২. সোহো অঞ্চলে

১১.

মাসখানেক পরের কথা।

সোহো অঞ্চলের একটা রেস্তোরাঁয় আমি আর পোয়ারো খাচ্ছি। জ্যাপ সেখানে খেতে এসে পোয়ারোকে জিজ্ঞেস করল, দাবা খেলায় আপনাকে আগ্রহ আছে? পোয়ারো হা বলাতে জ্যাপ জানাল রাশিয়ার বিখ্যাত দাবা খেলোয়াড় ডঃ সাবারোনফ আর আমেরিকার খেলোয়াড় গিলমোর উইলসনের মধ্যে গতকাল একটা ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু উইলসন খেলার শুরুতেই হার্টফেল করে মারা যান। কিন্তু আমাদের সন্দেহ তার এই মৃত্যু মোটেই স্বাভাবিক নয়, তাকে বিষ খাইয়ে মারা হয়েছে।

ব্যাপারটা একটু খুলে বল জ্যাপ। পোয়ারো বলল।

-বলছি। রুশ বিপ্লব শুরুর পর ডঃ সাবাহরানকে বলশেভিকদের শত্রু বলে ঘোষণা করা হয়। এমন কি তখন গুজব রটে গিয়েছিল যে, ডঃ সাবারোনফকে তারা হত্যা করেছে। আসলে তিনি মারা যাননি। সাইবেরিয়ায় আত্মগোপন করেছিলেন। সেইসময় রোগে, শোকে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। নানান দেশ ঘুরতে ঘুরতে শেষে ইংল্যান্ডে এসে আশ্রয় নেন। তার ফ্ল্যাট তার ভাগ্নী সোলিয়া আর ভৃত্য আইভান থেকে। সাবারোনফের ধারণা বলশেভিকরা সুযোগ পেলে এখনও তাকে হত্যা করবে। সেজন্যে তিনি কোথাও বের হন না বা কারো সঙ্গে দেখা করেন না। ম্যাচ খেলার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিলেন কয়েকবার। কিন্তু উইলসন তার ফলে ঢাক পিটিয়ে রটাতে থাকল যে সুযোগ পেলে সে তাকে গো-হারান হারিয়ে দেবে। অগত্যা তিনি রাজী হলেন সম্মান বাঁচাতে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, সাবারোনফের শত্রুরা সেদিন তার পানীয়ে বিষ মিশিয়েছিল, কিন্তু কোনো বিশেষ ভুলে সেটা খেয়েছিল উইলসন।

–সাবানেফ মারা গেলে কে লাভবান হতো?

–তার ভাগ্নী।

–খেলাটা কোথায় হয়েছিল?

–তার ফ্ল্যাটে। খেলার সময় জনা সাত-আট লোক সেখানে ছিল।

–মৃতদেহ পরীক্ষা হবে কখন?

–আজই রাত্রে। চলুন না মর্গ থেকে একবার ঘুরে আসি।

–চলো।

উইলসনের মৃতদেহকে একটা টেবিলে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। তন্ন-তন্ন করে পরীক্ষা করে পোয়ারো মৃতদেহের বাঁ হাতে একটা পোড়ার দাগ দেখতে পেল। একজন কনস্টেবল মৃত উইলসনের পকেট থেকে পাওয়া একটা রুমাল, একতোড়া চাবি, মানিব্যাগ, একতাড়া নোট, কিছু খুচরো পয়সা আর একটা দাবার খুঁটি সেটা হাতির দাঁতে তৈরি–এগুলো নিয়ে এল। জ্যাপ জানালো খুঁটিটা উইলসনের হাতে মুঠোর মধ্যে শক্ত করে আঁকড়ে ধরা ছিল। অনেক কষ্টে সেটা হাত থেকে ছড়ানো হয়েছে।

পোয়ারো জ্যাপের কাছ থেকে খুঁটিটা চেয়ে নিল আর বলল, খুঁটিটা ফের দেবার অছিলায় ডঃ সাবারোনফের সঙ্গে আমি একবার দেখা করতে চাই। আচ্ছা জ্যাপ, উইলসনের সম্পর্কে সবকিছু বললেও তুমি এটা আমাকে জানাওনি যে সে বাঁ হাতে সব কাজ করত অর্থাৎ ন্যাটা ছিল।

–মঁসিয়ে পোয়ারো, হা সে ন্যাটাই ছিল বটে। পোয়ারো হেসে বলল, চলি, কাল সকালে আমি ডঃ সাবাহরানফের সঙ্গে দেখা করতে যাবো।

.

ডঃ সাবারোনফের ওয়েস্টমিনস্টার অঞ্চলের বাড়িতে গিয়ে বেল টিপতে তার রুশ ভৃত্য আমাদের দরজা খুলে দিল। আমাদের পরিচয় জানিয়ে জ্যাপ একখানা চিঠি লিখে দিয়েছিল সেটা দেখাতে আইভান আমাদের ড্রইংরুমে বসালো।

পোয়ারো তৎক্ষণাৎ সামনের টেবিলের পায়ার কাছে মেঝের ওপর উবু হয়ে বসে কার্পেটখানাকে দেখতে লাগল। আমি বললাম, অত মনোযোগ দিয়ে কি দেখছো?

-দেখছি, এত দামী কার্পেটটাকে এইভাবে ফুটো করল কে?

ইতিমধ্যে সুন্দরী, অল্পবয়সী, নীলচুলের একটা মেয়ে ঘরে ঢুকল এবং নিজের পরিচয় দিল সাবারোনফের ভাইঝি সোনিয়া বলে।

পোয়ারো বলল, আমার নাম এরকুল পোয়ারো। গিলমোর উইলসনের মৃত্যু সম্পর্কে সামান্য কিছু খবর জানতে এসেছি।

–ও, তিনি তো হার্টফেল করে মারা গেছেন।

–পুলিশ সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ নয়।

–সেকি! আইভান তাহলে ঠিক কথাই বলেছে। তার ধারণা আমার মামাকে কেউ বিষ খাইয়ে মারতে চেয়েছিল কিন্তু মামা সেটা খাননি, খেয়েছে মিঃ উইলসন।

-আচ্ছা, আপনার মামার কোনো শত্রু আছে?

–কী জানি! মামা আমাকে বিশ্বাস করে কখনও কিছু বলেন না। অনেক বছর পর আমাদের আবার যোগাযোগ ঘটলো তো। তবে সবসময় তিনি কেমন যেন ভয়ে ভয়ে থাকেন। আড়াল থেকে সেদিন তার মুখে একটা গুপ্ত সমিতির নাম শুনলাম। আচ্ছা মঁসিয়ে, আপনি চতুরঙ্গ বলে কোনোও সমিতির কথা জানেন।

পোয়ারো আর আমি চমকে উঠলাম। পোয়ারো বলল, এ নাম আপনি কোথায় শুনেছেন?

 আড়াল থেকে। পরে এ-বিষয়ে মামাকে প্রশ্ন করাতে তিনি কোনো জবাব দেননি। তবে আমার ধারণা ঐ গুপ্তসমিতিই হয়ত বিষ খাইয়ে মামাকে মারতে চেয়েছিল।

–আচ্ছা মাদাম, সেদিন কোনো টেবিলে খেলা হয়েছিল আর কে কোনোদিকে বসেছিলেন আমি জানতে চাই।

ঘরের কোণা থেকে একটা ছোট্ট টেবিল বার করে এনে সনিয়া বলল, এই টেবিলটা মামাকে এক ভদ্রলোক উপহার দিয়েছিলেন। ঘরের মাঝখানে ওটা পাতা হয়েছিল।

দাবার খুঁটিগুলো ভালো করে পরীক্ষা করল পোয়ারো। বলল, চমৎকার সেট।

এবার আমরা গেলাম ডঃ সাবারোনফের সঙ্গে দেখা করতে। দীর্ঘদেহী শীর্ণকান্তি পুরুষ, চোখদুটি উজ্জ্বল, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। সোনিয়া ঘর ছেড়ে চলে গেল। অভিবাদন বিনিময়ের পরে পোয়ারো বলল, ডঃ সাবারোনফ, আপনার এই বিপুল সম্পত্তি আপনি মারা যাবার পর কে পাবে?

-আমার ভাগ্নী সোনিয়া। আমি সম্প্রতি উইল করেছি, তাতে আমি আমার সমস্ত সম্পত্তিই আমার মৃত্যুর পর সোনিয়া পাবে বলে লিখেছি। তা হঠাৎ এ প্রশ্ন?

তার কারণ, দীর্ঘকাল বাদে আপনি আপনার ভাগ্নীকে দেখছেন। কিন্তু যাকে আপনি ভাগ্নী বলে দেখছেন, সে যে আপনার ভাগ্নী তার প্রমাণ কি? যাগে এসব কথা। আপনাকে একটু সতর্ক করে দিলাম আর কি? এবার সেদিনকার খেলার একটু বর্ণনা দিন।

–খেলা তো হয়নি বললেই হয়। প্রথম চাল দিয়েই তিনি মুখ থুবড়ে পড়ে যান।

–কি চাল দিয়েছিলেন তিনি?

রাই লোপেজ–চাল। অনেকেই আজকাল এই চাল দিয়ে খেলা শুরু করেন।

–উইলসন কি সেদিন খেলা শুরুর আগে এখানে কিছু খেয়েছিলেন?

–এক পাত্র হুইস্কি খেয়েছিলেন। আর কিছু না।

–ধন্যবাদ। পোয়ারো বলল।

আমরা ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এলাম। আইভানকে দেখতে পেয়ে পোয়ারো জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, তোমাদের এই ফ্ল্যাটের ঠিক নিচেরটায় কে থাকেন?

–এই কয়েকদিন আগে নতুন এক ভাড়াটে এসেছেন। তার আগে অনেকদিন ওটা খালি পড়েছিল।

আমরা সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালাম। বাড়িতে পৌঁছে টেবিলে একটা চিঠি পড়ে আছে দেখে পোয়ারো সেটা খুলল। জ্যাপের চিঠি। চিঠিতে লেখা ছিল যে, উইলসনের মৃতদেহ পরীক্ষা করে কোনো বিষের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। চিঠিটা পড়ে পোয়ারো বলল, আমি জানতাম উইলসনকে বিষ খাইয়ে মারা হয়নি। পকেট থেকে একটা দাবার খুঁটি বার করে পোয়ারো বলল, এই খুঁটিটা দেখে জেনেছিলাম। এটা আমি ডঃ সাবারোনফের বাড়ি থেকে হাতিয়ে এনেছি। আর উইলসনের মুঠোর খুঁটিটা আমার বাঁ পকেটে রয়েছে।

-কেন?

–দেখতে চাই এ দুটোর ওজন এক কিনা।

আমি পোয়ারোকে পাশের ঘর থেকে দাঁড়িপাল্লা এনে দিলাম। পোয়ারো দুটো খুঁটি দুটো পাল্লায় বসিয়ে দেখল দুটোর ওজন সমান নয়। উইলসনের মুঠোর হুঁটিটার পাল্লাটা ঝুলে পড়েছে। অর্থাৎ ঐ খুঁটি ভারী। এবং নিশ্চয়ই ওর মধ্যে কিছু কারচুপি করা আছে।

আলোর কাছে খুঁটিটা তুলে নিয়ে দেখল পোয়ারো। তারপর উল্টে ধরে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করে বলল, দেখো, হেস্টিংস, এই খুঁটির মধ্যে দিয়ে একটা লোহার তার চালিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এরপরই কথার মধ্যে হঠাৎ পোয়ারো ফোন তুলে জ্যাপকে নির্দেশ দিল, ডঃ সাবারোনফের বাড়িতে যারা পাহারা দিচ্ছে, তাদের জানিয়ে দাও, আইভানের ওপর যেন কড়া নজর রাখে, সে যেন পালাতে না পারে। রিসিভার নামিয়ে এবার সে আমাকে বলল, এখনও তুমি কিছু বুঝতে পারনি হেস্টিংস। আরে উইলসন মোটেই বিষ খেয়ে মারা যায়নি, সে মারা গেছে ইলেকট্রিক শক খেয়ে। ডাঃ সাবারোনফের ঘরের মেঝেয় যে কার্পেটটা পাতা আছে, তার একজায়গায় আমি একটু ফুটো লক্ষ্য করেছিলাম। এবং সেই ফুটোটার তলাকার মেঝেটায় ছিল ফুটো।

–মেঝেতে আবার কারা ফুটো করল।

–হত্যাকারীরা। নিচের ফ্ল্যাটটা তারাই ভাড়া নিয়েছিল। তারা সেই ফ্ল্যাটের সিলিং ফুটো করে উপর তলার ঘরের অর্থাৎ ডঃ সাবাহরানফের ঘরের মঝের ওপরে তারা একটা বৈদ্যুতিক তার চালিয়ে দিয়েছিল। ঘরের মেঝে থেকে কার্পেটের ছ্যাদার মধ্যে দিয়ে টেবিলের তলা কুঁড়ে সেই তারের ডগাটা দাবার ছকের একটা নির্দিষ্ট জায়গা এসে পৌঁছে। আর সেটা রাইলোপেজ চাল দিয়ে খেলা শুরু করলে একটা নির্দিষ্ট খুঁটিকে যেখানে পৌঁছতে হয় সেখানে।

আমি সমস্ত ব্যাপারটা এবার বুঝলাম। উইলসন সেই খুঁটিটাকে যখন দাবার ছকের নির্দিষ্ট জায়গায় এগিয়ে দিয়েছে, ঠিক তক্ষুনি সেই ঘুটির মধ্যেকার লোহার তারটা সেখানকার বৈদ্যুতিক তারের সংস্পর্শে এসেছে, আর উইলসনও সেই মুহূর্তে কারেন্ট খেয়ে মারা যায়। বললাম, আমার তো মনে হয় এই চক্রান্তের সঙ্গে সাবারোনফের বাড়ির লোকেদের কিছু। যোগসাজশ আছে।

–তা তো আছেই। আমার মনে হয়, আইভানই চতুরঙ্গের সেই জল্লাদ।

–আর সোনিয়া?

এরপরই কথাত যারা পাহারা দিচ্ছে, তার নামিয়ে এবার সে আমাথায়নি, সে মারা

-সোনিয়া সেই জল্লাদেরই চর। ভাগ্নীর পরিচয়ে সে সাবারোনফের বাড়িতে ঢুকেছিল। আইভান আর সে মিলে ডঃ সাবারোনফকে শক খাইয়ে মারতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের প্ল্যানটা ভেস্তে গেল। কারণ সাধারণত সাবারোনফ সাদা ঘুটি নিয়ে খেলতেন। কিন্তু উইলসনের সঙ্গে খেলার দিন, তিনি উইলসনকে সাদা ঘুটি নিতে দেন। তাছাড়া নিজের আসনটা ছেড়ে প্রথম চালটা উইলসনকে দিতে বলেন। ফলে উল্টো ঘটনা ঘটল।

ফোনের ক্রিং আওয়াজে আমার চমক ভাঙ্গলো।

জ্যাপের গলা, বলল, মঁসিয়ে পোয়ারোকে জানাও আইভান সরে পড়েছে। ট্যাক্সি নিয়ে একটা পোড়ো বাড়িতে ঢুকেছে, পুলিশ এখন বাড়াটাকে ঘিরে রেখেছে।

ফোন নামিয়ে পোয়ারোকে সব জানালাম। বললাম, চার নম্বর তাহলে ধরা পড়ল।

-তাই কি? অর্থাৎ আইভানই যদি চার নম্বর হতো, তাহলে এত সহজে তাকে ঘেরাও করা অন্তত জ্যাপের পক্ষে সম্ভব হতো না। হেস্টিংস আমার একটা ভুল হয়ে গেল। গর্ব করতাম আমার কখনও ভুল হয় না। কিন্তু…

–কিন্তু কি?

দীর্ঘদিন বাদে মামা ভাগ্নীর দেখা হল, আমি ধরেই নিলাম ভাগ্নীটি জাল। এক্ষেত্রে মামাটি জাল। প্রথমে আমি সোনিয়াকে সন্দেহ করেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, ডঃ সাবারোনফই হয়ত জাল। যাকগে, আর দেরি করা আমাদের ঠিক হবে না। সহজে ধরা দেওয়া আইভান আসলে নিতান্ত গোবেচারা মানুষ। আসল কালপিট ডঃ সাবারোনফই। চলো, তার ফ্ল্যাটে একবার হানা দেওয়া যাক।

বারবার বেল বাজিয়েও কারোর সাড়া না পেয়ে, দারোয়ানের কাছে সব চাবি ছিল; সেই চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখি সোনিয়া হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে। গোঁ-গোঁ করছে। মুখে কাপড় গোঁজা, নাকের উপর ক্লোরোফর্মের প্যাড। তাড়াতাড়ি বাঁধন খুলে ডাক্তার ডাকলাম। রিপোর্ট শুনলাম, ভয়ের কিছু নেই। খানিক বাদেই সুস্থ হয়ে উঠবে।

–ব্যাপার কি পোয়ারো? ডঃ সাবারোন কোথায়? তিনি যে অসুস্থ।

–মোটেই তিনি অসুস্থ নন। সত্যিকারের সাবারোনফ অনেকদিন আগেই মারা গেছেন। আসল সাবাহরানফের সম্পত্তি হাতাবার জন্যেই এ লোকটা নকল পরিচয়ে লণ্ডনে এসে হাজির হয়েছিল। সম্পত্তিটা হাতিয়ে নিয়েছে। নকল সাবাহরানফকে মারার কোনো চক্রান্ত হয়নি। চক্রান্ত হয়েছিল উইলসনকে মারার। উদ্দেশ্য একটাই, নকল সাবাহরানফের ছদ্মপরিচয়টাকে গোপন রাখা। ভুলে যেও না আসল সাবারোনফ ছিলেন বিশ্বখ্যাত দাবা খেলোয়াড়। এদিকে নকল সাবারোনফ দাবার কিছুই জানেনা। এবং সেটা ফাঁস হবার আগেই সে উইলসনকে খতম করতে চেয়েছে। তাই সে করছেও।

বললাম, এরকুল, এরা যতখানি ধূর্ত, ঠিক ততখানিই নৃশংস।

.

১২.

শীতের সময় লন্ডন যেমন নোংরা তেমনি স্যাঁতস্যাঁতে।

পোয়ারো বলল, হেস্টিংস, ভাবছি যে, তুমি মাত্র মাস দুয়েকের জন্যে ইংল্যাণ্ডে এসেছিলে কিন্তু মাসের পর মাস কাটছে, তবু তুমি আর্জেন্টিনায় ফেরার নাম করছ না।

-ফিরবো কি করে? সিণ্ডেরেলা মোটেই স্বার্থপর মেয়ে নয়। সে ঠিক বুঝবে, তোমাকে একা ফেলে আমার পক্ষে ফিরে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যাকগে ও কথা বাদ দাও, এখন বলো চতুরঙ্গকে আমরা ঠিক কবে নাগাদ জালে আটকাতে পারবো?

–অধৈর্য হয়ো না হেস্টিংস, তাদের সম্পর্কে যেটুকু জেনেছি, তার মূল্যও নেহাত কম নয়, আমরা দু নম্বর তিন নম্বর কর্তার খোঁজ পেয়েছি। চার নম্বরের কর্মকৌশলও আন্দাজ করেছি। আমি কি ভাবছি জানেনা, চতুরঙ্গ আমাদের ওপর আঘাত হানছে না কেন? তা যাই করুক, তুমি তাক থেকে আমার পাঁচখানা বই একসঙ্গে নামিয়েছো কেন? সব বইগুলো একসঙ্গে পড়ছো?

একটা কথা বলা দরকার, পোয়ারো ভীষণ ফিটফাট মানুষ। শৃঙ্খলার অভাব সে আদৌ বরদাস্ত করে না। এরপর পোয়ারো বলল, আমি একটু বেরোচ্ছি। ফিরে এসে যেন দেখতে পাই সব জায়গামতো সাজানো আছে। পোয়ারো বেরিয়ে গেল।

এরপর লেডি পিয়ারসন আমাকে একটা টেলিগ্রাম দিয়ে গেল।

টেলিগ্রামটা দক্ষিণ আমেরিকায় আমার কাজকর্ম যে দেখাশোনা করে সেই ব্রনসেন পাঠিয়েছে। সে জানাচ্ছে :

গতকাল থেকে মিসেস হেস্টিংস নিখোঁজ। অপেক্ষা করছি যে, চতুরঙ্গ নামে কোনো গুপ্ত সমিতি তাকে চুরি করেছে। পুলিশে খবর দিয়েছি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মিসেস হেস্টিংসের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ব্রনসেন।

সিণ্ডেরেলা নিখোঁজ। আমি পাথরের মতো বসে রইলাম। কি করব। পোয়ারোকে এক্ষুনি এ-কথা জানানো দরকার। সে নিশ্চয় কোনোও পথ বার করতে পারবে।

দরজায় আবার টোকা পড়ল। মিসেস পিয়ারসন এবার একটা চিঠি দিয়ে গেলেন। আর তিনি জানালেন, পত্রবাহক একজন চীনেম্যান উত্তরের জন্যে নিচে অপেক্ষা করবে। ছোট্ট চিঠি। তাতে লেখা?

আপনি যদি আপনার স্ত্রীকে আবার জীবিত অবস্থায় দেখাতে চান, তাহলে পত্রবাহকের সঙ্গে চলে আসুন। আপনার বন্ধু পোয়ারোকে এ-কথা জানাবেন না। যদি জানান, তাহলে আপনার স্ত্রীকে তার ফল ভুগতে হবে।

চিঠির নিচে লেখা রয়েছে : ৪।

.

এ চিঠি পাবার পর আমি কী করতে পারতাম? ভাববার মতো মানসিক অবস্থাই আমার নেই।

মুহূর্তে মনস্থির করে নিলাম। পত্রবাহকের সঙ্গে আমি যাব। যা ঘটে ঘটুক।

কিন্তু পোয়ারোকে আমি যদি তা চিঠিতে লিখে দিয়ে যাই, তাহলে চতুরঙ্গের চররা নিশ্চয়ই জানতে পারবে। তার ফল ভুগতে হবে আমার সিণ্ডারেলাকে। আমি বরং এই টেলিগ্রামটাই টেবিলে রেখে দিয়ে যাই। পোয়ারো সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পারবে।

আমি নিচে নেমে চীনেম্যান পত্রবাহককে দেখতে পেলাম। সে আমার জিজ্ঞেস করল, আপনিই ক্যাপ্টেন হেস্টিংস?

–হ্যাঁ।

–চিঠিটা আপনি পড়েছেন?

–হ্যাঁ।

চিঠিটা ফেরৎ দিন আমাকে।

আমি জানতাম চিঠিটা ওরা ফেরৎ চাইবে। সঙ্গেই এনেছিলাম। ফেরৎ দিলাম।

দাঁত বের করে লোকটা হেসে বলল, আর্জেন্টিনা থেকে আপনার নামে যে টেলিগ্রামটা এসেছে, সেটাও দিন।

আমি হতবাক। ব্রনসেন টেলিগ্রাম করেছে, তাই কি এদের নজর এড়ায় না।

আমি কিছুই করার নেই ভেবে টেলিগ্রামটা এনে তার হাতে দেব বলে ওপরে গেলাম। কিন্তু এখন পোয়ারোর জন্যে কিছু একটা সঙ্কেত রেখে যেতে হবে। হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। তাক থেকে চারখানা বই নামিয়ে নিয়ে বিছানায় ফেলে রাখি। পোয়ারো সংকেতটা নিশ্চয়ই আঁচ করতে পারবে। তাই করলাম।

টেলিগ্রাম নিয়ে নিচে এসে চীনেম্যানটার হাতে দিলাম। সে বলল, আসুন।

আমি তার সঙ্গে যত পথ ঘুরলাম তার হিসেব নেই। কখনও বাসে, কখনও ট্রেনে, কখনও হেঁটে, ঘিঞ্জি নোংরা সব পাড়া ঘুরে আমি এমন একটা অঞ্চলে পৌঁছালাম যেখানকার অধিকাংশ বাসিন্দা চীনে।

এঁদো একটা গলির মধ্যে জরাজীর্ণ একটা বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কড়া নাড়তে একটা চীনে দরজা খুলে দিল। সেই লোকটার হাতে সে আমাকে সঁপে দিতে দ্বিতীয় চীনাটা আমাকে বাড়ীর মধ্যে নিয়ে গেল। সিঁড়ি, উঠোন পেরিয়ে আমরা একটা হলঘরে গিয়ে হাজির হলাম। ঘরে বিরাট বিরাট বস্তা সাজানো আর তার থেকে কড়া একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম।

আমার সঙ্গী দেয়ালের ধার থেকে একটা বস্তাকে ঠেলে সরিয়ে দিল। দেখলাম দেয়ালে একটা ফোকর রয়েছে। সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে আমরা একটা বিরাট ঘরে পৌঁছলাম। আমার সঙ্গী সেই ঘরের দেয়ালে পরপর চারবার টোকা দিতেই যেন একটা ভোজবাজি ঘটে গেল। দরজা খুলে গেল। একটা ঘরে ঢুকলাম। মনে হয় আরব্য রজনীতে বর্ণিত কোনো মায়াকক্ষে আমি হাজির হয়েছি। দরজায় রেশমের পর্দা ঝুলছে।

পর্দার আড়াল থেকে পরিষ্কার ইংরাজীতে কে যেন জিজ্ঞেস করল, ক্যাপ্টেন হেস্টিংসকে নিয়ে এসেছ?

সঙ্গী বলল, হ্যাঁ।

পর্দা সরে গেল। দেখলাম একটা দীর্ঘদেহী মানুষ বসে আছে। সে চীনদেশের মানুষ।

–আসুন ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, আমার অনুরোধ রাখার জন্যে ধন্যবাদ।

–কে আপনি? আপনিই কি বিল চ্যাংয় ইয়েন?

-না, আমি তার নগণ্য এক নফর মাত্র। আমার মতো অসংখ্য নফর দেশে দেশে ছড়িয়ে আছে।

বুকের মধ্যে ধক করে উঠল, বললাম, আমার স্ত্রী কোথায়?

–যেখানেই থাকুন তিনি নিরাপদে আছেন। এখনও তার কোনো বিপদ ঘটেনি। তবে যেকোনো মুহূর্তে তাকে আমরা হত্যা করতে পারি।

-কেন তাকে আটকে রেখেছেন? টাকার জন্যে? কত টাকা চান আপনারা?

–আমাদের প্রয়োজনীয় টাকা মেটানো আপনার পক্ষে সম্ভব হবে না।

তবে কেন তাকে আটকে রেখেছেন?

-তাঁকে না আটকালে কি আপনাকে আমরা হাতের মুঠোয় পেতাম। আর আপনাকে না পেলে সেই বেলজিয়াম গোয়েন্দাটাকে আমার পাবো কিভাবে?

-মানে?

-মানে সোজাই। আপনাকে মঁসিয়ে পোয়ারোকে একটা চিঠি লিখতে হবে। তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে এখানে আনতে হবে।

অসম্ভব। অমন চিঠি আমি মেরে ফেললেও লিখতে পারবো না।

দরজার দিকে তাকিয়ে একটা হাততালি দিল লোকটা। দুজন চীনেম্যান এলো। লোকটা তাদের উদ্দেশ্যে দুর্বোধ্য ভাষায় কীসব বলতেই তারা আমার হাত-পা বেঁধে ঠেলতে ঠেলতে ঘরের এককোণে নিয়ে গেল। হঠাৎ দেখলাম, আমার সামনের মেঝের উপরে খানিকটা জায়গা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে।

দীর্ঘদেহী মানুষটি আমাকে বলল, ক্যাপ্টেন, ঐ ফাঁকের নিচ দিয়ে নদী বয়ে যাচ্ছে। এখনও বলুন চিঠি লিখতে রাজী আছেন কিনা?

–যদি না লিখি?

 –হাত পা বাঁধা অবস্থায়ঐ নদীর মধ্যে আপনাকে ফেলে দেওয়া হবে।

–তাহলে তাই করুন। আমি বরং ডুবে মরি, কিন্তু তাই বলে আমার বন্ধুকে আমি ডোবাতে পারবো না।

.

১৩.

 মৃত্যুকে এত কাছ থেকে আমি কখনও দেখিনি। এখুনি আমাকে ফেলে দেওয়া হবে।

আশ্চর্য, নদীগর্ভে আমাকে ফেলে দেওয়া হল না। কিন্তু আমাকে না মেরে আমার স্ত্রীকে তিলে তিলে মারবার ভয় দেখানো হল আমাকে। ভয়াবহ উপায়ে অমানুষিক শাস্তি দেওয়া হবে তাকে।

আমি আঁতকে চেঁচিয়ে উঠলাম, না, না, তার কোনো দোষ নেই। তাকে আপনারা নির্যাতন করবেন না।

–তাহলে ঐ কলমটা তুলে নিয়ে আপনার বন্ধু মঁসিয়ে পোয়ারোর কাছে একটা চিঠি লিখুন। তাহলে আপনার স্ত্রীকে আমরা মুক্তি দেব।

আমি যা বলছি, শুধু তাই লিখুন।

আমি কাগজে কলম ছোঁয়ালাম। লিখলাম ঃ

প্রিয় পোয়ারো,

চতুরঙ্গের গুপ্তঘাঁটির সন্ধান আমি পেয়েছি। আজ বিকেলে চতুরঙ্গের চর একজন চীনেম্যান আমাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করেছিল। একটা ভুয়ো-খবর দিয়ে সে আমাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে এখানে নিয়ে আসে। তখন তার চোখে ধুলো দিয়ে সরে পড়ি, এবং খানিক বাদে আমিই তার অলক্ষ্যে তাকে অনুসরণ করতে থাকি। এখানে তাদের গুপ্তঘাঁটি একটা পোড়ো বাড়িতে সে ঢুকেছে। আমি দূর থেকে বাড়ীটায় নজর রাখছি। বাড়ীটার মধ্যে ঢোকা আমার একার কাজ নয়। তাই একটা ছেলেকে নিয়ে তোমার কাছে চিঠি পাঠালাম। পত্রপাঠ তুমি চলে এসো। একটা কথা, তোমার গোঁফ দেখলে লোকে চিনে ফেলবে, তাই মাফলারে মুখটাকে ভালোভাবে ঢেকে আসবে। আমি তোমার প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করে রইলাম। তুমি এলে আমরা দুজনে মিলে চতুরঙ্গের ঘাঁটিতে হানা দেব। ভালোবাসা সহ,

ইতি–
হেস্টিংস

ডিক্টেশন অনুযায়ী চিঠিখানা লিখতে লিখতে লজ্জায়,অপমানে আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল। আমি নিজের হাতে বন্ধুকে শত্রুর হাতে তুলে দিচ্ছি; যে বন্ধু এ চিঠি পেয়েই ছুটে আসবে। অথচ এছাড়া আমি আর কী-ই বা করতে পারি? পোয়ারোর চাইতে আমার স্ত্রীর নিরাপত্তার প্রশ্নই এখন আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

আমি ঢ্যাঙা লোকটাকে বললাম, এবার আমার স্ত্রীকে ছেড়ে দেবেন তো?

–দাঁড়ান। আগে পোয়ারোকে আমরা গ্রেপ্তার করি, তারপর তাকে ছাড়া হবে।

 –তোমরা শঠ, প্রতারক। কুকুরের চাইতেও ঘৃণ্য জীব।

এতটুকু উত্তেজিত হল না লোকটা। বলল, চটবেন না ক্যাপ্টেন হেস্টিংস। বলে আমাকে ঘরের মধ্যে ফেলে রেখে লোকটা চলে গেল।

ঘণ্টা কয়েক বাদে সেই ঢ্যাঙা লোকটা ঘরে ঢুকে বলল, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, আপনার বন্ধু আমাদের ফাঁদে পা দিয়েছেন। তিনি এই দিকেই এগিয়ে আসছেন। যেহেতু তিনি আপনাকে দেখলে এ বাড়ীতে ঢুকতে রাজী হন, তাই আপনাকে দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। যদি কোনো চালাকি করার চেষ্টা করেন তো তার ফল ভয়াবহ হবে। আমি সদরে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেই ঢ্যাঙা লোকটা আর জনাকয় সঙ্গী আমার পিছনে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল। দেখলাম পোয়ারো আসছে একটা অল্পবয়সী ছেলের সঙ্গে। পোয়ারোর মুখটা দেখলাম মাফলার দিয়ে ঢাকা, ভীষণ খারাপ লাগছিল আমার। রাস্তা পার হয়ে সে ব্যাকুল মুখে আমারদিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, যাক, তোমার কোনো বিপদ হয়নি তো? উঃ কি দুশ্চিন্তায় ছিলাম, বলো, এখন কি করতে হবে?

আমি আর পারলাম না। চেঁচিয়ে উঠলাম বিকৃত গলায়, পালাও এরকুল, পালাও। এটা একটা চক্রান্ত। এরা তোমাকে…

দরজার পেছন থেকে ছুটে বেরিয়ে লাফ দিয়ে দাঁড়াল চতুরঙ্গের এক অনুচর।

পোয়ারো এক পা পিছিয়ে গেল। তারপরেই এক প্রচণ্ড শব্দ শুনলাম আর রাশি রাশি ধোঁয়া। আমার দম আটকে এল। দু-চোখে অন্ধকার নেমে এল। আর কিছু মনে নেই আমার।

জ্ঞান হবার পরে প্রথমে যার মুখ দেখলাম, সে পোয়ারো। আমাকে চোখ মেলে তাকাতে সে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল।

তারপর আমাকে সে বলল, বিছানার উপরে এলোমেলোভাবে চারখানা বই তুমি ছড়িয়ে গিয়েছিলে। সেই সংকেতের অর্থ বুঝে আমার এটা বুঝতে অসুবিধা হলো না যে তুমি চতুরঙ্গের পাল্লায় পড়েছ। এটাও বুঝলাম, আমাকে ধরার জন্যে তোমাকে টোপ হিসেবে তারা ব্যবহার করতে চায়। আমি সঙ্কেতটা জ্যাপকে জানিয়ে আমার ফ্ল্যাটের ওপর নজর রাখতে বললাম। তখুনি স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের জনাকয় ছদ্মবেশী লোক নজর রাখতে থাকে।

খানিক বাদেই একটা ছেলে আমার কাছে তোমার চিঠিটা নিয়ে এল। আমি তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। অলক্ষ্যে অনুসরণ করতে লাগল সেই ছদ্মবেশী গোয়েন্দারা। আমি জানতাম আমার ওপর হামলা হবে। তাই আমি আমার কয়েক বছর আগে যোগাড় করা গ্যাসবোমাটা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। চতুরঙ্গের লোকেরা আমার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তেই আমি বোমাটা ফাটালাম। আর সকলে অজ্ঞান হয়ে গেল সেই বিষাক্ত ধোঁয়া নাকে যেতে।

–কিন্তু ধোঁয়া তো তোমার নাকেও গিয়েছিল, তুমি কেন অজ্ঞান হওনি?

–ঐ যে চিঠিতে আমার গোঁফ নিয়ে ঠাট্টা করা হয়েছিল, মাফলার দিয়ে আমি যেন মুখটাকে ঢেকে রাখি। তাই মাফলার লাগিয়েছিলাম। আর তার আড়ালে ছিল ধোঁয়া নিরোধক ছোট্ট যন্ত্র রেসপিরেটর। তাই আমি অজ্ঞান হইনি।

একথা শুনে আমি হাসতে গেলাম। কিন্তু তখুনি আমার মনে পড়ল সিণ্ডারেলার কথা। বললাম, এরকুল আমার স্ত্রীর কী হবে?

তার মানে? তোমার স্ত্রীর আবার কি হবে? পোয়ারো হতভম্বের মতো প্রশ্ন করল।

–সেতো এখন চতুরঙ্গের হাতে বন্দিনী। ব্রনসেন আমাকে টেলিগ্রাম করে জানিয়েছে সে চতুরঙ্গের হাতে বন্দিনী। চতুঙ্গের লোকেরাও আমাকে শাসিয়েছিল যে, তোমায় যদি আমি চিঠি না লিখি তাহলে তিলে তিলে ওকে হত্যা করবে।

সব শুনে পোয়ারো বলল, ছি ছি, স্রেফ বাজে কথা। তোমার স্ত্রীকে মোটেই ওরা আটক করতে পারেনি। অনেকদিন আগেই আমার সন্দেহ হয়েছিল যে, চতুরঙ্গের লোকেরা হয়তো তোমার স্ত্রীকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে আমাদের বন্দী করবে। তাই আগে থাকতেই আমি দক্ষিণ আমেরিকায় চিঠি লিখে তাকে এমন জায়গায় সরিয়ে দিয়েছি যাতে ওরা তার নাগাল না পায়। এখন মনে হচ্ছে, তোমাকে আগেই ওসব কথা আমার বলা উচিত ছিল। থাক, এখন নিশ্চিন্ত হলো তো?

–এরকুল, বিশ্বাস করো, আমি যদি জানতাম ওরা আমার স্ত্রীর সম্পর্কে মিথে ভয় দেখাচ্ছে, তাহলে কিছুতেই তোমাকে ঐ চিঠি লিখতে রাজী হতাম না।

-জানি। আমি জানি যে তুমি কাপুরুষ নও।

.

১৪.

 গ্যাস বোমা ফাটতেই ঐ ঢ্যাঙা লোকটা সরে পড়েছিল। পুলিশ যাদের গ্রেপ্তার করল তারা নেহাতই চুনোপুঁটি। জ্ঞান ফিরলে তারা জানাল, চতুরঙ্গের কোনোদিন নামই শোনেনি। তারা ঐ বাড়িতে চাকরের কাজ করত মাত্র, মালিকের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তারা কিছু জানে না। বাড়ীটায় তল্লাসী চালিয়ে জনপ্রাণীর দেখা মেলেনি।

-এরকুল আমরা শুধু হেরেই যাচ্ছি।

 দৃঢ় গলায় পোয়ারো বলল, না, তা বলতে পারি না। চতুরঙ্গের চার নম্বর কর্তাকে নিয়েই একটু মুশকিল বেঁধেছে। চার নম্বরকে সনাক্ত করা কঠিন বটে কিন্তু তার সম্পর্কে যে আমরা কিছুই জানিনে, এমন বলাও ঠিক নয়।

-কী জানো তার সম্পর্কে?

-জানি যে, সে মাঝারী দৈর্ঘ্যের মানুষ। এ যাবৎ যে কয়জনের ভূমিকায় তাকে দেখা গেছে, তাদের কারুর দৈর্ঘ্য খুব বেশি নয়। দ্বিতীয়ত, তার নাকটা চ্যাপ্টা। চ্যাপ্টা নাকের লোকেদের পক্ষে নাক খাড়া করা সহজ ব্যাপার কিন্তু খাড়া নাকের লোকের পক্ষে নাকটাকে চ্যাপ্টা করা সহজ নয়। তৃতীয়ত, তার বয়স মোটামুটি ৩০/৩৫ এর মধ্যে। চতুর্থত, তার সমস্ত দাঁত কিংবা অধিকাংশ দাঁতই নকল। কেননা রক্ষীর ভূমিকায় তার দাঁতগুলো ছিল ভাঙাচোরা। ডাঃ কুয়েন্টিনের ভূমিকায় দেখেছি তার সামনের দাঁত ছিল উঁচু। ডঃ সাবারোনফের ভূমিকায় দেখেছি সামনের দাঁত উঁচু ছিল না। দাঁত যদি আসল হতো এভাবে পাল্টানো যেত?

–ছদ্মবেশ ধারণে দেখছি লোকটা ওস্তাদ।

–সেজন্যেই আমার মনে হয় লোকটা এককালে পাকা অভিনেতা ছিল। তা না হলে বিভিন্ন ভূমিকায় তার চালচলন এত সহজ হতো না।

–তাহলে এখন আমাদের করণীয় কি?

করণীয় আর কিছুই নয়। এমন একজনকে খুঁজে বের করতে হবে আমাদের, যে বছর ৩/৪ আগেও স্টেজে অভিনয় করেছে, বয়স মোটামুটি ৩০/৩৫। সত্যি বলতে কি, ইতিমধ্যেই আমি এমন চারজন মানুষের খোঁজ পেয়েছি।

সেই চারজনের বর্ণনা শোন, পোয়ারো বলে যেতে লাগল। প্রথম জন আনোট নাটরেল। তেইশ বছর বয়সে রঙ্গমঞ্চে যোগ দিয়ে বিভিন্ন ভূমিকায় সে অভিনয় করেছে। চার বছর আগে ইংল্যাণ্ড পরিত্যাগ করেছে। উচ্চতা ৫৮”। নাক সোজা, চোখ বাদামী।

দ্বিতীয়জন–জন মরে। গরিব ঘরের ছেলে। বছর তিনেক যাবৎ নিখোঁজ। বাল্যবয়স থেকে অভিনয় করছে। উচ্চতা ৫৮”।

তৃতীয় জন-অস্টেন লী। অক্সফোর্ডের ছাত্র। ছাত্রজীবনেই অভিনয়ে যোগ দেয়। যুদ্ধে যোগ দিয়ে কৃতিত্ব দেখায়। বছর তিনেক আগে মোটর অ্যাক্সিডেন্টে আহত হয়। তারপর আর অভিনয় করেনি। ঠিকানা জানা নেই। বয়স ৩৫। উচ্চতা ৫৭”। চোখ নীল।

চতুর্থ জন-ক্লড ডরেল। বংশপরিচয় কেউ জানে না। ভ্রাম্যমাণ থিয়েটারের সঙ্গে অনেক দেশে গিয়েছে। ১৯১৯ সালে চীনে গিয়েছিল। ফিরতি পথে আমেরিকায় নামে। নিউইয়র্কে কিছুদিন অভিনয় করে। তারপর হঠাৎ একদিন নিখোঁজ হয়ে যায়। বয়স ৩৩। চোখের রং কটা। উচ্চতা ৫৮”।

–এই চারজনের মধ্যে তোমার কাকে সন্দেহ হয়? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

–চারজনকেই, তবে ক্লড ডরেলকেই সন্দেহ হয় সবচেয়ে বেশি।

–তা এই সন্দেহজনক চারজন লোকের খোঁজ পাওয়া যাবে কী করে?

–কাগজে আলাদা আলাদাভাবে এই চারজনের নামে বিজ্ঞাপন দিয়েছি। তাতে এদের আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধুবান্ধব, অবিলম্বে মিঃ ম্যাকনীলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। ম্যাকনীল আমার অ্যাটর্নী।

টেলিফোনটা বেজে উঠল।

পোয়ারো বলল, হ্যালো, আমি পোয়ারো…মিঃ ম্যাকনীল? তাই নাকি? …আচ্ছা ওকে বসিয়ে রাখুন, আমি এখুনি যাচ্ছি।

ফোন নামিয়ে পোয়ারো বলল, ক্লড ডরেলের এক বান্ধবী মিঃ ম্যাকনীলের সঙ্গে দেখা করেছে। চল সেখানে যাই।

ট্যাক্সি ধরে সোজা ম্যাকনীলের অফিসে। একটি রোগা মেয়ে চেয়ারে বসেছিল। পোশাকে বোঝা যাচ্ছে অবস্থা খুব ভালো নয়। বয়স বোঝার উপায় নেই।

–আসুন, মঁসিয়ে পোয়ারো। মিস ফ্লসি মনরোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি মিঃ ক্লড ডরেলের বান্ধবী। মিঃ ম্যাকনীল বললেন।

পোয়ারো হেসে তাকে বলল, তাই নাকি?

–হ্যাঁ, ক্লডি আমার বন্ধু ছিল। আপনাদের বিজ্ঞাপন পড়ে মনে হল, হয়তো ক্লডির কোনোও বড়লোক আত্মীয় মরবার সময় তাকে কিছু সম্পত্তি দিয়ে গেছে, তাই আপনারা ওর খোঁজ করছেন। তাই ওকে খুঁজে বার করার সুবিধার জন্যে আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম।

পোয়ারো বলল, মাদমোয়াজেল, চলুন কোনোও রেস্তোরাঁয় বসি গিয়ে। মিস মনরো আপত্তি করলেন না। আমরা বেরিয়ে একটা শৌখিন রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসলাম।

লাজুক হেসে মনরো বলল, ক্লডি ছিল আমার বন্ধু। আমাকে ভালোবাসত। তারপর বিয়ে করবে বলে আশায় আশায় রেখে একদিন সে নিখোঁজ হল।

–আচ্ছা, তার কোনো মুদ্রাদোষ আছে?

–আছে। এক চুমুক শ্যাম্পেন খেয়ে মনরো বলল, খাবার টেবিলে একটুকরো রুটি হাতে নিয়ে, সে রেকাবির গায়ে সেই টুকরোটাকে ঘষতে থাকে। এটা তার অনেকদিনের মুদ্রাদোষ। এই নিয়ে আমি অনেক ঠাট্টাও করেছি।

পোয়ারোর চোখদুটো চকচক করে উঠলো, আচ্ছা মিস মনরো, তার লেখা কোনো চিঠি আপনার কাছে আছে?

-না, চিঠি নেই, তবে ওর একটা ফটো আমার কাছে আছে।

 উত্তেজনায় প্রায় চেঁচিয়ে উঠল পোয়ারো, কোথায় তার ফটো?

–আমার বাসায় আছে। আজ বিকেলে আপনার ফ্ল্যাটে আমি ফটো নিয়ে দেখা করব আপনার সঙ্গে।

নিশ্চয়ই।

–মিস মনরো বিদায় নিলেন।

 ফ্ল্যাটে ফিরে এসেই জ্যাপকে ফোন করে পোয়ারো বলল, মিস ফ্লসি মনরো নামে এক মহিলার সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়েছে। আজ বিকেলে তিনি আমার কাছে আসবেন। হয়তো তাকে মারবার চেষ্টা হতে পারে। তুমি দুজন গোয়েন্দা পাঠাবার ব্যবস্থা করো। কেউ যেন মনরোর কাছে ঘেঁষতে না পারে।

ফোন নামিয়ে রাখল পোয়ারো। কিন্তু তার মিনিট কয়েক বাদেই আবার ফোন বেজে উঠল। আমি ধরলাম। সেন্ট জেমস হাসপাতাল থেকে বলা হোল, একটু আগে এক ভদ্রমহিলা মোটর চাপা পড়েছেন। নাম মিস মনরো। তার অবস্থা সঙ্কটনজক এবং তিনি বারবার আপনার নাম বলছেন। গাইড থেকে আপনার নম্বর খুঁজে ফোন করছি। এখুনি হাসপাতালে যেন আসেন মঁসিয়ে পোয়ারো।

আমরা এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে পৌঁছাতেই একজন নার্সের মুখ থেকে শুনলাম, একটু আগে তিনি মারা গেছেন।

পোয়ারো নার্সের দিকে চেয়ে বলল, ওঁর ব্যাগে আপনারা কি একটা চাবি পেয়েছেন? কারণ তিনি ফ্ল্যাটে একলা থাকতেন। বেরোবার সময় নিশ্চয় চাবি নিয়ে বেরিয়েছেন।

-না, টুকিটাকি জিনিষ ছাড়া কোনো চাবি আমরা পাইনি।

পোয়ারো আমাকে বলল, চলো হেস্টিংস, চারনম্বর মিস মনরোর বাসা থেকে সরে পড়বার আগেই আমার সেখানে পৌঁছোনো দরকার।

আমরা ট্যাক্সি ধরলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার পোয়ারো?

পোয়ারো বলল, মিস মনরো মোটর চাপা পড়েছেন। সেটা আকস্মিক নয়, চার নম্বর তাকে গাড়ী চাপা দিয়েছে কারণ সে জানতে পেরেছে মনরোর কাছ থেকে আমরা তার সম্বন্ধে খবরাখবর পাচ্ছি। এবং দুর্ঘটনার পর রাস্তার ভিড়ের মধ্যে চারনম্বরের কোনো অনুচর চাবিটা তার ব্যাগ থেকে হাতিয়েছে। চাবি দিয়ে তার মনরোর বাসায় ঢুকে সমস্ত তথ্য সরিয়ে ফেলবে। এই তো আমরা এসে গেছি।

তাড়াতাড়ি মনরোর ফ্ল্যাটে এলাম। দরজা খোলাই ছিল, বুঝলাম কেউ ঢুকেছিল। মেঝের ওপর স্তূপীকৃত কাগজপত্র, আলমারির পাল্লা খোলা, টেবিলের ড্রয়ার হাঁ করা দেখেই বোঝা গেল তল্লাশীর কাজটা ভালোভাবেই সারা হয়েছে। মেঝের ওপর একটা ফটোফ্রেম পড়ে ছিল, ফটো উধাও। এ সবই চতুরঙ্গের চারনম্বরের কাজ বুঝতে একটুও অসুবিধা হলনা।

.

১৫.

 মিস মনরোর মৃত্যুর পরে পোয়ারোর চরিত্রে রাতারাতি একটা পরিবর্তন ঘটে গেল। বাড়ি থেকে বেরোয় না, কথা বলে কম। কিন্তু আমার মনে হতো, সে চুপচাপ বসে নেই, তলেতলে সে পাল্টা আঘাতের আয়োজন করছে। অদ্ভুত চেহারার এক একজন মানুষ মাঝে মাঝেই তার কাছে আসে। চাপা গলায় তাদের কথা হয়, তারপর নিঃশব্দে বিদায় নেয়। দিন কয়েক আগে একজন রাশিয়ানকে সে একটা মোটা অঙ্কের চেক দিয়েছে।

একদিন মার্চের শেষের দিকে পোয়ারো আমাকে ডেকে বলল, চল, আমাদের স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে একবার দেখা করে আসি। ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী মঁসিয়ে দেজার্দু এখন লণ্ডনে। স্বরাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে আলোচনার সময়ে তিনিও উপস্থিত থাকবেন।

মিঃ সিডনি ক্রোথারের বাড়িতে গোপন বৈঠকে মোট পাঁচজন উপস্থিত ছিলেন। আমি এবং পোয়ারো ছাড়া মিঃ ক্রোথার, মঁসিয়ে দেজার্দু, মিঃ ইনগ্লেস।

মাঁসিয়ে দেজাদুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ক্রোথার বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো চতুরঙ্গের ব্যাপারটা এবার বুঝিয়ে বলুন।

পোয়ারো অল্প কথায় বলল, চতুরঙ্গ একটা গুপ্ত সংগঠন। পৃথিবীর সর্বত্র এরা রাষ্ট্রিয় কাঠামোকে ধ্বংস করতে চায়। মোট চারজন এই সংগঠন চালায়। সেজন্যেই এই সংগঠনের নাম চতুরঙ্গ। প্রথমজন একজন চীনা লি চ্যাং ইয়েন, দ্বিতীয়জন মার্কিন কোটিপতি আবে রাইল্যাণ্ড। তৃতীয়জন এক ফরাসী মহিলা; চতুর্থজন এক ইংরেজ তার নাম ক্লড ডরেল।

মঁসিয়ে দেজার্দু হাসছিলেন। পোয়ারোর কথার একবর্ণও তার বিশ্বাস হয়নি। তিনি বললেন, আবে রাইল্যাণ্ড একজন বিখ্যাত মানুষ। তাঁর সম্পর্কে আপনি এসব কি বলছেন? পোয়ারো বলল, ঠিকই বলছি, মঁসিয়ে। আমার প্রত্যেকটি কথার প্রমাণ দিতে পারি।

মিঃ ক্রোথার বললেন, স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডকেও মঁসিয়ে পোয়ারো তথ্যপ্রমাণ দেখিয়েছিলেন।

দেজার্দু বলেছিলেন, মিঃ রাইল্যাণ্ডের কথা না হয় বুঝলাম, কিন্তু ফরাসী মহিলাটি কে?

-মাদাম অলিভিয়ের, পোয়ারো বলল।

–অসম্ভব! মাদাম কুরির পরে তাঁর মত বিজ্ঞানী কোনো দেশে জন্মায়নি। তাঁর নামে এ কি অন্যায় কথা বলছেন? মিঃ ক্রোথার আপনিও কি এইসব আজগুবী কথা বিশ্বাস করেন?

না করে উপায় নেই, মঁসিয়ে। তাঁর সম্পর্কে যে সব প্রমাণ মঁসিয়ে পোয়ারো যোগাড় করেছেন তারপরে বিশ্বাস না করে পারা যায় না।

গুম হয়ে বসে রইলেন দেজার্দু। অনেকক্ষণ বাদে বললেন, মাদাম অলিভিয়েরের বিরুদ্ধে যে প্রমাণই আপনারা দিন না কেন, ব্যাপারটা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু এবার বলুন লি চ্যাং ইয়েন আবার কে? এমন নাম তো শুনিনি।

মিঃ ইনগ্লেস এবারে মুখ খুললেন, খুব কম লোকই তার নাম শুনেছে। চীনে দীর্ঘকাল কাটানোর ফলে আমি তাকে চিনি। আড়াল থেকে কাজ হাসিল করে। পৃথিবী জুড়ে আধিপত্য বিস্তারের লালসায় বোধহয় এমন কাজ নেই সে করতে পারে না।

মিঃ ক্রোথার এবার পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি আর কিছু বলবেন মঁসিয়ে?

-হ্যাঁ, আমার আর একটা কথা বলার আছে। চতুরঙ্গের চক্রান্ত ছিঁড়ে ফেলবার জন্যে এতদিন ধরে আমি যে আয়োজন করেছি, তাদের আক্রমণে আমার মৃত্যু হলে তা যাতে ব্যর্থ না হয় তাই চতুরঙ্গ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য আমি একটা খাতায় লিখে রেখেছি, আর সেই খাতাখানাকে আমি একটা ব্যাঙ্কের ভল্টে রেখে দিয়েছি। মিঃ ক্রোথার এই নিন তার চাবি। যদি তারা আমাকে হত্যা করে আপনি খাতাখানাকে বার করে নেবেন, চতুরঙ্গের বিরুদ্ধে কিভাবে এগোতে হবে তার নির্দেশ ওতে পেয়ে যাবেন। আর আমার কিছুই করার নেই।

আমরা সবার কাছে বিদায় নিয়ে নিচে নেমে এলাম। মিঃ ইনগ্লেসও আমাদের সঙ্গে বেরোলেন। তিনি বললেন, খুব শিগগির আবার চীনে যাচ্ছি। লি চ্যাং ইয়েনকে খুঁজে বার কর জোনাথান হোয়েলিকে হত্যা করার অপরাধে শাস্তি দেবার জন্যে। বলে ইনগ্লেস একটা বাসে উঠে পড়ল।

হাঁটতে হাঁটতে পোয়ারো বলল, জানো হেস্টিংস, এক একসময় মনে হয় বেলজিয়াম থেকে আমার যমজ ভাইকে নিয়ে আসি।

পোয়ারোর যে ভাই আছে আমি জানতাম না। বললাম, তার নাম কি?

–আকিল পোয়ারো। তার যেমন বুদ্ধি তেমনি সাহস। তার পরামর্শ নিয়ে আমি বিস্তর রহস্যের সমাধান করেছি। হুবহু আমার মতো দেখতে, তার গোঁফ নেই।

বাড়ী ফিরতে দেখলাম এক নার্স ভদ্রমহিলা পোয়ারোর জন্যে অপেক্ষা করছে। পরিচয় বিনিময়ের পর সে বলল, আমার নাম ম্যাবেল পামার। লার্ক ইনস্টিটিউশন থেকে আমাকে, এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক মিঃ টেম্পলটনের বাড়ী হার্টফোর্ডশায়ারে পাঠানো হয় তাঁকে সেবার। করার জন্যে। এক ছেলে আর স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। ছেলেটি হাবা গোছের, প্রথমপক্ষের। সৎ মায়ের সঙ্গে তার বনিবনা নেই। মিঃ টেম্পলটনের প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পর তিনি এক অল্পবয়সী মহিলাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। যাই হোক, মিঃ টেম্পলটন গ্যাসট্রিক আলসারের রুগী। মাঝে মাঝেই পেটে ভীষণ ব্যথা হয় বমি করেন। ডাক্তারের তা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। তিনি তাকে একই ওষুধ দিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে একদিন একটা ব্যাপার ঘটল। আমি দেখলাম সন্ধ্যার অন্ধকারে বাড়ির বাগানের নির্জন জায়গায় মিসেস টেম্পলটন আর ডাক্তার ঘনিষ্ঠভাবে বসে আছেন। এরপর থেকে আমার মনে হয় ডাক্তার হয়ত ইচ্ছে করেই মিঃ টেম্পলটনকে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। আমার ধারণা, খাবারের সঙ্গে নিয়মিতভাবে অল্পমাত্রায় সেঁকোবিষ মেশানো হচ্ছে। যাতে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে তিনি এগিয়ে যান। একদিন শুনলাম মিঃ টেম্পলটন বললেন, এই চারজনেই আমাকে মেরে ফেলবে।

–চারজন বলতে কাদের বুঝিয়েছিলেন?

–ছেলে, স্ত্রী, স্ত্রীর এক বন্ধু, আর ডাক্তার।

–চক্রান্তকে ব্যর্থ করার জন্যে আপনি কিছু চেষ্টা করেছেন?

-হ্যাঁ, গতকাল রাতের স্যুপ খাবার পরেই মিঃ টেম্পলটনের পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। আমি সেই স্যুপের কিছু অংশ শিশিতে করে এনেছি। আপনি কি এটা পরীক্ষা করে দেখবেন?

পোয়ারো শিশিটাকে তার কেমিস্ট বন্ধুর কাছে পাঠালো। ঘন্টাখানেক পরে রিপোর্ট এল স্যুপের মধ্যে বিষ আছে। শুনে ভদ্রমহিলা চমকে উঠে বললেন, আমি বাবা পুলিশ-টুলিশের ঝামেলায় যেতে পারব না। তার চেয়ে বরং আপনি একবার ওখানে চলুন। যা ভালো বুঝবেন করবেন।

আমরা মিনিট কয়েকের মধ্যেই হার্টফোর্ডশায়ারে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে নিলাম। ইতিমধ্যে আমি লার্ক ইনস্টিটিউশনে ফোন করে জেনে নিলাম মিস পামার সত্যিই নার্স কিনা। তারা জানালো, হ্যাঁ, তিনি নার্স, তাঁকে হার্টফোর্ডশায়ারে পাঠানো হয়েছে।

পোয়ারো বলল, ওখানে গিয়ে আমরা আমাদের উদ্দেশ্য ভাড়ালেও পরিচয় গোপন করবো না। বলব যে, একটা চুরির ব্যাপারে, মিঃ টেম্পলটনের বাড়ির একজন ভৃত্য হয়ত জড়িত আছে, সেই সম্পর্কে খোঁজ নিতেই আমাদের এখানে আসা।

বলা বাহুল্য, আমরা ওখানে মিস পামারের সঙ্গে গেলাম না। আলাদাভাবে গেলাম। কলিংবেল টিপতে মিসেস টেম্পলটন দরজা খুলে দিলেন।

–আমার নাম এরকুল পোয়ারো, একটা তদন্তের ভার নিয়ে, আমি আর আমার বন্ধু ক্যাপ্টেন হেস্টিংস মিঃ টেম্পলটনের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

একটু দাঁড়ান আপনারা, আমি আসছি, বলে ভদ্রমহিলা চলে গেলেন। আর এলেন না। এলেন ডাক্তার ট্রিভস। বললেন, আমি এ বাড়ির ডাক্তার। মিঃ টেম্পলটন ডাইনিং হলে খাচ্ছেন, আপনারা সেখানে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারেন।

ডাইনিং হলে গিয়ে মিঃ টেম্পলটনের ছেলের সঙ্গেও আলাপ হল। বয়স ৩০/৩২ সে বাপের সঙ্গে খেতে বসেছে।

পোয়ারো মিঃ টেম্পলটনের সঙ্গে কথা বলতে লাগল। আমি শুনতে লাগলুম। ছেলে পাশে। হঠাৎ সে আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, সবাই আমাকে হাবা মনে করে। আমি সব জানি। বাবা মরে গেলে মা ঐ ডাক্তারকে বিয়ে করবে। তাই ওরা বাবাকে মারতে চায়।

বলেই সে মুখ ফিরিয়ে নিতান্ত নিরীহভাবে রেকাবির ওপরে একটুকরো রুটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল।

পোয়ারোর দৃষ্টি আমাদের দিকে। হঠাৎ সে পেটে হাত চেপে গোঙাতে লাগল। ডাক্তার এল। পোয়ারো গোঙাতে গোঙাতে বলল, পেটে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। মাঝে মাঝেই এরকম হয়। একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।

ডাক্তার তখন আমাদের অন্য ঘরে পৌঁছে দিল। সে বেরিয়ে যেতেই পোয়ারো বিদ্যুৎবেগে বিছানা থেকে নেমে পড়ল। বলল, পালাও, হেস্টিংস, পালাও।

তার মানে?

–ডিনার-টেবিলের ঐ ছেলেটাই ক্লড ডরেল। রুটির টুকরো নিয়ে সে রেকাবিতে ঘষছিল, সেটাই তার মুদ্রাদোষ। আমার বিশ্বাস, এ বাড়ির প্রত্যেকেই চতুরঙ্গের চর। এক্ষুনি আমাদের পালাতে হবে। চলো, ঐ জানলা দিয়ে বেরিয়ে, পাঁচিল টপকে পালাই।

তাই করলাম আমরা। দৌড়, দৌড়। স্টেশনে পৌঁছলাম। তারপর বাড়ি পৌঁছে ঘরে ঢুকতে যাবো। পোয়ারো আমাকে বাধা দিল। বলল, দাঁড়াও হেস্টিংস, কে জানে কোনো ফাঁদ পাতা আছে। পা টিপে টিপে আমরা আলো জ্বালালাম। না, কেউ নেই।

অনেকক্ষণ সিগারেট খাওয়ার জন্যে আমার প্রাণ আকুলি-বিকুলি করছিল। প্যাকেট বের করলাম। দেখলাম, বিছানার ওপর একটা দেশলাই পড়ে রয়েছে। দেশলাই তুলে নিয়ে বললাম, দ্যাখো পোয়ারো, তুমি নিজেও কিছু কম অগোছালো নও। দেশলাইটা বিছানায় ফেলে রেখেছ।

-বাজে কথা, পোয়ারো বলল। ততক্ষণে আমি কাঠি বার করেছি। পোয়ারো ঝাঁপিয়ে, দাঁড়াও, দাঁড়াও। আমি তখন কাঠিটাকে বারুদের গায়ে ঘষে দিয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে একটা চোখ ধাঁধালো আলোর সঙ্গে বিস্ফোরণ। তারপরে আর কিছু মনে নেই আমার।

.

জ্ঞান হবার পর দেখি ডক্টর রিজওয়ে আমার মুখের কাছে ঝুঁকে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, পোয়ারো? পোয়ারো কেমন আছে?

ডক্টর রিজওয়ে ভগ্ন, বিকৃত গলায় জানালেন, দৈবক্রমে আপনি বেঁচে গেলেও, মঁসিয়ে পোয়ারো রক্ষা পাননি। তার আত্মা শান্তি লাভ করুক।

.

.

মনে পড়ে বালিশে মুখ গুঁজে আমি সেদিন শিশুর মতো কেঁদেছিলাম। আর রোগশয্যাতে শুয়েই আমি কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলাম, পোয়ারোর মৃত্যুর প্রতিশোধ আমি নেবই।

ডাক্তার রিজওয়ে আমাকে কোনো উৎসাহ না দিয়েই বললেন, আপনার বরং দক্ষিণ আমেরিকাতে ফিরে যাওয়াই ভালো।

স্বরাষ্ট্রসচিব মিঃ ক্রোথারও ঐ একই উপদেশ দিলেন। আরও বললেন, পোয়ারোর মৃত্যুর পরে ভল্ট থেকে তিনি খাতাখানাকে এনেছিলেন। তাঁর নির্দেশিত পথেই তারা এগোচ্ছেন।

কেউ আমার সাহায্য নিলেন না। আমি একাই আমার কাজে এগিয়ে যাবো।

চতুরঙ্গের বিরুদ্ধে এগোনোর একটা ছক করে ফেললাম। প্রথমে ক্লড ডরেলকে খুঁজে বার করতে হবে। বিভিন্ন কাগজে বিজ্ঞাপন দিলাম। ক্লড ডরেল সম্পর্কে কেউ জানলে আমার সঙ্গে যেন যোগাযোগ করেন।

মার্চ-এপ্রিল-মে গেল। কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ আমার চোখে পড়ল যে, মিঃ ইনগ্লেস মার্সাই থেকে এস. এস. সাংহাই জাহাজে উঠে চীনে যাচ্ছিলেন। মাঝপথে একদিন রাত্রে তিনি হঠাৎ ডেক থেকে সমুদ্রে পড়ে যান। দুর্ঘটনাকালে সমুদ্র ছিল শান্ত। জাহাজ দুলছিল। তবু তিনি রেলিং টপকে কিভাবে পড়লেন তা জানা যায়নি।

এই স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম এটা চতুরঙ্গেরই কাজ।

একদিন রেস্তোরাঁয় খাচ্ছি। আমার সামনের ভদ্রলোক, আমার নুনের দরকার পড়াতে আমার প্লেটে চার জায়গায় নুন ঢেলে বললেন, মরতে আপনি ভয় পান না, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস?

আপনার এখন দক্ষিণ আমেরিকাতেই ফিরে যাওয়া উচিত। বলে তিনি দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেলেন।

এর দশদিন পর। রাত নটা নাগাদ হাইড পার্কের পাশে হাঁটছি। হঠাৎ একটা গাড়ী আমার গা ঘেঁষে ব্রেক কষল। এক মহিলা মুখ বাড়িয়ে বললেন, ভয় পাবেন না ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, এদেশ ছেড়ে চলে যান।

মহিলাকে চিনতে পারলাম। কাউন্টেস রসাকোফ।

আমি বললাম, কেন? আমি থাকলে আপনার প্রভুদের অসুবিধা হচ্ছে?

-পাগল। চতুরঙ্গ ইচ্ছে করলেই আপনাকে পিষে মারতে পারে। কিন্তু তাদের আমিই বাধা দিয়েছি। মঁসিয়ে পোয়ারো আমার প্রতিপক্ষ হলেও, আমি তাকে শ্রদ্ধা করতাম। আপনি তার বন্ধু। তাই বলছি, আপনি ফিরে যান দক্ষিণ আমেরিকায়।

গাড়ীটা ছুটে বেরিয়ে গেল। গাড়ীর নম্বর প্লেটটা ঝুটো বলেই আমি নম্বর টুকলাম না।

ফ্ল্যাটে ফিরে এসে ভাবলাম, তাহলে কি পোয়ারোর মৃত্যুর প্রতিশোধ না নিয়েই আমাকে ফিরে যেতে হবে?

টেলিফোনটা বেজে উঠল।

-হ্যালো, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস বলছি।

অন্যপ্রান্ত থেকে উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো :

সেন্ট গাইলস হাসপাতাল থেকে বলছি। খানিক আগে এক চীনাকে এখানে ভর্তি করা হয়েছে। তার অবস্থা এখন সঙ্কটজনক। লোকটার পকেট থেকে একটা চিরকুট পাওয়া গেছে, তাতে আপনার নাম, ঠিকানা লেখা ছিল। আপনি এখানে আসবেন?

–যাচ্ছি।

আমি হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম অ্যাকসিডেন্ট-ওয়ার্ডে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। পাশে ডাক্তার, নার্স।

ডাক্তার বললেন, বাঁচবার কোনো সম্ভাবনা নেই। আপনি একে চেনেন নাকি?

–না। কখনও একে দেখিনি।

-আশ্চর্য। পকেটে আপনার নাম-ঠিকানা কোত্থেকে এলো? ওর পকেটে অন্যান্য কাগজপত্তরও কিছু পাওয়া গেছে, তার থেকে জানা গেছে মিঃ ইনগ্লেস নামে এক ভদ্রলোকের কাছে ও চাকরী করত।

তখন আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, আমি হেস্টিংস…হেস্টিংস…আমাকে কিছু বলবে?

-লাগো…কারোজা…দুটি কথা বলে তার ঠোঁট থেমে গেল। মারা গেল।

লার্গো…কারোজা…এই শব্দ দুটির অর্থ কি হতে পারে?

 ফ্ল্যাটে ফিরে এসে সলিসিটরের চিঠি পেলাম।

প্রিয় মহাশয়,

আমাদের পরলোকগত মক্কেল মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো তাহার জীবদ্দশায় আমাদের যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তদানুসারে তাহার একখানি পত্র এইসঙ্গে আপনার কাছে পাঠাইতেছি। মৃত্যুর সপ্তাহকাল পূর্বে এই পত্রখানি আমাদের কাছে জমা দিয়া তিনি এইরূপ নির্দেশ দেন যে, তাহার মৃত্যু ঘটিলে যেন পত্রখানি আপনার কাছে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। আপনার বিশ্বস্ত….

এরই সঙ্গে ছিল আমাকে লেখা পোয়ারোর একখানা চিঠিঃ

প্রিয় হেস্টিংস, এই চিঠি যখন তোমার হাতে পৌঁছবে, তখন আমি মৃত। আমার জন্যে দুঃখ না করে যদি আমার নির্দেশ পালন করো, তাহলেই আমার আত্মা শান্তি পাবে। আমার নির্দেশ এই চিঠি পেয়েই তুমি দক্ষিণ আমেরিকায় ফিরে যাবে। আমি জানি তুমি আমার নির্দেশ অমান্য করবে না। আমি আমার জীবদ্দশায় যে প্ল্যান ছকেছি, তুমি ইংল্যান্ডে থাকলে সেই কাজ করা শক্ত হবে। তুমি বুদ্ধিমান। সুতরাং আশা করি এর চেয়ে বেশি কিছু তোমাকে বলার দরকার নেই। পরলোক থেকে আমি শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

ইতি
এরকুল

বারবার পড়লাম চিঠিখানা। পোয়ারোর প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুয়ে আসছিল। তার কোনো কাজেই খুঁত নেই। মৃত্যুর আগে আমার কথা ভেবে নিজের হাতে সে জানিয়ে গেছে, আমি যেন ফিরে যাই। তার নির্দেশ অমান্য করতে আমি পারব না।

অ্যানিসোনিয়া জাহাজে উঠে আমি দক্ষিণ আমেরিকার দিকে রওনা হলাম। জাহাজ ছাড়ার আগে একজন স্টুয়ার্ড এসে আমার হাতে একটা চিরকূট দিল।

তাতে লেখা : ইংল্যাণ্ড থেকে বিদায় নিয়ে আপনি সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন ৪।

শান্ত সমুদ্র, কেবিনে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ মাঝরাত্রিতে জাহাজেরই এক অফিসারের ধাক্কায় আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। উত্তেজিত গলায় তিনি বলছেন, নৌ-বিভাগ থেকে বিশেষ নির্দেশ পাঠানো হয়েছে আমাদের। জাহাজ থেকে এইখানেই আপনাকে আমরা নামিয়ে দেব।

–এই মাঝসমুদ্রে?

–সমুদ্রে নয়, এই ডেস্ট্রয়ারে। নৌবিভাগের আদেশ আমরা অমান্য করতে পারি না।

আমাকে একটা ডেস্ট্রয়ারে নিয়ে যাওয়া হল। খানিকক্ষণের মধ্যেই আমাকে বেলজিয়ামের উপকূলে নামিয়ে দেওয়া হল। সেখানে একজন মোটরগাড়ীর ড্রাইভারকে, ডেস্ট্রয়ার ক্যাপ্টেন বলে দিল, আমাকে যেন এখানকার স্পা-শহরের কাছাকাছি একটা বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝছিলাম না। গাড়ী ছুটছে। বিদ্যুৎচমকের মতই হঠাৎ আমার মনে পড়ল, এরকুলের ভাই আকিলের কথা। এরা কি আমার আকিল পোয়ারোর কাছে নিয়ে যাচ্ছে? কিন্তু কেন? ছোট্ট একটা বাড়ীর সামনে আমাকে নামিয়ে দেওয়া হল। মাঝবয়সী

একজন ভৃত্য এসে আমাকে জানাল, বাড়ীর মালিক আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন।

আমি সেই ভৃত্যের সঙ্গে গেলাম। একটা ঘরের পর্দা সরিয়ে আমি ভিতরে ঢুকলাম। অসম্ভব…সম্পূর্ণ অসম্ভব। ও, কে! আমার দিকে দুই হাত প্রসারিত করে এগিয়ে আসছে?

-”পোয়ারো!”

-হ্যাঁ, হেস্টিংস, আমি পোয়ারো, ও আমাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, আমি মারা যাইনি। এরকুলকে মারা অত সহজ নাকি?

–কিন্তু আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না। এরকুল হাসল, বলল, শত্রুর চোখে ধুলো দিতেই এই মিথ্যে রটনা। ডাঃ রিজওয়ে আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছেন। সেদিন আমি আহত হয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু আমার পরামর্শানুযায়ী ডাঃ রিজওয়ে রটিয়ে দেন আমি মারা গেছি। ফাঁকা একটা কফিনকে কবর দেওয়া হয়। তোমাকে কিছু না জানানোও আমার প্ল্যানের অঙ্গ। কিছু মনে কোর না ভাই। তোমার শোকার্ত অবস্থা দেখে চতুরঙ্গের লোকেদের আর কোনো সন্দেহই রইল না। নৌ-বিভাগের সঙ্গে ব্যবস্থা করে আমি তোমাকে গোপনে আনিয়েছি। এইবারে শুরু হবে আমাদের আসল আক্রমণাত্মক খেলা। এইবারে আমরা চূড়ান্ত আঘাত হানবো।

.

১৭.

বেলজিয়ামের ঐ নিভৃত অঞ্চল থেকেও পোয়ারো তার সমস্ত যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ রেখেছিল।

বুঝতেই পারছিলাম জালটা এবার বেশ ভালোভাবেই বিস্তৃত করা হচ্ছে। রোজই ফ্রান্স, ইটালি, ইংল্যাণ্ড, চীন দেশ থেকে একটা না একটা প্যাকেট তার কাছে এসে পৌঁছায়। নিচুগলায় কি সব কথাবার্তা হয়। পোয়ারো কাউকে কাউকে টাকা বা অন্যকিছু দেয়। আবার তারা নিঃশব্দে বিদায় নেয়।

কথায় কথায় পোয়ারো একদিন বলল, বুঝলে হেস্টিংস, চারজনে যেই এক জায়গায় এসে যাবে, অমনি আমি তাদের আঘাত হানব। ধৈর্য হারিয়ে বিপদের দিকে ছুটে গেলে লাভ নেই, মিঃ ইনগ্লেসই তার জীবন দিয়ে সে কথা বুঝিয়ে দিয়েছেন।

ইনগ্লেস প্রসঙ্গে ঐ চীনা ভৃত্যের কথা আমার মনে পড়ল। আমি এরকুলকে সমস্ত জানিয়ে বললাম, মরবার আগে দুটো শব্দ সে উচ্চারণ করেছিল, লাগো…কারোজা। পোয়ারো আমার কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনল।

দিন কয়েক পরের কথা। আমাদের বাড়ীতে এলেন ক্যাপ্টেন হার্ভে। পোয়ারো আমার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলো।

ক্যাপ্টেন বলল, মঁসিয়ে পোয়ারো, চীনে একটা গুরুতর হাঙ্গামা বাঁধায় চীনের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সপ্তাহ খানেক আগে আবে রাইল্যাণ্ড ইংল্যাণ্ডে এসেছিলো। গতকাল তিনি ইংল্যাণ্ড ছেড়েছেন।

–ছেড়ে ইতালির দিকে গেছেন, পোয়ারো বলল।

–হ্যাঁ।

–আর মাদাম অলিভিয়ের?

তিনিও ফ্রান্স ছেড়েছেন গতকাল

 –তিনিও ইতালীর দিকে গেছেন তাই না?

–হ্যাঁ। ব্যাপারটা আপনি আঁচ করলেন কি করে?

–আঁচ করতে পারতুম না; যদি না আমার বন্ধু হেস্টিংস আমাকে সাহায্য করত। এরকুলের কথা আমি ভাবতে লাগলাম, আমি আবার তাকে কী সাহায্য করলাম।

পোয়ারো বলল, সবাই তাহলে স্বাস্থ্যনিবাসের দিকে যাচ্ছে।

আজ্ঞে হ্যাঁ, সেখানে নজরও রাখা হয়েছে। ইতালি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড সরকার এ ব্যাপারে একযোগে কাজ করছেন। আপনাকে সাহায্য করতে তারা সর্বতোভাবে রাজী।

–ভাবনা তো মঁসিয়ে দেজার্দুকে নিয়ে, তাহলে তিনি আমার কথা বিশ্বাস করেছেন?

 –না করে উপায় কী! আপনি যেসব প্রমাণ দিয়েছেন, তা খণ্ডন করা সম্ভব নয়।

-তাহলে সময় নষ্ট না করে আমরা আজই ইতালির পথে রওনা দেব। হেস্টিংস, তুমি বরং বিপদের মধ্যে না গিয়ে এখানেই থাকো।

-অসম্ভব, যত বিপদই আসুক আমি তোমার পাশেই থাকতে চাই, আমি বললাম।

ট্রেন ছাড়ার পর এরকুলকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, এরকুল আমি তোমাকে কিভাবে সাহায্য করলাম ঠিক বুঝলাম নাতো।

-লাগো কারোজা–এই কথাটা তুমি সেদিন জুগিয়ে আমাকে সাহায্য করেছ। ওটা লাগো কারোজা নয়, লাগো-ডি-কারোজা, তুমি শুনতে ভুল করেছিলে। ওটা একটা ইউরোপের সুন্দর স্বাস্থ্যনিবাস। যতদূর মনে হয় ওটাই চতুরঙ্গের সদর দপ্তর। সেখানে পাহাড়ের মধ্যে তাদের গোপন ল্যাবরেটারী, সুড়ঙ্গ, ঘরবাড়ী, অস্ত্রাগার সব আছে। এই গোপন ঘাঁটি থেকে এক-একটা বেতার নির্দেশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এক-একটা বিপর্যয় ঘটবে। শাসন-ব্যবস্থা, যানবাহন-ব্যবস্থা, যোগাযোগ সব নষ্ট হবে। দুর্ভিক্ষ মহামারী, রক্তস্রোত ঘটবে।

-আর?

–আর চতুরঙ্গের সাঙ্গোপাঙ্গোরা প্রতিষ্ঠা করবে এক ভয়ঙ্কর স্বৈরতন্ত্র।

.

লাগো-ডি-কারোজায় পৌঁছালাম আমরা। চারিদিকে পাহাড়, সবুজঘেরা সুন্দর জায়গা।

ক্যাপ্টেন হার্ভে পোয়ারোকে আঙুল নির্দেশ করে দেখাল, বলল, ঐখানে, ঐ যে ঘোরালো পথটা রয়েছে। ভীষণ জটিল পথ, পাহাড়ের গা বেয়ে এঁকেবেঁকে উঠে গেছে।

সেদিন রাত্রে ডাইনিং হলে আমরা খেতে বসেছি। হঠাৎ পোয়ারো বলল, সামনের লোকটাকে একবার দে, দোহারা চেহারা, তলপোয়ারো মুখ নিচু কত

দেখলাম, মাঝবয়সী, দোহারা চেহারা, চোখে চশমা পরা একজন লোক বসে আছে। আমাদের দিকে তার চোখ পড়তেই চমকে উঠল। পোয়ারো মুখ নিচু করে বলল, চার নম্বর। রুটির টুকরো নিয়ে খেলা করার মুদ্রাদোষের কথা মনে আছে তো হেস্টিংস। আমি ভেবেছিলাম, শত্রু যখন আমার সম্পর্কে একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ দেখা দেব। যাতে ওরা আমাকে মারবার জন্যে উঠে পড়ে লাগে। কিন্তু এবার ওদের পাল্টা আঘাতের জন্য তৈরি থাকতে হবে।

–কিন্তু সত্যিই কি ও আঘাত হানবে নাকি?

নিশ্চয়ই। পৃথিবীতে একমাত্র আমাকেই ও ভয় করত। আমার মৃত্যু সংবাদে ওরা বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছিল। সেই স্বপ্ন পূরণ করতে ওরা সকলে এখানে এসে জমায়েত হয়েছে। ওদের প্ল্যান যাতে ভেস্তে না যায়, তারজন্যে আমার উপর এবার চূড়ান্ত আঘাত হানতে হবে।

লোকটা উঠে দাঁড়াল, বেরিয়ে গেল। পোয়ারো বলল, তাড়াহুড়োর দরকার নেই। কফিটা শেষ কর। আমি একবার ঘর থেকে ঘুরে আসি। এসে লবিতে গিয়ে বসবো।

আমরা লবিতে বসলাম। খানিক বাদে সেই লোকটা আমাদের সামনে এসে বসল আর পোয়ারোর সঙ্গে গল্প জমিয়ে বসল। পোয়ারো পকেট থেকে সিগারেট মুখে ধরতেই লোকটা লাইটার বার করে বলল, আসুন। বলেই সে তার লাইটার জ্বালল। তারপরেই হোটেলের সমস্ত আলো হঠাৎ নিভে গেল। কে যেন আমার মুখে একটা রুমাল চেপে ধরল। তীব্র ঝাঝালো গন্ধে আমি জ্ঞান হারালাম।

.

১৮.

 বড়জোর মিনিট খানেক বাদেই জ্ঞান ফিরে আসতে অনুভব করলাম, আমার হাত-পা বাঁধা, মুখে কাপড় ঠাসা। অন্ধকার। অন্ধকারটা চোখে সয়ে আসতে বুঝলাম আমাকে আর আমার সামনে একজনকে চ্যাংদোলা করে বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পোয়ারোর সিগারেডে বিষাক্ত সূচ ছিল। কিন্তু সেই সূঁচ নিক্ষেপ করার আগেই হোটেলের মেন সুইচের কাছেই কোনো লোক সুইচটা অফ করে দেয়। আমার মনে পড়ল, ডাইনিং হল থেকে চারনম্বর একবার বেরিয়েছিল। তখনই সে এই ব্যবস্থা করে গেছে। ক্ষোভে, অপমানে আমার চোখ ফেটে জল আসছিল।

জঙ্গলে পাহাড়িয়া রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে আমাদের বয়ে নিয়ে ওপরদিকে উঠছিল তারা। একটার পর একটা বাঁক পার হচ্ছিল তারা। সামনে একটা বড় পাথর। সেই পাথরের কাছে গিয়ে, মনে হল, একজন যেন বোতাম টিপল। পাথরটা তৎক্ষণাৎ সরে গিয়ে একটা সুড়ঙ্গ পথ দেখা গেল। বাহকরা সেই সুড়ঙ্গপথে আমাদের বয়ে নিয়ে নামতে লাগল।

হঠাৎ অন্ধকার চিরে ইলেকট্রিকের আলোয় আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, এটাই তাহলে চতুরঙ্গের সদর ঘাঁটি।

বাহকরা আমাদের নামাল। চারনম্বর লোকটা আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বলল, আসুন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমাদের গুপ্তঘাঁটিতে আপনাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাই।

এবার বাহকরা আমাদের নিয়ে মস্ত একটা ঘরে নিয়ে গেল। পিছনে চারটে চেয়ার। সামনে বড় টেবিল। প্রথম চেয়ারটা শূন্য, দ্বিতীয়, তৃতীয় চেয়ারে বসে আছেন যথাক্রমে রাইল্যাণ্ড, মাদাম অলিভিয়ের আর চতুর্থ চেয়ারে গিয়ে বসল চার-নম্বর।

চতুরঙ্গকে এত কাছ থেকে কখনও দেখিনি। ভয়ে আমার বুক কাঁপছিল।

গম্ভীর গলায় রাইল্যাণ্ড বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, আজ আপনাকে এখানে দেখতে পাবো বলে সত্যিই আশা করিনি। আপনি যে মারা গেছিলেন, এখন দেখছি তা সত্যি নয়। এবারে আর আপনার রক্ষে নেই।

পোয়ারো বলল, ধন্যবাদ।

 বিস্মিত হয়ে পোয়ারোর দিকে তাকালাম। এত গলা ভাঙা আওয়াজ কেন? ঠান্ডা লেগেছে? শুধু কণ্ঠস্বরই নয়, বাচনভঙ্গিও তার পাল্টে গেছে।

আমার ভাবনায় ছেদ টেনে ওদিককার পর্দা সরিয়ে এসে দাঁড়ালেন, কাউন্টেস রসাকোফ। পোয়ারোর দিকে চোখ পড়তেই সে ফোঁস করে উঠল, একী, আমি কি ভূত দেখছি। মঁসিয়ে পোয়ারো আপনি মারা যাননি?

-না, মাদাম, পোয়ারো এত সহজে মরে না।

পোয়ারোর কণ্ঠস্বর কাউন্টেসের সন্দেহকে আরো গাঢ় করল। তার চোখ দুটো জ্বলে উঠল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমারও অবচেতন মনে জেগে ওঠা সন্দেহটা হঠাৎ জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল।

আমার মনে হল, এ পোয়ারো হতে পারে না। এরা তাহলে এরকুলের যমজ ভাই আকিলকে ধরে এনেছে। কিন্তু আকিল কিভাবে এল? তাহলে কি ডাইনিং হল থেকে পোয়ারো যখন একবার ঘরে গিয়েছিল, তারপর তার ভাই আকিলকে পাঠিয়ে দিয়েছিলো?

হয়তো তাই হবে। হঠাৎই কাউন্টেস রসাকোফ চেঁচিয়ে উঠলেন, এ কাকে ধরে এনেছেন আপনারা? ইনি তো এরকুল পোয়ারো নন। বলেই তিনি পোয়ারোর মুখ থেকে মাফলারটা সরিয়ে গোঁফটায় টান মারলেন। গোঁফটা খসে পড়ল।

–দেখুন, এ লোকটা এরকুল নয়, রসাকোফ বললেন, তখনই আমার মুখ ফস্কে বেরিয়ে এল, আমি জানি ইনি আকিল পোয়ারো। এরকুলের যমজ ভাই।

অসম্ভব, রাইল্যান্ড চেঁচিয়ে উঠলেন।

শান্ত গলায় আকিল পোয়ারো বললেন, না মঁসিয়ে, এরকুল যা চেয়েছিলো ঠিক তাই হয়েছে। তার বুদ্ধির সঙ্গে আপনারা পেরে ওঠেননি। সে আপনাদের প্রতিটা চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়েছে। এই স্বাস্থ্যনিবাসে গত একমাসে যত লোক এসেছে তারা সবাই পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা। এখানে যে হোটেল আছে, তার প্রতিটি কর্মচারীই ইতালিয়ান, ফরাসী আর নয়তো ব্রিটিশ সরকারের গুপ্তচর বিভাগের লোক। এরকুলের নির্দেশ তারা এই পাহাড়টাকে ঘিরে রেখেছে।

মাদাম এবার মুখ খুললেন, বললেন, আমরা পাহাড়ের কোনো গোলকধাঁধায় লুকিয়ে আছি, তা তারা জানবে কি করে? আমাদের যা বিস্তর রসদ আছে, তাতে আমরা বছরের পর বছর এখানে কাটিয়ে দিতে পারব।

–সেটাও পারবেন না মাদাম। এরকুলের ঘর থেকে বেরোবার সময় আমি জুতোর তলায় বেশ খানিকটা তাৰ্পিন তেল মাখিয়ে এনেছিলাম। হোটেল থেকে শুরু করে এই গুপ্ত ঘাঁটি পর্যন্ত সারা পথে উগ্র তেলের গন্ধে পুলিশ কুকুরের পৌঁছতে দেরি হবে না।

মাদামের চোখ ঝলসে উঠল। চাপা গলায় বললেন, ডিনামাইট দিয়ে এই পাহাড়টাকে উড়িয়ে দেব আমরা। নিজেরা মরব, তার সঙ্গে তোমাদেরও মারব।

এরপর দূর থেকে একটা কোলাহল ভেসে এল। একটা লোক দৌড়ে ঘরে ঢুকে রাইল্যাণ্ডকে কি যেন বলল। রাইল্যাণ্ড, অলিভিয়ের বেরিয়ে গেলেন। চারনম্বর রসাঁকোফের হাতে একটা পিস্তল দিয়ে বলল, পুলিশের লোক জমায়েত হচ্ছে। আমাদের ঘাঁটিটা উড়িয়ে দিতে হবে। আপনি পাহারায় থাকুন। আমি ল্যাবরেটরীতে যাচ্ছি। চারনম্বর চলে গেল।

কী মনে করে কাউন্টেস আকিলের মুখখানাকে বেশ ভালো করে দেখে হেসে উঠে বললেন, মঁসিয়ে আকিল পোয়ারো, আপনার বুদ্ধির সত্যিই তুলনা হয় না।

আকিল বুদ্ধির প্রসঙ্গটাকে এড়িয়ে গিয়ে বললেন, মাদাম সময় বিশেষ নেই। আসল কথাটা সেরে নেওয়া যাক, বলুন আপনার দাম কত?

দাম? আমার আবার দাম কি?

-মাদাম এখন ছলনার সময় নয়। কী দাম পেলে আপনি এই গুপ্তঘাঁটি থেকে আমাদের বাইরে নিয়ে যাবেন?

টাকা দিয়ে আমাকে কিনতে চান? না মঁসিয়ে আমার টাকার দরকার নেই।

আপনার যেকোন ইচ্ছা পূরণ করার জন্যে আমি প্রস্তুত। বলুন মাদাম বলুন, তাড়াতাড়ি।

কী চাই আমি? হাসি থামিয়ে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে কাউন্টেস বললেন, যাই চাই তা কি আপনি দিতে পারবেন?

-পারব মাদাম, বলুন।

-আপনি কি আমার শত্রুদের শাস্তি দিতে পারবেন? আপনি কি আমার বিগত যৌবনকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন? আপনি কি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন? হো হো করে আবার হেসে উঠলেন রসাকোফ।

আকিল কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে বললেন, আপনার তিনটি ইচ্ছার একটি আমি পূর্ণ করব বলুন কোনো ইচ্ছা আপনি পূর্ণ করতে চান?

–আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন?

–দেব। আপনি যদি আমাদের এখান থেকে বের করে নিয়ে যান, তাহলে আপনার ছেলেকে আমি ফিরিয়ে এনে দেব।

-মঁসিয়ে আমার ছেলে বেঁচে নেই, সে মৃত, মরা ছেলেকে বাঁচাতে পারবেন?

–ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি, আপনার ছেলেকে আমি বাঁচিয়ে তুলব।

কাউন্টেস পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।

আকিল তাঁর ব্যাগ থেকে একটা ফটো বের করে নিয়ে রসাকোফকে বললেন, মাদাম, ফটোটা একবার দেখুন। আমার ব্যাগটা বের করুন।

কাউন্টেস মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকিলের কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা ব্যাগ বের করে আনলেন। তার ভেতর থেকে সত্যি সত্যিই একটা ফটো বার করে দেখলেন।

ফটোটা দেখার পর চেঁচিয়ে বলে উঠলেন রসাকোফ, কোথায়…কোথায় পেলেন এই ফটো?

–পরে বলব, আগে বাইরে নিয়ে চলুন।

 কাউন্টেস দ্রুত হাতে আমাদের বাঁধন খুলে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চললেন। সুড়ঙ্গপথ এখন পুলিশের ভয়ে অন্ধকার। কতক্ষণ হেঁটেছি তা মনে নেই। ঠিক এমনই সময় আমাদের চোখে পড়ল পুলিশের টর্চের আলো। তারা সুড়ঙ্গের প্রবেশ পথটা খুঁজে পেয়েছে। তারা আমাদের শত্রু ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

— আকিল বললেন, আমরা বন্ধু। বেরিয়ে পড়ুন। এখন ডিনামাইট দিয়ে ওরা ঘাঁটিটাকে উড়িয়ে দেবে! চলুন…শিগগির…।

বলতে না বলতেই প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণে পায়ে নিচের মাটিটা দুলে উঠল। আমি মূৰ্ছিত হয়ে পড়লাম।

জ্ঞান হবার পর দেখি হোটেলের ঘরে শুয়ে আছি। পাশে এরকুল।

এরকুল বলল, এক মিনিটের জন্যে আমরা বেঁচে গেছি।

 আমি অবাক হয়ে বললাম, কিন্তু আকিল পোয়ারো? তিনি কোথায়?

হো-হো করে হেসে উঠল এরকুল। বলল, কল্পনায় তার জন্ম হয়েছিল, কল্পনাতেই আবার মিলিয়ে গেছে।

–তার মানে?

-মানে আর কিছুই নয়। অমন ভাই আমার কখনও ছিল না। আসলে কাল আমি ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে আমার ঘরে গিয়ে গোঁফ কামিয়ে ফেলে একজোড়া নকল গোফ লাগাই। ঔষুধ লাগিয়ে চোখের রঙও পাল্টে ফেলি এবং আর কিছু ছোটখাটো রদবদল ঘটিয়ে মুখের নীচে মাফলার জড়িয়ে আমি লবিতে গিয়ে বসি। কাউন্টেসের চোখে পড়েছিল পরিবর্তনগুলো। তার ওপর ইচ্ছে করে ধরাগলায় কথা বলছিলুম। ঘাঁটিতে রসাকোফ যখন বলেন এ এরকুল নয়, তখন তুমিও বলে উঠলে যে, আমি আকিল পোয়ারো। আসলে তুমিও জানতে না আকিল বলে সত্যিই কেউ নেই। তাতে আমার সুবিধাই হলো। তুমি এমন জোর দিয়ে কথাটা বললে যে তাদের মনে কোনো সন্দেহই জাগল না।

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আমি বললাম, কিন্তু কাউন্টেস তো তোমাকে বহুদিন ধরে জানেন, তিনিও তো তোমার চালাকিটা ধরতে পারেননি।

মৃদু হেসে পোয়ারো বলল, প্রথমে পারেনি কিন্তু একটু বাদেই পেরেছিল। আবে রাইল্যাণ্ড, মাদাম অলিভিয়ের, চারনম্বর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে সে আমার আপাদ-মস্তক দেখে কী বলেছিলেন তোমার মনে আছে?

–আছে।

–তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, মঁসিয়ে আকিল পোয়ারো, আপনার বুদ্ধির সত্যিই কোনো তুলনা হয় না।

–তা না হয় হলো, কিন্তু মৃত ছেলেকে বাঁচিয়ে তোলা–এসব উদ্ভট কথার অর্থ কি?

-ঐ তো মজা, পোয়ারো বলল, কাউন্টেসের ছেলে মোটেই মারা যায়নি। ছেলেটা আমার এক বন্ধুর কাছেই থাকে। আর দু-একদিনের মধ্যেই তিনি তাকে ফিরে পাবেন।

–অর্থাৎ?

বছর কয়েক আগে কাউন্টেস রাশিয়ায় ছিলেন, সেইসময় ছেলেটি হারিয়ে যায়। রটে গিয়েছিল যে, কাউন্টেসের শত্রুরা তার ছেলেটিকে হত্যা করেছে। কাউন্টেসও সেটা বিশ্বাস করেছিল।

–এতদিন বাদে তুমি কি করে তার সন্ধান পেলে?

–সহজে পাইনি, পোয়ারো বলল, তার জন্যে অনেক কষ্টে আমার শত্রুদের অতীত ইতিহাস খুঁজে বার করতে হয়েছে। এরজন্যে আমি তোক লাগিয়েছিলুম। কাউন্টেসের ছেলেটিকে আসলে তারই এক শত্রু আঁটকে রেখেছে। প্রচুর টাকা খরচ করে, এক রাশিয়ানকে মোটা অঙ্কের চেক দিয়ে তাকে আমি উদ্ধার করার ব্যবস্থা করেছিলুম। তারপর ছেলেটাকে উদ্ধার করে এনে বেলজিয়ামে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে রাখবার ব্যবস্থা করি। তার একটা ফটো আমি তুলে রেখেছিলাম। জানতাম কখনও না কখনও কাউন্টেসের কাছে আমাকে সাহায্য নিতে হবে, তাই ফটোটা সবসময় সঙ্গে রাখতুম।

–তোমার তুলনা হয় না এরকুল, আমি বিভোরের মত বলে উঠলাম। একটু লজ্জিত হলো পোয়ারো।

বলল, না না, আমি কি আর এমন করেছি। এখন আমার কাউন্টেসের ওপর কোনো বিদ্বেষ নেই, আমার যুদ্ধ চতুরঙ্গের সঙ্গে। কাউন্টেস সেদিন ঐ বিস্ফোরণে পড়লে আমি সত্যিই দুঃখ পেতাম।

-কিন্তু পোয়ারো চতুরঙ্গের কি হলো বলো তো?

–বিস্ফোরণে সবাই মারা গেছে।

–আর লি-চ্যাং-ইয়েন? সে তো ঐ গুপ্তঘাঁটির মধ্যে ছিল না। তার কি হলো?

পোয়ারো রহস্যের হাসি হাসল।

সে বলল, রক্ষা সেও পায়নি। সে ছিল চীনদেশে। এই একটু আগে রেডিওতে শুনলাম, সেইখানে সে আত্মহত্যা করেছে। চতুরঙ্গের চক্রান্তের ব্যর্থতার খবরে ভেঙে পড়ে আত্মহত্যা করেছে।

একটুক্ষণ চুপ করে রইল পোয়ারো। বলল, কি যে করবো এখন তাই ভাবছি।

-সেকি? তোমার আবার কাজের অভাব হয় নাকি? –না না, দীর্ঘশ্বাস ফলে পোয়ারো বলল, এরকুল পোয়ারোর কখনও কাজের অভাব হয় না। কিন্তু চতুরঙ্গের কেসটাই ছিল আমার জীবনের সবচাইতে বড় রহস্যভেদ। এর পরে অন্য আর সব রহস্যই বড় ফিকে লাগবে।