৭.২ আল-মালিকুস সালিহ

আলমালিকুস সালিহ

 জোহর নামায আদায় করে জায়নামাযে বসে তাসবীহ ঝপ করছেন রোজি খাতুন। খাদেমা কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে সমাহিত কণ্ঠে বললো খালাম্মা! আপনার মেয়ে শামসুন্নিসা আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছে। সঙ্গে আরো লোক আছে।

রোজি খাতুন প্রথমে অপলক নেত্রে খাদেমার প্রতি তাকিয়ে থাকেন। পরক্ষণে তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াতে শুরু করে।

মা-মেয়ের মাঝে যখন বিরহ ঘটে, তখন মেয়ের বয়স ছিলো ৯ বছর। এখন পনের। সংবাদ পাওয়া মাত্র মায়ের কই আমার বাছা বলে ছুটে বেরিয়ে এসে কলজেছেঁড়া ধন মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরার কথা ছিলো। কিন্তু মা কঠিন গলায় ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন- ও কেন এসেছে?

আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে খালাম্মা!- খাদেমা বললো- বোধ হয় ও আপনার কোলে ফিরে এসেছে।

রোজি খাতুন চুপ হয়ে যান। খাদেমা অপেক্ষমান দাঁড়িয়ে আছে। খানিক পর মাথা তুলে বললেন- ওকে ফিরে যেতে বলো। বলো, বিশ্বাসঘাতক ভাইয়ের নিকট চলে যাক। আমার চোখের সামনে আসবার দুঃসাহস যেনো ও না দেখায়।

আপনার ছেলে যখন ওকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন, ও তো তখন অবুঝ ছিলো মাত্র ৯ বছর- খাদেমা বললো- অবুঝ মেয়েটি কি জানতো ভাই তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।

আমি জানি, ওকে তার ভাই পাঠিয়েছে- রোজি খাতুন বললেন- কেন পাঠিয়েছে তাও বলতে পারি। আমার পুত্র গাদ্দার এবং আত্মমর্যাদাহীন। আমি মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবো না।

রোজি খাতুন নূরুদ্দীন জঙ্গী মরহুমের স্ত্রী। আপনারা পড়ে এসেছেন, ইসলামের অতন্দ্র প্রহরী নূরুদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যুর পর তার আমীর-উজির ও কতিপয় আমলা তাঁর পুত্র আল-মালিকুস সালিহকে রাজার আসনে আসীন করেন। তখন তার বয়স ছিলো এগার বছর। শামসুন্নিসা তার ছোট বোন। বয়স ৯ বছর। নূরুদ্দীন জঙ্গীর শাসনকালের কতিপয় আমীর ও দুর্গপতি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাগদাদের খেলাফত থেকে মুক্ত হয়ে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। সুলতান আইউবী সে সময়ে মিসর ছিলেন। জঙ্গী মরহুম ও সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ ছিলো, তারা তাদেরকে ভোগ-বিলাসিতা করতে দিচ্ছেন না। জীবনের সকল সুখ-আহ্লাদ পরিত্যাগ করে খৃস্টানদের প্রত্যয় পরিকল্পনাকে চুরমার করে ফিলিস্তীনকে মুক্ত করা এবং সালতানাতে ইসলামিয়ার সম্প্রসারণ ঘটানোই তাদের একমাত্র ব্রত। নূরুদ্দীন জঙ্গী ও সুলতান আইউবীর এই নিরানন্দ জিহাদী জীবনধারাকে বরণ করে নিতে পারেননি তাদের এই বিলাসী আমীর-উজীরগণ।

বিদ্রোহী এই আমীরদের উপর ক্রুসেডারদের প্রভাব ছিলো বিস্তর। সে কারণে ভোগ-বিলাসিতা তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য চরিত্রে পরিণত হয়ে যায়। খৃস্টানদের প্রেরিত নারী আর সোনা-মাণিক্য তাদের ঈমান ক্রয় করে ফেলেছিলো। নূরুদ্দীন জঙ্গী মৃত্যুবরণ করেছেন। এবার এই লোকগুলো সুলতার আইউবীকে পরাজিত করে তার শাসনের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছেন। তারা জঙ্গী মরহুমের অর্ধেক ফৌজকে বিদ্রোহী বানিয়ে ফেলেছেন। সংবাদ পেয়ে সুলতান আইউবী মাত্র সাতশ অশ্বারোহী নিয়ে দামেশক প্রবেশ করেন। জনগণ তাঁকে স্বাগত জানায়। নগরীর বিচারক তাঁকে ফটকের চাবি দিয়ে দেন। কিন্তু দামেশকের ফৌজের বিদ্রোহী অংশটি তাঁর মোকাবেলা করে। এটা ছিলো গৃহযুদ্ধ। নূরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী সুলতান আইউবীর সমর্থক ছিলেন। তিনি তাঁর স্বামীর অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করতে চাচ্ছিলেন।

এক রাতেই বিদ্রোহী বাহিনীর পরাজয় ঘটে। রাতেই আল-মালিকুস সালিহ, তার আমীর-অনুচরবৃন্দ, দু-তিনজন সালার এবং বিদ্রোহী বাহিনী দামেশক থেকে পালিয়ে হাল্ব চলে যায়। আল-মালিকুস সালিহ স্বীয় বোন শামসুন্নিসাকেও সঙ্গে নিয়ে যান। যেসব আমীর ও দুর্গপতি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, তন্মধ্যে হাররানের দুর্গপতি গোমস্তগীন এবং মসুলের আমীর সাইফুদ্দীন অন্যতম।

আল-মালিকুস সালিহ হাবকে নিজের রাজধানী বানিয়ে নেন। পরে এই নগরীটি তার, গোমস্তগীন ও সাইফুদ্দীনের সম্মিলিত বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে পরিণত হয়ে যায়। সকলের নিকট খৃস্টান উপদেষ্টা এসে পড়ে। তাদের সঙ্গে মদ আর এমন নারীও আসে, যারা শুধু অপরূপা সুন্দরীই নয়- গুপ্তচরবৃত্তি এবং চিন্তা-চেতনা বিধ্বংসের ওস্তাদও বটে। খৃস্টানরা তাদেরকে সহযোগিতা প্রদান করে প্রোপাগান্ডা মিশনকে এমনভাবে ব্যবহার করে যে, তাদের অন্তরে সুলতান আইউবীর বিরোধিতা ষোল কলায় পূর্ণ হয়ে যায়।

সুলতান নূরুউদ্দীন জঙ্গীর স্ত্রী দামেক থেকে যান। সেখানে তিনি মেয়েদের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণের আয়োজন করেন। বয়সে তিনি এখনও বার্ধক্যে উপনীত হননি। দুটি মাত্র সন্তান। দুজনই অপ্রাপ্তবয়স্ক। দুজনই তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তিনি বুকে পাথর বেঁধে নেন এবং এই বলে সান্ত্বনা নেন যে, স্বামীর সঙ্গে আমার সন্তানরাও মরে গেছে। কিন্তু মাঝে মধ্যে মমতা উথলে ওঠছে এবং চোখে অশ্রু নেমে আসছে। মায়ের মন বলে কথা।

সুলতান আইউবী হাব ও হাররানে গোয়েন্দা প্রেরণ করেছেন। তারা ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর রিপোর্ট প্রেরণ করছে। ওখানে খৃস্টানরা জোরে-শোরে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।

সুলতান আইউবী মিসর থেকে ফৌজ তলব করেন। দামেশকের বাহিনীর বৃহৎ অংশটি তাঁর সঙ্গে। তিনি প্রথমে বিদ্রোহী আমীরদের নিকট বার্তা প্রেরণ করেন, তোমরা ইসলামের মর্যাদার খাতিরে খৃস্টানদের হাতে খেলো না এবং তাদের সঙ্গ দিও না। এসো, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে তাদেরকে ইসলামী দুনিয়া থেকে উৎখাত করে ইউরোপ দখল করে নেই। কিন্তু ঈমান নিলামকারী আমীরগণ সুলতান আইউবীর দূতদের লাঞ্ছিত করে বিদায় দেন। গোমস্তগীন সুলতান আইউবীর দুজন দূতকে বন্দি করে ফেলেন।

সুলতান আইউবী তাদের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি হাবের উদ্দেশ্যে রওনা হন। রোজি খাতুন তাঁকে বিদায় জানানোর জন্য দামেশক থেকে অনেক দূর পর্যন্ত তার সঙ্গে যান। বিদায় জানিয়ে ফিরে আসার সময় বললেন- আমার পুত্র যদি আপনার তীর তরবারী-বর্শার আয়ত্ত্বে এসে পড়ে, তাহলে ভুলে যাবেন ও আমার সন্তান। ও বিশ্বাসঘাতক। ওর লাশ পাওয়া গেলে দাফন করবেন না। শৃগাল শকুনদের জন্য ফেলে রাখবেন।

মায়ের চোখ শুষ্ক। কিন্তু সুলতান আইউবীর দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়াতে শুরু করে। রোজি খাতুন বয়সে সুলতানের ছোট। তিনি সুলতানের প্রতি পরম শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে বিগলিত কণ্ঠে বললেন- আল্লাহ আপনাকে বিজয় দান করুন।

রোজি খাতুন অনেকক্ষণ পর্যন্ত বাহিনীর যাওয়া প্রত্যক্ষ করতে থাকেন।

এখান থেকেই মুসলমানদের গৃহযুদ্ধের দীর্ঘ ও খুনরাঙা যুগের সূচনা হয়। সুলতান আইউবীকে মুসলিম আমীরদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত যুদ্ধ লড়তে হয়েছিলো, আপনারা সে কাহিনী বিস্তারিত পড়েছেন। খৃস্টানদের পরিকল্পনা ছিলো, তারা নিজেরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে তাদেরকে আপসে লড়াবে এবং ঐক্যের সঙ্গে তাদের সামরিক শক্তিটাকেও নিঃশেষ করে দেবে। পাশাপাশি তারা হাসান ইবনে সাব্বাহর ঘাতকদের দ্বারা বহুবার সুলতান আইউবীর উপর সংহারী আক্রমণও করিয়েছিলো। প্রতিবারই আল্লাহ ইসলামের এই অতন্দ্র প্রহরীটাকে রক্ষা করেছেন।

তিন-চার বছর যাবত মুসলমানরা আপসে যুদ্ধ করে করে মরতে থাকে। মহান আল্লাহ প্রতিটি যুদ্ধে সুলতান আইউবীকে বিজয় দান করেন। এক যুদ্ধে নূরুদ্দীন জঙ্গীর স্ত্রীর প্রেরিত কয়েকশ মেয়েও যুদ্ধ করেছিলো এবং যুদ্ধের পট-পরিবর্তন করে দিয়েছিলো। কিন্তু সুলতান আইউবী কঠোর নির্দেশ জারি করে দেন, আগামীতে কোন নারী রণাঙ্গনে আসবে না।

সর্বশেষ যুদ্ধে সুলতান আইউবী হাল্ব পর্যন্ত পৌঁছে যান এবং হাবের প্রতিরক্ষা দুর্গ এজাজ দখল করে নেন। আল-মালিকুস সালিহ স্বীয় বোন শামসুন্নিসাকে কয়েকজন দূতের সঙ্গে সন্ধির প্রতিশ্রুতিসহ সুলতান আইউবীর নিকট প্রেরণ করেন এবং বোনের মাধ্যমে সুলতানের নিকট আর্জি পেশ করান, এজাজ দুৰ্গটা আমাদেরকে ফিরিয়ে দিন। সুলতান আইউবী জঙ্গীর মেয়েটিকে স্বস্নেহে গলায় জড়িয়ে ধরেন এবং আবেদন মঞ্জুর করে নেন। তিনি এজাজ দুর্গটি জঙ্গীর মেয়েকে দান করেন। কতিপয় শর্ত আরোপ করে আল-মালিকুস সালিহকে হাবের আধা স্বায়ত্বশাসন প্রদান করেন। তন্মধ্যে একটি শর্ত ছিলো, সুলতান আইউবীর যখন সৈন্যের প্রয়োজন হবে, আল-মালিকুস সালিহ তাঁকে সৈন্য দেবেন। গোমস্তগীনকে আল-মালিকুস সালিহ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে হত্যা করেন। বাদ বাকি আমীরগণ সুলতান আইউবীর আনুগত্য মেনে নেন।

সুলতান আইউবী কারাহেসারের শাসক ইবনে লাউনকে পরাজিত করেছিলেন। সে কাহিনী আপনারা পাঠ করেছেন। সে যুদ্ধে চুক্তি অনুযায়ী হাল্ব থেকেও ফৌজ এসেছিলো। তার অব্যবহিত পরই সুলতান আইউবী খৃস্টান সম্রাট বল্ডউইনকে- যিনি সুলতানের উপর আক্রমণ করতে এসেছিলেন অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। বল্ডউইন অল্পের জন্য বন্দি হওয়া থেকে রক্ষা পেয়ে যান এবং তার বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটে।

এখন সুলতান আইউবী উক্ত অঞ্চলেরই কোন এক স্থানে ছাউনি ফেলে অবস্থান করছেন। খৃষ্টানরা তাদের গুপ্তচরদের মাধ্যমে জানার চেষ্টা করছে, আইউবীর পরবর্তী অগ্রযাত্রা কোন্ দিকে হবে।

***

নবেম্বর ১১৮১ মোতাবেক রজব ৫৭৭ হিজরীর ঘটনা। আল-মালিকুস সালিহর বোন শামসুন্নিসা হাল্ব থেকে দামেশকে মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে। মেয়েটি যখন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তখন তার বয়স ছিলো ৮-৯ বছর। এখন সে পনের বছরের তরুণী। আল-মালিকুস সালিহর বয়স সতের-আঠার। শামসুন্নিসার সঙ্গে রক্ষী সেনারা আছে। খাদেমা নূরুদ্দীন জঙ্গীর স্ত্রীকে সংবাদটি জানায়। কিন্তু তিনি মেয়েকে সাক্ষাৎ দিতে অস্বীকৃতি জানান। খাদেমাও নারী। সে রোজি খাতুনকে মত করার জন্য বললো- মেয়েটা এতোদূর থেকে এতোদিন পর আসলো। আপনি তাকে ভেতরে ডেকে এনে বলে দিন, সে যেনো চলে যায়। স্নেহ বলতে একটা কথা তো আছে খালাম্মা!

আমার স্নেহ মরে গেছে। রোজি খাতুন বললেন।

এমন সময় এক তরুণী রোজি খাতুনের নামায কক্ষে প্রবেশ করে। মেয়েটার মাথার চুল, মুখমণ্ডল ও পরিধানের পোশাকে ধূলির স্তর জমে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, দীর্ঘ সফর করে এসেছে। রোজি খাতুন তার প্রতি দৃষ্টিপাত করে জিজ্ঞেস করেন- তুমি কে?

মেয়েটি নীরব দাঁড়িয়ে আছে। খাদেমা এক ধারে সরে গেছে। রোজি খাতুন ধীরে ধীরে সামনের দিকে অগ্রসর হন। তার বাহুদ্বয় আপনা-আপনি প্রসারিত হচ্ছে। মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো- তুমি আমার কন্যা, আমার শামসুন্নিছা। রোজি খাতুন ধীর পদবিক্ষেপে সম্মুখপানে অগ্রসর হচ্ছেন আর ক্ষীণ গলায় বলছেন- তুমি এতো বড় হয়ে গেছে! শামসুন্নিসা দরজা ঘেঁষে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে।

এখন মা-মেয়ের মধ্যখানে ব্যবধান দু-তিন পা। রোজি খাতুন থেমে যান। তার প্রসারিত বাহু গুটিয়ে আসে। এতোক্ষণ ঠোঁটে যে মুচকি হাসির আভা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল, তা উবে গেছে। দু-তিন পা অগ্রসর হওয়ার স্থলে দু-তিন পা পিছিয়ে যান। হাসি হাসি দাঁতগুলো রাগে কড়মড় করতে শুরু করে। মায়ের হৃদয়সাগরে মমতার যে ঢেউ উত্থিত হতে শুরু করেছিলো, তা মিলিয়ে যায়।

তুমি এখানে কেন এসেছো? মা চাপা অথচ রোষান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন।

মা!- শামসুন্নিছা দুবাহু প্রসারিত করে সম্মুখে এগিয়ে গিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বললো- আমি আপনার সঙ্গে মিলিত হতে এসেছি। আমি বারো দিনের পথ তিন দিনে অতিক্রম করে এসেছি মা!

কিন্তু কেন এসেছো? রোজি খাতুন উচ্চকণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন এবং বললেন- কাছে এসো না, দূরে দাঁড়িয়ে উত্তর দাও। আমি ক্রুসেডারদের ছায়ায় লালিত একটি মেয়েকে আমার কাছে ঘেঁষতে দিতে পারি না।

মা! আগে আমার দুটো কথা শোনো- শামসুন্নিছা অতিশয় মিনতির স্বরে বললো- আমার গায়ের ধুলোবালি দেখো।

এই ধুলা থেকে আমি মুজাহিদীনে ইসলামের রক্তের ঘ্রাণ পাচ্ছি রোজি খাতুন বললেন- সেই মুজাহিদদের রক্ত, যারা আমার পুত্রের বাহিনীর হাতে শহীদ হয়েছে। এটা গৃহযুদ্ধের রক্ত।

মা!- শামসুন্নিছা সম্মুখে এগিয়ে এসে মায়ের পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে। শামসুন্নিছা কাঁদছে আর বলছে- ভাইয়া মৃত্যুশয্যায় শায়িত মা। হয়তো এতোক্ষণে মারা গেছে। তিনি মা মা করে আপনাকে ডাকছেন। ভাইয়া বড় কষ্টে আছেন মা। তিনি আমাকে আপনাকে নিতে পাঠিয়েছেন। বলেছেন, তুমি মাকে নিয়ে আসো। আমি তার থেকে দুধের দাবি আর গুনাহ মাফ করাবো।

আমি তার দুধের দাবি ক্ষমা করতে পারি- রোজি খাতুন বললেন- কিন্তু তার সেই খুন কে ক্ষমা করবে, যা সে মুসলমানের সন্তান হয়ে মুসলমানদের ঝরিয়েছে? মা স্বীয় পুত্রের গাদ্দারীর অপরাধ ক্ষমা করতে পারেন না।

ভাইয়া আপনার একমাত্র পুত্র মা- শামসুন্নিছা বললো- তিনি আপনার মহান স্বামীর একমাত্র স্মৃতি।

কিন্তু সে পিতার মহত্ত্ব-মর্যাদাকে ক্রুসেডারদের পায়ের তলে নিক্ষেপ করেছে। রোজি খাতুন বললেন।

তিনি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে সন্ধি করে নিয়েছেন শামসুন্নিছা বললো- এখন আর তাদের আপসে কোন যুদ্ধ হবে না।

তুমি কি আমাকে কসম খেয়ে বলতে পারবে, তার কাছে কোন খৃস্টান নেই- রোজি খাতুন গর্জে ওঠে মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন- তার হেরেমে কি কোন ইহুদী-খৃস্টান মেয়ে নেই? এখন সে আঠার বছর বয়সের যুবক। তার নীচের ঘোড়াও অনুভব করতে পারে পিঠের আরোহী একজন পুরুষ। তুমি যদি আমাকে নিশ্চয়তা দিতে পারো, আমার পুত্রের দরবার থেকে খৃস্টানদের অশুভ ছায়া সরে গেছে, তাহলে বারো দিনের যে দূরত্ব তুমি তিন দিনে অতিক্রম করে এসেছো, সে পথ আমি দেড় দিনে অতিক্রম করে আমার মুমূর্ষ পুত্রের নিকট পৌঁছে যাবো।

ভাইয়ার এখন কোন নারীর প্রতি চোখ তুলে তাকাবারও শক্তি নেই মা- শামসুন্নিছা বললো- আপনি তার জন্য দুআ করুন।

আমি দুআ করবো না- রোজি খাতুন বললেন- অভিশাপও দেবো না।

আবেগে রোজি খাতুনের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। তবু থামছেন না। থামতে পারছেন না। বললেন- আমি কাউকে বদ দুআ দেই না। কিন্তু কোন মায়ের আহ মহান আল্লাহ উপেক্ষা করেন না। আমার ছেলে ক্ষমতার লোভে খৃস্টানদের ক্রীড়নক হয়ে হাজার হাজার মুসলমানকে শহীদ করেছে। কিয়ামতের দিন আমি তাদের মা, স্ত্রী ও কন্যাদের সম্মুখে লজ্জিত হতে পারবো না। আমার হৃদয় উজাড়করা মমতা তাদের জন্য নিবেদিত। খুনী পুত্রের প্রতি আমার একবিন্দু মমতা নেই।

ভাইয়া নিজের পাপের ক্ষমা প্রার্থনা করছেন মা। শামসুন্নিছা কান্না বিজড়িত কণ্ঠে চীৎকার করে বললো।

এও এক প্রতারণা মনে হচ্ছে- রোজি খাতুন বললেন- আমি জানি, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী হালব দখল করে নেয়ার পর সে তোমাকে এজাজ দুর্গ ভিক্ষা চাওয়ার জন্য আইউবীর নিকট পাঠিয়েছিলো। মহান সুলতান তোমাকে নিজের কন্যা মনে করে তোমাদেরকে দুৰ্গটা দান করেছেন। সে আগেই নিজে সুলতানের দরবারে আসলো না কেন? পরাজিত হওয়ার পর তো তাকে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হওয়ার প্রয়োজন ছিলো। নিজে এসে তরবারীটা আইউবীর পায়ে রাখা দরকার ছিলো। আইউবী তার শত্রু ছিলেন না। সে তো তাকে মামা ডাকতো। কিভু আসল ব্যাপার হচ্ছে, গাদ্দারদের ঈমানদারদের সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার সাহস হয়। যারা নিজেদের ঈমান নীলাম করে দেয়, তারা কাপুরুষ ও প্রতারক হয়ে থাকে। আমার পুত্র মালিকুস সালিহ গাদ্দার, কাপুরুষ, প্রতারক।

এতো পাষাণ হয়ো না মা। শামসুন্নিছা মিনতির সুরে বললো। এই গৃহযুদ্ধে যতো মুসলমান শহীদ হয়েছে, তাদের মায়েরা অন্তরে পাথর বেঁধে রেখেছে- রোজি খাতুন বললেন- তারা বলতে লজ্জাবোধ করছে, তারা যে সন্তানদেরকে ইসলামের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রেরণ করেছিলো, তারা আপসে যুদ্ধ করে মারা গেছে। সেই মায়েদের দায়িত্ব কে বহন করবে? আমার ছেলে!

তখন তো তিনি অনেক ছোট ছিলেন মা।

তাহলে আমার কাছেই থাকতো- রোজি খাতুন বললেন- আমি যা বলি শুনতো। যখনই তার শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছিলো, আমার নিকট ফিরে আসতো। হাবকে সুলতান আইউবীর হাতে অর্পণ করে দিতে। তাতে সে করেনি।… তুমি চলে যাও। ইসলামের মায়েরা যদি মমতার জালে আটকা পড়ে যায়, তাহলে আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার মতো কেউ থাকবে না। আমি মমতাকে গলাটিপে মেরে ফেলেছি। আমার দেহ শহীদ হয়ে গেছে।

মায়েরা কি গর্ভজাত কন্যাদেরকে এভাবে বিদায় করে দেয়! বলো মা, বলো! শামসুন্নিছা বললো।

তুমি আমার কাছে থাকো- রোজি খাতুন মেয়েকে বললেন- তবে শর্ত থাকবে, আমার সামনে কখনো ভাইয়ের নাম উচ্চারণ করবে না।

এটা সম্ভব নয় মা! এটা সম্ভব নয়- শামসুন্নিছা বললো- যে, ভাইটি তার বোনকে অপত্য স্নেহে লালন-পালন করে বড় করেছে, সে তার নাম মুখে নেবে না কেন মা!

 তাহলে সেই ভাইয়ের কাছেই চলে যাও- রোজি খাতুন বললেন তুমি খৃস্টানদের ছায়ায় বড় হয়েছে। এখানকার মেয়েদের দেখো, তারা ইসলামের জন্য জান কুরবান করতে প্রস্তুত। আমি যখন তাদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করি, তাদের রাগ-ধমক দেই, তখন ভয় লাগে কেউ বলে বসে কিনা, নিজের মেয়ের খবর নেই, আমাদেরকে ধমকায়। তুমি কি এই নোংরা বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারবে যে, আমার ছেলে খৃস্টানদের সঙ্গে মদপান করে এবং তার হেরেমে খৃস্টান ও ইহুদী মেয়েরা আছে?

শামসুন্নিছা মস্তক অবনত করে ফেলে। অভিযোগটা সে অস্বীকার করতে পারলো না।

যাও, হাত-মুখ ধুয়ে মায়ের ঘরে কিছু খেয়ে চলে যাও- রোজি খাতুন বললেন- ফিরে গিয়ে যদি আমার ছেলেটাকে জীবিত পাও, তাহলে বলবে, মা তোমার দুধের দাবি ক্ষমা করে দিয়েছেন; কিন্তু শহীদের রক্তের দাবি ক্ষমা করেননি। তাকে বলবে, তোমার বুকে যদি খৃষ্টানদের তীর বিদ্ধ হতো আর তুমি সালতানাতে ইসলামিয়ার পতাকাতলে জীবন কুরবান করে দিতে, তাহলে তোমার মা উড়ে এসে পৌঁছে যেতেন এবং তোমার মৃতদেহ বুকে করে দামেশক নিয়ে যেতেন এবং গর্বভরে বলতেন, এই আমার শহীদ পুত্রের মাজার। এখন আমি কী বলবো? মায়ের গর্ব তো পুত্র কেরে নিয়ে গেছে।

শামসুন্নিছা অনেকক্ষণ যাবত নীরব দাঁড়িয়ে থাকে। তার মাথাটা অবনত। পরক্ষণে যখন সে মাথা উঠায়, ততোক্ষণে উভয় গণ্ডদেশে ধূলির যে স্তর জমাট হয়েছিলো, তার মধ্যদিয়ে অশ্রুর নদীর ন্যায় রাস্তা হয়ে গেছে। হঠাৎ মেয়েটি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে হাঁটু গেড়ে বসে মায়ের আঁচল ধরে চুমো খেয়ে চোখের সঙ্গে লাগায়। সচেতন মেয়ে শামসুন্নিছা মাকে বুকে জড়িয়ে ধরেনি। কারণ, মায়ের নিষেধ আছে, খৃস্টানদের ছায়ায় লালিত মেয়ে যেনো তার কাছে না ঘেঁষে। শামসুন্নিছা খৃষ্টানদের ছায়ায় লালিত মেয়েই বটে। এই মহাসত্য শান্নিছা অস্বীকার করতে পারে না। শামসুন্নিছা উঠে দাঁড়িয়ে কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে বললো- তিনি আমার ভাই, আমার শৈশবের সঙ্গী। তিনি বোধ হয় বাঁচবেন না। আমি তার কাফন দাফনের পর আপনার কাছে ফিরে আসবো মা।

কী জন্য? রোজি খাতুন নিরতিশয় কঠিন ও তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন।

আমি এমন একটি পুত্রসন্তান জন্ম দেবো, যে আল্লাহর পথে শহীদ হবে- শামসুন্নিছা বললো- আপনার পুত্রের বিনিময়ে আমি এমন একটি পুত্রের জন্ম দেবো, যার কবরের উপর স্বস্নেহে হাত বুলিয়ে আপনি গর্বের সাথে বলবেন, এটি আমার নাতির মাজার।… আমি ফিরে আসবো মা। আমি ফিরে আসবো। আপনি আমার বিয়ের ব্যবস্থা করে রাখুন। আমি চোখ বন্ধ করে এসেছিলাম। এখন চোখ খুলে ফিরে যাচ্ছি। আমাকে অনুমতি দিন, আমি নিজ হাতে ভাইয়ার কাফন পরাতে পারি।… বিদায় মা, বিদায়।

শামসুন্নিছা পা টিপে টিপে ধীরে ধীরে স্বভয়ে ঘরে প্রবেশ করেছিলো। এখন বের হয়ে গেলো বুক ফুলিয়ে, ঘাড় উঁচু করে লম্বা পদক্ষেপে।

রোজি খাতুন মেয়ের প্রতি তাকিয়ে থাকেন। তিনি উঠে দরজার দিকে এগিয়ে যান। তাঁর মুখ থেকে চীৎকার বেরিয়ে এলো মেয়েটি আমার। তিনি দরজাটা সামান্য ফঁক করে বাইরের দিকে তাকান। বাইরে থেকে শামসুন্নিছার কণ্ঠ ভেসে আসে। মেয়েটি গর্জন করে বলছে- ইবনে আজর। সকল আরোহীকে ডাকো। জলদি করো। হাল্ব অভিমুখে রওনা হও। তাড়াতাড়ি করো।

মা দরজার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছেন। মেয়ে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে অশ্বারোহী কাফেলার সকলের সম্মুখে চলে যাচ্ছে। কাফেলার গতি তার আদেশে উত্তরোত্তর বেড়ে চলছে।

রোজি খাতুন দরজা বন্ধ করে দেন। চোখ তার অশ্রু-আবিল। খাদেমা ভেতরে প্রবেশ করলে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন- আহা, মেয়েটা না খেয়েই চলে গেলো।

***

মা-মেয়ের এই সাক্ষাতের ঘটনা ১১৮১ সালের নবেম্বর মাসের। সুলতান আইউবীর ইবনে লাউনকে পরাজিত করে তারই বাহিনীর সৈন্যদের দ্বারা তার দুর্গকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া এর দুবছর আগের ঘটনা। দুর্গের ধ্বংসাবশেষগুলো নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছিলো। তার পরপরই সুলতান আইউবী খৃষ্টান সম্রাট বল্ডউইনকে পরাজিত করেছিলেন। কৃতিত্বটা ছিলো মূলত একজন মুসলিম গোয়েন্দার। তারই সময়োচিত রিপোর্টের ভিত্তিতে সুলতান আইউবী এই সফল অভিযান পরিচালনা করেন।

এটি বল্ডউইনের দ্বিতীয় পরাজয়। এর আগে তিনি সুলতান আইউবীর ভাই আল-আদিলের হাতে এমনিভাবে পরাস্ত হয়েছিলেন। এবার আইউবী তার কোমর ভেঙ্গে দিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন। এখন আর তার উঠে দাঁড়াবার শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই।

কিন্তু ওখানে তিনি খৃস্টান সম্রাট একা তো নন। ইসলামী দুনিয়ায় একাধিক খৃস্টান বাহিনীর উপস্থিতি বিদ্যমান। তারা অন্তরের দিক থেকে একে অপরের প্রতিপক্ষ। কিন্তু সকলের শত্রু অভিন্ন। এ কারণে তারা পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করতেন। সকলেরই কামনা, কীভাবে একাকী অধিকতর অঞ্চলে দখল প্রতিষ্ঠিত করা যায়। এ লক্ষ্যেই বল্ডউইন একাকী আল-আদিল ও সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তার সৈন্য ও উপকরণের অভাব নেই। অস্ত্রও আছে বিস্তর। আছে বিপুলসংখ্যক শক্তিশালী উট-ঘোড়া। কিন্তু তারপরও হেরে গেলেন।

বিক্ষিপ্ত সৈনিকদেরকে একত্রিত করতে কিছু সময় লেগে যায় বল্ডউইনের। ইতিমধ্যে সংবাদ পান, সুলতান আইউবী ইবনে লাউনকে পরাজিত করে তার রাজত্ব ও সামরিক শক্তি দুর্বল করে দিয়েছেন। ইবনে লাউন আর্মেনীয় নাগরিক। আর্মেনীয়রা খৃস্টানদের মিত্র। তাদের পরাজয় খৃস্টানদের হৃদয়ে বেশ আঘাত হানে। সেই সঙ্গে বল্ডউইন আরো সংবাদ পান, ইবনে লাউনের রাজ্য তালখালেদ ও তার দুর্গ কারাহেসার আক্রমণে সুলতান আইউবীর ফৌজৈর সঙ্গে আল-মালিকুস সালিহর বাহিনীও ছিলো। এটি বল্ডউইনের জন্য একটি অতিরিক্ত দুঃসংবাদ। বল্ডউইন অস্থির হয়ে ওঠেন। তিনি এবং অন্যান্য খৃস্টান সম্রাটগণ অবশ্য জানেন, সুলতান আইউবী আল-মালিকুস সালিহকে পরাজিত করে তাকে নিজের অধীন করে নিয়েছেন। কিন্তু আল-মালিকুস সালিহ চুক্তি অনুযায়ী কাজ করবেন, তা তাদের ভাবনায় ছিলো না। না করাটা আস-সালিহর চরিত্র। তাদের ধারণা ছিলো, লোকটা উপরে উপরে সুলতান আইউবীর অনুগত হয়ে গেলেও খৃস্টানদের সঙ্গে বাঁধা গাঁটছড়া অটুট থাকবে। কিন্তু তাদের সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো।

বল্ডউইন জেরুজালেমে খৃস্টান সম্রাটদের হেডকোয়ার্টারে ফিরে যান। খৃস্টানদের আরেকটি হেডকোয়ার্টার আছে আক্ৰায়।

আপনারা কি জানেন, মুসলমানরা আবারও ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে? বল্ডউইন কমফারেন্সে খৃস্টান সম্রাট ও সেনানায়কদের উদ্দেশে বললেন- আল মালিকুস সালিহকে আপনারা আপনাদের জোটভুক্ত মিত্র মনে করছেন আর তিনি সালাহুদ্দীন আইউবীকে তার বাহিনী প্রদান করেছেন।

ইবনে লাউনের পরাজয় আমাদেরই পরাজয়- ফিলিপ অগাস্টাস বললেন- আপনারা যদি ওৎ পেতে বসে থাকার পরিবর্তে ইবনে লাউনের সাহায্যে এগিয়ে যেতেন এবং পেছন থেকে সালাহুদ্দীন আইউবীর উপর আক্রমণ করতেন, তাহলে পরাজয় আইউবীরই হতো।

দেখুন, সালাহুদ্দীন আইউবীর অগ্রযাত্রার গতি পরিবর্তন করে তালখালেদ অভিমুখে মুখ করার সংবাদ যেমন আপনারা কেউ জানতেন না, তেমনি আমিও জানতে পারিনি।

এটা আপনার গোয়েন্দা ব্যবস্থার দুর্বলতা- গাই অফ লুজিনান বললেন- আমরা অনেক দূরে ছিলাম। খোঁজ-খবর নেয়া এবং গোয়েন্দা ব্যবস্থা সম্পন্ন করার দায়িত্ব আপনার ছিলো। আপনি নিকটে ছিলেন। আইউবীর বাহিনী আপনার সন্নিকট দিয়ে অতিক্রম করেছে। কিন্তু আপনি টেরও পেলেন না। আপনি ওঁৎ পেতে চুপটি মেরে বসে রইলেন।

আমি জানতাম না, আমার সঙ্গে একজন মুসলমান আছে- বল্ডউইন বললেন- আমি তাকে গুরুত্বহীন লোক মনে করতাম। সে আমার কয়েদী ছিলো। পরে পালিয়ে গিয়ে সুলতান আইউবীকে আমার তথ্য প্রদান করে। সে যা হোক এখন আমাদের ভাবনার বিষয়, আইউবী- আস-সালিহর ঐক্য কীভাবে ভেঙ্গে দেয়া যায়।

আপনি কি মুসলমানদের দুর্বলতাগুলো ভুলে গেছেন নাকি উপেক্ষা করছেন?- এক খৃস্টান সম্রাট বললেন- আমরা যখন আস-সালিহর উপদেষ্টা, আমীর এবং সালারদেরকে উপঢৌকন ও বিলাস উপকরণ দিয়ে আমাদের হাতে এনেছিলাম, আস-সালিহ তখন কিশোর ছিলো। এখন যুবক হয়েছে। এখন তাকে হাতে আনা অধিকতর সহজ। আমরা আমাদের অস্ত্র ব্যবহার করি এবং বিশেষ উপহারটা দূত মারফত পাঠিয়ে দিই। আপনি যদি সামরিক শক্তির মাধ্যমে তাকে অনুগত বানাতে মনস্থ করে থাকেন, তাহলে এই ধারণা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিন। সুলতান আইউবীর বাহিনী এই অঞ্চলে উপস্থিত আছে। আপনারা যদি হাব আক্রমণ করেন, তাহলে সুলতান আইউবী তার সমগ্র বাহিনীর কমান্ড নিজ হাতে তুলে নেবেন। তিনি যদি আমাদের উপর জয়ী নাও হতে পারেন, তবু আমাদের এই ক্ষতিটা অবশ্যই হবে যে, আস-সালিহ আমাদের হাত থেকে আজীবনের জন্য বেরিয়ে যাবে। ফিলিস্তীন আমাদেরকে রক্ষা করতেই হবে। আমরা আমাদের বাহিনীকে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছি এবং লক্ষ্য রাখছি, সালাহুদ্দীন আইউবী কোন্‌দিকে মুখ করেন এবং তার পরিকল্পনা কী। এমতাবস্থায় আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারবো না। আপনি নিজের মতো করে আস-সালিহকে হাত করে নিন।

***

১৯৮০ সালে মসুলের গবর্নর সাইফুদ্দীন মৃত্যুবরণ করেন। তার স্থলে ইযযুদ্দীন মাসউদ শাসন ক্ষমতা হাতে নেন। একই বছর সুলতান আইউবীর ভাই শামসুদ্দৌলা তুরান শাহ ইস্কান্দারিয়ায় মারা যান। সুলতান মিসরে চলে যান। সেখানকার পরিস্থিতি খারাপ হতে চলেছে। তিনি নিজ বাহিনীকে স্বীয় ভাই আল-আদিলের কমান্ডে পেছনে রেখে যান।

এখন ১১৮১ সাল। বল্ডউইন তার বাহিনীর সেনা সংখ্যা পূরণ করে নিয়েছেন। তাদের প্রশিক্ষণও সম্পন্ন করেছেন। তিনি নিজ বাহিনীকে সুলতান আইউবীর কৌশল মোতাবেক সামরিক মহড়াও করিয়ে নিয়েছেন। এখন তিনি পরবর্তী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু তার আগে তাকে আল মালিকুস সালিহকে হাতে নেয়া আবশ্যক।

আল-মালিকুস সালিহ এখন কিশোর নয়- পরিণত যুক। রাষ্ট্র পরিচালনা বুঝতে শুরু করেছেন। তার উপদেষ্টা ও সালারগণ হচ্ছেন তার দুর্বলতা, যারা:তলে তলে খৃস্টানদের সহযোগী-সমর্থক। সুলতান আইউবীয় সঙ্গে তিনি সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছেন বটে; কিন্তু রাজত্বের পোকা এখনো মাথা থেকে বের হয়নি। এখনো তিনি স্বাধীন শাসক হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।

একদিন তার নিকট সংবাদ আসে, খৃস্টান সম্রাট বল্ডউইনের দূত এসেছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাকে ভেতরে নিয়ে আসার অনুমতি প্রদান করেন। এই দূত নাশকতার ওস্তাদ এবং মানবীয় দুর্বলতা বিষয়ে ওয়াকিবহাল ব্যক্তি। সে আল-মালিকুস সালিহকে জানায়, আপনার জন্য কিছু উপহারও নিয়ে এসেছি।

কী উপহার? মহা মূল্যবান হীরা-জহরত ও স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি একটি বাক্স। দুটি তরবারী। পঁচিশটি উন্নত জাতের ঘোড়া। আর? আর একটি মেয়ে।

আস-সালিহ বাইরে গিয়ে ঘোড়াগুলো দেখেন। হীরা-জহরত স্বর্ণমুদ্রাগুলোও দেখেন। কিন্তু যে উপহারটির উপর তার চোখ আটকে যায়, সেটি হলো মেয়ে।

আস-সালিহ অনেকক্ষণ যাবত মেয়েটির প্রতি তাকিয়ে থাকেন। তার উঠতি যৌবনের সবগুলো দুর্বলতা একটি যাদুর রূপ ধারণ করে বিবেকের উপর প্রভাব বিস্তার করে ফেলে। তিনি হাড়ে হাড়ে অনুভব করছেন, তিনি যৌবনে পদার্পণ করেছেন এবং তিনি টগবগে এক যুবক।

দূত আস-সালিহর হাতে বল্ডউইনের একটি বার্তা প্রদান করে। পত্ৰখানা আরবীতে লেখা। কিন্তু খৃষ্টান সম্রাটের পত্রের প্রতি তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। মেয়েটি তার কল্পনার চেয়েও বেশি রূপসী।

দূত পত্ৰখানা খুলে অন্য চিন্তায় বিভোর আস-সালিহর সম্মুখে রেখে দেয়। এবার তার চৈতন্য ফিরে আসে। তিনি পত্রখানা পাঠ করেন। বল্ডউইন লিখেছেন–

প্রিয় হালবের গবর্নর আলমালিকুস সালিহ! আমি দূত ও উপহারের পরিবর্তে বাহিনী প্রেরণ করতে পারতাম। কিন্তু আমি আপনার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ প্রয়োজন অনুভব করি না। আপনি আমার বন্ধু ও সন্তানতুল্য। আপনি যখন কিশোর ছিলেন এবং সালাহুদ্দীন আইউবী আপনার সালতানাতের উপর দখল প্রতিষ্ঠিত করতে এসেছিলেন, তখন আমরা আপনাকে সাহায্য করেছিলাম। আমি আক্ষেপে ফেটে যাচ্ছি, গোমস্তগীন ও সাইফুদ্দীন আপনাকে বন্ধুত্বের ধোঁকায় রেখেছে। আমরাও তাদের প্রতারণা ধরতে পারিনি। আপনি যদি একা হতেন, তাহলে আপনার বাহিনী পরাজিত হতো না। আপনি দেখেছেন, গোমস্তগীন কত বড় ধোকাবাজ ছিলো, যার ফলে আপনি তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। সাইফুদ্দীনও আপনাকে বরাবরই ধোকার মধ্যে রেখেছে। সে হাবের উপর দখল প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছিলো। আমরা তাকে তার প্রত্যয়-পরিকল্পনা থেকে বিরত রেখেছি।….

অবশেষে আপনি সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট পরাজয়বরণ করেছেন, যা আপনাকে তার আনুগত্য মেনে নিতে বাধ্য করেছে। আপনি এতোই অসহায় হয়ে পড়লেন যে, আপনি ইবনে লাইনের উপর আক্রমণ করার জন্য তাকে সৈন্য দিতে বাধ্য হলেন। আমি ভালো করেই জানি, আপনার ন্যায় একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন যোদ্ধা এই অপমান সহ্য করতে পারেন না। কিন্তু আপনি তো সঙ্গীহীন ছিলেন। আমি নিজেও যুদ্ধ-বিগ্রহ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। অন্যথায় আমি আপনার সাহায্যে ধেয়ে আসতাম। এখন আমি আপনাকে নিয়ে ভাববার সুযোগ পেয়েছি। আপনার ভুলে গেলে চলবে না, সালাহুদ্দীন আইউবী আপনাকে এমন এক স্বায়ত্তশাসন দান করেছেন, যার অর্থ দাসত্ব। তিনি আপনাকে ধীরে ধীরে গোলামে পরিণত করছেন। তিনি ইযযুদ্দীনের সাহায্যার্থে আর্মেনীয়দের পরাজিত করেছেন এবং তাকে নিজের অনুকম্পার শিকলে বেঁধে ফেলেছেন। সমস্ত ছোট ছোট আমীর তার আনুগত্য মেনে নিয়েছে। এখন তার দৃষ্টি আপনি ছাড়াও মসুল ও হাররানের উপর নিবদ্ধ।…

ভেবে দেখুন, তিনি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মিসর থেকে সৈন্য নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি তালখালেদের উপর গিয়ে আক্রমণ করলেন এবং আপনার থেকেও সৈন্য নিলেন। এখন আবার মিসর ফিরে গেছেন। তার এই যাওয়ার রহস্য কী? গোয়েন্দারা আমাদেরকে অবহিত করেছে, তিনি বিপুল পরিমাণ ধন-ভাণ্ডার নিয়ে গেছেন। সেগুলো কায়রোতে রেখে আবার ফিরে আসবেন। বলুন তো, আপনাকে তিনি কী দিয়েছেন? আপনার বাহিনীকে তিনি গনীমতের সম্পদের কতো অংশ দিয়েছেন? তিনি জেরুজালেম অভিমুখে কেন অগ্রযাত্রা করলেন না? আপনি কি জানেন, তিনি আর্মেনীয়দের কয়েকটি মেয়ে সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন?…

আমি জানি, এসব প্রশ্ন আপনার মস্তিষ্ককে আউলা-ঝাউলা করে দেবে। আপনার নিকট সালাহুদ্দীন আইউবীর চরিত্র এবং তার নিয়তের প্রকৃতি স্পষ্ট হয়ে যাবে। আপনার সঙ্গে আমাদের কোন শত্রুতা নেই। আমরা এই ভূখণ্ডে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত করতে এসেছি। আমরা এও জানি, সুলতান আইউবী আমাদেরকে এখান থেকে উৎখাত করে ইউরোপের উপর আক্রমণ করার এবং নিজের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটানোর ভাবনা ভাবছেন। তিনি আপনাকে এবং অন্যান্য আমীরদেরকে নিজের থলের মুদ্রা জ্ঞান করেন। আপনি যদি নিজের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা না করেন, তাহলে আপনার নাম-চিহ্ন মুছে যাবে। এখানে আমরা ইউরোপের প্রতিরক্ষার জন্য যুদ্ধ করছি। আমার বক্তব্য যদি আপনার বুঝে এসে থাকে, তাহলে আমাকে উত্তর দিন। আমি আপনাকে উপদেষ্টা পাঠিয়ে দেবো, যে আপনার আর্থিক ও সামরিক প্রয়োজনের পরিসংখ্যান নিয়ে আমাকে অবহিত করবে। আমি যে ঘোড়াগুলো প্রেরণ করেছি, এগুলো আপনার জন্য উপহার। আপনার ফৌজের জন্য আমি এমন হাজার হাজার ঘোড়া দিতে পারি। ইউরোপ থেকে আমি নতুন অস্ত্র চেয়ে পাঠিয়েছি। তাও আপনাকে দিয়ে দেবো। আপনি সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে কৃত চুক্তি ভঙ্গ করবেন না। উপরে উপরে তার অনুগত থেকেই আপনি নিজের প্রতিরক্ষা শক্ত করুন। আমরা আপনার সঙ্গে আছি।

ইহুদীদের চিত্তহারী রূপসী এই মেয়েটি শুরুতেই আল-মালিকুস সালিহর তরুণ মস্তিষ্কটা কজা করে ফেলে। বার্তার প্রতিটি শব্দ যাদুর ন্যায় তার হৃদয়ে গেঁথে যায়। তিনি দূতের বিশ্রাম ও খাওয়ার এমন আয়োজনের নির্দেশ প্রদান করেন, যেনো বল্ডউইন নিজেই এসে হাজির হয়েছেন। তারপর তিনি নিজেকে মেয়েটির হাতে সপে দেন। আল-মালিকুস সালিহ এর চেয়েও অধিক রূপসী মেয়ে দেখেছেন। কিন্তু এই মেয়েটি অপূর্ব ভাবভঙ্গি আর মুচকি হাসি তার রূপে অবিশ্বাস্য এক যাদুকরি ক্রিয়া সৃষ্টি করে রেখেছে।

আস-সালিহ অন্ধ হয়ে যান।

 রাতে যখন মেয়েটি আল-মালিকুস সালিহর শয়নকক্ষে প্রবেশ করে, তখন তার হাতে পিপা ও পেয়ালা। এগুলোও তার সঙ্গে উপহার হিসেবে আসা। মেয়েটি তাকে বললো, এগুলো ফ্রান্সের মদ, যা কিনা শুধু সম্রাটদের জন্যই প্রস্তুত হয়ে থাকে।

আপনার হেরেমে কিছুই তো নেই- মেয়েটি বললো- আপনি কি প্রয়োজন মনে করেন না আপনার হেরেমটা সজ্জিত হোক?

আমার হেরেমের জন্য তুমি একাই যথেষ্ঠ। আস-সালিহ বললেন। আমি আমার ন্যায় আরো মেয়েদের দ্বারা হেরেম ভরে দেবো- মেয়েটি মদের পেয়ালাটা আস-সালিহর হাতে দিতে দিতে বললো- এটা কি সত্য, সালাহুদ্দীন আইউবীর একজনই স্ত্রী এবং তিনি কাউকে হেরেমে নারী রাখার অনুমতি দেন না?

হ্যা- আস-সালিহ জবাব দেন- এটাও ঠিক, তিনি মদপানের অনুমতি দেন না।

 আপনি তাহলে জানেন না তার একটি গোপন হেরেম আছে, যাতে অসাধারণ সুন্দরী মেয়েরা আছে। তাদের মধ্যে মুসলমান আছে, ইহুদী খৃষ্টানও আছে। মেয়েটি বললো।

ঝাড়বাতির রঙিন ও হাল্কা মিষ্টি আলো আর ফ্রান্সের মদের নেশার মধ্যে এই মেয়েটি আপাদমস্তক যাদুর রূপ ধারণ করে আস-সালিহকে প্রভাবিত করে চলেছে। ক্ষণিকের মধ্যেই তিনি মেয়েটির রেশমী চুলের শিকলে বন্দী হয়ে যান।

রাত পোহাবার পর চোখ মেলে আল-মালিকুস সালিহ মেয়েটিকে বললেন- এখানে আমার এক বোন আছে। তুমি তার মুখোমুখি হবে না। বিবাহ ছাড়া কোন মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়া সে পছন্দ করে না। তোমার আমার এই সম্পর্ক সে মেনে নেবে না। সুযোগ মতো আমি তাকে বলে দেবো, তুমি মুসলমান এবং আমার সঙ্গে বিয়ে বসতে এসেছে।

বোনকে মুক্ত করে দেন না কেন?- মেয়েটি বললো- তাকে পুরুষদের। সঙ্গে উঠা-বসা করতে দিন। সে রাজকন্যা। আপনি রাজা। সালাহুদ্দীন আইউবী আপনার পদমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করছেন। আমরা আপনার বোনকে আলাদা একটা রাজ্য দিয়ে রাণী বানিয়ে দেবো।

আল-মালিকুস সালিহ স্বপ্নের রাজা হয়ে যান।

***

কী সংবাদ এনেছো? বল্ডউইন মদমাতাল কণ্ঠে দূতকে জিজ্ঞেস করেন।

 আমি কখনো ব্যর্থ হয়ে ফিরেছি নাকি? দূত জবাব দেয়। সে আল মালিকুস সালিহর প্রাসাদে চার দিনের দীর্ঘ সফর শেষে এইমাত্র এসে পৌঁছেছে। সে বললো- মুসলমানদের উপর সামরিক অভিযান পরিচালনা করে আপনারা অযথা জীবন ও সম্পদহানি করছেন। একটি মেয়েই তো মুসলমানদের শাসকদের হাত থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে আনতে যথেষ্ঠ।

মেয়ে নয়- বল্ডউইন বললেন- মুসলমানকে যদি তুমি একটি মেয়ের শুধু কল্পনা দাও, তাতেই সে নিজের নেরু-বদ ভুলে গিয়ে সেই কল্পনার গোলাম হয়ে যায়। এবার বলো, তুমি কী করে এসেছো?

তিনি লিখিত উত্তর দেননি- দূত বললো- সালাহুদ্দীন আইউবীর গোয়েন্দা ও কমান্ডো সেনারা সর্বত্র গিজ গিজ করছে। লিখিত উত্তয় দিলে পাছে ধরা পড়ে যায় কিনা। তিনি আপনার সব বক্তব্য মেনে নিয়েছেন। তিনি সালাহুদ্দীন আইউবীর সমর্থক নন। তবে সন্ত্রস্ত এবং আইউবীর মোকাবেলায় নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করছেন। আপনার বার্তা তাকে অনেক সাহস যুগিয়েছে। তিনি বলেছেন, আপনি আপনার উপদেষ্টা পাঠিয়ে দিন, তবে তাকে যেতে হবে বণিকের বেশে। ওখানকার সকলকে বলবে, সে উচ্চ পর্যায়ে ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনা করতে এসেছে।

তার মনে কোন সন্দেহ নেই তো? বল্ডউইন দূতকে জিজ্ঞেস করেন।

আপনি তাকে ইহুদীদের যে উপহারটা প্রদান করেছেন, সে সন্দেহ করার কোন অবকাশ থাকতে দেয়নি- দূত জবাব দেয়- আমি সেখানে চারদিন অবস্থান করেছি। এ সময়টায় আমি, তার সালারদের ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলিত হয়েছি, কথাবার্তা বলেছি ও মতবিনিময় করেছি। তাদের অনেকে আইউবীর সমর্থক। আমি তাদের দুজনকে হাত করে নিয়েছি। তাদেরকে আমি বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছি এবং লুকিয়ে লুকিয়ে উপহারও দিয়েছি। ওখানে সালাহুদ্দীন আইউবীর গোয়েন্দাও আছে। সে কারণে কোন কথাই গোপন রাখা সম্ভব হয় না। তথাপি আল-মালিকুস সালিহকে আপনারই লোক মনে করুন। যে দুজন সালারকে হাত করে এসেছি, মেয়েটির সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। সে তার দায়িত্ব পালন করবে। আপনি তাড়াতাড়ি উপদেষ্টা পাঠিয়ে দিন।

এই দূত শুধু দূতই নয়; মানুষের মনস্তত্ব নিয়ে খেলা করার দক্ষ ওস্তাদ। সে বললো- সালাহুদ্দীন আইউবী তার অফিসার-কর্মকর্তা ও দেশের জনগণকে উপদেশ দিয়ে থাকেন, রাজত্বের স্বপ্ন-মোহ, সম্পদ ও নারী এই তিনটি বিষয় মানুষের ঈমানকে নিঃশেষ করে দেয়। এই তিনটি বস্তু যখন একজন বিজ্ঞ আলেমেরও সম্মুখে এসে হাজির হয়, তারও ঈমানের পা উপড়ে যায়। এটা মানবীয় দুর্বলতা। তখন তাকে ওয়াজ শুনিয়েও কোন লাভ হয় না।

বল্ডউইন তখনই তিনজন উপদেষ্টা ঠিক করে ফেলেন। খাষা রওনা হয়ে যায়।

***

ব্যবসার পণ্য বোঝাই অনেকগুলো উটের একটি কাফেলা হবে আল মালিকুস সালিহর প্রাসাদের সামান্য দূরে এসে দাঁড়িয়ে যায়। কাফেলায় জনাকতক লোক। তন্মধ্যে তিনজন এ্যারাবিয়ান পোশাক পরিহিত। উটগুলোকে দাঁড় করিয়ে রেখে এই তিনজন প্রাসাদের দিকে হাঁটা দেয়। দারোয়ান তাদের থামিয়ে দেয়। তারা নিজেদের ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে আলোচনার জন্য আল-মালিকুস সালিহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছে বলে জানায়। বললো, আমরা হীরা এবং অন্য আরো মহা-মূল্যবান কিছু পণ্য নিয়ে এসেছি, যেগুলো রাজা-বাদশাগণ ক্রয় করে থাকেন। তাছাড়া আমরা আপনাদের রাজার সাথে হাবের সঙ্গে ব্যবসা করার ব্যাপারেও আলোচনা করবো। রক্ষী কমান্ডার ইবনে খতীব তাদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে। আলাপ জমিয়ে তাদেরকে মুক্তমনে কথা বলার সুযোগ করে দেয়। সে লোকগুলোর চোখের সবুজ ও নীলাভ বর্ণ এবং মুখশ্রীটা গভীরভাবে পরখ করে দেখে। তার জানা আছে, ব্যবসা সংক্রান্ত আলাপ আলোচনা কখনো সরাসরি রাজার সঙ্গে হয় না।

ইবনে খতীব লোকগুলোকে সরিয়ে নিয়ে যায়।

আপনাদের আসল উদ্দেশ্যটা বলুন। ইবনে খতীব বললো।

বলেছি তো আমরা ব্যবসায়ী। পণ্য বিক্রি করতে এবং আপনাদের রাজার সঙ্গে আলোচনা করতে এসেছি। লোকগুলো বললো।

জেরুজালেম থেকে এসেছেন, নাকি আক্ৰা থেকে? ইবনে খতীব জিজ্ঞেস করে।

আমরা ব্যবসায়ী- একজন উত্তর দেয়- আমরা সব দেশেই যাই। জেরুজালেম-আক্ৰায়ও যাই। আপনার সন্দেহটা কী?

না, আমার কোন সন্দেহ নেই- ইবনে খতীব বললো- আমি নিশ্চিত, আমি আপনাদের তিনজনকেই চিনি। তবে আপনারা আমাকে চেনেন না। আমি আপনাদেরই লোক। আমার নাম ইবনে খতীব। এটা আমার আসল নাম নয়। হারমান আমাকে ভালো করেই জানেন।

ইবনে খতীব কিছু সাংকেতিক শব্দ উচ্চারণ করে, যেগুলো খৃস্টানদের গুপ্তচররা পরস্পর পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য ব্যবহার করে থাকে। ব্যবসায়ীগণ- যারা মূলত বল্ডউইনের প্রেরিতে উপদেষ্টা মুচকি হাসে। তাদের বলে দেয় হয়েছিলো, আল-মালিকুস সালিহর দরবারে খৃস্টান গোয়েন্দা আছে। ইবনে খতীব নিশ্চিত করে দেয়, সে তাদেরই গুপ্তচর।

আপনারা কি সেই উদ্দেশ্যেই এসেছেন?- ইবনে খুতীব জিজ্ঞেস করে আমাকে বলতে সমস্যা নেই। অন্যথায় আপনাদের ভেতরে যেতে দেয়া হবে না।

হ্যাঁ- একজন অস্ফুট স্বরে বললো- সে উদ্দেশ্যেই। আচ্ছা, এই প্রাসাদে সালাহুদ্দীন আউইবীর চর আছে কি?

আছে- ইবনে খতীব উত্তর দেয় তবে তাদের উপর আমরা নজর রাখছি। আমরা আপনাদেরকে তাদের থেকে লুকিয়ে রাখবো। কিন্তু আপনাদের উদ্দেশ্য এবং তৎপরতা সম্পর্কে আমাকে পুরোপুরি অবহিত করতে হবে।

গোপন সাঙ্কেতিক শব্দ এবং বর্ণনাভঙ্গি থেকে আগন্তুক তিন খৃস্টান নিশ্চিত হয়ে যায়, ইবনে খতীব তাদেরই লোক। তারা ইবনে খতীবকে তাদের উদ্দেশ্য খোলাখুলি ব্যক্ত করে। ইবনে খতীব ভেতরে ঢুকে আল মালিকুস সালিহকে সংবাদ জানায় তিনজন ব্যবসায়ী আপনার সাক্ষাৎ কামনা করছে।

তুমি কি রক্ষী বাহিনীর নতুন কমান্ডার আল-মালিকুস সালিহ জিজ্ঞেস করেন।

 জ্বি হুজুর। ইবনে খতীব জবাব দেয়।

 বাড়ি কোথায়?

ইবনে খতীব একটি গ্রামের নাম বলে। আল-মালিকুস সালিহ বললেন আমি যখন তখন যার তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারি না। ভবিষ্যতে খেয়াল রাখবে। আচ্ছা, তাদেরকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।

ইবনে খতীব বেরিয়ে গিয়ে আগন্তুকদের ভেতরে যেতে বলে এবং বিশেষ ভঙ্গিতে চোখ টিপে বলে দেয় অনেক সাবধানে কথা বলবেন।

***

এখন রাত। ঈশার নামাযের পর। ইবনে খতীব জামে মসজিদের ইমামের নিকট উপবিষ্ট। আরো দুজন লোক আছে।

এখন আর কোন সন্দেহ থাকলো না যে, আল-মালিকুস সালিহ পুনরায় খৃষ্টানদের ফাঁদে চলে আসছেন- ইবনে খতীব বললো- আমি আপনাকে প্রথমে একজন দূতের আগমন এবং উপহারের সংবাদ অবহিত করেছিলাম। সেসব খৃস্টানদের পক্ষ থেকে এসেছিলো। উপহারের মধ্যে একটি অপরূপা সুন্দরী মেয়েও ছিলো। আজ প্রমাণিত হয়ে গেলো, সেই দূত বল্ডউইনের পক্ষ থেকে এসেছিলো। আজ তিনজন ব্যবসায়ী আল মালিকুস সালিহর সঙ্গে ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনা করতে এসেছে। আপনি জানেন, আমি দুই বছর বায়তুল মুকাদ্দাসে খৃস্টানদের মাঝে অবস্থান করে গুপ্তচরবৃত্তি করেছি। আজ যে তিন ব্যক্তি এসেছে, তাদের চেহারা এবং বর্ণনাভঙ্গি প্রমাণ করছে, তারা যে এ্যারাবিয়ান পোশাক পরিধান করেছে, এটা তাদের ছদ্মবেশ। আমি তাদেরই লোক দাবি করে তাদের আসল রূপ দেখে নিয়েছি। বায়তুল মুকাদ্দাসের চরবৃত্তি আজ আমাকে অনেক উপকার করেছে। আমি তাদের সঙ্কেত জানি, বিশেষ ইঙ্গিতও বুঝি। মুহতারাম আলী বিন সুফিয়ানের প্রশিক্ষণের সুফল আজ আমি চোখে দেখেছি।

ইবনে খতীব সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর গুপ্তচর। অল্প কদিন হলো হাবে এসেছে এবং আল-মালিকুস সালিহর এমন একজন নায়েব সালারের মাধ্যমে এখানকার রক্ষী বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত হয়েছে, যিনি মূলত সুলতান আইউবীর সমর্থক। ইবনে খতীব আলী বিন সুফিয়ানের একজন বিচক্ষণ ও নির্ভীক গোয়েন্দা। বায়তুল মুকাদ্দাসে খৃস্টান ম্রাট ও সেনা অধিনায়কদের হেডকোয়ার্টারে দুবছর অবস্থান করে সফল গুপ্তচরবৃত্তি করে এসেছে।

হা্লবের জামে মসজিদের এই ইমাম সে সকল গোয়েন্দাদের কমান্ডার, সুলতান আইউবী যাদেরকে হাবে প্রেরণ করে রেখেছেন। যার রিপোর্ট দেয়ার প্রয়োজন হয়, ঈশার নামাযে মসজিদ গিয়ে ইমামকে দিয়ে আসে। ইমাম এই সময়টায় গোয়েন্দাদের রিপোর্ট নেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকেন। সেসব রিপোর্টের সত্যতা ও বাস্তবতা যাচাই করে তিনি সুলতান আইউবীর নিকট প্রেরণ করেন। এখন ইবনে খতীব অতিশয় মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট নিয়ে ইমামের সম্মুখে বসা।

এমন সময় এক মধ্যবয়সী মহিলা এসে হাজির হয়। মহিলা মাথা থেকে পা পর্যন্ত কালো বোরকায় ঢাকা। ভেতরে প্রবেশ করেই সে বোরকাটা খুলে ফেলে। বোরকার ভেতরের মানুষটাকে দেখেই সকলে হেসে ওঠে। মহিলা আল-মালিকুস, সালিহর চাকরানী। আস-সালিহর শয়ন কক্ষের দেখাশোনা করা তার দায়িত্ব। তার সকল গোপন তথ্য এই মহিলার পেটে। সেদিনই সে ইমামকে রিপোর্ট করেছিলো, খৃস্টানদের পক্ষ থেকে আল মালিকুস সালিহর নিকট একটি মেয়ে এসেছে, যে কিনা আকার, গঠন, শরীর এবং অঙ্গসৌষ্ঠব ও মুখের ভাষায় আপাদমস্তক একটা যাদু, যার থেকে রক্ষা পাওয়ার শক্তি ইয়া বড় অলি-দরবেশেও নেই। রূপের এক মূর্ত প্রতীক মেয়েটি। চাকরানী ইমামকে জানিয়ে রেখেছে, আস-সালিহর নিয়মতান্ত্রিক হেরেম নেই। কিন্তু নারী ছাড়া তার রাত কাটে না। নারী তার দুর্বলতায় পরিণত হয়েছে।

… কিন্তু আমার কাছে মেয়েটা ইহুদী মনে হচ্ছে- চাকরানী বললো আস-সালিহকে সে নিজের গোলাম, বরং কয়েদী বানিয়ে নিয়েছে। লোকটা এমনই পাগল হয়ে গেছে যে, গর্বভরে আমাকে জিজ্ঞেস করে মেয়েটাকে কি তোমার পছন্দ হয়? আমি কি ওকে বিয়ে করে নেবো? আমি একবার বলেছিলাম, আপনার বোনকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, সে কী বলে। কিন্তু তিনি আমাকে শক্তভাবে বলে দেন, খবরদার ওকে কিছু বলবে না।

আস-সালিহর চাকরানীও গোয়েন্দা। সে ইমামকে বিস্তারিত জানায়, আল-মালিকুস সালিহ পুরোপুরি মেয়েটির জালে আটকা পড়ে গেছেন। এখন আর অন্য কোন নারী তার শয়নকক্ষে ঢুকতে পারে না। কিন্তু ভাবনার বিষয় হলো, এখনই সুলতান আইউবীকে রিপোর্ট করবো নাকি দেখবো খৃস্টানরা কী করে কিংবা আস-সালিহকে দিয়ে কী করায়।

ইমাম বললেন- আমার অভিমত হচ্ছে, আস-সালিহ যদি চুক্তি পরিপন্থী কোন আচরণ করে, তবেই সুলতানকে বিস্তারিত জানাবো।

সুলতান আইউবী মিসর চলে গেছেন- অপর একজন বললো। লোকটি বৃদ্ধ এবং মনে হচ্ছে বিচক্ষণ- এদিকে আল-আদিল আছেন। সুলতানের সিদ্ধান্ত না নিয়ে তিনি কোন অভিযান পরিচালনা করবেন না। ততোক্ষণে এখানকার পরিস্থিতি এমন রূপ ধারণ করতে পারে, যা হয়তো আমাদের আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যাবে। আমাদের এমন কিছু করা দরকার, যার ফলে এই ধারাটি এখানেই শেষ হয়ে যায়।

আমি আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি- চাকরানী ইমামকে উদ্দেশ্য করে বললো- আস-সালিহর মনোযোগ শুধু মেয়েটির প্রতি। মেয়েটি ছাড়া তিনি এখন কিছুই বোঝেন না। ভাল-মন্দ ভাববার শক্তি তার নেই। মেয়েটি দিনের বেলায়ও তাকে মদ খাইয়ে মাতাল করে রাখে। হতভাগা আগেও মদপান করতেন, তবে শুধু রাতে পান করতেন। তাছাড়া এতো বেশি করতেন না। নেশা অবস্থায় বোনের মুখোমুখি হতেন না। বোমের সঙ্গে দিনে সাক্ষাৎ করতেন। এখনকার অবস্থা হলো, এই মেয়েটি আসার পর থেকে এ যাবত ভাই-বোনের সাক্ষাৎ ঘটেনি। বোনের মাঝে পিতার কৌলিন্য আছে। আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি বলি, রাষ্ট্রীয় কাজ-কর্ম এতো বেড়ে গেছে যে সময় পান না।… যা হোক, আমার পরামর্শ হলো, মেয়েটিকে গুম করে ফেলা দরকার। তবেই আস-সালিহ দিকদিশা হারিয়ে ফেলবেন।

প্রস্তাবের উপর দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনা হয়। ইবনে খতীব বললো, আমি বণিক তিনজনকেও গায়েব করে ফেলতে পারবো। কাজটা সহজ না হলেও অসম্ভব নয়।

***

১১৮১ সালের নবেম্বর মাস। উটের কাফেলা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষ কেনাকাটা করছে। তিন খৃস্টান উপদেষ্টা আল-মালিকুস সালিহর সঙ্গে সাক্ষাৎ-যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। তারা আস-সালিহকে বল্ডউইনের পরিকল্পনা মাফিক ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করছে। দিনটা নবেম্বর মাসের ১৬ কি ১৭ তারিখ। ৫৭৭ হিজরীর ৭ কিংবা ৮। রাতে আল-মালিকুস সালিহ বিরাট এক ভোজের আয়োজন করেছেন। কারণটা বাহ্যত বুঝা যাচ্ছে না। বিষয়টা জানেন আস-সালিহর দুজন সালার। আস-সালিহ খৃস্টান উপদেষ্টাদের সঙ্গে গোপন চুক্তি সম্পন্ন করেছেন। সে উপলক্ষেই এই ভোজের আয়োজন। মেহমান অসংখ্য। তন্মধ্যে বণিকবেশী তিন খৃস্টান উপদেষ্টাও আছে। কাফেলার উষ্ট্ৰচালকরাও আজকের এই ভোজসভার বিশিষ্ট মেহমান। কিন্তু আসলে তাদের উপস্থিতি উষ্ট্ৰচালকের বেশে নয়; তারা উষ্ট্ৰচালকও নয়। তাদের কেউ গোয়েন্দা, অন্যরা খৃস্টান বাহিনীর অফিসার। উষ্ট্ৰচালক তাদের ছদ্ম পরিচয়। ভোজের আসরে ইহুদী মেয়েটিও আছে। আছে আস-সালিহর বোনও। কিন্তু তার দায়িত্ব আয়োজন তদারকি করা।

আজ রাত রক্ষীসেনাদের তৎপরতা কম। মেহমানগণ দলে দলে আসছে। কোন আশঙ্কা বোধ হচ্ছে না। অন্তত আস-সালিহর মনে কোন শঙ্কা নেই। মদপানের ধারা চলছে। আস্ত খাসীর রোস্ট তৈরি করা হয়েছে। খোলা মাঠে জাকজমকপূর্ণ প্যান্ডেল তৈরি করা হয়েছে। রাত যতো গম্ভীর হচ্ছে, আসরের রং ততোটা উজ্জ্বল হচ্ছে। সর্বত্র মেহমানদের পদচারণা বিরাজ করছে।

ইহুদী মেয়েটি ফাং ফাং করে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। মেয়েটি কার সঙ্গে যেনো সাক্ষাৎ করে এদিকে আসছিলো। এমন সময় চাকরানী তাকে দাঁড় করিয়ে একজন সালারের নাম করে বললো, কি এক প্রয়োজনে তিনি আপনাকে যেতে বলেছেন। মেয়েটি জানে, সালার তাদের লোক। সে সালারের নিকট চলে যায়। কিন্তু আর ফিরে আসেনি। কী হলো, কোথায় গেলো, কেউ বলতে পারছে না। ঘটনাটা আস-সালিহ এখনো জানতে পারেননি।

ইবনে খতীব আজ রাত ডিউটিতে নেই। সুযোগ সৃষ্টি করে সে তিন বণিকের একজনের সঙ্গে কথা বলে বললো- আপনারা তিনজন এখান থেকে বেরিয়ে যান। অন্যথায় মারা পড়বেন। বিরাট সমস্যা দেখা দিয়েছে। সুলতান আইউবীর কমান্ডোরা জেনে ফেলেছে, আপনারা মেহমানের বেশে এখানে আছেন।

ইবনে খতীব একটি জায়গার নাম বলে বললো- আপনারা ওখানে চলে আসুন।

আমাদের চলে যাওয়ার সময়ও হয়ে গেছে- খৃস্টান বললো- আমাদের কাজ হয়ে গেছে।

তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ুন- ইবনে খতীব বললো- অন্যথায় সকালে এখান থেকে আপনাদের লাশ বের হবে।

তৎক্ষণাৎ খৃস্টান লোকটি কথাটা তর সঙ্গীদের কানে দেয়। তারা একজন একজন করে প্রাসাদ থেকে এমনভাবে বেরিয়ে পড়ে, যেনো কারো মনে সন্দেহ না জাগে। প্যান্ডেলের ভেতর থেকে সাবধানে বের হয়েই তারা। অন্ধকার পথে ঢুকে পড়ে। ইবনে খতীব তিনটি ঘোড়ার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। সেও একটি ঘোড়ার পিঠে সওয়ার। আসরে নাচ-গান চলছে। আমোদে উন্মাতাল অতিথিগণ। হট্টগোল এতো যে, চারটি ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ কারো কানেই প্রবেশ করেনি। আস-সালিহ টেরই পাননি যে, তার বিশিষ্ট তিন মেহমান কাল্পনিক বিপদ থেকে পলায়ন করে প্রকৃত বিপদের মধ্যে চলে গেছে।

***

লোকালয় থেকে দূরে ঝুপড়ির মতো একটি ঘর। তিন খৃস্টান সেই ঘরে বসা। ইবনে খতীব মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছে যে, তাদের জীবন রক্ষা পেয়ে গেছে। তারা তাদের উষ্ট্ৰচালকদের সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে। ইবনে খতীব তাদেরকে সান্ত্বনা প্রদান করে। তাদেরকেও বের করে আনা হলে ইবনে খতীব বললো, আস-সালিহর সঙ্গে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমার জানা দরকার। আমাকেও তো সতর্ক থাকতে হবে। তারা বললো, আমরা আস-সালিহকে নেপথ্য থেকে সমর সরঞ্জাম ও ঘোড়া দেবো। তার বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেবো। গোয়েন্দা দেবো। আর যখন তিনি সুলতান আইউবীর উপর আক্রমণ করবেন, তখন আমরা আইউবী বাহিনীর উপর পেছন থেকে আক্রমণ করবো। মোটকথা, আস-সালিহ আইউবীর সঙ্গে কৃত চুক্তি ভঙ্গ করে ফেলবেন। কিন্তু যুদ্ধ তখন করবেন, যখন আমরা তাকে সবুজ সঙ্কেত দেবো।

এখনই কি আমাদের রওনা হওয়া উচিত না? এক খৃস্টান বললো।

হ্যাঁ- ইবনে খতীব বললো- আপনাদের রওনা হওয়ার সময় হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে আসুন।

ইবনে খতীব কক্ষের দরজা খোলে। এটি অন্য এক দরজা। বললো, চলুন।

তারা দরজা পেরিয়ে একটি কক্ষে ঢুকে পড়ে। কক্ষটা অন্ধকার। কিন্তু ঢোকামাত্র হঠাৎ কি যেনো ঘটে গেলো। তিন খৃস্টানের প্রত্যেককে একজন করে লোক ঝাঁপটে ধরে এবং পরক্ষণেই প্রত্যেকের হৃদপিণ্ডে খঞ্জর ঢুকে যায়। আগেই কক্ষের এক কোনে একটি গভীর গর্ত খুড়ে রাখা হয়েছিলো। আল-মালিকুস সালিহর তিন খৃস্টান উপদেষ্টাকে তাতে পুঁতে রাখা হলো।

সেই কক্ষেরই এক কোণে আল-মালুিকস সালিহর উপহার ইহুদী মেয়েটি উপবিষ্ট। অন্ধকারে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। হাত-পা বাঁধা। মুখে কাপড় গোজানো। তাকেও ভোজসভা থেকে চাকরানীর মাধ্যমে সফলভাবে অপহরণ করা হয়েছে। কক্ষে ইবনে খতীব ছাড়া আরও পাঁচ ব্যক্তি। তারা মেয়েটির হাত-পা খুলে দেয় এবং মুখের কাপড় বের করে ফেলে। মেয়েটি তার সহকর্মী খৃস্টানদের পরিণতি দেখেছে। বললো, আমাকে অপর কক্ষে নিয়ে চলো। তাকে অপর কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে একটি প্রদীপ জ্বলছে।

তোমরা কি আমার চেয়ে রূপসী মেয়ে কখনো দেখেছো? মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।

তুমি কি আমাদের অপেক্ষা বেশি ঈমানদার কোন দিন দেখেছো? ইবনে খতীব পাল্টা প্রশ্ন করে আমরা তোমাকে এতোটুকু সুযোগ দেবো না যে, তুমি আস-সালিহর ন্যায় আমাদের ঈমানও ক্রয় করে ফেলবে।

আমি তোমাদের নিকট জীবন ভিক্ষা চাচ্ছি- মেয়েটি বললো- তোমাদের যদি আমাকে ভালো না-ই লাগে, তাহলে কী পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা তোমাদের দরকার বলো; আমি সকালেই সেসব তোমাদের নিকট এনে হাজির করবো। তারপর আমি এখান থেকে সোজা জেরুজালেম চলে যাবো।

ইবনে খতীব সঙ্গীদের প্রতি তাকায়। দুজনের চেহারায় বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়া দেখতে পায়। সে অতি দ্রুততার সাথে খঞ্জর বের করে অস্ত্রটা মেয়েটির বুকে সেঁধিয়ে দেয়। মেয়েটি লুটিয়ে পড়ে গেলে মাথার চুলে ধরে টেনে-হেঁচড়ে অপর কক্ষে নিয়ে গর্তে ছুঁড়ে ফেলে। সকলে মিলে গর্তটা মাটিতে ভরে দেয়।

ইমামকে রাতেই জানানো হলো, কাজ সমাধা হয়ে গেছে।

ওদিকে আস-সালিহ তিন উপদেষ্টা ও রক্ষিতা মেয়েটির জন্য অস্থির বেচাইন হয়ে ওঠেছেন। কী ব্যাপার, ওরা গেলো কোথায়? ওদের দেখছি না কেন?

মধ্য রাতের খানিক পর যখন শেষ মেহমানটিও বিদায় নিয়ে গেলো, তখন আস-সালিহ ঘনিষ্ঠদের জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, ওরা গেলো কোথায়? অনেক খোঁজাখুঁজি করে কোথাও পাওয়া গেলো না। আস-সালিহ বিশেষত মেয়েটির জন্য বেশি অস্থির ছিলেন। এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করছেন আর চাকরানীকে বকছেন। অবশিষ্ট রাত নিজেও ঘুমালেন না, চাকর-নকরদেরও ঘুমাতে দিলেন না। চাকরানী ইমামকে বলেছিলো, মেয়েটি হাতছাড়া হয়ে গেলে আস-সালিহ হুঁশ হারিয়ে ফেলবেন। এখন তারই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। তার মন্তব্য সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। আল মালিকুস সালিহ পাগল হয়ে যাচ্ছেন।

***

রাত পোহাবার পর আল-মালিকুস সালিহর অবস্থা এখন পাগলের চেয়েও শোচনীয়। তিনি দুজন ঘনিষ্ঠ সালারকে সম্মুখে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। তারা ইবনে খতীবকে ডেকে নিয়ে আসে। খতীবকে জিজ্ঞেস করা হয়- একটি মেয়ে এবং আরবীয় ব্যবসায়ীদের বের হতে দেখেছো কি?

হ্যাঁ দেখেছি- ইবনে খতীব উত্তর দেয়- আমি তো বাহিনীসহ বাইরে প্রস্তুত দণ্ডায়মান ছিলাম। মধ্য রাতের আগে ব্যবসায়ী তিনজন বাইরে আসে। তাদের সঙ্গে একটি সুন্দরী মেয়েও ছিলো। তারা এখান থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমি ছুটন্ত ঘোড়র পদশব্দ শুনতে পেয়েছি। পরে আর তাদেরকে ফিরে আসতে দেখিনি।

সুলতান আইউবীর সমর্থক সালারও এসে পড়েছেন। তিন খৃস্টান ও মেয়েটির সন্ধান তার জানা আছে। তিনি আস-সালিহকে খৃস্টানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে শুরু করেন। তারা এমন একটি রূপসী মেয়েকে আপনার কাছে রেখে যাওয়া সমীচীন মনে করেনি। আপনাকে ধোঁকা দিয়ে তারা আপনার অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য নিয়ে পালিয়েছে। হয়তোবা আপনিও জানেন না, কী সে মূল্যবান তথ্য।

আস-সালিহর উপর নীরবতা ছেয়ে গেছে। বোধ হয় তার চৈতন্য ফিরে এসেছে যে, মেয়েটি তাকে দিনের বেলায়ও মদপান করিয়ে অচেতন করে রাখতো। সে সময় কে জানে সে তার মুখ থেকে কী সব কথা বের করে নিয়েছে। এখন ভাবটা এমন, যেনো আল-মালিকুস সালিহ কৃতকর্মে মর্মাহত। গত রাতে একটুও ঘুমাননি। অনেক দিন যাবত মদপান করে আসছেন। একদিকে তার ক্রিয়া, অন্যদিকে আক্ষেপ-অনুশোচনা। হঠাৎ মুখ খুলে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে আদেশ করেন- লোকগুলোর সঙ্গে যে কাফেলা এসেছিলো, তাদের প্রত্যেককে বন্দী করে কয়েদখানায় নিক্ষেপ করো, তাদের উট ও অন্যান্য মালপত্র ক্রোক করে নাও।

সেদিনই সন্ধায় আস-সালিহর পেট ব্যথা শুরু হয়। ডাক্তার দেখে ওষুধ দেন। কিন্তু রোগ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। রাত নাগাদ পেট ফুলে ওঠে। ৫৭৭ হিজরীর ৯ই রজব অর্থাৎ পরদিন অবস্থা আশঙ্কাজনক রূপ ধারণ করে। ডাক্তার এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকছেন। কিন্তু আস-সালিহর অবস্থার কোন উন্নতি হচ্ছে না। পরবর্তী রাতও একইভাবে অতিবাহিত হয়। দ্বিতীয় দিন তার সংজ্ঞা হারিয়ে যেতে শুরু করে। ডাক্তার তাকে কিছু বুঝেত না দিয়ে সালার প্রমুখদের জানিয়ে দেন, মহারাজের সেরে ওঠার সম্ভাবনা নেই। জামে মসজিদের ইমামকে ডেকে আনা হলো। তিনি শিয়রে বসে কুরআন তিলাওয়াত শুরু করেন। রাতে আস-সালিহ চোখ খোলেন। ইমামের প্রতি তাকিয়ে অনুচ্চ স্বরে বললেন- কুরআন যদি সত্য হয় থাকে, তাহলে তার বরকতে আমাকে সারিয়ে তুলুন।

আমার একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, কুরআনের বিরুদ্ধাচরণ করা আপনার মিশনে পরিণত হয়েছে- ইমাম বললেন- এই সংক্ষিপ্ত জীবনের পুরোটাই আপনি কুরআন ও ইসলামের বিপক্ষে ব্যয় করেছেন। কুরআনের বরকত সেই ব্যক্তির জন্য, যে তার আনুগত্য করে চলে। আপনি আল্লাহর সমীপে পাপের ক্ষমা ভিক্ষা করুন। তার নিকট থেকে ক্ষমা নেয়ার চেষ্টা করুন।

আস-সালিহর বোন পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। আস-সালিহ বলে ওঠেন যাও আমার মাকে ডেকে আনন। তাকে বলল, তোমার পুত্র মৃত্যুবরণ করছে; তুমি এসে তার দুধের দাবি এবং জীবনের পাপ ক্ষমা করে দাও।

ইমাম শামসুন্নিসার প্রতি তাকান। শামসুন্নিসা ভাইয়ের মাথায় স্বস্নেহে হাত বুলিয়ে বললো- আমি এক্ষুনি দামেশকের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছি। আমি মাকে নিয়েই তবে আসবো। সে পর্যন্ত তুমি বেঁচে থাকো ভাইয়া!

শামসুন্নিসা দ্রুতপদে বাইরে বেরিয়ে যায়। অল্পক্ষণ পরই সে রক্ষীদের সঙ্গে দামেশকের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়।

কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ তাঁর রোজনামচায় লিখেছেন- রজবের ১৩ তারিখ আস-সালিহর অবস্থা এতোই গুরুতর রূপ ধারণ করে যে, দুর্গের ফটক বন্ধ করে দেয়া হয়। এক পর্যায়ে সামান্য চৈতন্য ফিরে এলে. আস সালিহ ইযুদ্দীনকে স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করেন। ইযযুদ্দীন সাইফুদ্দীনের মৃত্যুর পর মসুলের গবর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন। সে সময় তিনি মসুল অবস্থান করছিলেন। এখন তাকে হালবেরও গবর্নর নিযুক্ত করা হলো। আস-সালিহ সকল আমীর ও সালারদের ডেকে বললেন, শপথ নাও, তোমরা ইযযুদ্দীনকে গবর্নর হিসেবে বরণ করে নেবে এবং তার অনুগত হয়ে কাজ করবে। সবাই শপথ করে।

৫৭৭ হিজরীর ২৫ রজব আল-মালিকুস সালিহ অচেতন অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। মসুলে দূত প্রেরণ করে ইযযুদ্দীনকে ডেকে আনা হলো। তাকে অবহিত করা হলো, আপনাকে হাবের গবর্নর নিযুক্ত করা হয়েছে।

***

যে সময়ে শামসুন্নিসা দামেশকে মায়ের পায়ের উপর বসে বলছিলো, আপনার একমাত্র পুত্র মৃত্যুবরণ করছে, আপনার দুধের দাবি মাফ করানোর জন্য তিনি আপনাকে নিতে পাঠিয়েছেন আর মা বলেছিলেন, আমি তার দুধের দাবি ক্ষমা করতে পারি; কিন্তু গুনাহের ক্ষমা আল্লাহর নিকট থেকে নিতে হবে, তখন আস-সালিহর জীবনের চির অবসান ঘটে। শামসুন্নিসা হাবে ফিরে এসে দেখতে পায়, দুর্গ থেকে তার ভাইয়ের জানাযা বের হচ্ছে।

দূত ইযযুদ্দীনকে আস-সালিহর মৃত্যুর সংবাদ জানায়। ইযযুদ্দীন সঙ্গে সঙ্গে রওনা হয়ে যান। দ্রুত এসে পৌঁছানোর জন্য তিনি অন্য পথ ধরেন। সুলতান আইউবীর ভাই আল-আদিলের সেনা ছাউনীর পাশ দিয়ে তার অতিক্রম ঘটে। তিনি আল-আদিলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আল-আদিল আস-সালিহর মৃত্যুর খবর জানতেন না। ইযযুদ্দীন তাকে সংবাদটি জানান। সঙ্গে এও অবহিত করেন যে, তাকে হাবের গবর্নর নিযুক্ত করা হয়েছে। আল-আদিল বললেন- তবে তো তুমি ইচ্ছে করলে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারো এবং হাবকে দামেশকের সঙ্গে একীভূত করে ফেলতে পারে। গাদ্দার মরেছে। তুমি তো গাদ্দার নও।

ইযুদ্দীন ক্ষণিকের জন্য গভীর ভাবনায় হারিয়ে যান। পরক্ষণে আল আদিলকে বললেন- হঁ, আমি হাব ও দামেশকে এমন এক সেতুবন্ধনে আবদ্ধ করতে পারি, যা কখনো ছিঁড়বে না। কিন্তু…। কিন্তু সেই সম্পর্কটা অটুট রাখার জন্য আপনি একটি কাজ বরং আমার একটি আকাঙ্খা পূরণ করে দিতে পারেন।… আমি নুরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবাকে বিয়ে করতে চাই যদি ভদ্র মহিলা রাজি হয়।

আমি আজই দামেশক চলে যাবো- আল-আদিল বললেন- আমি আশা করি তিনি সম্মত হবেন।

আল-আদিল দামে পৌঁছে যান। রোজি খাতুনকে পুত্রের মৃত্যুর সংবাদটা জানান। শুনে তিনি বললেন, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন।

আল-আদিল রোজি খাতুনকে জানালেন- আস-সালিহ ইযযুদ্দীনকে হাবের গবর্নর নিযুক্ত করে গেছে। আর… আর ইযুদ্দীন আপনাকে বিবাহ করার জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছে।

রোজি খাতুন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

এই পরিণয় আপনার আর ইযযুদ্দীনের নয়- আল-আদিল বললেন এই বিবাহটা হবে দামেশক ও হালবের। এই সম্পর্কের সূত্র ধরে আগামীতে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটবে এবং ক্রুসেড বিরোধী অভিযান আরো জোরদার হবে।

ঠিক আছে- রোজি খাতুন বললেন- ইসলামের মর্যাদার খাতিরে আমি এই প্রস্তাবে সম্মতি দিলাম। আমার ব্যক্তিগত কামনা-বাসনা বলতে কিছু নেই। ৫৭৭ হিজরীর ৫ শাওয়াল মোতাবেক ১৯৮২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইযুদ্দীন ও রোজি খাতুনের শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *