৬.৩ দায়িত্ব যখন সঙ্গীকে হত্যা করল

দায়িত্ব যখন সঙ্গীকে হত্যা করল

 সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর তরবারী থেকে যে খুন টপ টপ করে ঝরছিলো, সেগুলো পরিষ্কার না করেই তিনি তরবারীটা খাপে ঢুকিয়ে ফেলেন। এই রক্ত সেই বিশ্বাসঘাতক হাকীমের, যিনি ক্রুসেডারদের চর ও সন্ত্রাসীর ভূমিকা পালন করছিলেন।

বিশ্বাসঘাতকতা ও শক্রর সঙ্গে হাত মেলানোর অপরাধে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিলো, শিকল বেঁধে তাদেরকে কারাগারে আটক করে রাখা হয়। সুলতান আইউবী তাঁর সালার, নায়েব সালার, সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মাঝে বৈঠকে অস্থিরচিত্তে পায়চারি করছেন। চোখে রক্ত নেমে এসেছে তাঁর। বৈঠকে সববেতেদের উদ্দেশে তিনি অনেক কথা বলেছেন এবং বলতে বলতে এক পর্যায়ে থেমে গেছেন। বৈঠকে যারা উপস্থিত আছেন, তাদের সুলতানের আবেগ-উচ্ছ্বাস সম্পর্কে ভালোভাবেই জানা আছে। আইউবীর চোখে চোখ রাখার সাহস কারো নেই।

মহামান্য সুলতান!–এক সালার বললেন- আমরা খৃস্টানদের কোন ষড়যন্ত্র সফল হতে দেবো না।

সুলতান আইউবী হঠাৎ দ্রুততার সঙ্গে কোষ থেকে তরবারীটা বের করেন। অস্ত্রটা রক্তমাখা। তিনি তরবারীটা সমবেতদের দিকে এগিয়ে ধরে বললেন- এই রক্ত কার? এই রক্ত আপনাদের সকলের। এই রক্ত আমার। এই রক্ত আমাদের সেই ভাইয়ের, যে মসজিদে আমাদের সঙ্গে নামায আদায় করতো। তার ঘরে কুরআনও আছে। এই রক্ত যদি গাদ্দার হতে পারে, তাহলে… তাহলে খৃস্টানদের এই ষড়যন্ত্র সফল হবে। খৃস্টানদের ষড়যন্ত্র সফল হয়ে গেছে। ইসলামের যে সৈনিকদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফিলিস্তীনকে ক্রুসেডারদের দখল থেকে মুক্ত করার কথা ছিলো, আপসে সংঘাতে জড়িয়ে খৃস্টানরা তাদেরকে এমন দুর্বল করে ফেলেছে যে, আমরা দীর্ঘ সময়ের জন্য ফিলিস্তীন অভিমুখে যাত্রা করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের গন্তব্য বাইতুল মুকাদ্দাস ছিলো। আজ আমাদেরকে কায়রো নয়- জেরুজালেম থাকার কথা ছিলো। কিন্তু ইসলামের সামরিক শক্তি ধ্বংস হয়ে গেছে।

সুলতান আইউবী তরবারীটা তাঁর দারোয়ানের প্রতি ছুঁড়ে মারেন এবং পরক্ষণেই খাপটাও খুলে তা হাতে দিয়ে বললেন- এই রক্ত যদি কোনো কাফিরের হতো, তাহলে আমি তরবারীটা ধৌত করাতাম না। এ এক গাদ্দারের খুন। খাপে এই রক্তের ঘ্রাণও যেনো না থাকে।

দারোয়ান তরবারী ও খাপ পরিষ্কার করার জন্য বাইরে নিয়ে যায়। সুলতান আইউবী সববেতদের বললেন- খৃস্টানদের ষড়যন্ত্র সফল হয়েছে। তারা চাচ্ছিলো, যেনো আমি হাল্ব অতিক্রম করে সম্মুখে যেতে না পারি। দেখছো না, সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে আমি কায়রো এসে পড়েছি! আমি আপনাদেরকে প্রবঞ্চনার মধ্যে রাখবো না। ক্রুসেডাররা এখন সম্মুখে অগ্রসর হবে। আমরা যে সময়ে আপসে লড়াই করছিলাম, তখন তারা আমাদেরকে সিদ্ধান্তমূলক পরাজয় দানের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলো।

আমরা মুসলমানদেরকে আপসে যুদ্ধ করিয়ে সালাহুদ্দীন আইউবীর গতি ঘুরিয়ে দিয়েছি। ত্রিপোলীর খৃস্টান সম্রাট রেমন্ড বললেন। তারা গোয়েন্দা মারফত সংবাদ পেয়ে গেছেন, সালাহুদ্দীন আইউবী হাল ছেড়ে মিসর চলে গেছেন এবং তার জায়গায় তার ভাই আল-আদিল রণাঙ্গনে এসেছেন। সংবাদটা জেরুজালেম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। বড় ক্রুশ এবং প্রধান পাদ্রীর আস্তানা আক্ৰায়ও পৌঁছে গেছে খবরটা। তাই তৎক্ষণাৎ তারা ত্রিপোলীতে এসে বৈঠকে বসেছেন।

দুদিকেই বৈঠক চলছে।

আইউবী জেরুজালেম জয় করার প্রত্যয় নিয়ে বের হয়েছিলেন রেমন্ড বললেন- আমরা একটি তীরও না ছুঁড়ে তাকে মিসর ফিরিয়ে দিয়েছি। তারই হাতে আমরা সেই মুসলিম শাসকদের বেকার করে দিয়েছি, যারা যে কোনো সময় আমাদের বিরুদ্ধে তার শক্তি হয়ে দাঁড়াতে পারতো। এর চেয়ে বড় সফলতা আর কী চাই! এখন বিজয় অর্জনে আমাদের সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না।

সাফল্যটা অতো বিরাট নয়, যতোটা বড় করে আপনি দেখালেন খৃস্টান সম্রাট বল্ডউইন বললেন- আমরা আক্রমণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছি মাত্র। আসল কাজ তো আক্রমণ। আক্রমণ করে বিজয় অর্জন করলেই তবে তাকে সাফল্য বলবো। দ্রুত বাহিনী প্রস্তুত করো। সম্মুখপানে রওনা হও এবং আইউবীকে আত্মসংবরণ করার সুযোগ দিও না।

আমরা যদি নিজেদেরকে খুব তাড়াতাড়ি সামলে নিতে সক্ষম না হই, তাহলে পরিণতি কী হবে জানি না- সুলতান আইউবী তাঁর সালার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বললেন- আজ থেকেই নতুন ভর্তি শুরু করে দাও। আরোহী সৈনিকের সংখ্যা বেশি হওয়া চাই। সেই সুদানী যুবকদেরও ভর্তি করে নাও, সাত বছর আগে বিদ্রোহের অপরাধে পদচ্যুৎ করে শাস্তিস্বরূপ যাদের দ্বারা কৃষি জমি আবাদ করানো হয়েছিলো। এখন আর তারা ধোকা দেবে না। যেসব যুবক ঘোড়সওয়ারী ও তরবারী চালনা জানে, তাদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ দাও। আমি তাড়াতাড়ি মিসর থেকে বের হতে চাই। খৃস্টানদের মাথা যদি খারাপ হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলেই আরব জগত তাদের দখলদারিত্ব থেকে রক্ষা পাবে। অন্যথায় আমার অনুপস্থিতির সুযোগে এক্ষুনি তাদের হামলা করা উচিত। তারা আনাড়ি নয়। এই যে। আমি মিসর ফিরে আসতে বাধ্য হলাম, পরিস্থিতিটা তাদেরই সৃষ্ট। এতে তাদের উদ্দেশ্য আছে। একটি মাত্র পন্থা অবলম্বন করলে তারা আমাদের থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস রক্ষা করতে পারবে- অধিকৃত অঞ্চল ত্যাগ করে তাদেরকে আমাদের এলাকায় এসে লড়াই করতে হবে। এই যুদ্ধে আমার অনেক সৈন্যের প্রয়োজন।

আমি এক্ষুনি দুশ পঞ্চাশজন নাইট (বর্মপরিহিত কমান্ডার) ময়দানে নিয়ে আসতে পারি- ত্রিপোলীর কনফারেন্সে বিখ্যাত খৃস্টান সম্রাট রেনাল্ট অফ খুনিন বললেন- এই আক্রমণের নেতৃত্ব আমার বাহিনী দেবে। আমি তার পরিকল্পনাও প্রস্তুত করে রেখেছি। আমরা সালাহুদ্দীন আইউবীর ন্যায় চোরের মতো যুদ্ধ করবো না। আমরা ঝড় ও স্রোতের ন্যায় এগিয়ে যাবো। আমরা যখন সবাই একত্রিত হয়ে রওনা হবো, তখন আপনি বুঝতে পারবেন, মানুষ ও ঘোড়ার এই ঝড়-স্রোত আরব দুনিয়াটাকে খড়-কুটোর ন্যায় ভাসিয়ে মিসরকেও পিষে ফেলবে এবং তার গতি সুদান গিয়ে ক্ষান্ত হবে।

খৃস্টানরা যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে আসে, তাহলে আরবের মাটি আমাদের থেকে এতো রক্ত কামনা করবে, যাতে মরুভূমির বালিকণা সাঁতার কাটবে- সুলতান আইউবী বললেন- এবার আমরা মাথায় কাফন বেঁধে যাবো। আমার বন্ধুগণ! আমাদেরকে পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং পুরোপুরি সংবরণ করে ময়দানে অবতীর্ণ হতে হবে।

আইউবীকে মিসরে আটকে রাখার জন্য আমাদেরকে অরাজক কর্মকাণ্ড তীব্রতর করতে হবে- রেমন্ড বললেন এবং খৃস্টান ইন্টেলিজেন্স প্রধান হারমানকে উদ্দেশ করে বললেন- হারমান! মিসরের উপর তোমার হামলা আরো জোরদার করো। আইউবী স্থির হয়ে বসে থাকবার কথা নয়। তার বাহিনীর জীবনহানি প্রচুর হয়েছে। বিলম্ব না করে তিনি নতুন ভর্তি শুরু করে দেবেন। তোমাকে চেষ্টা করতে হবে, যেনো তিনি ভর্তি না পান। যদি তাতে সফল না হও, তাহলে মিসরের বাহিনীকে ধ্বংস করতে থাকো। সেখানকার বাহিনীর উপর দৃষ্টি রাখো। ওখানে আমাদের কর্তব্যরত গোয়েন্দাদের বলো, সালাহুদ্দীন আইউবীর যে কোনো গতিবিধির সংবাদ যেনো দ্রুত আমাদের কাছে পৌঁছাতে থাকে।

আর হারমান!- এক খৃস্টান কমান্ডার বললেন- মিসরের সংবাদ পাওয়া যাক আর না যাক এখানকার কোন সংবাদ যেনো বাইরে যেতে না পারে। আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে, আইউবী যেভাবে যুদ্ধের ময়দানে আমাদের জন্য আপদ হিসেবে আবির্ভূত হন, তেমনি গুপ্তচরবৃত্তির ময়দানেও তিনি আমাদের সম্পর্কে সতর্ক থাকেন। আমাদের মাঝে তার চর থাকা বিচিত্র নয়। এখানকার মুসলিম পরিবারগুলোর উপর নজর রাখতে হবে। কারো প্রতি সামান্যতম সন্দেহ সৃষ্টি হলেই তাকে বন্দি করে ফেলো। প্রয়োজনে হত্যা করে ফেলল। আমি তোমাকে এ ব্যাপারে পূর্ণ ক্ষমতা ও স্বাধীনতা প্রদান করলাম।

আমি তো কারো অন্তরে প্রবেশ করতে পারি না- সুলতান আইউবী বললেন- গাদ্দার কারো গায়ে লেখা থাকে না। গাদ্দারদের মাথায় শিংও থাকে না। আমি আলী বিন সুফিয়ান ও গিয়াস বিলবীসকে অনুমতি প্রদান করছি, যাকে খৃস্টানদের চর বলে সন্দেহ হবে, তাকেই হত্যা করে ফেলো। তার প্রতি দয়া প্রদর্শন করতে চাইলে কারাগারে ফেলে রাখো। যে সময়টায় খৃস্টানরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আসছে, সেই সঙ্গিন পরিস্থিতিতে আমি কাউকে ক্ষমা করতে পারি না। আমি তদন্ত ও সুবিচারের ধরণ-পদ্ধতি পরিবর্তন করতে চাই।… আর আলী বিন সুফিয়ান! আমি নিশ্চিত, তুমি অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে তোমার জাল বিছিয়ে রেখেছে। খৃস্টানদের ভেতরে আরো কিছু লোক পাঠিয়ে দাও এবং সেখানকার গোয়েন্দাদের বলে দাও, কোন তথ্য-সংবাদ যেনো বেশি সময় নিজেদের কাছে না রাখে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও যেনো তীর গতিতে কায়রোতে সংবাদ পৌঁছায়। আমাকে অন্ধ করে দিও না আলী! আর সতর্ক থাকো, এখান থেকে কোনো সংবাদ যেনো বের হতে না পারে।

আমাদের বাহিনীর কমান্ড যদি যৌথ হয়, তাহলে আমরা আরো বেশি ভালো ও কার্যকর পন্থায় লড়াই করতে পারবো। রেমন্ড বললেন।

আমি ঐক্যের উপর জোর দেবো, যৌথ কমান্ডের উপর নয়- রেনাল্ট বললেন- যৌথ কমান্ডের কিছু ক্ষতিকর দিকও থাকে। যুদ্ধের ময়দানে আমাদেরকে একে অপরের সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে এবং একে অন্যের পথে চলা থেকে বিরত থাকতে হবে। অগ্রযাত্রার জন্য আমরা এলাকা ভাগ করে নেবো। সতর্ক থাকতে হবে, যেনো আমাদের গতিবিধি ফাঁস না হয়ে যায়।

***

উভয় দিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। সুলতান আইউবীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা খৃস্টানদের এবারকার প্রত্যয়। সুলতান বিক্ষত। খৃস্টানদের মদদপুষ্ট তিনটি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে অস্তিত্ব রক্ষা করতে হয়েছে তাঁকে। প্রায় তিনটি বছর মুসলিম সৈনিকরা পরস্পরের রক্ত ঝরিয়েছে। সুলতান আইউবী তিন মুসলিম বাহিনীকে পরাজিত করে তাদের থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে এনেছেন এবং তারা সুলতানের আনুগত্য মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু সুলতানের মতে এই জয় উম্মাহর নিকৃষ্টতম বিজয়। কারণ, খৃস্টানদের ষড়যন্ত্র সফল হয়েছে। এই ভ্রাতৃঘাতি গৃহযুদ্ধে আল্লাহর হাজার হাজার সেই সৈনিকরা মৃত্যুবরণ করেছে কিংবা আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেছে, যাদের খৃস্টানদের হাত থেকে ফিলিস্তীনকে মুক্ত করার কথা ছিলো।

ইত্যবসরে খৃস্টানরা তাদের সেনাসংখ্যা বৃদ্ধি করে নিয়েছে। বাহিনীকে বিশ্রাম গ্রহণের সুযোগও দিয়েছে। তাদের যুদ্ধ প্রস্তুতি এখন সম্পন্ন। তাদের দাবি ভিত্তিহীন ছিলো না যে, তারা ঝড়ের গতিতে আসবে এবং আরব বিশ্বকে খড়ের ন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। বিপরীত দিকে সুলতান আইউবীর বাহিনীর অভিজ্ঞ অনেক সৈনিক ও কমান্ডার শাহাদাতবরণ করেছে, যার ফলে সুলতান এখন নতুন ভর্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন। অনভিজ্ঞ নতুন সৈনিকদের দ্বারা যুদ্ধ করানো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তবু সুলতান আইউবীর এছাড়া উপায় নেই। এ মুহূর্তে মিসরেও অনেক সৈন্য রাখা প্রয়োজন। কারণ, সুদানের দিক থেকেও আক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। সর্বোপরি দেশজুড়ে নাশকতা ও বিশ্বাসঘাতকতার সমস্যা তো আছেই।

খৃস্টানরা ঝড়ের বেগে ধেয়ে আসার পরিকল্পনা প্রস্তুত করছে। কিন্তু সুলতান আইউবী তাঁর নিজস্ব রণকৌশল থেকে সরে আসতে চাচ্ছেন না। তার সিদ্ধান্ত, তিনি গেরিলা হামলা চালাও আর পালিয়ে যাও এই রীতি অনুযায়ীই লড়াই করবেন। খৃস্টানদের বর্তমানকার পরিকল্পনায় ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যেনো সুলতান আইউবীর কমান্ডো অপারেশন সফল হতে না পারে। তারা আইউবীর বাহিনীকে বেষ্টনীর মধ্যে নিয়ে এসে সামনাসামনি লড়াবার কৌশল ভাবছে। উভয়পক্ষের জোর প্রচেষ্টা, আপন আপন যুদ্ধ প্রস্তুতি, পরিকল্পনা ও গতিবিধি যেনো গোপন থাকে এবং প্রতিপক্ষের গোপন তথ্য বের করে আনা যায়। এ লক্ষ্যে উভয়পক্ষের মধ্যেই প্রতিপক্ষের গুপ্তচর ঢুকে রয়েছে।

খৃস্টান কমান্ডার প্রমুখ মোটের উপর জানে, তাদের মধ্যে সুলতান আইউবীর গোয়েন্দা আছে। কিন্তু ত্রিপোলীর সম্রাট রেমন্ড ও অপরাপর খৃস্টান সম্রাটদের জানা নেই, খোদ তাদের এই কনফারেন্সে দুজন মুসলমান গোয়েন্দা উপস্থিত রয়েছে। একজন রাশেদ চেঙ্গিস। অপরজন ভিক্টর। রাশেদ চেঙ্গিস তুর্কি মুসলমান। ভিক্টর ফরাসী। এরা খৃস্টানদের উচ্চ পর্যায়ের কর্মচারি। খৃস্টান সম্রাট ও উচ্চপদস্থ কমান্ডারদের সভা নিমন্ত্রণ ইত্যাদি অনুষ্ঠানে মদ-খাবার ইত্যাদি পরিবেশনের দেখা-শোনা এদের দায়িত্ব। রাশেদ চেঙ্গিস ছদ্মনাম। ঠিক খৃস্টানদের নামের ন্যায়। তুর্কি হওয়ার কারণে গায়ের রংটা ইউরোপিয়ানদের মতো। তাছাড়া অত্যন্ত চালাক ও বাকপটু। ভিক্টরের ব্যাপারে কারো কোন সন্দেহ নেই, সে খৃস্টান। ফ্রান্সের বাসিন্দা। কিন্তু ছদ্মনামটা রেখেছে গ্রীক খৃস্টানদের।

খৃস্টানদের এই কনফারেন্সেও তারা দুজন তাদের বিশেষ পোশাকে উপস্থিত আছে। কারণ, খৃস্টানরা মদ ছাড়া কোনো কাজই করতে পারে না। এরা মদ পরিবেশন করছে আর সতর্কতার সাথে মনোযোগ সহকারে তাদের কথোপকথন শুনছে। অত্যন্ত মূল্যবান আলোচনা, যা কিনা এই মুহূর্তে কায়রো পৌঁছে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু আলোচনা ও সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত হয়নি। খৃস্টানদের পূর্ণ পরিকল্পনা জ্ঞাত হয়ে যে কোনো মূল্যে সেসব তথ্য কায়রো পৌঁছাতে হবে। এই দুই গোয়েন্দার উপর আলী বিন সুফিয়ানের পরিপূর্ণ আস্থা আছে।

***

মিসরে সেনাভর্তির কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে দুতিনটি ইউনিট গঠনও হয়ে গেছে। সামরিক কুচকাওয়াজ ও খেলাধুলার আয়োজন করা হয়েছে। দ্রুতগামী দূত মারফত মসজিদের ইমামদের নিকট সুলতান আইউবীর বার্তা পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছে, আপনারা জনগণকে জিহাদের গুরুত্ব বর্ণনা করুন, তাদেরকে বলুন, কাফেররা পূর্ণ শক্তি নিয়ে ইসলামী সুমিয়ার উপর আক্রমণ কয়তে ধেয়ে আসছে। প্রথম কেবলা বাইতুল মুকাদ্দাসকে কাফেরদের স্থল থেকে মুক্ত করতে হবে। এমতাবস্থায় প্রত্যেক মুসলমানের উপর জিহাদ ফরয হয়ে গেছে। ইমামদের বলা হলো, আপনারা যুবকদেরকে মিসরের সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করুন।

ইসলাম ও জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যুবা-তরুণরা ভর্তি হতে শুরু করেছে। তাদের সম্মুখে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পরিষ্কার। কিন্তু বহু যুবক ভর্তি হয়েছে গনীমতের লোভে। এরা পল্লী অঞ্চলের মানুষ। তাদের কানে ইমামদের আওয়াজ পৌঁছেনি। তারা সাক্ষাৎ পেয়েছে সেনা অফিসারদের, যারা এই লোকগুলোকে এই বলে উদ্বুদ্ধ করেছে, আসো, যুদ্ধ করে। আমরা খৃস্টানদের এমন সব এলাকা জয় করবো, যেখানে বিপুল সম্পদ আছে। তোমাদেরকে সেই সম্পদের ভাগ দেয়া হবে। ফলে তারা জিহাদী জযবায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভর্তি হওয়ার পরিবর্তে হাসিমুখে গনীমতের লোভে ভর্তি হয়েছে। এই অনভিজ্ঞ ও আনাড়ী অফিসারগণ সুলতান আইউবীর আকাঙ্খর বিপরীত বিপুলসংখ্যক যুবককে ভর্তি করে নেয়। যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়ে এই সৈনিকরা সুলতান আইউবীর জন্য বিরাট এক সমস্যারূপে আবির্ভূত হয়।

ওদিকে ত্রিপোলীর সামান্য দূরে খৃস্টান বাহিনী সমবেত হতে শুরু করেছে। ফিলিস্তীনের অধিকৃত শহরগুলোতে দূত প্রেরণ করা হয়েছে যে, তোমরা বাহিনী প্রস্তুত করো। ত্ৰিপোলীতে খৃস্টান সম্রাট রেনাল্ট সবচে বেশি তৎপর। তার সেনাসংখ্যা অপেক্ষাকৃত বেশি, যাদের মধ্যে দুইশত পঞ্চাশজন নাইট রয়েছে। নাইট একটি সম্মানসূচক পদবী। অস্বাভাবিক বিচক্ষণ, সাহসী ও অত্যধিক যোগ্য সামরিক অফিসারদের এই পদবী প্রদান করা হয়। তাদেরকে বিশেষ ধরনের বর্ম দেয়া হয় এবং এরা বিশেষ বিশেষ ইউনিটের কমান্ডার হয়ে থাকেন। প্রতিশোধের আগুন রেনাল্টকে অস্থির করে রেখেছে। প্রিয় পাঠক! আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ১১৭৪ সালের শুরুর দিকে খৃষ্টানরা সমুদ্রের দিক থেকে আলেকজান্দ্রিয়ার উপর আক্রমণ করেছিলো। কিন্তু সুলতান আইউবী গুপ্তচর মারফত যথাসময়ে সেই আক্রমণ প্রস্তুতির সংবাদ পেয়ে গিয়েছিলেন। তিনি খৃস্টান হামলাকারীদের স্বাগত জানানোর জন্য এমন বন্দোবস্ত করেছিলেন যে, খৃস্টানদের নৌ-বহর সমুদ্রেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো।

সেই অভিযানে একটি আক্রমণ হওয়ার কথা ছিলো স্থল পথে, যার নেতৃত্ব ছিলো রেনাল্টের হাতে। কিন্তু যেহেতু মুসলমান গোয়েন্দারা খৃস্টানদের পূর্ণ পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলো, তাই নুরুদ্দীন জঙ্গী স্থলপথে ফাঁদ পেতে রেখেছিলেন। পেছন এবং উভয় পার্শ্ব থেকেও আক্রমণের ব্যবস্থা করে রাখেন। রেনাল্ট সেই ফাঁদে এসে পা দেন। বাঁচার জন্য তিনি অনেক হাত-পা ছোঁড়েন। কিন্তু এক রাতে জঙ্গীর কমান্ডো সেনারা রেনান্টের হেডকোয়ার্টারের উপর হামলা চালায় এবং রেনাল্টকে ধরে ফেলে। খৃস্টানদের আক্রমণ অভিযান শুধু ব্যর্থই হয়নি, বরং তাদের শোচনীয় পরাজয়ও ঘটে। তাদের জীবন ও সম্পদের বিপুল ক্ষতি সাধিত হওয়া ছাড়াও উল্লেখযোগ্য বড় একটি ক্ষতি এই হয় যে, রেনাল্টের ন্যায় একজন যুদ্ধবাজ সম্রাট বন্দি হন।

রেনাল্ট নুরদ্দীন জঙ্গীর অতিশয় মূল্যবান একজন বন্দি ছিলেন। তার মুক্তির বিনিময়ে তিনি খৃস্টানদের থেকে বড় শর্ত আদায়ের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। কিন্তু আয়ু তাঁকে সময় দেয়নি। দুমাস পরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পদস্থ কর্মকর্তা ও সালারগণ তারই এগারো বছর বয়সী পুত্র আল-মালিকুস সালিহকে তার স্থলাভিষিক্ত করেন। তারা আল-মালিকুস সালিহকে পুতুলের ন্যায় ব্যবহার করে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্র প্রস্তুত করে নেয় এবং তাকে পরাজিত করার লক্ষ্যে খৃস্টানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে। এই বন্ধুত্বের প্রথম বিনিময় তারা এই প্রদান করে যে, রেনাল্টের ন্যায় মূল্যবান কয়েদিকে বিনা শর্তে মুক্তি দিয়ে দেয়। সেই থেকে ওস্তাদ নুরুদ্দীন জঙ্গীর পুত্র আল-মালিকুস সালিহর সঙ্গে সুলতান আইউবীর যুদ্ধ-সংঘাত শুরু হয়ে যায়। অন্যান্য আমীরগণও খেলাফত থেকে আলাদা হয়ে যান এবং তারা প্রত্যেকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে সম্মিলিত বাহিনী গঠন করে নেন। তাদের এই আত্মঘাতি অবস্থানের ফলে অন্য সব ক্ষতির পাশাপাশি বড় একটি ক্ষতি এই হয়েছিলো যে, রেনাল্ট একটি সামরিক শক্তির রূপ ধারণ করে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধেই নয়- এখন ইসলামী, দুনিয়ার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসছেন।

আল-মালিকুস সালিহ রেনাল্টের সঙ্গে আরো যে বন্দিদের মুক্তি দিয়েছিলেন, তারাও ইসলামের জন্য বিরাট সমস্যারূপে আবির্ভূত হয়েছে। রেনাল্ট আর পরাজয় এবং অপমানের প্রতিশোধ নিতেও বদ্ধপরিকর। খৃস্টানদের কনফারেন্সে তিনি সকল খৃস্টান বাহিনী যৌথ কমান্ডের অধীনে কাজ করার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। তার বড় কারণ, তিনি স্বাধীন থেকে নিজের প্রত্যয়-পরিকল্পনা অনুযায়ী যুদ্ধ করতে চাচ্ছেন। খৃস্টানদের একটি দুর্বলতা ছিলো, তারা ঐক্যবদ্ধ হতো নাযার যার অবস্থানে থেকে একে অপরকে সহযোগিতা দিয়ে স্বার্থ উদ্ধার করতে চাইতো। তাদের প্রত্যেকের হৃদয়ের আকাঙ্খা ছিলো, একাকি যুদ্ধ করে নিজেই বিজিত এলাকার রাজা হবে। কোনো কোনো ঐতিহাসিক লিখেছেন, খৃস্টানদের এই দুর্বলতা আরব বিশ্বে তাদের অনেক ক্ষতি করেছে। এতো অধিক ও বিশাল সামরিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, সুলতান আইউবীর সারিতে যদি গাদ্দার না থাকতো, খৃস্টানদেরকে আরব দুনিয়া থেকে বিতাড়িত করে ইউরোপের জন্যও তিনি বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতেন।

আপনারা যদি সালাহুদ্দীন আইউবীকে পরাজিত করতে চান, তাহলে আমাদের প্রত্যেকে আপন আপন বাহিনীকে যৌথ কমান্ডের অধীনে ছেড়ে দিতে হবে- রেমন্ড বললেন- অন্যথায় বিক্ষিপ্ত হয়ে আমরা ব্যর্থও হয়ে যেতে পারি। প্রধান সেনাপতি কে হবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেবে জোট।

আমি আপনার সঙ্গে দ্বি-মত করবো না- রেনাল্ট বললেন- তবে আমি সেই কমান্ডের অধীনে থেকে যুদ্ধ করবো না। আমাকে আমার বিগত পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই হবে। তার জন্য আমার স্বাধীনতা প্রয়োজন। নুরুদ্দীন জঙ্গী মরে গেছে। জঙ্গী আমাকে বন্দি করে যেভাবে দামেশক নিয়েছিলো, ঠিক তেমনি আমি সালাহুদ্দীন আইউবীকে বন্দি করে আপনাদের সম্মুখে এনে হাজির করবো। অন্যথায় ইতিহাস আজীবন আমাকে অভিশম্পাত করতে থাকবে। আমি আপনাদের প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা করতে চাই, নুরুদ্দীন জঙ্গী যখন আমার উপর গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে আমার সৈন্যদের বিক্ষিপ্ত করে দিয়েছিলো এবং তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছিলো, তখন আপনাদের কে তার উপর জবাবী হামলা করেছিলেন? কে আমার জন্য সাহায্য নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন? কেউ নন। এখন আপনারা আমার পায়ে শিকল পরাবেন না। আমি এই দিনটির জন্যই বাহিনী প্রস্তুত করেছি। আমার প্রতিশোধের দিন এসে গেছে। আমার ফৌজ আপনাদের কারো ফৌজের পথে প্রতিবন্ধক হবে না। যাকেই আমার সাহায্যের প্রয়োজন হবে, সব রকম ঝুঁকি বরণ করে নিয়ে আমি তাকে সাহায্য করবো। কিন্তু আপনাদের সকলের কাছে আমার নিবেদন, আমাকে শিকলবন্দি করবেন না।

আজ এ পর্যন্তই- বল্ডউইন বললেন- আমাদের আজকের এই কনফারেন্স প্রাথমিক আলাপ-আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলো। আপাতত সিদ্ধান্ত হলো, আমাদের গোপন তৎপরতা গৃহযুদ্ধের আদলে মুলমানদের কোমর ভেঙে দিয়েছে এবং সালাহুদ্দীন আইউবী এদিকে আসার পরিবর্তে মিসর চলে গেছেন। তাই অতিশীঘ্র আমাদেরকে জোরদার আক্রমণ চালাতে হবে। আজকের এই সভায় আমরা আক্রমণের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম। এখন দু-চারদিন আমরা আলাদা আলাদাভাবে চিন্তা-ভাবনা করবো। যারা এ বৈঠকে অনুপস্থিত আছেন, তাদেরকেও তলব করবো। তারপর একদিন বসে আক্রমণের পরিকল্পনা প্রস্তুত করে নেবো। আমাদের বাহিনীগুলো প্রস্তুত আছে। এই ফাঁকে হারমানকে গোয়েন্দা তৎপরতা আরো জোরদার করতে হবে। আইউবীর গুপ্তচরদের পাতাল থেকে হলেও বের করে এনে আটক করতে হবে। এখানকার প্রত্যেক মুসলমানের উপর কড়া নজর রাখতে হবে। প্রতিটি মুসলিম পরিবার ও ব্যক্তির প্রতি মুহূর্তের গতিবিধির, উপর চোখ রাখতে হবে। হারমান! আপনাকে বিশেষভাবে আরো একটি কাজ করতে হবে। পুরুষ হোক কিংবা নারী, এখান থেকে যে-ই বের হবে নিশ্চিত হতে হবে সে শত্রুর চর কিনা।

তা-ই হবে-হারমান বললেন- আমাকে না জানিয়ে এখান থেকে পক্ষিটিও বের হতে পারবে না।

***

রাশেদ চেঙ্গিস ও ভিক্টর। খৃস্টানদের দুই বিশ্বস্ত পরিচারক। নিয়োগ দেয়া হয়েছে গভীর যাচাই-বাছাইয়ের পর। তারপরও এরা সুলতান আইউবীর গুপ্তচর। অতিশয় বিচক্ষণ গোয়েন্দা। হারমানের ন্যায় বিজ্ঞ গোয়েন্দা প্রধানকে পরাজিত করে ঢুকে গেছে খৃস্টানদের একেবারে ভিআইপি কক্ষে। খৃস্টানদের এই কনফারেন্সের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আগা-গোড়া সব আলোচনা- সকল সিদ্ধান্ত তাদের জানা। মধ্যরাতের পর সভা মুলতবি হয়ে গেলে তারা নিজ কক্ষে চলে যায়।

ডিউটি থেকে অনুপস্থিত থাকা আমাদের কারো পক্ষেই সম্ভব নয় ভিক্টর বললো- এসব তথ্য অন্য কারো মাধ্যমে কায়রো পৌঁছাতে হবে। এমন লোক কে আছে?

ইমাম সাহেবের সঙ্গে কথা বলে দেখা যাক- রাশেদ চেঙ্গিস বললো তিনি-ই ভালো জানবেন, কাকে পাঠানো যায়। দ্রুতগতিতে কায়রো পৌঁছার জন্য বিশেষ কোনো ব্যক্তির প্রয়োজন হবে। তবে তাদের পূর্ণ পরিকল্পনা জানার পরই কায়রোকে সংবাদ দেয়া উচিত। অসম্পূর্ণ সংবাদ জেনে সুলতান ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারেন।

ইমাম সাহেবকে এতোটুকু সংবাদ তো জানানো প্রয়োজন যে, খৃস্টানরা অনেক বড় আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে- ভিক্টর বললো- যাতে তথ্য পেয়ে সুলতান অন্তত তার বাহিনীকে প্রস্তুত করতে পারেন এবং অতি দ্রুত ক্ষয়-ক্ষতি পুরণ করে নিতে সচেষ্ট হন। আর শোন, তারা যখন আক্রমণ নিয়ে আলোচনা করছিলো, তখন আমি তোমার দিক তাকিয়েছিলাম। তুমি রেমন্ডের সামনে মদের পেয়ালা রাখতে রাখতে থেমে গিয়েছিলে। তাতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছিলো, তুমি মনোযোগ সহকারে আলোচনা শুনছো। আমি তোমার চেহারা দেখেছিলাম। তাতে আমি লক্ষ্য করার মতো ঔজ্বল্য দেখেছি। আমি জানি, এতোটা মূলবান তথ্য প্রাপ্তিতে উত্তেজনা ও আনন্দের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তোমাকে ভুলে গেলে চলবে না, এ জাতীয় সভা-সমাবেশে হারমানও উপস্থিত থাকেন। হারমান। আমাদের আলী বিন সুফিয়ানের সমপর্যায়ের গোয়েন্দা। আমি তোমার প্রতি তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ হারমানের প্রতিও তাকিয়েছিলাম। আমার মনে হলো, তিনি তোমাকে লক্ষ্য করছেন। সাবধান থেকো ভাই! জানো তো আমরা দুশমনের পেটের মধ্যে বসবাস করি।

হারমানের কাছে আমরা অপরিচিত নই- রাশেদ চেঙ্গিস বললো আমাদের ব্যাপারে তিনি নিঃসন্দেহ। ভয়ের কোনো কারণ নেই।

ভয় নয়- সতর্ক থাকা প্রয়োজন- ভিক্টর বললো- হারমান ন কী নির্দেশনা পেয়েছেন, শুনেছো নিশ্চয়। এখন তিনি যে কাউকে সন্দেহের চোখে দেখবেন। আচ্ছা, তুমি একটা কাজ করো- মসজিদে চলে যাও। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। খৃস্টানরা আজ কী কী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, ইমামকে জানাও। কেউ কায়রো যাওয়ার থাকলে সংবাদটা আলী বিন সুফিয়ানকে জানাতে বলল। আর ওদিক থেকে কেউ আসলে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে যায় না যেন।

নগরীর এক মসজিদের ইমাম সুলতান আইউবীর গুপ্তচর। মসজিদটি গুপ্তচরবৃত্তির গোপন ঠিকানা। সুলতান আইউবীর গোয়েন্দারা মসজিদে গিয়ে ইমামকে সংবাদ পৌঁছায় এবং তার থেকে নির্দেশনা গ্রহণ করে। ভিক্টর কখনো মসজিদে যায়নি। লোকটা নামায পড়ার নিয়ম-কানুন ও মসজিদের আদব-কায়দা কিছুই জানে না। তাই তার ভয়, মসজিদে গেলে খৃস্টানদের কোন মুসলমান গুপ্তচর তাকে ধরিয়ে দিতে পারে। আশঙ্কাটা অমূলক নয়। খৃস্টানদের গুপ্তচরদের মধ্যে এমন অনেক মুসলমান ছিলো, যারা মুসল্লি বেশে মসজিদে যাওয়া-আসা করতো এবং মুসলমানদের কথা বার্তা শুনে তথ্য সংগ্রহ করতো। এভাবে তারা বহু মুসলমানকে খৃস্টানদের হাতে গ্রেফতারও করিয়েছে। রাশেদ চেঙ্গিস যেহেতু নিজেকে মুসলমান পরিচয় দিয়ে রেখেছিলো, তাই দিনের বেলা সে মসজিদে যেতো না। খৃস্টান কমান্ডার প্রমুখ রাতের আসর ও ভোজ-ভাজির অনুষ্ঠান থেকে বিদায় নেয়ার পর প্রয়োজন হলে মধ্য রাতের পর মসজিদ সংলগ্ন ইমামের বাসায় যেতো।

***

রাশেদ চেঙ্গিস পোশাক পরিবর্তন করে। জুব্বা ও পাগড়ি পরিধান করে। মুখে কৃত্রিম দাড়ি স্থাপন করে কক্ষ থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়। এ সময়ে খৃস্টানদের এই কেন্দ্রে রাতেও জাকজমক অব্যাহত থাকে। রেমন্ডের বাহিনী তো আছেই, রেনাল্টও তার অনেক অফিসারসহ এখন এখানে অবস্থান করছেন। আছে তার কয়েকটি সেনা ইউনিটও। এই সেনা অফিসার এবং অন্যান্য খৃস্টান কমান্ডাররা আমোদ-বিনোদনের মধ্যদিয়ে রাত অতিবাহিত করছে। পেশাদার মেয়েদের নাচ-গান ও প্রমোদ চলছে। সারারাত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের স্ত্রী-গণিকারাও সঙ্গে থাকছে। কে কার স্ত্রী, বাছ-বিচার থাকছে না। চলছে নারী বেঁচা-কেনাও।

কক্ষ থেকে বের হয়ে রাশেদ চেঙ্গিসের লুকিয়ে লুকিয়ে যেতে বেশ বেগ পেতে হয়। কক্ষে কক্ষে ও তাঁবুতে তাঁবুতে তো বেহায়াপনা চলছেই, বাইরেও কোথাও কোথাও একই আচরণ চোখে পড়ে। তাদের এড়িয়ে ভিন্ন পথ ধরতে হলো রাশেদ চেঙ্গিসকে। অবশেষে সে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাটা নিরাপদে অতিক্রম করে ফেলে এবং নগরীর গলিপথে ঢুকে পড়ে। তারপর মসজিদের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

রাশেদ চেঙ্গিস এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে যখন মসজিদে প্রবেশ করতে শুরু করে, তখন সে অনুভব করে, কে যেনো গলির মধ্যে পা টিপে টিপে হেঁটে এসে একদিকে মোড় নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। রাশেদ চেঙ্গিস হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবে। কিন্তু পরক্ষণে কুকুর-বিড়াল বা অন্য কোন প্রাণী হতে পারে মনে করে নিশ্চিন্ত হয়ে যায়। সে মসজিদের বারান্দায় ঢুকে পড়ে এবং ইমামের কক্ষের দরজায় বিশেষ পদ্ধতিতে করাঘাত করে। দরজা খুলে যায়। রাশেদ চেঙ্গিস ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং ইমামকে ঘটনার বিস্তারিত রিপোর্ট প্রদান করে।

খৃস্টানদের বেশির ভাগ সৈন্য এখানে সমবেত হবে–চেঙ্গিস বললো এরা হবে রেনাল্টের ফৌজ। এখানকার বাহিনী তো পূর্ব থেকেই এখানে উপস্থিত আছে। এই বাহিনীর অভিযান এবং প্রত্যয়ের সংবাদ তো কায়রো পেয়েই যাবে। আমরা চেষ্টা করলে যাত্রার আগেই বাহিনীর কিছু ক্ষতিসাধন করতে পারি এবং তাদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে পারি।

অর্থাৎ- তুমি বলতে চাচ্ছো, আমাদের কমান্ডো বাহিনীকে বলবো, তারা যেনো খৃস্টান বাহিনীর রসদে আগুন ধরিয়ে নষ্ট করে দেয়- ইমাম বললেন- এ কাজটা আমি করাতে পারি। কিন্তু করাবো না। তুমি নিশ্চয় এমন বহু ঘটনা শুনেছো, যে অধিকৃত অঞ্চলে আমাদের কমান্ডো সেনারা খৃস্টানদের ক্ষতিসাধন করেছে, সেখানকার মুসলমান বাসিন্দাদের জীবন জাহান্নামের চেয়েও কঠিনতর করে তোলা হয়েছে। ঘরে ঘরে তল্লাশী হয়েছে। আমাদের সম্ভ্রান্ত মা-বোনদের লাঞ্চিত করা হয়েছে। যুবতী মেয়েদেরকে খৃস্টানরা তুলে নিয়ে গেছে। সর্বোপরি বন্দিত্ব ও হত্যা-নির্যাতন শুরু হয়ে গেছে। আমি দূত মারফত সুলতান আইউবীকে সমস্যাটা অবহিত করেছি। সুলতান সম্পূর্ণ আমার আশানুরূপ উত্তর প্রেরণ করেছেন। তিনি বলেছেন, এখন থেকে মুসলিম অধিবাসীদের মর্যাদা, জীবন ও সম্পদের খাতিরে কোন শহরে গোপন ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা বন্ধ থাকবে। দুশমনের রসদ বাহিনীর সঙ্গে আসতে দাও, আমার গেরিলা সৈনিকরা সেগুলো রণাঙ্গনে যেতে দেবে না।

পূর্ণাঙ্গ সংবাদ আমি আপনাকে দু-চারদিনের মধ্যেই জানাতে পারবো- চেঙ্গিস বললো- আপনি এখন আরো সতর্ক হয়ে যান। এখানকার গুপ্তচররা অস্বাভাবিক রকম তৎপর হয়ে ওঠেছে। এখন থেকে তারা এখানকার পশু-পাখিগুলোকেও সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখবে।

একজনকে কায়রো পাঠিয়ে দেয়া হবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে চেঙ্গিস মসজিদ থেকে বেরিয়ে যায়। এখন আর তার মধ্যে কোন লুকোচুরি নেই, যাতে কেউ সন্দেহ না করে। গলির দিকে মোড় নেয়ামাত্র আবারো যেনো কারো পায়ের শব্দ কানে এলো। চেঙ্গিস মোড় ঘুরিয়ে তাকায়। গলিটা অন্ধকার। কিছুই দেখতে ফেলো না। চেঙ্গিস সামনের দিকে হাঁটা দেয়। গন্তব্যের কাছাকাছি গিয়ে কৃত্রিম দাড়ি খুলে কাপড়ের নীচে লুকিয়ে ফেলে। পোশাকে তাকে সন্দেহ করার কোন কারণ নেই। এমন পোশাক খৃস্টানরাও পরে থাকে।

এখন ভিক্টর ও চেঙ্গিসের প্রচেষ্টা, কীভাবে খৃস্টানদের আক্রমণ পরিকল্পনার বিস্তারিত জানা যায়। খৃস্টান বাহিনী কোথায় কোথায় আক্রমণ করবে এবং তাদের রওনা হওয়ার প্রোগ্রাম কী ইত্যাদি। অধিক থেকে অধিকতর সৈন্য সমাবেশ ঘটানোর জন্য আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। দূতদের দৌড়ঝাঁপ চলছে। এখানকার জন্য রেমন্ড হলেন মেজবান। এটি তার রাজধানী। এক রাতে তিনি সকল খৃস্টান সম্রাট, উচ্চপদস্থ কমান্ডার ও অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিমন্ত্রণ করেন। মেহমানগণ ভোজ সভায় উপস্থিত। ভিক্টর ও চেঙ্গিস মহাব্যস্ত নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ নেই। যেহেতু মেহমানদের মধ্যে সম্রাটগণও আছেন, তাই তাদের মদ ইত্যাদি পরিবেশনের জন্য ভিক্টর-চেঙ্গিসকে প্রস্তুত থাকতে হচ্ছে। তবে তাদের জানা আছে, এই সতর্ক প্রস্তুত ততোক্ষণ পর্যন্ত থাকতে হবে, যতক্ষণ মেহমানদের চেতনা ঠিক থাকে। পরে যখন মদ মাতাল হয়ে তারা অসামাজিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তখন চাকর-নকরদের ব্যস্ততা কমে যায়।

আজকের আসরে যতোজন পুরুষ, ততোজন নারী। রূপসী যুবতীরা আছে। আছে এমন নারীও, যারা বার্ধক্যে উপনীত হয়ে গেলেও তরুণী সেজে ধোকা দিচ্ছে। ভিক্টর ও চেঙ্গিস খাবার-মদ ইত্যাদি পরিবেশনের দায়িত্বে নিয়োজিত চাকরদের কাজ তদারকি করছে এবং ছুটোছুটি করছে। এক ইউরোপীয় তরুণী চেঙ্গিসের নিকট দু-তিনবার মদ চায়। প্রতিবারই চেঙ্গিস কোনো চাকর বা চাকরানিকে ডেকে বলে দেয়, একে মদ দাও। সে সময়ে মেহমানগণ রেমন্ডের মহলে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিলো। মেয়েটি অত্যন্ত রূপসী। চেঙ্গিসকে বারবার চাকরদের ডেকে মদ দিতে বলছে দেখে সে মুচকি হেসে বললো- আমি তোমার হাতে পান করতে চাচ্ছি আর তুমি কিনা চাকরদের নির্দেশ দিয়ে এদিক-ওদিক চলে যাচ্ছো।

আজ্ঞে, আমিই এনে দিচ্ছি।- চেঙ্গিস ভৃত্যসুলভ ভঙ্গিতে বললো।

এখানে নয়- মেয়েটি বললো- আমি বাইরে বাগানে যাচ্ছি। ওখানে নিয়ে আসো।

মেয়েটি মহল থেকে বের হয়ে বাগানে এক স্থানে গিয়ে বসে। এটি মহলের বাগিচা। রাশেদ চেঙ্গিস আকর্ষণীয় একটি সোরাহীতে করে মদ নিয়ে সেখানে চলে যায়। ওখানেও মেহমানগণ ছড়িয়ে রয়েছে। সকলেই যৌন উন্মাদ। প্রত্যেকের হাতে মদের পেয়ালা আর সঙ্গে একজন করে নারী। এই মেয়েটি একা। এমন রূপসী এক যুবতী একা কেন ভেবে চেঙ্গিস বিস্মিত হয়। মেহমানদের তো এর দেহের চার পাশে মাছির ন্যায় ভন ভন করার কথা ছিলো। এখানে চলে তো এ সবই। যা হোক, চেঙ্গিস মেয়েটির পেয়ালায় মদ ঢালতে শুরু করে। মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, তোমার বাড়ি কোথায়? চেঙ্গিস ইউরোপের একটি গ্রামের নাম উল্লেখ করে বললো, কৈশোর থেকেই আমি সম্রাট রেমন্ডের রাজ কর্মচারি।

তুমি কি কিছু সময় আমার কাছে থাকতে পারো?-তরুণী জিজ্ঞেস করলো এবং পেয়ালাটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো- নাও, আমার পেয়ালা তুমি পান করো। আমি পরে পান করবো। মেয়েটির কণ্ঠে অনুনয় ও তৃষ্ণার সুর।

দেখুন, আমি একজন ভৃত্য- চেঙ্গিস বললো- আপনি রাজকন্যা। এ মুহূর্তে ডিউটি ছাড়া আমি অন্য কাজে সময় দিতে পারি না। এখনো আমি ডিউটিতে আছি।

এ মুহূর্তে আমাকে তোমার চাকরানি মনে করো- মেয়েটি রাশেদ চেঙ্গিসের হাত ধরে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো- তুমি রাজপুত্র। মানুষের মনই বলে দেয় কে কী।

আপনি একা কেন? চেঙ্গিস জিজ্ঞাসা করে।

কারণ, আমার মন সায় দেয় না, যার প্রতি আমার ঘৃণা, তার সঙ্গে হাসবো, খেলা করবো- মেয়েটি জবাব দেয়- আমার যাকে ভালো লাগে, সে এখন আমার সঙ্গে। এখন আমি নিঃসঙ্গ নই, একা নই। কিন্তু তুমি আমার হাত থেকে পেয়ালাটা নাওনি!

কেউ দেখে ফেললে আমাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে। চেঙ্গিস বললো।

তুমি যদি আমার পেয়ালা থেকে এক ঢোকও পান না করো, তাহলে আমিই তোমাকে শূলিতে দাঁড় করাবো- মেয়েটি বললো। মেয়েটির মুখে মুচকি হাসি। এবার আরো একটু এগিয়ে রাশেদ চেঙ্গিসের একেবারে কাছে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো- পাগল! দেখো, তোমাকে আমার এতোই ভালো লাগে যে, একান্ত বাধ্য হয়েই আমি তোমাকে ডেকে এনেছি। আমাকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করো না।

আমি মদপান করবো না। চেঙ্গিস বললো।

তা না করো- মেয়েটি বললো- কিন্তু আমি যখন এবং যেখানে ডাকি, তোমাকে যেতে হবে।

রাশেদ চেঙ্গিস বুদ্ধিমান ও অভিজ্ঞ মানুষ। উচ্চস্তরের একটি রূপসী মেয়ে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব-ভালোবাসার আকাঙ্খা প্রকাশ করছে বলে সে বিন্দুমাত্র বিস্মিত হয়নি। তার এ-ও মনে হয়, মেয়েটি হয়তো কোনো বৃদ্ধ সেনাপতির স্ত্রী কিংবা এমন এক পুরুষের বউ, যে এই মুহূর্তে অন্য কারো স্ত্রীকে নিয়ে আমোদে মেতে আছে। একটা কারণ তো স্পষ্ট যে, রাশেদ চেঙ্গিস সুদর্শন যুবক, যার দেহে আকর্ষণ আছে। কোন নারীর তাকে আকৃষ্ট করার প্রচেষ্টা এটাই প্রথম নয়। খৃস্টান সম্রাট ও উচ্চপদস্ত অফিসারদের ভোজসভায় মদ পরিবেশেনকারী মেয়েরা অতিশয় রূপসী এবং চিত্তহারীই হয়ে থাকে। তাদের দুজন ইতিমধ্যে রাশেদ চেঙ্গিসের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানোর চেষ্টা করে ফেলেছে। কিন্তু চেঙ্গিস তাদের পাত্তা দেয়নি। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী তাকে যে দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছিলেন, তার দাবি ছিলো, নিজের চারিত্রিক পবিত্রতাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।

প্রশিক্ষণের সময় আলী বিন সুফিয়ান তাকে ধারণা প্রদাণ করেছেন, মস্তিষ্ক যদি বিলাসিতার প্রতি ঝুঁকে পড়ে, তাহলে মন থেকে কর্তব্যবোধ হারিয়ে যেতে শুরু করে। তাকে বুঝানো হয়েছে, নারী এমন এক বিষের ন্যায়, যে মানুষের ঈমান খেয়ে ফেলে। রেমন্ড আর ত্রিপোলীর মহলে তার অবস্থান ছিলো, সে যখন ইচ্ছা যে কোনো চাকর-চাররানিকে চাকুরিচ্যুৎ করতে পারতো। তাছাড়া তার ব্যক্তি চরিত্র ছিলো যাদুর ন্যায় ক্রিয়াশীল। তার এ-ও জানা ছিলো, খৃস্টানদের কোনো চরিত্র নেই। তাদের নারীরা নির্লজ্জতা ও অসচ্চরিত্রকে গৌরব মনে করে থাকে। এসব কারণে চেঙ্গিস এর নিকট এই মেয়েটি এবং তার খোলামেলা প্রেমনিবেদন বিস্ময়কর বিষয় ছিলো না।

রাশেদ চেঙ্গিস যেহেতু একজন যোগ্য গুপ্তচর, তাই সে ততক্ষণাৎ ভাবে, নিজের গোয়েন্দা পরিচয় গোপন রেখেই মেয়েটাকে চরবৃত্তিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই যে মেয়েটি বললো, আমি তোমাকে যখন এবং যেখানে আসতে বলি, আসতে হবে তার এই বক্তব্যে কোন নির্দেশ বা হুমকি নেই। আছে বন্ধুসুলভ সরলতা। তার বাচনভঙ্গির ক্রিয়াও চেঙ্গিসের অজানা নয়। মেয়েটির মুচকি হাসির জবাবে রাশেদ চেঙ্গিসও মুখ টিপে একটা হাসি উপহার দিয়েছিলো। এই হাসির মাধ্যমে শিকারীকে নিজের পাতা জালে আটকানোর প্রচেষ্টা ছিলো।

এবার যেতে পারি কি?- রাশেদ চেঙ্গিস বললো- আমার ডিউটি এখনো শেষ হয়নি। আপনি মেহমানদের মাঝে চলে যান। পরক্ষণে চেঙ্গিস খানিকটা ঝাঝালো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে- আপিন কার স্ত্রী?

স্ত্রী নই-গণিকা- মেয়েটি বললো এবং একজন উচ্চপদস্থ কমান্ডারের নাম উল্লেখ করে বললো- অভাগার কাছে ঢের সম্পদ আছে। এখানে এসে আরেকজন পেয়ে গেছে। এখন আর আমার প্রয়োজন নেই। আমাকে মুক্তও করে দেয় না। আমি নিজের পছন্দের বাইরে কিছু করতে পারি না। লোকটাকে আমার একটুও ভালো লাগে না। নিজের পছন্দ-অপছন্দ এমন. একটা বিষয় যে, যার নিজস্ব পছন্দ থাকে, তার যাকে ভালো লেগে যায়, সে রাজা না গোলাম, সেই বিবেচনা করে না। প্রেম প্রেমই। প্রেমের কাছে রাজাও যা, গোলামও তা। তোমার পদমর্যাদায় আমার কোনো কাজ নেই। তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেও না। অন্যথায় আমার প্রতি অবিচার হবে। তুমিই প্রথম মানুষ, আমার হৃদয় যাকে পছন্দ করেছে। আমি দৈহিক পরিতৃপ্তির পিয়াসী নই। আমার আত্মা পিপাসু। তোমার চোখের তারাই পারবে আমার আত্মার পিপাসা নিবারণ করতে। এখন যাও। কাল রাত আমিই তোমাকে খুঁজে নেবে।

***

রাশেদ চেঙ্গিস যে সময়ে মেয়েটির সঙ্গে বাগিচায় অবস্থান করছিলো, সে সময়ে তার সঙ্গী ভিক্টর মেহমানদের মাঝে ঘোরাফেরা করছিলো। এই ফাঁকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে ফেলেছে সে। খৃস্টানরা অগ্রযাত্রা কোন্‌দিকে করবে, আক্রমণ কোথায় করবে ইত্যাদি সকল তথ্য জেনে ফেলেছে ভিক্টর। কিন্তু বিষয়গুলো এখনো প্রস্তাব ও পরামর্শের পর্যায়েই রয়েছে। রাশেদ চেঙ্গিসও মেহমানদের মাঝে ফিরে গেছে এবং রেনাল্টের আশপাশে ঘুরতে শুরু করেছে। রেনাল্ট সঙ্গীদের সামনে তার সেই প্রত্যয়ের কথাই পুর্নব্যক্ত করছে, যা তিনি কনফান্সে ব্যক্ত করেছিলেন। তার হাতে এতো প্রবল সামরিক শক্তি রয়েছে, যার উপর ভিত্তি করেই তিনি এতো বড় দাবি করছেন।

রাত কেটে গেছে। পরদিন চেঙ্গিসের নিকট তার দলের এক গোয়েন্দা এসে পৌঁছে। চেঙ্গিস তাকে মধ্য রাতের পর ইমামের কাছে যেতে বলে। দিন কেটে রাত এলো। চেঙ্গিস ও ভিক্টর রেমন্ডের ভোজসভায় ডিউটিতে চলে যায়। যখন অবসর হয়, তখন গভীর রাত। চেঙ্গিস ভিক্টরকে এখনো বলেনি, একটি মেয়ে তাকে প্রেম নিবেদন করেছে। ডিউটি থেকে অবসর হয়ে সে ভিক্টরকে বললো, আমি পোশাক পরিবর্তন করে ইমামের কাছে যাচ্ছি। ভিক্টর ইমামকে অবহিত করার জন্য তাকে বেশ কিছু তথ্য প্রদান করে।

চেঙ্গিস পোশাক পরিবর্তন করে এবং মুখে কৃত্রিম দাড়ি স্থাপন করে মুখমন্ডলটা ঢেকে কক্ষ থেকে বের হয়ে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। ভবনটির খানিক দূরে সবুজ ভূমি, যাতে বিপুল গাছ-গাছালির সমারোহ। আশপাশে কোনো বসতি নেই। এই প্রাকৃতিক বাগিচাটির মধ্য দিয়েই চেঙ্গিসকে যেতে হচ্ছে।

চেঙ্গিস সবে বাগানে ঢুকেছে। অমনি একটি বৃক্ষের আড়াল থেকে এক ছায়ামূর্তি আত্মপ্রকাশ করে তার দিকে এগুতে শুরু করে। চেঙ্গিস ঝটপট মুখমন্ডল থেকে কৃত্রিম দাড়িগুলো খুলে চোগার পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে। তার ধারণা, এখানে এখানকারই তার পরিচিত কোনো চাকর ছাড়া অন্য কেউ আসতে পারে না। সে হাঁটার গতি কমিয়ে দিয়ে ধীর পায়ে পায়চারি করতে শুরু করে।

ছায়াটা ডান দিক থেকে আসছিলো। নিকটে এসেই বলে ওঠলো বলেছিলাম না, আমিই তোমাকে খুঁজে নেবো। চেঙ্গিস একটি নারীকণ্ঠ শুনতে পায়। গত রাতের সেই মেয়েটি।

এতো মেহমান, এতো কাজ- আমার মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে চেঙ্গিস বললো- হাওয়া খাওয়ার জন্য এদিকে চলে আসলাম।

আমি তোমার কক্ষের দিকে আসছিলাম- মেয়েটি বললো- তোমাকে এদিকে আসতে দেখলাম। কিন্তু তোমার পেছনে পেছনে না এসে ওদিক দিয়ে আসলাম। যাতে কেউ দেখতে না পায়। বসবে, নাকি পায়চারিই করবে? আমি সোরাহী আর দুটি পেয়ালা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। মেয়েটি হেসে ওঠে।

রাশেদ চেঙ্গিস মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো না, তুমি থাকো কোথায় আর এতো রাতে কোথা থেকে লাফিয়ে পড়েছো? এ কথাও জানতে চায়নি, তুমি যার গণিকা, এই গভীর রাতে সে তোমাকে খুঁজবে কিনা। তার বিশ্বাস, মেয়েটি আবেগ দ্বারা তাড়িত এবং মাথায় ঝুঁকি বরণ করে নিচ্ছে। তথ্য নেয়ার জন্য চেঙ্গিস তাকে জিজ্ঞেস করলো- তুমি তোমার কমান্ডার প্রভু থেকে মুক্তি পেতে চাচ্ছো। এটা তখন সম্ভব হবে, যখন তিনি যুদ্ধে চলে যাবেন। কিন্তু এমন সম্ভাবনা চোখে পড়ছে না। আচ্ছা, তিনি কোন্ ফৌজে আছেন?

তিনি বল্ডউইনের ফৌজের হাইকমান্ডের সেনাপতি- মেয়েটি উত্তর দেয়- সম্ভবত যুদ্ধে চলে যাবেন। কিন্তু তিনি আমাকে ও অন্যান্য মেয়েদেরকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন।

যুদ্ধের কোনো সম্ভাবনা আছে নাকি?–চেঙ্গিস জিজ্ঞেস করে- এখানে কেননা এসেছো?

বল্ডউইন তাকে এখানে এ উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন যে, তিনি যুদ্ধের সম্ভাবনা সৃষ্টি করবেন। মেয়েটি উত্তর দেয়।

সালাহুদ্দীন আইউবীর ফৌজ কোথায়? চেঙ্গিস জিজ্ঞেস করে।

তা তো জানি না- মেয়েটি বললো- তোমার প্রয়োজন হলে জিজ্ঞেস করে বলবো।

রাশেদ চেঙ্গিস মেয়েটিকে আরো বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করে। মেয়েটির যা যা জানা ছিলো বলে দেয় এবং যা জানা ছিলো না, সে সম্পর্কে বলে, আমি জেনে তোমাকে পরে জানাবো।

আচ্ছা, কে লড়াই করলো আর কে জয়লাভ করলো, তাতে তোমার কী আসে-যায়?- মেয়েটি আবেগময় ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে- তিনি যদি আমাকে যুদ্ধের মাঠে যেতে বলেন, আমি যাবো না। আমি তো তার স্ত্রী নই। আমি না আমার বর্তমান প্রভুর দাসী, না সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে আমার শত্রুতা আছে। আমাকে এতোই অপদস্থ করা হয়েছে যে, এদের প্রত্যেককে যারা নিজেদেরকে ক্রুশের মোহাফেজ মনে করে বিষ প্রয়োগ করে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হয়।

আবেগে আপ্লুত হয়ে মেয়েটি রাশেদ চেঙ্গিসকে ধরে বসিয়ে ফেলে। পেয়ালা দুটো মাটিতে রেখে তাতে মদ ঢালে এবং একটি পেয়ালা চেঙ্গিসের হাতে দিয়ে বললো- এমন নির্জন আর গভীর অন্ধকার রাতের রোমাঞ্চকে যুদ্ধের আলাপ দিয়ে নষ্ট করো না, নাও পান করো।

চেঙ্গিস সমস্যায় পড়ে যায়। দেড় বছর যাবত এই মদ্যপদের মাঝে জীবন অতিবাহিত করছে চেঙ্গিস। নিজ হাতে তাদের মদপান করাচ্ছে। কিন্তু নিজে কখনো এক ঢোকও পান করেনি। এই পাপপূর্ণ পরিবেশে যেখানে প্রতি মুহূর্তে চলে লোভনীয় পাপের আহ্বান, সেখানেও চেঙ্গিস নিজের ঈমানে কলঙ্কের দাগ পড়তে দেয়নি। এখন এমন একটি মেয়ে তার হাতে এসে ধরা দিয়েছে, যার মাধ্যমে সে নিজের কর্তব্য ভালোভাবে পালন করতে পারতো। কিন্তু মেয়েটি তার ঠোঁটের সামনে মদের পেয়ালা এগিয়ে ধরলো। আশঙ্কা হচ্ছে, আবেদন প্রত্যাখ্যান করলে মেয়েটি ফসকে যেতে পারে। চেঙ্গিসের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে কর্তব্য পালনের খাতিরে পেয়ালাটা হাতে নিয়ে দুঢোক পান করে নেবে, নাকি এমন মূল্যবান মেয়েটাকে হাতছাড়া করে ফেলবে।

আমি মদ পছন্দ করি না। চেঙ্গিস বললো।

খোদা তোমাকে পুরুষালী রূপ আর চিত্তাকর্ষক দেহবল্লরী দান করেছেন- মেয়েটি বললো- কিন্তু মদপান না করে প্রমাণ করছো, তুমি পাথরের নিষ্প্রাণ একটি মূর্তি বৈ নও।

অনেক্ষণ পর্যন্ত পীড়াপীড়ি ও প্রত্যাখ্যানের সংঘাত চলতে থাকে। অবশেষে চেঙ্গিস রূপসী মেয়েটাকে জালে আটকানোর নিমিত্তে তার হাত থেকে মদের পেয়ালাটা নিয়ে নেয়। তারপর পেয়ালায় মুখ লাগায়। মেয়েটি তার পেয়ালায় আরো মদ ঢেলে দেয়। চেঙ্গিস কম্পিত হাতে পেয়ালাটা পুনরায় ঠোঁটের সঙ্গে লাগিয়ে ধীরে ধীরে পেয়ালাটা খালি করে ফেলে। খানিক পর সে অনুভব করতে শুরু করে, যেনো তার কল্পনার জগতে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। তার আশপাশে প্রাচীরসমূহ ভেঙে পড়ছে এবং সে স্বাধীন হয়ে গেছে মনে করে আনন্দে আপ্লুত হয়ে ওঠে। যেনো তাকে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে মুক্তি তাকে দেয়া হয়েছে।

রাশেদ চেঙ্গিস নারীর পরশের সাথে পরিচিত ছিলো না। বিয়েও করেনি। অবিবাহিত হওয়া এবং পেছনে লেজুড় না থাকার কারণেই তাকে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য বেছে নেয়া হয়েছিলো। এটি তার প্রাথমিক গুণ। কিন্তু একটি অতিশয় রূপসী মেয়ে তাকে মদপান করিয়ে যখন তার গা ঘেঁষে বসে পড়লো, তখন অবিবাহিত পরিচয়টাই তার জন্য দুর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়ালো। মেয়েটি তাকে কোন পাপের আহ্বান জানাচ্ছে না। তার কাছে সে সেই ভালোবাসা প্রত্যাশা করছে, যা তার আত্মাকে শান্তি দেবে। যেহেতু চেঙ্গিসের চরিত্রে পাপ প্রবণতা ছিলো না, তাই এ মুহূর্তেও তার মনে কোন বাজে ইচ্ছা জাগ্রত হলো না। কিন্তু রূপসী মেয়েটির রেশমী চুলের পরশ, পিপাসু আবেগময় বক্তব্য, সুডৌল বাহু আর সুকোমল গণ্ডদেশ রাশেদ চেঙ্গিসকে সেই চেঙ্গিস থাকতে দিলো না, যা সে দুটেক মদ কণ্ঠনালীতে প্রবেশের আগে ছিলো।

রাত কেটে যাচ্ছে।

রাশেদ চেঙ্গিস যখন আলাদা হওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়, তখন মেয়েটি তাকে জিজ্ঞেস করে- তুমি আমাকে যুদ্ধ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করেছিলে। আমার সবকিছু জানা নেই। তুমি যদি সবগুলো প্রশ্নের উত্তর পেতে চাও, তাহলে এসব প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করে আগামী রাতে আবার দেখা করবো।

অকস্মাৎ চেঙ্গিসের মধ্যে সেই চেঙ্গিস জেগে ওঠে, সে সুলতান আইউবীর গোয়েন্দা ছিলো। তার কর্তব্যের কথা মনে পড়ে যায়। এ অনুভূতিও জেগে ওঠে, তার উপর মদ ও নারীর নেশা আচ্ছন্ন হয়ে আছে এবং তাকে অনেক সতর্ক থাকতে হবে। সে মেয়েটিকে বললো- তোমার মতো আমারও যুদ্ধের প্রতি কোনো আন্তরিকতা নেই। আমি শান্তির জীবনে বিশ্বাসী। ফৌজ অভিযানে রওনা হলে মদ নিয়ে আমাকেও তো যেতে হবে। তাই জানতে চেয়েছিলাম, আসলেই সহসা কোনো যুদ্ধ হচ্ছে কিনা এবং হলে কোথায় হবে এবং ফৌজ কোন্ পথে অগ্রসর হবে।

***

ফিরে এসে রাশেদ চেঙ্গিস ভিক্টরকে তখনই ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা সমীচীন মনে করলো না। তার কষ্টটা হলো, সে ইমামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রওনা হয়েছিলো; কিন্তু পথে মেয়েটি তাকে আটকে দিলো এবং তাকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেলো। সময়টা রাতের শেষ প্রহর। খৃস্টানদের এই বিলাসী জগতে সকাল সকাল জাগ্রত হওয়ার কোনো নিয়ম নেই। চেঙ্গিস ইমামের কাছে যেতে পারতো। কিন্তু মুখে মদের গন্ধ নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করার সাহস হলো না। তার মনে অনুভূতি জাগ্রত হলো, মদপান গুরুতর পাপ। কিন্তু পাপটা সে করে ফেলেছে। তথাপি যখন মেয়েটি তার মনের পর্দায় ভেসে ওঠলো, তার মধ্যে কোন দোষ দেখতে পেলো না। প্রেমের মাদকতা তাকে নতুন করে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। নারীর কল্পনার সঙ্গে কোনো পাপের সংশ্লিষ্টতা ছিলো না। এটি পবিত্র ভালোবাসার আনন্দ, যা ত্যাগ করতে চেঙ্গিস প্রস্তুত নয়।

চেঙ্গিস শুয়ে পড়ে। তার দুচোখের পাতা বুজে আসে।

ভিক্টর চেঙ্গিসকে জাগিয়ে তোলে। সূর্যটা মাথার উপর উঠে এসেছে। ভিক্টরই প্রথম কথা বলে- ইমামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসেছো? কী কথা হয়েছে?

না- চেঙ্গিস ভিক্টরকে অবাক করে দেয়- মসজিদ পর্যন্ত যেতে পারিনি।

চেঙ্গিস ভিক্টরকে ঘটনার ইতিবৃত্ত শুনিয়ে বললো- যদি মদপান না করতাম, তাহলে মেয়েটি থেকে আলাদা হওয়ার পরও ইমামের কাছে যেতে পারতাম। সময় ছিলো।

মদপান করে ভালো করোনি- ভিক্টর বললো- আগামীতে আর পান করো না। মেয়েটিকে হাত করার জন্য দুঢোক পান করেছে বেশ; কিন্তু কর্তব্য পালনে ত্রুটি করা ঠিক হয়নি। ইমামের কাছে যাওয়া তোমার কর্তব্য ছিলো। ইমাম সাহেব তোমার অপেক্ষায় পেরেশান হয়ে থাকবেন। দিনের বেলা যাওয়া ঠিক হবে না। আজ রাতে অবশ্যই যেতে হবে।

ভিক্টর চেঙ্গিসকে জিজ্ঞেস করে- তুমি তো আনাড়ি নও চেঙ্গিস। নিজেই তো বুঝতে পারো মেয়েটির উদ্দেশ্য কী এবং সত্যিই সে অন্তর থেকে তোমাকে ভালোবাসে কিনা? তোমাকে বুঝতে হবে, সে তোমাকে ধোকা দিচ্ছে, নাকি তোমাকে মনোরঞ্জনের উপকরণে পরিণত করতে চাচ্ছে। তার ফেরেশতাও তো জানে না তুমি গুপ্তচর। আমি তোমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া আবশ্যক মনে করি যে, নারীর যাদু ফেরাউনদের ন্যায় রাজাদেরকেও সিংহসান থেকে নামিয়ে খড়-কুটোর মধ্যে গুম করে ফেলেছে। নিজের জাতিটাকেই দেখো না, খৃস্টানদের প্রেরিত চিত্তহারি মেয়েরা মিসরে বিদ্রোহের আগুন পর্যন্ত প্রজ্বলিত করেছে এবং সুলতান আইউবীর অতিশয় বিশ্বস্ত সালারদেরকে গাদ্দারে পরিণত করেছে!

আমি এতো কাঁচা নই ভিক্টর- চেঙ্গিস বললো- মেয়েটাকে মজলুম মনে হচ্ছে। ও যে রক্ষিতা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু রাজকন্যা বা বেশ্যা নয়। চাল-চলন, পোশাক-পরিচ্ছদ, গহনা-অলংকার এসবের উপর ভিত্তি করে আমি তাকে শাহজাদি মনে করি। কিন্তু মনের দিক থেকে সে নির্যাতিতা। মেয়েটা পবিত্র ভালোবাসার প্রত্যাশী। তার সকরুণ নিবেদন প্রত্যাখ্যান করে তার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে চাইনি আমি। তুমি ভেবো না আমি তার হয়ে যাবো। তার ভালোবাসা প্রয়োজন- আমি তা তাকে দেবো। আমার তথ্য প্রয়োজন তা আমি তার কাছ থেকে নেবো।

তুমি মন থেকেই তাকে কামনা করছো বুঝি? ভিক্টর সন্দেহ প্রকাশ করে।

হা ভিক্টর- চেঙ্গিস জবাব দেয়- আমি তোমার থেকে কিছুই লুকাবো না। মেয়েটি আমার হৃদয়ে ঢুকে পড়েছে।

অন্তরে ঢুকে পড়া মেয়েরা পায়ের বেড়িতে পরিণত হয়ে যায় চেঙ্গিস।- ভিক্টর বললো- আমি তোমাকে এর চে বেশি আর কী বলতে পারি যে, কর্তব্যই সবার বড় ও সবচে পবিত্র। কর্তব্য ও প্রেমের মাঝে, নেশা ও চেতনার মাঝে, ঈমান ও আবেগের মাঝে এমন কোনো প্রাচীর থাকে না, যা অতিক্রম করা দুঃসাধ্য। থাকে চুলের ন্যায় সরু একটি রেখা, যা সামান্য পদস্খলনে মুছে যায় এবং মানুষ একদিক থেকে অন্যদিকে চলে যায়। এমনটা যেনো না হয় রাশেদু! তার থেকে তথ্য নিতে নিতে তুমিই বরং নিজেকে তার সম্মুখে উন্মোচিত করে ফেলো।

রাশেদ চেঙ্গিস একটা অট্টহাসি দিয়ে ভিক্টরের উরুতে চাপড় মেরে বললো- এমনটা হবে না দোস্ত, এমনটা হবে না।

আর স্মরণ রেখো বন্ধু!- ভিক্টর বললো- মদের সম্পর্ক শয়তানের সঙ্গে। শয়তানের যততগুলো গুণ আছে, সব মদের মধ্যে আছে। এই অভ্যাসটা গড়ে না ওঠে যেনো। মেয়েটাকে খুশি রাখার জন্য যতোটুকু পান করে চৈতন্য ঠিক রাখা যায়, তার বেশি পান করো না।

আচ্ছা, ইমামকে জানানো দরকার, রাতে বিশেষ কারণে আমি যেতে পারিনি। আজ রাতে আসবো। চেঙ্গিস বললো।

বাজারে চলে যাও। ভিক্টর বললো।

ভিক্টর নিজেই বাজারে চলে যায়। তাদের দু-চারজন সঙ্গী বাজারে ব্যবসার আড়ালে দায়িত্ব পালন করছে। ইমামের কাছে ছোটখাট সংবাদ তাদেরই মাধ্যমে পৌঁছানো যায়। ভিক্টর তাদের একজনকে সংবাদ বলে ফিরে আসে।

***

পরবর্তী রাত। চেঙ্গিস কাজ-কর্ম সেরে তাড়াতাড়ি অবসর হয়ে যায়। কক্ষে প্রবেশ করে ডিউটির পোশাক খুলে অন্য পোশাক পরে কৃত্রিম দাড়িগুচ্ছ পোশাকের তলে লুকিয়ে নেয়। তার ভয়, মেয়েটি হঠাৎ দেখে ফেললে দাড়ির রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে। তার পরিকল্পনা, ইমামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ফিরে আসার পথে মেয়েটির সঙ্গে নির্দিষ্ট স্থানে মিলিত হবে। যাবেও সে পথেই। এ পথটি নিরাপদ এবং সংক্ষিপ্ত। চেঙ্গিস গাছ গাছালিতে পরিপূর্ণ এলাকাটিতে ঢুকে পড়ে। মাঝামাঝি স্থানে গিয়ে পৌঁছুলে একদিক থেকে একটি পরিচিত ছায়া এগিয়ে আসতে দেখে। চেঙ্গিসের পালানো সম্ভব নয়। ছায়াটা আত্মপ্রকাশ করেছে নিকট থেকে। তৎক্ষণাৎই তার সম্মুখে এসে পৌঁছে বলে ওঠে- আজ তুমি আগে-ভাগে এসে পড়েছে, এটা আমার ভালোবাসার ক্রিয়া।

আর তুমি এতো তাড়াতাড়ি এসে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেননা? চেঙ্গিস জিজ্ঞেস করে- মধ্যরাতের ঘণ্টা তো এখনো বাজেনি।

আমার মন বলছিলো তুমি ঘণ্টা বাজার আগেই এসে পড়বে। মেয়েটি বললো।

কিন্তু আমি ভাবিনি তুমি এতো তাড়াতাড়ি এসে পড়বে–চেঙ্গিস বললো- আমি একটি কাজে যাচ্ছিলাম। এ পথেই ফেরার ইচ্ছা ছিলো।

কাজটা যদি বেশি জরুরী হয়, তাহলে যাও- মেয়েটি বললো- প্রয়োজন হলে তোমার অপেক্ষায় আমি সারারাত এখানে দাঁড়িয়ে থাকবো।

কিন্তু এখন তো আমি এখান থেকে নড়তেই পারবো না–চেঙ্গিস মেয়েটিকে বাহুতে জড়িয়ে ধরতে ধরতে বললো।

মেয়েটির উন্মুক্ত রেশমী চুলের সৌরভ এবং গায়ের পোশাকে মাখানো সুগন্ধি চেঙ্গিসকে মাতোয়ারা করে তোলে। চেঙ্গিস ইমামের নিকট যাওয়ার পরিকল্পনা মুলতবী করে দেয়। ভাবে, যা-ই হোক না কেনো মেয়েটি খৃস্টান তো বটে। হৃদয়ে প্রভুর প্রতি অনীহা থাকতে পারে। কিন্তু নিজের জাতি এবং ক্রুশকে তো ধোঁকা দিতে পারে না। চেঙ্গিস আশঙ্কা করে, সে যদি ইমামের নিকট যায়, তাহলে মেয়েটি সন্দেহবশত তার পিছু নিতে পারে। তাই ভালোবাসার তীব্রতা প্রকাশ করে সম্মুখে কাজে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করে দেয়।

মেয়েটি পেয়ালা দুটো মাটিতে রেখে তাতে সোরাহী থেকে মদ ঢেলে একটি পেয়ালা চেঙ্গিসের দিকে এগিয়ে দেয়। চেঙ্গিস অনিচ্ছা প্রকাশ করে তুমি যদি বিষের পেয়ালাও দাও পান করবো; কিন্তু মদপান করবো না।

খৃস্টান হয়ে মদকে ঘৃণা করছো কেনো? মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।

মদের নেশা তোমার রূপ ও ভালোবাসার নেশার উপর জয়ী হয়ে যায় চেঙ্গিস বললো- কৃত্রিম ও দৈহিক হওয়ার কারণে তোমার অন্তর যেমন বিত্ত-বৈভব ও ভোগ-বিলাসকে গ্রহণ করেনি, তেমনি আমার হৃদয় মদকে বরণ করছে না। কারণ, এর নেশাও কৃত্রিম। আমার উপর তুমি তোমার নেশা আচ্ছন্ন করে দাও।

মেয়েটি মাথাটা রাশেদ চেঙ্গিসের কোলের মধ্যে ঢেলে দিয়ে তার উপর নিজের নেশা আচ্ছন্ন করে দেয়। রাশেদ চেঙ্গিস এতোক্ষণ তার সঙ্গে যেসর কথাবার্তা বলেছে, তা ছিলো কৃত্রিম ও মিথ্যা। কিন্তু এবার সত্যি সত্যি মেয়েটির নেশা তাকে পেয়ে বসেছে। চেঙ্গিস নারীর স্বাদ অনুভব করতে শুরু করে। এখন সে আসক্ত নারীর আসক্ত। এই আসক্তির মধ্যে নিজেই পেয়ালাটা তুলে এক নিঃশ্বাসে সবটুকু গিলে ফেলে।

আরো দাও। চেঙ্গিস তৃপ্তি ও আনন্দের ঢেকুর তুলে বললো।

মেয়েটি চেঙ্গিসের হাতে ধরা পেয়ালাটা আবার ভরে দেয়। সে ধীরে ধীরে পান করতে থাকে। তারপর মেয়েটির মধ্যে হারিয়ে যায়।

আচ্ছা, আমরা এভাবে আর কতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে মিলিত হবো? মেয়েটি বললো- একটু ভেবে দেখো, আমি কতো বড় যন্ত্রণার মধ্যে নিপতিত হয়ে আছি। আমার দেহের মালিক একজন আর হৃদয়ের অধিকারী অন্যজন- তুমি। তোমার ভালোবাসা তার ঘৃণাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন আর লোকটাকে মুহূর্তের জন্যও সহ্য করা আমার পক্ষে

সম্ভব নয়। চলো এখান থেকে পালিয়ে যাই।

কোথায় যাবে? চেঙ্গিস জিজ্ঞেস করে।

পৃথিবীটা অনেক প্রশস্ত- মেয়েটি জবাব দেয়- তুমি আমাকে এখান থেকে বের করো। বৃদ্ধ আমার যৌবনটাকে পিষে ফেলছে।

ঠিক আছে, যাবো–চেঙ্গিস বললো- কটা দিন অপেক্ষা করো। আচ্ছা, আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর এনেছো?

এনেছি- মেয়েটি বললো- আমাদের বাহিনীগুলো সমবেত হচ্ছে। কার বাহিনী কোথায় সমবেত হবে এবং তাদের উদ্দেশ্য কী, মেয়েটি চেঙ্গিসকে বিস্তারিত জানায়। তবে শেষ পরিকল্পনাটা এখনো সে জানতে পারেনি। চেঙ্গসি তাকে খুটিয়ে খুটিয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকে।

দুজন আলাদা হয়ে দুদিকে চলে যায়।

 এখন তারা দুজনে দুজনার।

***

আমি ইমাম পর্যন্ত পৌঁছতে পারিনি বটে- চেঙ্গিস ভিক্টরকে বললো তবে মেয়েটির নিকট থেকে নতুন কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এনেছি। মেয়েটি আমার জালে ধরা পড়েছে এবং আমার হাতে খেলতে থাকবে।

আমার মনে হয় তুমিও তার জালে আটকা পড়ে গেছো- ভিক্টর সন্দেহের আঙুল তোলে- তোমার ভাবগতি বলছে, তার হৃদয় তোমার হৃদয়ে ঢুকে গেছে।

আমি তো তোমাকে আগেই বলে দিয়েছি, মেয়েটি আমার হৃদয়ে আসন গেড়ে বসেছে–চেঙ্গিস বললো- এখন সে এমনও বলেছে, সে আমার সঙ্গে পালিয়ে যাবে। আমি তাকে কদিন অপেক্ষা করতে বলেছি। তাকে নিয়ে আমি এখান থেকে পালিয়ে যাব। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, খৃস্টানদের পরিকল্পনা পুরোপুরি জানা হয়ে গেলে এসব তথ্য নিজেই কায়রো নিয়ে যাবো। আর মেয়েটিকেও সঙ্গে নেবো।

তাকে কখন বলবে, তুমি মুসলমান এবং এখানে গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য এসেছিলে?

মিসরের সীমান্তে প্রবেশ করে- চেঙ্গিস জবাব দেয়। এখানে তাকে সামান্যই বলবো।

চেঙ্গিস প্রেমের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। খৃস্টানদের তথ্য সংগ্রহের জন্য তার যতোটা না চিন্তা, তার চে বেশি ভাবনা কখন প্রেমিকার সঙ্গে মিলনের সময় আসবে। সে নিজেই অনুভব করছে, তার ভাবনার ধরন এবং গতিবিধিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসে গেছে। প্রথমবার মদপান করার পর মনে অনুতাপ জাগ্রত হয়েছিলো। কিন্তু গত রাতে নিজ হাতে পেয়ালা তুলে নিয়ে স্বেচ্ছায় ও স্বাচ্ছন্দ্যে মদপান করেছে। এখন এ কাজের জন্য তার কোনো অনুতাপ নেই। এ এক বিরাট পরিবর্তন।

সেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ জানানো হলো, কয়েকজন খৃস্টান সম্রাট ও কমান্ডার আসবেন। তারা রেমন্ডের মেহমান হবেন। চেঙ্গিস তড়িঘড়ি প্রয়োজনীয় আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলে। তার জানা আছে, এসব মেহমানের আপ্যায়নের এক নম্বর উপকরণ মদ।

রাতে যথাসময়ে মেহমানগণ এসে উপস্থিত হন। অল্প কজন বিশিষ্ট মেহমান। চেঙ্গিস ও ভিক্টর বুঝে ফেলে, আজকের অনুষ্ঠানটা মূলত ভোজসভা নয়- গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। ভিক্টর ও চেঙ্গিস আসল কর্তব্য পালনের জন্য বিশেষভাবে তৎপর ও প্রস্তুত। বৈঠকে খৃস্টানদের ইন্টেলিজেন্স বিভাগের প্রধান হারমানও উপস্থিত আছেন। মদপানের পালা এবং আক্রমণ বিষয়ক আলোচনা শুরু হয়ে যায়। এখনকার কথোপকথন প্রস্তাব নয়- সিদ্ধান্ত। আছে পরিকল্পনার কাঠামোেও। তাদের কথাবার্তায় বুঝা গেলো, শীঘ্রই অভিযান শুরু হয়ে যাবে।

হারমানকে তার বিভাগের তৎপরতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো। যেসব এলাকায় তাদের ফৌজ অবস্থান করছে, সেসব অঞ্চলের দায়িত্বশীলদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা যেনো সালাহুদ্দীন আইউবীর গোয়েন্দাদের খুঁজে বের করে গ্রেফতার করে ফেলে। ত্রিপোলীর যেখানে তাদের সবচে বৃহৎ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো, সেখানে আইউবীর গোয়েন্দাদের ধরার বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। হারমান আরো জানায়, এখানে শত্ৰু গোয়েন্দাদের একটি চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাদেরকে ব্যর্থ করে দেয়ার প্রচেষ্টা চলছে। একজন লোককে ধরতে পারলে তার মাধ্যমে পুরো গ্যাংটির সন্ধান বেরিয়ে আসবে। কায়রোর গোয়েন্দাদের নিকট নির্দেশনা পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ওখান থেকে গতকালই একজন এসেছিলো। সে বলেছে, সালাহুদ্দীন আইউবী জোরেশোরে ভর্তি ও প্রশিক্ষণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং তিনি জেরুজালেম অভিমুখে যাত্রা করার ইচ্ছা রাখেন।

রাশেদ চেঙ্গিস ও ভিক্টর যেটুকু তথ্য পেয়েছে, তা-ই যদি কায়রো পৌঁছিয়ে দেয়া যায়, তা সুলতান আইউবীর জন্য যথেষ্ট ছিলো। খৃস্টানরা অতিসত্বর যাত্রা শুরু করবে এবং হাররান ও হাল্ব তাদের গন্তব্য এই সংবাদটা তাড়াতাড়ি সুলতান আইউবীর কাছে পৌঁছানো দরকার।

বৈঠক ভেঙে যায়। চেঙ্গিস ও ভিক্টর মধ্যরাতের পর ডিউটি শেষ করে। চেঙ্গিসের ইমামের নিকট যাওয়া দরকার। সে প্রতি রাতের ন্যায় পোশাক পরিবর্তন করে এবং কৃত্রিম দাড়িগুচ্ছ পোশাকের ভেতর লুকিয়ে নিয়ে রওনা দেয়। আজ তার যেতে অনেক রাত হয়ে গেছে। তাই পথে মেয়েটির হাতে ধরা পড়ার আশঙ্কা নেই। চেঙ্গিস নিশ্চিন্তে বেরিয়ে পড়ে।

***

রাশেদ চেঙ্গিসের ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। সবুজঘেরা এলাকা দিয়ে অতিক্রম করার সময় মেয়েটি ঠিকই তার পথ আগলে দাঁড়িয়ে যায়। চেঙ্গিস কখনো মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করেনি, সে কোথায় থাকে এবং কীভাবে দেখে ফেলে প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও প্রশ্নটা করার ফোরসত পায়নি সে। কারণ, সাক্ষাৎ মাত্রই দুজনে প্রেমে মজে যাচ্ছে আর মেয়েটি একথা ওকথায় তাকে ব্যস্ত রাখছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সে ওখানেই ধারে কাছে কোথাও থাকে এবং চেঙ্গিসের পায়ের শব্দ শুনেই বেরিয়ে আসে। কিন্তু চেঙ্গিস বিষয়টি ভেবে দেখেনি। আজ রাতেও বরাবরের ন্যায় একই ঘটনা ঘটলো। চেঙ্গিস ইমামের কাছে যেতে পারলো না। কিন্তু তার মনে কোন অনুতাপও জাগলো না। মুহূর্ত মধ্যে মেয়েটি তাকে প্রেমে মজিয়ে ফেলে। আজ সে এই প্রথম করুণভাবে নিজের অসহায়ত্ব ও দুঃখের কাহিনী শোনাতে শুরু করে যে, চেঙ্গিসের পা উপড়ে যায়।

আমাকে তোমার আশ্রয়ে নিয়ে নাও- মেয়েটি গভীর আবেগের সাথে কম্পিত কণ্ঠে বললো- দর্শকরা আমাকে রাণী-রাজকন্যা মনে করে। কিন্তু বাস্তবে আমার জীবনটা এমন একটা জাহান্নাম, যাকে কাছে থেকে দেখলে তোমার মাথার চুলের আগা থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত সমস্ত শরীর কেঁপে ওঠবে। আমি মুসলিম পিতা-মাতার সন্তান। কিন্তু রূপ আমাকে এমন এক অত্যাচারের মধ্যে ফেলে দিয়েছে, যা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভের কোন লক্ষণ আমি দেখতে পাচ্ছি না। আমার বয়স যখন পনের বছর ছিলো, তখন আমার পিতা আমাকে এক আরব ব্যবসায়ীর নিকট বিক্রি করে দেন। আব্বা গরীব ছিলেন না। তবে ছিলেন অর্থের কুমির। আমরা ছয় বোন ছিলাম। তিনি আমাদেরকে একদম দেখতে পারতেন না। আমার বড় দুবোন পিতার আচরণে বিরক্ত হয়ে দুব্যক্তির হাত ধরে চলে যায়। আর আমাকে তিনি বিক্রি করে দেন। এক বছর পর ব্যবসায়ী আমাকে উপহারস্বরূপ এক খৃস্টান অফিসারের হাতে তুলে দেন।

কিছুদিন পর অফিসার যুদ্ধে নিহত হলে আমি তার সংসার থেকে পালিয়ে আসি। কিন্তু যাবো কোথায়! এক খৃস্টান আমাকে আশ্রয় প্রদান করে। কিন্তু আশ্রয়ের নামে সে আমার শরীরকে উপার্জনের মাধ্যম বানিয়ে ফেলে। আমি বেশ্যা ছিলাম না। কিন্তু সে আমাকে কয়েক দিনের জন্য খৃস্টান বাহিনীর উচ্চস্তরের অফিসারদের গণিকা হিসেবে ভাড়া দিতে থাকে। সেই লোকটি এবং সে যাদের কাছে আমাকে প্রেরণ করতো, সবাই আমাকে অলংকার দিয়ে লাল করে দেয় এবং রাজকন্যার সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। এদিক থেকে আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও সুখী ছিলাম। কিন্তু আত্মিক শান্তি আমার কপালে জুটেনি। এই পেশার সুবাদে বড় বড় সামরিক অফিসার-কর্মকর্তার সঙ্গে আমার উঠাবসা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ধীরে ধীরে আমি অভিজ্ঞ হয়ে উঠি। আমি সম্রাট ও শীর্ষ স্তরের কমান্ডারদের শয্যা পর্যন্ত পৌঁছে যাই। তারা আমাকে গুপ্তচরবৃত্তির প্রশিক্ষণ দিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে শুরু করে।

একবার আমাকে বাগদাদ পাঠানো হলো। দায়িত্ব দেয়া হলো নূরুদ্দীন জঙ্গীর এক সালারকে তার বিরুদ্ধে উস্কে দেয়া। আমি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দায়িত্বটা পালন করেছি। আমি যদি তোমাকে আমার গুপ্তচরবৃত্তির পুরো কাহিনী শোনাতে শুরু করি, তাহলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবে। বোধ হয় বিশ্বাসও করবে না। কাহিনী অনেক দীর্ঘ। যা হোক সেই কমান্ডার আমাকে গণিকা হিসেবে রেখে দেয়। লোকটা বৃদ্ধ। তবে আমাকে নিয়ে বেশ ফুর্তি করতো। সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। সম্ভবত অন্যদের বুঝাতে চাইতো, সে বৃদ্ধ নয় এবং আমার মতো একটি রূপসী যুবতীকে আনন্দে রাখতে সক্ষম। লোকটি আমার সকল আবদার-আকাঙ্খা পূরণ করতো। চাহিদার কথা মুখ দিয়ে বের করতে দেরি; কিন্তু দিতে বিলম্ব করতো না। আমি তার সঙ্গে আক্ৰায় ছিলাম। সেখানে ঘটনাক্রমে এক মুসলমান গোয়েন্দার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিলো। সে দামেশক থেকে এসেছিলো।

তার নাম কী? চেঙ্গিস জিজ্ঞেস করে।

নাম শুনে তোমার কী লাভ হবে? মেয়েটি উত্তর দেয়- তুমি তো তাকে চেনো না। আমার কথা শোনো। তোমার ভালোবাসা আমার মুখের বাঁধ ভেঙে দিয়েছে, আমার হৃদয়ের দ্বার খুলে দিয়েছে। আমি তোমার সম্মুখে এমন সব তথ্যাদি ফাঁস করে দিচ্ছি, যা আমাকে কারাগারে পাঠাতে পারে, যেখানে মানুষরূপী হায়েনারা আমাকে অসহনীয় নির্যাতনে মেরে ফেলবে। কিন্তু আমি তোমার জন্য জীবন দিতে কুণ্ঠাবোধ করবো না। যা হোক, আমি বলছিলাম দামেশকের কথা। সেই গোয়েন্দা ধরা পড়েছিলো এবং তাকে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করা হয়েছিলো।

আমি অনেক বড় একজন অফিসারের রক্ষিতা ছিলাম। সেই গোয়েন্দার তামাশা দেখার জন্য আমি পাতাল কক্ষে চলে গেলাম। তাকে এমন নিষ্ঠুর ও নির্মম অত্যাচার করা হচ্ছিলো যে, আমার গা শিউরে ওঠে। তাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছিলো, তোমার সঙ্গীরা কোথায় এবং এ যাবত তুমি কী কী তথ্য জ্ঞাত হয়েছে? লোকটির পিঠ থেকে রক্ত ঝরছিলো। চেহারাটা নীল বর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তারপরও সে বলছিলো- আমার শিরায় মুসলমান পিতার রক্ত প্রবাহমান। আমি আমার কোনো সহকর্মীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবো না। শুনে আমার শিরাগুলো সব সক্রিয় হয়ে ওঠে। ভাবি, আমার শিরায়ও তো মুসলিম পিতামাতার রক্ত আছে। আমার মধ্যে ভূমিকম্পের ন্যায় এক ধরনের দোলা খেলে যায়। আমি সংকল্প করি এই মুসলমানটাকে পাতাল প্রকোষ্ট থেকে বের করবো। আমি আমার মনিবের পদমর্যাদা, নিজের রূপের জাল আর তিন-চার টুকরো সোনা ব্যবহার করি। একদিন সকালে আমার মনিব আমাকে খবর শোনালেন পাতাল কক্ষ থেকে মুসলমান গোয়েন্দাটা পালিয়ে গেছে।

বৃদ্ধ জানতো না লোকটা পালায়নি; বরং আমি তাকে পাতাল থেকে সরিয়ে উপরের এক কক্ষে রেখেছি। আমার মনিব যখন আমাকে লোকটার পলায়নের খবর শোনাচ্ছিলেন, সেই পলাতক গোয়েন্দা উক্ত শহরেই অবস্থান করছিলো। আমি আমার এক মুসলমান চাকরের মাধ্যমে তার আত্মগোপনের ব্যবস্থা করেছিলাম। সেও তোমারই ন্যায় সুদর্শন যুবক ছিলো। পাতাল কক্ষ তাকে লাশে পরিণত করেছিলো। আমি তাকে ভিটামিন ওষুধ ও পুষ্টিকর খাবার খাইয়ে সুস্থ করে তুলেছিলাম। রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে আমি তার কাছে যেতাম। সে আমার সত্ত্বার মধ্যে ঈমান জাগ্রত করে দিয়েছে। আমি তাকে বলে দিয়েছিলাম, আমি মুসলিম কন্যা। এখন তোমাকে যে কাহিনী শোনাচ্ছি, তাকেও শুনিয়েছিলাম। সে আমাকে বলেছিলো, তুমি আমার সঙ্গে চলল। আমি বললাম, আমাকে গুপ্তচরবৃত্তির কৌশল শিখিয়ে দাও। আমি নিজের জাতি ও ধর্মের জন্য কিছু করতে চাই। সে আমাকে আক্রার তিনজন লোকের নাম-ঠিকানা বলেছিলো। পরে তাদের সঙ্গে সাক্ষাতেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো।

লোকটা সুস্থ্য হয়ে উঠলে আমি তাকে শহর থেকে বেরিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দেই। তার চলে যাওয়ার পর আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তার সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে থাকি। তারা আমাকে গুপ্তচরবৃত্তির পাঠ শেখাতে থাকে। কোর্স সমাপ্ত করে একসময় আমি তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ কাজ করতে শুরু করি। একে তো আমি উচ্চপদসস্থ একজন সেনা অফিসারের রক্ষিতা, তদুপরি আমার রূপ-যৌবনের কারণে অন্য বহু অফিসার আমার বন্ধুত্বের প্রত্যাশী ছিলো। এগুলোকে আমি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করি। সম্ভ্রম তো আগেই খুইয়ে ফেলেছি। নির্লজ্জতা এবং যার-তার বিছানায় রাত কাটানো আমার স্বভাবে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। পাপী লোকদের সঙ্গে জীবন যাপন করে আমি একজন প্রতারক হয়ে ওঠেছিলাম। তাদেরকে অনেক সুদর্শন টোপ দিয়েছি এবং মুসলমানদের অনেক দামি দামি তথ্য দিয়েছি। এই যে গোয়েন্দার কাহিনী শোনালাম, সে আমাকে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর কথা শোনাতো। আমি আইউবীকে ফেরেশতা মনে করি। আমার মনে আকাঙ্খ জাগে, আমি জাতির জন্য কিছু করে যাবো এবং একবারের জন্য হলেও সুলতান আইউবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবো আর সেই সাক্ষাতকেই আমি আমার হজ্ব মনে করবো। এখন আমি সেই কমান্ডারের সঙ্গে এখানে এসেছি। না এসে পারিনি। খৃস্টানরা বিপুল শক্তি নিয়ে মুসলমানদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করতে যাচ্ছে। আমি তাদের সমস্ত তথ্য জেনে নিয়েছি। এখন আমার এমন একজন লোক প্রয়োজন, যে আইউবীর গুপ্তচর।

এতো বীরত্বের সঙ্গে তুমি এসব তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছো কেনো? চেঙ্গিস মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে- তুমি সত্যিই যদি গোয়েন্দা হয়ে থাকো, তাহলে তুমি একেবারেই আনাড়ি। তুমি আমার ভালোবাসার উপর নির্ভর করছে। যদি বলি, আমি তোমা অপেক্ষা কুশকে বেশি ভালোবাসি এবং আমার অফাদারী ক্রুশের প্রতি, তাহলে তুমি কী করবে? বুদ্ধিমান গোয়েন্দা কর্তব্যের খাতিরে নিজের সন্তানকেও কুরবান করে থাকে।

যদি আসল কথাটা বলি, তাহলে মানতে বাধ্য হবে। আমি আনাড়ি নই- মেয়েটি বললো- আমি জানি, নিশ্চিত করেই জানি, তুমি খৃস্টান নও-তুমি মুসলমান এবং মিসরের চর।

রাশেদ চেঙ্গিস নিজের অলক্ষ্যেই চমকে ওঠে, যেনো মেয়েটি তাকে দংশন করেছে। মদের নেশা আর রোমাঞ্চকর আবেগের মাদকতা সহসা এমনভাবে উবে যায়, যেনো ধনুক থেকে তীর বেরিয়ে গেছে। চেঙ্গিস কিছু বলার চেষ্টা করে। কিন্তু মনে হলো যেনো তার কিছুই বলার নেই। মেয়েটি তো ঠিকই বলেছে।

রাশেদ চেঙ্গিস মেয়েটির চাপা হাসির শব্দ শুনতে পায়। মেয়েটি বললো- বলো, আমি কি আনাড়ি?

কোন উত্তর দেয়া চেঙ্গিসের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। মেয়েটি সত্যিই যদি মুসলমান হয়ে থাকে, তাহলে নিজের পরিচয়টা কি স্বীকার করে নেয়া উচিত? নিয়ম তো ছিলো এক দলের গোয়েন্দা নিজ দেশেরই অপর দলের কাছেও পরিচয় গোপন রাখবে। চেঙ্গিস তো এও জানে না, মেয়েটা কোন্ স্তরের গোয়েন্দা। এমনও তো হতে পারে, সে যা বলেছে সবই মিথ্যা এবং আসলেই সে খৃস্টানদের গুপ্তচর। তাছাড়া সুলতান আইউবীর তো কোন নারীকে গুপ্তচরবৃত্তিতে ব্যবহার করেন না। এই মেয়েটি যদি মুসলমানদের চরবৃত্তি করে থাকে, তাহলে সম্পূর্ণ নিজের থেকেই করছে। এমন একটি মেয়েকে বিশ্বাস করা ঠিক হয়নি।

চুপ হয়ে গেলে কেন?- মেয়েটি জিজ্ঞাসা করে- আমি কি ভুল বলেছি?

সম্পূর্ণ ভুল বলেছে- রাশেদ চেঙ্গিস জবাব দেয়- তুমি আমাকে নমস্যায় ফেলে দিয়েছে।

কীরূপ সমস্যা? মেয়েটি জানতে চায়।

এই যেমন আমি তোমাকে গ্রেফতার করাবো, নাকি ভালোবাসার খাতিরে চুপ থাকবো–চেঙ্গিস বললো- আমি খৃস্টান এবং পাক্কা ক্রুসেডার। 

দুজনই মাটিতে বসা। মেয়েটি নিজের উরুর নীচ থেকে কিছু একটা বের করে চেঙ্গিসের কোলের মধ্যে রেখে দিয়ে বললো- এই নাও তোমার দাড়ি। কাল যখন তুমি আমার কাছে ছিলে, তখন তোমার চোগার পকেট থেকে এগুলো বের করেছিলাম। আজো বের করে নিয়েছি। কিন্তু তুমি কালও টের পাওনি, আজও না।

রাশেদ চেঙ্গিস মেয়েটির ভালোবাসা এবং মদের নেশায় এমনই মজে গিয়েছিলো যে, তার কোনো হুশ-জ্ঞান ছিলো না।

এক রাতে এই দাড়ি আমি তোমার মুখে দেখেছিলামও- মেয়েটি বললো- এই দাড়ি স্থাপন করে তুমি কক্ষ থেকে বের হয়েছিলে। আমি তোমাকে পথে থামিয়ে দেই এবং তুমি যখন আমাকে বাহুতে জড়িয়ে ধরেছিলে, তখন তোমার চোগার উভয় পকেটে হাত ঢুকিয়ে ছিলাম। আমার হাত দাড়ি অনুভব করেছিলো।

কৃত্রিম দাড়ি দেখেই তুমি কীভাবে নিশ্চিত হলে যে, আমি গোয়েন্দা?

তুমি যে ধারায় আমার কাছে খৃস্টানদের যুদ্ধ ইত্যাদি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলে, সে ধারাটা গোয়েন্দাদের- মেয়েটি বললো আমাকে তুমি যেসব প্রশ্নের উত্তর এনে দিতে বলেছিলে, সেসব প্রশ্ন গোয়েন্দা ছাড়া অন্য কারো জানার বিষয় নয়। আর মদপান করতে অস্বীকার করে শুধু মুসলমানরাই।

 মেয়েটি বলতে বলতে থেমে যায়। নিজের একটা বাহু চেঙ্গিসের কাঁধের উপর রেখে তার গালের সঙ্গে গাল লাগিয়ে বললো তুমি আমাকে ভয় করছে। তোমার কি বিশ্বাস হচ্ছে না, আমি মুসলমান? আমার অন্তরটা তোমাকে কীভাবে দেখাবো। আমরা দুজন একই পথের পথিক। আমি তোমাকে সুলতান আইউবীর গোয়েন্দা মনে করে হৃদয়ে স্থান দেইনি। তবে তোমাকে আমার কেন যে ভালো লাগলো, বলতে পারবো না। আমার এমনটা মনে হয়েছিলো, তুমি আর আমি আকাশেও একত্রে ছিলাম, পৃথিবীতেও একত্রিত হয়েছি এবং দুজনে এক সাথেই উত্থিত হবো। তুমি বললে আমি তোমার গোয়েন্দা হওয়ার পক্ষে আরো একাধিক প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারি। কিন্তু আমি তোমাকে রক্ষা করবো। আমি এই সংকল্পও করে রেখেছি, আমরা দুজন অনেক মূল্যবান তথ্য নিয়ে এখান থেকে একত্রে বেরিয়ে যাবো। এসব তথ্য যদি সময়মতো কায়রো না পৌঁছে, তাহলে হাররান, হাব, হামাত, দামেক ও বাগদাদ খৃস্টানদের সয়লাবে ডুবে যাবে। মিসরকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। সুলতান আইউবী এখানকার আয়োজন-প্রস্তুতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ বে-খবর। সময় নষ্ট করো না। আমার পক্ষে এখান থেকে একাকি বের হওয়া সম্ভব ছিলো না। আমাকে তোমার সঙ্গ প্রয়োজন। আমি তোমাকে সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণের নামে শহর থেকে বেরিয়ে যেতে পারবো। তুমি আমার রক্ষী সাজবে। তাহলে কেউ আমাদেরকে সন্দেহ করবে না।

রাশেদ চেঙ্গিসের মুখে কোন কথা নেই। মেয়েটি পেয়ালায় মদ ঢালে। মদভর্তি পেয়ালাটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আবেগমাখা কণ্ঠে বললো তুমি ভয় পেয়ে গেছে। মদটা পান করে নাও। এটি মদের শেষ পেয়ালা। এরপর আমরা তওবা করে নেবো।

মেয়েটি চেঙ্গিসের উপর নিজের রেশমী চুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে পেয়ালাটা তার ঠোঁটের সঙ্গে লাগিয়ে ধরে। চুলের কোমল ছোঁয়া আর সৌরভ, নারী দেহের নরম পরশ আর উত্তাপ এবং মদ সবকিছু মিলে চেঙ্গিসের মুখ খুলে দেয়- তুমি সত্যিকার অর্থেই গোয়েন্দা। অন্যথায় দেড়টি বছর সব গোয়েন্দার প্রধান গুরু হারমানের ছায়ায় থাকা সত্ত্বেও তিনি ধরতে পারেননি আমি গোয়েন্দা। আমি তোমার বিচক্ষণতার কাছে হার মানলাম। তুমি ঠিকই বলেছো, আমরা একই পথের পথিক। আমার সঙ্গে তুমি কায়রো চলো।

অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে- মেয়েটি বললো- আগামীকাল এখানে এসে সাক্ষাৎ করবো। আমি তোমাকে আরো এমন সব তথ্য জানাবো, যা জানা তোমার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব হবে না।

***

রাতের শেষ প্রহর। রাশেদ চেঙ্গিস নিজ কক্ষে গিয়ে পৌঁছে। ইতিপূর্বে এতো রাতে ফিরে কখনো সে ভিক্টরকে জাগায়নি। সকালে ঘুম থেকে জেগে, তাকে রাতের কাহিনী শোনাতো। কিন্তু আজ রাত চেঙ্গিসের আনন্দের জোয়ার ধৈর্যের বাধ মানছে না। অন্যরকম এক উত্তেজনা বিরাজ করছে তার হৃদয় জগতে। নিজেকে একজন সফল সেনানায়ক মনে হচ্ছে তার। যে মেয়েটি তাকে হৃদয় দিয়েছিলো, যে সুন্দরী মেয়েটিকে সে ভালোবেসেছিলো; সে মুসলমান এবং সুলতান আইউবীর একজন অভিজ্ঞ গুপ্তচর। একটি রূপসী মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ত্রিপোলী ত্যাগ করতে যাচ্ছে, এটিও কম আনন্দের বিষয় নয়।

রাশেদ চেঙ্গিস তখনই ভিক্টরকে জাগিয়ে তোলে এবং জানায়, আরে, মেয়েটি তো আমাদেরই গোয়েন্দা সদস্য! চেঙ্গিস ভিক্টরকে মেয়েটির রাতের পুরো কাহিনী শোনায়।

তুমি কি তাকে বলে দিয়েছো তুমি গোয়েন্দা? ভিক্টর জিজ্ঞেস করে।

 হ্যাঁ- চেঙ্গিস জবাব দেয়- বলাই প্রয়োজন ছিলো।

আমার কথাও বলেছো? 

না- চেঙ্গিস উত্তর দেয়- তোমার সম্পর্কে কোনো কথা হয়নি। ভিক্টরকে চুপচাপ দেখে চেঙ্গিস বললো- তুমি কি মনে করছে, আমি ভুল করেছি? আমি আনাড়ি নই ভিক্টর!

আমার কথা না বলে তুমি ভালো করেছো- ভিক্টর বললো- আর এ দাবিটা করো না, তুমি আনাড়ি নও।

আমি কি ভুল করেছি? চেঙ্গিস পুনরায় জিজ্ঞেস করে।

হতে পারে তুমি অনেক ভালো কাজ করেছো- ভিক্টর বললো- আর যদি ভুল করে থাকো, তাহলে এই ভুল সাধারণ ভুল নয়। তুমি সম্ভবত ভুলে গেছে, একজন মাত্র গুপ্তচর একটি বাহিনীর জয়ের কারণ হতে পারে। আবার হতে পারে পরাজয়ের কারণও। তুমি জানো, সুলতান আইউবী খৃস্টানদের এই প্রস্তুতি সম্পর্কে অনবহিত। আমরা যদি ধরা পড়ে যাই আর এই তথ্য আমাদের সঙ্গে কয়েদখানায় চলে যায় কিংবা জল্লাদের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়, তাহলে সকল যুদ্ধে বিজয়ী সেনানায়ক বলে খ্যাত সুলতান আইউবী ইতিহাসে পরাজিত সিপাহসালার আখ্যায়িত হবেন।

না- চেঙ্গিস পূর্ণ আস্থা ও আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো- সে আমাকে ধোকা দেবে না। সে মুসলমান। আমি আগামী রাতে আবার তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবো। আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করবো। এখন আর আমাদের ইমামের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এই তথ্য আমি নিজেই কায়রো নিয়ে যাবো। আমার হৃদয়ের রাণী আমার সঙ্গে থাকবে। তবে আমার অবর্তমানে কারো মনে সন্দেহ জাগবে না, আমি এখান থেকে তথ্য নিয়ে পালিয়ে গেছি। কারণ, মেয়েটিও যেহেতু আমার সঙ্গে যাবে, তাই প্রচার করে দিও তুমি আমাকে ও তাকে গোপনে মিলিত হতে দেখেছে এবং আমি মেয়েটিকে নিয়ে জেরুজালেমের দিকে চলে গেছি। ঘটনাটিকে প্রেমঘটিত বলে প্রচার করতে হবে।

ভিক্টর গভীর ভাবনায় হারিয়ে যায়। রাশেদ চেঙ্গিস মদের নেশায় ঝিমুতে শুরু করে।

চেঙ্গিস যখন ভিক্টরের কক্ষে প্রবেশ করে, তখন অদূরে অবস্থিত অফিসারদের বেডরুমগুলোর একটিতে মেয়েটিও প্রবেশ করে। কক্ষের বাসিন্দা ঘুমিয়ে আছে। মেয়েটি কক্ষে ঢুকেই অবলীলায় তার একপা ধরে সজোরে ঝটকা টান দেয়। লোকটি বিড় বিড় করে ওঠে। মেয়েটি হেসে বললো- ওঠো, ওঠো, শিকার মেরে এসেছি।

লোকটি ধড়মড় করে শয্যা ছেড়ে উঠে বসে বাতি জ্বালায়। তারপর মেয়েটিকে বাহুতে জড়িয়ে ধরে বিছানায় ফেলে দেয়। কিছু সময় অশ্লীলতার নগ্ন প্রদর্শনী চলে। তারপর মেয়েটি যে সোরাহীতে করে চেঙ্গিসের জন্য মদ নিয়ে গিয়েছিলো, তার অবশিষ্টটুকু দুটি পেয়ালায় ঢেলে দুজনে মিলে পেয়ালা দুটো খালি করে ফেলে।

এবার বলল, কী সংবাদ নিয়ে এসেছো?

লোকটি গোয়েন্দা- মেয়েটি বললো- আর মুসলমান।

তাহলে তো হারমানের সন্দেহ সঠিক প্রমাণিত হলো।

সম্পূর্ণ সঠিক- মেয়েটি বললো- মদ আর আমার যাদু ক্রিয়া করেছে। অন্যথায় হারমানের ন্যায় অভিজ্ঞ গোয়েন্দাও তাকে ধরতে পারতেন না। যদি তার কৃত্রিম দাড়ি আমার হাতে না পড়তো, তাহলে বোধয় আমিও ব্যর্থ হতাম। আমার সন্দেহ তো সেদিনই দূর হয়ে গিয়েছিলো, যেদিন প্রথম সে মদপান করতে অস্বীকার করে। মুসলমান না হলে মদপান করবে না কেন। তাতেই আমি বুঝে ফেলেছি, লোকটা মুসলমান। আমি তাকে বলেছি, আমি পবিত্র ভালোবাসার জন্য ছটফট করছি। তখনই সে সূরলমনে আমাকে ভালোবেসে ফেলে-পবিত্র ভালোবাসা। এটাও প্রমাণ করে লোকটা মুসলমান। আমাদের লোকেরা তো ভালোবাসার কথা বলে প্রথমে বস্ত্ৰ উদোম করে থাকে।

ভালোবাসা পবিত্র হোক কিংবা অপবিত্র নারীর দেহ পাহাড়কেও চূণবিচূর্ণ করে দিতে সক্ষম- লোকটি বললো- এই দুর্বলতা প্রত্যেক মুসলমানের মধেও বিরাজমান। আমি তোমাকে বলেছিলাম, তোমার রূপ তার মুখোশ উন্মোচিত করে দিতে সক্ষম হবে। নারী সশরীরে কাছে থাকুক কিংবা নিছক কল্পনায়, মানুষকে অপ্রকৃতিস্থ করে তোলে।

লোকটা খৃস্টানদের ইন্টেলিজেন্স বিভাগের অফিসার এবং হারমানের নায়েব। হারমানের কোনোভাবে সন্দেহ হয়ে গিয়েছিলো, চেঙ্গিস গুপ্তচর। একে তো তিনি একজন অভিজ্ঞ গোয়েন্দা; তদুপরি তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কাউকে গোয়েন্দা বলে সামান্যতম সন্দেহ হলেও তাকে ধরে ফেলল। রাশেদ চেঙ্গিসকে সম্ভবত রাতে তিনি মসজিদে যেতে দেখেছিলেন। তাই নায়েবকে নির্দেশ দেন, কোনো নারীর ফাঁদে ফেলে দেখো লোকটা সন্দেহমুক্ত নাকি সন্দেহভাজন। এ বিভাগে বেশ কজন নারী কাজ করছে, যারা একজন অপেক্ষা অপরজন বেশি রূপসী। হারমানের নায়েব এই মেয়েটিকে নির্বাচন করে চেঙ্গিসের পেছনে লেলিয়ে দেয়। মেয়েটি তার বিদ্যায় অভিজ্ঞ। অত্যন্ত নৈপুণ্যের সাথে সে একটি নাটক মঞ্চস্থ করে, যার বিস্তারিত আপনারা পড়েছেন। চেঙ্গিস কখনো ভাবেনি, প্রতি রাতে ইমামের নিকট যাওয়ার সময় এই যে মেয়েটি তার পথ আগলে দাঁড়ায়, আসে কোথা থেকে এবং কীভাবে জানে যে সে যাচ্ছে? মেয়েটি ছায়ার মতো তার পিছে লাগা ছিলো। তার প্রতিটি গতিবিধিই সে প্রত্যক্ষ করতো।

আমি তাকে তোমার গড়ে দেয়া বেদনাদায়ক কাহিনী শোনালে সে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে- মেয়েটি বললো- তৎক্ষণাৎ সে বিশ্বাস করে নেয়, আমি মুসলমান এবং সত্যি সত্যিই আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করছি।

মুসলমান আবেগপ্রবণ জাতি- হারমানের নায়েব বললো- বরং এরা এক বিস্ময়কর ও অভিনব সম্প্রদায়। মুসলমানরা ধর্মের নামে এমন সব ত্যাগ স্বীকার করে বসে, যা অন্য কোন জাতি পারে না। যুদ্ধের ময়দানে একজন মুসলমান দশ-পনেরজন খৃস্টানের মোকাবেলা করতে সক্ষম এবং করছেও। একে তারা ঈমানী শক্তি বলে অভিহিত করে। আটজন, দশজন কমান্ডো সৈনিকের আমাদের পেছনে চলে যাওয়া, গেরিলা আক্রমণ করা, আমাদের খাদ্যসামগ্রীতে অগ্নি সংযোগ করে উধাও হয়ে যাওয়া, ঘেরাও এর মধ্য থেকে বেরিয়ে যাওয়া, বের হতে না পারলে নিজেদেরই লাগানো আগুনে স্বেচ্ছায় ভষ্মীভূত হওয়া কোন সাধারণ বীরত্ব নয়। এ এক অস্বাভাবিক শক্তি। আমি তাদের এই শক্তিকে অলৌকিক বিষয় মনে করি। আমাদের কিছু বিশেষজ্ঞ আছেন, যারা মানব চরিত্রের দুর্বল শিরাগুলো চেনেন। তারা মুসলমানদের এই শক্তিকে দুর্বল করার লক্ষ্যে এমন কতিপয় পন্থা আবিষ্কার করে নিয়েছেন, যেগুলোর মাধ্যমে মুসলমানদের ধর্মীয় উন্মাদনাকে তাদের দুর্বলতায় পরিণত করছে। এখন তারা যাকে ধর্মীয় চেতনা বলে মনে করে, সেটাই মূলত তাদের দুর্বলতা। এক্ষেত্রে ইহুদীরা অনেক কাজ করেছে। আমরা কতিপয় ইহুদী ও খৃস্টানকে মুসলমানদের আলেমের রূপে প্রেরণ করে এই সাফল্য অর্জন করেছি। মুসলিম অঞ্চলের বেশকটি মসজিদের ইমাম মূলত ইহুদী কিংবা খৃস্টান। তারা কুরআন হাদীসের এমন ব্যাখ্যা সর্বসাধারণের মাঝে গ্রহণযোগ্য করে দিয়েছেন, যার উপর ভিত্তি করে মুসলমান ভুল বিশ্বাস ও কুসংস্কারের অনুসারী হয়ে চলেছে। তাদের সফল তৎপরতার ফলে মুসলমান এখন এমন সব কর্মকাণ্ডকে ইসলাম বা দীন বলে বিশ্বাস করে, যা মূলত ইসলাম পরিপন্থী। এখন তাদেরকে ধর্মের নামে ভাইয়ের বিরুদ্ধে লড়ানো যায়, আমরা যার মহড়া করিয়ে দেখিয়েছি। মুসলমানদের মাঝে আমরা যৌন উন্মাদনাও সৃষ্টি করে দিয়েছি। এখন যে মুসলমানের হাতে বিত্ত আর ক্ষমতা আসে, আগে সে হেরেম তৈরি করে এবং তাকে সুন্দরী যুবতীদের দ্বারা সাজায়। এই নারীপূজা এখন মুসলমানদের উচ্চস্তর থেকে শুরু করে নিম্নস্তরেও ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা একাধিক পন্থায় মুসলিম মেয়েদের মাঝে কল্পনাপূজা ও মনস্তাত্ত্বিক বিলাসিতা ঢুকিয়ে দিয়েছি। তাছাড়া মুসলমান একটি আবেগপ্রবণ জাতি। তুমি তো দেখেছো, তোমার শিকার মুসলমানটির আবেগে খোঁচা দিয়েছো আর অমনি সে তোমার জালে ফেঁসে গেলো। আবেগ বড় একটি দুর্বলতা। হারমান বলে থাকেন, অদূর ভবিষ্যতে এই জাতিটা কল্পনার দাস হয়ে যাবে এবং বাস্তব থেকে দূরে সরে যাবে। তখন আর আমাদের যুদ্ধ-বিগ্রহের প্রয়োজন হবে না। চিন্তা-চেতনার দিক থেকে মুসলমান আমাদের দাসানুদাস হয়ে যাবে। নিজেদের নীতি-আদর্শ ত্যাগ করে তারা আমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি গ্রহণ করে গৌরববোধ করবে।

আমার ঘুম আসছে- মেয়েটি বিরক্ত কণ্ঠে বললো- আমি তোমাকে একটি শিকার দিয়েছি। তুমি ওটাকে এখনই গ্রেফতার করে নাও।

না- নায়েব বললো- তোমার কাজ এখনো শেষ হয়নি। গ্রেফতার করতে চাইলে তার সঙ্গে এ নাটক খেলার প্রয়োজন ছিলো না। তোমাকেও এতো কষ্ট দেয়া হতো না। আমরা তো সামান্যতম সন্দেহেও কাউকে গ্রেফতার করতে পারি। আমরা এখনই তাকে গ্রেফতার করবো না। তার মাধ্যমে তার সেই সকল সহকর্মীর সন্ধান বের করতে হবে, যারা ত্রিপোলীতে গোয়েন্দাগিরি করছে। তাদের মধ্যে নাশকতাকারী কমান্ডোও থাকতে পারে। তার মাধ্যমে অন্যান্য শহরের শত্রু গোয়েন্দাদেরও চিহ্নিত করা যেতে পারে। তুমি তার সঙ্গে আবারও দেখা করো। তাকে বলবে, আমি সকল তথ্য সংগ্রহ করেছি। এখন আরো কয়েকজন গোয়েন্দার প্রয়োজন। এ-ও বলবে, এক স্থানে খৃস্টানরা বিপুল পরিমাণ দাহ্য পদার্থ ও মূল্যবান মালামাল মজুদ করে রেখেছে। আক্রমণে যাওয়ার সময় এগুলো সূঙ্গে নিয়ে যাবে। আমাদেরকে এগুলো ধ্বংস করতে হবে। এ কাজের জন্য তুমি আমাদের এখানকার কমান্ডোদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ করিয়ে দাও।

আমি বুঝে গেছি- মেয়েটি বললো- কিন্তু এমনও তো হতে পারে, সে তার সঙ্গীদের তথ্য ফাঁস করবে না।

হারমানের নায়েব মেয়েটির মাথার চুল, নগ্ন কাধ ও বুকে হাত বুলিয়ে বললো- কেন, তোমার এসব অস্ত্র কি অকর্মণ্য হয়ে গেছে? নিজের মুখোশ খুলে দিয়ে লোকটা দুর্গের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এবার তোমাকে ভেতরে ঢুকে কোণায় কোণায় তল্লাশি নিতে হবে। এ কাজটাও তুমি করতে পারবে। আমি সকালে হারমানকে তোমার কৃতিত্বের কথা অবহিত করবো।

রাতের আহারের পর চেঙ্গিস ও ভিক্টর কর্তব্য পালন করছে। এমন সময় হারমান এসে হাজির হন। তিনি চেঙ্গিসের সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ হাত মেলান এবং বললেন- তোমার নিশ্চয়ই জানা আছে, আমাদের বাহিনী ইতিহাসের সর্ববৃহৎ আক্রমণ অভিযানে রওনা হতে যাচ্ছে। আমরা তোমাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবো। বহুদূর পর্যন্ত ভ্রমণ করাবো। ভিক্টরও সঙ্গে থাকবে। যেহেতু দু-তিনজন সম্রাট সঙ্গে থাকবেন, তাই তোমাদেরকেও সঙ্গে থাকা আবশ্যক।

আমি প্রস্তুত আছি। চেঙ্গিস বললো।

হারমান রিপোর্ট পেয়ে গেছেন, রাশেদ চেঙ্গিস গুপ্তচর এবং আজ রাত তার বিভাগের এক রূপসী যুবতী তার গ্রুপের অন্যান্য সদস্যদেরও নাম ঠিকানা উদ্ধার করবে। হারমান মেয়েটিকে নতুন কিছু নির্দেশনা প্রদান করেন এবং নায়েবকে বললেন, চেঙ্গিসের দলের সন্ধান বের না হওয়া পর্যন্ত মেয়েটি একাকি তার সঙ্গে মিলিত হতে থাকবে। পাশাপাশি সতর্ক থাকবে, যেনো চেঙ্গিসের কোনো সন্দেহ জাগতে না পারে।

চেঙ্গিসের কোনো কাজে মন বসছে না। গুনে গুনে ক্ষণ অতিক্রম করছে। এতো বড় সাফল্য তার কখনো অর্জিত হয়নি। একদিকে এতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও পেয়েছে গেছে, অপরদিকে একটি অতিশয় রূপসী তরুণীও তার মুঠোয় এসে পড়েছে। এ এক বিরাট অর্জন। এ রাতটাকে সে ব্রিপোলীতে শেষ রাত মনে করছে। আগামী রাত তথ্য ও মেয়েটিকে নিয়ে ত্রিশোলী ত্যাগ করছেই। মনে আনন্দের ঠাই হয় না রাশেদ চেঙ্গিসের।

অবশেষে ডিউটি শেষ করে রাশেদ চেঙ্গিস কক্ষে চলে যায়। ভিক্টরও তার সঙ্গে আছে। চেঙ্গিস পোশাক পরিবর্তন করে। আজ কৃত্রিম দাড়িগুচ্ছ নেয়নি। প্রয়োজন নেই। খঞ্জরটা চোগার পকেটে লুকিয়ে নেয়।

আমি তোমাকে শেষবারের মতো বলছি- ভিক্টর বললো- নারী ও মদের নেশা থেকে মুক্ত থেকে মাথা ঠিক রেখে কথা বলবে। আমার ভয় হচ্ছে, পুরোপুরি যাচাই-বাছাই না করে তুমি তাকে আমাদের গোপন তথ্য দিয়ে দেবে।

শোনো ভিক্টর- চেঙ্গিস বিস্ময়কর এক ভঙ্গিতে বললো। আমি মেয়েটার বিরুদ্ধে কোনো কথা শুনবো না। আমি তার সঙ্গে একাধিকবার দীর্ঘ সাক্ষাৎ করেছি, তার পুরো কাহিনী শুনেছি। সে এখন আমার ভালোবাসার মানুষ। আমি তাকে শতভাগ বিশ্বাস করি। তার সঙ্গে যেহেতু তোমার কোনো কথা হয়নি, তাই তুমি বুঝবে না। তুমি আমাকে পাগল মনে করো না। এটা আমার জীবনের প্রথম ও শেষ ভালোবাসা।

ভিক্টর নীরব হয়ে যায়। চেঙ্গিসের বলার ধরণ থেকেই সে বুঝে ফেলেছে লোকটার হুঁশ-জ্ঞান ঠিক নেই। এখন সে একটি মেয়ের প্রেমে মাতোয়ারা। ভিক্টর বুঝে, রাশেদ চেঙ্গিস একটি সুদর্শন যুবক। এই মেয়েটির চেয়েও অধিক রূপসী ও উচ্চস্তরের নারী তার জন্য পাগলপারা হওয়া বিচিত্র নয়। কিন্তু এই মেয়েটির ব্যাপারে তার ঘোর সন্দেহ, সে চেঙ্গিসকে ধোঁকা দিচ্ছে। আর যদি ধোকা নাও দিয়ে থাকে, তবু চেঙ্গিস নিজের আসল পরিচয় বলে দিয়ে নিজেকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এই মেয়েটি মুসলমান গুপ্তচরও যদি হয়, তবুও তার উপর নির্ভর করা যায় না। কারণ, তাকে তো সরকারীভাবে পাঠানো হয়নি।

ভিক্টরের যোগ-বিয়োগ মিলছে না।

রাশেদ চেঙ্গিস চলে গেছে। ভিক্টর গভীর ভাবনায় হারিয়ে যায়। চেঙ্গিসের চলে যাওয়ার পর ভিক্টরের ঘুমিয়ে যাওয়ার নিয়ম। কিন্তু আজ তার ঘুম আসছে না। ভিক্টর কক্ষে গিয়ে না শুয়ে অস্থিরচিত্তে পায়চারি করতে থাকে।

***

মেয়েটি একই স্থানে চেঙ্গিসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। তার সন্নিকটে মাটিতে মদের সোরাহী ও দুটি পেয়ালা পড়ে আছে। অন্ধকারে চেঙ্গিসকে ছায়ার ন্যায় আসতে দেখে দৌড়ে গিয়ে তাকে ঝাঁপটে ধরে, যেরূপ ঝাঁপটে ধরে ছোট্ট শিশু তার মাকে। মেয়েটি এমনভাবে প্রেম নিবেদন ও আত্মসমর্পণের ভাব প্রদর্শন করে যে, চেঙ্গিসের বিবেকের উপর যৌনতার মাদকতা আচ্ছন্ন করে ফেলে। রূপসী মেয়েটি তার রূপ-যৌবনের সেই অস্ত্রগুলো ব্যবহার করে, যেগুলোর উপর হাত বুলিয়ে হারমানের নায়েব বলেছিলো, তোমার এসব অস্ত্র অকর্মণ্য হয়ে যায়নি তো।

তুমি আমাকে ধোকা দিচ্ছে না তো?- মেয়েটি চাপা কণ্ঠে চেঙ্গিসকে জিজ্ঞেস করে- তোমার ভালোবাসা আমাকে এমন অসহায় বানিয়ে দিয়েছে যে, আমি আমার এমন স্পর্শকাতর তথ্যাবলী তোমাকে দিয়ে দিয়েছি।

মেয়েটি এক হাতে চেঙ্গিসের কোমর ধরে গায়ে গা মিশিয়ে তাকে সেই জায়গায় নিয়ে যায়, যেখানে মদের সোরাহী ও পেয়ালা রাখা আছে। চেঙ্গিসকে বসিয়ে পেয়ালায় মদ ঢেলে বললো- নাও, জয়ের আনন্দে এক পেয়ালা।

চেঙ্গিস এতোই উৎফুল্ল যে, সঙ্গে সঙ্গে পেয়ালাটা হাতে তুলে নেয় এবং গল গল করে পেয়ালাটা খালি করে ফেলে। মেয়েটি শূন্য পেয়ালায় আবারো মদ ঢালে। চেঙ্গিস তাও পান করে ফেলে।

তাদের থেকে আট-দশ কদম দূরে একটি বৃক্ষ। পেছন থেকে কে যেন হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এসে গাছটার আড়ারে বসে পড়ে। রাতের নীরবতা খা খা করছে। বৃক্ষের আড়ালে বসা লোকটি চেঙ্গিস ও মেয়েটির কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছে। তারা খানিকটা উচ্চস্বরেই কথা বলছে।

এবার বল, কী খবর নিয়ে এসেছো? চেঙ্গিস মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে।

এমন সংবাদ এনেছি, যা সুলতান আইউবী জীবনে স্বপ্নেও শুনেননি মেয়েটি বললো- আমি খৃস্টানদের মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে এসেছি। মেয়েটি চেঙ্গিসকে খৃস্টানদের পরিকল্পনা ও অগ্রযাত্রার পথ বলে দেয়। আক্রমণ কোথায় হবে তাও অবহিত করে। খৃষ্টান বাহিনীর রসদ কোন্ পথে যাবে এবং রওনা কবে হবে, সব বলে দেয়।

এখান থেকে আমাদেরকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে যাওয়া দরকার চেঙ্গিস বললো- কাল রাতেই যাবে?

না- মেয়েটি বললো- আমাদের যেসব তথ্যের প্রয়োজন ছিলো, পেয়ে গেছি। কিন্তু আমার হৃদয়ে প্রতিশোধের যে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে, তা না নিভিয়ে যাবো না। খৃস্টানরা তাদের বাহিনীর জন্য বিপুল পরিমাণ রসদ সংগ্রহ করেছে। অস্ত্র আর তাঁবুর তো কোনো হিসাবই নেই। তরল দাহ্য পদার্থের মটকাও আছে। আছে তরিতরকারীর সম্ভার। এসব দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। এগুলো ধ্বংস করা কঠিন কিছু নয়। পাহারা এটুকু ব্যবস্থা আছে যে, মাত্র সাত-আটজন সিপাহী রাতে টহল দেয়। এই ভাণ্ডার খৃস্টানরা তিন-চার মাসে সংগ্রহ করেছে। আমরা যদি এগুলো ধ্বংস করে দিতে পারি, তাহলে তাদের আক্রমণ তিন-চার মাসের জন্য পিছিয়ে যাবে। এ সময়ের মধ্যে সুলতান আইউবী তার প্রস্তুতি পরিপূর্ণ করে নিতে পারবেন। তুমি তো হারমানকে জানো। আমি তার হৃদয় থেকেও তথ্য বের করে এনেছি। তিনি বলেছেন, সুলতান আইউবী নতুন ভর্তি নিচ্ছেন। তার আগেকার বাহিনীটি আপন ভাইদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে, এখন আর তাদের যুদ্ধ করার শক্তি নেই। এই অভাগা খৃস্টানরা আইউবীর সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে চাচ্ছে। এ সময় প্রয়োজন হলো খৃস্টানদের অভিযান বিলম্বিত করে দেয়া। তার একমাত্র উপায় হচ্ছে তাদের রসদ জ্বালিয়ে দেয়া। তাদের যে হাজার হাজার ঘোড়া আছে, সেগুলোও ধ্বংস করার ব্যবস্থা হতে পারে।

রসদে আগুন লাগাবে কে? চেঙ্গিস জিজ্ঞেস করে।

তুমিই বলতে পারো, এখানে তোমাদের কতো লোক আছে- মেয়েটি বললো- এদের মধ্যে কমান্ডোও আছে নিশ্চয়ই। দায়িত্বটা তাদের উপর ন্যস্ত করা যেতে পারে। এখানে তোমাদের কতোজন কমান্ডো সেনা আছে?

সুলতান আইউবী নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন, অধিকতৃ অঞ্চলে নাশকতা চালানো যাবে না। কেননা, কমান্ডোরা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে এদিক-ওদিক সরে যায়। তার শাস্তি ভোগ করে নিরীহ সাধারণ মুসলমান- চেঙ্গিস বললো খৃস্টানরা তাদের ঘরে ঘরে প্রবেশ করে নারীদের উপর নির্যাতন চালায়। এ কারণে আমরা আমাদের কমান্ডোদের ফেরত পাঠিয়েছি। যে কজন আছে, সবাই গুপ্তচর। তবে তারা নাশকতাও চালাতে জানে। তাছাড়া তারা এখানকার কিছু যুবককেও প্রস্তুত করতে পারে।

তাদেরকে কি কোনো এক স্থানে একত্র করার ব্যবস্থা করা যায়? মেয়েটি জিজ্ঞেস করে এবং চেঙ্গিসের পেয়ালায় মদ ঢেলে পেয়ালাটা তার হাতে ধরিয়ে দেয়।

আমরা একটি মসজিদকে আমাদের আস্তানা বানিয়ে রেখেছি- মদের পেয়ালাটা খালি করে চেঙ্গিস বললো। মসজিদের অবস্থান জানিয়ে সে বললো- উক্ত মসজিদের ইমাম আমাদের নেতা। অত্যন্ত যোগ্য ও সাহসী মানুষ। আজ রাতই আমি এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলবো। কালই তিনি যুবকদেরকে মসজিদে একত্রিত করবেন। তারা সকলে নামাযের নাম করে মসজিদে এসে হাজির হবে।

শুধু একজন যোগ্য ও সাহসী লোক দ্বারা কাজ হবে না- মেয়েটি বললো- ইমামের সঙ্গে তুমিও থাকবে। তাছাড়া আরো তিন-চারজন বিচক্ষণ লোকের প্রয়োজন, যাতে এই নাশকতা পরিকল্পনাটা নিখুঁতভাবে প্রস্তুত করা যায়। আর এই সম্ভার তখন ধ্বংস করতে হবে, যখন আমরা দুজন এখান থেকে বেরিয়ে যাবো। কারণ, ঘটনার পরপরই শহর সীল হয়ে যাবে। তখন আর আমরা বেরুতে পারবো না।

শুধু ইমাম নন–চেঙ্গিস বললো- এখানে আমাদের একজন থেকে অপরজন অধিক যোগ্য লোক আছে। চেঙ্গিস কয়েকজন লোকের নাম বললো- আমি এদের প্রত্যেককে মসজিদে উপস্থিত করতে পারি।

চেঙ্গিস থেকে এসব তথ্যই নিতে চাচ্ছে মেয়েটি। সে চেঙ্গিসকে তার দল সম্পর্কে আরো জিজ্ঞাসা করে, যা চেঙ্গিস অকপটে বলে দেয়। অবশেষে বললো- জানো, এই প্রাসাদেও আমি একা নই, ভিক্টর নামক যে লোকটি আমার সঙ্গে কাজ করে, সেও আমার দলের সদস্য।

 ভিক্টরও? মেয়েটি চমকে ওঠে জিজ্ঞাসা করে।

হ্যাঁ- চেঙ্গিস বললো- তুমি কি আমাদের ওস্তাদির প্রশংসা করবে না যে, আমরা একজন খৃস্টানকেও আমাদের গুপ্তচর বানিয়ে রেখেছি?

মেয়েটি অনেকক্ষণ পর্যন্ত নীরব থাকে। তারপর বললো- আগামীকাল দিনের বেলা আমি তোমার কক্ষে আসবো। কেউ আমাকে ঠেকাতে পারবে না।

***

মেয়েটি যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়। গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা লোকটি নড়ে ওঠে। বসে বসে কটিবন্ধ থেকে খঞ্জর বের করে এবং আট দশ কদমের দূরত্বটা দুলাফে অতিক্রম করে মেয়েটাকে পেছন থেকে এক বাহু দ্বারা ঝাঁপটে ধরে। তার খঞ্জরধারী হাত উপরে উঠেই তীব্রবেগে নীচে নেমে আসে। খঞ্জর মেয়েটার বুকে গেঁথে যায়। মেয়েটা হাল্কা একটা চীৎকার দিয়ে শুধু বললো- আমার বুকে খঞ্জর ঢুকে গেছে।

চেঙ্গিস ঝটপট নিজের খুঞ্জরটা বের করে বীরত্বের সাথে লোকটার উপর আক্রমণ চালায়। লোকটি মোড় ঘুরিয়ে মেয়েটিকে সামনে নিয়ে আসে এবং বলে- আমি ভিক্টর চেঙ্গিস! এই হতভাগীর বেঁচে না থাকাই উচিত।

মেয়েটি কোকাচ্ছে। ভিক্টর তাকে পেছন থেকে এক বাহুতে ঝাঁপটে ধরে আছে।

তুমি অপদার্থ খৃস্টান- মদের নেশায় বুঁদ হওয়া চেঙ্গিস বললো- সাপের বাচ্চা! চেঙ্গিস মোড় ঘুরিয়ে ভিক্টরের উপর আক্রমণ করতে উদ্যত হয়।

ভিক্টর মেয়েটিকে আবার সামনে নিয়ে এসে তাকে ঢাল বানিয়ে বললো চৈতন্যে আসো চেঙ্গিস! মেয়েটাকে সবকিছু বলে দিয়ে তুমি আমাদের খেলাটা সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে দিয়েছো। ও যদি জীবিত থাকে, তাহলে রাত পোহাবার পরই আমরা সকলে গ্রেফতার হয়ে যাবো।

চেঙ্গিস ক্ষ্যাপা সিংহের মতো ভিক্টরের চার পার্শ্বে ঘুরছে আর হুংকার ছাড়ছে। মেয়েটির এখনো চৈতন্য আছে। সে কোঁকাতে কোকাতে বললো চেঙ্গিস! আমার রক্তের প্রতিশোধ নেয়ার দায়িত্ব তোমার উপর অর্পণ করলাম। খৃস্টানরা আমাদের বন্ধু হতে পারে না। আমি বাঁচবো না। এই লোকটা আমাদের নয়- খৃস্টানদের গুপ্তচর।

চেঙ্গিস লাফ দিয়ে ভিক্টরের উপর আক্রমণ করে। ভিক্টর তাকে বারবার বোঝাতে চেষ্টা করে, তুমি প্রতারণার শিকার। চলো, মেয়েটাকে হত্যা করে লাশটা দূরে ফেলে আসি। কিন্তু চেঙ্গিস এখন কারো গোয়েন্দা নয়। এখন সে একজন পুরুষ, যার প্রেয়সীকে অন্য এক পুরুষ ধরে রেখেছে এবং তার বুকে খঞ্জর বিদ্ধ করেছে। সম্মুখ থেকে সে মেয়েটাকে সজোরে এক ধাক্কা মারে যে, ভিক্টর পেছন দিকে পড়ে যায় আর মেয়েটি তার উপর ছিটকে পড়ে। চেঙ্গিস ভিক্টরের উপর খঞ্জরের আঘাত হানে। ভিক্টর পূর্ব থেকেই সতর্ক ছিলো। সে একদিকে সরে গিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। চেঙ্গিস তার উপর পুনরায় আক্রমণ চালায়। খঞ্জর তার কাঁধে গিয়ে আঘাত হানে।

ভিক্টর নিজেকে সামলে নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করে। চেঙ্গিসের বেঁচে থাকাও ঝুঁকিপূর্ণ। ভিক্টরের খঞ্জর চেঙ্গিসের পেটে আঘাত হানে। চেঙ্গিস পাল্টা আঘাত করে। ভিক্টরের বাহু কেটে যায়। ভিক্টর চেঙ্গিসের বুকে খঞ্জর মারে। মদমত্ত চেঙ্গিস দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ভিক্টর তার বুকের উপর আরেকটি আঘাত হানে। চেঙ্গিস লুটিয়ে পড়ে যায়। ভিক্টর মেয়েটার বুকে হাত রাখে। হৃদপিণ্ডটা নীরব। মরে গেছে। চেঙ্গিসও শেষ নিঃশ্বাস গ্রহণ করছে। এখন আর চৈতন্য নেই তার।

ভিক্টরের কাঁধ ও বাহু থেকে রক্ত ঝরছে। মেয়েটির পরিধানের কাপড় ছিঁড়ে বাহুটা বেঁধে নেয় সে। রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য কাঁধের জখমে কাপড় ঢুকিয়ে দেয়। ভিক্টর হাঁটতে শুরু করে।

ভিক্টর দ্রুত হাঁটছে। জখমের রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি। তবু তার কোনো পরোয়া নেই। অবলীলায় হাঁটছে ভিক্টর।

ভিক্টর একটি গলিতে ঢুকে পড়ে। দুটি মোড় অতিক্রম করে সে একটি প্রশস্ত গলিতে পৌঁছে যায়। গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন ত্রিপোলী। সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে সর্বত্র। প্রতিটি ঘরের দরজা বন্ধ। একটি মাত্র ঘরের দরজা, খোলা- আল্লাহর ঘর মসজিদের দরজা।

ভিক্টর এই মসজিদে এ-ই প্রথমবার এসেছে। তবে কীভাবে আসতে হবে, এসে কী করতে হবে, তার জানা আছে। বাম দেয়ালে একটি দরজা আছে। এটিই ইমামের বাসার দরজা। ভিক্টর পায়ের জুতো খুলে খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে।

***

রাতের অর্ধেকটা কেটে গেছে। ইমাম গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। দরজার করাঘাত তাকে জাগিয়ে তোলে। জাগ্রত হয়ে তিনি খানিক অপেক্ষা করেন। পুনরায় করাঘাত পড়ে। ঠিক আছে, আমারই গোয়েন্দাদের বিশেষ সাংকেতিক আওয়াজ। তারপরও তিনি লম্বা খঞ্জরটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খোলেন। ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন- চেঙ্গিস?

ভিক্টর- ভিক্টর জবাব দেয়- ভেতরে চলুন।

রক্তের গন্ধ আসছে কোথা থেকে? ইমাম অন্ধকারে ভিক্টরের বাহু ধরে জিজ্ঞেস করে।

আমার রক্ত। ভিক্টর জবাব দেয়।

ইমাম ভিক্টরকে টেনে ভেতরে নিয়ে যান। বাতি জ্বালালে দেখতে পান ভিক্টরের পরিধেয় রক্তে লাল এবং ভিজা। ইমাম ভিক্টরকে কখনো দেখেননি। পরিচয়টা চেঙ্গিসের মুখে শোনা। ভেতরের খবরাখবর পরিবেশন করা ছিলো তার দায়িত্ব। ইমামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ভিক্টরের কোন প্রয়োজন ছিলো না।

তুমি এসেছো?- ইমাম জিজ্ঞেস করেন- চেঙ্গিস আসেনি কেন?

চেঙ্গিস আর কখনো আসবে না। ভিক্টর উত্তর দেয়।

 কেনো?- ইমাম ভীতকণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন- ধরা পড়েছে?

হ্যাঁ, ধরা পড়েছে- ভিক্টর জবাব দেয়- নিজের পাপের হাতে ধরা পড়েছে। আমার খঞ্জর তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছে। আপনি আমার রক্ত দেখতে পাচ্ছেন। সম্ভব হলে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার ব্যবস্থা করুন। আপনি ভয় পাবেন না। আল্লাহর শোকর আদায় করুন যে, চেঙ্গিস জীবিত নেই। অন্যথায় আমাদের প্রত্যেককে কয়েদখানার নির্যাতনে জীবন হারাতে হতো।

ইমাম তাড়াতাড়ি ওষুধ বের করেন। পানি আনেন। ভিক্টরের জখম ধুইতে শুর করেন। ভিক্টরকে পোশাক পরিবর্তন করতে বললেন।

না- ভিক্টর বললো- আমি আমার করণীয় ঠিক করে রেখেছি। এই কাপড়েই আমি ফিরে যাবো। আমি আপনার নুন খেয়েছি। আমার প্রিয় বন্ধু ও অতিশয় বিপজ্জনক সফরের সঙ্গী আমার হাতে খুন হয়েছে। আমি স্থির করেছি, আপনাদের সকলের জন্য নিজেকে কুরবান করে দেবো। নিজের ঘাড়টা জল্লাদের সম্মুখে অবনত করে দিয়ে আপনাদের সকলকে রক্ষা করবো।

ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে ইমাম তাতে ওষুধ প্রয়োগ করছেন আর ভিক্টর ইমামকে সমস্ত ঘটনা বলে শোনাচ্ছে। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করে ভিক্টর বললো- আমার সন্দেহ জেগে গিয়েছিলো মেয়েটি প্রতারণা করছে। সে নিজেকে একজন বৃদ্ধ কমান্ডারের রক্ষিতা বলে দাবি করতো; কিন্তু আমি এমন কোনো বৃদ্ধ কমান্ডারকে কখনো দেখিনি। প্রতিদিন তার চেঙ্গিসের পথে দাঁড়িয়ে থাকা প্রমাণ করে, সে নিকটেই কোথাও থাকতো এবং চেঙ্গিসের উপর দৃষ্টি রাখতো। আমি চেঙ্গিসকে যখনই সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছি, সে ক্ষেপে ওঠেছে। আমি আপনাকে বলেছি, সে মদপানও করতে শুরু করেছিলো। আমার সন্দেহ, তাকে মদের সঙ্গে হাশিশ মিশিয়ে খাওয়ানো হতো। অন্যথায় চেঙ্গিসের মতো কঠিন ও পাকা ঈমানের মানুষটা এতো তাড়াতাড়ি এবং এতো সহজে এই ফাঁদে পা দেয়ার কথা নয়। অনেক রূপসী নারী তাকে ভালোবাসার জালে আটকানোর চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু সব অফারই সে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। মেয়েটি তাকে নিজের রূপ আর হাশিশ মিশ্রিত মদের যাদুতে দৈহিকভাবে নয় মানসিকভাবে ঘায়েল করে নিয়েছিলো।

চেঙ্গিস যখন বললো, সে মেয়েটিকে বলে দিয়েছে সে গোয়েন্দা, তখন আমার মনটা কেঁপে ওঠেছিলো। আমি যেনো অদৃশ্য থেকে ইঙ্গিত পেয়ে গেছি, এটি এতো বিরাট পদস্খলন, যার শাস্তি শুধু তার নয়। আমাদের প্রত্যেকের মৃত্যু। তার এই পদস্খলন মিসর-সিরিয়ার আযাদীর অপমৃত্যুরও কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমি তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু মেয়েটি তার বিবেকের উপর যে যাদু প্রয়োগ করে দিয়েছিলো, তা তাকে আমাদের থেকে এবং নিজের ঈমান ও কর্তব্য থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়েছিলো। আমি তখনই সংকল্প করে নিয়েছি, রক্ষা পাওয়ার একটি মাত্র পথ আছে মেয়েটিকে হত্যা করতে হবে। চেঙ্গিস যদি এই ভয়ঙ্কর পথ থেকে সরে না আসে, তাহলে তাকেও শেষ করে ফেলতে হবে। দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার লক্ষ্যে একজন মানুষকে হত্যা করা কোনো ব্যাপার নয়। তাছাড়া গোয়েন্দা বিধান তো আছেই যে, কারো প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার সন্দেহ হলে কিংবা কারো মাধ্যমে তথ্য ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে, তাকে হত্যা করতে হবে। কিন্তু তারপরও আমি সময় নিয়েছি। তাকে রক্ষা করেই জাতিকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু লোকটি আমাকে খুন করার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলো।

এমনও তো হতে পারে, তুমি তাকে ভুল বুঝাবুঝির উপর ভিত্তি করে হত্যা করেছো- ইমাম বললেন- হতে পারে মেয়েটি আসলেই মুসলমান এবং সত্যমনেই আমাদের জন্য কাজ করছিলো।

হতে পারে- ভিক্টর বললো- কিন্তু আমি নিশ্চিত ঘটনা এমন নয়। আমি প্রমাণ পেয়ে নিশ্চিত হয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। আমি মেয়েটিকে সেই ভবন থেকে বের হতে এবং ওখানেই ফিরে যেতে দেখেছি; যে ভবনে হারমানের বিভাগের মেয়েরা থাকে। আমি এও জেনেছি, মেয়েটি কোনো কমান্ডারের রক্ষিতা নয়। আজ রাত আমি চেঙ্গিসের পেছনে চলে গেলাম এবং যে স্থানে চেঙ্গিস মেয়েটিকে নিয়ে উপবিষ্ট ছিলো, আমি সেখান থেকে কয়েক পা দূরে একটি গাছের আড়ালে বসে গেলাম। মেয়েটি চেঙ্গিসের নিকট যেসব তথ্য জানতে চায় এবং যে ধারায় জিজ্ঞেস করে, তা-ই আমাকে নিশ্চিত করার যথেষ্ট ছিলো যে, মেয়েটি খৃস্টানদের গুপ্তচর। মেয়েটি ত্ৰিপোলীতে আমাদের কমান্ডো সেনাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। সে চেঙ্গিসকে জানালো, খৃস্টান বাহিনীর জন্য রসদ ইত্যাদির বিপুল সম্ভার সংগ্রহ করা হয়েছে, যাতে দাহ্য পদার্থের অসংখ্য মটকাও আছে। আমিও গুপ্তচর। আমি ভালো করেই জানি, এখানে কোথাও এতো সম্ভার সগ্রহ করা হয়নি। এই সম্ভার রাখার যে জায়গার কথা বলেছে, সেখানে কিছুই নেই। প্রয়োজন মনে করলে আপনি নিজে গিয়ে দেখে আসুন। চেঙ্গিস মেয়েটির কাছে আমাদের সবগুলো স্পট চিহ্নিত করে দিয়েছে। নাম উল্লেখ করে আমাকেও ফাঁসিয়ে দিয়েছে। মেয়েটি আমার নাম শুনে বিস্ময় লুকাতে পারেনি। এ তথ্য পাওয়ার পর সে অনেকক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চুপ থাকে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে যায়। মেয়েটি আমাদের অতিশয় বিপজ্জনক তথ্য নিয়ে যাচ্ছিলো। এ তথ্য যাচ্ছিলো সোজা হারমানের কাছে। আপনি এর পরিণতি আন্দাজ করতে পারবেন। আমি উঠে প্রথমে মেয়েটিকে ধরে ফেলি এবং খঞ্জরটা তার বুকের মধ্যে সেঁধিয়ে দেই। চেঙ্গিস মেয়েটির পক্ষ নিয়ে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি তাকে অনেক বুঝালাম, ঘটনার বাস্তবতা বুঝাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু মদ আর নারীর পরশ তাকে পশু বানিয়ে রেখেছিলো। আমি তার খঞ্জরের আঘাত খেয়েও বুঝালাম। কিন্তু কোনো বুঝ নেয়ার মতো অবস্থা তার ছিলো না। আমি অনুভব করলাম, চেঙ্গিস জীবিত থাকলে আমি তাকে কাবুতে রাখতে পারবো না এবং আমার প্রকৃত উদ্দেশ্য নস্যাৎ হয়ে যাবে। আমি তাকেও খতম করে দিলাম।

তুমি ভালো করেছো- ইমাম বললেন- আমি তোমার সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত। এখন তুমি ত্রিপোলী থেকে বেরিয়ে যাও। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

না- ভিক্টর বললো- রাত পোহালে সকলে চেঙ্গিস ও মেয়েটির লাশ দেখবে। আমার বিশ্বাস, হারমান জেনে ফেলেছেন চেঙ্গিস গোয়েন্দা ছিলো। তিনিই মেয়েটিকে তার পেছনে লাগিয়েছিলেন। তাই তিনি ধরে নেবেন এদেরকে মুসলমান গোয়েন্দারা খুন করেছে। তারপর এখানকার মুসলমানদের উপর কেয়ামত নেমে আসবে। আগেই নির্দেশ জারি হয়ে গেছে, কারো উপর চরবৃত্তির সন্দেহ হলে তাকে বন্দি কিংবা হত্যা করে ফেলবে। হারমান এখানকার প্রতিটি গৃহের উপর একজন করে গোয়েন্দা নিয়োগ করে রেখেছেন। তারা মুসলমানদেরকে টার্গেট বানানোর বাহানা খুঁজছে। আমি নিজের জায়গায় ফিরে যাচ্ছি। এই খুনের দায় আমি নিজে বহন করবো। কারণ বলবো, আমি আর চেঙ্গিস একই নারীর প্রেম-প্রত্যাশী ছিলাম।

তোমার থেকে আমরা এতো কুরবানী গ্রহণ করবো না- ইমাম বললেন আমি একজন লোক দেবো, যে তোমাকে কায়রো রেখে আসবে।

আমি আমার জীবনের কুরবানী দিতে চাই- ভিক্টর বললো- আমার শহরে খৃস্টান বাহিনীর দুজন অফিসার আমার এক বোনের প্রতি হাত বাড়িয়েছিলো। সে সময়টার কথা আমার স্মরণ আছে। তারা তাদের সৈনিকদেরকে আমার বোনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলো। কোন খৃস্টান আমার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। তিনজন মুসলমান যুবক খৃস্টান সৈন্যদের মোকাবেলা করেছিলো। তারা আহত হয়েছিলো। তবু তারা আমার বোনকে রক্ষা করেছে। খৃষ্টানদের উচ্চ পর্যায়ে ভালো একজন অফিসার ছিলেন। তিনি আমার অভিযোগ শুনেছিলেন। অন্যথায় শেষ পর্যন্ত আমার বোনও রক্ষা পেতো না, প্রতিরোধকারী মুসলিম যুবকরাও রেহাই পেতো না। এই ঘটনাটাই আমাকে মুসলমানদের গোয়েন্দায় পরিণত করেছে। আমি আপনার জাতিকে এই অনুগ্রহের প্রতিদান দিতে চাই। নিজের জীবনটা জল্লাদের হাতে তুলে দিয়ে আমি ত্রিপোলীর মুসলমানদের জীবন ও সম্মান রক্ষা করবো।

ভিক্টর ইমামকে জানায়- খৃস্টানরা সৈন্য সমাবেশ শুরু করেছে। তাদের গন্তব্য হাল্ব। প্রথমে তারা সিরিয়া জয় করার ইচ্ছা পোষণ করছে। তবে রওনা কবে হবে এখনো জানা যায়নি। এও জানা সম্ভব হয়নি, তাদের সকল সৈন্য একই এলাকার উপর আক্রমণ চালাবে, নাকি সামনে গিয়ে বিভক্ত হয়ে একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে হামলা করবে। এসব সংবাদ খুব তাড়াতাড়ি সুলতান আইউবীর কানে পৌঁছে যাওয়া দরকার, যাতে তিনি মিসরে বসে না থাকেন।

ভিক্টর যা কিছু জানতে পেরেছিলো, ইমামকে জানিয়ে দেয়। সে উঠে দাঁড়ায়। ইমাম যেতে নিষেধ করলে বললো- আপনি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনাকে কেউ ধরতে পারবে না।

ভিক্টর বেরিয়ে যায়।

***

ভিক্টরের ক্ষতস্থানের রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে গেছে। ইমাম তার জখম দুটোতে পট্টি বেঁধে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন সে এই ভেবে পড়িগুলো খুলে ফেলে যে, যাদের নিকট যাচ্ছে, তারা জিজ্ঞেস না করে বসে ব্যান্ডেজ কে করে দিয়েছে?

পট্টি খুলে ফেলার পর আবার রক্তক্ষরণ শুরু হয়। চেঙ্গিস ও মেয়েটির লাশ যেখানে পড়ে আছে, ভিক্টর সেখানে এসে পৌঁছে। রাতের শেষ প্রহরের চাঁদ উপরে উঠে এসেছে। ভিক্টরের মদের সোরাহী ও দুটি পেয়ালার উপর দৃষ্টি পড়ে। মেয়েটির চেহারার প্রতি গভীর চোখে তাকায়। মৃত্যু মেয়েটির চেহারার রূপ নষ্ট করতে পারেনি। উন্মুক্ত রেশমকোমল চুলগুলো বুকের উপর ছড়িয়ে আছে। ভিক্টর পুনরায় মদের সোরাহীটার প্রতি তাকিয়ে মনে মনে বললো- হায়রে মানুষ! নিজের ধ্বংসের জন্য কতোই না উপায় বের করে নিয়েছ।

ভিক্টর চেঙ্গিসের লাশটার প্রতি তাকায়। খানিক কি যেনো ভেবে এক পার্শ্বে বসে পড়ে। চেঙ্গিসের মরদেহটা বরফের ন্যায় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ভিক্টর তার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললো- তুমি ভালোভাবেই জানতে বন্ধু, নারী পুরুষের জন্য কতো বড় দুর্বলতা আর মদ কতো রাজা-বাদশাহর সিংহাসন উল্টে দিয়েছে। তারপরও জেনে-শুনে তুমি এই দুর্বলতা নিজের মধ্যে স্থান দিয়েছে। যাক গে ওসব, আমিও আসছি বন্ধু! জল্লাদ খুব তাড়াতাড়ি আমাকে তোমার নিকট পৌঁছিয়ে দেবে। আমরা একই পথের পথিক। আমি আসছি বন্ধু- আমি আসছি।

ভিক্টর উঠে দাঁড়ায়। দ্রুত হাঁটতে শুরু করে। খৃস্টান অফিসারদের বাসভবন তার গন্তব্য। জখম থেকে রক্ত ঝরছে। খঞ্জরটা খাপ থেকে বের করে দেখে খঞ্জরের গায়ে রক্ত জমে আছে। নিজের জখমের রক্ত দ্বারা খঞ্জরটা ভিজিয়ে নেয়। খঞ্জর হাতে নিয়েই হাঁটছে ভিক্টর।

 অধিক রক্তক্ষরণের ফলে ভিক্টর শরীরে দুর্বলতা অনুভব করছে। অফিসারদের ভবনে এসে পৌঁছে একটি দরজায় করাঘাত করে। তার জানা আছে, এখন তাকে যার নিকট যেতে হবে, তার বাসগৃহ এটিই। কিছুক্ষণ পর এক কর্মচারি দরজা খুলে দেয়। ভিক্টর অফিসারের নাম উল্লেখ করে বললো- ওনাকে জাগিয়ে তুলে বলল এক খুনী এসেছে।

চাকর দৌড়ে ভেতরে চলে যায়।

ভেতর থেকে বকবকানির শব্দ ভেসে আসতে শুরু করে। অফিসার গালাগাল করতে করতে এগিয়ে আসেন। দরজায় দাঁড়িয়ে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন- কে তুমি? কাকে খুন করে এসেছো?

চাকর একটি প্রদীপ হাতে নিয়ে ছুটে আসে। অফিসার আলোতে ভিক্টরকে দেখে বললেন- তুমি? কার সঙ্গে লড়াই করেছো?

আমি দুজন মানুষের খুনের দায় স্বীকার করতে এসেছি- ভিক্টর বললো- আমাকে গ্রেফতার করুন।

অফিসার ভিক্টরের মুখে সজোরে একটা চপেটাঘাত মেরে বললেন- খুন করার আর সময় পাওনি? দিনে করলে না কেননা? আমি কি তোমার বাপের চাকর যে, এখন তোমাকে গ্রেফতার করবো? আমার গভীর সুখ নিদ্রাটা তুমি বরবাদ করে দিয়েছো! পরক্ষণে চাকরকে বললেন- যাও, একে নিয়ে কয়েদখানায় বন্দি করে রাখো।

 চাকর ভিক্টরকে বাহুতে ধরে হাঁটতে শুরু করলে অফিসার গর্জন করে  বলে ওঠলেন- দাঁড়াও, থামো জংলী কোথাকার! ভেবে দেখলে না লোকটা তো পথে তোমাকেও খুন করে ফেলতে পারে। ভেতরে নিয়ে আসো। শুনি কী করেছে।

আমি একজন পুরুষ এবং একজন মহিলাকে হত্যা করেছি স্যার! ভিক্টর উচ্চকণ্ঠে বললো।

হত্যা করেছো?- অফিসার চমকে ওঠে জিজ্ঞেস করে- হত্যা করেছে? যদি কোনো মুসলমানকে হত্যা করে থাকো, তাহলে যাও নিজের ব্যান্ডেজ চিকিৎসা করাও। তুমি তাকে খুন না করলে নিশ্চয়ই সে তোমাকে খুন করে ফেলতো। আর যদি কোনো খৃস্টানকে খুন করে থাকো, তাহলে তোমাকেও খুন হতে হবে। ভেতরে এসে খুলে বলল কী ঘটেছে।

আপনি আমার সঙ্গে অতিশয় সুদর্শন এক যুবককে দেখে থাকবেন ভিক্টর ভেতরে গিয়ে বসে বললো- একটি মেয়ের সঙ্গে আমার প্রেম ছিলো। আমার সেই বন্ধু মেয়েটিকে ফুসলিয়ে আমার সাথে তার সম্পর্ক ভেঙে দেয়। নিজে তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তার দ্বারা আমাকে অপদস্ত করায়। কিন্তু আমি হাল ছাড়তে চাইনি। দুজনে মিলে আমাকে অনেক যন্ত্রণা দেয়। আজ রাতে আমি তাদেরকে একসঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় বসে থাকতে দেখে ফেলি। আমি মূলত তাদের দেখতেই গিয়েছিলাম। তাদেরকে এমন অবস্থায় দেখলাম যে, আমি সহ্য করতে পারলাম না। আমি মেয়েটির উপর আক্রমণ করে বসি এবং তাকে খঞ্জরের আঘাতে হত্যা করে ফেলি। তারপর আমার প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে আমার সংঘাত হয়। সে আমাকে দুটি আঘাত করে। আমিও তাকে দুটি আঘাতই করেছিলাম। কিন্তু আঘাত ছিলো গুরুতর। সেও মারা যায়। আমি কোথাও পালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে আপনার নিকট এসে পড়েছি।

নারীর জন্য খুন করা এবং খুন হওয়া কোনোটিই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। অফিসার বললেন।

ঘটনাটিকে অফিসার মোটেই গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না। এই মুহূর্তে কথা শুনতেই তার ভালো লাগছে না। চোখে তার রাজ্যের ঘুম। কে খুন হলো আর কে খুন করলো, সেদিকে তার কোনোই ভ্রূক্ষেপ নেই। ভিক্টরকে তিনি ছেড়েই দিতেন বোধ হয়। কিন্তু ততোক্ষণে ভোর হয়ে গেছে। লাশ দুটো দেখা হলো।

আসল ঘটনা জানতে পেরে হারমান ও তার নায়েব ক্ষোভে পাগলের মতো হয়ে যান। নিহত মেয়েটি অত্যন্ত মূল্যবান ও সক্রিয় গুপ্তচর ছিলে আর চেঙ্গিস ছিলো তার শিকার, যার মাধ্যমে তার পুরো দলের সন্ধান বের করার পরিকল্পনা ছিলো। তাদের সব পরিকল্পনা ও অর্জন শেষ হয়ে গেলো। সেই সঙ্গে মূল্যবান গোয়েন্দা মেয়েটিকেও হারাতে হলো।

ভিক্টরের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছে। কেউ তার ব্যান্ডেজ-চিকিৎসার কথা ভাবলো না। হারমান তাকে প্রহার করতে শুরু করেন। মার খেয়ে ভিক্টর অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তারপর আর কখনো তার জ্ঞান ফিরে আসেনি। পরদিন অচেতন অবস্থায়ই তাকে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়া হলো। জল্লাদ কুড়ালের এক আঘাতে তার মাথাটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

যে সময়ে ভিক্টরের মাথা ও দেহকে একটি গর্তে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছিলো, ঠিক তখন ইমামের প্রেরিত এক গোয়েন্দা ত্রিপোলী থেকে বহুদূর চলে গিয়েছিলো। তাকে উটের পিঠে চড়িয়ে পাঠানো হয়েছে। কায়রো পর্যন্ত সফর অনেক দীর্ঘ ও দুর্গম, যার ধকল একমাত্র উটই সহ্য করতে পারে।

***

৫৩৭ হিজরীর (১১৭৭ সাল) প্রথম দিকের ঘটনা। কায়রোর সামরিক এলাকায় অস্বাভাবিক জঁকজমক বিরাজ করছে। কোন মাঠে ঘোড়া ছুটাছুটি করছে। কোথাও পদাতিক সৈনিকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। কায়রো থেকে দূরে পার্বত্য এলাকার দৃশ্যটা এমন, যেনো সেখানে যুদ্ধ চলছে। এসব হলো, সুলতান আইউবীর বাহিনীর সামরিক মহড়া। এক উপত্যকায় দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপ করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হলো। অশ্বারোহী সৈনিকরা ছুটে এসে বিশ-পঁচিশ গজ বিস্তৃত এই আগুনের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। একটি মহড়া দূরবর্তী বালুকাময় প্রান্তরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কোনো সৈনিকের সঙ্গে পানি রাখার অনুমতি নেই।

কঠিন এক প্রশিক্ষণ। এরা সকলে নবাগত যোদ্ধা। ভর্তি এখনো চলছে। ফৌজের সকল সালার ও অন্যান্য অফিসার এই প্রশিক্ষণদানে মহাব্যস্ত। সুলতান আইউবী সালতানাতের অন্যান্য কাজ ও সমস্যার প্রতি দৃষ্টি দেন রাতে। দিন কাটে তার প্রশিক্ষণের তত্ত্বাবধান ও সালারদের দিক-নির্দেশনা প্রদানের মধ্য দিয়ে। তিনি সকলকে বলে রেখেছেন, খৃস্টানরা যদি সিরিয়ার উপর আক্রমণ না করে, তার অর্থ হবে, তারা যুদ্ধ থেকে তাওবা করেছে কিংবা তাদের মস্তিষ্ক সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তার এই দুই ধারণার একটিও সঠিক নয়। তারা অবশ্যই আসবে।

এ সময় পর্যন্ত কোন না কোনো অধিকৃত এলাকা থেকে কারো না করো আসবার কথা ছিলো- সুলতান আইউবী পার্শ্বে দন্ডায়মান এক সালারকে উদ্দেশ করে বললেন। তখন তিনি একটি টিলার উপর দাঁড়িয়ে সামরিক মহড়া দেখছিলেন। তিনি বললেন- খৃস্টানরা অবশ্যই আসবে। গোয়েন্দারাই বলতে পারবে, তারা কোন দিক থেকে আসবে, কোথায় আসবে এবং তাদের সেনাসংখ্যা কতো হবে।

সুলতান আইউবী টিলার উপর থেকে নীচে নেমে একদিকে হাঁটতে শুরু করেন। হঠাৎ দেখতে পান, দূরে একস্থানে ধূলি উড়ছে, যা একটি কিংবা দুটি ঘোড়ার ধূলি হবে। সুলতান দাঁড়িয়ে যান। ধূলি ও সুলতানের মাঝে দূরত্ব কমতে থাকে। দুটি ঘোড়া তার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে যায়। একটির আরোহী আলী বিন সুফিয়ান। অপরজন ত্রিপোলী থেকে ইমামের প্রেরিত গোয়েন্দা। সুলতান তাকে চেনেন না। লোকটি উটের পিঠে করে বেশ কদিনে কায়রো গিয়ে পৌঁছে। আলী বিন সুফিয়ান তার থেকে রিপোের্ট নিয়ে তাকে একটি ঘোড়া দিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন।

গোয়েন্দা সুলতান আইউবীকে জানায়- খৃস্টানরা ইসলামী দুনিয়ার উপর চূড়ান্ত আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। সেনা সমাবেশ শুরু হয়ে গেছে। খুনিনের সম্রাট রেনাল্টের সৈন্যসংখ্যা সবচে বেশি। তিনি মহাযুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে চাচ্ছেন।

সেই রেনাল্ট, যাকে মুহতারাম নুরুদ্দীন জঙ্গী (রহ.) গ্রেফতার করে বন্দি করেছিলেন- সুলতান আইউবী বললেন- জঙ্গী তাকে শর্তের ভিত্তিতে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জঙ্গীর অকাল মৃত্যু রেনাল্টের শর্তহীন মুক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষমতা আর সোনা-জহরতের লোভী আমীরগণ নুরুদ্দীন জঙ্গীর অপ্রাপ্তবয়স্ক পুত্রকে পুতুল শাসক বানিয়ে রেনাল্টকে মুক্তি দিয়ে দেয়। আজ সেই রেনাল্ট ইসলামের মূলোৎপাটনের জন্য আসছে। …আচ্ছা, তারপর বলো। আক্রমণ তাদের করারই কথা। আর কে থাকবে?

ত্রিপোলীর সম্রাট রেমন্ড- গোয়েন্দা বললো- অধিকতর সৈন্য সমাবেশ সেখানেই হচ্ছে। আক্রমণের বিস্তারিত সেখানেই স্থির হচ্ছে। তৃতীয়জন বল্ডউইন। তার সৈন্যও কম নয়। তবে তারা কবে নাগাদ রওনা হবে, জানা যায়নি। আক্রমণ হবে সিরিয়ার উপর। হাল্ব, হাররান ও হামাতের নামও শোনা যাচ্ছে। অভিযানটা খুব তাড়াতাড়ি হবে।

আলী বিন সুফিয়ান- সুলতান আইউবী বললেন- আমি ত্রিপোলীর সর্বশেষ সংবাদের অপেক্ষায় থাকবো।

না- আপনি আর কোনো সংবাদের অপেক্ষায় থাকবেন না- আলী বিন সুফিয়ানের পরিবর্তে ত্রিপোলী থেকে আসা গোয়েন্দা উত্তর দেয়- খৃস্টানদের সামরিক শাখায় আমাদের দুজন লোক ছিলো। দুজনই মারা গেছে।

গোয়েন্দা সুলতান আইউবীকে রাশেদ চেঙ্গিস ও ভিক্টরের কাহিনী শোনায়। সুলতান আইউবীর চোখ লাল হয়ে যায়। গোয়েন্দা বললো রেনা দাবি করছেন, তার বাহিনীতে দুইশত পঞ্চাশজন নাইট থাকবে। আমাদের উক্ত দুই গোয়েন্দা মৃত্যুর আগে ইমামকে জানিয়েছিলো, খৃষ্টানরা আপনাকে অতর্কিত গেরিলা আক্রমণ পদ্ধতি প্রয়োগের সুযোগ দেবে না। তারা এমন কৌশল অবলম্বন করবে, আপনি তাদের মুখোমুখি হয়ে যুদ্ধ করতে বাধ্য হবেন। আপনার সৈন্য কম এই দুর্বলতা তাদের জানা আছে। আপনি যাতে ঘুরে-ফিরে লড়াই করতে না পারেন, এই লক্ষ্যেই তারা অধিক সংখ্যক সৈন্য নিয়ে আসছে।

এই গোয়েন্দা রিপোর্টের পর সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে এখন বাইরে তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। তিনি কক্ষবদ্ধ হয়ে থাকতে শুরু করেছেন। কাগজে সম্ভাব্য রণাঙ্গনের নকশা এঁকে তার উপর অগ্রযাত্রা ও অন্যান্য কৌশলের দাগ টানছেন। যোগ-বিয়োগ দিয়ে হিসাব মেলাচ্ছেন। কখনো হঠাৎ সালারদের ডেকে তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। সেই সালারদের একজন হলেন ঈসা এলাহকারী ফকীহ, যিনি যোগ্য সেনা অধিনায়ক হওয়ার পাশাপাশি বড় মাপের একজন আলেম এবং ইসলামী আইন বিশারদও। কোনো কোনো ঐতিহাসিক তাকে সুলতান আইউবীর ডান হাত বলে অভিহিত করেছেন।

কথা নেই, বার্তা নেই হঠাৎ একদিন সুলতান আইউবী রওনা হওয়ার নির্দেশ দিয়ে বসেন। বাহিনীর উল্লেখযোগ্য অংশকে তিনি সুদানের সীমান্ত ঘেঁষে ছাউনি ফেলতে নির্দেশ দেন। কারণ, ওদিকে থেকেও আক্রমণ আসার সম্ভাবনা আছে। সুলতান আইউবীর জন্য সবচে বড় আপদ হলো, তিনি যখন কোনো অভিযানে রওনা হন, তখন পেছনেও শত্রু থেকে যায়। খৃস্টানদের জন্য তিনি মিসরের সকল সৈন্য নিয়ে যেতে পারেন না। এবার যখন তিনি রওনা হন, ঐতিহাসিকদের পরিসংখ্যান মোতাবেক তখন তার সঙ্গে সৈন্য ছিলো এক হাজার পদাতিক। এরা সকলে আযাদকৃত দাস। তবে যুদ্ধবাজ। আর ছিলো আট হাজার অশ্বারোহী, যাদের কেউ মিসরী, কেউ সেই সুদানী, যাদেরকে ১১৬৯ সালে সুলতান আইউবী বিদ্রোহের অপরাধে সেনা বাহিনী থেকে বহিষ্কার করে উর্বর জমি দান করে পুনর্বাসিত করেছিলেন। এখন তারা মিসরের অফাদার ও নির্ভরযোগ্য। কিন্তু এই এক হাজার পদাতিক সৈন্য নিতান্তই নতুন। তারা এখনো যুদ্ধ করেনি, যুদ্ধ। দেখেনি। তাদের প্রশিক্ষণও শেষ করা হয়েছে তাড়াহুড়ো করে।

সুলতান আইউবী তার বাহিনীকে স্বীয় ভাই আল-আদিলের কমান্ডে হাবের উপকণ্ঠে রেখে এসেছিলেন। তার অনুমান ছিলো, খৃস্টানরা এতো তাড়াতাড়ি সিরিয়া এসে পৌঁছবে না। তিনি দ্রুত রওনা হয়ে হাল্ব পৌঁছে যান। সেখানে পৌঁছে সংবাদ পান, খৃষ্টানরা হাররান দুর্গকে অবরোধ করে রেখেছে। সুলতান অবরোধকারী খৃস্টান সৈন্যদেরকে ঘিরে ফেলেন। তাঁর এই কৌশলটা এতোই আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত ছিলো যে, খৃস্টানরা শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম হলো না। সুলতান বহু শত্রুসেনাকে গ্রেফতার করেন এবং খৃস্টানদের অনেক ক্ষতিসাধন করেন। তিনি অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখেন এবং দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান লিড্ডিয়া ও রামাল্লা দখল করে নেন।

এ বিজয়গুলো ছিলো অপেক্ষাকৃত সহজ। তাতে, মিসর থেকে আসা নতুন সৈনিকদের মনোবল বেড়ে যায়। তারা বুঝে নেয়, যুদ্ধ এভাবেই হয়ে থাকে, যাতে বিজয় আমাদেরই হয়। নতুন সৈনিকরা অসতর্ক হয়ে ওঠে। খৃস্টানরা সম্ভবত ইচ্ছাকৃতভাবে পিছপা হয়ে সুলতান আইউবীকে ধোঁকা দিয়েছিলো। তারা অল্প কজন সৈন্যের মহড়া দিয়েছিলো মাত্র। এরা ফিরিঙ্গি। রেনাল্ট ও বল্ডউইনের বাহিনী এখনো সম্মুখে আসেনি। তারা উক্ত এলাকাতেই অবস্থান করছে। এখন খৃস্টানরা এমন শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে যে, সুলতান আইউবীর গুপ্তচররা শত্রুর এলাকা থেকে বেরই হতে পারছে না। ত্রিপোলীর গোয়েন্দার পর ওদিক থেকে আর কেউ আসতেই পারেনি।

রামাল্লার সন্নিকটে একটি নদী আছে। পানি গভীর না হলেও নদীটা বেশ গভীর ও চওড়া। ঈসা এলাহকারী রামাল্লা জয় করে তার বাহিনীকে রামাল্লার আশপাশে ছড়িয়ে দেন। নদীর তীরের আড়াল থেকে খৃস্টান বাহিনী এমনভাবে বেরিয়ে আসে, যেনো পানির স্রোত কূলের বাইরে চলে এসেছে। আল্লাহ জানেন, এই বাহিনী কবে থেকে ওখানে লুকিয়ে বসে ছিলো। ঈসা এলাহকারীর বাহিনী অসতর্কতা হেতু মারা পড়ে। তারা বিক্ষিপ্ত ছিলো। ফলে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়নি। ত্রিপোলীর গোয়েন্দার রিপোর্ট নির্ভুল প্রমাণিত হলো যে, খৃস্টানরা এমন কৌশল অবলম্বন করবে, যার ফলে সুলতান আইউবীর বিশেষ রণকৌশল অকার্যকর হয়ে পড়বে।

তৎকালের এক ঐতিহাসিক ইবনে আর্সীর লিখেছেন- ফিরিঙ্গিরা নদীর দিক থেকে এমনভাবে আত্মপ্রকাশ করে, যেনো মানুষ আর ঘোড়ার প্লাবন কূল অতিক্রম করে বাইরে এসে জনবসতিগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সুলতান আইউবীর বাহিনী অসতর্ক অবস্থায় পুরোপুরি ঘেৰাওয়ে চলে আসে।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জেমস লিখেছেন- সম্রাট বল্ডউইন সালাহুদ্দীন আইউবীর আগেই তার বাহিনীকে রামাল্লার উপকণ্ঠে নিয়ে এসেছিলেন। আইউবীর বাহিনী রামাল্লা জয় করার পর বল্ডউইনের এক সালার শহরে আগুন ধরিয়ে দেয়। খৃষ্টানদের কৌশল সফল হয়। আইউবী ঘেরাওয়ে এসে পড়েন। তার বাহিনী বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। তিনি কয়েকিট ইউনিটকে একত্রিত করে বিশেষ পদ্ধতিতে জবাৰী আক্রমণ করেন। কিন্তু ময়দান খৃস্টানদের হাতেই থাকে। আইউবীর হামলা ব্যর্থ হয়। এমনকি তার পক্ষে পেছনে সরে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।

সুলতান আইউবীর নতুন সৈনিকরা- যারা কয়েকটি স্থানে সহজে সাফল্য অর্জন করে ভেবে বসেছিলো, তাদেরকে কেউ পরাজিত করতে পারবে না- এমনভাবে পলায়ন করে যে, তারা মিসরের উদ্দেশ্যেই রওনা হয়ে যায়। পলায়নকারীদের মধ্যে তাদের সংখ্যাই বেশি, যাদেরকে অদূরদর্শী সেনা অফিসারগণ গনীমতের প্রলোভন দেখিয়ে ভর্তি করেছিলেন। সবচে বড় কারণ, এরা অনভিজ্ঞ। পরিশেষে সুলতান আইউবীর অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, তিনি একটি উটের পিঠে চড়ে রণাঙ্গন থেকে বেরিয়ে যান এবং নিজের জীবন রক্ষা করেন।

কাজি বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ- যিনি এই যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তাঁর রোজনামচায় লিখেছেন–

সুলতান আইউবী আমাকে এই যুদ্ধের পরাজয়ের কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন- খৃস্টানরা আমারই কৌশল প্রয়োগ করে আমার বাহিনীকে সেই সময় রণাঙ্গনে টেনে আনে, তখনো আমি তাদেরকে যুদ্ধের বিন্যাসে সাজাতে পারিনি। আরেক কারণ, আমার বাহিনীর উভয় পার্শ্বে যে ইউনিটগুলো ছিলো, তারা পরিকল্পনাবিহীন স্থান পরিবর্তন করতে থাকে। তাদের মধ্যে কোন সাবধানতা ছিলো না। এই সুযোগে শত্রুরা তাদের উপর আক্রমণ করে বসে। সেই আক্রমণ এতোই তীব্র ও আকস্মিক ছিলো যে, আমার নতুন যোদ্ধারা ভীত হয়ে পেছনে পালিয়ে যায় এবং মিসরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়। তারা পথ হারিয়ে ফেলে এবং এদিক-ওদিক বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। আমি তাদেরকে একত্রিত করতে ব্যর্থ হই। দুশমন আমার বাহিনীর বহু সৈনিকদের বন্দি করে ফেলে। তন্মধ্যে ঈশা এলাহকারীও ছিলেন।

 সুলতান আইউবী তাঁর সৈনিকদেরকে জীবনহানি ঘটানোর পরিবর্তে নির্দেশ প্রদান করেন, যার যার মতো ময়দান থেকে সরে যাও এবং কায়রো পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করো।

খৃস্টানদেরকে ষাট হাজার দিনার পণ আদায় করে সুলতান আইউবী সালার ঈশা ইলাহকারীকে ছাড়িয়ে আনেন। এক মিসরী ঐতিহাসিক মোহাম্মদ আল ওয়াহদীদ লিখেছেন- সুলতান আইউবী স্বীয় ভাই শামসুদ্দৌলা তুরান শাহকে এই যুদ্ধ এবং নিজের পরাজয়ের চিত্র লিখেছিলেন। তাতে তিনি একটি আরবী পংক্তিও লিখেছেন, যার মর্ম নিম্নরূপ

আমি তোমাকে এমন সময়ে স্মরণ করলাম, যখন খৃস্টানদের অস্ত্র কাজ করে চলছে। শত্রুর সরল ও গৌর বর্ণের বর্শাগুলো আমাদের শরীরে প্রবেশ করে রক্ত পান করে ফিরছে।

যুদ্ধটা হয়েছিলো ৫৭৩ হিজরীর (১১৭৬ খৃস্টাব্দে) জুমাদাল আউয়ালে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী যখন কায়রোতে প্রবেশ করেন, তখন তাঁর মাথাটা অবনত। সঙ্গে কোনো সৈন্য নেই। নেই একজন দেহরক্ষীও।

কায়রো পৌঁছেই সুলতান আইউবী পুনরায় সেনাভর্তির নির্দেশ দেন। তিনি সিরিয়ার রণাঙ্গনে স্বীয় ভ্রাতা আল-আদিলকে এবং যোগ্যতম সালারদেরকে হামাত রেখে এসেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *