৩. মিস ওয়েনফ্লিটের বক্তব্য

মিস ওয়েনফ্লিটের বক্তব্য

 লিউক পরদিন সকালবেলা একটা সিদ্ধান্ত নেয়। বই লিখতে আসার বাহানা আর ধোপে টিকবে না; সুতরাং উইচউডে আসার পেছনে যা সত্যিকারের কারণ, তা-ই সামনে রেখে তদন্ত চালিয়ে যাবে।

 ও ঠিক করে মিস ওয়েনফ্লিটের সঙ্গে দেখা করবে। উনি যা যা নিজে জানতেন, ইতিমধ্যেই লিউক ওঁর কাছ থেকে সব শুনেছে। কিন্তু এবার ও বের করার চেষ্টা করবে উনি যা অনুমান করেন ও সন্দেহ করেন।

ও চার্চে গিয়ে উপস্থিত হয়। এভাবে হঠাৎ লিউককে দেখে ভদ্রমহিলার ব্যবহারে কোনোরকম অস্বাভাবিক আচরণ দেখা গেল না। ফলে অনেক সহজ হলো লিউকের পক্ষে সরাসরি প্রসঙ্গে আসতে।

আপনার কাছে বলতে আর দ্বিধা নেই মিস ওয়েনফ্লিট যে আমি শুধুমাত্র একখানা বই লিখতে এখানে আসিনি–একথা আপনি নিশ্চয়ই সন্দেহ করেছেন?

মিস ওয়েনফ্লিট সম্মতি জানান।

অ্যামি গিবস্ নামে মেয়েটির মৃত্যুর কারণে তদন্তের জন্যই আমি এখানে আসি।

 অর্থাৎ, পুলিশ থেকে আপনাকে পাঠিয়েছে?

না না, আমি সাদা পোশাকের টিকটিকি নই।–লিউক একটু হেসে বলে–বরঞ্চ বলতে পারেন, আমি সেই গল্পেপড়া বিখ্যাত সখের গোয়েন্দা।

আচ্ছা! আপনাকে তাহলে নিশ্চয়ই ব্রিজেট কনওয়ে আনিয়েছে?

মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–ব্রিজেট অত্যন্ত দক্ষ মেয়ে আর খুব উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন। ওর জায়গায় যদি আমি হতাম, তাহলে কিন্তু এমন একটা সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারতাম না। কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে ঘটনাগুলো না জানা থাকলে কর্মপন্থা ঠিক করা এক দুরূহ কাজ।

কিন্তু আপনার তো জানা আছে, আছে না?

কী বলছেন মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম? আমি কী করে জানবো? বিশেষ করে আমার মত যারা একা থাকে এবং যেখানে কারও সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার পর্যন্ত সুযোগ নেই।

তা সত্ত্বেও লিউক প্রশ্ন করে–কিন্তু আপনার মন নিশ্চয়ই জানে কী ঘটেছে?

এবারও মিস ওয়েনফ্লিট অসম্মতি জানিয়ে প্রশ্ন করলো-আমরা কি পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সওয়াল জবাব করছি?

লিউক হেসে বলে-বুঝতে পারলাম। আপনি চান যে, আপনার কাছে সোজাসুজি সব ব্যাপারটা রাখি। বেশ, তাই হবে। আচ্ছা, আপনি কি মনে করেন অ্যামি গি খুন হয়েছিলো?

ওঁর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে আমি মোটেই নিঃসন্দেহ নই–সব ব্যাপারটার ভেতরে একটা গভীর সন্দেহের কারণ আছে বলেই আমি মনে করি।

কিন্তু আপনি এ কথা বলবেন যে ও স্বাভাবিক কারণে মারা গিয়েছিলো?

না, তা বলবো না।

তাহলে কি মনে করেন যে ওর মৃত্যুর কারণ কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনা?

না, তাও আমার মনে হয় না। নানা রকমের

লিউক প্রশ্ন করে–নিশ্চয়ই আত্মহত্যা বলে মনে করেন না?

অসম্ভব।

 তাহলে? আপনি ভালো করেই জানেন যে এটা খুন?

 হ্যাঁ, আমি ঠিক তাই মনে করি।

বেশ। এবার তাহলে কার্যকারণ বিশ্লেষণ করা যাক।

 কিন্তু আমার এই ধারণার পেছনে কোনো প্রমাণ আমি দিতে পারবো না–সবটাই আমার অনুমান মাত্র।

তাতে কিছু এসে যায় না। আমরা শুধুই আলোচনা করছি মাত্র এবং দুজনের কে কী। ভাবছি, কী সন্দেহ করছি–এটা পরস্পরকে বলছি।

মিস ওয়েনফ্লিট সম্মতি জানান।

লিউক প্রশ্ন করে-কে খুন করতে চাইতে পারে?

ও যে ছেলেটিকে ভালোবাসতো, তার সঙ্গে ওর ঝগড়া হয়েছিলো গ্যারাজে বসে। জিম হারভে ছেলেটির নাম-অত্যন্ত ভালো ছেলে। শুনেছি কোনো কোনো ছেলে তার বান্ধবীর ওপর পাশবিক অত্যাচার করে কিন্তু জিম সেইরকম ছিলো না। তা ছাড়া যেভাবে খুন করা হয়েছে জিম হলে সেভাবে করতোও না। পাইপ বেয়ে জানলায় উঠে ঘরের ভেতর ঢুকে কাশির ওষুধের বোতল সরিয়ে তার জায়গায় বিষভরা শিশি রেখে দেওয়া। মানে, ঠিক এমন

লিউক বললো–হঠাৎ রেগে যাওয়া কোনো প্রেমিকের কাজ বলে মনে হয় না, তাই না? ঠিকই বলেছেন। অ্যামিকে খুন করেছে এমন একজন, যে ওকে পথের কাঁটা ভেবে একেবারে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছে এবং এমন ভাবে ভেবেচিন্তে সরিয়েছে, যাতে মনে হতে পারে যে, মৃত্যুর কারণ দুর্ঘটনা। আমাদের সমস্যা এবং প্রশ্ন–কে সেই একজন?

না, সত্যিই তেমন কারও কথা আমি ভাবতেই পারছি না।

ভালো করে ভেবে দেখেছেন?

না না, বিশ্বাস করুন—

 ও অন্য প্রশ্ন করে–কোনো অভিসন্ধি আছে বলে আপনার মনে হয়?

কী অভিসন্ধি থাকতে পারে? আমি তো বুঝতে পারছি না।

 ও কি উইচউডের সর্বত্র ঘোরাঘুরি করতো?

 লর্ড হুইটফিল্ডের ওখানে কাজ করার আগে ও বছর খানেক হর্টনদের বাড়িতে ছিলো।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, কেউ একজন ওকে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিলো এবং যতটুকু আমরা জেনেছি, তার থেকে অনুমান করা যায় যে,–প্রথমতঃ সেই কেউ একজন হচ্ছে পুরুষ মানুষ, তার দৃষ্টিভঙ্গী মোটামুটি সেকেলে। দ্বিতীয়তঃ লোকটির শরীর সুগঠিত এবং শক্তিশালী–তার প্রমাণ মেলে দেওয়াল বেয়ে বাড়ির বাড়ির ছাদে উঠে মেয়েটির ঘরের জানলার মধ্য দিয়ে ঢোকার মধ্যে। আমার বক্তব্যের সঙ্গে আপনি একমত?

পুরোপুরি–মিস ওয়েনফ্লিট বলেন।

আচ্ছা, আমি নিজে যদি ওই জানলায় উঠে দেখি, আপনি কিছু মনে করবেন না তো?

 মনে করবো কেন? এতো খুব ভালো কথা।

লিউককে সঙ্গে নিয়ে একটা ছোট্ট দরজা দিয়ে বার বাড়ির উঠোনে গিয়ে উপস্থিত হলেন। লিউক অল্পায়াসেই ছাদে উঠে গেল এবং ওখানে দাঁড়িয়ে খানিকটা চেষ্টা করে জানলার শার্সি খুলে তার ভেতর দিয়ে হল ঘরের ভিতরে ঢুকলো। কিছুক্ষণ পরেই মিস ওয়েনফ্লিটের কাছে ফিরে এলো।

যতটা কঠিন বলে মনে হয়েছিলো ততটা কঠিন নয়, হাতে পায়ে একটু জোর থাকলেই হলো। আচ্ছা জানলার বাইরে কোনো রকম চিহ্ন বা ছাপ পাওয়া যায়নি?

মিঃ ওয়েনফ্লিট বললেন–মনে তো হয় না। তাছাড়া, পুলিশের লোকও তো উঠেছিলো ওখানে।

ওকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে এলেন মিস ওয়েনফ্লিট।

লিউক জিজ্ঞেস করে–অ্যামি গিবসের ঘুম খুব গাঢ় ছিলো কিনা আপনি জানেন?

মিস ওয়েনইফ্লিট বলেন–সকালে ওকে ঘুম থেকে জাগানো এক দুরূহ ব্যাপার ছিলো। কোনো কোনোদিন বার বার ওর দরজায় টোকা দিয়ে ওর সাড়া পেতাম না; তবে কথা হচ্ছে যে, যে শুনেও শুনতে চায় না–তাকে আর কে শোনাতে পারে বলুন?

সে তো ঠিকই। আচ্ছা, ওই লোকটি–এলওয়ার্দি–ওর সঙ্গে কি এই মেয়েটির কোনো ব্যাপার-স্যাপার কিছু ছিলো?-প্রশ্নটা করেই সঙ্গে সঙ্গে জুড়ে দেয়–আমি কিন্তু স্রেফ আপনার মতামত জানতে চাইছি।

হা ছিলো।

 লিউক মাথা নাড়ে–আপনার কি মনে হয় এলসওয়ার্দিকে ও ব্ল্যাকমেল করতো?

এবারও সেই একই কথা; অর্থাৎ আমার মত যদি চেয়ে থাকেন তাহলে বলবো, ওর পক্ষে তা সম্ভব।

আপনি কি জানেন, মারা যাবার সময় ওর কাছে অনেক টাকাকড়ি ছিলো কিনা?

 মিস ওয়েনফ্লিট বললেন–আমার মনে হয় না। ওর কাছে বেশি টাকা থাকলে আমি অন্ততঃ জানতে পারতাম।

মৃত্যুর আগেই কোনো মোটা খরচপত্র করেছিলো কি না জানেন?

যতদূর জানি–করেনি।

তাহলে তো আর ব্ল্যাকমেলতত্ত্ব দাঁড়াচ্ছে না। অবশ্য আরও একটা সূত্র আছে–মেয়েটি হয়তো বিশেষ কোনো ধরনের ঘটনা জানতো।

কোনো ধরনের ঘটনা?

এমন কিছু, যা উইচউডের কোনো ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে অত্যন্ত মারাত্মক। ধরুন, এখানকার বেশ কয়েকটা বাড়িতে মেয়েটি কাজ করত; কাজ করতে গিয়ে সেই বাড়ির কারো একজন সম্পর্কে ও এমন সব তথ্য জেনে ফেললো যা সেই লোকটির আয় উপার্জনের ক্ষতি করতে পারে। ধরুন, মিঃ অ্যাবটের মতো কেউ একজন।

মিঃ অ্যাবট?

লিউক আবার বলে–অথবা ধরুন, ডাঃ টমাসের কোনো গাফিলতি বা ডাক্তার হিসেবে কোনো অপরাধমূলক কাজে প্রশ্রয়দান?

কিন্তু তা কি–মিস ওয়েনফ্লিট বলতে গিয়ে থেমে যান।

লিউক বলে যায়–আপনিই বলেছেন যে অ্যামি গিবস্ ঝি-এর কাজ করতো এবং মিসেস হর্টন যখন মারা যান, তখন ও ওই বাড়িতেই কাজ করতো।

মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–আপনি কী বলছেন মিঃ ফিস উইলিয়াম? এর মধ্যে আবার হর্টনদের এনে টানাটানি করছেন কেন? বছর খানেকেরও বেশি হয়ে গেল মিসেস হর্টন মারা গেছেন।

সেই কথাই তো বলছি।

অ্যামি গিবস্ তখন ও বাড়িতেই কাজ করতো।

বুঝলাম। কিন্তু হর্টনরা এর মধ্যে আসে কী করে?

মিসেস হর্টন তো মারাত্মক ধরনের গ্যাস্ট্রাইটিসে মারা গেছেন, তাই না?

হ্যাঁ।

 ওর মৃত্যু কি আকস্মিক হয়েছিলো?

আমার কাছে তাই মনে হয়েছিলো। ও বেশ ভালো হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু একেবারেই হঠাৎ একদিন রোগটা প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেল এবং তাতেই মারা গেল।

ডাঃ টমাসও কি খুব আশ্চর্য হয়েছিলেন?

কার বেশ কয়েকটা, এমন সব তথ্য জেনে কেউ একজন

সঠিক জানি না–হয়তো হয়েছিলো!

কিন্তু আপনার নিজের কাছে কি এই মৃত্যুটা অদ্ভুত মনে হয়নি?

তা হয়েছে। ওর চোখেমুখে মৃত্যুর কোনো চিহ্নই ছিলো না–বরঞ্চ অনেকটা সুস্থই মনে হয়েছিলো।

এই অসুস্থতা সম্পর্কে ভদ্রমহিলা কি কিছু বলতেন?

 বলতেন যে নার্সরা ওকে বিষ খাওয়াচ্ছে।

আপনি নিশ্চয়ই এসব কথার কোনো গুরুত্বই দেননি?

না, দিইনি। আমি ধরে নিয়েছিলাম যে, এই মনোভাব অসুস্থতার ফল।

 লিউক বলে–ভদ্রমহিলা কি ওর স্বামীকে সন্দেহ করতেন?

না না, স্বামীর ওপর কোনো সন্দেহ ওর ছিলো না।

মিস ওয়েনফ্লিট বললেন–আপনার কি তাই মনে হয়?

দুনিয়ার বহু স্বামীরাই তাদের বউকে খুন করে পার পেয়েছে। তাছাড়া, শুনেছি যে স্ত্রীর মৃত্যুতে ভদ্রলোক অনেক টাকাও পেয়েছেন।

তা পেয়েছেন।

এ থেকে আপনার কী মনে হয় মিস ওয়েনটি?

মিস ওয়েনফ্লিট বললেন–আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মেজর হন তাঁর স্ত্রীর প্রতি একান্ত অনুরক্ত ছিলেন; স্বপ্নেও এসব বাজে চিন্তাও ওঁর মাথায় আসেনি।

লিউক বললো-বুঝলাম। আপনি যখন বলছেন তখন হয়তো এ কথাই ঠিক। তেমন কিছু হলে নিশ্চয়ই আপনার চোখে পড়তো।

আচ্ছা, অ্যামি গিবস্ সম্পর্কে পিঙ্কারটন কী ভাবতেন?

বলা খুব কঠিন। ল্যাভিনিয়ার একটা অদ্ভুত ধারণা ছিলো।

কী ধারণা?

ও মনে করতো যে উইচউডে কিছু একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটছিলো।

 আচ্ছা, উনি কি ভাবতেন যে টমি পিয়ার্সকে কেউ জানলা থেকে ফেলে দিয়েছিলো?

 একথা আপনি কী করে জানলেন মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম?

 লিউক বলে–যেদিন উনি খুন হয়েছিলেন, সেদিন আমরা একই সঙ্গে লণ্ডনে যাচ্ছিলাম।

ও আপনাকে ঠিক কী বলেছিলো?

উনি বলেছিলেন যে উইচউডে বড্ড বেশি পরিমাণ লোক মারা যাচ্ছিলো। কয়েকটা নামও উনি করেছিলেন–অ্যামি গিবস, টমি পিয়ার্স এবং কার্টারের নাম। তাছাড়া, উনি ডাঃ আম্বলবির নাম করে বলেছিলেন যে, তারও দিন অতি সীমিত। এমন একজন লোক যার চোখে একটা বিচিত্র দৃষ্টি দেখলেই বোঝা যায় যে, সেই-ই খুনী। সেই লোকটি যখন আম্বলবির সঙ্গে কথা বলেছিলো, তখন তার চোখের সেই দৃষ্টি উনি দেখতে পেয়েছিলেন এবং তার সঙ্গে কথা বলেছিলো যে, আম্বলবির মৃত্যু আসন্ন।

মিস ওয়েনফ্লিট বললেন–কী সর্বনাশ! এবং তার পরেই সে মারা গেল।

প্রশ্ন করে লিউক–কে সেই লোক? বলুন মিস ওয়েনফ্লিট। আপনি নিশ্চয়ই জানেন–বলুন সে কে?

আমি জানি না–ও আমায় বলেনি।

কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারেন, কে হতে পারে? ওঁর মনে কার কথা ছিলো সে সম্পর্কে অন্ততঃ একটা ধারণা আপনার আছে।

মাথা নিচু করেন মিস ওয়েনফ্লিট।

এবার তাহলে বলুন।-জোর দেয় লিউক।

মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–কী করে আপনি আমাকে এমন একটা কাজ করতে বলছেন–যা অত্যন্ত অন্যায়। না জেনে শুধুমাত্র অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কাউকে দোষারোপ করা আমার পক্ষে অসম্ভব।

হেরে গিয়েও কিন্তু লিউক মাথা ঠিক রাখতে জানে। ও যে আবার এই ব্যাপার নিয়ে এখানে আসবে–ওর আচরণের মধ্যে তেমন আভাস দিয়ে বলে–

আপনার বিবেক যা নির্দেশ দেয়, সেই অনুযায়ী আপনি চলুন। যাই হোক, আমাকে আপনি প্রচুর সাহায্য করেছেন–ধন্যবাদ।

মিস ওয়েনফ্লিট বলেন-আমাকে দিয়ে আর যদি কোনো উপকার হয়, আনায়াসে বলবেন।

নিশ্চয়ই বলবো। আমাদের যা যা কথাবার্তা হলো, কাউকে বলবেন না।

না না, এর একটি কথাও কেউ জানতে পারবে না।

একথার অন্যথা যে হবে না লিউক জানে। আবার ভদ্রমহিলা বললেন–ব্রিজেটকে আমার ভালোবাসা জানাবেন। মেয়েটি ভারী সুন্দর আর বুদ্ধিও রাখে প্রচুর। ও সুখী হোক।

উনি বললেন–লর্ড হুইটফিল্ডের সঙ্গে বিয়েতে ও সুখী হোক–বয়সের পার্থক্যটা বড়ই বেশি।

হুঁ, তা খানিকটা বেশিই।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন মিস ওয়েনফ্লিট–এক সময়ে ওর সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল।

আশ্চর্য হয়ে লিউক ওঁর দিকে তাকায়।

বহুকাল আগের কথা, তখন ও সবেমাত্র ওপরের দিকে উঠেছে। ওর লেখাপড়ায় আমিই সাহায্য করেছিলাম। ওর মধ্যে যে বড় হবার একটা অদম্য স্পৃহা ছিলো, তা নিয়ে আমার গর্বের শেষ ছিলো না। তারপর বললো–অবশ্য আমার বাড়ির লোকেরাই ওর সম্পর্কে বদনাম রটালো। সেই যুগে শ্রেণী বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট ছিলো। ওর উন্নতির দিকে আমি সব সময়ে সচেতন ছিলাম। কিন্তু আমার নিজের লোকেরাই ভুলটা করলো।

লিউকের মনে পড়লো সেও মিস ওয়েনফ্লিটকে একেবারে বৃদ্ধের পর্যায়ে ভেবেছিলো। কিন্তু এখন বুঝতে পারলো যে ভদ্রমহিলার বয়স হয়তো ষাটের নিচে।

মরুকগে, আমার কী?–ও নিয়ে চিন্তা করা আমার কী দরকার? তার চেয়ে যে কাজে এসেছি–তাই-ই করি।

***

লিউকের মনোসংযোগ

অ্যামি গিবসের মামী মিসেস চার্চ একজন নিতান্তই অপ্রীতিকর মহিলা। টিকালো নাক, অস্থির তাকানো আর ঘনঘনে বাচনভঙ্গী-এই সব মিলে মহিলাকে দেখেই অস্বস্তিকর মনে হলো লিউকের।

আমি যে প্রশ্নগুলো করবো, আপনার কাজ হবে তার যতদূর সম্ভব সঠিক উত্তর দেওয়া। যদি কিছু গোপন করেন, তার ফলাফল খুব খারাপ হবে।

আজ্ঞে, বুঝতে পেরেছি। আমি যতটুকু জানি তার সবটাই আপনাকে বলবো। আমি এর আগে কক্ষনো পুলিশী ঝামেলায় পড়িনি।

আমি আপনার বোনঝি-র সম্পর্কে সব কথা জানতে চাই–কে কে ওর বন্ধু ছিলো, কী পরিমাণ টাকা ছিলো, সাধারণত যে সমস্ত কথাবার্তা বলতে তার বাইরে কিছু বলেছিলো কি না। প্রথমেই শুরু করা যাক, কারা ওর বন্ধু ছিলো।

মিসেস চার্চ বললেন–আপনি কি ওর পুরুষ বন্ধুদের কথা বলছেন?

ওর কি মেয়ে বন্ধু ছিলো?

আজ্ঞে বলতে গেলে না থাকারই মতো। আমি তাদের সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ রাখতো না। তবে ওই গ্যারাজে জিম হারভে নামে একটি ছেলে আছে, তার সঙ্গেই ওর ব্যাপার-স্যাপার চলছিলো। ছেলেটি কিন্তু বেশ ভালো।

বাধা দেয় লিউক–আর কোনো বন্ধু ছিলো?

আবার সেই নোংরা ধূর্ত চাহনি–ওহো, আপনি সেই ভদ্রলোকের কথা বলছেন, যার খেলনা, পুতুলের দোকান আছে? আমার ওই লোকটাকে মোটেই ভালো লাগতো না-সোজা কথা। নিজের ইজ্জত নিজের হাতে। যেখানে-সেখানে চুকচ্ছুক করা আমি পছন্দ করি না–কিন্তু বলবো কাকে? আজকালকার মেয়েগুলো কি ভালো কথায় কান দেয়? যা মনে হয় তাই-ই করে। কিন্তু পরে পস্তায়।

অ্যামি অনুতাপ করতো?

না, তা মনে হয় করতো না।

 মৃত্যুর দিনে আমি গিয়েছিলো ডাঃ টমাসের কাছে–এই সমস্ত কারণেই কি ওখানে গিয়েছিলো?

না না, আপনি যা ভাবছেন তেমন কোনো রোগের জন্য ও ডাক্তারের কাছে যায়নি, এ আমি সঠিক করে বলতে পারি। ও কদিন সর্দিকাশিতে ভুগছিলো, সেই জন্যেই গিয়েছিলো।

আপনার কথাই মেনে নিচ্ছি। কিন্তু ওর আর এলসওয়ার্দির মধ্যেকার ব্যাপার কতদূর এগিয়েছিলো?

মিসেস চার্চ বলেন–সে কথা আমি বলতে পারবো না–অ্যামি ওর গোপন ব্যাপার আমায় কখনো বলতো না।

লিউক বলে–কিন্তু ওরা তো অনেকটাই এগিয়েছিলো?

এই ভদ্দর লোককে এখানকার কেউ ভালো বলতো না। শহর থেকে বন্ধু-বান্ধব এনে কি সমস্ত করতো-টরতো সবাই মিলে ওই ডাইনী মাঠে।

অ্যামি যেতো?

একবার গিয়েছিলো বলে জানি। সারারাত ওখানে ছিলো। লর্ড হুইটফিল্ডের কাছে ধরাও পড়েছিলো। লর্ড খুব বকেছিলেন, আমিও মুখে মুখে জবাব দিয়েছিলো, তাতেই তো ওর চাকরিটা গেল।

ও যাঁদের বাড়ি কাজ করতো, তাদের সম্পর্কে আপনার সঙ্গে কোনো গল্পগুজব করতো?

খুব একটা করতো না।

মেজর হর্টনের বাড়িতেও কিছুদিন কাজ করেছে–না?

তা–প্রায় বছর খানেক হবে।

ছাড়লো কেন?

ভালো মাইনে পেয়ে গেলো। সেই সময়ে ম্যানরে কাজ খালি ছিলো–ওঁদের মাইনে অনেক ভালো ছিলো।

মাথা নাড়ে লিউক।–আচ্ছা, মিসেস হর্টনের মৃত্যুর সময় ওতত ওই বাড়িতেই কাজ করছিলো–তাই না?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

উকিল মিঃ অ্যাবট-তাঁর বাড়িতেও ও কাজ করছে?

না, মিঃ অ্যাবটের বাড়িতে একজন লোক আর তার বউ–এই দুজনে মিলে কাজ করতো। তবে, মিঃ অ্যাবটের বাড়িতে ও একবার গিয়েছিলো–কেন গিয়েছিলো বলতে পারবো না।

এ অঞ্চলের আর কোনো লোকের কাছে ও যাতায়াত করতো?

 যা বলেছি তার বাইরে আর কিছু বলতে পারবো না।

মিসেস চার্চ, মনে রাখবেন আমি সত্যি কথা শুনতে চাই।

কিন্তু সেই লোকটা মোটেই ভদ্দরলোক ছিলেন না; আমিও ওকে বলেছিলাম যে, আর নিজেকে অত নিচে নামাস না।–কিন্তু শুনলে তো

মিসেস চার্চ, হেঁয়ালি রেখে স্পষ্ট করে বলবেন?

আপনি সেভেন স্টাপ-এর নাম শুনেছেন? মোটেই ভালো বাড়ি নয় ওটা।–ওই বাড়ির মালিক হলে গিয়ে হ্যারি কার্টার–একটা আস্ত ছোটোলোক; সব সময়ে মদে চুর হয়ে থাকতো।

সেও অ্যামির বন্ধু ছিলো?

দুএকদিন ওর সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলো।

লিউক অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়–টমি পিয়ার্স নামে একটা ছোটো ছেলেকে চিনতেন?

কাকে? মিসেস পিয়ার্সের ছেলেকে? খু-উ-ব ভালো করে চিনতাম–হাড়বজ্জাত ছিলো।

 ওর সঙ্গে কি অ্যামির ঘন ঘন দেখাশুনো হতো।

 না না, অ্যামির সঙ্গে বজ্জাতি করতে গেলে ওর কান আর আস্ত থাকতো না।

মিস ওয়েনফ্লিটের কাছে ও খুশী মনে ছিলো?

ওখানে মাইনেপওর ভালো ছিলো না, আর খুব একঘেঁয়েমি ছিলো।

ও অন্য কোথাও চলে যেতে পারতো না?

 লণ্ডনের কথা বলছেন?

কিংবা, দেশের অন্য কোনো অঞ্চলে?

মিসেস চার্চ বলেন–অ্যামি উইচউডের ওই সব কাণ্ডকারখানা ছেড়ে যেতে চাইতো না।

ওই সব বলতে কী বোঝাতে চাইছেন?

জিম আর সেই খেলনা-পুতুলের দোকানের ভদ্দরলোকদের সঙ্গে ওর দহরম-মহরমের ব্যাপার।

মিসেস চার্চের কাছে জানার মতো আর বিশেষ কিছু নেই। কিন্তু তবুও শেষ বারের মতো আন্দাজে একটা ঢিল ছুঁড়লো।

বুঝতেই পারছেন যে, এই সমস্ত প্রশ্ন আপনাকে কেন করলাম। দুর্ঘটনার ফলে ও মারা গেছে–এটা ঠিক মেনে নিতে পারছি না এবং তা যদি না হয়, তাহলে বুঝে নিন যে এটা কী হতে পারে।

মিসেস চার্চ বলেন–হত্যাকাণ্ড।

ঠিক। ধরে নিন যে, আপনার বোনঝি এক হত্যাকাণ্ডের ফলে মারা গিয়েছিলো–কাকে আপনি সন্দেহ করেন?

মিসেস চার্চ বললেন–আচ্ছা, পুলিশকে খুনীর হদিস বলতে পারলে পুরস্কার পাওয়া যাবে?

তা হয়তো পাওয়া যেতে পারে।

কিন্তু একেবারে ঠিক ঠিক বলতে পারবো না–তবে ঐ খেলনার দোকানের লোকটাকে আমার যেন কেমন মনে হয়। ক্যাস্টর মামলার কথা মনে করে দেখুন–সেই মেয়েটার খুনের খুঁটিনাটি সব প্রমাণ পেলো ক্যাস্টর সৈকতের সেই বাংলো বাড়িটায়, আর তা থেকেই অন্য মেয়েদের খুনের কথা সব বেরিয়ে পড়লো। এই এলসওয়ার্দিও হয়তো এমনই একজন।

আপনার তাই মনে হচ্ছে?

হতেও তো পারে; বলুন পারে কি না?

লিউক স্বীকার করে, হা হতেও পারে। তারপর বলেন–আচ্ছা ডারবী খেলার দিন বিকেলে এলসওয়ার্দি কোথাও বাইরে গিয়েছিলো? এটা কিন্তু খুব দরকারী।

চিন্তিতভাবে মিসেস চার্চ বলেন–ডারবীর দিনে?

হ্যাঁ, দিন পনেরো আগের এক বুধবার।

মিসেস চার্চ বলেন-তা বলতে পারবো না। তবে বুধবার এমনিতেই ওর দোকান সকাল সকাল বন্ধ হয়। সেদিন ও সাধারণতঃ শহরে যায়।

ওহো, আগেই বন্ধ হয়?

উঠে পড়ে লিউক। মানুষ হিসেবে মহিলাকে ওর মনে হয়েছে অত্যন্ত নিম্নশ্রেণীর। তবে বিচ্ছিন্নভাবে পরচর্চার মধ্য থেকে কিছু কিছু দরকারী খবর ও সংগ্রহ করতে পেরেছে।

নিজের মনে ও সমস্ত খবরগুলো পর্যালোচনা করে। ওই চারজনের নামই ঘুরে ফিরে মনে আসছে–টমাস, অ্যাবট, হর্টন আর এলসওয়ার্দি। মিস ওয়েনফ্লিটের কথাবার্তা থেকেও এই চারজনের যে-কোনো একজনকেই সন্দেহ হচ্ছে। কোনো মাংসওয়ালা, বা রুটিওয়ালা অথবা মোমবাতি বিক্রেতা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়।

প্রথমেই দেখতে হবে যে, মিস ওয়েনফ্লিট-এর নাম বলতে অনিচ্ছার কী কারণ; ভদ্রমহিলার বিচার-বিবেচনা অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ এবং মানবিক। ওঁর ধারণা যে মিস পিঙ্কারটন যাকে সন্দেহ করেন সেই লোকে কে তা ওঁর জানা; কিন্তু আবার বলছেন যে সেটা ওঁর বিশ্বাস মাত্র–সত্যি না-ও হতে পারে।

কাকে সন্দেহ করেন মিস ওয়েনফ্লিট?

মিস ওয়েনফ্লিটের ভয় যে, ওঁর দোষারোপের ফলে একজন নিরপরাধ লোকের ক্ষতি হতে পারে। এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় সেই লোকটি সমাজে উচ্চ প্রতিষ্ঠিত এবং আশেপাশের সবাই তাকে সম্মান করে।

সুতরাং, এইদিক থেকে বিচার করলে আর এলসওয়ার্দিকে সন্দেহ করা চলে না। উনি উইচউডে নতুন এসেছেন; তাছাড়া, সুনামও নেই।

এবার আর কে কে আছে দেখা যাক। মেজর হর্টন তার স্ত্রীকে বিষ খাওয়াতে পারেন কিনা এই প্রসঙ্গ উঠতেই মিস ওয়েনফ্লিট বিরক্তির সঙ্গেই এই সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেন। মিসেস হর্টনের মৃত্যুর পরের খুনগুলো নিয়ে মিস ওয়েনফ্লিট যদি কোনোরকম সন্দেহ করতেন হর্টনকে, তাহলে বিষ প্রয়োগের প্রশ্নে এতটা নিঃসন্দেহ হতে পারতেন না।

এবার বাকি থাকছেন ডাঃ টমাস আর মিঃ অ্যাবট। পেশার দিক থেকে দুজনেই স্বাধীন এবং পদমর্যাদাসম্পন্ন। দুজনেই মোটামুটি জনপ্রিয় এবং প্রতিবেশীদের মধ্যে সুপরিচিত। এই সব তথ্যের দিক থেকে বিচার করলে দুজনকেই সমানভাবে সন্দেহ করা চলে।

মিস পিঙ্কারটন নিশ্চিতভাবে জানতেন সেই লোকটিকে। তার প্রথম প্রমাণ ওঁর নিজের মৃত্যু এবং দ্বিতীয় প্রমাণ ডাঃ আম্বলবির মৃত্যু। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে যে, মিস পিঙ্কারটন সেই লোকটির নাম মিস ওয়েনফ্লিটের কাছে বলেননি।

স্বগতোক্তি করে লিউক–ধরে নেওয়া যাক যে, এলসওয়ার্দিই খুনী, এবং এটা আমার বেশ ভালো করেই জানা। এবার আসা যাক, একের পর এক যারা খুন হয়েছে : এক নম্বর–মিসেস হর্টন। মিসেস হর্টনকে খুন করার পেছনে এলসওয়ার্দির কী উদ্দেশ্য চরিতার্থ হলো বোঝ কঠিন। মিসেস হর্টন এলসওয়ার্দির কাছ থেকে কি সব তুকতা ওষুধ নিয়েছিলো। সেই ওষুধের সঙ্গে খুব সহজেই কিছু আর্সেনিক মিশিয়ে দেওয়া মোটেই কঠিন ছিলো না। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে কেন?

এবার আসা যাক অ্যামি গিবসের প্রসঙ্গে। এলওয়ার্দির কী অভিসন্ধি থাকতে পারে অ্যামিকে খুন করার পেছনে? সহজেই যে কারণটা মনে আসে, তা হলো এই যে, আমি কোনো বিষয়ে আশাহত হয়েছিলো এবং তার জন্য ভয় দেখিয়েছিলো। হয়তো বা লর্ড হুইটফিল্ড উইচউডে বেশ প্রভাবশালী এবং ব্রিজেটের মতে তিনি একজন যথার্থ চরিত্রবান লোক। এলওয়ার্দির সেই সব অসামাজিক বীভৎস কাণ্ডকারখানার কথা জানাজানি হয়ে গেলে লর্ড হুইটফিল্ড ছেড়ে দিতেন না। অতএব, সরাও অ্যামিকে। যেভাবে খুন করা হয়েছে, তাতে মনে হয় না যে স্রেফ খুন করার আনন্দে খুন করা হয়েছে।

এরপর কে? কার্টার? কার্টার মরলো কেন? মাঝরাতের পিশাচ সাধনার কথা তো ওর জানবার কথা নয়। এমন হতে পারে যে, ওর সুন্দরী তরুণী মেয়েটি এসব ভুতুড়ে ব্যাপারের সঙ্গে জড়িত ছিলো। এলসওয়ার্দি হয়তো মেয়েটির ওপর পাশবিক অত্যাচার করতো তাতে কার্টার খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিলো তার জন্যই তাকে খুন করা হয়েছে।

এরপর টমি পিয়ার্স। টমিকে কেন এলসওয়ার্দি মারতে গেল? টমি সেই মাঝরাতের পৈশাচিক পুজো-পার্বণের ব্যাপারে ছিলো এবং সবাইকে বলে দেবে বলে ভয় দেখিয়েছিলো। হয়তো বা বলেছিলোও সুতরাং, টমির মুখ বন্ধ করার প্রয়োজন ছিলো।

ডাঃ আম্বলবিকে কেন খুন করলো? খুবই সহজ কারণে। ডাক্তার হিসেবে আম্বলবি ধরে ফেলেছিলো ওর মানসিক বৈকল্যের ব্যাপার। তার ফলেই আম্বলবির জীবনাবসান। এলসওয়ার্দি কী উপায়ে ডাঃ আম্বলবির রক্ত বিষিয়ে দিতে পারলো?

সবার শেষে মিস পিঙ্কারটন। বুধবার তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধের দিন। এলসওয়ার্দি সেদিন দোকান বন্ধ করে শহরে চলে গেল। ওর গাড়ি আছে না কি? যাকগে, এলসওয়ার্দি টের পেয়েছিলো যে, মিস পিঙ্কারটন ওকে সন্দেহ করেন সুতরাং তিনি হয়তো খুন হন।

মাথা নাড়তে নাড়তে লিউক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর আবার যুক্তির সাগরে ডুব দেয়।

অ্যাবট হতে পারে? ভদ্রলোক সুচতুর এবং আত্মবিশ্বাসী-খুনীরা সাধারণতঃ এমন হয়ে থাকে। আমি গিবস একবার এর সঙ্গে দেখা করেছিলো। কী কারণ হতে পারে? অ্যামি দেখা করতে চেয়েছিলো কেন? আইনের পরামর্শ নেবার ব্যাপারে? কে যেন বলেছিলো যে–জনৈক মহিলার কাছ থেকে একটা চিঠি এসেছিলো যেটা টমি দেখে ফেলেছিলো। সেই চিঠি কি অ্যামি লিখেছিলো? না কি মিসেস হর্টন? হয়তো অ্যামি সেই চিঠি হাত করেছিলো। এরা ছাড়া কে আর এমন মহিলা থাকতে পারে–যার চিঠি দৈবক্রমে টমি দেখে ফেলতে ভদ্রলোক রেগে অগ্নিশর্মা হয়েছিলেন? অ্যামি কেমন করে মারা গেল? হ্যাট পেইন্ট খেয়ে? কিন্তু টমি পিয়ার্সকে মারলো কেন?–স্বাভাবিক কারণ। চিঠিটা দেখে ফেলেছিলো বলে।

কিন্তু কার্টার? সম্ভবতঃ কার্টারের মেয়ের সঙ্গে একটা কিছু হয়েছিলো। অ্যাবটের পক্ষে সেই কেলেঙ্কারির কথা জানাজানি হওয়া ভয়ানক ক্ষতিকর হতো। কার্টারের যা মোটাবুদ্ধি আর উগ্র মেজাজও হয়তো অ্যাবটুকে শাসিয়েছিলো। অতএব কার্টারও খতম হলো।

এবার আম্বলবি। অ্যাবটের মতো ধূর্ত প্যাচালো উকিলের বিরুদ্ধে আম্বলবির মতো সহজ-সরল লোকের জেহাদ ঘোষণা। এর ফলে তার মৃত্যু।

এরপর পিঙ্কারটন। যে লোকটি ধরেই নিয়েছিলো যে, যে সব সন্দেহের অতীত তারই ওপর মিস পিঙ্কারটনের সন্দেহ হলো। মিস পিঙ্কারটন সেই ভয়াবহ গোপন কথাটি জেনে ফেললেন। কিন্তু তাহলেও হাতে কোনো প্রমাণ ছিলো না। স্বভাবতই তিনি প্রমাণ যোগাড়ের চেষ্টায় ছিলেন। অ্যাবটন লোকচরিত্র খুব ভালোই বোঝে। অতএব পিঙ্কারটন খুন হলেন।

চিন্তাসূত্রে লিউকের ছেদ পড়ে। মেজর হর্টনও যে একজন সার্থক খুনী হতে পারেন, সেই সম্ভাবনার সূত্র ধরতে ওর কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হয়।

হর্টন ওঁর স্ত্রীকে খুন করেছিলো। একথা ধরে নিয়েই হর্টনের প্রসঙ্গ আরম্ভ করা যাক। হর্টনের খুন করার পেছনে যথেষ্ট কারণ ছিলো এবং স্ত্রীর মৃত্যুতে ওঁর প্রচুর লাভও হয়েছিলো। সুনিপুণ হাতে স্ত্রীকে হত্যা করার জন্য স্ত্রীর প্রতি অস্বাভাবিক অনুরাগ খুব একটা প্রয়োজনীয় ছিলো না।

এরপর অ্যামি গিবস। সহজ ব্যাপার। অ্যামি যে সময়ে ও বাড়িতে কাজ করতো; কিছু একটা হয়তো দেখে ফেলেছিলো। মেজরের পক্ষে স্ত্রীর চায়ের সঙ্গে কোনো বিষ মিশিয়ে দেওয়া কিছু কঠিন কাজ ছিলো? প্রথম দিকে আমি হয়তো বুঝতে পারেনি; কিন্তু যখন বুঝেছে তখন হ্যাট পেইন্টের সাহায্যে ওকেও সরানো মেজরের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক।

এরপর কার্টার। অ্যামি হয়তো কার্টারকে কিছু বলেছিলো; অতএব, আরো একটা সাদাসিধে খুন।

এবার টমি পিয়ার্স। সম্ভবতঃ অ্যাবটের অফিসে ও যে চিঠিটা দেখেছিলো সেটা হয়তো মিসেস হর্টনের লেখা। উনি হয়তো লিখেছিলেন যে, ওর স্বামী তাঁকে বিষ খাইয়ে মারবার চেষ্টা করেছিল? অতএব মেজর বুঝতেই পেরেছিলেন টমি ওঁর পক্ষে বিপজ্জনক। তাই টমিকে খুন করা হলো।

এবারই হলো আসল এবং কঠিনতম সমস্যা। আম্বলবি। কী উদ্দেশ্য? দুরুহ ব্যাপার। মিসেস হর্টনকে প্রথমদিকে আম্বলবিই দেখেছিলেন। রোগের ধরন দেখে হয়তো কিছু একটা আঁচও করেছিলেন; ফলে হর্টন স্ত্রীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে টমাসকে এনেছিলো। কিন্তু তাহলে একদিন বাদে আম্বলবির বিপদ এলো কেন? মুশকিল। তাছাড়া ওঁর মৃত্যুর পদ্ধতিও ঠিক ছকে মিলছে না। বিষিয়ে যাওয়া আঙ্গুলের সঙ্গে মেজরের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

লিউকের চিন্তার ভারে ভুরু-কপাল কুঁচকে আসে।

আমার মনে হয় না এ সব এলওয়ার্দির কাজ–ওদেরই মধ্যে কেউ একজন–কে জানে, আবার হতেও পারে, ওর কথাই সবার মনে আসে। মিস ওয়েনফ্লিট মূর্খ নন, কাকে সন্দেহ করেন ভদ্রমহিলা? অ্যাবটকে না টমাসকে? নিশ্চয়ই এই দুজনের একজনকে। যদি একটু কায়দা করে ওঁকে সরাসরি প্রশ্ন করি-বলুন এদের মধ্যে কে?–হয়তো উত্তরটা পেয়ে যেতে পারি।

কিন্তু মিস ওয়েনফ্লিটের ভুল হতে পারে। উনি যে সঠিক বলেছেন, সেকথা তো প্রমাণ করার উপায় নেই–যেমন মিস পিঙ্কারটন প্রমাণ করেছিলেন নিজের প্রাণের বিনিময়ে। আমার প্রয়োজন অকাট্য প্রমাণ। যদি আর একটা তেমন ঘটে মাত্র আর একজনের জীবন বলি হয় তাহলেই হয়তো বুঝতে পারতাম…

লিউক চিন্তায় ছেদ টানে। কী সর্বনাশ! আমি একজনের মৃত্যু কামনা করছি?

***

ড্রাইভারের অসম আচরণ

সেভেন স্টারস্ বার-এ শেষ পর্যন্ত বেশ বিব্রত হয়েই লিউক ওর বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দেয়।

অগত্যা কাউন্টারের ওপাশের মেয়েটির মনোরঞ্জনে মন দিলো। এই মেয়েটি যে লুসি কার্টার এটা ও প্রথমেই অনুমান করেছিলো।

লিউক পরিষ্কার বুঝতে দেয় যে, ও মেয়েটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। মিস কার্টারও খিলখিল করে হেসে বলে–আপনি কি সত্যিই আপনার সঙ্গে বেড়াতে যেতে বলছেন না ওটা শুধুই কথার কথা?

লিউক এক চুমুকে বাকি বিয়ারটুকু শেষ করে উঠে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে ও নদীর ওপর যেখানে পায়ে চলার জন্য সাঁকো আছে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়।

পেছন থেকে হঠাৎ কে যেন কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে–এই সেই জায়গা। এখান থেকেই হ্যারি পড়ে গিয়েছিলো।

ও পেছন ফিরেই লোকটিকে চিনতে পারলো। ওই লোকটি কিছুক্ষণের আগেই ওর পাশে বসে মদ খাচ্ছিলো। সেই-ই এখন সানন্দে এগিয়ে এসেছে মৃত্যুদৃশ্যের বর্ণনায়।

ঐতো, ওখানে একেবারে কাদার মধ্যে মাথাটা পুরো ডুবে গিয়েছিলো।–লোকটি বললো।

ওখান থেকে পড়ে যাওয়াটা ভারী অদ্ভুত।–বললো লিউক।

লোকটি বলেও একেবারে পাঁড় মাতাল অবস্থায় ছিলো।

তা হয়তো ছিলো; কিন্তু ঐ অবস্থায় তো ও প্রতিদিন থাকতো।

সে আপনি যথার্থ বলেছেন–হ্যারি প্রায় সব সময়েই মদের ঘোরে থাকতো।

লিউক বললো–কেউ হয়তো ওকে ওখান থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলো।

তা হবে। তবে এমন কাজ কে করতে যাবে? আমার তো মাথায় আসছে না!

মাতাল অবস্থায় ও যখন যাকে গালাগাল করতো, তাদের মধ্যেই হয়তো কেউ কেউ ওর শত্রু ছিলো।

তা সত্যি। কিন্তু সেজন্য ওকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে–তা মনে হয় না।

লিউক প্রসঙ্গ বদলে বলে যেভাবেই ঘটে থাক–ঘটনাটা কিন্তু খুব দুঃখের।

ওর বউ আর মেয়ে লুসি খুব একটা দুঃখিত বলে আমার মনে হয় না। বৃদ্ধ লোকটি বলে।

হ্যারি কার্টারকে নিয়ে আলোচনায় ছেদ টেনে ওরা পরস্পরকে বিদায় দেয়।

ওল্ড হলের দিকে লিউক পা বাড়ায়। বাড়ির সামনের দুটো ঘরে লাইব্রেরি; ঘর দুটো পেরিয়ে ও পেছনের দিকে যায়। একটা ঘরের দরজায় লেখা আছে-মিউজিয়াম। সেইখানে আছে রোম দেশের কিছু টাকা পয়সা, কিছু বাসনপত্র। এছাড়া আছে মেজর হর্টনের দেওয়া কিছু ভারতীয় দেব-দেবী–যার মধ্যে আছে বিকট দর্শন এক বুদ্ধমূর্তি। আর রয়েছে কিছু মিশরীয় সন্দেহজনক পুঁতির মালা।

লিউক আবার হলে ঢোকে। সেখানে কাউকে না দেখতে পেয়ে উপরে উঠে যায়। ওর মতে বেশির ভাগ ঘরগুলোই বাজে জবরজং লটবহরে ভর্তি। কোথাও কোথাও আবার রাখা আছে মান্ধাতার আমলের গল্প-উপন্যাসের বই।

জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় লিউক। টমি হয়তো জানলার ওপর দাঁড়িয়ে পরিষ্কার করছিলো। এমন সময় একজন কেউ এখানে এলো। সেই লোকটি কথায় কথায় একেবারে কাছে এগিয়ে এলো। অতঃপর-অতর্কিতে এক ধাক্কা।

ও নিজের মনে বলে–যে কেউ অতি সহজেই এসে কাজ হাসিল করে চলে যেতে পারে।

মিস ওয়েনফ্লিট বগলে একগাদা বই নিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসেন। মুখে চোখে একটা পরিতৃপ্তি-মাখানো ব্যস্ততার ছাপ। লিউককে দেখে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার চোখ।

আরে, মিঃ ফিস্ উইলিয়াম্! আমাদের মিউজিয়ামটা দেখেছেন? যদিও দেখবার মতো বিশেষ কিছুই নেই; তবে লর্ড হুইটফিল্ড বলেছেন যে ভালো ভালো কিছু দর্শনীয় জিনিষ উনি এনে দেবেন।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, বলেছেন লণ্ডনের বিজ্ঞান-মন্দিরে যেমন আছে, তেমনি আধুনিক, কিছু কিছু দ্রষ্টব্য–এ্যারোপ্লেন, রেল-ইঞ্জিনের মডেল–এইসব আর কি।

এগুলো আনলে মিউজিয়ামের চেহারা অনেক ভালো হবে।

তা হবে। আমি একথা মানি না যে, মিউজিয়াম কেবলমাত্র অতীতের আস্তানা। আপনার কী মত?

তা হয়তো নয়।

ওসব ছাড়া আরও নানা রকম জিনিষপত্র আসবে–যেমন, খাবারদাবার এবং সেগুলোর। গুণগত তাৎপর্য; কোন খাদ্যে কী কী ভিটামিন ইত্যাদি। লর্ড হুইটফিল্ড উপযুক্ততার মতবাদে দারুণ বিশ্বাসী।

এই ধরনের কথাই উনি সেদিন বলেছিলেন।

আমার মতে বর্তমানই হলো আসল। লর্ড হুইটফিল্ড কিন্তু বলেছিলেন যে, একদিন উনি ওয়েলারম্যান গবেষণাগারে কী কী সব জীবাণু, জীবাণুতত্ত্ব এবং সে সব নিয়ে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা দেখে এসেছেন–যেটা আমার বুদ্ধিতে কুলালো না।

লিউক বললো,–লর্ড হুইটফিল্ডও হয়তো কিছুই বোঝেননি। ওঁর চেয়ে আপনার মাথা অনেক পরিষ্কার।

মিস ওয়েনফ্লিট বললেন–এ আপনি নেহাই আমার প্রশংসা করলেন মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম।

লিউক বললো–মিউজিয়ামটা একটু ঘুরে ঘুরে দেখে ওপরতলার সেই জানলাটা দেখতে গিয়েছিলাম।

অর্থাৎ যেখান থেকে টমিযেন শিউরে ওঠেন মিস ওয়েনফ্লিট-উঃ কী ভয়াবহ সেই ব্যাপার।

হ্যাঁ, ব্যাপারটা সুন্দর নয় মোটেই। অ্যামির মামী মিসেস চার্চের ওখানে ঘণ্টাখানেক ছিলাম। ভদ্রমহিলা মোটেই সুবিধের নয়।

আপনি ঠিকই ধরেছেন।

আমাকে বাধ্য হয়েই বেশ কিছুটা কড়া হয়ে কথাবার্তা বলতে হয়েছে। আমার ধারণা, মহিলা ধরেই নিয়েছিলো যে, আমি একজন পুলিশের কোনো কর্তাব্যক্তি।

মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম, ওকে সব বলে আপনি কি ঠিক কাজ করলেন?

সঠিক বুঝতে পারছি না। তবে, একদিন না একদিন আমাকে বলতেই হতো। আসল ঘটনা। জানবার জন্য সোজাসুজি প্রশ্ন আমাকে করতে হতোই।

মাথা নাড়েন মিস ওয়েনফ্লিটজানেন তো, এসব জায়গায় যে-কোনো খবর আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে!

অর্থাৎ, আপনি বলছেন যে, যখন আমি রাস্তা দিয়ে যাবো, লোকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলবে–ওই চললো টিকটিকি? ওতে বিশেষ কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না, বরঞ্চ এর ফলে আমি হয়তো আরও বেশি খবর পাবো।

আমি কিন্তু সে কথা ভাবছি না। আমার ভয়, সেই লোকটি টের পেয়ে যাবে। সে বুঝে ফেলবে যে আপনি ওর পেছনে লেগেছেন। –মিস ওয়েনফ্লিটের কথায় একটা দমচাপা আর্তি।

লিউক বলে–তা হয়তো বুঝতে পারবে।

সেটা যে কি ভয়ানক হবে বুঝতে পারছেন না? অত্যন্ত বিপজ্জনক।

 লিউক বলে–আপনি বলতে চান, হত্যাকারী এবার আমার ওপর চড়াও হবে?

মজার কথা কি জানেন, এদিকটা আমি একেবারে ভেবে দেখিনি। আপনি হয়তো ঠিকই ভেবেছেন। দেখা যাক্, তাই যদি ঘটে তাতে আমার লাভ সবচেয়ে বেশি।

আপনি কি বুঝতে পারছেন না যে, সেই লোকটা–লোকটা প্রচণ্ড ধূর্ত আর শেয়ালের মতো সতর্ক?

লিউক বলে–আপনার কথাই হয়তো ঠিক।

মিস ওয়েনফ্লিট যেন আঁতাকে ওঠেন–সত্যি বলছি। আমার মোটেই ভালো লাগছে না। আমি খুব শঙ্কিত।

আপনি ভয় পাবেন না। আমি সাবধানে চলবো। কিন্তু ভেবে দেখুন, বিভিন্ন সম্ভাবনাগুলো গুছিয়ে আমি এমন এক জায়গায় এনেছি যে এখন আমার মোটামুটি একটা ধারণা হয়েছে যে, কে খুন করে থাকতে পারে…

চকিতে চোখ তুলে তাকান ভদ্রমহিলা।

 লিউক প্রশ্ন করলো–মিস ওয়েনফ্লিট, ডাঃ টমাস আর মিঃ অ্যাবট–এই দুজনের মধ্যে কাকে আপনার খুনী বলে মনে হয়?

মিস ওয়েনফ্লিট হাঁফ ছাড়েন–ওঃ। আমি জানি না কিছু জানি না। বলেই আচমকা ঘুরে দাঁড়ান। লিউক বুঝতে পারে না।

লিউক বলে–আপনি কি বাড়ি যাচ্ছেন?

না, এই বইগুলো নিয়ে মিসেস আম্বলবির বাড়ি যাচ্ছিলাম। আপনার ম্যানরে ফেরবার পথেই বাড়িটা। চলুন, আরও কিছুটা পথ একসঙ্গেই যাওয়া যাবে।

সেই ভালো চলুন।

পেছন ফিরে লিউক বাড়িটার রাজকীয় গঠনের দিকে একবার তাকিয়ে বলে–আপনার বাবার আমলে বাড়িটা হয়তো আরও কত সুন্দর ছিলো।

মিস ওয়েনফ্লিট বলেন-আমরা সবাই মিলে এই বাড়িটায় খুব সুখে ছিলাম। অন্য আর পাঁচটা বাড়ির মতো এই বাড়িটাও যে ভাঙ্গা হয়নি, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।

সেটা কিন্তু সত্যিই দুঃখের হতো।

 এবং, সত্যি কথা বলতে কি–এই নতুন বাড়িগুলো খুব একটা সুন্দর হয় না।

আমারও মনে হয় এই বাড়িগুলো বেশিদিন টিকবে না।

মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–তবে একথা সত্যি যে, আধুনিক বাড়িগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে খুব একটা পরিশ্রম করতে হয় না, পুরানো বাড়ির দাওয়া বারান্দা এত বড় বড় হয় যে, শুধু মেঝে মুছতেই দম শেষ।

সম্মতি জানায় লিউক।

মিস ওয়েনফ্লিট ইতস্ততঃ করে বলেন–এমন সুন্দর বিকেল–আমার বড় ভালো লাগছে। চলুন, আপনার সঙ্গে বরং আর একটু এগিয়ে যাই। হাওয়াটা খুব ভালো লাগছে।

লিউক এ প্রস্তাবে সানন্দে আগ্রহ দেখায়। কিন্তু বুঝে উঠতে পারে না, এমন বিকেলকে কী করে সুন্দর বলা যায়।

অবশ্য মিস ওয়েনফ্লিটের মধ্যে বেশ স্ফুর্তির ভাব। লিউকের সঙ্গে যেতে যেতে একনাগাড়ে গল্প করে যাচ্ছিলেন।

লর্ড হুইটফিল্ডের বাড়ির গেটে ঢুকতেই দুধারে দুটো কারুকার্য করা মনোরম থাম দিয়ে সাজানো। থাম দুটোর ওপরে দুটো বিশালাকায় গোলাপী পাথরের আনারস। এত কিছুর মধ্যে আনারস কেন?–এ প্রশ্নের সমাধান লিউক করতে পারেনি। তবে শুনেছে যে, লর্ড হুইটফিল্ডের মতে আনারসের মধ্যে একটা বিদগ্ধ আর উন্নত রুচির পরিচয় আছে।

ওরা গেটে ঢুকতেই শুনতে পেলো কেউ একজন রেগে প্রচণ্ড চিৎকার করছে। একটু এগোতেই দেখলো লর্ড হুইটফিল্ড একজনকে ধমকাচ্ছেন।

যাও, তোমার চাকরি গেল। শুনছো, তোমাকে আর আমি রাখবো না।

এইবারের মতো মাফ করে দিন হুজুর।

না, মাফ আমি করবো না। আমার গাড়ি নিয়ে বাইরে যাওয়া। তার ওপর গাড়িতে বসেই মদ খেয়ে ফুর্তি করা–হ্যাঁ, তুমি করেছে–অস্বীকার কোরো না। পই পই করে বলেছি, আমার জমিদারিতে তিনটে ব্যাপার কিছুতেই করা চলবে না–মাতলামো, দুশ্চরিত্রতা আর অবাধ্যপনা।

লোকটিও বললো-বুড়ো বেজন্মা–সব সময়ে এই কোরো না, সেই কোরো না! তোর কথা শুনে বমি আসে। তোকে চিনতে আমার বাকি আছে। আমার আর তোর মধ্যে ফারাক কোথায় রে?

লর্ড হুইটফিল্ড একেবারে ছাইয়ের মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন।

এত স্পর্ধা তোমার? কোনো সাহসে তুমি আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছো?

মোটর চালকটি রুখে এগিয়ে যায়। লিউক ততক্ষণে এগিয়ে আসে; গাড়ির চালককে ধমক দেয়-যাও এখান থেকে।

ড্রাইভারটি বলে–আমি লজ্জিত। কি করে যেন আমার মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে গেল।

লোকটি বিদায় হতেই লর্ড হুইটফিল্ড রাগে ফেটে পড়েন,–কী নির্লজ্জ অসভ্যতা! আমায়! শেষ পর্যন্ত আমার সঙ্গে এহেন বর্বরতা! ওই লোকটার শিগগিরই একটা কিছু ঘটবে। ছোটো বড় বোধ নেই–কাকে কী সম্মান দিতে হয় তা পর্যন্ত জানে না। বলতে বলতে চুপ করে যায়। এতক্ষণে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা মিস ওয়েনফ্লিটের দিকে চোখ পড়ে। –হনরিয়া তুমি? এঃ, আমার ভাবতেই লজ্জা করছে যে, এমন একটা ন্যাক্কারজনক ঘটনা তোমার চোখে পড়লো।

মিস ওয়েনফ্লিট বলেন–লোকটির তখন জ্ঞানগম্যি ছিলো না লর্ড হুইটফিল্ড।

ও পুরো মাত্রায় মাতাল ছিলো–একেবারে পাঁড় মাতাল।

 কেবল মাত্র একটু রেগে ছিলো এই যা।–ফোড়ন কাটে লিউক।

 লর্ড হুইটফিল্ড বলেন–তোমরা জানো ও কী করেছে? আমার ছোটো গাড়িটা ব্রিজেট নিজেই চালিয়ে আমাকে লাইনে নিয়ে গিয়েছিল; আর সেই ফাঁকে আমার গাড়ি বের করে ওই লুমি কার্টার না কি যেন নাম মেয়েটার, তাকে নিয়ে ও বেড়াতে গিয়েছিলো।

মিস ওয়েনফ্লিট বলেন,–অত্যন্ত অন্যায় করেছে।

বলো, অন্যায় নয়?–লর্ড বললেন।

কিন্তু আমি জানি এরজন্য ওকে অনুতাপ করতে হবে।

আমি ওকে অনুতাপ করিয়ে ছাড়বো।

আপনি তো ওকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেইছেন।–মনে করিয়ে দেয় মিস ওয়েনফ্লিট।

লর্ড হুইটফিল্ড বলেন–ওই লোকটার ওতেই শেষ হবে না। তারপর বলেন, চলো না হনরিয়া, বাড়িতে গিয়ে একটু শেরী খাওয়া যাক।

আপনি বললেন এই-ই যথেষ্ট লর্ড, কিন্তু এই বইগুলো নিয়ে আমাকে একবার এক্ষুনি মিসেস আম্বলবির কাছে যেতে হবে। চলি। মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম–আশা করি, এবার আপনি নিরাপদ বোধ করবেন।

লিউকের আত্মনিবেশ ভাঙ্গে লর্ড হুইটফিল্ডের কথায়।

ওই হনরিয়া ওয়েনফ্লিট–অত্যন্ত বুদ্ধিমতী আর কাজের মহিলা।

আমারও তাই মনে হয়।

আজকের মতো তখন ও মোটেই রোগা আর এত বিশীর্ণ ছিলো না-রীতিমত সুন্দরী ছিলো। এখন যেন ভাবতেও কেমন লাগে। তখন ওরাই ছিলো এখানকার সম্ভ্রান্ত পরিবার।

তাই নাকি?

কর্নেল ওয়েনফ্লিটের তখন এখানকার জনমানসে দারুণ প্রভাব; সবাই ওঁকে সেলাম ঠুকে চলত। অত্যন্ত রক্ষণশীল প্রকৃতির লোক ছিলেন, তেমনি ছিলেন গর্বিত।

তারপর বললেন–হনরিয়া যখন আমাকে বিয়ে করবে বলে পরিবারের সবাইকে বললো, তখন যেন একেবারে তপ্ত কড়ায় ঘি পড়লো। ও নিজেকে পরিবর্তন পন্থী বলতো। জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে ছিলো। তাছাড়া, ও যা ভাবতো, তা আরম্ভ করবার চেষ্টা করতো।

ও, তাহলে ওর পরিবার থেকে এমন সুন্দর সম্ভাবনাকে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিলো?

 ঠিক তা নয়, আসলে একটা সামান্য কারণে আমাদের মধ্যে একটা কথা কাটাকাটি হয়েছিলো। ওর কতকগুলো অতি বিচ্ছিরি বেড়াল আর কতকগুলো বিরক্তিকর ক্যানারী ছিলো। পাখিগুলো সব সময়ে কিচিরমিচির করতো। অতি বিরক্তিকর। তারপর সেই একটা পাখির ঘাড় মটকাবার ঘটনাটা ঘটায়–সে এক বিশ্রী ব্যাপার। যাকগে, অতীতের চর্বিতচর্বণ করে কী-ই-বা হবে? ও ভুলে যাওয়াই ভালো।

কথাগুলো এমনভাবে বললো যেন মনে হলো একটা দুর্বল চিন্তার বোঝা শরীর থেকে। ঝেড়ে ফেলে দিলেন। তার পরেই বললেন,–মনে করবেন না যে, ও আমাকে তার জন্য কোনোদিন ক্ষমা করবে। অবশ্য না করাটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু আমার মনে হয় আপনার ওপর ওঁর কোনো রাগ নেই।–বললো লিউক।

আপনার কি তাই মনে হয়? কি জানেন, আমি হনরিয়াকে শ্রদ্ধা করি। ও একজন সত্যিকারের মহিলা–আজকালকার দিনেও এটা মূল্যবান। ওরই নিপুণ পরিচালনায় লাইব্রেরিটা এত ভালো চলছে। ওঁর গলার স্বর পালটে যায় চোখ তুলে তাকাতেই–ওই, ব্রিজেট এগিয়ে আসছে।

***

আনারস-রহস্য

লিউকের পেশী শক্ত হয়ে উঠল ব্রিজেটকে আসতে দেখেই। টেনিস খেলার পর থেকে আর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি ওদের মধ্যে।

ব্রিজেট হাল্কা গলায় বললো–গর্ডন, আমি ভেবেই পাচ্ছিলাম না যে তোমার হঠাৎ কী হলো।

লর্ড হুইটফিল্ড বললেন,–এই খানিকটা কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করতে হলো। রিভার্সটা এত বড় বেয়াদব যে আজ বিকেলে ও আমার রোস্ নিয়ে বেরিয়েছিলো।

ঠাট্টা করে ব্রিজেট–রাজকীয় রসনা।

এই নিয়ে রসিকতা মোটেই ভালো নয় ব্রিজেট। ঘটনা অত্যন্ত গুরুতর। ও একটা মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলো।

আমার বিশ্বাস, ও যদি একা একা গাড়ি নিয়ে বেড়াতে যেতো, তাহলে সব আনন্দই মাটি হতো।

আমার অধীনে থাকতে গেলে উন্নত চারিত্রিক মান বজায় রেখে চলতে হবে।

 একটি মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে গেলেই কেউ দুশ্চরিত্র হয় না।

 হা, হয়। যখন আমার গাড়ি নিয়ে যায়।

সেটা অবশ্যই দুশ্চরিত্রার অপরাধ থেকেও জঘন্য। একেবারে নরকীয় পাপ। তবে কিনা যৌবনের দাবীকে তুমি একেবারে অস্বীকার করতে পারো না গর্ডন। বিশেষ করে এমন ভরাট গ্রীষ্মের প্রারম্ভে তার ওপর যদি আবার পূর্ণচন্দ্রমার মায়াজাল হাতছানি দেয়।

কী সর্বনাশ! তাই নাকি?-বলে লিউক।

 ব্রিজেট বলে–বে মোটলিতে তিনটি কিস্তুতের আবির্ভাব ঘটেছে। আমি আশঙ্কা করছি এরা সবাই আমার শ্রীমান এলার্দির সাঙ্গপাঙ্গ। কিংবদন্তীর লেখক বলেন–কে যেন কানে কানে বলে গেল যে আজ রাতে হেথাকার ডাইনীর প্রান্তরে উদযাপিত হবে এক আনন্দ লহরিত উৎসব।

লর্ড হুইটফিল্ড বলেন–এ আমি কিছুতেই হতে দেবো না।

 প্রিয়তম আমার, এক্ষেত্রে নিতান্তই তুমি অক্ষম।

অধর্ম এই হল্লা আমি এখানে কিছুতেই হতে দেবো না। স্ক্যাণ্ডাল পত্রিকায় আমি সব ফাঁস করে দেবো।

ব্রিজেট বলে–অতঃপর ডাইনীতত্ত্বের বিরুদ্ধে লর্ড হুইটফিল্ডের জেহাদ–গ্রাম্য জীবনের শান্ত পরিবেশে কুসংস্কারের প্রভাব অদ্যাবধি বিদ্যমান।

ব্রিজেটের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে লর্ড বাড়ির ভেতর চলে গেলেন।

নিজের আখের সম্পর্কে তোমার আরও যত্ন নেওয়া উচিত।–লিউকের গলায় আনন্দের অভিব্যক্তি।

কী বলতে চাও?

চাকরিটা যদি খোয়া যায়, তাহলে কিন্তু পস্তাবে। বিবাহহাৎসব নামক অনুষ্ঠানটি পর্যন্ত তোমার সরস ব্যঙ্গোক্তিগুলো একটু রয়ে সয়ে ব্যবহার কোরো।

আহা লিউক, তুমি কী মহান আর দারুণ পরোপকারী।

ব্রিজেট বললো-আজ সারাদিন তুমি কী করলে?

সেই গতানুগতিক ব্যাপার-খবর সংগ্রহ।

কিছু পেলে?

রাজনৈতিক ভাষায় হা এবং না–দুটোই বলা চলে। ভালো কথা বাড়িতে কোনো যন্ত্রপাতি পাওয়া যাবে?

তা হয়তো যাবে। কিন্তু কী ধরনের যন্ত্রপাতি?

এই ছোটোখাটো কিছু? আচ্ছা, আমি নিজেই দেখে নিচ্ছি।

 একটা পেয়েছি। ওতেই কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে।

 তুমি জোর করে কোথাও দরজা খুলে ভেতরে ঢোকবার মতলব করছো না কি?

 হতে পারে।

মনে হচ্ছে, যেন তুমি ব্যাপারটা গোপন করতে চাইছো?

ব্যাপারটা কি জানো, আমার নিজের অবস্থা খুব একটা স্বচ্ছ ও স্বাভাবিক নয়। শনিবারের সেই ঘটনার পর নিজে থেকেই হয়তো আমার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু মুশকিল হয়েছে যে, এক মদমত্ত খুনীকে খুঁজে বের করবার উজ্জ্বল সম্ভাবনার ফলে এখানে বাধ্য হয়ে থেকে যেতে হচ্ছে। তবে, বেল-মোটলি অতিথিশালায় গিয়ে ওঠবার মতো কোনো যুৎসই কারণ যদি বলতে পারো, তাহলে না হয় ওখানেই যাই।

ব্রিজেট বলে–নাঃ, তা সম্ভব নয়। বিশেষ করে তুমি যখন আমার দূরসম্পর্কের ভাই। তাছাড়া ওখানে মাত্র তিনখানা ঘর। সব ঘর এখন এলসওয়ার্দির সাঙ্গপাঙ্গতে ভর্তি।

অতএব, এখানেই থেকে যেতে হচ্ছে তাতে তোমার যত কষ্টই হোক না কেন।

 কষ্ট আর কি, এমন দুচারজন নিরেট লোকজনকে নিয়ে আমি অনায়াসে চালিয়ে নিতে পারি।

লিউক বলে–এ কিন্তু তোমার একান্তই রূঢ় অভিব্যক্তি। বস্তুতঃপক্ষে, তোমার চরিত্রে মমতাবোধের কোনো রকম বালাই নেই।

তারপর লিউক নিজের ঘরে চলে যায়। ওর মাথায় অনেক চিন্তা। ঘরে গেলেও বিছানায় যায় না।

রাত বারোটার সময় টেনিস খেলার জুতো পড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে লাইব্রেরি ঘরের জানলা দিয়ে গলে বাইরে বের হয়।

লিউক ইচ্ছা করেই ঘুরপথ ধরলো এলসওয়ার্দির বাড়ি যাবার জন্য। আজ গ্রীষ্মের রাত। এমন রাতে এলসওয়ার্দি ও তার বন্ধুরা কিছুতেই ঘরে থাকবে না। সেই সুযোগে এলসওয়ার্দির বাড়িঘর মনের সাধ মিটিয়ে খুঁজে নিতে পারবে।

দুএকটা দেওয়াল টপকে ও বাড়ির পেছন দিকটায় এসে উপস্থিত হলো। যন্ত্রপাতির মধ্যে থেকে একটা যন্ত্র বেছে নিয়ে রান্নাঘরের একটা জানলার পাল্লা নিয়ে কিছুক্ষণ খুটখাট করতেই জানলাটার ছিটকিনিটা খুলে গেল। সার্সিটা ওপরে ঠেলে সহজে ভেতরে গিয়ে উপস্থিত হলো।

অতি সাবধানে মিনিট পনেরো ধরে খোঁজাখুঁজির পর ও নিশ্চিন্ত হয় যে, বাড়ি একেবারে ফাঁকা, বাড়ির মালিক অন্যত্র আপন কাজে ব্যাপৃত।

লিউক ঘরের প্রতিটি কোণ এবং অংশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে। এছাড়া দুএকখানা পাকা হাতে আঁকা ছবি দেখে লিউক অবাক হয়ে যায়। আলমারির একেবারে দেওয়াল ঘেঁষে রাখা কয়েকখানা বই দেখে ও বেশ উৎসাহ বোধ করলো।

এগুলো ছাড়া আরও তিনটে জিনিস ও পেলো। প্রথমটা, একটা নোটবই। তাতে লেখাটমি পিয়ার্সের সঙ্গে একটা মীমাংসা করো–লেখার তারিখ ছেলেটির মৃত্যুর আগের দিন। দ্বিতীয়ত, পেনসিল দিয়ে আঁকা অ্যামি গিবসের একখানা ছবি। ছবিটার মুখে গভীর লাল রং দিয়ে একটা ক্রশ চিহ্ন। তৃতীয়টি–এক বোতল কাশির ওষুধ। বিচ্ছিরিভাবে দেখলেই এর কোনোটাই সঠিক কোনো প্রমাণ দেয় না, কিন্তু এই নিদর্শনগুলো একত্র করলে একটা অর্থ বহন করে।

যখন লিউক জিনিষপত্র গোছগাছ করছিলো, তখন বাইরের দরজায় চাবি খোলার শব্দ পেয়েও কিছুক্ষণ টর্চের আলো নিবিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইলো। ওর আশঙ্কা এলসওয়ার্দিই এসেছে। যদি তাই হয়, তবে তার সোজা ওপরে উঠে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

এলসওয়ার্দি পাশের একটা দরজা খুলে ঢোকে। এলসওয়ার্দি একটি সুইচ টিপে হল ঘরের আলো জ্বালায়।

হলঘর পেরিয়ে যাবার সময় লিউক ওর মুখখানা দেখতে পেয়ে আতঙ্কে একেবারে শিউরে ওঠে।

তাকে চেনবার উপায় নেই মুখ দেখে। ঠোঁটের দুই কোণে বজ বজ করে একরাশ ফেনা, চোখের দৃষ্টিতে উদ্ভ্রান্তি, চলার সময়ে মনে হচ্ছিলো যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নাচছে। এলসওয়ার্দির দুটো হাতেই ঈষৎ বাদামী লাল রং–যেমন রক্ত শুকিয়ে গেলে হয়ে থাকে।

সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যাবার একটু পরেই নিভে যায় হলের আলো।

লিউক হলঘরের ভেতর দিয়ে রান্নাঘরের সেই জানলা দিয়ে বেরিয়ে আসে। বাইরে এসে একবার বাড়িটার দিকে তাকায়–সমস্ত বাড়ির ভেতরটা একেবারে নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে থম্ থম করছে।

লিউক মনে মনে বলে,–লোকটা একেবারে বদ্ধ উন্মাদ। ওর মনে কী আছে কি জানি! ওর হাতে ওটা নিশ্চয়ই রক্তের দাগ!

বেশ কিছুক্ষণ বাদে ও অ্যাশম্যানরে ফিরে আসে। বাড়ির প্রান্তসীমায় ঢোকবার জন্য ছোটো একটা গলিপথে পা দিতেই শুকনো পাতার খস্ খস্ শব্দে চমকে একবারে ঘুরে দাঁড়ায়।

কে ওখানে?

আগাগোড়া কালো কাপড়ে ঢাকা একটা লম্বা মূর্তি। তা দেখে লিউকের মনে হল যেন হৃৎপিণ্ডটা থেমে গেছে। কিন্তু কাছে আসতেই ঢাকনার আড়ালের মুখখানা চিনতে পেরেই বলে–ব্রিজেট? ওঃ, আমাকে একেবারে চমকে দিয়েছিলে।

ব্রিজেট প্রশ্ন করে–তুমি কোথায় গিয়েছিলে? তোমাকে আমি বেরিয়ে যেতে দেখেছি।

এবং তারপর থেকেই আমায় অনুসরণ করছো?

পারিনি; কারণ তুমি অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিলে।

 তুমি অত্যন্ত দায়িত্বহীনের মতো কাজ করেছে। রাগ করে লিউক।

ব্রিজেট জিজ্ঞেস করে–কিন্তু তুমি গিয়েছিলে কোথায়?

এলসওয়ার্দির বাড়ি তোলপাড় করছিলাম। লিউকের কণ্ঠে স্ফূর্তির আভাস।

দম বন্ধ হয়ে আসে ব্রিজেটের–কিছু পেলে ওখানে।

বুঝতে পারছি না, তবে বজ্জাতটাকে আর একটু ভালো করে চিনতে পেরেছি–বিশেষ করে ওর যৌনরুচি সম্পর্কে। তাছাড়া গোটা তিনেক জিনিষ পেয়েছি, যেগুলো থেকে কিঞ্চিৎ ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে।

বেশ মন দিয়ে ব্রিজেট রাতের অভিযানের গল্প শোনে।

ব্রিজেটের সারা অঙ্গ থর থর করে কেঁপে ওঠে–কী ভয়ানক কাণ্ড!

চটে যায় লিউক,–কিন্তু তোমার এভাবে একা একা বেরিয়ে আসা উচিত হয়নি ব্রিজেট। যে কেউ তোমার মাথায় একটা বাড়ি দিয়ে ফেলে দিতে পারতো।

ব্রিজেট বলে–তোমার ক্ষেত্রেও তো একই কথা খাটে।

না খাটে না, আমি আত্মরক্ষা করতে পারি।

এক ঝলক মত্ত হাওয়া ভেঙ্গে পড়ে। আচমকা লিউক বলে ওঠে–মাথা থেকে ওই বোরখাটা সরাও তো।

লিউকের আচরণে অস্থিরতা চনমন করে ওঠে। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে শেষ পর্যন্ত লিউক বলে–

চলো বাড়ি যাই।

 দাঁড়াও।

কেন?

কারণ, তোমাকে দুএকটা কথা বলা দরকার। আসলে এই কথা বলবার জন্যই ম্যানরের বাইরে এসে অপেক্ষা করছিলাম।

লিউক বলে–তুমি কী বলতে চাও?

বলতে চাই যে আমি হুইটফিল্ড-ঘরণী হবার ইচ্ছেকে বিসর্জন দিয়েছি।

লিউক বলে–সত্যি বলছো?

হ্যাঁ, লিউক।

তুমি আমাকে বিয়ে করবে?

করবো।

 কিন্তু কেন?

জানি না, তবে তুমি আমার যতসব বিজাতীয় আখ্যায় ভূষিত করেছে, আমার ধারণা সেগুলো আমার ভালোই লেগেছে।

ওর হাত দুটো বুকে টেনে চুমু দিয়ে লিউক বলে–এ দুনিয়াটা একটা সত্যিকারের পাগলের কারখানা।

কিন্তু তুমি খুশী হলে তো লিউক?

খুশী হয়েছি একথা ঠিক বলা যায় না।

তুমি কি আমাকে নিয়ে কখনো খুশী হতে পারবে?

তা জানি না; তবে ঝুঁকি নেবো।

লিউক ব্রিজেটের একখানি হাত নিয়ে নিজের হাতে ধরে বললো–জানো সোনা, এই ব্যাপারটায় আমরা দুজনেই সমান বিদঘুঁটে। চলো, বাড়ি যাই, সকাল হলে হয়তো দুজনেই স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।

হঠাৎ ব্রিজেট লিউককে সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে আঁতকে উঠে বলে–লিউক, লিউক, দেখো এখানে এটা কী?

একটা ঢিবির মতো পড়ে থাকা কিসের সঙ্গে যেন ব্রিজেটের জুটো ঠোক্কর খেলো।

লিউক বিদ্যুৎ গতিতে ব্রিজেটের হাত সরিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পরীক্ষা করেই ওপরের গেটের পিলারের দিকে তাকায়। আর সেখানে সেই আনারসটা নেই। ও উঠে দাঁড়ায়।

এই সেই ড্রাইভার রিভার্স–বেঁচে নেই…।

 নিশ্চয়ই এই বিশাল পাথরটা–বেশ কিছুদিন থেকেই ওটা আলগা হয়ে গিয়েছিলো। এমনকি হতে পারে যে, হাওয়ার দাপটে ওটা ওর ওপর এসে পড়েছিলো?

মাথা নাড়ে লিউক–বাতাসের অত জোর হতে পারে না। আসলে ঘটনাটা এভাবেই সাজানো হয়েছিলো–এমন কিছু একটা বোঝাবার জন্য যাতে দুর্ঘটনা মনে হয়। কিন্তু টিকলো না–আবার সেই খুনী।

না, লিউক না।

নির্ঘাত তাই। তুমি জানো ওর মাথার চটচটে রক্তের মধ্যে কী পেলাম?–গুড়ো গুঁড়ো বালি। অথচ, এখানে কোথাও বালির চিহ্ন নেই। আমি তোমাকে বলছি ব্রিজেট, কেউ এখানে দাঁড়িয়েছিলো আর ও যেমনি বাড়িতে যাবার জন্য গেটের তলা দিয়ে ঢুকতে যাবে, তখন একটা কিছু দিয়ে ওকে আঘাত করে যার ফলে ও মারা যায় এবং তারপর এই আনারস সে ঠেলে ওর ওপর ফেলে দেয়!

ব্রিজেট বলে–লিউক, তোমার হাতভর্তি রক্ত…

লিউক বলে–আরও একজনের হাতেও এই রক্ত লেগে আছে। জানো, আজই সন্ধ্যাবেলা কী ভাবছিলাম? ভাবছিলাম, আর একজন যদি কেউ খুন হতো তাহলেই সমস্ত ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যেতো। এবং, আমরা জেনেছি! এলসওয়ার্দি। ও রাতে বাইরে গিয়েছিলো এবং ফিরেও এসেছিলো রক্তমাখা হাতে–চোখে মুখে খুনীর মতো এক উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি নিয়ে…

পড়ে থাকা লোকটিকে দেখে ব্রিজেটের সারা শরীর থর থর করে কেঁপে ওঠে। ও বলে–আহা রে, বেচারা রিভার্স।

লিউক বলে–হতভাগ্য। লোকটার কপাল নেহাতই মন্দ। কিন্তু ব্রিজেট, এই শেষ–এবার আমরা টের পেয়ে গেছি; ওর আর নিস্তার নেই।

ব্রিজেট যেন একটু একটু টলছে লিউক দেখলো। ও দুহাতে ব্রিজেটকে জড়িয়ে ধরলো।

ব্রিজেট বলে–লিউক আমার দারুণ ভয় করছে…

ভয় পেয়োর না লক্ষ্মীটি। এই শেষ–এখানেই এর শেষ।

 আমার মনে কখনো কোনো কষ্ট দিয়ো না। আমি আঘাতে আঘাতে একেবারে জর্জরিত।

আমরা দুজনেই দুজনকে আঘাত করেছি। এবার থেকে আর কোনো আঘাত নয়।

***

লর্ড হুইটফিল্ডের ভাষ্য

ডাঃ টমাস আর লিউক রোগী পরীক্ষা করার ঘরে মুখোমুখি বসে।

আশ্চর্য! দারুণ বিস্ময়কর মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম। আপনি কি সত্যিই একথা নিজে বিশ্বাস করেন?

নিঃসন্দেহে। আমার স্থির বিশ্বাস এলসওয়ার্দি একজন বিপজ্জনক নেশাগ্রস্ত খুনী।

আমি যদিও ওকে খুব একটা লক্ষ্য করিনি, তবে হতেও পারে যে লোকটা হয়তো কিছুটা অন্য ধরনের।

আমি কিন্তু বলবো যে, ওর চেয়ে অস্বাভাবিকতার মাত্রা কল্পনা শক্তিকে ছাড়িয়ে যায়।

 আপনার স্থির বিশ্বাস যে রিভার্স খুন হয়েছে?

 নিশ্চিত। আপনি নিজে ওর মাথায় বালি পাননি?

ডাঃ টমাস বলেন–আপনি বলবার পর আমি দেখেছিলাম, স্বীকার করছি যে আপনার কথা সত্য।

এ থেকেই তো প্রমাণ হয় যে, দুর্ঘটনাটা ছিলো একটা সাজানো ব্যাপার। আসলে ওকে হত্যা করা হয়েছিলো বালির বস্তা দিয়ে আঘাত করে অথবা ঐ জাতীয় একটা কোনো উপায়ে।

তা প্রমাণ হয় না।

কী বলছেন আপনি?

ডাঃ টমাস বললেন,-এ অঞ্চলে প্রচুর বালির ঢিবি ছড়িয়ে রয়েছে। এমনও তো হতে পারে যে, সেদিন রিভার্স ওইরকম একটা বালির ঢিবিতে শুয়েছিলো? তাতেও তো ওর চুলে বালি পাওয়া যেতে পারে?

শুনুন মশাই, আমি বলছি যে ওকে খুন করা হয়েছে।

আপনি সেকথা আমাকে বলতে পারেন, কিন্তু তাতেই তো আর আপনার বক্তব্য সত্যি হয়ে যাবে না। ডাঃ টমাস শুকনো গলায় বলেন।

লিউক বলে–মনে হচ্ছে যে, আমি যা বলছি তার একটি কথাও আপনি বিশ্বাস করছেন না।

মৃদু হেসে টমাস–মিঃ লিউক, একথা আপনাকে স্বীকার করতেই হবে যে, পুরো ব্যাপারটাই আরব্য-উপন্যাসের মত অবিশ্বাস্য। আপনি নিতান্তই গায়ের জোরে বলছেন যে, এলওয়ার্দি সেই ঝি মেয়েটিকে, ছোটো ছেলেটাকে, আমার সহকারীকে এবং শেষকালে রিভার্সকে পর পর খুন করেছে।

আপনি বিশ্বাস করেন না?

ডাঃ টমাস বলেন–আম্বলবির রোগ সম্পর্কে অন্ততঃ আমার নিজের জানা ছিলো। এলওয়ার্দির মতো লোকের পক্ষে ওভাবে মৃত্যু ঘটানো প্রায় অসম্ভব; অথচ ওর অপরাধ প্রমাণ করবার মতো কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণও আপনার নেই।

আমি সঠিক বলতে পারবো না ও কী করে করতে পেরেছিলো–লিউক স্বীকারোক্তি করে, তবে সমস্ত ঘটনাই মিস পিঙ্কারটনের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়। একবার যখন জেনেছি যে, কে খুনী। তখন সাক্ষ্যপ্রমাণও জোগাড় করে ফেলবো।

ডাঃ টমাস বলেন–তা যদি করতে পারেন তাহলে অবশ্য সবচেয়ে ভালো হবে। তবে, যদি এমন হয় যে, আপনার ধারণা আগাগোড়া এক ভুলের…

বাধা দেয় লিউক। আপনি কি আমার বক্তব্যের সবটাই অবিশ্বাস করেন?

 এই পাইকারী হারে খুন?–সত্যিকথা বলতে কি লিউক, এ আমি বিশ্বাস করি না।

 বিরক্ত হয় লিউক–আপনি কি ভেবে দেখেছেন যে আমি নিজে একজন পুলিশের লোক? পুরোপুরি শৌখিন খেয়াল নয়।

ডাঃ টমাস হেসে বলেন–জানি, মেয়াংস্ট্রেটেও?

 নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই!

লিউক রাগ চেপে নিয়ে ডাঃ টমাসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ব্রিজেটের কাছে যেতেই ব্রিজেট জিজ্ঞেস করে–কেমন কথাবার্তা হলো?

ও আমাকে আদৌ বিশ্বাস করেনি। অবশ্য ভালো করে ভেবে দেখতে গেলে ওকে দোষ দেওয়া যায় না।

কেউ কি বিশ্বাস করবে?

এখন হয়তো করবে না, তবে আমার পুরানো বন্ধু বিলিবোনসের সঙ্গে আগামীকাল দেখা করার পর চাকা ঘুরে যাবে। ওর এই লম্বাচুলওয়ালা এওয়াদি সম্পর্কে খোঁজখবর করলেই সব ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝা যাবে।

ব্রিজেটের ভেতরটা শিরশির করে ওঠে–দোহাই লিউক, একটু সাবধান হও।

আমি খুবই সতর্ক আছি। পাথরের আনারস দিয়ে সাজানো গেটের তলা দিয়ে হাঁটি না। রাত-বিরেতে বন-জঙ্গলে যাই না আর খাবারদাবারও বেশ সাবধানে খাই–এসব পথ আমার ভালো করে জানা আছে।

আচ্ছা, এখানকার পুলিশকে বললে কিছু সুরাহা হয়?

জবাব দেয় লিউক–মনে হয় না–তার চেয়ে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডেই যাওয়া ভালো।

 মিস পিঙ্কারটনও এই কথা ভেবেছিলেন।

তা ঠিক,আমি সবরকম বিপদের জন্যই তৈরি থাকবো।

আমি কাল গর্ডনকে সঙ্গে করে ওই বদমাসটার দোকানে গিয়ে ওকে দিয়ে জিনিষপত্রের দরদাম করবো।

যাতে এলসওয়ার্দি হোয়াইট হলের সিঁড়ির মুখে আমাকে খুন করার জন্য লুকিয়ে থাকতে না পারে?

হা, সেই জন্যই।

 লিউক বিব্রত হয়ে বলে–হুঁইটফিল্ড সম্পর্কে

ব্রিজেট বাধা দিয়ে তাড়াতাড়ি বলে–ওসব তুমি ফিরে আসা পর্যন্ত থাক। পরে এক সময়ে বলা যাবে।

আচ্ছা, ভদ্রলোক কি খুব রেগে যাবেন? তোমার কী মনে হয়?

 ব্রিজেট বলে–তা–ওর খুব মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে।

লর্ড হুইটফিল্ড সন্ধ্যাবেলাটা প্রচণ্ড খুশীর মেজাজে ছিলেন। মোটর ড্রাইভারের মৃত্যুতে আনন্দে একেবারে ডগমগ করছিলেন।

পোর্টে ভরা দামী কাঁচের গ্লাসটা আলোর দিকে ধরে তার দিকে তাকিয়ে বললেন–আমি তোমাদের আগেই বলেছিলাম যে, লোকটা শেষ পর্যন্ত পস্তাবে। কাল সন্ধ্যাবেলায়ই একথা বলিনি?

হ্যাঁ, বলেছিলেনই তো।

দেখলেন তো, আমি ঠিক কথা বলেছিলাম কিনা? আমার বেশির ভাগ কথাই এমন আশ্চর্যজনক ভাবে সত্যি বলে প্রমাণিত হয়।

এটা সত্যিই আপনার গৌরবের বিষয়।

শুনুন, আমি ধর্মকে মেনে চলি। ভালো আর মন্দ–দুটোতেই আমার সমান বিশ্বাস; আর বিশ্বাস রাখি সেই শাশ্বত সুবিচারের ওপর। স্বর্গীয় বিচার কতটা একেবারে ধ্রুব সত্য, মিঃ ফিৎস্ উইলিয়াম, এখানেও সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

আমারও সুবিচারের ওপর আস্থা আছে।–যোগ দেয় লিউক।

মার কথা মনে হলো, সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সদাচরণ কর, সৃষ্টিকর্তাও তোমার সঙ্গে সদাচার করবেন।

সে তো নির্জলা সত্য।–লিউক হাই তুলতে তুলতে বলে।

লর্ড হুইটফিল্ড বলেন–আশ্চর্য! পরমাশ্চর্য ব্যাপার। যে ন্যায়পরায়ণ তার শত্রুরা যেভাবেই হোক নিঃশেষ হয়ে যাবেই। কালকের ঘটনাটাই দেখুন না। লোকটা আমাকে গালাগাল দিলো, এমনকি আমার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলতে যাচ্ছিলো। অথচ কী হলো? আজ ও কোথায়?

নাটকীয় ভঙ্গীতে নিজেই জবাব দিলো–মৃত্যু! ঈশ্বর-প্রদত্ত চরম শাস্তি!

লিউক বললো–একপাত্র বেশি মদ খাওয়া রাগের মাথায় দুচারটে ছোটোবড়ো কথা বলার পক্ষে দণ্ডটা বোধহয় একটু বেশিই হয়ে গেছে।

লর্ড হুইটফিল্ড অস্বীকার করেন–এই রকমই হয়। পাপের শাস্তি অতি দ্রুত ফলে এবং তা আসেও অতি ভয়াল মূর্তিতে। এইভাবেই এর প্রতিবিধান হয় মিঃ ফিস্ উইলিয়াম্‌।

আমার কিন্তু সব সময়েই মনে হতো যে, এটা কিছুটা বাড়াবাড়ি রকম নিষ্ঠুরতা।

কক্ষনো নয়, আপনি ভুল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। এলিসা ছিলেন এক মহান স্বর্গীয় পুরুষ; তাঁকে অপদস্থ করে কারোরই আর বেঁচে থাকার অধিকার থাকতে পারে না।-এবং, আমার বিশ্বাস, আমার ক্ষেত্রেও ওই একই কারণ।

বিমূঢ় দৃষ্টিতে লিউক তাকায়।

লর্ড হুইটফিল্ড বলেন–প্রথমটায় আমি বিশ্বাস করতে পারতাম না, কিন্তু প্রতিবারই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। যারাই আমার শত্রু এবং বিরোধী, তারাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়?

লর্ড হুইটফিল্ড গম্ভীর ভাবে মাথা ঝাঁকান।

বার বার ঘটলো। একটা ঘটনা একেবারে এলিসার মতো–একটা বাচ্চা ছেলে ও–আমার কাছে সেই সময়ে চাকরি করতো। একদিন ওকে এই বাগানেই ধরে ফেললাম। জানেন, ও তখন কী করছিলো? একগাদা লোক যোগাড় করে আমার অনুকরণ করে আমাকে ব্যঙ্গ করেছিলো। আমার বাড়িতে বসে আমাকেই অপমান? আর কাউকে নয়, আ-মা-কে! জানেন ওর কী হলো? দশ দিনও কাটলো না–একটা উঁচু জানলা থেকে পড়লো আর মরলো।

তারপর এই গুণ্ডাটা–কার্টার! লোকটা যেমন মাতাল ছিলো, তেমনি ছিলো ওর অশ্রাব্য মুখ। ও এখানে এসে আমাকে গালাগাল করে গেল! ওরই বা কী হলো? এক সপ্তাহের মধ্যে পাঁকের মধ্যে ডুবে মারা গেল। আমার এখানে একটি ঝি ছিলো–সেও একদিন চিৎকার করে আমাকে যা-নয়-তাই বলে গালমন্দ করলো; কয়েক দিনের মধ্যে ওরও শাস্তি হলো-ভুল করে ওষুধের বদলে বিষ খেলো। এইরকম অজস্র উদাহরণ আছে। আম্বলবি! জল সরবরাহ নিয়ে আমার পরিকল্পনার বিরোধিতা করে বসলো আর রক্তে বিষক্রিয়ার ফলে শেষ হলো। এই রকমটাই হয়ে আসছে দীর্ঘদিন যাবৎ। মিসেস হর্টন–আমার সঙ্গে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করেছিলেন একবার। কিছু দিনের মধ্যে তিনিও মারা গেলেন।

অপলক দৃষ্টি লিউকের চোখে। ওর মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে সাপের মতো কুটিল সন্দেহ। বিদ্যুতের মতো ওর মাথায় খেলে যায় পুরানো অনেক কথা। একদিন মেজর হর্টন বলেছিলেন–লর্ড হুইটফিল্ড অত্যন্ত সহৃদয় ব্যক্তি। একদিন নিজের বাগানের আঙুর আর পিচফল পাঠিয়েছিলেন।–এই লর্ড হুইটফিল্ডই দয়াপরবশ হয়ে টমিকে লাইব্রেরির জানলা

পরিষ্কার করার কাজে লাগিয়ে ছিলেন। আবার এই লর্ডই ওয়েলারম্যান ক্রেইৎস গবেষণাগারে গিয়ে নানারকম বিষাক্ত রসায়ন আর জীবাণু সম্পর্কে সর্বসমক্ষে জাহির করেছিলেন। আম্বলবির মৃত্যুর কয়েকদিন আগে ওখানে গিয়েছিলেন। এই সব ঘটনা বিশ্লেষণ করলে একই দিকেরই নির্দেশ পাওয়া যায়–আর ও নিজে এমন মূর্খ যে, এই সম্ভাবনার কথা ওর মনেই আসেনি–এমনকি সামান্য সন্দেহ পর্যন্ত করেনি…।

তখনো মৃদু মৃদু হাসছিলেন লর্ড হুইটফিল্ড, আত্মতুষ্টিতে পরিপূর্ণ সেই হাসি। একটু এগিয়ে লিউককে বললেন–ওরা সবাই একে একে মরলো।

***