করে দেয়। টাকা এবং সম্পত্তি হওয়া মানেই কাজ বেড়ে যাওয়া। স্বভাবতই সুজিতের এখন প্রতি দিনই নানান কাজ। কালাচাঁদই সে সব করে দেয়। কালাচাঁদের সংসারের দায়িত্বও তাই সুজিতেরই। এতে অবশ্যই বীরেন্দ্রর আপত্তি ছিল। সুজিত সে দায়িত্ব নিয়েছে। কালাচাঁদ যে একজন দুঃখী এবং নিপীড়িত, এটা সে বুঝেছে। লোকটিকে তার ভালই লাগে।

দোলার সঙ্গে সুজিতের বিয়ের প্রস্তাবও উঠল। কিরণময়ী নিজেই সুজিতের অভিমত জানতে চাইলেন, দোলার মনোভাবের কথাও জানালেন। সুজিত জানাল, সে তার মস্তিষ্কের অসুখ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত নয়। দোলাকে বিয়ে করতে তার আপত্তি নেই, কারণ দোলার মনের ইচ্ছা সে নিজেও জানে। কিন্তু কিছুকাল অপেক্ষা করা দরকার। অসুস্থতার সব লক্ষণগুলি সে একেবারে কাটিয়ে উঠতে চায়। সেটাই সাব্যস্ত হল। দীপু রীতিমতো যোগাযোগ রাখে সুজিতের সঙ্গে। আস্তে আস্তে সুজিতকে কেন্দ্র করে একদল লোকের ভিড় বাড়তে থাকে। তারা কেউ ব্যবসায়ী, কেউ রাজনীতিক। এবং সকলেরই ধারণা সুজিত একটি বিচিত্র ধরনের নির্বোধ।

মাসখানেক পরে, যখন সুনীতারঞ্জনের বিয়ের রেজেস্ট্রি আসন্ন, ঠিক এ সময়েই শোনা গেল, সুনীতা আবার অদৃশ্য হয়েছে। রঞ্জনের সেই অদৃশ্য প্রহরা আবার শুরু হল। ঘর থেকে বেরুনো সে একেবারে বন্ধ করে দিল। বীরেন্দ্র প্রস্তাব করলেন, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের সীমায় নামখানার বাংলোয় কয়েক দিন সবাই মিলে বেড়িয়ে এলে হয়। সুজিত সম্মতি দিল। এবং একদিন মোটরে সবাই নামখানায় চলে এল। সুজিতের মনটা প্রফুল্ল হয়ে উঠল সমুদ্র ও সুন্দরবনের এই সীমায় এসে।

কিন্তু যেদিন তারা এল, সেদিন সন্ধ্যাবেলায় সুনীতা এসে উপস্থিত হল। সুজিত অবাক হয়ে তাকে ঘরে তুলে নিয়ে গেল। বীরেন্দ্র, কিরণময়ী এবং দোলা এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করল। সুজিত জিজ্ঞেস করে জানল, এবারেও দীপুর কাছেই খবর নিয়ে সুনীতা এসেছে। সুনীতার চেহারা আর সেরকম নেই। চোখের কোল বসা, এবং দৃষ্টিতে উন্মাদনা। এসে সুজিতকে জড়িয়ে ধরে অজস্র কান্নায় ভেঙে পড়ল, পারছি না, পারছি না সুজিত, তোমাকে ভুলতে পারছি না, দোলার ওপর হিংসেয় মরে যাচ্ছি। এইবারটি শেষ বার, আর আসব না।

সুজিত বলল, সুনীতা, একটু শান্ত হও, তোমাকে এরকম দেখলে আমি অস্থির হয়ে উঠি। তুমি আবার কেন পালিয়ে এলে?

সুনীতা বলল, পারি না যে। মনকে অনেক বুঝিয়েও কিছুতেই তোমার কাছ থেকে সরে থাকতে পারছি না। কেন এমন হল সুজিত? সংসারে তো এমন কতই ঘটে, ভালবেসে সবাই কি সবাইকে পায়? আসলে কী জান সুজিত, আমি যে বিশ্বাস হারাবার পর বিশ্বাস খুঁজে পেয়েছিলাম। কিন্তু হাত বাড়াবার দরজা আমার আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।

এই সময়ে দোলা এল। দোলাকে দেখেই সুনীতা হেসে বলে উঠল, ভয় নেই, তোমার ভাবী বরকে নিয়ে পালাব না। এতে দোলা অত্যন্ত কুপিত হল, সহসা যেন ওর ভিতর থেকে বিস্ফোরণ হল, আপনার মতো মহিলার সঙ্গে আমার কথা বলতেও রুচিতে বাধে।

সুজিত ডাকল, দোলা!

সুনীতা মুহূর্তে যেন হিংস্র ডাকিনী হয়ে উঠল। বলল, তাই নাকি? তোমার ভাবী বর বলেছি, তাই যথেষ্ট। আমি ইচ্ছে না করলে তা হবে না। নিয়ে যাও দেখি তুমি ডেকে ওকে এখান থেকে?

বলে সে সুজিতের হাত ধরল। সুজিত সুনীতাকে বোঝাতে চাইল। দোলা অপলক চোখে সুজিতের দিকে তাকিয়ে রইল। সুজিত বুঝতে পারল, দোলা তাকে ডাকছে। সুনীতা তখন খিলখিল করে হাসছে। দোলা অনড়, নিশ্চল, রুদ্ধশ্বাস, আরক্ত এবং চোখ সরাল না সুজিতের চোখ থেকে। সুজিত সুনীতাকে বারবার ডাকতে লাগল, সুনীতা শোনো, শোনো।…কিন্তু সে দোলার দিকে এগিয়ে যেতে পারল না।

দোলার চোখে জল এসে পড়ল। সে সহসা দ্রুতবেগে বাইরে চলে গেল। সুনীতা হাসতে হাসতে সুজিতের বুকের ওপর লুটিয়ে পড়ল। সুনীতার নিজের চোখ ফেটেও জল এসে পড়েছে, তা ও নিজেই বোধ হয় জানে না। তারপর সহসা হাসি থামিয়ে বলল, আমার যাবার সময় হয়েছে সুজিত, আমি যাচ্ছি। নইলে রঞ্জন ঠিক এখানে এসে পড়বে।

ইতিমধ্যে অন্ধকার নেমে এসেছিল। সুনীতার কথা শেষ হবার আগেই, বাংলোর বাইরে মোটরের শব্দ হল, আর কাঁচের জানালায় গাড়ির হেডলাইটের আলো পড়ল। পরমুহূর্তেই গাড়ির দরজা খোলা ও বন্ধের শব্দ শোনা গেল। মিনিটখানেক পরেই রঞ্জনকে দেখা গেল দরজায়। তার মুখ রক্তাভ, চোখ রক্তাভ, ঘৃণা ও হিংস্রতার এক প্রতিমূর্তি। তখনও সুনীতা সুজিতের হাত ধরে ছিল। তাড়াতাড়ি হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, চলো রঞ্জন, চলো আমরা যাই।

রঞ্জন দরজা থেকে সরে দাঁড়াল, সুনীতা বেরিয়ে গেল। রঞ্জন তাকাল সুজিতের দিকে, এবং হঠাৎ ছুরির ফলার মতো একটু হাসি ঝলকে উঠল তার ঠোঁটে। তারপরে সেও চলে গেল। গাড়ি ছেড়ে দেবার শব্দ শোনা গেল। সুজিত অভিভূতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল, তার খেয়াল নেই। বীরেন্দ্র এসে ডাকতে তার সংবিৎ ফিরল, এবং রঞ্জনের সেই হাসি স্মরণ করে কেঁপে উঠল। বলল, আমি এখুনি একবার কলকাতায় যেতে চাই, আপনি একটু ব্যবস্থা করুন।

বীরেন্দ্র প্রথমে আপত্তি করলেও, পরে রাজি হলেন। প্রায় মাঝরাতে কলকাতায় পৌঁছে সুজিত কালাচাঁদকে ডাকল। তাকে বলল, যেখান থেকে হোক, রঞ্জনকে খুঁজে বের করতেই হবে। কালাচাঁদ সম্ভাব্য সমস্ত জায়গায় সুজিতকে সঙ্গে নিয়ে খোঁজ করল। কোথাও তাদের পাওয়া গেল না। খুঁজতে খুঁজতে ভোর হল, এবং শেষপর্যন্ত এক জায়গায় জানা গেল, সে সম্প্রতি দক্ষিণেশ্বরের দিকে একটা বাসা নিয়েছিল, সেখানে খোঁজ করলে পাওয়া যেতে পারে। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, মস্ত বড় বাড়ি। গঙ্গার ধারে, পোডড়া বাড়ির মতো স্তব্ধ। মানুষ বাস করে কিনা সন্দেহ। কালাচাঁদ যখন দরজায় ঘা দিচ্ছিল, ঠিক সে সময়েই ওপরের জানালায় সুজিত রঞ্জনের মুখটা এক বার দেখতে পেল। সুজিত বলে উঠল, রঞ্জন দরজা খোলো।

কিন্তু সাড়া পাওয়া গেল না। কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে গেল। রঞ্জনই খুলে দিল। সুজিত দৌড়ে ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, ও কোথায়?

রঞ্জন কালাচাঁদের মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে, ঘরের ভিতর এগিয়ে এল। সবই অন্ধকার লাগছিল। কোনও কথা না বলে এক বার তাকিয়ে রঞ্জন সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠল। সুজিত তাকে অনুসরণ করল। তারপর একটার পর একটা ঘর পার হয়ে, চতুর্থ ঘরে রঞ্জন থামল। সেই ঘরটার দরজা জানালা সব বন্ধ, গাঢ় অন্ধকার। রঞ্জন এগিয়ে গিয়ে একটা ছোট জানালা খুলে দিতেই আলো এল। সুজিত দেখল, একটা খাটে সুনীতা শায়িত। তার সর্বাঙ্গে ঢাকা। মুখখানি খোলা। সুজিত এগিয়ে গিয়ে মুখের কাছে ঝুঁকতেই দেখতে পেল, সুনীতার চোখ বোজা। ঠোঁটের কোণে উদগত রক্ত জমাট বেঁধে আছে। সুজিতের মনে হল, সে কিছু বুঝতে পারছে না। সব যেন বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। সে রঞ্জনের দিকে ফিরে তাকাল।

রঞ্জন এগিয়ে এসে, বুকের কাছ পর্যন্ত সুনীতার ঢাকা খুলে দিল। সুজিত দেখল সুনীতার গলায় কালশিরার দাগ। তার হঠাৎ মনে পড়ে গেল, সেই চিঠির লাইন, আমার হাত যাকে খুঁজছে, সে তুমি নয়, সুনীতা।

রঞ্জন আবার গলা অবধি ঢাকা দিয়ে, গভীর আগ্রহে, পরম স্নেহে যেন ঝুঁকে পড়ে, রুক্ষ চুলের গোছা সুনীতার কপাল থেকে সরিয়ে দিল। তারপর বলল, আমি ওকে মেরেছি সুজিত।

সুজিত অনেকটা ভাবলেশহীন মুখে বলল, ও! মেরে ফেলেছ?

-হ্যাঁ। আমার প্রেম, আমার ঘৃণা, আমার ঈর্ষা, আমার সুখ, আমার যাতনা, যা বলো, আমার সবকিছুর অস্তিত্বকেই আমি বিনাশ করেছি। এখন আমি শান্তি বোধ করছি।

সুজিত নির্বাক হয়ে রইল। সুনীতার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রঞ্জন আবার বলল, সুজিত, ওকে মারার পর অনেক আদর করেছি। তুমি একটু করবে না? তুমি ওকে একটু আদর করো সুজিত, বেঁচে থাকতে ওর তৃষ্ণা মেটেনি, তুমি ওকে আমার সামনে একটু আদর করো। আর সময় নেই, পুলিশ আমাকে ধরতে আসবে।

আদর করব? সুজিত অন্যমনস্কের মতো বলল, সুনীতার মুখের কাছে মুখ নামিয়ে গভীরভাবে দেখল। একবার বলল, গাড়ি ছেড়ে দেবার শেষ ঘণ্টায় তুমি এসে পৌঁছেছিলে, মনে আছে?

সে হাসল, কিন্তু চোখের কোণ বেয়ে জল পড়ছিল। সুনীতার ঠোঁটের কোণে রক্তের কাছে তার ঠোঁট নেমে এল। ডাকল, সুনীতা! সুনীতা!

রঞ্জন পুলিশের হেফাজতে। তার যাবজ্জীবন কারাবাসেরই সম্ভাবনা। কিন্তু সুজিতের সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। সে আবার আগের মতোই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এখনও তার কথার মধ্যে ছিটেফোঁটা চিন্তা বা সংবিৎ টের পাওয়া যায়। বীরেন্দ্র যখন জানালেন, গুঁড়িয়াঁটাঁড়ের সেই মানসিক চিকিৎসালয়ে আবার নতুন করে একজন মনোবিজ্ঞানী চিকিৎসা শুরু করেছেন, তখন সে সেখানেই যেতে চাইল। যাবার আগে সে দোলাকে বলল, আমার ওপর রাগ কোরো না। তোমাকে আমি মনে রাখতে চেষ্টা করব। মনটা–মানে–ঠিক আগের মতো হয়তো থাকবে না। তাই এ কথা বলছি।

দোলা কেঁদেছিল, হয়তো যেতে দিতে চায়নি। সুজিত বলেছে, ওর যাওয়া দরকার। ও কলকাতার অযোগ্য। সুজিত আবার ওর নিজের জায়গায় ফিরে চলল। কালাচাঁদ ওকে পৌঁছে দিতে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *