৭.৪ শরাব নয় শরবত

শরাব নয় শরবত

ইযযুদ্দীনের মহলের আভ্যন্তরীণ জগতের গোপন তথ্যাদি অবহিত করে রোজি খাতুনের পায়ের তলার মাটি সরিয়ে দিয়েছে খাদেমা। রোজি খাতুন যেসব স্বপ্ন দেখে হাবের গভর্নর ইযযুদ্দীনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন, সেসব স্বপ্ন থেকে তিনি জাগ্রত হয়ে গেছেন।

রোজি খাতুন এক মহান নারী। ইসলামে ইতিহাস সৃষ্টিকারী এক বীর মুজাহিদা। মৃত স্বামী নূরুদ্দীন জঙ্গী এবং পাসেবানে ইসলাম সালাহুদ্দীন আইউবীর ন্যায় রোজি খাতুনও ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এবং সালতানাতে ইসলামিয়ার ঐক্য সম্প্রসারণের জন্য জন্মেছিলেন। খাদেমা তাকে যেসব তথ্য অবহিত করেছে, সেসব যদি সত্য ও বাস্তব হয়ে থাকে, তাহলে তার অর্থ হচ্ছে- এই বীর নারীর স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে এবং তার তরবারীটাকে ভোলা বানিয়ে তাকে কয়েদীতে পরিণত করা হয়েছে। তার যুবতী কন্যা শামসুন্নিসা এ মহলেই অবস্থান করছে। অথচ, এখনো মেয়ের সঙ্গে তার দেখা মেলেনি।

পিতা নূরুদ্দিন জঙ্গীর মৃত্যুর সময় শামসুন্নিসার বয়স ছিলো আট-নয় বছর। তার বড় এবং একমাত্র ভাই আল-মালিকুল সালিহর এগারো। জঙ্গীর মৃত্যুর পর ক্ষমতালোভী চাটুকাররা তাঁর এই এগারো বছরের বালক পুত্রটাকে খলীফা নিযুক্ত করে পুতুল রাজায় পরিণত করে। সুলতান সালাহুদ্দীন এই ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে দেশ রক্ষার জন্য মিসর থেকে দামেশক এসেছিলেন। তার আগমনের ধরনটা ছিলো একরকম সেনা অভিযানের মতো। জঙ্গীর বিধবা রোজি খাতুনের প্রচেষ্টা ও সর্বাত্মক সহযোগিতায় দামেশকের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আল-মালিকুস সালিহ বিপুলসংখ্যক সৈন্যসহ পালিয়ে হাল্ব চলে যান। বোন শামসুন্নিসাকেও সঙ্গে নিয়ে যান। মা রোজি খাতুন দামেশকে থেকে যান এবং খৃস্টানদের বিরুদ্ধে জিহাদে রত থাকেন। শামসুন্নিসা পনের বছরে উপনীত হলে ভাই আল-মালিকুস সালিহ রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুশয্যায় শায়িত হন। তিনি মাকে এক মজর দেখার আকাঙ্খা ব্যক্ত করলে শামসুন্নিসা দামেকে মায়ের নিকট গিয়ে আর্জি পেশ করে, আপনার একমাত্র পুত্র মৃত্যুশয্যায় শায়িত, তিনি আপনার সাক্ষাৎ কামনা করছেন।

রোজি খাতুন স্পষ্ট অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন- তোমার ভাই যেদিন সুলতানের আসনে আসীন হয়েছিলো এবং সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে। তরবারী উত্তােলন করেছিলো, সেদিনই তার মৃত্যু হয়ে গেছে। শামসুন্নিসা ফিরে যায়। ততোক্ষণে ভাই আল-মালিকুস সালিহ দুনিয়া থেকে চলে গেছেন।

আজ রোজি খাতুন পুত্র যে মহলে মৃত্যুবরণ করেছিলো, তার স্থলাভিষিক্ত ইযযুলীনের স্ত্রী হয়ে সেই মহলে আগমন করেছেন। কন্যা শামসুন্নিসা- যে কিনা এই মহলেই অবস্থান করছে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেনি। রোজি খাতুন খাদেমাকে জিজ্ঞেস করেন- শামসুন্নিসা কোথায়? আমি কি তার সঙ্গে দেখা করতে পারবো?

সে এখানেই আছে- খাদেমা জবাব দেয়- মনিবকে জিজ্ঞেস করুন, তার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন কিনা। যদি কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়ে থাকে, তাহলে আমি গোপনে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করবো।

তুমি তোমার দলের যে কমান্ডারের কথা বলছে, তার সঙ্গে আমি সাক্ষাৎ করতে পারবো কি? রোজি খাতুন জিজ্ঞেস করেন।

কটা দিন যাক- খাদেমা উত্তর দেয়- দেখি আপনার উপর কী কী বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। পরিস্থিতি অনুপাতে সব সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। আপনার বিয়েটা হঠাৎ হয়েছে এবং এতো দ্রুত যে, আমরা আগে জানতেই পারিনি। অন্যথায় এ বিয়ে হতে দিতাম না।

আচ্ছা, আমি কীভাবে বিশ্বাস করবো, তুমি আমার সমর্থক এবং আমার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করছে না? রোজি খাতুন সরল মনে জিজ্ঞেস করেন।

খাদেমার ঠোঁটে হাসি দেখা দেয়। রোজি খাতুনকে গভীর দৃষ্টিতে দেখে বললো- আমি যদি কোন ধনাঢ্য নারী হতাম, কোন প্রাসাদের রাজকন্যা হতাম কিংবা আমার মর্যাদা যদি আপনার ন্যায় হতো, তাহলে আপনি আমাকে এরূপ প্রশ্ন করতেন না। আপনি প্রতিটি মিথ্যাকে সত্য বলে মেনে নিয়ে প্রতারণার শিকার হতেন। আমার অবস্থান তো এমন যে, আমার সত্যটাও মিথ্যা বলে মনে হবে। এখনো কি আপনার এই অভিজ্ঞতা হয়নি, সততা, বিশ্বস্ততা ও চেতনা শুধু গরীবদেরই হৃদয়ে বিদ্যমান থাকে। অনাগত ভবিষ্যই বলে দেবে আপনাকে কার উপর আস্থা রাখা উচিত- একজন গরীব সেবিকার উপর, নাকি হালবের রাজার উপর, যিনি আপনার স্বামীও বটে। আপনি আমাকে বিশ্বাস করার ঝুঁকি বরণ করে নিন আর দুআ করুন, আল্লাহ যেনো আপনার ও আমাদের সাহায্য করেন।

খাদেমা কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। রোজি খাতুন চিন্তার সাগরে হাবুডুবু খেতে শুরু করেন। রাজকীয় এই কক্ষটা তার কাছে মনে হচ্ছে আস্ত একটা জাহান্নাম।

দু-তিন দিন হয়ে গেলো রোজি খাতুন ইযযুদ্দীনের দেখা পাচ্ছেন না। কক্ষে খাবার-পানীয় ইত্যাদি সব এসে যাচ্ছে যথারীতি। তার কখন কী প্রয়োজন হয়, সমাধার জন্য সেবিকাগণ মহাব্যস্ত। যেন তিনি এই মহলের রাণী। কিন্তু এই রাজকীয় আয়োজন তাকে মানসিকভাবে নিদারুণ পীড়া দিয়ে যাচ্ছে। তিনি একজন সুলতানের বিধবা। স্বামীর জীবদ্দশায় কখনো তিনি নিজেকে রাণী কিংবা রাজকন্যা ভাবেননি। তার প্রত্যয় ছিলো, তিনি পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হবেন, মাঠে-ময়দানে শক্রর মুখোমুখি যুদ্ধ করবেন এবং একদিন শহীদের মর্যাদা লাভ করবেন।

হঠাৎ একদিন ইম্যুদীন তার কক্ষে এসে প্রবেশ করেন এবং ব্যস্ততার কারণে এতোদিন আসতে পারেননি বলে ওজরখাহী করেন।

আপনি আসেননি বলে আমার কোন অভিযোগ নেই- রোজি খাতুন বললেন- আমি এখানে মূলত বধূ হয়ে আসিনি। আপনি প্রতি মুহূর্তে আমার সঙ্গে থাকুন কিংবা প্রতিরাত আমার সাথে সময় অতিবাহিত করুন, এরূপ আকাঙ্খা আমার নেই। আমার দাম্পত্য জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় নিঃসঙ্গ কেটেছে। মরহুম নূরুদ্দীন জঙ্গী রণাঙ্গনে থাকতেন আর আমি তার নয়- তার লাশের অপেক্ষায় থাকতাম। যে সময়টা তিনি যুদ্ধের ময়দানে থাকতেন না, সে সময়টা রাজ্যের বিভিন্ন কাজ এবং ফৌজের প্রশিক্ষণে ব্যস্ত থাকতেন। আমাকে দেয়ার মতো সময় তিনি তেমন একটা পেতেন না। কিন্তু সেখানে আমিও ব্যস্ত থাকতাম। সালতানাতের কিছু কিছু কাজের তত্ত্বাবধান ও শহীদ পরিবারের দেখাশোনা আমার উপর ন্যস্ত ছিলো। আমি মেয়েদেরকে আহত যোদ্ধাদের ব্যান্ডেজ, তরবারী চালনা, তীরন্দাজি ও অশ্বচালনার প্রশিক্ষণ দিতাম। ওখানে আমি এক কক্ষে বন্দী ছিলাম না, যেমনটা এখানে আছি। এই বন্দিদশা আমি পছন্দ করি না।

রোজি খাতুন খাদেমার নিকট থেকেই ইযযুদ্দীনের মতলব জানতে পেরেছেন। তাই এই দ্বিতীয় স্বামীর মনভোলানো প্রেমনিবেদনে প্রবঞ্চিত হতে প্রস্তুত নন তিনি। একবার মাত্র এবং আজই তিনি নিজের উদ্দেশ্যের কথা ব্যক্ত করে ফেলবেন মনস্থ করেন রোজি খাতুন। রোজি খাতুন ছোট্ট খুকি নয়- একজন পরিপক্ক অভিজ্ঞ নারী।

কিন্তু আমাকে এই কক্ষে যেভাবে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে এটা আমার পছন্দ নয়- রোজি খাতুন বললেন- আমি আপনার হেরেমের দাসী-গোলাম নই। আপনি আমাকে এভাবে রাখতে পারেন না।

রোজি খাতুন!- ইযযুদ্দীন কক্ষে পায়চারি করতে করতে বললেন নূরুদ্দীন জঙ্গীর সংসারে তুমি যে দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করেছে, সেই ধারা এখানে তোমাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। তিনি তোমাকে যে স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিলেন, তা আমার পছন্দ নয়। আর কোন স্বামীই এই জীবনধারা মেনে নিতে পারে না। তুমি যদি বাইরে বেড়াতে যেতে চাও তো তোমার জন্য ঘোড়াগাড়ি প্রস্তুত আছে। যখন খুশি তুমি বেড়িয়ে আসতে পারো।

যার মহলের অভ্যন্তরে ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি নেই, সে আবার বাইরে বেড়ানোর অনুমতি কী করে পেতে পারে?- রোজি খাতুন প্রশ্ন করেন- আপনি কি সত্যিই নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমি মহলের ভেতর ঘোরাফেরা করতে পারবো না?

এই আদেশ আমি তোমার নিরাপত্তার জন্য দিয়েছি- ইযযুদ্দীন উত্তর দেন- তুমি তো জানো, হাল্ব ও দামেশকে কিরূপ গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো। সুলতান আইউবী তোমার পুত্রকে পরাজিত করে তাকে আনুগত্যের চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু এখানকার লোকজন অন্তর থেকে আইউবীর শত্রুতা ভুলতে পারেনি। মহলে এমন লোকও থাকতে পারে, যে তোমাকে এবং সুলতান আইউবীকে শত্রু মনে করে। সুলতান আইউবীর ফৌজের হাতে তাদের বাস্তুভিটা ধ্বংস হয়েছে এবং তাদের যুবক ছেলেরা নিহত হয়েছে। তারা জানে, তুমি আইউবীর সমর্থক এবং তার দামেক দখলে সহায়তা করেছে। তাদের কেউ তোমাকে খুন কিংবা অপহরণ করতে পারে।

তারা আপনাকেও হত্যা করতে পারে। কারণ, আপনি সালাহুদ্দীন আইউবীর বন্ধু ও জোটভুক্ত শাসক- রোজি খাতুন বললেন- তো যে লোকগুলো ইসলামী ঐক্যের বিরোধী তাদেরকে গ্রেফতার করা আবশ্যক নয় কি? আপনার নিকট কি এমন কোন গুপ্তচর নেই, যারা খুঁজে বের করে এদেরকে ধরিয়ে দিতে পারে?

আমি সকল ব্যবস্থাই করছি- ইযুদ্দীন এমনভাবে কথাটা বললেন যেনো তার কাছে এ প্রশ্নের উপযুক্ত কোন জবাব নেই- আমি তোমার জীবনটা ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষেপ করতে চাই না।

এই ঝুঁকি কি শুধু মহলের ভেতরে?- রোজি খাতুন জিজ্ঞেস করেন আপনি আমাকে ঘোড়াগাড়িতে চড়ে যেখানে খুশি ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি প্রদান করেছেন। বাইরেও তো কেউ আমাকে খুম কিংৰা গুম করতে পারবে।

ইফুদ্দীন উত্তর দিতে চাইলে রোজি খাতুন তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন- আমি আপনাকে শুধু এই উদ্দেশ্যে বিয়ে করেছি যে, নূরুদ্দীন জঙ্গী যে কাজ অসমাপ্ত রেখে দুনিয়া থেকে চলে গেছেন; আমি, সালাহুদ্দীন আইউবী আর আপনি মিলে কাজটা সমাপ্ত করবো। তার জন্য এখনো যদি আপনার পোষ্যদের মধ্যে আমাদের মিশন বিরোধী কেউ থেকে থাকে, তাদের নির্মূল করা এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এই ভূখণ্ড থেকে খৃস্টানদের উৎখাত করা জরুরি।

তোমার কি সন্দেহ আছে, আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর দলভুক্ত নই? ইযুদ্দীন বললেন।

আপনি কি আমাকে নিশ্চয়তা দিতে পারবেন, আমার পুত্র এই মহলের উপর খৃস্টানদের যে প্রভাব জন্ম দিয়ে গেছে, সব নির্মূল হয়ে গেছে- রোজি খাতুন জিজ্ঞেস করেন- আপনার সকল আমীর ও সালার কি বাগদাদের খেলাফতের অনুগত?

এখানে তুমি আমার স্ত্রী হয়ে এসেছো- দূত হয়ে নয়। ইযযুদ্দীন খানিকটা তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন।

আমি এখানে কী উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি, তা আপনাকে ব্যক্ত করেছি- রোজি খাতুন বললেন- আমি আমার পেটে আপনার সন্তান ধারণ করতে আর শুধু স্ত্রী হয়ে এই কক্ষে আবদ্ধ থাকতে আসিনি। আমি মহলের সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে এবং হাব খৃস্টানদের অপচ্ছায়া থেকে নিরাপদ আছি কিনা জানতে চাই। যদি না থাকে, তাহলে নগরকে নিরাপদ বানাতে হবে। কেউ আমাকে ঠেকাতে পারবে না।

আমি তোমাকে আরেকবার বলছি- ইযযুদ্দীন বললেন- আমার কাজে তুমি কোন বাধার সৃষ্টি করো না। তুমি আমার স্ত্রী। স্ত্রীর মর্যাদা নিয়েই থাকো। যদি মুক্ত হতে চেষ্টা করো, তাহলে বাইরে গিয়ে ঘুরে বেড়ানোর যে অনুমতি আমি তোমাকে দিয়েছি, সেটাও প্রত্যাহার করে নেবে।

আমি যদি আপনার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করি, তাহলে

তাহলে তুমি এই কক্ষে বন্দী হয়ে থাকবে- ইযযুদ্দীন বললেন তালাক পাবে না। আমি তোমাকে তালাক দেবো না।বলেই ইযযুদ্দীন বেরিয়ে যান।

***

আপনি ভুল করেছেন- খাদেমা রোজি খাতুনকে বললো। এতোক্ষণ পেছন দরজার সঙ্গে কান লাগিয়ে ইযুদ্দীন ও রোজি খাতুনের কথোপকথন শুনছিলো খাদেমা। ইযযুদ্দীন বেরিয়ে যাওয়ার পর খাদেমা পেছন দরজায় ভেতরে ঢুকে পড়ে।

খাদেমা বললো- আপনি যদি হটকারিতা দেখান, তাহলে লোকটা সত্যি সত্যিই আপনাকে এমন এক কারাগারে নিক্ষেপ করবে, যা হবে স্বাধীনতা; কিন্তু কয়েদ থেকে নিকৃষ্ট। আপনি মনিবের মনোভাব নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন। এখন আর তার সঙ্গে এ ধারায় কথা বলবেন না। তার সামনে হাসি-খুশি থাকবেন এবং বাহ্যত অনুভূতিহীন হয়ে যাবেন। আপনি যে ইচ্ছা ও স্বপ্ন নিয়ে এসেছেন, আমরা তা পূরণ করবো। মনিব আপনাকে বাইরে বের হয়ে ঘোড়াগাড়িতে চলে বেড়ানোর অনুমতি দিয়েছেন শুনে আমার আনন্দ লাগছে। আমি আপনাকে আমাদের কমান্ডারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাবো। আর ইসহাক তুর্কি যদি এসে পড়ে, তার সঙ্গেও সাক্ষাতের সুযোগ করে দেবো।

কে যেনো আস্তে করে দরজাটা ঠেলা দেয়। উভয়ে চাতক নয়নে দরজার দিকে তাকায়। আগন্তুক রোজি খাতুনের কন্যা শামসুন্নিসা। মেয়েটা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। ঠোঁটে মুচকি হাসি। কিন্তু চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে। ঠোঁটের হাসি ভেসে যাচ্ছে চোখের পানিতে। রোজি খাতুন উঠে এগিয়ে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন। মা-মেয়ে দুজনই কাঁদছেন। হেঁচকি শোনা যাচ্ছে উভয়ের। খাদেমা বাইরে বেরিয়ে যায়। বেশ সময় ধরে দুজনে আল-মালিকুস সারিহর কথা স্মরণ করে কাঁদতে থাকেন।

তুমি এতোদিন কোথায় ছিলে? রোজি খাতুন বললেন।

 চাচাজান (ইযযুদ্দীন) আমাকে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেননি।

কী কারণে সাক্ষাৎ করতে দেননি, তাকে জিজ্ঞেস করেছিলে?

করেছিলাম- শামসুন্নিসা উত্তর দেয়- তিনি স্পষ্ট কোন উত্তর দেননি। এইমাত্র বললেন, যাও মায়ের সঙ্গে দেখা করো। বলেছেন, তিনি অনেক ব্যস্ত থাকেন, তাই আমাকে বেশি বেশি সময় দিতে বলেছেন।

একথা কি বলেননি যে, মায়ের উপর দৃষ্টি রাখো আর আমাকে রিপোর্ট করো, তার কাছে কারা আসে এবং কী কী কথা হয়? রোজি খাতুন বললেন।

বলেছেন- শামসুন্নিসা সরল মনে উত্তর দেয়- তিনি এমন কিছু কথাও বলেছেন, যা আমি বুঝতে পারিনি। আমি তাকে বলেছি, ঠিক আছে বলবো। তিনি বলেছেন, তোমার মা খুব জেদি, সন্দেহপ্রবণ এবং ঝগড়াটে মনে হচ্ছে। তাকে বলবে, আমি খুব ব্যস্ত ও পেরেশান থাকি।

শোনো মেয়ে- রোজি খাতুন বললেন- তুমি বড় হয়েছে। সরল সিধা মন ত্যাগ করতে হবে। আমি বলছি না এখনই তোমার বিয়ে হওয়া দরকার। মুজাহিদদের মেয়ে হাতে রক্তের মেহেদী ব্যবহার করে। জীবন্ত জাতির মেয়েদের পালকি কমই বহন করা হয়। যুদ্ধের ময়দান থেকে তাদের লাশ বহন করা হয়ে থাকে। তোমার দুর্ভাগ্য হলো, তুমি তোমার ভাই এবং তার উপদেষ্টাদের ছায়ায় লালিত হয়ে বড় হয়েছে। এরা সবাই গাদ্দার। তোমার ভাইও গাদ্দার ছিলো। তুমি তোমার ভাইয়ের বাহিনীকে তোমার পিতার বাহিনী এবং সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দেখেছো! তোমার ভাই- আমি যাকে পুত্র বলতে লজ্জাবোধ করতাম- ক্রুসেডারদের বন্ধু ছিলো। তাদের বন্ধু, যারা তোমার ধর্মের শত্রু। তোমার পিতা সারাটা জীবন তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন।

ভাইয়া বলতেন, খৃস্টানরা খুব ভালো মানুষ- শামসুন্নিসা বলল তিনি সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে কথা বলতেন।

রোজি খাতুন কন্যা শামসুন্নিসাকে খৃস্টানদের চক্রান্ত-পরিকল্পনার কথা অবহিত করে বললেন- ইসলাম ও মুসলমানের শত্রুতায় তারা এতো কট্টর যে, তাদের বন্ধুত্বের মধ্যেও শত্রুতা থাকে। রোজি খাতুন বলে যাচ্ছেন আর শামসুন্নিসার চোখ খুলে যাচ্ছে। মায়ের মুখনিসৃত প্রতিটি শব্দ ও বাক্য তার মনের পর্দা খুলে দিয়ে। মায়ের মমতামিশ্রিত কথাগুলো মেয়ের মনে গেথে যাচ্ছে।

মুসলমানের কোন বন্ধু নেই- রোজি খাতুন বললেন- জগতের প্রতিটি বেঈমান জাতি মুসলমানের শত্রু। আর তাদের শত্রুতার সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর পন্থা বন্ধুত্ব। খৃস্টানরা হব, মসুল, হাররানের আমীরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে আমাদের জাতিকে দুভাগে বিভক্ত করে দিয়েছে। তোমার ভাই তাদের হাতের পুতুল ছিলো। উম্মতের ঐক্য বিনষ্ট করে জাতিকে বিভক্ত করা ছিলো তার মহা-অপরাধ। কেননা, এই বিভক্তি জাতির এক সদস্য দিয়ে অপর সদস্যকে খুন করায়। কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশ হচ্ছে কাফেরদের মোকাবেলায় সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় দণ্ডায়মান থাকো। আমরা ছিলামও তাই। কিন্তু কাফেররা বিলাসিতার উপকরণ আর নারীদের ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের সেই দেয়ালে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে। শয়তানের কাজে যাদুর ক্রিয়া থাকে। নারী, মদ, স্বর্ণমুদ্রা ও ক্ষমতার লোেভ মানুষকে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন করে রাখে। আমাদের বিপক্ষে শয়তানের এ কাজটা খৃস্টানরী করছে।

এসব আমি এই মহলে নিজ চোখে দেখেছি- শামসুন্নিসা বললো আমি তখন ছোট ছিলাম। কিছুই বুঝতাম না। ভাইয়া যখন আমাকে এজাজ দুর্গ ভিক্ষা চাওয়ার জন্য সুলতান আইউবীর নিকট প্রেরণ করেছিলেন, তখন আমি হেসে-খেলে এখানকার সালারদের সঙ্গে সুলতানের নিকট গিয়েছিলাম। কেউ আমাকে বলেনি, এসব কী ঘটছে। আমার জানা ছিলো না, এটা গৃহযুদ্ধ, যা মূলত খৃষ্টানদের কারসাজি। আমি কিছুই বুঝতাম না। আমার কিছু জানা ছিলো না মা! বলুন মা বলুন।

মনোযোগ দিয়ে শোনো- রোজি খাতুনের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে- এই মহলে এখনো শয়তানের রাজত্ব চলছে। আমি এখন বুঝতে পারছি, ইযযুদ্দীন বিয়ে করে আত্মাকে স্ত্রী নয়- কয়েদী বানিয়েছে। অথচ আমি: এই বিয়েতে শুধু এ জন্যই রাজি হয়েছিলাম যে, আমরা সুলতান আইউবীর বিরোধী যুদ্ধের সকল সম্ভাবনাকে দূর করে জাতির মান ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করবো এবং খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বো। কিন্তু জীবনে এই প্রথম আমি ধোঁকায় পড়েছি, যেটি কোন সাধারণ ধোকা ময়। তথাপি আমি আমার প্রত্যয় পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করবোই। আর এ কাজে তোমার সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।

বলুন আম্মা, আমাকে কী করতে হবে- শামসুন্নিসা বললো- আপনি এই প্রথমবার ধোকা খেয়েছেন আর আমি এই প্রথমবারের মতো বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হলাম। আমি ধোকা আর প্রতারণার মধ্যেই এতোদিন বড় হয়েছি। বলুন, আমার এখন করণীয় কী?

গুপ্তচরবৃত্তি। রোজি খাতুন মেয়েকে বিস্তারিত দিক-নির্দেশনা দিতে শুরু করেন।

শামসুন্নিসা যখন মায়ের কক্ষে প্রবেশ করে, তখন ছিলো বেপরোয়া ও উদাসীন মেয়ে। আর যখন বের হলো, তখন সে আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গকারী এক মুজাহিদ নারী। তার ব্যক্তিসত্তা ও ভাবনার জগতে এসেছে বিরাট বিপ্লব।

***

আপনাকে কে বললো, আমার মা ঝগড়াটে ও সন্দেহপ্রবণ শামসুন্নিসা ইব্‌যুদ্দীনকে বললো- আপনি তো জানেন তার জীবনটা কীভাবে অতিবাহিত হয়েছে। তিনি তো আপনাকেও আমার পিতা নূরুদ্দীন জঙ্গীর ন্যায় বিখ্যাত যোদ্ধা ও মুজাহিদে ইসলাম বানাতে চাচ্ছেন।

তোমার মা আমার কাজে হস্তক্ষেপ করতে চায়- ইযুদ্দীন বললেন- তার সন্দেহ, আমরা খৃস্টানদের বন্ধু।

আপনার কাজে হস্তক্ষেপ করতে আমি তাকে বারণ করেছি শামসুন্নিসা বললো- আপনি খৃস্টানদের সুহৃদ এই সন্দেহও তার থেকে দূর করে দিয়েছি। আপনি তাকে ভুল বুঝবেন না। আর তার উপর অপ্রয়োজনীয় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন না।

আমি কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করিনি- ইযযুদ্দীন বললেন- ঘোড়াগাড়ি সারাক্ষণ প্রস্তুত থাকে, তোমরা যখন খুশি ভ্রমণ করতে পারো।

ইনুদ্দীন শামসুন্নিন্সার রিপোর্ট সত্য বলে মেনে নেয়। কথোপকথন হচ্ছে ইষযুদ্দীনের দফতরে। আলাপ শেষে শামসুন্নিসা বেরিয়ে এসে দেখে, আমের ইবনে ওসমান দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার বয়স এখনো ত্রিশের নীচে। সুঠাম আকর্ষণীয় এক যুবক। তীরন্দাজ ও তরবারী চালনায় ভার জুড়ি নেই। মেধাও খুব প্রখর। আল-মালিকুল সালিহর বিশেষ রক্ষী বাহিনীর কমান্ডার ছিলো। বাসগৃহ মহলেরই ভেতরে। অল্প কদিন হলো শামসুন্নিসাকে ভালো লাগতে শুরু করেছে তার। সহজ সরল রূপসী মেয়ে শামসুন্নিসা। পিতার ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে কেউ কোনদিন তাকে ধারণা দিতে হয়নি। মহলের একজন বিশ্বস্ত মেয়ে হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিলো। ভাইয়ের মৃত্যুর পর সরল মেয়ে মনে করে ইযুদ্দীন তাকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এই সুযোগে আমের ইবনে ওসমানের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হতো।

এখন শামসুন্নিসা ষোল বছরের যুবতী। সে যুগের মেয়েরা উচ্চতা ও আকার-গঠনে বয়সের চেয়ে বড় মনে হতো এবং অনেকে এই বয়সেই দুএকটি সন্তানের মা হয়ে যেতো। শামসুন্নিসা শাসক পরিবারের কন্যা। অর্থাৎ রাজকন্যা। আল্লাহ তাকে যে রূপ দান করেছিলেন, তার চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় মনে হতো তাকে। তার এই রূপসাগরে সাঁতার কাটতে শুরু করেছে আমের ইবনে ওসমান। তাদের মাঝে গোপনে দেখা সাক্ষাৎ হতো। তবে এই প্রেম ছিলো পবিত্র। যার তীব্রতা দুজনকে গভীরভাবে একে অপরের অনুরক্ত বানিয়ে রেখেছিলো। পরস্পর বিয়ের প্রতিশ্রুতি নিয়ে রেখেছে তারা। তবে সমস্যা হচ্ছে, আমের ইবনে ওসমান শামসুন্নিসার বংশের একজন নিম্ন পর্যায়ের চাকর। তাকে স্ত্রীরূপে লাভ করার স্বপ্ন তার পক্ষে ছিলো কল্পনা মাত্র। তথাপি শামসুন্নিসাকে পাওয়ার আশায় বাবা-মার পছন্দ করা মেয়েকে প্রত্যাখ্যান করেছে সে।

শামসুন্নিসা যখন ইযুদ্দীনের দফতর থেকে বের হয়, তখন আমের ইবনে ওসমান বাইরে দণ্ডায়মান। শামসুন্নিসা তাকে দেখে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বিশেষ ভঙ্গিতে ইশারা করে চলে যায়। আমের তার ইঙ্গিতের মর্ম ভালোভাবে বুঝে। সে মাখ দুলিয়ে জবাব দেয়- যাও, আসছি।

***

জায়গাটা গাছপালা, লতাপাতায় সুশোভিত। উপরটা রাতের আঁধারের চাদরে ঢাকা। মহলের জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশ ছেড়ে আমের ইবনে ওসমান ও শামসুন্নিসা এখানে উপবিষ্ট। যৌবনদীপ্ত উন্মাতাল ভালেবাসার মাদকতায় আচ্ছন্ন দুজন।

আমি আজ মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি- শামসুন্নিসা বললো এখন থেকে তার সঙ্গে থাকবে।

তোমার মা-ও তো রাজ পরিবারের মেয়ে- আমের বললো- তিনি তোমাকে রাজপুত্র ছাড়া কারো সঙ্গে বিয়ে দেবেন না নিশ্চয়ই।

না- শামসুন্নিসা বললো- মা রাজ পরিবারের মেয়ে বটে কিন্তু তিনি সেই তাঁবুকে বেশি পছন্দ করেন, যেটি রণাঙ্গনের একেবারে সন্নিকটে স্থাপিত হয়। আমাকে তিনি সৈনিক বানাতে চান।

আমি কি আশা করতে পারি, তুমি তার সঙ্গে আমার ব্যাপারে কথা বলবে এবং তিনি বিষয়টা মেনে নেবেন? আমের জিজ্ঞেস করে।

আমার উপর তিনি যে দায়িত্ব অর্পন করেছেন, আমি যদি তা পালন করতে সক্ষম হই, তাহলে তিনি অবশ্যই আমার সকল মনোবাঞ্ছা পূরণ করবেন– শামসুন্নিসা উত্তর দেয়- তার এই বাসনা পূরণে তোমাকেও দায়িত্ব পালন করতে হবে।

কেন, তিনি আমার নাম নিয়ে কিছু বলেছেন কি? আমের জিজ্ঞাসা করে।

না- শামসুন্নিসা উত্তর দেয় আমাকে তিনি তার উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন, যার বাস্তবায়নে তার আমাকে প্রয়োজন। আর আমার প্রয়োজন তোমাকে। কিন্তু তার আগে শপথ নিতে হবে, আমাকে সাহায্য করো আর না করো, আমাদের তৎপরতার কথা গোপন রাখবে।

যদি শপথ না নেই, তাহলে? আমের মুচকি হেসে শামসুন্নিসাকে টেনে কাছে এনে বসায়।

শামসুন্নিসা দূরে সরে যায়। প্রেম-পিপাসায় মাতাল আমের ইবনে ওসমান.। শামসুন্নিসা বললো- আমি আগেও ওয়াদা করেছি এবং আজো প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছি, আমার যদি বিয়ে হয় তোমার সঙ্গেই হবে। কিন্তু তার আগে আম্মা আমার উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, সেটি সম্পাদন করতে হবে।

আমের ইবনে ওসমান এই ভেবে বিস্মিত হয় যে, শামসুন্নিসাকে ইতিপূর্বে কখনো এতো কর্তব্যপরায়ণ ও আবেগপ্রবণ দেখা যায়নি। সে মুখে বিস্ময়ভার টেনে বললো- তোমার হৃদয়ে আমাকে ভালোবাসার এই কি নমুনা যে, তুমি আমার থেকে শপথ নেয়া প্রয়োজন মনে করছো?

কাজটা এমনই যে, শপথ নেয়া জরুরি- শামসুন্নিসা উত্তর দেয় আমি তো আম্মার আদেশ পালনার্থে জীবন কুরবান করতেও প্রস্তুতি আছি। তখন বোধ হয় আমার সঙ্গ দেয়া তোমার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে।

তোমার ভালোবাসার খাতিরে আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত।  

না- শামসুন্নিসা বললো- ভালোবাসার খাতিরে নয়, জীবন দিতে হবে ইসলামের মর্যাদার খাতিরে। তবে সেই ইসলাম নয়, যে ইসলাম আমরা এই মহলে দেখতে পাচ্ছি। আমি সেই ইসলামের কথা বলছি, যার খাতিরে আমার পিতা কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জীবন অতিবাহিত করেছেন এবং সুলতান আইউবীও তারই জন্য লড়াই করছেন।

আমি আল্লাহর নামে শপথ করছি, এ কাজে আমাকে যে দায়িত্ব অর্পণ করা হবে, জীবন বাজি রেখেও তা পালন করবো- আমের ইবনে ওসমান শামসুন্নিসার ডান হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে বললো- আমি যদি এই শপথ ভঙ্গ করি, তাহলে আমাকে জীবনে মেরে ফেলো এবং আমার লাশটা কুকুর-শিয়ালকে খেতে দিও। এবার বলো, আমাকে কী করতে হবেঃ

গোয়েন্দাগিরি- শামসুন্নিসা বললো- সুলতান আইউবী মিসরে আছেন। তিনি এই আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত যে, তিনি আমার ভাই আল মালিকুস সালিহর সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং ভবিষ্যতে যুদ্ধ না করার যে চুক্তি করেছিলেন, তার মৃত্যুর পরও তা বহাল আছে। কিন্তু তুমি হয়তো অবগত আছে, এই চুক্তি থাকা সত্ত্বেও হাবের শাসন ক্ষমতা ক্রুসেডারদের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। সুলতান আইউবী ইযযুদ্দীনকে বন্ধু মনে করলেও আমার মা অন্য আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।

মনিবের সাথে তোমার মায়ের বিয়ের পর এখন তো কোন শঙ্কা থাকার কথা নয়। আমের বললো।

আসল বিপদ তো সেখান থেকেই শুরু- শামসুন্নিসা বললো- এই বিবাহ মূলত বন্দী জীবন, আমার মাকে যার শিকলে বাঁধা হয়েছে। ইযুদ্দীন বিবাহটা এই উদ্দেশ্যে করেছেন, যাতে দামেশকবাসীকে সঠিক পথ দেখানোর মতো কেউ না থাকে। আমাদেরকে এই মহলের সকল গোপন তথ্য সংগ্রহ করে কায়রো পৌঁছাতে হবে। এও জানতে হবে, খৃস্টানদের উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা কী? তারা কি পুনরায় আমাদের বাহিনীকে গৃহযুদ্ধের আগুনে পোড়াতে চায়, নাকি অন্য কোন সামরিক পদক্ষেপ নিতে চায়। তুমি এমন এক অবস্থানে আছে, যেখান থেকে অনেক কিছুই দেখতে পাও। কারণ, তুমি ইযযুদ্দীনের খাস রক্ষী বাহিনীর কমান্ডার।

আমি তোমার কথা বুঝতে পেরেছি- আমের বললো- তুমি ঠিকই বলেছে, আমি এমন এক অবস্থানে আছি, যেখান থেকে অনেক কিছু দেখি। শোন শামসী! আমি এযাবত যা কিছু দেখে আসছি, বিষয়গুলো কখনোই গভীরভাবে চিন্তা করিনি, যার ফলে মুজাহিদ থেকে চাকরে পরিণত হয়েছি। সৈনিক যখন মুজাহিদ থেকে বেতনভোগী কর্মচারিতে পরিণত হয়, তখন এমনই ঘটে। আমাদের মহলে এখন তাই ঘটছে। সৈনিক যখন চাকরি নেয়, তখন সে শত্রুর রক্ত ঝরানোর পরিবর্তে চাটুকারিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে, যাতে মনিব তার উপর সন্তুষ্ট থাকেন। খুন আর তোষামোদে সেই পার্থক্য, যে পার্থক্য জয় আর পরাজয়ের মাঝে। আমাকে কখনো কেউ বলেনি, একজন সৈনিকের কর্তব্য শুধু বাইরের আক্রমণ প্রতিহত করাই নয়, ভেতরের সমস্যার মোকাবেলা করাও তার দায়িত্ব। কেউ আমাকে বলেনি, সৈনিকের এটাও কর্তব্য যে, দেশ ও জাতির জন্য যদি শাসকের পক্ষ থেকে সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে তার বুকটা তীরের আঘাতে ঝাঁঝরা করে দুর্গের বাইরে ছুঁড়ে ফেলতে হবে। তুমি আমাকে দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। বলো, কাউকে খুন কতে হবে নাকি ভেতরের গোপন খবরাখবর সগ্রহ করলেই চলবে?

দুটোই করতে হবে- শামসুন্নিসা বললো- তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে যদি কোন গাদ্দারকে খতম করতে হয় পরোয়া করবে না।

শোনো শামসী- আমের ইবনে ওসমান বললো- এখন আমি সরকারি কর্মচারি হিসেবে নয় একজন মুজাহিদ হিসেবে কথা বলবো। হবের শাসকমণ্ডলী এবং কতিপয় সালারের উপর আস্থা রাখা যায় না। ইযযুদ্দীন যদি নিষ্ঠাবান এবং সত্যমনে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বন্ধু হতেন, তবুও তিনি হাবের বাহিনীকে মিসরের সহযোগি বানাতে পারবেন না। তার প্রশাসনিক কর্মকর্তা, উপদেষ্টা ও উজির-মন্ত্রীবর্গের ঈমান খৃস্টানরা ক্রয় করে নিয়েছে। তোমার ভাইয়ের মৃত্যুর পর তারা ইযুদ্দীনকে এমনভাবে পেরেশান করতে শুরু করেছে যে, কারণে অকারণে তারা কোষাগারের অর্থে হাত দিতে শুরু করেছে। রাষ্ট্রীয় কোষাগার দ্রুত শূন্য হয়ে যাচ্ছে। আমার ধারণা, এটি একটি ষড়যন্ত্র। যার উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোষাগার শূন্য করে ইযুদ্দীনকে বাধ্য করা যেনো তিনি খৃস্টানদের কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা করেন। আর ইযযুদ্দীনও যে যা চাইছেন, দিয়ে দিচ্ছেন।

তার অর্থ হচ্ছে, ইষযুদ্দীন দুর্বল শাসক। শামসুন্নিসা বললো।

তার দুর্বলতা হলো, তিনি ক্ষমতার মসনদ ছাড়তে চাচ্ছেন না। আমের ইবনে ওসমান বললো। আমি তার যেসব বক্তব্য শুনেছি তাতে প্রমাণিত হয়, ক্ষমতা অটুট রাখতে তিনি খৃষ্টানদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধছেন। আমি তার এবং তার উপদেষ্টাদের কথাবার্তা মনোযোগ সহকারে শুনবো আর তোমাকে জানাতে থাকবো।

এণ্ড মাথায় রাখতে হবে যে, এখানে খৃস্টানদের গুপ্তচর তৎপর রয়েছে- শামসুন্নিসা বললো- আর আমাদের গোয়েন্দারাও কাজ করছে। তোমার সাথে হয়তো তাদের সাক্ষাৎও ঘটবে। শামসুন্নিসা মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে- তোমার সুদানী পরীটা কি হালে আছে, খবর-টবর কি রাখে?

রাখে- আমের জবাব দেয়- পরশু তার সাথে দেখা হলে সে কেঁদে ফেললো। বললো একটিবারের জন্য হলেও তার কক্ষে যেনো যাই। শোনো শামসী! মেয়েটাকে আমার ভয় করছে। তার জালে আটকা পড়লে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব হবে না। আমি তাকে এ জন্য ভয় করছি না যে, মেয়েটা রূপসী। ভয় হলো, মেয়েটা হাবের গভর্নর ইযযুদ্দীনের হেরেমের অধিপতি। তার নাম আনুশি। মহলের লোকেরা তাকে সুদানী পরী বলে ডাকে। ইযুদ্দীন কিংবা তার কোন আমীর-উজির যদি জেনে ফেলে আমাকে সে ভালোবাসে, তাহলে মাশুল দিতে হবে আমাকে। আমার ভয়, আমি তার কথায় রাজি না হলে সে হয়তো মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আমাকে জেল খাটাবে।

সে বোধ হয় তোমার-আমার ভালোবাসার কথা জানে না, না? শামসুন্নিসা জিজ্ঞেস করে।

যেদিন জানতে পারবে, সেই দিনটা তোমার-আমার জীবনের শেষ দিন হবে- আমের জবাব দেয়- তোমাকে ক্ষমা করা হলেও, আমি ক্ষমা পাবো না।

আনুশি মূলত খৃস্টানদের প্রেরিত উপহার। মেয়েটি হাবে এসে পৌঁছার পরপরই আল-মালিকুস সালিহ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অবশেষে মারা যান। ইযুদ্দীন এসে হাবের শাসন ক্ষমতা হাতে নিতেই খৃস্টানরা আনুশিকে তার খেদমতে পেশ করে। সেই সঙ্গে ইযযুদ্দীন রোজি খাতুনকেও বিয়ে করে ঘরে তোলেন। সে যুগের নিয়ম ছিলো, বিবাহিত স্ত্রী ও হেরেমের মেয়েরা আলাদা থাকতো। ইহুদী-খৃস্টানরা তাদের এই রীতিকে পাকাঁপোক্ত করার জন্য মেয়ে উপহার দিতো। তারা এভাবে উপহারের নামে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী চর প্রেরণ করতে থাকে।

আনুশি তেমনি এক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়ে। সে ইযযুদ্দীনের ভোজসভায় মদ পরিবেশনের দায়িত্ব পালন করছে। নিজেও মদপান করে। সে হাবের এমন দুজন প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে নিজের প্রতারণার ফাঁদে আটক করেছিলো, যাদের হাতে ছিলো হাবের অস্তিত্ব। মেয়েটি ইযুদ্দীনকে কজা করে নিয়েছিলো। আমের ইবনে ওসমান ইযযুদ্দীনের কাছে থাকতো। কেননা, সে ছিলো, তার ব্যক্তিগত রক্ষী। তার দৃষ্টি ছিলো ঈগলের ন্যায় প্রখর ও দূরদর্শী। আনুশি দেখলো, লোকটি যেমন সুদর্শন, তেমনি স্মার্ট।

সে আমেরকে ভালোবেসে ফেলে। আমেরের সঙ্গে প্রেম নিবেদন করতে শুরু করে। কিন্তু আমের তাতে সাড়া দেয়নি। কারণ, তার জানা ছিলো, হেরেমের হীরাটার সঙ্গে যদি কেউ কথা বলতেও দেখে, তাহলে তার পরিণতি হবে ভয়ঙ্কর। কিন্তু আনুশি তার পিছু ছাড়লো না।

আমি এই মহলের একজন কর্মচারি মাত্র- আমের একদিন মেয়েটিকে বললো- তোমার অন্তরে যদি আমার সত্যিকার ভালোবাসা থাকে, তাহলে তুমি আমাকে দয়া করো, আমার থেকে দূরে থাকো।

তোমার প্রতি চোখ তুলে তাকাবার সাহস কেউ পাবে না- আনুশি বললো- একটিবারের জন্য আমার কক্ষে আসো।

ঐ সময় আমের ও শামসুন্নিসার গোপন অভিসার চলছিলো।

***

সে সময়কার ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষ সাক্ষী কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ তাঁর রোজনামচায় লিখেছেন –

 ইযযুদ্দীন অনুভব করেন, মসুল ও সিরিয়ার শাসকদের নিজের অধীনে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারবেন না। তিনি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে প্রচণ্ড ভয় করতেন। তার অধীন আমীর-উজীরগণ তার নিকট যখন-তখন কারণে-অকারণে এত বেশি অর্থ দাবি করতে শুরু করে, যা দিতে তিনি ব্যর্থ হন। কেননা, রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ততো সম্পদ ছিলো না। আয়ের উৎসও ছিলো সীমিত।

বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ আরো লিখেছেন

ইযযুদ্দীনের ভয় ছিলো, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী অবশ্যই হাব দখল করে নেবেন। তিনি আইউবীর বিরুদ্ধে মুখোমুখি যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকতেন। তিনি তার এক সুযোগ্য ও দুঃসাহসী সালার মুজাফফর উদ্দীন কাকবুরীর সঙ্গে পরামর্শ করেন। এই পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত ছিলো সাত স্তর মাটির নীচে লুকানো এক গোপন রহস্য। মসুলের গভর্নর ছিলেন ইমুদ্দীনের ভাই ইমাদুদ্দীন, যিনি ছিলেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ঘোর বিরোধী। ইযযুদ্দীন মসুলের শাসনক্ষমতা হাতে নেন আর ইমাদুদ্দীন হাব এসে হাবের গভর্নর হয়ে যান। ক্ষমতার এই হাতবদল ছিলো উভয় নগরীর বাসিন্দাদের জন্য একটি রহস্যজনক ঘটনা।

কতিপয় ঐতিহাসিক এই ক্ষমতার রদবদল সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। একেকজন একেক অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সে সময়কার কাহিনীকারদের লেখনী থেকে কিছু গোপন বিষয়ের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ইযুদ্দীন যখন মসুলের সুর্গে গমন করেন, তখন রোজি খাতুন ও কন্যা শামসুন্নিসা তার সঙ্গে ছিলেন। তার ব্যক্তিগত রক্ষী বাহিনীও ছিলো, যার কমান্ডার ছিলো আমের ইবনে ওসমান। বিশাল এক বহর ছিলো। বহরে কয়েকটি উটের পাল্কি ছিলো, যেগুলো চারদিক থেকে পর্দাঘেরা ছিলো। রোজি খাতুন ও শামসুন্নিসার উট ছিলো সকলের সামনে। রোজি খাতুনের খাদেমাও সঙ্গে ছিলো। রাতে এক স্থানে অবস্থান করতে হয়েছিলো।

মসুল পৌঁছতে তাড়া ছিলো ইযযুদ্দীনের। সে কারণে কাফেলার জন্য একজন দলনেতা নিযুক্ত করে নিজে অবস্থান না করে কয়েকজন রক্ষী ও দুতিনজন উপদেষ্টাসহ সফর অব্যাহত রাখেন ইযুযুদ্দীন। আমের ইবনে ওসমানকে কাফেলার সঙ্গে রেখে দেয়া হয়। সূর্য অস্ত যাওয়ামাত্র তবু স্থাপন করা হলো। রোজি খাতুনের তাঁবু সেই তাঁবুগুলো থেকে অনেক দূরে স্থাপন করা হলো, যেগুলোতে রাতে হেরেমের মেয়েরা অবস্থান করবে। ইযযুদ্দীন রোজি খাতুন ও শামসুন্নিসাকে হেরেমের তাবু থেকে দূরে রাখার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়ে যান। অবস্থানের জায়গাটা ছিলো সবুজ-শ্যামল বনানীতে সুশোভিত।

রাত। আমের ইবনে ওসমান ঘুরে ঘুরে ছাউনি এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। ভয়ের কোন কারণ ছিলো না। সে সময় কোথাও যুদ্ধ ছিলো না। সুলতান আইউবী মিসরে আছেন। খৃস্টানরা দূরে এক জায়গায় বসে সুলভাল আইউবীর পরবর্তী রণ-পরিকল্পনা মোকালোর প্রস্তুতি গ্রহণ কচ্ছে। তবু অবস্থানস্থল ও পশুপালের আশপাশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমেরের কর্তক। সে হেরেমের তাঁবুগুলো থেকে সামান্য দূরে ঘোরাফেরা করছে। সঙ্গে কেউ নেই। তার থেকে আরো কিছুটা দূরে চলে যাওয়ার পর সমুখে একটি ছায়া দেখতে পায়। ছায়াটার নিকট গিয়ে ঘোড়া থামায়।

অন্ধকারে এতোদূর থেকে আমি তোমাকে চিনে ফেললাম, আর তুমি কিনা নিকটে এসেও চিনতে পারলে না। কণ্ঠটা আনুশির।

আমের ইবনে ওসমান কণ্ঠ চিনে বললো- এখনো অনেক কাজ করতে হবে। এতে বিস্তৃত ভাবু অঞ্চল আর এতোগুলো পশুর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব আমার উপর ন্যস্ত। তুমি আমার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করো না আনুশি।

অনুশি আমেরের ঘোড়র সামনে এসে লাগাম ধরে রেখেছিলো। বললো- ঘোড়া থেকে নেমে এলো আমের। যে লোকটাকে তোমার ভয় ছিলো, সে মসুল চলে গেছে। এবার নেমে এলো।

আমের ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে। মানুশি তার কাহু ধরে টেনে নিয়ে একটি গাছের আড়ালে গিয়ে বসে। আমের অনুগত পশুটির ন্যায় বসে পড়ে।

আমের!- আপুত কণ্ঠে বললো আনুশি- আমাকে চরিত্রহীনা ও খারাপ মেয়ে মনে করে তুমি আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি জানি, আমার আসল পরিচয় সম্পর্কে তুমি অবহিত। তুমি নিজেকে সাধু ও পবিত্র মনে করছে। যৌবন আর আকর্ষণীয় দেহটার জন্য তোমার বেজায় গর্ব। কিন্তু ভেবে দেখেনি কখনো, এই দেহখানা যে কোন মুহূর্তে লাশে পরিণত হতে পারে। এটা যুদ্ধ-বিগ্রহের যুগ। একদল লোক যুদ্ধের মাঠে প্রাণ নিচ্ছে ও প্রাণ দিচ্ছে। আরেক শ্রেণীর জন্য অনুপ ঘটনা ঘটছে দুর্গ ও রাজপ্রাসাদে গোপনে। তোমার পরিণতিও এমনটি হতে পারে। নিজের পুরোষিত রূপ আর দেহের আকর্ষণটাকে স্থায়ী ভেবো না।

তুমি কি আমাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে? আমের বললো।

 না- আনুশি জবাব দেয়- আমি তোমাকে বুঝাতে চেষ্টা করছি, তুমি যদি মনে করে থাকো আমি তোমার রূপ-যৌবনের জন্য পাগল, তাহলে এ ধারণা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও। আমার নিজের শরীরটাও ভোগের একটা উৎকৃষ্ট উপকরণ। কিন্তু আমি দেহ আস্বাদনের প্রতি সম্পূর্ণ অনীহ। মানুষ যতো শক্ত পাথরে পরিণত হোক, হৃদয়টাকে ফতো শক্ত পাথর মনে করুক না কেন, হৃদয় কখনো পাথর হয় না। মানুষের আত্মা মুর্খা যেতে পারে- মরে না। ভালোবাসা দিয়ে ও আত্মাকে জীবিত রাখে- যার সম্পর্ক দেহের সঙ্গে নয়। তুমি আমাকে আরো গভীর চোখে নিরীক্ষা করো। আমার ও তার যাদুময়তা দেখো। আমি নিজে পাপ করি এবং অপরকে পাপের প্রতি উৎসাহিত করি। মানুষ আমাকে রাজকন্যা নয়- পরী বলে ডাকে। তোমাদের রাজা ও আমীরগণ আমার পায়ের নীচে তাদের ঈমান ও মাথা রাখতে কুণ্ঠাবোধ করে না। কিন্তু আমি এমন একটি পিপাসায় কাতর ছিলাম, যা কখনো অনুভব করতে পারিনি। তোমাকে দেখলাম, ভালো লাগলো। প্রথমবার যখন আমি তোমার কাছে এলাম,তখন আমার উদ্দেশ্য পবিত্র ছিলো না। তুমি আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে এবং পরে এমনভাবে তাড়িয়ে দিলে যে, আমি বুঝে ফেললাম সেই পিপাসাটা আসলে কী, যেটি আমাকে অস্থির করে রেখেছে। আমি তৈমাকে হৃদয়ের গভীর থেকে কামনা করতে শুরু করলাম। এটা তোমার ব্যক্তিত্বের নয়- চরিত্রের ক্রিয়া ছিলো। আর ক্রিয়াটা এমন যে, আমার হৃদয়ে সেই লোকদের বিরুদ্ধে ঘৃণার সৃষ্টি করে, যারা আমাকে বিলাসিতার খেলনা মনে করতো এবং নিজেদের ঈমান ও জাতীয় মর্যাদাকে আমার হাত থেকে নেয়া মদের পেয়ালায় ডুবিয়ে দিতো।

আবেগ-আপ্লুত কণ্ঠে বলে যাচ্ছে আনুশি। চুপচাপ শুনতে থাকে আমের ইবনে ওসমান। কিন্তু মনে তার ভয়, দৃশ্যটা কেউ দেখে ফেললে রেহাই পাওয়া কঠিন হবে। আরো ভয়, শামসুন্নিসা যদি তার সন্ধানে এদিকে এসে পড়ে, তবে তো ভালোবাসাটা খুন হয়ে যাবে। আনমনে শুধু শুনেই যাচ্ছে আনুশির কথা। রূপসী কন্যা আনুশির এমন আবেগময় কথাগুলো তার হৃদয়ে কোনই রেখাপাত করছে না।

তুমি কি ভয় পাচ্ছো: আমের! নাকি তোমর অন্তরটা মরে গেছে আনুশি আমেরের গালে হাতের পরশ বুলিয়ে বললো- আমার হৃদয়টা যদি মরে গিয়ে না থাকে, তাহলে আমি মানতেই পারছি না তোমার অন্তর মরে গেছে।

আনুশি তার মাথাটা আমেরের বুকের সঙ্গে লাগিয়ে ধরে। তার রেশম কোমল বিক্ষিপ্ত চুলগুলো আমেরের অরুণ গণ্ডদেশ ছুঁয়ে যেতে শুরু করে। চরিত্র যেমনই হোক, যুবক তো! আমেরের দেহটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে কেমন যেনো একটা তোলপাড়া শুরু হয়ে গেছে তার হৃদয় জগতে। আমের আনুশি, চাপা হাসির শব্দ শুনতে পায়। মেয়েটি হাসতে হাসতে বললো- হৃদয়টা জীবিত আছে। ধুক ধুক করছে। আমি তোমার থেকে কিছুই চাই না। তুমি আমার কাছে চাও। হীরা, জহরত, মণিমুক্তা, স্বর্ণমুদ্রা- যা খুশি চাও দেবো।

আমার কিছুই প্রয়োজন নেই সুদানী পরী। আমের বললো।

আমাকে আনুশি বলো- মেয়েটি বললো- আমাকে যারা সুদানী পরী ডাকে, তাদের অন্তরে ভালোবাসা নেই, তারা পাপিষ্ঠ। তুমি তাদের চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে, পবিত্র। আমার থেকে ধন-ভাণ্ডার নিয়ে নাও। বিনিময়ে তুমি আমাকে ভালোবাসা দাও।

আনুশি নিজের চিবুকটা আমেরের চিবুকের সঙ্গে লাগিয়ে দেয়। আমের চমকে ওঠে পেছনে সরে যায়। এখন তার অবস্থাটা পিঞ্জিরাবদ্ধ পাখিটির মতো। ছটফট করতে শুরু করে দেয় আমের।

আমার মনে হয়, তোমার অন্তরে অন্য কারো ভালোবাসা আছে- আনুশি বললো- আমার যাদুতে কখনো কেউ এভাবে ছটফট করে না। তুমি বলে, কোন শক্তি তোমাকে আমার প্রতি ভালোবাসার বাধার সৃষ্টি করছে।

আনুশি দাঁত কড়মড় করে বললো- তুমি এটুকুও বুঝছে না যে, একটা গুনাহগার মেয়ে তোমার থেকে পবিত্র ভালোবাসা প্রার্থনা করছে। হতে পারে সে পাপ থেকে তাওবা করে তোমার পায়ে লুটিয়ে পড়বে। আশ্চর্য পুরুষ বটে তুমি। শুনে রাখো হতভাগা, তুমি এমন একটি মেয়েকে তাড়িয়ে দিচ্ছে, দুচারটি দেশের সিংহাসন উল্টে দেয়ার ক্ষমতা যার আছে। তুমি এমন একটি মেয়েকে রুষ্ট করছো, যে ইচ্ছা করলে ভাইকে ভাইয়ের হাতে খুন করাতে পারে। আমার সম্মুখে তোমার একটা পোকার চেয়ে বেশী মর্যাদা নেই।

তাহলে আমাকে পিষে ফেলো- বললো আমের আমি তোমার যোগ্য নই।

আমের উঠে দাঁড়ায়।

আমি তোমার কাছে কিছুই চাই না আমের- আনুশি আমেরের উভয় হাত নিজের হাতে নিয়ে বললো- তুমি শুধু আমার পাশে বসে থাকে।

আমের কথা না বাড়িয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে।

***

আমের ইবনে ওসমানের ঘোড়া ধীরে ধীরে হাঁটছে। আমেরের মাথাটা অবনত। নাকে আনুশির চুলের ঘ্রাণ আর গালে মেয়েটির হাতের কোমল ছোঁয়া এখনো অনুভব করছে। ভাবে, মেয়েটি যদি অন্ধকারে নির্জনে তাকে ধরে বসে, তাহলে শামসুন্নিসার সাথে কৃত শপথ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। তার কাছে আর ঠাই মিলবে না। আমের ভাবনার মোড় শামসুন্নিসার দিকে ঘুরিয়ে দেয়। তার মনে পড়ে যায়, সন্ধ্যায় ভাবু স্থাপনের সময় স্বল্প সময়ের জন্য সে শামসুন্নিসার কাছে পঁড়িয়েছিলো। দুজনে সাক্ষাতের সময় ও স্থান ঠিক করে এসেছিলো। সে ওদিকেই যাচ্ছিলো; কিন্তু পথে আনুশি পথরোধ করে দাঁড়ায়।

ঘোড়ার পিঠ বসে পেছনের দিকে তাকায় আমের। অন্ধকারে আনুশিকে আর দেখা যাচ্ছে না। পথের মোড় ঘুরে আমের সেই জায়গায় এসে পৌঁছে, যেখানে শামসুন্নিসার আসার কথা ছিলো। আমের যেভাবে আনুশির ছায়া দেখেছিলো, তেমনি শামসুন্নিসার ছায়াও দেখতে পায়। ছায়াটা ঘোড়ার দিকে এগিয়ে আসে। আমের ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে।

এতক্ষণ কোথায় ছিলে?- শামসুন্নিসা প্রশ্ন করে অনেকক্ষণ যাবত অপেক্ষা করছি।

কী করেছি, কোথায় থাকতে পারি, তুমি তো সব জানো- আমের মিথ্যা বলে- এদিকেই তো আসছিলাম। পথে এক স্থানে থামতে হলো। তাতেই দেরি হয়ে গেলো।

নিজেদের লোকদের প্রতিও লক্ষ্য রাখবে- শামসুন্নিসা বললো তারা প্রত্যেকে সতর্ক। তাদের প্রতি কারো সন্দেহ জাগবে না।

শামসুন্নিসা সেই লোকদের কথা বলছে, যারা হাবে সুলতান আইউবী ও রোজি খাতুনের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করছে। যারা মহলে কর্মচারি ছিলো, এই বহরে তারা একই পদে দায়িত্ব পালন করছে। রোজি খাতুনের খাদেমা শামসুন্নিসা ও আমের ইবনে ওসমানকে তাদের চিনিয়ে দিয়েছে।

এসো, এখানে কিছুক্ষণ বসি। শামসুন্নিসা আমেরের কোমর জড়িয়ে ধরে বললো।

দুজনে দুজনার হয়ে একান্ত ঘনিষ্ঠে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে আমের ইবনে ওসমান ও শামসুন্নিসা। শামসুন্নিসা এক পা অগ্রসর হয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়। নিজের নাকটা আমেরের বুকের সঙ্গে লাগিয়ে শুঁকতে শুঁকতে তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে বলে ওঠে- তুমি কোথায় ছিলে? কার কাছে ছিলে?

আমি পশগুলো দেখাশোনা করে আসছিলাম। আমের উত্তর দেয়।

পশুরা সুগন্ধি ব্যবহার করছে কবে থেকে- শামসুন্নিসা চাপা অথচ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে- তোমাকে তো কোনদিন সুগন্ধি ব্যবহার করতে দেখিনি।

আমের চুপসে যায়। তার মুখে কোন উত্তর নেই। শামসুন্নিসা কেইসটা ঠিকই ধরেছে। বলতে থাকে- রূপসী ডাইনীটা তোমাকে পেয়ে বসেছে। তুমি ফঁদে আটকে গেছে।

এখনো আটকাতে পারেনি- আমের বললো- পথে হঠাৎ দেখা হয় আনুশির সাথে। বিষয়টা তোমাকে জানাতে চাচ্ছিলাম না। সন্দেহের কোন কারণ নেই। আমি এতোটা আনাড়ি নই। আমার বক্ষে যে ঘ্রাণ পেয়েছে, সে অনুশির তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু বুকের ভেতরটা শুঁকে দেখার চেষ্টা করো। আমেরের কঠে ভীতির হাল্কা একটা কম্পন অনুভব করে শামসুন্নিসা। আমের বলতে থাকে। আমি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন শামসী। আমি কোন আমীর-শাসক কিংবা সালার নই। আমি একজন সাধারণ কর্মচারি মাত্র। আনুশি আমাকে অতি সহজে প্রতিশোধের নিশানা বানাতে পারে।

মনে হচ্ছে, মেয়েটা আজ তোমাকে বেশি পেরেশান করেছে। শামসুন্নিসা বললো।

খুব বেশী- আমের জবাব দেয় মেয়েটা আজ নিজে থেকে বলেছে, সে পাপিষ্ঠা এবং চরিত্রহীনা। বেহায়াপনা ছড়ানো এবং নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বাধানোর জন্যই সে এসেছে। আমার থেকে সে পবিত্র ভালোবাসার বিনীত আবেদন জানিয়ে বলেছে, তার বিনিময়ে আমি যা চাই তাই সে দেবে। আমি বড় কষ্টে তার বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে এসেছি। শামসী। মেয়েটা যদি তার সমুদয় সম্পদও আমার সামনে হাজির করে, তবুও আমি তোমাকে ধোকা দিতে পারবো না।

তারপরও তাকে ধোকা দাও- শামসুন্নিসা বললো- তাকে সেই ভালোবাসা দাও, যা সে কামনা করছে। বিনিময়ে সেই তথ্য নাও, যা আমাদের প্রয়োজন। এখানে তাকে কী উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছে, তা তোমাকে বলে দিয়েছে। তুমি অভিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান। তোমার মহলের গোপন তথ্য প্রয়োজন একথা বলে কাজ আদায় করবে, নাকি কিছু না জানিয়ে কৌশলে তথ্য বের করবে, তা তুমিই ভালো বুঝে।

আমি বিষয়টা ভেবেছি- আমের বললো- কিন্তু ভয় পাচ্ছি এ জন্য যে, একদিন হয়তো তুমি আমাকে ভুল বুঝবে। 

তোমার-আমার ভালোবাসা আমি আল্লাহর উপর সোপর্দ করেছি শামসুন্নিসা বললো- আম্মার নির্দেশমূলক কথাগুলো আমার আত্মায় গেঁথে আছে। আমার ভালোবাসার মৃত্যু হতে পারে না। হৃদয়ের ভালোবাসাকে আমি সেই মহান লক্ষ্য অর্জনে কুরবান করতে চাই, যে দায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করা হয়েছে। আল্লাহর নামে শপথ নেয়ার যদি আমি স্মরণ রাখি, তাহলে কোন ভুল বুঝাবুঝির জন্ম নিতে পারবে না। শামসুন্নিসা প্রশ্ন করে মেয়েটি কি জানতে পেরেছে তোমার আমার দেখা-সাক্ষাৎ হয়?

তাতো সে বলেনি- আমের উত্তর দেয়- বোধ হয় নিশ্চিত জানে না।

একটা কাজের কথা বলি- শামসুন্নিসা বললো- আমরা হাব থেকে রওনা হওয়ার কিছু আগে কায়রো থেকে একজন লোক এসেছিলো। সে জানতে চাচ্ছিলো, ইযযুদ্দীনের উদ্দেশ্য এবং খৃষ্টানদের পরিকল্পনা কী। আমরা তাকে সঠিক কোন উত্তর দিতে পারিনি। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী তাড়াতাড়ি কায়রো থেকে ফৌজ নিয়ে রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুত। লোকটি বলেছে, আইউবীর এই তাড়াহুড়ার কারণ হলো, খৃষ্টান বাহিনী মসুল, হালক্ ও দামেশকের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পর কায়রো থেকে ফৌজ নিয়ে এখানে সময় মতো পৌঁছানো সম্ভব হবে না। সমস্যা হলো, সুলতান যদি বাহিনী নিয়ে এসে পড়েন আর খৃস্টানদের কৌশল অন্যকিছু হয়, তাহলে সুলতানকে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। আমাদের অতি দ্রুত মুসলমান আমীর ও খৃস্টানদের সম্বন্ধে জানতে হবে।

আমি শুনেছি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর গোয়েন্দারা কিনা আকাশ থেকে তারকাও ছিঁড়ে আনতে পারে- আমের ইবনে ওসমান বললো- খৃস্টান অঞ্চলগুলোতে কি তার কোন লোক নেই?

আম্মা আমাকে বলেছেন, ইসহাক তুর্কি নামে অত্যন্ত বিচক্ষণ একজন গোয়েন্দা আছে- শামসুন্নিসা উত্তর দেয়- তিনি বৈরুত গেছেন। সঠিক সংবাদ তো তিনি নিয়েই আসবেন। কিন্তু কায়রো থেকে তার কোন সংবাদ আসেনি। দেখো আমের! সোনাবাহিনী তৎপরতা চালালে কিছু একটা আন্দাজ করা যায়। এখানে তো তেমন কোন তৎপরতা দেখছি না। যা কিছু গোপন তথ্য আছে, সব ইযযুদ্দীন ও ইমাদুদ্দীনের পেটে। আর এসব তথ্য মহলের ভেতর থেকে উদ্ধার করা যেতে পারে। আর সেই সংবাদ তুমি একমাত্র আনুশির কাছ থেকেই সংগ্রহ করতে পারো।

কিন্তু সে যে বিনিময় দাবি করছে, তা তো আমি দিতে পারবো না। আমের বললো।

এই মূল্য তোমাকে দিতেই হবে- শামসুন্নিসা বললো- আমি আমার ভাইয়ের পাপের কাফফারা আদায় করতে চাই। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর স্বার্থের কাছে ভালোবাসা ও কামনা-বাসনার কোন মূল্য নেই। আমাদেরকে সেই শহীদদের ঋণ শোধ করতে হবে, যারা ইসলামের জন্য স্ত্রীদের বিধবা করে গেছেন।

***

ইসহাক তুর্কি এখন বৈরুতে। এখানে খৃষ্টান ম্রাট বল্ডউইনের ফিরিঙ্গি বাহিনীর বিশাল সেনাক্যাম্প। বল্ডউইন এক পরাজয়বরণ করেছিলেন সুলতান আইউবীর ভাই আল-আদিলের হাতে। তার পরপরই সুলতান আইউবীর বাহিনীকে ফাঁদে ফেলতে গিয়ে নিজেই সুলতান আইউবীর ফাঁদে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন এবং বন্দি হতে হতে অল্পের জন্য রক্ষা পান। উভয় বারই তার বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে পেছনে সরে যায়।

এখন দিন-রাত সমানে কাজ করছেন বল্ডউইন। রাতে ঘুমান না। পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের পরিকল্পনায় মহাব্যস্ত। তিনি আল-মালিকুস সালিহকে অনুগত বানিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু তার কোন উপকার না করেই আস-সালিহ মৃত্যুবরণ করেছেন। এখন ইযযুদ্দীন ও ইমাদুদ্দীনকে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে ব্যবহারের ফন্দি আঁটছেন বল্ডউইন। কায়রোতে তার গোয়েন্দারা সুলতান আইউবীর পরিকল্পনার তথ্য সংগ্রহে ব্যস্ত।

বৈরুতে গিয়ে ইসহাক তুর্কি প্রথমে বল্ডউইনের হাইকমান্ড পর্যন্ত পৌঁছোনোর বুদ্ধি ঠিক করে নেয়। নিজেকে মুসলিম অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা খৃস্টান বলে পরিচয় দেয়। এভাবে সে তাদের সহানুভূতি অর্জনে সক্ষম হয়। ইসহাক তুরস্কের নাগরিক। গায়ের রং ফর্সা। সুদর্শন ও স্বাস্থ্যবান যুবক। অশ্বচালনা, বর্শা নিক্ষেপ, তীরন্দাজি ও তরবারী চালনায় বিশেষ পারদর্শী। দীর্ঘ বাহুতে রেজায় শক্তি। মস্তিষ্কটা প্রখর ও সূক্ষ্মদর্শী। অপরের মন জয় করে প্রভাব বিস্তার ও অনুরক্ত বানানোর কলাকৌশল তার জানা। প্রয়োজন অনুযায়ী যথাযথ রূপ ধারণ করায় ওস্তাদ। সঙ্গীদের বলতো, তার আসল শক্তি হলো তার ঈমান ও চরিত্র।

বৈরুতে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। দেশের নাগরিকদের সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে সমর মেলা বসানো হয়েছে। মেলায় সৈন্যদের কৃতিত্ব প্রদর্শন, তরবারী ইত্যাদি অস্ত্র চালনার প্রতিযোগিতা চলছে।

ইসহাক তুর্কি এরকম এক মেলায় হাজির হন। খৃস্টানদের একটি প্রাচীন খেলা চলছে। দুজন অশ্বারোহী লম্বা বর্শা হাতে বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা বর্শার সাহায্যে একে অপরকে ঘোড়া থেকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছে। প্রথমবার কেউ কাউকে ফেলতে না পারলে পুনরায় সুযোগ দেয়া হচ্ছে। আরোহীরা বর্ম পরিহিত।

প্রতিযোগিতা চলছে। একের পর এক গ্রুপ আসছে। পরাজিত আরোহী ঘোড়া থেকে পড়ে যাচ্ছে। বিজয়ী হুংকার দিয়ে বলছে- আর কি কেউ আছে লড়াই করার কেউ আসলো না। ইসহাকের গায়ে মরু পোশাক। সে মাঠে নেমে যায়। মোকাবেলাকারী অশ্বারোহী সৈনিক ধর্ম পরিহিত। ইসহাককে সাধারণ পোশাকে ময়দানে নামতে দেখে দর্শকরা টিটকারি মারতে থাকে। মেলায় খৃস্টার্ন সেনাপতি ও অন্যান্য কমান্ডাররা উপস্থিত। তারাও ইসহাককে দেখে অবজ্ঞার হাসি হাসে। একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিতকারী অশ্বারোহী শেষবারের মতো হুংকার ছেড়ে মোড়াকে এদিক ওদিক হাঁকিয়ে বেড়াচ্ছে, যেনো শিকার খুঁজছে। ঘোড়সওয়ার খৃষ্টান বাহিনীর ইউনিট কমান্ডার। ঠাট্টার ছলে সে ঘোড়াটা ইসহাক তুর্কির দিকে ঘুরিয়ে দেয় এবং নিকটে এসে বর্শাটা তার গায়ে নিক্ষেপ করে। ইসহাক বর্শার আঘাত প্রতিহত করে। দর্শনার্থীরা আবারও অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। রব উঠে- পাগল, পাগল। ওকে মেরে ফেলল।

অশ্বারোহী কমান্ডার ঘোড়াটা পেছন দিকে মোড় ঘুরায়।.তার সঙ্গী কমান্ডারদের একজন বললো- বর্শায় গেঁথে পাগলটাকে এদিকে নিয়ে এসো। অন্য একজন বললো- লোকটা বর্শা প্রতিরোধ করে তোমাকে চ্যালেঞ্জ করছে।, অশ্বারোহী ঘোড়া হাঁকায়। ইসহাক নিরস্ত্র। ঘোড়াটা নিজের দিকে আসতে দেখে গায়ের চোগাটা খুলে বর্শার আঘাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। অশ্বারোহী সামান্য নত হয়। বর্শাটা হাতে তুলে নেয়। নিকটে এসে ইসহাকের উপর আঘাত হানে। ইসহাক কিহুদূর পর্যন্ত ঘোড়ার সঙ্গে এমনভাবে দৌড়াতে থাকে, যেনো বর্শা তার দেহে গেঁথে গেছে। দর্শকরা উল্লাস করতে থাকে। কিন্তু পরক্ষণেই নীরবতা থেমে যায়। সকলে অবাক বিস্ময়ে দেখতে পায়, ইসহাক দৌড়ের মধ্যে অশ্বারোহী কমান্ডারের ঘোড়র পেছনে বসে পড়েছে। বর্শা তার গায়ে বিদ্ধ হয়নি। সে বরং বর্শাটা ধরে রেখেছে। আরোহীও ধরে রেখেছে বর্শার এক মাথা। সে ঘোড়ার মোড় ঘুরায়। ঘোড়া এক চক্কর ছুটতে শুরু করে। ইসহাক তার থেকে বর্শাটা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে।

ইসহাক বর্শাটা ছিনিয়ে নিয়ে ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফ দিয়ে সটান দাঁড়িয়ে যায়। বর্শাটা চারদিক ঘুরিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে- আমাকে একটা ঘোড় দাও। সাহস থাকে তো আমার মোক্ষাবেলা করো।

অশ্বারোহী কমান্ডার ঘোড়া থেকে নেমে ইহাকের কাছে চুলে আসে। এখন তার হাতে কোন অস্ত্র নেই। উভয় বাহু সম্প্রসারিত করে রেখেছে। ইসহাক বর্শাটা মাটিতে গেড়ে দেয়। খৃস্টান অশ্বারোহী তাকে গলায় জড়িয়ে ধরে। ইসহাক বললো- আমি মোকাবেলা করবো, আমাকে ঘোড় দাও।

ইসহাককে একটি ঘোড়া আর একটি বর্শা দেয়া হলো। সে কমান্ডারের মোকাবেলায় অবতীর্ণ হয়। দর্শনার্থীরা অপলক চোখে, অনিঃশ্বাস দাঁড়িয়ে আছে। তারা নিশ্চিত ছিলো, হতভাগ্য লোকটি বর্শার আঘাতে শোচনীয়ভাবে মারা পড়বে।

উভয় ঘোড়া খানিক দূরত্বে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। ইঙ্গিত পেয়ে ঘোড় ছুটতে শুরু করে। কমান্ডার তার বর্শাটা ইসহাকের পেট বরাবর। তাক করে রেখেছিলো। চলন্ত ঘোড়া থেকে আঘাত হানে সে। ইসহাক সামান্য মোড় ঘুরিয়ে কমান্ডারের আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়। সেই সঙ্গে তার বর্শাটা গিয়ে কমান্ডারের পেটে গেঁথে যায়। কমান্ডার ঘোড়ার অপরদিকে পড়ে যায়। কমান্ডার ওদিককার পা রেকাব থেকে সরাতে ভুলে গিয়েছিলো। তাই পড়তে গিয়ে পা রেকাবে আটকে যায়। ঘোড়া কমান্ডারকে হেঁচড়ে নিয়ে যেতে শুরু করে।

প্রতিযোগিতায় কোন প্রতিযোগিকে দর্শনার্থীদের সাহায্য করার অনুমতি নেই। কোন প্রতিযোগিকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার প্রয়োজন দেখা দিলেও নয়।

ঘোড়া কমান্ডারকে হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। ইসহাক পেছন ফিরে দেখতে পেয়ে ঘোড়ার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ঘোড়া হাঁকায়। কমান্ডারের ঘোড়ার পার্শ্বে গিয়ে এক লাফে তাতে চড়ে বসে। লাগাম টেনে ধরে ঘোড়ার গতি থামিয়ে দেয়। কমান্ডার বর্ম পরিহিত। দেহটা অক্ষত আছে। অন্যথায় এতোক্ষণ চামড়া ছিলে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যেতো।

কমান্ডার ইসহাককে বাহুতে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে- তুমি কে? তোমার পরিচয় কী?

ইসহাক উত্তর দেয়- আমি মুসলমানদের অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা খৃস্টান। এখন তো আর নিজেকে সাধারণ খৃস্টান দাবি করতে পারছি না।

ইসহাক কৃতিত্বটা দেখিয়েছে অসাধারণ। এমন অশ্বচালক, বর্শাবাজ হয়তো কোন সুদক্ষ সৈনিক কিংবা কোন উচ্চ বংশের যোগ্য সন্তান। ইসহাক কমান্ডারকে জানায়, মুসলমানরা তাকে জোরপূর্বক ফৌজে ভর্তি করাতে চেয়েছিলো। তাই সে পালিয়ে এসেছে।

কমান্ডার ইসহাককে সঙ্গে নিয়ে যায়। কমান্ডার বল্ডউইন বাহিনীর একজন নাইট। নাইট হওয়ার কারণেই তার আপাদমস্তক বর্ম দ্বারা আবৃত। সামরিক যোগ্যতা ও দুঃসাহিসকতার কারণে খৃস্টানদের নাইটরা আজো বিখ্যাত। তাদেরকে এতো মর্যাদা দেয়া হতো যে, সম্রাটগণ তাদের পরামর্শে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফেলতেন।

ইসহাক তুর্কি বর্ম ছাড়াই খালি গায়ে এই বর্ম পরিহিত নাইটকে ধরাশায়ী করে এবং তাকে ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করে। রতনে রতন চেনে। বল্ডউইনের এই নাইট ইসহাককে চিনে ফেলে। বুঝে ফেলে লোকটার দাম কতত। সঙ্গে করে নিজ গৃহে নিয়ে ইসহাককে মদ খেতে দেয়।

ইসলামে মদ হারাম। মুসলমান মদপান করে না। ইসহাক তুর্কি মুসলিম গোয়েন্দা। ছদ্মবেশে ভিন্ন পরিচয়ে গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে এরকম সমস্যায় পড়তে হয় আইউবীর গোয়েন্দাদের। খৃস্টান পরিচয়ে খৃস্টানদের মাঝে ঢুকে পড়ার পর তাদের সামনে মদ আসে। তাদের বিব্রত হতে হয়। বাধ্য হয়ে হারাম খেতে হয়। মদ না খেলে তাদেরকে সন্দেহে পড়তে হয়, খৃস্টান হলে মদ খাবে না কেন?

এই মুহূর্তে ইসহাক তুর্কি তেমনি এক বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন। সামনে মদের পেয়ালা। ইসহাক পরিপক্ব ঈমানদার মুসলমান। সে মদপান করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বললো- আপনি আমার শক্তি দেখেছেন। এই শক্তি অর্জন করতে গেলে মদপান থেকে বিরত থাকতে হয়। এটা মদপান না করার সুফল। আমার ওস্তাদ বলেছেন, তোমার পেটে যদি মদ ঢুকে, তাহলে তোমার ঘোড়াটা অনুভব করবে তার পিঠে একজন দুর্বল লোক সওয়ার হয়েছে। ফলে ঘোড়া তোমার নির্দেশ মান্য করবে না।

ইসহাক গলায় ঝুলানো তাগাটা টেনে বের করে। শার্টের ভেতর থেকে ছোট একটা ক্রুশ বেরিয়ে আসে। বললো- আমি নিজের শক্তিটা ক্রুশের সুরক্ষার জন্য ব্যয় করার লক্ষ্যে কুশ হাতে শপথ করেছিলাম, মদপান আর চরিত্রহীন কাজ থেকে বিরত থাকবো। আমি শপথটা ভঙ্গ করতে পারি না।

তুমি কোথায় থাকো- নাইট জিজ্ঞেস করে- পরিজন সঙ্গে আছে কি?

 না- ইসহাক উত্তর দেয়- আমি আমার পরিবার-পরিজনকে বলে এসেছি, নিরাপদ কোন ঠিকানা পেলে তাদেরকে নিয়ে আসবো।

ঠিকানা পেয়ে গেছো- নাইট বললো- আমি তোমার মূল্য বুঝি। আজ থেকে তুমি আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষীর দায়িত্ব পালন করবে। আমার মতো প্রত্যেক কমান্ডারের সঙ্গে দুচারজন করে রক্ষী থাকে। তুমি হলে আমার একজনই যথেষ্ট। আমি তোমার থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

সময়টা যুদ্ধের। ইসহাকের ন্যায় শক্তিশালী সাহসী লোকদের খুব দাম। বল্ডউইনের নাইট সুলতান আইউবীর গোয়েন্দা ইসহাকের থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। তার জন্য আরবীয় ঘোড়া ও অন্যান্য সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করা হয়। মাসিক ভাতাও নির্ধারিত হয়।

আল্লাহ ইসহাককে প্রখর মেধা দান করেছেন। সেই মেধাকে কাজে লাগাতে শুরু করে সে। দুদিনেই ইসহাক খৃস্টান নাইটের বিস্ত ব্যক্তিতে পরিণত হয়।

আমার একটি মাত্র আকাঙ্খা- ইসহাক নাইটকে বললো মুসলমানদের প্রথম কেবলা বাইতুল মুকাদ্দাসের ন্যায় খানায়ে কাবাও আমাদের দখল করে নেয়া দরকার। তাহলে ইসলাম অল্প দিনেই মৃত্যুবরণ করবে। সারা পৃথিবীতে না হলেও কমপক্ষে আরব বিশ্বের উপর ক্রুশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার।

তুমি স্বপ্ন দেখছো বন্ধু–নাইট বললো- মুসলমানদের এতো তাড়াতাড়ি পরাস্ত করা সহজ নয়। আমরা যদি মুসলমানদের কাবা গৃহ অভিমুখে অভিযান পরিচালনা করি, তাহলে সমগ্র পৃথিবীর মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবে। সকল মুসলমানের মোকাবেলা করে জয়লাভ করা তো দূরের কথা, এক সালাহুদ্দীন আইউবীকেও তো এখন পর্যন্ত পরাজিত করতে পারলাম না।

আপনি তাহলে হীনম্মন্যতায় ভুগছেন- ইসহাক বললো মুসলমানদের ঐক্য ভেঙ্গে গেছে। সালাহুদ্দীন আইউবী সঙ্গীহীন হয়ে পড়েছেন। মুসলমানরাই এখন তার শত্রু। হাব ও মসুলের নতুন শাসনকর্তা ইযযুদ্দীন-ইমামুদ্দীন কি আপনার সমর্থক সহযোগি নন? তারা কি আপনার সাহায্যের মুখাপেক্ষী নন। আপনাদের গোয়েন্দারা। মুসলমানদের ফোকলা করে দিয়েছে। আমি আপনাকে সেখানকার বাস্তব চিত্র তুলে ধরছি।

ইসহাকের বক্তব্যে নাইটের চোখ ছানাবড়া। ইসহাক নাইটকে এমন সব পরার্শ দেয় যে, একজন সেনাপতির পক্ষেই এ ধরনের পরামর্শ দেয়া সম্ভব। নাইটের চোখ খুলে যায়। তুমি তো আমাকে অবাক করে দেয়ার মতো কথা বলছো- নাইট বললো- আমরা তো এমন পরিকল্পনাই প্রস্তুত করে রেখেছি, যা কিনা তোমার আকাঙ্খা ও প্রত্যয়ের অনুকূল।

আপনাকে আমি আরেকটি পরামর্শ দিতে চাই- ইসহাক বললো আপনারা সালাহুদ্দীন আইউবীর ন্যায় কমান্ডো বাহিনী গঠন করুন। একটা বাহিনী আমার হাতে তুলে দিন। আমি মুসলিম ভূখণ্ড এবং তাদের স্পর্শকাতর শিরাগুলো সম্পর্কে অবগত আছি। আমি তাদের হাড়ির খবর পর্যন্ত জানি। রসদ প্রভৃতির ডিপো কোথায় থাকে, সব খবর আমার কাছে আছে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তাদের কোন ভাণ্ডার থাকতে দেবো না।

তা-ই হবে- নাইট বললো- আমি তোমাকে সুযোগ করে দেবে।

***

আমি তোমাকে শামসুন্নিসার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। আনুশি আমের ইবনে ওসমানকে বললো।

তারা এখন মসুলে। ভালোবাসার ডালি নিয়ে এগিয়ে এসেছে আমের। আনুশি মধ্য রাতের পর তার কক্ষে চলে আসে। বললো শামসুন্নিসা কি আমার চেয়ে বেশি রূপসী?

ওর নামও উচ্চারণ করো না- আমের বিরক্তির সুরে বললো- ও রাজকন্যা। তাকে আমি তোমার চেয়েও বেশী ভয় করতাম। তোমাকেও আমি রাজকন্যা মনে করতাম। কিন্তু তুমি আমার ভয় দূর করে দিয়েছে। তারপরও মাঝে-মধ্যে ভয় এসে যায় তুমি আমার সঙ্গে প্রতারণা করে কিনা। তাছাড়া তোমার-আমার সম্পর্কটা জানাজানি হলে কি পরিস্থিতি দাঁড়াবে, সে জন্যও ভয় হচ্ছে।

কেউ যদি তোমার এক বিন্দু ক্ষতি করে, তাহলে আমার ইঙ্গিতে প্রাসাদের প্রতিটি ইট খসে পড়বে বলেই আনুশি আমেরকে কাছে টেনে নিয়ে বললো- কেউ তোমাকে ধোকা দিচ্ছে এ আশঙ্কা যথার্থ। আমার অস্তিত্ব একটা চিত্তাকর্ষক প্রতারণা। কিন্তু তুমি আমাকে মানুষরূপে দেখো। আমাকে আমার ইবাদত করতে দাও।

আবেগ চেপে বসে আনুশির উপর। তার মাথার চুলে বিলি কাটছে আমের ইবনে ওসমানের আঙ্গুলগুলো। রাত কেটে যাচ্ছে। আনুশির কণ্ঠ ও বাচনভঙ্গিতে মাদকতা। আমেরের জন্য এটা একটা কঠিন পরীক্ষা। সে একজন অবিবাহিত যুবক। একাধিকবার আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিপথগামী হওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। প্রতিবারই আল্লাহকে স্মরণ রেখে প্রার্থনা করেছে- হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ধৈর্যধারণের শক্তি দাও, আমার চরিত্রকে পবিত্র রাখো।

রাত আর বেশি বাকি নেই। আনুশি আমেরের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। এভাবে আরো তিন-চার রাতে দুজনের গোপনে কথাবার্তা চলে। আনুশি আমেরের অস্তিত্বে একাকার হয়ে যায়। সে দেখেছে, আমেরের মধ্যে একটা ভালো মানুষী আছে। কিন্তু তার সত্ত্বায় স্পেন সৃষ্টি হতে চলেছে, আনুশি তা টের পায়নি।

মুসলিম শাসকদের প্রতি আমার ঘৃণা জন্মে গেছে- এক রাতে আমের আনুশিকে বললো- আমি খৃষ্টান সম্রাটদের দেখিনি। আমাদের রাজাদের চেয়ে ভালো তো হবে নিশ্চয়ই। আমের গোপন কথা বের করতে বললো- আচ্ছা, এটা কি সম্ভব যে, খৃস্টানরা এসে এই অঞ্চলটা দখল করে ফেলবে?

আনুশি অত্যন্ত চালাক মেয়ে। শৈশব থেকেই ওস্তাদি শিখে আসছে। তার রূপ-যৌবন দুর্ভেদ্য দুর্গের শক্ত প্রাচীর ভাঙ্গার ক্ষমতা রাখে। প্রতাপান্বিত রাজা-বাদশাহদের গোলাম বানিয়ে রাখার মতো যোগ্যতা তার আছে। কিন্তু সে মানবিক দুর্বলতা এবং স্বভাবজাত চাহিদা ও দারি থেকে মুক্ত নয়। একজন মানুষ স্বভাব-চরিত্রে হিংস্র পশুতে পরিণত হোক না কেন, সৃষ্টিগত স্বভাবের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পারে না। আনুশি আমের ইবনে ওসমানকে তার পিপাসার কথা ব্যক্ত করেছিলো। সত্য প্রেমের পিপাসা আর আমেরের অস্তিত্ব তাকে অক্টোপাসের ন্যায় জড়িয়ে রেখেছে। মদের নেশা তার জানা ছিলো। কিন্তু প্রেমের নেশা সম্পর্কে ছিলো অনবহিত। এই নেশা যখন তাকে পেয়ে বসলো এবং দুর্বল মুহূর্তটায় আমের খৃষ্টান শাসকদের পক্ষে কথা বললো, তখন মেয়েটির প্রশিক্ষণ দীক্ষা বেকার হয়ে পড়লো। সে আমেরের সঙ্গে এমন সব কথাবার্তা বলতে শুরু করে, যা কোন গুপ্তচর সাধারণত প্রকাশ করে না।

আমেরের লক্ষ্য অর্জিত হয়ে গেছে। গা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে প্রশ্ন করতে রু করেছে সে। এ মুহূর্তে যদি আনুশির খৃস্টান গুরু, ইযযুদ্দীন কিংবা অন্য কোন কর্মকর্তা তাকে এই অবস্থায় দেখতে পায়, তাহলে তারা বিশ্বাসই করবে না, এই সেই মেয়ে, যাকে তারা সুদানী পরী বলে ডাকেন। নিষ্পাপ মেয়ের মতো লাজুক হয়ে বসে আছে আনুশি। তার একবিন্দু অনুভূতি ইে নেয, এই মুহূর্তে এখানে বসে সে সালতানাতে ইসলামিয়ার মূলোৎপাটনের পরিবর্তে ক্রুশকেই বরং ফোকলা করে ফেলছে। আমের আনুশিকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ধার করছে।

আজ যখন আনুশি আমেরের কক্ষ থেকে বের হয়, তখন রাতের শেষ প্রহর। আমেরকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে গেছে আনুশি।

***

অনেক দিন কেটে গেছে। ইসহাক তুর্কি এখন বৈরুতে খৃষ্টান নাইটের ব্যক্তিগত দেহরক্ষীই নয়- অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হয়েছে। খৃস্টান নাইটের এমন কোন গোপন তথ্য নেই, যা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর গোয়েন্দা ইসহাক তুর্কি জানে না। ইসহাক একটা বিষয় অনুভব করে, তার এই কমান্ডার ক্রুশের জন্য এতোটা আন্তরিক নয় যতোটা আন্তরিক পরবর্তী যুদ্ধে জয়লাভ করে সম্রাট বল্ডউইন থেকে আরবের কোন একটা ভূখণ্ড পুরস্কার হিসেবে অর্জন করার। একটি ভূখণ্ডের স্বাধীন শাসক হওয়ার স্বপ্ন চেপে বসেছে তার মাথায়। ওস্তাদ আলী বিন সুফিয়ানের প্রশিক্ষণ মোতাবেক ইসহাক তুর্কি তার মনস্তত্ব নিয়ে খেলতে শুরু করে। যেভাবে আনুশির ন্যায় একটি ভয়ঙ্কর মেয়ে মানবীয় দুর্বলতা ও চাহিদার সামনে অসহায় হয়ে পড়েছিলো, তেমনি খৃস্টানদের এই নাইটও আপন দৃঙ্গিভঙ্গী থেকে সরে গিয়ে এবং কামনা বাসনার কাছে পরাজিত হয়ে ভাবনার প্রযোজনীয়তা হারিয়ে ফেলেছে যে, অচেনা লোকটিকে সে নিজের অন্তরঙ্গ বানিয়ে নিলো। সে শুধু তারই নয়- তার সম্রাট ও তার ক্রুশের পরাজয়ের বার্তাবাহক।

একদিন নাইট ইসহাক তুর্কিকে বৈরুত থেকে দূরে একস্থানে নিয়ে যায়। ইসহাক জানে, নাইটের সেনা ইউনিট রাতে বেশ তড়িঘড়ি রওনা হয়ে গেছে। সে তার বাহিনীকে বিভিন্ন স্থানের জন্য বন্টন করার লক্ষ্যে নিয়ে যাচ্ছে। দেহরক্ষী হিসেবে ইসহাক তার সঙ্গে আছে। বাহিনীর অবস্থান স্থলে পৌঁছে ইসহাক দেখতে পেলো, তাঁৰু স্থাপন করা হয়নি। বাহিনীতে অশ্বারোহীও আছে, পদাতিকও আছে। নাইট তার অধীন কমান্ডারদের ডেকে কয়েকটি জায়গার নাম উল্লেখ করে উক্ত স্থানগুলোতে তাঁবু স্থাপন করতে এবং প্রস্তুত অবস্থায় থাকতে নির্দেশ দেয়। ইসহাক পাশে দাঁড়িয়ে সব পর্যবেক্ষণ করে।

হতে পারে তোমাদেরকে এক মাস পর্যন্ত এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে- নাইট তার অধীন কমান্ডারদের বললো- কিন্তু বিরক্ত হতে পারবে না। গতকাল কায়রো থেকে আসা এক গোয়েন্দা সংবাদ জানিয়েছে, সালাহুদ্দীন আইউবী বৈরুত অবরোধ করে নগরীটা দখল করে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। আমাদের আশা ছিলো, তিনি এখনো দামেশকের দিক থেকেই আসবেন এবং সর্বপ্রথম তার মুসলিম আমীরদেরকে যাদের মধ্যে হাব, মসুল এবং হাররানের আমীরগণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সঙ্গে নেবেন। তারপর আমাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবেন। কিন্তু এখন নির্ভরযোগ্য তথ্য পেলাম, তিনি সর্বাগ্রে আমাদের হৃদপিণ্ডের উপর আঘাত হানবেন এবং তারপর তার যেসব আমীরকে আমরা আমাদের বন্ধু বানিয়ে রেখেছি, তাদের সঙ্গে বোঝাঁপড়া করবেন। আমরা যদি এ সংবাদ না পেতাম, তাহলে আমরা বৈরুতের অভ্যন্তরে তার দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়তাম। তোমরা অনেকে হয়তো জানো না, সালাহুদ্দীন আইউবী অররোধে অভিজ্ঞ। কোন ভূখণ্ড তার দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে তাদের অস্ত্র সমর্পণ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকে না। ক্রুশের আশির্বাদে আমরা সময় থাকতে ইঙ্গিত পেয়ে যাই।

ইসহাক শুনছে। শরীরটা ঘেমে ওঠছে তার। মনে রাগ আসে, সালাহুদ্দীন আইউবীর আভ্যন্তরীণ জগতেও খৃস্টানদের চর আছে। এতো ভেতরের খবর শক্রর হাতে চলে আসলে চলবে কী করে? তার মনে পড়ে যায়, তার মুসলমান ভাইদের ঈমান বিক্রি করতে সময় লাগে না। সুলতান আইউবীর ব্যক্তিগত বলয়ে কোন খৃস্টান ঢুকতে পারে না। এটা কোন ঈমান নিলামকারী মুসলমানেরই কাজ। ইসহাক তুর্কি তীব্রভাবে অনুভব করে, তাকে এই মুহূর্তে কায়রো পৌঁছে আশী বিন সুফিয়ানকে বলতে হবে, সুলতান সত্যিই যদি বৈরুতের উপর সেনা অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন, তাহলে যেনো তিনি সরাসরি বৈরুত না যান।

সময় মতো সংবাদটা পাওয়ায় আমাদের লাভ হয়েছে। যেভাবে আমাদের এই বাহিনীকে ওঁৎ পেতে থাকার জন্য এখানে পাঠানো হয়েছে, তেমনি আরো কয়েকটি ইউনিটকে- যাদের মধ্যে অশ্বারোহী সৈনিকের সংখ্যাই বেশি- বৈরুতের আশপাশে এবং দূর-দূরান্তে প্রেরণ করা হয়েছে। যে বাহিনীটি বৈরুতে প্রস্তুত আছে, তারা সালাহলীল আইউবীকে স্বাগত জানাবে। আইউবী অতর্কিত আক্রমণ করে বৈরুত দখল করে নিতে চাইবেন। তিনি যখন অবরোধ সংকীর্ণ করবেন, তখন আমরা পেছন থেকে তার উপর আক্রমণ চালাবে। তারপর তিনি বৈরুতের অভ্যন্তরে আমাদের বাহিনীর এবং বাইরের বাহিনীগুলোর গ্যাড়াকলে আটকে যাবেন।

জনাবা- এক প্রবীণ কমান্ডার বললো-জানতে পেরেছেন কি তিনি কোন্ দিক থেকে আসবেন?

এখনো তা জানতে পারিনি- নাইট উত্তর দেয়- মনে হচ্ছে তিনি আমাদের অঞ্চলসমূহের উপর দিয়ে আসার ঝুঁকি বরণ করবেন। সম্রাট বল্ডউইন নির্দেশ জারি করেছেন, পথে যেনো তাকে না ঘটানো হয়। আমরা তাকে আমাদের ভেতরে এবং বৈরুত পর্যন্ত পৌঁছতে দেবো। এখানে আমরা তার বাহিনীকে রসদ থেকে বঞ্চিত করে মারবো।

আপনি তো জানেন, বৈরুত সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত- প্রবীণ কমান্ডার বললো- তিনি তো তার নৌশক্তিও ব্যবহার করতে পারেন।

তিনি নৌশক্তি ব্যবহার করবেন- নাইট বললো- তার বিপুলসংখ্য সৈন্য সমুদ্র জাহাজে করে আসছে। আমরা তারও ব্যবস্থা করে রেখেছি। আমরা সমুদ্রে তার মোকাবেলা করবো না। তার বাহিনীকে কুলে অবতরণ করার সুযোগ দেবে। এভাবে আমরা তার জাহাজগুলোকে ধ্বংস কিংবা তাদেরকে পালানোর সুযোগ না দিয়ে জাহাজগুলোকে দখল করবো। আমার বন্ধুগণ! তোমরা তো জানো, সেনাবাহিনীর এসব গোপন তথ্য বলা যায় না। কেননা, মুসলমানদের অঞ্চলে যেমন আমাদের গুপ্তচর আছে, তেমনি আমাদের অঞ্চলেও মুসলমান চর তৎপর রয়েছে। আমাদের সৈনিকদের মুখনিঃসৃত যে কোন কথা সালাহুদ্দীন আইউবীর কানে পৌঁছে যাওয়া বিচিত্র নয়। তবে কোন কোন সময় অন্তত কমান্ডারদের জানা থাকা দরকার, অনাগত পরিস্থিতি কিরূপ হবে এবং তার পটভূমি কী হবে। সাবধান থাকবে, সৈনিকরা যেনো জানতে না পারে, আমরা সালাহুদ্দীন আইউবীর কোন সংবাদ পেয়েছি। অন্যথায় আইউবী সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফেলবেন।

মুসলমান আমীরদের মনোভাব কি আপনার জানা আছে- অপর এক কমান্ডার জিজ্ঞেস করে- এমনও তো হতে পারে, তারাও আমাদের উপর আক্রমণ করবে।

তাদের পক্ষ থেকে আমাদের কোন আশঙ্কা নেই- নাইট বললো হাবের গভর্নর ইয়ুদ্দীন মসুলে এসে পড়েছেন আর আমীর চলে গেছেন হালবে। ক্ষমতার এই হাতবদল আমাদের কারসাজিতে হয়েছে। ওখানকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে আমাদের নিয়ন্ত্রণে। এতোটুকু আশা করা যায় যে, তাদের কেউ না কেউ সালাহুদ্দীন আইউবীর উপর আক্রমণ করবে কিংবা তাকে রসদ সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানাবে। মোটকথা, এটা নিশ্চিত, আইউবী তার মুসলমান আমীরদের থেকে কোন সাহায্য পাবেন না।

***

রাতে ইসহাক তুর্কি নাইটের সঙ্গে সুলতান আইউবীর সম্ভাব্য আক্রমণ এবং বৈরুত অবরোধ সম্পর্কে মতবিনিময় করে এবং সন্তোষ প্রকাশ করে বলে- এবার আমি আমার বাসনা পূর্ণ করার সুযোগ পাবো। সে আরো কিছু জরুরি তথ্য জেনে নেয়। তার সামনে এখন কাজ, তাকে ওখান থেকে পালিয়ে কায়রো পৌঁছতে হবে। সে ভাবে, হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেলে নাইট সন্দেহ করে বসবে, আমি গোয়েন্দা ছিলাম এবং তাদের সবকিছু দেখে-শুনে চলে গেছি। ফলে সে পরিকল্পনা পরিবর্তন করে ফেলবে। তাই ইসহাক নাইটকে বলে, ছুটি নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে। অজুহাত তার আছে। ঠিক করে, বলবে, পরিবার-পরিজনকে মুসলমানদের অঞ্চলে রেখে এসেছি, আপনি তা জানেন। এখন যেহেতু আমি মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়ে গেছি, তাই এদেরকে উদ্ধার করে আনতে চাই। অন্যথায় মুসলমানরা তাদেরকে উত্যক্ত করতে থাকবে।

অজুহাত উপস্থাপন করে ইসহাক নাইটকে বলে- এক-আধ মাস পর তো আমরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়বোই। তারপর কে জানে কতদিন আমাদের যুদ্ধের মাঠে থাকতে হয়। পরিবারের লোকদেরকে এখনই নিয়ে আসতে পারলে ভালো হতো। তাছাড়া এমনও তো হতে পারে, আমি যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করলাম আর ওদিকে তাদের কোন সহায় রইলো না।

অজুহাতটা যৌক্তিক। নাইট তাকে যে ঘোড়াটি দিয়েছিলো, সেটি দেখিয়েই বললো- তুমি এখনই রওনা হয়ে যাও। যতো তাড়াতাড়ি সব ফিরে এসো।

ইসহাক তুর্কির তাড়া খৃস্টান নাইটের চেয়ে বেশি। কারণ, তাকে দ্রুত কায়রো পৌঁছুতে হবে। তবে তার আগে তাকে হালব ও মসুল যাওয়া আবশ্যক। কেননা, ওখানকার শাসকদের সম্পর্কে তার কানে কিছু কথা এসেছে। সে জানে না, সুলতান আইউবী যখন অভিযান পরিচালনা করবেন, তখন মসুলের শাসনকর্তা ও সেনা অধিনায়কদের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে। হাবে তার সহকর্মী কারা আছে এবং কোথায় আছে, তার জানা আছে। কিন্তু সে নাইটের মুখ থেকে শুনেছে, ইযযুদ্দীন মসুল এবং ইমাদুদ্দীন হালবে চলে গেছেন। তার অর্থ হচ্ছে, রোজি খাতুনও এখন মসুলে অবস্থান করে থাকবেন। তা-ই যদি হয়, তাহলে তার খাদেমাও তার সঙ্গে থাকবে। মহলের ভেতরের যোগাযোগ এই খাদেমার মাধ্যমেই হতে পারে।

ইসহাক তুর্কি সে রাতেই রওনা হয়ে যায়। ঘোড়াটা উন্নত জাতের। ইসহাক দক্ষ অশ্বারোহী। মাসের দূরত্ব কয়েক দিনে অতিক্রম করার অভিজ্ঞতা তার আছে। ইসহাক পথ চলতে থাকে আর আল্লাহর নিকট দুআ করতে থাকে, যেনো তার কায়রো পৌঁছার আগে সুলতান আইউবী রওনা না হন। ছুটতে ছুটতে ঘোড়া ক্লান্ত হয়ে পড়লেও ইসহাক থামছে না। ধীরে ধীরে ঘোড়ার গতি কমতে শুরু করে। ইসহাক নিজেও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সে সামনের দিকে কে পেটটা যিনের সঙ্গে লাগিয়ে চলন্ত ঘোড়ার পিঠে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে।

শেষ রাতে ইসহাকের চোখ খোলে। হন্তদন্ত হয়ে আকাশের দিকে তাকায়। তার পথ প্রদর্শনকারী তারকাটা জ্বল জ্বল করছে। ঘোড়া সঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছে। ভোরের আলোতে ইসহাক এক স্থানে ঘোড়াটাকে পানি পান করায় এবং ঘাস খাওয়ায়। নিজেও খানিকটা বিশ্রাম নেয়। তারপর আবার চলতে শুরু করে।

এ দিনটিও কেটে গেলো। রাতও অতিক্রান্ত হলো। খৃস্টান নাইটের প্রদত্ত ঘোড়াটা ইসহাককে খুব কাজ দিচ্ছে। সূর্য অস্ত যেতে এখনো বেশ দেরি। মসুলের মিনারের চূড়াটা দেখতে পাচ্ছে ইসহাক। ইসহাক এই নগরী সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত আছে। দুসঙ্গী গোয়েন্দার ঠিকানাও তার কাছে আছে। তবে তারা কোন তথ্য দিতে পারবে কিনা তার জানা নেই। এমনও হতে পারে, তারা তাকে হালবের পথ দেখিয়ে দেবে।

***

ইযযুদ্দীন নিশ্চিন্ত হয়েছেন, রোজি খাতুন তার প্রতি সন্তুষ্ট। তিনি রোজি খাতুনের কোন কর্মকাণ্ডে আর হস্তক্ষেপ করেন না। রোজি খাতুন এ কথাও জিজ্ঞেস করলেন না যে, সে ইমামুদ্দীনের সঙ্গে ক্ষমতা রদবদল কেন করলেন। যে উদ্দেশ্যে তিনি ইযুদ্দীনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন, তা পূরণ হয়নি। তথাপি তিনি এই ভেবে সান্ত্বনা পান যে, তিনি এই রহস্যময় জগতটার অভ্যন্তরে ঢুকতে পেরেছেন এবং সুলতান আইউবী এখানে যে গোয়েন্দা জাল বিছিয়ে রেখেছেন, তাকে আরো কার্যকর করতে পারছেন। তিনি শামসুন্নিসাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং মেয়েটি বিভ্রান্ত জীবনের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে মুজাহিদ নারীতে পরিণত হয়েছে। সে ইযযুদ্দীনের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী আমের ইবনে ওসমানকে সংবাদদাতা ও গুপ্তচর বানায়। আর নিজের প্রেমাস্পদ হওয়া সত্ত্বেও গুপ্তচরবৃত্তির স্বার্থে তাকে এমন একটি চতুর ও রূপসী মেয়ের পেছনে নিয়োজিত করে, যে তাকে আজীবনের জন্য ছিনিয়ে নিতে সক্ষম।

আমের ইবনে ওসমান আনুশি থেকে যেসব তথ্য উদঘাটন করছে, তা সব শামসুন্নিসার মাধ্যমে রোজি খাতুনের নিকট পৌঁছিয়ে দিচ্ছে। এ এক অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, যা কায়রোতে পৌঁছিয়ে দেয়া একান্ত জরুরি। হাব থেকে সুলতান আইউবীর যে গোয়েন্দা এসেছিলো, তাদের কমান্ডারকে কায়রো যাওয়ার জন্য একজন লোক ঠিক করে রাখতে বলা হলো। সে বলেছিলো, ইসহাক তুর্কি বৈরুত থেকে এসে পড়বে। ওখানকার সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত রিপোর্ট অসম্পূর্ণ থাকবে। সুলতান আইউবী আলী বিন সুফিয়ানকে বারবার বলছেন খৃষ্টানদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার তথ্য সংগ্রহ করো।

আনুশি আমের ইবনে ওসমানকে যেসব তথ্য দিয়েছে, সবই ছিলো সত্য। মেয়েটি ইমুদ্দীন ও তায় ব্যক্তিগত উপদেষ্টাদের উপর এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিলো যে, তারা তার উপস্থিতিতে যারপরনাই স্পর্শকাতর কথাবার্তা বলতে কুণ্ঠাবোধ করতো না। লোকগুলোর প্রতি আনুশির কোনো হৃদ্যতা ছিলো না। সে তাদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করতো। শুধুমাত্র নিজের কর্তব্য পালন করে যাচ্ছিলো। কিন্তু তার জানা ছিলো, যে যুবকটিকে সে মনে-প্রাণে ভালোবাসে, সেই আমের ইবনে ওসমনিও নিজ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। আনুশির প্রেমের ফাঁক গলিয়ে অনেক অজানা তথ্য বের করতে সক্ষম হয় আমের।

ইযযুদ্দীন রোজি খাতুনের ভ্রমণ বিহারের জন্য ঘোটঘন দিয়ে রেখেছেন। এক সন্ধ্যায় রোজি খাতুন শামসুন্নিসাকে সঙ্গে করে বাইরে বেড়াতে যান। নগরীর সন্নিকটে একটি সবুজ বাগিচা। ভেতরে মনোরম একটি কূপ। জায়গাটা এতো সুন্দরও মন ভোলানো যে, রাজ পরিবারের সদস্যরা ব্যতীত অন্য কেউ এখানে আসতে পারে না। রোজি খাতুনের সঙ্গে খাদেমাও আছে। রক্ষী হিসেবে সঙ্গে এসেছে আমের ইবনে ওসমান। আমের ইযুদ্দীনের বিশ্বস্ত ব্যক্তি। তার প্রতি নির্দেশ রয়েছে, রোজি খাতুন যখন বাইরে বেড়াতে যাবেন, সে তার সঙ্গে থাকবে।

গন্তব্যে পৌঁছে গাড়িটা দূরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। রোজি খাতুন ওঁ শামসুন্নিসা কূপের দিকে চলে যায়। আমের ইবনে ওসমানও সঙ্গে আছে। আসলে এটা তাদের শুধু ভ্ৰমণ নয়, ভ্রমণের বাহানায় রোজি খাতুনের আমের থেকে প্রাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করার ব্যবস্থা কাটে।

ইসহাক তুর্কি মসুলে তার এক সহকর্মীর নিকট পৌঁছে গেছে। সঙ্গী তাকে জানায়, রোজি খাতুনও তাদের দলে যোগ দিয়েছেন। বরং বলা যায়, তিনি তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছেন। উভয়ের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ কথোপকথন ও তথ্য আদান-প্রদান হয়। ইত্যবসরে তাদের আরেক সঙ্গী এসে পড়ে। সে ইসহাককে জানায়, রোজি খাতুনের খাদেমাকে এ মুহূর্তে অমুক কূপের নিকট পাওয়া যাবে। ভালো হবে, তুমি গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করো। ইসহাক সঙ্গীদের তার ব্যস্ততার কথা জানায়। সম্ভব হলে রাতেই আবার সে কায়রোর উদ্দেশ্যে রওয়া হয়ে যাবে।

কূপের কিনারায় বসে আমের ইবনে ওসমান রোজি খাতুন ও শামসুন্নিসাকে বলছে, আনুশির কথা অনুযায়ী সে নিশ্চিত হয়েছে, খৃস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হলে হাদীন সুলতান আইউবীকে বন্ধুত্বের ধোকায় ফেলে প্রতারণা করবেন। সুলতান আইউবী যদি রসদ দিতে বলেন, তিনি সময়মতো রসদ সরবরাহ করবেন না। সুলতান যদি সৈন্য তলব করেন, তাহলে এই অজুহাতে ব্যর্থতা প্রকাশ করবেন যে, ইমামুদ্দীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো নেই। সে যে কোন মুহূর্তে আক্রমণ চালাতে পারে। তাই আমাকে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় আপনাকে আমি সৈন্য দিতে অপারগ। ইমাদুদ্দীনের দৃষ্টিভঙ্গিও একই রকম। ব্যাপারগুলো সুলতান আইউবী অবহিত হওয়া দরকার। কারণ, তিনি তো দুশাসককেই তাঁর অত্যন্ত কাছের মানুষ মনে করছেন।

খাদেমা এদিক-ওদিক টহল দিচ্ছে। ভ্রমণস্থলের নিকট থেকে কারো গানের শব্দ তার কানে আসে। কে যেনো গাইছে- পথভোলা পথিক হে! তারকাটা দেখে নে। খামা কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে যায়। এই গান তো তাদের গোয়েন্দাদের গোপন সংকেত। তারা একজন অপরজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলে এই গান গাইতে থাকে। খাদেমা ঝোঁপের আড়ালে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সে ইসহাক তুর্কিকে চিনে ফেলে। তাকে দাঁড় করায়। ইসহাক বললো- আমার সময় নেই, তুমি পায়চারি করতে থাকো। বলেই বোজি খাতুনের নিকট চলে যায়।

***

সূর্য ডুবে গেছে। ভ্রমণ স্থলের উপর আঁধার নেমে আসছে। ইসহাক তুর্কি এমন এক জায়গায় রোজি খাতুন, শামুসন্নিসা ও আমেরের সঙ্গে বসে আছে, যেখানে তাদের দেখার সাধ্য কারো নেই।

রোজি খাতুন ইসহাক তুর্কির কাছে হাব ও মসুলের যাবতীয় গোপন রহস্য ও প্রতারণার চিত্র তুলে ধরে। তিনি ইসহাককে বললেন- তুমি সালাহুদ্দীন আইউবীকে বলবে, আমি নূরুদ্দীন জঙ্গীর আসনটা ইযষুদ্দীনকে দিয়েছিলাম হৃদয়ে পাথর বেঁধে আমি ইযুদ্দীনকে এজন্য গ্রহণ করেছিলাম যে, তাকে জঙ্গীর যথাযথ উত্তরাধিকার বানাবো, এবং তিনি জঙ্গীর ন্যায় তোমার ডান হাত হয়ে কাজ করবেন। কিন্তু বিয়ের পর তার আসল রূপ উন্মোচিত হয়ে পড়েছে। এই বিয়ে করে আমি জীবনে একটি মারাত্মক ভুল করেছি। বিয়ের বাহানায় আমাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। এখন দামেশকের মর্যাদা তোমার হাতে। বৈরুতে তোমাকে কীভাবে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি চলছে, তা তুমি ইসহাকের নিকট থেকে জেনে নেবে। তোমার বৈরুত অবরোধের পরিকল্পনার সংবাদ বৈরুত পৌঁছে গেছে। এমতাবস্থায় ল করতে হবে তুমিই অলো বুঝে। ভেবে দেখো, সরাসরি বৈরুতই যাবে, নাকি পরিকল্পনা পরিবর্তন করে ফেলবে। তথ্যটা বৈরুতে কে পৌঁছালো, এ প্রশ্নের উত্তর আলী বিন সুফিয়ান দিতে পারবে। আমাদের জাতির মধ্যে ঈমান বিক্রি একটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরবের আমীরদের বিলাসিতার এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে তারা খানায়ে কাবাকেও বিক্রির চেষ্টা করবে। বিলাসিতা আর ক্ষমতার মোহ এই দুই মিলে আমাদের রাজ্যগুলোকে টুকরো টুকরো করে ফেলছে এবং জাতিগুলোর নাম-চিহ্ন মুছে ফেলছে। তুমি ইবুদীন ও ইমামুদ্দীনের উপর আস্থা রাখবে না। এরা তোমাকে সাহায্য নয় বরং ধোকা দেবো। আমার পরামর্শ হলো, বৈরুতের পরিবর্তে হালব ও মসুল অবরোধ করে আগে ঈমান নিলামকারী শাসকদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে এবং এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এটা ইসলামের অনেক বড় খেদমত হবে। ইতিহাসের উপর একবার চোখ বুলাও সালাহুদ্দীন। আমাদের রাজা-বাদশাগণ আজীবন দেশ-জাতি-রাষ্ট্রকে বিক্রিই কব্লেছে। দেশ-জাতির লাজ রক্ষা করেছে ইসলামের সৈনিকরা। সৈনিক ছাড়া কেউ শত্রু দেখে না। আর শক্রর হাতে জীবন দেয় শুধু সৈনিক। সে কারণে দেশ ও জাতির মূল্য-মর্যাদা শুধু সৈনিকরাই বুঝে। যে সময় এই বিলাসী শাসকরা শঙ্কর প্রেরিত মন্দ, সুন্দরী নারী আর বিত্তের নেশায় মাতাল পড়ে থাকে, তখন আল্লাহর সৈনিকগশ্ব মরু বিয়ান, পাহাড়-জঙ্গল আর নদী-সমুদ্রে জীবন অতিবাহিত করে। তাই সালাহুদ্দীন। গোমার জীবনটাও তেমনি মরু বিয়াবানে, পাহাড়-জঙ্গলে লড়াইরত অবস্থায় অতিবাহিত হচ্ছে। আমার প্রথম স্বামী নূরুদ্দীন জঙ্গীও সারা জীবন ইসলামের শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কাটিয়েছেন। কিন্তু তুমি যখন ঈমান বিক্রিকারী শাসকদের বিরুদ্ধে বুকটান করে দাঁড়াও, তখন তারা তোমাকে জাতির ঘাতক ও পাদ্দার আখ্যা দেয়। আমাদেরকে এসব ফতোয়ার পরোয়া করা চলবে না। এ সব ইহুদী-খৃষ্টানদের ফতোয়া, যা আমাদের ভাইয়েরা তোমার বিরুদ্ধে আরোপিত করছে। তুমি আসো- ঝড়ের ন্যায় আসো। আল্লাহ তোমার সঙ্গে আছেন। আমি তোমার জন্য ভূমি সমত করছি। এখানকার প্রতিটি শিশু, বৃদ্ধ ও নারী তোমার সঙ্গে থাকবে। বাকি সংবাদ ইসহাকের নিকট থেকে জেনে নিও।

ইসহাক তুর্কিকে প্রাপ্ত সকল তথ্য অবহিত করা হলো। সে উঠে ঝোঁপ-জঙ্গলের মধ্যদিয়ে অতি সন্তর্পণে বেরিয়ে পড়ে। এ সময় তার অনুভব হতে লাগলো, কার যেন পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ইসহাক এদিক-ওদিক তাকায়। আর সন্দেহ জাগে, খানিক দুরে ছায়ার মতো একটা কি যেনো চলে গেছে এবং ঝোঁপের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে। বিষয়টার প্রতি মনোযোগ দেয় না ইসহাক। মাথায় তার ভাবনা, যুঙ্গে তাড়ি সঞ্জয় তাকে কায়রো পৌঁছতে হবে। এমন যেনো না হয়, তার পেছার আগেই সুলতান আইউবী রওনা হয়ে গেছেন। এখান থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে বলে অত্যন্ত আনন্দিত সে। ইসহাক তার সখীদের নিকট যায়। খুব তাড়াতাড়ি করে চারটা খেয়ে রওনা হয়ে যায়। সামনে তার আরো কাজ আছে। হালব গিয়ে কমান্ডারের সঙ্গে দেখা করতে হবে।

ইসহাক হা্লব পৌঁছে যায়। কমান্ডারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। কমান্ডার ইসহাককে অতিশয় উন্নত জাতের একটি ভাগড়া ঘোড়া প্রদান করে। পানির জােট একটি মশক ও খাদ্যভর্তি থলে ঘোড়ার সাথে বেঁধে দেয়। ইসহাক কায়রোর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়।

***

যে রাতে ইসহাক ভ্রমণস্থলে রোজি খাতুনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলো, সে রাতে মন ভালো না থাকার অজুহাতে আনুশি ইম্যুদ্দীন ও সাঙ্গপাঙ্গদের আসরে যায়নি। মেয়েটি অসুস্থ ভেবে ইমুদ্দীন ডাক্তার অলর করেন। ডাক্তার দেখে ওষুধ দেন। কিন্তু আনুশি ওষুধ খেতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বললো- বিরক্ত করো না, আমাকে একটু শান্তিতে এক খাকতে দাও।

রাত জাগরণ ও অধিক মদ্যপানের কারণে তার এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

ইযযুদ্দীন ও ডাক্তার চলে যায়। আলুশি কক্ষের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে কক্ষে ভেতরে পায়চারি করতে থাকে। মনটা তার বেজায় অস্থির। বার কয়েক জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকায় আবার পায়চারি করতে শুরু করে।

আনুশি তার অলঙ্কারের বাক্সটা খোলে। একটি আংটি বের করে। আংটির নগিনার জায়গাটা ডিবার মতো। অত্যন্ত সুন্দর ও ভারী একটি আংটি। আনুশি আংটির ডিবাটা খুলে। তার মধ্যে সাদা পাউডার ভর্তি। সে পাউডারগুলোর প্রতি খানিক তাকিয়ে ডিবাটা বন্ধ করে আংটিটা আঙ্গুলে পরিধান করে। এবার তাকে কিছুটা শান্ত মনে হলো, যেনো অস্থিরতা দূর করার চেষ্টা করছে।

রাত অর্ধেক কেটে গেছে। আনুশির সেবিকা তার কক্ষের কাছাকাছি অপর এক কক্ষে ঘুমিয়েছিলো। তাকে বলে দিয়েছিলো, আজ রাতে আর তাকে প্রয়োজন নেই। কিন্তু মধ্যরাতের পর আনুশি সেবিকার কক্ষে গিয়ে তাকে জাগিয়ে বললো, আমের ইবনে ওসমানকে ডেকে আন।

সেবিকা আনুশি-আমরের প্রেমের ঘটনা জানতো। সে উঠে গিয়ে আমেরকে ডেকে আনে। আনুশি সেবিকাকে বললো- তুমি কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকো।

আমের!- আনুশি এমন এক ভঙ্গিতে বললো, যেনো তার সঙ্গে আমেরের পরিচয় নেই- আজ ভ্রমণস্থলে তোমাদের সঙ্গে যে লোকটা বসা ছিলো, সে কে?

কেউ নয়- আমের অজ্ঞতা প্রকাশ করে উত্তর দেয়- আমার নিকট কেউ আসেনি তো। আমি তো বেগমের সঙ্গে রক্ষী হিসেবে যাই এবং তার থেকে দূরে থাকি।

আমের!- আনুশি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত কণ্ঠে বললো- আমার সাত স্তর মাটির নীচের গোপন খবরও জানা আছে। তোমাকে আমি হৃদয়ের গভীর থেকে কামনা করি। কিন্তু তুমি আমাকে বোকা ভেবো না। তুমি, রোজি খাতুন, শামসুন্নিসা ও তার খাদেমা একসঙ্গে বসেছিলে আর একজন অপরিচিত লোক তোমাদের মাঝে বসা ছিলো। অতি গোপনীয় কথপোকথন হচ্ছিলো। প্রমাণ চাইলে তাও দিতে পারি। তোমরা কানে কানে কথা বলছিলে। শেষে অপরিচিত লোকটা সেখান থেকে চলে যায়। আমি তখন ফিরে আসি।

ইসহাক তুর্কি সেখান থেকে ওঠে চলে যাওয়ার সময় কারো পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছিলো। খানিক দূরে একটি ছায়াও দেখেছিলো। আসলে সে ছিলো আনুশি। মেয়েটি চুপি চুপি রোজি খাতুন, শামসুন্নিসা ও আমের ইবনে ওসমানের পিছু নিয়েছিলো।

আমের ইবনে ওসমান উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়। আমতা আমতা করে কিছু বলার চেষ্টা করে, যার কোন অর্থ দাঁড়ায় না। আনুশি দক্ষ গোয়েন্দা। তার সন্দেহটা ভিত্তিহীন নয়। বললো- শামসুন্নিসা যদি একা হতো তাহলে মনে করতাম, রাজকন্যা তোমাকে দখল করে রেখেছে। কিন্তু বিষয়টা ছিলো ভিন্ন। আচ্ছা বলো তো, তুমি আমাকে গোপন বিষয়াদি কেন জিজ্ঞেস করো?

এমনিই- আমের মুচকি হেসে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে- এমনিতেই জিজ্ঞেস করি। ওসব রাজকীয় ব্যাপারের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক থাকতে পারে। মনে কৌতূহল জাগে, আমরা রাজা-বাদশাহদের কী ভাবি, আর আসলে তারা কী।

আমের!- আনুশি অত্যধিক ক্ষুব্ধকণ্ঠে বললো- তুমি জানো না আমি কে। আমার এক ইশারায় এই নগরীর প্রতিটি ইট খসে পড়তে বাধ্য। আমার পিপাসু আবেগ আমাকে ধোঁকা দিলো। আমি তোমার প্রেমের নেশায় নিজের কর্তব্য ভুলে গেলাম আর তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। তারপরও আমার হৃদয়ে তোমার প্রতি দুর্বলতা কাজ করছে। তার প্রমাণ, তুমি এখানে নিরাপদে অবস্থান করছে। আমি চাইলে তোমাকে সেই কয়েদখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করা রাখতে পারতাম, যেখানে নির্যাতনের পর গাদ্দার ও গোয়েন্দাদের ফেলে রাখা হয়। তোমাকে আমি সেই জাহান্নাম থেকে রক্ষা করেছি। শুধু এটুকু স্বীকার করো, আমার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ঐ অচেনা লোকটাকে দিয়েছে এবং সংবাদ নিয়ে লোকটা কায়রো চলে গেছে। তুমি আমার নিষ্ঠা আর ভালোবাসার প্রমাণ দেখো, আমি তোমাদের দেখে ফেলার পরও লোকটাকে চলে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছি। আমি ইচ্ছা করলে তাকে গ্রেফতার করাতে পারতাম। কিন্তু তোমার ভালোবাসা আমাকে এ কাজে বাধার সৃষ্টি করেছে।

আনুশির চোখে অশ্রু এসে যায় যে আমি নিজেই চিত্তাকর্ষক প্রতারণা, সেই আমি ধোঁকায় পড়ে গেলাম। তুমি জিতে গেছো আমের, তুমি জিতে গেছো। ভালোবাসার কাছে আমি পরাজিত। বলল, সত্য বলো আমের!

হ্যাঁ, আনুশি- আমের বললো- তুমি তোমার কর্তব্য পালন করেছো, আর আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। আমাকে তুমি কয়েকখানায় বন্দী করে রাখো।

আনুশির গণ্ড বেয়ে অশ্রু গড়াতে থাকে। হঠাৎ সে অট্টহাসি দিয়ে বললো- ব্যস, এতোটুকুই জানবার প্রয়োজন ছিলো, যা তুমি স্বীকার করেছে। আমি তোমাকে বন্দী করাতে পারবো না। এখন আমিও এই পিঞ্জিরা থেকে মুক্ত হতে চাই। তুমি মদপান করো না। আমাদের সম্রাটগণ যে শরবত পান করেন, আমি তোমাকে সেই শরবত পান করাবো।

আনুশি বসা থেকে ওঠে টেবিলটার নিকট গিয়ে দাঁড়ায়। টেবিলের উপর একটি সোরাহি রাখা আছে। তার পিঠটা আমেরের পিঠের দিকে। আনুশি দুটি পেয়ালা নিয়ে নখের সাহায্যে আংটিতে স্থাপন করা ডিবাটা খোল। ভিবার কিছু পাউডার এক পেয়ালায়, কিছু অপর পেয়ালায় ঢেলে দেয়। বিষয়টা আমের দেখতে পায়নি। আনুশি উভয় পেয়ালায় সোরাহি থেকে শরবত চেলে একটি আমেরের হাতে তুলে দেয়, অপরটি নিক্সের হাতে রাখে।

শুকে দেখো- আনুশি বললো- এগুলো শরব নয় শরবত। এ আমার প্রিয় পানীয়। নাও পান করো।

আনুশি নিজের পেয়ালাটা ঠোঁটে লাগায়। আমেরও পান করতে শুরু কয়ে। ঢক ঢক করে পান করে উভয়ে পেয়ালা শূন্য করে ফেলে। আনুশি আমেরের হাত থেকে পেয়ালাটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমেরের গলাটা নিজের বাহুতে জড়িয়ে ধরে বললো- এখন আমরা স্বাধীন।

আনুশি হঠাৎ লাফিয়ে আমের থেকে আলাদা হয়ে বলে ওঠে- তুমি তা অনুভব করছো?

হ্যাঁ- আমের উত্তর দেয়- তোমার ডাক পেয়ে আমি ঘুম থেকে উঠে এসেছি। নিদ্রা আমাকে অস্থির করে তুলছে।

এখন আমরা উভয়ে এমন গভীর ঘুম ঘুমাবো যে, কেউ আমাদের জাগাতে পারবে না- আনুশি আচ্ছন্ন কণ্ঠে বললো- আমি তোমার চেয়ে বেশি ক্লান্ত। পাপের বোঝা আমাকে ক্লান্ত করে তুলেছে।

মেয়েটির মাথাটা একদিকে কাত হয়ে পড়তে শুরু করে। সে আত্মসংবরণ করে বললো- বেশি কথা বলার সময় নেই আমের। তুমি আমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা। এখন আমরা পরকালে একসঙ্গে উত্থিত হবো। আমি আমার কর্তব্য আদায় করেছি। তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছ। এই শরাবে আমি সেই বিষ মিশিয়েছি, যে বিষ দিয়ে আমাদেরকে বিদেশ প্রেরণ করা হয়ে থাকে। বস্তুটা প্রয়োজনের সময়কার জন্য দেয়া হয়। এই বিষপানে কোন তিক্ততা অনুভব হয় না। অত্যন্ত মিষ্টি আবেশের মধ্যে মানুষ চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়ে। আমি এই জন্য জীবিড় থাকতে চাই না, যদি জীবিত থাকি, তাহলে তোমাকে শান্তি দিতে হবে। তোমাকে এ কারণে জীবিত থাকতে দেইনি, যেনো অন্য কোন মেয়ে বলতে না পারে আমেরের সঙ্গে আমায় ভালোবাসা আছে।

আমের ইবনে ওসমান শুয়ে পড়েছে। যেনো সে আনুশির বক্তব্য শুনতেই পাচ্ছে না। তার চোখ দুটো বুজে আসছে। আনুশির মাথাটা দুলছে। সে নড়বড়ে পায়ে দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়। সেবিকা দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ভেতরে ডেকে এনে বললো- আমরা দুজনে বিষপান করেছি। তুমি সকলকে বলে দেবে, আমরা স্বেচ্ছায় বিষপান করেছি। অন্য কেউ পান করায়নি। কোন খৃষ্টানের দেখা পেলে বলবে, তাদের সুদানী পরী আয় কর্তব্য পালন করে চিরবিদায় নিয়েছে।

আনুশির কষ্ঠ ক্ষীণ হয়ে আসছে। পড়তে পড়তে আমেরের নিকট চলে যায়। সেবিকা দৌড়ে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর দুজন লোক কক্ষে প্রবেশ করে। তারা দেখতে পায়, আমের ইবনে ওসমান পালকের উপর পড়ে আছে আর আনুশি তার গা ঘেঁষে এমনভাবে শুয়ে আছে যে, তার মাথা আমেরের বুকের উপর আর একহাত মাথার উপর। এক হাতের আঙ্গুলগুলো আমেরের চুলের ভেতর ঢুকে আছে, যেনো মেয়েটি আমেরের মাথায় বিলি কাটছে। দুজনই মৃত।

***

ইসহাক তুর্কি এখন মসুল থেকে বেরিয়ে গেছে। অপৱিচিত লোকটা সালাহুদ্দীন আইউবীর গুপ্তচর হতে পারে সন্দেহ করেও অনুশি তাকে, ধাওয়া করেনি, গ্রেফতার করার চেষ্টা করেনি। ভালোবাসার প্রতারণার মধ্যে যে সামান্য সময়টা আমেরের সঙ্গে অতিবাহিত করেছে, এ সময়টুকুতে সে আত্মিক প্রশাড়ি পেয়েছিলো। সেই ভালোবাসার বিনিময় হিসেবে মেয়েটি ইসহাককে নিরাপদে চলে যেতে দিয়েছে।

কায়রো পৌঁছতে আরো দিন কয়েকের পথ বাকি থাকতেই সাপটা ইসহাকের ঘোড়াটাকে দংশন করে। অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে কায়রো যাচ্ছিলো ইসহাক, যার সঙ্গে ইসলামের মর্যাদা ও সুলতান  ও আইউবীর অস্তিত্বের সম্পর্ক। ইসহাক এক মর্দে মুজাহিদ। জীবনের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে এই বিস্তৃত নির্দয় মরুদ্যান অতিক্রম করে সেই তথ্য নিয়ে কায়রো পৌঁছুতে চাচ্ছিলো। কিন্তু সাপ ঘোড়াটাকে দংশন করায় ইসহাক মরুর নির্মম আচরণে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে। যখন জ্ঞান ফিরে, সুলতান আইউবীর গোয়েন্দা ইসহাক তখন খৃস্টানদের তাঁবুতে পড়ে আছে। ইসহাক চোখ খুলে দেখতে পায়, দুটি মেয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

বিস্তারিত কাহিনী আপনারা পেছনে পড়ে এসেছেন।

ইসহাক তুর্কি অচৈতন্য অবস্থায় বিড় বিড় করতে থাকে। অজ্ঞাতসারে তার উচ্চারিত শব্দগুলো থেকে খৃস্টান দলটি বুঝে ফেলে লোকটি মুসলমান গোয়েন্দা এবং কোন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিয়ে কায়রো যাচ্ছে। দুই মেয়ে মেরিনা ও বারবারার মধ্যে মন কষাকষি ছিলো। তারা উভয়ই কমান্ডারকে পেতে চাচ্ছিলো। কিন্তু কমান্ডার বারবারাকে প্রেমের ধোকা দিয়ে মেরিনার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলে। বারবারা প্রতিশোধ

যার লক্ষ্যে ইসহাককে বলে দেয়, তুমি খৃস্টান গোয়েন্দাদের জালে এসে পড়েছে। ইসহাক তাদের এই জালে এমনভাবে ফেঁসে যায় যে, সে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়, আমি সুলতান সালাহুদ্দীনের গোয়েন্দা এবং হাল্ব থেকে এসেছি। খৃস্টানদের দলনেতা তাকে জিজ্ঞেস করে, কী সংবাদ নিয়ে যাচ্ছিলে? ইসহাক বললো, নূরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী রোজি খাতুন ইযযুদ্দীনকে বিয়ে করেছেন। দলনেতা বললো, এ খবর বাসি হয়ে গেছে। তোমাদের সুলতান এখন সিরিয়া অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

খৃস্টান দলনেতা জানতে চায়, বলো, তুমি কী কী তথ্য নিয়ে যাচ্ছিলে। বৈরুতে তোমাদের মুসলমান গোয়েন্দারা কারা এবং তাদের আস্তানা কোথায়। যদি না বলো, তাহলে খৃস্টান অঞ্চলে নিয়ে তোমাকে কয়েদখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ করে রাখা হবে। ইসহাক এই ভেবে নমনীয়তা প্রদর্শন করেছিলো যে, পালানোর একটা সুযোগ বের করে নিতে হবে। খৃস্টান দলনেতা তাকে খৃস্টানদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করার প্রস্তাব করলে ইসহাক তাতেও সম্মত হয়ে যায়। কী তথ্য নিয়ে যাচ্ছিলে এই প্রশ্নের উত্তরে ইসহাক আসল তথ্য ফাঁস না করে তাদের বুঝ দেয়ার চেষ্টা করে। সিরিয়ার মুসলিম আমীদের সম্পর্কে কিছু কথা বললেও বৈরুতের বিষয়টা সম্পূর্ণ চেপে যায় ইসহাক।

খৃস্টান দলটির সদস্য সংখ্যা আট। তারা কায়রোতে দায়িত্ব পালন করে বৈরুত ফিরে যাচ্ছে। দলনেতা ইসহাককে বললো, আমরা রাতে রওনা হবো। তারা বৈরুত যাচ্ছে এবং তাকেও ধৃত হয়ে বৈরুত যেতে হবে শুনে ইসহাকের পিলে চমকে ওঠে। ওখানে গেলে নাইটের সঙ্গেও তার দেখা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ইসহাকের জন্য এটা আসল সমস্যা নয়– আসল সমস্যা হচ্ছে সুলতান আইউবীকে বল্ডউইনের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করার প্রয়োজন ছিলো এবং তাকে সতর্ক করার আবশ্যক ছিলো, যেনো তিনি বৈরুত অভিযান মুলতবী রাখেন। এ দায়িত্ব পালন করতে পারলে ইসহাকের জীবন দিতেও পরোয়া ছিলো না। কিন্তু এখন তো সে শত্রুর হাতে বন্দি এবং নিরস্ত্র হয়ে পড়েছে।

কাফেলা রাতে রওনা হয়। হাত দুটো পিঠমোড়া করে বেঁধে ইসহাককে একটা উটের পিঠে বসিয়ে দেয়া হয়। এই উটের উপর মালামালও বোঝাই করা। সুলতান আইউবীর এই গোয়েন্দা বৈরুত থেকে কায়রো রওনা হয়েছিলো। কিন্তু কায়রো না পৌঁছেই মাঝপথ থেকে এখন পুনরায় বৈরুত যেতে হচ্ছে। দূরত্ব অনেক দীর্ঘ। কাফেলা এগিয়ে চলছে। ইসহাক তুর্কি পালানোর পথ খুঁজে ফিরছে।

***

আমি আর একটা দিনও অপেক্ষা করতে পারি না- সুলতান আইউবী তাঁর সালারদের বললেন- ফৌজ প্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে। ফৌজকে এভাবে বেশি দিন রাখা উচিত নয়। অন্যথায় সৈনিকদের স্নায়ু ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়বে। আর এই অবস্থাটা যুদ্ধের জন্য ক্ষতিকর হয়। তাছাড়া আমি খৃস্টানদেরকে প্রস্তুত অবস্থায় ঝাঁপটে ধরতে চাই। অতীতে আমরা যখনই যুদ্ধ করেছি, নিজেদের অঞ্চলে করেছি। আর এই ভেবে আনন্দিত হয়েছি যে, আমরা দুশমনকে পিছু হটিয়ে দিয়েছি। দুশমন আমাদেরই ভূখণ্ডে আক্রমণ করলে আবার পিছপা হয়ে আমাদেরই মাটিতে অবস্থান নিয়ে থাকলো। এখন আমার প্রতিটি পদক্ষেপ আক্রমণাত্মক ও হিংস্র হবে। ফিরিঙ্গি বাহিনী বৈরুতে অবস্থান করছে। তাদের ব্যাপারে আমি কোন সংবাদ পাইনি। বল্ডইউন যদি তৎপরতা চালাতো, তাহলে আমি সংবাদ পেতাম। আমার অনুমান হচ্ছে, সে আর অন্যান্য খৃস্টানরা মুসলমান আমীরদেরকে তাদের সমর্থক ও আমাদের শত্রু বানানোর কাজে ব্যস্ত। তারা আমাদেরকে আরেকবার গৃহযুদ্ধে জড়াতে চায়। তারা গোপন তৎপরতায় ব্যস্ত রযেছে। আমরা বৈরুত অবরোধ করবো। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন। এই গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ডটি আমাদের দখলে এসে যাবে।

সালরদের এই বৈঠকে সুলতান আইউবীর নৌ-বাহিনী প্রধানও উপস্থিত আছেন। এক মিসরী কাহিনীকার মুহাম্মদ ফরিদ আবু হাদীস তার নাম হুসামুদ্দীন লুলু লিখেছেন। তিনি নৌ-যুদ্ধের বিশেষজ্ঞ এবং অতিশয় যোগ্য নৌ-বাহিনী প্রধান হিসেবে বিবেচিত ছিলেন। বৈরুত যেহেতু নোম উপসাগরের উপকূলে অবস্থিত ছিলো, তাই সুলতান আইউবী ঘেরাও পরিপূর্ণ করার লক্ষ্যে সমুদ্রের দিক থেকেও বাহিনী প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন।

যে ইউনিটগুলোর নৌযানে যাওয়ার এবং তীরে অবতরণ করার কথা, তারা ইসকান্দারিয়া পৌঁছে গেছে। হুসামুদ্দীনকে যাবতীয় দিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে- সুলতান আইউবী বললেন- নৌপথে গমনকারী বাহিনী খুব তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। সে জন্য এই বাহিনী কিছুদিন পর রওনা হবে। নৌ-বাহিনী তীরে অবতরণ করবে। দ্রুতগামী দূত এসে আমাদেরকে তাদের অবতরণের সংবাদ জানাবে। নগরীর উপর তাদের আক্রমণ হবে ঝড়গতিতে। ফিরিঙ্গিরা যদি অল্প সমর্পণ না করে, তাহলে আপনাদের সকলের জন্য অনুমতি আছে নগরীটা ধ্বংস করে দিন। নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও রুগ্নদের গায়ে হাত তুলবেন না। তাদেরকে আশ্রয়ে নিয়ে নেবেন। সৈনিকদেরকে হত্যা নয়- বন্দী করবেন। কোন অবস্থাতেই লুটতরাজ করা যাবে না। আপনাদের জন্য অনুমতি থাকবে, যে কেউ আমার নীতি-নির্দেশনা অমান্য করবে, পদমর্যাদায় সে যতই উচ্চ হোক না কেন, তাকে হত্যা করে ফেলবেন। স্থলপথে গমনকারী বাহিনীর অগ্রযাত্রা শান্তির ধারায় নয়- যুদ্ধের গতিতে হবে। বিরতি হবে তাঁৰু ছাড়া। বিরতির সময় মালামাল খোলা ও নামানো যাবে না। সকলে পানি পাবে সীমিত পরিমাণে। খাদ্য রান্না হবে না। খেজুর ইত্যাদি কোনো খাবার সঙ্গে যাচ্ছে। পশুগুলোকে পর্যাপ্ত খাবার দেয়া হবে।

সুলতান আইউবী চওড়া একখণ্ড কাপড়ের উপর কায়রো থেকে বৈরুত পর্যন্ত ভূখণ্ডের মানচিত্র আঁকিয়ে রেখেছিলেন। এখন সেটিকে দেয়ালের সঙ্গে ঝুলিয়ে অগ্রযাত্রার পথের উপর আঙ্গুল রেখে বললেন– এটি হবে আমাদের অগ্রযাত্রার রাস্তা।

বৈঠকের নীরবতা আরো অধিক গম্ভীর হয়ে যায়। সুলতান আইউবী সকলের চেহারার প্রতি তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন- আপনারা নীরব কেন? বলছেন না কেন, আমরা তাহলে শর অখালের উপর দিয়ে পথ অতিক্রম করছি?… আমার বন্ধুগণ! আমরা সাবধানতার নীতির ভিত্তিতে যুদ্ধ করছি। যাত্রা শুরু করার আগে আমরা পার্শ্বের নিরাপত্তা ও পিছু হটার পথ দেখে আসছি। তার ফল হচ্ছে, খৃষ্টানরা আমাদের ফিলিস্তীন দখল করে আছে এবং দামেশক-বাগদাদ দখল করে মক্কা-মদীনা অভিমুখে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা এটে রেখেছে। যিয়াদের পুত্র তারেক যদি মিসরের উপকূলে বসে থাকতেন, তাহলে ইউরোপ পর্যন্ত ইসলামের পতাকা কোনদিন পৌঁছতো না। কাসেমের পুত্র মুহাম্মদ এতো বিপজ্জনক ও দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ভারত পৌঁছেছিলেন। খৃষ্টানরা বহু দূর থেকে আমাদের ভূখণ্ডে এসেছিলো। ইসলামের সমুন্নতি যদি কাম্য হয়, তাহলে আমাদেরকে আগুনের মধ্যদিয়েও অতিক্রম করতে হবে। আর যদি রাজ্য শাসন উদ্দেশ্য হয়, তাহলে আসুন মিসর সিরিয়াকে ভাগ করে নিয়ে আমরা প্রত্যেকে রাজা হয়ে যাই। তারপর আপন আপন রাজত্বকে অটুট রাখার জন্য নিজেদের দ্বীন ও ঈমান বন্ধক রেখে ইহুদী-খৃস্টানদের থেকে সাহায্য গ্রহণ করি।

মহামান্য সুলতান!- এক সালার দাঁড়িয়ে বললো- আমরা আপনার আদেশ-নির্দেশনার অপেক্ষায় অপেক্ষমান। দুশমনের অঞ্চলের উপর দিয়ে অতিক্রম করতে হবে বলে আমরা একজনও ভীত নই। আপনি বলুন এই পথ অতিক্রমে আমাদের বিন্যাস কী হবে? বাহিনী কি যার যার হেফাজত নিজে করবে?

না- সুলতান আইউবী বললেন- আমি সেই দিক-নির্দেশনার দিকেই আসছিলাম। প্রতিটি ইউনিট অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবে। ডানে বাঁয়ে, আগে-পিছে কী ঘটছে সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করবে না। রসদ একসঙ্গে যাচ্ছে না। রসুদগুলো কয়েকভাবে বন্টন করে দেয়া হয়েছে, যাতে শক্ররা এগুলো ধ্বংস করতে না পারে। গেরিলা বাহিনী পুরো বাহিনীর নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব পালন করবে। গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার সায়েম মিসরী এখানে উপস্থিত আছে। তাকে এ বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। তিনি তার গেরিলাদের প্রশিক্ষণ ও মহড়া সম্পন্ন করে ফেলেছেন। অন্য সকলে বৈরুতের উপর দৃষ্টি রাখবে।

সব রকম দিক-নির্দেশনা প্রদান করে সুলতান আইউবী বললেন রওনা আজ রাতের প্রথম প্রহরে হবে। সবচেয়ে বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে- এখন এই কক্ষে আমরা যে কজন আছি, তার অতিরিক্ত একজনও যেনো না জানে আমাদের গন্তব্য কী। সৈনিক কমান্ডাররাও যেনো জানতে না পারে আমরা কোথায় যাচ্ছি।

সুলতান আইউবীর কল্পনায়ও নেই যে, বৈরুতে তাকে স্বাগত জানানোর আয়োজন সম্পন্ন করে রাখা হয়েছে এবং ফিরিঙ্গিদেরকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ঝাঁপটে ধরা তার সম্ভব হবে না।

রাতের প্রথম প্রহর। বাহিনী রওনা হচ্ছে। সুলতান আইউবী তার হাই-কমান্ডের সালারদের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিটি ইউনিটের সালাম গ্রহণ করছেন এবং দুআ দিচ্ছেন। তাঁর পার্শ্বে তার এক পুত্রের ওস্তাদ আতালীক দণ্ডায়মান। সুলতান আইউবী ওস্তাদ ও আলেমদের বেশ মর্যাদা দিতেন। মুহাম্মদ ফরিদ আবু হাদীদ লিখেছেন, বাহিনীর শেষ ইউনিটটি অতিক্রম করে যাওয়ার পর সুলতান আইউবী রওনা হতে উদ্যত হন। এমন সময় পুত্রের ওস্তাদ আতালীক একটি আরবী পংক্তি আবৃত্তি করেন, যার অর্থ হচ্ছে- আজ নজদের আরার ফুলের সুগন্ধি উপভোগ করে নাও। সন্ধ্যার পর এই ফুল পাওয়া যায় না।

মুহাম্মদ ফরিদ আবু হাদীদ লিখেছেন, সে সময় পর্যন্ত সুলতান আইউবীর মেজাজ উৎফুল্ল ছিলো। কিন্তু পংক্তিটা কানে আসার পর তিনি ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেন। তার চেহারার দ্যোতি উবে যায়। বিদায়কাল এই পংক্তিটা তার কাছে অশুভ বলে মনে হলো। তিনি বাহিনীর পেছনে পেছনে রওনা হয়ে যান। পথে সালারদের বললেন আমার আশা ছিলো বিদায়কালে লোকটা আমাকে দুআ দেবেন। কিন্তু তার পরিবর্তে এমন একটা পংক্তি শোনালেন, যেটি আমার হৃদয়ের উপর ভার সৃষ্টি করে দিয়েছে।

ঘটেছেও তাই। এই ওনার পর সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী আর মিসর ফিরে আসতে পারেননি। পরবর্তী বাকি জীবন তার আরব ভূখণ্ডের যুদ্ধের মাঝে অতিবাহিত হয়েছে। মিসরবাসী আরার ফুল আর কখনো দেখতে পায়নি।

সুলতান আইউবী ১৯৮২ সালের মে মাসে মিসর থেকে রওনা হয়েছিলেন। খৃস্টান গোয়েন্দা ও নাশকতা কর্মীদের কাফেলা ইসহাককে নিয়ে এগিয়ে চলছে। ইসহাক তাদের কয়েদী। এখন তার হাত-পা বন্ধনমুক্ত। ইতিপূর্বে দুদিন দুরাত খাওয়ার সময় ছাড়া সারাক্ষণ তার হাত-পা বাঁধা থাকতো। ইসহাক দলনেতাকে বললো, আমি পালাবো না। বস্তুত তার পালাবার সুযোগও নেই আর পালিয়ে যাবেওবা কোথায়। বড়জোর দুক্রোশ পথ অতিক্রম করতে পারবে। তারপর নির্দয় মরুভূমি তাকে এমন অবেচতন করে নিঃশেষ করে ফেলবে, যেমনটি অজ্ঞান অবস্থায় সে ধরা পড়েছিলো। দলনেতা সঙ্গীদের সাথে পরামর্শ করে ইসহাকের বাঁধন খুলে দিয়ে সকলকে বলে রাখে, এর প্রতি নজর রাখবে। ইসহাক কথাবার্তা ও হাবভাবে তাদের আস্থা অর্জন করে নয়। সে সুলতান আইউবী এবং অন্যান্য মুসলিম শাসকদের গালমন্দ করতে শুরু করে। ইসহাক খৃস্টান দলনেতাকে প্রতিশ্রুতি প্রদান করে, আমি আপনাদের গোয়েন্দা হয়ে যাবো। কিন্তু দলনেতা যখনই তাকে জিজ্ঞেস করছে, তুমি কী তথ্য নিয়ে যাচ্ছিলে, তখন সে সঠিক উত্তরদানে বিরত থাকছে।

দুই খৃস্টান মেয়ের শত্রুতা যথারীর্তি চলছে। মেরিনা তার নেতার প্রিয়পাত্রী হয়ে আছে। আর বারবার এমনভাবে বিতাড়িত হয়ে আছে যে, দলনেতা যখনই তার সঙ্গে কথা বলছে, বলছে তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞার সাথে। রাগে-ক্ষোভে ফুঁসে আছে বারবারা। ইসহাক যে তথ্য নিয়ে কায়রো যাচ্ছিলো, মেরিনা তার পক্ষ থেকে সেসব বের করে নেয়ার তালে ব্যস্ত। এই রূপসী মেয়েটি রাতের পর রাত ইসহাকের পাশে বসে তাকে উত্তেজিত করার সব রকম প্রচেষ্টা ও পরীক্ষা চালিয়েছে। কিন্তু ইসহাক যেনো পাথরের মূর্তি। বারৰারীর ঐকান্তিক কামনা ইসহাক বারবারাকে কোন তথ্য না দিক।

দলনেতার পরের অবস্থান মার্টিন নামক এক ব্যক্তির। এই লোকটি বারবারার প্রেমের প্রিয়াসী। কিন্তু বাররা তাকে কোন সুযোগ দিচ্ছিলো না। মার্টিন তাকে হুমকিও প্রদান জ্বরছিলো, এ শাস্তি তোমাকে ভোগ করতে হবে। এই হুমকি তাকে দলনেতাও দিয়েছিলো। মেয়েটি পূর্ব থেকেই নিরাশ। এবার সে ভয়ও পেতে শুরু করেছে।

মেরিনার অবজ্ঞামূলক কথাবার্তায় বারবারার রক্ত চড়ে যায়। একদিন মেরিনা তাকে বললো- কারবারা! তুমি এ কাজের মোগ্য নও। তোমার খুলিতে মগজই নেই। তোমাকে নাচ-গানের আর বেশ্যালয়েই বেশ মানায়। আমি মরু অঞ্চলে এসেও একটি মুসলমান গোয়েন্দাকে ধরে ফেলেছি। এটি আমার শিকার। তুমি তার কাছে ঘেঁষবে না। বৈরুতে গিয়ে আমি এই কৃতিত্বের পুরস্কার লাভ করবে।

বারবারা জ্বলে ওঠে। আজ ক্ষোভের জোয়ারে তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। মার্টিন তো তার পেছনে ঘুর ঘুরই করছে। বারবারা রাতে তার নিকট গিয়ে বললো, আমি মেরিনা থেকে প্রতিশোধ নিতে চাই। সে আশঙ্কাও প্রকাশ করে, বৈরুত পৌঁছার পর মেরিনা যে কোন কৌশলে তাকে শাস্তি দেয়াবে। মার্টিনের সাহায্য ও আশ্রয় প্রার্থনা করে। মাটিনকে মেয়েটির এমন একটি দুর্বল পরিস্থিতিরই প্রয়োজন ছিলো। সুযোগটা হাতে এসে যায় তার। সে বারবারাকে সর্বাত্মক সাহায্য দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়। বিনিময় দাবি করে শুধু এটুকু যে, তুমি আমার হয়ে যাবে। বারবারা ভদ্র মেয়ে নয়। মাটিন তার নিকট দাবি করেছে, তা দেয়া মেয়েটির পক্ষে কোন ব্যাপার নয়। সে সঙ্গত হয়ে যায়। বারবারা পাপের মাঝে প্রতিপালিত এবং পাপের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি নষ্টা মেয়ে। মানি তৎক্ষণাৎ একটা পরিকল্পনা ঠিক করে নেয়ু এবং বারবারাকে অবহিত করে। পরিকল্পনাটা আগামী রাতে বাস্তবায়ন করা হৰে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখে।

পরবর্তী রাত। আজ যে স্থানটায় অবস্থান গ্রহণ করা হলো, এটি মরুভূমির এক ভয়ঙ্কর এলাকা। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত বিস্ময়কর ও অভিনব আকৃতির অসংখ্য টিলা দাঁড়িয়ে আছে। কোনটি দেখতে স্তম্ভ ও মিনারের ন্যায়। কোনটি আঁকাবাকা দেয়ালের মতো। ফোনটি যেনো আস্ত একটা প্রাণী। টিলাগুলো ইতস্তুত ছড়িয়ে রয়েছে। পানি ও গাছ-গাছালির চিহ্নও নেই। রাতের বেলা ষ্টিলগুলোকে মনে হচ্ছে ফেলো কতগুলো মানর দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসার পর ফেলা এই ভূখণ্ডে এসে যাত্রাবিরতি নেয়। মাটিন অন্ধকারে নিজের ঘোড়াটা নিজ তাঁবুর সঙ্গে বেঁধে যিনটা খুলে কাছেই এক স্থানে রেখে দেয়।

ইসহাকের তাবুটা মার্টিনের তাঁবুর কাছে স্থাপন করা হয়েছে। দলমে এখন ইসহাক সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত। ব্রাতে উট-ঘোড়ার আশপাশে রক্ষীরা ঘুমায়। ইসহাক ঘোড় নিয়ে পালিয়ে যাবে এমন আশঙ্কা নেই। ঘোড়ার পিঠে যি কয়ে পালাতে গেলে কেউ না কেউ টের পাবেই। কাফেলার সদস্যরা সকলেই ক্লান্ত। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমিয়ে পড়েছে ইসহাকও। মধ্যরাতে গায়ে কারো আলতো পরশ অনুভব করে জেগে ওঠে ইসহাক। ফিসফিস কণ্ঠ শুনতে পায় ওঠো, পাশের তাঁবুর সঙ্গে যোড় দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই যিন পড়ে আছে। দেরি করো না, পালাও।

কে তুমি?

বারবারা- মেয়েটি উত্তর দেয়- তোমার প্রতি আমার এই সহানুভূতি কেন সে প্রশ্ন করো না। আমিই তোমাকে বলে দিয়েছিলাম, আমরা খৃষ্টান গোয়েন্দা। তুমি সময় নষ্ট করো না। সকলে ঘুমিয়ে আছে। তাড়াতাড়ি ওঠো। যে তাঁবুর সঙ্গে ঘোড়া বাঁধা আছে, তার ডানদিকে যাবে। সামনে পথ পরিষ্কার। আমি আমার তাঁবুতে চলে যাচ্ছি।

বারবারা নিজ তাঁবুতে চলে যায়। ধনুক ও নীটা হাতে নিয়ে। আবার বেরিয়ে যায়। বারবারা সেই পথের এক ধারে বসে যায়, সে পথে ইসহাককে পালাতে বুলেছিল।

ইসহাক দ্রুততার সাথে যিন বেধে ঘোড়াটা খুলে পা টিপে টিপে এগুতে শুরু করে। বালুর কারণে ঘোড়র পায়ের কোন শব্দ হচ্ছে না। কাফেলার সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছ। ইসহাক আঁৰু এলাকা থেকে বেশ দূরে গিয়ে ঘোড়ায় সওয়ার হয় এবং কিছুক্ষণ ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে এবার জোরে ঘোড়া হাঁকায়। হঠাৎ মরুর শীতল রাতের নীরবঅ ভেদ করে একটা শা শব্দ কানে ঢুকে ইসহাকের। সেই সঙ্গে একটা তীর এসে গেথে যাত্ম তার পিঠে। পরক্ষণে এসে বিদ্ধ হয় আরেকটা তীব্র। সঙ্গে নারী কণ্ঠের চীৎকার পালিয়ে গেছে, পালিয়ে গেছে, ওঠো, জাগো, বন্দি পালিয়ে গেছে।

সবাই ধড়মড় করে জেগে ওঠে। বারবারা চীৎকার করে বেড়াচ্ছে বন্দি পালিয়ে গেছে। তার হাতে ধনুরু। তাড়াতাড়ি করে ঘোড়া দুটানো হয়। বেশি দূর যেতে হলো না। ইসহাক দুটি তীর পিঠে নিয়ে পড়ে আছে। ঘোড়াটা খানিক দূরে সঁড়িয়ে আছে। তীর নিকট থেকে ছেঁড়া হয়েছে। দেহের গভীরে গেঁথে আছে তীর দুটি। তবে এখনো হুঁশ আছে ইসহাকের। তাকে তুলে নেয়া হলো। দলনেতা তাকে জিজ্ঞেস করে পলায়নে কি তোমাকে কেউ সহায়তা করেছিলো? ইসহাক বললো–না, আমি মোড়া আর যিন দেখতে পেলাম। সকলে ঘুমিয়ে ছিলো। আমি পালিয়ে এলাম। এটুকু বলার পরই ইসহাক চৈতন্য হারিয়ে ফেলে। আর তার জ্ঞান ফিরে আসেনি। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর গোয়েন্দা ইসহাক তুর্কী শহীদ হয়ে যায়।

আমি লোকটাকে ঘোড়ায় আরোহণ করতে ও পালাতে দেখি-বারবারা বললো- ঘটনাক্রমে আমার তাঁবুতে ধনুক ও ভূনীর ছিলো। আমি তুনীর ধনুক তুলে নিয়ে তার পিছনে ছুটে গেলাম। পরপর দুটি তীর ছুঁড়লাম। তীরটি ছুটেই গেঁথে যায়। অন্যথায় লোকটা পালিয়ে গিয়েছিলো।

আজই এমন কী ঘটলো যে, তোমার তাঁবুতে তীর-ধনুক ছিলো? মেরিনা বারবারাকে জিজ্ঞেস করে।

আর মার্টিন! এই ঘোড়াটা তোমার ছিলো- দলনেতা বললো- এটা কোথায় ছিলো? এর যিন কোথায় ছিলো?

ঘোড়াটা বন্দির তাঁবুর নিকট বাঁধা ছিলো। এক রক্ষী উত্তর দেয়।

তোমরা আমার এ কৃতিত্বটা মাটি করে দেয়ার চেষ্টা করছে। বারবারা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো- লোকটা কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে কায়রো যাচ্ছিলো। আমি তাকে প্রতিহত করেছি। তাকে নয়- আমি বরং আমাদের স্বার্থ পরিপন্থী একটি গোপন তথ্য কায়রো পৌঁছানো ঠেকিয়েছি।

ঘটনাটা মূলত একটা নাটক। মেরিনার শত্রুতা উদ্ধারের লক্ষ্যে বারবারার পক্ষে প্রস্তুত করে দেয়া মার্টিনের ষড়যন্ত্র। মার্টিন এভাবেই উপকার করে বারবারাকে পেতে চেয়েছিলো। কিন্তু তাদের দলনেতা একজন অভিজ্ঞ গোয়েন্দা। সে বারবারা ও মার্টিনের প্রতি গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো- মার্টিন! এ পেশায় আমি তোমার অনেক আগে এসেছি। বৈরুতে পৌঁছানোর আগে আগে যথার্থ একটা উত্তর ঠিক করে ফেলল।

ঘটনাটা লোকগুলোর ব্যক্তিগত শত্রুতার ও বন্ধুত্বের রাজনীতি। যার শিকার হতে হলো সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর একজন মূল্যবান গুপ্তচরকে।

***

দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে সুলতান আইউবীর বাহিনী। অর্ধেক পথ অতিক্রম করে তারা এখন যে অঞ্চলে এসে উপনীত হয়েছে, সেটি খৃস্টান কবলিত এলাকা। বাহিনীর সকল সৈন্যের আকৃতি-গঠন এখন একই রকম। ধূলি-বালির স্তর জমে জমে এখন আর কাউকে চেনা যাচ্ছে না।

এখন মে মাস। মরুভূমি পোড়ানো লোহার ন্যায় উত্তপ্ত। সকলের মুখ-মাথা কাপড়ে আবৃত। অনুমতি ছাড়া পানি পান করতে পারছে না কেউ। বাহিনীর কোন বিন্যাস নেই। উট-ঘোড়ার আরোহীরা পদাতিকদের পালাক্রমে সওয়ার করিয়ে পথ চলছে। আকাশটা জ্বলছে। আর দূর-দূরান্ত পর্যন্ত লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহু মুখরিত ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। কয়েকজন সৈনিক মিলে সম্মিলিত কণ্ঠে আবেগময় গান গাইছে আর তার তালে তালে সুর লহরীতে মুগ্ধ হয়ে ফৌজ এগিয়ে চলছে।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ফৌজের মধ্যস্থলে অবস্থান নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন। তিনি নিজের জন্য পানি পান নিষিদ্ধ করে রেখেছেন। হঠাৎ তিনি ঘোড়ার গতি পরিবর্তন করে অন্য একদিকে ছুটে যান। তাঁর হাইকমান্ডের সালার ও অপরাপর আমলাগণ যাদের মধ্যে দ্রুতগতিসম্পন্ন দূতও ছিলো- তার পেছনে চলে যান। সমুখেই সেই জায়গা, যেখানে ইসহাক তুর্কি শহীদ হয়েছিলো। ভয়ানক আকৃতির কতগুলো টিলা। সুলতান আইউবী টিলাগুলোর মধ্যে প্রবেশ করে দাঁড়িয়ে যান এবং গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার সারেমকে উদ্দেশ্য করে বললেন- দোস্ত! এখান থেকেই তোমার কাজ শুরু হচ্ছে। ইউনিটগুলোকে ছড়িয়ে দাও। প্রতিটি বাহিনী অন্য অপর বাহিনী থেকে দূরে থাকবে। প্রথম বাহিনীটিকে এক্ষুনি পাঠিয়ে দাও।

আর বাকি ফৌজ এভাবেই চলতে থাকবে- সারেম মিসরীর চলে যাওয়ার পর সুলতান আইউবী অন্যদের বললেন- যে কোন পরিস্থিতিতে ফৌজ অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবে। আমরা শত্রুর অঞ্চলে এসে পড়েছি।

জরুরী দিক-নির্দেশনা প্রদান করে সুলতান আইউবী ধীরে ধীরে ঘোড়া চালাতে শুরু করেন। হঠাৎ এক ধারে তিনি এমন কিছু চিহ্ন দেখতে পান, যাতে প্রমাণিত হয় এখানে কোন পথিক অবস্থান নিয়েছিলো। সেখানেই একটি লাশ পড়ে আছে দেখা গেলো, যার অধিকাংশ বালিতে ঢেকে আছে। সুলতান আইউবী দাঁড়িয়ে যান। লাশটা অক্ষত নেই। হাড়গুলো দেখা যাচ্ছে শুধু। একজন কঙ্কলটা সোজা করে দেখায়। পিঠে দুটি তীর গেঁথে আছে। চেহারার গোশত শুকিয়ে গেছে।

বাদ দাও এসব- সুলতান আইউবী বললেন- কোন কাফেলার কেউ নিহত হয়েছে মনে হয়। মরুভূমিতে এসে মানুষ পাগল হয়ে যায়।

সুলতান আইউবী জানেন না, এই কঙ্কাল তারই একজন মূল্যবান গোয়েন্দা ইসহাক তুর্কির, যে বলতে যাচ্ছিলো, আপনি বৈরুত যাবেন না। ওখানে খৃস্টানরা যেভাবে তাদের সৈন্যদের ছড়িয়ে রেখেছে, তার নকশা বক্ষে এঁকে মিসর যাচ্ছিলো ইসহাক। এখন সুলতান আইউবীর সঙ্গে ইসহাকের সাক্ষাৎ হয়েছে বটে; কিন্তু তার কংকাল সুলতানকে কিছুই জানাতে পারলো না।

সুলতান আইউবীর গেরিলা বাহিনীটি এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, তারা অগ্রসরমান মূল বাহিনীর উভয় পার্শ্বে দুতিন মাইল দূর পর্যন্ত চলে গেছে। কয়েকটি ইউনিট চলে গেছে পেছনে। বৈরুত থেকে অনেক দূরেই তাদের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তারা ভয়ানক অঞ্চলটা অতিক্রম করে চলে গেছে।

ফৌজ এগিয়ে চলছে।

মধ্যরাতে ছাউনি ফেলার আদেশ জারি হয়। বাহিনী দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু গেরিলা ইউনিটগুলো সক্রিয় ও তৎপর থাকে। তাদের জন্য নির্দেশ হলো, সন্দেহভাজন কাউকে দেখা গেলে এবং সে পালাবার চেষ্টা করলে মেরে ফেলবে। কোন কাফেলার দেখা পেলে তাদেরও গতিরোধ করে তল্লাশি নেবে।

বাহিনী এগিয়ে চলছে ও যাত্রাবিরতি দিচ্ছে। সূর্য উদিত হচ্ছে এবং মুজাহিদ বহরটিকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে অস্ত যাচ্ছে। সুলতান আইউবীর নিকট প্রথম সংবাদ আসে, তার একটি গেরিলা ইউনিট খৃস্টানদের একটি সীমান্ত চৌকির উপর হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। মরু অঞ্চল শেষ হতে চলেছে। গাছ-গাছালি চোখে পড়তে শুরু করেছে। কোথাও সবুজের সমারোেহ দেখা যাচ্ছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রাম-জনবসতিও চোখে পড়ছে।

বৈরুতে বল্ডউইন তার বিভিন্ন সামরিক শাখা থেকে রিপোর্ট গ্রহণ করছেন। তার নিকট সংবাদ এখনো সেটিই যে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বৈরুত অবরোধ করবেন। তিনি সুলতানকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি গ্রহণ করে রেখেছেন বটে; কিন্তু পরবর্তী আর কোন সংবাদ পাননি, সুলতান আইউবী কায়রো থেকে রওনা হয়েছেন কিনা।

এতোক্ষণে খৃস্টান গোয়েন্দা কাফেলাটিও বৈরুত পৌঁছে গেছে। কিন্তু তারাও সম্রাট বল্ডউইনকে কোন সংবাদ জানাতে পারেনি। বল্ডউইন তথ্য সংগ্রহের জন্য বিশ-পঁচিশজনের একটি অশ্বারোহী দলকে সম্মুখে প্রেরণ করেছিলেন। অরাও ফেরত আসেনি। তারা ফেরতে আসতে পারবেও না।

বল্ডউইনের অশ্বারোহী বাহিনীটি অনেক দূর চলে গিয়েছিলো। তারা দূর থেকে এক স্থানে এমন ধারায় ধূলি উড়তে দেখে, যা কোন কাফেলার হতে পারে না। মাটি থেকে উত্থিত এই ধূলিমেঘ কোন সৈন্য বাহিনীর ছাড়া অন্য কারো হতে পারে না। তারা টিলার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। কমান্ডার একটি টিলার উপর উঠে দেখতে শুরু করে। হঠাৎ একদিক থেকে একটি তীর এসে তার ঘাড়ে বিদ্ধ হয়। অন্যান্য আরোহীরা নীচে ছিলো। হঠাৎ তাদের উপরও তীরবর্ষণ শুরু হয়ে যায়। তাদের কয়েকজন পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু সারেম মিসরীর গেরিলারা তাদেরকে জীবিত পালাতে দিলো না। সব কজনকে খুন করে তাদের অস্ত্র ও ঘোড়াগুলো দখল করে নেয়।

কোন সংবাদ না পাওয়া সত্ত্বেও বল্ডউইন ও তার প্রধান সেনাপতি নিশ্চিন্ত। তারা বৈরুতকে অবরোধ থেকে রক্ষা করার জন্য অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা করে রেখেছেন। তাদের চিন্তামুক্ত হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, সুলতান আইউবী এখনো কায়রো থেকে রওনা হননি এবং যুদ্ধ এখনো বহুদূর। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সুলতান আইউবী যতোই সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছেন, গেরিলাদের আক্রমণ ও তৎপরতার সংবাদ ততোই বেশি আসছে। এখন তো এমন সংবাদও আসতে শুরু করেছে যে, এতো মাইল দূরে দুশমনের একটি বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে এতোজন গেরিলা শহীদ ও এতোজন আহত হয়েছে। এ ধরনের প্রতিটি সংবাদে সুলতান আইউবী একই উত্তর দিচ্ছেন- শহীদদেরকে কোথাও দাফন করে রাখো আর আহতদের পেছনে পাঠিয়ে দাও।

সুলতান আইউবী তার বাহিনীকে এমন অঞ্চল দিয়ে নিরাপদে নিয়ে যাচ্ছেন, যেখানে স্থানে স্থানে শত্রুর উপস্থিতি বিদ্যমান। এটা তার পরম সামরিক যোগ্যতার প্রমাণ। তার স্বল্পসংখ্যক সৈন্যের গেরিলা ইউনিট আক্রমণ চালাতে চালাতে এবং শত্রুর শক্তি খর্ব ও ব্যর্থ করতে করতে এগিয়ে চলছে। কোথাও গেরিলা আক্রমণ শেষ পর্যন্ত তুমুল যুদ্ধের রূপ ধারণ করছে। কিন্তু গেরিলারা একস্থানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করছে না। এই রক্তপাত সুলতান আইউবীর বাহিনী থেকে দূরে দূরে ঘটে চলছে।

***

হুসামুদ্দীন লুলুর নৌ-বহর ইসকান্দারিয়ায় প্রস্তুত অপেক্ষমান। প্রস্তুত নৌ-সেনারাও। হুসামুদ্দীন সুলতান আইউবীর দূরত্ব ও গতি অনুমান করে রেখেছেন। একদিন তিনি বাহিনীকে জাহাজে আরোহণ করার আদেশ প্রদান করেন এবং রাতের বেলা জাহাজের নোঙ্গর তুলে পাল উড়িয়ে দেন। নদীর বুক চিরে জাহাজ এগুতে শুরু করে। মুক্ত সমুদ্রে গিয়ে হুসামুদ্দীন জাহাজগুলোকে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে দেন। তিনি একজন সুদক্ষ নৌ-প্রধান। তার জাহাজে করে ফৌজ যাচ্ছে, তার সালার ও নায়েব সালারগণ সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তারা অন্ধকারে যাচ্ছে না। খোঁজ খবর নেয়ার জন্য তারা মৎস্য শিকারীর বেশে ছোট ছোট নৌকায় করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কিছু সৈনিককে আগেই পাঠিছে রেখেছে।

কয়েকদিন ও কয়েক রাতের পথ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। দিগন্তে বৈরুত চোখে পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু এখনো কোন নৌকা ফিরে আসেনি। হুসামুদ্দীন জাহাজের গতি থামিয়ে দেন এবং খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য অপর একটি নৌকা নামিয়ে দেন। রাতে তার দণ্ডায়মান জাহাজের সন্নিকটে সমুদ্র থেকে এক ব্যক্তি চীৎকার করে বললো- রশি ফেলল, রশি ফেলো। রশি ছুঁড়ে ফেলা হলো। রশি বেয়ে এক নৌ সেনা উপরে উঠে আসে। লোকটা অর্ধমৃত। সে বললো, খৃষ্টানদের একটি নৌকা তাদের নৌকার গতিরোধ করেছিলো। তাতে সৈন্য ছিলো। উভয়পক্ষে তীর বিনিময় হয়। আমি সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। আমার সঙ্গীরা ধরা কিংবা মারা পড়েছে। আমি সংবাদ জানাতে এসেছি যে, দুশমন সজাগ রয়েছে।

এই ঘটনায় বুঝা গেলো, খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য প্রথমে যে লোকদের প্রেরণ করা হয়েছিলো, তারা ধরা পড়েছে এবং সম্ভবত তাদের মাধ্যমে দুশমন নৌ-বহর আগমনের তথ্যও পেয়ে গেছে।

হুসামুদ্দীন লুলুর নৌ-বহর আর বৈরুতের মাঝে এখন দূরত্ব এতোটুকু যে, সূর্যাস্তের পর পর পাল তুললে জাহাজ মধ্যরাত নাগাদ কূলে ভিড়তে পারবে। কিন্তু আশঙ্কা হচ্ছে, খৃস্টানরা অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করার জন্য কূলে মিনজানিক স্থাপন করে রাখতে পারে। তা-ই যদি হয়, তাহলে জাহাজগুলোকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। কিন্তু এই ভয়ে পিছিয়ে থাকাও উচিত হবে না। সুলতান আইউবীর সমুদ্রের দিক থেকে সাহায্যের খুবই প্রয়োজন। এমন সময়ে তারা একটা নৌকা দেখতে পায়। নৌকাটা তাদের বহরের। তার সৈনিকরা সমুদ্র থেকে দুজন খৃস্টান সৈন্যকে ধরে নিয়ে এসেছে। খৃস্টানদের যে নৌকাটি হুসামুদ্দীনের বহরের নৌকার উপর আক্রমণ করেছিলো, এরা তার মধ্যে ছিলো। তারা আত্মরক্ষার জন্য সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর মুসলিম সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ে যায়। প্রথমে কোন তথ্য দিতে সম্মত না হলেও হাত-পা বেঁধে সমুদ্রে ফেলে দেয়ার হুমকি দেয়া হলে তারা তথ্য দেয়, কূলে বল্ডউইনের সৈন্যরা ওঁৎ পেতে আছে এবং বহরে আগুন ধরানোর জন্য মিনজানিক প্রস্তুত রয়েছে। এই ধৃত সৈন্যদের থেকে আরো তথ্য পাওয়া গেলো, বৈরুতের ফৌজ ভেতরে কম এবং বাইরে শহর থেকে দূরে দূরে বেশি।

সংবাদটা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। সুলতান আইউবীর নৌ-বাহিনী প্রধান হুসামুদ্দীন রীতিমতো ভাবনায় ডুবে যান। তারা পরস্পর মতবিনিময় করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ফিরিঙ্গিরা আমাদের আগমনের সংবাদ পেয়ে গেছে। বিষয়টা সুলতান জানেন কিনা কে জানে। সিদ্ধান্ত হলে, সুলতানকে সংবাদটা পৌঁছানো হবে। এ সময় তার বৈরুতের কাছাকাছি থাকার কথা।

তৎক্ষণাৎ জাহাজ থেকে দুটি নৌকা নামানো হলো। দুজন দূতকে দুটি ঘোড়া দিয়ে তীরে কোথায় অবতরণ করবে এবং কোন্‌দিকে যাবে বলে দেয়া হলো। দূতরা সুলতান আইউবীকে সংবাদ জানানোর জন্য রওনা হয়ে যায়।

***

দূতরা রাতারাতি গন্তব্যে পৌঁছে যায়। কিন্তু ততোক্ষণে সুলতান আইউবী ফিরিঙ্গিদের ফাঁদে আটকা পড়ে গেছেন। তিনি বৈরুত অবরোধ করেছিলেন। স্থলের সবদিকে সৈন্য ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। রিজার্ভ ফোর্সের একটি ইউনিটকেও জবাবি আক্রমণের লক্ষ্যে ব্যবহার করে ফেলেছেন সুলতান। ফিরিঙ্গিরা কঠোরভাবে তার মোকাবেলা করে। পরদিন অবরোধের অপর একটি অংশের উপর আক্রমণ হয়। সুলতান আইউবী তাদের বিরুদ্ধেও রিজার্ভ ফোর্স প্রেরণ করেন। এবার তিনি ভাবনায় পড়ে যান, আমি তো রিজার্ভ ফোর্স ব্যবহার করা ছাড়াই যুদ্ধ জয় করে নিতাম। কিন্তু এখানে তো রিজার্ভ ফোর্সের অর্ধেক শক্তি শুরুতেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লো। তিনি অবরোধকে দুর্বল করতে চাচ্ছিলেন না। এবার তার মনে সন্দেহ জাগতে শুরু করে।

সুলতান আইউবীর অনুসন্ধান ও গেরিলা ব্যবস্থাপনা ছিলো খুবই উন্নত। তিনি সংবাদ পেতে শুরু করেন, পেছনে, সবদিকে শত্রুর উপস্থিতি বিদ্যমান। একটি গেরিলা ইউনিটের একজন মাত্র সৈনিক রক্তরঞ্জিত অবস্থায় ফিরে এসেছে। লোকটি মাত্র এটুকু বলে শহীদ হয়ে গেছে যে, তার পুরো বাহিনী ফিরিঙ্গিদের বেষ্টনীতে এসে পড়েছিলো। সে ছাড়া আর একজনও জীবন রক্ষা করতে পারেনি এবং আমাদের এই অবরোধ ফিরিঙ্গিদের বিপুলসংখ্যক সৈন্যের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে আছে।

তার পরক্ষণেই নৌ-দূতরা এসে পৌঁছে। তারা সুলতান আইউবীকে সংবাদ জানায় এবং হুসামুদ্দীনের জন্য নির্দেশ কামনা করে।

খৃষ্টানদেরকে আমি এরূপ প্রস্তুত অবস্থায় কখনো দেখিনি- সুলতান আইউবী তার হাইকমান্ডের সালার প্রমুখদের বললেন- স্পষ্ট বুঝতে পারছি, তারা সময়ের আগেই সংবাদ পেয়ে গিয়েছিলো যে, আমরা বৈরুত অবরোধ করতে যাচ্ছি। এখন আমরা নিজেরাই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছি। ঠিকানা থেকে এতো দূরে এসে পরাজিত যুদ্ধ লড়া যায় না। তিনি হুসামুদ্দীনের দূতদেরকে বললেন- তোমরা হুসামুদ্দীনকে বহর নিয়ে ফিরে যেতে এবং তার সৈন্যদেরকে ইসকান্দারিয়া নেমে দামেশক রওনা হতে বলো।

 দূতরা চলে গেলে সুলতান আইউবী মসুল অভিমুখে পিছপা হওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু পিছপা হওয়াও সহজ নয়। এ কাজেও গেরিলাদের ব্যবহার করা হয়। রাতে বাহিনীকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে এনে বের করে দেয়া হলো। কিছু সংঘাতের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু গেরিলা ও পশ্চাৎ বাহিনী জীবন ও রক্তের নজরানা দিয়ে বাহিনীকে সেখান থেকে বের করে আনে। ফিরিঙ্গিরা ধাওয়া করেনি।

মসুলের পথে সুলতান আইউবীর মসুল থেকে আসা এক গোয়েন্দার সাক্ষাৎ ঘটে। সে ইসহাক তুর্কির রওনা হওয়া এবং মসুলের গবর্নর ইযুদ্দীনের পরিকল্পনা সম্পর্কে পুরোপুরি তথ্য প্রদান করে। সুলতান ক্ষোভে লাল হয়ে যান। তিনি মসুল অবরোধ করার আদেশ জারি করেন।

কাজী রাহউদ্দীন শাদ্দাদ তাঁর রোজনামচায় লিখেছেন- সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ১৯৮২ সালের ১০ নবেম্বর মোতাবেক ৫৭৮ হিজরীর ১১ রজব বুধবার মসুলের নিকটে গিয়ে পৌঁছেন। আমি তখন মসুল ছিলাম। ইযযুদ্দীন আমাকে বললেন, আপনি গিয়ে খলীফার নিকট থেকে সাহায্য নিন। আমি দজলার কোল ঘেঁষে ঘেঁষে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে মাত্র দুদিন দুঘণ্টায় বাগদাদ পৌঁছে যাই। খলীফা আমাকে বললেন, তিনি শাইখুল উলামাকে বলে মসুল ও সুলতান আইউবীর মাঝে সমঝোতা করিয়ে দেবেন। মসুলের গবর্নর আজারবাইজানের শাসনকর্তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু তিনি যে শর্ত আরোপ করেন, তার চেয়ে ভালো ছিলো ইযযুদ্দীন সুলতান আইউবীর হাতে অস্ত্র সমর্পণ করবেন।

সন্ধি-সমঝোতার আলাপ-আলোচনা শুরু হয়ে যায়। ১৯৮২ সালের ১৫ ডিসেম্বর মোতাবেক ১৬ শাবান ৫৭৮ হিজরী সুলতান আইউবী মসুলের অবরোধ প্রত্যাহার করে নেন এবং নাসীবা নামক স্থানে ফৌজকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ছাউনি স্থাপনের নির্দেশ দেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *