৮.১ দ্বিতীয় দরবেশ

দ্বিতীয় দরবেশ

 ক্রুসেডাররা মসুলের সন্নিকটে পাহাড়ের অভ্যন্তরে যে বিপুল অস্ত্র ও তরল দাহ্য পদার্থ মজুদ করেছিলো, তদ্বারা সমগ্র ইসলামী সাম্রাজ্যকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা সম্ভব ছিলো। কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর গোয়েন্দারা মুহূর্ত মধ্যে সব ধ্বংস করে দিলো। ক্রুসেডারদের জন্য সে ছিলো এক প্রচণ্ড আঘাত। তাদের সব আয়োজন, সব নাটক তছনছ হয়ে গেলো।

সংগ্রহটা ছিলো পাহাড়ের বিীর্ণ গুহার অভ্যন্তরে। আগুন লাগার পর বিস্ফোরণে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত মাটি কেঁপে ওঠে, যেনো ভূমিকম্প হয়েছে। কিন্তু কেউ জানে না, ঘটনাটা কীভাবে ঘটলো।

এ ঘটনায় ক্রুসেডারদের বড় মিত্র ইযযুদ্দীনের কোমর ভেঙে গেছে। ক্রুসেডাররা নিশ্চিত, এটা দুর্ঘটনা নয়। বরং সালাহুদ্দীন আইউবীর গুপ্তচরদের কাজ।

ক্রুসেডাররা মসুলের শাসনকর্তা ইষষুদ্দীনকে মিত্র বানিয়ে মসুলের পার্বত্য অঞ্চলে অস্ত্র, গোলা-বারুদ ও রসদপাতি সংগ্রহ করে সুলতান আইউবীর উপর চূড়ান্ত আঘাত হানতে চেয়েছিলো। কিন্তু রাদী নামক একটি মাত্র মেয়ে সঙ্গী হাসান আল-ইদরীসের পরিকল্পনা ও সহযোগিতায় সব ধ্বংস করে দিয়েছে।

জনগণকে এলাকা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য ক্রুসেডাররা এক দরবেশের নাটক মঞ্চস্থ করে প্রচার করেছে, এই দরবেশ উক্ত পাহাড়ে ধ্যানে বসবেন এবং খোদা তাকে মসুলের বিজয়ের ইঙ্গিত প্রদান করবেন। তারপর মসুল তথা ইযযুদ্দীনের সাম্রাজ্য দূর-দূরান্ত পর্যন্ত বিস্তীর্ণ হয়ে যাবে। কিন্তু পরিণামে দরবেশও অস্ত্র গুদানের সঙ্গে ধ্বংস হয়ে গেছে।

একদিন কেটে গেছে। মসুলের জনগণ ভীত-সন্ত্রস্ত। রাতে যে বিস্ফোরণটা ঘটলো এবং এই যে মাঠ কেঁপে কেঁপে ওঠেছিলো, ঘটনাটা কী ঘটেছিলো তারা জানে না। বিষয়টা তাদের বলবার মতোও কেউ নেই। দাহ্য পদার্থগুলো কয়েকদিন পর্যন্ত জ্বলতে থাকে। সেই সঙ্গে সুপরিসর গুহায় যেসব রসদ রাখা হয়েছিলো, সেগুলোও পুড়ে যায়। ভয়ে কেউ ওদিকে পা বাড়াচ্ছে না। সকলের ধারণা, এটা হয় দরবেশের কেরামত, নয়তো আল্লাহর গজব। এমনি ভীতিকর এক পরিস্থিতিতে তাদের কানে একটি শব্দ ভেসে আসে। তিনি জাহান্নামে চলে গেছেন। জাহান্নামের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছেন।

ইনি সবুজ আবা পরিহিত আরেক দরবেশ। মাথায় লম্বা সাদা চুল। মুখে আবক্ষ-লম্বিত সাদা দাড়ি। মুখে বার্ধক্যের বলিরেখা। এক হাতে কাঁধ পর্যন্ত লম্বা একটা লাঠি, অপর হাতে পাক কুরআন। প্রথম দরবেশের ন্যায় ইনিও হঠাৎ আত্মপ্রকাশ করেন এবং বাজারে ঢুকে পড়েন। উৎসুক জনতা ভক্তি গদ গদ চিত্তে তার চারপার্শ্বে এসে ভিড় জমায়। মাঝ বাজারে দাঁড়িয়ে ভাবগম্ভীর কণ্ঠে বললেন- তিনি জাহান্নামের আগুনে পুড়ে গেছেন, যিনি বলতেন খোদা তাকে ইশারা দেবেন। যদি তার পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করো, তাহলে তোমরাও সেই জাহান্নামের আগুনে ভস্ম হয়ে যাবে। খোদা রাতের বজ্রনিনাদে তোমাদেরকে ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। আকাশ ছেয়ে যাওয়া সেই কালো ধোঁয়ার কথা মনে করো। আল্লাহর রোষকে ভয় করো। আমার হাতে যে পত্রখানা দেখতে পাচ্ছো, এটি মান্য করো। এটি আল্লাহর কালাম। এটি পাক কুরআন।

আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদেরকে বলুন- এক বৃদ্ধ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে- এসব কী ছিলো? তিনি কে ছিলেন? আপনি কে? বলুন, রাতে মাটি কেনো কেঁপে ওঠেছিলো? কালো ধোঁয়াগুলো কী ছিলো?

 তিনি আত্মহারা ছিলেন- নতুন দরবেশ বললেন- পাগল ছিলেন। তিনি আল্লাহর রহস্যের জগতে হস্তক্ষেপ করেছেন। আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ বিজয় কিংবা অন্য কোন আগাম সংবাদ দিতে পারেন না। জয় পরাজয়, আনন্দ-বেদনা সবই আল্লাহর হাতে। নিজেকে আল্লাহর দূত দাবি করে তিনি গুনাহগার হয়েছেন। তিনি তার শাস্তি পেয়ে গেছেন। তোমরা গিয়ে দেখে আসো, পাহাড় এখনো জ্বলছে। সেই মিথ্যাবাদী দরবেশকে এখনো যদি তোমরা সত্য বলে মান্য করো, তাহলে তোমরাও পুড়ে মরবে।

বলুন সঠিক কে?- জনতা জিজ্ঞেস করে- আপনি কি সত্য?

 না- দরবেশ উত্তর দেন এবং কুরআনখানা উর্ধ্বে তুলে ধরে বললেন আল্লাহর এই কালাম সত্য। সেই দরবেশকে ভুলে যাও। এই কিতাবের কথা মান্য করো। আল্লাহ এর মধ্যে যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, তা কোনো মানুষ দিতে পারে না।

দরবেশ সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করেন।

***

দরবেশ দিনভর মসুলের অলি-গলিতে ঘুরে ঘুরে ঘোষণা দিতে থাকেন তিনি জাহান্নামে ভস্ম হয়ে গেছেন, তিনি নিজের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছেন।

 জনতা যেখানেই তাকে ঘিরে ধরছে, দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছেন- কোনো মানুষ গায়েব জানে না। কুরআনে যা কিছু আছে, তা-ই খোদার ইঙ্গিত।

দরবেশ এক মসজিদে জোহর নামায আদায় করেন। আসর পড়েন অন্য মসজিদে। মাগরিব আরেক মসজিদে। মসজিদে ঢুকলেই মুসল্লীরা তাকে ঘিরে ধরছে। তিনি ওয়াজ করছেন- লোক সকল! একমাত্র কুরআনই সত্য। তোমরা কুরআনের ইঙ্গিত অনুযায়ী আমল করো।

মাগরিবের নামায আদায় করে দরবেশ এক মসজিদ থেকে বের হন। এক বিরান অঞ্চল অভিমুখে হাঁটতে শুরু করেন। জনতাও তার পেছনে পেছনে হাঁটছে। তিনি সকলকে দাঁড় করিয়ে বললেন- এখন আর তোমরা আমার পেছনে এসো না। আমি সারা রাত ঐ বিজন এলাকায় ইবাদত করবো। আমি তোমাদের পাপের ক্ষমা প্রার্থনা করবো।

নতুন দরবেশ মানুষের উপর এমন প্রভাব সৃষ্টি করে ফেলেন যে, তাদের মন থেকে প্রথম দরবেশের ভীতি দূর হয়ে গেছে। জনতাকে নিয়ে তিনি হাত তুলে দুআ করে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যান। মানুষ ওখানেই দাঁড়িয়ে কানাঘুষা শুরু করে। নিষেধ করার পর একজন মানুষও দরবেশের পেছনে যেতে সাহস করলো না।

কিন্তু এক ব্যক্তি দরবেশের পিছু নেয়। অন্ধকারে কেউ তাকে দেখেনি। দরবেশ জনতার চোখের আড়ালে গিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করেন। তাকে অনুসরণকারী লোকটিও হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। হঠাৎ দরবেশ কার যেনো পায়ের শব্দ শুনতে পান। দাঁড়িয়ে পেছন পানে তাকান। অন্ধকারে ছায়ার মতো কী যেনো দেখতে পান। তৎক্ষণাৎ ছায়াটা থেমে যায় এবং বসে পড়ে। দরবেশ ইতিউতি তাকান আর কিছু না দেখে হাঁটতে শুরু করেন। কিন্তু তার মনে সন্দেহ ঢুকে গেছে। এখন বারবার তিনি পেছন ফিরে তাকাচ্ছেন।

দরবেশ আরো কিছু পথ এগিয়ে যান। এবার পেছনের লোকটা দরবেশের কাছাকাছি চলে এসেছে। দরকেশ কুরআন তিলাওয়াত করতে শুরু করেন। তিনি হাঁটার গতি মন্থর করে দেন। পেছনের লোকটা কটিবন্ধ থেকে খঞ্জর বের করে বেড়ালের ন্যায় পা টিপে টিপে দরবেশের একেবারে কাছে চলে যায়। খঞ্জরধারী হাতটা উপরে তুলে ধরে। পেচ্ছন থেকে আঘাত হেনে দরবেশকে শেষ করে ফেলা তার পরিকল্পনা। খঞ্জরটা এখনো তার উপরে ঝুলছে। এমন সময় দরবেশ বিদ্যুতের ন্যায় মোড় ঘুরে দাঁড়ান। হাতের মোটা লাঠিটা উল্পে তুলে চারদিক ঘোরান। লাঠি আক্রমণোদ্যত লোকটির খঞ্জরধারী বাহুতে গিয়ে আঘাত করে। সেই সঙ্গে লোকটার পেটে এমন এক লাথি মারেন যে, লোকটা চিৎ হয়ে পেছন দিকে পড়ে যায়। দরবেশের এক হাতে কুরআন। লড়তে হবে অপর এক হাতেই। তিনি লোকটার মাথায় লাঠি দ্বারা আঘাত হানেন। তার খঞ্জর হাত থেকে ছুটে পড়ে যায়।

দরবেশ খঞ্জরটা তুলে নেন। আক্রমণকারী লোকটা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। দরবেশ তাকে বললেন- খঞ্জর আমার হাতে। উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে।

লোকটি উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। দরবেশ মুখে পশুর ডাকের ন্যায় শব্দ করেন। দূর এক স্থান থেকেও অনুরূপ শব্দ ভেসে আসে। দরবেশ পুনরায় শব্দ করেন। অন্ধকারে ধাবমান পায়ের শব্দ শোনা যায়। দুজন লোক দরবেশের কাছে এসে দাঁড়িয়ে যায়। দরবেশ হেসে বললেন- আমরা যে বিপদের আশঙ্কা করেছিলাম, এই হতভাগা তা-ই ঘটাতে যাচ্ছিলো। আমার তো ধারণা ছিলো, দিনেই মসুলের কোনো এক স্থান থেকে তীর এসে আমার হৃদপিণ্ডে গেঁথে যাবে। কিন্তু তারা আমাকে রাতে এর দ্বারা খুন করার চেষ্টা করেছে। এই নাও তার খঞ্জর।

দরবেশ মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা লোকটাকে লাঠি দ্বারা হাল্কা খোঁচা দিয়ে বললেন- ওই শয়তান। তুই কি মুসলমান?

হ্যাঁ হযরত!- লোকটি আদবের সঙ্গে উত্তর দেয়- আমি মুসলমান।

দরবেশ ও তার সঙ্গী দুজন খিল খিল করে হেসে ফেলেন। দরবেশ বললেন- আমাকে হযরত বলো না বন্ধু! আমি তোমার চেয়েও বেশি যুবক।

তোমার ছদ্মবেশ সার্থক হয়েছে। দরবেশের এক সঙ্গী বললো।

তিনজন আক্রমণকারী লোকটাকে সঙ্গে করে দূরে এক তাঁবুতে নিয়ে যায়। তাবুর সন্নিকটে চার-পাঁচটি উট বাঁধা আছে। আশপাশ টিলায় ঘেরা। লোকটাকে আঁবুতে বসিয়ে রাখা হলো। তাঁবুতে বাতি জ্বলছে। দরবেশকে আশি বছরের বৃদ্ধ বলে মনে হয়েছিলো। এখন কথা বলছেন ঠিক একজন নওজোয়ালের ন্যায়। দরবেশ মুখের সাদা দাড়ি এবং মাথার কৃত্রিম চুল খুলে আসল রূপে আবির্ভূত হন। ভেজা কাপড়ে মুখমণ্ডলটা ভালোভাবে চলে ধুয়ে পরিষ্কার করে ফেলেন। এখন তিনি বৃদ্ধ নন- পঁচিশ বছর বয়সের তাগড়া যুবক।

তুমি আসলে কে আক্রমণকারী জিজ্ঞেস করে।

যাকে তুমি হত্যা করতে এসেছে- যুবক উত্তর দেয় আমাকে খুন করতে তোমাকে কে পাঠিয়েছে লুকাবার চেষ্টা করলে তোমাকে বড় কষ্টদায়ক মৃত্যু ভোগ করতে হবে।

 আমার কাছে লুকাবার মতো কিছুই নেই– লোকটি উত্তর দেয় মহলের এক কর্মকর্তা আহমদ ইবনে আমর আমাকে বললেন, শহরে এক দরবেশ ঘুরে ফিরছে। তিনি আমাকে আপনার গঠন-আকৃতি ও বক্তব্য সম্পর্কে অবহিত করে বললেন, লোকটাকে অন্ধকারে হত্যা করতে হবে। কেউ যেনো টের না পায়। কাজটা করে গেলে আমাকে দুশ দিনার পুরস্কার দেবেন বলে ওয়াদা দিয়েছেন।

আহমদ ইবনে আমর কি আমাকে বৃদ্ধ এবং দরবেশই মনে করেছিলেন?

তা বলেননি- লোকটি উত্তর দেয়- আমাকে শুধু বললেন, দরবেশটাকে খুন করতে হবে।

ছদ্মবেশী এই দরবেশ ও তার সঙ্গী দুজন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর আন্ডারগ্রাউন্ড দলের সদস্য। মসুলে কর্মরত। গত পর্বের কাহিনীর দরবেশের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া দূর করার লক্ষ্যে আইউবী পক্ষের লোকেরা এই লোকটিকে দরবেশ সাজিয়ে নগরীতে ঘুরিয়েছে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন অশিক্ষিত মানুষগুলো দরবেশদেরকে খোদার কণ্ঠ বলে বিশ্বাস করতো। প্রথম দরবেশকে ক্রুসেডাররা তাদের এক প্রতারণার সাফল্যের জন্য ব্যবহার করেছিলো। সুলতান আইউবীর লোকেরা তাদের এক যুবক সহকর্মীকে দরবেশের রূপে উপস্থাপন করে বিভ্রান্ত জনতাকে কুসংস্কার ও কল্পনাপূজা থেকে সরিয়ে কুরআনের প্রতি আকৃষ্ট করার সকল প্রচেষ্টা চালিয়েছে।  

আহমদ ইবনে আমর মসুলে ইবনে আমর নামে পরিচিত। মসুলের শাসনকর্তা ইযযুদ্দীনের প্রশাসনের মন্ত্রী পদমর্যাদার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি সংবাদ পান, এক দরবেশ শহরে প্রথম দরবেশের বিরুদ্ধে ঘোষণা দিয়ে ফিরছেন। তিনি বুঝে ফেললেন, এই দরবেশ সুলতান আইউবীর পক্ষের লোক তাতে সন্দেহ নেই। কাজেই তাকে খুন করা আবশ্যক। অন্যথায় মানুষের কাছে প্রথম,দরবেশের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যাবে এবং পাহাড়ের অভ্যন্তরে কী সব জ্বলছে জেনে ফেলবে।

সুলতান আইউবীর এই লোকটাকে হত্যা করার জন্য মহলের নিরাপত্তা বিভাগের এক সৈনিককে নির্বাচন করা হয়। তাকে দুশ দিনার পুরস্কারের প্রলোভন দিয়ে দরবেশকে হত্যা করার জন্য প্রেরণ করা হয়। এই ভাড়াটে খুনী যাকে বৃদ্ধ মনে করছিলো, সে এক তাগড়া যুবক বলে আত্মপ্রকাশ করলো। তার জানা ছিলো না, বৃদ্ধরূপী এই যুবক এক অভিজ্ঞ লড়াকু গোয়েন্দা ও গেরিলা সৈনিক।

ইবনে আমর প্রেরিত এই ঘাতককে তাঁবুতে দীপের আলোতে বসিয়ে বহু কিছু জিজ্ঞেস করা হলো। কিন্তু কোনো তথ্য পাওয়া গেলো না। সে ক্রুসেডারদের নিয়মতান্ত্রিক গুপ্তচর কিংবা নাশকতাকারী গ্রুপের লোক নয়। সে ভাড়ায় খুন করতে এসেছিলো। দরবেশরূপী লোকটি তার উভয় সঙ্গীর প্রতি তাকায়। তিনজন চোখে চোখে কথা বলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। একজন উঠে তাঁবু থেকে এক গজ লম্বা এক টুকরো রশি নিয়ে আসে। লোকটার পেছন থেকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ধরে রাখে। লোকটা ছটফট করতে শুরু করে। অল্পক্ষণের মধ্যেই নিথর হয়ে যায়।

পরদিন। আহমদ ইবনে আমর মসুলের শাসনকর্তা ইযযুদ্দীনের দেউড়িতে তার সম্মুখে দণ্ডায়মান। ক্ষোভে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। ইযযুদ্দীনেরও চেহারায় অস্থিরতার ছাপ। ইবনে আমরের হাতে এক চিলতে কাগজ। সম্মুখে মেঝেতে পড়ে আছে একটি মৃতদেহ, যার গলায় রশি পেঁচানো। সেই রশির সঙ্গেই এই চিরকুটটা বাধা ছিলো।

লাশটা নিরাপত্তা বাহিনীর সেই সৈনিকের, যাকে নতুন দরবেশকে হত্যা করতে প্রেরণ করা হয়েছিলো। ইবনে আমর সারাটা রাত তার অপেক্ষায় নির্মুম অতিবাহিত করেছেন। ভোরে তার নিকট সংবাদ আসে, তার বাসভবনের সামনে একটি লাশ পড়ে আছে। তিনি দ্রুত ছুটে আসেন। ভবনের সম্মুখে মাটিতে তার সেই সৈনিকেরই লাশ পড়ে আছে। চোখ দুটো খোলা। জিহ্বাটা বেরিয়ে আছে। গলায় রশি পেঁচানো। রশির সঙ্গে এক টুকরো কাগজ বাঁধা।

কাগজে লেখা আছে–

মসুলের তথাকথিত শাসনকর্তা ইযযুদ্দীন। তোমার এক কর্মকর্তা আহমদ ইবনে আমর এই ব্যক্তিকে আমাকে হত্যা করার জন্য প্রেরণ করেছিলো। আমি তার মৃতদেহটা অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে আহমদ ইবনে আমরের আঙ্গিনায় রেখে গেলাম। হতভাগা আমাকে হত্যা করতে সক্ষম হয়নি। তুমিও তেমনি এক হতভাগা যে, আজো সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর এতোটুকু ক্ষতি করতে পারোনি এবং ভবিষ্যতেও পারবে না। কাফেরদের বন্ধুত্ব থেকে তুমি লাঞ্ছনা ব্যতীত আর কিছুই অর্জন করতে পারবে না। আমরা তোমাকে স্বস্তিতে থাকতে দেবো না। একদিন তোমার লাশটাও তোমার প্রাসাদের আঙ্গিনায় পড়ে থাকবে। আহমদ ইবনে আমরের ন্যায় কর্মকর্তা-উপদেষ্টাদের থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলল। এরা চাটুকারের দল। কখনোই তোমার অনুগত নয়। এরা তোমাকে পতনের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের শক্তিটা দেখো। তোমার সামরিক উপদেষ্টা এহতেশামুদ্দীন বৈরুতে ক্রুসেডারদের সঙ্গে চুক্তি করতে গিয়েছিলো। কিন্তু আমরা তাকে গুম করে ফেলেছি। এখন সে সুলতান আইউবীর কাছে অবস্থান করছে। তোমার খৃস্টান বন্ধুরা পর্বতমালা খনন করে তার অভ্যন্তরে সামরিক সরঞ্জাম মজুদ করেছিলো। আমরা সেসব ভস্ম করে তোমার সিংহাসনে কম্পন ধরিয়ে দিয়েছি। তুমি তোমার এক সৈনিককে আমাকে খুন করতে প্রেরণ করেছিলে। আমরা নৈতিকতার সঙ্গে তার লাশটা তোমাদের হাতে পৌঁছিয়ে দিয়েছি। আমরা জিন-ভূতের ন্যায় তোমাদের উপর সওয়ার হয়ে থাকবে। কিন্তু তোমরা আমাদেরকে দেখতে পাবে না। তোমার পতন শুরু হয়ে গেছে। মুক্তি যদি পেতে চাও, তো সালাহুদ্দীন আইউবীর আনুগত্যের বিকল্প নেই। যাও সুলতান আইউবীর পায়ে লুটিয়ে পড়ো এবং বাহিনীটাকে তার হাতে তুলে দাও। আমাদেরকে প্রথম কেবলা মুক্ত করতে হবে। এই জাগতিক ভোগ-বিলাস, রং-তামাশা ত্যাগ করো। রাজ-সিংহাসন কোনোদিন কারো সঙ্গে কবরে যায়নি।

আহমদ ইবনে আমর লাশটা নিজ গৃহের সম্মুখ থেকে তুলে ইযযুদ্দীনের সামনে নিয়ে রাখেন। ইয়ুযুদ্দীন পত্রখানা পাঠ করে আহমদ ইবনে আমরের হাতে ফেরত দিয়ে গভীর ভাবনায় হারিয়ে যান। ইবনে আমর ক্ষোভ প্রকাশ করলেও ইষযুদীন ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে চেষ্টা করছেন।

আমি সংবাদ পেয়েছি, মসজিদে মসজিদেও নাকি এই নতুন দরবেশের আলোচনা চলছে- ইবুদ্দীন বললেন- এখন এই পত্র দ্বারা প্রমাণ হয়ে গেলো দরবেশ আসলে দূরবেশ নয়- সালাহুদ্দীন আইউবীর লোক।

ইহূদীন ইবনে আমরের হাত থেকে পত্ৰখানা নিয়ে পেঁচিয়ে লাশটার উপর জুড়ে মারেন।

আমি তাকে খুঁজে বের করবো- ইবনে আমর ক্ষোভের সাথে বললো ধরে এনে জনসম্মুখে তার মাথাটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবো।

আমাদের ঠান্ডা মাথায় সবড়ে হবে- ইবুদীন বললেন- এই একটা লোককে হত্যা করে তুমি সালাহুদ্দীন আইউবীর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আমাদেরকে অনাকিছু করতে হবে। অন্যকিছু ভাবতে হবে। আমি চালিম, ক্রুসেডাররা আইউবীর উপর আক্রমণ করুক। কিন্তু জানি না তারা কোনো সামনে আসছে না। তারা চাচ্ছে প্রকাশে আমি আইউবীর সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়। পরে তারা আমাকে এভাবে সাহায্য করবে যে, তাদের গেরিলা বাহিনী আইউবীর পার্শ্ব, পেছন এবং রসদের উপর কমান্ডো আক্রমণ চালাতে থাকবে। এ প্রক্রিয়ায়ও আমি যুদ্ধের ময়দানে সাফল্য অর্জন করতে পারি।

আর হবেও নিশ্চয়ই। ইবনে আমর মেঝেতে শ্ম দ্বারা আঘাত হেনে বললো।

এই পত্রে সঠিক লেখা হয়েছে যে, তোমরা চাটুকার- ইযুদ্দীন বললেন- আমি এক মহাসংকটে নিপতিত আর তোমরা আমাকে খুশি করার জন্য শিশুর ন্যায় কথা বলছে। তোমরা কি আমাকে ভালো কোন পরামর্শ দিতে পারো না?

ইযুবুদ্দীন হাত তালি দেন। এক যুবতী সেবিকা ছুটে এসে অবনত মস্তকে সালাম করে দাঁড়িয়ে যায়। ইযযুদ্দীন বললেন- দারোয়ানকে বলো, লাশটা তুলে নিয়ে কোথাও দাফন করে রাখুক। বলেই তিনি নিজের খাস কাকে চলে যান। আহমদ ইবনে আমরও সঙ্গে আছেন। ইযযুদ্দীন পুনরায় বেরিয়ে এসে সেবিকাকে বললেন- সোরাহি-পেয়ালা নিয়ে আসো। দারোয়ানকে বলেদাও, এদিকে যেনো কাউকে আসতে না দেয়।

সেবিকা লাশটা দেখে ভয় পেয়ে যায়। মোচড়ানো কাগজটার উপর তার চোখ পড়ে। মেয়েটা আরবী জানে। খুলে লেখাগুলো পড়েই কাগজটা কাপড়ের ভেতরে লুকিয়ে ফেলে। তারপর এক দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দারোয়ানকে বললো, লাটা তুলে দাফন করিয়ে ফেলে। বলেই একটা সোনার থালায় করে একটা সোরাহি আর দুটো পেয়ালা নিয়ে ইমৃত্যুণীদের কক্ষে ফিরে যায়।

আর্মেনীয় সম্রাট আমার বার্তার উত্তর দিয়েছেন- ইবুদ্দীন ইবনে আমাকে বলছেন- তিনি আমাকে তার রাজধানী তালখালেদের পরিবর্তে হারোম যেতে বলেছেন। নিজে তালখালেদ থেকে রওনা হয়ে গেছেন। আমি দুদিন পর যাচ্ছি।

সেবিকা পেয়ায় দ্রুত মদ ঢালার পরিবর্তে ধীরে ধীরে কাপড় দ্বারা পেয়ালাগুলো মুছতে থাকে। মেয়েটা ইন্দীনের বক্তব্য মনোখোশ সহকারে শুনছে।

আমার মনে হচ্ছে আর্মেনীয় সম্রাটের ডালখালেদ ছেড়ে যাওয়ার সিন্ধান্ত ভুল। ইবনে আমর বললো।

কারণ সালাহুদ্দীন আইউবী ভালখালেদ অভিমুখে অগ্রযাত্রা করছে, তাই না- ইহুদ্দীন বললেন- তুমি ভয় করছে, আর্মেনীয় ম্রাটের অবর্তমানে সালাহুদ্দীন আইউবী তালখালেদ অবয়োধ করে ফেলবেন। না, এমনটা হবে না। হয়ও যদি আমরা আইউবীর উপর পেছন দিক থেকে আক্রমণ চালাবো। এই যুদ্ধকে আমরা দীর্ঘ করে তুলবো এবং ক্রুসেডারদের অবহিত করবো। তারাও আইউবীর উপর আক্রমণ চালাবে। আমি নিশ্চিত, এমনটা হলে সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনী পিষে যাবে।

আপনি কবে যাচ্ছেন ইবনে আমর জিজ্ঞেস করে।

 দুদিন পর। ইষুদ্দীন উত্তর দেন।

 মদ পরিবেশনে আর বিলম্ব করা যাচ্ছে না। সেবিকা পেয়ালা দুটোয় মদ ঢেলে দুজনের সামনে পেশ করে। ইফষুদ্দীন বললেন, এবার তুমি চলে যাও। সেবিকা দেউড়িতে গিয়ে দেখে লাশটা তুলে নেয়া হয়েছে। মেয়েটি এখনই বাইরে বেরুতে পারছে না। ডিউটি আছে। সে বসে বসে ভাবতে শুরু করে। হঠাৎ তার মুখ থেকে সশব্দে আহ! বেরিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে পেটটা চেপে ধরে। মাথাটা নত করে ফেলে। পরোয়ান ও অন্যান্য চাকররা ছুটে আসে। সেবিকা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো- হঠাৎ পেট ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। তৎক্ষণাৎ অন্য এক সেবিকাকে ডেকে তার জায়গায় বসিয়ে দেয়া হলো এবং তাকে ডাক্তারের নিকট নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তারকে বলা হলো, পেটে হঠাৎ ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে প্রচণ্ড ব্যথা। ডাক্তার ওষুধ দিয়ে বললেন, তোমাকে দুদিন বিশ্রামে থাকতে হবে।

অল্প পরই সেবিকার সব ঠিক হয়ে যায়। ডাক্তার তাকে দুদিনের ছুটি দিয়ে বললেন, নিজের কক্ষে গিয়ে আরাম করো। সেবিকা নিজ কক্ষে না গিয়ে অলি-গলি ঘুরে ইযযুদ্দীনের স্ত্রী রোজি খাতুনের কক্ষে চলে যায়।

রোজি খাতুন কক্ষে উপবিষ্ট। ইযযুদ্দীনের সেবিকা কক্ষে প্রবেশ করে।

 পেট ব্যথার বাহানা করে এসেছি– সেবিকা বললো- ডাক্তার আজ এবং কালকের ছুটি দিয়েছেন।

মেয়েটি লাশের উপর থেকে যে কাগজখানা কুড়িয়ে নিয়েছিলো, সেটি কামিজের ভেতর থেকে বের করে রোজি খাতুনের হাতে দিয়ে বললো এই কাগজটা এক সৈনিকের লাশের সঙ্গে ছিলো।

রোজি খাতুন কাগজটা খুলে পাঠ করে বললেন- শাশ। আমাদের মুজাহিদরা কাজ করছে। তো এর অর্থ হচ্ছে, হতভাগ্যরা আমাদের এই লোকটাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলো। আমি সংবাদ পেয়েছি, আমাদের এই দরবেশ মানুষের অন্তর থেকে ক্রুসেডারদের দরবেশের ভীতি ও প্রভাব বের করে দিয়েছে।

এই পত্র তারই- সেবিকা বললো- আমি তার হাতের লেখা চিনি।

রোজি খাতুন হেসে বললেন- আমি জানি। তুমি তার হাতের লেখা-ই নয়- হৃদয়টাও চেনো। তবে খেয়াল রাখবে, হৃদয়ের জালেই আটকে থেকো না। কর্তব্য সকলের আগে।

সেবিকা লজ্জা পেয়ে যায়। লাজুক কণ্ঠে বললো- এ পর্যন্ত নিজের আবেগ-উচ্ছ্বাসকে কর্তব্যের পথে আসতে দেইনি। ফাহদকেও এ কথাই বলি, আমি তোমাকে ভালোবাসি ঠিক; কিন্তু কর্তব্য যেনো সবার উপরে থাকে।

ফাহদ সেই যুবক, যে দরবেশের রূপ ধারণ করেছিলো। বাড়ি বাগদাদ। গোয়েন্দা হওয়ার জন্য যতোগুলো গুণের প্রয়োজন, সবই তার মধ্যে বিদ্যমান। রূপবান যুবক। দুবছর যাবত মসুলে অবস্থান করছে এবং সফলতার সাথে গুপ্তচরবৃত্তি করছে। এই সূত্রেই ইযযুদ্দীনের এই সেবিকার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ও যোগাযোগ। দুজন দুজনের হৃদয়ে ঢুকে গেছে।

সেবিকা শহরে থাকে। তবে তার বেশিরভাগ সময় কাটে রাজপ্রাসাদে ডিউটিতে। গুপ্তচরবৃত্তির গোপন তৎপরতা ছাড়াও অন্য প্রয়োজনে তাদের দেখা-সাক্ষাৎ চলতে থাকে।

আমি যে সংবাদ নিয়ে এসেছি, এখনো তা বলা হয়নি- সেবিকা রোজি খাতুনকে বললো- ইযযুদ্দীন দুদিন পর আর্মেনিয়ার সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হারোম যাচ্ছেন। মদ পরিবেশনের সময় আমি তাকে একথা বলতে শুনেছি। তিনি আহমদ ইবনে আমরকে বলছিলেন, আর্মেনিয়ার সম্রাট বার্তা পঠিয়েছেন, তিনি তালখালেদ থেকে হারাম অভিমুখে রওনা করেছেন এবং আমার সঙ্গে ওখানে সাক্ষাৎ করবেন। আমি বের হওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। তাই পেট ব্যথার অজুহাত তৈরি করে আপনার কাছে এসেছি।

রোজি খাতুন নিজ উরুতে চাপড় মেরে বললেন- সালাহুদ্দীন আইউবী তালখালেদ অভিমুখে এগিয়ে আসছেন। আমার জানা নেই, তালখালেদে আমাদের গুপ্তচর আছে কিনা। সংবাদটা আইউবীকে জানানো আবশ্যক। হতে পারে তিনি দুজনকে হারমেই পাকড়াও করে ফেলবেন। কাজটা তুমিও করতে পারো। ফাহ্দ কিংবা তার কোনো একজন সঙ্গীর নিকট যাও। সংবাদটা অবহিত করে আমার পক্ষ থেকে বলবে, সালাহুদ্দীন আইউবী এই মুহূর্তে তালখালেদের পথে থাকবেন। সংবাদটা যেনো তাঁকে পৌঁছিয়ে দেয়। তুমি এক্ষুনি যাও।

সেবিকা চলে যায়

পরক্ষণেই ইযযুদ্দীন রোজি খাতুনের কক্ষে প্রবেশ করেন। চেহারায় প্রচণ্ড ভীতির ছাপ। রোজি খাতুন তার এই পেরেশানীর কারণ জানেন। তথাপি জিজ্ঞেস করেন- আপনাকে বেশ অস্থির দেখাচ্ছে। কারণ কী?

আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর শত্রুতা আর ক্রুসেডারদের বন্ধুত্বের শিল পাটায় পিষে যাচ্ছি। ইযযুদ্দীন পরাজিত কণ্ঠে বললেন।

আমার পূর্ণ আন্তরিকতা, হৃদ্যতা আপনার সঙ্গে- রোজি খাতুন বললেন- কিন্তু যখন আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর পক্ষে কথা বলি, তখন আপনার সন্দেহ জাগে, আমি তার সমর্থক এবং আপনার বিরোধী। আপনার প্রকৃত সমস্যা এই নয় যে, আপনার ও সালাহুদ্দীন আইউবীর মাঝে শত্রুতা সৃষ্টি হয়ে গেছে। প্রকৃত কারণ হচ্ছে, আপনি সেই জাতিকে বন্ধু ভেবে বসেছেন, যারা আপনার বন্ধু হতে পারে; কিন্তু আপনার ধর্মের আপন হতে পারে না। ক্রুসেডাররা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আপনাকে ধোকা দেবে এবং অবশ্যই দেবে।

তবে কি আমি আইউবীর নিকট গিয়ে আত্মসমর্পণ করবো?- ইযযুদ্দীন তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন- তা-ই যদি করি, তাহলে নিজ বাহিনীকে কীভাবে মুখ দেখাবো!

সালাহুদ্দীন আইউবী আপনাকে প্রজা নয়- মিত্র বানাতে চান। রোজি খাতুন বললেন।

তুমি লোকটার মতলব বুঝতে পারোনি- ইযযুদ্দীন বললেন- তিনি ইসলামী সাম্রাজ্যের কথা বলেন। আসলে তিনি ক্ষমতালোভী।

তার অর্থ হচ্ছে, আপনি তার সঙ্গে লড়াই করবেন- রোজি খাতুন বললেন- এ-ই যদি আপনার সংকল্প হয়ে থাকে, তাহলে অস্থির না হয়ে আপনি যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। সেনাসংখ্যা বৃদ্ধি করুন।

আমার পেরেশানীর কারণ হচ্ছে, সালাহুদ্দীন গোয়েন্দা এবং নাশকতাকারীদের জাল বিছিয়ে রেখেছেন- ইযুদ্দীন বললেন- তুমি বোধ হয় জানেনা, আমার এমন যোগ সামরিক উপদেষ্টা এহতেশামুদ্দীন বৈরুতে বল্ডউইনের সঙ্গে চুক্তি করতে গিয়ে সেখান থেকে নিখোঁজ হয়ে গেছে। আমি সংবাদ পেয়েছি, সে সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট আছে। আমার সকল গোপন তথ্য তার কাছে। আমি খৃস্টানদের দ্বারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, তরল দাহ্য পদার্থ ও অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জাম সংগ্রহ করিয়েছিলাম। কিন্তু সব ধ্বংস হয়ে গেছে। আজ আমার এক নিরাপত্তা কর্মীর লাশ আমার নিকট এসেছে!

তাই নাকি? কেউ তাকে খুন করেছে নাকি? রোজি খাতুন কিছুই জানেন না ভান ধরে জিজ্ঞেস করেন।

হ্যাঁ- ইযযুদ্দীন আসল কথা গোপন রেখে বললেন- তাকে কেউ হত্যা করেছে। তাকে বিশেষ এক কাজে পাঠানো হয়েছিলো। ঘাতক সালাহুদ্দীন আইউবীরই লোক মনে হচ্ছে।

লাশের সঙ্গে থাকা ফাহৃদের পত্রখানা রোজি খাতুনের কাছে। কিন্তু তিনি ভান ধরেছেন, কিছুই জানেন না। ভাবেন, ইযযুদ্দীন এমনিতেই ভীত। আরো ভয় ধরিয়ে দেয়া প্রয়োজন।

আপনার ভালোভাবে জানা আছে, সালাহুদ্দীন শুধু রণাঙ্গনেই লড়েন না- রোজি খাতুন বললেন- তিনি যখন নিজ গৃহে ঘুমিয়ে থাকেন, তখনো তার শত্রুরা মনে করে, তিনি তাদের মাথার উপর বসে আছেন। এই মুহূর্তে তিনি তালখালেদ অভিমুখে অগ্রযাত্রা করছেন। কিন্তু মনে হচ্ছে, যেনো তিনি মসুলে বসে বসে নিজ তত্ত্বাবধানে ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করছেন। ক্রুসেডারদের বাহিনীর অবস্থাটা দেখুন। আইউবীর বাহিনীর তুলনায় তারা দশ গুণ। তবু তারা মুখোমুখি এসে যুদ্ধ করার সাহস পাচ্ছে না। খৃস্টানদের তুলনায় আপনার যে সৈন্য আছে, তাতে আপনি জানেন। তাছাড়া আপনার বাহিনীতে এমন সব কমান্ডারও আছে, যারা আপনার অনুগত নয়। তারা আপনাকে ধোঁকা দিতে পারে।

ইযযুদ্দীনের ভীতি আরো বেড়ে যায়। বললেন- আমি এমন এক অবস্থানে এসে পৌঁছেছি, যেখান থেকে সহজে বেরিয়ে আসতে পারবো না। দুদিন পর আমি বাইরে এক জায়গায় যাবো। ভাগ্য প্রসন্ন হলে সফল হবো। তিনি নিশ্চুপ হয়ে গভীর ভাবনায় হারিয়ে যান। খানিক পর বললেন- রোজি! আমি তোমার সঙ্গে আমার একটা বাসনা সম্পৃক্ত করে রেখেছি।

আমি আপনার প্রতিটি আশা-আকাঙ্খা পূর্ণ করবো- রোজি খাতুন বললেন- আপনি যদি আমাকে সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে কোন অভিযান পরিচালনা করতে বলেন, তা-ও করবো। আমি আপনার এক সন্তানের মা হয়েছি। আপনার বাসনা আমি পূরণ না করলে কে করবে বলুন। বলুন, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি। আপনি আমাকে কঠিন পরীক্ষায় নিক্ষেপ করুন।

আমি বাইরে যাচ্ছি- ইযযুদ্দীন বললেন- এখনই জিজ্ঞেস করো না কোথায় যাচ্ছি। বিষয়টা এখনো গোপন রাখতে হবে। ফিরে এসেই আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করবো। তবে পরিস্থিতি যদি আমার বিপক্ষে চলে যায়, তাহলে আমি তোমার কাছে আশা রাখবো, তুমি সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট গিয়ে তাঁর সঙ্গে আমাকে সমঝোতা করিয়ে দেবে। হতে পারে তখন আমি গেলে তিনি আমাকে গ্রাহ্য করবেন না।

রোজি খাতুন ইযযুদ্দীনকে এই পরামর্শ দিলেন না যে, তার চেয়ে বরং পরাজিত হওয়ার আগেই আপনি আইউবীর সঙ্গে আপস করে নিন। ইযুদ্দীন কোথায় যাচ্ছেন, তাও তিনি জিজ্ঞেস করলেন না। সব তো তার জানাই আছে। তাছাড়া ইযযুদ্দীন যখন বিষয়টা এখনো গোপনই রাখতে চাচ্ছেন, তাহলে অযথা ঘাটানোর প্রয়োজন কী। তিনি জানেন না, তিনি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর একজন বিজ্ঞ গোয়েন্দা নারীর সঙ্গে কথা বলছেন। যা হোক, রোজি খাতুন ইযযুদ্দীনকে নিশ্চয়তা প্রদান করেন, যখনই প্রয়োজন হবে আমি সুলতান আইউবীর সঙ্গে আপনাকে সমঝোতা করিয়ে দেবো। ইযযুদ্দীনের ভীতিকর অবস্থা দেখে রোজি খাতুনের হৃদয় সাগরে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়।

ইযযুদ্দীন অবনত মস্তকে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। রোজি খাতুনের ব্যক্তিগত সেবিকা কক্ষে প্রবেশ করে। মহিলা রোজি খাতুনেরই সমান বয়সী। প্রবেশ করেই রোজি খাতুনকে জিজ্ঞেস করে, সম্রাটকে অনেক পেরশান দেখা গেলো। এই সেবিকাও রোজি খাতুনের গোপন মিশনের সহকর্মী।

ঈমান আর চরিত্র ত্যাগ করলে মানুষের এই দশাই ঘটে- রোজি খাতুন বললেন- এই যে শাসকরা জাতি ও ধর্ম থেকে আলাদা হয়ে আপন সাম্রাজ্যের রাজা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, এরা বৃক্ষ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া ডালের মতো। ডালের পাতাগুলো ঝরে যাবে। তারপর বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে। শেষে ডালগুলো শুকিয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। যে বস্তুটা আমার স্বামীকে মদ-নারীর আসক্তে পরিণত করেছে, সে হলো ক্ষমতার লোভ। লোকটি ক্রুসেডারদের মধুর বিষ শিরায় ঢুকিয়ে নিয়েছে। আমার স্বামী ইযযুদ্দীন রণাঙ্গনের রাজা ছিলেন। তার তরবারী ক্রুশের হৃদপিণ্ড কর্তন করতো। কিন্তু আজ তিনি নিজ ঘরে ভয়ে কাঁপছেন। তার বীরত্ব হারিয়ে গেছে। আমার কাছে একজন নারীর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছেন। রাজত্বের নেশা আর মদ-নারী মানুষের এ দশাই ঘটায়। তার ভাগ্যে পরাজয় লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে। একজন সেনাপতি যখন সিংহাসনের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তখন তার গোটা বাহিনী দীন ও ঈমান থেকে হাত গুটিয়ে নেয়। তারপর দেশ ও জাতির মর্যাদা মাটিতে মিশে যায়। দুশমন মাথার উপর চড়ে বসে।

***

ফাহ্দকে তথ্য সরবরাহ করতে রওনা হয়ে গেছে ইযযুদ্দীনের সেবিকা। ফাহদ যেখানে থাকার কথা, সে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে সে। কিন্তু ফাঁদের ঘরে তালা। সাধারণত উষ্ট্ৰচালকের বেশে থাকে ফাহদ। দুটি উট সঙ্গে রাখে আর ব্যবসায়ীদের মালপত্র ভাড়া টানে। ভাড়ার অপেক্ষায় যেখানে উট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, মেয়েটি সেখানে যায়। ফাহদ সেখানেও নেই। উষ্ট্ৰচালক হিসেবে ফাহদের নাম অন্য। সেই নাম নিয়ে এক উষ্ট্ৰচালককে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে ফাহদ ভাড়া নিয়ে এক জায়গায় গেছে। সেবিকা জায়গাটার নাম জেনে নিয়ে সেদিকে হাঁটা দেয়। কিন্তু মেয়েটি জানে না এক ব্যক্তি তাকে অনুরণ করছে।

লোকটা মসুলের মুসলমান। কিন্তু খৃস্টানদের চর। ইযযুদ্দীনের মহলের কর্মচারি। সেবিকাকে সে ডাক্তারের নিকট দেখেছিলো। মেয়েটিকে চিনতো সে। ডাক্তারের ব্যবস্থা নিয়ে যখন সে মহল থেকে বের হচ্ছিলো, তখনো তাকে সে দেখেছিলো। তবে জানতো না, মেয়েটা রোজি খাতুনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসেছে। সে দেখলো, মেয়েটি এতো দ্রুত হাঁটছে, যেনো তার কোনো অসুখ নেই। লোকটা খৃস্টানদের তৈরিকরা গুপ্তচর। মেয়েটিকে তার সন্দেহ হয়। ইযুদ্দীনের গোয়েন্দা ব্যবস্থা অতোটা উন্নত নয়। খৃস্টানরা তার মহলে চর ঢুকিয়ে রেখেছে তা তিনি জানেন না। তাদের কাজ দুটো এক, ইযযুদ্দীনের প্রতি চোখ রাখা, পাছে তলে তলে তিনি সুলতান আইউবীর বন্ধু হয়ে যান কিন। দুই. ইযযুদ্দীনের মহলে এবং মসুলে আইউবীর যেসব লোক গোয়েন্দাগিরি করছে, তাদের চিহ্নিত করা।

খৃস্টানদের এই চরটা মেয়েটার অনুসরণ শুরু করে। যখন দেখলো, মেয়েটা আরো দ্রুত হাঁটছে এবং কাউকে খুঁজে ফিরছে, তখন তার সন্দেহ আরো পোক্ত হয়ে গেলো। এবার দেখতে হবে, মেয়েটা কাকে তালাশ করছে। মেয়েটা সত্যিই যদি গোয়েন্দা হয়ে থাকে, তাহলে তার মাধ্যমে অন্য গোয়েন্দাদেরও ধরা যাবে। ফাহদ ভাড়া নিয়ে যেখানে গেছে, মেয়েটি সেদিকে হাঁটা দেয়। খৃস্টানদের চরটাও তার পেছনে পেছনে হাঁটতে শুরু করে।

এক স্থানে উটের পিঠ থেকে মালপত্র নামানো হচ্ছে। ফাহদও মালপত্র নামাচ্ছে। ফাহদ মেয়েটিকে দেখে ফেলে। কাছ ঘেঁষে অতিক্রম করতে করতে মেয়েটি ফাঁদের চোখে চোখ রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ফাহদ তাড়াতাড়ি উটের পিঠ থেকে মালামাল খালাস করে মেয়েটির পেছনে চলে যায়। এক উটের লাগাম হাতে ধরা। অপরটির লাগাম এটির পেছনে বাঁধা। মানুষ আসছে, যাচ্ছে। ফাহদ মেয়েটির কাছে চলে যায়। মেয়েটি দাঁড়াচ্ছে না। মনে হচ্ছে, আনমনে হাঁটছে। আশপাশের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। ফাঁদেরও বাহ্যত সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। মেয়েটি ফাহদকে তথ্য দিচ্ছে।

মেয়েটির ফাহদকে যা বলবার বলা হয়ে গেছে। শেষে বললো, কাজ শেষ করে জায়গামতো আসো- গল্প করবো। তবে কর্তব্য সকলের আগে। আচ্ছা, সুলতান আইউবীর ফৌজ এখন কোথায় জানো তো, না?

জানি- ফাহদ উত্তর দেয়- আমি এখনই রওনা হয়ে যাচ্ছি।

আল্লাহ হাফেজ।

ফী আমানিল্লাহ।

মেয়েটি একদিকে মোড় নেয়। সেদিকে একটি গলিপথ। দেখে, এক ব্যক্তি তার পেছনে পেছনে আসছে। তার মনে পড়ে যায়, ফাঁদের সন্ধানে আসবার সময় লোকটাকে তিন-চারবার দেখেছিলো। এই লোকটাকে সে মহলেও দেখেছে। লোকটা কে হতে পারে, খানিক চিন্তা করার পর স্মরণ আসে, লোকটা মহলের কর্মচারি। মেয়েটির মনে সন্দেহ জাগে। লোকটার মতিগতি বুঝবার জন্য মেয়েটি কয়েকবার তার প্রতি তাকায়। লোকটা তার পিছু ছাড়ছে না। মেয়েটি লোকালয় থেকে বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে যায় তাকে অনুসরণকারী লোকটিও। খানিক দূরে এক স্থানে ঝোঁপ-জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। মেয়েটি সেখানে গিয়ে বসে পড়ে। লোকটি তাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যায়। তাতে বোধ হয় তার সন্দেহ জাগে, মেয়েটা কারো অপেক্ষায় বসে পড়েছে। লোকটি বেশ সম্মুখে চলে যায়।

মেয়েটি অত্যন্ত চতুর ও সতর্ক। সে দ্রুত ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে যায়। সেখান থেকে বসে বসে ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে একটি গলিপথে অদৃশ্য হয়ে যায়। লোকটি বেশ দূরে চলে গিয়ে আবার ফিরে আসে। অন্য এক পথে মেয়েটি যে ঝোঁপের আড়ালে বসে পড়েছিলো, সেখানে চলে আসে। তার ধারণা, ওখানে অন্য কেউও আছে। কিন্তু কাছে এসে দেখে, কেউ নেই। মেয়েটিও নেই। সে এদিক-ওদিক তাকায়। মেয়েটির নাম-চিহ্নও নেই।

লোকটাকে ফাঁকি দিয়ে বুদ্ধিমতী মেয়ে নিজ গৃহে চলে যায়।

***

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী আর্মেনিয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। জীবনের সবচে বড় ঝুঁকিটা মাথায় তুলে নিয়েছেন তিনি। খৃস্টান বাহিনী যে কোন সময় ঐক্যবদ্ধভাবে তাঁর উপর আক্রমণ করে বসতে পারে। অথচ তিনি একা। মুসলমান আমীরগণ তাঁর প্রতিপক্ষ। নিজ নিজ রাজ্য ও শাসন ক্ষমতা আলাদা আলাদাভাবে মুঠোয় রাখার জন্য তারা নিজেদের ঈমান খৃস্টানদের হাতে বিক্রি করে ফেলেছেন। গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, যা ছিলো মূলত খৃষ্টানদেরই ষড়যন্ত্রের ফল। এখন সুলতান আইউবী সে সকল মুসলিম শাসককে তরবারীর জোরে নিজের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়ে মাঠে নেমেছেন। তিনি ঘোষণা করে দিয়েছেন, যে শাসক আমার দলে ফিরে আসবে না, সে স্বাধীনও থাকতে পারবে না। ইতিমধ্যে কয়েকটি দুর্গ তিনি দখল করে নিয়েছেন এবং সেগুলোর অধিপতিরা তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছেন। এবার তিনি সেই শাসকদের প্রতি অগ্রসর হচ্ছেন, যারা অপেক্ষাকৃত বেশি শক্তিশালী। তিনি অত্যন্ত বীরত্ব ও দক্ষতার সঙ্গে তাদের মাঝে বাহিনী নিয়ে ঘুরে ফিরছেন, যা মূলত বিরাট এক ঝুঁকি।

তোমাদের লক্ষ্য যদি মহৎ হয়ে থাকে, তাহলে তোমাদেরকে ভয় করা চলবে না- সুলতান আইউবী তালখালেদের পথে এক ছাউনিতে বসে নিজ সালারদের বলছেন- আমি জানি, তোমরা কী ভাবছো। আমি খৃস্টানদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ বে-খবর অবস্থায় ভুল পথে বাড়িয়েছি, আমার এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে যদি তোমাদের কেউ একমত না হয়ে থাকো, তাহলে আমি তাকে সঙ্গতই মনে করবো। আমি তাকে বলবো না, আমার সিদ্ধান্ত মান্য করে তুমি আমার ভুল সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করো। আমি বরং তাকে বলবো, তুমি আমার লক্ষ্য হৃদয়ঙ্গম করো, অন্তর থেকে সমস্ত ভীতি ও কুমন্ত্রণা ঝেড়ে ফেলে দাও। আমাদের গন্তব্য বাইতুল মুকাদ্দাস মুসলমানের প্রথম কেবলা। আল্লাহ আমাদেরকে এক কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছেন যে, আমাদেরই কতিপয় ভাই ঈমান বিক্রি করে ফেলেছেন। প্রথম কেবলা নয়- তাদের ক্ষমতার প্রয়োজন। স্মরণ রেখো আমার বন্ধুরা! যখন ইতিহাস লিপিবদ্ধ হবে, তখন লেখা হবে, আমাদের কালের সৈন্যরা কাপুরুষ ও অযোগ্য ছিলো। পরাজয়ের অভিশাপ সর্বদা সৈন্যদের ভাগেই ফেলা হয়। শাসক গোষ্ঠী যদিও তলে তলে কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতে, তবু অনাগত বংশধর সৈন্যদেরই উপর অভিশাপ বর্ষণ করবে।

আমাদের একদিন আল্লাহর দরবারে হাজির হতে হবে। তিনি আমাদের উপর যে কর্তব্য আরোপ করেছেন, তা পালন করতে হবে। সেই কর্তব্য পালনে প্রয়োজনে আমাদেরকে জীবন বিলিয়ে দিতে হবে। ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে যারা কেন্দ্র থেকে আলাদা হয়ে গেছে, আমার হৃদয়ে তাদের প্রতি কোনো মমতা নেই। আজ যদি আমরা এই বিভক্তির ধারা রুখে না দেই, তাহলে একদিন এই প্রবণতা ইসলামের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। রাজ্যগুলো নামে ইসলামী হবে; কিন্তু তার শাসকরা নিজেদের রাজত্ব ও ভোগ-বিলাসিতা অটুট রাখার জন্য আপন শত্রুর সঙ্গে সমঝোতা করবে এবং ঈমান নিলাম করে বেড়াবে। আপন শত্রুকে তুষ্ট করার জন্য তারা তলে তলে একে অপরের শিকড় কাটতে থাকবে। দুর্বল শত্রুটাও তাদের কাছে শক্তিশালী মনে হবে। একজন শাসক তার সকল প্রজাকে লাঞ্ছনার মুখে ঠেলে দেবে। কাজেই জাতির এই বিক্ষিপ্ত শক্তিটাকে এখনই নিয়ন্ত্রিত করে ফেলার চেষ্টা করতে হবে।

আমি কথাগুলো বারবার এ জন্য ব্যক্ত করছি, যাতে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা- যা কিনা সময়ের বড় প্রয়োজন- তোমাদের হৃদয় জগতে অংকিত হয়ে যায় এবং পাছে আপন ভাইকে সামনে দেখে যে কিনা আমাদের ধর্মের শত্রু- তোমাদের তরবারী অবনত না হয়ে পড়ে। জাতির কেন্দ্র ও ঐক্য বিনষ্টকারী ভাই শত্রু অপেক্ষা ভয়ঙ্কর হয়ে থাকে। আমি তোমাদেরকে বলেছি, আমরা তালখালেদ অবরোধ করতে যাচ্ছি এবং এটি আমাদের সর্বশেষ বিরতি। এর পরেই তালখালেদের অবস্থান। অবরোধে কার কার ইউনিট অংশগ্রহণ করবে, আমি তোমাদেরকে অবহিত করেছি। রিজার্ভ ফোর্স আমার সঙ্গে থাকবে। কমান্ডো বাহিনীটি ছোট ছোট উপদলে বিভক্ত হয়ে সেই পথগুলোকে আয়ত্ত্বে নিয়ে নেবে, যেসব পথে খৃস্টান বাহিনীর আসবার আশঙ্কা আছে কিংবা আর্মেনীয় বাহিনী অবরোধ ভাঙতে আসতে পারে। গোয়েন্দাদের রিপোর্ট মোতাবেক খৃস্ট বাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কা নেই। তারপরও সতর্ক থাকা আবশ্যক।

আমরা আর্মেনিয়া দখল করতে চাই না। আর্মেনীয় সম্রাটকে আমাদের শর্ত মান্য করতে বাধ্য করতে হবে। আমি তোমাদেরকে বলেছি, ইযযুদ্দীন আর্মেনীয় সম্রাটের সাহায্য প্রত্যাশী। আমাদেরকে আর্মেনিয়ার উপর আপদরূপে আবির্ভূত হতে হবে, যাতে আর্মেনিয়ার সম্রাট ইযযুদ্দীনকে সাহায্য দিতে না পারে। তবে আমি তোমাদেরকে কোনো প্রকার আত্ম প্রবঞ্চনায় লিপ্ত করতে চাই না। এমনো হতে পারে, আর্মেনীয় বাহিনী ও জনসাধারণ আমাদের এমন কঠোর মোকাবেলা করবে যে, আমাদেরকে পিছপা হতে হবে। আর তখন ইযযুদ্দীনও আমাদের উপর আক্রমণ করে বসতে পারে। আক্রমণ করতে পারে হালবের শাসনকর্তা ইমাদুদ্দীনও। আমাদের পতন দেখে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আমীরগণও আমাদেরকে ঘোড়ার পায়ের তলায় পিষ্ট করার চেষ্টা করবে। এসব ফলাফল এবং আশঙ্কাসমূহকে সামনে রেখেই আমাদেরকে লড়াই করতে হবে। আমি তোমাদেরকে মানচিত্র দেখিয়েছি। কারো মনে কোনো সংশয় থাকলে দূর করে নাও। এই অবরোধ ও আক্রমণ আমাদেরকে এমন মহাবিপদে ফেলে দিতে পারে যে, আমরা পরাজয় বরণ করতে পারি।

***

সুলতান আইউবী যখন তাঁর শেষ ছাউনীতে নিজ সালারদেরকে পূর্বপ্রদত্ত নির্দেশনাবলী স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন রাতের শেষ প্রহর। মানচিত্রটা তার সম্মুখে পড়ে আছে। দারোয়ান তাবুতে প্রবেশ করে সুলতানের কানে কী যেনো বললো। সুলতান বললেন- এক্ষুনি ভেতরে পাঠিয়ে দাও।

দারোয়ান তাবুর পর্দা ফাঁক করে মাথায় ইঙ্গিত করে। ফাহদ তাবুতে প্রবেশ করে। সে পথে কোথাও না থেমে মসুল থেকে এখানে এসে পৌঁছেছে। চেহারাটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ঠোঁট শুষ্ক। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে। আসছে। গোয়েন্দা উপনেতা হাসান ইবনে আবদুল্লাহ তাঁবুতে উপস্থিত।

মনে হচ্ছে বিশ্রাম ছাড়াই তুমি পথ অতিক্রম করেছো- সুলতান আইউবী ফাহদকে উদ্দেশ করে বললেন- বসে পড়ো। সুলতান দারোয়ানকে ডাক দিয়ে বললেন- এর খাবার এখানেই নিয়ে আসো।

সংবাদটা এমন ছিলো যে, বিশ্রামের সুযোগ নেয়া অপরাধ মনে হচ্ছিলো ফাঁদ ক্ষীণকণ্ঠে বললো- আমার ঘোড়াটা বোধ হয় জীবিত নেই।

খবর বলো।

আর্মেনিয়ার সম্রাট তার রাজধানীতে নেই- ফাহদ রিপোর্ট প্রদান করে তিনি হারযামে তাঁবু গেড়েছেন। ইযযুদ্দীন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হারযাম যাচ্ছেন। বুঝাই যাচ্ছে, তারা আমাদের ফৌজের বিরুদ্ধে চুক্তিবদ্ধ হবে। আর্মেনীয় সম্রাটের সঙ্গে তার দুপ্লাটুন সৈন্যও থাকবে। ইযযুদ্দীনও দুতিন প্লাটুন সৈন্য নিয়ে আসছেন।

এই রাজারা রাজকীয় ধারায় একত্রিত হচ্ছে- সুলতান আইউবী মুচকি হেসে বললেন- মসুলে খৃস্টানদের মতিগতি কী?

ক্রুসেডারদেরকে কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা মনে হচ্ছে- ফাহদ উত্তর দেয়— তাদের অস্ত্র ডিপোর ধ্বংসের সংবাদ আপনি শুনেছেন। আমরা ওখানকার লোকদের অন্তর থেকে প্রথম দরবেশের প্রভাব-প্রবঞ্চনা দূর করে দিয়েছি।

আর্মেনীয় সম্রাট ও ইযযুদ্দীনের হারমে সাক্ষাৎ ঘটবে এ সংবাদ তোমরা কোথা থেকে পেয়েছো?- সুলতান আইউবী জিজ্ঞেস করেন আমি কীভাবে বিশ্বাস করবো এ তথ্য সঠিক?

রোজি খাতুনের তথ্য ভুল হতে পারে না। ফাহদ উত্তর দেয়।

আল্লাহ এ মহিয়সী নারীকে হেফাজত করুন। সুলতান আইউবী বললেন। আবেগের আতিশয্যে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে।

রোজি খাতুন আপনাকে সালাম বলেছেন- ফাহ্ বললো- বলেছেন, ইযযুদ্দীনের পা যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আগেই উপড়ে গেছে। ভয় তাকে পেয়ে বসেছে। একটা আঘাত হানতে পারলে তার হাঁটু ভেঙে যাবে।

মসুলে কোনো সামরিক তৎপরতা চোখে পড়ছে কি?- সুলতান আইউবী জিজ্ঞেস করেন- কোনো যুদ্ধ প্রস্তুতি?

খৃস্টান গুপ্তচর ও উপদেষ্টারা তৎপর- ফাহদ উত্তর দেয়- কোনো যুদ্ধ প্রস্তুতি চোখে পড়েনি। ইযযুদ্দীন খৃস্টানদের থেকে যে ধরনের সাহায্য প্রার্থনা করছেন, তাতে আপনি ভালোভাবেই জানেন। নগরীতে আমাদের লোকেরা পূর্ণ সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে এবং রোজি খাতুন ও তাঁর কন্যা শামসুন্নিসার প্রচেষ্টায় দুর্গ ও প্রাসাদের প্রতিটি কোণ ও প্রতিটি গোপন তথ্য আমাদের নজরে থাকছে।

শাবাশ! বন্ধু শাবাশ!- সুলতান আইউবী দাঁড়িয়ে ফায়ূদের গালে হাতের পরশ বুলিয়ে বললেন- তুমি জানো না, তুমি যে সংবাদ নিয়ে এসেছো তা কতো মূল্যবান। আমি আশাবাদী, এখন আর অতো রক্তারক্তি হবে না, যতোটুকু অবরোধ ও আক্রমণে হয়ে থাকে। সুলতান সালারদের উদ্দেশ করে বললেন- এখন আর আমরা তালখালেদ অবরোধ করবো না। ফৌজ ওদিকেই যাবে। গেরিলাদের একটি মাত্র ইউনিট আমার সঙ্গে হারাম অভিমুখে যাবে।

***

হার্যাম একটি মনোরম জায়গা। চারদিকে সবুজের সমারোহ। ঝর্নাধারা ও ঘন গাছ-গাছালিতে পরিপূর্ণ। আছে সবুজে ঢাকা টিলা-পর্বতও। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উপর আরো রং চড়িয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে জায়গাটাকে জান্নাতে পরিণত করে নিয়েছেন আর্মেনিয়ার সম্রাট। ক্যানভাসে শামিয়ানায় তৈরি তাবুটা যেনো এক রাজপ্রাসাদ। ভেতরে রঙিন আলোর ঝাড়-লণ্ঠন। সম্মুখে দণ্ডায়মান ছয়টি ঘোটকযান ও রক্ষী বাহিনী। নাচ গানের বিশেষ আয়োজন করা আছে। আর্মেনিয়ার সবচে রূপসী গায়িকাদের এনে হাজির করা হয়েছে। হেরেমের নির্বাচিত মেয়েদের জন্য আলাদা তাঁবু স্থাপন করা হয়েছে। আর্মেনীয় সম্রাট ক্ষরদীনের আমীরকেও আমন্ত্রণ করেছেন। মারদীন আর্মেনিয়ারই সন্নিকটস্থ একটি অঞ্চল, যার আমীর কুতুবুদ্দীন গাজী। মারদীন তার জমিদারী। শামিয়ানা-ক্যানভাস ও তাঁবু থেকে সামান্য দূরে আর্মেনীয় সম্রাটের দুপ্লাটুন সৈন্য তাঁবু স্থাপন করে অবস্থান নিয়েছে।

আর্মেনীয় সম্রাট মারদীনের আমীরের সঙ্গে দুতিন দিন যাবত শিকার খেলতে থাকেন। তারপর একদিন মসুলের শাসনকর্তা ইযযুদ্দীন এসে পৌঁছেন। তিনিও সঙ্গে করে দুপ্লাটুন নির্বাচিত সৈন্য নিয়ে আসেন। রাতে নাচ-গানের আসর বসে। সোরাহির পর সোরাহি মদ শূন্য হতে থাকে। মদ আর নারী এমনই এক অবস্থার সৃষ্টি করে যে, এই মুসলিম আমীর-উজীর ও সালারগণ প্রথম কেবলার সঙ্গে খানায়ে কাবাকেও ভুলে গেছেন। রাতটা বিলাসিতার মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করে তারা দিনভর গভীর ঘুম ঘুমান। অপরদিকে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী সেখান থেকে দুআড়াই মাইল দূরে এক স্থানে একটি গেরিলা ইউনিটের সঙ্গে পাথুরে মাটির উপর ঘুমিয়ে আছেন। তিনি ছোট্ট একখানা সফরী তবু সঙ্গে রেখেছেন, যাতে স্থাপন করতে ওঁ গুটাতে বেশি সময় না লাগে। এখানে তিনি সুলতান নন গেরিলা সৈনিক হয়ে এসেছেন।

সুলতান আইউবী হারযামের উক্ত রাজকীয় ক্যাম্পটার পরিসংখ্যান নেয়া এবং তথ্য সংগ্রহের জন্য যাযাবরের বেশে গুপ্তচর পাঠিয়ে দিয়েছেন। ফাহদও আছে তাদের মধ্যে। ফায়ূদের পরণে পুরাতন ছেঁড়া কাপড়। তিন চারজন গোয়েন্দা আপন আপন উটের লাগাম ধরে ক্যাম্পের চতুর্পার্শ্বে ঘুরতে থাকে। কেউ তাদেরকে সরে যেতে বললে তারা হাত বাড়িয়ে ভিক্ষা চাচ্ছে। ফাহ্দ রাজকীয় শামিয়ানার নিকট দিয়ে অতিক্রম করলে সেই যুবতী সেবিকাকে দেখতে পায়, যে তাকে রোজি খাতুনের বার্তা পৌঁছিয়েছিলো। ফাঁদ মেয়েটিকে চিনে ফেলে। মেয়েটি ইযুদ্দীনের খাস সেবিকা। এখানে তারই সঙ্গে এসেছে।

ফাহদ ভিখারীর ন্যায় হাঁক দেয়- শাহজাদী! আপনার গোলাম সফরে আছে। কিছু খেতে দিন না।

ভাগো এখান থেকে মেয়েটি দূর থেকে ধমক দেয়- অন্যথায় ধরা খাবে।

 ফাহ্দকে মসুলে কেউ ধরতে পারেনি- ফাহদ আসল কণ্ঠে বললো এখানে তুমি ধরিয়ে দেবে!

উহ!- মেয়েটি এদিক-ওদিক তাকিয়ে লোকটির নিকটে চলে আসে তুমি এসে পড়েছো? দেখলে তো, আমার সংবাদ মিথ্যা ছিলো না। কিন্তু এখানে আর একদণ্ডও দাঁড়িয়ে থেকো না। রাতে কোথায় থাকবে? আজ রাত আশা করি তাড়াতাড়ি অবসর হয়ে যাবো।

তুমিই তো বলেছিলে, কর্তব্যের উপর আবেগকে জয়ী হতে দিও না ফাহদ বললো- আমাদের কর্তব্য এখনো পালিত হয়নি। বেঁচে থাকলে দেখা হবে।

সবকিছু দেখে নিয়েছো?- মেয়েটি জিজ্ঞেস কর- সুলতান কোথায়?

সুলতান শীঘ্রই এসে পড়বেন। ফাঁদ উত্তর দেয়।..

ঐ, লোকটা কে রে?- কারো কণ্ঠ শোনা যায়- হতভাগাকে তাড়িয়ে দাও ওখান থেকে।

মেয়েটি ফাহদকে ধমকাতে শুরু করে। ফাহদ সেখান থেকে চলে যায়। মেয়েটি একটি তাঁবুর আড়ালে আড়ালে ফাঁদের চলে যাওয়া দেখতে থাকে। ভাবে, ফাঁদের দায়িত্ব কতোই না ঝুঁকিপূর্ণ, কতোই না কষ্টকর। মেয়েটির চোখ থেকে অশ্রু বেরিয়ে আসে। এই সুঠাম যুবকটাকে মনে প্রাণে কামনা করে মেয়েটি। কিন্তু যখন তার সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে সাক্ষাৎ করে, তখন আলোচনা আবেগের কম এবং কর্তব্যের বেশি করে থাকে। সুলতান আইউবী যে কটি যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন, সেসব এই ফান্দ আর মেয়েটির ন্যায় গোয়েন্দাদের বদৌলতেই জিতেছেন। এরা শত্রুর ঘরে অবস্থান করে গোপন যুদ্ধ লড়ে থাকে। এদের জীবন প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর মুখে থাকে। এই যুবক ফাহদ আর সেবিকা মেয়েটির মাঝে ভালোবাসা আছে। কর্তব্য যদি প্রতিবন্ধক না হতো, তাহলে মেয়েটি তাকে এভাবে জীবন হাতে নিয়ে ঘুরে-ফিরতে বারণ করে দিতো। মেয়েটি জানে, ফাহদ এই পাথুরে ভূমিতে রাতে কোথায় ঘুমায়।

যাক গে, আমরা আল্লাহর সান্নিধ্যে মিলিত হবো। মেয়েটি মনে মনে বলে নিজ কাজে চলে যায়।

রাতের প্রথম প্রহর। হারযামের শাহী ক্যাম্পে আজ নাচ-গানের কোনো প্রোগ্রাম নেই। সর্বত্র নীরবতা বিরাজ করছে। আর্মেনীয় ম্রাটের শামিয়ানায় তার সঙ্গে ইযযুদ্দীন ও মারদীনের আমীর কুতুবুদ্দীন গাজী উপবিষ্ট। ইযযুদ্দীন বলছেন—

সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, সালাহুদ্দীন তার সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করছে। আমরা যদি তার জোটভুক্ত হয়ে যাই, তাহলে সে আমাদেরকে তার গবর্নর নিযুক্ত করে রাখবে। আমরা স্বাধীন থাকতে পারবো না। ইতোমধ্যে তিনি মুসলিম আমীরদের বেশ কটি দুর্গ দখল করে নিয়েছেন এবং তার সামরিক শক্তিতে ভীত হয়ে সে সকল আমীর ও দুর্গপতি তার আনুগত্য বরণ করে নিয়েছেন। এমতাবস্থায় আমি যদি তাকে প্রতিহত না করি, তাহলে তিনি মসুল দখল করেই ক্ষান্ত হবেন নাহাবের উপরও চড়াও হয়ে বসবেন। কিন্তু আমি একা তো আর তার সঙ্গে লড়াই করতে পারবো না। ইযুদ্দীন আমার সঙ্গে আছেন। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে সালাহুদ্দীন বাহিনী নিয়ে লুটেরার ন্যায় ঘুরে ফিরছে, সেই পরিস্থিতিতে ইমাদুদ্দীনকে তার বাহিনী হাব থেকে বের হতে দেয়া সমীচীন হবে না। হাবের প্রতিরক্ষা অধিক জরুরি। কারণ, অঞ্চলটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আমি জানি- আর্মেনীয় সম্রাট বললেন- খৃস্টানদের দৃষ্টিও হাবের উপর নিবদ্ধ হয়ে আছে।

সে কারণেই আমি খৃস্টানদের সঙ্গে কোনো চুক্তি করছি না- ইযযুদ্দীন বললেন- সাহায্যের বিনিময়ে আমাদের থেকে তারা হাল্ব দাবি করবে।

অবশ্যই করবে- কুতুবুদ্দীন গাজী বললেন- আমি মনে করি আপনাদের আপসে সন্ধি করে নেয়া উচিত। আপনাদের দুজনের বাহিনী একত্রিত হলে সালাহুদ্দীন আইউবীকে পরাজিত করতে পারে।

আমি জানতে পেরেছি, আইউবীর বাহিনী তালখালেদ অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছে। ইযযুদ্দীন বললেন।

আইউবীর সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা নেই- আর্মেনীয় ম্রাট বললেন- আমার বিশ্বাস, তিনি আমার সীমান্তের কাছে ঘেঁষবেন না। আমি তার অগ্রযাত্রা পর্যবেক্ষণ করেছি। তিনি অন্য কোনো দিকে যাচ্ছেন।

আমার ক্রুসেডারদের উপর কোনো আস্থা নেই- ইযযুদ্দীন বললেন তারা আমাকে সব ধরনের সাহায্য প্রদান করছে বটে; কিন্তু যুদ্ধ শুধু সরঞ্জাম আর উপদেষ্টাদের দ্বারা পড়া যায় না। তাদেরকে পরামর্শ দিচ্ছি, আমি আইউবীকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলি আর তোমরা তার উপর আক্রমণ করো। তাদেরকে আমি এই পরামর্শও দিয়েছিলাম যে, তোমরা দামেশক এবং বাগদাদকে অবরোধ করে ফেলে। যদি তারা আমার এই পরামর্শ মোতাবেক কাজ করে, তাহলে সালাহুদ্দীন আমাদের সীমানা ত্যাগ করতে বাধ্য হবে। কিন্তু জানি না তারা কী চিন্তা করছে। 

তারা আমাদের প্রত্যেককে তাদের প্রজা বানানোর চিন্তা করছে আর্মেনীয় সম্রাট বললেন- সালাহুদ্দীন আইউবী না থাকলে ক্রুসেডাররা আমাদেরকে খেয়ে ফেলতো। তাদের উপর আমাদের আস্থা না রাখা উচিত।

তাহলে আপনি আমাকে সাহায্য দিন- ইযযুদ্দীন বললেন- আমি এগিয়ে গিয়ে আইউরীর উপর আক্রমণ করি। আপনিও তার উপর হামলা করুন।

এ বিষয়টির উপর দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মতবিনিময় হয়। শেষে আর্মেনীয় সম্রাট এই শর্তে ইযযুদ্দীনের প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করেন যে, তার বাহিনীর সেনা সদস্য এবং পশুদের খাদ্যের দায়িত্ব ইযযুদ্দীন বহন করবেন। ইযযুদ্দীন শর্তটা মেনে নেন এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তিনি সুলতান আইউবীর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হবেন এবং আর্মেনীয় সম্রাটের বাহিনী সুলতান আইউবীর বাহিনীর উপর পেছন থেকে আক্রমণ করবে। ইনুদ্দীন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন যোদ্ধা। তিনি যুদ্ধ লড়তেও জানেন, লড়াতেও জানেন। তিনি সেখানে বসেই যুদ্ধের পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলেন।

***

এখন রাত দ্বি-প্রহর। ইযযুদ্দীন ও আর্মেনীয় সম্রাট যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রস্তুত করছেন। হঠাৎ কতগুলো ঘোড়ার পদশব্দে রাতটা যেনো কেঁপে ওঠে। আর্মেনীয় ম্রাট দারোয়ানকে ডেকে ক্ষুব্ধকণ্ঠে বললেন- যেসব সৈন্যের ঘোড়া রশি খুলে ছুটে বেড়াচ্ছে, সকালে তাদেরকে এখানে নিয়ে আসবে। গাধাগুলো কেমন অসচেতনের ঘুম ঘুমাচ্ছে।

কিন্তু এই ঘোড়া তার ফৌজের নয়। এরা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর গেরিলা সৈনিক। সংখ্যায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশজনের মধ্যে। এটা তাদের কমান্ডো অপারেশন।

খানিক পরেই বাইরে প্রলয় শুরু হয়ে যায়। আইউবীর গেরিলারা দুভাগে বিভক্ত হয়ে ধেয়ে এসে ক্যাম্প অতিক্রম করে চলে যায়। তাদের হাতে প্রদীপ ছিলো। এই প্রদীপের আগুন দ্বারা ফৌজের তাঁবুগুলো ভষ্ম করে চলে যায়। কয়েকটি তাঁবুতে আগুন ধরে যায়। ঘুমন্ত সৈনিকরা বিড়বিড়িয়ে ওঠে। পরক্ষণেই বাহিনীর আরেকটি ঢেউ ধেয়ে আসে, যারা বর্শা ও তরবারী দ্বারা যাকেই সামনে পাচ্ছে, কেটে কেটে অতিক্রম করে যাচ্ছে। প্রজ্বলমান তাঁবুগুলো আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। এবার শুরু হয় তীরের বর্ষণ। জ্বলন্ত সলিতাওয়ালা তীরও আছে। রশিবাধা উট-ঘোড়াগুলোর মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আহতদের আর্তচিৎকার কেয়ামতের বিভীষিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

এবার পশুগুলোর বাঁধন খুলে যায় এবং উট-ঘোড়াগুলো ছুটে এদিক-ওদিক পালাতে শুরু করে। এই ঘটনাযজ্ঞ ও হাঁক-চিৎকারের মধ্যে ক্যাম্পের আশপাশ থেকে উচ্চকণ্ঠের শব্দ ভেসে আসে অস্ত্র ফেলে দাও। ইযযুদ্দীন! তুমি আমাদের হাতে এসে ধরা দাও। আর্মেনিয়ার সম্রাট! তোমার তালখালেদ আমাদের অবরোধে আছে।

কিন্তু একজনও এসে ধরা দিচ্ছেন না। ইযযুদ্দীন তার এক অনুগত কমান্ডারকে বললেন, আমাকে একটা ঘোড়া দাও। কমান্ডার বড় কষ্টে তাকে একটা ঘোড়া এনে দেয়। তিনি তাতে আরোহণ করে সুযোগ বের করে এই কেয়ামতের মধ্য থেকে বেরিয়ে যান। নিজ বাহিনী, ব্যক্তিগত আমলা-কর্মকর্তা এবং সঙ্গে করে আনা মেয়েদের কী হবে, তার কোনো ভাবনাই ভাবলেন না। আপন জীবনটা রক্ষা করে কোনো মতে পালিয়ে যান।

সেকালের এক ঐতিহাসিক আসাদুল আসাদী লিখেছেন, সুলতান আইউবী ঘেরাও সংকীর্ণ করে সেই শাসকগুলোকে ধরে ফেলতে পারতেন। কিন্তু তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। তার একটি কারণ এই হতে পারে, তিনি সেই শাসকমণ্ডলীকে নিজের জোটভুক্ত করে ফিলিস্তীন জয়ে ব্যবহার করতে চাচ্ছিলেন। তবে কারণ যাই থাকুক, ১১৮৩ সালের এই যুদ্ধটা সুলতান আইউবী তার গেরিলাদের দ্বারা এভাবেই লড়িয়েছেন। তিনি সম্মুখে অগ্রসর হয়ে কাউকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করেননি। এই গেরিলা অভিযানটা সুলতান আইউবী নিজে পরিচালনা করেছেন।

আর্মেনীয় সম্রাট পালানোর পরিবর্তে সেখানেই অবস্থান করা সঙ্গত মনে করলেন। রাত কেটে যায়। ভোর হলে এবার দেখা গেলো আসল চিত্র। ক্যাম্পে ভস্মীভূত তাবুমালার ছাই-ভস্ম ছড়িয়ে রয়েছে। মৃতদেহগুলো এখানে-সেখানে পড়ে আছে। আহতরা ছটফট করছে। উট-ঘোড়াগুলো ওদিক-ওদিক ঘুরে ফিরছে। যারা আক্রমণ করলো, তারা কোথায় গেলো পাত্তা নেই। আর্মেনীয় সম্রাট জানতেন, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী এখানেই কোথাও অবস্থান করে থাকবেন। আইউবীকে কোথায় পাওয়া যাবে ভাবতে শুরু করেন। ইত্যবসরে তিনি দুজন আরোহীকে দেখতে পান। তারা এগিয়ে আর্মেনীয় সম্রাটের সম্মুখে এসে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে সালাম করে। লোক দুজন সুলতান আইউবীর সামরিক কর্মকর্তা।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী আপনাকে সালাম বলেছেন একজন বললো- তিনি বলেছেন, তাঁর কাউকে গ্রেফতার করার ইচ্ছে নেই। ইযযুদ্দীন ফেরত যান এবং মসুল চলে যান এবং ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করুন। আর আর্মেনীয় সম্রাটের জন্য সুলতানের বার্তা হচ্ছে, সুলতানের ফৌজ তালখালেদের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। আপনি সন্ধ্যা নাগাদ সংবাদ পেয়ে যাবেন। আপনার ফিরে পৌঁছার আগে আপনার রাজধানী আমাদের দখলে চলে আসবে। আপনি যদি মিসর-সিরিয়ার সুলতানের শর্তাবলী কবুল করে নেন, তাহলে তালখালেদ থেকে ফৌজ ফিরে আসতে পারে। তবে আপনার যদি মোকাবেলার ইচ্ছা থাকে, তাহলে আপনার জন্য আগে পরিণতি ভেবে দেখার পরামর্শ আছে। আপনি উত্তর দিন। এই মুহূর্তে আপনি আমাদের ঘেরাওয়ের মধ্যে অবস্থান করছেন।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে আমার সালাম বলবে আর্মেনীয় সম্রাট বললেন- আমি বিকাল নাগাদ আমার এক মন্ত্রীকে সুলতানের নিকট প্রেরণ করছি।

উভয় আরোহী ফিরে যায়। আর্মেনীয় সম্রাটের যে মন্ত্রী এ মুহূর্তে তার সঙ্গে আছে, তার নাম বকতিয়োর। সম্রাট তাকে বললেন, আমাদের আইউবীর সঙ্গে শত্রুতায় জড়িয়ে পড়ার প্রয়োজন নেই। ওদিকে তালখালেদ অবরুদ্ধ, এদিকে আমরা। তুমি যাও, সালাহুদ্দীন আইউবীকে বলো, আপনি আপনার ফৌজ প্রত্যাহার করে নিন। আমরা আপনার কোনো শত্রুর সঙ্গে কোনো সন্ধি বা ঐক্য গড়বো না।

বকতিমোর বিচক্ষণ মন্ত্রী। তিনি সুলতান আইউবীর সঙ্গে কথা বলেন। সুলতান কঠিন কঠিন শর্ত আরোপ করেন। বকতিয়োর সকল শর্ত মেনে নেয়। তিনি লিখিত প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন, আর্মেনীয় সম্রাটের বাহিনী সুলতান আইউবীর কোনো শত্রুকে সাহায্য করবে না।

সুলতান আইউবী অবরোধ তুলে নেন এবং আর্মেনীয় সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করেই তালখালেদ অভিমুখে রওনা হয়ে যান।

***

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিয়ারে বকর। সে যুগে জায়গাটার নাম, ছিলো উমাইদা। সামরিক দিক থেকে জায়গাটার অপরিসীম গুরুত্ব ছিলো। তার আশপাশের অঞ্চলে যারা বসবাস করতো, তাদের অনেকেই যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিলো। সুলতান আইউবীর বহু সৈনিক অত্র অঞ্চলের বাসিন্দা। সেনা সংকট দেখা দিলে সুলতান আইউবী এখান থেকে লোক নিয়ে তা পূরণ করতেন। এখানকার সাধারণ মানুষ সুলতান আইউবীর সমর্থক ছিলো বটে; কিন্তু শাসকরা নিজ নিজ ক্ষমতার স্বার্থে আইউবীর বিরোধী ছিলো এবং মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও খৃস্টানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের প্রচেষ্টায় রত ছিলো।

সুলতান আইউবী তাঁর বাহিনীকে দিয়ারে বকর অভিমুখে যাত্রা করার আদেশ দেন। অগ্রযাত্রা ছিলো বিদ্যুগতিসম্পন্ন। সুলতান আইউবী তাঁর সালারদেরকে শুধু এতোটুকু অবহিত করেন যে, দিয়ারে বকর অবরোধ করে জায়গাটা দখল করে নিতে হবে। বিজয় অর্জিত হলে তার আমীরের কোনো শর্ত মান্য করা হবে না এবং তার প্রতি কোনো প্রকার মমতা প্রদর্শন করা হবে না।

আমার অভিমত হচ্ছে ঐ আমীরদের উপর কোনো প্রকার জুলুম না করাই উচিত হবে- এক সালার বললেন- তাদের বাহিনীকে আমাদের বাহিনীতে যুক্ত করে নিয়ে তাদেরকে নামমাত্র আমীর থাকতে দিন।

এখন আর আমি জাতির আস্তিনে কোনো সাপই পুষবো না সুলতান আইউবী বললেন- আমি সংবাদ পেয়েছি, এই লোকটি তার অঞ্চলের লোকদেরকে আমাদের বাহিনীতে যোগ দিতে বাধা সৃষ্টি করছে এবং খেলাফতের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাচ্ছে। একটা কথা সবসময় মনে রাখবে, যে শাসক কেন্দ্র থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন হতে চায়, তারা অবশ্যই বিশ্বাসঘাতকতায় লিপ্ত। তাদের এই গাদ্দারী খুবই ভয়ানক হয়ে থাকে। কেননা, তারা জাতির শত্রু থেকে সাহায্য নিয়ে সেই সাহায়্য জাতিরই বিরুদ্ধে ব্যবহার করে থাকে। আমি এজাতীয় ব্যক্তিদের মস্তক পিষে ফেলতে চাই। যাতে আমার প্রকৃত শত্রু তথা খৃস্টানরা যখন আমার মুখোমুখি লড়াইয়ে লিপ্ত হবে, তখন পেছন থেকে আমার উপর আক্রমণ করার মতো কেউ না থাকে এবং মাটি ফুড়ে বেরিয়ে কোনো সাপ যেনো আমাকে দংশন করতে না পারে। দিয়ারে বকর আল্লাহর সৈনিকদের ভূখণ্ড। আমাদের বাহিনীর এক-চতুর্থাংশ সৈনিক এই ভূখণ্ডের লোক। আমরা যদি আমাদের সেই যোদ্ধাদের বিশ্বাসঘাতক শাসকদের ক্ষমা করি, তাহলে অত্র ভূখণ্ডের সাধারণ লোকদের ঈমানও নষ্ট হয়ে যাবে এবং তাদের যুদ্ধবিদ্যাও হারিয়ে যাবে।

সমগ্র জাতি তথা কোনো দেশের সকল মানুষ গাদ্দার কিংবা বেঈমান হয় না। শাসক যদি ঈমান বিক্রেতা হয়; তাহলে জাতির ঈমানও নষ্ট হয়ে যায়, উন্নততর জাতিও মর্যাদাহীন হয়ে পড়ে। তাদের চেতনা মরে যায়। পরিণতিতে জাতি একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে জীবিত থাকে না। আমাদেরকে এ জাতীয় শাসকদের পর্তন ঘটিয়ে সালতানাতে ইসলামিয়ার জন্য একটি কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। আপনারা দেখেছেন, বাগদাদের খেলাফত পঙ্গু হয়ে গেছে। খেলাফতের আদেশ-নিষেধ পালিত হলে আমাদেরকে এসব সেনা অভিযান পরিচালনা করে ফিরতে হতো না। দেশের অস্থিতিশীলতা দূর করা এবং ঈমান নিলামকারী শাসকদের নির্মূল করা সেনাবাহিনীর কর্তব্য। আমি পুনর্ব্যক্ত করতে বাধ্য যে, ইতিহাস বলবে, হিজরী ষষ্ঠ শতকের বাহিনী অকর্মণ্য ছিলো। তারা না তাদের খেলাফতের মর্যাদা অটুট রেখেছে, না শত্রুকে দমন করেছে।

***

দিয়ারে বকর অবরোধের কাজটা এত দ্রুত সম্পন্ন হয় যে, ভেতরের লোকেরা মোকাবেলা করার সুযোগই পায়নি। সুলতান আইউবী ঘোষণা করেছেন, চেষ্টা করবে সাধারণ নাগরিকদের ক্ষয়ক্ষতি যতো কম হয়। ভেতরে আইউবীর গোয়েন্দা ছিলো। তাছাড়া সুলতান নিজেও নগরীর শাসকদের মহল ও হেডকোয়ার্টার সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। কাজেই মিনজানিকের সাহায্যে যেসব তরল দাহ্য পদার্থের পাতিল নিক্ষেপ করা হলো, সবই সরকারি : ভবনগুল্মের উপরই নিক্ষিপ্ত হয়েছে। বাইরে থেকে ঘোষণা করা হয়েছে- দিয়ারে বকরের আমীর! অস্ত্র ত্যাগ করে বেরিয়ে আসো। কিন্তু দুর্গোর পাচিলের উপর দাঁড়িয়ে আমীর পাল্টা ঘোষণা দেন, অস্ত্র ত্যাগ করা হবে না। পারো যদি যুদ্ধ করে শহর দখল করে নাও।

দিয়ারে বকরের বাহিনী দৃঢ়পদে মোকাবেলা করে। সুলতান আইউবী অবরোধের অভিজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু প্রতিরোধ দেখে তিনি বুঝে ফেললেন, এই অবরোধ দীর্ঘ হবে এবং এর জন্য অপেক্ষাকৃত বেশিই কুরবানী দিতে হবে।

পাঁচিল ভাঙার দায়িত্বে নিয়োজিত সৈন্যরা রাতের অন্ধকারে পাঁচিলের নিকট পৌঁছে যায়। কিন্তু উপর থেকে তাদের উপর আগুন ও ভারি পাথর নিক্ষেপ করা হয়। প্রধান ফটকের উপর মিনজানিকের সাহায্যে দাহ্য পদার্থ ভর্তি পাতিল নিক্ষেপ করে সলিতাওয়ালী তীর ছোঁড়া হয়। তাতে ফটকের কাঠের অংশটা পুড়ে যায় বটে; কিন্তু লোহার অংশ অটুট থাকে, যার মধ্যদিয়ে অতিক্রম করা সম্ভব নয়। তথাপি ফটক অতিক্রম করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। আকাশে তীর উড়ছে।

সুলতান আইউবী বিস্মিত যে, ভেতরের লোকেরা এতো কঠোর মোকাবেলা কেন করছে! রহস্যটা পরে উনোচিত হয় যে, অবরোধের সংবাদ প্রকাশ পাওয়ামাত্র শহরে ঘোষণা করে দেয়া হয়, ক্রুসেডাররা শহর অবরোধ করেছে। এই ঘোষণায় নগরবাসী জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। তারা ফৌজের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেখা গেছে, চারদিকে ফৌজের সঙ্গে সাধারণ মানুষও যুদ্ধ করছে। কিন্তু সুলতান আইউবী তারপরও নির্দেশ দেননি, নগরীর উপরও গোলা নিক্ষেপ করো।

অবরোধ আট দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। বেশি ক্ষতি আইউবীর বাহিনীর হচ্ছিলো। কেননা, তাঁর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সেনাদল একের পর এক সম্মুখে এগিয়ে যাচ্ছিলো আর তীরের নিশানায় পরিণত হচ্ছিলো। কিন্তু পরে বিস্ময়কর ঘটনা এই ঘটে যে, হঠাৎ একদিন নগরীর পাঁচিলে ধ্বনিত হয়ে ওঠে। এরা ক্রুসেডার নয়- ইনি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী! তার পতাকা দেখো। মুসলমানগণ! তোমরা আপসে লড়াই করছে। পরক্ষণে সুলতান আইউবীর বাহিনীতে দিয়ারে বকরের যেসব সৈন্য ও কমান্ডার ছিলো, তারা উচ্চকণ্ঠে হাঁক দিতে শুরু করে। আমরা তোমাদেরই সৈন্য- তোমাদেরই ভাই। দুর্গের ফটক খুলে দাও।

নগরীর ভেতরে সুলতান আইউবীর যে চর ও আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মী ছিলো, অবস্থা বেগতিক দেখে তারাই ছুটে গিয়ে জনতার কানে দিয়েছে, অবরোধকারীরা খৃস্টান বাহিনী নয়- মুসলমান এবং ইনি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। কাজটা সহজ ছিলো না। একজন শত্রুর গোয়েন্দা জনগণকে স্বাধীনতা ও সরকারী ঘোষণার পরিপন্থী কথা বলতে পারে না। এই অভিযানে দুচারজন গোয়েন্দা ধরাও পড়েছে। তারা সাফল্য অর্জন করে ফেলেছে। অবরোধের ৯ দিনের মাথায় ফৌজ ও সাধারণ নাগরিকদের চিন্তা-চেতনা বদলে যায়। জনগণ প্রশাসনের বাধা ও হুমকি উপেক্ষা করে নগরীর ফটক খুলে দেয়। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী নগরীতে প্রবেশ করলে জনগণ তাকবীর ধ্বনি তুলে তাঁকে স্বাগত জানায়। নারীরা বাড়ির ছাদ ও বারান্দা থেকে মাথার ওড়না ছুঁড়ে ফেলে সুলতানকে স্বাগত জানায়।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী দিয়ারে বকরের আমীরকে নগরী ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। তিনি নুরুদ্দীন ইবনে কারা আরসালানকে নগরীর আমীর নিযুক্ত করেন। সুলতান আইউবী তাকে জরুরি নির্দেশনা প্রদান করে উক্ত অঞ্চল থেকে আরো সৈন্য সংগ্রহের নির্দেশ প্রদান করেন।

১১৮৩ সালের মে মাসে সুলতান আইউবী দিয়ারে বকরের ক্ষমতা দখল করে হাল্ব অভিমুখে রওনা হন। হাবের শাসনকর্তা ইমাদুদ্দীন এবং মসুলের শাসনকর্তা ইযযুদ্দীন তাঁর সবচে বড় মুসলিম দুশমন। তাই হালব-মসুল এখন তার টার্গেট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *