৪.২ ক্রুশের ছায়াতলে

ক্রুশের ছায়াতলে

সুলতান আইউবী জরুরী বৈঠক তলব করেছেন। বৈঠকে অন্যদের সঙ্গে দামেস্কের আমীর একং সেনা কর্মকর্তাগণও উপস্থিত। কারো মন-মেজাজই ভালো নয়। শক্ররা সুলতান আইউবীর নিবেদিতপ্রাণ একজন রক্ষীসেনাকে দিয়ে তাঁর উপর সংহারী আক্রমণ চালিয়েছে ভেবে আইউবীর সামরিক কর্মকর্তাগণ হতবাক। আল্লাহর মেহেরবানী, সুলতান এবারও রক্ষা পেয়ে গেছেন।

বৈঠকে উপস্থিত সবাই ক্ষুদ্ধ-ক্রুদ্ধ। তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভভ আস-সালেহ ও. আমীর-উজীরদের থেকে প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর। তাদের ধারণা, সুলতান তাদেরকে হামলা সম্পর্কে আলোচনা করতে ডেকেছেন।

সুলতান আইউবীর বক্তব্য শেষ হল। সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতারা গর্জে ওঠলেন। তারা শত্রু থেকে প্রতিশোধ নেয়ার পক্ষে কথা বলতে শুরু করেন। সুতলান আইউবী ঠাণ্ডা মাথায় মুখে মুচকি হাসির রেখা টেনে বললেন- উত্তেজনা, ক্রোধ ও আবেগ পরিহার কর। দুশমন তোমাদেরকে উত্তেজিত করে এমন তৎপরতায় জড়িয়ে পড়তে বাধ্য করতে চায়, যা তোমাদের জন্য অমঙ্গল ডেকে আনতে পারে। আমার গোটা পরিকল্পনাই এক ধরনের প্রতিশোধমূলক তৎপরতা। কিন্তু এ প্রতিশোধ ব্যক্তির জন্য নয়- দ্বীনের জন্য। আমার জীবন, আমার ব্যক্তিস্বত্ত্বা, তোমাদের জীবন ও ব্যক্তিস্বত্ত্বার গুরুত্ব এর বেশী নয় যে, আমরা ইসলামী দুনিয়ার মোহাফেজ। ইসলামের ও ইসলামী ভূখণ্ডের জন্য আমাদেরকে জীবন দিতে হবে। আমরা যুদ্ধের ময়দানে মারা যেতে পারি। প্রতারিত হয়ে শত্রুর হাতেও প্রাণ হারাতে পারি। শাসক আর মুজাহিদদের মধ্যে এই পার্থক্য। শাসক হেফাজত করে নিজেকে আর ক্ষমতাকে। কিন্তু মুজাহিদ দেশ, জাতি ও দ্বীনের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়। আস-সালেহ ও তার আমীর-উজীরগণ তাদের রাজত্বের হেফাজত করছে। তাদের পরাজয় অবধারিত।

সুলতান আইউবী গোয়েন্দা উপপ্রধান হাসান ইবনে আব্দুল্লাহকে বললেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মালিকানাবিহীন যেসব পরিত্যক্ত প্রাসাদ আছে, সেগুলো গুঁড়িয়ে দাও। তিনি এই নির্দেশও জারি করেন যে, দেশের মসজিদগুলোর ইমামদেরকে বলে দাও, যেন তারা এই মর্মে বয়ান করেন যে, দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতের মালিক আল্লাহ এবং গায়েবের অবস্থা তিনি ছাড়া আর কেউ জানেন না। আল্লাহর কোন বান্দা আল্লাহর ও বান্দার মাঝে যোগাযোগের মাধ্যমে হতে পারে না। আল্লাহ সরাসরি যে কারো কথা শুনেন। কোন মানুষের সামনে সেজদাবনত হওয়া মস্তবড় পাপ। তোমরা দেশবাসীকে ভিত্তিহীন বিশ্বাস ও কল্পনাবিলাস থেকে রক্ষা কর।

সুলতান আরো বললেন, তোমরা সৈনিকদেরকে বুঝাও, যুদ্ধের ময়দানে যেমন তোমরা নিজেদের দেহকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে থাক, তেমনি বিশ্বাস ও মনন-মানসকেও দুশমনের হামলা থেকে রক্ষা করে চল। আর এই আক্রমণ তরবারীর নয়- মুখের আক্রমণ। দেহের জখম একদিন ভাল হয়ে যায়, দেহ আহত হয়েও লড়াই করে থাকে। কিন্তু মানুষের বিশ্বাস, মন-মস্তিষ্ক ও চিন্তাধারা আহত হয়ে পড়লে দেহ বেকার হয়ে যায়। তোমরা নেশার ক্রিয়া তো দেখেছ। নেশাগ্রস্ত হয়ে আমার একজন দেহরক্ষী আমারই উপর হামলা করে বসেছে! কিন্তু পরে যখন তার মস্তিষ্ক থেকে নেশা দূর হয়ে গেল, তখন আর সে স্বীকারই করল না যে, সে আমার উপর হামলা করেছে। এই নেশার মধ্যে একটি রূপসী নারীর নেশাও ছিল। তোমরা মানুষের মধ্যে দায়িত্বশীলতা এবং ইসলাম ও মুসলমানের মর্যাদার অনুভূতি জাগ্রত কর। তাদের মধ্যে নাগরিক কর্তব্যবোধ ও জাতীয় মর্যাদার নেশা সৃষ্টি কর। দেশ ও জাতির মর্যাদার অনুভূতি এবং এই মর্যাদার সংরক্ষণ তাদের ঈমানের অংশে পরিণত কর। তাহলে অন্য কোন নেশা তাদেরকে ঘায়েল করতে পারবে না।

সুলতান আইউবী আক্রমণের যে পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছিলেন, তাতে দুর্গের পর দুর্গ জয় করে সম্মুখে অগ্রসর হতে হবে। হেমস, হামাত ও হাবের দুর্গ হল সবচে শক্ত ও প্রসিদ্ধ। হাবের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও অত্যন্ত শক্তিশালী। হাল্ব দুর্গ এই শহর থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত। এগুলো ছাড়াও আরো কয়েকটি দুর্গ আছে, যেগুলোর অধিকাংশ পাহাড়ী ও দুর্গম এলাকায় অবস্থিত। সবচে বড় সমস্যা হচ্ছে ঐসব এলাকার শীত। শীতের সঙ্গে বরফপাত যোগ হয়ে এক অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রেখেছে। এ কারণে ঐসব এলাকায় শীত মওসুমে কখনো যুদ্ধ হয়নি। তাই বিরুদ্ধবাদীরা তাদের বাহিনীকে দুর্গে ঢুকিয়ে রেখেছে। এই সময়ে কেউ হামলা করতে পারে, তা তাদের কল্পনার বাইরে। তাদের খৃস্টান উপদেষ্টারাও তাদেরকে এই পরামর্শই প্রদান করেছে। অপরদিকে সুলতান আইউবী এই শীতের মওসুমেই লড়াই করার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। গোয়েন্দারা তাকে একের পর এক সংবাদ পৌঁছাচ্ছে।

সুলতান আইউবী গোয়েন্দা মারফত জানতে পারেন যে, হাবের মসজিদগুলোর ইমাম ও খতীবরা জনগণকে বুঝাবার চেষ্টা করছে, সালাহুদ্দীন আইউবী একজন পাপিষ্ট মানুষ। তিনি রাজত্বের লোভে ও সামরিক শক্তির দাপটে খুতবা থেকে খলীফার নাম তুলে দিয়েছেন। তারা সুলতান আইউবীকে বিলাসপ্রিয় ও চরিত্রহীন মানুষ হিসেবে অভিহিত করছেন। তারা বলছেন, জুমার খুতবায় খলীফার নাম উল্লেখ করা না হলে খুতবা পরিপূর্ণ হয় না। আর অসম্পূর্ণ খুতবায় গুনাহ হয়। সরাইখানা, হাট-বাজর এবং রাস্তাঘাটেও মানুষ বলাবলি করছে যে, সালাহুদ্দীন আইউবী একজন চরিত্রহীন মানুষ, নামের মুসলমান। সেই সঙ্গে লোকদেরকে সালাহুদ্দীন আইউবীর বিপক্ষে যুদ্ধ করার জন্যও উত্তেজিত করা হচ্ছে।

আস-সালেহর সৈন্য কম। তার অর্ধেক সৈন্য সেনাপতি তাওফীক জাওয়াদের নেতৃত্বে সুলতান আইউবীর সঙ্গে যোগ দিয়েছে। তাই তার স্বার্থপূজারী মুসলিম আমীর ও শাসকমণ্ডলী এভাবে জনসাধারণকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করছে। খৃষ্টানরা তাদের মদদ যোগাচ্ছে।

গোয়েন্দারা সুলতান আইউবীকে তথ্য প্রদান করে যে, হাবে জনসাধারণ সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছে। সব মানুষ যুদ্ধের জন্য উন্মাদ ও উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছে। তবে বয়সী মুসলমানরা খুবই অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে এবং বলছে, এটা কেয়ামতের লক্ষণ যে, মুসলমানে মুসলমানে যুদ্ধ হবে। কিন্তু তাদের আওয়াজ আইউবী বিরোধী লোকদের ধ্বনি ও অপবাদ প্রচারণার মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। প্রবীণদের এই আওয়াজ ছিল খৃস্টানদের বিপক্ষে। তারা তাকে স্তব্ধ করার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বস্তুত আইউবী বিরোধী মুসলমানদের পুরো কার্যক্রমই খৃস্টানদের পরিকল্পনা। যেসব ইমাম মিম্বরে দাঁড়িয়ে মুসলমানদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে প্রস্তুত নন, তাদেরকে অপসারণ করে অন্য ইমাম নিয়োগ দেয়া হয়।

উপযুক্ত বিনিময় হাতে নিয়ে ত্রিপোলীর খৃষ্টান সম্রাট রেমন্ড তার কয়েকজন সামরিক কমান্ডারকে উপদেষ্টা হিসেবে হাল্ব প্রৈরণ করেন। তাদের মধ্যে একজন বিশেষ গোয়েন্দা কর্মকর্তাও ছিলেন, যিনি নাশকতা পরিচালনায় বেশ দক্ষ।

পদচ্যুৎ খলীফা আল-সালেহ বিলম্ব না করে তাকে মুসলিম বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করে দেন। সৈন্যরা বিভিন্ন দুর্গে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। মসুলের গবর্নর সাইফুদ্দীন, গবর্নর পদমর্যাদায় ভূষিত গোমস্তগীন নামক এক কেল্লাদার, সুলতান আস- মালিকুস সালিহ ও ইয়াজুদ্দীন বাহিনীর কমান্ডারদের অন্যতম। রেমন্ড তাদেরকে নিশ্চয়তা প্রদান করেন যে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মিশর থেকে সালাহুদ্দীন আইউবী এবং যে রসদ ও ফোর্স আসবে, তিনি তাদেরকে প্রতিহত করবেন এবং আইউবী যেখানেই অবরোধ আরোপ করবেন, সেখানেই খৃস্টান বাহিনী বাহির থেকে হামলা করে অবরোধ ভেঙ্গে ফেলবে।

***

দামেস্কে সুলতান আইউবী দুই-তিন দিন পরপর কমান্ডারদের নিয়ে বৈঠক করছেন। সামরিক প্রশিক্ষণ নিজেও পর্যবেক্ষণ করছেন এবং কমান্ডারদের থেকেও রিপোর্ট গ্রহণ করছেন। রাতের বেলা উদোম শরীরে প্রশিক্ষণ দিয়ে তিনি তার বাহিনীকে হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত করে নিয়েছেন। আশপাশে অনেক টিলা আছে। তিনি মরুভূমিতে চলাচলে অভ্যস্ত ঘোড়াগুলোকে টিলায়-পাহাড়ে উঠানামা করার অভ্যাস গড়ে তুলেছেন।

ওদিকে হালবেও দু-তিনটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। সেখানকার কমান্ডাররা সংবাদ পেয়েছে যে, সুলতান আইউবী রাতের বেলা তার বাহিনীকে সামরিক মহড়া করাচ্ছেন। কিন্তু এ বিষয়টাকে তারা কোন গুরুত্ব দেয়নি। বলছে, আইউবীর মাথা খারাপ হয়ে গেছে; আমাদের মুখোমুখি হলে সে হামলা করার স্বাদ বুঝতে পারবে। সেই কমান্ডারদের একজনও ইন্টেলিজেন্স বিষয়ে অভিজ্ঞ নয়। খৃস্টানরা দামেস্কে তাদের গোয়েন্দা পাঠিয়ে রেখেছিল। শেখ সান্নানের ঘাতক ও নাশকতাকারী দলটিও তাদের। খৃস্টান সম্রাট রেমন্ডও তার একজন বিশেষ দূত প্রেরণ করেছেন দামেস্কে। সুলতান আইউবী কেন রাতে বেলা সামরিক মহড়া করাচ্ছেন, তার রহস্য উদ্ঘাটনে আত্মনিয়োগ করে রেমন্ড এর বিশেষ গোয়েন্দা। হাবে কমান্ডারদের কনফারেন্সে বিষয়টি এখনো উত্থাপন করেনি সে। ঘটনার রহস্য এখনো তার জানা হয়নি।

সুলতান আইউবী হা্লব ও মসুল ইত্যাদি এলাকায় গোয়েন্দা জাল বিছিয়ে রেখেছেন। তাঁর গোয়েন্দা তৎপরতা নিয়ন্ত্রিত হয় হাল্ব থেকে। দলনেতা একজন বিজ্ঞ আলিমের বেশে হাবে অবস্থান করছেন এবং গোয়েন্দাদের থেকে তথ্য গ্রহণ করে দামেস্ক পৌঁছাবার ব্যবস্থা করছেন। তিনি তার গোয়েন্দাদের নিরাপত্তা বিধান ও বিপদ দেখা দিলে তাদেরকে লুকিয়ে ফেলার বন্দোবস্তও করে রেখেছেন। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীকে গাল-মন্দ এবং সমালোচনা করার কাজে তিনি সকলের বাড়া। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আমীর-উজীর এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে থাকেন। তার গোয়েন্দা সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ সবকটি স্থানেই অবস্থান নিয়ে আছে। আল-মালিকুস সালেহর মহলের বডিগার্ডের মধ্যেও তার গোয়েন্দা রয়েছে। দুজন গোয়েন্দা বিশেষ প্রহরীর পদ নিয়ে খলীফার কেন্দ্রীয় কমান্ডের সেই প্রাসাদ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, যেখানে তাদের যুদ্ধ বিষয়ে বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। খৃস্টান গোয়েন্দাদের কমান্ডার এসেই সর্বপ্রথম দামেস্কে তাদের গোয়েন্দা ব্যবস্থাকে সংহত ও কার্যকর করা এবং হাবে সুলতান আইউবীর যেসব গোয়েন্দা রয়েছে, তাদের সন্ধান বের করার কাজে আত্মনিয়োগ করে।

***

সুলতান আইউবী যে দুজন গুপ্তচর হাবে হাইকমান্ডের প্রহরীদের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল, তাদের একজনের নাম খলীল।

একটি ভবনের কতগুলো কক্ষ। তার একটি হলরুম। এখানে ভোজসভা, নাচ-গানের আসর ও দরবার অনুষ্ঠিত হয়। অত্যন্ত সাজানো-গোছানে, একটি কক্ষ। হাল্‌বে আমীর-উজীরদের খৃস্টানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের পর এখন কক্ষটি আরো পরিপাটি, আরো সুসজ্জিত। অপরূপ সুন্দরী ও অভিজ্ঞ যুবতী মেয়েরা এখানে নাচ-গান করে। এখন কয়েকটি খৃস্টান মেয়েও এসে যোগ দিয়েছে এখানে। এরা সুশিক্ষিত পেশাদার মেয়ে। খলীফা আস-সালিহর আমীর-উজীরগণ এদের আঙ্গুলের ইশারায় ওঠ-বস করে। এদের আসল কর্তব্য, আস-সালিহর বিশিষ্ট দরবারী আমীর ও সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কমান্ডারদের উপর নজর রাখা এবং অনুধাবন করা যে, তাদের মধ্যে সুলতান আইউবীর অনুগত কেউ আছে কিনা। তাছাড়া, খলীফার পদস্থ কর্মকর্তাদের মনে খৃস্টান প্রীতি ও ক্রুশের অনুগত্য সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা চালানোও তাদের অন্যতম দায়িত্ব।

মাঝে-মধ্যে ভোজের আয়োজন হয় হলটিতে। তখন নাচ-গানের আসর বসানো হয়। উজাড় হয় হাড়ি হাড়ি মদ। সব শেষে অপকর্মের চরমে পৌঁছে যায় মজলিস। কখনো কখনো সামরিক বিষয়ে কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় এখানে।

রক্ষীবাহিনীর দুজন প্রহরী কোমরে তরবারী, ও হাতে বর্শা নিয়ে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সবৃসময়। তিন-চার ঘন্টা পরপর প্রহরী বদল হয়।

খলীল সুলতান আইউবীর গুপ্তচর। আইউবীর আরেক গোয়েন্দা তার সহকর্মী। দুজনের ডিউটি পড়ে একসঙ্গে। তারা এখান থেকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছে। অনেক তথ্য দেমস্কে পৌঁছিয়েও দিয়েছে।

একদিন সন্ধ্যা বেলা। নতুন এক নর্তকীর আগমন ঘটে হলে। আজ ভোজসভার আয়োজন আছে। মেহমানরাও আসছেন। নর্তকী-গায়িকা এবং অন্যান্য মেয়েরাও আসছে। খলীল ও তার সঙ্গী তাদের সবাইকে চিনে। দূর দূরান্তের কেল্লাদারগণও এসেছেন। এক ব্যক্তি এসেছে নতুন। ইনি রেমন্ড-এর প্রেরিত গোয়েন্দাদের কমান্ডার। তার পরিচয়টা জেনে নেয় খলীল। এবার লোকটার তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করতে হবে খলীলকে।

তাকে ছাড়া আরো একটি নতুন মুখ দেখতে পায় খলীল। এই মুখ একটি মেয়ের। খলীল মেয়েটিকে আজ তিন-চার দিন ধরে দেখছে। নতুন আসা মেয়ে।

একদিন ডিউটি শেষ করে সঙ্গীসহ কর্মস্থল ত্যাগ করছে খলীল। হঠাৎ মেয়েটা এসে সামনে দাঁড়ায়। খলীল উঠে থমকে দাঁড়ায়। অপলক জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় তার প্রতি। মেয়েটাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে খলীলের। কে এই মেয়েটা? খলীলের মনে কৌতূহল। আবার ভাবে, না পরিচিত কেউ নয়। মানুষের চেহারায় চোহরায় মিল থাকে। খলীল দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। কিন্তু মেয়েটা তাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে এবং তাকাতে তাকাতে সামনের দিকে চলে যায়। খলীল ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েটার প্রতি তাকায়। মেয়েটাও তাকায় তার প্রতি।

পরদিনও এমনি ঘটনা ঘটে। তার আগেই খলীল মেয়েটার ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়। জানতে পারে, মেয়েটা নর্তকী।

মেয়েটা দেখতে যেন রাজকন্যা। খলীল একজন সাধারণ সিপাহী। এমন একটি মেয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক জমতে পারে না। রাজকন্যারূপী নর্তকীরা তো আমীরদের সম্পদ। কিন্তু এই মেয়েটাকে দেখে খলীলের অন্য একটা মেয়ের কথা মনে পড়ে গেছে- যাকে দেখতে ঠিক এই মেয়েটিরই ন্যায়।

***

 এগার-বার বছর আগের কথা। খলীল তখন আঠার বছরের যুবক। দামেস্কের সামান্য দূরে এক গ্রামে বাস করত এবং পিতার সঙ্গে ক্ষেতে-খামারে কাজ করত। হাসি-খুশি স্বভাবের মানুষ খলীল। উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন মেধাবী ছেলে। পাড়ার শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলের কাছেই প্রিয়।

তখন হিজরতের পালা চলছিল। খৃস্টানদের দখল করা এলাকাসমূহ থেকে মুসলমান পরিবারগুলো খৃস্টানদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মুসলিমশাসিত এলাকায় চলে যাচ্ছিল। স্থানীয় লোকেরা তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করত এবং তাদের বসবাস করার সুযোগ করে দিত।

এমনি একটি পরিবার কোথা থেকে হিজরত করে খলীলদের গ্রামে চলে আসে। সেই পরিবারের একটি মেয়ের নাম হুমায়রা। তখন তার বয়স ছিল এগার কি বার বছর। অত্যন্ত সুন্দরী ও ফুটফুটে একটি মেয়ে।

গ্রামবাসীরা এই পরিবারটিকে সাদরে বরণ করে নেয় এবং মাথা গোজার ঠাই করে দিয়ে চাষাবাদ করে কোন রকমে জীবিকা নির্বাহের জন্য জমি-জিরাত দান করে। হুমায়রার ভাই-বোন সবাই ছোট। সংসারে কর্মক্ষম লোক একমাত্র পিতা। খলীল এই অসহায় পরিবারটির প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। খলীলের কথাবার্তা ভাল লাগে হুমায়রার কাছে। হুমায়রাকেও ভাল লাগে খলীলের। হুমায়রা খলীলের ঘরে আসা-যাওয়া করতে শুরু করে। সুযোগ পেলেই খলীলের কাছে গল্প শুনে হুমায়রা। হুমায়রাকে শুনানোর জন্য মজার মজার গল্প বানিয়ে নিয়েছে খলীল। ভাব গড়ে ওঠে দুজনের মাঝে।

এভাবে মাস চারেক সময় কেটে যায়। ক্ষেত-খামারে কাজ করা তখন আর ভাল লাগছে না হুমায়রার পিতার। দামেস্ক শহরটা সেখান থেকে নিকটে। হুমায়রার পিতা সকালে শহরে চলে যান এবং সন্ধ্যায় ফিরে আসেন। এভাবে কেটে যায় এক বছর। হুমায়রার পিতাকে কিছু করতে দেখছে না কেউ। কিন্তু সংসার চলছে বেশ ভালভাবেই।

খলীলের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে হুমায়রা। তাকে ছাড়া একদণ্ডও ভাল লাগে না মেয়েটার। সবসময় খলীলের সঙ্গে সঙ্গে থাকতে চায় সে। খলীল ক্ষেতে গেলে হুমায়রাও চলে যায় সেখানে।

হুমায়রার বয়স এখন তের বছর। ভাল-মন্দ বুঝতে শুরু করেছে। প্রেম ভালবাসা, মন দেয়া, মন নেয়া এসব এখন হুমায়রার অবোধ্য নয়।

একদিন খলীল হুমায়রাকে জিজ্ঞেস করে- আচ্ছা, তোমার আব্বা এখন কী কাজ করেন?

হুমায়রা উত্তর দেয়- আমি জানি না। আমি শুধু এটুকু জানি যে, আমার বাবা ভাল মানুষ নন। তিনি শহর থেকে যখন আসেন, নেশা করে আসেন।

হুমায়রা খলীলকে আরো নতুন একটি তথ্য প্রদান করে- ইনি আমার পিতা নন। আমার মা-বাপ দুজনই মারা গেছেন। আমার বয়স যখন পাঁচ-ছয় বছর, তখন ইনি আমার ভার নেন এবং আমাকে তার ঘরে নিয়ে লালন-পালন করেন। পরে আমি তাকেই পিতা ডাকতে শুরু করি। আমাকে তিনি আপন মেয়ের মত আদর করেন এবং নিজের মেয়ের মতই আচরণ করেন। কিন্তু মানুষটা ভাল নন।

এভাবে কেটে গেছে দুটি বছর। খলীলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে হুমায়রা। হুমায়রা এখন পরিপূর্ণ যুবতী। হৃদয়কাড়া সুশ্রী মুখাবয়ব। যৌবন-রসে টইটুম্বর ও নজরকাড়া দেহ।

একদিন খলীলের নিকট গিয়ে হাজির হয় হুমায়রা। মুখে অস্থিরতা ও মলিনতার ছাপ। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে কথা বলে খলীলের সঙ্গে আমার সন্দেহ হচ্ছে, বাবা বিয়ের নামে আমাকে এক অপরিচিত ব্যক্তির হাতে তুলে দিতে চাচ্ছেন। বাবার সঙ্গে একজন লোক এসেছিল। তিনি লোকটাকে অনেক খাতির যত্ন করলেন এবং কিছুক্ষণ পর আমাকে ডেকে তার কাছে নিয়ে বসালেন। লোকটা আমাকে খুব নীরিক্ষন করে দেখল। আমি বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাকে কেন ডাকলেন বাবা? জবাবে তিনি আমতা আমতা করে যা বলতে চাইলেন, তাতেই আমার মনে এই সন্দেহ সৃষ্টি হয়। হুমায়রা খলীলকে বলল, আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে চাই না।

খলীল বলল- ঠিক আছে, আমি আমার আব্বা-আম্মার সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেব।

হুমায়রা যে লোকটাকে পিতা বলে ডাকে, সে তার পিতা নয়। কাজেই হুমায়রার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার কোন ভাবনা নেই। সে যুগে মেয়েদের কোন মর্যাদা ছিল না। অর্থের বিনিময়ে মেয়েদেরকে অন্যের হাতে তুলে দেয়ার প্রচলন ছিল। শাসক ও ধনবান লোকেরা হেরেম বানিয়ে রেখেছিল। তারা নিত্যনতুন সুন্দরী যুবতী মেয়েদের ক্রয় করত। হুমায়রাকে যদি তার পিতা বিক্রি করার পরিকল্পনা করেও থাকে, সে সমাজের রীতি অনুযায়ী তা অপরাধ ছিল না।

খলীল ধনবান পিতা-মাতার সন্তান নয়। হুমায়রাকে নিয়ে পালিয়ে কোথাও আত্মগোপন করা অপেক্ষা বেশী কিছু করার সুযোগ তার নেই। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কী করবে খলীল? ভাবনায় পড়ে যায় সে। হুমায়রার প্রতি তার ভালবাসা এতই গভীর যে, বিষয়টা উপেক্ষাও করতে পারছে না খলীল।

খলীলের ভাবতে ভাবতে কেটে যায় অনেক সময় দুদিন। তৃতীয় দিনও কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারল না সে।

খলীল ক্ষেতে গিয়ে কাজে লেগে যায়। এমন সময় একদিক থেকে নারী কণ্ঠের চিৎকার ভেসে আসে তার কানে। একটি মেয়ে যেন তাকেই ডাকতে ডাকতে দৌড়ে আসছে। খলীল হঠাৎ চমকে উঠে মাথা তুলে তাকায়। হুমায়রা। হুমায়রা-ই তাকে ডাকতে ডাকতে তার দিকে পাগলিনীর ন্যায় ছুটে আসছে। পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে তিনজন লোক। তাদের একজন হুমায়রার পিতা। অপর দুজনকে চিনে না খলীল।

হুমায়রার চিৎকার শুনে পাড়ার অনেক মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। কিন্তু তারা সবাই তামাশা দেখছে শুধু। তারা এই ভেবে হুমায়রার সাহায্যে এগিয়ে আসছে না যে, পেছনের লোকগুলোর মধ্যে হুমায়রার পিতাও আছেন।

খলীল হুমায়রার দিকে এগিয়ে যায়। হুমায়রা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানায়, এরা আমাকে নিয়ে যেতে এসেছে। বাবা আমাকে এদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। হুমায়রার পিতা হুমায়রাকে খলীলের সম্মুখ থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। খলীল তাকে ধমক দেয়- খবরদার! এর গায়ে হাত দেবেন না। আগে আমার সঙ্গে কথা বলুন।

এ আমার কন্যা- হুমায়রার পিতা বলল- তুমি কে আমাকে ঠেকাবার?

এ আপনার কন্যা নয়- খলীল বলল- আমি সব জানি।

অপর দুজন হুমায়রার দিকে এগিয়ে আসে। একজন হাতে তরবারী তুলে নেয়। খলীলের হাতে কোদাল। সেটি দ্বারা লোকটার মাথায় আঘাত করে সে। লোকটার হাত থেকে তরবারীটা পড়ে যায়। পরক্ষণেই রক্তাক্ত মাথায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে লোকটি। খলীল তরবারীটা হাতে তুলে নেয়।

দ্বিতীয় ব্যক্তির হাতেও তরবারী। খলীল তরবারী চালনা ও তরবারী আঘাত প্রতিহত করার কলা-কৌশল জানে না। তারপরও লোকটার দু-একটা আঘাত প্রতিহত করে সে। কিন্তু বেশীক্ষণ টিকতে পারল না খলীল। ভারী কি একটা বস্তু আঘাত হানে তার মাথায়। হঠাৎ দুচোখের সামনের সব অন্ধকার হয়ে যায়। খলীল মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

খলীলের যখন জ্ঞান ফিরে, তখন সে নিজের ঘরে। হঠাৎ ধড়মড় করে শোয়া থেকে উঠে বসে সে। চোখে মুখে প্রচন্ড ক্রোধ। তার পিতা ও দু-তিনজন লোক এগিয়ে এসে তাকে ধরে ফেলে শান্ত করার চেষ্টা করে- তুমি অনেকক্ষণ যাবত অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলে। এইমাত্র তোমার জ্ঞান ফিরেছে। শুয়ে থাক। হুমায়রা এই এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। তাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না।

খলীল চিৎকার করে ওঠে- লোকটা মেয়েটাকে বিক্রি করে ফেলেছে! আহ! আমি বুঝি হুমায়রাকে হারিয়ে ফেললাম। খলীলকে বুঝানো হল, হুমায়রাকে যথারীতি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করিয়েই বিদায় করা হয়েছে।

খলীলের মাথার অবস্থা ভাল নয়। বসার চেষ্টা করলেই মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে। বড়রা তাকে উপদেশ দেন, হুমায়রাকে নিয়ে ভাবা তোমার পক্ষে ঠিক হবে না। ও এখন অন্যের বিবাহিতা স্ত্রী।

খলীল সুস্থ্য হয়ে যখন বাইরে বের হয়, ততক্ষণে হুমায়রার পিতা পরিবারসহ এলাকা ত্যাগ করে চলে গেছে।

***

হুমায়রাকে হারিয়ে পাগলের মত হয়ে গেছে খলীল। মেয়েটির ভালবাসা আর তার মুখডাকা পিতার প্রতিশোধস্পৃহা অস্থির করে তুলেছে তাকে। কাজ-কর্মে মন বসছে না তার। মাঝে-মধ্যে দামেস্ক গিয়ে হুমায়রার পিতাকে খুঁজে বেড়ায় খলীল। তার পিতা-মাতা তাকে অনেক ভাল ভাল মেয়ে দেখায়; কিন্তু কাউকেই পছন্দ হচ্ছে না তার। তার মন-মস্তিষ্কে চেপে বসে আছে হুমায়রা।

এক-দেড় বছর পর্যন্ত এভাবেই সময় কাটে খলীলের। একদিন দামেস্কে ঘোরাফেরা করতে গিয়ে জানতে পারে, সেনাবাহিনীতে লোক নেয়া হচ্ছে। খলীল সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়ে যায়।

খলীলকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। অশ্বচালনা, তীরন্দাজি ও অন্যান্য অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ নেয়। একটা ব্যস্ততা পেয়ে যায় খলীল। এবার হুমায়রার ভাবনা ধীরে ধীরে কেটে যেতে শুরু করে তার মাথা থেকে। স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায় সে। খলীল পুনরায় একজন কর্মতৎপর যুবকে পরিণত হয়।

এ সেই সময়কার কথা, যখন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী প্রসিদ্ধি লাভ করেননি। মানুষ তখনো শুধু নুরুদ্দীন জঙ্গীকেই চিনে। সুলতান আইউবী এ পর্যন্ত একবার রণাঙ্গনে হাজির হয়ে বীরত্ব প্রদর্শন করতে পেরেছেন মাত্র। সেটি ছিল এক রক্ষক্ষয়ী লড়াই। তিনি এই প্রথমবার দুশমনকে চোখে দেখেছেন। তিনি খৃস্টানদের নির্যাতনের শিকার লুষ্ঠিত একটি পরিবারের করুণ দৃশ্য দেখলেন। তিনি জানতে পারলেন, খৃস্টানরা বহু মুসলিম যুবতী মেয়েকে তাদের হাতে কজা করে রেখেছে। এসব দেখে-শুনে তার ভেতরে জাতীয় চেতনা ও ইসলামী মূল্যবোধ জেগে উঠে। সেই চেতনা ও বোধ-বিশ্বাস তাঁকে সেই সৈনিকদের সারিতে নিয়ে দাঁড় করায়, যারা বেতন-ভাতা ও গনীমতের জন্য নয়- আল্লাহর নামে লড়াই করে ও জীবন কুরবান করে।

তিন-চার বছর পর সালাহুদ্দীন আইউবীকে মিসরের গভর্নর নিযুক্ত করে কায়রো প্রেরণ করা হয়। খৃস্টানরা সুদানীদের সঙ্গে গোপন চুক্তি করে সমুদ্রের দিক থেকে মিসরের উপর হামলা চালালে সুলতান আইউবী নুরুদ্দীন জঙ্গীর নিকট সাহায্যের আবেদন জানান। নুরুদ্দীন জঙ্গী তাঁর একটি বিশেষ বাহিনীকে কায়রো পাঠিয়ে দেন। খলীল ছিল সেই বাহিনীর একজন সদস্য। খলীল সেই বিচক্ষণ সৈনিকদের একজন, যারা তরবারীর পাশাপাশি বুদ্ধিমত্ত্বাকে কাজে লাগায়। তাকে পঞ্চাশ সদস্যের এক বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। মিশরে আসার পর তার বুদ্ধিমত্ত্বা ও বিচক্ষণতা পুরোপুরি জাগ্রত হয়ে ওঠে। গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান সুলতান আইউবীর পরামর্শে খলীলকে তার যুদ্ধবাজ গোয়েন্দা বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করে নেন। তাকে একাধিকবার কমান্ডো ও গেরিলা অভিযানে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু গুপ্তচরবৃত্তির জন্য তাকে দেশের বাইরে কখনো পাঠান হয়নি। তাকে দেশের অভ্যন্তরে শত্রু-চরদের তথ্য সংগ্রহ, পশ্চাদ্ধাবন ও গ্রেফতার করার কাজে নিয়োজিত করা হয়। এ কাজে বড় দক্ষ খলীল।

এখন ১১৭৪ সাল। নুরুদ্দীন জঙ্গীর ওফাতের পর যখন সুলতান আইউবী সাতশ অশ্বারোহী সৈনিক নিয়ে দামেস্ক দখল ও আল-মালিকুস সালিহকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে রওনা হন, তখন তিনি তার গোয়েন্দা দলকে আগেই দামেস্ক পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তারা বিভিন্ন বেশে দামেস্ক অনুপ্রবেশ করে এবং সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সুলতান আইউবী যখন দামেস্ক দখল করে ফেলেন এবং খলীফা আল-মালিকুস সালিহ ও তার আমীর-উজীর-দেহরক্ষীগণ দামেস্ক ছেড়ে পালিয়ে যায়, তখন আলী বিন সুফিয়ানের নায়েব হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ যিনি গোয়েন্দাদের সঙ্গে দামেস্ক ঢুকে গিয়েছিলেন কয়েকজন গোয়েন্দাকে সেদিকে পাঠিয়ে দেন, যেদিকে আস-সালিহ ও তার দেহরক্ষীরা পালিয়েছিল। এই গোয়েন্দাদেরকে কতগুলো বিশেষ নির্দেশনা ও বিভিন্ন মিশন বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল। খলীল ছিল তাদের একজন। তার এক সঙ্গীও ছিল সেই দলে।

এই গোয়েন্দা দলটি যখন হাব পৌঁছে, তখন সেখানে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছিল। আস-সালিহর সাঙ্গপাঙ্গদের এই মুহূর্তে সৈন্যের প্রয়োজন। তাদের মনে প্রবল আশংকা, সুলতান আইউবী তাদের ধাওয়া করবেন এবং হামলা চালাবেন। ফলে তারা সেই অস্থির পরিস্থিতিতে যাকেই পেয়েছে, সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে নিয়েছে। খলীল এবং তার সঙ্গী নিজেদেরকে দামেস্ক থেকে পালিয়ে আসা সৈনিক পরিচয় দিয়ে বাহিনীতে ঢুকে পড়ে।

সুলতান আইউবীর এই গোয়েন্দারা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আস্তানা তৈরি করে নেয়।

খলীল অত্যন্ত সুশ্রী ও শক্তসামর্থ যুবক। অতিশয় বাকপটু। এই সুবাদে তাকে রাজপ্রাসাদের প্রহরী নিযুক্ত করা হয়। কৌশলে সঙ্গীকেও সাথে রাখে।

***

দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার জিহাদে ব্যস্ত হয়ে পড়ে খলীল। ভুলে গেছে হুমায়রার কথা। একদিনও- একবারও তার মনে পড়ছে না ভালবাসার মানুষটির কথা। এসব ভাবনার সুযোগই পায়নি খলীল। কিন্তু এই নতুন মেয়েটি খলীলকে স্মরণ করিয়ে দিল হুমায়রার কথা।

খলীল হুমায়রাকে হারিয়েছে সাত-আট বছর হয়ে গেছে। তখন মেয়েটির রুস ছিল ষোল বছর। মেয়েটি অত্যন্ত রূপসী। কিন্তু তার মুখাবয়বে হুমায়রার সেই নিষ্পপতা ও সরলতা এখন অনুপস্থিত। দুজনের মুখোমুখি হওয়ার সময় তার পরনে ছিল সংক্ষিপ্ত পোশাক। বলা চলে অর্ধনগ্ন। কাজেই অশালীন এই মেয়েটি হুমায়রা হতে পারে না। মেয়েটা তৃতীয়বার যখন খলীলের মুখোমুখি হয়, তখন খলীল আরো নিরীক্ষা করে দেখে। মেয়েটিও তাকিয়ে থাকে খলীলের প্রতি। এবার কথা বলে মেয়েটি- তোমার নাম কী?

খলীল নিজের ছদ্মনাম বলে, যে নাম এখানে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার সময় লিখিয়েছিল। তারপর প্রশ্ন করে- তুমি আমার নাম জিজ্ঞেস করছ কেন?

তুমি আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখছ। তাই নামটা জিজ্ঞেস করলাম। হুমায়রা এমনভাবে জবাব দেয়, যেন তার মধ্যে সভ্যতার লেশমাত্র নেই- তুমি একজন সাধারণ সৈনিক। নিজের কাজ কর; ওসব ভেবে লাভ নেই।

আজ রাতেই ভোজসভা। রেমন্ডের গোয়েন্দা বাহিনীর কমান্ডার দিন চারেক আগে এখানে এসে পৌঁছেছে। তার নাম উইন্ডসর। তারই সম্মানে এই ভোজসভার আয়োজন। উইন্ডসর একজন অভিজ্ঞ গুপ্তচর। হাবের গোয়েন্দা ব্যবস্থাকে সুসংহত করার লক্ষ্যেই তার আগমন।

সূর্য ডুবে গেছে। সাজের আঁধারে ছেয়ে গেছে চারদিক। মেহমানরা আসছেন। আয়োজন চলছে। চলছে মদপানের ধারা। প্রধান অতিথি উইন্ডসর এখনো আসেননি। খলীল ও তার সঙ্গীর ডিউটি হলরুমের দরজায়।

কিছুক্ষণ পর উইন্ডসর এসে পৌঁছান। হলরুমের দরজা পর্যন্ত এসেই থমকে দাঁড়ান তিনি। গভীর দৃষ্টিতে তাকান প্রহরীদ্বয়ের প্রতি। তারপর খলীলের চেহারায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন।

তুমি খলীফার রক্ষীবাহিনীতে কবে ঢুকেছ? উইন্ডসর খলীলকে জিজ্ঞেস করেন। তার কণ্ঠে গাম্ভীর্য।

এখানে আসার পরই আমাকে রক্ষী বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়খলীল জবাব দেয়। তার আগে আমি দামেস্কের সেনাবাহিনীতে ছিলাম।

তুমি কি মিশর গিয়েছিলে? উইন্ডসর জিজ্ঞেস করেন।

না। খলীল জবাব দেয়।

 উইন্ডসর খলীলকে অপর প্রহরী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে- তুমি একে কখন থেকে জান?

আমরা দুজন দামেস্কের বাহিনীতে একসঙ্গে ছিলাম- খলীল জবাব দেয় আমরা উভয়ে উভয়কে ভালভাবেই জানি।

আর আমি সম্ভবত তোমাদের দুজনকেই ভালভাবে চিনি- উইন্ডসর মুচকি হেসে বললেন- একটু আমার সঙ্গে এস।

খলীল ও তার সঙ্গীকে প্রহরা থেকে সরিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে যান উইন্ড। লোকটা অত্যন্ত ঘাঘু ও বিচক্ষণ গোয়েন্দা। এখানে এসে পৌঁছেই তিনি গোপনে গোপনে দেহরক্ষীদের বিশ্বস্ততা যাচাই-বাচাই শুরু করে দেন। খলীলকে দেখামাত্র তার কিছু একটা মনে পড়ে যায়। মনে সন্দেহ জেগে ওঠে। পরক্ষণে খলীলের সঙ্গীকে দেখার পর তার সন্দেহ পোক্ত হয়ে যায়।

উইন্ডসর-এর সন্দেহ অমূলক নয়। খলীল ও তার সঙ্গী তিন-চার বছর যাবত সুলতান আইউবীর গোয়েন্দা বিভাগে এক সঙ্গে কাজ করেছিল।

উইন্ডসর খলীল ও তার সঙ্গীকে নিজ কক্ষে নিয়ে যান। এই ভবনেরই বড় রুমটির সামান্য দূরের রুমটিই উইন্ডসরের কক্ষ। কক্ষে প্রবেশ করে তিনি রাতের আলোতে তাদেরকে পুনরায় গভীরভাবে নিরীক্ষা করে দেখেন।

আমাকে যদি প্রমাণ দিতে পার যে, তোমরা এখানকার অফাদার এবং সালাহুদ্দীন আইউবী তোমাদের দুশমন, তাহলে আমি তোমাদেরকে শুধু ছেড়েই দেব না, বরং এমন পদে চাকুরী দেব যে, তোমাদের ভাগ্য ফিরে যাবে। উইন্ডসর বললেন- কিন্তু মিথ্যা বললে পরে অনুতাপ করতে হবে।

আমরা এখানকারই অফাদার। খলীল জবাব দেয়।

তোমরা অফাদারী কখন থেকে পরিবর্তন করেছ?- উইন্ডসর জিজ্ঞেস করে এবং কেন করেছ?

আল্লাহ ও রাসূলের পরই খলীফার মর্যাদা- খলীল বলল- সালাহুদ্দীন আইউবীর কোন মর্যাদা নেই। তিনি খলীফা নন।

মিশর থেকে কবে এসেছ? উইন্ডসর জিজ্ঞেস করেন এবং জবাবের অপেক্ষা না করেই বললেন, তোমরা বোধ হয় আমাকে চেন না। আমি তোমাদেরই ন্যায় একজন গুপ্তচর। আমি যাকে একবার দেখি, নাম ভুলে যেতে পারি- চেহারা ভুলি না। আলী বিন সুফিয়ান কোথায়? মিসরে না দামেস্কো

আপনি কার কথা বলছেন? আমরা তো এই নামের কাউকে চিনি না–খলীলের সঙ্গী বলল- আমরা সাধারণ সিপাহী মাত্র।

উইন্ডসর বসা থেকে উঠে দাঁড়ান। দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরে এদিক অদিক তাকিয়ে একজন চাকে ডাক দেন। চাকর আসলে তিনি একটি মেয়ের নাম উল্লেখ করে তাকে ডেকে আনতে বললেন।

মেয়েটি পাশেরই একটি কক্ষে ছিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই অতিশয় রূপসী একটি মেয়ে এসে কক্ষে প্রবেশ করে। খলীল জানে, এই মেয়েটি খৃষ্টান। তার সঙ্গে সেই নর্তকীও আসে, যাকে দেখলে খলীলের হুমায়রার কথা মনে পড়ে।

উইন্ডসর খৃস্টান মেয়েটির সঙ্গে আরবীতে কথা বলেন। তাকে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করেন, বাইজীটাকে সঙ্গে এনেছ কেন?

মেয়েটি জবাব দেয়, না, মানে ও প্রস্তুত হয়ে আমার কক্ষে এসে গিয়েছিল আর আমিও প্রস্তুত হচ্ছিলাম। এর মধ্যে আপনার ডাক পেয়ে মনে করলাম, ভোজসভায় আপনার সঙ্গে যেতে হবে তাই ডাকছেন। তাই আমি একেও সঙ্গে করে নিয়ে আসলাম।

ঠিক আছে, অসুবিধা নেই- উইন্ডসর বললেন- এসেছে যখন তামাশা দেখতে পাবে।

উইন্ডসর খৃস্টান মেয়েটিকে বললেন, আমি তোমাকে অন্য এক কাজের জন্য ডেকেছি- তিনি প্রহরীদ্বয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে মেয়েটিকে বললেন- এদের প্রতি ভালভাবে তাকাও, দেখ তো কিছু মনে পড়ে কিনা?

মেয়েটি খলীল ও তার সঙ্গীর প্রতি গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর মাথা ঝুঁকিয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে অনেকক্ষণ পর্যন্ত চিন্তা করে। মাথা তুলে আবার দুজনের মুখাবয়বে চোখ বুলায়। এবার তার ঠোঁটে মুচকি হাসির আভা ফুটে ওঠে। সে খলীল ও তার সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করে- তোমাদের জ্ঞান ফিরে এসেছিল কখন?

খলীল ও তার সঙ্গী পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। তারপর মেয়েটির দিকে দৃষ্টিপাত করে। খলীল, উপস্থিত জ্ঞানের অধিকারী মানুষ। সে বুঝে ফেলে, এরা আমাদের চিনে ফেলেছে। কিভাবে বাঁচা যায় পন্থা খুঁজতে শুরু করে সে। এরূপ পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয় হুঁশ-জ্ঞান ঠিক রেখে বুদ্ধিমত্ত্বা দিয়ে। মুহূর্তে হাবা বনে যায় খলীল, যেন সে কিছুই বুঝতে পারছে না–আমাদের বুঝে আসছে না, আপনারা পাহারাদারী থেকে সরিয়ে এনে আমাদের সঙ্গে কেন মস্কারা করছেন। কমান্ডার দেখে ফেললে তো আমাদেরকে শাস্তি ভোগ করতে হবে।

তোমরা প্রহরী নও- উইন্ডসর বললেন- তোমাদের দুজনকে ওখানে দাঁড় করিয়ে রাখার চেয়ে বরং ভাল, ওখানে কেউ না দাঁড়াক। ওখানে তোমাদের কোন প্রয়োজন নেই। তিনি খলীলের কাঁধে হাত রেখে বললেন, এখানে এসে বেশ-ভূষা পরিবর্তন করে নিলে না কেন? সালাহুদ্দীন আইউবী ও আলী বিন সুফিয়ান চরবৃত্তিতে দক্ষ বটে, কিন্তু আমরাও আনাড়ী নই। নিজেদেরকে বিপদের মুখে ঠেলে দিও না। ভালোয় ভালোয় বলে ফেল, আমরা মিশর থেকে আসা গুপ্তচর। তোমাদের সঙ্গে আমার ও এই মেয়েটির সাক্ষাৎ আগেও হয়েছিল। তোমরা আমাকে চিনতে পারনি। কারণ, আমি তখন ছদ্মবেশে ছিলাম। কিন্তু আমি তোমাদের চিনে ফেলেছি। কেননা, এখনও তোমরা সেই বেশেই আছ, যে বেশে আড়াই বছর আগে ওখানে ছিলে। একটু চিন্তা কর; স্মরণ এসে যাবে। তোমরা দুজন মিশরের উত্তরে একটি কাফেলায় ঢুকে গিয়েছিলে। কাফেলাটার প্রতি তোমাদের সন্দেহ ছিল। সেই কাফেলার সঙ্গে তোমরা একটি রাত কাটিয়েছিলে। কিন্তু তোমাদের দুর্ভাগ্য, যখন তোমরা চোখ খুললে, তখন মরুভূমিতে সংজ্ঞাহীন পড়ে ছিলে। কাফেলা ততক্ষণে বহুদূরে চলে গিয়েছিল।

খলীল ও তার সঙ্গীকে পরিচয়ের সূত্রটা স্মরণ করিয়ে দেন উইন্ডসর।

***

 আড়াই থেকে তিন বছর আগের কথা। খলীল ও তার সঙ্গী তথ্য সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ছিল। সুদানীরা সুলতান আইউবীর হাতে পরাজয়বরণ করেছিল ঠিক, কিন্তু খৃস্টানদের সহযোগিতায় মিশর আক্রমণ পরিকল্পনায় লিপ্ত হয়ে পড়ে তারা। মিসরের অভ্যন্তরে খৃস্টান গুপ্তচর ও নাশকতাকারীরা তৎপর। তাদেরই খুঁজে বের করার জন্য আলী বিন সুফিয়ানের গোয়েন্দা বিভাগ কাজ করছিল। সীমান্তে টহল বাহিনী নিয়োজিত ছিল। মিসরের গোয়েন্দারা মুসাফির ইত্যাদির বেশে সীমান্ত এলাকাগুলোতে ঘোরাফেরা করছিল।

একদিন খলীল ও তার এই সঙ্গী মিশরের উত্তরাঞ্চলীয় এক এলাকায় ঘোরাফেরা করছিল। দুজনই উটের উপর সওয়ার। দীনহীন মরু মুসাফিরের বেশ তাদের। এমন সময়ে তারা একটি কাফেলা দেখতে পায়, যাতে অনেকগুলো উট ও দুটি ঘোড়া ছিল। কাফেলায় যুবক-বৃদ্ধ-নারী-শিশু সব বয়সের লোকই ছিল।

খলীল ও তার সঙ্গী গোয়েন্দা। তারা কাফেলা থামিয়ে তদন্ত করতে পারে না। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল, তারা গমনাগমনকারী কাফেলার প্রতি নজর রাখবে এবং সামান্যতম সন্দেহ হলে নিকটবর্তী সীমান্ত চৌকিতে সংবাদ দেবে। বাহিনী সামরিক শক্তির বলে এ কাজ আঞ্জাম দেবে। এতে বিপুলসংখ্যক লোকের কাফেলার গতিরোধ করে তল্লাশি চালানো দুজন গোয়েন্দার পক্ষে সম্ভব নয়।

খলীল ও তার সঙ্গী কাফেলার সঙ্গে এসে ভীড়ে। পরিচয় দেয়, আমরা সাফির এবং সামনে যাব। কাফেলার লোকেরা খলীল ও তার সঙ্গীকে তাদের লে নিয়ে নেয়।

খলীল ও তার সঙ্গী গল্প-গুজব ও কথোপকথনের মধ্যদিয়ে জানার চেষ্টা করে, কাফেলা কোথা থেকে এসেছে এবং কোথায় যাচ্ছে। সামনের সীমান্ত চৌকিটা কোথায়, তা তাদের জানা আছে। কিন্তু তারা দেখতে পেল, কাফেলা সেই পথ এড়িয়ে এমন এক পথ ধরেছে, যে পথে কোন চৌকি নেই। অঞ্চলটাই এমন যে, সেনা টহল চৌকি এড়িয়ে পথচলা সম্ভব। কাফেলার উটপালের পিঠে যে মালামাল বোঝাই করা আছে, তাও সন্দেহজনক মনে হল। এই বিশাল বিশাল মটকা ও পেচিয়ে রাখা তাঁবুর মধ্যে কী আছে কে জানে। মালামালও অনেক।

খলীল ও তার সঙ্গী মরু যাযাবর সেজে তথ্য নেয়ার চেষ্টা করছে। কাফেলায় চারটি যুবতী মেয়েও আছে। পোশাক-পরিচ্ছদে তারা যাযাবরই নয়- রীতিমত বেদুঈনের মত। মাথার চুলের ধরণ-কাটিংও প্রমাণ করছে, সভ্যতা-ভদ্রতার ছোঁয়া তাদের গা স্পর্শ করেনি। কিন্তু তাদের মুখাবয়ব, চোখের চাহনি ও শারীরিক গঠন-আকৃতি প্রমাণ করছে, আসলে ব্যাপার অন্যকিছু এবং এটা তাদের ছদ্মবেশ।

কাফেলায় একজন বৃদ্ধ লোক আছে। তার গায়ের রং গৌর। মুখে বসন্তের দাগ। কিন্তু তার দাঁত বলছে, তার বয়স এত বেশী নয়, যতটা চেহারা দেখে মনে হচ্ছে।

এই বৃদ্ধ খলীল ও তার সঙ্গীকে নিজের সঙ্গে নিয়ে নেয় এবং অত্যন্ত মেহের সাথে জিজ্ঞেস করতে শুরু করে, তোমরা কোথা থেকে এসেছ এবং কোথায় যাচ্ছ

খলীল নিজের আসল পরিচয় না দিয়ে উল্টো জানতে চাচ্ছে, কাফেলা কোথা থেকে এসেছে, কোথায় যাচ্ছে এবং এই মালপত্রগুলো কী?

বৃদ্ধ এত হৃদয়গ্রাহী মজার মজার কথা বলতে শুরু করে যে, খলীল ও তার সঙ্গী সুযোগ পায়নি তথ্য নেয়ার।

চলতে চলতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। তারপর গভীর রাত। কাফেলা চলতে থাকে। খলীল বৃদ্ধকে কাফেলার গতিপথ পরিবর্তন করার পরামর্শ দিয়ে বলল, এই পথে চলুন, তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছা যাবে। সে চেষ্টা করছে কাফেলাটি সেনা চৌকির নিকট দিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা। খলীল স্পষ্ট বুঝতে পারছে, কাফেলা সেনা চৌকি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে।

খলীলের সন্দেহ পাকাপোক্ত হতে চলেছে। আমরা একটু সামনে অগ্রসর হওয়ার পর ছাউনি ফেলার উপযোগী স্থান পাওয়া যায়। কাফেলা থেমে যায়। রাত যাপনের জন্য তাঁবু খাটায়।

খলীল ও তার সঙ্গী কাফেলা থেকে খানিক দূরে সরে গিয়ে একস্থানে বসে পরামর্শ করে, কী করা যায়। দুটি পন্থা অবলম্বন করা যায়। প্রথমত, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে কাফেলার মালপত্রের তল্লাশী নেয়া যায়। দ্বিতীয়ত, দুজনের একজন চুপিচুপি এখান থেকে বেরিয়ে যাবে এবং নিকটবর্তী চৌকিতে গিয়ে সংবাদ দেবে। কিন্তু দ্বিতীয় পন্থায় আশংকা আছে। তাতে কাফেলার লোকদের মনে সন্দেহ জাগবে এবং অপরজনকে হত্যা কিংবা অপহরণ করে দ্রুতগতিতে স্থান ত্যাগ করে কেটে পড়বে।

তারা না ঘুমিয়ে জাগ্রত থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কাফেলার লোকেরা আহরাদি সেরে শুয়ে পড়ে।

ইতিমধ্যে কাফেলার দুটি মেয়ে চুপিচুপি তাদের নিকট এমনভাবে চলে আসে, যেন তারা সঙ্গীদের ফাঁকি দিয়ে এসেছে। তারা অত্র এলাকার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে শুরু করে। তারা খলীল ও তার সঙ্গীকে বলল, আমরা যদি তোমাদেরকে একটি রহস্য জানিয়ে দেই, তাহলে কি তোমরা আমাদেরকে সাহায্য করবে?

রহস্য শব্দটা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর গুপ্তচরদের চমকে দেয়। তাদের কাজই তো রহস্য উদঘাটন করা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ানো এবং বিশেষ করে এই কাফেলায় যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যই তো রহস্য জানা।

মেয়েরা বলল, কাফেলার লোকগুলো অপহরনকারী। আমরা যে চারটি মেয়ে আছি, আমাদেরকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, আমরা জানি না। মেয়েরা আরো জানায়, আমরা মুসলমান এবং এদের থেকে মুক্ত হতে চাই।

কথায় কথায় এক মেয়ে খলীলকে সরিয়ে নিয়ে যায়। মেয়েটির কথাবার্তায় সরলতা আছে, আকর্ষণও আছে। সে খলীলকে বলল, তুমি যদি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও, তাহলে আমি তোমাকে বিয়ে করব এবং সারাজীবন তোমার সেবা করব। মেয়েটি আরো এমন কিছু কথা বলল, যার ফলে খলীল তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। মেয়েটা খলীলের প্রতি তার ভালবাসা ও নিজের অসহায়ত্বের কথা এমনভাবে প্রকাশ করে যে, খলীল তার ও অন্যান্য মেয়েদেরকে কিভাবে মুক্ত করা যায় ভাবতে শুরু করে।

অপর মেয়ে খলীলের সঙ্গীর সঙ্গে আলাদা ঘনিষ্ঠভাবে বসে আছে এবং এ ধারায়ই কথা বলছে। একজন নারীর স্রেফ নারী হওয়াই একটা শক্তি। সেই নারী যখন হয় রূপসী-যুবতী এবং বিপদগ্রস্ত, তখন একজন পুরুষ না গলে পারে না। সে অবস্থায়ই হয়েছে খলীল ও তার সঙ্গীর। দুজনই যৌবনদীপ্ত যুবক। তাছাড়া একজন নারী- সে যে-ই হোক- বিপদে পড়লে সাহায্য করা তাদের সামরিক নীতির অংশ।

মেয়েরা আলাদাভাবে দুই মিশরী গুপ্তচরকে খুশী করার জন্য অত্যন্ত সুস্বাদু কি যেন খেতে দেয়। এক মেয়ে উঠে পা টিপে টিপে তাঁবুতে যায় এবং ছোট একটি মশক হাতে নিয়ে ফিরে আসে। মশক থেকে শরবত ধরনের পানীয় ঢেলে দুজনকে খাওয়ায়। অত্যন্ত সুস্বাদু শরবত। তৃপ্তি সহকারে পান করে খলীল ও তার সঙ্গী।

 অল্পক্ষণ পরই দুজনের চোখের পাতা বুজে আসে। তারা ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন যখন তাদের চোখ খুলে, তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে ডুবি ডুবি করছে। সারা রাত ও সারাটা দিন ঘুমিয়ে থাকে তারা। মরুভূমির বালুকা প্রান্তরের ঝলসানো রোদও তাদেরকে জাগাতে পারেনি। সন্ধ্যাবেলা যখন তারা চোখ মেলে তাকায়, তখন কাফেলাও নেই, তাদের উটও নেই। আর তারাও সেই জায়গায় নেই, যেখানে ঘুমিয়েছিল। এ অন্য এক স্থান, যার আশপাশে মাটি ও বালির টিলা।

খলীল ও তার সঙ্গী ধড়মড় করে উঠে একটি উঁচু টিলার উপর চড়ে এদিক ওদিক তাকায়। তারা চারদিকে সারি সারি টিলার চূড়া আর দূরদিগন্তে মরুভূমির বালু ছাড়া আর কিছুই দেখছে না।

***

সেই বৃদ্ধ লোকটা আমি ছিলাম, সফরের সময় তুমি যার সঙ্গে কথা বলছিলে, রেমন্ডের গোয়েন্দা কমান্ডার বললেন- আমি তোমার কথাবার্তায় বুঝে ফেলেছিলাম, তুমি গোয়েন্দা এবং জানতে চাচ্ছ আমরা কারা এবং কোথায় যাচ্ছি।

না, সে লোকটি তুমি নও- খলীল বলল- সে তো বৃদ্ধ ছিল।

ওটা ছিল আমার ছদ্মবেশ- উইন্ডসর বলল- যা হোক আমি খুশি হলাম যে, তুমি মেনে নিয়েছ, তোমরা গুপ্তচর ছিলে এবং এখনও তা-ই আছ। আরো শুন, যে দুটি মেয়ে তোমাদেরকে অজ্ঞান করেছিল, এ হল তাদের একজন।

এখন আমরা গুপ্তচর নই- খলীল বলল- আমরা এখন খলীফার, অনুগত সৈনিক।

তুমি বকওয়াস করছ- উইন্ডসর বললেন- আমি সব সময় আলী বিন সুফিয়ানের প্রশংসা করে থাকি। কিন্তু তোমাদের প্রশিক্ষণ তো অসম্পূর্ণ। তোমরা এখনো পরিচয় গোপন করা ও গঠন-আকৃতি পরিবর্তন করা শেখনি।

উইন্ডসর খলীল ও তার সঙ্গীকে জানায় আমরা সামরিক সরঞ্জাম ও প্রচুর নগদ অর্থ নিয়ে সিরিয়া যাচ্ছিলাম। কাফেলার মরুবাসী বেশের লোকগুলো ছিল সামরিক উপদেষ্টা। তারা ছিল খৃস্টান। সুদান যাচ্ছিল। তারাই সুদানী ফৌজ গঠন করে এবং সালাহুদ্দীন আইউবীর ভাই তকিউদ্দীনকে এমন শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে যে, সে অর্ধেক ফৌজ সুদান ফেলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। সালাহুদ্দীন আইউবী যদি বিচক্ষণতার পরিচয় না দিতেন, তাহলে তকিউদ্দীনের অবশিষ্ট ফৌজও সুদান থেকে বেরিয়ে আসতে পারত না। ঐ মেয়েগুলোও সেই যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল।

উইন্ডসর আরো জানায়, সেদিন মিশরের উত্তরাঞ্চলে যখন খলীলদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল, সেদিন ছাউনীতে অবস্থান করার সময় তাদের একজন লোকও ঘুমায়নি এবং তাদেরকে কথা ও নারী দেহের ফাঁদে ফেলে অজ্ঞান করার জন্য মেয়ে দুটোকে প্রেরণ করা হয়েছিল। তাদের কৌশল সফল হয় এবং খলীল ও তার সঙ্গীকে অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে রেখে কাফেলা রওনা হয়ে যায়।

ঘটনাটা খলীলের ভালভাবেই মনে আছে এবং অন্তরে কাঁটার ন্যায় বিদ্ধ হয়ে আছে। এমন একটি ভয়ংকর গোয়েন্দা দলের কাফেলা তার হাত থেকে ছুটে গেল! তার গুপ্তচরবৃত্তির ইতিহাসে এমন ঘটনা দ্বিতীয় আরেকটি ঘটেনি। খলীল তার হেডকোয়ার্টারে এ ঘটনার রিপোের্টই করেনি। কারণ, প্রতিপক্ষের গোয়েন্দারা তাকে ধোকা দিয়ে কাবু করে ফেলেছিল। এটা তার ও তার সঙ্গীর এমন একটা অপমান, যা কাউকে বলা যায় না।

এখন সেই কাফেলার একজন পুরুষ ও একটি মেয়ে তার সামনে দন্ডায়মান। খলীল ও তার সঙ্গী তাদের কয়েদী। তবে খলীল অন্ত্রত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়। হয়ত তাকে এখান থেকে পালাতে হবে কিংবা জীবন ত্যাগ করতে হবে।

তোমরা আমার একটা প্রস্তাব মেনে নাও- উইন্ডসর বললেন- আমি তোমাদের উপর এমন দয়া করব, যেমনটি পূর্বে কখনও কারো উপর করিনি। তোমরা উভয়ে আমার দলে শামিল হয়ে যাও। বেতন-ভাতা যা চাইবে, তা-ই দেব। বললে দামেস্কে পাঠিয়ে দেব। যদি কায়রো পাঠাতে বল, তাতেও আপত্তি করব না। সেখানে গিয়ে তোমরা সালাহুদ্দীন আইউবীর লোক হয়ে থাকবে; কিন্তু কাজ করবে আমাদের। তোমাদের দায়িত্ব হবে, ওখানে আমাদের যেসব গোয়েন্দা কাজ করছে, তাদের সাহায্য করা। ধরা পড়ার উপক্রম হলে তোমরা কয়ের আগে তাদেরকে সতর্ক করে ঠিকানা থেকে সরিয়ে দেবে।

উইন্ডসর বলেই যাচ্ছেন আর খলীল ও তার সঙ্গী চুপচাপ শুনছে। তার রণা ছিল, এরা তার প্রস্তাব মেনে নেবে। তিনি বললেন, তবে এই প্রস্তাব গ্রহণ করে নেয়ার আগে একটি শর্ত পালন করতে হবে। তাহল, এখানে তোমাদের যত গোয়েন্দা আছে, তাদেরকে ধরিয়ে দেবে এবং বলে দেবে তারা কে কোথায় আছে।

আপনার প্রস্তাবের প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই- খলীল বলল- আর এখানে কারো গোয়েন্দা আছে কিনা, তাও আমার জানা নেই।

তোমরা সম্ভবত বুঝতে পারছ না, আমি তোমাদের কী দশা ঘটাব উইন্ডসর বললেন- তোমরা যদি এই আশা করে থাক যে, আমি হুট করে তোমাদেরকে খুন করে ফেলব, তাহলে তোমাদের সেই বাসনা পূরণ হবে না। যে জাহান্নামে আমি তোমাদেরকে নিক্ষেপ করব, সেখান থেকে অত তাড়াতাড়ি তোমরা মুক্তি পাবে না।

উইন্ডসর মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললেন- তোমরা কি আশা কর যে, আমি মেনে নেব তোমরা গোয়েন্দা নও তোমরা কি ভাবছ, আমি এখনো দ্বিধার মধ্যে আছি। তোমাদের অত জ্ঞান নেই যে, তোমরা আমাদের ধোকা দিতে পারবে। তাই যদি হত, তাহলে দুটা মেয়ের হাতে তোমরা বোকা সাজতে। তারা তোমাদেরকে তাদের যৌবন ও রূপের জালে আটকে ফেলেছিল।

শোন আমার খৃস্টান বন্ধু-কণ্ঠস্বর দৃঢ় ও কঠিন রূপ ধারণ করল খলীলের আমরা দুজন গোয়েন্দা। তবে এটা ভুল যে, আমি কিংবা আমার এই বন্ধু সেদিন তোমার মেয়েদের রূপের ফাঁদে আটকেছিলাম। আমি পাথর। কিন্তু আমার মধ্যে একটা দুর্বলতা আছে। বেশ কবছর আগে পনের-ষোল বছর বয়সের একটি মেয়ে আমার চোখের সামনে বিক্রি হয়েছিল। আমি তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলাম। এক ব্যক্তির হাত থেকে তরবারী ছিনিয়ে নিয়েছিলাম। একজনকে জখমও করেছিলাম। তারা ছিল তিনজন আর আমি একা। তারা আমাকে কাবু করে ফেলে। সেদিন যদি আমি অজ্ঞান না হয়ে পড়তাম, তাহলে মেয়েটাকে বাঁচাতে পারতাম। তারা মেয়েটাকে নিয়ে গেল। মানুষ আমাকে অচেতন অবস্থায় তুলে আমার ঘরে নিয়ে যায়।

তোমার বাড়ী কোথায়? উইন্ডসই জিজ্ঞেস করেন।

আমি কিছুই গোপন করব না। দামেস্কের সন্নিকটে একটি গ্রাম আছে। আমি সেখানকার বাসিন্দা। আর আমার এই বন্ধুর বাড়ী বাগদাদে। এসব কথা এত খোলামেলাভাবে আমি তোমার ভয়ে বলছি না। তুমি আমাকে এত সহজে পাকড়াও করতে পারবে না। সাহস থাকে তো আমার হাত থেকে বশীগুলো কেড়ে নাও। তুমি যে চুলার কথা উল্লেখ করেছ, সেখানে নিক্ষিপ্ত হলে আমার লাশ নিক্ষিপ্ত হবে।

খলীলের বক্তব্য শুনে উইন্ডসর অবজ্ঞার হাসি হাসলেন। পার্শ্ব থেকে খৃস্টান মেয়েটি হেসে বলল- এই আত্মবিশ্বাসই তোমাদের জীবনের অবসান ঘটাবে। নতুন নর্তকী খলীলের মুখপানে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

আমি বলছিলাম, আমি ঐ মেয়েটাকে রক্ষা করতে পারিনি- তার স্মৃতি কাঁটা হয়ে আমার হৃদয়ে বিদ্ধ হয়ে আছে। সেই রাতে যখন আমরা দুজন তোমাদের কাফেলার সঙ্গে ছিলাম, তখন তোমার মেয়ে দুটো আমাকে বলেছিল, তাদেরকে বিক্রি করার জন্য অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তখন সেই মেয়েটির মুখাবয়ব আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে, আমি যাকে রক্ষা করতে পারিনি। আমি তোমার মেয়ে দুটোর চেহারায় সেই মেয়েটির নিষ্পপ চেহারা দেখতে পেয়েছি। আমার হৃদয়ে বিদ্ধ হয়ে থাকা কাঁটা আমার বিবেকের উপর পর্দা ফেলে দেয়। তখন যদি আমার সেই মেয়েটির কথা মনে না পড়ত, তাহলে তোমার মেয়েরা কক্ষনো আমাকে বোকা বানাতে পারত না।

নতুন নর্তকীর দেহ সজোরে একটা ঝাকুনী দিয়ে ওঠে। একটু পেছনে সরে গিয়ে সে পালংকের উপর ধপাস করে বসে পড়ে। চেহারাটা বিবর্ণ হয়ে যায়।

আর এখন তো মৃত্যুও আমাকে বোকা বানাতে পারবে না- খলীল বলল আর তোমার কোন প্রলোভনই আমাকে আমার কর্তব্য থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না।

ভোজসভার হলরুমে আগত মেহমানরা উইন্ডসরের অপেক্ষা করছে। তাদের অধীর অপেক্ষা নতুন নর্তকীর জন্য। হলরুমের দরজার বাইরে যে দুজন সান্ত্রী দন্ডায়মান ছিল, তারা এখন কোথায়, সে খবর কেউ জানে না।

বর্শা ও তরবারী এখনো খলীল ও তার সঙ্গীর সঙ্গেই আছে। উইন্ডসর যখন দেখলেন, আসামীরা তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে এবং তারা ঈমান ও কর্তব্যবোধে অটল, তখন তিনি বললেন- ঠিক আছে, তোমাদের অস্ত্রগুলো আমার হাতে দিয়ে দাও।

খলীল ও তার বন্ধু তাও স্পষ্টভাবে অস্বীকার করে। উইন্ডসর জোরপূর্বক অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়ার জন্য উদ্যত হয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যান। সম্ভবত তিনি তার দেহরক্ষীদের ডাকতে যাচ্ছিলেন। খলীল দ্রুত ছুটে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেয় এবং বর্শার আগাটা উইন্ডসরের দিকে তাক করে কঠোর ভাষায় বলে উঠে যেখানে আহু, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাক; এক চুলও নড়বে না বলে দিলাম। খলীল আরো সম্মুখে এগিয়ে গিয়ে বর্শার আগাটা উইন্ডসরের ধমনীর উপর স্থাপন করে। খলীলের সঙ্গীও তৎপর হয়ে ওঠে। সেও তার বর্শার আগা উইন্ডসরের ধমনীতে স্থাপন করে।

উইন্ডসরের ডেকে আনা মেয়েটি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে পিছনে সরতে সরতে দেয়ালের সঙ্গে গিয়ে দাঁড়ায়। খলীল ও তার সঙ্গী তাদেরকে ওখানেই কাবু করে ফেলে। খলীল নতুন নর্তকীকে উদ্দেশ করে বলল- তুমিও ওদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে যাও। চিৎকার করলে শেষ করে ফেলব বলে দিলাম।

তুমি যদি খলীল হয়ে থাকে, তাহলে আমি হুমায়রা- নতুন নর্তকী বলল- আমি তোমাকে প্রথমদিনই চিনেছিলাম। আর তুমি আমাকে চিনতে চেষ্টা করছিলে।

খানিক আগে খলীল তার নাম ব্যতীত আর সব লক্ষণই বলে দিয়েছিল। হুমায়রা এখানে এসে অবধি খলীলকে অবলোকন করছিল। কিন্তু খলীলের মতো সেও সন্দেহে নিপতিত ছিল। সেও ভাবছিল, মানুষে মানুষে চেহারায় মিল থাকে, আমার ধারণা সঠিক নাও হতে পারে।

তুমিও কি গুপ্তচর- খলীল জিজ্ঞেস করে।

 না- হুমায়রা জবাব দেয়- আমি শুধু নর্তকী। আমাকে সন্দেহ কর না খলীল। আমি তোমার সঙ্গে আছি এবং তোমার সঙ্গেই থাকব। যদি জীবন দিতে হয়, তোমার সঙ্গেই দেব।

***

ক্ষমতাচ্যুত খলীফা আল-মালিকুস সালিহ ভোজসভায় এসে পৌঁছান। এসে উপস্থিত হন তার সকল আমীর-উজীর ও আমন্ত্রিত অথিতিগণ। উপদেষ্টা হিসেবে আগত খৃস্টান সেনা অফিসারগণও আছেন মেহমানদের মধ্যে। তাদের চলন-বলনের ধরণ রাজা-বাদশার মতো। তাদের একজন হল রেমন্ডের সামরিক প্রতিনিধি। তারা সকলে উইন্ডসরকে তালাশ করছে। উইন্ডসর এখনো এসে পৌঁছাননি। এখানকার সকল খৃস্টান মেয়ে হলে এসে গেছে। আসেনি শুধু একজন। নর্তকীরাও সবাই এসেছে। আসেনি কেবল নতুনজন। আস-সালিহ এসে পৌঁছানোর পর সকলের অস্থিরতা বেড়ে গেছে। আর বিলম্ব সইছে না কারো। এক চাকরকে বলা হল, তুমি উইন্ডসর ও মেয়ে দুজনকে গিয়ে বল, সবাই এসে গেছেন, আপনাদের অপেক্ষা করছেন।

চল, হাত-পা বেঁধে এদেরকে এখানেই ফেলে রেখে আমরা পালিয়ে যাই। খলীলের বন্ধু বলল।

তুমি কি একটা বিষাক্ত সাপকে জীবিত রাখতে চাও? বলেই খলীল পূর্ব থেকে উইন্ডসরের ধমনী স্পর্শ করে রাখা বর্শাটা পূর্ণ শক্তিতে সেঁধিয়ে দেয়। উইন্ডসরের মাথাটা দেয়ালের সঙ্গে লাগা ছিল। বর্শার আগা তার ধমনী অতিক্রম করে পিছন দিকে বেরিয়ে যায়। উইন্ডসরের মুখ থেকে সামান্য একটু গোঙ্গানীর শব্দ বেরিয়ে আসে। পরক্ষণেই অনুরূপ একটি গড়গড় শব্দ বেরিয়ে আসে খৃস্টান মেয়েটির মুখ থেকেও। খলীলের বন্ধুও একই কায়দায় মেয়েটিকেও কাবু করে ফেলে।

বর্শা দুটো টেনে বের করে আনে তারা। উইন্ডসর ও মেয়েটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ছটফট করতে থাকে। এবার খলীল ও তার সঙ্গী তাদের হৃদপিণ্ডের উপর বর্শা রেখে উপর থেকে সজোরে চাপ দেয়। ঠাণ্ডা হয়ে যায় দুজন। খলীল লাশ দুটিকে ঠেলে দেয় পালংকের নীচে।

কক্ষটা উইন্ডসরের। দেয়ালের সঙ্গে হেঙ্গারে তার চোগাটা ঝুলছিল। মাথা ঢাকার অংশটাও আছে সঙ্গে। হুমায়রা টান দিয়ে চোগাটি নিয়ে পরে ফেলে এবং মাথাটা ঢেকে নেয়। নিজের পোশাক খুলে দেহের নিম্নাংশে পুরুষের পোশাক পরিধান করে। পায়ের মোজা পরিবর্তন করে ফেলে এবং মুখটা ঢেকে নেয়। এখন এক নজরে কারো বুঝবার উপায় নেই যে, সে একজন মহিলা।

খলীল দরজা খুলে বাইরে তাকায়। বারান্দায় চাকর-বাকরদের আসা-যাওয়া ও দৌড়-ঝাঁপ চলছে।

তারা তিনজন বাইরে বেরিয়ে পড়ে। দরজাটা বাহির থেকে বন্ধ করে একদিকে হাঁটা দেয়। মুহূর্তের মধ্যে তারা অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।

খলীল ও তার সঙ্গীর জানা আছে, তাদের কোথায় যেতে হবে। বুজুর্গ আলেমের বেশে তাদের কমান্ডার যেখানে অবস্থান করছেন, সেখানে লুকাবার জায়গাও আছে। ওখান থেকে পালাবার ব্যবস্থাও আছে। এ সময়ে শহর থেকে বের হওয়া নিরাপদ নয়। সঙ্গে ঘোড়াও নেই। হাল্ব থেকে পালিয়ে তাদের দামেস্কে পৌঁছতে হবে। খুনের ঘটনা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর শহরে কী তোলপাড় শুরু হবে, সেই আন্দাজও তাদের আছে।

উইন্ডসরের খুনের ঘটনা জানাজানি হতে বেশী বিলম্ব হল না। একব্যক্তি উইন্ডসরের কক্ষের দরজা খুলেই চীৎকার করে ওঠে। পালংকের নীচ থেকে রক্ত বেয়ে বেয়ে দুরজা পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রাসাদময় হুলস্থল শুরু হয়ে যায়। একটি নয়- দুটি লাশ! জখম দুজনের একই ধরনের!

কর্মকর্তারা ছুটে আসেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রহরীদের কথা মনে পড়ে যায়। তাদের উপস্থিতিতে একসঙ্গে দুটি খুন কিভাবে হতে পারে? কর্তব্যরত সান্ত্রীদের তলব করা হয়। কিন্তু দুজনই উধাও। এই ভবনে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষিদ্ধ। শাসক কিংবা গণ্যমান্য নাগরিক ছাড়া কেউ এই প্রাসাদে ঢুকতে পারে না। তাদেরকেও চেক করে ঢুকতে দেয়া হয়। রক্ষী কমান্ডারের উপর বিপদ নেমে এল। এই দুর্ঘটনার জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে।

এই হত্যাকাণ্ড কাদের কাজ? পেশাদার ঘাতকদের, নাকি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর গুপ্তচরদের ফেদায়ী ঘাতকদেরও হতে পারে। এই ভাড়াটিয়া ঘাতকরা অর্থের বিনিময়ে যে কাউকে খুন করতে পারে।

কর্তব্যরত প্রহরীদেরকে খুঁজে না পাওয়ায় সন্দেহ আরো ঘনীভূত হল যে, এটা সুলতান আইউবীর কাজ এবং পলাতক প্রহরীরা তারই লোক। গভীর রাত অবধি খলীল ও তার সঙ্গীকে না পেয়ে শহরে তাদের অনুসন্ধান শুরু হয়ে যায়। নতুন নর্তকী যে নেই, সে তথ্য ফাঁস হয় অনেক পরে। শহর সীল করে দেয়া হয়।

খলীল, তার সঙ্গী ও হুমায়রা ঠিকানায় পৌঁছে গেছে। তারা কমান্ডারকে ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করে। কমান্ডার তাদেরকে লুকিয়ে ফেলেন এবং বলে দেন, বাইরের পরিস্থিতি অনুযায়ী তোমাদের জানানো হবে, তোমরা কবে এবং কখন এখান থেকে বেরিয়ে পড়বে।

এই কমান্ডারের উপর কারো সন্দেহ হবে না। কারণ, মানুষ তাকে একজন বিজ্ঞ আলেম ও বুজুর্গ ব্যক্তি বলেই জানে। যে দুজন শিষ্যকে তিনি সঙ্গে রেখেছেন, তারাও গোয়েন্দা। হাবের তথ্যাদি দামেকে এরাই পৌঁছিয়ে থাকে। তিনি বাইরের পরিস্থিতির উপর নজর রাখার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেন।

হুমায়রা কমান্ডারের সম্মুখে খলীলকে তার কাহিনী শোনায়—

 তুমি যখন আমাকে আমার পিতা ও লোক দুজন থেকে রক্ষা করার জন্য সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলে, তখন আমার পিতা তোমার মাথায় কোদাল দ্বারা আঘাত হানে। আঘাতের ফলে সঙ্গে সঙ্গে তুমি মাটিতে পড়ে গিয়েছিলে। তারা তিনজন আমাকে ধরে নিয়ে একজন মৌলভী ডেকে আনে। মৌলভী সাহেব আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস না করে আমার বিবাহ পড়িয়ে দেন। তারপর লোক দুজন আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। তারা আমাকে এক রাত দামেস্কে রাখে। তারপর এমন একটি এলাকায় নিয়ে যায়, যেখানে খৃস্টানদের শাসন চলছে। তারা আমাকে নাচ-গানের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। আমি প্রথম প্রথম অমত পোষণ করি। ফলে আমার উপর এমন নির্যাতন চালানো হয় যে, আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। শুরু দিকে আমাকে উন্নত মানের খাবার দেয়া হত এবং অত্যন্ত সুস্বাদু এক প্রকার শরবত পান করাত, যার ক্রিয়ায় আমি হাসতে ও নাচতে শুরু করতাম।

তারা নির্যাতন ও নেশার ঘোরে আমাকে নর্তকী বানিয়ে নেয়। আমি উঁচুমানের লোকদের ভোগের বস্তুতে পরিণত হই। আমাকে জেরুজালেম নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওখানে দুব্যক্তি আমাকে দেখে আমার মালিককে বলল, মূল্য যা চাইবে, তা-ই দেব, মেয়েটাকে আমাদেরকে দিয়ে যাও। কিন্তু মালিক এই বলে তা প্রত্যাখ্যান করে যে, আমরা একে গুপ্তচরবৃত্তি ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করে থাকি।

হুমায়রা জানায়– আমাকে বেশ কয়েকবার অপহরণ করারও চেষ্টা করা হয়েছে, যা ব্যর্থ করে দেয়া হয়েছে। এখন আমাকে এক আমীরের ফরমায়েশে হাবে তলব করা হয়েছে।

হুমায়রা জানায়, প্রথমদিন যখন আমি তোমাকে দেখি, তখন আমি নিশ্চিত বুঝেছিলাম যে, তুমি খলীল। কিন্তু পরক্ষণে মনে এই সন্দেহও জাগ্রত হয় যে, মানুষে মানুষে চেহারায় মিল থাকে। হয়ত তুমি দেখতে খলীলের মত অন্য কেউ। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি তোমাকে নিরীক্ষা করে দেখতে থাকি। তারপর তো নিশ্চিত হলাম তুমি খলীল ছাড়া আর কেউ নও।

হুমায়রা জানায়–

আমি নোংরা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। আমার চেতনা মরে গিয়েছিল। আমি একটি পাথরখণ্ডের ন্যায় এদিক-ওদিক নড়াচড়া করতে থাকি। কিন্তু তোমাকে দেখার পর আমার চেতনা জীবিত হয়ে ওঠে। আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে, তুমি খলীল। কিন্তু তোমার গঠন-আকৃতি আমাকে সেই সময়টা স্মরণ করিয়ে দেয়, যখন আমার হৃদয়ে তোমায় ভালবাসা ছিল এবং আমি তোমার সন্তানের মা হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম যে, সুযোগমত একসময় তোমাকে জিজ্ঞেস করব, তুমি কি খলীল? তুমি খলীল প্রমাণিত হলে তোমাকে বলব, চল আমরা পালিয়ে যাই এবং যাযাবরদের ন্যায় জীবন-যাপন করি।

হুমায়রা খলীলকে পেয়ে গেছে এবং তার সঙ্গে পালিয়ে এসেছে। কিন্তু হাল থেকে নিরাপদে বের হওয়া তাদের পক্ষে বিরাট এক সমস্যা।

***

খলীফার ভোজস এবং নাচ-গানের আসর লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। ওখানে অপেক্ষা চলছিল উইন্ডসরের। কিন্তু পৌঁছে তার লাশ। খৃষ্টান সেনাবাহিনীর উর্ধতন যে অফিসার সভায় উপস্থিত ছিলেন, তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সবচে বেশি ক্ষুব্ধ হয় রেমন্ডের প্রতিনিধি।

উইন্ডসর অত্যন্ত চৌকস অফিসার ছিলেন। রেমন্ডের প্রতিনিধি আল মালিকুস সালিহ, তার আমীর ও সেনা কমান্ডারদের বকাঝকা শুরু করে দেয়। তার সম্মুখে নতশীরে চুপসে আছে সবাই। তাদের অন্তরে সালাহুদ্দীন আইউবীর শক্রতা ও ঘৃণা এত প্রবল যে, তারা খৃস্টান অফিসারদেরকে ফেরেশতা মনে করেন। তাদেরই সাহায্য-সহযোগিতায় তারা আইউবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কাজেই তাদের তোষামোদ করা আবশ্যক। রেমন্ডের প্রতিনিধি যা-ই বলছে, তার সামনে তারা মাথানত করছে এবং জ্বি হ্যাঁ, জ্বি হ্যাঁ বলছে। রেমন্ডের প্রতিনিধি বলল

ঘাতকরা রাতারাতি শহর ত্যাগ করতে পারবে না। কাজেই ভোর থেকেই হাবের প্রতিটি ঘরে তল্লাশি চালানো হোক। এলাকার সমস্ত ফৌজকে এ কাজে লাগিয়ে দাও। মানুষ ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার আগেই ফৌজ ঘরে ঘরে ঢুকে পড়বে। এখানকার অধিবাসীদের অস্থির করে তুলতে হবে, যাতে তারা নিজেরাই ঘাতকদেরকে আমাদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়।

তা-ই হবে- এক মুসলমান আমীর বললেন- আমরা ফৌজকে এখনই নির্দেশ দিচ্ছি, যেন তারা রাতের আঁধারেই শহরে ছড়িয়ে পড়ে।

না, এটা হতে পারে না- একজন মুসলমান কেল্লাদারের কণ্ঠ। তিনি হুংকার ছেড়ে আবার বললেন- না, এমন হতে পারে না। তল্লাশি শুধু সেই ঘরেই নেয়া হবে, যে ঘরে ঘাতকরা লুকিয়েছে বলে প্রবল সন্দেহ হবে এবং সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকবে।

কেল্লাদারের এ হুংকারে অকস্মাৎ উত্তপ্ত মজলিস ঠাণ্ডা হয়ে যায়। পিনপতন নীরবতা নেমে এলে হলরুমে। হঠাৎ চুপসে গেল প্রতাপান্বিত এতগুলো পদস্ত শাসক-কর্মকর্তা। এমন একটি জ্বলন্ত সত্য ভাষণ শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না কেউ। রেমন্ডের সামরিক প্রতিনিধির নির্দেশকে কোন মুসলমান এত সাহসিকতার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করতে পারে, তা সকলের কল্পনার বাইরে। মাথা উঁচু করে, চোখ বড় করে ও কপালে ভার্জ তুলে দেখার চেষ্টা করল, লোকটা কে।

লোকটা হামাতের দুর্গ- অধিপতি। তার নাম জুরদিক। ইতিহাসে তার নাম এই জুরদিকই উল্লেখ করা হয়েছে। পুরো নাম পাওয়া যায় না। ইতিহাস তার সম্পর্কে এটুকুই বলছে যে, লোকটা সালাহুদ্দীন আইউবীর বন্ধু ছিলেন। কিন্তু এই ঘটনা পর্যন্ত তিনি আইউবী বিরোধী শিবিরেরই লোক ছিলেন এবং আল মালিকুস সালিহর অফাদার ছিলেন। তার প্রমাণ, তিনি এই ভোজসভায় শুধু উপস্থিত-ই ছিলেন না; বরং আইউবী বিরোধীদের জঙ্গী কর্মকাণ্ডগুলোতেও হাজির থাকতেন। সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে যেসব যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রস্তুত হয়েছিল, তিনি তাতেও উপস্থিত ছিলেন।

জুরদিক যখন একজন খৃষ্টানের মুখ থেকে শুনলেন যে, হাবের প্রতিটি ঘরে তল্লাশি চালানো হবে, তখন তার মধ্যে ইসলামী মর্যাদাবোধ জেগে ওঠে। তিনি প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। তিনি বললেন- এখানকার প্রতিটি পরিবার মুসলমান। তাদের মধ্যে পর্দানশীল সভ্রান্ত মহিলারাও রয়েছেন। আমি তাদের অবমাননা মেনে নিতে পারি না। সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোতে সৈন্য ঢুকতে পারবে না।

উইন্ডসরের ঘাতক এই নগরীরই মানুষ- এক খৃস্টান অফিসার বলল আমরা সব নাগরিক থেকে প্রতিশোধ নেব। উইন্ডসরের ন্যায় একজন সুদক্ষ অফিসার খুন হল। আমরা কারো ইজ্জত, কারো পর্দার পারোয়া করি না।

আর তোমাদের একজন অফিসার খুন হয়েছে, তাতে আমাদের কিছু যায়। আসে না। ক্ষুব্ধ জুরদিক কম্পিত কণ্ঠে বললেন।

চুপ কর জুরদিক!–অনভিজ্ঞ বালক সুলতান আদেশের ভঙ্গিতে বললেন এরা এতদূর থেকে আমাদের সাহায্যের জন্য এসেছেন! এরা আমাদের সম্মানিত মেহমান। তুমি কি মেহমানদারীর আদব-কায়দা ভুলে গেছ নিমকহারামী কর না জুরদিক! যে করেই হোক, খুনীকে আমাদের ধরতেই হবে।

খলীফার সমর্থনে আরো কয়েকটি কণ্ঠ ভেসে এল- ঠিক, ঠিক।

 আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরোধী হতে পারি এবং বিরোধী-ই- জুরদিক বললেন- কিন্তু আমি আমার স্বজাতির বিরোধী নই। মুহতারাম সুলতান। আপনি যদি জনসাধারণকে বিরক্ত করেন, তাহলে তারা আপনার বিরুদ্ধে চলে যাবে। আপনি সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে যে রণ প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তা দুর্বল হয়ে পড়বে।

আমরা জনগণের পরোয়া কখনো করি না- রেমন্ডের প্রতিনিধি বলল উইন্ডসরের ঘাতকদেরকে আমরা খুঁজে বের করবই। শহরের যেখানেই পালিয়ে থাকুক, তাদেরকে ধরবই। এ হত্যাকাণ্ড যে সালাহুদ্দীন আইউবী করিয়েছেন, তাতে সন্দেহ নেই।

আমার দোস্ত!- জুরদিক বললেন- তোমাদের একজন অফিসারের খুন হওয়া তেমন কোন ঘটনা নয়। তোমরা সালাহুদ্দীন আইউবীকে খুন করার জন্য কতবার চেষ্টা করেছ! পারনি, সে ভিন্ন কথা। আমি একথা বলছি না যে, আইউবীকে খুন করার চেষ্টা করে তোমরা অন্যায় করেছ। দুশমন একে অপরকে বৈধ-অবৈধ যে কোন পন্থায়ই ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তোমাদের উইন্ডসরকে যদি আইউবী-ই খুন করিয়ে থাকেন, তাহলে পার্থক্য শুধু এটুকু যে, তাকে হত্যা করার প্রচেষ্টায় তোমরা সফল হওনি; কিন্তু তিনি সফল হয়েছেন। তোমরাও তো। তার কয়েকজন অফিসারকে খুন করিয়েছ। তারপরও তো তিনি জনসাধারণকে বিরক্ত করেননি।

সমস্ত মুসলিম আমীর ও কর্মকর্তা জুরদিকের বিপক্ষে কথা বলতে শুরু করেন। তারা খৃস্টানদেরকে নারাজ করতে চাচ্ছেন না। কিন্তু জুরদিক একাই সকলের মোকাবেলা করেন এবং নিজের অভিমতের উপর সুদৃঢ় থাকেন যে, নগরীর ঘরে ঘরে নির্বিচারে তল্লাশী চালানো যাবে না।

তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে, তুমিও এই খুনের ঘটনায় জড়িত রয়েছ? এক খৃস্টান উপদেষ্টা বলল- আমার সন্দেহ হচ্ছে, তুমি সালাহুদ্দীন আইউবীর অনুগত।

যদি হালবের মুসলিম পরিবারগুলোকে অন্যায়ভাবে পেরেশান করা হয়, তাহলে আমি যে কারো হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে পারি- জুরদিক বললেন, আর আইউবীর বন্ধুও হয়ে যেতে পারি।

আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত এখানে আছি, আমাদেরই নির্দেশ চলবে। খৃস্টান, প্রতিনিধি বলল।

এখানে তোমরা ভাড়ায় এসেছ- জুরদিক বললেন- এদেশে শাসন চলবে আমাদের। আমরা মুসলমান। পরিস্থিতি আমাদেরকে আপসে যুদ্ধে করাচ্ছে। মুসলিম-অমুসলিমে কখনো সখ্য হতে পারে না। যদি বল, তোমরা পারিশ্রমিক ছাড়া, এসেছ, তাহলে আমি তোমাদের সাহায্য থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছি। দুর্গ অধিপতির পদ থেকেও আমি অব্যাহতি গ্রহণ করছি। আমি তোমাদের সকলকে জানিয়ে দিতে চাই যে, আমার জাতির একটি নিরপরাধ লোককেও যদি কষ্ট দেয়া হয়, আমি তার প্রতিশোধ নেব।

কার যেন ইশারায় দুব্যক্তি জুরদিককে বাহিরে নিয়ে যায়। তার অনুপস্থিতিতে খৃস্টান প্রতিনিধি সভাসদদের উদ্দেশ করে বলল- পরিস্থিতি এমন যে, দুর্গ অধিপতিকে ক্ষেপানো যাবে না। লোকটা যেভাবে সাহসিকতার সঙ্গে, কথা বলছে, তাতে বুঝা যায় যে, তার দুর্গে যেসব সৈন্য আছে, তারা তার অনুগত। ঘটনা যদি তা-ই হয়, তাহলে পরিস্থিতিটা ভাল নয়।

আপসে শলা-পরামর্শ করে জুরদিককে ভেতরে নিয়ে আসা হল। তাকে আশ্বস্ত করা হল, নিরীহ জনসাধারণকে হয়রানী করা হবে না। কিন্তু ঘাতকদের খুঁজে বের করতে হবে।

জুরদিক বললেন- ঠিক আছে, আমি তিন-চার দিন এখানে থাকব। দেখব, তোমরা কী কর।

চারদিন পর জুরদিক হালব থেকে রওনা হন। গন্তব্য তার হামাতের দুর্গ। তার উপস্থিতিতে খুনীদের অনুসন্ধান ও গোয়েন্দা তৎপরতা চলে। তিনি পরিস্থিতির উপর কড়া দৃষ্টি রাখেন। তার দাবি অনুযায়ী কারো বাড়ি-ঘরে হানা দেয়া হয়নি। তিনি নিশ্চিন্ত মনে যাচ্ছেন। কিন্তু খৃস্টানরা তার ব্যাপারে আশ্বস্ত নয়। সঙ্গে দশ-বারজন রক্ষীসেনা। তিনিসহ সবাই অশ্বারোহী।

জুরদিক এগিয়ে চলছেন। একটু পরপর পার্বত্য এলাকা অতিক্রম করতে হচ্ছে। দু-তিনটা পাহাড়ী এলাকা অতিক্রম করার পর আরো একটা পাহাড়ী এলাকায় ঢুকে পড়েন। পথের দুপার্শ্বে উঁচু-নীচু অনেক টিলা। হঠাৎ কোন একদিক থেকে একসঙ্গে দুটি তীর ছুটে আসে তার দিকে। উভয় তীর জুরদিকের ঘোড়ার মাথায় এসে বিদ্ধ হয়। হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে ঘোড়াল দিগ্বিদিক ছুটতে শুরু করে। শাঁ করে ধেয়ে আসে আরো দুটি তীর। এগুলোও বিদ্ধ হয় ঘোড়র গায়ে।

জুরদিক দক্ষ ঘোড়সওয়ার। তিনি ধাবমান ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়ে একটি পাথরের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ান। তার রক্ষী সেনারা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ে। যারা তীর ছুঁড়েছে তাদেরকে খুঁজতে থাকে।

এলাকাটি এমন যে, কাউকে গ্রেফতার করা কঠিন ব্যাপার। জ্বরকিবুঝে ফেলেন, এরা ভাড়াটিয়া ঘাতক। সাম্প্রতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে খৃষ্টানরা তাকে খুন করার জন্য এদের নিয়োগ করেছে। খৃষ্টানদের মনে সন্দেহ, জুরদিক সুলতান আইউবীর সমর্থক।

জুরদিক দক্ষ যোদ্ধা। তিনি পাথরের আড়াল থেকে বের হয়ে উপরে উঠে আসেন। চারদিকে টিলা আর টিলা। তার রক্ষীসেনারা তীরন্দাজদের খুঁজে বেড়াচ্ছে।

এদিকে আস! এক রক্ষী চিৎকার করে বলল- জলদি এদিকে আস, ধরে ফেলেছি।

সবাই ওদিকে ছুটে যায়। তিন ব্যক্তিকে ঘিরে ফেলেছে তারা। তিনজনই মুখোশ পরিহিত। কিন্তু তাদের নিকট ধনুক নেই, নীরও নেই। শুধু ঘোড়া আছে। তাদেরকে এমন অবস্থায় পাকড়াও করা হয়েছে, যখন তারা ঘোড়ায় আরোহন করছিল। সবারই মুখমণ্ডল আবৃত। শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। বৃক্ষীরা তদেরকে ধরে জুরদিকের নিকট নিয়ে যায়।

তোমাদের ধনুক-তূনীর কোথায়? জুরদিক ধৃতদের জিজ্ঞেস করে।

আমাদের কাছে তরবারী ছাড়া আর কিছুই নেই। একজন জবাব দেয়।

শোন ভাইয়েরা!- জুরদিক শান্ত কণ্ঠে বললেন- তোমাদের চারটি তীরই লক্ষভ্রষ্ট হয়েছে। তোমরা আমাকে খুন করতে ব্যর্থ হয়েছ। এবার ধরাও পড়েছ। কাজেই মিথ্যা বলে লাভ নেই।

কিসের তীর?- বিস্ময়ভরা কণ্ঠে একজন বলল- আমরা তো কোন তীর হুঁড়িনি। আমরা পথচারী। খানিক বিশ্রাম করার জন্য বসেছিলাম। যখন রওনা হতে উদ্যত হলাম, এরা আমাদেরকে ধরে নিয়ে এল।

জুরদিক হাসেন এবং মুখোশ পরিহিত উত্তরদানকারী লোকটিকে উদ্দেশ করে বললেন, আমি তোমাদেরকে আমার শত্রু মনে করি না। তা-ই যদি হতো, তাহলে এতক্ষণে তোমাদের সকলের মস্তক উড়িয়ে দিতাম। আমি জানি, তোমরা ভাড়াটিয়া খুনী। তোমরা শুধু এটুকু স্বীকার কর- আমাকে খুন করার জন্য তোমাদেরকে কে পাঠিয়েছে। সত্য সত্য বল, তোমাদেরকে ছেড়ে দেব। কিন্তু ধৃত একই কথা বলছে যে, এ ব্যাপারে তারা কিছুই জানেনা।

দুজন মুখোশধারী শপথ করে বলল- এই ঘটনার ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না।

তৃতীয় জন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

দেখ, অযথা নিজেদেরকে বিপদের মুখে ঠেলে দিও না- জুরদিক বললেন পরের জন্য নিজের জীবন নষ্ট কর না। আমি তোমাদেরকে শাস্তি দেব না, এক্ষুণি ছেড়ে দেব।

এদের মুখোশগুলো খুলে ফেল- জুরদিক তার রক্ষীদের নির্দেশ দেন। এদের হাত থেকে তরবারীগুলো নিয়ে নাও।

দুই মুখোশধারী খাপ থেকে তরবারী খুলে হাতে নেয় এবং লাফ মেরে পিছনে সরে যায়। তৃতীয়জন তাদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার সঙ্গে তরবারী নেই।

জুরদিক অট্টহাসি হেসে বললেন- তোমরা কি এতগুলো রক্ষীসেনার মোকাবেলা করতে পারবে? অথচ তোমাদের তৃতীয়জনের হাতে অস্ত্র নেই! আমি তোমাদেরকে পুনরায় সুযোগ দিলাম। তোমাদের গর্দান উড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ কিন্তু আমি এখনো দেইনি।

রক্ষীরা অস্ত্র তাক করে তাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে দাঁড়িয়ে যায়।

আর আমি আপনাকে শেষবারের মতো বলছি, আমরা কেউ তীর ছুঁড়িনি। এক মুখোশধারী বলল।

রক্ষীসেনাদের কমান্ডার ধৃত তিন ব্যক্তির পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার মনে বিশেষ সন্দেহ জাগে। তৃতীয় যে লোকটির হাতে অস্ত্র নেই, টান মেরে তার মুখোশটা খুলে ফেলে। তার মুখোশহীন উন্মুক্ত মুখাবয়ব দেখে সবাই থ খেয়ে যায়। এ যে একজন রূপসী যুবতী!

জুরদিক বললেন, ওকে আমার কাছে নিয়ে আস। অপর দুজন হঠাৎ লাফ মেরে পেছনে মোড় ঘুরিয়ে মেয়েটিকে পাকড়াওকারী রক্ষীর বুকে তরবারী তাক. করে ধরে।

একজন চিৎকার করে বলে ওঠে- যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা আমাদেরকে তোমাদের পুরো ঘটনা খুলে না বলবে এবং আমাদের ইতিবৃত্ত না শুনবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মেয়েটির গা স্পর্শ করবে না বলে দিচ্ছি। আমরা জানি, আমাদেরকে তোমাদের হাতে প্রাণ দিতে হবে। কিন্তু তোমাদের অন্তত অর্ধেক রক্ষীসেনাকে না মেরে আমরা মরছি না। মেয়েটাকে তোমরা জীবিত নিতে পারবে না।

জুরদিক ঠাণ্ডা মেজাজের লোক। তিনি রক্ষীদেরকে পেছনে সরিয়ে দিয়ে, মুখোশধারীদের বললেন- তোমরা আমার কাছে আর কী কথা শুনতে চাও বল। কথা তো এটুকুই যে তোমরা ভাড়াটিয়া খুনী আর এই মেয়েটিকে পুরষ্কার হিসেবে লাভ করেছ।

তোমরা ভুল করছ- একজন মুখোশধারী বলল- খৃস্টান অফিসার ও একটি মেয়েকে হত্যা করে আমরা অপরাধ করিনি। পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছি, সে আমাদের দুর্ভাগ্য। তারপরও আমরা আনন্দিত যে, আমরা কর্তব্য পালন করেছি। এই মেয়েটি মুসলমান ও নিপীড়িত। আমরা একে খৃস্টানদের পাঞ্জা থেকে উদ্ধার করে এনেছি। আর যাচ্ছি দামেস্কে।

আচ্ছা! উইন্ডসর ও খৃস্টান মেয়েটাকে তাহলে তোমরা খুন করেছ! হঠাৎ মকে ওঠে জিজ্ঞেস করেন জুরদিক।

হা- এক মুখোশধারী জবাব দেয়- আমরাই তাদেরকে হত্যা করেছি।

আর তোমরা আমার উপর এই জন্য তীর ছুঁড়েছ যে, আমি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর দুশমন। জুরদিক বললেন।

দেখুন, আমরা ভালভাবেই জানি, আপনার নাম জুরদিক এবং আপনি হামাত দুর্গের অধিপতি- এক মুখোশধারী বলল- আমরা এ-ও জানি যে, আপনি সালাহুদ্দীন আইউবীর দুশমন। কিন্তু আপনাকে হত্যা করার প্রয়োজন আমাদের নেই। আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। অতি শীঘ্র আমরা তোমাদেরকে নিরস্ত্র করব। সকল সৈন্যসহ তোমাদেরকে কয়েদী বানাব। সুলতান আইউবী হাসান ইবনে সাব্বাহ কিংবা শেখ সান্নান নন। তিনি ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ করেন- চোরের মতো কাউকে খুন করান না। উইন্ডসর ও খৃস্টান মেয়েটির হত্যাকাণ্ড আমাদের ব্যক্তিগত কাজ। কাজটা আমরা বাধ্য হয়েই করেছি। পরিস্থিতি আমাদেরকে বাধ্য করেছিল। এতে সুলতান আইউবীর কোন হাত নেই।

জুরদিকের ঘোড়াটা মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। তারা সেটির দিকে তাকায়। দুটি তীর ঘোড়াটার কপালে আর দুটি পাজরে বিদ্ধ হয়েছে। বলল- আপনি সুদক্ষ দ্রুতগামী ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসুন। আমাদের একজনকে তীর-ধনুক দিন। আপনি ঘোড়া হাঁকান। অশ্ব চালনার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করুন। আমরা যে কোন একজন ঘোড়ার পিঠে বসে তীর ছুঁড়ব। যদি প্রথম তীরটি লক্ষভ্রষ্ট হয়, তাহলে আমাদের গর্দান উড়িয়ে দিন। যে চারটি তীর আপনার বদলে ঘোড়ার গায়ে বিদ্ধ হয়েছে, এগুলো আমরা হুঁড়িনি। আমাদের নিশানা কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না।

তোমাকে তো সাধারণ সৈনিক মনে হয় না!- জুরদিক বললেন- তুমি কি সালাহুদ্দীন আইউবীর ফৌজের লোক?

আর আপনি কে? মুখোশধারী জিজ্ঞেস করে- আপনি কি সালাহুদ্দীন আইউবীর ফৌজের লোক নন? আপনি কি ইসলামের সৈনিক নন? আপনি কি আপনার পরিচয় ভুলে গেছেন? কেল্লাদারির পদমর্যাদা আপনার মস্তিষ্ক নষ্ট করে দিয়েছে। আপনি আরো উচ্চ মর্যাদা লাভ করার জন্য কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছেন।

আপনি ভেঙ্গে যাওয়া সেই বৃক্ষ ডালটির ন্যায়, যার ভাগ্যে শুকিয়ে পরে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে। অপর মুখোশধারী বলল আপনি এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব নন যে, সালাহুদ্দীন আইউবীর আপনাকে হত্যা করার গরজ পড়েছে। নিজের কৃতকর্মের সাজা ভোগ করার জন্য আপনার বেঁচে থাকা প্রয়োজন। আপনি খুন হবেন তো খৃস্টানদের হাতে হবেন।

আপনি হালবে মদপান করতে আর আয়েশ করতে গিয়েছিলেন- প্রথম মুখোশধারী বলল- আপনি এই মেয়েটির নাচ উপভোগ করতে গিয়েছিলেন।

আমি মুসলমান মেয়ে- মেয়েটি বলে ওঠল- আমাকে খৃষ্টানদের আসরে আসরে নাচানো হয়েছে। খৃষ্টানরা আমার দেহ নিয়ে খেলা করেছে। আপনি কিছুক্ষণের জন্য কল্পনা করুন, আমি আপনার কন্যা। আমি ওখানে মুসলিম মেয়েদেরকে উলঙ্গ নাচতে দেখেছি। আপনারা এতো আত্মমর্যাদাহীন হয়ে গেছেন যে, আপন বোন-কন্যাদের শ্লীলতাহানিও আপনাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ জাগাতে পারে না। আমি খৃস্টানদের মাঝে সাত-আট বছর কাটিয়ে এসেছি। আমি সেই খৃস্টান সম্রাট-শাসকদের সঙ্গেও সময় অতিবাহিত করেছি, যাদেরকে আপনারা বন্ধু বানিয়ে আপনাদের মাতৃভূমিতে ডেকে এনেছেন। আমি তাদের কথাবার্তা শুনেছি। তারা বন্ধুত্বের ফাঁদ পেতে মুসলমানদের আপসে যুদ্ধ করাচ্ছে।

জুরদিক নীরব-নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছেন। অপলক নেত্রে এক নাগাড়ে তাকিয়ে আছেন মেয়েটির প্রতি। তার রক্ষীরা হতভম্ব যে, এত প্রতাপশালী ও দুঃসাহসী দুর্গ অধিপতি কীভাবে এসব বরদাশত করছেন।

গভীর ভাবনায় হারিয়ে গেছেন জুরদিক। কিছুক্ষণ পর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে কোমল কণ্ঠে মুখোশধারীদের উদ্দেশ করে বললেন- আমি তোমাদেরকে কেল্লায় নিয়ে যেতে চাই।

কয়েদি বানিয়ে প্রশ্ন করে এক মুখোশধারী।

না- সবাইকে হতবাক করে জুরদিক বললেন- মেহমান বানিয়ে। আমার উপর ভরসা রাখ। তরবারীগুলো সঙ্গেই রাখ।

সকলে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে। জুরদিকের ঘোড়া মারা গেছে। তিনি এক রক্ষীর ঘোড়ায় ওঠে বসেন।

কাফেলা রওনা হয়ে যায়।

***

কাফেলা পার্বত্য অঞ্চল ত্যাগ করে সমতলভূমিতে বেরিয়ে এল বলে, ঠিক এমন সময় তারা একাধিক ধাবমান ঘোড়ার পদধ্বনি শুনতে পায়। তারা ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে দেয়। দেখতে পায়, দুজন অশ্বারোহী দ্রুতগতিতে হাবের দিকে ছুটে যাচ্ছে। তাদের ধনুক-তূনীর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তারা এখান থেকেই পালিয়েছে বলে কাফেলা নিশ্চিত হয়।

সম্ভবত এরাই আপনার ঘাতক। বলেই এক মুখোশধারী ঘোড়ার গতি আরো বাড়িয়ে দেয়। অপর মুখোশধারীও তার ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে দেয়। উভয়ে তরবারী হাতে তুলে নেয়।

পলায়নপর ঘোড়া দুটিকে ধাওয়া করছে কাফেলা। দুই মুখোশধারীর ঘোড়ার গতিই সবচে বেশী। সামনে বালির টিলা ও পার্বত্য অঞ্চল। পলায়নপর আরোহীদ্বয় ঘোড়ার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। মুখোশধারী দুজন অভিজ্ঞ অশ্বারোহী। তারাও ঘোড়ার মোড় ঘুরিয়ে দূরত্ব কমিয়ে ফেলে। পলায়নকারীরা কাঁধের ধনুক হাতে নিয়ে তাতে তীর সংযোজন করে। হঠাৎ ঘোড়ার মোড় ঘুরিয়ে মোকাবেলার পজিসনে ধাওয়াকারীদের প্রতি তীর ছোঁড়ে। তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। মুখোশধারী দুজন আরো নিকটে চলে আসে। এখন উভয়ই তীর ছোঁড়ার চেষ্টা করে। পলায়নকারী একজন একটি ঘোড়ার পিছন দিকে তরবারীর আঘাত হানে। ঘোড়া নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। অপর পলায়নকারীর উপরও আঘাত করা হয়। তার একটি বাহু কেটে যায়। ঘোড়াটিও আহত হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। কাফেলার রক্ষীরা পলায়নকারী অশ্বারোহীদের ধরে ফেলে।

ধৃতদেরকে জুরদিকের নিকট নিয়ে যাওয়া হয়। এবার আসল চেহারা খুলে যায়।

মুখোশধারীরা তাদের মুখোশ খুলে ফেলে স্পষ্ট ভাষায় বলে দেয়, তারা সুলতান আইউবীর গুপ্তচর। তাদের একজন হল খলীল। অপরজন তার সঙ্গী।

পলায়নরত অবস্থায় যে দুঅশ্বরোহীকে ধরা হল, তারাও মুসলমান। কিন্তু এখানে এসেছিল তারা জুরদিককে হত্যা করতে। খৃস্টানদের নিকট ঈমান বিক্রিকরা বিভ্রান্ত মুসলমান তারা। তাদের যে লোকটির বাহু কেটে গেছে, তাকে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে কিছু দূরে ফেলে দেয়া হল। অপরজনকে বলা হল, তুমি যদি জীবিত ফিরে যেতে চাও, তাহলে বল তোমাদেরকে কে পাঠিয়েছে? অন্যথায় তোমাকেও সঙ্গীর পরিণতি বরণ করতে হবে।

অশ্বরোহী এবার মুখ খুলল- পাঠিয়েছে রেমন্ডের সামরিক প্রতিনিধি। তিনি হাবের ভোজসভায় মুসলিম আমীরদের উপস্থিতিতে বলেছিলেন, অমুক দিন অমুক সময় জুরদিক পার্বত্য এলাকা অতিক্রম করবে। তিনি আমাদেরকে বিপুল অর্থ প্রদান করেছেন। আমাদেরকে বলে দেয়া হয়েছে, তোমরা পাহাড়ের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকবে আর জুরদিককে সময়মত তীরের নিশানা বানিয়ে ফিরে আসবে।

আমরা দুজন নির্দিষ্ট সময়ে এই এলাকায় পৌঁছি এবং পথের দিকে দৃষ্টি রেখে একটি উঁচু পাথরের উপর লুকিয়ে বসে থাকি। দীর্ঘ অপেক্ষার পর আপনার কাফেলা এসে পড়ে। আমরা আপনাকে লক্ষ্য করে তীর হুঁড়ি। কিন্তু তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। পুনরায় তীর ছুঁড়লে সেটিও লক্ষভ্রষ্ট হয়ে ঘোড়র গায়ে বিদ্ধ হয়।

অক্ষত তীরান্দাজকে নিয়ে জুরদিক হামাতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়। অপরজন কর্তিত বাহুর রক্তক্ষরণের ফলে প্রাণ হারায়।

পথে খলীল হুমায়রার ইতিবৃত্ত কাহিনী জুরদিককে শোনায়। উইন্ডসরকে সে কিভাবে হত্যা করেছিল, তারও বিবরণ দেয়। জুরদিক বিস্ময় প্রকাশ করেন যে, এমন ঝুঁকিপূর্ণ একটি ঘটনা ঘটিয়ে তোমর হাল্ব থেকে কিভাবে বেরিয়ে এলে!

খলীল জুরদিককে আরো জানায়- হাবে আমাদের একজন কমান্ডার রয়েছেন। কিন্তু আমি তার নাম ও গঠন-আকৃতি আপনাকে বলব না। তিনি কাপড় ইত্যাদি বস্তু পেঁচিয়ে নবজাতক শিশুর সমান একটি প্রতিকৃতি তৈরি করে তার উপর কাফন পরিয়ে দেন। আমাদের চার-পাঁচজন গোয়েন্দা আশপাশে সংবাদ ছড়িয়ে দেয় যে, এখানে অমুকের একটি সন্তান মারা গেছে। কমান্ডার কাফন পেঁচানো প্রতিকৃতিটি দুহাতে তুলে কবরস্তানের দিকে হাঁটা দেন। আমি, আমার সঙ্গী, হুমায়রা (পুরুষের পোশাকে) এবং আরো চার-পাঁচ ব্যক্তি শবযাত্রার ন্যায় তার পেছন পেছন এগিয়ে আসি। কবরস্তানটি শহরের বাইরে। ওখানে তিনটি ঘোড়া দাঁড়িয়ে ছিল। হাবের ফৌজে কর্মরত আমাদের এক গোয়েন্দা ঘোড়াগুলো সংগ্রহ করে ওখানে নিয়ে রেখেছিল। জানাযা হাবের ডিউটিরত সেনা সদস্যদের সম্মুখ দিয়েই কবরস্তানে গিয়ে পৌঁছে। ওখানে একটি কবর খনন করলাম। লাশ দাফন করে আমি, আমার সঙ্গী ও হুমায়রা ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে আসি।

জুরদিকের কাফেলা যখন দুর্গে গিয়ে পৌঁছে, তখন রাত হয়ে গেছে। জুরদিক খলীল ও তার সঙ্গীদেরকে সম্মানিত মেহমানের ন্যায় থাকতে দেন। তিনি খলীলকে বললেন- এবার আমাকে তোমার বন্ধু মনে করতে পার। বল, সালাহুদ্দীন আইউবী কী করছেন? তোমার অবশ্যই জানা আছে যে, আইউবী আস-সালিহকে ধাওয়া করে ধরলেন না কেন। বল, কারণটা কী?

আমি সুলতান আইউবীর পরিকল্পনা যদিও জানি, কিন্তু আপনাকে বলব না খলীল বলল- আর হাল্ব থেকে আমি কী কী তথ্য নিয়ে এসেছি, তাও আপনাকে জানাব না।

সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল- জুরদিক বললেন- পরে এই শত্রুতা আদর্শিক দ্বন্দ্বের রূপ ধারণ করে। তার কারণ যা ই থাকুক, আমি ভুলের উপর ছিলাম। দুশমন আমাকে ভুলটা ধরিয়ে দিয়েছে। আমি খৃস্টানদের মতলব বুঝে ফেলেছি। তারা একদিকে আমার ফৌজ ও আমার দুকে ব্যবহার করতে চায়, অন্যদিকে আমাকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছে। আমার মরহুম নুরুদ্দীন জঙ্গী ও সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর কথা মনে পড়ে। তাদের মতে এই যুদ্ধ চাঁদ-তারা ও ক্রুশের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ কোন মুসলিম রাজার সঙ্গে কোন খৃস্টান রাজার যুদ্ধ নয়। সুলতান আইউবী বলেছিলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত পৃথিবীতে একজন মুসলমানও জীবিত থাকবে, খৃস্টানরা তাকে খতম করার চেষ্টায় রত থাকবে। অমুসলিম যে ধর্মেরই হোক মুসলমানের আপন হতে পারে না। অমুসলিম মুসলমানের প্রতি বন্ধুত্বের নামে যে হাত প্রসারিত করে, তাতে শক্রতার বিষ মেশানো থাকে। নুরুদ্দীন জঙ্গীও এই নীতিরই অনুসারী ছিলেন। তিনি সবসময় বলতেন, যেদিন মুসলমান কোন অমুসলিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়বে, সেদিন থেকে ইসলামের পতন শুরু হয়ে যাবে।

তবে কি আপনি সালাহুদ্দীন আইউবীর সঙ্গে যোগ দেবেন?- খলীল জিজ্ঞাসা করল- আমি একজন সামান্য মানুষ, সাধারণ একজন সৈনিক। আমার এই দুঃসাহস না দেখানেই উচিত যে, একজন দুর্গপতিকে জিজ্ঞেস করব, আপনি কী ভাবছেন এবং আপনার উদ্দেশ্য কী? কিন্তু একজন মুসলমান হিসেবে আমার অধিকার আছে, যে মুসলমান পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে, তাকে এটুকু বলব, তুমি গোমরাহ হয়ে গেছ।

হ্যাঁ- জুরদিক বললেন- তোমার এই অধিকার রয়েছে। আমি তোমাকে একটি পয়গাম শোনাতে চাই। পয়গামটি তুমি সুলতান আইউবীর কানে পৌঁছিয়ে দিও। আমি লিখিত পয়গাম পাঠাতে চাই না। আপাতত দূত প্রেরণ করাও সমীচিন মনে করছি না। তুমি আইউবীকে বলবে, তিনি যেন হামাতের দুর্গকে তারই দুর্গ মনে করেন। কিন্তু সাবধান! কোন বিশ্বস্ত সালারকেও যেন বুঝতে না দেন যে, আমি এই প্রস্তাব পেশ করেছি। বিষয়টা অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তাকে বলবে, খৃষ্টানরা বন্ধুত্বের আড়ালে আমাদের ভূখণ্ডে বেঁকে বসেছে। তোমরা সম্ভবত শীতের পর হামলা করবে। কিন্তু সাবধান! এদিক থেকে তোমাদের উপর আগেই হামলা হয়ে যায় কিনা। তোমরা যদি অগ্রসর হও, তাহলে হামাতের পথে আসবে। আমি ইনশাল্লাহ তোমাদের পুরাতন বন্ধুত্বের হক আদায় করব।

পরদিন জুরদিক খলীল, তার সঙ্গী ও হুমায়রাকে বিদায় করে দেন।

***

খৃষ্টান ইন্টেলিজেন্স কমান্ডার উইন্ডসরের হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে একটি আকস্মিক ঘটনা। তিনি সুলতান আইউবীর দুই গোয়েন্দার সামনে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন, যার ফলে তারা বাধ্য হয়েই তাকে খুন করে। কিন্তু কাজটি ছিল অবশ্যই দুঃসাহসিক। উইন্ডসর হত্যাকাণ্ডে সুলতান আইউবীর একটি উপকার এই হয়েছিল যে, তাঁর শত্রুপক্ষের গোয়েন্দা বিভাগ- যা পূর্ব থেকেই দুর্বল ছিল- সংগঠিত হতে পারল না। অপরদিকে সুলতান আইউবীর গোয়েন্দা ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত ও বিচক্ষণ। তার গোয়েন্দারা কেবল গোয়েন্দাই নয় যে ধরা পড়ে গেলে কিছুই করতে পারবে না। তিনি তার গোয়েন্দাদেরকে কঠিন থেকে কঠিনতর কমান্ডো প্রশিক্ষণ দিয়ে রেখেছেন, যাতে ধরা পড়ে গেলেও প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করে বেরিয়ে আসতে পারবে এবং কাউকে হত্যার প্রয়োজন হলে হত্যা করবে। তাদের দেহ-মন এতই পাষাণ যে, নির্যাতন যতো কঠিনই হোক, তারা সহ্য করে নেবে। তীব্র থেকে তীব্রতর ক্ষুধা তৃষ্ণা ও চরম ক্লান্তি তাদের কাছে কোন ব্যাপারই নয়।

খলীল ও তার সহকর্মীদের মধ্যেও এসব গুণাবলী বিদ্যমান। তারা কেবলমাত্র গুরুত্বপূর্ণ খৃস্টান অফিসারকে হত্যা করেই দুশমনকে বোকা বানায়নি, বরং জুরদিকের ন্যায় কঠিন মনের দুর্গপতিকে কথার মাধ্যমে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে, তাকে সুলতান আইউবীর পক্ষে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।

খলীল যখন সুলতান আইউবীকে জুরদিকের বার্তা শোনায়, তখন সুলতান এমন এক স্বস্তি অনুভব করেন, যেন উত্তপ্ত মরুভূমিতে হঠাৎ শীতল বায়ুর ঝাঁপটা এসে গায়ে লাগে। সুলতনি চারদিকে শুধু দুশমনই দেখতে পেতেন। আপনও দুশমন, পরও দুশমন। জুরদিকের পয়গাম তাকে স্বস্তি দিল বটে; কিন্তু তিনি আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত হলেন না। বিষয়টা প্রতারণাও হতে পারে বিধায় তিনি আক্রমণ পরিকল্পনায় কোন রদবদল করলেন না। শুধু এতটুকু চিন্তা মাথায় রাখলেন যে, হামাত থেকে সাহায্য পেতে পারি।

দুশমনের আস্তানা হাব থেকে যেসব সংবাদ আসছে, তাতে নতুন কোন তথ্য নেই। ওখানে কোন পরিবর্তন সাধিত হয়নি। ওখানকার উপদেষ্টা ও কমান্ডারদের দৃঢ় বিশ্বাস, শীতের মওসুমে যুদ্ধের সম্ভাবনা নেই। একটি সংবাদই পাওয়া গেছে যে, খৃস্টানরা বাহ্যত ওখানকার সকলের বন্ধুর রূপ ধারণ করেছে। ঠিক; কিন্তু আমীরদের একজনের বিরুদ্ধে অপরজনকে উত্তেজিত করে তুলছে। আস-সালিহর আশপাশের লোকেরা একে অপরের দুশমন, সে তো সুলতান। আইউবীর জানা বিষয়। তারা সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে শুধু এজন্যে একত্রিত হয়েছে যে, সুলতান তাদের সকলের প্রতিপক্ষ। আর এই শক্রতার কারণ হল, সুলতান আইউবী তাদেরকে বিলাসিতা ও স্বাধীন জীবন-যাপন করার অনুমতি দেন না। সুলতান আইউবীর এই মিশনটাও তাদের ভাল লাগে না যে, সালতানাতে ইসলামিয়ার সম্প্রসারণ ও সুরক্ষাকে ঈমানী দায়িত্ব ভাবতে হবে। তিনি সেইসব রাষ্ট্রনায়কদের মত নন, যারা শান্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা ও ভোগ বিলাসিতার জন্য শত্রুকে বন্ধুরূপে বরণ করে নেয়। যুদ্ধের যত প্রকার বিদ্যা ও কলাকৌশল রপ্ত করা আবশ্যক, তার সবই সুলতান আইউবী অর্জন করেছেন। তার বাহিনী হাড়কাঁপানো শীতের মধ্যেও লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে। এখন রাতের প্রশিক্ষণে কোন সৈনিক অসুস্থ হচ্ছে না।

১১৭৪ সালের ডিসেম্বর মাস। সুলতান আইউবী তার সেনাকমান্ডারদের সর্বশেষ বৈঠক তলব করেন। কেন্দ্রীয় কমান্ডের সকল অফিসার ও সকল ইউনিট কমান্ডারগণের বৈঠকে উপস্থিত হলে তিনি তাদেরকে সর্বপ্রথম নির্দেশ এই প্রদান করেন যে, এ মুহূর্ত থেকে বাহিনীর গতিবিধি সংক্রান্ত কোন তথ্য কোনক্রমেই বাইরের কাউকে বলবে না। এমনকি নিজ স্ত্রী-সন্তানদেরকেও নয়। ফৌজ অভিযানে রওনা হওয়ার সময় এসে গেছে। কিন্তু বুঝতে হবে, নিত্যদিনের ন্যায় ফৌজ মহড়া ও প্রশিক্ষণে যাচ্ছে।

এসব দিক-নির্দেশনার পর সুলতান বললেন- আমাদের বিলাস-পূজারী ও ঈমান-বিক্রয়কারী ভাইয়েরা ইসলামের ইতিহাসকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে এসেছে যে, আজ তোমাদের উপর তোমাদেরই আপনজনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কি কখনো কল্পনা করেছে, আমি আমার পীর ও মুরশিদ নুরুদ্দীন জঙ্গীর পুত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করব? কিন্তু পরিস্থিতি এমনই রূপ ধারণ করেছে যে, জঙ্গীর এই ছেলেটির মা আমাকে অভিসম্পাৎ করছে, আমি কেন তার মুরতাদ পুত্রকে হত্যা করছি না। আমার বন্ধুগণ! তোমরা যে বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে যাচ্ছ, তাতে তোমাদের চাচাতো ভাই আছে, মামাতো ভাই আছে, খালাতো ভাই আছে। আমি এমন দুই আপন ভাই সম্পর্কেও জানি, যাদের একজন আমার বাহিনীতে আর অপরজন দুশনের বাহিনীতে। তোমরা যদি রক্ত ও আত্মীয়তা সম্পর্ককে হৃদয়ে স্থান দাও, তাহলে ইসলামের সঙ্গে তোমাদের যে সম্পর্ক রয়েছে, তা ছিন্ন হয়ে যাবে। রওনা হওয়ার আগে এখানেই তোমাদেরকে ওয়াদা করতে হবে, প্রতিপক্ষ কে তা তোমরা দেখবে না। তোমাদের দৃষ্টি থাকবে নিজেদের পতাকার উপর। তোমরা হৃদয়ে এই সত্যটাকে বসিয়ে নাও যে, তোমাদের সম্মুখের প্রতিপক্ষ লোকটি তোমাদের মতো কালেমা-গো মুসলমান ঠিক; কিন্তু তার পিছনের লোকগুলো খৃস্টান। আমি সেই ভাইকে ভাই মনে করি না, যে নিজ ধর্মের শত্রুকে বন্ধু মনে করে।

এক ঐতিহাসিকের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি থেকে জানা যায়, এই ভাষণের মধ্যখানে এক পর্যায়ে সালাহুদ্দীন আইউবীর কণ্ঠ থেমে যায়। তিনি কিছুক্ষণ মাথা ঝুঁকিয়ে চুপচাপ বসে থাকেন। তাঁর দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে শুরু করে। নীরব-নিস্তব্ধ গোটা সভাকক্ষ। কারো মুখে রা নেই।

খানিক পর সুলতান আইউবী মাথা তুলে দুহাত উত্তোলন করে আকাশের দিকে তাকিয়ে করুণ সুরে দুআ করতে শুরু করেন

আমার মহান আল্লাহ! আমি তোমার খাতিরে, তোমার রাসূল ও তোমার দ্বীনের খাতিরে আমার ভাইদের বিরুদ্ধে তরবারী উত্তোলন করছি। এটা যদি অন্যায় হয়ে থাকে, তাহলে তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। হে আমার আল্লাহ! আমাকে তোমার দিক-নির্দেশনা প্রয়োজন। আমি পাপী, আমি গুনাহগার। তুমি আমাকে পথ দেখাও।

সুলতান আবারো মাথানত করে ফেললেন। নিজের মাথায় নতুন কোন বুদ্ধি আসল নাকি আল্লাহর পক্ষ থেকে তার মনে জাগল জানিনা, তিনি উচ্চকণ্ঠে বললেন- আমাকে প্রথম কেবলা বাইতুল মোকাদ্দাস মুক্ত করতে হবে। বাইতুল মোকাদ্দাস তোমাদেরকে ডাকছে। আমার তরবারীর নীচে যদি আমার পিতাও আসেন, আমি তাকেও হত্যা করব। আমার সন্তানও যদি আমার মিশনের প্রতিবন্ধক হয়, তাকেও আমি খুন করে ফেলব।

সুলতান আইউবীর মুখমন্ডল জ্বল জ্বল করে ওঠে। তার আবেগ দমে গেছে। এখন তিনি সেই সালাহুদ্দীন, যিনি শুধু বাস্তবভিত্তিক সংক্ষিপ্ত কথা বলে থাকেন। তিনি কমান্ডারদের বললেন- দুদিন পর রাতে রওনা হতে হবে। তিনি পরিকল্পনা অনুসারে বাহিনীকে যেভাবে বিভক্ত করেছেন, তা সবাইকে জানিয়ে দেন এবং প্রতিটি গ্রুপের কমান্ডারদেরকে রওনা হওয়ার সময় বলে দেন। অগ্রগামী ইউনিটের কমান্ডারদেরকে জরুরী দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন। কমান্ডো বাহিনীকে উপদেশ প্রদান করেন। পার্শ্ব বাহিনীগুলোর কমান্ডারদেরকে রওনা হওয়ার সময়, ধরন ও পথের নির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি সকলকে জানিয়ে দেন, তোমাদের হেডকোয়ার্টার ঘোরাফেরা করতে থাকবে। তিনি আগেই মিশরের পথে টহল বাহিনী পাঠিয়ে দেন এবং পথচারী ও যাযাবরের বেশে সেইসব এলাকায় অসংখ্য গুপ্তচর পাঠিয়ে দেন, যে পথে রেমন্ডের বাহিনীর আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

রসদের ব্যাপারে সুলতান আইউবীর কোন পেরেশানী নেই। অন্তত এক বছর মিশর থেকে রসদ ও রিজার্ভ ফোর্স তলব করার প্রয়োজন হবে না। বিপুল অস্ত্র এবং পণ্ড তিনি দামেস্কে মজুদ করে রেখেছেন। তিনি মিশরের রাস্তার আশ-পাশে এই নির্দেশনাসহ অশ্বারোহী কমান্ডো প্রেরণ করে রেখেছেন যে, রেমন্ডের বাহিনী যদি এগিয়ে আসে, তাদের উপর গেরিলা হামলা চালাবে এবং আবশ্যক মনে করলে তৎক্ষণাৎ সংবাদ পাঠাবে। আমরা খৃস্টানদেরকে ঘিরে ফেলার ব্যবস্থা করব।

***

১১৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ৭ তারিখ রাতে অগ্রগামী বাহিনী দামেস্ক থেকে রওনা হয়। সে রাতে শীতের প্রকোপ ছিল খুব বেশী। তীব্র শীত গায়ে কাটার মত বিদ্ধ হচ্ছিল। তবে সুলতান আইউবীর সৈন্য ও ঘোড়া এই শীত সহ্য করতে অভ্যস্ত। অগ্রগামী বাহিনীর কমান্ডারকে বলে দেয়া হল, তত্ত্বাবধানকারী বাহিনী আগেই রওনা হয়ে গেছে। সে বাহিনীর সৈন্যরা সামরিক পোশাকে নয় গেছে মুসাফিরের বেশে। সুলতান আইউবী তাদেরকে নির্দেশনা দিয়েছেন, যেন দ্রুতগামী দূত পিছনে এসে অগ্রগামী বাহিনীর কমান্ডারকে সম্মুখের খবরাখবর পৌঁছাতে থাকে। অগ্রগামী বাহিনী যাবে হামাত পর্যন্ত। কমান্ডারকে সুলতান আইউবী বলে দিয়েছেন, হামাতের দুর্গ যুদ্ধ ছাড়া জয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু প্রতারণা সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। তিনি যেন দুর্গ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেমে যান এবং দুর্গওয়ালাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেন। জুরদিক যদি সন্ধি করতে চায়, তা হলে তাকে দুর্গের বাইরে ডেকে আনবে এবং সুলতানের এসে পৌঁছা পর্যন্ত কোন সমঝোতায় উপনীত না হয়।

শক্ত দেয়াল ভাঙ্গতে সক্ষম এমন অভিজ্ঞ একদল লোক সুলতান আইউবী আগেই পাঠিয়ে দিয়েছেন। অগ্রগামী বাহিনীর রওনা হওয়ার তিন-চার ঘন্টা পর আরো দুটি ইউনিটকে এমনভাবে রওনা করিয়েছেন যে, তাদের এক ইউনিট অগ্রগামী বাহিনীর ডানে এবং অপর ইউনিট বাঁয়ে অবস্থান নিয়ে চলরে। তাদের জন্য নির্দেশনা ছিল, অগ্রগামী বাহিনী যদি হামাত দুর্গ থেকে সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়, তাহলে তারা দুদিক থেকে এগিয়ে গিয়ে দুর্গ অবরোধ করে ফেলবে এবং দুর্গের উপর এমনভাবে তীর বর্ষণ করবে, যেন দেয়াল ভাঙ্গার দলটি দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে।

সুলতান আইউবী এই দুই বাহিনীর মাঝে অগ্রসর হচ্ছেন। অগ্রগামী বাহিনী ও দুই পার্শ্ব বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা সুলতান আইউবীর মোট বাহিনীর চারভাগের একভাগ। অন্য সকল সৈন্যকে তিনি পিছনে রেখে এসেছেন। তিনি যত কম সংখ্যক সৈন্য দিয়ে সম্ভব দুশমনকে ঘায়েল করতে চান। সেই পরিকল্পনা তিনি আগেই ঠিক করে রেখেছেন। শত্রুবাহিনীর রসদের প্রতি নজর রাখার জন্য তিনি কমান্ডো ছড়িয়ে রেখেছেন। হামাত থেকে অনেক সম্মুখেও এরূপ বেশ কটি ছোট ছোট দল পাঠিয়ে দিয়েছেন, যাতে হামাত থেকে কোন দূত হাব যেতে না পারে এবং কোন দিক থেকে শক্রর সাহায্যে সৈন্য এসে গেলে কমান্ডো হামলা চালিয়ে। তাদেরকে অস্থির করে রাখে এবং তাদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করে।

পরদিন অতিবাহিত হয়েছে। রাত গম্ভীর হয়ে গেছে। অগ্রগামী বাহিনীর হামাত পৌঁছাতে আর দু-তিন মাইল পথ বাকি।

১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর। রাতের শেষ প্রহর। হামাত দুর্গের ফটকে দন্ডায়মান শান্ত্রী আবছা আলো-আঁধারীতে ছায়ার মত এমন কিছু দেখতে পায়, যেন বিপুলসংখ্যক মানুষ ও ঘোড়া। হয়ত কোন কাফেলা এগিয়ে আসছে।

ভোর হয়েছে। দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। অন্ধকার পুরোপুরি কেটে গেছে। শান্ত্রীরা এবার দেখতে পেল, ওরা সৈন্য। কিন্তু তাদের দুর্গের ডানে-বাঁয়ে যে ফৌজ রয়েছে, তা এখনো তারা টের পায়নি। ডংকা বাজিয়ে দেয়া হল। এক কমান্ডার দৌড়ে উপরে উঠে যায়। ফৌজ দেখে দৌড়ে গিয়ে সে দুর্গপতি জুরদিককে সংবাদ জানায়।

ভয় পেওনা- জুরদিক কমান্ডারকের বললেন- এরা আক্রমণকারী ফৌজ নয়। খৃস্টানরা আমাকে খুন করতে পারেনি। তারা অন্য কোন ষড়যন্ত্র করে থাকবে হয়ত। তারা হয়ত আস-সালিহ-এর নিকট থেকে এই অনুমোদন নিয়েছে যে, আমার থেকে দুর্গ ছিনিয়ে নিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে দেবে। তোমরা বাইরে গিয়ে দেখ বাহিনীটা কার এবং তারা কী চায়।

কমান্ডার ঘোড়ায় চড়ে বাইরে বেরিয়ে যায় এবং সুলতান আইউবীর অগ্রগামী বাহিনীর দিকে এগিয়ে যায়। পতাকা দেখেই চিনে ফেলে, এ তো আইউবীর বাহিনী! খানিক দূরে থাকতেই কমান্ডার থেমে যায়। আইউবীর অগ্রগামী বাহিনীর কমান্ডার তার নিকট এগিয়ে যায়। দুজন-ই একে অপরকে চিনে ফেলে। তারা নুরুদ্দীন জঙ্গীর বাহিনীতে একসঙ্গে কাজ করেছে।

আহ! এমন একটা সময়ও প্রত্যক্ষ করতে হল যে, আমাদের দুজনকে পরস্পর লড়াই করতে হবে- আইউবীর অগ্রগামী বাহিনীর কমান্ডার দুর্গের কমান্ডারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল- জঙ্গী যখন জীবিত ছিলেন, আমরা তখন বন্ধু ছিলাম। তিনি মারা গেছেন, তো আমরা পরস্পর দুশমন হয়ে গেলাম।

তোমরা কেন এসেছ? দুর্গের কমান্ডার জিজ্ঞেস করে।

তোমরা দুর্গকে রক্ষা করতে পারবে না- অগ্রগামী বাহিনীর কমান্ডার বললেন- তোমার প্রতি আমার পরামর্শ, দুর্গের অধিপতিকে বল, যেন তিনি দুটা আমাদের হাতে তুলে দেন এবং রক্তক্ষয় হতে না দেন। আমরা তোমাদেরকে বেশী সময় দিতে পারব না। অল্পক্ষণের মধ্যেই দুর্গ অবরুদ্ধ হয়ে যাবে। আমরা তোমাদের সাহায্য-সহযোগিতার সব পথ বন্ধ করে এসেছি। তোমরা অন্ত্রত্যাগ কর।

দুর্গের কমান্ডার কোন জবাব না দিয়েই ফিরে যায়। জুরদিককে জানায়, সালাহুদ্দীন আইউবী হামলা করেছেন। তিনি আমাদেরকে অস্ত্রত্যাগ করতে বলছেন। এই বাহিনী তারই। জুরদিক চীৎকার করে বলে উঠলেন, দুর্গ থেকে পতাকা সরিয়ে ফেল। সাদা পতাকা উড়িয়ে দাও। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী এসেছেন।

জুরদিক দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন। ঘোড়ায় চড়ে দুর্গ থেকে অগ্রগামী বাহিনীর কমান্ডারের নিকট চলে যান। সুলতান আইউবী অনেক পিছনে অবস্থান করছেন। জুরদিক একজন রাহবার ও তার দেহরক্ষীদের নিয়ে সুলতান আইউবীর হেডকোয়ার্টারের দিকে রওনা হয়ে যান।

***

সুলতান আইউবী জুরদিককে বুকে জড়িয়ে ধরেন। জুরদিক সুলতানের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে আবেগময় কিছু কথা বলেন এবং সৈন্যসহ দুর্গকে সুলতান আইউবীর হাতে তুলে দেন। সুলতান আইউবী তার সহকর্মীদের নিয়ে দুর্গে প্রবেশ করেন এবং সাদা পতাকার স্থলে নিজের ঝান্ডা উড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। জুরদিক দুর্গে অবস্থানরত তার বড়-ছোট সব কমান্ডারকে সুলতান আইউবীর সম্মুখে উপস্থিত করে বললেন- তোমাদেরকে পরাজিত করা হয়নি। তোমরা যার যার ইউনিটের সৈন্যদেরকেও বলে দাও, তারা যেন নিজেদেরকে পরাজিত মনে না করে। আমরা সবাই মুসলমান। এখন আমরা খৃস্টান ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে লড়াই করব।

সম্মুখে হেমস দুর্গ। সুলতান আইউবী রওনা হওয়ার জন্য এমন একটা সময় নির্ধারণ করেন যে, হেমস গিয়ে পৌঁছুতে রাত হয়ে যাবে। তিনি এই অগ্রগামী বাহিনীটিকেই সম্মুখে রওনা করিয়ে দেন। এবার তিনি সেনাবিন্যাসে কিছু রদবদল করেন। কারণ, হেমস দুর্গ যুদ্ধ ব্যতীত জয় হবে, এমন আশা তার নেই। খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য একটি দলকে তিনি আগেই রওনা করিয়ে দিয়েছিলেন। ফিরে এসে তারা সুলতানকে দুর্গের অবস্থান ও আশ-পাশের পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করে। যেসব দিক থেকে শত্রুপক্ষের সাহায্য আসার সম্ভাবনা রয়েছে, সেসব দিকেও তিনি বাহিনী প্রেরণ করে রেখেছেন। নিজের রসদ তিনি হামাত দুর্গে জড়ো করে রাখেন এবং রসদ সরবরাহের পথকে টহল বাহিনী ও কমান্ডারদের দ্বারা নিরাপদ করে রাখেন। তাদের সঙ্গে হামাতের একটি ইউনিটও রয়েছে। সুলতান আইউবীর প্রচেষ্টা ছিল, এই অভিযানের সংবাদ যাতে হাল্ব পর্যন্ত না পৌঁছে। তাহলে তিনি দুশমনকে তাদের অজ্ঞাতেই কাবু করে ফেলতে পারবেন। অভিযানের ব্যবস্থাপনাটা তিনি এভাবেই করে নিয়েছেন। তিনি হাবের পথে নিজের লোক ছড়িয়ে রেখেছেন, যাদের প্রতি নির্দেশ হল, সৈনিক বা সাধারণ কাউকে পালাতে দেখলে আক্রমণ করে হলেও তাকে প্রতিহত করবে।

রাত গম্ভীর হয়ে গেছে। হেস দুর্গের অধিপতি ও তার কমান্ডাগণ প্রশস্ত একটি কক্ষে সুরাপানে ব্যস্ত। সঙ্গে আছে দুজন নর্তকী। কক্ষে বাদ্য-বাজনা ও নাচ-গান চলছে। সাধারণ সৈনিকরা অবচেতন মনে নিদ্রা যাচ্ছে। প্রহরারত সৈনিকরাও শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আড়ালে-আবডালে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। কনকনে শীত। কমান্ডার সবাইকে জানিয়ে রেখেছে, শীতের মওসুমে যুদ্ধের কোন আশংকা নেই।

আমরা এ কারণেই নুরুদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যুর জন্য দুআ করতাম যে, দুনিয়াতেই আমরা জান্নাতের সুখ উপভোগ করব- দুর্গের অধিপতি মদের পেয়ালা মুখে দিতে দিতে বলল- এখন সালাহুদ্দীন আইউবী এসেছেন। আল্লাহ তাকেও জলদি তুলে নেবেন।

না, তাকে আমরা তুলে আনব- এক কমান্ডার বলল- ঋতুটা, একটু পরিবর্তন হোক।

দুর্গের দেয়ালে দন্ডায়মান এক শান্ত্রী তার সঙ্গীকে বলল- এই দেখ, দেখ, আগুন জ্বলছে।

জ্বলতে দাও- সঙ্গী বলল- কোন কাফেলা হবে বোধ হয়। বলতে না বলতে আগুনের তিন-চারটি গোলা উপরে উঠে দুর্গের দিকে ধেয়ে এসে শান্ত্রীদের মাথার উপর দিয়ে অতিক্রম করে দুর্গের ভিতর গিয়ে নিক্ষিপ্ত হয়। পরক্ষণে আরো একটি গোলা ধেয়ে আসে। তারপর আরো কয়েকটি। সব কটি-ই দুর্গের সামান-পত্রের উপর গিয়ে নিক্ষিপ্ত হয় এবং আগুন ধরে যায়। দুর্গে বিপদ ঘন্টা বেজে ওঠে। দুর্গ অধিপতির আসর ভেঙ্গে যায়। সবাই জান্নাতের সুখ ত্যাগ করে দৌড়ে ফটকের দিকে ছুটে আসে। এবার তীরবর্ষণ চলছে তাদের উপর। ফটকের শান্ত্রীরা চীৎকার ও হৈ-হুঁল্লোড় শুরু করে দেয় ফটক পুড়ে যাচ্ছে। সুলতান আইউবীর আক্রমণকারী সৈন্যরা ফটকের উপর দাহ্য পদার্থ ছুঁড়ে মেরে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। শান্ত্রীরা চীৎকার করে দুর্গের সৈন্যদেরকে জাগ্রত করে। দুর্গের ভিতর থেকেও প্রতিরোধ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু বাহির থেকে এত তীর আসতে থাকে যে, মাথা উত্তোলন করাও সম্ভব হচ্ছে না। সুলতান আইউবীর মিনজানীকগুলো দুৰ্গটাকে জাহান্নামে পরিণত করে তোলে। দুর্গের কমান্ডার চীৎকার করে করে তার সৈন্যদের মনোবল বাড়াবার চেষ্টা করছে। সৈন্যরা এলোপাতাড়ি তীর ছুঁড়ছে।

অস্ত্রসমর্পন কর- সুলতান আইউবীর দিক থেকে একজন উচ্চকণ্ঠে বলতে শুরু করে- তোমরা অস্ত্রত্যাগ কর। তোমরা কোন দিক থেকে সাহায্য পাবে না। জীবন রক্ষা কর। তোমরা সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর হাতে আত্মসমর্পন কর। কাউকে যুদ্ধবন্দি বানানো হবে না। তোমরা সুলতানের আনুগত্যবরণ করে নাও। আমাদের ফৌজে শামিল হয়ে যাও।

রাতভর এই ঘোষণা চলতে থাকে এবং উভয় পক্ষে তীর বিনিময় হতে থাকে। পরদিন ভোরের আলো ফুটলে দুর্গপতি বাইরের দৃশ্য ও দুর্গের ফটকে তার সৈনিকদের লাশ দেখে সাদা পতাকা উড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ প্রদান করে। সুলতান আইউবী এই দুর্গও দখল করে নেন। দুর্গপতি ও তার কমান্ডারগণ অস্ত্রত্যাগ করে। সুলতান দুর্গের অভ্যন্তরে ঢুকে দুর্গপতি ও কমান্ডারদের উদ্দেশ করে শুধু বললেন- আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন। তিনি নির্দেশ প্রদান করেন, সিপাহীদেরসহ এদেরকে দামেস্ক পাঠিয়ে দাও। সুলতান তদেরকে নিজের ফৌজের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে পারবেন না। কারণ, তাদের অফাদারী এখনো সন্দেহযুক্ত। এই দুর্গে অস্ত্র ও রসদের বিপুল সংগ্রহ। আছে মদ আর নর্তকী। মদের পাত্রগুলো বাইরে ফেলে দেয়া হল। নর্তকীদেরকে তাদের লোকদের সঙ্গে দামেস্ক পাঠিয়ে দেয়া হল। সুলতান আইউবী হেসের দুর্গকে তার দ্বিতীয় ঘাঁটিতে পরিণত করেন।

সামনে হালবের দুর্গ। এটি হাব শহর থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত। এখানেও হেমসের ন্যায় একই ঘটনা ঘটে। সুলতান আইউবীর হামলা ছিল আকষ্মিক। তিনি এই দুর্গের লোকদেরকেও সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় পেয়ে যান। পর পর দুটি দুর্গ জয় করার পর তার বাহিনীর মনোবল এখন অনেক চাঙ্গা। তারা হাবের দুর্গও জয় করে নেয় এবং সেখানকার সৈনিকদেরকে কমান্ডারদেরসহ দামেস্ক পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু এ পর্যন্ত এসে সুলতানের গোপনীয়তা শেষ হয়ে যায়। অসমর্পনকারী সিপাহীদের কেউ পালিয়ে গিয়ে কিংবা অন্য কেউ হাব গিয়ে সংবাদ জানিয়ে দেয় যে, সুলতান আইউবী হামাত, হেমস ও হাল্ব দুর্গ জয় করে এখন হাব শহরের দিকে অগ্রস হচ্ছেন। কিন্তু এই তথ্য সুলতান জানতেন না। তিনি অগ্রসরতার গতিও কমিয়ে দেন। তার কারণ, যে বাহিনী হামাত, হেস ও হাল্ব দুর্গকে অবরোধ করে রাতের বেলা লড়াই করেছে, তাদের বিশ্রামের প্রয়োজন এবং আগে প্রেরণের জন্য তাদের স্থলে নতুন বাহিনী আবশ্যক। এখন পরিবর্তিত বিন্যাসে সৈন্যদের সম্মুখে অগ্রসর হতে হবে। কেননা, হালব শহরের লড়াই দুর্গ অবরোধ থেকে ভিন্ন। নতুন বিন্যাসে কিছু সময় ব্যয় হয়ে যায়। সুলতান আইউবী অত্যন্ত সতর্ক মানুষ। তিনি জানেন, আসল লড়াই সামনে রয়ে গেছে। আবার খৃস্টান বাহিনীর এসে পড়ার আশংকাও রয়েছে।

***

হালবে সংবাদ পৌঁছে গেছে। খৃস্টান উপদেষ্টাগণ সেখানে উপস্থিত। তারা প্রথমে বিস্ময় প্রকাশ করে যে, সুলতান আইউবী এই শীতের মধ্যে হামলা করলেন! পরে তারা এই ভেবে সন্তোষ প্রকাশ করে যে, সুলতানের ফৌজ মরুযুদ্ধে অভ্যস্ত। তারা পার্বত্য এলাকায় লড়াই করে জিততে পারবে না। আবার তাদের এই অনুভূতিও আছে যে, হাবের সৈন্যও এ অঞ্চলে লড়তে পারবে না। তারা দুটি পন্থা নিয়ে ভাবে। এক. সুলতান আইউবীকে তাদের-ই মনঃপুত স্থানে যুদ্ধে লিপ্ত করাতে হবে। দুই. এখানে খৃস্টানদের সেই বাহিনীটিকে নিয়ে আসতে হবে, যারা ইউরোপ থেকে এসেছে। এদের অধিকাংশ সৈন্য-ই রেমন্ডের বাহিনীতে কর্মরত। সিদ্ধান্ত মোতাবেক দ্রুতগামী দূতের মাধ্যমে রেমন্ডকে সংবাদ পৌঁছানো হল, সুলতান আইউবী হাবের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। তাকে পিছন দিক থেকে ঘিরে ফেলা হোক।

রেমন্ড যাতে সময় থাকতে এসে পৌঁছুতে পারে, সে জন্য তারা কালক্ষেপণের পন্থা অবলম্বন করে যে, সুলতান আইউবীকে হাল্ব অবরোধে দীর্ঘ সময় আটকে রাখতে হবে। খৃস্টান উপদেষ্টাগণ গোপনীয়তা রক্ষা করার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ প্রদান করে। তাদের জানা আছে যে, শহরে সুলতান আইউবীর গুপ্তচর রয়েছে। তাই তারা শহরটা সম্পূর্ণ সীল করে দেয়। তারা তৎক্ষণাৎ ঘোষণা করে দেয়, যদি কেউ শহর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে তাকে সাবধান না করেই তীর ছুঁড়বে। সঙ্গে সঙ্গে মসজিদে মসজিদেও ঘোষণা করে দেয়া হয় যে, সুলতান আইউবী সামরিক শক্তি ও রাজত্বের নেশায় হাব আক্রমণ করেছেন। খৃস্টানরা নাশকতার ওস্তাদ। তারা নতুন নতুন পন্থায় প্রোপাগান্ডা চালাতে শুরু করে। ঘরে ঘরে, গলিতে গলিতে, মসজিদে মসজিদে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে যে, সুলতান আইউবীর ফৌজ যে শহর জয় করে, সেখানকার সকল যুবতী মেয়েদের একত্রিত করে তারা তাদের সম্ভ্রম ছিনিয়ে নেয়। মানুষের সহায়-সম্পদ লুট করে শহরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ কথাও প্রচার করা হয় যে, সুলতান আইউবী নবুওতের দাবি করেছেন এবং একটি নতুন ধর্ম নিয়ে এসেছেন, যা সম্পূর্ণ কুফ্রী।

এমন বহু গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় হাবের সর্বত্র। এমনিতেই সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টির তৎপরতা বিগত ছয় মাস যাবত চলে আসছে। জনমনে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ-উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়েছে। সর্বশেষ এসব তাজা প্রোপাগান্ডা জনগণকে অগ্নিশর্মা করে তোলে। তারা জীবন দিতে ও জীবন নিতে প্রস্তুত হয়ে যায়।

শহর সীল হওয়ার কারণে সুলতান আইউবীর গোয়েন্দারা বেকার হয়ে পড়ে। তারা শহরের অধিবাসীদের মধ্যে আইউবী বিরোধী রোষ ও ক্রোধ প্রত্যক্ষ করে। এক গোয়েন্দা শহর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে প্রাণ হারিয়েছে। সে সুলতান আইউবীকে এই সংবাদ পৌঁছাতে চেয়েছিল যে, শহরের পরিস্থিতি আমাদের অনুকূল নয় এবং তিনি যেন আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত হয়ে না আসেন। সে শহর থেকে বের হওয়ার জন্য ঘোড়া হাঁকায়। কিন্তু দুটি তীর তাকে কাবু করে ফেলে। আইউবীর গোয়েন্দাদের কমান্ডার নাগরিকদের মধ্যে খৃস্টানদের প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছিলেন বটে; কিন্তু তার লোকেরা কোথাও মুখ খুলতে পারেনি।

আস-সালিহ খৃস্টান উপদেষ্টাদের পরামর্শে মসুলের গভর্নর সাইফুদ্দীনের নিকটও সাহায্যের আবেদন জানান। হাসান ইবনে সাব্বাহর ফেদায়ীদের শুরু শেখ সান্নান-এর নিকট সংবাদ প্রেরণ করা হয়, দাবি অনুপাতে পারিশ্রমিক দেয়া হবে, আপনি সালাহুদ্দীন আইউবীকে যেভাবে তোক খুন করে দিন। শেখ সান্নানের আইউবী হত্যার একটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। সুলতান আইউবীর একজন দেহরক্ষীকে নেশা খাইয়ে সে প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। এবার সে তার এমন ফেদায়ীদের তলব করে, যারা জীবন ও মৃত্যুকে কিছু-ই মনে করে না। তারা নামেমাত্র মানুষ। নিজের জীবন দেয়া ও অন্যের জীবন নেয়া তাদের পক্ষে ডাল-ভাত। তাদের মধ্যে অনেক পলাতক খুনীও রয়েছে। শেখ সান্নান তাদেরকে বলল, পারিশ্রমিক যা চাও, দেব; সুলতান আইউবীকে হত্যা করে আস। নয়জন ফেদায়ী একাজের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।

আস-সালিহ-এর সমর্থকদের মধ্যে সবচে হিংসুক ও শয়তান প্রকৃতির মানুষ হল গোমস্তগীন। একজন গবর্নরের সমান মর্যাদা তার। লোকটা বাহ্যত সুলতান আইউবীর বিরোধী বটে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার বন্ধু কেউ-ই নয়। আস সালিহকে খুশি করার জন্য তাকে সহযোগিতা প্রদান করে এবং খৃষ্টানদের সনে বন্ধুত্ব এভাবে প্রকাশ করে যে, তার দুর্গে অনেক খৃস্টান সৈন্য বন্দি ছিল, তাদের সকলকে মুক্ত করে দেন। এখনো সে সুলতান আইউবী দ্বারা হাব আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ পেয়ে বাহিনী প্রেরণ করেন এবং নিজেও যুদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।

সুলতান আইউবীর জন্য এ এক মহা-বিপদ। অল্প কজন সৈন্য দিয়ে এত বিশাল শত্রুবাহিনীর মোকাবেলা তিনি কীভাবে করবেন! তদুপরি বর্তমানে তাঁর গোয়েন্দারা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার ফলে তিনি জানতেই পারছেন না, হাবে দুশমনের ক্যাম্পে কী হচ্ছে। এখনো তিনি এই আত্মপ্রচঞ্চনায় লিপ্ত যে, হাবকেও তিনি সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে দখল করে নেবেন। কিন্তু আশার কথা হল, সুলতান আনাড়ি যোদ্ধা নন। তিনি বাহিনীর পেছন ও দুপার্শ্ব রক্ষা করার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। তদারককারী দল সামনে এগিয়ে গেছে। সম্মুখের এলাকা টিলাময়, পাথুরে ও উঁচু-নীচু। পথে মাঝারী আকারের একটি নদী।

***

১১৭৫ সালের জানুয়ারী মাস শুরু হয়ে গেছে। শীতের তীব্রতা বেড়ে গেছে আরো। সুলতান আইউবী যুদ্ধের জন্য তাঁর মোট সেনাবাহিনীর চার ভাগের এক ভাগ ময়দানে নিয়ে এসেছেন। অধিকাংশ সৈন্যকে তিনি রিজার্ভ রেখে এসেছেন। তিনি যখন হাবের উদ্দেশ্যে রওনা হন, তখন গোয়েন্দারা সংবাদ দেয়, নদীর ওপারে বিশাল-বিস্তৃত এক মাঠে শক্ৰবাহিনী প্রস্তুতি নিয়ে অবস্থান করছে। সুলতান আইউবীকে এ পথেই নদী পার হতে হবে। শীত মওসুমের কারণে নদীতে পানি কম। এ জায়গাটায় আরো কম। মানুষ ও ঘোড়া পানি ভেঙ্গে অনায়াসে নদীটা পার হতে পারবে। দুশমন এ জায়গাটায়ই তাদের সেনাদের ছড়িয়ে রেখেছে। গোয়েন্দারা সুলতান আইউবীকে জানায়, রাতে শত্রু বাহিনীর কয়েকজন শান্ত্রী জেগে পাহারা দেয় আর দিনে টহল বাহিনী চারদিক ঘুরে বেড়ায়।

এ সংবাদে সুলতান আইউবীর মনে সন্দেহ জাগে, তাহলে কি হলববাসীরা আমার আগমন সংবাদ জেনে ফেলল! তবে তো তাদের অজ্ঞাতসারে হাল জয় করা সম্ভব হবে না। তিনি অন্য কোন স্থান দিয়ে নদী পার হওয়া যায় কিনা তথ্য নেয়ার জন্য আবার গোয়েন্দা প্রেরণ করেন। পাশাপাশি তিনি এই সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেন, ওপারের শত্রুবাহিনীকে ধোঁকা দিতে হবে যে, আমার আক্রমণ ও অগ্রযাত্রা এ পথেই হবে। তিনি সে রাতেই কমান্ডো বাহিনী রওনা করিয়ে দেন। তাঁর নিজের হেডকোয়ার্টার সেখান থেকে পাঁচ মাইল দূরে। নদীর তীরে দুশমনের যে ফৌজ অবস্থান করছে, তারাও এই আত্মপ্রচঞ্চনায় লিপ্ত যে, এত তীব্র শীতের রাতে কেউ হামলা করবে না।

তখন মধ্যরাত। হাবের সৈন্যরা নিজ নিজ তাঁবুতে জবুথবু হয়ে পড়ে আছে। কমান্ডার নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাচ্ছে। জেগে আছে শুধু কয়েকজন প্রহরী। এক প্রহরী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করছে। হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন তার ঘাড় ঝাঁপটে ধরে। অন্য একজন এসে দুজনে মিলে লোকটাকে তুলে নিয়ে যায়। এরা সুলতান আইউবীর কমান্ডো। তারা প্রহরীকে তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোমাদের ঘোড়ার পাল কোথায়? কমান্ডোরা প্রহরীর বুকে দুটি তরবারীর আগা ঠেকিয়ে রেখেছে। প্রহরী বুঝে ফেলেছে, এরা সুলতান আইউবীর সৈনিক। সে বিনীত কণ্ঠে বলল, আমি তোমাদের মুসলমান ভাই। যুদ্ধটা হচ্ছে রাজ বাদশাহদের বিবাদ। আমরা কেন পরস্পর রক্ত ঝরাব?

প্রহরী জানায়, ঘোড়াগুলো এক স্থানে বাধা নেই। ফৌজ প্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে। সে কারণে সৈন্যদের তাঁবুর সঙ্গে দু-তিনটি করে ঘোড়া বেঁধে রাখা হয়েছে।

কমান্ডোরা প্রহরীকে তাদের ক্যাম্পের নিকট নিয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে, কমান্ডাররা কে কোথায় আছে বল। প্রহরী অনুমানের ভিত্তিতে কমান্ডারদের তাবুর অবস্থান দেখিয়ে দেয়।

প্রহরীকে পিছনে সরিয়ে আনা হল এবং বলা হল, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তামাশা দেখ।

সেখানে ছোট আকারের একটি মিনজানীক ছিল। কমান্ডোরা তাতে একটি পাতিল বসিয়ে দেয়। চারজন লোক ওটিকে একটু পিছনে টেনে নিয়ে ছেড়ে দেয়। পাতিলটা গুলির ন্যায় উড়ে যায়। আরেকটি পাতিল ছোঁড়া হয় অন্যদিকে। তারপর আরো দুটি। সবগুলো গিয়ে দুশমনের ক্যাম্পে নিক্ষিপ্ত হয়। প্রহরীরা কে? কে? বলে চীৎকার জুড়ে দেয়। কোন্‌দিক থেকে যেন মাথায় সলিগাথা তীর এসে মাটিতে পড়ে। পাতিলগুলো এখানেই এসে পড়ে ভেঙ্গেছিল। ভাঙ্গা পাতিলের ভিতর থেকে তরল পদার্থ বের হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল। এগুলো দাহ্য পদার্থ। তীরের সলিতাগুলো তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। দুটি তাঁবুতেও আগুন ধরে যায়। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। ক্যাম্পে শোর-গোল, ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায়। ঘোড়াগুলো রশি ছিঁড়ে পালাতে থাকে। সৈন্যরা এদিক-ওদিক ছুটাছুটি শুরু করলে কমান্ডোরা তীর ছুঁড়তে শুরু করে। দৈর্ঘ-প্রস্থে এক মাইলেরও বেশী জায়গা জুড়ে তাঁবু। কমান্ডার জবাবী অভিযান শুরু করতে না করতে সুলতান আইউবীর কমান্ডোরা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে উধাও হয়ে গেছে।

শোচনীয় রূপ ধারণ করেছে ক্যাম্পের অবস্থা। বিপুল ক্ষতিসাধণ করেছে। আগুন। তার উপর কমান্ডোদের তীর আর ভীত-সন্ত্রস্ত অশ্বপালের পায়ের তলায় পিষে হতাহত হয়েছে অসংখ্য সৈনিক। অবস্থা সামলাতে তাদের ভোর হয়ে যায়। হঠাৎ একদিক থেকে এক ব্যক্তি চীৎকার করে ওঠে- সাবধান! সাবধান! পুনরায় প্রলয় শুরু হয়ে যায়। এবার কমান্ডো নয়-হামলা করেছে সুলতান আইউবীর বাহিনীর একটি ইউনিট। দুশমন এখানে প্রতি মুহূর্ত প্রস্তুত থাকে। কিন্তু রাতের কমান্ডোরা তাদের অবস্থা এমনই শোচনীয় করে এসেছে যে, তাদের সব প্রস্তুতি লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। তারা পুনঃসংগঠিত হয়ে লড়াই করার অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু আর স্থির হতে পারেনি তারা। সুলতান আইউবী তাদের শক্তি-সাহস আগেই শেষ করে দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও উভয় পক্ষের অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। শত্রুবাহিনী পিছু হটতে শুরু করে। কমান্ডাররা তাদের উজ্জীবিত করার বহু চেষ্টা করে। কিন্তু কোন কাজ হল না। সুলতান আইউবীর কমান্ডোরা তাদের উদ্দেশে চীৎকার করে বলতে থাকে তোমরা কাফেরদের বন্ধু। আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। তোমরা নিজেদের পরিণতি দেখ। তোমাদের উপর আল্লাহর গজব নাযিল হচ্ছে।

সুলতান আইউবী তার বাহিনীর একজন সাধারণ সৈনিকের মাথায়ও এই বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছেন যে, তোমরা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত আর কাফেরদের বন্ধুরা মুরতাদ। তার বিপরীতে খলীফার বাহিনীর কাছে এরূপ কোন লক্ষ্য বা কোন স্লোগান ছিল না।

শত্রুবাহিনী বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে। অনেকে পিছপা হয়ে নদী পার হয়ে পালিয়ে গেছে। অনেকে এদিক-ওদিক গিয়ে লুকিয়ে গেছে। সুলতান আইউবী তার আক্রমণকারী বাহিনীর কমান্ডারকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন, দুশমন যদি পিছু হটে যায়, তাহলে তোমার বাহিনী বা কোন সৈন্য যেন নদী পার না হয়। তিনি এই ক্যাম্পের উপর হামলা করে মূলত শক্রকে ধোকা দিয়েছেন। তিনি শক্রদেরকে ধাওয়া করতে চাচ্ছেন না। সামনের বিস্তারিত তথ্য না নিয়ে তিনি আর অগ্রসর হবেন না। দূরের অন্য কোন স্থান দিয়ে তিনি নদী পার হতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু দুশমন যখন এখান দিয়েই তাকে সুযোগ দিয়ে দিল, তখন তিনি এখান দিয়েই নদী অতিক্রম করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তিনি নিজে সম্মুখে এগিয়ে যান। তাঁর সৈনিকরা এদিক-ওদিক লুকিয়ে থাকা শত্রুসেনাদের খুঁজে খতম করছে। অস্ত্রসমর্পনকারীদের সংখ্যাও অনেক। সুলতান একটি উঁচু টিলার উপর চড়ে রণাঙ্গনের দৃশ্য অবলোকন করছেন। আনন্দের পরিবর্তে তার মুখমন্ডল বিষাদে ছেয়ে গেছে।

এ দৃশ্য দেখে হয়ত আল্লাহও কাঁদছেন- পার্শ্বে দন্ডায়মান নায়েবদের উদ্দেশে সুলতান বললেন- উভয় পক্ষে এ কাদের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে? এ হল ইসলামের পতনের আলামত। মুসলমান যদি হুঁশে না আসে, তাহলে কাফেররা তাদেরকে এভাবেই যুদ্ধ করিয়ে করিয়ে শেষ করে দেবে। আমার বন্ধুগণ! তোমরা আমাকে নিশ্চিত কর যে, আমি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নই। আমি আমার তরবারীটা আস্-সালিহ-এর পায়ের উপর ফেলে দেই।

আপনি অবশ্যই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত মোহতারাম সুলতান- এক নায়েব বললেন- আমরাও সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। আপনি মন থেকে সব সংশয় সন্দেহ দূর করে ফেলুন।

সুলতান আইউবীর বাহিনী নদী পার হয়ে গেছে। সম্মুখে হাল্ব নগরী দেখা যাচ্ছে। সুলতান নগরীর প্রতি তাকান। তার বিস্তৃতি, গঠন প্রণালী ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেখে ভাবেন, সরাসরি হামলা করে শহরের অভ্যন্তরে ঢুকে লড়াই করব নাকি অবরোধ করব। শহরের আভ্যন্তরীণ অবস্থাটা আসলে কী, তা এখনো তার অজানা। হাবের সাধারণ মানুষগুলো তাঁর বিপক্ষে এক একটা আগুনের ফুল্কি হয়ে আছে, তা তিনি জানেন না। তাঁর আশা ছিল, যেহেতু তারা মুসলমান, তাই জনগণ যুদ্ধে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে। সম্ভবত আশাবাদ-ই তাঁকে দিয়ে এমন কিছু কাজ করায়, তাকে অস্থির করে ফেলে। তিনি আধা অবরোধের বিন্যাসে তার বাহিনীকে সম্মুখে এগিয়ে দেন। যুদ্ধের সূচনা হয় তীর বিনিময়ের মাধ্যমে। কিন্তু খানিক পর-ই তিনি অনুভব করলেন যে, তাঁর বাহিনী পিছনে সরে আসছে। হাবের নিরাপত্তা বিধানে একদিক থেকে অন্তত দুশত ঘোড়সওয়ার বেরিয়ে আসে। তারা সুলতান আইউবীর এক পদাতিক ইউনিটের এক পার্শ্বের উপর আক্রমণ চালায় বড় তীব্র ও দুঃসাহসী আক্রমণ।

সুলতান আইউবীর অশ্বারোহী বাহিনী পাল্টা আক্রমণ করে তাদের পদাতিক বাহিনীকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। কিন্তু ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হয়ে নিজেদের-ই সৈন্য মারা যায়। তারপর পরিস্থিতি এই দাঁড়ায় যে, শহর থেকে পদাতিক কিংবা অশ্বারোহী এক একটি সেনাদল বেরিয়ে আসছে আর তাদের পিছনে পিছনে শহরের উঁচু উঁচু স্থান থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর ছুটে আসছে। এই তীরবৃষ্টির আড়ালে আক্রমণকারী সেনারা সুলতান আইউবীর বাহিনীর অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ছে। হাবের এই যুদ্ধ ছিল বড়ই রক্তক্ষয়ী।

এই অবস্থায় সুলতান আইউবীর দু-তিনজন গোয়েন্দা শহর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে এবং সুলতানকে খুঁজে বের করে তাঁর নিকট চলে যায়। হাবের জনসাধারণকে কীভাবে উত্তেজিত করা হয়েছে, তারা সুলতানকে তা অবহিত করে। তারা জানায়, শহর প্রতিরক্ষায় যত না সৈন্য যুদ্ধ করছে, তার চেয়ে বেশি করছে সাধারণ নাগরিক। এ মুহূর্তে আপনার মোকাবেলায় সৈন্যের চে জনসাধারণের সংখ্যা বেশী। সুলতানের শুধু এটুকু জানা ছিল যে, হাবের অধিবাসীদেরকে তার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু তারা যে তাঁর বিরুদ্ধে এমন উন্মাদনার সাথে লড়াই করবে, সে ধারণা তার ছিল না। সুলতান তাদের বীরত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে আফসোসের সুরে বললেন- এ হল মুসলমানের শান! এই হল মুসলমানদের সামরিক চেতনা! কিন্তু কাফেররা তাদের এই চেতনাকে তাদের-ই দ্বীন-ধর্মের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে; কিন্তু তারা তা বুঝছে না।

সুলতান আইউবী তাঁর বাহিনীকে পিছনে সরিয়ে আনেন। এক নায়েব তাঁকে পরামর্শ দিলেন, শহরের উপর মিনজানীক দ্বারা অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করা হোক। কিন্তু সুলতান তার পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে বললেন- তা করা হলে সাধারণ মানুষদের বাড়ী-ঘর পুড়ে যাবে। নারী ও শিশুরা মারা যাবে। শহরটা যদি খৃস্টানদের হত, তাহলে এতক্ষণে নগরীর সর্বত্র দাউ দাউ করে আগুন জ্বলত এবং তা আমার কমান্ডোদের আয়ত্ত্বে চলে আসত। যেসব মুসলমান ময়দানে এসে যুদ্ধ করে ও জীবন দেয়, আমি তাদেরকে ঠেকাতে পারি না আর যারা ঘরে বসে আছে, তাদেরকে হত্যা করতে পারি না।

সুলতান আইউবী আরো কয়েকটি ইউনিটকে সামনে ডেকে এনে শহরকে পরিপূর্ণরূপে অবরোধ করে ফেলেন এবং নির্দেশ জারি করেন, আপতত আমরা আত্মরক্ষামূলক লড়াই করব। আমাদের উপর যদি হামলা হয়, তাহলে তা প্রতিহত করব এবং অবরোধ শক্তভাবে ধরে রাখব। সুলতান আইউবীর সেনা সংখ্যাও কম, শহরকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করাও তাঁর লক্ষ্য।

১১৭৫ সালের জানুয়ারী পুরো মাসটা অবরোধ বহাল থাকে। হাবের ফৌজ ও জনসাধারণ অবরোধ ভাঙ্গার জন্য হামলা চালায়। কিন্তু তারা সফল হতে পারছে না।

১লা ফেব্রুয়ারী ভোরবেলা সুলতান আইউবী সংবাদ পান, ত্রিপোলীর খৃস্টান সম্রাট রেমন্ড হামাতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তিনি রেমন্ডের সৈন্য সংখ্যা সম্পর্কেও অবহিত হন। এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, সে ব্যাপারে সুলতান আইউবীর আগে থেকেই ধারণা ছিল। তার মোকাবেলার প্রস্তুতিও তিনি নিয়ে রেখেছেন। তিনি তার জন্য দুইউনিট সৈন্য রিজার্ভ রেখে দিয়েছেন এবং এমন জায়গায় রেখেছেন, যেখান থেকে রেমন্ডকে স্বাগত জানানোর জন্য তাদের সময়মত পৌঁছানো সম্ভব। সুলতান সংবাদটা পাওয়ামাত্র তাদের নিকট দূত প্রেরণ করেন- যত দ্রুত সম্ভব তোমরা আলরিস্তান পৌঁছে গিয়ে উঁচুতে তীরন্দাজদের বসিয়ে দাও। অশ্বারোহী বাহিনীকে পিছনে রাখবে। আমি আসছি। খৃষ্টান বাহিনী যদি আমার আগে পৌঁছে যায়, তাহলে তোমরা মুখোমুখি যুদ্ধের ঝুঁকি নেবে না। ততক্ষণ পর্যন্ত ওঁৎ পেতে গেরিলা হামলা চালিয়ে যাবে।

আলরিস্তান একটি পর্বতশ্রেণীর নাম। রেমন্ডকে তার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে হবে। তার পরিকল্পনা অনুপাতে এই পথ তার জন্য খুবই উপযোগী। হামাত এসে সুলতান আইউবীর বাহিনীকে পিছন ভাগ ও রসদ ইত্যাদির পথে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে, এই হল তার পরিকল্পনা। তাতে সফল হলে সুলতান আইউবী হাবের ফৌজ ও রেমন্ডের বাহিনীর মধ্যখানে আটকা পড়ে যাবেন। কিন্তু সুলতান আইউবী হাল অবরোধ প্রত্যাহার করে বাহিনীকে অন্য একদিকে পাঠিয়ে দেন এবং নিজে আলরিস্তানের দিকে রওনা হয়ে যান।

আলরিস্তানের পাহাড়ের চূড়াগুলো বরফে ঢাকা। রেমন্ড আনন্দিত যে, এই মওসুমে সুলতান আইউবীর মরু সৈনিকরা তার ইউরোপিয়ান ও অত্র অঞ্চলের খৃষ্টান সেনাদের সঙ্গে লড়াই করে পেরে উঠবে না। কিন্তু এই ভাবনা ভাবতে ভাবতে যখন সে একটু সামনে অগ্রসর হল, তো বরফঢাকা পর্বতমালার চূড়া থেকে তার বাহিনীর উপর তীর বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল। ঘটনাটা তার কাছে নিতান্তই আকষ্মিক ও অভাবিতপূর্ব।

রেমন্ড কোন যুদ্ধ ছাড়াই তার বাহিনীকে পিছনে সরিয়ে নিয়ে যায়। সর্বত্রই তার আক্রান্ত হওয়ার আশংকা। সুলতান আইউবীর যুদ্ধকৌশল তার ভালভাবেই জানা। অনেক দূর পিছনে সরে গিয়ে সে ছাউনি ফেলে। এবার কোন্ পথে এগুবে, ভাবতে শুরু করে সে।

ঋতু পাল্টে গেছে। বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। সাত-আটদিনে ঘোড়ার শুকনা ঘাস শেষ হয়ে গেছে। রসদ-পাতিরও অভাব দেখা দিয়েছে। রেমন্ড রসদের ব্যবস্থাটা ভালই করে রেখেছিল। ওখান থেকে নিয়মিত রসদ আসছিল। কিন্তু দিন কয়েক হল, এখন আর আসছে না। আসছেনা কোন সংবাদও। ব্যাপারটা কী? রেমন্ড দূত পাঠায়। দূত ফিরে এসে সংবাদ জানায়, সুলতান আইউবীর সৈন্যরা রসদের পথও অবরোধ করে রেখেছে। শুনে রেমন্ড বিস্মিত হয়ে পড়ে যে, সুলতান আইউবী এত দ্রুত এ পর্যন্ত আসল কীভাবে! পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য রেমন্ড দুজন অফিসারকে পিছনে প্রেরণ করে।

অফিসাররা তিন-চারদিন পর ফিরে আসে। তারা সংবাদের সত্যতা স্বীকার করে, সত্যিই সুলতান আইউবী রসদের পথ বন্ধ করে রেখেছেন। তারা এ সংবাদও নিয়ে আসে যে, আইউবী হাবের অবরোধ তুলে নিয়েছেন।

তার অর্থ আমরা আমাদের কর্তব্য পালন করেছি- রেমন্ড বলল- চল, ত্রিপোলী ফিরে যাই।

***

রেমন্ড যুদ্ধ না করেই ফিরে গেছে, এ সংবাদ শুনে সুলতান আইউবী বিস্মিত হন। পিছুহটার জন্য সে যেপথ অবলম্বন করে, তা ছিল দুর্গম। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে যেপথে এসেছিল, সে পথে যেতে রাজি নয়। সুলতান আইউবীর সঙ্গে যুদ্ধ করার ইচ্ছা-ই ত্যাগ করেছে সে। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, রেমন্ড যুদ্ধ করার ইচ্ছা ত্যাগ করেছিল কথাটা সঠিক। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হল, সুলতান আইউবী তাকে লড়াই করার পজিশনে থাকতে দেননি। রেমন্ড এই ভেবে ঘাবড়ে গিয়েছিল যে, মুসলিম সৈন্যরা এই শীতের মধ্যে এত চমৎকার লড়াই করছে, যেন তারা লড়াইটা উপযুক্ত মওসুমে সমতল ময়দানে করছে। দ্বিতীয় কারণ, সুলতান আইউবী তার পিছনে এবং রসদ সরবরাহের পথে গিয়ে বসে পড়েছিলেন। তৃতীয় ও সবচে বড় কারণ ছিল ভিন্ন একটি, যা পরে ফাঁস হয়। তাহল, রেমন্ড মূলত আস-সালিহ-এর নিকট থেকে বিপুল অর্থ-সম্পদ নিয়েছিল। কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল, মুসলমানদেরকে পরস্পর যুদ্ধে জড়িয়ে দেয়া। সে লক্ষ্য তার পূরণ হয়ে গেছে। খৃস্টানরা মুসলিম উম্মাহকে দুভাগে বিভক্ত করে ফেলেছে এবং তাদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। যখন ত্রিপোলী থেকে রেমন্ডের দূত একটি বার্তা এনে আস-সালিহ-এর হাতে পৌঁছায়, তখন তার উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে যায়। বার্তাটা হল- আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে, সালাহুদ্দীন আইউবী যদি আপনাকে অবরোধ করে ফেলে, তাহলে আমি সেই অবরোধ ভেঙ্গে দেব। আমি যেইমাত্র সংবাদ পেলাম যে, সালাহুদ্দীন আইউবী হাব আক্রমণ করেছে, সঙ্গে সঙ্গে আমি নিজে ফৌজ নিয়ে আপনার সাহায্যে ছুটে এসেছি। আমার আগমনের সংবাদ টের পেয়ে তৎক্ষণাৎ আইউবী হাবের অবরোধ তুলে নিয়েছেন। আমি আমার ওয়াদা পূর্ণ করেছি। কাজেই আপনার সঙ্গে আমার যে সামরিক চুক্তি ছিল, তা এখন আর নেই। যে কর্তব্য পালনের জন্য আপনি আমাকে সোনা-দানা পাঠিয়েছিলেন, তা আমি পালন করেছি। কাজেই পত্র পাওয়া মাত্র আপনি আমার সামরিক প্রতিনিধি ও উপদেষ্টাদের ফেরত পাঠিয়ে দিন।

রেমন্ডের বার্তা পাঠ করে হাবের শাসকরা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। দুজন ঐতিহাসিক লিখেছেন, রেমন্ডের মনে এই শংকাও জাগতে শুরু করে যে, সুলতান আইউবী তার রাজধানী ত্রিপোলী আক্রমণ করে বসতে পারেন। এই আশংকার ভিত্তিতে আলরিস্তান থেকে ফিরে গিয়ে রেমন্ড তার রাজধানীর প্রতিরক্ষা আরো শক্ত করতে শুরু করে।

আস-সালিহ এখনো আনাড়ি-অনভিজ্ঞ। তার এক-দুজন উপদেষ্টা তাঁকে পরামর্শ দেয়, আপনি সুলতান আইউবীর সঙ্গে আপস করে নিন। কিন্তু সাইফুদ্দীন ও গোমস্তগীন প্রমুখ তাঁকে সাহায্যের নিশ্চয়তা দিয়ে আপস সমঝোতার পথ থেকে সরিয়ে রাখে। তাদেরই একজন আস-সালিহকে বলেছিল, সালাহুদ্দীন আইউবী দিন কয়েকের মেহমান মাত্র। নতুন ঘাতকদল এসে গেছে। তারা ধর্মীয় নেতা ও পীর-বুযুর্গের বেশে সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট এই আবেদন নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে যে, আপনারা আর পরস্পর যুদ্ধ করবেন না। উভয়পক্ষ বসে বসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা করে নিন। সুলতান আইউবী সম্মানার্থে তাদেরকে নিজের পার্শ্বে বসতে দেবেন। নির্জনে বসে তাদের কথা শুনবেন। এই সুযোগে ঘাতক তাকে হত্যা করে নিরাপদে কেটে পড়বে।

সুলতান আইউবী আলরিস্তানের পর্বতমালায় বসে পরবর্তী হামলার পরিকল্পনা ঠিক করছেন আর হাবে বসে নয়জন ভাড়াটিয়া খুনী ভাবছে, আইউবীকে কোথায় কীভাবে হত্যা করা যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *