০৩. বন্দিনী

বন্দিনী

রাত্রি নয়, কালরাত্রি। রাত্রি কী ভয়ংকর। মন বুঝে ক্ষণ। মনে সুখ থাকলে আঁস্তাকুড় স্বর্গ হয়ে ওঠে। অথচ রাত্রি কী সুন্দর। ফুটফুটে তারা ভরা আকাশ। থাকল বা অন্ধকার। মেঘ নেই ঝড় নেই। তবু হাওয়া যেন আগলখোলা পাগলা দামাল। গাছে গাছে মাথা ঠোকাঠুকি। শনশন শোঁ-শোঁ রব বাঁশঝাড়ে। সারাদিন কে আগুন জ্বালালে আকাশ ভরে। আর দেখ এখন। শরীর জুড়িয়ে শীতল।

আহা, বাতাসে কী প্রাণ ভোলানো গন্ধ! গন্ধ খুঁই চামেলি বেলফুলের। তীব্র গন্ধ হাসনুহেনার। খুশিতে ডগমগ নাগ-নাগিনীরা। ওই গন্ধে ওরা পাগল। এই বাতাসে ওরা মাতাল। এই তো সময়। এই অন্ধকারে, সোহাগ করে জড়িয়ে থাকবে জুইয়ের ঝাড়ে আর হাসনুহেনার ঝোপে।

আকাশে জ্বলছে তারা আর ডুয়ে জ্বলছে জোনাকি-তারা। অস্থির আর উড়ন্ত তারা। বাতাস তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না। ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে দূর দূরান্তে।

আর গঙ্গা কী দুস্তর!দু ক্রোশের উপরে তার এপার ওপার। হলে কী হবে। মাঝখানে দু ক্রোশ সামিল সুদীর্ঘ চড়া। দু ধারা চলেছে গঙ্গার দু পাড় ভাসিয়ে। গঙ্গা যেন দুটি। পুবে শান্তিপুর, পশ্চিমে গুপ্তিপাড়া। দিনের বেলা গ্রাম দেখা যায় না শান্তিপুরের। ধু-ধু করে। যেন কালো পাহাড়ের মাথা ঠেকে আছে আকাশে। সাত ক্রোশ উত্তরে হল নবদ্বীপ ধাম।

কিন্তু কে দেখবে। বিনি জেলেনির মেয়ে, যেন সাপের মাথার মণি। সে কোন সাপের! কোন নাগরে মাথায় করে নিয়ে চলেছে তাকে, কোন দুধ সাগরের পাড়ে, কে জানে। গুপ্তিপাড়ার অন্ধকার পথ আলো করে চলেছে। রূপের আলো। বুকের মধ্যে আঁকুপাঁকু ধুকুধুকু। দিব্যি নুন জরিয়ে জরিয়ে খাচ্ছিল আম। নোনা স্বাদের ভেজা মুখে গুনগুন করে গান গাইছিল আর গাঁথছিল ঘাসডগার হার। কিন্তু কোথা থেকে কী হল। নোনা স্বাদ কাটল না। চোখের জলে ভরে উঠল মুখ। ঘর ছেড়ে এল মেয়ে। চোখের জলে অন্ধ হল চোখ। ভাবি, কার মুখ দেখে পুইয়েছিল রাত। জেলেনি রূপসী মেয়ের কপালে কে লিখে রেখেছিল এই বরাত।

সোজা মেয়ে, সরল মেয়ে। সাত বোঝে না, পাঁচ বোঝে না। প্রাণখানি বেরিয়ে আসতে চায় নিশ্বাসে। বেরিয়ে আসতে চায় চোখ ফেটে, বুক ফেটে। খোলা পিঙ্গল চুলের রাশি এলোমেলো। ছেয়ালো ছেয়ালো শরীরে কাপড় আলুথালু। ভয়ে প্রাণ ছটফট করে জাঁতাকলের ইঁদুরের মতো। বাপ মরল। ঘোড়ার লাথিতে খুলি ভেঙে মরল। মরে হল ঘোড়ায় পাওয়া দানো জিন! বাবাগো! শিউরে ওঠে গায়ের মধ্যে। ঘোট মেয়ে। তবু হাঁসফাঁস করে বুকের মধ্যে। বুকের মধ্যে কিলবিল করে সংশয়ের সাপ। ঘটক ঠাকুর, ঠাকুরদা চলেছে কোথায় নিয়ে। কতটুকুন আর মগজখানি তার। মাথায় কিছু আসে না। এখন শুধু কান্না, ভয় আর নির্ভরতা। পায়ের নীচে নরম দূর্বা ঘাস। তাকেও যেন ভয়। দু হাতে সর্বেশ্বরকে আঁকড়ে ধরে চলেছে মেয়ে। সে-ই এখন তার সব। তার জীবন মৃত্যু, তার সুখ দুঃখ, সবই তার হাতে।

এই গুপ্তিপাড়াকে দুচোখ ভরে দেখবার কত সাধ ছিল ভানুর। কিন্তু কে দেখবে। এই গুপ্তিপাড়া। নাম তার গুপ্তপল্লী। জাগ্রত ভগবানের বাসভূমি। গাঁয়ের মাটিতে পা দেওয়ার আগে, মাটিতে কপাল ঠেকাতে হয়। কিন্তু কে দেখবে। কে ঠেকাবে মাথা। জাগ্রত ভগবানের লীলাভূমিতে ত্রাস ও প্রাণ মানে না।

আর এই গুপ্তিপাড়ায় আসার জন্যে একদিন কত হাঁপাহাঁপি। কত দাপাদাপি। এক বারটি, বাবাগো, এক বারটি নে চল গুপ্তিপাড়ার মেলায়। রথের মেলায়। কেউ বলত গুমিপাড়া, কেউ বলত গুপ্তিপাড়া। মেলা? অত বড় রথের মেলা এ তল্লাটে আর কোথাও হয় না। জাগ্রত রাধাবল্লভ ঠাকুর। মন্দির কী। গায়ে তার রক্তবর্ণের পোড়া ইটের ছাপে কত চিত্র আঁকা। কী বা তার বাহার। আসল মন্দিরে অধিষ্ঠিত স্বয়ং বৃন্দাবনচন্দ্র। সে মন্দিরের সামনের দেয়ালেও কত কালের কত চিত্রবিচিত্র। পাথরের গায়ে রং-এর আলপনা। রাধাবল্লভের পোড়া ইটে যেন জমাট বেঁধে আছে লাল রক্ত। রাম-রাবণের যুদ্ধের সে কী ভীষণ ছবি! কান পাতলে শুনতে পাবে তুরি ভেরির নাদ। রাক্ষসের হুংকার, বানর সৈনিকের উল্লাস, মৃত্যুর আর্তনাদ। কদমতলায় রাধাকৃষ্ণের মন রং রাঙানির কত লীলা ফুটে আছে দেয়ালে। কান পাতলে শুনতে পাওয়া যাবে কদমগাছে বাতাসের ঝিরিঝিরি, ফুট অস্ফুট প্রেম-পিরিত-রীতি, কপট অভিমান ছলা কলকাকলী। কোথাও গোপিনীরা বস্ত্র হারিয়ে, কুচ যুগে রাখি হাত, শরমে ঢাকি মুখচাঁদ, ডাকে হরি হরি ॥ ইটের গায়ে কত নাচের তাল, চোখে কত ইশারা, নারী পুরুষের কী বিচিত্র ভঙ্গির মিথুন মিলন। আর আছে দশপ্রহরণধারিণীং বিষ্ণু ও গরুড় মূর্তি।

যেমনি ঠাকুর, তেমনি ঠাকুরসেবক বাবুরা। অতিথির অনাদর হয়নি কোনওদিন। রথের মেলায় লোক আসে সারা দেশ ঝেটিয়ে। এক বার তো নৌকা উলটে পঞ্চাশ জন মেয়ে পুরুষ ডুবেই মরল। সে খবর ছাপা হয়েছিল কলকাতার কাগজে। সেই রথ দেখতে আসার জন্য কী কান্না মেয়ের, কিন্তু কে নিয়ে আসবে। বাপ তো বাপ। হাঁক তো হাঁক। এক হাঁকেই রা বন্ধ।

আর আজ। সেই গুপ্তিপাড়া। অন্ধকারে ঝোড়ো বাতাস। ঘরে ঘরে আগল বন্ধ। নিশুতি গাঁ। কানে শুধু হুতোম পেঁচার হুম হুম। মনে আসে গুপ্তিপাড়ার ভয়। ভয় নেই আবার। মনে নেই কেষ্টানাদ মোহান্তের কথা। হালিশহরের মানুষে আজও গল্প করে। বৃন্দাবনচন্দ্র ঠাকুরের সেবাইত কেষ্টানাদ। যম। মেয়ে-খেগো যম। আজ এর মেয়ে ললাটে, কাল ওর মেয়ে। মস্ত ডাকাত ছিল। দল ছিল বিরাট। রাত করে কত মহাজনি নৌকার সর্বনাশ করেছে। তারপরে ধরা পড়ল। সেও কি আজকের কথা। পঁচিশ বছর হল। তখনকার ম্যাজিস্ট্রেট স্মিথ সাহেব দিল জেল ঠুকে। চার দফা মিছিলে সাজা সাব্যস্ত হল। চার দফা মিছিল মানে চার দফা শুনানি। কলকাতার সংবাদপত্রে এ নিয়ে কত লেখালেখি। দু হাত তুলে সবাই আশীর্বাদ করলে ম্যাজিস্ট্রেটকে।

কেন, তারকেশ্বরের মোহান্ত? সব মোহান্তই অমনি। সে আরও আগের কথা। নষ্ট মোহান্ত বেশ্যা নিয়ে বাস করত। সে বেশ্যার আবার উপপতি ছিল একটা। মোহান্ত টের পেয়ে একদিন গেল সেই মেয়েমানুষের বাড়িতে। দেখে, উপপতি জাঁকিয়ে বসে রয়েছে। অমনি মাথায় চড়ল আগুন। মেয়েমানুষটিকে বলল খাবার জল আনতে। সে গেল তো অমনি মোহান্ত এত বড় একটা ছুরি বের করে ঢুকিয়ে দিল উপপতির বুকে। তার আবার কত কথা। আদালতে দাঁড়িয়ে বলে, আমি হলাম দশনামী দণ্ডী। আমি অবধূত। মেয়েমানুষ নিয়ে থাকা আমার ধর্ম। তোর ধর্ম তো তোর ধর্ম। ফিরিঙ্গি মেয়ে রাজার পুলিশেরাও তেমনি ডাকসাইটে। মোহান্তকে ধরে দিল গলায় লটকে ফাঁসি। যাও দশনামী দণ্ডী, অবধূত ফাঁসির দড়ি গলায় পরে যত খুশি মেয়েমানুষ নিয়ে ধর্ম কর গে। নাম ছিল তার শ্রীমৎ রামগিরি।

গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। মনে জাগে শুধু সেই সব ভয়ের কথা। চারদিকে শুধু ভয়। ভয়ের সমুদ্র। তার বুকে আশ্রয়ের ভেলা হল কিনা সর্বেশ্বর ঘটক।

নিশুতি গুপ্তপল্লী। গুপ্ত আছেন ভগবান। শুধু সেইজন্যেই গুপ্ত নয়, সত্যিকারের গুপ্ত অর্থাৎ বৈদ্যদের বড় ছড়াছড়ি। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রী ও ভিষকরত্নের দেশ। সেনেরাও ঘরানা ঘর। সেনপাড়া নাম থেকেই সেটা অনুমান করা যায়। এ গ্রাম ছিল ওপারে। শান্তিপুর ছিল এপারে। তলে তলে খেলা জুড়ে দিল গঙ্গা। কত শত বছরের খেলা, আর কী বিচিত্র খেলা। গ্রামকে গ্রাম ঠেলে নিয়ে গেল ওপারে, অন্যগ্রাম ঠেলে দিল এপারে। নবদ্বীপকে সুদ্ধ এপার করে দিল।

পুণ্যবতী বৃদ্ধা গুপ্তিপাড়া। ছানিপড়া চোখে, ভীত বিস্মিত বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে দেখে গঙ্গাকে। হাসিতে ঢলঢল, রূপে ঝলমল গঙ্গা। কিন্তু তার খাঁই বড় কম নয়। তার চোরা ঘূর্ণি স্রোত কোনওদিন হয়তো ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সারা গুপ্তিপাড়া।

একদিন ছিল কত কী! তখন সপ্তগ্রাম জমজমাট। গুপ্তিপাড়া বামুনের ছেলেদের ভিড়ে গিজগিজ করত। তখন ছিল অনেক টোল। আজ ঊনবিংশ শতাব্দীর অর্ধেক উজাড়। এখনও কুল্যে গোটা পনেরো ন্যায়শাস্ত্রের টোল আছে। তবে ফাঁকা ফাঁকা। আড়ো আড়ো ছাড়ো ছাড়ো। সে যুগই যে আর থাকতে চায় না। বেদ আর বেদ-ভাষা যাচ্ছে দূরে। এখন শুধু কোম্পানির ভাষা ইংরেজি শিক্ষা। যখন যেমন তখন তেমন। নইলে কে জোগাবে ভাত কাপড়। রাজ-ভাষা না শিখলে কে দেবে কাজ। কাজ চলবেই বা কেমন করে। তা ছাড়া ওই সর্বনাশী বর্ধমানের জ্বর। কী রোখ ওই সর্বনাশী জ্বরের। মড়কে উজাড় করতে চলেছে সারা দেশ।

তবু, গ্রাম কি আজকের। মুকুন্দরামের চণ্ডীতে আছে, বাহ বাহ বল্যা ঘন ঘন পড়ে গেল সাড়া। বামভাগে শান্তিপুর, ডাহিনে গুপ্তিপাড়া ॥ শুধু কি তাই। বিজয়রাম সেনের তীর্থমঙ্গলে আছে, গুপ্তিপাড়ায় ব্রাহ্মণের কি কহিব নীত। মহাতেজ ধরে তারা বিচারে পণ্ডিত ॥ আরও কত। হালিশহরের লাটু ঠাকুর রোয়াকে বসে কেমন সুর করে করে পড়ে ওইসব চণ্ডী-পুথি। গল্প করে। বলে, এই গুপ্তিপাড়ার ছেলে হল মোহনলাল। সিরাজদ্দৌলার বাঙালি বীর সেনাপতি। যেমনি লড়িয়ে তেমনি বোঝদার। ঠিক ধরল মিরজাফরের কারসাজি। কত বললে নবাবকে, হুজুর, জাঁহাপনা আপনার বড় সেনাপতিকে সামলান। লইলে সব যাবে। আর যাবে। তখন যেয়ে বসে আছে। তবু গুপ্তিপাড়ার ছেলে গেল না। লড়াই করে প্রাণ দিল পলাশীর মাঠে।

আর আছে মেয়েদের চোপা। নাম করা চোপা। বিনির মেয়ে গঙ্গারও বড় চোপা। কতজনে কতদিন গুপ্তিপাড়ার মেয়েদের চোপার তুলনা দিয়েছে তার সঙ্গে। বলেছে–

উলার মেয়ে কুল কুনুটি,
নদের মেয়ের খোঁপা,
শান্তিপুরে নথ নাড়া দেয়
গুপ্তিপাড়ার চোপা।

 ওই চোপাই আবার বড় মিষ্টি। নইলে নদের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ভাঁড়, নাপতে গোপাল কেন বিয়ে করবে গুপ্তিপাড়ার বাঁচাল নাপতেনিকে! আর, কাঁচড়াপাড়ার ওই সরস্বতী ঠাকরুনের আদুরে ছেলে, কী নাম যেন তার এখন কলকাতায় কাগজ বের করে। কাগজের নাম সংবাদ প্রভাকর। সে একজন কবি। বুলি কী! বলে,

যত ছুঁড়িগুলো তুড়ি মেরে কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে,
এ.বি. শিখে, বিবি সেজে, বিলাতী বোল কবেই কবে।

সেও তো এই গুপ্তিপাড়ার চোপাউলিকেই ঘরনী করেছে। কাঞ্চনপল্লীর গুপ্ত এসে গুপ্তিপাড়ার বদ্যিনিকে বিয়ে করেছে তাই বুঝি অত কলমের চোপা। এখন হুগলি চুঁচুড়ার কতকগুলি মেয়ে নাকি মেমসাহেবের স্কুলে যায়। আর পাড়ার ছোঁড়াগুলি ওই ছড়া বলে বলে পেছনে লাগে তাদের।

আর আছে কাঁড়ি কাঁড়ি বাঁদর। তাই গুপ্তিপাড়ায় গাছে গাছে, মন্দিরে মন্দিরে, বাড়িতে বাড়িতে বাঁদরের বড় উপদ্রব। কোত্থেকে এসেছে? না গুপ্তিপাড়া থেকে। ও গুপ্তিপাড়ার বাঁদর। ভিন গাঁয়ে এই বলে বড় জব্দ হতে হয় গুপ্তিপাড়ার মানুষকে। মহারাজ কেষ্টচন্দ্র তো একবার গুপ্তিপাড়ার বাঁদর বাঁদরি আনিয়ে বিয়েই দিয়ে ফেলল৷ সে বিয়েতে নদে হুগলির কত পণ্ডিত গিয়েছিল। আর সবাইকে, এই এত এত দানসামগ্রী।

সেই গুপ্তিপাড়া। না, হাতি নেই, ঘোড়া নেই। মস্ত মস্ত হাবেলি নেই। হাবেলি হল হাউলি। যাকে বলে বড় বড় বাবুদের সুন্দর সুন্দর বাড়ি। সে আছে হাবেলি শহরে। অর্থাৎ হালিশহরে।

 এখানে আছে মন্দির। মন্দির আর টোল। তাও টোলের ধ্বংসাবশেষ। পুণ্যভূমির সেদিন নেই। সে পুণ্য নেই। টিমটিম করছে কিছু ন্যায়শাস্ত্রের টোল। নতুন যুগে সাড়াশব্দহীন। বিগত জীবনের ঢেউহীন নিস্তরঙ্গ স্তিমিত জীবনযাত্রা। সন্ধ্যারাত্রে শাঁখ কাঁসর ঘন্টার শব্দে এক বার জেগে ওঠার চেষ্টা করে।

কিন্তু শয়নবিমানে ঠাকুরকে শোয়ানোর পরেই সব নিঝুম। ভগবান গুপ্ত আছেন কি না কে জানে। তার সবকিছুর সঙ্গে সঙ্গে রাম-সেনানীর দাপটও আর তেমন নেই। রাম-সেনানী অর্থাৎ বাঁদর।

এখন গভীর অরণ্য, গহন বন। দিকে দিকে লতা ও গুল্মের সর্বগ্রাসী আক্রমণ। বাড়ি ও মন্দিরগুলিতে বট অশ্বথের চারা তুলছে মাথা। কেয়ারি করা জুই মল্লিকার ঝাড়ের ছড়াছড়ি সারা গাঁয়ে। বাড়ি বাড়ি মন্দিরে মন্দিরে। হাসনুহেনা আর বনতুলসীর সীমা নেই। তারই গন্ধে মদির বাতাস। সেই মদিরতার রূপ এই রাত্রি।

কিন্তু পুরনো দিনের মাঝে গুপ্তিপাড়ায় যেটি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, সেটি কুটির পাড়া। এখন সুবিস্তৃত গুপ্তিপাড়ার যত রং, যত ঢং, যত আলো বাতাস, লোক-লশকর, গাড়ি ঘোড়া, দাসী-বাঁদি, মারধোর হল্লা চিৎকার, সে সব গিয়ে জড়ো হয়েছে কুটির পাড়ায়। এত কথার সঙ্গে সেটা না বললে, অপূর্ণ থেকে যায় গুপ্তিপাড়ার পরিচয়।

কুটির পাড়া হল কুঠি পাড়া। নীলকুঠি। এখন কুঠিয়াল সাহেবদের বড় দবদবা। গঙ্গার ধার থেকে গাঁয়ে ঢুকতে, কুঠিপাড়া ডাইনে রেখে আসিবার সময়ও দেখা যায়, আলোর রোশনাই। শোনা যায় বরকন্দাজের হুংকার, বে-আদব রায়তের চিৎকার শোনা যায় জেলখানা ঘর থেকে। সেই সঙ্গে গুমোট ঘরের শিকল ঝনঝনা। শুধু রায়ত কেন, গোটা দেশটাই বে-আদব, কুঠিয়ালের মর্জি না মানলে।

এখন সব রস ওখানে। কখনও জুড়িগাড়ি, কখনও ঘোড়ায় চড়ে ছুটছে সাহেব। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়, সাহেবের আগে ছোট দেওয়ান। সাহেব মাতলামি করে ফিরছে, মেয়েমানুষ আনছে একটার জায়গায় দশটা।

সেখান থাকে থাকে নীল পচাবার চৌবাচ্চা। পেতলের পেল্লায় কড়াই আর ভলকে ভলকে ধোঁয়া বেয়োয় উঁচু চিমনির হা মুখ দিয়ে। গুপ্তিপাড়ার কোনও যোগাযোগ নেই।

.

রাত্রি ভয়ংকরী। চারপাশে তার বিভীষিকার ছায়া। মাঝে আছে শুধু ভানুমতী। ছোট মেয়ের মনে খিল এঁটেছে ভাবনা। ভাবনা এখন শুধু দুর্বোধ্য দুরন্ত ভয়। মন ভাঙছে। ভাঙছে শরীর। দু হাতে জড়িয়ে ধরে আছে সর্বেশ্বরকে। অন্ধকার রাজপথ। শরীর এলিয়ে পড়তে চাইছে। ছোট বুকটি আর সয় না, সয় না। উত্তর দক্ষিণ নেই, পূর্ব পশ্চিম নেই। কোনদিকে চলেছে কিছু জানে না।

শুধু গুপ্তপল্লীর পথে গুপ্ত আনন্দে মত্ত সর্বেশ্বর আর নন্দন। খাসা বস্তু এনেছে লুটে, সেই আনন্দ। নির্বিঘ্নে এসেছে এত দূর, সেই আনন্দ। এবার বস্তুটির সদগতি হল শেষ কাজ। কিন্তু সদগতি হতে কিছু বিলম্ব আছে। তার আগে দরকার, ঠিক জায়গাতে বস্তুটি গুদামজাত করা। এখন আর কোনও কথা নেই।

গতি একটু মন্দ হল। সামনে একটি ভাঙা মন্দির। সন্ধ্যাবেলা কে রেখে গেছে প্রদীপ। এখনও জ্বলছে টিমটিম করে। মন্দিরের পেছনেই বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড়ের পশ্চিমে একটেরে একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল তারা।

চোখ মেলল ভানুমতী। কোথায় এল। একি তাদের বাড়ি। ঘরে বুঝি শুয়ে আছে বাপ। যেন স্বপ্নভাঙা চোখে তাকাল ভানু।

আশেপাশে আর বাড়ি দেখা যায় না। শুধু একটি। মাটির বাড়ি, গোলপাতার ছাউনি। চারপাশে বেড়া লাগানো ভেরান্ডা আর ফণীমনসার বেড়া। উঠোনের মাঝে দেখা যায় কোনও ফলপাকুড়ের মাচা। নিঝুম বাড়ি। শুধু ঝিঁঝির চিৎকার! আগল ঠেলে ঢুকল সর্বেশ্বর। সঙ্গে ভানু, পেছনে নন্দন। পা টিপে টিপে যেন চোর ঢুকছে বাড়িতে। কেন? এত চুপি-চুপি কীসের। ঘটক ঠাকুরের বোনের বাড়ি তো!

দরজায় এসে টোকা দিল সর্বেশ্বর। চাপা গলায় মোলায়েম করে ডাকল, দিদি। দিদি কি ঘুমোচ্ছ?

রাতজাগা হুতোম ডেকে উঠল, হুম! হুম! কেঁপে উঠল ভানুর বুকের মধ্যে। লেপটে এল আরও সর্বেশ্বরের গায়ে।

আবার ডাকল, ও দিদি, একবারটি জায়গা।

মেয়ে গলায় জবাব এল, দূর হ ঘাটের মড়া। অন্য জায়গায় দ্যাখ। এ ঘরে খাঁড়া হাতে জাগছে মা কালী।

ওই রকম বলা হল রেওয়াজ। রাত বিরেতে চোর ডাকাতে এসে ডাকে এমনি করে। ছলনার মায়া ডাক। ডাকে, ও মাসি! ও পিসি! এমনি কত ডাক। যেন কত কালের আত্মীয় এসেছে যুগযুগান্ত পরে! যে চালাক সে এমনি করেই জবাব দেয়।

সর্বেশ্বর আরও মোলায়েম করে বলল, দিদি, শৈলদিদি, আমি তোমার সোব্বেশ্বর।

জবাব এল তেমনি গলায়, আমি সোব্বেশ্বরের যমদুতী। ভাগ তো ভাগ, নইলে চেঁচ্চে গাঁ মাথায় করব।

কী বিড়ম্বনা! যত তাদের বিড়ম্বনা, তত ভয় ভানুর। ঘটক ঠাকুরদার এ কেমন ধারা বোন। ভাইয়ের গলাও চেনে না।

সর্বেশ্বর আর নন্দন, দুজনেই হাঁসফাঁস করে। শেষটায় কূলে এসে তরী ডুববে! আর হুতোম পেঁচা কোত্থেকে ভ্যাংচায় যেন তাদেরই, হু-উ-হুঁ-উ!

সর্বেশ্বর ব্যাকুল গলায় আবার বলল, দোহাই শৈলী, একবার দেখ বেড়ার ফাঁক দিয়ে, কাকে নিয়ে এসেছি। নন্দন এসেছে আমার সঙ্গে। বিশ্বেস না হয় লক্ষ্মী ভাই, এক বারটি উঁকি মেরে দেখ।

বোধ হয় উঁকি মেরেই দেখল। ঘরে জ্বলল বাতি। তারপর খুলে দিল দরজা। ঢোকবার মুখে বোনরূপী শৈলকে চোখের ইশারা করল সর্বেশ্বর। মুখে রাখল আঙুল। অর্থাৎ, চুপ!

শৈল এমনিতেই চুপ। ঘুম-ভাঙা চোখে তার রূপের ধাঁধা। এ কোন রূপের ঝাঁপি নিয়ে এল ঘটক ঠাকুর। তার অন্ধকার ঘরে এ কোন সাপের মাথার ছিনিয়ে আনা মণি। বিস্ময়ের সঙ্গে বুকের মধ্যে ভয়ের শিহরন। রূপের মণি যে সাপের মাথার। ঘরে এনে তুলল, কিন্তু এ রূপের এদিকে ওদিকে কালনাগের ছোবলের ভয়। আঁধারে অঘোরে কখন আসবে সেই মণিহারা নাগ। আসবে দারুণ রাগে, ফুঁসে ফুঁসে। জল জঙ্গলে তার মণির পথ চিনে চিনে। রূপ দেখে কাঁটা দিয়ে উঠল বুকের মধ্যে।

চোখ টিপল সর্বেশ্বর। চোখ টিপল নন্দন। চোখ টেপে আর বলে ভানুমতীর দুঃখের কাহিনী। তার বাপের অপঘাত মৃত্যুর কথা বলে আরও ভয়ংকরের অলংকার দিয়ে। বলে শৈলীকে, কিন্তু ছল করে শোনায় ভানুকে। মাঝে মাঝে দেয় স্নেহ ও করুণার রসান।

শৈলী শোনে আর ভাবে। বাগদিনি শৈল। পরিচয়ে কোথাও তার লুকোচুরি কিছু নেই। সবাই জানে, শৈলী হল ঘুসকি। গৃহস্থীর আবরণে রসিক নাগরী। আবরণ আছে, কিন্তু লুকোচুরি নেই তা বলে। সমাজের এমনি রীতি রঙ্গ। বিধবা বাদগিনি মেয়ে, ঘর করে একলা একলা। ধান ভানে এর ওর বাড়িতে। পালা পার্বণে কাজে কর্মে উৎসবে ঝিয়ের কাজ করতে যায় বাবুদের বাড়িতে। গোরু পোষে, দুধ দোয়, বিক্রি করে বাঁধা খদ্দেরকে। বাবুদের লুকিয়ে চুরিয়ে অন্তঃপুরের বউ-ঝিদের গোপন ফাইফরমাশ খাটে। অন্তঃপুরই গোপন স্থান। তারও আবার গোপনতা আছে। গোপনতার সেই চোরা পথ অন্তঃপুরের বাইরে, নানাদিকে, বহু দুর বিস্তৃত। স্যাকরার বাড়ি থেকে গুণিন ওঝার গুপ্ত আবাসে। স্বামী বশীকরণ আর কুলীন মেয়ের ভ্রুণ-হত্যার গোপন ঔষধালয়ে। অন্তঃপুরে সে গুপ্ত দূতী। কিন্তু চোখের মণি নয়, চোখের বিষ।

অন্তঃপুরেরই বুক ভেঙে সে যে আবার মন কাড়ে বাবুদের। বাবুরা যখন গৃহকর্তা, যখন ডাকসাইটে স্বামী আর বাপ, তখন বাবুরা চিনতে পারে না শৈলী বাগদিনিকে। কিন্তু গোঁফের ফাঁকে লুব্ধ হাসি, চোখের কোণে রসের অন্তঃস্রোতের ধারা পড়ে গলে গলে। অন্তঃপুরে তার দূতী-লীলার কথা বাবুরা জেনেও জানে না, ভেবেও ভাবে না। পরে আবার তার শোধ তুলবে না শৈলী! মুখের চেয়েও বড় অস্ত্র শৈলীর সামান্য নারকেল শলার ঝাঁটা। তার সামনে দাঁড়াবে কে?

সর্বেশ্বর আর নন্দনের কল্পিত কাহিনী শোনে আর আহা আহা করে ওঠে তার বুকের মধ্যে। দুধের শিশু। বাপ থাকতে বাপহারা করে নিয়ে এল। বামুন দুটোর প্রাণে কি ছাই ভগবান একটু মায়া-মমতাও দেয়নি গো! আহা আহা!

ভাবে আর দেখে। সাপের মণি দেখে। নাগরী শৈলী। কিন্তু গৃহস্থের পূর্ণ রূপ আছে তার ঘরে! খালি কি গুপ্ত দূতী! আর বুঝি গাঁয়ে কোনও কাজ নেই। প্রসব করানো, আঁতুড় সামলানো। কত কাজ। তাকে ছাড়া চলে কার। জীবনে তার আলো আছে, আঁধারও আছে। আলো-আঁধারে মেশানো জীবন। সে আছে সকলের কুরীতি সুরীতির মধ্যে। সকলের সুখে দুঃখে। থাকলই বা গাঁয়ের এককোণে, দুর বন বাঁশঝাড় জঙ্গল আর মাঠের ধারে।

আর লুণ্ঠিতা ভানুমতীর ভয় বেদনাটুকু বাজবে না তার বুকে! এক ফোঁটা মেয়ে। হালিশহরের কোন জেলের সর্বনাশ করে নিয়ে এসেছে বামুন দুটো। শোনে আর ভাবে। ওইটুকুই মেয়ে। কিন্তু খাঁটি শলুই, জাত সাপের বাচ্চা। কেমন টিকোলো নাক, চোখের তরাস কী! গলায় ওটা কী? ও, ঘাসবিনুনির হার। বেচারি! মাথায় একটু তেলের ছোঁয়াও নেই। জট পাকিয়েছে, রং হারিয়েছে রোদে ধুলোয়। মেয়ের মাথার উপরে মা নেই, তাই। তাই এত অযত্ন। বুঝি তাই হাতে পড়েছে সর্বেশ্বরের। ধাড়িবিহীন বাচ্চা, সে তো বলির জীব।

ঘুম কেটে গেল শৈলীর। সে দেখে শোনে আর ভাবে। ভাবে, কী ভাবে কাজ উদ্ধার করতে হবে। এক মন পোড়ে, আর এক মন আঁটে মতলব। সর্বেশ্বরের কথার আড়ালে সঠিক সাংকেতিক উক্তিগুলি বুঝতে তো ভুল হচ্ছে না। কাজও তো নতুন নয়। এর আগে দু বার হয়েছে এমনি। কিন্তু সেই দুবার ছিল না এত গোপনতা, ছিল না এত কঠিন পরীক্ষা। যে আসল মানুষ, ওই ভানুমতী, সে নিজে জানে না তার ভবিষ্যতের বিন্দুবিসর্গ। যা মেয়ে। দেখে যা মনে হচ্ছে, বেঁকে বসবে নিশ্চয়। এ পাখি কি পোষ মানবে? বুলি কপচাবে? মনে হয় না।

তবু চেষ্টা করতে হবে, মন্ত্র ছাড়তে হবে। যেমন করে মদ্দা পায়রা পাখা বিস্তার করে মেয়ে পায়রার চারপাশে ঘুরঘুর করে আর মন্ত্র ছাড়ে বকবকম! তেমনি করে। রাজি না হলে ঠোকরাতে হবে, ঠোঁট শানিয়ে। ওই ওঝাদের মতো। হাত বুলোতে হবে আবার মারতে হবে সপাং সপাং ছপটি।

তবে বড় গোপনে। এ ব্যাপারে বড় ঢিঢি পড়ে গেছে চারদিকে। কলকাতার সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে এ সব কেলেঙ্কারির কথা। কী যন্ত্রই বেরিয়েছে। যন্ত্র বের করেছে সাহেবরা। সেও কি আজকের কথা। শৈল শুনছে জন্ম-অবধি। মস্ত মস্ত কাগজ, আষ্টেপৃষ্ঠে তার লেখা। তাও কি একখানি। অমনি ছাপা হয়। শত শত। শৈল নিজের চোখে দেখেছে তার হরফ। পড়তে পারে না। কিন্তু দেখেছে। গুপ্তিপাড়ার অনেকেই দেখেছে। কয়েক বার এসেছে ছাপা কাগজ। এখনও আসে মাঝে মাঝে। পণ্ডিতদেরই বাসভূমি এই গুপ্তিপাড়া। এখানে আসবে না তো, আসবে কোথায়। তবে আসে কালে ভদ্রে। কলকাতা বলে কথা। সে কি এখানে? রেল লাইনের কাছে হলেও কথা ছিল। সেখান দিয়ে না কি দিনে দুটো তিনটে রেলগাড়ি চলে। তা ছাড়া এখন আনবেই বা কে? যারা আনবে দেখবে, নতুন জ্বরের আক্রমণে আর কাজকর্মের ফিকিরে তারা অনেকেই গেছে কলকাতা নয়তো চুঁচুড়া। তবে হ্যাঁ, এখনও আছে। মস্ত জ্ঞানীগুণী পণ্ডিত বামুন। সত্যযুগের তেজি ব্রাহ্মণ তারা। এখনও পৈতেয় হাত দিলে সবাই চমকে ওঠে। তারাই আছে টোল আর পড়ুয়া নিয়ে। কিন্তু ছাপা কাগজ আনে না তারা।

খালি কাগজে ছাপেনি সেই কেলেঙ্কারি। ছড়াও বেঁধেছে। দেশের মানী জ্ঞানী লোকেরা লেগেছে উঠে পড়ে এই সব কেলেঙ্কারি থামাবার জন্যে। কত কেলেঙ্কারি। বামুনদের ঘরে শূদ্রাণী। শুদ্ধের ঘরে অশুদ্ধ। ভটচাযের ঘরে কেওরানি। বাঁড়ুয্যের ঘরে জেলেনি। তাদেরই ছেলেরা আবার টিকি নেড়ে, ঘণ্টা বাজিয়ে পুজো করে।

শাস্ত্রের নামে শাস্ত্র। যে যার কাজ ঠিক করে চলেছে। শাস্ত্র বিধান দিয়েছে একদল কুলীন, আর একদল বংশজ। কুলীনের পায়ে গড়াগড়ি যায় শত শত মেয়ে। আর বংশজের কপালে জোটেনি একটা কানা-খোঁড়া বামনি।

এই বংশজ বামুনেরাই হল সর্বেশ্বর আর নন্দনের শিকার। ওই শাস্ত্রবিহিতের সুযোগেই মেয়ে বিক্রির ব্যবসা ধরেছে তারা। দেখা-শোনা নেই, বাছ-বিছার নেই। খোঁজ-খবর নেই জাত-বেজাতের। নজর খালি বঁড়শির মুখে খাবারটুকুর দিকে। তার আড়ালে যে আছে গেঁথে মারার তীক্ষ্ণ বিষবঁড়শি, সে খোঁজ কে করে। কথায় বলে, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।

চোখে নয়, শৈল তার মনের সোনা দিয়ে ঘষে ঘষে দেখে ভানুমতীর মন কষ্টিপাথরে। এ মেয়েকে রাজি করানো যাবে কি। সর্বেশ্বরের সঙ্গে এই মেয়ে বিক্রি ব্যবসা করেছে আগে। কিন্তু সে দুটো ছিল সেয়ানা। কেনা মেয়ে। যাকে বলে ক্রীতদাসী। বয়সও হয়েছিল। দু কথায় রাজি হয়ে গিয়েছে। তাদের আবার পাপ-জ্ঞান। আত্মীয়স্বজনে বিক্রি করে দিতে পেরেছে আর তারা পারবে না বে-জাতের মেয়ে হয়ে বামুনের ঘর করতে। খেতে পেলেই হল। মাথার উপর মিললেই হল ঘর।

এখন তো তবু কমেছে এই ব্যাপার। আগে খোলাখুলি, দিনমানে, যাকে বলে খাতায় খাতায় ভরার মেয়ে এনে, মেয়ে-বেচা ঘটকেরা মেয়ে বিক্রি করত। অর্থাৎ বিয়ে দিত। নৌকায় করে নিয়ে আসত সেই সব মেয়েদের। তাই বলে ভরার মেয়ে। তার মধ্যে তেলি, বাগদি, নাপিত, মালাকার সবই আছে।

এখন বড় কড়াকড়ি। বড় মাজামাজি। কাগজে কাগজে কথা। কেউ কেউ বলে, মেয়ে-রাজা আইন করেছে এর জন্যে। কুলীনের কুড়ি কুড়ি, বংশজের কানাকড়ি, সেটি হবে না। এ সব নাকি বন্ধ হবে।

কবে হবে, কে জানে। চলছে তো। কয়েক সন ধরে দেশে অরাজক অবস্থা। সিপাহি বিদ্রোহের জের কাটেনি এখনও। যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে, শান্তিও হয়েছে। তবু কোম্পানির মাথার ঘাম পায়ে পড়ছে অষ্টপ্রহর। দেশের মাথারাও তাই চুপ করে আছে।

সর্বেশ্বরেরা নির্বিঘ্নেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের আটকায় না। আর সে তো পাপিষ্ঠা। সে তো নষ্ট মেয়েমানুষ।

শৈল দেখে ভানুকে। ভানুও দেখে শৈলকে। ঘটক ঠাকুরদার বোন। বয়স কত আর। ত্রিশ-বত্রিশ হবে হয়তো। কপালে সিঁথিতে সিঁদুর নেই। এদিকে পরেছে পাছাপেড়ে। দিব্যি তেল চকচকে আঁটসাঁট করে বাঁধা খোঁপা। তাম্বুলরঞ্জিত ঠোঁট। চোখে কাজল। কপালে টিপ কাঁচপোকার। আলতা পায়ে পরেছে। বাঁকমল, কোমরে বেড় দিয়েছে রুপোর গোট। নাকে নোলক। চেহারাখানিও মন্দ নয়। আঁটসাঁট গড়ন। কালো হলে তার মাকে কি এমনি দেখতে হত? কে জানে?

কিন্তু, কেমন যেন লাগে ভানুর। এ কি বামুনের বিধবা মেয়ে? ঘটক ঠাকুরদার বোন! এমনি চেহারা দু-একটা না দেখেছে এমন নয়। কিন্তু তারা সকলেই খারাপ মেয়েমানুষ। নইলে বামুনের বিধবার আবার পায়ে মল, চোখে কাজল কীসের। কোমরে বা অমন ঘটা করে গোট পরে কে? ভয়ের ঘোরে সন্দেহের নতুন ঘুলঘুলি চোখে পড়ে যেন তার। এইখানে, এই মেয়েমানুষটির কাছে থাকতে হবে তাকে? কিন্তু, এ কী রকম মেয়েমানুষ। এ কেমন ধারা চাউনি। যেন বিধে মারছে, যেন ছুঁচ ফুটিয়ে দেখছে গায়ের মধ্যে।

হাত দিয়ে ধরে আছে সর্বেশ্বরের উড়নি। আর মন বেঁকে উঠছে আপনি আপনি। ভয়ে আতঙ্কে রুদ্ধশ্বাস বুকে ঝড়ের আগের গুমোট ছটফটানি৷ শৈল যেন দুরে মেঘগর্জনের গুরগুরোনি ধরিয়ে দিল বুকের মধ্যে। চোখ সরে না ঘটক ঠাকুরদার বোনের মুখের উপর থেকে। শিকারের নজর সরে না শিকারির চোখ থেকে। এ কী রকম মেয়েমানুষ। কী রকম তার পরিবেশ। ঝকঝকে ঘর, চকচকে শয্যা। আর কেমন একটা বড়মানুষি, বাবুমানুষি সুবাস ঘরটির মধ্যে।

ভানু দেখে আর শোনে। বারে বারে শোনে বাবার অপঘাত মৃত্যুর কাহিনী। ঘোটক রূপী প্রেতের ভয়ংকর লোভের কথা। শুনছে আর শক্ত করে ধরে রেখেছে ঠাকুরদার উড়নি। ঘটক ঠাকুরদা বলছে বটে, তাকে রাখবার জন্য। কিন্তু তার মন যে চাইছে না থাকতে।

কথায় কথায় রাত হচ্ছে। এদিকে আবার ফিরতে হবে। না ফিরলে সন্দেহ হতে পারে হালিশহরের লোকের। ভোলা জেলের মেয়ে গঙ্গাকে পাওয়া যাচ্ছে না। খোঁজ খোঁজ রব পড়বে জেলে পাড়ায়। খোঁজার মুখে শুনতে পায় যদি, সর্বেশ্বর ঘটক কাল থেকে গাঁয়ে নেই। ঘরের বামনি যেমন ট্যারা বাঁকা কথা বলে। কী বলতে কী বলবে, কে জানে। অবশ্য, গঙ্গার প্রসঙ্গে কারও মনেও আসবে না সর্বেশ্বর-নন্দনের কথা। তবু, সাবধানের মার নেই। ফিরে যেতে হবে রাতে রাতে।

কাহিনী শেষ হল। লক্ষ্মী বোনকে অনুরোধ উপরোধ হল অনেক। আহা, এটুকু করতেই হবে তাকে।

তারপর বলল সর্বেশ্বর, পা ধোবার জল দেও দিকিনি শৈল। ভানুকে বলল, বোস দিদি, হাত পা-টা ধুই একটু।

ওটা হল বাইরে যাওয়ার ইশারা। শৈল ঘটি ভরে জল নিল। সর্বেশ্বর গেল বাইরে। ঘটি নিয়ে বাইরে যাবার আগে শৈল বলল ভানুকে, বলল চোখমুখ ঘুরিয়ে, আদরের সুরে, ভয় কী গো নাতনি। আমি যে তোমার ঠাগমা, বয়স কম হলে কী হবে। বসো নন্দন দাদার কাছে, দাদার পায়ে জল দিয়ে আসি।

কথা শুনে ধক করে উঠল ভানুর বুকের মধ্যে। কিছুই নয়, তবু কথাগুলি যেন কেমন করে বলল ঠাকুরদার বোন। হাসিটি কেমন যেন বিশ্রী। আর কেমন করে চলছে। যেন ঘুমের ঘোরে, হেলে দুলে।

সর্বেশ্বরকে ছেড়ে নন্দনকে ধরল ভানু।

বাইরে এসে ঠকাস করে জলভরা ঘটি রেখে দিল শৈল। আসল মূর্তিতে দেখা দিল এতক্ষণে। তীব্র চাপা গলায় বলল, মরণ! রাত দুপুরে আপদ নে এসে হাজির।

সর্বেশ্বর তাড়াতাড়ি শৈলর হাত চেপে ধরল, চুপ! চুপ! শৈল, প্রাণ আমার

শৈল হাত ঝটকা দিয়ে বলল, থাক। আর পেরাণ দেখাতে হবে না। হাত দিয়ো না গায়ে। কিন্তুস, কথা নেই, বার্তা নেই, এ কী নিয়ে এসে তুললে?

সর্বেশ্বর বলল, কেন

হালিশহর থেকে খোঁজ করতে আসে যদি?

অন্ধকারে সর্বেশ্বরের চোখ জ্বলে উঠল হাসিতে, পাগল তুমি। সে ভার তো আমার।

কথাটা ঠিকই। ওটা শৈলর দর বাড়ানোর ব্যাপার।

তবু বলল, দুধের শিশু। পাপের ভয়ও কি নেই?

সর্বেশ্বর খালি বলল, কী যে বলো।

শৈল এবার চাপা গম্ভীর সুরে বলল, কিন্তুস ও যা মেয়ে। ওকে তো আমি রাজি করাতে পারব না বাপু। বয়সও হয়নি, একেবারে হা-ঘরেও নয়। রাজি হবে কেন?

সর্বেশ্বর গলায় মধু ঢেলে বলল, তোমার কাছে ওই মেয়ে! বলে, সীতা সাবিত্রী হলেও রাজি হয়ে যেত তোমার কাছে। সে সব নয়, কথা তোমাকে রাখতেই হবে শৈলমণি। রাজি করাতেই হবে।

শৈল বলল তিক্ত গলায়, উ, খোশামোদে যে গলে পড়ছ? তোমাদের আর কী? শুনছি, এ সব নিয়ে নানান দিকে ঘোঁট পাঁচালি। আইনকানুনও নাকি হয়েছে? মরলে মরবে এই শৈলী শালী।

সর্বেশ্বর আবার হেসে শৈলর গা ঘেঁষে এসে বলল, ওগো না না। সে তোমার কুলীনদের নে গণ্ডগোল হচ্ছে। ব্যাটারা যে বে করবে গণ্ডা গণ্ডা। সেটা কত বড় পাপ। এই যে আমি। আমি কি কোনওদিন বাপকে দেখেছি, না চিনি। জন্মে অবধি শুনছি, সেই বাপ বেটা কবে একদিন নাকি রাতে এসে পড়েছিল, তাইতেই আমি হয়ে পড়েছি। দেখ তো কী কাণ্ড। বাপকে কোনওদিন দেখতেই পেলুম না।

কান পাতলে একটা চাপা আর্তনাদ শোনা যায় যেন সর্বেশ্বরের গলায়। কারণে অকারণে ফাঁকা পেলেই তার মনে আসে কথাটা। মায়ের কাছে তার বাপের একটি নাম শুনেছে বটে। সেই নামে দেশে কত লোকই আছে। কিন্তু নদে কুষ্টিয়ার কান্ত পাঠকের দেখা কোনওদিন পায়নি সে। পাঠক তার পিতৃপুরুষের পদবি। বাঙাল হলেও বাপ তো। কুলীনও বটে। দেখা হলে সর্বেশ্বর কি আর…। থাক। ও সব সর্বেশ্বরের মনেই চাপা থাক। সাত পাঁচ ভেবে আসল কাজে ফাঁকি।

অন্ধকারে ঠোঁট উলটাল শৈল। মনে মনে হেসে বলল, তোের আবার ছিল বাপ। তুই আবার দেখবি তাকে। যমেরও অরুচি বাপ তোর হালিশহরেরই কোন দাদা মামা জ্যাঠা-খুড়ো, তাই দেখগে যা। কুলীন বামুনের আবার খাঁটি বাপ? শিবের বাবা জানে সে কথা।

রাত হয়ে যাচ্ছে। প্রথম রাত্রের শেয়াল ডাকার পরই এসে হাজির হয়েছে সর্বেশ্বর। তার পরের প্রহরেও ডেকে গেছে শেয়ালের পাল। বউখুনি শাশুড়ি পাখি ডেকে উঠেছে কয়েকবার। কালপেঁচাটা থেমেছে অনেকক্ষণ। এখন একেবারে নিস্তব্ধ। এই-ই প্রকৃত মধ্য-প্রহর রাত্রি। সিঁদকাটিওয়ালারা বেরিয়েছে নিজের নিজের কাজে।

আর দেরি করা যায় না। কিন্তু শৈলীকে জপ করে না জপালে কার্যসিদ্ধি হবে না। মনে মনে বলল, ঘুসকি হারামজাদি কত বড় তেঁদড়। রাজি হবে, তবু জল ঘোলাচ্ছে। বলল, কুলীনের আইন হোক তাতে তোমার আমার ভয় কী। আমরা তো পুণ্যি করছি গো। যাদের নেই তাদের জুগিয়ে দিচ্ছি। যেমন দিচ্ছি, তেমনি কষ্টের কাজে ছিটে-ফোঁটা কেষ্ট মিলছে। হেঁ হেঁ, ও সব নয়। তুমি আমার আস্তো প্রাণ, চোখের বালি, গঙ্গাজল, গোলাপজল। রাখো, বোঝাও। ঘুড়ি একটু কড়া ধাতের। আমার শৈলমণি তো তারও বাড়া কড়া।

শৈল ভাবে। চাটুবাক্যে কান নেই তার। সে ভাবে অনেক কিছু। দিনমানে পাহারা দিতে হবে। আর যা রূপ মেয়েটার! কোনদিন না আবার এখান থেকেই বামাল গায়েব হয়ে যায়।

কাছাকাছি শৈল। হাত নিশপিশ করছে সর্বেশ্বরের। কী সুন্দর গন্ধ; শৈলীর গায়ে। অন্ধকারেও রূপোর গোটে ঘেরা নিতম্বরেখা ফুটে উঠেছে। একদিকে কাজ হাসিলের ব্যস্ততা, অন্যদিকে মনের রসে প্লাবন।–দুয়ে মিলে অদ্ভুত অবস্থা সর্বেশ্বরের। সে বলল, এত তুমি কী ভাবছ? ফিরিয়ে তো নে যাব না। বরাবর তোমাকে যা দিয়েছি, এবার তার দ্বিগুণ দেব। ভগবানের নাম করে বলছি।

শৈল বলল, দ্বিগুণ কত শুনি?

সর্বেশ্বর বলল, এক কুড়ি এক টাকা।

শৈল আঁচলের ঝাঁপটা দিয়ে সরে গেল দু হাত। বলল, তোমার এক কুড়িতে আমি ইয়ে করি। জিনিস নে সরে পড়ো।

সর্বেশ্বর সরে এসে বলল, আচ্ছা পঁচিশ।

 উঁহু।

তিরিশ?

অত সুখ খায় না। ওই রূপ কী দরে বিকোবে আমি জানি না?

 কথা কাটাকাটি করে আরও দশ বাড়াতে হল। এ ছাড়া, মেয়ে যত দিন থাকবে, দিতে হবে তার খোরপাশ।

শৈল জিজ্ঞেস করল, ক-দিন থাকবে?

সর্বেশ্বর বলল, এই তো বোশেখ কাবার হতে চলেছে। মাঝে জষ্টি। আষাঢ়ের রথের আগেই কাজ হয়ে যাবে।

বলে শৈলর হাত টেনে ধরল সর্বেশ্বর। হাত থেকে চকিতে একেবারে গায়ের উপর এসে পড়ল তার অস্থির ব্যাকুল হাত। যেন একটি লতানো সাপের মতো।

শৈল ছাড়িয়ে নিল নিজেকে আলিঙ্গন থেকে। বলল, মরণ! রাত দুকুরে উঠোনে এলেন পিরিত করতে। ছাড়ো ছাড়ো। যেতে হয়, সরে পড়ো তাড়াতাড়ি।

আবেগে ভরে উঠল সর্বেশ্বরের গলা। বলল, সত্যি বলছি শৈল, তুমি ভাববে খালি কাজ হাসিলের জন্যে আসি। কিন্তু তোমার কথা মনে হলে বুকের মধ্যে কেমন করে।

শৈল আনন্দে হেসে ঠাট্টার গলায় বলল, কেন, ঘরে বউ আছে তো

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল সর্বেশ্বর, তুমি বুঝবে না সে কথা। একদিন সব ছেড়ে দিয়ে তোমার কাছে চলে আসব, দেখে নিয়ো। তখন পায়ে রাখবে তো?

শৈল এতক্ষণে হেসে বলল, যাত্রা রাখো বাপু। চলো চলো, নন্দনকে ডেকে নে বেইরে পড়ো। আর দেরি করো না। কিন্তুস শিগগির করে একদিন এসো।

তারা দুজনেই ঘরে এল। সর্বেশ্বর ভানুর গায়ে হাত দিয়ে বলল, থাকো দিদি। বোন আমার তোমাকে খুব যত্ন করবে। চলো হে নন্দন।

কী কথা হল সে বিষয়ে যেমন কৌতূহল ছিল নন্দনের, তেমনি ওই অন্ধকারে শৈলর কাছে যাওয়ার জন্যে তারও প্রাণটা ছটফট করছিল। নিজের অজান্তেই চোখে তার আগুনের ধিকিধিকি। সে দেখছিল সর্বেশ্বর আর শৈলকে। দাঁড়িয়ে উঠে বলল, চলো।

কিন্তু ভানু আচমকা দু হাতে আঁকড়ে ধরল সর্বেশ্বরকে। ডুকরে উঠে বলল, আমি এখানে থাকতে পারব না ঠাকুরদা। আমাকে নে চলল। নে চলো হালিশহরে। তোমাদের কাছে থাকলে আমার কিছু হবে না।

সর্বনাশ! মন্ত্র তন্ত্র সব বিফল। শেষ সময়ে মেয়েটা এ সব কী বলছে। কিন্তু আর উপায় নেই। কোনও পথ নেই। সময় নেই।

আদরের ছলেই দৃঢ় গলায় বলল সর্বেশ্বর, না, এখন তোর যাওয়া চলবে না দিদি। পাগলি, আমরা তোকে বাঁচাতে পারব হালিশহরে? বাপরে!

বলে তার কঠিন আলিঙ্গন ছাড়িয়ে চোখের ইশারা করল শৈলকে। শৈল এসে দুহাতে ধরল ভানুকে। বলল, ছি দিদি আমার, অমন করতে নেই, এসো৷

কিন্তু ভয়ে ব্যথায় ভানু তখন মরিয়া। তার ছোট্ট হৃদয় বার বার বলে উঠল, তাকে জন্মের শোধ রেখে যাচ্ছে। তার মন গেয়েছে, এতক্ষণে গেয়েছে কী যেন আছে এর মধ্যে। কীসের এক গোপন কারসাজি যেন। তার মন আপনি বলেছে, তাকে বন্দি করছে।

সে চিৎকার করে উঠল, ওগো ঠাকুরদা, না না। তোমার পায়ে পড়ি, পায়ে পড়ি…

নন্দনকে নিয়ে ততক্ষণ বেরিয়ে পড়েছে সর্বেশ্বর! গাঢ় অন্ধকারে, দ্রুত পায়ে ছুটে চলেছে তারা।

আর ভানুর মুখ চেপে ধরেছে শৈল তার বুকে। হাত দিয়ে চেপে ধরার চেয়ে ওইটিই ভাল। জোরে চেপে ধরেছে বুকের মধ্যে। তার নির্দয় নিটোল নরম বুকে ভানুর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তবু, তবু। বুকে চেপে এই আদরের রূপ দিয়েই চুপ করাতে হবে। তারপর দু হাতে জড়িয়ে নিয়ে বিছানায় শোয়াল ভানুকে। গলা স্তিমিত হয়ে এসেছে তার। কাঁদতে পারছে না। ভয়ে আতঙ্কে দুঃখে ব্যথায় কণ্ঠরোধ হয়েছে মেয়ের।

ভর দুপুরে বেরিয়েছিল পথে। কত বলেছে লোকে, সেই সময় পথে পথে, গাছে গাছে, হাওয়ায় হাওয়ায় ঘোরে অদৃশ্য দানোরা। সে দানোই আজ ধরল তাকে।

ভানুর রূপ দেখতে দেখতে তীব্র দীপশিখার মতো জ্বলে উঠল শৈলর চোখ। নারী হয়ে নারীর রূপে প্রাণ আলোড়িত হয়ে উঠল তার। সে দু হাতে সেই রূপশিখাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেল। বলল, লক্ষ্মী আমার, সোনা আমার। তোমাকে কেউ কিছু করবে না। ভয় কী, আমি তো আছি।

বাইরে বাতাস। দুরন্ত বাতাস হা-হা করে আসছে দক্ষিণ সাগরোপকূল থেকে। বাতাস ও অন্ধকারের আলিঙ্গনে রাত্রি যেন হাস্যময়ী। দুলছে, ছুটছে, গুনগুন করছে।

আড়ষ্ট দেহ ভানুর। নিষ্পলক চোখ। গাল ভরা জল। শৈলীর সুগন্ধী পান খাওয়া মুখের ব্যাকুল চুম্বন ভয়ের একটা বিভীষিকাময় বিস্ময় ধরিয়ে দিল মনে। ভয় আর বিস্ময়ে আড়ষ্ট ও নিস্তেজ হয়ে পড়ল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *