৪.১ সর্পকেল্লার ঘাতক

সর্পকেল্লার ঘাতক

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী যখন দামেস্কে প্রবেশ করেন, তখন তার সঙ্গে ছিল সাতশ অশ্বারোহী যোদ্ধা। সকল ঐতিহাসিক এ সংখ্যা-ই লিখেছেন। কিন্তু ইতিহাস সুলতান আইউবীর সেই জানবাজদের ব্যাপারে বে-খবর, যাদের কেউ বণিকের বেশে, কেউ সাধারণ পর্যটকরূপে এবং কেউ সিরীয় সাধারণ সৈনিকের পোশাকে- একজন, দুজন, চারজন- এভাবে দলবদ্ধ হয়ে দামেস্কে প্রবেশ করেছিল। তাদের অধিকাংশই সুলতান আইউবীর নীরব হামলার আগেই এখানে এসে পৌঁছেছিল। আর কতিপয় প্রবেশ করেছিল তখন, যখন সুলতান আইউবীর জন্য দামেস্কের দ্বার খোলা হয়েছিল। এরা সবাই ছিল জানবাজ গোয়েন্দা। তারা সর্বপ্রকার লড়াই, সব ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার ও নাশকতামূলক কাজে পারঙ্গম ছিল। মানসিক দিক থেকে তারা ছিল অত্যন্ত দৃঢ়, বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান। তাদের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, তারা জীবনের পরোয়া করত না। তারা এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে ফেলত, যার কল্পনা করলে সাধারণ সৈনিকরা শিউরে ওঠত। এ কাজের জন্য এমন যুবকদের বেছে নেয়া হত, যাদের অন্তর দ্বীনি চেতনা ও দুশমনের ঘৃণায় পরিপূর্ণ থাকত। কাজকর্ম দেখলে এ জানবাজদের উন্মাদ মনে হত। সুলতান আইউবী এমন জানবাজদের কয়েকটি ইউনিট প্রস্তুত করে রেখেছিলেন।

সাতশ অশ্বারোহী নিয়ে সুলতান আইউবী যখন দামেস্কের উদ্দেশ্যে রওনা হন, তার আগেই তিনি একদল জানবাজ গোয়েন্দাকে জরুরী নির্দেশনা প্রদান করে দামেস্কে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল, দামেস্কের ফৌজ যদি মোকাবেলায় অবতীর্ণ হয়, তাহলে তোমরা নগরীতে নিজেদের বুঝ ও প্রয়োজন অনুপাতে নাশকতা পরিচালনা করবে এবং ভিতর থেকে নগরীর ফটক খুলে দেয়ার চেষ্টা করবে। তারা ছিল জনমনে ত্রাস সৃষ্টি ও গুজব ছড়ানোর কাজে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এই জানবাজদের সংখ্যা ছিল দু থেকে তিনশর মত। সে সময়কার ঐতিহাসিকগণ এদের সুনির্দিষ্ট কোন সংখ্যা উল্লেখ করেননি। শুধু লিখেছেন যে, সুলতান আইউবীর আগমনের সময় দামেস্কে দু-তিনশ গোয়েন্দা ও নাশকতাকারী অবস্থান করছিল।

একজন ফরাসী ঐতিহাসিক ক্রুসেড যুদ্ধের পরিস্থিতি ও ঘটনাবলী সম্পর্কে লিখতে গিয়ে সুলতান আইউবীর লড়াকু গোয়েন্দাদের সম্পর্কে অনেক কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি সুলতান আইউবীর এই জানবাজদের ইসলামী চেতনাকে ধর্মীয় উন্মাদনা আখ্যা দিয়ে লিখেছেন, এই গোয়েন্দাগুলো মানসিক রোগী ছিল। তারা ধর্মীয় উন্মাদনাকে মানসিক ব্যাধি বলে নিন্দা করেছেন।

প্রকৃতপক্ষে সেটি একটি মানসিক অবস্থাই ছিল বটে। একজন মুসলমান তখনই প্রকৃত ঈমানদার বলে পরিগণিত হয়, যখন ধর্ম তার মনন ও মানসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়। সুলতান আইউবীর এই জানবাজদের গুপ্তচরবৃত্তি ও নাশকতার প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন আলী বিন সুফিয়ান এবং তার দুনায়েব হাসান বিন আব্দুল্লাহ ও জাহেদান। আর যুদ্ধের প্রশিক্ষণ পেয়েছিল অভিজ্ঞ সৈন্যদের হাতে।

সুলতান আইউবী দামেস্কে প্রবেশ করলেন। আলী বিন সুফিয়ানকে রেখে এসেছেন কায়রো। ওখানকার আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ভালো নয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছেন আলী। সুলতান আইউবীর অনুপস্থিতি, তাঁর দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ ও খেলাফতের পতন- সবমিলে অরাজকতার আশংকা বেড়ে গেছে কায়রোতে। এসব কারণেই সুলতান আইউবী আলী বিন সুফিয়ানকে রেখে এসেছেন। দামেস্কে এসেছেন আলীর এক নায়েব হাসান বিন আব্দুল্লাহ। তিনিই লড়াকু জানবাজদের কমান্ডার।

সুলতান আইউবী দামেস্ক কজা করার পর সেখানকার অধিকাংশ ফৌজ সালার তাওফীক জাওয়াদের নেতৃত্বে সুলতানের সঙ্গে যোগ দেয়। অবশিষ্ট ফৌজ, খলীফার দেহরক্ষী বাহিনী, খলীফা ও তার অনুচর আমীরগণ দামেস্ক ছেড়ে পালিয়ে যায়। ধারণা ছিল, গ্রেফতার করার জন্য সুলতান তাদের পেছনে ফৌজ প্রেরণ করবেন।

কিন্তু না, তিনি এমন কিছু করলেন না। দু-তিনজন সালার সুলতানকে এমনও বলেছিলেন যে, এই আমীর-ওমরাদের গ্রেফতার করা আবশ্যক। অন্যথায় তারা কোথাও গিয়ে সংগঠিত হবে এবং আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করবে।

আর আমি এ-ও জানি যে, তারা খৃষ্টানদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করবে এবং পেয়েও যাবে- সুলতান আইউবী বললেন- কিন্তু আমি অন্ধকারে পথ চলি না। আমাকে প্রথমে জানতে হবে, তারা কোথায় যাচ্ছে এবং কোথায় জড়ো হচ্ছে। আপনারা অস্থির হবেন না। আমার চোখ-কান পলায়নকারীদের সঙ্গে লেগে আছে। তারা এত তাড়াতাড়ি হামলা করার জন্য প্রস্তুত হতে পারবে না। আমি দেখছি, খৃস্টানরা কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা মিশরে আক্রমণ চালাতে পারে। পারে সিরিয়ায় হামলা করতে। তারা সম্ভবত আমি কি করি, দেখার অপেক্ষায় আছে। তারা হয়ত আমার পদক্ষেপের উপর ভিত্তি করে নিজেরা পদক্ষেপ নিতে চাইছে। আপনারা আমার নির্দেশনা মোতাবেক সেনা প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধ মহড়া অব্যাহত রাখুন।

***

সুলতান আইউবী যাদেরকে নিজের চোখ-কান বলে অভিহিত করেছিলেন, তারা হল মিশর থেকে আগত একদল গোয়েন্দা। খলীফা আল-মালিকুস সালিহ ও তার আমীর-উজীরগণ যখন দামেস্ক ত্যাগ করে পালিয়ে যায়, তখন সুলতান আইউবীর এই গোয়েন্দারাও তাদের সঙ্গ নেয়। পলায়নকারীদের সংখ্যা কম। ছিল না। দেশের সকল আমীর-উজীর এবং বেশ কজন জাগীরদার মোসাহিবও ছিল তাদের সঙ্গে। ছিল কতিপয় সেনা সদস্য এবং চাটুকার। তারা পালিয়ে গেছে বিক্ষিপ্তভাবে। সুলতান আইউবীর গোয়েন্দাদের তাদের সঙ্গে মিশে যাওয়া কঠিন ছিল না। পদচ্যুত খলীফা আল মালিকুস সালিহ ও তার আমীরগণ কোথায় যায়, কি করে, পাল্টা আক্রমণ করে কিনা এবং খৃস্টানদের থেকে তারা কী পরিমাণ সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছে। এসব ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। এই গুপ্তচররা হল হাসান ইবনে আব্দুল্লাহর নির্বাচিত লোক। তারা উদ্ভূত পরিস্থিতির রাজনৈতিক মূল্যায়নও বেশ ভাল করেই বুঝত।

তাদের একজন হল মাজেদ ইবনে মুহাম্মদ হেজাজী। সুদর্শন যুবক, সুঠাম দেহ; সর্বোপরি আল্লাহ তাকে দান করেছেন জাদুকরী মধুর ভাষা। সুলতান আইউবীর সব গোয়েন্দাই সুশ্রী, সুঠাম, স্বাস্থ্যবান ও স্বচ্চরিত্রের অধিকারী। তাদের না আছে নেশার অভ্যাস, না তারা বিলাসী। তাদের চরিত্র আয়নার ন্যায় স্বচ্ছ। মাজেদ হেজাজী তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চারিত্রিক পরিচ্ছন্নতায় তার চেহারায় নূর চমকায়। সে-ও দামেস্ক ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। আরবের উন্নত জাতের একটি ঘোড়া তার বাহন। সঙ্গে আছে তরবারী আর ঘোড়ার জিনের সঙ্গে বাঁধা চকচকে ফলাবিশিষ্ট বর্শা।

বিজন মরুভূমিতে একাকী পথ চলছে মাজেদ। তার একজন সঙ্গীর প্রয়োজন- এমন সঙ্গী, যার দ্বারা তার এই মিশন উপকৃত হবে। মাজেদ দেখতে পায়, বেশকিছু লোক হাব অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সঙ্গী হিসেবে তাদের একজনও তার পছন্দ হল না। কারণ, সফরসঙ্গী হিসেবে তার প্রয়োজন পদস্থ কোন সেনা অফিসার কিংবা এমন একজন লোক, যার আল মালিকুস সালিহ সম্পর্কে জানাশোনা আছে।

পালিয়ে আসা খলীফাকে খুঁজে ফিরছে মাজেদের অনুসন্ধানী চোখ। কয়েকজন লোককে সে জিজ্ঞেসও করেছে যে, আল-মালিকুস সালিহ কোন্‌দিক গেছেন। কিন্তু কেউ কোন তথ্য দিতে পারেনি। তার জানা ছিল, আল-মালিকুস সালিহ সুলতান জঙ্গীর সমবয়স্ক ব্যক্তি নন, বরং তিনি এগার বছর বয়সের বালক মাত্র, যাকে স্বার্থপূজারী আমীরগণ তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সালতানাতের মসনদে বসিয়েছিল। শাসনক্ষমতা মূলত ছিল তাদেরই হাতে। মাজেদ হেজাজীর আন্দাজ করা কঠিন ছিল না যে, এই কিশোর খলীফা একাকী যাচ্ছেন না। তার সঙ্গে আছে তার আমীর-উজীর ও দরবারীদের বিরাট বহর। বহরে থাকছে সোনা-দানা ও মূল্যবান সম্পদ বোঝাই অসংখ্য উট।

মাজেদ হেজাজী ভেবে রেখেছে- এই কাফেলাটি পাওয়া গেলে কি করতে হবে এবং তাদের মনের কথা কিভাবে বের করা যাবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত শিকারের সন্ধান পেল না মাজেদ। সামনে পার্বত্য এলাকা। আশাপাশে সবুজের সমারোহ। পর্বতমালার গভীর প্রবেশ করে মাজেদ।

মাজেদ একস্থানে দুটি ঘোড়া দেখতে পায়। সেখান থেকে খানিক দূরে সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে আছে একজন পুরুষ। সঙ্গে একজন মহিলা। মহিলাও শায়িত। মাজেদ থেমে যায়। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে একটি গাছের নীচে বসে পড়ে। তার বিশ্রামের প্রয়োজন।

হঠাৎ হ্রেষারব তুলে একটি ঘোড়া। ঘোড়ার শব্দ শুনে শোয়া থেকে ওঠে বসে লোকটি। মাজেদ ভালভাবে দেখতে পায় তাকে। পোশাক-আশাকে প্রমাণ মেলে লোকটা উঁচু শ্রেণীর। মাজেদ হেজাজীর প্রতি চোখ পড়ে তার। ইশারায় তাকে নিজের কাছে ডাকে।

মাজেদ তার নিকটে চলে যায়। তার সঙ্গে হাত মিলায়। মহিলাও উঠে বসে। মহিলা নয়- এক রূপসী যুবতী। যুবতীর গলার হার প্রমাণ করছে, মেয়েটি কোন সাধারণ ঘরের সন্তান নয়। লোকটির বয়স চল্লিশের মতো মনে হল। আর যুবতীর বয়স পঁচিশেরও কম। মাজেদ হেজাজী এক দৃষ্টিতেই আন্দাজ করে নেয় দুজনকে।

তুমি কে?- লোকটি মাজেদ হেজাজীকে জিজ্ঞেস করে- তুমি কি দামেস্ক থেকে এসেছ?

আমি দামেস্ক থেকেই এসেছি- মাজেদ জবাব দেয়- কিন্তু আমি কে, সে কথা আপনাকে বলতে পারব না। আপনাদের পরিচয় বলুন?

বোধ হয় আমরা একই পথের পথিক- লোকটি মুচকি হেসে বলল- তুমি সম্ভ্রান্ত তোক বলে মনে হচ্ছে।

আমি সম্ভ্রান্ত না বদমাশ, তা কি আপনি নিশ্চিত হতে চান?- দুঠোঁটের মাঝে মুচকি হাসির রেখা টেনে মাজেদ বলল- যার সঙ্গে এমন একটি রূপসী যুবতী আছে আর যুবতীর গলায় এত মহামূল্যবান হার আছে এবং সঙ্গে আরো মূল্যবান সম্পদ আছে, সে যে একজন পথচারীকে বদমাশ আর দস্যু মনে করবে, তা বিচিত্র কিছু নয়। আমি দস্যু নই। তবে নিজের জীবন বিলিয়ে হলেও আপনাদেরকে দুবৃত্তের হাত থেকে রক্ষা করতে পারি। দামেস্ক থেকে পালিয়ে আসা কিছু লোক পথে দস্যুর কবলে পড়েছিল। আমি পথে তাদের দুটি লাশও দেখে এসেছি। পরিস্থিতিটা দস্যু-তস্করদের জন্য খুবই অনুকূল যে, মানুষ ধন-দৌলত নিয়ে দামেস্ক থেকে পালিয়ে যাচ্ছে আর ওরা ধরে ধরে লুট করছে।

সহসা মেয়েটির লাবণ্যময় চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায়। সঙ্গী পুরুষটির গা ঘেঁষে জড়সড় হয়ে বসে। লোকটির মুখমণ্ডলেও ভীতির ছাপ পরিলক্ষিত হয়। এবার মাজেদ হেজাজী বুঝে গেছে, এরা কারা এবং কী এদের মিশন। মাজেদ তাদের মনে ভীতি সৃষ্টি করে নিজের জাদুকরী ভাষার কারিশমা দেখাতে শুরু করে। কথা প্রসঙ্গে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সমালোচনা করে এবং এমনভাবে খলীফা আল-মালিকুস সালিহর প্রশংসা করে, যেন তিনিই জগতের একমাত্র মহান ব্যক্তিত্ব। মাজেদ তাদেরকে আরো প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে বলল- সালাহুদ্দীন আইউবী দামেস্ক থেকে পলায়নরত আপনার ন্যায় লোকদের সম্পদ লুণ্ঠন এবং তাদের সুন্দরী মেয়েদের ছিনিয়ে নেয়ার জন্য এদিকে তার ফৌজ লেলিয়ে দিয়েছেন। আচ্ছা, এই মেয়েটি আপনার কী হয়?

আমার স্ত্রী। লোকটি জবাব দেয়।

আর দামেস্কে কটি রেখে এসেছেন? মাজেদ জিজ্ঞেস করে।

চারটি। লোকটি জবাব দেয়।

আল্লাহ করুন, এই পঞ্চমজন আপনার সঙ্গে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে যায়। মাজেদ বলল।

আচ্ছা, আইউবীর ফৌজ এখান থেকে কত দূরে?- লোকটি জিজ্ঞেস। করে- তুমি কি সৈন্যদেরকে লুট করতে দেখেছ?

হ্যাঁ, দেখেছি- মাজেদ জবাব দেয়- যদি বলি, আমিও সালাহুদ্দীন আইউবীর একজন সৈনিক, তাহলে আপনি কী করবেন?

লোকটি কাঁপতে শুরু করে। আবার পরক্ষণেই হাসতে চেষ্টা করে। কিন্তু তার কম্পিত ঠোঁটের ব্যর্থ হাসির রেখা মুহূর্তে মিলিয়ে যায়। বলে- আমি তোমাকে কিছু দিয়ে দেব। তোমার প্রতি আমার নিবেদন, তুমি আমাকে ভিখারীতে পরিণত কর না। আরো আবেদন করব, এই মেয়েটাকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিও না।

মাজেদ হেজাজী খিল খিল করে হেসে ফেলে। হাসি বন্ধ করে বলে- ধন আর নারীর মোহ মানুষকে ভীরু ও দুর্বল করে তোলে। কেউ যদি মাথার উপর তরবারী উঁচিয়ে বলে, সঙ্গে যা আছে দিয়ে দাও; তাহলে আমি নিজের তরবারীটা কোষমুক্ত করে বলব, আগে আমাকে খুন কর, তারপর আমার সঙ্গে যা পাও নিয়ে যাও। জনাব! বলে ফেলুন, আপনি কে? দামেস্কে আপনি কী ছিলেন? আর এখন যাচ্ছেন কোথায়? সত্য বললে হয়ত আমিই হব আপনার একনিষ্ঠ মোহাফেজ। আমার মনে হচ্ছে, আপনাদের আর আমার গন্তব্য এক। আমি আইউবীর ফৌজের সেনা বটে, তবে দলত্যাগী।

চরমভাবে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে লোকটি। সে অকপটে নিজের আসল পরিচয় ও ইতিবৃত্ত ব্যক্ত করে মাজেদ হেজাজীর নিকট। লোকটি দামেস্কের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জাগীরদার। রাজ দরবারে তার অনেক মর্যাদা ছিল। সালতানাতের রাষ্ট্রীয় ও সামরিক বিষয়ে বেশ দখল ছিল। খলীফার দেহরক্ষী বাহিনীর অধিকাংশ সৈনিকই ছিল তার দেয়া। এক কথায় বলা চলে, এই লোকটি সরকারের উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা ছিল। সুলতান আইউবীর দামেস্ক অনুপ্রবেশের পর যখন পলায়নের প্রয়োজন দেখা দিল, তখন তার ঘর থেকে বের হতে একটু বিলম্ব হয়ে যায়। আল-মালিকুস সালিহ তার অনুচরদের বলে দিয়েছিলেন, আমি হাল্ব পৌঁছে যাব, তোমরাও সেখানে চলে এস। সে মতে এই জাগীরদারও হাব-এর দিকেই যাচ্ছে। লোকটি এও বলে দেয় যে, আমার সঙ্গে প্রচুর সোনা-রূপা ও মণি-মাণিক্য আছে। স্ত্রী চারজনকে দামেস্কে ফেলে এসেছে। এটি সকলের ছোট ও রূপসী বলে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। লোকটি অত্যন্ত আক্ষেপের সঙ্গে জানায়, তার রক্ষীবাহিনী ও সকল চাকর-বাকর দামেস্কেই তাকে ত্যাগ করে চলে গেছে। তারা তার সব লুট করে নিয়ে গেছে।

লোকটির কাহিনী শুনে মাজেদ হেজাজী বেশ আনন্দিত হয়। তার বড় কাজের লোক এই জাগীরদার। অন্তত হাবের দরবার পর্যন্ত পৌঁছা যাবে এর সঙ্গে।

মাজেদ হেজাজী তাকে নিজের পরিচয় প্রদান করে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী মিশর থেকে যে ফৌজ দামেস্কে নিয়ে এসেছেন, আমি তার একটি ব্যাটলিয়নের কমান্ডার। কিন্তু আমি আল-মালিকুস সালিহর অনুরক্ত। এ জন্য দলত্যাগ করে আইউবীর ফৌজ থেকে পালিয়ে এসেছি এবং খলীফার দরবারে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পথ চলছি। খলীফা যদি আমাকে পছন্দ করেন, তাহলে তার রক্ষী বাহিনীতে যোগ দেব।

আমি যদি এখনই তোমাকে আমার রক্ষী বানিয়ে নেই, তাহলে তোমাকে কত বেতন দিতে হবে? লোকটি মাজেদ হেজাজীকে জিজ্ঞেস করে- আমি দামেস্কে যেমন রাজা ছিলাম, ওখানেও তা-ই থাকব। আমার রক্ষী হলে তোমার ভাগ্য বদলে যাবে।

আপনি যদি আমাকে আপনার মোহাফেজ নিয়োগ করেন, তাহলে আপনার আর সামরিক উপদেষ্টার প্রয়োজন হবে না।- মাজেদ হেজাজী বলল- আর যোগ্যতা দেখে পারিশ্রমিক আপনিই ঠিক করে নেবেন। আমি এখনই কিছু বলব না। 

মাজেদ হেজাজী লোকটির বডিগার্ড হয়ে যায়। কথাটা এভাবেও বলা যায় যে, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর একজন গুপ্তচর একজন দরবারী জাগীরদারের ঘনিষ্ঠজনে পরিণত হয়ে যায়।

সময়টা সূর্যাস্তের পূর্ব মুহূর্ত। অল্প পরেই সূর্য অস্তমিত হয়ে আঁধার নেমে আসবে। আজকের মতো আর সামনে অগ্রসর হওয়ার সময় নেই। মাজেদ হেজাজীর পরামর্শে তারা ওখানে রাত কাটানোর আয়োজন করে। রাত পোহাবার পর জাগীরদার এখন নিশ্চিত- মাজেদ বিশ্বস্ত, তারই একজন।

***

দীর্ঘ সফরের পর তারা হাল্ব গিয়ে পৌঁছে। সে সময়ে হালব-এর আমীর ছিলেন শামসুদ্দীন, যিনি অল্প কদিন আগে খৃস্টানদের সঙ্গে সন্ধি করেছিলেন। আল-মালিকুস সালিহ দামেস্ক থেকে পালিয়ে তার নিকট গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তার সকল আমীর ও উজীর তার সঙ্গে। দেহরক্ষী বাহিনীও তথায় পৌঁছে গেছে।

আল-মালিকুস সালিহ হাব-এর শাসনক্ষমতা হাতে তুলে নেন। সেনা বাহিনীকেও নতুনভাবে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তার কাছে সোনাদানা ও সম্পদের অভাব ছিল না। অভাব ছিল ফৌজ, কমান্ডার ও উপদেষ্টার। তিনি এবং তার অনুচরদের ভাবনা, কিভাবে সুলতান আইউবীকে পরাজিত করে খেলাফত বহাল করা যায়। তাদের ভাবনা ও অস্থিরতা প্রমাণ করে, তাদের দুশমন খৃস্টানরা নয়- সুলতান আইউবী। তারা এদিক-ওদিকের আমীরদের নিকট খলীফার সীল-স্বাক্ষরযুক্ত বার্তা প্রেরণ করে যে, সালতানাতের প্রতিরক্ষার জন্য তোমরা খলীফাকে সামরিক সাহায্য প্রদান কর। তাদের কারো নিকট থেকে আশাব্যঞ্জক জবাব পাওয়া গেল, কারো নিকট থেকে পাওয়া গেল মৌখিক প্রতিশ্রুতি।

এই জাগীরদার হাল্ব পৌঁছলে খলীফা তাকে স্বাগত জানান। ইনি ছিলেন খলীফার সামরিক উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য। বসবাসের জন্য হালবে তাকে একটি ভবন প্রদান করা হল। এখানে এসেই তিনি এত ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে, ঘর থেকে সকালে বের হচ্ছেন তো ফিরছেন মধ্যরাতে।

তার এই অনুপস্থিতির সুযোগে তার স্ত্রী ঝুঁকে পড়তে শুরু করে মাজেদ হৈজাজীর প্রতি। সুযোগটাকে লুফে নেয় মাজেদ। সে আত্মমর্যাদা ও চারিত্রিক পবিত্রতা বজায় রেখে মেয়েটাকে ঘনিষ্ঠ করে নেয়। মেয়েটা মাজেদ হেজাজীর প্রতি এমনভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে যে, মাজেদ হেজাজী যে তার স্বামীর একজন দেহরক্ষী, সে তা ভুলেই গেছে। এই ফাঁকে মাজেদ অগ্রসর হচ্ছে তার মিশন : নিয়ে। সে দু-তিন দিনের মধ্যেই মেয়েটাকে পুরোপুরি মুঠোয় নিয়ে আসে। .. মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে, তোমার স্বামীর অন্য চার স্ত্রী কেমন ছিল?

মেয়েটি বলল, খারাপ তেমন ছিল না। পুরাতন বিধায় তিনি তাদেরকে ধোকা দিয়ে ফেলে আমাকে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন।

 আর একদিন তোমাকেও ফেলে অন্য কাউকে নিয়ে অন্যত্র পালিয়ে যাবে। এই আমীরদের কাজই এই। মাজেদ বলল।

আচ্ছা, আমি যদি তোমাকে আমার মনের কথা বলি, তা আমার স্বামীকে বলে দেবে না তো? আমার সঙ্গে তুমি প্রতারণা করবে না তো! মেয়েটি বলল।

দেখ, আমার চরিত্রে যদি ধোকা-প্রতারণা বলে কিছু থাকত, তাহলে ঐ যেখানে তোমাদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল, তোমার স্বামীকে খুন করে সেখানেই আমি তোমাকে ও তোমাদের ধন-দৌলত ছিনিয়ে নিতাম। মাদেজ বলল। আরো বললো, আমি পুরুষ, একজন নারীর সঙ্গে প্রতারণা করা পুরুষের মর্যাদার খেলাফ।

হৃদয়ের গোপন কথাটা আর চেপে রাখতে পারছি না আমি- মেয়েটি বলল- আমি তোমাকে ভালবাসি মাজেদ! আর আজ এ কথাটাও আমি গোপন রাখছি না যে, আমি আমার স্বামীকে ঘৃণা করি। আমি কারো স্ত্রী নই। আমি বিক্রি হওয়া মেয়ে। আমি বহুবার আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু সম্ভবত আমি ভীরু। আত্মহত্যা করার সাহসটুকুও আমার নেই। আমার ইচ্ছে ছিল এক, করছি আরেক। এবার তুমি আমার ইচ্ছাশক্তিকে প্রবল করে দিয়েছ যে, আত্মহত্যা আমাকে করতেই হবে।

তার মানে আমাকে ভালবাস বলে তুমি আত্মহত্যা করতে চাচ্ছ?

না- মেয়েটি বলল- আমার বিশ্বাস ছিল, সালাহুদ্দীন আইউবী নুরুদ্দীন জঙ্গী অপেক্ষা মোগ্য ও মহৎ মানুষ। কিন্তু তুমি আমার সেই বিশ্বাসে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছ। আচ্ছা, সালাহুদ্দীন আইউবী কি এতই খারাপ, যেমনটা তুমি বলেছিলে?

মাজেদ হেজাজীর ভাবান্তর ঘটে যায়। বুঝতে পারে আঘাতটা ওর কোথায় লেগেছে। বলল- তুমি তোমার মনের গোপন কথা আমাকে বলে দিয়েছ তার বিনিময়ে আমিও আমার একটি গোপন কথা তোমাকে বলছি। আমি তোমার থেকে কোন ওয়াদা নেব না যে, আমার এই গোপন কথা তুমি কাউকে বলতে পারবে না। শুধু এতটুকু বলে রাখব, আমার ভেদ যদি ফাঁস হয়ে যায়, তাহলে তুমিও বাঁচবে না, তোমার স্বামীও নয়। শোন, আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর একজন গুপ্তচর। আমি দু-চার দিনেই তোমার আসল পরিচয় টের পেয়ে গেছি। শোন, তুমি সালাহুদ্দীন আইউবীকে যতটা পবিত্র ভেবেছিলে, তিনি তার চেয়েও বেশী পবিত্র, বেশী মহৎ। তিনি সেইসব আমীর ও রাজা বাদশাহদের দুশমন, যারা নারীদেরকে হেরেমে আবদ্ধ করে রেখেছেন। তিনি নারীদেরকে বিনোদন ও ভোগের সামগ্রী মনে করেন না। তিনি নারীর মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষা এবং পুরুষদের জন্য বহু বিবাহ-বিলাসিতা পছন্দ করেন না। নারীদেরকেও তিনি সমরবিদ্যায় পারদর্শী করে তুলতে চান। আমি তোমার স্বামীর আস্থা অর্জনের জন্য মিথ্যা বলেছিলাম যে, আইউবী দামেস্ক থেকে পলায়নকারী লোকদের লুণ্ঠন ও তাদের মেয়েদের তুলে নেয়ার জন্য বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছেন। তিনি ইসলামের পতাকাবাহী। আমি ইসলামের বিজয় ও সালাহুদ্দীন আইউবীর জন্য এখানে একটি মিশন নিয়ে এসেছি।

সহসা মেয়েটির চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। দুহাতে মাজেদ হেজাজীর একটা হাত চেপে ধরে টেনে মুখের কাছে নিয়ে চুমো খেয়ে বলল, তোমার এই ভেদ কখনো ফাঁস হবে না। আমাকে বল, এখানে তুমি কেন এসেছ এবং আমি তোমার জন্য কী করতে পারি? বল, সালাহুদ্দীন আইউবী আসলে কেমন মানুষ। নুরুদ্দীন জঙ্গীর জীবদ্দশায় আমরা একটি মহিলা সংগঠন করেছিলাম। আমরা খৃস্টানদের বিরুদ্ধে কাজ করেছিলাম। জঙ্গীর স্ত্রী আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কিন্তু আমি এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হয়ে কাজ করি, আমার পিতা তা পছন্দ করতেন না। তিনি একজন মোহান্ধ ও চাটুকার মানুষ। তার নিকট ক্রুশ ও চাঁদ-তারার মাঝে কোন পার্থক্য নেই। যে তার হাতে কটি টাকা গুঁজে দেয়, তিনি তারই গোলাম হয়ে যান। তিনিই এই লোকটির কাছে আমাকে বিক্রি করে দিয়েছেন। এই সওদাকে মানুষ বিবাহ বলে। তুমি তো জান, একজন মুসলিম নারী সুযোগ পেলে যুদ্ধের ময়দানে পুরুষদেরকেও তাক লাগিয়ে দিতে পারে। পারে দুশমনের হাঁটু ভেঙ্গে দিতে। কিন্তু সে নারীকেই যখন হেরেমে বন্দী করে ফেলা হয়, তখন সে পিপিলিকায় পরিণত হয়ে যায়। আমার দশাটা তা-ই হয়েছে। আমার স্বামী যদি সাধারণ মানুষ হতেন, তাহলে আমি অবশ্যই বিদ্রোহ করতাম, তার কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু তার শক্তি আছে, আছে সম্পদ। খলীফা আল মালিকুস সালিহর রক্ষী বাহিনীর অর্ধেকই তার লোক।

তার আরো চারটি বউ আছে। কিন্তু তাদের অপেক্ষা আমার বয়স কম ও রূপসী বিধায় তিনি আমাকে তার খেলনা বানিয়ে রেখেছেন। আমার আত্মা মরে গেছে। বেঁচে আছে শুধু দেহটা। বাইরের জগতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আমি বন্দী হয়ে যে জগতে পড়ে ছিলাম সেখানে মদ আর নাচগান ছাড়া কিছুই ছিল না। হ্যাঁ, ছিল আরো একটি বিষয়। তাহল, নুরুদ্দীন জঙ্গী ও সালাহুদ্দীন আইউবীর হত্যার পরিকল্পনা।

বলতে বলতে মেয়েটি থেমে যায়। আবেগে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে তার। বার কয়েক ঢোক গিলে দুহাতে মাজেদ হেজাজীর বাহু ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, শুনছ কি ভাই আমার কথা? তুমি সালাহুদ্দীন আইউবীর গুপ্তচর না আমার স্বামীর, সেই পরিচয় বাদ দিয়েই আমি তোমাকে আমার মনের কথাগুলো বলে দিচ্ছি। আমি জানি, জানতে পারলে আমার স্বামী আমাকে শাস্তি দেবেন- নির্মম শাস্তি। কিন্তু আমি যে কোন শাস্তি ভোগ করতে প্রস্তুত আছি। আমার এখন দেহ ছাড়া আর কিছুই নেই। দেহটাও পাথর হয়ে। গেছে। আমার আত্মা মরে গেছে।

না, তোমার, আত্মা জীবিত আছে- মাজেদ হেজাজী বলল- আমার চোখ হৃদয়ের গভীরে দেখতে পায়। আমি দেখেছি, তোমার আত্মা বেঁচে আছে। অন্যথায় কখনো আমি তোমার সম্মুখে আমার ভেদ প্রকাশ করতাম না। আমি রূপ-যৌবনের কাছে পরাজিত হওয়ার মত মানুষ নই। আমি পুরুষ। নিজের জীবনটা ইসলামের জন্য ওয়াফ করে দিয়েছি। তুমি বলে যাও, হৃদয়ের বোঝা হাল্কা করতে থাক। আমি শুনছি। তোমার কাহিনী আমার কাছে নতুন কিছু নয়। এটা প্রতিটি মুসলিম নারীর কাহিনী। যেদিন প্রথম একজন মুসলমান হেরেম নামক ভোগ্যালয়ে রূপসী মেয়েদের বন্দী করেছিল, সেদিন থেকে ইসলামের পতন শুরু হয়েছিল। খৃস্টানদের পরিকল্পনা, তারা আমাদেরকে নারীর হাতে খুন করাবে। তারাই তাদের মেয়েদের দ্বারা আমাদের রাজা বাদশাদের হেরেম ভরে রেখেছে।

আমার স্বামীর ঘরেও এই একই ঘটনা ঘটেছে- মেয়েটি বলল- আমি খৃস্টান মেয়েদের আমার স্বামীর ঘরে আসতে এবং মদপান করতে দেখেছি। চোখের পানি ফেলা ছাড়া আমার তখন কিছুই করার ছিল না। আমি এ জন্যে কাঁদতাম না যে ওরা আমার স্বামীকে ছিনিয়ে নিচ্ছে। আমার কান্নার কারণ ছিল, ওরা আমার থেকে সেই ইসলামকে ছিনিয়ে নিচ্ছে, যার জন্য তোমার ন্যায় আমিও আমার জীবন ওয়াকফ করে দিয়েছিলাম।

আবেগ ত্যাগ কর। এস, কাজের কথা বলি। আমি যে মিশন নিয়ে এখানে এসেছি, কাজ শুরু করা প্রয়োজন- মাজেদ হেজাজী বলল- আচ্ছা, স্বামীর উপর তোমার প্রভাব কেমন? তুমি কি তার মনের কথা বের করতে পারবে?

দু-পেয়ালা মদপান করিয়ে তার মাথাটা আমার বুকের সঙ্গে লাগিয়েই আমি তার মনের সব ভেদ বের করে ফেলতে পারব- মেয়েটি জবাব দেয়- কি তথ্য বের করতে হবে বল। তারপর একটুখানি ভেবে মুচকি হেসে মেয়েটি বলল, তুমি আমার একান্ত ব্যক্তিগত একটি দাবি মানবে কিনা বল- আমি যদি তোমার কাজ আদায় করে দিতে পারি, তাহলে তুমি আমাকে এখন থেকে উদ্ধার করবে, আমার এই আশা পূরণ হবে কি? আমার ভালবাসা প্রত্যাখ্যান করবে না তো?

হবে, তোমার এই মনোবাসনা পূরণ হবে। আমি তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব। তোমার ভালবাসার মূল্যায়ন করব। মেয়েটির দাবি মেনে নেয় মাজেদ।

মাজেদ হেজাজী বলল, খলীফা আল-মালিকুস সালিহ এগার বছর বয়সের কিশোর। তিনি আমীর-উজীরদের খেলনায় পরিণত হয়ে আছেন। এই আমীর উজীরগণ উম্মাহকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেলতে চায়। তাদের এই আশা যদি পূরণ হয়, তাহলে খৃস্টানরা খণ্ডিত মুসলিম ভূখণ্ডগুলোকে খেয়ে হজম করে ফেলবে। এই পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ইসলামের নাম-চিহ্ন মুছে ফেলবে। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বলে থাকে, যে জাতি নিজ সাম্রাজ্যকে, খণ্ডিত করে, তাদের অস্তিত্ব টিকে না। আমাদের এই আমীরগণ খৃস্টানদের থেকে সাহায্য নিতে কুণ্ঠিত হবে না। খৃস্টানরা তাদেরকে মদদ দেবে ঠিক, কিন্তু তার বিনিময়ে তাদেরকে প্রজায় পরিণত করে ফেলবে। সুলতান আইউবী আমাকে এখানে এই তথ্য সগ্রহ করতে পাঠিয়েছেন যে, খলীফা কী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং খৃস্টানরা তাদেরকে কিরূপ সাহায্য প্রদান করছে। এই তথ্য আমাকে যত দ্রুত সম্ভব সুলতানের নিকট পৌঁছাতে হবে। তিনি সেই মোতাবেক পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন। এমন যাতে না হয় যে, সুলতান কোন প্রস্তুতি-পদক্ষেপ না নিতেই খৃস্টানরা তার উপর হামলা করে বসল।

আচ্ছা, সালাহুদ্দীন আইউবী কি মুসলিম আমীরদের উপর হামলা করবেন? মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।

যদি প্রয়োজন হয়, তিনি তাতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব করবেন না।

মেয়েটি যেমন আগেগপ্রবণ, তেমন বুদ্ধিমতী। তার চোখ গড়িয়ে ঝরঝর করে পানি গড়াতে শুরু করে। বলল, ইসলামকে সেই দিনটিও দেখতে হল যে, একই রাসূলের উম্মত পরস্পর লড়াই করবে!

এছাড়া আর কোন পথ নেই যে!- মাজেদ বলল- সালাহুদ্দীন আইউবী রাজা নন; আল্লাহর একজন সৈনিক মাত্র। তার মতে, দেশ-জাতিকে বিপদ ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর। এই বিপদ বাইরের দুশমনের পক্ষ থেকে আসুক কিংবা ভেতরের গাদ্দার ও স্বার্থপূজারী শাসকদের থেকে; জাতিকে রক্ষা করা সৈনিকদের পবিত্র কর্তব্য। তিনি প্রায়ই বলে থাকেন, আমি দেশের সেনাবাহিনীকে শাসকগোষ্ঠীর খেলনায় পরিণত হতে দেব না। সেই মুসলমান কাফিরদের চেয়েও বেশী ভয়ংকর, যে কাফিরদেরকে বন্ধু ভেবে বুকে জড়িয়ে নেয়। এখন তোমার কাজ হল, তুমি তোমার স্বামীর নিকট থেকে তথ্য নাও, এখানে কী পরিকল্পনা প্রস্তুত হচ্ছে।

আমি তোমাকে তথ্যও দেব এবং এই দুআও করব যে, তুমি যখন এখান থেকে দামেস্ক ফিরে যাবে, তখন যেন তোমার সঙ্গে তথ্যের সঙ্গে আমিও থাকি।

***

ত্রিপোলীর খৃস্টান সম্রাট রেমন্ড-এর নিকট দূত মারফত আবেদন পাঠান হয়েছে, তিনি যেন আল-মালিকুস সালিহর সাহায্যে এগিয়ে আসেন–পরদিনই মেয়েটি মাজেদ হেজাজীকে বলল- রাতে আমি আমার স্বামীকে মদপান করিয়ে সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে অনেক কথা বললাম এবং শেষে বললাম, তোমরা আসলে কাপুরুষ বলেই দামেস্ক থেকে পালিয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছ। কোন মুসলমানই শাসকগোষ্ঠীর এই অপমান সহ্য করতে পারে না, যা সালাহুদ্দীন আইউবী তোমাদের করল। মেয়েটি বলল, আমি তাকে এমন সব কথা বললাম যে, তিনি শিউরে ওঠলেন এবং আমার সঙ্গে অশালীন আচরণ করতে করতে বললেন, আইউবী দিন কয়েকের মেহমান মাত্র। ফেদায়ী ঘাতকদের প্রধান শেখ সান্নানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সে সালাহুদ্দীন আইউবীকে হত্যা করার ব্যবস্থা করবে এবং তাকে তার দাবি অনুপাতে পুরষ্কার দেয়া হবে। সে তার অভিজ্ঞ ঘাতক দলকে দামেস্ক পাঠাচ্ছে। তিনি আরো বললেন, আমরা বাহিনী প্রস্তুত করার জন্য অনেক সময় পাব। কারণ, শীতের মওসুম এসে গেছে। পার্বত্য এলাকাগুলোতে বরফপাত শুরু হবে। সালাহুদ্দীন আইউবী তার মরু এলাকার বাহিনীকে এত ঠান্ডা আর বরফের মধ্যে লড়াতে পারবে না।

মাত্র শুরু। মদ আর নারী একজন পুরুষের মনের গোপন রহস্য বের করতে শুরু করেছে। মেয়েটি রাতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নানা কৌশলে তার স্বামীর সারাদিনের কারগুজারী শুনতে আরম্ভ করেছে। আর দিনের বেলা এই ভেদ রহস্য কানে দিচ্ছে মাজেদ হেজাজীর।

একদিন মেয়েটির স্বামী মাজেদ হেজাজীকে বলল- তোমার নামে নালিশ আছে। মাজেদ শিউরে ওঠে। ভাবে, তাহলে কি ধরা খেয়ে গেলাম! লোকটি বলল, শুনলাম, তুমি নাকি আমার স্ত্রীকে উত্যক্ত করছ! আমার অবর্তমানে তুমি ওর কাছে গিয়ে বসে থাকছ! আমি জানি, আমার তুলনায় তুমি সুদর্শন এবং যুবক। আমার স্ত্রী তোমার প্রতি আকৃষ্ট হবে, তা স্বাভাবিক। কিন্তু এখনই বিরত না হলে আমি তোমাকে খুন করে ফেলব।

মাজেদ হেজাজী তার মনিবকে বুঝাবার চেষ্টা করে যে, এটা আপনার ভুল ধারণা। বাস্তবে এমন কোন ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু লোকটির মন থেকে সংশয় দূর হচ্ছে না। সে তার স্ত্রীকেও একই কথা বলে এবং তাকে বারণ করে দেয় মাজেদের সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ করা চলবে না।

এখনই এখান থেকে চলে যেতে চাচ্ছে না মাজেদ হেজাজী। তার মিশন এখনো সফল হয়নি। এখনো এখানকার পুরো পরিকল্পনা তার জানা হয়নি। মেয়েটিও রাগ-ধমক সহ্য করে নিয়ে উপরে উপরে মান্যতা ও আনুগত্যের ভান ধরে স্বামীর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং ভবিষ্যতে এমন হবে না বলে অঙ্গীকার করে। স্বামী তাকে ক্ষমা করে দেয় বটে; কিন্তু সেদিনই আরো ছয়জন দেহরক্ষী নিয়ে এসে তাদের একজনকে কমান্ডার নিযুক্ত করে মাজেদ হেজাজীকে তার অধীন করে দেয়। দায়িত্ব বুঝে পেয়েই কমান্ডার মাজেদ হেজাজীকে শতর্ক করে দেয়, তুমি মনিবের দৃষ্টিতে সন্দেহভাজন। অতএব কখনো মনিবের বাসভবনের দরজার নিকটও যেতে পারবে না। আর রাতে সামান্য সময়ের জন্যও অনুপস্থিত থাকতে পারবে না।

মাজেদ অম্লান বদনে কমান্ডারের নির্দেশ মেনে নেয় এবং মাথা ঝুঁকিয়ে আনুগত্য প্রকাশ করে।

এভাবে কেটে যায় আরো তিন দিন। তৃতীয় দিন মধ্যরাতে মেয়েটি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। প্রধান ফটকে একজন প্রহরী দণ্ডায়মান। মেয়েটি চেহারায় মনিবের প্রভাব ও গাম্ভীর্যসহ তাকে জিজ্ঞেস করে, এই তুমি কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাক, নাকি ভবনের আশপাশটাও ঘুরে-ফিরে দেখ? প্রহরী উত্তরে কিছু বললে মেয়েটি বলল, তুমি নতুন মানুষ, আমাদের আগের দামেস্কের প্রহরীটা বেশ সতর্ক ও চৌকস ছিল। এখানে চাকুরী টেকাতে হলে তোমাকে তার মত হুঁশিয়ার হতে হবে। জান তো, সাহেব কড়া মেজাজের মানুষ।

প্রহরী মনিবের স্ত্রীর প্রতি অবনত হয়ে যায়।

প্রহরীদের এক এক করে তদারকি করছে মেয়েটি। ঘুমন্ত প্রহরীদের তাবুর দিকে এগিয়ে যায় সে। প্রধান ফটকের প্রহরী ছুটে গিয়ে কামান্ডারকে জাগিয়ে দিয়ে বলে, মনিবের স্ত্রী পরিদর্শনে এসেছেন। কমান্ডার ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ায় এবং এগিয়ে এসে মনিব-পত্নীর সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। মেয়েটি তাকে জরুরী নির্দেশনা দিয়ে আরেকটি তাঁবুর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে কথা বলতে শুরু করে।

মাজেদ হেজাজী এই তাবুতে শুয়ে আছে। মেয়েটির কথার শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। শোয়া থেকে উঠে তাঁবুর বাইরে চলে আসে। মেয়েটি তার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলে, যেন তার সঙ্গে তার কোন পরিচয় নেই। সে মাজেদকে জিজ্ঞেস করে, তুমিই বোধ হয় পুরাতন প্রহরী? মাজেদ শ্রদ্ধার সঙ্গে জবাব দেয়, জি, হ্যাঁ। মেয়েটি কমান্ডারকে বলে, এই লোকটিকে জলদি প্রস্তুত করে দাও, এ আমার সঙ্গে রাজ দরবারে যাবে। জলদি দুটি ঘোড়া প্রস্তুত কর।

মনিব যদি আপনার কথা জিজ্ঞেস করে, তাহলে কী বলব? কমান্ডার জিজ্ঞেস করে।

আমি আমোদ ভ্রমণে যাচ্ছি না- মেয়েটি শাসকসুলভ কণ্ঠে বলল মনিবের কাজেই যাচ্ছি। রাষ্ট্রীয় কাজে তোমাদের অতো মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। যাও, দুটি ঘোড়া প্রস্তুত করে ফেল।

কমান্ডার এক রক্ষীকে আস্তাবলের দিকে পাঠিয়ে দেয়। মাজেদ হেজাজী তরবারী সজ্জিত হয়ে প্রস্তুত হয়ে যায়। মেয়েটি তাকে আস্তাবলের দিকে নিয়ে যায়।

মেয়েটির স্বামী কমান্ডারকে আগেই বলে রেখেছে, মাজেদের প্রতি নজর রাখবে এবং তাকে ঘরে ঢুকতে দেবে না। আর এখন কিনা তার স্ত্রী নিজেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লোকটাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে।

মেয়েটি ও মাজেদ আস্তাবলের দিকে চলে যায়। কমান্ডার নিশ্চিত হতে চায়, মনিবের স্ত্রী সন্দেহভাজন রক্ষীর সঙ্গে যাচ্ছে, তা তার মনিবের জানা আছে কিনা। মেয়েটিকে সে বাধাও দিতে পারছে না। কারণ, সে তার মনিবের স্ত্রী।

কমান্ডার ঘরে ঢুকে পড়ে। ভয়ে ভয়ে মনিবের কক্ষের দরজায় হাত রাখে। সামান্য ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে যায়। ভেতরে প্রদীপ জ্বলছে। কক্ষটা মদের দুর্গন্ধে ভরে আছে। মনিবের প্রতি দৃষ্টিপাত করে কমান্ডার। লোকটা বিছানার উপর এমনভাবে পড়ে আছে যে, তার মাথা ও একটি বাহু পালংকের উপর থেকে ঝুলে আছে। একটি খঞ্জর বিদ্ধ হয়ে আছে তার বুকে। একাধিক আঘাতের চিহ্নও দেখা যাচ্ছে। রক্তে লাল হয়ে আছে তার সমস্ত দেহ, বিছানা ও মেঝে। কমান্ডার মনিবের নিকটে গিয়ে দাঁড়ায়। শিরায় হাত রেখে পরীক্ষা করে। নেই। মারা গেছে।

মেয়েটি মাজেদ হেজাজীকে জানায়, সে তার স্বামীর নিকট থেকে সব পরিকল্পনা জেনে এসেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণ শুরু হয়ে গেল বলে।

প্রতিদিনের ন্যায় মেয়েটি আজও লোকটিকে মদপান করায় এবং একটু বেশি পরিমাণে করায় যে, নেশায় লোকটা অজ্ঞান হয়ে গেছে। তাকে অচেতন অবস্থায় ফেলে আসতে পারতো মেয়েটি। কিন্তু প্রতিশোধ-স্পৃহা তাকে পাগল করে তুলেছে। খঞ্জর দ্বারা লোকটির বুক ঝাঁঝরা করে দিয়ে খঞ্জরটি বুকে বিদ্ধ রেখেই বেরিয়ে আসে।

ঘটনা শুনে মাজেদ হেজাজী এতটুকুও ভয় পেল না। সে তো প্রতি মুহূর্তই এমন লোমহর্ষক ঘটনার সংবাদ শুনে অভ্যস্ত। মাজেদ মেয়েটির এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানায় এবং বলে, সুস্থিরভাবে ঘোড়ায় চড়।

তারা ঘোড়ায় আরোহন করছে। ঠিক এমন সময় রাতের নীরবতা ভেদ করে উচ্চস্বর কানে আসে- ঘোড়া দিও না, ওদেরকে আটক কর, ওরা খুন করে পালাচ্ছে।

রক্ষীরা তরবারী ও বর্শা উঁচিয়ে বেরিয়ে আসে। মাজেদ হেজাজী ও মেয়েটি ঘোড়ায় সওয়ার হয়েছে। রক্ষীরা যে পথটা আগলে রেখেছে, তাদেরকে সে পথই অতিক্রম করতে হবে। মাজেদ মেয়েটিকে বলল, তুমি যদি ঘোড়া হাঁকাতে না জান, তাহলে দ্রুত আমার ঘোড়ার পেছনে চড়ে বস। ঘোড়া যথাসম্ভব দ্রুত হাঁকাতে হবে।

মেয়েটি প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, সমস্যা নেই। আমি ঘোড়সওয়ারী জানি।

তোমার ঘোড়া আমার পিছনে রাখবে বলে মাজেদ হেজাজী হাতে তরবারী তুলে নেয়।

এদিকে রক্ষীদের চেঁচামেচির শব্দ ধীরে ধীরে নিকটে আসছে। তারা আস্তাবলের দিকে ছুটে আসছে। মাজেদ দ্রুত ঘোড়া হাঁকায়। দেখাদেখি তার পেছন পেছন মেয়েটিও ঘোড়া হুঁটায়। কমান্ডার গর্জে উঠে- থেমে যাও, অন্যথায় বাঁচতে পারবে না।

জ্যোত্মা রাত। মাজেদ পেছন ফিরে দেখে রক্ষীরা বর্শা উঁচিয়ে এগিয়ে আসছে। মাজেদ ঘোড়ায় গতি ঘুরিয়ে দেয়। মোকাবেলা করতে হবে। সামান্য এগিয়ে গিয়ে তরবারী ঘুরাতে শুরু করে। ঘোড়ার গতি তার আশার চেয়ে তীব্র। দুজন রক্ষী তার সম্মুখে চলে আসে এবং ঘোড়ার পায়ের নীচে পিষে যায়। একটা বর্শা ধেয়ে আসে মাজেদের দিকে। কিন্তু মাজেদ তরবারীর আঘাতে নিশানা ব্যর্থ করে দেয়।

ধনুক বের কর-কমান্ডার চিৎকার করে বলল। লোকটা অভিজ্ঞ বলে মনে হচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে দু-তিনটা তীর শাঁ করে মাজেদ হেজাজীর কানের কাছ দিয়ে অতিক্রম করে চলে যায়। মাজেদ তার ঘোড়াটা ডানে-বাঁয়ে ঘোরাতে শুরু করে, যাতে তীরান্দাজ নিশানা করতে না পারে।

ইতিমধ্যে মাজেদ তীরের আওতা থেকে বেরিয়ে যায়। এখন ভয়, রক্ষীরা ঘোড়ায় চড়ে তাকে ধাওয়া করে কিনা। কিন্তু ধরা খাওয়ার ভয় নেই মাজেদের। জিন কষে ঘোড়ার পিঠে চড়তে চড়তে মাজেদ চলে যেতে পারবে অনেক দূর। লোকালয় ত্যাগ করা পর্যন্ত পেছনে ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা গেল না। মাজেদ মেয়েটিকে বলল, এবার তোমার ঘোড়াটা আমার ডান পার্শ্বে নিয়ে আস।

মেয়েটি তার ঘোড়া মাজেদের পার্শ্বে নিয়ে আসে। মাজেদ তাকে জিজ্ঞেস করে, ভয় পাওনি তো?

মেয়েটি জবাব দেয় না, কোন অসুবিধা হয়নি।

পাশাপাশি ছুটে চলেছে দুটি ঘোড়া। মেয়েটি দূরন্ত ঘোড়ার পিঠ থেকেই উচ্চস্বরে তথ্য শোনাতে শুরু করে, যা সে তার স্বামীর নিকট থেকে সংগ্রহ করেছে। মাজেদ বলল, এখন কথা রাখ; আরো কিছু পথ অতিক্রম করে যাত্রাবিরতি দিয়ে তোমার সব কথা শুনব। কিন্তু মেয়েটি বলেই যাচ্ছে। মাজেদ বারবার বলছে, এখন কথা রাখ, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মেয়েটি বলল, তাহলে এখানেই থেমে যাও; বেশী অপেক্ষা করতে পারব না। মাজেদ হেজাজী এখনই যাত্রাবিরতি দিতে চাচ্ছে না! কিন্তু মেয়েটি কথা বলেই যাচ্ছে।

হাত বাড়িয়ে মাজেদ তার ঘোড়ার বাগ টেনে ধরে। এর জন্য তাকে সামনের দিকে এত ঝুঁকতে হয় যে, মাজেদ দেখতে পায়, মেয়েটির এক পাজরে তীর বিদ্ধ হয়ে আছে। মাজেদ সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া থামিয়ে ফেলে।

এই তীর এখানেই বিদ্ধ হয়েছিল মেয়েটি বলল- আমি এ কারণেই ছুটন্তু ঘোড়ার পিঠ থেকেই ভোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম, যাতে আমার অর্জিত মহামূল্যবান তথ্য মৃত্যুর আগেই তোমাকে বলে দিতে পারি।

মাজেদ মেয়েটিকে ঘোড়ার পিঠ থেকে নীচে নামায়। মাটিতে বসে মেয়েটির মাথাটা কোলের উপর রাখে। তীর বিদ্ধ জাগায় হাত লাগায় মাজেদ। অনেক গভীরে ঢুকে গেছে তীরটি। বের করার উপায় নেই। ডাক্তার হলে হয়ত পারত।

ওটাকে ওখানেই থাকতে দাও। মেয়েটি বলল। অতঃপর সে তার স্বামীর নিকট থেকে যা তথ্য সংগ্রহ করেছে, সব মাজেদকে জানায়। তারপর বলল, আমরা যে হাব থেকে তথ্য নিয়ে পালিয়েছি, তা বোধ করি কেউ বুঝতে পারেনি। কাজেই ওদের পরিকল্পনায় কোন পরিবর্তন আসবে না। মোহাফেজরা পর্যন্ত জানে, আমার স্বামীর সন্দেহ, তোমার ও আমার মধ্যে ভালবাসার সম্পর্ক রয়েছে। তারা শুধু এ কথাই বলবে যে, তোমার ভালবাসার খাতিরেই আমি পালিয়েছি।

তথ্য বলা শেষ হলে মেয়েটি মাজেদের হাতে চুমো খেয়ে বলল- এবার আমি শান্তিতে মরতে পারব! পরক্ষণেই নিথর হয়ে আসে তার দেহ।

মাজেদ অপর ঘোড়াটি নিজের ঘোড়র সঙ্গে বেঁধে নিয়ে মেয়েটিকে নিজের ঘোড়ায় তুলে নেয়। মেয়েটিকে এমনভাবে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে রাখে, যাতে তীর তাকে কোন কষ্ট না দেয়।

***

মাজেদ হেজাজী যখন দামেস্কে তার কমান্ডার হাসান ইবনে আব্দুল্লাহর নিকট পৌঁছে, তখন মেয়েটি শহীদ হয়েছে অন্তত বার ঘন্টা অতিক্রম হয়েছে। মাজেদ হাব-এর রাজপ্রাসাদের পরিকল্পনার কথা বর্ণনা করে মাজেদ হেজাজী বলল, এর সবটুকু কৃতিত্ব এই মেয়েটির। হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ ততক্ষণে মাজেদ হেজাজীকে এবং মেয়েটির প্রাণহীন দেহটিকে সুলতান আইউবীর নিকট নিয়ে যান। মাজেদ হেজাজী মেয়েটির ইতিবৃত্ত বর্ণনা করে। সুলতান আইউবী মেয়েটির লাশ নুরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে বলেন, মেয়েটিকে সামরিক মর্যাদায় দাফন করার ব্যবস্থা করুন।

মৃত্যুর আগে মেয়েটি মাজেদ হেজাজীকে যে তথ্য দিয়েছিল, তা সংক্ষেপে নিম্নরূপ

খলীফা আল-মালিকুস সালিহ সকল মুসলিম রাষ্ট্রের আমীরদেরকে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেছেন এবং তাদের সেনাবাহিনীগুলোকে এক কমান্ডারের অধীনে নিয়ে আসতে চাচ্ছেন। ত্রিপোলীর খৃস্টান সম্রাট রেমন্ডের নিকট সাহায্যের আবেদন পাঠানো হয়েছিল আগেই। এই মেয়েটি নতুন যে তথ্য দিয়েছে, তাহল রেমন্ড তার বাহিনীকে এমনভাবে ব্যবহার করতে চায় যে, তারা মিশর ও সিরিয়ার মাঝখানে সুলতান আইউবীর রসদ ও সহযোগিতার জন্য আসা বাহিনীকে প্রতিহত করবে। রেমন্ড আন্দাজ করে নিয়েছে, যুদ্ধ বেঁধে গেলে সুলতান আইউবী মিশর থেকে সৈন্য তলব করবেন। তাছাড়া রেমন্ড সুলতান আইউবীকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলার জন্যও দ্রুতগামী অশ্বারোহী বাহিনী প্রস্তুত রাখবে। প্রয়োজন হলে সে অন্যান্য খৃস্টান সম্রাটদের কাছেও সাহায্যের আবেদন জানাবে। হাসান ইবনে সাব্বাহর ঘাতক বাহিনীর সঙ্গে সুলতান আইউবী হত্যার চুক্তি ও লেনদেন চূড়ান্ত হয়ে গেছে। ফেদায়ীরা দামেস্ক এসে পৌঁছল বলে।

পরিকল্পনার প্রতিটি অংশই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সুলতান আইউবী যে অংশটির প্রতি অধিক গুরুত্ব প্রদান করলেন, তাহল, দুশমন শীতের মওসুম শেষ হওয়ার পর আক্রমণ করবে। হাড়কাঁপানো শীত, প্রবল বর্ষণ ও বরফপাতের কারণে শীত মওসুমে এসব এলাকায় যুদ্ধ করা কঠিন ব্যাপার।

তারা সেনাসংখ্যা বৃদ্ধি করছে। সৈন্যরা দুর্গে অবস্থান নিয়ে থাকবে এবং আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। ঋতু পরিবর্তন হলেই তারা সিরিয়ায় হামলা করবে। খৃস্টান সম্রাট রেমন্ডকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, আইউবী বিরোধী যুদ্ধে সহযোগিতা করলে বিনিময় দেয়া হবে অনেক স্বর্ণমুদ্রা। রেমন্ড শর্ত দেয়, বিনিময় আগে পরিশোধ কর। আল-মালিকুস সালিহ ও তার অনুচররা রেমন্ডের শর্ত মেনে নেয়।

মুসলমানদের দুর্ভাগ্য- দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুলতান আইউবী বললেন মুসলমান আজ কাফেরদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে। প্রিয়নবীজির আত্মার এর চেয়ে বড় কষ্ট আর কী হতে পারে!

কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ তার রোজনামচায় লিখেছেন

আমার প্রিয় বন্ধু সালাহুদ্দীন আইউবী আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন না। কিন্তু যখন তাঁকে তথ্য প্রদান করা হল, খৃস্টানদেরকে আরব ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করে আপনি ইসলামী সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটানোর যে স্বপ্ন দেখছেন, খলীফা আল-মালিকুস সালিহ ও তার অনুগত মুসলিম আমীরগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আপনার সেই পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র করছে, তখন তিনি এতই আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেন যে, তেমনটা কখনো দেখিনি। তথ্যটি শোনামাত্র তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু নেমে আসে এবং তিনি কক্ষে পায়চারী শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে প্রবল আবেগঘন কণ্ঠে বললেন- এরা আমাদের ভাই নয়- শক্র। মুরতাদ ভাইকে হত্যা করা যদি পাপ হয়, তাহলে এই পাপ করে আমি পরজগতে জাহান্নামে যেতে প্রস্তুত আছি, তবু ইহজগতে ইসলামকে লাঞ্ছিত হতে দেব না। যেসব মুসলিম শাসক কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতায়, কাফেরদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ায়, তাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ। আমি জানি, এরা সবাই ক্ষমতা ও অর্থের লোভী। এরা ঈমান নীলাম করে ক্ষমতার নেশা পূরণ করতে চায়। সুলতান আইউবী তরবারীর হাতলে হাত রেখে বললেন, ওরা শীত মওসুমে লড়াই করতে রাজি নয়। বরফময় অঞ্চলে যুদ্ধ করতে ওরা ভয় পায়। কিন্তু আমি হাড় কাঁপানো কনকনে শীতের মধ্যেও যুদ্ধ করব। আমি বরফের স্তরজমা পর্বতচূড়ায় এবং তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সমুদ্রের মধ্যেও লড়াই করব…।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী বাস্তববাদী মানুষ ছিলেন। তিনি কখনো আবেগের কাছে পরাজিত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন না। তিনি সস্তা স্লোগানে বিশ্বাসী ছিলেন না। প্রতিটি সেনা ইউনিটের কমান্ডারদেরকে দফতরে ডেকে নিয়ে কাগজে দাগ টেনে নকশা এঁকে এবং যুদ্ধের ময়দানে মাটিতে আঙ্গুল দ্বারা রেখা টেনে নির্দেশনা প্রদান করতেন। কিন্তু সেদিন নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না তিনি। আবেগের নিকট পরাজিত হয়ে এমন সব কথা বলে ফেললেন, যা সচরাচর আম মজলিসে বলেন না।

তাওফীক জাওয়াদ!- সুলতান আইউবী দামেস্কের সেনা অধিনায়ককে উদ্দেশ করে বললেন- তোমার বাহিনী শীতের মধ্যে লড়াই করতে পারবে কিনা, তাতো এখনো জানা হল না। আমি কমান্ডারদেরকে রাতে এমন স্থানে হানা দেয়ার জন্য প্রেরণ করব, যেখানে তাদেরকে সমুদ্র অতিক্রম করে গমন করতে হবে। তখন প্রচণ্ড শীত থাকবে, বরফপাত হবে, বৃষ্টিও হতে পারে। কাজেই, চিন্তা-ভাবনা করে জবাব দাও।

আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, আমার সৈন্যদের মধ্যে জবা আছে- তাওফীক জাওয়াদ বললেন- তার একটি প্রমাণ হল, তারা আমার সঙ্গে আছে; আস-সালিহর সঙ্গে পালিয়ে যায়নি। আমার সৈনিকরা যুদ্ধের লক্ষ-উদ্দেশ্য বুঝে।

সৈনিকের মধ্যে যদি জযবা থাকে এবং তারা যদি যুদ্ধের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত থাকে, তাহলে তারা উত্তপ্ত বালুকাময় ময়দানে দাঁড়িয়েও যুদ্ধ করতে পারে। পারে জমাটবাঁধা বরফের উপর দাঁড়িয়েও।- সুলতান আইউবী বললেন- আল্লাহর সৈনিকদের ঠেকাতে না পারে মরুভূমির অগ্নি-উত্তাপ, না হীমশীতল বরফ।

সুলতান আইউবী সভার উপস্থিতিদের প্রতি একবার চোখ ঘুরিয়ে নিলেন এবং বললেন, ইতিহাস হয়ত আমাকে মাতাল বলবে। কিন্তু আমার স্থির সিদ্ধান্ত, ডিসেম্বর মাসে আমি যুদ্ধ শুরু করব। এই সিদ্ধান্ত থেকে কেউ আমাকে টলাতে পারবে না। তখন শীতের তীব্রতা থাকবে তুঙ্গে। পাহাড়-পর্বতের রং হবে সাদা বরফঢাকা। থাকবে হাড় কাঁপানো শীত। আপনারা সবাই কি আমার এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে প্রস্তুত আছেন?

সকলের সমবেত কণ্ঠে জবাব- আমরা প্রস্তুত, সুলতানের যে কোন সিদ্ধান্ত শিরোধার্য।

এবার সুলতান আইউবীর ঠোঁটে হাসি ফুঠে ওঠে। কণ্ঠ তার আবেগমুক্ত, ধীর-শান্ত। তিনি নির্দেশ দিতে শুরু করেন

আজ রাতেই সকল ফৌজ মহড়া শুরু করবে। সালার থেকে সিপাহী প্রত্যেকে আবরণমুক্ত থাকবে। কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত একখণ্ড কাপড় ছাড়া কারো গায়ে আর কোন পোশাক থাকবে না। নামাযের পরপর সকল সৈন্য পোশাক খুলে ব্যারাক থেকে বাইরে বেরিয়ে যাবে। সন্নিকটে অনেক ঝিল আছে। ফৌজ সেগুলোর মধ্যদিয়ে অতিক্রম করবে। আমাদের সামরিক ডাক্তারগণও তাদের সঙ্গে থাকবে। প্রথমদিকে সৈন্যরা ঠাণ্ডায় অসুস্থতার শিকার হতে পারে। ডাক্তারগণ তাদেরকে গরম কাপড়ে পেঁচিয়ে এবং আগুনের কাছে শুইয়ে দিয়ে চিকিৎসা করবে। আমার আশা, এই অসুস্থতার ঘটনা বেশী ঘটবে না। দিনের বেলা ডাক্তারগণ সৈন্যদের খোঁজ-খবর নেবে। প্রয়োজন হলে মিশর থেকে আরো ডাক্তার তলব করতে হবে।

১১৭৪ সালের নভেম্বর মাসের শুরুর দিক। এই সময়টায় রাতে প্রচণ্ড শীত পড়ে। সুলতান আইউবী রাতের বেলা সামরিক জুনিয়র কমান্ডারদের তলব করেন। তিনি তাদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ প্রদান করেন—

এবার তোমাদেরকে যে দুশমনের সঙ্গে লড়তে হবে,তাদেরকে দেখার পর তোমাদের তরবারী খাপ থেকে বাইরে বের হতে ইতস্তত করবে। কারণ, তারাও আল্লাহু আকবার স্লোগান তুলে তোমাদের সামনে আসবে। তাদের পতাকাও তোমাদের পতাকারই ন্যায় তারকাখচিত থাকবে। তারাও সেই কালেমা পাঠ করে, যা তোমরা পড়। তোমরা তাদেরকে মুসলমান মনে করবে; কিন্তু তারা মুরতাদ। আল্লাহু আকবার স্লোগান দিয়ে তোমাদের মুখোমুখি এসে তারা কোষ থেকে যে তরবারী বের করবে, তা খৃস্টবাদীদের সরবরাহ করা তরবারী। তাদের নীরে খৃস্টবাদীদের তীর। তোমরা ঈমানের প্রহরী আর তারা ঈমানের ব্যাপারী। সুলতান আস-সালিহ বাইতুলমালের সোনাদানা ও সমুদয় সম্পদ সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। সেই সম্পদ তিনি এই উদ্দেশ্যে ত্রিপোলীর খৃস্টান সম্রাটের হাতে তুলে দিয়েছে, যাতে সে তোমাদের পরাজিত করতে তাকে সামরিক সহযোগিতা দেয়। এই পরাজয় তোমাদের নয় ইসলামের। এই ধনভাণ্ডার কারো ব্যক্তিগত নয়- জাতির। এগুলো দেশের জনগণেরই প্রদত্ত যাকাতের অর্থ। সেই সম্পদ এখন মদ-বিলাসিতায় ব্যবহৃত হচ্ছে, সেই সম্পদ কাফেরদেরকে বন্ধু বানানোর কাজে ব্যয়িত হচ্ছে, তোমরা কি জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠনকারী এই দস্যুটাকে সুলতান মেনে নেবে?

সকলে সমস্বরে বলে উঠল, না, না, আমরা এমন লোকদের ক্ষমতার স্বপ্নসাধ চিরতরে মিটিয়ে দেব।

সুলতান আইউবী বললেন—

 আমি যে নীতিমালার ভিত্তিতে মিশরের ফৌজ গঠন করেছি, তা-ই তোমাদের সম্মুখে উপস্থাপন করতে চাই। আমার মৌলিক নীতি হল, দুশমনের অপেক্ষায় ঘরে বসে থাকা চলবে না। দুশমন আক্রমণ করলে আমি তা প্রতিহত করব, এটা কোন নীতি হতে পারে না। কুরআন আমাদেরকে যে, শিক্ষা প্রদান করেছে, তাহল, যুদ্ধ আছে তো লড়াই কর। যুদ্ধ নেই, যুদ্ধের প্রস্তুতিতে নিমগ্ন থাক। তোমরা যখনই টের পাবে যে, দুশমন তোমাদের উপর আক্রমণ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে, তোমরা দুশমনের উপর তখনই হামলা কর। স্মরণ রেখ! যারা মুসলমান নয়, তারা তোমাদের বন্ধু নয়। কাফের যদি তোমার পায়ে সেজদাও করে, তবু তাকে বন্ধু মনে কর না।

আমার দ্বিতীয় মূলনীতি হল, তোমরা ইসলামী সাম্রাজ্য ও দেশের জনগণের ইজ্জতের প্রহরী। তোমাদের শাসকগোষ্ঠী যদি আত্মমর্যাদা হারিয়ে ফেলে, জাতি যদি পাপ করতে করতে ধ্বংস হয়ে যায় এবং দুশমন তোমাদের উপর জয়ী হয়, তাহলে ভবিষ্যত প্রজন্ম বলবে, এই জাতির সৈন্যরা অযোগ্য ও দুর্বল ছিল। মনে রাখবে, জয়-পরাজয়ের সিদ্ধান্ত হয় যুদ্ধের মাঠে। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর বিলাস-প্রিয়তা ও স্বার্থপরতা দেশের সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে দেয়। কিন্তু পরাজয়ের দায় চাপানো হয় সেনাবাহিনীর কাঁধে। কাজেই, তোমাদের যে খলীফা ও শাসকগোষ্ঠী জাতিকে লাঞ্ছনায় নিক্ষিপ্ত করার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তাদেরকে উপযুক্ত শিক্ষা দাও। আমি যে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছি, তার রূপ কেমন হবে, তা আমি এই মুহূর্তে বলতে পারব না। আমি শুধু এটুকু জানি, একটি ভয়াবহ ও কঠিন যুদ্ধ সংঘটিত হবে। কঠিন এই অর্থে যে, আমি তোমাদেরকে চরম এক সংকটাপূর্ণ অবস্থায় লড়াচ্ছি। আরেক সমস্যা হল, তোমাদের সংখ্যা কম। সংখ্যার এই অভাব পুষিয়ে নিতে হবে জযবা ও ঈমানী শক্তি দ্বারা।

সুলতান আইউবী কমান্ডারদের এ-ও অবহিত কবেন যে, তোমাদের মধ্যে দুশমনের চর ঢুকে আছে। তারা কি কি পন্থায় কাজ করছে, তিনি তারও বিবরণ প্রদান করেন।

***

তোমরা বিশ্বাস কর না যে, সালাহুদ্দীন আইউবী মুসলমান- হাবে নিজ সৈন্যদেরকে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে এক আমীর বলল- খলীফার মর্যাদা একজন নবীর সমান। নাজমুদ্দীন আইউবীর এই মুরতাদ ছেলেটা খলীফাকে করে খেলাফত থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে এবং সিরিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নিয়ে মিশর ও সিরিয়ার রাজা হয়ে বসেছে। তোমরা যদি খোদার আজাব-গযব থেকে রক্ষা পেতে চাও, প্রলয়ংকারী ভূমিকম্প ও ব্যাপক বিধ্বংসী জলোচ্ছাস থেকে নিরাপদ থাকতে চাও, তাহলে সালাহুদ্দীন আইউবীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে সালতানাতের গদি ফিরিয়ে আন। শীতকাল শেষ হলেই আমরা দামেস্কে আক্রমণ করব। তার আগে আমরা সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করব এবং তোমরা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে নিতে থাক।

একটি জাতির চরিত্র ও চিন্তা-চেতনা ধ্বংস করতে না পারলে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়লাভ করা যায় না- আল-মালিকুস সালিহর নিকট রেমন্ড কর্তৃক প্রেরিত খৃস্টান সেনাবাহিনীর এক সামরিক উপদেষ্টা বলল- আমরা তোমাদের এলাকায় এসে যুদ্ধ করব না। আইউবীর সাহায্যে মিশর থেকে যে বিশেষ ফোর্স আগমন করবে, আমরা পথে তাদেরকে প্রতিহত করব এবং সুযোগমত আইউবীকে কোথাও ঘিরে ফেলব। আপনার বাহিনী দামেস্কে হামলা করবে। শীতের মওসুমে না আপনি হামলা করতে পারবেন না- না আইউবী। এই সময়টাকে আপনি কাজে লাগান। আমি যে আশংকা অনুভব করছি, তাহল, আপনার জাতি আপসে লড়াই করতে ইতস্তত করতে পারে। আপনি আপনার নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোর জনগণকে সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলুন। এর জন্য উত্তম হাতিয়ার হল আপনার ধর্ম ও কুরআন। এই লক্ষ্য অর্জনে আপনি ধর্ম, কুরআন ও মসজিদকে ব্যবহার করুন। মুসলমানদের নিকট ধর্ম একটি স্পর্শকাতর বিষয়। তারা ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু শুনলে অমনি উত্তেজিত হয়ে ওঠে। আপনি সহযোগিতা করলে আমরা দামেস্কেও এ লক্ষ্যে কাজ করতে পারি।

পাঁচ পাঁচটি বছর কেটে গেল; কিন্তু আমরা সালাহুদ্দীন আইউবীকে খুন করতে পারলাম না! লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে আসে- সুলতান আইউবীকে হত্যার জন্য গমনকারী ফেদায়ী ঘাতক বলল- আইউবীর উপর আমাদের চারটি হামলা ব্যর্থ হয়েছে। তাও এত শোচনীয়ভাবে যে, তাতে আমাদের কিছু লোক মারা গেছে এবং গ্রেফতার হয়েছে। হাসান ইবনে সাব্বাহর আত্মা আমাকে তিরষ্কার করছে- তুমি কি আইউবীকে বিষ খাইয়ে হত্যা করতে পারলে না? তুমি কি লুকিয়ে কোথাও তাকে তীরের নিশানা বানাতে পারলে না? তুমি কি মৃত্যুর ভয়ে ভীত? তুমি আমার সঙ্গে কী বলে অঙ্গীকার করেছিলে, তা কি ভুলে গেছ? কাজেই আমি এখন আর এক মুহূর্তের জন্যও একথা শুনতে চাই না যে, সালাহুদ্দীন আইউবী জীবিত।

তিনি আর বেশীদিন জীবিত থাকবেন না। এক ফেদায়ী বলল। তাঁর সঙ্গীরা তার বক্তব্যে সমর্থন ব্যক্ত করল।

সুলতান আইউবী দামেস্ক আগমনের সময় তাঁর ভাই আল-আদেলকে মিসরের সেনাবাহিনীর প্রধান অধিনায়ক নিযুক্ত করে আসেন। তিনি তাকে নির্দেশ দিয়ে আসেন যে, সেনাভর্তি বেগবান করে তোল এবং সামরিক মহড়া অব্যাহত রাখ। তিনি তাকে সুদানের ব্যাপারেও সতর্ক করে আসেন এবং বলে আসেন, সুদানের পক্ষ থেকে সামান্যতম সামরিক তৎপরতা যদি চোখে পড়ে, তাহলে তুমি ব্যাপকহারে সেনা অভিযান পরিচালনা করবে।

সুলতান আইউবী তার ভাইকে সদা রিজার্ভ বাহিনী ও রসদ প্রস্তুত রাখতে নির্দেশ দিয়ে আসেন। দামেস্কের অভিযান সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছুই বলা যাচ্ছিল না, পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে। এখন সুলতান যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন, তাতে তার সেনা সহযোগিতার প্রয়োজন। কিন্তু গুপ্তচর মাজেদ হেজাজীর সংগৃহীত তথ্য মোতাবেক খৃস্টান সম্রাট রেমন্ড মিশর ও সিরিয়ার মধ্যস্থলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সুলতান আইউবীর রিজার্ভ সেনা ও রসদ আগমন প্রতিহত করবে- এই তথ্যের ভিত্তিতে সুলতান আইউবী সময়ের আগেই মিশর থেকে স্পেশাল ফোর্স ও রসদ এনে রাখা আবশ্যক মনে করেন। এই বাহিনীকে শীতের মধ্যে যুদ্ধ করার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তিনি দীর্ঘ একটি বার্তাসহ একজন দূতকে কায়রো প্রেরণ করেন।

পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য কতজন করে পাঠাতে হবে সুলতান পত্রে তাও উল্লেখ করেন। সঙ্গে এই নির্দেশনাও প্রদান করেন যে, সকল সৈন্য যেন একত্রে না আসে। বরং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে রাতের বেলা একদল অপরদল থেকে দূরত্ব বজায় রেখে পথ চলবে। দিনে সফর বন্ধ রাখবে। এই ফোর্স আগমন যথাসম্ভব গোপন রাখবে।

 আল-আদেল তাঁর ভাই সালাহুদ্দীন আইউবীরই হাতে গড়া। পয়গাম পাওয়ামাত্র তিনি বাহিনী রওনা করিয়ে দেন এবং বিষয়টা গোপন রাখার জন্য পন্থা অবলম্বন করেন যে, কয়েকজন সেনা সদস্যকে ছদ্মবেশে উটে চড়িয়ে এই নির্দেশনা দিয়ে রাস্তায় পাঠিয়ে দেন, তোমরা ডানে-বাঁয়ে ছড়িয়ে গিয়ে পরস্পর দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করবে। কোন সন্দেহভাজন লোক দেখলে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। প্রয়োজন বোধ করলে গ্রেফতার করে ফেলবে।

বাহিনীর সৈন্যরা দিন কয়েক পরই দামেস্ক পৌঁছতে শুরু করে। সুলতান আইউবী তাদেরকেও রাতের প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। তার সঙ্গে তিনি নতুন ভর্তিরও নির্দেশ জারি করেন।

***

দামস্কের প্রত্যন্ত এলাকা। ঘন বনজঙ্গল আর খানাখন্দকে ভরা গোটা অঞ্চ সেখানে শত শত বছরের পুরাতন একটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান। তার অভ্যন্তরে কেউ কখনো অনুপ্রবেশ করেছে বলে জানা যায়নি। রাতে মানুষ তার পাশ দিয়েও হাঁটে না। দুৰ্গটা এক সময় সামরিক কাজে ব্যবহৃত হলেও এখন তা ব্যবহারের অনুপযুক্ত। যোগাযোগের ক্ষেত্রেও স্থানটি অনুপযোগী। সে কারণে দেশের সামরিক বাহিনীর কখনো সেদিকে চোখ যায়নি। সুলতান আইউবীর আমলে দামেস্কের প্রতিরক্ষার জন্য অন্যত্র একটি দুর্গ তৈরি করে নেয়া হয়েছিল। এই পুরাতন দুর্গটি সর্পকেল্লা নামে পরিচিত। কথিত ছিল যে, দুর্গের ভেতর এক জোড়া নাগ-নাগিনী বাস করে। তাদের বয়স হাজার বছর পেরিয়ে গেছে। এও বলা হত যে, দুর্গটি সেকান্দারে আজম নির্মাণ করেছিলেন। কারো মতে, ইরানের বাদশা দারা এর নির্মাতা। অনেকের মতে, দুর্গটি তৈরি করেছিল বনী ইসরাঈল।

 সে যা হোক, এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে, কয়েকশ বছর আগে এখানে এক পারস্য রাজা আগমন করেছিলেন। জায়গাটা তার পছন্দ হয়ে গেলে তিনি এখানে এই দুর্গটি নির্মাণ করেন এবং তার অভ্যন্তরে নিজের জন্য একটি মনোরম মহল তৈরি করেন। কিন্তু মহলটি আবাদ করার জন্য তার কোন স্ত্রী ছিল না। খুঁজে পেতে তিনি এক রাখাল কন্যাকে পছন্দ করেন। কিন্তু মেয়েটি ছিল অন্য এক যুবকের বাগদত্তা। দুজনের মধ্যে ছিল গভীর ভালবাসা। রাজা মেয়েটির পিতামাতাকে অগাধ সম্পদ দিয়ে বাগিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে নেয়। যুবক বাদশার নিকট এসে বলল, মহারাজ! শখ করে মহল নির্মাণ করেছেন এবং আমার বাগদত্তা প্রেমিকাকে ছিনিয়ে এনেছেন। কিন্তু এই দুর্গে বাস করা আপনার কপালে জুটবে না। আপনি এখানে থাকতে পারবেন না। যুবকের কথায় বাদশা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে দুর্গে নিয়ে হত্যা করে ফেলে এবং লাশটা নিকটেই এক স্থানে পুঁতে রাখে। অপরদিকে মেয়েটি বাদশাকে বলল, আপনি আমার দেহটা ক্রয় করেছেন, আমার হৃদয়টাকে কখনোই আপনি দখল করতে পারবেন না।

বাদশাহ রাখাল কন্যাকে রাজকীয় সাজে সাজিয়ে প্রথম দিনের মতো মহলে প্রবেশ করেন। সঙ্গে সঙ্গে মহলের মেঝে ধসে যায়, ছাদ ও দেয়াল তাদের খার উপর ভেঙ্গে পড়ে। দুজনই মহলের ছাদ ও দেয়াল চাপা পড়ে মারা যায়। বাদশাহর সেনাদল ছুটে এসে মহলের ধ্বংসাবশেষ সরাতে শুরু করে। এসময় ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে দুটি নাগ বেরিয়ে আসে। সেনারা তাদেরকে তীর-ধনুক আর তরবারী দ্বারা মারার চেষ্টা করে। কিন্তু নাগ দুটোর গায়ে না লাগে বর্শা, না বিদ্ধ হয় তীর, না আঘাত হানে তরবারী। বাদশার সেনাদল ভয়ে পালিয়ে যায়। এ কথাও প্রসিদ্ধ ছিল যে, এখনো রাতের বেলা দুর্গের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলে রাখালের পোশাক পরিহিত একটি মেয়েকে ভেড়া চড়াতে দেখা যায়। মাঝে-মধ্যে একটি যুবক চোখে পড়ে। এক কথায়, সবাই বিশ্বাস করত যে, দুৰ্গটা জ্বিন-পরীর আবাস।

সুলতান আইউবী যে সময়টায় খলীফা ও আমীরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলেন, ঠিক তখন দামেস্কে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, সর্পকেল্লায় এক বুজুর্গ আত্মপ্রকাশ করেছেন, যিনি দুআ করলে মানুষের সব রোগ ভাল হয়ে যায় এবং তিনি ভবিষ্যতের সংবাদ বলে দিতে পারেন। কে একজন শহরে সংবাদটা বলামা মুহূর্তের মধ্যে দাবানলের ন্যয় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে তাকে ইমাম মাহদী আখ্যা দিতে ভুল করেনি। মানুষ সেখানে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আবার এই ভয়ে পিছিয়ে যায় যে, ওটা রাখালের কন্যা ও তার বাগদত্তার কিংবা পারস্যের রাজার প্রেতাত্মা কিনা! নাকি জ্বিন-ভুতের কারসাজি। অনেকে দূরে দাঁড়িয়ে দুর্গের দিকে তাকায়, কিছু দেখা যায় কিনা। জনা তিন-চারেক লোক দাবি করে, তারা কালো দাড়ি ও সাদা চোগা পরিহিত এক ব্যক্তিকে দুর্গের বাইরে আসতে এবং সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ঢুকে যেতে দেখেছে। মানুষ বুজুর্গের কারামত নিয়ে বলাবলি করছে। কিন্তু এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, যে বলবে, আমি দুর্গের ভেতরে প্রবেশ করেছি এবং বুজুর্গ লোকটি আমার জন্য দুআ করেছেন।

একদিনের ঘটনা। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর রক্ষী বাহিনীর এক সিপাহী ডিউটি পালন শেষে বাইরে ঘোরাফেরা করছিল। লোকটার সুদর্শন চেহারা, সুঠাম দেহ। তাঁগড়া যুবক। হঠাৎ সম্মুখ থেকে নূরানী চেহারার এক ব্যক্তি এগিয়ে আসে। মুখে কালো দাড়ি, পরনে সাদা চোগা, মাথায় অতীব আকর্ষণীয় পাগড়ি, হাতে তসবীহ। সিপাহীর সামনে এসেই লোকটি দাঁড়িয়ে যায়। হাত বাড়িয়ে চিবুক ধরে সামান্য উপরে তুলে আবার ছেড়ে দেয়। তারপর ক্ষীণকণ্ঠে বলল, আমি কখনো ভুল করি না; তোমার বাড়ি কোথায় দোস্ত?

বাগদাদ- মিষ্টি ভাষায় সিপাহী জবাব দেয়- আপনি আমাকে চেচেন নাকি?

হ্যাঁ, দোস্ত! আমি তোমাকে চিনি- আগন্তুক জবাব দেয়। তবে বোধ হয়। তুমি নিজেকে চেন না।

লোকটি যে ধারায় কথা বলছে, তাতে সিপাহী প্রভাবিত হয়ে পড়ে। বস্তুত তার নূরানী চেহারা, আকর্ষণীয় দাড়ি, সাদা পোশাক ও পাগড়ী যে কোন মানুষকে প্রভাবিত না করে পারে না। এসব না থাকলে হয়ত সিপাহী তাকে মাতাল বলে এড়িয়ে যেত। কিন্তু লোকটার ভাবভঙ্গি, পোশাক-পরিচ্ছদ ও কথার ধরণ সুলতান আইউবীর সৈনিককে কাবু করে ফেলে।

আচ্ছা, তুকি কি তোমার পূর্বপুরুষকে জান, তারা কারা ছিলেন এবং কী ছিলেন? লোকটি সিপাহীকে জিজ্ঞেস করে।

না! সিপাহী জবাব দেয়।

দাদার কথা জান না?

না।

তোমার পিতা বেঁচে আছেন?

না।- সিপাহী জাৰাব দেয়- আমি যখন দুধের শিশু, তখনই তিনি মারা যান।

তোমার পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ কি রাজা ছিলেন?- আগুন্তুক জিজ্ঞেস করে- পরদাদা?

কেউ নয়, সিপাহী জবাব দেয়- আমি কোন রাজবংশের সন্তান নই। আমি সুলতান সালাহউদ্দীন আইউবীর রক্ষী বাহিনীর একজন সাধারণ সৈনিক। আপনি বোধ হয় ভুল করছেন। আমার গঠন-আকৃতির সঙ্গে আপনার পুরনো কোন বন্ধুর মিল আছে হয়ত। আপনি আমাকে অন্য কেউ মনে করেছেন।

লোকটি এমন ভাব দেখায়, যেন সে সিপাহীর কথাটা শুনেইনি। তার হাত ধরে ডান হাতের তালুর রেখাগুলো গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে। তারপর তার কাঁধে হাত রেখে মাথাটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে ঝুঁকে তার মুখমণ্ডলের প্রতি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মধুর ভাষায় ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে বলে- তবে এই সিংহাসনে আমি কাকে দেখতে পাচ্ছি। এই মুকুটটার মালিক কে? তোমাকে কে বলল, তুমি রাজবংশের সন্তান নও? আমার বিদ্যা আমাকে ধোকা দিতে পারে না। আমার চোখ ভুল দেখতে পারে না। আচ্ছা, তুমি কি বিয়ে করেছ

না। সিপাই ভয়ার্ত কণ্ঠে জবাব দেয়- বংশের একটি মেয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা চূড়ান্ত হয়ে আছে।

হবে না লোকটি বলল- এই বিয়ে হবে না।

কেন? চকিত হয়ে সিপাহী প্রশ্ন কর।

তোমার জুড়ি অন্য কোথাও লোকটি বলল- কিন্তু মেয়েটি অন্যত্র আটক পড়ে আছে। শোন বন্ধু! তুমি মজলুম, প্রতাণার শিকার। তুমি বিভ্রান্ত। তোমার ধনভাণ্ডারের উপর সাপ বসে আছে। একজন রাজকন্যা তোমার পথপানে তাকিয়ে আছে। কেউ যদি তোমাকে তথ্য প্রদান করে, মেয়েটি কোথায়, তাহলে কি তুমি জীবনের বাজি রেখে তাকে উদ্ধার করবে?

এই বলে লোকটি যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে হাঁটা দেয়।

 সিপাহী ছুটে গিয়ে তার পথরোধ করে দাঁড়ায় এবং বলে- আমার হাত ও চোখে আপনি কী দেখেছেন? আপনি কে? কোথা থেকে এসেছেন? আপনি আমাকে কেন বিভ্রান্ত ও অস্থির করে চলে যাচ্ছেন!

আমি কিছুই নই লোকটি জবাব দেয়- আমার আল্লাহর সত্ত্বাই সবকিছু। গোটা তিন-চারেক মহান পবিত্র আত্মা আমার হাতে আছে। এরা আল্লাহ পাকের সেই প্রিয়জনদের আত্মা, যারা অতীত ও ভবিষ্যতকে সমানভাবে জানতেন। আমি কিছু অজিফা পালন করি। এক রাতে আমি নির্দেশ পাই যে, তুমি সর্পকেল্লায় চলে যাও। একব্যক্তি তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছেন। ওখানে যেতে আমি ভয় পেতাম। কিন্তু এটা খোদার নির্দেশ। কাজেই এখন আর ভয় কিসের। আমি সর্পকেল্লায় চলে গেলাম। প্রথম রাতেই অজিফা যপকালে আত্মাগুলো পেয়ে যাই। তারা আমাকে এমন শক্তি দান করে যে, আমি মানুষের চেহারা ও চোখের প্রতি তাকালে তাদের দাদা ও পরদাদার ছবি দেখতে পাই। কিন্তু এই অবস্থা সবসময় থাকে না। মাঝে-মধ্যে দেখা যায়। তোমাকে দেখামাত্র আমার কানে একটি আত্মার কণ্ঠ ভেসে আসে। এই যুবকটিকে দেখ! ছেলেটা রাজপুত্র। কিন্তু সে তার ভাগ্যলিপি সম্পর্কে অনবহিত। রাজপুত্র হওয়া সত্ত্বেও সে সিপাহী বেশ ধারণ করে অন্যের সুরক্ষার জন্য পাহারাদারী করে। এখন আমার সেই অস্বাভাবিক অবস্থা চলে গেছে, এখন আমি তোমাকে একজন সিপাহীরূপেই দেখছি। আমি জ্যোতিষী নই, গায়েবও জানি না। আমি একজন দরবেশ মাত্র। আল্লাহ-বিল্লাহ করে দিন কাটাই। কিন্তু তারপরও আবদার যখন করেছ, কিছু জানার চেষ্টা করব এবং আমি যেখানকার কথা বলি, তোমাকে সেখানে যেতে হবে। পারবে বেটা?

হ্যাঁ, পারব! আপনি যথায় বলেন, তথায়ই গিয়ে আমি হাজির হব।

সর্পকেল্লায় এসে পড়।

 ঠিক আছে আসব, অবশ্যই আসব।

 পাকসাফ হয়ে মন-মস্তিষ্ককে দুনিয়ার ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্ত করে আসবে। খবরদার, কাউকে বলবে না, আমার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল এবং রাতে তুমি কোথাও যাচ্ছ। একদম চুপি চুপি এসে পড়বে। বলল লোকটি।

***

ধনভাণ্ডার, রাজকন্যা ও সিংহাসনের লোভে না পেলে সুলতান আইউবীর এই সৈনিক যত সাহসীই হোক রাত্রিকালে স্বৰ্পকেল্লায় যেত না। রাতের শেষ প্রহরে সুলতান আইউবীর বাসগৃহের পেছন দরজায় তার পাহারা ছিল। তার পূর্ব পর্যন্ত পুরো রাত তার ঘোরাফেরা করার সুযোগ রয়েছে। রাত খানিকটা গম্ভীর হলে সিপাহী চুপি চুপি স্বৰ্পকেল্লা অভিমুখে হাঁটা দেয়। কেল্লার দ্বার পর্যন্ত পৌঁছামাত্র ভয়ে তার গা ছমছম করে ওঠে। দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে বলে- আমি এসে গেছি, আপনি কোথায়?

তাকে বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। কোথা থেকে একটি মশাল বেরিয়ে আসে এবং তার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। তার মনের ভয় আরো বেড়ে যায়। সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়ে ওঠে। মশালটি এক ব্যক্তির হাতে। লোকটি নিকটে এসে সিপাহীকে জিজ্ঞেস করে, হযরত আজ পথে কোথাও কাকে দেখেছিল, তুমিই কি সেই লোক?

সিপাহী বলল, হ্যাঁ, আমিই সেই লোক।

 মশালবাহী লোকটি বলল, আমার পেছনে পেছনে আস।

তুমি কি মানুষ? ভয়জড়িত কণ্ঠে সিপাহী তাকে জিজ্ঞেস করে।

তুমি চোখে যা দেখছ, আমি তা-ই। মন থেকে ভীতি দূর করে ফেল। মাথা থেকে সব দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেল। চুপচাপ আমার পেছনে পেছনে আস মশালবাহী লোকটি সম্মুখের দিকে হাঁটছে আর কথা বলছে- তুমি হযরতকে কোন কথা জিজ্ঞেস করবে না। তিনি যা নির্দেশ দেন, তা-ই করবে।

ঘোর অন্ধকার। ছাদটকা আঁকা-বাঁকা সরু পথ। ডান-বাম করে কয়েকটি রাস্তা অতিক্রম করে মশালবাহী লোকটি একটি দরজার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায় এবং উচ্চস্বরে বলে, হযরত! অনুমতি হলে তাকে নিয়ে আসি। ভেতর থেকে জবাব আসে, আস। মশালবাহী একদিকে সরে যায় এবং সিপাহীকে ইঙ্গিতে বলে, যাও, ভেতরে চলে যাও।

সিপাহী ভেতরে ঢুকে পড়ে। কিন্তু কী আশ্চর্য! এই ভয়ানক স্থানে আকর্ষণীয় মহামূল্যবান জিনিসপত্রে সাজানো মনোরম এক কক্ষ যুগপৎ বিস্ময় ও ভীতি চেপে ধরে সিপাহীকে। একধারে অদৃশ্যপূর্ব কারুকার্যখচিত নয়ন মাতানো একটি পালংক। তাতে ততোধিক মনোহরী জাজিম বিছানো। তার উপর তাকিয়ায় হেলান দিয়ে গুরুগম্ভীর মুখে বসে আছে সেই ব্যক্তি। চোখ বন্ধ করে তাসবীহ যপ করছে লোকটি। সে-ই ইঙ্গিতে সিপাহীকে বসতে বলল। সিপাহী বসে যায়। মন মাতানো সুগন্ধিতে মৌ মৌ করছে কক্ষটি।

হযরত চোখ খোলেন, সিপাহীর প্রতি তাকান এবং হাতের তাসবীহটি ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, গলায় পরে নাও। সিপাহী তসবীহটি হাতে নিয়ে চুমো খায়। তারপর গলায় পরিধান করে নেয়। কক্ষে মিটমিট করে একটি প্রদীপ জ্বলছে। হযরত হাত তালি দেন। সঙ্গে সঙ্গে পাশের আরেকটি কক্ষের দরজা খুলে যায়। একটি মেয়ে বেরিয়ে আসে। অপরূপ সুন্দরী এক যুবতী। মাথার চুলগুলো খোলা। সোনালি তারের ন্যায় ঝিকমিক করছে। চুলগুলো ছড়িয়ে আছে দুকাঁধের উপর। এমন রূপসী মেয়ে এর আগে কখনো সিপাহী দেখেনি। মেয়েটির হাতে সুদর্শন একটি পেয়ালা। পেয়ালাটা সিপাহীর তাতে দেয় সে। হযরত বসা থেকে উঠে দাঁড়ান। চলে যান অন্য কক্ষে। সিপাহী পেয়ালাটা হাতে নিয়ে একবার মেয়েটির প্রতি একবার পেয়ালার প্রতি দৃষ্টিপাত করছে। মুখ খুলে মেয়েটি। বলল- হযরতের আসতে একটু দেরী হবে। তুমি এগুলো পান কর। মেয়েটির ঠোঁটে হাসি- মন মাতানো অকৃত্রিম হাসি। সিপাহী পেয়ালাটা ঠোঁটের সঙ্গে লাগায় এবং এক ঢোক পান করে মেয়েটির প্রতি তাকায়।

তোমার মতো সুশ্রী যুবক আমি মাঝে-মধ্যে দেখি- সিপাহীর কাঁধে হাত রেখে মেয়েটি বলল- পান কর! এই শরবত আমি তোমার জন্য মনের মাধুরি মিশিয়ে তৈরি করে এনেছি। হযরত আমাকে বলেছিলেন, আজ রাতে তোমার পছন্দের এক যুবক আসবে; কিন্তু আমি ছেলেটার পরিচয় জানি না।

সিপাহী প্রথমে থেমে থেমে দুতিন চুমুক পান করে। তারপর ঢক ঢক করে গিলতে শুরু করে। পেয়ালাটা শূন্য হয়ে যায়। মেয়েটি ধীরে ধীরে সিপাহীর একেবারে গা ঘেঁষে বসে। সিপাহী অনুভব করে, মেয়েটি তার তেলেসমাতী রূপ আর জাদুকরী দেহটা নিয়ে শরবতের ন্যায় তার কণ্ঠনালী অতিক্রম করে শিরায় শিরায় মিশে গেছে।

হযরত ফিরে এসেছেন। তার হাতে কাঁচের একটি বল, আকারে যেন একটি নাশপতী। তিনি বলটি সিপাহীর হাতে দিয়ে বললেন, এটি চোখের সামনে ধর। এর ভেতর দিয়ে প্রদীপের শিখার দিকে তাকাও এবং তাকিয়ে থাক।

সিপাহী কাঁচের বলটির মধ্যদিয়ে প্রদীপের দিকে তাকায়। তাতে চোখের সামনে কয়েকটি রংও শিখায় দেখতে পায়। মেয়েটির রেশমী এলোমেলো চুল তার গন্ত স্পর্শ করেছে। মেয়েটি তাকে এমনভাবে বাহুবন্ধনে আগলে রেখেছে যে, সিপাহী তার দেহের উষ্ণতা ও সুবাস অনুভব করছে। এবার তার কানে জাদুকরী এক সুরেলা কণ্ঠ ভেসে আসতে শুরু করে- আমি সুলায়মানের সিংহাসন দেখতে পাচ্ছি। আমি সুলায়মানের সিংহাসন দেখতি পাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর্যন্ত সে অনুভব করে কণ্ঠটা হযরতের। কিন্তু পরক্ষণেই সেটি তার নিজের কণ্ঠে পরিণত হয়ে যায়। সিপাহী এখন সেই জগতের বাসিন্দা, যা সে কাঁচের বলের মধ্যদিয়ে দেখছিল। সিপাহী সুলায়মানের সিংহাসন দেখতে পাচ্ছে। নূরানী চেহারার এক বাদশাহ তার উপর বসে আছেন। তার ডানে বামে ও পেছনে চার-পাঁচটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েগুলো এতই রূপসী যে, মনে হচ্ছে হুর-পরী।

হ্যাঁ হ্যাঁ- সিপাহী বলে ওঠল- আমি সুলায়মানের সিংহাসন দেখতে পাচ্ছি।

মেয়েটির বিক্ষিপ্ত চুলগুলো সিপাহীর বুকে-পিঠে ছড়িয়ে পড়েছে। সিপাহী কাঁচের মধ্যে দেখছে, সুলায়মানী সিংহাসনের নিকটে দাঁড়িয়ে এক ব্যক্তি বলছে- এই রাজা তোমার দাদা, যিনি সাত রাজ্যের বাদশাহ। সুলায়মান বাদশাহর জিন-পরীরা তার দরবারে সিজদা করে। তুমি তোমার দাদাকে চিনে নাও। এই সিংহাসন তোমার উত্তরাধিকার সম্পদ।

সিংহাসনটা সিপাহীর চোখের সম্মুখ থেকে সরে যেতে শুরু করে। সিপাহী চীৎকার করে ওঠে- উনি সিংহাসন নিয়ে গেলেন। ওরা দৈত্য। অনেক বড় বড়। ওরা সিংহাসনটা তুলে নিয়ে যাচ্ছে।

এখন কাঁচের বলের মধ্যে কয়েক বর্ণের কতগুলো শিখা রয়ে গেছে শুধু। শিখাগুলো তিরতির করে কাঁপছে, যেন উদ্বেলিত হয়ে নাচছে। সিপাহী অনুভব করে, যেন কোন বস্তু তার নাকের সঙ্গে লেপটে আছে। কাঁচের বলটি তার চোখের সামনে থেকে আপনা-আপনি সরে যায়। সিপাহী তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

 তন্দ্রাভাব কেটে যায় সিপাহীর। এখন সে প্রকৃতিস্থ। মেয়েটি তার মাথায় হাত বুলাচ্ছে। চোখ খুলে দেখতে পায়, সে জাজিমের উপর বসে আছে। মেয়েটির একটি বাহু তার মাথার নীচে। মেয়েটি আধা শোয়া আধা বসা। সিপাহী উঠে বসে। রাজ্যের বিস্ময় তার মাথায়, বেজায় অস্থির। তার মুখ থেকে প্রথম কথা বের হয়। তিনি বলছিলেন, এটি তোমার দাদার সিংহাসন। এটি তোমার পৈত্রিক সম্পদ।

হরতও একথাই বলেছেন। মেয়েটি অত্যন্ত কোমল ও আন্তরিক কণ্ঠে বলল।

হযরত কোথায়? সিপাহী জিজ্ঞেস করে।

 তিনি আজ আর তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন না। মেয়েটি জবাব দেয়।

 তুমি বলেছিলে রাতের শেষ প্রহরে তোমার ডিউটি আছে। সেজন্য আমি তোমাকে জাগিয়ে দিলাম। এখন মধ্যরাত। তুমি এবার চলে যাও।

সিপাহী ওখান থেকে উঠতে চাচ্ছে না। সে মেয়েটির নিকট জানতে চায় আমি স্বপ্ন দেখলাম, না বাস্তব।

মেয়েটি বলল- না, তুমি স্বপ্ন দেখনি, এটা হযরতের বিশেষ কেরামত। তার প্রতি নির্দেশ, তিনি কোন ভেদ নিজের কাছে রাখতে পারবেন না। যার ভেদ তার নিকট পৌঁছিয়ে দেবেন। কিন্তু এই হালত তার মাঝে-মধ্যে দেখা যায়, সব সময় থাকে না। আবার কখন দেখা দেবে বলতে পারব না।

সিপাহী মেয়েটির কাছে অনুনয়-বিনয় করতে শুরু করে। মেয়েটি বলল, তুমি আমার হৃদয়ে গেঁথে গেছ। আমার আত্মাটা আমি তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। আমি প্রয়োজন হলে তোমার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেব। আমি তোমাকে কোনদিন যেতে দেব না। কিন্তু তোমার কর্তব্য পালন করাও তো জরুরী। এখন চলে যাও। আগামী রাতে আবার এস। আমি হযরতকে ব, যেন তিনি তোমার ভেদ তোমাকে দিয়ে দেন।

সিপাহী দুর্গ থেকে বের হয়। তার পা উঠছে না। তার মস্তিষ্কে দাদার তখতে সুলায়মানী জেঁকে বসেছে। হৃদয়টা দখল করে আছে মেয়েটা। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার রাত। কিন্তু দুর্গের ধ্বংসস্তূপটা তার কাছে রাজমহলের ন্যায় হৃদয়কাড়া মনে হচ্ছে। আনন্দের ঢেউ খেলছে তার মনে। এখন তার মনে কোন ভীতি নেই, অস্থিরতা নেই।

***

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর পূর্ণ দৃষ্টি সৈন্যদের প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধ পরিকল্পনায় নিবদ্ধ। তিনি নিজের ও ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের আরাম হারাম করে রেখেছেন। ইন্টেলিজেন্স ইনচার্জ হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ শত কর্মব্যস্ততার মধ্যে এ চিন্তাও মাথায় রেখেছেন যে, সুলতান আইউবী নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে সবসময় উদাসীন থাকেন। তার দেহরক্ষী কমান্ডার একাধিকবার হাসান ইবনে আব্দুল্লাহর নিকট অভিযোগ করেছেন যে, সুলতান অনেক সময় তাকে কিছু না জানিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে যান এবং তিনি ভেতরে আছেন মনে করে আমরা শূন্যকক্ষ পাহারা দেই। কমান্ডার সুলতান আইউবীর সঙ্গে দু-চারজন গার্ড ছায়ার মত জড়িয়ে রাখতে চায়। কমান্ডারকে সতর্ক করা হয়েছিল যে, ফেদায়ী ঘাতকদল পূর্ণ প্রস্তুতি সহকারে সুলতান আইউবীকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে দামেস্কে ঢুকেছে। এই সংবাদ কমান্ডারকে আরো বেশী পেরেশান করে তুলে। কিন্তু সুলতান আইউবী নিজে এতই বেপরোয়া যে, হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ যখন তাকে বললেন, মহামান্য সুলতান! আপনি কখনো গার্ড ছাড়া বের হবেন না। তখন সুলতান মুখে মুচকি হাসি টেনে তার পিঠ চাপড়ে বলেন, আমাদের প্রত্যেকের জীবন আল্লাহর হাতে। রক্ষীদের উপস্থিতিতে খুন করার উদ্দেশ্যে আমার উপর চারবার হামলা, হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর অভিপ্রায় ছিল, আমি আরো কদিন বেঁচে থাকব। আমি আল্লাহর পথে চলছি। তিনি যদি ভিন্ন কিছু কামনা করেন, তাহলে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমরা কিছুই করতে পারব না। মোহাফেজরা পারবে না আমার মৃত্যু ঠেকিয়ে রাখতে।

কিন্তু তারপরও মোহতারাম সুলতান!- হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ বললেন আমার এবং রক্ষী বাহিনীর কর্তব্য তো এমন যে, আমরা আপনার বিশ্বাস ও আবেগের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারি না। আমি ফেদায়ীদের সম্পর্কে যে তথ্য পেয়েছি, তাতে রাতেও আমাকে আপনার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত।

আমি তোমার ও তোমার রক্ষী বাহিনীর কর্তব্যবোধকে শ্রদ্ধা করি সুলতান আইউবী বললেন- কিন্তু যখন আমি মোহাফেজবেষ্টিত হয়ে বাইরে বের হই, তখন আমার নিকট মনে হয় যেন জনগণের উপর আমার কোন আস্থা নেই। নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমের অভাব থাকলেই কেবল শাসকগোষ্ঠী জনগণকে ভয় করে থাকে।

ভয় জনগণের নয় মাননীয় সুলতান!- হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ বললেন আমি ফেদায়ীদের প্রসঙ্গে বলছি।

ঠিক আছে, আমি সাবধান থাকব। সুলতান আইউবী হেসে বললেন।

সর্পকেল্লা থেকে ফিরে এসে রক্ষী সিপাহী তার ডিউটিতে চলে যায়। দিনটা সে এই মানসিক অবস্থার মধ্যে কাটায় যে, কল্পনায় তখুতে সুলায়মান ও মেয়েটিকে দেখতে থাকে। সন্ধ্যা গম্ভীর হওয়ামাত্র আবার সে দুর্গ অভিমুখে হাঁটা দেয়। এবার তার মনে কোন ভয় নেই। দুর্গের ফটক অতিক্রম করে অন্ধকারে কিছুদূর অগ্রসর হয়ে বলল- আমি এসে পড়েছি। অগ্রসর হতে পারি কি?

তাকে বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। সে মশালের আলো দেখতে পায়। মশালটা তার থেকে খানিকটা দূরে এসে থেমে যায়। মশালধারী বলল- কক্ষে ঢুকে অবশ্যই হযরতের পায়ে সিজদা করবে। আজ তিনি কাউকে সাক্ষাৎ দিতে রাজি নন, তুমি যখন এসে পড়েছ, তোমার জন্য ব্যবস্থা করা হবে।

গতরাতের ন্যায় আজও আঁকাবাঁকা গলিপথ অতিক্রম করে সিপাহী মশলবাহী লোকটির পেছনে পেছনে হযরতের কক্ষের দরজার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ায়। হযরত তাকে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি প্রদান করেন। সিপাহী কক্ষে ঢুকে তার পায়ে লুটিয়ে পড়ে এবং নিবেদন করে- হযরত! আমাকে কী দেখাবেন বলেছিলেন, দেখিয়ে দিন।

হযরত হাততালি দেন। সঙ্গে সঙ্গে গতরাতের মেয়েটি পাশের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। সিপাহীকে দেখে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি একটি হাসি দেয় ভূবন মতানো হাসি। সিপাহী মেয়েটিকে নিজের কাছে বসানোর জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। হযরত মেয়েটির প্রতি দৃষ্টিপাত করে বললেন- লোকটা আজো এসে পড়েছে। আমি কি এখানে তামাশা দেখাতে বসেছি!

আপনি এই গুনাহগারকে ক্ষমা করে দিন- মেয়েটি বলল- লোকটা বড় আশা নিয়ে অনেক দূর থেকে এসেছে।

কিছুক্ষণ পর। কাঁচের ছোট্ট গোলকটি সিপাহীর হাতে। তার আগে মেয়েটি তাকে শরবত পান করিয়েছে। এখন তার পেছনে বসে পিঠটা নিজের বুকের সঙ্গে লাগিয়ে বাহু দ্বারা তাকে জড়িয়ে রেখেছে, যেন মা তার শিশুটিকে কোলে নিয়ে বসে আছে। সিপাহী হযরতের সুরেলা কণ্ঠ শুনতে পায় আমি সুলায়মান বাদশাহর রাজপ্রাসাদ দেখতে পাচ্ছি। আমি সুলায়মান বাদশাহর সিংহাসন দেখতে পাচ্ছি। আওয়াজটা ধীরে ধীরে ক্ষীণ হতে থাকে, যেন বক্তা আস্তে আস্তে দূর থেকে দূরান্তে চলে যাচ্ছে।

উহ!- হতচকিত হয়ে সিপাহী বলল- এমন প্রাসাদ ইহজগতের কোন রাজা-বাদশাহর হতে পারে না।

আমি এই প্রাসাদে জন্মলাভ করেছিলাম- সিপাহী কারো কণ্ঠ শুনতে পায় আমি এই প্রাসাদেই জন্মলাভ করেছিলাম। পরক্ষণে এটি তার নিজের কণ্ঠে পরিণত হয়ে যায়। তারপর সে অনুভব করে, যেন তারই অস্তিত্বের মধ্যে এই আওয়াজটি সঞ্চারিত হচ্ছে আমি এই প্রাসাদে জন্মলাভ করেছিলাম।

কিন্তু পরক্ষণেই এখন আর কোন সাড়াশব্দ নেই। সিপাহী এখন কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। এখন তার চোখের সামনে একটি মহল ভাসছে এবং নিজে তার বাইরে একটি বাগানের ভেতর ঘোরাফেরা করছে। এখন আর কাঁচের মধ্যদিয়ে নয়, এসব সে বাস্তবেই প্রত্যক্ষ করছে। ইচ্ছে করলে এখন সে বাগান, ফুল ইত্যাদি হাত দ্বারা স্পর্শ করতে পারে, শুঁকতে পারে। এখন সে কারো সিপাহী নয়- রাজপুত্র।

হঠাৎ মহলটি সিপাহীর দৃষ্টি থেকে উধাও হয়ে যায়। এখন সে বিস্ময়কর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। তাকিয়ে দেখে, সে মেয়েটির কোলে বসে আছে। মেয়েটিকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করে সে। মেয়েটি বলে- হযরতু বলে গেছেন, এই লোকটি (অর্থাৎ তুমি) রাজপুত্র ছিল। এখনো সে রাজপুত্র হতে পারে। তিনি জানতে চেষ্টা করছেন, তোমার সিংহাসন কে দখল করে আছেন। তিনি বলে গেছেন, তুমি যদি সাত-আট দিন এখানে থাক, তাহলে সবকিছু জানতে পারবে এবং তোমাকে সবকিছু দেখানো হবে।

***

পরের রাত। সিপাহী স্বপকেল্লার উক্ত কক্ষে উপবিষ্ট। চার দিনের ছুটি নিয়ে এসেছে সে। মেয়েটি আগের পেয়ালাটিতে করে তাকে শরবত পান করায় এবং কাঁচের বলটি তার হাতে দেয়। কারো কিছু বলার অপেক্ষা না করেই সে বলটি চোখের সামনে ধরে তার মধ্যদিয়ে দীপশিখা দেখতে থাকে। শিখার মধ্যে রং-বেরঙের আলোর খেলা দেখতে পায় সে। হযরত তার জাদুকরী ধারায় কিছু বলতে শুরু করেন। ইতিপূর্বে সে কয়েকবার এররূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। প্রথম সে কাঁচের বলের মধ্যে তখৃতে সুলায়মান এবং দ্বিতীয়বার শাহে সুলায়মান দেখেছিল। কিন্তু পরক্ষণে আর তার হাতে বলটি থাকত না। বলটির মধ্যদিয়ে যখন সে কিছু দেখতে শুরু করত, তখনই হযরত কিংবা মেয়েটি সিপাহীর হাত থেকে বলটি নিয়ে যেত।

আজ তৃতীয় রাতে অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে। কালো দাড়িওয়ালা হযরত তার সামনে বসে পড়ে এবং তার চোখে চোখ রেখে জাদুকরী ভাষায় ক্ষীণ কণ্ঠে বলছে- এটি ফুল, এটি বাগিচা। আমি বাগানে আছি। দেখাদেখি সিপাহীও একই কথা উচ্চারণ করছে। মেয়েটি সিপাহীর গা ঘেঁষে বসে তার চুলে বিলি কাটছে।

সিপাহী একটি বাগিচা দেখতে পায়। বাগানটি উঁচু-নীচু, সর্বত্র ফুলের সমারোহ। যেদিকে চোখ পড়ে শুধু ফুল আর ফল। মন মাতানো সৌরভ মৌ মৌ করছে। সিপাহী দেখতে পায়, বাগিচার মধ্যে একটি মেয়ে পায়চারী করছে। মেয়েটি অত্যন্ত রূপসী। তার গায়ে এক রংয়ের পোশাক। কিন্তু তা দুনিয়ার কোন রং নয়। সিপাহী এখন সর্পকেল্লার কক্ষে নয়। কালো দাড়িওয়ালা হযরত আর সঙ্গের মেয়েটি থেকে সম্পূর্ণ বেখবর ও সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছে সে। বাগিচায় অপরূপ সুন্দরী মেয়েটিকে দেখে দুর্গ থেকে বেরিয়ে তার দিকে ছুটে যায়। মেয়েটিও তার দিকে দৌড়ে আসে। মেয়েটির শরীর থেকে ফুলের সৌরভ চুড়ি পড়ছে। সিপাহী সুলায়মান বাদশাহর বংশের রাজপুত্র। মেয়েটির সঙ্গে তাকে মানিয়েছে বেশ। দুজন বাগিচার এক কোণে চলে যায়। ওখানে গুহাসম একটি জায়গা। গুহাটিও ফুল দিয়ে সাজানো। মেঝেতে ঘাসের ন্যায় মখমল বিছানো।

ফুলসজ্জিত গুহার এক কোণ থেকে সুন্দর একটি কলসি বের করে আনে মেয়েটি। তার থেকে কি যেন ঢেলে পেয়ালায় নিয়ে সিপাহীর হাতে দেয়। মদ। মেয়েটির রূপ আর ভালবাসার নেশা সিপাহীকে আগে থেকেই মাতাল করে রেখেছে। এবার মদের নেশা তাকে আরো মাতাল করে তুলে। মেয়েটি বলল, তুমি থাক। আমি এক্ষুণি আসছি। বলেই স্থান ত্যাগ করে চলে যায়। মুহূর্ত পর সিপাহী মেয়েটির চীৎকার শুনতে পায়- আর্তচিৎকার। সিপাহী বাইরের দিকে ছুটে যায়। এদিক-ওদিক তাকায়। কিন্তু মেয়েটি নেই কোথাও। সে চিৎকারের শব্দ অনুসরণ করে দৌড়াতে থাকে। মেয়েটির হৃদয়বিদারক চিৎকার শোনা যাচ্ছে। সিপাহী ক্ষুব্ধ হয়ে তরবারী হাতে নিয়ে মেয়েটিকে খুঁজতে থাকে। পাগলের ন্যায় ছুটাছুটি করছে সে। অবশেষে খুঁজতে খুঁজতে সিপাহী এক বৃদ্ধাকে দেখতে পায়। বৃদ্ধা তাকে জানায়, তুমি যাকে খুঁজছ, তাকে আর পাওয়া যাবে না। যে ব্যক্তি তোমার প্রেয়সীকে নিয়ে গেছে, সে তোমার চেয়ে বেশী শক্তিশালী। তাকে তুমি কোথাও খুঁজে পাবে না। তাকে যে নিয়ে গেছে, সে এখন সেই সিংহাসনে আরোহণ করবে, যেখানে, তোমার বসবার কথা ছিল। ছুটাছুটি করে লাভ নেই। বেঁচে থাক, সময় সুযোগ মতো তাকে খুন করে তোমার প্রিয়াকে উদ্ধার করে এন। মেয়েটি তোমার বিরহে নিঃশেষ হয়ে যাবে।

আমার প্রিয়াকে যে নিয়ে গেল, সে কে? সকেল্লার মহলের কক্ষে ফিরে এসে সিপাহী জিজ্ঞেস করে- আর আমি এসব কী দেখলাম?

তুমি তোমার অতীত জীবন দেখেছ- হযরত বললেন- আমি তোমাকে ফিরিয়ে এনেছি।

না, আমি ওখান থেকে ফিরে আসতে চাই না- অস্থির ও ব্যাকুল কণ্ঠে সিপাহী বলল- আমাকে ওখানেই পাঠিয়ে দিন।

ওখানে গিয়ে তুমি কী করবে?- হযরত জিজ্ঞেস করেন- যার জন্য যাওয়া, তাকে অন্য কেউ ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। সে তো এখন অন্যের দখলে। তুমি যতক্ষণ না তাকে হত্যা করবে, ততক্ষণ ওকে ফিরে পাবে না। আমি চাই তুমি কাউকে হত্যা কর। আর তুমি তাকে হত্যা করতে পারবেও না।

হযরত!- সিপাহী গর্জে ওঠে- কাউকে খুন করে যদি আমি পৈত্রিক সিংহাসন আর প্রেয়সীকে ফিরে পেতে পারি, তাহলে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর চেয়েও মর্যাদাবান এবং ক্ষমতাসম্পন্ন লোককে আমি খুন করব।

তারপর সেই খুনের দায় আমার ঘাড়ে চাপাবে, না দোস্ত! হযরত বললেন।

সিপাহী তার পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে মাথা ঠুকতে শুরু করে- হযরত! হযরত! বলে ক্রন্দন করতে থাকে।

হযরত সিপাহীকে আবার সেই জগতে পৌঁছিয়ে দেন, যেখানে তখতে সুলায়মানী ছিল, মহল ও বাগিচা ছিল। সিপাহীর কানে আওয়াজ আসতে শুরু করে- এই তো সেই ব্যক্তি, যে তোমার দাদাকে হত্যা করেছে, তোমার পিতাকে হত্যা করেছে। তোমার সিংহাসন ও মুকুট ছিনিয়ে নিয়েছে এবং তোমার প্রেয়সী এরই হাতে বন্দী।

না না, ইনি নন- সিপাহী ভয়জড়িত কণ্ঠে বলল- ইনি তো সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।

আরে ইনিই তো তোমার ভাগ্যের হন্তা।- সিপাহীর কানে আওয়াজ আসতে শুরু করে- ইনি তোমার সুলতান হতে পারেন না। ইনি কুর্দী আর তুমি আরব। তুমি বল, সালাহুদ্দীন, আইউবী আমার দাদার ঘাতক, আমার পিতার ঘাতক, আমার সিংহাসন ও রাজমুকুট ছিনতাইকারী। ভেদ বেরিয়ে এসেছে, রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। তুমি প্রতিশোধ নাও। আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন মানুষ প্রতিশোধ গ্রহণ করে থাকে।

সিপাহী এই জাদুময় পরিবেশে চক্কর কাটছে আর জপ করছে- সালাহুদ্দীন আইউবী আমার দাদার হন্তারক, আমার পিতার ঘাতক, আমার সিংহাসন ও রাজমুকুট ছিনতাইকারী, আমার প্রেমের সংহারক, আমার ভাগ্যের খুনী।

এখন তার দৃষ্টির সামনে শুধুই সালাহুদ্দীন আইউবী। সালাহুদ্দীন আইউবী তার চোখের সামনে হাঁটছেন, চলাফেরা করছেন। সিপাহী হাতে খঞ্জর তুলে নিয়ে তার পেছনে পেছনে হাঁটছে। কিন্তু খুন করার মওকা পাচ্ছে না।

হঠাৎ প্রেয়সী মেয়েটি চোখে পড়ে সিপাহীর। পিঞ্জিরায় আবদ্ধ মেয়েটি। সালাহুদ্দীন আইউবী যেন পিঞ্জিরার পার্শ্বে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে হাসছেন। মেয়েটি সিপাহীর প্রতি করুণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। সুলতান আইউবীর চেহারাটা ধীরে ধীরে হিংস্র হয়ে ওঠছে। সিপাহী বলা বন্ধ করে। এবার তার কানে শূন্য থেকে আওয়াজ ভেসে আসে- সালাহুদ্দীন আইউবী আমার দাদার ঘাতক, আইউবী আমার পিতার হন্তারক…।

 ***

 সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী নিজ কক্ষে তার উপদেষ্টাবৃন্দ ও ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যুদ্ধ বিষয়ে কথা বলছেন। নতুন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে, পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা করছেন তিনি। সর্পকেল্লায় গিয়ে আসা মোহাফেজ সিপাহী এই মুহূর্তে সুলতানের প্রহরায় বাইরে দণ্ডায়মান। দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর উপদেষ্টা প্রমুখ কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। সুলতান আইউবী একাকী কক্ষে থেকে যান। সিপাহী হন হন করে কক্ষে ঢুকে পড়ে এবং সুলতানের মাথার উপর তরবারী উঁচিয়ে বলে ওঠে- তুমি আমার দাদার ঘাতক, তুমি আমার পিতার ঘাতক। সুলতান চকিতে তার দিকে ফিরে তাকান- ওকে মুক্ত করে দাও, ও আমার স্ত্রী। সঙ্গে সঙ্গে অতিশয় ক্ষোভের সাথে সিপাহী সুলতান আইউবীর উপর তরবারীর আঘাত হানে। সুলতানের হাতে কিছু নেই। তিনি কৌশলে আঘাত প্রতিহত করেন। সঙ্গে সঙ্গে চীৎকার করে রক্ষী কমান্ডারকে ডাক দেন এবং উঠে ছুটে গিয়ে নিজের তরবারীটা হাতে তুলে নেন। সিপাহী আরো অধিক ক্ষুব্ধ হয়ে পুনরায় আঘাত হানে। সিপাহীর টার্গেট যদি সুলতান আইউবী না হতেন, তাহলে তার মতো অভিজ্ঞ সৈনিকের একটি আঘাতও ব্যর্থ হতো না। সুলতান আইউবী শুধু তার আক্রমণ প্রতিহত করেন। নিজে একটি আঘাতও করলেন না। ডাক শুনে কমান্ডার যখন ছুটে আসে, তখন সুলতান তাকে বললেন, ওকে আঘাত কর না; অক্ষত ধরে ফেল।

সিপাহী চক্কর কেটে কমান্ডারের উপর আঘাত হানে। ইতিমধ্যে তিন চারজন বডিগার্ড কক্ষে ঢুকে পড়ে। সিপাহী এতই ক্ষিপ্ত ও উত্তেজিত যে, সে একের পর এক আঘাত হেনে কাউকেই তার কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। তার লক্ষ্য সুলতান আইউবীকে হত্যা করা। তাই তাকে উদ্দেশ করে গর্জন করে বলছে- তুমি আমার দাদার ঘাতক, আমার পিতার ঘাতক, তুমি আমার সিংহাসন ও রাজমুকুট কেড়ে নিয়েছ।

অবশেষে তাকে পাকড়াও করা হল। তার থেকে তরবারী ছিনিয়ে নেয়া হল।

ধন্যবাদ আমার মোহাফেজ!- সুলতান আইউবী ক্ষোভ জাহির করার পরিবর্তে সিপাহীর প্রশংসা করে বললেন- সালতানাতে ইসলামিয়ার জন্য তোমার মত দক্ষ অসিবাজের প্রয়োজন রয়েছে।

রক্ষী কমান্ডার ও অন্যান্য সিপাহীরা বিস্ময়ে হতবাক যে, ঘটনা কী ঘটল। সুলতান আইউবী কমান্ডারকে বললেন- ডাক্তার এবং হাসান ইবনে আব্দুল্লাহকে এক্ষুণি নিয়ে আস।

চারজন বডিগার্ড সিপাহীকে ঝাঁপটে ধরে রেখেছে। সিপাহী চিৎকার করছে- ইনি আমার ভালাবাসার ঘাতক। ইনি আমার ভাগ্যের হন্তারক।

এক বডিগার্ড হাত দ্বারা সিপাহীর মুখটা চেপে ধরে। কিন্তু সুলতান বললেন- ওকে বলতে দাও, মুখ থেকে হাত সরিয়ে নাও- তিনি সিপাহীকে উদ্দেশ করে বললেন- বলতে থাক দোস্ত! বল, তুমি কেন আমাকে খুন করতে চেয়েছিলে?

ওকে মুক্ত করে দিন- সিপাহী চীৎকার করে বলল- আপনি ওকে পিঞ্জিরায় আবদ্ধ করে রেখেছেন। হযরত আমাকে বলেছেন, আমি নাকি আপনাকে খুন করতে পারব না। আসুন, আমার মোকাবেলা করুন, আপনি নিজেকে রক্ষা করার জন্য, কাপুরুষের ন্যায় এতগুলো লোক জড়ো করেছেন। তরবারী বের করুন, আমার তরবারীটা আমাকে দিয়ে দিন, আপনি ময়দানে আসুন।

সুলতান আইউবী অপলক তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সিপাহীর প্রতি তাকিয়ে আছেন। বডিগার্ড সুলতানের নির্দেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। হামলাকারী সিপাহীকে কয়েদখানায় নিক্ষেপ করা প্রয়োজন। তার অপরাধ লঘু নয়। হত্যার উদ্দেশ্যে সুলতান আইউবীর উপর হামলা করেছে। সুলতান যদি উদাসীন থাকতেন কিংবা কক্ষে সিপাহীর প্রবেশ দেখে না ফেলতেন, তাহলে তার খুন হয়ে যাওয়া নিশ্চিত ছিল। কিন্তু সুলতান আইউবী তাকে কয়েদখানায় নিক্ষেপ করার আদেশ দিলেন না। সিপাহী বকে যাচ্ছে উন্মাদের ন্যায়। এমন সময়ে ডাক্তার এসে গেছেন। তার খানিক পর হাসান ইবনে আব্দুল্লাহও এসে পড়েন। ভেতরের পরিস্থিতি দেখে তিনি হতবাক হয়ে যান।

একে নিয়ে যান।- সুলতান আইউবী ডাক্তারকে বললেন- লোকটা বোধ হয় হঠাৎ পাগল হয়ে গেছে।

লোকটা চারদিন ছুটি কাটিয়ে এসেছে রক্ষী কমান্ডার বললেন- আসার পর থেকে লোকটা কোন কথা বলছে না।

সিপাহীকে টেনে-হেঁচড়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া হল। ডাক্তারও সঙ্গে চলে যান। সুলতান আইউবী হাসান ইবনে আব্দুল্লাহকে অবহিত করলেন, এই সিপাহী হত্যার উদ্দেশ্যে আমার উপর হামলা করেছে। হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ সন্দেহ ব্যক্ত করলেন, লোকটা ফেদায়ী হতে পারে। সুলতান বললেন, যে কারণেই হোক, লোকটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। সুলতান হাসান ইবনে আব্দুল্লাহকে বললেন, একে ভালভাবে জিজ্ঞাসাবাদ কর, তথ্য নাও।

দীর্ঘক্ষণ পর ডাক্তার সুলতান আইউবীর নিকট ফিরে এসে তথ্য প্রদান করেন, আপনার এই সিপাহীকে লাগাতার কয়েকদিন পর্যন্ত নেশাগ্রস্ত অবস্থায় রাখা হয়েছে এবং তার উপর হেপটানিজম প্রয়োগ করা হয়েছে। ডাক্তার তার নিঃশ্বাস কে বুঝতে পারেন যে, লোকটাকে নেশাকর দ্রব্য খাওয়ানো বা পান করানো হয়েছে। তিনি সুলতান আইউবীকে জানান, হেপটানিজম চিকিৎসা শাস্ত্রে বিস্ময়কর কোন বিষয় নয়। এর উদ্ভাবক হল হাসান ইবনে সাব্বাহ। আপনার হয়ত জানা আছে, হাসান ইবনে সাব্বাহ এক প্রকার নেশাকর শরবত আবিষ্কার করেছে। যে-ই তা পান করে, তার চোখের সামনে অত্যন্ত সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক দৃশ্য ভেসে ওঠে। সেই অবস্থায় যে কথাই তার কানে দেয়া হোক, তা তার সামনে বাস্তব সত্যরূপে প্রতিভাত হয়।.হাসান ইবনে সাব্বাহ এই নেশা আর হেপটানিজমেরই ভিত্তিতে একটি জান্নাত তৈরি করে রেখেছে, যাতে কেউ একবার প্রবেশ করলে আর বের হতে চায় না। সে মাটির চাকা আর কংকর মুখে দিয়ে মনে করে, অতি সুদ্বাদু খাবার খাচ্ছে। কাঁটার উপর দিয়ে হেঁটে মনে করে গালিচার উপর দিয়ে চলছে। হাসান ইবনে সাব্বাহ দুনিয়া থেকে চলে গেছে ঠিক, কিন্তু তার এই শরবত আর প্রক্রিয়া দুনিয়াতে রেখে গেছে। তার অনুসারীরা ঘাতক চক্র হিসেবে অবির্ভূত হয়েছে। এরা কার্যসিদ্ধির জন্য সুন্দরী নারী আর শরবতের ব্যবহার করে। আমি যতটুকু বুঝেছি, এই সিপাহী আপনাকে হত্যা করার লক্ষ্যে এই হেপটানিজম প্রক্রিয়ার শিকার।

ডাক্তার সিপাহীকে ঔষধ সেবন করান। অল্প সময়ের মধ্যেই ঔষধ ক্রিয়া করতে শুরু করে। সিপাহী শান্ত হয়ে গভীর ন্দ্রিায় ঢলে পড়ে। হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ জানতে পারেন যে, সিপাহী ইতিমধ্যে চারদিনের ছুটিতে গিয়েছিল। কিন্তু ছুটিটা কোথায় কাটিয়ে এসেছে, তা কেউ জানে না। সর্পকেল্লা, সম্পর্কে শহরে যে গুজব ছড়িয়েছে, হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ গোয়েন্দা মারফত সে সংবাদ পেয়ে গেছেন। মানুষ বলাবলি করছে, সর্পকেল্লায় এক বুজুর্গ আত্মপ্রকাশ করেছেন, যিনি অদৃশ্যের খবর বলতে পারেন এবং মানুষের মনোবাসনা পূরণ করে দেন। হাসান ইবনে আব্দুল্লাহর এক গুপ্তচর রিপোর্ট করেছে, আমি কালো দাড়িওয়ালা এক বুজুর্গকে দু-দুবার দুর্গে ঢুকতে দেখেছি। কিন্তু হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি। তিনি মনে করেছেন, এ ধরনের পীর-বুজুর্গদের উৎপাত-আনাগোনা তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। অনেক সময় মানুষ উন্মাদ দেওয়ানাকে বুজুর্গ মনে করে তাদের পিছনে ছুটতে শুরু করে।

দুর্গের আশপাশে চলাচলকারী লোকদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাদের এক ব্যক্তি জানায়, হ্যাঁ, আমি কালো দাড়ি ও সাদা চোগা পরিহিত এক ব্যক্তিকে দুর্গে আসা-যাওয়া করতে দেখেছি। এরূপ একাধিক সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ সেদিনই সূর্যাস্তের কিছু আগে একটি সেনাদল প্রেরণ করে কেল্লায় হানা দেন। সৈন্যরা মশাল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। দুর্গের অভ্যন্তরে আঁকা-বাঁকা পথ। বিধ্বস্ত দেয়াল ও ছাদের ধ্বংসাবশেষ। কয়েকটি কক্ষ এখনো অক্ষত আছে। সৈন্যরা দুর্গের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ এক কোন থেকে শোরগোল ভেসে আসে। কয়েকজন সিপাহী সেদিকে দৌড়ে যায়। ওখানে দুজন সিপাহী মাটিতে পড়ে তড়পাচ্ছে। তাদের বুকে তীর বিদ্ধ হয়ে আছে। ইতিমধ্যে আরো তিন-চারটি তীর ছুটে আসে। পড়ে যায় আরো তিন-চারজন সিপাহী। কয়েকজন সিপাহী এই ভয়ে পেছনে সরে যায় যে, এরা মানুষ নয়- ভূত-প্রেত হবে নিশ্চয়ই। হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ ছিলেন বাস্তববাদী মানুষ। তিনি সিপাহীদের উৎসাহ প্রদান করে বললেন, এই তীর মানুষই ছুঁড়ছে। তিনি অবরোধের বিন্যাস পরিবর্তন করে ঘেরাও সংকীর্ণ করতে শুরু করেন। কিন্তু তারা কোথাও কোন মানুষ দেখতে পেলেন না। কেবল অজ্ঞাত স্থান থেকে দু-চারটি তীর ছুটে আসছে আর তাতে দু-চারজন সিপাহী জখম হচ্ছে।

হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ আরেক দল সৈন্য ডেকে আনেন। রাত গম্ভীর হয়ে গেছে। তিনি অনেকগুলো মশালেরও ব্যবস্থা করেন। সিপাহী যে কক্ষটিতে যাওয়া-আসা করেছিল, এক সেনা ইউনিটের কমান্ডার সে পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এই ভয়ংকর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে এমন সাজানো-গোছানো মনোরম একটি কক্ষ দেখে কমান্ডার ভয় পেয়ে যায়। জিন-ভূতের আবাস কিনা কে বলবে। হাসান ইবনে আব্দুল্লাহকে তলব করা হল। তিনি এসে ভেতরে প্রবেশ করে সামানপত্র দেখতে শুরু করলেন। আস্তে আস্তে রহস্য উন্মোচিত হতে লাগল। ইতিমধ্যে কয়েকজন সিপাহী কালো দাড়িওয়ালা লোকটিকে কোথাও থেকে ধরে নিয়ে আসে। তার সঙ্গে অতিশয় রূপসী একটি মেয়ে। তার পরক্ষণেই ধরা পড়ল অন্য এক স্থানে লুকিয়ে থাকা আরো ছয়জন। তাদের হাতে তীর-ধনুক। কালো দাড়িওয়ালা নিজেকে দুনিয়াত্যাগী নির্জনবাসী বুযুর্গ দাবি করে সাধু সাজতে চেষ্টা করে। কিন্তু সঙ্গের রূপসী যুবতী ও তীর-ধনুক-সজ্জিত সেনা বাহিনীর সঙ্গে মোকাবেলা তাকে মিথ্যুক বলে প্রমাণিত করে। হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ তাদের সামানপত্র ও অস্ত্রশস্ত্রসহ তাদেরকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসেন।

কক্ষে পাওয়া গেছে তিন-চারটি সোরাহী ও পানপাত্র। বস্তুগুলো রাতেই হাকীমের হাতে তুলে দেয়া হয়। হাকীম সেগুলো নাকে কেই বলে দিলেন, আমি হাসান ইবনে সাব্বার যে শরবত উদ্ভাবনের কথা বলেছিলাম, এগুলো থেকে তারই ঘ্রাণ পাচ্ছি। মেয়েটিসহ গ্রেফতারকৃত সবাইকে কয়েদখানায় বন্দী করে রাখা হল।

পরদিন ভোরবেলা। এখনো সূর্য উদিত হয়নি। জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম ধাপেই মেয়েটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করে দেয়- লোকগুলো ফেদায়ী ঘাতক। কালো দাড়িওয়ালা লোকটি নতুন শপথ নিয়ে এসেছে, হয়ত সুলতান আইউবীকে হত্যা করে ফিরবে, অন্যথায় নিজে জীবন দেবে। মেয়েটি জানায়, এই মোহাফেজ সিপাহীকে কালো দাড়িওয়ালা ফাঁদে ফেলেছে এবং নেশা পান করিয়ে তার উপর হেপটানিজম প্রয়োগ করেছে। সেই নেশা আর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর বিরুদ্ধে এমন ঘৃণা সৃষ্টি করা হয়েছে যে, সে সুলতানকে হত্যা করার জন্য ছুটে এসেছে। আশা ছিল, সুলতান আইউবী এই সিপাহীর হাতে নিহত হবেন। সেজন্য তিনি নিশ্চিন্তে দুর্গে বসে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি গুপ্তচরবৃত্তির জন্যে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু কোন তথ্য নিতে পারেননি। সিপাহীকেও কোথাও দেখতে পাননি। আর সন্ধ্যার সময় হঠাৎ ফৌজ হানা দিয়ে বসে।

কালো দাড়িওয়ালা লোকটি বড় কঠিন হৃদয়ের মানুষ প্রমাণিত হল। সে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, মেয়েটির সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। তার সঙ্গীরাও প্রথম প্রথম অস্বীকার করে। কিন্তু হাসান ইবনে আব্দুল্লাহ যখন তাদেরকে পাতাল কক্ষে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন শুরু করে, তখন এক এক করে, অপরাধের কথা স্বীকার করে। কালো দাড়িওয়ালা ব্যক্তিকে যখন তাদের সামনে উপস্থিত করা হল, তখন আর তার অস্বীকার করার কোন উপায় থাকল না। সঙ্গীদের করুণ দৃশ্য দেখামাত্র তার কাঁপুনি শুরু হয়ে যায়। তাকে বলা হল, সব ঘটনা খুলে বললে তোমাকে স্বসম্মানে রাখা হবে। অন্যথায় তুমি বাঁচতেও পারবে না, মরতেও পারবে না। হাড়-গোশত একাকার হওয়ার আগে সত্য সত্য বলে দাও। লোকটি কক্ষে নির্যাতনের উপকরণ ও পথ-পদ্ধতি দেখে সব কথা বলে দিতে সম্মত হয়ে যায়।

তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক সে ফেদায়ী ঘাতকদলের সদস্য। ফেদায়ীদের পৃষ্ঠপোষক শেখ সান্নানের বিশেষ ভক্ত। কিন্তু সে নিজ হাতে হত্যা করে না। হাসান ইবনে সাব্বাহ আবিষ্কৃত বিশেষ পন্থায় অন্যকে দিয়ে খুন করায় সে। সকল ঐতিহাসিক অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, আল্লাহ হাসান ইবনে সাব্বাহকে অস্বাভাবিক মেধা দান করেছিলেন, যা সে শয়তানী কাজে ব্যবহার করেছে।

কালো দাড়িওয়ালা জানায়, সুলতান আইউবীকে হত্যা করার লক্ষ্যে ইতিপূর্বে চারবার হামলা করা হয়েছিল। তার প্রতিটি হামলা ব্যর্থ হওয়ার পর আমাকে আবার বিশেষ পন্থা প্রয়োগ করার জন্য পাঠানো হয়েছে। সে জানায়, সুলতান আইউবীর উপর যে কটি হামলা হয়েছে, সবকটিই হয়েছে সরাসরি। তাতে প্রমাণিত হয়েছে, সুলতানকে সোজা পথে হত্যা করা যাবে না। সে তার দলের ছয়জন অভিজ্ঞ লোক ও একটি মেয়েকে নিয়ে দামেস্ক চলে আসে। এসে সর্পকেল্লায় আস্তানা বানায়। এই চক্রটি রাতের অন্ধকারে তাতে প্রবেশ করে। তাদেরই দলের লোকেরা শহরে গুজব ছড়িয়ে দেয় যে, দুর্গে একজন দরবেশ আত্মপ্রকাশ করেছেন, যার হাতে গায়েবী শক্তি আছে এবং ভবিষ্যতের কথা বলে দিতে পারেন। এই গুজবের উদ্দেশ্য ছিল, মানুষ দুর্গে আসুক এবং লোকটিকে অস্বাভাবিক শক্তিধর পীর-বুজুর্গ বলে বিশ্বাস করুক। তিনি প্রভাব বিস্তার করে এক বা একাধিক লোককে হাত করে নিয়ে তাদের দ্বারা সুলতান আইউবীকে হত্যা করাবে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য সফল হল না, একজন মানুষও দুর্গে এল না। কারণ, মানুষ জানত, এই দুর্গে এমন দুটি নাগ-নাগিনী বাস করে, যাদের বয়স হাজার বছর অতিক্রম করেছে। এখন তারা মানুষের রূপে আত্মপ্রকাশ করে এবং যাকে পায় তাকেই গিলে ফেলে।

এই চক্রের প্রধান কালো দাড়িওয়ালা লোকটি একজন অভিজ্ঞ ঘাতক। তার মাথায় পরিকল্পনা আসে যে, উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য, সুলতান আইউবীর বাহিনীর কোন সিপাহীকে ব্যবহার করতে হবে। সে কয়েকদিন পর্যন্ত খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করে, রক্ষী বাহিনীর সিপাহীরা কোথায় থাকে এবং তাদের ডিউটি কোন্ দিন পড়ে। কিন্তু সে সুলতান আইউবীর দফতর ও বাসগৃহ পর্যন্ত পৌঁছতে পারল না। কারণ, এ দুটো হল সাধারণের জন্য নিষিদ্ধ এলাকা। কোন নাগরিক কিংবা সাধারণ কোন সৈনিক সে এলাকায় ঢুকতে পারে না। এক পর্যায়ে লোকটি এই সিপাহীর সন্ধান পায় এবং কোন প্রকারে জানতে পারে যে, সে সুলতান আইউবীর দফতরের রক্ষীসেনা। অর্থাৎ এই লোকটি অনায়াসে সুলতানের দফতর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। দলনেতা এই সিপাহীর উপর নজর রাখতে শুরু করে। তখন তার বেশভূষা ছিল অন্যরকম। একদিন এই সিপাহী বাইরে বের হয়। ঘাতক নেতা তাকে দেখতে পায়। সে পথেই তার গতিরোধ করে। এবং এমনভাবে এমন ধারার কথা বলে, যাতে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষও প্রভাবিত না হয়ে পারে না। লোকটা ঘাতকচক্র নেতার জাদুকরী জালে আটকে যায় এবং রাতে দুর্গে চলে যায়।

দুর্গের একটি মনোরম কক্ষে যে আয়োজন-ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছিল, তা পাথরকে মোমে পরিণত করার জন্য যথেষ্ট ছিল। এক তো ছিল কক্ষের সাজগোজ, পরিপাটি ও মহামূল্যবান জাজিম বিছানো; তদুপরি যাদুকরী রূপ-যৌবন ও সুডৌল-সুঠাম দেহের অধিকারী অর্ধনগ্ন একটি মেয়ে। মেয়েটির উন্মুক্ত রেশমী চুলে জাদুর আকর্ষণ, যা কিনা একজন দুনিয়াত্যাগী আবেদের মধ্যেও পাশবিকতা জাগিয়ে তোলে। আসল বস্তু হল শরবত, যা পান করিয়ে নেশা সৃষ্টি করা হয়। কাঁচের গোলকটি ব্যবহার করা হয় দৃষ্টিতে ভেল্কিবাজি সৃষ্টি করার জন্যে। সিপাহীর মস্তিষ্কে এই ধারণা দেয়া হয় যে, সে রাজবংশের সন্তান এবং তার বংশ তখতে সুলায়মানীর উত্তরসূরী।

এই সিপাহী যখন উক্ত কক্ষে প্রবেশ করে, তখন কক্ষের সাজসজ্জা ও মূল্যবান জিনিসপত্র তাকে প্রভাবিত করে ফেলে। কালো দাড়িওয়ালা ঘাতকনেতা তখন ধ্যানমগ্ন ছিলেন। তারও একটি ক্রিয়া ছিল। উপরন্তু পার্শ্বে একটি রূপসী মেয়েকে পেয়ে সে রীতিমত কাবু হয়ে যায়। মেয়েটি তাকে যে শরবত পান করায়, তাতেও নেশা ছিল। সেই নেশার ক্রিয়া এমন ছিল যে, তাতে মানুষ বাস্তব জগত থকে সম্পর্কহীন হয়ে মন ভোলানো সুদৃশ্য এক কল্পনার জগতে চলে যায়। আর সেই অবস্থায়ই তাকে হেপটানাইজ করা হয় এবং তার মস্তিষ্কে কাঙ্খিত কল্পনা ঢেলে দেয়া হয়। তার হাতে কাঁচের যে গোলকটি দেয়া হয়, তার মধ্য দিয়ে দীপ শিখার কয়েকটি রং দেখা যায়, যা মূলত ভেল্কি ছাড়া কিছু নয়। কাঁচের গঠন এমন যে, তার মধ্যদিয়ে অতিক্রমকারী আলো সাতটি বর্ণে প্রতিভাত হয়, যা মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে। পরক্ষণে একটি রূপসী মেয়ে সিপাহীর পার্শ্বে বসে যায় এবং কথায় কথায় প্রকাশ করে যে, সে তাকে অন্তর দিয়ে ভালবাসে। কালো দাড়িওয়ালা লোকটি জাদুকরী সুরেলা কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করে। তার উচ্চারিত শব্দমালা সিপাহীর কানে পৌঁছে তার মস্তিষ্কে কাঙিখত কল্পনা সাজিয়ে তোলে। কালো দাড়িওয়ালা আন্দাজ করে নেয় যে, সিপাহী এখন প্রকৃতিস্থ নেই। সেই অবস্থায় তার হাত থেকে কাঁচের গোলকটি নিয়ে গিয়ে তার চোখে চোখ রাখে এবং তাকে হেপটানাইজ করে।

সিপাহী যাকে নিজের আওয়াজ মনে করে, তা মূলত কালো দাড়িওয়ালা ব্যক্তির কণ্ঠস্বর। তারপর সে এমন এক স্তরে গিয়ে উপনীত হয়, যেখানে সে নিজের কল্পনাকে বাস্তব মনে করে তাতে একাকার হয়ে যায়। এবার দুর্বলমনা সিপাহী সম্পূর্ণরূপে প্রভাবিত হয়ে পড়ে। কালো দাড়িওয়ালা ব্যক্তি তাকে বাস্তব জগতে নিয়ে এসে নিজে অন্য কক্ষে চলে যায় এবং মেয়েটি একাকী সিপাহীর সঙ্গে থেকে যায়। সে সিপাহীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও মন-মস্তিষ্কে জেঁকে বসে। এই উদ্দেশ্য সাধনে সে এমন আচরণ ও এমন কথা বলে, যার ক্রিয়া থেকে অন্তত এই সিপাহী রক্ষা পেতে পারে না। সিপাহীকে শুধু তখুতে সুলায়মানী প্রদর্শন করিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় এবং ধারণা দেয়া হয় যে, ভেদ এখনো অবশিষ্ট আছে। সিপাহী সম্পূর্ণরূপে তার জালে ফেঁসে যায়। এবার সে কাকুতি-মিনতি শুরু করে যে, অবশিষ্ট ভেদও বলে দাও। তাকে বলা হল, ঠিক আছে, তুমি আরো কয়েকদিন আমার নিকট থাক। সিপাহী কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে পুনরায় দুর্গে চলে যায়।

সিপাহী টানা চার দিন চার রাত সৰ্পকেল্লার কক্ষে অবস্থান করে। এ সময়টায় তাকে লাগাতার নেশা ও হেপটানিজমের ক্রিয়াধীন রাখা হয় এবং তার নিষ্ক্রীয় মস্তিষ্কে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর কল্পনা সৃষ্টি করে এই বক্তব্য ঢেলে দেয়া হয় যে, সালাহুদ্দীন আইউবী সিপাহীর পিতা ও দাদার ঘাতক এবং তিনি তাদের সিংহাসন দখল করে আছেন। সিপাহীকে একটি রূপসী মেয়ে দেখানো হয় এবং তারপর দেখানো হয়, সুলতান আইউবী মেয়েটিকে পিঞ্জিরায় আবদ্ধ করে রেখেছেন। চারদিন পর তাকে সেই অবস্থায়ই দুর্গ থেকে বের করে দেয়া হয়। সে ডিউটিতে চলে যায় আর সুযোগ পাওয়া মাত্র সুলতান আইউবীর উপর হামলা করে বসে।

***

সিপাহী অচেতন হয়ে পড়ে আছে। হাকীম তার মস্তিষ্ক থেকে নেশার ক্রিয়া দূর করার জন্য ঔষধ প্রয়োগ করেন। লোকটি বাস্তবতা ও কল্পনার। মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে। হাকীম তার স্বাভাবিক জ্ঞান ফিরিয়ে আনার জন্য একাধিক পন্থা অবলম্বন করেন।

দুদিন পর সিপাহী চোখ খুলে। সে এমনভাবে উঠে বসে, যেন এতক্ষণ গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে ছিল এবং স্বপ্ন দেখছিল। উঠে বসেই বিস্মিত চোখে চারদিক তাকাতে শুরু করে। ডাক্তার জিজ্ঞেস করে, এতক্ষণ কোথায় ছিলে? সে জবাব দেয়, ঘুমিয়ে ছিলাম। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হতে তার অনেক সময় কেটে যায়। কিন্তু তেমন কিছু বলতে পারল না। সে বলল, চোগা পরিহিত কালো দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তি তাকে সর্পকেল্লায় নিয়ে গিয়েছিল। সে সেখানকার কিছু ঘটনাও শোনায়। কিন্তু তখতে সুলায়মানী ইত্যাদি যে দেখেছিল, তা তার মনে নেই। তার একথাও স্মরণ নেই যে, সে সুলতান আইউবীর উপর হামলা করেছিল।

সিপাহী অসত্য বলে ধোকা দিচ্ছে কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাকে সুলতান আইউবীর নিকট নিয়ে যাওয়া হল। সে একজন সৈনিকের ন্যায় সুলতানকে সালাম করে। সুলতান তার সঙ্গে মেহসুলভ কথা বলেন। কিন্তু সিপাহীর মনে রাজ্যের বিস্ময়, এদের কী হয়ে গেল, এরা আমার সঙ্গে এমন আচরণ করছে কেন! শেষ পর্যন্ত তাকে তার কৃতকার্য সম্পর্কে অবহিত করা হল। শুনে সে চিৎকার করে ওঠে- মিথ্যা কথা, আমি আমার সুলতানের উপর হামলা করতে পারি না। সুলতান আইউবী বললেন, আমার এই সিপাহী নিরপরাধ। এ কী কাজ করেছে, তা তাকে স্মরণ করানোরও প্রয়োজন নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *