৫.২ দৃষ্টির আড়ালে

দৃষ্টির আড়ালে

সুলতান সালাউদ্দীন আইউবীর এক সালার আহার পরবর্তী আসরে কোনো এক যুদ্ধের আলোচনা করছিলেন। এক সৈনিকের বীরত্বের আলোচনা উঠলো। সুলতান আইউবী বললেন

কিন্তু ইতিহাসে নাম আসবে শুধু আপনার আর আমার। এটা ইতিহাস রচয়িতাদের চরম অবিচার যে, তারা সুলতান আর সালারের নীচের আর কারো প্রতি চোখ তুলে তাকায় না। জয়-পরাজয় আল্লাহর হাতে বটে; কিন্তু সাধারণ সৈনিকদের আত্মত্যাগ ছাড়া জয় সূচিত হয় না। আমাদের জানবাজ সৈনিকরা দুশমনের কাছে গিয়ে যদি তাদের আপন হয়ে যায়, তাহলে আমরা তাদের কী করতে পারবো? যুদ্ধের সময় সৈনিকরা লড়াই করার পরিবর্তে যদি নিজের জীবনের চিন্তা বেশী করে, তাহলে আমরা কিভাবে বিজয় অর্জন করবো? ইনসাফের দাবি হলো, ইতিহাসে আমাদের সেই সৈনিকদের কথাও উল্লেখ থাকতে হবে, যারা এক একজন দশ দশজন শত্রুসেনার মোকাবেলা করে বিজয় ছিনিয়ে আনছে এবং জাতীয় পতাকা অবনমিত হতে দিচ্ছে না। এই সৈনিকরা যদি কখনো পরাজিত হয়, হবে আপনার-আমার অযোগ্যতার কারণে। কিংবা তাদেরকে সেই গাদ্দার ও ঈমান নিলামকারীরা পরাজয়ের মুখে ঠেলে দেবে, যারা আপন সেজে শত্রুর হয়ে কাজ করছে।

আচ্ছা, আল্লাহ আমাদেরকে কোন্ পাপের শাস্তি প্রদান করছেন যে, তিনি আমাদের মাঝে গাদ্দার সৃষ্টি করে দিচ্ছেন? আসরের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো।

আমি আলিম নই যে, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো- সুলতান আইউবী বললেন- তবে সম্ভবত আল্লাহ গাদ্দারের মাধ্যমে আমাদের সদা শংকিত করে রাখতে চাচ্ছেন, যাতে আমরা প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকি এবং একের পর এক বিজয় অর্জন করে প্রবঞ্চিত না হয়ে পড়ি। তবে আল্লাহর প্রকৃত ইচ্ছা কি, তা তিনিই জানেন। আমার ভয় হচ্ছে, ঈমান-বিক্রেতারা কোন না কোন কালে ইসলামের মর্যাদাকে ডুবিয়ে ছাড়বে। খৃস্টানদের প্রত্যয় আপনার অজানা নয় যে, তাদের যুদ্ধ আপনার-আমার বিরুদ্ধে নয়- ইসলামের বিরুদ্ধে। তাদের ঘোষণা হলো, যতোদিন পর্যন্ত ক্রুশের অস্তিত্ব থাকবে, তারা চাঁদ-তারার বিরুদ্ধে সক্রিয় থাকবে। এই প্রত্যয় তারা অনাগত প্রজন্মের জন্যও রেখে যাবে। আমি চাই, আমাদের সেই সাধারণ সৈনিকদের জীবনী ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকুক, যারা উত্তর মিশরের মরু প্রান্তরে, হামাতের বরফ-টাকা উপত্যকায় লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। আমি চাই, সেই জানবাজ গেরিলাদের কথাও ইতিহাসে লিখে রাখা হোক, যারা দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে বিজয় কেড়ে এনেছে, যা সমগ্র বাহিনীর পক্ষে সম্ভব ছিলো না। এদের কজন জীবন নিয়ে ফিরে আসে? দশজনের মধ্য থেকে একজন। তাও আসে আহত হয়ে।

হ্যাঁ, মোহতারাম সুলতান!- সালার বললেন- এ এক মূল্যবান সম্পদ, যা আমরা ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য রেখে যাব। বীরত্বের কাহিনী পাঠ করে জাতিসমূহ বেঁচে থাকে।

তুমি সম্ভবত জানো না, আমাদের সৈনিকরা দেশ থেকে অনেক দূরে জাতির দৃষ্টির আড়ালে এমন যুদ্ধ লড়ে যাচ্ছে, যার নির্দেশ আমরা তাদেরকে দেইনি। সুলতান আইউবী বললেন- তাদের উপর তাদের ধর্মের মর্যাদাবোধ জাগ্রত থাকে। তাদের নিজেদের জীবন বলতে কিছু থাকে না। তাদের কোনো ব্যক্তিসত্ত্বা নেই। তারা দুশমনের কজায় পড়েও স্বাধীন থাকে। জাতি যখন বিজয় অর্জন করে, তখন তারা তাদের সম্পর্কে অবহিত থাকে। তারা পর্দার আড়ালে থেকে বিস্ময়কর ও অভিনব পদ্ধতিতে লড়াই করে জাতির নাম উজ্জ্বল করে থাকে।

সে যুগের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপিতে এরূপ জনাকয়েক সৈনিকের উল্লেখ পাওয়া যায়, যাদের আলোচনা সুলতান আইউবী করেছিলেন। তাদের একজনের নাম আমর দরবেশ। লোকটি সুদানী মুসলমান। উপরে উল্লেখিত হয়েছে যে, সুলতান আইউবীর ভাই তকিউদ্দীন সুদানের সেনা অভিযান প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু তারা দুশমনের প্রতারণার শিকার হয়ে সুদানের মরু অঞ্চলে এতো দূরে চলে গিয়েছিলো যে, সে পর্যন্ত রসদের সরবরাহ বজায় রাখা সম্ভব ছিলো না। দুশমন তাদের রসদের পথ বন্ধ করে দেয় এবং তকিউদ্দীনের বাহিনীকে বিক্ষিপ্ত করে তাদের কেন্দ্রীয় কমান্ড থেকে বিচ্ছন্ন করে দিয়েছিলো। তাতে ইসলামী বাহিনীর অনেক ক্ষতি সাধিত হয়েছিলো। অগ্রযাত্রার আশা তো শেষ হয়েই গিয়েছিলো। এমনকি পিছপা হওয়াও সম্ভব ছিলো না। বহু সৈন্য বন্দীত্ব বরণ করে। তাদের মধ্যে তকিউদ্দীনের দু তিনজন নায়েব, সালার এবং কমান্ডার ছিলেন।

এই বন্দীদের মধ্যে মিশরী এবং বাগদাদীদের সংখ্যা ছিলো বেশী। কয়েকজন সুদানী মুসলমানও ছিলো। শেষে সুলতান আইউবী তার সামরিক দক্ষতা এবং অস্বাভাবিক বিচক্ষণতার বিনিময়ে তকিউদ্দীনের বিক্ষিপ্ত সৈন্যদেরকে সুদান থেকে বের করে এনেছিলেন। তারপর তিনি এই বার্তাসহ সুদানীদের নিকট দূত প্রেরণ করেন যে, আমার যুদ্ধ বন্দীদের মুক্তি দিয়ে দাও। সুদানীরা আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। কারণ, সুলতান আইউবীর নিকট তাদের কোনো বন্দী ছিলো না। তারা বন্দীদের বিনিময়ে মিশরের কিছু ভূখণ্ড দাবি করে। সুলতান আইউবী জবাব দেন- তোমরা আমাকে ও আমার সন্তানদের ফাঁসি দিয়ে দাও। তবু আমি সালতানাতে ইসলামিয়ার এক ইঞ্চি ভূমি তোমাদেরকে দেবো না। আমার সৈনিকরা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মুসলমান। তারা জাতির ইজ্জতের জন্য জীবন কুরবান করতে জানে।

তারপর সুদান সরকার হাবশীদের দ্বারা মিশর আক্রমণ করায়। এই আক্রমণ অভিযানে অংশগ্রহণকারী একজন হাবশীও সুদান ফিরে যেতে পারেনি। যারা জীবিত ছিলো, তাদেরকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। আশা ছিলো, সুদানীরা বন্দীদের মুক্তির দাবি জানাবে। কিন্তু তারা কোনো দূত প্রেরণ করেনি। এই হাবশীদেরকে তারা ধোকা দিয়ে মিশর এনেছিলো। এরা তাদের নিয়মিত সৈনিক ছিলো না। সুলতান আইউবী এই হাবশী কয়েদীদেরকে তার সেনাবাহিনীর শ্রমিক বানিয়ে নেন। তাদের দ্বারা মাটি খনন, বোঝা বহন এবং এ জাতীয় অন্যান্য কাজ নেয়া হতো।

 সুদানীরা সুলতান আইউবীর সৈন্যদেরকে মুক্তি না দেয়ার মূল কারণ ছিলো, তারা তাদেরকে সুদানী ফৌজে যোগ দেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করছিলো। সুদানীদের নিকট খৃস্টান উপদেষ্টা ছিলো। তারাই তাদেরকে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করছিলো। মিশরী সৈন্যদেরকে ফুসলিয়ে সুদানী বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করে নেয়ার পরিকল্পনাও তাদেরই শেখানো ছিলো। তারা কতজন মিশরী সৈনিককে এভাবে দলে ভেড়াতে সক্ষম হয়েছিলো, ইতিহাস তার সংখ্যা জানাতে অপারগ। ভরে সুদানীদের প্রতি ভালোবাসার অস্ত্র যাকেই ঘায়েল করতে ব্যর্থ হয়েছিলো, তাকেই অত্যন্ত নির্দয় ও নির্মম নির্যাতন-নিপীড়নের মাধ্যমে হত্যা করেছিলো, সে তথ্য প্রমাণিত।

এই কয়েদীদের মধ্যে ইসহাক নামক এক সেনা কর্মকর্তা ছিলেন, যিনি সুলতান আইউবীর কোন এক সেনা ইউনিটের কমান্ডার ছিলেন। তিনি ছিলেন সূদনের অধিবাসী। যৌবনেই মিশরী বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। সুদানের এক পাহাড়ী এলাকায় কিছু মুসলমানের বাস ছিলো। যাদের সংখ্যা চার থেকে পাঁচ হাজারের মধ্যে। তাদের বিভিন্ন গোত্র ছিলো। কিন্তু ইসলাম তাদের মাঝে ঐক্য সৃষ্টি করে রেখেছিলো। সবকটি গোত্রের কমান্ডারদের একটি পঞ্চায়েত ছিলো। সকল গোত্রের সব মানুষ এই পঞ্চায়েতের আইন ও সিদ্ধান্ত মেনে চলতো। তারা মিশরী ফৌজে ভর্তি হতো এবং সুদানী ফৌজকে এড়িয়ে চলতো। তারা ছিলো যোদ্ধা এবং সাহসী। তীরন্দাজীতে অভিজ্ঞ ছিলো তারা। সুদানী ফৌজ ও সরকার প্রলোভন দেখিয়ে এবং আক্রমণ করে নিঃশেষ করে দেয়ার হুমকি দিয়েও তাদেরকে ঘায়েল করতে পারেনি। কিন্তু ঈমানী শক্তির পাশাপাশি তাদের একটি সহায়ক শক্তি ছিলো পাহাড়। সুদানীরা তাদের উপর। দুবার আক্রমণ করেছিলো। কিন্তু তীরন্দাজরা পাহাড়ের চূড়া থেকে তীর বর্ষণ করে তাদেরকে প্রতিহত ও পরাজিত করে।  

তকিউদ্দীনের সামরিক পদস্খলনের কারণে সুদানীদের হাতে বহুসংখ্যক মিশরী সৈন্য বন্দী হয়েছিলো। ইসহাক তাদের একজন। নিজ গোত্রসমূহের উপর তার ব্যাপক প্রভাব ছিলো। বন্দী হওয়ার পর সুদানীরা তাকে প্রস্তাব করে, তুমি তোমার মুসলিম গোত্রগুলোকে সুদানী ফৌজে যোগ দিতে সম্মত করো, তাহলে তোমাকে শুধু মুক্তিই দেয়া হবে না বরং যে পাহাড়ী অঞ্চলগুলোর অধিবাসীরা মুসলমান, সেই সবগুলো অঞ্চল নিয়ে একটি আলাদা রাজ্য গঠন করে তোমাকে তার গভর্নর বা রাজা নিযুক্ত করা হবে।

আমি আগে থেকেই সেই রাজ্যের রাজা- ইসহাক জবাব দেন- এটি আমাদের স্বাধীন রাজ্য।

ওটা সুদানের ভূখণ্ড- তাকে বলা হলো- একদিন সেখানকার লোকদেরকে বন্দী করে ফেলবো কিংবা ধ্বংস করে দেবো।

 আগে তোমরা এলাকাটা দখল করো- ইসহাক বললেন- সেখানকার মুসলমানদেরকে নিরস্ত্র করো। তোমরা তাদেরকে তোমাদের ফৌজে শামিল করতে পারবে না। ঐ এলাকায় তোমাদের পতাকা নিয়ে দেখাও। তারপর দেখো, তারা তোমাদের ফৌজে শামিল হয় কিনা।

ইসহাককে কয়েদখানায় রাখার পরিবর্তে একটি সুরম্য কক্ষে রাখা হলো, যেটি কোনো এক রাজপুত্রের মহল বলে মনে হলো। এক সুদানী সালার তাকে উক্ত কক্ষে প্রবেশ করিয়ে নিজের তরবারীটা উভয় হাতে নিয়ে হাঁটু গেড়ে তার সমুখে বসে তরবারীটা তার সমীপে পেশ করে বললো- আপনি আমাদের বন্দী নন, অতিথি।

আমি এই তরবারী গ্রহণ করবো না- ইসহাক বললেন- আমি অতিথি নই, বন্দী। আমি পরাজিত। আপনার থেকে আমি তরবারী সেভাবেই নেবো, যেভাবে আপনি আমার থেকে নিয়েছেন। তরবারী তরবারীর জোরে নেয়া হয়।

কিন্তু আপনি আমাদের শত্রু নন। সুদানী সালার বললো।

আমি আপনার শত্রু- ইসহাক মুচকি হেসে বললেন- তরবারীর বিনিময় এমন সুরম্য কক্ষে নয়- যুদ্ধের ময়দানে হয়ে থাকে। আমি আপনার কৃতজ্ঞতা আদায় করছি যে, আপনি আমাকে এতোটুকু সম্মান করলেন।

আমরা আপনাকে আরো বেশী সম্মান করবো- সালার বললো- আপনার সিংহাসন খার্তুমের সিংহাসনের সমপর্যায়ের হবে।

আর কিয়ামতের দিন আমার মসনদ থাকবে জাহান্নামের অতল তলে। ইসহাক বললেন।

আমি দুনিয়ার কথা বলছি।

কিন্তু মুসলমান, কথা বলে আখেরাতের- ইসহাক বললেন- যা হোক, বলুন আপনার পর আর কে আসবেন এবং কী উপহার নিয়ে আসবেন?

যে আসে আসুক- সালার মুচকি হেসে বললো- আমিও সৈনিক আপনিও সৈনিক। আমি আপনার সৈনিক সুলভ কীর্তির মূল্যায়ন করতে এসেছিলাম। কিন্তু আপনি আমার মনটা ভেঙ্গে দিলেন।

আপনি আমার সৈনিক সুলভ কীর্তি দেখলেন কখন?- ইসহাক বললেন আমি তো যুদ্ধ করার সুযোগই পেলাম না। আমার সেনাদল মরুভূমির এমন, একটি স্থানে গিয়ে উপনীত হয়, যেখানে পানির কোনো চিহ্ন ছিলো না। তিন চার দিনেই মরুভূমি আমার পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈনিক এবং ঘোড়াগুলোকে হাড়িতে পরিণত করে ফেলে। তারা জিহ্বা বের করে পানির অনুসন্ধান করতে শুরু করে। এই অবস্থায় আপনার একটি বাহিনী আমাদের উপর হামলা করে বসে এবং আমরা ধরা পড়ে যাই। মরুভূমি আমাদেরকে পরাজিত করেছে। আপনি আমার তরবারীর পরাকাষ্ঠা কোথায় দেখলেন যে, আমাকে কৃতিত্বের পুরস্কার প্রদান করছেন?

আমাকে অবহিত করা হয়েছে, আপনি বীরযোদ্ধা। সালার বললো। শোনা কথায় বিশ্বাস করতে নেই- ইসহাক বললেন- কাল সকালে আমাকে একটি তরবারী দেবেন। আপনিও একটি নেবেন। তারপর আপনার আমার মোকাবেলা হবে। তখন আশা করি, আমি আপনার তরবারী গ্রহণ করে নেব। কিন্তু সে সময়ে আপনি জীবিত থাকবেন না।

সালার আরো কি যেন বলতে ইচ্ছা করলো। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে ইসহাক বললেন- মন দিয়ে শোনো, সম্মানিত সালার! কাল তোমরা আমাকে যে কয়েদখানায় নিক্ষেপ করবে আজই তা করে ফেলো। তোমার এই সুদর্শন কয়েদখানায় মাতাল হয়ে আমি ঈমান বিক্রি করবো না।

কয়েকখানার নোংরা পরিবেশের পরিবর্তে আপনি এই হৃদয়কাড়া পরিবেশেই ভালোভাবে চিন্তা করতে পারবেন- সালার বললো- আমি আশা করি; আপনার সম্মুখে যে প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে, আপনি তা ভেবে দেখবেন। একজন সৈনিক ভাই মনে করে আমার এই পরামর্শটা মেনে নিন যে, নিজের ভবিষ্যণ্টা অন্ধকার করবেন না। খোদা আপনার ভাগ্যে রাজত্ব লিখে রেখেছেন। সুযোগটা নষ্ট করবেন না।

আমার আল্লাহ আমার ভাগ্যে যা কিছু লিখে রেখেছেন, আমি তা ভালোভাবে জানি- ইসহাক বললেন- আর তোমার খোদা কী লিখে রেখেছেন, তাও জানি। তুমি চলে যাও, আমাকে ভাবতে দাও।

সালার চলে যায়। কিছুক্ষণ পর খাবার এসে হাজির হয়। খাবার নিয়ে এসেছে তিনটি মেয়ে- অতিশয় রূপসী যুবতী মেয়ে, অর্ধনগ্ন। নানা রকম উন্নতমানের খাবার, যা ইসহাক কখনো স্বপ্নেও দেখেনি। সঙ্গে সুদর্শন সোরাহীতে মদ। ইসহাক তার প্রয়োজন অনুপাতে আহার করে পানি পান করে। দস্তরখান তুলে নেয়া হয়। দুটি মেয়ে চলে যায়। একটি তার কাছে থেকে যায়। ইসহাক মেয়েটির প্রতি তাকায়। মেয়েটি অবজ্ঞা মিশ্রিত মুচকি একটা হাসি দেয়।

আমাকে কি আপনার ভালো লাগছে না? মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।

  তোমার ন্যায় কুৎসিত মেয়ে আমি এই প্রথম দেখলাম। ইসহাক বললেন।

মেয়েটির চেহারার রং বদলে যায়। সে তো অত্যন্ত রূপসী মেয়ে। ইসহাক তার বিস্ময় ভাব বুঝতে পেরে বললেন- রূপ থাকে লাজে। নারী যদি উলঙ্গ হয়ে যায়, তাহলে তার আকর্ষণ শেষ হয়ে যায়। উলঙ্গপনা তোমার জাদুময়তা নষ্ট করে দিয়েছে। আমি এখন আর তোমার মুঠোয় যাবো না।

আমাকে দেখেও কি আপনি আমার প্রয়োজন অনুভব করছেন না। মেয়েটি বললো।

আমার দেহের তোমার কোনো প্রয়োজন নেই- ইসহাক বললো- আমার আত্মার একটি প্রয়োজন আছে, যা তুমি পূরণ করতে পারবে না। তুমি চলে যাও।

আমার প্রতি নির্দেশ, আমি আপনার কাছে থাকবো- যুবতী বললো ব্যত্যয় করলে শাস্তিস্বরূপ আমাকে হাবশীদের হাতে তুলে দেয়া হবে।

দেখো মেয়ে- ইসহাক বললেন- আমি মুসলমান। আমার চিন্তাধারা ও চরিত্র তোমার চেয়ে ভিন্ন। আমার ধর্ম আমাকে বেগানা মেয়েকে সঙ্গে রাখার অনুমতি দেয় না। আমি তোমাকে আমার এই কক্ষে রাখতে পারি না। যদি তুমি এই কক্ষে রাত কাটানোর আদেশ নিয়ে এসে থাকো, তাহলে তুমি থাকো, আমি বাইরে গিয়ে ঘুমাই।

আমার জন্য এটাও অপরাধ বলে বিবেচিত হবে- মেয়েটি বললো আপনি আমাকে এই কক্ষে থাকতে দিন। আমার প্রতি দয়া করুন। মেয়েটি বুঝে ফেললো, লোকটি পাথর। তাই সে ইসহাকের নিকট অনুনয়-বিনয় করতে শুরু করলো।

তোমার কাজ কী?- ইসহাক জিজ্ঞেস করেন- তোমাকে আমার কাছে কী উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছে? যদি বলো, থাকতে দেবো।

আমার কাজ হলো আপনার ন্যায় পুরুষদেরকে মোমে পরিণত করা- মেয়েটি জবাব দেয়- আপনিই প্রথম পুরুষ, যিনি আমাকে প্রত্যাখ্যান করলেন। আমি বহু ধর্মীয় কর্ণধারকে আমার অনুরক্ত বানিয়েছি এবং তাদেরকে সুদানের ছাঁচে ঢেলে নিজের মতো করে প্রস্তুত করেছি। মেয়েটি জিজ্ঞেস করে- আচ্ছা, সত্যিই কি আপনি আমাকে কুৎসিত ভেবেছেন, নাকি ঠাট্টা করলেন?

তোমরা যাকে সুগন্ধি বলো, আমার কাছে তা দুর্গন্ধ- ইসহাক বললেন আমার দৃষ্টিতে তুমি বাস্তবিকই কুৎসিত। যা হোক, তুমি যেখানে ইচ্ছা শুয়ে পড়ো। আচ্ছা, তুমি খাটে শোও, আমি মেঝেতে শোবো।

মেয়েটি মেঝেতে শুয়ে পড়ে।

তোমার নাম কী মেয়ে? ইসহাক জিজ্ঞেস করেন।

আশি।

 তোমার ধর্ম?

আমার কোনো ধর্ম নেই।

তোমার পিতামাতা কোথায় থাকেন?

জানি না।

ইসহাকের চোখে ঘুম এসে যায়। অল্পক্ষণ পরই তিনি নাক ডাকতে শুরু করেন।

***

আপনারা এমন এক ব্যক্তির পেছনে সময় নষ্ট করছেন- আশি বললো। তার সম্মুখে সুদানী ফৌজের পদস্থ অফিসারগণ উপবিষ্ট- তার মধ্যে চেতনা বলতে কোনো বস্তু নেই। আমি কত কঠিন পাথরকে মোমে পরিণত করেছি, আপনারা তা জানেন। কিন্তু এর মতো মানুষ আমি আর দেখিনি।

বোধ হয় তুমি কোনো ত্রুটি করেছে। এক অফিসার বললো।

ইসহাককে জালে আটকবার জন্য যা যা করেছে, যতো সব ফাঁদ-ফন্দি অবলম্বন করেছে, মেয়েটি তার সবিস্তার বিবরণ প্রদান করে এবং জানায় আমি যতো যা কিছু করেছি, তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়ে আমার প্রতি নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকেন এবং কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়েন।

সুদানী কর্মকর্তাগণ চার-পাঁচদিন পর্যন্ত ইসহাককে তাদের মতে আনার চেষ্টা চালাতে থাকে। তার মানসিকতা পরিবর্তনের কোনো পন্থাই তারা বাদ রাখেনি। কিন্তু ইসহাকের একটাই কথা- আমি মিশরী ফৌজের একটি ইউনিটের কমান্ডার, আমি মুসলমান, আমি একজন বন্দী।

অবশেষে তাকে মহল থেকে বের করে কয়েদখানায় নিয়ে একটি সংকীর্ণ প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ করে রাখা হলো। কক্ষের ছিদ্রযুক্ত দরজা তালাবদ্ধ করে রাখা হলো। কক্ষটি এতোই দুর্গন্ধময় যে, ইসহাকের মস্তিষ্ক বিগড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।

রাতের বেলা। কক্ষটি অন্ধকার। এক সৈনিক একটি বাতি নিয়ে এসে দরজার ছিদ্র দিয়ে ইসহাকের হাতে দেয়। ইসহাক বাতিটি মেঝেতে রেখে দেয়। বাতির আলোতে তিনি কক্ষে পচা-গলা লাশ দেখতে পায়। লাশটির মুখ খোলা। চোখও খোলা। ইসহাক সৈনিককে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করে, এটি কার লাশ?

তোমার কোনো এক বন্ধুর- সৈনিক জবাব দেয়- কোনো এক মিশরী। যুদ্ধে ধরা পড়েছিলো। লোকটাকে অনেক নির্যাতন করে খুন করা হয়েছে। পাঁচ-ছয় দিন আগে এই কক্ষে মারা গেছে।

তা লাশটা এখানে পড়ে আছে কেন? ইসহাক জিজ্ঞেস করেন।

তোমার জন্য- সৈনিক অবজ্ঞার সুরে বললো- তাকে তুলে নেয়া হলে তুমি একা হয়ে যাবে তাই। সৈনিক অট্টহাসি হেসে চলে যায়।

ইসহাক বাতিটা উপরে তুলে লাশটা পরখ করতে থাকে। পোশাক দেখে বুঝে ফেলেন লোকটা মিশরী ফৌজের সদস্য।

ইসহাক কক্ষে প্রবেশ করার পর যে দুর্গন্ধ অনুভব করেছিলেন, তা উবে যায়। তিনি গলিত লাশটির মুখমণ্ডলে হাত বুলিয়ে বললেন- তোমার দেহ নিঃশেষ হয়ে যাবে। তোমার আত্মা সতেজ থাকবে। তুমি আল্লাহর পথে জীবন দিয়েছো। তুমি আমার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। তুমি জীবিত আছে এবং জীবিত থাকবে! সৈনিক ঠিকই বলেছে যে, তুমি না থাকলে আমি নিঃসঙ্গ হতাম।

ইসহাক দীর্ঘক্ষণ সঙ্গীর লাশের সঙ্গে কথা বলেন। তারপর তার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। ভোরে ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে তিনি দেখতে পান, সেই সুদানী সালার দাঁড়িয়ে আছে। সৈনিক বললো- কিছুর প্রয়োজন হলে বলুন, এনে দেই।

আমি তোমার উদ্দেশ্য বুঝি-ইসহাক বললেন- আমি পরাজিত। তুমি আমাকে তিরস্কার করতে পারো। তবে সত্যিই যদি তুমি আমার প্রয়োজন পূরণ করতে আগ্রহী হয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই রণাঙ্গন থেকে তোমরা মিশরের পতাকা কুড়িয়ে পেয়ে থাকবে। আমাকে একটি পতাকা এনে দাও, লাশটা ঢেকে রাখি।

সালার অট্টহাসি হেসে বললো- আমরা কি তোমাদের পতাকা বুকে জড়িয়ে। রেখেছি? মিশরের কোনো পতাকায় হাত লাগানোকেও আমরা অপমানবোধ করি। সে সিপাহীকে বললো- একে এখান থেকে বের করে নীচে নিয়ে যাও। লাশ এখানে পড়ে থাকুক।

ইসহাককে কয়েকখানার পাতাল কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। এখানে অসহনীয় উকট দুর্গন্ধ। ইসহাক বুঝে ফেললেন, এখানেও লাশ আছে, অনেকগুলো লাশ। সুদানী সালার আগে আগে হাঁটছে। এক স্থানে ছয়-সাতজন মিশরী উল্টো মুখো ঝুলে আছে। তাদের বাহুর সঙ্গে পাথর বাঁধা। এক ধারে এক ব্যক্তিকে বড় একটি ক্রুশের সঙ্গে এমনভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে যে, তার দুহাতের তালুতে একটি করে পেরেক গাঁথা। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে।

এখানে আটক শত্রুসেনাদের কিরূপ নির্যাতন-নিপীড়ন করা হচ্ছে, এই পাতাল কক্ষে ঘুরিয়ে ইসহাককে তার দৃশ্য দেখানো হলো। স্থানে স্থানে রক্ত। কোনো কোনো বন্দী বমি করছে। কয়েকজন অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। নির্যাতনের সব ধরন প্রদর্শন করিয়ে সুদানী সালার ইসহাককে জিজ্ঞেস করে এবার বলো কোন্ পন্থাটি তোমার পছন্দ হয়। তবে নির্যাতন-নিপীড়ন ছাড়াই যদি তুমি আমাদের কথা মেনে নাও, তাহলে তোমারই জন্য তা কল্যাণকর হবে।

তোমাদের যেমন খুশী আমার উপর নিপীড়ন চালাও। আমাকে যেখানে খুশী নিয়ে যাও। আমি জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবো না। ইসহাক বললেন।

তোমাকে দিয়ে আমরা কী করাতে চাই, আমি পুনরায় তোমাকে বলে দিচ্ছি- সালার বললো- তোমাকে বলা হয়েছিলো, সবকটি মুসলিম কবিলাকে সুদানী বাহিনীতে নিয়ে আসো। বিনিময়ে তোমাকে মুক্তি দেয়া হবে এবং মুসলিম গোত্রসমূহের শাসকও নিযুক্ত করা হবে। কিন্তু সেই সুযোগ তুমি হারিয়ে ফেলেছে। এবার প্রস্তাব হলো, আমাদের মতে চলে আসো, বিনিময়ে তোমাকে নিপীড়ন থেকে রেহাই দেয়া হবে এবং সুদানী ফৌজের সম্মানজনক একটি পদ দেয়া হবে।

আমার কোন পদের প্রয়োজন নেই। তোমরা আমার সঙ্গে যেমন খুশী আচরণ করো। ইসহাক বললেন।

ইসহাকের নিপীড়নের পালা শুরু হলো। পায়ে শিকল পরিয়ে পা দুটো ছাদের সঙ্গে বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হলো। সালার সিপাহীদের বললো- একে সন্ধ্যা পর্যন্ত এভাবে থাকতে দিও। সন্ধ্যার সময় লাশের কক্ষে ফেলে এসো। আশা করি, এতটুকুতে লোকটার মস্তিষ্ক পরিষ্কার হয়ে যাবে।

***

সন্ধ্যা নাগাদ ইসহাক সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। যখন জ্ঞান ফিরে পান, তখন তিনি মিশরী সহকর্মীর লাশের নিকট পড়ে আছেন। কক্ষের এক কোণে সামান্য পানি আর কিছু খাবার রাখা ছিলো। ইসহাক পানিটুকু পান করেন এবং খাবার খান। তিনি লাশটিকে উদ্দেশ করে বললেন- আমি তোমার আত্মার সঙ্গে প্রতারণা করবো না। শীঘ্রই আমি তোমার নিকট চলে আসছি।

কথা বলতে বলতে ইসহাকের চোখ বুজে আসছে। ইসহাক ঘুমিয়ে পড়েন।

মধ্যরাতে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে চাকার সঙ্গে বাঁধা হলো। সুদানী সালার উপস্থিত। সে বললো- হাজার হাজার মুসলমান আমাদের সঙ্গে আছে। তুমি বোধ হয় পাগল হয়ে গেছো। তুমি ইসলামের জন্য ত্যাগ দিচ্ছে; অথচ সালাহুদ্দীন আইউবী নিজের রাজত্ব বিস্তারের জন্য তোমার ন্যায় পাগলদেরকে মৃত্যুর হাতে তুলে দিচ্ছে। লোকটা মদও পান করে, নারীও ভোগ করে। আর তোমরা কিনা তার নামে জীবন উৎসর্গ করছে।

সেনাপতি মহোদয়!–ইসহাক বললেন তোমাকে আমার ধর্ম ও সুলতানের বিরুদ্ধে মিথ্যা বলা থেকে বিরত রাখার সাধ্য আমার নেই। আর তুমিও আমাকে আমার ধর্ম ও রাজ্যের জন্য জান কুরবান দেয়া থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারবে না। আমার জাতির কোনো গোত্রের একজন মুসলমানও তোমার ফৌজে যোগ দেবে না। মুসলমান মুসলমানের বিরুদ্ধে তরবারী উত্তোলন করে না।

তুমি সম্ভবত জানো না আরবে মুসলমান মুসলমানের রক্ত ঝরাচ্ছে- সালার বললো- খৃস্টানরা ফিলিস্তিনে বসে বসে তামাশা দেখছে। সকল আমীর ও মুসলিম শাসকগণ সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে।

তারা হয়ত করেছে- ইসহাক বললেন- কিন্তু আমি করবো না। যারা ইসলাম ও ইসলামী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, তারা এ জগতেও ভুগবে, পরজগতেও ভুগবে। তুমি তোমার সময় নষ্ট করো না। আমার সঙ্গে যা কিছু করতে চাও করে ফেলে। তারপর আরেকজন সুদানী মুসলমানকে ধরে আনো। তার দ্বারা তোমার কাজ হতে পারে।

আমরা জানতে পেরেছি, তুমি শুধু একটা ইশারা করলেই সমস্ত মুসলমান আমাদের সঙ্গে চলে আসবে- সালার বলল- আমরা তোমার দ্বারা এ কাজ বিনামূল্যে করাতে চাই না। আমরা তোমার ভাগ্য বদলে দেবো।

আমি শেষবারের মতো বলছি, আমি আমার জাতিকে বিক্রি করবো না। ইসহাক বললেন।

ইসহাক চাক্কির সঙ্গে বাঁধা। লম্বা যে খুঁটিটা ধাক্কা দিলে চাক্কি নড়তে শুরু করে, তিন-চারজন হাবশী তার সন্নিকটে দণ্ডায়মান। সুদানী সালারের ইঙ্গিত। পেয়ে তারা খুঁটিটা ধাক্কা দিয়ে একপা সম্মুখে সরিয়ে দেয়। চাক্কি ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে। ইসহাকের দেহটা একবার উপরে একবার নীচে উঠানামা করতে থাকে। তার বাহুদ্বয় কাঁধ থেকে আর পদদ্বয় হাঁটু থেকে ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। শরীর থেকে তার এমন ধারায় ঘাম ঝরতে শুরু করে, যেনো কেউ উপর থেকে পানি ঢেলে দিয়েছে।

এবার ভেবে-চিন্তে জবাব দাও। ইসহাকের কানে সুদানী সালারের কণ্ঠ ভেসে আসে।

আমি ঈমান বিক্রি করবো না। ইসহাক ক্ষীণকণ্ঠে জবাব দেন।

চাক্কিটা আরো সম্মুখে টেনে নেয়া হয়। ইসহাকের গায়ের চামড়া ছিলে যেতে শুরু করে।

এখনও সময় আছে, জবাব দাও।

আমার লাশও একই উত্তর দেবে- আমি ঈমান বিক্রি করবো না। বড় কষ্টে ইসহাক জবাব দেন।

একে কিছুক্ষণ এভাবে থাকতে দাও- সালার আদেশ করে। তারপর প্রস্তাব মেনে নেবে।

ইসহাক কুরআন তিলাওয়াত করতে শুরু করেন। সালার চলে যায়। তার দেহের জোড়াগুলো যেনো খুলে যাচ্ছে। চামড়াগুলো ছিলে যাচ্ছে। মুখটা আকাশের দিকে। তিনি কল্পনায় মহান আল্লাহকে সম্মুখে দেখতে পান। বললেন- ইয়া আল্লাহ! আমি গুনাহগার। তুমি আমাকে আরো শাস্তি দাও। আমি যদি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকি, তাহলে তুমি আমাকে শাস্তিদান করো। তোমার সম্মুখে আমি লজ্জিত হতে চাই না।

তারপর চোখ বুজে পুনরায় কুরআন তিলাওয়াত আরম্ভ করেন।

তুমি চিৎকার করছো না কেন?- ইসহাকের পার্শ্বে দণ্ডায়মান সিপাহী বললো তুমি উচ্চস্বরে চিৎকার করো; তাতে তোমার কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে।

আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না- ইসহাক বললেন- চাক্কিটা আরো সামনের দিকে ঠেলে দাও।

কয়েদখানার হিংস্র প্রকৃতির এই সিপাহী হাবশীদের বললো- চাক্কি আরো চালাও। হাবশীদের ধাক্কা খেয়ে চাক্কি আরো সম্মুখে চলে যায়। ইসহাকের দেহটা মট মট করে শব্দ করে ওঠে। শুনে অপর এক সিপাহী ছুটে আসে। এসে সঙ্গীকে বললো- তোমাকে কে চাক্কি চালাতে বললো? লোকটা তো মরে যাবে। একে আরো কিছু সময় বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

চাকি কিছুটা নীচু করে দেয়া হয়।

 লোকটা বলছে, তার নাকি কোনো কষ্ট হচ্ছে না। সিপাহী তার সঙ্গীকে বললো।

 তোমার কি চেতন আছে?- সিপাহী ইসহাককে জিজ্ঞেস করে- তুমি কী বলছো?

অবচেতন মনে বলছে- অপর সিপাহী বললো- তুমি চাক্কি যে পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে গেছো, সে পর্যন্ত গেলে মানুষ মারা যায়। লোকটার চেতন থাকতে পারে না।

আমার হুশ-জ্ঞান ঠিক আছে বন্ধুগণ!- ক্ষীণ কণ্ঠে ইসহাক বললেন- আমি আমার প্রভুর সঙ্গে কথা বলছি।

সিপাহীদ্বয় বিস্ময়ের সাথে পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ী করে। একজন বললো- লোকটাকে তো অতোটা শক্তিশালী মনে হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে তো মহিষের ন্যায় হাবশীরাও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। লোকটা বোধ হয় আলিম হবে। তার সঙ্গে আল্লাহর শক্তি আছে।

হা, তোমরা ঠিক বলেছো- ইসহাক বললেন- আমার নিকট আল্লাহর শক্তি আছে। আমি তাঁর কালাম পাঠ করছি। তোমরা চাক্কি পুরোপুরি চালিয়ে দেখো, আমার দেহ দুভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে এবং উভয় অংশ থেকে এই আওয়াজই শুনতে পাবে, যা এ মুহূর্তে শুনতে পাচ্ছো।

সিপাহী মুসলমান নয়। সুস্থ কোনো আদর্শ তার নেই। কুসংস্কারই তার ধর্ম। পীর-ফকির, পাগল-দেওয়ানারা তার খোদা। মূর্তিপূজাও করে সে। এই চাক্কির মর্ম ভালোভাবে বুঝে সে। ইতিপূর্বে সে দেখেছে, এই চার্জির সঙ্গে বাঁধা মানুষটি তার সামান্য আন্দোলনেই চিৎকার করে ওঠতো এবং সবকিছু মেনে নিতো। চাক্কির আন্দোলন একটু বাড়িয়ে দিলে অজ্ঞান হয়ে যেতো এবং কিছুক্ষণ পর মরে যেতো। কিন্তু ইসহাক চাক্কির সর্বশেষ কার্যকারিতা পর্যন্ত বেঁচে রইলো এবং সচেতন রইলো। তাতে সিপাহী বুঝে ফেলেছে এই লোকটি কোনো সাধারণ মানুষ নয়।

তুমি কি আকাশের অবস্থা জানো? এক সিপাহী জিজ্ঞেস করে।

আমার আল্লাহ জানেন। ইসহাক জবাব দেন।

তোমার আল্লাহ কোথায়? সিপাহী জিজ্ঞেস করে।

আমার অন্তরে- ইসহাক জবাব দেন- এতো নির্যাতনের পরও তিনি আমাকে যন্ত্রণা হতে রক্ষা করছেন। আমার কোনো কষ্টই হচ্ছে না।

আমি গরীব মানুষ- এক সিপাহী বললো- এখানে তোমার মতো মানুষদের হাড় ভেঙ্গে স্ত্রী-সন্তানদের রুটি-রুজির ব্যবস্থা করি। তুমি আমার অবস্থার পরিবর্তন করে দিতে পারো।

বাইরে গিয়ে- ইসহাক বললেন- আমি যা কিছু পাঠ করছি, তোমাকে শিখিয়ে দেবো তোমার কিসমত বদলে যাবে।

আমরা চাক্কি নীচু করে দিচ্ছি- এক সিপাহী বললো- সালারকে আসতে দেখলে আবার উপরে তুলে দেবো।

না- ইসহাক বললো- আমি তোমাকে এই খেয়ানত করতে দেবো না। এটাই আমার শক্তি। একেই আমরা ঈমান বলে থাকি।

আমরা তোমাকে সাহায্য করবো- এক সিপাহী বললো- তুমি যখন যা বলবে, তা-ই করে দেবো। সম্ভব হলে তোমাকে কয়েদখানা থেকে বের হতে সাহায্য করবো।

***

সালার এসে গেছে।

কী ব্যাপার, এখনও তোমার জ্ঞান ঠিক আছে বিস্ময়ের সুরে সালার জিজ্ঞেস করে।

আমার আল্লাহ আমার হুশ-জ্ঞান ঠিক রেখেছেন। ইসহাক জবাব দেন।

সালারের ইঙ্গিতে চাক্কিটা আরো সম্মুখে চালানো হয়। ইসহাক স্পষ্ট অনুভব করেন, তার দেহটা দ্বিখণ্ডিত হয়ে আলাদা হয়ে গেছে এবং তার জীবনের শেষ হূর্ত এসে পড়েছে। তিনি কোঁকাতে কোকাতে আরো উচ্চস্বরে কালামে পাক তিলাওয়াত শুরু করেন। চাক্কি আরো সম্মুখে এগিয়ে নেয়া হলো। ইসহাকের দেহ থেকে মট মট শব্দ শোনা যায়, যেনো তার হাড়গুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে।

এই ভেবে খুশী হয়ো না যে, আমরা তোমাকে জীবনে মেরে ফেলবো নী সালার বললেন- তুমি জীবিত থাকবে এবং তোমার সঙ্গে প্রতিদিন এরূপ আচরণ হতেই থাকবে। মেরে ফেলে আমরা তোমাকে নিপীড়ন থেকে মুক্তি দেবো না।

ইসহাক কোনো জবাব দিলেন না। তিনি কুরআন তিলাওয়াত করতে থাকেন।

 সালারের ইঙ্গিতে চাক্কি কিছুটা নীচে নামিয়ে দেয়া হলো। ফৌজের অপর এক অফিসার সালারের সঙ্গে ছিলো। সালার তাকে সরিয়ে নিয়ে বললো লোকটা বড় কঠিনপ্রাণ মনে হচ্ছে। এতো নিপীড়নের পরও অচেতন পর্যন্ত হলো না। শাস্তির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিলে মারা যাবে। কিন্তু লোকটাকে আরো কদিন বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আমি অন্য একটি পন্থা ভাবছি। জানতে পেরেছি তার চৌদ্দ-পনের বছরের একটি মেয়ে আছে। স্ত্রীও আছে। তাদেরকে এই বলে এখানে নিয়ে আসবে যে, ইসহাক কয়েদখানায় মৃত্যু শয্যায় শায়িত। ইচ্ছে হলে তাকে দেখে যেতে পারে। আর যদি মৃত্যুবণ করে, লাশটা নিয়ে যাবে।

হ্যাঁ- অফিসার বললো- এভাবে ধোকা দিয়েই আনতে হবে। অন্যথায় ওখানকার মুসলমানরা আমাদের কাউকে তাদের এলাকায় ঢুকতে দেবে না।

এনে তাদেরকে উলঙ্গ করে এর সম্মুখে দাঁড় করিয়ে রাখবো- সালার বললো- তারপর তাকে বলবো, আমাদের শর্ত মেনে নাও, অন্যথায় তোমার যুবতী মেয়ে ও স্ত্রীকে তোমার চোখের সামনে অপদস্ত করা হবে।

সালারের অনুপস্থিতিতে যে দুজন সিপাহী ইসহাকের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছিলো, তারা নিকটে দাঁড়িয়ে সালার ও অফিসারের কথোপকথন শ্রবণ করছিলো। সালার তাদের একজনকে পাঠিয়ে ফৌজের কমান্ডারকে ডেকে মানেন। তাকে ইসহাকের গ্রামের ঠিকানা ও দিক-নির্দেশনা দিয়ে ওখানে যেতে বলে এবং দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়। তাকে বিশেষভাবে বলে দেয়া হলো, মুসলমানদের সঙ্গে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে কথা বলবে এবং সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রশংসা করবে। অন্যথায় মুসলমানরা তোমাকে জীবিত ফিরে আসতে দেবে না।

কমান্ডার তৎক্ষণাৎ রওনা হয়ে যায়।

ইসহাককে নিপীড়নযন্ত্র থেকে নামিয়ে সেই কক্ষে নিক্ষেপ করা হলো, যেখানে একজন মিশরীর গলিত লাশ পড়ে ছিলো। ইসহাক মহান আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন। এতো তীব্র যন্ত্রণা সত্ত্বেও তিনি নিজের মধ্যে শান্তি অনুভব করছিলেন। তার আত্মায় কোনো ব্যথা নেই। শারীরিক ব্যাথা-বেদনার প্রতি তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। কিন্তু তার জানা নেই যে, তাকে এমন এক লাঞ্ছনায় নিক্ষেপ করার আয়োজন চলছে, যা তার আত্মাকে রক্তাক্ত করে দেবে। তিনি জানেন না, তার ষোড়শী কন্যা ও স্ত্রীকে কয়েদখানায় নিয়েআসার জন্য এক ব্যক্তি রওনা হয়ে গেছে।

এখান থেকে ইসহাকের গ্রাম ঘোড়ায় চড়ে ভ্রমণ করলে পুরো এক দিনের পথ। এখন ভোর বেলা। সুদানী সালার তার সঙ্গী অফিসারের সঙ্গে চলে গেছেন। কয়েদখানার সিপাহীদ্বয়ের ডিউটি শেষ হওয়ার পথে। দিনের ডিউটির জন্য অন্য সিপাহীরা আসছে। এই দুসিপাহী পরস্পর কথা বলে একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারা ইসহাককে একজন বুজুর্গ ব্যক্তি বলে বিশ্বাস করে। তারা মনে করে, সরাসরি কোনো এক অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে তার সম্পর্ক। এমন একজন বুজুর্গ ব্যক্তির স্ত্রী-কন্যাকে কয়েদখানায় ডেকে এনে অপদস্ত করা হবে, তা তারা সহ্য করতে পারবে না। এক সিপাহী এই আশংকাও ব্যক্ত করে যে, এই লোকটির স্ত্রী-কন্যাকে অপমান করা হলে প্রত্যেকের উপর গজব আপতিত হবে। ইসহাক বের হতে পারলে তাদের ভাগ্য বদলে দেবেন, এমন আশাও তারা পোষণ করছে। এক সিপাহী বললো, সে ইসহাকের স্ত্রী ও কন্যাকে এই স্থান পর্যন্ত আসতে দেবে না।

***

বার্তাবাহী সুদানী কমান্ডার যখন মুসলমানদের পার্বত্য অঞ্চলে প্রবেশ করে, তখন সন্ধ্যা। এলাকায় প্রবেশ করে প্রথমে সে জিজ্ঞেস করে, মিশরী ফৌজের কর্মকর্তা, সুদানী মুসলমান, নাম ইসহাক; তার বাড়িটা কোন্ গ্রামে? এলাকায় ইসহাক একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। যে কেউ তাকে চেনে। কমান্ডার জানায়, লোকটি আহতাবস্থায় যুদ্ধবন্দী হয়ে আছে। অন্যান্য কয়েদীদের সঙ্গে তাকেও কয়েদখানায় নিক্ষেপ করা হয়েছে। তার অবস্থা খুবই শোচনীয়। তার একান্ত কামনা, জীবনের শেষ মুহূর্তে স্ত্রী ও কন্যাদের এক নজর দেখে যাবেন। আমি তাদেরকে নিতে এসেছি।

এক ব্যক্তি কমান্ডারের সঙ্গ নেয়। উপত্যকার পর উপত্যকা অতিক্রম করে দুজন ইসহাকের গ্রামে প্রবেশ করে। তারপর তার বাড়ি গিয়ে পৌঁছে।

ইসহাকের বৃদ্ধ পিতার সঙ্গে কমান্ডারের সাক্ষাৎ হয়। সুদানী কমান্ডার মাথানত করে তার সঙ্গে করমর্দন করে এবং নেহায়েত আদবের সঙ্গে বলে আপনার পুত্র এতোই বীর পুরুষ যে, আমাদের সালারও তাকে সালাম করেন। তিনি বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছেন বটে; কিন্তু মরুভূমি তাকে পিপাসায় কাতর করে বেহাল করে তোলে। তিনি আহতাবস্থায় আমাদের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। আমরা সুদানী সালার ও শাসকদের যেভাবে চিকিৎসা-সেবা দিয়ে কি, তারও ঠিক তেমনি সেবা-চিকিৎসা চলছে। তথাপি তিনি সুস্থ হচ্ছেন না। তার অবস্থা উত্তরোত্তর খারাপই হচ্ছে। তারপরও তাকে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। তিনি আকাঙ্খ ব্যক্ত করেছেন যে, তার কন্যা ও স্ত্রীকে শেষবারের মতো এক নজর দেখবেন।

তোমরা যদি তাকে এতোই ইজ্জত করে থাকে, তো তাকে আমাদের হাতে তুলে দিচ্ছো না কেন?- ইসহাকের পিতা বললেন- হয়তোবা সে আমাদের ডাক্তারদের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে যাবে।

সুদানের সেনা প্রধান বলেছেন, তিনি আমাদের মেহমান- কমান্ডার জবাব দেয়- মেহমানকে অসুস্থাবস্থায় বিদায় দেয়া মেজবানের জন্য অপমান। সুস্থ হলেই তাকে স্বসম্মানে আপনাদের হাতে তুলে দেয়া হবে।

 আচ্ছা, এটা কি সম্ভব নয় যে, তার স্ত্রী ও কন্যা তার কাছে থেকে তার সেবা করবে বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করেন।

এরা যদি ওখানে থাকতে চায়, তাহলে সম্মানের সঙ্গে রাখা হবে- কমান্ডার বললো- আমাদের দেশে বীর-বাহাদুরের সম্মান করা হয়। আমাদের ধর্ম আপনাদের থেকে ভিন্ন। কিন্তু আমরাও সুদানী, আপনারাও সুদানী। দেশ আমাদের এক। আর আমরা দেশকে শ্রদ্ধা করি। ইসহাক যদিও সালাহুদ্দীন আইউবীর সৈনিক, কিন্তু তাতে কিছু যায়-আসে না। আমরা ভাই ভাই। সালাহুদ্দীন আইউবীকে আমরা বড় যোদ্ধা বলে বিশ্বাস করি। তিনি খৃস্টানদের কোমর ভেঙ্গে দিয়েছেন।

 তাহলে তোমরা তাকে শত্রু ভাবছো কেন?- বৃদ্ধ বললেন- তোমরা কেননা খৃস্টানদেরকে বন্ধু মনে করছো?

মুহতারাম!- কমান্ডার বললো- আমরা যদি কথার পাকে জড়িয়ে পড়ি, তাহলে দায়িত্ব পালনে ত্রুটি হয়ে যাবে। আপনার পুত্রবধূ ও নাতনীকে রাত পোহাবার আগেই আপনার পুত্রের নিকট পৌঁছাতে হবে। আপনার পুত্রের আকাঙ্খ পূরণ করা আমাদের নৈতিক কর্তব্য। তারা এখনই আমার সঙ্গে রওনা হতে প্রস্তুত আছে কি?

পর্দার আড়াল থেকে এক নারীকণ্ঠ ভেসে আসে- হ্যাঁ, আমরা প্রস্তুত।

সঙ্গে কোনো পুরুষ যেতে পারবে কি?- বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করেন- আমিও আমার পুত্রকে দেখতে চাই।

সফর অনেক দীর্ঘ- কমান্ডার বললো- আপনি এতো দীর্ঘ ঘোড়সাওয়ারী : বরদাশত করতে পারবেন না। আমি শুধু ইসহাকের স্ত্রী-কন্যাকেই নিয়ে যাওয়ার আদেশ পেয়েছি।

কয়েদখানার সিপাহী ডিউটি শেষ করে বাড়ি চলে যায়।-অদ্রুিত পোশাক পরিবর্তন করে সে। মাথাটা এমনভাবে ঢেকে নেয় যে, মুখমণ্ডলও আবৃত হয়ে গেছে। ঘোড়ার সঙ্গে খাদ্য-পানি বেঁধে নিয়ে কাউকে কিছু না বলেই রওনা দেয়। ইসহাকের বাড়ির পথ আগেই জেনে নিয়েছে সে। সালার যখন কমান্ডারকে ইসহাকের বাড়ির পথ নির্দেশ করেছিলো, এই সিপাহী তখন পার্শ্বে দণ্ডায়মান ছিলো। ইসহাকের প্রতি ভক্তিতে পরিপূর্ণ তার হৃদয়। লোকালয় থেকে বের হয়ে দ্রুত ঘোড়া হাঁকায় সিপাহ। কমান্ডার তো চলে গেছে তারও বহু আগে। কাজেই তার আগে ইসহাকের বাড়ি পৌঁছা সিপাহীর পক্ষে সম্ভব নয়।

***

ইসহাকের পিতার নিকট দুটি ঘোড়া ছিলো। তিনি ঘোড়াগুলোকে প্রস্তুত করে দেন। ইসহাকের কন্যা ও স্ত্রী ঝটপট প্রস্তুত হয়ে ঘোড়ায় চড়ে বসে। এলাকার আরো কতিপয় লোক এসে জড়ো হয়। তারাও সুদানী কমান্ডারের বক্তব্যে বিশ্বাস স্থাপন করে ইসহারে কন্যা ও স্ত্রীকে কমান্ডারের সঙ্গে বিদায় করে দেয়।

রাতের সফর। পথে কোথাও যাত্রাবিরতি দেয়া যাবে নাঃ ইসহাকের ভাবনায় দুমহিলার চোখের নিদ্রা উড়ে গেছে। তাদের পক্ষে ঘোড়সওয়ারী নতুন কিংবা কঠিন বিষয় নয়। এখানকার মুসলমানরা তাদের সন্তানদের অশ্বারোহন ও তীরচালনা শৈশবেই শিক্ষা দিয়ে থাকে।

তিনটি ঘোড়া পাহাড়ী এলাকা থেকে বেরিয়ে গেছে। কমান্ডার এই ভেবে আনন্দিত যে, সে সাফল্যের সাথে ইসহাকের স্ত্রী-কন্যাকে জালে আটকাতে সক্ষম হয়েছে।

ইসহাক সেই প্রকোষ্ঠে বসে আছেন, যেখানে মিশরী সৈনিকের গলিত লাশ পড়ে ছিলো। এই লাশ সেখানে তাকে অস্থির করে তোলার জন্য রাখা হয়েছিলো। কিন্তু ইসহাক তো এখন দৈহিক অনুভূতি থেকে সম্পূর্ণ উদাসীন। তিনি লাশটির সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছেন, যেনো লাশটি জীবিত। দুর্গন্ধের এক তিল অনুভূতিও তার নেই। তিনি যেন এখন আর দেহ নন- একটি আত্মা। সারাটা দিন তাকে কক্ষ থেকে বের করা হয়নি। সন্ধ্যার পরও কেউ তাকে বিরক্ত করেনি। তিনি এই ভেবে বিস্মিত যে, তাকে কেননা শান্তিতে থাকতে দেয়া হচ্ছে। সম্ভবত সুদানী সালার তার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেছে।

পাহাড়ী এলাকা থেকে বের হয়ে দুই মহিলাকে নিয়ে কমান্ডার মরু এলাকার দিকে যাচ্ছে। মহিলাদেরকে সে ইসহাক সম্পর্কে ভালো ভালো কথা শোনাচ্ছে। তারা মনোযোগ সহকারে তার বক্তব্য শুনছে।

সুদানী সালার তার সঙ্গীকে বলছে-কেউ কি আপন স্ত্রী ও কন্যার অপমান সহ্য করতে পারে? আমি আশাবাদী, কমান্ডার ইসহাকের স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে আসবে। আমি ইসহাককে বলবো, যতোক্ষণ না তুমি মুসলিম গোত্রগুলোকে সুদানী ফৌজে শামিল করে সুদানের অফাদার না বানাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার স্ত্রী ও কন্যা আমাদের হাতে বন্দী থাকবে।

আমাদের কমান্ডারকে ভোর নাগাদ এসে পৌঁছা উচিত। সালারের সঙ্গী বললো।

 তার আগেও এসে পড়তে পারে- সালার বললো- লোকটা বড় চতুর।

 কমান্ডারের পেছনে পেছনে রওনা হওয়া সিপাহী পার্বত্য এলাকার মধ্যদিয়ে অতিক্রম করছে। অর্ধেকেরও বেশী পথ অতিক্রম করে ফেলেছে সে। আকাশে চাঁদ নেই। তবু মরু এলাকা বলে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। তারকার আলোয় চলার মতো পথ দেখা যায়।

রাতের নীরবতার মধ্যে সিপাহী কারো কথা বলার শব্দ শুনতে পায়। বক্তা তারই দিকে এগিয়ে আসছে। সিপাহী একটি টিলার আড়ালে গিয়ে থেমে যায়। কথা বলার শব্দ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে। এবার একাধিক ঘোড়ার পায়ের আওয়াজও শোনা যাচ্ছে। পরক্ষণেই সিপাহী টিলার আড়াল থেকে তিনটি ঘোড়া অতিক্রম করতে দেখে। সে তরবারী হাতে নেয়। কমান্ডার এখনো ইসহাকের কথা বলে যাচ্ছে। সিপাহী নিশ্চিত হয়, লোকটি তাদের সেই কমান্ডার এবং তার সঙ্গে ইসহাকের স্ত্রী ও কন্যা।

 সিপাহী ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়ে এবং কমান্ডারের পিছু নেয়। তার ঘোড়ার পদশব্দে কমান্ডার চমকে ওঠে। সে তরবারী উঁচু করে পেছন দিকে ঘুরে যায়। কিন্তু সিপাহী ধাবমান ঘোড়ার পিঠ থেকে কমান্ডারের উপর এমন এক আঘাত হানে যে, কমান্ডারের একটি বাহু কেটে যায়। পাল্টা আঘাত হানার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে কমান্ডার। সিপাহী তার ঘাড়ে আঘাত হেনে তাকে ঘোড়ার পিঠ থেকে ফেলে দেয়।

 ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ভ হয়ে যায় মহিলাদ্বয়। ইসহাকের স্ত্রী তার মেয়েকে বললো- পালাও, ডাকাত মনে হচ্ছে। তারা ঘোড়ার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সিপাহী তাদের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো- এখানে কোনো ডাকাত নেই। আমাকে ভয় করো না। আমি তোমাদেরকে একজন দস্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছি। আমার সঙ্গে নিজ বাড়িতে চলো। আমি তোমাদের সঙ্গে যাবো। আমার সঙ্গে আর কোনো মানুষ নেই।

ইসহাকের স্ত্রী ও কন্যা অস্থির-পেরেশান যে, এসব কী ঘটছে। সিপাহী কমান্ডারের ঘোড়ার লাগাম তার ঘোড়ার জিনের সঙ্গে বেঁধে রওনা হয়। পথে সে ইসহাকের স্ত্রী ও কন্যাকে জানায়, ইসহাক কয়েদখানায় বন্দী। মুসলমান গোত্রগুলোকে সুদানী ফৌজে শামিল করে দেয়ার জন্য তার উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। কিন্তু তিনি তা মেনে নিতে নারাজ। ইসহাকের সঙ্গে কিরূপ আচরণ চলছে, সিপাহী তাদের তা জানতে দেয়নি। সে বললো, তোমাদেরকে নিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে পরিকল্পনা হলো, তোমাদেরকে ইসহাকের সামনে উলঙ্গ দাঁড় করিয়ে লাঞ্ছিত করে ইসহাককে বাধ্য করা। এই যে লোকটিকে আমি খুন করেছি, সে এ লক্ষ্যেই তোমাদেরকে নিতে এসেছিলো। আমি তোমাদেরকে এই ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তার পেছনে পেছনে আসি। আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি।

তুমি কে?- ইসহাকের স্ত্রী জিজ্ঞেস করে- তুমি কি মুসলমান?

আমি কয়েদখানার সিপাহী- সিপাহী জবাব দেয়- আমি মুসলমান নই।

তাহলে আমাদের জন্য তোমার হৃদয়ে দয়া জাগলো কেন?

আমি শুনেছি, মুসলমানদের একজন পয়গম্বর আছেন- সিপাহী বললো তোমার স্বামীকে পয়গম্বর বলে মনে হচ্ছে।

ইসহাকের স্ত্রী জানতে চায়, তুমি কেন আমার স্বামীকে পয়গম্বর মনে করছে। সিপাহী আসল ঘটনা এড়িয়ে গিয়ে বললো- আমি তাকে সত্য পয়গম্বর মনে করি। তিনি মুসলমান এবং কয়েদখানায় বন্দী। আমি মুসলমান নই। তার স্ত্রী ও কন্যাকে লাঞ্ছিত করার যে আয়োজন চলছে, তা তিনি জানেন না। আমার অন্তরে ইচ্ছা জাগলো, তোমাদের দুজনের ইজ্জত রক্ষা করবো। আবেগের বশবর্তী হয়ে আমি এমন কাজ করে ফেলেছি, যা আমার সামর্থের বাইরে ছিলো। এ তারই অদৃশ্য শক্তি। আমি তাকে পয়গম্বর মনে করি।

***

রাতের শেষ প্রহরে চারটি ঘোড়া ইসহাকের ঘরের সম্মুখে গিয়ে থেমে যায়। ঘরের দরজায় করাঘাত পড়ে। পুত্রবধূ ও নাতনীর সঙ্গে ভিন্ন এক পুরুষকে দেখে ইসহাকের পিতা বিস্মিত হন। ভেতরে প্রবেশ করে সিপাহী তাকে পুরো ঘটনা ও পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করে। কিন্তু কয়েদখানায় ইসহাকের সঙ্গে, কিরূপ আচরণ চলছে, তা গোপন রাখে। ইসহাকের পিতা তৎক্ষণাৎ গোত্রের লোকদেরকে বিষয়টি অবহিতু করে। মানুষ এসে ইসহাকের বাড়িতে ভিড় জমায়। সিপাহী তাদেরকে জানায়, ইসহাককে এই শর্তে মুক্তি দেয়ার কথা বলা হচ্ছে যে, তিনি আমাদের সব মুসলমানকে, সুদানী ফৌজে শামিল করে দেবেন এবং আপনারা সবাই সুদানের অনুগত হয়ে যাবেন। কিন্তু ইসহাকের বক্তব্য আমাকে জীবনে মেরে ফেলো, তবু আমি আমার স্বজাতির সঙ্গে গাদ্দারী করতে পারবো না।

শুনে সবাই আৎকে ওঠে এবং সুদানকে গালমন্দ করতে শুরু করে। একজন বললো- এখানে সালাহুদ্দীন আইউবীর আগমন ঘটবে। এটা আল্লাহর জমিন।

আমরা কয়েদখানা আক্রমণ করে ইসহাককে উদ্ধার করবো। এক ব্যক্তি বললো।

তোমাদের পক্ষে এ কাজ সহজ নয়- সিপাহী বললো- পাতাল কক্ষ থেকে কাউকে বের করে আনার সাধ্য তোমাদের নেই।

তুমি তো কয়েদখানার সিপাহী- ইসহাকের পিতা বললেন- তুমি সহযোগিতা করতে পারো।

আমি গরীব এবং সাধারণ একজন সৈনিক- সিপাহী বললো- আমি আপনার পুত্রকে পয়গম্বর মনে করি। আমি তাকে বলেছি, তুমি আমার ভাগ্য বদলে দাও। তিনি বলেছেন, এখান থেকে বের হয়ে আমি তোমার ভাগ্য বদলে দেবো। সময় যতো অতিক্রম করছে, তার প্রতি আমার ভক্তি-শ্রদ্ধা ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আপনারা সবাই তার জন্য জীবন ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছেন। আমার জীবনও কি তেমন হতে পারে না, যেমনটা আপনাদের?

তুমি মুসলমান হয়ে যাও এবং এখানেই থাকো- ইসহাকের পিতা বললেন- আমরা সবাই জান্নাতে বাস করি। এখানকার জমি এতো অধিক ফসল উৎপন্ন করে যে, যারা কৃষি কাজ করে না, তাদেরও না খেয়ে থাকতে হয় না। এটা আমাদের আল্লাহর অনুগ্রহ। তুমি আমাদের নিকট এসে পড়ো এবং ভাগ্য পরিবর্তন করো। আমরা স্বাধীন। এখানকার পর্বতমালা আমাদের দুর্গ। এই দুর্গ আল্লাহ আমাদের জন্য বানিয়ে দিয়েছেন।

সিপাহী ইসহাকের এলাকায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ইসহাকের পিতার হাতে কালেমা পাঠ করে মুসলমান হয়ে সেখানেই বসবাস করতে শুরু করে।

এখন ভোর বেলা। সুদানী সালার অস্থিরচিত্তে কমান্ডারের আগমনের অপেক্ষা করছে। কিন্তু তার কোনো খোঁজ নেই। সূর্য মাথার উপর ওঠে আসছে আর সালারের অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার ধারণা, কমান্ডার পথ ভুলে গেছে। সে অপর এক কমান্ডারকে ডেকে দায়িত্ব বুঝিয়ে পথের নির্দেশনা দিয়ে রওনা করিয়ে দেয়।  ইসহাক কক্ষে আবদ্ধ। সারাটা দিন তার এই অবরুদ্ধ অবস্থায় কেটেছে। তার কক্ষে পড়ে থাকা লাশটি গলতে শুরু করেছে। কয়েদখানার যে সান্ত্রী মানুষের হাড় ভাঙ্গা এবং পাতাল প্রকোষ্ঠের দুর্গন্ধ সহ্য করতে অভ্যস্ত, সেও ইসহাকের কক্ষের নিকটে যেতে আপত্তি করছে। এক সান্ত্রী নাকে হাত রেখে ইসহাককে জিজ্ঞেস করলো- হতভাগা! এতো দুর্গন্ধ তুমি কিভাবে সহ্য করছো? এরা তোমার নিকট যা যা দাবি করছে, তুমি মেনে নাও এবং এখান। বেকে মুক্তি গ্রহণ করো। তুমি তো এই মুদারের গন্ধে পাগল হয়ে যাবে।

আমার কোনো দুর্গন্ধ অনুভব হচ্ছে না- ইসহাক বললেন- এটা মুর্দার নয়, ইনি শহীদ। আমি রাতে তার গা ঘেঁষে ঘুমাই।

তুমি পাগল হয়ে গেছো- সান্ত্রী বললো- লাশের দুর্গন্ধের ক্রিয়া এমনই হয়ে থাকে।

ইসহাকের মুখে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে। তিনি লাশটির সন্নিকটে বসে রআন তিলাওয়াত করতে শুরু করেন।

কেটে গেছে এ রাতটিও। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে সালার পরবর্তী যে কমান্ডারকে প্রেরণ করেছিলেন, সে ফিরে আসে। লাগাতার দীর্ঘ সফরে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত কমান্ডার যা কিছু দৈখে এসেছে, তা বিবৃত করতে তার ঠোঁট কাঁপছে। সে সালারকে জানায়, পথে কিছু এলাকা বালির টিলা ও পর্বতময়। দেখলাম, এক স্থানে অনেকগুলো শকুন একটি মুর্দা খাচ্ছে। পার্শ্বেই এক স্থানে পড়ে আছে একটি তরবারী, এক জোড়া জুতা ও কিছু কাপড়-চোপড়। শকুনগুলোকে তাড়িয়ে দেয়ার পর বুঝতে পারলাম, ওরা যা খাচ্ছিলো ওটি একটি মানুষের লাশ। লাশের মুখমণ্ডল বিকৃত হয়ে গেছে। পার্শ্বে পরিত্যক্ত যার ও চামড়ার বেল্ট ইত্যাদি দেখে আমি নিশ্চিত হই যে, এটি আমাদের সুদানী কমান্ডারের লাশ। আমি কিছুদূর সম্মুখে এগিয়ে মাটি পরখ করে ঘোড়ার পদচিহ্ন দেখতে পাই। তাতে বুঝা গেলো, এই কমান্ডার পাহাড়ী এলাকায় প্রবেশ করছিলো। তবে সে মহিলা দুজনকে নিয়ে এসেছিলো কিনা এবং তাকে কে খুন করলো, বুঝা গেলো না।

শুনে সালার বললেন- সব জানা যাবে।

মুসলমানদের উক্ত অঞ্চলে সুদানীরা তাদের গুপ্তচর ছড়িয়ে রেখেছিলো, যারা ওখানকার মুসলমানদেরই একজন। ওখানে তাদের একমাত্র কাজ প্রবৃত্তি। তারাই ইসহাক সম্পর্কে তথ্য দিয়েছিলো, ঐ অঞ্চলে তিনি একজন এভাবশালী ব্যক্তিত্ব।

 সালারের ধারণা সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। সন্ধ্যার পর দুজন গুপ্তচর সেখান থেকে এসে পৌঁছে। তারা সালারকে জানায়, কমান্ডার ইসহাকের স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু আমাদের কয়েদখানার এক সিপাহী পথে কমান্ডারকে হত্যা করে মহিলা দুজনকে ফেরত নিয়ে গেছে। গোয়েন্দারা সিপাহীর নামও জানায়। সালার বিষয়টি সুদানের সম্রাটকে অবহিত করে। সম্রাট জানায় খৃস্টান উপদেষ্টাদের। খৃস্টান উপদেষ্টারা পরামর্শ দেয়, তোমরা চুপ থাকো। মুসলমানদের উপর হামলা করার মতো বোকামী করো না। তাদেরকে কৌশলে বন্ধুতে পরিণত করার চেষ্টা করো। বড়জোর এটুকু করতে পারো যে, উক্ত সিপাহীকে গোপনে হত্যা করাও, যাতে মুসলমানরা বুঝতে পারে, আমাদের হাত সর্বত্র পৌঁছতে পারে। ইসহাক যদি তোমাদের শর্ত মেনে না নেয়, তাহলে অন্য কোনো সুদানী মুসলমানকে টার্গেট করো এবং ইসহাকের নির্যাতন অব্যাহত রাখো।

ইসহাককে পুনায় নিপীড়নের যাঁতাকলে নিক্ষেপ করা হলো। এবার তার, থেকে কমান্ডার হত্যার প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে সালার। তাকে এমন পাশবিক নির্যাতনে নিষ্পিষ্ট করা হলো, যা মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। রাতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন ইসহাক। অচেতন অবস্থায়ই তাকে একটি কক্ষে নিক্ষেপ করা হলো। যখন তার জ্ঞান ফিরে আসে, তখন কক্ষে ঘোর অন্ধকার। বাইরে একটি প্রদীপ জ্বলছে। ইসহাক অন্ধকারে একদিকে হাত বাড়ালে হাত কারো গায়ের সঙ্গে লাগে। তার স্মরণে এসে যায়, এতো সেই লাশ, যেটি প্রথম দিন থেকে তার সঙ্গে পড়ে আছে। কিন্তু তার কাছে মনে হলো, লাশটা নিঃশ্বাস গ্রহণ করছে। তার শরীরের অবস্থা এতই শোচনীয় যে, উঠে বসার শক্তি নেই।

হঠাৎ লাশটা নড়ে ওঠে। ইসহাক চমকে ওঠে তাকায়। লাশের চেহারায় দৃষ্টিপাত করে। এ্যা, এতো সেই লাশ নয়, এতো অন্য কোনো জীবিত মানুষ এবং এটি অপর একটি কক্ষ। লোকটি সম্ভবত অচেতন। পরে ধীরে ধীরে তার চৈতন্য ফিরে আসে এবং চোখ খুলে। ইসহাক বড় কষ্টে উঠে বসে জিজ্ঞেস করে- তুমি কে?

আমর দরবেশ। অতিশয় ক্ষীণ কণ্ঠে লোকটি জবাব দেয়।

আহ! আমর দরবেশ- ইসহাক চমকে ওঠে বললেন- আমি ইসহাক।

ইসহাক ও আমর দরবেশ একে অপরকে ভালোভাবেই চেনে। আমর দরবেশও সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর ফৌজের একটি ইউনিটের কমান্ডার ছিলেন। তিনি সেই মুসলমান কবিলার লোক, যারা সুদানী হওয়া সত্ত্বেও সুদানী ফৌজে ভর্তি হওয়া থেকে বিরত থাকছে। আমর দরবেশও এখন, যুদ্ধবন্দী। ইসহাকের নাম শুনে তিনি উঠে বসেন।

তারা তোমাকে কী বলছে? ইসহাক জিজ্ঞেস করেন।

তারা বলছে- আমর দরবেশ জবাব দেন- তুমি আলেমের বেশ ধারণ  করে নিজ এলাকায় গিয়ে লোকদের অন্তরে সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে শত্রুতা সৃষ্টি করে। আমরা তোমাকে কৌশল বলে দেবো, তোমাকে রাজপুত্রের ন্যায় রাখবে এবং যে মেয়েকে পছন্দ হয়, তোমার সঙ্গে দেবো। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছি, তোমাদের উদ্দেশ কি? তারা বলেছে, তুমি তোমার সবকটি গোত্রকে সুদানের অনুগত বানিয়ে দাও। বিনিময়ে তারা আমাকে মুসলিম অঞ্চলের আমীর নিযুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এরা মুসলমানদের আলাদা বাহিনী গড়তে চায়।

আমি জানতে পেরেছি- আমর দরবেশ বললেন- তারা তোমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছে। বুঝতে পারছি না, আমাদের দুজনকে কেননা এক কক্ষে আবদ্ধ করলো। এর মধ্যে কল্যাণ থাকতে পারে। আমি তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছিলাম। আমি একটা পন্থা ভেবেছি। সে মতে কাজ করার আগে তোমার অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন ছিলো। ভালোই হলো, তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে গেছে।

কী পন্থা ভেবেছেন? ইসহাক জিজ্ঞেস করেন।

তুমি তো বুঝতে পারছে, এরা আমাদেরকে ছাড়বে না- আমর দরবেশ বললেন- আমরা কতকাল নিপীড়ন সহ্য করবো। আজ না হোক কাল তো আমাদের মরতেই হবে। এখানে আরো কয়েকজন সুদানী মুসলমান বন্দী আছে। কেউ না কেউ তাদের হাতে এসে যাবে। আমার আশংকা, এরা আমাদের কোনো না কোনো সহকর্মীকে ফাঁদে ফেলে আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করবে। একটা পন্থা এই হতে পারে যে, আমরা এদের শর্ত মেনে নিয়ে এখান থেকে মুক্তি লাভ করবো এবং এলাকায় গিয়ে কোনো কাজ করবো না। আমরা রাতের আঁধারে গোপনে মিশর চলে যাবো। আমাদের বেঁচে থাকা প্রয়োজন। দ্বিতীয় পন্থা হলো, আমি এদের সব প্রস্তাব মেনে নেবো। এরা আমাকে যা যা পাঠ শোনাবে, আমি সব পড়ে নেবো। তাদের নির্দেশিত বেশ ধারণ করবো এবং গোত্রের লোকদেরকে সাবধান করে দেবো, যেনো তারা সুদানীদের কারো খপ্পরে না পড়ে। বের হয়ে আমি তোমাদেরকে এখান থেকে বের করে নেয়ার চেষ্টা করবো।

এ-ও তো হতে পারে যে, তখন সুদানীরা আমাদের এলাকার উপর হামলা করে বসবে- ইসহাক বললেন- আমাদের জনগণ অতো তাড়াতাড়ি অস্ত্র সমর্পণ করার মতো লোক নয় বটে; কিন্তু সেনাবাহিনীর শক্তিও অতো দ্রুত নিঃশেষ হবে না। সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়ে সাধারণ জনতার পেরে ওঠা সহজ হবে না।

আমাদের ত্যাগ স্বীকার করতে হবে- আমর দরবেশ বললেন- আমরা মিশর থেকে কমান্ডো বাহিনীর সাহায্য নিতে পারি। এক্ষুণি যা প্রয়োজন, তাহলো, আমাদের একজন বেরিয়ে যাবো। আমরা দুজনই যদি একসঙ্গে তাদের শর্ত মেনে নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারি, তাহলে আরও ভালো হবে।

আমি এখানেই থাকবো- ইসহাক বললেন- তুমি তাদেরকে ধোঁকা দাও। আমরা দুজনই যদি একসঙ্গে তাদের দাবি মেনে নেই, তাহলে তারা বুঝে ফেলবে, এক কক্ষে অবস্থান করে আমরা পরামর্শের মাধ্যমে কোনো পরিকল্পনা ঠিক করেছি। আমি তাদের নিপীড়ন ভোগ করতে থাকবো। তুমি বেরিয়ে যাও।

***

রাত পোহাবা মাত্র কক্ষের দরজা খুলে যায়। এক সিপাহী বর্শার আগা দ্বারা খোঁচা দিয়ে জাগিয়ে তুলে ধাক্কাতে ধাক্কাতে সঙ্গে করে ইসহাককে নিয়ে যায়। কক্ষের দরজা পুনরায় বন্ধ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর সুদানী ফৌজের এক কর্মকর্তা এসে হাজির হয়। সে দেয়ালের ফাঁক দিয়ে আমর দরবেশকে জিজ্ঞেস করে- আজও যদি তুমি অস্বীকার করো, তাহলে কল্পনা করতে পারবে না তোমার শরীরের দশা কী হবে। আমরা তোমাকে মরতে দেবো না। দুনিয়াতেই তুমি জাহান্নাম দেখতে পাবে। প্রতিদিনই মরবে, প্রতিদিনই জীবিত হরে।

আমাকে কোনো একটি ভালো জায়গায় নিয়ে যাও- আমর দূরবেশ বললেন আমার দেহটাকে একটু শান্তি দাও। এখানে আমি কিছুই ভাবতে পারি না।

আমি তোমাকে জান্নাতে নিয়ে বসাতে পারি- সুদানী কর্মকর্তা বললো আমি তোমাকে জান্নাতের হুরদের মাঝে বসাবো। কিন্তু সেখানেও যদি আমাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করো, তাহলে যততদিন বেঁচে থাকবে, আফসোস করবে। কেঁদে কেঁদে আমাদের বলবে, আমি তোমাদের প্রস্তাব মেনে নিয়েছি। কিন্তু তখন আর আমরা তোমাকে বিশ্বাস করবো না।

আমর দরবেশ কোকাচ্ছেন। চোখ দুটো পুরোপুরি খুলতে পারছেন না। তিনি কর্মকর্তার কানে ফিসফিসিয়ে অস্ফুট স্বরে বললেন- এমনটা হবে না। আমাকে কোথাও নিয়ে চলে এবং বলল, আমাকে কী করতে হবে।

আমর দরবেশকে তখনই সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হলো এবং ইসহাককে যেরূপ বিলাসবহুল কক্ষে রাখা হয়েছিলো, তেমনি এক কক্ষে রাখা হলো। সামান্য পরে একজন ডাক্তার এসে উপস্থিত হন। তিনি তার দেহ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ওষুধ দিয়ে যান। তাকে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হতো। এ সময়ে ইসহাককে নিপড়িনকারী সেই সুদানী সালার আমর দরবেশকে জিজ্ঞেস করে- তুমি কি আমাদের সবগুলো প্রস্তাব মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছো? আমর দরবেশ মাথা নেড়ে সম্মতিসূচক জবাব দেন। তারপর আহার শেষ করেই শুয়ে পড়েন। আমর দরবেশ গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। হয়ে পড়েন।

গোটা রাত এবং পরবর্তী দিনের অর্ধেক অতিবাহিত হওয়ার পর আমর দরবেশের ঘুম ভাঙ্গে। তিনি কয়েদখানায় বহুদিন যাবত নিপীড়ন ভোগ করে আসছেন। শরীর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। হাড়-চামড়ার মাঝে গোশত নেই। শুলে হাড়ে ব্যথা পান। কিন্তু এখন সুদর্শন কক্ষে মনোরম গালিচায় কয়েক ঘন্টা ঘুমাবার পর তার দেহে সুস্থতা ও সজীবতার ভাব ফুটে উঠেছে। তাকে ওষুধ সেবন করানো হয়েছে। খাওয়ানো হয়েছে রাজকীয় খাবার।

চোখ খুলে দেখতে পান এক যুবতী তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে হাসছে। অত্যন্ত রূপসী। মাথাটা উন্মুক্ত। ঝলমলে রেশমী চুল। কাঁধ, বাহু ও বুকের অনেকখানি উদোম।

আমর দরবেশ সৈনিক মানুষ। জন্মেছেন জঙ্গলে। যৌবনে কেটেছে যুদ্ধের ময়দানে। মেয়েটিকে তার কাছে স্বপ্ন মনে হলো। কিন্তু মেয়েটি এগিয়ে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলালে তিনি নিশ্চিত হন এটা স্বপ্ন নয়, বাস্তব।

মেয়েটি কক্ষ থেকে বের হয়ে ডাক্তারকে ডেকে আনে। ডাক্তার তার স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর নিয়ে ওষুধ খাইয়ে চলে যান।

খানিক পর এসে উপস্থিত হয় দুজন খৃস্টান। তারা অনর্গল সুদানী ভাষায় কথা বলছে। নাশকতায় অভিজ্ঞ। তারা আমর দরবেশকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে যে, নিজ এলাকায় গিয়ে বলবে না, তুমি আমাদের হাতে বন্দী ছিলে। বরং বলবে, যুদ্ধের ময়দানে এক বুযুর্গের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিলো, যিনি বলেছেন মিশরী বাহিনীর সুদান আক্রমণ ভুল প্রমাণিত হবে। মুসলমানদের জন্য উত্তম হলো, তারা সুদানের সঙ্গে যোগ দেবে। অন্যথায় তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। তুমি, একজন দেওয়ানা আলেমের বেশে মুসলমানদের অন্তরে সালাহুদ্দীন আইউবী ও মিশর সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি করবে।

আমর দরবেশ হাসিমুখে সম্মতি প্রকাশ করেন। তৎক্ষণাৎ তার প্রশিক্ষণ ও রিহার্সেল শুরু হয়ে যায়। সন্ধ্যার পর কয়েকটি মেয়ে তার জন্য খাবার নিয়ে আসে। এনে হাজির করে মদও। আমর মদ পান করতে অস্বীকার করেন। আহার শেষে এই মেয়েরা চলে যায়। রাতের পোশাকে এসে উপস্থিত হয় অপর এক মেয়ে। দেহটা অর্ধনগ্ন। চাল-চলন, ভাবভঙ্গী উত্তেজনাকর।

তুমি কেন এসেছ? আমর দরবেশ মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করেন।

 আপনার জন্য মেয়েটি জবাব দেয়- আমি আপনার কাছে থাকবো।

তোমার নাম কি?

আশি। নামটা বলেই মেয়েটি আমর দরবেশের পালংকের উপর বসে পড়ে।

আমি আদেশ পেয়ে এসেছি, আমাকে আপনার সঙ্গে থাকতে হবে।

এরা আমার থেকে যা আদায় করতে চাচ্ছে, আমি তা মেনে নিয়েছি- আমর দরবেশ বললেন- তোমার ন্যায় সুদর্শন ফাঁদের কোনো প্রয়োজন নেই।

আমি জানি- আশি বললো- আমাকে আপনার সম্পর্কে সবকিছু বলা হয়েছে। আমি পুরস্কার হিসেবে এসেছি। আমি জানি আমাকে আপনার প্রয়োজন রয়েছে। সৈনিক যখন রণাঙ্গন থেকে ফিরে আসে, তখন তার আত্মা, নারীর প্রয়োজন অনুভব করে থাকে।

আমি পরাজিত সৈনিক- আমর দরবেশ বললেন- আমার আত্মা মরে গেছে। নিজ দেহের প্রতি আমার ঘৃণা জন্মে গেছে। কোনো প্রয়োজনের অনুভূতি আমার নেই। কয়েদখানায় সিদ্ধ পাতা খেয়েও আমি আনন্দ পেয়েছি। এখানে এতো সুস্বাদু রাজকীয় খাবার খেয়েও তৃপ্ত। কিন্তু সামগ্রিক বিচারে আমি আনন্দিত নই। আমি পরাজিত।

মেয়েটি খিলখিল করে হেসে ওঠে। যেনো কোনো রসিক বন্ধু তার গায়ে পানি ছিটিয়ে দিয়েছে।

দু-চার ডোক মদ আপনাকে আনন্দে উদ্বেলিত করে তুলবে- মেয়েটি বললো- কয়েক ঢোক লাল পানি কণ্ঠনালী অতিক্রম করার পর আমার প্রতি তাকাবেন। তখন আমার মধ্যে ফুলের সৌন্দর্য দেখতে পাবেন।

আমার সমস্যাটা হলো, আমি মুসলমান- আমর দরবেশ বললেন আমরা সম্ভ্রম নিয়ে খেলা করি না, বরং আমরা সন্ধ্রমের সুরক্ষা করে থাকি।

সে তো মুসলমান মেয়েদের সম- মেয়েটি বললো- আমি মুসলমান নই। তোমার সম্ভ্রমের প্রতি লক্ষ্য রাখবো। নারী মুসলমান হোক কিংবা অন্য ধর্মাবলম্বী বা ভিন্ন জাতির; মুসলমান যদি পাক্কা ঈমানদার হয়, তার সম্প্রমের হেফাজত করবেই। তুমি সারা রাত আমার কাছে বসে থাকে। সকালে সকলের নিকট বলে বেড়াবে, গত রাতটা আমি একটা পার্থরের কাছে অতিবাহিত করেছি।

আমি কি রূপসী নই? মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।

যেমনই হয়ে থাকো, তুমি আমার কোনো কাজের নও- আমর দরবেশ বললেন- আমি বরং তোমার কাজে আসতে পারি। তুমি যদি এই লাঞ্ছনাময় জীবন থেকে মুক্তি পেতে চাও, তাহলে জীবন বাজি রেখে হলেও আমি তোমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাবে এবং কোনো ভদ্র ঘরে পুনর্বাসন করে দেবো।

আপনার আগেও এক ব্যক্তি এখানে এসেছিলেন- আশি বললো- তিনিও আপনার ন্যায় কথা বলতেন। তিনিও সুদানী মুসলমান ছিলেন। মুসলমান বিধায় নারীর প্রতি আপনার কোনো আকর্ষণ নেই, আপনার এ দাবি আমি মানতে পারছি না। আমি মিশরের এমন অনেক মুসলমানকে দেখেছি, যারা নারী পেলে ক্ষুধার্ত জন্তুতে পরিণত হয়। আমি এমন তিনজন মিশরী মুসলমানের নাম বলতে পারবো, যাদেরকে আমি এবং সোরাহী বিশ্বাসঘাতকে পরিণত করেছে। তারা কিরূপ মুসলমান?

তারা ঈমান বিক্রেতা- আমর দরবেশ বললেন- তুমি যখন কথা বললো, তখন আমি তোমার চেহারা ও চোখে তোমার মাতা-পিতার ঝলক দেখার চেষ্টা করছি। তারা কোথায়? বেঁচে আছেন কি?

জানি না- আশি বললো- আপনার পূর্বে যিনি এখানে এসেছিলেন, তিনিও জিজ্ঞেস করেছেন, আমার বাবা-মা বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন।

আশি ইসহাকের প্রসঙ্গ টেনে আনে। ইসহাককে যখন এই কক্ষে রাখা। হয়েছিলো, তখনও এই মেয়েটিকেই তার কাছে এখানে পাঠানো হয়েছিলো। মেয়েটি আমর দরবেশকে বললো- ঐ সুদানী মুসলমান আমার পিতা-মাতা সম্পর্কে প্রশ্ন করে আমাকে অস্থির করে তুলেছিলো। ইতিপূর্বে তিনি ব্যতীত আর কেউ আমাকে আমার পিতা-মাতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেনি। তাই অপ্রীতিকর প্রশ্নের ফলে আমি রাত ভাবতে থাকি, আমার পিতামাতা কারা এবং কিরূপ ছিলেন ছিলো তো অবশ্যই। কিছু কিছু স্মৃতি মনে আসে আবার অন্ধকারে হারিয়ে যায়। এখন আমি নিজেকে তাদের স্বরণ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু সফল হইনি। আজ আপনি পুনরায় নতুন করে তাদের কথা মনে করিয়ে দিলেন। আমার পিতা-মাতা থাকতে পারে- এমন ভাবনা যখন আমার থাকে না, তখন আমি ভালো থাকি।

তোমার কোনো ভাই ছিলো?

স্মরণ নেই- আশি বললো- রক্ত সম্পর্ক কী জিনিস, আমি জানি না।

 তোমার ঘুম আসছে, শুয়ে পড়ে। আমর দরবেশ বললেন।

আমার মন চায় বসে বসে আপনার কথা শুনি- আশি বললো- আপনার। মতো মানুষগুলোকে আমার খুব ভালো লাগে। আমি যারই সঙ্গে কিছু সময় অতিবাহিত করি, তার প্রতি আমার ঘৃণা জন্মে যায়। আপনার পূর্বে যে সুদানী মুসলমান এখানে এসেছিলো, তাকে আমার সারাজীবন স্মরণ থাকবে। আর আপনি দ্বিতীয় ব্যক্তি, যাকে আমি আজীবন শ্রদ্ধা করবো। আপনি আমার মধ্যে আত্মা ও চেতনাকে জাগ্রত করে দিয়েছেন। আপনি সম্ভবত আমাকে হৃদয়ের চোখে দেখছেন। অন্যরা আমাকে দেখে ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে।

আমি তোমাকে সম্ভ্রমহারা নারী মনে করতাম- আমর দরবেশ বললেন কিন্তু এখন দেখছি তুমি বুদ্ধির কথা বলছে।

আমি প্রিয়দর্শিনী ও মধুর বিষ- আশি বললো- আমাকে পাথরকে মোমে পরিণত করার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। আমি কোনো সহজ-সরল মেয়ে নই। আমি প্রতাপান্বিত শাসকের তরবারী আমার পায়ের উপর রাখাতে জানি। আমি আলেমদের আদর্শ পরিবর্তন করে দিতে পারি। কিন্তু এখন নিজেকে এমন এক মোম বলে মনে হচ্ছে, যা সামান্য তাপেই গলে যাবে, যা কোনো পাথরকে, গলাতে সক্ষম নয়।

এটা আমার বক্তব্যের ক্রিয়া নয়- আমর দরবেশ বললেন- এটা আমার ঈমানের উত্তাপ, যা তোমাকে বিগলিত করে ফেলেছে। আমি তোমার মাঝে রক্ত সম্পর্ক জাগিয়ে দিয়েছি। তুমি মানুষ। তুমি কারো কন্যা, তুমি কারো। বোন। তুমি কোনো একটি জাতির স্ট্রম।

রাত কেটে যাচ্ছে। একদিকে ঘুমের আবেশ, অপরদিকে আমর দরবেরি বক্তব্য আশির উপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মেয়েটি পালংকের কোণে বসা ছিলো। সেখানেই এলিয়ে পড়ে সে।

ঘুম ভাঙ্গার পর আশি দেখতে পেলো, সে পালংকে শায়িত আর আমর দরবেশ মেঝেতে। ঘুমন্ত আমরের প্রতি এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে আশি। বুকের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য জেগে ওঠে। নিজের গওদেশে অশ্রুর উপস্থিতি অনুভব করে সে। বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবে, আরে আমার অশ্রুও তে আছে তাহলে। ইতিপূর্বে আশির চোখ থেকে কখনো অশ্রু বের হয়নি। ধীরে ধীরে আমর দরবেশের নিকটে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বলে তার ডান হাতটা উপরে তুলে এনে নিজের চোখের সঙ্গে লাগায়।

আমর দরবেশের ঘুম ভেঙ্গে যায়। তাকিয়ে দেখে, আশি তার পাশে বসা। মুখে কথা নেই, হাসিও নেই। এ কথাও বললো না, মেঝেতে ঘুমানো তোমার পক্ষে ঠিক হয়নি। সে নীরবে বাইরে চলে যায়। পানি নিয়ে ফিরে আসে। আমর দরবেশ এই পানি দ্বারা ওজু করে নামাযে দাঁড়িয়ে যান। আশি কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়।

***

নাস্তার পর দুজন খৃস্টানের সুদানী সালার এসে উপস্থিত হয়।

আমার একটি কথা মনোযোগ সহকারে শুনে নাও- আমর দরবেশ সালারকে বললেন- যে কোনো সময় আমার ইসহাককে প্রয়োজন হতে পারে। তাকে অস্থির না করে খোলামেলা আরামদায়ক কক্ষে থাকতে দিন। পাতাল কক্ষ থেকে সরিয়ে তাকে উপরে নিয়ে আসা হোক। তিনি আমার বন্ধু। আমি যখন তার প্রয়োজন অনুভব করবে, তখন আমিই তাকে বুঝিয়ে নেবো। প্রয়োজন হলে ধোঁকা দিয়ে হলেও তার থেকে কাজ নেবো। তখন যদি তিনি মতে না আসেন, তখন তার সঙ্গে যা খুশি আচরণ করুন।

সুদানী সালার বললো- তাই হবে।

খৃস্টান উপদেষ্টাগণ আমর দরবেশকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। তিনি ভালোভাবেই প্রশিক্ষণ রপ্ত করেন। তারা তাকে যা যা বলেছে, তাও তিনি মুখে আওড়াতে থাকে। চার-পাঁচ দিন পর্যন্ত তার প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। দিনে তার সঙ্গে থাকে খৃষ্টান উপদেষ্টারা, আর রাতে আশি। এই মেয়েটি তার ভক্তে পরিণত হয়ে যায়। কিন্তু দুএকদিন আমর দরবেশের সাহচর্যে থাকার পর এখন তার নিজেকে পবিত্র বলে মনে হচ্ছে।

একটানা ছয় দিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পর আমর দরবেশ সপ্তম দিন একজন দরবেশের বেশে নিজ এলাকায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। তাকে দরবেশ ও দেওয়ানা আলেমের পোশাক পরিধান করানো হলো। আশি তাকে বলেছিলো, আপনি যখন মিশন নিয়ে রওনা হবেন, আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবেন। তার আবার রক্ষার্থে আমর দরবেশ সুদানী সালারকে বললেন, পুরস্কার স্বরূপ মেয়েটিকে আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই। আমি তাকে সঙ্গে রাখতে চাই। সালার তার আবেদন মেনে নেয়। আশিকে তার সঙ্গে দেয়া হলো। প্রদান করা হলো তিনটি উট। একটিতে আমর দরবেশ আক্লোন করেন। একটিতে আরোহন করে আশি। অপরটিতে বোঝাই করা হলো তাঁর ও রসদ-সামন।

রওনা হওয়ার প্রাক্কালে সুদানী সালর আমর দরবেশকে অবহিত করে, ইসহাককে পাতাল কক্ষ থেকে বের করে উপরে আরামদায়ক উন্মুক্ত কক্ষে নিয়ে আসা হয়েছে। তাকে আরো জানানো হয়, মুসলমানদের এলাকায় আমাদের লোক আছে। তারা নিজ থেকে আপনার সঙ্গে মিলিত হবে এবং আপনাকে সাহায্য করবে।

আমর দরবেশ আশিকে সঙ্গে নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এক মিশনে রওনা হয়ে যান। আমর দরবেশকে রওনা করিয়েই সুদানী সালার নিজ কক্ষে চলে যায়। স্নেখানে ছয়জন লোক উপবিষ্ট। তারা সবাই সুদানী মুসলমান এবং পার্বত্য এলাকার বাসিন্দা। সুদান সরকার থেকে বহু সুযোগ-সুবিধা ও মান-মর্যাদা পাচ্ছে। নিজ এলাকায় খাঁটি মুসলমানরূপে জীবন-যাপন করে তারা।

সে রওনা হয়ে গেছে- সালার বললো- তোমরা অন্য পথে রওনা হও। একজন একজন করে যাবে। নিজ এলাকায় চলে যাও এবং তার উপর দৃষ্টি রাখো। যদি কখনো সন্দেহ হয় যে, সে ধোঁকা দিচ্ছে, তাহলে তাকে এমনভাবে খুন করে ফেলবে, যেনো কেউ টের না পায়। আমি আরো লোক পাঠাচ্ছি। তাদেরকে তোমাদের ঘরে থাকতে দেবে।

এরা একজন একজন করে রওনা হয়ে যায়। সুদানী সালার অপর দুজন লোককে ডেকে আনে। তারা সুদানী হলেও মুসলমান নয়। সালার তাদেরকে বললো- এই মুসলমানদের উপর ভরসা রাখা যায় না। নিজ এলাকায় গিয়ে কী করে বলা যায় না। এই যে ছয়জন লোক রওনা হয়ে গেলো, ওরা। আমাদেরই লোক। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, ওরা মুসলমান। ওখানে গিয়ে তাদের নিয়ত পাল্টে যেতে পারে। আমর দরবেশ যদি ঠিক থাকে, তাহলে তোমাদের দাহ্য পদার্থের প্রয়োজন হতে পারে। সেগুলো এদের ঘরে লুকিয়ে রাখা আছে। এগুলো কখন কোথায় ব্যবহার করতে হবে, তা তোমাদের জানা আছে।

এই দুজনও রওনা হয়ে যায়।

যে সিপাহী সুদানী কমান্ডারকে হত্যা করে ইসহাকের স্ত্রী ও কন্যাকে রক্ষা করেছিলো, এখন সে ইসহাকের ঘরে অবস্থান করছে। আমর দরবেশ যেদিন রওনা হলো, সেদিন বাইরে এক স্থানে ঘোরাফেরা করছিলো। হঠাৎ একদিক থেকে একটি তীর এসে তার গা-ঘেঁষে একটি গাছে গিয়ে বিদ্ধ হয়। সিপাহী দৌড়ে ইসহাকের ঘরে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। ইসহাকের পিতাকে ঘটনাটি অবহিত করে। কিন্তু তীর কে ছুঁড়তে পারে, কেউই বুঝে উঠতে পারলো না। এটা যে তাকে হত্যা করার সুদানীদের প্রথম প্রচেষ্টা, তা কেউ জানে না।

***

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান আলী বিন সুফিয়ান কায়রোতে অবস্থান করছেন। অপরদিকে সুলতান আইউবী, ক্রুসেডারদের সুহৃদ মুসলিম শাসক সাইফুদ্দীন, গোমস্তগীন ও আল-মালিকুস সালিহ-এর বাহিনীকে পরাজিত করে তাদের কেন্দ্রীয় শহর হালবের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। সুলতান আইউবীর এই মুসলিম বিরুদ্ধবাদীরা এমন বিশৃঙ্খল অবস্থায় পলায়ন করেছিলো যে, পথে কোথাও দাঁড়াতে পারেনি। পথে এমন তিন-চারটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছিলো, যেখানে তারা যাত্রাবিরতি দিয়ে বিক্ষিপ্ত সৈনিকদেরকে গুছিয়ে নিয়ে সুলতান আইউবীর মোকাবেলা করতে পারতো। কিন্তু সেসব পথে না গিয়ে তারা পিছু হটার জন্য এমন পথ অবলম্বন করে, যেটি সামরিক দিক থেকে তাদের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। সুলতান আইউবী অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখেন এবং ঐসব গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো দখল করে নেন। তার গন্তব্য হাল।

গোয়েন্দা মারফত প্রাপ্ত তথ্যাবলীতে সুলতান জানতে পারছেন মিশরে কখন কী ষড়যন্ত্র মাথা তুলছে। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে তিনি কখনো পেরেশান হতেন না। কিন্তু ইসলাম ও ইসলামী সাম্রাজ্য বিরোধী ষড়যন্ত্র তাকে বেচাইন করে তুললো। আর এই বাস্তবতা ছিলো তার জন্য বিষের ন্যায় তিক্ত যে, এসব ষড়যন্ত্রের হো হলো খৃষ্টানরা আর এর ক্রীড়নক মুসলমান। আলী বিন সুফিয়ান তার ডান হাত। বরং বলা যায় আলী তাঁর চোখ-কান। নিজের অবর্তমানে সুলতান তাকে মিশর রেখে এসেছেন এবং তার সহকারী হাসান ইবনে আবদুল্লাহকে নিজের সঙ্গে নিয়ে আসেন। মিশরের শাসনক্ষমতা আইউবীর ভাই আল-আদিলের হাতে। নিজ ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে আল আদিল রাতে ঘুমান সামান্য। আলী বিন সুফিয়ানকে সব সময় সঙ্গে রাখেন। এভাবেই বর্তমানে মিশরের শান্তি, নিরাপত্তা ও এই ভূখণ্ডে ইসলামের মান অস্তিত্ব সুরক্ষার দায়িত্ব এই দুব্যক্তির হাতে ন্যাস্ত।

আল-আদিল ও আলী বিন সুফিয়ানের ভালোভাবেই জানা আছে, সুলতান আইউবীর অবর্তমানে মিশরে নাশকতা বেড়ে চলেছে। তাছাড়া সুদানের দিক থেকে আশংকা বিদ্যমান। মাস চারেক আগে আল-আদিল সুদানীদের ভয়ংকর এক ষড়যন্ত্রকে অবিশ্বাস্য সাফল্যের সাথে নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে সুদানীদের ষড়যন্ত্র বন্ধ হয়নি। কারণ, তাদের যে হামলাটি ব্যর্থ হয়েছিলো, সেটি তাদের নিয়মিত ফৌজের হামলা ছিলো না। সেই হামলা ব্যর্থ হওয়ার পরও সুদানের নিয়মিত সেনাবাহিনী কোনো প্রকার ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই প্রস্তুত ছিলো। এই বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলো খৃষ্টানরা। এমনকি কোনো কোনো ইউনিটের কমান্ডও ছিলো খৃস্টানদের হাতে।

তার প্রমাণ, সুদানের হামলার মোকাবেলায় সীমান্তে সীমান্ত বাহিনীর সেনাসংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। তাছাড়া আলী বিন সুফিয়ান বিপুলসংখ্যক গোয়েন্দা সদস্যকে সীমান্ত এলাকায় ছড়িয়ে দিয়েছেন। তারা মরু মুসাফির ও যাযাবরের বেশে সীমান্ত এলাকায় ঘোরাফেরা করছে। সীমান্ত চৌকিগুলোর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়েছে। এসব চৌকিতে তাদের জন্য ঘোড়া প্রস্তুত থাকছে। সীমান্ত বাহিনীগুলোর টহলসেনারাও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। পাশাপাশি আছে আরো একটি আয়োজন। আলী বিন সুফিয়ানের কয়েকজন অভিজ্ঞ গোয়েন্দা বণিকের বেশে সুদানের সঙ্গে অবৈধ ব্যবসা করছে, যাকে চোরাচালানী বলা হয়। পণ্য দিয়ে তাদেরকে সীমান্ত পার করিয়ে দেয়া হতো। এরা সুদান গিয়ে বলতো, আমরা মিশরের সীমান্ত বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে এসেছি। সুদানে কিছু কিছু পণ্যের অভাব ছিলো। তন্মধ্যে সবজি উল্লেখযোগ্য। সুলতান আইউবীর পরামর্শে মিশরে অধিক হারে সবজি উৎপাদন করা হতো, যার একাংশ সুদান পাচারের মাধ্যমে সুদানের গোপন তথ্য সংগ্রহ করা হতো।

সুদানের যেসব ব্যবসায়ী মিশরী বণিকদের সঙ্গে কারবার করতো, তাদেরও অধিকাংশ গুপ্তচর, যারা মিশরের পক্ষে কাজ করতো। মিশরী গোয়েন্দারাই তাদেরকে তৈরি করে নিয়েছে। গুপ্তচরবৃত্তির এই পদ্ধতি সফল হলে সুলতান আইউবী নির্দেশ প্রদান করেন, সুদানের জন্য পণ্যের দাম সস্তা করে দাও, যাতে আমাদের এই কর্মপদ্ধতি সমগ্র সুদানে জালের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে। সুলতানের নির্দেশ মোতাবেক জাল ছড়িয়ে দেয়া হলো এবং সুদানী ফৌজ ও সরকারের প্রতিটি গতিবিধি কায়রোতে গোচরীভূত হতে লাগলো। আলী বিন সুফিয়ান সীমান্তের কাছাকাছি দুতিনটি জরুরী কেন্দ্র স্থাপন করে দেন। যখনই ওদিক থেকে কোনো সংবাদ আসতো, সঙ্গে সঙ্গে সীমান্তের কোনো না কোনো কেন্দ্র হয়ে সেই সংবাদ বিদ্যুাতিসম্পন্ন ঘোড়ায় চড়ে কায়রো পৌঁছে যেতো। এ কাজের জন্য যেসব বাহন রাখা হয়েছিলো, তারা দিন-রাত অবিরাম ছুটে চলার ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলো।

সুদানে একটি বিস্তৃত পাহাড়ী এলাকা আছে। সেখানকার অধিবাসীরা সবাই মুসলমান। তাদের অধিকাংশ মিশরী ফৌজের সৈনিক। বিষয়টি সুলতান আইউবী জানেন। তাঁর এ-ও জানা আছে, এ লোকগুলো সুদানী ফৌজে ভর্তি হতে চায় না। সুলতান আইউবীর শাসন ক্ষমতায় আসীন হওয়ার আগে মিশরী ফৌজে সুদানী হাবশী ও সুদানী মুসলমান সবাই ভর্তি হতো। তাদের কমান্ডারও ছিলো এক সুদানী। প্রিয় পাঠকদের হয়েতো মনে আছে, সেই কমান্ডারের নাম নাজি। সুলতান আইউবীর আগে নাজিই ছিলো মিশরের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। অথচ, দেশে খেলাফতের মসনদও ছিলো নিয়মতান্ত্রিক। এমারতও ছিলো। খলীফা বলুন কিংবা আমীর, তারা প্রকৃত অর্থে রাজা ছিলেন। খৃস্টানরা মিশরকে সালতানাতে ইসলামিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করার পক্ষে এখানে নাশকতা ও ষড়যন্ত্রের আখড়া প্রতিষ্ঠিত করে। নাজি তাদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। সে মিশরের সুদানী ফৌজকে নিজের মুঠোয় নিয়ে নেয়। এই বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিলো পঞ্চাশ হাজার।

মিশরের শাসনক্ষমতা হাতে নেয়ার পর সুলতান আইউবীর সঙ্গে প্রথম সংঘাতটা হয় নাজির সঙ্গে। তিনি নূরুদ্দীন জঙ্গীর নিকট থেকে বাছাইকৃত জানবাজ সৈন্য এনে মিশরের পঞ্চাশ হাজার সুদানী ফৌজকে ভেঙ্গে দেন। তার কতিপয় সালারকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন এবং নতুন বাহিনী গঠন করে নেন। তার অল্প কদিন পরই তিনি আদেশ জারি করেন যে, সুদানের অপসারিত সৈন্যদের যারা আনুগত্যের শপথ নিয়ে নিষ্ঠার সাথে মিশরী ফৌজে শামিল হতে আগ্রহী, তাদেরকে ভর্তি করে নেয়া হোক। ফলে যেসব সুদানী মুসলমান মিশরী ফৌজে ছিলো, তারা সকলে ফিরে আসে। তারা বুঝতে সক্ষম হয়, তাদেরকে অমুসলিম ষড়যন্ত্রের ক্রীড়নকে পরিণত করা হয়েছিলো। সুলতান আইউবীর ফৌজে শামিল হয়ে যখন তারা খৃস্টানদের বিরুদ্ধে দুতিনটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং সুলতানকে কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করে, তখন তাদের ঈমান তাজা হয়ে যায়। সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাদেরকে দ্বীন, ঈমান ও জাতীয় মর্যাদার উপদেশও প্রদান করা হতো। তাদেরকে বুঝানো হতো, যারা তাদের ধর্মের শক্ত, তারা তাদেরও শক্ত, যাদের চাখে মুসলিম মা-বোনদের কোনো মর্যাদা নেই। সুলতান আইউবীর যে বাহিনীটি আরবে লড়াই করেছে, তাদের বেশীরভাগ সৈন্যই সুদানী মুসলমান।

সুদান সরকার তথাকার মুসলমানদের নানাভাবে বাধ্য করার চেষ্টা করছে বে, মিশরী ফৌজে ভর্তি হওয়ার পরিবর্তে সুদানী ফৌজে ভর্তি হবে। কায়রোর গোয়েন্দা বিভাগ এ বিষয়ে অবগত। সুদানীরা মুসলমানদের উপর নিপীড়ন গলিয়েও দেখেছে। এর ফলে সুদানের ঊর্ধ্বতন এক সামরিক অফিসার গুপ্তভাবে খুনও হয়েছে। সুদান সেই এলাকায় যথারীতি সামরিক অভিযানও রিচালনা করেছিলো। মুসলমানরা সুদানী বাহিনীকে পাহাড়-উপত্যকায় ভঙ্গ করে হত্যা করেছিলো ও তাড়িয়ে দিয়েছিলো। সেখানকার ভৌগোলিক ঠামো মুসলমানদের পক্ষে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে। পাহাড় না তাদের নিরাপত্তা বিধান করতো। এই মুসলমানরা যোদ্ধাও ছিলো বটে।

 সুলতান আইউবী আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা বিভাগের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে রেখেছিলেন। মিশরী বণিক কাফেলার মাধ্যমে তাদেরকে এতো পরিমাণ অস্ত্র দিয়ে রেখেছিলেন, যার দ্বারা তারা সারাবছর অবরোধের মধ্যেও লড়াই করতে সক্ষম ছিলো। তাদেরকে ক্ষুদ্র মিনজানীক এবং দাহ্য পদার্থও সরবরাহ করা হয়েছিলো। সুদানী মুসলমানরা সেগুলো ঘরে ঘরে লুকিয়ে রেখেছিলো। সুলতান আইউবীর পরিকল্পনা ছিলো, সামরিক অভিযান কিংবা অন্য কোনো উপায়ে উক্ত অঞ্চলকে মিশরের অন্তর্ভুক্ত করে নেবেন, যাতে সেখানকার মুসলমানরা সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে। এই অবস্থান সীমান্ত থেকে আধা দিনের পথ। আলী বিন সুফিয়ান সেখানে তার গোয়েন্দা পাঠিয়ে রেখেছিলেন, যারা শুধু সংবাদদাতাই নয় অভিজ্ঞ কমান্ডো যোদ্ধাও ছিলো।

এই মুসলমানদের সংখ্যা ছিলো পাঁচ হাজার। সংখ্যায় কম হলেও তার বিরাট এক সামরিক শক্তি। এদের বাদ দিলে সুদানের হাতে থাকে শুধু কতিপয় হাবশী, যাদের কোনো সামরিক ঐতিহ্য নেই। তারা লড়াই করতে বেতনভোগী কর্মচারী হিসেবে। যুদ্ধের ময়দানে তাদের অবস্থা এই দাঁড়াতে যে, যদি তাতে দুশমনের পা উপড়ে যাওয়ার উপক্রম হতো, তাহলে তারা সিংহে পরিণত হতো। পক্ষান্তরে সামান্য বেকায়দায় পড়ে গেলে তারা পিছু হটতে শুরু করতো।

 ইতিমধ্যে তাদের প্রশিক্ষণের জন্য খৃষ্টান বিশেষজ্ঞরা এসে গেছে এবং মিশরী ফৌজের দুতিনজন গাদ্দার সালার সোনা-দানার লোভে সুদান চলে এসেছে। খৃস্টান বিশেষজ্ঞ দল ও মিশরী সালারদের বদৌলতে সুদানী ফৌজে কিছুটা যোগ্যতা সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণেই সুদান সরকার মিশরের উপর প্রকাশ্য হামলা করতে ভয় পেতো এবং এ কারণেই সুদান মুসলমানদেরকে অদের ফৌজে শামিল করার চেষ্টা করছিলো। খ্রস্টান উপদেষ্টারা জানতো, পঞ্চাশ হাজার হাশীর মোকাবেলায় পাঁচ হাজার মুসলমানই যথেষ্ট।

***

 আলী বিন সুফিয়ান সংবাদ পেয়ে গেছেন যে, সুদানের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় সে দেশেরই কয়েদখানার এক সিপাহী সুদানী ফৌজের এক কমান্ডারকে হত্যা করে মুসলমানদের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সংবাদদাতা গুপ্তচর আলীকে পুরো ঘটনা শোনায়। এ গুপ্তচর ঘটনাটা সরাসরি সিপাহীর মুখ থেকে শুনে এসেছে এবং এ তথ্যও জেনে এসেছে যে, ইসহাক নামক এক মিশরী কমান্ডার সুদানের কয়েদখানায় বন্দী আছেন এবং এ উদ্দেশ্যে তার উপর নিপীড়ন চালানো হচ্ছে, যেনো তিনি তার এলাকার মুসলমানদের সুদানের অনুগত বানিয়ে দেন। গোয়েন্দা আলী বিন সুফিয়ানকে এ তথ্যও প্রদান করেন যে, উক্ত কমান্ডারের নিজ এলাকায় বেশ প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে।

ইসহাককে কয়েদখানা থেকে মুক্ত করা জরুরী মনে হচ্ছে- রিপোর্টটা মিশরের ভারপ্রাপ্ত গবর্নর আল-আদিলকে অবহিত করে আলী বিন সুফিয়ান বললেন- আপনি তো জানেন, কয়েদখানায় কিরূপ নিপীড়ন চলে। সেখানে শথিরও কথা বলতে বাধ্য হয়। নির্যাতনে বাধ্য হয়ে ইসহাক সুদানীদের অনুগত হয়ে যেতে পারে। আমি এ তথ্যও পেয়েছি, আমাদের আরো দুতিনজন মুসলমান কমান্ডার সুদানের কয়েদখানায় বন্দী আছে। তাদের এত্যেকেরই উপর নিপীড়ন চলছে। আমি তো আপনাকে এ পরামর্শ দিতেও কুণ্ঠাবোধ করবো না, আমাদের কয়েকজন কমান্ডো সেনাকে সুদানের মুসলিম এলাকায় প্রেরণ করুন। আমার আশংকা হচ্ছে, কমান্ডার হত্যার প্রতিশোধ রূপ সুদানী বাহিনী মুসলমানদের উপর আক্রমণ করে বসবে।

অন্য দেশে কমান্ডো প্রেরণ করার আগে আমাদেরকে সবদিক ভালোভাবে বিবেচনা করে দেখতে হবে- আল-আদিল বললেন- এর পরিণতিতে প্রকাশ্য যুদ্ধও বেঁধে যেতে পারে।

আমাদের হাতে ভাববার মতো সময় নেই- আলী বিন সুফিয়ান বললেন এক্ষুণি আমাদেরকে দুটি অভিযান পরিচালনা করা আবশ্যক। প্রথমত, একজন বিচক্ষণ দূতকে পয়গাম দিয়ে মোহতারাম সুলতানের নিকট প্রেরণ করতে হবে এবং তার সিদ্ধান্ত জানতে হবে। দ্বিতীয়ত, আমি স্বয়ং সুদানে প্রবেশ করে মুসলমানদের এলাকায় চলে যাবো। ওখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। পরিস্থিতির সঠিক চিত্র শুধু আমার চোখই দেখতে পারে। হতে পারে, ওখানে ফৌজ হামলা করবে না। ওখানে খৃষ্টানও আছে। তারা মুসলমানদেরকে কুসংস্কারে লিপ্ত করে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী ও বিশ্বাসের ভিত টলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে পারে। মসজিদে মসজিদে তাদের প্রশিক্ষিত মাওলানা প্রেরণ করে মুসমানদের বিভ্রান্ত করতে পারে। তারা মিশরে অনুপ্রবেশ করেও এমন চাল চেলেছে। আমার প্রবল আশংকা, তারা মুসলমানদের বিশ্বাস ও জাতীয় চেতনার উপর হামলা চালাবে। আপনার তো জানা আছে, আমাদের মুসলিম সম্প্রদায় দুশমনের আবেগময় ও উত্তেজনাকর বক্তব্যে দ্রুত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। আমাদের শত্রুরা বুঝে ফেলেছে, মুসলমানকে যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত করা সহজ নয়। বিকল্প হিসেবে তারা বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনার যুদ্ধে এমন অস্ত্র ব্যবহার করে, মুসলমান তাতে কাবু হয়ে যায়। আপনার অনুমতি পেলে আমি ওখানে চলে যাচ্ছি। আপনি সুলতান আইউবীর নিকট একজন দূত পাঠিয়ে দিন।

আপনার অবর্তমানে আপনার দায়িত্ব কে পালন করবে? আল-আদিল জিজ্ঞেস করেন।

গিয়াস বিলবীস- আলী বিন সুফিয়ান জিজ্ঞাসার জবাব দেন তার সঙ্গে আমার এক সহকারী যাহেদীনও থাকবে। আপনি আমার অনুপস্থিতি টেরই পাবেন না।

ভালোভাবেই টের পাবো- আল-আদিল বললেন- আপনি শত্রুর দেশে যাচ্ছেন। যদি ফিরে আসতে না পারেন, তাহলে মিশর অন্ধ ও বোবা হয়ে যাবে।

আমি না থাকলে জাতি মরে যাবে না- আলী বিন সুফিয়ান মুচকি হেসে বললেন- ব্যক্তি যখন জাতির জন্য প্রাণ দেয়, তখন জাতি জীবিত থাকে। সুলতান আইউবী যদি মনে করতেন, তিনি মৃত্যুবরণ করলে জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে, তাহলে তিনি ঘরেই বসে থাকতেন আর সালতানাতে ইসলামিয়া খৃষ্টানদের হাতে চলে যেতো। সুলতানের এই নীতিটা আমার বড়ই ভালো লাগে যে, তিনি বলে থাকেন, দুশমনের অপেক্ষায় ঘরে বসে থেকো না। বরং তার উপর দৃষ্টি রাখো। যদি তাকে প্রস্তুত অবস্থায় দেখতে পাও, তাহলে তার পার্শ্ব কিংবা পেছনে চলে যাও। আমি সেই নীতির ভিত্তিতেই সুদান যাচ্ছি। দুশমন যদি মুসলমানদের এলাকায় সাফল্য অর্জন করেই ফেলে, তাহলে আমরা আমাদের কোন্ কীর্তির জন্য গর্ব করবো?

ঠিক আছে, আপনি যান- আল-আদিল বললেন- আমি সুলতানের নামে পয়গাম লিখে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

আলী বিন সুফিয়ান সুদান সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে চলে যান। আল আদিল কাতিবকে ডেকে পয়গাম লেখাতে শুরু করেন। তিনি সুদানের মুসলমানদের খবরাখবর বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করান। এ-ও লিখান যে, এই বার্তা আপনার হাতে পৌঁছার আগে আলী বিন সুফিয়ান সুদান গিয়ে পৌঁছবেন। তিনি বার্তায় আলী বিন সুফিয়ানের পরামর্শের কথাও উল্লেখ করেন। অবশেষে সুলতানের নিকট সিদ্ধান্ত প্রার্থনা করেন।

পত্ৰখানা দূতের হাতে দিয়ে আল-আদিল বললেন, প্রতিটি চৌকি থেকে ঘোড়া বদল করে নেবে এবং কোনো অবস্থাতেই ঘোড়র গতি মন্থর হতে দেবে না। পানাহার ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠেই সমাধা করবে। পথে যদি দুশমনের হাতে পড়ে যাও, তাহলে যে কোনোভাবে হোক পত্ৰখানা নষ্ট করে ফেলবে।

দূত রওনা হয়ে যায়।

আমর দরবেশ শহর ছেড়ে বহুদূর চলে গেছেন। এখন তার আশপাশে কোনো বসতি নেই। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। তিনি রাত যাপনের জন্য উপযুক্ত একটি জায়গার সন্ধান করছেন। দূরে এক স্থানে কিছু গাছ-গাছালী চোখে পড়লো। সেখানে পানিও থাকতে পারে। কিন্তু তার কাছে পানির মজুদ আছে। উটগুলোকেও পানি পান করানোর প্রয়োজন নেই। তিনি মরু দস্যুদের আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকার জন্য বৃক্ষময় এলাকা থেকে দূরে অবস্থান করতে চান। তার সঙ্গে কালো বোরকায় আবৃতা আশি। অত্যন্ত মূল্যবান মেয়ে। ডাকাত দলের চোখে পড়ে গেলে তার রক্ষা পাওয়া অসম্ভব। ভেবে-চিন্তে আমর দরবেশ পার্শ্বেই এক স্থানে নেমে পড়েন এবং সেখানেই তাঁবু স্থাপন করেন।

হঠাৎ আমর দরবেশ দুজন উজ্জ্বারোহীকে তাদের দিকে আসতে দেখেন। তিনি আশিকে তাঁবুর ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে পর্দা ফেলে দেন এবং নিজে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। তার চোগার ভেতরে তরবারী লুকায়িত আছে। আছে মঞ্জরও। তাঁবুতে দুটি ধনুক ও অনেকগুলো তীর আছে।

উষ্ট্রারোহীদেরকে নিজের দিকে আসতে দেখে আমর দরবেশ ভাবতে শুরু করলেন, ওরা যদি ডাকাত হয়ে থাকে, তাহলে কি আমি তাদের মোকাবেলা করতে পারবো। তবে মোকাবেলা করতে হলে আশিকে তিনি সঙ্গে পাবেন বলে নিশ্চিত। তিনি জানেন, আশি শুধু মনোমুগ্ধকর মেয়েই নয়- লড়াকুও বটে। তার তীর চালনার প্রশিক্ষণ আছে। সে খৃস্টানদের গড়া এক নাশকতাকারী নারী।

 উষ্ট্রারোহীরা এগিয়ে আসছে। আমর দরবেশ তাদের প্রতি মুখ রেখে আশিকে বললেন- ধনুকে তীর সংযোজন করো। ওরা যদি ডাকাত প্রমাণিত হয়, তাহলে পেছন থেকে তীর ছুঁড়বে।

উষ্ট্রারোহীরা তাঁবুর নিকটে এসে দাঁড়িয়ে যায়। একজন উটের পিঠ থেকেই জিজ্ঞেস করে-তোমরা কারা? কোথায় যাচ্ছো?

আমর দরবেশ আকাশপানে হাত তুলে চোখ বন্ধ করে বললেন- যার বুকে, আসমানের পয়গাম থাকে, তার কোনো গন্তব্য থাকে না। আমি কে? আমিও তো জানি না। আসমান থেকে একটি পয়গাম আসলো। আমার বুকে গেঁথে গেলো। তারপর ভুলে গেলাম, আমি কে, আমি কোথায় যাচ্ছি। সে সত্ত্বাআমার বুকে আলো প্রজ্বলিত করেছেন, তিনিই বলতে পারেন, আমি কে, কোথায় যাচ্ছি। এখানে আমার ইচ্ছার কোন দখল নেই। আমি এখন সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছি। সকালবেলা হয়তো আবার পেছন দিকে হাঁটা দেবো।

আগন্তুক দুজন উটের পিঠ থেকে নেমে আসে। একজন বললো আপনাকে তো একজন পীর-পয়গম্বর বলে মনে হচ্ছে। আমরা উভয়ে মুসলমান। আপনি কি গায়েবের খবর বলতে পারেন আমাদের ন্যায় গুনাহগারদেরকে সোজা পথ দেখাতে পারেন?

আমিও মুসলমান- আমর দরবেশ আপ্লুত কণ্ঠে বললেন- তোমরাও মুসলমান। আমি তোমাদের ধ্বংস দেখতে পাচ্ছি। আমিও তোমাদের ন্যায় ঘুরেফিরে জিজ্ঞেস করতাম, সোজা পথ কোটি। কিন্তু কেউ বলতে পারেনি। একদিন রক্তরঞ্জিত কতগুলো লাশের মধ্যে আমি সবুজ বর্ণের চোগা পরিহিত সাদা দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। তিনি আমাকে লাশের মধ্য থেকে তুলে এনে সোজা পথের সন্ধান দিলেন। পরক্ষণেই তিনি লাশগুলোর খুনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তো পাহাড়ে-জঙ্গলে বসবাস না করে তোমরা মরু এলাকায় চলে যাও। মিশরের নাম ভুলে যাও। ওটা ফেরাউনদের দেশ। ওখানে যখন যিনি রাজার আসনে আসীন হন, মিশরের; মাটি ও বাতাস তাকেই ফেরাউন বানিয়ে দেয়।

এখন তো সেখানকার রাজা সালাহুদ্দীন আইউবী- এক উদ্যারোহী বললো- তিনি তো খাঁটি মুসলমান।

সালাহুদ্দীন আইউবী নামের মুসলমান- আমর দরবেশ এমন ভঙ্গীতে বললেন, যেন তিনি স্বপ্ন দেখছেন- সে-ই তো তোমাদের ধ্বংস ডেকে আনছে। তোমরা যে মাটির তৈরি, সেই মাটির মর্যাদার জন্য রক্ত ঝরাও। তোমরা সুদানের সন্তান।

কিন্তু সুদানের রাজা তো কাফির। উল্লারোহী বললো।

তিনি মুসলমান হয়ে যাবেন- আমর দরবেশ বললেন- তিনি। মুসলমানদের পথে অগ্রসর হচ্ছেন। তার ফৌজ কাফিরদের ফৌজ। তাই তিনি ইসলামের নাম মুখে আনেন না। তোমরা চলে যাও। তরবারী, বর্শা, তীর ধনুক নিয়ে যাও। উট-ঘোড়র উপর সওয়ার হয়ে যাও। তাকে বলল, তোমরা তার মোহাফেজঁ। তোমরা সুদানের মোহাফেজ।

তারপর আমর দরবেশ হঠাৎ উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন- যাও, ওঠো, এখান থেকে চলে যাও।  

আগন্তুক দুজন উটের পিঠে চড়ে বসে এবং চলে যায়। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর একজন অপরজনকে বললো- ধোকা দেবে না।

আমার ধারণাও তাই- অপরজন বললো- পাক্কা মনে হচ্ছে, পাঠ ভুলেনি।

আশির মতো রূপসী মেয়ে যদি উপহার হিসেবে পেয়ে যাই, তাহলে পিতা মাতার বিরুদ্ধে চলে যেতেও কুণ্ঠিত হবো না। উষ্ট্রারোহী বললো।

চলো, আমরা ফিরে যাই- অপরজন বললো- গিয়ে বলবো, সব ঠিক আছে…। আচ্ছা, মেয়েটি বোধ হয় তাঁবুতে আছে।

লোকটা সতর্ক মনে হচ্ছে। মেয়েটাকে লুকিয়ে রেখেছে- একজন বললো- আমাদেরকে তাদের হেফাজত করার প্রয়োজন নেই।

প্রয়োজন নেই- অপরজন বললো- সৈনিক মানুষ। সঙ্গে অস্ত্র আছে। তীর-ধনুকও আছে। আশিও সতর্ক মেয়ে।

এরা দুজন, সুদানী গুপ্তচর। আমর দরবেশ পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করছে কিনা জানবার জন্য তাদেরকে পেছনে প্রেরণ করা হয়েছে। আমর দরবেশও বিচক্ষণতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে দিয়েছেন, যার ফলে তারা নিশ্চিত হয়ে ফিরে গেছে।

ওরা ডাকাত নয়- তাঁবুতে প্রবেশ করে আমর দরবেশ আশিকে বললেন চলে গেছে।

এরা দস্যু অপেক্ষাও ভয়ংকর- আশি বললো- তুমি তাদেরকে যথার্থই উত্তর দিয়েছে। যারা তোমাকে এদিকে প্রেরণ করেছে, এরা তাদের গুপ্তচর। এরা খোঁজ নিতে এসেছে, তুমি তাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে কিনা।

তুমি কি এদেরকে চেনো।

আমি এদের গাছের ডাল- আশি বললো- যদি তাদের থেকে কেটে পড়ে যাই, তাহলে শুকিয়ে যাবো।

তাহলে তো আমাকে তোমার থেকেও সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

মেয়েটি হেসে ওঠলো এবং বললো- তুমি তো নিজেই আমাকে পুরস্কার স্বরূপ চেয়ে এনেছে।

***

তাঁবুতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আহমদ দরবেশ। আশিও ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ আশির চোখ খুলে যায়। বাইরে কতগুলো চিতা হুংকার দিয়ে বেড়াচ্ছে। উটগুলো ভয়ে দাঁড়িয়ে গেছে এবং ভয়ার্ত চিৎকার করছে। আশি আমর দরবেশকে জাগিয়ে তুলে বললো- আমি ভয়ে মরে যাচ্ছি। আমর দরবেশ বাইরের হুংকার-চিৎকার শুনতে পান। আশি বললো- এগুলো ব্যাঘ্ৰ। নিকটে আসবে না। উটগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। কোনো ভয় নেই। উটের ভয়ে ব্যারা পালিয়ে যাবে। 

হঠাৎ ব্যাঘ্রগুলো পরস্পর হামলে পড়ে। সবগুলো ব্যাঘ্র একসঙ্গে হুংকার ছাড়ে। আশি চিৎকার করে উঠে আমর দরবেশের গায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আমর বসা ছিলেন। তিনি মেয়েটিকে এমনভাবে কোলে ও বাহুবন্ধনে নিয়ে নেন, যেমনিভাবে মা তার ভয়পাওয়া শিশুকে লুকিয়ে ফেলেন। মেয়েটির সারা শরীর কাঁপছে। তার মুখ থেকে কথা বেরুচ্ছে না। ব্যাঘ্রগুলো পরস্পর লড়াই করতে করতে দূরে চলে যায়।

আমর দরবেশ মেয়েটিকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে বললেন- ওরা চলে গেছে। তুমি শুয়ে পড়ো।

না- আশি তার কোল থেকে মাথা সরালো না। ক্ষীণ কণ্ঠে বললো- তুমি আমাকে কিছুক্ষণ এভাবে থাকতে দাও।

এ দৃশ্য আমর দরবেশের পছন্দ নয়। তাঁর মনে ধারণা জন্মালো, মেয়েটি তাঁকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। তিনি আরো শক্ত পাথর হয়ে যান। এমন রূপসী মেয়ে ইতিপূর্বে তিনি কখনো ছুঁয়ে দেখেননি। এখন তার মনে হতে লাগলো, মেয়েটি এভাবে পড়ে থাকলে তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন না। যতো পাথরই হোন, তিনি মানুষ তো বটে। তদুপরি সুদেহী সুপুরুষ। আমর দরবেশ নিজের নফসের মোকাবেলা করতে শুরু করলেন।

কিছুক্ষণ পর মেয়েটি মাথা উঠায়। অন্ধকারে তার চেহারার প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। সে আমার দরবেশের মুখমণ্ডলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো- তুমি এক রাতে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে, আমার পিতা-মাতা কারা এবং কোথায়? তোমার যে সঙ্গী তোমার আগে উক্ত কক্ষে এসেছিলো, সেও আমাকে একই প্রশ্ন করেছিলো। তখন আমার এর উত্তর জানা ছিলো না। কিন্তু প্রশ্নটা আমাকে অস্থির করে তুলেছিলো এবং বহু অতীতের স্মৃতিমালা জাগিয়ে তুলেছিলো। কিছু স্মৃতি আমার স্মরণ আসছিলোও। কিন্তু পরক্ষণেই তা স্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিলো। আজ তা স্মরণে এসে গেছে। তুমি যখন বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে আমাকে কোলে তুলে লুকিয়ে ফেলেছিলে, তখন আমার স্মৃতিতে আলোর মতো চমকে উঠেছিলো। তার আলোকে আমি আমার বহু পুরনো স্মৃতি দেখতে পাই। আমি তখন বেশ ছোট ছিলাম। বাবা আমাকে ঠিক এমনি তার বুকে জড়িয়ে নিয়ে নিজ বাহুতে লুকিয়ে ফেলেছিলেন।

মেয়েটি নীরব হয়ে যায়। চুপচাপ স্মৃতির পাতা উল্টাতে থাকে সে। হঠাৎ শিশুর ন্যায় লাফিয়ে উঠে বললো- হ্যাঁ, আমার পিতা ছিলেন। এমনই মরু এলাকা ছিলো। রাত ছিলো না দিন ছিলো মনে পড়ছে না। আমরা একটি কাফেলার সঙ্গে যাচ্ছিলাম। অনেকগুলো অশ্বারোহী ধেয়ে এসে কাফেলার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের কাছে তরবারী ছিলো, বর্শা ছিলো। ভয়ানক এক দৃশ্য ছিলো, যা আজ তোমার কোল ও বাহুর উত্তাপে স্মৃতিতে জেগে উঠেছে। আব্বাজান আমাকে তোমারই ন্যায় আশ্রয়ে নিয়ে নিয়েছিলেন। হ্যাঁ, মায়ের কথাও মনে পড়ছে। মা আমার গায়ের উপর পড়ে গিয়েছিলেন। সম্ভবত, তিনি আমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। তারপর মনে পড়ছে, তিনি একদিকে পড়ে গিয়েছিলেন। আমার রক্তের কথাও মনে পড়ছে। এক ব্যক্তি আমাকে আমার বাহুতে ধরে তুলে নিয়েছিলো। একজন বলেছিলো- খাঁটি হিরা। জোয়ান হলে দেখবে। আমার সে সময়কার চিৎকারের কথাও মনে পড়ছে। সেদিন আমি আজ রাতের ন্যায় চিৎকার করছিলাম।

মস্তিষ্কের উপর বেশী চাপ সৃষ্টি করো না- আমর দরবেশ মেয়েটির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন- আমি তোমার পুরো কাহিনী বুঝে ফেলেছি। তুমি মুসলমানের সন্তান। তুমি আরব কিংবা ফিলিস্তিনের বাসিন্দা। খৃস্টানরা মুসলমানদের কাফেলা লুণ্ঠন করতো। এখনো যেসব অঞ্চল খৃস্টানদের দখলে, সেখানে তারা মুসলমানদের কাফেলা লুট করে থাকে। তারা সোনা-চাদি এবং তোমার ন্যায় রূপসী মেয়েদেরকে নিয়ে যায়। আমি বুঝে ফেলেছি, তুমি এ পর্যন্ত কিভাবে পৌঁছেছে।

আমি যখন সবকিছু বুঝতে শুরু করেছি, তখন আমি এমন বহু মেয়েকে দেখেছি- আশি বললো- আমাদেরকে উন্নতমানের খাবার ও দামী দামী পোশাক দেয়া হতো। গৌর বর্ণের পুরুষ-মহিলারা আমাদেরকে আদর করতো। তারা আমার মস্তিষ্ক থেকে সব স্মৃতি মুছে দিয়েছে। আমি ওখানেই বড় হয়েছি। জায়গাটি ছিলো জেরুজালেম। শৈশব থেকেই আমাদেরকে অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতার প্রশিক্ষণ শুরু হয়। মদও পান করানো হতো। আমাকে প্রথমে আরবী এবং পরে সুদানী ভাষা শিক্ষা দেয়া হয়। তারপর যখন আমি যৌবনে পা রাখি, তখন আমাকে এই কাজে ব্যবহার করা শুরু হয়, যে কাজে তুমি আমাকে দেখেছো। তীর-তরবারী চালনার তো আমাদেরকে বহু অনুশীলন করা হয়। আজ যখন তুমি আমাকে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় নিজ আশ্রয়ে নিয়ে নিয়েছে, তখন হঠাৎ আমার পিতার কথা মনে পড়ে যায়। আমার ব্যাপারে তাঁর আবেগ ছিলো পবিত্র। আর তোমার আবেগও পবিত্র। এ কারণেই আমি তোমাকে বলেছিলাম, আরো কিছু সময় আমাকে তোমার কোলে পড়ে থাকতে দাও। তোমার কোলে মাথা রেখে আমি পিতার মমতা অনুভব করছিলাম। আজ আমি শপথ নিলাম, আমি যতোদিন বেঁচে থাকবো, তোমার গোলাম হয়ে থাকবো। এখন আমি সুদানীদের কোনো কাজে আসবো না। এটা তোমারই স্বচ্চরিত্রতা ও সৎ নিয়তের সুফল। আমি মুসলমান। তুমি আমার শিরায় মুসলমান পিতার রক্ত ছড়িয়ে দিয়েছে। এখন আর আমি তোমাকে সেই কাজ করতে দেবো না, যে কাজের জন্য তুমে এসেছো। তুমি আমার ভেতরটায় ঈমানের প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছে।

কয়েকদিন তোমাকে এ কাজ করতে হবে- আমর দরবেশ বললেন আমি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে যাচ্ছি।

আমি তোমাকে সাহায্য করবো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *