৭.৩ সাপ ও খৃস্টান মেয়ে

সাপ খৃস্টান মেয়ে

 সাপটা দেড় বিঘতের বেশি লম্বা হবে না। কিন্তু প্রাণীটা ইসহাক তুর্কির এমন শক্তিমান ঘোড়াটাকে উপুড় করে ফেলে দিলো। গন্তব্য এখনো বহুদূর। সিনাই মরুদ্যানের অর্ধেক পথ এখনো বাকি।

ইসহাক তুরস্কের নাগরিক। সুঠাম দেহ, সুদর্শন চেহারা, আকর্ষণীয় গাত্রবর্ণ, নীলরঙা চোখ। দেখে কেউ বলতে পারবে না লোকটা মুসলমান না খৃস্টান। যেমন সুঠাম, তেমনি সুদর্শন। তার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বাহিনীতে যখন যোগ দেয়, তখন ইসহাক তুর্কির বয়স আঠার বছর। সৈনিকগিরি করে অর্থ উপার্জন তার উদ্দেশ্য ছিলো না। ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত এক সত্যিকার মর্দে মুমিন ইসহাক। ক্রুশের অনুসারীদের ইসলাম ও মুসলমান বিরোধী পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত ইসহাক ইসলামের জন্য কাজ করতে দামেশক এসেছিলো। এসেই ভর্তি হয়ে যায় সুলতান আইউবীর বাহিনীতে। সুলতান আইউবী মিসরের গবর্নর নিযুক্ত হলে ইসহাক তুর্কিকে মিসর পাঠিয়ে দেয়া হয়। গর্বের সাথে নিজেকে তুর্কি দাবি করতো ইসহাক।

তুরস্কের বহু নাগরিক সুলতান আইউবীর বাহিনীর সৈনিক ছিলো। তাদের উপর সুলতান আইউবীর পরিপূর্ণ আস্থা ছিলো। সুলতান যখন কমান্ডো ফোর্স গঠন করেন, তখন তুর্কিদেরই বেশি নিয়োগ দান করেন। সেই ফোর্স থেকে গোয়েন্দা বাহিনীও গঠন করা হয়েছিলো। ইসহাক তুর্কি তাদেরই একজন।

বাহিনীতে যোগ দেয়ার পরপরই ইসহাক তুর্কি নিজেকে অস্বাভাবিক বুদ্ধিমান-বিচক্ষণ ও দুঃসাহসী কমান্ডো প্রমাণিত করে। তাকে কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। তারপর তাকে খৃস্টানদের বিভিন্ন অঞ্চলে গুপ্তচরবৃত্তির লক্ষ্যে প্রেরণ করা হয়।

অতিশয় কর্তব্যপরায়ণ ও দুঃসাহসী মানুষ ইসহাক তুর্কি। জীবনটা হাতে নিয়ে মাটির কয়েক স্তর নীচ থেকেও তথ্য বের করে আনার সাহস যোগ্যতা আছে তার। 

কিন্তু এই মুহূর্তে সিনাই মরুদ্যানে দেড় বিঘত লম্বা সামান্য একটা সাপ কঠিন এক পরীক্ষায় ফেলে দিলো লোকটাকে।

ইসহাক তুর্কি খৃস্টান অধ্যুষিত মুসলিম অঞ্চলে কর্মরত ছিলো। সেখান থেকে চলে যায় হাব। এখন একটি নিরতিশয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে কায়রোর পথে। সুলতান আইউবী এখন কায়রো। অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছে যেতে হবে ইসহাককে। তাই অবিশ্রাম পথ চলছে লোকটা।

সবুজ-শ্যামল এলাকা থেকে বেরিয়ে এসেছে ইসহাক তুর্কি। সম্মুখে বালির সমুদ্র, যার ভেতর থেকে কোন পথভোলা পথিক কখনো জীবিত বের হয়নি।

মরুভূমি মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর শত্রু। ইসহাক তুর্কি মরু বিশেষজ্ঞ। সবুজ অঞ্চল থেকে পানি সংগ্রহ করে ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে নিয়েছে সে। পথটা তার জানাশোনা ছিলো। কোথায় কোথায় পানি আছে জানতো।

এই মরু অঞ্চলে একাধিকবার যুদ্ধও করেছে ইসহাক তুর্কি। হাল্ব থেকে রওনা হয়ে এ পর্যন্ত নির্ভয়ে-নিরাপদেই এসে পৌঁছেছে। খৃস্টান আর মরু যাযাবরদের ভয় করে না ইসহাক। এই যুদ্ধ-বিগ্রহ আর অবিরাম পথচলাকেই জীবন মনে করে লোকটা। তার বিশ্বাস, আল্লাহর সন্তুষ্টি এই জিহাদের মধ্যেই নিহিত।

সম্মুখে বিশাল মরু অঞ্চল। স্থানে স্থানে টিলা-পর্বত। ঘোড়াটাকে সামান্য বিশ্রাম দেয়ার জন্য একটি টিলার আড়ালে দাঁড়িয়ে যায় ইসহাক। দুপুরের সূর্যটা খানিকটা পশ্চিম দিকে ঢলে পড়েছে। ইসহাক একটি টিলার আড়ালে ছায়ায় বসে পড়ে। তার চোখের পাতা বুঝে আসে।

খানিক পর ঘোড়াটা উচ্চস্বরে ডেকে ওঠে। ইসহাকের চোখ খুলে যায়। ঘোড়াটা সামান্য জায়গার মধ্যে চারদিক ঘুরে ঘুরে দৌড়াচ্ছে। কিন্তু বেশি দৌড়াতে পারলো না। থেমে গেলো। সমস্ত শরীর কাঁপছে প্রাণীটার।

কী হলো? ইসহাক এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখতে পায়, সে যে জায়গাটায় শুয়েছিলো, তার চার-পাঁচ পা দূরে দেড় বিঘত লম্বা একটা সাপ। সাপটার রং কালো। কালোর মধ্যে সাদা সাদা গোলাকার দাগ। সাপটা ছটফট করছে। লেজের দিক থেকে দেহের অর্ধেকটা থেতলানো।

ঘোড়াটা ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ইসহাক বুঝতে পারে, দংশনের আগে কিংবা পরে সাপটা ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট হয়েছে। এখন তার চলচ্ছক্তি অবশিষ্ট নেই। ইসহাক তুর্কি সাপটার মাথাটা পায়ের নীচে পিষে ফেলে।

ঘোড়াটা বাঁচার আশা নেই। মরুভূমির বিচ্ছু আর এ জাতের সাপ এতোই বিষাক্ত যে, যাকে দংশন করে, সে পানি পান করারও সুযোগ পায় না। মরুভূমির পথিকরা প্রখর সূর্যতাপ এবং দস্যুদেরও এতো ভয় করে না, যতোটা করে এই সাপ-বিচ্ছুকে। এই সাপ মেঠো ও পাহাড়ী অঞ্চলের সাপের ন্যায় বুক টেনে সামনের দিকে অগ্রসর হয় না। এরা পাশের দিকে এক বিস্ময়করভাবে চলাচল করে থাকে।

ইসহাক হতাশ নয়নে ঘোড়াটার প্রতি তাকায়। ঘোড়াটা সজোরে কেঁপে ওঠে। মুখটা হা হয়ে গেছে। পাগুলো বাইরের দিকে ছড়িয়ে দিয়ে ধপাস করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তাকে কোন সাহায্য করার ক্ষমতা ইসহাকের নেই। উন্নত জাতের যোদ্ধাঘোড়া। ঘাস-পাতা, তরুলতাহীন মরু বিয়াবান, ক্ষুৎপিপাসা কিছুই আমলে নেয় না।

এরূপ একটি ঘোড়ার মৃত্যুতে ইসহাকের বিরাট ক্ষতির মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হলো, এখন তাকে পায়ে হেঁটে কায়রো পৌঁছতে হবে। তাকে অতি দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছার কথা ছিলো। বুকে করে যে মূল্যবান তথ্য ইসহাক নিয়ে যাচ্ছিলো, তা যদি যথাসময়ে সুলতান আইউবীর নিকট পৌঁছানো না যায়, তাহলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

ইসহাক অনুতপ্ত চোখে ঘোড়াটার দিকে তাকায়। ঘোড়ার একটা পায়ের উপর তার দৃষ্টি পড়ে। ক্ষুরের সামান্য উপরে কয়েক ফোঁটা রক্ত জমে আছে। সাপটা এখানেই দংশন করেছে।

ঘোড়া মরে গেছে। ইসহাক ঘোড়ার যিন থেকে খেজুরের থলে এবং পানির মশক খুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। মৃত সাপটার প্রতি তাকিয়ে ঘৃণার সাথে বললো- সাপ আর খৃস্টানের স্বভাব একই।

***

ইসহাক টিলাময় এলাকা থেকে বেরিয়ে গেছে। উপর থেকে সূর্যটা যেনো আগুন ঢালছে। ১১৮২ সালের এপ্রিল মাস। বসন্তকাল। কিন্তু মরু এলাকায় কখনো বসন্ত আসে না। ইসহাক তুর্কির সামনে এখন বালির সমুদ্র। বালি এমনভাবে চিক চিক করছে, যেনো এই আধা মাইল পথ অতিক্রম করলেই পানি পাওয়া যাবে।

ইসহাক এখনো সজীব-তরতাজা। খেজুরের থলে, মশক, তরবারী আর খঞ্জরের ভার তার অনুভবই হচ্ছে না। চলার গতি তীব্র। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব কায়রো পৌঁছে যাওয়ার প্রত্যয় এখনো বিদ্যমান।

ইসহাক হাঁটছে। পশ্চিম আকাশে সূর্যটা ডুবে গেছে।

একস্থানে সামান্য সময়ের জন্য যাত্রা বিরতি দেয় ইসহাক। কয়েকটা খেজুর খেয়ে পানি পান করে। মিনিট কয়েক শুয়ে বিশ্রাম নিয়ে উঠে বসে।

ইসহাকের মনে বেজায় আনন্দ যে, এক মহা-মূল্যবান তথ্য নিয়ে সুলতান আইউবীর নিকট যাচ্ছে সে। পানাহারের প্রয়োজনটা বেশি অনুভব করছে না ইসহাক। তার আত্মা পরিতৃপ্ত। কর্তব্যপরায়ণ মানুষ যখন কর্তব্য আদায় করে ফেলে, তখন তার আত্মা আনন্দিত হয়। ইসহাক তুর্কিও আত্মিক আনন্দে পরিতৃপ্ত।

ইসহাক উঠে দাঁড়ায়। তারকার দিকে তাকায়। দিক নির্ণয় করে হাঁটতে শুরু করে।

মরুভূমির রাত ততোটা শীতল হয়ে থাকে; যতোটা উত্তপ্ত থাকে দিন। তাই মরু অঞ্চলে রাতের সফর আরামদায়ক।

ইসহাক হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে তার মনের পাতায় অনেক কিছু ভেসে ওঠে। চিন্তা করে, এতো দীর্ঘ পথ এই সামান্য সময়ে অতিক্রম করতে পারবে কি। কোন নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী-উজ্জ্বারোহী যদি পাওয়া যায়, তাহলে তার বাহনটা কেড়ে নিয়ে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। কিংবা যদি কোথাও অবস্থানরত কাফেলা পাওয়া যায়, তাহলে তাদের একটা উট বা ঘোড়া চুরি করে একটা বিহিত করা যায়। এছাড়া আর কোন উপায় দেখছে না ইসহাক।

ইসহাক আশায় বুক বেঁধে পথ চলতে থাকে। রাত অতিক্রান্ত হচ্ছে। ইসহাকের পায়ের তলা থেকে মরুভূমি ধীরে ধীরে পেছনে সরে যাচ্ছে। এখন তার ক্লান্তি অনুভব হতে শুরু করেছে। কিন্তু ক্লান্তি, ঘুম, ক্ষুধা ও পিপাসা কয়েকদিন পর্যন্ত সহ্য করার প্রশিক্ষণ তার আছে। ইসহাক ক্লান্তির প্রথম অনুভূতিটা একটা সঙ্গীতের কাছে পরাজিত করে দেয়। সে গান গাইতে শুরু করে- যুদ্ধের গান।

রাতের শেষ প্রহরে ইসহাক এক স্থানে বসে পড়ে। সামান্য পানি পান করে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে।

এখনো সূর্য উদিত হয়নি। ইসহাক সজাগ হয়ে যায়। ক্ষিধেয় পেটটা ঠো চো করছে। কিন্তু এই ক্ষুধাটাকেও জয় করে নেয় ইসহাক। এক ঢোক পানিও পান না করে হাঁটতে শুরু করে। গন্তব্য এখনো অনেক দূর। তাই যে সামান্য, খেজুর-পানি আছে, তা এখনই শেষ করা যাবে না।

দূর থেকে আরেকটি বিপদ চোখে পড়ছে ইসহাকের। বালির গোল গোল অসংখ্য টিলা। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে টিলাগুলো। দেখতে সবগুলো এক রকম। সবগুলোর উচ্চতাও প্রায় সমান। অপরিচিত কোন লোক তার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়লে বের হতে পারবে না। এলাকাটা একটা মরণ ফাঁদের রূপ ধারণ করে আছে। কারণ, অনেক পথিক একই টিলার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে মনে করে সে পথ অতিক্রম করছে। আসলে সে গন্তব্যের দিকে না গিয়ে টিলার চতুর্দিকেই ঘুরছে। মরু বিশেষজ্ঞরাও এরূপ অঞ্চলকে ভয় করে।

ইসহাক তুর্কি প্রথমে ভাবে, দিক অনুযায়ী এই টিলাময় অঞ্চলটা তার অতিক্রম করার কথা ছিলো না। তাহলে কি সে ভুল পথে এসেছে? ইসহাক অস্থির হয়ে ওঠে। এখন তাকে সামনের দিকেই অগ্রসর হতে হবে। ইসহাক সম্মুখে এগিয়ে যায় এবং টিলার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে।

সূর্যটা মাথার উপর উঠে এসেছে। পায়ের তলার বালি উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। ইসহাক টিলাময় অঞ্চলে পথ চলছে। ডান-বাম মোড় ঘুরে ঘুরে হাঁটছে ইসহাক। অঞ্চলটির বালুময় জমিন প্রমাণ করছে এ পথে ইসহাক ছাড়া অন্য কোন মানুষের আগমন ঘটেনি।

ইসহাক হাঁটছে তো হাঁটছেই। এই ডানে মোড় তো পরক্ষণেই বামে। আসলেই কি সে পথ অতিক্রম করছে কিছুই বুঝতে পারছে না ইসহাক।

এভাবে এক স্থানে মোড় ঘুরতে গিয়েই হঠাৎ চমকে ওঠে দাঁড়িয়ে যায় ইসহাক। মাটিতে পায়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। চিহ্নটা তারই পায়ের, যা অপর একটি টিলার পাশ হয়ে মোড় ঘুরে গেছে। ইসহাক বুঝে ফেলে, সে মরুভূমির নিঃসীম বিপজ্জনক ধোঁকায় পড়ে গেছে। যতোই হাঁটছে, একটুও অগ্রসর হচ্ছে না। কারণ, এতোক্ষণ যাবত হাঁটার পরও সে টিলাময় অঞ্চল থেকে বের হতে পারেনি।

ইসহাক পার্শ্বের টিলার উপর উঠে যায়। চতুর্দিকে চোখ মেলে তাকায়। তার মনে হচ্ছে, পৃথিবীটা গোল গোল উঁচু উঁচু বালির স্তূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। সূর্যের আগুন আর বালির উত্তাপ ইসহাকের দেহের রস চুষে নিতে শুরু করেছে। পা দুটো যেন কয়েক মণ ওজন হয়ে গেছে।

ইসহাক পানি পান করে। দিকটা আন্দাজ করে নীচে নেমে আসে। কিন্তু পরিস্থিতি যাই হোক, মাথাটা ঠিক রেখে কাজ করতে হবে। প্রতিটি মোড় মুখস্ত করে রাখতে হবে। এসব ক্ষেত্রে তার প্রশিক্ষণও আছে। এখন প্রশিক্ষণটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে সে।

ইসহাক আবার হাঁটতে শুরু করে। এখন সে প্রতিটি টিলা, প্রতিটি মোড় হিসেব করে করে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু মরুভূমির নির্মমতা তার মাথাটা ঘুলিয়ে ফেলছে। ইসহাকের সহনশক্তি অস্বাভাবিক। অন্যথায় বহু আগেই তাকে বালির বিছানায় শুয়ে পড়তে হতো।

এখন বিকাল। সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। ইসহাক মরুভূমির ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। কিন্তু এখন তার দেহের ভার বহন করার শক্তি নেই। কর্তব্যের অনুভূতিটাই তাকে সামনের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।

ইসহাক সম্মুখপানে তাকায়। দেখে, কতগুলো ঘোড়া সারিবদ্ধ হয়ে তাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি ঘোড়ায় একজন করে আরোহী। ইসহাক হাঁক দেয়। আবার উচ্চকণ্ঠে ডাকে। কিন্তু কোন সাড়া নেই। ঘোড়াগুলো আপন গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।

ইসহাক তুর্কি দাঁড়িয়ে যায়। চোখ দুটো বন্ধ করে মাথাটা সজোরে একটা ঝাঁকুনি দেয়। সে বুঝে ফেলে, আসলে ওগুলো ঘোড়া নয়- কল্পনা। ওগুলো মরিচিকা, যা কিনা মরুভূমির ভয়ানক এক প্রতারণা।

এখন পা টেনে টেনে হাঁটছে ইসহাক।

***

ইসহাক অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছে। এখন দিন না রাত সে বুঝতে পারছে না। এক স্থানে তার পা ফসকে যায়। পড়ে গিয়ে গড়াতে গড়াতে নীচে চলে যায়। তার খানিকটা চৈতন্য ফিরে আসে। সে এদিকে-ওদিক তাকায়। তীব্র পিপাসা অনুভব করে। পিপাসায় কণ্ঠনালীতে কাঁটা বিঁধছে যেনো। ঠোঁট দুটো শুকনো কাঠের ন্যায় খসখসে হয়ে গেছে। কিন্তু তার কাছে না আছে পানির মশক, না আছে খেজুরের থলে। ওগুলো কোথায় হারিয়ে এসেছে খবর নেই।

ইসহাক এখন অনেকটা অসহায় ও হতাশ। তবুও চলার চেষ্টা করছে। যেদিকে তাকায় শুধু সাদা সাদা পরিচ্ছন্ন অগ্নিশিখা দেখতে পাচ্ছে। শিখাগুলো যেনো তাকে গোল বৃত্তের ন্যায় ঘিরে রেখেছে।

সে দাঁড়িয়ে যায়। এক স্থানে তিনজন লোক দেখতে পায়। দুজন পুরুষ, একজন নারী। তিনজনই এক নাগাড়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকগুলোর পেছনে সামান্য দূরে খেজুর গাছও চোখে পড়ে ইসহাকের। তাদের সন্নিকটে টিলা। ইসহাক তুর্কি এসবকেও কল্পনা জ্ঞান করে এবং মরিচিকা বলে ধারণা করে। তার হতাশা আরো বেড়ে যায়। তাতে দেহের অবশিষ্ট শক্তিটুকুও নিঃশেষ হয়ে যায়। ডাকাডাকি করে লাভ নেই। কাল্পনিক দৃশ্য আর মরিচিকারা তো সাড়া দিতে পারে না। মরিচিৎকার কাজ পথচারীদের লোভ দেখিয়ে কাছে টানা আর নিজে পেছনে সরে যাওয়া। এক সময় তার পেছনে পেছনে ছুটে চলা মানুষটি পরাজিত হয়ে লুটিয়ে পড়ে আর মরুভূমির বালি তার চামড়া-মাংস চুষে চুষে কংকালে পরিণত করে।

ইসহাক তুর্কির মধ্যে এতোটুকু জীবন অবশিষ্ট আছে, সে লোকগুলোকে কল্পনা বলে স্থির করেছে। কিন্তু চলার জন্য সম্মুখপানে পা ফেলা মাত্র পা দুটো নিথর হয়ে দুদিকে সরে যাচ্ছে। তার চোখের সামনে মরুভূমির মরিচিকা-কল্পনা সব ঘন অন্ধকারে হারিয়ে যায়।

ইসহাক চৈতন্য হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

আবার ধীরে ধীরে তার চৈতন্য ফিরে আসে। কারো কথপোকথন কানে আসছে তার। ইসহাক বালির উপর লুটিয়ে পড়েছিলো। তখন পায়ের নীচের বালিগুলো আগুনের উপর রাখা লোহার পাতের ন্যায় গরম ছিলো। কিন্তু এখন জ্ঞান ফিরে আসার পর ইসহাক শীতলতা অনুভব করছে।

ওখানেই মরতে দেয়া ভালো ছিলো- ইসহাক পুরুষালী কণ্ঠ শুনতে পায়- এখন তুলে বাইরে ফেলে দাও। লোকটা পথভোলা কোন পথিক হবে হয়তো।

না, লোকটা কোন সাধারণ পথচারী মনে হচ্ছে না। আরেকটি পুরুষ কণ্ঠ শোনা গেলো।

হুশ ফিরে আসুক- এবার নারীকণ্ঠ- আমার সন্দেহ হচ্ছে। লোকটা অচেতন অবস্থায় বিড় বিড় করছিলো। বলছিলো, কায়রো আর কতো দূর? সুলতান…। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী! আপনি সতর্কতার সঙ্গে কায়রো থেকে বের হবেন। আমি অনেক মূল্যবান সংবাদ নিয়ে এসেছি। লোকটাকে আমি একটু যাচাই করে দেখবো।

এই কথোপকথনকেও ইসহাক তুর্কির কল্পনা মনে হতে লাগলো। কিন্তু সে জানে না, এই কণ্ঠ সেই দুই পুরুষ ও এক মেয়ের, যাদেরকে সে মরুদ্যানে নিজের সম্মুখে দণ্ডায়মান দেখেছিলো। তাদেরকে সে কল্পনা বলে মনে করেছিলো। কিন্তু আসলে তারা বাস্তবে মানুষ ছিলো- কল্পনা নয়।

তুমি এর কাছে বসে থাকো- একজন বললো- জ্ঞান ফিরে এলে পানি পান করতে এবং কিছু খেতে দিও। তারপর তার পরিচয় জানা যাবে। লোকটি বাইরে বেরিয়ে যায়।

ইসহাক ধীরে ধীরে চোখ খুলে। ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি তার কানে আসে। সে পুরোপুরি সজাগ হয়ে যায় এবং উঠে বসে। অলক্ষ্যে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে- এই ঘোড়াটা আমাকে দিয়ে দাও।

নাও, সামান্য পানি পান করো- ইসহাক একটি নারীকণ্ঠ শুনতে পায়। এক মেয়ে এক পেয়ালা পানি হাতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। মেয়েটি বললো- সামান্য পান করে নাও। একসঙ্গে সবটুকু পান করো না, অন্যথায় মারা পড়বে।

পিপাসাকাতর ইসহাকের পানির বড় প্রয়োজন। মেয়েটির পরিচয় জানার চেষ্টা করে ইসহাক। পানির পেয়ালাটা হাতে নিয়ে ঠোঁট লাগিয়ে কয়েক ঢোক পান করে। তারপর পেয়ালাটা ঠোঁট থেকে সরিয়ে বললো আমি জানি, এরূপ অবস্থায় বেশি পানি পান করা ঠিক নয়।

ইসহাক মেয়েটাকে পরখ করে। যুবতী মেয়ে। পোশাক-আশাকে এই অঞ্চলের মরু যাযাবরদের মতো হলেও গঠন-আকৃতি ও চেহারায় এখানকার মেয়েদের মতো নয়। মাথায় পেঁচানো রোমালের ফাঁক দিয়ে দৃশ্যমান চুলও যাযাবর মেয়েদের মতো মনে হলো না। ইসহাক ভাবে, এই অঞ্চলে তো কোন সম্ভ্রান্ত ধনী ঘরের মেয়েদের আসার কথা নয়। এখানে সাধারণত যাযাবররাই আসে।

তুমি কি কোন কাফেলার সঙ্গে আছে? ইসহাক মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে।

হা- মেয়েটি জবাব দেয়- আমি এক বণিক কাফেলার সঙ্গে আছি। আমরা ব্যবসায়ী। তুমি কোথা থেকে এসেছে এবং কোথায় যাচ্ছো?

ইসহাক তুর্কি উত্তর দেয়ার পরিবর্তে পানির পেয়ালাটা আবার ঠোঁটে লাগায়। কয়েক ঢোক পান করে। আস্তে আস্তে তার শরীরে সজীবতা ফিরে আসছে। চিন্তা করার শক্তি ফিরে পেয়েছে ইসহাক। তার মনে পড়ে যায়, সে সুলতান আইউবীর গোয়েন্দা এবং নিজের আসল পরিচয় যাবে বলা না।

আমিও একটি বণিক কাফেলার সঙ্গে ছিলাম- ইসহাক চিন্তা করে উত্তর দেয়- এক রাতে এখান থেকে দূরবর্তী এক স্থানে একদল দস্যু আমাদের কাফেলার উপর আক্রমণ চালিয়ে সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে। উট-ঘোড়াগুলোও নিয়ে গেছে। আমি একা ওখান থেকে পালিয়ে এসে পথ হারিয়ে ফেলেছি।

আমি তোমার জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করছি। বলেই মেয়েটি বেরিয়ে যায়।

ইসহাক তুর্কি একটি তাঁবুতে বসা। প্রদীপ জ্বলছে। ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে সে বাইরের দিকে তাকায়। জোৎস্না রাত। বাইরে ফকফকা চাঁদের আলো। তিন-চারজন লোককে ঘোরাফেরা করতে দেখতে পায় ইসহাক। মেয়েটির গাল ভরা হাসি শুনতে পায় সে। পরক্ষণে মেয়েটিকে তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে। ইসহাক পেছনে সরে গিয়ে নিজ জায়গায় বসে পড়ে। তাঁবুতে প্রবেশ করে মেয়েটি ইসহাকের সামনে খাবার রাখে। ইসহাক খেতে শুরু করে।

তুমি কি এখন কায়রো যাচ্ছো? মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।

না- ইসহাক মিথ্যা উত্তর দেয়- আমি ইস্কান্দারিয়া যাচ্ছি।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী তো কায়রোতে আছেন- মেয়েটি মুচকি হেসে বললো- ইস্কান্দারিয়া গিয়ে কী করবে?

সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে আমার আবার কী সম্পর্ক! ইসহাক বিস্ময়মাখা কণ্ঠে বললো।

আমাদের তো আছে- মেয়েটি বললো- তিনি আমাদের সুলতান। তাঁর নির্দেশে আমরা জীবন কুরবান করতেও প্রস্তুত আছি।

ভালো কথা- ইসহাক বললো- কিন্তু আইউবী কায়রোতে আছেন সে কথা আমাকে বললে কেন?

শোন- মেয়েটি ইসহাকের মাথায় হাত রেখে বললো- তোমার একটি ঘোড়া দরকার। তুমি সুলতান আইউবীর নিকট যাচ্ছে। আমরা তোমাকে সাহায্য করবো। তোমাকে ঘোড়া দেবো। তুমি অনেক তাড়াতাড়ি সুলতানের নিকট পৌঁছে যাবে।

এসব তুমি কীভাবে জানলে? ইসহাক বিস্ময়ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

ও কথা জিজ্ঞেস করো না- মেয়েটি বলছে- তুমি তোমার কর্তব্য পালন করছে। আমাদের দায়িত্ব আমাদেরকে পালন করতে দাও। তোমাকে ঘোড়া দিয়ে প্রমাণ করবো, আমরা আমাদের কর্তব্য পালন করেছি।

মেয়েটি এমন ধারায় কথা বললো যে, ইসহাক চিন্তায় পড়ে যায়। বললো- হ্যাঁ, আমাকে অনেক তাড়াতাড়ি সুলতান আইউবীর নিকট পৌঁছতে হবে।

জরুরী কোন সংবাদ আছে মনে হয়? 

ওসব জিজ্ঞেস করো না- ইসহাক উত্তর দেয়- সব কথা বলাও যায় না। সবকিছু সকলের জানারও প্রয়োজন নেই।

আমি তোমার ঘোড়ার ব্যবস্থা করছি- মেয়েটি উঠতে উঠতে বললো- তুমি বিশ্রাম নাও। রাত সবে মাত্র শুরু হয়েছে। শেষ প্রহরে রওনা হলেই চলবে।

মেয়েটি তাবু থেকে বেরিয়ে যায়। ইসহাক তুর্কি বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।

***

কে না বলেছিলে ওকে ওখানেই মরতে দিলে ভালো হতো?- মেয়েটি তাঁবুর বাইরে গিয়ে দলের লোকদের বললো- ওস্তাদ মানে আমাকে? লোকটা আইউবীর গুপ্তচর। বলছে কি জানো, বলছে, আমাকে একটা ঘোড় দাও, সুলতান আইউবীর নিকট তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে। লোকটা যখন অচেতন অবস্থায় বিড় বিড় করছিলো, তখন আমি কান পেতে শুনছিলাম, সে আইউবীর নাম উচ্চারণ করে বলছে, আমি বড় মূল্যবান তথ্য নিয়ে এসেছি।

ইসহাকের সঙ্গে মেয়েটির যেসব কথাবার্তা হয় এবং তার মুখ থেকে যেসব কথা বের করে, মেয়েটি দলের লোকদেরকে সব জানায়।

এটি বণিক কাফেলা নয়। এরা সবাই খৃস্টানদের গুপ্তচর এবং নাশকতার কর্মী। মিসরে দায়িত্ব পালন করে এখন ফিরে যাচ্ছে কিংবা অন্য কোন অঞ্চলে যাচ্ছে। সঙ্গে রক্ষীও আছে। দশ-বারোজন পুরুষ। দুটি মেয়ে। মেয়ে দুটি অত্যন্ত রূপসী ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ছদ্মবেশ ধারণ করেছে বণিকের। তাদের সঙ্গে উট আছে, ঘোড়া আছে। ছায়া-পানি দেখে এখানে অবস্থান নিয়েছে। সন্ধ্যার খানিক আগে তারা দূর থেকে ইসহাককে দেখতে পায়। দুজন পুরুষ ও একটি মেয়ে তার দিকে এগিয়ে আসে।

ইসহাক তুর্কি তাদেরকে দেখেছিলো। কিন্তু এই দেখাকে সে কল্পনা এবং মরিচিকা মনে করেছিলো। তার পরক্ষণেই সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো। খৃস্টান পুরুষ দুজন আর মেয়েটি তার কাছে যায়। মেয়েটি বললো, লোকটা সাধারণ মুসাফির মনে হয় না। পুরুষ দুজন অভিমত ব্যক্ত করে, আনাড়ি কোন পথচারীই হবে। অন্যথায় এ দশা ঘটতো না। তথাপি ইসহাকের শারীরিক গঠন-আকারে তাদেরও কিছুটা সন্দেহ জাগে, অন্য কিছু হতে পারে। কিছুটা সন্দেহ, কিছুটা কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে তারা ইসহাককে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে আসে এবং এই তাঁবুতে শুইয়ে দেয়। ফোঁটা ফোঁটা করে ইসহাকের মুখে পানি ও মধু ঢালে। ইসহাক বিড় বিড় করে ওঠে। ইসহাক অচেতন ছিলো। এই অচেতন অবস্থা আর ঘুমের মধ্যেই মানুষের মস্তিষ্ক জেগে ওঠে। গোয়েন্দাদের বিশেষভাবে নির্দেশনা দেয়া থাকে, যেনো তারা শত্রুর এলাকায় অচেতন না হয়। অজ্ঞান অবস্থায় অনেক সময় তার কাছ থেকে গোপন তথ্য বেরিয়ে আসে। মরুভূমি ইসহাককে অসহায় ও অচেতন করে দিয়েছিলো। অন্যথায় তার যথেষ্ট প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিলো। অচেতন অবস্থায় যদি তার মুখ থেকে বিড় বিড় শব্দ বের না হতো, তাহলে কেউ তাকে সন্দেহ করতে পারতো না।

ইসহাক বিচক্ষণ ও কৌশলী হওয়া সত্ত্বেও চেতনা ফিরে পেয়ে এখন সে খৃস্টান মেয়ের ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে। মেয়েটি সুদক্ষ খৃস্টান গোয়েন্দা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। মেয়েটি নিশ্চিত হয়ে যায়, লোকটি মুসলমান এবং সালাহুদ্দীন আইউবীর গুপ্তচর। তাঁবুর বাইরে গিয়ে সে সঙ্গীদের জানায়, আমার সন্দেহ সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। এই সুদর্শন লোকটি সুলতান আইউবীর গোয়েন্দাই বটে।

বড় শিকার- দলনেতা বললো- এখন জানতে হবে, লোকটা কী তথ্য নিয়ে যাচ্ছে এবং কোথায় কার নিকট যাচ্ছে।

তথ্য কোথা থেকে এনেছে জানার পর আরো জানতে হবে, ওখানে তারা। কতোজন আছে এবং তাদের আস্তানা কোথায়। দলের একজন বললো।

কিন্তু আমাদের পরিচয় সে যেনো বুঝতে না পারে- দলনেতা বললো আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর গোয়েন্দাদের ভালো করে জানি। তারা মৃত্যুকে বরণ করে নেবে; তবু তথ্য দেবে না। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কথা বলতে হবে।

ঐ মুসলমানগুলোকে আমিও ভালোভাবেই জানি- মেয়েটি অর্থবহ মুচকি হেসে বললো- তথ্য তো দেবেই, নিজের খঞ্জর দ্বারা নিজের হৃদয়টাও বের করে আমার পায়ের উপর রাখবে।

তুমি সেই মুসলমানদেরু জানো, যারা ক্ষমতা আর বিত্তের নেশায় মাতাল হয়ে গেছে- অপর এক খৃস্টান বললো- সাধারণ মুসলমান আর সাধারণ সৈনিকের পাল্লায় তুমি পড়েনি। তোমাদের দ্বারা বিভ্রান্ত মুসলমানরাই সম্পদ ও মর্যাদার গোলাম হয়ে থাকে। কিন্তু যেসব মুসলমানের নিকট ঐশ্বর্যের স্থলে ঈমান বড়, তাদের কাছে গিয়ে দেখো।

দলে আরো একটি খৃস্টান মেয়ে আছে। সেও এই বৈঠকে উপস্থিত। এ পর্যন্ত সে কোন কথা বলেনি। দলনেতা তার প্রতি তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো- তুমি এই মুসলমানটার কাছ থেকে তথ্য বের করতে পারবে না বারবারা।

মেয়েটি মুখ তুলে দলনেতার প্রতি তাকায়।

দলনেতা আবার বললো- তুমি কায়রোতে আমাদের অনেক ক্ষতি করেছো। মেরিনার দক্ষতা দেখো এবং তার থেকে শেখো। আমি তোমাকে আর সুযোগ দেবো না। মেরিনার দক্ষতার কথা চিন্তা করো। আমরা সবাই লোকটাকে পথভোলা পথিক মনে করেছিলাম। কিন্তু মেরিনা ঠিকই ধরে ফেলেছে, লোকটা মূল্যবান শিকার হবে। আমি তোমাকে এ জন্য মিসর থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছি যে, তুমি ক্রুশের উপকার করার পরিবর্তে ক্ষতি করছো।

তোমার পরিণতি খুবই মন্দ হবে বারবারা- অপর এক খৃষ্টান বললো এই পেশায় তোমরা একজন রাজকন্যার মর্যাদ পেয়ে থাকে। কিন্তু তুমি এই মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে। তারপর কারো গনিকা কিংবা বেশ্যাবৃত্তি ছাড়া তোমার আর কোন উপায় থাকবে না।

উহ্! পাশ থেকে মেরিনা ঘৃণা প্রকাশ করে বারবারার উদ্দেশে বললো- এ তো যোগ্যই এ কাজের।

বারবারা ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে মেরিনার প্রতি তাকায়। রাগে-ক্ষোভে তার চেহারা লাল হয়ে গেছে। কিন্তু কোন কথা বলছে না। মেয়েটি মেরিনার মতোই রূপসী ছিলো। কিন্তু মিসর যাওয়ার পর তার দক্ষতায় ভাটা পড়ে যায়। সমস্যাটা সৃষ্টি করেছে দলনেতা। লোকটা পদস্থ অফিসার এবং সুদর্শন যুবক। বারবারাকে তার ভালো লাগতো। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে মেয়েটির সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তোলে। তারা দুজনে দুজনার হয়ে যায়। কিন্তু এই দৃশ্য মেরিনার সহ্য হয় না। সে তার কূটচাল প্রয়োগ করে দলনেতাকে বারবারা থেকে সরিয়ে নিজের মুঠোয় নিয়ে আসে। তার সঙ্গে প্রেম প্রেম খেলা শুরু করে দেয়। বারবারার সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। বারবারা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে এবং কর্তব্য পালনে অবহেলা শুরু করে। এই সুযোগে মেরিনা এমনও পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায় যে, বারবারার সন্দেহে নিপতিত হয়ে ধরা পড়ার উপক্রম হয়। কিন্তু শেষমেশ রক্ষা পেয়ে যায়।

মেয়েটিকে সুলতান আইউবীর উচ্চপদস্থ একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তার পেছনে নিয়োজিত করা হয়েছিলো। কিন্তু সে উদ্দেশ্যে সফল হতে পারেনি। দলনেতা টের পেয়ে যায়, বারবারা ও মেরিনার সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। পরস্পর সহকর্মী হয়ে কাজ করার পরিবর্তে এখন তারা একজন অপরজনকে ঘায়েল করার সুযোগটাই কাজে লাগায়। এই পরিস্থিতি মিশনের জন্য খুবই ক্ষতিকর। মেয়েটি এই দল ত্যাগ করে অন্য দলে যাওয়ার চিন্তা করে।

বারবারা দলনেতার শত্রুতে পরিণত হয়েছে। মেরিনা তার সঙ্গে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকায়। নিজের অশুভ পরিণতি চোখের উপর ভাসছে মেয়েটির। আর এখন কিনা মেরিনা বলে ফেললো, বেশ্যাবৃত্তিই বারবারার মানানসই পেশা। প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে বারবারার মনে।

এই লোকটার কাছ থেকে তথ্য কেবল আমিই বের করতে পারবো মেরিনা বললো- এ কাজ বারবারার সাধ্যের অতীত।

বারবারা ক্ষুব্ধ মনে নিজের তাবুতে চলে যায়।

***

রাতে লোকটা পালাবার কোন সুযোগ পাবে না- দলনেতা বললো- এ যাবত পালাবার কোন কারণও নেই। তথাপি সতর্ক থাকতে হবে। লোকটাকে অজ্ঞান করে রাখো।

খানিক পর মেরিনা ইসহাকের তাঁবুতে প্রবেশ করে। ইসহাক শুয়ে আছে। প্রদীপটা জ্বলছে। মেরিনার হাতে একটি রোমীল। রোমালটি অচেতনকারী ওষুধে ভেজা। মেরিনা পা টিপে টিপে ইসহাকের নিকট গিয়ে বসে পড়ে। রোমালটি ইসহাকের নাকের উপর রেখে কিছুক্ষণ পর সেটি সরিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যায়। মেরিনা সঙ্গীদের জানালো- আগামীকাল সূর্য উঠার সামান্য পর হুঁশ ফিরে পাবে।

এবার নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ো- দলনেতা বললো- আগামী দিন সালাহুদ্দীন আইউবীর এই গোয়েন্দাকে তার চাহিদা মোতাবেক ঘোড়া ঠিকই দেবো, তবে সেই ঘোড়ায় সে কায়রো নয়- আমাদের সঙ্গে বৈরুতে যাবে। লোকটা আমাদের সফরসঙ্গী হবে।

সুলতান আইউবীর একজন গোয়েন্দাকে নিজেদের কজায় নিয়ে আসা তাদের জন্য বিরাট সাফল্য। তারা উৎসবে মেতে ওঠে। মদের আসর বসায়। সাফল্যের আনন্দে মেরিনার পা যেনো মাটিতে পড়তে চাচ্ছে না।

কিন্তু আজ বারবার মনে আনন্দের পরিবর্তে তুষের আগুন জ্বলছে। ফুর্তিতে যোগ না দিয়ে নিজ তাঁবুতেই ব্যথিত মনে অবস্থান করছে।

দীর্ঘ রাত পর্যন্ত আমোদ-ফুর্তিতে কাটিয়ে প্রত্যেকে যার যার তাঁবুতে চলে যায়। দলনেতা মেরিনাকে নিয়ে একসাথে চলে যায়।

ব্যর্থ ও বেদনাহত বারবারা নিজ তাঁবুতে বসে অস্থির সময় অতিবাহিত করছে। অন্তরে তার প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। বাইরের আসরের হৈ-হুঁল্লোড় তার আগুনকে আরো উত্তেজিত করে তুলেছে। বারবারা উঠে তাবুর পর্দা ফাঁক করে উঁকি দিয়ে বাইরে তাকায়। দেখে, তাদের দলনেতা, আর মেরিনা টিলার দিকে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে তারা টিলার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়।

বারবারার কানে মেরিনার কণ্ঠ বাজছে- একমাত্র আমিই তার কাছ থেকে তথ্য বের করতে পারবো। বারাবারার মাথায় চিন্তা জাগে, ইচ্ছে করলে আমি মেরিনাকে ব্যর্থ করতে পারি। একটা পন্থা এই হতে পারে, আমি ইসহাককে বলে দেবো আমরা সকলে খৃস্টান গোয়েন্দা, তুমি সতর্ক হয়ে যাও। আবার সহযোগিতা দিয়ে লোকটাকে ভাগিয়েও দিতে পারি। প্রতিশোধ আগুনে প্রজ্জ্বলমান বারবারার মাথায় নানা ভাবনা জাগে।

সকলের ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষায় আছে বারবারা। তার চোখে ঘুম আসছে না। এমন সময় তাঁবুর পর্দা সরে যায়। কে যেনো ফিসফিস শব্দে তাকে ডাকছে।

বারবারা বুঝতে পারে কে এসেছে।

চলে যাও মার্টিন- বারবারা ক্ষুব্ধকণ্ঠে বললো- চলে যাও এখান থেকে।

মার্টিন চলে যাওয়ার পরিবর্তে তাঁবুতে ঢুকে পড়ে এবং বারবারার পাশ ঘেঁষে বসে- তোমার হয়েছেটা কী বলো তো? তুমি কি মনে করো, দলনেতা মেরিনাকে হৃদয় থেকে ভালোবাসে? তুমি কি বিশ্বাস করো, তোমাকে সে মন দিয়ে ভালোবেসেছিলো? এ সবকিছুই তার বদমায়েশী ও ফষ্টিনষ্টি। বারবারা! তুমি অযথা হৃদয়ের উপর অস্থিরতার বোঝা চাপিয়ে কর্তব্য থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছো। তুমি যদি সত্যিকার ভালোবাসার প্রত্যাশী হয়ে থাকো, তাহলে সেটা তুমি আমার কাছ থেকেই আশা করতে পারো। আমি তোমাকে অন্তর থেকে কামনা করি। তুমিই বলো, আমি কি তোমাকে কখনো ধোকা দিয়েছি?

তোমরা আপাদমস্তক প্রতারক- বাবারা ক্ষুব্ধকণ্ঠে বললো- তোমরা প্রত্যেকেই ধোকাবাজ। আমি আমার কর্তব্য থেকে সরে যাইনি। তবে আমার হৃদয় জগতটার প্রতিই অনীহা এসে গেছে। আমাদেরকে শৈশব থৈকেই প্রতারণার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে যে, আমরা মুসলমানদের ধোকা দিয়ে ক্রুশের মোকাবেলায় তাদেরকে নিষ্ক্রিয় করে দেবো। কিন্তু সেই বিদ্যা আমরা পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করছি। গলায় কুশ ঝুলিয়ে আমরা অপকর্ম করছি এবং একে অপরকে ধোঁকা দিচ্ছি। মুসলমানরা আমাদের চেয়ে বুদ্ধিমান। তারা গুপ্তচরবৃত্তি-নাশকতার কাজে মেয়েদের ব্যবহার করে। আমাদের নেতা আমাকে ভালোবাসার টোপ দিলেন। কিন্তু মেরিনা বেশি চালাক বলে তাকে হাত করে নিলো। তুমি আমাকে দখল করার চেষ্টা করছে। ফল দাঁড়াচ্ছে, এখন আমরা পুরো দলটিই ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছি। তোমাদের সঙ্গে যদি আমরা দুটি মেয়ে না থাকতাম, তাহলে তোমরা অত্যন্ত সফলতার সাথে কর্তব্য পালন করতে সক্ষম হতে। নারীর উপস্থিতি পুরুষদের মধ্যে শত্রুতার জন্ম দিয়ে থাকে।

এ লক্ষ্যেই তো আমরা মুসলমানদের মাঝে আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়েদের ছেড়ে দেই- মার্টিন বললো- তাদের মাঝে শত্রুতা সৃষ্টি করাই আমাদের উদ্দেশ্য। আমরা কাজটা এ জন্য করি, যাতে ইসলামের পতন ঘটে এবং ক্রুশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

মার্টিন বারবারাকে নিজের দিকে টেনে এনে ফিসফিস করে বললো এমন রাতটাকে নিরামিষ আলাপে বিস্বাদ করো না বারবারা! এসো বাইরে যাই। দেখো, চাঁদটা কতো সুন্দর!

আমার মনটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে- বারবারা বললো- আমি ব্যর্থ হয়েছি। আমার হৃদয়ে ঘৃণা জন্ম নিয়েছে। আমি কোথাও যাবো না। তুমি যেতে পারো।

একদিন এমন আসবে, তুমি আমার পায়ের উপর পড়ে কাকুতি-মিনতি করে বলবে, মার্টিন আমাকে বাঁচাও; ওরা আমাকে কুকুরের মুখে তুলে দিচ্ছে। তখন কিন্তু আমি তোমাকে সাহায্য করবো না।

এখনো আমি কুকুরের মুখেই আছি- বারবারা তাচ্ছিল্যের সুরে বললো- আমি কোনদিন তোমার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করবো না। তুমি এখান থেকে চলে যাও।

মার্টিন ক্ষুব্ধ মনে উঠে দাঁড়ায় এবং তাঁবু থেকে বেরিয়ে যায়।

বারবারা মার্টিন চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে এবং অপেক্ষা করতে থাকে মার্টিন কখন ঘুমিয়ে পড়ে। সে জানে, দলনেতা আর মেরিনার ফিরতে অনেক দেরি হবে।

খানিক পর বারবারা তাবু থেকে বের হয়। বসে বসেই সামনের দিকে এগুতে থাকে। সম্মুখের জায়গাটা সামান্য গভীর। বারবারা সেখানে নেমে পড়ে। সেখান থেকে ঝুঁকে ঝুঁকে কূপের পেছনে চলে যায়। অনেক দূর ঘুরে ইসহাক যে তাঁবুতে অবচেতন পড়ে আছে, সেখানে পৌঁছে যায়। বারবারা জানে না, ইসহাককে অজ্ঞান করে রাখা হয়েছে। সে তাঁবুর ভেতর ঢুকে পড়ে। বাতিটা জ্বলছে। বারবারা পা ধরে ইসহাককে নাড়া দেয়। কিন্তু ইসহাক জাগলো না। মাথা ধরে নাড়ায়। হাত ধরে টানে। কিন্তু না, কিছুতেই লোকটা নড়ছে না।

ওঠো হতভাগা!- বারবারা ইসহাকের গালে চড় মেরে বিরক্তির সাথে বললো- তুমি প্রতারণার জালে আটকা পড়েছে। আমরা সবাই গোয়েন্দা। তুমি কায়রো যেতে পারবে না। বৈরুতের কারাগারের অন্ধকার পাতাল প্রকোষ্ঠে নির্যাতনের মুখে ধুকে ধুকে মরবে।

ইসহাক অচেতন পড়ে আছে। যেনো মরে গেছে। বারবারা তাবুর বাইরে হাল্কা হাসির শব্দ শুনতে পায়। কিন্তু ভয় পায় না। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দা কিনা। শব্দগুলো নিকটে চলে আসার পরও মেয়েটি ইসহাকের নিকট বসে থাকে। হাসি আর ফিসফিস কথোপকথনের শব্দ তাঁবু পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে। একটি কণ্ঠ মেরিনার। নেতার সঙ্গে কয়েদী দেখতে এসেছে।

আমরা মুসলমান- বারবারা ইসহাককে উদ্দেশ্য করে উচ্চস্বরে বললো- তোমাকে আমরা এমন একটি ঘোড়া দেবো, যে তোমাকে দুদিনের মধ্যে কায়রো পৌঁছিয়ে দেবে।

বারবারা! বারবারা! বারবারা দলনেতার কণ্ঠ শুনতে পায়। পেছন ফিরে তাকায়। দলনেতা ও মেরিনা দাঁড়িয়ে আছে। নেতা বললো- এই মুহূর্তে তুমি তোমার কর্তব্য পালন করতে পারবে না। লোকটাকে অজ্ঞান করে রাখা হয়েছে।

এটা আমার শিকার বারবারা- মেরিনা তাচ্ছিল্যভরা হাসি হেসে বললো এর থেকে কীভাবে তথ্য বের করতে হবে, সেটা শুধু আমিই জানি।

দলনেতা ও মেরিনা হেসে ওঠে। এই তিরস্কারের হাসি বুঝতে পারে বারবারা। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে বললো- আমি কোন ভুল করিনি, আমি আমার দায়িত্ব পালন করছিলাম।

যাও, ঘুমিয়ে পড়ো। দলনেতা আদেশের সুরে বললো।

 বারবারা উঠে দাঁড়ায়। তাঁবু থেকে বেরিয়ে যায়।

দলনেতা ইসহাকের শিরায় হাত রাখে। তারপর মেরিনাকে নিয়ে চলে যায়।

ইসহাক তুর্কি সুলতান আইউবীর জন্য অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে।

***

আলী বিন সুফিয়ান!- কায়রোতে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী তাঁর ইন্টেলিজেন্স প্রধান আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন- ওদিক থেকে এ যাবত কোন সংবাদ আসেনি। তার অর্থ হচ্ছে, ওখানে কোন পরিবর্তন ঘটেনি, কোন সমস্যা নেই। কিন্তু আমি বিষয়টা মানতে পারছি না।

আর আমিও মানতে পারছি না- আলী বিন সুফিয়ান বললেন- ওখানে কোন পরিবর্তন আসবে, সমস্যা দেখা দেবে অথচ আমাদের নিকট কোন খবর আসরে না। ওখানে আমাদের যে লোক আছে, তারা সাধারণ গোয়েন্দা নয়। ইসহাক তুর্কিকে আপনি তো ভালো করেই জানেন। মাটির বুক চিরে তথ্য বের করে আনার মতো হিম্মত ও মোগ্যতা তার আছে। অন্যরাও তার মতোই বিচক্ষণ।

ওদিকে যেসব ঘটনার উদ্ভব হয়েছে, খৃস্টানরা তা দ্বারা স্বার্থ উদ্ধার করবেই- সুলতান আইউবী বললেন- বল্ডউইন তার ফিরিঙ্গি বাহিনীকে নিয়ে হাল্ব ও মসুলের আশপাশে অবস্থান করছে।

কিন্তু আল-মালিকুস সালিহ তো মারা গেছে- আলী বিন সুফিয়ান বললেন- হালবের শাসক এখন ইযযুদ্দীন। তিনি তো খৃস্টানদের আনুগত্য করার মতো লোক নন।

আলী!- সুলতান আইউবী মুখে বিস্ময় ফুটিয়ে বললেন- তুমি কি তাহলে আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত? তুমি সম্ভবত এ জন্য ই্যুযুদ্দীনকে পরিপক্ক মুসলমান মনে করছে যে, আমি তাকে বন্ধু ভাবি এবং তার সাহায্যার্থে পরিকল্পনা বদল করে তালখালেদের উপর আক্রমণ করেছিলাম আর্মেনীয়দের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছিলাম। তাই না? কিন্তু শুনে রাখো আলী। আমি আমার মুসলমান শাসক ও আমীরদের উপর ভরসা রাখতে পারি না। ইযযুদ্দীন আমাদের পক্ষভুক্ত শাসক হতে পারে। কিন্তু তার আমীর-উজীরদের মধ্যে খৃস্টানদের অনুগত লোকও আছে। আলী! তুমি কি দেখোনি, একজন ঈমানদার শাসকও মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের তোষামোদমূলক পরামর্শের জালে এসে মুমিন থেকেও দেশ-জাতিকে ভুল সিদ্ধান্ত দ্বারা ধ্বংসের অতলে নিক্ষেপ করে থাকে। আমি পরামর্শ পরামর্শকের বিরোধী নই। শিক্ষা গ্রহণের আগে পরামর্শ নেয়া কুরআনের নির্দেশ। কিন্তু যিনি শাসনকার্য পরিচালনা করেন, তার এতোটুকু বুদ্ধি বিচক্ষণতা থাকতে হবে, যেনো পরামর্শকদের উদ্দেশ্য ও চরিত্র বুঝতে সক্ষম হন। তোষামোদ-চাটুকারিতা রাজত্বের মোহকে চাঙ্গা করে তোলে। একসময় শাসক তোষামোদের সুর লহরীতে সুখনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত বুদ্ধির শাসক যত বড় যোদ্ধা কিংবা দুনিয়াবিমুখই হোক না কেন, জাতি ও মাতৃভূমিকে নিয়ে সাগরে ডুবে মরে। এমনি আশঙ্কা আমার ইম্যুদীনের ব্যাপার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।

আমি আশাবাদী এই জন্য যে, নূরুদ্দীন জঙ্গী মরহুমের বিধবা মুহতারামা রোজি খাতুন ইযুদ্দীনকে বিয়ে করেছেন- আলী বিন সুফিয়ান বললেন- আপনি নিশ্চয়ই জেনেছেন, মুহতারামা রোজি খাতুন এই বিবাহ এ জন্য কবুল করেছেন, যেনো হালব ও মসুলের শাসক ও সেনাবাহিনী আমাদের পক্ষে কাজ করে। দ্র মহিলার এছাড়া বিবাহের আর কী প্রয়োজন থাকতে পারে?

তথাপি আমার সন্দেহ হচ্ছে- সুলতান আইউবী বললেন- সন্দেহের কারণটা হলো, ইযুদ্দীন খৃস্টানদের দ্বারা সরাসরি বেষ্টিত। নিজের নিরাপত্তার জন্য তিনি তলে তলে খৃষ্টানদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে পারেন। ওখানকার খবরাখবর আমার তাড়াতাড়ি জানা দরকার। আমি কখনো অন্ধকারে পথ চলি না তুমি তো জানো।

আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন মহামান্য সুলতান। আলী বিন সুফিয়ান পরামর্শ দেন।

আমি বেশি দিন অপেক্ষা করবো না- সুলতান আইউবী বললেন তুমি জানো, আমি বাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছি। এতো তোমার সম্মুখের ঘটনা, আমি দিন-রাত অবিশ্রাম বাহিনীকে মহড়া করাচ্ছি। গোপন কথাটা শুনে নাও, আমি হালব-মসুলের দিকে যাবো না। আমার টার্গেট এখন বৈরুত। এখন আর আমি প্রতিরক্ষা যুদ্ধ লড়বে না। হা, মসুল প্রভৃতি অঞ্চলে যাওয়ার অর্থ হবে, আমি প্রতিরক্ষা লড়াই করতে যাচ্ছি। কিন্তু এখন আমার যুদ্ধ হবে আক্রমণাত্মক-মারমুখী। বৈরুত ফিরিঙ্গিদের হৃদপিণ্ড। হাত-পায়ে আঘাত হানার পরিবর্তে কেন দুশমনের হৃদপিণ্ডে এক আঘাত হেনে নিঃশেষ করে দেবো না। এখন আমি বাহিনীকে আক্রমণাত্মক যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। নিজ এলাকায় যুদ্ধে জড়িয়ে থাকলে আমি কোনদিন বায়তুল মুকাদ্দাস পৌঁছতে পারবো না। বুঝতে চেষ্টা করো আলী। ওদিক থেকে কোন সংবাদ এখনো না আসার কারণ কী। আমার দুটি তথ্যের প্রয়োজন। প্রথমত, বৈরুতে ফিরিঙ্গি বাহিনীর তৎপরতা। দ্বিতীয়ত, হাবে ইযযুদ্দীনের উদ্দেশ্য কী। আমার জানার প্রয়োজন, আমরা আরেকটি গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি না তো।

বৈরুতে ইসহাক তুর্কি আছে- আলী বিন সুফিয়ান বললেন- নিজে না আসলে অন্য কাউকে পাঠিয়ে দেবে। আমি এখান থেকে কাউকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

আমি বেশি দিন অপেক্ষা করতে পারবো না আলী- সুলতান আইউবী বললেন- তুমি এখান থেকে কাউকে পাঠাবে। সে খবর নিয়ে যাবে, তারপর আসবে। এই যাওয়া-আসার মাঝে সময় ব্যয় হবে কমপক্ষে তিন, মাস। না, আমি এতোদিন অপেক্ষা করতে পারবো না। দিন কয়েকের মধ্যেই আমি বাহিনীকে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেবো।

তা এই অগ্রযাত্রা কি অন্ধকারের পথচলা হবে না আলী বিন সুফিয়ান বললেন।

কমান্ডো ইউনিটগুলোকে অগ্রগামী বাহিনীরও অনেক সম্মুখে ছড়িয়ে রাখবো- সুলতান আইউবী বললেন- আমি আল্লাহর আদেশে তারই পবিত্র ভূমির মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে যাচ্ছি। নিজের নিরাপত্তার জন্য আমি মিসরে আরামে বসে থাকতে পারি না আলী।

১৯৮২ সালের কোন একদিন সুলতান আইউবী খৃস্টানদের অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে তার প্রেরিত গোয়েন্দাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় অস্থির প্রহর গুনছেন। আপনারা পেছনে পড়ে এসেছেন, তার দুমাস আগে নূরুদ্দীন জঙ্গীর পুত্র আল-মালিকুস সালিহ- যিনি হাবের গভর্নর নিযুক্ত হয়ে সুলতান আইউবীর বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। মৃত্যুবরণ করেছেন। সুলতান আইউবীর সঙ্গে তার যুদ্ধ না করা এবং সুলতানের জোটভুক্ত হয়ে কাজ করার চুক্তি থাকা সত্ত্বেও গোপনে গোপনে খৃষ্টানদের সঙ্গে মিতা রেখেছিলেন। তার মৃত্যু সংবাদ খৃস্টান ও সুলতান আইউবী উভয় পক্ষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। আল-মালিকুল সালিহ মৃত্যুর পূর্বে ইযযুদ্দীন মাসউদকে নিজের স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করে যান। এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিলো। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো যে ঘটনাটি, সেটি হচ্ছে ইমুদ্দীন-রোজি খাতুনের বিবাহ। নূরুদ্দীন জঙ্গীর স্ত্রী এবং আল-মালিকুস সালিহর মা এই বিয়ে সংসার পাতার জনা বরণ করেননি। সুলতান আইউবীর ভাই আল-আদিল ইবুদ্দীনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, এই বিবাহ হবে দামেশক ও হাবের বিবাহ। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে গৃহযুদ্ধের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে এবং খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান শক্ত হবে। রোজি খাতুন শেষ পর্যন্ত এই বলে সম্মতি প্রদান করেন যে, তার ব্যক্তিগত সব কামনা-বাসনা মরে গেছে। তিনি শুধুমাত্র ইসলামের মর্যাদার খাতিরে যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত আছেন।

রোজি খাতুন ত্যাগ স্বীকার করে নেন এবং ইযযুদ্দীনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। হাল্ব এবং মসুলের প্রজাতন্ত্রগুলোর উপর বহুদিন যাবত খৃস্টানদের প্রভাব কাজ করে আসছিলো। যার ফলে এই প্রজাতন্ত্রগুলো সুলতান আইউবীর বিপক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায় এবং তিন বছর পর্যন্ত মুসলমানদের মাঝে গৃহযুদ্ধ অব্যাহত থাকে। আপনারা তার বিস্তারিত কাহিনী পড়ে এসেছেন। এখন রোজি খাতুন ইযযুদ্দীনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে খৃস্টানরা চিন্তায় পড়ে যায়, রোজি খাতুন খৃস্টানদের সবচেয়ে বড় শত্রু জঙ্গীর স্ত্রী। বিচক্ষণ এই মহিলা তো হা মসুল ও অন্যান্য মুসলিম অঞ্চলসমূহ থেকে খৃস্টানদের প্রভাব নস্যাৎ করে দেবেন। ওদিকে মিসরে সুলতান আইউবী এই ভাবনায় অস্থির যে, খৃস্টানরা সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে ফেলে কিনা। সুলতান আরো ভাবছেন, আরবে তার অনুপস্থিতিতে খৃস্টানরা স্বার্থ উদ্ধার করার অপচেষ্টা করতে পারে।

সুলতান আইউবী বর্তমান এবং অনাগত ভবিষ্যতের একটা সম্ভাব্য চিত্র এঁকে সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন, খৃস্টানরা অগ্রযাত্রা করে হাল্ব-মসুল অবরোধ করে নেয়ার আগে তিনি দ্রুতগতিতে অগ্রযাত্রা করবেন এবং বৈরুত অবরোধ করে ফেলবেন।

সুলতান আইউবীর এ এক চরম স্পর্শকাতর ও বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত। বৈরুত অবরোধ করতে হলে তাকে শত্রুর এলাকা অতিক্রম করে যেতে হবে। পথেই সংঘাতের আশঙ্কা বিদ্যমান।

যা হোক, সুলতান আইউবী সম্ভাব্য সব ধরনের সকল শঙ্কা-বিপদের পরিসংখ্যান মাথায় নিয়ে সবরকম পরিস্থিতির মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গোয়েন্দা রিপোর্ট ব্যতীত অভিযান-অগ্রযাত্রা ছিনি কমই করেছেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতির দাবি ভিন্ন। ইযুদ্দীনের নিয়ত কী এবং ওখানে রোজি খাতুনের প্রতিপত্তি আছে কিনা জানা খুবই প্রয়োজন ছিলো তার।

আলী বিন সুফিয়ানের প্রেরিত গোয়েন্দারা আনাড়ি কিংবা ভীতু নয়। তথ্য সংগ্রহ করা এবং তা কায়রোতে পৌঁছানোর জন্য জীবন বাজি রাখা তাদের জন্য মামুলি ব্যাপার। একটা দীক্ষা তারা সবসময় মনে রাখে যে, অর্ধেক যুদ্ধ লড়াই শুরু হওয়ার আগেই গোয়েন্দারা জয় করে থাকে। তারা এও জানে, একজন গোয়েন্দার কর্তব্য অবহেলা কিংবা ভুল তথ্য গোটা বাহিনীকে শেষ করে দিতে পারে। আবার একজন মাত্র গুপ্তচর দুশমনকে অস্ত্র সমর্পণ করাতে বাধ্য করতে পারে।

ইসহাক তুর্কির উপর আলী বিন সুফিয়ানের পরিপূর্ণ আস্থা আছে। লোকটি যেমন যোগ্য, তেমনি সাহসী। তদুপরি পরিপক্ক, ঈমানদার মুসলমান। আলীর এই আস্থা যথার্থ। ইসহাক তুর্কি দক্ষতার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সগ্রহ করে কায়রোর উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলো। সে সুলতান আইউবীকে অবহিত করতে আসছিলো যে, বল্ডউইনের ফিরিঙ্গি বাহিনী বৈরুতের আশপাশে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে এবং ইযযুদ্দীনের ঝোঁক খৃষ্টানদের প্রতি। কাজেই সুলতান যেনো বৈরুতের দিকে পা বাড়ান। তদুপরি সুলতান যদি অগ্রযাত্রা করেনই,তার অনুকূলে ইসহাক ফিরিঙ্গি বাহিনীর বিস্তার ও অবস্থানের নকশা তৈরি করে আসছিলো। কিন্তু পথেই ইসহাক খৃস্টান গোয়েন্দাদের জালে আটকা পড়ে গেলো।

***

বলো, সেই তথ্যটা কী, যা তুমি সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট নিয়ে যাচ্ছো?- খৃস্টান গোয়েন্দা ইসহাককে জিজ্ঞেস করে। বললল- আমরাও মুসলমান। সুলতান আইউবীর সমর্থক ও অনুগত। তোমার জন্য ঘোড়া প্রস্তুত আছে। খাদ্য-পানীয়ও ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে।

আল্লাহ আমাদের সুলতানকে এরূপ সমর্থক-অনুগতদের থেকে নিরাপদ রাখুন-ইসহাক বললো- আমি এই মেয়েটাকে বলেছিলাম, মধ্যরাতে পর আমাকে তুলে দিও, আমি রাত থাকতেই রওনা হয়ে যাবে। কিন্তু তোমরা আমাকে জাগালে না। রাত কেটে দিনেরও অর্ধেকটা চলে গেছে। সময় তো নষ্ট হয়েছেই, তদুপরি এখন রওনা হলে ঘোড়া অতোটা পথ অতিক্রম করতে পারবে না যতোটা রাতে পারতো।

তুমি অনেক ক্লান্ত ছিলে- মেরিনা অস্নেহে বললে- এমন গভীর সুম ঘুমিয়েছিলে যে, আমি তোমাকে জাগিয়ে তোলা অবিচার হবে মনে করেছি। আমরা তোমার জন্য যে ঘোড়াটা প্রস্তুত করে রেখেছি, ওটা এতো ভালো যে, সময় যেটুকু নষ্ট হয়েছে তা পুষিয়ে দেবে।

ইসহাক তুর্কি এখনো বুঝতে পারেনি, যাকে ওরা ক্লান্তির পর গভীর নিদ্রা বলছে, আসলে তা কোন ওষুধের ক্রিয়ার অচেতনতা। এতো দীর্ঘ সময় ঘুমানোর পরও তার শরীরটা কেমন ম্যাজ ম্যাজ করছে। ইসহাক শারীরিকভাবে এখনো ভ্রমণে সমর্থ নয়। তবু এক্ষুনি রওনা হওয়ার জন্য ব্যাকুল সে।

ইসহাকের যখন চোখ খুলেছিলো, তখন সূর্য মাথার উপরে উঠে এসেছে। খৃস্টান দলনেতা ও মেরিনা তার চৈতন্য ফিরে আসার আগেই তার কাছে এসে বসেছিলো। ইসহাক চোখ খুললে তারা তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। তারা এমন ধারায় কথা বলে যে, ইসহাক তুর্কির মনে কোন সন্দেহ জাগেনি। সে তার সকল পরিকল্পনার কথা বলে যাচ্ছে। তবে ইসহাক সুলতান আইউবীর জন্য কী তথ্য নিয়ে যাচ্ছে তা বলছে না।

খৃস্টান দলনেতা তাঁবু থেকে বেরিয়ে যায়। ইসহাককে কুপোকাত করার জন্য রেখে যায় মেরিনাকে। চিত্তহারী মেয়ে মেরিনা ইসহাককে উত্তেজিত করে তোলার লক্ষ্যে বললল- আমি তোমাকে হৃদয়ের গভীর থেকে অলোবাসি। তাকে প্রেমের আহ্বানসহ আরো অনেক কথা বলতে থাকে মেরিনা।

কায়রো পৌঁছে প্রেমালাপের জন্য সময় বের করে নেবো- বললো ইসহাক- তুমি যদি আমাকে হৃদয় থেকেই কামনা করো, তাহলে আমাকে কর্তব্য পালনে সাহায্য করে।

ইসহাক উঠে দাঁড়ায়। লম্বা পায়ে তাবু থেকে বেরিয়ে যায়। বলতে শুরু করে- আমাকে ঘোড়া দাও, এক্ষুনি দাও।

কিছু খেয়ে নাও- মেরিনা ইসহাকের বাহু ধরে তাবুতে ফিরিয়ে নিতে নিতে বললো- আমি তোমাকে না খাইয়ে যেতে দিতে পারি না।

মেরিনা ইসহাককে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু কর্তব্যপরায়ণ ইসহাককে কোন কিছুই গলাতে পারছে না। তাঁবুতে নিয়ে মেরিনা ইসহাককে বসিয়ে দেয় এবং ভাবুর দরজায় দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে হাঁক দেয় খাবার তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো, সময় নেই। উনি এক্ষুনি চলে যাবেন।

বারবারা খাবার নিয়ে এসে ইসহাকের সামনে রেখে পেছনে সরে দাঁড়ায়। মেরিনা ইসহাকের পার্শ্বে উপবিষ্ট। বারবারা মেরিনাকে পেছন করে দাঁড়ায়। ইসহাক খেতে শুরু করে। খাওয়ার মধ্যে ইসহাক বায়রার প্রতি তাকায়। বারবারা হাতে ক্ষুদ্র একটি কুশ লুকিয়ে রেখেছিলো। অতি সতর্কতার সাথে সেটি ইসহাককে দেখায়। নিজের বুকে হাত রেখে মেরিনার প্রতি ইঙ্গিত করে। তারপর বাইরের দিকে ইশারা করে আঙ্গুল নাড়ায় এবং আঙ্গুলটি নিজের ঠোঁটের উপর রাখে। বারবারা তাবু থেকে বেরিয়ে যায়।

বারবারার ইশারা-ইঙ্গিতে ইসহাক বুঝে ফেলে এরা খৃষ্টান এবং এদের আর কোন তথ্য দেয়া যাবে না। ব্যাপারটা অনুধাবন করে ইসহাক মনে মনে চমকে ওঠে বটে; কিন্তু অভিজ্ঞ গুপ্তচর বলে কিছুই প্রকাশ পেতে দেয়নি। তার সন্দেহ দৃঢ় সত্যে পরিণত হয়। সে বুঝতে পারে, সুলতান আইউবীর উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া তথ্য জানার এদের এতো আগ্রহ কেন। তার চেতনা আসে, সে তো ঘুমকাতর নয়। তবে কি তাকে বেহুশ করে রাখা হয়েছিলো। ঘুম থেকে জেগে সে বিস্ময়কর এক ঘ্রাণ অনুভব করেছিলো। তার আর সন্দেহ রইলো না তাকে অজ্ঞান করে রাখা হয়েছিলো? কিন্তু একটি প্রশ্ন তার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, দ্বিতীয় মেয়েটি তাকে ইশারা করে গেলো কেন? তবে কি মেয়েটি মুসলমান, এদের ফাঁদে আটকা পড়ে আছে।

মিষ্টিমধুর কথা, পাগলকরা মুচকি হাসি আর মনকাড়া ভাবভঙ্গিতে ইসহাককে তথ্য প্রকাশের জন্য কসরত চালিয়ে যাচ্ছে মেরিনা। ইসহাকের মাথাটাও কাজ করে যাচ্ছে দ্রুত কীভাবে এদের কবল থেকে মুক্তিলাভ করবে।

ইসহাক মেরিনাকে জিজ্ঞেস করে- তোমাদের কাফেলায় কতোজন লোক আছে মেরিনা সংখ্যা বলে। ইসহাক আরো কিছু প্রশ্ন করে শেষে বললো- দাও, আমাকে ঘোড় দাও।

ইসহাক বাইরে চলে আসে। এদের সংখ্যা যাচাইয়ের চেষ্টা করে। কীভাবে এদের কবল থেকে মুক্ত হওয়া যায়, সে ফন্দি করতে থাকে। তার জন্য যে ঘোড়া প্রস্তুত করে রাখার কথা বলা হয়েছিলো, বাইরে এলে সে কোন ঘোড়া দেখতে পায় না।

মেরিনা ইসহাকের পাশে এসে দাঁড়ায়।

ঘোড়া কোথায়? ইসহাক জিজ্ঞেস করে।

আমি দেখছি। বলেই মেরিনা চলে যায়।

***

তুমি ঠিকই বলেছিলে- মেরিনা দলনেতাকে বললো- লোকটা পাথর, ঘোড়া ছাড়া কোন কথাই বলছে না। আমার কথার কোন পাত্তাই দিচ্ছে না।

তার কোন সন্দেহ জাগেনি তো? খৃস্টান দলনেতা বললো।

এ পর্যন্ত না- মেরিনা বললো- তবে তার মুখ থেকে আসল তথ্য বের করা যাচ্ছে না।

তার মানে তোমরা ব্যর্থ! খৃস্টান দলনেতা বললো।

 দলনেতা জানে না, বারবারা তাদের থেকে প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছে। সে প্রমাণ করে দিয়েছে, মেরিনা জাদুকর নয় যে, অসম্ভব কাজও করে দেখাবে। সুলতান আইউবীর এই গোয়েন্দাকে পলায়নের কাজে সহায়তা করার ইচ্ছা তার আছে। পারলে মজাটা জমতো ভালো। মেরিনার দম্ভ মাঠে মারা যেতো। কিন্তু তার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

ইসহাক আবারও তাবু থেকে বেরিয়ে আসে। মেরিনা ও তাদের নেতা দূরে একস্থানে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ইসহাক দৌড়ে তাদের নিকট চলে যায়। জিজ্ঞেস করে- ঘোড়া কোথায়?

কোথাও নেই- দলনেতা রাগান্বিত কণ্ঠে বললো- তোমার যাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ।

ইসহাক কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। তার সঙ্গে না আছে তরবারী, না খঞ্জর। ইসহাক তাদের আসল পরিচয় জেনে গেছে। তথাপি বললো- আমার অবাক লাগছে, মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তোমরা আমার পথ আগলে দাঁড়াচ্ছো কেন?

যদি লাঞ্ছনা থেকে রক্ষা পেতে চাও, তাহলে তাড়াতাড়ি বলল, তোমার সুলতানের জন্য কী বার্তা নিয়ে যাচ্ছিলে? খৃস্টান দলনেতা বললো।

শুধু এটুকু যে, আমাদের এক আমীর ইযযুদ্দীন নূরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবাকে বিয়ে করেছেন। ইসহাক উত্তর দেয়।

এই সংবাদ বাসি হয়ে গেছে- খৃস্টান দলনেতা বললো- তোমাদের সুলতান এ সংবাদ পেয়ে গেছেন দুমাস আগে। এখন তিনি সিরিয়ায় যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আসল কথা বলল।

তোমরা কি আসল কথা বলে থাকো? ইসহাক জিজ্ঞেস করে।

আসল তথ্য, সঠিক তথ্য তোমাকে দিতেই হবে- খৃস্টান দলনেতা বললো- আর তোমাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। তোমার সাথে অন্ত্র থাকলেও আমাদের লোকগুলোর মোকাবেলা করতে পারতে না। আমি তোমার বেঁচে থাকার এবং রাজপুত্রের ন্যায় বেঁচে থাকার বুদ্ধি দিতে পারি। আমার প্রস্তাব মেনে নাও। আমাদের সঙ্গে চলো। আমাদের জন্য সেই কাজ করো, যা সালাহুদ্দীন আইউবীর জন্য করেছো আর বিত্ত-বৈভবের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করো।

খৃস্টান দলনেতা মেরিনার প্রতি ইঙ্গিত করে বললো- এর মতো মেয়েরা তোমার সেবার জন্য একপায়ে খাড়া থাকবে। কী দরকার এভাবে বনে বাদারে মরুবনে ঘুরে মরবে!

আমি ক্রুশের জন্য কাজ করবো?

না করবে তো আমাদের কয়েদখানার অন্ধকার পাতাল কক্ষে বন্দি হয়ে থাকবে- খৃস্টান দলনেতা বললো- সেটাই হবে তোমার জন্য জাহান্নাম। তুমি মরবেও না, জীবিতও থাকবে না। আমরা তোমাকে এমন শাস্তি দেবো, যার কল্পনাও হবে তোমার জন্য ভয়ঙ্কর। আমাদের সঙ্গে চলো। ফিরে তো আর যেতে পারবে না।

তা তোমরা আমাকে বিশ্বাস করবে কীভাবে?- ইসহাক বললো- আমি তোমাদের দলভুক্ত হওয়ার পর তোমরা আমাকে আমারই এলাকায় প্রেরণ করবে। তোমরা কীভাবে নিশ্চিত হবে, আমি নিজ এলাকায় থেকে যাব কিংবা তোমাদের ধোকা দেবে না?

আমাদের নিকট তার ব্যবস্থা আছে- খৃস্টান দলনেতা বললো তুমি নিজ অঞ্চলের কথা বলছে। আমরা ইচ্ছে করলে তোমাকে তোমার ঘরের গোপন ঠিকানা থেকেও বের করে আনতে পারবো। সেই বিদ্যা আমাদের আছে। তোমার ধারণা কী, তোমাদের দেশে আমাদের যতো গুপ্তচর আছে, তাদের মধ্যে তোমাদের দেশের কোন লোক কি নেই? দশজন গোয়েন্দার একটি দলে আমাদের লোক থাকে মাত্র দুজন। বাকিরা তোমাদেরই ভাই। আমাদেরকে ধোঁকা দেবে এমন সাহস তাদের কারো নেই। এমন দুঃসাহস দেখানোর পরিণতি কী তা তারা জানে। কেউ এমন অপরাধ করলে আমরা শুধু তাকেই হত্যা করি না, প্রথমে তার স্ত্রী-সন্তানদের এক এক করে হত্যা করে লাশগুলো তার সামনে রাখি। তারপর তাকে হত্যা করি। আর যে আমাদের অনুগত থেকে কাজ করে, তার জন্য জগতটাকে স্বর্গ বানিয়ে দেই। কেউ ধরা পড়ে গেলে তার পরিজনের সম্পূর্ণ দায়ভার আমরা বহন করে নেই।

আমাকে ভাবতে দাও-ইসহাক কললো- এখান থেকে কবে রওনা হবে।

আজই- খৃষ্টান দলনেতা বললো- মধ্যরাতের পর। তুমি চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নাও। মনে রাখবে, প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে তার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হবে।

আমি জানি। ইসহাক বললো।

আর তোমাকে বলতে হবে, তুমি আইউবীর নিকট কী তথ্য নিয়ে যাচ্ছিলে। খৃষ্টান দলনেতা বললো।

বলবে- ইসহাক জবাব দেয়। পরে বলবো। মথাটা আউলা-ঝাউলা হয়ে আছে। একটু স্থির হয়ে নিই।

যাও, এখন বিশ্রাম নাও। খৃষ্টান দলনেতা বললো।

ইসহাক তুর্কি তাঁবুর দিকে চলে যায়।

***

নূরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী রোজি খাতুন এখন ইযুযুদ্দীনের স্ত্রী। মহিলার ব্যক্তিগত কোন চাওয়া-পাওয়া নেই। নেই কোন জৈবিক চাহিদাও। তবু এই বিয়েতে তিনি আনন্দিত। আনন্দিত এ জন্য যে, স্ত্রী হওয়ার সুবাদে ইযুদ্দীনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন এবং হাবের বাহিনীকে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সহযোগি হয়ে কাজ করাবেন। তার আশা ছিলো ইযুদ্দীন তাকে নিজের উপদেষ্টা নিযুক্ত করবেন।

কিন্তু বিবাহের প্রথম দিনই যখন রোজি খাতুন এ জাতীয় আলাপের অবতারণা করেন, দেখা গেলে তাতে ইযুদীনের কোন আগ্রহ নেই। কেমন যেনো বিরক্তি ভাব তার মধ্যে। তিনি রাতে রোজি খাতুনের সঙ্গে এক শয্যায় ঘুমালেনও না। থাকলেন মহলের অন্য এক কক্ষে।

রোজি খাতুন প্রাথমিকভাবে ধরে নিলেন, নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত বিধায় ঝামেলার কারণে মন-মানসিকতা ভালো নেই। দুচারদিন গেলে হয়তো স্বাভাবিক হয়ে যাবে। রাষ্ট্রীয় ঝক্কি-ঝামেলার প্রতি তার কোন অনুযোগ নেই। তিনি নিজেও তো রাষ্ট্রের ভাবনাই ভাবেন। নূরুদ্দীন জঙ্গীর জীবদ্দশায় তিনি বহু কাজ করেছেন। করেছেন জঙ্গীর মৃত্যুর পরও। দামেশকের যুবতী মেয়েদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে রীতিমতো একটি মহিলা বাহিনী গঠন করে ফেলেছিলেন।

রাত পোহারার পর রোজি খাতুন কক্ষ থেকে বের হন। হাঁটতে হাঁটতে মহলের ভেতরেই এক স্থানে চলে যান। বিশাল প্রাসাদ। তিনি দূরে একটি বাগিচা দেখতে পান। তাতে পাঁচ-ছয়টি যুবতী হাসি-তামাশা করছে।

রোজি খাতুন এখনো তাদের থেকে বেশ দূরে। এক মধ্যবয়সী মহিলা ধেয়ে এসে তাকে বললো- আপনি আপনার কামরায় চলে যান।

কেন?

মুহতারাম আমীরের এটাই নির্দেশ মহিলা বললো- চলুন, আপনার জায়গায় আপনাকে পৌঁছিয়ে দেই। ওখানেও আপনি ঘোরাফেরা করতে পারবেন। মাননীয় আমীরের কড়া নির্দেশ, আপনাকে যেনো এখানে আসতে না দেই।

আমি যদি সেই নির্দেশ অমান্য করি, তাহলে কী হবে। রোজি খাতুন পাল্টা প্রশ্ন করেন।

আমাকে গোস্তাখী করার সুযোগ দেবেন না- মহিলা অনুরোধের সুরে বললো- মনিবের আদেশ আমাকে মানতেই হবে।

আরেক মধ্যবয়সী মহিলা এসে হাজির হয়। সে রোজি খাতুনের পাশে এসে দাঁড়ায়। রোজি খাতুনকে সঙ্গে করে তার কক্ষে নিয়ে যায়। মহিলা বলতে শুরু করে- আমি আপনার সেবিকা। সর্বক্ষণ আপনার কাছে থাকার নির্দেশ পেয়েছি। আরো নির্দেশ পেয়েছি, আপনাকে যেনো নির্ধারিত সীমানার বাইরে যেতে না দেই।

রোজি খাতুন চমকে ওঠেন। সেবিকা বললো- আপনি ভয় পাবেন না। আমি জানি, আপনি কী স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে এসেছেন। আপনার প্রতিটি স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। আমাকে আপনার সহকর্মী মনে করুন। এই মহল খৃষ্টানদের কড়া নজরদারির মধ্যে আছে। আপনার পুত্র তাদের হাতের খেলা ছিলেন। বর্তমান আমীরও- যিনি এখন আপনার স্বামী- খৃষ্টানদের মদদপুষ্ট ও অনুগত হয়েই থাকবেন। এখানকার বহু উজির ও উপদেষ্টা খৃস্টানদের কেনা দাসে পরিণত হয়েছে।

সালাহুদ্দীন আইউবীর ব্যাপারে মহলের লোকদের অভিমত কী? রোজি খাতুন জিজ্ঞেস করেন। এখানে তার কোন প্রভাব আছে কি?

এতোটুকু নেই, যতোটুকু আছে খৃস্টানদের- সেবিকা গোপনীয়তা রক্ষা করে বললো- মহলে সুলতান আইউবীর গোয়েন্দা আছে। আমি নিজে সেই গ্রুপের সদস্যা। আমি আপনাকে ভালো করেই জানি। তাই নিজের পরিচয়টা দিয়েছিলাম। তবে সব কথা এখনই বলবো না। আপনি ইযযুদ্দীনের নিকট আপত্তি জানান। তিনি আপনাকে এই কক্ষের কয়েদী বানাবেন কেন।

তাতো করবোই।

 তার উদ্দেশ্যটা আপনার নিকট স্পষ্ট হয়ে যাবে- সেবিকা বললো পরবর্তী পরিস্থিতিই প্রমাণ করবে, আমি মিথ্যা বলিনি। সত্য হলো, ইযযুদ্দীনের আপনাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্য হলো, তিনি আপনাকে কয়েদী বানাবেন। আপনাকে নিজের মতো করে কাজ করতে দেবেন না। সুলতান সালাহুদ্দিন আইউবীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক চিরদিনের জন্য নষ্ট করা দিতে এবং আপনাকে দামেশক থেকে বের করে আনাই তার উদ্দেশ্য। দামেশকের মানুষ সুলতান আইউবীর সমর্থক ও অনুগত এ জন্য যে, আপনি ওখানে ছিলেন। এখন শত্রুরা দামেশকের জনগণকে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলবে। ফলে মুসলমানরা পুনরায় গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে এবং খৃস্টানরা অনায়াসে আমাদের ভূখণ্ডগুলো দখল করে নেবে।

এই তথ্যগুলো সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট পৌঁছানো যায় না? রোজি খাতুন জিজ্ঞেস করেন।

সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে- সেবিকা উত্তর দেয়- আমাদের দলের কমান্ডার অত্যন্ত বিচক্ষণ ও সাহসী এক ব্যক্তিকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তার নাম ইসহাক তুর্কি। আমি তাকে ভালো করে জানি। আপনার ছেলের মৃত্যুর পর খৃষ্টানদের পরিকল্পনা জানতে খৃষ্টানদের অঞ্চলে চলে গেছে। শীঘ্রই এসে পড়বে।

আমি কি তার সঙ্গে দেখা করতে পারবো? রোজি খাতুন জিজ্ঞেস করেন।

অবশ্যই। সেবিকা জবাব দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *