০১. প্ৰাগৈতিহাসিক মিশর

মিশরের ইতিহাস – আইজাক আসিমভ – অনুবাদ: দ্বিজেন্দ্রনাথ বর্মন

১. প্ৰাগৈতিহাসিক মিশর

নীল নদ

উত্তর আফ্রিকায় প্রবাহিত এক অস্বাভাবিক নদ। ৪১৫৭ মাইল দীর্ঘ- পৃথিবীর দীর্ঘতম নদী- যার নাম নীল নদ। নামটি এসেছে গ্রিক শব্দ নীলোস থেকে। গ্রিকরা কোথা থেকে পেল শব্দটা তা অজানা, কারণ এর তীরে যারা বাস করত তারা এটাকে শুধু “নদী” বলেই জানত।

নীল নদের সবচেয়ে উত্তরে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন দুটি সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, আর প্রায় ছয় হাজার বছর ধরে এর উভয় কুল বরাবর গ্রামগুলিতে জটিল সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে।

এ সময়টাতে কেউই জানত না এই নদের উৎপত্তি কোথায় হয়েছে। এর জলধারা দক্ষিণ থেকে উত্তরে প্রবাহিত। তবে প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কোনো মানুষই সর্ব দক্ষিণে এর উৎসস্থল আবিষ্কার করতে পারেনি। প্রাচীন জাতিসমূহের কাছে নীলের উৎস সন্ধান ছিল চাঁদের অপরপৃষ্ঠ আবিষ্কারের মতোই কৌতূহলোদ্দীপক আর দুঃসাধ্য- যতদিন না উপগ্রহের মাধ্যমে চাঁদের উল্টোপিঠের ছবি আমাদের দৃষ্টিসীমায় আসে, ততদিন চাঁদের উল্টোপিঠের চেহারা ছিল সবার অজানা।

শুধু উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধেই ইউরোপীয় আর আমেরিকান অভিযাত্রীরা নীল নদের গতিপথ অনুসরণ করে তার উৎসমূলে পৌঁছতে সমর্থ হয়। ১৮৫৭ সালে জন হেনিং নামে এক ইংরেজ এক বিশাল হ্রদ ভিক্টোরিয়াতে পৌঁছে ব্রিটেনের তৎকালীন রানির নামানুসারে তার নাম রাখে ভিক্টোরিয়া। এটা ঠিক নিরক্ষরেখার উপর আর এখান থেকেই নীল নদের উৎপত্তি। মধ্য-পূর্ব আফ্রিকার ছোট বড় অনেক নদীই এসে মিশেছে নীল নদের সাথে।

উত্তরমুখী গতিপথে একে অনেক সংকীর্ণ আর খাড়া উপত্যকা পেরিয়ে যেতে হয়েছে। উন্মত্ত জলধারা প্রস্তরখণ্ডের উপর ছিটকে পড়ছে আর নিম্নমুখী গতিপথে সৃষ্টি করেছে অনেক জলপ্রপাত। উত্তাল জলধারা আর জলপ্রপাত পার হয়ে জাহাজ চলাচল সম্ভব নয়, আর তাই নদীটা বিভক্ত রয়েছে কয়েক খণ্ডে।

প্রপাতগুলির সংখ্যা নির্ণয় করা হয় উত্তর থেকে দক্ষিণে। প্রথম প্রপাতটা অবস্থিত মোহনা থেকে প্রায় ছয়শ মাইল দক্ষিণে। বর্তমানে প্রপাতটা আসোয়ান শহরের সামান্য দক্ষিণে, তবে প্রাচীনকালে গ্রিকদের কাছে শহরটা পরিচিত ছিল “সাইয়িনি” নামে।

মোহনা থেকে প্রথম প্রপাত পর্যন্ত নীল নদের প্রথমাংশ এই গ্রন্থের মূল দৃশ্যপট। নদীর এই অংশ অতি সাধারণ নৌযানের জন্যও সহজনাব্য, যার ফলে এখানেই গড়ে উঠেছে এক লক্ষণীয় সভ্যতা।

সাহারা মরুভূমির পূর্বপ্রান্ত ঘেঁষে নীল নদ প্রবাহিত। সাহারা (আরবী ভাষায় যার অর্থ মরুভূমি) উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ এলাকা জুড়েই অবস্থিত আর এর আয়তন প্রায় যুক্তরাষ্ট্রের সমান। প্রকৃতপক্ষে এটা পৃথিবীর বৃহত্তম মরুভূমি। এই গোটা এলাকাতেই কোনো বৃষ্টিপাত নাই। যেটুকু পানি আছে তা মাটির অত্যন্ত গভীরে, শুধু মাঝে মাঝে মরুদ্যানে তা ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি উঠে এসেছে।

তবে সাহারা চিরকাল মরু অঞ্চল ছিল না। বিশ হাজার বৎসর পূর্বে ইউরোপের অধিকাংশ এলাকা হিমবাহে আবৃত ছিল, আর শীতল বায়ুপ্রবাহ সেখান থেকে আর্দ্রতা বয়ে নিয়ে আসত উত্তর আফ্রিকায়। আজ যেখানে মরুভূমি সেকালে সেখানে ছিল নদী, হ্রদ, অরণ্য আর তৃণভূমিশোভিত মনোরম এক ভুখও। প্রাগৈতিহাসিক মানুষরা সেখানে ঘুরে বেড়াত আর তারাই রেখে গেছে পাথরের অমসৃণ অস্ত্রশস্ত্র।

ধীরে ধীরে অপসৃত হলো হিমবাহ আর জলবায়ু হতে থাকে উষ্ণতর আর শুকতর। অধিক সংখ্যায় মানুষ নীল নদের আশেপাশে ভিড় জমাতে থাকে। শুরু হলো অনাবৃষ্টি আর ধীরে ধীরে তা তীব্রতর হয়ে উঠল। গাছপালা মরে গেল আর জীবজন্তু আর্দ্রতর অঞ্চলের দিকে সরে যেতে থাকে যেখানে তারা পর্যাপ্ত খাদ্য আর উপযুক্ত আবাসস্থল পাবে। মানুষও সরে যেতে থাকে কিছু দক্ষিণে বিষুবীয় অঞ্চলের দিকে আর কিছু উত্তরে সমুদ্র উপকূলের দিকে। সবচেয়ে বেশি জড়ো হতে থাকে নীল নদের উপত্যকায়, সেই সুদূর অতীতে যা ছিল আরও প্রশস্ততর আর ধীরগতিতে প্রবহমান ছিল বৃহৎ জলাভূমির মধ্য দিয়ে। বাস্তবিকপক্ষে নীল নদের উপত্যকা মানববসতির জন্য মোটেই সুখকর ছিল না যতদিন না এর জলধারা কিছুটা হ্রাস পায়।

এমনটা ঘটার পরে নীলের উপত্যকা হয়ে উঠল ঈশ্বরের আশীর্বাদরূপে। আবহাওয়া যতই শুষ্ক হোক না কেন নীল নদ হয়ে রইল মাটি ও মানুষের জন্য নিরন্তর পানির উৎস, যাতে করে জীবন যে শুধু সম্ভব তাই নয় আরামদায়কও হয়ে উঠল।

সমগ্র শীতকালব্যাপী মধ্য-পূর্ব আফ্রিকার পর্বত শীর্ষে ভূপীকৃত হতে থাকে বরফ। বসন্তের আগমনে বৃষ্টি নামে আর জমাট বরফ গলতে শুরু করে। বিপুল জলধারা পর্বতের গা বেয়ে প্রবল বেগে নেমে আসে আর তা নদীর স্রোতে আর বড় বড় হ্রদের জলে মিশে যায়। অবশেষে এই জলধারা এসে পড়ে নীল নদে আর তা উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়।

নীল নদে প্রবাহিত পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে জুলাই মাস থেকে আর তা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে সেপ্টেম্বরে। পানির উচ্চতা স্বাভাবিক স্তরে নেমে আসে অক্টোবরে। ফিতকায় পানির প্রবাহ কূল ছাপিয়ে দু পাশের তৃষ্ণার্ত ভূমিকে সিক্ত করে আর উত্তরের পাহাড় থেকে বয়ে নিয়ে আসে উর্বর পলিমাটি। কাজেই নদী উপত্যকার মাটির অবিরাম রূপান্তর ঘটছে আর উর্বরতা বজায় রাখছে।

মানুষ যখন প্রথম নীল উপত্যকায় প্রবেশ করে, তখন বন্যা ছিল প্রবল আর বিস্ত ত ছিল জলাভূমি আর নদীর উভয় তীরে ছিল অসংখ্য জলহস্তি, বল্গাহরিণ, সারস, আরও নানা রকমের শিকার্য পশু। ক্রমবর্ধমান শুষ্কতা বন্যা কমিয়ে আনল আর শেষ পর্যন্ত শুধু নদীর দুই তীরেই সীমাবদ্ধ হয়ে রইল, আর বহু সহস্র বছর পূর্ব থেকে আজ পর্যন্ত বহমান নদীর দুই ধারে শুধু বার মাইল পর্যন্তই নীল নদের সুবিধাপ্রাপ্ত এলাকারূপে টিকে রইল।

তারচেয়েও বড় কথা উর্বর চাষযোগ্য ভূমির সীমানা এমন স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট হয়ে যায় যে কোনো ব্যক্তি এক পা উর্বর ভূমিতে আর অন্য পা মরুভূমিতে রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।

.

নব্য প্রস্তর যুগ

সময়ের সাথে সাথে যেহেতু নীল উপত্যকায় জনসংখ্যার চাপ বাড়তে থাকে আর সেই সাথে শিকার্য পশু কমতে থাকে, তাই কিছু একটা উপায় বের করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। যে কোনো ভাবেই হোক খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে। সৌভাগ্যবশত ৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যখন উত্তরের হিমবাহ তার শেষ ধাপে গিয়ে পৌঁছেছিল তখন দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কোনো কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা নতুন পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছিল। নীল নদের হাজার মাইল পূর্বে ইরান ও ইরাকে- যেখানকার উঁচু ভূমিতে পানির প্রাচুর্য। সেখানে কোনো কোনো সম্প্রদায়ের মানুষ বীজ থেকে ফসল উৎপাদনে সফলতা অর্জন করেছিল।

এটাকেই বলা যায় নিওলিথিক এজ বা নব্য প্রস্তর যুগের সূচনা। নব্য প্রস্তর যুগের মানুষরা তখন পর্যন্ত ধাতুর ব্যবহার শেখেনি আর তাই পাথরের উপচারের উপরই নির্ভর করতে হতো। এসব পাথরের যন্ত্রপাতি আদি ও মধ্য প্রস্তর যুগের ভোতা অমসৃণ যন্ত্রপাতির চাইতে অনেক বেশি সূক্ষ্ম ও কার্যকর ছিল। নব্য প্রস্তর যুগের আর সব অগ্রগতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মাটির পাত্র তৈরি, পশুপালন ও পশুচারণ, আর বলা উচিত, বীজ বপন ও ফসল কর্তন। আমরা সঠিকভাবে বলতে পারব না কীভাবে এই কৃষি যুগের উত্থান ঘটে, তবে এর ফল সহজবোধ্য, কারণ এর ফলে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত হয়েছিল।

নব্য প্রস্তরযুগীয় জীবনধারা কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় পৌঁছানোর আগে সেখানকার মানুষের জীবিকা নির্ভর করত পশু শিকার, ও ফলমূল সংগ্রহের উপর। তবে শিকার ও ফলমূলের সরবরাহ অঢেল ছিল না, আর কোনো কোনো দুর্বৎসরে খাদ্য সরবরাহের জন্য মানুষকে দূর দূরান্তে ভ্রমণ করতে হতো। কোনো সীমাবব্ধ এলাকায় খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব ছিল না।

পশুপালন ও ফসল ফলানো আয়ত্ত করার পর প্রাকৃতিকভাবে আহরণের চাইতে খাদ্য সরবরাহ মানুষের জন্য অনেক বেশি নিশ্চিত করা সম্ভব হলো। কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় পশুপালন ও ফসল ফলানো নিশ্চিত করার পর পশুপালক ও কৃষকদের ব্যবস্থা নিতে হলো যাতে বন্য পশু বা অন্য গোত্রের লোকজন সেগুলি নষ্ট না করে বা দখল করে না নেয়। খাদ্য সরবরাহ যেমন পরিমাণে বৃদ্ধি পেল তেমনি সুরক্ষিতও রইল, আর এটা কৃষির জন্য অধিকতর প্রযোজ্য হলো, কারণ পশুপালনের চাইতে ফসল ফলানো অধিকতর সহজ এবং নিরাপদ। এক একর কৃষি জমি এক একর বনভূমির চাইতে অনেক বেশি পরিমাণ মানুষের খাদ্য নিশ্চয়তা দিতে পারে। আর এ কারণেই যেখানেই নব্য প্রস্তর যুগের অনুপ্রবেশ সেখানেই এটা জনসংখ্যা বৃদ্ধিরও কারণ হয়ে দাঁড়াল।

অধিকন্তু, যেখানেই মানুষ শিকারের উপর নির্ভরশীল (অথবা কিয়ৎ পরিমাণে পশুপালন বা পশুচারণ) তারা কখনোই এক জায়গায় স্থিতিশীল ছিল না। অপরপক্ষে যারা যেখানে ফসল ফলাত, সেখানেই তাদের বসবাস করতে হতো। তাদের বাস করতে হতো একত্রে সংঘবদ্ধ হয়ে, কারণ শিকারি বা পশুপালক গোষ্ঠীর হাত থেকে নিজেদের সুরক্ষার প্রয়োজন ছিল (এসব উটকো লোক নিজেরা ফসল না ফলালেও অন্যের ফসল ছিনিয়ে নিতে আপত্তি ছিল না)। আর এভাবেই গড়ে ওঠে আদিম বসতি গ্রাম ও নগর।

যেহেতু গ্রামের বাসিন্দাদের একে অন্যের সাথে বাধ্য হয়ে মানিয়ে চলতে হতো, তাই শিকারি যুগের স্বেচ্ছাচারিতার অবসান ঘটল। আর তাই ঘরবাড়ি নির্মাণ, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ভূমি কর্ষণ প্রভৃতি কাজের জন্য গ্রামবাসীদের ঐক্য গড়ে উঠল। আর এভাবেই ঘটল সভ্যতার গোড়া পত্তন।

ইরানের উচ্চভূমিতে গোড়াপত্তনের পরবর্তী সহস্রাব্দে কৃষিকাজ চতুর্দিকে সম্প্রসারিত হতে থাকে। অন্যান্য গোষ্ঠীর লোকেরাও কৃষিকে আপন করে নেয় আর বিশেষ করে দুটি এলাকায় এর ব্যাপক উন্নতি ঘটে। এর মধ্যে একটা দুই নদী ইউফ্রেতিস ও টাইগ্রিসের মধ্যভাগের উপত্যকায়, আর অন্যটি এর হাজার মাইল পশ্চিমে নীল নদের উপত্যকায়। ইউফ্রেতিস তাইগ্রিস এলাকা নিকটবর্তী হওয়ায় ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল বেশ আগেই, আর সভ্যতার উন্নয়নও ঘটেছিল আগেভাগেই- তবে নীল উপত্যকাও তেমন পিছিয়ে ছিল না।

মিশরে নব্য প্রস্তরযুগীয় জীবনধারার পরিপূর্ণ আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ। এ সময় নীল উপত্যকা ছিল সুস্থির, তবে কর্দমাক্ত আর অরণ্যসংকুল থাকায় কৃষিকাজের জন্য তেমন উপযুক্ত ছিল না, কিন্তু নীলের পশ্চিম তীরে আর ভূমধ্যসাগরের প্রায় ৪৫০ মাইল দক্ষিণে ছিল একটা হ্রদ, যার আশেপাশের এলাকা ছিল কৃষিকাজের জন্য আদর্শ।

পরবর্তীকালে এই জলাধারটির পরিচিতি হয়েছিল মিয়েরিস হ্রদ নামে, কারণ প্রায় ৪৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক ঐতিহাসিক পর্যটক হেরোডোটাস এখানে বেড়াতে এসে হ্রদটা দেখে ভেবেছিলেন এক পৌরাণিক রাজা মিয়েরিস কর্তৃক কৃত্রিমভাবে বানানো হয়েছিল এটি।

তবে এটা মোটেই কৃত্রিম কোনো জলাশয় নয়, আর মিয়েরিস একটি মিশরীয় শব্দ, যার অর্থ হ্রদ। হেরোডোটাসের অনেক আগেই উত্তর আফ্রিকার এই অঞ্চল অনেক বেশি জলাভূমিতে আকীর্ণ ছিল আর এটা তারই অবশেষ। এই হ্রদের পানিতে জলহস্তিসহ আরও অনেক শিকার্য জলজন্তু ছিল যার কারণে ৪৫০০ থেকে ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে এর তীর ঘেঁষে অনেক নব্য প্রস্তরযুগীয় বসতি গড়ে ওঠে।

তবে এই ভূভাগের অবিরাম শুষ্কভবনের কারণে এর জলাধারও ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। পানির উচ্চতা কমার সাথে সাথে জলজ প্রাণীর সংখ্যাও হ্রাস পেতে থাকে। যার ফলে উপকূলবর্তী গ্রামগুলিও ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় চলে যায়, আর অন্যদিকে নীল উপত্যকায় সভ্যতার বিস্তৃতি ঘটতে থাকে, যেখানে জীবনযাপন সহজলভ্য, কারণ এখানকার পানির প্রবাহ সুদূর দক্ষিণের পর্বতমালা থেকে উৎসারিত।

খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ নাগাদ মিয়েরিস হ্রদকে একটা শোভনীয় আকারে রাখা সম্ভব হয়েছিল। একে নীল নদের সাথে সংযুক্ত রাখা সম্ভব হয়েছিল আর নদী উপকূলবর্তী জনগণকে এজন্য অনেক পরিশ্রম করতে হতো। এটা করার সগ্রাম এখন থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, আর এখন হ্রদটা প্রায় নিঃশেষিত। এর জায়গায় এখন যা রয়েছে তা হলো একটা শুকনো নিচু ভূখণ্ড যার মাঝ বরাবর রয়েছে ত্রিশ মাইল দীর্ঘ আর পাঁচ মাইল চওড়া ছোট একটা হ্রদ। এই জলাধারটি এখানকার আরবী ভাষাভাষী লোকের কাছে পরিচিত বিরকেত কারুন নামে। এটাই সেই প্রাচীন মিয়েরিস হ্রদের অবশেষ। এই ক্ষুদ্র জলাশয়ের তীরেই রয়েছে আধুনিক শহর এল ফাইয়ুম।

নীল নদের তীরে যে নিওলিথিক বসতি গড়ে উঠেছিল (যা ঘটেছিল মিয়েরিস তীরের বসতির পরবর্তী ঘটনা) পরবর্তীকালে তা-ও উৎখাত হয়ে যায়। পরবর্তী গ্রামগুলির অবশেষ দেখা যায় পূর্ববর্তী গ্রামের উপরিভাগে। পুরাতত্ত্ববিদরা প্রতিটি প্রাচীন গ্রামের নাম দিয়েছেন সেখানকার আধুনিক গ্রামের নামানুসারে যেখানে খনন করে উল্লেখযোগ্য অবশেষ পাওয়া গেছে।

তাই বলা হয়ে থাকে তাসিয়ান, বাদারিয়ান, আম্রাশিয়ান ইত্যাদি কালচার। তাসিয়ান জনগোষ্ঠী ইতিমধ্যেই কৃষিকাজ শুরু করে দিয়েছিল। বাদারিয়ানরা উন্নত মানের মাটির পাত্র তৈরি করতে পারত। আম্ৰাশিয়ানরা গরু, ভেড়া, শূকর ইত্যাদি পশুপালন করত আর নলখাগড়া দিয়ে নৌকা বানিয়ে নীল নদে পাড়ি জমাত।

.

সেচ

পশ্চিম এশিয়ার আদি কৃষিভিত্তিক জনগোষ্ঠী কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল শুধু সেসব এলাকায় যেখানে প্রয়োজনীয় বৃষ্টির পানি সহজলভ্য ছিল। ইউফ্রেতিস তাইগ্রিস এলকায়, বিশেষ করে নীল উপত্যকায়, কৃষিকাজে পানি সরবরাহের জন্য বৃষ্টির উপর একান্ত নির্ভরতা সম্ভব ছিল না। তার পরিবর্তে নদীর পানি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল।

প্রথম দিকে নীল অববাহিকার অধিবাসীদের বন্যার পানি অপসৃত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই যথেষ্ট ছিল, তারপর কর্দমাক্ত মাটিতে বীজ ছিটিয়ে দেওয়া। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই পদ্ধতিতে ফসল ফলানো যথেষ্ট ছিল না। তার পরিবর্তে নদীর উভয় পার্শে খাল কেটে দূরবর্তী এলাকায় পানি সরবরাহ জরুরি হয়ে পড়েছিল। একটি ক্যানাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নীল এবং ইউফ্রেতিস তাইগ্রিস এলাকায় সেচ দিয়ে শুষ্ক মওসুমে যখন বন্যার পানি সহজলভ্য ছিল না তখনও ভূমিতে আর্দ্রতা বজায় রাখা সম্ভব হতো।

এটা একদিক দিয়ে অবস্থা আরও কঠিন করে তুলেছিল। প্রথমত খাল কাটা কাজটা তেমন সহজ ছিল না আর সেটা ব্যবহার উপযোগী রাখাও ছিল তেমনি কঠিন। কঠোর পরিশ্রম করতে হতো, বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করার চাইতে অনেক বেশি কঠিন। কাজটা করতে হতো অনেকে একসাথে মিলেজুলে- সাধারণ কৃষিকাজের চাইতে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধভাবে।

প্রকৃতপক্ষে, এই অতিরিক্ত ঐক্যের প্রয়োজনে, এবং সেচ ব্যবস্থায় উন্নত কৌশল উদ্ভাবন উচ্চভূমিতে সাধারণ কৃষির চাইতে সেচ এলাকায় সমৃদ্ধ কৃষি, সভ্যতার অগ্রগতিতে বিশেষ উদ্দীপনা প্রদান করে।

নদী তীরবর্তী শহরগুলিকে সুসংগঠিত করতে হয়েছিল। যেসব কুশলী জনগণ ক্যানেল তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষ পারদর্শী ছিল তারাই শহরগুলিতে প্রাধান্য লাভ করত। কোনো স্থানীয় দেবতার নামে তারা নিজেদের মর্যাদা ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করত।

আদি যুগের মানুষেরা সব সময় বিশ্বাস করে এসেছে যে কোনো না কোনো অতিপ্রাকৃতিক সত্তা বীজ থেকে চারা উৎপাদন এবং বৃক্ষ ফলবান করা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, আর শহরের নিয়ন্ত্রককেই নির্দিষ্ট দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য উপযুক্ত যাদুমন্ত্র প্রয়োগ করতে হয়। সাধারণ জনগণের দায়িত্ব পুরোহিতরা যেন সঠিকভাবে সকল আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখা। সাধারণ জনগণ বিশ্বাস করত যাদের উপর এসব আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদনের দায়িত্ব, তাদের জ্ঞান ও সচেতনতার উপরই শহরের সমৃদ্ধি নির্ভর করে। এভাবেই নীল উপত্যকায় একটি পুরোহিত-তন্ত্রের প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল যা হাজার হাজার বছর ধরে টিকেছিল।

সেচ কাজে যেটুকু কষ্টভোগ করতে হয়েছিল এর সুফলের তুলনায় সেটা অতি তুচ্ছ। মানুষ যত বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে শিখেছিল তত বেশি সুবিধা ভোগ করতে পেরেছিল। উদাহরণস্বরূপ মানুষকে জানতে হয়েছিল ঠিক কখন নীল নদে বন্যা আসবে, যদি এর থেকে সর্বাধিক ফল লাভ করতে হয়। যেসব পুরোহিতের ওপর বন্যা পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল তারা দিনের পর দিন নদীর পানির উচ্চতা পর্যবেক্ষণ করত, আর তাতে করে তারা নির্ণয় করতে পেরেছিল গড়ে প্রায় ৩৬৫ দিন পর পর বন্যা আসে।

কাজেই নীল উপত্যকার মানুষরাই সর্বপ্রথম ৩৬৫ দিন ভিত্তিক একটা পঞ্জিকা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রতিটি বছরের মধ্যে ছিল বারোটি মাস, কারণ প্রতিটি বছরের সামান্য কম সময়ের মধ্যে চন্দ্রের বারোটি সুস্পষ্ট আবর্ত লক্ষ করা যেত। আর নীল নদের বাসিন্দারা (অন্য অনেকের মতো) চন্দ্রভিত্তিক একটা ক্যালেন্ডার ব্যবহার করতে শিখেছিল। প্রতিটি মাসের দৈর্ঘ্য ৩০ দিন নির্ধারণ করা হয়েছিল, আর বছরের শেষ প্রান্তে অতিরিক্ত পাঁচ দিন যোগ করা হতো।

প্রাচীনকালে আবিষ্কৃত সকল ক্যালেন্ডারের মধ্যে এটাই সবচাইতে সরল ও ব্যবহার উপযোগী ছিল। ঐতিহাসিকরা এর আরম্ভকাল নির্ণয় করতে পারেননি, তবে ২৮০০ খ্রিস্টপূর্ব গ্রহণযোগ্য অনুমান মনে হয়। পরবর্তী তিন হাজার বছর ধরে এর চাইতে ভালো কোনো উপায় বের করা সম্ভব হয়নি। আর পরবর্তিকালে যে ক্যালেন্ডার আবিষ্কার করা হয়েছিল সেটার ভিত্তিও ছিল সামান্য সংশোধনসাপেক্ষে মিশরীয় ক্যালেন্ডার। সত্যি বলতে কি আমাদের বর্তমান ক্যালেন্ডার মিশরীয় ক্যালেন্ডারেরই অনুসারী।

তারপরেও নীলের বন্যা, মানুষের অধিকৃতি মুছে ফেলত্ব। সেই সীমানা পুনর্নির্ধারণের একটা উপায় বের করা আবশ্যক ছিল। হিসাবনিকাশের একটা পদ্ধতি ধীরে ধীরে উদ্ভাবিত হয়েছিল যাকে বলা হয় জিওমেট্রি (ভূ মাপন)। গণিতের অন্যান্য শাখারও উন্নতি হয়েছিল।

ভূমির সীমানা ও উৎপাদিত ফসলের রেকর্ড সংরক্ষণ করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন সংখ্যার প্রতীক উদ্ভাবন আবশ্যক ছিল যা বিভিন্ন জাতি, আলাদা ফসল ও ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা ও বিবরণ নির্ণয় করারও সহায়ক ছিল।

তাইগ্রিস ইউফ্রেতিস এলাকার লোকজন ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগেই এক ধরনের চিত্রলিপি আবিষ্কার করতে পেরেছিল যা বস্তুর প্রতিবিম্বরূপে চিত্রিত হতো। প্রথম দিকে এসব প্রতীকী চিহ্ন ছিল বেশ সরল, তবে ধীরে ধীরে তা জটিল রূপ ধারণ করে আর শেষ পর্যন্ত মানুষের যে কোনো ভাবনাকে রূপ দিতে সক্ষম হয়।

নীল উপত্যকার মানুষেরা লিখনশৈলীর ধারণা লাভ করেছিল সম্ভবত ইউফ্রেতিস তাইগ্রিস এলাকা থেকে, উভয় অঞ্চলে যাতায়াতকারী বণিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে। নীল উপত্যকার অধিবাসীরা শীঘ্রই প্রাপ্ত লিখনশৈলীকে তাদের ব্যবহার উপযোগী পরিবর্তন করে নেয়। তারা নিজেদের মতো করে প্রতীক চিহ্ন আবিষ্কার করে যা ইউফ্রেতিস তাইগ্রিস এলাকার চাইতে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের অল্প পরেই নীল উপত্যকার লিখন পদ্ধতি পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করে।

এই লিখনপদ্ধতি মূলত পুরোহিতদের হাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। সাধারণ জনগণ এসব জটিল প্রতীক চিহ্ন রপ্ত করতে পারেনি যেমনটা এযুগের সাধারণ মানুষ উচ্চতর গণিত আয়ত্ত করতে পারেনা। আরও কয়েক শতাব্দী পরে যখন এখানে গ্রিক পর্যটক ও সৈন্যদের ঢল নেমেছিল, তারা এই প্রাচীন লিপির পাঠোদ্ধার করতে পারেনি, তবে যেহেতু তারা এগুলি উত্তীর্ণ দেখেছিল শুধু মন্দিরের গায়ে, তাই তারা ধরে নিয়েছিল এগুলির নিশ্চয়ই ধর্মীয় তাৎপর্য আছে, আর তাই এর নাম দিয়েছিল হিয়ারোগ্লিফিক্স (পবিত্র খোদাই)।

.

নিরাপত্তা

সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে নীল উপত্যকায় উচ্চতর সভ্যতা গড়ে ওঠে আর দুটি ক্ষেত্রে ইউফ্রেতিস তাইগ্রিস এলাকার সাথে তার পার্থক্য লক্ষ করা যায়। তাইগ্রিস ইউফ্রেতিস এলাকার পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর প্রান্ত ছিল অরণ্যবেষ্টিত বর্বর জাতি অধ্যুষিত। অবিরাম আক্রমণ ও লুটপাটের ভয়ে নদীতীরবর্তী এলাকার গ্রামবাসীরা নিজেদেরকে প্রাচীরবেষ্টিত করে রেখেছিল। তাদের যেমন সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটছিল, তেমনি অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধকৌশলেরও উন্নতি ঘটাচ্ছিল।

এই উপায়ে ইউফ্রেতিস তাইগ্রিস এলাকার জনগণ অধিকাংশ সময়েই বর্বরদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিল। উপজাতীয় প্রশান্তির সময়ে সশস্ত্র গ্রামবাসীরা তাদের অস্ত্র ও লোকবল দিয়ে কী করেছিল? অলস হয়ে বসে থাকতে দিলে যে শহর তাদের নিয়োগ দিয়েছে, সেখানেই অশান্তি সৃষ্টি করতে পারত। সেক্ষেত্রে শহরগুলি স্বভাবতই নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারত।

এ ধরনের লড়াই একক শাসনাধীন (সাম্রাজ্য) এলাকার বিরাট অংশে হরহামেশাই ঘটেছে। অপরপক্ষে, এসব লড়াই কৃষি ও কৃষিকাজে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি যেমন নষ্ট করত, তেমনি ঐক্যও ক্ষঙ্খিস্ত করত, যে ঐক্যের উপর কৃষির সমৃদ্ধি নির্ভরশীল ছিল, যার কারণে সূচনা হয়েছিল এক অন্ধকার যুগের যেখানে লক্ষণীয় সভ্যতার অধোগতি আর সমৃদ্ধির অবক্ষয়। ফলে পার্শ্ববর্তী বর্বরদের পক্ষে সাময়িক দখলদারির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল।

নীল এলাকার অধিবাসীরা এসবের হাত থেকে বহু শতাব্দীব্যাপী মুক্ত থাকতে পেরেছিল। তাদের শান্তিময় এলাকার পূর্ব ও পশ্চিমে ছিল মরুভূমি, শত্রুবাহিনী যা সহজে অতিক্রম করতে পারত না। উত্তরে ছিল ভূমধ্যসাগর, আর প্রথম দিকে সৈন্য ও রসদ পরিবহণের মতো যথেষ্ট বড় জাহাজ ছিলনা, যাতে করে তারা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আসতে পারে। দক্ষিণে ছিল প্রথম জলপ্রপাত, যা নীলের পথে পাড়ি দিয়ে নেমে আসা সম্ভব ছিল না।

তাই দীর্ঘদিন যাবৎ নীলের অধিবাসীরা বিচ্ছিন্ন নিরাপত্তার মধ্যে বাস করেছিল। তাদের গ্রামগুলি রয়ে গিয়েছিল নিরস্ত্র অনাক্রান্ত। কোনো কোনো আম ছিল বিশাল আয়তনের যাতে নীল উপত্যকাকে বর্ণনা করা যায় এক দীর্ঘ শহরতলীর শৃঙ্খলরূপে।

এর ফলে আরাম-আয়েস লাভ করা যায় ঠিকই তবে জীবনযাত্রায় কোনো পরিবর্তন আসে না। যেখানে অন্যান্য নদী অববাহিকার লোকেদের নিত্যই নূতন নূতন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হতো, যেখানে শর্করা নিত্যনূতন পদ্ধতি নিয়ে আসত, অথবা অধিবাসীদের নিজেকেও প্রতিরক্ষার নূতন কৌশল খুঁজে বের করতে হতো, সেখানে নীল অববাহিকার লোকদের এসব কিছুই করতে হতো না। পুরুষানুক্রমে পুরনো জীবনধারাই তারা যথেষ্ট মনে করত।

ইতিমধ্যে বহিরাগতরা নীল উপত্যকায় প্রবেশ করে এবং জোর করে স্থানীয়দের উপর তাদের শাসন কয়েম করে। স্থানীয়রা তাদের পূরনো রীতিনীতিকে এমন কঠোরভাবে আঁকড়ে ধরেছিল যে ইতিহাসে তারাই পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে রক্ষণশীল জাতি হিসাবে প্রতিপন্ন হয়েছিল (চীনারা ব্যতিক্রম হলেও হতে পারে)।

তাদের লিখনপদ্ধতি জটিলই রয়ে গিয়েছিল, উদাহরণস্বরূপ, অসংখ্য প্রতীক, যার অনেকগুলিই নির্দিষ্ট শব্দ বোঝাত, আবার কতকগুলি শব্দাংশ। প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলের কোনো এলাকায় প্রতীকগুলিকে মাত্র ডজনদুয়েকের মধ্যে সীমিত রাখা হয়েছিল, যার প্রত্যেকটি কোনো ব্যঞ্জনবর্ণের প্রতীক ছিল। সেই কটি বর্ণের সাহায্যে হাজার হাজার শব্দ লেখা সম্ভব ছিল, যাতে করে পুরো লিখনপদ্ধতি সহজবোধ্য হয়েছিল।

নীল অববাহিকার অধিবাসীরা যেহেতু তাদের সভ্যতার প্রাচীনত্ব নিয়ে অহংকার করত, আর সেই প্রাচীন জীবনধারার মধ্যে নিজেদের শক্ত করে বেঁধে রাখার চেষ্টা করত, তাই পরবর্তী দুই সহস্রাব্দ পর্যন্ত তারা সেই বর্ণমালা গ্রহণ করেনি। একগুয়েমীভাবে তারা সেই দুর্বোধ্য কষ্টকর পদ্ধতিই আঁকড়ে ধরেছিল। প্রথম দিকে অভিনব ও কার্যকর হলেও এটা পরবর্তীকালে দুর্বহ বোঝয় পরিগণিত হয়। এরূপ রক্ষণশীলতা শুধু অন্য প্রগতিশীল জনগোষ্ঠীর কাজে লেগেছিল যারা এগুলি ব্যবহার করে নীল অধিবাসীদের পেছনে ফেলে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিল (বমানে চীনারা তাদের প্রতীকী লিখনপদ্ধতি পরিত্যাগ করেনি, মিশরীয়দের মতোই জটিল)।

আর একটা রক্ষণশীলতা লক্ষ করা যায় ক্যালেন্ডার সংক্রান্ত ব্যাপারে। নীল অববাহিকার পুরোহিতরা ৩৬৫ দিনের বৎসর উদ্ভাবন করেছিল। প্রতি চতুর্থ বৎসর হবে ৩৬৬ দিনের। এটা নির্ধারণ করা হয়েছিল নীলের বন্যার সাথে সম্পর্ক রেখে। এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে নীলের বন্যা একটা নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করত। তবে ক্যালেন্ডারের এসব সংশোধনী সাধারণ লোকদের গ্রহণ করানো সম্ভব হয় নাই। লোকেরা অতীতের সব রীতি প্রথাকে আঁকড়ে ধরে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত, যদিও এতে করে আগামি বন্যার সময় নির্ধারণে জটিলতা দেখা দিত।

.

দুই মিশর

নীল অববাহিকার অধিবাসীরা তাদের দেশের নাম দিয়েছিল “খেম”। তাদের স্থানীয় ভাষায় এর আপাত অর্থ “কালো”। সম্ভবত নীলের বন্যায় রেখে যাওয়া কালো মাটি বোঝাতেই এই নামটা দেওয়া হয়েছিল। নীলের উভয় পার্শ্বে মরুভূমির লালচে বেলে মাটির সাথে যার পার্থক্য ছিল বেশ স্পষ্ট।

পরবর্তীকালে গ্রিকরা দেশটির নাম দিয়েছিল এইজিপ্টস। হয়তো তারা এই নামটা বিকৃতভাবে আহরণ করেছিল পরবর্তী এক বিখ্যাত মিশরীয় শহরের নামানুসারে যার সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। উত্তরাধিকারসূত্রে আমরা এই নামেই দেশটার সাথে পরিচিত।

সভ্যতার আদিপর্বে মিশর দেশটি ছিল অনেকগুলি ছোট ছোট শহর বা নোমস (nomes) নিয়ে যার প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা দেবতা, আলাদা মন্দির, পুরোহিত এবং প্রশাসক ছিল, যারা নদী এলাকার কৃষিভূমি নিয়ন্ত্রণ করত। এক শহর থেকে আর এক শহরের পরিবহণ বলতে ছিল একমাত্র জলপথ, আর তা ছিল বেশ সহজসাধ্য, কারণ জলপ্রবাহ ছিল এক দিকে আর বায়ুপ্রবাহ ছিল তার বিপরীত দিকে। পাল ছাড়া চলত একদিকে আর পাল তুলে তার বিপরীত দিকে।

প্রতিটি শহরের লোক একে অন্যের সাথে সহযোগিতা করত, ব্যাপারটাকে আরও সহজ করে তুলেছিল, কারণ শহরগুলিও একে অন্যের সাথে সহযোগিতা করত। তাদের মধ্যে মৈত্রী (League) স্থাপন করেছিল যার মাধ্যমে তারা প্রতিবেশী শহরগুলির মাধ্যমে সাধারণ সমস্যা দূর করার চেষ্টা করত। ঘটনাক্রমে কোনো কোনো শাসক নদীর বিশেষ এলাকায় দখল পোক্ত করার প্রয়াস পেত।

সাধারণভাবে অববাহিকাটি দুটি প্রধান অঞ্চলে বিভক্ত ছিল একদিকে ছিল নদীর সরু উপত্যকা, যার বিস্তার ছিল প্রথম জলপ্রপাত থেকে লেক মিয়েরিস পর্যন্ত সমুদ্র থেকে মোটামুটি একশ মাইল। এটা ছিল এক সংকীর্ণ ভূভাগ যাকে বলা যায় আপার ঈজিপ্ট। আপার ঈজিপ্টের উত্তরে নীল নদ বেশ কয়েকটি জলধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে যা ১২৫ মাইল প্রশস্ত এক ত্রিভুজাকৃতি ভূখণ্ড। অনেকগুলি ধারায় বিভক্ত হয়ে নীল নদ সাগরে প্রবেশ করেছে, আর এসব জলধারার মধ্যবর্তী প্রত্যেকটি ভূখণ্ড উর্বর কৃষিভূমি। এই উর্বর কৃষিভূমি দীর্ঘদিনব্যাপী দক্ষিণের পাহাড় থেকে নীলের বয়ে আনা পলিমাটি দ্বারা সৃষ্ট।

আধুনিক ভূগোলবিদরা ম্যাপের মধ্যে লোয়ার ঈজিটকে আপার ইজিপ্ট দেখিয়ে মিশরের ম্যাপ এঁকেছেন তা সত্যিই কিত। তবে নদীই ছিল এর প্রতিভূ। কেউ যদি নদীর স্রোতকে অবলম্বন করে মোহনার দিকে অগ্রসর হয়, আমরা বলি “ভাটির” দিকে যাওয়া হচ্ছে, আর তার উল্টো দিকে গেলে বলি “উজান” দিকে। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো।

গ্রিক বর্ণমালার একটি অক্ষর “ডেল্টা এর অর্থ সমবাহু ত্রিভুজ। তাই গ্রিকরা নিঃ মিশরকে এর ত্রিভুজাকৃতির কারণে বলত নীলের ডেল্টা। আজকাল যে কোনো নদীর মোহনাকে বলা হয় “ডেল্টা” তার আকৃতি যেমনটাই হোক না কেন। যেমন আমরা বলে থাকি মিসিসিপি ডেল্টা, যদিও তার গঠন অনিয়মিত।

2 Comments
Collapse Comments
Md Arshad Ahammed Arshad March 2, 2021 at 3:09 pm

Thank you to the writer who continuesly published great book to this website for us…

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *