৩৩. কলিকাতার অবস্থা

কলিকাতার অবস্থা তখন বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের মত। সভা-সমিতি, শোভাযাত্রায় জাতির জীবনচ্ছাস বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের উচ্ছ্বসিত তরঙ্গের মত ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতেছিল। স্বেচ্ছাসেবকের দল দলের পর দল, শাসনতন্ত্রের দুর্গপ্রাচীরমূলে আঘাত করিতে দুর্বার স্রোতের মত ছুটিয়া চলিয়াছে। মহানগরীর ঘরে ঘরে প্রতিটি নরনারীর সর্বাঙ্গে, প্রতিটি রোমকূপে তীব্র শিহরন বহিয়া চলিয়াছে। তবুও আনুপাতিক সংখ্যায় অধিকাংশ গৃহদ্বার রুদ্ধ, সমুদ্রগর্জনের মত আহ্বান সত্ত্বেও অধিকাংশ মানুষই সভয়ে মূক হইয়া আছে।

ইহারই মধ্যে আবার একদল আছেন, যাহারা এই জীবনোম্ফাসকে অভিসম্পাত দেন, ঘরের মধ্যে সমধর্মী কয়েকজনে মিলিয়া তীব্র সমালোচনা করিয়া এই আন্দোলনকে আত্মঘাতী প্ৰতিপন্ন করিয়া তোলেন। ইহাদের সকলেই ধনী, অনেকে জমিদার, প্রত্যেকেই সমাজে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। বিপ্লবের কলরোলে ইহাদের স্নায়ুমণ্ডলী সূক্ষ্ম ধাতব তারের মত ঝনঝন করিয়া ওঠে। বিপ্লবের ভাবী রূপ কল্পনা করিয়া ইহারা শিহরিয়া ওঠেন, মনশ্চক্ষে প্রত্যক্ষ যেন দেখিতে পান, বিপ্লবের প্রবল তাওবে এই বর্তমান অতীতের মধ্যে বুদ্বুদের মত মিলাইয়া যাইতেছে, সেই বর্তমানের সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের জীবনের সবকিছুও যেন হারাইয়া যায়।

রামকিঙ্করবাবুরা এই দলের লোক। একাধারে তাহারা ধনী এবং জমিদার, তাহার ওপর জেলার উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী-মহলে সুপরিচিত এবং সমাদৃত ব্যক্তি। ভাবীকালে প্রচুর মানসম্মানের প্রত্যাশা তাহাদের অলীক নয়, ইহা সর্ববাদিসম্মত; সুতরাং তাহাদের মতবাদ এমন হওয়াই স্বাভাবিক। পথে শোভাযাত্রার কলরবে ধ্বনিতে রামকিঙ্করবাবুর ললাটে কুঞ্চনরেখা দেখা দেয়। সেই বিরক্তির সংস্পর্শ ক্রমে ক্রমে সমগ্র বাড়িতে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, বাড়ির মেয়েরা পর্যন্ত বিরক্তিভরে বলে, মরণ হতভাগাদের, যত সব মায়ে খেদানো বাপে তাড়ানোর দল। কাজ নেই, কন্ম নেই, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গেলেন।

একজন হাসিয়া বলে, না চেঁচালে ধরবে না যে পুলিশে। বাইরে খেতে পায় না, জেলে গেলে তবু কিছুদিন খেয়েদেয়ে বাঁচবে।

অন্য একজন বলে, দেবে যেদিন গুলি করে মেরে, সেইদিন হবে।

এ সমস্তই তাহাদের শোনা কথা, শেখা বুলি।

কিন্তু তবু পথে ধ্বনি উঠিলেই বারান্দায় তাহাদের ছুটিয়া যাওয়া চাই। বাড়ির সম্মুখেই বড় একটা পার্ক, সেখানে সভা হইলেই ছাদে উঠিয়া আরম্ভ হইতে শেষ পর্যন্ত না দেখিয়া তাহারা নিচে কিছুতেই নামে না। বক্তৃতার কতক তাহারা শুনিতে পায়, কতক পায় না, কিন্তু বাতাসের স্তরে স্তরে বক্তার এবং আবেগস্পন্দিত জনতার ক্ষুব্ধ জীবনের সংস্পৰ্শ তাহারা অনুভব করে। সভয় নির্বাক হইয়া তাহারা তখন মাটির পুতুলের মত দাঁড়াইয়া থাকে, ছোট ছোট ছেলেরা ছাদের আলিসার ফাঁকে মুখ রাখিয়া উঁকি মারিয়া দেখে, জনতার সঙ্গে সঙ্গে তাহারাও চিৎকার করে, বন্দে মাতরম্।

গৌরীর আড়াই বছরের শিশুটি অপটু জিহ্বায় বলে, বন্ডে মাটর। মাঝে মাঝে শব্দটা সে ভুলিয়া যায়, তখন সে ছুটিয়া মায়ের কাছে আসিয়া বলে, বন্ডে–, বল।

গৌরী বলে, ও বলতে নেই, ছি!

ছেলে কাঁদে, বলে, না, বল।

অগত্যা গৌরী বলে, বন্দে মাতরম্।

খুশি হইয়া শিশু আপন মনেই মুখস্থ করে, বন্ডে মাটর, বন্ডে মাটরম্‌।

সেদিন কমলেশ হঠাৎ শিশুর চিৎকার শুনিয়া ঠোঁট বাঁকাইয়া হাসিয়া বলিল, বাঃ! এই যে বাপকা বেটা সিপাইকা ঘোড়া, বেশ বুলি বলছে।

গৌরী ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল, কমলেশের কথাটা তাহাকে অত্যন্ত তীক্ষ্ণভাবে আঘাত করিল, সে বলিল, ছোট ছেলেতে যা শোনে, তাই শেখে, তাই বলে। তাতে আবার দোষ আছে নাকি? এই তো বাড়ির সকল ছেলেতে বলছে, দোষ হল আমার ছেলের?

কমলেশ হাসিতে হাসিতেই বলিল, অন্য ছেলের বলা আর তোর ছেলের বলায় তফাত আছে গৌরী। কেমন বাপের বেটা! ওর বাপ হল স্বদেশপ্ৰাণ, মহাপ্ৰাণ, মহাপুরুষ ব্যক্তি। তোর ছেলেও দেখবি, ঠিক তাই হবে। এও একটা গ্ৰেটম্যান-ট্রেটম্যান কিছু হবে আর কি। দেখিস নি, ছেলের গো কেমন?

গৌরীর আঁচল ধরিয়া নাচিতে নাচিতে ছেলেটা তখনও চিৎকার করিতেছিল, বন্ডে মাটর। গৌরী সজোরে তাহার পিঠে একটা চড় কষাইয়া দিয়া বলিল, কাপড় ধরে টানছি, কাপড় ছিঁড়ে যাবে যে! হতভাগা ছেলে মলে যে খালাস পাই।

কমলেশ অপ্রস্তুত হইয়া একরকম পলাইয়া গেল। ছেলের কান্নার শব্দ পাইয়া ও-ঘর হইতে গৌরীর দিদিমা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হইয়া গৌরীকে তিরস্কার করিয়া উঠিলেন, এই হারামজাদী নান্তি, ছেলেকে মারছিস কেন, শুনি? কেন তুই ছেলেটিকে এমন যখন-তখন মারিস? হারামজাদী পাজি মেয়ে কোথাকার! মাগিরি ফলানো হচ্ছে নাকি?

প্রথম প্রথম গৌরী শঙ্কিত হইয়া ক্ষান্ত হইত। তাহাকে তিরস্কারের অন্তরালে তাহার সন্তানের প্রতি দিদিমার স্নেহ অনুভব করিয়া সান্ত্বনা পাইত, শান্ত হইত। কিন্তু আজকাল আর সে শঙ্কিতও হয় না, সান্ত্বনাও পায় না, বরং সে আরও উগ্র হইয়া সমানে ঝগড়া শুরু করিয়া দেয়। আজও সে উগ্রভাবে বলিয়া উঠিল, বেশ করব মারব, আমাকে জ্বালাচ্ছে, আমি মারছি, শাসন করছি। আদর দিয়ে ছেলের মাথা খাওয়ার মত অবস্থা তো আমার নয়। ছেলেকে আমাকে মানুষ করতে হবে।

ঝগড়া এমন ক্ষেত্রে প্রায়ই প্রচণ্ড হইয়া ওঠে, শেষ পর্যন্ত গৌরীর দুরন্ত অভিমান ভাঙাইতে আসিতে হয় রামকিঙ্করবাবুকে। তাঁহার কথায় গৌরী আজও সান্ত্বনা পায়, শান্ত হয়। রামকিঙ্করবাবু ঘটা করিয়া সেদিন মেয়েদের থিয়েটারে পাঠাইয়া দেন, কিংবা আপিসের ফেরত কতকগুলো ভাল কাপড়চোপড়, কোনোদিন বা একখানা গহনা আনিয়া গৌরীকে দেন। সেদিন সমস্ত রাত্রি গৌরীর বিনিদ্ৰ নয়নে কাটিয়া যায়, নানাভাবে ঘুরিয়া ফিরিয়া একটি কল্পনাই তাহার মনোলোকে ভাসিয়া ওঠে, সে কল্পনা করে আপনার মৃত্যুশয্যার, সে যেন মৃত্যুশয্যায় শায়িতা, আর তাহার শয্যায় বসিয়া আছে সে। তাহার বুক ভাসাইয়া চোখের জল ঝরিয়া পড়িতেছে, বলিতেছে, আমাকে ক্ষমা কর। কখনও সে ভাবে সে তাহাকে হাসিমুখে ক্ষমা করিল; কখনও ভাবে, সে বিরক্তিভরে পাশ ফিরিয়া শুইল, তাহার আগমন সংবাদ শুনিবামাত্র সে বলিল, না না না, তাহাকে আমি দেখিব না, দেখিতে চাই না। কল্পনার সঙ্গে সঙ্গে দারুণ উত্তেজনায় সে বিছানার মধ্যে রোগগ্রস্তার মত চঞ্চল অস্থির হইয়া ওঠে, তাহার নড়াচড়ায় ছেলেটি জাগিয়া কাঁদতে আরম্ভ করে। গৌরী দুর্দান্ত ক্রোধে আবার ছেলেকে পিটিয়া চিৎকার করিয়া হাট বাঁধাইয়া বসে, কোনো দিন বা ব্যাকুল স্নেহে ছেলেকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া অঝোরে কাঁদিতে আরম্ভ করে।

আজিকার কলহও ঠিক সেই খাতের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইয়া সেই অবশ্যম্ভাবী পরিণতির দিকেই চলিয়াছিল, কিন্তু আকস্মিক একটা বিপরীতমুখী জলোচ্ছাস আসিয়া সে স্রোতোবেগের গতি রুদ্ধ করিয়া দিল। গৌরীর দিদিমা গৌরীর কথার একটা উত্তর দিতে উদ্যত হইয়াছিলেন, সে মুহূর্তটিতেই গৌরীর এগার-বার বৎসরের মামাতো ভাই ছুটিয়া আসিয়া বলিল, ঠাকুমা, গৌরী-দিদির বরকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।

তড়িতাহতের মত মুহূর্তে গৌরী যেন পঙ্গু মূক হইয়া গেল। কয়েক মিনিটের জন্য গৌরীর দিদিমার মুখেও কথা ফুটিল না। কয়েক মিনিট পরে তিনি সরবে কাঁদিয়া উঠিলেন, এ কি হল আমার, মাগো! এ আমি কী করেছি গো!

ছেলেটি বলিল, তার আর কাদলে কী হবে? যেমন কৰ্ম তেমনই ফল, গভর্নমেন্টের সঙ্গে চালাকি!

রাখাল সিং-ই সংবাদটা লইয়া ছুটিয়া আসিয়াছিলেন। শিবনাথের ওপর অভিমান করিয়া তিনি সেই দিনই বাড়ি চলিয়া গিয়াছিলেন, কিন্তু একটা দিনও বাড়িতে স্থির হইয়া থাকিতে পারেন নাই। তৃতীয় দিনের দিন স্থির করিলেন, বউমাকে লইয়া আসিবেন। সেই দিনই রওনা হইয়া কলিকাতায় আসিয়া রামকিঙ্করবাবুর নিকট যাহাকে বলে গড়াইয়া পড়া—সেই গড়াইয়া পড়িলেন। রামকিঙ্করবাবুর পা দুইটি জড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন, রক্ষে করুন বাবু, বউমাকে পাঠিয়ে দেন, নইলে সর্বনাশ হল।

রামকিঙ্করবাবু চমকিয়া উঠিলেন, তিনি ভাবিলেন, শিবনাথের বোধহয় অসুখবিসুখ কিছু করিয়াছে, তিনি সভয়ে প্রশ্ন করিলেন, কী হয়েছে রাখাল সিং? শিবনাথ–

সর্বনাশ হয়েছে বাবু, শিবনাথবাবুকে পুলিশে ধরেছে।

পুলিশে?

হ্যাঁ, বাবু। ধরেছিল, একবার ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু আর ছাড়বে না। আর বাবুও কিছুতে কারও মানা শুনবেন না। সে যেন একেবারে ধনুকভাঙা পণ।

রামকিঙ্কর বুঝিয়াও বুঝিতে চাহিতেছিলেন না। বিশ্বাস করিতে মন পীড়িত হইতেছিল। তাই তিনি প্রশ্ন করিলেন, ফৌজদারি কার সঙ্গে?

আজ্ঞে না, ফৌজদারি নয়, স্বদেশী হাঙ্গামা।

হুঁ। দীর্ঘ সুরে হুঁ বলিবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন।

বউমাকে পাঠিয়ে দেন বাবু, তিনি গিয়ে পড়লে হয়ত ক্ষান্ত হবেন। তিনি বললে, তিনি কদলে, বাবু কখনও স্থির থাকতে পারবেন না।

আপনার কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনায়, এই তরলমস্তিষ্ক অবাধ্য জামাতা,টর প্রতি ক্ৰোধে রামকিঙ্করবাবুর সমস্ত অন্তর তিক্ততায় ভরিয়া উঠিল। ইচ্ছা হইল, একবার তাহার সহিত মুখামুখি দাঁড়াইতে, আরক্ত দৃষ্টি হানিয়া তাহাকে মাটির সঙ্গে মিশাইয়া দিতে। অকস্মাৎ তাহার মনে পড়িয়া গেল আর একদিনের কথা। হ্যারিসন রোডের ফুটপাতের উপর তিনি এমনই দৃষ্টিই হানিয়াছিলেন শিবনাথের ওপর, কিন্তু তরুণ কিশোর ছেলেটি অনায়াসে সে দৃষ্টিকে তুচ্ছ বস্তুর মত উপেক্ষা করিয়া তাহাকে অতিক্ৰম করিয়া চলিয়া গিয়াছিল। ক্রোধ তাহার বাড়িয়া উঠিল, রাখাল সিংকেও তিনি যেন আর সহ্য করিতে পারিতেছিলেন না। ঠিক এই সময়টিতে উপরে তাহার মা—গৌরীর দিদিমা কাঁদিয়া উঠিলেন। কান্না শুনিয়া তিনি দ্রুতপদে উপরে উঠিয়া গেলেন, তাহাকে দেখিবামাত্র গৌরীর দিদিমা কাঁদিতে কাঁদিতে বলিয়া উঠিলেন, নান্তিকে আমার জলে ভাসিয়ে দিলি বাবা! তার কপালে কি শেষে এই ছিল বাবা!

রামকিঙ্করবাবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, কই, নান্তি কই? রামকিঙ্করবাবুর ভাইপো, সেই সংবাদদাতা ছেলেটি বলিল, ছাদে উঠে গেল এখুনি।

গৌরীর জীবনে এমন একটা অবস্থা কখনও আসে নাই। এক দিক দিয়া তাহার প্রচণ্ড অভিমান আহত হইল এই ভাবিয়া যে, শিবনাথ তাহাকে উপেক্ষা করিয়া, তাহার সহিত সম্বন্ধ। একেবারে শেষ করিয়া দিবার জন্যই, এমন করিয়া অন্ধকূপের মধ্যে পচিয়া, বোধ করি নিজেকে নিঃশেষে শেষ করিতে চলিয়া গেল। আর এক দিক দিয়া হইল তাহার প্রচণ্ড লজ্জা। এই পরিবারের সংস্কৃতি ও রুচির সংস্পর্শে গঠিত মনের বিচারবুদ্ধিতে জেলে যাওয়ার মত লজ্জা যে আর হয় না! একেই তো জীবনে তাহার লজ্জার অবধি নাই। যখন তাহার ভাই এবং ভগ্নীপতির দল হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জনের পথে সগৌরবে সদম্ভে অগ্রসর হইয়া চলিয়াছে, তখন তাহার স্বামী কোন্ অখ্যাত নিবিড় পল্লীর মধ্যে চাষীর মত চাষ করিতেছে! এই সুসজ্জিত মহানগরীর রাজপথে মহাৰ্ঘ পরিচ্ছদ পরিয়া যে মানুষের দল শোভাযাত্ৰা করিয়া চলিয়াছে, তাহাদের তুলনায় হতশ্ৰী পল্লীর মধ্যে রৌদ্রদগ্ধমুখ তাহার স্বামীকে কল্পনা করিয়া লজ্জায় তাহার। মাথা হেঁট হইয়া পড়ে। সে লজ্জার উপরে এই লজ্জার বোঝা সে সহিবে কেমন করিয়া?

সম্মুখেই রাজপথের উপর জনস্রোত চলিয়াছে। সহসা তাঁহার কাছে সেসব যেন অর্থহীন। বলিয়া মনে হইল, পার্কের গাছপালা, চারিপাশের বাড়িঘর সব যেন আজ নিরর্থক হইয়া গেল। এমনকি আকাশ হইতে মাটি পর্যন্ত দৃশ্যমান প্রকৃতিরও কোনো আবেদন তাহার মনের দুয়ারে আসিতেছে না। কিছুক্ষণ পর সহসা একটা গানের সুর তাহার কানে আসিয়া পৌঁছিল, কোন দূরদূরান্তরের ডাকের মত। ধীরে ধীরে দৃষ্টি শব্দধ্বনি অনুসরণ করিয়া ফিরিল; গৌরী দেখিল, একদল। স্বেচ্ছাসেবক শোভাযাত্ৰা করিয়া আসিতেছে, তাহারাই গান গাহিতেছে। ধীর পদক্ষেপে সারি সারি তাহারা অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। এদিকে রাস্তার মোড়ের উপর একদল পুলিশ আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।

আবার অদ্ভুত একটা অনুভূতি গৌরী এই মুহূর্তে অনুভব করিল। কেমন করিয়া জানি না, তাহার দৃষ্টি এতদিন যাহা দেখিয়াছে, সহসা তাহার বিপরীত দেখিল। আজ আর সে এই স্বেচ্ছাসেবকগুলির মুখে উচ্ছঙ্খলতার ছাপ দেখিতে পাইল না, দস্যুর মত কঠোর নিষ্ঠুরতা দেখিতে পাইল না; সে যেন স্পষ্ট দেখিল, বীর্যে সাহসে মহিমায় কিশোর দেবতাদলের মতই। ইহারা মহিমান্বিত। কোটি কোটি নরনারীর বিস্ময়বিমুগ্ধ শ্রদ্ধান্বিত দৃষ্টি তাহাদের আরতি করিয়া ফিরিতেছে।

তাহার মামাতো ভাইটি আসিয়া তাঁহার এই অভিনব বিচিত্র অনুভূতির ধ্যান ভাঙিয়া দিল, বলিল, জ্যাঠামশাই ডাকছে তোমাকে গৌরীদি।

গৌরী সচেতন হইয়া অনুভব করিল, তাহার অন্তর যেন কত লঘু হইয়া গিয়াছে, এক বিন্দু লজ্জার প্রভাবও আর নাই। সে মাথা উঁচু করিয়াই হাসিমুখে নিচে নামিয়া আসিল। রামকিঙ্করবাবু চিন্তাকুল মুখেই মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করিতেছিলেন, গৌরী আসিয়া কাছে দাঁড়াইয়া অকুণ্ঠিত

অথচ কন্যাসুলভ লজ্জার সহিতই বলিল, বড়মামা, আমি বন্দর শ্যামপুর যাব।

তাহার মুখের দিকে চাহিয়া সবিস্ময়ে রামকিঙ্করবাবু বলিলেন, শ্যামপুর।

হ্যাঁ।

রামকিঙ্করবাবু বলিলেন, তাই যাও। কমলেশ সঙ্গে যাক তোমার, তুমি শিবনাথকে রাজি করিও, কমলেশ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে ধরে সব ঠিক করে দেবে। কিছু ভেবো না তুমি।

 

ট্রেনে উঠিয়া গৌরী যেন বাঁচিয়া গেল। ইন্টার-ক্লাস ফিমেল কম্পার্টমেন্টে সে খোকাকে লইয়া একা। কমলেশ আপত্তি করিল, কিন্তু গৌরী বলিল, না, এতেই আমি ভাল যাব। বেটাছেলেদের সঙ্গে সমস্ত রাস্তা ঘোমটা দিয়ে প্রাণ আমার হাঁপিয়ে উঠবে।

নিৰ্জন কামরাটার ভিতর সে যেন পরম সান্ত্বনা অনুভব করিল। এমনই একটি নির্জনতার মধ্যে আপনাকে অধিষ্ঠিত করার যেন তাহার প্রয়োজন ছিল। অকস্মাৎ সমস্ত সংসারের রঙ বদলাইয়া গিয়াছে। দৃশ্যমান প্রকৃতির খণ্ডাংশ হইতে আপনার অদৃশ্য মর্মলোক পর্যন্ত সমস্ত কিছু আজ যেন নূতন কথা কহিতেছে। হু-হু করিয়া ট্রেন ছুটিয়া চলিয়াছে, জানালার বাহিরে দিগন্তপ্রসারী সবুজ শস্যসমৃদ্ধ মাঠ পিছনের দিকে ছুটিয়াছে। এই মাঠ তাহার বরাবরই ভাল লাগে, কিন্তু আজিকার ভাল লাগার আস্বাদনের অর্থ সম্পূর্ণ বিভিন্ন। সবুজ শস্যের গাছগুলির মধ্যে সে আজ জীবনকে যেন স্পষ্ট অনুভব করিল। উহাদেরও জীবন আছে, হেলিয়া দুলিয়া উহারাও যেন কথা কয়। আবার এই শস্যসম্ভারের অন্তরালে আছে মাটি। মাটিও আজ তাহার কাছে নূতন রূপে ধরা দিল। সে মাটি ধুলা নয়, কাদা নয়, যাহাকে মানুষ ঝাড়িয়া ফেলে, ধুইয়া দেয়। যে মাটির বুকে ফসল ফলিয়া ওঠে, যে মাটির বুকে প্রাণফাটা দুঃখে পড়িয়া পড়িয়া কাঁদিতে ভাল লাগে, এ মাটি সেই মাটি। যে মাটির বুকে মানুষ ঘর গড়িয়া তুলিয়াছে, এ মাটি সেই মাটি। সঙ্গে সঙ্গে তাহার মনে পড়িয়া গেল আপনার ঘর। কমলেশের ঘর নয়, শিবনাথের ঘর। সে ঘরের প্রতি প্রগাঢ় মমতা সে আজ অনুভব করিল। কেমন করিয়া এমন হইল, সে ভাবিবার তাহার অবসর ছিল না, ব্যগ্রতা ছিল না, এই হওয়াটাই সে যেন কতদিন হইতে চাহিয়াছে, এই সংঘটন না ঘটাতেই, এর পাওয়া না পাওয়াতেই সে অস্থিরতায় অশান্তিতে জ্বলিয়াছে। ঘর ছাড়িয়া বাহিরে ঘুরিয়া মরিয়াছে, আপন ছাড়িয়া পরের আশ্রয়ে আপনাকে অপমানিত করিয়াছে। গাড়ির গতির চেয়েও বহুগুণ দ্রুততর গতিতে মন তাহার ছুটিয়া চলিয়াছিল, শিবনাথকে সে সর্বাগ্রে প্রণাম করিবে। ক্ষমা চাহিবার প্রয়োজনও তাহার মনে হইল না। প্রণামের পরই সে তাহার কণ্ঠলীনা হইয়া বুকে মুখ লুকাইবে। খোকাকে তাহার কোলে তুলিয়া দিবে। ঘুমন্ত খোকাকে তুলিয়া লইয়া সে বুকে জড়াইয়া ধরিল। খোকা জাগিয়া উঠিল।

গভীর ধ্যানমগ্নার মতই সে গাড়ি হইতে নামিয়া গাড়ি বদল করিল।

প্রায় সন্ধ্যার মুখে গাড়ি আসিয়া দাঁড়াইল বন্দর শ্যামপুরে। কমলেশ তাড়াতাড়ি গৌরীকে নামাইয়া জিনিসপত্র প্ল্যাটফর্মের উপর নামাইয়া ফেলিল। জিনিসপত্র নামানো শেষ করিয়া সে চারিদিকে চাহিয়া বিস্মিত না হইয়া পারিল না, একদল কিশোের ইহারই মধ্যে গৌরীকে ঘিরিয়া ফেলিয়াছে, তাহারা প্রত্যেকে গৌরীর পায়ের ধূলা লইয়া প্ৰণাম করিতেছে। স্টেশনের বাহির হইতেও কয়েকজন ছুটিয়া আসিতেছে। একজনকে কমলেশ চিনিল, সে শ্যামু। সে ভিড় ঠেলিয়া গৌরীর দিকে অগ্রসর হইল।

কমলেশ বিরক্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, এ কী, ব্যাপার কী?

শ্যামু অহঙ্কৃত কণ্ঠেই উত্তর দিল, কাল শিবনাথদা গ্রেপ্তার হয়েছেন। আমরা এবার পাঁচ জন। তৈরি হয়েছি গ্রেপ্তার হবার জন্যে।

কমলেশ শঙ্কিত হইয়া ব্যস্তভাবে গৌরীর হাত ধরিয়া বলিল, গৌরী, আয় আয়, বাইরে আয়। ভিড় ছাড় মেরা, ভিড় ছাড়।

মৃদুস্বরে গৌরী উত্তর দিল, হাত ছাড়, আমি যাচ্ছি।

কমলেশ বলিল, সিংমশায়, জিনিসপত্র আমাদের বাড়িতেই পাঠিয়ে দিন তা হলে!

গৌরী বলিল, না। এ বাড়িতেই যাব আমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *