৭.৬ হেজাজের কাফেলা

হেজাজের কাফেলা

হাসান আল-ইদরীস, সারা এবং সারার পিতা সুলতান আইউবীর নিকট পৌঁছে গেছে। সুলতান তাঁর অভ্যাস মতো তাঁবুতে পায়চারি করছেন। সারার পিতা আইউবীকে বল্ডউইনের সঙ্গে তাদের চুক্তি ও পরিকল্পনার বিবরণ প্রদান করে। সুলতান আইউবী তৎক্ষণাৎ তার সালারদের তলব করেন। মানচিত্রটা সামনে মেলে নিয়ে তাদেরকে খৃষ্টানদের পরিকল্পনা বুঝাতে শুরু করেন এবং তার বিপরীতে নিজের পরিকল্পনা ঠিক করে নেন।

হালব ও মসুলের শাসনকর্তা ইযযুদ্দীন ও ইমাদুদ্দীন খৃস্টানদের সঙ্গে যোগসাজশ করেছে এই সংবাদে সুলতান আইউবী বিচলিত বা বিস্মিত হননি। খৃস্টানদের সঙ্গে তলে তলে খাতির পাতানো সে কালের ছোট বড় মুসলিম আমীরদের রেওয়াজে পরিণত হয়েছিলো। তার একমাত্র কারণ ছিলো সুলতান আইউবী তাদের সকলকে এক খেলাফতের অধীনে এনে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত করতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু এই আমীরগণ আপন আপন রাজ্য বহাল রেখে তার শাসক হয়ে থাকাকে জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে নিয়েছিলেন। তাদের বিশ্বাস ছিলো, এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে খৃস্টানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাততে হবে।

তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাসক ছিলেন ইযযুদ্দীন ও ইমামুদ্দীন। ভৌগোলিক অবস্থান, বিস্তৃতি এবং নিরাপত্তার দিক থেকে এদের রাজ্য মসুল ও হাল্ব ছিলো বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। খৃষ্টানদের সর্বাত্মক চেষ্টা ছিলো, কীভাবে মুসলমানদের এই অঞ্চল দুটি দখল করা যায় কিংবা সুলতান আইউবীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখা যায়। সুলতান আইউবী যদি এই অঞ্চল দুটি দখল করে নিতে পারেন, তাহলে সৈন্য ও রসদ ইত্যাদির জন্য তা এমন দুটি আস্তানা হয়ে যায়, যেখান থেকে তিনি অতি সহজে বায়তুল মুকাদ্দাসের উপর সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে পারবেন।

কাবার প্রভুর কসম! আমি হাল্ব ও মসুল দখল করতে চাই না সুলতান আইউবী বার কয়েক বললেন- আমি কোন মুসলিম প্রজাতন্ত্রের উপর দিয়ে বাহিনী অতিক্রম করাতেও পছন্দ করি না। আমার একটাই কামনা, এই আমীর ও শাসকগণ খৃস্টানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাক। তারা সকলে বাগদাদের খেলাফতের অফাদার হয়ে যাক, যা কিনা কুরআনেরই নির্দেশ। আমি তাদেরকে আমার পদানত করে রাখবো না। আমি খলীফা নই- খলীফার একজন অনুসারী এবং সেবক মাত্র।

তাদের ভয় হলো, খেলাফতের অধীনে চলে এলে তাদের বিলাসিতা এবং এখন খৃস্টানদের পক্ষ থেকে নারী ও মদের যে উপহার-উপঢৌকন পেয়ে আসছে বন্ধ হয়ে যাবে। তারা ক্ষমতা আর জগতের মিথ্যা আড়ম্বর ও ভোগ-বিলাসিতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের দৃষ্টিতে সালতানাতে ইসলামিয়ার কোন মর্যাদা নেই।

১১৮৩ সালের শুরুর দিক। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী নাসীবার সেনা ছাউনিতে অবস্থান করছেন। এখান থেকে তার বাইতুল মুকাদ্দাস অভিমুখে অগ্রযাত্রা করার কথা। কিন্তু তিনি মুসলিম আমীর-শাসকদের নিয়তে গড়বড় লক্ষ্য করছেন। তিনি জানবার চেষ্টা করছেন, হাল্ব ও মসুলের দুই গবর্নরের গোপন তৎপরতাটা কী এবং খৃস্টানরা কী পরিকল্পনা প্রস্তুত করছে।

গোয়েন্দা হাসান আল-ইদরীস বৈরুত থেকে এসে তাকে পূর্ণ তথ্য প্রদান করেছে। সুলতান আইউবী এখন ইযযুদ্দীন-ইমাদুদ্দীনের অবস্থান এবং খৃস্টানদের পরিকল্পনা সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিফহাল। হাসান আরো একটি কীর্তির স্বাক্ষর রেখেছে যে, সে ইযযুহীনের এক সামরিক উপদেষ্টা এবং তার এক কন্যাকে- যে কিনা এক সময় বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে খৃস্টানদের ওখানে নর্তকীর কাজ করছিলো- সঙ্গে নিয়ে এসেছে। হাসান আল-ইদরীস সুলতান আইউবীর নিকট এসে জানালো, ইযুদ্দীন বৈরুতে খৃস্টানদের নিকট সাহায্যের জন্য দুজন দূত প্রেরণ করেছেন। এই তথ্যে সুলতান বিস্মিত হননি। তবে এই তথ্যটা ছিলো তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই তৎক্ষণাৎ সালারদের ডেকে পাঠান এবং মানচিত্রটা সামনে নিয়ে তাদেরকে পৃস্টানদের পরিকল্পনাটা বুঝিয়ে দেন।

ইযুদ্দীনের যে দূত বৈরুতে খৃস্টানদের থেকে সাহায্য নিতে গিয়েছিলো, তার নাম এহতেশামুদ্দীন। সুলতান আইউবীর নিকট অর মর্যাদা একজন বন্দির সমান হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু সুলতান তাকে সম্মানের সাথে তার সালারদের সঙ্গে বসালেন। এহতেশামুদ্দীনকে প্রায় সকল সালারই চিনতেন। কেউ তার প্রতি তাচ্ছিল্যের চোখে তাকাচ্ছেন। আবার কারো চেহারায় আনন্দের দ্যোতি যে, এহতেশামুদ্দীন তাদের মাঝে উপবিষ্ট এবং তাদের কয়েদী হয়েছে। সুলতান আইউবী হাসান আল-ইদরীসের রিপোর্ট শুনেছেন।

আমি আশা করি আমাদের বন্ধু এহতেশামুদ্দীন নিজেই আপনাদেরকে বলবে, ইযযুদ্দীন ও ইমাদুদ্দীনের নিয়ত কী- সুলতান আইউবী বললেন- আমি এহতেশামুদ্দীনের উপর এই অভিযোগ আরোপ করবো না যে, সে আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য খৃস্টানদের সাহায্য নিতে গিয়েছিলো। তাকে মসুলের গবর্নর ইযযুদ্দীন প্রেরণ করেছিলো। এতো ইযযুদ্দীনের কর্মচারি।

সুলতানে মুহতারাম!- এক সালার বললেন- আমি আশা করি, আপনি আমাকে বলতে নিষেধ করবেন না, এহতেশামুদ্দীন তার সরকারের সাধারণ কোন কর্মচারী নয়। লোকটা ইযযুদ্দীনের সামরিক উপদেষ্টা। একজন সেনা অধিনায়ক। গবর্নরকে খৃস্টানদের থেকে সাহায্য নেয়ার পরামর্শ তার না দেয়া উচিত ছিলো।

আমাকে আদেশ করা হয়েছিলো- এহতেশামুদ্দীন উত্তর দেয় আমি যদি আদেশ অমান্য করতাম, তাহলে…।

তাহলে আপনাকে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়া হতো- এক নায়েব সালার বললেন- আপনি মৃত্যুর ভয়ে আপনার রাজার এমন একটি আদেশ মান্য করেছেন, যা কিনা নিজ জাতি ও আপন ধর্মের অপদন্তের কারণ। আমরা কি বাড়ি-ঘর, পরিবার-পরিজন থেকে দূরে এবং স্ত্রী সন্তানদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থেকে ইসলাম ও দেশ-জাতির জন্য কাজ করছি না? দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত আমরা এই পাহাড়ে-পর্বতে ঘুরে ফিরছি এবং এই পাথুরে জমিনের উপর শুয়ে রাত কাটাচ্ছি। অথচ আপনার কিনা হালবের প্রাসাদে রাজা-রাজপুত্রদের ন্যায় জীবন-যাপন করছেন। আপনি মদপান করছেন, ইহুদী-খৃস্টান ও মুসলমান রূপসী নর্তকীরা আপনাদের মনোরঞ্জন করছে। আপনারা পালঙ্কের উপর নরম গালিচায় ঘুমাচ্ছেন। আর আমরা কিনা এই বন-বাদাড়ে, পাহাড়-জঙ্গল মরু বিয়াবানে মরতে বসে আছি। আমাদের সহকর্মীদের লাশ কোথায় কোথায় হারিয়ে গেছে আমরা জানি না। আমাদের সৈনিকদের হাড় কঙ্কাল সমগ্র অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। কোন শহীদের হাড় চোখে পড়লে আপনি বলবেন, এটা মানুষের নয়- পশুর হাড়। ভোগ-বিলাসিতা আপনাদের হৃদয়ে শহীদদের প্রতি কোন শ্রদ্ধা থাকতে দেয়নি। আপনারা শত্রু-বন্ধুকে এক করে ফেলেছেন। আমরা যখন মরতে এসেছি তো আপনাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার নেই।

আহরাম!- সুলতান আইউবী বললেন- এহতেশামুদ্দীন আমার নিকট এসে জীবনের সব পাপের কাফফারা আদায় করে দিয়েছে। তাকে তিরষ্কার করতে হলে আমিও করতে পারতাম।

মহান সুলতান! অপর এক সালার বললেন।

আল্লাহর ওয়াস্তে তোমরা আমাকে শুধু সুলতান নামে ডাকো- সুলতান আইউবী বললেন- আমাকে শান-শওকত থেকে দূরে থাকতে দাও। আমাকে রাজা বানাবার চেষ্টা করো না। আমি একজন সৈনিক। তোমরা আমাকে সৈনিকই থাকতে দাও। আচ্ছা বলো, কী যেনো বলতে চেয়েছিলে?

আমি উপস্থিত সকলকে, বিশেষভাবে এহতেশামুদ্দীনকে বলতে চাই, সালার তার শাসনকর্তার এতোটুকু গোলাম হয়ে যায় যে, তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য তার ভুল নির্দেশও মান্য করে, সেই সালার আপন জাতির মর্যাদার ঘাতকে পরিণত হয়। জাতির মর্যাদার মোহাফেজ আমরা। সালতানাতের মালিক রাজা কিংবা সুলতান নয়- দেশের জনগণ। বর্তমানে আমরা যে কাল অতিক্রম করছি, এটা সৈনিকের যুগ। এটা জিহাদের যুগ। খলীফা এবং সুলতান যদি নৈতিকতার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা না করেন, তাহলে আল্লাহর সৈনিকগণ তাদেরকে এমন শত্রু মনে করবে, যেনো তারা ইহুদী-খৃস্টান। আর যখন এহতেশামুদ্দীনের ন্যায় আল্লাহর সৈনিকদের উপরও সুলতান হওয়ার নেশা চেপে বসবে, তখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুর লাশের উপর গীর্জার ঘণ্টা বাজতে শুরু করবে।

ইসলামের প্রতিটি যুগই সৈনিকের যুগ- সুলতান আইউবী বললেন- যতোদিন পর্যন্ত ইসলাম জীবিত আছে, কাফেররা ইসলামের শই থাকবে। আজ আমাদের সালারদের অন্তরে সম্মান-সুখ্যাতির যে বাসনা জন্মলাভ করেছে, তা কোন একদিন ইসলামকে নিয়ে ডুবে মরবে। আমি দেখতে পাচ্ছি, ইসলাম বেঁচে থাকবে তবে সেই সিংহের ন্যায়, যে ভুলে গেছে সে বনের রাজা। এরূপ সিংহ ভেড়া-বকরিকেও ভয় করে থাকে। মুসলমান কাফেরদের আঙ্গুলের ইশারায় নাচবে। পৃথিবীতে আল্লাহর সৈনিক থাকবে; কিন্তু তার হাতে তরবারী থাকবে না। থাকেও যদি তা হবে কোন খৃস্টানের উপহার, যার কোষ থেকে বের হতে হলে খৃস্টানদের অনুমতির প্রয়োজন হবে।

সুলতান বলতে বলতে থেমে যান। তিনি চোখ ঘুরিয়ে সকলকে এক নজর দেখে নেন এবং বললেন- আমিও আলাপচারিতায় জড়িয়ে পড়েছি। আমার বন্ধুগণ! আমাদেরকে কাজ করতে হবে। আমরা যদি এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়ি যে, এই পাপ কার, এই ভুল কার এবং কে সত্য, কে মিথ্যা- তাহলে আমরা কথাই বলতে থাকবো। কথা শেষ হবে না। এখন হাল্ব ও মসুলের গবর্নরদ্বয় খৃস্টানদের সঙ্গে কী চুক্তি সম্পাদন করেছে এবং আমাদেরকে কোন্ জাতীয় শত্রুর সঙ্গে কী রকম যুদ্ধ করতে হবে, এহতেশামুদ্দীন তার বিবরণ প্রদান করবে।

***

এহতেশামুদ্দীন উঠে সকলের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ায়। সকলের প্রতি একবার দৃষ্টি বুলিয়ে বলতে শুরু করে

আমার বন্ধুগণ! আমি তোমাদের দৃষ্টিতে তাচ্ছিল্য ও রোষ দেখতে পাচ্ছি। আমি যে অপরাধ করেছি, তার জন্য তোমরা আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারো। কিন্তু আমি তোমাদের জন্য একটা শিক্ষার উপকরণ। আমি একটা নমুনা। কথা ঠিক যে, আমি মসুলের শাসনকর্তা ইযযুদ্দীনের সন্তুষ্টির জন্য নিজের ঈমান ক্রয় করেছি, তার দূত হয়ে বৈরুত গিয়েছি এবং খৃস্টানদের নিকট সাহয্য কামনা করেছি। তবে এ কথাও ঠিক, যে যাদু আমার বিবেক ও ঈমানকে কজা করে নিয়েছে, তোমরাও তার থেকে রক্ষা পাবে না। তোমাদের কোন প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং সেনা অধিনায়ক কি বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে ধরা পড়েনি? তাদের অনেকে তো এমন ছিলো, যাদের উপর সুলতান আইউবীর এতোটুকু আস্থা ছিলো, যতোটুকু আস্থা আছে তার নিজের উপর। কিন্তু তারা ঈমান নিলামকারী প্রমাণিত হয়েছে। আমি তোমাদেরকে বলতে চাই, মানবীয় স্বভাবে এমন একটি দুর্বলতা আছে, যেটি মানুষকে বিলাসিতার পথে ঠেলে দেয়। আর যেখানে দিন-রাত সারাক্ষণ ক্ষমতা আর সমাজে অপরাধ বিস্তারের উৎসাহ দানকারী আলোচনা চলে, সেখানে একজন অতি বুযুর্গও বিলাসপ্রিয় এবং পাপাচারী হয়ে ওঠেন। তখন যে কেউ আমীর এবং সুলতান হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তোমরা যদি আমাকে অপরাধী মনে করো, তাহলে আমার মাথাটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দাও। তবে যদি আমাকে তওবা করার সুযোগ দান করো, তাহলে ইসলামের মর্যাদার সুরক্ষা এবং সালতানাতে ইসলামিয়ার সম্প্রসারণে আমি তোমাদের অনেক সহযোগিতা করতে পারি।

খৃস্টানরা সম্ভবত তোমাদের মুখোমুখি যুদ্ধ করার ঝুঁকি নেবে না এহতেশামুদ্দীন বললো- তারা আমাদেরকে আমাদেরই তরবারী দ্বারা হত্যা করার আয়োজন সম্পন্ন করেছে। আমাদেরকে নিঃশেষ করতে তাদের একজন সৈন্যকেও প্রাণ দিতে হবে না। তারা মুসলমানকে মুসলমানের বিরুদ্ধে লড়াবার জন্য একদলকে সাহায্য দিচ্ছে। এই ছোট-বড় মুসলিম এমারত ও প্রজাতন্ত্র- যেগুলো মূলত বাগদাদের খেলাফতের প্রদেশ- সকলে তলে তলে খৃস্টানদের গোলাম হয়ে গেছে, যাতে তারা স্বাধীন থাকতে পারে। কেন্দ্র থেকে সটকে স্বাধীন তখনই–কা যায়, যখন শত্রুর সাহায্য মিলে। তাদের নীতি হলো, শত্রুর নিকট থেকে সাহায্য নাও আর নিজের ভাইকে শত্রু বলো। গৃহযুদ্ধে যে কোন এক পক্ষ সঠিক ও দেশপ্রেমিক হয়ে থাকে। অপূরপক্ষ হয় শত্রুর বন্ধু। শত্রু তাদেরকে নিষ্ঠার সাথে সহযোগিতা দেয় না। তারা নিজেদের স্বার্থে ও নিজেদের মতলবে একদল মুসলমানকে সাহায্য দিয়ে থাকে। খৃস্টানরা তোমাদের প্রতিপক্ষকে সাহায্য দিচ্ছে। তারা মসুলে তাদের গেরিলা বাহিনীর আস্তানা গড়তে যাচ্ছে। বহুদিন পর্যন্ত তারা গেরিলা ও কমান্ডো যুদ্ধ লড়বে। এভাবে পর্যায়ক্রমে হাবকে এবং অন্য সকল মুসলিম প্রজাতন্ত্রকে আস্তানা বানিয়ে সেগুলোকে তোমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। মসুল থাকাকালে আমি জানতে পেরেছি, খৃস্টানরা মসুলের সামান্য দূরে পাহাড়ী এলাকায় বিপুল অস্ত্র ও সরঞ্জাম লুকিয়ে রাখবে। তাতে অনেক দাহ্য পদার্থ থাকবে! সেগুলোকে তারা গেরিলা অপারেশনে ব্যবহার করবে এবং পরে প্রকাশ্য যুদ্ধেও। তারা অনেকগুলো মুসলিম প্রজাতন্ত্রে নিজেদের শক্ত ঘাঁটি স্থাপনের পর প্রকাশ্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। সেই অস্ত্র ও দাহ্য পদার্থগুলো ঠিক কোন্ স্থানে রাখা হবে, তা অবশ্য আমি জানতে পারিনি। এ তথ্য সংগ্রহ করা আপনাদের গোয়েন্দাদের কাজ।

বৈঠক শেষ হলো। সুলতান আইউবী গোয়েন্দা উপ-প্রধান হাসান ইবনে আবদুল্লাহ এবং গেরিলা বাহিনীর অধিনায়ক সারেম মিসরী ছাড়া অন্যদের বিদায় করে দেন।

আমার অনুমান সঠিক প্রমাণিত হয়েছে- সুলতান আইউবী তাদেরকে বললেন- আমার জানা ছিলো, খৃস্টানরা মসুল ও হালবে গোপনে তাদের ঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা করবে এবং আমাদের ভাইয়েরা তাদের পূর্ণ সহযোগিতা দেবে। তোমরা এহতেশামুদ্দীনের জবানবন্দি শুনেছো যে, বল্ডউইন ও অন্যান্য খৃস্টানরা অদূরে কোথাও যুদ্ধ সরঞ্জাম ও দাহ্য পদার্থ ইত্যাদির সমাবেশ ঘটাচ্ছে। তোমরা জানো, আমাদের যেমন রসদ প্রয়োজন, তেমনি তাদেরও আবশ্যক। দুপক্ষের যাদের রসদ নিঃশেষ কিংবা ধ্বংস হয়ে যাবে, তারা অর্ধেক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে যাবে। আমাদের কতিপয় সৈন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে মসুল ও হালবের মাঝে বসে আছে। আমি তাদেরকে ইযযুদ্দীন ও ইমাদুদ্দীনের পারস্পরিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার জন্য বসিয়েছি। এখন বৈরুতের সঙ্গেও এই দুই অঞ্চলের পথ বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। এই অভিযান খানিকটা কঠিন ও বিপজ্জনক হবে। কেননা, গেরিলাদেরকে তাদের অবস্থান থেকে বেশ দূরে চলে যেতে হবে।

আমি চিন্তা করে দেখবো, অভিযানটা কঠিন না সহজ- সারেম মিসরী বললেন- তাছাড়া কঠিনকে সহজ করা আমার কর্তব্যও তো বটে। আপনি আদেশ করুন।

কোন কাফেলা চোখে পড়লে গতিরোধ করবে- সুলতান আইউবী বললেন- তল্লাশি নেবে। সংঘাত হলে রীতিমতো যুদ্ধ করবে। বেশি বেশি কয়েদী বানাবার চেষ্টা করবে।

আর হাসান!- সুলতান হাসান ইবনে আবদুল্লাহকে উদ্দেশ করে বললেন- তুমি আমাকে একটা কাজ করে দেখাও। তথ্য নাও, খৃস্টানরা দাহ্য পদার্থ এবং অস্ত্রের ডিপো কোথায় সমবেত করছে। হতে পারে কাজটা তারা করেও ফেলেছে। তুমি স্থানটা চিহ্নিত করো, সেগুলো ধ্বংস করার ব্যবস্থা আমি করবো।

সেই ব্যবস্থাও আমিই করবো ইনশাআল্লাহ। সারেম মিসরী বললেন। একটা বিষয় মাথায় রাখবে, কিছুদিন পর্যন্ত আমাদের যুদ্ধ কানামাছি খেলার ন্যায় হবে- সুলতান আইউবী বললেন- খৃস্টানরা মুখোমুখি যুদ্ধ করার পরিবর্তে গেরিলা ও নাশকতামূলক যুদ্ধ লড়বে। তারা সম্ভবত তাদের উপর আক্রমণ করার জন্য আমাকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করবে। কিন্তু আমি সেই বোকামী করবো না। তারা আমার জন্য কয়েকটি স্থানে ওঁৎ পাতবে। আমি সর্বাগ্রে সেই আমীরদেরকে সঙ্গে জুড়ে নেবো, যারা খৃস্টানদের বন্ধুতে পরিণত হতে যাচ্ছে। তাদের কাছে আমি সাহায্য ভিক্ষা চাইবো না। এখন আমি তরবারীর আগা দ্বারা তাদের থেকে সাহায্য নেবো। তাদের যে কারো রক্ত ঝরাতে আমি কুণ্ঠিত হবো না। এরা নামের মুসলমান। যে মুসলমান কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে, সেও কাফের হয়ে যায়। এখন আর আমি এই পরোয়া করি না, ইতিহাস আমাকে কী বলবে। আজ যদি কেউ বলে, অনাগত বংশধর আপনাকে ভাইয়ের ঘাতক বলবে কিংবা গৃহযুদ্ধের অপরাধে অপরাধী বলবে, তবু আমি আমার প্রত্যয় থেকে ফিরে আসবো না। আমি ইতিহাস ও অনাগত বংশধরদের নিকট নয়- আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করবো। আল্লাহ ছাড়া নিয়তের খবর আর কেউ জানে না। আমার পুত্রও যদি আমার ও ফিলিস্তীনের মাঝে প্রতিবন্ধক হয়, তবে আমি তাকেও খুন করে ফেলবো। আজ যদি আমরা প্রথম কেবলাকে খৃস্টানদের হাত থেকে মুক্ত না করি, অহলে কাল তারা কাবা গৃহকেও দখল করে নেবে। আমাদের আমীর ও শাসকদের গতিবিধি প্রমাণ করছে, তারা রাজা হবে এবং তাদের সন্তানরাও রাজা হবে। এই লোকগুলো ফিলিস্তীনকে ইহুদীদের দখলে নিয়ে দেবে। এখন তরবারী ছাড়া আমার কাছে আর কোন প্রতিকার নেই।

আমরা আপনার আদেশের অপেক্ষায় অপেক্ষমান- সারেম মিসরী বললেন- আপনি যদি আমাকে মতামত প্রদানের অনুমতি দেন, তাহলে আমি বলবো, যারা কেন্দ্র থেকে স্বায়ত্তশাসন কিংবা আধা-স্বায়ত্তশাসনের আবেদন করছে, তাদেরকে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি দেয়া উচিত।

আমি তাদেরকে শাস্তি দেবো। সুলতান বললেন।

 সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী সারেম মিসরী ও হাসান ইবনে আবদুল্লাহকে যুদ্ধ বিষয়ে দিক-নির্দেশনা প্রদান করে বিদায় করে দেন।

হাসান ইবনে আবদুল্লাহ ও সারেম মিসরী বিদায় গ্রহণ করেন। সুলতান আইউবী অপর একটি বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। তিনি যখন বৈরুত থেকে অবরোধ প্রত্যাহার করে নাসীবায় ছাউনি স্থাপন করেছিলেন, তার কিছুদিন আগে লোহিত সাগরের পূর্বাঞ্চল সম্পর্কে রিপোর্ট পেয়েছিলেন, খৃস্টান সৈন্যরা উক্ত অঞ্চলে কাফেলা লুণ্ঠন করে ফিরছে। তারা শুধু মুসলমান কাফেলাগুলো লুট করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, ধন-সম্পদ ছাড়া উট-ঘোড়াও নিয়ে যাচ্ছে এবং স্বল্পবয়সী ও যুবতী মেয়েদেরকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। মিসরের হজ্ব কাফেলাগুলো যাওয়ার সময় এই লুটতরাজের প্রবণতা বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এই দস্যুদের প্রতিহত করতে হলে রীতিমতো সামরিক অভিযান প্রয়োজন। কিন্তু অতো সৈন্য তো সুলতান আইউবীর নেই। তাছাড়া তার এসব নিয়ে ভাববারই বা সময় কোথায়। তার মাথায় তো চেপে বসে আছে ফিলিস্তীন আর সেইসব মুসলিম আমীর, যারা তলে তলে খৃস্টানদের সঙ্গে আপোস ও সাহায্যের চুক্তি করে বসে আছে।

আপনারা পড়ে এসেছেন, বৈরুত অবরোধে সুলতান আইউবী নৌ বহরও ব্যবহার করেছিলেন, যার সেনাপতি ছিলেন হুসামুদ্দীন লুলু। অবরোধ শুরুতেই ব্যর্থ হয়ে গেলে সুলতান হুসামুদ্দীনকে বার্তা প্রেরণ করেন যেনো বহরটা ইস্কান্দারিয়া নিয়ে যান। তার পরপরই কায়রো থেকে সংবাদ আসে, খৃস্টানরা কাফেলা লুণ্ঠন করাকে রীতিমতো পেশা বানিয়ে নিয়েছে এবং এখন একটি কাফেলাও গন্তব্যে পৌঁছতে পারছে না। সুলতান আইউবী কায়রোকে কোন জবাব দেয়ার পরিবর্তে নৌ-বাহিনী প্রধান হুসামুদ্দীনকে আদেশ প্রেরণ করেন, যেন তিনি তার বহরের যে অংশটি লোহিত সাগরে অবস্থান করছে, তার নেতৃত্ব হাতে তুলে নেন।

সুলতান আইউবীর আদেশ ছিলো এরকম- লোহিত সাগরে দুশমনের নৌ-বহরের সঙ্গে তোমার মোকাবেলা হবে না। তুমি বরং স্থলে ওঁৎ পেতে সেই দস্যুদের পাকড়াও করে ফেলবে, যারা মুসলমানদের কাফেলাগুলো লুণ্ঠন করছে। আমি জানতে পেরেছি, এই দস্যুরা খৃস্টান সৈন্য, যারা সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে এবং উপরের আদেশে এই লুটতরাজ চালাচ্ছে। এরা নদীর কূলে কূলে থাকে। তুমি বাছাই করে একদল সৈন্য নিয়ে যাও এবং নদীতে টহল দিতে থাকো। যেখানেই ডাকাতরা আছে বলে সন্দেহ হবে, সেখানেই সৈন্যদেরকে নৌকায় করে নামিয়ে ডাঙ্গায় পাঠিয়ে দেবে এবং ডাকাতদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করবে। আমার পরবর্তী আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত তুমি ওখানে থাকবে।

আদেশ পাওয়ামাত্র হুসামুদ্দীন চলে যান। সে যুগে রোম উপসাগর ও এর মাঝে সংযোগের জন্য সুইজ খাল ছিলো না। আপনি মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে এবং তার উপর সুইজ উপসাগর দেখতে পাবেন। এই নদীটির পশ্চিম তীরে মিসর এবং পূর্ব তীরে সৌদি আরবের অবস্থান। উত্তরে সিনাই মরু এবং দক্ষিণে লোহিত সাগরের অবস্থান। মিসরের অনেক হজ্ব কাফেলা উট-ঘোড়াসহ নৌকায় করে এই সুইজ উপসাগর অতিক্রম করে থাকে। তবে অধিকাংশ কাফেলাই স্থল পথেই গমনাগমন করে থাকে এবং লোহিত সাগরের কূল ঘেঁসে সফর করে। কেননা, গরমের দিনে সমুদ্রতীর ঠাণ্ডা থাকে।

হুসামুদ্দীন সেখানে পৌঁছেই স্থলে হানা দিতে শুরু করেন এবং কয়েকজন ডাতাতকে ধরে হত্যা করে ফেলেন। কিন্তু তাদের একজনও খৃস্টান সৈন্য নয়।

***

একদিন হুসামুদ্দীন সংবাদ পান, মিসর থেকে বিশাল একটি কাফেলা রওনা হয়েছে। এতোক্ষণে কাফেলাটির আরব সাহারায় এসে পৌঁছানোর কথা। হুসামুদ্দীন যাযাবরের বেশে জনাচারেক সৈন্যকে সংবাদ সংগ্রহের জন্য পাঠিয়ে দেন। কিন্তু তারা কোথাও কোন কাফেলার সন্ধান পেলো না।

এটি একটি হতভাগ্য কাফেলা। তারা নীর কূল থেকে অনেক দূর দিয়ে পথ চলছিলো। একদিন কাফেলা এক স্থানে যাত্রাবিরতি দেয়। কাফেলায় হজ্বযাত্রীও ছিলো, ব্যবসায়ীও ছিলো। অনেকে গোটা পরিবার নিয়ে যাচ্ছিলো। সদস্যদের মধ্যে শিশু, বৃদ্ধ, কিশোর এবং যুবতী মেয়েও ছিলো। উট-ঘোড়ার সংখ্যা ছিলো অনেক। লোকসংখ্যা কমপক্ষে ছয়শত। সবাই খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়ে।

কাফেলা রাতের শেষ প্রহরে জাগ্রত হয়। এখনো অন্ধকার। একজন আযান দেয়। সকলে তায়াম্মুম করে জামাতের সঙ্গে নামায আদায় করে এবং রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করে। হঠাৎ একদিক থেকে উচ্চকণ্ঠে হুঙ্কার ভেসে আসে- সামান বেঁধে না। সকলে একধার হয়ে দাঁড়িয়ে যাও। কেউ মোকাবেলা করার চেষ্টা করলে মেরে ফেলবো।

কাফেলার মধ্যে এক ভীতিকর গুঞ্জরণ শুরু হয়ে যায়- ডাকাত! ডাকাত!

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। কাফেলার লোকেরা দেখলো, মরু পোশাক পরিহিত শত শত মানুষ তাদের ঘিরে চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকে ঘোড়ায় সওয়ার। কারো হাতে বর্শা। কারো হাতে তলোয়ার। কাফেলার লোকদের সংখ্যা অনেক। ফলে অবস্থানের জায়গাটাও বেশ বিস্তৃত। ডাকাতরা ঘেরাও সংকীর্ণ করতে শুরু করে। কাফেলার সদস্যরা মুসলমান। মোকাবেলা ছাড়া অস্ত্র ফেলে দেয়া তাদের রীতি নয়। তারা জানে, এ ধরনের কাফেলার উপর আক্রমণ হয়ে থাকে। সে কারণে তারা সকলে সশস্ত্র এবং যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত।

নারী ও শিশুদেরকে মধ্যখানে এক স্থানে একত্রিত করে ফেলো এক ব্যক্তি অনুচ্চস্বরে বললো। এক কান দুকান করে এই নির্দেশনা সব কানে পৌঁছে গেলো।

মহিলা ও শিশুরা অবস্থান স্থলের মধ্যখানে যেতে শুরু করে। কাফেলার ভেতর থেকে তরবারী বেরিয়ে আসে। কিছু বর্শাও দেখা যাচ্ছে। ডাকাতরা চতুর্দিক থেকে একযোগে কাফেলার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরক্ষণেই ঘোড়ার ছুটাছুটি, হাঁক-ডাক ও তরবারীর সংঘাতের শব্দ শোনা যেতে শুরু করে। নারী ও শিশুদের আর্ত-চীঙ্কার ভেসে ওঠে হট্টগুলোর মধ্যে মিশে যাচ্ছে। দস্যুরা অধিকাংশ অশ্বারোহী। সকলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ সৈনিক। কাফেলা মোকাবেলায় তাদের সঙ্গে পেরে ওঠছে না। তৰু তারা দৃঢ়পদে লড়ে যাচ্ছে এবং মুহুর্মুহু তাকবীর ধ্বনি দিয়ে চলছে। একটি শব্দ বারংবার শোনা যাচ্ছে মেয়েদেরকে মধ্যখানে রাখো। মেয়েদেরকে আলাদা হতে দিও না।

একটি মেয়ে উচ্চস্বরে হাঁক দেয়- তোমরা আমাদের চিন্তা করো না, আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি।

কাফেলার লোকেরা যদি ঘোড়ায় আরোহণ করার সুযোগ পেতো, তাহলে তারা ভালোভাবে লড়াই করতে পারতো। কিন্তু তাদের ঘোড়াগুলোয় তখনো যিন বাঁধা হয়নি। ফলে তারা দস্যুদের ঘোড়ার নীচে পিষে যেতে থাকে। সংঘর্ষে কাফেলার লোকদেরই বেশি ক্ষতি হচ্ছে। তাছাড়া নারী-শিশুদেরকে আগলে রাখতে হচ্ছে বলে তারা প্রয়োজন অনুসারে ঘুরে-ফিরে মোকাবেলা করতে পারছে না।

কাফেলায় সাত-আটটি যুবতী মেয়ে ছিলো। তন্মধ্যে আলেকজান্দ্রিয়ার অধিবাসী এক নর্তকীও ছিলো। তার নাম রাদী। পেশার প্রতি বিরক্ত ও বিতৃষ্ণ হয়ে আত্মার শান্তি লাভের জন্য মেয়েটি হজ্বে যাচ্ছিলো। সঙ্গে তার প্রেমিক। এই লোকটিকেই আশ্রয় করে মেয়েটি তার মনিবদের থেকে পালিয়ে এসেছে। এখনো তারা বিয়ে করেনি। কথা ছিলো পবিত্র মক্কায় গিয়ে বিয়ে সম্পন্ন করে হজ্ব পালন করবে।

রাদী অনেকক্ষণ পর্যন্ত প্রেমিক সহযাত্রীর সঙ্গে অবস্থান করে। লোকটার সঙ্গে তরবারী নেই। আছে একটা খঞ্জর। রাদীকে সঙ্গে রেখে তার মাথা ও মুখমণ্ডলটা এমনভাবে ঢেকে রাখে, যেনো কেউ বুঝতে না পারে এটি মেয়ে। সে পদাতিক দস্যুকে পেছন থেকে খঞ্জর দ্বারা আঘাত হানে। আঘাত এতো তীব্র হয় যে, সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রটা বের করে আনা সম্ভব হলো না। দস্যু মোড় ঘুরিয়ে লোকটির পাজরে বর্শার ন্যায় তরবারীর আঘাত হানে। তারপর দুজনই লুটিয়ে পড়ে যায়। দস্যু ও রাদীর সহযাত্রী প্রেমিক মারা যায়।

দস্যুর পিঠে তীরভর্তি তূনীর বাধা ছিলো এবং কাঁধে ধনুক ঝুলছিলো। রাদী হুনীর ও ধনুকটা খুলে নেয়। এরা তিনজন অবস্থান স্থলের একধারে ছিলো। নিকটেই কিছু সরঞ্জাম পড়ে ছিলো। তন্মধ্যে তবুও ছিলো। রাদী মালামাল ও তাঁবুর স্তূপের আড়ালে লুকিয়ে যায়। তার সমুখ দিয়ে খৃস্টান দস্যুদের ঘোড়াগুলো ছুটে অতিক্রম করছে। রাদীর ধনুক থেকে এক একটি তীর বেরিয়ে যাচ্ছে আর অশ্বারোহী দস্যুরা উপুড় হয়ে পড়ে যাচ্ছে। এভাবে মেয়েটি কয়েকজন অশ্বারোহী দস্যকে ফেলে দেয় এবং তার তীর খেয়ে অনেকগুলো ঘোড়া নিয়ন্ত্রণহীন ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকে।

রাদীকে এতোক্ষণ কেউ দেখতে পায়নি। এবার সে এক আরোহীর গায়ে তীর ছুঁড়লে তীরটা ঘোড়ার ঘাড়ে গিয়ে বিদ্ধ হয়। ঘোড়াটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মোড় ঘুরিয়ে চক্কর খেয়ে খেয়ে রাদী যে মালপত্র ও তাঁবুর আড়ালে লুকিয়ে ছিলো, সেগুলোর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়। পিঠের আরোহী ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে। স্কুপের ভেতর থেকে একটা চীৎকার ভেসে আসে। ঘোড়াটা রাদীর ঠিক উপরে পড়েছে। তবে পশুটা এখনো মরেনি। তার ঘাড়ে তীর বিদ্ধ হয়ে আছে। পরপরই উঠে দাঁড়িয়ে ঘোড়াটা এলোপাতাড়ি ছুটতে শুরু করে। আরোহী উঠে দাঁড়াবার পর আঁৰু ও মালপত্রের স্কুপের মধ্যে একটা মাথা দেখতে পায় নারীর মাথা। আরোহী তাঁবু সরিয়ে দেখে অতিশয় এক রূপসী লুকিয়ে আছে। মেয়েটা উঠে দাঁড়াতে পারছে না। তবে সংজ্ঞাহীনও নয়। খৃস্টান দস্যু তাকে তুলে দাঁড় করালে সে কোঁকাতে শুরু করে।

***

দুদিন পর। হুসামুদ্দীন এক নৌ-জাহাজে কেবিনে বসে আছেন। দরজায় করাঘাত পড়ে। স্থল বাহিনীর এক ইউনিট কমান্ডার দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। তার সঙ্গে অপর এক ব্যক্তি, যার চেহারা ফ্যাকাশে এবং লাশের ন্যায় সাদা।

খৃস্টান দস্যুরা বিশাল এক কাফেলা লুট করে ফেলেছে- কমান্ডার হুসামুদ্দীনকে বললো- এই লোকটি তাদের বন্দিদশা থেকে পালিয়ে এসেছে। বিস্তারিত এর নিকট শুনুন।

কাফেলার উপর কিভাবে আক্রমণ হলো, ক্ষয়ক্ষতি কী হলো, এখন কী অবস্থা লোকটি হুসামুদ্দীনকে বিস্তারিত শুনিয়ে বললো- আমরা অনেক মোকাবেলা করেছি। কিন্তু আমাদের ঘোড়াগুলো তখনো যিনছাড়া বাঁধা ছিলো। অন্যথায় আমরা তাদেরকে সফল হতে দিতাম না। কাফেলার অল্প কজন মানুষ জীবিত আছে। তারা সকলে দস্যুদের হাতে বন্দী। আমার মনে হচ্ছে, এতোক্ষণে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। আমিও তাদের হাতে বন্দি ছিলাম। আমরা না হয় পুরুষ। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের পাঁচটি যুবতী মেয়ে এবং দশ বারোটি কিশোরী তাদের আয়ত্তে রয়েছে। কাফেলায় বহু মূল্যবান মালামাল ছিলো। সকলের কাছে নগদ অর্থ ছিলো। নব্বইটি ঘোড়া এবং প্রায় দেড়শত উট ছিলো।

এখন তারা কোথায়? হুসামুদ্দীন জিজ্ঞেস করেন।

সেখানে ভয়ানক খাড়া খাড়া টিলা আছে- লোকটি উত্তর দেয় টিলাগুলোর মধ্যে দস্যুরা কক্ষের ন্যায় গুহা তৈরি করে রেখেছে। তাদের কাছে পানির সম্ভার আছে। মনে হচ্ছে, সেটা তাদের স্থায়ী ঘাঁটি। বিজন-বিরান হওয়া সত্ত্বেও জায়গাটা বিরান মনে হচ্ছে না।

আগন্তুক যে জায়গাটার কথা বললো, সেটির অবস্থান সমুদ্র থেকে বিশ মাইল দূরে। সে বললো- কয়েকজন দস্যুও আমাদের তরবারী বর্শার আঘাতে মারা গেছে। কিন্তু বেশি ক্ষয়ক্ষতি আমাদের হয়েছে। আমরা যে কজন জীবিত ছিলাম, তাদেরকে তারা ওখানে নিয়ে গেছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের সমস্ত উট-ঘোড়া ও সমুদয় মালপত্র তুলে তাদের ঘাটিতে নিয়ে যায়। তারা রাতে মদপান করে এবং আমাদের সমস্ত মালপত্র খুলে খুলে দেখতে শুরু করে। তাদের একজন নেতাও আছে। মেয়েগুলোকে তার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। আমি মেয়েগুলোকে পরে আর দেখিনি। তারা আমাদের দ্বারা মালামাল বহন করিয়ে প্রশস্ত একটি গুহায় রাখা ছিলো। অনেকগুলো প্রদীপ জ্বলছিলো। আমার অধিকাংশ সঙ্গী আহত ছিলো। আমি তাদের বলে রেখেছিলাম, আমি পালাবার চেষ্টা করছি। তাদেরই একজন আমাকে বললো, নিরাপদে বেরিয়ে যেতে পারলে সমুদ্র পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করবে। সেখানে আমাদের বাহিনীর টহল নৌকা পেয়ে যাবে। তাতে আমাদের সৈন্য থাকবে। আমাদের ঘটনাটা তাদেরকে অবহিত করে ব্যবস্থা নিতে বলবে। আমার মনে পড়ে যায়, আমরা যখন মিসরের সীমান্ত অতিক্রম করছিলাম, তখন সেখানে আমাদের বাহিনীর সঙ্গে দেখা হয়েছিলো। তারা আমাদেরকে বলেছিলো, পথে কোন সমস্যায় পড়লে নদীর তীরে চলে যাবে। সেখানে আমাদের বাহিনী আছে। তারা তোমাদের সাহায্য করবে। যা হোক, দস্যুরা মদ মাতাল হয়ে উঠতে শুরু করলো। আমরা মালপত্র সরিয়ে গুহায় রাখছিলাম। আমি অন্ধকারে পালাবার সুযোগ পেয়ে গেলাম। কিন্তু টিলা এলাকাটায় পথ পাচ্ছিলাম না। দুবার ঘুরে ফিরে যেখান থেকে পলায়ন করলাম, সেখানেই পৌঁছে গেলাম। আমি আল্লাহকে স্মরণ করলাম। কুরআন তেলাওয়াত করতে শুরু করলাম এবং মধ্য রাতের অনেক পর টিলাময় অঞ্চল থেকে বেরিয়ে এলাম। নদীটী কোন দিকে আন্দাজ করতে পারলাম না। আমি এলোপাতাড়ি হাঁটতে শুরু করলাম। ভোর নাগাদ এতোটুকু দূরে চলে এলাম যে, এখন আর দস্যুরা আমাকে খুঁজে পাবে না। সারাটা দিন আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকি। সঙ্গে পানির ছোট্ট একটি মশক ছিলো। অল্প কটা খেজুরও ছিলো। আল্লাহর ইচ্ছায় এই পানি আর খেজুর আমাকে বাঁচিয়ে রাখলো। দুপুর পর্যন্ত পা টেনে টেনে হাঁটলাম। ক্লান্তিতে শরীরটা অবশ হয়ে আসে। এখন আর পা চলছে না। আমি একটি বালির ঢিপির পাদদেশে পড়ে গেলাম। আমার ঘুম এসে গেলো। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর আমার চোখ খুলে। আকাশে তারকা উজ্জ্বল হলে দিক নির্ণয় করতে সক্ষম হলাম। আমি হাঁটতে শুরু করলাম। দীর্ঘক্ষণ পর আমি সমুদ্রের ঘ্রাণ অনুভব করতে শুরু করলাম। আমি বাতাসের বিপরীত পথে এগুতে শুরু করলাম এবং সম্ভবত রাতের শেষ প্রহরে নদীর তীরে এসে পৌঁছি। এবার গন্তব্যে এসে পৌঁছেছি ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বিশ্রামের জন্য অবসন্ন দেহটা মাটিতে এলিয়ে দেই। আমার দুচোখের পাতা বুজে আসে। যে লোকটি আমাকে জাগিয়ে তুললো, তাকে সৈনিক বলে মনে হলো। আমি কূলে একটি নৌকা বাঁধা দেখলাম। তার মধ্যে সৈন্য দেখলাম। তারা সকলে আমার নিকট চলে আসে। আমি তাদের ঘটনাটা শোনালাম। তারা আমাকে নৌকায় তুলে নিয়ে আহার করায় এবং এখানে নিয়ে এসে এই কমান্ডারের হাতে তুলে দেয়। কমান্ডার আমাকে আপনার কাছে নিয়ে আসে।

পথ দেখানোর জন্য তোমাকে আমাদের সঙ্গে যাওয়া প্রয়োজন হুসামুদ্দীন বললেন- কিন্তু এই শরীরে যাবে কী করে? চেহারাটা তোমার লাশের ন্যায় সাদা হয়ে গেছে। তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন।

আমি এক্ষুনি আপনার সঙ্গে যেতে প্রস্তুত- লোকটি বললো- আমি বিশ্রাম করতে পারি না। এই সফরে যদি ক্লান্তিতে আমাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়, তো আমি প্রস্তুত আছি। ডাকাতদের কবলে আমাদের মেয়েদের না জানি কী পরিণতি ঘটেছে। এই নিষ্পাপ মেয়েগুলাকে হায়েনাদের কবল থেকে উদ্ধার করা আমার ঈমানী কর্তব্য। এই কর্তব্য পালনে আমি জীবন বিলিয়ে দিতে চাই।

দস্যুদের সংখ্যা কত? হুসামুদ্দীন জিজ্ঞেস করেন।

পাঁচশরও বেশি হবে। লোকটি উত্তর দেয়।

পাঁচশত লোক যথেষ্ট হবে?- হুসামুদ্দীন স্থল বাহিনীর কমান্ডারকে জিজ্ঞেস করেন- আমারও সঙ্গে থাকা প্রয়োজন।

হবে- কমান্ডার উত্তর দেয়- তন্মধ্যে অন্তত একশত অশ্বারোহী এবং অবশিষ্ট পদাতিক হবে। আমাদেরকে কমান্ডো অভিযান চালাতে হবে। সে জন্য গন্তব্যে পৌঁছা পর্যন্ত নীরবতা বজায় রাখতে হবে। ঘোড়া যতো বেশি হবে, শোরগোলের আশঙ্কা ততো বেশি হবে। আমি এর থেকে জায়গাটার অবস্থান ভালোভাবে বুঝে নিয়ে এখনই রওনা হয়ে যাবো। এমনিতেই এর এসে পৌঁছুতে বিলম্ব হয়ে গেছে। আমাদের যতো দ্রুত সম্ভব পৌঁছে যাওয়া দরকার। আমি দিকটা অনুমান করে নিয়েছি। আশা করি সন্ধ্যায় রওনা হলে মধ্যরাত নাগাদ পৌঁছে যেতে পারবো।

ছোট মিনজানিক সঙ্গে নেবে- হুসামুদ্দীন বললেন- তরল দাহ্য পদার্থের পাতিল এবং সলিতাওয়ালা তীরও রাখবে। আর একে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিশ্রাম করতে দাও। সকলকে বলে দেবে, মোকাবেলা দস্যুর সঙ্গে নয়- অভিজ্ঞ খৃস্টান সৈন্যদের সঙ্গে হবে।

স্থল বাহিনীর কমান্ডার লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে চলে যায়।

***

দস্যুদের ঘাঁটিটা দুর্গের মতো শক্ত ও দুর্ভেদ্য। টিলাগুলো আঁকাবাঁকা এমন দুর্গম পথ তৈরি করে রেখেছে যে, চির চেনা না হলে ঢুকলে আর বের হওয়া সম্ভব নয়। মধ্যখানে বিস্তৃত একটা মাঠ। মাঠের চতুর্পাশ্বের টিলাগুলোর ভেতরে খৃস্টানরা অসংখ্য উঁচু ও লম্বা-চওড়া কক্ষ তৈরি করে রেখেছে। উট-ঘোড়ার থাকার জায়গা আলাদা। হুসামুদ্দীনের স্থল বাহিনীর নির্বাচিত ইউনিটটি পুরোপুরি নীরবতা বজায় রেখে মধ্যরাতের আগেই উক্ত অঞ্চলের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। খৃস্টানরা ধরা পড়ার কিংবা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বোধ হয় কখনো অনুভব করেনি। অন্যথায় এদিক-ওদিক প্রহরার ব্যবস্থা করে রাখতে।

হুসামুদ্দীন ঘোড়াগুলোকে পেছনে রাখেন, যাতে তাদের তুষারব দুমশনের কানে না পৌঁছে। বাহিনীর কমান্ডার চারজন সৈনিক নিয়ে একটি গলির মধ্যে ঢুকে পড়ে। এদিক-ওদিক মোড় ঘুরিয়ে অনেক ভেতরে চলে যায়। এবার ঘোড়র ক্ষীণ শব্দ তার কানে আসতে শুরু করে। কমান্ডার একটা উঁচু টিলার উপর উঠে যায়। কমান্ডো আক্রমণ এবং লুকিয়ে লুকিয়ে টার্গেটে পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার ওস্তাদ কমান্ডার। টিলার উপরটা চওড়া। কমান্ডার সেখান থেকে নেমে আরেকটি টিলার উপর চড়ে। মানুষের হাঙ্গামার মতো শব্দ শুনতে পায়। সে সেখান থেকেও নেমে পড়ে। এবার অপর এক গলিতে ঢুকে হাঁটতে শুরু করে। হঠাৎ নিকট থেকে কারো কথা বলার শব্দ শুনতে পায়। কমান্ডার তার সৈনিকদের ইশারা করে। সকলে অস্ত্র তাক করে টিলার সঙ্গে গা ঘেঁষে এগুতে থাকে। সামনে মোড়।

দুজন লোক কথা বলতে বলতে মোড়ে এসে পৌঁছে। কণ্ঠে বুঝা যাচ্ছে, লোকগুলো মদ খেয়ে এসেছে। সৈনিকদের অতিক্রম করে পা চারেক অগ্রসর হওয়া মাত্র পেছন থেকে সৈনিকরা তরবারীগুলো তাদের পার্শ্বে ঠেকিয়ে ধরে। কমান্ডার বললো- শব্দ করবে তো মেরে ফেলবো।

সেখান থেকে তাদেরকে দূরে এক স্থানে নিয়ে যাওয়া হলো। তারা জীবন বাঁচাতে তাদের ঘাটির কথা বলে দেয় এবং সেখানে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেয়। মুসলিম কমান্ডার তাদের একজনকে সঙ্গে করে উপরে নিয়ে যায়। সেখান থেকে দস্যুদের আস্তানা দেখা যায়। উপর থেকে দেখে কমান্ডার অবাক হয়ে যায়। এই জাহান্নামসম অঞ্চলটাকে খৃস্টানরা জান্নাতের দৃশ্য বানিয়ে রেখেছে। যেখানে পথিকরা পিপাসায় জীবন হারায়, সেখানে এরা মদপান করছে। মদ খেয়ে অনেকে এদিক-ওদিক বেহুশ পড়ে আছে। লোকগুলো প্রশস্ত মাঠটায় দলে দলে বিভক্ত হয়ে নানা কাজে ব্যস্ত। কোন দল মদপান করছে। কোন দল গল্প-গুজবে মেতে আছে। কোন দল বসে বসে গান গাইছে। এক স্থানে একটি মেয়ে নাচছে। তার চার পাশে অসংখ্য দর্শকের ভিড়। স্থানে স্থানে প্রদীপ জ্বলছে।

যখন বড় কোন কাফেলা লুট করা হয়, এরূপ উৎসব তখনই পালন করা হয়। তিন-চার রাত চলে। খৃস্টান বন্দি বললো।

কতজন আছে?

প্রায় ছয়শত- বন্দি জবাব দেয়- কমান্ডার একজন নাইট। এ সময়ে তার মেয়েদের নিয়ে পড়ে থাকার কথা।

কমান্ডার টিলার চূড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাঠের পরিসংখ্যানটা নিয়ে নেয়। প্রদীপের আলোতে যা কিছু দেখা যাচ্ছিলো, দেখে নেয়। যা কিছু দেখা যাচ্ছে না, বন্দি তার তথ্য দেয়। লোকগুলোকে হঠাৎ ঘিরে ফেলে কীভাবে কাবু করে ফেলা যায়, কমান্ডার সেই পরিকল্পনাই ঠিক করছে। পরে কয়েদীটাকে সঙ্গে নিয়ে নীচে নেমে আসে। অপর কয়েদীও সঙ্গীদের নিয়ে হুসামুদ্দীনের নিকট চলে যায় এবং অভিযান কিরূপ হতে পারে ধারণা দেয়।

***

মাঠে প্রদীপের আলোতে গল্প-গুজবকারী খৃস্টান দস্যুদের সংখ্যা কমে গেছে। অনেকেই যার যার অবস্থানে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। জেগে আছে অল্প কজন। হুসামুদ্দীন বলে দেন যতো বেশিসংখ্যাক সম্ভব দস্যুকে ধরে নিয়ে আসবে। কমান্ডার তাতে আপত্তি উত্থাপন করে বললো আমি এদের থেকে প্রতিশোধ নিতে চাই। হত্যা করে করে আমি এদের মৃতদেহগুলো শৃগাল-শকুন ও মরু শিয়ালের আহারের জন্য এখানে ফেলে রাখতে চাই। আপনি তাদেরকে জীবিত গ্রেফতার করে তাদের সম্রাটদের সঙ্গে কোন সওদা করতে চাচ্ছেন কি?

না- হুসামুদ্দীন বললেন- আমারও প্রতিশোধ নেয়ার ইচ্ছা আছে। আমাদের সেই মুসলমান কয়েদীদের রক্তের বদলা নিতে হবে, যাদেরকে খৃস্টানদের এক যুদ্ধবাজ সম্রাট অনাথ আক্রা নিয়ে হত্যা করেছিলো। যুদ্ধবন্দীদের হত্যা করা আইনত অবৈধ। কিন্তু অনাথ প্রথমে আমাদের সকল বন্দিকে উপোস রাখে, তাদের দ্বারা কঠিন কঠিন কাজ করায়। তারপর এক সারিতে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। ঘটনাটা সাত বছর আগের। আমি জীবনেও এই স্মৃতি ভুলতে পারবো না। আজ প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ পেয়ে গেছি। আমি এ কথা শুনতে প্রস্তুত নই যে, খৃস্টান দস্যুরা আমাদের সঙ্গে মোকাবেলা করতে এসে মারা গেছে। তাদেরকে জীবিত ধরে নিয়ে আসো। তবে আমি তাদেরকে জীবিত রাখবো না। খৃস্টানরা আমাদের বন্দিদেরকে যেভাবে হত্যা করেছিলো, আমি তাদেরকে ঠিক সেভাবেই হত্যা করবো।

হুসামুদ্দীনের সৈন্যরা তিনটি পথে এগিয়ে গিয়ে মাঠে ঢুকে পড়ে। তারা মাঠের স্থানে স্থানে প্রজ্বলমান প্রদীপ থেকে নিজেদের বাতিগুলো জ্বালিয়ে নেয়। যে কজন জাগ্রত ছিলো, তারা নেশার ঘোরে গালাগাল করতে শুরু করে। তারা যুদ্ধ করার পজিশনে নেই। আক্রমণকারী সৈন্যরা তাদেরকে জীবিত বন্দি করার পরিবর্তে তরবারীর আঘাতে হত্যা করতে শুরু করে। হট্টগোল শুনে ঘুমন্তরা জেগে ওঠে। কী ঘটছে বুঝে ওঠার আগেই অধিকাংশ বর্শাবিদ্ধ হয়ে যায়। তারা অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার সুযোগ পেলো না। গুহাসম কক্ষগুলো থেকে কয়েকজন বর্শা ও তরবারী নিয়ে বেরিয়ে আসে। তাদের কতিপয় মারা পড়ে এবং বাকিরা অস্ত্র ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। তাদের নাইট এমনভাবে অচেতন পড়ে আছে যে, তার পরিধানে পোশাক নেই। সে গালাগাল করতে শুরু করে। মুসলিম সৈন্যদেরকে সে নিজের সৈন্য মনে করেছে। তার কক্ষ থেকে তিনটি মুসলিম মেয়ে বেরিয়ে আসে।

অন্যান্য কক্ষগুলো থেকেও আরো কয়েকটি মেয়ে বের হয়। তারা সকলে মুসলমান। অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। তারা মুসলিম সৈন্যদেরকে সম্ভবত দস্যুদের অন্য কোন দল মনে করেছে। সে কারণে তারা ভয়ে জড়সড় হয়ে গেছে। কিন্তু পরে যখন বুঝতে পারলো, এরা মুসলিম সৈনিক, তখন তারা পাগলের ন্যায় আচরণ করতে শুরু করে। তারা কাঁদছে এবং দাঁত কড়মড় করে খৃস্টান দস্যুদের গালাগাল করছে। কেউ কেউ মুসলিম সৈন্যদেরকে কাপুরুষ বলে ভর্ৎসনা করছে যে, তোমরা যদি বীর মুসলমান হয়ে থাকে, তাহলে এদেরকে হত্যা করছো না কেন? তোমাদের কি বোন-কন্যা নেই? আমাদের সম্ভ্রম কি তোমাদের বোন কন্যাদের ন্যায় মূল্যবান নয়?

হুসামুদ্দীন ও স্থল বাহিনীর কমান্ডার কক্ষে কক্ষে তল্লাশি নিতে শুরু করেন। এখন বাইরে কোন যুদ্ধ নেই। দস্যুদেরকে আলাদা এক জায়গায় বসিয়ে রাখা হয়েছে। সশস্ত্র সৈন্যরা তাদের ঘিরে রেখেছে।

***

সকালে যখন খৃস্টানদের নেশার ঘোর কাটে, তখন তারা সমুদ্রের কূলে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উপবিষ্ট। হুসামুদ্দীন মেয়েগুলোকে জাহাজে তুলে রাখেন। বন্দিদের সংখ্যা কমপক্ষে পাঁচশত। অন্যরা মারা গেছে। তারা টিলার অভ্যন্তরে যেসব মালামাল ও নগদ অর্থ জমা করে রেখেছিলো, সেগুলো খৃস্টান বন্দীদের দ্বারা বহন করিয়ে সমুদ্রকূলে নিয়ে আসে। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কমান্ডার থেকে যেসব তথ্য বেরিয়ে আসে, তাতে জানা গেলো, এটি বিখ্যাত খৃস্টান সম্রাট রেনাল্ড ডি শাইতুনের বাহিনী। মুসলিম কাফেলাগুলো লুণ্ঠন করার জন্য এদেরকে এখানে নিয়োজিত রাখা হয়েছে। কিছুদিন পর সেনা বদল হয়। নতুন একদল আসে তো আগের দল চলে যায়। লুণ্ঠিত অর্থ-সম্পদের একটা অংশ সৈন্যদেরকে দেয়া হয়। অবশিষ্টগুলো সম্রাটের নিকট পাঠিয়ে দেয়া হয়। উট-ঘোড়াগুলো সব রাষ্ট্রীয় মালিকানায় চলে যায়।

মেয়েদের ব্যাপারে নির্দেশ ছিলো, অল্পবয়স্ক অসাধারণ রূপসী মেয়েদেরকে খৃস্টানদের হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিতে হবে। সেখানে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যৌবনপ্রাপ্ত হওয়ার পর গুপ্তচরবৃত্তি এবং নাশকতার জন্য মুসলমানদের অঞ্চলে প্রেরণ করা হতো। কোন যুবতী মেয়ে যদি অতিশয় সুন্দরী হতো, তাহলে তাকেও হেডকোয়ার্টারের হাতে তুলে দেয়া হতো। অন্যান্য মেয়েদেরকে এই খৃস্টান সৈন্যরা নিজেদের কাছে রেখে দিতো।

এই কাফেলায়ও কিশোরী মেয়ে ছিলো নিশ্চয়ই। কটা ছিলো? হুসামুদ্দীন জিজ্ঞেস করেন।

বারো-চৌদ্দটা- খৃস্টান কমান্ডার বললো- মাত্র একটাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

আর অন্যরা?

 সব কটা খুন হয়েছে।

কাফেলার যে কজন পুরুষকে নিয়ে এসেছিলো তাদেরকে মালপত্র বহন করার জন্য আনা হয়েছিলো। পরে তাদেরকেও হত্যা করা হয়েছে।

খৃস্টান কমান্ডার যুবতী মেয়েদের সম্পর্কে জানায় তাদের মধ্যে একজন নর্তকী ছিলো। অতিশয় রূপসী মেয়ে। তার দেহ-রূপ ও নাচ ঠিক সেই মানের ছিলো, যার জন্য আমরা মেয়ে সংগ্রহ করে থাকি। মেয়েটাকে সেদিন সন্ধ্যায়ই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তৎক্ষণাৎ পাঠিয়ে দেয়ার কারণ হচ্ছে, এমন মূল্যবান ও আকর্ষণীয় একটি মেয়ের সৈনিকদের মাঝে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ। যে কোন সৈনিক তাকে মুক্ত করার টোপ দিয়ে ভাগিয়ে নিতে পারতো।

মুসলমানদের হজ্বযাত্রী কাফেলাকে তারা হত্যশ করে ফেলেছে হুসামুদ্দীন কমান্ডারকে বললেন- কাফেলা হেজাজ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলো না। সেই হতভাগাদের পরিবর্তে আমি তাদের ঘাতকদেরকে হেজাজ প্রেরণ করবো এবং সেখানেই তাদেরকে হত্যা করাবো।

দস্যুরা কাফেলাটা যেখানে লুণ্ঠন ও গণহত্যা করেছিলো, হুসামুদ্দীন বন্দিদেরকে সেখানে নিয়ে যান। ঘটনাস্থলে শিয়াল, নেকড়ে ও শকুনের খাওয়া লাশগুলো ছড়িয়ে আছে। হুসামুদ্দীন বন্দিদের দ্বারা কবর খনন করান। জানাযা পড়িয়ে সবকটি লাশ দাফন করে ফেলেন। তিনি কায়রোর নির্দেশ ছাড়াই বন্দিদেরকে একটি জাহাজে করে জেদ্দার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন। জেদ্দায় নামিয়ে তাদের এই বার্তাসহ হেজাজের উদ্দেশ্যে রওনা করিয়ে দেয়া হয়, এদেরকে যেনো মিনার মাঠে হত্যা করা হয়। বার্তায় তিনি এদের, অপরাধের বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করেন।

ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ এই খৃস্টান দস্যু সৈনিক এবং তাদের কমান্ডারের হত্যাকাণ্ডে বেশ মাতামাতি করেছেন এবং ইতিহাসের পাতায় অনেক বিভ্রান্তিমূলক তথ্য পরিবেশন করেছেন। তাদেরকে তারা যুদ্ধবন্দি আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু কোন্ যুদ্ধে বন্দী হয়েছে, সে কথা উল্লেখ করেননি। তারা কোন দুর্গ কিংবা রণাঙ্গন থেকে বন্দি হয়নি। বন্দী হয়েছিলো কাফেলা, লুণ্ঠণকারী ডাকাতদের ঘাঁটি থেকে। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ প্রকৃত ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। তাদের লেখনী থেকে প্রমাণিত হয়, এই সিদ্ধান্তটা ছিলো নৌ-বাহিনী প্রধান হুসামুদ্দীন লুলুর একান্তই নিজস্ব, যার সম্পর্কে সুলতান আইউবী সম্পূর্ণ অনবহিত ছিলেন।

***

খৃস্টান দস্যু কমান্ডার যে নর্তকী সম্পর্কে বলেছিলো, তাকে সেদিন সন্ধ্যায়ই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, সে হলো রাণী। কমান্ডারের জবানবন্দী মোতাবেক মেয়েটাকে এতো দ্রুত পাঠিয়ে দেয়ার একটি কারণ হলো, মেয়েটি ঘোড়ার নীচে পড়ে আহত হয়েছিলো। যেহেতু তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, তাই তার চিকিৎসারও প্রয়োজন ছিলো। তাছাড়া কমান্ডার তাকে কাছে রেখে কোন প্রকার দুর্নাম মাথায় নিতে চাচ্ছিলো না।

যে সময়ে কমান্ডার হুসামুদ্দীনকে এসব জবানবন্দী দিচ্ছিলো, ততোক্ষণে রাদী চারজন খৃস্টান সৈন্যের সঙ্গে সেখান থেকে বহুদূর পৌঁছে গিয়েছিলো। সে ঘোড়ায় চড়া। এতোক্ষণে তার শারীরিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। পথে সে সৈন্যদের কয়েকবারই বলেছিলো, তোমরা আমাকে কায়রো দিয়ে আসো, আমি তোমাদেরকে বিপুল পুরস্কার দেবো। কিন্তু সৈন্যরা তাতে সম্মত হয়নি। অবশেষে এক সৈনিক বললো- তুমি দেখতে পাচ্ছো আমরা তোমাকে রাজকন্যার ন্যায় নিয়ে যাচ্ছি। তুমি এতো রূপসী এবং তোমার শরীরে এমন যাদু আছে যে, যাকেই ইঙ্গিত করবে, সে-ই তোমার পায়ে এসে জীবন দেবে। তথাপি আমরা তোমর দেহ থেকে চার পা দূরে থাকছি। কারণ, তুমি আমাদের কাছে আমানত। আর এই আমানত আমাদের সম্রাটদের, যারা কিনা ক্রুশের রাজা। আমরা যদি তোমার প্রস্তাব মেনে নেই কিংবা তোমাকে আমাদের সম্পদ মনে করি, তাহলে আমাদেরকে না সম্রাটগণ ক্ষমা করবেন, না ক্রুশ।

আমাদের গন্তব্য কোথায়? রাদী জিজ্ঞেস করে।

অনেক দূর- একজন উত্তর দেয়- সফর অনেক কঠিন ও দীর্ঘ। আমাদেরকে এমন সব অঞ্চল দিয়ে অতিক্রম করতে হবে, যেগুলো মুসলমানদের দখলে।

চার খৃস্টান সৈনিক রাদীকে আসলেই রাজকন্যার ন্যায় নিয়ে যাচ্ছিলো। এক সৈনিক জিজ্ঞেস করে- তোমাকে কোন শাসনকর্তা কিংবা বড় কোন ব্যবসায়ীর মেয়ে মনে হচ্ছে। পরিবারের সঙ্গে হজ্বে যাচ্ছিলে, না?

কেউ কি তোমাদেরকে বলেনি, আমি নর্তকী?- রাদী উত্তর দেয় আমার পিতা নেই। কোন ভাই নেই। আমার মা ইসমাঈলার বিখ্যাত নর্তকী ও গায়িকা। আমি তার কোন্ খদ্দেরের কন্যা আমার জানা নেই। মা শৈশবেই আমাকে নাচের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। নাচ-গান আমার ভালো লাগতো। ষোল-সতের বছর বয়সে মা আমাকে বড় এক ধনী লোকের ঘরে পাঠিয়ে দেন। লোকটা বৃদ্ধ ছিলো। মদে মাতাল ছিলো। আমাকে বললো, আমি তোমার প্রেমে পাগল হয়ে যাচ্ছি। বৃদ্ধের প্রতি আমার ঘৃণা জন্মে যায়। আমার হৃদয়ে অনুভূতি জাগে, আমার পিতা নেই। বৃদ্ধকে দেখে আমার মনে পিতার কল্পনা এসে যায়। কিন্তু বৃদ্ধ আমার সঙ্গে অশ্লীল আচরণ করতে শুরু করে। তাতে আমি বুঝে ফেললাম, এই লোক আমার পিতা নয়- খদ্দের। আমি বৃদ্ধের কবল থেকে পালিয়ে গেলাম। মাকে বললাম। মা বুঝালেন, এটা তোমার পেশা। আমি মানলাম না। মা আমাকে মারধর করলেন। আমি বললাম, আমি নাচবো, গাইবো, কিন্তু কারো ঘরে যাবো না। মা আমার শর্ত মেনে নেন।

এবার বিত্তশালীরা আমাদের ঘরে আসতে শুরু করে। কারো ঘরে যাচ্ছি না বলে আমার দাম বেড়ে যায়। তিন বছর কেটে গেছে। এ সময় আমার মনে বাসনা জাগে, যদি এমন একজন সচ্চরিত্রবান পুরুষ পেয়ে যেতাম, যে আমার রূপ উপভোগ এবং নাচানোর পরিবর্তে আমাকে ভালোবাসবে, যার মধ্যে কোন বিলাসিতা ও বদমায়েশী থাকবে না। অবশেষে আমি একজন পুরুষ পেয়ে গেলাম। লোকটা দুবার আমার ঘরে এসেছিলো। আমার তাকে ভালো লাগতো। বয়সে আমার চেয়ে সাত-আট বছরের বড়। আমরা ঘরের বাইরে মিলিত হতে শুরু করলাম। দুজনের মাঝে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠলো। লোকটা রাজপুত্র ছিলো। মদপান করতো।

একদিন সন্ধ্যায় আমি তাকে বললাম, তুমি মদ ছেড়ে দাও। সে শপথ করে বললো, ভবিষ্যতে আমি আর কখনো মদপান করবো না। আর খায়নি। একদিন সে আমাকে বললো, তুমি নাচ ছেড়ে দাও। আমি কসম খেয়ে বললাম, এই পেশার প্রতি আমি অভিসম্পাত করবো। কিন্তু মায়ের ঘরে বাস করে তো এই পেশা ত্যাগ করা সম্ভব নয়। সে বললো, আমি বিলাসী পিতার বিলাসী পুত্র। আমার পিতার হেরেমে তোমার চেয়েও অল্পবয়সী মেয়েরা আছে। সেই ঘরে বাস করে আমিও পুণ্যবান হতে পারবো না। আমি বললাম, আমি নর্তকী মায়ের নর্তকী মেয়ে আর তুমি বিলাসী পিতার বিলাসী পুত্র। তোমার পিতার চরিত্র তোমাকে নষ্ট করছে আর আমার মায়ের পেশা আমাকে নষ্ট করছে। চলো আমরা দূরে কোথাও পালিয়ে যাই এবং স্বামী-স্ত্রী হয়ে পবিত্র জীবন-যাপনকরি। সে আমার প্রস্তাবটা মেনে নেয়।

ছেলেটা মুসলমান ছিলো। আমার কোন ধর্ম নেই। আমার জনক মুসলমান ছিলো নাকি ইহুদী-খৃস্টান তাও আমি জানি না। আমি তাকে বললাম, আমাকে মুসলমানই মনে করো এবং বুঝাও ধর্ম কী। তুমি আমাকে ভালোবাসা দাও, পবিত্র জীবন দাও। সে অনেক চিন্তা করে বললো, পবিত্র যদি হতে চাও, তাহলে হেজাজ চলে যাও। আমি হেজাজের অনেক গান শুনেছি। যে গানে হেজাজ এবং হেজাজের কাফেলার কথা থাকে, সেই গান আমার খুব ভালো লাগে। একটা গান আমি একাকী গুন গুন করে থাকি- চলে কাফেলে হেজাজ কে। ছেলেটা হেজাজের নাম উচ্চারণ করে আমার কামনাকে উত্তেজিত করে তোলে। বললাম, আমি প্রস্তুত। তুমি সাহস করো, আমার আকাঙ্খা পূর্ণ করো। সে জিজ্ঞেস করে, জানো, হেজাজ কেন যাবো? আমি বললাম, শুনেছি জায়গাটা অত্যন্ত সুন্দর। সে বললো, শুধু সুন্দরই নয়- পবিত্রও। ওখানেই কাবা ঘর। ওখানেই যমযমের কূপ। ওখানে যে যায়, তার আত্মা পবিত্র হয়ে যায়। সেখানে গিয়ে আমরা হজ্ব করবো এবং পবিত্র হয়ে বিয়ে করবো। তারপর সেখানেই বসবাস করবো।

আমি সে সময়টার কথা ভুলতে পারবো না, যখন ছেলেটা আমার সঙ্গে শিশুর ন্যায় কথা বলছিলো আর আমি যেনো চোখের পথে তার আত্মায় ঢুকে গিয়েছিলাম। আমার ব্যক্তিসত্ত্বা তার সত্ত্বায় মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো। আমি তাকে বললাম, যাবোই যখন সময় নষ্ট না করে আজই চলো- এখনই। সে বললো, কোন কাফেলার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেতে হবে। দেখি কাফেলা কবে পাই। একাকী যাওয়া যাবে না।

একদিন সন্ধ্যায় সে আমাকে বললো, আজ রাতেই এখানে চলে আসবে। একটা কাফেলা রওনা হয়েছে। আমরা তার সঙ্গে মিশে যাবো। আমি বললাম, এখন ঘরে গেলে রাতে আর বেরুতে পারবো না। এখনই রওনা হও। সে বললো, ঠিক আছে, আসো। সন্ধ্যা গম্ভীর হয়ে গেলে সে আমাকে এক স্থানে লুকিয়ে রেখে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর দুটি ঘোড়া নিয়ে ফিরে আসে। একটির উপর নিজে চড়ে বসেছে, অপরটি শূন্য। উভয়টির সঙ্গেই পানি ও খাবার বাঁধা আছে। আমরা পরদিন সন্ধ্যায় কাফেলার সঙ্গে গিয়ে মিলিত হই এবং রাতে সেখানে গিয়ে পৌঁছাই, যেখানে তোমরা আমার স্বপ্নটাকে আমার ভালোবাসার লহুতে ডুবিয়ে দিয়েছে। লোকটা মারা গেছে। আমি ধরা পড়ে গেলাম। হেজাজের কাফেলাটা লুষ্ঠিত হলো আর মনের মানুষটি স্বপ্নের পুরুষটি কাবা গৃহে না পৌঁছেই আল্লাহর নিকট চলে গেলো। আল্লাহ আমার পাপ ক্ষমা করেননি। আমার কপালের ভাগ্যে কাবা ঘরে সেজদা লিপিবদ্ধ হয়নি। আমার অস্তিত্ব নাপাক ছিলো। সে কারণেই আল্লাহ আমাকে কবুল করেননি।

তোমার যদি কোন ধর্মের ছায়ায় আশ্রয় নিতেই হয়, তাহলে আমাদের ধর্মকে কাছে থেকে দেখে নিও। এক সৈনিক বললো।

তোমরা আমার একটা পবিত্র স্বপ্নকে চুরমার করে দিয়েছে- রাদী বললো- এটা কি তোমাদের ধর্মের আদেশ, যা তোমরা তামিল করেছো? এ ধরনের বিপদের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা আমার রওনা হওয়ার সময়ও ছিলো। কিন্তু শঙ্কাটা এতো ভয়ানক ছিলো না।

এটা আমাদের ধর্ম নয়- সৈনিক বললো- এটা সেই মানুষদের নির্দেশ, আমরা যাদের চাকরি করি।

তোমাদের চেয়ে আমি অনেক ভালো- রাদী বললো- রাজা রাজপুতরা হিরা-জহরত নিয়ে আমার পায়ে লুটিয়ে পড়ে থাকে। আর তোমরা তাদের দাসত্ব করছে। যে আদেশটা আত্মা থেকে আসে, সেটা মান্য করো। আমি সেই ব্যক্তির ধর্মের ভক্ত, যে আমাকে পবিত্র ভালোবাসা দান করেছে এবং পবিত্র চিন্তার অধিকারী করেছে। এর থেকেই ধরে নিয়েছি, তার ধর্মই মহান হবে। লোকটা আমাকে আমার স্বপ্নের ভূমি হেজাজ নিয়ে যাচ্ছিলো। তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?

আমরা মানুষের আদেশের কাছে দায়বদ্ধ। সৈনিক বললো।

 আমি আল্লাহর হুকুমের পাবন্দ। রাদী বললো।

তোমার আল্লাহ তোমাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন- অপর এক সৈনিক বললো- এখন তুমি আমাদের কাছে দায়বদ্ধ। গন্তব্যে পৌঁছে ভেবো খোদাকে কীভাবে খুশি করবে। প্রয়োজন হলে কোন নেক কাজ করবে। হয়তো খোদা তোমাকে ক্ষমা করে দেবেন।

আমি জানি, তোমরা আমাকে কোথায় এবং কেন নিয়ে যাচ্ছো রাদী বললো আমার অস্তিত্বটা আপাদমস্তক পাপ হয়ে যাবে এবং আমি কোন নেক কর্ম করতে পারবো না।

কোন পুণ্যের কল্পনাও তুমি করতে পারবে না- এক সৈনিক বললো- তুমি পাপের সৃষ্টি। পাপের মাঝে লালিত-পালিত। একজন পাপিষ্টের সঙ্গে ঘর পালিয়েছে। কী পুণ্য করবে তুমি?

সেই নিরপরাধ মানুষগুলোর রক্তের প্রতিশোধ নেবো, তোমরা যাদেরকে হত্যা করেছে। রাদী দাঁত কড়মড় করে বললো।

চার সৈনিক উচ্চকণ্ঠে একটা অট্টহাসি দেয়। একজন বললো তোমার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা আমাদের কর্তব্য। আমরা এমনই আদেশ পেয়েছি। অন্যথায় এ ধরনের উক্তি তোমার মুখ থেকে দ্বিতীয়বার বের হতে পারতো না।

রাদী লোকগুলোর প্রতি তাকিয়ে থাকে। তার হৃদয়ে এই অমানুষগুলোর প্রতি ঘৃণা বাড়তে থাকে।

***

মসুলে একজন দরবেশ এসেছেন। এক মুখ দুমুখ করে সংবাদটা রাষ্ট্র হয়ে গেছে মুহূর্ত মধ্যে। অশীতীপর এক বৃদ্ধ। মানুষ বলাবলি করছে, তিনি যে কোন ভাগ্যবান লোকেরই সঙ্গে কথা বলেন। আর যার সঙ্গে কথা বলেন, তার সকল মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়ে যায়। নগরীর প্রাচীরের বাইরে একটি ঝুপড়িতে থাকেন। তার কারামতের কাহিনী নগরীর মানুষের মুখে মুখে।

জনতা দরবেশের আস্তানার চারদিকে ভিড় জমাতে শুরু করেছে। তিনি সামান্য সময়ের জন্য বাইর এসে হাতের ইশারায় অপেক্ষমান জনতাকে নীরব থাকতে বলছেন। জনতা নিশ্চুপ হয়ে গেলে তিনি মুখে কিছু না বলে ইঙ্গিতে তাদের সান্ত্বনা প্রদান করে ঝুপড়িতে ঢুকে পড়ছেন। তার সঙ্গে সাদা-গোলাপী বর্ণেল চার-পাঁচজন সুশ্রী লোকও রয়েছে। দরবেশের মাথা থেকে পা পর্যন্ত সবুজ চাদরে আবৃত।

এবার আরেক খবর। দরবেশ মসুলবাসীর জন্য কী একটা সুসংবাদ নিয়ে এসেছেন। নগরীতে অপরিচিত লোকজনের আনাগোনা বেড়ে গেছে। তারা জনতাকে দরবেশের কল্প-কাহিনী শুনিয়ে বেড়াচ্ছে। শুনে মানুষ আপ্লুত হয়ে পড়ছে। সকলে এই দরবেশের দ্বারা নিজে সকল সমস্যা দূর করাতে এবং সকল কামনা পূরণ করাতে উদগ্রীব হয়ে উঠছে। অল্প কদিন পর খবর ছড়িয়ে পড়ে দরবেশ আসলে ইমাম মাহদী। কেউ কেউ বলছে ঈসা। ঐ যে আসমান থেকে দুনিয়াতে নেমে আসার কথা ছিলো, এসে পড়েছেন।

একদিন জনতা দেখলো, দরবেশ মসুলের গবর্নর ইযযুদ্দীনের ঘোড়াগাড়িতে করে তার প্রাসাদ অভিমুখে যাচ্ছেন। ইযযুদ্দীনের রক্ষী সেনারা তাকে স্বাগত জানায় এবং তিনি মহলে ঢুকে পড়েন। ঘণ্টা কয়েক পর বেরিয়ে রাষ্ট্ৰীয় গাড়িতে করে চলে যান। জনতা তার আস্তানায় গিয়ে দেখে, আস্তানা উধাও। সেই গাড়িটিই দরবেশকে অন্য কোথাও নিয়ে গেছে। সন্ধ্যায় গাড়ি ফিরে আসে। ভেতরে গাড়োয়ান আর দুজন রক্ষী। জনতা গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করে, দরবেশ কোথায়?

আমরা বলতে পারবো না তিনি কোথায় গেছেন- এক রক্ষী বললো একটা পাহাড়ের নিকট গিয়ে গাড়ি থামাতে বললেন। গাড়ি থেমে গেলে আমাদেরকে বললেন, তোমরা চলে যাও। আমরা তার এক সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করলাম, হুজুর কোথায় যাচ্ছেন? তারা বললো, তিনি পাহাড়ের চূড়ায় ধ্যানে বসবেন। দিগন্তে একটি নিদর্শন দেখতে পাবেন। তারপর পর্বতচূড়া থেকে নেমে এসে মসুলের গবর্নকে বলবেন তার করণীয় কী। তারপর মসুলের বাহিনী যেদিকেই যাবে, পাহাড় তাদেরকে পথ করে দেবে। মরুভূমি শ্যামলিমায় ভরে ওঠবে। দুশমনের ফৌজ অন্ধ হয়ে যাবে এবং মসুলের গবর্নর যে পর্যন্ত পৌঁছৰেন, সে পর্যন্ত তার রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। সালাহুদ্দীন আইউবী ইযযুদ্দীনের সম্মুখে অস্ত্র সমর্পণ করবে। খৃস্টানরা তার গোলাম হয়ে যাবে এবং মসুলের অধিবাসীরা অর্ধ পৃথিবীর রাজা হয়ে যাবে। তারা সোনা-রূপার মধ্যে খেলা করবে। তবে আমরা বলতে পারবো না, তিনি কোন্ পাহাড়ে ধ্যানে বসবেন।

মসুল থেকে খানিক দূরে একটি পার্বত্য অঞ্চল। সেখানে কোন বসতি নেই। একস্থানে একটা মাঠ আছে। মাঠটা পাহাড়বেষ্টিত। সেখানে দুচারটি কুঁড়েঘর চোখে পড়ে। অঞ্চলটা সবুজ-শ্যামল। রাখালরা পশু চড়াতে নিয়ে যায়।

একদিন রাখালদেরকে সেদিকে পশু নিয়ে যেতে বারণ করা হলো। মসুলের সেনারা টহল দিয়ে ফিরছে। তাদের সঙ্গে বহিরাগত অচেনা, লোকও আছে। পার্বত্য অঞ্চলটার বিস্তীর্ণ এলাকায় মানুষের যাতায়াত নিষিদ্ধ। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে অঞ্চলটার প্রতি মানুষের কৌতূহল জন্মে গেছে। সকলের মনে প্রশ্ন ব্যাপারটা কী? মানুষ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুরু করে দেয়। নানা রকম বিস্ময়কর ও অভিনব কাহিনী ছড়াতে শুরু করে। একদিনের মধ্যেই সকলের কানে কানে পৌঁছে যায়, দরবেশ আকাশ থেকে একটি নিদর্শন লাভ করবেন। তারপর আধা পৃথিবীর উপর মসুলবাসীদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।

***

ছোট্ট একটি কুঁড়েঘর। তাতে বসে ভিন্ন ধরনের কথা বলছে চার ব্যক্তি। তাদের একজন হাসান আল-ইদরীস। হাসান আল-ইদরীস সুলতান আইউবীর গুপ্তচর, যে কিনা বৈরুত থেকে অত্যন্ত মূল্যবান তথ্য নিয়ে এসেছিলো এবং সঙ্গে এনেছিলো মসুলের গবর্নর ইযযুদ্দীনের দূত এহতেশামুদ্দীন ও তার নর্তকী কন্যা সায়েরাকে। সে নজিরবিহীন সাফল্য ছিলো হাসানের। এহতেশামুদ্দীন সুলতান আইউবীকে তথ্য দিয়েছিলো, খৃস্টানরা মসুলের সন্নিকটে কোন এক পার্বত্য অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, দাহ্য পদার্থ এবং রসদ জমা করবে। তার থেকে প্রমাণিত হয়, তারা এ পার্বত্য অঞ্চলটাকে তাদের সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করবে। মসুলকে তো গেরিলাদের ঘাঁটি আগেই বানিয়ে নিয়েছে। সুলতান আইউবী ও তাঁর সালারগণ জানেন, যে বাহিনীর ঘাঁটি ও রসদ নিকটে থাকে, তারা অর্ধেক মুদ্ধ আগেই জিতে নেয়। খৃস্টান বাহিনীর একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা হচ্ছে, যখনই তারা কোন অগ্রযাত্রা কিংবা আক্রমণ করেছে, আইউবীর কমান্ডো সৈন্যরা পেছনে গিয়ে তাদের রসদ ধ্বংস করে দিয়েছে কিংবা রসদ ও বাহিনীর মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ফেলেছে। তাছাড়া যুদ্ধের পরিকল্পনা হাতে নিয়ে ময়দানে অবতীর হয়ে সুলতান আইউবী আগে-ভাগে ঘাস-পানির জায়গাটা দখল করে নিতেন এবং পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় তীরন্দাজদের বসিয়ে রাখতেন।

যা হোক, এহতেশামুদ্দীন থেকে তথ্য পাওয়ার পর সুলতান আইউবী গোয়েন্দা উপপ্রধান হাসান ইবনে আবদুল্লাহকে আদেশ করেন, খুঁজে বের করো খৃস্টানরা কোন্ পাহাড়ে ঘাঁটি গেড়েছে। গেরিলা বাহিনীর প্রধান সারেম মিসরীকে বললেন, জায়গাটা চিহ্নিত হয়ে গেলে সব ধ্বংস করে ফেলার ব্যবস্থা করবে। সুলতান আইউবীর দূরদর্শী চোখ দেখতে পেয়েছে, খৃস্টানরা এখন পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে।

সুলতান এহতেশামুদ্দীনের মুখে খৃস্টানদের প্রত্যয়-পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর পরিকল্পনা ঠিক করেন, খৃস্টানদের কোথাও দাঁড়াতে, দেবেন না। তিনি এক আদেশ তো এই প্রদান করেন যে, খৃস্টানরা কোথায় ঘাঁটি গাড়ছে খোঁজ নাও। আরেকটি আদেশ জারি করেন, সানজার অভিমুখে অভিযান প্রেরণ করো এবং দুর্গটা অবরোধ করে ফেলল।

সানজার মসুল থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ। তার অধিপতি শরফুদ্দীন ইবনে কুতুবদীন। সানজার দুর্গ দখল করার অভিযান সুলতান আইউবীর সেই পরিকল্পনারই ধারাবাহিকতা, তিনি বলেছেন- এখন আর আমি কারো নিকট সাহায্য ভিক্ষা করবো না, বরং তরবারীর আগা দ্বারা সাহায্য আদায় করবো। তার জানা ছিলো, ছোট ছোট মুসলিম আমীরগণ স্বাধীন শাসক থাকতে চাচ্ছে। সেই লক্ষ্যে তারা তলে তলে খৃষ্টানদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে। সানজারের অধিপতি শরফদ্দীন সম্পর্কে সুলতানের নিকট নিশ্চিত তথ্য ছিলো, তিনিও ইযযুদ্দীনের সুহৃদ। আর সেই হৃদ্যতার সূত্রে তিনিও সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে কাজ করছেন।

মসুলে মুসলিম গোয়েন্দা উপস্থিত ছিলো। তবু হাসান ইবনে আবদুল্লাহ ভাবলেন, এ কাজের জন্য আরো বিচক্ষণ ও সাহসী গোয়েন্দা প্রেরণ করা আবশ্যক। খৃষ্টানদের গোপন ঘাঁটি ও অস্ত্রের ডিপো আবিষ্কার করা সহজ হবে না। এরূপ গোয়েন্দা কে আছে? হা, হাসান আল-ইদরীস। তার কৃতিত্ব চোখের সামনে বিদ্যমান। কিন্তু হাসান ইবনে আবদুল্লাহ তাকে প্রেরণ করতে চাচ্ছেন না। কারণ, হাসান দীর্ঘ সময় বৈরুত অবস্থান করে এসেছে। শত্রুরা তাকে চিনে ফেলতে পারে। হাসান বেশ-ভূষা, কণ্ঠ ও বলার ভঙ্গিমা পরিবর্তন করার ওস্তাদ। সে হাসান ইবনে আবদুল্লাহকে বললো, অসুবিধা নেই। আপনি আমাকে প্রেরণ করুন। আমি এমন এক রূপ ধারন করবো, চির পরিচিতরাও আমাকে চিনতে পারবে না। হাসানকে মসুলের কেউ চিনে না। অবশেষে তাকেই প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। সুলতান আইউবী স্বয়ং দিক-নির্দেশনা প্রদান করে হাসান আল-ইদরীসকে প্রেরণ করেন।

প্রিয় বন্ধু আমার!- সুলতান আইউবী হাসান আল-ইদরীসের মাথায় হাত রেখে বললেন- ইতিহাসে নাম সালাহুদ্দীন আইউবীর আসবে। পরাজয়বরণ করবে তো ইতিহাস আমাকে লজ্জা দেবে। জয়লাভ করে মৃত্যুবরণ করবে তো মানুষ আমার কবরের উপর ফুল ছিটাবে। আর অনাগত প্রজন্ম আমার ভূয়সী প্রশংসা করবে। এটা খুবই অবিচার হবে। আমি বিজয়ের কৃতিত্ব তোমাকে এবং তোমার সেই সঙ্গীদের দিতে চাই, যারা দুশমনের অভ্যন্তরে ঢুকে গিয়ে তথ্য সগ্রহ করে আনছে এবং আমার বিজয়ের পথ সুগম করছে। আল্লাহ সাক্ষী, এটাই বাস্তব। আল্লাহ নিজ হাতে তোমাদের বিজয় মালা পরাবেন। তবে যদি পরাজিত হই, তাহলে তার দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমার। তখন ধরে নেবব, আমি তোমাদের এনে দেয়া তথ্য অনুযায়ী কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছি। তোমরা আমার চোখ। তোমরা আমার কান। আমার আত্মা তোমাদের কবরের উপর ফুল ছিটাতে থাকবে। অতি মহান তুমি ও তোমার সঙ্গীরা। আমার কোন মর্যাদা নেই। আমি সমগ্র বাহিনী নিয়ে সানজার যাচ্ছি। আর তুমি যাচ্ছো একা। গোটা বাহিনীকে ব্যবহার করে আমি যে বিজয় অর্জন করবো, তুমি একাই তা করে ফেলবে। যাও বন্ধু, যাও। আল্লাহ হাফেজ।

হাসান আল-ইদরীস একজন গরীব মুসাফিরের বেশে একটি উটের পিঠে সওয়ার হয়ে নাসীবার তাবু থেকে বের হয়। সূর্য ডুবে গেছে। বেশ পথ অতিক্রম করার পর সে অনেকগুলো ঘোড়র পায়ের শব্দ শুনতে পায়। হাসান দাঁড়িয়ে যায়। তার জানা আছে এসব ঘোড়া কার। সুলতান আইউবী সানজার অভিযানে রওনা হয়েছেন। এটি তারই বাহিনী। তিনি নাসীবা থেকে ক্যাম্প প্রত্যাহার করেননি। হেডকোয়ার্টার ও কতিপয় আমলাকে সেখানে রেখে এসেছেন। রিজার্ভ বাহিনীটিকেও প্রস্তুত অবস্থায় রেখে এসেছেন।

***

তুমি জানতে এসেছো, খৃস্টানরা পার্বত্য অঞ্চলের কোন্ জায়গাটায় অস্ত্রের সমাবেশ ঘটাচ্ছে- মসুলে কর্মরত মুসলিম গোয়েন্দাদের কমান্ডার বললো- আর আমরা এখানে জানবার চেষ্টা করছি, এই দরবেশটা কে, যিনি সেই পাহাড়গুলোরই কোন একটির চূড়ায় গিয়ে বসেছেন। কেউ তাকে ইমাম মাহদী বলছে। কেউ বলছে ঈসা।

কমান্ডার হাসান আল-ইদরীসকে দরবেশের পূর্ণ কাহিনী শুনিয়ে বললো- ঐ পাহাড়গুলোর ধারে-কাছে ঘেষবারও অনুমতি নেই। ফৌজের কিছু সান্ত্রী এবং কতিপয় অপরিচিত লোক পাহারা দিচ্ছে। তারা কাউকে ওদিকে যেতে দিচ্ছে না। দরবেশ কোন একটি পাহাড়ের চূড়ায় বসে আছেন। খোদা আকাশ থেকে তাকে কোন একটা ইঙ্গিত দেবেন। রাতে মানুষ ঘরের ছাদের উপর দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। মানুষ আল্লাহ-রাসূলকে ভুলে যাচ্ছে।

এরা চারজন। বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দা। তারা জানে,কুরআন হাদীসে ভিত্তি নেই এমন বিশ্বাস-ধারণা সম্পূর্ণ হারাম। দরবেশকে কেন্দ্র করে এখন মানুষ যে বিশ্বাস পোষণ করছে, সবই কুসংস্কার ও ভিত্তিহীন কল্পনা মাত্র। ইসলামে এগুলো হারাম। চার গোয়েন্দা বসে বসে ভাবছে, কিভাবে দরবেশের রহস্য উদঘাটন করা যায়।

বন্ধুগণ! যদি হেসে উড়িয়ে না দাও, তাহলে বলবো- হাসান আল ইদরীস বললো- দরবেশ যেখানে গিয়ে ধ্যানে বসেছেন, খৃস্টানদের অস্ত্রের ডিপো সেখানে। আর দরবেশ নাটক মঞ্চস্থ করা এবং উক্ত অঞ্চলে সাধারণ মানুষের যাতায়াত নিষিদ্ধ করা প্রমাণ করছে এই ডিপো বিপুল এবং এর পেছনে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বিদ্যমান। তোমরা জানো, এতো বিস্তীর্ণ অঞ্চলের চার পার্শ্বে একটা পুরো বাহিনীর প্রহরা বসালেও কোন না কোন দিক থেকে মানুষ ভেতরে ঢুকে যেতে পারতো। সেই জন্য তারা দরবেশ নাটক মঞ্চস্থ করে প্রচার করেছে, পাহাড়ের চূড়ায় একজন দরবেশ বসে আছেন। তিনি চাচ্ছেন না কেউ উক্ত অঞ্চলে প্রবেশ করুক। ফলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ এখন আর সেদিকে পা বাড়াতে সাহস পাচ্ছে না।

ঘোষণা করা হয়েছে, কেউ যদি উক্ত অঞ্চলে প্রবেশ করার এবং দরবেশকে দেখার চেষ্টা করে, তাহলে সে নিজে অন্ধ হয়ে যাবে এবং তার সন্তানরাও অন্ধ হয়ে যাবে- হাসান আল-ইদরীসের এক সঙ্গী বললো- খৃস্টানরা ওখানে কিছু রেখে থাকতে পারে তথ্য দিয়ে তোমরা আমাদের অর্ধেক সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। রহস্য উদঘাটনে এখন আমাদেরকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে।

দরবেশকেসহ অস্ত্রের ডিপোটা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতে হবে। হাসান আল-ইদরীস বললো।

আর জনগণকে তাদের এই অলীক বিশ্বাস থেকে রক্ষা করতে হবে- কমান্ডার বললো- খৃস্টানদের বুদ্ধির প্রশংসা করতে হবে। বেটারা অস্ত্রের ডিপোটা মানুষের দৃষ্টি থেকে দূরে রাখার জন্য এক ব্যক্তিকে দরবেশ বানিয়ে পাহাড়ে নিয়ে বসিয়ে রেখেছে। সেই সঙ্গে মসুলের ফৌজ ও জনগণকে খোদার ইশারার টোপ দিয়ে সামরিক প্রস্তুতি থেকে বিরত রাখার কৌশল অবলম্বন করেছে। অবস্থাটা দেখো, তাদের কৌশলের কাছে পরাজিত হয়ে ফৌজ এবং সাধারণ মানুষ সকলে সব বাদ দিয়ে খোদার ইশারার অপেক্ষায় বসে আছে।

দরবেশ সম্পর্কে মসুলের গবর্নরের দৃষ্টিভঙ্গী কী? হাসান জিজ্ঞেস করে।

দরবেশ তার মহলে তারই ঘোড়াগাড়িতে করে গিয়েছিলেন–কমান্ডার উত্তর দেয়। আবার সেই গাড়িতে করেই পার্বত্য এলাকায় চলে গেছেন। এতেই প্রমাণিত হচ্ছে, মসুলের গবর্নর ইযযুদ্দীনও এই চক্রান্তে জড়িত কিংবা তিনিও এই ষড়যন্ত্রের শিকার। বাদ বাকি তথ্যও আমরা জেনে যাবো। রোজি খাতুন মহলে আছেন। তার থেকেই জানা যাবে, মহলে দরবেশের অবস্থান কী?

সুলতান আইউবীর চার গোয়েন্দা উক্ত পার্বত্য অঞ্চল ও মহলে দরবেশের অবস্থান জানতে তৎপরতা শুরু করে দেয়।

***

সানজার দুর্গের প্রধান ফটকের প্রহরীরা ঘুম ঘুম চোখে শুয়ে আছে। যুগটা যুদ্ধ-বিগ্রহের হলেও সানজারের অধিপতি শরফুদ্দীন ইবনে কুতুবুদ্দীন কোন শঙ্কা অনুভব করছেন না। খৃস্টানদের আনুগত্য বরণ করে নিরাপত্তা বোধ করছেন তিনি। মসুলের গবর্নর ইযযুদ্দীন এবং হালবের গবর্নর ইমাদুদ্দীন তাকে বলে রেখেছেন, চিন্তা করবেন না, প্রয়োজন হলে আমরা আপনার সাহায্যে এগিয়ে আসবো। তিনি এই আত্মপ্রবঞ্চনায়ও লিপ্ত, সুলতান আইউবী তার অবস্থান সম্পর্কে অবহিত নন। তিনি মদ-নারীতে মাতাল হয়ে গভীর ন্দ্রিায় ঘুমিয়ে আছেন। খৃস্টানরা তাকে দুটি অতিশয় সুন্দরী মেয়ে উপহার দিয়েছিলো। এই মেয়ে দুটো তাকে সবসময় স্বপ্নে বিভোর করে রাখছে।

দুর্গের প্রাচীরের উপর দিয়ে লিঙ্গের ন্যায় একটা বস্তু উড়ে যায়। পরক্ষণেই আরো একটা। তারপর আবো। প্রহরীরা সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। এই ফুলিঙ্গগুলো দুর্গের ভেতরে গিয়ে নিক্ষিপ্ত হয় এবং ভয়ানক শিখায় পরিণত হয়ে যায়। নিকটেই মালপত্র পড়া আছে। কাছাকাছি একটি গৃহ। দুটোতেই আগুন ধরে যায়। বস্তুগুলো তরল দাহ্য পদার্থের পাতিল। সুলতান আইউবীর সৈন্যরা মিনজানিকের সাহায্যে সেগুলো নিক্ষেপ করেছে। সঙ্গে বাঁধা ছিলো প্রজ্জ্বল্যমান সলিতা। পাতিলগুলো ছিলো মাটির তৈরি। পড়েই ভেঙ্গে গেলো। আর অমনি ভেতরের তরল দাহ্য পদার্থগুলো ছড়িয়ে পড়লো এবং সঙ্গে থাকা সলিতা থেকে আগুন ধরে গেলো।

দুর্গে প্রলয় ঘটে গেছে। যে যেখানে ছিলো জেগে ওঠেছে। দুর্গপতি শরফুদ্দীনকে জানানো হলো। তিনি কক্ষের জানালার ফাঁক দিয়ে আগুনের শিখা দেখে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন। শরফুদ্দীন এক সময় ময়দানের পুরুষ ছিলেন। কিন্তু খৃস্টানরা মদ-নারী দিয়ে তাকে এখানে এনে পৌঁছিয়েছে। আজ রাতে তার পা চলছে না। রাতের পর রাত মরুভূমি ও দুর্গম পাহাড়ে ছুটে বেড়ানো যুদ্ধবাজ লোকটা এখন দুর্গের সমতল পথেও হাঁটতে পারছেন না।

খানিক পর উপর থেকে কমান্ডার দৌড়ে এসে শরফুদ্দীনকে জানালো, দুর্গ অবরোধ হয়েছে।

কোন্ হতভাগা অবরোধ করলো শরফুদ্দীন জিজ্ঞেস করেন।

সালাহুদ্দীন আইউবী- কমান্ডার উত্তর দেয়- তিনি বাইরে থেকে হুঙ্কার দিচ্ছেন, ফটক খুলে দাও। অন্যথায় দুর্গ জ্বালিয়ে ভষ্ম করে দেবো।

শরফুদ্দীনের নেশা কেটে গেছে। তিনি ভাবনায় পড়ে যান। অনেকক্ষণ পরে বললেন- ফটক খুলে দাও। আমি নিজে বাইরে যাবো।

দুর্গের ফটক খুলে গেছে। শরফুদ্দীন বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। ওদিক থেকে সুলতান আইউবী এক সালারকে বললেন, এগিয়ে গিয়ে শরফুদ্দীনকে আমার কাছে নিয়ে আসো। সুলতান নিজে এক পা-ও অগ্রসর হলেন না। শরফুদ্দীন সুলতান আইউবীর সম্মুখে এসে ঘোড়া থেকে নেমে দুবাহু প্রসারিত করে সুলতানের দিকে ছুটে আসেন। সুলতান এমন একটা ভাব ধারণ করেন, যেনো তিনি শরফুদ্দীনের সঙ্গে হাত মেলাতেও রাজি নন।

শরফুদ্দীন!- সুলতান আইউবী বললেন- ফৌজ আর সামরিক সরঞ্জাম ব্যতীত যা কিছু নিতে চাও, রাত পোহাবার আগেই নিয়ে বেরিয়ে যাও। তারপর আর এদিকে মুখ ফেরাবে না। সুলতান তার এক সালারকে বললেন- কয়েকজন সৈন্য নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ো এবং দেখো এরা নিষিদ্ধ কোন বস্তু নেয় কিনা। কতজন সৈন্য আছে গণনা করো এবং তাদেরকে আমাদের ফৌজে অন্তর্ভুক্ত করে নাও।

আমি আপনার গোলাম মহামান্য সুলতান- শরফুদ্দীন বললেন দুর্গ ও ফেজ আপনারই থাকবে। আমাকে দুর্গে থাকতে দিন।

দুর্গের প্রয়োজন থাকলে মোকাবেলা করতে- সুলতান আইউবী বললেন- তোমার ন্যায় এমন কাপুরুষ ও ঈমান নিলামকারীর এতো বড় দুর্গের অধিপতি হওয়ার অধিকার নেই।

আমি কীভাবে আপনার মোকাবেলা করবো!- শরফুদ্দীন বললেন শুনলাম আপনি এসেছেন আর অমনি বেরিয়ে এলাম। মুসলমান মুসলমানের বিরুদ্ধে লড়ে কি করে!

যেমনটা আগে লড়েছে- সুলতান আইউবী বললেন- শরফুদ্দীন! তুমি খৃস্টানদের বন্ধু এবং নামের মুসলমান। নিজের চরিত্রটা একটু দেখে নাও। তুমি সৈনিক থেকে কী হয়েছে। ঈমান বিক্রি করে বিলাসিতা ক্রয়কারীদের এ দশাই হয়। মদ আর নারী তোমার সব শক্তি-সাহস নিঃশেষ করে দিয়েছে। তুমি মিথ্যাও বলছো। তোমার মধ্যে যদি এতোটুকু আত্মমর্যাদাবোধও থাকতো, তাহলে নিজের দুর্গটা এভাবে বিনা যুদ্ধে আমার হাতে তুলে দিতে না।

মহামান্য সুলতান!- শরফুদ্দীন অনুনয়-বিনয় করেন- আমাকে দুর্গে থাকতে দিন।

সুলতান আইউবী এক সালারকে বললেন- একে দুর্গে নিয়ে যাও এবং বন্দি করে ফেলে। এর বাসনা পূর্ণ করো।

তিন-চারজন লোক সম্মুখে এগিয়ে আসলে শরফুদ্দীন সুলতান আইউবীর আরো নিকটে এসে মিনতির স্বরে বললেন- আমি মসুল যেতে চাই।

হ্যাঁ, ইযযুদ্দীন তোমার বন্ধু- সুলতান আইউবী বললেন- তার কাছে চলে যাও।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী সানজার দুর্গের দখল বুঝে নিয়ে তকিউদ্দীনকে অধিপতি নিযুক্ত করেন।

সম্মুখে আরেকটি দুর্গ আছে। তার নাম আমিদ। সুলতান অবশিষ্ট রাত সানজার দুর্গে অতিবাহিত করে সকালে আমিদ অভিমুখে রওনা হন। দুৰ্গটার বর্তমান নাম উমিদা। দজলার তীরে বিখ্যাত এক পল্লী ছিলো। তার আমীরও ছিলেন মুসলমান। এই পল্লীটাই একটা দুর্গ। সুলতান আইউবী সেটি অবরোধ করে ফেলেন। সেখানকার সেনা ও জনসাধারণ মোকাবেলা করার চেষ্টা করে। কিন্তু অবরোধের অষ্টম দিন আমীর অস্ত্র সমর্পণ করেন। সুলতান আইউবী নূরুদ্দীন নামক এক ব্যক্তিকে এই দুর্গের অধিপতি নিযুক্ত করেন।

***

চার খৃস্টান সৈনিকের সঙ্গে রাদী এখনো সফরে আছে। তার শরীরিক অবস্থা ঠিক হয়ে গেছে। খৃস্টান সৈনিকরা পথে তার বিশ্রাম ও সুযোগ সুবিধার প্রতি বেশ লক্ষ্য রেখে চলছে। কিন্তু যে রাতে সে তাদেরকে নিজের জীবন-কাহিনী শুনিয়েছিলো, তারপর আর তাদের সঙ্গে কথা বলেনি। খৃস্টান সৈনিকের খোদা তোমাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, তুমি পুণ্য করো, খোদা তোমাকে ক্ষমা করে দেবেন উক্তিটি তার হৃদয়ে তোলপাড় করে চলেছে। মেয়েটার শারীরিক অবস্থা ভালো থাকলেও মানসিক অবস্থা ভালো নয়। যে লোকটির সঙ্গে হজ্বে যাচ্ছিলো, তার স্মরণে সে ছটফট করছে। মনটা বেশি অস্থির হয়ে গেলে ভাবে- আল্লাহ আমাকে আমার পাপের শাস্তি দিচ্ছেন। তার জানা ছিলো না, আল্লাহর সমীপে কীভাবে পাপের ক্ষমা চাইতে হয়।..

চার রক্ষীর সঙ্গে রাদী গন্তব্যের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। এখন তারা মসুলের সীমানার ভেতরে। একদিন তারা এক উষ্ট্রারোহীকে দেখতে পায়। আরোহী তাদের দেখে উট থামিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। লোকটার মাথা ও মুখমণ্ডল কালো পাগড়িতে পেঁচানো। শুধু চোখ দুটো খোলা। রাদীর উপর তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে পড়ে। খৃস্টান সৈনিকরা সামরিক পোশাক পরিহিত ছিলো না। তাই তারা যে খৃস্টান সৈনিক বুঝবার উপায় নেই।

উষ্ট্রারোহীর চোখ দুটো দেখেছো? এক খৃস্টান তার সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করে।

অনেক গভীরভাবে দেখেছি- একজন জবাব দেয়- এসব দৃষ্টির অর্থ আমি বুঝি। এখন আমাদেরকে বেশি সতর্ক থাকতে হবে। মেয়েটা এতোই রূপসী যে, কোন দস্যুর চোখে পড়ে গেলে বিপদ হয়ে যাবে। সামনের অঞ্চলটা পাহাড়ী।

তারা দিনভর চলতে থাকে। সন্ধ্যার পর দুটি টিলার মধ্যখানে উপযুক্ত একটা জায়গা দেখে অবতরণ করে এবং খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করতে শুরু করে। খাওয়ার পর সকলে ঘুমিয়ে পড়ে। শুধু প্রতিদিনকার ন্যায় একজন জেগে পাহারা দিতে থাকে। খানিক পর সে কিছু একটার শব্দ শুনতে পায়। শিয়াল কিংবা অন্য কোন প্রাণীর হাঁটার সময় ধাক্কা খেয়ে একটা পাথর খণ্ড ঢালু বেয়ে নীচে গড়িয়ে পড়েছে হয়তো। তথাপি সৈনিক সর্তক হয়ে যায়। কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকে। শব্দটা আবারো শোনা গেলো। সৈনিক তার এক সঙ্গীকে জাগিয়ে তোলে এবং কানে কানে তাকে বিষয়টা অবহিত করে। সেও উঠে দাঁড়ায়। উভয়ে ধনুকে তীর সংযোজন করে একজন একদিকে অপরজন আরেক দিকে দাঁড়িয়ে যায়।

রাতটা অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এখন কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু পরক্ষণেই পরপর দুবার দুটো শব্দ ভেসে এলো। শব্দটা কোন দিক থেকে এলো বুঝে ওঠার আগেই একটি করে তীর ধেয়ে এসে দুজনের পাজরে গেঁথে যায়। তাদের অন্য সঙ্গীরা সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে গভীর ঘুম ঘুমাচ্ছিলো। জাগ্রত দুজন তীর খেয়ে তাদের হাঁক দিলে তারা ধড়মড় করে উঠে বসে। তারা পলায়নপর পায়ের শব্দ শুনতে পায়। সঙ্গে সঙ্গে একটি প্রদীপ জ্বলে ওঠে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে। পরক্ষণেই তারা সাত-আটজন লোকের অবরোধে চলে আসে। তাদের একজনের মাথা ও মুখমণ্ডলে কালো পাগড়ী পেঁচানো। দিনের বেলা যে উজ্জ্বারোহীকে দেখা গিয়েছিলো এবং রাদীর প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো, এই লোকটা সে-ই বলে মনে হলো।

দুজনই সৈনিক। তারা তরবারী দ্বারা মোকাবেলা করে। কিন্তু সাত আটটা বর্শা তাদের দেহ দুটোকে, ঝাঁঝরা করে দেয়। রাদী আক্রমণকারীদের কজায় চলে আসে। মেয়েটি আলাদা এক স্থানে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার চেহারায় ভয়ের সামান্যতম ছাপও নেই। প্রদীপের কম্পমান আলোয় তার রূপটা এমন রহস্যময় মনে হচ্ছে, যেনো সে এ জগতের প্রাণী নয়।

রাদীকে ঘোড়ার পিঠে তুলে নেয়া হলো। কালো পাগড়িওয়ালাও ঘোড়ায় চড়ে বসে। দুজন পাশাপাশি চলতে শুরু করে। লোকটা রাদীকে জিজ্ঞেস করে নিজের সম্পর্কে কিছু বলবে কি? রানী সব কিছু বলে দেয়।

***

রাদীকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হলো, সেটি কোন প্রাসাদ কিংবা ঘর নয়- একটি তাঁবু। তাঁবুর অর্ধেকটা মাটির উপরে, অবশিষ্টটুকু নীচে। পার্টিশন ও শামিয়ানা ফুলদার রেশমি কাপড়ের। ভেতরে সুপরিসর একটি পালঙ্কের উপর জাজিম বিছানো। ঝাড়বাতির উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে ভেতরটা। মনেই হচ্ছে না এটি তাঁবু। থরে থরে সাজানো মদের পিপা-পেয়ালা। ভেতরে তিনজন লোক উপবিষ্ট। রাদী তৎক্ষণাৎই বুঝে ফেলে, লোকগুলো খৃস্টান। তারা রাদীকে দেখে অপলক চোখে তার প্রতি তাকিয়ে থাকে। কালো নেকাব পরিহিত লোকটা তার সঙ্গে। ভেতরে প্রবেশ করে মুখোশটা খুলে ফেলে দিয়েই বলে ওঠে- এমন উপহার আগে কখনো দেখেছো? তাছাড়া মেয়েটা নর্তকীও।

রাণী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ঝাড়বাতির আলোতে তার রূপ অধিক যাদুময় মনে হচ্ছে। মেয়েটার মুখে ভয়-ভীতির কোন ছাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

রাদীকে পালঙ্কের উপর বসিয়ে দেয়া হলো। জিজ্ঞেস করা হলো–তুমি কে এবং কোথায় যাচ্ছিলে?

রাদী তার জীবনের সকল বৃত্তান্ত শোনায়। তবে তাতে কারো মনে কোন প্রতিক্রিয়া জাগলো না। একজন নির্যাতিতা নারীর করুণ কাহিনীতে প্রভাবিত হওয়ার জন্য যে চেতনার প্রয়োজন, তা তাদের কাছে নেই। কোথায় যাচ্ছিলে? প্রশ্নের উত্তরে রাণী বললো- আমাকে এক খৃস্টান সম্রাটের নিকট নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো।

তার মানে তুমি চারজন খৃস্টানকে হত্যা করেছো? যে লোকটি রাণীকে নিয়ে এসেছে, একজন ক্ষুব্ধকণ্ঠে তাকে জিজ্ঞেস করে।

তাদেরকে খৃস্টান মনে হচ্ছিলো না- লোকটি উত্তর দেয়- তোমরা আমাকে বলেছিলে, দুতিনটি মেয়ে নিয়ে আসো, যাদের নিয়ে আমরা এই বিজন ভূমিতে ফুর্তি করবো। আমি বেরিয়ে পড়লাম। ঘটনাক্রমে একে পেয়ে গেলাম। লোকগুলোকে সন্দেহভাজন মুসলমান মনে হলো। আমি তাদের পিছু নিলাম। লোকগুলোকে হত্যা করে মেয়েটাকে নিয়ে এলাম।

তোমার সঙ্গে কে কে ছিলো?

আমাদের মাত্র দুজন ছিলো- লোকটি উত্তর দেয়- অবশিষ্ট পাঁচজন মসুলের মুসলমান, যারা এখানে প্রহরার দায়িত্ব পালন করে থাকে।

চারজন খৃস্টানকে হত্যা করে তোমাদেরই এক সম্রাটের একটি উপহার ছিনিয়ে এনেছো, এই তথ্য যদি ফাঁস হয়ে যায় তাহলে জানেনা তার পরিণতি কী হবে?

লোকটি কথা বলছে না। হঠাৎ এক ব্যক্তি ভেতরে প্রবেশ করে বললো- এই তথ্য ফাস হবে না। আপনি ভয় করছেন, আমরা যে মুসলমানরা সঙ্গে আছি এ তথ্য ফাঁস করে দেবো। না এমনটা হবে না।

এ লোকটি কে?

আমার ঘনিষ্ঠ সহচর- আগের লোকটি বললো এবং মসুলের বড় এক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে বললো- তিনি দিয়েছেন। বিশ্বস্ত এবং বুদ্ধিমান।

আমি আপনাদেরই লোক- নবাগত লোকটি বললো- মসুলের যেসব তথ্য আপনারা লাভ করছেন, সব আমার ও আমার সঙ্গীদেরই সংগ্রহ করা তথ্য।

লোকটাকে আরো অনেক প্রশ্ন করা হয়। উত্তরে সে এমন ধারায় কথা বলে যে, সবাই তাকে বিশ্বস্ত বলে নিশ্চিত হয়ে যায়। কারো মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ জাগলো না, লোকটি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ভয়ঙ্কর একজন গুপ্তচর, যার নাম হাসান আল-ইদরীস। আল্লাহ লোকটার মুখাবয়ব ও দৈনিক গঠনে এমন এক আকর্ষণ দান করেছেন, যে কেউ এক নজর দেখার পর তার ভক্ত হয়ে যায়। লোকটার মুখের ভাষা ও বর্ণনা ভঙ্গিতে এমন এক যাদু যে, তার বক্তব্যে শ্রোতারা মুগ্ধ হতে বাধ্য। তাছাড়া যেকোন সময় যেকোন রূপ ও যেকোন ভাব ধারণ করায় বড় পারঙ্গম। মসুলে সুলতান আইউবীর যে কজন গোয়েন্দা ছিলো, প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত তাদের যাতায়াত ও যোগাযোগ ছিলো। তারা তথ্য সগ্রহ করেছে, মসুলের গবর্নর ইযযুদ্দীনও উক্ত দরবেশ দ্বারা প্রভাবিত। মসুলের জনসাধারণের ন্যায় তিনিও বিশ্বাস করে নিয়েছেন, দরবেশ আসমান থেকে ইশারা লাভ করবেন এবং পরে যখনই তার বাহিনী অভিযানে অবতীর্ণ হবে, তখন জয়ের পর জয়লাভ করতে থাকবে।

গোয়েন্দাদের এ তথ্য সরবরাহ করেছেন নূরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী রোজি খাতুন। তিনি আইউবীর গোয়েন্দাদের তথ্য সরবরাহ করেছেন, ইযুদ্দীন অত্যন্ত কঠোরভাবে খৃস্টানদের জালে আটকে গেছেন। খৃস্টানরা যেনো তাকে যাদু করে ফেলেছে। দরবেশটা যদি খৃষ্টানদের সাজানো নাটক না হয়ে দরবেশই হয়ে থাকে, তাহলে লোকটা নিঃসন্দেহে বিভ্রান্ত। আল্লাহ তাকে জয়ের ইঙ্গিত দান করবেন, তার এই আগাম ঘোষণা সম্পূর্ণরূপে ইসলাম পরিপন্থী।

এসব তথ্য সরবরাহ করে রোজি খাতুন গোয়েন্দাদের পরামর্শ প্রদান করেন, তোমরা দরবেশটার মুখোশ উন্মোচন করো এবং সম্ভব হলে তাকে হত্যা করে ফেলো। রোজি খাতুন এই সন্দেহও ব্যক্ত করেন যে, খৃস্টানরা উক্ত পাহাড়ের অভ্যন্তরে কিছু একটা করছে। তোমরা তথ্য নাও কী করছে এবং সুলতান আইউবীকে অবহিত করো।

হাসান আল-ইদরীস দরবেশের রহস্যময় জগতে ঢুকে পড়েছে। এই পার্বত্য অঞ্চলে কর্তব্যরত খৃস্টানদের বিশ্বস্ত ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে গেছে হাসান। কিন্তু একটা সীমানার পরে আর অগ্রসর হওয়ার এখনো অনুমতি পাচ্ছে না সে। রহস্য এই সীমানারও পরে। পাহাড়গুলো বেশ উঁচু। স্থানে স্থানে উঁচু উঁচু অনেক টিলা। হাসান আল-ইদরীস দরবেশের দর্শন লাভে উদগ্রীব। কিন্তু তার দেখা মিলছে না। সন্দেহ জাগতে পারে ভয়ে কাউকে জিজ্ঞেসও করছে না। লোকটা খৃস্টানদের এতই আস্থাভাজন হয়ে গেছে যে, তারা তাকে রাদীর অপহরণে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলো।

রাদী তাঁবুতে অবস্থানকারী দুতিনজন খৃস্টানের বিনোদনের উপকরণে পরিণত হয়েছে। মেয়েটার প্রতি দলনেতার লোভ ও আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি। তাই মেয়েটাকে সে যে কারো খেলনা হয়ে থাকতে দিতে চাচ্ছে না। এক রাতে দলনেতা রাদীকে জিজ্ঞেস করে- তুমি কি আমাদের সন্তুষ্টির জন্য নাচছো? আমার সঙ্গে রাত যাপন করে কি তুমি আনন্দ অনুভব করছো?

না আপনাদের সন্তুষ্ট হওয়া উচিত, না আমি আপনাদের প্রতি সন্তুষ্ট- রাদী গম্ভীর কণ্ঠে বললো- নিরুপায় হয়েই আমি আপনাদের খেলনা হয়ে আছি। মনের কথা বলতে আমি ভয় করবো না। আপনাদেরকে আমি মনে-প্রাণে ঘৃণা করি। আপনাদের আদেশ আমি অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে পালন করি।

তুমি কি জানো, এই অপমানজনক বক্তব্যের জন্য আমি তোমার মাথাটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারি- দলনেতা বললো- ইচ্ছে করলে আমি তোমার এই সুন্দর চেহারাটা শৃগাল-শকুনের সম্মুখে নিক্ষেপ করতে পারি?

যদি করেন, তাহলে এটা হবে আমার জন্য বিরাট এক পুরস্কার রাণী বললো- আমার মাথাটা দেহে থাকা আমার জন্য কঠিন এক শাস্তি। আপনার ন্যায় শেয়ালটা তো আমার আত্মাটাকে খাবলে খাবলে খাচ্ছেনই। আপনি নিজেকে যুদ্ধবাজ ও বীর মনে করে থাকেন। একটা অসহায় মেয়েকে বন্দি করে গর্ব করছেন। পৌরুষ আর তরবারীর জোরে আপনি আমাকে দাসীতে পরিণত করতে চাচ্ছেন। পারেন যদি আমার হৃদয়ের উপর এমনভাবে শাসন করেন, যেনো জিজ্ঞেস করতে না হয়, আমি আপনার সন্তুষ্টির জন্য আপনার আদেশ মান্য করছি কিনা। বরং আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করবো, আমার নাচ ও অস্তিত্বে আপনি আনন্দ লাভ করছেন কিনা?

আচ্ছা, আমি যদি তোমার সম্মুখে সোনার স্তূপ রেখে দেই, তাহলে কি তুমি আমাকে হৃদয় থেকে মনিব বলে মেনে নেবে?

না- রাদী উত্তর দেয়- আমার যে পুরস্কারের প্রয়োজন, তা তোমাদের কাছে নেই। যার কাছে ছিলো, সে মারা গেছে। লোকটা মানুষ ছিলো, দেহের প্রতি তার কোন আকর্ষণ ছিলো না। আর তোমরা! তোমরা শিয়াল-শকুন-নেকড়ে।

লোকটা তোমাকে ভালোবাসা দিয়েছিলো- দলনেতা বললো আমি যদি তোমাকে সেই ভালোবাসা দেই, তাহলে?

আমি নই। আমার আত্মা ভালোবাসার পিয়াসী। রাদী উত্তর দেয়। দলনেতা মদের পেয়ালাটা হাতে নিয়ে মুখের সঙ্গে লাগাতে উদ্যত হয়। রাদী খপ করে পেয়ালাটা ধরে ফেলে তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে দূরে ফেলে দিয়ে বললো-কথা বলতে যখন বাধ্য করেছে, শুনে নাও। মদপান করবে তত তোমার বিবেক ও চেতনার উপর পর্দা পড়ে যাবে। তুমি জিজ্ঞেস করেছো, তুমি যদি আমাকে সেই ভালোবাসা প্রদান করো, তাহলে আমি বরণ করবো কিনা? আগে আমাকে ভালোবাসা দেখাও। যদি পারো, তাহলে যদি তুমি আমাকে উত্তপ্ত মরুভূমিতেও নিয়ে যাও, আমি খুশিমনে তোমার সঙ্গে যাবো এবং জ্বলে-পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাবো।

দলনেতা মেয়েটির প্রতি তাকায়। লোকটা মেয়েটির সর্বাঙ্গ খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকে। দেখে আসছে তো কয়েকদিন ধরেই। মেয়েটার বিক্ষিপ্ত রেশম কোমল চুলের পরশও উপভোগ করেছিলো। উন্মুক্ত বক্ষ তার উন্মুক্ত পিঠের উপর ছড়িয়ে থাকা অবস্থায়ও এই চুলের যাদু প্রত্যক্ষ করেছে লোকটা। মেয়েটার দেহ সম্পর্কে এতোটাই অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেছে যে, অতোটা অভিজ্ঞতা তার নিজ দেহ সম্পর্কেও ছিলো না। কিন্তু রাদী যখন লোকটার প্রতি নির্লিপ্তভাবে ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য প্রকাশ করলো এবং হাত থেকে মদের পেয়ালাটা কেড়ে নিয়ে ফেলে দিলো, তখন তার পৌরুষ যেনো হারিয়ে গেলো। লোকটা নিজের মধ্যে এমন অসহায়ত্ব অনুভব করলো, যেনো মেয়েটা তাকে যাদু করে ফেলেছে। একজন পুরুষ দশজন পুরুষের মোকাবেলা করতে পারে। লড়তে পারে হিংস্র প্রাণীর সঙ্গেও। কিন্তু ভালোবাসার নারীটা যখন বলে বসে, আমি তোমাকে ঘৃণা করি, তখন সে বালির স্তূপে পরিণত হয়ে যায়। এই খৃস্টান লোকটির অবস্থাও হয়েছে তা-ই।

আমি তোমাকে আমার কোন সঙ্গীর খেলনায় পরিণত হতে দেবো না।

আমি হুকুমের গোলাম- রাদী বললো- আমি আত্মহত্যা করবো না। আত্মহত্যা করা কাপুরুষতা। পালাবারও চেষ্টা করবো না। এটা প্রতারণা। আমি আত্মহত্যা করে ফেলেছি। নিজের আত্মাটাকে আমি মেরে ফেলেছি।

লোকটি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে এমনভাবে পা ফেলে রাদীর দিকে এগিয়ে যায়, যেনো রাণী তাকে যাদু করেছে। কাছে এসে ধীরে ধীরে ডান হাতটা উপরে তুলে রাদীর চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললো তুমি আমার কল্পনার চেয়েও বেশি রূপসী। বলেই হাতটা পেছনে সরিয়ে নিয়ে বললো- আজ আমি প্রথমবার অনুভব করেছি, তোমার কণ্ঠে জ্বলন আছে। তুমি নর্তকী- গায়িকা নও তো?

আমি গানও গাই- রাদী বললো- কিন্তু গান সেটি শোনাবো, যেটি আমার ভালো লাগে, যার মধ্যে আমার ব্যথা আছে।

রাদী গুন গুন করতে শুরু করে চলে কাফেলৈ হেজাজ কে।

তাঁবুর ভেতরের পরিবেশটা এখন আবেগময়। রাণীর প্রতিটি শব্দ হৃদয়ের গভীর থেকে বেরিয়ে আসছে। এই গানটায় তার ভালোবাসার স্বাক্ষর আছে। হৃদয়ের কান্না আছে। কামনার জ্বলন আছে। আছে তার সেই স্বপ্নমালার সৌন্দর্য, যা হেজাজের পথে শহীদ হয়ে গেছে।

রাদীর চোখে অশ্রু সাঁতার কাটতে শুরু করে। তার গানের লয়-তাল আরো জ্বালাময়ী হয়ে ওঠে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এই গানেও খৃস্টান দলনেতার এমন ঝিমুনি আসতে শুরু করে, যা তার জীবনে কখনন আসেনি। প্রতি রাতেই মদপান করে অচেতন অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়া ছিলো তার স্বভাব।

রাদীর গানের তালে তালে গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়ে খৃস্টান দলনেতা।

পালঙ্কের সন্নিকটে তেপাইর উপর পড়ে থাকা লোকটার উপর চোখ পড়ে রাদীর। রাদী ধীরে ধীরে খঞ্জরটা খাপ থেকে বের করে। খঞ্জরের আগায় আঙ্গুল রাখে এবং অস্ত্রটা শক্ত করে ধরে ঘুমিয়ে থাকা খৃস্টানের নিকট চলে যায়। খঞ্জরের আগাটা লোকটার ধমনীর কাছে নিয়ে যায়। তারপর হৃদপিণ্ডটা কোথায় থাকতে পারে ঠিক করে হাতটা উপরে তোলে। অমনি একটা শব্দ ভেসে আসে কানে- শী। হঠাৎ চমকে ওঠে হাতটা সরিয়ে নিয়ে রাদী ওদিকে তাকায়। তাবুর পর্দা ফাঁক করে সেই সুদর্শন যুবকটা দাঁড়িয়ে, যে বলেছিলো আমি খৃস্টানদের গুপ্তচর মুসলমান হাসান আল-ইদরীস।

***

হাসান আল-ইদরীস হাতের ইশারায় রাদীকে ডাক দেয়। রাদী খঞ্জরটা খাপে ঢুকিয়ে উঠে এগিয়ে যায়। হাসান রাদীকে বাহুতে ধরে বাইরে নিয়ে যায়। বললো- আজ রাত লোকটা একা। অন্যরা অনেক দিনের জন্য চলে গেছে। এই লোকটা আমার দায়িত্ব ও নিরাপত্তায় রয়েছে। কিন্তু আমি একজন ঘুমন্ত মানুষকে হত্যা করবো না। আমার দায়িত্ববোধ আছে। কেউ তাকে খুন করতে এলে সে আমার হাতে মারা যাবে। তুমি তাকে বলেছিলে আমি আত্মহত্যা করবো না। কারণ, এটা কাপুরুষতা। আর আমি পালাবোও না, কারণ এটা প্রতারণা। কিন্তু তুমি একজন ঘুমন্ত মানুষকে হত্যা করতে চেয়েছিলে, এটা কি প্রতারণা নয়?

তুমি কি তাকে বলে দেবে, আমি তার ধমনি ও হৃদপিণ্ডের উপর খঞ্জর রেখেছিলাম- রাদী জিজ্ঞেস করে এবং দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো- যদি বলে দাও, তাহলে লোকটা আমাকে মেরে ফেলবে। তাতে আমার ভালো হবে। তোমারও উপকার হবে। তিনি তোমাকে পুরস্কার দেবেন।

এই লোকটার প্রতি আমার ততোখানি ঘৃণা, যতোখানি তোমার অন্তরে রয়েছে- হাসান আল-ইদরীস বললো- আমি তাকে কিছুই বলবো না।

বিনিময়ে আমার থেকে তার পুরস্কার দাবি করবে?- রাদী জিজ্ঞেস করে- বরং পুরস্কার হিসেবে আমাকেই চেয়ে বসবে, না।

না- হাসান আল-ইদরীস বললো- আমার কোন পুরস্কারের প্রয়োজন নেই।

হাসান মেয়েটাকে খানিক আড়ালে নিয়ে গিয়ে মমতার সুরে বললো আমি তোমার ন্যায় হেজাজেরই যাত্রী। যে রাতে আমরা তোমাকে অপহরণ করে এনেছিলাম, সে রাতে তুমি আমাদেরকে তোমার বৃত্তান্ত শুনিয়েছিলে। তুমি তোমার হৃদয়ের আবেগ এবং একটি বাসনার কথা ব্যক্ত করেছিলে। তখন থেকেই আমি ভাবছি, তোমাকে কোন্ পুণ্যের কথা বলবো, যার মাধ্যমে তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবে।

হাসান আল-ইদরীসের মুখের যাদু রাণীকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। হাসান বলতে থাকে আর রাণী শুনতে থাকে। সুলতান আইউবীর এই গোয়েন্দা এই রূপসী মেয়েটার হৃদয়টা জয় করে ফেলেছে। এখন আর রাণী সেখান থেকে উঠতে চাচ্ছে না। হাসান আল-ইদরীস তাকে চলে যেতে বাধ্য করে।

এভাবে তিন-চার রাত দুজনের সাক্ষাৎ ঘটে। হাসান আল-ইদরীস মেয়েটাকে তার আবেগময় বক্তব্য ও সৎ উদ্দেশ্যের যাদুতে আটকে ফেলে। রাদী তার কাছে হেজাজের কথা জিজ্ঞেস করতে থাকে আর সে অত্যন্ত আবেগময় ভঙ্গিতে তাকে হেজাজের চিত্তাকর্ষক কথা-বার্তা শোনাতে থাকে। দিনের বেলা হাসান জানার চেষ্টা করছে, যে স্থানটায় তাকে যেতে দেয়া হচ্ছে না, সেখানে কী আছে। কিন্তু সে কিছুই জানতে পারছে না।

এক রাতে হাসান মেয়েটাকে বললো- আচ্ছা, লোকগুলো ঐ পাহাড়টায় কী লুকিয়ে রেখেছে বলতে পারো? রাদী সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়- যুদ্ধের সরঞ্জাম। ঐ লোকটা (দলনেতা) আমাকে বলতো, তার মধ্যে দাহ্য, প্রদার্থ এতো পরিমাণে আছে যে, মুসলমানদের সমগ্র নগরীকে পুড়িয়েও শেষ হবে না। আমি লোকটার দাসী কিংবা গনিকা ঠিক, কিন্তু সে আমার সম্মুখে দাসের ন্যায়ই আচরণ করে থাকে।

তুমি কি আনন্দিত যে, তুমি উচ্চপদস্থ একজন খৃস্টানের গনিকা আর তিনি তোমার গোলাম?

না- রাদী উত্তর দেয়- আমি দেহের কথা বলছি। আমার আত্মা কখনো আনন্দিত হবে না। যারা আমাকে হেজাজের পথ থেকে অপহরণ করে এনেছিলো, তারা বলতো, খোদা তোমার উপর অসন্তুষ্ট। এমন একটি পুণ্য করো, যার উসিলায় খোদা তোমাকে ক্ষমা করে দেবেন। আর যে লোকটি আমাকে হেজাজ নিয়ে যাচ্ছিলো, আমি যাকে কামনা করছিলাম, সে বলতো, আমরা হজ্ব করে পবিত্র হয়ে যাবো। তারপর সেখানেই বিয়ে করবো। আমি পাপের সাগরে ডুবে যাচ্ছি। খোদা আমাকে শাস্তি দিয়ে চলেছেন।

শুধু যমযমের পানিই নয়- আগুনও তোমাকে পবিত্র করতে পারে হাসান আল-ইদরীস হেসে বললো- তুমি হেজাজ যেতে পারোনি। এখন হেজাজের প্রহরীকে সন্তুষ্ট করো, খোদা তোমার আত্মাকে গুনাহ থেকে পবিত্র করে দেবেন। তুমি মুক্তি পেয়ে যাবে।

হেজাজের প্রহরী কে?- রাদী বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে- আর সে কোন্ আগুন, যে আমাকে পবিত্র করতে পারবে?

হেজাজের প্রহরী সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী- হাসান আল ইদরীস বললো- আর আগুন হচ্ছে, এই পাহাড়ী অঞ্চলে মটকা ও পাতিলে ভর্তি যে বিপুল তেল আছে, সেগুলো, যে তেলের মাধ্যমে হেজাজ পর্যন্ত পুড়িয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া সম্ভব। পাহাড়ী অঞ্চলের যে জায়গাটায় আগুন ও যুদ্ধ সরঞ্জাম আছে, তুমি আমাকে সেই পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দাও।

রাদী কিছুই বুঝতে পারলো না। হাসান আল-ইদরীস তাকে দীর্ঘ কাহিনী শোনায়। সুলতান আইউবীর প্রত্যয়-পরিকল্পনা ও চরিত্র সম্পর্কে অবহিত করে। খৃস্টানদের পরিকল্পনার কথাও জানায় এবং এমন এমন কথা শোনায়, যার ফলে তার হৃদয়ে খৃস্টানদের প্রতি ঘৃণা জন্মে যায় এবং হক-বাতিলের দ্বন্দ্ব তার বুঝে এসে যায়।

***

পরদিন আল-ইদরীস দেখে রাদী ঘোড়ায় চড়ে তার মনিব খৃস্টান দলনেতার সঙ্গে পাহাড়ের সেই অংশটায় ঢুকে পড়েছে, যেখানে হাসান ও খৃস্টান প্রহরীদের যাওয়ার অনুমতি নেই। রাতে দলনেতা রাণীকে নিয়ে মনোরঞ্জন করে গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়ে। হাসান আল-ইদরীস তাকে কিছু পাউডার দিয়েছিলো। রাদী সেগুলো মদের সঙ্গে মিশিয়ে লোকটাকে খাইয়ে অচেতনের ন্যায় ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। গোয়েন্দারা চেতনানাশক পাউডার সঙ্গে রাখে। প্রয়োজন হলে ব্যবহার করে। রাদী ফিরে এসে নির্ধারিত স্থানে হাসান আল-ইদরীসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে।

ওখানে বিশাল এক গুহা- রাদী বললো- এরা খনন করে করে গুহাটাকে আরো প্রশস্ত করে নিয়েছে। এতো চওড়া ও দীর্ঘ যে, একদিক দাঁড়ালে অপরদিক দেখা যায় না। বিশাল এক গুদাম। ভেতরে দাহ্য পদার্থ ভর্তি হাজার হাজার মটকা। বর্শা, তীর-ধনুক, খাদ্যদ্রব্য, তবু ও অন্যান্য সরঞ্জামের কোন হিসেব নেই। আমি খৃস্টান লোকটাকে শিশুর ন্যায় বললাম, আমি ঐ পাহাড়ী এলাকাটায় একটু বেড়াতে যেতে চাই। তিনি বললেন, কাল দিনে নিয়ে যাবো। তুমি আমার রাণী। তবে কাউকে বলবে না ওদিকে গিয়েছিলে। তিনি আমাকে নিয়ে যান।

রাদী জানালো- গুহার সম্মুখে দুজন লোক প্রহরায় দাঁড়িয়ে থাকে। মুখটা ভোলা থাকে। শ দেড়েক গজ দূরে প্রহরীদের তাঁবু। গুহা থেকে সামান্য দূরে অপর একটি তাঁবু, যার বাইরে দুর্বল এক বৃদ্ধ বসে ঝিমুচ্ছিলো। দলনেতা তাকে পা দ্বারা খোঁচা দিয়ে জাগিয়ে বললো- ঐ দরবেশ! কোন কষ্ট হচ্ছে না তো? ভাত-পানি পাচ্ছো ঠিক মতো? বৃদ্ধ দুর্বল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে- জনাব! আমাকে কবে মুক্তি দেবেন? এবার আমাকে যেতে দিন। নেতা তাচ্ছিল্যের সুরে বললো- অপেক্ষা করো, অনেক পুরস্কার পাবে। এই লোকটাই বোধ হয় সেই দরবেশ, তুমি যার কথা বলেছিলে।

হ্যাঁ- হাসান আল-ইদরীস বললো- এ খৃস্টানদের সেই নাটক, যেটি মসুলের জনসাধারণ ও তাদের গবর্নর ইযযুদ্দীনকে পর্যন্ত মাতাল বানিয়ে রেখেছে। আসো রাদী। দুজনে মিলে আল্লাহর নিকট তোমার জীবনের সব পাপের ক্ষমা আদায় করে নিই।

দুজন রওনা হয়ে যায়। তবে চুপিসারে। রাতের আঁধার তাদের সহায়তা করছে। দুটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী সরুপথে কান খাড়া রেখে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে এগিয়ে চলে। যে স্থানটায় দুজন প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে, সে পর্যন্ত পৌঁছে যায়। প্রহরীদের নিকট একটি প্রদীপ জ্বলছে, যার লাঠিটা মাটিতে গাড়া। হাসান আল-ইদরীস ও রাণী তাদের থেকে পনের-বিশ পা দূরে লুকিয়ে থাকে। দুজনই জীবন বাজি রাখতে এসেছে। আল্লাহ দেখছেন। হাসান আল-ইদরীস রাদীকে এক ধারে সরিয়ে দিয়ে নিজে বসে পড়ে। এক সান্ত্রী কে? হাঁক দিয়ে এদিকে এগিয়ে আসে। অন্ধকারে লোকটা কিছুই দেখলো না। হাসান আল ইদরীস পেছন থেকে তার ঘাড়টা এক বাহুতে জড়িয়ে ধরে অপর হাতে তার হৃদপিণ্ডের উপর খঞ্জর দ্বারা তিন-চারটা আঘাত হানে। সান্ত্রী লুটিয়ে পড়ে যায়।

হাসান আল-ইদরীস অপেক্ষা করতে থাকে। অপর সান্ত্রী তার সঙ্গীকে ডাক দেয়। কোন সাড়া না পেয়ে সে ধীর পায়ে এদিকে এগিয়ে আসে। মৃত সঙ্গীর লাশের নিকট এসেই অন্ধকারে মাটিতে কিছু একটা পড়ে আছে অনুভব করে। নত হয়ে দেখে। অমনি সেও হাসান আল ইদরীসের পাঞ্জায় এসে পড়ে।

রাদী অপেক্ষা না করে গুহার দিকে ছুটে যায়। মাটি থেকে প্রদীপটা তুলে হাতে নিয়ে গুহার ভেতরে ঢুকে পড়ে। হাসান আল-ইদরীস অপর সান্ত্রীকেও শেষ করে দেয়।

অন্যান্য প্রহরীরা তাঁবুতে ঘুমিয়ে আছে। হাসান আল-ইদরীস রাদীকে ডাক দেয়। কিন্তু রাণী ওখানে নেই। হাসান গুহার দিকে ছুটে যায়। সেখানেও প্রদীপ জ্বলছে না।

ইতিমধ্যে গুহায় একটা শিখা জ্বলে ওঠে। রানী দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। তার পরিধানের কাপড়ে আগুন ধরে গেছে। গুহায় ঢুকে মেয়েটা তরল দাহ্য পদার্থের একটা মটকা উপড় করে ফেলে দিয়ে প্রদীপ থেকে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তার জানা ছিলো না, এই পদার্থ কিভাবে খপ করে জ্বলে ওঠে। শিখা ছড়িয়ে গিয়ে তাকেও জড়িয়ে ফেলে। হাসান আল-ইদরীস যখন তার কাছে গিয়ে পৌঁছে, ততোক্ষণে তার রূপময় মুখমণ্ডলটা ঝলছে গেছে। রেশমের ন্যায় চুলও পুড়ে গেছে রাদীর। তার কাপড়ের আগুন নেভাতে গিয়ে হাসান আল-ইদরীস নিজের হাতও পুড়ে ফেলে। রাদীর কাপড়ের আগুন নিভে গেছে ঠিক; কিন্তু তার চৈতন্য হারাবার উপক্রম হয়ে পড়েছে।

হাসান আল-ইদরীস রাদীকে কাঁধে তুলে নিয়ে ছুটতে শুরু করে। নিষিদ্ধ অঞ্চল থেকে বেরিয়ে আসে। সামনের অঞ্চলটা তার পুরোপুরি চেনা। গুহায় লাগানো আগুনের তাপে মুখবদ্ধ তেলের মটকাগুলো এমন ভয়ানক শব্দে বিস্ফোরিত হতে শুরু করে যে, জমিন ভূমিকম্পের ন্যায় কেঁটে ওঠে। হাজার হাজার মটকা একসঙ্গে ফেটে যায়। তাতে খৃস্টানদের সংগৃহীত বিধ্বংসী সকল যুদ্ধ সরঞ্জাম ধ্বংস হয়ে যায়।

বিস্ফোরণ মসুল নগরীকে জাগিয়ে তোলে। মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। কী ঘটেছে কেউ বলতে পারছে না।

হাসান আল-ইদরীস নগরীতে ঢুকতে পারছে না। কারণ, নগরীর ফটক বন্ধ। সে মসুলের পরিবর্তে নাসীবা অভিমুখে রওনা হয়ে পড়ে।

হাসান এখন বিপদমুক্ত। রাদী তার কাঁধে। অনেক দূর যাওয়ার পর হাসান ক্লান্ত হয়ে পড়ে। দাঁড়ায়। রাদীকে মাটিতে শুইয়ে দেয়। রাদী ফিসফিসিয়ে বলে- আগুন আমাকে পবিত্র করে দিয়েছে। মেয়েটা বিড় বিড় করতে শুরু করে- কাফেলা হেজাজ যাচ্ছে। ওখানে গিয়ে আমরা বিয়ে করবো।

রাদী! রাদী! হাসান আল-ইদরীস রাদীকে ডাকে।

আল্লাহ আমার পাপ ক্ষমা করে দিয়েছেন, না? রাদী জিজ্ঞেস করে। মেয়েটা উঠে বসে বাহু দুটো সম্মুখে এগিয়ে ধরে বললো- আমি যাচ্ছি। কাফেলা হেজাজ যাচ্ছে। আমিও যাচ্ছি।

রাদী একদিকে পড়ে যায়। হাসান আল-ইদরীস তাকে ডাকে। ধরে নাড়ায়। শেষে শিরায় হাত রাখে। রাণীর আত্মা হেজাজের কাফেলার সঙ্গে চলে গেছে।

হাসান আল-ইদরীস খঞ্জর দ্বারা কবর খনন করে। দুআড়াই ফুট গভীর আর রাদীর সমান লম্বা একটা কবর খুঁড়তে তার ভোর হয়ে যায়। রাদীকে সেই কবরে শুইয়ে রেখে উপরে মাটি চাপা দেয়।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী যখন খৃস্টানদের অস্ত্র ও দাহ্য পদার্থের ডিপো ধ্বংস হওয়ার সংবাদ পান, তখন তিনি তালখালেদ অভিমুখে অগ্রযাত্রা করছিলেন। তালখালেদ বিশাল একটি সাম্রাজ্য, যার শানসকর্তা সুকমান আল-কিবতী শাহ আরমান। সে সময় তিনি মসুলের শাসনকর্তা ইযযুদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য হারযাম নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য শাহ আরমানের ইযযুদ্দীনকে সাহায্য দেয়ার কথা। সে বিষয়ে আলোচনার জন্যই তাদের এই সাক্ষাৎ। সুলতান আইউবী সময়ের আগেই এক বৈঠকের সংবাদ পেয়ে গেছেন। তিনি শাহ আরমানের রাজধানী তালখালেদ অবরোধ করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন।

[সপ্তম খণ্ড সমাপ্ত]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *