২৬. ফাল্গুনের প্রথম

ফাল্গুনের প্রথম।

মাঘ মাস না যাইতেই দেশ জুড়িয়া হাহাকার উঠিল। লক্ষ্মীর অপমৃত্যু ঘটিয়াছে, ধরিত্রীর বুক শুকাইয়া ফাটিয়া চৌচির হইয়া গিয়াছে। গত ভাদ্রের মাঝামাঝি বৃষ্টি হইয়াছিল, তাহার পর আজও পর্যন্ত একফোঁটা বৃষ্টি নাই; পুকুরের জল কার্তিক মাসে ধান সেচিতে নিঃশেষিত হইয়া গিয়াছে। পানীয় জলের পুষ্করিণী হিসাবে যে পুকুরগুলির জল ছাড়া হয় নাই, মানুষের সকল প্রয়োজনে তাহাই খরচ করিয়া করিয়া সে ভাণ্ডারও প্রায় ফুরাইয়া আসিল। মাঠ ইহার মধ্যে ধু-ধু করিতেছে, কোথাও সবুজের চিহ্ন নাই। জলের অভাবে রবি ফসল বোনা হয় নাই, ঘাস শুকাইয়া গিয়াছে, মাটির শুষ্কতায় গাছের পাতা এবার মাঘ মাসেই ঝরিয়া গেল।

শিবনাথ ঘরের মধ্যে বসিয়া পড়িতেছিল। চারিদিকে রাশীকৃত বই, খাটের উপর রাত্রির বিছানা এখনও অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় পড়িয়া আছে। ঘরখানার কোণে ঝুল, খাটের তলায় তলায় ধুলার একটা জমাট স্তর।

সে নিবিষ্টমনে পড়িতেছিল, The French people were divided into three classes or Estates, of which two, the clergy and the nobility, comprised fewer than 300,000 souls and were Privileged, while one, the Third Estate comprised more than 20,000,000 and was, unprivileged.

মাঠে মাঠে ঘুরিয়া সে দেশের ব্যবস্থা দেখিয়াছে, অসংখ্য পঙ্গপালের মত দীনদরিদ্র মানুষকে সে দেখিয়াছে, সর্বোপরি মাটির অন্তরাল হইতে ধরিত্রীদেবতার শুষ্ক কণ্ঠের ভূষিত হাহাকার সে শুনিয়াছে। এই দুঃখের প্রতিকার খুঁজিয়া সে সারা হইয়া গেল, দেশ-দেশান্তরের ইতিহাসের মধ্য হইতে প্রতিকারের উপায় খুঁজিতেছিল। বারবার সে এই ফরাসি-বিপ্লবের ইতিহাস পড়িয়া থাকে। নিরুপায় হতাশার মধ্যে মনে মনে যেন সান্ত্বনা পায়। আরও একটু অগ্রসর হইয়া সে পড়িল, It has been estimated that in the eighteenth century a French peasant could count on less than one fifth of his income for the use of himself and family; four fifth went in taxes to the king, in tithes to the clergy, and in rents and dues to the nobility.

পাড়ায় কোথায় একটা শোরগোল উঠিতেছে, খুব ব্যস্ত কর্মতৎপরতার সাড়ার মত। অভ্যাসবশে বাহিরের কোলাহলে আর শিবনাথের মনোযোগ ভ্ৰষ্ট হয় না। একটা ধ্যানযোগ তাহার যেন অভ্যাস হইয়া গিয়াছে। তবুও ওই শোরগোলটা আজ তাহার মনোযোগ আকৃষ্ট করিল, চকিতের মত একখানা নিমন্ত্রণপত্রের কথা গতকল্যকার স্মৃতি হইতে জাগিয়া উঠিল। সম্মুখেই দোল-পূর্ণিমা; দোল-পূর্ণিমায় রামকিঙ্করবাবুদের বাৎসরিক উৎসব তাহাদের রাধাগোবিন্দ বিগ্রহের দোলপর্ব মহাসমারোহের সহিত অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। সেই উপলক্ষে জামাতা হিসাবে নিমন্ত্রণপত্ৰ কাল সে পাইয়াছে। এই সময় সপরিবারে তাহারা কলিকাতা হইতে দেশে আসেন। আজই তাঁহাদের আসিবার কথা। বোধহয় বাড়ি ঝাড়ামোছা সারা হইতেছে, গৌরীও আসিবে। আজ এই কয়েক মাস ধরিয়া গৌরী সেখানে; পত্র নিয়মিত সে দিয়াছে, গৌরীও উত্তর দিয়াছে; কিন্তু সে পত্রে আনন্দ নাই, আগ্ৰহ নাই। শিবনাথ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ডাকিল, নিত্য! নিত্য!

উত্তর দিল পাচিকা রতন শিবনাথের রতনদিদি, নিত্য বউকে দেখতে গেল ভাই। বড়বাবুদের বাড়ির সব এল কিনা, তাই নিত্য গেল; বলে, একবার বউদিকে দেখে আসি। কেন, কিছু বলছ?

শিবনাথ নীরব হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। গৌরী আসিয়াছে সংবাদ শুনিবামাত্র তাহার মন কী এক গভীর আবিষ্টতার মধ্যে নিমগ্ন হইয়া গেল। গৌরী আসিয়াছে! বুকের মধ্যে হৃদযন্ত্র দ্রুততর গতিতে চলিতে আরম্ভ করিল।

রতনদিদি আবার জিজ্ঞাসা করিল, শিবু, নিত্যকে কিছু বলছিলে ভাই? নিত্য তো নাই, আমি করে দিই। কী বলছ বল?

শিবু এবার আত্মস্থ হইয়া বলিল, একবার চা খেতাম রতনদি।

রতন বলিল, কবার চা খেলে, আবার চা খাবে? নাক দিয়ে যে রক্ত পড়বে। বরং একটু দুধ গরম করে দিই।

শিবনাথ বলিল, দূর, দুধ বাছুরে খায়।

রতন হাসিয়া ফেলিল, হাসিতে হাসিতে বলিল, তবে একটু শরবত দিই নেবু দিয়ে?

শিবনাথ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, উঁহুঁ, শরবত খায় ভটচাজ্জি মশায়রা।

রতন এবার উনান হইতে কড়া নামাইয়া ফেলিয়া বলিল, আচ্ছা বড়সাহেব, চায়ের জলই আমি চড়িয়ে দিলাম।

শিবনাথ আবার গিয়া চেয়ারের উপর বসিল। ইতিহাসখানা খুলিয়া চোখের সম্মুখে ধরিল বটে, কিন্তু একবৰ্ণ আর পড়া হইল না। বই হইতে মুখ তুলিয়া সে আপনার ঘরের জানালা দিয়া রামকিঙ্করবাবুদের জানালার দিকে চাহিয়া রহিল। দীর্ঘকাল পরে আবার তাহার দেহ-মন এক পুলকিত অস্থিরতায় অধীর হইয়া উঠিতেছে।

 

একমুখ হাসি লইয়া চায়ের কাপ হাতে নিত্য ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিল, বউদিদি এসেছেন, দাদাবাবু। দেখা করে এলাম আমি।

হুঁ। শত প্ৰশ্ন মনের মধ্যে গুঞ্জরিত হইতেছিল। কিন্তু নিত্যর কাছে শিবনাথ কেমন লজ্জাবোধ করিল; নিত্য এ-বাড়ির পুরনো ঝি, তাহার সম্মুখে সে সঙ্কোচ কাটাইতে পারি না, নিস্পৃহতার ভান করিয়া শুধু বলিল, হুঁ।

নিত্য বলিল, বউদিদি এবার বেশ সেরেছেন, রঙ ফরসা হয়েছে, যাকে বলে, টকটকে রঙ মাথায়ও খানিকটা বেড়েছেন। তা তিন-চার আঙুল লম্বা হয়েছেন মাথায়।

হাসিয়া শিবনাথ বলিল, ভাল। কিন্তু মনের অস্থিরতা তাহার মুহূৰ্তে মুহূর্তে বাড়িতেছিল।

নিত্য আপন উৎসাহেই বলিতেছিল, আমি বলে এলাম বউদিদিকে পাঠিয়ে দেবার কথা। বললাম, আমরা আর পারব না বাপু বউদিদির ঘর-সংসার চালাতে, পাঠিয়ে দ্যান আমাদের বউদিদিকে। তা বউদিদির দিদিমায়ের যে রাগ। বললেন, তা বলে আপনা থেকে আমার নাতিন যাবে নাকি লো হারামজাদী? পাঠিয়ে দিগে তোদের দাদাবাবুকে, এসে পায়ে ধরে নিয়ে যাবে।

শিবনাথের বুকে দ্রুত ধাবমান রক্তস্রোতের বেগ স্তিমিত হইয়া গেল, সে গম্ভীরভাবে চায়ের কাপে চুমুক দিয়া কহিল, তারপর?

নিত্য বলিল, বউদিদির গায়ে এবার অনেক নতুন গয়না দেখলাম দাদাবাবু। এক গা গয়না, গয়নায় সর্বাঙ্গ ঢাকা যাকে বলে।

হুঁ। শিবনাথ আবার কাপে চুমুক দিল।

আপনি বাপু একবার যান, গিয়ে বউদিদিকে নিয়ে আসুন। নইলে ভাল লাগছে না বাপু!

শিবনাথ কোনো উত্তর দিল না, তার মন বিদ্বেষে ক্ষোভে ভরিয়া উঠিল; সে আবার বইখানায় মনঃসংযোগ করিল-Louis XV wasted millions on idle personal pleasure and at the same time encourged the upper classes to imitate his shameful and prodigal manner of living, with the result that the Privileged orders vied with their worthless master in exacting more and more money from the unprivileged.

নিত্য কিন্তু নাছোড়বান্দা; সে বলিল, বউদিদিকে নিয়ে আসুন, পিসিমাকে নিয়ে আসুন, নিয়ে সাজিয়ে ঘরকন্না করুন বাপু। পিসিমারই আর সেখানে থাকলে চলবে কেন? দুদিন পরে নাতি হবে।

শিবনাথ অসহিষ্ণু হইয়া বলিয়া উঠিল, বকিস নি নিত্য কানের কাছে এমন করে। যা এখান থেকে তুই।

নিত্য এ কথায় মনে মনে আহত না হইয়া পারিল না, সে বলিল, আমরা চাকরবার লোক, এমন করে দায়িত্ব নিয়ে সংসার চালাতে পারব না বাপু, আমাদের বলা সেই জন্যে। বলিয়া সে হনহন করিয়া নিচে নামিয়া গেল।

শিবনাথ চায়ের কাপ ও বই-দুই-ই ফেলিয়া উঠিয়া পড়িল। পিসিমার কথা উঠিলেই সে এমনই অস্থির হইয়া পড়ে, দারুণ একটা অস্বস্তির গ্লানিতে তাহার অন্তর পীড়িত হইয়া ওঠে, সংসারের সকল কিছুর উপরেই বিতৃষ্ণা জন্মিয়া যায়, বিতৃষ্ণা হয় গৌরীর উপর বেশি। গৌরীকেই এ অপরাধের একমাত্র হেতু না ভাবিয়া সে পারে না। মনের ওত্তাপে সে রুক্ষ হইয়া ওঠে; তারপর ধীরে ধীরে সে এক রহস্যময় গভীরতার মধ্যে ড়ুব দেয়। তখন সে অতিমাত্রায় সংযত, মিতভাষী, চিন্তাশীল; তারপরই আসে কর্মমুখর অধ্যায়। কর্মক্লান্ত হইয়া তবে আবার সে একদিন ঘরে ফেরে। শ্ৰান্ত হইয়া আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়া আসে। কিন্তু এমনই করিতে করিতে তাহার স্বাভাবিক রূপেরও একটা পরিবর্তন ঘটিতে চলিয়াছে। পৃথিবীর সর্বত্রব্যাপী একটা দুঃখময় অবস্থার আভাস সে অনুভব করিতেছে। কল্পনার সহিত বাস্তবের সাদৃশ্য খুঁজিতে সে পল্লীতে পল্লীতে ঘুরিয়া তাহাদের দুঃখ-দারিদ্র্যের কথা প্রত্যক্ষ করিয়া আসে। সমুখে অন্নহীনতার একটা গভীর অবস্থা কল্পনা করিয়া এক-একটি গ্রামের কাহার কতদিনের খাদ্য আছে সন্ধান করিতে গিয়া এমনই একটা ভাবময় অনুভূতি তাহার মনে জাগিয়া উঠিয়াছে। এই অনুভূতির সহিত তাহার অন্তরেরও যেন একটা সহজ সহানুভূতি আছে।

আজও সে ঘর হইতে বাহির হইয়া ওয়াটারবটা জলে পূর্ণ করিয়া লইল, রতনকে বলিল, আমার জলখাবার তৈরি করে রতনদি?

রতন তাহার দিকে চাহিয়া বলিল, ও কী, পিঠে আবার চামড়ার দড়ি ঝোলালে যে?

একবার বেরুব।

কোথায়?

রামপুরের খবর অর্ধেক নেওয়া হয়েছে, তারপর বাকি পড়ে আছে। ওটা আজ শেষ করে আসব। দাও, খাবারগুলো এই ব্যাগের মধ্যে পুরে দাও।—বলিয়া সে বাইসিটা ঠেলিয়া বাহির করিয়া আনিল। ঘোড়ায় এখন আর সে যায় না, ঘোড়ায় গেলে ঘোড়াটার খাওয়াদাওয়ার একটু অসুবিধা হয়, বাড়ি ফিরিবার জন্য তাগিদ থাকে। রতন জানে, প্রতিবাদে ফল হইবে না; প্রতিবাদ করিতে গেলে মধ্যে মধ্যে রুক্ষ দৃষ্টি, কখনও বা রূঢ় কথা সহিতে হয়, তাই সে বিনা প্রতিবাদে ব্যাগে খাবার পুরিয়া দিল। শিবনাথ মাথায় একটা হ্যাট চড়াইয়া বাইসিক্ল লইয়া বাহির হইয়া গেল।

রতন আজ ছানা কিনিয়া ডালনা ব্রাধিতেছিল, শিবু ছানার ডালনা ভালবাসে। শিবু চলিয়া যাইতেই সে অর্ধসমাপ্ত ডালনাটা ষ্টুড়িয়া উঠানে ফেলিয়া দিল এবং উচ্ছিষ্টপ্রত্যাশী কয়টা কুকুরকে কহিল, নে খা, তোরাই খা।

তারপর সে শূন্য কড়াটা লইয়া সশব্দে রান্নাঘরে নামাইয়া রাখিল।

 

অপরাহ্নে রামকিঙ্করবাবুর বাড়ি হইতে নিমন্ত্ৰণ আসিল। তাহাদের বাড়ির এক পোয্য আত্মীয়া আসিয়া রতনকে দেখিয়া বলিল, কই গো, তোমাদের দাদাবাবু কই?

রতন সম্ভাষণ জানাইয়া বলিল, এস ভাই, এস। আজই এলে বুঝি সব? বস।

হ্যাঁ। বসবার কি যো আছে ভাই, এখুনি ডাক পড়বে। তোমাদের দাদাবাবুকে নেমন্তন্ন। করতে এসেছি, রাতে খাবে, ওখানেই থাকবে, বুঝলে?—বলিয়া একটু হাসিল।

রতন বলিল, তিনি তো বাড়িতে নাই।

ওই নাও! কোথায় গেলেন আবার?

কোথা কোন্ পাড়াগাঁয়ে গিয়েছেন, সে ভাই তিনিই জানেন। বেরিয়েছেন সেই সকালে স্নানও নাই, খাওয়াও নাই, আবার কখন যে ফিরবেন, তারও কিছু ঠিকঠিকেনা নাই।

বেশ। আমি তাই বলিগা হবে।

সন্ধ্যার প্রাক্কালে আবার লোক আসিল, রতন জবাব দিল, এখনও তিনি ফেরেন নাই। কিছুক্ষণ পরে গৌরীর দিদিমা আসিয়া হাজির হইলেন; রতন শশব্যস্ত হইয়া আসন পাতিয়া দিয়া

সসম্ভ্ৰমে দাঁড়াইয়া রহিল।

গৌরীর দিদিমা বলিলেন, আমরা নেমন্তন্ন করব, যেতে হবে, এই ভয়েই সে বুঝি পালিয়েছে?

সবিনয়ে রতন বলিল, আজ্ঞে না গিন্নিমা, আজকাল তার কাজই হয়েছে ওই। কোনোদিন খান, কোনোদিন খান না, অদ্ধেক রাত তো ঘুমোনই না, ফিরতে কোনো দিন বারটা-একটা হয়, আবার ঘরে থাকলে বই নিয়েই বসে থাকেন অদ্ধেক রাত।

গৌরীর দিদিমা কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন, যালো রতন, বুলি স্বভাবচরিত্তির খারাপটারাপ হয় নি তো?

শিহরিয়া উঠিয়া রতন বলিল, আমরা সে কথা বলতে পারব না গিন্নিমা; মুখ দিয়ে তা হলে পোকা পড়বে আমাদের।

নিত্য বলিল, ই কিন্তু স্বভাবচরিডির খারাপের চেয়েও খারাপ গিন্নিমা, এই করেই বিবেগী হয়।

গৌরীর দিদিমা চিন্তিত মুখে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। নিত্য আবার বলিল, সেদিন আবার মাস্টারকে বলছিলেন, যুদ্ধে গেলে বেশ হয়। ওই মাস্টারটি কিন্তু একটি নষ্টগুড়ের খাজা। ওই তো বাহবা দিয়ে পুকুর মেরে দেশের লোককে জল দিয়ে রাজ্যের মাছগুলোকে লণ্ডভণ্ড করে

দিলে।

গৌরীর দিদিমা অত্যন্ত চিন্তিত হইয়া বলিলেন, এ আমি কী করলাম মা; দুয়োরের কাছে ফুলবাগান করে সাধ করে ফাঁস গলায় পরলাম! চোখের সামনে কুটুম করে এ কী বিপদ করলাম আমি! তা যখনই আসুক, পাঠিয়ে দিও, বুঝলে? দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া তিনি বাহির হইয়া গেলেন।

শিবনাথ ফিরিল রাত্রি বারটায়। পথে বাইসিটার টিউব ফাটিয়া যাওয়ায় বাইসিক্ল ঠেলিতে ঠেলিতে সে বার মাইল রাস্তা হাঁটিয়া আসিয়াছে। ধুলায় সর্বাঙ্গ ভরা, শ্ৰান্ত অবসন্নদেহ শিবুকে দেখিয়া সকলে ত্রস্ত হইয়া উঠিল। শিবনাথ বলিল, এক হাঁড়ি জল গরম করতে দে তো সতীশ, স্নান করতে হবে।

রতন সবিস্ময়ে বলিল, এই রাত্রে স্নান করবে কি?

হ্যাঁ, ধুলোয় সমস্ত শরীর কিচমিচ করছে। সমস্ত পথটা হেঁটে আসছি।

হেঁটে!

হ্যাঁ, গাড়িটা অচল হয়ে গেল যে। জলদি কর সতীশ, আর বসে থাকতে পারছি না আমি।

রতন বলিল, তোমায় আবার নেমন্তন্ন করে গেছেন তোমার দিদিশাশুড়ি।

কুঞ্চিত করিয়া শিবনাথ বলিল, কী বিপদ! নেমন্তন্ন নিলে কেন তোমরা? এই এত রাত্রে কি নেমন্তন্ন খেতে যায় কোথাও?

এত রাত্রি হবে, তা কী করে আমরা জানব বল? আর বলে গেছেন তিনি, যত রাত্রিই হোক, এলে পাঠিয়ে দিও। আমরা কী বলব, বল?

হুঁ।—বলিয়া সে ইজিচেয়ারের উপর শ্ৰান্তভাবে এইয়া পড়িল। তাহার মনের সে এক বিচিত্র অবস্থা, গৌরীর আকর্ষণ নাই, পিসিমার স্মৃতি সমাহিত হইয়া পড়িয়াছে, চোখের পাতায় ঘুম নামিয়া আসিতেছে মায়ের স্পর্শের মত; নিস্তব্ধ রাত্রের অসংখ্য কোটি কীটপতঙ্গের সঙ্গীত ঘুমপাড়ানি গানের মত অবোধ্য অথচ মধুর ঝঙ্কারে ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া মিলাইয়া আসিতেছে।

সতীশ জল গরম করিয়া আসিয়া ডাকিল, কিন্তু সাড়া মিলিল না। রতন আসিয়া দেখিয়া নিত্যর সহিত পরামর্শ করিয়া কিছু খাবার টেবিলের উপর ঢাকা দিয়া রাখিয়া দিল। নিত্য বিছানাটা ঝাড়িতে ঝাড়িতে বলিল, ডাক না রতনদিদি, কিছু খেয়ে বিছানার উপর শুয়ে পড়ুন।

রতন দক্ষিণের খোলা জানালাটার দিকে আঙুল দেখাইয়া বলিল, ওদের বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে আমাদের বউ, নয় নিত্য?

নিত্য চাহিয়া দেখিয়া বলিল, হাঁ।

দিদিমার বাড়ির খোলা জানালায় দাঁড়াইয়া গৌরী এই ঘরের দিকেই চাহিয়া ছিল, পরমুহূর্তেই সে সরিয়া গেল, রতন ও নিত্যর ইঙ্গিতে ভঙ্গিতে তাহাকে দেখতে পাওয়াটা সে বোধহয় বুঝিতে পারিয়াছিল।

রতন বলিল, আর গতিক ভাল নয় নিত্য, এ বাড়ির আর ভাল বুঝছি না ভাই; এখন মানে মানে আমরা সরতে পারলে বাঁচি।

নিত্য বলিল, আমার সব্বনাশ যে আমি নিজে করেছি ভাই। আমার মাইনেপত্তর সবই যে এখানেই জমা আছে, যাব বললেই বা যাই কী করে, বল্‌?

তাহারা বাহির হইয়া গেল। সতীশ ঘরের বাতিটা কমাইয়া দিয়া এদিক-ওদিক চাহিয়া খাবারের থালা হইতে একটি রসগোল্লা তুলিয়া লইয়া চলি গেল।

 

প্রাতঃকালে জনতিনেক লোক ঝুড়িতে করিয়া ফল, মিষ্টি ও দুইটা বাক্স মাথায় আসিয়া। উপস্থিত হইল। নিত্য পুলকিত হইয়া বলিল, বউদিদির বাক্স!

সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় গৌরীর দিদিমা গৌরীকে সঙ্গে লইয়া বাড়িতে প্রবেশ করিয়া ডাকিলেন, কই, নাতজামাই কই?

রতন সসম্ভ্ৰমে বলিল, এখনও ওঠেন নাই গিন্নিমা। কাল ফিরেছেন সেই শেষত্রে, গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়ে ছ কোশ রাস্তা হেঁটে এসে বললেন, চান করব; আমি নেমন্তনের কথা বললাম। তা জল গরম হতে হতে চেয়ারে পড়ে সেই যে ঘুমালেন, উঠলেন না, চানও না, খাওয়াও না; সেই চেয়ারে পড়ে পড়ে এখনও ঘুমোচ্ছেন।

গৌরীর দিদিমা নাতনীকে বলিলেন, যা কেন লো হারামজাদী, দেখ, উঠল কি না! না। উঠেছে তো ডাক্‌!

গৌরী বলিল, এই দেখ, তোমাকে ফাজলামি করতে হবে না, আমি ডাকতে পারব না। পারবি না? পারবি না তো তোর সোয়ামিকে আমি ডাকতে যাব নাকি? যা বলছি, যা।

গৌরী মুখে না বলিলেও কাজে অগ্রসর হইয়াছিল। দিদিমার কথা শেষ না হইতেই সে সিঁড়িতে উঠিয়াছে। গৌরীর দিদিমা বলিলেন, পারবি না বলে চললি যে হারামজাদী! লজ্জাবতী লতা আমার!

গৌরী আসিয়া ঘরের দরজায় দাঁড়াইয়া দেখিল, শিবনাথ তখনও নিদ্ৰামগ্ন; তাহার সর্বাঙ্গে ধুলা, মাথার চুলে ধুলায় ও ঘামে যেন জট পড়িয়া গিয়াছে। তাহার শরীর যেন অনেক শীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে, দেহবর্ণ রৌদ্রে রৌদ্ৰে যেন পুড়িয়া গিয়াছে। টেবিলের উপর স্থূপীকৃত বই, টেবিলল্যাম্পটা এখনও নিবানো হয় নাই। পাশে খাবার তেমনই চাপা দেওয়া আছে। সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ডাকিল, শুনছ!

কিন্তু সে মৃদু স্বর নিদ্ৰিতের চেতনা পর্যন্ত পৌঁছিল না। সে আবার ডাকিল, শুনছ! তারপর অগ্রসর হইয়া সলজ্জভাবে শিবনাথকে স্পর্শ করিয়া ডাকিল, শুনছ।

এবার নিদ্রারক্ত চোখ মেলিয়া শিবনাথ বলিল, অ্যাঁ! চোখের সম্মুখে গৌরীকে তখনও তাহার মূর্তিমতী স্বপ্নের মত বোধ হইতেছিল। কিন্তু গৌরী সাড়া দিয়া বাস্তবকে প্ৰকট করিয়া বলিল, ওঠ। মুখ-হাত ধোও। কাল সমস্ত দিনরাত্রি কিছু খাও নি, কিছু খাও।

শিবনাথ চোখ মুছিয়া প্রত্যক্ষ বাস্তবকে যেন অনুভব করিয়া বলিল, কখন এলে তুমি?

গৌরী অভিমানভরে বলিল, তুমি তো গেলে না, আমি নিজেই যেচে এলাম।

সেই মুহূর্তে উচ্চহাস্যরোলে সিঁড়িটা যেন ভাঙিয়া পড়িল। শিবনাথ সচকিত হইয়া উঠিল, গৌরী মাথার অবগুণ্ঠন টানিয়া দিয়া বলিল, মরণ তোমার!

শিবনাথ সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, কে?

আমি হে আমি, বড়াই বুড়ি, তোমাদের দূতীগিরি করতে এসেছি।—বলিয়া দিদিমা ঘরে প্রবেশ করিলেন।

শিবনাথ ত্ৰস্ত হইয়া উঠিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিল।

দিদিমা নাতনীকে বলিলেন, বেশ তো এখুনি ছেদ্দা হচ্ছিল, সোহাগ হচ্ছিল, আমাকে দেখে যে আবার সানুবুড়ি হয়ে গেলি! যা না ভাই, মুখ-হাত ধোবার জল দিতে বল, চা করে নিয়ে আয়। দাঁড়িয়ে রইলি যে?

শিবনাথ ব্যস্ত হইয়া বলিল, না না, আমাকে আগে স্নান করে ফেলতে হবে। দিদিমা বলিলেন, বেশ তো, তা হলে তেল আনুক, গামছা আনুক, পিঠে তেল দিয়ে দিক।

আমাকে দেখে আবার লজ্জা! আমি বুড়ি, চোখে ভাল দেখতে পাই না, তার ওপর দিদিমা, আমাকে দেখে আবার লজ্জা!

 

শিবনাথ স্নান করিয়া আসিয়া দেখিল, দিদিমা চলিয়া গিয়াছেন, গৌরী চা ও খাবার টেবিলের উপর রাখিয়া অপেক্ষা করিয়া দাঁড়াইয়া আছে, নিত্য ঘর পরিষ্কার করিতে আরম্ভ করিয়াছে। শিবনাথকে দেখিয়া গৌরী বলিল, মাগো, ঘরের যেমন ছিরি, তেমনই মানুষের ছিরি! তোমার রঙ কী কালো হয়েছে বল তো!

শিবনাথ একটু হাসিল শুধু, কোনো উত্তর দিল না। ঘর অপরিষ্কারের কথায় নিত্যর একটা কথা মনে পড়িয়া গেল, ঝুল ঝাড়িতে গিয়া গৌরী একদিন ছবি ভাঙিয়াছিল; চুরি করা পানের পিচকে রক্ত ভাবিয়া সকলে হায় হায় করিয়া উঠিয়াছিল; সে হাসিয়া বলিল, আপনি একদিন ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে ছবি ভেঙেছিলেন বউদিদি, মনে আছে আপনার?

গৌরীও হাসিয়া উত্তর দিল, মনে নেই আবার! বাবাঃ পিসিমার যে বকুনি!

শিবনাথ চায়ের কাপ হাতে লইয়া হঠাৎ যেন অন্যমনস্ক হইয়া গেল। নীরবে বাহিরের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল। গৌরী শিবনাথের এই আকস্মিক উদাসীনতায় বিস্মিত না হইয়া পারিল না, তাহার ভ্রূ কুঞ্চিত হইয়া উঠিল। এদিকে নিত্য আপন মনে প্রশ্নের পর প্রশ্ন, প্রসঙ্গের পর প্রসঙ্গ উথাপন করিয়া চলিয়াছে। সে বলিল, এবার আপনার কী কী গয়না হল বউদিদি?

শিবনাথের উদাসীনতায় ক্ষুণ্ণ গৌরী উত্তর দিল, নাম আর কত করব নিত্য, এরপর বরং দেখাব তোমাদের।

দাদাবাবুকে দেখিয়েছেন?

তোমাদের দাদাবাবুর চোখে ওসব ঠেকে না, সাধু মানুষকে ওসব দেখতে নেই।

শিবনাথ ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল, না না, দেখব বৈকি, কিন্তু না দেখালে কী করে দেখব, বল?

না দেখালে? খুব মানুষ তুমি যা হোক। এই তো পাঁচ-সাতখানা নতুন গয়না আমি পরে রয়েছি।

কই, দেখি দেখি! বাঃ, গলার ওই কণ্ঠিটা কিন্তু ভারি ভাল হয়েছে!

নিত্য প্ৰশ্ন করিল, এসব আপনার দিদিমা দিলেন, নয় বউদিদি?

গৌরী বলিল, হ্যাঁ, ভারি গরজ দিদিমার, আমাকে গয়না গড়িয়ে দেবে! এ আমার মায়ের উইলের দরুন টাকা। আমার মামা বের করে ব্যাংকে দিয়ে দিয়েছেন। তা থেকে এই কতক গয়না গড়ালাম।

ব্যগ্ৰ কৌতূহলভরে নিত্য বলিল, কত টাকা দিয়েছেন আপনার মা?

চোদ্দ হাজার হয়েছে সুদে-আসলে।

সব অঙ্গে তা হলে তোমার দুখানা করে হল, নাকি বউদিদি?

দুখানা, তিনখানা, নামো-হাতে চারখানা হয়েছে—রুলি, দু রকম চুড়ি, ব্রেসলেট। কেবল কোমরে আছে একখানা,বিছে হয়েছে, চন্দ্রহার গড়াব এইবার।

বিষণ্ণতার মধ্যেও শিবনাথ কৌতুক অনুভব না করিয়া পারিল না, অদ্ভুত স্বৰ্ণতৃষা! সে ভাবিতেছিল, এ তৃষা কি নারীর জীবনের সহজাত! সঙ্গে সঙ্গে তাহার মায়ের কথা মনে পড়িয়া গেল, তাহার সধবা-জীবনের চিত্র দেখিলেও তাহার মনে নাই, কিন্তু শুনিয়াছে। তাহার বৈধব্যজীবন সে স্বচক্ষে দেখিয়াছে, কোনোদিন তিনি তাঁহার আভরণ স্পৰ্শ করিয়া দেখেন নাই, এমনকি এই বিষয়ের একটা টাকাও তিনি প্রয়োজন আছে বলিয়া গ্রহণ করেন নাই।

গৌরী সহসা শিবনাথকে বলিল, আমি কিন্তু এবার মায়ের গয়না ভেঙে চন্দ্রহার গড়াব।

ম্লান হাসি হাসিয়া শিবনাথ বলিল, বেশ।

বেশ নয়, আজই দিতে হবে বের করে, আজই গড়াতে দোব আমি।

আজ হবে না, দিনকতক পরে দোব। এত ব্যস্ত কেন?

না, সে হবে না। আজ হতে বাধাটা কী, শুনি?

কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকিয়া শিবনাথ বলিল, সেগুলো অন্য জায়গায় আছে, নিয়ে আসতে হবে।

তার মানে? অন্য জায়গায় গেল কেন? শাশুড়ির গয়না তো বউ পায়। সে তো আমার জিনিস।

শিবনাথ ধীরে ধীরে বলিল, পৌষ মাসের লাটের টাকা হয় নি এবার; সেইজন্যে সেগুলো বাধা দিয়ে ঢাকা নেওয়া হয়েছে।

মুহূর্তে গৌরীর মুখে এক বিচিত্র অভিব্যক্তি ব্যক্ত হইয়া উঠিল—বিস্ময়, ঘৃণা, ক্ৰোধ, হতাশার সে এক সম্মিলিত অভিব্যক্তি। শিবনাথ সে মুখ দেখিয়া শিহরিয়া উঠিল। থাকিতে থাকিতে গৌরীর চোখে জল দেখা দিল। শিবনাথ আত্মসংবরণ করিয়া হাসিমুখে সান্ত্বনা দিয়া বলিল, কাঁদছ কেন এর জন্যে?

গৌরী বলিল, কেন বাপু, মিছে আমাকে ভোলাচ্ছ? কাঁদতে হবেই আমাকে দুদিন পরে। বাধা দিয়া শিবনাথ বলিল, ছি গৌরী।

উত্তেজিত হইয়া গৌরী উত্তর দিল, কেন, ছি কেন? ভাগ্য মন্দ হলে লোকে কঁদে না? আমি আমার ভাগ্যের জন্য কাঁদছি।—বলিতে বলিতে তাহার আবেগ আরও বাড়িয়া উঠিল, বলিল, দিদিমা আমাকে জলে ভাসিয়ে দিয়েছেন। ছিঃ ছি! অস্থির হইয়া সে দ্রুত সেখান হইতে চলিয়া গেল। শিবনাথ একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল। গৌরী যেন অশান্তির উত্তাপ ছড়াইতে ছড়াইতে এখানে আসে, সে উত্তাপে বায়ুস্তর উত্তপ্ত হইয়া তাহার পক্ষে যেন শ্বাসরোধী হইয়া উঠিতেছে। কয় মাস পূর্বে গৌরী ঠিক এমনই ভয়ঙ্করী রূপের আভাস দিয়া চলিয়া গিয়াছিল, ঠিক সেই মূৰ্তি লইয়াই আবার সে ফিরিয়া আসিয়াছে।

দূরে হোলি-পর্বের উৎসবে রামকিঙ্করবাবুদের ঠাকুরবাড়িতে নহবত বাজিতেছিল। কিন্তু সে তাহার ভাল লাগিল না। অশান্তির মধ্যে সান্ত্বনা পাইবার জন্য সে বই খুলিয়া বসিল, সেও ভাল লাগিল না। বই হইতে মুখ তুলিয়া বাহিরের দিকে চাহিল, ইহারই মধ্যে একটা শুষ্ক উতলা বাতাস উঠিতে আরম্ভ করিয়াছে। নীরস মৃত্তিকাস্তর গুঁড়া হইয়া হইয়া ধুলা হইয়া সে বাতাসের বেগে উড়িতে আরম্ভ করিয়াছে। এই ধুলায় ধূসর প্রকৃতির রুক্ষ মূর্তি কল্পনা করিতে গিয়া তাহার মনশ্চক্ষে ভাসিয়া উঠিল—গৌরীর ক্ষণপূর্বের মুখচ্ছবি।

নিত্য এতক্ষণ স্তব্ধ হইয়া ঝাটা হাতে বসিয়া ছিল, সে আবার ঘর পরিষ্কার করিতে আরম্ভ করিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *