৮.৩ হিত্তীন

হিত্তীন

৫৩৮ হিজরীর মহররম মাস। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী দামেশকে অবস্থান করছেন। আজ তার চেহারাটা উজ্জ্বল। চোখে আনন্দের ঝিলিক বিরাজ করছে। তার চেহারার এই ঔজ্জ্বল্য আর চোখের এই ঝিলিক তার হাইকমান্ডের সালার ও ঘনিষ্ঠজনরা ভালোভাবে জানেন। তিনি যখন কোনো ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন তার চোখে-মুখে এই ভাবটা ফুটে ওঠে। যেসব মুসলিম আমীর, শাসক ও দুর্গপতি ক্রুসেডারদের বন্ধু হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, সুলতান তাদের প্রত্যেককে নিজের অনুগত ও পক্ষভুক্ত করে নিয়ে ফেলেছেন। তাদের মধ্যে সবচে গুরুত্বপূর্ণ হলেন হাব ও মসুলের গবর্নর ইযযুদ্দীন ও ইমাদুদ্দীন। তারা কয়েক বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে সুলতান আইউবীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেছেন। তাদের বাহিনী এখন আইউবীর যৌথ বাহিনীর অধীন।

সুলতান আইউবী প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ফিলিস্তীন অভিমুখে যাত্রা করার আগে তিনি ঈমান বিক্রেতা মুসলিম আমীর-শাসকদের পদানত করবেন, যাতে তারা তার ও প্রথম কেবলার মাঝে প্রতিবন্ধক হতে না পারে। এই প্রতিজ্ঞা পালন করে এখন তিনি দামেশকে অবস্থান করছেন। তিনি তরবারীর জোরে গাদ্দারদের সোজা পথে এনে বলেননি আমি বিজয়ী। বরং তিনি আক্ষেপ করে বলতেন, ইসলামের ইতিহাসের এই অধ্যায়টি খুবই লজ্জাজনক বিবেচিত হবে, যাতে বর্ণনা করা হবে সালাহুদ্দীনের শাসনামল কালো যুগ ছিলো। সে যুগে ক্রুসেডাররা বাইতুল মুকাদ্দাস দখল করেছিলো আর মুসলমানরা আপসে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলো। অবশ্য সুলতান বলতেন, গাদ্দারদেরকে পক্ষভুক্ত করে আমি ক্রুসেডারদের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়েছি।

আজ যখন তিনি দামেশকে তার হাইকমান্ডের সালার-উপদেষ্টা এবং অসামরিক কর্মকর্তাদের বৈঠকে তলব করেন, তখন সকলে তার চেহারায় বিশেষ এক দীপ্তি ও চোখে সেই ঝিলিক দেখতে পান, যা মাঝে-মধ্যে দৃষ্টিগোচর হয়ে থাকে। সকলে বুঝে ফেলে, সুলতান তার গন্তব্য অভিমুখে রওনা হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেছেন। আর সকলের জানা, সুলতানের গন্তব্য বাইতুল মুকাদ্দাস। এখন তাদেরকে তার মুখ থেকে শুনতে হবে, কবে কোন্ সময় যাত্রা শুরু হবে, বিন্যাস কীরূপ হবে এবং পথ কোন্‌টা হবে।

আমার বন্ধুগণ!- সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ভাষণ শুরু করেন আপনারা প্রত্যেকে নিশ্চয়ই এ কথা বলে আমাকে সমর্থন যোগাবেন যে, আমরা বাইতুল মুকাদ্দাস অভিমুখে রওনা করতে প্রস্তুত আছি। আজ আমি আপনাদের উদ্দেশে যে বক্তব্য দান করবো, সন্দেহ নিরসনের লক্ষ্যে। আপনারা আমাকে যেসব প্রশ্ন করবেন, আপত্তি উত্থাপন করবেন, সব আমাদের ইতিহাস হয়ে থাকবে। আমাদের শব্দ-ভাষা, আমাদের অঙ্গীকার ইতিহাসের লিপিতে পরিণত হবে। এই লিপি আমাদের সর্বশেষ প্রজন্ম পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। আমরা জগতে এই ইতিহাসের লেখা রেখে যাবো আর মহান আল্লাহর সমীপে নিজেদের আমল নিয়ে উপস্থিত হবো। আমরা আমাদের অনাগত প্রজন্ম এবং মহান আল্লাহর সমীপে লজ্জিত হবো, নাকি সম্মানিত সে সিদ্ধান্ত আমাদেরকেই নিতে হবে। বিজয়ের গ্যারান্টি আমরা কেউ দিতে পারবো না। তবে আমরা প্রত্যেকে এই প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে পারি যে, আমরা লড়াই করবো, জীবন দেবো- ফিরে আসবো না।

সুলতান আইউবী সকলের প্রতি তাকান। তার ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটে ওঠেছে। তিনি বললেন- আমি আপনাদেরকে আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত করবো না। আপনাদের কারো কারো মনে ভয় থাকতে পারে, আমাদের সৈন্য সংখ্যা ক্রুসেডারদের তুলনায় অনেক কম। তাছাড়া আমরা নিজ ভূমি থেকে বহু দূরে যুদ্ধে যাচ্ছি। আমি আপনাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমরা সব সময় অল্প কম নয়- অনেক কম সৈন্য দ্বারা কয়েকগুণ বেশি দুশমনের সঙ্গে লড়াই করেছি ও বিজয় অর্জন করেছি। যুদ্ধ সংখ্যা দ্বারা নয়- চেতনা ও বুদ্ধি দ্বারা লড়া হয়। ঈমান শক্ত হলে বাহু, তরবারী এবং মনও শক্ত হয়ে যায়। আমাদের কাছে ঈমানের কমতি নেই। বুদ্ধির অভাব নেই। আপনারা ঈমান অটুট রাখুন। শক্তিকে ব্যবহার করুন।

আমাদের একজনও নিজেদের ও দুশমনের সামরিক শক্তির তুলনা করছি না- কমান্ডো বাহিনীর সালার সারেম মিসরী দাঁড়িয়ে বললেন। তিনি সঙ্গীদের উপর দৃষ্টি বুলান। এক এক করে সকলের প্রতি তাকান। প্রত্যেকে তাকে সমর্থন জ্ঞাপন করেন। তিনি বললেন- তবে দেখা আবশ্যক, আমরা বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত কোন দিক থেকে এবং কোন্ ধারায় পৌঁছবো। সাবধানতা অবশ্যম্ভাবী। আত্মম্ভরিকতা পরিহার করে আমাদেরকে বাস্তবতাকে স্বীকার করে কাজ করতে হবে।

আমি আপনাদেরকে এ কথাটাই বলার জন্য তলব করেছি- সুলতান আইউবী বললেন- আমি অগ্রযাত্রা ও যুদ্ধের পরিকল্পনা আপনাদের পরামর্শেই প্রস্তুত করেছি। আর আমি কয়েক রাত ভাবনা-চিন্তার পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি, আমাদের প্রথম মনজিল হবে হিত্তিন। আপনারা সকলে হিত্তিনের সামরিক গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত আছেন। সেখানে সেই ভূখণ্ড পেয়ে যাবো, যেই ভূখণ্ডে আমি ক্রুসেডারদের লড়াই চাই। যুদ্ধে; আপনাদের উত্তম বন্ধু সেই ভূখণ্ড, আপনারা যেখানে দুশমনকে টেনে এনে যুদ্ধ করিয়ে থাকেন। এ কথা আমি আপনাদের আগেও বহুবার বলেছি। কথাটা আপনারা হৃদয়ে অংকন করে নিন। যুদ্ধের জন্য এমন অঙ্গন বেছে নিন, যা আপনাদেরকে উপকার দেবে এবং শত্রুর ক্ষতি করবে। এ অঙ্গন আমরা হিত্তিনের অঞ্চলে পেয়ে যাবো। শর্ত হলো, আমাদেরকে গোপনীয়তা বজায় রেখে দ্রুত গতিতে আগে-ভাগে সেখানে পৌঁছে যেতে হবে এবং দুমশনকে সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে ফেলতে হবে।

হিত্তিনের অঞ্চলে উঁচু ভূমি আছে, পানিও আছে। আপনারা যদি উঁচু পাহাড় এবং পানির উৎসগুলো দখল করে নিতে পারেন, তাহলে ভাবতে পারেন আপনারা অর্ধেক যুদ্ধ জিতে গেছেন। তবে দুশমনকে সেখানে টেনে নেয়া সহজ হবে না। আমাদের পরিকল্পনার একটি অংশও যদি অবাস্তবায়িত থাকে, তাহলে গোটা পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যাবে এবং ধ্বংস আমাদেরকে যে পর্যন্ত নিয়ে যাবে, সেখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা অসম্ভব হবে। আমার ইচ্ছা, এ মাসের মাঝামাঝি নাগাদ আমরা দামেশক থেকে রওনা হবো। আমি হাল্ব ও মিসরে দূত পাঠিয়ে দিয়েছি। তারা দ্রুততার সঙ্গে যথাসম্ভব কম বিরতি দিয়ে পৌঁছে ফৌজ প্রেরণ করবে, যাদের সঙ্গে আমাদের পথে দেখা মিলবে। আমাদের সকল সৈন্যকে একস্থানে সমবেত করতে হবে। বাইরে থেকে আসা এবং এখানকার সৈন্যদের একত্রিত করে এবং তাদের সালারদেরকে পরিপূর্ণ পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিয়ে বণ্টন করতে হবে। আমাদের অগ্রযাত্রা বিভিন্ন অংশের অগ্রযাত্রা হবে। প্রতিটি অংশের পথ আলাদা হবে।

আমি যথারীতি গোপনীয়তা বজায় রাখার ব্যবস্থা করে রেখেছি। আপনাদের ব্যতীত অন্য কারো কোনো কমান্ডার বা সৈনিকের জানবার প্রয়োজন নেই, আমরা কোথায় যাচ্ছি। দুশমনের অঞ্চলে আমাদের গোয়েন্দারা কাজ করছে। তারা দুশমনের খুঁটিনাটি সকল গতিবিধি ও সিদ্ধান্তের সংবাদ আমাদের পৌঁছিয়ে দিচ্ছে। এখন আবশ্যক হলো, আমাদের অঞ্চলে শত্রুর যেসব গোয়েন্দা আছে, তাদেরকে অন্ধ, বধির ও বিভ্রান্ত বানিয়ে ফেলতে হবে। হাসান ইবনে আবদুল্লাহ তারও ব্যবস্থা করে রেখেছে। আমি আপনাদেরকে আরো একটি বিষয় বলে দিতে চাই। তা হচ্ছে, ফৌজের একটি অংশ আমার সঙ্গে থাকবে। আমি তাদের কার্ক নিয়ে যাবো।

সুলতান আইউবী হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে যান। তার মাথাটা নুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর মাথাটা ঝটকা দিয়ে উপরে তুলে বললেন- চার বছর কেটে গেছে আমি একটি কসম খেয়েছিলাম, আমাকে সেই কসম পূরণ করতে হবে।

***

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সেই কসম ছিলো এক ঐতিহাসিক ঘটনা। তিনি কনফারেন্সে চার বছর আগের সেই ঘটনাটি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন। আপনারা পড়ে এসেছেন, খৃস্টান শাসকগণ এমনই চরিত্রহীন মানুষ ছিলেন যে, তারা মুসলমানদের কাফেলা লুণ্ঠন করতেন। তারা কাজটা সৈন্যদের দ্বারা করাতেন। হজ্ব যাত্রীদের কাফেলা হেজাজ যাওয়া এবং আসার সময় তারা পথে পথে ওঁৎ পেতে বসে থাকতো। এক খৃস্টান ম্রাট প্রিন্স অর্নাত- যিনি সে সময় কার্কের শাসক ছিলেন। নিজ আদেশে এবং নিজের বিশেষ বাহিনী দ্বারা এ কাজ করাতেন। এই অপকর্মের জন্য তিনি গর্ব করে বেড়াতেন। কোন হজ্ব কাফেলা লুণ্ঠন করাতে পারলে তিনি এমনভাবে উল্লাস প্রকাশ করতেন, যেনো বড় ধরনের বিজয় করে ফেলেছেন। শুধু মুসলমান ঐতিহাসিকগণই নন- ইউরোপিয়ান ঐতিহাসিকগণও তার এই দস্যুবৃত্তির কাহিনী বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন।

১১৮৩ অথবা ১১৮৪ সালের ঘটনা। অর্নাতের বাহিনী হেজাজ থেকে মিসরগামী একটি হজ্ব কাফেলার উপর আক্রমণ চালায় এবং কাফেলা লুণ্ঠন করে। মিসরী কাহিনীকার মুহাম্মদ ফরিদ আবু হাদীদ লিখেছেন, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর এক কন্যাও উক্ত কাফেলায় ছিলো। তবে আর কোন ঐতিহাসিক উক্ত কাফেলার সুলতান আইউবীর কন্যা থাকার কথা উল্লেখ করেননি। একজন ঐতিহাসিক শুধু এটুকু লিখেছেন যে, সুলতান আইউবী যখন অর্নাতের বাহিনীর হজ্ব কাফেলা লুণ্ঠনের এবং কয়েকটি মেয়ের অপহরনের সংবাদ পান, তখন তিনি গর্জে ওঠে বলেছিলেন- ওরা আমার কন্যা। আমি এর প্রতিশোধ নেবো।

কাফেলায় কয়েকটি যুবতী মেয়ে ছিলো। খৃস্টানরা তাদেরকে তুলে নিয়ে যায়। তখনই সুলতান আইউবী কসম খেয়েছিলেন- অর্নাতকে আজ থেকে আমি আমার ব্যক্তিগত শত্রু মনে করছি। আমি কসম খাচ্ছি, তার থেকে আমি নিজ হাতে এর প্রতিশোধ নেবো।

সকলে জানেন, তাদের সুলতান এই ধারায় এবং এই ভঙ্গিতে কখনো। কথা বলেননি। তিনি উত্তেজিত হয়ে কথা বলা এবং আবেগ পছন্দ করেন না। তাঁর প্রতিটি উক্তি সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে। আজ যখন তিনি প্রতিশোধের কসম খেলেন, সকলে বুঝে ফেললেন, এটা সুলতানের প্রত্যয় এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। এমনিতে প্রত্যেক খৃস্টান সম্রাটই ইসলামের দুশমন। কিন্তু অর্নাতের অতিরিক্ত একটি অপরাধ হলো, তিনি ইসলাম ও রাসূলে পাক (সা.) সম্পর্কে অপমানজনক উক্তি করে থাকেন। মুসলিম বন্দিদের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে রাসূলে আকরামকে (সা.) গালাগাল করেন এবং বলেন ডাকো তোদের কাবার প্রভূকে, এসে তোদের সাহায্য করুক। পাঠ করো তোদের রাসূলের কালেমা, তোমরা মুক্ত হয়ে যাও। তারপর তিনি অট্টহাসিতে ফেটে পড়তেন। তার এই চরিত্র সম্পর্কে সুলতান আইউবী অবহিত ছিলেন। তাই যখনই তিনি অর্নাতের নামোচ্চারণ করতেন, তার প্রতি মন ভরে ঘৃণা প্রকাশ করতেন।

আজ চার বছর পর সুলতান আইউবী যখন খৃস্টানদের বিরুদ্ধে সেনাভিযানের জন্য সালারদের দিক-নির্দেশনা প্রদান করছেন, তখন তাদের উক্ত ঘটনাটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন- ঐ হতভাগ্য কাফেরটা থেকে আমাকে নিজ হাতে প্রতিশোধ নিতে হবে। আল্লাহ আমাকে আমার রাসূলের অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার সাহস ও সুযোগ দান করুন। তিনি সালারদেরকে আরো দিক-নির্দেশনা দিতে গিয়ে বললেন- আমি আশা, করছি, আমরা তিন মাস পর সেই মওসুমে হিত্তিনের অঞ্চলে গিয়ে উপনীত হবো, যখন সূর্যের কিরণ পানির ফোঁটাকে বালিকণায় পরিণত করে দেয় এবং যখন বালির সেই জ্বলন্ত কণাগুলো মানুষকে সিদ্ধ করে ফেলে এবং বালুকাময় প্রান্তরে মরিচিকা আর আকাশে উড়ন্ত বালুকণা ছাড়া আর কিছুই থাকে না। আমি ক্রুসেডারদেরকে সেই সময় যুদ্ধ করতে বাধ্য করবো, যখন সূর্যটা মাথার উপর থাকবে। ক্রুসেডাররা লোহার বর্ম ও শিরস্ত্রাণে ঝলসে যাবে। তারা আমাদের তীর-তরবারী-বর্শার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যে লোহার পোশাকটা পরিধান করে থাকে, তা প্রত্যেক ক্রুসেডারের জন্য জাহান্নামে পরিণত হয়ে যাবে। • ••

যুদ্ধের জন্য সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী জুন-জুলাই মাসকে নির্বাচন করেছেন। ইতিহাসবিদ এবং ইউরোপীয় যুদ্ধ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকগণ সুলতান আইউবীর এই পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন। এই সময়টায় মরুভূমি চুল্লি থেকে বের করা লোহার ন্যায় গরম থাকে। ক্রুসেডার সৈন্যরা লোহার পোশাকের নীচে সংরক্ষিত থাকে। তাদের নাইটরা মাথা থেকে পা পর্যন্ত বর্মপরিহিত থাকে। তীর-তরবারী তাদের উপর কোন ক্রিয়া করতে পারে না। কিন্তু সুলতান আইউবী তাদের এই নিরাপত্তা পোশাকটাকে তাদের বিরাট এক দুর্বলতায় পরিণত করে দেন। একে তো তিনি গেরিলা ধরনের যুদ্ধ করতেন। স্বল্পসংখ্যক সৈন্য দ্বারা দুশমনের পার্শ্বের উপর বিদ্যুতিতে আক্রমণ চালাতেন। তারা কাজ সেরে চোখের পলকে উধাও হয়ে যেতো। তার এই কৌশলের কারণে দুশমনকে ছড়িয়ে যেতে হতো এবং চলার গতিবেগ বাড়িয়ে দিতে হতো। কিন্তু এ বর্ম-শিরস্ত্রাণের কারণে তারা প্রয়োজন অনুপাতে দ্রুত দৌড়াতে পারতো না। বিপরীতে সুলতান আইউবীর সৈন্যদের এ সমস্যাটা ছিলো না।

সুলতান আইউবী আরেকটি কৌশল এই অবলম্বন করেছিলেন যে, তিনি যুদ্ধ তখন শুরু করবেন, যখন সূর্য মাথার উপর থাকবে এবং মরুভূমি স্ফুলিঙ্গে পরিণত হবে। এ সময়টায় বর্ম চুলার ন্যায় উত্তপ্ত হয়ে যায়। পিপাসায় দেহ শুকিয়ে যায়। অথচ পানি থাকবে সুলতান আইউবীর দখলে। মরুভূমির ঝলসানো উত্তাপ ইসলামী বাহিনীর জন্যও সমস্যা সৃষ্টি করতো। কিন্তু তাদের পোশাক হতো হাল্কা-পাতলা। তাছাড়া সুলতান আইউবীর প্রশিক্ষণ ছিলো অত্যন্ত কঠিন। তিনি উট-ঘোড়া এবং সমস্ত বাহিনেিক দীর্ঘ সময়ের জন্য মরুভূমিতে রেখে দিতেন এবং নিজেও তাদের সঙ্গে অবস্থান করতেন। তিনি তার ফৌজকে ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকারও প্রশিক্ষণ দিয়ে রেখেছেন। তিনি রমযান মাসে প্রশিক্ষণ ও মহড়া বেশি কাতেন এবং বলতেন- এই পবিত্র মাসে মহান আল্লাহ আপন হাতে আমাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।

দৈহিক প্রশিক্ষণ ছাড়াও তিনি সৈনিকদের মানসিক বরং আত্মিক প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। তিনি সৈনিকদেরকে বুঝ প্রদান করতেন, তোমরা আল্লাহর সৈনিক এবং ইসলামের সংরক্ষক। তোমরা কোনো রাজা কিংবা সুলতানের কর্মচারি নও। তিনি গনীমতের সম্পদ সৈনিকদের মাঝে বণ্টন করে দিতেন। কিন্তু বুঝ দিতেন, যুদ্ধ গনীমতের জন্য লড়া হয় না এবং গনীমত জিহাদের পুরস্কারও নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা ছিলো আত্মমর্যাদাবোধ, যা তিনি সমগ্র বাহিনীর মধ্যে সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। যেসব মুসলিম মেয়েকে খৃস্টানরা তুলে নিয়ে যেতো, সুলতান আইউবী তাদের কথা বেশি বেশি স্মরণ করতেন এবং সেই মুসলিম নারীদেরও, যারা খৃস্টান অধিকৃত অঞ্চলে তাদের হিংস্রতার শিকার হয়ে জীবন অতিবাহিত করছিলো।

যে জাতি জাতির শহীদ ও মজলুম কন্যাদেরকে ভুলে যায়, সে জাতির ভাগ্যে কাফেরদের গোলামি লিপিবদ্ধ হয়ে যায়- কথাটা সুলতান আইউবী সব সময় মুখে আওড়াতেন। তিনি সৈনিকদের মাঝে ঘোরাফেরা করতেন, তাদের গল্প-গুজব ও খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতেন। তাদেরকে বলতেন প্রতিশোধ সৈন্যরাই নিয়ে থাকে। ফৌজ যদি দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে তাদের জন্য এ জগতেও অপমান, পরজগতেও অপমান।

***

বড় ক্রুশটা সম্মুখে রাখা। পার্শ্বে দণ্ডায়মান ক্রুশের মোহাফেজ, যিনি আক্রার পাদ্রী। খৃষ্টানদের বিশ্বাস মোতাবেক এটি সেই আসল ক্রুশ, যার উপর হযরত ঈসাকে (আ.) শূলি দেয়া হয়েছিলো। তারা মনে করে, এ কুশটার গায়ে এখনো হযরত ঈসা (আ.)-এর রক্তের দাগ বিদ্যমান। একে বড় কুশ বলা হয়। এ কারণেই আক্রার পাদ্রীকে বড় ক্রুশের মোহাফেজ বলা হয়ে থাকে এবং তার আদেশ-নিষেধ সম্রাটদের আদেশ-নিষেধ অপেক্ষা বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। খৃস্টান সম্রাটগণও তার আদেশ-নিষেধ মান্য করে থাকেন। খৃস্টান ও ইহুদী মেয়েদেরকে তারই অনুমতিক্রমে মুসলমানদের অঞ্চলে গুপ্তচরবৃত্তি, চরিত্র হনন ইত্যাদি কাজের জন্য প্রেরণ করা হতো। যে মেয়ে এ কাজের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে দায়িত্ব পালনে রওনা হতো, তাকে ক্রুশের মহান মোহাফেজ দুআ দিয়ে বিদায় জানাতেন। সেই মেয়েদের থেকে বড় ক্রুশের উপর হাত রাখিয়ে অফাদারি এবং ক্রুশকে ধোকা না দেয়ার প্রতিজ্ঞা নেয়া হতো। এরূপ প্রতিজ্ঞা খৃস্টান ফৌজের প্রতিজন অফিসার ও সৈনিকের থেকেও নেয়া হতো। শেষে এমনি ছোট্ট একটি ক্রুশ তাদের গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হতো।

নাসেরা নামক এক স্থানে খৃস্টান সম্রাটগণ সমবেত হয়েছেন। তাদের মধ্যে গাই অফ লুজিনান, রেমন্ড অফ ত্রিপোলী, গ্র্যান্ড মাস্টার জেরাড, মাউন্ট ফেরাত, হামফ্রে অফ তুরান, এমারিক এবং প্রিন্স অর্নাত অফ কার্ক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

কনফারেন্সে আক্রার পাদ্রী বড় ক্রুশের মোহাফেজও উপস্থিত আছেন। হলঘরটা কাপড়ের তৈরি একটি সুদৃশ্য প্রাসাদ। প্রাসাদের ন্যায় তার কক্ষ, বারান্দা, গলি। রং-বেরঙের বাতির আলো বিদ্যমান। সব মিলে হলটা মর্মর নির্মিত প্রাসাদের চেয়েও বেশি সুদৃশ্য ও মনোরম। তারই আশপাশে মেহমানদের থাকার জায়গা, নাইট ও সৈন্যদের তাঁবু। মদের মটকার সঙ্গে আছে সেসব রূপসী মেয়ে, যাদের যাদুকরী রূপ ভাইকে ভাইয়ের এবং পিতাকে পুত্রের শত্রুতে পরিণত করে থাকে।

পাকা প্রাসাদের কক্ষের ন্যায় এক শামিয়ানার নীচে বড় ক্রুশটা রাখা আছে। তার সামনে তার সম্রাটগণ, তাদের সেনাপতি ও নির্বাচিত নাইটগণ উপবিষ্ট। সকলেই জানেন, এটি একটি ঐতিহাসিক সমাবেশ এবং ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায় রচিত হতে যাচ্ছে। এই অধ্যায়ের শিরোনাম হচ্ছে সালাহুদ্দীন আইউবীকে চিরতরে খতম করে দাও।

ক্রুশের মোহাফেজগণ!- আক্রার পাদ্রী বললেন- এ হচ্ছে সেই ক্রুশ, যার গায়ে হাত রেখে তোমরা সকলে শপথ নিয়েছিলে। আজ এই ক্রুশ তোমাদের সম্মুখে এ কারণে আক্রা থেকে নিয়ে আসা হয়েছে, যাতে তার সঙ্গে তোমরা যে অঙ্গীকার করেছিলে, তা যেনো তাজা হয়ে যায়। আজ তোমাদেরকে এক রক্তক্ষয়ী ও সিদ্ধান্তমূলক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। এই যুদ্ধ তোমাদেরকে লড়তেই হবে। তোমরা সকলে যোদ্ধা, সেনাপতি। তোমাদের জীবন যুদ্ধের ময়দানে অতিবাহিত হয়েছে। আমি সেই ময়দানের লোক নই। আমি তোমাদের ধর্মের নেতা। আমি তোমাদেরকে বলতে এসেছি, সালাহুদ্দীন আইউবীকে পরাজিত করে আরব বিশ্বে ক্রুশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। জেরুজালেম আমাদের আছে এবং থাকবে। আমাদেরকে মক্কা-মদীনাও দখল করতে হবে এবং এই পবিত্র কুশকে মুসলমানদের কাবা ঘরে স্থাপন করতে হবে। তাকে ঈসা মসীহর উপাসনালয় বানাতে হবে।

মনে রেখো, তোমরা মদীনা থেকে তিন মাইল দূরে পৌঁছে গিয়েছিলে। কিন্তু মুসলমানরা তোমাদেরকে আর এগুতে দেয়নি। মুসলমানরা তাদের পবিত্র ভূমির সুরক্ষার জন্য যে উন্মাদনার সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলো, তোমাদেরকেও সেই উন্মাদনার সঙ্গে লড়াই করতে হবে। সালাহুদ্দীন আইউবীর দৃষ্টি জেরুজালেমের উপর নিবন্ধ হয়ে আছে। সে বলছে, এটা বাইতুল মুকাদ্দাস। এটা নাকি তাদের প্রথম কেবলা। তোমরা যদি তার থেকে জেরুজালেমকে রক্ষা করতে চাও, তাহলে মক্কার উপর দৃষ্টি রাখো। মনে এ কথাটা জাগরুক রাখো, আমাদের যুদ্ধ সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে নয়- এটা ক্রুশ ও ইসলামের লড়াই। এটা দুটি ধর্মের, দুটি বিশ্বাসের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আমরা যদি জয়ী হতে না পারি, তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম লড়াই করবে। তারাও যদি ইসলামের বিনাশ ঘটাতে না পারে, তাহলে তাদের পরের প্রজন্ম যুদ্ধ করবে। দুটি ধর্মের একটির পতন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলতে থাকবে। তবে পতন ইসলামেরই হবে এবং সমগ্র পৃথিবীতে ক্রুশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।

আমরা মুসলমানদের পরাজয় ঘটানোর জন্য অন্য পন্থা অবলম্বন করে রেখেছি। কিন্তু, সেটি এখনো সফল হয়নি। তোমাদের সকলেরই জানা থাকবে, সেই অভিযানে আমরা কী পরিমাণ মেয়ে নষ্ট করেছি। বিপুল সম্পদ এবং অস্ত্রও হারিয়েছি। এসব সম্পদ ও অস্ত্র আমরা সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে মুসলিম আমীরদের পেছনে ব্যয় করেছি। সেসব মেয়ে ও হীরা-জহরতের বিনিময়ে আমরা এটুকু অর্জন করেছি যে, মুসলমানদের মাঝে মদ ও বিলাসিতার স্বভাব গড়ে ওঠেছে। তারই বদৌলতে আমরা তাদেরকে ছয়-সাত বছর যাবত আপসে যুদ্ধ করিয়ে চলছি। তাদের গৃহযুদ্ধ থেকে আমরা এটুকু লাভবান অবশ্যই হয়েছি যে, মুসলমানদের সামরিক শক্তি বহুলাংশে নষ্ট হয়ে গেছে এবং আইউবীর বহু অভিজ্ঞ ও ভালো ভালো সৈনিক ও কমান্ডার মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। এই গৃহযুদ্ধ থেকে আমরা এ স্বার্থও উদ্ধার করেছি যে, সাত-আট বছর যাবত আমরা সালাহুদ্দীন আইউবীকে নিজ অঞ্চল থেকে বের হতে দেইনি। এই সময়টায় আমরা যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি এবং জেরুজালেমের প্রতিরক্ষা এতো শক্ত করে তুলেছি যে, সালাহুদ্দীন আইউবীর পক্ষে জেরুজালেমের পথে পা রাখাই অসম্ভব হয়ে গেছে।

কিন্তু গৃহযুদ্ধের আগে আইউবীর যে অবস্থাটা ছিলো, এখন সেই অবস্থা পুনরায় অর্জন করে নিয়েছে। সে হাল্ব এবং মসুলের সৈন্যদেরও পেয়ে গেছে। সকল মুসলিম আমীর তার সমর্থক হয়ে গেছে। মুজাফফর উদ্দীন ও কাকবুরীর ন্যায় সালার- যারা তার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলো এবং আমাদের বন্ধু হয়ে গিয়েছিলো তার নিকট চলে গেছে। সে গাদ্দারদেরকে এমন দুর্বল ও অসহায় করে তুলেছে যে, এখন আর তারা আমাদের কোন কাজে আসছে না, এখন এমন কোন মুসলিম শাসক অবশিষ্ট নেই, যে সালাহুদ্দীন আইউবীর উপর পেছন থেকে হামলা করবে। আমরা হাশিশিদেরকেও পরীক্ষা করে দেখেছি। চার-পাঁচটি সংহারী আক্রমণেও তারা আইউবীকে হত্যা করতে পারেনি। এখন আমাদের এ ছাড়া আর কোন গতি আর কোনো পথ নেই যে, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আইউবীর উপর আক্রমণ চালাবো। কিন্তু আমাদের সেনাপতিরা পরামর্শ দিয়েছে, আক্রমণটা তাকে যেনো আগে করতে দেই। তারা আমাকে এর দুটি কারণ বলেছে। এক হচ্ছে, তার বাহিনীকে এতো দূরে নিয়ে যাওয়া দরকার, যেখানে রসদের পদ রুদ্ধ এবং বিপজ্জনক হয়ে পড়বে। দ্বিতীয় কারণ, সালাহুদ্দীন আইউবী যে ধারায় যুদ্ধ করে, তাতে আমরা আমাদের সৈন্যদেরকে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়ে পড়ি। এখন যেহেতু দুশমনের অঞ্চলে আমাদের কোনো সহযোগি রইলো না, তখন আক্রমণের ঝুঁকি আমাদেরকে বুঝে-শুনে নিতে হবে।

আমাদেরকে বেশি অপেক্ষা করতে হবে না। গোয়েন্দাদের রিপোর্ট মোতাবেক সালাহুদ্দীন আইউবী জেরুজালেম অভিমুখে রওনা হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেছে। এখন তোমাদেরকে দেখতে হবে, সে কোন্ পথে আসে। সোজা জেরুজালেমের দিকে আসে, না কী করে। আমাদেরকে এই বাস্তবতা স্বীকার করতেই হবে যে, আমরা একাকি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পেরে ওঠবো না। এখন তোমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেছো। বড় ক্রুশকে এখানে টেনে আনার উদ্দেশ্য হলো, তোমরা সকলে একসঙ্গে ক্রুশের উপর হাত রেখে শপথ নাও, তোমরা দুশমনের বিরুদ্ধে একপ্রাণ হয়ে যুদ্ধ করবে এবং ইসলামের পতন না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবে না।

সকলে উঠে দাঁড়ায়। ক্রুশের গায়ে হাত রাখে। আক্রার পাদ্রীর উচ্চারিত বাক্যগুলো উচ্চারণ করে শপথ গ্রহণ করে।

***

পরদিন সম্রাটগণ বেশ বেলা হলে জাগ্রত হন। রাতে পাদ্রী ছুটি দেয়ার পর তারা মদ-নাচে মগ্ন হয়ে পড়েন। প্রত্যেকে আপন আপন পছন্দের মেয়ে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। তাদের রূপ, অর্ধনগ্ন দেহ, বিক্ষিপ্ত রেশমি চুল, হৃদয়কাড়া নাচ আর মদ এই ভূখণ্ডটাকে ভূস্বর্গে পরিণত করে ফেলেছে। পরদিন সূর্যোদয় হয়ে গেছে। কিন্তু নিদ্রা খৃষ্টানদের এই রাজকীয় ক্যাম্পে কবরের নীরবতা আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

প্রিন্স অর্নাতের তাবু থেকে এক তরুণী বের হয়। অতিশয় রূপসী ও দীর্ঘকায় মেয়ে। আকর্ষণীয় গাত্রবর্ণ। টানা টানা কাজলকালো চোখ দুটোয় যেনো যাদুর ক্রিয়া। এই রং আর এই চোখ খৃস্টান কিংবা ইহুদী মেয়েদের নয়। সুদান, মিসর কিংবা দামেশকের মেয়ে বলে মনে হলো। মেয়েটা অবর্ণনীয় রূপসী হওয়ার পক্ষে এ প্রমাণটাই যথেষ্ট যে, প্রিন্স অর্নাত তাকে পছন্দ করে সঙ্গে এনেছেন।

মেয়েটাকে দেখে এক বৃদ্ধা চাকরানি দৌড়ে তার নিকট চলে আসে। এখানে সম্রাটদের চাকর-চাকরানিদের সংখ্যা এখানকার সেনাসংখ্যা অপেক্ষা বেশি। অর্নাত মেয়েটাকে প্রিন্সেস লিলি বলে ডাকেন। আকারে গঠনে-উচ্চতায়-অবয়বে মেয়েটাকে রাজকন্যাই মনে হলো। সে চাকরানিকে বললো- স্রেফ আমার জন্য তাড়াতাড়ি নাস্তা নিয়ে আসো আর গাড়ি প্রস্তুত করো। আমি ভ্রমণে বের হবো।

অর্নাত গভীর ঘুম ঘুমিয়ে আছেন। জাগ্রত হতে তার কোন তাড়া নেই। শুধু পাদ্রী সকাল সকাল জাগ্রত হয়ে উপাসনা করে আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন। লিলির এখন কোনো কাজ নেই। নাস্তা আসতে আসতে সে প্রস্তুত হয়ে যায়। নাস্তা সারতে না সারতে গাড়িও এসে হাজির। দুই ঘোড়ার সুদৃশ্য গাড়ি। কার্ক থেকে অর্নাতের সঙ্গে সে এ গাড়িতে করেই এসেছিলো।

গাড়িতে চড়ে বসার আগে মেয়েটি গাড়োয়ানকে বললো- এই এলাকাটা খুবই সুদৃশ্য ও মনোরম লাগছে। আমি ভ্রমণে যেতে চাই। তুমি কি অঞ্চলটা চেনো?

ভালোভাবেই চিনি প্রিন্সেস- গাড়োয়ান উত্তর দেয়- আপনি যদি ভ্রমণে যেতে চান, তাহলে তীর-ধনুক-তূনীরও নিয়ে নিই। শিকারও খেলতে পারবেন। এ অঞ্চলে হরিণ বেশি নেই বটে; তবে কোথাও কোথাও দেখাও যায়। অনেক খরগোশ আছে। পাখিও আছে। ,

লিলি মুচকি হেসে বললো- তুমি কি আমাকে তীরন্দাজ মনে করছো? আচ্ছা যাও। নিয়ে আসো।

কোন সমস্যা নেই- গাড়োয়ান বললো- আপনি যুদ্ধে তো আর যাচ্ছেন না। শিকারের গায়ে তীর ছোঁড়ার পর যদি ব্যর্থ যায়, তাহলে সমস্যার তো কিছু নেই।

গাড়োয়ান ছুটে গিয়ে তীর-ধনুক-তূনীর নিয়ে আসে।

গাড়ি তাবু অঞ্চল থেকে অনেক দূরে চলে যায়। এলাকাটা সবুজ শ্যামল। গাছ-গাছালিও আছে বেশ। আছে উঁচু উঁচু টিলা-টিপি। সময়টা মার্চ-এপ্রিল। বসন্ত কাল। তাতে এলাকাটা অধিকতর সুদৃশ্য হয়ে ওঠেছে। গাড়ি ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে। লিলির কথায় একটি ঝাড়ের নীচে গাড়ি থেমে যায়। লিলি নেমে পড়ে। গাড়োয়ানের নাম সায়বাল। ধর্মে খৃস্টান এবং উক্ত অঞ্চলেরই অধিবাসী।.বয়স ত্রিশের কিছু বেশি। সুদর্শন ও দীর্ঘকায় যুবক। এসব দেখেই অর্নাত তাকে নিজের গাড়ির গাড়োয়ান হিসেবে নির্বাচন করেছেন। লিলিরও লোকটা বেশ পছন্দ। প্রাণোচ্ছ্বল ও অনুগত লোক। লিলির অর্নাতের নিকট আসার এক বছর পর সায়বাল তাদের কাছে এসেছিলো।

আচ্ছা, মুসলমানদের সীমান্ত কোথা থেকে শুরু হয়েছে? লিলি গাড়ি থেকে নেমে গাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করে।

কোন ফৌজ যে স্থানে পৌঁছে ছাউনি ফেলে বসে, সেটাই তাদের সীমানা হয়ে যায়- গাড়োয়ান উত্তর দেয়- আমি আপনাকে এটুকু বলতে পিরবো, এখান থেকে আট-দশ মাইল দূরে সমুদ্রের দিকে বিস্তীর্ণ একটি ঝিল আছে। তার নাম গ্যালিলি। তারই কূলে তাবরিয়া নামক একটা পল্লী আছে। তার থেকে খানিক এদিকে হিনি নামে বিখ্যাত একটি গ্রাম আছে। ঐ ঝিলটা অতিক্রম করে গেলেই মুসলমানদের অঞ্চল শুরু হয়ে যায়।

তার মানে মুসলমানদের অঞ্চল এখান থেকে বেশি দূরে নয়- লিলি বললো- আমরা কি গাড়িতে করে ঝিল পর্যন্ত যেতে পারবো?

আমরা কার্ক থেকে ঘোড়াগাড়িতে করে এসেছি- সায়বাল বললো ঝিল অনেক কাছের এলাকা। এই ঘোড়া দুটো ক্লান্তি ছাড়াই সে পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারবে।

লিলি শিশুদের ন্যায় পথ-ঘাট জিজ্ঞেস করতে শুরু করে। গাড়োয়ান মাটিতে রেখা টেনে নকশা এঁকে তাকে রাস্তা বোঝতে শুরু করে।

এখান থেকে দামেশক যাওয়ারও তত পথ আছে, না? লিলি জিজ্ঞেস করে।

 হ্যাঁ আছে বলে গাড়োয়ান তাকে দামেশকের পথটাও বুঝিয়ে দেয়।

***

লিলি তুনীর থেকে তীর বের করে ধনুকে সংযোজন করে গাছে পাখি দেখতে শুরু করে। ঐ এক গাছে কি একটা পাখি যেনো বসে আছে। লিলি তীর ছোঁড়ে। কিন্তু তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। লিলি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। গাড়োয়ান এগিয়ে এসে নিশানা ঠিক করার পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়। লিলি এদিক-ওদিক কয়েকটা তীর ছোঁড়ে।

আরো সামনে চলো- লিলি গাড়িতে চড়ে বসতে বসতে বললো কোথায় হরিণ আছে, সেখানে, চলো। হরিণ তো মারতে পারবো।

সায়বাল লিলিকে দেড়-দুমাইল দূরে নিয়ে যায়। এক স্থানে গড়ি থামিয়ে বললো, একটু অপেক্ষা করুন, হরিণ কিংবা খরগোশ পেয়ে যাবেন। বলেই সায়বাল একদিকে চলে যায়। পা বিশেক দূরে একটা গাছ আছে। সায়বাল তার সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সে প্রিন্সেস লিলির জন্য হরিণ-খরগোশ খুঁজতে শুরু করে। তার পিঠটা লিলির দিকে। লিলি ধনুকে তীর সংযোজন করে। সায়বালের পিঠটাকে নিশানা বানায়। কেউ দেখলে এটাই ভাবতো, সে ঠাট্টা করছে। সে ধনুক টেনে ধরে। তার হাতে ধনুকটা কাঁপছে। একটা চোখ বন্ধ করে সায়বালের পিঠটা নিশানা বানিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

লিলি ধনুকটা আরো টেনে ধরে তীরটা ছুঁড়ে দেয়। তীর সায়বালের কাঁধ ঘেঁষে গাছটার ডালে গিয়ে গেঁথে যায়। সায়বাল হটাৎ ঘাবড়ে ওঠে মোড় ঘুরিয়ে তাকায়। প্রথমে গাছের ডালে গেঁথে যাওয়া তীরটার প্রতি এবং পরে লিলির দিকে তাকায়। লিলি হাসছে না। তার চেহারায় গাম্ভীর্য। যেমনটি সায়বাল ইতিপূর্বে কখনো দেখেনি। তবু সে হেসে বললো- আপনি বুঝি আমার উপর তীর অনুশীলন করছেন? বলেই সে লিলির দিকে এগিয়ে যেতে উদ্যত হয়।

লিলি ঝটপট তূনীর থেকে আরো একটি তীর বের করে ধনুকে সংযোজন করে বলে ওঠে- থামো, ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। এদিক ওদিক হবে না।

সায়বাল দাঁড়িয়ে যায়। লিলি ধনুকটা সামনে নিয়ে টেনে ধরে। সায়বাল চীৎকার করে বলে ওঠে- প্রিন্সেস! আপনি একী করছেন?

লিলির ধনুক থেকে তীর বেরিয়ে যায়। সায়বালের দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ। সে বসে পড়ে। তীরটা শা-শব্দ তুলে তার পার্শ্ব ঘেঁষে অতিক্রম করে যায়। সায়বাল লিলির মর্যাদা ও নিজের অবস্থানের কথা ভুলে যায়। লিলি তুনীর থেকে আরো একটি তীর বের করতে উদ্যত হয়। সায়বাল, অতি দ্রুততার সাথে তার দিকে ছুটে যায়। অতো তাড়াতাড়ি তীর বের করে ধনুকে সংযোজন করার অভিজ্ঞতা লিলির নেই। সায়বাল তার দিকে এগিয়ে এলে সে দৌড়ে আড়ালে চলে যায়। কিন্তু সায়বাল তো পুরুষ এবং তাগড়া যুবক। পৌঁছে গিয়ে সে লিলিকে ধরে ফেলে। লিলির হাত থেকে ধনুকটা কেড়ে নেয়। কাঁধ থেকে নীরটাও ছিনিয়ে নেয়।

আমি সেই দাস শ্রেণীর মানুষ নই, যাদের উপর তাদের মনিবরা সব রকম জুলুম করে থাকে- সায়বাল বলে এবং ধনুকে একটা তীর সংযোজন করে লিলির প্রতি তাক করে ধরে। বললো- আপনি কি আমার উপর তীর অনুশীলন করতে চাচ্ছেন? নাকি এটা আমার আন্তরিক সেবা ও আনুগত্যের প্রতিদান?

লিলির মুখে কোন উত্তর নেই। মেয়েটির ওষ্ঠাধর কাঁপছে। তার চোখে অশ্রু নেমে এসেছে। সায়বাল ধনুকটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ধীর পায়ে লিলির দিকে এগিয়ে যায়।

আমি বুঝতে পারলাম না, আপনি আমার উপর কেননা তীর চালালেন এবং কেননাই বা আপনার চোখে অশ্রু নেমে এলো? সায়বাল জিজ্ঞেস করে।

তুমি কি আমাকে সাহায্য করতে পারো? লিলি এমন এক কণ্ঠে বললো, যেটি কোন রাজকন্যার কণ্ঠ নয়। এটি একটি ভয়পাওয়া সাধারণ মেয়ের কণ্ঠ।

আপনার জন্য আমি জীবনও দিতে পারি- সায়বাল বললো- বলুন আপনার কীরূপ সাহায্যের প্রয়োজন?

পুরস্কার দিয়ে লাল করে দেবো- লিলি বললো- পুরস্কার হিসেবে আমাকে দাবি করবে, তো তাও মৈনে নেবে। তুমি আমাকে গ্যালিলি ঝিলের ওপারে মুসলমানদের অঞ্চলে গিয়ে চলো। আমাকে সামেশক দিয়ে। আসো। তারপর এই গাড়ি আর ঘোড়া দুটো তোমার হবে। পুরস্কার আলাদা পাবে।

আমার মনে হচ্ছে, আপনার মাথায় কোনো গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে সায়বাল বললো- চলুন, আমরা ফিরে যাই।

যদি আমার কথা না শোনন, তাহলে ফিরে গিয়ে প্রিন্স অর্নাতকে বলবে, এখানে তুমি আমার প্রতি হাত বাড়িয়েছে। লিলি সায়বালের কানে কানে বললো।

ভালোই হলো, কথাটা বলে ফেলেছেন- সায়বাল বললো- এখন না আপনি ফিরে যেতে পারবেন, না আমি ফিরে যাবো। হাত-পা বেঁধে আমি আপনাকে গাড়িতে করে কোন এক নগরীতে নিয়ে কোনো ব্যবসায়ীর নিকট বিক্রি করে ফেলবো। আচ্ছা, বলুন তো, মুসলমানদের অঞ্চলে যেতে চাচ্ছেন কেন?

এবার লিলি টের পেয়েছে, সে জালে আটকা পড়েছে। মেয়েটি বসে পড়ে এবং মাথাটা উভয় হাঁটুর মধ্যখানে গুজিয়ে কোঁকাতে শুরু করে। সায়বাল তার প্রতি তাকিয়ে আছে। লিলি তার অপরিচিত মেয়ে নয়। কিন্তু এখন তাকে গভীর চোখে দেখতে শুরু করেছে, যেনে নতুন কাউকে। দেখছে। মেয়েটার মাথার চুল, গায়ের রং, চলন-বলন কোনটিই খৃস্টান। মেয়েদের মতো নয়। তার জানা আছে, খৃস্টানদের কাছে অনেক অপহৃতা মুসলিম মেয়েও আছে। এই মেয়েটিও তেমনি অপহৃতা হতে পারে। কিন্তু কিন্তু একে তো সে আজ তিন-চার বছর যাবত হাসি-খুশিই দেখতে পাচ্ছে। সায়বাল লিলির পাশে বসে পড়ে।

যদি মুসলমান হয়ে থাকো, তো বলো- সায়বাল বললো-সম্ভবত তোমাকে অপহরণ করা হয়েছিলো।

আর তুমি প্রিন্স অনাতকে বলে দিয়ে পুরস্কার গ্রহণ করবে- লিলি বললো- আর তাকে বলে দেবে, আমি পালাবার চেষ্টা করেছিলাম।

লিলি দেখতে পায়, সায়বালের গলায় একটা ফিতা ঝুলছে। সে ফিতাটা যরে টান দিলে ক্ষুদ্র একটি ক্রুশ বেরিয়ে আসে। লিলি বললো- এটা হাতে নিয়ে কসম খাও, আমাকে ধোকা দেবে না। অর্নাতকে বলবে না আমি তোমার গায়ে তীর ছুঁড়েছিলাম।

সায়বাল মেয়েটির আসল পরিচয় জেনে ফেলে। বললো- কুশ হাতে ওয়া কসম মিথ্যা হবে। সে ফিতাটা গলা থেকে খুলে ফেলে এবং ক্রুশটা। একদিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বলে- মুসলমান ক্রুশ হাতে কসম খায় না।

লিলি চমকে ওঠে সায়বালের দিকে তাকায়, যেনো লোকটার কথায় তার বিশ্বাস হচ্ছে না। সে দূরে মাটিতে পড়ে থাকা কুশটার প্রতি দৃষ্টিপাত করে। কোনো খৃস্টান সে যতোই পাপিষ্ঠ হোক না কেন, ক্রুশের অবমাননা করে না। সায়বাল নিশ্চিত হয়ে গেছে, লিলি কোনো মুসলমান পিতার কন্যা।

আমি তোমার কাছে আমার গোপনীয়তা ফাঁস করে দিয়েছি সায়বাল বললো- তুমি বলো, তোমাকে কখন এবং কোথা থেকে অপহরণ করা হয়েছিলো?

আমি হজ্ব করে পিতা-মাতার সঙ্গে মিসর ফিরে যাচ্ছিলাম- লিলি ভয় পাওয়া শিশুটির ন্যায় বললো- অনেক বড় কাফেলা ছিলো। তখন আমার বয়স ছিলো ষোল-সতের বছর। চার-সাড়ে বছর কেটে গেছে। কার্কের সন্নিকটে এই কাফেররা কাফেলার উপর আক্রমণ চালায় এবং মালপত্র লুটে নেয়। তারা অনেক রক্ত ঝরায়। আমি জানি না, আমার পিতা-মাতা মারা গেছেন, নাকি জীবিত আছেন। কাফেররা আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে। বোধ হয় আমার দুর্ভাগ্যই ছিলো, আমি এতো রূপসী ছিলাম যে, কার্কের শাসনকর্তা প্রিন্স অর্নাত আমাকে পছন্দ করেন এবং নিজের কাছে রেখে দেন।

প্রিন্স অর্নাতের সামনে আমি অনেক কান্নাকাটি করি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তিনি বললেন, আমি রাজত্ব ত্যাগ করবো তবু তোমাকে ছাড়বো না। তারপর তিনি আমাকে বিবাহ করেননি এবং নিজের ধর্মও গ্রহণ করে নিতে বলেননি। আমি তার ভোগের উপকরণ হয়ে থাকি। তার নিকট আরো কয়েকটি রূপসী মেয়ে ছিলো। তারা আমার শত্রু হয়ে যায়। কিন্তু অর্নাত শুধু আমাকেই সঙ্গে রাখেন এবং আমি যা বলি শোনেন। আমি এই অবস্থাটা মেনে নিই। এ ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিলো না। নারীর ভাগ্যই এমন যে, যখন যার কজায় এসে পড়ে, তখন তার মালিকানা ও গোলাম হয়ে যায়।

লিলি বলতে বলতে নীরব হয়ে যায়। সায়বালকে গভীর দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে বললো- তুমি কি আমার সমস্ত কথা প্রিন্স অর্নাতকে বলে দেবে? শুনে তিনি আমাকে কী শাস্তি দেবেন?

আমি যদি সত্যি সত্যি সায়বাল হতাম, তাহলে তা-ই করতাম, তুমি যার ভয় করছো- গাড়োয়ান বললো- আমি সিরীয় মুসলমান। আমার নাম বকর ইবনে মুহম্মদ।

তুমি সেই গোয়েন্দাদের একজন তো নও, যাদের সম্পর্কে অর্নাত বলে থাকেন, আমাদের দেশে মুসলমান গোয়েন্দা লুকিয়ে আছে? মেয়েটি জিজ্ঞেস করে এবং বলে- আমার নাম ছিলো কুলসুম।

আমি যা কিছু হই না কেন- বকর উত্তর দেয়- আমি মুসলমান। আমি তোমাকে ধোকা দেবো না। এটা কোনো নতুন বিষয় নয় যে, একটি অপহৃতা মুসলিম মেয়ের এমন এক মুসলমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে গেছে, যে কিনা খৃস্টান বেশে খৃস্টানদের কর্মচারি হয়ে কাজ করছে। এরূপ ঘটনা আগেও বহু ঘটেছে। এমনও হয়েছে ভাই গোয়েন্দা হয়ে খৃস্টানদের শহরে ঢুকে পড়েছে তো সেখানে তার সেই বোনের সাক্ষাৎ পেয়ে গেছে, যে বহু বছর আগে অপহৃতা হয়েছিলো। বিস্মিত হয়ো না কুলসুম। তুমি হজ্ব সম্পাদন করে ফিরে যাচ্ছিলে। আল্লাহ তোমার হজ্ব কবুল করে নিয়েছেন। আমি আলিম নই যে, তোমাকে বলবো, আল্লাহ তোমাকে এই শাস্তিটা কেন দিলেন? তবে এখন মনে হচ্ছে, আল্লাহ তোমার দ্বারা বড় কোনো মহৎ কাজ করাবার জন্যই এ জাহান্নামে নিক্ষেপ করেছিলেন। তা তুমি কি শুধুই পালাতে চাও, নাকি পালাবার পেছনেও কোনো উদ্দেশ্য আছে?

অনেক বড় উদ্দেশ্য- কুলসুম বললো- তুমি বোধ হয় জানো না, আক্রার পাদ্রী এই খৃষ্টান সম্রাটদেরকে এখানে কেনো তলব করেছেন। রাতে অর্নাত যখন তার তাঁবুতে আসে, তখন তিনি নেশায় ঢুলু ঢুলু করছিলেন। তিনি আমাকে বাহুবন্ধনে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি অনেক বড় একটা রাজ্যের রাণী হতে যাচ্ছো। সালাহুদ্দীন আইউবী দিন কয়েকের মেহমান মাত্র। তিনি আমাদের জালে এগিয়ে আসছেন। খুব দ্রুত আসছেন। আমি আনন্দ প্রকাশ করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের পরিকল্পনা কী? তিনি বিস্তারিত বলে শেষে বললেন, এখানে যে কজন খৃষ্টান সম্রাট এসেছেন, তারা ক্রুশের গায়ে হাত রেখে ঐক্য এবং পরস্পর অফাদারির শপথ নিয়েছেন।

তারা কি সালাহুদ্দীন আইউবীর কোনো অঞ্চলের উপর আক্রমণ করবেন? বকর জিজ্ঞেস করে।

আমার পলাবার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমি সুলতান আইউবীর নিকট সংবাদ পৌঁছাবো, ক্রুসেডারদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা কী, তারা কী পরিমাণ সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছে এবং তাদেরকে কোথায় কোথায় বণ্টন করে ছড়িয়ে রেখেছে। অর্নাত আমাকে বলেছেন, তারা আক্রমণ করতে যাবেন না। বরং সালাহুদ্দীন আইউবীকে আক্রমণ করার সুযোগ দেবেন, যাতে তিনি নিজ অবস্থান থেকে দূরে সরে যান এবং তার রসদের পথ দীর্ঘ হয়ে যায়। তাদের আরো পরিকল্পনা, আইউবী যদি সহসা আক্রমণ না করেন, তাহলে তারা তিন দিক থেকে এগিয়ে গিয়ে হামলা চালাবে।

হঠাৎ তোমার চিন্তাটা আসলে কোনো, সংবাদটা সুলতান আইউবীকে পৌঁছানো দরকার? বকর ইবনে মুহাম্মদ জিজ্ঞেস করে এবং বলে কুলসুম! আমি এই ময়দানের মুজাহিদ। আমি যদি বলি, তুমি অর্নাতের কথায় ভুল তথ্য পৌঁছিয়ে সুলতান আইউবীকে বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছে, তাহলে কী উত্তর দেবে?

বলবো, তুমি স্বল্প বুদ্ধির মানুষ- কুলসুম উত্তর দেয়- তুমি যদি সুলতান আইউবীর গোয়েন্দা হয়ে থাকে, তাহলে তুমি নির্বোধ গোয়েন্দা। তুমি নিজ বাহিনীকে ক্রুসেডারদের হাতে খুন করিয়ে ফেলবে। অর্নাত যদি সুলতান আইউবীকে বিভ্রান্ত করতে চাইতেন, তাহলে কি অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করতে পারতেন না? যদি কাজটা আমাকে দিয়েই করাতে চাইতেন, তাহলে রাতে আমাকে গাড়িতে বসিয়ে মুসলমানদের অঞ্চলের নিকটে রেখে আসতে পারতেন না? শোনো বকর! মনোযোগ সহকারে শোনো! আমি তোমার গায়ে প্রথম যে তীরটি ছুঁড়েছিলাম, সে চিন্তাটা বিদ্যুতের ন্যায় হঠাৎ করেই আমার মাথায় এসেছিলো। আমি আসলেই শুধু ভ্রমণের জন্য বের হয়েছিলাম। তীর-ধনুক এনেছো তুমি।

এখানে এসে আমি মুসলমানদের সীমান্ত এখান থেকে কতো দূর জানবার জন্য, তোমাকে সীমান্ত ও দামেশূর্কের পথের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তুমি যখন বললে অঞ্চলটা এখান থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে, তখন মনে ভাবনা জাগে, কোনো প্রলোভন দেখিয়ে তোমাকে নিয়েই যাবো কিনা। কিন্তু আবার ভাবি, তুমি তো খৃস্টান, আমাকে সাহায্য করবে কিনা কীভাবে বিশ্বাস করি। পরে এই আশঙ্কাই প্রবল হয়ে দেখা দেয় যে, বললে হিতে বিপরীত হবে এবং তুমি আমাকে মুসলমানদের গুপ্তচর সাব্যস্ত করে অর্নাতের নিকট থেকে পুরস্কার লাভ করবে আর আমি ফেঁসে যাবো। আমার সামনে কোনো পথ ছিলো না। তুমি খানিক দূরে গাছের সঙ্গে ঠেদিয়ে দাঁড়িয়ে গেলে আমি গাছের উপর একটা পাখির গায়ে ছোঁড়ার জন্য ধনুকে তীর সংযোজন করি। তখন আমার দৃষ্টি তোমার পিঠের উপর নিবদ্ধ ছিলো।

তখনই মাথায় ভাবনা আসে, একটা কাজ করি না কেননা! লোকটা যখন এভো কাছাকাছি পজিশন মতো দাঁড়িয়ে আছে, তো তীরটা তাকেই বিদ্ধ করি না কেন। একটার বেশি দুটো ছুঁড়তে হবে না। তুমি মরে যাবে। আমি গাড়িতে চড়ে তোমার দেখানো পথে পালিয়ে যাবো। অন্য কোনো সমস্যার কথা আমি চিন্তাই করিনি। বোধ হয় আমার মধ্যে বিবেক কম আর আবেগ বেশি ছিলো। আর আবেগের মধ্যে প্রতিশোধের স্পৃহাই অধিক ছিলো। আমি কম্পিত হাতে তীর চালিয়ে দেই। পরে আমার মাথায় এই বুদ্ধিটুকুও আসলো না যে, বলবো, তীর ভুলবশত বেরিয়ে গেছে। বললে তো তুমি অজুহাতটা মেনে নিতে। কারণ, তোমার জানা আছে, আমি কোনোদিন ধনুক হাতে নেইনি। মোটকথা, তোমাকে হত্যা করে মুসলমানের এলাকায় পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার মুক্তির আর কোনো উপায় ছিলো না। কিন্তু আমি সফল হইনি।

এর আগে, কখনো পালাবার চিন্তা মাথায় এসেছিলো কিবকর জিজ্ঞেস করে।

প্রথম প্রথম অনেক চিন্তা করেছি- লিলি উত্তর দেয়। কিন্তু পরে বাস্তবতাকে মেনে নিতে বাধ্য হই যে, পালাতে পারবো না। অর্নাত আমাকে সত্যিকার অর্থেই রাজকন্যা বানিয়ে রেখেছেন, তাতে সন্দেহ নেই। তিনি বলতেন, তোমার প্রতি আমার যতোটুকু ভালোবাসা জন্মে গেছে, ইতিপূর্বে অন্য কোনো মেয়েকে আমি ততোটুকু ভালোবাসিনি। আমি তার সঙ্গে মদও পান করতে থাকি। না করে উপায় ছিলো না। দৈহিকরূপে আমি তার জীবনে একাকার হয়ে গিয়েছিলাম। এমন রাজকীয় জীবন তো আমি কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু একাকি হলেই আমি মুসলমান হয়ে যেতাম এবং আমার মনে হতো, এই মাত্র আমি হজ্ব করে এসেছি। মাঝে মধ্যে আমি আল্লাহকে গালাগালিও করে ফেলতাম। অনেক সময় মনে হতো, আমি আল্লাহকে ভুলে যাচ্ছি।

এমনি সময়ে সুলতান আইউবী কার্ক অবরোধ করলেন এবং অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করে নগরীর বিপুল অংশ ধ্বংস করে দিলেন। আমি প্রস্তুত হয়ে যাই, আমাদের বাহিনী শহরে ঢুকে পড়বে আর আমি অর্নাতকে নিজ হাতে হত্যা করে ফেলবো। কিন্তু এক মাস পর সুলতান অবরোধ তুলে নিলেন এবং ফেরত চলে গেলেন। অর্নাত অট্টহাসি হাসতে হাসতে আমার নিকট বললো, আমি লোকটাকে আবারো বোকা ঠাওরে দিলাম। আমি তার সঙ্গে চুক্তি করেছি, আগামীতে হাজীদের কাফেলার প্রতি হাত বাড়াবো না। আমি তার সঙ্গে আর যুদ্ধ না করারও চুক্তি করেছি।

আমি খুব ব্যথা পেলাম। সুলতান আইউবীর ফেরত না যাওয়া দরকার ছিলো। আমাকে মুক্ত না করে তার অবরোধ তুলে নেয়া ঠিক হয়নি।

সুলতান আইউবীর সামনে এর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে আছে- বকর বললো- তাকে বরং আমাদেরকে বাইতুল মুকাদ্দাস মুক্ত করতে হবে, যা কিনা আমাদের প্রথম কেবলা। আমাদেরকে ফিলিস্তিনীনের মাটি দখলমুক্ত করতে হবে, যেটি আমাদের নবী-রাসূলগণের জন্মভূমি। সুলতান আইউবী, যদি এক একটি মুসলিম নারীর মুক্তির জন্য বেরিয়ে পড়েন, তাহলে তিনি স্বীয় পবিত্র লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাবেন এবং লড়াই করতে করতেই নিঃশেষ হয়ে যাবেন। জাতি আপন পবিত্র লক্ষ্যের খাতিরে আপন সন্তানদের কুরবান করে থাকে।

অর্নাতের একটি মন্দ স্বভাব আমাকে ভুলতে দেয়নি যে, আমি মুসলমান- কুলসুম বললো- তিনি আমাদের রাসূলে খোদার শানে গোস্তাখি করে থাকে। আরো বলেন, সালাহুদ্দীন আইউবী তার প্রথম কেবলা দখল করার জন্য হাত-পা ছুঁড়ছে আর আমরা তার খানায়ে কাবাকে নিশ্চিহ্ন করে সেখানে আমাদের উপাসনালয় গড়ার জন্য এগিয়ে যাচ্ছি। 

ক্রুসেডারদের এই প্রতিজ্ঞা-পরিকল্পনার উল্লেখ ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরাও করেছেন। একবার তারা মদীনা থেকে তিন মাইল দূরে পৌঁছেও গিয়েছিলো। সুলতান আইউবীর কার্ক অবরোধ করে এক মাস পরে তুলে নেয়াও এক ঐতিহাসিক ঘটনা। অর্নাত যুদ্ধ এবং ভবিষ্যতে হাজীদের কাফেলা লুণ্ঠন না করার চুক্তি করেছিলেন বলে সুলতান অবরোধ প্রত্যাহার করেছিলেন, তা নয়। সুলতানের তো জানাই ছিলো, খৃষ্টানরা চুক্তি করেই ভঙ্গ করার জন্য। অবরোধ তুলে নেয়ার আসল কারণ ছিলো, সুলতান বায়তুল মুকাদ্দাস জয়ের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন। অর্নাত এই চুক্তির দুবছর পর আরেকটি হজ্ব কাফেলার উপর আক্রমণ করেছিলেন। চুক্তির মেয়াদ ছিলো ১১৮৮ সাল পর্যন্ত। সুলতান আইউবী ১১৮৭ সালে হিত্তীন অভিমুখে অগ্রযাত্রা করেন এবং অর্নাতকে নিজ হাতে হত্যা করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে দামেশক থেকে বের হয়েছিলেন।

***

কুলসুম বকর ইবনে মুহাম্মদকে নিজের ইতিবৃত্ত শোনাতে থাকে—

 অর্নাতের সঙ্গে আমি হাসি-খুশিও থাকি এবং আমার হৃদয়ে প্রতিশোধের আগুনও জ্বলতে থাকে। তিনি আমাকে মাঝে-মধ্যে বলতেন, সালাহুদ্দীন আইউবীর গোয়েন্দারা বেশ-ভূষা বদল করে আমাদের ভেতরে ঢুকে পড়ে এখানকার তথ্য নিয়ে যায়। তিনি আরো বলেছেন, অতিশয় রূপসী খৃস্টান ও ইহুদী মেয়েরা মুসলমানদের অঞ্চলে মুসলমান নাম-পরিচয় ধারণ করে তাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরকে ফাঁদে ফেলে তাদেরকে ক্রুশের স্বার্থে ব্যবহার করছে। অর্নাত আমাকে ঐ মেয়েদের কাহিনী শোনাতেন। শুনে কয়েকবার আমার মাথায় চিন্তা আসে, এই মেয়েরা আপন ধর্মের জন্য নিজেদের সম্ভ্রম বিসর্জন দিচ্ছে। সম্ভ্রম তো সেই সম্পদ, যার সুরক্ষার জন্য নারীরা জীবনের ঝুঁকি বরণ করে থাকে। অথচ এই মেয়েরা কিনা ধর্মের জন্য সম্ভ্রম বিসর্জন দিচ্ছে। এ কেমন ধর্ম! এরা কেমন নারী!

আমার সম্ভ্রম সুরক্ষিত নেই- লুণ্ঠিত হয়ে গেছে। আমি মনে মনে সংকল্প করি, আমিও আমার ধর্মের জন্য কুরবানী দেবো। কিন্তু তার জন্য সুযোগের তো প্রয়োজন। আমি সুযোগ পাচ্ছিলাম না। এখন এখানে এসে অর্নাত আমাকে এমন সব মহামূল্যবান সম্পদ দান করেছেন যে, সেই সম্পদ নিয়ে আমাকে সুলতান আইউবীর নিকট পৌঁছুতেই হবে। বোধ হয় আল্লাহ এই পুণ্যের জন্যই আমাকে এই জাহান্নামে প্রেরণ করেছিলেন। তুমি কি বলতে পারবে, এই সংবাদে সুলতানের কোনো উপকার হবে কিনা?

অনেক- বকর বললো- কিন্তু এ সংবাদ নিয়ে তোমাকে যেতে দেবো না। তুমি যাবে না। তুমি কিংবা আমরা দুজনই নিখোঁজ হয়ে গেলে প্রিন্স অর্নাত অমনি ধরে নেবেন, আমরা গোয়েন্দা ছিলাম। ফলে তারা তাদের পরিকল্পনায় রদবদল করে ফেলবে আর আমরা সুলতান আইউবীর নিকট যে সংবাদ পৌঁছাবো, তা তাঁর পরাজয়ের সূত্র হয়ে দাঁড়াতে পারে।

তার মানে, এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো সুলতানের নিকট পৌঁছুবে না! কুলসুম বললো।

পৌঁছুবে এবং অবশ্যই পৌঁছে যাবে- বকর বললো- কিন্তু ব্যবস্থাটা কার্কে গিয়ে করবো।

তুমি যাবে?- কুলসুম জিজ্ঞেস করে- আমি তো এখান থেকে পালাতেও চাই।

আমি যাবো না- বকর বললো- তুমিও যাবে না। কার্কে আমাদের সহকর্মীরা আছে। তথ্য পৌঁছানোর দায়িত্ব তাদের। আমার কাজ তথ্য সংগ্রহ করা। এখন এ কাজ তুমিও করবে। তোমার কাজ শেষ হয়নি। সবে শুরু হয়েছে মাত্র। সুলতানের জন্য কী ধরনের তথ্যের প্রয়োজন, আমি তোমাকে বলে দেবো। সেসব তথ্য তুমি আমাকে দেবে আর আমি দামেশক পৌঁছাবো।

তো এই নরকে আমাকে থাকতেই হচ্ছে, না? কুলসুম ক্ষুণ্ণমনে জিজ্ঞেস করে।

হ্যাঁ- বকর উত্তর দেয়- তোমাকে এই নরকে আর আমাকে মৃত্যুর মুখে পড়ে থাকতে হবে- এ ত্যাগ তোমাকে দিতেই হবে কুলসুম। সুলতান আমাদেরকে বলে থাকেন, একজন গোয়েন্দা কিংবা একজন কমান্ডো তার গোটা বাহিনীর জয় কিংবা পরাজয়ের কারণ হতে পারে। কিন্তু একজন গুপ্তচর সবসময় মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। গুপ্তচর দুশমনের হাতে পড়ে গেলে তাকে তৎক্ষণাৎ খুন করে ফেলা হয় না, তাকে নির্যাতন করা হয়, কষ্ট দেয়া হয়। আপন ধর্ম ও মাতৃভূমির জন্য কাউকে না কাউকে জীবন্ত চামড়া খসানোর মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতেই হয়। একটি জাতির নাম-চিহ্ন তখন মুছে যেতে শুরু করে, যখন তাদের মধ্যে কুরবানীর জযবা নিঃশেষ হয়ে যায়। তুমি এখানে চারটি বছর কাটিয়ে দিয়েছে। আর চারটা মাস কাটাও। এখন আর অর্নাতকে মনিব মনে করো না। তার সঙ্গে আগের চেয়ে বেশি ভালোবাসা দেখাও। মনে মনে বুঝ রাখো, তুমি এমন একটা বিষাক্ত নাগকে কজা করে রেখেছো, যে তোমার হাত থেকে ছুটে গেলে ইসলামী দুনিয়াকে দংশন করবে।

বলে যাও বকর, বলে যাও- কুলসুম বললো- আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে বলো, আমি মহান আল্লাহর দরবারে কীভাবে মুখ দেখাতে পারবো।

বকর বলতে শুরু করে। লিলিকে পরিপূর্ণ দিক-নির্দেশনা দিয়ে বললো তোমার এবং আমার মাঝে অন্য কোনো সম্পর্ক আছে বিষয়টা কাউকে বুঝতে দেবে না। এখানে আমাদের গোয়েন্দাদের খুঁজে বের করার জন্য নানা বেশে খৃস্টান গোয়েন্দারাও ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ-ও স্মরণ রাখবে, এখানে আমরা দুজনই গোয়েন্দা নই। আমাদের আরো অনেক সহকর্মী আছে। খৃষ্টান সম্রাট ও সেনাপতিগণ যে নগরীতে অবস্থান করছেন, তারা সেখানে দায়িত্ব পালন করছে। তাদের একজন অপরজন থেকে অধিক সাহসী ও বুদ্ধিমান। অন্তরে প্রবঞ্চনা রাখবে না যে, আমরা দুজনে মিলে বিরাট কাজ করে ফেলেছি। ভাবো না আমরা আল্লাহর বিরাট উপকার করে ফেলেছি। এসব আমাদের কর্তব্য, যা আমাদেরকে পালন করতে হবে। তার জন্য যত কষ্টই করতে হয়, আমরা বরণ করে নেবো।

ফিরে এসে কুলসুম যখন তাবু এলাকায় নিজ তাঁবুর সামনে গাড়ি থেকে অবতরণ করে, তখন সে প্রিন্সেস লিলি আর বকর ইবনে মুহম্মদ সায়বাল। কুলসুম যখন গাড়ি থেকে অবতরণ করছিলো, তখন সায়বাল গাড়ির পার্শ্বে দাঁড়িয়ে গোলামের ন্যায় মাথানত করে দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটি যখন তাঁবুতে গিয়ে প্রবেশ করে, তখন প্রিন্স অর্নাত একটি মানচিত্রের উপর ঝুঁকে রয়েছেন। ঢুকেই কুলসুম বলে ওঠে- ভ্রমণে গিয়েছিলাম, শিকারও খেলেছি।

কী মেরেছ? অর্নাত মানচিত্র থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই জিজ্ঞেস করেন।

কিছুই না- কুলসুম উত্তর দেয়- সব কটা তীরই ব্যর্থ গেছে। তর্কে সত্বর শিকার মারার যোগ্যতা এসে যাবে। বলে সেও মানচিত্রের উপর ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করে- অগ্রযাত্রার চিত্র, নাকি প্রতিরক্ষার

অগ্রযাত্রা সালাহুদ্দীন আইউবী করবেন- অর্নাত অন্যমনঙ্কের ন্যায় বললেন- আর প্রতিরক্ষাও তাকেই করতে হবে। আমরা তাকে জালে টেনে আনছি। তার নিঃশ্বাস নাকের ডগায় এনেই তবে আমরা অগ্রযাত্রা করবো। তখন আমাদেরকে ঠেকাবার মতো কেউ থাকবে না। তুমি নিজ তাঁবুতে চলে যাও লিলি। আমাকে বহু কিছু ভাবতে হবে। আজ রাত আমাদের কনফারেন্স বসবে। তাতে যুদ্ধের পরিকল্পনা ও মানচিত্র প্রস্তুত করা হবে। আমাকে সম্পূর্ণ ঠিক ঠিক পরামর্শ দিতে হবে। আমি এই অভিযানের হিরো হতে চাই।

***

তার নাম কুলসুম। বকর ইবনে মুহম্মদ তার সহকর্মী। সুলতান আইউবীর ইন্টেলিজেন্স বিভাগের উপ-প্রধান হাসান ইবনে আবদুল্লাহ সুলতানকে কার্কের গুপ্তচরদের প্রেরিত রিপোর্ট শোনান।

সুলতানের চোখ লাল হয়ে গেছে। তিনি বললেন- কে বলতে পারবে, আমাদের কতো কন্যা ঐ কাফেরদের কজায় আটক আছে এবং তাদের বিলাসিতার উপকরণে পরিণত হয়ে আছে। অনাতকে আমি ক্ষমা করবো না। মনে রাখবে হাসান! এই মেয়েটাকে ওখান থেকে উদ্ধার করতেই হবে। তবে এখনই নয়।

কার্কে আমাদের যে লোক আছে, তারাই উপযুক্ত সময়ে তাকে উদ্ধার করে আনবে। হাসান ইবনে আবদুল্লাহ বললেন।

আক্রার পাদ্রী এবং খৃষ্টান সম্রাটগণ তিন দিন নাসেরায় অবস্থান করেন। তারা যুদ্ধের পরিকল্পনা নকশা প্রস্তুত করে ফেলেছেন। কুলসুম অর্নাত থেকে সবকিছু জ্ঞাত হয়ে বকরকে অবহিত করেছে। ক্রুসেডাররাও সুলতান আইউবীর কিছু কিছু তথ্য জেনে ফেলেছে। মসুল, হাল্ব ও দামেশক, কায়রো সব অঞ্চলে তাদের গোয়েন্দা আছে। তারা ক্রুসেডারদেরকে সঠিক তথ্য সরবরাহ করছে। ক্রুসেডাররা এ-ও জেনে গেছে যে, মিসর থেকেও ফৌজ আসছে। সুলতান আইউবী খুব তাড়াতাড়ি অগ্রযাত্রা করবেন, তা-ও তারা জেনে ফেলেছে। ফলে তারা প্রতিরক্ষা যুদ্ধ লড়ে পরে আইউবীকে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা ঠিক করেছে। এ লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন স্থানে সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছে। তবে তারা এখনো জানতে পারেনি, সুলতান আইউবী কোন্ দিক থেকে আসবেন এবং যুদ্ধের অঙ্গন কোটা হবে। তারা অনুমানের ভিত্তিতে আইউবীর সেনাসংখ্যা, কতোজন আরোহী, কতোজন পদাতিক হতে পারে, ঠিক করে নিয়েছে।

হাসান ইবনে আবদুল্লাহ কার্ক থেকে আগত তার লোকদের থেকে বিস্তারিত রিপোর্ট গ্রহণ করেছেন। তারাই তাকে কুলসুম ও বকর সম্পর্কে তথ্য প্রদান করেছে। হাসান সেই রিপোর্ট সুলতানকে অবহিত করেছেন।

এ সংবাদ সেই সকল সংবাদের সত্যতা প্রমাণ করেছে, যেগুলো অন্যান্য অঞ্চলের গোয়েন্দারা আমাদের প্রেরণ করেছে- সুলতান আইউবীর বললেন- এ তো আমি আগেই বলেছি, ক্রুসেডাররা আমাদের অপেক্ষা করছে। এবার কার্কের রিপোর্ট তার সত্যায়ন করলো। এই রিপোর্টে নতুন তথ্যটি হচ্ছে ক্রুসেডারদের সামরিক শক্তির পরিমাণ। তাদের সঙ্গে দুহাজার নাইট থাকবে। এটা নিঃসন্দেহে বিরাট শক্তি। নাইট মাথা থেকে পা পর্যন্ত বর্মপরিহিত এবং সুরক্ষিত থাকে। তাদের ঘোড়া সাধারণ জঙ্গী ঘোড়ার তুলনায় বেশি শক্তিশালী ও কর্মচঞ্চল হয়ে থাকে। রৌদ্রতাপের ব্যারোমিটার যখন উচ্চাঙ্গে থাকবে, আমি তাদেরকে তখন যুদ্ধ করতে বাধ্য করবো।

আর সেই বর্ম পরিহিত নাইটদের সঙ্গে আট হাজার অশ্বারোহী সৈনিক থাকবে- হাসান ইবনে আবদুল্লাহ বললেন- পদাতিক বাহিনীর সংখ্যা ত্রিশ হাজারের বেশি জানানো হয়েছে।

আমার জন্য একটি নতুন সুসংবাদ হচ্ছে, আর্মেনিয়ার সম্রাটের বাহিনীও ক্রুসেডারদের সঙ্গে আসছে- সুলতান আইউবী বললেন- এরা ক্রুসেডারদের ত্রিশ-বত্রিশ হাজার সৈনিকের অতিরিক্ত। এদেরসহ দুশমনের সেনাসংখ্যা চল্লিশ হাজার হয়ে যাবে। কার্কের রিপোর্ট এবং অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদিতে আমরা নিশ্চিত হতে পারি, ক্রুসেডাররা প্রতিরক্ষা যুদ্ধ লড়বে এবং আমাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করবে। সে মোতাবেক আমার এই সিদ্ধান্ত সঠিক বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, আমি হিত্তীনের উপকণ্ঠে লড়াই করবো। আমি এই অঞ্চল সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত।

***

বন্ধুগণ! মহান আল্লাহ আমাদের উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, সেসব পালনে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াবার সময় এসে গেছে- সুলতান আইউবী দামেশকে নিজ কক্ষে সালার ও নায়েব সালারদের উদ্দেশে বললেন- আমাদেরকে ক্ষমতার জন্য লড়াই করার এবং ক্ষমতার জন্য মৃত্যুবরণ করার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। তারপরও আমরা আপসে অনেক ধুনাখুনি করেছি। সেই সুযোগে দুশমন ফিলিস্তীনের মাটিতে জেঁকে বসেছে। জাতি আমাদের হাতে তরবারী তুলে দিয়েছিলো এবং এই ভরসায় সঙ্গ দিয়েছিলো যে, আমরা ইসলামের দুশমনদের নির্মূল করবো এবং আরবের পবিত্র ভূখণ্ডকে কাফেরদের নাপাক অস্তিত্ব থেকে পবিত্র করবো।

আপনারা কয়েক বছর যাবত অবিরাম যুদ্ধ করে আসছেন। কিন্তু আসল যুদ্ধ সবে শুরু হয়েছে। মস্তিষ্কে এই যুদ্ধের লক্ষ্য তাজা করে নিন। সিদ্ধান্ত নিন, আমাদেরকে একটি স্বাধীন ও মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে জীবিত থাকতে হবে এবং আল্লাহ পাকের মহান ধর্মকে কুফরের অশুভ ছায়া থেকে মুক্ত রাখতে হবে। মুহাম্মদ ইবনে কাসিম ও তারিক ইবনে যিয়াদ সালতানাতে ইসলামিয়াকে যে পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন, আমাদেরকেও ইসলামী সাম্রাজ্যকে সে পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। তাদের পরে আগত বংশধরদের কর্তব্য ছিলো, আল্লাহর পয়গামকে সেখান থেকেও সম্মুখে এগিয়ে নিয়ে যেতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তার পরিবর্তে আমাদের ধর্মের শত্রুরা আমাদের ঘরে এসে জেঁকে বসেছে এবং তারা খানায়ে কাবা ও রওজায়ে মুবারককে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছে। কেন, এমনটা কীভাবে সম্ভব হলো? যেখানে মস্তিষ্কে রাজত্বের উন্মাদনা চেপে বসে, সেখানে সীমান্ত অনিরাপদ হয়ে পড়ে এবং আমীর-শাসকরা ক্ষমতার খাতিরে আপন ধর্ম ও আত্মমর্যাদাবোধকে বিসর্জন দিয়ে দেন।

আমাদের পতনের কারণ ক্ষমতার গদির নেশা এবং সম্পদের মোহ। তারা পৃথিবীর উপর রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আর এখন পৃথিবী আমাদের উপর রাজত্ব করছে। আমরা আখেরাতকে ভুলে বসেছি। আমরা শত্রু-বন্ধুর পরিচয় জানি না। আমাদের সামরিক চেতনার উপর ধ্বংসশীল জগতের স্বপ্নের যাদু প্রভাব বিস্তার করে বসেছে। মনে রাখুন আমার বন্ধুগণ! আমি আপনাদেরকে বহুবার বলেছি, জাতির ভাগ্য তরবারীর আগা দ্বারা লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে। সেনাপতি যখন সিংহাসনে বসে মাথায় মুকুট পরিধান করে, তখন তার হাতে কোষ থেকে তরবারীটা বের করার শক্তি তাকে না। তাদের হৃদয়ে আপন বোধ-বিশ্বাস ও স্বজাতির মর্যাদা সুরক্ষার চেতনা থাকে না। শেষে ধর্মটা প্রতারণার কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া ব্যতীত আর কোনো কাজের থাকে না।

আজ আমরা ইসলামের মর্যাদার খাতিরে শুধু এ জন্য আপন ঘর পরিজন ত্যাগ করে বেরিয়ে আসতে এবং দুশমনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে সক্ষম হয়েছি যে, আমরা ক্ষমতার পূরজারীদের খতম করে দিয়েছি। আমরা আস্তিনের সাপগুলোর মস্তক পিষে ফেলেছি। তারপরও আমরা যদি হেরে যাই, তাহলে বুঝতে হবে, আমাদের নিয়ত ঠিক ছিলো না।

সুলতান আইউবী এরূপ আবেগময় এবং দীর্ঘ ভাষণদানে অভ্যস্ত নন। কিন্তু যে লক্ষ্যে তিনি বের হচ্ছেন, তার জন্য সকলকে মানসিক ও আত্মিকরূপে প্রস্তুত করা জরুরি। এরা তাঁর অনুগত ও বিশ্বস্ত সালার-নায়েব সালার। তাদের মধ্যে মুজাফফর উদ্দীনের ন্যায় সুযোগ্য ও দুঃসাহসী সালারও উপস্থিত আছেন, যিনি এক সময় সুলতানের সঙ্গ ত্যাগ করে তার বিরোধী শিবিরে চলে গিয়েছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছিলেন। তকিউদ্দীন, আফজালুদ্দীন, ফররুখ শাহ এবং আল-মালিকুল আদিলের ন্যায় সালারগণও তার সঙ্গে আছেন, যারা তার রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়। সালার কাকবুরী তার ডান হাত। সামরিক যোগ্যতা এবং চেতনার দিক থেকে তারা একজনও কম নন। কিন্তু সুলতান আইউবী এই প্রথমবার ফিলিস্তীনের মাটিতে আক্রমণ করতে যাচ্ছেন এবং তার গন্তব্য বাইতুল মুকাদ্দাস।

অভিযানটা সহজ নয়। ক্রুসেডারদের সামরিক শক্তি যেমন পরিমাণে বেশি, তেমনি মানে উন্নত। তাদের জন্য সুবিধাটা হচ্ছে, তারা প্রতিরক্ষার জন্য নিজ ভূমিতে লড়াই করবে, যেখানে তাদের রসদের কোনো সমস্যা নেই এবং তারা নিজ অবস্থানের নিকটে। সুলতান আইউবী নিজ অবস্থান থেকে বহু দূরে অভিযানে যাচ্ছেন, যেখানে পর্যন্ত তার রসদ পৌঁছার পথ ঝুঁকিপূর্ণ এবং দূরে। যুদ্ধবিদ্যার হিসাব মোতাবেক আক্রমণকারী পক্ষই বেশি সমস্যা-অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে থাকে। সে কারণে আক্রমণকারী পক্ষের সেনাসংখ্যা প্রতিপক্ষের তুলনায় তিনগুণ না হোক দ্বিগুণ তত বেশি হতেই হয়। কিন্তু সুলতান আইউবী আক্রমণকারী হওয়া সত্ত্বেও তার সেনাসংখ্যা প্রতিপক্ষের তুলনায় কম। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, এই যুদ্ধ দীর্ঘ লাভ করবে এবং ঘরে ফিরে আসা সম্ভব হবে না। তাই তিনি সালারদেরকে তারিক ইবনে যিয়াদের সেই অভিযানের কথা স্মরণ রাখতে বলে দিলেন, যাতে তিনি রোম উপসাগর অতিক্রম করে নৌকাগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে ফিরে যাওয়ার চিন্তা মাথা থেকে বেরিয়ে যায়।

কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ তাঁর রোজনামচায় সুলতান আইউবীর উপর কী বিভীষিকা নেমে এসেছিলো শিরোনামে লিখেছেন

সুলতানের বিশ্বাস ছিল, আল্লাহ কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আদেশ প্রদান করেছেন। ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা তাঁর প্রথম কর্তব্য। কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধ করা এবং পৃথিবীতে আল্লাহর রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করা তাঁর অন্যতম দায়িত্ব। অধিক থেকে অধিক রাজ্যকে আল্লাহর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা এবং বিশ্ব মানবতাকে আল্লাহর অনুগত বানানো তাঁর প্রধান ব্রত। তিনি যেখানে তাঁর যতো বাহিনী ছিলো, সকলকে এশতরা নামক স্থানে সমবেত হওয়ার আদেশ জারি করেন। আদেশনামায় আল্লাহ পাকের নির্দেশের উদ্ধৃতিও উল্লেখ করেছেন।

***

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর দৃষ্টিভঙ্গী ভবিষ্যতের ঘন আধারের উপর উঁকি মারছে। তিনি হিত্তীনের অঞ্চলকে যুদ্ধের অঙ্গন বানানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। হিত্তীন ফিলিস্তীনের একটি অখ্যাত গাঁ। কিন্তু সুলতান আইউবী গ্রামটাকে এতোই মর্যাদা দান করেন যে, খৃষ্টজগতের সমর বিশ্লেষকগণ আজো পর্যালোচনা করে চলেছেন, ক্রুসেড যুদ্ধের এই হিরো কীরূপ কৌশল-স্ট্রাটেজি প্রয়োগ করে এমন শক্তিমান ও উন্নত অস্ত্রসজ্জিত শত্রুপক্ষকে এমন লজ্জাজনক পরাজয়ের মুখে নিপতিত করলেন, খৃষ্টানদের একজন ব্যতীত বাকি সব কজন সম্রাট যুদ্ধবন্দি হয়ে গেলেন!

যুদ্ধবিদ্যার খুঁটিনাটি ও সূক্ষাতিসূক্ষ বিষয়াবলী বোঝেন এমন সব সামরিক বিশ্লেষক ও ঐতিহাসিকগণ সুলতান আইউবীর অন্যান্য গুণাবলী ছাড়াও তাঁর ইন্টেলিজেন্স, কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ও কমান্ডো অপারেশনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বকর ইবনে মুহম্মদের ন্যায় গোয়েন্দাদের আপন জীবনকে মৃত্যুর মুখে রেখে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা এবং সেসব তথ্য সুলতানের নিকট পৌঁছানো সে আরেক বাস্তবতা। কুলসুমের ন্যায় নির্যাতিতা মেয়েরা রাজকীয় বিলাসী জীবন পরিত্যাগ করে নিজ নিজ উদ্যোগে ইসলামী বাহিনীর সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছিলো। ইতিহাস এই অখ্যাত গাজী ও শহীদদের নাম জানাতে অপারগ, যারা পর্দার আড়ালে এবং মাটির নীচে যুদ্ধ করে হিত্তীনকে ইসলামের মর্যাদার সুমহান প্রতাঁকে পরিণত করেছিলো।

সুলতান আইউবী সবসময় যুদ্ধের জন্য জুমার দিন রওনা হতেন। কারণ, এটি পুণ্যময় ও বরকতময় দিন। এই মুবারক দিনে প্রত্যেক মুসলমান মহান আল্লাহর সমীপে সেজদাবনত হয়ে থাকে। আর সৈনিক যখন আপন জাতিকে ইবাদতে নিমগ্ন রেখে জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হয়, তখন সমগ্র জাতির দুআ তাদের সঙ্গ নেয়। হিত্তীন অভিমুখে রওনা হওয়ার জন্যও সুলতান এই জুমার দিনটিকে নির্বাচন করেন। ১১৮৭ সালের ১৫ মার্চ। সুলতান আইউবী ফৌজের মাত্র একটি অংশকে সঙ্গে নিয়ে কাকের সন্নিকটে এক স্থানে গিয়ে ছাউনি ফেলেন।

খৃস্টান গুপ্তচররা তৎক্ষণাৎ তাদের জোট বাহিনীকে সংবাদ পেঁছিয়ে দেয়, সুলতান আইউবী কার্কের সন্নিকটে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তা থেকে বুঝে নেয়া হয়, সুলতান কার্ক অবরোধ করবেন। কিন্তু আসলে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে মিসর ও সিরিয়ার হজ্ব কাফেলী। হাজীরা হজ্ব সম্পাদন করে ফিরে আসছে। তাদের উপর কার্কের অদূরেই আক্রমণ হয়ে থাকে। কার্কের শাসনকর্তা প্রিন্স অর্নাত এ কাজে বেশ পারঙ্গম। কাফেলাগুলোকে নিরাপদে এলাকাটা পার করিয়ে দেয়ার জন্যই সুলতান আইউবী এখানে এসে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তাঁর আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, তিনি ক্রুসেডারদের ধোকা দিতে চান, যেনো তারা তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ছড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়। তিনি তাঁর সালারদেরকে সকল পরিকল্পনা অবহিত করে রেখেছেন।

***

কার্কের রাজপ্রাসাদে যেনো কম্পন শুরু হয়েছে। প্রিন্স অর্নাতকে মধ্যরাতে ঘুম থেকে জাগ্রত করে বলা হলো, বিশাল এক বাহিনী নগরীর অনতিদূরে ছাউনি ফেলছে। অর্নাত ধড়মড় করে উঠে বসেন। সালাহুদ্দীন আইউবী ছাড়া আর কে হতে পারে! কুলসুমও অর্নাতের শয্যায় শায়িত ছিলো। কথার শব্দে জাগ্রত হয়ে সেও অনাতের সঙ্গে দৌড়ে নগরীর প্রধান ফটকের উপর দিককার প্রাচীরের উপর উঠে যায়। ওখানে হাজার হাজার প্রদীপ জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। তাবু স্থাপন করা হচ্ছে। রাতের নিস্তব্ধতায় ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনির শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

অর্নাত তার বাহিনীকে অবরোধের মধ্যে যুদ্ধ করার জন্য প্রাচীরের উপর দাঁড় করিয়ে দেন। ফটকের উপর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্ত করা হয়। অর্নাত ছুটে বেড়াচ্ছেন। কুলসুমের কোনো খেয়াল নেই তার। কুলসুম ফিরে গিয়ে দেখতে পায়, অর্নাতের রক্ষী বাহিনী জাগ্রত হয়ে আদেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। এক স্থানে সেই ঘোটকযানটি দণ্ডায়মান, যেটিতে করে কুলসুম নাসেরা গিয়েছিলো এবং ভ্রমণে বের হয়েছিলো। তার পার্শ্বে বকর ইবনে মুহম্মদ প্রস্তুত দাঁড়িয়ে আছে। ওখানকার প্রতিজন মানুষ যার যার ডিউটিতে চলে গেছে।

কুলসুম আদেশের সুরে বকরকে বললো- সায়বাল! গাড়িটা এদিকে নিয়ে আসো।

বকর গাড়ি নিয়ে এলে কুলসুম তাতে চড়ে বসে এবং তাকে একদিকে নিয়ে যায়। অর্নাতের হেরমের নারীরাও জাগ্রত হয়ে বেরিয়ে এসেছে। তারা তাদের ভাষায় প্রিন্সেস লিলিকে গাড়োয়ানকে আদেশ দিতে এবং গাড়িতে চেপে বসে যেতে দেখেছে। একজন দাঁত কড়মড় করে বললো- এই হতভাগী মুসলমানের বাচ্চাটা নিজেকে রাণী ভাবতে শুরু করেছে। ওকে, নিশানা বানাতেই হবে।

সময় এসে গেছে- আরেকজন বললো- সালাহুদ্দীন আইউবীর অবরোধ খুব ভয়ঙ্কর হয়ে থাকে। তিনি আগুন নিক্ষেপ করবেন, মিনজানিকের সাহায্যে পাথর ছুঁড়বেন। ভেতরে ধ্বংসযজ্ঞ চালাবেন। এরূপ অস্থিতিশীল মুহূর্তের কোনো এক সুযোগে আমরা ডাইনিটাকে ঠিকানা লাগিয়ে দেবো।

তোমার প্রেমিক প্রবর সেনাপতিটাও তো কিছু করতে পারলো না। তৃতীয়জন বললো।

কিছু করবার লোক আরো বহু আছে- সে উত্তর দেয়- কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের অবস্থা দেখো। তারপরে প্রিন্স অর্নাত অন্য কোনো প্রিন্সেসকে খুঁজে বেড়াতে বাধ্য হবেন।

কুলসুম গাড়িটা এক অন্ধকার স্থানে দাঁড় করিয়ে রাখে। বকর গাড়ির সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। কুলসুম তাকে জিজ্ঞেস করে- আমাদের লোকেরা কি ভেতর থেকে ফটক খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারে না? 

চেষ্টা করা হবে- বকর বললো- এই ফৌজ যদি আমাদের হয়ে থাকে, তাহলে আমার বিস্ময় লাগছে, আমাদেরকে আগে অবহিত করা হলো না কেননা! সুলতান আইউবী তো এমন ভুল করেন না। আমার সন্দেহ হচ্ছে। সকালে জানতে পারবো, এ কার ফৌজ।

আমরা কি এখান থেকে পালাতে পারবো? কুলসুম জিজ্ঞেস করে।

পরিস্থিতি বলবে। বকর উত্তর দেয়।

এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে আমি অর্নাতকে হত্যা করতে পারি। কুলসুম বললো।

এমন যেনো না করো- বকর ইবনে মুহম্মদ বললো- ফৌজ নগরীতে ঢুকে পড়লে আমরা চোখ রাখবো, যেন তিনি পালাতে না পারেন। নতুন কোনো খবর?

অর্নাত নজর রাখছিলেন, সুলতান আইউবী কোন্ দিকে অগ্রযাত্রা করেন- কুলসুম বললো- এখন পরিস্থিতি অন্য কিছু হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম বলতেন, আইউবী ফৌজ নিয়ে গ্যালিলি ঝিলের দিকে যাচ্ছেন।

বেশিক্ষণ থাকা যাবে না- বকর বললো- চলো, ফিরে যাই।

***

পরদিন ভোর বেলা। কার্কের পাঁচিলের উপর দূরপাল্লার ধনুক হাতে তীরন্দাজগণ দণ্ডায়মান। পাথর ও অগ্নিগোলার পাতিল নিক্ষেপকারী মিনজানিক স্থাপন করা হয়েছে। ফৌজ প্রস্তুত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রিন্স অর্নাত পাঁচিলের উপর দাঁড়িয়ে সুলতান আইউবীর বাহিনীর প্রতি তাকিয়ে আছেন। এততক্ষণে নিশ্চিত হওয়া গেছে, এটি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীরই বাহিনী। তবে সুলতান নিজে সঙ্গে আছেন কিনা জানা যায়নি। কিন্তু বাহিনীর মধ্যে অবরোধ জাতীয় কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তবু স্থাপন করা আছে। সৈনিকরা স্বাভাবিক ক্রিয়া-কর্মে রত।

এ দিনটি কেটে গেছে। তারপর অতিবাহিত হয়ে গেছে আরো ছয় দিন। অর্নাতের অপেক্ষার পালা যত দীর্ঘ হচ্ছে, অস্থিরতা তত বাড়ছে। তিনি যে বিষয়টি জানতে পারেননি, তা হচ্ছে, রাতে সুলতান আইউবী তার অশ্বারোহী কমান্ডো বাহিনীটিকে সে পথে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছেন, যে পথে হাজীদের কাফেলার আসবার কথা। দিন কয়েক পর প্রথম কাফেলাটি আসতে দেখা গেলো। এটি মিসরের কাফেলা। সুলতান আইউবীর অশ্বারোহী বাহিনীটি তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। কাফেলা সুলতানের তাবু অঞ্চলের সন্নিকটে পৌঁছুলে তিনি ছুটে এগিয়ে গিয়ে হাজীদের সঙ্গে মুসাফাহা করেন। পরম ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে সকলের হাতে চুমো খান এবং বিশ্রাম ও আহারের জন্য তাবুতে নিমন্ত্রণ জানান। আইউবীর কমান্ডোরা বহুদূর পর্যন্ত কাফেলার সঙ্গে গমন করে। একদিন পরই সিরীয় হাজীদের কাফেলাও এসে পড়ে। সুলতান তাদেরও স্বাগত জানান, আপ্যায়ন করেন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদায় জানান।

এ সময়ে কার্কের অভ্যন্তরে খৃস্টান বাহিনী প্রস্তুত অবস্থায় অবস্থান করে। জনমনে আতঙ্ক ছেয়ে গেছে। সুলতান আইউবীর গোয়েন্দারা নিজ নিজ কর্তব্য পালনে ব্যস্ত থাকে। এক সকালে অর্নাত সংবাদ পান, সুলতান আইউবীর ফৌজ চলে যাচ্ছে। অর্নাত শুধু এটুকু দেখলেন যে, হাজীদের দুটি কাফেলা সুলতান আইউবীর বাহিনীর হেফাজতে অতিক্রম করে গেছে। শুধু সুলতান আইউবীর গোয়েন্দারাই জানে, আসল কাহিনী কী ছিলো। সুলতান রওনা দেয়ার আগে গোয়েন্দাদের জানিয়ে দিয়েছেন, আমরা অন্যত্র যাচ্ছি। গোয়েন্দারা সুলতানকে অর্নাতের গতিবিধির খোঁজ খবর জ্ঞাত করতে থাকে।

১১৮৭ সালের ২৭ মে। সুলতান আইউবী এশতরা নামক স্থানে ছাউনি স্থাপন করেন। সেখানে মিসর ও সিরিয়ার ফৌজ তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়। সুলতানের জ্যেষ্ঠ পুত্র আল-মালিকুল আফজাল- যার বয়স ষোল বছর প্রখ্যাত সেনাপতি মুজাফফর উদ্দীনের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয়। এভাবে তার সমস্ত বাহিনী একত্রিত হয়ে যায়। তিনি সকল সালার ও নায়েব সালারদের সর্বশেষ দিক-নির্দেশনার জন্য একত্রিত করেন। সুলতান বললেন

আমার বন্ধুগণ! আল্লাহ আপনাদের সাহায্য করুন। অন্তর থেকে আপন-পরিজন ও বাড়ি-ঘরের চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিন। হৃদয়ে প্রথম কেবলার ভাবনা ঠাই করে নিন এবং যে মহান আল্লাহ আমাদেরকে মুসলমানের প্রথম কেবলাকে ক্রুসেডারদের অপবিত্র দখল থেকে মুক্ত করার এবং কাফেরদের হাতে সম্ভ্রম হারানো বোন-কন্যাদের লাঞ্ছনার প্রতিশোধ নেয়ার তাওফীক দান করেছেন, তাকে স্মরণ রাখুন।

আজ আমরা বাস্তব কথা বলবো। আমাদের সংখ্যা শত্রুর মোকাবেলায় কম। আমাদের মোকাবেলা সাতজন খৃস্টান সম্রাটের সঙ্গে, যাদের সঙ্গে থাকবে মাথা থেকে পা পর্যন্ত বর্মাবৃত দুহাজার দুশত নাইট। বাদ বাকি সৈন্যরাও আধা-বর্মাচ্ছাদিত। তদুপরি এই বাহিনীর জন্য সুবিধাটা হচ্ছে, তাদের ঠিকানা নিকটে এবং এই সমগ্র অঞ্চল নিজেদের, যেখানে তাদের রসদের সমস্যায় পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমাদের দুটি যুদ্ধ লড়তে হবে। সরাসরি শত্রুর মোকাবেলায় এবং আমাদের যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে, তার মোকাবেলায়। এই সংকট-সমস্যা আমাদেরকে শত্রুর দিকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

নকশাটা সামনে মেলে ধরে সুলতান আইউবী যুদ্ধক্ষেত্র কোন্‌টা হবে তরবারীর আগা দ্বারা সকলকে দেখিয়ে দেন। যেসব সালার অঞ্চলটা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, তারা চমকে ওঠে সুলতান আইউবীর দিকে তাকান। তাদের চোখে বিস্ময়। সুলতান তাদের বিস্ময়ভাব বুঝে ফেলে মুচকি হাসলেন।

এটা হিত্তীনের উপকণ্ঠীয় ময়দান- সুলতান আইউবী বললেন আপনারা ভাবছেন, এ অঞ্চল তো শুকিয়ে যাওয়া গাছের বাকলের ন্যায় শুষ্ক, উঁচু-নিচু এবং ঋতুর নির্মমতায় চৌচির। আরো ভাবছেন, এই এলাকার মাটি এতোই পিপাসু যে, মানুষ-ঘোড়া যাকেই পাবে, রক্ত চুষে খাবে। আপনারা দেখেছেন, তার এখানে-সেখানে উঁচু-নিচু পাথরখণ্ড ছড়িয়ে আছে। হ্যাঁ, জায়গাটা ঠিকই ঘাস-পাতা, তরুণতাহীনই এবং পিপাসাকাতরও। রোদের সময় লোহার ন্যায় উত্তপ্ত থাকে। আপনাদের জিজ্ঞাসু চোখে যে প্রশ্নটি উঁকি-ঝুঁকি মারছে, আমি তা বুঝি। আপনারা আমাকে জিজ্ঞেস করতে চাইছেন, সে কোন্ বাহিনী, যারা নরকময় এই অঞ্চলে যুদ্ধ করতে পারবে? হ্যাঁ, সে আমাদের বাহিনী। আপনাদের হাল্কা পাতলা আরোহী সৈন্যরা এই অঞ্চলে প্রজাপতির ন্যায় উড়ে বেড়াবে আর লোহার ভারি পোশাকে আবৃত নাইট আর অধ-বর্মপরিহিত খৃস্টান সৈন্যদের নাচাতে থাকবে। দুশমনের এই আরোহী ও পদাতিক সৈন্যরা লোহার উত্তাপে অল্প সময়ে পিপাসায় বেহাল হয়ে যাবে এবং লোহার ভার তাদেরকে অতোটুকু ছুটে বেড়াতে দেবে না, যতোটুকু ছুটে বেড়াবে আমাদের সৈন্যরা।

আপনারা জানেন, আমি প্রতিটি অভিযান পবিত্র জুমা দিবসে শুরু করে থাকি। আমি সেই সময়ে রওনা হবো, যখন মসজিদগুলোতে মুসলমানরা খুতবা শ্রবণ করবে। এটা দুআ কবুল হওয়ার সময়। আমি প্রতিটি পাড়া মহল্লায় নির্দেশনা প্রেরণ করেছি, জুমার দিবসের দুআয় যেনো মুসল্লিরা সেই মুজাহিদদের কথা স্মরণ রাখে, যারা জুমার নামায থেকে বঞ্চিত হয়ে যুদ্ধের ময়দানে আহত হয়ে লুটিয়ে পড়ে, আবার উঠে দাঁড়ায় এবং জুমা না পড়তে পারার কাফফারা রক্তের নজরানা দ্বারা আদায় করে। আর এ সময়টা ঠিক সেই সময়, যখন সূর্যটা মাথার উপরে থাকবে এবং লোহাকে কামানের চুল্লির ন্যায় উত্তপ্ত করে তুলবে।

আর এই দেখুন, এটা গ্যালিলির ঝিল আর এটা হচ্ছে নদী তরবারীটাকে লাঠির ন্যায় নকশার উপর মেরে মেরে সুলতান আইউবী বললেন- আর এটা হলো অত্র অঞ্চলের একমাত্র পুকুর, যাতে পানি আছে। বাদ বাকি সব পুকুর-কূপ শুকিয়ে গেছে। এই সেই মাস, যাকে ক্রুশের পূজারীরা জুন বলে থাকে। আমাদেরকে পানি আর দুশমনের মধ্যখানে অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। আমি মুখের ভাষায় দুশমনকে পানি থেকে বঞ্চিত করে ফেলেছি। বাস্তবে তাদেরকে পিপাসায় মারা আপনাদের কাজ। দুশমন হিত্তীনের এই অঞ্চলে যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করব। কিন্তু আমি তাদেরকে এখানেই যুদ্ধ করাবো। আমি ফৌজকে চার ভাগে বিভক্ত করেছি। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, মুজাফফর উদ্দীন এবং আমার পুত্র আল-আফজাল আমাদের মাঝে উপস্থিত নেই। তারা বাহিনীর একটি অংশকে নিয়ে গ্যালিলি ঝিলের দক্ষিণ দিয়ে জর্ডান নদী পার হয়ে গেছে। এই বাহিনীটি তুর পর্বত পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। বোধ হয় পৌঁছে গেছে। এটা একটা ধোকা, যা আমি দুশমনকে প্রদান করছি।

সুলতান আইউবী ফৌজের অবশিষ্ট তিন অংশের বিস্তারিত এবং তাদের মিশন বর্ণনা করেন। তার একটি অংশ সুলতান নিজের সঙ্গে রাখেন। ঐতিহাসিকদের মতে, এই বাহিনীকে রিজার্ভ এবং টাস্কফোর্স হিসেবে ব্যবহার করার কথা ছিলো। শেষ পর্যায়ে চূড়ান্ত অপারেশনে অংশ নেয়া এদের দায়িত্ব ছিলো। সবগুলো অংশকে বিভিন্ন স্থান দিয়ে নদী পার করিয়ে দেয়া হয়েছে। ক্রুসেডাররা তাদের গুপ্তচর ও সোর্সদের মাধ্যমে এই গতিবিধি প্রত্যক্ষ করছিলো। কিন্তু বুঝে ওঠতে পারছিলো না, আইউবীর পরিকল্পনাটা কী। সুলতান আইউবী নিজে গ্যালিলি ঝিলের পশ্চিম তীর হয়ে তাবরিয়া নামক স্থানে এক পাহাড়ের উপর গিয়ে ছাউনি ফেলেন।

***

ক্রুসেডাররা আরো একটি প্রতারণার শিকার হয়। সুলতান আইউবী সাধারণত কমান্ডো ধরনের যুদ্ধ লড়তেন, গেরিলা আক্রমণ চালাতেন। স্বল্প থেকে স্বল্পতর সংখ্যক সৈন্য দ্বারা দুশমনের বিপুল সৈন্যের উপর আঘাত করো, পালিয়ে যাও নীতি অনুযায়ী হামলা করতেন এবং দুশমনকে ছড়িয়ে দিতেন। ক্রুসেডাররা সুলতান আইউবীর এ ধারার যুদ্ধেরই মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতো। তার বাহিনীর যে অংশটি মুজাফফর উদ্দীন ও আল-আফজালের কমান্ডে নদী পার হয়ে গিয়েছিলো, সেটি ক্রসেডারদের সেনা চৌকিগুলোর উপর গেরিলা হামলা করতে শুরু করে দিয়েছে। এতে ক্রুসেডাররা বিভ্রান্তির শিকার হয়ে পড়ে যে, সুলতান আইউবী তার বিশেষ ধারায়ই যুদ্ধ করবেন। কিন্তু এই যুদ্ধে তাঁর পরিকল্পনা ভিন্ন। কমান্ডো সেনাদের তিনি যথারীতি সেই মিশনই বুঝিয়ে দেন, যা প্রতিটি যুদ্ধে দিয়ে থাকেন।

খৃস্টান ফৌজ দুর্গের ভেতরেও আছে, বাইরেও আছে। সুলতান আইউবী দ্রুতগতিতে তার বাহিনীকে এমনভাবে বিন্যস্ত করে ফেলেন যে, গ্যালিলি ঝিলের এবং উক্ত অঞ্চলের একমাত্র পানির পুকুরটি তার দখলে এসে যায়। খৃস্টান বাহিনীর একটি অংশ সাইফুরিয়া নামক স্থানে সমবেত হয়। কিন্তু সুলতান আইউবী সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে তাবরিয়ায় বসে থাকেন। তিনি দুশমনকে হিত্তীনের নিকটে নিয়ে আসতে চাইছেন। যখন দেখলেন, ক্রুসেডাররা সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছে না, তখন তিনি পদাতিক বাহিনীকে খানিক সম্মুখে এগিয়ে নিয়ে অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে তাবরিয়ার উপর আক্রমণ করে বসেন এবং আদেশ জারি করেন, তাবরিয়াকে ধ্বংস করে নগরীতে আগুন লাগিয়ে দাও। তার আদেশ পালিত হয়।

তাবরিয়ার দুর্গ নগরী থেকে সামান্য দূরে। ফৌজ দুর্গে ছিলো। নগরীকে রক্ষা করার জন্য ফৌজ দুর্গ থেকে বেরিয়ে নগরীর উদ্দেশে রওনা হয়। সুলতান আইউবী তাদের পথরোধ করে ফেলেন। তিনি বাহিনীর অপর অংশকে বিভিন্ন দিকে রওনা করিয়ে দিয়েছিলেন। ক্রুসেডারদের যে বাহিনী দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসেছে, তার কমান্ডার হলেন সম্রাট রেমন্ড। তাবরিয়ার পাথুরে অঞ্চলে তার ও সুলতান আইউবীর মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ সেই যুদ্ধের চোখে দেখা চিত্র এভাবে অংকন করেছেন

উভয় বাহিনীর আরোহী সেনারা প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথমে সমুখের অংশটি তীর চালাতে চালাতে পরস্পরের দিকে এগিয়ে যায়। পরে পদাতিক বাহিনীকেও মাঠে নামানো হয়। ক্রুসেডাররা চোখে মৃত্যু দেখতে শুরু করে। মুসলমানদের পেছনে নদী এবং সামনে শত্রু। পেছনে সরে যাওয়ার জন্য তাদের কোনো জায়গা নেই। সে কারণে উভয় বাহিনী এমন উন্মাদের ন্যায় লড়াই করে, যার বিবরণ বলে বুঝানো সম্ভব নয়।

সারাটা দিন যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। রাতে মুসলমান কমান্ডোরা দুশমনকে অস্থির করে রাখে। দুশমনের ফৌজ ও ঘোড় পিপাসার্ত। পানি মুসলমানদের দখলে। গেরিলারা দুশমনকে পানির সন্ধানে যেতে দিচ্ছে না। পরদিন ক্রুসেডাররা টিলায় চড়ে যুদ্ধ করে। মুসলমানরা এগিয়ে এসে এসে আক্রমণ করতে থাকে। কিন্তু উপরে থাকায় ক্রুসেডাররা আজ বেশি সুবিধা ভোগ করছে। মুসলমানরা টিলা ঘেরাও করে উপরে উঠতে শুরু করে। পদাতিক তীরন্দাজরা উপর থেকে তাদের উপর তীর ছুঁড়তে শুরু করে। এমন সময়ে ক্রুসেডাররা দেখে, তাদের কমান্ডারের ঝাণ্ডা দেখা যাচ্ছে না। তখনই জানা গেলো, কমান্ডার রেমন্ড যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেছেন। অথচ, তিনি বড় ক্রুশের উপর হাত রেখে জোটের শরীকদের অনুগত থাকার এবং রনাঙ্গনে পিঠ না দেখানোর শপথ নিয়েছিলেন। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, হিত্তীনের এই যুদ্ধে বড় কুশটা নিয়ে আসা হয়েছিলো।

ক্রুসেডারদের পলায়নের পথ বন্ধ। এখন তারা প্রতিরক্ষা যুদ্ধ লড়ছে। উঁচু স্থানগুলো তাদের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। ঐদিনটিও কেটে গেছে। মুসলিম সৈন্যরা বিপুল পরিমাণ শুষ্ক ঘাস ও কাঠ সংগ্রহ করে ক্রুসেডারদের চারপার্শ্বে আগুন ধরিয়ে দেয়। রাতে আইউবীর সৈন্য ঘাস-লাকড়ি সংগ্রহ করে আগুনের তেজ বৃদ্ধি করতে থাকে। সারাদিনের পিপাসাকাতর ও ক্লান্ত খৃস্টান সৈন্যরা টিলার উপর ঝলসে যেতে থাকে। তাদের একটি ইউনিট পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু মুসলমানরা তাদের একজনকেও জীবন নিয়ে যেতে দেয়নি। পরদিন ক্রুসেডাররা অস্ত্র সমর্পণ করে এবং সেনাপতিগণসহ সকলে সুলতান আইউবীর হাতে বন্দি হয়ে যায়।

***

সুলতান আইউবীর বাহিনীর অপর তিন অংশ বিভিন্ন স্থানে কখনন ক্রুসেডারদের পার্শ্বের উপর আক্রমণ করছে ও বেরিয়ে যাচ্ছে, কখনো পেছনের উপর হামলা চালিয়ে এদিক-ওদিক সরে যাচ্ছে। এক-দুটি প্লাটুন এমন ধারায় দুশমনের সম্মুখে অবস্থান নিয়ে আছে যে, তারা এই সম্মুখে এগিয়ে যাচ্ছে, তো এই পিছিয়ে আসছে। এভাবে দুশমন হিত্তীনের ময়দানে এসে পড়ে। কিন্তু ততক্ষণে তারা এবং তাদের ঘোড়াগুলো পিপাসায় আধমরা হয়ে গেছে।

১১৮৭ সালের ৩ জুলাই। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী হিত্তীনের জন্য যে পরিকল্পনা ঠিক করে রেখেছিলেন, এদিনে সে অনুপাতে অভিযান শুরু করেন। এ দিনটিও ছিলো পবিত্র জুমার বরকতময় দিন। ইতিপূর্বে গোয়েন্দারা। যাদের মধ্যে কুলসুম ও বকর উল্লেখযোগ্য- রিপোর্ট করেছিলো, সাত খৃস্টান জোট বেঁধেছেন। মোকাবেলায় সুলতান আইউবীর সেনাসংখ্যা বৃদ্ধি করার তো সুযোগ ছিলো না। কিন্তু তিনি যুদ্ধকৌশল, বাহিনীর বণ্টন, বিন্যাস, কমান্ডো গেরিলাদের ব্যবহার, তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা, রণাঙ্গনে দ্রুত চলাচলের ধরণ ইত্যাদিতে রদবদল করে নিয়েছেন এবং নতুন করে কিছু কার্যকর কৌশল ঠিক করে রেখেছেন। তিনি দুশমনকে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে হিত্তীনে নিয়ে এসেছেন। আশপাশের দুর্গ এবং বসতিগুলোও দখল করে নিয়েছেন। পানির উৎস তার নিয়ন্ত্রণে। ঋতুর রুদ্ররোষও তার পক্ষে।

শত্রু বাহিনী যখন হিত্তীন এসে উপনীত হয়, তখন তারা জানতো না, তারা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নিপুণভাবে পাতা জালে এসে অনুপ্রবেশ করেছে। আইউবীর গেরিলা বাহিনী দুশমনের পাহারা চৌকি, টহল সেনা, আউটপোস্ট এবং রসদের জন্য প্রলয় সৃষ্টি করে রেখেছে। রাতে তারা না শত্রুসেনাদের আরাম করতে দিচ্ছে, না সেনাপতিদের ভাবনা-চিন্তার সুযোগ দিচ্ছে।

১১৮৭ সালের ৪ জুলাই সুলতান আইউবীর বাহিনীর মধ্যম অংশ মুখোমুখি আক্রমণ করে বসে। টিলা-টিপির কারণে যুদ্ধের অঙ্গনটা সংকীর্ণ। ক্রুসেডাররা এদিক-ওদিক থেকে সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলে মুসলিম সেনারা তৎপর হয়ে ওঠছে। তীরন্দাজগণ উঁচুতে অবস্থান গ্রহণ করে ক্রুসেডারদের উপর তীর ছুঁড়ছে। সুলতান আইউবী একবার উপরে উঠছেন, আবার নীচে অবতরণ করছেন। তাঁর দূত সংবাদ-বার্তা আদান-প্রদান করছে। লোহার বর্ম খৃস্টান নাইটদের পুড়ে মারছে। তাদের ঘোড়াগুলো পিপাসায় কাতর। সম্মুখে পানি দেখা যাচ্ছে, যা তাদের পিপাসাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে। কিন্তু পানির দখল আইউবীর হাতে।

ক্রুসেডাররা হেডকোয়ার্টারে সাহায্যের আবেদন পাঠায়। অল্প সময়ে সাহায্য তথা নতুন সৈন্য এসে পড়ে। শেষবারের মতো তারা একটা জবাবি আক্রমণ চালায়।

তারা মুসলিম বাহিনীর যে অংশটির উপর আক্রমণ চালায়, তার সেনাপতি তকিউদ্দীন। আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তিনি তার বাহিনীকে অর্ধ বৃত্তাকারে বিন্যস্ত করে দেন। দুশমন সোজা ধেয়ে আসে। তকিউদ্দীন বৃত্তের মুখ বন্ধ করে দেন। ক্রুসেডাররা তার বেষ্টনীতে আটকা পড়ে যায়। মুসলিম অশ্বারোহীরা তাদের কেটে-পিষে ফেলে।

এখন যুদ্ধের অবস্থাটা হলো, ক্রুসেডাররা হিত্তীনের ময়দানে প্রতিরক্ষা যুদ্ধ লড়ছে। হিত্তীন থেকে দূরে কোথাও তাদের যদিও কোনো ইউনিট থেকে গিয়ে থাকে, তাহলে মুসলমানরা তাদের সেখানেই বেকার করে দিয়েছে। এই প্রথম ও শেষবারের মতো আক্রার পাদ্রী বড় কুশসহ রণাঙ্গনে উপস্থিত রয়েছেন। তিনি মনে বড় আশা নিয়ে এসেছিলেন। খৃষ্টান সম্রাটগণ এই ক্রুশেই হাত রেখে আমৃত্যু অটল থেকে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শপথ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সম্রাটগণ তার আশার গুড়ে বালি ছিটিয়ে পিঠ দেখাতে শুরু করেছেন। গাই অফ লুজিনান দুজন সঙ্গীসহ পালাতে শুরু করলে মুসলিম সৈনিকরা দেখে ফেলে এবং তাকে জীবিত ধরে ফেলে।

আক্রার পাত্রী মৃত্যুবরণ করেছেন। বড় ক্রুশ মুসলমানদের হাতে এসে পড়েছে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিকগণ এই ক্রুশ সম্পর্কে কিছু লিখেননি। সে কালের লিপি থেকে প্রমাণিত হয়, বাইতুল মুকাদ্দাস জয়ের পর সুলতান আইউবী ওখানকার খৃস্টানদের সম্মানার্থে কুশটা তাদের ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

সন্ধ্যা পর্যন্ত হিত্তীন যুদ্ধ চূড়ান্তে পৌঁছে যায়। ক্রুসেডারদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ ছিলো না। অসংখ্য-অগণিত সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে। অবশিষ্টরা অস্ত্র, সমর্পণ করে আইউবীর হাতে বন্দি হয়ে গেছে। যুদ্ধ শেষে সুলতান আইউবীর সম্মুখে যেসব বন্দিকে হাজির করা হলো, তাদের মধ্যে রেমন্ড ব্যতীত জোট বাহিনীর ছয় সম্রাটই আছেন। আছেন প্রিন্স অর্নাতও, সুলতান যাকে নিজ হাতে হত্যা করার কসম খেয়েছিলেন। ঐতিহাসিকগণ লিখেছে এবং কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদও বর্ণনা করেছেন, সুলতান আইউবী খৃস্টান সম্রাট জেফ্রেকে শরবত পান করতে দিয়েছিলেন। জেফ্রে অর্ধেক পান করে গ্লাসটা অনাতকে দিয়ে দেন।

অর্নাত শরবত পান করতে শুরু করেন। সুলতান আইউবী দোভাষীর মাধ্যমে গর্জে ওঠে বললেন- ওকে (অর্নাতকে) বলল, ওকে আমি নই- তার সম্রাট শরবত দিয়েছে। আরবী মেজবান শুধু সেই শত্রুকে শরবত পান করতে দেয়, যার জীবন ক্ষমা করে দেয়া হয়। আমি অর্নাতকে শরবত দেইনি।

বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ লিখেছেন, সে সময় সুলতান আইউবীর চোখ থেকে যেনো স্ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছিলো।

সুলতান চাকরদের বললেন, এদের খাওয়ার ব্যবস্থা করো। সকলে তাঁবুতে বসে আহার করেন। সুলতান পুনরায় জেফ্রে এবং অর্নাতকে নিজ তাবুতে ডেকে পাঠান। অর্নাতকে বললেন- তুমি সবসময় আমার রাসূলকে অবমাননা করতে। এখন ইসলাম গ্রহণ করা ব্যতীত তোমার মুক্তির আর কোন পথ নেই।

অর্নাত অস্বীকৃতি জানান।

সুলতান আইউবীর এটাই কামনা ছিলো। তিনি ঝট করে তরবারীটা বের করে এক আঘাতে অর্নাতের একটা বাহু দেহ থেকে আলাদা করে ফেলেন এবং চীৎকার করে বলে ওঠেন- শয়তান! আমার প্রিয় রাসূলের অবমাননা করেছি। গালিগুলো যদি আমাকে দিতে, তবু জীবনটা রক্ষা পেতো।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, সুলতান আইউবীর তাঁবুতে তাঁর যে দুতিনজন সালার ছিলেন, তারা তরবারীর আঘাতে অর্নাতকে খতম করে দেন। সুলতান শ্লেষমাখা কণ্ঠে বললেন- এই নাপাক মরদেহটাকে বাইরে ফেলে দাও।

কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ লিখেছেন- সুলতান আইউবী অর্নাতের দেহটা তাঁবুর বাইরে এবং তার আত্মাটা জাহান্নামে নিক্ষেপ করেছেন।

সহকর্মীর এই পরিণতি দর্শনে সম্রাট জেফ্রের মুখ শুকিয়ে যায়। তিনি বুঝে নেন, এবার আমার পালা। সুলতান আইউবী তার দিকে এগিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে কোমল কণ্ঠে বললেন- রাজা রাজাকে হত্যা করে না। কিন্তু লোকটার অপরাধ এমন ছিলো যে, আমাকে এক সময় তাকে নিজ হাতে হত্যা করার শপথ করতে হয়েছিলো। আপনি ভয় পাবেন না।

বন্দি সম্রাটদেরকে বন্দিদের তাঁবুতে পাঠিয়ে দেয়া হলো। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী সিজদায় লুটিয়ে পড়েন।

***

এখন রাত। কার্কের রাজপ্রাসাদ নীরব-নিস্তব্ধ। প্রিন্স অর্নাত সেখানে নেই। নেই তার সেনাপতি-দরবারিগণও। আছে কেবল হেরেমের নারীরা। কুলসুমও আছে। তার চাকর-চাকরানিরাও আছে। দুর্গে অল্প কজন সৈন্য আছে। এখনো সেখানে অর্নাতের মৃত্যু সংবাদ পৌঁছেনি। রাতের প্রথম প্রহর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এতোক্ষণে কুলসুমের শুয়ে পড়ার কথা।

এক মহিলা পা টিপে টিপে কুলসুমের শয়নকক্ষে প্রবেশ করে। তার হাতেখঞ্জর। সে কুলসুমের পালঙ্কের নিকটে পৌঁছে যায়। কক্ষে আলো নেই। কিছু দেখা যাচ্ছে না। মহিলা খঞ্জরধারী হাতটা উঁচু করে পূর্ণ শক্তিতে আঘাত হানে। কিন্তু কেউ চীৎকার করেনি। খঞ্জর পালঙ্কে গেঁথে যায়। সে বিছানা হাতড়ায়। কুলসুম নেই। মেয়েটি কোথাও গেছে মনে করে মহিলা পালঙ্কের পাশ ঘেঁষে লুকিয়ে বসে থাকে।

খানিক পর চাপা পায়ে কে একজন কক্ষে প্রবেশ করেছে শোনা যায়। শব্দটা পালঙ্কের নিকটে চলে আসে। মহিলা উঠে তার উপর খঞ্জরের আঘাত হানে। পরক্ষণেই উল্টো তার পেটে খঞ্জর গেঁথে যায়। তারপর কিছুক্ষণ দুখঞ্জরের সংঘর্ষ চলে। আঘাত-পাল্টা আঘাত চলে। তারপর দুজনই বাইরে বেরিয়ে গিয়ে লুটিয়ে পড়ে। হেরেমের অন্যান্য মেয়েরা ছুটে আসে।-দেখে। আঘাতপ্রাপ্ত দুজন মারা গেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কুলসুম। নেই। এরা দুজনই হেরেমের নারী- দুজনই কুলসুমকে হত্যা করতে গিয়েছিলো। সেদিনই তারা কুলসুমকে খুন করার পরিকল্পনা এঁটেছিলো। কিন্তু খুনটা কে গিয়ে করবে, তাতে ভুল বুঝাবুঝি হয়ে যায়। ফলে অন্ধকার কক্ষে তারাই কুলসুম মনে করে একে অপরকে হত্যা করে ফেলে।

ততোক্ষণে কুলসুম প্রাসাদ থেকেই নয় শুধু কার্ক থেকেও বেরিয়ে গেছে। সেদিনই বকর তার গোয়েন্দা সঙ্গীদের মারফত জানতে পারে, হিত্তীনে ক্রুসেডারদের অত্যন্ত শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে। কার্কের গোয়েন্দারাই তাকে পরামর্শ দিয়েছে, তুমি কুলসুমকে নিয়ে পালিয়ে যাও। রাতে দুর্গের ফটক খোলানো কুলসুমের পক্ষে ব্যাপার নয়। সকলেই জানে, এই মেয়েটি প্রিন্স অর্নাতের প্রেপাম্পদ। বকর ইবনে মুহম্মদ সায়বাল সেজে তাকে ঘোটক্যানে করে নিয়ে যাচ্ছে। হেরেমের কোনো নারী কুলসুমকে যেতে দেখেনি।

শহর থেকে দূরে এক স্থানে পৌঁছে তারা দুটি ঘোড়া পেয়ে যায়। এগুলো তাদেরই গোয়েন্দাদের ব্যবস্থাপনায় সেখানে অপেক্ষমান দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটা সেখানেই ছেড়ে দেয়া হলো। কুলসুম ও বকর ঘোড়া দুটোতে আরোহণ করে অদৃশ্য হয়ে যায়। পরদিন পথে নিজ বাহিনীর এক দূত তাদের জানায়, ক্রুসেডাররা পরাজয়বরণ করেছে। অর্নাত মৃত্যুবরণ করেছে। সুলতান আইউবী এখনো হিত্তীন ও নাসেরার অঞ্চলে অবস্থান করছেন। কুলসুম সুলতান আইউবীর নিকট যেতে চাচ্ছে।

তারা গ্যালিলি ঝিলে পৌঁছে গেছে। কুলসুমকে যখন সুলতান আইউবীর সম্মুখে উপস্থিত করা হলো, তখন মেয়েটি সুলতানের পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে।

আমার কন্যা- সুলতান আইউবী মেয়েটিকে ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে স্বস্নেহে বললেন- আমার এই বিজয়ে না জানি তোমার মতো আরো কতো মেয়ের হাত রয়েছে।

আমি অর্নাতের লাশটা দেখতে চাই- কুলসুম বললো।

সব কটার লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে- সুলতান আইউবী বললেন- অর্নাতকে আমি নিজ হাতে শাস্তি দিয়েছি। আগামীকাল তোমাকে কায়রো পাঠিয়ে দেয়া হবে। আমাকে এখনো বহুদূর যেতে হবে। যেখানে থাকবে, আমার জন্য দুআ করবে, যেনো আমি কেবলই সম্মুখে অগ্রসর হতে পারি। দুআ করবে সূর্য যেখানে অস্ত যায়, সে পর্যন্ত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পয়গাম পৌঁছিয়ে দিতে পারি।

হিত্তীনের জয় ছিলো অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। এই জয়ের মাধ্যমে সুলতান আইউবী ফিলিস্তীনের দ্বার উন্মুক্ত করেছিলেন এবং তাতে ঢুকে পড়েছিলেন। এতো বিশাল একটা অঞ্চল জয় করার ফলে সুলতানের জন্য ফিলিস্তীন জয় সহজ হয়ে গিয়েছিলো। তিনি এই অঞ্চলটাকে আস্তানা বানিয়ে নেন এবং বাইতুল মুকাদ্দাস অভিমুখে অগ্রযাত্রার প্রস্তুতি ও অস্ত্র রসদ ইত্যাদি সগ্রহে আত্মনিয়োগ করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *