৫.৩ তুরের জ্যোতি

তুরের জ্যোতি

তাবু গুটিয়ে সুদানী মুসলমানদের পার্বত্য অঞ্চলের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন আমর দরবেশ। কিন্তু সফরসঙ্গী রূপসী মেয়েটি নিয়ে তার অন্তহীন ভাবনা। মেয়েটি মুসলমান। এ কারণে আমর দরবেশ তাকে ক্রুসেডারদের হাত থেকে রক্ষা করতে চাচ্ছেন। মেয়েটি চার-পাঁচ বছর বয়সে ক্রুসেডারদের হাতে চলে গিয়েছিলো। তারপর বিশ বিশটি বছর ব্যয় করে তারা তার গায়ে যে রঙের প্রলেপ মাখিয়েছে, তা অপসারণ করা সহজ নয়। ভালো হলো, মেয়েটি নিজেই বুঝে ফেলেছে যে, সে মুসলমান ঘরের সন্তান। এখন তার হৃদয়ে ক্রুসেডারদের প্রতি প্রবল ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সে আমর দরবেশকে বলে দিয়েছে, আমি তোমাকে সাহায্য করবো। কিন্তু আমর দরবেশ ভাবছেন, মেয়েটির উপর আস্থা স্থাপন করা যায় কিনা।

একই তাঁবুতে রাত কাটিয়ে ভোরে ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে মেয়েটি আমর দরবেশকে বললো- আমার সন্দেহ হচ্ছে, তুমি এখনো আমাকে তোমার শত্রু মনে করছে।

 নারীর ফাঁদে পড়ে মুসলিম জাতি বহু ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে আশি! আমর দরবেশ উত্তর দেন- তুমি অত্যন্ত রূপসী মেয়ে। তোমার চলন-বলন ও ভাবভঙ্গী মানুষের মধ্যে পশুত্বকে জাগিয়ে তোলে। আমি এক যুবক। আমি কয়েক বছর যাবত যুদ্ধের ময়দানে আছি। কিছুদিন সুদানের কয়েদখানায় যুদ্ধবন্দী হিসেবে সময় কাটিয়েছি। এই দীর্ঘ সময়টায় আমি আপনজনদের চেহারা পর্যন্ত দেখিনি। রাতে তাঁবুতে তুমি আমার সঙ্গে একাকী ছিলে। আমি রাতভর মহান আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেছি, যেনো আমি পশুত্বের মোকাবেলায় জয়ী হতে পারি। আমি সফল হয়েছি। আল্লাহ আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। তারপর ভাবতে শুরু করি, আমি তোমাকে শত্রু ভাববো, না বন্ধু। সেই ভাবনা এখনো ভাবছি। এখনো আমি তোমার এই সন্দেহ দূর করতে পারছি না যে, আমি তোমাকে শত্রু ভাবছি। শেষ পর্যন্ত তোমাকেই প্রমাণ করতে হবে, তুমি বিশ্বাসযোগ্য।

আমি আবারও বলছি, তুমি আমার বুকে ঈমানের প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছো- আশি বললো- আর আমি তোমাকে এ কথাও বলে রাখছি, সুদানীরা তোমাকে যে মিশন নিয়ে প্রেরণ করেছে, তুমি যদি তাতে তাদেরকে ধোকা দিতে চাও, আমি তোমাকে সঙ্গ দেবো। জীবন বিপন্ন হলেও আমি পিছপা হবো না। আমিই তো তোমাকে বলেছিলাম, যে দুজন লোক এসে তোমার ভক্ত হয়ে চলে গেলো, তারা মূলত সুদানীদের গুপ্তচর।

আমাকে ভাবতে দাও আশি- আমর দরবেশ বললেন- আমি বুঝে ফেলেছি, আমার চার পাশে গোয়েন্দা জাল বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। তোমাকে আমি সেই জালের একটি অংশ মনে করি। এখনো তুমি তা-ই করো, যা তোমাকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমিও সেই পাঠ ও নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করবে, যা আমাকে শেখানো হয়েছে। আমি তোমাকে বলেছিলাম, আমি অন্য কোনো উদ্দেশে যাচ্ছি। কিন্তু এই মিশন থেকে মুখ ফেরানো সম্ভব নয়। আমি এর পরিণাম জানি। দুতিনটি তীরের গতি সবসময় আমার দিকে থাকে। আমি তাদেরকে তখনই দেখতে পাবো, যখন তীর আমার বুকে এসে বিদ্ধ হবে।

আমি সর্বাবস্থায় তোমাকে সঙ্গ দেবো- আশি বললো- আমি প্রমাণ করবো, আমার শিরায় মুসলমানের রক্ত বিদ্যমান।

আমর দরবেশ ও আশি দুটি উটে চড়ে মুসলিম ভূখণ্ড অভিমুখে এগিয়ে চলছেন। তৃতীয় উটটিতে তাদের তাবু ও অন্যান্য মালপত্র বোঝাই করা। যে আশি এক সময় অর্ধনগ্ন চলাফেরা করতো, এখন সে আপাদমস্তক কালো বোরকায় আবৃত। মুখমণ্ডলও নেকাবে ঢাকা। দেখে বুঝবার কোনো উপায় নেই যে, মেয়েটি ক্রুসেডারদের একটি সুদর্শন তীর, যা পাথরসম শক্ত একজন মানুষের অন্তরে ঢুকে গেলে মানুষটি মোম হয়ে খৃস্টানদের ধাঁচে তৈরি হয়ে যায়।

আমর দরবেশ ও আশি যেদিকে যাচ্ছেন, দূরে এক অশ্বারোহীকে সেদিকেই যেতে দেখা গেলো। আমর দরবেশ ভাবলেন, এই লোকটিও সম্ভবত সেই সুদানী গুপ্তচরদের একজন, যারা তার সঙ্গে ছায়ার মতো লেপ্টে আছে। তার এই ধারণা যদি ভুল হয়, তাহলে নিশ্চয়ই সে মরুদস্যু। আশপাশে কোথাও তার সাঙ্গরা লুকিয়ে আছে। তাই যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে আমর কী করবেন?

আশি- সফর সঙ্গীকে উদ্দেশ করে আমর দরবেশ বললেন- তুমি কি ঐ অশ্বারোহীকে দেখতে পাচ্ছো?

অনেকক্ষণ ধরেই দেখছি।

যদি দস্যু হয়ে থাকে, তাহলে কি আমরা তাদের মোকাবেলা করতে পারবো?

আমাদের সঙ্গে অস্ত্র আছে- আশি সাহসী জবাব দেয়- যদি রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় এসে আমাদের উপর আক্রমণ চালায়, তাহলে কী হবে বলতে পারবো না। দিনের বেলায় হলে মোকাবেলা করবো। তোমার সঙ্গে স্বয়ং আমি একটি সম্পদ। তারা আমাকে তোমার হাত থেকে কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমাকে তারা জীবন্ত নিতে পারবে না।

নানাবিধ শংকার মাঝে দোল খেতে খেতে এগিয়ে চলে আমর দরবেশ ও আশি। সূর্যটা পশ্চিম আকাশে অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ধীরে ধীরে পর্বতমালা চোখে পড়তে শুরু করেছে তাদের। উঁচু পর্বতমালা এখনো বহুদূর হলেও অঞ্চলটা যেখান থেকে শুরু হয়েছে, সেই স্থান আর বেশী দূরে নয়। উটগুলো এগিয়ে চলছে।

যে অঞ্চল থেকে তার মিশন শুরু করবেন বলে কথা, সেখানে এসে পৌঁছে গেছেন আমর দরবেশ। মুসলমানদের প্রথম গ্রামটায় পৌঁছতে আর অল্প কিছু পথ বাকি। আমর দরবেশ স্বয়ং সেই গ্রামের বাসিন্দা। যে অশ্বারোহী লোকটি দূর পথে অগ্রসর হচ্ছিলো, গতি পরিবর্তন করে সে এদিকে এগিয়ে আসে এবং আমর দরবেশের সঙ্গে মিলিত হয়।

তোমাদের আস্তানা ঐখানে- অশ্বারোহী আমর দরবেশকে উদ্দেশ করে বললো- তোমরা আমাকে না চিনলেও আমি তোমাদেরকে চিনি।

লোকটিকে দেখে আশি মুখের নেকাব সরিয়ে হাসতে শুরু করে। অশ্বারোহী তাকে জিজ্ঞেস করে- সফর কেমন কাটলো?

খুব ভালো- আশি হাসিমুখে জবাব দেয়।

তোমরা ভয় পাওনি তো- আরোহী জিজ্ঞেস করে- সফরকালে তোমাদের নিরাপত্তার এমন ব্যবস্থা ছিলো, যা তোমরা কল্পনা করতে পারবে না। অন্যথায় এমন একটি রূপসী মেয়ে নিয়ে এ পর্যন্ত পৌঁছতে পারতে না।

তুমি কে? আমর দরবেশ জিজ্ঞেস করেন।

সুদানী মুসলমান- আরোহী জবাব দেয়- এখন এ ভাবনা ভেবো না, তুমি কে আর আমি কে। তোমরাও আমার ন্যায় এ অঞ্চলেরই বাসিন্দা। তুমি ভালোভাবেই জানো, আমরা যদি সামান্যতম ভুলও করি, তাহলে এখানকার মুসলমানরা আমাদের চামড়া তুলে ফেলবে।

আরোহী আমর দরবেশের আরো কাছে এসে কানে কানে বললো- এ কথাও মনে রেখো,তুমি যদি দায়িত্ব পালনে সামান্যতম হেরফের করো, তাহলে বিনা নোটিশে খুন হয়ে যাবে। এখানে তোমার কাজ কী তা তোমার ভালোভাবেই জানা আছে। এই রাতটা বিশ্রাম করবে। আগামীকাল থেকে এখানে তোমার নিকট লোকজন আসতে শুরু করবে। আশির জানা আছে, তাকে কী করতে হবে।

আমর দরবেশের সবকিছু জানা আছে। তার দায়িত্ব এই এলাকার মুসলমানদের বিভ্রান্ত করা, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো এবং মুসলমানদেরকে সুদানের অফাদার বানিয়ে সুদানী বাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রস্তুত করা।

সুলতান আইউবী মিশরে অনুপস্থিত। এ মুহূর্তে তিনি আরব ভূখণ্ডে শক্রর মোকাবিলায় যুদ্ধরত। ক্রুসেডারদের পরিকল্পনা হলো, সুদানী ফৌজকে প্রস্তুত করে মিশরের উপর আক্রমণ করাবে। কিন্তু সুদানী মুসলমানদের যুদ্ধবাজ গোত্রগুলো সুদানের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও সুলতান আইউবীর ভক্ত ও অনুসারী। আমর দরবেশ তাদের ভক্তি-বিশ্বাসকে তছনছ করে দিতে এসেছেন।

সূর্য ডুবে গেছে। আমর দরবেশ আগন্তুক অশ্বারোহীর সহায়তায় তাঁবু স্থাপন করেন। আরোহী বিদায় নেয়ার আগে বললো- আগামীকাল সম্ভবত তোমাদের সঙ্গে নিভৃতে কথা বলার সুযোগ হবে না। সকাল সকালই লোকজন এখানে আসতে শুরু করবে। সে একটি পাহাড়ের দিকে ইঙ্গিত করে বললো- সাঝের আলো আঁধারীতেও পাহাড়টা তোমাদের চোখে ছাতার ন্যায় বৃক্ষ মনে হবে। আগামী রাত ওখানে একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখবে। কাল যে পোশাক পরিধান করবে, ভোরেই তা প্রস্তুত করে রাখবে। আমি যাচ্ছি। এখন থেকে প্রতি পদক্ষেপে সতর্কতা অবলম্বন করবে।

আরোহী মেয়েটিকে ইঙ্গিতে বাইরে নিয়ে বললো- তোমাকে বেশী সতর্ক থাকা প্রয়োজন। এখানকার মুসলমানরা জংলী। তোমার হেফাজতের জন্য আমরা প্রস্তুতি আছি। কিন্তু তোমার হেফাজত নিজেকেই বেশী করতে হবে। এই লোকটাকে আয়ত্ত্বে রাখবে। সে মেয়েটির দুকাকের উপর ছড়িয়ে থাকা চুলে বিলি কেটে ঠোঁটে শয়তানী হাসি হেসে বললো- এই সুদর্শন শিকলগুলোয় তো তুমি সিংহকেও আটকে ফেলতে পারো।

তুমিও তো এখানকার মুসলমান- আশি বললো- তুমি হিংস্র নও কি?

তোমার দর্শনে কে হিংস্র হয়ে ওঠে না? বলেই আরোহী ঘোড়ার পিঠে চড়ে সন্ধ্যার ঘনায়মান আঁধারে হারিয়ে যায়।

***

এই অশ্বারোহী ঈমান নীলামকারী মুসলমানদের একজন। সুদানের সহজ-সরল মুসলমানদের বিশ্বাসের উপর পরিচালিত যুদ্ধের সেনাপতি। এই এলাকারই বাসিন্দা। কিন্তু কেউ জানে না লোকটি জাতির আস্তিনের বিষাক্ত সাপ। এই মিশনে সে একা নয়। তারা আট-দশজন মুসলমানের একটি দল।

ঘোড়ায় চড়ে লোকটি একটি গ্রামের দিকে ছুটে চলে। পথে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে। তারই পথপানে তাকিয়ে ছিলো সে।

সব ঠিক তো? লোকটি আরোহীকে জিজ্ঞেস করে।

হা, সবই ঠিক আছে- আরোহী জবাব দেয়- তবে যে কোনো সময় পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে। ক্রুসেডাররা যদি আমাকে পরিপক্ক পাঠ শিখিয়ে থাকে, তাহলে আমি বলবো, মেয়েটার চিন্তাধারা পাল্টে গেছে। তাকে কেমন যেনো আনমনা ও নীরব মনে হলো।

তা হয় না। আশি অনেক সতর্ক ও বিচক্ষণ মেয়ে।

তাহলে বোধ হয় দীর্ঘ সফরের ক্লান্তিতে নির্জীব হয়ে পড়েছে- আরোহী বললো- তাছাড়া আমর দরবেশও তো কম হিংস্র নয়।

কথা বলতে বলতে তারা গ্রামে ঢুকে পড়ে। এক স্থানে দুজন লোক দাঁড়িয়ে কথা বলছে। অশ্বারোহী ও তার সঙ্গী তাদের নিকটে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো- আমরা ভ্রমণে বের হয়েছিলাম। এখন গ্রামে ফিরছি। তারপর বিস্ময়মাখা কণ্ঠে বললো- এখান থেকে সামান্য দূরে এক বুযুর্গের আবির্ভাব ঘটেছে। লোকটি শুধু আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেন। দিনের বেলায়ও ডানে বায়ে দুটি প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখেন। তাকে দেখে আমরা তার কাছে বসে পড়েছিলাম। তিনি কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন। মুখস্ত পড়েন। আমাদের প্রতি ক্ষেপও করলেন না। আমরা তাকে ডাকলাম। তিনি রা করলেন না। তার তাঁবুর নিকট হতে একটি ধোঁয়ার কুণ্ডলী উত্থিত হয়ে উপরে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো এবং তার মধ্য হতে একটি মেয়ে বেরিয়ে এলো। মেয়েটির রূপ আমরা তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। কেননা, মানুষ নয়- মেয়েটিকে পরী বলে মনে হলো। মেয়েটি বুজুর্গের সম্মুখে গিয়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়লো। পরে সেজদা থেকে ওঠে বুজুর্গের মুখের সঙ্গে কান লাগালো। বুজুর্গের ওষ্ঠাধর নড়ে উঠলো। মেয়েটি আমাদের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে গেলো।

আমরা ভয়ে পালাতে উদ্যত হলাম। কিন্তু মাটি আমাদেরকে ধরে রাখে। সম্ভবত মেয়েটির চোখ আমাদেরকে আটকে রাখে। সে আমাদেরকে বললো- ইনি খোদার দূত। তোমাদের সকলের জন্য পয়গাম নিয়ে এসেছেন। তাকে বিরক্ত করো না। এ মুহূর্তে তিনি খোদার সঙ্গে কথা বলছেন। তোমরা আগামী দিন এসো। যদি তোমাদের প্রতি তার দয়া হয়, তাহলে তিনি তোমাদের প্রত্যেককে তুর পর্বতের দীপ্তি দেখাবেন। আমি এই মাত্র দূর পর্বত থেকে এসেছি। তিনি আমাকে তলব করেছিলেন। আমার কানে কানে তোমাদেরকে বলতে বলেছেন যে, তিনি তোমাদের ভাগ্য বদলে দেবেন। যদি তোমরা অধৈর্য হও, তাহলে তিনি অন্যত্র চলে যাবেন। আমরা মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। আমরা সম্পূর্ণরূপে তার নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিলাম। আমরা কিছুই বলতে পারিনি। বুজুর্গের প্রতি তাকালাম, দেখতে পেলাম, তার মাথার উপর নূর চমকাচ্ছে। আমরা সেখান থেকে চলে এলাম।

লোকগুলোর কণ্ঠস্বর স্পর্শকাতর। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিলো, তারা বিস্মিত ও ভীত-সন্ত্রস্ত। মানবীয় ফিতরাতের একটি দুর্বলতা হলো, বিস্ময়কর বক্তব্য চেতনাকে নাড়িয়ে তোলে। স্পর্শকাতরতা আনন্দ দান করে। কাহিনী শ্রবণে দুএলাকাবাসীর সে অবস্থা-ই সৃষ্টি হলো। তারা দুটি গৃহের দরজায় করাঘাত করে দুতিনজন লোককে ডেকে আনে এবং তারা যা শুনেছে, তাদেরকে শোনায়। অশ্বারোহী ও তার সঙ্গী কাহিনী বর্ণনায় একটি বিশেষ আকর্ষণ যুক্ত করে দেয়। তারা মেয়েটির রূপের বিবরণ এমন ভাষায় ও এমন শব্দে প্রদান করে যে, শ্রোতারা খোদা, কুরআন ও উক্ত বুযুর্গের পরিবর্তে মন-মস্তিষ্কে মেয়েটিকেই স্থান দিতে শুরু করে। তারা অশ্বারোহী ও তার সঙ্গীকে মেহমান হিসেবে বরণ করে নেয়। অন্যান্য ঘরের লোকজনও এসে ভিড় জমায়।

***

ভোর বেলা। সূর্য এখনো উদিত হয়নি। গ্রামের সব মানুষ অশ্বারোহী ও তার সঙ্গীর নেতৃত্বে আমর দরবেশের আস্তানা অভিমুখে ছুটে চলে। তাঁবুর সম্মুখে ছোট্ট একটি জাজিমের উপর আমর দরবেশ এলোপাতাড়ি বসে আছেন। চক্ষু বন্ধ করে বিড় বিড় করছেন। একটি লাঠি তার ডানে, একটি বাঁয়ে। মাটিতে পুঁতে দাঁড় করিয়ে রাখা আছে। লাঠি দুটোর মাথায় তেলে ভেজা কাপড় জ্বলছে। এগুলো প্রদীপ। আমর দরবেশের আট-দশ পা দূরে তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামবাসীরা এসে তাদের কাছে দাঁড়িয়ে যায়।

তাদের একজন বললো- আমি এগিয়ে গিয়ে বুযুর্গের সঙ্গে কথা বলি। তিন-চার পা অগ্রসর হওয়ার পর লোকটি পেছন দিকে এমনভাবে চিৎ হয়ে পড়ে যায়, যেনো কেউ তাকে সামনের দিক থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে। দিয়েছে। ওঠে সে জনতার মাঝে গিয়ে দাঁড়ায়। ভয়ে থর থর করে কাঁপছে লোকটি। সে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো- কেউ সম্মুখে যেও না। কে যেনো আমাকে সামনে থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। আমি কাউকে দেখতে পাইনি। বোধ হয় জিন হবে।

তার অপর দুসঙ্গী বললো- আমরা যাবো। তুমি ভীত হয়ে পড়েছে। তারা দুজন একসঙ্গে এগিয়ে যায়। তিন-চার পা অগ্রসর হওয়ার পর তারাও প্রথমজনের ন্যায় পেছন দিকে চিৎ হয়ে পড়ে যায়। তারা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। জনতা ভয় পেয়ে যায়। সকলের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, বুজুর্গ তার প্রহরায় জিন দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, যে কাউকে সম্মুখে অগ্রসর হতে দিচ্ছে না।

তাঁবু থেকে একটি মেয়ে বেরিয়ে আসে। মেয়েটি আশি। তার পরনে। কালো রেশমী পোশাক। চিবুক ও মুখমণ্ডল হাল্কা নেকাবে আবৃত। চোখ দুটো খোলা। মাথাটা কালো কাপড়ে ঢাকা। মাথার রেশমকোমল চুলগুলো দুকাঁধের উপর দিয়ে ভাগ হয়ে বুকের উপর এসে ঝুলছে। মেয়েটি আবৃতা বটে; কিন্তু পোশাকটা এমন যে, তাকে অর্ধনগ্ন বলেই মনে হচ্ছে। এই পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ এমন রূপসী মেয়ে আর কখনো দেখেনি। মেয়েটিকে তারা পরী মনে করছে। তার চাল-চলন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। যেমন চিত্তাকর্ষক, তেমনি মায়াময়।

আশি আমর দরবেশের সম্মুখে এসে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। সেজদা থেকে উঠে নিজের একটি কান তার মুখের সঙ্গে লাগায়। আমর দরবেশের ঠোঁট নড়ে ওঠে। আশি উঠে দাঁড়িয়ে যায়।

তোমরা ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকো- আশি জনতাকে উদ্দেশ করে বললো- কেউ সামনে অগ্রসর হওয়ার দুঃসাহস দেখাবেন না। খোদার দূত জিজ্ঞেস করেছেন, তোমরা এখানে কেননা এসেছো? তোমরা ওখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারো।

যে তিন ব্যক্তি সম্মুখে অগ্রসর হয়ে পড়ে গিয়েছিলো, তাদের একজন উচ্চ কণ্ঠে বললো- হে আল্লাহর দূত! তুমি কি অনাগত ভবিষ্যতের সংবাদ বলতে পারো?

জিজ্ঞেস করো কী জানতে চাও? আমর দরবেশের গুরুগম্ভীর মুখে ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন।

সুদানের অনুগত না হয়ে কি আমরা এই ভূখণ্ডকে ইসলামী রাজ্যে পরিণত করতে পারবো? লোকটি জিজ্ঞেস করে।

হঠাৎ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন আমর দরবেশ। দুহাত মাটিতে ছুঁড়ে মারেন। আশি ছুটে এসে তার কাছে বসে পড়ে এবং তার মুখের সঙ্গে কান লাগিয়ে রাখে। আমর দরবেশের ঠোঁট নড়ে ওঠে। আশি উঠে দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশে বললো- খোদার দূত বলেছেন, পানিতে যদি আগুন ধরে যায়, তাহলে তোমরা এই ভূখণ্ডকে ইসলামী রাজ্যে পরিণত করতে পারবে। কারো কাছে পানি থাকলে এই কাপড়টির উপর ঢেলে দাও।

আমর দরবেশের সামান্য দূরে একটি কাপড় এমনভাবে পড়ে আছে, যেনো কেউ দেহ থেকে খুলে দলা করে রেখে দিয়েছে। যে তিন ব্যক্তি সম্মুখে অগ্রসর হতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলো, তাদের একজন এগিয়ে আসে। তার হাতে চামড়ার ছোট্ট একটি মক। সে বললো আমার কাছে পানি আছে। আমি সফরে আছি বিধায় সঙ্গে পানি রেখেছি। এগিয়ে নিয়ে সে মশকটির মুখ খুলে কাপড়ের উপর পানি ঢেলে দেয়।

আশি মাটি থেকে প্রদীপটি আমর দরবেশের হাতে তুলে দেয়। আমর দরবেশ আকাশের দিকে মুখ করে ঠোঁট নাড়ান, যেনো তিনি কারো সঙ্গে কানে কানে কথা বলছেন। তারপর প্রদীপের শিখা কাপড়ের সঙ্গে লাগান। কারো কল্পনা ছিলো না, পানিভেজা কাপড়ে আগুন ধরে যাবে। কিন্তু তা-ই হলো। আমর দরবেশ যেইমাত্র প্রদীপের শিখা কাপড়ের নিকট নিয়ে যান, অমনি কাপড়টি জ্বলে উঠে এবং পুরো বস্ত্রটি একটি অগ্নিশিখায় পরিণত হয়। জনতার ভিড়ের মধ্য থেকে কয়েক ব্যক্তি বিস্মিত কণ্ঠে আল্লাহু আকবার ধ্বনি তোলে। তারা চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছে, তাদের সম্মুখে পানি জ্বলছে।

খোদার ইশারা বুঝে নাও- আমর দরবেশ বললেন- আর ভালো ভাবে চিনে নাও আমি কে। আমি তোমাদেরই একজন।

তিনি নিজ গ্রামের নাম উল্লেখ করে বললেন- আমি ঐ এলাকার বাসিন্দা। আমি হাশেম দরবেশের পুত্র আমর দরবেশ। আমি নবী-রাসূল নই। খোদা তার শেষ নবীকে প্রেরণ করে ফেলেছেন।

তিনি নিজের আঙ্গুলে চুমো খেয়ে চোখে লাগিয়ে বললেন- আমিও তোমাদেরই ন্যায় আখেরী নবীর একজন উম্মত। খোদা আমাকে আলো দেখিয়েছেন এবং আদেশ করেছেন, যেনো এই আলোকে আমি সেই লোকদের কাছে পৌঁছিয়ে দেই, যারা অন্ধকারে নিমজ্জিত।

আমর দরবেশ এমন ভঙ্গীতে কথা বলছেন, যেনো তার উপর উন্মত্ততা চেপে আছে। তিনি বললেন

আমার গ্রামে গিয়ে জিজ্ঞেস করো, আমি সালাহউদ্দীন আইউবীর কমান্ডার। আমি সেই বাহিনীর সঙ্গে ছিলাম, যারা সুদান আক্রমণ করেছিলো। যাদের আক্রমণ ব্যর্থ হয়েছে। আমরা সবাই অনুতপ্ত হলাম। কিন্তু মহান আল্লাহ আমাকে মিশরী ফৌজের লাশের মধ্য থেকে তুলে এনেছেন এবং আমাকে ইঙ্গিত দিয়েছেন সালাহুদ্দীন আইউবীর ফৌজ কেনো পরাজিত হলো। আমার অনুতাপ আনন্দে রূপান্তরিত হলো। আমি একটি বৃক্ষের ডালে খোদার নূর দেখতে পেলাম। এমন এক আলো, যেনো একটি তারকা আকাশ থেকে নেমে এসে গাছের ডালে আটকে গেছে। সেই তারকার ভেতর থেকে আওয়াজ এলো- সামনে দেখো, পেছনে দেখো, ডানে দেখো, বামে দেখো…।

আমি সব দিক তাকালাম। আওয়াজ এলো- তুমি কি কোনো জীবিত মানুষ দেখতে পাচ্ছো? আমি চতুর্দিকে শুধু লাশ আর লাশ দেখতে পেলাম। সকলের শোচনীয় অবস্থা। আহতদের সংখ্যা খুবই কম। অধিকাংশ সৈনিক পিপাসায় মারা গেছে। এরা সকলে লড়াই করছিলো। তারকার আলোর মধ্য হতে আওয়াজ এলো- তুমি কি দেখোনি, তোমাদের তরবারী ভোলা হয়ে গিয়েছিলো? তুমি কি দেখোনি, তোমাদের তীরগুলোর কোনো গতিই ছিলো না? তুমি দেখোনি, তোমাদের ঘোড়াগুলোর পা মাটিতে বসে গিয়েছিলো?

তখন আমার মনে পড়লো, আলোর মধ্যকার আওয়াজ আমাকে যা যা বলেছে, আমি সঁবই দেখেছি। আমার তরবারী কর্তন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলো। আমি দেখেছি; আমার ছোড় তীরটা বাতাসের মধ্যদিয়ে এমনভাবে যাচ্ছিলো, যেনো বাতাসের তোড়ে শুকনো খড় উড়ছে। আমার ঘোড়া গতি হারিয়ে ফেলেছিলো। বালুকাময় প্রান্তর যেনো সূর্যের সমস্ত উত্তাপ ধারণ করে আমাকে ও আমার সঙ্গীদেরকে ঝলসে দিয়েছিলো। আমি একটি ভস্মিত লাশে পরিণত হয়ে গিয়েছিলাম।  

তারপর তারকার মধ্য হতে একটি স্ফুলিঙ্গ এসে আমার উভয় চোখে ঢুকে পড়ে। পরে সেটি আমার অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে যায়। আওয়াজ এলো- আমি তোমাকে পুনর্জীবন দান করলাম। জিজ্ঞেস করো, আমি তোমাকে এই অনুগ্রহ কেননা করলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম। আওয়াজ উত্তর দিলো আমি মুসলমানদের ভালোবাসি। মুসলমান আমার রাসূলের কালেমা পাঠ করে। এই লাশগুলো যাদের, আমি তাদেরকে শিক্ষার উপকরণে পরিণত করেছি যে, এরা পথ হারিয়ে ফেলেছিলো। যারা এখনো পথ হারায়নি, বিপথগামী হওয়ার উপক্রম হয়েছে, আমি তাদেরকে সোজা পথ দেখাতে চাই। আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি। কেননা, তুমি প্রতি সকালে কুরআন পাঠ করে থাকো। যাও, আমি তোমাকে আলো দান করলাম। এই আলো আমার মুসলমান বান্দাদের দেখাও।

কথাগুলো আমি ভালোভাবে বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম- হে আমার প্রভুর আলো! বিষয়টা আমাকে খুলে বলুন এবং বলে দিন, আমার কথা কে গ্রহণ করবে? কিভাবে করবে? বলুন- আমাদের তরবারীগুলো কেনো ভোতা হয়ে গিয়েছিলো? তীরগুলোর গতি কোথায় উঠে গিয়েছিলো? আলোর আওয়াজ বললো- সেই তরবারী ভোলা হয়ে যায়, যার আঘাত নিজ মায়ের উপর করা হয়। সেই তীর খেজুরের শুকনো ডালের ন্যায় হয়ে যায়, যেটি আপন মায়ের বুকের ছোঁড়া হয়। তুমি জানো না, মা কে? মা হলো সেই ভূখণ্ড, যে তোমাকে জন্ম দিয়েছে, যার মাটিতে খেলাধুলা করে তুমি যৌবন লাভ করেছো। তুমি সুদানের মুসলমানদেরও জানিয়ে দাও, সুদানের পবিত্র ভূখণ্ড তোমাদের মা। তাকে তোমরা ভালোবাসো। এরই মাটির ভেতর তোমাদের জান্নাত। বাইরে থেকে কোনো মুসলমান যদি এই জান্নাতকে জয় করতে আসে, তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। তুমি তো জাহান্নাম দেখে নিয়েছে। যাও, তোমার কালেমাগো সুদানী ভাইদের বলল, তোমাদের মা, তোমাদের জান্নাত, তোমাদের কাবা হলো সুদান।

হযরত- এক ব্যক্তি বললো- তাহলে কি আপনি বলছেন, আমরা সুদানের রাজার অনুগত হয়ে যাবো, যিনি আমাদের রাসূলকে মান্য করে না?

 এই লোকটিও সেই তিন ব্যক্তির একজন, যারা সম্মুখে অগ্রসর হতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলো।

খোদার আওয়াজ বলেছেন, সুদানের এই কাফির বাদশাহ মুসলমান হয়ে যাবেন- আমর দরবেশ পরম গাম্ভীর্যের সাথে বললেন- তিনি মুসলমানদের পথপানে চেয়ে আছেন। তার ফৌজ কাফিরদের ফৌজ। সে কারণে তিনি আল্লাহ ও রাসূলের নাম উচ্চারণ করেন না। তোমরা চলে যাও তরবারী, বর্শা ও তীর-ধনুক নিয়ে যাও। উট-ঘোড়ায় সাওয়ার হয়ে যাও। তাকে গিয়ে বলো, আমরা আপনার মোহাফেজ। আমরা সুদানের সন্তান।– আমি খোদাকে বললাম, আমি বললে এসব কথা কেউ গ্রহণ করবে না। আমার মুসলমান ভাইয়েরা আমাকে হত্যা করে ফেলবে। উত্তরে খোদার আওয়াজ বললো- আমি ব্যতীত আর কে পানিতে আগুন লাগাতে পারে? তুমি যাও, আমি তোমাকে এই শক্তি দিয়ে দিলাম, যাতে মানুষ তোমাকে বিশ্বাস করতে পারে, তোমার কণ্ঠকে আমার কণ্ঠ মনে করে। কোনো মানুষ তো আর পানিতে আগুন ধরাতে পারে না। তারপর আলোর মধ্য হতে আওয়াজ আসলো- তারপরও যদি মানুষ তোমাকে মিথ্যা মনে করে, তাহলে তুমি তাদেরকে রাতে আসতে বলে। আমি তাদেরকে সেই জালওয়া দেখিয়ে দেবো, যা মূসাকে তূর পর্বতে দেখিয়েছিলাম।

 আচ্ছা তোমরা কি তুর পর্বতের জ্যোতি দেখে সত্যের আওয়াজকে মেনে নেবে? আমর দরবেশ জিজ্ঞেস করেন।

হ্যাঁ, হে খোদার দূত!- সেই তিন ব্যক্তির একজন বললো- আপনি যদি আমাদেরকে তুর পর্বতের জ্যোতি দেখাতে পারেন, তাহলে আমরা আপনার কণ্ঠকে খোদার কণ্ঠ বলে মেনে নেবো।

যাও- আমর দরবেশ ক্ষোভের সাথে মাটিতে হাত ছুঁড়ে বললেন- চলে যাও। যখন সূর্যের কিরণমালা পাহাড়ের পেছনে চলে যাবে এবং আকাশে তারকারাজির প্রদীপমালা জ্বলে উঠবে, তখন আবার আসবে।

জনতা আমর দরবেশের আস্তানা ত্যাগ করে ফিরে যায়। তাদের অন্তরে কোনো সন্দেহ নেই। তারা চার-পাঁচজন করে দল বেঁধে হাঁটছে আর মন্তব্য মূল্যায়ন করছে। মানবীয় ফিতরাতের দুর্বলতাগুলো ভেসে ওঠেছে। বিশ্বাস চাপা পড়ে গেছে। জযবা শীতল হয়ে গেছে। সহজ-সরল পশ্চাৎপদ মানুষ এরা। একটি স্পর্শকাতর নাটক তাদের বিবেকের গতি ঘুরিয়ে দিয়েছে। আমর দরবেশের কণ্ঠ ও বাচনভঙ্গী তাদের হৃদয়ে প্রভাব বিস্তার করে ফেলে। কেউ সন্দেহ প্রকাশ করলে অপর কেউ না কেউ বলছে- তুমি কি পানিতে আগুন ধরাতে পারো?

এখনো রাতে তূর পর্বতের জ্যোতি দেখার কাজ বাকি আছে। এরা আশিকে জিন মনে করছে। স্পষ্ট ভাষায় তা ব্যক্ত করছে।

এরা সেইসব মুসলমান, যারা সুদানের অমুসলিম বাদশাকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে রেখেছিলো। তারা সুদানী বাহিনীকে এই পার্বত্য অঞ্চলে পরাস্ত করে পিছু হটিয়ে দিয়েছিলো। তারা ছিলো আল্লাহ ও তার রাসূলের অনুসারী এবং সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ভক্ত-সমর্থক। সুদানী নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তারা তাদের পার্বত্য অঞ্চলকে স্বাধীন ইসলামী রাজ্য মনে করতো। কিন্তু আমর দরবেশের স্পর্শকাতর ও জাদুময় বক্তব্য তাদের সব চিন্তাধারা পাল্টে দিলো। তারা বিপথগামী হয়ে উঠলো। একটি দেশের সেনাবাহিনী যাদের কাছে হার মানতে বাধ্য হলো, একজন মানুষের একটি চিত্তাকর্ষী আক্রমণে তাদের সব অস্ত্র হাত থেকে পড়ে গেলো। এখন এরা যে যেখানে যাকে পাচ্ছে, গুজব ছড়াচ্ছে। তারা যা দেখলো, যা শুনলো, তাকে আরো আকর্ষণীয় করে প্রচার করতে লাগলো।

***

একটি আশংকা আমাকে অস্থির করে রেখেছে যে, সুদানী মুসলমানরা স্পর্শকাতর, কুসংস্কারের সামনে অস্ত্র ত্যাগ করে বসবে। সুলতান আইউবী বললেন।

সুলতান এখন সুদান থেকে দূরে বহু দূরে ফিলিস্তিনের দোরগোড়ায় একটি পাহাড়ের পাদদেশে তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলী ও সালারদের মাঝে বসে আছেন। তিনি আল-আদিল-এর পত্রখানা পাঠ করছেন। মিশরের ইন্টেলিজেন্স সুদানী মুসলমানদের সম্পর্কে পুরো তথ্য মিশরের ভারপ্রাপ্ত গবর্নর আল-আদিলকে অবহিত করে। আল-আদিল পত্রে সেসব তথ্য সুলতান আইউবীর নিকট লিখে পাঠিয়েছেন। পত্রে তিনি এ-ও লিখেছেন যে, আলী বিন সুফিয়ান বণিকের বেশে সুদান রওনা হয়ে গেছেন। পত্রে আল আদিল জানতে চেয়েছেন, সুদানের মুসলমানদের পাহাড়ী এলাকায় কমান্ডো দল পাঠাবেন কিনা। তিনি এই আংশকাও ব্যক্ত করেছেন যে, আমরা যদিও বা গোপনে কমান্ডো দল প্রেরণ করি, তবু সুদান সরকার যদি জানতে পারে, তাহলে অভিযানটা প্রকাশ্য যুদ্ধের রূপ নিতে পারে। অথচ এখন আমাদের অধিকাংশ ফৌজ আরবে যুদ্ধরত। বার্তায় উল্লেখ করা হয়, সুদানী সরকার মুসলমানদেরকে তাদের অনুগত বানানোর লক্ষ্যে আমাদের যুদ্ধবন্দীদের ব্যবহার করার চেষ্টা করছে।

সুলতান আইউবী তাঁর সালার ও উপদেষ্টামণ্ডলীকে পত্ৰখানা পাঠ করে শুনিয়ে বললেন- সুদানের এই মুসলমানগুলো সুদান সেনাবাহিনীর জন্য সাক্ষাৎ যম। তোমরা দেখে থাকবে, তাদের যে কজন লোক আমাদের বাহিনীতে আছে, তারা কিরূপ জযবা ও বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করছে। কিন্তু দুশমন যখন তাদেরকে তেলেসমাতি ভাষায় উস্কে দেয় এবং মস্তিষ্ককে কল্পনা বিলাসের প্রতি আকৃষ্ট করে, তখন তারা বালির মূর্তিতে পরিণত হয়ে যায়। আল-আদিল একথা লিখেনি যে, খৃস্টানরা সুদানের মুসলিম অঞ্চলে চরিত্র ধ্বংস এবং নাশকতামূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। কিন্তু তোমরা তো খৃস্টানদেরকে জানো। তারা এই বিদ্যায় পারদর্শী। আমি জানি, সুদানীদের নিকট খৃস্টান উপদেষ্টা রয়েছে। তারা মুসলমানদের চিন্তা-চেতনা ধ্বংসে তৎপরতা চালাবে, তাতে সন্দেহ নেই।

সুলতান আইউবী আল-আদিলের দূতকে আহার ও বিশ্রামের জন্য পাঠিয়ে দেন এবং কাতেবকে ডেকে পত্রের জবাব লেখাতে শুরু করেন–

প্রিয় ভাই আল-আদিল!

আল্লাহ তাআলা তোমাকে সাহায্য করুন। তোমার পত্র আমার নিকট সুদানের মুসলমানদের বাস্তব চিত্র স্পষ্ট করে দিয়েছে। তুমি বিচলিত হয়ে না। তুমি তো জানো, কাফিররা ইসলামের ধ্বংস কামনা করে। উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তারা কোনো সুযোগই হাতছাড়া করছে না। আলী বিন সুফিয়ানের সুদান গমনকে আমি স্বাগত জানাই। তুমি তাকে অনুমতি দিয়ে ভালোই করেছে। আল্লাহ আলী বিন সুফিয়ানকে সাহায্য করুন। লোকটা অত্যন্ত সতর্ক ও যোগ্য গোয়েন্দা। পাথরে ভেতর থেকেও কথা বের করতে জানে। সে ফিরে এসে তোমাকে জানাবে, সেখানকার আসল পরিস্থিতিটা কী! তুমি তার দেয়া তথ্য মোতাবেক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

তুমি জানতে চেয়েছো, সুদানের মুসলমানদের সাহায্যে কমান্ডো প্রেরণ করবে কিনা? এই আশংকাও ব্যক্ত করেছে, কমান্ডো প্রেরণ করলে সুদানীরা পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। যা প্রকাশ্য যুদ্ধের রূপ নিতে পারে। তুমি ভালোই করেছে যে, আমার অনুমতি নেয়া আবশ্যক মনে করেছে। কিন্তু সাবধান! কখনো যদি পরিস্থিতি গুরুতর রূপ ধারণ করে, তাহলে আমার অনুমতির অপেক্ষায় সময় নষ্ট করবে না। তুমি নিশ্চয়ই জেনেছো, সুদানের কয়েদখানার একজন সিপাহী সুদানী ফৌজের একজন কমান্ডারকে হত্যা করে মুসলমানদের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেছে এবং ইসলাম গ্রহণ করেছে। তুমি এ-ও জানো যে, সুদানীরা আমাদের কয়েদীদেরকে আমাদের বিরুদ্ধে প্রস্তুত করার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং আমাদের ইসহাক নামক এক কমান্ডারের স্ত্রী ও কন্যাকে পর্যন্ত প্রতারণার মাধ্যমে অপহরণ করার চেষ্টা করেছে। এতেই প্রমাণিত হচ্ছে, সুদানী মুসলমানদের মাঝে কিছু গাদ্দারও আছে। এমতাবস্থায় তুমি যত দ্রুত সম্ভব কিছু কমান্ডো সেনাকে ব্যবসায়ী ও পর্যটকের বেশে সুদানী সীমান্তে পাঠিয়ে দাও।

আমার প্রিয় ভাই! এটা সত্য যে, আমাদের সেনাসংখ্যা কম এবং আমরা আরেকটি রণাঙ্গন চালু করতে অক্ষম। কিন্তু আমরা কুরআনের সেই নির্দেশনা কিভাবে উপেক্ষা করতে পারি যে, পৃথিবীর কোনো একটি ভূখণ্ডে যদি কাফেররা মুসলমানদের উপর জুলুম করে কিংবা প্রলোভন বা প্রতারণার মাধ্যমে তাদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে, তাদের জাতীয় মর্যাদা ও দ্বীন-ঈমানকে সংকটাপন্ন করে তোলে; তাহলে পৃথিবীর সকল মুসলমানের উপর জিহাদ ফরজ হয়ে যায়? আমি বহুবার বলেছি, সালতানাতে ইসলামিয়ার কোনো সরহদ-সীমানা নেই। ইসলামের সুরক্ষার জন্য আমরা যে কোনো দেশের সীমানা অতিক্রম করতে পারি। তুমি জানো, আমরা সুদানী মুসলমানদেরকে কমান্ডো দিয়ে রেখেছি, যারা কৃষকের বেশে তাদের সঙ্গে অবস্থান করছে। সুদানী মুসলমানদেরকে আমরা সামরিক সরঞ্জামও দিয়েছি। তুমি যদি প্রয়োজন মনে করো, তাহলে আদেরকে আরো সাহায্য দাও।

সুদানীরা যদি তাদের সীমান্ত নিরাপদ করার জন্য মিশরে সেনা অভিযান চালায়, তাহলে ভয় পেয়ো না। তোমরা স্বল্পসংখ্যক ফৌজ দ্বারা কয়েকগুণ বেশি ফৌজের মোকাবেলা করতে পারবে। তোমরা তাদের এক আক্রমণ নস্যাৎ করেছে, দ্বিতীয়টিও নস্যাৎ করতে পারবে ইনশাআল্লাহ। তবে মুখোমুখি সংঘর্ষের ঝুঁকি নেবে না। দুশমনকে এমন জায়গায় ঠেলে নিয়ে আসবে, যেখানে তোমরা অল্পসংখ্যক লোকে অধিক ধ্বংসসাধন করতে পারবে। কমান্ডোদের বেশি ব্যবহার করবে এবং দুশমনের রসদ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করবে। তোমাদের অর্ধেক যুদ্ধ আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দারা জয় করে ফেলবে। তবে আমার মনে আশা জাগছে না, সুদানীরা আক্রমণ করার মতো বোকামী করবে। তাদের খৃস্টান উপদেষ্টারা যদি জ্ঞানের পরিচয় দিয়ে থাকে, তাহলে তারা আক্রমণের পরিবর্তে তাদের পাহাড়ী এলাকায় মুসলমানদেরকে দলে ভোড়াবারই চেষ্টা করবে। মুসলমানরা যদি তাদের অফাদার হয়ে যায় এবং তাদের ফৌজে শামিল হয়ে যায়, তাহলে তারা যে কোনো ঝুঁকি মাথায় নিতে পারবে। তাই তোমাকে চেষ্টা করতে হবে, যেনো মুসলমানরা তাদের বিভ্রান্তির শিকারে পরিণত না হয়। আমি শতবার যে কথাটা বলেছি, এখনও তারই পুনারাবৃত্তি করবো। মুসলমান যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত করে পরাজিত হয় না। কিন্তু যখন তাদের মধ্যে পাশবিকতা জাগিয়ে দেয়া হয়, তখন তারা তরবারী ছুঁড়ে ফেলে। মুসলিম জাতির যখনই পতন এসেছে, এ কারণেই এসেছে। আমাদের শত্রুরা আমাদের জাতির মাঝে এই আগুনই প্রজ্বলিত করছে। এইভাবে আমরা এক সঙ্গে দুটি রণাঙ্গনে লড়াই করছি। একটি মাটির উপরে, অপরটি নীচে। আমাদের শত্রুরা আমাদেরকে বিষমাখা তীর দ্বারা হত্যা করতে পারেনি। এখন তারা মিষ্টিমধুর ভাষার জাদুতে আমাদেরকে অকর্মন্য ও পঙ্গু করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এটি বড়ই ভয়াবহ যুদ্ধ। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

এখানকার পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে। দুশমনরা পরাজিত হয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে। আমি তাদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগই দেবো না। আল্লাহর সাহায্য অব্যাহত থাকলে আমি হাব দখল করে ফেলবো। মোকাবেলা সম্ভবত এখনো কঠিন হবে। কিন্তু আমি ব্যবস্থা করে রেখেছি। খৃস্টানরা এখনো মুখোমুখি আসেনি। বোধ হয় আসবেও না। তারা ভাইয়ে–ভাইয়ে সংঘাতে লিপ্ত করে তামাশা দেখছে। তাদের শত্রুরা যদি আপসে লড়াই করেই যদি নিঃশেষ হয়ে যায়, তাহলে তাদের সামনে আসবার প্রয়োজন কী। আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করুন। তুমি ভীত হয়ো না। আল্লাহ হাফেজ।

***

আমর দরবেশের আস্তানায় যে তিন ব্যক্তি জনতার ভিড়ের মধ্য থেকে বেরিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হতে গিয়ে চিৎ হয়ে পেছন দিকে পড়ে গিয়েছিলো, তারা এখন আমর দরবেশের তাঁবুতে উপবিষ্ট। জনতা চলে যাওয়ার সময় তারা কিছুদূর পর্যন্ত তাদের সঙ্গে গিয়ে মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে এক একজন করে আস্তানায় ফিরে এসে আমর দরবেশের তাঁবুতে ঢুকে পড়ে। এরা আমরের দলেরই লোক এবং অত্র এলাকার বাসিন্দা। সুদানী সরকারের নিকট থেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা লাভ করছে।

আমার ধারণা ছিলো, কাপড় জ্বলবে না- আমর দরবেশ বলছেন- কাপড়টার নীচে দাহ্য পদার্থ কম রাখা হয়েছিলো এবং পানি বেশি ঢালা হয়েছিলো।

আপনি জানেন না, এই তেল যদি পানিতেও ঢেলে দেয়া হয়, তাতেও আগুন ধরে যায়- যে লোকটি কাপড়ের উপর মশক থেকে পানি ঢেলে দিয়েছিলো, সে বললো- আমরা আগেই পরীক্ষা করে দেখেছি।

মানুষের উপর এর কিরূপ প্রভাব পড়লো? আমর দরবেশ জিজ্ঞেস করেন।

আমরা কিছুদূর পর্যন্ত তাদের সঙ্গে গিয়েছিলাম- একজন জবাব দেয় তারা পানিতে আগুন ধরে যাওয়াকে আপনার মোজেযা মনে করে। তারা কেউই বিশ্বাস করছে না, দুনিয়ার কোনো মানুষ পানিতে আগুন প্রজ্বলিত করতে পারে। আপনি যে ভঙ্গিতে কথা বলেছেন, তাতে আপনার সব কথা তাদের হৃদয়ে গেঁথে গেছে, খোদার কসম।

না দোস্ত- আমর দরবেশ তাকে বাধা দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন খোদার নামে কসম করো না। আমরা যে খোদার বিরুদ্ধাচরণে নেমেছি, তার কসম খাওয়ার অধিকার হারিয়ে ফেলেছি।

মনে হচ্ছে, আপনার অন্তরে এখনো আসল খোদা বিদ্যমান- একজন বললো- আমর দরবেশ! আপনি কিন্তু আপনার আসল খোদা ও ঈমানকে বিক্রি করে এসেছেন।

অপর একজন পার্শ্বে উপবিষ্ট আশির উরুতে হাত বুলিয়ে বললো- আর এই মূল্যবান সম্পদটা কিভাবে পেয়েছেন, তাও স্মরণ করুন। মেয়েটি খৃস্টান রাজাদের মানিক্য, যাকে সুদানের শাসকমণ্ডলী আপনাকে দান করেছেন।

আমর দরবেশ আশির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। আশি তার প্রতি একবার গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। তাকে বিচলিত মনে হলো আমর দরবেশের কাছে। আমর দরবেশ তার ইঙ্গিত বুঝে ফেললেন। বললেন– নতুন বিদ্যা কিনা; তাই ভুলে গেছি। আসলেই আমি এতো মূল্যবান সম্পদের উপযুক্ত ছিলাম না। যাক গে এসব। আগামী রাতের কথা বলো।

সব প্রস্তুতি সম্পন্ন- এক ব্যক্তি বললো- আপনি তো আমাদের যোগ্যতা দেখেছেন। দেখলেন না, আমরা কীভাবে পেছন দিকে পড়ে গেলাম?

রাতে আপনি তূর পর্বতের জালওয়া দেখাবেন- অন্য একজন বললো–কী করতে হবে, বুঝে নিন। আমাদের লোকজন সব প্রস্তুত।

আমাদের চলে যাওয়া উচিত- তৃতীয় ব্যক্তি বললো- এখন আর আপনি তাঁবু থেকে বের হবেন না।

তারা চলে যায়।

***

সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকজন আসতে শুরু করে। দিনের বেলা যেসব লোক আমর দরবেশের বক্তব্য শুনে গেছে এবং পানিতে আগুন লাগানোর মোজেযা দেখেছে, তারা সর্বত্র প্রচার করে দিয়েছে যে, আমর দরবেশ নামক খোদার এক দূত আজ রাতে তূর পর্বতের সেই জালওয়া দেখাবেন, যা আল্লাহ হযরত মূসাকে (আ.) দেখিয়েছিলেন। আমর দরবেশের আস্তানায় সুদানের গোয়েন্দারাও উপস্থিত। তারা অত্যন্ত দক্ষতা ও গুরুত্বের সাথে গুজব ছড়ানোর দায়িত্ব পালন করেছে। তারই ফলে সন্ধ্যার পর আমর দরবেশের তাবুর সম্মুখে জনতার ভিড় দিনের তুলনায় বেশি। তাবুর পেছনে ও ডানে-বাঁয়ে কারো দাঁড়াবার অনুমতি নেই।

আমর দরবেশ এখনো তাঁবুতে অবস্থান করছেন। বাইরে দুটি প্রদীপ জ্বলছে। প্রদীপগুলো মাটিতে গেড়ে রাখা লাঠির মাথায় বাঁধা। জনতা খোদার দূতকে দেখার জন্য উদগ্রীব।

তাবুর পর্দা নড়ে ওঠে। আশি সম্মুখে এগিয়ে আসে। তার পোশাক কালো। কাঁধ থেকে পা পর্যন্ত লম্বিত ফ্রক। ফ্রকটি অভ্রখচিত যা প্রদীপের। আলোতে তারকার ন্যায় মিট মিট করে জ্বলছে। আশির মাথার উপর রেশমের পাতলা রুমাল। মাথার চুলগুলোও সেই রেশমের ন্যায় সরু ও কোমল, যেগুলো তার উভয় স্কন্ধের উপর এমনভাবে পড়ে আছে যে, তার মাঝে তার উদোম স্কন্ধের শুভ্রতা তারার ন্যায় জ্বল জ্বল করছে। মেয়েটি এমনিতেই রূপসী, তদুপরি তার এই সাজ-সজ্জা, রং-ঢং তাকে এমন মোহময় করে তুলেছে যে, একজন পুরুষের পশুবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ হারাতে বাধ্য।

পাহাড়-জঙ্গলে বসবাসকারী এই লোকগুলোর নিকট এই মেয়েটি, তার চাল-চলন ও পোশাক একটি বিরল দৃশ্য। তাদের চক্ষু আটকে গেছে। মেয়েটির রূপের জাদুক্রিয়ায় তারা মোহাচ্ছন্ন।

আশির হাতে এক-দেড় গজ লম্বা এবং আধা গজের মতো চওড়া গালিচা। সেটি সে উভয় প্রদীপের মধ্যখানে বিছিয়ে দেয়। মেয়েটি উভয় বাহু বিস্তার করে আকাশের দিকে তাকায়। তাবুর পর্দা সরে যায় এবং আমর দরবেশ মাদকাসক্তের ন্যায় হেলে-দুলে হেঁটে এসে গালিচার উপর দাঁড়ায়। তিনিও আশির ন্যায় ডানে-বায়ে বাহু ছড়িয়ে দিয়ে আকাশপানে দৃষ্টিপাত করে বিড় বিড় করতে শুরু করে।

হে খোদার প্রিয়পাত্র, যাকে শ্রদ্ধা করা আমাদের সকলের উপর ফরয, : আমরা আপনার সমীপে উপস্থিত হয়েছি- সেই তিন ব্যক্তির একজন বললো- আপনার দিনের বক্তব্য আমাদের হৃদয়ে গেঁথে গেছে। এবার আমাদেরকে তূর পর্বতের জ্যোতি দেখান, আপনি যার ওয়াদা দিয়েছিলেন।

মিশর ফেরাউনদের রাষ্ট্র- আমর দরবেশ উচ্চস্বরে বললেন- ফেরাউন মারা গেছে। কিন্তু খোদা মিশরের রাজত্ব যাকেই দান করেছেন, সে-ই ফেরাউন হয়ে গেছে। এটা মিশরের মাটি, পানি ও বাতাসের ক্রিয়া। যে ব্যক্তি এক সময় রাসূলের বন্দনা করতো, ক্ষমতার মসনদে আসীন হওয়ায় সেও ফেরাউন হয়ে গেছে। হযরত মূসা (আঃ) ফেরাউনের মোকাবেলা করেছেন এবং নীল নদের রাস্তা তৈরি করে দেখিয়েছেন। বর্তমানে মিশর পুনরায় ফেরাউনের দখলে চলে গেছে। সেখানে এখন মদের নদী প্রবাহিত হচ্ছে এবং পর্দানশীল, সম্ভ্রান্ত মহিলাদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। তোমরা মিশরকে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত করার সৌভাগ্য অর্জন করো। মহান আল্লাহ তোমাদেরকে তুর পর্বতের জ্যোতি দর্শন লাভের সৌভাগ্য দান করেছেন।

আমর দরবেশ দুবাহু সম্প্রসারণ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে জ্বালাময়ী কণ্ঠে বললেন- হে আল্লাহ! তুমি তোমার পথহারা বান্দাদের সেই নূর দেখাও, যে নূর তুমি মূসাকে দেখিয়েছিলে।

হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে আমর দরবেশ হাতের আঘাতে একটি প্রদীপ মাটিতে ফেলে দেন। অন্ধকার রাত। ঘোর অন্ধকারে পাহাড়-টিলা বৃক্ষরাজি কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আলো বলতে আছে শুধু সেই প্রদীপ দুটির কিরণমালা, যাতে শুধু আমর দরবেশ আর আশিকে দেখা যাচ্ছে। আমর দরবেশ প্রদীপটি উপরে তুলে ধরে একদিকে ইশারা করে বললেন ঐদিকে দেখ। ওদিকে একটি পাহাড় আছে। তোমরা পাহাড়টাকে দেখতে পাচ্ছে না। তার জ্যোতি দেখ।

আমর প্রদীপটা আরো উর্ধ্বে তুলে ডানে-বাঁয়ে নাড়ান। সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখের পাহাড় থেকে একটি শিখা ভেসে ওঠে এবং অল্প পরেই তা নিঃশেষ হয়ে যায়। জনতা সেই যে বিস্ময়ে হা করে তাকিয়ে ছিলো, এখন হা করেই আছে। বিস্ময় তাদের বাশক্তি কেড়ে নিয়ে গেছে।

তোমরা যদি খোদার এই জ্যোতিকে হৃদয়ে প্রোথিত করে না নাও, তাহলে এই শিখা তোমাদের এই সবুজ-শ্যামল ভূখণ্ডকে মরুভূমিতে পরিণত করে দেবেন- আমর দরবেশ বললেন- আমি তাকে প্রতিহত করতে পারবো না। সেই জোতিকে তোমরাই তো ডেকে এনেছে।

আমর দরবেশ তাঁর তাঁবুতে চলে যান। আশি জনতাকে ইঙ্গিত করে, তোমরা চলে যাও। জনতা স্থান ত্যাগ করে ফিরে যেতে শুরু করে। এখন তারা পরস্পর কথা বলতেও ভয় পাচ্ছে। এখন আর তাদের অন্তরে কোন শোবা-সন্দেহ নেই।

তারা যখন তাঁবু থেকে বেশ দূরে চলে যায়, তখন তাদের মধ্যে থেকে এক যুবক দ্রুত হেঁটে সম্মুখে এগিয়ে গিয়ে সকলের প্রতি মুখ করে দাঁড়িয়ে যায়। যুবক পাশ্ববর্তী এক গ্রামের মসজিদের ইমাম।

একটু দাঁড়ান- ইমাম হাত দুটো উঁচু করে বললেন- আপনারা আপনাদের ঈমানকে সংযত রাখুন। দরবেশ আপনাদের যা দেখিয়েছে, সবই ভেল্কি। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর পর না আর কোনো নবী এসেছেন, না আসবেন। আল্লাহ সেই পাপিষ্ঠকে তার জ্যোতি দেখান না, যে একটি বেহায়া মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

এটি মেয়ে নয়- জিন। এক ব্যক্তি বললল।

 জিন মানুষের আকৃতিতে আসতে পারে না- ইমাম বললেন- জিন মানুষের আনুগত্য করে না। মুসলমানগণ! আপনারা আপনাদের বিশ্বাসকে হেফাজত করুন। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী ফেরাউন নন। তিনি আল্লাহর সাচ্চা বান্দা। তিনি নবী হওয়ার দাবি করেননি। তিনি ধর্মের প্রহরী এবং খৃস্টানদের দুশমন।

সম্মানিত ইমাম!- এক ব্যক্তি বললো- আপনি কি পানিতে আগুন লাগাতে পারবেন?

আরে বাদ দাও ওর কথা- অপর একজন বললো- ইমামতি ঠিক রাখার জন্য এসব বলছে।

আমরা যা যা দেখেছি, পারলে আপনি সেসব দেখান- আরেকজন বললো- তবেই আমরা আপনার কথা মেনে নেবো।

আপনারা আমার সঙ্গে সেই পাহাড়ে চলুন, যেখান থেকে শিখাটা জ্বলে উঠেছিলো- ইমাম বললেন- আমি আপনাদের প্রমাণ করে দেবো, এসবই ভেল্কিবাজি। আপনারা চলুন। যদি আমার দাবি ভুল প্রমাণিত হয়, তাহলে আমাকে সেখানেই খুন করে ফেলুন।

আমরা খোদার কাজে হস্তক্ষেপ করার দুঃসাহস দেখাবো না। এক ব্যক্তি বললো।

দু-তিনজন লোক এক সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। তারাও ইমামের মতের বিপক্ষে। তারা জনতাকে এমনভাবে উত্তেজিত করে তোলে যে, সব মানুষ হাঁটতে শুরু করে এবং ইমামকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ইমাম একাকী দাঁড়িয়ে থাকেন।

কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে যুবক ইমাম সেই পাহাড়টির দিকে হাঁটা দেন, যার উপর শিখা জ্বলে ওঠেছিলো। খুব দ্রুতপদে হাঁটছেন তিনি। একটি পাথুরে বিরান ভূমি অতিক্রম করে পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছলে তিনি টের পেলেন, দুজন লোক তার থেকে খানিক দূরে তার পেছন দিয়ে একদিকে চলে গেলো। ইমাম পাহাড়ের কোল ঘেঁষে হাঁটছেন। পেছন দিয়ে চলে যাওয়া ব্যক্তিদ্বয় চলার গতি আরো বাড়িয়ে দেয়। তাদের পায়ের শব্দ শুনে ইমাম দাঁড়িয়ে যান। লোক দুজন আকস্মাৎ তার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে যায়। তাদের মুখমন্ডল কাপড়ে আবৃত। ইমাম তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, আপনারা কারা? তারা কোন জবাব দেয় না। একজন ইমামের পেছনে চলে যায়। ইমাম তার দিকে মোড় ঘুরে দাঁড়ালে অপরজন ইমামকে ঝাঁপটে ধরে। ইমাম কোমরবন্ধ থেকে খঞ্জর বের করেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে খঞ্জরধারী হাতটা অপর ব্যক্তির মুঠোয় চলে যায়। গলায় ঝাঁপটে ধরার কারণে ইমামের শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।

ইমাম আক্রমণকারীদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার শেষ চেষ্টা চালান। শরীরের পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করেন। সম্মুখের ব্যক্তি ইমামের লাথি খেয়ে পেছনে গিয়ে ছিটকে পড়ে এবং ইমামের গলায় তার বাহুর বন্ধন শ্লথ হয়ে আসে। ইমাম আরেকটি ঝটকা মেরে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে যান। এবার তিনি রক্তক্ষয়ী লড়াই করার প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে যান। কিন্তু ইতিমধ্যে আক্রমণকারী দুজন পালিয়ে গেছে। ইমাম তাদেরকে হাঁক দেন। কিন্তু তারা দষ্টির আড়ালে চলে গেছে। ইমাম আর সম্মুখে অগ্রসর হওয়া সমীচীন মনে করলেন না এবং সেখান থেকেই ফিরে আসেন।

আমর দরবেশের তাবুতে সেই তিন ব্যক্তি উপবিষ্ট, যারা দিনের বেলায়ও এসেছিলো। তারা আমর দরবেশকে বললো- আমাদের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। আমরা যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিলাম, মানুষ সেই প্রতিক্রিয়া নিয়েই ফিরে গেছে। তারা আমর দরবেশকে এ-ও বললো যে, আগামী রাত আপনাকে সম্মুখে অপর একটি গ্রামের নিকটে যেতে হবে এবং অন্য এক পাহাড়ের উপর তুর পর্বতের জালওয়া দেখাতে হবে।

লোক তিনজন চলে গেছে। এখন তাঁবুতে আছে আশি আর আমর দরবেশ।

 আপনি কি আপনার সাফল্যে আনন্দিত? আশি জিজ্ঞেস করে।

আশি? আমর দরবেশ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন- আমি তোমাকে এ জাতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে ভয় পাচ্ছি।

আচ্ছা, আপনি কী চাচ্ছেন? আমি খৃস্টান ও সুদানীদের হাতে খেলনা হয়েই থাকবো? আশি বললো- আপনি আমার অভ্যন্তরে ঈমান জাগ্রত করে দিয়েছেন। আর এখন কিনা আমাকে বিশ্বাস করছেন না।

আমি তোমাকে বিশ্বাস করবো তোমার কাজের উপর ভিত্তি করে আমর দরবেশ বললেন- তোমার কথার উপর ভিত্তি করে নয়।

বলুন, আমি কী করবো? আশি জিজ্ঞাসা করে- আপনি যা বলবেন, তা-ই করবো।

এখনো সে কাজই করতে থাকো, যা করছো- আমর দরবেশ বললেন সময় এলেই বলবো তোমাকে কী করতে হবে।

হতে পারে সে সময়টা আপনি পাবেন না- আশি বললো- আপনি তো দেখেছেন, আপনার চারপাশে কিভাবে গোয়েন্দার জাল ছড়িয়ে আছে। যখনই আপনার থেকে সামান্যতম সন্দেহজনক আচরণ প্রকাশ পাবে, তখন এই গোয়েন্দারা আপনাকে গুম কিংবা খুন করে ফেলবে। আর আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। আপনি যদি আগেই বলে রাখেন আপনার উদ্দেশ্যে কী, তাহলে আমি যথাসময়ে সাবধান হতে পারবো। তারা তো আমাকে সন্দেহাতীতরূপে তাদেরই দলের সদস্য মনে করে।

আশি এমন সহজ-সরল ও নিষ্ঠাপূর্ণ কথাটা বললো যে, আমর দরবেশ নিশ্চিত হয়ে গেলেন মেয়েটি তাকে ধোকা দেবে না। তিনি বললেন তোমার যোগ্যতা দেখলে মনে হয়, তুমি আমাকে ধোকা দেবে।

দক্ষতায় আপনিও কম নন- আশি বললো- তাই তো আমার মনে হচ্ছে, আপনি নিজ জাতিকে ধোকা দেয়ার পাক্কা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।

আচ্ছা শোন, আমি তোমাকে আমার পরিকল্পনা বলে দিচ্ছি- আমর দরবেশ বললেন- আর এ কথাও বলে রাখছি, তুমি যদি তোমার প্রতিশ্রুতি পূরণ না করা এবং আমার সঙ্গে প্রতারণা করো, তাহলে তুমি জীবিত থাকতে পারবে না। আমি খুন হওয়াকে যেমন ভয় করি না, তেমনি খুন করাকেও না। আসার পথে তোমাকে বলেছিলাম, আমি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে যাচ্ছি। আমার আশা ছিলো, এখানে নিজ এলাকায় এসে নিজের গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহজে কামিয়াব হবো। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম, সুদানীরা আমাকে গুপ্তচরদের বেঈমানীতে আবদ্ধ করে রেখেছে। আমার আরেকটি উৎকণ্ঠা হলো, আমি আমার জাতির পিঠে খঞ্জর বিদ্ধ করে ফেলেছি। মূল লক্ষ্য অর্জনের খাতিরে আমি নিজেকে গোপন রাখছি বটে; কিন্তু আমার যে কর্মকাণ্ডকে তুমি আমার দক্ষতা বলছো, তা আমার জাতির ধর্মীয় বোধ-বিশ্বাসকে বিষের ন্যায় খুন করে ফেলছে। আমি যদি আমার এই মিশন অব্যাহত রাখি, তাহলে তা সুদানী মুসলমানদেরকে আজীবনের জন্য গোলামীর শিকলে আবদ্ধ করে ফেলবে এবং তাদের জাতীয় মর্যাদা চিরদিনের জন্য নিঃশেষ হয়ে যাবে।

তুমি কী করতে চাও? আশি জিজ্ঞেস করে।

আমি ইসহাকের গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছতে চাই- আমর দরবেশ বললেন ইসহাককে চেনো তো! সেই কমান্ডার, যে যুদ্ধবন্দী হিসেবে কয়েদখানায় পড়ে আছে। তাকে ঘায়েল করার জন্য তোমাকেও এক রাতের জন্য তার নিকট প্রেরণ করা হয়েছিলো।

উহ! ঐ লোকটাকে আমি জীবনেও ভুলবো না- আশি বললো- আমি তারও ততোটুকু ভক্ত, যতটুকু ভক্ত তোমার।

আমি তার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে চাই- আমর দরবেশ বললেন- তারপর নিজ গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছা রাখি। আমি ভেবে এসেছিলাম, এখানে এসে অদৃশ্য হয়ে যাবো এবং এখানকার লোকদেরকে বলবো, তারা যেন সুদানীদের ক্রীড়নকে পরিণত না হয়।

আমি কয়েদখানায় নির্মম নির্যাতনের পর বের হয়েছি- আমর দরবেশ বললেন- জ্ঞান বলতে এতোটুকুই ছিলো যে, কয়েদখানা থেকে বের হওয়ার এই পন্থাটা ভাবতে পেরেছি। কিন্তু এখানে এসে এখন মনে হচ্ছে, সফল হওয়া সম্ভব নয়।

আপনি আমাকেও ভাবতে দিন- আশি বললো- আমরা যদি আল্লাহর পথে দৃঢ়পদ থাকি, তাহলে উদ্দেশ্য সফল হবে। আগামী দিন আমরা সম্মুখে যাবো। পন্থা একটা বেরিয়ে আসবে। আপাতত এখানকার কোন একজন বিজ্ঞ লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়া প্রয়োজন।

***

এ অঞ্চলেই আমর দরবেশের তাবু থেকে দু-আড়াই মাইল দূরে মিশর ব্যবসায়ীদের একটি কাফেলা এসে অবস্থান নিয়েছে। কাফেলায় চারজন পুরুষ এবং ছয়টি উট। দলনেতা লম্বা শশ্রুমণ্ডিত বুযুর্গ ধরনের ব্যক্তি। তার একটি চোখের উপর সবুজ বর্ণের একখণ্ড কাপড় ঝুলানো, যেনো চোখটি নষ্ট। কাফেলা দু-রাত আগে সুদানের সীমান্তে প্রবেশ করেছিলো। সীমান্ত অতিক্রমে তাদেরকে কোন বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। রাতের অন্ধকারে সুদানের সীমান্ত রক্ষীরা টের পায়নি যে, চার ব্যবসায়ী এবং ছয় উটের এই কাফেলাটি কোনো শহরের দিকে না গিয়ে সেই পার্বত্য অঞ্চলের কোনো এলাকার দিকে চলে যায়, যেখানকার বাসিন্দারা মুসলিম। অথচ ওদিকে কোনো বণিক কাফেলার যাওয়ার অনুমতি ছিলো না। কারণ, সুদান সরকার মুসলমানদেরকে তরিতরকারী ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে বঞ্চিত রাখতে চাইতো।

কাফেলা রাতভর চলতে থাকে। রাত পোহালে তারা উটগুলোকে পার্বত্য এলাকায় লুকিয়ে ফেলে। সীমান্ত এখন তাদের থেকে অনেক দূরে- পেছনে। সারাদিন তারা সেখানে লুকিয়ে অতিবাহিত করে।

রাতের অন্ধকার নেমে এলে কাফেলা পুনরায় চলতে শুরু করে এবং মধ্যরাত নাগাদ পার্বত্য এলাকায় ঢুকে পড়ে। এই এলাকাই কাফেলার গন্তব্য।

রাতের শেষ প্রহরে কাফেলা একটি গ্রামে প্রবেশ করে। দলনেতা একটি ঘরের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে দরজায় করাঘাত করেন। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে যায়। এক ব্যক্তি প্রদীপ হাতে বেরিয়ে আসে। দলনেতা তাকে কানে কানে কিছু বললেন। গৃহকর্তা খোশ আমদেদ বলে বললেন- আপনারা সবাই ভেতরে আসুন। উটগুলোকে আমরা সামলাবো।

চার ব্যবসায়ী ভেতরে ঢুকে পড়ে। মেজবান তার ঘরের লোকদেরকে এবং আরো দু-তিনজন প্রতিবেশীকে জাগিয়ে তোলেন। তারা ব্যবসায়ীদের উটগুলোকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তাদের উটপালের সঙ্গে বেঁধে রাখে। মালামাল নামিয়ে মেজবানের ঘরে রাখা হলো। কাফেলা প্রধান বললেন- মালগুলো লুকিয়ে ফেলো।

সবাই ধরাধরি করে মালগুলো খুললো। তার মধ্যে তরিতরকারীর স্থলে বেরিয়ে এলো তীর-তরবারী, খঞ্জর এবং তিন-চারটি চাটাইয়ে মোড়ানো দাহ্য পদার্থ ভর্তি অনেকগুলো পাতিল। মালগুলো লুকিয়ে ফেলা হলো।

এবার আসলরূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারি? দলনেতা বললেন- অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি।

কোন সমস্যা নেই- মেজবান বললেন- সবাই নিজস্ব লোক।

দলনেতা মুখের লম্বা দাড়িগুচ্ছ টান দিয়ে খুলে ফেলেন এবং চোখের সবুজ কাপড়ও সরিয়ে ফেলেন। তার আসল দাড়ি ছোট এবং পরিপাটি করে ছাটা। দৃশ্যমান দাড়ি তার কৃত্রিম ছিলো। মালপত্র এখানে-সেখানে লুকিয়ে রেখে লোকজন মেহমানদের নিকট এলে এক ব্যক্তি কাফেলার নেতাকে দেখে চমকে ওঠে। দলনেতা মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন–আমাকে চেনেননি বুঝি?

ও, আলী বিন সুফিয়ান- লোকটি বললো- আল্লাহর শপথ! আমি তোমাকে প্রথমে চিনতে পারিনি। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন- আমাদের সৌভাগ্য যে, আপনি নিজে এসেছেন। এখানকার পরিস্থিতি ভালো নয়।

আমি সংবাদ পেয়েছি যে, সুদানের কয়েদখানার এক সিপাহী সুদানী ফৌজের দুজন কমান্ডারকে হত্যা করে ফেলেছে- আলী বিন সুফিয়ান, বললেন- আর আমি এও জানতে পেরেছি, সুদানীরা আমাদের যুদ্ধবন্দীদেরকে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে।

লম্বা দাড়িওয়ালা, চোখে পট্টিবাধা, চোগা পরিহত লোকটি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর অভিজ্ঞ গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য এখানে এসেছেন। কায়রোতে বসে গোয়েন্দা মারফত যেসব তথ্য পেয়েছিলেন, তারই আলোকে এখন কথা বলছেন। যে ঘরটিতে। এখন তিনি বসা আছেন, সেটিই তাঁর প্রেরিত গোয়েন্দাদের কেন্দ্র। গৃহকর্তা সুদানী নাগরিক। এরা সবাই সুলতান আইউবীর অনুগত। আলী বিন সুফিয়ানকে তারা একটি নতুন সংবাদ শোনালো

গুজব প্রচারিত হচ্ছে যে, আল্লাহর এক দূত এসেছেন, যিনি পানিতে আগুন লাগাতে পারেন- মেজবান আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন- তিনি বলছেন, আল্লাহ আমাকে মৃতদের মধ্য থেকে তুলে এনে বলেছেন, তুমি মুসলমানদেরকে বলল, তোমরা সুদানের অনুগত হয়ে যাও। কারণ, এই মাটি তোমাদের মা।

 মেজবান আলী বিন সুফিয়ানকে আমর দরবেশ সম্পর্কিত সব কাহিনী শোনন। কিন্তু তার জানা ছিলো না যে, রাতে আমর দরবেশ তূর পর্বতের জালওয়া দেখিয়ে মানুষের অন্তরে অত্যন্ত ভয়ানক সন্দেহ সৃষ্টি করে দিয়েছেন।

আমি এ আশংকাই করছিলাম যে, দুমশন আমাদের বোধ-বিশ্বাসের উপর আক্রমণ করবে- আলী বিন সুফিয়ান বললেন- সে জন্য আমি নিজেই এসেছি। খৃস্টানরা নাশকতায় ওস্তাদ। আর আমাদের জনগণ হলো আবেগপ্রবণ। খৃস্টানরা হৃদয়গ্রাহী ভাষার ধুম্রজাল ছড়িয়ে দেয় আর আমাদের আবেগপ্রবণ আনাড়ী ভাইয়েরা তার সূক্ষ্ম সুতোয় আটকে পড়ে। যা হোক, কাল বিলম্ব না করে এক্ষুণি আমাকে এই ফেতনা সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। আমার মনে হয় আমর দরবেশকে আমি চিনি। আমাদের ফৌজের এক ইউনিটের কমান্ডার ছিলো। অত্র এলাকায় মিশরী গোয়েন্দা কমান্ডোও ছিলো।

আলী বিন সুফিয়ান মেজবানকে বললেন- আপনি আমাদের কয়েকজন গোয়েন্দাকে ডেকে আনার ব্যবস্থা করুন। এর বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

***

সকাল বেলা। এখানে সূর্য উদয় হয়নি। গোয়েন্দাদের ডেকে আনার জন্য লোক পাঠানো হয়েছে। তাদের রওনা হওয়ার পরক্ষণেই একটি ঘোড়া দ্রুতবেগে ছুটে এসে ঘরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে যায়। আরোহী ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এলে সকলে তার সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যান।

ইনি ইমাম। সেই ইমাম, যিনি আমর দরবেশের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। কিন্তু জনতা তার কথা না শুনে তাকে ধাক্কা মেরে চলে গিয়েছিলো। পরে রাতে দুজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর উপর আক্রমণ করেছিলো। তিনি সেখান থেকেই ফিরে এসেছিলেন। তিনি জানতেন, এই গৃহটি মুসলমানদের গুপ্তচরবৃত্তি ও অন্যান্য তৎপরতার কেন্দ্র। পাবর্ত্য এলাকা থেকে ফিরে এসে ঘরে গিয়ে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তিনি এই গৃহের উদ্দেশ্যে রওনা হন। যুবক ইমাম নিশ্চিত, আমর দরবেশ একজন জাদুকর ও ভেল্কিবাজ। তিনি এখানে রিপোর্ট প্রদান এবং ভণ্ডামীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সহযোগিতা নিতে এসেছেন।

যুবক ইমাম আলী বিন সুফিয়ানকে চেনেন না। পরিচয় লাভ করার পর আমর দরবেশ কী কী ভেল্কি প্রদর্শন করেছেন এবং মুসলমান দর্শনার্থীরা কিভাবে প্রভাবিত হয়েছে, তিনি তার বিবরণ প্রদান করেন।

আমরা যদি এই ধারা বন্ধ না করি, তাহলে মুসলমান তাদের বোধ। বিশ্বাস থেকে সরে যাবে- ইমাম বললেন- তাদের আকীদা নষ্ট হয়ে যাবে। আমর দরবেশ নামক এই লোকটি আজ রাত সামনের গ্রামে যাবে এবং ভেল্কি দেখাবে।

তারা কিছুক্ষণ বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করেন। একজন আমর দরবেশকে হত্যা করার প্রস্তাব দেন। আলী বিন সুফিয়ান তাতে একমত হলেন না। তিনি আস্থা জ্ঞাপন করেন- আমর দরবেশকে হত্যা না করেই সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা যাবে এবং তারই মুখে বলানো যাবে, সে যে মোজেযা দেখিয়েছে, তা ছিলো ভেল্কিবাজি। যুক্তি উপস্থাপন করে তিনি বললেন–হত্যা করা হলে মানুষ তাকে আরো বেশি সত্যাশ্রয়ী ভাবতে শুরু করবে।

আলী বিন সুফিয়ানের সঙ্গে বণিকবেশে আরো যে তিন ব্যক্তি এসেছিলেন, তারা মিশরী ফৌজের অতিশয় বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ লড়াকু গুপ্তচর। আলী বিন সুফিয়ান তাদেরকে বণিকের বেশে সঙ্গে নেন এবং নিজে মুখে লম্বা দাড়ি স্থাপন করেন ও এক চোখের উপর পট্টি বাঁধেন। নিজেরা ঘোড়ায় চড়ে আরো কয়েক ব্যক্তিকে উট-ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে পেছন পেছন আসার জন্য বললেন। সকলকে জরুরী নির্দেশনা প্রদান করে তিনি ইমামের সঙ্গে আমর দরবেশের আস্তানা অভিমুখে রওনা হন।

আমর দরবেশ ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে সকাল সকাল পরবর্তী আস্তানা অভিমুখে রওনা হয়ে গেছেন। তাঁর সঙ্গীরা স্থানীয় লোকদের পোশাকে নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে।

তিনি অপর একটি গ্রামের সামান্য দূরে এক স্থানে যাত্রাবিরতি দেন এবং তবু স্থাপন করেন। অল্পক্ষণের মধ্যে তিনি ও আশি প্রস্তুত হয়ে যান। তাঁবুর সম্মুখে দুটি প্রদীপ জ্বালিয়ে গেড়ে দেয়া হলো। তার সঙ্গীরা গিয়ে এলাকাবাসীকে জানায়, তোমরা খোদার যে দূতের মোজেযার কথা শুনেছিলে, তিনি এখন তোমাদের মহল্লার অদূরে অবস্থান করছেন।

সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ছুটতে শুরু করে। একদিন আগে যারা আমর দরবেশকে দেখেছিলো, তারাও দূর-দূরান্ত থেকে এসে উপস্থিত হয়।

আমর দরবেশ প্রদীপ দুটোর মধ্যখানে ছোট্ট গালিচাটির উপর বসে পড়েন। আশি আগের দিনকার ন্যায় আকর্ষণীয় পোশাকে সজ্জিতা। আমর দরবেশের সম্মুখে একটি কাপড় ছড়িয়ে পড়ে আছে। তিনি সেইসব ভাবভঙ্গি ও আচার-আচরণ দেখাতে শুরু করেন, যা বিগত দিন দেখিয়েছিলেন। গতকাল তাকে যে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, এক ব্যক্তি এবারও সেই প্রশ্ন করেন। আমর দরবেশ একই ভঙ্গিতে একই জবাব প্রদান করেন। বললেন কারো কাছে পানি থাকলে এই কাপড়টির উপর ঢেলে দাও।

আলী বিন সুফিয়ান তাঁর দলবলসহ পৌঁছে গেছেন। তিনি আমর দরবেশকে চিনে ফেলেছেন। তার ভালভাবেই জানা আছে, এই লোকটি মিশরী ফৌজের এক ইউনিটের কমান্ডার ছিলো।

আলী বিন সুফিয়ানকে অবহিত করা হয়েছিলো, আমর দরবেশ পানিতে আগুন লাগাতে পারেন। কিন্তু পানিতে আগুন জ্বলে কিভাবে বিষয়টির রহস্য উদঘাটনের জন্য তিনি ক্ষুদ্র একটি মশকে করে কতটুকু পানি সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। আমর দরবেশ যেই মাত্র বললেন, কারো নিকট পানি থাকলে এনে এই কাপড়টির উপর ঢেলে দাও, অমনি এক ব্যক্তি দ্রুতবেগে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তার কাছে মশক ছিলো। সে কিছু পানি কাপড়টির উপর ঢেলে দেয়।

আলী বিন সুফিয়ান সামনে এগিয়ে যান। তিনি প্রদীপটি মাটি থেকে তুলে হাতে নিয়ে জনতাকে উদ্দেশ করে বললেন- তোমাদের মধ্য থেকে একজন এগিয়ে আসো। আলীর সঙ্গে আসা এক ব্যক্তি এগিয়ে আসে। আলী প্রদীপটি তার হাতে দিয়ে বললেন- এই কাপড়টায় আগুন ধরাও। লোকটি ইতস্তত করে। আলী বিন সুফিয়ান জনতার উদ্দেশে বললেন- তোমাদের যে কেউ পানিতে আগুন ধরাতে পারবে।

এগিয়ে আসা লোকটি প্রদীপটা কাপড়ের কাছে ধরামাত্রই কাপড়ে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। এক ব্যক্তি- যে মূলত আমর দরবেশের সঙ্গী বলে উঠলো- নিশ্চয় তুমি জাদু জানো। সরে যাও এখান থেকে। অন্যথায় এই বুযুর্গের অভিশাপে শেষ হয়ে যাবে।

আমর দরবেশ বিস্মিত নয়নে চুপচাপ আলী বিন সুফিয়ানের প্রতি তাকিয়ে আছেন। আলী বিন সুফিয়ান নিজের কোমরবন্ধটা খুলে আমর দরবেশের সামনে রেখে তার উপর পানি ঢেলে দিয়ে বললেন- তুমি যদি খোদার দূতই হয়ে থাকো, এতে আগুন লাগাও দেখি। বলেই তিনি প্রদীপটা আমর দরবেশের দিকে এগিয়ে দেন। কিন্তু আমর দরবেশ তার মুখপানে তাকিয়েই আছেন।

জনতার মাঝে কানা-ঘুষা শুরু হয়ে গেছে। তারা আমর দরবেশের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করে। সবচেয়ে উঁচু ইমামের কণ্ঠ। আমর দরবেশের লোকেরা তার পক্ষে সাফাই গাইতে শুরু করে। উভয় পক্ষেরই বক্তারা গোয়েন্দা। সাধারণ মানুষ নির্বাক কিংবর্তব্যবিমূঢ়। এটিও একটি যুদ্ধ। হক-বাতিলের লড়াই। আলী বিন সুফিয়ান জনতাকে ওদিকে ব্যস্ত দেখে আমর দরবেশের সম্মুখে বসে পড়েন।

আমর দরবেশ! আলী ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন- ঈমান বিক্রি করে কতো মূল্য পেয়েছো?

তুমি কে? আমর দরবেশ জিজ্ঞেস করেন।

বহুদূর থেকে এসেছি- আলী বিন সুফিয়ান বললেন- তোমার সুখ্যাতি শুনে সীমান্তের ওপার থেকে এসেছি।

আমর অস্থির চিত্তে এদিক-ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেন- আমি তোমাকে কিভাবে বিশ্বাস করবো?

আমার দাড়িতে হাত বুলাও- আলী বিন সুফিয়ান বললেন- কৃত্রিম। ঈমান বিক্রি করে যে মূল্য আদায় করেছে, তার চেয়ে দ্বিগুণ দেবো। এই ভেল্কিবাজি বন্ধ করো। আমি তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবো।

আমি ঘাতকদের দ্বারা অবরুদ্ধ। আমর দরবেশ বললেন।

আমাকে অমান্য করলেও খুন হয়ে যাবে- আলী বিন সুফিয়ান বললেন এখানে আমাদের বহু মানুষ আছে। তোমার সঙ্গে কজন আছে?

আমি জানি না- আমর দরবেশ বললেন- আপনার নাম কী?

বলা যাবে না- আলী বিন সুফিয়ান বললেন- আমি যা যা জিজ্ঞেস করছি, জবাব দাও। তুরের জালওয়া কী? সত্য সত্য বলে। তোমার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার।

উঠবার সময় ডানে-বাঁয়ে দেখে নেবেন- আমর দরবেশ বললেন- উঁচু পাহাড়টির সামনে উঁচু একটি টিলা আছে। বিশাল একটি গাছ আছে। সন্ধ্যার সামান্য পরে ওখানে দু-চারজন লোক লুকিয়ে রাখুন। যেভাবে পানিতে আগুন লাগানোর রহস্য জেনেছেন, তেমনি তুরের জালওয়ার ভেদও জেনে যাবেন। আমাকে এই তামাশাটা দেখানোর সুযোগ দিন। আপনি সেখান থেকে শিখা উঠতে দেবেন না। আমার পলায়ন ও নিরাপত্তার দায়িত্ব আপনার। ইসহাককে কয়েদখানা থেকে মুক্ত করে আনতে হবে। উঠুন, ঘোষণা করে দিন, রাতে তুর পর্বতের জালওয়া দেখানো হবে।

আলী বিন সুফিয়ানের স্থলে অন্য কেউ হলে আমর দরবেশের এই অসম্পূর্ণ বক্তব্য বুঝতেন না। তিনি তো এই ময়দানের একজন দক্ষ খেলোয়াড়। ইশারায় অনেক কিছু বুঝবার যোগ্যতা তার আছে। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন- খোদার এই দূত আজ রাতে তূর পর্বতের জালওয়া দেখাবেন। আমি তার বুযুর্গীর প্রমাণ পেয়েছি। আপনারা এখন চলে যান। সন্ধ্যার পর আবার আসবেন।

আলী বিন সুফিয়ান উঠে চলে যান। জনতা তাকে ঘিরে ধরে। জিজ্ঞাসা করে, হযরতের সঙ্গে আপনার কী কথা হয়েছে? তিনি উচ্চস্বরে বললেন মহান মানুষটির বুকে একটি পয়গাম ও একটি ভেদ আছে। তার সঙ্গে কথা বলে আমি আমার সন্দেহ দূর করেছি। রাতে এসে আপনারা অবশ্যই তাঁর মোজেযা দেখবেন।

 একজন আমর দরবেশের কাছে গিয়ে বসে এবং জিজ্ঞেস করে, লোকটার সঙ্গে আপনার কী কথা হয়েছে? আমর দরবেশ বললেন- আমি তাকে ভক্ত বানিয়ে ছেড়েছি।

কিন্তু লোকটা কে?- আমর দরবেশ মুচকি হেসে বললেন- আজ রাতই আমি তার অবশিষ্ট সব সন্দেহ দূর করে দেবো।

লোকটা যদি রাতে আবার আসে, তাকে খুন করে ফেলবো। অপর একজন বললো।

এখনই নয়- আমর দরবেশ বললেন- ফল উল্টোও হতে পারে। যদি রাতে সে আমার কাছে আসে, তাহলে তাঁবুতে এনে আমার নিকটে বসাবো আর তোমরা বেঁধে তাকে তুলে নিয়ে যাবে।

আমরা তার পিছু নিচ্ছি- তৃতীয় একজন বললো- একে নজরে রাখতে হবে।

দুব্যক্তি উঠে বিদায়ী জনতার সঙ্গে গিয়ে মিশে যায়। তারা আলী বিন সুফিয়ানকে খুঁজতে শুরু করে। কিন্তু তিনি জনতার মাঝে নেই। অনেককে জিজ্ঞেস করেও তারা সন্ধান পেলো না, লম্বা দাড়িওয়ালা চোখে পট্টিবাধা লোকটি কোথায়।

আলী বিন সুফিয়ান ঘোড়ায় চড়ে অতক্ষণে বহু দূরে চলে গেছেন।

***

তাঁবুতে এখন আমর দরবেশের সঙ্গে আশি ছাড়া আর কেউ নেই। আশি জিজ্ঞেস করে- লোকটি আসলে কে ছিলো? তোমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বললো, যেনো সে তোমার এবং তোমার ছদ্মরূপ সম্পর্কে অবগত।

শোনো আশি!- আমর দরবেশ বললেন- আজ রাতে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আমি বলতে পারছি না, কী ঘটবে? লোকটাকে আমি চিনতে পারিনি। সে নিজের পরিচয় দেয়নি। কিন্তু সে অসাধারণ কোনো মানুষ নয়। আজ রাতে পালাবার সুযোগও পেয়ে যেতে পারি, আবার খুনও হতে পারি। আজ ধাতেই তোমাকে প্রমাণ করতে হবে, তোমার শিরায় মুসলিম পিতার খুন বিদ্যমান। তুমি যদি ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করো, তাহলে আমার হাতেই তোমার জীবনের অবসান ঘটবে।

তুমি যদি আমাকে আরো খুলে বলো, কী ঘটবে এবং আমাকে কী করতে হবে, তাহলে আমি ভালভাবে তোমার সাহায্য করতে পারবো- আশি বললো- তোমার জন্য খুন হতেও আমি প্রস্তুত আছি। কিন্তু তাতে যদি তোমার লক্ষ্য অর্জিত না হয়, তাহলে আমার জীবনটাও বৃথা যাবে।

আচ্ছা, শোনো- আমর দরবেশ বললেন- আমাদের লোকদের কোনো কথা তুমি শুনবে না। তারা কখন কী পদক্ষেপ নিচ্ছে জেনে আমাকে অবহিত করার চেষ্টা করবে। রাতটায় কী যে ঘটবে, আমি ঠিক বলতে পারছি না। তুমি প্রস্তুত থাকবে।

তুমি একাধিকবার বলেছে, আমাকে তুমি বিশ্বাস করো না- আশি বললো- কিন্তু আমি এ কথা একবারও বলিনি। যাই হোক, তুমি যদি এখান থেকে মুক্তিলাভ করো, তাহলে আমাকে সঙ্গে করে নেবে কী?

যাবে তুমি?

 না- আশি ব্যথিত অথচ প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠে বললো- আমি মরে যাবো।

— তুমি রাজকন্যা আশি- আমর দরবেশ বললেন- আমার সঙ্গে গেলে তোমার ভবিষ্যৎ কী হবে, তা তো আমি ভেবেই দেখিনি। নিশ্চয় বন-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোকে পছন্দ করবে না। আমি তোমাকে কায়রো নিয়ে যাবো। তোমাকে নিয়ে ভাববার মতো ওখানে ভালো ভালো মাথা আছে।

কেন আমাকে সঙ্গে রাখবে না? হঠাৎ চমকে উঠে আশি জিজ্ঞেস করে আমাকে তোমার বউ বানাবে না?

তোমার এই শর্ত আমি কবুল করবো না- আমর দরবেশ বললেন মানুষ বলবে, আমি যা করেছি, তোমাকে হাসিল করার জন্য করেছি। আমার গৃহ- যেখানে আমার স্ত্রী থাকে- তোমার যোগ্য নয় আশি। আমি সৈনিক। আমার ঘর হলো যুদ্ধের ময়দান। স্ত্রীর চেহারা দেখেছি তিন বছর হয়ে গেছে। যদি তুমি এই জন্য আমার স্ত্রী হতে চাও যে, আমি তোমার পছন্দের পুরুষ, তাহলে তুমি নিরাশ হবে। তোমার ভালোবাসা আর দোআ সেই তীরকে প্রতিহত করতে পারবে না, যেটি আমার বুকে বিদ্ধ হবে। তুমি তোমার মনোবা আমাকে বলে দাও।

আমি এই লাঞ্ছনার জীবন হতে মুক্ত হতে চাই- আশি বললো আমাকে তোমার সহযোগিতা ও আশ্রয় প্রয়োজন। পরে যা হবে, সময়মত দেখা যাবে। আমি তোমার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবো না।

আমি যদি বেঁচে থাকি, তোমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও আশ্রয় দেবো।

 আচ্ছা, লোকটা গেলো কোথায়?- আমর দরবেশের এক গোয়েন্দার কণ্ঠ। আমর দরবেশের তাবু থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে আলী বিন সুফিয়ান সম্পর্কে ভাবছে সে। হতে পারে, আমর দরবেশ তার হৃদয়টা কজা করার পরিবর্তে নিজের হৃদয়টাই তার কজায় তুলে দিয়েছে। এখন আমাকে অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে। আমাকে তো আমর দরবেশের উপর ভরসা রাখতে নিষেধ করা হয়েছিলো।

 লম্বা দাড়িওয়ালা লোকটা আগুনের ভেদ জেনে গেছে- অপর একজন বললো- এখন দেখতে হবে, আমর দরবেশ তার কাছে হার মেনেছে, নাকি সে আমরের কাছে হার মেনেছে।

যদি কোন ষড়যন্ত্র থাকে আর আশি তাতে জড়িত থাকে, তাহলে সিদ্ধান্ত স্পষ্ট, তাকে খুন করে ফেলতে হবে। একজন বললো।

এমন মূল্যবান সম্পদটাকে এভাবে নষ্ট করে ফেলবে?- অন্য একজন বললো- ওকে তুলে নিয়ে যেতে হবে এবং উচ্চমূল্যের বিনিময়ে কোনো বিত্তশালী লোকের কাছে বিক্রি করে ফেলতে হবে। ওখানে গিয়ে বলবো, আশিকে খুন করে দাফন করে রেখেছি।

তিন গোয়েন্দা পরস্পর এমনভাবে চোখাচোখি করে যেন এ প্রস্তাবে তারা সবাই একমত। একজন বললো- আজ রাতে আমাদেরকে তুর পর্বতের জালওয়া দেখাতে হবে। তখন দেখবো, আমর দরবেশ কিংবা ঐ লোকটির মতলব কী? রাতে আমাদের একজনকে আশির সঙ্গে সঙ্গে থাকতে হবে। মেয়েটি যাতে হাতছাড়া হয়ে না যায়, সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে। আমর দরবেশ ও আশিকে রাতে কে কে পাহারা দেবে তারা ঠিক করে নেয়।

***

চারজনই যথেষ্ট- আলী বিন সুফিয়ান বললেন- আমি আমর দরবেশের সঙ্গে থাকবে। যে তিন-চারজন লোক আমর দরবেশের পক্ষে কথা বলছিলো, তাদেরকে তো তোমরা চিনে রেখেছে। তারা তোমাদেরই এলাকার সেইসব মুসলমান, যারা সুদানীদের জন্য কাজ করছে। আমর দরবেশ তাদের সম্পর্কেই বলেছে যে, সে খুনী চক্রের বেষ্টনীতে অবরুদ্ধ। তাদের প্রতি নজর রাখবে। প্রয়োজন হলে শেষ করে দেবে। তবে জীবিত ধরে ফেলতে পারলে ভালো হবে।

আলী বিন সুফিয়ান একটি মসজিদে উপবিষ্ট। যুবক ইমাম এ মসজিদেরই ইমাম। আলী বিন সুফিয়ানের মুখোশ খুলে রেখে দিলেন। তিনি নিজের লোকদেরকে রাত যাপনের জন্য মসজিদের বিভিন্ন কাজে জুড়ে দিয়ে বলছিলেন- আমার সন্দেহ ছিলো। কিন্তু লোকটা সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। আমি আশা করি রাতের মিশনেও আমরা সফল হবো।

সূর্য অস্ত্র যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত। আমর দরবেশ আলী বিন সুফিয়ানকে যে  পাহাড়টি দেখিয়েছিলেন, এক ব্যক্তি তার উপর আরোহণ করছে। এমন সতর্কতার সাথে আরোহন করছে, যেনো কেউ দেখতে না পায়। তার ঠিক বিপরীত দিক দিয়ে নুয়ে নুয়ে তারই ন্যায় সন্তর্পনে চড়ছে অপর দুব্যক্তি। আরেক দিক থেকে উঠছে অন্য একজন। প্রথম ব্যক্তি চূড়ায় উঠে হামাগুড়ি দিয়ে বড় একটি গাছের নিকট পৌঁছে যায় এবং এদিক-ওদিক তাকিয়ে গাছটিতে চড়তে শুরু করে। দুজন বৃহৎ একটি পাথরের পেছনে বসে পড়ে। এই জায়গাটা বৃক্ষ থেকে বেশি দূরে নয়। চতুর্থ ব্যক্তিও উপরে উঠে যায় এবং উপযুক্ত এক স্থানে লুকিয়ে যায়। প্রথম ব্যক্তি গাছে চড়ে মোটা একটি ডালের উপর যুৎসইভাবে বসে থাকে। গাছের ডাল ও পাতা এতো ঘন যে, নীচ থেকে লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না। খানিক পর সে অনুচ্চ কণ্ঠে পাখির

সূর্যটা পাহাড়ের আড়ালে আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে। আরো তিনজন একসঙ্গে পাহাড়ে আরোহন করছে। তাদের সঙ্গে আগুন জ্বালাবার উপকরণ ও একটি মাটির পাত্রে দাহ্য পদার্থ। প্রত্যেকের সঙ্গে লম্বা খঞ্জর।

সাঝের আলো-আঁধারি গাঢ় হতে চলেছে। এই তিন ব্যক্তির ভাবভঙ্গী এমন যেনো কোনো দিক থেকে তাদের কোনো শংকা নেই। তারা কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। তাদের কথাবার্তা আগে থেকে লুকিয়ে থাকা চার ব্যক্তি শুনতে পাচ্ছে। তারা সম্পূর্ণরূপে লুকিয়ে আছে। সেখান থেকে বেশ দূরে নীচে আমর দরবেশের আস্তানা। সাঝের আঁধারে আস্তানাটি দেখা যাচ্ছে না। শুধু তাঁবুর বাইরে পুঁতে রাখা দুটি প্রদীপের আলো দেখা যাচ্ছে।

খোদার দূত প্রস্তুত হয়ে গেছেন- এ তিন ব্যক্তির একজন হেসে বললো মাল-মসলা বের করে প্রস্তুত রাখো।

আজ আমার কেনো যেনো ভয় লাগছে– অন্য একজন বললো- কোনো অঘটন ঘটে যায় কিনা বলা যাচ্ছে না।

যে লোকটি চোখে সবুজ পট্টি বেঁধে এসেছিলো, তার জন্য আমার কেমন কেমন লাগছে- তৃতীয়জন বললো- কিন্তু যাক গে, ভয় পেয়ে লাত নেই। আমরা তুর পর্বতের জালওয়া দেখিয়ে সকলের সংশয়-সন্দেহ মুছে ফেলবো। সবাই মেনে নিলে একজনের বিরোধিতায় কিছু আসে-যায় না। তোমরা যার যার দায়িত্ব পালন করো। সময় বেশী নেই। অন্ধকার গাছ হয়ে আসছে।

একজন পাত্রের মুখ খুলে তেলের ন্যায় একটা তরল পদার্থ মাটিতে ঢেলে দেয়। জায়গাটা পাথুরে বিধায় এ পদার্থটা চুষে খায়নি। সেখান থেকে সামান্য দূরে সরে গিয়ে একজন ছোট একটি বাতি জ্বালিয়ে বড় বড় পাথরের মাঝে রেখে দেয়, যাতে দূর থেকে সেটি দেখা না যায়। তার আলোতে এই তিনজনকেও দেখা যাচ্ছে।

 এবার ওদিকে প্রদীপের প্রতি দৃষ্টি রাখো- এক ব্যক্তি বললো- যখনই প্রদীপটি উপর-নীচ নড়তে শুরু করবে, তখন বাতিটি তেলের উপর ছুঁড়ে মারবে। জনতা তূর পর্বতের জালওয়া দেখতে পাবে।

এই আয়োজনটা চলছে সেই বৃক্ষটির নীচে, যার ডালে এক ব্যক্তি বসে আছে। নীচে লোক তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। গাছের লোকটি ঝিঁঝির শব্দ করে ওঠে। বড় একটি পাথরের পেছন থেকেও ঝিঁঝির ডাক শোনা গেলো। নীচের তিন ব্যক্তি নিঃশঙ্কচিত্তে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ গাছের উপর থেকে একজন ধপাস করে নীচে দাঁড়ানো লোকগুলোর একজনের উপর পড়ে যায়। এতে সে প্রায় চেপ্টা হয়ে যায়। অপর দুজন ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে এদিক-ওদিক সরে যায়। পরক্ষণেই পাশে লুকিয়ে থাকা আরো তিন ব্যক্তি বেরিয়ে এসে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা খঞ্জর বের করার সুযোগ পেলো না। লোকটি গাছের উপর থেকে যার উপর পড়েছিলো, সে ছিলো খুব শক্তিশালী। ফলে উপর থেকে পড়া লোকটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজেকে রক্ষা করে। আলী বিন সুফিয়ান বলেছিলেন, ওদের জীবিত ধরে আনতে পারলে ভালো হবে। কিন্তু এখন এই লোকটাকে হত্যা না করে উপায় নেই। যে লোকটি তার উপরে পড়েছিলো, সে তার খঞ্জর বের করে শক্তিশালী লোকটির বুকে আঘাত হানে। অপর দুজনকে সঙ্গে করে নিয়ে আসা হ্যান্ডকাপ পরিয়ে নিয়ে আসা হয়।

***

আমর দরবেশের তাঁবুর বাইরে জনতার ভিড়। আলী বিন সুফিয়ানও আছেন তাদের মাঝে। আছে তার মিশরী ফৌজের বেশ কজন কমান্ডে সেনা, যারা এই অঞ্চলে বিভিন্ন বেশ ধারণ করে বিভিন্ন পরিচয়ে অবস্থান করছিলো। দিনের বেলা একত্রিত করে তাদেরকে তাদের মিশন বুঝিয়ে দেয়া হলো। তাদের কয়েকজন ঘোড়ার পিঠে বসা। তাদের কাছে অস্ত্র আছে।

জনতার মাঝে আমর দরবেশের গতিবিধি পর্যবেক্ষণকারী ও তাকে সহায়তাকারী সুদানী গোয়েন্দাও রয়েছে। তারা পাঁচ-ছয়জনের বেশী হবে। আলী বিন সুফিয়ান তাদেরকে চিনে রেখেছেন। তারাও মরা ও মারার প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে। কিন্তু তারা জানে না, তাদের প্রতিপক্ষের লোক সংখ্যা কত।

আশি তার বিশেষ তেলেসমাতী পোশাক পরিধান করে ও সাজগোজ করে বাইরে বেরিয়ে আসে। তারপর কর্তব্য সম্পাদন করে। উভয় প্রদীপের মধ্যখানে ছোট গালিচাটি বিছানো। আমর দরবেশ তাবু থেকে বেরিয়ে এলেন এবং মদ-মাতালের ন্যায় হেঁটে হেঁটে গালিচার উপর এসে উপবেশন করেন। উভয় বাহু প্রসারিত করে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে আকাশপানে তাকিয়ে বিড় বিড় করতে শুরু করলেন। আশি তার সম্মুখে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। তারপর তার সম্মুখে দোজানু হয়ে বসে পড়ে।

হে খোদার মহান দূত, যাকে সম্মান করা আমাদের প্রত্যেকের জন্য ফরজ- আশি বললো- এই বিপুলসংখ্যক লোক তূর পর্বতের সেই জালওয়া দেখতে এসেছে, যা মহান আল্লাহ মূসাকে দেখিয়েছিলেন। আর জিনরাও- যাদের মধ্যে আমিও একজন-ভূরের জালওয়া দেখতে এসেছে।

তাদের কি সন্দেহ আছে, আমি খোদার যে পয়গাম নিয়ে এসেছি, তা সত্য? আমর দরবেশ জিজ্ঞেস করেন।

গোস্তাখী মাফ করবেন হে খোদার দূত!- এক ব্যক্তি বললো- তুর পর্বতের জালওয়া দেখিয়ে আমাদের হৃদয়ের সব সন্দেহ দূর করে দিন।

আলী বিন সুফিয়ান সেই লোকটার প্রতি তাকান। তাকে চিনে রাখেন। আমর দরবেশের দলের লোক।

হা, পবিত্র সত্ত্বা!- আলী বিন সুফিয়ান এগিয়ে এসে বললেন- আমরা সংশয়ে নিপতিত। আমাদেরকে তুর পর্বতের জালওয়া দেখান। আর এই মেয়েটি যদি জিন হয়ে থাকে, তাহলে সে কিছুক্ষণের জন্য অদৃশ্য হয়ে যাক। তাতে আমাদের সব সন্দেহ দূর হয়ে যাবে।

আমর দরবেশ পাহাড়ের প্রতি ইশারা করে বললেন- এদিকে তাকাও। অন্ধকারে তোমরা কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। তিনি মাটি থেকে একটি প্রদীপ হাতে নিয়ে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে উচ্চকণ্ঠে বললেন- মহান খোদা। তোমার সরল ও অজ্ঞ বান্দারা সংশয়ের আঁধারে হাতড়ে ফিরছে। তুমি তাদেরকে সেই জালওয়া দেখাও, যা মূসাকে দেখিয়েছিলে এবং যা দ্বারা ফেরাউনের সিংহাসনকে ভস্ম করে দিয়েছিলে।

আমর দরবেশ প্রদীপটি ডানে-বায়ে নাড়ান। তারপর উপরে তুলে নীচে নামান। কিন্তু পাহাড়ের উপর কোনো জ্যোতি আত্মপ্রকাশ করলো না। তিনি পুনরায় প্রদীপটি উপর-নীচ করে নাড়ান। কিন্তু পাহাড়ে ক্ষুদ্র একটি স্ফুলিঙ্গও চমকালো না।

আমর দরবেশের তিন ব্যক্তির একজন পাহাড়ে মৃত পড়ে আছে। অপর দুজন হ্যান্ডকাপ পরা। তারা এখন আলী বিন সুফিয়ানের লোকদের হাতে বন্দী। ওখানে তারা আমর দরবেশের প্রদীপের নাড়াচাড়া দেখতে পাচ্ছে। একজন বললো- আজ কেউ তূর পর্বতের জালওয়া দেখতে পাবে না। অন্যরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।

আজ তূরের জালওয়া দেখা যাবে না- আলী বিন সুফিয়ান উচ্চকণ্ঠে বললেন। তিনি আমর দরবেশকে উদ্দেশ করে বললেন- আমর দরবেশ! আজ যদি তুমি পাহাড়ের চূড়ায় অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে দেখাতে পারো, তাহলে আমি খোদার বদলে তোমার ইবাদত করবো।

এক ব্যক্তি খঞ্জর বের করে আলী বিন সুফিয়ানের পেছন দিক দিয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে যায়। কেউই দেখতে পেলো না, একজন লোক পেছন দিক দিয়ে তাঁবুতে ঢুকে পড়েছে। তাঁবুর ভেতর থেকে সে আশিকে ডাক দেয়। আশি ভেতরে ঢুকে পড়ে।

এক্ষুণি পালাও- লোকটি আশিকে বললো- আমাদের রহস্য ফাঁস হয়ে গেছে। যে লোকটা বললো আজ তুর পর্বতের জালওয়া দেখা যাবে না, সে এই অঞ্চলের বাসিন্দা নয়। লোকটা মিশর থেকে এসেছে। আমাদের এক সাথী ধরা পড়েছে। এখানকার মুসলমানরা হিংস্র। তারা হয়তো আমর দরবেশকে খুন করে ফেলবে। আমরা পালিয়ে যাচ্ছি। তুমি এদের হাতে পড়ে গেলে তোমার সঙ্গে এরা পশুরন্যায় আচরণ করবে।

আমি যাবো না- আশি মুচকি হেসে বললো- এই হিংস্র ও জংলীদের ব্যাপারে আমার কোনো ভয় নেই।

 তুমি কি পাগল হয়ে গেছে?

আমি পাগল ছিলাম- আশি বললো- এখন আমার মাথা ঠিক হয়েছে। আমি এখন সেখানেই যাবো যেখানে আমর দরবেশ যেতে বলে।

বাইরে আলী বিন সুফিয়ান ও যুবক ইমাম জনতাকে বলছেন- আসো, তোমাদেরকে সেই স্থানে নিয়ে যাবো, যেখান থেকে তূর পর্বতের জালওয়া দেখা যাওয়ার কথা ছিলো। গত রাতে তোমাদেরকে যে জালওয়া দেখানো হয়েছিলো, তার রহস্য দেখাবো।

আলী বিন সুফিয়ানের কমান্ডাররা তিন ব্যক্তিকে এমনভাবে ধরে ফেলে যে- কেউ টেরই পেলো না। পাজরে খঞ্জরের আগা ঠেকিয়ে তাদেরকে অন্ধকারে নিয়ে আটক করে রাখা হয়েছে। আমর দরবেশ এখনো ওখানেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাঁড়িয়ে আছেন।

***

তাঁবুর ভেতর এক সুদানী গুপ্তচর আশিকে বাঁচানোর জন্য তাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। লোকটি এই ভেবে বিস্মিত যে, মেয়েটি যেতে চাচ্ছে না কেন! সে বারংবার বলছে, মুসলমান জংলী ও পশু চরিত্রের মানুষ।

আশি বললো- তুমি মুসলমান, আমিও মুসলমান। আমি আমার স্বজাতিকে ছেড়ে যাবো না।

বাইরে হট্টগোল বেড়ে চলেছে। তাঁবুর ভেতরের লোকটি লম্বা একটি খঞ্জর বের করে আশিকে হত্যা করার হুমকি দিয়ে সঙ্গে যেতে চাপ সৃষ্টি করছে। আশিরও তরবারী আছে। অস্ত্রটা রাখা আছে এমন জায়গায়, যেখান থেকে ঝটপট নিয়ে নেয়া যায়। আমর দরবেশ তাকে প্রতি মুহূর্তে অস্ত্র প্রস্তুত রাখতে বলে রেখেছেন। আশি মুহূর্ত মধ্যে তরবারীটা হাতে নিয়ে বললো আমরা দুজনের একজনও তোমাদের সঙ্গে যাবো না।

একজন পুরুষের জন্য এ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ যে, একটি নারী তাকে হুমকি দিচ্ছে। সে বুঝে ফেলেছে, সমস্যা একটা আছে এবং এই মূল্যবান মেয়েটা তাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় মেয়েটিকে হত্যা করা কিংবা তুলে নিয়ে যাওয়া আবশ্যক। আশি যে তরবারী চালাতে জানে, এ ধারণা সুদানী গুপ্তচরের ছিলো না। অগত্যা সে মেয়েটির উপর খঞ্জরের আঘাত হানে। আশি তরবারী দ্বারা তার আঘাত প্রতিহত করে। সুদানী গোয়েন্দার হাত থেকে খঞ্জরটা ছুটে পড়ে যায়। কিন্তু তাঁবুর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে অস্ত্রটি তার নিকটেই এসে পড়ে। সে খঞ্জরটা তুলে নেয়। আশি তার উপর তরবারী দ্বারা আক্রমণ করে। গোয়েন্দা অভিজ্ঞ তরবারী চালক। আশির আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। আশি বললো- তুমি তরবারী চালনা যার কাছে শিখেছো, তিনি এ বিদ্যায় আমারও ওস্তাদ।

একদিকে সরে গিয়ে সে আশির আরো একটি আক্রমণ প্রতিহত করে এবং নিজেকে সামলে নিতে না নিতেই আশির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তার কব্জি চেপে ধরে বললো- আশি! আমি তোমাকে খুন করবো না। তুমি আত্মসংবরণ করো।

আশি ঝট করে তার নাকে একটা সঝোরে ঘুষি মারে। লোকটি পেছনে ছিটকে পড়লে তরবারীর আঘাতে হাতের খঞ্জরটা তাঁর পুনরায় পড়ে যায়। আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পেছন দিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তাঁবু তাকে ঠেকিয়ে দেয়। এখন আশির তরবারীর আগা সুদানী গোয়েন্দার ধমনীর উপর।

আমি মুসলিম পিতার কন্যা- তরবারীর আগাটা ধমনীর উপর চাপ দিয়ে আশি বললো- বসে পড়ে। হাত পেছনে নিয়ে যাও। আমার শক্তি হলো আমার ঈমান। আমি এখন আর কারো ক্রীড়নক নই।

বাইরের চিত্র নিম্নরূপ–

আলী বিন সুফিয়ান একটি প্রদীপ হাতে তুলে নেন। অপরটি হাতে নেন যুবক ইমাম। চার-পাঁচজন কমান্ডোসেনা আমর দরবেশকে ঘিরে রেখেছে। আসামী হিসেবে বন্দী করা নয়- তাকে নিরাপত্তার জন্য আশ্রয়ে দিয়েছে। আশংকা হলো, যেসব সুদানী গুপ্তচর তাকে চোখে চোখে রেখেছিলো, তারা তাকে হত্যা করে ফেলতে পারে। তবে যতটুকু মনে হচ্ছে, তাদের একজনও মুক্ত নেই। কাজটা আলী বিন সুফিয়ানের পরিকল্পনা মোতাবেক সম্পাদিত হয়েছে।

আমর দরবেশ এক কমান্ডোকে বললেন- তাবুতে একটি মেয়ে আছে। তাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। মেয়েটি মুসলমান।

তাঁবুতে গিয়ে দেখা গেলো সেখানে অন্যরকম এক দৃশ্য বিরাজ করছে। আশি তরবারীর আগায় এক ব্যক্তিকে বসিয়ে রেখেছে। লোকটাকে গ্রেফতার করা হলো। আলী বিন সুফিয়ান আমর দরবেশকে বললেন- আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার লোকেরা ঐ পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে এবং তারাই সেখান থেকে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা প্রতিহত করেছে। ভালো হবে, যদি জনতাকে এখনই সেখানে নিয়ে দেখানো হয় তূর পর্বতের জালওয়া কিভাবে সৃষ্টি করা হয়, তাহলে তারা স্পষ্ট বুঝতে পারবে, তাদেরকে যা দেখানো হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভেল্কিবাজি।

আরো একটি বিষয় আছে, সেদিকে এখনই দৃষ্টি দেয়া আবশ্যক- আমর দরবেশ বললেন- ইসহাককে কয়েদখানা থেকে মুক্ত করতে হবে। এই অঞ্চলে সুদানীদের অনেক গুপ্তচর আছে। তাদের কেউ না কেউ এখানকার পরিস্থিতির আকস্মিক ও অনাকাঙ্খিত পরিবর্তন সম্পর্কে সরকার ও সেনাবাহিনীকে তথ্য দেবে। তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ তারা ইসহাককে কয়েদখানার পাতাল কক্ষে নিক্ষেপ করে নিপীড়ন করে মেরে ফেলবে। আমি সুদানী সালারকে ধোঁকা দিয়ে এসেছি যে, আমি এখানকার মুসলমানদের চিন্তাধারা বদলে দেবো। কয়েদখানায় আমি ইসহাকের সঙ্গে কথা বলেছি এবং তাকে বলে এসেছি, আমি সুদানীদের প্রস্তাব মেনে নিয়ে নিজ এলাকায় গিয়ে দিনকয়েক তাদের মর্জিমাফিক কাজ করবো। আমার ইচ্ছা ছিলো, এখানে এসে আমি লোকদেরকে আমার আসল উদ্দেশ্যের কথা বলে দেবো এবং কায়রোর সঙ্গে যোগাযোগ করে ইসহাককে মুক্ত করে আনার ব্যবস্থা করবো। কিন্তু এখানে এসে আমি বুঝতে পারি যে, বহু সুদানী গুপ্তচর- যারা আমারই অঞ্চলের মানুষ আমার চারদিকে ঘোরাফেরা করছে এবং আমি স্বাধীন নই। তবে ভাগ্য ভালো যে, শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হলো, আমার সঙ্গে দেয়া এই মেয়েটি মুসলমান।

আমর দরবেশ আশির অতীত ইতিবৃত্ত শুনিয়ে বললেন- আমার আশা ছিলো না যে, আমি লক্ষ্য অর্জনে সফল হবো। আমি বেজায় অস্থির হয়ে পড়ি। আমাদের মুসলমান ভাইয়েরা এততাই সরলমনা ও আবেগপ্রবণ যে, তারা আমার বক্তব্য ও ভেল্কিবাজিতে প্রভাবিত হতে শুরু করে। আমি কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমি প্রতিটি মুহূর্ত সুদানী গুপ্তচরদের চোখে চোখে অতিবাহিত করেছি। আল্লাহ আমার নিয়তের কদর করেছেন। আপনাকে প্রেরণ করে তিনি ধ্বংসের হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করেছেন। বাকি কথা পরে হবে। আমি ইসহাককে মুক্ত করতে চাই। আপনি আমাকে দুজন সাহসী ও বিচক্ষণ কমান্ডোসেনা দিন।

আমর দরবেশ আলী বিন সুফিয়ানকে তার পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করেন। আলী বিন সুফিয়ান ভেবে-চিন্তে পরিকল্পনায় কিছু রদবদল করে তাকে বললেন- তুমি দুজন কমান্ডো ও আশিকে নিয়ে এখনই রওনা হয়ে যাও এবং ইসহাককে মুক্ত করে আনো। আমি তোকগুলোকে পাহাড়ে নিয়ে দেখিয়ে আনি, তূর পর্বতের জালওয়ার হাকীকত কী ছিলো।

আমর দরবেশ দুজন কমান্ডো ও আশিকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে রওনা হয়ে যান।

***

তারা তাঁবুর পেছন দিকে দিয়ে চুপিসারে বেরিয়ে যায়। আলী বিন সুফিয়ান তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে আসেন। জনতা চরম বিস্ময় ও হতাশার মধ্যে দলবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে কানাঘুষা করছে। আলী বিন সুফিয়ান উচ্চকণ্ঠে বললেন- আপনারা যদি তূর পর্বতের জালওয়ার হাকীকত দেখতে চান, তাহলে আমার সঙ্গে আসুন। আপনারা জানেন, রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর পর নবুওতের ধারা শেষ হয়ে গেছে। তার পরে আল্লাহ না কাউকে কখনো জালওয়া কিংবা মোজেযা দেখিয়েছেন, না দেখাবেন। ঐ লোকটিকে আপনাদের আকীদা নষ্ট করার জন্য প্রেরণ করা হয়েছিলো। আপনারা ভেবে দেখেননি, লোকটি কেবল একটি কথাই বলতো যে, তোমরা সুদানের ফৌজকে সবসময় এই এলাকা থেকে দূরে রেখেছে। তারা এবার আপনাদের হৃদয় জয় করার জন্য এই অস্ত্রটা ব্যবহার করেছে।

আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মুসলমানগণ! দুশমন যখন এ জাতীয় হীন অস্ত্র হাতে তুলে নেয়, তখন বুঝতে হবে, তারা ময়দানে আপনাদের মুখোমুখি হতে ভয় পায়। আপনারা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই ভূখণ্ড আপনাদের। এখানে ইসলামের শাসন চলছে। কাফেররা আপনাদের অন্তর থেকে জাতীয় ও ধর্মীয় চেতনা নিঃশেষ করার লক্ষ্যে মাঠে নেমেছে। আজ আপনাদেরকে তুর পর্বতের জালওয়া দেখানো হচ্ছে। কাল খৃস্টান মেয়েদের রূপ দেখিয়ে আপনাদের মাঝে নির্লজ্জতা ও অশ্লীলতার জন্ম দেবে। আপনাদেরকে মানুষ থেকে পশুতে পরিণত করবে। তারপর টেরও পাবেন না, আপনারা ইজ্জত, আত্মমর্যাদাবোধ ও জাতীয় চেতনা থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত হয়ে গেছেন। আপনারা কাফিরদের গোলামে পরিণত হয়ে যাবেন। সুদানের রাজা মুসলমান নন- তিনি ইসলামের শত্রু ও খৃস্টানদের বন্ধু। আচ্ছা, আপনাদের মেয়েরা খৃস্টান পুরষদের সঙ্গে মদপান করুক, অপকর্মে লিপ্ত হোক, তা কি আপনারা মেনে নেবেন? আপনারা কি মেনে নেবেন যে, আপনাদের মসজিদগুলো বিরান হয়ে যাক এবং কুরআনের অবমাননা করা হোক?

কাবার প্রভুর শপথ! আমরা এমনটা চাই না- এক ব্যক্তি বললো- ঐ : লোকটাকে আমাদের সামনে নিয়ে আসুন, যে নিজেকে খোদার দূত বলে দাবি করছে। বেটা গেল কোথায়?

না, সে নির্দোষ- আলী বিন সুফিয়ান বললেন- সে আপনাদেরই একজন। এখন সে তার আসল রূপে আপনাদের সম্মুখে আসবে এবং আপনাদের অবহিত করবে, কাফেররা কিভাবে আপনাদের শিকড় কাটছে। এখন আপনারা আমার কথা শুনুন। আপনারা মুসলমান। আল্লাহ আপনাদেরকে সুউচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। আর কাফেররা আপনাদেরকে আল্লাহ প্রদত্ত মর্যাদা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়।

আপনি কে?- এক ব্যক্তি উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করে- আপনার বক্তব্যে পাণ্ডিত্য আছে। আপনি কি বলতে পারেন, আমাদেরকে যা কিছু দেখানো হয়েছিলো, সেগুলো আসলে কি?

সেই রহস্য দেখাচ্ছি- বলেই আলী বিন সুফিয়ান তাঁবুর ভেতর থেকে একটি থালা নিয়ে আসেন, যার মধ্যে তেলের ন্যায় তরল দাহ্য পদার্থ আছে। তিনি তেলগুলো একটি কাপড়ের উপর ঢেলে কাপড়টা মাটিতে রেখে দেন। পরে তাতে পানি ঢেলে দিয়ে প্রদীপটা কাপড়ের সঙ্গে লাগান। সঙ্গে সঙ্গে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। তিনি সকলকে অবহিত করেন, আমর দরবেশ যে কাপড়টিতে পানি ঢেলে আগুন ধরাতো, সেটিতে এই তেল মাখানো থাকতো।

এবার আপনারা সেই লোকগুলোকে দেখুন, যারা তার সঙ্গী ছিলো আলী বিন সুফিয়ান বললেন। তিনি কাউকে আওয়াজ দিয়ে বললেন ওদেরকে জনতার সামনে নিয়ে আসো।

আমর দরবেশের দলের লোকগুলোকে ধরে জনতার ভিড় থেকে কিছু দূরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিলো। আলী বিন সুফিয়ানের কমান্ডোরা তাদেরকে ঘিরে রেখেছে। হঠাৎ হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। ঘোড়ার দৌড়ের আওয়াজ পাওয়া গেলো। এক ব্যক্তি চিৎকার করে বলে উঠলো- একজন পালিয়ে গেছে।

এক গোয়েন্দা পালিয়ে গেছে। অন্যদেরকে জনতার আদালতে হাজির করা হলো। প্রদীপ উঁচু করে সকলকে তাদের চেহারা দেখানো হলো।

এরা মুসলমান- আলী বিন সুফিয়ান বললেন- এই অঞ্চলের বাসিন্দা। এরা ঈমান বিক্রেতা।

আলী বিন সুফিয়ান এদের কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করে বক্তব্য রাখেন।

এদেরকে মেরে ফেলা হোক- জনতার মধ্য থেকে কয়েকজন সমস্বরে বলে উঠলো- পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হোক।

উপস্থিত লোকগুলো তাদের দিকে ছুটে আসার চেষ্টা করে। মশালের আলোতে কতগুলো তরবারীর চমক দেখা গেলো।

থামো- আলী বিন সুফিয়ান মধ্যখানে এসে দাঁড়িয়ে বললেন আল্লাহর আইন নিজেদের হাতে তুলে নিও না। যথাযথ কর্তৃপক্ষ এদের শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। এদেরকে হেফাজতে নিয়ে যাও। আর আপনারা আমার সঙ্গে আসুন।

জনতা আলী বিন সুফিয়ানের পেছনে পেছনে হাঁটতে শুরু করে। তিনি তাদেরকে নিয়ে পাহাড়ের দিকে রওনা হন, যেখানে তার লোকেরা এক ব্যক্তিকে খুন করেছে এবং দুজনকে রশি দ্বারা বেঁধে রেখেছে।

***

আমর দরবেশ, আশি ও দুকমান্ডো বহু পথ এগিয়ে গেছেন। তারা সুদানের রাজধানী অভিমুখে এগিয়ে চলেছেন।

বন্ধুগণ!- আমর দরবেশ চলন্ত ঘোড়র উপর থেকে বললেন আমদেরকে খুব দ্রুত পৌঁছতে হবে। আশি, তুমি যদি ক্লান্ত হয়ে পড়ো, তাহলে আমার পেছনে এসে বসবে। সফর খুব দীর্ঘ এবং সময় খুবই অল্প। আমার ভয় হচ্ছে, কোনো শত্রু গোয়েন্দা আমাদের আগে পৌঁছে যায় কিনা।

একজন সুদানী গোয়েন্দাও রাজধানীর উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছে। সেই গোয়েন্দা, যে আলী বিন সুফিয়ানের হেফাজত থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো। পেছন থেকে ধাওয়া হতে পারে এই ভয়ে সে একটি উপত্যকার পথ ধরে ছুটছে। একসময় উপত্যকা থেকে বেরিয়ে বহু পথ ঘুরে রাজধানীর পথ ধরে। এদিকে আমর দরবেশও বহুদূর চলে গেছেন।

সুদানী গোয়েন্দা কেন্দ্রকে সংবাদ পৌঁছাবে, আমর দরবেশের ভেদ ফাস হয়ে গেছে। রিপোর্টে আমর দরবেশের উপর সন্দেহও ব্যক্ত করবে বলে তার সিদ্ধান্ত। তার উদ্দেশ্য আমর দরবেশকে পুনরায় কয়েদখানায় আবদ্ধ করানো।

অপরদিকে আমর দরবেশের পরিকল্পনা হচ্ছে, তার আগে পৌঁছে গিয়ে সুদানী সালারকে ধোঁকা দেয়া এবং ইসহাককে মুক্ত করে আনা। আশি এই পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত এবং সে সাক্ষী হিসেবে সঙ্গে যাচ্ছে।

প্রদীপের আলোতে জনতা পাহাড়ের উপর আরোহন করছে। আলী বিন সুফিয়ান সকলের সামনে হাঁটছেন। তার লোকেরা পাহাড়ের চূড়ায় দুজন গুপ্তচরকে বেঁধে রেখেছে। তারা দেখতে পাচ্ছে, কয়েকটি প্রদীপ এবং কতগুলো লোক পাহাড়ে আরোহন করছে। তারা বাতি উপরে তুলে ধরে দেখার চেষ্টা করে লোকগুলো কারা এবং তাদের গন্তব্য কোথায়।

আমাদের সঙ্গে চলো- হ্যান্ডকাপ পরিহিত এক ব্যক্তি বললো- যা চাইবে তাই দেবো, আমাদেরকে ছেড়ে দাও।

তোমরা কি সকল মুসলমানকে ঈমান-বিক্রেতা মনে করো?- আলী বিন সুফিয়ান এক কমান্ডোকে বললেন- দুনিয়ার সম্পদ আর জাহান্নামের আগুনের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। তোমরা স্বজাতিকে ধোকা দিয়েছিলে।

তিনি আসছেন- অপর কয়েদী বললো- তিনি আমাদেরকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলবেন। আমাদেরকে অতি নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করতে হবে। বলো, কী দেবো। ছেড়ে দাও, আমরা পাহাড়ের অপরদিক দিয়ে পালিয়ে যাই। হিরা-জহরত দেবো, যতো চাও ততো দেবো।

প্রদীপগুলো যতোটুকু উপরে উঠছে, কয়েদীদের অস্থিরতা ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। একজন বললো- তোমার সঙ্গে তো তরবারী আছে। তা দ্বারা এক আঘাতে আমাদের ঘাড় দ্বিখণ্ডিত করে দাও। আমাদেরকে ঐ লোকগুলো থেকে রক্ষা করো।

আল্লাহর নিকট গুনাহর মাফ চাও।

প্রদীপগুলো তাদের মাথার উপর এসে দাঁড়িয়ে যায়। আলী বিন সুফিয়ান, জনতাকে দূরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। দুজন লোককে রশিতে বাধা দেখে লোকগুলো বিস্মিত হয়ে যায়।

এরাই হলো তূর পর্বতের জালওয়া প্রদর্শনকারী- বলে আলী বিন সুফিয়ান মাটিতে চোখ বুলান। একদিকে বাতিটা ইশারা করে বললেন- এই দেখো, এখানে দাহ্য পদার্থ পড়ে আছে। তার পার্শ্বেই পড়ে আছে একটি থালা। আলী বিন সুফিয়ান বললেন- এই থালায় সেই তেল ছিলো, যা দ্বারা কাপড়ে আগুন ধরানো হতো। এ তেল এখানে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আমি চার ব্যক্তিকে সন্ধ্যায় এখানে লুকিয়ে রেখেছিলাম। আমর দরবেশের প্রদীপের সংকেতে এই বাতি থেকে তেলে আগুন ধরিয়ে দেয়ার কথা ছিলো। এটিই সেই ভূরের জালওয়া, যা তোমরা দেখতে পারেনি। কারণ, আমার লোকেরা আগুন জ্বালানোর আগেই এদেরকে পাকড়াও করে ফেলে।

এরা তিনজন ছিলো- এক ব্যক্তি বললো- তৃতীয়জন আমাদের মোকাবেলা করেছিলো। তার লাশ গাছের গোড়ায় পড়ে আছে।

আলী বিন সুফিয়ান প্রদীপের আগুন তেলের কাছে নিয়ে বললেন- এই দেখেন। অমনি তেলে আগুন জ্বলে ওঠে। আগুনের শিখা উপরে ওঠে পরক্ষণেই ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে শুরু করে। আলী বললেন- এরপর কি সন্দেহের কোনো অবকাশ আছে যে, আপনাদেরকে আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে অগ্নিপূজারী বানানোর চেষ্টা চলছিলো?

আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন- বন্দীদের একজন বললো- আপনি ঠিকই বলেছেন।

তোমরা কি এই অঞ্চলের মুসলমান নও? আলী জিজ্ঞেস করেন।

হা। দুজনই মাথা নাড়ায়।

খৃস্টান ও সুদানী কাফেররা কি তোমাদেরকে এ কাজের প্রশিক্ষণ দেয়নি।

 হ্যাঁ, তারাই দিয়েছে। আমরা কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন।

তোমরা কি স্বজাতিকে ধোকা দেয়া এবং নিজ ধর্মকে ধ্বংস করার জন্য পুরস্কার লাভ করতে না?

হা- একজন জবাব দেয়- এর বিনিময়ে আমরা বড় অংকের পুরস্কার পেতাম।

আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন- একজন বললো- আমরা আমাদের জাতি ও ধর্মের জন্য জীবন বিলিয়ে দেবো।

সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ পেছন থেকে এক তজোদীপ্ত মুসলমান তরবারী দ্বারা এতো তীব্রবেগে আঘাত হানে যে, একসঙ্গে দুজনের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

আমি যদি খুনের অপরাধে অপরাধী হয়ে থাকি, তাহলে আমাকে হত্যা করে ফেলল। আক্রমণকারী লোকটি তরবারীটা জনতার সম্মুখে ছুঁড়ে ফেলে বললো।

আল্লাহর কসম! এই লোকটি খুনী হতে পারে না। যুবক ইমাম বললেন।

এ খুন বৈধ। জনতার মধ্য থেকে সমস্বরে রব ওঠে।

***

রাতের শেষ প্রহরে আমর দরবেশ ঘোড়া থামান। আশি ও কমান্ডোদের বললেন- কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নেই। ঘোড়াগুলোকেও বিশ্রামের সুযোগ দেয়ার প্রয়োজন ছিলো।

রাজধানীগামী গোয়েন্দা আধা রাত চলার পর বিশ্রামরে জন্য এক স্থানে থেমে যায়। তার জানা নেই। আমর দরবেশ আগে আগে যাচ্ছেন। গোয়েন্দা মাটিতে মাথাটা এলিয়ে দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।

রাত পোহাবার পরপরই আমর দরবেশ প্রস্তুত হয়ে পুনরায় রওনা হন। তিনি সৈনিক। কষ্ট সহ্য করতে অভ্যস্ত। আশি প্রাসাদের মেয়ে। তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিলো বটে; কিন্তু তার সময় কাটছিলো বিলাসিতার মধ্যদিয়ে।

 আশি!- আমর দরবেশ ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠ থেকে বললেন- তোমার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তোমার রাত জাগার অভ্যাস নেই। আমাণ ঘোড়ায় পিঠে উঠে বসো।

আশি মুখ টিপে হাসে। কিন্তু চোখ দুটো তার বন্ধু। আমর দরবেশ তাকে পুনরায় বললেন- তোমার ঘোড়াটা ছেড়ে দাও।

আশি মাথা নেড়ে অস্বীকৃতি জানায়। ঘোড়া ছুটে চলছে। আরো কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর এক কমান্ডো আমর দরবেশকে বললেন- মেয়েটি ঝিমুচ্ছে, ঘোড়া থেকে পড়ে যাবে।

আমর দরবেশ নিজের ঘোড়াটা আশির নিকটে নিয়ে তার ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরেন। আশি জেগে যায়। আমর দরবেশ বললেন- নিজের ঘোড়াটা ছেড়ে দিয়ে আমার ঘোড়ায় চলে এসো।

সহায়তা নিতে চাই না- আশি বললো- আমি অন্যকে সহায়তা দিতে, চাই। আমাকে আমার প্রতিজ্ঞা পূরণ করতে হবে। পিতা-মাতার খুন এবং নিজের সম্ভ্রমের প্রতিশোধ নিতে হবে। আমি জেগে থাকার চেষ্টা করছি।

ঘোড়া এগিয়ে চলে। অনেক পথ এগিয়ে যাওয়ার পরও আশির ঘুমের ভাব কাটছে না। আমর দরবেশ তার পাশে পাশেই ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছেন। তিনি দেখে না ফেললে আশি ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়েই যেতো। তিনি ঘোড়া থামিয়ে কোন কিছু না বলে আশিকে নিজের ঘোড়ায় তুলে নেন এবং সম্মুখে বসিয়ে দেন। এক কমান্ডো আশির ঘোড়ার লাগাম নিজের জিনের সঙ্গে বেঁধে নেয়। সবগুলো ঘোড়া একসাথে ছুটে চলছে।

আশি নিজের মাথাটা আমর দরবেশের বুকের উপর ছেড়ে দিয়ে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। মেয়েটির খোলা চুলগুলো আমার দরবেশের মুখের উপর উড়তে থাকে। এমন কোমল আর রেশম-সুন্দর চুলের পরশের সঙ্গে আমর দরবেশ পরিচিত নয়। কিন্তু মেয়েটির কোনকিছুই তার উপর সেই প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি, একজন সুপুরুষ যুবকের উপর করার কথা। আশির পূর্বেকার বলা কথাগুলো তার মনে পড়তে শুরু করে।

তোমার কোলে আমার পিতা-মাতার কোলের আনন্দ অনুভূত হয়েছিলো- আশি কয়েকদিন আগে সেই মরু এলাকায় বসে বলেছিলো আমার তো এ কথাও স্মরণ নেই যে, আমারও বাবা-মা ছিলেন। আপনি আমার অতীতটা আমার চোখের সামনে এনে দিয়েছেন।

আমর দরবেশের মনে হতে লাগলো, যেনো আশি বাতাসের সঙ্গে ফিস ফিস করে কথাগুলো বলছে আর তিনি শুনছেন- আমাকে তোমার বক্ষ ও বাহুর আশ্রয়ে নিয়ে রাখো। আমি মুসলমানের কন্যা। আমাকে খৃস্টানদের হাতে তুলে দিও না। রক্ত… রক্ত…। আমি রক্ত দেখতে পাচ্ছি। এগুলো আমার পিতার রক্ত। এগুলো মায়ের। দুজনের রক্ত একত্রিত হয়ে বাইতুল মোকাদ্দাসের বালিতে শুকিয়ে যাচ্ছে…। আমর দরবেশ! আপনার শিরায় হাশেমের খুন প্রবাহিত হচ্ছে। আপনি সেই খুনের প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষান্ত হবেন না, যা বাইতুল মোকাদ্দাসের বালি চুষে নিয়েছে। ফিলিস্তিনের সম্ভ্রম আপনাকে ডাকছে। প্রথম কেবলাকে হৃদয় থেকে ফেলে দেবেন না হাশেমের পুত্র।

আমর দরবেশ ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে দেন। কমান্ডোদেরও নিজ নিজ ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে দিতে হলো। আশির এলোমেলো চুলগুলো আরো বিক্ষিপ্ত হয়ে বাতাসের তালে তালে আমর দরবেশের মুখের উপর উড়ছে।

আমর দরবেশ- এক কমান্ডো তার ঘোড়াটা আমর দরবেশের পাশে এনে বললো- সামনে কোনো চৌকি থেকে ঘোড়া বদল করে নেয়ার আশা নেই। ঘোড়াগুলোকে এভাবে মেরে ফেলো না। আরো ধীরে চলো।

আমর দরবেশ কমান্ডোর প্রতি দৃষ্টিপাত করে মুচকি হাসেন। তিনি ঘোড়ার গতি কিছুটা হ্রাস করে বললেন- মহান আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। ঘোড়া ক্লান্ত হবে না ইনশাআল্লাহ।

আমর দরবেশের কথা বলার শব্দে আশির ঘুম ভেঙ্গে যায়। হঠাৎ চমকে উঠে খানিকটা ভয়জড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে- আমি কতক্ষণ যাবত ঘুমিয়ে ছিলাম? আমার ঘোড়া কোথায়?

তুমি তো ঘোড়ার পিঠে ঘুমিয়ে পড়েছিলে- আমর দরবেশ বললেন কিন্তু আমার ঘুমন্ত ঈমানের শিরা জেগে উঠেছিলো। ওঠো, নিজের ঘোড়ায় গিয়ে চড়ে বসো। সন্ধ্যা নাগাদ গন্তব্যে পৌঁছে যেতে হবে।

***

আলী বিন সুফিয়ান সেই গ্রামটিতে চলে যান, যাকে মুসলমানরা তাদের আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রভূমি বানিয়ে রেখেছিলো। তিনি তার কমান্ডোসেনা ও গুপ্তচরদের দায়িত্ব প্রদান করেন যে, তোমরা অঞ্চলময় ছড়িয়ে পড়ে আমর দরবেশের ভেল্কিবাজির রহস্য ফাঁস হওয়ার কথা প্রচার করে দাও। তিনি সেখানকার নেতৃবর্গকে বললেন, আপনারা লোকদের প্রস্তুত করুন।

যাই বলি না কেননা, এলাকাটা সুদানের, যেখানে মুসলমানদের স্বাধীনতা বলতে কিছুই নেই। সুদানী ফৌজ প্রয়োজন বোধ করলে হামলা করার অধিকার রাখে। কিন্তু তারপরও মুসলমানরা এলাকায় তাদের বিধি বিধান চালু রেখেছে। তারা যে কজন শত্ৰু গোয়েন্দাকে গ্রেফতার করেছিলো,তাদেরকে নিজেদের তৈরি কয়েদখানায় ফেলে রেখেছে। তাদের শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু এই শাস্তি বিধান সুদানী আইনে অপরাধ। এই আসামীরা যা কিছু করেছে, সবই সুদানের স্বার্থে করেছে। কিন্তু আলী বিন সুফিয়ান ঝুঁকি মাথায় তুলে নেন। তিনি তার কমান্ডোদের ভাগ করে দুটি দল গঠন করে নেন।

কয়েদখানায় ইসহাককে উন্নত একটি কক্ষে রাখা হয়েছে। তাকে অত্যন্ত সম্মানজনকভাবে উন্নত খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। তিনি ভালোভাবেই বুঝেন, তার সঙ্গে এই সদাচারণ কেননা করা হচ্ছে। আমর দরবেশ তাকে তার পরিকল্পনা পুরোপুরি বলে গিয়েছিলো। ইসহাক একাকী বসে সে নিয়েই ভাবছেন। দুটি আশংকা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রথমত, আমর দরবেশ কয়েদখানার নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে সুদানীদের হাতে খেলতে শুরু করলো কিনা। দ্বিতীয়ত, নাকি নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলেন।

ইসহাক নিজের পলায়ন সম্পর্কেও ভাবছেন। কিন্তু কোনো পন্থা তার চোখে পড়ছে না। সুদানীদের জন্য তিনি একজন মূল্যবান কয়েদী, যার ফলে তার জন্য অতিরিক্ত পাহারার ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। আমর দরবেশের চলে যাওয়ার পর থেকে কেউ তাকে বলেনি, তোমার সম্প্রদায়কে সুদানের অফাদার বানিয়ে দাও। যে সুদানী সালার তার পেছনে ছায়ার মতো লাগা ছিলো, সেও এ যাবত একবারের জন্যও তার সামনে আসেনি।

সূর্য ডুবে গেছে। চারটি ঘোড়া সুদানের রাজধানীতে প্রবেশ করে সোজা সেনা হেডকোয়ার্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আমর দরবেশের জানা আছে, তাকে কোথায় যেতে হবে এবং কার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে। চিন্তা চেতনা বিধ্বংসী তৎপরতার প্রশিক্ষণ তিনি এখান থেকেই গ্রহণ করেছিলেন। তিনি রক্ষী বাহিনীর কমান্ডারকে সেই সুদানী সালারের নাম বললেন, যে তাকে এ কাজের জন্য প্রস্তুত করেছিলো। সঙ্গে সঙ্গে তাকে সালারের বাসভবনে পৌঁছিয়ে দেয়া হলো।

ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে নাকি ভালো কোনো সংবাদ নিয়ে এসেছে। আমর দরবেশকে দেখেই সুদানী সালার জিজ্ঞেস করে।

ভালো সংবাদ ওর নিকট থেকে শুনুন- আমর দরবেশ আশির প্রতি ইশারা করে বললেন- আমার বক্তব্যে আপনার বিশ্বাস নাও হতে পারে।

আশি ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত বদনে পালংকের উপর ধপাস করে বসে পড়ে। তার দুঠোঁটের ফাঁকে মিষ্টি হাসি। সে আমর দরবেশকে উদ্দেশ করে বলে বিস্তারিত ঘটনা আপনিই বিবৃত করুন এবং তাড়াতাড়ি করুন। হাতে সময় বেশী নেই।

আমাদের মিশন এতো দ্রুত সফল হয়ে গেলো যে, আমি তার কল্পনাও করিনি। আমর দরবেশ বলেন। তিনি কিভাবে পানিতে আগুন লাগালেন এবং কিভাবে দূর পর্বতের জালওয়া দেখালেন, তার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন।

আর তার কথা বলার ভঙ্গী এতো আকর্ষণীয় ছিলো যে, আমি বিস্মিত হয়ে পড়ি- আমর দরবেশ সম্পর্কে আশি বললো- মানুষ তার ভেল্কিবাজিতে তেমনি প্রভাবিত হয়ে গেছে, যেমনটি হয় তার ভাষায়।

আচ্ছা, আমাদের ওখানকার সাফল্যের সংবাদ নিয়ে কি এখনো কেউ আসেনি? আমর দরবেশ জিজ্ঞেস করেন।

না, কেউ আসেনি- সালার বললো- আমি তো তোমাদের চিন্তায় অস্থির ছিলাম।

শুনে আমর দরবেশ নিশ্চিত হন যে, এখনো কোনো গুপ্তচর এসে পৌঁছেনি। যে সুদানী গোয়েন্দা মুসলমানদের বন্দীদশা থেকে পালিয়ে এসেছিলো, এখনো সে এসে পৌঁছেনি। তার গতি আমর দরবেশের গতি অপেক্ষা শ্লথ। তার এসে পৌঁছতে রাত পার হয়ে যাবে। আমর দরবেশের যা করার উক্ত গোয়েন্দা পৌঁছানোর আগেই শেষ করতে হবে। সে এসে পৌঁছলেই ঘটনা ফাঁস হয়ে যাবে। আমর দরবেশ তাড়াতাড়ি কার্যসিদ্ধি করে বের হতে না পারলে তাকে আবারও ভয়ংকর পরিণতি বরণ করতে হবে।

এবার কাজের কথা বলি- আমর দরবেশ বললেন- আমাদের ইসহাককে প্রয়োজন। আমি অর্ধেকেরও বেশী মুসলমানের চিন্তা-চেতনাকে ধোলাই করে ফেলেছি। তাদেরকে আমি সুদানের অফাদার হতে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছি। তাদের অন্তরে আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে দিয়েছি। আমি প্রমাণ করে দিয়েছি, সালাহুদ্দীন আইউবী ফেরাউনদের উত্তরসূরী। এখন যদি তাদেরকে তাদের কোনো নেতা বলে দেন যে, তোমাদেরকে সুদানের আনুগত্য করতে হবে, তাহলে উক্ত অঞ্চলের সব মানুষই আপনাদের হয়ে যাবে। আমি তথ্য পেয়েছি এবং আগে থেকে নিজেও জানি, এই জননেতা ইসহাক ছাড়া আর কেউ নয়। সেখানকার মুসলমানরা তাকে পীর-পয়গম্বর বলে মান্য করে।

কিন্তু ইসহাককে রাজি করাবে কে- সুদানী সালার বললেন- আমি তাকে এই ভূখণ্ডের ক্ষমতার লোভ দেখিয়েছি। এমন এমন নিপীড়ন করেছি, যা একটি ঘোড়াও সহ্য করতে পারে না। আশি পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে।

এবার আমাকে চেষ্টা করে দেখার সুযোগ করে দিন- আমর দরবেশ বললেন- কয়েদখানা থেকে বের করে তাকে সেই কক্ষে পাঠিয়ে দিন, যেখানে তাকে একবার রেখেছিলেন এবং আমাকেও রেখেছিলেন। আপনি তার দুশমন, আমি বন্ধু- সহকর্মী। আমার কথা তাকে ভাবিয়ে তুলবে পারে।

আচ্ছা, তা না করে আশিকে দিয়ে আরেকবার চেষ্টা করে দেখবো নাকি? সুদানী সালার জিজ্ঞেস করে।

না- আমর দরবেশ বললেন- আমি তার উপর আমার ভাষার জাদু প্রয়োগ করবো। এখনই যদি আপনি তাকে উক্ত কক্ষে পাঠিয়ে দেন, তাহলে আশা করি ভোর পর্যন্ত আমি তাকে জালে আটকে ফেলতে পারবো। আমার হাতে সময় বেশি নেই। উক্ত এলাকা থেকে আমার অনুপস্থিতি দীর্ঘ না হওয়া উচিত। আপনি তো জানেন, সেখানে মিশরী গোয়েন্দাও আছে। আমি যে জাদু প্রয়োগ করে এসেছি, আমার অনুপস্থিতিতে মিশরী গোয়েন্দারা তা ব্যর্থ করে দিতে পারে।

সুদানী সালার আমর দরবেশকে তার সঙ্গের কমান্ডো দুজন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আমর বললেন, এরা আমার রক্ষী ও ভক্ত। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে আমার সঙ্গে এসেছে।

***

ইসহাককে একটি মনোরম ও সুদক্ষ কক্ষে নিয়ে আসা হলো। তাকে নিয়ে আসার জন্য সালার নিজে কয়েদখানায় যায়। গিয়ে তাকে বললো- তোমার জাতীয় চেতনা ও ঈমানী শক্তিতে আমি মুগ্ধ হয়ে পড়েছি। তোমার এক বন্ধু আমর দরবেশ তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছে। আমি চাই, একটি ভালো পরিবেশে তোমাদের সাক্ষাৎ পর্ব অনুষ্ঠিত হোক।

কয়েদখানা অপেক্ষা অধিক নোংরা ও কষ্টদায়ক কিংবা তোমার প্রাসাদ অপেক্ষা হৃদয়গ্রাহী ও মনোরম পরিবেশ কোনটিই আমাকে আমার আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না- ইসহাক বললেন- আমাকে অন্ধকার পাতাল কক্ষে নিক্ষেপ করো কিংবা বালাখানায় নিয়ে যাও, কোন অবস্থাতেই আমি আমার ঈমান বিক্রি করবো না।

সুদানী সালার হেসে পড়ে এবং ইসহাককে সেই কক্ষে নিয়ে যায়, যেখানে আমর দরবেশ তার অপেক্ষায় বসে আছেন। সালার নিজেও কক্ষে অবস্থান নেয়।

তোমার চেহারা বলছে, তুমি এই কাফেরদের নিকট নিজের ঈমানটা বিক্রি করে ফেলেছে- ইসহাক আমর দরবেশকে উদ্দেশ্য করে বললেন তোমার চেহারার রওনক আর চোখের চমক বলছে, তুমি দীর্ঘদিন যাবত কয়েদখানার বাইরে ঘুরে বেড়িয়েছে। আমার সঙ্গে সাক্ষাতে তোমার উদ্দেশ্য কি?

আমি তোমার চেহারায়ও এই রওনক আর চোখে সেই চমক দেখতে চাই, যা তুমি আমার চেহারা ও চোখে দেখতে পাচ্ছো- আমর দরবেশ বললেন আমাকে একটু সময় দাও। ক্ষণিকের জন্য তোমার হৃদয় ও মস্তিষ্কটা আমাকে দিয়ে দাও। ধৈর্যের সাথে ও শান্তমনে আমার কথা শোনো।

সুদানী সালার পার্শ্বে দণ্ডায়মান। সে ঝুঁকি মাথায় নিতে চাচ্ছে না। ইসহাক তার অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ কয়েদী। আমর দরবেশও তার কয়েদী ছিলো। এটা আমর দরবেশের প্রতারণাও হতে পারে। এই দুজন লোককে সে এমন একটি কক্ষে একাকী ছেড়ে যেতে চাচ্ছে না, যেটি কয়েদখানার নিরাপদ কক্ষ নয়। পাহারার জন্য সে চারজন প্রহরী নিযুক্ত করে দিয়েছে। দুজন কক্ষের সামনে আর দুজন পেছনের দরজায়। বর্শা ও তরবারী ছাড়া তাদের কাছে তীর-ধনুকও আছে, যাতে কেউ পালাবার চেষ্টা করলেও সফল হতে না পারে। আমর দরবেশ চাচ্ছেন, সালার এখান থেকে চলে যাক। কিন্তু লোকটা এক পা-ও নড়ছে না। তার উপস্থিতিতে আমর দরবেশ ইসহাককে বলতে পারেন না তার পরিকল্পনা কী।

সুদানী সালার আশিকে খাওয়া-দাওয়ার জন্য এ ভবনেরই অন্য এক কক্ষে পাঠিয়ে দিয়েছে। সালারকে এই কক্ষ থেকে সরিয়ে নেয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিলো। কিন্তু আপাতত তার এদিকে আসবার সম্ভাবনা নেই।

যে সুদানী গুপ্তচর পরিস্থিতি জানানোর জন্য ছুটে আসছে, এখন আর সে শহর থেকে বেশী দূরে নয়। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। আমর দরবেশের দুকমান্ডো সঙ্গী এই ভবনেরই বারান্দায় তার সংকেতের অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর আশি বেরিয়ে আসে। পোশাক পরিবর্তন করে এসেছে আশি। রূপ যেনো ঠিকরে পড়ছে তার। সফরের ক্লান্তিও মুখ থেকে ধুয়ে-মুছে পরিস্কার হয়ে গেছে। সে কমান্ডোদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে যায়।

সালার চলে গেছেন? আশি কমান্ডোদের জিজ্ঞেস করে।

না- এক কমান্ডো জবাব দেয়- তিনি ভেতরে আছেন।

তার চলে যাওয়া দরকার। বলেই আশি কক্ষের দিকে এগিয়ে যায়।

আশিকে কক্ষে প্রবেশ করতে দেখে আমর দরবশের মনে আশার সঞ্চার হয়। সুদানী সালার তার প্রতি তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দেয়। সেই হাসি, যে হাসি আশির মতো মেয়েদের প্রতি চোখ পড়লে তার মতো পুরুষদের ওষ্ঠাধর গলে বেরিয়ে আসে।

আশি দুলতে দুলতে বিশেষ এক ভঙ্গিমায় সালারের পেছনে চলে যায়। আমর দরবেশের প্রতি গভীর দৃষ্টিতে তাকায় সে। আমর দরবেশ সুযোগ পেয়ে যান। তিনি আশিকে ইশারা করলেন, সালারকে এখান থেকে সরিয়ে ফেলে।

ইসহাক ভাই!- আমর দরবেশ জিজ্ঞেস করে আমরা কি সুদানের সন্তান নই?

আমরা সর্বাগ্রে ইসলামের সৈনিক- ইসহাক জবাব দেন- আর আমি এখনও মিশরী কমান্ডার ও সুলতান আইউবীর অফাদার। মিশরের ভূখণ্ড যদি আমার মা হয়ে থাকে, তাহলে আমি আমার জননীকে ইসলামের শত্রুর হাতে তুলে দিতে পারি না। আমর দরবেশ! আমি তোমার ন্যায় ইসলামের মর্যাদা ও নিজের ঈমান বিক্রি করতে পারবো না।

আশি পেছন থেকে সুদানী সালারের কাঁধে নিজের উভয় বাহু রেখে মুখটা তার কানের সঙ্গে লাগিয়ে বললো- দিন কয়েকের মধ্যেই আপনার হৃদয়টা মরে গেছে।

সুদানী সালার মোড় ঘুরিয়ে তাকালে আশির গাল ও বিক্ষিপ্ত চুলগুলো তার গণ্ডদেশ ছুঁয়ে যায়। আশির মুখে মুচকি হাসি। বললো- আমি এতো ঝুঁকিপূর্ণ ও ভয়ংকর মিশন থেকে ফিরে আসলাম, আগামীকাল আবার পাহাড়-জঙ্গলে চলে যেতে হবে, যেখানে পানি ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। মদের ঘ্রাণটাও কি আমি ভুলে যাবো?

উহ!- সুদানী সালার চমকে উঠে বললেন- আমি তো গল্প শোনায় ব্যস্ত হয়ে তোমার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আচ্ছা, আমি ব্যবস্থা করছি। তুমি ঐ কক্ষে চলে যাও।

নাহ- আশি বললো- একা একা মজা হবে না। আপনিও চলুন। এখানে কোনো সমস্যা নেই। দুদিকে সান্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। প্রয়োজন হলে পরে আবার আসবেন।

আশি এই বিদ্যায় ওস্তাদ। শৈশব থেকে অদ্যাবধি প্রশিক্ষণই পেয়ে আসছে। এবার সেই বিদ্যা নিজের বস ও গুরুদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে শুরু করেছে। সুদানী সালার তার হাসির ফাঁদে আটকা পড়েছে। লোকটি সবকিছু ভুলে গিয়ে আশির সঙ্গে কক্ষপানে পা বাড়ায়। বাইরে বের হয়ে সে এক কর্মচারীকে মদ আনতে বলে নিজে আশির সঙ্গে কক্ষের দিকে চলে যায়। আশি তাকে তার বাহু বেষ্টনীতে নিয়ে নেয়। অল্পক্ষণের মধ্যেই বৃদ্ধ সালারের উপর যুবতী মেয়েটির জাদু ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।

ইতিমধ্যে মদ এসে গেছে। আশি সালারকে পেয়ালার পর পেয়ালা গেলাতে শুরু করে।

***

নিয়ত স্বচ্ছ হলে আল্লাহও সাহায্য করেন- আমর দরবেশ ইসহাককে বললেন- আমার পরিকল্পনা পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়েছে। বিস্তারিত কথা শহর থেকে বের হয়ে শোনাবো। দুজন কমান্ডো সঙ্গে এনেছি। দু সান্ত্রী এদিকে দাঁড়িয়ে আছে আর দুজন ওদিকে। আমরা যেদিক দিয়ে বের হবো, সেদিককার সান্ত্রীদের খতম করলেই চলবে। আমাদের চারটি ঘোড়া প্রস্তুত আছে। চারটি প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সান্ত্রীদের, যাতে আমরা পালিয়ে গেলে ধাওয়া করতে পারে। আমাদের ওখানে মিশর থেকে কিছু লোক এসেছেন। একজনকে খুবই বিচক্ষণ মনে হচ্ছে। তিনি নিজের নাম বলেননি। কায়রোতে ওখানকার খবরাখবর পৌঁছে গেছে। সালারকে মেয়েটি নিয়ে গেছে। আমি একটু বাইরের অবস্থাটা দেখে আসি। মেয়েটিকেও সঙ্গে নিতে হবে।

কেন?- ইসহাক জিজ্ঞেস করেন- এই বেশ্যাটার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক

এখান থেকে বের হয়ে বলবো- আমর দরবেশ বললেন- মেয়েটি মুসলমান।

আমর দরবেশ কক্ষ থেকে বের হন। সান্ত্রীরা তাকে সুদানী সালারের সঙ্গে এ কক্ষে আসতে দেখেছিলো। সে কারণে তারা তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। তিনি তার কমান্ডোদের নিকট গিয়ে বললেন, সান্ত্রীদের সামলানোর সময় এসে গেছে। তারপর সালারের কক্ষের দরজাটা খানিক ফাঁক করে তাকান। সালার মদের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে মুদিত চোখে মাতাল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে- কে? আশি বললো- আমি দেখছি। বলেই উঁকি দিয়ে মুখ ফিরিয়ে বললো- বাতাস। মেয়েটি সালারকে ঠেস দিয়ে পালংকের উপর শুইয়ে দেয়। সালার বাহু এগিয়ে দিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো- তুমিও আসো। নেশা আরো বাড়িয়ে দাও।

আশি কিছুই না বলে বিড়ালের ন্যায় পা টিপে টিপে শব্দ ছাড়া দরজা খুলে কক্ষ থেকে বের হয়ে বাইরে থেকে আলতোভাবে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। আমর দরবেশ ও আশি কমান্ডো দুজনকে সঙ্গে নিয়ে ইসহাকের কক্ষের দিকে যান।

ইতিমধ্যে সুদানী গোয়েন্দা শহরে ঢুকে পড়েছে। গন্তব্য তার গোয়েন্দা হেডকোয়ার্টার।

আমর দরবেশ দরজার বাইরে দাঁড়ানো সান্ত্রীদের বললেন- ভেতরে চলো, কয়েদীকে কয়েদখানায় নিয়ে যাও। সালার নির্দেশ দিয়েছেন, হাত বেঁধে নিতে হবে।

উভয় সান্ত্রী একসঙ্গে কক্ষে প্রবেশ করে। সঙ্গে সঙ্গে কক্ষের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। দুকমান্ডো একসঙ্গে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে দুসান্ত্রীর ঘাড় দুকমান্ডোর বাহুতে আটকে যায়। কমান্ডোদের খঞ্জর পূর্ব থেকেই বের করা আছে। তারা সান্ত্রীদের হৃদপিণ্ডে আঘাত হানে। সান্ত্রীদ্বয় সাথে সাথেই নিস্তব্ধ হয়ে যায়।

সুদানী গোয়েন্দা গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। সে এক নায়েব সালারকে রিপোর্ট দিচ্ছে।

আমর দরবেশ ইসহাককে বললেন- বেরিয়ে পড়ুন। বাইরে আটটি ঘোড়া দণ্ডায়মান। চারটি আমর দরবেশের, চারটি সুদানী সান্ত্রীদের। অপর দিকের সান্ত্রীরা টেরই পেলো না, ভেতরে কী ঘটছে। আমর দরবেশ ইসহাককে নিয়ে বেরিয়ে যান।

সুদানী সালারের ভবন ত্যাগ করে তারা ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে। গোটা শহর গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। পলায়নকারীরা তৎক্ষণাৎ ঘোড়া হাঁকালো না। আশিও আছে তাদের সঙ্গে। সুদানী সালারের রিপোর্ট শুনে নায়েব সালার তাকে সালারের নিকট নিয়ে যায়। এদিকে আসতে পথে তারা পাঁচটি ঘোড়া যেতে দেখে। পরস্পর কাছাকাছি দিয়েই অতিক্রম করে। কিন্তু অন্ধকারে কেউ কাউকে চিনতে পারেনি।

নায়েব সালার সালারের বাসভবনের সেই বারান্দাটায় এসে এদিক-ওদিক তাকায়, যেখানে একটু আগে দুজন সান্ত্রী দাঁড়িয়ে ছিলো। কক্ষের দরজা খুলে সে উক্ত সান্ত্রীদের লাশ পড়ে থাকতে দেখে। ভেতরে গিয়ে পেছনের দরজাটাও খুলে। ওদিকে দুজন সান্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। দৌড়-ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। এক কক্ষে সালার মাতাল অবস্থায় পড়ে থেকে আশিকে ডাকছে। নায়েব সালার তাকে ডেকে তোলে। আশি তাকে পেটপুরে খাইয়ে গেছে। তাকে জানানো হলো, দুজন সান্ত্রী কক্ষে মৃত পড়ে আছে। এবার তার সম্বিৎ ফিরে পায়। তার কথা বলার ও কথা বুঝার মতো অবস্থা ফিরে আসে যখন, ততোক্ষণে আমর দরবেশ, ইসহাক, দুমিশরী কমান্ডো ও আশি চলে গেছে বহুদূর। ধাওয়া করা বৃথা।

পরদিন মধ্যরাত আমর দরবেশ কাফেলাসহ পার্বত্য অঞ্চলে গিয়ে। পৌঁছেন। আলী বিন সুফিয়ান তার অপেক্ষায় অস্থিরচিত্তে প্রহর গুণছিলেন। এ মুহূর্তে ইসহাক ও আমর দরবেশকে মিশর পাঠিয়ে দেয়া আবশ্যক। কিন্তু তার আগে এ-ও প্রয়োজন যে, তারা অত্র এলাকায় ঘুরেফিরে মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন, যাতে মানুষ সুদানীদের যে ভেল্কিবাজি দেখেছিলো, তার হাকীকত পুরোপুরি জানতে পারে। তবে তৎক্ষণাৎ কিছু লোককে নিযুক্ত করা হলো, যাতে সুদানীরা হামলা করলে যথাসময়ে সংবাদ পাওয়া যায়। দ্বিতীয় প্রয়োজনটি হলো, মিশরী ফৌজের আরো কিছু কমান্ডো সেনাকে এই অঞ্চলে নিয়ে আসা, যাতে সুদানীরা আক্রমণ করলে তারা পেছন দিক থেকে গেরিলা হামলা চালাতে পারে এবং সুদানী ফৌজকে অত্র অঞ্চল থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে।

এভাবে আমর দরবেশ, আলী বিন সুফিয়ান ও তাঁর কমান্ডো সেনারা শত্রুবাহিনী ও জনগণের দৃষ্টির আড়ালে থেকে একটি যুদ্ধ জয় করে ফেলে। এটি ছিলো ব্যক্তিগত লড়াই, যা ঈমান ও জাতীয় চেতনার শক্তিতে লড়া হয়েছিলো। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী এই গোপন যুদ্ধ সম্পর্কে সব সময় সজাগ থাকতেন। তাঁর ইন্টেলিজেন্স ব্যবস্থা অত্যন্ত দক্ষ ছিলো।

যে সময়টায় সুদানী মুসলমানগণ এই যুদ্ধে জয়লাভ করে, ঠিক তখন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী মুসলিম শাসক গোমস্তগীন, সাইফুদ্দীন ও আল-মালিকুস সালিহর সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করে তাদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে তিনি আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও ছোট ছোট দুর্গ দখল করে নেন। তিনি হাতের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন, যেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ও আল-মালিকুস সালিহর বাহিনীর হেডকোয়ার্টার। সুলতান আইউবী এই শহরটিকে অবরুদ্ধ করার পর অবরোধ তুলে নিয়েছিলেন। সেখানকার মুসলিম অধিবাসীরা এতো কঠিন হাতে তার মোকাবেলা করে যে, সুলতান আইউবী হাঁফিয়ে ওঠেন।

তিন তিনটি মুসলিম বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে সুলতান আইউবী তাদেরকে এমনভাবে পিছু হটিয়ে দেন যে, তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। সুলতান তাদের পশ্চাদ্ধাবন অব্যাহত রাখেন। তাঁর অধিকতর দৃষ্টি হাবের বাহিনীর উপর নিবদ্ধ। কেননা, তারা বীর যোদ্ধা। তারা পিছপা হয়ে হাবের দিকে ফিরে যাচ্ছে। সুলতান আইউবী তাদেরকে পথেই ধ্বংস করে দিতে চাইলেন। কেননা, তাঁর সৈন্যদেরকে হাল্ব বাহিনীর পেছনে ধাওয়া করতে বলেননি, বরং তিনি তার বিদ্যুাতিসম্পন্ন বাহিনীটিকে অন্য পথে রওনা করিয়ে কিছু কমান্ডো সেনাকে শত্রু বাহিনীর দুপার্শ্বে পাঠিয়ে দেন।

হালবের বাহিনী ছিন্নভিন্নভাবে হাবের দিকে ছুটে চলেছে। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর তার কমান্ডাররা দেখতে পেলো, সুলতান আইউবীর সৈন্যরা হাবের পথ অবরুদ্ধ করে রেখেছে। হাসানের বাহিনী থেকে গেলো। তার সৈন্যদের যুদ্ধ করার মতো মনোবল নেই। তাদের সরঞ্জামও এখন অনেক কম। রসদও অপর্যাপ্ত। এরা থেকে গেলে সুলতান আইউবীর কমান্ডোরা গেরিলা আক্রমণ চালাতে শুরু করে। আইউবীর কমান্ডাররা ঘোষণা দেয়- হাবের সৈন্যরা! তোমরা অস্ত্র ত্যাগ করো।

সুলতান আইউবী রণাঙ্গন থেকে অনেক পেছনে। তিনি সংবাদ পাচ্ছেন, হাবের সৈন্যরা অস্ত্র সমর্পণ করার পর্যায়ে এসে যাচ্ছে। তিনি বললেন–এই বাহিনীটি যদি খৃস্টানদের হতো, তাহলে আমি তার একজন সৈন্যকেও জীবিত ফিরে যেতে দিতাম না। কিন্তু এটা যে আমার ভাইদেরই বাহিনী। তারা অস্ত্র ত্যাগ করলে আমি তাদেরকে ক্ষমা করে দেবো। কিন্তু তারপরও আমি আনন্দ পাবো না। মৃত্যুর পর আমার আত্মা এই ভেবে কষ্ট পাবে যে, আমার শাসনামলে মুসলমানদের তরবারী নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছিলো। আমার এই ভাইয়েরা যদি এখনো বন্ধু-শত্রু চিনতে সক্ষম হয়, তাহলে এই লজ্জাজনক ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হতে পারে।

আল্লাহ সুলতান আইউবীর দুআ কবুল করেন। পরদিন-ই তার প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়। তিনি দেখতে পান, দুজন অশ্বারোহী তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। একজনের হাতে সাদা পতাকা। তাদের ডানে-বাঁয়ে সুলতান আইউবীর ফৌজের দুজন কমান্ডার। নিকটে এসে ঘোড়া দুটি থেমে যায়। এক কমান্ডার ঘোড়া থেকে নেমে এসে সালাম করে বললো হাবের শাসক আস-সালিহ সন্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। এই দূত দুজন যুদ্ধবিরতি ও সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।

এক দূত বার্তাটি সুলতান আইউবীর হাতে দেয়। সুলতান বার্তাটি পাঠ করে বললেন- আস-সালিহকে বলবে, সালাহুদ্দীন আইউবী যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে যখন পয়গাম পাঠিয়েছিলেন, তখন তুমি ফেরাউনের ন্যায় দূতকে অপমান করে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলে। আজ আল্লাহ আমাকে বিজয় আর তোমাকে শোচনীয় পরাজয় দান করেছেন। এখন আমার এতোটুকু শক্তি আছে যে, আমি তোমার বাহিনীকে এমনভাবে পিষে মারতে পারি, যেমনি দুপাথরের মাঝে গম পেষণ করা হয়। কিন্তু তারপরও আমি মনে করি, আমার শত্রু তোমরা নও। তুমি সেই পিতার সন্তান, যিনি খৃস্টানদেরকে আজীবন তটস্থ রেখেছিলেন। অথচ তুমি কিনা খৃস্টানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে পিতার ফৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছে। শোন দূত! তাকে বলবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। দুআ করো, আল্লাহও যেন তোমাদের মাফ করে দেন।

সুলতান আইউবী কয়েকটি শর্তের ভিত্তিতে আস-সালিহর প্রস্তাব মঞ্জুর করে নেন। তিনি এই শর্তে আস-সালিহর ফৌজকে হাব ফিরিয়ে নেয়ার অনুমতি প্রদান করেন- যখন আমার ফৌজ হাব আসবে, তখন তোমার ফৌজ আমার ফৌজের মোকাবেলা করতে পারবে না।

এ সময় আরো একটি মজার ঘটনা ঘটে। আল-মালিকুস সলিহ তার বাহিনী নিয়ে বেরিয়ে যায়। সাইফুদ্দীনও পিছপা হয়ে মসুল চলে গিয়েছিলো। আর গোমস্তগীন নিজ দুর্গ হাররানের পরিবর্তে হাবের অভিমুখে রওনা হয়। সুলতান তার বাহিনীকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যান। তুকমান নামক স্থানে তিনি অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করেন। একদিন হাবের এক দূত তার নিকট এসে আল-মালিকুস সালিহরর একটি পয়গাম তার হাতে দেন। সুলতান পত্রখানা খুলে পাঠ করে চমকে ওঠেন। কারণ, এ পয়গাম তার প্রতি নয়- সাইফুদ্দীনের প্রতি লেখা। আল মালিকুস সালিহ সাইফুদ্দীন লিখেছেন

আপনার পত্র পেয়েছি। আমি সালাহুদ্দীনের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেছি বলে আপনি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আপনি যা জেনেছেন, ঠিকই জেনেছেন। কারণ, তাছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলো না। আমার ফৌজ তাঁর ফৌজের ঘেরাওয়ে পড়ে গিয়েছিলো। আমার সৈনিকরা ছিলো পরিশ্রান্ত, সন্ত্রস্ত ও আহত। এমতাবস্থায় আমার সালারগণ পরামর্শ দেয়, আপনি সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে প্রতারণামূলক সন্ধি করে ফেলুন এবং আপনার ফৌজকে এই বন-বাদার থেকে বের করে নিন। আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর এই শর্ত মেনে নিয়েছি যে, তার ফৌজ হা আগমন করলে আমার ফৌজ তাদের প্রতিরোধ করবে না। কিন্তু তিনি যখন আসবেন, তাঁকে অবশ্যই এমন প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হবে, যা তার কল্পনার অতীত। আপনি আপনার বাহিনীকে নতুনভাবে প্রস্তুত করে নিন। আমাদেরকে সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে এবং তার সকল শক্তি নিঃশেষ করে দিতে হবে।

পত্রে আরো অনেক কিছু লেখা ছিলো। ঐতিহাসিকগণ একমত যে, আল মালিকুস সালিহ সত্যিই সুলতান আইউবীকে ধোঁকা দিয়েছিলো এবং সে বিষয়ে সাইফুদ্দীনের পত্রের জবাবে যে বার্তা প্রেরণ করেছিলো, সেটি ভুলক্রমে সুলতান আইউবীর হাতে পৌঁছে ছিলো। দুজন ইতিহাসবিদ লিখেছেন, পত্ৰখানা খামে ভরে সীলমোহর করার পর ভুলে তার গায়ে সুলতান আইউবীর নাম লেখা হয়েছিলো। কয়েকজন মুসলিম ঐতিহাসিক যাদের মধ্যে সিরাজুদ্দীন অন্যতম। লিখছেন, সুলতান আইউবীর গোয়েন্দা ব্যবস্থা এতোই শক্তিশালী ছিলো যে, আল-মালিকুস সালিহর দূত মূলত তাঁরই গোয়েন্দা ছিলো। ফলে সে আল-মালিকুস সালিহর এই গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি সুলতান আইউবীর হাতে পৌঁছিয়ে দেয়। কাজী বাহাউদ্দীন সাদ্দাদ তাঁর রোজনামচায় লিখেছেন- এই পত্রটি সুলতান আইউবীকে এতো বিচলিত করে তোলে যে, কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত তিনি কারো সঙ্গে কথা বলেননি। এসময় তিনি তাঁবুতে একাকী পড়ে ছিলেন। তাতে তিনি আনন্দিতও হয়েছেন যে, দুশমনের পরিকল্পনা তিনি জেনে ফেলেছেন। তিনি নির্দেশ দেন, আল-হামারা, দিয়ার ও বকর থেকে এক্ষুণি সেনাভর্তি শুরু করে দাও। সুলতান আইউবী তার মুসলিম ভাইদের বিরুদ্ধে আরেকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *