৮.৫ বাইতুল মুকাদ্দাস বিজয়

বাইতুল মুকাদ্দাস বিজয়

সমুদ্রের নিঃসঙ্গ ও নিরানন্দ জীবনে মেয়ে দুটো আল-ফারেসকে নব জীবন দান করতে শুরু করেছে। কিন্তু একদিকে মেয়ে দুটো যেমন আল ফারেসের জন্য রহস্যময় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, তেমনি আল ফারেসও তাদের কাছে এক বিস্ময়কর পুরুষে পরিণত হয়েছেন। মেয়েরা বলেছিলো, তারা যাযাবর। তাদের গোত্রের সব মানুষ যুদ্ধের কবলে পড়ে মারা গেছে এবং তারা অনেক কষ্টে লুকিয়ে লুকিয়ে নদীর তীর পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। কিন্তু আল-ফারেস দেখতে পাচ্ছেন, তাদের স্বভাব-চরিত্র, চলন-বলন ও রীতি-নীতি যাযাবরদের মতো নয়। যাযাবর মেয়েরা রূপসী হতে পারে; কিন্তু এদের মধ্যে যে রুচিশীলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে না। তাছাড়া এদের মধ্যে যেটুকু অশ্লীলতা দেখা যাচ্ছে, যাযাবর মেয়েরা সাধারণত এমন বেহায়া হয় না।

মেয়েদের জন্য আল-ফারেস এক বিস্ময়কর পুরুষ। তাদের আশা ছিলো, তিনি তাদের সঙ্গে সেই আচরণই করবেন, যেমনটি অন্য পাঁচ দশজন মুসলমান করেছিলো। ফলে মেয়ে দুটো প্রথম প্রথম নিরাশই হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা আল-ফারেসের অন্য একটি দুর্বলতা আন্দাজ করে নেয়। তা হচ্ছে, নোকটা দায়িত্বের ক্ষেত্রে যতোটা কর্তব্যপরায়ণ, অবসরে ততোটা অবোধ শিশুতে পরিণত হয়ে যান। তিনি মেয়েদের সঙ্গে সমবয়সী বান্ধবীর ন্যায় খেলতে শুরু করেন এবং তাদের রূপ-লাবণ্য থেকে স্বাদ উপভোগ করেন। তিনি তাদের বিক্ষিপ্ত রেশমি চুলে বিলি কাটেন, তাদের মাঝে হারিয়ে গিয়ে দুনিয়ার কথা ভুলে যান।

একদিনের ঘটনা। এক মেয়ে আর আল-ফারেন্স কক্ষে উপবিষ্ট। অপরজন বাইরে কোথাও গেছে। মেয়েটি আল-ফারেসের চেতনাকে উত্তেজিত করতে কিংবা লোকটার মধ্যে চেতনা বলতে কিছু আছে কিনা, জানবার চেষ্টা করে। আল-ফারেস তার খোঁচাটা বুঝে ফেলে বললেন–প্রথম দিন যখন আমি তোমাদেরকে বলেছিলাম, আমি জাহাজে তোমাদেরকে আশ্রয় দিতে পারি, তখন তোমরা বলেছিলে, দয়া করে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করবেন না। আমি বলেছিলাম, তোমাদেরকে মিসর নিয়ে যাবো এবং বিয়ে করবো। আমি আমার সেই প্রতিশ্রুতির উপর অটল থাকতে চাই। বিবাহ না করা পর্যন্ত আমি তোমাদের সঙ্গে এমন আচরণ করবো না, যা থেকে তোমাদের মনে সন্দেহ জাগ্রত হবে। আমি সাময়িকভাবে মনোরঞ্জনের জন্য তোমাদেরকে এখানে এনেছি। আমি তোমাদের অসহায়ত্ব থেকে লাভবান হতে চাই না। মিসর রওনা হওয়া পর্যন্ত তোমরা চিন্তা করো। যদি আমার সঙ্গে থাকা পছন্দ না করো, তাহলে যেখানে বলবে পৌঁছিয়ে দেবো।

সহসা মেয়েটি আবেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আল-ফারেসের গলা জড়িয়ে ধরে এবং তার গালে নিজ গালের পরশ বুলিয়ে বলে ওঠে আমরা তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। তোমাকেই প্রথম পুরুষ পেলাম, যার হৃদয়ে মানবতার পবিত্রতা আছে এবং যার মনোজগত শয়তানি চরিত্র ও পশুত্ব থেকে মুক্ত।

মেয়েটি এমন ভাষায় ও এমন ধারায় প্রেম নিবেদন করে যে, পানির উপর সন্তরমান জাহাজটা আল-ফারেসের নিকট শূন্যে উড়ে বেড়াচ্ছে বলে মনে হলো। এটিই তার দুর্বলতা, মানবীয় স্বভাবের সবচে বেশি বিপজ্জনক দোষ। দীর্ঘ সময় দিনরাত সমুদ্রে টহল দান এবং মাঝে-মধ্যে ছোটখাটো সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার ফলে তার দেহে যে ক্লান্তি ও হৃদয়ে যে অবসাদ নেমে এসেছিলো, এক রূপসী যুবতীর দেহের পরশ ও প্রেম নিবেদনে সব দূর হয়ে গেছে। আল-ফারেসের দেহ-মন এখন চাঙ্গা ও ঝরঝরে। এখন দায়িত্ব তার আগের তুলনায় বেশি। হাতে ছয়টি জাহাজের কমান্ড এবং ফিলিস্তীন কূলের সামান্য দূরে সতর্ক টহল দিয়ে ফিরছেন। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বিদ্যুতের ন্যায় ফিলিস্তীনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং তীরবর্তী অঞ্চলগুলো দখল করে নিয়েছেন। আর এখন আসকালানে এসে বাইতুল মুকাদ্দাস দখলে প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। আল-ফারেসের দায়িত্ব, সমুদ্র পথে খৃস্টানদের জন্য কোনো সাহায্য কিংবা রসদ ইত্যাদি আসলে তাকে তীর পর্যন্ত পৌঁছুতে না দেয়া। এই দায়িত্ব তার ঘুম হারাম করে রেখেছে। এখন মেয়ে দুটো তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার চেষ্টা করছে।

আল-ফাবেস একদিন মেয়ে দুটোকে বললেন- তোমাদের মধ্যে যাযাবরের স্বভাব নেই। তার স্থলে আমি তোমাদের মাঝে ভদ্রতা ও সামাজিকতা দেখতে পাচ্ছি। এসব কোথা থেকে আসলো?

আমরা উচ্চমানের খৃস্টান পরিবারে চাকুরি করেছি- এক মেয়ে উত্তর দেয়- তারা আমাদেরকে আতিথেয়তার রীতি-নীতি এবং উঁচু স্তরের মেহমানদের সঙ্গে আচার-ব্যবহারের পন্থা-পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন। আপনি যদি সাধারণ মানুষ হতেন, তাহলে আপনার সঙ্গে যাবাবরের ন্যায়ই আচরণ করতাম। আমাদের কথা-বার্তা ও চাল-চলন যাযাবরেরই মতো হতো। আপনি একটি দেশের নৌ-বাহিনীর এতো বড় একজন কমান্ডার এবং আপনার হৃদয়ে আমাদের এতো অধিক ভালোবাসা যে, আমরা আপনার সঙ্গে গেঁয়োর ন্যায় আচরণ করতে পারি না।

অপর পাঁচ জাহাজের ক্যাপ্টেনগণ জেনে গেছেন, তাদের কমান্ডার আল-ফারেস নিজ জাহাজে দুটি মেয়ে নিয়ে এসেছেন। শুনে সবাই মুখ টিপে হাসেন ও টিপ্পনি কাটেন। কিন্তু সবাই অনুভব করেন, যুদ্ধের সময় জাহাজে অচেনা-অপরিচিত মেয়েদের রাখা নিরাপদ নয়। প্রয়োজন হলে নিজ স্ত্রীকেই তো রাখা যায়। তারা বিষয়টি নিয়ে আল-ফারেসের সঙ্গে মতবিনিময়ও করেন। আল-ফারেস তাদের আশ্বস্ত করে দেন যে, কোনো সমস্যা হবে না। এদেরকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে মাত্র। সকলে জানেন, আল-ফারেস চরিত্রহীন মানুষ নন এবং কর্তব্যপরায়ণ কমান্ডার। আল ফারেসের উত্তরে তারা সহজেই সন্দেহমুক্ত হয়ে যান।

***

বাইতুল মুকাদ্দাসের অভ্যন্তরে বিরাজ করছে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। এখানকার মুসলমানদের উপর যে অত্যাচার-নিপীড়ন চলছিলো, তার তুলনা অন্তত ফিলিস্তীনের অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে নেই। এই নিপীড়নের ইতিহাস অনেক পুরনো। খৃস্টানরা ১০৯৯ সালে বাইতুল মুকাদ্দাস জয় করেছিলো। মুসলমানদের অনৈক্য, ক্ষমতার মোহ ও গাদ্দারীর ফল ছিলো এটা। ইতিহাসে বহু হানাদার শক্তির এর চেয়েও অনেক বড় গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড দখলের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ক্রুসেডাররা বাইতুল মুকাদ্দাস জয় করে তাকে এতো অধিক গুরুত্ব প্রদান করে, যেনো তারা অর্ধেক দুনিয়া জয় করে ফেলেছে। সমগ্র ইউরোপ এমনকি সমগ্র খৃস্টজগত ও পৃথিবীর তাবৎ গীর্জার দৃষ্টি বাইতুল মুকাদ্দাসের উপর নিবদ্ধ হয়ে পড়ে।

এই গুরুত্বের এক কারণ ছিলো, খৃস্টানরা বাইতুল মুকাদ্দাসকে তাদের পবিত্র স্থান মনে করতো। তাদের বিশ্বাস মতে, হযরত ঈসাকে (আ.) এ অঞ্চলেরই কোথাও শূলিবিদ্ধ করা হয়েছিলো। আরেক কারণ, বাইতুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের প্রথম কেবলা। রাসূলুল্লাহ (সা.) এখান থেকেই মিরাজে গমন করেছিলেন। এ কারণে মসজিদে আকসার গুরুত্ব ও মাহাত্ম খানায়ে কাবার চেয়ে কম ছিলো না। মুসলমানরা বাইতুল মুকাদ্দাসকে তাদের ধর্মীয় প্রাণকেন্দ্র মনে করতো। এখনও এটি আমাদের বিশ্বাসের কেন্দ্রস্থল। খৃস্টানরা আমাদের এই কেন্দ্রটার উপর দখল প্রতিষ্ঠিত করে আমাদের বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনাকে মিথ্যা প্রমাণিত করতে চেয়েছিলো। খৃষ্টানদের গোয়েন্দা প্রধান হারমান ভুল বলেননি যে, এই ক্রুসেড যুদ্ধ মুসলমান ও খৃষ্টানদের রাজাদের লড়াই। এটা কালেমা ও কাবার লড়াই, যা সেদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, যেদিন দুয়ের একটির পতন ঘটবে।

হিন্দুরা যেভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে, মুসলমানদের পরাজিত করাকে এবং যুদ্ধের ময়দানে তো বটে, যে কোনো অবস্থায় ধোকায় ফেলে হলেও মুসলমানদেরকে হত্যা করাকে ধর্মীয় কর্তব্য স্থির করে রেখেছে, তেমনি খৃষ্টানদের পাদ্রীরাও মুসলমানদের খুন করাকে পুণ্যের কাজ সাব্যস্ত করে রেখেছিলেন। খৃস্টানরা যুদ্ধের বিধান লাভ করতে পোপের (প্রধান পাদ্রী) নিকট থেকে। আপনারা পড়েছেন, হিত্তীনের যুদ্ধে আক্রার পাদ্রী সেই বড় কুশটি নিয়ে রণাঙ্গনে উপস্থিত ছিলেন, যাতে তাদের বিশ্বাস মতে হযরত ঈসাকে শূলিবিদ্ধ করা হয়েছিলো। এই ঘটনাই প্রমাণ করছে, কাবার বিরুদ্ধে যুদ্ধের সূচনা করেছিলো গীর্জা এবং ক্রুসেড যুদ্ধ দুটি ধর্ম ও দুটি সভ্যতার লড়াই ছিলো।

ক্রুসেড যুদ্ধগুলোতে অংশগ্রহণকারী সম্রাট, সেনাপতি ও সাধারণ সৈনিক প্রত্যেকের থেকে বড় ক্রুশের উপর হাত রেখে ক্রুশের অফাদারী এবং জীবন ও সম্পদের কুরবানীর শপথ নেয়া হতো। এই শপথের কারণেই তাদেরকে সলীবি তথা ক্রুসেডার বলা হতো এবং বাইতুল মুকাদ্দাস রক্ষায় যেসব যুদ্ধ লড়া হয়েছিলো, সেগুলোকে ক্রুসেড যুদ্ধ আখ্যা দেয়া হয়েছিলো। খৃষ্টজগতে মুসলমান বিরোধী যুদ্ধ এবং আরব ভূখণ্ড দখল করাকে এমন উন্মাদনার রূপ দান করা হয়েছিলো, মহিলারা পর্যন্ত তাদের সঞ্চিত অর্থ-সম্পদ ও অলংকারাদি অকুণ্ঠচিত্তে গীর্জার হাতে অর্পণ করতে শুরু করেছিলো। এই উন্মাদনার চূড়ান্ত রূপ এই ছিলো যে, যুবতী মেয়েরা উদার মনে তাদের সম-সতীত্ব ক্রুশের বিজয় ও মুসলমানদের পরাজয়ের লক্ষ্যে উৎসর্গ করে দিয়েছিলো। মুসলমানদের চরিত্র ও চিন্তা-চেতনা ধ্বংসের জন্য যেভাবে প্রয়োজন গীর্জার পক্ষ থেকে খৃস্টান মেয়েদের ব্যবহার করার অনুমোদন দিয়ে রাখা হয়েছিলো। মেয়েদেরকে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছিলো, গীর্জার লক্ষ্য ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের খাতিরে সম্ভ্রম উৎসর্গকারী মেয়েরা স্বর্গ লাভ করবে।

এই বিশ্বাসেরই অনুকূলে রূপসী খৃস্টান মেয়েদেরকে নিয়মতান্ত্রিক প্রশিক্ষণ প্রদান করে মুসলিম ভূখণ্ডগুলোতে প্রেরণ করা হয়েছিলো। এরা মুসলিম আমীরদের হেরেমে ঢুকে গিয়ে একের পর এক ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করে, যার বিস্তারিত কাহিনী আপনারা পেছনে পড়ে এসেছেন। তাদেরই কারসাজিতে মুসলমানরা পরস্পর সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে এবং খৃস্টানদের পাতা এই সুদৃশ্য ফাঁদে এমনভাবে আটকে যায় যে, তারা আপন চিন্তা-চেতনা, স্বকীয়তা ও বোধ-বিশ্বাসকে ছুঁড়ে ফেলে সিংহাসনের জন্য পাগল হয়ে যায়। তারা তাদের ঈমান নিলাম করে দেয়। তবে তারপরও এমন কিছু লোক অবশিষ্ট থাকে, যাদের আত্মা ঈমানের আলোতে আলোকিত ছিলো। তারা বাইতুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধারে রক্তের নজরানা দিতে থাকে। কিন্তু নিয়তির অমোঘ বিধান হচ্ছে, একজন গাদ্দারই সমগ্র জাতিকে আত্মমর্যাদাহীন করে তোলার জন্য যথেষ্ট। আর সেই গাদ্দার যখন ক্ষমতার মসনদে আসীন হয়, তখন তার শত্রু অপেক্ষা দশগুণ বেশি সৈন্যও পরাজয়বরণ করে।

মুসলিম শাসকদের এই গাদ্দার চরিত্রেরই ফলে ১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই মোতাবেক ৪৯২ হিজরীর ২৩ শাবান খৃষ্টানরা বাইতুল মুকাদ্দাস দখল করে নিতে সক্ষম হয়। খৃস্টানদের এই বিজয়ে যেসব মুসলিম আমীর ও শাসক খৃস্টানদেরকে সহযোগিতা দান করে এবং যেভাবে করে, সে এক দীর্ঘ ও লজ্জাকর উপাখ্যান। উপমাস্বরূপ এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, খৃস্টান বাহিনী যখন বাইতুল মুকাদ্দাস অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছিলো, তখন শাহজার আমীর তাদের প্রতিহত করা থেকে বিরত থেকেই ক্ষান্ত হননি; বরং তাদেরকে রসদ সরবরাহ করেন এবং গাইড দিয়েও সহযোগিতা করেন। হামাত-ত্রিপোলীর আমীরগণও খৃস্টান বাহিনীকে নিরাপদ রাস্তা, রসদ ও উপঢৌকন দিয়ে তাদের প্রথম কেবলা বাইতুল মুকাদ্দাস দখলের জন্য রওনা করিয়ে দিয়েছিলেন। পথে তাদের আরো কয়েকটি মুসলিম রাজ্য অতিক্রম করতে হয়েছিলো। তারা তাদের রাজ্য ও ক্ষমতার নিরাপত্তার খাতিরে খৃস্টানদের চিত্তাকর্ষক ও সুদৃশ্য উপঢৌকন সাদরে গ্রহণ করে এবং খৃস্টান বাহিনীকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি সরবরাহ করে।

আরাকার আমীর ছিলেন একজন ঈমানদার পুরুষ, যার সামরিক শক্তি খৃস্টানদের মোকাবেলায় কিছুই ছিলো না। তবু তিনি খৃস্টান সেনাপতিদের দাবি পূরণ করতে অস্বীকৃত জানান এবং তাদেরকে মোকাবেলার জন্য হুংকার ছাড়েন। খৃস্টান বাহিনী আরাকা অবরোধ করে ফেলে। ১০৯৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ মে পর্যন্ত আরাকার মুসলমানরা এমন প্রাণপণ মোকাবেলা করে যে, খৃস্টান বাহিনী বিপুল প্রাণহানির ক্ষতি মাথায় করে অবরোধ তুলে নিয়ে পথ পরিবর্তন করে সম্মুখে চলে যেতে বাধ্য হয়। সকল মুসলিম আমীর যদি নিজ নিজ এলাকায় বাইতুল মুকাদ্দাস অভিমুখে অগ্রসরমান খৃষ্টান বাহিনীকে এভাবে প্রতিহত করতো, তাহলে ফোঁটায় ফোঁটায় নিঃসরিত হয়ে খৃস্টানদের রক্ত পথেই নিঃশেষ হয়ে যেতো, তাদের বাইতুল মুকাদ্দাস দখলের পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যেতো এবং ইতিহাস ভিন্নভাবে রচিত হতো।

***

যা হোক, মুসলমান আমীরগণ খৃস্টানদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে নিরাপদে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়েছিলো। তার শাস্তি সেই মুসলমানরা ভোগ করে, যারা বাইতুল মুকাদ্দাসে বসবাস করছিলো। সে সময়ে বাইতুল মুকাদ্দাসে যেসব মুসলিম পর্যটক অবস্থান করছিলেন, তারাও খৃষ্টানদের পদতলে নিস্পৃষ্ট হন। ১০৯৯ সালের ৭ জুন খৃস্টানরা এই মহান ও পবিত্র শহরটি অবরোধ করে। তখন বাইতুল মুকাদ্দাসের গবর্নর ছিলেন ইফতেখারুদ্দৌলা। তিনি পরম বীরত্ব ও বুদ্ধিমত্তার সাথে শত্রুর মোকাবেলা করেন। মুসলিম সৈন্যেরা দুর্গ থেকে বেরিয়ে খৃস্টানদের উপর আক্রমণ চালায়। কিন্তু খৃস্টানদের সৈন্যসংখ্যা ছিলো যেমন অগণিত, তেমনি সরঞ্জামও ছিলো প্রচুর। ১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই খৃস্টান বাহিনী শহরে ঢুকে পড়ে।

সমগ্র ইউরোপ ও সকল খৃস্টান রাজ্যে এই বিজয়ের আনন্দ উদযাপন করা হয়। কিন্তু সবচে ভয়ংকর ও ভয়াবহ উৎসবটি পালিত হয় বিজিত বাইতুল মুকাদ্দাসে। খৃস্টান সৈন্যরা মুসলমানদের ঘরে ঘরে ঢুকে লুটপাট করে। কোনো গৃহে কাউকে- সে অশীতিপর বৃদ্ধ হোক কিংবা দুগ্ধপোষ্য শিশু- জীবিত ছাড়েনি। জীবিত রাখে শুধু সুন্দরী যুবতী মেয়েদের, যারা, পরে তাদের পাশবিকতার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলো। অলি-গলিতে পলায়নপর মুসলিম শিশু, নারী ও পুরুষদেরকে অমানুষিক পন্থায় হত্যা করেছে। অবুঝ শিশুদেরকে জীবন্ত বর্শার আগায় গেঁথে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে উৎসবে মেতে ওঠেছে। প্রকাশ্যে নারীর সম্ভ্রমহানি এবং নিহতদের মাথা কেটে কেটে ফুটবল খেলেছিলো খৃস্টানরা।

অবশেষে মুসলমানরা একটি নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে বের করে। তারা নিশ্চিত ছিলো, অন্তত এখানে গিয়ে আশ্রয় নিলে নিরাপত্তা পাওয়া যাবে এবং যে কোনো ধর্মেরই অনুসারীরা এখানে তাদের উপর অত্যাচার করাকে পাপ মনে করবে। সে ছিলো মসজিদে আকসা। মুসলমানরা পরিবার-পরিজনসহ মসজিদে আকসায় চলে যায়। কিন্তু এখানে তারা পা রাখারও জায়গা পায়নি। তারা বাবে দাউদ ও অন্যান্য মসজেদ চলে যায়। স্বয়ং খৃস্টান ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, এই উদ্বাস্তু মুসলমানদের সংখ্যা ছিলো প্রায় ৭০ হাজার। খৃস্টানরা যে মসজিদে আকসাকে তাদের উপাসনালয় দাবি করতো, তার মর্যাদার একবিন্দু তোয়াক্কাও তারা করেনি। তারা আশ্রয় প্রার্থীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একজনকেও জীবিত রাখেনি। মসজিদে আকসা, বাবে দাউদ এবং অন্য সকল মসজিদ লাশে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। রক্ত বেয়ে বেয়ে মসজিদের বাইরে গড়িয়ে পড়েছিলো। ঐতিহাসিকদের ভাষায়, খৃষ্টানদের ঘোড়ার পা গোড়ালি পর্যন্ত মুসলিম নাগরিকদের রক্তে ডুবে গিয়েছিলো।

মেয়েদেরকে মসজিদে মসজিদে এবং মুসলমানদের অন্যান্য পবিত্র স্থানে নিয়ে শ্লীলতাহানি করা হয়েছে। সবচে বেশি হতভাগ্য ছিলো এই মেয়েরা আর যুদ্ধবন্দিরা। বন্দিদের সঙ্গে পশুর ন্যায় আচরণ করা হয়েছে। তাদের আহার অল্প দেয়া হতো এবং কাজ বেশি নেয়া হতো। সেকালে যেসব কাজে উট-ঘোড়া ব্যবহার হতো, সেসব কাজে এই মুসলিম যুদ্ধবন্দিদের ব্যবহার করা হয়। তাদের হাতে মসজিদগুলো গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। যারা অস্বীকার করে, তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এক হিংস্র খৃস্টান এক যুদ্ধবন্দিকে হত্যা করে তার দেহের গোশত কেটে রান্না করে খায়। পরে সঙ্গীদের জানায়, গোশতগুলো খেতে বেশ স্বাদ লেগেছে। তারপর থেকে খৃস্টানরা মানুষ খেতে শুরু করে। যখন কোনো উৎসব কিংবা অনুষ্ঠান হতো, তারা সুস্থ-সবল মুসলমানদের ধরে এনে যবাই করে তাদের গোশত রান্না করে খেতো।

খৃস্টান ঐতিহাসিকগণ এসব ঘটনা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু স্বয়ং ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণই খৃস্টানদের মানবশোরর ঘটনা উল্লেখ করেছেন।

মসজিদগুলোকে অবৈধ কাজে ব্যবহার করা ছাড়াও খৃস্টানরা সেগুলোতে ঘোড়া বাঁধতো। মসজিদে আকসায় বিভিন্ন মুসলিম রাজা এবং সৌখিন পর্যটকগণ সোনা-চাদির ঝাড় ইত্যাদি স্থাপন করেছিলেন। উপহার হিসেবে প্রাপ্ত কয়েকটি সোনার বস্তু রাখা ছিলো। খৃস্টানরা সেসব সামগ্রী তুলে নিয়ে যায় এবং মসজিদের মিনারের উপর কুশ স্থাপন করে দেয়।

***

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে বাইতুল মুকাদ্দাসের অবমাননা ও সেখানকার মুসলমানদের উপর অমানুষিক নির্যাতনের এই কাহিনী তাঁর পিতা নাজমুদ্দীন আইউব শৈশব থেকেই শোনাতে শুরু করেছিলেন। নাজমুদ্দীন আইউব উপাখ্যানটা শুনেছেন তার পিতা শাদীর নিকট। এই কাহিনী সুলতান আইউবীর রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলো। এক সময়ে তিনি শপথ করে ফেলেন, যে কোনো মূল্যে বাইতুল মুকাদ্দাস মুক্ত করে ছাড়বেন। আজ যখন তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস জয় করতে বের হলেন, তার দুই যুবক পুত্র আল-মালিকুল আফজাল ও আল-মালিকুয যাহিরও তার বাহিনীতে রয়েছে। বাইতুল মুকাদ্দাস সম্পর্কে যে কাহিনী তিনি স্বীয় পিতা থেকে শুনেছিলেন, সেসব নিজ পুত্রদেরও শুনিয়ে দেন, যেনো একটি মূল্যবান পৈতৃক সম্পত্তি বংশ পরম্পরায় হাত বদল হচ্ছে।

লক্ষ্যহীন বেঁচে থাকার চেয়ে সময়ের আগে মরে যাওয়াই ভালো পুত্রদের সামরিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে ফৌজে অন্তর্ভুক্ত করার সময় সুলতান আইউবী বললেন- এই উক্তি তোমাদের মরহুম দাদার। আমি যখন আমার চাচা শেরেকোহর সঙ্গে খৃস্টানদের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধে রওনা হয়েছিলাম, তখন আব্বাজান আমাকে কথাটা বলেছিলেন। তিনি বলেছেন, আমি দেখতে পাচ্ছি, তুমি কোনো একটি ভূখণ্ডের শাসক হবে। হতে পারে তুমি সুলতান হয়ে যাবে। স্মরণ রেখো বেটা! আজ থেকে তুমি আমার পুত্র নও- জাতির পুত্র। কুরআন মানুষকে পিতা-মাতার সেবা করার নির্দেশ দিয়েছে। এখন থেকে দেশের জনগণ ও সালতানাত তোমার পিতা-মাতা। আল্লাহ সন্তানকে পিতার উপর শাসন করতে এবং তাদের কষ্ট দিতে বারণ করেছেন। সাবধান ইউসুফ! দেশের জনগণকে কষ্ট দেবে না। দেখবে তোমার উপর জাতির কী কী হক আছে। সেসব আদায় করতে সচেষ্ট হবে।…।

আর আমার প্রিয় পুত্রগণ! তোমাদের দাদা বলেছেন, ঘাড় সেদিন উঁচু করবে, যেদিন মসজিদে আকসাকে কাফেরদের থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হবে। আরামের ঘুম সেই রাত ঘুমাবে, যে রাতে মসজিদে আকসায় বিজয়ের নফল নামায আদায় করবে। আর আমাদের প্রিয় রাসূল যে মসজিদের আঙ্গিনা থেকে আল্লাহর দরবারে মিরাজে গমন করেছিলেন, তাকে নিজ চোখের অশ্রু দ্বারা ধৌত করবে। আমার পুত্রগণ! যেসব শিশু বাইতুল মুকাদ্দাসের অলি-গলিতে ও মসজিদে মসজিদে খুন হয়েছিলো এবং জাতির যে মেয়েরা লাঞ্ছিত-নিগৃহীত হয়েছিলো, তারা আমাকে রাতে ঘুমাতে দেয় না। যে মসজিদে আমার প্রিয় রাসূলের পবিত্র পা পড়েছিলো, যে মসজিদে রাসূলে পাকের পবিত্র কপাল সেজাদবনত হয়েছিলো, তার ইটগুলো রাতভর আমার উপর পতিত হতে থাকে। আমি ব্যাথায় কুকিয়ে উঠি। মুখ থেকে এমন চীৎকার বেরিয়ে আসে, যেনো মসজিদে আকসায় খুন হওয়া শিশুরা কান্নার সুরে আযান দিচ্ছে। তারা তোমাদের ডাকছে আমার পুত্রগণ! তারা আমাকে ডাকছে।…।

তোমাদের দাদা বার্ধক্যে কম্পমান হাত দুটো আমাকে দেখিয়ে বলতেন, আমি আমার যৌবন তোমাদের দিয়ে দিলাম। যে কাজ আমি করতে পারিনি, তা তোমরা সম্পন্ন করো। বাইতুল মুকাদ্দাস যাও। বাইতুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধারই হয় যেনো তোমাদের জীবনের লক্ষ্য। ক্ষমতার মসনদে বসে যদি নিশ্চিন্তে-নির্বিঘ্নে জাতির উপর শাসন করার জন্য শত্রুকে উপেক্ষা করে চলো, তাহলে এই মসনদের আয়ু দীর্ঘ হবে না। শহীদদের আত্মা জিনের রূপ ধারণ করে তোমার ক্ষমতার মসনদ উল্টে দেবে। আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টিই যেনো তোমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়।

  আমার প্রিয় পুত্রগণ! আজ আমি আমার পিতার উত্তরাধিকার তোমাদের হাতে অর্পণ করছি। আজ থেকে তোমরা আমার নও- মিল্লাতে ইসলামিয়ার সন্তান। আমি তোমাদের মাকে বলে দিয়েছি, তোমার কোলে কোনো সন্তান জন্মলাভ করেছিলো, সে কথা ভুলে যাও। যদি না পারো, তাহলে অন্তত তাদের বেঁচে থাকার দুআ করো না। আমি তাদেরকে সেই জায়গায় জবাই করতে নিয়ে যাচ্ছি, যেখানে হযরত ইবরাহীম (আ.) স্বীয় পুত্র ইসমাঈলকে আল্লাহর পথে কুরবান করতে গলায় ছুরি চালিয়েছিলেন। দুআ যদি করতেই হয়, আল্লাহর সমীপে ফরিয়াদ জানাবে, এই সন্তানদের তুমি যে দুধপান করিয়েছে, তা যেনো নূরান্বিত রক্তে পরিণত হয়ে মসজিদে আকসার মেঝে ধৌত করে দেয়। আর আল্লাহকরুন, যেনো এমনই হয়। শপথ করো আমার পুত্রগণ! আমি যদি বেঁচে না থাকি, তাহলে তোমরা বাইতুল মুকাদ্দাসকে মুক্ত করবে।….

সুলতান আইউবী তাঁর পুত্রদ্বয়কে ১০৯৯ সালের রক্তাক্ত কাহিনী শোনান। শেষে যখন তিনি তাদের চলে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেন, তখন তারা সুলতানকে সে নিয়মে সালাম করেনি, যেভাবে পুত্ররা পিতাকে সালাম করে থাকে। তারা উঠে দাঁড়ায়। আল-আফজল বললো- মহান সুলতান! শুধু শহীদ হওয়া কোনো কৃতিত্ব নয়। আমরা শহীদ হওয়ার আগে বাইতুল মুকাদ্দাসের অলি-গলিতে দুশমনের এতো রক্ত প্রবাহিত করবো যে, আপনার ঘোড়ার পা পিছলে যাবে আর আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো, আপনি মসজিদে আকসা থেকে ক্রুশটা নিজ হাতে খুলে ক্রুসেডারদের নাপাক রক্তের মাঝে ছুঁড়ে ফেলছেন।

আর সেই রক্ত নিরস্ত্র নাগরিকদের না হওয়া চাই আল-আফজাল! সুলতান আইউবী বললেন।

এই রক্ত বর্মপরিহিত ক্রুসেডারদের হবে- আল-আফজল বললো এই রক্ত সেই লোহা থেকে ঝরবে, যদ্বারা ক্রুসেডাররা তাদের দেহকে আবৃত করে রাখে। ঈমানের তরবারী মিথ্যার ইস্পাতকেও কেটে ফেলার ক্ষমতা রাখে।

আল্লাহ তোমার মুখ রক্ষা করুন। সুলতান আইউবী বললেন।

 পুত্রগণ সামরিক কায়দায় পিতাকে সালাম করে বেরিয়ে যায়।

***

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী এখন বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে চল্লিশ মাইল দূরে রোম উপসাগরের তীরে আসকালানে সেই ব্যাঘ্রের ন্যায় ওঁৎ পেতে বসে আছেন, যে আপন শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত। আবেগের দিক থেকে তিনি এক্ষুনি বায়তুল মুকাদ্দাস অভিমুখে অগ্রযাত্রা করতে প্রস্তুত আছেন বটে; কিন্তু আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে তিনি যুদ্ধের বাস্তবতাকে পর্যবেক্ষণ করছেন। এই চল্লিশ মাইলের দূরত্বটা যেনো আগুন-গরম পাথরে পরিপূর্ণ। এ হচ্ছে বাইতুল মুকাদ্দাসের বিশেষ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। শুধু নগরীটাই প্রাচীরঘেরা নয়- নগরীর চারদিকে দূর দূরান্ত পর্যন্ত অঞ্চলেও ছোট ছোট দুর্গ ও খৃস্টান বাহিনীর অসংখ্য চৌকি বিদ্যমান। টহল প্রহরার ব্যবস্থাও বাদ নেই। বাইতুল মুকাদ্দাসের পথে অশ্বারোহী সেনারা দলে দলে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। এখন এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আগের তুলনায় বেশি শক্ত করা হয়েছে। বাইতুল মুকাদ্দাসের ভেতরে যে ফৌজ আছে, তার সেনাপতিরা সুলতান আইউবীর প্রতিটি গতিবিধি সম্পর্কে অবগত। কিন্তু তাদের এতোটুকু হিম্মত নেই যে, তারা সুলতান আইউবীকে আসকালানে প্রতিহত করবে কিংবা তার উপর জবাবী আক্রমণ চালাবে। হিত্তীন থেকে আসকালান পর্যন্ত সুলতান আইউবী তাদের সামরিক শক্তির অনেক রক্ত চুষে নিয়েছেন।

বাইতুল মুকাদ্দাসের সম্রাট গাই অফ লুজিনান- যিনি হিত্তীনের যুদ্ধে বন্দি হয়েছেন এবং এখন দামেশকের কারাগারে আটক রয়েছেন যে বাহিনীটি সঙ্গে নিয়েছিলেন, তার কিছু অংশ মারা গেছে। কিছু বন্দিত্ববরণ করেছে। অবশিষ্টরা এমনভাবে পলায়ন করেছে যে, এখন তার অফিসার, সৈনিক ও বর্মপরিহিত নাইটরা আহত কিংবা ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় বাইতুল মুকাদ্দাসে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। নাইটদের মনোবলে কিছুটা প্রাণ আছে। কারণ, পদমর্যাদার লাজ তো রাখতে হবে। অন্যান্য সৈন্যরা শহরে ঢুকে ভীতি ছড়িয়ে দিয়েছে। সেনাপতিগণ নাইটদেরকে নতুন করে সংগঠিত করে নিয়েছে। এখন বাইতুল মুকাদ্দাসের ভেতরের সেনাসংখ্যা ষাট হাজারে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু নাগরিক সাধারণ জেনে ফেলেছে, সালাহুদ্দীন আইউবী নগরী জয় করতে আসছেন, তাই তারাও যুদ্ধ লড়া ও মৃত্যুবরণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে। নগরীর প্রতিরক্ষাকে আরো বেশি শক্ত করা হয়েছে।

নগরীর এক-দুটি ফটক দিনের বেলা খোলা রাখতে হচ্ছে। কেননা, রণাঙ্গন থেকে পলাতক খৃস্টান সেনারা একজন-দুজন-চারজন করে এসে নগরীতে প্রবেশ করছে। সুলতান আইউবীর গোয়েন্দারা আগে থেকেই নগরীতে উপস্থিত। এবার পলায়নপর খৃস্টানদের বেশে আরো কিছু গুপ্তচর এসে নগরীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও প্রাচীর ভালোভাবে দেখে বেরিয়েও গেছে। মুসলমানদের উপর কড়াকড়ির মাত্রা আগের চেয়ে বেশি কঠোর করে দেয়া হয়েছে।

বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে দশ-বারো মাইল দূরে আসকালানের দিকে খৃস্টানদের একটি চৌকি ছিলো। তাতে প্রায় একশ খৃস্টান সৈন্য অবস্থান করতো। তারা তাবু স্থাপন করে রেখেছিলো। ১১৮৭ সালের সেপ্টেম্বরের এক রাতে তাদের সেই চৌকির সন্নিকটে একটি বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটে। পরে অনুরূপ আরো দুতিনটি বিস্ফোরণ ঘটে। পরক্ষণেই আগুন জ্বলে ওঠে এবং তিন-চারটি তাঁবু জ্বলতে শুরু করে। সৈনিকরা জাগ্রত হয়ে এদিক-ওদিক পালিয়ে যায়। যেইমাত্র সৈন্যদের মাঝে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে যায়, অমনি তাদের উপর চতুর্দিক থেকে তীর আসতে শুরু করে। জ্বলন্ত তাঁবুগুলোর আলোতে এই তীরবৃষ্টি চোখে পড়তে শুরু করে। এ ছিলো দাহ্য পদার্থের সেসব পাতিলের কৃতিত্ব, যেগুলো সুলতান আইউবীর একটি কমান্ডো দল মিনজানিকের সাহায্যে নিক্ষেপ করেছিলো। পাতিলগুলো চৌকিগুলোতে এসে নিক্ষিপ্ত হয়ে বিস্ফোরিত হওয়ার পর পর সেখানে সলিতাওয়ালা অগ্নিতীর ছোঁড়া হয়। এই তীর এসে নিক্ষিপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাহ্য পদার্থে আগুন ধরে যায়।

খৃস্টানরা এদিক-ওদিক পালিয়ে যাওয়ার পর টের পায়, তারা শত্রুবাহিনীর ঘেরাওয়ে পড়ে গেছে এবং এই ঘেরাও থেকে জীবিত বের হওয়া সম্ভব নয়। কমান্ডোরা হুংকার ছাড়তে শুরু করে- যদি জীবনে রক্ষা পেতে চাও, তাহলে অস্ত্র ত্যাগ করে একদিকে সরে দাঁড়িয়ে যাও। আগুনের ধ্বংসলীলার পর সুলতান আইউবীর কমান্ডোদের এই হুংকার ক্রুসেডারদের অবশিষ্ট দমটুকুও নিঃশেষ করে দেয়। তারা অস্ত্র ত্যাগ করে কমান্ডোদের হাতে আত্মসমর্পণ করে। এখন তাদের সংখ্যা পঁচিশ থেকে ত্রিশজন। তাদের ঘোড়া ও অস্ত্র ইত্যাদি দখল করে পেছনে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

ভোর নাগাদ ভস্মিভূত চৌকিটিতে সুলতান আইউবীর সম্মুখ বাহিনীর একটি ইউনিট পৌঁছে যায়। এতে বাহিনীর অগ্রযাত্রা বেশ দূর অঞ্চল পর্যন্ত নিরাপদ হয়ে যায়। গেরিলাদের অবস্থা বনের হায়েনাদের ন্যায় হয়ে যায়। দুজন দুজন করে জানবাজ ঝোঁপ-ঝাড়, পাথরখণ্ড ও টিলার আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকে। যেখানেই টহল অশ্বারোহী কিংবা পদাতিক সৈন্যদের শব্দ কানে আসছে, তারা চুপসে যাচ্ছে এবং যখনই খৃস্টানরা নিকটে এসে পৌঁছছে, অমনি তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। দুজন লোক যদি ছয় ব্যক্তির উপর আক্রমণ চালায়, তাহলে দুজনের পরিণতি কী হয় সহজেই বোঝা যায়। কাজেই এই অভিযানে কমান্ডোরা শহীদ এবং জখমীও হয়ে চলছে।

এ ছিলো তাদের এক স্বতন্ত্র যুদ্ধ। তাদের কোনো কমান্ডার নেই। এদিক-ওদিক কোথাও লুকিয়ে বসে থাকলে তাদের জিজ্ঞেস করার কেউ ছিলো না। কিন্তু দৈহিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাদের যে আত্মিক ও মানসিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছিলো, তা তাদেরকে আগুনের ন্যায় উত্তপ্ত করে রেখেছিলো। হিত্তীনের জয়ের পর সুলতান আইউবী যে বড় শহরটি জয় করেছিলেন, সেখানকার মুসলমানদের করুণ অবস্থা ফৌজকে দেখানো হয়েছিলো। তাদেরকে মসজিদের অবমাননা ও ধ্বংসলীলা দেখানো হয়েছিলো। তাদের বলা হয়েছে, এই যুদ্ধ কোনো রাজার রাজত্বের নিরাপত্তা বা পুনরুদ্ধারের জন্য লড়া হচ্ছে না, বরং এই যুদ্ধ লড়া হচ্ছে ইসলামের সুরক্ষা ও এই মহান ধর্মের দুশমনের মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে। প্রশিক্ষণের পর এই যুদ্ধ তাদের ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়ে গেছে।

আসকালানে সুলতান আইউবী রাতে ঘুমাবার তেমন সময় পাচ্ছেন না। গেরিলাদের পক্ষ থেকে দূতরা যাওয়া-আসা করছে ও সংবাদ আদান প্রদান করছে। বাইতুল মুকাদ্দাস থেকেও দূতরা আসছে-যাচ্ছে। এরা রাতেও আসছে। সুলতান আইউবী নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন, কোথাও থেকে কোনো সংবাদ আসলে যখনই আসুক তৎক্ষণাৎ যেন তাকে অবহিত করা হয়। যদিও তিনি গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে থাকেন। গেরিলারা রিপোর্ট নিয়ে আসছে, অমুক স্থানে খৃস্টানদের একটি চৌকির উপর আক্রমণ হয়েছে, এভোজন খৃস্টান সেনা মারা গেছে, এতোজন গেরিলা শহীদ ও এতোজন আহত হয়েছে। অমুক রাস্তাটি নিরাপদ করে ফেলা হয়েছে ইত্যাদি। সে মোতাবেক সুলতান আইউবী নকশায় অগ্রযাত্রার পথের চিহ্নে রদবদল করে নিচ্ছেন।

***

সুলতান আইউবী সালার ও নায়েব সালারদের সর্বশেষ বৈঠকের আয়োজন করেন। তাতে নৌ-বাহিনীর ক্যাপ্টেন আল-ফারেসকে তলব করা হয়। দূত যখন আল-ফারেসের নিকট পৌঁছে, তখন তার জাহাজ আসকালান থেকে বিশ মাইল দূর খোলা সমুদ্রে অবস্থান করছিলো। ডিঙি সে পর্যন্ত পৌঁছুতে আধা দিন সময় লেগে যায়। আল-ফারেস সেই ডিঙিতে করে রাতেই আসকালান পৌঁছে যান। দূত তাকে বলেছিলো, সুলতান সকল সালারকে তলব করেছেন। তাতেই তিনি বুঝে ফেলেন, বাইতুল মুকাদ্দাসের উপর আক্রমণ সম্পর্কে বৈঠক হবে। দূতের সঙ্গে জাহাজ থেকে। রওনার সময় মেয়ে দুটোকে বললেন- আমি আসকালান যাচ্ছি।

সুলতান ডেকেছেন? এক মেয়ে জিজ্ঞেস করে।

কেনো ডেকেছেন? অপরজন জানতে চায়।

আমার রাষ্ট্রীয় কাজে তোমরা এতো মাথা ঘামাচ্ছো কেনো?- আল ফারেস বিরক্তি প্রকাশ করেন- তোমাদের কয়েকবার বলেছি, আমার ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করো না।

দুজনেই হেসে ওঠে। একজন বললো- যোগ্যতা থাকলে আপনার অনুপস্থিতিতে আপনার জাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ করতাম এবং দুশমনরা আক্রমণ করলে মোকাবেলা করতাম।

তোমরা যার যোগ্য, আমি তোমাদের থেকে সে কাজই নেবো- আল ফারেস বললেন- আমার অবর্তমানে বেশিরভাগ সময় নীচে কাটাবে। উপরে গিয়ে মাল্লা ও সৈনিদের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না।

আপনি কবে ফিরবেন?

আজ রাতে বোধ হয় আসতে পারবো না- আল-ফারেস উত্তর দেন কাল সন্ধ্যা নাগাদ এসে পড়বে।

আল-ফারেস মেয়ে দুটির মাঝে পুরোপুরি একাকার হয়ে গেছেন। মেয়েরা তাকে সুলতান আইউবীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতো। জানতে চাইতো, রোম উপসাগরে মিসর ও সিরিয়ার নৌ-বহর বন্দরে আছে, নাকি সমুদ্রে। মোট জাহাজ কয়টি। এগুলোতে, কতোজন সৈন্য আছে। আল-ফারেস তাদের পরিষ্কার বলে দিতেন, আমাকে এসব ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করবে না। তথাপি তারা নিজেদের রূপ-লাবণ্য ও ভাবভঙ্গির যাদু প্রয়োগ করে তার নিকট এমন সব বিষয়ে। জিজ্ঞেস করে বসতো, যা একটি বাহিনীর গোপন সামরিক বিষয়। আল ফারেস আবেগময় অবস্থা থেকে সঙ্গে সঙ্গে সচেতন হয়ে যেতেন এবং তাদেরকে প্রীতির সাথে শাসিয়ে দিতেন।

নেশার অবস্থায় মানুষ হৃদয়ে লুকায়িত গোপন তথ্য উগরে দিয়ে থাকে। চাই নেশাটা মদের হোক কিংবা অন্য কোন ওষুধের। কিন্তু আল ফারেস মদপান করতেন না। না জাহাজে মদ কিংবা অন্য কোনো নেশাকর দ্ৰব্য রাখার অনুমতি ছিলো। তিনি চরিত্রহীন মানুষও নন। কিন্তু এখন দুটি মেয়ের নেশা তাকে জেঁকে ধরেছে, যাদের সাহায্যে তার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায় এবং তিনি চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। এই মেয়ে দুটো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তারা দেখলো, আল-ফারেসের মধ্যে না মদের অভ্যাস আছে, না তার চরিত্রে কোনো কলুষতা আছে। তারা তার উপর প্রেম ভালোবাসার নেশা জাগিয়ে তুলতে শুরু করে। কিন্তু আল-ফারেস নিজ কর্তব্যে এতোই পরিপক্ক যে, আবেগের উপর মাদকতা ছেয়ে গেলেও তিনি কর্তব্যে একবিন্দু ত্রুটি করছেন না।

***

এক রাত। আল-ফারেস গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছেন। মেয়ে দুটো কেবিন থেকে বেরিয়ে উপরে চলে যায় এবং ছাদের রেলিং ধরে জোৎস্না রাতের হিমেল হাওয়া উপভোগ করতে শুরু করে।

রোজি!- এক মেয়ে অপরজনকে বললো- আমি সামনে অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি। আল-ফারেস দেখতে মোম। কিন্তু এটা-ওটা জিজ্ঞেস করলে পাথর হয়ে যান। আমার মনে হচ্ছে, এখানে আমরা কোনো কাজ করতে পারবো না। এন্ড্রু আসলে বলবো, সম্ভব হলে তুমি আমাদেরকে এখান থেকে কোথাও নিয়ে যাও। কী বলো, ভালো হবে না?

ক্ষুদ্র ডিঙিতে করে জাহাজের নিকট এসে জাহাজের মাল্লা ও সৈনিকদের নিকট এটা-ওটা বিক্রি করতে যে বৃদ্ধ, আসলে মেয়ে দুটো যাকে জাহাজে তুলে নিয়ে কেনা-কাটার ভান ধরে কথা বলতো, এন্ড্রু সেই ব্যক্তি। লোকটার সঙ্গে মেয়ে দুটোর ঘটনাক্রমে সাক্ষাৎ হয়েছিলো। লোকটি গরীব হকারের বেশে নিজের ডিঙিতে করে আল-ফারেসের জাহাজের নিকট পণ্য বিক্রয় করতে এসেছিলো। সে মেয়ে দুটোকে এবং মেয়ে দুটো তাকে চিনে ফেলে। মেয়েরা পণ্য ক্রয়ের কথা বলে তাকে জাহাজে তুলে নিয়েছিলো। সে মেয়েদের বলেছিলো, তারা আল ফারেসের এই ছয়টি জাহাজের সঙ্গে ছায়ার ন্যায় লেগে আছে এবং সুযোগ পেলেই জাহাজগুলোকে ধ্বংস করে দেবে। মেয়েরা তাকে বলেছিলো, আশ্রয়ের বাহানায় আমরা তোমাদের জন্য গোয়েন্দাগিরি করব।

এন্ড্রু একজন নাশকতাকারী গোয়েন্দা। প্রথম সাক্ষাতের পর সে দুবার আপন বেশে এসেছিলো এবং মেয়েদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলো। মেয়েরা তাকে জানায়, আল-ফারেস তাদের জালে আসছেন না এবং কোনো তথ্যও দিচ্ছেন না। এডুর জানবার প্রয়োজন ছিলো, জাহাজগুলো কতদিন এই ডিউটিতে থাকবে এবং টায়েরের দিকে যাবে কিনা? সে। মেয়েদের বললো, মনে হচ্ছে তোমরা বিদ্যা ভুলে গেছে। এই জাহাজে তো আল-ফারেস একজনই লোক নয়। তার নায়েবও তো আছে এবং তার নীচে আরো একজন অফিসারও আছে। তোমরা তাদের একজনকে হাত করে নাও। তাদের মাঝে বিরোধ সৃষ্টি করে দাও। আল-ফারেসের নায়েবকে তার শত্রু বানিয়ে দাও। যাদু প্রয়োগ করো। কী করতে হবে জানো না? সবই তো জানো।

সে রাতে এক মেয়ে অপরজনকে হতাশা ব্যক্ত করে বললো, রোজি! এন্ড্রু আসলে বলবো, আমাদেরকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাও।

শোন ফ্লোরি!- রোজি উত্তর দেয়- এন্ড্রু এখান থেকে আমাদেরকে উদ্ধার করতে পারবে না। এটি যুদ্ধজাহাজ। দেখছো না, রাতে ছাদের। উপর বরং আরো উপরে মাস্তুলে মাচান পেতে এক সৈনিক দাঁড়িয়ে থাকে। পালাবার চেষ্টা করলে আমাদের সঙ্গে এরও ধরা পড়ার আশঙ্কা আছে। আমাদেরকে এতো তাড়াতাড়ি নিরাশ হওয়া ঠিক হবে না।

 তাহলে কি অন্য কোনো অস্ত্র ব্যবহার করবে? ফ্লোরি জিজ্ঞেস করে।

করতে হবে- রোজি বললো- আল-ফারেসের নায়েব তো পূর্ব থেকেই আমাদেরকে কামনার চোখে দেখছে এবং মুচকি হাসছে। এই লোকগুলো দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সমুদ্রে অতিবাহিত করছে। মৃত্যু সব সময় এদের মাথার উপর অপেক্ষমান থাকে। খোদা পুরুষের মধ্যে নারীর যে দুর্বলতা সৃষ্টি করেছেন, তা এমনি পরিস্থিতিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ইঙ্গিত করতে দেরি, সাড়া আসতে দেরি হয় না। বলো, কাজটা আমি করবো, নাকি তুমি? আমার তুলনায় অবশ্য তোমার অভিজ্ঞতা ভালো।

আচ্ছা আমিই করি। ফ্লোরি বললো।

কিন্তু এ কাজের নিয়ম-নীতি মনে রাখতে হবে- রোজি বললো তথ্য নেবে; তবে তার মূল্যটা শুধু দেখাবে- পরিশোধ করবে না। লোকটার মধ্যে এমন পিপাসা সৃষ্টি করবে, যেনো সে আল-ফারেসকে, হত্যা করার ভাবনা ভাবতে বাধ্য হয়।

আল-ফারেসের নায়েবের নাম রউফ কুর্দি। আগে থেকেই লোকটি মেয়েগুলোর প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ করে আসছে। এদের প্রতি তাকাতো আর মিটি মিটি হাসতো। তার জানা ছিলো, এরা আল-ফারেসের স্ত্রী কিংবা গণিকা নয়- আশ্রিতা যাযাবর। আল-ফারেস এদেরকে নিজ জাহাজে আশ্রয়দান করেছেন। মেয়ে দুটো রউফ কুর্দির হৃদয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে দিয়েছিলো। সে রাতে যখন তারা ছাদে রেলিং ধরে কথা বলছিলো, রউফ কুর্দি দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের দেখছিলো। আল-ফারেস তত সুলতান আইউবীর বৈঠকে যোগ দিতে চলে গেছেন। জাহাজের কর্তৃত্ব এখন রউফ কুর্দির হাতে।

ফ্লোরি ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রোজি পায়চারি করার ভান ধরে সেখান থেকে সরে যায় এবং রউফ কুর্দির পাশ দিয়ে যেতে যেতে মুচকি একটা হাসি দেয়। রউফ কুর্দি শোন বলে তাকে কাছে ডেকে নেয় এবং কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে শুরু করে। দুচারটি কথার উত্তর দিয়ে। রোজি চলে যেতে উদ্যত হলে রউফ কুর্দি তাকে বসতে বলে।

আমি আপনার কাছে বসে থাকলে ও (ফ্লোরি) ক্ষেপে যাবে। রোজি বললো।

কেন? রউফ কুর্দি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে।

এ যার যার মনের ব্যাপার- রোজি বললো- আল-ফারেস একদিন নীচে ঘুমিয়ে ছিলেন। আমি উপরে এসে আপনার কাছে দাঁড়ালাম। ও দেখে ফেলে। পরে আমাকে বললো, আমার মালিকানায় ভাগ বসাতে চেষ্টা করো না। রউফ আমার। মিসর গিয়ে আমি তার সঙ্গে চলে যাবো। ও আবার আল-ফারেসকে পছন্দ করে না। কিন্তু পাছে আল-ফারেস অসন্তুষ্ট হন কিনা সে ভয়ে আপনার কাছে ঘেঁষে না।

রউফ কুর্দির আবেগের সমুদ্রে জোয়ার এসে যায়। পুরুষিত স্বভাবের দুর্বলতা তাকে কাবু করে ফেলে। ফ্লোরি-রোজি অপেক্ষা বেশি রূপসী মেয়েও রউফ দেখেছে। কিন্তু এদের রূপ ও অঙ্গভঙ্গিতে যে আকর্ষণ রয়েছে, তা অন্যদের মধ্যে দেখেনি। এখন যখন জানতে পারলো, এদের একজন তাকে কামনা করছে, তখন তার মস্তিষ্ক আবেগের উপর সেই পথে চলতে শুরু করে দিয়েছে, যে পথে একজন পুরুষের যাওয়া দেখা যায়; কিন্তু ফিরে আসা দেখা যায় না। রোজি তাকে আত্মহারা এক ঘরের মধ্যে ফেলে রেখে চলে যায়। কেবিনে অবতরণের জন্য সিঁড়িতে পা রেখে সে পেছন পানে তাকায়। দেখে, রউফ কুর্দি ধীরে ধীরে ফ্লোরির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

আজ রাত ঘুমাবে না জুয়াশি! ফ্লোরি আল-ফারেসকে নিজের যে নাম বলেছিলো, রউফ কুর্দি কাছে গিয়ে তাকে সেই নামে ডাকে। 

রোজি নিজের নাম বলেছিলো আজমির। যাযাবরদের নাম এমন। অদ্ভূতই হয়ে থাকে।

রউফ কুর্দিকে পার্শ্বে দণ্ডায়মান দেখে ফ্লোরি প্রশিক্ষণ অনুযায়ী এমন ধারায় লজ্জা প্রকাশ করে, যেমনটি নববধূও করে না। রউফ কুর্দি মেয়েটির কাঁধে হাত রাখলে সে সলাজ নতমুখে একদিকে সরে যায়।

আজমির আমাকে তোমার সম্পর্কে কিছু কথা বলেছে- রউফ কুর্দি বললো- এসব কি সত্য?

ফ্লোরি রউফের প্রতি একবার মুখ তুলে তাকিয়েই অমনি ঘাড় ঘুরিয়ে সমুদ্রের দিকে দেখতে থাকে। রউফ কুর্দি প্রশ্নটা পুনর্ব্যক্ত করে ফ্লোরি যে হাতে রেলিং ধরেছিলো, সে হাতের উপর নিজের একটা হাত রাখে। ফ্লোরি ধীরে ধীরে নিজের হাত উল্টো করে আঙুলগুলো রউফ কুর্দির আঙুলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়।

অল্পক্ষণ পর। ফ্লোরি এখন রউফ কুর্দির সঙ্গে তার ডিউটির স্থলে উপবিষ্ট। জাহাজ নোঙ্গরকরা। গোটা চারেক বাতি সমুদ্রে সাঁতার কাটছে। এগুলো আল-ফারেসের জাহাজ, সমুদ্রে টহল দিয়ে ফিরছে।

 মধ্যরাতে রউফ কুর্দির স্থলে তার এক অধীন অফিসার ডিউটিতে আসবার কথা। রউফ কুর্দি ফ্লোরিকে বললো, তুমি আমার কেবিনে চলে যাও, আমি আসছি।

ফ্লোরি চলে যায়।

জাহাজের ছাদ থেকে ফজরের আযান ভেসে আসলে ফ্লোরি, রউফ কুর্দির কেবিন থেকে বের হয়। মেয়েটি আল-ফারেসের নায়েবকে নিশ্চিত, করে, তাকে সে মনে-প্রাণে কামনা করছে এবং কোনো দিনই আল ফারেসকে স্বামী হিসেবে বরণ করবে না। সে রউফ কুর্দিকে জানালো, আল-ফারেস আমাকে বলেছিলেন, তুমি রউফের সঙ্গে কথা বলবে না। লোকটা বড় খারাপ মানুষ। আসলে তিনি নিজেই বদমাশ। আমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন বটে; কিন্তু আমাদের অসহায়ত্ব থেকে পুরোপুরিই সুযোগ নিচ্ছেন। আমরা যদি অসহায়-নিরাশ্রয় না হতাম, তাহলে এতো বেশি মূল্য কখনো দিতাম না।

রউফ কুর্দির অন্তরে নিজের ভালোবাসার প্রতারণা ও আল-ফারেসের প্রতি শত্রুতা সৃষ্টি করে ফ্লোরি তার কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। আল ফারেস যে তথ্য কখনো তাদের দেননি, রউফ তার সব উগরে দেয়।

সুলতান আইউবীর চোখে ঘুম নেই। গোটা রাত বৈঠকে কেটেছে। তিনি এমন কোনো ঝুঁকি মাথায় নিতে চাচ্ছেন না, যার ফলে বাইতুল মুকাদ্দাসের অবরোধ ব্যর্থ হতে পারে। তিনি মানচিত্রে সালার ও অন্যান্যদের বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত পৌঁছার রাস্তা দেখিয়ে দেন। যেসব স্থানে এই কদিন খৃস্টানদের চৌকি ছিলো আর এখন সেখানে তার গেরিলা কিংবা সম্মুখ বাহিনীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল অবস্থান করছে কিংবা ওখানে কিছুই ছিলো না, সেসব জায়গার উপর চিহ্ন দিয়ে রাখেন। এমন স্থানগুলোও চিহ্নিত করে রাখেন, যেখানে এখনো ক্রুসেডারদের চৌকি বহাল আছে এবং তাতে অনেক সৈন্য বিদ্যমান রয়েছে। সুলতান সকলকে অবহিত করেন, তিনি এসব চৌকি দখল করার চেষ্টা-ই করেননি। কারণ, তিনি বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত নিজের সামরিক শক্তি নষ্ট করতে চাচ্ছেন না। এই চৌকিগুলো সব উঁচুতে অবস্থিত। তাই এগুলো এড়িয়ে সামান্য দূর দিয়ে পথ অতিক্রম করার কৌশল অবলম্বন করেছেন তিনি। সেগুলোতে যে সৈন্য আছে, তারা বাইরে বেরিয়ে এসে আমাদের পথরোধ করার সাহস করবে না।

কিন্তু দূর থেকে আমাদেরকে দেখে তাদের দূত বাইতুল মুকাদ্দাস গিয়ে সংবাদ পৌঁছাবে- এক সালার বললেন- ফলে আমরা বাইতুল মুকাদ্দাসকে অসতর্ক অবস্থায় ঝাঁপটে ধরতে ব্যর্থ হবো।

অসতর্ক অবস্থায় ঝাঁপটে ধরার আশা মন থেকে ফেলে দাও- সুলতান আইউবী বললেন- ক্রুসেডাররা ভালোভাবেই জানে, আমরা বাইতুল মুকাদ্দাস যাচ্ছি। তাদের গতিবিধি প্রমাণ করছে, তারা বাইতুল মুকাদ্দাসের পথে আমাদের মোকাবেলায় আসবে না। একে তো নগরীতে এমন বাহিনী আছে, যারা কখনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। তাদেরকে নগরীর নিরাপত্তার জন্য রিজার্ভ রাখা হয়েছে। সেখান থেকে গুপ্তচর রিপোর্ট নিয়ে এসেছে, এই বাহিনী দিনরাত অবরোধে লড়াই করার ও অবরোধ ভাঙার মহড়া দিচ্ছে। ইতিমধ্যে আমরা যেসব অঞ্চল জয় করেছি, সেখানকার পালিয়ে যাওয়া সৈন্যরাও বাইতুল মুকাদ্দাস চলে গেছে। তাদের মধ্যে বর্মপরিহিত নাইটও আছে। আমাদের গোয়েন্দারা জানিয়েছে, অবরোধ চলাকালে এই নাইটরা ফটকের বাইরে এসে আক্রমণ করবে এবং প্রতিটি আক্রমণের পর নগরীতে ঢুকে পড়বে। এই পদ্ধতি তারা আমাদের থেকে শিখেছে। আঘাত হানো আর অদৃশ্য হয়ে যাও। কাজেই দুশমনকে অসতর্ক অবস্থায় ঝাঁপটে ধরার আশা বাদ দাও। দুশমন তোমাদের অপেক্ষায় প্রস্তুত দাঁড়িয়ে আছে। তারপরও খৃস্টানদের কোনো চৌকি থেকে কোনো দূত যেনো বাইতুল মুকাদ্দাস পৌঁছতে না পারে, আমি সেই ব্যবস্থা করে রেখেছি। বাইতুল মুকাদ্দাস ও তাদের চৌকিগুলোর মাঝে আমাদের গেরিলাদের বসিয়ে রেখেছি। তারা কাউকে জীবিত যেতে দেবে না। 

তাদের সেনাসংখ্যা সম্পর্কে গোয়েন্দারা বিভিন্ন তথ্য বলেছে। সে থেকে আমি অনুমান করেছি, বাইতুল মুকাদ্দাসের অভ্যন্তরে খৃস্টানদের নিয়মতান্ত্রিক সেনাসংখ্যা ষাট হাজারেরও কিছু বেশি হতে পারে। আমাদেরকে এ কথাটাও মাথায় রাখতে হবে যে, ওখানে মুসলমানরা কয়েদ ও নজরবন্দি অবস্থায় আছে। ফলে ভেতর থেকে তারা আমাদের কোনো সাহায্য করতে পারবে না। বিপরীতে খৃস্টান জনসাধারণ তাদের বাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। খৃস্টানরা তাদের। কিশোরদেরকেও তীরন্দাজির প্রশিক্ষণ দিয়ে রেখেছে। নগরীর প্রাচীরের উপর থেকে আমাদের উপর তীর সঠিক অর্থেই মুষলধারার বৃষ্টির ন্যায় আসবে। তীর ছোঁড়ার জন্য খৃস্টানরা নতুন ধরনের একটি ধনুক নিয়ে এসেছে, যেটি দেখতে ক্রুশের ন্যায়। তা দ্বারা ছোঁড়া তীর বেশ দূরেও যায় এবং নিশানাও অব্যর্থ হয়।

সুলতান আইউবী নকশা ধরে ধরে উপস্থিত সকলকে প্রতিটি স্থান ও রাস্তা ইত্যাদি দেখিয়ে দেন। পরে অবরোধ সম্পর্কে জরুরি দিক-নির্দেশনা প্রদান করে বললেন, এটি শেষ বৈঠক। কারো মনে কোনো সন্দেহ থাকলে দূর করে ফেলল। কোনো প্রশ্ন থাকলে তা যতো অর্থহীন হোক না কেন জিজ্ঞেস করে উত্তর জেনে নাও। কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ- যিনি সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধাভিযানে সুলতান আইউবীর সঙ্গে ছিলেন তার রোজনামচায় সুলতান ইউসুফের উপর কী বিভীষিকা নেমে এসেছিলো শিরোনামে লিখেছেন- সুলতান আইউবী (উক্ত শেষ বৈঠকে) রাসূলে আকরাম (সা.)-এর একটি হাদীস শোনান- যার জন্য সফলতার দরজা খুলে যায়, তাতে তার সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে যাওয়া উচিত। বলা যায় না, এই দরজা কখন বন্ধ হয়ে যায়। সুলতান আইউবী দ্রুত অধিকৃত অঞ্চল ও দুর্গ জয় করতে আসছিলেন। তাই তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস আক্রমণে বিলম্বের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি বলেছেন- আল্লাহ আমাদের সফলতার দরজা খুলে দিয়েছেন। বন্ধ হওয়ার আগেই তাতে ঢুকে পড়ো।…।

আমার বন্ধুগণ!- সুলতান আইউবী নকশাটা একধারে সরিয়ে রাখতে রাখতে বললেন- হিত্তীন যুদ্ধের আগে আমি তোমাদেরকে কয়েকটি কথা বলেছিলাম। সে কথাগুলোই আবার বলছি। এরপর আর কথা বলার সুযোগ পাবো না। পরস্পর জীবিত সাক্ষাৎ হবে কিনা, তাও বলতে পারি না। ইতিপূর্বে আমরা শুধু যুদ্ধ লড়েছি। গৃহযুদ্ধে একে অপরের রক্ত ঝরিয়েছি আর শত্রুকে আমাদের অঞ্চলে দুর্গ সুসংহত করতে ও বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রতিরক্ষা শক্ত করতে সময় ও সুযোগ দিয়েছি। তারপর আমরা আন্ডারগ্রাউন্ড লড়াই লড়তে থাকি। খৃস্টানরা আপন রূপসী কন্যাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাদের আমীর-উজির ও সামরিক-বেসামরিক অফিসারদের নিকট প্রেরণ করতে থাকে। তারা আমাদের সারিতে বিশ্বাসঘাতক ও কুচক্রী ঢুকিয়ে দেয়। এই নারী আর গাদ্দাররা যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে, সেসব তোমাদের কারুরই অজানা নয়। আলী বিন সুফিয়ান ও গিয়াস বিলবীস এবং তাদের বিভাগ বড় দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার সঙ্গে সেই অদৃশ্য অঙ্গনে দুশমনের মোকাবেলা করেছে। বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে আমার হাতে আমার অভিজ্ঞ অনেক কর্মকর্তা ও সালার মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়। একের পর এক বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে আর আমরা সেগুলো দমন করি।…

দুশমনের উদ্দেশ্য কী ছিলো? আমাদের চরিত্র ও নৈতিকতা ধ্বংস করা, ধর্ম ও ঈমানকে দুর্বল করা এবং আমাদের নতুন প্রজন্মকে মানসিক বিলাসিতায় অভ্যস্ত করে গড়ে তোলা। আমাদের মাঝে দুশমন গাদ্দার তৈরি করেছে। তাদের লক্ষ্য ছিলো, প্রথম কেবলার দখল অটুট রেখে আমাদের ঈমান-বিক্রেতা ভাইদের সাহায্যে পবিত্র মক্কাও দখল করে নেবে। তোমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, পাঁচটি বছর আমি দক্ষিণাঞ্চলে দুশমনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে ছিলাম। রেজিনাল্ড (প্রিন্স অর্নাত) পবিত্র মদীনার সামান্য দূর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলো। আমার ভাই আল-মালিকুল আদিল ও নৌবাহিনী প্রধান হুসামুদ্দীনের কৃতিত্ব যে, তারা সময়মতো তৎপর হয়ে ওঠে এবং ঐ খৃস্টানটাকে পেছনে হটিয়ে দেয়। আমি লোকটাকে নিজ হাতে হত্যা করে প্রতিশোধ নিয়েছি।…।

দুশমনের টার্গেট আমাদের উৎসগুলোকে বন্ধ করে দিয়ে সেগুলোকে খৃস্টানদের উৎসে পরিণত করা। আমাদের লক্ষ্য দুশমনের এই টার্গেটকে বানচাল করা। যুদ্ধের এদিকটাকে তোমরা সবসময় স্মরণ রাখবে। এটি আমাদের নৈতিকতার যুদ্ধ। ইসলাম তরবারীর জোরে বিস্তার লাভ করেছিলো কিনা সে বিতর্ক ভিন্ন। কিন্তু আমি ইসলামের সুরক্ষার জন্য তরবারীকে জরুরি মনে করি। জাতি সেই তরবারী সৈনিকদের হাতে তুলে দিয়েছে। ইতিহাস আমাদের পানে তাকিয়ে আছে। মহান আল্লাহর দৃষ্টিও জাতির সৈনিকদের উপর নিবদ্ধ। আল্লাহর রাসূলের পবিত্র আত্মা আমাদের দেখছেন। ভেবে দেখো, আমাদের দায়িত্ব কতো মহান ও কতো পবিত্র। আল্লাহর সৈনিকরা শাসন করে না- আল্লাহর শাসন ও সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিধান করে মাত্র।…

বলতে বলতে সুলতান আইউবী আবেগময় হয়ে ওঠেন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন- আহ আমার বন্ধুগণ! ষোল হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসের কথা স্মরণ করো। সেদিন হযরত উমর ইবনুল আস ও তার সঙ্গী সেনাপতিগণ বাইতুল মুকাদ্দাসকে কাফেরদের থেকে মুক্ত করেছিলেন। হযরত উমর (রা.) তখন খলীফা ছিলেন। তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস গমন করেন। হযরত বিলাল (রা.) তাঁর সঙ্গে। তাঁরা সকলে মসজিদে আকসায় নামায আদায় করেন। সেই নামাযের আযান দীর্ঘ সময় পর হযরত বিলাল। (রা.) দিয়েছিলেন। হযরত বিলাল রাসূলে আকরাম (সা.)-এর ওফাতের পর এমন নীরব হয়ে গিয়েছিলেন যে, মানুষ তাঁর জ্বালাময়ী কণ্ঠ ভুলে গিয়েছিলো। তিনি আযান দেয়া ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু মসজিদে আকসায় এসে হযরত উমর (রা.) তাকে বললেন, বিলাল! মসজিদে আকসা ও বাইতুল মুকাদ্দাসের দরজা-দেয়াল বহুদিন যাবত আযান শোনেনি। আযাদীর প্রথম আযানটা তুমিই দাও। রাসূলে মকবুল (সা.) এর ওফাতের পর হযরত বিলাল এ-ই প্রথম আযান দিলেন।…

আমার প্রিয় বন্ধুগণ! আমাদের আমলে মসজিদে আকসা পুনরায় আযানের সুর ভুলে গেছে। নব্বইটি বছর যাবত এই মহান মসজিদের দরজা-দেয়াল একজন মুয়াজ্জিনের পথপানে তাকিয়ে আছে। স্মরণ রেখো, মসজিদে আকসার আযান সমগ্র পৃথিবীতে শোনা হয়। খৃস্টানরা সেই আযানের গলা টিপে ধরে রেখেছে। এই পবিত্র লক্ষ্যটাকে সামনে রেখে অগ্রসর হও। আমরা সাধারণ কোনো যুদ্ধ লড়তে যাচ্ছি না। আমরা আপন রক্তের ইতিহাসের সেই অধ্যায়টি পুনরায় লিখতে যাচ্ছি, যা আমর ইবনুল আস ও তার সঙ্গীরা লিখেছিলেন। যদি কামনা করো, মাথায় আলো নিয়ে মহান আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে, যদি কামনা করো,অনাগত বংশধর তোমাদের কবরের উপর ফুল ছিটাক; তাহলে তোমাদেরকে সেই মিম্বরটি বাইতুল মুকাদ্দাসে স্থাপন করতে হবে, যেটি বিশ বছর আগে নুরুদ্দীন জঙ্গী মরহুম ওখানে স্থাপনের জন্য তৈরি করিয়েছিলেন।

সুলতান আইউবী মিম্বরটি সকলকে দেখালেন এবং বললেন- এই মিম্বর জঙ্গী মরহুমের বিধবা ও কন্যা বয়ে নিয়ে এসেছে। আমাদেরকে সেই নারীর লাজ রক্ষা করতে হবে, যে জাতির দুশ মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এখানে এসেছে। উদ্দেশ্য, আমাদের কেউ যেনো যুদ্ধের ময়দানে পিপাসার মারা না যাই, কেউ যাতে আহত হয়ে ব্যান্ডেজ-চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না থাকি। তোমরা জানো, আমি কখনো যুদ্ধের ময়দানে নারীর উপস্থিতির পক্ষে ছিলাম না। কিন্তু এই মেয়েগুলোকে এ জন্য রেখে গিয়েছি, যেনো আত্মমর্যাদা ও জাতীয় মর্যাদার এই চিহ্নটা আমাদের সম্মুখে থাকে এবং আমাদের স্মরণ থাকে, আমাদের এদেরই ন্যায় কন্যারা বাইতুল মুকাদ্দাসে কাফেরদের হিংস্রতা ও পাশবিকতার শিকার হয়ে আছে। মনে রেখো আমার বন্ধুগণ! যে জাতি জাতির কন্যা ও শহীদদের কথা ভুলে যায়, আল্লাহও সে জাতিকে ভুলে যান এবং তাদের ভাগ্যে আজীবনের জন্য অভিশাপ লিখে দেয়া হয়। কিয়ামতের দিন তোমরা অভিশপ্তদের মাঝে উত্থিত হবে, নাকি আল্লাহর রহমত ও রাসূলের সুপারিশপ্রাপ্তদের মাঝে, সে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব তোমাদের।

সুলতান আইউবী এরূপ আবেগময় কথা বলায় অভ্যস্ত ছিলেন না। কিন্তু বাইতুল মুকাদ্দাসের ব্যাপারে তিনি এতোই আবেগপ্রবণ ছিলেন যে, যখনই ইতিহাসের এ ভূখণ্ডটি আলোচনায় উঠে আসতো, তাঁর চোখে অশ্রু নেমে আসতো এবং তিনি অস্থির হয়ে উঠে পায়চারি করতে শুরু করতেন। এই শেষ বৈঠকে তিনি তাঁর সালার প্রমুখদের মাঝে এমন আবেগ জাগিয়ে তোলেন যে, তিনি এজলাস ত্যাগ করে বেরিয়ে যাওয়ার পরও কারো মুখ থেকে কোনো কথা ফোটেনি। তাদের গতি-প্রকৃতিই বদলে গেছে। তারা সোজা নিজ নিজ বাহিনীর নিকট চলে যায় এবং স্ব স্ব কমান্ডারদেরকেও অনুরূপ আবেগময় করে তোলে।

সকলে চলে গেলে সুলতান আইউবী নৌবাহিনীর কমান্ডার আল ফারেস বায়দারীনকে ডেকে কাছে বসিয়ে জিজ্ঞেস করেন, সমুদ্রের খবর কী? আল-ফারেস জানান, আমার জাহাজ টহল দিয়ে ফিরছে এবং আমি আলেকজান্দ্রিয়া থেকে যথারীতি বার্তা পেয়ে আসছি, যা থেকে প্রমাণিত হচ্ছে ক্রুসেডারদের নৌবহরের কোনো চিহ্ন নেই। টায়েরের বন্দর এলাকায় আমার রণতরী অবস্থান করছে এবং ছোট ছোট পালতোলা ডিঙিতে করে মৎস্যজীবির বেশে আমার গোয়েন্দারা সেখানে যাওয়া-আসা করছে। টায়ের এবং তার আগে ক্রুসেডারদের বহরে কোনো সংযোজন হয়নি। যে তরীগুলো বিদ্যমান আছে, সেগুলো প্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে। তারা জাহাজে এমন অগ্নিগোলার ব্যবস্থা করে রেখেছে, যেগুলো দূর থেকে উড়ে এসে পালে আগুন ধরিয়ে দিতে সক্ষম।

এই গোলা এতো দূর থেকে আসতে পারে, যতোটুকু দূর পর্যন্ত তোমাদের প্রজ্বলমান সলিতাওয়ালা তীর যেতে পারে- সুলতান আইউবী বললেন- ভয় পাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।

আমাদের কারো অন্তরে কোন ভীতি নেই- আল-ফারেস বললেন নৌ-কমান্ডোরা এতোটুকু প্রস্তুত যে, নৌ-যুদ্ধের সময় তারা ছোট ছোট ডিঙিতে করে দুশমনের জাহাজের নিকটে গিয়ে তাতে ছিদ্র করে ফেলবে এবং তার উপর আগুনের গোলা নিক্ষেপ করবে।

যদি যুদ্ধটা রাতে হয়- সুলতান আইউবী বললেন- দিনের বেলা কোন কমান্ডো যেনো সমুদ্রে না নামে। আবেগতাড়িত হয়ে কাজ করলে জীবনই নষ্ট হবে। সাবধান থাকতে হবে আল-ফারেস! তোমরা যেমন মৎস্য শিকারীর বেশে টায়ের পর্যন্ত গোয়েন্দা প্রেরণ করো, তেমনি দুশমনের গোয়েন্দাও কোনো না কোনো ছদ্মবেশে তোমাদের জাহাজের নিকট এসে থাকবে। জাহাজগুলোকে একটি অপরটি থেকে দূরে রাখবে, যাতে হঠাৎ আক্রমণ হলে সবগুলো একসঙ্গে ঘেরাওয়ে পড়ে না যায়। এমনভাবে ছড়িয়ে রাখবে, যেনো প্রয়োজনে দুশমনকে ঘিরে ফেলতে পারো। দিনে পতাকা আর রাতে বাতির মাধ্যমে পরস্পর যোগাযোগ রক্ষা করবে।

আল-ফারেস যখন সুলতান আইউবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন, তখন রাতের শেষ প্রহর। সেখানেই তিনি ফজর নামায আদায় করেন।

 আল-ফারেস!- আল-ফারেস সন্নিকটেই কারো ডাক শুনতে পান। মোড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখেন ইন্টেলিজেন্সর কমান্ডার হাসান ইবনে আবদুল্লাহ। হাসান এগিয়ে কাছে এসে আল-ফারেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জিজ্ঞেস করেন ধন্যবাদ ভাই। একই সঙ্গে দুটি মেয়েকে বিয়ে করেছে বুঝি? দুজনকেই সঙ্গে রেখেছো? নিজের সঙ্গে তাদেরও খুন করতে চাও নাকি?

উহ হাসান ভাই!- আল-ফারেস অন্ধকারে কণ্ঠে হাসানকে চিনতে পেরে বললেন- ওরা তো আশ্রিতা মেয়ে দোস্ত! কূলে একস্থানে লুকিয়ে ছিলো। বলছে যাবাবর। সমগ্র গোত্র নাকি যুদ্ধের কবলে পড়ে ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট হয়ে মরেছে।

আর ভাগ্যক্রমে শুধু তারা বেঁচে রয়েছে এবং সমুদ্রের তীর পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে- হাসান ইবনে আবদুল্লাহ বললেন- খৃস্টানরা অন্যসব যাবাবরদের ঘোড়র পায়ের নীচে পিষে মারলো আর এমন রূপসী দুটি মেয়েকে জীবিত ছেড়ে দিলো! তুমি বোধ হয় সমুদ্রে থেকে থেকে স্থলের মানুষগুলোর স্বভাব-চরিত্র ভুলে গেছো দোস্ত!

আল-ফারেস হেসে ওঠে বললেন- হাসান ভাই! গোয়েন্দাগিরি করতে করতে এখন তুমি কাক-চিলকেও ক্রুসেডারদের গোয়েন্দা ভাবতে শুরু করেছে। বলতে চাচ্ছো, এই মেয়ে দুটো দুশমনের গোয়েন্দা হতে পারে, তাই না?

হতে পারে- হাসান বললেন- তুমি খানিকটা বেশি প্রাণোচ্ছল মানুষ আল-ফারেস! ভালো হবে, তুমি মেয়ে দুটোকে টায়েরের নিকট কূলে রেখে আসো। অপরিচিত মেয়েদের জাহাজে রাখা ঠিক হবে না।

 কেন, মিসর নিয়ে ওদের বিবাহ করে নেয়া কি পুণ্যের কাজ হবে না?- আল-ফারেস বললেন- কিংবা আমি তাদের একজনকে বিয়ে করে নেবো আর অপরজনকে অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেবো। এরা গরীব মেয়ে। এদেরকে কূলে কোথাও ফেলে আসলে জানো তো খৃস্টানরা এদের সঙ্গে কীরূপ আচরণ করবে।

হতে পারে তারাও খৃস্টান- হাসান ইবনে আবদুল্লাহ বললেন শোনো আল-ফারেস! তুমি অবুঝ শিশু নও। সাধারণ সৈনিকও নও। তুমি নৌ-বাহিনীর একজন অভিজ্ঞ ও গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডার। ভাবতে ও বুঝতে চেষ্টা করো। আমি রিপোর্ট পেয়েছি, অবসর সময়টা তুমি ওদের সঙ্গে হেসে-খেলে অতিবাহিত করে। এক হাজার কসম খেলেও আমি মেনে নেবো না, তুমি ওদেরকে পবিত্র মেয়ে বানিয়ে রেখেছে। তারা যদিও তোমাকে না দেয়, তুমি তো নিজেকে ধোঁকা দিতে পারো। সুন্দরী ও যুবতী মেয়েদের যাদু যে কোন পুরুষকে কর্তব্য থেকে বিচ্যুৎ করতে পারে। অনেক কিছু হতে পারে আল-ফারেস! বলছি, মেয়েগুলোকে তুমি কোথাও রেখে আসো। 

যদি আমি তোমার পরামর্শ মান্য না করি, তাহলে?

তখন আমাকে দেখতে হবে মেয়েগুলো আসলে কারা ও কেমন হাসান ইবনে আবদুল্লাহ বললেন- যদি সন্দেহভাজন বলে প্রতীয়মান হয়, তাহলে জাহাজ থেকে নামিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসতে বাধ্য হবো। কিন্তু বিষয়টা নিষ্পত্তির ভার আমি তোমারই উপর অর্পণ করতে চাই। তুমি আমার পুরনো বন্ধু। তুমি নিজেই সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হও, যাতে আমাকে কর্তব্য পালনে বন্ধুত্বকে বিসর্জন দিতে না হয়।

আমার দিক থেকে কোনো অন্যায় আচরণের আশংকা করো না হাসান!- আল-ফারেস বললেন- তুমি বন্ধুত্বের কথা বলছো। আমি তো কর্তব্য পালনে নিজের জীবনও কুরবান করে দিতে প্রস্তুত আছি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, মেয়ে দুটো আমার কোনো ক্ষতি করবে না। তাদের প্রতি যদি আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ জাগ্রত হয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আমি তাদেরকে কূলে নিয়ে রেখে আসবো কিংবা সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলবো।

জাহাজে কখন ফিরবে? হাসান ইবনে আবদুল্লাহ জিজ্ঞেস করেন।

নামায পড়ে কিছুক্ষণ ঘুমাবো। অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছি- আল ফারেস বললেন- তারপর চলে যাবো। সন্ধ্যা নাগাদ জাহাজে গিয়ে পৌঁছবো।

***

আল-ফারেস থেকে বিদায় নিয়ে হাসান ইবনে আবদুল্লাহ সেই কক্ষে চলে যান, যেখানে তার বিভাগের লোকেরা থাকে। তাদের একজনকে বাইরে ডেকে এনে বললেন, আল-ফারেস বায়দারীনের জাহাজ অমুক জায়গায় নোঙ্গর ফেলে অবস্থান করছে। তুমি জাহাজে গিয়ে আল ফারেসের নায়েব রউফ কুর্দিকে বলবে, আমাকে হাসান ইবনে আবদুল্লাহ প্রেরণ করেছেন।

হাসান ইবনে আবদুল্লাহ রউফ কুর্দির নামে বার্তা প্রদান করেন। এই লোকটিকে কোনো কাজে জুড়িয়ে দাও। জাহাজে আশ্রিতা মেয়ে দুটো সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে হবে, জাহাজে ওদের কোনো গোপন তৎপরতা আছে কিনা। যদি থাকে, তাহলে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমি এ কাজে তোমার সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করছি।

হাসান ইবনে আবদুল্লাহ লোকটিকে জরুরি দিক-নির্দেশনা প্রদান করে একটি পালতোলা নৌকায় তুলে বিদায় করে দেন। বাতাসের গতি অনুকূল ও তীব্র ছিলো। নৌকা অল্প সময়ের মধ্যে জাহাজের সঙ্গে গিয়ে ভিড়ে। জাহাজ থেকে সিঁড়ি ফেলে তাকে উপরে তুলে নেয়া হলো। লোকটি রউফ কুর্দির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। তাকে হাসান ইবনে আবদুল্লাহর বার্তা প্রদান করে এবং নিজেও মৌখিকভাবে উদ্দেশ্যের কথা ব্যক্ত করে। কিন্ত রউফ কুর্দির চেহারা বলছে, লোকটাকে তার ভালো লাগেনি। তবে বিপক্ষে কিছু বলাও তো সম্ভব নয়। তার জানা আছে, সুলতান আইউবীর অন্তরে একজন গুপ্তচরের ততোটুকু মর্যাদা আছে, যতোটুকু একজন সালারেরও নেই। একজন গোয়েন্দার রিপোর্ট একজন সালারকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে। অগত্যা রউফ কুর্দি উপরে উপরে হাসান ইবনে আবদুল্লাহর এই গোয়েন্দা লোকটিকে বরণ করে নেয় এবং খাতির-যত্ন করতে শুরু করে।

আপনি মেয়ে দুটোকে প্রথম দিন থেকেই দেখে আসছেন- গোয়েন্দা রউফ কুর্দিকে বললো- তাদের ব্যাপারে আপনার সামান্যতম সন্দেহ থাকলে বলুন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমি তাদেরকে আসকালান নিয়ে যাবো।

না, এ যাবত তাদের মধ্যে সন্দেহজনক কোনো আচরণ দেখিনি- রউফ কুর্দি উত্তর দেয়। বেশিরভাগ সময় তারা আল-ফারেসের কক্ষেই থাকে।

সঙ্গে সঙ্গে রউফ কুর্দির ফ্লোরির কথা মনে পড়ে যায়। গোয়েন্দা লোকটা যদি একদিন আগেও আসতো, তাহলে রউফ কুর্দি বলতো, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এদেরকে এখান থেকে নিয়ে যাও। কারণ, আমাদের কমান্ডার সারাক্ষণ এদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু এই গত রাতই ফ্লোরির সঙ্গে তার ভাব গড়ে ওঠেছে। রোজি তাদের এই গোপন সম্পর্কের সব জানে। রউফ কুর্দি এখন কোনো মূল্যে ফ্লোরিকে হারাতে চাচ্ছে না। তার অন্তরে আল-ফারেসের শত্রুতা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিলো বটে; কিন্তু ফ্লোরির ভাবনায় এখন আসল কথা বলা যাচ্ছে না।

আমি আপনার সঙ্গে থাকবো- গোয়েন্দা বললো- আল-ফারেস যেনো জানতে না পারে আমি গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছি। আপনি আদেশনামা পাঠ করেছেন। আমি নিজ চোখে দেখবো, মেয়ে দুটো কেমন এবং কী করে। মেয়েগুলো শত্রুর গোয়েন্দা হতে পারে। নাও যদি হয়, যদি শুধু এটুকু প্রমাণ পাই যে, আল-ফারেস কাজের সময়েও এদের নিয়ে নিমগ্ন থাকে, আমি তাদেরকে এখানে থাকতে দেবো না। আল-ফারেস যদি টের পেয়ে যান আমি এখানে গোয়েন্দাগিরি করছি, তাহলে ধরে নেবো, তাকে বিষয়টা আপনি বলে দিয়েছেন। কারণ, আপনি ছাড়া আমার উদ্দেশ্য আর কেউ জানে না।

এটি যুদ্ধজাহাজ। জাহাজে আমলা-কর্মচারি আছে। আছে নৌযুদ্ধের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্থল বাহিনীও। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, রান্না-বান্না ও অন্যান্য কাজের জন্য আছে অনেক কর্মচারি। কাজেই একজন লোকের পক্ষে নিজের আসল রূপ গোপন রেখে অবস্থান করা কঠিন নয়। আল-ফারেস কমান্ডার। প্রত্যেককে আলাদা ডেকে ডেকে বলে দেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয় যে, ঐ লোকটি বহিরাগত। ওর সঙ্গে কথা বলবে না।

গোয়েন্দা সেদিনই মেয়ে দুটোকে দেখে রউফ কুর্দিকে জানিয়ে দেয় এরা যাযাবর মেয়ে নয়, বিপদগ্রস্তও নয়। আমার সন্দেহ জেগে গেছে।

ওরা অনেক দিন যাবত আমাদের সঙ্গে থাকছে- রউফ কুর্দি বললো আমরা তো সন্দেহ করার মতো কিছু দেখিনি।

আমার গোয়েন্দা চোখ যা দেখে, আপনার চোখ তা দেখে না গোয়েন্দা বললো- শীতল অঞ্চলের যাযাবর নারীর গায়ের রং এমনই হয়ে থাকে; কিন্তু তাদের চোখের রং এরূপ হয় না। তাছাড়া তাদের মধ্যে এমন সাজগোজ-পরিপাটিও থাকে না। মুহতারাম! আমরা এরূপ মেয়েদের সঙ্গেই যুদ্ধ করে থাকি। এই মেয়েগুলো এখানে থাকবে না।

ঠিক আছে, কিছুদিন দেখেন- রউফ কুর্দি বললো- পাছে এমন না হয়, মেয়েগুলো আসলেই বিপদগ্রস্ত আর আপনি তাদেরকে আরেক বিপদের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছেন।

হ্যাঁ- গোয়েন্দা বললো- আমি তাড়াহুড়া করবো না। কয়েক দিন দেখেই তবে সিদ্ধান্ত নেবো।

***

সুলতান আইউবী তাঁর সালাদের ঠিকই বলেছেন, বাইতুল মুকাদ্দাসে অবস্থানরত খৃস্টান সেনাপতিরা জানে, ইসলামী ফৌজ বাইতুল মুকাদ্দাস আক্রমণ করতে আসছে। এদিকে সুলতান আইউবী তাঁর সালারদেরকে সর্বশেষ দিক-নির্দেশনা প্রদান করছেন, ওদিকে বাইতুল মুকাদ্দাসে খৃস্টান হাইকমান্ড আপন সেনাপতিদেরকে অবরোধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত করছে।

আমরা সালাহুদ্দীন আইউবীকে পথে প্রতিহত করবো না- খৃস্টানদের কমান্ডার ইন চীফ বললেন তার বাহিনী সংখ্যায় আমাদের চেয়ে কম অবশ্যই। কিন্তু তার অস্ত্র ও রসদের কোন ভাবনা নেই। সাহায্য ব্যবস্থাপনা তার খুবই মজবুত ও বিশ্বস্ত। লোকটাকে বাইতুল মুকাদ্দাস অবরোধ করতে দাও। আমাদের কাছে দীর্ঘ সময়ের জন্য খাদ্য সামগ্রী ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি মজুদ রয়েছে। অবরোধ দীর্ঘ হতে হতে যদি খাদ্য সামগ্রীর অভাব দেখা দেয়, তাহলে আমরা নগরীর মুসলমানদেরকে না খাইয়ে মারবো। তাতে আমাদের অনেক খাদ্য বেচে যাবে। আমার সবচে বেশি ভরসা নাইটদের উপর। তারা বাইরে বেরিয়ে আক্রমণ করবে এবং ফিরে আসবে। আমি আপনাদেরকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আইউবীর অবরোধ ব্যর্থ হবে।

আপনি বাহিনীর অবস্থাকে বিবেচনায় আনেননি- এক সেনাপতি বললো- নগরীতে অবস্থানরত বাহিনীর অর্ধেক এমন যে, তারা হিত্তীন থেকে আসকালান পর্যন্ত সংঘটিত যুদ্ধগুলো থেকে পালিয়ে এসেছে এবং তাদের যুদ্ধ করার স্পৃহায় ভাটা পড়ে গেছে। বরং এ কথা বললেও ভুল হবে না, এদের উপর সালাহুদ্দীন আইউবীর ভীতি সঞ্চারিত হয়ে গেছে। যেসব সৈন্য বাইরের রণাঙ্গনগুলোতে যায়নি, তাদেরই শুধু মনোবল চাঙ্গা রয়েছে।…

আমরা এ সমস্যার সমাধান বের করে নিয়েছি- কমান্ডার ইন চীফ বললেন- মহামান্য পাদ্রী ফৌজের মাঝে ঘোরাফেরা করছেন। তিনি ইঞ্জিলের উদ্ধৃতি দিয়ে সৈন্যদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন, ইসলামী বাহিনীকে পরাজিত করা জরুরি। কেন জরুরি তারও ব্যাখ্যা প্রদান করছেন। এ-ও বোঝাচ্ছেন, এটা তোমাদের ধর্মীয় কর্তব্য। সেনাপতি ও অন্যান্য কমান্ডারগণ যদি একে ধর্মযুদ্ধ জ্ঞান করে লড়াই করে, তাহলে সাধারণ সৈন্যরা ধর্মীয় চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করবে। আমরা যদি বাইতুল মুকাদ্দাসের যুদ্ধে পরাজয়বরণ করি, তাহলে নোম উপসাগরও আমাদের আশ্রয় দিতে পারবে না। সালাহুদ্দীন আইউবী সফল হয়েছেন কেন? কারণ, তিনি পাকা ধার্মিক। আমরা তাকে গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে ধ্বংস করার চেষ্টা করছি। কিন্তু তিনি সে যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন। যেসব মুসলিম শাসককে আমরা তার বিরোধি বানিয়ছিলাম, তারা তার অনুগত। হয়ে গেছে। আমরা আমাদের মেয়েদের দ্বারা তার সামরিক শক্তি ও সাম্রাজ্যকে দুর্বল করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমাদের এই ত্যাগও বৃথা গেছে। এটা বোধ হয় আমাদের ভুলই ছিলো যে, আমরা মেয়েদের বহার করেছি এবং এই আশায় বসে ছিলাম যে, সালাহুদ্দীন আইউবী রে বসেই মরে যাক।…

আমাদের কোনো ত্যাগ ব্যর্থ যায়নি- সভায় উপস্থিত পোপ বললেন আপনার এই চিন্তা ভুল যে, দুটি ধর্মের যুদ্ধ শুধু সৈন্যরাই লড়ে থাকে। আপন ধর্মের বিজয়-প্রতিষ্ঠা এবং শত্রু ধর্মের ধ্বংসের জন্য তরবারী আবশ্যক বটে। কিন্তু শত্রুর চিন্তা-চেতনা বিনষ্টের জন্য সেই পদ্ধতিটি আবশ্যকীয় ছিলো, আপনি যার ব্যাপারে বলেছেন, আমাদের সেই ত্যাগ বৃথা গেছে। উঁচুমানের রূপের বদৌলতে আমাদের যে মেয়েদের পদস্থ শাসক-অফিসারদের স্ত্রী হয়ে, রাজকীয় জীবন-যাপন করার কথা ছিলো, তারা নিজেদেরকে এবং নিজেদের ভবিষ্যৎকে ক্রুশের জন্য কুরবান করে মুসলমানদের হেরেমে অপদস্ত-লাঞ্ছিত হয়েছে। তারা মুসলমানদের মাঝে গৃহযুদ্ধ ঘটিয়েছে, মুসলিম শাসকদের ঈমান ক্রয় করে এনেছে। একই দেশের গুরুত্বপূর্ণ শাসকদের মাঝে বিরোধ সৃষ্টি করে একজনকেঅপরজনের শত্রুতে পরিণত করেছে। এসব কীর্তির জন্য আমি তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।…

ক্রুশের সেনাপতিগণ! তোমরা ভুলে যেয়ো না, দুশমনকে খুন করার উত্তম পন্থা হচ্ছে তাদের মাঝে মানসিক বিলাসিতা ও যৌনতা সৃষ্টি করে দেয়া। তাদেরকে রাগ-রং ও কল্পনার সুখ-সমুদ্রে ডুবিয়ে দাও। তাদের শাসকগোষ্ঠীকে ক্ষমতার মোহ ও বিত্তের গোলাম বানিয়ে তোলো। মুসলমান দুঃসাহসী সৈনিক। সামরিক চেতনা ও ধর্মযুদ্ধের (জিহাদের) উন্মাদনা মুসলমানদের মাঝে যতোটুকু আছে, ততোটুকু আমাদের মাঝে নেই। মুসলমান যে পরিমাণ সুদক্ষ সেনাপতি জন্ম দিয়েছে, আমরা তা. পারিনি। এটা তাদের ধারা। আমরা যদি তাদের চিন্তা-চেতনা পরিবর্তন করতে না পারি, তাহলে তাদের এই চেতনা ও ধর্মীয় উন্মাদনার এই ধারা অব্যাহত থাকবে। আর তা-ই যদি থাকে, তাহলে, ক্রুশের পতন ঘটবে। ইসলাম ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ভারতবর্ষ পার হয়ে চীন পর্যন্ত চলে গেছে। চীনের নৌ-বাহিনী প্রধান একজন মুসলমান। ওখানকার অনেক সেনাপতি এখনো মুসলমান। হিন্দুস্তানের পূর্বাঞ্চলে বড় বড় দ্বীপে গিয়ে দেখে আসো, সেখানেও আরব তথা মুসলমানদের শাসন দেখতে পাবে।…।

আপনি এই প্লাবন শুধু তরবারী দ্বারা রুখতে পারবেন না। এর জন্য আপনাকে অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হবে। ইসলামের যে কেন্দ্রটাকে মুসলমানরা খানায়ে কাবা বলে থাকে, তাকে নিষ্প্রাণ করে দিতে হবে।

বাইতুল মুকাদ্দাসের দখল অটুট রাখতে হবে। মুসলমান শাসক ও রাজা বাদশাহগণ যে যেখানে থাকুন না কেন, সামরিক ও আর্থিক সাহায্য দিয়ে তাদেরকে অথর্ব করে রাখতে হবে। সেই সঙ্গে তাদের হেরেমে আমাদের অভিজ্ঞ মেয়েদেরকে ঠিক সেভাবে ঢুকিয়ে দিতে হবে, যেভাবে আরবের রাজ্যগুলোতে ঢুকিয়ে রেখেছে। এই পন্থাটা আমরা ইহুদীদের নিকট থেকে শিখেছি। তারা মুসলমানদের চরিত্র ধ্বংস ও ধর্মের মূলোৎপাটনে বেশ চমৎকার পরিকল্পনা তৈরি করে নিয়েছে এবং সে অনুপাতে কাজও করছে। তারা আমাদেরকে সাহায্য প্রদান করছে। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, অনতিবিলম্বে বাইতুল মুকাদ্দাসের উপর আমাদের একক দখল প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। তার আশপাশের দূর দূরান্তের অঞ্চলও আমাদের দখলে এসে যাবে। মুসলিম রাজ্যগুলো খণ্ডিত হয়ে হয়ে একে অপরের শত্রুতে পরিণত হবে। অন্তত তারা। নিজেরা ঐক্যবদ্ধ থাকবে না। ইহুদীদের বিশেষজ্ঞরা ঠিকই বলেছেন যে, মুসলমান নিজেদেরকে রাজার আসনে আসীন ভাববে বটে; কিন্তু রাজত্ব ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বাগডোর আমাদের হাতে থাকবে। এ কাজটা আপনি আমাদের উপর ছেড়ে দিন। এই গোপন ও আন্ডারগ্রাউন্ড কাজ আঞ্জাম দেয়ার দায়িত্ব বিশেষজ্ঞজন ও ধর্মী নেতাদের। আপনি সৈনিক। যুদ্ধের ময়দানের কথা বলুন। আপনার অতিশয় ভয়ঙ্কর এক শত্রু বাইতুল মুকাদ্দাস আক্রমণ করতে আসছে। তাকে কীভাবে পরাজিত করবেন চিন্তা করুন।

***

এক রবিবারের সকাল বেলা। ১১৮৭ সালের সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখ। সুলতান আইউবী বিস্ময়কর দ্রুততার সাথে বাইতুল মুকাদ্দাস পৌঁছে যান। হিজরী ক্যালেন্ডার মোতাবেক দিনটি ৫৮৩ হিজরীর ১৫ রজব। ক্রুসেডাররা সুলতান আইউবীর জন্য অপেক্ষমান ছিলো। কিন্তু সুলতান এতো দ্রুত এসে পড়বেন তারা ভাবেনি। তিনি পথে উঁচুতে অবস্থিত ক্রুসেডারদের দুর্গ ও পোস্টগুলোকে এড়িয়ে এগিয়ে যান। দুর্গগুলো থেকে বাইতুল মুকাদ্দাসে সময়ের আগে সংবাদ পৌঁছোনোর জন্য দূত প্রেরণ করা হয়েছিলো। কিন্তু তারা একজনও গন্তব্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়নি। তার প্রমাণ, রাতভর পথ চলে ভোরবেলা সুলতান আইউবীর সম্মুখ ইউনিট যখন শহর গিয়ে পৌঁছে, তখন নগরীর প্রাচীরের উপর দু-চারজন সান্ত্রী দণ্ডায়মান ছিলো মাত্র। নগরীর ফটক বন্ধু ছিলো। ভেতর থেকে গীর্জার ঘন্টার শব্দ শোনা যাচ্ছিলো।

নাকাড়া ও বিউগল বেজে ওঠে। প্রাচীরের উপর চতুর্দিকে একের পর এক মাথা উত্থিত হতে শুরু করে। লোহার টুপি পরিহিত মাথাগুলো। সকলের হাতে ধনুক। ধীরে ধীরে মাথার সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে মনে হলো, যেনো প্রাচীরের উপর মানবমুণ্ডের আরেক প্রাচীর দাঁড় করানো হয়েছে। নগরীর পশ্চিম দিকে খোলামেলা একটি অঞ্চল। সুলতান আইউবী তার বাহিনীকে সেখানে ছাউনি স্থাপনের নির্দেশ দিয়ে নিজে দেখতে চলে গেছেন, প্রাচীর কোন্‌দিক থেকে দুর্বল, কোন্ স্থানে ছিদ্র করা যায় এবং কোথাও থেকে সুড়ঙ্গ খনন করা যায় কিনা। শত্রুর দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেঙে ছিদ্র করার জন্য সুলতান আইউবীর আছে একদল বিখ্যাত জানবাজ সৈনিক।

ইসলামী ফৌজ নগরীর চারদিকে অবস্থান করছে। বড় সমাবেশটা পশ্চিম প্রান্তে। সুলতান আইউবী নগরীর চারদিকে ঘুরে-ফিরে প্রাচীর পর্যবেক্ষণ করছেন। পশ্চিম দিকে অবস্থানরত বাহিনীর সালার আগুন ও পাথর নিক্ষেপকারী মিনজানিক স্থাপন করতে শুরু করেছে। ক্রুসেডাররা তাদের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা মোতাবেক নগরীর একটি ফটক খুলে দেয়। প্রথমে বর্মপরিহিত নাইটরা ঘোড়ায় চড়ে হাতে বর্শা তাক করে দ্রুতগতিতে বেরিয়ে পড়ে এবং মিনজানিক স্থাপনরত মুসলিম সৈন্যদের উপর আক্রমণ করে বসে। তারা বেরিয়ে আসামাত্র ফটক বন্ধ হয়ে যায়।

বেশ প্রশস্ত জায়গা। ঘোড়ার ছুটে চলতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। নাইটরা বর্মপরিহিত। তীর তাদের গায়ে কোনো ক্রিয়া করতে পারছে না। তাছাড়া তাদের এই আক্রমণ এতোই আকস্মিক, তীব্র ও অপ্রত্যাশিত ছিলো যে, মুসলিম সৈন্যরা কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। বেশ কজন মুসলিম সৈন্য নাইটদের বর্শার আঘাতে আহত ও শহীদ হয়ে যায়। অনেকে ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে কার্যসিদ্ধি করে উল্কার ন্যায় ছুটে আসা নাইটরা ঝড়ের ন্যায় কেটে পড়ে। ফটক খুলে যায়। তারা নগরীতে ঢুকে পড়ে। আবার ফটক বন্ধ হয়ে যায়।

ময়দানে আহত মুসলিম সৈন্যরা ছটফট করছে। অক্ষত সৈনিকরা তাদের তুলে আনতে ছুটে যায়। এমন সময় দু-তিনটি নারীকণ্ঠ ভেসে ওঠে- সরে যাও, এ কাজ আমাদের। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো মেয়ে ছুটে আসে। তারা গাছের ডালের তৈরি স্ট্রেচার নিয়ে আসে। কয়েকজনের কাঁধে পানির মশক। উপর থেকে খৃস্টানদের তীর ছুটে আসছে। সেই তীরের আঘাতে দু-তিনটি মেয়ে লুটিয়ে পড়ে। দেখে মুসলিম তীরন্দাজ সৈন্যরা এগিয়ে আসে। তারা পাল্টা তীর ছুঁড়তে শুরু করে। এবার নগরীর প্রাচীরের উপর থেকে আসা তীরবৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়। উভয় দিকের তীরের ছায়ায় মেয়েরা জখমীদের তুলে পেছনে গাছের ছায়ায় নিয়ে যায়।

সে যুগের কাহিনীকার আসাদুল আসাদী তাঁর অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপিতে লিখেছেন, সৈনিকরা যে কোনো যুদ্ধেই আহত হতো, তাদের তুলে ডাক্তারের নিকট নিয়ে যাওয়া হতো। কিন্তু এই সেবাটা করতো তাদেরই ন্যায় পুরুষ সৈনিকরা। এ কাজে তারা বিন্দুমাত্র ক্রটি করতো না। কিন্তু বাইতুল মুকাদ্দাসের এই অবরোধ যুদ্ধে এ কাজের জন্য কয়েকটি মেয়ে এগিয়ে আসে। তারা জখমীদের তুলে ডাক্তারের নিকট নিয়ে যায়। নিজ হাতে ক্ষতস্থানে পট্টি বাধে এবং আহতদের মাথা কোলে তুলে নিয়ে পানি পান করায়। কয়েকজন জখমী উঠে দাঁড়িয়ে হুংকার ছেড়ে বলে ওঠে এই জখম আমাদেরকে যুদ্ধ করা থেকে বিরত রাখতে পারবে না। কেউ বলে- আমরা বাইতুল মুকাদ্দাস প্রবেশ করেই তবে জখমে পট্টি বাঁধবো। আহতরা যখন দেখলো, তিন-চারটি মেয়েও তীরবিদ্ধ হয়েছে, তখন তাদেরকে সামলে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। মেয়েরা সৈনিকদের জোশ-জযবায় আগুন ধরিয়ে দেয়।

***

উক্ত স্থানেই মিনজানিক স্থাপন করার জন্য আরেকটি বিশেষজ্ঞ সেনাদল এগিয়ে আসে। তীরন্দাজি তীব্র করে দেয়া হয়। মিনজানিক স্থাপিত হয়ে যায়। সেগুলোর সাহায্যে ভারি পাথর ও আগুনের গোলা নিক্ষেপ শুরু হয়ে যায়। পাথর-গোলা প্রাচীরের উপর এবং প্রাচীর অতিক্রম করে ভেতরেও নিক্ষিপ্ত হতে থাকে।

ফটক আরেকবার খুলে যায়। নাইটদের ঘোড়াগুলো মিনজানিকের দিকে বাতাসের গতিতে ধেয়ে আসে। এবার এক পার্শ্ব থেকে মুসলিম অশ্বারোহী দল শকুনের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। পেছন থেকে আরেকটি দল তাদের পলায়নের পথ বন্ধ করার জন্য এগিয়ে আসে। মুসলমানরা বর্শা ও তরবারীর সাহায্যে নাইটদের ঘোড়াগুলোকে আহত করতে শুরু করে। কিন্তু লোহার বর্ম-শিরস্ত্রাণ নাইটদেরকে অক্ষত ও নিরাপদ রাখে।

 আহত ঘোড়াগুলোর সঙ্গে অক্ষত নাইটরাও ভূ-তলে লুটিয়ে পড়তে শুরু করে। এ অবস্থায় তাদেরকে ঘায়েল করা কঠিন ছিলো না। কিন্তু তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ সৈনিক। ঘায়েল করা সম্ভব হলো না। উল্টো তারা কয়েকজন মুসলিম সৈন্যকে ধরাশায়ী করে ফেলে। এবার ফিরে যেতে উদ্যত হলে মুসলিম অশ্বারোহীরা তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে। কিন্তু ঘোড়ার পিঠে বহাল থাকা নাইটরা মুসলমানদের প্রতিরোধ উপেক্ষা করে ভেতরে ঢুকে পড়ে। ফটক বন্ধ হয়ে যায়।

তারপর এই ধারা চলতে থাকে। বাইতুল মুকাদ্দাস নগরীর পশ্চিমে প্রাচীরের বাইরে এরূপ যে যুদ্ধ লড়া হয়েছিলো, গতি, তীব্রতা, রক্তক্ষরণ ও উভয় পক্ষের বীরত্বের দিক থেকে তাকে নজিরবিহীন আখ্যা দেয়া হয়েছে। এই সংঘাত-সংঘর্ষ থেকে উভয় বাহিনীর প্রত্যয় ও দৃঢ়তা অনুমান করা যায়। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, বাইতুল মুকাদ্দাস মুসলিম খৃস্টান উভয় পক্ষের উপর উন্মাদনা সৃষ্টি করে রেখেছিলো। যেসব খৃস্টান অশ্বারোহী আহত হয়ে বাইরে পড়েছিলো, তারা ছিলো হতভাগ্য। তাদের তুলে নিয়ে ব্যান্ডেজ-চিকিৎসা করাবার মতো কেউ ছিলো না। একে তো সেপ্টেম্বর মাস- গরমের মওসুম, তদুপরি সময়টা দ্বি-প্রহর। আহত খৃষ্টান নাইটরা লোহার পোশাকের ভেতর পুড়ে মরতে শুরু করে। বিপরীতে মুসলিম জখমীদেরকে নারী স্বেচ্ছাসেবীরা আহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিয়ে পানি পান করাতো, মুখ-মাথা ধুয়ে দিতে এবং পোশাক পরিবর্তন করে ব্যান্ডেজ-চিকিৎসার ব্যবস্থা করতো। কয়েকটি মেয়ে মশক ভরে কোথাও থেকে পানি এনে এনে আধমরা হয়ে গিয়েছিলো।

খচ্চর গাড়িগুলো ভারি ভারি পাথর কুড়িয়ে এনে সগ্রহ করার কাজে ব্যস্ত। মিনজানিকগুলো রাতেও প্রাচীরের উপর এবং ভেতরে পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। তাদের দিকেও পাথর ও আগুনের গোলা আসতে শুরু করে। পেছনে সলিতাওয়ালা তীর এসে আগুন ধরিয়ে দেয়। দু তিনটি মিনজানিক আগুনের কবলে এসে পড়ে। সেগুলোর প্রকৌশলীগণ আগুনে ঝলসে যায়। তবু পাথর নিক্ষেপ অব্যাহত থাকে।

প্রাচীরের অন্যান্য দিক থেকেও পাথর ও আগুনের গোলা নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। বাইরে কোথাও কোথাও ভূমি উঁচু ছিলো। সেখান থেকে নিক্ষিপ্ত পাথর-গোলা প্রাচীর অতিক্রম করে ভেতরে অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে যেতো। তার পেছনে পেছনে সলিতাওয়ালা অগ্নিতীরও চলে যেতো। মুসলিম সৈন্যরা নগরীতে কয়েক স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাইরে থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখা যাচ্ছিলো।

***

যেসব খৃস্টান সৈন্য পূর্ব থেকে নগরীর ভেতরে ছিলো, তাদের মনোবল শক্ত। অন্যান্য অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা সৈন্যদের কতিপয়ের অবস্থা হচ্ছে, তারা পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বদ্ধপরিকর এবং কতিপয় ভীত-সন্ত্রস্ত। কিন্তু এখন সকলে কোমর বেঁধে মোকাবেলা করছে। তাদের জোশ ও মনোবল দেখে মনে হচ্ছে, তারা সুলতান আইউবীকে পিছু না হটিয়ে ছাড়বে না। অপর একটি ফটক অতিক্রম করেও একটি অশ্বারোহী বাহিনী বাইরে গিয়ে অবরোধের উপর আক্রমণ করতে শুরু করে।

কিন্তু সাধারণ মানুষের অবস্থা সৈনিকদের চেয়ে ভিন্ন। তাদের মাঝে আক্রা-আসকালান প্রভৃতি অঞ্চল থেকে আসা উদ্বাস্তুও রয়েছে। তারা আপাদমস্তক ত্রাসের প্রতীক হয়ে আছে। শহরময় তারা আতঙ্ক ছড়িয়ে রেখেছে। সুলতান আইউবীর সৈন্যরা তাদের চোখের সামনে কয়েকটি জনবসতিকে পুড়িয়ে দিয়েছিলো।

বাইতুল মুকাদ্দাসের সবকটি গীর্জার ঘণ্টা অনবরত বেজে চলছে। দিন-রাত এক হয়ে গেছে। খৃস্টানরা গীর্জায় গিয়ে ভিড় জমিয়েছে। পাদ্রীদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে প্রার্থনার গান গাইছে। নগরীর বাইরে সুলতান আইউবীর সৈন্যদের তাকবীর ধ্বনি নগরীর ভেতরে এমন শোনা যাচ্ছে, যেনো অনবরত বজ্রপাত হচ্ছে। প্রজ্বলমান অগ্নিশিখা খৃস্টানদের দম নাকের আগায় এনে রেখেছে। সুলতান আইউবীর যেসব গোয়েন্দা খৃস্টান বেশে নগরীতে অবস্থান করছে, তারা ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর গুজব ছড়িয়ে : বেড়াচ্ছে। একটি গুজব এই ছড়ানো হয় যে, সুলতান আইউবী বাইতুল মুকাদ্দাস দখল করবেন না। নগরীটা ধ্বংস করে তিনি সকল খৃস্টানকে হত্যা করে ফেলবেন এবং তাদের যুবতী মেয়ে ও সকল মুসলিম অধিবাসীদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। আতঙ্কের সবচে বড় কারণ ছিলো, খৃস্টানদের বড় কুশটা সুলতান আইউবীর দখলে। তার অর্থ হচ্ছে, যীশুখৃস্ট খৃস্টানদের প্রতি নারাজ। তাছাড়া দীর্ঘদিন যাবত তারা মুসলমানদের উপর যে অকথ্য, নির্মম ও অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে আসছিলো, সেই অপরাধবোধ তাদের তাড়া করে ফিরছিলো। তারা তাদের বিশ্বাস মোতারেক গীর্জায় গিয়ে অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা শুরু করে দিয়েছে।

বর্তমান শতাব্দীর এক আমেরিকান ইতিহাসবিদ এ্যান্থনি ওয়েস্ট বেশ কজন ঐতিহাসিকের সূত্রে লিখেছেন, বাইতুল মুকাদ্দাসের অবরুদ্ধ খৃস্টানরা এতোই আতঙ্কিত হয়ে ওঠে যে, বহু খৃস্টান রাস্তায়-গলিতে বেরিয়ে আসে। কেউ হায় হায় করে বুক চাপড়াতে শুরু করে এবং কেউ কেউ নিজেই নিজেকে বেত্রাঘাত শুরু করে। তাদের বিশ্বাস মতে, এটি খোদার নিকট পাপের ক্ষমা লাভের একটি পন্থা। খৃস্টান যুবতী মেয়েদের মায়েরা তাদের মাথার চুল ন্যাড়া করে দেয় এবং তাদের পানিতে নামিয়ে ডুব দেয়াতে শুরু করে। তাদের বিশ্বাস ছিলো, এভাবে মেয়েরা সম্ভ্রম খোয়ানো থেকে রক্ষা পেয়ে যাবে। পাদ্রীরা তাদেরকে এই ভীতি ও শঙ্কা থেকে মুক্তি দেয়ার বহু চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের অভয় বাণী কোনো ক্রিয়া করতে ব্যর্থ হয়।

মুসলমান অধিবাসীদের অবস্থা ছিলো ভিন্ন রকম। তিন হাজারের অধিক মুসলিম পুরুষ, নারী ও শিশু বন্দি ছিলো। যারা বাড়ি-ঘরে ছিলো, তারা নজরবন্দির জীবন-যাপন করছিলো। খৃস্টানদের ভয়ে তারা মসজিদে যেতো না। সকল মুসলমান জেনে ফেলেছে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বাইতুল মুকাদ্দাস অবরোধ করেছেন। খৃস্টানদের ভীতি ও কাপুরুষতা দেখে কয়েকটি উত্তেজিত মুসলিম যুবক বাড়ির ছাদে ওঠে আযান দিতে শুরু করে। মহিলারা ঘরে-কারাগারে যে যেখানে ছিলো, মহান আল্লাহর– দরবারে কাকুতি-মিনতি ও দুআ-দরূদ পাঠ করতে শুরু করে।

খৃস্টানরা তাদের দেখেও নিপ থাকে। কেউ কিছু বলছে না। কারণ, তারা বুঝে গেছে, তারা মুসলমানদের উপর যে নিপীড়িন চালিয়েছিলো, তার শাস্তি শুরু হয়ে গেছে। এখন অনাগত শাস্তির ভয়েই তারা কাঁপছে। তাই এখন মুসলমানদের কোনো কাজে বাধা দেয়ার হিম্মত তাদের নেই। খৃস্টানদের এই মনোভাব আন্দাজ করে মুসলিম যুবকরা অলি-গলিতে চীৎকার করতে শুরু করে ইমাম মাহদী এসে পড়েছেন। আমাদের মুক্তিদাতা এসে গেছেন। তিনি নগরীর দেয়ালের উপর দিয়ে আসছেন। ফটক ভেঙে আসছেন।

নগরীর ভেতরে হক ও বাতিলের, গীর্জার ঘণ্টা ও আযান ধ্বনির সংঘর্ষ চলছে। বাইরে চলছে ঘোড়া, তরবারী ও তীর-বর্শার যুদ্ধ। খৃস্টানদের গীর্জাগুলোতে প্রার্থনা গীতও উচ্চ হচ্ছে। সেই তালে তালে কুরআন তিলাওয়াতের সুরও উঁচু হচ্ছে। অবুঝ শিশুরাও মহান আল্লাহর দরবারে সেজদায় অবনত হয়ে আছে।

কিন্তু বাইরে সুলতান আইউবী এখনো কোথাও থেকে প্রাচীর ভাঙার কিংবা সুড়ঙ্গ খনন করার ব্যবস্থা করে ওঠতে পারেননি। প্রাচীরের উপর থেকে বাইরের দিকে মুষলধারা বৃষ্টির ন্যায় তীর আসছে। মিনজানিক চালনাকারী ও পাথর বহনকারী মুসলিম সৈনিকদের হাত থেকে রক্ত ঝরছে। বর্মপরিহিত নাইটরা এখনো থেকে থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে আক্রমণ করছে এবং যানপরনাই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ লড়ে ফিরে যাচ্ছে।

***

চল্লিশ মাইল দূরে রাম উপসাগরে আল-ফারেস বায়দারীনের ছয়টি জাহাজ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে টহল দিয়ে ফিরছে। উদ্দেশ্য, যাতে টায়েরে অবস্থানরত খৃস্টানদের নৌবহর সৈন্য ও সরঞ্জামাদি নিয়ে আসতে না পারে। মেয়ে দুটো তার জাহাজে আছে। কিন্তু বর্তমানে তিনি তাদের প্রতি মনোনিবেশ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। নৌ-বাহিনী প্রধান আল-মুহসিন তার উপর অতিশয় স্পর্শকাতর দায়িত্ব অর্পণ করে রেখেছেন। কখনো কখনো নিজে মাস্তুলের উপর পাতা মাচানে উঠে দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত গভীর চোখে সমুদ্র পর্যবেক্ষণ করছেন। অন্যান্য জাহাজে গিয়েও খোঁজ-খবর নিচ্ছেন, যাতে কেউ দায়িত্বে অবহেলা না করে।

এদিকে নায়েব রউফ কুর্দি ফ্লোরির সঙ্গে মিলিত হচ্ছে, যা এখন অনেকটা গোপন অভিসারের রূপ লাভ করেছে। হাসান ইবনে আবদুল্লাহর গোয়েন্দা উভয়ের প্রতি গভীর দৃষ্টি রেখে চলছে।

মিসরে নৌবহর দূর-দূরান্ত পর্যন্ত টহল দিচ্ছে। আশঙ্কা আছে, ইউরোপ থেকে বিশেষত ইংল্যান্ড থেকে বাইতুল মুকাদ্দাসকে রক্ষা করার জন্য সাহায্য আসবে। সুলতান আইউবীর ঝড়গতির অগ্রযাত্রা এবং খৃস্টানদের প্রতিটি দুর্গ ও নগরীর উপর সফল আক্রমণের প্রেক্ষিতে তারা জার্মানির সম্রাট ফ্রেডারিক ও ইংল্যান্ডের সম্রাট রিচার্ডকে এ মর্মে পত্র লিখেছে যে, আরব থেকে ক্রুশের পতন ঘটছে এবং বাইতুল মুকাদ্দাসকে রক্ষা করা কঠিন মনে হচ্ছে। তোমরা আসো, আমাদেরকে সাহায্য করো। বাইতুল মুকাদ্দাসের যুদ্ধ রোম উপসাগরেও অনুষ্ঠিত হোক এবং যুদ্ধ অনেক ভয়ঙ্কর রূপ লাভ করুক, তা সুলতান আইউবীর কাম্য। কিন্তু জার্মানি ও ইংল্যান্ড থেকে কোনো তৎপরতার সংবাদ আসছে না। পরাজিত খৃস্টান বাহিনীর নৌবহর টায়েরের বন্দর অঞ্চলে চুপচাপ বসে আছে। তথাপি সুলতান আইউবীর নৌবাহিনী প্রধান দুশমনের নৌবাহিনীর এই নীরবতাকে বিপদের পূর্ব সংকেত মনে করছেন। তাই তিনি পূর্ণ সতর্ক রয়েছেন।

***

অবরোধের চতুর্থ রাত। এখনো কোনো সফলতা অর্জিত হয়নি। খৃস্টান ও অন্যান্য অশ্বারোহী সেনারা বাইরে এসে অত্যন্ত দুঃসাহসী আক্রমণ চালাচ্ছে এবং মানুষ ও পশুদের জীবনহানির ঝুঁকি বরণ করছে। চার দিনের আহত ও শহীদদের হিসাব নেয়ার পর সুলতান আইউবীর মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। তার অস্ত্র ও সরঞ্জামের অভাব নেই। বিজিত অঞ্চলগুলো থেকে তিনি দীর্ঘ যুদ্ধ লড়ার জন্য বিপুল অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম সংগ্রহ করে নিয়েছেন। তার অভাব শুধু লোকের। সেনাসংখ্যা দ্রুতগতিতে কমে যাচ্ছে এবং বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রাচীর তার জন্য যথারীতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পঞ্চম দিন সুলতান আইউবী পশ্চিম দিককার ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেন এবং সেখানকার যুদ্ধ বন্ধ করে দেন। দক্ষিণ দিকে এক স্থানে প্রাচীর দুর্বল পেয়েছেন। পশ্চিম দিক থেকে মিনজানিকগুলো সরিয়ে নেয়া হচ্ছে এবং দূরে পেছনে যে তাঁবু স্থাপন করা ছিলো, সেগুলো তুলে নেয়া হয়েছে। চিত্রটা এমন, যেনো সুলতান আইউবী অবরোধ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। প্রাচীরের উপর যেসব খৃস্টান নাগরিক ছিলো, তারা নগরীতে সংবাদ ছড়িয়ে দেয়, অবরোধ উঠে গেছে এবং মুসলিম সৈন্যরা পেছনে সরে যাচ্ছে। সুলতান আইউবী প্রাচীর থেকে দূরে বাহিনীকে স্থানান্তরিত করছেন।

ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। নগরীতে খৃস্টানরা ভীতি, শঙ্কা, হা-হুঁতাশ ও প্রার্থনার স্থলে উল্লাসে মেতে ওঠে। সারারাত তারা গীর্জায় সমবেত হয়ে খোদাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে শুরু করে। এই সন্ধ্যা পর্যন্ত যারা নিজেদের কৃত অপরাধের ক্ষমা প্রার্থনা করছিলো, তারা নবউদ্যমে মুসলমান নাগরিকদের উপর নিপীড়ন চালানোর পরিকল্পনা আঁটতে বসে গেছে। তিরস্কার ও গালাগাল দ্বারা তারা তার উদ্বোধন করে। মুসলমানরা স্তব্ধ, হতবুদ্ধি ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে।

 পরদিন শুক্রবার। ১১৮৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। খৃস্টানরা প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে দেখতে পেলো, দক্ষিণ দিকে যাইতুন পর্বতের উপর সুলতান আইউবীর পতাকা উড়ছে এবং তার সম্মুখে প্রাচীর থেকে সামান্য দূরে মুসলমানরা মিনজানিক স্থাপন করেছে ও অশ্বারোহী ও পদাতিক মিলে কমপক্ষে দশ হাজার সৈন্য আক্রমণের জন্য প্রস্তুত দাঁড়িয়ে আছে। পজিশন ও প্লন পরিবর্তন করে সুলতান আইউবী জুমার দিন বাইতুল মুকাদ্দাসের উপর আক্রমণ চালান।

নগরীর উপর পাথর ও আগুনের গোলা পূর্বাপেক্ষা বেশি নিক্ষিপ্ত হতে শুরু করেছে। তৎক্ষণাৎ খবর ছড়িয়ে পড়ে, মুসলমানদের আরো বেশি ফৌজ এসে পড়েছে এবং নগরী এখন এক-দুদিনের মেহমান মাত্র। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, নগরীতে আতঙ্কের নতুন ধারা শুরু হয়ে যায়। খৃস্টানরা ঘর থেকে বের হয়ে অলি-গলি ও হাট-বাজারে হা হুতাশ শুরু করে দেয়। মুসলমানদের আযান পুনর্বার ধ্বনিত হতে শুরু করে। খৃস্টানদের করুণ অবস্থায় স্বয়ং পাদ্রীও প্রভাবিত হয়ে পড়েন। তিনি ক্রুশ হাতে অলিতে-গলিতে ঘুরতে শুরু করেন। তিনিও কাঁদছেন এবং প্রার্থনা করছেন।

খৃস্টান অশ্বরোহীগণ পুনরায় বের হয়ে মুসলমানদের মিনজানিকগুলোর উপর আক্রমণ চালায়। কিন্তু এই যুদ্ধ এখন সুলতান আইউবী নিজে তদারক করছেন। তার অশ্বারোহী সেনারা তিন দিক থেকে খৃস্টান সৈনিকদের উপর দ্রুতগতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাদের পিষে ফেলে। পরে খৃস্টানরা আরো দুবার বেরিয়ে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু মুসলিম সৈনিকরা তাদেরকে ফটক থেকে বেশি এগুতে দেয়নি। সুলতান আইউবী প্রথমবারের মতো সুড়ঙ্গ খনন ও প্রাচীর ভাঙ্গার জন্য সম্মুখে বাহিনী প্রেরণ করেন। প্রত্যেকের হাতে একটি করে ঢাল। তারা এই ঢালের পেছনে মাথা থেকে পা পর্যন্ত লুকিয়ে লুকিয়ে এগিয়ে যায়। তাছাড়া প্রাচীরের যে অংশটির নীচে সুড়ঙ্গ খনন কিংবা প্রাচীর ভাঙা হবে, সুলতান আইউবীর তীরন্দাজ সৈন্যরা অত্যন্ত তীব্রতার সাথে তার উপর তীর ছুঁড়তে শুরু করে।

সেখানে একটি ফটক আছে, যার উপর ভবন নির্মিত আছে। সে ফটকের পেছনে অনুরূপ আরা একটি মজবুত ফটক আছে। দুই ফটকের মাঝে দেউড়ি। এই দেউড়ির উপরও একটি ভবন। সুলতান আইউবী তারই নীচে সুড়ঙ্গ খনন করাতে চাচ্ছেন। এই ফটকের একটু দূরে প্রাচীর খানিকটা দুর্বল মনে হলো। বড় মিনজানিকগুলো তার উপর কয়েক মণ ওজনের পাথর নিক্ষেপ করে চলছে। প্রাচীরটা বেশ চওড়া। কিন্তু অনবরত একই স্থানে পাথর নিক্ষেপের ফলে তাতে ফাটল ধরে যায়। পাথরের বিস্ফোরণ নগরবাসীদের রক্ত শুকিয়ে ফেলতে শুরু করে।

দিনের বেলা বাহিনী ঢালের আড়ালে ও তীরের ছায়ায় ফটক পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এখন উপর থেকে তাদের উপর তীর ছোঁড়া হচ্ছে না। রাতে কয়েকশ জানবাজ মিলে দেউড়ির নীচে ত্রিশ গজ লম্বা সুড়ঙ্গ খনন করে ফেলে, যা দেউড়িরই সমান চওড়া। এই সুরঙ্গের মধ্যে ঘাস ও শুকনো কাঠ ভরে তার উপর তরল দাহ্য পদার্থ ঢেলে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। জানবাজ সেনারা সেখান থেকে সরে আসে।

আগুনে সবকিছু পুড়ে ভষ্ম হয়ে যায়। উপর থেকে ভবনটাও ধসে পড়তে শুরু করে। একসময় ভয়ঙ্কর শব্দ করে ভবনটি পড়ে গুঁড়িয়ে যায়। ওদিকে প্রাচীরের উপর যে স্থানে ভারী ভারী পাথর নিক্ষেপ করা হচ্ছিলো, সেখানেও প্রাচীর ভেঙে পথ বেরিয়ে আসে। এবার ধ্বংসাবশেষের উপর দিয়ে অতিক্রম করে নগরীতে প্রবেশ করার পালা। কিন্তু এ বড় বিপজ্জনক পদক্ষেপ। ধ্বংসাবশেষ সরানোর অভিযান শুরু হয়ে যায়।

নগরীর গীর্জাগুলোর ঘণ্টা আরো জোরে বাজতে শুরু করেছে। সুললিত আযানের পবিত্র ও জয়সূচক ধ্বনিও তীব্র হয়ে ওঠেছে। খৃস্টান সেনাপতি-সম্রাটদের মনোবলেও ভাটা এসে পড়েছে। তারা বৈঠকে বসেছেন। সেনাপতিরা প্রস্তাব পেশ করেছে, সৈন্য ও স্বেচ্ছাসেবী জনসাধারণ সকলে মিলে একযোগে বাইরে বেরিয়ে সুলতান আইউবীর বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু পোপ এ প্রস্তাব এই বলে নাকচ করে দেন যে, এ পন্থা অবলম্বন করলে নগরীতে শুধু নারী ও শিশুরা রয়ে যাবে, যারা মুসলমানদের প্রতিশোধের শিকারে পরিণত হবে। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তারা সুলতান আইউবীর সঙ্গে সন্ধি করবে। এক খৃস্টান নেতা বালিয়ানকে এ কাজে প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়।

বাইরে থেকে সুলতান আইউবীর সৈন্যরা দেখে, ফটকের বিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসাবশেষের উপর সাদা পতাকা উড়ছে। তীরন্দাজদের থামিয়ে দেয়া হলো। পতাকার সঙ্গে তিন-চারজন লোকও আত্মপ্রকাশ করে। একজন উচ্চস্বরে বললো- আমরা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে আলোচনা করতে চাই। সুলতান আইউবী ঘোষণাটা শুনলেন। বললেন ওদেরকে নিয়ে আসো।

সুলতান আইউবী তাদের স্বাগত জানান এবং তাঁবুতে নিয়ে বসান। দলনেতা বালিয়ান কথা শুরু করে। আপনি অবরোধ প্রত্যাহার করে ফিরে যান। সুলতান আইউবী শর্ত আরোপ করেন। আসলে খৃস্টানরা বাইতুল মুকাদ্দাসের দখল ছাড়তে চাচ্ছে না। আর সুলতান আইউবীও বাইতুল মুকাদ্দাস না নিয়ে নড়তে রাজি নন। অথচ তার একজন সৈনিকও এ পর্যন্ত নগরীতে প্রবেশ করতে পারেনি। তিনি এখনো দাবি করতে পারছেন না, তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস দখল করে ফেলেছেন। খৃস্টানরা এখনো বলতে পারে, বাইতুল মুকাদ্দাস তাদের দখলে।

একদিকে সন্ধির আলোচনা চলছে, অপরদিকে অবরোধ যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। সুলতান আইউবী আলোচনা ও সন্ধি চুক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই তিনি আলোচনার সঙ্গে যুদ্ধও অব্যাহত রেখেছেন। প্রাচীরের ছিদ্র এখন বিস্তৃত হয়ে গেছে। মুসলিম জানবাজরা বিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসাবশেষ অতিক্রম করে এবং প্রাচীরভাঙা পথে ভেতরে ঢুকতে শুরু করেছে। কিন্তু খৃস্টানদের দৃঢ় প্রত্যয়, তারা নগরী হাতছাড়া করবে না। তারা উভয় স্থান থেকে আক্রমণকারীদের বাইরে ঠেলে দেয়। বাইরে থেকে সৈন্যরা স্রোতের ন্যায় এগিয়ে যায়। সম্মুখভাগের সৈনিকরা খৃস্টানদের তীব ও বর্শার আঘাতে লুটিয়ে পড়ে। পেছনের সৈনিকরা তাদের পদপৃষ্ঠ করে করে সম্মুখে এগিয়ে যেতে থাকে। অত্যন্ত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ইতিমধ্যে এক জানবাজ নগরীর প্রধান ফটকের উপর লাল ক্রস খচিত পতাকাটা সরিয়ে সেখানে ইসলামী পতাকা উড়িয়ে দেয়। খৃষ্টান জনসাধারণ এমন হুলস্থুল শুরু করে দেয় যে, তারা সৈন্যদের জন্য প্রতিবন্ধক ও সমস্যারূপে আবির্ভূত হয়।

সুলতান আইউবীর জানবাজরা পাগলের মতো হয়ে গেছে। তাদের কতিপয় মসজিদে আকসায় ঢুকে উপর থেকে ক্রুশটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে। সেখানেও ইসলামী পতাকা উড়তে শুরু করে। কিন্তু নগরীতে উভয় বাহিনী ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে। তবে পরিলক্ষিত হচ্ছে, ক্রুসেডারদের হিংস্রতা ও প্রতিরোধ ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসছে।

***

সুলতান আইউবী খৃস্টান প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সন্ধির আলোচনা করছেন। বাইরের এবং নগরীর ভেতরের নতুন কোনো সংবাদ এখনো তিনি জানেন না। তিনি বালিয়ানকে বললেন- আমি বাইতুল মুকাদ্দাসকে শক্তির জোরে মুক্ত করবো বলে কসম খেয়েছি। আপনারা যদি নগরীটা আমাকে এমনভাবে দিয়ে দেন, যেনো আমি জয় করেছি, তাহলে সন্ধি করা যেতে পারে।

সালাহুদ্দীন!- বালিয়ান খানিকটা হুমকির সুরে বললো- এ নগরীর নাম এখনো জেরুজালেম- বাইতুল মুকাদ্দাস নয়। আপনি যদি সন্ধি করতে সম্মত না হন, তাহলে আমরা আপনাকে বাধ্য করবো না। তবে শুনে রাখুন, এই নগরীতে আপনার চার হাজার সৈনিক আমাদের যুদ্ধবন্দি আছে। আমাদের কাছে আটক সাধারণ মুসলমান কয়েদির সংখ্যা তিন হাজার। আমরা এই প্রত্যেক কয়েদি এবং নগরীর প্রতিজন মুসলিম অধিবাসীকে- চাই সে নারী হোক কিংবা শিশু, যুবক হোক বা বৃদ্ধ-হত্যা করে ফেলবো।

রাগে-ক্ষোভে সুলতান আইউবীর চোখ দুটো লাল হয়ে যায়। ঠোঁট দুটো কেঁপে ওঠে। কিছু বলতে উদ্যত হলেন। এমন সময় তাঁবুর পর্দা ফাঁক হয়ে যায়। তাঁর এক কমান্ডার এসেছে। সুলতান তাকে ইঙ্গিতে কাছে ডেকে নেন। কমান্ডার সুলতানের কানে ফিসফিস শব্দে বললো নগরী জয় হয়ে গেছে। প্রধান ফটক ও মসজিদে আকসার উপর ইসলামী পতাকা উড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

সুলতান আইউবী বালিয়ানের হুমকির জবাব পেয়ে গেছেন। তাঁর রক্তজবার ন্যায় লাল চোখে অস্বাভাবিক এক ঝিলিক ভেসে ওঠে। তিনি সজোরে নিজের উরুতে চাপড় মেরে খৃস্টান নেতা বালিয়ানকে বললেন বিজেতা পরাজিতের সঙ্গে সন্ধি আলোচনা করে না। একজন মুসলমানও আর তোমাদের কয়েদি নেই।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, সুলতান আইউবী সব সময় অত্যন্ত সহনশীলতার সঙ্গে কথা বলতেন। সেদিনও একই নিয়মে বলছিলেন। কিন্তু বালিয়ানের হুমকির সঙ্গে সঙ্গে জয়ের সংবাদে তার কণ্ঠে রোষ ও গর্জন সৃষ্টি হয়ে যায়। তিনি বললেন- তোমরা সকলে আমার বন্দি। তোমাদের সমস্ত ফৌজ আমার কয়েদি। নগরীতে অবস্থানরত প্রতিজন খৃস্টান আমার কয়েদি। এই নগরী থেকে এখন একজন খৃস্টানও আমার নির্ধারিত ফি আদায় না করে বের হতে পারবে না। যাও, ভেতরে গিয়ে দেখো, ওটা জেরুজালেম নয়- বাইতুল মুকাদ্দাস।

বালিয়ান ও তার সঙ্গের খৃস্টানরা ভয় পেয়ে যায়। তবু থেকে বেরিয়ে দেখে। সুলতান আইউবীর অধিকাংশ সৈন্য ভেতরে ঢুকে গেছে। প্রধান ফটকের উপর ইসলামী পতাকা পত্ পত্ করে উড়ছে।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ৫৮৩ হিজরীর ২৭ রজব মোতাবেক ১১৮৭ খৃস্টাব্দের ২ অক্টোবর শুক্রবার বিজয়ী বেশে বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করেন। হতে পারে ঘটনাটা কাকতালীয় কিংবা সুলতান আইউবী পরিকল্পনাটাই এভাবে প্রণয়ন করেছিলেন অথবা মহান আল্লাহর ইচ্ছাই এমন ছিলো। একে তো শুক্রবার, সুলতান আইউবীর মহৎ কাজের মহান দিবস। তদুপরি রজবের সাতাশতম রাত। এ রাতে রাসূলে আকরাম (সা.) উক্ত স্থান থেকেই পবিত্র মিরাজে গমন করেছিলেন। সকল মুসলিম ও অমুসলিম ঐতিহাসিক বাইতুল মুকাদ্দাস জয়ের এ তারিখই লিখেছেন।

***

সুলতান আইউবী যখন নগরীতে প্রবেশ করেন, তখন মুসলমানরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। মহিলার মাথার ওড়না খুলে খুলে সুলতানের চলার পথে ছুঁড়ে দিয়ে সুলতানকে স্বাগত জানায়। সুলতানের দেহরক্ষীর ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে ওড়নাগুলো রাস্তা থেকে তুলে নেয়।

দীর্ঘ অমানুষিক নির্যাতনে নিষ্পিষ্ট মুসলমানরা চীৎকার করে করে তাকবীর ধ্বনি দিতে থাকে। অনেকে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। অশ্রু নেমে আসে সকলেরই চোখে। সে এক আবেগঘন ও বেদনাবিধূর দৃশ্য। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ মোতাবেক সুলতান আইউবী এতোটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন যে, জনতার ধ্বনির উত্তরে তিনি হাত দুটো উঁচু করে নাড়াতে থাকেন ঠিক, কিন্তু ঠোঁটে হাসির বাম্পও ছিলো না। বরং তিনি উভয় ঠোঁট একত্রিত করে দাঁতে চেপে ধরে আবেগ দমন করার এবং হেঁচকি প্রতিহত করার চেষ্টা করছিলেন।

খৃস্টান নাগরিকরা নিজ নিজ ঘরে নিস্তব্ধ বসে ভয়ে কাঁপতে থাকে। তারা তাদের যুবতী কন্যাদেরকে লুকিয়ে ফেলে। ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, অনেকে মেয়েদেরকে পুরুষের পোশাক পরিয়ে দেয়। তাদের বিশ্বাস হিলো, মুসলিম সৈনিকরা মুসলিম নারীদের অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তাদের মেয়েদের লাঞ্ছিত করবে। কিন্তু ইউরোপীয় ঐতিহাসিক লেনপোল লিখেছেন, সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনী যখন খৃষ্টান বাহিনী থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস নগরীর দখল বুঝে নিচ্ছিলো, তখন তিনি যে পরিমাণ উদারতা ও উন্নত চরিত্রের স্বাক্ষর রেখেছিলেন, তেমনি অতীতে কখনো করেননি। তাঁর নির্দেশে তার বাহিনীর সৈন্য ও অফিসারগণ নগরীর শান্তি ও সকলের নিরাপত্তার জন্য রাস্তায়-গলিতে টহল দিতে নেমে পড়েছিলো। কোনো মুসলিম নাগরিক যেনো কোনো খৃস্টান নাগরিকের উপর প্রতিশোধমূলক আক্রমণ না করে বসে, সেদিকে তারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন। তবে কোনো খৃস্টান নাগরিকের নগরী থেকে বের হওয়ার অনুমতি ছিলো না।

সুলতান আইউবী সর্বপ্রথম মসজিদে আকসায় গমন করেন। আবেগের আতিশয্যে তিনি মসজিদের বারান্দায় যেনো উপুড় হয়ে পড়ে যান। তিনি মসজিদের বারান্দাতেই সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ ও আহমদ মিসরীর বর্ণনা মোতাবেক সুলতান আইউবীর চোখ থেকে এমন ধারায় অশ্রু ঝরতে শুরু করে, যেন তিনি এই মহান মসজিদটি চোখের পানিতে ধৌত করছিলেন।

মসজিদের অবস্থা ছিলো অত্যন্ত শোচনীয়। কয়েকজন মুসলিম শাসক আপন আপন শাসনামলে মসজিদে সোনা-রূপার ঝাড়বাতি ও দীপাধার স্থাপন করেছিলেন। তারা ভক্তির নিদর্শনস্বরূপ মসজিদে নানা রকম মূল্যবান উপহার সামগ্রীও রেখেছিলেন। খৃস্টানরা সে সকল ঐতিহ্যবাহী মূল্যবান সম্পদ ও স্মৃতি চিহ্নগুলো তুলে নিয়ে গেছে। মসজিদের মেঝে থেকে স্থানে স্থানে মর্মরের পাত উধাও হয়ে গেছে। মেরামত ছাড়া মসজিদটি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছিলো।

মসজিদ মেরামতের প্রতি মনোনিবেশ করার আগে সুলতান আইউবী পরাজিত খৃস্টানদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি মনে করেন। তিনি উপদেষ্টাদের সঙ্গে পরামর্শ করে নির্দেশ জারি করেন, প্রতিজন খৃস্টান। পুরুষ দশ দিনার, মহিলারা পাঁচ দিনার এবং শিশুরা এক দিনার করে পণ আদায় করে নগরী থেকে বেরিয়ে যাবে। একজন খৃস্টানও সেখানে থাকতে প্রস্তুত ছিলো না। দীর্ঘদিনের অপরাধবোধ তাদেরকে বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে বেরিয়ে যেতে তাড়া করে ফিরছিলো। পশ্চিম দিককার ফটক খুলে দিয়ে সেখানে পণ আদায় করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। খৃস্টানরা বেরিয়ে যেতে শুরু করে। সর্বপ্রথম খৃস্টান নেতা বালিয়ান নগরী থেকে বের হয়। তার নিকট ইংল্যান্ডের রাজা হেনরির প্রেরিত বিপুল অর্থ ছিলো। সেখান থেকে ত্রিশ হাজার দিনারের বিনিময়ে সে দশ হাজার খৃস্টানকে মুক্ত করে নেয়।

ফটকে বাইতুল মুকাদ্দাস ত্যাগকারী খৃস্টানদের ভিড় জমে যায়। তারা গোটা পরিবারের পণ আদায় করে করে বেরিয়ে যাচ্ছে।

বিজিত নগরীকে বিজয়ী বাহিনীর নির্বিচার লুণ্ঠন করা একটি সাধারণ নিয়ম। বাইতুল মুকাদ্দাস তো সেই নগরী, যেখানে জয়লাভের পর খৃস্টানরা মুসলমানদের গণহত্যা করেছিল, তাদের বাড়ি-ঘর লুট করেছিলো, যুবতী কন্যা ও মসজিদগুলোর অবমাননা করেছিলো। কিন্তু সেই বাইতুল মুকাদ্দাস দখল করার পর লুটপাটের পরিবর্তে সুলতান আইউবীর বাহিনী এবং বাইরে থেকে তৎক্ষণাৎ পৌঁছে যাওয়া মুসলিম ব্যবসায়ীগণ খৃস্টানদের ঘরের মালামাল ন্যায্যমূল্যে ক্রয় করে নেয়, যাতে : তারা পণ আদায় করে বেরিয়ে যেতে পারে। এতে সেই খৃস্টান পরিবারগুলোও মুক্তি পেয়ে যায়, যাদের নিকট পণ আদায় করার মতো নগদ অর্থ ছিলো না।

বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রধান প্যাট্রিয়ক হারকিডলেস দেখান ভিন্ন এক চরিত্র। তিনি সকল গীর্জার সঞ্চিত অর্থ একা কুক্ষিগত করে ফেলেন। গীর্জাগুলোর সোনার পেয়ালা ও অন্যান্য মূল্যবান বস্তু-সামগ্রী চুরি করে নিয়ে যান। বর্ণিত আছে, এই সম্পদ এতো বেশি ছিলো যে, তার বিনিময়ে কয়েক হাজার গরীব খৃস্টান পরিবারকে মুক্ত করা যেতো। কিন্তু তাদের বড় পাদ্রী একজনেরও পণ আদায় করেননি। শুধু নিজের পণটুকু আদায় করে বেরিয়ে যান। একজন মুসলিম সৈনিক টের পেয়ে যায়, লোকটা বিপুল পরিমাণ সম্পদ নিয়ে যাচ্ছে। তার রিপোের্ট মোতাবেক এক কর্মকর্তা সুলতান আইউবীকে বিষয়টি অবহিত করেন। কিন্তু সুলতান আইউবী বললেন- সে যদি পণ আদায় করে থাকে, তাহলে তাকে বাধা দিও না। আমি কারো থেকে অতিরিক্ত মূল্য নিতে বারণ করে দিয়েছি। আমি আমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে পারি না।

সুলতান আইউবী এই পণ আদায় করে বাইতুল মুকাদ্দাস ত্যাগ করার মেয়াদ চল্লিশ দিন নির্ধারণ করেন। চল্লিশ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও কয়েক হাজার গরীব-অসহায় খৃস্টান নগরীতে রয়ে যায়। নব্বই বছর আগে খৃস্টানরা যখন বাইতুল মুকাদ্দাস দখল করেছিলো, তখন দূর-দূরান্ত থেকে খৃস্টানরা সেখানে এসে বসতি স্থাপন করেছিলো। কোনদিন আবার সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে, তাদের কল্পনায়ও ছিলো না। এই অবস্থা দেখে সুলতান আইউবীর ভাই আল-আদিল সুলতানের নিকট আসেন।

সুলতানে মুহতারাম!- আল-আদিল বললেন- আপনি জানেন এই নগরী জয়ে আমার ও আমার সেনা ইউনিটের অবদান কততখানি। তার বিনিময়ে গোলাম হিসেবে আমাকে এক হাজার খৃস্টান দান করুন।

এতো গোলাম কী করবে? সুলতান আইউবী জিজ্ঞেস করেন।

আমি যা খুশি করবো।

সুলতান আইউবী আল-আদিলকে এক হাজার খৃস্টান দিয়ে দেয়ার আদেশ দেন। অনুমোদন পেয়ে আল-আদিল এক হাজার খৃস্টান নির্বাচন করে তাদেরকে ফটকের নিকট নিয়ে মুক্ত করে দেন।

মহামান্য সুলতান!- আল-আদিল ফিরে এসে সুলতান আইউবীকে বললেন- আমি সে সকল নাগরিককে নগরী থেকে বিদায় করে দিয়েছি। তাদের কাছে পণ আদায় করার মতো অর্থ ছিলো না।

আমি জানতাম তুমি এমনই করবে- সুলতান আইউবী বললেন অন্যথায় আমি তোমাকে একটি গোলামও দিতাম না। মানুষ মানুষের গোলাম হতে পারে না। আল্লাহ তোমার এই পুণ্য কবুল করুন।

এসব কাহিনী রূপকথা নয়। ঐতিহাসিকদের বর্ণিত বাস্তব সত্য। তারা লিখেছেন, একদল খৃস্টান মহিলা সুলতান আইউবীর নিকট আসে। জানা গেলো, এরা নিহত কিংবা বন্দি হওয়া খৃস্টানদের স্ত্রী, কন্যা, বোন। এদের কাছে পণ আদায় করার অর্থ নেই। সুলতান আইউবী তাদেরকে শুধু মুক্তই করে দেননি, বরং প্রত্যেককে কিছু কিছু করে অর্থ দিয়ে বিদায় করে দেন। তারপর তিনি ঘোষণা দেন, এখনো যেসব খৃস্টান নগরীতে রয়ে গেছে, তাদের পণ মাফ করে দেয়া হলো। তারা এমনিতেই চলে যেতে পারে। বাইতুল মুকাদ্দাসে শুধু খৃস্টান বন্দিরাই অবশিষ্ট থাকে।

ইতিমধ্যে সুলতান আইউবী মসজিদ পরিচ্ছন্ন ও মেরামতের কাজ সম্পন্ন করে ফেলেন। ঐতিহাসিক সূত্রমতে, মেরামত কাজে সুলতান স্বয়ং ইট-পাথর বহন করেছিলেন। ১১৮৭ সালের ১৯ অক্টোবর শুক্রবার সুলতান আইউবী জুমার নামায আদায়ের জন্য মসজিদে আকসায় গমন করেন। নুরুদ্দীন জঙ্গীর প্রস্তুতকৃত মিম্বরটি তাঁর সঙ্গে। তিনি নিজ হাতে মিম্বরটি মসজিদে রাখেন। দামেশক থেকে আসা এক খতীব জুমার খুতবা পাঠ করেন।

এবার সুলতান আইউবী মসজিদের সাজসজ্জার প্রতি মনোনিবেশ করেন। মেঝেতে মর্মর পাথর স্থাপন করেন এবং মনের মতো করে মসজিদটি সুদৃশ্য করে তোলেন। সুলতান আইউবী নিজ হাতে যে সুন্দর সুন্দর পাথরগুলো স্থাপন করেছিলেন, আজও সেসব মসজিদে আকসায় বর্তমান রয়েছে এবং তার সৌন্দর্য এতোটুকুও বিনষ্ট বা বিকৃত হয়নি। এখনো সেদিনেরই ন্যায় চকচক করছে।

***

বায়তুল মুকাদ্দাস জয় ইসলামের ইতিহাসের বিরাট এক ঘটনা এবং এক সুমহান কীর্তি। কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর জিহাদ এখনো শেষ হয়নি। তার আরব ভূখণ্ড ও ফিলিস্তীনকে খৃষ্টানদের থেকে মুক্ত করতে হবে। বাইতুল মুকাদ্দাসকে তিনি একদিকে যেমন ইসলামী শক্তির শক্ত এক ঘাঁটিতে পরিণত করেন, তেমনি এই পবিত্র স্থানটিকে ইসলামী জ্ঞানের কেন্দ্রের রূপদান করেন। ৫৮৩ হিজরীর ৫ রমযান মোতাবেক ১১৮৭ খৃস্টাব্দের ৮ নবেম্বর সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে রওনা হন। গতি তাঁর উত্তর দিকে। তিনি পুত্র আল মালিকুয যাহিরকে- যিনি অন্য কোথাও অবস্থান করছিলেন- বার্তা প্রেরণ করেন, তুমি তোমার সঙ্গীদেরসহ আমার নিকট চলে আসো। সুলতান টায়েরের উপর আক্রমণ করতে যাচ্ছেন। এটি ক্রুসেডারদের একটি শক্ত ক্যাম্প এবং বন্দর অঞ্চল। সুলতান নৌবাহিনীর কমান্ডার আল-ফারেসকে বার্তা পাঠান, যেনো তিনি টায়েরের খানিক দূরে এসে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং সুলতান যখন এই নগরীটা আক্রমণ করবেন, তখন যেনো তিনি খৃস্টান নৌবহরের উপর আক্রমণ চালান। সুলতান আইউবী আল ফারেসকে যে দিনটির কথা বলেন, সেটি ডিসেম্বরের শেষ কিংবা জানুয়ারির শুরুর দিককার কোনো একটি দিন ছিলো।

মেয়ে দুটো আল-ফারেসের জাহাজে অবস্থান করছে। হাসান ইবনে আবদুল্লাহর প্রেরিতে গোয়েন্দা জাহাজে নেই। হাসান বাইতুল মুকাদ্দাসের যুদ্ধ এবং বিজয় পরবর্তী কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এদিক থেকে অবসর হলে তার মনে পড়ে, আল-ফারেসের জাহাজে এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করেছিলেন। লোকটি কী করছে জানার জন্য তিনি রউফ কুর্দির নিকট একজন দূত প্রেরণ করেন। দূতের জাহাজ পর্যন্ত পৌঁছুতে কয়েকদিন লেগে যায়। রউফ কুর্দি দূতকে জানায়, সেই গোয়েন্দা অনেক দিন হলো চলে গেছে।

 কিন্তু গোয়েন্দা এতোক্ষণে রোম উপসাগরে মাছের পেটে হজম হয়ে। গেছে। রউফ কুর্দি তার এই পরিণতি সম্পর্কে ভালোভাবে জানে। দিন কয়েক আগে গোয়েন্দা রউফ কুর্দিকে বলেছিলো, আমি এই মেয়েগুলোকে এখানে থাকতে দেবো না। সে দেখেছে, জাহাজ যখন কূলে গিয়ে নোঙ্গর ফেলে, তখন ছোট ছোট অনেক ডিঙ্গি তার নিকটে এসে পড়ে এবং মৎস্য শিকারীরূপী অনেক লোক নানা জিনিস বিক্রি করে। তাদের একজনকে সে কয়েক জায়গায় দেখেছে। মেয়ে দুটো তাকে রশির সিঁড়িতে করে উপরে তুলে আনে এবং কিছু ক্রয় করার পরিবর্তে তার সঙ্গে কথা বলে। জাহাজ যখন দশ-পনের মাইল দূরে কূলে কোথাও অবস্থান করে, তখনো এই লোকটি ডিঙি নিয়ে এসে পড়ে। এই নোকটার প্রতি গোয়েন্দার সন্দেহ জমে যায়।

ফ্লোরি রউফ কুর্দির বিবেক মেরে ফেলেছে। সে তাকে নানা গোপন তথ্য জিজ্ঞেস করছে এবং অবলীলায় সব বলে দিচ্ছে। আল-ফারেস অনেক ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। তিনি মাঝে-মধ্যে অন্যান্য জাহাজেও চলে যাচ্ছেন এবং খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। একদিন রউফ কুর্দি ফ্লোরির যাদুতে বিমোহিত হয়ে আবেগের আতিশয্যে বলে দেয়, জাহাজে একজন বিপজ্জনক লোক আছে। তার সঙ্গে কোনো কথা বলো না। রউফ কুর্দি এখনো মেয়েগুলোকে যাযাবরই মনে করছে এবং তাদের আসল নাম ফ্লোরি ও রোজি সম্পর্কে অনবহিত। মেয়েগুলো মূলত অভিজ্ঞ গুপ্তচর। ফ্লোরি বুঝে ফেলে, রউফ কুর্দি যার কথা বলছে, সে একজন গোয়েন্দা। ফ্লোরি জাহাজ থেকে চলে যাক, রউফ কুর্দি মেনে নিতে পারছেন না। তাই সে মেয়েগুলোকে জানিয়ে দেয়, এই লোকটি গোয়েন্দা, তোমরা তার ব্যাপারে সতর্ক থাকবে।

এক রাতে আল-ফারেন্স অন্য এক জাহাজে যান। মধ্যরাতে রউফ কুর্দি ও ফ্লোরি জাহাজের ছাদের উপর রেলিংয়ের সঙ্গে এমন এক স্থানে লুকিয়ে : যায়, যার পেছনে ও ডানে-বাঁয়ে অনেক মালপত্র পড়ে আছে। হাসান ইবনে আবদুল্লাহর গোয়েন্দা জ্ঞাতসারে কিংবা ঘটনাক্রমে ওদিকে চলে যায়। সে দুজনকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে। রউফ কুর্দি ভীত হওয়া কিংবা মিথ্যা বুঝ দেয়ার পরিবর্তে তাকে সরিয়ে খানিক আড়ালে। নিয়ে যায় এবং বলে, মেয়েটাকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করছিলাম, তোমরা আসলে কারা। আমি চলে যাচ্ছি, তুমি তার পাশে বসে যাও এবং নিজের অভিজ্ঞতা ও বিদ্যা অনুসারে কথা বলে তার থেকে তথ্য উদ্ধার করো, তারা কারা।

গোয়েন্দাকে ফ্লোরির কাছে বসিয়ে দিয়ে রউফ কুর্দি কক্ষে গিয়ে রোজিকে জাগিয়ে তোলে। বলে, শিকার অমুক জায়গায় আছে। তুমিও চলে যাও। আমি কেউ এসে পড়ে কিনা এদিক-ওদিক দেখতে থাকি।

রোজি ছাদে আসে। রউফ কুর্দি তাকে হাত দুয়েক লম্বা একটা রশি দিয়ে দেয়। গোয়েন্দা ও ফ্লোরি যেখানে বলা আছে, রোজি সেখানে চলে যায়। জায়গাটায় অন্ধকার। রোজি আস্তে করে অদের কাছে বসে পড়ে। গোয়েন্দার গল্প-গুজবের এক ফাঁকে মোজি রশিটা তার গলায় পেঁচিয়ে ধরে। মেয়ে দুটো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ফ্লোরি সঙ্গে সঙ্গে রশির অপর মাথা ধরে ফেলে। গোয়েন্দা নিজেকে রক্ষা করার জন্য হাত-পা ছোঁড়ার আগেই মেয়েরা দুদিক থেকে টান দিয়ে তার গলার ফাস শক্ত করে ফেলে। ক্ষণকাল ছটফট করে করে হাসান ইবনে আবদুল্লাহর গোয়েন্দা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

রউফ কুর্দি খানিক দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো। এক কর্মচারি ওদিকে আসতে চাইলে কাজের কথা বলে তাকে সরিয়ে দেয়। মেয়ে দুটো গোয়েন্দার মৃতদেহটা সমুদ্রে ফেলে দেয়। রোজি চলে যায়। ফ্লোরি ওখানেই বসে থাকে। রউফ কুর্দি তার নিকট ফিরে আসে এবং দুজনে দুজনের মাঝে হারিয়ে যায়।

***

আল-ফারেস জানেনই না তার জাহাজে কোনো গোয়েন্দা এসেছে কিবা রউফু কুর্কি নতুন কাউকে চাকরিতে নিয়োগদান করেছে। গোয়েন্দার হত্যাকাস্ত্রে তিন-চার দিন পর আল-ফারেসের মনে ভাবনা জাগে, নিজের ও অন্যান্য জাহাজের মাল্লা ও সৈনিকরা মাসের পর মাস সমুদ্রে নিরানন্দ জীবন-যাপন করছে এবং এতো দিনে সবাই ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ওঠেছে। অন্যান্য জাহাজে গিয়ে তিনি মাল্লা ও সৈনিকদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। কারোরই মন ভালো নেই। মাঝে-মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হলেও তাদের মনের অবস্থা অন্তত এরূপ হতো না। তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ঈমানদীপ্ত দান করেন, কোনো এক রাতে সবাইকে একত্রিত করে একটা বিনোদন ও ভোজসভার আয়োজন করবেন।

আল-ফারেস রউফ কুর্দি এবং অন্যান্য অধীন অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেন। আলোচনার সময় মেয়ে দুটোও উপস্থিত ছিলো। তারা খুশিতে আটখানা হয়ে বললো, আমরা নাচবো। আল-ফারেস প্রাণোচ্ছল ফুর্তিবাজ মানুষ। তিনি মেয়েদের প্রস্তাব গ্রহণ করে নেন। তবে অনুষ্ঠান কোন্ রাতে হবে এখনো ঠিক করেননি। কারণ, তিনি স্থল থেকে সুলতান আইউবীর দূতের অপেক্ষা করছেন। সময়টা ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ।

দুদিন পর দূত এসে পৌঁছে। জানায়, সুলতান আইউবী টায়ের থেকে সামান্য দূরে এসে অবস্থান নিয়েছেন। আপনি বহর নিয়ে টায়েরের কাছাকাছি চলে যান, যাতে প্রয়োজনের সময় দ্রুত টায়ের পৌঁছে যেতে পারেন। দূত বিশেষভাবে সতর্ক করে, এখন দিন-রাত সব সময় চৌকস থাকতে হবে। কেননা, খৃস্টান রণতরীগুলো নিকটেই অবস্থান করছে। আল-ফারেস দূতকে বিদায় দিয়ে সেদিনই সন্ধ্যায় বিক্ষিপ্ত জাহাজগুলোকে এক স্থানে একত্রিত করার ইঙ্গিত দিয়ে দেন। তিনি রউফ কুর্দিকে জানান, সম্ভবত দিন কয়েকের মধ্যেই আমাদেরকে নৌযুদ্ধ লড়তে হবে। কাজেই, অনুষ্ঠানটা দুরাত পরই আয়োজন করে ফেললে ভালো হয়।

রউফ কুর্দি মেয়েদেরকে জানিয়ে দেয়, অমুক রাত জাহাজগুলো একত্রিত হবে এবং আমাদের বিনোদন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।

এন্ড্রুর আসা-যাওয়া অব্যাহত রযেছে। হাসান ইবনে আবদুল্লাহর গোয়েন্দা তাকে কয়েক জায়গায় দেখেছিলো। এখন যখন জাহাজগুলো কূলে এসে ছিঁড়ে, তো এ এসে পড়ে। মেয়েরা যথারীতি তাকে উপরে তুলে আনে এবং কেনাকাটার ছলে তার কানে তথ্য দিয়ে দেয়, অমুক রাত জাহাজগুলো একত্রিত হবে এবং এই জাহাজের ছাদে বিনোদন অনুষ্ঠান হবে। সে এই বলে চলে যায় যে, সে রাতে আমার ডিঙ্গি আসবে। তোমরা সিঁড়ি ফেলে আমাকে উপরে তুলে নেবে।  

***

 আজ সেই রাত। ছয়টি জাহাজ পাল খুলে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজগুলোর ক্যাপ্টেন ও অন্যান্য অফিসার- আল-ফারেসের জাহাজে এসে সমবেত হয়েছে। উন্নতমানের সুস্বাদু খাবার প্রস্তুত হচ্ছে। মান্না ও সৈনিকগণ নিজ নিজ জাহাজে উৎসব করছে। আল-ফারেসের জাহাজে মেয়ে দুটো নাচছে। দফ ও সারেন্দার বাজনা চলছে। জাহাজে অনেকগুলো বাতি জ্বলছে। রাতকে দিনে পরিণত করা হয়েছে।

উৎসব যখন তুঙ্গে ওঠে, তখন রাত অনেক কেটে গেছে। খৃস্টানদের দশ-বারোটি রণতরী আল-ফারেসের জাহাজের দিকে বাতি নিভিয়ে এগিয়ে আসছে। নবচন্দ্রের বিন্যাসে আসছে জাহাজগুলো। নিকটে এসে পৌঁছার পরও কারো খবর হয়নি, শত্রুর নৌবহর আসছে। এদিকে ছোট একটি ডিঙি নৌকা আল-ফারেসের জাহাজের দিকে এগিয়ে আসে। হঠাৎ আল-ফারেসের জাহাজগুলোর উপর জ্বলন্ত গোলা এসে পড়তে শুরু করে এবং এমন মুষলধারায় তীর আসতে শুরু করে যে, মুহূর্ত মধ্যে কয়েকজন মাল্লা ও সৈনিক লুটিয়ে পড়ে। আল-ফারেস ও তার কাপ্তানগণ এই অতর্কিত আক্রমণ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু জাহাজ বের করে নেয়া সম্ভব হলো না। সৈনিকরা তীর ছুঁড়ে আক্রমণের উত্তর দেয়। মিনজানিক দ্বারা গোলা নিক্ষেপ করা হয়। একটি খৃস্টান জাহাজে আগুন ধরে যায়। কিন্তু খৃষ্টানরা তাদের কার্যসিদ্ধি করে ফেলে। তাদের জাহাজ, ফিরে চলে যায়।

যুদ্ধ যেরূপ হঠাৎ শুরু হয়েছিলো, তেমনি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদের বিবরণ তোমাবেক আল-ফারেসের পাঁচটি জাহাজ। পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। এ ঘটনা ৫৮৩ হিজরীর ২৭ শাওয়াল মোতাবেক ১১৮৭ খৃস্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর ঘটে।

জাহাজগুলো জ্বলছিলো। প্রজ্বলমান জাহাজের আলোতে এক ব্যক্তি দেখে একটি ডিঙি চলে যাচ্ছে, যাতে দুজন পুরুষ ও দুজন নারী। আল-ফারেস জাহাজ দেখে নৌকা নামিয়ে দিয়ে ধাওয়া করে তাদের ধরার চেষ্টা করেন। এদিক থেকেও তীর ছোঁড়া হয়। ডিঙিটি ঘিরে ফেলা হয়। পুরুষ দুজন ও এক নারী তীরবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছে। এক মেয়ে রক্ষা পেয়েছে। পরে তার থেকে প্রাপ্ত তথ্যে এই ধ্বংসযজ্ঞের প্রকৃত রহস্য উন্মোচিত হয়েছে।

সে সময় সুলতান আইউবী টায়ের থেকে সামান্য দূরে ছাউনি ফেলে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকেই তার সোজা টায়ের আক্রমণ করার পরিকল্পনা। রওনার একদিন আগে তিনি সংবাদ পান, ছয় জাহাজের পাঁচটি ধ্বংস হয়ে গেছে। শুনে তিনি স্তব্ধ হয়ে যান। এ মুহূর্তে এরূপ দুঃসংবাদ শুনতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি অগ্রযাত্রা মুলতবি করে দেন এবং আল-ফারেন্স ও জাহাজের কাপ্তানদের ডেকে পাঠান। আল ফারেস সোজাসাপ্টা উত্তর দেন, সৈনিকদের বিনোদনের জন্য আমরা একটু উৎসবের আয়োজন করেছিলাম। সবাই আনন্দে মেতে ছিলো। সে ফাঁকে দুর্ঘটনাটা ঘটে গেছে।

সুলতান আইউবী তার সালার ও উপদেষ্টাদের বৈঠক ডাকেন। সকলকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। সবাই পরামর্শ দেয়, প্রচণ্ড শীত পড়ছে। বর্ষা শুরু হয়ে গেছে। এ মওসুমে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া অবিরাম যুদ্ধে সৈনিকরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় তাদের দ্বারা যুদ্ধ করানো অবিচার হবে। পরিণামে পরাজয় আসতে পারে। তারা নৌবহরের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে সুলতান আইউবীকে বুঝবার চেষ্টা করে, এতো দীর্ঘ সময় সৈনিকদেরকে বাড়ি-ঘর থেকে দূরে রাখার প্রতিক্রিয়া এমনই হয়ে থাকে। এমন না হয় যেন, বাইতুল মুকাদ্দাসের মহান বিজয়ও আমাদের জন্য নতুন কোনো দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুলতান আইউবী একনায়ক শাসক নন। তিনি নায়েব-উপদেষ্টাদের পরামর্শ গ্রহণ করে নেন এবং আদেশ জারি করেন, বিজিত অঞ্চলগুলো থেকে যে অস্থায়ী বাহিনী গঠন করা হয়েছিলো, সেগুলো ভেঙে দেয়া হোক এবং কিছু অর্থ প্রদান করে তাদের বাড়ি-ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হোক। তিনি তার নিয়মতান্ত্রিক সৈন্যদের একাংশকেও অল্প কদিনের ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন এবং নিজে ১৯৮৮ সালের ২০ জানুয়ারি আক্রার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। মার্চ পর্যন্ত সুলতান আইউবী আক্ৰায় অবস্থান করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *